—আর ছোটবৌঠান? তার আর দেখা পেয়েছিলেন? ভূতনাথবাবু বলেছিলেন—পেয়েছিলাম, কিন্তু না পেলেই যেন ভালো হতো।
–সেই গল্পটা বলুন।
ভূতনাথবাবু বললেন—যেদিন বনমালী সরকার লেন-এ বড়বাড়ি ভাঙবার অর্ডার দিয়ে চলে এলাম, সে তো আপনাকে বলেছি, এ তার পরের দিনের কথা। সে এক অদ্ভুত দেখা! এমন করে শেষ দেখা হবে ভাবিনি। ছোটবৌঠান বলেছিল—আমার মৃত্যুর পর তুই কাদিস ভূতনাথ, আমার জন্যে একটু চোখের জল ফেলিস—আমাকে আমার বিয়ের বেনারসীটা পরিয়ে সাজিয়ে-গুজিয়ে দিস, কিন্তু কিছুই করা হলো না।
ভূতনাথবাবু প্রশান্ত হাসি হাসতে লাগলেন।
এ উপকাহিনীতে সেই গল্পটাই বলি।
ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট হলো সেই ১৯১১ সালে। প্রথম থেকেই ভূতনাথের চাকরি হয়ে গেল এখানে। রূপচাঁদবাবুর চেষ্টায় প্রথম নেটিখেকেই ঢুকে পড়লো এ-আপিসে।
ইদ্রিস বললে—খোদা আপনার ভালো করবে ওভারসিয়ারবাবু।
যে-সরকারবাবু অমন হিংসে করতো, সে-ও কেমন যেন নরম হয়ে এল শেষকালে। বললে—ভাগ্যবানের বোঝা ভগবান বয়এ আপনাকে দেখেই বুঝতে পারলাম মশাই।
নতুন অপিসে কাজ আরম্ভ হয়েছে। রাস্তা চওড়া করা হয়। বাড়ি ভেঙে মাটি সমান করে। এ-সব পুরোনো কাজ ভূতনাথের। তবু যেদিন বৌবাজারের বনমালী সরকার লেন ভাঙবার ফরমাশ হলো সে একটা দিন বটে! ভূতনাথের মনে হেলো—নিজের পাঁজর কখানা যেন ভেঙে গুড়িয়ে দেবার আদেশ হয়েছে। সে-বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর কোনো দিন ও-রাস্তা আর মাড়ায়নি তো ভূতনাথ। ওদিক দিয়ে গেলেই কেমন যেন আকর্ষণ করতো কেউ! কিন্তু চাকরি তো তার! আদেশ মানতেই হবে। প্রথম যেদিন মাপজোপ করতে গিয়েছিল ভূতনাথ, সেই দিনই কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল বারে-বারে। মনে হয়েছিল—কোথা থেকে যেন এক অদৃশ্য শক্তি তাকে বার-বার আকর্ষণ করছে। সে-বড়রাড়ি আর চেনা যায় না। সে পূজোর দালানটার তবু কিছু-কিছু অংশ তখনও রয়েছে। ফালি-ফালি ভাগ হয়ে গিয়েছে সব। এক ঘর, থেকে আসছে চিংড়ি মাছের গন্ধ। আর এক ঘর থেকে আসছে। মাংসর। এক ঘরে হয় তো চেয়ার, টেবিল, পাখা—আর এক ঘরে মাদুর,চটের পর্দা, আর এনামেলের কাপ। কত বিচিত্র লোক বাসা বেঁধেছে বড়বাড়িতে। কোথায় গেল তোষাখানা, ভিস্তিখানা, রান্নাবাড়ি। কোনো কিছুরই চিহ্ন নেই আজ। সেইদিন তেতলায় ওঠেনি ভূতনাথ। ইচ্ছে থাকলেও ওঠবার প্রয়োজন হয়নি।
কিন্তু যেদিন সেই সমস্ত পাড়াটা খালি হয়ে যাবার পর চরিত্র মণ্ডলকে বাড়ি ভাঙবার কাজ বুঝিয়ে দিয়ে চলে আসছিল, সেদিন ভূতনাথ ভাঙা বাড়ির ওপরে উঠেছিল সিঁড়ি দিয়ে। কিন্তু না উঠলেই বোধ হয় ভালো হতো। সে পুরোনো পরিত্যক্ত ঘর গুলোর মধ্যে কী যাদু ছিল কে জানে। মনে হয়েছিল কে যেন তাকে তেতলার ভাঙা রেলিং থেকে একেবারে নিচে ঠেলে ফেলে দিতে চেয়েছিল। সন্ধ্যার অস্পষ্ট অন্ধকারে মনে হয়েছিল বৌঠান যেন তাকে হঠাৎ মদ আনবার জন্যে হীরের কানফুলটা খুলে দিলে!
