বিধু সরকারের মতো খাজাঞ্চীর কাজে এমন নিষ্ঠা ভূতনাথ আর কারও দেখেনি।
দু’পাশে দুটি ঘর, মধ্যেখান দিয়ে বারবাড়িতে ঢোকবার রাস্তা। রাস্তার ওপাশেই বারমহলের উঠোন। উঠোনের দক্ষিণমুখে পূজোর দালান। সেই পূজোর দালানটা এখনও যেন তেমনি আছে। আশে পাশের আর সবই গিয়েছে বদলে। শ্বেতপাথরের সিঁড়ির টালিগুলো সবই প্রায় ভাঙা। বোধহয় এখনও পূজোট। চলছিল। ওটা বন্ধ হয়নি।
একবার নবমী পূজোর দিন একটা কাণ্ড হয়েছিল। শোনা গল্প। এই বাড়িতে এখানেই ঘটেছিল।
পূজো টুজো সব শেষ হয়ে গিয়েছে। প্রাসাদ বিতরণ হচ্ছে। রাঙাঠাকমা তসরের কাপড় পরে পুরুমশাই-এর জন্যে নৈবেদ্যর থালাগুলো সাজিয়ে গুণে গুণে তুলছে। ওধারে উঠোনে রান্নাবাড়িতে, গোলাবাড়িতে, আস্তাবলবাড়িতে যে-যেখানে ছিল সবাই ছুটে এসেছে। প্রসাদ পাবে। ভেতরে অন্দরমহলের জন্যে বারকোষ ভর্তি প্রসাদ গেল ঠিকে লোকদের মাথায় মাথায়।
ওদিকে ভিস্তিখান, তোশাখানা, বাবুর্চিখানা, নহবৎখানা, দপ্তরখানা, গাড়িখানা, কাছারিখানা সমস্ত জায়গায় যারা কাজের জন্যে আসতে পারেনি, আটকে গিয়েছে তাদের কাছেও পাঠিয়ে দেওয়া হলো।
দরদালান, দেউড়ি, নাচঘর, স্কুলঘর, সব জায়গায় সবাই প্রসাদ খাচ্ছে। হঠাৎ এদিকে এক কাণ্ড হলো।
–খাবো না আমি–
–-কেন খাবিনে—
–পূজো হয়নি—
—সে কি–কে তুই—
–আমি হাবু—
–কোথাকার হাবু? কাদের হাবু? বাড়ি কোথায় তোর?
আশে পাশে ভিড় জমে গেল। সবাই জিজ্ঞেস করে—কী হলো? কে ও? কাদের ছেলে? কিন্তু চেহারা দেখেই তো চিনতে পারা উচিত। পাগলই বটে! পাগলা হাবু। বাপের জন্মে কেউ মনে করতে পারলে না যে দেখেছে ওকে কোথাও। আধময়লা কাপড়, খালি গা, এক পা ধুলো, চুল একমাথা। উদাস দৃষ্টি! খেলো না তো বয়ে গেল। সেধো না ওকে। কলাপাতা আসন পেতে রূপোর গেলাস দিয়ে আসুন বসুন করতে হবে নাকি! দাও তাড়িয়ে। হাঁকিয়ে দাও দূর করে।
মেজকর্তা খবর পেয়ে ছুটে এলেন। মেজকর্তা শুধু নামে–আসলে কিন্তু মেজকর্তাই মালিক। সারা গায়ে গরদের উড়নি, পরনে গরদের থান। কপালে চন্দনের ফোটা। ভারিক্কী মানুষ। নিখুত করে দাড়ি কামানো—শুধু তীক্ষ একজোড়া গোঁফ মুখের দু’পাশে সোজা ছুঁচলো হয়ে বেরিয়ে রয়েছে। গায়ে আতরের গন্ধ কিন্তু আতরের গন্ধকে ছাপিয়েও আর একটা তীব্র গন্ধ আসছে গা থেকে। যারা অভিজ্ঞ তারা জানে ওটা ভারি দামী গন্ধ। দামী আতরের গন্ধের চেয়েও আরো দামী। মেজকর্তাকে দেখে সবাই সরে দাঁড়ালো। এসে বললেন—কই দেখি–
দেখবার মতো চেহারা নয় তার। ভয় নেই। ও নেই। মেজকর্তাকে দেখে নমস্কার করাও নেই। শুধু একদিকে আপন মনে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।
একবার জিজ্ঞেস করলেন-প্ৰসাদ খাবিনে কেন?
