হোক মধ্যবিত্ত! না থাক সেই সেকালের জুড়ি, চৌঘুড়ি, ল্যাণ্ডো, ল্যাণ্ডোলেট, ফিটন আর ব্রুহাম। নাই বা রইল ঘেরাটোপ দেওয়া পাল্কি, তসর-কাপড়-পর ঝি, কিম্বা সোনালি-রূপালি কোমরবন্ধ পর দরোয়ান, সরকার, হরকরা, চোদার, হুকাবরদার, আর খানসামা। নাই বা চড়লাম চল্লিশ দাড়ের ময়ুরপঙ্খী। ছিল চিংড়ি মাছ, পেঁয়াজ, পুইশাক, মাথার ওপর একটা ছাদ আর সূতিকা-রুগী বউ। এবার তাও যে গেল। এবারে দাঁড়াব কোথায়?
নোটিশ দিয়েছে ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট যথাসময়ে।
জোর আলোচনা চলে বাঞ্ছার তেলেভাজার দোকানে। “ইণ্ডিয়া টেলারিং হল-এ”। গুরুপদ দে’র “স্বদেশী বাজারে”র সামনে, প্রভাস বাবুর “পবিত্র খদ্দর ভাণ্ডারে”র ভেতরে বাইরে। আর ‘সবুজ সঙ্ঘের আড্ডায়। আরো আলোচনা চলে ত্রিকালদর্শী শ্রীমৎ অনন্তহরি ভট্টাচার্যের “শ্রীশ্রীমহাকালী আশ্রমে”। জ্যোতিষার্ণব বলেন—আগামী মাসে কর্কট রাশিতে রাহুর প্রবেশ—বড় সমস্যার ব্যাপার—দেশের কপালে রাজ-রোষ— অনেক আলোচনা চলে বড়বাড়িতে। এর থেকে ভূমিকম্প ছিল ভালো। ছিল ভালো ১৭৩৮ সনের মতো আশ্বিনে ঝড়। যেবার চল্লিশ ফুট জল উঠেছিল গঙ্গাতে। তাও কি একবার! বড়বাড়িতে যারা বুড়ো, তারা জানে সে-সব দিনের কথা। তোমরা তখন জন্মাওনি ভাই। আর আমিই কি জন্মিয়েছি, না জন্মেছে আমার ঠাকুর্দা। এ কি আজকের দেশ? কত শতাব্দী আগেকার কথা। গঙ্গা তো তখন পদ্মায় গিয়ে মেশেনি। নদীয়া আর ত্রিবেণী হয়ে সাগরে গিয়ে মিশতে। ওই যে দেখছো চেতলার পাশ দিয়ে এক ফালি সরু নদৰ্মা, ওইটেই ছিল যে আদিগঙ্গা, ওকেই বলতে লোকে বুড়িগঙ্গা। তারপর যেদিন কুশী এসে মিশলো গঙ্গার সঙ্গে, স্রোত গেল সরে। ভগীরথের সেই গঙ্গাকে তোমরা বলে হুগলী নদী আর আমরা বলি ভাগীরথী। তখন হুগলীর নামই বা কে শুনেছে, আর কলকাতার নামই বা শুনেছে কে! প্লিনি সাহেবের আমল থেকে লোকে তত শুধু সপ্তগ্রামের পাশের নদীকেই বলতে দেবী সুরেশ্বরী গঙ্গে! তারপর উত্থান আর পতনের অমোঘ নিয়মে যেদিন সাতগাঁ’র পতন হলো, উঠলো হুগলী, সেদিন পর্তুগীজদের কল্যাণে ভাগীরথী নাম হলো গিয়ে হুগলী নদী।
গল্প বলতে বলতে বুড়োরা হাঁপায়। বলে—পড়োনি হুতোম প্যাঁচার নক্সায়—
“আজব শহর কলকাতা
রাঁড়ি বাড়ি জুড়ি গাড়ি মিছে কথার কি কেতা।
হেতা ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে বলিহারী ঐক্যতা,
যত বক-বিড়ালী ব্ৰহ্মজ্ঞানী, বদমাইসির ফাঁদ পাতা—”
চূড়ামণি চৌধুরী আলীপুরের উকীল। বলেন—আরে কিপলিং সাহেবই তো লিখে গিয়েছে—
Thus from the midday halt of Charnock
Grew a city……
Chance-directed chance-erected laid and
Built
On the silt
Palace, byre, hovel, poverty and pride
Side by side……
