শোষণভিত্তিক সমাজে যে শোষণ করে না সে শোষিত হয়। আর যে এই শোষণকে পাপ বলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ও শোষিতের জন্যে দুঃখ পায়, সমাজ তাকে কায়দা করে মুঠোয় পুরতে চায়, না পারলে তাকে সেখানে তিষ্ঠতে দেয় না। আসলে তার বিবেকই তাকে সমাজ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। ঘটেও ছিল তাই। নরনারায়ণ চৌধুরী সদানন্দকে আয়ত্তে আনতে পেরেছেন ভেবে খুশী হয়েছিলেন। সে নববধূর ঘরে গিয়ে দরজায় খিল দিয়েছে। এতএব আর চিন্তা কী! এখন থেকে পুত্রপৌত্রাদিক্রমে বংশপরম্পরা তিনি অমর হয়ে থাকবেন, অনন্তকাল ধরে নিজের রক্তের ধারার মধ্যে অখণ্ড পরমায়ু লাভ করবেন। কিন্তু তিনি জানলেন না তাদেরই পাপের প্রতিবাদ ও প্রায়শ্চিত্ত করতে ফুলশয্যার পালঙ্ক থেকে নেমে সকলের অগোচরে আকাশের নিচে কন্টক শয্যা পাততে বেরিয়ে গেছে সে। কিন্তু পাপের বিরুদ্ধে জেহাদ জানিয়ে একটা মানুষ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেই তো তার বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব কাজ থেমে যায় না। থেমে যেতে দিতেও চান না নরনারায়ণ চৌধুরীর। যোগ্যপুত্র হরনারায়ণ চৌধুরী। তাই তিনি নিজেই পরিত্যক্তা পুত্রবধূর গর্ভে সন্তান উৎপাদন। করতে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠলেন। এখানে লেখকের সংযম ও শিল্প-নৈপুণ্য দেখে বিস্মিত হতে হয়। সুপরিচিত এবং সম্পর্কযুক্ত শব্দের মাধ্যমে সাধারণ গ্রাহ্য যুক্তির পথ ধরে তিনি অনায়াসে এক নিদারুণ সংকট উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছেন।
সত্যকে দেখার স্লং সেই সত্যের সামাজিক ও ব্যক্তিগত বাস্তব রূপ তুলে ধরার ক্ষমতা শ্রেষ্ঠ শিল্পীর লক্ষণ সন্দেহ নেই কিন্তু সংকটের সত্যকে টুকরো টুকরো করে দেখলে সংকটের পূর্ণ চেহারা যেমন দেখা যায় না, তেমনি, Positive good man, যাকে কেন্দ্র করে সংকট প্রকট হয়ে ওঠে তাকেও সম্পূর্ণ করে পাওয়া যায় না। লেখকের শ্রেষ্ঠত্বের আর এক প্রমাণ এই তাত্ত্বিক সত্য তাঁর শুধু জ্ঞাতই নয়, এর স্বরূপও তাঁর অনায়াস-আয়ত্ত। তাই তো তিনি সদানন্দর মাধ্যমে স্তরে স্তরে বিন্যস্ত সামাজিক সংকটের জটিল রূপটি। সামগ্রিক ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। আর সামাজিক সংকট সামগ্রিক ভাবে ফুটে ওঠার দরুন সদানন্দ চরিত্রও স্বচ্ছন্দে স্বতঃই পূর্ণবিকশিত হয়ে উঠতে পেরেছে।
এই যে যুগপৎ চিত্র ও চরিত্র আঁকা, এ এক দুর্লভ গুণ। লেখক আমাদের সামনে যুগসংকট তুলে ধরতে চান; কিন্তু কী ভাবে? যুগসংকটকে আমরা নিজেরাই কি দেখতে চাই যে কেউ দেখালেই দেখব? দৈনন্দিন জীবনে এত অসংখ্য অন্যায় আমরা দেখছি আর ভুগছি যে আমাদের বোধশক্তিটাই ভোঁতা হয়ে গেছে, চোখে পড়ে গেছে চালশে। এখন আর কোন অসঙ্গতিই আমাদের চোখে পড়ে না, কোন মর্মান্তিক ঘটনাই আর দাগ কাটে আমাদের মনে। অতএব লেখককে আনতে হয়েছে এমন একজন মানুষকে যে এই সমাজ-সংসারে একেবারেই আগন্তুক। আগন্তুকের চোখে সবই ধরা