—আজ্ঞে পূজো হয় নি—
—পূজো হয়নি মানে—
–পিতিমের পাণ পিতিষ্ঠে হয়নি—
মেজকর্তা হাসলেন না। কিন্তু হাসলেন রূপলাল ভট্টাচার্য। পাশে তিনিও এসে দাঁড়িয়েছিলেন। পায়ে খড়ম। পরনে কোসার থান। গায়ে নামাবলী। মাথার লম্বা শিখায় গাঁদা ফুল। বললেন—পাগলের কথায় কান দেবার প্রয়োজন নেই বাবাজী-তুমি এসো।
কিন্তু মেজকর্তা সহজে ছাড়বার পাত্র নন। বললেন-না ঠাকুরমশাই, আমার বাড়িতে বসে অতিথি নবমীর দিন অভুক্ত থাকবে—এটা ঠিক নয়।
রূপলাল ঠাকুর কেমন যেন চিন্তিত হলেন। জিজ্ঞেস করলেনপ্রতিমার প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়নি তুই বুঝলি কিসে?
পাগলা হাবু বললে–মা তো নৈবিদ্যি খায়নি।
রূপলাল ঠাকুর এবার বিরক্ত হলেন।
আশে পাশের ভিড়ের মধ্যে যেন একটা কৌতুক সঞ্চার হয়েছে!
রূপলাল ঠাকুর এবার জিজ্ঞেস করলেন-প্রাণ প্রতিষ্ঠা তা হলে কীসে হবে?
—আমি পিতিষ্ঠে করবো!
–বামুনের ছেলে তুই?
—আজ্ঞে মায়ের কাছে আবার বামুন শুদ্দুর কী—মা যে জগদম্বা জগজ্জননী।
পাগলা হাবুর কথায় যেন সবাই এবার চমকে গেল। নেহাৎ বাজে কথা নয় তো। মেজকর্তা কেমন যেন মজা পাচ্ছেন মনে হলো। তিনি যেন অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশি মৌজে আছেন। আজ কেমন যেন মিষ্টি মিষ্টি হাসি হাসছেন।—তা কর তুই প্রাণ প্রতিষ্ঠা—বলছে যখন, তখন করুক ও।
রূপলাল ঠাকুর প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বৃথা। মেজকর্তার ওপর কথা বলা চলে না।
ততক্ষণ খবর ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। বারমহল ঝেটিয়ে এসে জুটেছে পূজোর দালানে। কেউ বলে ছদ্মবেশী সাধু বটে। পাগলাটার সঙ্গে কথা বলবার লোভ হচ্ছে। রান্নাবাড়ি থেকে ঠাকুররা এসেছে রান্না ফেলে। শুধু মেজকর্তার ভয়ে কেউ বেশি এগোতে সাহস পায় না। দাসু মেথর আজ ছেলেমেয়ে নাতি নাতনি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে। নিজে পরেছে চীনা-সিল্কের গলাবন্ধ কোট—আর বউ ছেলে-মেয়েদেরও গায়ে নতুন জামা-কাপড়-শাড়ি।
পাগলা হাবুকে নিয়ে যাওয়া হলে পূজোমণ্ডপে। পূজোর দালানের ভেতর।–কর প্রাণ প্রতিষ্ঠে-কর তুই।
—কলার বাশ্না দাও—
—কলার বাশ্না কী হবে—
—আগে দাওই না, দেখোই না, কী করি–
এল গাদা গাদা কলার বাশ্না দক্ষিণের বাগান থেকে। মেজকর্তার হুকুম। দেখাই যাক না মজা। পূজোর বাড়িতে মজা করতে আর মজা দেখতেই তো আসা। ভিড় করে সবাই দাঁড়ালো শ্বেত মার্বেল পাথরের সিঁড়ির ওপর। ঝুঁকে দেখছে সামনে পাগলা হাবুর দিকে।
পাগলা হাবু কিন্তু নির্বিকার। ধারালো কাটারি দিয়ে কলার বাশ্নাগুলো ছোট ছোট করে কাটলে। তারপর এক কাণ্ড! সেই এক-একটা বাশ্না নেয় আর কী মন্ত্র পড়ে, আর জোরে জোরে ছুঁড়ে মারে প্রতিমার গায়ে, মুখে, পায়ে, সর্বাঙ্গে।