অনেক, অনেক পথ পেরিয়ে এসেছে ভূতনাথ।
হাসপাতালের খাটিয়ায় শুয়ে সমস্ত ঘটনাটা ভাবতে গিয়ে ভূতনাথ কেমন যেন তলিয়ে যায়।
জবাদের বাড়ি থেকে সেদিন বড়বাড়িতে আসতেই বংশী, বললে–কী ভাবনায় ফেলেছিলেন বলুন তো-কোথায় ছিলেন সারারাত?
ভূতনাথ বলেছিল—বৌঠান কি খুঁজেছিল নাকি?
—তা খুঁজবে না? সারা রাত কেবল এপাশ ওপাশ করেছি, সারা সন্ধ্যে ঘর-বার করেছি—কী যে মানুষ আপনি—ছোটমাকে নাকি বলেছিলেন—বউ আনতে যাচ্ছি।
ভূতনাথ বললে—পান সুপুরি এনেছিস তো বংশী?
–সে তো কাল বিকেল থেকে শুকোচ্ছে আজ্ঞে।
ভূতনাথ বলেছিল—তা হলে একটা ঠিকে গাড়ি ডাকবার বন্দোবস্ত কর বংশী।
বংশী বললে—এখনি যাবেন নাকি?
—হ্যাঁ, সকাল-সকাল যাওয়াই তো ভালো।
—তা ঠিক বলেছেন শালাবাবু, বেণীর কথাটা শোনা এস্তোক ভালো লাগছে না যেন, মেজবাবু যা ক্ষেপে গিয়েছেন…তা হলে রান্না হোক, ভাতটা খেয়েই একেবারে যাবেন—এই ধরুন দুটো তিনটে নাগাদ।
ভূতনাথ বললে—কিন্তু বৌঠানকে আগে থাকতে তৈরি হয়ে থাকতে বলগে তুই।
ভূতনাথও একবার ভেবেছিল—হঠাৎ যদি বৌঠান কালকের কথা ছোলে। যদি বলে—কোথায় রে, তোর বউ কই? ভূতনাথ তখন কী উত্তর দেবে?
বংশী বললে—ছোটমা আজ যেতে পারে কিনা দেখুন আগে, যা অবস্থা।
ভূতনাথ অবাক হয়ে গিয়েছে—কেন?
—বার-বার আনতে হয় বলে আমি কাল আজ্ঞে একেবারে দু’ বোতল এনেছিলাম, কিন্তু কাল রাত্তিরে একেবারে সবটা খেয়ে বসে আছে, আজকে সকালেও খেয়েছে—দেখে এলুম একটু আগে, শুয়ে পড়ে আছে, কাপড়-চোপড়ের হুশ নেই—বেসামাল বেঠিক অবস্থা, সেই বরানগর পর্যন্ত অমন মানুষকে নিয়ে যাবেন কী করে শুনি?
ভূতনাথ যখন সেদিন বোঠানের ঘরে গিয়েছিল তখনও প্রায় তেমনই অবস্থা। তবে একটু যেন ভালো। নিজেই উঠে দাঁড়ালো বৌঠান। কালকের কথা আর কিছু মনে নেই।
বৌঠান বললে—কোন্ শাড়িটা পরবো আমি?
আজ যেন কোনো দিকে কোনো খেয়াল নেই বৌঠানের। চিন্তাই সাজিয়ে-গুজিয়ে দিলে। গলায় চেন-হার। চুলটা খোঁপা বেঁধে তাতে ‘পতি-পরম-গুরু’ লেখা সোনার চিরুণী গুজে দিলে। কানে তুলোয় করে আতর লাগিয়ে দিলে। কোমরে মিনেকরা সোনার গোট-ছড়া পরিয়ে দিলে।
ভূতনাথ একবার জিজ্ঞেস করেছিল—যেতে পারবে তো ঠিক বৌঠান? যদি বলো না হয় থাক আজকে।
বৌঠান বলেছিল–খুব যেতে পারবো।
সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময়েও কিন্তু অল্প-অল্প টলছিল বৌঠান। বললে–মিয়াজানকে বলিস যেন খুব জোরে গাড়ি চালায়। যাবো আর আসবোছোটকর্তা বাড়িতে একা রইল—দেখিস বংশী। তারপর বললে–যদি জিজ্ঞেস করেন তো বলবি আমি বাড়িতেই আছি।
বংশী কানের কাছে মুখ এনে বললে—শালাবাবু, দোহাই আপনার বেশি রাত করবেন না—এখনই তো সন্ধ্যে হয়ে গেল— যদি বলেন তো আমি সঙ্গে যাই।
–না, তুমি গেলে ছোটকর্তাকে কে দেখবে আবার?
