একটা বেঁটে কালোপানা লোক গাছতলায় বসে ছিল। ডাকলে–আসো বাবু আসো–
ভূতনাথকে বাবু বলে ডাকা এই বুঝি প্রথম। মনে হলো— তার হাব-ভাব দেখে বুঝতে পেরেছে নাকি যে গ্রাম থেকে আজ নতুন এসেছে ভূতনাথ।
—তোমার বাসনা সিদ্ধ হবে বাবু, সিদ্ধ হবে–বলতে বলতে এক কাণ্ড করে বসলো লোকটা। বলা নেই কওয়া নেই, কড়ে আঙুলে সিঁদুরের ফেঁটা নিয়ে লাগিয়ে দিলে ভূতনাথের কপালে। বললে—সিদ্ধিদাতা গণেশের পায়ে কিছু প্রণামী দাও বাবু—যাত্রা শুভ হবে—মনবাঞ্ছা পূরণ হবে–
ভূতনাথ এতক্ষণে ভালো করে দেখলে। বটগাছটার তলায় অনেকখানি জায়গা জুড়ে ইটের উচু বেদী বাঁধানো। তারই ওপর নানা জানা-অজানা দেব-দেবীর মূর্তি ছড়ানো। শুধু সিদ্ধিদাতা গণেশ নয়। কালী, শিব, দুর্গা, মনসা, জগদ্ধাত্রী পুতুলের মতন মাপের সব দেবতামণ্ডলী। ফুল, বেলপাতা, সিঁদুর আর অসংখ্য
আধলা আর পয়সা ছড়ানো চার পাশে।
লোকটা আবার বলতে লাগলো—কপালে রাজটীকা আছে বাবু—অনেক পয়সা হবে—-অনেক সুখ হবে—বাবুর তিনটা বিবাহ হবে—
গড় গড় করে লোকটা অনেক সুসংবাদ শুনিয়ে গেল। হাসি পেলে ভূতনাথের। তিনটে বিয়ে। মরেছি। চাকরি-বাকরি নেই, খাওয়াবো কি। ভূতনাথ পাশ কাটিয়ে চলে আসছিল। বেলা হয়ে আসছে। স্নান নেই, খাওয়া নেই, ঘুম নেই, মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে।
—প্রণামী দাও বাবু, প্রণামী-গণেশের ফোঁটা নিলে প্রণামী দিলে না—মহাপাতক হবে—দেবতার শাপ লাগবে
বোধহয় রেগে গেল পূজারী বামুন। টাক থেকে একটা আধলা বার করে দিলে ঠাকুরের পায়ে, তারপর গড় হয়ে প্রণাম করলে বেদীতে মাথা ঠেকিয়ে। দেবতা সন্তুষ্ট হলেন কিনা কে জানে কিন্তু পূজারী বামুনের মুখ প্রসন্ন হলো।
হাতে একটা ফুল দিয়ে পূজারী বললে-বলে-নমামিহাত জোড় করে ভূতনাথও বললে—নমামি—
—সর্বসিদ্ধিদাতাঃ
–সর্বসিদ্ধিদাতাঃ
—বিনায়কং
—বিনায়কং—
আরো কী কী বলেছিল মনে নেই। লম্বা সংস্কৃত শ্লোক। ছাড়া পেয়ে ভূতনাথ গলি দিকে চলতে-চলতে বাড়ির নম্বরগুলো দেখতে লাগলো। পকেট থেকে ব্রজরাখালের চিঠিটা আর একবার বার করলে ভূতনাথ। পাঁচ নম্বর-বনমালী সরকার লেন। এক নম্বর, দু’ নম্বর করে—পাঁচ নম্বর বাড়িটা দেখেই চমকে গেল ভূতনাথ। এত বড় বাড়ি! এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত সমস্তটা ঘুরে দেখে নিলে একবার। এ-বাড়ির নম্বর যে পাঁচ, সে-সম্বন্ধে আর কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু তবু সন্দেহ হলে। এই ব্রজরাখালের বাড়ি। এখানে থাকে নাকি ব্রজরাখাল!
