ব্রজরাখাল সোজা চললো সামনে। আসল বড় বাড়িটা ডানদিকে রেখে, পেছনের পুব-পশ্চিম বরাবর লম্বা বাড়িটার নিচে এসে দাঁড়ালো। একতলায় সার-সার তিনটে পাল্কি। তারপর ঘোড়ার গাড়ি। তার ওপাশে কয়েকটা ঘোড়া। মুখের দু’পাশে দড়ি দিয়ে বাঁধা। ঘোড়াগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শক্ত ইটের মেঝের ওপর ঘন ঘন পা ঠুকছে। তারই পাশ দিয়ে সরু সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে ব্রজরাখালের পেছনে ভূতনাথ চললো।
ওপরে ডানদিকে সার-সার ঘর। চাকর-বাকর ঘোরা ফেরা করছে। মেঝের ওপর ময়লা বিছানা গোটানো পড়ে রয়েছে পর পর। নাথু সিং তখন নিজের ঘরে লেঙটু পরে পেতলের থালায় একতাল আটা মাখছে।
সব পার হয়ে পুবদিকের একেবারে শেষ ঘরটায় এসে দরজার তালা খুললো ব্রজরাখাল। ঘরে ঢুকে বললে—এই হলো আমার ঘর—আর এর পাশের ঘরটাও তোমায় দেখাই চলো—বলে পাশের আর একটা ঘর খুললে।–এটাও আমারই, কিন্তু আমার আর কে আছে বলো—খালিই পড়ে থাকে—যতো রাজ্যের জঞ্জাল জমে আছে–তুমিই না হয় এ-ঘরটায় থেকো
তারপর বললে— বিছানা-টিছানা তো কিছু আনননি দেখছি –তাতে কিছু অসুবিধে হবে না, কিন্তু তুমি হলে আবার বড়কুটুম কিনা, একটু খাতির-যত্ন না করলে নিন্দে হবে— কী বলো–
ব্ৰজরাখাল নিজের তোষক বিছানা পেতে দিলে ভূতনাথের জন্যে। বললে—আমার জন্যে তুমি ভেবো না, আমি সন্নিসী মানুষ—আমার ও-সব কিছু লাগে না।
সত্যিই বজ্ররাখাল সন্ন্যাসী মানুষ। আপিসের ধুতি আলপাকার কোট খুলে একটা গেরুয়া রং-এর ছোট ফতুয়া পরলে। আর গেরুয়া ধুতি-কাছা কোঁচাহীন। ভূতনাথের এতক্ষণে নজরে পড়লো—দেয়ালের গায়ে একটা মস্ত বড় সাধুর ছবি। ফুলের মালা ঝুলছে ছবির গায়ে। নিচে কুলুঙ্গীর ওপর কয়েকটা বই–অনেকটা গীতার মতন চেহারা। ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলেও কার ছবি ব্রজরাখাল?
—প্রণাম করে ওঁকে—বলে ব্রজরাখাল নিজেই আগে সভক্তি প্রণাম করলে। তারপর মাথা তুলে বললে—আমার গুরুদেবপরমহংসদেব—এখন দেহরক্ষা করেছেন
খানিক থেমে বললে–সারাদিনটাতো উপোষ-আজ রাত্রে কী খাবে বলো তো বড়কুটুম—আমি তের মাছ মাংস খাইনে—অড়র ডাল ভাতে দিয়ে দেবো’খন—আর গাওয়া ঘি আছে ব্রিজ সিং-এর দেশ থেকে আনা-সঙ্গে একটু আলুর দম করি, কী বলো–
ভূতনাথের মনে আছে সেই বিকেলবেলা ব্রজরাখাল নিজের হাতে উনুনে আগুন দিয়ে ভাত চড়িয়ে দিলে। তারপর এক ঘণ্টার মধ্যে রান্না সেরে, খাওয়া-দাওয়া করে নিয়ে বললে—এইবার শুয়ে পড়ো আরাম করে—আমি ততক্ষণ ছেলেদের পড়িয়ে আসি–
ব্ৰজরাখাল ধুতি চাদর পরে ছেলে পড়াতে গেল। ভূতনাথ নিজের বিছানায় শুয়ে আবোল-তাবোল নানা কথা ভাবতে লাগলো সেদিনকার সেই ব্ৰজরাখাল-বর-বেশী ব্ৰজরাখাল—এ হঠাৎ এমন অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছে যেন। মাছ-মাংস খায় না। কোন সাধুর শিষ্য! কোথাকার পরমহংসদেব। কে তিনি? কেনই বা এই চাকরি করছে সে? কার জন্যে? ঘুমের মধ্যে কত রকম শব্দ কানে আসতে লাগলো। একতলায় ঘোড়াগুলো শক্ত সিমেন্টের মেঝের ওপর পা ঠুকছে। গেটের ঘড়িঘরে ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজছে। আশে পাশের ঘর থেকে চাকর-বাকরদের হাঁক-ডাক শোনা যায়। কোথা থেকে যেন কালোয়াতী গানের সুর ভেসে আসছে। ইমনকল্যাণের খেয়াল। সঙ্গে তবলা। রাত বাড়তে লাগলো। রাধার কথা মনে পড়লো। এ-সংসার তো তারই। কপালে নেই তার। হয় তো রাধা মরে গিয়েছে বলেই ব্রজরাখালের এই বৈরাগ্য।