খালের ধারে একটা পরিষ্কার জায়গা দেখে ভূতনাথ টিনের বাক্সটা রাখলে। তারপর তার ওপরেই বসে পড়লল। খালের ওপর দিয়ে মালপত্র বোঝাই নৌকো চলছে। বড়-বড় বাঁশের লগ্নি দিয়ে ঠেলতে-ঠেলতে ভোঙা চলেছে। ওরা কত দূর-দূরান্ত থেকে আসছে কে জানে। শহরে এসে কাঁচামাল বিক্রি করবে। ফেরবার সময় কেরোসিন, দেশলাই, নুন, কলের কাপড় কিনে নিয়ে গ্রামে ফিরে যাবে আবার। অলস দৃষ্টিতে সব দেখতে-দেখতে ভূতনাথের কেমন মনে হলো—কেন সে এখানে বসে আছে। তার কি যাবার জায়গার অভাব। এখনি সে বড়বাড়িতে যেতে পারে। তার চোরকুঠুরিতে তার নিশ্চিন্ত আশ্রয় বাঁধা। বৌঠানকে নিয়ে বরানগরে একবার যাবার কথা আছে। সেখানে গিয়ে ভূতনাথ নিজেও একবার মানত করে আসবে পাঁচ পণ সুপুরি আর পাঁচ গোছ পান দিয়ে।
আবার উঠলো ভূতনাথ। আস্তে-আস্তে চলতে শুরু করলে সোজা রাস্তা ধরে। বংশী তাকে দেখে খুব অবাক হয়ে যাবে বটে। বলবে—এ কি, ফিরে এলেন যে-দেশে যাননি শালাবাবু?
ভূতনাথ বলবে—না রে বংশী, তোদের ছেড়ে যেতে চাইলো না মন। ফিরেই এলাম তাই—আর কটাই বা দিন। তারপরে তো বড়বাড়ি খালি করতেই হবে! তখন?
কিন্তু আর একজনের কথা যেন জোর করেই ভুলে থাকতে চেষ্টা করলো ভূতনাথ। সে কি করে সম্ভব! ভালোবাসার প্রশ্ন নয়। চাওয়া-পাওয়ার প্রশ্নও নয়। কিন্তু সে কেমন করে গিয়ে বলবে তাকে—আমিই সেই! আমার অধিকারের দাবি নিয়ে আমি এসেছি—আমাকে গ্রহণ করো। শুধু দুটো মন্ত্র আর এক রাত্রির ষড়যন্ত্রের পরিণামফল! জবার জীবনে সে-রাত্রিটা কি চিরকাল একটা বিড়ম্বনা হয়েই থাকবে? জবার সেই বিড়ম্বনাই কি ভূতনাথ চেয়েছিল?
ভাবতে-ভাবতে এক সময় ভূতনাথ আবার চলতে আরম্ভ করেছে। হাতে টিনের বাক্সটা যেন ক্রমেই ভারী ঠেকছে। মনে হলো—পথ চলা যেন তার শেষ হবে না। কোথায়ই বা যাবে। কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে সে। রাস্তায় লোকজন চলাচল করছে। ট্রাম, ঘোড়ার গাড়ি, সাইকেল, মোটর সমস্ত চলছে। হঠাৎ কেমন যেন মনে হলো-সংসারে কেউ তো স্থির হয়ে নেই। কিন্তু যাচ্ছে কোথায় সবাই? সবাই কি উদর পূরণের অন্ন খুজছে? নিজের প্রাত্যহিক প্রয়োজনের চারিদিকেই প্রতিদিন প্রদক্ষিণ করে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে?
বহুদিন আগের একটা ঘটনা মনে পড়লো ভূতনাথের। ফতেপুরে নদীর ধারে একদিন এক বাউল এসে উঠেছিল। তখন সবে তার পিসীমা মারা গিয়েছে। কিছুই ভালো লাগে না। একদিন বেড়াতে-বেড়াতে গিয়েছিল ভূতনাথ সেখানে। ছোট খাচার মধ্যে একটা ময়না পাখী, একটা ঝোলা আর একটা একতারা—এই ছিল তার সম্বল। কিন্তু সেই একতারার মধ্যে দিয়েই সেদিন কী সুন্দর সব সুর যে বেরিয়ে এসেছিল! কত ভালো ভালো গান যে সেদিন শুনেছিল তার মুখে।
ভূতনাথ জিজ্ঞেস করেছিলা গো ঠাকুর, তোমরা কি জাত?
বাউল উত্তর দিয়েছিল—আমরা বাউল বাবা।
—তোমরা আমাদের মতো হিন্দু তো?