পড়ে। অথচ আগন্তুক যেহেতু এই সমাজ-সংসারের সুখ-দুঃখের শরিক নয় তাই সে সব কিছু দেখবে খোলা চোখে সাদা মনে, নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে। তাই তার সেই দেখায় কোথাও গাম্ভীর্য বা গুরুত্ব নেই। থাকলেও Positive good man যেহেতু রাজনীতি বোঝে না, তার চোখের দেখা দুরূহ ব্যাপারগুলোও তখন আর গুরুভার হয় না। কৌতুকে-শ্লেষে মিলে মিশে এক উপাদেয় রসবস্তু হয়ে ওঠে, যার নাম দেওয়া যায় grotesque beauty. পাঠক লক্ষ্য করবেন, এই শ্লেষ ও কৌতুক মেশানো রচনার grotesque beauty শুধু নায়ক সদানন্দর মধ্যে নয়, গ্রন্থের সর্বত্র সমস্ত চরিত্র ও ঘটনার মধ্যেই সূক্ষ্মভাবে বিরাজমান।
তবে কি শুধু কৌতুকে বিদ্রুপে আমাদের এই যুগসংকটের অন্ধকারটাকেই প্রকট করার জন্যে positive good man-এর মাধ্যম ব্যবহার? না। তমসো মা জ্যোতির্গময়য়া-উপনিষদের এই প্রার্থনাই লেখকের শিল্প-প্রেরণা। positive good man-এই আলোরই প্রদীপ। যুগ সংকটেই এদের আবির্ভাব ঘটে। এরা এলেই সংকটের সামগ্রিক চেহারাটা আমাদের সামনে প্রকট হয়, আমরা শিউরে উঠি, আমরা আলোতে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রার্থনায় নতজানু হই। আর সেই তো আমাদের পরিত্রাণ।
শ্বশুরের লালসাকে ধিক্কার দিয়ে, তার মর্যাদার মুখোশটাকে খুলে জনতার সামনে দু’পায়ে থেঁতলে দিয়ে নয়নতারা তার স্বামীর ভিটে জন্মের মতন ছেড়ে এসেছিল বটে কিন্তু সেই থেকে তাকে হতে হয়েছিল পরস্পরবিরোধী দুই প্রবণতার শিকার। অসুস্থ সদানন্দকে রাস্তা থেকে বাড়িতে কুড়িয়ে এনে নয়নতারা তাকে প্রাণপাত সেবা করে এবং তজ্জনিত লাঞ্ছনা। সয়ে তাকে সুস্থ করে তোলে অথচ সে নিজে তখন নিখিলেশের স্ত্রী। নিখিলেশ ততদিনে তাকে লেখাপড়া শিখিয়েছে, তাকে অফিসে চাকরি পাইয়ে দিয়েছে। নিখিলেশ তাকে তার অসহায় অবস্থা থেকে রক্ষা করেছে। সে তাই নিখিলেশকে ভালবাসে। কিন্তু সদানন্দকে?…
সদানন্দ নয়নতারাকে অপ্রত্যাশিত ভাবে বিপুল অর্থ দিয়েছিল বটে কিন্তু সে কি নয়নতারা তাকে রোগে সেবা করেছিল বলে? কিম্বা সে কি নয়নতারাকে সে বিনা দোষে ত্যাগ করেছিল বলে? নাকি…
ফাউস্টকে বাজী রেখেছিলেন ঈশ্বর। শয়তান বলেছিল, এই পৃথিবীকে আমি বাড়ি গাড়ি নারী সম্পদ আর খেতাব খয়রাৎ দিয়ে দখল করে ফেলেছি, ব্যভিচার যুদ্ধ আর মহামারী ছড়িয়ে মানুষদের এমন কোণঠাসা করে রেখেছি যে, সবাই আমাকে ষোড়শোপচারে পূজো করছে। অতএব এই দুনিয়াদারী আমার। ঈশ্বর বললেন, তুমি যদি ওই পবিত্র-প্রাণ ফাউস্টের আত্মাকেও আয়ত্ব করতে পারো, নিভিয়ে দিতে পারো তার বুক থেকে প্রেমের দীপশিখা তবেই স্বীকার করব এই পৃথিবী তোমার। শয়তান ফাউস্টের আত্মা কিনে নিয়েছিল, তাঁকে ভোগ সুখ ও জগতের যাবতীয় বিলাস-ব্যসনের মধ্যে ডুবিয়ে রাখতে পেরেছিল। কিন্তু ফাউসট তাঁর প্রাণের সেই প্রেমের দীপশিখাটি কিছুতেই নিভতে দেন নি। শেষ পর্যন্ত তাই ফাউস্টেরই জয় হল। শয়তান আর পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতি হতে পারল না।