কত রাত্রে যে ব্রজরাখাল শুলো, কখন ঘুমোলো আর কখনই বা উঠলে কে জানে। ভূতনাথ উঠে দেখলে ব্রজরাখাল ততক্ষণে রান্না ঘরে গিয়ে রান্নায় ব্যস্ত। সকাল বেলা বাড়িটার চারদিকে চেয়ে দেখলে এক পলক। দক্ষিণ দিকে জানালা দিয়ে দেখা যায় মস্ত বড় বাগান। মাঝখানে একটা পুকুর।
ব্ৰজরাখাল এল হঠাৎ। বললে—এটা খেয়ে নাও দিকিনি বড়কুটুম–
এক কাসি ফ্যানে-ভাত। ব্রজরাখাল বললে–খেয়ে দেখো খাঁটি ঘি দিয়েছি—তোমাদের ফতেপুরের ঘিয়ের চেয়ে ভালো–
ব্ৰজরাখালের ব্যবহারে ভূতনাথ অবাক হয়ে গেল। কোথাকার কে নন্দজ্যাঠা-তার মেয়ে রাধ—সেও তো আর বেঁচে নেইকী-ই বা সম্পর্ক—অথচ এমন করে আপন করে নিতে পারে পরকে! ভূতনাথ বললে—তুমি খাবে না?
—আমার ভাত ওদিকে তৈরি—এখনি ন’টার ঘণ্টা পড়বে— আমিও আপিসে বেরুবোহাঁটতে হাঁটতে আপিসে দশটার মধ্যে পৌঁছে যাবো ঠিক—তারপর ফিরতে যার নাম সেই খানিক পরেই খাওয়া দাওয়া সেরে তৈরি হয়ে পড়লো ব্রজরাখাল। সেই ধুতির কোঁচাটা কোমরে গুজে আলপাকার কোটটা চড়ালে গায়ে। তারপর যাবার আগে বললে—এইটে রাখো তত বড়কুটুম—এই পুরিয়াটা–
—কী এটা—ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে।
—হোমিওপ্যাথিক ওষধর পুরিয়া, যদি কেউ এসে ওষুধ চায়— বলে–মাস্টারবাবু কোন ওষুধ রেখে গিয়েছে—ত দেবে এইটে। আমি বলেছি কিনা বংশীকে যে, আমার সম্বন্ধীর কাছে রেখে যাবে–
ভূতনাথের বিস্মিত দৃষ্টির দিকে চেয়ে ব্ৰজরাখাল হো হো করে হেসে উঠলো। বললে—চেয়ে দেখছে কি—ডাক্তারিও জানি তোমার বোনকেই শুধু যা বাঁচাতে পারলাম না—আমার রুগীদের মধ্যে ওই একজনই যা মরে গিয়েছে—নইলে এ পাড়ায় আমার খুব নাম-ডাক হে—বলে হন্ হন্ করে বেরিয়ে গেল। আবার ফিরে এল খানিক পরে। বললে—একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি—যদি রাস্তায় বেরোও তত বেশি দূর যেও না—নতুন মানুষ হারিয়ে যাবে —আর একটা কথা, তুমি ভেবো না, তোমার চাকরিরও
একটা চেষ্টা করছি—তবে বাজার বড় খারাপ কি না—
ব্ৰজরাখাল চলে গেল। এ যেন একেবারে অন্য মানুষ। কখন সে ভাত রাঁধলে নিজের হাতে, কখন খেলে—আবার আপিসেও চলে গেল—ন’টার ঘণ্টা পড়বার সঙ্গে সঙ্গে। কাজের মানুষ বটে! ঘর ছেড়ে আর একবার বাইরে এসে দাঁড়ালো ভূতনাথ। কত বড় বাড়ি। এখানে দাঁড়ালে বাড়ির বাইরে আর কিছু দেখা যায় না। বড়বাড়িটার ভেতরে যে কোনও মানুষ বাস করে বাইরে থেকে তা। বোঝবার উপায় নেই। শুধু বাইরেই যা তোড়-জোড়-নড়া-চড়া হাঁক-ডাক। চারদিকে চেয়ে চেয়ে দেখতেই বেলা বেড়ে গেল। আস্তে আস্তে রান্না বাড়ির দিকে গেল। পাশেই সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি দিয়ে নেবে স্নান করবার জায়গা। নতুন জলে স্নান করা উচিত নয়। মুখ হাত পা ধুয়ে ওপরে রান্নাঘরে ঢুকলো। খাবার ঢেকে রেখেছে ব্রজরাখাল। এক হাতে অনেক রান্না করেছে বটে। ডাল, ঝোল, ভাত।
সবে থালা বাটি গেলাশ সাজিয়ে বসেছে খেতে—এমন সময় দরজার পাশে কে যেন উঁকি দিলে।
—কে? ভূতনাথ দরজার দিকে মুখ করে জিজ্ঞেস করলে। লোকটা কিন্তু সামনে এল না। আড়াল থেকে বললে—আপনি খান আজ্ঞে-আমি আসবো’খন পরে—
লোকটা সত্যি সত্যিই পরে এল। ভূতনাথ ততক্ষণে খাওয়া-দাওয়া সেরে বাসন কোসন মেজে রান্নাঘর ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে ফেলেছে।
এসে বললে—আপনি মাস্টার বাবুর শালা
রোগ ক্ষয়-ক্ষয় চেহারা। তেল-চকচকে তেড়ি কাটা মাথা। আধ-ময়লা ধুতিটা কোঁচা করে কোমরে গোঁজা। বললে—আমি বংশী
ভূতনাথ ওষুধের পুরিয়াটা দিয়ে জিজ্ঞেস করলে—অসুখ কার
-আজ্ঞে চিন্তার
–চিন্তা কে?