পান সুপুরির পুটলি গাড়ির এক কোণে রেখে দিয়েছিল, বংশী। খিড়কির গেট-এর ভেতরে ঠিকে গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে বৌঠান গিয়ে উঠলো ভেতরে। বললে–মিয়াজানকে বলে দে বংশী যেন তাড়াতাড়ি চালায়—বাড়িতে ছোটকর্তা একলা রইল…।
কোথায় মিয়াজান! বংশী শুধু বললে-বলে দিচ্ছি, তুমি কিছু ভেবো না ছোটমা।
বৌঠান আবার বললে—চিন্তাকে বলিস যেন সন্ধ্যেবেলা ধূপধুনো গঙ্গাজল দেয় আমার ঘরে।
বৌঠান তারপর গাড়িতে উঠে বলেছিল—কোনো সাড়াশব্দ নেই বাড়িতে, রাত বুঝি অনেক হয়েছে না রে, ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝি সবাই।
কিন্তু গাড়িটা চলতে আরম্ভ করার সঙ্গে-সঙ্গে একটা ঝকানি দিলে। সে ঝাঁকানিতে বৌঠান আর একটু হলেই বুঝি টলে পড়েছিল। ঠিক সময়ে ভূতনাথ ধরে ফেলেছে।
বৌঠান বললে—আজকাল মিয়াজান গাড়ি চালাতে ভুলে গিয়েছে নাকি?
ভূতনাথ কোনো কথা বললে না। বৌঠানকে দেখে যেন ভয় করতে লাগলো আজ তার। চোখ দুটো লাল। সমস্ত শরীর যেন শিথিল হয়ে গিয়েছে। দু’হাতে ধরে রেখেছে ভূতনাথ। ছেড়ে দিলেই যেন পড়ে যাবে। গাড়ি নানা রাস্তা ধরে চলেছে। কোথায় বউবাজার স্ত্রীট, কোথায় বৈঠকখানা, কোথা দিয়ে চলেছে বোঝা গেল না। গাড়ির জানালা-দরজা বন্ধ। বাইরে রাত হয়ে এল। বেরোবে-বেরোবে করেও সেই রাত হলো কেবল বৌঠানের জন্যে। কিছুতেই আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। শেষে স্নান করে, খানিকটা বরফ মাথায় দিয়ে তবে খাড়া হতে পেরেছে। কিন্তু আজ না গেলে কি আর কখনও যাওয়া হতো! ছোটকর্তার অসুখটা যে-রকম দিন-দিন বাড়ছে। সংসারে দিন-দিন অভাব-অনটনও বাড়ছে। ক’দিন আর টিকিয়ে রাখা যায়। ক’দিন আর পরমায়ু বাড়ানো যায় এর। বৌঠানও অনেকদিন বলে আসছিল। শেষ পর্যন্ত দৈবই তো ভরসা। হঠাৎ বৌঠান টলে পড়লো ভূতনাথের কোলে। বললে—তোর কোলেই শুলাম রে ভূতনাথ।
বৌঠানকে কোলে নিয়ে ভূতনাথ আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল। বললে —তা শোও, বরানগর এলে উঠিয়ে দেবো।
বৌঠান আবার বললে—বড় ঘুম আসছে রে আমার।
ভূতনাথ বললে—তা ঘুমোও না।
—যদি আমার ঘুম না ভাঙে—আমার ডেকে দিস কিন্তু তুই!
আজও মনে পড়লে ভূতনাথ ভাবে সে-ঘুম সেদিন অমন করে চিরকালের ঘুম হবে কে জানতো! কে জানতো সে-ঘুম ভাঙাবার দায়িত্ব ভূতনাথের ছিল না। ছিল মেজবাবুর গুণ্ডাদের। তারপর যখন গাড়ি অনেকদূর চলে গিয়েছে। হঠাৎ যেন অনেক লোকের চিৎকার শোনা গেল। একটা হা-রে-রে-রে শব্দ! ডাকাত পড়লে যেমন শব্দ হয় তেমনি। গাড়িটা হঠাৎ থেমে গিয়েছে। আর সেই অন্ধকারে কারা যেন দু’পাশ থেকে দরজা খুলে ঢুকলো ভেতরে। ভূতনাথ একবার প্রতিবাদ করতেও বুঝি গিয়েছিল, কিন্তু কোনদিক থেকে যেন একটা অদৃশ্য হাত এসে তাকে এক প্রচণ্ড আঘাতে শুইয়ে দিলো…আর কিছু মনে, নেই তারপর।