দুটো হাতই অবশ হয়ে গিয়েছে। বংশী ভাতের থালাটা কাছে নিয়ে গিয়ে ডাকে—ছোটবাবুও ছোটবাবু—
জেগে থাকে তো ভালো। কিন্তু না-জেগে থাকলেই মুশকিল। তন্দ্রা ভাঙতেই এক ঘণ্টা। গায়ে হাত দিয়ে ঠেলতে হয়। তারপর একটু শুধু নিয়ম রক্ষা। কিন্তু ওইটুকুর জন্যেই বংশীর আর হেনস্থার শেষ নেই।
ছোটবাবু রেগে যায়। বলে—খাবো না আমি। ক্ষিদে নেই, যা—
বংশী বলে—খেয়ে নিন বাবু, না-খেলে শরীল টিকবে কী করে?
সত্যি যেন ছোটবাবুর শরীর টিকে আছে। কিন্তু হাসে না ছোটবাবু। দুটি মুখে দিয়ে আবার বংশী তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসিয়ে দেয়।
বলে—খেয়ে উঠে ঘুমোবেন না হুজুর, শরীলে বাত হবে।
তা সেদিনও ভাতের থালা নিয়ে বংশী ঘরে গিয়েছে যেমন রোজ যায়।
গিয়ে ডাকলে—ছোটবাবু ভাত এনেছি, উঠুন—
উত্তর নেই কোনো।
আবার ডাকলে—ভাত যে ঠাণ্ডা হয়ে গেল, উঠুন হুজুর–
হুজুরের তবু সাড়া নেই। বংশী তখন গায়ে হাত দিয়ে জাগিয়ে দিতে গিয়েছে। কিন্তু গায়ে হাত লাগতেই যেন দশ পা পেছিয়ে এসেছে। সমস্ত গা-টা যেন বরফ হিম। তারপর হঠাৎ নজর পড়লো একটা পিঁপড়ে যেন ছোটবাবুর ঠোটের ওপর চরে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ হাত থেকে ভাতের থালা ঝনঝন করে পড়ে গেল বংশীর। সে-শব্দতে ভয় পেয়ে আরো চমকে উঠেছে বংশী। সমস্ত বাড়িটা যেন ভূমিকম্পের মতো তখন কাঁপছে। বংশীর আর জ্ঞান নেই তখন।
কাঁদতে-কাঁদতে বংশী যা বললে তা বড় করুণ। বংশী বললেটেরও পেলাম না শেষটায় আমি শালাবাবু—আমারই কপাল …আর বলতে পারলো না বংশী। শব্দ করে কেঁদে উঠলো শুধু।
অনেকক্ষণ ভূতনাথও কিছু কথা বলতে পারলে না যেন। বংশী বললে-কাল পটলডাঙার বাবুরা এসেছিল–মেজবাবু এসেছিল, ছুটুকবাবুও এসেছিল—সকলকে জিনিষপতোর বুঝিয়ে দিয়ে চাবি দিয়ে দিলাম ওদের হাতে। সেজখুড়ি কাজ পেয়েছে দত্তবাড়িতে, সেখানেই চলে গেল—আর আমি চললাম দেশে…
তারপর আর একবার প্রণাম সেরে উঠে বললে—যাই শালাবাবু, ট্রেনের টাইম হয়ে যাচ্ছে আবার চিন্তাকে দাড় করিয়ে রেখে এসেছি বাইরে—যাই…
বংশী চলেই যাচ্ছিলো।
ভূতনাথ আর একবার ডাকলে-বংশী–
–আজ্ঞে।
ফিরে এল আবার বংশী। বললে—আমায় ডাকছিলেন?
ভূতনাথ বললে—আর তোমার ছোটমার কোনো খবর পেয়েছে তার পরে?
