পিসীমা’র পেতলের ঘটিটা আর রূপোর গোট ছড়াটা হর গয়লানীর কাছে বন্ধক রেখে বাড়ির দরজায় তালা চাবি লাগিয়ে ভূতনাথ রাত থাকতে বেরিয়ে পড়েছে পায়ে হেঁটে। তারপর সকালবেলা এই কলকাতা। রেলের টিকিট কিনে, বাকি দুটো টাকা রয়েছে। টাকা দুটো সাবধানে টাকে পুরে নিয়ে ভূতনাথ শেয়ালদা’ স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়ালো।
০২. ১৬৯০ সালের জব চার্নকের কলকাতা
১৬৯০ সালের জব চার্নকের কলকাতা নয়। বিংশ শতাব্দীর ও শুরু হয়নি তখন। চৌধুরীদের লাইব্রেরী ঘরে সে-কলকাতার ছবি দেখেছে ভূতনাথ। করফিল্ড সাহেবের ছবির বইতে চৌরঙ্গীর সেই ছবি। ১৭৮৭ সালের চৌরঙ্গী। এর্দোপড় পুকুর চারদিকে। ছই ঢাকা গরুর গাড়ি চলেছে চৌরঙ্গী দিয়ে। লোক চলেছে উটের পিঠে চড়ে। তারই পাশাপাশি আবার সঙ্গীন উঁচু করে সৈন্যরা প্যারেড করতে করতে যাচ্ছে। এখন ভাবলে হাসি পায়।
অথচ যে-দিন ভূতনাথ শেয়ালদা স্টেশনে এসে প্রথম ট্রেন থেকে নেমেছিল—সে-শেয়ালদা’র সঙ্গে আজকের শেয়ালদা’রও কোনো মিল নেই। মনে আছে—ভূতনাথ স্টেশন থেকে বাইরে এসে বৈঠকখানা বাজারের সামনের ফুটপাথে এসে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো। ভাবতে লাগলো কোথায় কোন দিকে যাওয়া যায়। ব্ৰজরাখাল বলে দিয়েছিল-সোজা পশ্চিম দিকে যেতে। পশ্চিম দিকের রাস্তা দিয়েই চলতে লাগলো ভূতনাথ।
কিন্তু ঠিক পথেই চলেছে কিনা কে জানে। এতে লোক একসঙ্গে কখনও দেখেনি সে। ঘোড়ার গাড়ির কী বাহার। ঘোড়াগুলোর মাথার দু পাশে কানের দিকে ছোট ছোট ঝালর লাগানো। কারো কারো গলায় ঠুংঠুঙি বাজছে তালে তালে। হৈ হৈ করতে করতে ছুটেছে। একটা গাড়ি যেমন-ইচ্ছে একবার রাস্তার ডাইনে, একবার বাঁয়ে হাঁকিয়ে চলেছে। সামনে কে একজন পড়েছিল—চাবুক দিয়ে বেদম মেরে পলকের মধ্যে উধাও হয়ে গেল।
বুক কাঁপতে লাগলো ভূতনাথের। তাকেও যদি মারে কেউ। সরে এসে দাঁড়ালো রাস্তার ধারে গা ঘেঁষে।
দুটো ঘোড়ার গাড়ি টেক্কা দিতে দিতে চলেছে। ঘোড়ার লাগাম ধরে গাড়োয়ান দুটো চিৎকার করছে-উ-উ-উ-উ-
এক-একবার মনে হয় বুঝি ধাক্কা লাগলে ট্রামগাড়ির সঙ্গে। কিন্তু লাগলো না। উ-উ-উ-উ-করতে করতে গাড়োয়ান দুটো দাঁড়িয়ে উঠে চালাচ্ছে গাড়ি। কে আগে যাবে—
একদৃষ্টে ওই দিকে চেয়ে চলতে গিয়ে হঠাৎ হুড়মুড় করে পড়লো ভূতনাথ। যতো রাজ্যের জঞ্জালের পাহাড় জমে ছিল রাস্তার ওপর। একগাদা ময়লার ওপর পড়ে আবার উঠে দাঁড়ালো। সবাই দেখছে তার দিকে। ভূতনাথ মাথা নিচু করলো। সবাই হয় তত ভাবছে—নতুন কলকাতায় এসেছে। ভারি লজ্জা হলো। সকলের দৃষ্টি এড়াবার জন্যে পাশের এক গলির মধ্যে ঢুকলো সে। একটা খাবারের দোকানের সামনে গরম-গরম জিলিপী ভাজছে একটা লোক। ভূতনাথ খানিকক্ষণ দেখলে চেয়ে চেয়ে।
দোকানদার বললে—কী দেখছো গা ছেলে–?
