জবা বলেছিল—রাস্তাতে ফেলাই হোক, আর কাউকে দিয়ে দেওয়াই হোক, আমার কাছে সে একই কথা।
—কিন্তু মন থেকেও কি মুছে ফেলতে পারবে?
—মুছে ফেলাই তো উচিত।
—উচিত অনুচিতের কথা বলছি না, কিন্তু তা পারবে কি?
-মানুষের অসাধ্য কিছু নেই বলেই তো বাবার কাছে শুনেছি, চেষ্টা করে দেখি।
ভূতনাথ বলেছিল—চেষ্টা করলেই যদি ভোলা যেতে তা হলে তো পৃথিবীতে এত দুঃখ-কষ্ট থাকতে না জবা, সেইজন্যেই তো আমাদের হিন্দুদের এক দেবতারই নাম হলো ভোলানাথ—ভাঙ খেয়ে সমস্ত বিশ্বসংসার ভুলে আছেন—কিন্তু সেই ভোলানাথও শেষে সতীর মৃতদেহ নিয়ে কী কাণ্ড করলেন জানো তো?
সেদিন যত কথাই বলুক, ভূতনাথ কিন্তু জবার এই ভোলবার আপ্রাণ চেষ্টা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। সে-চেষ্টায় কোথাও ফাঁকি নেই। কোথাও শিথিলতা নেই।
জবা বলেছিল—হয় তো আমার এ সংস্কার বলতে পারেন আপনি —কিন্তু মন যা চায় তা তো পশুতেও করে, তা হলে মানুষের বৈশিষ্ট্য কোথায়। সংযম, সাধনা, শৃঙ্খলা এ সব ত মানুষেরই জন্যে।
ভূতনাথ তাড়াতাড়ি দরজার কড়া নাড়লে। ভেতর থেকে ক্ষুদির মা’র জবাব এল-কে?
—আমি ক্ষুদির মা, আমি।
—ওমা, দাদাবাবু—বলে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিয়েছে।
—দিদিমণি কোথায়? বাড়িতে আছে?
—দিদিমণির যে ভারী অসুখ দাদাবাবু—আপনি আসেন নি, আমি একা মানুষ…
—অসুখ? কী অসুখ?
ক্ষুদির মা বললে–হঠাৎ কাল থেকে এমন জ্বর, গা একেবারে পুড়ে যাচ্ছে, সমস্ত রাত্তির জ্ঞান নেই দিদিমণির, কাকে ডাকি, কী. করি, ভেবে অস্থির। কেঁপে জ্বর এল, আর তার পর থেকেই কথা বন্ধ।
—তারপর?
-তারপর আজ সকালে ভাবলাম, কাকে ডাকি, কাকেই বা চিনি, তা গেলাম ছোটদাদাবাবুকে ডাকতে।
—ছোটদাদাবাবু কে? সুপবিত্রবাবু?
-হ্যাঁ, তাঁর বাড়িটা চিনতাম, তাকেই ডেকে আনলাম, তিনি এসে ডাক্তার ডেকে আনলেন, ওষুধ খাচ্ছেন, তবে জ্ঞান আসেনি এখনও। সেই রকম ঝিম হয়ে আছেন—ভেবে অস্থির হয়ে গিয়েছি—একলা মেয়েমানুষ–
—সুপবিত্রবাবু ওপরে আছেন নাকি?
