- বইয়ের নামঃ সাহেব বিবি গোলাম
- লেখকের নামঃ বিমল মিত্র
- প্রকাশনাঃ মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
ভূমিকা – উৎসর্গ – পূর্বাভাষ
সাহেব বিবি গোলাম
দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা
প্রথম সংস্করণে ভূমিকা দেবার প্রয়োজন বোধ করিনি অতি স্বাভাবিক কারণেই। কিন্তু এখন অবস্থাভেদে সে-প্রয়োজন অনিবার্য হয়ে উঠেছে।
আমি প্রধানত গল্পকার, ইতিহাসবেত্তা নই। গল্পের প্রয়োজনে কখনো কখনো ইতিহাস, বিজ্ঞান বা সমাজ তত্ত্বের আলোচনা প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। গল্পেরই প্রয়োজনে আমি প্রাচীন কলকাতার সমাজ বা জীবন-আলোচনা করেছি এবং গল্পের প্রয়োজনে তা করা অপরিহার্য বলেই করেছি, ইতিহাস সম্পর্কে কোনো নতুন আলোকপাত করবো বলে করিনি। এখানে গল্পই মুখ্য, ইতিহাস বা অন্য সব কিছুই গৌণ। কিন্তু ইতিহাসের পাখায় চড়ে আমার গল্প রস-বিহার করলেও, গল্পের পাখায় চড়ে ইতিহাস যাতে রস-বিহার না করে, সেদিকে আমার সতর্ক দৃষ্টি ছিল। সর্বত্র নিজেকে আমি সত্যের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রেখেছি। গল্পের সুবিধের জন্যে ইতিহাসের কিছু অংশ গ্রহণ বা বর্জন করেছি বটে, কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই তাকে বিকৃত করিনি।
বঙ্কিমচন্দ্র তার ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসের ভূমিকায় লিখেছেন–“ইতিহাসের উদ্দেশ্য কখন কখন উপন্যাসে সুসিদ্ধ হইতে পারে।” ‘সাহেব বিবি গোলাম’ উপন্যাসের দ্বারা যদি কোথাও কোনোপ্রকারে ইতিহাসের উদ্দেশ্য সুসিদ্ধ হয়ে থাকে তো স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তা হয়েছে। আমি কোথাও ইতিহাস শোনাবো বলে গল্প শোনানোর ভান করিনি।
এই উপন্যাস রচনায় যে-সব প্রাচীন, অপ্রচলিত বা আধুনিক গ্রন্থাদির সাহায্য গ্রহণ করা হয়েছে, তার জন্যে আমি স্বকৃতজ্ঞ ঋণ স্বীকার করছি। বাহুল্যবোধে তার দীর্ঘ তালিকা দিয়ে ভূমিকা দীর্ঘতর করা অনাবশ্যক। বিশেষ করে উপন্যাস পাঠকের পক্ষে তা একান্তই অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করি।
গ্রন্থকার
—————
Thus from the midday halt of Charnock
grew a city,
As the fungus sprouts chaotic from its
bed
So it spread.
Chance-directed, chance-erected, laid and
built
On the silt,
Palace, byre, hovel, poverty and pride
Side by side.
