তা হোক, তবু ইপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের নোটিশ দিতে বাধা নেই। বড়বাড়ির ছোট ছোট মালিকরা নোটিশ নিয়ে সই দিলেন।
নোটিশের পেছন পেছন এল চেন, কম্পাস, শাবল, ছেনি, হাতুড়ি, কোদাল, গাঁইতি, ডিনামাইট—লোকলস্কর, কুলিকাবারি। আর এল ভূতনাথ। ওভারসিয়ার ভূতনাথ। ভূতনাথ চক্রবর্তী। নিবাস—নদীয়া। গ্রাম—ফতেপুর, পোস্ট আপিস—গাজনা।
দুপুরবেলা ধুলোর পাহাড় ওড়ে। টিনের চালাগুলো ভাঙতে সময় লাগবার কথা নয়। এদিকে ভুজাওয়ালাদের টিনের দোতলা বাড়িটা থেকে শুরু করে সবুজ সঙ্ঘের ঘরটা পর্যন্ত ভাঙা হয়ে গিয়েছে। শীতকাল। দল বেঁধে কুলির দল লম্বা দড়ির শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে সুর করে চিৎকার করে—
—সামাল জোয়ান—
—হেঁইও—
—সাবাস জোয়ান—
—হেঁইও—
–পুরী গরম—
—হেঁইও—
গরম পুরী ওরা খায় না কিন্তু। দুপুরবেলায় এক ঘণ্টা খাবার সময়। সেই সময় ছাতু কাঁচালঙ্কা আর ভেলী গুড় পেটের ভেতর পোরে। বউবাজার স্ত্রীটের ট্রামের ঘড় ঘড় শব্দ এখানে ক্ষীণ হয়ে আসে—আর এদিকে সেন্ট্রাল এভিনিউতে তখন দুপুরের ক্লান্তি নেমেছে। মাঝখানে “শ্রীশ্রীমহাকালী আশ্রম”-এর অশথ গাছটার তলায় একটু গড়িয়ে নেয় ওরা। বনমালী সরকার লেন-এর সর্পিল গতি সরল হয়ে গিয়েছে। ভাঙা বাড়ির সমতল ভূমিতে দাঁড়িয়ে বেহারী কুলিরা জানতেও পারে না—কোন্ শাবলের আঘাতে জীবনের কোন্ পর্দায় কোন্ সুর মূৰ্ছিত হয়ে উঠলো। এক একটা ইট নয় তো যেন এক একটা কঙ্কাল। ইতিহাসের এক একটা পাতা ভাঙা ইটের সঙ্গে গুড়িয়ে ধুলো হয়ে যায়—আর তারপর উত্তরে হাওয়ায় আকাশে উঠে আকাশ লাল করে দেয়।
চূড়ামণি চৌধুরী কোর্ট ফেরৎ বাড়ি যেতে যেতে তখন ফিরে চেয়ে দেখেন। মনে হয় আকাশটা যেন লাল হয়ে গিয়েছে। আশে পাশে ট্রামে লোক বসে আছে—মুখে কিছু বলেন না। বাড়িতে এসে ইতিহাসটা খুলে কসেন। কোথায়, কবে সিরাজদ্দৌলা শহর পুড়িয়ে ছারখার করে দিলে। আবার দেখতে দেখতে নতুন করে গড়ে উঠলো কলকাতা। পোড়া কলকাতা যেন আবার আজ পুড়ছে—নতুন করে গড়ে ওঠবার জন্যে। ভালোই হলো। বহু বিষ জমে উঠেছিল ওখানে। খোলা হাওয়া ঢুকতে না ঘরগুলোতে। পুরুষানুক্রমে বড়বাড়ির অবস্থা যা দাঁড়িয়েছিল, তাতে সরিকের সঙ্গে সরিকের আর পাশাপাশি বাস করা চলতো না। বড়কর্তাদের সে আমলের একটা রূপোর বাসন নিয়ে মামলা হয়ে গেল সেদিন। তবু আজকালকার ছেলেরা সে-সব দিন তো দেখে নি। চূড়ামণি চৌধুরীও তখন খুব ছোট। মেজ-কাকীমার পুতুলের বিয়েতে মুক্তোর গয়না এসেছিল ফ্রান্স থেকে। আর মেজকর্তার পায়রা নিয়ে মোকর্দমা লাগলে ঠঠনের দত্তদের সঙ্গে। সে কী মামলা। সে মামলা চললো তিন বছর ধরে। কজ্জনবাঈ সেকালের অত বড় বাঈজী। গান গাইতে এসেছিল দোলের দিন। ধর্মদাসবাবু ড়ুগি-তবলা বাজিয়েছিলেন। বড়দের দোলের উৎসবে ছোটদের ঢোকবার অধিকার ছিল না তখন। