- বইয়ের নামঃ গল্প (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়)
- লেখকের নামঃ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
অন্নপ্রাশন
খোকার অবস্থা শেষ রাত হইতে ভালো নয়।
কী যে অসুখ তা-ই কী ভালো করিয়া ঠিক হইল? জন্তিপুরের সদানন্দ নাপিত এসব গ্রামে কবিরাজি করে, ভালো কবিরাজ বলিয়া পসারও আছে। সে বলিয়াছিল, সান্নিপাতিক জ্বর। মহেশ ডাক্তারের কম্পাউন্ডার একটাকা ভিজিটে রোগী দেখে, সে বলিয়াছিল, ম্যালেরিয়া। মহেশ ডাক্তারকে আনিবার মতো সংগতি থাকিলে এতদিন তাহাকে আনা হইত; কাল বৈকালে যে আনা হইয়াছিল সে নিতান্ত প্রাণের দায়ে, খোকা ক্রমশ খারাপের দিকে যাইতেছে দেখিয়া খোকার মা কান্নাকাটি করিতে লাগিল, পাড়ার সকলেই মহেশকে আনিবার পরামর্শ দিল, পরিবারের গায়ের একমাত্র সোনার অলংকার মাকড়ি জোড়াটা বাঁধা দিয়া আটটা টাকা কেশব ঘোড়ারগাড়ির ভাড়া ও ভিজিটেই ডাক্তারের পাদপদ্মে ঢালিয়াছে। তবুও তো ওষুধের দাম বাকি আছে, নিতান্ত কম্পাউন্ডারবাবু এখানে ডাকতোক পান, সেই খাতিরেই টাকা-দুই আন্দাজ ওষুধের বিলটা এক হপ্তার জন্য বাকি রাখিতে রাজি হইয়াছেন।
এই তো গেল অবস্থা!
মহেশ ডাক্তার বলিয়া গিয়াছেন, কোনো আশা নাই। অসুখ আসলে নিউমোনিয়া, এতদিন যা-তা চিকিৎসা হইয়াছে। রাতটা যদি বা কাটে, কাল দুপুরে ‘ক্রাইসিস’ কাটাইবার সম্ভাবনা কম।
কেশব এ কথা জানিত, কিন্তু স্ত্রীকে জানায় নাই। শেষরাত্রের দিকে যখন খোকার হিক্কা আরম্ভ হইল, খোকার মা বলিল—ওগো, খোকার হিক্কা উঠেছে, একটু ডাবের জল দিলে হিক্কাটা সেরে যাবে এখন।
জল দেওয়া হইল, হেঁচকি ক্রমশই বৃদ্ধি পাইতে লাগিল, কমিবার নামটিও করে। অতটুকু কচি বালকের সে কী ভীষণ কষ্ট! এক-একবার হেঁচকি তুলিতে তার ক্ষুদ্র দুর্বল বুকখানা যেন ফাটিয়া যাইতেছে। আর তার কষ্ট দেখা যায় না, তখন
কেশবের মনে হইতেছিল, “হে ভগবান! তুমি হয় ওর রোগ সারিয়ে দাও, নয় তো ওকে নাও, তোমার চরণে স্থান দাও, কচি ছেলের এ কষ্ট চোখের ওপর আর দেখতে পারি নে।”
সূর্য উঠিবার পূর্বেই খোকা মারা গেল।
কেশবের স্ত্রী কাঁদিয়া উঠিতেই পাশের বাড়ি হইতে প্রৌঢ়া বাঁড়ুয্যে-গিন্নি ছুটিয়া আসিলেন। তাঁর সঙ্গে তাঁর তিন মেয়ে আসিল। সামনের বাড়ির নববিবাহিতা বধূটিও আসিল। বধূটি বেশ, আজ মাস-দুই বিবাহ হইয়াছে, কিন্তু খোকার অসুখের সময় দু-বেলা দেখাশোনা করা, রোগীর কাছে বসিয়া খোকার মাকে স্নানাহারের অবকাশ দেওয়া, নিজের বাড়ি হইতে খাবার করিয়া আনিয়া খোকার মাকে খাওয়ানো—ছেলেমানুষ বউয়ের কাণ্ড দেখিয়া সবাই অবাক। এখন সে আসিয়া কাঁদিয়া আকুল হইল। বড়ো নরম মনটা।
দশ মাসের ছেলে মোটে। শ্মশানে লইয়া যাইবার প্রয়োজন নাই।
খোকাকে কাঁথা জড়াইয়া কেশব আগে আগে চলিল, তার সঙ্গে পাড়ার আরও তিন-চারজন লোক। ঘন বাঁশবাগান ও বনের মধ্যে পুঁড়ি-পথ। এত সকালে এখনও বনের মধ্যে রৌদ্র প্রবেশ করে নাই, হেমন্তের শিশিরসিক্ত লতাপাতা, ঝোপঝাপ হইতে একটা আর্দ্র অস্বাস্থ্যকর গন্ধ বাহির হইতেছে।
ওপাড়ার সতু বলিল—আর বেশিদূর গিয়ে কী হবে, কী বলো রজনি খুড়ো? এখানেই–
কেশব বলিল—আর একটু চলো বিলের ধারে—
বিলের ধারে ঘন বাঁশবনের মধ্যে গর্ত করিয়া কাঁথা-জড়ানো শিশুকে পুঁতিয়া ফেলা হইল। দশ মাসের দিব্যি ফুটফুটে শিশু, কাঁথা হইতে গোলাপ ফুলের মতো ছোট মুখখানি বাহির হইয়া আছে। মুখখানিতে ছোট্ট একটুখানি হাঁ, মনে হইতেছে যেন ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। কেশবের কোলেই ছেলে, গর্তের মধ্যে পুঁতিবার সময় সে বলিল—গা এখনও গরম রয়েছে।
রজনী খুড়ো ইহাদের মধ্যে প্রবীণ, তিনি বলিলেন—আহা-হা, ওসব ভেব না। সতু, নাও না ওর কোল থেকে, ওর কোলে কী বলে রেখে দিয়েছে?
গর্তে মাটি চাপানো হইল। কেশব অবাক নয়নে গর্তের মধ্যে যতক্ষণ দেখা যায়, চাহিয়া রহিল। ছোট্ট মুঠাবাঁধা হাত দুটি মাটি চাপা পড়িয়া অদৃশ্য হইবার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা শেষ হইয়া গেল।
রজনী খুড়ো বলিলেন—চল হে বাবাজি, ওদিকে আর চেয়ো না। সংসার তবে আর বলেচে কেন? আমারও একদিন এমন দিন গিয়েছে, আমার সেই মেয়েটা জানো তো সবই। আজ আবার তোমার মনিব-বাড়ি কাজ, তোমায় তো সেখানে থাকতে হবে। দেখো তো, দিন বুঝে আজই—
কাজটা সাঙ্গ হইয়া গেল খুব সকালেই। বাড়ি যখন ইহারা ফিরিল, তখন সবে রৌদ্র উঠিয়াছে।
একটু পরে সান্যাল-বাড়ি হইতে লোক আসিল কেশবকে ডাকিতে। বলিল— আসুন মুহুরি মশায়, বাবু ডাকচেন। তিনি সব শুনেছেন, কাজকর্ম করলে মনটাকে ভুলে থাকবেন, সেই জন্যে ডেকে নিয়ে যেতে বলে দিলেন।
আজ সান্যাল বাড়ির মেজোবাবুর ছেলের অন্নপ্রাশন। সান্যালেরা গ্রামের জমিদার না-হইলেও খুব সম্পন্ন গৃহস্থ বটে। পয়সাওয়ালা ও বর্ধিষ্ণু। এ অঞ্চলে প্রতিপত্তিও খুব। তেজারতিতেও ষাট-সত্তর হাজার টাকা খাটে। পাশাপাশি আট দশখানা গ্রামে এমন চাষি প্রায় নাই, যে সান্যালদের কাছে হাত পাতে নাই।
কেশব বলিল, চল যাচ্চি, ইয়ে…বাড়িতে একটু শান্ত করে যাই! মেয়েমানুষ, বড্ড কান্নাকাটি করছে।
সান্যালেরা লোক খুব ভালো। বৃদ্ধ সান্যাল মশায় কেশবকে দেখিয়া বলিলেন, আরে এসো, এসো কেশব। আহা, শুনলাম সবই। তা কী করবে বলো। ও দেবকুমার, শাপভ্রষ্ট হয়ে এসেছিল, কী রূপ, তোমার অদৃষ্টে থাকবে কেন? যেখানকার জিনিস সেখানে চলে গিয়েছে। তা ও আর ভেব না, কাজকর্মে থাকো, তবুও অনেকটা অন্যমনস্ক থাকবে। দেখো গিয়ে বাড়ির মধ্যে, ভাতের উনুনগুলো কাটা হচ্ছে কিনা। বউমাকেও আনতে পাঠাচ্চি, তিনিও এসে দেখাশোনা করুন, কাজের বাড়ি ব্যস্ত থাকবেন।
মোটরে করিয়া একদল মেয়ে-পুরুষ কুটুম্ব আসিল।
শহরের লোক। মেয়েদের গহনার বাহার নাই, সে-সব বালাই উঠিয়া গিয়াছে, শাড়ির রংচং-এ চোখ ধাঁধিয়া গেল। মেয়েরা ঠিকই কলিকাতার চাল শিখিয়া ফেলিয়াছে, কিন্তু এসব পাড়াগাঁয়ের শহরে পুরুষদের বেশভূষা নিজের নিজের ইচ্ছামতো—ধুতির সঙ্গে কোট পরা এখানকার নিয়ম, কেউ তাতে কিছু মনে করে না।
চারিধারে হাসিখুশি, উৎসবের ধূম। কেশবের মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা প্রকাণ্ড বড়ো ফাঁক, এদের হাসিখুশির সঙ্গে তার মিল খাইতেছে না। আচ্ছা, এদের মধ্যে কেউই বোধ হয় জানে না, তার আজ সকালে কি হইয়া গিয়াছে…
একটি ভদ্রলোক চার বছরের একটি ছেলেকে সঙ্গে লইয়া গাড়ি হইতে নামিলেন। বেশ সুন্দর ফুটফুটে ছেলেটি, গায়ে রাঙা সিল্কের জামা, কোঁচানো ধুতি পরনে এতটুকু ছেলের, পায়ে রাঙা মখমলের উপর জরির কাজ করা জুতো। কী সুন্দর মানাইয়াছে।
কেশবের ইচ্ছা হইল ছুটিয়া গিয়া ভদ্রলোকটিকে বলে—শুনুন মশায়, আমারও একটি ছেলে ছিল, অবিকল এমনটি দেখতে। আজ সকালে মারা গেল। আপনার ছেলের মতোই তার গায়ের রং।
মহিমপুরের নিকারিরা মাছ আনিয়া ফেলিল। গোমস্তা নবীন সরকার ডাকিয়া বলিল—ওহে কেশব, চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকো না, চট করে মাছগুলোর ওজনটা একবার দেখে নিয়ে ওদের হাতচিঠেখানা সই করে দাও—দাঁড়িয়ে থাকবার সময় নেই-কাতলা আধ মণের বেশি হলে ফেরত দিও—শুধু রুইয়ের বায়না আছে।
নবীন সরকার জানে না তাহার খোকা আজ সকালে মারা গিয়াছে। কী করিয়া জানিবে, ভিন গাঁয়ের লোক, তাতে এই ব্যস্ত কাজের বাড়িতে; সে খবর তাকে দেওয়ার গরজ কার?
কেশব একবার নবীন সরকারকে গিয়া বলিবে—গোমস্তা মশায়, আমার খোকাটি মারা গিয়েছে আজ সকালবেলা। ফুটফুটে খোকাটি! বড়ো কষ্ট দিয়ে গিয়েছে।
নবীন সরকার নিশ্চয় আশ্চর্য হইয়া যাইবে। বল কী কেশব! তোমার ছেলে আজ সকালে মারা গিয়েছে, আর তুমি ছুটোছুটি করে কাজ করে বেড়াচ্ছ! আহা হা, তোমার ছেলে! আহা, তাই তো!
কিন্তু কেউ কিছু জানে না। কেশব তো কাহাকেও কিছু বলিবে না।
মাছ ওজন করিয়া লইবার পরে দুধ-দই আসিয়া উপস্থিত। তারপর আসিল বাজার হইতে হরি ময়রার ছেলে, দু-মণ আড়াই মণ সন্দেশ ও আড়াই মণ পান্তুয়া লইয়া। দই-সন্দেশ ওজন করিবার হিড়িকে কেশব সম্পূর্ণ অন্যমনস্ক হইয়া পড়িল। সপ বিছানো, সামিয়ানা খাটানো প্রভৃতি কাজ তদারক করিবার ভারও পড়িল তাহার উপর।
ইতিমধ্যে সকলেই সব ভুলিয়া গেল, একটা বড়ো গ্রাম্য দলাদলির গোলমালের মধ্যে। সকলেই জানিত, আজ হারাণ চক্রবর্তীর বিধবা মেয়ের কথা এ সভায় উঠিবেই উঠিবে। সকলে প্রস্তুত হইয়াই আসিয়াছিল। প্রথমে কথাটা তুলিলেন নায়েব মশায়—তারপরে তুমুল তর্কবিতর্ক ও পরিশেষে ওপাড়ার কুমার চক্রবর্তী রাগ করিয়া চেঁচাইতে চেঁচাইতে কাজের বাড়ি ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন—অমন দলে আমি থাকিনে! যেখানে একটা বাঁধন নেই, বিচার নেই—সে সমাজ আবার সমাজ? যে খায় খাক, একটা ভ্ৰষ্টা স্ত্রীলোককে নিয়ে আমি বা আমার বাড়ির কেউ খাবে না—আমার টাকা নেই বটে, কিন্তু তেমন বাপের—ইত্যাদি।
তিন-চারজন ছুটিল কুমার চক্রবর্তীকে বুঝাইয়া ঠান্ডা করিয়া ফিরাইয়া আনিতে। কুমার চক্রবর্তী যে একরোখা, চড়ামেজাজের মানুষ সবাই তা জানে। কিন্তু ইহাও জানে যে, সে রাগ তার বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। নায়েবমশায় বলিলেন—তুমি যেও না হরি খুড়ো—তোমার মুখ ভালো না, আরও চটিয়ে দেবে। কার্তিক যাক আর শ্যামলাল যাক—
হারাণ চক্রবর্তীর যে মেয়েটিকে লইয়া ঘোঁট চলিতেছে, সে মেয়েটি কাজের বাড়িতে পদার্পণ করে নাই।
পাশের বাড়ির গোলার নীচে সে এতক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়াছিল, আজই একটা মিটিং হইয়া তাহার সম্বন্ধে যে চূড়ান্ত সামাজিক নিষ্পত্তি কিছু হইবে, তাহা সে জানিত এবং তাহারই ফল কী হয় জানিবার জন্যই সে অপেক্ষা করিতেছিল।
হঠাৎ চেঁচামেচি শুনিয়া সে ভয় পাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল এবং তাহারই নাম কুমার চক্রবর্তীর মুখে ওভাবে উচ্চারিত হইতে শুনিয়া পাঁচিলের ঘুলঘুলি দিয়া দুরু দুরু বক্ষে ব্যাপারটা কী দেখিবার চেষ্টা পাইল।
পাঁচিলের ওপাশে নিকটেই কেশবকে দেখিতে পাইয়া সে ডাকিল-কাকা, ও কাকা—
কেশব কাকাকে সে ছেলেবেলা হইতে জানে, কেশব কাকার মতো নিপাট ভালোমানুষ এ গাঁয়ে দুটি নাই।
আহা, সে শুনিয়াছে যে, আজই সকালে কেশব কাকার খোকাটি মারা গিয়াছে, অথচ নিজের দুর্ভাবনায় আজ সকাল হইতে সে এতই ব্যস্ত যে, কাকাদের বাড়ি গিয়া একবার দেখা করিয়া আসিতে পর্যন্ত পারে নাই।
কেশব বলিল—কে ডাকে? কে, বিদ্যুৎ? কী বলচ মা? তা ওখানে দাঁড়িয়ে কেন?
হারাণ চক্রবর্তীর মেয়েটির নাম বিদ্যুৎ। খুব সুন্দরী না-হইলেও বিদ্যুতের রূপের চটক আছে সন্দেহ নাই, বয়স এই সবে উনিশ।
বিদ্যুৎ স্লানমুখে গলার সুমিষ্ট সুরে অনেকখানি খাঁটি মেয়েলি সহানুভূতি জানাইয়া বলিল—কাকা, খোকামণি নাকি নেই? আমি সব শুনেছি সকালে। কিন্তু কোথাও বেরুতে পারিনি সকাল থেকে, একবার ভেবেছিলুম যাব।
কেশব উত্তর দিতে গিয়া চাহিয়া দেখে বিদ্যুতের চোখ দিয়া জল পড়িতেছে। এতক্ষণ এই একটি লোকের নিকট হইতে সে সত্যকার সহানুভূতি পাইল। কেশব একবার গলা পরিষ্কার করিয়া বলিল—তা যা, এখানে দাঁড়িয়ে থাকিসনে—যা। ও ঘোঁটের কথা শুনে আর কী হবে, তুই বাড়ি যা। কুমার চক্কোত্তি রাগারাগি করে চলে গিয়েচে, ওকে সবাই গিয়েছে ফিরিয়ে আনতে। তোর ওপর খুব রাগ কুমারের। তবে ও তো আর সমাজের কর্তা নয়, ওর রাগে কি-ই বা এসে যাবে!
–কী বলছিল ওরা?
—তুই নাকি এখনও গাঙ্গুলী বাড়ি যাস, তোকে ওদের টিউবকলে জল তুলতে যেতে দেখেছে কুমারের স্ত্রী। কোনদিন নাকি ওদের নারকোল তলায়—ইয়ে, সুশীলের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলি, তাও কুমারের স্ত্রী দেখেছে—এইসব কথা।
বিদ্যুৎ বলিল—আমি যাইনি কাকা, সেবার সেই বারণ করে দেওয়ার পর থেকে আর কখনো যাইনি।
এ কথাটা বিদ্যুৎ মিথ্যা বলিল। সুশীলের সঙ্গে তার ছেলেবেলা হইতেই আলাপ। সুশীল যখন কলেজে পড়িত, তখন বিদ্যুৎ বারো-তেরো বছরের মেয়ে। সুশীলদার দেখা পাইলে তখন হইতেই সে আর কোথাও যাইতে চায় না।
সুশীলের সঙ্গে তাহার বিবাহ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না, কারণ তাহারা বৈদিক আর সুশীলেরা রাঢ়িশ্রেণি। বিদ্যুতের বিবাহ হইয়াছিল পাশের গ্রামের শ্রীগোপাল আচার্যের সঙ্গে। বিদ্যুৎ বিধবা হইয়াছে বিবাহের দু-বছর পরেই। শ্বশুরবাড়ি মাঝে মাঝে যায়, কিন্তু বেশির ভাগ এখানেই থাকে। সুশীলের সঙ্গে তাহার ছেলেবেলার মাখামাখি লইয়া একটা অপবাদ গ্রামের মাঝে রটিয়াছিল। এই অপবাদের দরুনই তাহারা এখন গ্রামে একঘরে হইয়া আছে, এ বাড়িতে তাহাদের নিমন্ত্রণ হয় নাই।
ইতিমধ্যে ঝুমুর গানের দল আসিয়া হাজির হইল। সামিয়ানার একধারে ইহাদের জন্য স্থান নির্দিষ্ট ছিল, গ্রামের ছোটো ছেলে-মেয়েরা, দল আসিতেই সেখানে গিয়া জায়গা দখল করিয়া বসিবার জন্য হুড়াহুড়ি বাধাইয়া দিল। কেশব ছুটিয়া গেল গোলমাল থামাইতে। দলের অধিকারী বলিল—ও সরকার মশাই, আমাদের একটু তামাক-টামাকের জোগাড় করে দিন, আর দু-পাঁচ খিলি পান। রোদুরে বামুনগাঁতির বিল পার হতে যা নাকালটা হয়েচি সবাই মিলে!
বেলা বারোটার সময় কেশব একবার বাড়ির মধ্যে ঢুকিল। স্ত্রীর জন্য তাহার মনটা চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। আহা, বেচারি এ বাড়ি আসিয়াছে তো,—না খালি বাড়িতে একা পড়িয়া পড়িয়া কাঁদিতেছে?
না, দেখিয়া আশ্বস্ত হইল স্ত্রী আসিয়াছে ও ইদারার পাড়ে একরাশ পুরোনো বাসন ঝিয়ের সঙ্গে বসিয়া মাজিতেছে, তাহাদের আজ মরণাশৌচ, বাহিরের কাজকর্ম ছাড়া অন্য কাজ করিবার জো নাই।
মেজোবাবুর যে-খোকার অন্নপ্রাশন, দালানে খাটের উপর সুন্দর বিছানাতে চারিদিকে উঁচু তাকিয়া ঠেস দিয়া তাহাকে বসাইয়া রাখা হইয়াছে। ছ-মাসের হৃষ্টপুষ্ট নধরকান্তি শিশু, গায়ে একগা গহনা, সামনের গদিতে একখানা থালে যেসব বিভিন্ন অলংকার আত্মীয়-কুটুম্ব, বন্ধুবান্ধবে দিয়াছে, সেগুলি সাজানো। তিন চার ছড়া হার, সোনার ঝিনুক, পদক, তাগা, বালা, রূপার কাজললতা। চারিধারে ঘিরিয়া মেয়েরা দাঁড়াইয়া আছে, ইহারা কেউ কেউ এ গ্রামের বউ-ঝি, কিন্তু বেশিরভাগই নবাগতা কুটুম্বিনীর দল। সকাল হইতে বেলা এগারোটা পর্যন্ত আপ ডাউন যে তিনখানা ট্রেন যায়, প্রত্যেক ট্রেনের সময়ে দু-তিনখানা ট্যাক্সি বোঝাই হইয়া ইহারা কোনো দল কলিকাতা হইতে, কোনো দল বা রানাঘাট, কী গোয়াড়ি কৃষ্ণনগর, কী শান্তিপুর হইতে আসিয়াছে। শহরের মেয়ে, কী সব গহনা ও শাড়ির বাহার, কী রূপ, কী মুখশ্রী, যেন এক-একজন এক-একখানি ছবি!
খোকাটি কেমন চমৎকার হাসিতেছে। কেমন সুন্দর মানাইয়াছে ওই বেগুনি রংয়ের জামাটাতে! তাহার খোকারও অন্নপ্রাশন দিবার কথা ছিল এই মাসে।
গরিবের সংসার, খোকার যখন চার মাস বয়স, তখন হইতে ধীরে ধীরে সব জোগাড় করা হইতেছিল। কাপালিরা মুসুরি ও ছোলা দিয়াছিল প্রায় আধ মণ, নাড়ুর চালের জন্য ধান জোগাড় করা হইয়াছিল, সাত-আটখানা খেজুরের গুড় দিয়াছিল বাগদিপাড়ার সকলে মিলিয়া। বৃদ্ধ ভুবন মণ্ডল বলিয়াছিল—মুহুরি মশায়, যত তরিতরকারি দরকার হবে, আমার খেত থেকে নিয়ে যাবেন খোকার ভাতের সময়, একপয়সাও দিতে হবে না। কেবল বামুন-বাড়ির দুটো পেরসাদ যেন পাই। শূদ্র-ভদ্র সবাই খোকাকে ভালোবাসিত।
মেজোবাবুর খোকার গায়ের রং অনেক কালো তার খোকার তুলনায়। মেজোবাবু নিজে কালো, খোকার খুব ফরসা হইবার কথাও নয়। সুতরাং এদের মানানো শুধু জামায় গহনায়। তাহার খোকা গরিবের ঘরে আসিয়াছিল। একজোড়া রূপার মল ছাড়া আর কোনোকিছু খোকার গায়ে ওঠে নাই।
আজ শেষরাত্রে খোকার সেই হেঁচকির কষ্টে কাতর কচি মুখখানি, অবাক দৃষ্টি, নিস্পাপ, কাচের চোখের মতো নির্মল ব্যথাক্লিষ্ট চোখদুটি…আহা, মানিক রে!
—ও কেশব, বলি হ্যাদ্দেশ্যে এখানে সঙের মতো দাঁড়িয়ে আছ যে! বেশ লোক যা হোক। ব্রাহ্মণদের পাতা করবার সময় হল, সামিয়ানা খাটাবার ব্যবস্থা করো গে। আমি তোমায় খুঁজে বেড়াচ্ছি চোদ্দোভুবন, আর তুমি এখানে, বেশ নম্বুরি নোটখানি বাবা! পা চালিয়ে দেখো গিয়ে—
নবীন সরকার।
কিন্তু, নবীন সরকার তো জানে না…
সে কী একবার বলিবে…?—ও গোমস্তা মশায়, এই আমার খোকা আজ সকালে…ওরকম করে আমায় ডাকবেন না…আমার মনটা আজ ভালো না…
দলে দলে নিমন্ত্রিত ব্রাহ্মণেরা আসিতে আরম্ভ করিয়াছে নানা গ্রাম হইতে। এগারোখানা গাঁ লইয়া সমাজ, সমাজের সকলেই নিমন্ত্রিত। বড়ো বৈঠকখানায় লোক ধরিল না, শেষে লিচুতলায় প্রকাণ্ড শতরঞ্জ পাতিয়া দেওয়া হইল। আসরের মধ্যে দাঁড়াইয়া দেউলে সরাবপুরের বরদা বাঁড়ুয্যে মশায় বলিলেন—একটা কথা আমার আছে। এ গাঁয়ে হারাণ চক্কোত্তি সমাজে একঘরে, তাদের বাড়ির কারুর কী নেমন্তন্ন হয়েছে আজ কাজের বাড়িতে? যদি হয়ে থাকে বা তাদের বাড়ির কেউ যদি এ বাড়িতে আজ এসে থাকেন, তবে আমি অন্তত দেউলে সরাবপুরের ব্রাহ্মণদের তরফ থেকে বলচি যে, আমরা এখানে কেউ জলস্পর্শ করব না।
আরও দু-পাঁচখানা গ্রামের লোকেরা সমস্বরে এ কথা সমর্থন করিল। অনেকে আবার হারাণ চক্রবর্তীর আসল ব্যাপারটা কি জানিতে চাহিল। ছেলে-ছোকরার দল না–বুঝিয়া গোলমাল করিতে লাগিল।
এ বাড়ির বৃদ্ধ কর্তা সান্যালমশায়ের ডাক পড়িল। তিনি কাজের বাড়িতে কোথাও ব্যস্ত ছিলেন, গোলমাল শুনিয়া সভায় আসিয়া দাঁড়াইলেন। এ গাঁয়ের সমাজ বড়ো গোলমেলে, তাহা তিনি জানিতেন। পান হইতে চুন খসিলেই এই তিনশো নিমন্ত্রিত ব্রাহ্মণ এখনই হই-চই বাধাইয়া তুলিবে, খাইব না বলিয়া শুভকার্য পণ্ড করিয়া দিয়া বাড়ি চলিয়া যাইবে। প্রাচীন, বিচক্ষণ ব্যক্তি সব, কিন্তু সামাজিক ঘোঁটের ব্যাপারে ইহাদের না-আছে বিচার-বুদ্ধি, না-আছে কাণ্ডজ্ঞান।
তবুও সান্যালমশায় সভার মধ্যে খুব সাহসের পরিচয় দিলেন। বলিলেন, আপনাদের সকলকেই জানাচ্চি যে হারাণ চক্কোত্তির বাড়ির একটি প্রাণীও আমার বাড়ি নিমন্ত্রিত নয়, তাদের কেউ এ বাড়িতে আসেওনি। কিন্তু, আমার আজ অনুরোধ, এই সভাতেই সে ব্যাপারের একটা মীমাংসা হয়ে যাওয়া দরকার। হারাণ আমার প্রতিবেশী, আমার বাড়ির পাশেই তার বাড়ি। তার ছেলে-মেয়ে আমার নাতি-নাতনির বয়সি। আজ আমার বাড়ির কাজ, আর তারা মুখ চুন করে বাড়ি বসে থাকবে, এ বাড়িতে আসতে পারবে না, খুদকুঁড়ো যা দুটো রান্না হয়েছে তা মুখে দিতে পারবে না, এতে আমার মন ভালো নেয় না। আপনারা বিচার করুন তার কী দোষ—আমাদের গাঁয়ের লোক মিলে আজ সকালে একটা মিটিং আমরা এ নিয়ে করেছিলাম, কিন্তু সকলে উপস্থিত না-হলে ব্যাপারটা উত্থাপন করা ভালো নয় বলে আমরা বন্ধ রেখেছি। আমার যদি মত শোনেন, আমি বলি হারাণ চক্কোত্তির মেয়ে নির্দোষ, তাকে সমাজে নিতে দোষ নেই।
ইহার পর ঘণ্টাদুইব্যাপী তুমুল বাগযুদ্ধ শুরু হইল, আজ সকালবেলার মতোই। এই সভায় সবাই বক্তা, শ্রোতা কেহ নাই। চড়া গলায় সকলেই কথা বলে, কথার মধ্যে যুক্তিতর্কের বালাই নাই। দেখা গেল, এ গাঁয়ের হারাণ চক্রবর্তীর ব্যাপার লইয়া দুটো দল, একদল তাহাকে ও তাহার মেয়েকে একঘরে করিয়া রাখিবার পক্ষে মত দিল। অপর পক্ষ ইহার বিরুদ্ধে। হারাণ চক্রবর্তীর ডাক পড়িল, তাঁর বয়স যদিও খুব বেশি নয়, কিন্তু কানে একেবারে শুনিতে পান না। টাইফয়েড হইয়া অল্পবয়স হইতেই কান দুটি গিয়াছে। তিনি হাতজোড় করিয়া নিবেদন করিলেন, তাঁহার মেয়েকে তিনি ভালো রকমই জানেন, তার স্বভাবচরিত্র সৎ। যে ছেলেটিকে লইয়া এ কথা উঠিয়াছে, গাঙ্গুলীবাড়ির সেই ছেলেটি কলেজের পাশ, উঁচু নজরে কাহারও দিকে চায় না। ছেলেবেলা হইতেই বিদ্যুতের সঙ্গে তার ভাই বোনের মতো মেশামেশি, এর মধ্যে কেউ যে কিছু দোষ ধরিতে পারে—ইত্যাদি!
ইহার উত্তরে বিরুদ্ধ দলের কর্তা কুমার চক্রবর্তী রাগিয়া উঠিয়া যাহা বলিলেন, তাহা আমাদের মনে আছে, কিন্তু সে-সব কথা পাড়াগাঁয়ের দলাদলি সভায় উচ্চারিত হইতে পারিলেও ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করিবার যোগ্য নয়।
অনেক করিয়াও হারাণ চক্রবর্তীর হিতাকাঙক্ষী দল কিছু করিতে পারিল না। কুমার চক্রবর্তীর দলই প্রবল হইল। আসলে বিদ্যুৎ যে খুব ভালো মেয়ে, বিদ্যুতের মনটি বড়ো নরম, পাড়ার আপদ-বিপদে ডাকিলেই ছুটিয়া আসে এবং বুক দিয়া পড়িয়া উপকার করে, তাহার উপর সে ছেলেমানুষ, এখনও তত বুঝিবার বয়স হয় নাই, বৃদ্ধের দলের আসল যুক্তি এই। কিন্তু এ সত্য কথা সভায় দাঁড়াইয়া বলা যায় না।
কুমার চক্রবর্তীর দলের লোকেরা বলিল—সেবার সুরেনের মেয়ের বিয়ের সময় আমরা তো বলে দিয়েছিলাম, বিদ্যুৎ সুশীলদের বাড়ি যাতায়াত বা সুশীলের সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করুক। এক বছর আমরা যদি দেখি, সে আমাদের কথা মেনে চলেচে, তবে আমরা তাদের দলে তুলে নেব—কিন্তু সে কী তা শুনেচে?
হারাণ চক্রবর্তী বলিলেন—কই কে দেখেচে—বলুক কবে আমার মেয়ে এই এক বছরের মধ্যে–
কিন্তু এমন ক্ষেত্রে পাড়াগাঁয়ে দেখিবার লোকের অভাব হয় না।
দেখিয়াছে বই কী! বহু লোক দেখিয়াছে। পরের বাড়ি কোথায় কী হইতেছে দেখিবার জন্য যাহারা ওত পাতিয়া থাকে, তাদের চোখে অত সহজে ধুলা দেওয়া চলে না।
অবশেষে কে বলিল—আচ্ছা, কাউকে দিয়ে সেই মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করা হোক না—সে যদি আমাদের সামনে স্বীকার করে, সে ওখানে যাতায়াত করে এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘাট স্বীকার করে, কথা দেয়, আর কখনো এ কাজ সে করবে না, তবে না-হয়—
বিদ্যুৎ পাঁচিলের ঘুলঘুলিতে চোখ দিয়াই দাঁড়াইয়া ছিল।
কেশব গিয়া বলিল—মা আছিস? রাজি হয়ে যা না, ওরা যা যা বলচে। কেন মিছে মিছে—
বিদ্যুৎ কাঁদিয়া বলিল—আপনি ওদের বলুন আমি সব তাতে রাজি আছি কাকা।
সভার মধ্যে বাপকে অপদস্থ হইতে দেখিয়া লজ্জায়, দুঃখে সে মরিয়া যাইতেছিল…তার জন্যই তার নিরীহ পিতার এ দুর্দশা…তা ছাড়া তার দাদা শ্রীগোপালের ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েরা আজ পাঁচ-ছ-দিন হইতে যজ্ঞিবাড়ির নিমন্ত্রণ খাইবার লোভে অধীর হইয়া আছে, ছেলেমানুষ তারা কী বোঝে—অথচ আজ তাদের নিমন্ত্রণ হয় নাই, এ বাড়িতে আসিতে না-পাইয়া মুখ চুন করিয়া বেড়াইতেছে—ইহা তাহার প্রাণে বড়োই বাজিয়াছে।
ছোটো মেয়ে সুবু তো কেবলই জিজ্ঞাসা করিতেছে—পিছিমা, ওদের বালি থেকে ডাকতে আছবে কখন? পায়েছ খাব, ছন্দেছ খাব, না, পিছি? আমি যাব, ওবু যাবে, দাদা যাবে, মা যাবে—
তার মা ধমক দিয়া থামাইয়া রাখিয়াছে—থাম, এখন চুপ কর। যখন যাবি তখন যাবি। তা না এখন থেকে—এখন বরং একটু ঘুমো দিকি। ঘুমিয়ে উঠে আমরা সেই বিকেলে তখন সবাই যাব
ঘরে বাহিরে বিদ্যুতের আর মুখ দেখাইবার জো নাই। কিন্তু কেশবের কথায় কী হইবে। এক-আধটি বাজে লোকের প্রস্তাবেই বা কী হইবে। বরদা বাঁড়ুয্যে ও কুমার চক্রবর্তী এ প্রস্তাবে রাজি হইলেন না। একবার যে শর্ত ভঙ্গ করিয়াছে, তাহার সঙ্গে আর শর্ত করিয়া ফল নাই। আর এ শর্তের ব্যাপার নয়। একটা স্ত্রীলোককে সামাজিক শাসন করা হইতেছে, ইহার মধ্যে শর্তই বা কীসের? মাথা মুড়াইয়া ঘোল ঢালিয়া যে গ্রাম হইতে বিদায় করিয়া দেওয়া হয় নাই এতদিন, ইহাই যথেষ্ট।
সুতরাং হারাণ চক্রবর্তী যেমন একঘরে ছিলেন, তেমনই রহিয়া গেলেন।
তারপর ব্রাহ্মণ-ভোজনের পালা। কেশবের মরণাশৌচ, সে পরিবেশন করিবে, ভিখারি বিদায়ের ভার পড়িল তার উপর। দু-তিন দফা ব্রাহ্মণ খাওয়ানো ও ভিখারি বিদায় করিতে সন্ধ্যা হইয়া গেল। সন্ধ্যার পরে শূদ্র-ভোজন, সে চলিল রাত দশটা পর্যন্ত।
কেশব সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর যখন খাইতে বসিল, তখন রাত এগারোটা। আয়োজন ভালোই হইয়াছিল, কিন্তু এত রাত্রে জিনিসপত্র বেশি কিছু ছিল না। কেবল দই ও মিষ্টি এবং দু-তিন রকমের টক তরকারি দিয়া কেশব পরিতৃপ্তির সঙ্গে দুইজনের আহার একা করিল। পরে স্ত্রীকে লইয়া অন্ধকারেই নিজের বাড়ি রওনা হইল।
কেশবের স্ত্রীও খুব খাইয়াছে। কেশবের প্রশ্নের উত্তরে বলিল—তা গিন্নির বড়ো মেয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে খাওয়ালে। নিজের হাতে আমার পাতে সন্দেশ দিয়ে গেল। খুব যত্ন করেছে। রান্নাবান্না কী চমৎকার হয়েছে, না?
কেশব বলিল—তা বড়োলোকের ব্যাপার, চমৎকার হবে না? নয় তো এমন অসময়ে কপি কোথা থেকে এই পাড়াগাঁয়ে আসে বল দিকি? পেয়েছিলে কপির তরকারি?
—তা আর পাইনি? দু-দু-বার দিয়েছে আমার পাতে। হ্যাঁ গা, এখন কপি কোথেকে আনালে? কলকাতায় কী বারোমাস কপি মেলে?
বাড়ির উঠানে তুলসীতলায় একটা মাটির প্রদীপ তখনও টিমটিম করিয়া জ্বলিতেছে। কেশবের স্ত্রী বলিল—ও বাড়ির ছোটো-বউ জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছে, আহা বড়ো ভালো মেয়ে। আজ সকালে কেঁদে একেবারে আকুল।
সকালে যেভাবে ইহারা ফেলিয়া রাখিয়া গিয়াছিল, ঘরবাড়ি সেইভাবেই পড়িয়া আছে। কারো সাড়াশব্দ নাই,—নির্জন, নিস্তব্ধ। বাড়িখানা খাঁ-খাঁ করিতেছে। আশেপাশে ঘন অন্ধকার, কেবল তুলসীতলায় ওই মিটমিটে মাটির প্রদীপের আলোটুকু ছাড়া।
কেশব শুইবামাত্র ঘুমাইয়া পড়িল।
অনেক রাত্রে ঘুমের মধ্যে কেশব স্বপ্ন দেখিতেছিল, বিদ্যুৎ আসিয়া উঠানের মাঝখানে দাঁড়াইয়া কাঁদো-কাঁদো মুখে বলিতেছে—কাকা, আজই বুঝি…একবার ভেবেছিলাম আসব, কিন্তু যে দুর্ভাবনা আমার ওপর দিয়ে আজ সারাদিন…
বাহিরে ঝমঝম বৃষ্টির শব্দে তার ঘুম ভাঙিয়া গেল। সে ধড়মড় করিয়া বিছানায় উঠিয়া বসিল—সর্বনাশ! ভয়ানক বৃষ্টি আসিয়াছে! খোকা, কচি ছেলে, নিউমোনিয়ার রোগী, বাঁশতলায় তার ঠান্ডা লাগিতেছে যে!…পরক্ষণেই ঘুমের ঘোরটুকু ছুটিয়া যাইতেই নিজের ভুল বুঝিয়া আবার শুইয়া পড়িল।
ভাবিল—আহা, যখন পুঁতি, তখনও ওর গা গরম, বেশ গরম ছিল হঠাৎ
দেখিল সে কাঁদিতেছে, আঝোর ধারে কাঁদিতেছে…বাহিরে ওই বৃষ্টিধারার মতো আধোর ধারে…বারা বার তার মনে হইতে লাগিল— তখনও ওর গা গরম ছিল…বেশ গরম ছিল…
অভিনন্দনসভা
এবার দেশে গিয়ে দেখি, গৌর পিয়োন পেনশন নিয়েছে। কতকাল পরে? বহুদিন…বহুদিন।
বায়ুমণ্ডলে যখন প্রজ্বলন্ত উল্কা ছুটে চলে, তখন গোটা ফোটোগ্রাফ প্লেটটা সে এক সেকেন্ডে পার হয়ে যায়। কিন্তু ছ-ঘণ্টা কী সাত ঘণ্টা ঠায় আকাশের দিকে ক্যামেরার মুখ ফিরিয়ে রাখলেও নীহারিকা একচুল নড়ে না।
গৌর পিয়োন (গৌরচন্দ্র হালদার, জেলে) আমাদের জীবনে সেই বহুদূরবর্তী নীহারিকার মতো অনড় ও অচল অবস্থায় এক ডাকঘরে, এক ডাকের ব্যাগ ঘাড়ে পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর ডাক-হরকরার কাজ করে আসছে। মধ্যে তিন বছরের জন্যে সে কেবল কোটচাঁদপুর গিয়েছিল, তাও তার মন সেখানে টেকেনি। ওভারসিয়ারের কাছে কান্নাকটি করে আবার চলে এসেছিল আমাদের এই ডাকঘরে।
১৯১২ সালের ৭ই জুলাই সে প্রথম ভরতি হয়েছিল এখানকার ডাকঘরে।
তার মুখেই শুনেছি, আমি তখন স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। বাবা বিদেশ থেকে টাকা পাঠাতেন, ও আমাদের বাড়ি এসে বলত—টাকা নিয়ে যান বাবাঠাকুর!
আমি বলতাম—ক-টাকা?
—ন-টাকা।
–কোন ডাকঘর থেকে?
–বহরমপুর।
একবার এক বুড়ো পিয়োন আমাদের গাঁয়ের বিটে বদলি হল, গৌর পিয়োনের পড়ল অন্য বিট। বুড়ো বাড়ি এসে আগেই বলত—কটহর নিয়ে এসো। সড়া কটহর দেবে না, আচ্ছা কটহর নিয়ে এসো—খাব!
তার নাম পাঁড়েজি। হিন্দুস্থানি ব্রাহ্মণ। অনেকদিন এদিকে ছিল। অমনিধারা বাংলা বলত। কিন্তু তার দোষ ছিল দূরের গাঁয়ের চিঠি থাকলে হাঁটবার ভয়ে যেত না।
একবার বাঁওড়ের ধারের ঝোপ থেকে এইরকম অনেক চিঠি কুড়িয়ে পাওয়া যায়। বুড়ো পাঁড়েজির নামে নালিশ গেল ওপরে। তাকে এখান থেকে বদল করে দিলে।
গৌর পিয়োন এল এরই পরে। সেই থেকেই ও এখানে আছে, মাত্র তিন বছর ছাড়া।
গৌর পিয়োন তিন-চার বছর কাজ করবার পরই আমি গ্রাম ছেড়ে চলে গেলাম। পুনরায় ফিরলাম দীর্ঘ আঠারো বছর পরে।
সেদিনই বিকেলে দেখি, গৌর পিয়োন চিঠি বিলি করতে এল আমাদের বাড়ি।
সত্যি আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমি আশা করিনি, এতকাল পরে সেই বাল্যের গৌর পিয়োন পুরোনো দিনের মতো চিঠি বিলি করতে আসবে।
গৌর উঠোন থেকে রোয়াকে উঠে এসে বললে—প্রাত:পেন্নাম বাবাঠাকুর।
—গৌর যে! ভালো আছ? এখনো তুমি এখানে ডাক বিলি করচ?
—আপনাদের আশীর্বাদে একরকম চলে যাচ্চে বাবাঠাকুর। বাড়িঘর আপনার একেবারে নষ্ট হয়ে যেতে বসেছিল যে না-থাকার জন্যে।
গৌর কিন্তু অবিকল সেইরকম আছে। বয়েস ষাটের কাছাকাছি হল হিসেবমতো।
গবর্নমেন্টের খাতায় যে-বয়েসই লেখা থাকুক না-কেন, মাথার একটি চুলও পাকেনি। তবে সামান্য একটু কুঁজো হয়ে পড়েছে। গলায় তুলসির ত্রিকণ্ঠী মালা বার্ধক্যের একমাত্র সুস্পষ্ট চিহ্ন।
—কতদিন চাকরি হল গৌরকাকা?
—তা একত্রিশ-বত্রিশ বছর।
—রোজ ক-খানা গাঁ বেড়াতে হয়?
—পাঁচ-ছ-খানা গাঁয়ে বিট থাকে রোজ। পাঁচ-ছ কোশ হাঁটতে হয় দৈনিক। জলে-কাদায় হানিভাঙা, দুগগোপুর, সরভোগ, দেকাটি এসব জায়গায় যেতে বড় কষ্ট। পা হেজে যায়, পাঁকুই হয়।
কতদিন পরে ওকে ডাক বিলি করতে দেখে এমন এক আনন্দ হল।
এতদিন পরে দেশে এলাম, বাইরের জগতে কত পরিবর্তন ঘটে গেল, আমার নিজের জীবনেও কত কী ওলট-পালট হল—কিন্তু সেই পুরাতন গ্রামে ফিরে এসে দেখি, সময় এখানে অচঞ্চল। বাঁশ, আম বনের ছায়ায় ছায়ায় পুরাতন জীবন সেইরকমই বয়ে চলেচে-গৌর পিয়োন সেই পুরোনো দিনের মতোই চিঠি বিলি করচে।
গৌর পিয়োন রোজ আসে, রোজ খানিকটা বসে গল্প করে। কোনোদিন একটা নারকোল, কোনোদিন বা একটা কাঁঠাল চেয়ে নিয়ে যায়।
মাস আট-নয় সেবার বড়ো আনন্দেই কেটেছিল গ্রামে।
তারপরই আবার চলে যেতে হল বিদেশে। কাটল সেখানে কয়েক বছর।
এইবার আষাঢ় মাসে দেশে ফিরে এলাম আবার।
এসে দেখি, বাড়ির কী ছিরিই হয়েছে! না-থাকলে যা হয়। কয়েক বছরের বর্ষার জলে পুষ্ট হয়ে আগাছার জঙ্গল বাড়ির ছাদ পর্যন্ত নিবিড়ো ঝোপের সৃষ্টি করেছে। সিমেন্ট উঠে গিয়ে রোয়াকে কাঁটানটের জঙ্গল গজিয়েচে। ঘরের মধ্যে কড়িকাঠে মৌমাছিরা চাক বেঁধেছে। কলা-বাদুড় কড়িতে-বরগাতে ঝুলচে। চামচিকের নাদি দু-ইঞ্চি পুরু হয়ে জমেচে মেঝের ওপর।
পরদিন সকালে গৌর পিয়োন চিঠি বিলি করতে এল। এসে সে বললে—আজই আমার চাকরির শেষদিন বাবাঠাকুর। বাড়ি এসেচেন, তবুও শেষদিনটা আপনাকে চিঠি দিয়ে গেলাম।
—আজই শেষদিন?
—আজই বাবাঠাকুর। পঁয়ত্রিশ বছর তিনমাস পূর্ণ হল। আর কতদিন রাখবে গবর্নমেন্ট।
—বোসো। একটা পাকা আনারস নিয়ে যাও। বাঁশবাগানে জংলি আনারস অনেক হয়ে আছে, বেশ মিষ্টি।
গৌর কিছুক্ষণ বসে গল্প করে চলে গেল।
পরদিনও দেখি সে ডাক-ব্যাগ ঝুলিয়ে চিঠি বিলি করে বেড়াচ্চে, সঙ্গে ছোকরা বয়সের পিয়োন।
বললাম—কী গৌর, আজ আবার যে?
গৌর প্রণাম করে বললে—নতুন লোক এসেছে, ও তো বাড়িঘর চেনে না, তাই ওকে নিয়ে বেড়াচ্চি।
কিছুদিন কেটে গেল।
গৌর পিয়োনের বাড়িতে ওর স্ত্রী অনেকদিন মারা গিয়েছে। একটি মেয়ে আছে, সেই রান্নাবাড়া করে। অবস্থা অতি দীনহীন।
একদিন ওর বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম, গিয়ে দেখি ও পরের বাড়িতে দুধ দুয়ে বেড়াচ্ছে।
গৌর বললে—বাবাঠাকুর, পেনশনে কী চলে? আজকাল এই বাজার। তাই দেখি, দুধ দুয়ে কিছু যদি উপরি পাই!
—একটা ছোটখাটো ব্যাবসা করো না কেন?
—বাবাঠাকুর, যথেষ্ট বয়েস হয়েছে। হাতে টাকাপয়সাও নেই যে ব্যাবসা করব। এই-রকম করে আপনাদের আশীর্বাদে একরকম চলে যাবে।
সত্যিকার দীনতমাখা মুখ ওর। দীনতা যদি বৈষ্ণবসুলভ গুণ হয়, তবে ও একজন খাঁটি বৈষ্ণব।
তারপর একটি মজার ঘটনা ঘটে গেল।
ব্যাপার এই মহকুমা হাকিম বদলি হয়ে যাচ্ছেন, তাঁর বিদায় অভিনন্দনের সভায় আমার ডাক পড়ল। খুব বক্তৃতা ও প্রচুর জলযোগের আয়োজন ছিল সেখানে। এমন সহৃদয় রাজকর্মচারী জীবনেও নাকি কেউ দেখেননি। তিনি মহকুমার যে উপকার করে গেলেন, এখানকার অধিবাসীরা কখনো তা বিস্মৃত হবে না (কী উপকার? আজকের দিনটি ছাড়া কারো মুখে এতদিন সেই মহদুপকারের বার্তা শোনা যায়নি। কেন?)। বীরেনবাবু বক্তৃতা করতে উঠলে কানে কানে বললাম, আর কেন বেশি কথা খরচ করেন অস্তগামী সূর্যের পিছনে, সংক্ষেপে সারুন! লুচি ঠাণ্ডা করেন কেন অকারণে!
বিদায়ী মহকুমা হাকিম তাঁর বক্তৃতায় বললেন—তিনি এই মহকুমার জন্যে বিশেষ কিছু করেননি (খাঁটি সত্য), তাঁর বন্ধুরা তাঁকে স্নেহ করেন বলেই এত
ভালো উক্তি তাঁর সম্বন্ধে করলেন (মিথ্যে কথা হয়ে গেল, স্নেহ করেন বলে নয়)। তিনি এখানকার কথা কখনো ভুলতে পারবেন না, ইত্যাদি।
সেখান থেকে ফেরবার পথে বার বার মনে হল, এসব বিদায়-অভিনন্দন ব্যাপারটা আগাগোড়া মিথ্যে ও অসার। মহকুমা হাকিমকে তোষামোদ করতে হবে বলেই এর আয়োজন। আমি গৌর পিয়োনকে অভিনন্দন দেব না কেন? সত্যিকার সমাজসেবক সে, পঁয়ত্রিশ বছর ধরে গ্রামে গ্রামে চিঠি বিলি করে এসেচে জল ঝড়কে তুচ্ছ করে—শীত মানেনি, গ্রীষ্ম মানেনি। বিনয়ের সঙ্গে, দীনতার সঙ্গে, মুখে কখনো একটা উঁচু কথা শোনা যায়নি তার।
গ্রামে তরুণ সংঘের ছেলেদের কাছে কথাটা পাড়তেই তারা তখুনি রাজি হয়ে গেল। সংঘের কর্মী নিতাই বললে—খুব ভালো কথা কাকা। নতুন জিনিস আমাদের দেশে।
বিনয় আর একজন ভালো কর্মী, সংঘের সেক্রেটারি। তার খুব উৎসাহ দেখা গেল এতে; সে বললে—রসিক চক্কত্তি দারোগাকে আমরা ও-বছর অভিনন্দন দিইচি কাকা, বাহাত্তর টাকা চাঁদা তুলে। আপনি জানেন না, সে অতিধড়িবাজ লোক ছিল, ঘুষ খেত দু-তরফ থেকেই। তাকে যখন অভিনন্দন দিয়েচি—
—সে সভায় সভাপতি কে ছিল?
–বরেন দাঁ, ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট।
—ওই যার দোকান?
—আজ্ঞে, যে এ-বাজারে কাপড়ের চোরাবাজারে লাল হয়ে গেল। সে একাই পঁচিশ টাকা চাঁদা দিয়েছিল।
—দেবেই তো। দারোগার সঙ্গে ভাব না-থাকলে চোরাবাজার হয় কি করে?
সন্ধ্যার সময় তরুণ সংঘের কর্মীরা এসে জানালে, কাজ তারা আরম্ভ করে দিয়েছে। তবে বাজারের অনেকেই হাসচে। বরেন দাঁ সবচেয়ে বেশি। বরেন দাঁ চাঁদা দেবে না। সে বলে—গৌর পিয়োনের অভিনন্দন! এ মোলব কার মাথায় এল? দূর! তোমরা বাবা লোক হাসালে দেখচি! লোকে কী বলবে? কে কবে শুনেচে, ডাক হরকরা পেনশন পেলে তাকে আবার ফেয়ার-ওয়েল-পার্টি দেওয়া হয়? হাকিম-দারোগাদের দেওয়া হয় জানি!
বিনয় বলেছে—আপনাদের কাল চলে গিয়েছে বরেন জ্যাঠা। একালে গরিব লোকেরাই অভিনন্দন পাবে। দিন চাঁদা। আমরা শুনব না। দশ টাকা দেবেন আপনি। কেন দেবেন না?
এই নিয়ে উভয় পক্ষের তর্ক হয়ে গিয়েছে। বরেন চাঁদা দেয়নি, শেষপর্যন্ত নাকি বলেছিল, আট আনা নিয়ে যাও। বিনয় না-নিয়ে চলে এসেছে।
তাতে কোনো ক্ষতি হয়নি। বিনয়কে বললাম—বুধবার অভিনন্দনসভা, বাজারের বড়ো চাঁদনিতে সবাইকে জানিয়ে দাও–
বিনয় বললে—আপনি শুধু পেছনে থাকুন, আমাদের ওপর কাজ করবার ভার রইল।
দু-তিন দিন খুব বর্ষা হল। আমি আর কোথাও বেরুতে পারিনি। ব্যাপারটা কতদূর এগিয়েছে তার খোঁজ নিতে পারলাম না। বুধবার দিন বিকেলের দিকে সেজেগুজে বাজারের দিকে বেরুলাম।
জিনিসটা কি আমিই নষ্ট করে দিলাম? একবার দেখা দরকার।
বাজারে যেতেই দেখি, ক্যাম্বিসের জুতো পায়ে, গায়ে জামা, গৌর পিয়োন আমার আগে আগে চলেচে।
বড়ো চাঁদনিতে গিয়ে দেখলাম, ছোকরার দল দিব্যি সভা সাজিয়েছে। রঙিন কাগজের মালা, দেবদারু পাতা, মায় কলাগাছ—কিছু বাদ যায়নি। স্কুল থেকে চেয়ার-বেঞ্চি আনিয়েছে। ভেঁপু মুখে দিয়ে তারা বলে বেড়াচ্ছে—’আজ বেলা পাঁচটায় অবসরপ্রাপ্ত পিয়োন শ্রীগৌরচন্দ্র হালদারের বিদায় অভিনন্দনসভা হবে বড়ো চাঁদনিতে—আপনারা দলে দলে যোগদান করুন।’
স্কুলের ছেলেরা ভিড় করে এল সভায়। মাস্টারদের মধ্যে কেউ বাদ রইলেন না। বাজারের লোকও সকলে এল—কী হয় দেখতে। ফলে সভা আরম্ভ হবার আগেই বসবার আসন সব ভরতি হয়ে গেল। লোকে চারিদিকে দাঁড়িয়ে থাকতে আরম্ভ করলে।
বিনয় নিয়ে এল বরেন দাঁকে সসম্মানে অভ্যর্থনা করে। স্মিতমুখে বরেন দাঁ সভায় ঢুকে আমাকে দেখে একটু যেন দমে গেল।
তাহলে কী সভাপতি তাকে করা হবে না? আমাকে বললে—ভায়া যে! কবে এলে?
—আমি তো এসেচি চার-পাঁচদিন হল।
—তাই!
–তার মানে বরেন-দা?
–এখন সব বুঝলাম ভায়া। তুমি যে এসেচ জানতাম না। এখন বুঝলাম।
—কী বুঝলে?
—তোমারই কাজ। নইলে গৌর পিয়োনের অভিনন্দন! এমন উদঘুট্টি কাণ্ড আবার কার মাথায় আসবে? তা ভায়া, আজকের সভাপতিত্বটা তুমিই করো।
আমি পল্লিগ্রামের ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টের মনের ভাব বুঝি নে? এত বোকা আমি নই!
তৎক্ষণাৎ বললাম, ক্ষেপেচ বরেন-দা? তুমি হাজির থাকতে আমি! কীসে আর কীসে! তা হয় না। চলো দাদা, তোমাকে আজকের দিনের
—না না, শোনো ভায়া…
বরেন দাঁর মুখে খুশির ঔজ্জ্বল্য। আমি ওকে হাত ধরে টেনে সভাপতির চেয়ারে এনে বসালাম।
আমার ইঙ্গিতে গৌর পিয়োনকে সভাপতির আসনের পাশে বসানো হল। একেবারে প্রেসিডেন্টের পাশের চেয়ারে…জনমণ্ডলীর উন্মুক্ত দৃষ্টির সামনে।
এ-ও আজ সম্ভব হল। গৌর পিয়েনের দিকে চেয়ে দেখলাম। ওর মুখও খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
গৌর চারিধারে চেয়ে চেয়ে দেখচে, একী ব্যাপার! সে বোধ হয় বিশ্বাস করতে পারেনি যে তার সভা এমন চেহরার হবে বা তাতে এত লোকের সমাগম হবে। বরেন দাঁর মতো বিশিষ্ট ব্যক্তি, স্কুলের হেডমাস্টারের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তি, অড়োতদার নৃপেন সরকারের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তি সে-সভা অলংকৃত করবেন তাঁদের মহিমময় উপস্থিতির দ্বারা। ছেলেরা সভায় দলবেঁধে এল, প্রত্যেকের হাতে একগাছা করে ফুলের মালা, একজনের হাতে চন্দনের বাটি। উদবোধনী সংগীত শুরু হল :
‘শরতে আজ কোন অতিথি এল প্রাণের দ্বারে’
রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেই হবে, যার যা জানা আছে, সভার উদ্দেশ্যের সঙ্গে মিল হল বা না-হল। পাড়াগাঁয়ে কে ক-টি রবীন্দ্রনাথের গান জানে? যা জানে ওই ভালো। লাগাও—
আমি সভাপতি নির্বাচনের প্রস্তাব করবার সময় বললাম—
আজকের এই জনসভায় বিশিষ্ট সমাজসেবক শ্রীগৌরচন্দ্র হালদার মহাশয়ের অভিনন্দন উৎসবে পৌঁরোহিত্য করবার জন্য দেশের অলংকারস্বরূপ (কীসে?) উদারহৃদয় (একদম বাজে) কর্মী আমাদের ইউনিয়ন বোর্ডের সুযোগ্য (নির্জলা মিথ্যে) প্রেসিডেন্ট মহোদয়কে (মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রম্যান আর কী) অনুরোধ করচি, তিনি দয়া করে অদ্য (দয়া করবার জন্যে পা বাড়িয়েই আছেন)—ইত্যাদি ইত্যাদি।
একটি ছোটো মেয়ে সভাপতির গলায় ফুলের মালা দিলে। কাৰ্যসূচীর প্রথমেই আমি লিখে রেখেচি, ‘সভাপতি কর্তৃক শ্রীগৌরচন্দ্র হালদার মহাশয়কে মাল্য-চন্দন দান।’ অতএব সভাপতিকে গৌর পিয়োনের কপালে চন্দন মাখিয়ে দিতে হল (কেমন মজা, বরেন দাঁ) এবং মালা পরিয়ে দিতে হল। সে কী হাততালির বহর চারিদিকে! বেচারি গৌর পিয়োন বিমূঢ় বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। একে একে বক্তাদের নাম ডাকা হতে লাগল। আমিই নাম-তালিকায় একের পর এক বক্তার নাম লিখে দিয়েচি। যথা—
১। স্থানীয় হোমিয়োপ্যাথিক ডাক্তার—গদাধরবাবু।
২। স্কুলের শিক্ষক, মহাদেববাবু।
৩। স্টেশনমাস্টার।
৪। পোস্ট মাস্টার।
৫। অড়োতদার নৃপেন সরকার।
৬। কবিরাজমশাই।
৭। প্রাইমারি স্কুলের পণ্ডিতমশাই।
৮। চামড়ার খটিওয়ালা রজবালি বিশ্বাস।
৯। বস্ত্র-ব্যবসায়ী রামবিষ্ণু পাল।
১০৷ আমি।
১১। সভাপতি। এদের মধ্যে অনেকে সভায় বক্তৃতা কখনো দেয়নি। সভায় দাঁড়িয়ে উঠে, মুখ শুকিয়ে গলা কাঠ হয়ে চোখে সর্ষের ফুল দেখে বক্তারা আর কিছু বলবার না পেয়ে, গৌর পিয়োনকে একেবারে আকাশে তুলে দিলে।
না, গদাধর ডাক্তার মন্দ বললেন না। মহাদেববাবু বৃদ্ধ হলেও শিক্ষিত ব্যক্তি, মোটামুটি গুছিয়ে দু-চার কথা যা হোক একরকম হল। স্টেশনমাস্টার হাত-পা কেঁপে অস্থির। পোস্ট মাস্টার খুব ভালো বললেন, তবে অনভ্যাসের দরুন একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল।
বক্তৃতার শেষে তিনি ঝোঁকের মাথায় একেবারে ছুটে এসে—’ভাই রে গৌর! আজ আর তুমি ছোটো আমি বড়ো নই, আজ তুমি আমার ভাই।’—বলে একেবারে নিবিড়ে আলিঙ্গনে গৌর পিয়োনকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। দস্তুরমতো ‘সিন’ যাকে বলে। লোকে মজা দেখে খুব হাততালি দিয়ে উঠল।
তারপরই অড়োতদার নৃপেন সরকার। বেচারি অত হাততালির পরের বক্তা। জীবনে এই সর্বপ্রথম তিনি সভায় দশজনের উৎসুক দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়েছেন। বেচারি প্রথমেই বলে ফেললেন, ‘আমরা একজন মহাপুরুষের বিদায়-উৎসব সভায় একত্র হয়েচি।’ যাকে বলা হচ্ছে সে পর্যন্ত অবাক হয়ে গেল।
কবিরাজমশাই সংস্কৃত শ্লোক-টোক আবৃত্তি করে সভাটাকে কুশণ্ডিকার আসর করে তুললেন। মানুষের মধ্যে ব্রহ্ম বাস করেন, অতএব গৌর পিয়োন ছোটো কাজ করত বলে ছোটো নয়, সেও ব্রহ্ম। উপনিষদের ঋষিদের তপোবনের এই আবহাওয়া বইয়ে দেবার পরে প্রাইমারি স্কুলের পণ্ডিত বেচারি মহাফাঁপরে পড়লেন, কিন্তু তার চেয়েও ফাঁপরে পড়ল চামড়ার খটিওয়ালা—রজবালি বিশ্বাস।
স্কুলের পণ্ডিত ভালোমানুষ লোক, ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টের গুণ ব্যাখ্যা করে বক্তৃতা শেষ করলেন।
নানা কারণে তাঁকে বরেন দাঁর মুখের দিকে চাইতে হয়।
রজবালি বিশ্বাস বললে, এ পর্যন্ত তার চিঠিগুলো ঠিকমতো বিলি করেচে গৌর, অমন পিয়োন আর হয় না। এইখানেই ইতি।
আর কোনো কথা বার হল না তার মুখ দিয়ে। ঘেমে উঠল আর অসহায়ভাবে এদিক ওদিক চাইতে লাগল। পরে হঠাৎ ধপ করে বসে পড়ে বক্তৃতার উপসংহার করলে।
রামবিষ্ণু পাল বৃদ্ধ ব্যবসায়ী, সৎলোক, গৌরকে তিনি বন্ধু বলে সম্বোধন করলেন। বাল্যে গৌর পাঠশালায় তাঁর সহপাঠী ছিল, এইটুকুমাত্র বললেন। আমি এক মানপত্র লিখে এনেছিলাম, তাতে গৌর পিয়োনের সম্বন্ধে অনেক ভালো ভালো কথা বলা ছিল। মানপত্র পড়ে আমি গৌরের হাতে দিলাম।
সভাপতি বরেন দাঁ ঘুঘু লোক, সভার গতি কোনদিকে সে অনেকক্ষণ বুঝেচে।
সভাপতির অভিভাষণে সে গৌর পিয়োনের এমনসব গুণের বর্ণনা করে গেল, যা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। গৌর পিয়োন প্রকৃতই দেখলাম লজ্জিত হয়ে উঠেচে ওর সব কথা শুনে এবং বিস্মিত সে নিশ্চিতই হত, কিন্তু তার বিস্ময়বোধের শক্তি আজ অনেকক্ষণ সে হারিয়ে ফেলেছে।
গৌর পিয়োন কিছু বলতে উঠে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললে। শুধু সে হাতজোড় করে সভার সকলের দিকে চেয়ে দু-দিনবার বললে—বাবুরা–বাবুরা…
তারপর সবাইকে করজোড়ে বার বার প্রণাম করে সে ধপ করে বসে পড়ল।
এবার সভা ভঙ্গ হবে। ছোকরার দল অমনি গেয়ে উঠল :
‘তোমার বিদায় বেলার মালাখানি আমার গলে’
—না, রবীন্দ্রনাথের গান চাই।
বিনয়কে বললাম—খাইয়েচ?
চাঁদনির পাশে হরি ময়রার দোকানে হাত ধরে গৌর পিয়োনকে নিয়ে যাওয়া হল।
গেল সে। সে চলে যাচ্ছিল বাড়ির দিকে। আমিও গেলাম ওদের পেছনে পেছনে।
তা ছেলেরা আয়োজন করেচে ভালো।
দুটো ফজলি আম, দই, সন্দেশ, নিমকি। বড়ো রাজভোগ যে-কটা পারে গৌর খেতে। খেয়ে কি খুশি বেচারি। চোখে তার প্রায় জল এসে গেল আবার।
আমার দিকে চেয়ে সে বললে—এমন দিন যে হবে তা ভাবিনি। সব আপনার কাণ্ড, আমি তা বুঝিচি। কি খাওয়াডাই খাওয়ালেন, কি ভালো কথাই বললেন আমার সম্বন্ধে। বড় গুরুবল আমার।
বললাম—খুশি হয়েচ গৌর?
