—আমিই ডাকছিলাম।
—কেন? কে তুমি?
হাতে সেই পেটফোলা ব্যাগ। ছুঁচলো গোঁফ। চিনতে ভুল হবার কথা নয়। কিন্তু কিছুই সহজে চিনতে পারার লোক নয় বুঝি ম্যানেজার। সহজে কাউকে চিনতে পারা বোধ হয় দুর্বলতার লক্ষণ। ননীবাবুর ম্যানেজার হাজারটা কাজের লোক। হাজারটা লোক তার পায়ে ধর্না দিয়ে বেড়ায়। এত সহজে চিনতে পারলে চলবে কেন তার?
ভূতনাথ বললে—আমি বড়বাড়ির লোক—আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম যে।
ম্যানেজার এতক্ষণে বললেও, তা ভালোই হলো—আমিও তো ছুটতে-ছুটতে যাচ্ছি বড়বাড়িতে—সেই সকাল বেলা বেরিয়েছি, আর এই দুপুর বেলা সবে এসেছি ফিরে, এমন সময় হুকুম হলো যাও বউবাজার-হুজ্জতের কাজ হয়েছে বটে।
ভূতনাথ বললে—বাবুরা আছে নাকি কেউ বাড়িতে?
-কেন? বাড়িতে যাবে কেন! সকাল থেকে হাজার জন লোক বাড়িতে দেখা করতে ছোটে। বাবুরা পইপই করে বারণ করে দিয়েছে, কাল সবাইকে খেদিয়ে দিয়েছি, সারাদিন কাজের পর একটু জিরোবে, গল্প করবে, তা না, রাত্তির পর্যন্ত লোকের আর কামাই নেই মশাই।
ভূতনাথ বললে কিন্তু পুলিশ-পেয়াদা এনে বাড়ি চড়াও হয়ে এই যে হলো—এতদিনের বংশ, তা ছাড়া রুগী মানুষ—বাবুদের একটা দয়ামায়া নেই? আর ননীবাবুকে তো চিঠি লেখাই হয়েছে, জবাবটা কী আসে না দেখেই
ম্যানেজার হঠাৎ বললে—সেই চিঠি লিখেই তো এত কাণ্ডরেগে একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলো ম্যানেজার। বলেছিলাম চিঠি দিও না সেখানে, চিঠি পেলে সাহেব চটে উঠবে, বলিনি তোমাদের, মনে করে দেখো দিকিনি-বলেছিলাম কিনা? শুধু-শুধু এতগুলো টাকা লোকশান…আমার কী, আমার হুকুম তামিল করা কাজ, বাবুদের লোকশান হয় বাবুরা বুঝবে—আমি কেন মাঝখানে কথা বলতে গেলাম।
তারপর ব্যাগটা খুলে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে কাগজপত্র ঘাঁটতে লাগলো ম্যানেজার। বললে—সেই সকাল থেকে রদ্দরে তেতেপুড়ে এখন আবার ছোটো বৌবাজার..বাবুদের আমি দেবো দু’কথা শুনিয়ে, তা হলে মিছিমিছি মামলা-মোকদ্দমা আদালতকাছারি করে এত কষ্ট দেওয়াই বা কেন আর এই বুড়ো লোকটার মিছিমিছি হয়রানি।
অনেক কষ্টে বুঝি পাওয়া গেল কাগজটা। রাগের মাথায় কাগজটা নিয়ে বললে—চলো, এখন এই কাজগটির জন্যেই এই হয়রানি।
ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—কীসের কাগজ?
ম্যানেজার তখন আবার হনহন করে চলতে শুরু করেছে। ভূতনাথও সঙ্গে-সঙ্গে চলতে লাগলো। ম্যানেজার বললে—এতক্ষণ বোধ হয় সব মালপত্তোর নামিয়ে ফেলেছে, কি বলে?
ভূতনাথ বললে—তা নামিয়েছে বৈকি! মাল তো আর একটা নয়!
—কিন্তু, যা নামিয়েছে নামিয়েছে, আর নামাবে না, কিন্তু ওঠাতে হবে তোমাদের লোক দিয়ে—তা বলে রাখছি। আমরা নামাবো আবার ওঠাবো, তা হবে না। লোকশানের ওপর লোকশান কেবল—কথা বলতে-বলতে বড়বাড়ির দিকেই চলতে লাগলো ম্যানেজার।
ভূতনাথও চলতে লাগলো সঙ্গে-সঙ্গে। বললে—মালপতত্তার তা হলে কি আর নামাবে না ওরা?
-আরে বাপু, না, না-নামাবে না তো বললুম—এক কথা এক শ’ বারহুজ্জতের কাজ হয়েছে দেখছি। বড়বাড়ির ভেতরে এসে ম্যানেজার ডাকলে—ওরে-এ-ই-ই, কী নাম যেন ওর—কৈলাশ—
কৈলাশ যেন ওদিকে ছিল। মালপত্তোর নামানোতে তারই উৎসাহ বেশি। হাঁক-ডাক হৈ-চৈ করে সে-ই এতক্ষণ সব তদ্বির তদারক করেছে। সকাল থেকে এসে লোকজন পুলিশ-পেয়াদা সেপাই নিয়ে কাজে লেগে গিয়েছিল।
ম্যানেজার বললে—হাতের কাজ সব বন্ধ করতে বল।
—সে কি ম্যানেজারবাবু?
—যা বলছি তাই কর, আমরা হুকুমের চাকর।
—আর এ মালপত্তোর?
–এ-সব থাকবে, যেমন আছে, যাদের মাল তারা ওঠাক— আমরা একবার ওঠাবো, একবার নামাবো, লোকশানের কপাল হয়েছে তাই—নইলে হাতীবাগানের সরকারবাড়িতে এক রাত্তিরে মাল নামিয়ে, সেইখানে বসে সেই মাল আবার নীলেমে বেচে তবে উঠেছিলুম—কিন্তু এমন করলে আর বন্ধকী কারবার চলবে না তাও বলে রাখছি।
ভূতনাথ বললে—তা হলে কি ছোটবাবুরা এখন বড়বাড়িতে থাকতে পাবে ম্যানেজারবাবু?
ম্যানেজার বললে—তা ছাড়া আর কি, সাহেব বিলেত থেকে টেলিগ্রাম করে জানিয়েছে। এর আর নড়চড় হবার উপায় নেই—সাহেবের কাছে চিঠি লিখেই যত গোল করলে তোমরা।
—বরাবর থাকতে পাবে তত?
—বরাবর কেন? এই তো হুকুম-নামা রয়েছে। দেখো না–বলে হাতের কাগজখানা দেখালে।
—যদ্দিন কর্তারা বেঁচে থাকবে, তদ্দিন ভোগদখল করবে এই পর্যন্ত—তারপর…
বংশীও পাশে এসে দাঁড়িয়ে শুনছিল। বললে—তাহলে শালাবাবু, ছোটবাবুকে থাকতে দেবে?
উত্তর দেবার আগেই একটা গাড়ি ঢুকলে সদর দিয়ে। ওপরে কোচবাক্সে বসে ইব্রাহিম গাড়ি চালাচ্ছে। ঢং-ঢং ঘণ্টা বাজালে পা ঠুকে। মেজবাবু গাড়ি থেকে নামলো।
বংশী গিয়ে নিচু হয়ে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলে।
মেজবাবু জলদ-গম্ভীর গলায় বললে—কই, পটলডাঙার বাবুদের লোক কোথায় রে?
মেজবাবু যেন আরো কালো হয়ে গিয়েছে এদানি। অনেকদিন পরে দেখা। শরীর ভেঙে গিয়েছে আরো। তবু কোঁচানো ধুতি মাটিতে লুটোচ্ছে। পামশু পায়ে। মাথায় বাবরি চুলের ফাঁকে যেন একটু-একটু টাক পড়েছে। গায়ে এসেন্সের গন্ধ। ভুরভুর করতে লাগলো জায়গাটা।
—পটলডাঙার লোক কোথায় গেল রে?
ম্যানেজার সামনে এগিয়ে গিয়ে নিচু হয়ে প্রণাম করলে।
মেজবাবু বললে কে তুমি? নাম কি তোমার?
মেজবাবুর সামনে ম্যানেজার যেন হঠাৎ ফণা গুটিয়ে নিয়েছে। ছুঁচলো গোঁফ দুটো যেন হঠাৎ বড় ঝুলে এল। মিনমিন করে নিজের নাম বললে ম্যানেজার।
মেজবাবু বললে—বেশ, বেশ, তোমাদের কাছেও টেলিগ্রাম এসেছে, আমাকেও করেছে টেলিগ্রাম, ননীবাবু লোকটি ভালো, তা এবার তোমাদের আর কাজ কি-যেতে পারে। এখন।