তারপর কতদিন পরে এই চাঁদনীর হাসপাতালে জ্ঞান হয়েছে। আস্তে-আস্তে মনে পড়েছে সব কথা। কোথায় গেল বৌঠান। বৌঠান কেমন আছে! কিন্তু বংশী খবর পেয়ে এসেছিল একদিন।
বংশী বললে—শালাবাবু!
বংশীকে দেখে ভূতনাথ অবাক হয়ে গিয়েছে। বললে—বংশী, তুই?
—আজ্ঞে, খবর কী পাই? চৌপর রাত বসে-বসে দেখা নেই আপনার, গাড়িও ফেরে না, কেমন যেন ভয় করতে লাগলো। এমন তো হয় না! ছোটবাবু তেমনি নিঝুম হয়ে পড়ে আছে! দেখে আবার ফিরে এলাম উঠোনে, রাস্তায় বেরিয়ে চোখ বাড়িয়ে দুর পানে চেয়ে দেখি, কোথাও হদিস নেই গাড়ির। রাস্তা নিরিবিলি হয়ে এল, ওপরে চিন্তা আর নিচেয় আমি, দুজনে সমস্ত রাত ডাহা বসে। রাত যখন পোয়ালোতখন বুঝি একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিলো কোথায় যেন কাছাকাছি কে শাবল দিয়ে মাটি খুড়ছে, ইট ভাঙছে, ঠুং-ঠাং ধুপ-ধাপ শব্দ, মনে হচ্ছিলো কারা বুঝি…
বংশী থামলো। তারপর হঠাৎ দু’হাত দিয়ে চোখ চাপা দিলে। তারপর আর কথা নেই একেবারে হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগলো।
কেমন যেন সন্দেহ হলে ভূতনাথের। বললে-বংশী বংশী—
তবু মুখ তোলে না বংশী।
ভূতনাথ বললে—বৌঠান কেমন আছে বল বংশী—বল্।
কাঁদতে-কাঁদতে বংশী বললে-ছোটমা আর নেই হুজুর!
—বৌঠান নেই?
—না শালাবাবু, কোথাও নেই ছোটম, বেলা দেড়টা নাগাদ খালি গাড়ি আর ঘোড়া দুটোকে টানতে-টানতে পুলিশ এনে তুললে বড়বাড়ির উঠোনে। গাড়োয়ানকে নাকি কোন্ হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে তারা। গাড়ি দেখে ছুটে গেলুম। ভাবলাম–ছোটমা শালাবাবু দুজনেই বুঝি ভেতরে আছে। গিয়ে দেখি রক্ত লেগে আছে সারা গাড়িতে—দেখে মাথায় বাজ পড়লো যেন! বললাম—আমার ছোটমা কোথায়? শালাবাবু কোথায়?
-তারপর?
—তা চাকর-মানুষকে কি বলে কিছু তারা? বলে—তোমার বাবু কোথায়?
বললাম—আমার ছোটবাবু কি আর মানুষ আছে আজ্ঞে, মানুষ নেই হুজুর, ছোটবাবুকে দেখিয়ে দিলাম ঘরে নিয়ে গিয়ে। তা দেখে বুঝলল তারা সব। মেজবাবুকে খবর দিলাম, ছুটুকবাবুকে খবর দিলাম। মেজবাবু পুলিশের সঙ্গে কী গুজ-গুজ ফুসফুস করলে আমি কি বুঝি ছাই। পুলিশের দারোগাকে কী বুঝিয়ে দিলে মেজবাবু, দারোগাবাবু সব তো খাতায় লিখে নিলে, তারপর চলে গেল পুলিশের দল নিয়ে।
আমি মেজবাবুকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম—আমার ছোটমা’র কী হলো গো মেজবাবু?
মেজবাবু ধমক দিয়ে উঠলল—যা, পালা এখান থেকে!
তখন কাকেই বা জিজ্ঞেস করি। কে-ই বা বলবে! আমি আর চিন্তা দুই ভাই বোনে শুধু মাথা খুড়ি ছোটমা’র যশোদাদুলালের কাছে। ঠাকুর না তো পাথর যেন! এমনি করে দিন যায়। শেষে বেণী এসেছিল বাড়িতে মেজবাবুর চিঠি নিয়ে। তার কাছেই শুনলাম আপনি আছেন এই হাসপাতালে।
—আর ছোটবৌঠান?