—ওই যে বললাম বাবাঠাকুর, এমনধারা দিন যে আমার আসবে তা…
ওর গলায় এখনো সেই ফুলের মালা।
অভিশপ্ত
আমার জীবনে সেই এক অদ্ভুত ব্যাপার সেবার ঘটেছিল।
বছর তিনেক আগেকার কথা। আমাকে বরিশালের ওপারে যেতে হয়েছিল একটা কাজে। এ অঞ্চলের একটা গঞ্জ থেকে বেলা প্রায় বারটার সময় নৌকোয় উঠলুম। আমার সঙ্গে এক নৌকোয় বরিশালের এক ভদ্রলোক ছিলেন। গল্পে গুজবে সময় কাটতে লাগল।
সময়টা পুজোর পরেই। দিনমানটা মেঘলা মেঘলা কেটে গেল। মাঝে মাঝে টিপটিপ করে বৃষ্টিও পড়তে শুরু হল। সন্ধ্যার কিছু আগে কিন্তু আকাশটা অল্প পরিষ্কার হয়ে গেল। ভাঙা ভাঙা মেঘের মধ্যে দিয়ে চতুর্দশীর চাঁদের আলো অল্প অল্প প্রকাশ হল।
সন্ধ্যার হবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা বড় নদী ছেড়ে একটা খালে পড়লুম — শোনা গেল খালটা এখান থেকে আরম্ভ হয়ে নোয়খালির উত্তর দিয়ে একেবারে মেঘনায় মিশেছে। পূর্ববঙ্গে সেই আমার নতুন যাওয়া, চোখে কেমন সব একটু নতুন ঠেকতে লাগল। অপরিসর খালের দুধারে বৃষ্টিস্নাত কেয়ার জঙ্গলে মেঘে আধোঢাকা চতুর্দশীর জ্যোৎস্না চিকমিক করছিল। মাঝে মাঝে নদীর ধারে বড় বড় মাঠ। শটি, বেত, ফার্নগাছের বন জায়গায় জায়গায় খালের জলে ঝুঁকে পড়েছে। বাইরে একটু ঠাণ্ডা থাকলেও আমি ছইয়ের বাইরে বসে দেখতে দেখতে যাচ্ছিলুম। বরিশালের যে অংশটা সুন্দরবনের কাছাকাছি, ছোট ছোট খাল ও নদী চারিধারে, সমুদ্র খুব দূরে নয়, দশ পনের মাইল দক্ষিণ পশ্চিমেই হাতিয়া ও সন্দ্বীপ। আর একটু রাত হল। খালের দু’পাড়ের নির্জন জঙ্গল অস্ফুট জ্যোৎস্নায় কেমন যেন অদ্ভুত দেখাতে লাগল। এ অংশে লোকের বসতি একেবারে নেই; শুধু ঘন বন আর জলের ধারে বড় বড় হোগলা গাছ।
আমার সঙ্গী বললেন, এত রাতে আর বাইরে থাকবেন না, আসুন ছইয়ের মধ্যে। এসব জঙ্গলে — বুঝলেন না?
তারপর তিনি সুন্দরবনের নানা গল্প করতে লাগলেন। তাঁর এক কাকা নাকি ফরেস্ট ডিপার্টমেণ্টে কাজ করতেন, তারই লঞ্চে করে তিনি একবার সুন্দরবনের নানা অংশে বেড়িয়েছিলেন — সেই সব গল্প।
রাত প্রায় বারোটার কাছাকাছি হল। মাঝি আমাদের নৌকোয় ছিল মোটে একটি। সে বলে উঠল — বাবু, একটু এগিয়ে গিয়ে বড় নদী পড়বে। এত রাতে একা সে নদীতে পাড়ি জমাতে পারব না। এখানেই নৌকো রাখি।
নৌকো সেখানেই বাঁধা হল। এদিকে বড় বড় গাছের আড়ালে চাঁদ অস্ত গেল, দেখলুম অপ্রশস্ত খালের দুধারেই অন্ধকারে ঢাকা ঘন জঙ্গল। চারিদিকে কোন শব্দ নেই, পতঙ্গগুলো পর্যন্ত চুপ করেছে। সঙ্গীকে বললুম, মশায়, এই তো সরু খাল — পাড় থেকে বাঘ লাফিযে পড়বে না তো নৌকোর ওপর?
সঙ্গী বললেন, না পড়লেই আশ্চর্য হব।
শুনে অত্যন্ত পুলকে ছইয়ের মধ্যে ঘেঁষে বসলুম। খানিকটা বসে থাকবার পর সঙ্গী বললে, আসুন একটু শোয়া যাক। ঘুম তো হবে না, আর ঘুমোনো ঠিকও না, আসুন একটু চোখ বুজে থাকি।
খানিকটা চুপ করে থাকবার পর সঙ্গীকে ডাকতে গিয়ে দেখি তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন, মাঝিও জেগে আছে বলে মনে হল না; ভাবলুম, তবে আমিই বা কেন মিথ্যে মিথ্যে চোখ চেয়ে চেয়ে থাকি — মহাজনদের পথ ধরবার উদ্যোগ করলুম।
তারপর যা ঘটল সে আমার জীবনের এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। শুতে যাচ্ছি হঠাৎ আমার কানে গেল অন্ধকার বন ঝোপের ওপাশে অনেক দূরে গভীর জঙ্গলের মধ্যে কে যেন কোথায় গ্রামোফোন বাজাচ্ছে। তাড়াতাড়ি উঠে বসলুম — গ্রামাফোন? এ বনে এত রাত্রে গ্রামাফোন বাজাবে কে? কান পেতে শুনলুম — গ্রামাফোন না। অন্ধকারে হিজল হিন্তাল গাছগুলো যেখানে খুব ঘন হয়ে আছে, সেখান থেকে কারা যেন উচ্চ কণ্ঠে আর্তকরুণ সুরে কি বলছে। খানিকটা শুনে মনে হল সেটা একাধিক লোকের সমবেত কণ্ঠস্বর। প্রতিবেশীর তেতলার ছাদে গ্রামোফোন বাজলে যেমন খানিকটা স্পষ্ট, খানিকটা অস্পষ্ট, অথচ বেশ একটা একটানা সুরের ঢেউ এসে কানে পৌঁছয় — এও অনেকটা সেই ভাবের। মনে হল যেন কতকগুলো অস্পষ্ট বাংলা ভাষার শব্দও কানে গেল, কিন্তু ধরতে পারা গেল না কথাগুলো কি। শব্দটা মাত্র মিনিটখানেক স্থায়ী হল, তারপরই অন্ধকার বনভূমি যেমন নিস্তব্ধ ছিল, তেমনি নিস্তব্ধ হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি ছইয়ের বাইরে এলুম। চারিপাশের অন্ধকার ঝিঙের বিচির মতন কালো। বনভূমি নীরব, শুধু নৌকোর তলায় ভাঁটার জল কলকল করে বাধছে, আর শেষ রাত্রের বাতাসে জলের ধারে কেয়া ঝোপে এক প্রকার অস্পষ্ট শব্দ হচ্ছে। পাড় থেকে দূরে হিজল গাছের কালো গুঁড়িগুলোর অন্ধকারে এক অদ্ভুত চেহারা হয়েছে।
ভাবলাম সঙ্গীদের ডেকে তুলি। আবার ভাবলুম বেচারীরা ঘুমুচ্ছে ডেকে কি হবে, তার চেয়ে বরং নিজে জেগে বসে থাকি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালুম; তারপর আবার ছইয়ের মধ্যে ঢুকতে যাব, এমন সময় সেই অন্ধকারে ঢাকা বিশাল বনভূমির কোন অংশ থেকে সুস্পষ্ট উচ্চ আর্তকরুণ ঝিঁঝি পোকার রবের মত তীক্ষ্ণস্বর তীরের মতন জমাট অন্ধকারের বুক চিরে আকাশে উঠল — ওগো নৌকাযাত্রীরা, তোমরা কারা যাচ্ছ — আমরা শ্বাস বন্ধ হয়ে মলাম — আমাদের ওঠাও ওঠাও — আমাদের বাঁচাও।
নৌকোর মাঝিটা ধড়মড় করে জেগে উঠল। আমি সঙ্গীকে ডাকলুম — মশায়, ও মশায়, উঠুন, উঠুন।
মাঝি আমার কাছে ঘেঁষে এল, ভয়ে তার গলার স্বর কাঁপছে। বললে — আল্লা! আল্লা! শুনতে পেয়েছেন বাবু?
আমি ব্যাপারটা বললুম। তিনিও তাড়াতাড়ি ছইয়ের বাইরে এলেন। তিনজনে মিলে কান খাড়া করে রইলুম। চারিদিক আবার চুপ। ভাঁটার জল নৌকোর তলায় বেধে আগের চেয়েও জোরে শব্দ হচ্ছিল।
সঙ্গী মাঝিকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি তবে…
মাঝি বললে, হ্যাঁ বাবু, বাঁয়েই কীর্তিপাশার গড়।
সঙ্গী বললেন, তবে তুই এত রাত্রে এখানে নৌকো রাখলি কেন? বেকুব কোথাকার!
মাঝি বললে — তিনজন আছি বলেই রেখেছিলাম বাবু। ভাঁটার টানে নৌকো পিছিয়ে নেবার তো জো ছিল না।
কথাবার্তার ধরণ শুনে সঙ্গীকে বললুম, কি মশায়, কি ব্যাপার? আপনি কিছু জানেন নাকি?
ভয়ে যত না হোক বিস্ময়ে আমরা কেমন হয়ে গিয়েছিলুম। সঙ্গী বললেন — ওরে তোর সেই কেরোসিনের ডিবেটা জ্বাল। আলো জ্বেলে বসে থাকা যাক — রাত এখন ঢের।
মাঝিকে বললুম, তুই শব্দটা শুনতে পেয়েছিলি?
সে বললে, হঁযা বাবু, আওয়াজ কানে গিয়েই তো আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি আরও দুবার নৌকো বেয়ে যেতে যেতে ও ডাক শুনেছি।
সঙ্গী বললেন, এটা এ অঞ্চলের একটা অদ্ভুত ঘটনা। তবে এ জায়গাটা সুন্দরবনের সীমানায় বলে আর এ অঞ্চলে কোন লোকালয় নেই বলে, শুধু নৌকোর মাঝিদের কাছেই এটা সুপরিচিত। এর পেছনে একটা ইতিহাস আছে, সেটা অবশ্য নৌকোর মাঝিদের পরিচিত নয় — সেইটে আপনাকে বলি শুনুন।
তারপর ধূমায়িত কেরোসিনের ডিবার আলোয় অন্ধকার বনের বুকের মধ্যে বসে সঙ্গীর মুখে কীর্তিপাশার গড়ের ইতিহাসটা শুনতে লাগলুম।
তিনশ’ বছর আগেকার কথা। মুনিম খাঁ তখন গৌড়ের সুবাদার। এ অঞ্চলে তখন বারভুঁইয়ার দুই প্রতাপশালী ভুঁইয়া রাজা রামচন্দ্র রায় ও ঈশা খাঁ মশনদ-ই-আলির খুব প্রতাপ। মেঘনার মোহনার বাহির সমুদ্র, যাকে এখন সন্দ্বীপ চ্যানেল বলে, সেখানে তখন মগ আর পর্তুগীজ জলদস্যুরা শিকারাণ্বেষণে শ্যেনপক্ষীর মত ওৎ পেয়ে বসে থাকত।
সে সময় এখানে এরকম জঙ্গল ছিল না। এ সমস্ত জায়গা তখন কীর্তি রায়ের অধিকারে ছিল। এইখানে তাঁর সুদৃঢ় দুর্গ ছিল — মগ জলদস্যুদের সঙ্গে তিনি অনেকবার লড়েছিলেন। তাঁর অধীনে সৈন্যসামন্ত, কামান, যুদ্ধের কোষা সবই ছিল। সন্দ্বীপ তখন ছিল পর্তুগীজ জলদস্যুদের প্রধান আড্ডা। এদের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করবার জন্যে এ অঞ্চলে সকল জমিদারকেই সৈন্যবল দৃঢ় করে গড়তে হত। এ বনের পশ্চিম ধার দিয়ে তখন আর একটা খাল বড় নদীতে পড়ত, বনের মধ্যে তার চিহ্ন এখনও আছে।
কীর্তি রায় অত্যন্ত অত্যাচারী এবং দুর্ধর্ষ জমিদার ছিলেন। তাঁর রাজ্যে এমন সুন্দর মেয়ে কমই ছিল, যে তাঁর অন্তঃপুরে একবার না ঢুকেছে। তা ছাড়া তিনি নিজেও এক প্রকার জলদস্যু ছিলেন। তাঁর নিজের অনেকগুলো বড় ছিপ ছিল। আশপাশের জমিদারি এমন কি নিজের জমিদারির মধ্যেও সম্পত্তিশালী গৃহস্থের ধনরত্ন স্ত্রী কন্যা লুঠপাট করা রূপ মহৎ কার্যে সেগুলি ব্যবহৃত হত।
কীর্তি রায়ের পাশের জমিদারি ছিল কীর্তি রায়ের এক বন্ধুর। এঁরা ছিলেন চন্দ্রদ্বীপের রাজা রামচন্দ্র রায়দের পত্তনিদার। অবশ্য সে সময় অনেক পত্তনিদারের ক্ষমতা এখনকার স্বাধীন রাজাদের চেয়ে বেশি ছিল। কীর্তি রায়ের বন্ধু মারা গেলে তাঁর তরুণবয়স্ক পুত্র নরনারায়ণ রায় পিতার জমিদারির ভার পান। নরনারায়ণ তখন সবে যৌবনে পদার্পণ করেছেন, অত্যন্ত সুপুরুষ, বীর ও শক্তিমান। নরনারায়ণ কীর্তি রায়ের পুত্র চঞ্চল রায়ের সমবয়সী ও বন্ধু।
সেবার কীর্তি রায়ের নিমন্ত্রণে নরনারায়ন রায় তাঁর রাজ্যে দিনকতকের জন্যে বেড়াতে এলেন। চঞ্চল রায়ের তরুণী পত্নী লক্ষ্মী দেবী স্বামীর বন্ধু নরনারায়ণকে দেবরের মতন স্নেহের চক্ষে দেখতে লাগলেন। দু’একদিনের মধ্যেই কিন্তু সে স্নেহের চোটে নরনারায়ণকে বিব্রত হয়ে উঠতে হল। নরনারায়ণ রায় তরুণবয়স্ক হলেও একটু গম্ভীর প্রকৃতি। বিদ্যুৎ চঞ্চলা তরুণী বন্ধুপত্নীর ব্যঙ্গ-পরিহাসে গম্ভীর প্রকৃতি নরনারায়ণের মান বাঁচিয়ে চলা দুষ্কর হয়ে পড়ল। স্নান করে উঠেছেন, মাথার তাজ খুঁজে পাওয়া যায় না, নানা জায়গায় খুঁজে হয়রান হয়ে তার আশা ছেড়ে দিযে বসে আছেন, হঠাৎ কখন নিজের বালিশ তুলতে গিয়ে দেখেন তার নিচেই তাজ চাপা আছে — যদিও এর আগে তিনি বালিশের নিচে খুঁজেছেন। তাঁর প্রিয় তরবারিখানা দুপুর থেকে বিকেলের মধ্যে পাঁচ বারই সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত স্থান থেকে খুঁজে পাওয়া গেল। তাম্বুলে এমন সব দ্রব্যের সমাবেশ হতে লাগল, যা কোন কালেই তাম্বুলের উপকরণ নয়। তরল মস্তিষ্ক বন্ধুপত্নীকে কিছুতেই এঁটে উঠতে না পেরে অত্যাচার জর্জরিত নরনারায়ণ রায় ঠিক করলেন তাঁর বন্ধুর স্ত্রীটি একটু ছিটগ্রস্ত। বন্ধুর দুর্দশায় চঞ্চল রায় মনে মনে খুব খুশি হলেও বাইরে স্ত্রীকে বললে, দুদিনের জন্য এসেছে বেচারী, ওকে তুমি যে রকম বিব্রত করে তুলেছ, ও আর কখনো এখানে আসবে না।
দিন কয়েক এ রকমে কাটবার পর কীর্তি রায়ের আদেশে চঞ্চল রায়কে কি কাজে হঠাৎ গৌড়ে যাত্রা করতে হল। নরনারায়ণ রায়ও বন্ধুপত্নী কখন কি করে বসে, সেই ভয়ে দিনকতক সশঙ্ক অবস্থায় কালযাপন করবার পর নিজের বজরায় উঠে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। যাবার সময় লক্ষ্মী দেবী বলে দিলেন — এবার আবার যখন আসবে ভাই, এমন একটি বিশ্বাসী লোক সঙ্গে এনো যে রাত দিন তোমার জিনিসপত্র ঘরে বসে চৌকি দেবে — বুঝলে তো?
নরনারায়ণ রায়ের বজরা রায়মঙ্গলের মোহানা ছাড়িয়ে যাবার একটু পরেই জলদস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হল। তখন মধ্যাহ্নকাল, প্রখর রৌদ্রে বজরার দক্ষিণ দিকের দিগ্ববলয় প্রসারী জলরাশি শানানো তলোয়ারের মত ঝকঝক করছিল, সমুদ্রের সে অংশে এমন কোন নৌকো ছিল না — যারা সাহায্য করতে আসতে পারে। সেটা রায়মঙ্গল আর কালাবদর নদীর মুখ, সামনেই বার সমুদ্র — সন্দ্বীপ চ্যানেল, জলদস্যুদের প্রধান ঘাঁটি। নরনারায়ণের বজরার রক্ষীরা কেউ হত হল, কেউ সাংঘাতিক জখম হল। নিজে নরনারায়ণ দস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে উরুদেশে কিসের খোঁচা খেয়ে সংজ্ঞাশূণ্য হয়ে পড়লেন।
জ্ঞান হলে দেখতে পেলেন তিনি এক অন্ধকার স্থানে শুয়ে আছেন, তাঁর সামনে কি যেন একটা বড় নক্ষত্রের মতন জ্বলছে। খানিকক্ষণ জোরে চোখের পলক ফেলবার পর তিনি বুঝলেন, যাকে নক্ষত্র বলে মনে হয়েছিল তা প্রকৃতপক্ষে একটি অতি ক্ষুদ্র গবাক্ষপথে আগত দিবালোক। নরনারায়ণ দেখলেন তিনি একটি অন্ধকার কক্ষের আর্দ্র মেঝের ওপর শুয়ে আছেন, ঘরের দেওয়ালের স্থানে স্থানে সবুজ শেওলার দল গজিয়েছে। আরও ক’দিন আরও ক’রাত গেল। কেউ তাঁর জন্যে খাদ্য আনলে না। তিনি বুঝলেন, যারা তাঁকে এখানে এনেছে, তাঁকে না খেতে দিয়ে মেরে ফেলাই তাদের উদ্দেশ্য। মৃত্যু! সামনে নির্মম মৃত্যু।
সে দিনমানও কেটে গেল। আঘাত জনিত ব্যথায় এবং ক্ষুধা তৃষ্ণায় অবসন্ন দেহ নরনারায়ণের চোখের সামনে থেকে গবাক্ষ পথের শেষ দিবালোক মিলিয়ে গেল। তিনি অন্ধকার ঘরে পাষাণ শয্যায় ক্ষুধা কাতর দেহ প্রসারিত করে অধীরভাবে মৃত্যুর অপেক্ষা করতে লাগলেন। প্রকৃতির একটা ক্লোরোফর্ম আছে, যন্ত্রণা পেয়ে মরছে এমন প্রাণীকে মৃত্যু যন্ত্রণা থেকে বাঁচাবার জন্যে সেটা মূমুর্ষু প্রাণীকে অভিভূত করে। ধীরে ধীরে যেন সেই দয়াময়ী মৃত্যু-তন্দ্রা এসে তাঁকেও আশ্রয় করলে। অনেকক্ষণ পরে, কতক্ষণ পরে তা তিনি বুঝতে পারলেন না — হঠাৎ আলো চোখে লেগে তাঁর তন্দ্রাঘোর কেটে গেল। বিস্মিত নরনারায়ণ চোখ মেলে দেখলেন, তাঁর সামনে প্রদীপ হস্তে দাঁড়িয়ে তাঁর বন্ধুপত্নী লক্ষ্মী দেবী। কথা বলতে গিয়ে লক্ষ্মী দেবীর ইঙ্গিতে নরনারায়ণ থেমে গেলেন। লক্ষ্মী দেবী হাতের প্রদীপটি আঁচাল দিয়ে ঢেকে নরনারায়ণকে তাঁর অনুসরণ করতে ইঙ্গিত করলেন। একবার নরনারায়ণের সন্দেহ হল — এসব স্বপ্ন নয় তো? কিন্তু ঐ যে দীপশিখার উজ্জ্বল আলোয় আর্দ্র ভিত্তিগাত্রের সবুজ শেওলার দল স্পষ্ট দেখা যায়।
নরনারায়ণ শক্তিমান যুবক, ক্ষুধায় দুর্বল হয়ে পড়লেও নিশ্চিত মৃত্যুর গ্রাস থেকে বাঁচবার উৎসাহে তিনি দৃঢ়পদে অগ্রবর্তিনী, ক্ষিপ্রগামিনী বন্ধুপত্নীর পশ্চাৎ পশ্চাৎ চললেন। একটা বক্রগতি পাথরের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে একটি দীর্ঘ সুড়ঙ্গ পার হবার পর তিনি দেখলেন যে তাঁরা কীর্তি রায়ের প্রাসাদের সামনের খালধারে এসে পৌঁছেছেন। লক্ষ্মী দেবী একটা ছোট বেতেবোনা থলি বার করে তাঁর হাতে দিয়ে বললেন — এতে খাবার আছে, এখানে খেও না, তুমি সাঁতার জানো, খাল পার হয়ে ওপারে গিয়ে কিছু খেয়ে নাও, তারপর যত শিগগির পারো পালিয়ে যাও।
ব্যাপার কি নরনারায়ণ রায় একটু একটু বুঝলেন। তাঁর বিস্তৃত জমিদারি কীর্তি রায়ের জমিদারির পাশেই এবং তাঁর অবর্তমানে কীর্তি রায়ই দনুজমর্দনদেবের বংশধরদের ভবিষ্যৎ পত্তনিদার। অত বড় বিস্তৃত ভূসম্পত্তি সৈন্যসামন্ত কীর্তি রায়ের হাতে এলে তিনি কি আর কিছু গ্রাহ্য করবেন? কীর্তি রায় যে মাথা নিচু করে আছেন, তার এই কি কারণ নয় যে, তাঁর একপাশে বাকলা, চন্দ্রদ্বীপ — অন্যপাশে ভুলুয়ার প্রতাপশালী ভুঁইয়া রাজা লক্ষ্মণমানিক্য?
প্রদীপের আলোয় নরনারায়ণ দেখলেন, তাঁর বন্ধুপত্নীর মুখে সে চটুল হাস্যরেখার চিহ্নও নেই, তাঁর মুখখানি সহানুভূতিতে ভরা মাতৃমুখের মতন স্নেহ কোমল হয়ে এসেছে। তাঁদের চারিপাশে গাঢ় অন্ধকার, মাথার ওপর আকাশের বুক চিরে দিগন্তবিস্তৃত উজ্জ্বল ছায়াপথ, নিকটেই খালের জল জোর ভাঁটার টানে তীরের হোগলা গাছ দুলিয়ে কলকল শব্দে বড় নদীর দিকে ছুটেছে। নরনারায়ণ আবেগপূর্ণ সুরে জিজ্ঞাসা করলেন, বৌ ঠাকরুণ, চঞ্চলও কি এর মধ্যে আছে?
লক্ষ্মী দেবী বললেন, না ভাই, তিনি কিছু জানেন না। এসব শ্বশুরঠাকুরের কীর্তি। এই জন্যে তাঁকে অন্য জায়গায় পাঠিয়েছেন, এখন আমার মনে হচ্ছে। গৌড়টৌড় সব মিথ্যে।
নরনারায়ণ দেখলেন, লজ্জায় দুঃখে তাঁর বন্ধুপত্নীর মুখ বিবর্ণ হয়ে উঠেছে। লক্ষ্মী দেবী আবার বললেন, আমি আজ জানতে পারি। খিড়কি গড়ের পাইক সর্দার আমায় মা বলে, তাকে দিয়ে দুপুর রাতের পাহারা সব সরিয়ে রেখে দিয়েছিলাম। তাই…
নরনারায়ণ বললেন — বৌ ঠাকরুণ, আমার এক বোন ছেলেবেলায় মারা গিয়েছিল — তুমি আমার সেই বোন, আজ আবার ফিরে এলে।
লক্ষ্মী দেবীর পদ্মর মতন মুখখানি চোখের জলে ভেশে গেল। একটু ইতস্তত করে বললেন, ভাই বলতে সাহস পাই নে, তবুও একটা কথা বলছি — বোন বলে যদি রাখ…
নরনারায়ণ জিজ্ঞাসা করলেন, কি কথা বৌ ঠাকুরুন?
লক্ষ্মী দেবী বললেন, তুমি আমার কাছে বলে যাও ভাই যে শ্বশুরঠাকুরের কোন অনিষ্ট চিন্তা তুমি করবে না?
নরনারায়ণ রায় একটুখানি কি ভাবলেন, তারপর বললেন, তুমি আমার প্রাণ দিলে বৌ ঠাকরুণ, তোমার কাছে বলে যাচ্ছি, তুমি বেঁচে থাকতে আমি তোমার শ্বশুরের কোন অনিষ্ট চিন্তা করব না।
বিদায় নিতে গিয়ে নরনারায়ণ একবার জিজ্ঞাসা করলেন, বৌ ঠাকরুণ, তুমি ফিরে যেতে পারবে তো?
লক্ষ্মী দেবী বললেন, আমি ঠিক যাব, তুমি কিন্তু যত দূর পার সাঁতরে গিয়ে তারপর ডাঙায় উঠে চলে যেও।
নরনারায়ণ রায় সেই ঘনকৃষ্ণ অন্ধকারের মধ্যে নিঃশব্দে খালের জলের পরে মিলিয়ে গেলেন।
লক্ষ্মী দেবীর প্রদীপটা অনেকক্ষণ বাতাসে নিবে গিয়েছিল, তিনি অন্ধকারের মধ্যে শ্বশুরের গড়ের দিকে ফিরলেন। একটু দূরে গিয়েই তিনি দেখতে পেলেন, পাশের ছোট খালটায় দুখানা ছিপ মশালের আলোয় সজ্জিত হচ্ছে, ভয়ে তাঁর বুকের রক্ত জমে গেল, সর্বনাশ! এরা কি তবে জানতে পেরেছে? দ্রুতপদে অগ্রসর হয়ে গুপ্ত সুড়ঙ্গের মুখে এসে তিনি দেখলেন সুড়ঙ্গের পথ খোলাই আছে। তিনি তাড়াতাড়ি সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকে পড়লেন।
কীর্তি রায় বুঝতেন নিজের হাতের আঙুলও যদি বিষাক্ত হয়ে ওঠে তো তাকে কেটে ফেলাই সমস্ত শরীরের পক্ষে মঙ্গল। পরদিন আবার দিনের আলো ফুটে উঠল, কিন্তু লক্ষ্মী দেবীকে আর কোন দিন কেউ দেখেনি। রাতের হিংস্র অন্ধকার তাঁকে গ্রাস করে ফেলেছিল।
নরনারায়ণ রায় নিজের রাজধানীতে বসে সব শুনলেন, গুপ্ত সুড়ঙ্গের দু’ধারের মুখ বন্ধ করে কীর্তি রায় তাঁর পুত্রবধূর শ্বাসরোধ করে তাঁকে হত্যা করেছেন। শুনে তিনি চুপ করে রইলেন। এর কিছুদিন পরে তাঁর কানে গেল বাশুন্তার লক্ষ্মণ রায়ের মেয়ের সঙ্গে শীঘ্র চঞ্চলের বিয়ে।
সেদিন রাত্রে চাঁদ উঠলে নিজের প্রাসাদ শিখরে বেড়াতে বেড়াতে চারিদিকের শুভ্র সুন্দর আলোয় সাগরের দিকে দৃষ্টিপাত করে দৃঢ়চিত্ত নরনারায়ণ রায়েরও চোখের পাতা যেন ভিজে উঠল। তাঁর মনে হল তাঁর অভাগিনী বৌ ঠাকুরাণীর হৃদয় নিঃসারিত নিষ্পাপ অকলঙ্ক পবিত্র স্নেহের ঢেউয়ে সারা জগৎ ভেসে যাচ্ছে — মনে হল, তাঁরই অন্তরের শ্যামলতায় জ্যোৎস্না ধৌত বনভূমির অঙ্গে অঙ্গে শ্যামল সুন্দর শ্রী নীরব আকাশের তলে তাঁরই চোখের দুষ্ট হাসিটি তারায় তারায় নব মল্লিকার মতন ফুটে উঠেছে। নরনারায়ণ রায়ের পূর্বপুরুষেরা দুর্ধর্ষ ভূম্যধিকারী দস্যু — হঠাৎ পূর্বপুরুষের সেই বর্বর রক্ত নরনারায়ণের ধমনীতে নেচে উঠল, তিনি মনে মনে বললেন, আমার অপমান আমি এক রকম ভুলেছিলাম বৌ ঠাকরুণ, কিন্তু তোমার অপমান আমি সহ্য করব না কখনও।
কিছুদিন কেটে গেল। তারপর একদিন এক শীতের ভোর রাত্রির কুয়াশা কেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল, কীর্তি রায়ের গড়ের খালের মুখ ছিপে, সুলুপে, জাহাজে ভরে গিয়েছে। তোপের আওয়াজে কীর্তি রায়ের প্রাসাদ দুর্গের ভিত্তি ঘন ঘন কেঁপে উঠতে লাগল। কীর্তি রায় শুলনেন, আক্রমণকারী নরনারায়ণ রায়, সঙ্গে দুরন্ত পর্তুগীজ জলদস্যু সিবাস্টিও গঞ্জালেস। উভয়ের সম্মিলিত বহরের চল্লিশখানা কোষা খালের মুখে চড়াও হয়েছে, পুরা বহরের বাকী অংশ বাহির নদীতে দাঁড়িয়ে।
এ আক্রমণের জন্য কীর্তি রায় পূর্ব থেকে প্রস্তুত ছিলেন, কেবল প্রস্তুত ছিলেন না নরনারায়ণের সঙ্গে গঞ্জালেসের যোগদানের জন্য। রাজা রামচন্দ্র রায় এবং রাজা লক্ষ্মণমাণিক্যের সঙ্গে গজ্ন্জালেসের কয়েক বৎসর ধরে শত্রুতা চলে আসছে, এ অবস্থায় গঙ্জালেস যে তাঁদের পত্তনিদার নরনারায়ণ রায়ের সঙ্গে যোগ দেবে, এ কীর্তি রায়ের কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ঘটনা। তা হলেও কীর্তি রায়ের গড় থেকেও তোপ চলল।
গঞ্জালেস সুদক্ষ নৌ বীর। তার পরিচালনে দশখানা সুলুপ চড়া ঘুরে গড়ের পাশের ছোট খালে ঢুকতে গিয়ে কীর্তি রায়ের নওয়ারার এক অংশ দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হল। গড়ের কামান সেদিকে এত প্রখর যে খালের মুখে দাঁড়িয়ে থাকলে বহর মারা পড়ে। গঞ্জালেস দুখানা কামান বাহী সুলুপ ছোট খালের মুখে রেখে বাকী গুলো সেখান থেকে ঘুরিয়ে এনে চড়ার পিছনে দাঁড় করালে। গঞ্জালেসের অধীনস্থ অন্যতম জলদস্যু মাইকেল রোজারিও ডি ভেগা এই ছোট বহর খালের মধ্যে ঢুকিয়ে গড়ের পশ্চিম দিক আক্রমণ করবার জন্যে আদিষ্ট হল।
অতর্কিত আক্রমণে কীর্তি রায়ের নওয়ারা শত্রু বহর কর্তৃক ছিপি আাঁটা বোতলের মতন খালের মধ্যে আটকে গেল — বার নদীতে গিয়ে যুদ্ধ দেবার ক্ষমতা তাদের আদৌ রইল না। তবুও তাদের বিক্রমে রোজারিও অনেকক্ষণ পর্যন্ত কিছু করে উঠতে পারলে না। কীর্তি রায়ের নৌ বহর দুর্বল ছিল না, কীর্তি রায়ের গড় থেকে পর্তুগীজ জলদস্যুদের আড্ডা সন্দ্বীপ খুব দূরে নয়, কাজেই কীর্তি রায়ের নৌ বহর সুদৃঢ় করে গড়তে হয়েছিল।
বৈকালের দিকে রোজারিওর কামানের মুখে গড়ের পশ্চিম দিকটা একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। নরনারায়ণ রায় দেখলেন প্রায় ত্রিশখানা কোষা জখম অবস্থায় খালের মুখে পড়ে, কীর্তি রায়ের গড়ের কামানগুলো সব চুপ,নদীর দু’পাড় ঘিরে সন্ধ্যা নেমে আসছে। উর্ধ্বে নিস্তব্ধ নীল আকাশে কেবলমাত্র এক ঝাঁক শকুনি কীর্তি রায়ের গড়ের উপর চক্রাকারে ঘুরছে — হঠাৎ বিজয়োন্মত্ত নরনারায়ণ রায়ের চোখের সম্মুখে বন্ধু পত্নীর বিদায়ের রাতের সন্ধ্যার পদ্মের মতন বিষাদভরা ম্লান মুখখানি, কাতর মিনতিপূর্ণ সেই চোখদুটি মনে পড়ল — তীব্র অনুশোচনায় তাঁর মন তখনি ভরে উঠল। তিনি করেছেন কি! এই রকম করে কি তিনি তাঁর স্নেহময়ী প্রাণদাত্রীর শেষ অনুরোধ রাখতে এসেছেন? নরনারায়ণ রায় হুকুমজারি করলেন — কীর্তি রায়ের পরিবারের এক প্রাণীরও যেন প্রাণহানি না হয়।
একটু পরেই সংবাদ এল, গড়ের মধ্যে কেউ নেই। নরনারায়ণ রায় বিস্মিত হলেন। তিনি তখনি নিজে গড়ের মধ্যে ঢুকলেন। তিনি এবং গঞ্জালেস গড়ের সমস্ত অংশ তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন — দেখলেন সত্যি কেউ নেই। পর্তুগীজ বহরের লোকেরা গড়ের মধ্যে লুঠপাট করতে গিয়ে দেখলে মূলবান দ্রব্যাদি বড় কিছু নেই। পরদিন দ্বিপ্রহর পর্যন্ত লুঠপাট চলল। কীর্তি রায়ের পরিবারের এক প্রাণীরও সন্ধন পাওয়া গেল না। অপরাহ্নে কেবলমাত্র দুখানা সুলুপ খালের মুখে পাহারা রেখে নরনারায়ণ রায় ফিরে চলে গেলেন।
এই ঘটনার দিনকয়েক পরে, পর্তুগীজ্জ জলদস্যুর দল লুঠপাট করে চলে গেলে, কীর্তি রায়ের এক কর্মচারী গড়ের মধ্যে প্রবেশ করে। আক্রমণের দিন সকালেই এ লোকটি গড় থেকে আরও অনেকের সঙ্গে পালিয়েছিল। ঘুরতে ঘুরতে একটা বড় থামের আড়ালে সে দেখতে পেলে একজন আহত মুমূর্ষ লোক তাকে ডেকে কি বলবার চেষ্টা করছে। কাছে গিয়ে সে লোকটাকে চিনলে, লোকটি কীর্তি রায়ের পরিবারের এক বিশ্বস্ত পুরনো কর্মচারী। তার মৃত্যুকালীন অস্পষ্ট বাক্যে আগন্তুক কর্মচারীটি মোটামুটি যা বুঝলে, তাতেই তার কপাল ঘেমে উঠল। সে বুঝলে কীর্তি রায় তাঁর পরিবারবর্গ এবং ধনরত্ন নিয়ে মাটির নিচের এক গুপ্তস্থানে আশ্রয় নিয়েছেন এবং এই লোকটিই একমাত্র তার সন্ধান জানে। তখনকার আমলে এই গুপ্ত গৃহগুলি প্রায় সকল বাড়িতেই থাকত এবং এর ব্যবস্থা এমন ছিল যে বাইরে থেকে কেউ এগুলো না খুলে দিলে তা থেকে বেরুবার উপায় ছিল না। কোথায় সে মাটির নিচে ঘর, তা স্পষ্ট করে বলবার আগেই আহত লোকটি মারা গেল। বহু অনুসন্ধানেও গড়ের কোন অংশে সে গুপ্ত গৃহ ছিল তা কেউ সন্ধান করতে পারলে না।
এই রকমে কীর্তি রায় ও তাঁর পরিবারবর্গ অনাহারে তিলে তিলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে গড়ের যে কোন নিভৃত ভূ-গর্ভস্থ কক্ষে মৃত্যুমুখে পতিত হলেন, তার আর কোন সন্ধানই হল না। সেই বিরাট প্রাসাদ দুর্গের পর্বতপ্রমাণ মাটি পাথরের চাপে হতভাগাদের সাদা হাড়গুলো কোন বায়ুশূন্য অন্ধকার ভূ কক্ষে তিলে তিলে গুঁড়ো হচ্ছে, কেউ তার খবর পর্যন্ত জানে না।
ঐ ছোট খালটা প্রকৃতপক্ষে সন্দ্বীপ চ্যানেলেরই একটা খাড়ি। খাড়ির ধার থেকে একটুখানি গেলে গভীর অরণ্যের ভিতর কীর্তি রায়ের গড়ের বিশাল ধ্বংসস্তুপ এখনও বর্তমান আছে দেখা যাবে। খাল থেকে কিছু দূরে অরণ্যের মধ্যে দুই সার প্রাচীন বকুল গাছ দেখা যায়, এখন এ বকুল গাছের সারের মধ্যে দুর্ভেদ্য জঙ্গল আর শূলোকাঁটার বন, তখন এখানে রাজপথ ছিল। আর খানিকটা গেলে একটা বড় দীঘি চোখে পড়বে। তারই দক্ষিণে কুচো ইঁটের জঙ্গলাবৃত স্তূপে অর্ধপ্রোথিত হাঙ্গরমুখো পাথরের কড়ি, ভাঙ্গা থামের অংশ — বারভুঁইয়াদের বাংলা থেকে, রাজা প্রতাপাদিত্য রায়ের বাংলা থেকে, বর্তমান যুগের আলোয় উঁকি মারছে। দীঘির যে ইষ্টক সোপানে সকাল সন্ধ্যায় তখন অতীত যুগের রাজবধূদের রাঙা পায়ের অলক্তক রাগ ফুটে উঠত, এখন সেখানে দিনের বেলায় বড় বড় বাঘের পায়ের থাবার দাগ পড়ে, গোখুরা-কেউটে সাপের দল ফণা তুলে ঘুরে বেড়ায়।
বহুদিন থেকেই এখানে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে থাকে। দুপুর রাতে গভীর বনভূমি যখন নীরব হয়ে যায়, হিন্তাল হিজল গাছের কালো গুঁড়িগুলো অন্ধকারে যখন বনের মধ্যে প্রেতের মত দাঁড়িয়ে থাকে — সন্দ্বীপ চ্যানেলের জোয়ারের ঢেউয়ের আলোকোৎক্ষেপী লোনা জল খাড়ির মুখে জোনাকির মতন জ্বলতে থাকে — তখন খাল দিয়ে নৌকো বেয়ে যেতে যেতে মোম মধু সংগ্রাহকেরা কতবার শুনেছে, অন্ধকারে বনের এক গভীর অংশ থেকে কারা যেন আর্তস্বরে চিৎকার করছে — ওগো পথযাত্রীরা, ওগো নৌকাযাত্রীরা — আমরা এখানে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেলাম — দয়া করে আমাদের তোল, ওগো আমাদের তোল…
ভয়ে বেশি রাত্রে এ পথে কেউ নৌকো বাইতে চায় না।
অরন্ধনের নিমন্ত্রণ
এক-একজন লোকের স্বভাব বড়ো খারাপ, বকুনি ভিন্ন তারা একদণ্ডও থাকতে পারে না, শ্রোতা পেলে বকে যাওয়াতেই তাদের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সুখ। হীরেন ছিল এই ধরনের মানুষ। তার বকুনির জ্বালায় সকলে অতিষ্ঠ। আপিসে যারা তার সহকর্মী, শেষপর্যন্ত তাদের অনেকের স্নায়ুর রোগ দেখা দিলে, অনেকে চাকরি ছাড়বার মতলব ধরলে।
সব বিষয়ের প্রতিভার মতোই বকুনির প্রতিভাও পৈতৃক শক্তির আবশ্যক রাখে। হীরেনের বাবার বকুনিই ছিল একটা রোগ। শেষবয়সে তাঁকে ডাক্তারে বারণ করেছিল, তিনি বেশি কথা যেন না-বলেন। তাতে তিনি জবাব দিয়েছিলেন—তবে বেঁচে লাভটা কী ডাক্তারবাবু? যদি দু-একটা কথাই কারো সঙ্গে বলতে না পারলুম! কথা বলতে বলতেই হৃৎপিণ্ড দুর্বল হবার ফলে তিনি মারা যান—মার্টার টু দি কজ!
এ হেন বাপের ছেলে হীরেন। বাইশ বছরের যুবক—আপিসে কাজ করে— আবার রামকৃষ্ণ মঠেও যাতায়াত করে। বিবাহ করবার ইচ্ছা নেই। শুনেছিলাম সন্ন্যাসী হয়ে যাবে। এতদিন হয়েও যেত, কিন্তু রামকৃষ্ণ আশ্রমের লোকেরা এ বিষয়ে তাকে বিশেষ উৎসাহ দেননি; হীরেন সন্ন্যাসী হয়ে দিনরাত মঠে থাকতে শুরু করলে একমাসের মধ্যেই মঠ জনশূন্য হয়ে পড়বে।
হীরেনের এক বৃদ্ধা পিসিমা থাকতেন দূর পাড়াগাঁয়ে। স্টেশন থেকে দশ-বারো ক্রোশ নেমে যেতে হয় এমন এক গ্রামে। পিসিমার আর কেউ নেই, হীরেন সেখানে পিসিমাকে একবার দেখতে গেল। বুড়ি অনেকদিন থেকেই দুঃখ করে চিঠিপত্র লিখছিল।
সে গ্রামের সবাই এতদিন জানত যে, তাদের কুমী অর্থাৎ কুমুদিনীর মতো বকুনিতে ওস্তাদ মেয়ে সে অঞ্চলে নেই। কুমীর বাবা গ্রাম্য পুরোহিত ছিলেন কিন্তু যেখানে যখন পুজো করতে যেতেন, আগডুম বাগডুম বকুনির জ্বালায় যজমান ভিটে ছেড়ে পালাবার জোগাড় করত, বিয়ের লগ্ন উত্তীর্ণ হবার উপক্রম হত।
কুমীর বাপের বকুনি-প্রতিভার একটা বড়ো দিক ছিল এই যে, তাঁর বকুনির জন্য কোনো বস্তুর প্রয়োজন হত না। যত তুচ্ছ বিষয়ই হোক না-কেন, তিনি তাই অবলম্বন করে বিশাল বকুনির ইমারত গড়ে তুলতে পারতেন। মনে যথেষ্ট উৎসাহ ও শক্তি এবং সঙ্গে সঙ্গে অসাধারণ বলবার ও ছবি গড়বার ক্ষমতা না-থাকলে মানুষে এমন বকতে পারে না বা শ্রোতাদের মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। তাঁর মৃত্যুর সময়ে গ্রামের সকলেই দুঃখ করে বলেছিল—আজ থেকে গাঁ নিঝুম হয়ে গেল।
দু-একজন বলেছিল—এবার আমসত্ব সাবধানে রৌদ্রে দিও, মুখুয্যেমশায় মারা গিয়েছেন, কাক-চিলের উৎপাত বাড়বে। অর্থাৎ তাদের মতে গাঁয়ে এতদিন কাক চিল বসতে পারত না মুখুয্যেমশায়ের বকুনির চোটে। নিন্দুক লোক কোন জায়গায় নেই?
কিন্তু হায়! নিন্দুকের আশা পূর্ণ হয়নি বা মুখুয্যেমশায়ের হিতাকাঙ্ক্ষীদের দুঃখ করবারও কারণ ঘটেনি। মুখুয্যেমশায় তাঁর প্রতিনিধি রেখে গিয়েছিলেন তাঁর আট বৎসরের মেয়ে কুমীকে। পিতার দুর্লভ বাক-প্রতিভার অধিকারিণী হয়েছিল মেয়ে। এমনকী তার বয়েস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই সন্দেহ করলেন যে, মেয়ে তার বাপকে ছাড়িয়ে না-যায়।
সেই কুমীর বয়েস এখন তেরো-চোদ্দো। সুশ্রী, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, কোঁকড়া কোঁকড়া একরাশ চুল মাথায়, বড়ো বড়ো চোখ, মিষ্টি গলার সুর, একহারা গড়ন, কথায় কথায় খিল খিল হাসি, মুখে বকুনির খই ফুটছে দিনরাত।
শুভক্ষণে দুজনের দেখা হল।
হীরেন সকালবেলা পিসিমার ঘরের দাওয়ায় বসে প্রাণায়াম অভ্যাস করবার চেষ্টা করছে, এমন সময়ে পিসিমা আপন মনে বললেন—দুধ কী আজ দিয়ে যাবে না? বেলা যে তেপহর হল—ছেলেটা যে না-খেয়ে শুকিয়ে বসে আছে, একটু চা করে দেব তার দুধ নেই—আগে জানলে রাত্রের বাসি দুধ রেখে দিতাম যে—
—রাতের বাসি দুধ রোজ রাখ কিনা—
বলতে বলতে একটি কিশোরী একঘটি দুধ হাতে বাড়ির পেয়ারা গাছটার তলায় এসে দাঁড়াল।
পিসিমা বললেন—দুধের ঘটিটা রান্নাঘর থেকে বের করে নিয়ে আয় দিকি, এনে দুধটা ঢেলে দে—
কিশোরী চঞ্চল লঘুপদে রান্নাঘরের মধ্যে ঢুকল এবং দুধ ঢেলে যথাস্থানে রেখে এসে আমতলায় দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বললে—শোনো ও পিসি, কাল কী হয়েছে। জানো?—হি–হি–
পিসিমা বললেন—কী?
এই কথার উত্তরে আমতলায় দাঁড়িয়ে মেয়েটি হাত-পা নেড়ে একটা গল্প জুড়ে দিলে—কাল দুপুরে নাপিত-বাড়িতে ছাগল ঢুকে, নাপিত-বউ কাঁথা পেতেছিল, সে কাঁথা চিবিয়ে খেয়েছে, এইমাত্র ঘটনাংশ গল্পের। কিন্তু কী সে বলবার ভঙ্গি, কী সে কৌতুকপূর্ণ কলহাসির উচ্ছাস, কী সে হাত-পা নাড়ার ভঙ্গি, পিসিমার চায়ের জল গরম হল, চা ভিজোনো হল, হালুয়া তৈরি হল, পেয়ালায় ঢালা হল—তবুও সে গল্পের বিরাম নেই।
পিসিমা বললেন—ও কুমী মা, একটু ক্ষান্ত দাও, সকালবেলা আমার অনেক কাজকর্ম আছে—তোমার গল্প শুনতে গেলে সারাদুপুরটি যাবে—এই চা-টা আর খাবারটুকু তোর এক দাদা—ওই বড়োঘরের দাওয়ায় বসে আছে—দিয়ে আয় দিকি।…
কুমী বিস্ময়ের সুরে বললে—কে পিসি?
—তুই চিনিসনে, আমার বড়ো জ্যাঠতুতো ভায়ের ছেলে—কাল রাত্তিরে এসেছে—তবে চা তৈরি করবার আর এত তাড়া দিচ্ছি কী জন্যে? তুই কী কারো কথা শুনতে পাস, নিজের কথা নিয়েই বে-হাতি—
কুমী সলাজমুখে চা ও খাবার দাওয়ার ধারে রেখে চলে যাচ্ছিল, কিন্তু হীরেন তাকে অত সহজে যেতে দিতে প্রস্তুত নয়। সে কুমীর নাপিতবাড়িতে ছাগলের কাঁথা চিবোনোর গল্প শুনেচে এবং মুগ্ধ, বিস্মিত, পুলকিত হয়েছে এইটুকু মেয়ের ক্ষমতায়।
সে বললে—খুকি তোমার নাম কী?
–কুমুদিনী—
হীরেন বললে—এই গাঁয়েই বাড়ি তোমার বুঝি? ওপাড়ায়? তা ছাগলের কথা কী বলছিলে? বেশ বলতে পারো–
কুমী লজ্জায় ছুটে পালাল।
কিন্তু কুমুদিনীকে আবার কী কাজে আসতে হল। হীরেনের সঙ্গে একটু একটু করে পরিচয় হয়ে গেল। দুজন দুজনের গুণের পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ। দুজনেই ভাবে এমন শ্রোতা কখনো দেখিনি। তিন দিন পরে দেখা গেল পিসিমার দাওয়ার সামনে উঠোনে দাঁড়িয়ে কুমী এবং দাওয়ার খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে হীরেন ঘণ্টাখানেক ধরে পরস্পরের কথা শুনচে, হীরেন অনর্গল বকে যাচ্চে, কুমী শুনছে—আর কুমী যখন অনর্গল বকচে তখন হীরেন মন দিয়ে শুনচে।
সেবার পাঁচ-ছ-দিন পর পিসিমার বাড়ি থেকে হীরেন চলে এল।
কুমী যাবার সময়ে দেখা করলে না বলে হীরেন খুব দুঃখিত হল, কিন্তু হীরেন চলে যাবার পরে কুমী দু-তিন দিন মনমরা হয়ে রইল, মুখে হাসি নেই, কথা নেই।
বুড়ি পিসিমার প্রতি হীরেনের টানটা যেন হঠাৎ বড়ো বেড়ে উঠল; যে হীরেন দু-বছর তিন বছরেও অনেক চিঠিপত্র লেখা সত্বেও এদিকে বড়ো একটা মাড়াত না, সে ঘন ঘন পিসিমাকে দেখতে আসতে শুরু করলে।
আজ বছর দুই আগের কথা, হীরেনকে পিসিমা বলেছিলেন—হীরু বাবা, যদি এলি তবে আমার একটা উপকার করে যা। আমার তো কেউ দেখবার লোক নেই তোরা ছাড়া। নরসুপুরের ধরণী কামারের কাছে একগাদা টাকা পাব জমার খাজনার দরুন। একবার গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে টাকাটার একটা ব্যবস্থা করে আয় না বাবা?
হীরেন এসেচে দু-দিন পিসিমার বাড়ি বেড়িয়ে আম খেয়ে ফুর্তি করতে। সে জষ্ঠি মাসের দুপুর রোদে খাজনার তাগাদা করে গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরতে আসেনি। কাজেই নানা অজুহাত দেখিয়ে সে পরদিন সকালেই সরে পড়েছিল। এখন সেই হীরেন স্বত:প্রবৃত্ত হয়ে একদিন বললে—পিসিমা, তোমার সেই নরসুপুরের প্রজার বাকি খাজনার কিছু হয়েছে? যদি না-হয়ে থাকে, তবে এইসময় না-হয় একবার নিজেই যাই। এখন আমার হাতে তেমন কাজকর্ম নেই, তাই ভাবছি তোমার কাজটা করেই দিয়ে যাই।–
ভাইপোর সুমতি হচ্ছে দেখে পিসিমা খুব খুশি।
হীরেন সকালে উঠে নরসুপুরে যায়, দুপুরের আগেই ফিরে এসে সেই যে বাড়ি ঢোকে, আর সারাদিন বাড়ি থেকে বার হয় না। কুমীকেও প্রায়ই দেখা যায় পিসিমার উঠোনে, নয় তো আমতলায়, নয়তো দাওয়ার পইঠাতে বসে হীরুদার সঙ্গে গল্প করতে। কাক-চিল পাড়ায় আর বসে না।
জ্যোৎস্না উঠেছে।
কুমী বললে—চললুম হীরুদা।
—এখনই যাবি কেন, বোস আর একটু—
উঠোনের একটা ধারে একটা নালা। হঠাৎ কুমী বললে—জ্যোৎস্না রাতে এলো চুলে লাফিয়ে নালা পার হলে ভূতে পায়—আমায় ভূতে পাবে দেখবে দাদা—হি হি-হি-হি–; তারপর সে লাফালাফি করে নালাটা বারকতক এপার-ওপার করছে, এমনসময় ওর মা ডাক দিলেন—ও পোড়ামুখী মেয়ে, এই ভরা সন্ধেবেলা তুমি ও করচ কী? তোমায় নিয়ে আমি যে কী করি? ধিঙ্গি মেয়ে, এতটুকু কাণ্ডজ্ঞান যদি তোমার থাকে!—হীরু ভালো মানুষের মতো মুখখানি করে হারিকেন লণ্ঠনটা মুছে পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল।
মায়ের পিছু পিছু কুমী চলে গেল, একটু অনিচ্ছার সঙ্গেই গেল, মুখে তার অপ্রতিভের হাসি। হীরেন মনমরা ভাবে লণ্ঠনের সামনে কী একখানা বই খুলে পড়তে বসবার চেষ্টা করল।
মাসের পর মাস যায়, বছরও ঘুরে গেল। নতুন বছরের প্রথমে হীরেনের চাকুরিটা গেল, অফিসের অবস্থা ভালো নয় বলে। এই এক বছরের মধ্যে হীরেন পিসিমার বাড়ি আরও অন্তত দশবার এল গেল এবং এই এক বছরের মধ্যে হীরেন বুঝেচে কুমীর মতো মেয়ে জগতে আর কোথাও নেই—বিধাতা একজন মাত্র কুমীকে সৃষ্টি করেছেন। কী বুদ্ধি, কী রূপ, কী কথাবার্তা বলবার ক্ষমতা, কী হাত নাড়ার ললিত ভঙ্গি, কী লঘুগতি চরণছন্দ।
প্রস্তাবটা কে উঠিয়েছিল জানিনে, বোধ হয় হীরুর পিসিমাই। কিন্তু কুমুদিনীর জ্যাঠামশাই সে প্রস্তাবে রাজি হননি—কারণ তাঁরা কুলীন, হীরেনরা বংশজ। কুলীন হয়ে বংশজের হাতে মেয়ে দেবেন তিনি, এ কথা ধারণা করাই তো অন্যায়।
হীরু শুনে চটে গিয়ে পিসিমাকে বললে—কে তোমাকে বলেছিল পিসিমা ডেকে অপমান ঘরে আনতে? আমি তোমার পায়ে ধরে সেধেছিলুম কুমীর সঙ্গে আমার বিয়ে দাও? সবাই জানে আমি বিয়ে করব না, আমি রামকৃষ্ণ আশ্রমে ঢুকব। সব ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছে, এবার এই ইয়েটা মিটে গেলেই–
কুমীর কানে কথাটা গেল যে হীরু এই সব বলেচে। সে বললে—হীরুদাকে বিয়ে করতে আমি পায়ে ধরে সাধতে গিয়েছিলুম যে! বয়ে গেল—সন্ন্যাসী হবে তো আমার কী?
হীরু তল্পি বেঁধে পরদিনই পিসিমার বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি চলে গেল।
হীরুর বাড়ির অবস্থা এমন কিছু ভালো নয়। এবার তার কাকা আর মা একসঙ্গে বলতে শুরু করলেন—সে যেন একটা চাকুরির সন্ধান দেখে। বেকার অবস্থায় বাড়ি বসে কতদিন আর এভাবে চলবে?
হীরুর কাকার এক বন্ধু জামালপুরে রেলওয়ে কারখানার বড়োবাবু, কাকার পত্র নিয়ে হীরু সেখানে গেল এবং মাস দুই তাঁর বাসায় বসে বসে খাওয়ার পরে কারখানার অফিসে ত্রিশ টাকা মাইনের একটা চাকুরি পেয়ে গেল।
লাল টালি-ছাওয়া ছোট্ট কোয়ার্টারটি হীরুর। বেশ ঘরদোর, বড়ো বড়ো জানালা। জানালা দিয়ে মারক পাহাড় দেখা যায়; কাজকর্মের অবসরে জানালা দিয়ে চাইলেই চোখে পড়ে টানেল দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে ট্রেন যাচ্চে-আসছে। শান্টিং ইঞ্জিনগুলো ঝক ঝক শব্দ করে পাহাড়ের নীচে সাইডিং লাইনের মুড়োয় গিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে। কয়লার ধোঁয়ায় দিনরাত আকাশ-বাতাস সমাচ্ছন্ন।
একদিন রবিবারে ছুটির ফাঁকে—সে আর তার কাকার বন্ধু সেই বড়োবাবুর ছেলে মণি, মারক পাহাড়ের ধারে বেড়াতে গেল। মণি ছেলেটি বেশ, পাটনা ইউনিভার্সিটি থেকে বি-এস সি. দিয়েছে এবার, তার বাবার ইচ্ছে কাশী হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে তাকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো। কিন্তু মণির তা ইচ্ছে নয়, সে কলকাতার সায়েন্স কলেজে অধ্যাপক রমণের কাছে ফিজিক্স পড়তে চায়। এই নিয়ে বাবার সঙ্গে তার মনান্তর চলচে। হীরু জানত এসব কথা।
বৈকাল বেলাটি। জামালপুর টাউনের আওয়াজ ও ধোঁয়ার হাত থেকে অব্যাহতি পাবার জন্যে ওরা দক্ষিণ দিকে পাহাড়ের ওপর দিয়ে অনেকটা চলে গিয়েছে, নীল অতসী ও বনতুলসীর জঙ্গল হয়ে আছে পাহাড়ের মাথায় সেই জায়গাটায়। ঘন ছায়া নেমে আসচে পূর্বদিকে শৈলসানুতে, একটি বন্যলতায় হলদে ক্যামেলিয়া ফুলের মতো ফুল ফুটেছে, খুব নীচে কুলিমেয়েরা পাহাড়তলির লম্বা লম্বা ঘাস কেটে আঁটি বাঁধছে—পূর্বদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় সমতল মাঠ, ভুট্টার খেত, খোলার বস্তি, কেবল দক্ষিণে, পূর্ব-পশ্চিমে টানা পাহাড়শ্রেণি ও শালবন থই থই করছে,
আর সকলের ওপরে উপুড় হয়ে পড়েছে—নিকট থেকে দূরে সুদূরে প্রসারিত মেঘমুক্ত সুনীল আকাশ।
একটা মহুয়াগাছের তলায় বসে মণি বাড়ি থেকে আনা স্যান্ডউইচ, ডিমসিদ্ধ, রুটি এবং জামালপুর বাজার থেকে কেনা জিলিপি একখানা খবরের কাগজের ওপর সাজালে—থার্মোফ্লাস্ক খুলে চা বার করে একটা কলাই-করা পেয়ালার ঢেলে বললে—এসো হীরুদা—
দেখলে, হীরু অন্যমনস্কভাবে মহুয়াগাছের গুঁড়িটায় ঠেস দিয়ে সামনের দিকে চেয়ে বসে আছে।
—খাবে এসো, কী হল তোমার হীরুদা?
হীরু নিরুৎসাহ ভাবে খেতে লাগল। সারা বৈকালটি যতক্ষণ পাহাড়ের ওপর ছিল, কেমন যেন অন্যমনস্ক, উদাস—কী যেন একটা ভাবচে। মণি ভাবলে, পাহাড়ে বেড়ানোটাই মাটি হয়ে গেল হীরুদার জন্যে। পাহাড় থেকে নামবার পথে হীরু হঠাৎ বললে—মণি, একটি মেয়েকে বিয়ে করবে ভাই?
মণি হো হো করে হেসে উঠে বললে—কী ব্যাপার বলো তো হীরুদা? তোমার আজ হয়েছে কী?
—কিছু হয়নি, বলো না মণি? একটি গরিবের মেয়েকে বিয়ে করে দায় উদ্ধার করো না—তোমার মতো ছেলের
—কী, তোমার কোনো আপনার লোক? তোমার নিজের বোন নাকি?
–বোন না-হলেও বোনের মতোই। বেশ দেখতে মেয়েটি, সুশ্রী, বুদ্ধিমতী।
—আমার কথায় তো কিছু হবে না, তুমি বাবাকে কী মাকে বলো। একে তো লেখাপড়া নিয়েই বাবাকে চটিয়ে রেখেচি, আবার বিয়ে নিয়ে চটালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। বাবার মেজাজ বোঝো তো?
রাত্রে নিজের ছোট্ট বাসাটিতে হীরু কথাটা আবার ভাবলে। আজ পাহাড়ের ওপর উঠেই তার কেমনসব গোলমাল হয়ে গিয়েছিল। কুমীর কথা তাহলে তো সে মোটেই ভোলেনি! নীল আকাশ, নির্জনতা, ফুটন্ত বন্য ক্যামেলিয়া ফুল, বনতুলসীর গন্ধ—সবসুদ্ধ মিলে একটা বেদনার মতো তার মনে এনে দিয়েচে কুমীর হাসিভরা ডাগর চোখ দুটির স্মৃতি, তার হাত নাড়ার ললিত ভঙ্গি, তার অনর্গল বকুনি—সে তো সন্ন্যাসী হয়ে যাবে রামকৃষ্ণ আশ্রমে সবাই জানে, মিথ্যেই পিসিমা কুমীর বাবাকে বিয়ের কথা গিয়েছিলেন বলতে। কিন্তু কুমীকে জীবনে সুখী করে দিয়ে যেতে হবে। এ তার একটা কর্তব্য।
সাহসে ভর করে মণির বাপের কাছে সে প্রস্তাবটা করলে। হীরুকে মণির বাপ মা স্নেহ করতেন; তাঁরা বললেন—মেয়ে যদি ভালো হয় তাঁদের কোনো আপত্তি নেই। তাঁরা চাকরি উপলক্ষ্যে পশ্চিমে থাকেন, এ অবস্থায় স্বঘরের মেয়ের সন্ধান পাওয়াও কঠিন বটে। যখন সন্ধান পাওয়া গিয়েছে ভালো মেয়ের—আর মণির বিয়ে যখন দিতেই হবে, তখন মেয়েটিকে দেখে আসতে দোষ কী?
কুমীর জ্যাঠাকে আগেই চিঠি লেখা হয়েছিল, কিন্তু তাঁরা সমস্ত জিনিসটাকে অবিশ্বাস করে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। অত বড়ো লোকের ছেলেকে জামাই করার মতো দুরাশা তাঁদের নেই। হীরুর যেমন কাণ্ড!
কিন্তু হীরু পুজোর ছুটিতে সত্যিই মণির এক জ্যাঠতুতো দাদাকে মেয়ে দেখাতে নিয়ে এল।
কুমী এসে হীরুর পায়ের ধুলো নিয়ে নমস্কার করলে।
হীরু বললে—ভালো আছিস কুমী?
—এতদিন কোথায় ছিলে হীরুদা?
—চাকরি করচি যে পশ্চিমে জামালপুরে। সাত-আট মাস পরে তো দেশে ফিরচি।
—ও কাকে সঙ্গে করে এনেচ? হীরু কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেও আমার এক বন্ধুর দাদা
—তা এখানে এসেছে কেন?
—এসেচে গিয়ে ইয়ে—এমনি বেড়াতে এসেচেই ধর—তবে—ইয়ে—
—তোমার আর ঢোঁক গিলতে হবে না। আমি সব জানি, কেন ওসব চেষ্টা করছ হীরুদা?
হীরু বললে—যাও—অমন করে না ছিঃ, চুলটুল বেঁধে দিতে বল গিয়ে। ওঁরা খুব ভালো লোক, আর বড়ো লোক। জামালপুরে ওঁদের খাতির কী! আমি অনেক কষ্টে ওঁদের এখানে এনেচি। বড়ো ভালো হবে এ বিয়ে যদি ভগবানের ইচ্ছেয় হয়–
অনেক কষ্টে কুমীকে রাজি করিয়ে তার চুল বাঁধা হল, মেয়ে দেখানোও হল। দেখানোর সময় মেয়ের অজস্র গুণ ব্যাখ্যা করে গেল হীরু। কুমী কিন্তু পাঞ্জাব প্রদেশ কোন দিকে বলতে পারলে না, তাজমহল কে তৈরি করেছিল সে সম্বন্ধেও দেখা গেল সে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। হাতের লেখা বেঁকে গেল। গান গাইতে জানে না বললে—যদিও সে ভালোই গাইতে জানে এবং তার গলার সুরও বেশ ভালো।
সঙ্গের ভদ্রলোকটি মেয়ে দেখা শেষ করেই ফিরতি নৌকোতে রেলস্টেশনে চলে গেলেন। রাত্রের ট্রেনেই তিনি খুলনায় তাঁর শ্বশুরবাড়ি যাবেন। যাবার সময়ে বলে গেলেন—মতামত চিঠিতে জানাবেন। হীরু তাঁকে নৌকোতে তুলে দিয়ে ফিরে এসে কুমীকে বললে—কী করে বললে—গান গাইতে জানো না? ছিঃ, এ কী ছেলেমানুষি, ওরা শহরের মানুষ, গান শুনলে খুব খুশি হয়ে যেত। এমনি তো ঘরের কোণে খুব গান বেরোয় গলায়? আর এর বেলা
কুমী রাগ করে বললে—ঘরের কোণে গান গাইব না তো কী আসরে বসে গাইতে যাব? পারব না যার-তার সামনে গান গাইতে।
হীরুও রেগে বললে—তবে থাকো চিরকাল আইবুড়ো ধিঙ্গি হয়ে। আমার কী? কুমীর বাড়ির ও পাড়ার সবাই এজন্য কুমীকে ভৎসনা করলে। গান গাও-না-গাও, গান গাইতে জানি এ কথা বলার দোষ ছিল কী? ছিঃ, কাজটা ভালো হয়নি।
বলাবাহুল্য, ভদ্রলোকের কাছ থেকে কোনো পত্র এল না এবং হীরু পুজোর ছুটি অন্তে জামালপুরে গিয়ে শুনলে, মেয়ে তাঁদের পছন্দ হয়নি।
মাস পাঁচ-ছয় কেটে গেল। কী অদ্ভুত পাঁচ-ছ-মাস! কাজ করতে করতে জানালা দিয়ে যখনই উঁকি দিয়ে বাইরের দিকে চায়, তখনই সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে, কুমীকে কতবার জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেচেহাত-পা নেড়ে উচ্ছ্বসিতকণ্ঠে হেসে গড়িয়ে পড়ে কুমী গল্প করছে…নিমফুলের গন্ধভরা কত অলস চৈত্র-দুপুরের স্মৃতিতে মধুর হয়ে উঠেচে বর্তমান কর্মব্যস্ত দিনগুলি…
ইতিমধ্যে এক ছোকরা ডাক্তারের সঙ্গে তার খুব আলাপ হয়ে গেল। নতুন এম.বি. পাস করে জামালপুরে প্র্যাকটিস করতে এসেছে, বেশ সুন্দর চেহারা, বাড়ির অবস্থাও খুব ভালো, তার জ্যাঠামশাই এখানে বড়ো চাকরি করেন। কথায় কথায় হীরু জানতে পারলে ছোকরা এখনও বিয়ে করেনি এবং কুমীদের পালটি ঘর। অনেক বুঝিয়ে সে তার জ্যাঠামশাইকে মেয়ে দেখতে যেতে রাজি করালে। মেয়ে দেখাও হল—কিন্তু শেষপর্যন্ত কিছুই হল না, তাঁদের কুটুম্ব পছন্দ হয়নি শোনা গেল। একে তো অজ পাড়াগাঁ, দ্বিতীয়ত তাঁরা ভেবেছিলেন পাড়াগাঁয়ের জমিদার কিংবা অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে, অমন গরিব ঘরের মেয়ে তাঁদের চলবে না।
মাস তিনেক পরে হীরু আর এক বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে গিয়ে পিসিমার বাড়ি হাজির হল। কুমীদের বাড়ির সবাই বললে—হীরু বড় ভালো ছেলে, কুমীর জন্য চেষ্টা করছে প্রাণপণে। কিন্তু অত বড়ো বড়ো সম্বন্ধ এনে ও ভুল করচে, ওসব কী জোটে আমাদের কপালে? মেয়ে পছন্দ হলেই বা অত টাকা দিতে পারব। কোত্থেকে?