বড়বাড়ির নতুন মালিকরা সেই সব দিনের কাহিনী জানে না। গড়গড়ায় তামাক খেতে নাকি ওয়ারেন হেস্টিংস আমাদের মতন। বড় বড় লোকদের নেমন্তন্নর চিঠিতে লেখা থাকতো ‘মহাশয় অনুগ্রহ করে আপনার হুকাবরদারকে ছাড়া আর কোনও চাকর সঙ্গে আনবার প্রয়োজন নেই।‘ আর সেই জব চার্নক। বৈঠকখানার মস্ত বড় বটগাছটার নিচে বসে হুঁকো খেতে, আড্ডা জমাতো, এবং সন্ধ্যে হলেই চোর-ডাকাতের ভয়ে চলে যেতে বারাকপুরে। বিয়েই করে ফেললে এক বামুনের মেয়েকে। ডিহি কলকাতায়, গোবিন্দপুর আর সূতানুটীতে বাস করবার জন্যে নেমতন্ন করে বসলো সকলকে। একদিন এল পর্তুগীজরা। এখন তাদের দেখতে পাবে মুরগীহাটাতে। আধা-ইংরেজ, আধা-পর্তুগীজ। নাম দিয়েছিল ফিরিঙ্গী। ওরাই ছিল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর প্রথম যুগের কেরানী। তারাই শেষে হলো ইংরেজদের চাপরাশী, খানসামা আর ওদের মেয়েরা হলো মেমসাহেবদের আয়া। আর এল আরমানীরা। তাদের কেউ কেউ খোরাসান, কান্দাহার, আর কাবুল হয়ে দিল্লী এসেছিল। কেউ এসেছিল গুজরাট, সুরাট, বেনারস, বেহার হয়ে। তারপর চু চুড়াতে থাকলে কতকাল। শেষে এল কলকাতায়। ওদের সঙ্গে এল গ্রীক, এল ইহুদীরা, এল হিন্দু-মুসলমান—সবাই।
এমনি করে প্রতিষ্ঠা হলো কলকাতার। সে-সব ১৬৯০ সালের কথা।
পাঠান আর মোগল আমল দেখতে দেখতে মিলিয়ে গেল। লোকে একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখলে ইন্দ্রপ্রস্থ আর দিল্লী কোথায় তলিয়ে গিয়েছে। তার বদলে এখানে এই সুন্দরবনের জলো হাওয়ার মাটিতে গজিয়ে উঠেছে আর এক আরব্য উপন্যাস। ভেল্কি বাজি যেন। কলকাতার একটি কথায় রাজ্য ওঠে, রাজ্য পড়ে। জীবনে উন্নতি করতে গেলে এখানে আসতে হয়। রোগে ভুগতে গেলে এখানে আসতে হয়। পাপে ড়ুবতে গেলে এখানে আসতে হয়। মহারাজা হতে চাইলে এখানে আসতে হয়। ভিখিরী হতে চাইলে এখানে আসতে হয়। তাই এলেন রায় রায়ান রাজবল্লভ বাহাদুর সূতানুটীতে। মহারাজ নন্দকুমারের ছেলে রায় রায়ান রাজা গুরুদাস এলেন। এলেন দেওয়ান রামচরণ, দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ। এলেন ওয়ারেন হেস্টিংস-এর দেওয়ান কান্তবাবু, এলেন হুইলারের দেওয়ান দর্পনারায়ণ ঠাকুর, এলেন কলকাতার দেওয়ান গোবিন্দরাম মিত্র, উমিচাঁদ—আর এলেন বনমালী সরকার।
এই যার নামের রাস্তায় বসে তোমাদের গল্প বলছি—
চূড়ামণি চৌধুরীর মক্কেল হয় না। কালো কোটটার ওপর অনেক কালি পড়েছে। সময়ের আর বয়েসের। হাতে কালি লেগে গেলেই কালো কোটে মুছে ফেলেন। বাইরে থেকে বেমালুম। কোর্টে যান। আর পুরনো পূর্বপুরুষের পোকায় কাটা বইগুলো ঘাঁটেন। তোমরা তো মহা-আরামে আছো ভাই। খাচ্ছ, দাচ্ছ, সিনেমায় যাচ্ছ। সেকালে সাহস ছিল কারো মাথা উচু করে চৌরঙ্গীর রাস্তায় হাঁটবার? বুটের ঠোক্কর খেয়ে বেঁচে যদি যাও তো বাপের ভাগ্যি। সেকালে দেখেছি সাহেব যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। হাত বেতের ছড়ি। দু’পাশের নেটিভদের মারতে মারতে চলেছে। যেন সব ছাগল, গরু, ভেড়া। আর গোরা দেখলে আমরা তো সাতাশ হাত দূরে পালিয়ে গিয়েছি। ওদের তো আর বিচার নেই। নেটিভরা আর মানুষ নয় তা বলে। রেলের থার্ড ক্লাশে পাইখানা ছিল না ভাই। নাগপুর থেকে আসানসোল এসেছি—পেট টিপে ধরে। কিছু খাইনি—জল পর্যন্ত নয়—পাছে…