-Kipling
—————–
উৎসর্গ
রমাপদ চৌধুরী
বন্ধুবরেষু
——————
পূর্বাভাস
ওদিকে বউবাজার স্ট্রীট আর এদিকে সেন্ট্রাল এভিনিউ। মাঝখানের সর্পিল গলিটা এতদিন দুটো বড় রাস্তার যোগসূত্র : হিসেবে কাজ চালিয়ে এসেছিল। কিন্তু আর বুঝি চললো না। বনমালী সরকার লেন বুঝি এবার বাতিল হয়ে গেল রাতারাতি। এতদিনকার গলি। ওই গলিরই পশ্চিমদিকে তখন বনমালী সরকারের পূর্বপুরুষ রাজত্ব করে গিয়েছিলেন সূতানুটী আর গগাবিন্দপুরের সময় থেকে। কথায় ছিল, “উমিচাঁদের দাড়ি আর বনমালী সরকারের বাড়ি”। দুটোরই বোধহয় ছিল সমান জাঁকজমক আর বাহার। সে-যুগে সদগোপ বনমালী সরকার ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর কাছ থেকে পাটনায় দেওয়ানী পেয়েছিলেন। আর কলকাতায় পেয়েছিলেন কোম্পানীর অধীনে ব্যবসা করবার অধিকার। সে-সব অনেক যুগ আগের কথা। সেকালের কুমোরটুলীতে তিনি লাটসাহেবের অনুকরণে এক বাড়ি করেন। তার দেখাদেখি সেকালের আর এক বড়লোক মথুর সেন বাড়ি করেন নিমতলায়। কিন্তু বনমালী সরকারের বাড়ির কাছে সে-বাড়ির তুলনাই হতো না যেন। তারপর কোথায় গেল সেই কুমোরটুলীর বাড়ি–কোথায় গেল বনমালী সরকার নিজে আর কোথায় গেল মথুর সেন! সত্যিই তো ভাবলে অবাক হতে হয়। কোথায় গেল সেই আরমানী বণিকরা, যারা করতে সূতা আর নুটীর ব্যবসা! আর কোথায় গেল জব চার্নকের উত্তরাধিকারী ইংরেজরা—যারা কালিকট থেকে পর্তুগীজদের ভয়ে পালিয়ে এসে সূতানুটীতে আশ্রয় নিলে—আর পরে কালিকটের অনুকরণে সূতানুটীর নামকরণ করলে ক্যালকাটা। আজ শুধু কোম্পানীর সেরেস্তার কাগজপত্রে পুরনো নথিপত্র ঘেঁটে সূতানুটীকে খুঁজে বার করতে হয়। তবু যে বনমালী সরকার ওই এদোপড়া গলির মধ্যে এতদিন দম আটকে বেঁচেছিলেন তা কেবল কলকাতা কর্পোরেশনের গাফিলতির কল্যাণে। এবার তাও গেল। এবার গোবিন্দরাম, উমিচাঁদ, হুজরি মল, নকু ধর, জগৎ শেঠ আর মথর সেনের সঙ্গে বনমালী সরকারও একেবারে ইতিহাসের পাতায় তলিয়ে গেল। আধখানা আগেই গিয়েছিল সেন্ট্রাল এভিনিউ তৈরি হবার সময়ে, এবার বাকি আধখানাও শেষ।
ভার পড়েছে ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্টের ওপর। গলির মুখে ছিল হিন্দুস্থানী ভুজাওয়ালাদের মেটে টিনের দোতলা। হোলির এক মাস আগে থেকে খচম খম শব্দে খঞ্জনী বাজিয়ে “রামা হো” গান চলতো। তারপর সোজা পুব মুখো চলে যাও। খানিকদূর গিয়ে বাঁয়ে বেঁকে আবার ডাইনে বেঁকতে হবে। সদ্গোপ বনমালী সরকারের প্যাঁচোয়া বুদ্ধির মতো, তার নামের গলিটাও বড় পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে মিশেছে গিয়ে বউবাজার