কুমীর সঙ্গে খিড়কি দোরের কাছে হীরুর দেখা। কুমী বললে—হীরুদা, তুমি কেন এসব পাগলামি করচ বলো তো? বিয়ে আমি করব না, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, তুমি ওসব বন্ধ করো।
হীরু বলল—ছিঃ লক্ষ্মী দিদি, এমন করে না, এবার যে জায়গায় ঠিক করচি, তাঁরা খুব ভালো লোক, এবার নির্ঘাত লেগে যাবে—
কুমী লজ্জায় রাঙা হয়ে বললে—তুমি কী যে বলো হীরুদা! আমার রাত্রে ঘুম হচ্চে না, লাগবে কী না-লাগবে তাই ভেবে। মিছিমিছি আমার জন্য তোমাকে লোকে যা তা বলে—তা জানো? তুমি ক্ষান্ত দাও, তোমার পায়ে পড়ি হীরুদা—
হীরু এসব কথা কানে তুললে না। পাত্রপক্ষের লোক নিয়ে এসে হাজির করলে, কিন্তু কুমী কিছুতেই এবার তাদের সামনে আসতে রাজি হল না। সে দস্তুরমতো বেঁকে বসল।
হীরু বাড়ির মধ্যে গিয়ে বললে—পিসিমা, আপনারা দেরি করচেন কেন? কুমীর মা বললেন—এসে বোঝাও না মেয়েকে বাবা! আমরা তো হার মেনে গেলাম। ও চুলে চিরুনি ছোঁয়াতে দেবে না, উঠবেও না, বিছানায় পড়েই রয়েছে।
কুমী ঘর থেকে বললে—পড়ে থাকব না তো কী? বারে বারে সং সাজতে পারব না আমি, কারো খাতিরেই না। হীরুদাকে বলো না—সং সেজে বেরুক ওদের সামনে।
হীরু ঘরের মধ্যে ঢুকে কড়া সুরে বললে—কুমী ওঠ, কথা শোন—যা চুল বাঁধগে যা—
—আমি যাব না—
—যাবিনে, চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে যাব—ওঠ—দিন দিন ইয়ে হচ্চেন–না? ওঠ বলচি—
কুমী দ্বিরুক্তি না-করে বিছানা ছেড়ে দালানে চুল বাঁধতে বসে গেল, সাজানো গোজানোও বাদ গেল না, মেয়ে দেখানোও হল, কিন্তু ফল সমানই দাঁড়াল অর্থাৎ পাত্রপক্ষ বাড়ি গিয়ে চিঠি দেব বলে গেলেন।
জামালপুরের কাজে এসে যোগ দিলে হীরু। কিন্তু সে যেন সর্বদাই অন্যমনস্ক। কুমীর জন্যে এত চেষ্টা করেও কিছু দাঁড়াল না শেষপর্যন্ত! কী করা যায়? এদিকে কুমীদের বাড়িতেও তার পসার নষ্ট হয়েছে, তার আনা সম্বন্ধের ওপর সবাই আস্থা হারিয়েছে। হারাবারই কথা। এবার সেখানেও কথা তুলবার মুখ নেই তার। অত বড়ো বড়ো সম্বন্ধ নিয়ে যাওয়াই বোধ হয় ভুল হয়েছে। কুমীর ভালো ঘর জুটিয়ে দেবার ব্যাকুল আগ্রহে সে ভুলে গিয়েছিল যে, বড়োতে ছোটোতে কখনো খাপ খায় না।
লজ্জায় সে পিসিমার বাড়ি যাওয়া ছেড়ে দিল।
বছর দুই-তিন কেটে গেল।
হীরু চাকুরিতে খুব উন্নতি করে ফেলেচে তার সুন্দর চরিত্রের গুণে। চিফ ইঞ্জিনিয়ারের অফিসে বদলি হল দেড়শো টাকায় মার্চ মাস থেকে।
হীরু আর সেই হীরু নেই। এমনি হয়, এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। প্রতি দিন, প্রতি মাস, প্রতি বৎসর, তিলে তিলে মানুষের দেহের ও মনের পরিবর্তন হচ্ছে—অবশেষে পরিবর্তন এমন গুরুতর হয়ে ওঠে যে, বহুকাল পরে আবার সাক্ষাৎ হলে আগের মানুষটিকে আর চেনাই যায় না। হীরু ধীরে ধীরে বদলেচে। অল্প অল্প করে সে কুমীকে ভুলেচে। রামকৃষ্ণ আশ্রমে যাবার বাসনাও তার নেই বর্তমানে। এর মূলে একটা কারণ আছে, সেটা এখানে বলি। জামালপুরে একজন বয়লার-ইনস্পেক্টার ছিলেন, তাঁর বাড়ি হুগলি জেলায়, রুড়কীর পাস ইঞ্জিনিয়ার, বেশ মোটা মাইনে পেতেন। কিন্তু অদৃষ্টের দোষে তাঁর ছ-টি মেয়ের বিয়ে দিতে তাঁকে সর্বস্বান্ত হতে হয়েছে। এখনও একটি মেয়ে বাকি।
হীরুর সঙ্গে এই পরিবারের বেশ ঘনিষ্ঠতা জন্মেছিল। সুরমা হীরুর সামনে বার হয়, তাকে দাদা বলে ডাকে, কখনো-কখনো নিজের আঁকা ছবি দেখায়, গল্প করে, গান শোনায়।
একদিন হঠাৎ হীরুর মনে হল—সুরমার মুখখানা কী সুন্দর! আর চোখ দুটি —পরেই ভাবল—ছিঃ, এসব কী ভাবচি? ও ভাবতে নেই।
আর একদিন অমনি হঠাৎ মনে হল—কুমীর চেয়ে সুরমা দেখতে ভালো—কী গায়ের রং সুরমার! তখনই নিজের এ চিন্তায় ভীত ও সংকচিত হয়ে পড়ল। না, কী ভাবনা এসব, মন থেকে এসব জোর করে তাড়াতে হবে। কিন্তু জীবনকে প্রত্যাখ্যান করা অত সহজ হলে আজ গেরুয়াধারী স্বামীজিদের ভিড়ে পৃথিবীটা ভর্তি হয়ে যেত। হীরুর বয়েস কম, মন এখনও মরেনি, শুষ্ক, শীর্ণ, এক অতীত মনোভাবের কঙ্কালের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে রাখতে তার নবীন ও সতেজ মন ঘোর আপত্তি জানালে। কুমীর সঙ্গে যা কিছু ছিল, সে অমূল তরু শুকিয়ে শীর্ণ হয়ে গিয়েছে আলো-বাতাস ও পৃথিবীর স্পর্শ না-পেয়ে।
সুরমাকে বিয়ে করার কিছুদিন পরে সুরমার বাবা বয়লার ফাটার দুর্ঘটনায় মারা গেলেন; রেল-কোম্পানি হীরুর শাশুড়িকে বেশ মোটা টাকা দিলে এজন্যে; প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাও যা পাওয়া গেল তাতে মেয়ের বিয়ের দেনা শোধ করেও হাতে ছ-সাত হাজার টাকা রইল। সুরমার মা ও একটি নাবালক ভাইয়ের দেখাশোনার ভার পড়েছিল হীরুর উপর, কাজেই টাকাটা সব এসে পড়ল হীরুর হাতে। হীরু সে টাকায় কয়লার ব্যাবসা আরম্ভ করল। চাকরি প্রথমে ছাড়েনি, কিন্তু শেষে রেল কারখানায় কয়লার কন্ট্রাক্ট নিয়ে একবার বেশ মোটা কিছু লাভ করে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যাবসাতে ভালো ভাবেই নামল। সুরমাকে বিয়ে করার চার বছরের মধ্যে হীরু একজন বড়ো কন্টাক্টর হয়ে পড়ল। শাশুড়ির টাকা বাদ দিয়েও নিজের লাভের অংশ থেকে সে তখন ত্রিশ-চল্লিশ হাজার টাকা কারবারে ফেলেছে।
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে হীরুর চালচলন বদলে গিয়েছে। রেলের কোয়ার্টার ছেড়ে দিয়ে মুঙ্গেরে গঙ্গার ধারে বড়ো বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানেই সকলকে রেখেচে। রেলে জামালপুরে যাতায়াত করে রোজ, মোটর এখনও করেনি—তবে বলতে শুরু করেছে মোটর না-রাখলে আর চলে না; ব্যাবসা রাখতে গেলে ওটা নিতান্তই দরকার, বাবুগিরির জন্যে নয়। হঠাৎ এই সময় দেশ থেকে পিসিমার চিঠি এল, তিনি আর বেশিদিন বাঁচবেন না; বহুকাল হীরুকে দেখেননি তিনি, তাঁর বড়ো ইচ্ছে মুঙ্গেরে হীরুর কাছে কিছুদিন থাকেন ও দু-বেলা গঙ্গাস্নান করেন।
সুরমা বললে—আসতে যখন চাইচেন, নিয়ে এগো গে—আমিও তাঁকে কখনও দেখিনি—আমরা ছাড়া আর তাঁর আছেই বা কে? বুড়ো হয়েচেন—যে ক-দিন বাঁচেন এখানেই গঙ্গাতীরে থাকুন।
বাসায় আর এমন কেউ ছিল না, যাকে পাঠানো যায় পিসিমাকে আনতে, কাজেই হীরুই দেশে রওনা হল।
ভাদ্র মাস। দেশ এবার ভেসে গিয়েচে অতিবৃষ্টিতে। কোদলা নদীতে নৌকোয় করে আসবার সময় দেখলে জল উঠে দু-পাশের আউশ ধানের খেত ডুবিয়ে দিয়েছে। গোয়ালবাসির বিলে জল এত বেড়েছে যে, নৌকোর বুড়ো মাঝি বললে সে তার জ্ঞানে কখনো এমন দেখেনি, গোয়ালবাসি ও চিত্রাঙ্গপুর গ্রাম দু-খানা প্রায় ডুবে আছে।
অথচ এখন আকাশে মেঘ নেই, শরতের সুনীল আকাশের নীচে রৌদ্রভরা মাঠ, জল বাড়বার দরুন নৌকো চলল মাঠের মধ্য দিয়ে, বড়ো বাবলা বনের পাশ কাটিয়ে। ঘন সবুজ দীর্ঘ লতানে বেতঝোপ কড় কড় করে নৌকোর ছইয়ের গায়ে লাগচে, মাঠের মাঝে বন্যার জলের মধ্যে জেগে আছে ছোটো ছোটো ঘাস, তাতে ঘন ঝোপ।
পিসিমাদের গ্রামে নৌকো ভিড়তে দুপুর ঘুরে গেল। এখানে নদীর পাড় খুব উঁচু বলে কূল ছাপিয়ে জল ওঠেনি; দু-পাড়েই বন, একদিকে হ্রস্ব ছায়া পড়েছে জলে, অন্য পাড়ে খররৌদ্র। এই বনের গন্ধ…নদীজলের ছলছল শব্দ…বাঁশবনে সোনার সড়কির মতো নতুন বাঁশের কোঁড় বাঁশঝাড়ের মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে…এই শরৎ দুপুরের ছায়া…এইসব অতিপরিচিত দৃশ্য একটিমাত্র মুখ মনে করিয়ে দেয়…অনেকদিন আগের মুখ…হয়তো একটু অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, তবুও সেই মুখ ছাড়া আর কোনো মুখ মনে আসে না। নদীর ঘাটে নেমে, পথে চলতে চলতে সে মুখ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল মনের মধ্যে… এক ধরনের হাত-নাড়ার ভঙ্গি আর কী বকুনি, অজস্র বকুনি!…জগতে আর কেউ তেমন কথা বলতে পারে না। অনেক দূরের কোন অবাস্তব শূন্যে ঘুরচে সুরমা, তার আকর্ষণের বাইরে এ রাজ্য। এখানে গৃহাধিষ্ঠাত্রী দেবী আর একজন, তার একচ্ছত্র অধিকার এখানে—সুরমা কে? এখানকার বন, নদী, মাঠ, পাখি সুরমাকে চেনে না।
হীরু নিজেই অবাক হয়ে গেল নিজের মনের ভাবে।
পিসিমা যথারীতি কান্নাকাটি করলেন অনেকদিন পরে ওকে দেখে। আরও ঢের বেশি বুড়ি হয়ে গিয়েছেন, তবে এখনও অথর্ব হননি। বেশ চলতে-ফিরতে পারেন। হীরুর জন্যে ভাত চড়াতে যাচ্ছিলেন, হীরু বললে—তোমায় কষ্ট করতে হবে না পিসিমা, আমি চিঁড়ে খাব। ওবেলা বরং রেঁধো।
অনেকবার বলিবলি করেও কুমীর কথাটা সে কিছুতেই পিসিমাকে জিগ্যেস করতে পারলে না। একটু বিশ্রাম করে বেলা পড়লে সে হাটতলার মধু ডাক্তারের ডাক্তারখানায় গিয়ে বসল। মধু ডাক্তারের চুল-দাড়িতে পাক ধরেচে, একটি ছেলে সম্প্রতি মারা গিয়েছে—সেই গল্প করতে লাগল। গ্রামের মক্তবের সেই বুড়ো মৌলবি এখনও আছে; এখনও সেইরকম নিজের অঙ্কশাস্ত্রে পারদর্শিতার প্রসঙ্গে সাব-ইনস্পেক্টার মহিমবাবুর গল্প করে। মহিমবাবু ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে এ অঞ্চলে স্কুল সাব-ইনস্পেক্টরি করতেন। এখন বোধ হয় মরে ভূত হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু কোনবার মক্তব পরিদর্শন করতে এসে নিজেই শুভঙ্করীর সারাকালির একটা অঙ্ক দিয়ে নিজেই কষে বুঝিয়ে দিতে পারেননি, সে গল্প আজও এদেশে প্রচলিত আছে। এই মৌলবি সাহেবের মুখেই হীরু এ গল্প বহুবার শুনেচে।
সন্ধ্যা হবার পূর্বেই হীরু হাটতলা থেকে উঠল। মধু ডাক্তার বললেবোস হে হীরু, সন্ধেটা জ্বালি—তারপর দু-এক হাত খেলা যাক। এখন না-হয় বড়োই হয়েচ, পুরোনো দিনের কথা একেবারে ভুলে গেলে যে হে!
হীরু পথশ্রমের অজুহাত দেখিয়ে উঠে পড়ল। তার শরীর ভালো নয়, পুরোনো দিনের এইসব আবেষ্টনীর মধ্যে এসে পড়ে সে ভালো করেনি।
কুমী এখানে আছে কিনা, একথাটা মধু ডাক্তারকেও সে জিগ্যেস করবে ভেবেছিল। ওদের একই পাড়ায় বাড়ি। কুমী মধু ডাক্তারকে কাকা বলে ডাকে। কুমীদের সম্বন্ধে মাত্র সে এইটুকু শুনেছিল যে, কুমীর জ্যাঠামশাই বছর পাঁচেক হল মারা গিয়েছেন এবং জ্যাঠতুতো ভাইয়েরা ওদের পৃথক করে দিয়েছে।
অন্যমনস্কভাবে চলতে চলতে সে দেখলে কখন কুমীদের পাড়াতে, একেবারে কুমীদের বাড়ির সামনেই এসে পড়েছে। সেই জিউলি গাছটা, এই গাছটাতে একবার সাপ উঠে পাখির ছানা খাচ্ছিল, কুমী তাকে ছুটে গিয়ে খবর দিতে, সে এসে সাপ তাড়িয়ে দেবার জন্য ঢিল ছোড়াছুড়ি করে। এ পাড়ার গাছে-পালায়, ঘাসে-পাতায়, সন্ধ্যার ছায়ায়, শাঁকের ডাকে কুমী মাখানো। এইরকম সন্ধ্যায় কুমীদের বাড়ি বসে সে কত গল্প করেচে কুমীর সঙ্গে।
চুপ করে সে জিউলিতলায় খানিকটা দাঁড়িয়ে রইল।…
তার সামনের পথটা দিয়ে তেইশ-চব্বিশ বছরের একটি মেয়ে দুটো গোরুর দড়ি ধরে নিয়ে আসছে। কুমীদের বাড়ির কাছে বাঁশতলাটায় যখন এল, তখন হীরু চিনতে পারলে সে কুমী।
প্রথমটা সে যেন অবাক হয়ে গেল…আড়ষ্টের মতো দাঁড়িয়ে রইল। সত্যিই কুমী? এমন অপ্রত্যাশিতভাবে একেবারে তার চোখের সামনে! কুমীই বটে, কিন্তু কত বড়ো হয়ে গিয়েছে সে।
হঠাৎ হীরু এগিয়ে গিয়ে বললে—কুমী কেমন আছ? চিনতে পারো? কুমী চমকে উঠল, অন্ধকারে বোধ হয় ভালো করে চিনতে পারলে না, বলল কে?
—আমি হীরু।
কুমী অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ তার মুখ দিয়ে কথা বার হল না। তারপর এসে পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করে হীরুর মুখের দিকে চেয়ে বললে— কবে এলে হীরুদা? কোথায় ছিলে এতকাল? সেই জামালপুরে?
—আজই দুপুরে এসেছি।
আর কোনো কথা তার মুখ দিয়ে বেরুল না। সে কেবল একদৃষ্টে কুমীর দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কুমীর কপালে সিঁদর, হাতে শাঁখা, পরনে একখানা আধময়লা শাড়ি—যে কুমীকে সে দেখে গিয়েছিল ছ-সাত বছর আগে, এ সে কুমী নয়। সে কৌতূহলোচ্ছল কলহাস্যময়ী কিশোরীকে এর মধ্যে চেনা যায় না। এ যেন নিরানন্দের প্রতিমা, মুখশ্রী কিন্তু আগের মতোই সুন্দর। এতদিনেও মুখের চেহারা খুব বেশি বদলায়নি।
কুমী বললে—এসো আমাদের বাড়ি হীরুদা। কত কথা যে তোমার সঙ্গে আছে, এই ক-বছরের কত কথা জমানো রয়েছে, তোমায় বলব বলব করে কতদিন রইলাম, তুমি এ পথে আর এলেই না।
হয়েচে! সেই কুমী! ওর মুখে হাসি সেই পুরোনো দিনের মতোই আবার ফুটে উঠেছে; হীরু ভাবলে, আহা, ওর বকুনির শ্রোতা এতদিন পায়নি তাই ওর মুখখানা ম্লান।
–তুই আগে চল, কুমী।
—তুমি আগে চলো, হীরুদা।
চার-পাঁচ বছরের একটি ছেলে রোয়াকে বসে মুড়ি খাচ্ছিল। কুমীকে দেখে বললে—ওই মা এসেচে।
-–বসো হীরুদা, পিঁড়ি পেতে দিই। মা বাড়ি নেই, ওপাড়ায় গিয়েচে রায়বাড়ি, কাল ওদের লক্ষ্মীপুজোর রান্না বেঁধে দিতে। আমি ছেলেটাকে মুড়ি দিয়ে বসিয়ে রেখে গোরু আনতে গিয়েছিলুম দিঘিরপাড় থেকে। উঃ—কতকাল পরে দেখা হীরুদা! বোসো, বোসো! কী খাবে বলো তো, তুমি মুড়ি আর ছোলাভাজা খেতে ভালোবাসতে। বসো, সন্দেটা দেখিয়ে খোলা চড়িয়ে গরম গরম ভেজে দিই। ঘরে ছোলাও আছে, নারকোলও আছে। দাঁড়াও, আগে পিদিমটা জ্বালি।
সেই মাটির ঘর সেইরকমই আছে। সেই কুমী সন্ধ্যা-প্রদীপ দিচ্ছে পুরোনো দিনের মতো, যখন সে কত রাত পর্যন্ত ওদের বাড়ি বসে গল্প করত। তবুও কত কত পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে! কত ব্যবধান এখন তার আর কুমীর মধ্যে।
কুমী প্রদীপ দেখিয়ে চাল ভাজতে বসল। একটু পরে ওকে খেতে দিয়ে সামনে বসল সেই পুরোনো দিনের মতোই গল্প করতে। সেই হাত-পা নাড়া, সেই বকুনি—সবই সেই। কত কথা বলে গেল। হীরু ওর দিকে চেয়ে থাকে, চোখ আর অন্য দিকে ফেরাতে পারে না। কুমীও তাই।
হীরু বললে—ইয়ে, কোথায় বিয়ে হল কুমী?
কুমী লজ্জায় চোখ নামিয়ে বললে—সামটা।
—তা বেশ।
তারপর কুমী বললে, ক-দিন থাকবে এখন হীরুদা?
—থাকবার জো নেই, কাজ ফেলে এসেছি, পিসিমাকে নিয়ে কালই যাব। পিসিমা চিঠি লিখেছিলেন বলেই তো তাঁকে নিতে এলাম।
—না, না হীরুদা, সে কী হয়? কাল ভাদ্র মাসের লক্ষ্মীপুজো, কাল কোথায় যাবে? থাকো এখন দু-দিন। কতকাল পরে এলে। তুমিও তো বিয়ে করেচ, বউদিকে নিয়ে এলে না কেন? দেখতাম। ছেলে-মেয়ে কী?
—দুটি ছেলে একটি মেয়ে।
—বেশ, বেশ। আচ্ছা, আমার কথা মনে পড়ত হীরুদা?
মনে খুব পড়ত না, কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, এখন এমন মনে পড়চে যে সুরমা ও জামালপুর অস্পষ্ট হয়ে গিয়েচে। বড়োলোকের মেয়ে সুরমা তার মনের মতো সঙ্গিনী নয়, তার সঙ্গে সব দিক থেকে মেলে—খাপ খায় এই কুমীর। অথচ সুরমার জন্য দামি মাদ্রাজি শাড়ি কিনে নিয়ে যেতে হবে কলকাতা থেকে যাবার সময়—সুরমা বলেচে, যাচ্চ যখন দেশে, ফিরবার সময় কলকাতা থেকে পুজোর কাপড়-চোপড় কিনে এনো। এখানে ভালো জিনিস পাওয়া যায় না, দরও বেশি।
আর কুমীর পরনে হেঁড়া আধময়লা কাপড়।
না—দরিদ্র গৃহলক্ষ্মীকে বড়োলোকী উপহার দিয়ে সে তার অপমান করবে না। কুমী বকেই চলেছে। অনেক দিন পরে আজই ও আনন্দ পেয়েছে—নিরানন্দ অসচ্ছল সংসারের একঘেয়ে কর্মের মধ্যে বালিকাবয়সের শত আনন্দের স্মৃতি নিয়ে পুরোনো দিনগুলো হঠাৎ আজ সন্ধ্যায় কেমন করে ফিরেচে।
ঘণ্টা দুই পরে কুমীর মা এলেন। বললেন—এই যে, জুটেচ দুটিতে? আমি শুনলুম দিদির মুখে যে হীরু এসেচে। কাল লক্ষ্মীপুজো, তাই রায়েদের বাড়ি রান্না করে দিয়ে এলাম। তা ভালো আছিস বাবা হীরু? কুমী কত তোর কথা বলে। তোর কথা লেগেই আছে ওর মুখে; এই আজও দুপুরবেলা বলছিল, মা, হীরুদা নদীতে বন্যা দেখলে খুশি হত; এবার তো বন্যা এসেছে, হীরুদা যদি দেখত, খুব খুশি হত—না মা? তা, আমি তুই এসেছিস শুনেই দিদির ওখানে গিয়েছিলুম। বাড়ি নেই দেখে ভাবলাম সে ঠিক আমাদের ওখানে গিয়েছে। তা বোসো বাবা, চট করে পুকুর থেকে কাপড় কেচে গা ধুয়ে আসি। গামছাখানা দে তো কুমী। খোকার জন্য তরকারি এনেচি কাঁসিতে। ওকে ভাত দে। এই ওর বিয়ে দিয়েচি সামটায়— বুঝলে বাবা হীরু? জামাই দোকানে সামান্য মাইনের খাতা-পত্র লেখার কাজ করে। তাতে চলে না। তার ওপর দজ্জাল ভাই-বউ। খেতে পর্যন্ত দেয় না ভালো করে মেয়েটাকে। এই দেখোএখানে এসেচে আজ পাঁচ মাস, নিয়ে যাবার নামটি নেই, বউদিদির হুকুম হবে তবে বউ নিয়ে যেতে পারবে। আর এদিকে তো আমার এই অবস্থা, মেয়েটার পরনে নেই কাপড়, জামাই আসে-যায়, কাপড়ের কথা বলি, কানেও তোলে না। আমি যে কী করে চালাই? তা সবই অদৃষ্ট! নইলে–
কুমী ঝাঁজালো সুরে বললে—আ : যাও না, গা ধুয়ে এসো না—কী বকবক শুরু করলে—
অদৃষ্ট, হাঁ অদৃষ্টই। সে আজ কোথায়, আর কুমী কোথায় পড়ে কষ্ট পাচ্ছে।
পরনে কাপড় নেই, পেটে ভাত নেই, জীবনে আনন্দ নেই, সাধ-আলহাদ নেই, কিছুই দেখলে না, কিছুই ভোগ করলে না, সবই অদৃষ্ট ছাড়া আর কী?
খানিক রাত্রে হীরু উঠল। কুমী প্রদীপ ধরে এগিয়ে দিলে পথ পর্যন্ত। বললে— আমাদের হ্যারিকেন লণ্ঠন নেই, একটা পাকাটি জ্বেলে দিই, নিয়ে যাও হীরুদা, বাঁশবনে বড় অন্ধকার।
সকালে কুমী পিসিমার বাড়ি এসে ডাক দিলে—কী হচ্চে, ও হীরুদা—
—এই যে কুমী, কামিয়ে নিলাম। এইবার নাইব।
কুমী ঘরের মধ্যে ঢুকে বললে—কেন, কীসের তাড়া নাইবার এত সকালে? তোমার কিন্তু আজ যাওয়া হবে না হীরুদা—বলে দিচ্চি। আজ ভাদ্রমাসের লক্ষ্মীপুজোর অরন্ধন, তোমায় নেমন্তন্ন করতে এলুম আমাদের বাড়ি। মা বললেন—যা গিয়ে বলে আয়।
হীরু আর প্রতিবাদ করতে পারলে না, কুমীর কাছে প্রতিবাদ করে কোনো লাভ নেই সে জানে। কুমী খানিকটা পরে বলল—আমার অনেক কাজ হীরুদা, আমি যাই। তুমি নেয়ে সকাল সকাল এসো।
হীরু বেলা দশটার মধ্যে ওদের বাড়ি গেল। আজ আর রান্নার হাঙ্গামা নেই। কুমী বললে—আজ কিন্তু পান্তা ভাত খেতে হবে জানো তো? আর কচুর শাক— আর একটা কী জিনিস বলো তো?…উঁহু… তুমি বলতে পারবে না।
কুমীর মা বললেন—কাল রাত্রে তুই চলে গেলে মেয়ে অত রাত্রে তোর জন্যে নারকেল কুমড়ো রাঁধতে বসল। বললে, হীরুদা বড়ো ভালোবাসে মা, কাল সকালে খেতে বলব, বেঁধে রাখি।
কুমী স্নান সেরে এসে একখানা ধোয়া শাড়ি পরেচে, বোধহয় এইখানাই তার একমাত্র ভালো কাপড়। সেই চঞ্চলা মুখরা বালিকা আর সে সত্যই নেই, আজ দিনের আলোয় কুমীকে দেখে ওর মনে হল—কুমীর চেহারা আরও সুন্দর হয়েছে, তবে ওর মুখে-চোখে একটা শান্ত মাতৃত্বের ভাব ফুটে উঠেচে, যেটা হীরু কখনো ওর মুখে দেখেনি। কুমী অনেক ধীর হয়েছে, অনেক সংযত হয়েচে। মাথায় সেইরকমের এক ঢাল চুল, মুখশ্রী এখনও সেইরকম লাবণ্যময়। তবুও যেন কুমীকে চেনা যায় না, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বালিকা কুমী অন্তর্হিত হয়েছে, এখন যে কুমীকে সে দেখচে তার অনেকখানিই যেন সে চেনে না।
কিন্তু খানিকটা বসবার পরে হীরুর এ ভ্রম ঘুচে গেল। বাইরের চেহারাটা যতই বদলে যাক না কেন, তার সামনে যে কুমী বার হয়ে এল, সে সেই কিশোরী কুমী। ওর যেটুকু পরিচিত তা ওর মধ্যে বার হয়ে এল—যেটুকু হীরুর অপরিচিত, তা নিজেকে গোপন রাখলে।
কী চমৎকার কুমীর মুখের হাসি। হীরুর মোহ নেই, আসক্তি নেই, আছে কেবল। একটা সুগভীর স্নেহ, মায়া, অনুকম্পা…এ এক অদ্ভুত মনের ভাব, কুমীকে সে সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে পারে তাকে একটুক খুশি করবার জন্য।
কুমী কত কী বকচে বসে বসে…পুরোনো দিনের কথা তুলচে কেবল।
–মনে আছে হীরুদা, সেই একবার জেলেদের বাঁশতলায় আলেয়া জ্বলেছিল —সেও তো এই ভাদ্রমাসে…সেই চারুপাঠ মনে আছে?
হীরুর খুব মনে আছে। সবাই ভয়ে আড়ষ্ট, আলেয়া নাকি ভূত, যে দেখতে যায় তার অনিষ্ট হয়। হীরু সাহস করে এগিয়ে গিয়েছিল দেখতে, কুমীও পিছু পিছু গিয়েছিল।
হীরু বলেছিল—আসছিস কেন পোড়ারমুখী, ভূত ধরে খাবে যে—
কুমী ভেংচি কেটে বলেছিল—ইস! ভূতে ধরে ওঁকে খাবে না—আমাকেই খাবে। আলেয়া বুঝি ভূত? ও তো একরকম বাষ্প, আমি পড়িনি বুঝি চারুপাঠে? শুনবে বলব…অনেকের বিশ্বাস আছে আলেয়া একপ্রকার ভূতযোনি, বাস্তবিক ইহা তা নয়—
হীরু ধমক দিয়ে বলেছিল—রাখ তোর চারুপাঠ—আরম্ভ করে দিলেন এখন অন্ধকারের মধ্যে চারুপাঠ…বলে ভয়ে মরচি—
পরক্ষণেই কুমী খিলখিল করে হেসে উঠে বলেছিল—কী বললে হীরুদা, ভয়ে মরচ? হি হি হি হি—এত ভয় তোমার যদি এলে কেন? চারুপাঠ পড়লে ভয় থাকত না…চারুপাঠ তো আর পড়োনি?
সেইসব পুরোনো গল্প। আলেয়া…আলেয়াই বটে।
কুমীর যে খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে তা বোঝা গেল, যখন ও গ্রামের এক বিধবা গরিব মেয়ের কথা তুললে। আগে এসব কথা কুমী বলত না। এখন সে পরের দুঃখ বুঝতে শিখেচে। মুখুয্যে বাড়ির বড়ো পুরীপাল্লার মধ্যে হর মুখুজ্যের এক বিধবা নাতনি—নিতান্ত বালিকা—কী রকম কষ্ট পাচ্চে, পুকুরঘাটে কুমীর কাছে বসে নির্জনে মৃত স্বামীর রূপগুণের কত গল্প করে—এ কথা কুমী দরদ দিয়ে বলে গেল। সত্যিই মাতৃত্ব ওর মধ্যে জেগেছে, ওকে বদলে দিয়েছে অনেকখানি।
হঠাৎ কুমী বললে—অই দেখো হীরুদা, বকেই যাচ্চি। তোমায় যে খেতে দেব, সে-কথা মনে নেই।
তার পরে সে উঠে তাড়াতাড়ি হীরুকে ঠাঁই করে দিয়ে ভাত বেড়ে নিয়ে এল। হাসিমুখে বললে—জামালপুরের বাবুর আজ কিন্তু পান্তা ভাত খেতে হবে। রুচবে তো মুখে? নেবু কেটে দেব এখন অনেক করে, নারকোল-কুমড়ি আছে, কচুর শাক আছে।
এসব সত্যিই হীরু অনেকদিন খায়নি। যা যা সে খেতে ভালোবাসে, কুমী তার কিছুই বাদ দেয়নি। হীরু আশ্চর্য হয়ে গেল—এতকাল পরেও কুমী মনে রেখেছে এসব কথা।
খেতে বসে হীরু বললে—কুমী, ছেলেবেলা ভালো লাগে, না এখন ভালো লাগে?
—এ কথার উত্তর নেই হীরুদা। ছেলেবেলায় তোমরা সব ছিলে, সে একদিন ছিল। এখনও তা বলে খারাপ লাগে না—জীবনে নানারকম দেখা ভালো নয় কি?
—কুমী, একটা কথার উত্তর দে। তোর সংসারের টানাটানি খুব?
-কে বললে এ কথা? মা বলেছিল সেই তো কাল রাত্তিরে? ও বাজে কথা, জানো তো, মা যত বাজে বকে। বুড়ো হয়ে মার আরও জিব আলগা হয়ে গেছে।
–কুমী, আমার কাছে সত্যি কথা বলবিনে?
—ওই, তুমিও পাগলামি শুরু করলে। নাও, খেয়ে নাও—যত বাজে বকতে পারো—মা গো!…দাঁড়াও পায়েসটা আনি, কচুর শাক পড়ে রইল কেন অতখানি?…না সে হবে না—
—দ্যাখ কুমী, আমার কাছে বেশি চালাকি করিসনে। তোকে আর আমি জানিনে? কোদলার ঘাটে পায়ে খেজুরকাঁটা ফুটে গিয়েছিল, মুখে একটু রা করিসনি, জানতে দিসনি কাউকে–
—আবার?
হীরু চুপ করে গেল। এতখানি বলে সে ভালো করেনি, ঝোঁকের মাথায় বলে ফেলেচে। কুমী যা ঢাকতে চায়, ও তা বার করে কুমীর আত্মসম্মানে ঘা দিতে চায় কেন? ছিঃ—
কুমী বললে—আবার কবে আসবে হীরুদা?
—সত্যি কথা যদি শুনতে চাস, আমার যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না কিন্তু।
—আবার বাজে বকতে শুরু করেচ হীরুদা। তোমার যা কিছু সব সামনে, চোখের আড়াল হলে আর মনে থাকে না। আর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যত বাজে বকুনি
—তুমি তো জানো না একটুও বাজে বকতে? আমি ইচ্ছে করলে থাকতে পারিনে ভেবেছিস?
—হাঁ, থাকো না দেখি কাজকর্ম বন্ধ করে। বউদি এসে চুলের মুঠি ধরে নিয়ে যাবে না?
—আচ্ছা সে যাক, একটা কথার উত্তর তোকে দিতেই হবে। আমি যদি এখানে থাকি তুই খুশি হোস?
—উঃ, মা গো, মুখ বুজে খেয়ে নাও দিকি? কী বাজে বকতেই পারো!
হীরু দুঃখিতভাবে বললে—আমার এ কথাটারও উত্তর দিবিনে কুমী? তুই এত বদলে গিয়েছিস আমি এ ভাবতেই পারিনে। আচ্ছা, বেশ।
কুমী হেসে প্রায় লুটিয়ে পড়তে পড়তে বললে—তোমার কিন্তু একটুও বদলায়নি হীরুদা, সেইরকম ‘আচ্ছা, বেশ’ বলা, সেইরকম কথায় কথায় রাগ করা। আচ্ছা, কী বলব বলো দিকি? তুমি জানো না ও-কথার কী উত্তর আমি দিতে পারি? ভেবে দেখো তা হলে আমি বদলাইনি, বদলে গিয়েছ তুমি হীরুদা।
—আচ্ছা কুমী, এতটা না-বকে সামান্য দু-কথায় সাদা উত্তর একটা দে না কেন? বকুনিতে আমি কি তোর সঙ্গে পারব?
-না, তা তুমি পারবে কেন? বকতে তুমি একটুও জানো না। হ্যাঁ, হই।
–মন থেকে বলছিস?
—আমার ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করচে হীরুদা, এতটা বদলে গিয়েছ তুমি? যাও—আমি তোমার কোনো কথার আর উত্তর দেব না, তুমি না-নিজের বুদ্ধির বড়ো অহংকার করতে?
—কুমা, রাগ করিসনে। অনেক কাজের মধ্যে থেকে আমার সূক্ষ্ম-বুদ্ধিটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। যাক, বাঁচলুম কুমী।
—পায়েসটা খাও, তোমার পায়ে পড়ি। আর বকুনিটা কিছুক্ষণের জন্যে ক্ষান্ত রাখো। কিছু তোমার পেটে গেল না এই অনাছিষ্টি বকুনির জন্যে।
কুমী পরদিন এসে বিছানা-বাক্স গুছিয়ে দিলে। ঘাট পর্যন্ত এসে ওদের নৌকোতে উঠিয়ে দিলে। নৌকো ছেড়ে যখন অনেকটা গিয়েচে তখনও কুমী ডাঙায় দাঁড়িয়ে আছে।
দু-পাড়ের নদীচড়া নির্জন। দুপুরের রৌদ্র আজ বড়ো প্রখর, আকাশ অদ্ভুত ধরনের নীল, মেঘলেশহীন। বন্যার জলে পাড়ের ছোটো কালকাসুন্দি গাছের বন পর্যন্ত ডুবে গিয়েছে। কচুরিপানার বেগুনি ফুল চড়ার ধারে আটকে আছে। সেইসব বনজঙ্গলময় ডাঙার পাশ দিয়ে চলেচে ওদের নৌকো। ঝোপের তলার ছায়ায় ডাহুক চরচে। বন্যার জলে নিমগ্ন আখের খেতের আখগাছগুলো স্রোতের বেগে থরথর করে কাঁপছে।
ছইয়ের মধ্যে পিসিমা ঘুমিয়ে পড়েছেন। নিস্তব্ধ ভাদ্র অপরাহু। নৌকোয় তক্তার ওপর বসে বসে হীরু কত কী ভাবছিল। এ গ্রামে যদি সে থাকতে পারত! মধু ডাক্তারের মতো হাটতলায় ওষুধের ডিসপেনসারি খুলে? ডাক্তারিটা যদি শিখত সে!
পুজোর বাজারটা ফিরবার সময় করতে হবে কলকাতা থেকে…অন্তত দেড়শো টাকার বাজার। আসবার সময় খুব উৎসাহ করে সুরমার কাছ থেকে ফর্দ করে নিয়ে এসেচে…
একটা মানুষের মধ্যে মানুষ থাকে অনেকগুলো। জামালপুরের হীরু অন্য লোক, এ হীরু আলাদা। এ বসে বসে ভাবচে, কুমীদের রান্নাঘরে অরন্ধনের নেমন্তন্ন খেতে বসেছিল, সেই ছবিটা। অনবরত ওই একটা ছবিই।…
কুমী বলছে—আমার কথা মনে পড়ত হীরুদা?…
কুমী এখনও কী ঠিক তেমনি হাত-পা নেড়ে কথা বলে…ঠিক সেই ছেলেবেলাকার মতো!…আচ্ছা, আর কারো সঙ্গে কথা বলে অমন আনন্দ হয় না কেন? সুরমার সঙ্গেও তো রোজ কত কথা হয়…কই…
রেলের বাঁশির আওয়াজে হীরুর চমক ভাঙল। ওই স্টেশনের ঘাট দেখা দিয়েছে। সিগন্যাল নামানো, বোধ হয় ডাউন ট্রেনটা আসবার দেরি নেই…
আইনস্টাইন ও ইন্দুবালা
আইনস্টাইন কেন যে দার্জিলিং যাইতে যাইতে রানাঘাটে নামিয়াছিলেন বা সেখানে স্থানীয় মিউনিসিপ্যাল হলে ‘On…ইত্যাদি ইত্যাদি’ সম্বন্ধে বক্তৃতা করিতে উৎসুক হইয়াছিলেন—এ কথা বলিতে পারিব না। আমি ঠিক সেইসময়ে উপস্থিত ছিলাম না। কাজেই প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ আমি আপনাদের নিকট সরবরাহ করিতে অপারগ, তবে আমি যেরূপ অপরের নিকট হইতে শুনিয়াছি সেরূপ বলিতে পারি।
আসল কথা, নাৎসি জার্মানি হইতে নির্বাসিত হওয়ার পর হইতে বোধ হয় আইনস্টাইনের কিছু অর্থাভাব ঘটিয়াছিল, বক্তৃতা দিয়া কিছু উপার্জন করার উদ্দেশ্যে তাঁর ভারতবর্ষে আগমন। বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা দিয়া বেড়োইতেছিলেনও এ কথা সকলেই জানেন, আমি নূতন করিয়া তাহা বলিব না।
কৃষ্ণনগর কলেজের তদানীন্তন গণিতের অধ্যাপক রায়বাহাদুর নীলাম্বর চট্টোপাধ্যায় একজন উপযুক্ত লোক ছিলেন। সেনেট হলে আইনস্টাইনের অদ্ভুত বক্তৃতা ‘On the Unity & Universality of forces’ শুনিয়া অন্য পাঁচজন চিন্তাশীল ব্যক্তিদিগের মতো তিনিও অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিলেন। তাঁহার কলেজে আইনস্টাইনকে আনাইয়া একদিন বক্তৃতা দেওয়াইবার খুব ইচ্ছা ছিল, কিন্তু প্রিন্সিপাল আপত্তি উত্থাপন করিলেন।
তিনি বলিলেন—“না রায় বাহাদুর, আমার অন্য কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু এমন দিনে একজন জার্মান—”
রায়বাহাদুর উত্তেজিত হইয়া বলিলেন (যেমন ধরনের উত্তেজিত হইয়া তিনি উঠিতেন সন্ধ্যায় রামমোহন উকিলের বৈঠকখানায় ভাগবত পাঠের সময়, অন্য কেহ যদি কোনো বিরুদ্ধ তর্ক উত্থাপন করিত)—”সে কী মহাশয়! জার্মান কী? জার্মান? আইনস্টাইন জার্মান? ওঁদের মতো মহামানবের, ওঁদের মতো ঋষি বৈজ্ঞানিকের দেশ আছে? জাতের গণ্ডি আছে? আমি বলিলাম।
প্রিন্সিপাল বলিলেন—”আমিও বলছিনে যে তা আছে। কিন্তু বর্তমানে যেমন অবস্থা—” দুই প্রবীণ অধ্যাপকে ঘোর তর্ক বাধিয়া গেল।
প্রিন্সিপাল দর্শনশাস্ত্রের পণ্ডিত, তিনি মধ্যযুগের স্কলাস্টিক দর্শনের প্রধান আচার্য জন স্কোটাসের উদাহরণ দেখাইলেন। আয়ার্লন্ডে জন্মগ্রহণ করিয়াও নবম শতাব্দীর গোঁড়াদিগের দ্বারা উৎপীড়িত হইয়া ফ্রান্সে তিনি আশ্রয় গ্রহণ করিতে বাধ্য হন। আয়ার্লন্ডে আর ফিরিতে পারিয়াছিলেন কি? আসল মানুষটাকে কে দেখে! তাঁর মতামতেরই মূল্য দেয় লোকে।
যাহা হউক, শেষপর্যন্ত যখন প্রিন্সিপাল রাজি হইলেন না তখন রায়বাহাদুরকে বাধ্য হইয়া নিরস্ত হইতে হইল। ইতিমধ্যে তাঁহার কানে গেল আইনস্টাইন শীঘ্রই দার্জিলিং যাইবেন। ভারতবর্ষে আসিয়া অবধি নানাস্থানে বক্তৃতা দিতে ব্যস্ত থাকার দরুন তিনি হিমালয় দেখিতে পারেন নাই, এইবার এত কাছে আসিয়া আর দার্জিলিং না-দেখিয়া ছাড়িতেছেন না।
রায়বাহাদুর ভাবিলেন দার্জিলিঙের পথে রানাঘাটে নামাইয়া লইয়া সেখানে এক সভায় আইনস্টাইনকে দিয়া বক্তৃতা দেওয়াইলে কেমন হয়?
রায়বাহাদুর গ্র্যান্ড হোটেলে আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা করিলেন।
আইনস্টাইন বলিলেন, “ভারতবর্ষের দর্শনের কথা আমায় কিছু বলুন।”
রায়বাহাদুর প্রমাদ গণিলেন। তিনি গণিতের অধ্যাপক; দর্শন, বিশেষত ভারতীয় দর্শনের কোনো খবর রাখেন না, তবু ভাগ্যে গীতা মাঝে মাঝে পড়া অভ্যাস ছিল, সুতরাং অকূল সমুদ্রে গীতারূপ ভেলা (কোনো আধ্যাত্মিক অর্থে নয়) অবলম্বন করিয়া দু-এক কথা বলিবার চেষ্টা করিলেন। ‘বাসাংসি জীর্ণানি’ ইত্যাদি।
আইনস্টাইন বলিলেন, “ম্যাক্সমুলারের বেদান্তদর্শনের উপর প্রবন্ধ পড়ে একসময়ে সংস্কৃত শেখবার বড়ো ইচ্ছে হয়। দর্শনে আমি স্পিনোজার মানসশিষ্য। স্পিনোজার দর্শন গণিতের ফর্মে ক্রমানুসারে সাজানো। স্পিনোজার মন গণিতজ্ঞ স্রষ্টার মন, সেজন্য আমি ওঁর দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। কিন্তু বেদান্ত সম্বন্ধে ম্যাক্সমুলারের প্রবন্ধ পড়ে আমি নতুন এক রাজ্যের সন্ধান পেলাম। ইউক্লিডের মতো খাঁটি বস্তুতান্ত্রিক মন স্পিনোজার, সেখানে কূটতর্কও বাঁধা পথে চলে। আমি কিন্তু ভেতরে ভেতরে কল্পনাবিলাসী—I’
রায়বাহাদুর অবাক হইয়া আইনস্টাইনের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, ‘‘আপনি!”
আইনস্টাইন মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “কেন, আমার কালের সঙ্গে ক্ষেত্রের একত্র মিলনকে আপনি কল্পনার ছাঁচে ঢালাই-করা বিবেচনা করেন না নাকি?”
রায়বাহাদুর আরও অবাক। আমতা আমতা করিয়া বলিলেন “নতুন ডাইমেনশানের সন্ধানদাতা আপনি, নিউটনের পর নববিশ্বের আবিষ্কারক আপনি আপনাকে কল্পনাবিলাসী বলতে—”
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান যুগের এই শ্রেষ্ঠতম বিজ্ঞানীর কবিসুলভ দীর্ঘ কেশ ও স্বপ্নভরা অপূর্ব চোখের দিকে চাহিয়া রায়বাহাদুরের মুখের কথা মুখেই রহিয়া গেল। কল্পনা প্রখর না–হইলে হয়তো বড়ো বৈজ্ঞানিক হওয়া যায় না, রায়বাহাদুর ভাবিলেন। কি একটা বলিতে যাইতেছিলেন, আইনস্টাইন পাশের ছোটো টেবিল হইতে চুরুটের বাক্স আনিয়া রায় বাহাদুরের সম্মুখে স্থাপন করিলেন। নিজের হাতে একটা মোটা চুরুট বাহির করিয়া ছুরি দিয়া ডগা কাটিয়া রায়বাহাদুরের হাতে দিলেন। রায়বাহাদুরের বাঙালি মন সংকুচিত হইয়া উঠিল। অত বড়ো বৈজ্ঞানিকের সামনে সিগার ধরাইবেন তিনি, জনৈক হেঁজিপেজি অঙ্কের মাস্টার? তা ছাড়া সাহেবও তো বটে, সেটাও দেখিতে হইবে তো। সাহেব জাত কাঁচাখেকো দেবতার জাত। রায়বাহাদুর একটা সিগার তুলিয়া বলিলেন—”আপনি?”
—”ধন্যবাদ। আমি ধূমপান করিনে।’
—”ও!”
—”আমি একটা কথা ভাবছি।”
—”কী, বলুন। “
—”রানাঘাটে সভা করলে কেমন লোক হবে আপনার মনে হয়? কেমন জায়গা রানাঘাট?”
—”জায়গা ভালোই। লোকও হবে।”
—”কিছু টাকা এখন দরকার। যা ছিল জার্মানিতে রেখে এসেছি। ব্যাঙ্কের টাকা এক মার্কও তুলতে দিলে না, একরকম সর্বস্বান্ত।”
—”আমি রানাঘাটে বিশেষ চেষ্টা করছি, সার।”
—’ওখানে বড়ো হল পাওয়া যাবে কি?”
—”তেমন নেই। তবে মিউনিসিপ্যাল হল আছে, মন্দ নয়, কাজ চলে যাবে।” রায়বাহাদুর কিছুক্ষণ পরে বিদায় লইতে চাহিলেন, ভাবিলেন এত বড়ো লোকের সময়ের ওপর অত্যাচার করিবার দরকার নাই।
আইনস্টাইন বলিলেন—’’আমার কিছু ছাপা কাগজ ও বিজ্ঞাপন নিয়ে যান। যে বিষয়ে বক্তৃতা হবে, সে আপনাকে পরে জানাব, টিকিটের দাম কত করব?”
—’খুব বেশি নয়—এই ধরুন—”
-–”তিন মার্ক—দশ শিলিং?”
—”আজ্ঞে না সার। সর্বনাশ! এসব গরিব দেশ। দশ শিলিং আজকাল দশ টাকার কাছাকাছি পড়বে। ও-দামে টিকিট কেনবার লোক নেই এদেশে, সার।’’
—”পাঁচ শিলিং?”
—”আচ্ছা, তাই করুন। ছাত্রদের জন্যে এক শিলিং।”
আইনস্টাইন হাসিয়া বলিলেন, “ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের টিকিট কিনতে হবে না। আমি নিজেও স্কুল-মাস্টার। আমার ওপর তাদের দাবি আছে। বম্বে ও বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতেও তাই হয়েছিল। ছাত্রদের টিকিট কিনতে হবে না। এই নিয়ে যান ছাপা হ্যান্ডবিল ও কাগজপত্র—”
রায়বাহাদুর হ্যান্ডবিল হাতে পাইয়া পড়িয়া দেখিতে গিয়া বিষণ্ণমুখে বলিলেন —”এ কী সার? এ যে ফরাসি ভাষায় লেখা!”
—”ফরাসি ভাষায় তো বটেই। প্যারিসে বক্তৃতা দেওয়ার সময় ছাপিয়েছিলাম। কেন, ফরাসি ভাষা বুঝবে না কেউ? আমি তো সেদিন শুনলাম এখানে ইউনিভার্সিটিতে ফরাসি পড়ানো হয়?”
—’’আজ্ঞে না। সে হয়তো এক-আধজন বুঝতে পারে। সেভাবে ফরাসি ভাষা পড়ানো হয় না। এখানে ইংরেজিটাই চলে। কেউ বুঝবে না সার।”
—’তাই তো! আপনি ইংরেজিতে অনুবাদ করে নিয়ে ওখানে কোনো প্রেসে ছাপিয়ে নেবেন দয়া করে?”
—’তা—ইয়ে…তা—আচ্ছা স্যার।”
রায়বাহাদুর মনে মনে ভাবিলেন—এখান থেকে বালিগঞ্জে গিয়ে বিনোদের শরণাপন্ন হইগে। ছোকরা ভালো ফ্রেঞ্চ জানে। কাঁহাতক আর একজন এত বড়ো লোকের সামনে ‘জানিনে মশাই’ বলা যায়! বিনোদ চৌধুরী তাঁর বড়ো শালা। পণ্ডিত লোক। অনেকরকম ভাষা তার জানা আছে। সে উৎসাহের সঙ্গে হ্যান্ডবিলগুলির বাংলা ও ইংরেজি অনুবাদ করিয়া দিয়া বলিল—”আমি চাটুয্যেমশায়, রানাঘাট যাব সেদিন। আমার থিওরি অব রিলেটিভিটির সঙ্গে পরিচয় অবিশ্যি লিন্ডেন বুলটনের পপুলার বই থেকে। তবুও আইনস্টাইনকে আমি এ যুগের ঋষি বলে মানি। সত্যকার দ্রষ্টা ঋষি। সত্যকে যাঁরা আবিষ্কার করেন, তাঁরাই মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি। লম্বা লম্বা লাঙল মার্কা ইকোয়েশন বুঝতে না-পারি, কষতে না-পারি, কিন্তু কে কী দরের সেটুকু— ।”
রায়বাহাদুর দেখিলেন চতুর শ্যালকটি তাঁহাকে ঠেস দিয়া কথা বলিতেছে। হাসিতে হাসিতে বলিলেন,—”অর্থাৎ সেই সঙ্গে আমার দরটাও বুঝি ঠিক করে ফেললে বিনোদবাবু? বেশ, বেশ।”
—”রামোঃ! চাটুয্যেমশায়, ছি ছি, তেমন কথা কী আমি বলি?”
—”বলো না?”
—”স্পেস-টাইম—কনটিনিউয়ামের মোহজালে পড়ে কোনটা কখন কী অবস্থায় বলেছি, তা কী সবসময় হলফ নিয়ে বলা যায় চাটুয্যেমশায়? এবেলা এখানে থেকে যাবেন না?”
—”না না, আমার থাকবার জো নেই। অনেক কাজ বাকি। যাতে দু-পয়সা হয় ভদ্রলোকের, সে ভার আমার ওপর। দেখি মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানদের একটু ধরাধরি করিগে। ঘুঘু সব। হলটা যদি পাওয়া যায়—”
—”কী বলেন আপনি চাটুয্যেমশায়! আইনস্টাইনের নাম শুনলে হল না-দিয়ে কেউ পারবে? আহা শুনলেও কষ্ট হয়, অত বড়ো বৈজ্ঞানিককে আজ এ বৃদ্ধ বয়সে পয়সার জন্যে বক্তৃতা করে অর্থ সংগ্রহ করতে হচ্ছে—দি ওয়ার্লড ডাজ নট নো ইটস গ্রেটেস্ট’।
—”তুমি এখনও ছেলেমানুষ বিনোদ। ওই যা শেষকালে বললে ওই কথাটাই ঠিক। অনেক ধরাধরি করতে হবে। পাঁচটা চল্লিশের ট্রেনেই যাই।”
ইহার পরের কয়েকদিন রায়বাহাদুর অত্যন্ত ব্যস্ত রহিলেন। রানাঘাট মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান, ভাইস-চেয়ারম্যান, স্কুলের হেডমাস্টার, উকিল, মোক্তার, সরকারি কর্মচারী ও ব্যাবসাদারগণের সঙ্গে দেখা করিয়া সব বলিলেন। আশ্চর্যের বিষয় লক্ষ করিলেন, সকলেরই যথেষ্ট উৎসাহ, সকলেরই যথেষ্ট আনন্দ। যেন সবাই আকাশের চাঁদ হাতে পাইতে চলিয়াছে।
বৃদ্ধ মোক্তার অভয়বাবু বলিলেন, “কী নামটি বললেন মশাই সাহেবের? আ —কী? আইন স্টাই—ন? বেশ বেশ। হাঁ, বিখ্যাত নাম। সবাই জানে সবাই চেনে। ওঁরা হলেন গিয়ে স্বনামধন্য পুরুষ—নাম শোনা আছে বই কী।”
রায়বাহাদুর রাগে ফুলিয়া মনে মনে বলিলেন—তোমার মুণ্ডু শোনা আছে, ড্যাম ওল্ড ইডিয়ট! এ তুমি কাপুড়ে মহাজন শ্যামচাঁদ পালকে পেয়েছ? স্বনামধন্য! তিনজন্ম কেটে গেলে যদি এ নাম তোর কানে পৌঁছায়। মিথ্যে সাক্ষী শিখিয়ে তো
জন্ম খতম করলি, এখন আইনস্টাইনকে বলতে এসেছে স্বনামধন্য পুরুষ! ইডিয়োসির একটা সীমা থাকা চাই।
নির্দিষ্ট দিনে রায়বাহাদুর কৃষ্ণনগর কলেজের কয়েকটি ছাত্র সঙ্গে লইয়া সকালের ট্রেনে রানাঘাটে নামিলেন। তাঁর শালা বিনোদ চৌধুরী দুঃখ করিয়া চিঠি লিখিয়াছে, বিশেষ কার্যবশত তাহার আসা সম্ভব হইল না, আইনস্টাইনের বক্তৃতা শোনা কী সকলের ভাগ্যে ঘটে, ইত্যাদি। সেজন্য রায়বাহাদুরের মনে দুঃখ ছিল, ছোকরা সত্যিকার পণ্ডিত লোক, আজকার এমন সভায় বেচারির আসিবার সুযোগ মিলিল না। ভাগ্যই বটে।
রানাঘাট স্টেশনের বাহিরে আসিয়া সম্মুখের প্রাচীরে নজর পড়িতে রায়বাহাদুর থমকিয়া দাঁড়াইয়া গেলেন। এ কী ব্যাপার! প্রাচীরের গায়ে লটকানো ঢাউস এক দুই-তিন-রঙা বিজ্ঞাপন। তাতে লেখা আছে…
বাণী সিনেমা গৃহে (নীল)
আসিতেছেন! আসিতেছেন!! (কালো)
আসিতেছেন!!! (কালো)
কে?? (কালো)
কবে?? (কালো)
সু প্রসিদ্ধি চিত্রতার কা ইন্দুবালা দেবী (লাল)
অদ্য রবিবার ২৭শে কার্তিক সন্ধ্যা ৫৷৷ টায় (নীল)
জনসাধারণকে অভিবাদন করিবে!! (কালো)
প্রবেশমূল্য ৫, ৩, ২ ও ১ টাকা (কালো)
মহিলাদের ৫ ও২ টাকা (কালো)
এমন সুযোগ কেহ হেলায় হারাইবেন না। (লাল)
কী সর্বনাশ!
রায়বাহাদুর রুমাল বাহির করিয়া কার্তিক মাসের শেষের দিকের সকালেও কপালের ঘাম মুছিলেন। তাহার পর একবার ভালো করিয়া পড়িলেন তারিখটা। না, আজই। আজ রবিবার ২৭শে কার্তিক।
অন্যমনস্কভাবে কিছুদূর অগ্রসর হইয়া দেখিলেন আর একখানা সেই বিজ্ঞাপন। ক্রমে যতই যান, সর্বত্রই সেই তিনরঙা বিজ্ঞাপন। মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যান মহাশয়ের বাড়ি পর্যন্ত যাইতে অন্তত ছত্রিশখানা সেই বিজ্ঞাপন আটা দেখিলেন বিভিন্ন স্থানে।
ভাইস-চেয়ারম্যান শ্রীগোপালবাবু ফুলবাগানের সামনে ছোটো বারান্দায় বসিয়া তেল-ধুতি পরনে তেল মাখিতেছিলেন। রায়বাহাদুরকে দেখিয়া ভালো হইয়া বসিলেন। হাসিয়া বলিলেন—”খুব সৌভাগ্য দেখছি। এত সকালে যে? — নমস্কার!”
—’নমস্কার, নমস্কার! স্নানের জন্যে তৈরি হচ্ছেন? ছুটির দিনে এত সকালে যে?”
—”আজ্ঞে হ্যাঁ, স্নানটা সকালেই করি।”
—”বাড়িতে?”
—”আজ্ঞে না, চুর্ণীতে যাই। ডুব দিয়ে স্নান না-করলে—অভ্যেস সেই ছেলেবেলা থেকেই। বসুন, বসুন। আজ যখন এসেছেন তখন দুপুরে গরিবের বাড়িতেই দুটো ডাল-ভাত—”
—”সেজন্য কিছু না। নো ফরম্যালিটি। আমার মাসতুতো ভাই নীরেনের ওখানে–গেলে রাগ করবে। সেবার তো যাওয়াই হল না।’’
—’’তাহলে চা চলবে তো?”
—’’তাতে আপত্তি নেই। সে হবে এখন। আসলে যে জন্যে আসা—তা এ এক কী হাঙ্গামা দেখছি? কে ইন্দুবালা দেবী আসছে বাণী সিনেমাতে আজই।”
—হ্যাঁ, তাই তো দেখছিলাম বটে।”
—”দিন বুঝে আজই?”
—”তাই তো—আমিও তাই ভাবছিলাম। ক্ল্যাশ করবে কিনা?”
—”এখন তো আমরা দিন বদলাতে পারি না। সব ঠিকঠাক। আমাদেরও হ্যান্ডবিল বিলি, বিজ্ঞাপন বিলি, সব হয় গিয়েছে। আইনস্টাইন আসবেন এই দার্জিলিং মেলে।”
—”আমিও তো ভেবেছি। তাই তো—”
—“তবে আমার কী মনে হয় জানেন? যারা সিনেমাতে ইন্দুবালাকে দেখতে যাবে, তারা সাহেবদের লেকচার শুনতে আসবে না। সাহেবদের সভায় যারা আসবে, তারা ঠিকই আসবে।”
আইনস্টাইনকে ‘সাহেব’ বলিয়া উল্লেখ করাতে রায়বাহাদুর মনে মনে চটিয়া গেলেন। এমন জায়গাতেও তিনি আনিতে চলিয়াছেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইনকে! এ কী পাট কলের ম্যানেজার, না রেলের টি. আই. যে ‘সাহেব’ ‘সাহেব’ করবি? বুঝেসুঝে কথা বলতে হয় তো!
মুখে বলিলেন,-”হ্যাঁ, তা বটে।”
ভাইস-চেয়ারম্যান শ্রীগোপালবাবু তাঁর অমায়িক আতিথেয়তার জন্যে রানাঘাটে প্রসিদ্ধ। চা আসিল, সঙ্গে এক রেকাবি খাবার আসিল। রায়বাহাদুর চা-পানান্তে আরও নানা স্থানে ঘুরিবেন বলিয়া বাহির হইলেন। অনেকের সঙ্গে দেখা করিতে হইবে, অনেক কিছু ঠিক করিতে হইবে।
যাইবার সময় বলিলেন—”মিউনিসিপ্যাল হলের চাবিটা—”।
শ্রীগোপালবাবু বলিলেন—’’আমাদের হলের চাকর রাজনিধিকে এখনই পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমার বাসার চাকরও যাবে। ওরা হল খুলে সব ঠিক করবে। সেখানে ফ্রি রিডিং রুম আছে, সকালে আজ ছুটির দিন খবরের কাগজ পড়তে লোকজন আসবে। তাদের মধ্যে যারা ছেলে–ছোকরা তাদের ধরে চেয়ার বেঞ্চি সাজিয়ে নিচ্ছি। কিছু ভাববেন না।”
শ্রীগোপালবাবু স্নান করিয়া বাড়ির মধ্যে ঢুকিতেই তাঁহার বড়ো মেয়ে (শ্রীগোপালবাবু আজ তিন বৎসর বিপত্নীক, বড়ো মেয়েটি শ্বশুরবাড়ি হইতে আসিয়াছে, সে-ই সংসার দেখাশোনা করে) বলিল—”বাবা, আমাদের পাঁচখানা টিকিট করে এনে দাও।”
—”কীসের টিকিট?”
—”বা রে, বাণী সিনেমায় ও-বেলা ইন্দুবালা আসছে—নাচ-গান হবে। সবাই যাচ্ছে আমাদের পাড়ার।”
—”কে যাচ্ছে?”
—”সবাই! এই মাত্তর রানু, অলকা, টেপি যতীন কাকার মেয়ে চেঁড়স—এরা এসেছিল। ওরা সব বক্স নিচ্ছে একসঙ্গে—বক্স নিলে মেয়েদের আড়াই টাকা করে রিজার্ভ টিকিট দিচ্ছে। আমাদের জন্যে একটা বক্স নাও।”
শ্রীগোপালবাবু বিরক্তির সুরে বলিলেন,—”হ্যাঁ ভারি—আবার একটা বক্স! বড্ড টাকা দেখেছিস আমার। সেই ১৯০৩ সাল থেকে জোয়াল কাঁধে নিয়েছি, সে জোয়াল আর নামল না। কেবল টাকা দাও আর টাকা দাও—”
অপ্রসন্ন মুখে দেরাজ খুলিয়া মেয়ের হাতে একখানা দশ টাকার নোট ও কয়েকটি খুচরা টাকা ফেলিয়া দিলেন।
একটু পরে প্রতিবেশী রাধাচরণ নাগ আসিয়া বৈঠকখানায় উঁকি মারিয়া বলিলেন —”কী হচ্ছে শ্রীগোপালবাবু?”
—’’আসুন ডাক্তারবাবু, খবর কী? যাচ্ছেন তো ও-বেলা?”
“হ্যাঁ, তাই জিজ্ঞেস করতে এসেছি। আপনারা যাচ্ছেন তো?”
