গোয়াবাগানের মেস-এর বাসাতেও আলোচনা চলেছে। সে বোধ হয় ১৯১৪ সালের মাঝামাঝি।
এই মেসেতেই পরে ওভারসিয়ার ভূতনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। যে-কাহিনী আমি—এই উপন্যাসের লেখকলিখেছি তার অনেক পরে আমার জন্ম। আমি ও-সব দেখিনি, জানিও না। আমার জানবার কথাও নয় ও-সব। ভূতনাথবাবু তখন বৃদ্ধ। চাকরি থেকে রিটায়ার করে গিয়েছেন। তেতলার ছোট একটা ঘরে একলা থাকেন। অতি ভোরে ওঠেন। কী শীত, কী গ্রীষ্ম ভোরবেলা পায়ে হেঁটে গঙ্গা স্নানে যান। তারপর ফিরে এসে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে অনেকক্ষণ কী সব জপ-তপ করেন। দুপুরবেলা শিরদাঁড়া সোজা করে গীতা পড়েন, রামায়ণ পড়েন। বিকেলবেলা পাড়ার একটা হরিসভায় গিয়ে কথকতা শোনেন। আমি যতটুকু জানতাম—এই ছিল তখন তার প্রাত্যহিক কাজ।
কী কারণে জানি না আমাকে তিনি একটু সুনজরে দেখতেন। আমাকে বলেছিলেন—আমার গল্প কি কারো ভালো লাগবে?
বললাম—যদি অনুমতি করেন তো লিখতে পারি।
বললেন—ও গল্প তো ওখানেই শেষ নয়, আরো আছে— শেষটাও তা হলে জুড়ে দেবেন আপনার গল্পে।
শেষটা তার কাছেই শুনেছিলাম। কাহিনীর সঙ্গে শেষ ঘটনাটা খাপ খাবে কিনা বুঝতে পারিনি তাই সেটা জুড়ে দিলাম ‘উপকাহিনী’তে।
আর তখনকার বনমালী সরকার লেন? ভূতনাথবাবুর কাছে শোনবার পর বউবাজারে একদিন দেখতে গিয়েছিলাম। সে আর চেনা যায় না। কোথায় দেউড়ি, কোথায় বাগান, কোথায় খাজাঞ্চীখানা, নহবৎখানা, তোষাখানা, ভিস্তিখানা, নাচঘর, পূজোবাড়ি! বড়বাড়ির একখানা ইটেরও পর্যন্ত সাক্ষাৎ পাওয়া গেল না। রাস্তার দু’পাশে বিরাট-বিরাট প্রাসাদ উঠেছে। এক শ’ ফুট চওড়া রাস্তা। ইলেকটিক লাইটের সার-সার থাম। এলাহি কাণ্ড! কোনোটাতে মোটরের শো-রূম, কোনোটা ইনসিওরেন্সের আপিস। গিসগিস করছে লোক। ব্যস্ত চাল-চলন। মিনিটে লক্ষ-লক্ষ টাকার মাল কেনা-বেচা হচ্ছে। সন্ধ্যে হলে সে-রাস্তায় শা-শা করে মোটর চলে। কেউ কারো মুখ চেনে না, নাম জানে না। অথচ পাশাপাশি বাস করছে দিনরাত। লিফটে করে উঠছেনামছে লোক জন। দেখে মনে হলো বড়বাড়ির সেই ঢিমে তালের জীবন-যাত্রার পর যেন জীবনের আর্কেস্ট। হঠাৎ বড় জলদে চলেছে এখন। সময়ের গতি বেড়েছে। দিন যেন ছোট হয়ে এসেছে এখানে। বৈদূর্যমণির নাম বললে কেউ চিনতে পারে না আর। হিরণ্যমণির পরিচয় কেউ আর জানে না। কৌস্তুভমণির ছায়াও কেউ দেখেনি। এমনি অবস্থা। পটলডাঙার বাবুদের হাত থেকে দশহাত বদল হয়ে-হয়ে বনমালী সরকার লেন তখন এক অন্য জগতে রূপান্তরিত হয়েছে।
আর বার-শিমলের সে-বাড়িটাও আমি দেখে এসেছি একদিন। দুটো রাস্তার মোড়ের মাথায় মস্ত বড় বাড়ি করেছেন সুপবিত্রবাবু। সত্যি বড় সুন্দর বাড়িটা। ভেতরের মানুষগুলোও, নিশ্চয় ভারী সুন্দর। তখন সন্ধ্যে হয়েছে। দোতলায় অর্গান বাজিয়ে একটি মেয়ের গান শুনেছি–
তোমারি রাগিণী জীবন-কুঞ্জে
বাজে যেন সদা বাজে গো—
একদিন ভূতনাথবাবুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম—সে চিঠিতে আপনি সেদিন কী লিখে এসেছিলেন?
