ভূতনাথের কাহিনী শেষ হয়ে গেল। শেষ হয়ে গেল উনবিংশ আর বিংশ শতাব্দীর একটা পরিচ্ছেদের ভগ্নাংশ। শেষ হয়ে গেল অনেক ওঠা-নামা, অনেক ভাঙা-গড়ার ইতিহাস! কিন্তু তবু সব যেন তখনও শেষ হয়নি। তখনও বনমালী সরকার লেন দিয়ে আপিসের বাবুরা পান চিবোতে-চিবোতে ছোটে। গলিটুকু পেরিয়ে গেলেই একেবারে সোজা রাস্তা। বউবাজার দিয়ে হেঁটে এসে বনমালী সরকার লেন-এ ঢুকে পড়ে—একে-বেঁকে সোজা পশ্চিমে বড় রাস্তা পাবে। বাঁ দিকে বড়বাড়ি আর ডানদিকে বরাবর ছোটছোট দোকানের সার। ছোট টিনের চালার নিচে বাঞ্ছার তেলেভাজার দোকান পাবে। বাঞ্ছা এখন নেই। তার ছেলে অধর। অধরের ছেলে আর এখন দোকানে বসে। অরের তেলেভাজার নাম-ডাক আছে এ-অঞ্চলে। শীতকালে ভোর থেকে ভিড় জমে অক্ররের দোকানে। গরম তেলের ওপর বেগুনীগুলো ফেলতে সময় দেয় না খদ্দেররা। ছেকে ধরে চারদিক থেকে। বলেআমাকে আগে দে রে—চা ফুটছে বাড়িতে…। তারপর রুপদ দে’র দোকান ‘স্বদেশী-বাজার। বিলিতি জিনিষ দোকানের ত্রি-সীমানায় ঢুকতে পাবে না। গুরুপদ দে’র এমনি নিয়ম। মোটা খদ্দরের পাঞ্চাবী আর ধুতি পরে গুরুপদ দে নিজের হাতে মাল বেচে। বলে—আপনার পণ করুন ভাই আজ থেকে বিলিতি জিনিষ কিনবেন না—প্রতিজ্ঞা করুন বিলিতি জিনিষ ছোঁবেন না–এ না হলে স্বাধীনতা আসবে না দেশের।
তারপর ত্রিকালদর্শী রাজজ্যোতিষী শ্রীমৎ অনন্তহরি ভট্টাচার্যির “শ্রীশ্রীমহাকালী আশ্রম”। এমন যে কলিকালের ভেজালের যুগ, এ-যুগেও অমন একটি খাঁটি নবগ্রহ কবচ কী করে যে মাত্র ১৩/১০য়, দিতে পারেন, তাই-ই এক বিস্ময়। তারপর আছে এ-পাড়ার ছেলেদের ‘সবুজ-সঙ্ঘ’। তারপর ‘পবিত্র খদ্দর ভাণ্ডার’। খদ্দর তো বাজারে অনেক রকম আছে। কিন্তু যদি পবিত্র খদ্দর চান তো ওখানেই যেতে হবে আপনাকে। তারপর বেণী স্বর্ণকারের সোনা-রূপেপার দোকান। আর তারপর মোড়ের মাথায় ভূজাওয়ালাদের মাটির দোতলা বাড়ি। হোলির এক মাস আগে থেকে খঞ্জনী বাজিয়ে পাড়া মাত করে তোলে।
এ-সব তো গেল রাস্তার ডানদিকের কাহিনী।
কিন্তু বাঁ দিকের বড়বাড়িটা তখনও ছিল। ছোট-ছোট খুপরি করে তখন ভাড়াটে বসিয়েছিল পটলডাঙার বাবুরা। দু’খানা করে ঘর আর একখানি রান্নাঘর। ব্যবস্থা ভালোই। রোদ আসে কলতলায়। ভাড়াটেদের কলকোলাহলে পাড়াটা মুখর হয়ে থাকতে দিনরাত। বাইরের দিকেও একটু অদল-বদল করে কয়েকজন ভাড়াটেকে বসানো হয়েছিল। কখনও-কখনও সন্ধ্যেবেলা সেখানে গানের আসর বসতো। ছুটুকবাবুর সে জমকালো আসর নয়। পর্দার আড়ালে সিদ্ধির সরবতেরও ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু মিয়া-কি-মল্লারের মতো কড়া রাগরাগিনীর চর্চা হতো। গানের সঙ্গে বায়া-তবলায় বিলম্বিত লয়ে মধ্যমানের ঠেকা চলতো। সঙ্গে বড় জোর পান-সুপুরি জর্দা-দোক্তা-কিমাম পর্যন্ত। তার বেশি নয়।