—”যাব বই কী। রানাঘাটের ভাগ্যে অমন কখনো হয়নি। যাওয়া উচিত নিশ্চয়।”
—’আমিও তাই বলছিলাম বাড়িতে। টাকা খরচও তো আছেই। কিন্তু এমন সুযোগ—বাড়ির সবাই ধরেছে। দিলাম দশটা টাকা বের করে। বলি বয়েস তো হল ছাপ্পান্নর কাছাকাছি, কোনদিন চোখ বুজব, তার আগে—”
—”নিশ্চয়। জীবনে ওসব শোনবার সৌভাগ্য ক-বার ঘটে? আমাদের রানাঘাটবাসীর বড়ো সৌভাগ্য যে উনি আজ এখানে আসবেন।”
—”আমিও তাই বলছিলাম বাড়িতে। বয়েস হয়ে এল, দেখে নিই, শুনে নিই —গেলই না-হয় গোটাকতক টাকা।”
—’’তা ছাড়া, অত বড়ো বিখ্যাত একজন—”
—”সে আর বলতে! আজকাল সব জায়গায় দেখুন ইন্দুবালা দেবী, সাবানের বিজ্ঞাপনে ইন্দুবালা, গন্ধতেলের বিজ্ঞাপনে ইন্দুবালা, শাড়ির বিজ্ঞাপনে ইন্দুবালার ছবি! তাকে চোখে দেখবার সৌভাগ্য—বিশেষ করে রানাঘাটের মতো এঁদোপড়া জায়গায়—সৌভাগ্য নয়? নিশ্চয় সৌভাগ্য!”
শ্রীগোপালবাবু হাঁ করিয়া নাগ মহাশয়ের দিকে চাহিয়া রহিলেন, প্রথমটা তাঁর মুখ দিয়া কোনো কথা বাহির হইল না। ঝাড়া মিনিট-দুই পরে আমতা আমতা করিয়া বলিলেন,—”আমি কিন্তু সে-কথা বলছিনে। আমি বলছি সায়েবের লেকচারের কথা, মিউনিসিপ্যাল হলে।’
রাধাচরণবাবু ভুরু কুঁচকাইয়া বলিলেন,-”কোন সায়েব?”
—”কেন, আপনি জানেন না? আইনস্টাইন—মিঃ আইনস্টাইন!’’
রাধাচরণবাবু উদাসীন সুরে হঠাৎ মনে পড়িয়া যাওয়ার ভঙ্গিতে বলিলেন, —”ও, সেই জার্মান না ইটালিয়ান সায়েব? হ্যাঁ—শুনেছি, আমার জামাই বলছিল। কী বিষয়ে যেন লেকচার দেবে? তা ওসব আর আমাদের এ বয়সে—লেখাপড়ার বালাই অনেকদিন ঘুচিয়ে দিয়েছি। ওসব করুকগে কলেজের ইস্কুলের ছেলে ছোকরারা—হ্যাঁঃ!”
শ্রীগোপালবাবু ক্ষীণ প্রতিবাদের সুরে কি বলিতে যাইতেছিলেন, রাধাচরণবাবু পুনরায় বলিলেন—”তা আপনি কী করবেন শুনি?”
“আমার বাড়ির মেয়েরা তো যাচ্ছে সিনেমায়। তবে আমাকে যেতেই হবে সায়েবের বক্তৃতায়। রায়বাহাদুর নীলাম্বরবাবু এসে খুব ধরাধরি করছেন”—
—”কে রায়বাহাদুর? নীলাম্বরবাবু কে?’
—”কৃষ্ণনগর কলেজের প্রোফেসর। তাঁরই উদ্যোগে সব হচ্ছে। তিনি এসেঃবিশেষ—
রাধাচরণবাবু চোখ মিটকি মারিয়া বলিলেন—’আরে ভায়া, একটা কথা বলি শোনো। একটা দিন চলো দেখে আসা যাক। ছবির ইন্দুবালা আর জ্যান্ত ইন্দুবালাতে অনেক ফারাক। ইহজীবনে একটা কাজ হয়ে যাবে। ওসব সায়েব টায়েব ঢের দেখা হয়েছে। দু-বেলা রানাঘাটে ইস্টিশানে দাঁড়িয়ে থাকা দার্জিলিং মেল শিলং মেলের সময়ে—দেখো না কত সায়েব দেখবে। কিন্তু ভায়া এ সুযোগ–বুঝলে না?”
শ্রীগোপালবাবু অন্যমনস্কভাবে বলিলেন,—”তা—তা—কিন্তু, তবে রায়বাহাদুরকে কথা দেওয়া হয়েছে কিনা, তিনি কী মনে করবেন—”।
রাধাচরণবাবু মুখ বিকৃত করিয়া খিঁচাইবার ভঙ্গিতে বলিলেন, “হ্যাঁঃ! কথা দেওয়া হয়েছে রায়বাহাদুরকে! ভারি রায়বাহাদুর! এত কী ওবলিগেশন আছে রে বাবা! বলো এখন, বাড়ির মেয়েরা সব গেল তাই আমায় যেতে হল। তারা ধরে বসল তা এখন কী করা। বলি কথাটা তো নিতান্ত মিথ্যে কথাও নয়!”
শ্রীগোপালবাবু অন্যমনস্কভাবে বলিলেন—”তা—তা—তা তো বটেই।সে কথাতো—”
রাধাচরণবাবু বলিলেন,-”রায়বাহাদুর এলে বলো এখন তাই। তাঁকেও অনুরোধ করো না বাণী সিনেমায় যেতে।–”
—’চললেন?”
-–”চলি। ওবেলা আসব ঠিক সময়ে।”
রায়বাহাদুর স্থানীয় জমিদার নীরেন চাটুয্যের বাড়িতে বসিয়া সভা সম্বন্ধে পরামর্শ ও আয়োজন করিতেছিলেন।
নীরেনবাবু রায়বাহাদুরের মাসতুতো ভাই, স্থানীয় জমিদার ও উকিল। উকিল হিসাবে হয়তো তেমন কিছু নয়, কিন্তু জমিদারির আয় ও পূর্বপুরুষ সঞ্চিত অর্থে রানাঘাটের মধ্যে অনেকেই তাঁহার সঙ্গে পারিয়া উঠেন না। শিক্ষিত লোকও বটে।
রায়বাহাদুর গুরুভোজন করিয়া উঠিয়াছেন মধ্যাহ্নে। ধনী মাসতুতো ভাই-এর বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজন রীতিমতো গুরুতর। দু-একবার নিদ্রাকর্ষণ হইতেও ছিল, কিন্তু কর্তব্যের খাতিরে শুইতে পারেন নাই।
নীরেনবাবু বলিলেন,-”আচ্ছা দাদা, বক্তৃতায় মোটকথাটা কী হবে আজকের?”
—”তা ঠিক জানিনে। On the unity of forces এই বিষয়বস্তু। এ থেকে ধরে নাও।”
—”উনি Space-এর অবস্থা শোচনীয় করে তুলেছেন, কী বলুন?”
—’অর্থাৎ?”
—’space বলছেন সীমাবদ্ধ। আগেকার মতো অসীম অনন্ত space আর নেই।”
—”তোমার ম্যাথমেটিকস ছিল এম. এসসি.-তে? Geometry of Hyperspaces পড়েছ?
—”মিক্সড ম্যাথমেটিকস ছিল। আপনি যা বলছেন, তা আমি জানি।”
-খুব খুশি হলুম দেখে নীরেন যে শুধু জমিদারি করো না, জগতের বড়ো বড়ো বিষয়ে একটু-আধটু সন্ধান রাখখা। খুব বেশি সন্ধান হয়তো নয়, তবুও The very little that you know is unknown to many”.
—’আচ্ছা দাদা, উনি কি আজই চলে যাবেন?”
—”সম্ভব। দার্জিলিং যাবেন বলছিলেন। দার্জিলিঙের পথে এখানে নামবেন। যাতে ওঁর দু-পয়সা হয়, সেদিকে আমাদের বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে।’
—”আজ সভার পরে আমার বাড়িতে আসুন না একবার দাদা? এখানে রাতের জন্যে রাখতেও আমি পারি। আজ দার্জিলিঙের গাড়ি নেই। রাত্রে এখানে থাকুন। কোনো অসুবিধা হবে না।”
—”বেশ, বলব এখন।”
—”যাতে থাকেন তাই করুন। কালই খবরের কাগজে একটা রিপোর্ট করিয়ে দেব এখন। ফ্রি প্রেসের আর আনন্দবাজারের রিপোর্টার এখানে আছে।”
রায়বাহাদুর বুঝিলেন তাঁর মাসতুতো ভাইটি দরদ কোথায়। সেসব কথা বলিয়া কোনো লাভ নাই, এখন কোনোরকমে কার্যসিদ্ধি হইলেই হয়। কোনোরকমে আজ মিটিং চুকিলে বাঁচেন।
বাড়ির ভিতর হইতে নীরেনবাবুর মেয়ে মীনা আসিয়া বলিল,-”ও জ্যাঠামশায়, বাবাকে বলে আমাদের টিকিটের টাকা দিন।”
নীরেনবাবু ধমক দিয়া বলিলেন,—”যা যা বাড়ির মধ্যে যা, এখন বিরক্ত করিসনি। ব্যস্ত আছি।”
মীনা আবদারের সুরে বলিল,-”তোমাকে তো বলিনি বাবা, জ্যাঠামশাইকে বলছি।”
রায়বাহাদুর জিজ্ঞাসা করিলেন,–”কীসের টিকিটরে মিনু?”
মীনা বলিল,-”আপনি কোথায় থাকেন যে সবর্দা! আমাদের পাশের বাড়ির সবিতা আপনাদের কলেজে পড়ে, সে বলে আপনি নাকি পথ চলতে চলতে অঙ্ক কষেন। সত্যি, হ্যাঁ জ্যাঠামশাই?”
নীরেনবাবু পুনরায় ধমকের সুরে বলিলেন,—’আঃ, জ্যাঠা মেয়ে! যা এখান থেকে। জ্বালালে দেখছি। কীসের টিকিট জানেন দাদা, ওই যে ইন্দুবালা নাকি আজ আসছে আমাদের এখানকার বাণী সিনেমাতে, নাচ-গান হবে, কী নাকি বক্তৃতাও দেবে, তাই পাড়াসুদ্ধ ভেঙেছে দেখবার জন্যে। মেয়েরা তো সকাল থেকে জ্বালালে।”
—’তা দাও না ওদের যেতে। আইনস্টাইনের লেকচারে আর ওরা কী যাবে। তবে দেখে রাখলে একটা বলতে পারত সারাজীবন। কীরে মিনু, কোথায় যাবি?”
—”আমরা জ্যাঠামশাই সিনেমাতেই যাই। ‘মিলন’ ফিলমে ইন্দুবালাকে দেখে পর্যন্ত বড় একটা ইচ্ছে আছে ওকে দেখব। রানাঘাটে অমন লোক আসবে—’
রায়বাহাদুর বাকিটুকু জোগাইয়া বলিলেন,—”স্বপ্নের অগোচর! তাই না মিনু? টিকিটের দাম দিয়ে দাও মেয়েকে, ওহে নীরেন।”
মীনা এবার সাহস পাইয়া বলিল,—’’আপনাকে আর বাবাকে যেতে হবে আমাদের নিয়ে। সে শুনছিনে। বাবার মনে মনে ইচ্ছে আছে জ্যাঠামশায়। শুধু আপনার ভয়ে—”।
নীরেনবাবু তাড়া দিয়া বলিলেন,—’তবেরে দুষ্টু মেয়ে—“
মীনা হাসিতে হাসিতে বাড়ির ভিতর চলিয়া গেল।
যাইবার সময় বলিয়া গেল,—”বাবা, তোমাকে যেতেই হবে আমাদের নিয়ে। ছাড়ব না বলে দিচ্ছি।”
দার্জিলিং মেলের সময় হইয়াছে। বেলা সাড়ে পাঁচটা। রা
য়বাহাদুর ও কয়েকজন ছাত্র, নীরেনবাবু ও শ্রীগোপালবাবু স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে উপস্থিত হইলেন। কিন্তু—এ কী?
এত ভিড় কীসের? প্ল্যাটফর্মের চারিদিকে এত ছোকরা ছাত্র, লোকজনের ভিড়! সত্যই কী আজ আইনস্টাইনের উপস্থিতিতে এখানকার সকলের টনক নড়িয়াছে? ইহারা সকলেই দার্জিলিং মেলের সময় আসিয়াছে তাঁহাকে নামাইয়া লইতে? অত বড়ো বৈজ্ঞানিকের উপযুক্ত অভ্যর্থনা বটে! লোকে লোকারণ্য প্ল্যাটফর্ম। হইহই কাণ্ড। রায়বাহাদুর পুলকিত হইলেন। সশব্দে মেল ট্রেন আসিয়া প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করিল।
একটি সেকেন্ড ক্লাস কামরা হইতে ছোটো একটি ব্যাগ হাতে দীর্ঘকেশ আয়তচক্ষু আইনস্টাইন অবতরণ করিলেন। সঙ্গে সঙ্গে পাশের একটি ফার্স্ট ক্লাস কামরা হইতে জনৈক সুন্দরী তরুণী, পরনে দামি ভয়েল শাড়ি, পায়ে জরিদার কাশ্মীরি স্যান্ডাল—হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ ঝুলাইয়া নামিয়া পড়িলেন। তরুণীর সঙ্গে আরও দুটি তরুণী, দুটিই শ্যামাঙ্গী—দুজন চাকর, তারা লাগেজ নামাইতে ব্যস্ত হইয়া পড়িল।
কে একজন বলিয়া উঠিল, ‘‘ওই যে নেমেছেন! ওই তো ইন্দুবালা দেবী—“
মুহূর্ত মধ্যে প্ল্যাটফর্মসুদ্ধ লোক সেদিকে ভাঙিয়া পড়িল। সেই ভীষণ ভিড়ের মধ্যে রায়বাহাদুর অতিকষ্টে আইনস্টাইনকে লইয়া গেটের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলেন।
আইনস্টাইন অত বুঝিতে পারেন নাই, তিনি ভাবিলেন তাঁহাকেই দেখিবার জন্য এত লোকের ভিড়। রায়বাহাদুরকে জিজ্ঞাসা করিলেন,—”এরা সবই কী স্থানীয় ইউনিভার্সিটির ছাত্র? এদের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেবেন না মিঃ মুখার্জি?’
রায়বাহাদুর এই উদার সরলপ্রাণ বিজ্ঞানতপস্বীর ভ্রম ভাঙাইবার চেষ্টা করিলেন।
রানাঘাটে আবার ইউনিভার্সিটি! হায়রে, এ দেশ কোন দেশ তা ইনি এখনও বুঝিতে পারেন নাই। সবই ইউরোপ নয়।
নীরেনবাবু চাহিয়া-চিন্তিয়া স্থানীয় প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী ধনী গোপাল পালেদের পুরোনো ১৯১৭ সনের মডেলের গাড়িখানি জোগাড় করিয়াছিলেন। তাহাতেই সকলে মিলিয়া চড়িয়া মিউনিসিপ্যাল হলের দিকে অগ্রসর হইলেন। গাড়িতে উঠিবার সময় দেখা গেল তখনও বহুলোকে স্টেশনের গেটের দিকে ছুটিতেছে। একজন কে বলিতেছিল,—”গাড়ি অনেকক্ষণ এসেছে, ওই দেখো লেগে আছে। প্ল্যাটফর্মে। শিগগির ছোটো।” ভিড়ের মধ্যে কে উত্তর দিলে,—”এখান দিয়েই তো বেরুবেন, আর ভিড়ের মধ্যে গিয়ে দরকার নেই। বড্ড ভিড়। ও তো চেনা মুখ। দেখলেই চেনা যাবে। কত ছবিতে দেখা আছে। সেদিনও ‘মিলন’ ফিলমে—”
আইনস্টাইন কৌতুকের সঙ্গে বলিলেন,—”এরাও ছুটেছে স্টেশনে বুঝি? ওরা জানে না যাকে দেখতে চলেছে সে তাদের সামনেই গাড়িতে উঠেছে। বেশ মজা, না? মিঃ মুখার্জি, এখানে ইউনিভার্সিটি কোন দিকে?”
সৌভাগ্যক্রমে ভিড়ের মধ্যের একটা লোক আইনস্টাইনের গাড়ির সামনে আসিয়া চাপা পড়-পড় হওয়াতে হঠাৎ ফুটব্রেক কষার কর্কশ শব্দের ও ‘এই এই ‘গেল গেল’ রবের মধ্যে তাঁহার প্রশ্নটা চাপা পড়িয়া গেল। স্টেশন ও ভিড় ছাড়াইয়া কিছুদূর অগ্রসর হইতেই মোড়ের মাথায় শ্রীগোপালবাবু ও নীরেনবাবু নামিয়া গেলেন। রায়বাহাদুর বলিলেন,—”এখুনি আসবেন তো?”
শ্রীগোপালবাবু কী বলিলেন ভালো বোঝা গেল না। নীরেনবাবু বলিলেন, “ওখানে ওদের পৌঁছে দিয়েই আসছি। আর কেউ বাড়িতে লোক নেই মেয়েদের নিয়ে যেতে। টিকিটে এতগুলো টাকা যখন গিয়েছে—“
ওই সামনেই মিউনিসিপ্যাল হল। স্টেশনের কাছেই। কিন্তু এ কী? সাড়ে পাঁচটা সময় দেওয়া ছিল। পৌঁনে ছ-টা হইয়াছে, কেউ তো আসে নাই। জনপ্রাণী নয়। কেবল মিউনিসিপ্যাল অফিসের কেরানি জীবন ভাদুড়ি একটা ছোটো টেবিলে অনেকগুলি টিকিট সাজাইয়া শ্রোতাদের কাছে বিক্রয়ের জন্য অপেক্ষা করিতেছে।
মোটর হলের সামনে আসিয়া দাঁড়াইতে আইনস্টাইনের হাত ধরিয়া নামাইলেন রায়বাহাদুর। মুখে হাসি ফুটাইবার চেষ্টা করিয়া বলিলেন,—”হে বৈজ্ঞানিক শ্রেষ্ঠ, সুস্বাগতম। আমাদের রানাঘাটের মাটিতে আপনার পদার্পণের ইতিহাস সুবর্ণ অক্ষরে অক্ষয় হয়ে বিরাজ করুক—আমরা রাণাঘাটবাসীরা আজ ধন্য!”
চকিত ও উদবিগ্ন দৃষ্টিতে শূন্যগর্ভ হলের দিকে চাহিয়া দেখিলেন সঙ্গে সঙ্গে। লোক কই? রানাঘাটবাসীদের অন্যান্য প্রতিনিধিবর্গ কোথায়?
আইনস্টাইন বিস্মিত দৃষ্টিতে জনশূন্য হলের দিকে চাহিয়া বলিলেন,—”এখনও আসেনি কেউ? সব স্টেশনে ভিড় করছে। মিঃ মুখার্জি, একটা ব্ল্যাকবোর্ডের ব্যবস্থা করতে হবে যে। বক্তৃতার সময় ব্ল্যাকবোর্ডে আঁকবার দরকার হবে।”
আর ব্ল্যাকবোর্ড! রায়বাহাদুর স্থানীয় ব্যক্তি। নাড়িজ্ঞান আছে এ জায়গার। তিনি শূন্য ও হতাশ দৃষ্টিতে চারিদিকে চাহিতে লাগিলেন।
জীবন ভাদুড়ি কাছে আসিয়া চুপি চুপি বলিল,-”মোটে তিন টাকার বিক্রি হয়েছে। তাও টাকা দেয়নি এখন। কী করব বলুন সার? আমাকে কতক্ষণ থাকতে হবে বলুন। আমার আবার বাসার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বাণী সিনেমায় যেতে হবে। কলকাতা থেকে ইন্দুবালা এসেছেন—বাড়িতে বড্ড ধরেছে সব। পঁয়ত্রিশ টাকা মোটে মাইনে—তা বলি, থাক গে, কষ্ট তো আছেই। এঁদের মতো লোকে রোজ কলকাতা থেকে আসবেন না। যাক, পাঁচ টাকা খরচ হলে আর কি করছি বলুন। আমায় একটু ছুটি দিতে হবে সার। এ সায়েব কে? এ সায়েবের লেকচারে আজ লোক হবে না—কে আজ এখানে আসবে সার!”
জীবন ভাদুড়ি ক্যাশ বুঝাইয়া দিয়া খসিয়া পড়িল। হলের মধ্যে দেখা গেল চেয়ার বেঞ্চির জনহীন অরণ্যে মাত্র দুটি প্রাণী—আইনস্টাইন ও রায়বাহাদুর।
আইনস্টাইন ব্যাগ খুলিয়া কী জিনিসপত্র টেবিলের উপর সাজাইতে ব্যস্ত ছিলেন, সেগুলি তাঁহার বক্তৃতার সময় প্রয়োজন হইবে—সেই সুযোগে রায়বাহাদুর একবার বাহিরে গিয়া রাস্তার এদিক-ওদিক উদবিগ্নভাবে চাহিতে লাগিলেন।
লোকজন যাইতেছে, ঘোড়ার গাড়িতে মেয়েরা সাজগোজ করিয়া চলিয়াছে, দ্রুতপদে পথিকদল ছুটিয়াছে—সব বাণী সিনেমা লক্ষ্য করিয়া।
রায়বাহাদুরের একজন পরিচিত উকিলবাবু ছড়িহাতে দ্রুতপদে জনসাধারণের অনুসরণ করিতেছিলেন, রায়বাহাদুরকে দেখিতে পাইয়া বলিলেন,—”এই যে! সাহেব এসেছেন? লোকজন কেমন হয়েছে ভেতরে? আজ আবার আনফরচুনেটলি ওটার সঙ্গে ক্ল্যাশ করল কিনা? অন্যদিন হলে—না, আমার জো নেই—বাড়ির মেয়েরা সব গিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে কেউ নেই। বাধ্য হয়ে আমাকে—কাজেই—’
রায়বাহাদুর মনে মনে বলিলেন—হ্যাঁ, নিতান্ত অনিচ্ছা সত্বেও।
আধ ঘণ্টা কাটিয়া গেল। সাড়ে ছটা। পৌঁনে সাতটা। সাতটা।
জনপ্রাণী নাই। বাণী সিনেমাগৃহ লোকে লোকারণ্য। টিকিট কিনিতে না-পাইয়া বহুলোক বাহিরে দাঁড়াইয়া জটলা করিতেছে। একদল জোর-জবরদস্তি করিয়া ঢুকিবার চেষ্টা করিয়া বিফলমনোরথ হইয়াছে। মেয়েদের বসিবার দুই দিকের ব্যালকনির অবস্থা এরূপ যে আশঙ্কা হইতেছে ভাঙিয়া না-পড়ে। স্টেজে যবনিকা উঠিয়াছে। চিত্রতারকা ইন্দুবালা সম্মুখে দাঁড়াইয়া গান গাহিতেছেন—তাঁরই গাওয়া ‘মিলন’ ছবির কয়েকখানি দেশবিখ্যাত, বালক বৃদ্ধ যুবার মুখে মুখে গীত গান—’জংলা হাওয়ায় চমক লাগায়’, ‘ওরে অচিন দেশের পোষা পাখি’, ‘রাজার কুমার পক্ষীরাজ’ ইত্যাদি।
এমন সময়ে রায়বাহাদুর নীলাম্বর চট্টোপাধ্যায় ভিড় ঠেলিতে ঠেলিতে টকিহলের মধ্যে প্রবেশ করিয়াই সম্মুখে শ্রীগোপালবাবুকে দেখিয়া বিস্মিত হইলেন। পাশেই অদূরে নীরেনবাবু বসিয়া। বলিলেন—”বা রে, আপনিও এখানে!”।
হঠাৎ ধরাপড়া চোরের মতো থতমতো খাইয়া মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে শ্রীগোপালবাবু বলিলেন—’’আসার ইচ্ছে ছিল না, কী করি, কী করি—মেয়েরা— ওদের আনা—ইয়ে—সাহেবের লেকচার কেমন হল? লোকজন হয়নি?”
—”কী করে হবে? আপনারা সবাই এখানে। লোক কে যাবে?”
—”সায়েব কোথায়? চলে গেলেন?”
—”এই যে—”
রায়বাহাদুরের পিছনেই দাঁড়াইয়া স্বয়ং আইনস্টাইন।
শ্রীগোপালবাবু শশব্যস্তে উঠিয়া আইনস্টাইনের হাত ধরিয়া খাতির করিয়া নিজের চেয়ারে বসাইলেন।
একটি খবরের কাগজের কাটিং রাখিয়াছিলাম। সেটি এখানে জানাইয়া দেওয়া গেল—
এখানে আলুর দর ক্রমেই বাড়িয়া চলিয়াছে। ধানের দর কিছু কমের দিকে। ম্যালেরিয়া কিছু কিছু দেখা দিয়াছে। স্থানীয় সুযোগ্য সাবডিভিশনাল অফিসার মহোদয়ের চেষ্টায় স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মচারীদের দৃষ্টি এদিকে আকৃষ্ট হইয়াছে।
গত সপ্তাহে স্থানীয় বাণী সিনেমা গৃহে সুপ্রসিদ্ধ চিত্রতারকা ইন্দুবালা দেবী শুভাগমন করেন। নৃত্যকলা-নৈপুণ্যে ও কিন্নরকণ্ঠের সংগীতে তিনি সকলের মনোহরণ করিয়াছেন। বিশেষত ‘কালো বাদুড় নৃত্যে তিনি যে উচ্চাঙ্গের শিল্প সংগতি প্রদর্শন করিয়াছেন, রানাঘাটবাসীগণ তাহা কোনোদিন ভুলিবে না। এই উপলক্ষ্যে উক্ত সিনেমাগৃহে অভূতপূর্ব জনসমাগম হইয়াছিল—সেও একটি দেখিবার মতো জিনিস হইয়াছিল বটে। লোকজনের ভিড়ে মেয়েদের ব্যালকনির নীচে বরগা দুমড়াইয়া গিয়াছিল। ঠিক সময়ে ধরা পড়াতে একটি দুর্ঘটনার হাত হইতে সকলে বাঁচিয়া গিয়াছেন।
বিখ্যাত জার্মান বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইন গতকল্য দার্জিলিং যাইবার পথে এখানে মিউনিসিপ্যাল হলে বক্তৃতা দিতে নামিয়াছিলেন। তাঁহাকেও সেদিন বাণী সিনেমা গৃহে ইন্দুবালার নৃত্যের সময় উপস্থিত থাকিতে দেখা গিয়াছিল।
আচার্য কৃপালিনী কলোনি
আমার স্ত্রী আমাকে কেবলই খোঁচাইতেছিলেন।
পূর্ববঙ্গে বাড়ি। এই সময় জমি না-কিনিলে পশ্চিমবঙ্গে ইহার পরে আর জমি পাওয়া যাইবে কি? কলিকাতায় জমি ও বাড়ি করিবার পয়সা আমাদের হাতে নাই, কিন্তু পনেরোই আগস্টের পরে কলিকাতার কাছেই বা কোথায় জমি মিলিবে? যা করিবার এইবেলা করিতে হয়।
সুতরাং চারিদিকে জমি দেখিয়া বেড়াই। দমদম, ইছাপুর, কাশীপুর, খড়দহ, ঢাকুরিয়া ইত্যাদি স্থানে। রোজ কাগজে দেখিতেছিলাম জমি ক্রয়-বিক্রয়ের বিজ্ঞাপন। পূর্ববঙ্গ হইতে যেসব হিন্দুরা আতঙ্কগ্রস্ত হইয়া চলিয়া আসিতেছেন, তাঁহাদের অসহায় ও উদভ্রান্ত অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করিতে বাড়ি ও জমির মালিকেরা একটুও বিলম্ব করেন নাই। এক বৎসর আগে যে জমি পঞ্চাশ টাকা বিঘা দরেও বিক্রয় হইত না, সেইসব পাড়াগাঁয়ের জমির বর্তমান মূল্য সাত আটশো টাকা কাঠা।
বহুস্থানে খুঁজিয়া খুঁজিয়া হয়রান হইলাম।
কলিকাতার খুব কাছাকাছি জমির দর অসম্ভবরূপে চড়িয়াছে, আমাদের সাধ্য নাই ওসব স্থলে জমি কিনিবার। তা ছাড়া জমি পছন্দই বা হয় কই?
এমন সময়ে আমার স্ত্রী একখানা কাগজ আনিয়া হাতে দিলেন। বলিলেন— তোমার তো জমি পছন্দই হয় না। ঠগ বাছতে গাঁ উজোড় করে ফেললে। সিনারি নেই তো কী হয়েছে? এটা পছন্দ হয় না, ওটা পছন্দ হয় না। এবার কী আর কিনতে পারবে কোথাও? যাও এটা দেখে এসো। খুব ভালো মনে হচ্ছে। তোমার মনের মতো। পড়ে দ্যাখো—
আমাকে আমার স্ত্রী যাহাই ভাবুন, হিম হইয়া বসিয়া আমি নাই। সত্যিই খুঁজিতেছি, মন-প্রাণ দিয়াই খুঁজিতেছি। ভালো জিনিস পাইলে আমার মতো খুশি কেহই হইবে না।
বলিলাম—এ কাগজ কোথায় পেলে?
—বীণাদের বাড়ি গিয়েছিলাম। ওরাও জমি খুঁজচে, ওদের দেশ থেকে সব উঠে আসচে ইদিকে, কলকাতার আশেপাশে। ওরা এটা কোথা থেকে আনিয়েছে।
পড়িয়া দেখিলাম—লেখা আছে—
‘আচার্য কৃপালনী কলোনি।’
আজই আসুন! দেখুন! নাম রেজেস্ট্রি করুন!!!
‘কলিকাতার মাত্র কয়েক মাইল দূরে অমুক স্টেশনের সংলগ্ন সুবিস্তৃত ভূখণ্ডে এই বিরাট নগরটি গড়িয়া উঠিতেছে। সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য। কলোনির পাদদেশ ধৌত করিয়া স্বচ্ছসলিলা পুণ্যতোয়া জাহ্নবী বহিয়া যাইতেছেন। পঞ্চাশ ফুট চওড়া রাস্তা, ইলেকট্রিক আলো, জলের কল, স্কুল, গ্রন্থাগার, নাগরিক জীবনের সমস্ত সুখ-সুবিধাই এখানে পাওয়া যাইবে। আপাতত পঞ্চাশটি টাকা পাঠাইলেই নাম রেজেস্ট্রি করিয়া রাখা হইবে।
স্টেশনের নাম পড়িয়া মনে হইল, কলিকাতার কাছেই বটে।
আমার স্ত্রী বলিলেন—দেখলে? ভালো না?
—খুব ভালো। বীণার কাকা জমি নিয়েচেন এখানে?
—না, নেবেন। নাম রেজেস্ট্রি করেছেন। তুমি ওঁর সঙ্গে দেখা করে পঞ্চাশটি টাকা পাঠিয়ে দাও। কাঠা-পিছু পঞ্চাশ টাকা পাঠিয়ে দিতে হবে, জমি পরে দেখো। উনিও তো দেখেননি এখনও।
—জমি দেখব না? আচ্ছা, বীণার কাকাকে জিগ্যেস করি। বীণার কাকার নাম চিন্তাহরণ চক্রবর্তী। চিরকাল বিদেশে চাকুরি করিয়াছেন, কোথাও বাড়িঘর করেন নাই, জমি-বাড়ি সম্বন্ধে খুব উৎসাহ। আগে-আগে ভাবিয়া আসিয়াছেন কলিকাতায় বাড়ি করিবেন, সম্প্রতি সে আশা ত্যাগ করিয়াছেন।
চিন্তাহরণবাবু বলিলেন—আসুন। ও কাগজটা আপনি দেখেছেন? ভালো জায়গাই বলে মনে হচ্ছে।
—একটু দূরে হয়ে যাচ্ছে না কী?
—ওর চেয়ে কাছে আর কোথায় পাবেন মশাই?
—তা বটে। স্টেশনের কাছেই, গঙ্গার পারে।
—এখনও সস্তা আছে। এর পরে আর থাকবে না। ইলেকট্রিক আলো, জলের কল, পঞ্চাশ ফুট চওড়া রাস্তা
—আপনি টাকা পাঠিয়েছেন?
—নিশ্চয়। রসিদ এসে গিয়েছে। আপনি যদি নেবার মত করেন তবে টাকা পাঠিয়ে দিন।
—জমি না-দেখেই?
—ও মশাই, এইবেলা নাম রেজেস্ট্রি করে রাখুন। এর পরে আর পাবেন না। ঠিকানাটা হচ্ছে—দি নিউ ন্যাশনাল ল্যান্ড ট্রাস্ট। রাজীবনগর।
আমার স্ত্রী আমার নামের রসিদ দেখিয়া খুশি হইলেন। বলিলেন—কাঠা-পিছু পঞ্চাশ টাকা। ক-কাঠার জন্যে টাকা পাঠালে, মোটে দু-কাঠা?
—এখন এই থাক। পনেরোই আগস্ট কেটে যাক। সীমানা কমিশনের রায় বের হোক। পরে—
পনেরোই আগস্ট পার হয়ে গেল। সীমানা কমিশনের রায় আর বাহির হয় না। আমার স্ত্রী বলিলেন—একবার জমিটা দেখে এসো না? বীণার কাকাকে সঙ্গে নিয়ে যাও—অনেক লোক আসচে ময়মনসিং পাবনা নোয়াখালি থেকে পালিয়ে। আমাদের পাশের বাড়ির ফ্ল্যাটগুলি সব বোঝাই। এক-এক গেরস্ত বাড়িতে তিন চার ঘর লোক আশ্রয় নিচ্ছে।
—কেন নিচ্চে? কোথাও তো কোনো গোলমাল নেই।
—তা কি জানি বাপু, অত-শত জিগ্যেস করেছে কে? বীণাদের বাড়িই ওর পিসতুতো ভাই আর বীণার দাদামশায়ের ছোটো ভাই এসেছেন ছেলে-মেয়ে নিয়ে।
কথাটা মন্দ নয়। নাম রেজেস্ট্রি করিয়াছি, জমি কোথাও যাইবে না। তবে আর এক-আধ কাঠা বেশি জমি রাখিব কি না, ইহাই ধার্য করিবার পূর্বে কলোনিটা একবার চোখে দেখা উচিত নয় কী?
সন্ধ্যার সময় ঝড়ের বেগে বীণার কাকা আমার ঘরে প্রবেশ করিলেন। বলিলাম —ব্যাপার কী? এত ব্যস্ত কেন?
—নিয়ে নিন, নিয়ে নিন। জমি কোথাও এতটুকু পাওয়া যাবে না এর পরে। হাজার হাজার লোক আসচে ‘ইস্টবেঙ্গল’ থেকে। আমার বাড়ি তো ভরতি হয়ে গেল। জমি এইবেলা যা যেখানে নেবার নিয়ে নিন।
-বলেন কী?
—সত্যি বলচি। কলোনির জমিটা চলুন কাল দেখে আসি। দেখে এসে কিছু বেশি করে জমি ওইখানেই কিনে রাখুন। কত করে দাম নেবে তা কিন্তু এখনও বলেনি। কাল সেটাও ওদের অফিস থেকে জেনে আসি চলুন—
—কোথায় যেন ওদের আপিস?
—রাজীবনগর। কোন্নগরের কাছে।
পরদিন কিন্তু আমাকে একাই যাইতে হইল। বীণার কাকা যাইতে পারিলেন না, তাঁহার বাড়িতে আবার দুটি গৃহস্থ আসিয়া উঠিয়াছেন। তাঁহাদের লইয়া তিনি বিব্রত হইয়া পড়িলেন।
কোন্নগর স্টেশনে নামিয়া রাজীবনগর যাইতে মনটা বড়ো খারাপ হইয়া গেল। স্টেশনের সংলগ্ন তো নয়ই, পাকা আড়াই মাইল দূরে। কাঁচা রাস্তা কাদায় ভরতি। যেমন জঙ্গল তেমনি মশা।
খোঁজ করিয়া এক গ্রাম্য ডাক্তারবাবুকে জমির মালিক হিসাবে পাওয়া গেল। তিনি একখানা টিনের ঘরে রোগীপত্র দেখিতেছিলেন, যাহাদের সংখ্যা আর যাহাই হউক ডাক্তারের পক্ষে ঈর্ষার বস্তু নহে। আমার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন— কাকে চাচ্ছেন?
বিনীতভাবে বলিলাম—আপনারই নাম মনীন্দ্র ঘটক? আমি যশোর থেকে আসছি। আপনি কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন—
ডাক্তারবাবু নিস্পৃহভাবে বলিলেন—ও—
এবং পরক্ষণেই রোগীদের দিকে মনোযোগ দিলেন পুনরায়।
আমি বড়ো আশা করিয়াই গিয়াছিলাম। কলিকাতা হইতে মাত্র নয় মাইল দূরে স্টেশনের গায়ে জমি, এ জমিটা লইতে পারিলে নানাদিক দিয়াই সুবিধা। কিন্তু জমির মালিক অত নিস্পৃহ কেন? তবে কী বিক্রয় করিবেন না স্থির করিলেন?
প্রায় মিনিট দশেক কাটিয়া গেল।
দাঁড়াইয়াই আছি, কেউ বসিতেও বলে না।
আবার সাহস সঞ্চয় করিয়া বলিলাম—আমি—মানে এই ট্রেনেই আবার— মানে—ডাক্তারবাবু মুখ তুলিয়া বলিলেন—কী বলছেন?
—জমিটা—
—কোন জমি?
—কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন—স্টেশনের সংলগ্ন—কৃপালনী কলোনি—
—ও—
আবার রোগীদিগের প্রতি তাঁহার দৃষ্টি নিবদ্ধ হইল। আমিও অতটা সুবিধাসম্পন্ন যে জমিটুকু, তাহার খোদ মালিককে বিরক্ত করিতে সাহস করিলাম না।
দশ মিনিট কাটিল।
এবার ডাক্তারবাবুই আমাকে বলিলেন—তা, বসুন।
বসিবার অনুমতি পাইয়া কৃতার্থ হইলাম। অনেকক্ষণ হইতে খাড়া দাঁড়াইয়া আছি। বসিবার মিনিট দুই পরে আমি বলিলাম—ইয়ে—জমিটার কথা—মানে—
ডাক্তারবাবু মুখ তুলিয়া বলিলেন—কী বলছেন?
জমিটার কথা বলছিলাম। মানে—একবার দেখলে ভালো হয়। এদিকে বেলা হয়ে যাচ্ছে—
—জমিটা দেখবেন? ও কার্তিক-কার্তিক! যাও এই বাবুকে জমিটা দেখিয়ে আনো।
ভাবিলাম, তাই তো ইহা আবার কী, ডাক্তারখানার পাশের ঘরে বড়ো বড়ো হরফে ইংরেজিতে লেখা আছে বটে, ‘দি নিউ ন্যাশনাল ল্যান্ড ট্রাস্ট’।
গঙ্গার ধারে বিরাট ভূখণ্ড লইয়া এই উপনিবেশ গড়িয়া উঠিবে—কিন্তু গঙ্গা হইতে রাজীবনগরই তো দেখিতেছি আড়াই মাইল দূরে। তবে ইহাও হইতে পারে, দি নিউ ন্যাশনাল ল্যান্ড ট্রাস্টের অফিস এখানে, জমি গঙ্গার ধারে।
কার্তিক নামধেয় লোকটি ডাক্তারবাবুর আহ্বানে এইমাত্র আসিয়াছিল। বলিল— কোন জমি বাবু?
—আরে, ওই যে বরোজের পশ্চিম গায়ে—
–জমি?
—আ মলো যা। হাঁ করে সঙের মতো দাঁড়িয়ে রইলে কেন? হ্যাঁ, জমি। কোথাকার ভূত?
বাড়ির চাকরটা বোধ হয় বোকা, প্রভুর এমন মূল্যবান ভালো বহুবিজ্ঞাপিত ভূমিখণ্ডের সম্বন্ধে কোনো খবর রাখে না কেন?
আমি পথে বাহির হইয়া বলিলাম—চলো—
লোকটা পশ্চিমদিকে যাইতেছে দেখিয়া বলিলাম—ওদিকে কোথায় যাচ্চো? ইস্টিশানের কাছে যে জমি—কৃপালনী কলোনি—
—ইস্টিশানের কাছে কোনো জমি নেই বাবু।
—আলবত আছে। তুমি কোনো খবর রাখে না।
—না বাবু, কোনো জমি নেই ওদিকে।
—শোনো, ইস্টিশানের গায়ে—কাগজে যে জমির বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। পঞ্চাশ টাকা খরচ করে নাম রেজিষ্ট্রি করতে বলা হয়েছিল যে জমির জন্যে। আমি নাম রেজেস্ট্রি করে রেখেছি—রসিদ আছে পকেটে—
—একথাটা আপনি ওখানে বললেন না কেন বাবু? আমি তো আর কোনো জমির সন্ধান জানি না। কালও তো এক বাবু এসেছিলেন, তিনিও নাম রিজিস্টারি করে নিয়ে গেলেন।
—জমি দেখেননি?
—না। ডাক্তারবাবু বললেন, জমি দেখে যাবেন সামনের রবিবারে।
—বেশ, আমায় নিয়ে চলো—
-বাবু—
—কী বলে আবার?
—আপনি জমি দেখতে চান?
—কি বলে আবোল-তাবোল! জমি দেখব না তো কী?
—আপনি এখানে দাঁড়ান, আমি জিজ্ঞেস করে আসি।
আমি বিরক্ত হইয়া নিজেই আবার ডাক্তারবাবুর কাছে গেলাম। বলিলাম— আপনার চাকর জানে না আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে হবে।
এবার ডাক্তারবাবু দেখিলাম, আর একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা কহিতেছেন। তিনিও জমির জন্যই আসিয়াছেন মনে হইল। কারণ তিনি পকেট হইতে টাকা বাহির করিয়া নাম রেজেস্ট্রি করিলেন। ডাক্তারবাবু রসিদ কাটিয়া দিলেন দেখিলাম। লোকটির সঙ্গে আরো কী কথা হইয়াছে জানি না, দু-টাকা দিয়া রসিদ লইয়া লোকটা চলিয়া গেল।
আমাকে ডাক্তারবাবু বলিলেন—জমি দেখবেন? আচ্ছা চলুন, আমিই যাচ্ছি।
পরে আমাকে দুর্গন্ধময় জল-ভরতি নালা, কচুবন, ভাঙা চালাঘর প্রভৃতির পাশ দিয়া কোথায় কোন অনির্দেশ্য রহস্যের দিকে লইয়া যাইতে লাগিলেন, তিনিই জানেন।
আমি একবার ক্ষীণ প্রতিবাদ করিবার চেষ্টা করিলাম—তিনি বোধ হয় ভুলিয়া যাইতেছেন, এ জায়গাটি স্টেশনের খুব কাছে। স্টেশনের সংলগ্ন বলিয়া বিজ্ঞাপনে আছে—
ডাক্তারবাবু আমার দিকে কটমট দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিলেন—আপনার তো আইডিয়া দেখছি বেশ। স্টেশন-সংলগ্ন মানে কী একেবারে কোন্নগর ইস্টিশানের টিকিটঘরের পাশে হবে মশাই?
বলিতে পারিতাম, ‘সংলগ্ন’ বলিতে দুই মাইল দূরবর্তীই কী বোঝায়? কিন্তু না, দরকার নাই। পূর্ববঙ্গের অসহায় হিন্দু আমি, এখানকার জমির মালিকের সঙ্গে অনর্থক ঝগড়া করিব না। স্থান পাওয়া লইয়া কথা। চটিয়া গেলে জমি না-দিতেও তো পারে।
বিনীতভাবে বলিলাম—কলোনি কতদূর?
—মাইলখানেক দূরে।
বিস্মিত হইয়া বলিলাম—বলেন কী! তবে সাড়ে তিন মাইল দূর পড়ল স্টেশন থেকে। এর নাম ‘সংলগ্ন’? এ তো কখনো শুনিনি—
ডাক্তারবাবু থমকিয়া দাঁড়াইয়া গেলেন। বলিলেন—না শুনেছেন কী করব? কিন্তু আপনাকে বলচি, কলোনির এক ইঞ্চি জমি পড়ে থাকবে না। সব নামে নামে রেজেস্ট্রি হয়ে যাচ্ছে। আপনার না-ইচ্ছে হয়, না-নেবেন। তবে কি দেখতে যাবেন, না দেখবেন না?
—চলুন যাই।
পকেট হইতে একগোছা চিঠি বাহির করিয়া ডাক্তারবাবু আমার নাকের কাছে ধরিয়া বলিলেন—এই দেখুন। মনি অর্ডারে টাকা আসচে অফিসে, রোজ একগোছা চিঠি আসছে, আপনি দেখুন না মশাই। না-দেখলে ঠকবেন এর পরে। তবে আপনি–
-নিলে জোর করে তো আপনাকে দেওয়া হবে না— রাস্তায় ভীষণ কাদা। একটা গোয়ালা পাড়ার ভিতর দিয়া যাইতেছিলাম, মহিষ ও গোরুর বাথান চারিদিকে। অত্যন্ত দুর্গন্ধ বাতাসে। ইহাতে মশা বিন-বিন করিতেছে। খানিকদ্দূর গিয়া একটা অবাঙালি কুলি বস্তি, যেমন নোংরা, তেমনি ঘিঞ্জি। তারপরে আবার জঙ্গল বাঁশবন আর ডোবা।
মাইলখানেক দূরে জঙ্গলের একপাশে রাস্তার ধারে একটা টিনের সাইনবোর্ডে বড়ো-বড়ো করিয়া লেখা আছে—’আচার্য কৃপালনী কলোনি’।
এখানে আসিয়া ডাক্তারবাবু দাঁড়াইলেন। সামনের দিকে হাত দিয়া দেখাইয়া বলিলেন—এই—
চারিদিক চাহিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম। বিস্ময়বোধের শক্তিও যেন হারাইয়া ফেলিয়াছে। ইহারই নাম, আচার্য কৃপালনী কলোনি। এই সেই বহু বিজ্ঞাপিত ভূখণ্ড? কোথায় ইহার পাদদেশ ধৌত করিয়া গঙ্গা প্রবাহিত হইতেছে? কোথায় সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য? পঞ্চাশফুট চওড়া রাস্তা, ইলেকট্রিক আলো, জলের কল প্রভৃতি ছবির সঙ্গে এই অন্ধকার বাঁশবন, কচুবন আর মশাভরা ডোবার খাপ খাওয়াইতে অনেক চেষ্টা করিলাম; মনকে অনেক বুঝাইলাম, রাসবিহারী অ্যাভিনিউ কী ছিল? অমুক কি ছিল? কিন্তু পারিয়া উঠিলাম না। তাহা ছাড়া এখানে ডাঙা-জমিই-বা কোথায়? সব তো জলেডোবা আর জলের মধ্যে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়া আছে বনকচুর ঝাড়।
সে-কথা বলিয়া লাভ নাই।
ডাক্তারবাবু গর্বের সহিত বলিলেন—সাড়ে ছ-শো করে কাঠা, তাই পড়তে পাচ্ছে না। সব প্লটের নাম রেজেস্ট্রি হয়ে গিয়েছে মশাই।
কিন্তু প্লট’ বলিতে জমির টুকরা বোঝায়, এখানে জমিই যে নাই, এ তো সবই জলাভূমি। পুণ্যতোয়া স্বচ্ছসলিলা জাহ্নবী ইহার ত্রিসীমানায় আছেন বলিয়া মনে হইল না।
বলিলাম—গঙ্গা এখান থেকে কতদূর?
—বেশি নয়। মাইলখানেক হবে কিংবা কিছু বেশি হবে—
তাই বা কী করিয়া হয়? গঙ্গা এখান হইতে চারি মাইলের কম কী করিয়া হয়, বুঝিলাম না।
সে যাহা হউক, তর্ক করিলাম না। ফিরিয়া আসিলাম। এই জলাভূমি আর কচুবনই হয় তো ইহার পর পাইব কিনা কে জানে? মন ভীষণ খারাপ হইয়া গেল।
বাড়ি আসিতেই স্ত্রী ব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—হ্যাঁ গা, কীরকম দেখলে? ভালো?
বলিলাম—চমৎকার!
–বলো না, কীরকম জায়গা? গঙ্গার ওপর?
-–সংলগ্ন বলা যেতে পারে।
—বেশ বড়ো রাস্তা করেছে?
—মন্দ নয়, বড়োই। বীণার কাকাকে সেদিন কিছু বলিলাম না। পঞ্চাশ টাকা জলে ফেলিলাম বটে, কিন্তু হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিলাম। পূর্ববঙ্গই ভালো। আর জমি খুঁজিব না ঠিক করিয়া ফেলিলাম।
পরদিন র্যাডক্লিফের রায় বাহির হইল।
আমাদের দেশ পশ্চিমবঙ্গে পড়িয়াছে।
উইলের খেয়াল
দেশ থেকে রবিবারে ফিরছিলাম কলকাতায়। সন্ধ্যার আর বেশি দেরি নেই, একটু আগে থেকেই প্ল্যাটফর্মে আলো জ্বেলেছে, শীতও খুব বেশি। এদিকে এমন একটা কামরায় উঠে বসেছি, যেখানে দ্বিতীয় ব্যক্তি নেই যার সঙ্গে একটু গল্পগুজব করি। আবার যার-তার সঙ্গে গল্প করেও আনন্দ হয় না। আমার দরের কোনো লোকের সঙ্গে গল্পে করে কোনো সুখ পাইনে, কারণ তারা যে-কথা বলবে সে আমার জানা। তারা আমারই জগতের লোক, আমার মতোই লেখাপড়া তাদেরও, আমারই মতো কেরানিগিরি কী ইস্কুল-মাস্টারি করে, আমারই মতো শনিবারে বাড়ি এসে আবার রবিবারে কলকাতায় ফেরে। তারা নতুন খবর আমায় কিছুই দিতে পারবে না, সেই একঘেয়ে কলকাতার মাছের দর, এম. সি. সি-র খেলা, ইস্টবেঙ্গল সোসাইটির দোকানে শীতবস্ত্রের দাম, চণ্ডীদাস কী সাবিত্রী ফিলমের সমালোচনা—এসব শুনলে গা বমিবমি করে। বরং বেগুনের ব্যাপারী, কী কন্যাদায়গ্রস্ত পাড়াগেঁয়ে ভদ্রলোক, কী দোকানদার—এদের ঠিকমতো বেছে নিতে পারলে, কথা বলে আনন্দ পাওয়া যায়। কিন্তু বেছে নেওয়া বড়ো কঠিন–কন্যাদায়গ্রস্ত ভদ্রলোক ভেবে যাঁর কাছে গিয়েচি, অনেক সময় দেখেছি তিনি ইনসিওরেন্সের দালাল।
একা বসে বিড়ি খেতে খেতে প্লাটফর্মের দিকে চেয়ে আছি, এমন সময় দেখি আমার বাল্যবন্ধু শান্তিরাম হাতে একটা ভারী বোঁচকা ঝুলিয়ে কোন গাড়িতে উঠবে ব্যস্তভাবে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমি ডাকতেই ‘এই যে!’ বলে একগাল হেসে আমার কামরার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললে—বোঁচকাটা একটুখানি ধরো না ভাই কাইন্ডলি—
আমি তার বোঁচকাটা হাত বাড়িয়ে গাড়িতে তুলে নিলাম—পেছনে পেছনে শান্তিরামও হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে আমার সামনের বেঞ্চিতে মুখোমুখি হয়ে বসল। খানিকটা ঠান্ডা হয়ে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললে—বিড়ি আছে? কিনতে ভুলে গেলাম তাড়াতাড়িতে। আর ক-মিনিট আছে? পৌঁনে ছ-টা না রেলওয়ের? আমি ছুটচি সেই বাজার থেকে—আর ওই ভারি বোঁচকা! প্রাণ একেবারে বেরিয়ে গিয়েছে। কলকাতায় বাসা করা গিয়েচে ভাই, শনিবারে শনিবারে বাড়ি আসি। বাগানের কলাটা, মুলোটা যা পাই নিয়ে যাই এসে—সেখানে তো সবই—-— বুঝলে না? দাঁতন-কাঠিটা ইস্তক তাও নগদ পয়সা। প্রায় তিন-চার দিনের বাজার খরচ বেঁচে যায়। এই দ্যাখো ওল, পুঁইশাক, কাঁচা লঙ্কা, পাটালি…দেখি দেশলাইটা—
শান্তিরামকে পেয়ে খুশি হলাম। শান্তিরামের স্বভাবই হচ্চে একটু বেশি বকা। কিন্তু তার বকুনি আমার শুনতে ভালো লাগে। সে বকুনির ফাঁকে ফাঁকে এমন সব পাড়াগাঁয়ের ঘটনার টুকরো ঢুকিয়ে দেয়, যা গল্প লেখার চমৎকার—অতিচমৎকার উপাদান। ওর কাছে শোনা ঘটনা নিয়ে দু-একটা গল্পও লিখেচি এর আগে। মনে ভাবলাম শান্তিরাম এসেচে, ভালোই হয়েছে। একা চার ঘণ্টার রাস্তা যাব, তাতে এই শীত। তা ছাড়া এই শীতে ওর মুখের গল্প জমবেও ভালো।
হঠাৎ শান্তিরাম প্ল্যাটফর্মের দিকে মুখ বাড়িয়ে ডাকতে লাগল—অবনী ও অবনী, এই যে, এই গাড়িতে এসো, কোথায় যাবে?
গুটি তিন-চার ছেলে-মেয়ে, এক পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের স্বাস্থ্যবতী ও সুশ্রী একটি পাড়াগাঁয়ের বউ আগে আগে, পিছনে একটি ফর্সা একহারা চেহারার লোক, সবার পিছনে বাক্স পেটরা মাথায় জন দুই কুলি। লোকটি আমাদের কামরার কাছে এসে দাঁড়িয়ে হেসে বললে—এই যে দাদা, কলকাতা ফিরছেন আজই! আমি? আমি একবার এদের নিয়ে যাচ্চি পাঁচঘরার ঠাকুরের থানে। মসলন্দপুর স্টেশনে নেমে যেতে হবে; বাস পাওয়া যায়। দলটি আমাদের গাড়ির পাশ দিয়ে এগিয়ে খালি একটা ইন্টার ক্লাস কামরায় উঠল।
শান্তিরাম চেয়ে চেয়ে দেখে বললে—তাই অবনী এখানে এল না, ইন্টার ক্লাসের টিকিট কিনা? আঙুল ফুলে কলাগাছ একেই বলে! ওই অবনীদের খাওয়া জুটত না, আজ দল বেঁধে ইন্টার ক্লাসে চেপে বেড়াতে যাচ্ছে…ভগবান যখন যাকে দেন,—আমাদের বোঁচকা বওয়াই সার।
গাড়ি ছাড়ল। সন্ধ্যার পাতলা অন্ধকারে পাম্পিং এঞ্জিনের শেড, কেবিনঘর, ধূমাকীর্ণ কুলিলাইন সট সট করে দু-পাশ কেটে বেরিয়ে চলেছে, সামনে সিগন্যালের সবুজ বাতি, তারপর দু-পাশে আখের খেত, মাঠ, বাবলা বন। শান্তিরামের গলার সুর শুনে বুঝলাম, সে গল্প বলার মেজাজে আছে, ভালো করে আলোয়ান গায়ে দিয়ে বসলাম, উৎসুক মুখে ওর দিকে চেয়েঃরইলাম।
শান্তিরাম বললে—অবনীকে এর আগে কখনো দেখোনি? নিশ্চয় দেখেছ ছেলেবেলায়, ও আমাদের নীচের ক্লাসে পড়ত আর বেশ ভালো ফুটবল খেলত— মনে নেই? ওর বাবা কোর্টে নকলনবিশি করতেন, সংসারের অভাব-অনটন টানাটানি বেড়েই চলেছিল। সেই অবস্থায় অবনীর বিয়ে দিয়ে বউ ঘরে আললেন। বললেন—কবে মরে যাব, ছেলের বউয়ের মুখ দেখে যাই। বাঁচলেনও না বেশিদিন, একপাল পুষ্যি আর একরাশ দেনা ছেলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে সংসার থেকে বিদায় নিলেন।
তারপর কী কষ্টটাই গিয়েচে ওদের। অবনী পাস করতে পারলে না, চাকরিও কিছু জুটল না, হরিণখালির বিলের এক অংশ ওদের ছিল অনেককাল আগে থেকে—শোলা হত সেখানে, সেই বিলের শোলা ইজারা দিয়ে যে কটা টাকা পেত, তাই ছিল ভরসা।
ওদের গাঁয়ে চৌধুরীপাড়ায় নিধিরাম চৌধুরী বলে একজন লোক ছিল। গাঁয়ে তাকে সবাই ডাকত নিসু চৌধুরী। নিসু চৌধুরীর কোনো কুলে কেউ ছিল না, বিয়ে করেছিল দু-দু-বার, ছেলেপুলেও হয়েছিল কিন্তু টেকেনি। ওর বাবা সেকালে নিমকির দারোগা ছিল, বেশ দু-পয়সা কামিয়ে বিষয়সম্পত্তি করে গিয়েছিল। তা শালিয়ানা প্রায় হাজার বারোশো টাকা আয়ের জমা, আম-কাঁঠালের বাগান, বাড়িতে তিনটে গোলা, এক-একটা গোলায় দেড়পাট দু-পাট করে ধান ধরে, দুটো পুকুর, তেজারতি কারবার। নিসু চৌধুরী ইদানীং তেজারতি কারবার গুটিয়ে ফেলে জেলার লোন অফিসে নগদ টাকাটা রেখে দিত। সেই নিসু চৌধুরীর বয়স হল, ক্রমে শরীর অপটু হয়ে পড়তে লাগল, সংসারে মুখে জলটি দেবার একজন লোক নেই। আবার পাড়াগাঁয়ের ব্যাপার জানো তো? পয়সা নিয়ে বাড়িতে কাউকে খেতে দেওয়া—এ রেওয়াজ নেই। তাতে সমাজে নিন্দে হয়, সে কেউ করবে না। নিসু চৌধুরী এমন একবার অসুখে পড়ে দিনকতক বড়ো কষ্ট পেলে—এসব দিকের পাড়াগাঁয়ের জানো তো ভায়া, না-পাওয়া যায় রাঁধুনি বামুন, না-পাওয়া যায় চাকর, পয়সা দিলেও মেলানো যায় না। দিন দশ-বারো ভুগবার পর উঠে একটু সুস্থ হয়ে একদিন নিসু চৌধুরী অবনীকে বাড়িতে ডাকলে। বললে—বাবা অবনী, আমার কেউ নেই, এখন তোমরা পাঁচজন ভরসা। তা তোমার বাবা আমায় ছোটো ভাইয়ের মতো দেখতেন, তোমাদের পাড়ায় তখন যাতায়াতও ছিল খুব। তারপর এখন শরীরও হয়ে পড়েছে অপটু, তোমাদের যে গিয়ে খোঁজখবর করব, তাও আর। পারিনে। তা আমি বলছি কী, আমার যা আছে সব লেখাপড়া করে দিচ্চি তোমাদের, নাও—নিয়ে আমাকে তোমাদের সংসারে জায়গা দাও। তুমি আমার দীনুদার ছেলে, আমার নিজের ছেলেরই মতো। তোমাকে আর বেশি কী বলব বাবা?
অবনী আশ্চর্য হয়ে গেল। নিসু চৌধুরীর নগদ টাকা কত আছে কেউ অবিশ্যি জানে না, কিন্তু বিষয়সম্পত্তির আয়, ধান—এসব যা আছে, এ গাঁয়ে এক রায়েদের ছাড়া আর কারু নেই। সমস্ত সম্পত্তি লিখে দিতে চায় নিসু চৌধুরী তার নামে! অবনীর মুখ দিয়ে তো কথা বেরুল না খানিকক্ষণ। তারপর বললে—আচ্ছা কাকা, বাড়িতে একবার পরামর্শ করে এসে কাল বলব।
নিসু চৌধুরী বললে—বেশ বাবা, কিন্তু এসব কথা এখন যেন গোপন থাকে। পরদিন গিয়ে অবনী জানালে এ প্রস্তাবে তাদের কোনো আপত্তি নেই। নিসু চৌধুরী বললে-বউমা তাহলে রাজি হয়েছেন? দ্যাখো তাহলে আমার একটা সাধ আছে, সেটা বলি। আমার এত বড়ো বাড়িখানা পড়ে আছে, অনেক দিন এতে মালক্ষ্মীদের চরণ পড়েনি, ঠিকমতো সন্ধে-পড়ে না। তোমাদের ও-বাড়িটাও তো ছোটো, ঘরদোরে কুলোয় না, তা ছাড়া পুরোনোও বটে। তোমরা আমার এখানে কেন এসো না সবসুদ্ধ? তোমারই তো বাড়িঘর হবে, তোমাকেই সব দিয়ে যখন যাব, তখন এখন থেকে তোমার নিজের বাড়ি তোমরা না-দেখলে নষ্ট হয়ে যাবেঃযে!
