রূপলাল ঠাকুর বাধা দিতে যাচ্ছিলো হাঁ হাঁ করে। কিন্তু মেজকর্তার দিকে চেয়ে আর সাহস হলো না। মেজকর্তা তখন এক দৃষ্টে পাগলা হাবুর দিকে চেয়ে মিষ্টি মিষ্টি হাসছেন।
পাগলা ততক্ষণ মেরেই চলেছে। সে কী জোর তার গায়ে। হঠাৎ সবাই অবাক হয়ে দেখলে দুর্গা প্রতিমার শরীর দিয়ে আঘাতের চোটে রক্ত ঝরছে। এক-একটা বাশ্না ছুঁড়ে মারে পাগলা, আর ঠাকুরের গায়ে গিয়ে সেটা লাগতেই রক্ত ঝরে পড়ে সেখান থেকে। সমস্ত লোক হতভম্ব।
শেষে এক সময় পাগলা থামলো। মেজকর্তার দিকে চেয়ে বললে—হয়েছে, এবার মায়ের পাণ পিতিষ্ঠে হয়েছে, এবার পেসাদ খাবো, দাও।
সে কী ভিড়। তবু সেই ভিড়ের মধ্যেই প্রসাদ আনতে পাঠানো হলো। দেখতে দেখতে খবর রটে গিয়েছে এ-বাড়ি ও-বাড়ি, এ-পাড়া, সে-পাড়া। হাটখোলার দত্তবাড়ি, পোস্তার রাজবাড়ি, ঠনঠনের দত্তবাড়ি, শোভাবাজারের রাজবাড়ি, জোড়াসাঁকোর ঠাকুর-বাড়ি, মল্লিকবাড়ি, সব জায়গা থেকে লোকের পর লোক আসতে লাগলো।
এদিকে ভেতরবাড়ি থেকে প্রসাদ আনানো হয়েছে। ভালো করে বসিয়ে প্ৰসাদ খাওয়ানো হবে, মেজকর্তার হুকুম।
কিন্তু পাগলা হাবু উধাও।
খোঁজ খোঁজ-কোথায় গেল। দশজন লোক দশদিক খুঁজতে গেল। কোথাও নেই সে। পাগলা হাবু সেই যে গেল আর কেউ দেখেনি তাকে কোনদিন।
তখনও লোকের পর লোক আসছে। সবাই দেখতে চায় পাগলা হাবুকে। প্রতিমার শরীরে তখনও রক্ত লেগে আছে। টাটকা রক্ত। সেই ভিড়, সেই লোকারণ্য চললে সমস্ত দিন, সমস্ত রাত ধরে—
পুরনো বড়বাড়ির ধ্বংসস্তুপের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে ভূতনাথ অতীতের আবর্তে ড়ুবে গিয়েছিল যেন। হঠাৎ এক সময় বংশী এসে ডাকতেই ভূতনাথের চটকা ভাঙলো।
—শালাবাবু—
–আমাকে ডাকছিস বংশী–ভূতনাথ ফিরে তাকালো।
—ছোটমা আপনাকে একবার ডাকছে যে—
আজ আর সে-বয়েস নেই ভূতনাথের। এখন অনেক বয়েস হয়েছে। কিন্তু তবু এই নির্জন শ্মশানপুরীতে দাঁড়িয়ে সেদিনকার ছোটবৌঠানের ডাক যেন অমান্য করতে পারলো না সে। আজ সে-বাড়ি আর সে-রকস নেই। পার্টিশনের ওপর পার্টিশন হয়ে হয়ে অতীতের স্মৃতিসৌধের সিং-দরজা, প্রায় বন্ধ হবার যোগাড়। তবু ছোটবৌঠানের ডাক শুনে কেমন করে ভূতনাথই বা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।
-তুই চল বংশী, আমি এখুনি আসছি—ভূতনাথ উঠলো। বারমহল পেরিয়ে অন্দর মহল। অন্দর মহলে ঢুকতেই যেন সেই গিরির সঙ্গে হঠাৎ মুখোমুখি দেখা। গিরি মেজগিন্নীর পান সাজতে এসেছে। পান নিতে এসে ঝগড়া বাধিয়েছে সদুর সঙ্গে। সদু হলো সৌদামিনী।
সৌদামিনীর গলা খুব। বলে—আ ভগমান, কপাল পুড়েছে বলেই তো পরের বাড়িতে গতর খাটাতে এইচি
—গতরের খোটা দিমনি সদু, তোর গতরে পোকা পড়বে— সেই পোকাশুদ্ধ গতর আবার নিমতলার ঘাটে মুদ্দোফরাসরা পুড়োবে একদিন, দেখিস তখন–
—হালা গিরি-গতরের খোটা আমি দিলুম না তুই দিলি—যারা গতরখাকী তারাই জন্ম জন্ম গতরের খোঁটা দিক—
—কী, এত বড় আস্পদ্দা—আমাকে গতরখাকী বলিস—বলচি গিয়ে মেজমা’র কাছে—বলে দুম দুম্ করে কাঠের সিঁড়ির ওপর উঠতে গিয়ে সামনে ভূতনাথকে দেখেই যেন থমকে দাঁড়ালো গিরি তারপর জিভ কেটে এক গলা ঘোমটা দিয়ে একপাশে সরে দাঁড়িয়ে রাস্তা করে দিলে।
সেই নির্জন সিঁড়ি। সেই নিরিবিলি অন্দর মহল। কোথায় গেল সেই যদুর মা। সিঁড়ির ওপাশে রান্নাবাড়ির লাগোয়া ছোট্ট ঘরখানাতে বসে কেবল বাটনা বেটেই চলেছে। হলুদ আর ধনে বাটনার জল গড়িয়ে পড়ছে রোয়াক বেয়ে নর্দমার ভেতর। কখন সূর্য ড়ুবতো, কখন উঠতো, কখন বসন্ত আসতো, শীত আসতে আবার চলেও যেতো, খোঁজও রাখতে না বুড়ী। যখন কাজ নেই, দুপুরবেলা, তখন হয়তো ডাল বাছতে বসেছে। সোনামুগের ডাল, খেসারি, মসুর, ছোলা-আরো কতরকমের ডাল সব। কখনও কথা ছিল না মুখে। শুধু জানতে কাজ। কাজের ফুটো দিয়ে কোন ফাঁকে কখন তার জীবনটুকু নিঃশেষ হয়ে ঝরে পড়ে গিয়েছে—কেউ খবর রাখেনি। সিঁড়ি দিয়ে ভূতনাথ উঠতে যাবে, হঠাৎ আবার পেছনে ডাক—
—শালাবাবু—ও শালাবাবু–
ভূতনাথ পেছন ফিরে তাকালো। শশী ডাকছে।—শিগগির আসুন–
-কেন?