স্ট্রীটে। গলিটাতে ঢুকে হঠাৎ মনে হবে বুঝি সামনের বাড়ির দেয়ালটা পর্যন্ত ওর দৈর্ঘ্য। কিন্তু বুকে সাহস নিয়ে এগিয়ে গেলে অনেক মজা মিলবে। নিচু নিচু বাড়িগুলোর রাস্তার ধারের ঘরগুলোতে জম্-জমাট দোকান-পত্তর। বাঁকের মুখে বেণী স্বর্ণকারের সোনা রূপোর দোকান। তারপর পাশের একতলা বাড়ির রোয়াকের ওপর “ইণ্ডিয়া টেলারিং হল”। কিছুদূর গিয়ে বাঁ হাতি তিন রঙা ন্যাশন্যাল ফ্ল্যাগ আঁকা সাইনবোর্ড। প্রভাস বাবুর “পবিত্র খদ্দর ভাণ্ডার”। তারপরেও আছে গুরুপদ দে’র “স্বদেশী বাজার”। যখন স্বদেশী জিনিস কিনতে খদ্দেরের ভিড় হয় তার জেরটা গিয়ে ঠেকে পাশের বাড়ির সবুজ সঙ্ঘের দরজা পর্যন্ত। এক একদিন “সবুজ সঙ্ঘ” হঠাৎ মুখর হয়ে ওঠে আলোতে আর জাঁকজমকে। একটা উপলক্ষ্য তাদের হলেই হলো। সেদিন পাড়ার লোকের ঘুমোবার কথা নয়। সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি “সবুজ সঙ্ঘের জয় ঘোষণা ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনও ঘটনা ঘটে না। লোকে আপিসে যায় না, বাজার করে না, ঘুমোয় না, খায় না—শুধু সবুজ সঙ্ঘ আর সবুজ সঙ্ঘ। কিন্তু তারপরেই আছে জ্যোতিষার্ণব শ্রীমৎ অনন্ত ভট্টাচার্যের “শ্রীশ্রীমহাকালী আশ্রম” যেখানে এই কলিকালের ভেজালের যুগেও একটি খাঁটি নবগ্রহ কবচ মাত্র ১৩টাকা ১০আনায় পাওয়া যায়—ডাকমাশুল স্বতন্ত্র। সত্য ত্রেতা দ্বাপর—বর্তমান, ভূত ভবিষ্যৎ—ত্রিকালদর্শী রাজজ্যোতিষীর প্রস্তুত বশীকরণ, বগলামুখী আর ধনদা কবচের প্রচার ইংলণ্ড, আমেরিকা, আফ্রিকা, চীন, জাপান, মালয়, সিঙ্গাপুরের মতো দূর-দূর দেশে। বনমালী সরকার লেন-এর “শ্রীশ্রীমহাকালী আশ্রম’-এর আরো গুণাবলী সাইনবোর্ডে লাল, নীল আর হলদে কালিতে সবিস্তারে লেখা আছে। তারপরের টিনের বাড়িটার সামনের চালার নিচে বাঞ্ছার তেলেভাজার দোকান। আশে পাশের চার পাঁচটা পাড়ায় বাঞ্ছার তেলেভাজার নাম আছে। তিন পুরুষের দোকান। বাঞ্ছা এখন নেই। বাঞ্ছার ছেলে অধর। অধরের ছেলে অক্রর এখন দোকানে বসে। অক্রর কারিগর ভালো। বেসনটাকে মাটির গামলায় রেখে বাঁ হাতে একটু সোডা নিয়ে বেসনটা এমন ফেটিয়ে নেয় যে, কড়ার গরম তেলে ফেলে দিলে প্রকাণ্ড ফোস্কার মতো নিটোল হয়ে ফুলে ফুলে ওঠে বেগুনিগুলো। হাতকাটা কেলো এসে সকাল থেকে বসে থাকে। তখন ঝাঁপ খোলেনি অক্রর। শীতকালের সকালবেলা চারদিকে গোল হয়ে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে খদ্দেররা—আর অক্রর ঝাঁঝরি খুন্তিটা দিয়ে বেগুনিগুলো ভেজে ভেজে তেলে চুবড়িতে। সময় সময় চুবড়িতে তোলবারও অবসর দেয় না কেউ। জিভ পুড়ে