সামনে লোহার গেট খোলা। কিন্তু বিরাট এক যমদূতের মতো চেহারার দারোয়ান বন্দুক উচিয়ে পাহারা দিচ্ছে। বুকে মালার মতো গুলী গুলো সাজানো।
সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরে চেয়ে দেখতে ভয় হলো। বলা নেই– কওয়া নেই–অমনি ভেতরে গিয়ে ঢুকলেই হলো নাকি। বাড়িটার উল্টো দিকে অনেকগুলো বাড়ি। একটা বাড়ির সামনে ছোট এক ফালি সিমেন্ট বাঁধানো বোয়াক। বসলো সেখানে ভূতনাথ। সেই সকাল থেকে হাঁটছে। পা দুটো বুঝি ব্যথা করে না। দেয়ালে পিঠ দিয়ে হেলান দিলে একটু। বনমালী সরকার লেন খুব বড় রাস্তা নয়। ট্রাম নেই এ-রাস্তায়। তবু লোকজন চলাচল আছে খুব। আস্তে আস্তে দুপুর গড়িয়ে এল। রাস্তাটা যেন একটু নিরিবিলি হয়ে আসছে। ভূতনাথের সমস্ত শরীরটা যেন ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে এল। একবার মনে হলো ফিরে যায় সেই জিলিপীর দোকানে প্রকাশ ময়রার কাছে। একটা রাত তো থাকা যাবে তবু সেখানে। তারপর কাল তাকে সঙ্গে নিয়ে এলেই চলবে। প্রকাশ লোকটা ভালো। ভগ্নিপতির দেশের লোক শুনে জিলিপীর দাম নেয়নি।
একটা ঘড়ঘড় শব্দে ঘুম ভাঙলো ভূতনাথের। কখন সেই কঠিন রোয়াকের ওপর ঘুমিয়ে পড়েছিল মনে নেই। সামনে দিয়ে একটা গাড়ি যাচ্ছে নজরে পড়লো। ঘোড়ায় টানছে গাড়িটা। চ্যাপটা চেহারার গাড়ি। কিন্তু পেছনের একটা অসংখ্য ফুটোওয়ালা নল দিয়ে ঝিরঝির করে জল পড়ছে। ধুলোর ওপর জল ছিটিয়ে দিচ্ছে। ধুলো ওড়া বন্ধ হঝে। কিন্তু খোয়ার রাস্তার ওপর গাড়ির লোহার চাকা লাগতে কী বিকট শব্দই না হচ্ছে।
উঠলো ভূতনাথ। সেই প্রকাশের জিলিপীর দোকানেই ফিরে যেতে হবে শেষ পর্যন্ত। বামুনের ওপর ভারি ভক্তি প্রকাশের। প্রকাশ শুধু চাল আর জল দিয়ে হাঁড়ি চাপিয়ে দেবে উনুনে, আর ভাত হলে নাবিয়ে নেবে ভূতনাথ। ময়রার এটো বামুনকে খাইয়ে মহাপাতক হবে নাকি সে। যে-রাস্তা দিয়ে এসেছিল ভূতনাথ, আবার সেই রাস্তা দিয়েই চলতে হয়।
—এ কী বড়কুটুম না—
চেনা গলার আওয়াজ পেয়ে ভূতনাথ আশে-পাশে সামনে পেছনে চেয়ে দেখলে। চেনা মুখ কেউ নেই। কে তবে ডাকলে তাকে। কিন্তু সামনের গোঁফ দাড়িওয়ালা লোকটাই যে ব্ৰজরাখাল
একথা কে বলবে।
ব্ৰজরাখাল বললে—কখন এলে?
–সকাল বেলা। বললে ভূতনাথ।
-–আচ্ছা মুশকিল তো, সেই সকাল থেকে এই বিকেল পর্যন্ত রাস্তায় কাটিয়েছে। নাকি? কী কাণ্ড দেখোদিকিনি—একটা চিঠি দিতে হয় তো আসবার আগে কিছু খাওয়া-দাওয়া হয়নি বোধহয়
সারাদিন হরিমটর—কপালে কী?
ভূতনাথ কপালে হাত দিয়ে মুছতেই হাতের পাতায় সিঁদুর লেগে গেল। বললে—গণেশের ফোটা
–ওই নরহরি দিয়েছে বুঝি——দেখোদিকিনি, ঠিক টের পেয়েছে, তুমি নতুন এসেছে। গা থেকে—চলল—এখন আমার সঙ্গে যদি দেখা না হতে-টানতে টানতে নিয়ে এল ব্রজরাখাল বাড়ির ভেতর।
ব্রিজ সিং আপত্তি করলে না। ব্ৰজরাখাল ভূতনাথকে নিয়ে সোজা ভেতরে ঢুকলো। বিরাট বাড়ি। কোথায় কোন্ দিকে কে থাকে, কোথায় রান্না হয়, কে কোথায় খায়। অসংখ্য লোক ঘোরাফেরা করছে। কেন করছে কেউ বলতে পারে না।