তারপর অনেকক্ষণ চুপ করে কান পেতে রইল ভূতনাথ। কেউ সাড়া দিলে না তবু।
আবার একটু জোরে ডাকলে—বৌঠান, আমি ভূতনাথ।
একটা প্রতিধ্বনি শুধু ভেতরের ফাঁকা ঘরগুলোর দেয়ালে আছাড় খেয়ে ফিরে এল। একটা গমগম করে শব্দ হলো শুধু। ফাঁকা-ফঁপা নিরর্থক শব্দ।
ভূতনাথ আবার ডাকলে—বৌঠান–
আবার সেই রকম। তারপর সেই ভাবে, মেঝের ওপরেই একবার বসে পড়লো ভূতনাথ। মাথা যেন ঝিমঝিম করছে। এত দিন হাসপাতালে শুয়ে যেন জড়তা এসেছে সমস্ত শরীরে। মাথা কুটতে লাগলো দেয়ালে। কোথায় গেল বৌঠান! কে বলে দেবে। কোথায় গেলে পাওয়া যাবে বৌঠানকে।
তারপর এক সময়ে উঠলো ভূতনাথ। সমস্ত পৃথিবীর ওপর যেন তার রাগ হতে লাগলো। সমস্ত সংসারের ওপর বিরাগ। আজ কেউ নেই ভূতনাথের। মানুষের পৃথিবীতে আজ যেন ভূতনাথ একলা। একেবারে নিঃসহায় নিঃসম্বল। মনে হলো নিশ্চয়ই এ মেজবাবুর কাণ্ড। মেজবাবুর গুণ্ডারা নিশ্চয়ই কোথাও নিয়ে গিয়েছে বৌঠানকে। মেজবাবু চৌধুরী বাড়ির বউ-এর এ আইন-অমান্য সহ্য করবে না। তাই বুঝি ভূতনাথকেই নিঃশেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু বৌঠানই যখন নেই তখন ভূতনাথ বেঁচে থেকেই বা কী করবে!
আবার সেই রাস্তা দিয়ে নেমে এল ভূতনাথ। সেই পরিত্যক্ত বড়বাড়ি। চারিদিক নিস্তব্ধ। দেউড়ি পেরিয়ে আবার সেই বনমালী সরকার লেন-এ এসে পড়লো। কোথায় যাবে কোনো ঠিক নেই। কোথায় গিয়ে আশ্রয় মিলবে। কার কাছে গিয়ে আব্দার করবে, আবেগ জানাবে। কা’কে সে বকবে। কাকে অনুরোধ করবে, অনুযোগ অভিযোগ করবে।
সমস্ত কলকাতা শহর তখন বিষণ্ণ। অন্তত ভূতনাথের মনে হলো যেন বৌঠানের বেদনায় সমস্ত শহর বিষণ্ণ হয়ে আছে সেদিন। কখন আস্তে-আস্তে গিয়ে ভূতনাথ বার-শিমলেয় পৌচেছে খেয়াল নেই। একবার ফিরে আসতে যাচ্ছিলো ভূতনাথ। কী হবে, সেখানে গিয়ে। সে তো চিঠি দিয়ে এসেছে। সে-চিঠিতে তো সে চুড়ান্ত কথা লিখে এসেছে সেদিন। এতদিনে জবা নিশ্চয়ই সুপবিত্রকে গ্রহণ করেছে। তবে কেন আর তার যাওয়া।
তবু যেন বাড়িটার সামনে গিয়ে দরজা না ঠেলে পারলো না।
দরজা খুলে দিয়ে ক্ষুদির মা’ও অবাক হয়ে গিয়েছে। বললেদাদাবাবু, আপনি?
ভূতনাথ বললে—দিদিমণি কোথায় ক্ষুদির মা?
সিঁড়ি দিয়ে উঠে ভূতনাথ সেদিন জবাকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল বৈকি। জবা বাবার ছবির সামনে তেমনি নিশ্চল হয়ে বসেছিল। কোনো পরিবর্তন নেই জবার। ভূতনাথকে দেখে জবাও যেন কম অবাক হয়নি। বললে-ভূতনাথবাবু, আপনি?
ভূতনাথ বললে—সুপবিত্র কোথায়?
জব সে-প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললে–কিন্তু এতদিন কোথায় ছিলেন আপনি, ভূতনাথবাবু?
