—সে পাত্রীর নাম কি জবাময়ী?
—হ্যাঁ—কিন্তু আমরা তো প্রথমে বুঝতে পারিনি, অত বড় পণ্ডিত লোক, বলরামপুরে ওদের অত নাম-ধাম, নৈয়ায়িক পণ্ডিত, যেবার সেই শোভাবাজারের রাজবাড়িতে অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ থেকে সক লোক এসেছিল, দাক্ষিণাত্য থেকে পর্যন্ত পণ্ডিতরা এসে বিচারে বসেছিল, রামহরি ভটচার্যির ঠাকুর্দাও সেখানে হাজির ছিল, বিচারে তারই শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছিল শুনেছি—তা সেই অত বড় পণ্ডিত মানুষ যে আমাদের ঠকাবে কে জানতত বল?
ভূতনাথ আবার জিজ্ঞেস করলে—তার আর কোনো দিন আমাদের খোঁজ খবর নিয়েছেন?
–নিয়েছে বৈকি, লোক পাঠিয়েছিল, তখন তোর বাপ গত হয়েছে, আমার কাছে আসতেই সাফ বলে দিলাম—ও বিয়ে অসিদ্ধ।
—কেন, অসিদ্ধ কেন?
নন্দজ্যাঠা বললে—সেই কথাই তো বলছি, তোর বাপ তো বড় ভালোমানুষ ছিল, ভটচার্যি মশাই ধরলে এসে—তা তখন তুইও সেবার গিয়েছিলি আমাদের সঙ্গে। আমাকে সতীশ বললে— ভারী পণ্ডিত মানুষ, এমন বংশে বিয়ে দিতে আপত্তি কি দাদা, শরীরের যা গতিক, কবে আছি কবে নেই—বিয়েটা দিয়েই কাজ সেরে নিই—তা এরকম বিয়ে তো হতো তখন—এই দেখ না আমারই তো যখন ছ’ বছর বয়স তোর জ্যাঠাইমার তখন এক বছরও বয়েস হয়নি, বিয়ে হয়ে গিয়েছিল—যখন ঘর করতে এল তোর জ্যাঠাইমা তখন বাবার কোলে চড়ে বেড়াতে দিনরাত… আমার এখনও মনে পড়ে—আর আমার ঠাকুমা যখন শ্বশুরবাড়িতে এসেছিল তখন মা’র কাছে শুনেছি কোমরে নাকি কাপড় থাকতো না—তা ঠাকুমা’র শাশুড়ী কোমরে দড়ি দিয়ে কাপড়টা বেঁধে দিতে খানিক থেমে নজ্যাঠা আবার বলতে লাগলো—তা সতীশের কথায় আমিও ভাবলাম—দেখাই যাক মেয়ে। তা মেয়ে আর দেখবো কি, দু’ মাস তো বয়েস, তবু চোখ নাক মুখ দেখে ভালোই মনে হলো। বললাম—আমরা রাজী। রামহরি ধরে বসলেন— আজই ভালো দিন আছে—আজই হয়ে যাক—শুভস্য শীঘ্রম্। পাঁজি দেখে একেবারে পাকা বন্দোবস্ত হয়ে গেল।
ভূতনাথ উদগ্রীব হয়ে শুনছিল। বললে—তারপর?
–তারপর সেদিন কী ঝড়-বৃষ্টি বাবারে বাবা! সতীশ বললেছেলের বিয়ে তো দেবে টাকা-কড়ি যে কিছু হাতে নিয়ে আসিনি। আমি বললুম—ত’বিল আমার কাছে, আমি দেবো’খন—তা বিয়ে নয় বিয়ে, রাত দেড়টার পর লগ্ন। সেই ঝড়ের মধ্যেই ঘুম থেকে তোকে উঠিয়ে নিয়ে গেলাম, গরুর গাড়ি বলে রেখেছিলাম একটা আগে থেকেই।
–তারপর?
—তারপর আর কি? পরদিনই ফিরে এলাম ফতেপুরে। সতীশ বলেছিল—কাউকে খবরটা দিও না দাদা। টাকার যোগাড়-যন্তর করে একেবারে খাওয়া-দাওয়ার দিন জানিয়ে দেবে—কিন্তু তার আগেই সংবাদ এসে গেল—সর্বনাশ কাণ্ড!
–কিসের সর্বনাশ?
