মেজবাবুর সঙ্গে বেণীও এসেছিল। বেণীর শরীরটাও খারাপ হয়ে গিয়েছে। ইব্রাহিমেরও গায়ে আর সে উর্দি নেই। মাথার বাবরি কিন্তু পরিপাটি। কাঠের চিরুণী দিয়ে আঁট করে বাঁধা। আর মোম লাগানো গোঁফ।
মেজবাবু বললে—চল তোর ছোটকর্তাকে দেখে আসি, কেমন আছে ও আজকাল?
তারপর ইব্রাহিম, বেণী, বংশী সবাই মিলে আবার সেই সব মালপতোর ওঠানো। ভারী-ভারী মাল সব। সেকালের সামগ্রী। ভারী না হলে যেন মানাতো না। এক-একটা কাঠের পিড়ি চারজনে ধরে তবে নড়াতে পারা যায়। এক-একটা শিল, বাসন, কাটারি, জলচৌকি, তোষক, গদি, সিন্দুক একলা নড়ায় কার সাধ্যি। কোম্পানীর আমলের জিনিষ সব। সস্তাগণ্ডার দিন ছিল তখন। কোম্পানী বাহাদুরের আমলে চল্লিশ মণ চালের দাম ছিল পঁচাত্তোর টাকা। পাঁচ মণ ঘি সাতাত্তোর টাকা, দু’মণ সরষের তেল একান্ন টাকা। এ-সব জিনিষ বড়বাড়িতে মণ-মণ আসতে। খেতেও এবেলা-ওবেলা অনেক লোক। ইংরেজ আমলেই প্রথম এল গোল-আলু। তা তাও সস্তা হলো ক্রমে। শুধু যা বাঁধাকপিটাই ছিল একটু আক্রা। ওটা খেতো সাহেব সুবোরা।
মালপত্তোর উঠতে বিকেল হয়ে গেল। সারাদিন কারোর খাওয়া হয়নি। রান্নার পাট হয়নি সকাল থেকে। যে-কাণ্ড চলেছে বাড়িতে। মাথার ঠিক ছিল না কারো। উনুনে আগুন পড়লো তখন। সেজখুড়ি ভাত চড়ালো। বংশী বাজারে গেল মাছ তরকারি আনতে। যাবার সময় বললে-আপনি যেন বেরোবেন না আজ্ঞে—একেবারে খেয়ে-দেয়ে তবে বেরোবেন।
ভূতনাথ বললে—আমার যে একবার বার-শিমলেয় কাজ আছে বংশী।
-না, না, শালাবাবু, না খেয়ে যাবেন না, ছোটমা জানলে রাগ করবে হুজুর।
—ছোটমা-ও কি না খেয়ে আছে বংশী?
–ছোটমা’র খাওয়ার কথা আর বলবেন না শালাবাবু, আজ যে এত কাণ্ড হয়ে গেল, কোনোদিকে খেয়াল নেই তার। জানতেও পারলে না কিছু-সকাল বেলাই এক বোতল খেয়ে শেষ করে দিয়েছে। সকাল থেকে বায়না ধরেছিল চান করবেন না, তারপর চিন্তা বলে-কয়ে চান-টান করিয়ে সাজিয়ে-গুজিয়ে দিয়েছে—তা আমি যখন গিয়ে বললুম-ছোটমা, আজ ভাত হতে দেরি আছে—এই জলখাবারটুকু খেয়ে নাও ততক্ষণ।
ছোটমা প্রথমে শুনতে পেলে না। চোখ বুজে শুয়ে পড়ে রইল। আবার যখন বললুম, তখন বললে—খাবো না আমি, নিয়ে যা আমার সামনে থেকে।
বললাম—না খেলে কী করে বাঁচবে—শুধু মদ খেলে পেট ভরবে? ছোটমা বোধহয় রেগে গেল। চোখ খুলে আমার দিকে তাকালে খানিকক্ষণ। আমি ভাবলাম—তাহলে বোধহয় রাগ থেমেছে। পাথরের রেকাবিটা সামনে এগিয়ে দিলাম আজ্ঞে তা সঙ্গে-সঙ্গে ছোটমা পা দিয়ে পাথরখানাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলে–মেঝের ওপর পড়ে সেখান ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে গেল শালাবাবু।
মুখ দিয়ে কিছু কথা বেরুলো না আমার। কোথায় আমার মাথায় ভাবনা, সেই ভোর এস্তোক ওরা এসে জ্বালাচ্ছে, মালপত্তোর নামাচ্ছে, ঘর খালি করতে বলছে, এত করে ঝাঁট দিলুম ঘর, সব ধুলো-কাদায় একসা করেছে—তার ওপর এই কাণ্ড, পাথর-বাটি ভাঙা কি ভালো শালাবাবু, গেরস্তের অকল্যেণ হয় যে—তা আমি আর থাকতে পারলুম না আজ্ঞে, মুখ বুজে থেকেথেকে আমার বুকের ভেতরটা একেবারে জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছে যে।
—তা, কী বললে তুমি?