বাউল বলেছিল—না বাবা, আমরা বাউল।
ভূতনাথ জিজ্ঞেস করেছিল—তোমরা আমাদের মতো ঠাকুর পূজো করো? ভগবান মানে?
—তা মানি বৈকি বাবা!
—তবে তোমাদের সঙ্গে আমাদের তফাৎ কোথায়? বাউল উত্তর দিয়েছিল—তফাৎ তত বাইরে নয় বাবা, ভেতরে। হিন্দুরা মন্দির গড়ে, প্রচার করে আমরা প্রচার করিনে, মন্দিরও গড়িনে। হিন্দুরা বাইরে ছড়ায়, আমরা ভেতরে গুটোই। আমাদের গুরুর উপদেশ হলো প্রথমে নিজেকে জানতে হয়, নিজেকে জানলে ভবেই নিজের মধ্যে ভগবানকে পাওয়া যায়।
—কিন্তু সে-কথা তোমরা দশজনকে জানাও না কেন? না ‘জানালে লোকে তোমাদের কাছে আসবে কেন?
বাউল হেসেছিল। কলকেতে টান দিতে দিতে বলেছিলআসবে বাবা আসবে, একদিন নিশ্চয়ই আসবে।
আজ এতদিন পরে ভূতনাথ যেন বাউলের সে-কথাটার মানে বুঝতে পারলে। মনে হলে সবাই যেন নিজেকে খুঁজে পাবার জন্যেই বেরিয়ে পড়েছে। নিজেকে না পেলে নিজের চেয়ে যে বো তাকে পাবার যেন কোনো উপায় নেই। মনে হলোছোটবেলা থেকে প্রত্যেকটি মানুষ যেন সেই একটি লক্ষ্য ধরে ছুটে চলেছে। মানুষের নিজের গড়া আচার-অনুষ্ঠানই তাকে কেবল মনে করিয়ে দেয়—এই দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় এর সমাপ্তি নেই। প্রাত্যহিক উদরপূরণ আর সামাজিকতা রক্ষার মধ্যে তার পূর্ণচ্ছেদ নয়। সে এমন এক আত্মসত্তাকে খুঁজছে যে তার বর্তমানকে, তার অতীতকে, তার প্রবৃত্তিকে, তার বাসনাকে ছাড়িয়ে অনেক দূর-দূরান্তে চলে গিয়েছে।
মনে পড়লো—সুবিনয়বাবুও সেই কথাই বলতেন। আত্মানং বিদ্ধিঃ। আপনাকে জানো। মনে পড়লো—এই আপনাকে জানার সাধনাই করে গিয়েছেন সুবিনয়বাবু। এই আপনাকে জানার সিদ্ধিলাভ করতেই ব্রজরাখাল দীক্ষা গ্রহণ করেছে। পটেশ্বরী বৌঠান আপনাকেই জানতে চাইছে এতদিন ধরে। ছোটকর্তা, ছুটুকবাবু, ননীলাল, চুনীদাসী, বংশী, বিধু সরকার সবাই যেন সেই আপনাকেই জানার সাধনা করে আসছে।
সকাল পেরিয়ে দুপুর হতে চললো। রোদের তেজ বাড়ছে, কিন্তু তবু যেন কষ্ট হলো না ভূতনাথের। হাতের টিনের বাক্সটা যেন ক্রমশ বড় হাল্কা হয়ে গিয়েছে। হাল্কা হয়ে গিয়েছে শরীর।
ভূতনাথ আবার একটা জায়গা দেখে বসে রইল কিছুক্ষণ। মনে পড়লো—আর একদিনের কথা। সুবিনয়বাবু বলেছিলেন— একদিন এ কলকাতা ছিল না, এ ভারতবর্ষ ছিল না, এ পৃথিবীও ছিল না। শুধু ছিল বাষ্প। বাষ্পের পরমাণুগুলো তাপের বেগে চারিদিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। তার না ছিল সার্থকতা না ছিল সৌন্দর্য। তারপর যখন সে সংহত হয়ে এক হলো, তখন গড়ে উঠলো এই পৃথিবী। ভূতনাথেরও মনে হলো—এতদিন সে-ও যেন প্রবৃত্তির তাপে, বাসনা-কামনার বেগে ছড়িয়ে ছিল চারিদিকে। কিছু দেয়ওনি। পায়নি কিছু। হঠাৎ যেন বড় সংযত হয়ে এসেছে মন। যেন সমস্ত বিচ্ছিন্ন-জানা একটি পরম প্রজ্ঞায় ঘনীভূত হয়ে এসেছে। সমস্ত বিচ্ছিন্ন-বাসনা একটি পরম প্রেমে সম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে।