পাশের ঘরে সুপবিত্র ঘুমোচ্ছিলো। ভূতনাথ তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে ডাকলে—সুপবিত্রবাবু—সুপবিত্রবাবু
সুপবিত্র ধড়ফড় করে উঠলো। বললে—কী হলো? জবা কেমন আছে?
ভূতনাথ বললে–জবা আপনাকে ডাকছে।
—আমাকে ডাকছে? সুপবিত্র ভালো করে চোখ মুছেও যেন ভালো করে জাগেনি। যেন জবাকেই স্বপ্ন দেখছিল এতক্ষণ। যেন সে ভুল শুনছে! বললে—আমাকে?
-হ্যাঁ, আপনাকে।
–কিন্তু আপনি ঠিক শুনেছেন, আমাকে?
—আমি ঠিক শুনেছি।
–কিন্তু, তা কেমন করে হয়, আমাকে দেখে হয় তো অসুখ আরো বেড়ে যেতে পারে ভূতনাথবাবু। আমাকে আসতে নিষেধ করেছিলো বার-বার করে, আমি যে এসেছি তা-ই এখনো জানে না যে।
—তা হোক, আমি বলছি আপনি যান।
সুপবিত্র যেন এতখানি আশা করতে পারেনি। যেন আশার অতিরিক্ত সে পেয়েছে। যেন বিশ্বাস হচ্ছে না তার। মুখখানা ছোট শিশুর মতো লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। নতুন অনুরাগের লজ্জা। সুপবিত্র রুমাল দিয়ে চোখ-মুখ মুছতে লাগলো আবার। যেতে গিয়েও যেন দ্বিধা করতে লাগলো খানিকক্ষণ। তারপর বললে আপনি যাবেন না?
–না, আপনাকে একলা ডেকেছে।
–একলা?
–হ্যাঁ, কিন্তু ভয় নেই, জবা সুস্থ হয়ে উঠেছে এখন, যদি পারেন সকাল বেলা একটু গরম দুধ খেতে দেবেন। বড় দুর্বল মনে হচ্ছে যেন।
সুপবিত্র যাচ্ছিলো।
ভূতনাথ আবার ডাকলে। বললে-শুনুন।
সুপবিত্র ফিরে এসে দাঁড়াতেই ভূতনাথ বললে-জবা একটু সুস্থ হয়ে উঠলে, এই চিঠিটা ওর হাতে দেবেন তো!
—আপনার চিঠি?
-হ্যাঁ, আমার বিশেষ কাজ আছে, তাই চললুম এখন, কাল আসবো আবার, আপনি ওকে এ ক’দিন একটু চোখে-চোখে রাখবেন, আর জবা বড় অভিমানী, জানেন তো, সব কথার বাইরের মানে নিয়ে বিচার করবেন না ওকে, আপনার হাতেই ওকে দিয়ে গেলাম।
দরজা খুলে দেবার সময় ক্ষুদির মা বলেছিল—আবার কখন আসবেন দাদাবাবু?
—আর আসবো না আমি ক্ষুদির মা। কিন্তু বলতে গিয়েই সামলে নিয়েছে নিজেকে। বললে-কালই আসবো।
ক্ষুদির মা দরজা বন্ধ করে দিলে।
বাইরে তখন বেশ রাত। ভোর হতে অনেক দেরি। কলকাতার প্রাণসমুদ্র নিঝুম নিস্তরঙ্গ। ভূতনাথ সেই অদৃশ্য অপরূপকে মনে-মনে প্রণাম করে বললে-হে অমৃত তোমায় প্রণাম করি। তোমার বিচিত্র আনন্দরূপের মধ্যে সেই অপরূপ অরূপকে প্রণাম করি। তোমাকেই আমি পেলাম। পেলাম তোমার অনন্ত প্রেম। সুখে-দুঃখে বিপদে-সম্পদে ললাকে-লোকান্তরে তোমাকে পেলাম। সংসার আমাকে আর পীড়া দিতে পারবে না, ক্লান্তি দিতে পারবে না। এই সৃষ্টি-সংসারই আমার প্রেম। এখানেই নিত্যের সঙ্গে অনিত্যের যোগ, আনন্দের সঙ্গে অমৃতের। এইখানেই বিচ্ছেদ-মিলনের মধ্যে দিয়ে, পাওয়া-না-পাওয়ার অনেক ব্যবধানের ভেতর দিয়ে নানা রকমে তোমাকে পেয়েছি, তোমাকে পেয়েও পেয়েছি, হারিয়েও পেয়েছি-এ-পাওয়া আমার নানা রসে নানা রঙে অক্ষয় অব্যয় হয়ে থাক। নমস্তেহস্তু…
৪৯. চাঁদনীর হাসপাতালে শুয়ে
চাঁদনীর হাসপাতালে শুয়ে-শুয়ে ভূতনাথ নিজের চিন্তাতেই তলিয়ে যায়।