—ছোটমা কোথায় গেল তা জানতেই তো আপনার কাছে আসা। ভাবলাম, শালাবাবু নিশ্চয়ই জানে ছোটমা’র খবর—কিন্তু আমাকে বলে দিন শালাবাবু, কোথায় গেলে পাবো ছোটমাকে, আমার যে নিজের মা ছিল না শালাবাবু, নিজের মাকে চোখে দেখিনি কখনও, একমাস বয়েসেই মাকে হারিয়েছি, এখন কী হবে শালাবাবু?
তারপর কতদিন কেটে গিয়েছে! নক্ষত্ৰাকীর্ণ রাত্রের আকাশের দিকে চেয়ে-চেয়েও অনেকদিন অনেক প্রশ্ন করেছে ভূতনাথ। দিনের বেলার নীল আকাশের দিকে চেয়ে-চেয়েও প্রশ্ন করেছে। প্রশ্ন করেছে রাত্রের নিবিড় কালো অন্ধকারকে। প্রশ্ন করেছে অদৃশ্য অন্তরাত্মাকে। হাসপাতালের চারটি দেয়ালের বেষ্টনীর মধ্যে শুয়ে-শুয়ে প্রার্থনা করেছে যেখানে যত দেবতা আছে সকলকে। প্রার্থনা করেছে যেখানেই থাক বৌঠান, যেন সুস্থ থাকে, যেন সুখী। হয়, যেন কল্যাণ হয়, যেন মঙ্গল হয় তার।
তারপর থেকে বংশী মাঝে-মাঝে এক-একদিন আসতো। এসে খাটিয়ার পায়ার কাছে চুপ-চাপ বসে-বসে শুধু কাঁদতে। কিছু বলতো না মুখে। যেন কোনো অভিযোগ ছিল না কারো ওপর। আবার এক সময় ঘণ্টা বাজবার সঙ্গে-সঙ্গেই নিঃশব্দে বেরিয়ে চলে যেতো।
হাসপাতাল থেকে ভূতনাথ ছাড় পাবার দিন কতক আগে বংশী আবার হঠাৎ একদিন এসে হাজির। বংশীর চেহারা দেখে ভূতনাথও অবাক হয়ে গিয়েছিল। জামা পরেছে, ধুতিটা কোঁচা করে পরেছে। হাতে একটা টিনের রঙ-চটা বাক্স। হাউহাউ করে কাঁদতে-কাঁদতে এসে ঢুকলো ঘরে। তারপর পায়ের কাছে মেঝেতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে বলেছিল— চললাম শালাবাবু!
-কোথায় চললে বংশী?
তেমনি কাঁদতে-কাঁদতেই বংশী বললে-দেশে আজ্ঞে।
-দেশে? ভূতনাথ শুনে কম অবাক হয়নি। বললে—তা হলে ছোটকর্তাকে কে দেখবে?
বংশীর গলা যেন বন্ধ হয়ে আসছিল। বললে—ছোটবাবু নেই আজ্ঞে।
–নেই?
বংশীর কাছেই শোনা সে-ঘটনা।
সকাল থেকেই বৃষ্টি সেদিন। শ্যাওলা ধরা পাঁচিলটার ওপর একটা কাক বসে-বসে এক নাগাড়ে ডেকে চলেছে। বংশী হঠাৎ ক্ষেপে উঠেছে এক মুহূর্তে। বলে—থাম, থাম্ হতচ্ছাড়া, আর জায়গা পেলে না, এখেনে এসেছে ডাকতে!
তখনও জানে না বংশী, জানেনা কোন্ অশুভ সংবাদ বয়ে এনেছে ও। তবু দিনের কাজ মুখ বুজে করে যাচ্ছে। চিন্তা দেখছে ছোটমার ঘরের কাজ। ঘরের কাজ আর কী! যশোদাদুলালের নিয়মিত ভোগ দেওয়া। শাড়িগুলো কুঁচিয়ে রাখা। দেরাজের, আলমারির, পালঙ-এর ধুলো ঝাড়া। ছোটমা ধুলো দেখতে পারে না। ছোটমা যদি আসে কখনও তো বলবোরে, আমি নেই বলে আমার ঘর এত নোংরা করে রাখবি তোরা—আমি কি মরেছি?
সেজখুড়ী যেমন রান্নায় ব্যস্ত থাকে তেমনি সেদিনও। একটা লোক তত খেতে। তা-ও কিছুই মুখে রোচে না তার। একটু মুখে দিয়েই বলে থুঃ থুঃ