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছিলেন দপ্তরখানার ভেতর দরজার ফাঁক দিয়ে। সে কী নাচ। সেই কজ্জনবাঈ-ই এসেছিল আর একবার দশ বছর পরে। তখন সে চেহারা আর নেই। মেজ-কাকীর কাছ থেকে ভিক্ষে চেয়ে নিয়ে গেল। অনেক বলা-কওয়াতে একটা গান গাইলে। সে গানটা সে দশ বছর আগে একবার গেয়েছিল।
বাজু বন্ধ্ খুলু খুলু যায়—
ভৈরবী সুরের মোচড়গুলো বড় মিঠে লেগেছিল সেদিন। বুড়ীর গলায় যেন তখনও যাদু মেশানো। ঠুংরীতে ওস্তাদ ছিল কজ্জনবাঈ। আজকালকার ছেলেরা শোনে নি সে গান।
কোর্টে আসা-যাওয়ার পথে ট্রামের জানালা দিয়ে বাড়িখানা আর একবার দেখেন। এদিককার সব ভাঙা হয়ে গিয়েছে। বড়বাড়িটা এখনও ছোঁয়নি ওরা। এদিকটা শেষ করে ধরবে ওদিকটা।
চূড়ামণি চৌধুরীর মনে হয় যেন এখনও কিছু বাকি আছে। চোখ বুজলেই যেন দেখতে পান সব। পাল্কি এসে দাঁড়ালো দেউড়িতে। মেজ-কাকীমার পেয়ারের ঝি গিরি এসে দাঁড়িয়েছে তসরের থান পরে। সদর গেটে ঘণ্টা বাজিয়ে দিলে ব্রিজ সিং। হটো সব, হটো সব। পাল্কি বেরুচ্ছে। বড় ছোট সব যোগে মেজ-কাকীমার গঙ্গাস্নান চাই। তারপরেই মনে হয় ভালোই হয়েছে। সেই বড়বাড়িতে একটা চাকরও রইল না তোষাখানাতে। মধুসূদন ছিল বড়কর্তার খাস চাকর। চাকরদের সর্দার। সে-ও একদিন দেশে গেল পূজার সময়, আর ফিরলো না।
যখন চোখ খোলেন চূড়ামণি চৌধুরী, তখন ট্রাম হাতীবাগানের কাছ দিয়ে হু হু করে চলেছে। পাতলা হয়ে গিয়েছে ভিড়। কালো কোটের পকেটে দুটো হাত ঢুকিয়ে চুপ করে বসে থাকেন আর ভাবেন, বাড়িতে গিয়েই কটন সাহেবের হিস্ট্রিটা পড়তে হবে। আর বাস্টীডের বইটা। সার ফিলিপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে ম্যাডাম। গ্র্যাণ্ডের প্রণয়কাহিণী। কী রাজত্বই করেই গিয়েছে বেটার। সাত সমুদ্র থেকে জব চার্নক আর ছ’ জন সহকারী আর সঙ্গে মাত্র তিরিশ জন সৈন্য। আকবর বাদশা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেন নি এত বড় সাম্রাজ্যের কথা।
বেহারী মজুররা পেতলের থালা ধুয়ে মুছে আবার ইট ভাঙতে শুরু করে। দুম-দাম করে পড়ে ইট। চুন-সুরকীর গুড়ো আকাশে উড়ে চলে। চোখ-মুখ ধুলোয় ধুলো হয়ে যায়। তবু ঠিকাদারের লোক হুঁশিয়ার নজর রাখে। কাজে কেউ ফাকি দেবে না। সায়েব কোম্পানী শহর বানিয়েছে, রাস্তা বানিয়েছে। বড় বড় তালাও কেটেছে। জলের কল বসিয়েছে। মাথায় বিজলী বাতি আর পাখা দিয়েছে। সব দিয়েছে সায়েব কোম্পানী। বনমালী সরকারের গলি ভেঙে দেশের কোনও ভালো করবে নিশ্চয়ই সায়েবরা।
—সেলাম হুজুর—বলে সরে দাঁড়ালো বৈজু।