তারপর আড়তের ভেতরে লম্বা গুদাম। সেখানে সামনেই কাঁটায় ফেলে ওজন করে কয়াল। বলে—লেখো, এক মণ সাঁইত্রিশ সের তিন কাঁচ্চা
এক পাশে রান্না চড়িয়েছে একজন লোক। বড়-বড় কই মাছ। আস্ত-আস্ত ভাজছে লোহার কড়ায়। গামছা পরে রান্না করছে।
আর বাঁ হাতে ডাবা হুঁকো। বলে-ও ভূষণ, কাঁচা নঙ্কা দিতি পারে?
ভূষণ বলে—কাঁচা নঙ্কা কোথায় পাবো, এ কি ফতেপুর পেয়েছো, এখানে বাজার থেকে কিনতি হয় সব।
—তবে ঝালও তেমনি হবে, কাঁচা নষ্কা না দিলি কইমাছের ঝাল হয়?
এদিকে যে এত পাটের আড়ত হয়েছে তা ভূতনাথের জানা ছিল না। এই সব পাটই বুঝি ননীলালের কলে গিয়ে উঠবে। তারপর সেখান থেকে জাহাজে ভর্তি হয়ে বিলেত যাবে। কী সব ব্যবসাই হলো! কতরকম ব্যবসাই করছে লোকেরা। আর বড়বাড়ির চৌধুরীবাবুরা কিছুই করলে না। আর যা-ও বা কয়লার ব্যবসায় নামতে গেল, তা-ও টিকলো না। কপালের ফের বৈকি!
প্রকাশকে দেখেই নন্দজ্যাঠা খাপ্পা। বলে—এই তোমার কথার ঠিক, আর ওদিকে…তারপর হঠাৎ ভূতনাথকে দেখেই যেন চিনতে পেরেছে। একেবারে রাতারাতি মুখের ভাব বদলে গেল। অনেকক্ষণ ধরে চেয়ে দেখতে লাগলো। বললে—আমাদের অতুল না?
ভূতনাথ একেবারে সোজাসুজি পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায় ঠেকালে। বললে—আপনার সঙ্গে একটা কথা ছিল জ্যাঠামশাই।
একেবারে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলে নন্দজ্যাঠা। বললে—ওরে অতুল আমার—সেই যে দেশ থেকে গেলি একটা খবর পর্যন্ত দিলিনি। তোদের বাড়িটা জঙ্গল হয়ে পড়ে আছে, দেখি আর ভাবি সতীশের কত সাধের বাড়ি। আসল সেগুন কাঠ দিয়ে কড়ি-বরগা করেছিল…সেই বাড়ির কাছে ঘেঁষতে আজ গা ছমছম করে।
নন্দজ্যাঠার চোখও বুঝি সজল হয়ে এল।কী করছিস আজকাল? সতীশ বলতো-ডাকপিওন করে দেবো অতুলকে—তা ডাকপিওন হতে পেরেছিস অতুল?
ভূতনাথ মাথা নিচু করে বললে—ওভারসিয়ারী করছি এখন —বিলবাবু ছিলাম, এই ক’দিন হলো ওভারসিয়ার হয়েছি—এক বাঙালীবাবুর আপিসে…
নন্দজ্যাঠা যেন শুনে ভারী খুশি হলো। বললে—যাক, সতীশের ছেলে মানুষ হলো তাহলে। তোর বাপ দেখে যেতে পারলে খুশি হতো—তা হ্যাঁ রে, কত বেতন পাচ্ছিস?
—এই মাস থেকে কুড়ি টাকা হলে আর কি।
—তা বাপু, এইবার গায়ের বাড়িটা সারিয়ে-সুরিয়ে তোল, জঙ্গল সাফ করাও—বিয়ে-থা করে, আমরা বুড়োর যাবার আগে দেখে যাই—তা যাক, তুই তবু গা ছেড়ে বেরিয়েছিলি বলে মানুষ হলি। তারাপদ সেই পাঠশালার পণ্ডিত হয়েছে, আর সব কেউ কিছু করে না, কেবল বিড়ি টানে বসে-বসে বারোয়ারিতলার মাচায়—আর পূজোর সময় একবার করে যাত্রা করে।
ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে জ্যাঠাইমা ভালো আছেন?
