হঠাৎ সুপবিত্র যেন কথা বললে এবার।-আমার আর থাকবার দরকার আছে ভূতনাথবাবু?
কেন? সুপবিত্র বললে—না, কিন্তু চোখ মেলে যদি আমায় দেখে জবা… হয় তো রাগ করতে পারে—আমাকে আসতে বারণই করেছিল।
-না, না, রাগ করবে কেন, অসুখের সেবা করতে এসেছেন আপনি—কিন্তু আপনাকে আজ কি জবা দেখেনি?
সুপবিত্র বললে—আমি এসেছি জানতেও পারেনি এখনও জ্বরের ঘোরে বড় কাতর ছিল কি না।
–ওষুধ খাওয়াবার সময়ও দেখতে পায়নি?
সুপবিত্র বললে—অনেক কষ্টে মুখটা চেপে ধরে ওষুধ খাওয়াতে হয়েছিল—বিকারের ঝোক ছিল তখন,জ্ঞান ছিল না ঠিক।
ভূতনাথ বললে—আচ্ছা, আপনি যাবেন না, তবে পাশের ঘরে গিয়ে আপনি একটু বসুন। যদি প্রয়োজন হয় আমি খবর দেবো আপনাকে।
সুপবিত্র চলে গেল।
ভূতনাথ জবার দিকে চেয়ে দেখলে। জবা জানতেও পারেনি সুপবিত্র এসেছে। মনে হলো—জবার যেন অসুখের ঘোরে স্বপ্ন দেখছে। একদৃষ্টে জবাকে দেখতে লাগলো ভূতনাথ। বড় অসহায় মনে হলো যেন তাকে। সমস্ত বিশ্বসংসারে যেন জবা কেউ নেই। আশ্চর্য। ভূতনাথের মতো অসহায় লোকের সঙ্গে যে-দুজনের পরিচয় হয়েছে ঘনিষ্ঠভাবে, তারা দুজনই অসহায়। এক পটেশ্বরী বৌঠান আর এক জবা। এমন করে এত ঘনিষ্ঠতা করা হয় তো ভালো হয়নি। তাতে না ভালো হয়েছে বৌঠানের, না জবার, না তার নিজের। কী প্রয়োজন ছিল ‘মোহিনী-সিঁদুর’ আপিসে চাকরির! অন্য কোনো আপিসেও তো হতে পারত! হতে পারতো ব্ৰজরাখালের আপিসে। হতে পারতো প্রথম থেকেই রূপচাঁদবাবুর আপিসে। তা হলে এমন করে জড়িয়ে পড়তে হতো না ভূতনাথকে। এমন করে নিজেকে নায়ক হতে হতো না উপন্যাসের। একবার মনে হলো জবা যেন আপন মনে স্বপ্নের ঘরে বিড়বিড় করে কী বলছে। মুখটা জবার মুখের কাছে নিয়ে এল ভূতনাথ। শোনবার চেষ্টা করলো। কিন্তু বড় অস্পষ্ট। খানিকক্ষণ পরে মনে হলো যেন একটু বুঝতে পারা গেল। যেন অস্পষ্টভাবে বিকারের ঝেকে সুপবিত্রর নামটা উচ্চারণ করলো। কান পেতে আবার শুনলে ভূতনাথ। আর ভুল নেই। মনে হলো সুপবিত্রর সঙ্গে যেন কিছু কথা বলছে। আবার কান পেতে শুনতে লাগলো ভূতনাথ। এবার আর কথা বলেছে না। আবার অঘোরে ঘুমোচ্ছে জবা। লম্বা নিঃশ্বাস পড়ছে। চেতনার কোনো লক্ষণ নেই।
হঠাৎ সেইভাবে বসে থাকতে-থাকতে ভূতনাথের মনে হলো—কেন সে বসে আছে এখানে। সে যেন সুপবিত্র আর জবা দুজনের মধ্যে প্রকাণ্ড একটা বাধা হয়ে আছে এতক্ষণ! সে কেন এখনও তার অস্তিত্বের বোঝা নিয়ে এখানে পীড়া দিচ্ছে এদের। সে তো নিজেকে অনায়াসে লোপ করে দিতে পারে। জবার জীবনে ভূতনাথ তো একটা আকস্মিকতা। ধরে নেওয়া যাক না, কোনো দিন কোনো অবসরে সে তার হৃদয়-মনকে কারো কাছে বিকিয়ে দেয়নি। কোনো সম্পর্কের গ্রন্থি দিয়ে বাঁধা হয়নি তাদের জীবন। একথা সত্যি বলে ধরে নিলেই হয়। যা ছিল তার দূরাশা, এখন তা আয়ত্তের মধ্যে হলেও আবার দূরাশা মনে করে দূরে চলে গেলেই হয়। কেউ কিছু বলবার নেই। কারো অভিযোগ করার কিছু নেই। কেউ ব্যথা পাবে না। ব্যথা যদি কেউ পায় তো সে নিজে। সে মনে করবে এটা জলের দাগ। জলের দাগকে চিরস্থায়ী বলে যে বিশ্বাস করে সে তো নির্বোধ। ভূতনাথ এ জীবনে অনেক দেখলে অনেক পথ মাড়িয়ে আজ এখানে এসে সে দাঁড়িয়েছে। ভূতনাথ জানে দুঃখ কাকে বলে, জানে আঘাত কী প্রচণ্ড, আশ্রয়ের প্রয়োজন যখন সব চাইতে বেশি তখন আশ্রয় কী দুর্লভ। কিন্তু। ‘এ-ও জানে আসল সুখ পাওয়ার মধ্যে নেই। মানুষের আত্মা সত্যকে নানার মধ্যে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করে।—সে যখন আত্মীয় বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যুক্ত হয় তখন সে নিজের একটা সার্থকতার রূপ দেখতে পায়। তাই সুবিনয়বাবু বলতেন—“আত্মার পরিপূর্ণ সত্যটি আছে পরমাত্মার মধ্যে। আমার আমি সেই একমাত্র মহাআমিতেই সার্থক। তেমনি আমরা যখন সত্যকে জানি তখন সেই অখণ্ড সত্যের মধ্যেই সমস্ত খণ্ডতাকে জানি।” আর একদিন বলেছিলেন—“খণ্ডের মধ্যে দিয়ে অখণ্ডকে যে উপলব্ধি করতে পেরেছে সে-ই সুখী। তখন যে আনন্দ সেই আনন্দই প্রেম। সেপ্রেম বেঁধে রাখে না। নির্মল নির্বাধ প্রেম। সেই প্রেমই মুক্তি সমস্ত আসক্তির মৃত্যু। সেই মৃত্যুরই সৎকার মন্ত্র হচ্ছে—
‘মধুবাতা ঋতায়তে
মধুক্ষরতি সিন্ধবঃ—
বায়ু মধু বহন করছে, নদী সিন্ধু মধু ক্ষরণ করছে, ওষধি বনস্পতি সকল মধুময় হোক, উষা মধু হোক, পৃথিবীর ধূলি মধুমৎ হোক, সূর্য মধুমনি হোক। আসক্তির বন্ধন যখন ছিঁড়ে গিয়েছে, তখন জল, স্থল, আকাশ, জড়, মানুষ সমস্ত অমৃতে পূর্ণ-তখন বুঝি আর আনন্দের শেষ নেই। সেই আনন্দই হলো প্রেম।”
জবার ঘরে বসে সেই শেষ রাত্রে ভূতনাথের মনে হলো—এখন সে সমস্ত ত্যাগ করতে পারে এই মুহূর্তে। কোনো আকর্ষণ আর নেই কোথাও। জবাকে ভালোবাসে বলেই জবাকে এত সহজে হারানো যায়। খণ্ডকে সে অখণ্ডের মধ্যে নতুন করে পাবে। নতুন করে মহাজীবন লাভ করবে।
জবা যেন এবার হঠাৎ জেগে উঠলো। একটু নড়ছে। ঠোট দুটো একটু কেঁপে উঠলো। একবার চোখ খুলতে চেষ্টা করলো। মুখ দেখে মনে হলো সে যেন হঠাৎ সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।
ভূতনাথ আস্তে-আস্তে জবার টেবিলে গিয়ে বসলো। একটা কাগজ নিয়ে তার ওপর কলম দিয়ে লিখতে লাগলো একটা চিঠি।
তখন তার ঘোরে জবা একটু যেন এপাশ ওপাশ করছে। এখনি চেতনা ফিরবে তার। চোখ চাইছে। অল্প-অল্প আলোয় তার দৃষ্টি যেন ঠিক জায়গাটায় নিবদ্ধ হতে পারছে না।