মুহূর্তের জন্যে বুঝি বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল ভূতনাথ, বললেআমি তো তোমাকে চিঠি লিখে রেখে গিয়েছিলাম জবা, পাওনি সে চিঠি?
—পেয়েছিলাম, কিন্তু…
—আমি সমস্ত জায়গায় খোঁজ নিয়েছিলাম, সেই নদীয়া জেলায় পর্যন্ত গিয়েছিলাম নিজে, তিনি মারা গিয়েছেন, তার বংশের কেউ আর জীবিত নেই—তিনি মৃত—বিশ্বাস করে।
—কিন্তু…
-তোমার কোনো দ্বিধা শুনবো না জবা, ছোটবেলার যে-বিয়ে সে-তত বলতে গেলে বান্দানেরই সামিল, তোমার কথা মতোই ‘অপূর্বা হয়ে তুমি নির্বিঘ্নে সুপবিত্রকে বিয়ে করতে পারবে।
জবা একবার বললে—সত্যিই কি তার কোনো সন্ধানই গেলেন না?
ভূতনাথ বললে—তার প্রেতাত্মা হয় তো আছে কিন্তু তাঁকে নিয়ে তুমি করবে কী? আমি সেই কথা বলতে অনেক দিন আগেই আসতাম, কিন্তু আসতে পারিনি এতদিন শুধু…
জবা সমস্ত শুনলে চুপ, করে। বললে—আপনি যে এতদিন হাসপাতালে ছিলেন, আমাকে একটা খবরও দেননি, আমি কিন্তু
অনেক দিন খোঁজ করেছিলাম আপনার—জানেন?
ভূতনাথের কেমন যেন রোমাঞ্চ হলে সমস্ত শরীরে। বললেসত্যি খোঁজ করেছিলে?
—কেন, মানুষ মানুষের খোঁজ করে না?
-না, তা করবে না কেন, তবু তুমি আমার খোঁজ করেছিলে এটা জানতে ভালো লাগে।
জবা খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। মুখটা যেন তার হঠাৎ বড় লাল হয়ে উঠেছে। তারপর যেন বড় মরীয়া হয়ে বললেআমার অনুরোধ, আপনি এবার একটা বিয়ে করে ফেলুন, আপনি সুখী হবেন হয় তো।
ভূতনাথ ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। ” হাসতে-হাসতে বললে—আমি দুঃখী এ-কথা তোমায় কে বললে জবা…আর তা ছাড়া আমার বিয়ে করা আর চলেও না, একবার করেছি।
-তার মানে? জবাও যেন চমকে উঠলো।
ভুতনাথ হঠাৎ যেন ব্যস্ত হয়ে উঠলো। বললে—সে কথা যাক জবা, সুপবিত্রকে তুমি গ্রহণ করবে কিনা বলো আগে তোমার বাবার অন্তিম অনুরোধ!
—কিন্তু সত্যিই আপনার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ভূতনাথ বললে—বলেছি তো হয়েছে।
—কোথায়? কবে?
ভূতনাথ বললে—এ-কথার জবাব আর একদিন দেবো জবা–এখনও সময় হয়নি, এখন বোধহয় আর সময়ও নেই, এতক্ষণে সুপবিত্ৰ নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েনি, তাকে আমি এখনি ডেকে আনছি, আমার সামনেই তোমাকে কথা দিতে হবে—আর আমিই থাকবো তার সাক্ষী।
জবা যেন কী বলে প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলো। ভূতনাথ থামিয়ে দিয়ে বললে—তুমি আর ‘না’ বলো না জবা, তোমার দায়িত্ব থেকে আমি শুধু মুক্তি চাই, তোমাকে এমন অবস্থায় ফেলে আমি চলে যেতে পারি না, তা ছাড়া তোমার বিয়ে না হলে এখানে আমার আসাও তত শোভন নয়।
তারপর সেই রাত্রে সুপবিত্রকে ডেকে এনে কেমন করে সমস্ত দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়েছিলেন ভূতনাথবাবু তা-ও বলেছিলেন।
জিজ্ঞেস করেছিলাম—আর কখনও যাননি ওখানে, জবাদের বাড়িতে?
ভূতনাথবাবু বলেছিলেন—গিয়েছিলাম, সে জবার বিয়ের দিনকিন্তু তারপর হয় তো আমাকে প্রয়োজনও হয়নি আর—আমার কোনো আহ্বানও আসেনি—যেদিন ডাক আসবে, সেদিন যাবে আবার।