ভোর বেলা কিন্তু যথারীতি ঘুম থেকে উঠেছে ভূতনাথ। মেসের তেতলা ঘরটার জানালা দিয়ে সূর্যোদয় দেখা যায়। গঙ্গাস্নান সেরে এসে সেদিকে চেয়ে যথারীতি প্রণামও করেছে। প্রাতঃকালীন জপ-তপ গায়ত্রী—কোনো কিছুই বাদ যায়নি সেদিনও। আপিসেও গিয়েছে যথাসময়ে। কোনো ব্যতিক্রম হয়নি কোথাও। কিন্তু আপিসের ঘড়িতে তখন বেলা দুটো….
বড় সাহেব ডাকলো। ঘরে যেতেই বড়সাহেব বললে—বনমালী সরকার লেন-এ যে বিল্ডিং ভাঙা হচ্ছে—সেখানে এখনি দৌড়ে যাও ‘—গিয়ে সেখানে কী হয়েছে দেখে এসে আমাকে রিপোর্ট দেবে।
ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে কিছু ম্যাক্সিডেন্ট হয়েছে নাকি?
সাহেব বললে—তা ঠিক নয়, তবে কুলীর কাজ বন্ধ করে দিয়েছে বলছে আর কাজ করবে না, টুলস্ যন্ত্রপাতি ফেলে দিয়ে বসে আছে।
সেদিনও ঠিক সেই জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো ভূতনাথ আবার। কিন্তু আজ দুপুরবেলা চেহারা যেন সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে বড়বাড়ির।–বড়বাড়ি আর বল কেন। বড়বাড়ির একখানা ইট পর্যন্ত আর দাঁড়িয়ে নেই। মাটি সমান হয়ে গিয়েছে সমস্ত। দূর থেকে কিছুই দেখা যায় না। কাছে এলে বোঝা যায় চারদিকে বড়-বড় গর্ত। ইট সিমেন্ট ভেঙে মাটি বেরিয়ে গিয়েছে। ভিত্ পর্যন্ত উপড়ে ফেলেছে সব। সমস্ত বনমালী সরকার লেনটা যেন মরুভূমির মতো খাঁ-খাঁ করছে।
কিন্তু কাছে যেতেই বোঝা গেল বেশ ভিড় জমেছে ঘন। কা’কে কেন্দ্র করে যেন অনেক জটলা চলেছে।
ভূতনাথ হাজির হতেই চরিত্র মণ্ডল এগিয়ে এল। মুখ দেখে ভাব তার বদলে গিয়েছে। বললে—আমরা কাজ করবো না হুজুর।
—কেন, কী হলো তোমাদের?
চরিত্র মণ্ডলকে আর বলতে হলো না কী হয়েছে। ভূতনাথ দেখলে পাশেই বৈজু নির্জীব হয়ে পড়ে আছে। গাঁইতির ঘা লেগে একেবারে রক্তারক্তি কাণ্ড। বউবাজার থেকে ডাক্তার এসে ব্যাণ্ডেঞ্জ। বেঁধে দিয়েছে। ব্যাণ্ডেজের কাপড়টাও তখন রক্তে ভেসে গিয়েছে।
চরিত্র মণ্ডল আবার বললে—আমরা আর এখানে কাজ করা হুজুর।
—কেন, কাজ বন্ধ করবি কেন? তা কাজ না করিস অন্যাকুল ডাকবো কাল থেকে!
চরিত্র বললে–কোনো কুলী এখানে কাজ করবে না– কবরখানা আছে হুজুর—ওই দেখুন—সঙ্গে-সঙ্গে চরিত্র মণ্ডল হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলে—ওই দেখুন হুজুর—ওই দেখুন।
অনেক লোক উৎসুক হয়ে সেদিকেই তখন দেখছিল। চরিত্র মণ্ডল ভূতনাথকে সঙ্গে করে নিয়ে গেল সেইদিকে। বড়বাড়ির তি খুড়েছে কুলীরা। গত করেছে জায়গায়-জায়গায়। একটা গর্তের ভেতর স্পষ্ট প্রত্যক্ষ দেখতে পেলে ভূতনাথ। কোনো সন্দে, নেই। মানুষের সম্পূর্ণ একটা কঙ্কাল। মাথার খুলি থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত। উপুড় হয়ে পড়ে আছে। কত দিনের, কত কাল আগের কে জানে। কিন্তু এতটুকু বিকৃত হয়নি যেন তখনও। খানিকটা মাটির আড়ালে তখনও ঢাকা। তার পাশে যেন কী একটা চিকচিক করছে। সোনার মতন। যেন মিনে-করা সোনা।
ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—ওটা কী?
এতক্ষণ কেউ দেখতে পায়নি। সবাই ঝুঁকে পড়লো এবার। কিন্তু ভূতনাথ চিনতে পেরেছে ঠিক।
কে যেন এবার বলে উঠলো-ওটা সোনার গয়না মনে হচ্ছে যেন-মেয়েছেলের গয়না-সোনার গোটছড়ার মতন ঠিক।
কিন্তু ভূতনাথ তখন অন্য কথা ভাবছে। তার মনে হলো–…পটপরিবর্তন যেন সম্পূর্ণ হলে এতদিনে।
তারপর সেই কঙ্কালটার দিকে চেয়ে ভূতনাথ অভিভূতের মতন দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। তার মনে হলো জীবনের যেন এক মহা অর্থ চোখের সামনে উদঘাটিত হয়ে গেল এক মুহূর্তে। মৃত্যু যেন আর শুধূ মৃত্যুই রইল না। মনে হলো জীবনেরই আর এক মহাপ্রকাশ যেন মৃত্যু। মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই যেন জীবনকে সম্পূর্ণ করে পেতে হয়। মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই যেন সার্থকতার চরম লক্ষ্যে। পৌঁছোতে হয়। মৃত্যু দিয়েই যেন জীবনের চরম উৎসর্গ সম্পূর্ণ হয়। কোনো সাংসারিক প্রয়োজনের তুচ্ছতা দিয়ে নয়, কোনো লৌকিক সম্বন্ধের ক্ষুদ্রতা দিয়েও নয়—জীবনের চরম সার্থকতা একটি মাত্র যোগে—সে অমৃতের যোগ। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তাই ভূতনাথ যেন অমৃতের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেল এক আশ্চর্য উপায়ে।
তারপর ভূতনাথ সেখানে দাঁড়িয়ে সেদিন তার পরম প্রার্থনা জানালো-যে-দেবতা সকল মানুষের দুঃখ গ্রহণ করেছেন, যার বেদনার অন্ত নেই, যার ভালোবাসারও অন্ত নেই, তাঁর ভালোবাসার বেদনা যেন সমস্ত মানবসন্তান মিলে গ্রহণ করতে পারি। ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।