ফোস্কা পড়বার অবস্থা। তেমনি চলে দুপুর বারোটা পর্যন্ত। এমনি করে আরো হরেক রকমের দোকান বাঁদিকে রেখে বনমালী সরকার লেন এঁকে বেঁকে ঘুরে ফিরে গিয়ে পড়েছে বউবাজার স্ত্রীটে। দোকানপত্তর যা কিছু সব বাঁদিকে কিন্তু অত বড় গলিটার ডানদিকটায় প্রায় সমস্তটা জুড়ে কেবল একখানা বাড়ি। নিচু নিচু ছোট ছোট পায়রার খোপের মতন ঘরগুলো। ভাড়াটের চাপাচাপিতে কালনেমির লঙ্কা ভাগের মতন আর তিল ধরবার জায়গা নেই ওতে। লোকে বলতো “বড়বাড়ি”। তা এদিককার মধ্যে সে-যুগে ও-পাড়ায় অত বড় বাড়ি আর ছিল কই! বালির পলেস্তারার ওপর রঙ চড়িয়ে চড়িয়ে যতদিন চালানো গিয়েছিল ততদিন চলেছে। তারপর রাস্তার দিকের চারপাঁচখানা ঘর নিয়ে কংগ্রেসের “ন্যাশন্যাল স্কুল” হয়েছিল ইদানীং। আর একটা ঘরে তঁত বসেছিল অনেক আগে থাকতে। সমস্ত দিন ঘণ্টায় ঘণ্টায় পেটাঘড়িতে ঢং ঢং আওয়াজ হতো। টিফিনের সময় লেবেনচুওয়ালা আর জিভে-গজার ফেরিওয়ালারা ঠুন ঠু বাজনা বাজিয়ে ছেলেদের আকর্ষণ করতো। কোনও দিন হয়তো এক ভাড়াটের ছোট বৈঠকখানার মধ্যে সন্ধ্যেবেলা গানের আসর বসে। তানপুরার একটানা শব্দের সঙ্গে বাঁয়া তবলায় কাহারবা তালের রেলা চলেছে। পিয়া আওয়াত নেহি’র সঙ্গে মিঠে তবলার তেহাই পাড়া মাত করে দেয়। কোনও কোনদিন ‘মিঞা কি মল্লারের সঙ্গে মিষ্টি হাতের মধ্যমানের ঠেকায় আকৃষ্ট হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ে রসিক লোকেরা। জানালা দিয়ে উঁকি মারে। এককালের মালিকরাই আজ ঘটনাক্রমে অবস্থার ফেরে ভাড়াটে হয়ে পড়েছে। তবু বড়বাড়ির ভেতরে ঢুকতে কারো সাহস হয় না। ছোট ফ্রকপরা একটা মেয়ে হয়তো টপ করে এক দৌড়ে অক্র রের দোকান থেকে এক ঠোঙা তেলেভাজা কিনে আবার ঢুকে পড়ে কোঠরের মধ্যে। দোতলার ওপর থেকে হঠাৎ তরকারীর খোসা ঝুপ করে পুষ্পবৃষ্টির মতো পড়ে হয়তো কোনও লোকের মাথায়। লোকটা ওপর দিকে বেকুবের মত চোখ তুলে চায়, কিন্তু কে কোথায়! এ-বাড়ির রান্নাঘর থেকে আসে কুচো চিংড়ি আর পেয়াজের ঠাট্টা আর হয়তো পাশের রান্নাঘর থেকেই আসছে মাংস গরম-মশলার বিজয়ঘোষণা। একটা দরজার সামনে এসে থামলো ট্যাক্সি মেয়েরা যাবে সিনেমায়। আবার হয়তো তখনই পাশের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে একটা থার্ড ক্লাশ ঘঘাড়ার গাড়ি মেয়েরা যাবে হাসপাতালের প্রসূতি-সদনে। জন্ম-মৃত্য-সঙ্গমের লীলাবিলাস কবে ষাট-সত্তর-আশী-একশ’ বছর আগে এ-পাড়ার বাড়িগুলোতে প্রথম শুরু হয়েছিল আভিজাত্যের খরস্রোতে, আজ এই ক’টি বছরের মধ্যে তা যেন বইতে শুরু করেছে নিতান্ত মধ্যবিত্ত খাতে।