‘প্রিয় ভূতনাথ,
আমরা গত শনিবার দিন এখানে আসিয়া পৌঁছিয়াছি। কলিকাতা বেশ বড় দেশ—কী যে চমৎকার দেশ বলিতে পারিব না। এখানে আসিয়া অবধি বাবার সঙ্গে চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছি। বড় বড় বাড়ি আর বড় বড় রাস্তা। খুব আনন্দ করিতেছি, তোমাদের কথা মনে পড়ে। তুমি কেমন আছো জানাইও। উপরের ঠিকানায় চিঠি দিও–
সেই চিঠির উত্তর দিতেই ভূতনাথের দশখানা খাতার কাগজ নষ্ট হয়ে গেল। তবু সেদিন ননীর চিঠির উত্তর আর কিছুতেই পছন্দ হয়নি তার। কত কথা ভূতনাথ লেখে—আবার কেটে দেয়। বড় লজ্জা করে। কলকাতা থেকে ননীর চিঠি আসাটাই সেদিন মনে হয়েছিল জীবনের চরম স্মরণীয় ঘটনা। সেই ননীর চিঠির উত্তর পাঠাতে হবে কলকাতায়! এ যেমন বিস্ময়কর তেমনই অবিশ্বাস্য যে। শেষ পর্যন্ত চিঠি ভূতনাথ কোনওরকমে পাঠিয়েছিল। কিন্তু তার উত্তর আসেনি আর এ-জীবনে। সেদিনকার মতো ননী হারিয়েই গিয়েছিল ভূতনাথের জীবন থেকে একেবারে। কিন্তু কলকাতার স্বপ্ন ভূতনাথের মন থেকে কোনোদিন মুছতে পারেনি কেউ!
এর পর আর এক ঘটনা ঘটলো। ভূতনাথের বয়েস তখন বারো কি তেরো আর রাধার এগারো। রাধার বিয়ে হবে। রাধাকে দেখতে এল কলকাতা থেকে। সে যে কী রোমাঞ্চ! রাধার রোমাঞ্চ হলো কিনা ভূতনাথ জানতে পারেনি সেদিন। কিন্তু যদি হয়েই থাকে তত তার হাজারগুণ হয়েছিল ভূতনাথের। রাধা! সেই রাধা! তার শ্বশুরবাড়ি হবে কলাকতায়। কী যে হিংসে হয়েছিল ভূতনাথের মনে। রাগও হয়েছিল খুব। রাগে রাধার সঙ্গে ভূতনাথ ক’দিন দেখাও করেনি, কথাও বলেনি।
কোঁচানো চাদর আর বার্নিশ করা পম্পসু পায়ে কয়েকজন ভদ্রলোক একদিন এল ফতেপুরে। একটা রাত থাকলোও। খেলও খুব। নন্দ জ্যাঠা গাছের ডাব, পুকুরের মাছ, গাওয়া ঘি, ছিন্নাথপুরের কেষ্ট ময়রার কাঁচাগোল্লা আর কাটারিভোগ চালের ভাত খাওয়ালেন।
রাধাকে পছন্দও করে গেল তারা। মাজদিয়া ইস্টিশন থেকে পাল্কি চড়ে একদিন ব্ৰজরাখাল এল বর হয়ে। ব্ৰজরাখাল কলকাতা থেকে বিয়ে করতে এসেছে। বর দেখে রাধার পছন্দ হলো কিনা কে জানে কিন্তু ভূতনাথের হলো না। বরের গোঁফ নেই এ কী রকম বর! ফতেপুরে যত বর এসেছেসব বরের গোঁফ ছিল। রাধার সই হরিদাসীর বরেরও গোঁফ ছিল আর ভূষণ কাকার মেয়ে জ্ঞানদার বর এখনও আসে— তারও গোঁফ। কিন্তু সেদিন সেই অল্প বয়সে ভূতনাথের মনে হয়েছিল রাধার বরের গোঁফ থাকলেই যেন মানাতো। এখন অবশ্য ভাবলেই হাসি পায়। যা হোক, সেদিন ব্ৰজরাখালের গোঁফ না থাকায় যে ক্ষোভ হয়েছিল ভূতনাথের, অপুষিয়ে গিয়েছিল রাধার কলকাতার শ্বশুরবাড়ি হওয়ার সৌভাগ্যে।
বাসরে অনেক রাত পর্যন্ত ভূতনাথ বসেছিল বরের পাশে। কত লোক কতরকম প্রশ্ন করছে—একে একে সব উত্তর দিচ্ছে ব্ৰজরাখাল। রাঙাকাকী ভূতনাথকে দেখিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল
—একে দেখছো তো—এ তোমার বড় সম্বন্ধী–সম্পর্কে গুরুজন
মল্লিকদের আন্না বলেছিল—ত গুরুজন যদি, এখেনে আমাদের সঙ্গে বসে কেন বাপু-বাইরে যাও না তুমি ভূতেদাদা।
সবাই হেসে উঠেছিল।
লজ্জায় ভূতনাথও আর বেশিক্ষণ বসতে পারেনি সেখানে। আস্তে আস্তে এক ফাঁকে উঠে চলে আসতে হয়েছিল। ইচ্ছে ছিল— ব্ৰজরাখালের সঙ্গে আলাপ করে, কলকাতার কথা জিজ্ঞেস করে কলকাতার বড় হাসপাতালের ডাক্তারবাবুর ছেলে ননীকে চেনে কিনা জেনে নেয় ইত্যাদি ইত্যাদি কত কথা মনের ভেতরে গুঞ্জন করছিল, কিন্তু কিছুই হলো না। পরের দিন যতক্ষণ ব্ৰজরাখাল ছিল বাড়িতে, তার সামনে যেতেও লজ্জা হলো তার।
সকালবেলা, মনে আছে, কুয়োতলার পাশে আতাগাছটার আড়ালে দাঁড়িয়ে ভূতনাথ শুনতে পেলে রাধা জ্যাঠাইমাকে বলছে
—মা, ভূতেদাদা বলছিল ও আমার সঙ্গে যাবে।
–কোথায়?—অবাক হয়ে গিয়েছে জ্যাঠাইমা।
-আমার সঙ্গে।
—তোর শ্বশুরবাড়িতে? কেন?
—তা জানিনে-ভূতোদাদা বলছিল।
—পাগল—বলে হেসে উঠেছিল জ্যাঠাইমা। ছি ছি—কী ভাবলো জ্যাঠাইমা। রাধা যে সে-কথা জ্যাঠাইমাকে বলবে কে জানতো। কী বোকা মেয়ে।
কিন্তু পরে শুনতে পেলে ভূতনাথ। রাধার শ্বশুরবাড়ি কলকাতায় নয়। কলকাতা থেকে অনেক দূরে গ্রামের মধ্যে। কামারপুকুরে। কোথায় কামারপুকুর কে জানে। রাধা সেইখানে থাকে। আর ব্রজরাখাল কলকাতার আপিসে চাকরি করে। শনিবার-শনিবার শুধু বাড়ি যায়।
রাধা যখন প্রথম বাপের বাড়ি এল—সে-রাধাকে আর যেন চেনাই যায় না।
রাধা হেসে উঠলো হো হো করে-ওমা, ভূতোদাদা আমার দিকে কেমন হাঁ করে চাইছে দেখো–
ভূতনাথ কিন্তু অন্য জিনিস দেখছিল। রাধা এই ক’দিনে এতো মোটা-সোটা হলে কী করে! আরো ফরসা হয়েছে যেন। ভালো ভালো জামা-কাপড় পরেছে। আরো গয়না হয়েছে।
রাধা মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল-না বাপু, তুমি আমার পানে অমন করে চেয়ে না ভূতোদাদা-ভয় করে আমার
ভূতনাথ অবাক হয়ে গিয়েছিল—কেন, ভয় কিসের–
—বারে নজর লাগে না বুঝি, আমার নতুন বিয়ে হয়েছে— নজর লাগা বুঝি ভালো
-আহা। তাই নাকি আবার লাগে।
—আর আমি যদি নজর দেই—তোমার কেমন লাগে শুনি
—দে না, যতো পারিস নজর দে—কিসে নজর দিবি দে—বলে ভূতনাথ রাধার দিকে আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে এগিয়ে গিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
রাধা কিছুক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবলে। ভূতনাথের নজর দেবার মতো কিছু আছে কিনা হয় তো তাই দেখলে। তারপর বললে—এখন তো দেবে না, তোমার বউ আসুক তখন দেবো
সে অবকাশ রাধা পায়নি। পরের বার রাধা এল।