এ তো গেল বনমালী সরকার লেন-এর কাহিনী। এই যার নামের রাস্তা নিয়ে গল্প বলছি।
কিন্তু বাইরে তখন অদল-বদল হয়ে গিয়েছে অনেক। দিল্লীর মসনদে বসবার দিন লর্ড হার্ডিঞ্জের ওপর বোমা ফেললে কে একজন। সবাই বললে—এ বাঙালী। বাঙালী ছাড়া আর কার কাজ হবে। কিন্তু মরলো না বড়লাট সাহেব। মরলো তার হাতীর মাহুত। দশ কোটি টাকা খরচ করে নতুন রাজধানী উঠলো দিল্লীতে। নতুন ইন্দ্রপ্রস্থ। কবরের দেশে এক নতুন ইন্দ্রপ্রস্থ গড়ে উঠলো। কিন্তু লর্ড সিংহ ইতিমধ্যে চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছেন। বেহারের লোক, স্যার আলী ইমাম এলেন এগিয়ে। লর্ড সিংহ-এর খালি জুতোয় তিনি পা গলালেন। তার নিজের দেশ বেহার। বেহারকে এবার আলাদা করে নিতে হবে। বেহারের জন্যে আলাদা লাটসাহেব, আলাদা ইউনিভার্সিটি, আলাদা হাইকোর্ট চাই। কিন্তু তা হোক, তবু তো বাঙলা দেশ আবার জোড়া লাগলো। তাইতেই খুশি সবাই।
বিলেতের ‘টাইমস পত্রিকা লিখলে–
“Bengal differs more from most other Indian provinces than they differ from one another. Economic, temperamental and social causes account for this difference. Caste is less powerful; a common literary language unites over forty million Bengalis. Even the Muslim community, who form a narrow majority of the population are indisputably less divided both socially and politically from their Hindu countrymen than they are in other parts of India. The Bengali temperament, at once calculating and emotional, critical and eithusiastic, baffles other Indians almost as much as it puzzles Britsh administrators.”
কিন্তু বড় ভালো মানুষ এই নতুন লাট কারমাইকেল সাহেব। কিন্তু হলে কি হবে। আসতে-না-আসতে যুদ্ধ গেল বেধে আর চার মাসের মধ্যে ভারতবর্ষ থেকে চব্বিশ হাজার লোক যুদ্ধ করতে গেল এক ফ্রান্সেরই লড়াইতে।
বুড়োনা রোয়াকের ওপর ‘হিল্লাদী বিছিয়ে পড়ে আর গল্প করে।
বলে—এবারকার লড়াইতে আট টাকা করে চালের মণ হবে দেখো-এই বলে রাখছি।
বলে—এবার আর টিকতে হবে না দাদা, টাকায় পাঁচ সের দুধ-বলল কি হে, দিনে ডাকাতি!
সত্যি, জিনিষপত্তোরের দাম আগুন তখন। ছ’ টাকা আট টাকা করে চাল, টাকায় পাঁচ সের করে দুধ, দশ আনা সের পাঁঠার মাংস, তিন আনা সের ডাল, সরষের তেল তিন আনা, মানুষ খাবে কী? কী খেয়ে বাঁচবে!