—আছেন, উনি আছেন বলেই তো এখন এদিকটা দেখতে পারছি, নইলে যা ভাবনা হয়েছিল।
আজো মনে আছে সেদিনের সে-দৃশ্যটা। তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গিয়ে ভূতনাথ দেখেছিল পালঙ-এর ওপর জবা অচৈতন্য হয়ে শুয়ে আছে। গায়ের ওপর চাদর ঢাকা। পাশের টেবিলের ওপর ওষুধের একটা শিশি। আর সুপবিত্র সামনে ঝুঁকে পড়ে পাখার বাতাস করছে। ভূতনাথের পায়ের শব্দ পেয়েই সুপবিত্র যেন চমকে উঠেছে। আজো সে-দৃশ্যটা চোখ বুজলেই ভূতনাথ দেখতে পায়। সুপবিত্রবাবু যেন একটা মহা অপরাধ করে ফেলেছে এমনি করে চেয়েছিল সেদিন।
ভূতনাথকে দেখেই বাইরে এসে সুপবিত্র বলেছিল—আপনি এসেছেন, আমার বড় ভয় করছিল।
সুপবিত্রর চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা। বেচারিকে যেন বড় অসহায় দেখাচ্ছে। বিপদ-আপদের মধ্যে সুপবিত্র একেই দিশেহারা হয়ে যায়। ভারী কাজ করতে তাল ঠিক রাখতে পারে না। ভুলো মানুষ। সব কাজেই ভুল করে। লেখাপড়া করে-করে বাস্তব প্রত্যক্ষ জগৎটার সঙ্গে বরাবরই তার অপরিচয়ের সম্পর্ক। সে যেন এতক্ষণ কূল পাচ্ছিলো না।
—কোন্ ডাক্তারকে ডেকেছিলেন?
—কী ওষুধ দিয়েছেন তিনি।
—কী হয়েছে বললেন?
অনেক প্রশ্ন করেছিল ভূতনাথ সেদিন একসঙ্গে। ডাক্তার বলেছিল—অনেকদিন অনিয়ম, উপোস, অত্যাচার করাতে শরীর দুর্বল ছিলই। এখন হঠাৎ দেখা দিয়েছে লক্ষণগুলো। কিন্তু ভেতরে-ভেতরে বহুদিন আগে থেকেই নিশ্চয়ই এ বিষ ছিল, বাইরে বোঝা যায়নি। ওষুধ পড়েছিল সময় মতো তাই রক্ষা।
—বিকেলবেলা ডাক্তার কি আসবে একবার?
–বলেছিলেন, যদি জ্ঞান না হয় তো খবর দিতে। কিন্তু জ্বর বোধ হয় এখন কমেছে, একটু আগে ঘাম হচ্ছিলো খুব, ছটফট করছিলেন খুব, এখন ঘুমোচ্ছেন—পাছে ঘুম ভেঙে যায় তাই হাওয়া করছিলাম।
ভূতনাথ বললে—তা হলে আমি তাকে ডেকে নিয়ে আসছি। আপনি জবার কাছে বসুন।
সুপবিত্র বললে—বরং, আমি যাই, আপনি বসুন।
-না, না, আপনি বসুন।
শেষ পর্যন্ত কিছুতেই সুপবিত্র রাজী হয়নি বসতে। ডাক্তার ডেকে নিয়ে এসে বাইরে দাঁড়িয়েছিল। কেমন যেন এড়িয়ে চলেছিল সমস্তক্ষণ! ডাক্তার এসে আবার নতুন একরকম ওষুধ লিখে দিয়ে গেলেন। সে-রাত্রিটা যে কেমন করে কেটেছিল আজো মনে আছে ভূতনাথের। বার-শিমলের সে-বাড়িতে সুবিনয়বাবুর অসুখের সময় আরো কয়েকটা রাত কাটাতে হয়েছিল আগে। রাত্রের নির্জন আবহাওয়াতে ট্রেনের সেই বাঁশীর শব্দ, আর তারপর বাইরের গভীর অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ একটা নিশাচর পাখীর ডেকে আবার থেমে যাওয়া—এ-অভিজ্ঞতা আছে ভূতনাথের। কিন্তু এবার যেন অন্যরকম। জবা নির্জীব হয়ে শুয়ে আছে। নিস্তব্ধ ঘরের পরিবেশ। শুধু সেইদিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কাজ কী?