বংশী বললে-মুখে যা না-আসে, তাই বলে ফেললাম আজ্ঞে, আমার মুখের রাশ আলগা করে দিলাম একেবারে। আমার তো আর জ্ঞান-গম্যি ছিল না তখন, রাগের ঝোঁকে কী বলছি, তা কি আর মনে আছে ছাই,আমার?…তা দেখি ছোটমা কাঁদছে হুজুর।
ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—কাঁদছিল বৌঠান?
বংশীর চোখ দিয়েও হঠাৎ ঝর-ঝর করে জল পড়তে লাগলো। কাপড়ের খুট দিয়ে জলটা মুছে নিয়ে বংশী বললে—দেখে তো আমার জ্ঞান ফিরে এল—ভাবলাম করছি কী! ছোটমা’র না-হয় জ্ঞান নেই, নেশার ঘোরে যা তা করছে—কিন্তু আমি করছি কী। আমার অন্নদাতা মা’কে আমি নাহাতক গালাগালি দিলাম এমন করে। আমার যে নরকেও ঠাঁই হবে না—তা সেখানেই বসে পড়ে ঠাস-ঠাস করে আমার গালে চড়াতে লাগলাম আজ্ঞে—কিন্তু তাতেও যেন প্রাচিত্তির হলো না আমার, দেয়ালের গায়ে কপালটা ঠুকতেঠুকতে বললাম—আমার মিত্যু হোক—আমার মিত্যু হোক— আমার মিত্যু হোক—আমার মিত্যু হয় না কেন রে—সেইখানে দাঁড়িয়েই আবার ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো বংশী।
বংশী চোখটা কাপড় দিয়ে মুছে নিলে। তারপর বললে–যাই আবার একবার বাজারের দিকে। এ-বেলায় বোতল নেই—শা মশাই-এর দোকান থেকে আবার আনতে হবে একটা—যদি আনতে ‘ভূলে যাই, তাহলেই চিত্তির।
তারপর থেমে বললে-আমার হয়েছে এই জ্বালা শালাবাবু –কাকেই বা বলবে—কে-ই বা বুঝবে। ওদিকে চিন্তা ছোটমাকে দেখেই খালাস, সেজখুড়ির রান্না করেই কাজ শেষ—আর বাকি সব কাজ—ছোটবাবুর ময়লা-মুক্ত থেকে ভেতর-বাইরের সব কাজ, এই বংশীর করতে হবে—আমি তো মানুষ বটে।
ভূতনাথ বললেএকবার ছোটমা’র সঙ্গে এখন দেখা করিয়ে দেবে বংশী? বার-শিমলেয় যাবার আগে একবার শুধু দেখা করতাম—দুটো কথা বলতাম।
বংশী হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। বললে—আপনি আর ছোটমা’র সঙ্গে দেখা করবেন না হুজুর।
-কেন?
—আজ্ঞে, আপনার ভালোর জন্যেই বলছি—দেখা করবেন না কখনও।
—কেন, ওকথা কেন বলছো? বংশী রেগে গেল।—ওই আপনার এক দোষ, বড় একগুয়ে, বলছি দেখা আর করবেন না, আপনার নিজের ভালোর জন্যেই না বলছি আমি।
ভূতনাথেরও কেমন যেন রোখ চেপে গেল। বললে—দেখা আমি করবোই।
-তবে করুন, আমাকে আবার জিজ্ঞেস করছেন কেন তাহলে? আমি বলছি দেখা করলে আপনার ভালো হবে না—ভালো হবে না—ভালো হবে না—এই বলে দিলাম তিনবার।