ভূতনাথ চেহারা দেখে অবাক—এ তোর কী চেহারা হয়েছে। রে রাধা
রাধা বললে—তোমারও তো চেহারা খারাপ দেখছি ভূতোদাদা
—আমার হোক—কিন্তু তোর কেন হবে—
রাধা এবার যেন একটু গম্ভীর-গম্ভীর। কিছু কথা বললে না। মাথা নিচু করে রইলো।
ভূতনাথ বললে—সেবার আমি নজর দিয়েছিলাম বলে, নারে–
—দূর, তা কেন—বলে রাধা চুপ করলো। আর কিছু বললে। শেষে মল্লিকদের আন্নার কাছে শুনতে পেলে ভূতনাথ। আন্না বললে-জানো ভূতেদা—রাধাদি’র ছেলে হবে–
সেদিন খবরটা শুনে ভূতনাথ যে কেন অমন চমকে উঠেছিল কে জানে। কিন্তু চমকানো শেষ হলো ভূতনাথের, যেদিন পেটে ছেলে নিয়ে রাধা মারা গেল। কেমন করে যে কী হলো সব আজ মনে নেই। তবু মনে আছে, খবর পেয়ে ব্রজরাখাল এসেছিল শেষ দেখা দেখতে। গম্ভীর মানুষ ব্ৰজরাখাল। বেশি কঁদেনি। রাধার গায়ের গয়না-টয়নাও কিছু নিলে না। নন্দজ্যাঠার একমাত্র মেয়ে। তার শোকটাও সমান গভীর। তবু বারবার পীড়াপীড়ি করলে।
ব্ৰজরাখাল বললে—মানুষটাই যখন চলে গেল—তখন আর মিছিমিছি ওসব…।
নন্দজ্যাঠা কিন্তু এদিকে শক্ত মানুষ। বললে—তুমি আবার বিয়ে করো বাবা—আমি বলছি
সেইবারই ব্রজরাখালের সঙ্গে প্রথম যা হোক দু একটা কথা বললে ভূতনাথ।
ব্ৰজরাখাল বললে-কলকাতা? তা আমি তো কলকাতাতেই থাকি আমার বাসায়—দেখাবো তোমায় কলকাতা। সে আর বেশি কথা কি—কলকাতা দেখতে তোমার এতো সাধ?
ঠিকানাটা নিয়ে রাখলে ভূতনাথ। ঠিক হলো—ভূতনাথ চিঠি লিখলেই সব ব্যবস্থা করবে ব্রজরাখাল। তারপর যতোদিন ইচ্ছে তার বাসায় থাকো আর দেখে বেড়াও কলকাতা শহর!
ব্ৰজরাখাল পরদিনই চলে গিয়েছিল কলকাতায়। আর আসেনি।
তারপরেই এল ভূতনাথের পরীক্ষা। মহকুমা থেকে একদিন এন্টান্স পরীক্ষাও দিয়ে এল। কোথা দিয়ে দিন আর রাত কাটতে লাগলো কে জানে। আর তারপরেই বিধবা পিসী পড়লে অসুখে। পিসী ছিল মা’র মতন। ভারি কঠিন অসুখ। কয়েক মাস চললো পিসীকে নিয়ে।
পিসী প্রায়ই বলতো—ভূতত মানুষ হবার পর যেন মরি—এই কামনা করে মা তোমরা
লোকে বলত—তুমি নিজের পরকাল তিথি-ধম্মো নিয়ে থাকো কেন—ছেলে হয়ে জন্মেছে, যেমন করে হোক ওর উপায় ও করে নেবেই—
পিসী বলতো—পেটেই ধরিনি-নইলে বাপ-মা কী জিনিস ও জানে না তো—আমি চোখ বুজলে ওকে দেখবার কেউ নেই যে
পাড়ার বউদের সঙ্গে গল্প করতে পিসী আর ভূতনাথ শুনতে পাশে বসে-বউ-এর ছেলে হয় আর মরে যায়—শেষে বামুনগাছির পঞ্চানন্দের থানে মানত করলাম আমি—সেই পঞ্চানন্দের দোর ধরেই তো হলো এই ছেলে। ওর বাপ সতীশ বললে—নাম রাখো ‘অতুল’-আমি বললাম-শিবের দোর ধরে যখন বেঁচেছেনাম থাক ভূতনাথ। তা ভূতনাথ তো ভূতনাথই আমার-আমার ভোলানাথ-বই পড়ছে তো পড়ছেই—ঘুমুচ্ছে তত ঘুমুচ্ছেই— খেতে ভুলে যায় এমন ছেলে কখনো দেখেছো মা তোমরা-ওকে নিয়ে আমি কী করি বলো তো মা।
সেই পিসীমাও একদিন মারা গেল।
পিসীমা’র শ্বশুরবাড়ি থেকে বিধবার নামে পাঁচ টাকা করে মাসোহারা আসতো—তা গেল বন্ধ হয়ে। তখন আর করবার কিছু নেই। ভূতনাথ বারোয়ারিতলায় গিয়ে আড্ডা জমালো। আডও বলতে পারে, আবার যাত্রার মহড়াও বলতে পারো।
‘নল-দময়ন্তী’ পালায় একবার ভূতনাথ প্রতিহারীর পার্ট করলে যাত্রার আসরে দাঁড়িয়ে, কিন্তু বড় ভয় করতে লাগলো তার। কাঁপতে লাগলো পা দুটো। কেমন গলাটা শুকিয়ে আসতে লাগলো। গ্লাশ-গ্লাশ জল খেলে খুব।
ভূষণ কাকা বললেও তারাপদ, ভূতোকে কেন পার্ট দিলে শুধু-শুধু—কোনও কম্মের নয়—লেখাপড়া শিখলে কী হবে–মাথায় যে গোবর পোরা।
কিন্তু ভূতোর তবলা শুনে সবাই অবাক। রসিক মাস্টার বললে—ড়ুগিতবলায় খাসা হাত তত ছোকরার—
দিনকতক তবলা নিয়েই পড়লো ভূতনাথ। বহুদূর থেকে শোনা যায় ভূতনাথের তবলার চাটি। অন্ধকার রাত্রে ঘরে বসে বসে সাধনা করে ভূতনাথ। বোল মুখস্ত করে—তা গে না ধিন, না গে ধিন-আবার কখনো–
তা ধিন
তা তা ধিন
ধিন ত্রে কেটে ত্রে কেটে তাক্—
ধিন…
কিন্তু তবলাও ঠিক শান্তি দিতে পারলে না ভূতনাথকে। পিসীমা’র মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে যেন হঠাৎ তার জীবনের একটা পরিচ্ছেদের একেবারে শেষ হয়ে গিয়েছে। মনে হলো একান্ত নিরাশ্রয় সে। আজ এর বাড়ি, কাল ওর বাড়ি—এমনি করে পরের অন্নদাস হওয়ার অগৌরব যেন তার ঘাড়ে ভূত হয়ে চেপে বসলো সেদিন প্রথম আর প্রখর হয়ে। ভূতনাথ একদিন বাঁয়া তবলা নিয়ে ফিরিয়ে দিয়ে এল বারোয়ারিতলায়। আর ও-মুখো হলো না।
খুব ছোটবেলায় ভূতনাথ একটা বেজি পুষেছিল। বুনো বেজি। বেশ পোষ মেনেছিল। কিন্তু সংসারে যারা পোষ মানে তারাই বুঝি কষ্ট পায় বেশি। ভূতনাথেরই অত্যাচারে মারা গেল একদিন বেজিটা। সেই বেজির মৃত্যু প্রথম আর শেষ পিসীমা। দুই প্রান্তের দুই চরম শোকের মধ্যে ডাক্তারবাবুর ছেলে ননীর বিচ্ছেদ আর রাধার মৃত্যু—সমস্ত মিলিয়ে ভালোমানুষ ভূতনাথ কেমন যেন মনে মনে স্তিমিত হয়ে এল।
এমন সময় এল ব্রজরাখালের চিঠি। রাধার স্বামী ব্রজরাখাল। ব্ৰজরাখাল ভূতনাথের চিঠি পেয়েছে অনেক পরে। এজরাখাল যে-ঠিকানা দিয়েছিল ভূতনাথকে, সে-ঠিকানা বদলে গিয়েছে। তাই চিঠি পেতে অত দেরি।
পরীক্ষায় পাশ করেছে জেনে ব্রজরাখাল খুশি হয়েছে। লিখেছে —চাকরি চেষ্টা করলে হতে পারে। কিন্তু এখনি কিছু বলা যায় না। তবে কলকাতায় কিছুদিন থাকতে হবে—ঘোরাঘুরি করতে হবে। শেষে লিখেছে—চলিয়া আইস—যেমন যেমন নির্দেশ দিলাম ওইভাবে আসিবে। বাসস্থান ও আহারের বন্দোবস্ত আমি করিব। এ কলিকাতা শহর—ট্রেনে ও রাস্তায় খুব সাবধানে আসিবে। জুয়াচোরেরা নতুন মানুষ জানিলে…ইত্যাদি ইত্যাদি।