–কোথায় আর পেলাম শালাবাবু, এতদিন হয়ে গেল, কেউ কিছু জানে না, ছোটবাবুকেও জিজ্ঞেস করে কিছু জানতে পারিনি, ছোটবাবুও আশ্চর্য লোক শালাবাবু। একটু কাঁদলে না পর্যন্ত, একবার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলে না কাউকে যে, মানুষটা গেল কোথায়…
তারপর খানিক থেমে আবার বললে–কলকাতায় এসেছিলাম সুখ করতে, কিন্তু সুখ আমার কপালে নেই শালাবাবু, মা-বাপ দুই-ই হারালাম, আমি একটা লক্ষ্মীছাড়া বই আর কী বলুন…
বংশী চলে গেল।
ভূতনাথ হাসপাতালের বাইরে চোখ মেলে দেখলে—অনেক নিচে রাস্তার ওপর অনেক ভিড়। এলোমেলো মহাকালের মিছিল চলেছে। কে যেন অদৃশ্য হাতে চালনা করছে মহাকালের রথ। কত কলকারখানা, যুদ্ধবিগ্রহ, কত বিচিত্র কোলাহল আকাশকে মথিত করছে। তাদের ভিড়ে কোথায় বংশী আর চিন্তা হারিয়ে গেল দেখা গেল না। মনে হলো ওদেরই মধ্যে কোথায় যেন এক নিমেষে সবাই হারিয়ে গিয়েছে। অথচ এই তো সেদিনের কথা। একটা ছেলে এসে নেমেছিল নিতান্ত অসহায়ের মতো শেয়ালদ’ স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম-এ। তারপর মিলনে, বিচ্ছেদে, জীবনে, মৃত্যুতে কতবার আকাশ কালো হয়ে উঠলো। কতবার দুঃস্বাদ হলো জীবন, উচ্ছল হলো প্রাণ, উজ্জ্বল হলো দিন, আবার রাত্রির মতো কখনও ম্লান হয়ে এল প্রাণের দিগন্ত, ক্ষীণ হয়ে এল কণ্ঠের গান। মনে হলো তবু যেন সে মানুষের চরম সত্যকে আবিল হতে দেয়নি। ভূতনাথের সমস্ত ক্ষুধা-তৃষ্ণা, বাসনা-কামনা, অর্জন-বর্জনের মধ্যে সে যেন ভাস্বর হয়ে রয়েছে। কত ভাষায় সে কথা কইছে, কত দেশে, কত রূপে, কত কালে সে মানুষের আপাত প্রয়োজনের ওপর জাগ্রত হয়ে আছে। কত তর্ক তাকে আঘাত করছে, কত সংশয় তাকে অস্বীকার করছে, তবু সে আছে। সমস্ত মানুষের মধ্যেই সে বেঁচে আছে। সে বলছে—নিজেকে চেনো, নিজের নিজেকে খোঁজে—আত্মানং বিদ্ধিঃ–
ভূতনাথ অনেকক্ষণ ধরে তেমনি চেয়ে রইল নিচের দিকে সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যে হলো। আজ আর নিবারণের কথা মনে পড়লো না তার। ব্রজরাখাল, ননীলাল, ছুটুকবাবু কাউকেই বিশেষ করে আজ তার মনে পড়লো না। মনে পড়লো না মেজবাবু, ছোটবাবু, বেণী, শশী, গিরি, সিন্ধু—কাউকেই। আরো অনেক অসংখ্য লোককেও মনে পড়লো না। শুধু মনে পড়লো। দুজনের কথা। যেদিন তাদের সে মানুষের মহাযাত্রার মিছিলে মিশিয়ে দিতে পারবে সেদিন তার সত্যিকারের সিদ্ধি হবে। সেদিন তার ভূতনাথ নাম সার্থক হবে। ভোলানাথ নাম সার্থক হবে।
দেখতে-দেখতে আলো নিবে এল কলকাতার আকাশে।
এক ঝাঁক পায়রা উড়তে-উড়তে একটা বাড়ির ছাদের ওপর দল বেঁধে নামলো। কাদের ছাদে একটা ফণি-মনসার গাছ আকাশে ডালপালা মেলে আছে। একটা ঘুড়ি এসে উড়তে-উড়তে পড়ছে রাস্তার ওপর। তারপর শহরের ওপাশে যেদিকে চাও সেদিকে কেবল সবুজ গাছের সার। সবুজ পাতার বেষ্টনী। শহর বোধহয় শেষ হয়ে গিয়েছে ওখানে। নীল আকাশের গায়ে রেল ইঞ্জিনের এক মুঠো ধোঁয়া আটকে আছে আলগা হয়ে। আর ওপাশে কয়েকটা তালগাছ সজাগ প্রহরীর মতো মাথা উচু করে বুঝি পাহারা দিচ্ছে। কয়েকটা নিশাচর পাখী শহর থেকে অরণ্যের দিকে বুঝি চলেছে দল বেঁধে। আবার দিনের বেলা তারা বুঝি ফিরে আসবে। তারপর একটা তারা উঠলো আকাশে। তারপর আর একটা। তারপর আরো একটা। কোলাহল থেমে আসছে পৃথিবীর। প্রশান্ত আকাশ। এক টুকরো শব্দ। একঝাঁক ঘুম। তারপর আর কিছুই নেই…
উপকাহিনী
উপকাহিনী