ভূতনাথ লোকটার দিকে চেয়ে দেখলে। আদুড় গা। বড় উনুনের ওপর বিরাট একটা কড়া চাপিয়েছে। নারকোল মালার তলা দিয়ে মশলা ছাড়ছে হাতটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একিয়ে বেঁকিয়ে, আর হলদে-হলদে জিলিপীগুলো ভেসে উঠছে গরম ঘিয়ের ওপর। লোকটা আবার বললে–হাঁ করে কী দেখছে। গা ছেলে
—জিলিপী ভাজা দেখছি তোমার—বললে ভূতনাথ।
—দেখো না অমন করে জিলিপীর দিকে—যারা খাবে তাদের পেট কামড়াবে যে—সরে যাও ভাই-পয়সা আছে পকেটে?
–পয়সায় ক’টা করে—জিজ্ঞেস করলে ভূতনাথ। ক্ষিধেও পেয়েছে বেশ। খেলে হয়। এক পয়সার নিলে। চারটে করে পয়সায়। তা হোক—এ তো আর ফতেপুর নয়। কলকাতা মাগগি-গণ্ডার দেশ। বললে— আর এক পয়সার দাও তো।
খেতে খেতে ভাব হলো। ফতেপুরের পাশের গ্রাম মামারাকপুরে ভগ্নির শ্বশুর বাড়ি। লোকটা আসলে ভালো। ময়রার ছেলে। জাত-ব্যবসা ধরেছে। বললে—আমিও ভাই একদিন তোমার মতন নতুন এসেছিলুম কলকাতায়—তারপর এই ধরেছি—কে দেবে চাকরি বলো না, লেখাপড়া তো শিখিনি কিছু, তোমার মতো লেখাপড়া শিখলে দশ-বারো টাকার চাকরি একটা জুটিয়ে নিতুম ঠিক—পাঁচ টাকায় মাস চালাতুম আর পাঁচ টাকা পাঠাতুম দেশে।
পেট ভরে এক গ্লাশ জল খেলে ভূতনাথ।
লোকটা বললে—বনমালী সরকার লেন? বড়বাড়িতে যাবে— তাহলে এখান থেকে বড় রাস্তা ধরে নাক-বরাবর সোজা চলে যাও—তারপর বাঁ দিকে গিয়ে আবার ডান দিকে প্রথম যে রাস্তা পড়বে…
রাস্তার নির্দেশ পেয়ে উঠলো ভূতনাথ। বললে-তোমার নামটা।
—প্রেকাশ—আর তোমার?
—ভূতনাথ চক্রবর্তী—বামুনগাছির পঞ্চানন্দের দোর ধরে হয়েছি কিনা তাই পিসী ওই নাম রেখেছিল—পরে দেখা করবো–
সমস্ত কলকাতার মধ্যে হঠাৎ যেন একটা আশ্রয় পেয়ে গেল ভূতনাথ। ব্ৰজরাখালের ঠিকানা যদি খুঁজে না-ই পাওয়া যায় আজ, এখানে এই প্রকাশ ময়রার কাছে এসেই ওঠা যাবে। মামারাকপুরে ওর ভগ্নির বিয়ে হয়েছে—আত্মীয়ই বলা চলে। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললে ভূতনাথ। ভগবান সহায় থাকলে নরকে গিয়েও নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। কথাটা ভূষণ কাকার। সে-কথার সত্যতার প্রমাণ আজ যেন হাতে-হাতে পাওয়া গেল এই কলকাতায় এসে।
রাস্তায় চলতে-চলতে একবার মনে হলো—এখন যদি হঠাৎ ননীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। এত বড় কলকাতা শহরে খুঁজে পাওয়া অবশ্য মুশকিল। তা আজ না হোক-কাল হোক, পরশু হোক একদিন দেখা হবেই। ননীর সঙ্গে দেখা করতেই হবে।
বউবাজার স্ট্রীট দিয়ে বনমালী সরকার লেন-এ ঢুকতেই প্রকাণ্ড একটা বটগাছ। বেশ ছায়া হয়েছে চারদিকে। এইখান দিয়েই ঢুকতে হবে গলির ভেতরে।