এ প্রস্তাবেও অবনী রাজি হল, একটা ভালো দিন দেখে সবাই এ বাড়িতে চলে এল। অবনীর বউ নিসু চৌধুরীর বাড়ি কখনো দেখেনি, কারণ সে ওপাড়ার বউ, এ-পাড়ায় আসবার দরকার তেমন হয়নি কখনো। ঘরবাড়ি দেখে বউ যেমন অবাক হয়ে গেল, তেমনি খুশি হল। নিসু চৌধুরীর বাবা রোজগারের প্রথম অবস্থায় শখ করে বাড়ি উঠিয়েছিলেন—তখনকার দিনে সস্তাগণ্ডার বাজার ছিল, দেখে অবাক হবার মতো বাড়িই করেছিলেন বটে, পাড়াগাঁয়ের পক্ষে অবিশ্যি। কলকাতার কথা ছেড়ে দাও। মস্ত দোতলা বাড়ি ওদের, নীচে বড়ো বড়ো সাত-আটখানা ঘর, বারান্দা, প্রকাণ্ড ছাদ, সান-বাঁধানো উঠোন, ভেতর বাড়িতে পাকা রান্নাঘর, দারা, বাইরে প্রকাণ্ড বৈঠকখানা। বাড়ির পেছনে বাগান, ছোটো একটা পুকুর, বাঁধানো ঘাটপাড়াগাঁয়ে সম্পন্ন গৃহস্থবাড়ি যেমন হয়ে থাকে।
ওরা বাড়িতে উঠে এসে জাঁকিয়ে সত্যনারায়ণের পুজো দিলে, লোকজন খাওয়ালে, লক্ষ্মীপুজো করলে। সবাই বললে অবনীর বউ-এর পয় আছে, নইলে অমন বিষয়সম্পত্তি পাওয়া কী সোজা কথা আজকালকার বাজারে। আবার অনেকেরই চোখ টাটালো।
এসব হল গিয়ে ওবছর ফাল্গুন মাসের কথা! গত বছর বৈশাখ মাসে নিসু চৌধুরী মারা গেল। জ্বর হয়েছিল, অবনী ভালো ভালো ডাক্তার দেখালে, খুলনা থেকে নৃপেন ডাক্তারকে নিয়ে এল—বিস্তর পয়সা খরচ করলে, অবনীর বউ মেয়ের মতো সেবা করলে—কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। অবনী বৃষোৎসর্গ শ্রাদ্ধ করলে খুব ঘটা করে, সমাজ খাওয়ালে—তা সবাই বললে দেখেশুনে যে নিজের ছেলে থাকলে নিসু চৌধুরীর—সেও এর বেশি আর কিছু করতে পারত না। তারপর এখন ওরাই সম্পত্তির মালিক, অবনী নিজেই খাটিয়ে ছেলে, কোনো নেশা-ভাঙ করে না, অতি সৎ। কাজেই বিষয় উড়িয়ে দেবে সে ভয় নেই, দেখেশুনে খাবার ক্ষমতা আছে।
তাই বলছিলাম, ভগবান যাকে দেন, তাকে এমনি করেই দেন। ওই অবনীর বউ আঁচল পেতে চাল ধার করে নিয়ে গিয়েছে আমার মাসিমাদের বাড়ি থেকে, তবে হাঁড়ি চড়েচে—এমন দিনও গিয়েচে ওদের। আমার মাসিমার বাড়ি ওদের একই পাড়ায় কিনা? তাঁরই মুখে সব শুনতে পাই। আর তারাই এখন দেখো ইন্টার ক্লাসে—ভগবান যখন যাকে—
অবনীর বউটি খুব ভালো, অত্যন্ত গরিব ঘরের মেয়ে ছিল, পড়েছিলও তেমনি গরিবের ঘরে। সে নাকি মাসিমার কাছে বলেচে, যা কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি দিদি তাই যখন হল, এখন ভাবি, ভগবান সব বাঁচিয়ে বর্তে রাখতে হয়। গরিব লোকের কপাল, ভরসা করতে ভয় পাই দিদি। প্রথম যেদিন বাড়িতে ঢুকলাম, দেখি এ যেন রাজবাড়ি, অত ঘরদোর অত বড়ো জানলা-দরজা, এতে আমার ছেলে-মেয়েরা বাস করতে পারবে, জানো তো কী অবস্থায় ছিলাম—তোমার কাছে আর কি লুকোব? এ যেন সবই স্বপ্ন বলে মনে হয়েছিল। এখন ব্ৰতটা নামটা করে, দু-দশ জন ব্রাহ্মণের পাতে দু-মুঠো ভাত দিয়ে যদি ভালোয় ভালোয় দিনগুলো কাটাতে পারি, তবে তো মুখ থাকে লোকের কাছে। সেই আশীর্বাদ করো তোমরা সকলে।
সন্ধ্যার অন্ধকার চারিধারে খুব গাঢ় হয়েছে। ট্রেন হু-হু করে অন্ধকার মাঠ, বাঁশবন, বিল, জলা, আখের খেত, মাঝে মাঝে ঘন অন্ধকারের মধ্যে জোনাকি জ্বলা ঝোপ পার হয়ে উড়ে চলেচে, মাঝে মাঝে ছোটো ছোটো গ্রাম, খড়ে-ছাওয়া বিশ-ত্রিশটা চালাঘর একজায়গায় জড়াজড়ি করে আছে, দু-চার-দশটা মিটমিটে আলো জ্বলে অন্ধকারে ঢাকা গাছপালায় ঢাকা গ্রামগুলোকে কেমন একটা রহস্যময় রূপ দিয়েছে।
একটা বড়ো গ্রামের স্টেশনে অবনী তার বউ ও ছেলেমেয়েকে নিয়ে নেমে গেল। স্টেশনের বাইরে একখানা ছইওয়ালা গোরুরগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, বোধ হয় ওদেরই জন্যে। অবনীর বউকে এবার প্লাটফর্মের তেলের লণ্ঠনের অস্পষ্ট আলোয় দেখে আরও বেশি করে মনে হল যে মেয়েটি সত্যিই সুশ্রী। বেশ ফর্সা রং, সুঠাম বাহু দুটির গড়ন, চলনভঙ্গি ও গলার সুরের সবটাই মেয়েলি। এমনি নিখুঁত মেয়েলি ধরনের মেয়ে দেখবার একটা আনন্দ আছে, কারণ সেটা দুষ্প্রাপ্য। ট্রেনখানা প্রায় দশ মিনিট দাঁড়িয়ে রইল; একজন লোক হারিকেন লণ্ঠন নিয়ে ওদের এগিয়ে নিতে এসেছিল, ওরা তার সঙ্গে স্টেশনের বাইরে যেতে গিয়ে ফটক খোলা না-পেয়ে দাঁড়িয়ে রইল, কারণ যিনি স্টেশনমাস্টার তিনিই বোধ হয় টিকিট নেবেন যাত্রীদের কাছ থেকে—ফটকে চাবি দিয়ে তিনি গার্ডকে দিয়ে প্লাটফর্মের মধ্যে আঁধারে লণ্ঠনের আলোয় কী কাগজপত্র সই করাচ্ছিলেন।
তারপর ট্রেন আবার চলতে লাগল—আবার সেইরকম ঝোপ-ঝাপ, অন্ধকারে ঢাকা ছোটোখাটো গ্রাম, বড়ো বড়ো বিল, বিলের ধারে বাগদিদের কুঁড়ে। আমার ভারি ভালো লাগছিল—এইসব অজানা ক্ষুদ্র গ্রামে ঘরে ঘরে অবনীর বউ-এর মতো কত গৃহস্থবধূ ভারবাহী পশুর মতো উদয়াস্ত খাটচে, হয়তো পেটপুরে দু বেলা খেতেও পায় না, ফর্সা কাপড় বছরে পরে হয়তো দু-দিন কী তিনদিন, হয়তো সেই পুজোর সময় একবার, কোনো সাধ-আহ্লাদ পুরে না মনের, কিছু দেখে না, জানে না, বোঝে না, মনে বড়ো কিছু আশা করতে শেখেনি, বাইরের দুনিয়ার কিছু খবর রাখে না—পাড়াগাঁয়ের ডোবার ধারের বাঁশবাগানের ছায়ায় জীবন তাদের আরম্ভ, তাদের সকল সুখ-দুঃখ, আনন্দ, আশা-নিরাশার পরিসমাপ্তিও ওইখানে।
অবনীর বউ গৃহস্থবধূদেরই একজন। অন্তত ওদের একজনও তার সাধের স্বর্গকে হাতে পেয়েছে। অন্ধকারের মধ্যে আমি বসে বসে এই কথাই ভাবছিলাম। আমি কল্পনা করবার চেষ্টা করলাম অবনীর বউকে, যখন সে প্রথম নিসু চৌধুরীর বাড়িতে এল—কী ভাবলে অত বড়ো বাড়িটা দেখে,…অত ঘরদোর!…যখন প্রথম জানলে যে সংসারের দুঃখ দূর হয়েছে, প্রথম যখন সে তার ছেলে-মেয়েদের ফর্সা কাপড় পরতে দিতে পারলে, আমি কল্পনা করলাম দশঘরার হাট থেকে অবনী বড়ো মাছ, সন্দেশ, ছানা কিনে বাড়িতে এসেচে…অবনীর বউ এই প্রথম সচ্ছলতার মুখ দেখলে। তার সে খুশি-ভরা চোখমুখ অন্ধকারের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি।…
ট্রেন আর একটা স্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছে। শান্তিরাম আলোয়ান মুড়ি দিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে, মাঝে মাঝে ঢুলচে। স্টেশনে পানের বোঝা উঠছে। শান্তিরামকে বললাম—শান্তিরাম, ঘুমুচ্চ নাকি? আমি একটা গল্প জানি এইরকমই, তোমার গল্পটা শুনে আমার মনে পড়েছে সেটা, শুনবে?…
কিন্তু শান্তিরাম এখন গল্প শোনবার মেজাজে নেই। সে আরামে ঠেস দিয়ে আরও ভালো করে মুড়িসুড়ি দিয়ে বসল। সে একটু ঘুমুবে।
পূর্ণবাবুর কথা আমার মনে পড়েছে, শান্তিরামের গল্পটা শোনবার পরে এখন। পূর্ণবাবু আমিন ছিল, পাটনায় আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। পূর্ণবাবুর বয়স তখন ছিল পঞ্চাশ কী বাহান্ন বছর। লম্বা রোগা চেহারা, বেজায় আফিম খেত—দাঁত প্রায় সব পড়ে গিয়েছিল, মাথার চুল সাদা,নাক বেশ টিকোলো, অমন সুন্দর নাক কিন্তু আমি কম দেখেছি, রং না-ফর্সা না-কালো। পূর্ণবাবু কম মাইনে পেত, এখানে কোনোরকমে চালিয়ে বাড়িতে তার কিছু টাকা না পাঠালেই চলবে না— কাজেই তার পরনে ভালো জামাকাপড় একদিনও দেখিনি। পূর্ণবাবু নিজে বেঁধে খেত। একদিন তার খাবার সময় হঠাৎ গিয়ে পড়েছি—দেখি পূর্ণবাবু খাচ্চে শুধু ভাত—কোনো তরকারি, কী শাক, কী আলুভাতে—কিছু না, কেবল একতাল সবুজ পাতালতা-বাটা ওষুধের মতো দেখতে—কী একটা দ্রব্য ভাতের সঙ্গে মেখে খাচ্চে। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, সবুজ রঙের দ্রব্যটা কাঁচা নিমপাতাবাটা। পূর্ণবাবু একটু অপ্রতিভের সুরে বললেন, নিমপাতা-বাটা এত উপকারী, বিশেষ করে লিভারের পক্ষে। ভাত দিয়ে মেখে যদি খাওয়া যায়—আমি আজ দু-বছর ধরে আজ্ঞে দেখবেন খেয়ে, শরীর বড়ো ঠান্ডা—তা ছাড়া কী জানেন, লোভ যত বাড়াবেন ততই বাড়বে—
উপকারী দ্রব্য তো অনেকই আছে, ডাল-ঝোলের বদলে কুইনাইন মিক্সচার ভাতের সঙ্গে মেখে দু-বেলা খাওয়ার অভ্যেস করতে পারলে দেশের ম্যালেরিয়া সমস্যার একটা সুসমাধান হয়, তাও স্বীকার করি। কিন্তু জীবনে বড়ো বড়ো উপদেশগুলো চিরকাল লঙঘন করে চলে এসে এসে আজ নীতি ও স্বাস্থ্য পালন সম্বন্ধে এত বড়ো একটা সজীব আদর্শ চোখের সামনে পেয়ে খানিকক্ষণের জন্যে নির্বাক হয়ে গেলাম। আর একদিন-দু-দিন নয়, দু-বছর ধরে চলছে এ ব্যাপার।
একদিন পূর্ণবাবু নিজের জীবনের অনেক কথা বললেন। কলকাতায় তাঁদের বাড়ি, ভবানীপুরে। তাঁর একজন পিসিমা আছেন, একটু দূর সম্পর্কের। সেই পিসিমার মৃত্যুর পরে তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন পূর্ণবাবু। কিন্তু পিসিমা মরি-মরি করচেন আজ ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর।
পূর্ণবাবুর বিবাহ হয় বাগবাজারের সম্রান্ত বংশের মেয়ের সঙ্গে—তবে তখন তাদের অবস্থা খুব ভালো ছিল না। পূর্ণবাবুদের পৈতৃক বাড়িও নেই কলকাতায়, ভবানীপুরে খুব আগে নাকি প্রকাণ্ড বাড়ি পুকুর ছিল, এখন তাদের দু-পুরুষ ভাড়াটে বাড়িতে থাকে। পূর্ণবাবুর আঠারো-উনিশ বছর বয়সে পিতৃবিয়োগ হয়, তিনি ছেলের জন্য শুধু যে কিছু রেখে যাননি তা নয়, ছেলেটিকে লেখাপড়াও শেখাননি। কারণ তিনিও জানতেন এবং সবাই জানত যে তার দরকার নেই, অতবড়ো সম্পত্তির যে মালিক হবে দু-দিন পরে—তার কী হবে লেখাপড়ায়?
ছেলেটিও জ্ঞান হওয়া পর্যন্ত তাই জানত বলে লেখাপড়া শেখবার কোনো চেষ্টাও ছিল না। পূর্ণবাবুর শ্বশুরও তাই ভেবে মেয়েকে ওই গরিব ঘরে দিয়েছিলেন।
পূর্ণবাবুর বাবা তো মারা গেলেন, পূর্ণবাবুর ঘাড়ে রেখে গেলেন সংসার, নব বিবাহিতা পুত্রবধূ, অল্প কিছু দেনা। কিন্তু পূর্ণবাবুর ক্রেডিট তখন পুরোমাত্রায়—কী বাজারে কী বন্ধুবান্ধব মহলে। টাকা হাত পাতলেই পাওয়া যায়—ধারে দোকানে জিনিস পাওয়া যায়, নিত্যনতুন বন্ধু জোটে। পূর্ণবাবু খুশি, পূর্ণবাবুর তরুণী বউ খুশি, আত্মীয়-স্বজন খুশি, বন্ধুবান্ধব খুশি। কারণ সবাই জানে, বুড়ি আর ক-দিন? না–হয় মেরেকেটে আর পাঁচটা বছর!
অবশ্য পূর্ণবাবুর তখন বয়স অনেক কম, সংসারের কিছুই বোঝেন না, জানেন না—মনে উৎসাহ, আশা অদম্য, আনন্দের উৎস—চোখের সামনে দীপ্ত রঙিন ভবিষ্যৎ—যে ভবিষ্যতের সম্বন্ধে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই, আশঙ্কা নেই, যা একদিন হাতের মুঠোয় ধরা দেবেই—এ অবস্থায় যে যা বুঝিয়েচে পূর্ণবাবু তাই-ই বুঝেছেন, টাকাকড়ি ধার করে দু-হাতে উড়িয়েছেন, বন্ধুবান্ধবদের সাহায্যও করেচেন, ধারে যতদিন এবং যতটা নবাবি করা চলে, বাকি রাখেননি।
কিন্তু ক্রমে বছর যেতে লাগল, দু-তিন বছর পরে আর ধার মেলে না— সকলেই হাত গুটিয়ে ফেললে। পাওনাদারের যাতায়াত শুরু হল এইজন্যে আরও বিশেষ করে পূর্ণবাবু বাজারে ক্রেডিট হারিয়ে ফেললেন যে, সবাই দেখলে পূর্ণবাবুর পিসিমা ওঁদের আদৌ বাড়িতে ডাকেন না, পূর্ণবাবুকেও না, পূর্ণবাবুর বউ ছেলে-মেয়ে কাউকে না।
পিসিমার কাছে খাতির পেলে বাজারেও পূর্ণবাবুর খাতির থাকত—অনেকে বলতে লাগল পূর্ণবাবুর পিসিমা ওদের দেখতে পারে না, সমস্ত সম্পত্তি হয়তো দেবোত্তর করে দিয়ে যাবে—একটি পয়সাও দেবে না ওদের।
পূর্ণবাবুর পিসিমার বিশ্বাস যে এরা তাঁকে বিষ খাইয়ে মারবে—যত বয়স হচ্ছে এ বিশ্বাস আরও দিন দিন বাড়ছে—এতে করে হয়েছে এই যে পূর্ণবাবুর, কী পূর্ণবাবুর স্ত্রীর, কী পূর্ণবাবুর ছেলে-মেয়ের পিসিমার বাড়ির ত্রি-সীমানায় ঘেঁষবার জো নেই। কাজেই অতবড়ো সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়েও পূর্ণবাবু আজ ত্রিশ টাকা মাইনের আমিনগিরি করচেন।
আমি পূর্ণবাবুর এ গল্প বিশ্বাস করিনি। কিন্তু সেটেলমেন্ট ক্যাম্পে আমরা একসঙ্গে দেড় বছরের উপর ছিলাম—এই দেড় বছরের প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যায় কী রাত্রে একসঙ্গে বসবার সুযোগ হলেই পূর্ণবাবু আমায় তাঁর পিসিমার সম্পত্তির গল্প করতেন। কখন কোনটা হয়তো বলে ফেলেচেন ছ-মাস আগে তাঁর মনে থাকবার কথা নয়, আবার আজ যখন নতুন কথা বলচেন ভেবে বললেন তখন খুঁটিনাটি ঘটনাগুলোও ছ-মাস আগের কাহিনির সঙ্গে মিলে যেত—নানা টুকরো কথার জোড়াতালি মিলিয়ে এই দেড় বছরে পূর্ণবাবুর সমস্ত গল্পটা আমি জেনেছিলুম—একদিন তিনি বসে আগাগোড়া গল্প আমায় করেননি, সে ধরনের গল্প করার ক্ষমতাও ছিল না পূর্ণবাবুর।
সেই থেকে পূর্ণবাবুর দুর্দশার সূত্রপাত হল। বন্ধুবান্ধব ছেড়ে গেল, শ্বশুরবাড়িতে খাতির কমে গেল, সংসারে দারিদ্রের ছায়া পড়ল। দু-এক জন হিতৈষী বন্ধুর পরামর্শে পূর্ণবাবু আমিনের কাজ শিখতে গেলেন—বউ-ছেলেকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।
এসব আজ ত্রিশ বছর আগেকার কথা।
এই ত্রিশ বছরে পূর্ণবাবু আমোদপ্রিয়, শৌখিনচিত্ত, অপরিণামদর্শী যুবক থেকে কন্যাদায়গ্রস্ত, রোগজীর্ণ, অকালবৃদ্ধ, দারিদ্রভারে কুজদেহ ত্রিশটাকা মাইনের আমিনে পরিণত হয়েছেন—এখন আর মনে তেজ নেই, শরীরে বল নেই, খেলে হজম করতে পারেন না, চুল অধিকাংশই পেকে গিয়েছে, কষের অনেকগুলো দাঁত পড়ে গেলেও পয়সার অভাবে বাঁধাতে পারেন না বলে গালে টোল খেয়ে যাওয়ায় বয়সের চেয়েও বুড়ো দেখায়।
বাড়ির অবস্থাও ততোধিক খারাপ। পনেরো টাকা ভাড়ার এঁদো ঘরে বাসকরার দরুণ স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে সকলেই নানারকম অসুখে ভোগে—অথচ উপযুক্ত চিকিৎসা হয় না। তিনটি মেয়ের বিয়েতে পূর্ণবাবু একেবারে সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছেন, অথচ মেয়ে তিনটির প্রথম দুটি ঘোর অপাত্রে পড়েছে। বড়ো জামাই বউবাজারে দরজির দোকান করে, ঘোর মাতাল, কুচরিত্র—বাড়িতে স্ত্রীকে মারপিট করে প্রায়ই, তবুও সেখানে মেয়েকে মুখগুজে পড়ে থাকতে হয়—বাপেরবাড়ি এলে শোবার জায়গাই দেওয়া যায় না। মেজো জামাই মাতাল নয় বটে, কিন্তু তার একপয়সা রোজগারের ক্ষমতা নেই—রেলে সামান্য কী চাকুরি করে, সে-সংসারে সবাই একবেলা খেয়ে থাকে, তাই নাকি অনেক দিন থেকে নিয়ম। আর একবেলা সকলে মুড়ি খায়। মেজো মেয়ের দুঃখ পূর্ণবাবু দেখতে পারেন না বলে মাঝে মাঝে তাকে বাড়িতে আনিয়ে রাখেন; সেখানে এলে তবু মেয়েটা খেতে পায় পেট পুরে দু-বেলা। আজকাল প্রায়ই জ্বরে ভোগে, শরীরও খারাপ হয়ে গিয়েছে, ডাক্তারে আশঙ্কা করচে থাইসিস। বুড়ি পিসিমা কিন্তু এখনো বেঁচে। এখনও বুড়ি গঙ্গাস্নানে যায়, নিজের হাতে বেঁধে খায়। বয়স নব্বই-এর কাছাকাছি, কিন্তু এখনও চোখের তেজ বেশ, দাঁত পড়েনি। বুড়ি একেবারে অশ্বামার পরমায়ু নিয়ে জন্মেছে, এদিকে যারা তার মরণের পানে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে, তাদের জীবন ভাঁটিয়ে শেষ হতে চলল।
সেটেলমেন্টের কাজ ছেড়ে পাটনা থেকে চলে এলাম। পূর্ণবাবু তখনও সেখানে আমিন। বছরতিনেক পরে একদিন গয়া স্টেশনে পূর্ণবাবুর সঙ্গে দেখা। দুপুরের পর এক্সপ্রেস আসবার সময় স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করচি, একটু পরেই ট্রেনটা এসে দাঁড়াল। পূর্ণবাবু নামলেন একটা সেকেন্ড ক্লাস কামরা থেকে, অন্য কামরা থেকে দুজন দারোয়ান নেমে এসে জিনিসপত্রের তদারকে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। পূর্ণবাবুর পরনে দামি কাঁচি ধুতি, গায়ে সাদা সিল্কের পাঞ্জাবি, তার ওপরে জমকালো পাড় ও কল্কাদার শাল, পায়ে প্যারিস গার্টার আটা সিল্কের মোজা ও পাম্পশু, চোখে সোনার চশমা, হাতে সোনার ব্যান্ডওয়ালা হাতঘড়ি।
আমি গিয়ে আলাপ করলাম। পূর্ণবাবু আমায় চিনতে পেরে বললেন—এই যে রামরতনবাবু, ভালো আছেন? তারপর, এখন কোথায়?
আমি বললাম—আমি এখানে চেঞ্জে এসেচি মাসতিনেক, আপনি এদিকে— ইয়ে—
তাঁর অদ্ভুত বেশভূষার দিকে চেয়ে আমি কেমন হয়ে গিয়েছিলাম। পূর্ণবাবুকে এ বেশে দেখতে আমি অভ্যস্ত নই, আমার কাছে সুতির ময়লা-চিট সোয়েটার ও সবুজ আলোয়ান গায়ে পূর্ণবাবু বেশি বাস্তব, তা ছাড়া চুয়ান্ন-পঞ্চান্ন বছরের বৃদ্ধের এ কী বেশ!
কী ব্যাপারটা ঘটেছে তা অবশ্য পূর্ণবাবু বলবার আগেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম।
জিনিসপত্র গুছিয়ে পূর্ণবাবু ওয়েটিং রুমে ঢুকলেন; তিনি সাউথ বিহার লাইনের গাড়িতে যাবেন। গাড়ির এখনও ঘণ্টা-দুই দেরি। একজন দারোয়ানকে ডেকে বললেন—ভূপাল সিং, এখানে ভালো সিগারেট পাওয়া যায় কিনা দেখে এসো— নইলে কাঁচি নিয়ে এসো এক বাক্স
আমায় বললেন—ওঃ, অনেক দিন পরে আপনার সঙ্গে দেখা। আর বলেন কেন, বিষয় থাকলেই হাঙ্গামা আছে। সামনে আসচে জানুয়ারি কিস্তি—তহশিলদার বেটা এখনও একপয়সা পাঠায়নি, লিখেচে এবার নাকি কলাই ফসল সুবিধে হয়নি। তাই নিজে যাচ্ছি মহালে, মাসখানেক থাকব। গাড়িটা এখানে আসে ক-টায়? ভালো কথা, এখানে টাইমটেবল কিনতে পাওয়া যাবে? কিনতে ভুল হয়ে গেল হাওড়ায়—
আমি জিজ্ঞেস করলাম—আপনার পিসিমা?
দারোয়ান সিগারেট নিয়ে এল। পূর্ণবাবু একটা সরু ও সুদীর্ঘ হোল্ডার বার করলেন, আমার দিকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বললেন, আসুন।
তারপর সিগারেট ধরিয়ে আরামে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন—পিসিমা মারা গিয়েচেন আর-বছর কার্তিক মাসে। তারপর থেকেই বিষয়-আশয়ের ঝাটে পড়েচি—নিজে না-দেখলে কি জমিদারি টেকে? আর এই বয়সে ছুটোছুটি করে পারিনে, একটা ভালো কাজ-জানা লোকের সন্ধান দিতে পারেন রামরতনবাবু? টাকা-চল্লিশ মাইনে দেব, খাবে থাকবে—
ওয়েটিং রুমে বসে পূর্ণবাবু দু-বোতল লেমনেড খেলেন এই শীতকালে। একবার দারোয়ানকে দিয়ে গরম জিলিপি আনালেন দোকান থেকে, একবার নিমকি বিস্কুট আনালেন। আর একবার নিজে স্টেশনের বাইরের দোকান থেকে এক ডজন কমলালেবু কিনে আনলেন। আমায় প্রতিবারেই খাওয়ানোর জন্য পীড়াপীড়ি করলেন, কিন্তু আমার শরীর খারাপ, খেতে একেবারেই পারিনে, সে-কথা জানিয়ে ক্ষমা চাইলাম। একটু পরেই পূর্ণবাবুর ট্রেন এসে পড়ল।
দিন পনেরো-কুড়ি পরে আবার বেড়াতে গিয়েচি স্টেশনে। সেদিন খুব শীত পড়েছে, বেশ জ্যোৎস্না, রাত আটটার কম নয়। স্টেশনের রাস্তা যেখানে ঠেকেছে সেখানে চপকাটলেট চায়ের দোকান থেকে কে আমার নাম ধরে ডাকলেও রামরতনবাবু—এই যে—এদিকে—ফিরে চেয়ে দেখি পূর্ণবাবু একটা কোণে টেবিলে বসে। পূর্ণবাবুর মাথায় একটা পশমের কানঢাকাঃটুপি, শালের কম্ভার গলায় জড়ানো, হাতে দস্তানা। আমায় বললেন—আসুন, বসুন—কিছু খাওয়া যাক। আজ ফিরে এলাম মহাল থেকে—এই রাতের গাড়িতে ফিরব কলকাতায়— কিছু খাবেন না?…না, না, খেতেই হবে কিন্তু, সেদিন তো কিছু খেলেন না—এই বয়, ইধার আও—
আমাকে জোর করে পূর্ণবাবু চেয়ারে বসালেন। তারপর তাঁর নিজের জন্যে যা খাবার নিলে, তা দেখে আমার তো হৃৎকম্প উপস্থিত হল। এত খাবেন কী করে পূর্ণবাবু এই বয়সে? আর একটা অতিবাজে দোকানে খানআষ্টেক চপ, খানচারেক কাটলেট, এক প্লেট মাংস, পাঁউরুটি, ডিমের মামলেট, পুডিং, কেক, চা—তিনি কিছু বাদ দিলেন না। আমাকে দেখিয়ে বললেন—এই, বাবুকো ওয়াস্তে এক প্লেট মাটন আউর তিন পিস—
আমি সবিনয়ে বললাম—আমার শরীর তো জানেন পূর্ণবাবু, ওসব কিছু আমি–
–আরে, তা হোক, শরীর শরীর করলে কী চলে! খান খান—মাংসটা বেশ করেছে—কলকাতায় মাংস রাঁধতে জানে না মশাই রেস্টোরেন্ট—আমি ঝাল পছন্দ করি, কলকাতায় শুধু মিষ্টি খেয়ে দেখুন মাংসটা–কাটলেটেও এরা কাঁচালঙ্কা বাটা দিয়েচে-ভারি চমৎকার খেতে—এই বয়…আউর দুটো কাটলেট–
কথাটা শেষ হবার আগেই তাঁর বেজায় কাশির বেগ হল—কাশতে কাশতে দম আটকে যায় আর কী!
একটু সামলে বললেন—বড্ড ঠান্ডা লেগেছে মহালে—সেইজন্যে বেশ একটু গরম চা–চপ খেয়ে দেখবেন? ভারি চমৎকার চপ করেছে! এই বয়,–
আমি কথাটা মুখ ফুটে বললাম—পূর্ণবাবু, আপনার শরীরে এসব খাওয়া উচিত নয়—আর এ ধরনের দোকান তো খুব ভালো নয়! চা বরং এক কাপ খান, কিন্তু এত—এগুলো খেলে—
পূর্ণবাবু হেসে উড়িয়ে দিলেন—খাব না বলেন কী রামরতনবাবু, খাবার জন্যেই সব। শরীরকে ভয় করলেই ভয়, ওসব ভাবলে কী আর—আপনিও যেমন।
রেস্টোরেন্ট থেকে বার হয়ে এসে আমায় নীচু স্বরে বললেন—কিছু মনে করবেন না রামরতনবাবু, একসঙ্গে অনেকদিন কাজ করেছি এক জায়গায়, এখানে কোনো ভালো বাইজির বাড়ি-টাড়ি জানা আছে? থাকে তো চলুন না, আজ রাতটা —শুনেছি পশ্চিমে নাকি ভালো ভালো—কলকাতায় না-হয় আজ না-ই গেলাম–
আমি বুঝিয়ে বললাম, পশ্চিমের যেসব জায়গায় ভালো বাইজি থাকে, গয়া সে তালিকায় পড়ে না। বিহারের কোথাও নয়। কাশি, লক্ষৌ, দিল্লি ওদিকেই সত্যিকার বাইজি বলতে যা বোঝায় তা আছে।
পূর্ণবাবু বললেন—পাটনাতে নেই?
—আমার তাই মনে হয়।
—এদিকে আর কোথাও নেই? না-হয় এমনি আর কোথাও—
কোথাও কিছু নেই। আমি ঠিক জানি।
পূর্ণবাবু ওয়েটিংরুমে ঢুকে আমায় বসতে বললেন। পূর্ণবাবুকে আরও বেশি বৃদ্ধ দেখাচ্ছিল। আমি তাঁর বাড়িতে কে কেমন আছে জিজ্ঞেস করলাম। থাইসিসের রোগী সেই মেয়েটিকে বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা করাচ্ছেন, বড়ো ছেলেটি বাপের সঙ্গে ঝগড়া করে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েচে আজ বছর দুই—সম্পত্তি পাবার আগেই। কাগজে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে তার খোঁজ করেছেন। অনেকক্ষণ পর্যন্ত এসব গল্প শুনলাম বসে বসে। পূর্ণবাবু গল্পের মধ্যে আরও দু-বার চা আনিয়ে খেলেন, ব্যাগ খুলে ওষুধ খেলেন তিন-চার রকম, কোনোটা কবিরাজি, কোনোটা বিলেতি পেটের ওষুধ। দু-প্যাকেট সিগারেট শেষ করলেন।
দেখলাম পূর্ণবাবু চিরবঞ্চিত জীবনের সর্বগ্রাসী তৃষ্ণার ভোগলালসা মেটাতে উদ্যত হয়েচেন বিকারের রোগীর মতো। চারিধারে ঘনায়মান মৃত্যুর ছায়ার মধ্যে স্বল্পতৈল জীবনদীপের আলো যত সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর জ্যোতি :বৃত্তের সৃষ্টি করেচে, উনি ততই উন্মাদ আগ্রহে যেখানে যা পাবার আছে পেতে চান—যা নেবার আছে নিতে চান। জীবনে ওঁর যখন সুবৃষ্টি এল, জল না-পেয়ে তখন তা আধ-মরা। সেই এল—কিন্তু এত দেরি করে ফেললে!
* * * *
আমায় বললেন—একটু কিছু বাড়াবাড়ি খেলেই, ওষুধ খেয়ে রাখি। আর হজম করতে পারি-নে এখন। আমাদের পাড়ায় আছে গদাধর কবরেজ…খুব ভালো চিকিচ্ছে করে, একহপ্তার ওষুধ নেয় দু-টাকা—তারই কাছে ভাবছি এবার। পূর্ণবাবুর সেই নিমপাতাবাটা মেখে ভাত খাওয়ার কথা আমার মনে পড়ল, আরও মনে পড়ল পূর্ণবাবুর প্রথম জীবনের শৌখিনতার কথা। এখন তিনি বুঝেছেন আর বেশি দিন বাঁচবেন না, চিরবঞ্চিত জীবনের সর্বগ্রাসী তৃষ্ণার ভোগলালসা তাঁর বিকারের রোগীর মতো অসংযত, অবুঝ।
শান্তিরামকে গল্পটা বলব ভেবেছিলাম, কিন্তু সে দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্চে।
উপেক্ষিতা
পথে যেতে যেতেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়।
সে বোধ হয় বাংলা দুই কী তিন সালের কথা। নতুন কলেজ থেকে বার হয়েছি, এমন সময় বাবা মারা গেলেন। সংসারের অবস্থা ভালো ছিল না, স্কুলমাস্টারি নিয়ে গেলুম হুগলি জেলার একটা পাড়াগাঁয়ে। …গ্রামটির অবস্থা একসময়ে খুব ভালো থাকলেও আমি যখন গেলুম তখন তার অবস্থা খুব শোচনীয়। খুব বড়ো গ্রাম, অনেকগুলি পাড়া, গ্রামের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত বোধ হয় এক ক্রোশেরও ওপর। প্রাচীন আম-কাঁটালের বনে সমস্ত গ্রামটি অন্ধকার।
আমি ওগ্রামে থাকতুম না। গ্রাম থেকে প্রায় এক মাইল দূরে সে-গ্রামের রেলস্টেশন। স্টেশনমাস্টারের একটি ছেলে পড়ানোর ভার নিয়ে সেই রেলের P.W.D.-এর একটা পরিত্যক্ত বাংলোয় থাকতুম। চারিদিকে নির্জন মাঠ, মাঝে মাঝে তালবাগান। স্কুলটি ছিল গ্রামের ও-প্রান্তে। মাঠের মধ্যে নেমে হেঁটে যেতুম প্রায় এক ক্রোশ।
একদিন বর্ষাকাল, বেলা দশটা প্রায় বাজে, স্কুলে যাচ্ছি। সোজা রাস্তা দিয়ে না গিয়ে একটু শীঘ্র যাবার জন্য পাড়ার ভেতর দিয়ে একটা রাস্তা নেমে গিয়েছে সেইটে দিয়ে যাচ্ছি। সমস্ত পথটা বড়ো বড়ো আম-কাঁটালের ছায়ায় ভরা। একটু আগে খুব একপশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল, আকাশ মেঘে আচ্ছন্ন ছিল। গাছের ডাল থেকে টুপটুপ করে বৃষ্টির জল ঝরে পড়ছিল। একটা জীর্ণ ভাঙা ঘাটওয়ালা প্রাচীন পুকুরের ধার দিয়ে রাস্তা। সেই রাস্তা বেয়ে যাচ্ছি, সেই সময় কে একটি স্ত্রীলোক, খুব টকটকে রংটা, হাতে বালা অনন্ত, পরনে চওড়া লালপাড় শাড়ি, বয়স চব্বিশ পঁচিশ হবে, পাশের একটা সরু রাস্তা দিয়ে ঘড়া নিয়ে উঠলেন আমার সামনের রাস্তায়। বোধ হয় পুকুরে যাচ্ছিলেন জল আনবার জন্যে। আমায় দেখে ঘোমটা টেনে পথের পাশে দাঁড়ালেন। আমি পাশকাটিয়ে জোরে চলে গেলুম। আমার এখন স্বীকার করতে লজ্জা হয়, কিন্তু তখন আমি ইউনিভার্সিটির সদ্যপ্রসূত গ্র্যাজুয়েট, বয়স সবে কুড়ি, অবিবাহিত। সংস্কৃত কাব্যসাহিত্যের পাতায় পাতায় যেসব তরলিকা, মঞ্জুলিকা, বাসন্তী—উজ্জয়িনীবাসিনী অগুরু-বাস-মোদিত-কেশা তরুণী অভিসারিকার দল, তারা—আর তাদের সঙ্গে ইংরেজি কাব্যের কত Althea, কত Genevieve, Theosebia তাদের নীল নয়ন আর তুষারধবল কোমল বাহুবল্লি নিয়ে আমার তরুণ মনের মধ্যে রাতদিন একটা সুমিষ্ট কল্পলোকের সৃষ্টি করে রেখেছিল। তাই সেদিন সেই সুশ্রী তরুণী রূপ, তাঁর বালা অনন্ত-পরা অনাবৃত হাতদুটির সুঠাম সৌন্দর্য আর সকলের ওপর তাঁর পরনের শাড়ি দ্বারা নির্দিষ্ট তাঁর সমস্ত দেহের একটা মহিমান্বিত সীমারেখা আমাকে মুগ্ধ এবং অভিভূত করে ফেললে। আমার মনের ভিতর এক প্রকারের নূতন অনুভূতি, আমার বুকের রক্তের তালে তালে সেদিন একটা নূতন স্পন্দন আমার কাছে বড়ড়া স্পষ্ট হয়ে উঠল।
বিকালবেলা রেললাইনের ধারে মাঠে গিয়ে চুপ করে বসে রইলুম। তালবাগানের মাথার ওপর সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। বেগুনি রং-এর মেঘগুলো দেখতে দেখতে ক্রমে ধূসর, পরেই আবার কালো হয়ে উঠতে লাগল। আকাশের অনেকটা জুড়ে মেঘগুলো দেখতে হয়েছিল যেন একটা আদিম যুগের জগতের উপরিভাগের বিস্তীর্ণ মহাসাগর। …বেশ কল্পনা করে নেওয়া যাচ্ছিল, সেই সমুদ্রের চারিপাশে একটা গাঢ় রহস্যভরা অজ্ঞাত মহাদেশ, যার অন্ধকারময় বিশাল অরণ্যানীর মধ্যে প্রাচীন যুগের লুপ্ত অতিকায় প্রাণীরা সব ঘুরে বেড়াচ্ছে।
দিন কেটে গিয়ে রাত হল। বাসায় এসে Keats পড়তে শুরু করলুম। পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, মাটির প্রদীপের বুক পুড়ে উঠে প্রদীপ কখন নিভে গিয়েছে। অনেক রাত্রে উঠে দেখলুম বাইরে টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে… আকাশ মেঘে অন্ধকার।…
তার পরদিনও পাড়ার ভেতর দিয়ে গেলুম। সেদিন কিন্তু তাঁকে দেখলুম না। আসবার সময়ও সেখান দিয়েই এলুম, কাউকে দেখলুম না। পরদিন ছিল রবিবার। সোমবার দিন আবার সেই পথ দিয়েই গেলুম। পুকুরটার কাছাকাছি গিয়েই দেখি যে তিনি জল নিয়ে ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে উঠছেন, আমায় দেখে ঘোমটা টেনে দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।… আমার বুকের রক্তটা যেন দুলে উঠল, খুব জোরে হেঁটে বেরিয়ে গেলুম।…রাস্তার বাঁকের কাছে গিয়ে ইচ্ছা আর দমন করতে না-পেরে একবার পিছন ফিরে তাকালুম, দেখি তিনি ঘাটের ওপর উঠে ঘোমটা খুলে কৌতূহলী নেত্রে আমার দিকেই চেয়ে রয়েছেন, আমি চাইতেই ঘোমটা আবার টেনে দিলেন।
ওপরের পথটা ছেড়েই দিলুম একেবারে। পুকুরের পথ দিয়েই রোজ যাই। দু একদিন পরে আবার একদিন তাঁকে দেখতে পেলুম। আমার মনে হল সেদিনও তিনি আমায় একটু আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ করলেন। এইভাবে পনেরো-কুড়ি দিন কেটে গেল। কোনোদিন তাঁকে দেখতে পাই, কোনোদিন পাই না। আমার কিন্তু বেশ মনে হতে লাগল, তিনি আমার প্রতি দিন দিন আগ্রহান্বিতা হয়ে উঠছেন। আজকাল ততটা স্তভাবে ঘোমটা দেন না। আমারও কি হল—তাঁর গতি-ভঙ্গির একটা মধুর শ্রী, তাঁর দেহের একটা শান্ত কমনীয়তা, আমায় দিন দিন যেন অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে ফেলতে লাগল।
একদিন তখন আশ্বিন মাসের প্রথম, শরৎ পড়ে গিয়েছে… নীল আকাশের সাদা সাদা লঘু মেঘখণ্ড উড়ে যাচ্ছে… চারিদিকে খুব রৌদ্র ফুটে উঠেছে… রাস্তার পাশের বনকচু, ভাঁট শ্যাওড়া, কুঁচলতার ঝোপ থেকে একটা কটুতিক্ত গন্ধ উঠছে।… শনিবার সকাল সকাল স্কুল থেকে ফিরছি। রাস্তা নির্জন, কেউ কোনো দিকে নেই। পুকুরটার পথ ধরেছি, একদল ছাতারে পাখি পুকুরের ওপারের ঝোপের মাথায় কিচ কিচ করছিল, পুকুরের জলের নীল ফুলের দলগুলো রৌদ্রতাপে মুড়ে ছিল। আমি আশা করিনি এমনসময় তিনি পুকুরের ঘাটে আসবেন। কিন্তু দেখলুম তিনি জল ভরে উঠে আসছেন। এর আগে চার-পাঁচ দিন তাঁকে দেখিনি, হঠাৎ মনে কী হল, একটা বড়ো দুঃসাহসের কাজ করে বসলুম। তাঁর কাছে গিয়ে বললুম— দেখুন, কিছু মনে করবেন না আপনি। আমি এখানকার স্কুলে কাজ করি, রোজ এই পথে যেতে যেতে আপনাকে দেখতে পাই, আমার বড় ইচ্ছে করে আপনি আমার বোন হন। আমি আপনাকে বউদিদি বলব, আমি আপনার ছোটো ভাই। কেমন তো? তিনি আমার কথার প্রথম অংশটায় হঠাৎ চমকে উঠে কেমন জড়োসড়ো হয়ে উঠেছিলেন, দ্বিতীয় অংশটায় তাঁর সে চমকানো ভাবটা একটু দূর হল। ঘড়া-কাঁখে নীচু চোখে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি যুক্তকরে প্রণাম করে বললুম-বউদিদি, আমার এ ইচ্ছা আপনাকে পূর্ণ করতে হবে। আমাকে ছোটো ভাইয়ের অধিকার দিতেই হবে আপনাকে।
তিনি ঘোমটা অর্ধেকটা খুলে একটা স্থির শান্তদৃষ্টিতে আমার দিকে চাইলেন। সুশ্রী মুখ যে আমি কখনো দেখিনি তা নয়, তবুও মনে হল তাঁর ডাগর কালো চোখদুটির শান্তভাব আর তাঁর ঠোঁটের নীচের একটা বিশেষ ভাঁজ, এই দুটিতে মিলে তাঁর সুন্দর মুখের গড়নে এমন এক বৈচিত্র্য এনেছে, যা সচরাচর চোখে পড়ে না।
খানিকক্ষণ দুজনেই চুপ করে রইলুম। তারপর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন তোমার বাড়ি কোথায়?
আনন্দে সারা গা কেমন শিউরে উঠল। বললুম-কলকাতার কাছে, চব্বিশ পরগনা জেলায়। এখানে স্টেশনে থাকি।
তিনি জিজ্ঞাসা করলেন—তোমার নাম কী?
নাম বললুম।
তিনি বললেন—তোমার বাড়িতে কে কে আছেন?
বললুম—এখন বাড়িতে শুধু মা আর দুটি ছোটো ছোটো ভাই আছে। বাবা এই দু-বৎসর মারা গিয়েছেন।
তিনি একটু যেন আগ্রহের সুরে বললেন—তোমার কোনো বোন নেই?
আমি বললুম—না। আমার দুজন বড়ো বোন ছিলেন, তাঁরা অনেকদিন মারা গিয়েছেন। বড়দি যখন মারা যান তখন আমি খুব ছোটো, মেজদি পাঁচ-ছ বৎসর মারা গিয়েছেন। আমি এই মেজদিকেই জানতুম, তিনি আমায় বড়ো ভালোবাসতেন। তিনি আমার চেয়েও ছয় বৎসরের বড়ো ছিলেন।
তাঁর দৃষ্টি একটু ব্যথা-কাতর হয়ে এল, জিজ্ঞাসা করলেন—তোমার মেজদি থাকলে এখন তাঁর বয়স হত কত?
বললুম—এই ছাব্বিশ বছর।
তিনি একটু মৃদু হাসির সঙ্গে বললেন—তাই বুঝি ভাইটির আমার একজন বোন খুঁজে বেড়ানো হচ্ছে, না?
কী মিষ্টি হাসি! কী মধুর শান্ত ভাব! মাথা নীচু করে প্রণাম করে তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে বললুম—তা হলে ভাইয়ের অধিকার দিলেন তো আপনি?
তিনি শান্ত হাসিমাখা মুখে চুপ করে রইলেন।
আমি বললুম-বউদি, আমি জানতুম আমি পাব। আগ্রহের সঙ্গে খুঁজলে ভগবানও নাকি ধরা দেন, আমি একজন বোন অনায়াসেই পাব। আচ্ছা এখন আসি। আপনি কিন্তু ভুলে যাবেন না বউদি, আপনার যেন দেখা পাই। রবিবার বাদে আমি দু-বেলাই এ রাস্তা দিয়ে যাব।
আমার মাঠের ধারের তালবাগানটার পাখিগুলো রোজই সকাল-বিকাল ডাকে। একটা কী পাখি তার সুর খাদ থেকে ধাপে ধাপে তুলে একেবারে পঞ্চমে চড়িয়ে আনে। মন যেদিন ভারী থাকে সেদিন সে সুরের উদাস মাধুর্য প্রাণের মধ্যে কোনো সাড়া দেয় না।… আজ দেখলুম পাখিটার গানের সুরের স্তরে স্তরে হৃদয়টা কেমন লঘু থেকে লঘুতর হয়ে উঠছে।… মনে হতে লাগল জীবনটা কেবল কতকগুলো স্নিগ্ধ ছায়াশীতল পাখির গানে ভরা অপরাহের সমষ্টি, আর পৃথিবীটা শুধু নীল আকাশের তলায় ইতস্তত বর্ধিত অযত্ন-সম্ভুত তাল-নারিকেল গাছের বন দিয়ে তৈরি—যাদের ঈষৎ কম্পমান দীর্ঘ শ্যামল পত্ৰশীর্ষ অপরাহ্রে অবসন্ন রৌদ্রে চিকচিক করছে।
তার পরদিন বউদিদির সঙ্গে দেখা হল ছুটির পর বিকালবেলা। বউদিদি যেন চাপা হাসির সুরে জিজ্ঞাসা করলেন—এই যে, বিমলের বুঝি আজ খুব সকাল সকাল স্কুলে যাওয়া হয়েছিল!
আমি উত্তর দিলুম—বেশ বউদি, আমি ওবেলা তো ঠিক সময়েই গেলুম— আপনিই ছিলেন না, এখন দোষটা বুঝি আমার ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে, না? আর বউদি, ঘাটে ওবেলা আরও সব মেয়েরা ছিলেন।
বউদিদি হেসে ফেললেন, বললেন—তাই তো! ভাইটির আমার ওবেলা তো বড়ো বিপদ গিয়েছে তা হলে!
আমার একটু লজ্জা হল, ভালো করে জবাব দিতে না-পেরে বললুম—তা নয় বউদি, আমি এখানে অপরিচিত, পাড়ার মধ্যে দিয়ে পথ—পাছে কেউ কিছু মনে করে!
বউদিদির চোখের কৌতুক-দৃষ্টি তখনও যায়নি, তিনি বললেন—আমি ওবেলা ঘাটের জলেই ছিলাম বিমল। তুমি ওই চটকা গাছটার তলায় গিয়ে একবার ঘাটের দিকে চেয়ে দেখলে, আমায় তুমি দেখতে পাওনি।
আমি জিজ্ঞাসা করলুম—বউদি, আপনার বাপেরবাড়ি কোথায়?
বউদিদি উত্তর দিলেন, খোলাপোতা চেনো? সেই খোলাপোতায়।
আমি ইতস্তত করছি দেখে আমায় আর একটু বিশদ সংবাদ দিয়ে বললেন, ওই যে খোলাপোতার রাস! বউদিদির হাসিভরা দৃষ্টি যেন একটু গর্বমিশ্রিত হয়ে উঠল। কিন্তু বলা আবশ্যক যে, খোলাপোতা বলে কোনো গ্রামের নাম এই আমি প্রথম শুনলুম। অথচ বউদির বাপেরবাড়ি, যেখানে এমন রাস হয়, সেই বিশ্ববিশ্রুত খোলাপাতার ভৌগোলিক অবস্থান সম্বন্ধে আমার অজ্ঞতা পাছে তাঁর মনে ব্যথা দেয়, এই ভয়ে বলে ফেললুম—ও! সেই খোলাপোতায়? ওটা কোন জেলায় ভালো…
বউদিদির কাছ থেকে সাহায্য পাবার প্রত্যাশা করেছিলুম কিন্তু দেখলুম তিনি সে বিষয়ে নির্বিকার। তাঁর হাসিভরা সরল মুখখানির দিকে চেয়ে আমার করুণা হল, এ-সমস্ত জটিল ভৌগোলিক তত্বের মীমাংসা নিয়ে তাঁকে পীড়িত করতে আর আমার মন সরল না।
বললুম—আচ্ছা বউদি, আসি তাহলে।
বউদিদি তাড়াতাড়ি ঘড়ার মুখ থেকে কলার পাতে মোড়া কী বার করলেন। সেইটে আমার হাতে দিয়ে বললেন—কাল চাপড়া ষষ্ঠীর জন্যে ক্ষীরের পুতুল তৈরি করেছিলাম, আর গোটাকতক কলার বড়া আছে, বাসায় গিয়ে খেও।
চার-পাঁচ দিন জ্বর ভোগের পর একদিন পথ্য পেয়ে স্কুলে যাচ্ছি, বউদিদির সঙ্গে দেখা। আমায় আসতে দেখে বউদিদি উৎসুক দৃষ্টিতে অনেকদ্দূর থেকে আমার দিকে চেয়েছিলেন। নিকটে যেতে জিজ্ঞাসা করলেন—এ কি বিমল, এমন মুখ শুকনো কেন?
বললুম-জ্বর হয়েছিল বউদিদি।
বউদিদি উদবেগের সুরে বললেন—ও, তাই তুমি চার-পাঁচদিন আসনি বটে। আমি ভাবলাম, বোধ হয় কীসের ছুটি আছে। আহা তাই তো, বড্ড রোগা হয়ে গিয়েছ যে বিমল।
তাঁর চোখের দৃষ্টিতে একটা সত্যিকারের ব্যথামিশ্রিত স্নেহের আত্মপ্রকাশ বেশ বুঝতে পেরে মনের মধ্যে একটা নিবিড় আনন্দ পেলুম। হেসে বললুম—যে দেশ আপনাদের বউদি, একবার অতিথি হলে আপ্যায়নের চোটে একেবারে অস্থির করে তুলবে।
বউদিদি জিজ্ঞাসা করলেন—আচ্ছা বিমল, ওখানে তোমায় বেঁধে দেয় কে?
আমি বললুম—কে আর রাঁধবে, আমি নিজেই।
বউদিদি একটু চুপ করে রইলেন, তারপর বললেন—আচ্ছা বিমল, এক কাজ করো না কেন?
আমি জিজ্ঞাসা করলুম—কী বউদি?
তিনি বললেন—মাকে এই পুজোর ছুটির পর নিয়ে এসো। এরকমভাবে কী করে বিদেশে কাটাবে বিমল? লক্ষ্মীটি, ছুটির পর মাকে অবিশ্যি করে নিয়ে এসো। এই গাঁয়ের ভেতর অনেক বাড়ি পাওয়া যাবে। আমাদের পাড়াতেই আছে। না হলে অসুখ হলে কে একটু জল দেয়? আচ্ছা হ্যাঁ বিমল, আজ যে পথ্য করলে, কে বেঁধে দিলে?
আমার হাসি পেল, বললুম—কে আবার দেবে বউদি? নিজেই করলুম।
তিনি আমার দিকে যেন কেমনভাবে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলেন। তাঁর সেদিনকার সেই সহানুভূতি-বিগলিত স্নেহমাখানো মাতৃমুখের জলভরা কালো চোখদুটি পরবর্তী জীবনে আমার অনেকদিন পর্যন্ত মনে ছিল।…
সেদিন স্কুল থেকে আসবার সময় দেখি, বউদিদি যেন আমার জন্যেই অপেক্ষা করছেন। আমায় দেখে কলার পাতায় মোড়া কী একটা আমার হাতে দিয়ে বললেন—শরীরটা একটু না–সারলে, রাত্রে গিয়ে রান্না, সে পেরে উঠবে না বিমল। এই খাবার দিলাম, রাত্রে খেও…।
বোধ হয় একটু আগেই তৈরি করে এনেছিলেন, আমি হাতে বেশ গরম পেলুম। বাসায় এসে কলার পাতা খুলে দেখি, খানকতক রুটি, মোহনভোগ, আর মাছের একটা ডালনা মতো।
তার পরদিন ছুটির পর আসবার সময়ও দেখি বউদিদি খাবার হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, আমার হাতে দিয়ে বললেন—বিমল, তুমি তোমার ওখানে দুধ নাও?
আমি বললুম—কেন, তাহলে দুধও খানিকটা করে দেন বুঝি? সত্যি বলছি বউদি, আপনি আমার জন্য অনর্থক এ কষ্ট করবেন না, তা হলে এ রাস্তায় আমি আর আসছি না।
বউদিদির গলা ভারী হয়ে এল, আমার ডান হাতটা আস্তে আস্তে এসে ধরে ফেললেন, বললেন—লক্ষ্মী ভাই, ছিঃ ও-কথা বোলো না। আচ্ছা, আমি যদি তোমার মেজদিই হতাম, তা হলে এ কথা কী আজ আমায় বলতে পারতে? আমার মাথার দিব্যি রইল, এ পথে রোজ যেতেই হবে।
সেই দিন থেকেই বউদিদি রোজ রাত্রের খাবার দেওয়া শুরু করলেন। সাত আট দিন পরে রুটির বদলে কোনোদিন লুচি, কোনোদিন পরোটা দেখা দিতে লাগল। তাঁর সে আগ্রহভরা মুখের দিকে চেয়ে আমি তাঁর সেসব স্নেহের দান ঠিক অস্বীকারও করতে পারতুম না, অথচ এই ভেবে অস্বস্তি বোধ করতুম যে আমার এই নিত্য খাবার জোগাতে না-জানি বউদিদিকে কত অসুবিধাই পোহাতে হচ্ছে। তার পরই আশ্বিন মাসের শেষে পুজোর ছুটি এসে পড়াতে আমি নিষ্কৃতি পেলুম।
সমস্ত পুজোর ছুটিটা কী নিবিড় আনন্দেই কাটল সেবার। আমার আকাশ-বাতাস যেন রাতদিন আফিমের রঙিন ধূমে আচ্ছন্ন থাকত। ভোরবেলা উঠোনের শিউলিগাছের সাদাফুল বিছানো তলাটা দেখলে—হেমন্ত রাত্রির শিশিরে ভেজা ঘাসগুলোর গা যেমন শিউরে আছে, ওইরকম আমার গা শিউরে উঠত…কার ওপর আমার জীবনের সমস্ত ভার অসীম নির্ভরতার সঙ্গে চাপিয়ে দিয়ে আমার মন যেন শরতের জলভরা নামানো হালকা মেঘের মতো একটা সীমাহারা হাওয়ার রাজ্যে ভেসে বেড়াতে লাগল।
ছুটি ফুরিয়ে গেল। প্রথম স্কুল খোলবার দিন পথে তাঁকে দেখলুম না। বিকালে যখন ফিরি, তখন শীতল হাওয়া একটু একটু দিচ্ছে।…পথের ধারের এক জায়গায় খানিকটা মাটি কারা বর্ষাকালে তুলে নিয়েছিল, সেখানটায় এখন বনকচু, কাল কাসুন্দা, ধুতুরা, কুচকাঁটা, ঝুমকো লতার দল পরস্পর জড়াজড়ি করে একটুখানি ছোটো ছোটো ঝোপ মতো তৈরি করেছে…শীতল হেমন্ত অপরাহের ছায়া-সবুজ ঝোপটির ওপর নেমে এসেছে…এমন একটা মিষ্টি নির্মল গন্ধ গাছগুলো থেকে উঠছে, এমন সুন্দর শ্রী হয়েছে ঝোপটির, সমস্ত ঝোপটি যেন বনলক্ষ্মীর শ্যামলা শাড়ির একটা অঞ্চল-প্রান্তের মতো।
তার পরদিন তাঁকে দেখলুম। তিনি আমায় লক্ষ করেননি, আপন-মনে ঘাটের চাতালে উঠতে যাচ্ছিলেন। আমি ডাকলুম-বউদি!…বউদিদি কেমন হঠাৎ চমকে উঠে আমার দিকে ফিরলেন।
—এ কি বিমল! কবে এলে? আজ কী স্কুল খুলল? কীরকম আছ?…সেই পরিচিত প্রিয় কণ্ঠস্বরটি। সেই স্নেহ-ঝরা শান্ত চোখ দুটি! বউদিদি আমার মনে
ছুটির আগে যে স্থান অধিকার করেছিলেন, ছুটির পরের স্থানটা তার চেয়ে আরও ওপরে।… আমি সমস্ত ছুটিটা তাঁকে ভেবেছি, নানামূর্তিতে নানা অবস্থায় তাঁকে কল্পনা করেছি, নানা গুণ তাঁতে আরোপ করেছি, তাঁকে নিয়ে আমার মুগ্ধ মনের মধ্যে অনেক ভাঙা-গড়া করেছি। আমার মনের মন্দিরে আমারই শ্রদ্ধা ভালোবাসায় গড়া তাঁর কল্পনামূর্তিকে অনেক অর্ঘ্যচন্দনে চৰ্চিত করেছি। তাই সেদিন যে বউদিদিকে দেখলুম, তিনি পূজার ছুটির আগেকার সে বউদিদি নন, তিনি আমার সেই নির্মলা, পূহৃদয়া পূণ্যময়ী মানসী প্রতিমা, আমার পার্থিব বউদিদিকে তিনি তাঁর মহিমাখচিত দিব্য বসনের আচ্ছাদনে আবৃত করে রেখেছিলেন, তাঁর স্নেহ করুণার জ্যোতির্বাষ্পে বউদিদির রক্তমাংসের দেহটার একটা আড়াল সৃষ্টি করেছিলেন।
আমার মাথা শ্রদ্ধায় সম্ভমে নত হয়ে পড়ল, আমি তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করলুম। বউদিদি বললেন—এসো এসো ভাই, আর প্রণাম করতে হবে না, আশীর্বাদ করছি এমনিই—রাজা হও। আচ্ছা বিমল, বাড়ি গিয়ে আমার কথা মনে ছিল?
মনে এলেও বাইরে আর বলতে পারলুম না—কে তবে আমার মগ্ন চৈতন্যকে আশ্রয় করে আমার নিত্যসুষুপ্তির মধ্যেও আমার সঙ্গিনী ছিল বউদি?…শুধু একটু হেসে চুপ করে রইলুম। বউদিদি জিজ্ঞাসা করলেন—মা ভালো আছেন?
আমি উত্তর দিলুম—হ্যাঁ বউদি, তিনি ভালো আছেন। তাঁকে আপনার কথা বললুম।
বউদিদি আগ্রহের সুরে বললেন—তিনি কী বললেন?
আমি বললুম—শুনে মার দুই চোখ জলে ভরে এল, বললেন—একবার দেখাবি তাকে বিমল? আমার নলিনীর শোক বোধ হয় তাকে দেখলে অনেকটা নিবারণ হয়।
বউদিদিরও দেখলুম দুই চোখ ছলছল করে এল, আমায় বললেন, হ্যাঁ বিমল, তা মাকে এই মাসে নিয়ে এলে না কেন?
আমি বললুম—সে এখন হয় না বউদি।
বউদিদি একটু ক্ষুব্ধ হলেন, বললেন—বিমল, জানো তো সেবার কীরকম কষ্টটা পেয়েছ! এই বিদেশ বিভুই, মাকে আনলে এই মিথ্যে কষ্টটা তো আর ভোগ করতে হয় না!
আমি উত্তর দিলুম—বউদি, আমি তো আর ভাবিনি যে আমি বিদেশে আছি, যেখানে আমার বউদি রয়েছেন, সে দেশ আমার বিদেশ নয়। মা না-থাকলেও আমার এখানে ভাবনা কীসের বউদি?
বউদিদির চোখে লজ্জা ঘনিয়ে এল, আমার দিকে ভালো করে চাইতে পারলেন, বললেন—হ্যাঁ, আমি তো সবই করছি। আমার কী কিছু করবার জো আছে? কত পরাধীন আমরা তা জানো তো ভাই! ওসব নয়, তুমি এই মাসেই মাকে আনো।
আমি কথাটাকে কোনোরকমে চাপা দিয়ে সেদিন চলে এলুম।
তার পরদিন ছুটির পর বউদিদির সঙ্গে দেখা। অন্যান্য কথাবার্তার পর আসবার সময় তিনি কলারপাতে মোড়া আবার কী একটা বার করলেন। তাঁর হাতে কলারপাত দেখলেই আমার ভয় হয়; আমি শঙ্কিতচিত্তে বলে উঠলুম—ও আবার কী বউদি? আবার সেই…
বউদিদি বাধা দিয়ে বললেন—আমার কি কোনো সাধ নেই বিমল? ভাইফোঁটাটা অমনি অমনি গেল, কিছু কী করতে পারলুম? কলার পাতা মোড়া রহস্যটি আমার হাতে দিয়ে বললেন—এতে একটু মিষ্টিমুখ করো, আর এইটে নাও—একখানা কাপড় কিনে নিও।
কথাটা ভালো করে শেষ না-করেই বউদি আমার হাতে একখানা দশ টাকার নোট দিতে এলেন। আমি চমকে উঠলুম, বললুম—এ কী বউদি, না না, এ কিছুতেই হবে না; খাবার আমি নিচ্ছি, কিন্তু টাকা নিতে পারব না।
আমার কথাটার স্বর বোধ হয় একটু তীব্র হয়ে পড়েছিল, বউদিদি হঠাৎ থতোমতো খেয়ে গেলেন, তাঁর প্রসারিত হাতখানা ভালো করে যেন গুটিয়ে নিতেও সময় পেলেন না, যেন কেমন হয়ে গেলেন। তারপর একটুখানি অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে থাকবার পরই তাঁর টানা কালো চোখদুটি ছাপিয়ে বাঁধ ভাঙা বন্যার স্রোতের মতো জল গড়িয়ে পড়ল; আমার বুকে যেন কীসের খোঁচা বিঁধল।
এই নিতান্ত সরলা মেয়েটির আগ্রহভরা স্নেহ-উপহার রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে তাঁর বুকে যে লজ্জা আর ব্যথার শূল বিদ্ধ করলুম, সে ব্যথার প্রতিঘাত
অদৃশ্যভাবে আমার নিজের বুকে গিয়েও বাজল!
আমি তাড়াতাড়ি দুই হাতে তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে তাঁর হাত থেকে নোটখানা ও খাবার দুই-নিয়ে বললুম—বউদি, ভাই বলে এ অপরাধ এবারটা মাপ করুন আমার। আর কখনো আপনার কথার অবাধ্য হব না।
বউদিদির চোখের জল তখনও থামেনি।
দুই চোখ জলে ভরা সে তরুণী দেবীমূর্তির দিকে ভালো করে চাইতে না-পেরে আমি মাথা নীচু করে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে রইলুম।
বাড়ি এসে দেখলুম, কলারপাতের মধ্যে কতকগুলো দুগ্ধশুভ্র চন্দ্রপুলি, সুন্দর করে তৈরি। সমস্ত রাত ঘুমের ঘোরে বউদিদির বিষণ্ণ-কাতর দৃষ্টি বারবার চোখের সামনে ভাসতে লাগল।
মাসখানেক কেটে গেল।
প্রায়ই বউদিদির সঙ্গে দেখা হত। এখন আমরা ভাই-বোনের মতো হয়ে উঠেছিলুম, সেই রকমই পরস্পরকে ভাবতুম। একদিন আসছি, ফ্লানেল শার্টের একটা বোতাম আমার ছিল না। বউদি জিজ্ঞাসা করলেন—এ কী, বোতাম কোথায় গেল?
আমি বললুম—সে কোথায় গিয়েছে বউদি, বোতাম পরাতে জানিনে কাজেই ওই অবস্থা।
তার পরদিন দেখলুম, তিনি ছুঁচ-সুতো-বোতাম সমেতই এসেছেন। আমি বললুম—বউদি, এটা ঘাটের পথ, আপনি বোতাম পরাতে পরাতে কেউ যদি দেখে তো কী মনে করবে! আপনি বরং চুঁচটা আমায় দিন, আমি বাড়ি গিয়ে চেষ্টা করব এখন।
বউদিদি হেসে বললেন—তুমি চেষ্টা করে যা করবে তা আমি জানি, নাও সরে এসো এদিকে।
বাধ্য হয়ে সরেই গেলুম। তিনি বেশ নিশ্চিন্তভাবেই বোতাম পরাতে লাগলেন। ভয়টা দেখলুম তাঁর চেয়ে আমারই হল বেশি। ভাবলুম, বউদির তো সে কাণ্ডজ্ঞান নেই, কিন্তু যদি কেউ দেখে তো এর সমস্ত কষ্টটা ওঁকেই ভুগতে হবে।
একদিন বউদিদি জিজ্ঞাসা করলেন—বিমল, গোকুলপিঠে খেয়েছ?
আমার মা খুব ভালো গোকুলপিঠে তৈরি করতেন, কাজেই ও জিনিসটা আমি খুব খেয়েছি। কিন্তু বউদিদিকে একটু আনন্দ দেওয়ার জন্য বললুম—সে কীরকম বউদি?
আর রক্ষা নেই। তার পরদিনই বিকাল বেলা বউদিদি কলার পাতে মোড়া পিঠে নিয়ে হাজির।
আমায় বললেন—তুমি এখানে আমার সামনেই খাও। ঘড়ার জলে হাত ধুয়ে ফেলো এখন।
আমি বললুম—সর্বনাশ বউদি, এই এতগুলো পিঠে খেতে খেতে এ পথে লোক এসে পড়বে, সে হয় না, আমি বাড়ি গিয়েই খাব।
বউদি ছাড়বার পাত্রীই নন, বললেন—না, কেউ আসবে না বিমল। তুমি এখানেই খাও।
খেলুম, পিঠে খুব ভালো হয়নি। আমার মায়ের নিপুণ হাতের তৈরি পিঠের মতো নয়। বোধ হয় নতুন করতে শিখেছেন, ধারগুলো পুড়ে গিয়েছে, আস্বাদও ভালো নয়। বললুম—বাঃ বউদি, বড়ো সুন্দর তো! এ কোথায় তৈরি করতে শিখলেন? আপনার বাপেরবাড়ির দেশে বুঝি?
বউদির মুখে আর হাসি ধরে না। হাসিমুখে বললেন—এ আমি, আমাদের গুরুমা এসেছিলেন, তিনি শহরের মেয়ে, অনেক ভালো খাবার করতে জানেন, তাঁর কাছে শিখে নিয়েছিলাম।
তারপর সারা শীতকাল অন্যান্য পিঠের সঙ্গে গোকুলপিঠের পুনরাবৃত্তি চলল। ওই যে বলেছি, আমার ভালো লেগেছে, আর রক্ষা নেই।
একটা কথা আছে।
কিছুদিন ধরে আমার মনের মধ্যে একটা আগ্রহ একটু একটু করে জমছিল, জীবনটাকে খুব বড়ো করে অনুভব করবার জন্যে। আমার এ কুড়ি-একুশ বছর বয়সে এই ক্ষুদ্র পাড়াগাঁয়ে খাঁচার পাখির মতো আবদ্ধ থাকা ক্রমেই অসহ্য হয়ে উঠছিল। চলেও যেতাম এতদিন। এখানকার একমাত্র বন্ধন হয়েছিলেন বউদিদি। তাঁরই আগ্রহে স্নেহ-যত্নে সে অশান্ত ইচ্ছাটা কিছুদিন চাপা ছিল। এমন সময় মাঘ মাসের শেষের দিকে আমার এক আত্মীয় আমায় লিখলেন যে, তাঁদের কারখানা থেকে কাচের কাজ শেখবার জন্যে ইউরোপ আমেরিকায় ছেলে পাঠানো হবে, অতএব আমি যদি জীবনে কিছু করতে চাই, তবে শীঘ্ৰ যেন মোরাদাবাদ গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করি। তিনি সেখানকার কাচের কারখানার ম্যানেজার।
পত্র পেয়ে সমস্ত রাত আমার ঘুম হল না। ইউরোপ-আমেরিকা! সে কত ঊর্মি-সংগীত-মুখরিত শ্যামল সমুদ্রতট…কত অকূল সাগরের নীল জলরাশি, দূরে সবুজ বিন্দুর মতো ছোটো ছোটো দ্বীপ, ওই সিসিল! নতুন আকাশ, নতুন অনুভুতি…ডোভারের সাদা খড়ির পাহাড়—প্রশস্ত রাজপথে জনতার দ্রুত পাদচরণ, লাডগেট সার্কাস, টটেনহাম কোর্ট রোডবার্চ-উইলো পপলার মেপলগাছের সে কত শ্যামল পত্রসম্ভার, আমার কল্পলোকের সঙ্গিনী কনককেশিনী কত ক্লারা, কত মেরি, কত ইউজিনী।…
পরদিন সকালে পত্র লিখলুম—আমি খুব শীঘ্রই রওনা হব। স্কুলে সেদিনই নোটিশ দিলুম, পনেরো দিন পরে কাজ ছেড়ে দেব।
মন বড়ো ভালো ছিল না, উপরের পথটা দিয়ে কয়েকদিন গেলুম। দশ-বারো দিন পরে নীচের পথটা দিয়ে যেতে যেতে একদিন বউদিদির সঙ্গে দেখা। বউদিদি একটু অভিমান প্রকাশ করলেন—বিমল, বড়ো গুণের ভাই তো! আজ চার-পাঁচ দিনের মধ্যে বোনটা বাঁচল কী ম’ল তা খোঁজ করলে না?