—ছোটমা’র ঝি—
–কী অসুখ?
–ম্যালেরিয়া-ডাক্তারবাবু তো বলেন ম্যালেরিয়া—দেশে গিয়ে অসুক বাধিয়ে এনেছে, আমার বোন হয় সে, এই ছোট বেলা থেকে কলকাতায় আছে কিনা, দেশে-গাঁয়ের জল আর সহ্য হয় না পেটে, আমার বিয়েতে সেবার গেল দেশে, বললুম অতো করে পুকুর ঘাটে জল ঘাঁটিসনে চিন্তা, তা কি শুনবে—ছোটমা’র আদর পেয়ে পেয়ে কথার বড় অবাধ্য হয়ে উঠেছে আজ্ঞে—এখন আমার ভোগান্তি—ছোটমা’র ভোগান্তি-মাস্টারবাবুর ভোগান্তি –এখন এক গেলাশ জল খেতে গেলে ছোটমা’কে নিজে গড়িয়ে খেতে হয়–
তারপর চলে যেতে গিয়ে থামলো বংশী—ছোটমা বলে বটে যে বংশী তোর নিজের মায়ের পেটের বোন, তুই বউবাজারের শশী ডাক্তারকে দেখা। আমি বলি—থাক। মাস্টারবাবু কি ছোট ডাক্তারবড়বাড়ির সমস্ত লোক ভালো হয়ে যাচ্ছে ওর ওষুদ খেয়ে—তা আজ্ঞে ছোটমা’র দেখুন কি জ্বলা, এই সাবু আনন। মিছরি আনো—ফলফুলুরি আনোহান্ আনো ত্যান্ আনোতা খরচার বেলায় তো সেই ছোটমা।
বংশী গলা নিচু করলো এবার। বললে—এ-বাড়ির সবার যে আজ্ঞে হিংসে আমাদের দুজনের ওপর কেউ তো ভালো চোকে দেখে না কি না—
ভুতনাথ জিজ্ঞেস–সের হিংসে—হিংসে কেন–
—ওই যে মধুসূদনকে দেখছেন—
–কে মধুসূদন? ভূতনাথ মধুসূদন কেন কাউকেই এখনও দেখেনি।
বংশী বললে-তোষাখানায় একদিন যাবেন—ওই মধুসূদনই তোষাখানার সর্দার কিনা—আমাদের পাশের গায়ে বাড়ি হুজুরবললে বিশ্বেস করবেন না, আমার আপন পিসীর সম্পর্কে ভাসুর হয় আজ্ঞে——আর তার এই কাণ্ড-বুঝুন—
—কী কাণ্ড–
—সে অনেক কথা হুজুর—অনেক কথা বলে বসলে বংশী। ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে গলা আরো নিচু করলো।
বংশীর অনেক অভিযোগ। এত বড় বাড়ি—কত পুরুষ আগে থেকে বংশপরম্পরায় কত দাস-দাসী, কত লোকজন আসা-যাওয়া করেছে। কত বংশের ভরণ-পোষণ জীবিকা নির্বাহ নির্ভর করেছে এই চৌধুরী পরিবারের দান-ধ্যান ধর্মানুষ্ঠানের সূত্রে। গ্রাম-কে-গ্রাম ঝেটিয়ে এসেছে চাকরির চেষ্টায় এখানে। উঠেছে এসে এই চৌধুরী বাড়িতে। ওই মধুসূদন এখন তোষাখানার সর্দার। ওর কোন্ পূর্ব পুরুষ কবে কী সূত্রে এসে আশ্রয় পেয়েছিল কর্তাদের আমলে। তারপর সংসারের আয়তন বেড়েছে, আয়োজন বেড়েছে, আয় বেড়েছে, ধনে জনে প্রতিষ্ঠায় প্রতিপত্তিতে চৌধুরী বংশের প্রসার বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছিয়েছে। আর সঙ্গে সঙ্গে আত্মীয়, স্বজন, পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, পারিষদ, মোসাহেব, দাস দাসী—তাদের প্রয়োজনও বৃদ্ধি পেয়েছে। কোন্ সুদূর বালেশ্বর, কটক, বারিপদা জেলা থেকে মধুসূদনের পূর্ব পুরুষের আত্মীয় পরিজন-গ্রামবাসীরা এসে জুটেছিল এখানে। এসে ভার নিয়েছিল এক একটা কাজের। ভিস্তিখানা, তোষাখানা, রান্নাবাড়ি, কাছারিবাড়ি, বৈঠকখানা সেরেস্তা অলঙ্কৃত করেছে। পূজোয়, পার্বণে, উৎসবে, আনন্দে যোগ দিয়েছে পরিবারের একজনের মতো। দেশে গিয়েছে, বিবাহ করেছে—আবার ফিরেও এসেছে, দেশে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে মাসে মাসে। এ-সংসারে তাদের প্রয়োজন যেমন অপরিহার্য, এ-সংসারও তেমনি তাদের জীবিকার পক্ষে অনিবার্য। এ-পরিবারের কেউ-ই পর নয়। সাধারণ পর্ব উপলক্ষে, দোল-দুর্গোৎসবে তারা নতুন কাপড় পেয়েছে, পার্বণী পেয়েছে। শুধু তারা কেন, একটা কুকুর-বেড়ালেরও ন্যায্য অধিকার আছে এ-বাড়ির ওপর। এখানে কেউ অনাত্মীয় নয় সবাই আপন—সবাই অনস্বীকার্য!