নার্স এসে মাথার ব্যাণ্ডেজ বদলে দিয়ে যায় মাঝে-মাঝে। ক’দিন হলো জ্ঞান ফিরেছে। এ ক’দিন কেমন করে যে কেটেছে, কোথা দিয়ে দিন রাত্রির শোভাযাত্রা একে-একে চলে গিয়েছে, মিলিয়ে গিয়েছে দূরে-দূরান্তরে, খেয়াল নেই। এখন যেন আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনাটা ভাবা যায়। কলকাতার সঙ্গে তার পরিচয় ঘনিষ্ঠ বৈ-কি। একটা প্রাচীন বংশের উত্থান না হোক পতন তত দেখেছে স্বচক্ষে। মনে পড়ে যায় আর একটা দিনের কথা। তখন বুঝি মোগল রাজত্বের মাঝামাঝি। সকাল থেকে আকাশটা একেবারে মেঘে-মেঘে ছেয়ে গিয়েছে। সপ্তগ্রামের পতন পুরোপুরি হয়ে গিয়েছে তখন। হুগলী তখন বেড়ে উঠছে হু-হু করে। ক’খানা জাহাজ পাল তুলে চলেছে সাঁকরেলের ঘাট থেকে। সঙ্গে কয়েকটা দেশী ছিপ, বোট আর ভাউলে নৌকো। সূতানুটি, গোবিন্দপুর আর কলকাতায় তখন সন্ধ্যে বেলা কার নামবার সাহস আছে! থাকবার মধ্যে মূতানুটিতে শুধু টিমটিম করা একটা হাট। শেঠ আর বসাকরা থাকতো সেখানে। হাটে তাদের সূতো আর কাপড়ের ব্যবসা ছিল। সে-সব কিনতে বাইরে থেকে আসতো নানা লোক। ইংরেজ পর্তুগীজ আর দিনেমার। সেদিন সেই বর্ষার রাতে সাকরেল ঘাট থেকে খিদিরপুরের পাশ দিয়ে পাল তুলে জাহাজ ক’খানা এসে দাঁড়ালো সূতানুটির ঘাটে। পানসি দিয়ে ঘাটে এসে নেমে সবাই দেখে—সর্বনাশ! কোথায় তাদের কুঠি, কোথায় তাদের মাটির চালাঘর। সব সমূলে উপড়ে নিয়েছে ঝড়ে। কোনো চিহ্ন নেই কিছুর। জব চার্নক আবার ফিরলো জাহাজে। বললেন, রাতটুকু জাহাজেই কাটাতে হবে। সেদিন জব চার্নকের এতটুকু পা রাখবার জায়গা পর্যন্ত ছিল না সূতানুটির মাটিতে। কিন্তু পরদিনই একটা কোঠাবাড়ি ভাড়া হলো—শেঠ বসাকরা আদর আপ্যায়ন করে বসালো তাদের। টাকা ধার দিলে, কড়ি দিলে, জমি দিলে, বাড়ি দিলে আর তারপর শুরু হলো ইতিহাসের নতুন অধ্যায়।
সে হলো ১৬৯০ সনের ২৪শে আগস্ট-এর গল্প।
সে-সব দিনের কথা কবে ভুলে গিয়েছে সবাই। আগে একএকটা বাড়ি খুলে পুরোনো কালের গাছের গুড়ি, সুদরি কাঠের সার বেরিয়ে পড়তো। কোথাও বেরোয় জল। কোথাও বেরিয়ে আসে নর-কঙ্কাল। কবে বুঝি ডাকাতি করে কারা মাটিতে পুতে রেখেছিল সেগুলো। সে-সব পুরোনো কথা ভুলে গিয়েছে সবাই। তারপর হলো শোভা সিং-এর বিদ্রোহ, ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর নতুন প্রতিনিধি এল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের দরবারে—উইলিয়ম মরিস। তারপর মুর্শিদকুলী খাঁ’র আমল, কোম্পানী বাহাদুরের প্রথম জমিদারী পত্তন, বৰ্গীর হাঙ্গামা, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, পলাশীর যুদ্ধ, ওয়ারেন হেস্টিংস, তারপর লর্ড কর্নওয়ালিশ আর লর্ড বেন্টিঙ্ক পেরিয়ে এসে গিয়েছে লর্ড কার্জন, আর্ল মিন্টো আর লর্ড হার্ডিঞ্জ। ওদিকে কংগ্রেসের মধ্যে দলাদলি শুরু হয়ে গিয়েছে। কুলী আইন পাশ হয়ে গিয়েছে। মুসলমানদের জন্যে আলাদা আসনের ব্যবস্থা হলো। দিল্লীর দরবার। বঙ্গভঙ্গ রদ হলো। বোমা পড়লো দিল্লীর বড়লাট হাডিঞ্জের গায়ে। সে বুঝি ১৯১২ সালের ২৩শে ডিসেম্বর। আর ওদিকে ভূমিপতি চৌধুরী থেকে সূর্যমণি চৌধুরী, তারপর বৈদূর্যমণি, হিরণ্যমণি আর কৌস্তুভমণি আর তার শেষ বুঝি চূড়ামণি!