আর তারপর সেই রাস্তার কুকুরটা! বড় ভয় পেয়ে গিয়েছিল ভূতনাথ। কিন্তু সেদিনও ভূতনাথ জানতো না এ কীসের যাই। এ কীসের আকর্ষণ! জানতে পারলে পরের দিন। সে এক অদ্ভুত কাণ্ড।
ছুটুকবাবুকেও তখন এক-একদিন দেখতে পাওয়া যেতো। কালো কোট গায়ে দিয়ে ট্রামে চড়ে যান। ভূতনাথের মনে হতো ও কোট যেন অনেক কালি লেগে কালো। সময়ের কালি কলঙ্কের কালি। ও কালি যেন ধুলেও যাবে না।
আর মেজবাবু? মেজবাবুই শুধু শেষদিন পর্যন্ত গাড়িঘোড়া চড়ে গেলেন। বিকেল বেলা ইডেন-গার্ডেন-এর কাছে দাঁড়ালে দেখা যেতো ইব্রাহিম আস্তে-আস্তে ঢিমে চালে গাড়ি চালিয়ে আসছে। গাড়ির ভেতর মেজবাবু দু’হাতে দুটো হাতল ধরে চুপ করে বসে আছেন। শূন্য দৃষ্টি চোখের। তবু গিলে করা মলমলের পাঞ্জাবী। হাতে একটা মস্ত হীরের আংটি। গাড়িটা এসে গঙ্গার ধারের দিকে ইডেন-গার্ডেন-এর গা-ঘেঁষে রোজ দাঁড়ায় একবার। মেজবাবু নামেন না। ঘোড়া দুটোকে তখন ঘাস খাওয়াতে নামে ইব্রাহিম। ঘোড়া দুটো কয়েক মুঠো ঘাস খায়, আর মাঝেমাঝে বিরক্ত হয়ে পা ঠোকে। হয়তো ঠিক পছন্দ হয় না শুকনো ঘাস। কিন্তু মেজবাবু সেই গাড়ির ভেতর বসে-বসেই খানিকক্ষণ হাওয়া খান। আর ইডেন-গার্ডেন-এর গোরা-ব্যাণ্ডের বাজনার সঙ্গে-সঙ্গে পায়ে মৃদু-মৃদু তাল দেন। এ-দৃশ্য সাইকেল-এ যেতেযেতে ভূতনাথ অনেকদিন দেখেছে।
সুপবিত্রও বোধহয় মোটর কিনেছে। কী চাকরি করে কে জানে। বড় চাকরি নিশ্চয়ই। কাট-প্যান্ট পরা অবস্থায় অনেকদিন সকালবেলা যেতে দেখেছে ভূতনাথ। গাড়ি চালায় ড্রাইভার। ভেতরে হেলান দিয়ে সুপবিত্র খবরের কাগজ পড়ে।
তবু এ-সব ঘটনা ভূতনাথের জীবনে কোনদিন কোনো রেখাপাত করেনি। রেখাপাত করবার মতন ঘটনাও নয়। কিন্তু শেষ ঘটনাটার জন্যে ভূতনাথ যেন সত্যিই প্রস্তুত ছিল না।
সেদিন রাত্রে বুঝি ফিরতে অনেক দেরি হয়েছিল। বড়বাড়ির ___ চিহ্নটুকু দেখে সাইকেল-এ চড়ে আসতে-আসতে যেন অনেক যুগ পার হয়ে এল ভূতনাথ। কাল ও-বাড়ির আর কোনো কিছু চিহ্ন থাকবে না। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বড়বাড়ি। আর বড়বাড়ির সঙ্গে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বনমালী সরকার লেন। বাতিল হয়ে যাবে বনমালী সরকার ইতিহাস থেকে। তাতেও কিছু দুঃখ নেই। দুঃখ শুধু এই যে, বাতিল করা তদারক করতে হবে সেই ভূতনাথকেই। একদিন যে আশ্রয় দিয়েছিল, শান্তি দিয়েছিল, সান্ত্বনা দিয়েছিল, তাকেই নিশ্চিহ্ন করতে হবে ভূতনাথকে নিজের হাতে। সারা রাত অসহ্য এক অনুভূতিতে কাটলো।