আমি বললাম—বউদিদি, করলে সেটাই অস্বাভাবিক হত! বোনেরাই ভাইদের জন্যে কেঁদে মরে, ভাইয়েদের দায় পড়েছে বোনেদের ভাবনা ভাবতে। দুনিয়াসুদ্ধ ভাই-বোনেরই এই অবস্থা।
বউদিদি খিলখিল করে হেসে উঠলেন। এই তরুণীর হাসিটি বালিকার মত এমন মিষ্ট নির্মল যে এ শুধু লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতের জ্যোৎস্নার মতো উপভোগ করবার জিনিস, বর্ণনা করবার নয়। বললেন—তা জানি, জানি, নাও, আর গুমোর করতে হবে না, সে গুণ যে তোমাদের আছে তা কী আমরা ভেতরে ভেতরে বুঝি না? কিন্তু বুঝে কী করব, উপায় নেই। হ্যাঁ, তা সত্যি সত্যি মাকে কবে আনছ?
আমার কাজ ছেড়ে দেওয়ার কথা আমি বউদিদিকে কিছু বলিনি। সেকথা বললে যে তিনি মনে অত্যন্ত আঘাত পাবেন, এ আমি বুঝতে পেরেছিলুম। একবার ভাবলুম, সেই তো জানাতেই হবে, একদিন বলে ফেলি। কিন্তু অমন সরল হাসিভরা মুখ, অমন নিশ্চিন্ত শান্তির ভাব—বলতে বড়ো বাধল। মনে মনে বললুম, তোমরা কেবল বুঝি স্নেহ ঢেলে দিতেই জানো? তোমাদের স্নেহ-পাত্রদের বিদায়ের বাজনা যে বেজে উঠেছে এ সম্বন্ধে এ রকম অজ্ঞান কেন?
জিজ্ঞাসা করলুম—বউদি, একটা কথা বলি, আপনি আমায় এই অল্পদিনে এত ভালোবাসলেন কী করে? আচ্ছা আপনারা কী ভালোবাসার পাত্র-পাত্রীও দেখেন না? আমি কে বউদি যে আমার জন্যে এত করেন?
বউদিদির মুখ গম্ভীর হয়ে এল। তাঁর ওই এক বড়ো আশ্চর্য ছিল, মুখ গম্ভীর হলে প্রায়ই চোখে জল আসবে, জল কেটে গেল তো আবার হাসি ফুটবে। শরতের আকাশে রোদ-বৃষ্টি খেলার মতো। বললেন—এতদিন তোমায় বলিনি বিমল, আজ পাঁচ বছর হল আমারও ছোটো ভাই আমার মায়া কাটিয়ে চলে গিয়েছে, তারও নাম ছিল বিমল। থাকলে সে তোমারই মতো হত এতদিন। আর তোমারই মতো দেখতে। তুমি যেদিন প্রথম এ রাস্তা দিয়ে যাও, তোমায় দেখেই আমার মনের মধ্যে সমুদ্র উথলে উঠল, সেদিন বাড়ি গিয়ে আপন মনে কত কেঁদেছিলাম। তুমি এখান দিয়ে যেতে, রোজ তোমাকে দেখতাম। যেদিন তুমি আপনা হতেই দিদি বলে ডাকলে, সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত যে কী সুখে আছি তা বলতে পারিনে। তোমায় যত্ন করে, তুমি যে বড়ো বোনের মতো ভালোবাসো, তাতে আমি বিমলের শোক অনেকটা ভুলেছি। ওই এক ভাই ছিল আমার। তুলসীতলায় রোজ সন্ধ্যাবেলা কত প্রণাম করি, বলি, ঠাকুর এক বিমলকে তো পায়ে টেনে নিয়েছ, আর এক বিমলকে যদি দিলে তো এর মঙ্গল করো, একে আমার কাছে রাখো।
চোখের জলে বউদিদির গলা আড়ষ্ট হয়ে গেল। আমি কিছু বললাম না। বলব কী!
একটু পরে বউদিদি নিজেকে একটু সামলে নিয়ে জলভরা চোখ দুটি তুলে আমার মুখের দিকে চাইলেন। কী সুন্দর তাঁকে দেখাচ্ছিল। কালো চোখ দুটি ছল ছল করছে, টানা ভুরু যেন আরও নেমে এসেছে, চিবুকের ভাঁজটি আরও পরিস্ফুট, যেন কোন নিপুণ প্রতিমাকারক সরু বাঁশের চেঁচাড়ি দিয়ে কেটে তৈরি করেছে।…পথের পাশেই প্রথম ফাল্গুনের মুগ্ধ আকাশের তলায় আঁকোড় ফুলের একটা ঝোপে কাঁটাওয়ালা ডালগুলিতে থোলো থোলো সাদা ফুল ফুটে ছিল…মনের ফাঁকে ফাঁকে নেশা জমিয়ে আনে, এমনি তার মিষ্টি গন্ধ!
দুজনে অনেকক্ষণ কথা বলতে পারলুম না। খানিক পরে বউদিদি বললেন
সেইজন্যেই বলছি ভাই, মাকে আনো। আমাদের পাড়ায় চৌধুরীদের বাড়িটা পড়ে আছে। ওরা এখানে থাকে না। খুব ভালো বাড়ি, কোনো অসুবিধা হবে না, তুমি মাকে নিয়ে এসো, ওখানেই থাকো, সে তাঁদের পত্র লিখলেই তাঁরা রাজি হবেন, বাড়ি তো এমনি পড়ে আছে। তোমার বোন পরাধীন, কিছু করবার তো ক্ষমতা নেই। তোমার সঙ্গে এসব দেখাশোনা, এসব লুকিয়ে, বাড়ির কেউ জানে না। তুমি দু-বেলা ঘাটের পথ দিয়ে যেও, দেখেই আমি শান্তি পাব ভাই। মাকে এ মাসেই আনো।
কেমন করে তা হবে?
একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করলুম—বউদি, আমি এখানে থাকলে কী আপনি খুব সুখী হন?
বউদিদি বললেন—কী বলব বিমল? মাকে আনলে তোমার কষ্টটাও কম হয়, তা বুঝেও আমার সুখ! আর বেশ দুটি ভাই-বোন এক জায়গায় থাকব, বারো মাস দু-বেলা দেখা হবে, কী বলো?
আমি বললুম—ভাই যদি কোনো গুরুতর অপরাধ করে আপনার কাছে, তাকে ক্ষমা করতে পারবেন?
বউদিদি বললেন—শোনো কথার ভঙ্গি ভাইটির আমার, আমার কাছে তোমার আবার অপরাধটা কীসের শুনি?
আমি জোর করে বললুম—না বউদি, ধরুন যদি করি তাহলে?
বউদিদি আবার হেসে বললেন—না না, তা হলেও না। ছোটো ভাইটির কোনো কিছুতেই অপরাধ নেই আমার কাছে, আমি যে বড়ো বোন।
চোখে জল এসে পড়ল। আড়ষ্ট গলায় বললুম-ঠিক বউদি, ঠিক!
বউদি অবাক হয়ে গেলেন, বললেন—বিমল, কী হয়েছে ভাই! অমন করছ কেন?
মুখ ফিরিয়ে আনতে উদ্যত হলুম, বললুম—কিছু না বউদি, অমনি বলছি।
বউদিদি বললেন—তবুও ভালো। ভাইটির আমার এখনও ছেলেমানুষি যায়নি। হ্যাঁ ভালো কথা বিমল, তুমি ভালোবাস বলে বাগানের কলার কাঁদি আজ কাটিয়ে রেখেছি, পাকলে একদিন ভালো করে দেব এখন।
তার পরদিনই আমার নোটিশ অনুসারে স্কুলের কাজের শেষদিন। গিয়ে শুনলাম আমার জায়গায় নতুন লোক নেওয়া ঠিক হয়ে গিয়েছে। স্কুলে সকলের কাছে বিদায় নিয়ে চলে এলুম।
শুধু একবার শেষ দেখা করবার জন্যেই তার পরদিন পুকুরের ঘাটে ঠিক সময়ে গেলুম। তাঁর দেখা পেলে যে কী বলব তা ঠিক করে সেখানে যাইনি, সত্য কথা সব খুলে বলতে বোধ হয় পারতুম সেদিন—কিন্তু দেখা হল না! সব দিন তো দেখা হত না, প্রায়ই দু-তিন দিন অন্তর দেখা হত, আবার কিছুদিন ধরে হয়তো রোজই দেখা হত। সেদিন বিকালে গেলুম, তার পরদিন সকালেও গেলুম, কিন্তু দেখা পেলুম না।
সেদিন চলে আসবার সময় সেখানকার মাটি একটু কাগজে মুড়ে পকেটে নিলুম, যেখানে তাঁর সঙ্গে প্রথম পরিচয় হবার দিন তিনি দাঁড়িয়েছিলেন।…
সেইদিনই বিকালে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে চিরদিনের মতো সে গ্রাম পরিত্যাগ করলুম।
মাঠের কোলে ছাতিম গাছের বনের মধ্যে কোথায় ঘুঘু ডাকছিল।–
সেসব আজ পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর আগেকার কথা।
তারপর জীবনে কত ঘটনা ঘটে গেল। ভগবানের কী অসীম করুণার দানই আমাদের এই জীবনটুকু! উপভোগ করে দেখলুম, এ কী মধু! কত নতুন দেশ, নতুন মুখ, কত জ্যোৎস্না-রাত্রি, নতুন নব-ঝোপের নতুন ফুল, কত সুঁইফুলের মতো শুভ্র নির্মল হৃদয়, কান্নাজড়ানো কত সে মধুর স্মৃতি!…
কাকার কাছে মোরাদাবাদে কাচের কারখানায় গেলুম। বছরখানেক পরে তারা আমায় পাঠিয়ে দিলে জার্মানিতে কাচের কাজ শিখতে। তারপর কোলেয়োঁ গেলুম, কাটা বেলোয়ারি কাচের কারখানার কাজ শেখবার জন্যে। কোলেয়োঁ অনেক দিন রইলুম। সেখানে থাকতে একজন আমেরিকান যুবকের সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হল, তিনি ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট। শিকাগো ইটার-ওশ্যন কাগজের তিনি ফ্রান্স দেশস্থ সংবাদদাতা। কোলোয়ে সবসময়না-থাকলেও তিনি প্রায়ই ওখানে আসতেন। তাঁরই পরামর্শে তাঁর সঙ্গে আমেরিকায় গেলুম। তাঁর সাহায্যে দু-তিনটে বড়ো বড়ো কাচের কারখানার কাজ দেখবার সুযোগ পেলাম…পিটসবার্গে কর্নেগীর ওখানে প্রায় ছ-মাস রইলুম, নতুন ধরনের ব্লাস্টফার্নেসের কাজ ভালো করে বোঝবার জন্য।…মিডল ওয়েস্টের একটা কাচের কারখানায় প্রভাত দে কী বসু বলে একজন বাঙালি যুবকের সঙ্গে দেখা হল, তাঁরও বাড়ি চব্বিশ পরগনা জেলায়। সে ভদ্রলোক নিঃসম্বলে জাপান থেকে আমেরিকায় গিয়ে মহা হাবুডুবু খাচ্ছিলেন, তাঁরই মুখে শুনলুম, সেয়াটল-এ একটা নতুন কাচের কারখানা খোলা হচ্ছে। আমি জাপান দিয়ে আসব স্থির করেছিলুম, কাজেই আসবার সময় সেয়াটল গেলুম। তারপর জাপান ঘুরে দেশে এলুম।…মা ইতিমধ্যে মারা গিয়েছিলেন। ভাইদুটিকে নিয়ে গেলুম মোরাদাবাদে। বেশিদিন ওখানে থাকতে হল না। বম্বেতে বিয়ে করেছি, আমার শ্বশুর এখানে ডাক্তারি করতেন। সেই থেকে বম্বে অঞ্চলেরই অধিবাসী হয়ে পড়েছি।
বহুদিন বাংলা দেশে যাইনি, প্রায় ষোলো-সতেরো বছর হল। বাংলা দেশের জলমাটি গাছপালার জন্যে মনটা তৃষিত আছে। তাই আজ সন্ধ্যার সময় সমুদ্রের ধারে বসে আমার সবুজ শাড়ি-পরা বাংলা মায়ের কথাই ভাবছিলুম।…রাজাবাই টাওয়ারের মাথার ওপর এখনও একটু একটু রোদ আছে। বন্দরের নীল জলে মেসাজেরি মারিতিমদের একখানা জাহাজ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে, এ-খানা এখুনি ছেড়ে যাবে। বাঁ-ধারে খুব দূরে এলিফ্যান্টার নীল সীমারেখা। ভাবতে ভাবতে প্রথম যৌবনের একটা বিস্মৃতপ্রায় ঝাপসা ছবি বড়ো স্পষ্ট হয়ে মনে এল। পঁচিশ বছর পূর্বের এমনি এক সন্ধ্যায় দূর বাংলা দেশের এক নিভৃত পল্লিগ্রামের জীর্ণ শানবাঁধানো পুকুরের ঘাট বেয়ে উঠেছে আর্দ্রবসনা তরুণী এক পল্লিবধূ!…মাটির পথের বুকে বুকে লক্ষ্মীর চরণচিহ্নের মতো তার জলসিক্ত পা দু খানির রেখা আঁকা…আঁধার সন্ধ্যায় তার পথের ধারের বেণুকুঞ্জে লক্ষ্মীপেঁচা ডাকছে। তার স্নেহভরা পবিত্র বুকখানি বাইরের জগৎ সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত অনিশ্চয়তায় ভরা। আম-কাঁটালের বনের মাথার ওপরকার নীলাকাশে দু-একটা নক্ষত্র উঠে সরলা স্নেহ-দুর্বলা বধূটির ওপর সস্নেহ কৃপাদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। তারপর এক শান্ত আঙিনায় তুলসী মঞ্চমূলে স্নেহাস্পদের মঙ্গলপ্রার্থিনী সে কোন প্রণাম-নিরতা মাতৃমূর্তি, করুণামাখা অশ্রু ছল ছল।…
ওগো লক্ষ্মী, ওগো স্নেহময়ী পল্লিবধু, তুমি আজও কী আছ? এই সুদীর্ঘ পঁচিশ বছর পরে আজও তুমি কি সেই পুকুরের ভাঙা ঘাটে সেইরকম জল আনতে যাও? আজ সে কতকালের কথা হল, তারপর জীবনে আবার কত কী দেখলুম, আবার কত কী পেলুম… আজ কতদিন পরে আবার তোমার কথা মনে পড়ল…তোমায় আবার দেখতে বড়ো ইচ্ছে করছে দিদিমণি, তুমি আজও কি আছে? মনে আসছে, অনেক দূরের যেন কোন খড়ের ঘর…মিটমিটে মাটির প্রদীপের আলো…মৌন সন্ধ্যা…নীরব ব্যথার অশ্রু…শান্ত সৌন্দর্য—স্নেহমাখা রাঙা শাড়ির আঁচল।…
আরব সমুদ্রের জলে এমন করুণ সূর্যাস্ত কখনো হয়নি!
কনে দেখা
সকালবেলা বৈঠকখানার গাছপালার হাটে ঘুরছিলাম।
গত মাসে হাটে কতকগুলি গোলাপের কলম কিনেছিলাম, তার মধ্যে বেশিরভাগ পোকা লেগে নষ্ট হয়ে গেছে। নার্সারির লোক আমার জানাশুননা, তাদের বললাম,-কীরকম কলম দিয়েছিলে হে! সে যে টবে বসাতে দেরি সইল না! তা ছাড়া আবদুল কাদের বলে বিক্রি করলে, এখন সবাই বলছে আবদুল কাদের নয় ও, অত্যন্ত মামুলি জাতের টি রোজ। ব্যাপার কী তোমাদের?
নার্সারির পুরোনো লোকটাই আজ আছে। সেদিন এ ছিল না, তাই ঠকেছিলাম। এই লোকটা খুব অপ্রতিভ হল। বললে—বাবু, এই হয়েছে কী জানেন? বাগানের মালিকেরা আজকাল আছেন কলকাতায়। আমি একা সব দিক দেখতে পারিনে, ঠিকে উড়ে মালী নিয়ে হয়েছে কাজ। তাদের বিশ্বাস করলে চলে না, আবার না করলেও চলে না। আমি তো সবদিন হাট সামলাতে পারিনে বাবু, ওদেরই ধরে পাঠাতে হয়। আমি বুনেছিলাম টি রোজ তিনডজন, আমি তো তার কাছ থেকে টি রোজেরই দাম নেব? এখানে এসে যদি আবদুল কাদের বলে বিক্রি করে তো তারই লাভ। বাড়তি পয়সা আমার নয়, তার। বুঝলেন না বাবু?
বাজার খুব জেঁকেছে। বর্ষার নওয়ালির মুখ, নানাধরনের গাছের আমদানি হয়েচে। বড়ো বড়ো বিলিতি দোপাটি, মতিয়া, বেল, অতসীলতা, রাস্তার ধারের সারিতে নানাধরনের পাম, ছোটো ছোটো পাম থেকে ফ্যান পাম ও বড়ো টবে ভালো এরিকা পামও আছে। সূর্যমুখীর যদিও এ সময় নয়, কিন্তু সূর্যমুখী এসেছে অনেক। তা ছাড়া কলকাতার রাস্তায় অনভিজ্ঞ লোকদের কাছে অর্কিড বলে যা বিক্রি হয়, সেই নারকেলের ছোবড়া ও তার-বাঁধা ফার্ন ও রঙিন আগাছা যথেষ্ট বিক্রি হচ্ছে। লোকের ভিড়ও বেশ।
হঠাৎ দেখি আমার অনেকদিন আগেকার পুরোনো রুমমেট হিমাংশু। ৭/৩নং কানাই সরকারের লেনে মেসে তার সঙ্গে অনেক দিন একঘরে কাটিয়েছি। সে আজ সাত-আট বছর আগেকার কথা—তারপর সে কলকাতা ছেড়ে চলে যায়। আর তার কোনো খবর রাখিনি আজকাল।
—এই যে হিমাংশু? চিনতে পারো?
হিমাংশু চমকে পেছন ফিরে চাইলে এবং কয়েক সেকেন্ড সবিস্ময়ে আমার দিকে চেয়ে থাকবার পরে সে আমার চিনলে। হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এল হাসিমুখে।
-আরে জগদীশবাবু যে! তারপর? ওঃ আপনার সঙ্গে একযুগ পরে ওঃ! তারপর আছেন কেমন বলুন!
আমি বললাম তোমার গাছপালার শখ দেখচি আছে হিমাংশু, সেই মনে আছে দুজনে কতদিন এখানে হাটে আসতাম?
হিমাংশু হেসে বললে—তা আর মনে নেই? সেই আপনি দার্জিলিংয়ের লিলি কিনলেন? আপনার তো খুব শখ ছিল লিলির। এখনও আছে? আসুন, আসুন, অন্য কোথাও গিয়ে একটু বসি। ও মেসটার কোনো খবর আর রাখেন নাকি? আচ্ছা সেই অনাদিবাবু কোথায় গেল খোঁজ রাখেন? আর সেই যে মেয়েটি স্টোভ জ্বালাতে গিয়ে গা-হাত পুড়িয়ে ফেললে, মনে আছে? তার বিয়ে হয়েছে?
দুজনে গিয়ে একটা চায়ের দোকানে বসলাম। এগল্প-ওগল্প—নানা পুরোনো দিনের কথা। তার কথাবার্তার ভাবে বুঝলাম সে কলকাতায় এসেছে অনেক দিন পরে।
জিজ্ঞেস করলাম—আজকাল কোথায় থাকো হিমাংশু?
সে বললে—বি. এন. আর.-এর একটি স্টেশনে বুকিং-ক্লার্ক ছিলাম। টাটানগরের ওদিকে, কিছুদিন থাকবার পর দেখলাম জায়গাটার মাটিতে ভারি চমৎকার ফুল জন্মায়, জমিও সস্তা। সেইখানেই এখন আছি—ফুলের বাগান করেচি—তুমি তো জানো বাগানের শখ আমার চিরকাল। কিছু চাষবাসের জমি নিয়েছি, তাতেই চলে যায়। কিন্তু সেসব কথা থাক—আজ এখন একটা গল্প করি শোনো। গল্পের মতো শোনাবে, কিন্তু আসলে সত্যি ঘটনা। আর আশ্চর্য এই, দশ বছর আগে যখন তোমাদের মেসে থাকতাম তখন এ গল্পের শুরু, এবং এর সমাপ্তি ঘটেছে গতকাল। আমি বললাম—ব্যাপার কী, তোমার কথা শুনে মনে হচ্চে নিশ্চয়ই প্রেমের কাহিনি জড়ানো আছে এর সঙ্গে। বলো বলো। সে বললে—না, সেসব নয়। অন্য এক ব্যাপার, কিন্তু আমার পক্ষে কোনো প্রণয়কাহিনির চেয়ে তা কম
মধুর নয়। শোনো বলি। আচ্ছা তোমার মনে আছে—মেসে থাকতে আমি একটা এরিকা পাম কিনেছিলাম, আমাদের ঘরের সামনে টবে বসানো ছিল, মনে আছে? আচ্ছা তা হলে শোনো।
তারপর আধঘণ্টা বসে হিমাংশু তার গল্পটা বলে গেল। আমরা আরও দু-বার চা খেলাম, একবাক্স সিগারেট পোড়ালাম। বউবাজারের মোড়ে গির্জার ঘড়িটায় সাড়ে ন-টা যখন বাজল, তখন হিমাংশু গল্প শেষ করে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
তার গল্পটা আমি আমার নিজের কথায় বলব, কেননা হিমাংশু সম্বন্ধে কিছু জানা থাকা দরকার, গল্পটা ঠিক বুঝতে হলে, সেটা আমাকে গোড়াতেই বলে দিতে হবে।
হিমাংশু যখন আমার সঙ্গে থাকত, তখন তার চালচলন দেখলে মনে হবার কথা যে, সে বেশ অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে। সে যে আহার-বিহারে বা বেশভূষায় খুব বেশি শৌখিন ছিল তা নয়, তার শখ ছিল নানা ধরনের এবং এই শখের পেছনে সে পয়সা ব্যয় করত নিতান্ত বেআন্দাজি।
তার প্রধান শখ ছিল গাছপালা ও ফুলের। আমার ফুলের শখটা হিমাংশুর কাছ থেকেই পাওয়া এ কথা বলতে আমার কোনো লজ্জা নেই। কারণ যত তুচ্ছ, যত অকিঞ্চিৎকর জিনিসই হোক না-কেন, যেখানে সত্যি কোনো আগ্রহ বা ভালোবাসার সন্ধান পাওয়া যায়—তাকে শ্রদ্ধা না-করে পারা যায় না।
হিমাংশুর গাছপালার ওপর ভালোবাসা ছিল সত্যিকার জিনিস। সে ভালো খেত, ভালো কাপড়জামা কখনো দেখিনি তার গায়ে—কিন্তু ও ধরনের সুখস্বাচ্ছন্দ্য তার কাম্যও ছিল না। তার পয়সার সচ্ছলতা ছিল না কখনো, টুইশনি করে দিন চালাত, তাও আবার সবসময় জুটত না, তখন বন্ধুবান্ধবদের কাছে ধার করত। যখন ধারও মিলত না তখন দিনকতক চন্দননগরে এক মাসির বাড়ি গিয়ে মাসখানেক, মাস-দুই কাটিয়ে আসত। কিন্তু পয়সা হাতে-হলে কাপড়–জামা না কিনুক, খাওয়া-দাওয়ায় ব্যয় করুক-না-করুক, ভালো গাছপালা দেখলে কিনবেই।
মেসে আমাদের ঘরের সামনে ছোটো একটা অপরিসর বারান্দাতে সে তার গাছপালার টবগুলো রাখত। গোলাপের ওপর তার তত ঝোঁক ছিল না, সে ভালোবাসত নানাজাতীয় পাম—আর ভালোবাসত দেশি-বিদেশি লতা— উইস্টারিয়া, অতসী, মাধবীলতা, বোগেনভিলিয়া ইত্যাদি। কত পয়সাই যে এদের পিছনে খরচ করেছে!
সকালে উঠে ওর কাজই ছিল গাছের পাট করতে বসা। শুকনো ডালপালা ভেঙে দিচ্ছে, গাছ ঘেঁটে দিচ্ছে, এ-টবের মাটি ও-টবে ঢালচে। পুরোনো টব ফেলে দিয়ে নতুন টবে গাছ বসাচ্ছে, মাটি বদলাচ্ছে। আবার মাঝে মাঝে মাটির সঙ্গে নানারকমের সার মিশিয়ে পরীক্ষা করছে। এসব সম্বন্ধে ইংরেজি বাংলা নানা বই কিনত—একবার কী একটা উপায়ে ও একই লতায় নীলকলমি ও সাদাকলমি ফোটালে। ভায়োলেটের ছিট ছিট দেওয়া অতসী অনেক কষ্টে তৈরি করেছিল। বেগুনি রং-এর ক্রাইসেনথিমামের জন্যে অনেক পরিশ্রম ও অর্থ ব্যয় করেছিল, সুবিধে হয়নি।
তা ছাড়া ও ধরনের মানুষ আমি খুব বেশি দেখিনি, যে একটা খেয়াল বা শখের পেছনে সমস্ত মনপ্রাণ ঢেলে দিতে পারে। মানুষের মনের শক্তির সে একটা বড়ো পরিচয়। হিমাংশু বলত—সেদিন একটা পাড়াগাঁয়ে একজনদের বাড়ি গিয়েছি, বুঝলেন?…তাদের গোলার কাছে তিন বছরের পুরোনো নারকেল গাছ হয়ে আছে। সে যে কী সুন্দর দেখাচ্চে! একটা প্রকাণ্ড তাজা, সতেজ, সবুজ পাম! সমুদ্রের ধারে নাকি নারকেলের বন আছে—পাম-এর সৌন্দর্য দেখতে হলে সেখানে যেতে হয়।
হিমাংশু প্রায়ই পাম আর অর্কিড দেখতে শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে যেত। আর এসে তাদের উচ্ছ্বসিত বর্ণনা করত।
একবার সে একটা এরিকা পাম কিনে আনলে। খুব ছোটো নয়, মাঝারিগগাছের মাটির টবে বসানো—কিন্তু এমন সুন্দর, এমন সতেজ গাছ বাজারে সাধারণত দেখা যায় না। সে সন্ধান করে করে দমদমায় কোনো বাগানের মালিকে ঘুষ দিয়ে সেখান থেকে কেনে। কলকাতার মেসের বারান্দায় গাছ বাঁচিয়ে রাখা যে কত শক্ত কাজ, যাঁদের অভিজ্ঞতা আছে তাঁরা সহজেই বুঝতে পারবেন। গোবি মরুভূমিতে গাছ বাঁচিয়ে রাখা এর চেয়ে সহজ। একবার সে আর আমি দিন-কুড়ি-বাইশের জন্যে কলকাতায় বাইরে যাই; চাকরকে আগাম পয়সা পর্যন্ত হিমাংশু দিয়ে গেল গাছে জল দেবার জন্যে, ফিরে এসে দেখা গেল ছ-সাতটা ফ্যান পাম শুকিয়ে পাখা হয়ে গেছে।
সকালে-বিকালে হিমাংশু বালতি বালতি জল টানত একতলা থেকে তেতলায়
টবে দেবার জন্যে। গাছ বাড়ছে না কেন এর কারণ অনুসন্ধান করতে তার উদবেগের অন্ত ছিল না। অন্যসব গাছের চেয়ে কিন্তু ওই এরিকা পাম গাছটার ওপর তার মায়া ছিল বেশি, তার খাতা ছিল—তাতে লেখা থাকত কোন কোন মাসে কত তারিখে গাছটা নতুন ডাল ছাড়লে। গাছটাও হয়ে পড়ল প্রকাণ্ড, মাটির টব বদলে তাকে পিপে-কাটা কাঠের টবে বসাতে হল। মেসের বারান্দা থেকে নামিয়ে একতলায় উঠোনে বসাতে হল। এসবে লাগল বছর পাঁচ-ছয়।
সেবার বাড়িওয়ালার সঙ্গে বনিবনাও না-হতে আমাদের মেস ভেঙে গেল।
দুজনে আর একত্র থাকবার সুবিধে হল না, আমি চলে গেলাম ভবানীপুর। হিমাংশু গিয়ে উঠল শ্যামবাজারে আর একটা মেসে। একদিন আমায় এসে বিমর্ষ মুখে বললে—কী করি জগদীশবাবু, ও মেসে আমার টবগুলো রাখবার জায়গা হচ্ছে না—অন্য অন্য টবের না-হয় কিনারা করতে পারি, কিন্তু সেই এরিকা পামটা সেখানে রাখা একেবারে অসম্ভব। একটা পরামর্শ দিতে পারেন? অনেকগুলো মেস দেখলাম, অত বড়ো গাছ রাখবার সুবিধে কোথাও হয় না। আর টানাটানির খরচাও বড়ো বেশি।
আমি তাকে কোনো পরামর্শ দিতে পারিনি বা তারপর থেকে আমার সঙ্গে আজকার দিনটি ছাড়া আর কোনোদিন দেখাও হয়নি।
বাকিটা হিমাংশুর মুখে আজই শুনেছি।
কোনো উপায় না-দেখে হিমাংশু শেষে কোনো বন্ধুর পরামর্শে ধর্মতলার এক নীলামওয়ালার কাছে এরিকা পামের টবটা রেখে দেয়। রোজ একবার করে গিয়ে দেখে আসত, খদ্দের পাওয়া গেল কিনা। শুধু যে খদ্দেরের সন্ধানে যেত তা নয়, ওটা তার একটা ওজুহাত মাত্র—আসলে যেত গাছটা দেখতে।
হিমাংশু কিন্তু নিজের কাছে সেটা স্বীকার করতে চাইত না। দু-দিন পরে যা পরের হয়ে যাবে, তার জন্যে মায়া কীসের?
তবুও একদিন যখন গিয়ে দেখলে, গাছটার সে নধর, সতেজ-শ্ৰী যেন ম্লান হয়ে এসেছে, নীলামওয়ালারা গাছে জল দেয়নি, তেমন যত্ন করেনি—সে লজ্জিত মুখে দোকানের মালিক একজন ফিরিঙ্গি ছোকরাকে বললে—গাছটার তেমন তেজ নেই —এই গরমে জল না-পেলে, দেখতে ভালো না-দেখালে বিক্রি হবে কেন? জল কোথায় আছে, আমি নিজে না-হয়—কারণ দু-পয়সা আসে, আমারই তো আসবে–
তারপর থেকে যেন পয়সার জন্যেই করছে, এই অছিলায় রোজ বিকেলে নীলামওয়ালার দোকানে গিয়ে গাছে জল দিত। এক-একদিন দেখত দোকানের চাকরেরা আগে থেকেই জল দিয়েছে।
রোজ নীলামের ডাকের সময় সে সেখানে উপস্থিত থাকত। তার গাছটার দিকে কেউ চেয়েও দেখে না—লোকে চেয়ার, টেবিল, সোফা, আলমারি কিনচে, ভাঙা পুরোনো ক্লক ঘড়ি পর্যন্ত বিক্রি হয়ে গেল, কিন্তু গাছের শখ খুব বেশি লোকের নেই, গাছটা আর বিক্রি হয় না। একদিন নীলামওয়ালা বললে—বাবু, গাছটার তো সুবিধে হচ্ছে না, তুমি নিয়ে যাবে ফেরত?
কিন্তু ফেরত নিয়ে গিয়ে তার রাখবার জায়গা নেই, থাকলে এখানে সে বিক্রির জন্যে দিয়েই বা যাবে কেন? সে-সময় তার অত্যন্ত খারাপ যাচ্চে, চাকুরির চেষ্টায় আকাশ-পাতাল হাতড়ে কোথাও কিছু মিলছে না—নিজের থাকবার জায়গা নেই তো পিপে-কাটা কাঠের টবে বসানো অত বড়ো গাছ রাখে কোথায়?
মাসখানেক পরে হিমাংশুর অবস্থা এমন হল যে আর কলকাতায় থাকাই চলে। কলকাতার বাইরে যাবার আগে গাছটার একটা কিনারা হয়ে গেলেও মনে শান্তি পেত। কিন্তু আজও যা, কালও তাই—নীলামওয়ালাকে কমিশনের রেট আরও বাড়িয়ে দিতে হয়েছে গাছটা রাখবার জন্যে, নইলে সে দোকানে রাখতে চায় না। কিন্তু হিমাংশুর দুর্ভাবনা এই যে, ও কলকাতা ছেড়ে চলে গেলে গাছটার আর যত্ন হবে না, নীলামওয়ালার দায় পড়েছে, কোথাকার একটা এরিকা পামগাছ বাঁচল কী মোলো—অত তদারক করবার তার গরজ নেই।
কিন্তু শেষে বাধ্য হয়ে কলকাতা ছাড়তে হল হিমাংশুকে।
অনেকদিন পরে সে আবার এল কলকাতায়। নীলামওয়ালার দোকানে বিকেলে গেল গাছ দেখতে। গাছটা নেই, বিক্রি হয়ে গিয়েছে সাড়ে সাত টাকায়। কমিশন বাদ দিয়ে হিমাংশুর বিশেষ কিছু রইল না। কিন্তু টাকার জন্যে ওর তত দুঃখ নেই, এত দিন পরে সত্যি সত্যিই গাছটা পরের হয়ে গেল!
তার প্রবল আগ্রহ হল গাছটা সে দেখে আসে। নীলামওয়ালা সাহেব প্রথমে ঠিকানা দিতে রাজি নয়, নানা আপত্তি তুললে—বহু কষ্টে তাকে বুঝিয়ে ঠিকানা জোগাড় করলে। সার্কুলার রোডের এক সাহেবের বাড়িতে গাছটা বিক্রি হয়েছে, হিমাংশু পরদিন সকালে সেখানে গেল। সার্কুলার রোডের ধারেই বাড়ি, ছোটো গেটওয়ালা কম্পাউন্ড, উঠোনের একধারে একটা বাতাবি লেবুগাছ, গেটের কাছে একটা চারা পাকুড়গাছ। সাহেবের গাছপালার শখ আছে—পাম অনেকরকম রেখেছে, তার মধ্যে ওর পামটাই সকলের বড়ো। হিমাংশু বলে, সে হাজারটা পামের মধ্যে নিজেরটা চিনে নিতে পারে। কম্পাউন্ডে ঢুকবার দরকার হল না, রাস্তার ফুটপাত থেকেই বেশ দেখা যায়, বারান্দায় উঠবার পৈঠার ধারেই তার। পিপে-কাটা টবসুদ্ধ পামগাছটা বসানো রয়েছে। গাছের চেহারা ভালো—তবে তার কাছে থাকবার সময় আরও বেশি সতেজ, সবুজ ছিল।
হিমাংশুর মনে পড়ল এই গাছটার কবে কোন ডাল গজালো—তার খাতায় নোট করা থাকত। ও বলতে পারে প্রত্যেকটি ডালের জন্মকাহিনি—একদিন তাই ওর মনে ভারি কষ্ট হল, সেদিন দেখলে সাহেবের মালি নীচের দিকের ডালগুলো সব কেটে দিয়েছে। মালিকে ডাকিয়ে বললে—ডালগুলো ওরকম কেটেচ কেন? মালিটা ভালো মানুষ। বললে—আমি কাটিনি বাবু, সাহেব বলে দিল নীচের ডাল না-কাটলে ওপরের কচি ডাল জোর পাবে না। বললে, টবের গাছ না-হলে ও ডালগুলো আপনা থেকেই ঝরে পড়ে যেত।
হিমাংশু বললে—তোমার সাহেব কিছু জানে না। যা ঝরে যাবার তা তো গিয়েচে, অত বড়ো গুঁড়িটা বার হয়েছে তবে কী করে? আর ভেঙো না।
বছর তিন-চার কেটে গেল। হিমাংশু গাছের কথা ভুলেচে। সে গালুডি না ঘাটশিলার ওদিকে কোথাও জমি নিয়ে বসবাস করে ফেলেছে ইতিমধ্যে।
গাছপালার মধ্যে দিয়েই ভগবান তার উপজীবিকার উপায় করে দিলেন। এখানে হিমাংশু ফুলের চাষ আরম্ভ করে দিলে সুবর্ণরেখার তীরে। মাটির দেয়াল তুলে খড়ের বাংলো বাঁধলে। একদিকে দূরে অনুচ্চ পাহাড়, নিকটে দূরে শালবন, কাঁকর মাটির লাল রাস্তা, অপূর্ব সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত।
ফুলের চাষে সে উন্নতি করে ফেললে খুব শিগগির। ফুলের চেয়েও বেশি উন্নতি করেচে চিনা ঘাস ও ল্যাভেন্ডার ঘাসের চাষে। এই জীবনই তার চিরদিনের কাম্য ছিল, ওজায়গা ছেড়ে শহরে আসতে ইচ্ছেও হত না। বছর-দুই কাটল আরও, ইতিমধ্যেই সে বিবাহ করেছে, সস্ত্রীক ওখানেই থাকে।
আজ তিন দিন হল সে কলকাতায় এসেছে প্রায় পাঁচ-ছ-বছর পরে।
কাজকর্ম সেরে কেমন একটা ইচ্ছে হল, ভাবলে—দেখি তো সেই সাহেবের বাড়িতে আমার সেই গাছটা আছে কিনা?
বাড়িটা চিনে নিতে কষ্ট হল না কিন্তু অবাক হয়ে গেল—বাড়ির সে শ্ৰী আর নেই। বাড়িটাতে বোধ হয় মানুষ বাস করেনি বছর-দুই—কী তার বেশি। উঠোনে বন হয়ে গিয়েছে। পৈঠাগুলো ভাঙা, বাতাবি লেবুগাছে মাকড়সার জাল, বারান্দার রেলিংগুলো খসে পড়েছে। তার সেই এরিকা পামটা আছে, কিন্তু কী চেহারাই হয়েছে। আরও বড় হয়েছে বটে কিন্তু সে তেজ নেই, শ্রী নেই, নীচের ডালগুলো
শুকিয়ে পাখা হয়ে আছে, ধুলো আর মাকড়সার জালে ভরতি। যায় যায় অবস্থা। টবও বদলানো হয়নি আর।
হিমাংশু বললে—ভাই সত্যি সত্যি তোমায় বলচি, গাছটা যেন আমায় চিনতে পারলে। আমার মনে হল ও যেন বলচে আমায় এখান থেকে নিয়ে যাও, আমি তোমার কাছে গেলে হয়তো এখনও বাঁচব! ছেড়ে যেও না এবার। আমায় বাঁচাও।
রাত্রে হিমাংশুর ভালো ঘুম হল না। আবার সার্কুলার রোডে গেল, সন্ধান নিয়ে জানলে সাহেব মারা গিয়েছে। বুড়ি মেম আছে ইলিয়ট রোডে, পয়সার অভাবে বাড়ি সারাতে পারে না, তাই ভাড়াও হচ্ছে না। এই বাজারে ভাঙা বাড়ি কেনার খদ্দেরও নেই।
মেমকে টাকা দিয়ে গাছটা ও কিনে নিলে। এখন ও সার্কুলার রোডের বাড়িটাতেই আছে, কাল ও গালুডিতে ফিরে যাবে, গাছটাকে নিয়ে যাচ্চে সঙ্গে করে।
বিদায় নেবার সময় হিমাংশু বললে—বৈঠকখানা বাজারে এসেছিলাম কেন জানো? আমার সাধ হয়েচে ওর বিয়ে দেব। তাই একটা ছোটোখাটো, অল্প বয়সের, দেখতে ভালো পাম খুঁজছিলাম। হি-হি—পাগল নয় হে পাগল নয়, ভালোবাসার জিনিস হত তো বুঝতে।
কিন্নরদল
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
পাড়ায় ছ’সাত ঘর ব্রাহ্মণের বাস মোটে। সকলের অবস্থাই খারাপ। পরস্পরকে ঠকিয়ে পরস্পরের কাছে ধার-ধোর করে এরা দিন গুজরান করে। অবিশ্যি কেউ কাউকে খুব ঠকাতে পারে না, কারণ সবাই বেশ হুঁশিয়ার। গরিব বলেই এরা বেশি কুচুটে ও হিংসুক, কেউ কারো ভালো দেখতে পারে না বা কেউ কাউকে বিশ্বাসও করে না।
আগেই বলেছি, সকলের অবস্থা খারাপ এবং খানিকটা তার দরুন, খানিকটা অন্য কারণে সকলের চেহারা খারাপ। কিশোরী মেয়েদেরও তেমন লালিত্য নেই মুখে, ছোট ছোট ছেলেরা এমন অপরিষ্কার অপরিচ্ছন্ন থাকে এবং এমন পাকা পাকা কথা বলে যে, তাদের আর শিশু বা বালক বলে মনে হয় না। কাব্যে বা উপন্যাসে যে শৈশবকালের কতই প্রশস্তি পাঠ করা যায়, মনে হয় সে সব এদের জন্য নয়, এরা মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়ে একেবারে প্রবীণত্বে পা দিয়েছে।
পাড়ায় একঘর গৃহস্থ আছে, তারা এখানে থাকে না, তাদের কোঠাবাড়িটা চাবি দেওয়া পড়ে আছে আজ দশ-বারো বছর। এদের মস্তবড় সংসার ছিল, এখন প্রায় সবাই মরে হেজে গিয়ে প্রায় পাঁচটি প্রাণীতে দাঁড়িয়েছে। বাড়ির বড় ছেলে পশ্চিমে চাকরি করে, মেজ ছেলে কলেজে পড়ে কলকাতায়, ছোট ছেলেটি জন্মাবধি কালা ও বোবা—পিসিমার কাছে থেকে মূকবধির বিদ্যালয়ে পড়ে। বড় ছেলে বিবাহ করেনি, যদিও তার বয়স ত্রিশ-বত্রিশ হয়েছে। সে নাকি বিবাহের বিরোধী, শোনা যাচ্ছে যে এমনিভাবেই জীবন কাটাবে।
পাড়ার মধ্যে এরাই শিক্ষিত ও সচ্ছল অবস্থার মানুষ। সেজন্য এদের কেউ ভালো চোখে দেখে না, মনে মনে সকলেই এদের হিংসে করে এবং বড় ছেলে যে বিয়ে করবে না বলছে, সে সংবাদে পাড়ার সবাই পরম সন্তুষ্ট। যখন সবাই ছোট ও গরিব, তখন একঘর লোক কেন এত বাড় বাড়বে? বড় ছেলে বিয়ে করলেই ছেলেমেয়ে হয়ে জাজ্বল্যমান সংসার হবে দুদিন পরে, সে কেউ সহ্য করতে পারবে না। মেজ ছেলে মোটে কলেজে পড়ছে, এখন সাপ হয় কী ব্যাঙ হয় তার কিছু ঠিক নেই, তার বিষয়ে দুশ্চিন্তার এখনো কারণ ঘটেনি, তবে বয়েসও বেশি নয়।
মজুমদার-বাড়িতে ভাঙা রোয়াকে দুপুরে পাড়ার মেয়েদের মেয়ে-গজালি হয়। তাতে রায়-গিনি্ন, মুখুজ্যে-গিনি্ন, চক্কত্তি-গিনি্ন প্রভৃতি তো থাকেনই, অল্প-বয়সী বৌয়েরা ও মেয়েরাও থাকে। সাধারণত যেসব ধরনের চর্চা এ মজলিসে হয়ে থাকে, তা শুনলে নারীজাতি সম্বন্ধে লিখিত নানা সরল প্রশংসাপূর্ণ বর্ণনার সত্যতার সম্বন্ধে ঘোর সন্দেহ যাঁর উপস্থিত না হবে, তিনি নিঃসন্দেহে একজন খুব বড় ধরনের অপটিমিস্ট।
আজ দুপুরে যে বৈঠক বসেছে, তাতে আলোচিত বিষয়গুলো থেকে মোটামুটি প্রতিদিনের আলোচনা ও বিতর্কের প্রকৃতি অনুমান করা যেতে পারে।
বোস-গিনি্ন বলছিলেন—আরে বাপু দিচ্ছি তো রোজই, আমার গাছের কাঁটাল খেয়েই তো মানুষ, আমাদের যখন কাঁটাল পাড়ানো হয়, ছেলেমেয়েগুলো হ্যাংলার মতো তলায় দাঁড়িয়ে থাকে—ঘেয়ো কী ভুয়ো এক-আধখানা যদি থাকে তো বলি, যা নিয়ে যা। তোদের নেই, যা খেগে যা। তা কি পোড়ার মুখে কোনো দিন সুবাক্যি আছে? ওমা, আজ আমার মেয়ে দুটো নেবু তুলতে গিয়েছে ডোবার ধারের গাছে, তা বলে কি না রোজ নেবু তুলতে আসে, যেন সরকারি গাছ পড়ে রয়েছে আরকি—চব্বিশ ঝুড়ি কথা শুনিয়ে দিলে মন্টুর মা। আচ্ছা বলো তো তোমরাই—
মন্টুর মা—যাঁকে উদ্দেশ করে এ কথা বলা হচ্ছিল, তিনি এঁদের মজলিসে কেবল আজই অনুপস্থিত আছেন নইলে রোজই এসে থাকেন। তাঁর অনুপস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করে সবাই তাঁর চালচলন, ধরন-ধারণ, রীতি-নীতির নানারূপ সমালোচনা করল।
প্রিয় মুখুজ্যের মেয়ে শান্তি—ষোল-সতেরো বছরের কুমারী—তার মায়ের বয়সী মন্টুর মায়ের সম্বন্ধে অমনি বলে বসল—ওঃ, সে কথা আর বোলো না খুড়িমা, কী ব্যাপক মেয়েমানুষ ওই মন্টুর মা। ঢের ঢের মেয়েমানুষ দেখিচি, অমন লঙ্কাপোড়া ব্যাপক যদি কোথাও দেখে থাকি, ক্ষুরে নমস্কার, বাবা বাবা!
ছোট মেয়ের ওই জ্যাঠামি কথার জন্য তাকে কেউ বকলে না বা শাসন করলে না, বরং কথাটা সকলেই উপভোগ করলে।
তারপর কথাটার স্রোত আরো কত দূর গড়াত বলা যায় না, এমন সময় রায়-বাড়ির বড়বৌ হঠাৎ মনে-পড়ার ভঙ্গিতে বললেন—হাঁ, একটা মজার কথা শোনোনি বুঝি। শ্রীপতি যে বিয়ে করেছে, বটঠাকুরের কাছে চিঠি এসেচে, শ্রীপতির মামা লিখেচে।
সকলে সমস্বরে বলে উঠল—শ্রীপতি বিয়ে করেচে!
তারপর সকলেই একসঙ্গে নানারূপ প্রশ্ন করতে লাগল :
—কোথায়, কোথায়?
—কবে চিঠি এলো?
—তবে যে শুনলাম শ্রীপতি বিয়ে করবে না বলেচে।
শ্রীপতির বিয়ের খবরে অনেকেই যেন একটু দমে গেল। খবরটা তেমন শুভ নয়। কারো উন্নতির সংবাদ এদের পক্ষে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করা অসম্ভব। তাদের যখন উন্নতি হলো না, তখন অপরের উন্নতি হবে কেন? কিন্তু এরপরেই যখন রায়-বৌ মুখ টিপে হেসে আস্তে আস্তে বললেন—বৌটি নাকি বামুনের মেয়ে নয়—তখন সকলে খাড়া হয়ে সটান উঠে বসল, তাদের মরা-মরা ভাবটা এক মুহূর্তে গেল কেটে। একটা বেশ সরস ও মুখরোচক পরনিন্দা আর ঘোঁটের আভাস ওরা পেলে, রায়-বৌয়ের চাপা ঠোঁটের হাসি থেকে।
শান্তি উৎসুক চোখে চেয়ে হাসিমুখে বললে—ভেতরে তাহলে অনেকখানি কথা আছে!
বোস-গিনি্ন বললেন—তাই বল! নইলে এমনি কোথাও কিছু নয় শ্রীপতি বিয়ে করলে, এ কি কখনো হয়। কি জাত মেয়েটার? হিঁদু তো?
অর্থাৎ তাহলে রগড়টা আরো জমে। রায়বৌ বললেন—হিঁদুই, মেয়েটা বদ্দি বামুন।
এদেশে বৈদ্যকে বলে থাকে ‘বদ্দি বামুন’—এ অঞ্চলের ত্রিসীমানায় বৈদ্যের বাস না থাকায় বৈদ্যজাতির সমাজতত্ত্ব সম্বন্ধে এদের ধারণা অত্যন্ত অস্পষ্ট। কারো বিশ্বাস ব্রাহ্মণের পরেই বৈদ্যের সামাজিক স্থান, তারা একপ্রকারের নিম্নবর্ণের ব্রাহ্মণ, তার চেয়ে নিচু নয়—আবার কারো বিশ্বাস তাদের স্থান সমাজের নিম্নতর ধাপের দিকে।
শান্তি বললে—বৌয়ের বয়েস কত?
ওঃ, তা অনেক। শুনচি চব্বিশ-পঁচিশ—
সকলে সমস্বরে আবার একটা বিস্ময়ের রোল তুললে। চব্বিশ-পঁচিশ বছর পর্যন্ত মেয়ে আইবুড়ো থাকে ঘরে! এ আবার কোথাকার ছোট জাত, রামোঃ। ছিঃ—
শান্তির মা বললেন—তাহলে মেয়ে আর নয়, মাগী বল! পাঁড় শসা—বাপ-মা বুঝি ঘরে বীজ রেখেছিল!
কে একজন মুখ টিপে হেসে বললেন—বিধবা না তো?
চক্কত্তি-গিন্নি বললেন—আগের পক্ষের ছেলেমেয়ে কিছু আছে নাকি মাগীর!
এ কথায় শান্তিই আগে মুখে আঁচল দিয়ে খিল্খিল্ করে হেসে উঠল—তারপরে বাকি সকলে তার সঙ্গে যোগ দিলে। হ্যাঁ, এটা একটা নতুন ও ভারি মজার খবর বটে, মেয়ে-গজালির কিছুদিনের মতো খোরাক সংগ্রহ হলো। আমচুরি কাঁটালচুরির গল্প একটু একঘেঁয়ে হয়ে পড়েছিল।
ঠিক পরের দিনই এক অপ্রত্যাশিত ব্যাপার ঘটল। শ্রীপতির মেজ ভাই উমাপতি গাঁয়ে এসে বাড়ির চাবি খুলে লোক লাগিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার করতে লাগল। তার দাদা বৌদিদিকে নিয়ে শীগ্গির আসবে এবং কিছুদিন নাকি গাঁয়েই বাস করবে। বৌদিদি পাড়াগাঁ কখনো দেখেননি,—গ্রামে আসবার তাঁর খুব আগ্রহ। তার দাদাও কলকাতায় বদলি হবার চেষ্টা করছে।
মেয়ে মজলিসে সবাই তো অবাক। শ্রীপতি কোন্ মুখে অজাতের বউ নিয়ে গাঁয়ে এসে উঠবে। মানুষের একটা লজ্জা-শরমও তো থাকে, করেই ফেলেছিস না হয় একটা অকাজ। এসব কি খিরিস্টানি কাণ্ডকারখানা, কালে কালে হলো কী! আর সে ধিঙ্গি মাগীটারই বা কী ভরসা, ব্রাহ্মণদের মধ্যে ব্রাহ্মণপাড়ায় বিয়ের বউ সেজে সে কোন সাহসে আসবে।
শ্রীপতি অবিশ্যি বৌ নিয়ে পৈতৃক বাড়িতে আসার বিষয়ে এঁদের মত জিজ্ঞাসা করেনি। একদিন একখানা নৌকো এসে গ্রামের ঘাটে দুপুরের সময় লাগল এবং নৌকো থেকে নামল শ্রীপতি, তার নববিবাহিত বধূ, একটা ছোক্রা চাকর ও দুটি ট্রাঙ্ক ও একটা বড় বিছানার মোট, একটা ঝুড়ি-বোঝাই টুকিটাকি জিনিস। ঘাটে দু-একজন যারা অত বেলায় স্নান করছিল, তারা তখুনি পাড়ার মধ্যে গিয়ে খবরটা সবাইকে বললে। তখন কিন্তু কেউ এলো না, অত বেলায় এখন শ্রীপতিদের বাড়ি গেলে তাদের খেতে বলতে হয়। অসময়ে এখন এসে তারা রান্নাবান্না চড়িয়ে খাবে, সেটা প্রতিবেশী হয়ে হতে দেওয়া কর্তব্য নয়, সুতরাং সে ঝঞ্ঝাট ঘাড়ে করবার চেয়ে এখন না যাওয়াই বুদ্ধির কাজ।
কিন্তু রাসু চক্কতি আর প্রিয় মুখুজ্যের বাড়ির মেয়েরা অত সহজেই রেহাই পেলেন না। শ্রীপতি নিজে গিয়ে একেবারে অন্তঃপুরের মধ্যে ঢুকে বললে—ও পিসিমা, ও বৌদিদি, আপনারা আপনাদের বৌকে হাতে ধরে ঘরে না তুললে কে আর তুলবে? আসুন সবাই। বাধ্য হয়ে কাছাকাছির দু-তিন বাড়ির মেয়েরা শাঁক হাতে, জলের ঘটি হাতে নতুন বৌকে ঘরে তুলতে এলেন—খানিকটা চক্ষুলজ্জায়, খানিকটা কৌতূহলে। মজা দেখবার প্রবৃত্তি সকলের মধ্যেই আছে। ছোটবড় ছেলেমেয়েও এলো অনেকে, শান্তি এলো, কমলা এলো, সারদা এলো।
শ্রীপতিদের বাড়ির উঠোনে লিচুতলায় একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, দূর থেকে মেয়েটির ধপ্ধপে ফর্সা গায়ের রং ও পরনের দামি সিল্কের শাড়ি দেখে সকলে অবাক হয়ে গেল। সামনে এসে আরো বিস্মিত হবার কারণ ওদের ঘটল—মেয়েটির অনিন্দ্যসুন্দর মুখশ্রী দেখে। কী ডাগর ডাগর চোখ! কী সুকুমার লাবণ্য সারা অঙ্গে। সর্বোপরি মুখশ্রী—অমন ধরনের সুন্দর মুখ এসব পাড়াগাঁয়ে কেউ কখনো দেখেনি।
সকলে আশা করেছিল গিয়ে দেখবে কালো কালো একটা মোটা-মতো মাগী আধ-ঘোমটা দিয়ে উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্যাট্ প্যাট্ করে চেয়ে রয়েছে ওদের দিকে। কিন্তু তার পরিবর্তে দেখল, এক নম্রমুখী সুন্দরী তরুণী মূর্তি…। মুখখানি এত সুকুমার যে, মনে হয় ষোল-সতেরো বছরের বালিকা।
বিকেলে ওপাড়ার নিতাই মুখুজ্যের বৌ ঘাটের পথে চক্কত্তি-গিনি্নকে জিজ্ঞেস করলেন—কী দিদি, শ্রীপতির বৌ দেখলে নাকি? কেমন দেখতে?
চক্কত্তি-গিন্নি বললেন—না, দেখতে বেশ ভালোই—
চক্কত্তি-গিন্নির সঙ্গে শান্তি ছিল, সে হাজার হোক ছেলেমানুষ, ভালো লাগলে পরের প্রশংসার বেলায় সে এখনো কার্পণ্য করতে শেখেনি, সে উচ্ছ্বসিত সুরে বলে উঠলে—চমৎকার, খুড়িমা, একবার গিয়ে দেখে আসবেন, সত্যিই অদ্ভুত ধরনের ভালো।
নিতাই মুখুজ্যের বৌ পরের এতখানি প্রশংসা শুনতে অভ্যস্ত ছিলেন না—বুঝতে পারলেন না শান্তি কথাটা ব্যঙ্গের সুরে বলছে, না সত্যিই বলছে। বললেন—কী রকম ভালো?
এবার চক্কত্তি-গিনি্ন নিজেই বললেন—না, বৌ যা ভেবেছিলাম তা নয়। বৌটি সত্যিই দেখতে ভালো। আর কেনই বা হবে না বলো শহরের মেয়ে, দিনরাত সাবান ঘষছে, পাউডার ঘষছে, তোমার-আমার মতো রাঁধতে হতো, বাসন মাজতে হতো, তো দেখতাম চেহারার কত জলুস বজায় রাখে।
এই বয়সে তো দূরের কথা, তাঁর বিগত যৌবন দিনেও অজস্র পাউডার সাবান ঘষলেও যে কখনো তিনি শ্রীপতির বৌয়ের পায়ের নখের কাছে দাঁড়াতে পারতেন না—চক্কত্তি-গিন্নির সম্বন্ধে শান্তির একথা মনে হলো। কিন্তু চুপ করে রইল সে।
বিকেলে এ-পাড়ার ও-পাড়ার মেয়েরা দলে দলে বৌ দেখতে এলো। অনেকেই বললে, এমন রূপসী মেয়ে তারা কখনো দেখেনি। কেবল হরিচরণ রায়ের স্ত্রী বললেন—আর বছর তারকেশ্বরে যাবার সময় ব্যান্ডেল স্টেশনে তিনি একটি বৌ দেখেছিলেন, সেটি এর চেয়েও রূপসী।
মেয়ে-মজলিসে পরদিন আলোচনার একমাত্র বিষয় দাঁড়াল শ্রীপতির বউ। দেখা গেল তার রূপ সম্বন্ধে দু-মত নেই সভ্যদের মধ্যে, কিন্তু তার চরিত্র সম্বন্ধে নানারকম মন্তব্য অবাধে চলেছে।
—ধরন-ধারণ যেন কেমন-কেমন—অত সাজগোজ কেন রে বাপু?
—ভালো ঘরের মেয়ে নয়। দেখলেই বোঝা যায়—
—বাসন মাজতে হলে ও-হাত আর বেশিদিন অত সাদাও থাকবে না, নরমও থাকবে না।
—ঠ্যালা বুঝবেন পাড়াগাঁয়ের। গলায় নেক্লেস ঝুলুতে আমরাও জানি—
—বেশ একটু ঠ্যাকারে। পাড়াগাঁয়ে মাটিতে যেন গুমরে পা পড়ছে না, এমনি ভাব। বামুনের ঘরে বিয়ে হয়ে ভাবছে যেন কী—
—তা তো হবেই, বদ্দি বামুনের মেয়ে, বামুনের ঘরে এসেছে, ওর সাত-পুরুষের সৌভাগ্যি না?
নববধূর স্বপক্ষে বললে কেবল শান্তি ও কমলা। শান্তি ঝাঁজের সঙ্গে বললে—তোমরা কারো ভালো দেখতে পার না বাপু! কেন ওসব বলবে একজন ভদ্দর ঘরের মেয়ের সম্বন্ধে? কাল বিকেলে আমি গিয়ে কতক্ষণ ছিলাম নতুন বৌয়ের কাছে। কোনো ঠ্যাকার নেই, অহংকার নেই, চমৎকার মেয়ে!
কমলা বললে—আমাদের উঠতে দেয় না কিছুতেই—কত গল্প করলে, খাবার খেতে দিলে, চা করলে—আর, খুব সাজগোজ কি করে? সাদাসিধে শাড়ি সেমিজ পরে তো ছিল। তবু খুব ফর্সা কাপড়চোপড়—ময়লা একেবারে দুচোখে দেখতে পারে না—
শান্তি বললে—ঘরগুলো এরই মধ্যে কী চমৎকার সাজিয়েছে! আয়না, পিক্চার, দোপাটি ফুলের তোড়া বেঁধে ফুলদানিতে রেখে দিয়েছে—শ্রীপতিদার বাপের জন্মে কখনো অমন সাজানো ঘরদোরে বাস করেনি—ভারি ফিটফাট গোছালো বৌটি—
দিন দুই পরে ডোবার ঘাটে নববধূকে একরাশ বাসন নিয়ে নামতে দেখে সকলে অবাক হয়ে গেল। চারদিকে বনে ঘেরা ঝুপসি আধ-অন্ধকার ডোবাটা যেন মেয়েটির স্নিগ্ধ রূপের প্রভায় এক মুহূর্তে আলো হয়ে উঠল, একথা যারা তখন ডোবার অন্যান্য ঘাটে ছিল, সবাই মনে মনে স্বীকার করলে। দৃশ্যটাও যেন অভিনব ঠেকলে সকলের কাছে, এমন একটা পচা এঁদো জঙ্গলে ভরা পাড়াগেঁয়ে ডোবার ঘাটে সাধারণত কালো কালো, আধ-ময়লা শাড়িপরা শ্রীহীনা ঝি-বৌ বা ত্রিকালোত্তীর্ণ প্রৌঢ়া বিধবাদের গামছা-পরিহিতা মূর্তিই দেখা যায়, বা দেখার আশা করা যায়—সেখানে এমন একটি আধুনিক ছাঁদে খোঁপা বাঁধা, ফর্সা শাড়ি ব্লাউজ-পরা, রূপকথার রাজকুমারীর মতো রূপসী, নব-যৌবনা বধূ সজনেতলার ঘাটে বসে ছাই দিয়ে নিটোল সুগৌর হাতে বাসন মাজছে, এ দৃশ্যটা খাপ খায় না। সকলের কাছেই এটা খাপছাড়া বলে মন হলো। প্রৌঢ়ারাও ভেবে দেখলে গত বিশ-ত্রিশ বছরের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটেনি এই ক্ষুদ্র ডোবার ইতিহাসে।
রায়পাড়ার একটি প্রৌঢ়া বললেন—আ-হা, বৌ তো নয়, যেন পিরতিমে—কিন্তু অত রূপ নিয়ে কি এই ডোবায় নামে বাসন মাজতে! না ও হাতে কখনোই ছাই দিয়ে বাসন মাজা অভ্যেস আছে! হাত দেখেই বুঝেছি।
তার পর থেকে দেখা গেল ঘর-সংসারের যা কিছু কাজ শ্রীপতির বৌ সব নিজের হাতে করছে।
ইতিমধ্যে শ্রীপতির কলকাতায় বদলি হবার খবর আসতে সে চলে গেল বাড়ি থেকে। পাড়ার মেয়েদের মধ্যে শান্তি ও কমলা শ্রীপতির বৌয়ের বড় ন্যাওটা হয়ে পড়ল। সকাল নেই বিকেল নেই, সব সময়েই দেখা যায় শান্তি ও কমলা বসে আছে ওখানে।
পাড়াগাঁয়ের গরিব ঘরের মেয়ে, অমন আদর করে কেউ কখনো রোজ রোজ ওদের লুচি-হালুয়া খেতে দেয়নি।
একদিন কমলা বলে—বৌদিদি, তোমার ঘরে কাপড়-মোড়া ওটা কী?
শ্রীপতির বৌ বলল, ওটা এসরাজ।
—বাজাতে জানো বৌদি?
—একটুখানি অমনি জানি ভাই, কিন্তু এ্যাদ্দিন ওকে বার পর্যন্ত করিনি। কেন জানো গাঁয়েঘরে কে কী হয়তো মনে করবে।
শান্তি বলল, নিজের বাড়ি বসে বাজাবে, কে কী মনে করবে? একটু বাজিয়ে শোনাও না, বৌদি!
একটু পরে রায়-গিন্নি ঘাটে যাবার পথে শুনতে পেলেন বাড়ির মধ্যে কে বেহালা না কী বাজাচ্ছে, চমৎকার মিষ্টি। কোনো ভিখিরি গান গাচ্ছে বুঝি? দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ শুনে তিনি ঘাটে চলে গেলেন।
ঘাটে গিয়ে তিনি মজুমদার-বৌকে বললেন কথাটা।
ওই শ্রীপতির বাড়ি কে একজন বোষ্টম বেহালা বাজাচ্ছে শুনে এলাম। কী চমৎকার বাজাচ্ছে দিদি, দুদণ্ড দাঁড়িয়ে শুনতে ইচ্ছে করে।
দুপুরের মেয়ে-মজলিশে শান্তির মা বললেন—শ্রীপতির বৌ চমৎকার বাজাতে পারে, এসরাজ না কী বলে, এ রকম বেহালার মতো। শান্তিদের ওবেলা শুনিয়েছিল—
রায়-বৌ বললেন, ও! তাই ওবেলা নাইতে যাবার সময় শুনলাম বটে। সে যে ভারি চমৎকার বাজনা গো, আমি বলি বুঝি কোনো ফকির বোষ্টম ভিক্ষে করতে এসে বাজাচ্ছে।
এমন সময় শান্তি আসতেই তার মা বললেন, ওই জিজ্ঞেস কর না শান্তিকে।
শান্তি বলল, উঃ, সে আর তোমায় কী বলব খুড়িমা, বৌদিদি যা বাজাল, অমন কখনো শুনিনি—শুনবে তোমরা? তাহলে এখন বলি বাজাতে—বললেই বাজাবে।
শান্তি শ্রীপতিদের বাড়ি চলে যাবার অল্প পরেই শোনা গেল শ্রীপতির বৌয়ের এসরাজ বাজনা। অনেকক্ষণ কারো মুখে কথা রইল না।
চক্কত্তি-গিন্নি বললেন, আহা, বড় চমৎকার বাজায় তো!
সকলেই স্বীকার করল শ্রীপতির বৌকে আগে যা ভাবা গিয়েছিল, সে-রকম নয়, বেশ মেয়েটি।
এসরাজ বাজনার মধ্য দিয়ে পাড়ার সকলের সঙ্গে শ্রীপতির বৌয়ের সহজভাবে আলাপ পরিচয় জমে উঠল। দুপুরে, সন্ধ্যায় প্রায়ই সবাই যায় শ্রীপতিদের বাড়ি বাজনা শুনতে।
তারপর গান শুনল সবাই একদিন। পূর্ণিমার রাত্রে জ্যোৎস্নাভরা ভেতর-বাড়ির রোয়াকে বসে বৌ এসরাজ বাজাচ্ছিল, পাড়ার সব মেয়েই এসে জুটেছে। শ্রীপতি বাড়ি নেই।
কমলা বলল, আজ বৌদি একটা গান গাইতেই হবে—তুমি গাইতেও জানো ঠিক—শোনাও আজকে।
বৌদি হেসে বলল, কে বলেছে ঠাকুরঝি আমি গাইতে জানি?