ভূতনাথবাবু বললেন—ওই একবার মাত্র মিথ্যাচার করেছি জীবনে। বার-বার ভেবেছি, কিন্তু এ-ছাড়া আমার আর কোনো গত্যন্তরও ছিল না। আমি লিখেছিলাম—আমি সমস্ত সূত্র হইতে অনুসন্ধান করিয়া জানিয়াছি অতুল চক্রবর্তীর মৃত্যু হইয়াছে। তাহাদের বংশের আর কেহ কোথাও নাই। তুমি সুপবিত্রকে বিবাহ করিতে আপত্তি করিও না…আরো এমনি সব কী-কী কথা লিখেছিলাম তাড়াতাড়িতে, আজ আর তা মনে নেই-আর তার পরে তো দেখাই করতে পারলাম না। দুর্ঘটনায় পড়ে কতদিন যে হাসপাতালে রইলাম।
জিজ্ঞেস করেছিলাম—পরে আর কখনও জবার সঙ্গে দেখা হয়নি আপনার?
ভূতনাথবাবু বললেন—হয়েছিল, শুনুন, সে-ঘটনা।
ভূতনাথবাবুর কাছে শোনা ঘটনা আমার নিজের ভাষায় বলি।
হাসপাতাল থেকে একদিন সন্ধ্যেবেলাই ছাড়া পেয়ে গেল ভূতনাথ হঠাৎ। তখন রাস্তায় বেরিয়ে কেমন যেন প্রথমটা আড়ষ্ট লাগলো চলতে। কোথায় যাবে সে। কোথায় গিয়ে উঠবে ভূতনাথ। সমস্ত পৃথিবীটা যেন ফাকা মনে হলো। বড়বাড়িতে কোথায় সে যাবে। কেউ নেই! শেষ পর্যন্ত ছিল বংশী আর চিন্তা। তারাও অবশেষে চলে গিয়েছে কলকাতার ত্রি-সীমানা ছেড়ে। একবার মনে হলো বড়বাড়িতে গিয়ে বৌঠানকে সে খুঁজে দেখবে। মনে হলো—বৌঠান যেন কোথাও বড়বাড়ির কোনো ঘরে লুকিয়ে আছে নিশ্চয়। ধরা দিচ্ছে না। নইলে সেদিন ঘোড়ার গাড়ির সে-দুর্ঘটনার পর কোথাও পাওয়া গেল না কেন তাকে—এ কেমন করে হয়! এ কেমন করে সম্ভব!
হাঁটতে-হাঁটতে চাঁদনীর হাসপাতাল থেকে ভূতনাথ গিয়ে দাঁড়ালো একবার বড়বাড়ির সামনে। মনে হলো সমস্ত বাড়িটা যেন একটা বিরাট সরীসৃপের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছ। সমস্ত শরীরে তার মৃত্যুর অবসন্নতা। অন্ধকারের বিবর্ণতা যেন সমস্ত আবহাওয়ায়।
কেউ কোথাও নেই। ভূতনাথ তালাবন্ধ গেটটা ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকলো। বেশ ঘাস গজিয়েছে উঠোনের ওপর। ভয় করে পা ফেলতে। কোথাও যেন শব্দ পেয়ে একটা ব্যাং আচমকা থপ করে লাফিয়ে ওঠে। সমস্ত ঘরগুলোয় তালা-চাবি দেওয়া। শুধু খিড়কির দিকে বাগানের মুখোমুখি চোরকুঠুরিতে যাবার সিঁড়িটা খোলা। আস্তে-আস্তে ওপরে গিয়ে উঠলো ভূতনাথ। চোরকুঠুরির সামনে বারান্দা। বারান্দার উত্তরদিকেই সেই দরজাটা তালাবন্ধ। ফাঁক দিয়ে দেখা যায় ভেতরে কেবল অন্ধকার। ওপাশে বউদের মহলে যাবার উপায় নেই। ভূতনাথ কান পেতে রইল অনেকক্ষণ! কিছু শব্দ যদি শোনা যায়। কিছু যদি আভাষ পাওয়া যায়। কিন্তু কিছু নেই। সব যেন মৃত্যুর মতো বধির। অন্ধকারের মতো বোবা। ভূতনাথ চুপি-চুপি শুধু একবার ডাকলে— বৌঠান—