—ছুটুকবাবু ডাকছে—গোঁসাইজী আসেনি—আসর আরম্ভ হচ্ছে না–
ছুটুকবাবুর আসরে তবলচী বুঝি অনুপস্থিত। ছুটুকবাবু বসবে তানপুরা নিয়ে। ওদিকে কান ধীরু ইমনের খেয়াল ধরেছে আর গোঁসাইজী তবলা। সমের মাথায় এসে সে কী হা-হা-হা-হ্যাঁ চিৎকার। ঘর বুঝি ফেটে যায়। অনেক রাত পর্যন্ত চলবে আসর। এক-একদিন মাংস হবে। মুরগীর ঝোল আর পরটা। আর পর্দার আড়ালে এক-একবার এক-একজন উঠে যাবে আর মুখ মুছতে মুছতে ফিরে আসবে।
ছুটুকবাবুর মলমলের পাঞ্জাবি তখন ঘামে ভিজে গিয়েছে। কপালে দর দর করে ঘাম ঝরছে। গলার সরু সোনার চেনটা চি চিক্ করছে ইলেকটিক আলোয়। তালে তালে মাথা দুলবে ছুটুকবাবুর। বলবে কুছ পরোয়া নেই—শালাবাবু, তুমি এবার থেকে তবলার ভারটা নাওগোঁসাই-এর বড় গ্যাদা হয়েছে—শশী কাল গোঁসাই এলে তুই জুতো মেরে তাড়াবি-বুঝলি—এবার দেখাচ্ছি গোঁসাই-এর গ্যাদা।
কিন্তু ব্ৰজরাখালের কথাটা ভূতনাথের আবার মনে পড়ে ওদের সঙ্গে অত দহরম-মহরম কেন ভূতনাথ, বাবুরা হলো সায়েবের জাত, আর আমরা হলুম ওদের গোলাম—গোলামদের সঙ্গে কি সায়েব-বিবির মেলে খুব সাবধান ভূতনাথ খুব..
ভূতনাথ শেষ পর্যন্ত বললে—ছুটুকবাবুকে গিয়ে বল শশী ছোটমা আমাকে ডেকেছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলো ভূতনাথ। দোতলায় উঠে লম্বা বারান্দা। ডানদিকে রেলিং ঘেরা। চক্-মিলানো মহল। চারদিকে ঘের রেলিং—রেলিং-এর ওপর ঝুকলে নিচে একতলার চৌবাচ্চা আর উঠোন দেখা যায়। রান্নাবাড়ি থেকে রান্না করে সেজখুড়ী একতলার রান্নার ভাঁড়ারে ভাত ডাল তরকারী এনে সাজিয়ে রাখে। এখানে দাঁড়ালে আরো দেখা যায় যদুর মা শিল নোড়া নিয়ে দিনের পর দিন হলুদ বেটেই চলেছে। আর তার পাশের জানালা দিয়ে দেখা যায় আনাজঘরের এক টুকরো মেঝে— সেইখানে হয়তো সৌদামিনী ঝি তারকেশ্বরের বিরাট একটা বঁটি পেতে আলু বেগুন কুমড়ো কুটছে। চারদিকে কাঁচা আনাজের পাহাড় আর তার মধ্যে সদু একলা বঁটি নিয়ে ব্যস্ত। কিম্বা হয়তো পান সাজছে—খিলি তৈরি করছে—কিম্বা বিকেল বেলা প্রদীপের সুলতে পাকাতে বসেছে—জানালার ওই ধারটিতে ছিল সদুর বসবার জায়গা। হাতে কাজ চলছে আর মুখও চলছে তার। কার সঙ্গে যে কথা বলছে কে জানে। যেন আপন মনেই বকে চলে—আ মরণ, চোক গেল তো তিভূবন গেল-ভোলার বাপ তাই বলতো– ফুলবউ, চোক কান থাকতে থাকতে তিভুবন চিনে নাও–তা সে ভোলার বাপও নেই, ভোলাও নেই—আমি মরতে পরের ভিটেয় পিদিম জ্বলছি—আর আমার সোয়ামীর ভিটে আজ অন্ধকার ঘুরঘুটি।