—না, ওসব রাখো—গাও একটা।
সকলেই অনুরোধ করল। বলল, গাও বৌমা, এ পাড়ায় মানুষ নেই, আস্তে আস্তে গাও, কেউ শুনবে না।
শ্রীপতির বৌ একখানা মীরার ভজন গাইল।
রাণাজি, ম্যায় গিরধর কে ঘর যাঁহু
গিরধর মেরা সাচো প্রিতম্ দেখত রূপ লুভাঁউ।
গায়িকার চোখে-মুখে কী ভক্তিপূর্ণ তন্ময়তার শোভা ফুটে উঠল গানখানা গাইতে গাইতে—শান্তি একটা গন্ধরাজ আর টগরের মালা গেঁথে এনেছিল বৌদিদিকে পরাবে বলে—গান গাইবার সময়ে সে আবার সেটা বৌয়ের গলায় আলগোছে পরিয়ে দিল—সেই জ্যোৎস্নায় সাদা সুগন্ধি ফুলের মালা গলায় রূপসী বৌয়ের মুখে ভজন শুনতে শুনতে মন্টুর মায়ের মনে হলো এই মেয়েটিই সেই মীরাবাই, অনেককাল পরে পৃথিবীতে আবার নেমে এসেছে, আবার সবাইকে ভক্তির গান গেয়ে শোনাচ্ছে।
মন্টুর মা একটু বাইরের খবর রাখতেন, যাত্রায় একবার মীরাবাই পালা দেখেছিলেন তার বাপের বাড়ির দেশে।
তারপর আর একখানা হিন্দিগান গাইল বৌ, এঁরা অবিশ্যি কিছু বুঝলেন না। তবে তন্ময় হয়ে শুনলেন বটে।
তারপর একখানা বেহাগ। বাংলা গান এবার। সকলে শুয়ে পড়ল। শান্তির চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। অনেকে দেখল বৌয়েরও চোখ দিয়ে জল পড়ছে গান গাইতে গাইতে—রূপসী গায়িকা একেবারে যেন বাহ্যজ্ঞান ভুলে গিয়েছে গানে তন্ময় হয়ে।
সেদিন থেকেই সকলে শ্রীপতির বৌকে অন্য চোখে দেখতে লাগল।
ওর সম্বন্ধে ক্রমে উচ্চ ধারণা করতে সকলে বাধ্য হলো আরো নানা ঘটনায়। পাড়াগাঁয়ে সকলেই বেশ হুঁশিয়ার, এ কথা আগেই বলেছি। ধার দিয়ে—সে যদি এক খুঁচি চাল কি দু পলা তেলও হয়—তার জন্যে দশবার তাগাদা করতে এদের বাধে না। কিন্তু দেখা গেল শ্রীপতির বৌ সম্পূর্ণ দিলদরিয়া মেজাজের মেয়ে। দেবার বেলায় সে কখনো না বলে কাউকে ফেরায় না, যদি জিনিসটা তার কাছে থাকে। একেবারে মুক্তহস্ত সে বিষয়ে—কিন্তু আদায় জানে না, তাগাদা করতে জানে না, মুখে তার রাগ নেই, বিরক্তি নেই, হাসিমুখ ছাড়া তার কেউ কখনো দেখেনি।
শ্রীপতির বৌয়ের আপন-পর জ্ঞান নেই, এটাও সবাই দেখল। পাশের বাড়িতে চক্কত্তি-গিন্নি বিধবা, একাদশীর দিন দুপুরে তিনি নিজের ঘরে মাদুর পেতে শুয়ে আছেন, শ্রীপতির বৌ এক বাটি তেল নিয়ে এসে তাঁর পায়ে মালিশ করতে বসে গেল। যেন ও তাঁর নিজের ছেলের বৌ।
চক্কত্তি-গিন্নি একটু অবাক হলেন প্রথমটা। পাড়াগাঁয়ে এ রকম কেউ করে না, নিজের ছেলের বৌয়েই করে না তো অপরের বৌ।
—এসো, এসো মা আমার এসো। থাক থাক, তেল মালিশ আবার কেন মা? তোমায় ওসব করতে হবে না, পাগলি মেয়ে—
এই পাগলি মেয়েটি কিন্তু শুনল না। সে জোর করেই বসে গেল তেল মালিশ করতে। মাথার চুল এসে অগোছালোভাবে উড়ে এসেছে মুখে, সুগৌর মুখে অতিরিক্ত গরমে ও শ্রমে কিছু কিছু ঘাম দেখা দিয়েছে—চক্কত্তি-গিন্নি এই সুন্দরী বৌটির মুখ থেকে চোখ যেন অন্যদিকে ফেরাতে পারলেন না। বড় স্নেহ হলো এই আপন-পর জ্ঞানহারা মেয়েটার ওপর।
ইতিমধ্যে কমলার বিয়ে হয়ে গেল। শ্বশুরবাড়ি যাবার সময়ে সে শ্রীপতির বৌয়ের গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলল, বৌদিদি, তোমায় কী করে ছেড়ে থাকব, ভাই? মাকে ছেড়ে যেতে কত কষ্ট না হচ্ছে, তত হচ্ছে তোমায় ছেড়ে যেতে।…এই এক ব্যাপার থেকেই বোঝা যাবে শ্রীপতির বৌ এই অল্প কয়েক মাসের মধ্যে গ্রামের তরুণ মনের কী রকম প্রভাব বিস্তার করেছিল।
পূজার সময় এসে পড়েছে। আশ্বিনের প্রথম, শরতের নীল আকাশে অনেক দিন পরে সোনালি রোদের মেলা, বনশিমের ফুল ফুটেছে ঝোপে ঝোপে, নদীর চরে কাশফুলের শোভা। পাশের গ্রাম সত্রাজিৎপুরে বাঁড়ুজ্যে-বাড়ি পুজো হয় প্রতিবছর, এবারও শোনা যাচ্ছে মহানবমীর দিন তাদের বাড়ি আর বছরের মতো যাত্রা হবে কাঁচড়াপাড়ার দলের।
শ্রীপতির বৌ গান-পাগলা মেয়ে, এ কথাটা এত দিনে এ গাঁয়ের সবাই জেনেছে। তার দিন নেই, রাত নেই, গান লেগে আছে, দুপুরে রাত্রে রোজ এসরাজ বাজায়। গান সম্বন্ধে কথা সর্বদা তার মুখে। শান্তির এখনো বিয়ে হয়নি; যদিও সে কমলার বয়সী। সে শ্রীপতির বৌয়ের কাছে আজকাল দিনরাত লেগে থাকে গান শেখবার জন্যে।
একদিন শ্রীপতির বৌ তাকে বলল, ভাই শান্তি, এক কাজ করবি, সত্রাজিৎপুরে তো যাত্রা হবে বলে সবাই নেচেছে। আমাদের পাড়ার মেয়েরা তো আর দেখতে পাবে না? তারা কি আর অপর গাঁয়ে যাবে যাত্রা শুনতে? অথচ এরা কখনো কিছু শোনে না—আহা! এদের জন্যে যদি আমরা আমাদের পাড়াতেই থিয়েটার করি?
শান্তি তো অবাক। থিয়েটার? তাদের এই গাঁয়ে? থিয়েটার জিনিসটার নাম শুনেছে বটে সে, কিন্তু কখনো দেখেনি। বলল, কী করে করবে, বৌদি কী যে তুমি বলো। তুমি একটা পাগল।
শ্রীপতির বৌ হেসে বলল, সেসব বন্দোবস্ত আমি করব এখন। তোকে ভেবে মরতে হবে না—দ্যাখ না কী করি।
সপ্তাহখানেক পর শ্রীপতি যেমন শনিবারের দিন বাড়ি আসে তেমনি এলো। সঙ্গে তিনটি বড় মেয়ে ও দুটি ছোট মেয়ে ও চার-পাঁচটি ছেলে। বড় মেয়ে তিনটির ষোলো-সতেরো এমনি বয়স, সকলেই ভারি সুন্দরী, ছোট মেয়ে দুটির মধ্যে যেটির বয়স তেরো, সেটি তত সুবিধে নয়, কিন্তু যেটির বয়স আন্দাজ দশ—তাকে দেখে রক্তমাংসের জীব বলে মনে হয় না, মনে হয় যেন মোমের পুতুল। ছেলেদের বয়স পনেরোর বেশি নয় কারো। সকলেই সুবেশ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।
শান্তি, শান্তির মা এবং চক্কত্তি-গিন্নি তখন সেখানেই উপস্থিত ছিলেন। শ্রীপতির বৌ ওদের দেখে ছুটে গেল রোয়াক থেকে উঠোনে নেমে। উচ্ছ্বসিত আনন্দের সুরে বলল, এই যে রমা, পিন্টু, তারা, এই যে শিব, আয় আয় সব কেমন আছিস? ওঃ কত দিন দেখিনি তোদের—
রমা বলে ষোলো-সতেরো বছরের সুন্দরী মেয়েটি ওর গলা জড়িয়ে ধরল, সকলেই ওকে প্রণাম করে পায়ের ধুলো নিল।
—দিদি কেমন আছিস, ভাই—
—একটু রোগা হয়ে গেছিস দিদি—
—ওঃ, কত দিন যে তোকে দেখিনি—
—দাদাবাবু যখন বললেন তোর এখানে আসতে হবে, আমরা তো—
—আহিরীটোলাতে মিউজিক কম্পিটিশন ছিল—নাম দিয়েছিলাম—ছেড়ে চলে এলাম—
মেয়েগুলোর মুখ, রং, গড়ন শ্রীপতির বৌয়ের মতো। রমা তো একেবারে হুবহু ওর মতো দেখতে, কেবল যা কিছু বয়সের তফাত। জানা গেল মেয়ে দুটির মধ্যে রমা ও তার ছোট সতী, এবং ছেলেমেয়েদের মধ্যে বারো বছরের ফুটফুটে ছেলে শিবু শ্রীপতির বৌয়ের আপন ভাইবোন, বাকি সবই কেউ খুড়তুতো, কেউ জ্যাঠাতুতো ভাইবোন।
ক্রমে আরো জানা গেল শ্রীপতির বৌ এদের চিঠি লিখিয়ে আনিয়েছে থিয়েটার করানোর জন্যে।
পাড়ার সবাই এদের রূপ দেখে অবাক। এসব পাড়াগাঁয়ে অমন চেহারার ছেলেমেয়ে কেউ কল্পনাই করতে পারে না। দশ বছরের সেই ছেলেটির নাম পিন্টু, সে শান্তির বড় ন্যাওটা হয়ে গেল। সে আবার একটা সাঁতার দেবার নীল রঙের পোশাক এনেছে, সিক্ত নীল পোশাক সুগৌর দেহে যখন সে নদীর ঘাটে স্নান করে উঠে দাঁড়ায়—তখন ঘাটসুদ্ধ মেয়েরা, বোস-গিন্নি, মন্টুর মা, শান্তির মা, মজুমদার-গিন্নি ওর দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকেন। রূপ আছে বটে ছেলেটির! শান্তি দস্তুর মতো গর্ব অনুভব করে, যখন পিন্টু অনুযোগ করে বলে, আঃ শান্তিদি, আসুন না উঠে, ভিজে কাপড়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব? আসুন বাড়ি যাই।
পূজা এসে পড়ল। এ-গাঁয়ে কোনো উৎসব নেই পূজার, গরিবদের গাঁয়ে পূজা কে করবে? দূর থেকে সত্রাজিৎপুরের বাঁড়ুজ্যে-বাড়ির ঢাক শুনেই গাঁয়ের মেয়েরা সন্তুষ্ট হয়। ভিনগাঁয়ে গিয়ে মেয়েদের পূজা দেখবার রীতি না থাকায় অনেকে দশ-পনেরো কি বিশ বছর দুর্গাপ্রতিমা পর্যন্ত দেখেনি। মেয়েদের জীবনে কোনো উৎসব-আমোদ নেই এ গাঁয়ে।
শ্রীপতির বৌ তাই একদিন শান্তিকে বলেছিল, সত্যি কী করে যে তোরা থাকিস ঠাকুরঝি—একটু গান নেই, বাজনা নেই, বই পড়া নেই, মানুষ যে কেমন করে থাকে এমন করে।
বোধ হয় সেই জন্যেই এত উৎসাহের সঙ্গে ও লেগেছিল থিয়েটারের ব্যাপারে।
শ্রীপতিদের বাড়ির লম্বা বারান্দায় একধাপে তক্তপোশ পেতে দড়ি টাঙিয়ে হলদে শাড়ি ঝুলিয়ে স্টেজ করা হয়েছে।
শ্রীপতির বৌ ভাইবোনদের নিয়ে সকাল থেকে খাটছে।
শান্তি বলল, তুমি এত জানলে কী করে, বৌদি।
রমা বলল, তুমি জানো না দিদিকে শান্তিদিদি। দিদি অল বেঙ্গল মিউজিক কম্পিটিশনে—
শ্রীপতির বৌ ধমক দিয়ে বোনকে থামিয়ে দিয়ে বলল, নে, নে—যা, অনেক কাজ বাকি, এখন তোর অত বক্তৃতা করতে হবে না দাঁড়িয়ে—
রমা না থেমে বলল, আর খুব ভালো পার্ট করার জন্যেও সোনার মেডেল পেয়েছে…।
যতবার পয়লা বোশেখের দিন আমাদের বাড়িতে থিয়েটার হয়, দিদিই তো তার পাণ্ডা—জানো আমাদের কি নাম দিয়েছেন জ্যাঠামশায়?
শ্রীপতির বৌ বলল, আবার?
রমা হেসে থেমে গেল।
মহাষ্টমীর দিন আজ। শুধু মেয়েদের আর ছোট ছোট ছেলেদের নিয়ে থিয়েটার দেখবে। শুধু মেয়েরাই—সমস্ত পাড়া কুড়িয়ে সব মেয়ে এসে জুটেছে থিয়েটার দেখতে।
ছোট্ট নাটকটি। শ্রীপতির বৌয়ের জ্যাঠামশায়ের নাকি লেখা। রাজকুমারকে ভালোবেসেছিল তাঁরই প্রাসাদের একজন পরিচারিকার মেয়ে। ছেলেবেলায় দুজনে খেলা করেছে। বড় হয়ে দিগ্বিজয়ে বেরুলেন রাজপুত্র, অন্য দেশের রাজকুমারী ভদ্রাকে বিবাহ করে ফিরলেন। পরিচারিকার মেয়ে অনুরাধা তখন নব-যৌবনা কিশোরী, বিকশিত মলি্লকা-পুষ্পের মতো শুভ্র, পবিত্র। খুব ভালো নাচতে-গাইতে শিখেছিল সে ইতিমধ্যে। রাজধানীর সবাই তাকে চেনে, জানে—নৃত্যের অমন রূপ দিতে কেউ পারে না। এদিকে ভদ্রাকে রাজ্যে এনে রাজকুমার এক উৎসব করলেন। সে সভায় অনুরাধাকে নাচতে-গাইতে হলো রাজপুত্রের সামনে ভাড়া করা নর্তকী হিসেবে। তার বুক ফেটে যাচ্ছে, অথচ সে একটা কথাও বলল না, নৃত্যের মধ্য দিয়ে সংগীতের মধ্য দিয়ে জীবনের ব্যর্থ প্রেমের বেদনা সে নিবেদন করল প্রিয়ের উদ্দেশে। এর পরে কাউকে কিছু না বলে দেশ ছেড়ে পরদিন একা একা কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেল।
শ্রীপতির বৌ অনুরাধা, রমা ভদ্রা। ওর অন্য সব ভাই-বোনও অভিনয় করল। শ্রীপতির বৌ বেশভূষায়, রূপে, গলে দোদুল্যমান জুঁইফুলের মালায় যেন প্রাচীন যুগের রূপকথার রাজকুমারী, রমাও তাই, গানে গানে অনুরাধা তো স্টেজ ভরিয়ে দিল, আর কী অপূর্ব নৃত্যভঙ্গি! সতী, রমা, পিন্টুও কি চমৎকার অভিনয় করল, আর কী চমৎকার মানিয়েছে ওদের!
তারপর বহুকাল পরে পথের ধারে মুমূর্ষু অনুরাধার সঙ্গে রাজপুত্রের দেখা। সে বড় মর্মস্পর্শী করুণ দৃশ্য! অনুরাধার গানের করুণ সুরপুঞ্জে ঘরের বাতাস ভরে গেল। চারদিকে শুধু শোনা যাচ্ছিল কান্নার শব্দ, শান্তি তো ফুলে ফুলে কেঁদে সারা।
অভিনয় শেষ হলো, তখন রাত প্রায় এগারোটা। গ্রামের মেয়েরা কেউ বাড়ি চলে গেল না। তারা শ্রীপতির বৌকে ও রমাকে অভিনয়ের পর আবার দেখতে চায়। শ্রীপতির বৌ ও তার ভাইবোনদের রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে চক্কত্তি-গিন্নি, শান্তির মা ও মন্টুর মা খেতে বসিয়ে দিলেন আর ওদের চারিধার দিয়ে পাড়ার যত মেয়ে।
ও পাড়ার রাম গাঙ্গুলীর বৌ বললেন, বৌমা যে আমাদের এমন তা তো জানিনে! ওমা এমন জীবন তো কখনো দেখিনি—
মন্টুর মা বললেন, আর ভাইবোনগুলোও কি সব হিরের টুকরো! যেমন সব চেহারা তেমনি গান—
শান্তি তো তার বৌদিদির পিছু পিছু ঘুরছে, তার চোখ থেকে অভিনয়ের ঘোর এখনো কাটেনি, সেই জুঁইফুলের মালাটি বৌদির গলা থেকে সে এখনো খুলতে দেয়নি। ওর দিক থেকে অন্যদিকে সে চোখ ফেরাতে পারছে না যেন।
চক্কত্তি-গিন্নি বললেন, আর কী গলা আমাদের বৌমার আর রমার। পিন্টু অতটুকু ছেলে, কী চমৎকার করল।…
শান্তির মা বললেন, পিন্টু খাচ্ছে না, দেখ সেজ বৌ। আর একটু দুধ দি, কটা মেখে নাও বাবা, চেঁচিয়ে তো খিদে পেয়ে গিয়েছে।…কী চমৎকার মানিয়েছিল পিন্টুকে, না সেজ বৌ?
—একে ফুটফুটে সুন্দর ছেলে…
শ্রীপতির বৌ হাজার হোক ছেলেমানুষ, সকলের প্রশংসায় সে এমন খুশি হয়ে উঠল যে খাওয়াই হলো না তার। সলজ্জ হেসে বলল, জ্যাঠামশায় আমাদের বলেন কিন্নর দল—এখন ঐ নামে আমাদের—
রমা হেসে ঘাড় দুলিয়ে বলল, নিজে যে বললে দিদি, আমি বলতে যাচ্ছিলুম, আমায় তবে ধমক দিলে কেন তখন?
তারা বলল, নামটি বেশ, কিন্নর দল, না? আমাদের শ্যামবাজারের পাড়ায় কিন্নর দল বলতে সবাই চেনে—
রমা বলল, কৃত্রিম গর্বের সঙ্গে—প্রায় এক ডাকে চেনে—হুঁ হুঁ—
তারপর এই রূপবান বালক-বালিকার দল, সকলে একযোগে হঠাৎ খিলখিল করে মিষ্টি হাসি হেসে উঠল।
সতী হাসতে হাসতে বললে—বেশ নামটি, কিন্নর দল, না?
এমন একদল সুশ্রী চেহারার ছেলেমেয়ে, তার ওপর তাদের এমন অভিনয় করার ক্ষমতা, এমন গানের গলা, এমন হাসি-খুশি মিষ্টি স্বভাব, সকলেরই মন হরণ করবে তার আশ্চর্য কী?
মন্টুর মা ভাবলেন, কিন্নর দলই বটে।…
ওদের খেতে খেতে হাসি গল্প করতে মহাষ্টমীর নিশি ভোর হয়ে এলো!
শ্রীপতির বৌ বলল, আসুন, বাকি রাতটুকু আর সব বাড়ি যাবেন কেন? গল্প করে কাটানো যাক।
শ্রীপতি বাড়ি নেই, সে সত্রাজিৎপুরের বাঁড়ুজ্যে-বাড়ির নিমন্ত্রণে গিয়েছে, আজ রাত্রের যাত্রা দেখে সকালে ফিরবে। সেই জন্যে সকলে বলল, তা ভালো, কিন্তু বৌমা তোমাকে গান গাইতে হবে!
শান্তি বলল, বৌদি, অনুরাধার সেই গানটা গেও আরেকবার, আহা, চোখে জল রাখা যায় না শুনলে।
শ্রীপতির বৌ গাইল, রমা এসরাজ বাজাল। তারপর রমা ও তারা একসঙ্গে গাইল। একটিমাত্র তেড়ো-পাখি বাঁশগাছের মগডালে কোথায় ডাক আরম্ভ করেছে। রাত ফরসা হলো।
সে মহাষ্টমীর রাত্রি থেকে গ্রামের সবাই জানল শ্রীপতির বৌ কী ধরনের মেয়ে।
কেবল তারা জানল না যে শ্রীপতির বৌ-প্রতিভাশালিনী গায়িকা, সত্যিকার আর্টিস্ট। সে ভালোবেসে শ্রীপতিকে বিয়ে করে এই পাড়াগাঁয়ের বনবাস মাথায় করে নিয়ে, নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছেড়েছে, যশের আশা, অর্থের আশা, আর্টের চর্চা পর্যন্ত ত্যাগ করেছে। তবু গানের ঝোঁক ওকে ছাড়ে না—ভূতে পাওয়ার মতো পেয়ে বসে—দিনরাত তাই ওর মুখে গান লেগেই আছে, তাই আজ মহাষ্টমীর দিন সেই নেশার টানেই এই অভিনয়ের আয়োজন করেছে।
শান্তি কিছুতেই ছাড়তে চায় না ওকে। বলে, তুমি কোথাও যেও না, বৌদিদি, আমি মরে যাব, এখানে তিষ্ঠুতে পারব না। শান্তি আজকাল শ্রীপতির বৌয়ের কাছে গান শেখে, গলা মন্দ নয় এবং এদিকে খানিকটা গুণ থাকায় সে এরই মধ্যে বেশ শিখে ফেলেছে। কিছু কিছু বাজাতেও শিখেছে। গান-বাজনায় আজকাল তার ভারি উৎসাহ। শ্রীপতির বৌ গান-বাজনা যদি পেয়েছে, আর বড় একটা কিছু চায় না, শান্তির সংগীত শিক্ষা নিয়েই সে সব সময় মহাব্যস্ত।
অগ্রহায়ণ মাসের দিকে বৌয়ের বাড়ি থেকে চিঠি এলো রমা কী অসুখ হয়ে হঠাৎ মারা গিয়েছে। শ্রীপতি কলকাতা থেকে সংবাদটা নিয়ে এলো। শ্রীপতির বৌ খুব কান্নাকাটি করল। পাড়াসুদ্ধ সবাই চোখের জল ফেলল ওকে সান্ত্বনা দিতে এসে।
শান্তি সব সময় বৌদির কাছে কাছে থাকে আজকাল। তাকে একদিন শ্রীপতির বৌ বলল, জানিস শান্তি, আমাদের কিন্নর দল ভাঙতে শুরু করেছে, রমাকে দিয়ে আরম্ভ হয়েছে, আমার মন যেন বলছে…
শান্তির বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল, ধমক দিয়ে বলল, থাক ওসব কী যে বলো বৌদি!
কিন্তু শ্রীপতির বৌয়ের কথাই খাটল।
সে ঠিকই বলেছিল, শান্তি ঠাকুরঝি, কিন্নর দলে ভাঙন ধরেছে।
রমার পরে ফাল্গুন মাসের দিকে গেল পিন্টু বসন্ত রোগে। তার আগেই শ্রীপতির বৌ মাঘ মাসে বাপের বাড়ি গিয়েছিল, শ্রাবণ মাসের প্রথমে প্রসব করতে গিয়ে সেও গেল।
এ সংবাদ গ্রামে যখন এলো, শান্তি তখন সেখানে ছিল না, সেই বোশেখ মাসে তার বিবাহ হওয়াতে সে তখন ছিল মোটরি বাণপুরে, ওর শ্বশুরবাড়িতে। গ্রামের অন্য সবাই শুনল, অনাত্মীয়ের মৃত্যুতে খাঁটি অকৃত্রিম শোক এ রকম এর আগে কখনো এ গাঁয়ে করতে দেখা যায়নি। রায়-গিন্নি, চক্কতি-গিন্নি, শান্তির মা, মন্টুর মা কেঁদে ভাসিয়ে দিলেন। ঐ মেয়েটি কোথা থেকে দুদিনের জন্যে এসে তার গানের সুরের প্রভাবে সকলের অকরুণ, কুটিলভাবে পরিবর্তন এনে দিয়েছিল, সে পরিবর্তন যে কতখানি, ওই সময়ে গাঁয়ের মেয়েদের দেখলে বোঝা যেত। ওদের চক্কত্তি-বাড়ির দুপুরবেলায় আড্ডায়, স্নানের ঘাটে শ্রীপতির বৌয়ের কথা ছাড়া অন্য কথা ছিল না।
চক্কত্তি-গিন্নি পেয়েছিলেন সকলের চেয়ে বেশি। শ্রীপতির বৌয়ের কথা উঠলেই তিনি চোখের জল সামলাতে পারতেন না। বলতেন, দুদিনের জন্যে এসে মা আমায় কী মায়াই দেখিয়ে গেল! আমার পেটের মেয়ে অমন কক্ষনো করেনি…আহা! আমার পোড়া কপাল, সে কখনো এ কপালে টেকে!
মন্টুর মামা বলতেন, সে কি আর মানুষ! দেবী অংশে ওসব মেয়ে জন্মায়। নিজের মুখেই বলত হেসে হেসে, ‘আমরা কিন্নর দল খুড়িমা’, শাপভ্রষ্ট কিন্নরীই তো ছিল।…যেমন রূপ, তেমনি স্বভাব, তেমনি গান…ও কি আর মানুষ, মা!
কথা বলতে বলতে মন্টুর মায়ের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ত।
এসবের মধ্যে কেবল কথা বলত না শান্তি। তার বিবাহিত জীবন খুব সুখের হয়নি, ভেবেছিল বাপের বাড়ি এসে বৌদিদির সঙ্গে অনেকখানি জ্বালা জুড়োবে। পূজার পরে কার্তিক মাসের প্রথমে বাপের বাড়ি এসে সব শুনেছিল। বৌদিদি যে তার জীবন থেকে কতখানি হরণ করে নিয়ে গিয়েছে, তা এরা কেউ জানে না। মুখে সেসব পাঁচজনের সামনে ভ্যাজ ভ্যাজ করে বলে লাভ কী? কী বুঝবে লোকে?
বছর দুই পরে একদিনের কথা। গাঁয়ের মধ্যে শ্রীপতির বৌয়ের কথা অনেকটা চাপা পড়ে গিয়েছে। শ্রীপতিও অনেকদিন পরে আবার গ্রামের বাড়িতে যাওয়া-আসা করছে শনিবারে কিংবা ছুটিছাঁটাতে।
শ্রীপতিদের বাড়ি থেকে শান্তিদের বাড়ি বেশি দূর নয়, দুখানা বাড়ির পরেই। শান্তি তখন এখানেই ছিল। অনেক রাত্রে সে শুনল শ্রীপতিদাদাদের বাড়িতে কে গান গাইছে। ঘুমের মধ্যে গানের সুর কানে যেতেই সে ধড়মড় করে বিছানার ওপর উঠে বসল—
বিরহিণী মীরা জাগে তব অনুরাগে, গিরিধর নাগর—
এ কার গলা? ওর গা শিউরে উঠল। ঘুমের ঘোর এক মুহূর্তে ছুটে গেল। কখনো সে ভুলবে জীবনে এ গান, এ গলা? সেই প্রথম পরিচয়ের দিনে ওদের রোয়াকে জ্যোৎস্না রাত্রে বসে এই গানখানা বৌদি প্রথম গেয়েছিল! সেই অপূর্ব করুণ সুর, গানের প্রতি মোচড়ে যেন একটি আকাঙ্ক্ষার প্রাণঢালা আত্মনিবেদন! এ কি আর কারো গলার—ওর কুমারী জীবনের আনন্দভরা দিনগুলোর কত অবসর প্রহর যে এ কণ্ঠের সুরে মধুময়!
ও পাগলের মতো ছুটে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল।
রাত অনেক। কৃষ্ণাতৃতীয়ার চাঁদ মাথার ওপর পৌঁছেছে। ফুটফুটে শরতের জ্যোৎস্নায় বাঁশবনের তলা পর্যন্ত আলো হয়ে উঠেছে।
ঠিক যেন তিন বছর আগেকার সেই মহাষ্টমীর রাত্রির মতো।
শান্তির মা ইতিমধ্যে জেগে উঠে বললেন, ও কে গান করছে রে শান্তি? তারপর তিনিও তাড়াতাড়ি বাইরে এলেন। শ্রীপতিদের বাড়ি তো কেউ থাকে না, গান গাইবে কে? ওদিকে মন্টুর মা, মণি, বাদল সবাই জেগেছে দেখা গেল।
প্রথমেই এরা সবাই ভয়ে বিস্ময়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। পরে ব্যাপারটা বোঝা গেল। শ্রীপতি কখন রাতের ট্রেনে বাড়ি এসেছিল, কেউ লক্ষ করেনি। সে কলের গান বাজাচ্ছে। ওদের সাড়া পেয়ে সে বাইরে এসে বলল, আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে আজ চেয়ে আনলুম ওর গানখানা। মরবার কমাস আগে রেকর্ডে গেয়েছিল।
সবাই খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। শান্তি প্রথমে সে নীরবতা ভঙ্গ করে আস্তে আস্তে বলল, ছিরুদা, রেকর্ডখানা আর একবার দেবে?
পরক্ষণেই একটি অতি সুপরিচিত, পরম প্রিয়, সুললিত কণ্ঠের দরদ-ভরা সুরপুঞ্জে পাড়ার আকাশ-বাতাস, স্তব্ধ জ্যোৎস্না রাত্রিটা ছেয়ে গেল। মানুষের মনের কী ভুলই যে হয়! অল্পক্ষণের জন্যে শান্তির মনে হলো তার কুমারী জীবনের সুখের দিনগুলো আবার ফিরে এসেছে, যেন বৌদিদি মরেনি, কিন্নরের দল ভেঙে যায়নি, সব বজায় আছে। এই তো সামনে আসছে পূজা, আবার মহাষ্টমীতে তাদের থিয়েটার হবে, বৌদিদি গান গাইবে। গান থামিয়ে ওর দিকে চেয়ে হাসি হাসি মুখে বলবে, কেমন শান্তি ঠাকুরঝি, কেমন লাগল!
কুয়াশার রঙ
ভয়ানক বর্ষা। ক-দিন সমানভাবে চলিয়াছে, বিরাম বিশ্রাম নাই। প্রতুল মেসের বাসায় নিজের সিটটিতে বসিয়া বসিয়া বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছে। কোথায় বা বাহির হইবে? যাইবার উপায় নাই কোনোদিকে, ছাদ চুইয়া ঘরে জল পড়িতেছে—সকাল হইতে বিছানাটা একবার এদিকে, একবার ওদিকে সরাইয়াই বা কতক্ষণ পারা যায়? সন্ধ্যার সময় আরও জোর বর্ষা নামিল। চারিদিক ধোঁয়াকার হইয়া উঠিল, বৃষ্টির জলের কুয়াশার ফাঁকে ফাঁকে গ্যাসের আলোগুলো রাস্তার ধারে ঝাপসা দেখাইতেছে।
প্রতুল একটা বিড়ি ধরাইল। সকাল হইতে এক বান্ডিল বিড়ি উঠিয়া গিয়াছে— বসিয়া বসিয়া বিড়ি খাওয়া ছাড়া সময় কাটাইবার উপায় কই? সিগারেট কিনিবার পয়সা নাই। এই সময়টা সিগারেট খাইয়া কাটাইতে হইলে দুই বাক্স ক্যাভেন্ডার নেভিকাট সিগারেট লাগিত।
প্রতুলের হঠাৎ মনে পড়িল, এবেলা এখনও চা খাওয়া হয় নাই। মেসের চাকরকে ডাকিবার উদ্যোগ করিতেছে—এমন সময় দুয়ারে কে ঘা দিল। হয়তো হরিশ চাকরের মনে পড়িয়াছে তাহার ঘরে চা দেওয়া হয় নাই। দুয়ার খুলিয়া প্রতুল অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল।
—এই যে প্রতুলদা, ভালো আছেন? নমস্কার। এলাম আপনার এখানেই—
একটি ত্রিশ-বত্রিশ বছরের লোক, গায়ে ময়লা পাঞ্জাবি, পায়ে রবারের জুতা, হাতে একটা ছোটো টিনের সুটকেস, সঙ্গে একটি বছর নয়-দশের ছোটো ছেলে লইয়া ঘরে ঢুকিল। ছাতি হইতে জল গড়াইয়া পড়িতেছে—ভিজা জুতায় ঘরের দুয়ারের সামনের মেঝেটাতে জলে দাগ পড়িল খোলা দরজা দিয়া ইতিমধ্যে বৃষ্টির ঝাপটা আসিয়া ঘরে ঢুকিল।
—আয় রে খোকা, যা, গিয়ে বোস গে যা—তোর জ্যাঠামশায়, প্রণাম কর। দাঁড়া,–টা মুছে দিই গামছা দিয়ে—যা—
প্রতুল তখনও ঠিক করিতে পারে নাই লোকটা কে, এমন দুর্যোগের দিনে তাহার আশ্রয় গ্রহণ করিতে আসিয়াছে। দেশের লোক, গ্রামের লোক তো নয়— কোথায় ইহাকে সে দেখিয়াছে? হঠাৎ তাহার মনে পড়িয়া গেল, এ সেই শশধর, নাথপুরের শশধর গাঙ্গুলী। এত বড়ো হইয়া উঠিয়াছে সেই আঠারো-উনিশ বছরের ছোকরা! আর বাল্যের সেই চমৎকার চেহারা এত খারাপ হইয়া উঠিল কীভাবে?
—চিনতে পেরেছেন প্রতুলদা?
—হ্যাঁ, এসো বোসো, ও কতকাল পরে দেখা, তা তুমি জানলে কী করে এখানে আমি আছি? ভালো আছ বেশ? এটি কে—ছেলে? বেশ, বেশ।
শশধর রাঙা দাঁত বাহির করিয়া একগাল হাসিয়া বলিল, তা হবে না? সে আজ কত বছরের কথা বলুন তো? আজ বারো-তেরো কী চোদ্দো বছরের কথা হয়ে গেল যে! আপনার ঠিকানা নিলুম জীবন ভটচায্যির কাছ থেকে। জীবন ভটচার্যকে মনে পড়ছে না? সেই যে জীবনদা, আমাদের লাইব্রেরির সেক্রেটারি ছিল।
—কিন্তু জীবনবাবুই বা আমার ঠিকানা জানলেন কী করে—তাঁর সঙ্গেও তো বারো-তেরো বছর দেখা নেই—যতদিন নাথপুর ছেড়েছি ততদিন তাঁর সঙ্গেও
—জীবনদার শালার এক বন্ধু আপনারও বন্ধু—রাধিকাবাবু, চিনতে পেরেছেন এবার? সেখানে জীবনদা শুনেছে—আপনি তো আমাদের খবর রাখেন না— আমরা আপনার রাখি। এই, স্থির হয়ে বোসো খোকা—এক কাপ চা খাওয়ান না দাদা, বড্ড ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে।
সঙ্গের ছোটো ছেলেটি অমনি বলিতে শুরু করিল, খিদে পেয়েছে, বাবা— আমার খিদে পেয়েছে।
তাহার বাবা ধমক দিয়া বলিল—থাম, ছোঁড়ার অমনি খিদে খিদে শুরু হল, থাম না, খেইচিস তো দুপুরবেলা—
প্রতুল বলিল—আহা, ওকে ধমকাচ্চ কেন, ছেলেমানুষের খিদে তো পেতেই পারে! দাঁড়াও খোকা, আমি খাবার আনাচ্চি।
চা ও জলযোগের পর্ব মিটিয়া গেলে প্রতুল বলিল—তারপর শশধর, এখন হচ্ছে কী?
শশধর বলিল—করব আর কী! রামজীবনপুরের ইউ. পি স্কুলের হেডপণ্ডিত। আজ দু–দিন ছুটি নিয়ে কলকাতায় এলাম, একটু কাজ আছে। ভালো কথা
প্রতুলদা, এখানে একটু থাকবার জায়গা হবে?
প্রতুল বলিল—হ্যাঁ হ্যাঁ, তার আর কী। থাকো না। জায়গা তো যথেষ্টই রয়েছে। আমি বলে দিচ্ছি তোমাদের খাওয়ার কথা রাত্রে।
আজ প্রায় বারো-তেরো বছর আগে প্রতুল নাথপুর গ্রামের মিউনিসিপ্যাল অফিসে কেরানির চাকুরি লইয়া যায়। নাথপুর নিতান্ত ক্ষুদ্র গ্রাম নয়, আশপাশের চার-পাঁচখানি ছোটো-বড়ো গ্রাম লইয়া মিউনিসিপ্যালিটি—ইলেকশন লইয়া দলাদলি মারামারি পর্যন্ত হইত। লাইব্রেরি ছিল, ডাক্তারখানা ছিল, হাই স্কুল ছিল, একটা পুলিশের ফাঁড়ি পর্যন্ত ছিল।
একদিন নিজের ক্ষুদ্র বাসাটিতে বসিয়া আছি একা, একটি আঠারো-উনিশ বছরের ছোকরা আসিয়া প্রণাম করিয়া বলিল—আপনি বুঝি নতুন এসেছেন আমাদের গাঁয়ে?
—হ্যাঁ। এসো, বোসো। তোমার নাম কী?
—আমার নাম শশধর। আপনার সাথে আলাপ করতে এলুম—একলাটি বসে থাকেন।
–এসো এসো, ভালোই। তুমি স্কুলে পড়ো বুঝি?
শশধর পরিচয় দিল।
না, সে স্কুলে পড়ে না। অবস্থা ভালো না, স্কুলে কে পড়াইবে? তাহা ছাড়া সংসারে বাবা নাই, তাহারই ঘাড়ে সংসার। মা, দুই বোন, তিনটি ছোটো ছোটো ভাই, স্ত্রী।
প্রতুল বিস্মিত হইয়া বলিল, তুমি বিয়ে করেছ নাকি?
—আজ্ঞে হ্যাঁ, ওবছর বিয়ে হয়ে গিয়েছে।
ছেলেটি দেখিতে খুব সুশ্রী, সুপুরুষ। অল্প বয়সে বিবাহ হওয়াটা আশ্চর্য নয় বটে।
কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিবার পরে ছেলেটি সেদিন চলিয়া গেল। তাহার পর হইতে মাঝে মাঝে সে প্রায়ই আসিত। এ গ্রামে প্রতুল নতুন আসিয়াছে, বিশেষ কাহারও সহিত পরিচয় নাই, এ অবস্থায় একজন তরুণ বন্ধু লাভ করিয়া প্রতুলও খুশি হইল। সময় কাটাইবার একটা উপায় হইল। সন্ধ্যাবেলাটা দুজনের গল্পগুজবে কাটিয়া যাইত।
একদিন শশধর প্রতুলকে বাড়িতে খাওয়ার নিমন্ত্রণ করিল। শশধরের মা তাকে ছেলের মতো যত্ন করিয়া খাওয়াইলেন, শশধরের বোন কণা তাকে প্রথম দিনেই ‘প্রতুলদা’ বলিয়া ডাকিল—এই নির্বান্ধব পল্লিগ্রামে ইহাদের স্নেহসেবা প্রতুলের বড়ো ভালো লাগিল সেদিন।
ইহার পর অফিস হইতে প্রতুল নিজের বাসায় ফিরিতে-না-ফিরিতে শশধর প্রতুলকে ডাকিয়া নিজের বাড়িতে প্রায়ই লইয়া যায়—প্রায়ই বৈকালিক চা-পানের ও জলযোগের ব্যবস্থা সেখানেই হইয়া থাকে।
দিনকতক যাইবার পরে প্রতুল ইহাতে সংকোচ বোধ করিতে লাগিল। শশধরদের সাংসারিক ব্যবস্থা বিশেষ সচ্ছল নয়, রোজ রোজ তাহার জলযোগের জন্য উহাদের খরচ করাইতে প্রতুলের মন সায় দিল না। সে খাওয়া বন্ধ করিল। অবশ্য মুখে সোজাসুজি কোনো কিছু বলিতে পারা সম্ভব ছিল না—তবে যাইবার ইচ্ছা না-থাকিলে ওজর-আপত্তির অভাব হয় না।
একদিন শশধর আসিয়া বলিল—আজ যেতেই হবে প্রতুলদা—কণা বলেছে তোমাকে নিয়ে না-গেলে সে ভয়ানক রাগ করবে আমার ওপর।
প্রতুল আশ্চর্য হইয়া বলিল—কণা?
—হ্যাঁ হ্যাঁ, কণা—আমার ছোটো বোন। ভুলে গেলেন নাকি? চলুন আজ। প্রতুলের মনে বিস্ময় এবং আনন্দ দুই-ই হইল। কণার বয়েস পনেরো-ষোলো— রং ফর্সা, বেশ সুশ্রী মেয়ে। কথাবার্তা বলে চমৎকার—পাড়াগাঁয়ের তুলনায় লেখাপড়াও জানে ভালো। তাহার সম্বন্ধে কণা আগ্রহ দেখাইয়াছে কথাটা শুনিতে খুব ভালো।
কণা সেদিন প্রতুলের কাছে কাছেই রহিল। কয়দিন না-দেখাশোনার পরে দুজনেরই দুজনকে যেন বেশি করিয়া ভালো লাগিতেছে। ফিরিবার সময় প্রতুলের মনে হইল, কণাকে আজ যেন তাহার অত্যন্ত আপনজন বলিয়া মনে হইতেছে। কেন?
নির্জন বাসায় ফিরিয়া কথাটা সে ভাবিল। কণা মেয়েটি ভালো, সত্যই বুদ্ধিমতী, সেবাপরায়ণা। তাহাদেরই পালটি ঘর। আহা, এই জন্যই কী শশধরের এ তাগাদা—তাহাকে ঘন ঘন বাড়ি লইয়া যাইবার জন্য?
কথাটা মনে হইবার সঙ্গে সঙ্গে এ চিন্তাও তাহার মনে না-আসিয়া পারিল না, তাই কণার অত গায়ে পড়িয়া আলাপ করার ঝোঁক তার সঙ্গে।
প্রতুল আবার শশধরদের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করিল।
শশধর আসিয়া পীড়াপীড়ি আরম্ভ করিতে আদৌ বিলম্ব করিল না। এবার কিন্তু প্রতুল অত সহজে ভুলিল না। তাহার মনে দ্বন্দ্ব লাগিয়াছে। কণা তাহাকে সত্যই ভালোবাসে, না তাহাকে বিবাহের ফাঁদে ফেলিবার জন্য ইহা তাহার একটি ছলনা মাত্র? কণার মা কীজন্য তাহাকে অত আদর করিয়া থাকেন বা শশধর তাহাকে বাড়ি লইয়া যাইতে অত আগ্রহ দেখায়—ইহার কারণ প্রতুলের কাছে ক্রমশ স্পষ্ট হইয়া উঠিল। গরিবের মেয়ে, বিবাহ দিবার সংগতি নাই উপযুক্ত পাত্রে—সে হিসাবে প্রতুল পাত্র ভালোই, ত্রিশ টাকা মাহিনা পায় অফিসে, বয়স কম, দেখিতে শুনিতেও এ পর্যন্ত তো প্রতুলকে কেহ খারাপ বলে নাই।
ইহাদের সকল স্নেহ ভালোবাসা আগ্রহের মধ্যে একটি গৃঢ় স্বার্থসিদ্ধির সন্ধান জানিয়া প্রতুলের মন ইহাদের প্রতি নিতান্ত বিরূপ হইয়া উঠিল।
মাস-দুই কাটিয়া গিয়াছে।
ভাদ্র মাস। সাত-আট দিন বেশ ঝলমলে শরতের রৌদ্র—খালের ধারে কাশফুল ফুটিয়াছে, জল-কাদা শুকাইয়া আসিতেছে। পূজার ছুটির আর বেশি দেরি নাই, প্রতুল বসিয়া বসিয়া সেই কথা ভাবিতেছিল—মিউনিসিপ্যাল অফিসে বারো দিন ছুটি।
এই সময় একদিন কাহার মুখে প্রতুল শুনিল শশধরের বাড়িতে বড়ো বিপদ। শশধরের মা মৃত্যুশয্যায়। শুনিয়া সে ব্যস্ত হইয়া উঠিল। শশধর এদিকে অনেক দিন আসে নাই তা নয়, প্রতুল উহাদের বাড়ি না-গেলেও সে এখানে প্রায়ই আসিয়া বসিয়া থাকে, চা খায়, গল্পগুজব করে। কই, মায়ের এমন অসুখের কথা তো শশধর বলে নাই?
প্রতুল শশধরদের বাড়ি গেল। এমন বিপদের সময় না-আসিয়া চুপ করিয়া থাকা —সেটা ভদ্রতা এবং মনুষ্যত্ব উভয়েরই বিরুদ্ধে। প্রতুলের কড়া নাড়ার শব্দে কণা আসিয়া দরজা খুলিয়া দিল। প্রতুলের মনে হইল কণা তাহাকে দরজায় দেখিয়া বিস্মিত হইয়াছে। প্রতুলই আগে কথা কহিল। বলিল, মা কেমন আছেন?
—আসুন বাড়ির মধ্যে। দাদা নেই বাড়িতে, ডাক্তার ডাকতে গিয়েছে। অবস্থা ভালো না।
—চলো চলো, দেখি গিয়ে। আমি কিছুই জানিনে কণা অসুখের কথা, শশধর কদিন আমার ওখানে যায়নি। তবে মাঝে যা গিয়েছিল, তখন কিছু বলেনি।
—বলবে কী, মার অসুখ আজ সবে পাঁচ দিন হয়েছে তো। পরশু রাত্তির থেকে বড়াবাড়ি যাচ্ছে। এর আগে এমন তো হয়নি।
ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া যেটা প্রতুলের চোখে সর্বপ্রথম পড়িল, সেটি ইহাদের দারিদ্র্যের কুশ্রী ও মলিন রূপ। সে নিজেও বড়োলোকের ছেলে নয়, কিন্তু তবুও তাহাদের বাড়িতে গৃহস্থালীর যে শ্রীছাঁদ আছে, এখানে তার সিকিও নাই।
কণা বলিল, এতকাল আসেননি কেন এদিকে? আমাদের তো ভুলেই গিয়েছেন।
প্রতুলের মনে কষ্ট হইল। কণার ক্লান্ত, উদবেগপূর্ণ এবং ঈষৎ বিষণ্ণ চোখ দুটির দিকে চাহিয়া তাহার মনে হইল সে বড়ো নিষ্ঠুর কাজ করিয়াছে এতদিন এখানে না-আসিয়া। কণা বড়ো ভালো মেয়ে, যতক্ষণ প্রতুল তাহাদের বাড়ি রহিল ততক্ষণের মধ্যেই প্রতুল জানিতে পারিল কণার কী কর্তব্যজ্ঞান, রুগণ মায়ের কী সেবাটাই করিতেছে কণা। এত দুঃখে উদবেগেও কণার সুন্দর রূপ ম্লান হয় নাই। অনেক মেয়েকে সে দেখিয়াছে—সাজিলে-গুজিলে সুশ্রী বলিয়া মনে হয়, কিন্তু মলিন কাপড় পরিয়া থাকিলে বা চুল না-বাঁধা থাকিলে কিংবা হয়তো সদ্য ঘুম হইতে ওঠা অবস্থায় দেখিলে বড়ো খারাপ দেখায়।
কণার রূপের মধ্যে একটা কিছু আছে যাহাতে কোনো অবস্থাতেই খারাপ দেখায় না। এত অনিয়ম, রাত্রি জাগরণ, উদবেগ, পরিশ্রমের মধ্যেও কণা তেমনই ফুটন্ত ফুলটির মতো তাজা, তেমনই লাবণ্য, ওর সুকুমার মুখে।
কণার সম্বন্ধে এই একটি মূল্যবান সত্য আবিষ্কার করিয়া প্রতুল আনন্দিত ও বিস্মিত দুই-ই হইল।
ইহার পর প্রতুল কয়দিনই কণাদের বাড়ি নিয়মিত যাইতে লাগিল—রোগিণীর সেবায় সেও কণাকে সাহায্য করিত—স্টোভ জ্বালা, জল গরম করা, বিছানার চাদর বদলানোর সময় রোগিণীকে বিছানার একপাশে সরানো, ডালিম বেদানার দানা ছাড়ানো। পঞ্চম দিনের প্রাত:কালে কণার মা যখন ইহলোকের মায়া কাটাইয়া চলিয়া গেলেন তখন সেই শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সে যথাযোগ্য সান্ত্বনা দিবার চেষ্টা করিতে লাগিল, দাহকার্যের খরচপত্র নিজ হইতে দিল, কারণ শশধর একেবারে কপর্দকশূন্য সেদিন। নিজে শ্মশানে গিয়া শেষপর্যন্ত রহিল। আবার সকলের সঙ্গে সেখান হইতে কণাদের বাড়ি ফিরিয়া আগুন তাপিল এবং নিমের পাতা দাঁতে কাটিল।
কণা আজকাল প্রতুলের দিকেও বড়ো টানে, তাহার সুখ-দুঃখ, সে রাত্রে ঘুমাইল কিনা, তাহাকে চা ঠিক সময়ে দেওয়া এবং সেই সঙ্গে কিছু না-হোক এক মুঠা মুড়িও তেল নুন মাখিয়া দেওয়া—এসব দিকে কণার সতর্ক দৃষ্টি—এত দুঃখ বিপদের মধ্যেও—ইহাও প্রতুলের মনে বড়ো আনন্দ দিয়াছে কয়দিন।
শ্রাদ্ধের আগের দিন প্রতুল শশধরকে নিজের মাহিনা হইতে কুড়িটি টাকা দিয়া তাহাকে কী করিতে হইবে-না-হইবে পরামর্শ দিল, জিনিসপত্র ও লোকজন খাওয়ানোর ফর্দ ধরিল। সামান্য তিলকাঞ্চন শ্রাদ্ধ হইবে—শ্রাদ্ধের দিন বারোটি ব্রাহ্মণ এবং নিয়মভঙ্গের দিন জন পনেরো জ্ঞাতি-কুটুম্ব খাইবে। এসব কথা কণাদের বাড়ি বসিয়াই হইতেছিল—পরামর্শান্তে প্রতুলকে বসাইয়া রাখিয়া শশধর কোথায় বাহির হইয়া গেল। প্রতুলের বসিয়া থাকিবার কারণ সে এখনও বৈকালিক চা পান করে নাই, না-খাইয়া গেলে কণা চটিয়া যাইবে।
কণা চা লইয়া ঘরে ঢুকিল, প্রতুল কণার হাত হইতে পেয়ালাটি লইয়া বলিল —বোস কণা। কালকার সব জোগাড় করে রাখো—ফর্দ দিয়েছেন নবীন ভটচায্যি। সন্ধের পর একবার দেখে নিও সে-খানা—শশধর কেনাকাটা করতে গিয়েছে, যদি কিছু বাদ পড়ে, আনিয়ে নিও।
—আপনি টাকা দিলেন?
—আমি? হ্যাঁ—তা ইয়ে—
—কত টাকা দিলেন?
—সে কথায় দরকার? সে এমন কিছু নয়—তা ছাড়া ধার—শশধর আবার আমায়—
—দাদা আবার আপনাকে ছাই দেবে। আপনাকে কথাটা বলব ভেবেচি। কেন আপনি আমাদের পেছনে এমন খরচ করবেন? রোগের সময় টাকা দিয়েছেন— আবার কাজের সময় দেবেন! আপনি কী এমন ন-শো পঞ্চাশ টাকা ব্যাঙ্কে জমিয়েছেন শুনি? মাইনে তো পান ত্রিশটি টাকা। আপনার নিজের বাবা-মা ভাই বোন রয়েছে, তাদের কী দেবেন? নিজে কী খাবেন? আপনাকে বলি শুনুন। দাদা বেকার বসে আছে, আপনার কাছ থেকে টাকা নিয়ে তা কখনো আর উপুড় হাত করবে না। ওর ওই স্বভাব। আপনি আর একপয়সা দেবেন না বলে দিচ্ছি। মায়ের কাজ হোক-না-হোক আপনার কী? আপনি কেন দিতে যাবেন?
প্রতুল বিস্মিত দৃষ্টিতে কণার মুখের দিকে চাহিল। কণার মুখে একটি সবল তেজস্বী সারল্য…সত্যবাদী ও স্পষ্টভাষী ওর ডাগর চোখ দুটি, যা খোশামোদ করিতে বা ছলনা করিতে শেখে নাই, আজও প্রতুলের মনে হইল।
কিন্তু কণা আজ এ কী নতুন ধরনের কথা বলিল? ভারি আশ্চর্য কথা। এতদিন কণাকে চিনিতে পারে নাই সে, আজ চিনিল বটে। শ্রদ্ধায় ও সম্ভ্রমে প্রতুলের মন পূর্ণ হইয়া উঠিল। কণা সাধারণ মেয়ে নয়।
শ্রাদ্ধশান্তি মিটিয়া গেল। প্রতুল নিয়মিত উহাদের বাড়ি যাতায়াত করিতে লাগিল। কণার সেবায় অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছে, সে যত্ন ও সেবায় এতটুকু খুঁত কোনোদিন প্রতুলের চোখে পড়িল না আজও। মায়ের শোক খানিকটা প্রশমিত হইবার পরে কণা আরও সুশ্রী হইয়া উঠিয়াছে এখন, পরিস্ফুট যৌবন-শ্রী তাহার অঙ্গপ্রত্যঙ্গে।
প্রতুল ইতিমধ্যে মনে মনে ভাবিয়া স্থির করিয়াছে কী করিয়া কথাটা এইবার সে পাড়িবে। কথাবার্তা পাকা না-হয় রহিল, অশৌচ কাটিয়া গেলে বিবাহ হইতে বাধা কী! পরের বাড়ির তরুণী পূর্ণযৌবন মেয়ের সহিত এভাবে মেলামেশা উচিত হইতেছে না—একটা পাকাপাকি কথা হওয়া ভালো। বৈকালে প্রতুল কণাদের বাড়ি গেল।
কণা আসিয়া বলিল, ওইরে বাস! আমি বলেছি কিনা বলেছি, প্রতুলদা তো এল বলে। দুধ নেই চা করবার, ওবেলা পিন্টু দুধের কড়া আলগা করে দিয়েছে, আর সব দুধখানি উপুড় করে রেখে দিয়েচে বেড়ালে।
-–বসো কণা এখানে। চা হবে এখন, তার জন্যে কিছু নয়।
কণা এখন মাতৃহীন ছোটো ভাই-বোনের মায়ের স্থান পূর্ণ করিয়া আছে, সংসারে সেই এখন কত্রী, প্রতুল তা জানে। কিন্তু এই ক্ষুদ্র কীটি মাঝে মাঝে কীরকম ফাঁদে পড়িয়া যায় পয়সা-কড়ির অভাবে তাহাও প্রতুল দেখিয়াছে। কণা তাহাকে কিছু বলে না—কোনোদিন না—কিন্তু সে নানা রকমে টের পায়, যেমন আজই পাইল।
কণা কী কাজে একটু উঠিয়া গিয়াছে, প্রতুল কণার ছোট্ট ভাই বিনুকে ডাকিয়া বলিল, কি খেয়েচ খোকাবাবু?
—ভাত খেয়েছি।
—এখন কী খেয়েচ?
—আর কিছু নেই, ভাত নেই। দিদি খায়নি।
তখন সেখানে কণার ছোটো বোন এগারো বছরের পিন্টু আসিল। প্রতুল বলিল, কণা খায়নি কেন?
পিন্টু বলিল, ভাত ছিল না। ওবেলা চাল ধার করে নিয়ে এল দিদি ওই সরকারদের বাড়ি থেকে। দাদা কাল কোথায় গিয়েছে, আজও তো ফিরল না। মহেশ চক্কত্তির দোকানে টাকা পাবে বলে চাল-ডাল দেয় না আজকাল, দিদি এখন কোথায় পাবে, কোন দিকে যাবে?
প্রতুল অনেক কথা ভাবিল। কণা সংসার চালাইতে পারে না টাকার অভাবে, সে নিজে যদি বাহির হইতে দু-দশ টাকা সাহায্য করে সেটা যেন ভিক্ষা দেওয়ার মতো দেখায়। সে টাকা হাত পাতিয়া লওয়ায় কণার গৌরব ক্ষুন্ন হয়। কণাকে সে অপমানের মধ্যে টানিয়া আনিতে তাহার মন সরে না, অথচ এরকম কষ্ট করিয়াই বা কণা কতদিন বাঁচিবে?
সবদিকের মীমাংসা করিতে হইলে বিবাহের কথাটা পাড়িতে আর বিলম্ব করা উচিত নয়। আজই সে কণার সঙ্গে এ বিষয়ে একটা বোঝাপড়া করিবে আগে— তাহার পরে শশধরকে জানাইলেই চলিবে এখন। শশধরটা মানুষ নয়, সে ইতিমধ্যে বেশ বুঝিয়া ফেলিয়াছে।
কণা চা লইয়া ঘরে ঢুকিল, বলিল—একটু দেরি হয়ে গেল প্রতুলদা, দুধ ছিল না একেবারে। আনলাম রায় কাকাদের বাড়ি থেকে। দেখুন তো চা-টা খেয়ে কেমন হয়েছে?
প্রতুল বলিল—ব্যস্ত হয়ে ঘুরচ কোথায় কণা? বোসো এখানে, কথা আছে।
শীতকালের বিকাল, কণাদের বাড়ির চারিপাশে বনজঙ্গলে বনমৌরি লতায় ফুল ফুটিয়াছে—বেশ একটা উগ্র সুগন্ধে অপরাহের শীতল বাতাস ভরপুর। ভাঙা ইটের পাঁচিলের গায়ে রাঙা রোদ পড়িয়া কণাদের পুরোনো পৈতৃক ভদ্রাসনের প্রাচীনত্ব ও দারিদ্র্য যেন আরও বাড়াইয়া তুলিয়াছে।
কণা বসিল, প্রতুলের মুখের দিকে আগ্রহের সহিত চাহিয়া বলিল, কী প্রতুলদা?
—তোমাকেই কথাটা বলি, কিছু মনে কোরো না কণা। অনেকদিন থেকে কথাটা আমার মনে রয়েছে—বলি বলি করে বলা ঘটে উঠছে না। তুমি আমার বিয়ে করবে কণা? আমি অত্যন্ত সৌভাগ্য বলে মনে করব, যদি—
কণা খানিকটা চুপ করিয়া রহিল। খানিকক্ষণ দুজনের কেহই কথা বলিল না। তারপরে কণা ধীরে ধীরে অনেকটা চাপা সুরে বলিল, সে হয় না, প্রতুলদা।
প্রতুল বিস্মিত হইল। কণার এ উত্তর সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত তাহার কাছে। বলিল, হয় না কণা?
কণা মাটির দিকে চোখ রাখিয়া পূর্ববৎ নিম্নসুরে বলিল, হয় না প্রতুলদা। কারণ আছে অবিশ্যি। কিন্তু সে-কথা বলব না। বিয়ে হতে পারে না।
কেন? কণা কি অন্য কোনো যুবককে ভালোবাসে? কই, আর কোনো যুবককে তো প্রতুল কোনোদিন উহাদের বাড়িতে যাওয়া-আসা করিতে দেখে নাই? ব্যাপার কী?
—কারণটা জানতে পারলে বড়ো ভালো হত, কণা। খুব বেশি বাধা কিছু আছে কি?
—হ্যাঁ।
—কারণটা বলবে?
—আপনি কিছুই জানেন না? দাদা কিছু বলেনি আপনাকে?
প্রতুল আরও বিস্মিত হইল। কী জানিবে সে! শশধরই বা তাহাকে কী বলিবে! অত্যন্ত আগ্রহ ও কৌতূহলের সঙ্গে সে বলিল—না কণা, তুমি কী বলছ আমি কিছুই বুঝতে পারচিনে। শশধর কী বলবে আমায়?
—আমি বিধবা।
—তুমি!
—হ্যাঁ, আট বছর বয়সে আমার বিয়ে হয়—তেরো বছর বয়সে—এই পাঁচ বছর হল।
প্রতুলের মাথা বন বন করিয়া ঘুরিতে লাগিল যেন। সর্বশরীর যেন ঝিম ঝিম করিতেছে। কণা বিধবা! কণার বিবাহ হইয়াছিল আট বছর বয়সে! অদৃষ্টের কী দারুণ পরিহাস! আর সে কত আকাশ-কুসুম না-রচনা করিয়াছে মনে মনে এই কণাকে লইয়া…ইহাদের প্রতি মনে মনে কত অবিচার করিয়াছে তাহাকে জামাই করিবার উদ্দেশ্য প্রতি-আরোপ করিয়া! গ্লানি ও অনুতাপে প্রতুলের মন পূর্ণ হইয়া গেল।
—কিন্তু কণা, এ কথা তো আমি কিছুই জানিনে। আমাকে তো কেউ কিছু বলেনি।
—আমার কিন্তু ধারণা ছিল যে, আপনি জানেন, দাদা বলেছে আপনাকে। আমিও অবাক হয়ে গেছি এ কথা শুনে।
—একটা কথা বলব! বিধবার পুনর্বিবাহ তো হচ্ছে সমাজে।
—প্রতুলদা ওসব কথা থাক। যা হয় না যেখানে, সেখানে সে-কথা তোলা মিথ্যে।
—না, আমার কথার উত্তর দাও কণা, আমি অমন ধরনের কথা শুনব না তোমার মুখে; তোমায় সুখী করার দিকে আমার লক্ষ্য। সেজন্যে সংস্কার এবং সমাজ আমি অনায়াসেই ঠেলব।
কণার চোখ দিয়া জল গড়াইয়া পড়িল। সে মুখ নীচু করিয়া আঁচলের প্রান্ত দিয়া চোখ মুছিয়া বলিল—আপনার পায়ে পড়ি প্রতুলদা—
প্রতুল আর কিছু বলিল না। পরদিন অফিসে আসিয়াই সে চাকুরিতে ইস্তফা দিয়া দিল এক মাসের নোটিশে। এখানে আর থাকিবে না, থাকিয়া লাভ নাই।
এই এক মাসের মধ্যে সে কণাদের বাড়ি গেল প্রায় প্রত্যেকদিনই, কিন্তু চাকুরিতে নোটিশ দেওয়ার কথা কাহাকেও বলিল না। বিবাহ সম্বন্ধে কণার সাথে আর কোনো কথাও সে বলে নাই, যদিও কণা আগের মতোই তাহার কাছে নিঃসংকোচে আসে, বসে, কথাবার্তা কয়।
যাইবার পূর্বে সে কণাদের বাড়ি গেল। অন্যান্য কথাবার্তার পর সে বলিল, কণা, আমি এখানে থেকে চলে যাচ্ছি কাল।
কণা আশ্চর্য হইয়া প্রতুলের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল—চলে যাবেন? কেন?
—চাকুরি ছেড়ে দিচ্চি।
—সে কী কথা!
—কথা ঠিকই তাই। কাল যাচ্ছি।
—সত্যি?
—সত্যি। মিথ্যে বলে লাভ কী?
—সে-কথা তো একদিনও বলেননি—
—না বলিনি। বলেই বা লাভ কী? যেতেই যখন হবে।
—কেন, এখানে আপনার অসুবিধা কী হচ্ছিল? ভালো চাকুরি পেয়েছেন বুঝি কোথাও?
—কোথাও না।
কণা চুপ করিয়া রহিল। প্রতুলও তাই।
খানিক পরে কণা বলিল, যাবেন তা জানতুম। বিদেশি লোক আপনি আপনাকে তো ধরে রাখা যাবে না। আমাদের কথা আপনি শুনবেনই বা কেন?
—অনেক জ্বালাতন করেচি, কিছু মনে কোরো না কণা।
কণা চুপ করিয়া রহিল।
এই পর্যন্ত সেদিন কণার সঙ্গে কথাবার্তা। পরদিন আর একবার কণাদের বাড়ি যাইবার কথা ভাবিয়াও প্রতুলের যাওয়া ঘটিল না, দুপুরের ট্রেনে প্রতুল চলিয়া আসিল।
সারাপথ কেবল কণার কথা মনে হইল প্রতুলের। সেই অভাব-অনটনের সংসারে চিরকাল কাটাইতে হইবে তাহাকে। গরিবের ঘরের অল্পবয়সি বিধবা মেয়ে, দাদার সংসার ছাড়া আর উপায় নাই। কণার জীবন অন্ধকার, কোন আলো নাই কোনোদিক হইতে। প্রতুলের বুকের মধ্যে কোথায় যেন টনটন করিতেছে। কণাকে কাহার কাছে রাখিয়া যাইতেছে সে!
পরক্ষণেই ভাবিল, কী মুশকিল! কণা রয়েছে তার বাপের ভিটেতে ভাই বোনের কাছে, দাদার কাছে। আমার সঙ্গে তার কী?
মাস পাঁচ-ছয় পরে, সেই ফান্তুন মাসেই মায়ের পীড়াপীড়িতে তাহাকে বিবাহ করিতে হইল।
প্রতুলের শ্বশুরের দু-তিনটি ছোটো বড়ো কোলিয়ারি ছিল। কিন্তু কলিয়ারিগুলির অবস্থা ছিল খারাপ। চুরি হইত, নির্ভরযোগ্য ম্যানেজারের অভাবে কোলিয়ারিগুলি লোকসানি মহল হইয়া পড়িয়া থাকিত।
প্রতুলের শ্বশুর একদিন প্রস্তাব করিলেন—সে অফিসে পরের চাকুরি না-করিয়া যদি কোলিয়ারিগুলির তত্বাবধান করে, তবে অফিসে যে বেতন পাইতেছে তাহা তো পাইবেই, উপরন্তু ভবিষ্যতে একটা উন্নতির আশা থাকে শ্বশুর-জামাই উভয়েরই। প্রতুল শ্বশুরের প্রস্তাবে রাজি হইল। আরও বছর দুই পরে কোলিয়ারির অবস্থা সত্যই ফিরিল প্রতুলের কর্মদক্ষতায়। প্রতুল আসানসোলের রেলস্টেশন হইতে তিন মাইল দূরে বুদ্ধচক কোলিয়ারিতে সাজানো বাংলোতে স্ত্রী-পুত্র (ইতিমধ্যে তাহার একটি ছেলে হইয়াছিল) লইয়া বাস করে—একটু স্টাইলের উপরই থাকে, না-থাকিলে চলে না, কাজের খাতিরেই থাকিতে হয় নাকি।
কী জানি কেন এখানে আসিয়া কণার কথা তাহার বড়োই মনে পড়িতে লাগিল। আজ তাহার এই সাজানো বাংলো, সুখ ঐশ্বর্য—ইহাদের ভাগ কণা কিছুই পাইল না। সেই সুদূর পাড়াগাঁয়ে দারিদ্র্য ও নিরাশার অন্ধকারের মধ্যে ভাঙা পুরোনো ইটের পুরোনো কোঠাবাড়ি আঁকড়াইয়া পড়িয়া রহিল!