–রামহরি ভটচার্যি আমাদের ঠকিয়েছে, মেয়ের বাপ হিন্দু নয়, ব্ৰহ্মজ্ঞানী, ভটচার্যি মশাই-এর ছেলে কলকাতায় গিয়ে কেশব সেন-এর দলে মিশে ধর্ম ত্যাগ করেছে, পৈতে খুলে ফেলেছে, গায়ত্রী জপ করে না, মুরগী খায়, গরু খায়, শোর খায়, বিধর্মীকে বিয়ে করেছে—সেই ছেলেরই মেয়ে এ-শুনে তো আমাদের চক্ষুস্থির!
–তারপর?
—তারপর সব শুনে সতীশের সঙ্গে পরামর্শ করলাম। সতীশ বললে—দাদা, একথা আর কাউকে জানিয়ে কাজ নেই, আমাদের মেয়ে নয় তাই রক্ষে। এখন চুপ-চাপ করে যাও। আমিও বললাম তাই ঠিক। শেষে যেবার বারুণীর মেলা হলো, সেবার তোকে নিয়ে গিয়ে খানিকটা গোবর খাইয়ে দিয়ে শুদ্ধ করে নিলাম, যা হয়ে গিয়েছে, হয়ে গিয়েছে, কথায় বলে—মনের অজান্তে পাপ নেই…তা সে সব অনেক দিনের কথা, তুই জানলি কী করে?
ভূতনাথ সে-কথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করলে—রামহরি ভটচার্যির ছেলের নাম কি সুবিনয়বাবু?
—তা হবে, অত-শত মনে নেই বাবু—সে কি আজকের কথা রে?
ভূতনাথ হঠাৎ বললে—আমি এবার উঠি তাহলে জ্যাঠামশাই বলে আবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে।
নন্দজ্যাঠা বললে—সে কি রে, এই কথা জানতেই কি এসেছিলি নাকি?
ভূতনাথ বললে—আজ্ঞে হ্যাঁ, এখানে দেখা না হলে আপনার সঙ্গে দেখা করতে আজ দেশেই যাচ্ছিলাম।
—কিন্তু, কী ব্যাপার, খুলে বল তো?
সে-কথার উত্তর না দিয়ে ভূতনাথ সোজা আড়তের বাইরে বেরিয়ে এল। এতদিন যদিও বা একটু সন্দেহ ছিল, আজ তারও সমাধান হয়ে গেল। খালের ধারে তখন ব্যাপারীদের নৌকোয় হৈ-চৈ চলেছে। ভারে-ভারে পাট, তিসি, সরষে, কাঠ নামছে। নৌকো থেকে সোজা লম্বা একটা করে কাঠের পাটা পেতে দিয়েছে। তার ওপর দিয়ে মাথায় করে মাল নিয়ে আসে মুটেরা। চারদিকে বেলা হয়েছে বেশ। রোদের তেজ বেড়েছে। খালের বারের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে ভূতনাথের কেমন যেন সব গোলমাল হয়ে গেল। হাতের টিনের বাক্স ভারী মনে হলো খুব।
কিন্তু এখন সে কোথায় যাবে! সাত দিনের ছুটি নিয়েছে আপিস থেকে। আপিস না গেলে আজ আর কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে না বটে। তা ছাড়া রূপচাঁদবাবু তাকে একটু
প্রীতির চোখেই দেখেন!
সেদিন রূপচঁদবাবু বলেছিলেন—আমার এখানে আর তোমার কতই বা উন্নতি হবে—আমার সামর্থ্যই বা কতটুকু।
ভূতনাথ বলেছিল-আমার ওপর আপনার অসীম অনুগ্রহ।
রূপচাঁদবাবু বলেছিলেন—অনুগ্রহ-নিগ্রহের কথা নয় ভূতনাথবাবু, ঈশ্বরের তেমন ইচ্ছে হলে কী না হয় তাকে ধন্যবাদ দিন— তাহলেই কাজ হবে। তারপর বলেছিলেন—আর একটা নতুন আপিস হবার কথা হচ্ছে, দেখি সেখানে যদি হয় তো আপনাকে ঢুকিয়ে দেবো—অবশ্য দেরি আছে। সেখানে ঢুকতে পারলে আপনার উন্নতি হবে ভবিষ্যতে।
-কোন্ আপিস?
—ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট আপিস হবার কথা হচ্ছে কলকাতায়, এই রাস্তা-ঘাট তৈরি করবে, পুরোনো সরু রাস্তা ভেঙে চওড়া করবে, বস্তি ভেঙে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করবে—শহর বড় করবে আর কি।