নিজের মনের গভীরে দৃষ্টিপাত করে দেখলে ভূতনাথ। সেখানে জবা নেই।
কিন্তু পরমাশ্চর্যের ব্যাপার হলো-যা আপাত বিচ্ছেদ বলে মনে হবার কথা—তা যেন পরম পাওয়া বলে মনে হলো তার। মনে হলো—জবা আছে। এতদিন সে কাকে চেয়ে এসেছিল কে জানে। কিন্তু যাকেই সে চেয়ে আসুক—কখনও বা ভুল করে, আবার কখনও বা ভুল ভেঙে-আসলে সে-ও বুঝি সেই নিজেকে জানার সাধনাই করে এসেছে। ছোটকর্তা বুঝি আজীবন নিজেকেই চেয়ে আসছে, চুনীদাসীও তাই, বৌঠানও তাই, সবাই তাই। সবাই যেন বলছে—সেই এককে জানো-জানো সেই নিজের আত্মাকে।
বনমালী সরকার লেন-এর সামনে এসেই কেমন যেন ধাধা লাগলো।
বড়বাড়ির সামনে যেন অনেক ভিড়। অনেক লাল পাগড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। ভিড় করে আছে চারপাশে আরো দশ-বিশজন লোক। বাড়ির গেট খোলা! বাড়ির ভেতরের অনেক জিনিষ উঠোনে এনে নামিয়েছে। পাহাড় হয়ে জমে আছে বাক্স, বালতি, বাসন, কাঠের সরঞ্জাম–সমস্ত।
ভূতনাথ একজনকে জিজ্ঞেস করলে—এ-সব কী?
একজন বললে-পটলডাঙার বাবুরা বাড়ির দখল নিচ্ছে।
—দখল নিচ্ছে কেন? পরোয়ানা আছে?
—আজ্ঞে, আদালত থেকে পরোয়ানা নিয়ে তবে এসেছে, পটলডাঙার বাবুরা কি কাঁচা নোক নাকি?
—তোমাদের সেই ম্যানেজার কই?
ম্যানেজারকে দূরে কাছে কোথাও দেখা গেল না।
হঠাৎ দূর থেকে বংশী ভূতনাথকে দেখতে পেয়ে হাউহাউ করে কাঁদতে-কাঁদতে দৌড়ে এসেছে।–শালাবাবু, কী হবে? কী হকে শালাবাবু?
ভূতনাথ বললে—এসব কী হচ্ছে? ছোটকর্তার হুকুম নিয়েছে? মাল বার করতে কার হুকুম নিয়েছে এরা?
–কার আবার হুকুম নেবে শালাবাবু?
–কেন, যার বাড়ি তার?
–হুকুম তো নেয়নি।
–তবে কেন মাল বার করতে দিলি তুই?
পুলিশগুলো দাঁড়িয়ে দেখছিল সব। আর পটলডাঙার বাবুদের লোক ঘাড়ে করে, মাথায় করে ভারী-ভারী মাল নামাচ্ছে উঠোনের ওপর।
বংশী বললে—আমি এতগুলো লোকের সঙ্গে পেরে উঠবো কেন, শালাবাবু?
ভূতনাথ যেন কী ভাবলে খানিকক্ষণ। তারপর বললে— বৌঠান কি করছে রে?
বংশী তখনও কাঁদছিল। গলা নিচু করে বললে—আজ সকাল থেকে নেশায় একেবারে বেহুশ হয়ে পড়ে আছে শালাবাবু-আজ যেন বড় বাড়িয়েছে ছোটমা।
—আর ছোটকর্তা?
ছোটকর্তা কিছু বলছে না আজ্ঞে, চুপ করে শুধু জানালার বাইরে চেয়ে আছে ঠায়। একটা কথারও উত্তর দিলে না আমার এত বললুম—এত বোঝালুম।
ভূতনাথ বললে—আমার সাইকেলটা একবার দে তো রে বংশী?