সুপবিত্র পাশে দাঁড়িয়েছিল। বললে—আমি চলে যাই আপনি তো রইলেন।
ডাক্তার পরীক্ষা করে বলে গিয়েছিলেন—এখন নাড়ীর অবস্থা ভালো-ভয় কেটে গিয়েছে। সকাল বেলার দিকে কিছু দুধ বা চা খেতে দিতে পারেন—আর ওষুধ তো রইলই।
রাত গভীর হয়ে এল। একটা মাকড়সা দেয়ালের কোণে বাসা করেছে। ভূতনাথ সেই দিকে একদৃষ্টে চেয়েছিল। ধূসর রঙের বাসাটা। তারই ওপর নিশ্চল হয়ে বসে আছে। নড়ছে না, চড়ছে না। ঘরে যে এতবড় একটা অসুখের ক্রিয়া চলেছে, যেন খেয়ালই নেই সেদিকে। ওর চোখ দুটো এখান থেকে দেখা যায় না। কিন্তু অমন একাগ্রতাও যেন ভূতনাথ জীবনে দেখেনি। একনিষ্ঠতাও বলা যায়। যেন ধ্যানে বসে আছে। সেখান থেকে, চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ভূতনাথ আবার অন্যদিকে চাইলে। ঘরের দেয়ালের প্রত্যেকটা খুটিনাটি যেন দেখবার ইচ্ছে হলো ভূতনাথের। কোথায় একটা কালির অস্পষ্ট দাগ, একটা আলোর পোকা নড়ছে–অন্য সময় হলে হয় তো এসব এত নজরে পড়তো না। আজ তার নিজের ছায়াটাকেও যেন অদ্ভুত মনে হলো। বাতির অল্প আলোয় ছায়াটা পড়েছে। খানিকটা দেয়ালে, খানিকটা মেঝের ওপর। বাঁকা-চোরা ভাঙা ছায়া। কিন্তু বড় বীভৎস মনে হলো ছায়াটাকে। তারই তো নিজের ছায়া! মানুষের ছায়া কেন এতো বীভৎস দেখায়! ভূতনাথও কি এমনি বীভৎস। পাশেই সুপবিত্রর ছায়াটা পড়েছিল। কিন্তু সে-ছায়াটা সোজা পুরোপুরি দেয়ালের ওপর স্পষ্ট। কোথাও ভাঙা-চোরা নয়। পাশাপাশি পড়েছে একেবারে। সুপবিত্রর নাকটা যেন সোজা একটা সাবলীল রেখায় সুন্দর হয়ে উঠেছে। সুপবিত্রকে যেন বড় সুন্দর মনে হলো। সত্যিই বড় সুন্দর দেখতে সুপবিত্রকে। জবার পাশে সুপবিত্রকে যেন মানায় ভালো। আর একবার দেখলে ছায়াটার দিকে। সুপবিত্র স্থির নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বোধ হয় পলকও পড়ছে না চোখের। হয় তত জবার দিকেই চেয়ে আছে একদৃষ্টে। এতদিন ধরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হতো। আজ জবার অসুখের সুযোগে এ-ঘরে আসতে পেরেছে। ছায়াতে সুপবিত্রর চুল গুলো উড়ছে। মাথাভরা চুল। নিয়ম করে চুল ছাঁটার কথা হয় তো মনে থাকে না তার। কিন্তু বেশ দেখায় ওই চুলগুলো। সুপবিত্র হয় তো সংসারপটু নয়, কিন্তু তাতে কী। সুপবিত্র সুন্দর তো! সমুদ্রের ঢেউ হয় তো নয় সে, কিন্তু রামধনু তো সে। কালো আকাশের কোণে অমন করে সাত রঙের প্রকাশ যে করতে পারে, তারই কি দাম কম! রামধনুর রঙে সমস্ত পৃথিবী যখন রঙিন হয়ে ওঠে, তখন তার চেয়ে সুন্দর আছে কিছু? ভূতনাথের এবার যেন হঠাৎ মনে হলো— দেয়ালের কোণের ওই একনিষ্ঠ মাকড়সা, ওই দেয়ালের ওপর একফোটা কালির দাগ আর নিশ্চল সুপবিত্রর সুন্দর ছায়াটা যেন হঠাৎ সব সজীব হয়ে উঠেছে। সব যেন হঠাৎ সচল হয়ে নড়তে শুরু করেছে। সমস্ত দেয়ালটা যেন কালো হয়ে উঠলো এক নিমেষে, মাকসাটা হঠাৎ বাসা ছেড়ে ঘুরতে শুরু করেছে পাগলের মতো। আর সুপবিত্রর ছায়াটা যেন আর দেখা যায় না।