বনমালী সরকারের সঙ্গে এই বড়বাড়ির ইতিহাসও তো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কথাটা ভাবতেই ভূতনাথ কেমন যেন অবশ হয়ে এল। তারপর একবার আশে পাশে ছেয়ে নিয়ে টুপ করে ঢুকে পড়লো সদর দরজা দিয়ে। কেউ কোথাও নেই, কে আর দেখতে আসছে তাকে। কিন্তু দেখতে পেলে হয়তো তাকে পাগলই ভাববে। ভূতনাথ পাশের ঘড়িঘরটার নিচে সাইকেলটা হেলান দিয়ে রেখে সোজা চলতে লাগলো।
মনে আছে তখন এই ঘড়িঘরের ঘণ্টার ওপর নির্ভর করেই সমস্ত বাড়িখানা চলতো।
সকাল ছ’টায় বাজতো একটা ঘণ্টা। ব্রজরাখাল উঠতো তারও আগে। তারই মধ্যে তখন তার মুখ ধোওয়া, প্রাতঃকৃত্য সমস্ত শেষ হয়েছে। পাথর বাটিতে ভিজোনো খানিকটা ছোল আর আদা-নুন নিয়ে কচ কচ করে চিবোচ্ছে।—ওঠো হে বড়কুটুম, ওঠো, ওঠো-ব্রজরাখাল ঘন ঘন তাগাদা দেয়।
আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে উঠে বসতে দু’চার মিনিট দেরিই লাগে ভূতনাথের। তখনও একতলার আস্তাবল থেকে ঘোড়া ডলাই-মলাই-এর শব্দ আসে। ছপছপছপ-ছ—হিস্স্-হিস্স্–ক্লপ-ক্লপ! ও-ধারে দরোয়ান ব্রিজ সিং আর নাথু সিং-এর ঘরে তখন হু হু করে ডনবৈঠকের আওয়াজ হচ্ছে। সিমেন্টের দাগরাজি করা সামনের উঠোনের ওপর দাসু জমাদারের খ্যাংরা ঝাটার খর-খর শব্দ আসছে। বোঝা যায় সকাল হলো। আর চোখ বুজে থাকা যায় না। ভূতনাথ দেউড়ি পেরিয়ে আরো সামনে এগিয়ে গেল।
বাঁদিকের এই ঘরটার ওপরে থাকতো ইব্রাহিম। ইব্রাহিমের গালপাট্টা দাড়ির কথা এখনও মনে পড়ে ভূতনাথের। একটা কাঠের চিরুণী নিয়ে ছাদের নিচু বারান্দাটায় বসে ইয়াসিন সহিস ইব্রাহিমের লম্বা বাবড়ি চুল আঁচড়ে চলেছে তো আঁচড়েই চলেছে। কিছুতেই আর ইব্রাহিমের মনঃপুত হয় না। ইব্রাহিম কাঠের কেদারাটায় বসে এক মনে বাঁ হাতের কাঠের আশিতে মাথা কাত করে নিজের চুলের বাহারই দেখছে। কোনও দিকে হৃক্ষেপ নেই—তারপর হঠাৎ এক সময় ফট করে উঠে দাঁড়াতে। অর্থাৎ চুলটা বাগানো তার পছন্দ হয়েছে। এবার সে নিজের হাতে চিরুণী নিয়ে বাগাবে পাঠানী দাড়িটা।…এমনি করে চলতে সকাল সাতটা পর্যন্ত।
ভূতনাথ আরো এগিয়ে চললো পায়ে পায়ে ইতিহাসের সিংহদ্বার যেন আস্তে আস্তে খুলছে ওভারসিয়ার ভূতনাথের চোখের সামনে। সন্ধ্যে হয়ে এল। কিন্তু চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর-একশ’–দেড়শ’ বছর পেছনে যেন ভূতনাথ চলে গিয়েছে। কালের নাটমঞ্চ যেন ক্রমশঃ ঘুরতে লাগলো। অষ্টাদশ শতাব্দীর মুর্শিদকুলী খাঁ’র কানুনগোর শেষ বংশধর বদরিকাবাবু যেন সামনের একতলার বৈষ্ঠকখানা-ঘরের শেতলপাটি ঢাকা নিচু তক্তপোশটার ওপর হঠাৎ উঠে বসেছেন।
সাধারণত সমস্ত দিন ওইভাবে ওই তক্তপোশটার ওপরই চিত হয়ে পায়ের ওপর পা দিয়ে শুয়ে থাকেন বদরিকাবাবু। তাঁর ভয়ে ও-ঘর কেউ মাড়ায় না। তবু কাউকে দেখতে পেলেই হলো। ডাকেন। কাছে বসান। টাকে একটা ছোট্ট ঘড়ি। বলেন— বাড়ি কোথায় হে ছোকরা?