বংশী চোরকুঠুরি থেকে সাইকেলটা বার করে এনে দিলে।
ভূতনাথ বললে—তুই দেখিস লে—ছোটবৌঠান, ছোটকর্তা কেউ যেন কিছুতেই ঘর থেকে বেরোয় না। আমি আসছি এখুনি—বলে সাইকেল-এ উঠে সোজা বাইরে রাস্তায় গিয়ে পড়লো।
৪৬. সেদিন ভূতনাথের একটিমাত্র উদ্দেশ্য ছিল
সেদিন ভূতনাথের একটিমাত্র উদ্দেশ্য ছিল—বৌঠানকে এই অবমাননা থেকে বাঁচাতে হবে। বড়বাড়ির অতীত গৌরবের অবমাননা নয়। বিংশ-শতাব্দীর নতুন সভ্যতার সঙ্গে যারা খাপ খাওয়াতে পারলো না নিজেদের, তাদের অবমাননা নয়। অপমানটা বৌঠানের ব্যক্তিগত। কেমন যেন ভূতনাথ নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিল বৌঠানের ভালো-মন্দর সঙ্গে। এ শুধু কৃতজ্ঞতা নয়। শুধু করুণার ঋণশোধের ব্যর্থ চেষ্টা নয়। শুকনো কর্তব্যও নয়। এ যেন পরমাত্মীয়কে রক্ষা। পরমাত্মীয়ের চেয়েও যদি বড় কেউ থাকে, তাকে।
বৌঠান বলেছিল—আমি যদি মরে যাই, তুই একটু কাঁদিস ভূতনাথ। আমার জন্যে কেউ কাঁদবে, এটা ভাবতেও বড় ভালো লাগে রে!
কিন্তু কাঁদবার অবশ্য প্রয়োজন হয়নি শেষ পর্যন্ত। তেমন দিন সত্যিই যখন এসেছিল—তখন ভূতনাথ নতুন এক উপলব্ধির সন্ধান পেয়েছে। নতুন আত্মানুভূতি। ভূতনাথ তখন নিজেকে জানতে পেরেছে। সুবিনয়বাবুর ভাষায়-আত্মানং বিদ্ধি। পৃথিবীতে কারোর জন্যে কাঁদবার প্রয়োজন তার ফুরিয়ে গিয়েছে। প্রথম-প্রথম জবার বাড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় ভেতরে যাবার লোভও হয়েছে। আবার মেয়ের গানের শব্দ শুনে অনেকবার দ্বন্দ্ব উদয় হয়েছে মনে। কিন্তু তারপর সে জয় করেছে নিজেকে। সকলকে হারিয়ে সে যে পৃথিবীকে পেয়েছে। নিজেকে জেনে সে যে বিশ্বকে জেনেছে।
কিন্তু সে-কথা এখন থাক।
সেদিন মনে হয়েছিল যেমন করে হোক সে পটলডাঙায় গিয়ে আদালতের পরোয়ানা বাতিল করে আনবেই। সে পা জড়িয়ে ধরবে বাবুদের। বলবে—আপনাদের যেমন করেই হোক এ হুকুম প্রত্যাহার করতেই হবে।
দারোয়ান হয় তো ভেতরে ঢুকতে দেবে না। বাবুর হয় তো বাড়িতে থাকবে না। কিন্তু তবু ভূতনাথ সেই সদর দরজার সামনেই বসে পড়ে থাকবে। প্রত্যাহারের আদেশ না নিয়ে সে ফিরবে না। না প্রত্যাহার হলে সে-ও ফিরবে না এখানে। দিনের-পর-দিন সে ওইখানেই পড়ে থাকবে। দরজার সামনে অভুক্ত থাকবে সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত।
সাইকেল-এ চড়ে যেতে-যেতে আবার মনে হলো—কেন সে যাচ্ছে! এও সেই আত্মবোধের তাড়নায়ই সে ছুটে চলেছে। এই আত্মবোধের তাগিদেই সে বৌঠানকে বাঁচাচ্ছে। বৌঠানকে বাঁচানো তার নিজেকে বাঁচানোরই নামান্তর।
কিন্তু বনমালী সরকার লেন তখনও পার হয়নি। হঠাৎ মনে হলো যেন ম্যানেজার আসছে এই দিকে। ভূতনাথ থামলো। নামলো সাইকেল থেকে। ডাকলে—ম্যানেজারবাবু–
ম্যানেজারও হনহন করে আসছিল। হনহন করে হাঁটাই তার অভ্যেস। আস্তে হাঁটতে যেন পারে না ম্যানেজার। ব্যস্ত না হলে যেন বাঁচতে পারে না লোকটা।
আবার ডাকলে ভূতনাথ–ও ম্যানেজারবাবু–
এবার ফিরে দাঁড়ালো। চাইলে ভূতনাথের দিকে একবার। কিন্তু চিনতে পারলে না। হাঁ করে ভূতনাথের মুখের দিকে চেয়ে বললে—আমায় ডাকলে যেন কে?