…ননীর সঙ্গে দেখা করলে হয় একবার। খুব চমকে যাবে। ননী কোন কলেজে ভর্তি হয়েছে কে জানে। প্রকাশ ময়রা জিলিপী ভাজতে জানে বটে। জিলিপী করা কি যার-তার কাজ। অমন পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে…কিন্তু গো-ব্রাহ্মণে ভক্তি আছে বটে প্রকাশের। এই বাজারে দুটো পয়সা কে ছাড়ে অমন!…অনেক রাত্রে ঘুমের মধ্যে মনে হলো যেন গেট খোলার শব্দ হলো। ঘোড়ার পায়ের টগবগ শব্দ–একটা গাড়ি যেন এসে দাঁড়ালো নিচের একতলায়। লোকজনের কথাবার্তা। চাকরদের ছুটোছুটি।
কেমন যেন ভয় করতে লাগলো ভূতনাথের। নতুন জায়গা, নতুন বিছানা। তার মধ্যে যেন কেমন একটা অসহ্য অস্বস্তিতে বিছানা ছেড়ে উঠলো। যেন গলা শুকিয়ে এসেছে। ডাকবে নাকি ব্ৰজরাখালকে। বাইরে ফুটফুটে জ্যোৎস্না। ঘরের ভেতরে চাঁদের আলো এসে পড়েছে। মনে পড়ে গেল ফতেপুরের কথা। কাল এই সময় সে ছিল ফতেপুরে আর আজ এই কলকাতায়। ফতেপুরের আকাশেও এমনি চাঁদের আলো এখন। গাঙের ধারে কুঁচগাছের ঝোপে জঙ্গলে আচমকা ছাতার পাখীর পাখা-ঝাপটানির শব্দ হচ্ছে। মাঝরাত থাকতেই হর গয়লানীর মেয়ে বিন্দী উঠেছে মল্লিকদের বাগানে আম কুড়োতে। মালোপাড়ায় বেহুলার ভাসান গানের ঢোলের আওয়াজ অস্পষ্ট ভেসে আসছে। কত দেশ কত বিচিত্র মানুষ—এক দেশের সঙ্গে আর এক দেশের মিল নেই—কিন্তু আকাশ একটা যে-আকাশ কলকাতার মাথায় —সে-আকাশ ফতেপুরের মাথাতে—সে-আকাশ সর্বত্র। এক শ’ বছর আগেও এই আকাশ ছিল—এক শ’ বছর পরেও থাকবে…
ভূষণ কাকা বলতো—তুই থাম তো ভূতে—যতে সব বিদঘুটে বিদঘুটে ভাবনা–
মল্লিকদের তারাপদ বলতো—ও বোধহয় বড় হয়ে কবি হবে কাকা—মধু কামারের মতো পালা-যাত্রার গান বাঁধবে—
কবি ভূতনাথ হয়নি। হয়েছে শেষ পর্যন্ত ওভারসিয়ার! কিন্তু সে-সব কথা যাক, সেই মাঝরাত্রে ভূতনাথ ডাকতে লাগলো–ব্ৰজরাখাল—ও ব্রজরাখাল–ও শব্দটা কিসের। উত্তর নেই। মাঝখানের দরজাটা ভেজানো ছিলো। সেটা খুলতেই ভূতনাথ অবাক হয়ে দেখলে ঘরের মাঝখানে যোগাসনে বসে আছে ব্রজরাখাল। আবছা আলো-অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা যায় না—কিন্তু মনে হলো ব্রজরাখাল যেন তন্ময় হয়ে আছে কোন দুশ্চর তপস্যায়। বাহ্যজ্ঞানশূন্য। সামনের দেয়ালে সেই সাধুর ছবিটা ঝুলছে। শিরদাঁড়া সোজা-চোখ দুটিও বোজা-শরীরে প্রাণস্পন্দনের লেশমাত্রও নেই বুঝি। ভূতনাথ আবার ডাকলে—ব্রজরাখালএবারও উত্তর নেই। ভূতনাথের মনে হলো—ব্রজরাখাল এখন যেন আর সামান্য ব্রজের রাখাল নয়, মথুরায় গিয়ে রাজা হয়ে বসেছে—রাধার নাগালের বাইরে ফতেপুরের নলজ্যাঠার এগারো বছর বয়সের সেই নগণ্য মেয়ে রাধা!
০৩. সকাল বেলা ব্রজরাখালের ডাকে
সকাল বেলা ব্রজরাখালের ডাকেই ঘুম ভাঙলো। কিন্তু ব্ৰজরাখাল ততক্ষণে স্নান করে তৈরি। বললে—ওঠো হে বড়কুটুম— এত দেরি করলে চলবে না, এখানে ঘড়ি ধরে সব কাজ হয়—এ কলকাতা—তোমার গিয়ে ফতেপুর নয়—