–বাপের নাম কী?
–গাঁ? কোন জেলা?
—বামুন কায়েত ক’ ঘর?
–বিঘে প্রতি ধান হয় কত?
—দুধ ক’ সের করে পাও?
এমনি অবান্তর অসংখ্য প্রশ্ন। ব্যতিব্যস্ত করে ছাড়েন সবাইকে। গ্রীষ্মকালে খালি গা। একটা চাদর কাঁধে। আর শীতকালে একটা তুলোর জামা। প্রথমটা কেউ সন্দেহ করে না। সরল সাধাসিধে মানুষ। তারপর যখন শুরু করেন গল্প—সে-গল্প আর শেষ হতে চাইবে না। মুর্শিদকুলি খাঁ থেকে শুরু করে লর্ড ক্লাইভ হালসীবাগান, কাশিমবাজার আর…ফিলিপ ফ্রান্সিস, ওয়ারেন হেস্টিংস…নন্দকুমার—
সব শুনতে গেলে আর ধৈর্য থাকে না কারো। তারপর যখন রাত ন’টা বাজে, তোপ পড়ে কেল্লায়, তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসেন বদরিকাবাবু। হাই তোলেন লম্বা একটা। তারপর দুটি আঙুলে তুড়ি দিয়ে একবার চিৎকার করে ওঠেন—ব্যোম্ কালী কলকাত্তাওয়ালী। তারপর টাকঘড়িটা বার করে মিলিয়ে নেন সময়টা।
বাঁ ধারে বদরিকাবাবুর বৈঠকখানাআর ডানদিকে খাজাঞ্চীখানা। খাজাঞ্চীখানা মানে বিধু সরকারের ঘর। সামনে একটা ঢালু কাঠের বাক্স নিয়ে বসে থাকে বিধু সরকার। চশমাটা ঝুলছে নাকের ওপর। মাদুরের ওপর উবু হয়ে বসে চাবি দিয়ে খোলন বাক্সটা। ভারি নিষ্ঠা বিধু সরকারের ওই ক্যাশবাক্সটি আর ওই চাবির গোছাটির ওপর। প্রতিদিন ঠনঠনে কালীবাড়ির ফুল আর তেল সিঁদুর আসে তার জন্যে। বিধু সরকার নিজের হাতে চাবির ফুটোটার তলায় ত্রিশূল এঁকে দেয় একটা। আর একটা ত্রিশূল আঁকে পশ্চিমের দেয়ালে আঁটা লোহার সিন্দুকটার চাবির ফুটোর নিচে।
সামনে বরফওয়ালা মেঝের ওপর ঠায় বসে আছে পাওনা টাকার তাগাদায়। সেদিকে বিধু সরকারের নজর দেবার কথা নয়।
ত্রিশূল আঁকার পর বিধু সরকার ক্যাশবাক্সটি খুলবে। খুলে ফুলটি রাখবে তলায়। তারপর বার করবে ছোট একটি ধুনুচি। বিধু সরকারের নিজস্ব ধুনুচি। একটি ছোট কোটো থেকে বেরুবে ধুনো, বেরুবে কাঠ কয়লা আর একটি দেশলাই। দেশলাইটি জ্বালিয়ে আগুন ধরাবে ধুনোয়। তারপর ঘন ঘন পাখার হাওয়া। করতে করতে যখন গল্ গল্ করে ধোঁয়া বেরুবে, ধোঁয়ায় চোখ নাক মুখ অন্ধকার হয়ে আসবে বিধু সরকারের, তখন সেই মজার কাণ্ডটি করে বসবে। আগুন সমেত ধুনুচিটি বাক্সর মধ্যে বসিয়ে বাক্সর ডালাটি ঝপাং করে বন্ধ করে দেবে। নিচু হয়ে বাক্সে মাথা ঠেকিয়ে অনেকক্ষণ ধরে নমস্কার করবে বিধু সরকার। তারপর মাথা তুলে। বাক্স খুলে ধুনুচি বার করে আবার ডালা বন্ধ করবে। তখন কাজ আরম্ভ করার পালা। সামনের দিকে চেয়ে বলবে-এবার বলো তোমার কথা।