—আর ভালো, রোগ-ভোগ হয়ে সে-ফতেপুর আর নেই আমাদের, ম্যালেরিয়া আরম্ভ হয়েছে, ভদ্দরলোকদের আর থাকা চলবে না ওখানে। ক’ঘর বামুন-কায়েত ছিল, মরে-ঝরে এখন কমে আসছে, বামুনকে ভক্তি নেই—ছোটলোকদেরই প্রতিপত্তি বাড়ছে কেবল দিন-দিন।
আরো অনেক কথা বলতে লাগলো নন্দজ্যাঠা। অনেক অভিযোগ। নন্দজ্যাঠাও যেন সামঞ্জস্য করতে পারছে না সময়ের সঙ্গে। ওখানেও ‘বন্দে মাতরম্ হয়েছে। কী যে সব করে! স্বদেশী করছে। তাঁত করছে। বলে—ইংরেজদের দেশ থেকে তাড়াতে হবে। শুনি আর হাসি। যে রাজত্বে সূর্য অস্ত যায় না-ভূগোলে পড়েছি—তাদের সঙ্গে বিরোধ! ইংরেজরা এসেছে বলে তবু সুখে খেতেপরতে পারছি। আগে কী অরাজক অবস্থা ছিল তোরা কি জানবি! ডাকাতির জ্বালায় রাস্তায় বেরোনো যেতো না। সতীদাহ দেখেছি। আমার মায়ের ঠাকুরমাকে পেছমোড়া করে বেঁধে পুড়িয়ে মেয়েছিল শুনিছি। তা ওই ইংরেজরাই এসে তো সব বন্ধ করলে। আর এখন সেই ইংরেজই আবার খারাপ হয়ে গেল!
ভূতনাথ চুপ করে শুনতে লাগলো। সেই নন্দজ্যাঠা! ঘুণাক্ষরেও একবার রাধার উল্লেখ করলে না! বোধহয় ভুলেই গিয়েছে। অথচ ভূতনাথ তো ভুলতে পারেনি রাধাকে।
বেলা হয়ে যাচ্ছিলো।
নন্দজ্যাঠা বললে—তা এবার তোর বিয়ের একটা প্রস্তাব করি অতুল—কি বল—ভালো মেয়ে আছে স্বরূপগঞ্জের ভুবন চৌধুরীর, দেবে থোবে ভালো, শহুরে জামাইও খুজছে। আমাকে বলে রেখেছে অনেক দিন থেকে।
ভূতনাথ হঠাৎ বললে—ওই সম্বন্ধেই কথা ছিল আপনার সঙ্গে।
–কী কথা? বিয়ের কথা?
তবু কেমন যেন লজ্জা করতে লাগলো ভূতনাথের। হাজার হোক, গুরুজন তো!
–বল না, লজ্জা কিসের?
ভূতনাথ দ্বিধা-সঙ্কোচ কাটিয়ে জিজ্ঞেস করলে—আচ্ছা, আপনি কি জানেন, আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল?
নন্দজ্যাঠা যেন আকাশ থেকে পড়লো। প্রথমটা কিছু হাঁ-না বলতে পারলে না। তারপর বললে–কিন্তু তুই জানলি কী করে, কার কাছে শুনলি?
ভূতনাথ বললে—আমি জেনেছি, সত্যি কি না বলুন?
নন্দজ্যাঠা কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগলো। আড়তের টিনের চালের তলায়, চারিদিকের পাটের গুদামের মধ্যে যেন দম বন্ধ হবার উপক্রম হলো। কোঁচার খুটটা দিয়ে বুকটা মুছতে লাগলো বার কয়েক। তারপর বললে—কিন্তু তোর তত জানবার কথা নয় অতুল—তোর তখন চার-পাঁচ কি ছ’ বছর বয়েস।
—সে কি বলরামপুরে?
নন্দজ্যাঠা বললে–হ্যাঁ, বলরামপুরে, সেবার বাবুদের নতুন মহাল কেনা হলো ওখানে। তাই তোর বাপকে নিয়ে গিয়েছিলাম প্রজাবিলি করতে..তুইও সঙ্গে ছিলি।
–সে কি রামহরি ভট্টাচার্যের নাতনীর সঙ্গে?
–হ্যাঁ, কিন্তু আমরা তো প্রথমে বুঝতে পারিনি…
—সে মেয়ের কি বয়সে তখন দু’মাস?
-হ্যাঁ, কিন্তু—নন্দজ্যাঠা আরো অবাক আরো অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছে।