—সেলাম হুজুর—গাইতি থামিয়ে দুখমোচনও সেলাম জানায়।
দু’পাশে পদে পদে সেলাম নিতে নিতে চলতে লাগলো ভূতনাথ। ভূতনাথ চক্রবর্তী। একবারে সোজা এসে দাঁড়ালো বড়বাড়ির সামনের সদর গেটে।
কুলির সর্দার চরিত্র মণ্ডল সামনে এসে নিচু হয়ে সেলাম করলে।
এতক্ষণে ভূতনাথও মাথা নোয়াল। বললে—দাগ শেষ করেছে। চরিত্র?
চরিত্র মণ্ডল মাথা নাড়লে—আজ বড় দাগ দিতে হবে হুজুর, কাল আরো চল্লিশজন কুলি লাগাচ্ছি, এদিকটা তত দিলাম শেষ করে, সন্ধ্যে নাগাদ সব সমান করে তবে কুলিরা ছুটি পাবে হুজুর।
ভূতনাথ চারিদিকটা চেয়ে দেখলে একবার। অনেকদিন আগেই সব বিলুপ্তপ্রায় হতে চলেছিল। এবার যেটুকু আছে, তা-ও নিঃশেষ করে দিতে হবে। কোথায় বুঝি কোন্ অভিশাপ কবে এ-বংশের রক্তের মধ্যে প্রবেশ করেছিল শনির মতো নিঃশব্দে, আজ তা নিশ্চিহ্ন হলো।
চরিত্র মণ্ডল আবার কথা বললে—কাল তা হলে ওই দাগটা ধরবো তো হুজুর?
একদিন এই বাড়ির আশ্রয়ে এসেই নিজকে ধন্য মনে করেছিল ভূতনাথ। সারা কলকাতায় সেদিন এই বাড়ি আর এই বাড়িরই আর একজন মানুষকে কেবল নিজের বলে মনে হয়েছিল। অথচ ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস!
চরিত্র মণ্ডল আবার বললে—কাল তা হলে কোথায় হাত লাগাবো হুজুর?
হঠাৎ ভূতনাথ বললে-না না, মদ টদ আমি খাইনে—-বলেই চমকে উঠছে। চরিত্র মণ্ডলও কম চমকায় নি। ওভারসিয়ার বাবুর দিকে হঠাৎ ভালো করে তাকিয়ে দেখলে সে।
কিন্তু এক নিমেষে নিজেকে সামলে নিয়েছে ভূতনাথ। এরই মধ্যে কি তার ভীমরতি ধরলো নাকি। সামলে নিয়ে ভূতনাথ বললে—কী বলছিলে যেন চরিত্র?
—আজ্ঞে দাগের কথা বলছিলাম, বলছিলাম এদিকটা তো শেষ করে দিলাম, কাল কোত্থেকে শুরু করবো তাহলে হুজুর?
ঈশ্বরের কী অভিপ্রায় কে জানে! যদি সেই অভিপ্রায়ই, হয়, তো সে বড় নিষ্ঠুর কিন্তু। একদা নিজের নিশ্চিন্ত আশ্রয়স্থলকে নিজের হাতেই আবার একদিন তাঙবার আদেশ দিতে হবে, কে জানতে! একদিন এই বড়বাড়িতে প্রবেশ করবার অনুমতির অভাবে এইখানে এই রাস্তার ওপর হাঁ করে পাঁচ ছ’ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। ব্রিজ সিং ওইখানে লোহার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। ডান হাতে সঙ্গীন উচু করা বন্দুক। আর বুকের ওপর মালার মতন বন্দুকের গুলীভরা বেল্ট। সেদিন এমন সাহস ছিল না যে, ওইখানে ব্রিজ সিং-এর সামনে দিয়ে ভেতরে যায় ভূতনাথ।
কোথায় সে গেট! কোথায়ই বা সে ব্রিজ সিং! ব্রিজ সিং ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে চেঁচাতে—হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার—হো-
ছোটবাবুর ল্যাণ্ডোলেট যখন ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে রাস্তায় বেরুতোতখন সাড়া পড়ে যেতো এ-পাড়ায় ও-পাড়ায়। কড়ির মতো সাঈ জুড়ি ঘোড়া টগবগ্ করতে করতে গেট পেরিয়ে ছুটে আসতো রাস্তায়। আর রাস্তায় চলতে চলতে লোকেরা অবাক হয়ে চেয়ে দেখতে ঘোড়া দুটোকে।
গাড়িটা যখন অনেক দূরে চলে গিয়েছে, তখন ব্রিজ সিং আবার সেই আগেকার মতো কাঠের পুতুল সেজে সঙ্গীন খাড়া করে দাঁড়িয়ে থেমে থাকতো।
সে-সব অনেক দিনের কথা। তারপর কত শীত কত বসন্ত এল। কত পরিবর্তন হলো কলকাতার। কত ভাঙা কত গড়া। ভূতনাথের সব মনে পড়ে।
এখনও দাঁড়ালে যেন দেখা যাবে ব্ৰজরাখাল রোজকার মতন আপিস থেকে বাড়ি ফিরছে। সেই গলাবন্ধ আলপাকার কোট। সামনে ধুতির কোঁচাটা উল্টে পেট-কোমরে গোঁজা। মুখে গালের ভেতর পান গোঁজা। হাতে পানের বোঁটায় চুন। রোগা লম্বা শক্তসামর্থ্য মানুষটি।
ব্ৰজরাখাল বলতোনা না, এটা কাজ ভালো করোনি ভূতনাথ, আমরা হলাম গিয়ে গোলাম—ওদের গোলাম—আর বাবুরা হলো সায়েব-সায়েব বিবির সঙ্গে কি গোলামদের মেলে-কাজটা ভালো করোনি বড়কুটুম।
চরিত্র মণ্ডল সামনে এল আবার। বললে—তা হলে আজ আমরা আসি হুজুর।
তার মানে! ওভারসিয়ার ভূতনাথ চোখ ফিরিয়ে দেখলে চারদিকে। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। শীতকালের বেলা দেখতে দেখতে যায়। বললে—তা হলে ওই কথাই রইল, এই দাগেই হাত দেবে কাল সক্কাল বেলা।
চরিত্র মণ্ডল সেলাম করে চলে গেল। সঙ্গে দু’চারজন যারা অবশিষ্ট ছিল সবাই সেন্ট্রাল এভিনিউ-এর দিকে পা বাড়ালো। একটা কুকুর হঠাৎ কোথা থেকে ভূতনাথের পায়ের কাছে এসে ল্যাজ নাড়াতে লাগলো। ধুলোয় ধুলো সারা গা। সমস্ত দুপুর বোধহয় বসে বসে রোদ পুইয়েছে। এবার হয়তো ইটের স্কুপের মধ্যে আশ্রয় নেবে রাতটুকুর জন্যে। কেমন যেন মায়া হলো ভূতনাথের। যারা মালিক, যারা ভাড়াটে, তারা কবে নোটিশ পেয়ে কোথায় চলে গিয়েছে। কিন্তু কুকুরটা বোধহয় কাস্তুভিটের মায়া ছাড়তে পারছে না। ও-পাড়ায় গিয়ে, ওই হিদারাম বড়য্যের গলিটা পর্যন্ত গেলেই চপকাটলেটের এটো টুকরো খেয়ে আসতে পারে। বউবাজারের পাটার দোকানের ফুটপাথে গিয়ে দাঁড়ালেও দু’চারটে টেংরি মেলে। তবে কীসের মায়া ওর? বাস্তুভিটের? কুকুর একটা, তার আবার বাস্তুভিটে, তার আবার মায়া!!
–দূর, দূর, দূর হ—ভূতনাথ কুকুরটার দিকে একটা লাথি ছুঁড়লে।
মেজকর্তার অত সখের পায়রা সব। তা-ই রইল না একটা। এক-একটা পায়রা ময়ুরের মতন পেখম তুলে আছে তো তুলেই আছে। হাতে করে ধরলেও পেখম উঁচু করে ছড়িয়ে থাকতো।
কী সব বাহার পায়রার। তাই বলে একটা রইল না।
—দূর, দূর, দূর হ–
ক্রমে অল্প অল্প অন্ধকার হয়ে এল। দূরে বউবাজারের ট্রাম লাইন-এর ঘড় ঘড় আওয়াজ আরো কর্কশ হয়ে আসে। রাস্তায় রাস্তায় আলো দেখা যায়। বনমালী সরকার লেন-এ আর আলো জ্বলবে না এবার থেকে। লোক চলবে না। ইতিহাস থেকে বনমালী সরকার বিলুপ্ত হয়ে যাবে শেষ পর্যন্ত।