প্রতুলের মনটা যেন হা-হা করিয়া ওঠে। সে বুঝিল, এখনও কণার কথা তাহার মন জুড়িয়া বসিয়া আছে, তাই তাহাকে ভুলিয়া যাওয়া প্রতুলের পক্ষে সহজ নয়। প্রতুলের স্ত্রী বড়লোকের মেয়ে, বাল্যকাল হইতে সে সুখ ভোগ করিয়া আসিতেছে, তাহাকে খাওয়াইয়া-পরাইয়া নতুন জিনিস দেখাইয়া লাভ কী? তেলা মাথায় তেল দেওয়া। বরং যে চিরবঞ্চিতা—জীবন যাহাকে কিছু দেয় নাই— তাহাকে যদি আজ সে—কেন এমন হয় জীবনে কে বলিবে?
যে পাইয়া আসিতেছে সে-ই বরাবর পায়, যে পায় না সে কখনই পায় না। যাহাকে খাওয়াইয়া সুখ পরাইয়া সুখ, দেখিয়া দেখাইয়া সুখ—তাহাকে খাওয়ানো যায় না, পরানো যায় না, দেখানোও যায় না।
কেন এমন হয়?
এসব চার-পাঁচ বছর আগের কথা।
আজ কয়েক দিন হইল প্রতুল কলিকাতায় আসিয়াছে চাকুরির খোঁজে।
কোলিয়ারি আছে কিন্তু প্রতুলের স্ত্রী নাই। পুনর্মুষিকের পর্যায়ে আসিয়া দাঁড়াইবার ইতিহাস আছে। সংক্ষেপে এই যে, গত বৎসর স্ত্রীর মৃত্যুর পর হইতেই শ্বশুরের কোলিয়ারিতে থাকা প্রতুলের ভালো মনে হইল না এবং তারপরে দেখা গেল প্রতুলের শ্বশুরেরও তাহা ক্রমশ ভালো বলিয়া মনে হইতেছে না। সুতরাং আজ কয়েকদিন হইল প্রতুল তাহার ছেলেটিকে সঙ্গে লইয়া কলিকাতায় আসিয়া এই পরিচিত মেসটিতে উঠিয়াছে এবং চাকুরির সন্ধানে আছে।
এই সেই শশধর। কণার ভাই। এতকাল পরে হঠাৎ এভাবে কোথা হইতে কেমন করিয়া আসিয়া পড়িল! কিছুক্ষণ বসিয়া শশধর চা খাইয়া সুস্থ হইবার পরে প্রতুল বলিল, তারপরে কী মনে করে? কেমন আছ?
শশধর বলিল, ভালোই আছি। আপনি এখানে আছেন তা শুনলুম জীবনদার কাছে। আপনি নাকি চাকুরি খুঁজছেন? সেই জন্যেই আমার এখানে আসা। আপনার সব কথাই শুনেছি।
কী ব্যাপার? চাকুরি সন্ধানে আছে নাকি?
আমাদের দেশের মিউনিসিপ্যাল অফিসের সেই কেরানির পোস্ট খালি হয়েছে। আপনি গেলে ওরা লুফে নেবে এখুনি। কিশোরী চাটুয্যে এখন চেয়ারম্যান, আপনাকে বড়ো ভালোবাসত, আমাদের আপনার লোক। দিন একখানা দরখাস্ত করে। আমি লিখলে একবার গিয়ে ইন্টারভিউ করে আসবেন চেয়ারম্যানের সঙ্গে।
আবার সেই নাথপুর! সেই মিউনিসিপ্যাল অফিসের ত্রিশ টাকা বেতনের কেরানির পদ! তাহাই হউক। প্রতুল দরখাস্ত লিখিয়া পরদিন সকালে শশধরের হাতে দিল। চাকরি না-করিলে চলিবে না। ছোটো ছেলেটি লইয়া ত্রিশ টাকায় তাহার খুব চলিয়া যাইবে। তাহার বাবা-মা জীবিত বটে, কিন্তু ছেলের রোজগারের উপর তাঁহাদের নির্ভর করিতে হয় না।
দিন পনেরো পরে শশধর লিখিল—চাকুরির সব ঠিক, একবার আসিয়া চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করা দরকার। প্রতুল ছেলেকে লইয়া নাথপুরে গেল। দশ বৎসর আসে নাই এদিকে, অথচ যেন মনে হইতেছে কাল এ গ্রাম ছাড়িয়া গিয়াছে। কণার কথা সে শশধরকে জিজ্ঞাসা করিতে পারে নাই, কোথায় যেন বাধিয়াছিল—বহু চেষ্টা করিয়াও পারে নাই। আজ স্টেশনে নামিতেই কণার কথা প্রথমেই মনে পড়িল। কণা যেখানে থাকে, সেখানেই সে থাকিবে জীবনের বাকি কয়টা দিন।
বেলা প্রায় একটা, শশধর স্টেশনে ছিল। বলিল—প্রতুলদা, আপনার সেই পুরোনো বাসা ভাড়া করে রেখেছি। কোনো অসুবিধে হবে না। আর কণা বলে দিয়েছে আজ ওখানে খাবেন। চাকুরি হয়ে যাবে এখন, সব বলা আছে।
প্রতুল বলিল—এবেলা খাব না। খোকাকে বরং নিয়ে যাও কণার কাছে। আমি অফিসের পরে যাব। আমরা দুজনেই সকালে খেয়ে গাড়িতে চড়েচি।
—বিকালের দিকে চেয়ারম্যানের সহিত সাক্ষাৎ করিবার পরে প্রতুল শশধরদের বাড়ি গেল। প্রথমেই কণা আসিয়া সামনে দাঁড়াইয়া বলিল—প্রতুলদা, এতদিন পরে মনে পড়ল? তারপর সে পায়ের ধুলো লইয়া প্রণাম করিল।
প্রতুল অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল। সে কণা কোথায়? কোথায় সেই লাবণ্যময়ী কিশোরী? এ কণাকে সে চেনে না। কণা পূর্বাপেক্ষা শীর্ণা হইয়াছে। যৌবনের সৌন্দর্য অন্তর্হিত হইয়াছে অনেককাল বলিয়াই হয়—যদিও বর্তমানে সাতাশ আটাশ বছরের বেশি বয়স নয় কণার। মুখের কোথাও পূর্ব লাবণ্যের চিহ্ন আছে। কিনা প্রতুল বিশেষভাবে খুঁজিয়া দেখিয়াও পাইল না।
সঙ্গে সঙ্গে প্রতুল দেখিল কণার উপর তাহার সে ভালোবাসা যেন এক মুহূর্তে মন হইতে কপূরের মতো উবিয়া গিয়াছে। এ কণা অন্য একজন স্ত্রীলোক—তাহার ভালোবাসার পাত্রী, তাহার পরিচিত কণা এ নয়। কাহাকে সে ভালোবাসিবে?
কণা অবশ্য খুব আদর-যত্ন করিল। আহারাদির পরে প্রতুলকে পান আনিয়া দিয়া কণা বলিল, কতদিন আসেননি, অনেক কথা আছে আপনার সঙ্গে প্রতুলদা। বসুন আমি আসছি।
প্রতুল ভাবিতেছিল, ভাগ্যে কণার সঙ্গে তাহার বিবাহের সুবিধা বা যোগাযোগ হয় নাই! কি বাঁচিয়াই গিয়াছে সে! ভগবান বাঁচাইয়া দিয়াছেন। উঃ!
দু-চারটি মামুলি কথা বলিয়া প্রতুল ছেলের হাত ধরিয়া উহাদের বাড়ি হইতে বাহির হইয়া হাঁপ ছাড়িয়া যেন বাঁচিল।
পরদিন সকালে শশধরকে ডাকিয়া বলিল, না ভাই, ছেলেটার শরীর খারাপ হয়েছে কাল রাত্রেই। তোমাদের যা ম্যালেরিয়ার দেশ, ছেলে নিয়ে এখানে চাকুরি পোষাবে না। অন্যত্র চেষ্টা দেখিগে।
ক্যানভাসার কৃষ্ণলাল
চাকুরি গেল। এত করিয়াও কৃষ্ণলাল চাকুরি রাখিতে পারিল না। সকাল হইতে রাত দশটা পর্যন্ত (ডাউন খুলনা প্যাসেঞ্জার, ১০-৪৫ কলিকাতা টাইম) টিনের সুটকেস হাতে শিয়ালদ হইতে বারাসত এবং বারাসত হইতে শিয়ালদ পর্যন্ত ‘তাঁতের মাকু’র মতো যাতায়াত করিয়া ও ক্রমাগত “দত্তপুকুরের বাতের তেল, দত্তপুকুরের বাতের তেল—বাত, বেদনা, ফুলো, কাটা ঘা, পোড়া-ঘা, দাঁত কনকনানি, এককথায় যতরকম ব্যথা, শূলানি, কামড়ানো আছে—সব এক নিমেষে চলে যাবে—আজ চব্বিশ বছর এই লাইনে, ওষুধটি প্রত্যেক ভদ্রলোক ব্যবহার করছেন, সকলেই এর গুণ জানেন—” বলিয়া চিৎকার করিয়াও চাকুরি রাখা গেল না।
সেদিন বসু মহাশয় (ইন্ডিয়ান সিন্ডিকেটের মালিক নৃত্যগোপাল বসু) কৃষ্ণলালকে ডাক দিয়া বলিলেন—পাল মশায়, কাল রাত্রের ক্যাশ জমা দেননি কেন?
—আজ্ঞে আজ্ঞে—অনেক রাত হয়ে গেল—খুলনার ট্রেন—প্রায় বিশ মিনিট লেট।
—দেখুন, আগেও আমি অন্তত সতেরো বার আপনাকে সাবধান করে দিয়েছি। খুলনা ট্রেন দশটা একুশে স্টেশনে আসে, আমি সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত অফিসে বসেছিলাম শুধু আপনার জন্যে। নিত্যাই দু-বার স্টেশনে দেখে এল ট্রেন রাইটটাইমে এসেছে, লেট এক মিনিটও ছিল না—
–আজ্ঞে বড়োবাবু, শরীরটা কাল বড়োই—
–ও আপনার পুরোনো কথা। ও কথা আর শুনবো না আজ। যাক, ক্যাশ এনেচেন এখন?
কৃষ্ণলাল অপরাধীর মতো বড়োবাবুর মুখের দিকে চাহিল। বলিল—ক্যাশটা আনিগে যাই—না—একটু মুশকিল হয়েচে, আচ্ছা আসি—
—যান আসুন—
কৃষ্ণলাল তবুও দাঁড়াইয়া আছে দেখিয়া নৃত্যগোপালবাবু বলিলেন—কী হল?
—আজ্ঞে ওবেলা দেব ওটা। বাসায় এনে রেখেছিলাম, চাবি দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে, আমি যার সঙ্গে থাকি।
—আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?
—একটু বেড়াতে বার হয়েছিলাম ওই গোলদিঘির দিকে—
—সব বাজে কথা। আমি বিশ্বাস করিনে। কেন করিনে তাও আপনি জানেন। রাত দশটার পরেই ক্যাশ এনে দেওয়ার কথা—আপনি বুড়ো হয়ে গেলেন এই ক্যানভাসারের কাজ করে, জানেন না যে ক্যাশ তখুনি জমা দেওয়ার নিয়ম আছে?
—আজ্ঞে, আজ্ঞে—
—এরকম আরও কতবার হয়েছে বলুন দিকি! আপনার কথার ওপর বিশ্বাস করা যায় না আর। বড়োই দুঃখের কথা। আপনি আমাদের পুরোনো ক্যানভাসার বলে আপনার অনেক দোষ সহ্য করেছি আমরা। কিন্তু এবার আর নয়। আপনি এ মাসের এই ক-দিনের মাইনে নিয়ে যাবেন অফিস খুললে—কমিশনের হিসেবটাও সেই সঙ্গে দেবেন। যান এখন।
অবশ্য এত সহজে কৃষ্ণলাল যাইতে রাজি হয় নাই—নৃত্যগোপালবাবুকে সে যথেষ্টই বলিয়াছিল, নৃত্যগোপালবাবুর বুড়োকর্তাকে গিয়া পর্যন্ত ধরিয়াছিল। শেষপর্যন্ত কিছুই হইল না।
মুশকিল এই, চাকুরি যখন যাইবার হয়, তখন তাহাকে কিছুতেই ধরিয়া রাখা যায় না। মৃত্যুপথযাত্রী মানবের মতোই তার গতিপথ নির্মম, ধরাবাঁধা!
সুতরাং চাকুরি গেল।
তখন বেলা আড়াইটা। সকাল হইতে ইহাকে উহাকে ধরাধরির ব্যাপারেই এতক্ষণ সময় কাটিয়াছে। স্নান-আহার হয় নাই।
২৫/২ রামনারায়ণ মিত্রের লেনে ঢুকিয়াই যে টিনের চালওয়ালা লম্বা দোতলা মাটির ঘর, অর্থাৎ যে মাঠকোঠার ঠিক সামনেই আজকাল কর্পোরেশনের সাধারণ স্নানাগার নির্মিত হইয়াছে—তারই পশ্চিম কোণে সতেরো নম্বর ঘরে আজ প্রায় এগারো বছর ধরিয়া কৃষ্ণলালের বাসা।
কৃষ্ণলাল ঘরে একা থাকে না। ছোট্ট ঘরে তিনটি ময়লা বিছানা মেঝেরে উপর পাতা। সে ঢুকিয়া দেখিল ঘরে কেবল যতীন শুইয়া ঘুমাইতেছে। আর একজন রুমমেট ট্রামের কান্ডাকটার, সাড়ে চারটার পরে সে ডিউটি হইতে ছুটি লইয়া একবার আধঘণ্টার জন্য বাসায় আসে এবং তারপরেই সাজিয়া-গুজিয়া কোথায় বাহির হইয়া যায়।
নীচে পাইস হোটেলে ইহাদের খাইবার বন্দোবস্ত।
কৃষ্ণলালের সাড়া পাইয়া যতীনের ঘুম ভাঙিয়া গেল। সে বলিল—এত বেলায়?
—বেলায় তা কী হবে! চাকরিটা গেল আজ।
—সে কী! এতদিনের চাকরিটা—
—কত করে বললুম বড়োবাবুকে। তা শোনে কী কেউ? গরিবের কথা কে রাখে বলো?
—হয়েছিল কী?
—ক্যাশ জমা দিতে দেরি হয়েছিল। বলে, তুমি ক্যাশ ভেঙেচ!
—তাই তো…তাহলে এখন উপায়?
—দেখি কোথাও আবার চেষ্টা—জুটে যাবে একটা-না-একটা। আমাদের এক দোর বন্ধ হাজার দোর খোলা—আমাদের অন্ন মারে কে?
সামান্য কিছু পয়সা হাতে ছিল—পাইস হোটেল হইতে শুধু ডাল-ভাত খাইয়া আসিয়া কৃষ্ণলাল কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিল, পরে নবীন কুণ্ডু লেনে একটি খোলার বাড়িতে ঢুকিয়া ডাক দিল—ও গোলাপী—গোলাপী—
তাহার সাড়ায় যে বাহির হইয়া আসিল সে বর্তমানে রূপযৌবনহীনা প্রৌঢ়া, পরনে আধময়লা খয়েরি রং-এর শাড়ি, হাতে গাছকয়েক কাচের চুড়ি, দু-গাছা সোনাবাঁধানো পেটি। মাথার চুলে পাক ধরিয়াছে, গায়ের রং এখনও বেশ ফর্সা।
গোলাপীকে ত্রিশ বছর আগে দেখিলে ঠিক বোঝা যাইত গোলাপী কী ছিল? এখন আর তাহার কী আছে? কৃষ্ণলাল তখন সবে ঔষধের ক্যানভাসারের পদে বহাল হইয়াছে—তাহার চমৎকার চেহারা ও কথাবার্তা বলিবার ভঙ্গিতে রেলগাড়ির প্যাসেঞ্জার কী করিয়া সহজেই ভুলিয়া যাইত-জলের মতো পয়সা আসিতে লাগিল।
এই নবীন কুণ্ডু লেনেই অন্য এক বাড়িতে এক বন্ধুর সহিত আসিয়া সে গোলাপীকে দেখে। তখন নতুন যৌবন, হাতেও কাঁচা পয়সা। গোলাপীর তখন বয়স ষোলো-সতেরো। রূপ দেখিয়া রাস্তার লোক চমকিয়া দাঁড়াইয়া যায়। গোলাপীর মার হাতে বছরে বছরে মোটা টাকা জমে। কৃষ্ণলাল সেই হইতেই নবীন কুণ্ডু লেনের নৈশ অধিবাসী। কত কালের কথা,-গোলাপীর ঘরে মেহগনি কাঠের দেরাজ হইল, ঘরের দেয়ালে বিলম্বিত বড়ো বিলাতি কাচ বসানো আয়না হইল, সেকালে প্রচলিত ম্যাকাসার অয়েলের শিশির পর শিশি ভিড় জমাইয়া তুলিল—বাতায়ন মালতী ফুলের টবে সজ্জিত হইয়া বাড়ির অন্যান্য ঘরের অধিবাসীদের মনে ঈর্ষার উদ্রেক করিল।
কাঁচা পয়সা কৃষ্ণলালের হাতে। প্রতিদিনের আয় তিন টাকা—আড়াই টাকার নীচে নয়।
একদিন গোলাপীর মা অভিমানের সুরে বলিল—যাই বলো বাপু, গোলাপী আমায় প্রায়ই বলে, একখানা বাড়ি তার নিজের না-হলে চলে না আর—তা তেমন কপাল কী—এই এক বাড়িতে ছত্রিশ জনার সঙ্গে
—কেন মা? তার ভাবনা কী? কালই ঘর দেখে দিচ্চি—
—কত টাকা ভাড়ার মধ্যে হবে বলো—এই আমাদের পাড়াতেই আছে—
—যা তুমি বলবে! কুড়ি কী পঁচিশ
—ত্রিশ টাকায় একখানা ভালো বাড়ি এ পাড়াতেই আছে—তাহলে তাই না হয়—
—হ্যাঁ হ্যাঁ—এ আবার আমায় জিজ্ঞেস করতে হয় মা?
গোলাপীরা নতুন বাড়িতে উঠিয়া আসিল। বড়ো পাঁচী বলিল—ওলো, একটু রয়ে-সয়ে নিস—দেখিস যেন আবার দড়ি না হেঁড়ে! খুব বরাত তোর যাহোক গোলাপী—আর আমাদের ওই বুড়ো রায়বাবু রোজ আসেন আর বাঁধানো দাঁত জলের গেলাসে খুলে রাখেন—ক-দিন বললাম একখানা ঢাকাই শাড়ি আর একটা বাজা-ঘড়ি দাও দেয়ালে টাঙানোের, তা বুড়ো মড়া আজ সাত মাস ঘুরুচ্চে—আজ এলে হয় একবার—ওর দাঁত খুলে জলের গেলাসে ডুবিয়ে রাখা বের করে দেব–
শুধু বাড়ি? গোলাপীর টেবিল-হারমোনিয়ম হইল, জোড়া জোড়া শাড়ি, চেয়ার, এমনকী শেষে কলের গান পর্যন্ত। কোন সুখ গোলাপীর বাকি ছিল? প্রতি রবিবারে কৃষ্ণলালের সঙ্গে গাড়ি করিয়া (অবশ্য ঘোড়ার গাড়ি) কালীঘাটে গঙ্গাস্নান ও দেবীদর্শন করিতে যাওয়া তাহার অভ্যাসের মধ্যে দাঁড়াইয়া গিয়াছিল। বছরের পর বছর কাটিয়া গেল।
গোলাপী আর কৃষ্ণলাল, কৃষ্ণলাল আর গোলাপী।
ইতিমধ্যে গোলাপীকে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে প্রতিষ্ঠিতা দেখিয়া তাহার মা একদিন নবীন কুণ্ডু লেনের মায়া কাটাইয়া বোধ হয় ঊর্বশী বা তিলোত্তমালোকে প্রস্থান করিল। অমন জাঁকের শ্রাদ্ধ এ অঞ্চলে কেহ দেখে নাই তার আগে।
ক্রমে ক্রমে গোলাপীর যৌবনে ভাটা পড়িল। কৃষ্ণলালেরও আয়ের অঙ্ক কমিতে লাগিল। দত্তপুকুরের তেলের অনুকরণে শত শত বাতের তেল বাজারে বাহির হইল—রেলগাড়ির কামরাও নিত্যনূতন ক্যানভাসারে ভরিয়া গেল। যা ছিল কৃষ্ণলালের একার—তাহার মধ্যে অনেক ভাগ বসিল। পূর্বের সচ্ছলতা কমিতে লাগিল।
তারপর দশ-বারো বছর কাটিয়া গিয়াছে।
এই দশ-বারো বছরে সুন্দরী গোলাপী কুরূপা প্রৌঢ়াতে পরিবর্তিত হইয়াছে— তাহার সে বাড়ি চলিয়া গিয়া আবার সাত-আটটি নানা বয়সের সঙ্গিনীর সঙ্গে পূর্বের বাড়িটিতে থাকিতে হয়।
তবুও কৃষ্ণালের যাহা কিছু উপার্জন, এইখানেই তাহার সদব্যয়। গোলাপীও তাহা বোঝে—এই ত্রিশ বছরের মধ্যে সে কৃষ্ণলালকে ছাড়িয়া অন্য কোথাও যায় নাই।
কৃষ্ণলাল বলিল—গোলাপী, চাকরিটা গেল!
গোলাপী বিস্ময়ের সুরে বলিল—সে কী গা!
—বড়োবাবু রাগ করেচে, কাল ক্যাশ জমা দিইনি বলে।
—কী করলে সে টাকা?
–খরচ হয়ে গেল।
—কোথায় খরচ হয়ে গেল—কীসে খরচ হয়ে গেল? তোমার এখনও দোষ গেল না, তা ওরা কী করে রাখে তোমায়? কাল কোথায় গিয়েছিলে?
—সে খরচ নয় গোলাপী। দক্ষিণেশ্বর সেদিন যাওয়ার দরুণ দেনা ছিল, মনে নেই? কাবুলির কাছ থেকে টাকা নিইনি? রাত দশটার পরে ইস্টিশনের গেটে আমায় ধরেচে–রূপি দেও। শেষে ভাবলাম কী, ছোরা মারবে নাকি? ভয়ে পড়ে দিয়ে দিলাম টাকা। কাবুলির দেনা, ও হজম করা কঠিন।
—তা নেও বেশ হয়েছে। এখন খাওয়া হয়েছে, না হয়নি? আমার অদেষ্টে ঝি গিরি নাচছে সে তো দেখতে পাচ্ছি! তখন বনু, পাড়াগাঁয়ের দিকে চলো—কোথাও একখানা ঘরদোর বেঁধে দুজনে থাকা যাবে—তা না, তোমার বাপু কলকেতা আর কলকেতা! কলকেতা ছেড়ে আমি থাকতে পারবোনি! এখন থাক কলকেতায়! কে। এখানে খাওয়ায় দেখি!
—জুটে যাবে, এখানেই জুটে যাবে। অত ভাবনার কারণ নেই—
—তোমার এ বুড়ো বয়সে চাকরি নিয়ে তোমার জন্যে বসে আছে। এখন আর কি তোমার হাত পা নেড়ে বক্তিমে করবার গতর আছে নাকি?
—দেখিয়ে দেব, গোলাপী, দেখবি! ভদ্রমহোদয়গণ, এই সেই বিখ্যাত আদি ও অকৃত্রিম দত্তপুকুরের বাতের তেল—ইহা ব্যবহারে সর্বপ্রকার বাত, বেদনা, মাথাধরা, দাঁত-কনকনানি, কাউর, ছুলি, কাটা-ঘা, পোড়া-ঘা—
গোলাপী হাসিতে হাসিতে বলিল—থাক গো গোঁসাই, আর বিদ্যে দেখাতে হবে …সবাই জানে তুমি খুব ভালো বক্তিমে দিতে পারো—আহা, কী হাত পা নাড়ার ছিরি! যেন থিয়েটারের অ্যাক্টো করছেন!
—তাহলে বল চাকুরিতে নেবে কিনা?
—নেবে না আবার! একশোবার নেবে—আমি যাই এখন ঝি-গিরি করে নিজের পেট চালাবার চেষ্টা দেখি—নিজেই খেতে পাবে না তা আমায় আর খাওয়াবে কোত্থেকে! কী অদেষ্ট যে নিয়ে এসেছিলাম!
কৃষ্ণলাল চলিয়া যাইতে উদ্যত হইয়াছে দেখিয়া গোলাপী বলিল—বোসো, দুটো মুড়িটুড়ি মেখে দি—খেয়ে একটু চা খেয়ে যাও—
অগত্যা কৃষ্ণলাল বসিল। বলিল—তাহলে বক্তৃতা এখনও দিতে পারি, কি বলো?
—নেও, আর আদিখ্যেতায় কাজ নেই। দিতে পারো তো—সত্যি কথা যদি বলি তবে তো পায়া ভারী হয়ে যাবে!
—কী, বলো না গোলাপী, বলতেই হবে।
—তোমার মতো অমন কারো হয় না, আমি তো কতই দেখলাম দাঁতের মাজনের, ওষুধের ফিরিওয়ালা আমাদের এই গলির মুখে হারমোনিয়াম গলায় বেঁধে নাচে, বক্তিমে দেয় পোড়ারমুখোরা—কিন্তু সে-সব ফিরিওয়ালা তোমার মতো নয়—
কৃষ্ণলাল রাগের সুরে বাধা দিয়া বলিল—কীসের সঙ্গে কীসের তুলনা! তোকে নিয়ে আর পারিনে দেখচি—তারা হল ফিরিওয়ালা—আমরা হলুম ক্যানভাসার— হারমোনিয়াম পিঠে বেঁধে যারা গান গেয়ে ঘুঙুর পায়ে দিয়ে নেচে বেড়ায়, আমরা
কী সেই দলের? অপমান হয়, ওকথা আমাদের বোলো না।
–যাক যাক, ভুল হয়েছে, তুমি এখন ঠান্ডা হয়ে বসে চা খেয়ে নেও।
গোলাপীর মন আজ বেশ খুশি। কতদিন পরে যেন যুবক কৃষ্ণলালের অঙ্গভঙ্গি ও সুন্দর সতেজ গলার স্বর সে আবার শুনিল! ত্রিশ বৎসরের অন্ধকার কালো হেঁড়া পর্দাটা কে টানিয়া সরাইয়া দিল!
সে যত্ন করিয়া কৃষ্ণলালকে খাওয়াইল—কৃষ্ণলাল বিদায় লইয়া যখন আসে তখন বলিল—একটা কথা বলি শোনো। যদি খাওয়া-দাওয়ার কোনো কষ্ট হয়, তবে আমার কাছে এসে অবিশ্যি খেয়ে যাবে। এই বেদ্দ বয়েসে না-খেলে শরীর থাকবে কেন? আমায় কিছু দিতে হবে না এখন। ওই সোনারবেনেদের ঠাকুরবাড়িতে একটা ঝিয়ের দরকার, সকাল-সন্ধে কাজ করব—আমি কাল থেকে সেখানে কাজে লেগে যাব—তা তোমায় বলাও যা না বলাও তাই—তুমি কি আসবে? তোমায় আমি চিনি কিনা?
কৃষ্ণলাল হাসিয়া বলিল—ভালোই তো। তোর রোজগারে এইবার খাই দিনকতক—সে সাধ আমার কাছে অনেকদিন থেকেই। আচ্ছা তাহলে এখন আসি, ওবেলা হয়তো আসব—সন্ধের পর।
তাহার পর এক মাস কাটিয়া যায়, কিন্তু গোলাপীর বাড়ি কৃষ্ণলাল আর আসিল। সুখের দিনে গোলাপীকে সে অনেক দিয়াছে—এখন দুঃখের দিনে বসিয়া বসিয়া গোলাপীর অন্ন ধ্বংস করিবে, তেমন-বংশে জন্ম নয় কৃষ্ণলালের। বিশেষত দেখিতে হইবে, গোলাপীও প্রৌঢ়া—ঝি-গিরি ভিন্ন এখন আর তার কোনো উপায় নাই!
মেসের ভাড়া বাকি পড়িয়াছিল দু-মাসের, মেসের অধ্যক্ষ কৃষ্ণলালকে ডাকিয়া বলিল—কী কৃষ্ণবাবু, আমাদের রেন্ট টার কী হবে?
—আজ্ঞে ক্ষেত্রবাবু, দেখতেই তো পাচ্ছেন—চাকুরিটা গেল, হাতে কিছু নেই। এ অবস্থায়
—ফি-মাসে আমি পকেট থেকে ঘরভাড়া জোগাব কোথা থেকে, সেটাও তো দেখতে হবে! দু-দিন সময় নিন—তারপর আপনি দয়া করে সিট ছেড়ে দিন, আমি অন্য ব্যবস্থা দেখি।
কৃষ্ণলাল পড়িল মহা বিপদে। একে খাইবার পয়সা নাই—তাহার উপর মাথা পুঁজিবার যে জায়গাটুকু ছিল, তাহাও তো আর থাকে না। তিনদিন কাটিয়া গেল, দু-একটি পূর্বপরিচিত বন্ধুর নিকট হইতে চাহিয়া-চিন্তিয়া দু-চার আনা ধার লইয়া পাইস হোটেলের ডাল-ভাতে কোনোরকমে ক্ষুধানিবৃত্তি করিয়া এই তিনদিন পরে তাহার সত্যই অনাহার শুরু হইল। দু-পয়সায় ছাতু বা মুড়ি সারাদিনে—শুধু ছাতু, একটু গুড় বা চিনি জোটে না তাহার সঙ্গে! তাহার পর পেট পুরিয়া জল, কলের নির্মল জল!
মেসে ম্যানেজার আবার ডাক দিলেন। বলিলেন—কিছু হল?
—আজ্ঞা এখনো—এই ভাবচি
—আমার লোক এসে গিয়েচে-কাল মাসের পয়লা। দু-মাসের ভাড়া পকেট থেকে দিয়েচি—এ মাসেরও দিতে হবে? আমিও ছাপোষা মানুষ মশাই—কত লোকসান হজম করি বলুন! আপনি জিনিসপত্তর নিয়ে চলে যান—আমার ভাড়ার দরকার নেই।
পরদিন সকালেই জিনিসপত্রসমেত (একটা টিনের ট্রাঙ্ক ও একটি ময়লা বিছানা) কৃষ্ণলালকে পথে দাঁড়াইতে হইল। বর্ষাকাল—জিনিসপত্র রাখিবার মতো জায়গা কোথায় পাওয়া যায়? গোলাপী অনেকবার মেসে খবর লইয়াছে—মধ্যে একদিন দু-ঘণ্টা মেসের বাহিরের ফুটপাতে বসিয়াছিল তাহার অপেক্ষায় (কারণ ম্যানেজার তাহাকে চেনে, মেসে কুচরিত্রা স্ত্রীলোক ঢুকিতে দিবে না)—কৃষ্ণলাল দুর হইতে দেখিয়া সরিয়া পড়িয়াছিল। এখন গোলাপীর বাড়ি গেলে সে কান্নাকাটি করিবে, আটকাইয়া রাখিতে চাহিবে। নতুবা সেখানে জিনিসপত্র রাখা চলিত।
মেস হইতে কিছু দূরে বড়ো রাস্তার উপর একটা চায়ের দোকানের মালিকের সঙ্গে কৃষ্ণলালের পরিচয় ছিল। বলিয়া-কহিয়া সেখানে কৃষ্ণলাল জিনিসপত্র আপাতত রাখিয়া দিল। তাহার পর উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরিতে ঘুরিতে হঠাৎ দেখিল সে গঙ্গার ধারে আহিরীটোলার স্টিমারঘাটে আসিয়া পড়িয়াছে।
সকাল হইতে কিছু খাওয়া হয় নাই। ঘাটের ধারে একটা গাছতলায় হিন্দুস্থানী ফিরিওয়ালা ভুট্টা পোড়াইতেছে, কৃষ্ণলাল এক পয়সায় একটা ভুট্টা কিনিয়া জলের ধারে বসিয়া সেটি পরম তৃপ্তির সহিত খাইল।
একটা বিড়ি পাইলে হইত এই সময়।
এই সময় একটি ছোকরা ব্যাগহাতে আসিয়া তাহার পাশে ব্যাগটি নামাইয়া পকেট হইতে ঝাড়ন বাহির করিয়া সিমেন্ট বাঁধানো রানার উপর পাতিল। বসিতে যাইবে এমন সময় ছোকরা হঠাৎ পকেটে হাত দিয়া কী দেখিয়া একবার চারিদিকে চাহিল এবং কাছেই কৃষ্ণলালকে দেখিয়া বলিল—একটু দয়া করে ব্যাগটা দেখবেন? এক পয়সার বিড়ি কিনে আনি—
বিড়ি কিনিয়া আনিয়া সে কৃষ্ণলালকে একটি বিড়ি দিল। কৃষ্ণলাল আগেই আন্দাজ করিয়াছিল, ছোকরা একজন ক্যানভাসার। এখন জিজ্ঞাসা করিল—আপনি বুঝি ক্যানভাস করেন?
–আজ্ঞে হ্যাঁ—
—কী জিনিস?
—হাতকাটা তেল—সার্জিক্যাল মলম—
—বেশ পাওয়া যায়? কমিশন কেমন?
—ভালোই। খদ্দেরকে হাত কেটে দেখাতে—সঙ্গে ছুরি থাকে—এই যে—
ছোকরা জামার আস্তিন গুটাইয়া দেখাইল—কবজি হইতে কনুই পর্যন্ত হাতের সমস্ত অংশটা ছুরি দিয়া ফালা ফালা করিয়া চেরা! কৃষ্ণলাল শিহরিয়া উঠিয়া বলিল—এ কী, লাগে না?
ছোকরা হাসিয়া বলিল—লাগে—আবার মলম লাগালে সেরে যায়।
—কীরকম আয় করেন?
—চব্বিশ টাকা থেকে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ টাকা মাসে।
কৃষ্ণলালের মন বেজায় দমিয়া গেল। এত কাণ্ড করিয়া ত্রিশ টাকা! অথচ এমন সময় গিয়াছে—যখন দত্তপুকুরের বাতের তেল ফিরি করিয়া সে মাসে ষাট-সত্তর টাকা অনায়াসে রোজগার করিয়াছে—তাহার জন্য নিজের হাত ছুরি দিয়া ফালা ফালা করিয়া কাটিবার প্রয়োজন হয় নাইঅ্যা
ক্যানভাসারের কাজে আর সুখ নাই। আর সে এ কাজ করিবে না।
পরদিন কৃষ্ণলাল কলিকাতা ছাড়িয়া স্বগ্রামে রওনা হইল। বসিরহাট স্টেশনে নামিয়া সাত ক্রোশ হাঁটিয়া তাহার পৈতৃক গ্রাম ইলশেখালি পৌঁছিতে বেলা তিনটা বাজিল। গ্রামে তাহার দূর-সম্পর্কের জ্ঞাতি ছাড়া অন্য কেহ আপনারজন নাই— নিজের পৈতৃক ভিটা জঙ্গলাকীর্ণ হইয়া পড়িয়া আছে। বহুদিন এদিকে আসে নাই, দেখাশোনাও করে নাই—খড়ের ঘর কতদিন টেকে? আজ প্রায় সতেরো-আঠারো বছর পূর্বে দু-পাঁচ দিনের জন্য একবার পিসিমার শ্রাদ্ধে গ্রামে আসিয়াছিল—সেই আর এই!
জ্ঞাতিরা অবশ্য কৃষ্ণলালকে জায়গা দিল। কিন্তু কিছুদিন থাকিয়া কৃষ্ণলালের কেমন অসহ্য বোধ হইতে লাগিল। গ্রামে তাহার মন টেকে না। কখনো সে দীর্ঘদিন ধরিয়া গ্রামে বাস করে নাই—এখানকার লোকে কথাবার্তা বলিতে জানে না, ভালো করিয়া মিশিতে জানে না, চা খায় না। কলিকাতায় রাস্তার ভিখারিও চা খায়। তাহার উপর এই পাড়াগাঁয়ে যেমন জলকাদা, তেমনি জঙ্গল—রাত্রে মশার উৎপাতে নিদ্রা হয় না। এর মধ্যে ম্যালেরিয়া প্রায় সকল বাড়িতেই দেখা দিয়াছে।
না, এখানে মন টেকে না। কৃষ্ণলাল চেষ্টা করিয়া দেখিল—এখানে সবাই যেন সারাদিন ঘুমাইয়া আছে। সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত ইহারা চড়কতলার ক্ষুদ্র মাঠে বেলতলায় বসিয়া হুকা হাতে আড্ডা দেয়, পরচর্চা করে। কোনো কাজ নাই অথচ দুপুরের ভাত দুটি মুখে দিতে না-দিতে এদের চোখ ঘুমে ঢুলিয়া পড়ে। দিবানিদ্রা চলে চারিটা পর্যন্ত—তারপর ঘুম হইতে রক্তবর্ণ চোখে উঠিয়া কেহ-বা বাজারে দু-পয়সার সওদা করিতে যায়—সেখানেও আবার আড্ডা…এ দোকানে ও দোকানে বসিয়া তামাক খাওয়া…চার পয়সার সওদা করিতে তিন ঘণ্টা লাগাইয়া সন্ধ্যার পর বাড়ি আসে। তারপরই আহার ও নিদ্রা। কেরোসিন তেলের দাম চড়িয়া গিয়াছে—তেল খরচ করিয়া আলো জ্বালাইয়া রাখিতে কেহ রাজি নয়। কয়েক বাড়ি যাও—অন্ধকারে বসিয়া দু-একটা কথা বলো, গল্প করো—এক-আধ কল্কে তামাক খাও—তাহার পর বাড়ি ফিরিয়া আবার বিছানা আশ্রয় করো, দিন শেষ। হইয়া গেল।
কৃষ্ণলাল এরকম জীবনে অভ্যস্ত নয়। এ কী জীবন? অথচ সকলেই বলিবে, দাদা, সংসার আর চলে না, বড়ো কষ্ট! কষ্ট ঘুচাইবার চেষ্টা কোথায়? আজ দীর্ঘ পঁচিশ-ত্রিশ বছর ধরিয়া যার কলিকাতায় ভীষণ কর্মব্যস্ত জীবন কাটিয়াছে—এ ধরনের অলস, শ্রমবিমুখ জীবনের ধারণাই করিতে পারে না সে!
সকালে উঠিয়াই নীচের তলার কলে স্নান সারিয়া লইতে হইত। খুব ভোরে স্নান না-সারিলে এমন ভিড় জমিয়া যাইবে কলে যে আর স্নান করা চলিবে না। নীচের তলায় সেকরার দোকানের লোকেরা, শালওয়ালা, দরজি, পুব দিকের ঘরে যে মুটেরা থাকে সবাই আসিয়া কলে ভিড় লাগাইয়া দিবে। ইহার পর আসিবে একদল বালতি হাতে জল ধরিতে ও চাউল ধুইতে। সারি সারি লোক দাঁড়াইয়া যাইবে কলসি হাতে জল ভরিতে। ওপরে তিনতলায় তিনটি মেসের চাকরেরা— সকলেই কর্মব্যস্ত, ঘড়ি ধরিয়া কাজ কলিকাতায়, “সময় গেল। ছ-টা বাজে, কখন কী হবে?” দিন আরম্ভ হইয়াছে…এখনি বাবুরা আসিয়া ভাত চাহিবে আটটা বাজিতে-না-বাজিতে, এতটুকু দেরি করিলে চলিবে না!
স্নান সারিয়া কৃষ্ণলাল ব্যাগ হাতে বাহির হইত শেয়ালদ’ স্টেশনে, প্রথমেই সাতটা দশ বারাসত, সাতটা পঁচিশ নৈহাটি, পৌঁনে আটটা রানাঘাট প্যাসেঞ্জার; সাড়ে আট-টা বনগাঁ লোকাল, আটটা পঞ্চাশ দত্তপুকুর, ন-টা কেষ্টনগর লোকাল…শুরু হইয়া গেল দিনের কাজ। বাতের তেল! বাতের তেল! যত প্রকার বাত, ফোলা, শূলানি, কনকনানি, মাথাধরা, পেটবেদনা, ইহার একমাত্রা ব্যবহারে…ভদ্রমহোদয়গণ, এই ওষুধটি আজ ত্রিশ বছর যাবৎ এই লাইনে সুখ্যাতির সহিত চলিতেছে,—এই চলিল বেলা বারোটা পর্যন্ত। বারোটা পঞ্চান্ন শান্তিপুর ছাড়িয়া গেলে তবে সকালের কাজ মিটিল। কী জীবন! কী আনন্দ! কী পয়সা রোজগার! কাঁচাপয়সা রোজ আসে, রোজ সন্ধ্যায় উড়িয়া যায়। যে পয়সা আয় করিতে জানে, সে-ই জানে খরচ করিতে, ইহাতে ক্ষোভ কী?
কৃষ্ণলাল আরও মাসখানেক কোনোরকমে কাটাইল।
আর চলে না। এ অলস জীবন তাহার অসহ্য। কখনো পা গুটাইয়া কূর্মবৃত্তি অবলম্বন করিয়া এভাবে সে থাকে নাই। বেশিদিন এভাবে থাকিলে সে পাগল হইয়া যাইবে, নয়তো মরিয়া যাইবে।
কিন্তু কলিকাতায় গিয়া সে খাইবে কী? কোনো উপায় তো দেখা যাইতেছে না! ইন্ডিয়ান ড্রাগ সিন্ডিকেটে আর চাকরি হইবার সম্ভাবনা নাই। তবুও একবার বসু মহাশয়কে গিয়া ধরিয়া দেখিলে কেমন হয়? কিছু যদি না-জোটে, তবে আহিরীটোলার ঘাটে সেই হাতকাটা তেলের ক্যানভাসার ছোকরার সঙ্গে দেখা করিয়া…তবে ছুরি দিয়া নিজের হাতটা ফালা ফালা করিয়া কাটা—এ বৃদ্ধ বয়সে, ক্যানভাসারের চাকুরির মতো সম্মানের চাকুরি, আরামের চাকুরি আর নাই, কিন্তু হাত কাটিয়া দেখাইয়া জিনিস বিক্রয় করা! ওতে মানসম্ভম থাকে না।
এভাবে গ্রামে বসিয়া থাকা জীবন নয়। চিরকাল কাজের মধ্যে থাকিয়া আজ বাঁচিয়া মরিয়া থাকা তাহার পোষাইবে না। গ্রামেও তো হাওয়া খাইয়া জীবনধারণ করা যায় না— কেহ কেহ তাহাকে সামনের বছর দু-এক বিঘা ধান করিতে পরামর্শ দিল—কেহ বলিল, ডোবার ধারে জমিটা পড়ে আছে কেষ্ট খুড়ো, তোমারই পৈতৃক জমি, এই শীতকালে মানকচু লাগাও ওটাতে, তবু হাটে হাটে কিছু ঘরে আসবে, সামনের শীতকাল নাগাৎকৃষ্ণলালের হাসি পায়।
কলিকাতায় রোজগার যে কী ধরনের, সেখানে ক্যানভাসারের কাজে মাসে যে টাকা এক সময় তাহার আয় ছিল, এখানে গোটা বছর ধরিয়া কচু, কুমড়ো বেচিয়াও যে সে আয় হওয়া অসম্ভব—এই মূর্খ, অর্বাচীনেরা তাহা কী করিয়া বুঝিবে?
অবশেষে সে একদিন বাক্সবিছানা বাঁধিয়া কলিকাতায় আসিয়া হাজির হইল।
বাঁচিতে হয় তো ভালো করিয়াই সে বাঁচিবে।
ট্রেনে পুরোনো ক্যানভাসারদের সঙ্গে দেখা। নবশক্তি ঔষধালয়, কবিরাজ অনঙ্গমোহন দেব, বিশ্বাস কোম্পানি—ইন্ডিয়ান ড্রাগ সিন্ডিকেট প্রভৃতি ফার্মের লোক সব। সবাই জানে, সবাই খাতির করে।
—আরে এই যে কেষ্টদা, আজকাল আর দেখিনে যে?
—কেষ্টদা, কোত্থেকে? বিয়েথাওয়া করলেন নাকি এ বয়সে?
—আজকাল কোনো কোম্পানিতে আছেন কেষ্টদা? দেখিনে ট্রেনে আর?
—জমিজমা দেখতে গেছলে ভায়া? তা দেখবেই তো, থাকলেই দেখে–আমাদের কোনো চুলোয় কিছু নেই, যা করে এই বিশ্বাস কোম্পানি, হিংসা হয় তোমায় দেখে, দু-শো টাকা বছরে আয়ের সম্পত্তি? বলো কী! তবে তো তুমি– ইত্যাদি, ইত্যাদি।
কৃষ্ণলালকে এ বিড়ি দেয়, ও পানের কৌটো খুলিয়া সামনে ধরে। পুরাতন বন্ধুর দল। ইহাদের ফেলিয়া সে এতকাল ঘুমন্তপুরীতে কাল কাটাইল যে কী ভাবিয়া? এখানে কাজ আছে, আমোদ আছে, পয়সা রোজগার আছে, তারপর ইয়ে আছে। আর সে কোথাও যাইবে না কলিকাতা ছাড়িয়া। মরিতে হয় এখানেই মরিবে।
পনেরো-বিশ দিন এখানে ওখানে হাঁটাহাঁটি করিয়াও কিন্তু চাকুরি মিলিল না। বসু মহাশয় ঝাড়া জবাব দিলেন। এখন সুশ্রী চেহারার ছোকরা ক্যানভাসার—বেশ লম্বা জুলপি, ঘাড় বাহির করিয়া চুল ছাঁটা, লপেটা জুতা পায়ে, থিয়েটারের রামের মতো গলা, এই সবাই চায়। বয়স হইয়া গেলে, মানে, উহাদের লোক আছে, দরকার হইলে চিঠি লিখিয়া জানাইবেন পরে।
পুরোনো মেসেই উঠিয়াছিল, বারান্দাতে আছে। গোলাপীর সঙ্গে দেখা করে নাই। এখন করিতে চাহেও না সে। অনাহারে দু-দিন কাটিল মধ্যে। অবশেষে একদিন আহিরীটোলার ঘাটেই গিয়া হাজির হইল, যদি হাতকাটা তেলওয়ালা সেই ছোকরার সঙ্গে দেখা হইয়া যায়! সে সাড়ে বারোটার স্টিমারে রোজ বালি হইতে আসে বলিয়াছিল। সাত-আট দিন ক্রমাগত ঘুরিয়াও কিন্তু ছোকরার দেখা মিলিল না। কৃষ্ণলালের দুঃখ শেষ সীমায় আসিয়া পোঁছিয়াছে। আর চলে না। আচ্ছা, সে ক্যানভাসারি ভুলিয়া যাইতেছে না তো? আজ কতদিন চাকুরি নাই, কতদিন বক্তৃতা দিবার অভ্যাস নাই। চর্চা-অভাবে শেষে কিনা ছোকরা ক্যানভাসারেরা তাহাকে— কৃষ্ণলালকে ছাড়াইয়া যাইবে!
সেদিন কৃষ্ণলাল নিজের টিনের ছোটো সুটকেসটি হাতে লইয়া ড্যালহাউসি স্কোয়ারের মোড়ে দাঁড়াইয়া হাত-পা নাড়িয়া ক্যানভাসারের বক্তৃতা জুড়িয়া দিল, চর্চা রাখা দরকার তো বটেই, তা ছাড়া সে নিজের শক্তি পরীক্ষা করিতে চায়, খরিদ্দার জোটে কিনা সে একবার দেখিবে। এখনও তাহার যাহা গলা আছে, থিয়েটারের রামের মতো গলাওয়ালা কোনো ছোকরা ক্যানভাসার তাহার সঙ্গে পাল্লা দিবে, সে দেখিতে চায়!—দত্তপুকুরের বাতের তেল! ব্যবহারে সর্বপ্রকার বাতবেদনা, মাথা ধরা, দাঁতশূলানি, হাত-বেদনা, পিঠ-বেদনা…ভদ্রমহোদয়গণ! এই ঔষধটি আজ ত্রিশ বছর ধরিয়া এই লালদিঘির মোড়ে…
কৃষ্ণলাল মিনিট পাঁচ-ছয় পরে সগর্বে একবার চারিদিকে পচহিয়া দেখিয়া লইল। বেশ ভিড় জমিয়া গিয়াছে। একজন ভিড় ঠেলিয়া কাছে আসিয়া বলিল—আমায় একটা ছোটো ফাইল—
কৃষ্ণলাল গম্ভীরভাবে বলিল—আমার কাছে ওষুধ নেই—আমি বসু ইন্ডিয়ান ড্রাগ সিন্ডিকেটের পাবলিসিটি ডিপার্টমেন্টে র লোক, যাঁদের দরকার হবে, তাঁরা একশো ছয়ের সি হরিধন পোদ্দার লেনে বসু ইন্ডিয়ান ড্রাগ সিন্ডিকেটের অফিসে…আমার নামের এই স্লিপটা নিয়ে যান দয়া করে, টাকায় চার আনা কমিশন পাবেন—দাঁড়ান লিখে দিচ্ছি—
দিন পাঁচ-ছয় কাটিল। কৃষ্ণলালের নেশা লাগিয়া গিয়াছে। সে বেলা তিনটার সময় রোজ সুটকেস হাতে ঝুলাইয়া ডালহাউসি স্কোয়ারের মোড়ে গিয়া বক্তৃতা জুড়িয়া দেয়। আফিস–ফেরতা লোকেরা ভিড় করিয়া শোনে।
সেদিন কৃষ্ণলাল দাঁড়াইয়া দত্তপুকুরের বাতের তেলের গুণ ব্যাখ্যা করিতেছে। এমন সময় একজন ভদ্রলোক ভিড় ঠেলিয়া একেবারে তাহার সামনে আসিয়া দাঁড়াইলেন।
কৃষ্ণলাল চমকিয়া উঠিল, বসু ড্রাগ সিন্ডিকেটের মালিক নৃত্যগোপাল বসু মহাশয় স্বয়ং।
বসু মহাশয় কৃষ্ণলালের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া বলিলেন, শুনুন একবার এদিকে—
কৃষ্ণলাল ভিড়ের পাশ কাটাইয়া কিছু দূরে বসু মহাশয়ের সঙ্গে গিয়া অপ্রতিভের মতো দাঁড়াইল। বসু মহাশয় বলিলেন, এ কী হচ্ছে?
কৃষ্ণলাল অপরাধীর মতো মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে বলিল,–আজ্ঞে, আজ্ঞে, একবার চর্চাটা রাখচি, নইলে–
বসু মহাশয় বলিলেন, তাই তো বলি, এ কী কাণ্ড! গত দিন পাঁচ-ছয়ের মধ্যে আফিসে আপনার নামের স্লিপ নিয়ে বোধ হয় একশো কী দেড়শো খদ্দের গিয়েছে। এত ওষুধ বিক্রি গত ক-মাসের মধ্যে হয়নি। একে তো এই ডাল সিজন যাচ্ছে, আমি তো অবাক! সবাই বলে লালদিঘির মোড়ে আপনাদের পাবলিসিটি অফিসার, তাঁরই মুখে শুনে…আমি বলি আজ নিজে গিয়ে ব্যাপারটা কী দেখি তো নিজের চোখে! তা আমি খুব সন্তুষ্ট হয়েচি, আপনার এরকম কাজে–
কৃষ্ণলাল বিনীতভাবে বলিল, আজ্ঞে, ভাবলাম ছোকরা ক্যানভাসারদের মতো থিয়েটারি রামের গলা কোথায় পাব—তবুও একবার দেখি দিকি—
বসু মহাশয় বলিলেন, শুনুন, ওসব থাক, আপনি আজই অফিসে আসুন এক্ষুনি।
আপনাকে আজ থেকে হেড ক্যানভাসার অ্যাপয়েন্ট করলাম। ষাট টাকা মাইনে পাবেন আর কমিশন, শুধু তদারক করে বেড়াবেন কে কেমন কাজ করছে, আর ছোকরাদের একটু তালিম দিয়ে দেবেন, বুঝলেন না? আসুন চলে আমার গাড়িতে–
সন্ধ্যাবেলা।…নবীন কুণ্ডুর লেনে খোলর ঘরের সংকীর্ণ রোয়াকে গোলাপী ক্যানেস্ত্রারাকাটা তোলা উনুনে আঁচ দিয়া প্রাণপণে পাখার বাতাস করিতেছে, এমন সময় বাহিরে কে পরিচিত গলায় ডাকিল—গোলাপী, ও গোলাপী, বাইরে এসে জিনিসগুলো ধরো দিকি! হাত ধরে গিয়েছে—
» খুঁটি-দেবতা
ঘোষপাড়ায় দোলের মেলায় যাইবার পথে গঙ্গার ধারে মঠটা পড়ে।
মঠ বলিলে ভুল বলা হয়। ঠিক মঠ বলিতে যাহা বুঝায়, সে ধরনের কিছু নয়। ছোটো খড়ের ঘর খান চার-পাঁচ মাঠের মধ্যে। একধারে একটা বড়ো তেঁতুলগাছ। গঙ্গার একটা ছোটো খাল মাঠের মধ্যে খানিকটা ঢুকিয়া শুকাইয়া মজিয়া গিয়াছে —জোয়ারের সময়ে তবুও খালটা কানায় কানায় ভরিয়া উঠে। ঠিক সেই সময় জেলেরা দোয়াড়ী পাতিয়া রাখে। জোয়ারের তোড়ের মুখে মাছ খালে উঠিয়া পড়ে, ভাটার টানে নামিবার সময় দোয়াড়ীর কাঠিতে আটকাইয়া আর বাহির হইতে পারে না। কাছেই একটু দূরে শঙ্করপুর বলিয়া ছোটো গ্রাম। কিছুকাল পূর্বে রেল-কোম্পানি একটা ব্রাঞ্চ লাইন খুলিবার উদ্দেশ্যে খানিকটা জমি সার্ভে করাইয়া মাটির কাজ আরম্ভ করাইয়াছিলেন, কোনো কারণে লাইন বসানো হয় নাই। মাঠের উত্তর-দক্ষিণে লম্বা প্রকাণ্ড উঁচু রেলওয়ে বাঁধটার দুই পাশের ঢালুতে নানাজাতীয় কাঁটাগাছ, আকন্দ ও অন্যান্য বুনো গাছপালা গজাইয়া বন হইয়া আছে। আকন্দ গাছটাই বেশি।
খুঁটি-দেবতার অপূর্ব কাহিনি এইখানেই শুনিয়াছিলাম।
গল্পটা বলা দরকার।
শঙ্করপুর গ্রামের পাশে ছিল হেলেঞ্চা-শিবপুর। এখন তাহার কোনো চিহ্ন নাই। বছর পনেরো পূর্বে গঙ্গায় লাটিয়া গিয়া মাঝ-গঙ্গার ওই বড়ো চরটার সৃষ্টি করিয়াছে। পূর্বস্থলীর চৌধুরী জমিদারদের সহিত ওই চরার দখল লইয়া পুরোনো প্রজাদের অনেক দাঙ্গা ও মোকদ্দমা হইয়াছিল। শেষপর্যন্ত প্রজারাই মামলায় জেতে বটে, কিন্তু চরটা চিরকালই বালুময় থাকিয়া গেল, আজ দশ বৎসরের মধ্যে চাষের উপযুক্ত হইল না। পাঞ্জা দখলে আসিলেও চরটা প্রজাদের কোনো উপকারে লাগে না, অনাবাদী অবস্থায় পড়িয়াই থাকে। আজকাল কেহ কেহ তরমুজ, কাঁকুড় লাগাইতেছে দেখা যায়।
এই গ্রামে রাঘব চক্রবর্তী পূজারি বামুন ছিলেন।
রাঘব চক্রবর্তীর কেহ ছিল না। পৈতৃক আমলের খড়ের বাড়িতে একা বাস করিতেনঃ একাই নদীর ঘাট হইতে জল আনিয়া, বনের কাঠ কুড়াইয়া রাঁধিয়া বাড়িয়া খাইতেন! গায়ে শক্তিও ছিল খুব, পিতামহের আমলের সেকেলে ভারী পিতলের ঘড়া ভরিয়া দুটি বেলা এক পোয় পথ দূরবর্তী গঙ্গা হইতে জল আনিতেন। ক্লান্তি বা আলস্য কাহাকে বলে জানিতেন না।
রাঘব চক্রবর্তী পয়সা চিনিতেন অত্যন্ত বেশি। বাঁশের চটার পাখা তৈয়ারি করিয়া কুড়ি দরে ডোমেদের কাছে ঘোষপাড়ার দোলে বিক্রয় করিতে পাঠাইয়া দিতেন। অবসর সময়ে ঝুড়ি, কুলোডালা বুনিয়া বিক্রয় করিতেন। মাটির প্রতিমা গড়িতে পারিতেন। উলুখড়ের টুপি, ফুল-ঝাঁটা তৈয়ারি করিতেন। সুন্দর কাপড় রিপু করিতে পারিতেন। এসব তাঁহার উপরি আয়ের পন্থা ছিল। সংসারে কেহই নাই, না-স্ত্রী, না-ছেলে-মেয়েকে তাঁহার পয়সা খাইবে, তবুও রাঘব টাকা জমাইয়া যাইতেন। একটা মাটির ভাঁড়ে পয়সাকড়ি রাখিতেন, সপ্তাহে একবার বা দুইবার ভাঁড়টি উপুড় করিয়া ঢালিয়া সব পয়সাগুলি সযত্নে গুনিতেন। ভাঁড়ের মধ্যে যাহা রাখিতেন পারতপক্ষে তাহা আর বাহির করিতেন না। গ্রামের সবাই বলিত, রাঘব চক্রবর্তী হাতে বেশ দু-পয়সা গুছাইয়া লইয়াছেন।
একদিন দুপুরে পাক সারিয়া রাঘব আহারে বসিবার উদ্যোগ করিতেছেন, এমন সময়ে একখানা ছই-ঘেরা গোরুরগাড়ি আসিয়া তাঁহার উঠানে থামিল। গাড়ি হইতে একটি পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের যুবক বাহির হইয়া আসিল। রাঘব চিনিলেন, তাঁর দূর-সম্পৰ্কীয় ভাগিনেয় নন্দলাল।
নন্দলাল আসিয়া মামার পায়ের ধূলা লইল।
রাঘব বলিলেন—এসো বাবা। ছই-এর মধ্যে কে?…
নন্দলাল সলজ্জমুখে বলিল—আপনার বউমা।
–ও! তা কোথায় যাবে? ঘোষপাড়ার দোল দেখতে বুঝি?
নন্দলাল অপ্রতিভের সুরে বলিল—আজ্ঞে না। আপনার আশ্রয়েই—আপাতত —মানে, বামুনহাটির বাড়িঘর তো সব গিয়েছে। গত বছর মাঘমাসে বিয়ে—তো এতদিন বাপের বাড়িতেই ছিল—সেখান থেকে না-আনলে আর ভালো দেখাচ্ছে। না। তাই নিয়ে আজ একেবারে এখানেই…
রাঘব বিশেষ সন্তুষ্ট হইলেন না। তিনি চিরকালই একা থাকিয়া আসিয়াছেন, একা থাকিতেই ভালোবাসেন। এ আবার কোথা হইতে উপসর্গ আসিয়া জুটিল, দ্যাখো কাণ্ড!
যাহাহউক, আপাতত বিরক্তি চাপিয়া তিনি ভাগিনেয়-বধূকে নামাইয়া লইবার ও পূর্বদিকের ভিটার ছোটো ঘরখানাতে তাহাদের থাকিবার বন্দোবস্ত করিলেন।
সন্ধ্যার পরে ভাগিনেয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন—এখানে নিয়ে তো এলে, হাতে কিছু আছে–টাছে তো? আমার এখানে আবার বড়ো টানাটানি। ধান অন্যবার যা হয়, এবার তার সিকিও পাইনি। যজমানদের অবস্থা এবার যা…
নন্দ এ কথার কিছু সন্তোষজনক জবাব দিতে পারিল না।
রাঘব বলিলেন-বউমার হাতে কিছু নেই?
—ও কোথায় পাবে! তবে বিয়ের দরুন গয়না কিছু আছে। ওর ওই হাতবাক্সটাতে আছে যা আছে।
—জায়গা ভালো নয়। গয়নাগুলো বাক্সে রাখাই আমি বলি বেশ। পাঁচজন টের–পায়। আমি আবার থাকি গাঁয়ের এক কোণে পড়ে—আর এই তো সময় যাচ্ছে। ওগুলো আগে সাবধান করা দরকার।
দিন দুই পরে নন্দলাল মামাকে বলিল—আমাকে আজ একবার বেরুতে হচ্ছে মামা। একবার বীজপুরে যাব। লোকো-কারখানায় একটা সন্ধান পেয়েছি—একটু দেখে আসি।
নন্দলাল ইতিপূর্বেও বীজপুরের কারখানায় কাজ খুঁজিয়াছিল কিন্তু তেমন লেখাপড়া জানে না বলিয়া কাজ জোটাইতে পারে নাই। বলিল—লোকো কারখানায় যদি মুগুর ঠ্যাঙাতে পারি তবে এক্ষুণি কাজ জোটে, ভদ্দরলোকের ছেলে, তা তো আর পেরে উঠিনে। এই আমার সঙ্গে পাঠশালায় পড়ত মহেন্দ্র, তারা জেতে যুগী। সে বাইসম্যানি করছে, সাড়ে সাত টাকা হপ্তা পায়—দিব্যি আছে। কিন্তু তাদের ও-সব সয়। আমাকে বলেছিল হেডমিস্ত্রির কাছে নিয়ে যাবে, তা আমায় দ্বারা কী আর হাতুড়ি পিটুনো চলবে?
পরদিন খুব ভোরে নন্দলাল বাটী আসিল। সে রাত্রেই স্টেশনে নামিয়াছিল কিন্তু অন্ধকারে এতটা পথ আসিতে না-পারিয়া সেখানে শুইয়াছিল, শেষরাত্রের দিকে জ্যোৎস্না উঠিলে রওনা হইয়াছে।
নন্দলাল বাড়ি ফিরিয়া দেখিল তখনও মামা উঠেন নাই, পূবের ভিটার ঘরে স্ত্রীও তখন ঘুমাইতেছে। স্ত্রীকে জাগাইতে গিয়া দেখিল, গহনার বাক্স ঘরের মধ্যে নাই। স্ত্রীকে উঠাইয়া বলিল—গহনার বাক্স কোথায়?
স্ত্রী অবাক হইয়া গেল।—বলিল—আহা, ঠাট্টা করা হচ্ছে বুঝি? এই তো শিয়রে এইখেনে ছিল। লুকিয়েছ বুঝি?…।
কিছুক্ষণ পরে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই মাথায় হাত দিয়া বসিল। ঘরের কোথাও বাক্স নাই। খোঁজাখুঁজি অনেক করা হইল। মামাও বিছানা ছাড়িয়া উঠিয়া আসিলেন। চুরির কথা শুনিয়া অবাক হইলেন, নিজে চারিদিকে ছুটাছুটি করিয়া বাক্সের বা চোরের খোঁজ করিতে লাগিলেন। প্রতিবেশীরাও আসিল, থানাতেও খবর গেল— কিছু হইল না।
নন্দলালের স্ত্রীর বয়স কুড়ি-একুশ। রং টকটকে ফরসা, মুখ সুশ্রী, বড়ো শান্ত ও সরল মেয়েটি। তার বাপেরবাড়ির অবস্থা বেশ ভালো, কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে তৃতীয় পক্ষে বিবাহ করিয়া তার বাপ পূর্ব দুই পক্ষের সন্তান-সন্ততিদিগকে এখন আর দেখিতে পারেন না। বিবাহের সময় এই গহনাগুলি তিনিই মেয়েকে দিয়াছিলেন; এই হিসেবে দিয়াছিলেন যে, গহনাগুলি লইয়া মেয়ে যেন বাপেরবাড়ির উপর সকল দাবি-দাওয়া ত্যাগ করে। পিতার কর্তব্য এইখানেই তিনি শেষ করিলেন।
নন্দলালের অবস্থা কোনো কালেই ভালো নয়, বিবাহের পর যেন তাহা আরও খারাপ হইয়া পড়িল। ওই গহনা কয়খানি দাঁড়াইল সংসারের একমাত্র সম্বল। গহনাগুলির উপর নন্দলাল বার দুই ঝোঁক দিয়াছিল—একবার পাটের ব্যাবসা ফাঁদিতে, আর একবার মুদির দোকান খুলিতে সিমুরালির বাজারে। কিন্তু নন্দলালই শেষপর্যন্ত কী ভাবিয়া দুইবার পিছাইয়া যায়। বউও বলিয়াছিল—দ্যাখো ওই তো পুঁজিপাটা, আর তো নেই কিছু—যখন আর কোনো উপায় থাকবে না, তখন ওতে হাত দিয়ো। এখন থাক।
গহনার বাক্স চুরি যাওয়ার দিন পাঁচ-সাত পরে একদিন নন্দলাল ভোরে উঠিয়া দেখিল স্ত্রী বিছানায় নাই। বাহিরে আসিয়া দেখিল, বউ ঘরের পাশের ছাইগাদা ঘাঁটিয়া কী দেখিতেছে! স্বামীকে দেখিয়া কেমন এক ধরনের হাসিয়া বলিল— ওগো, এসো না গো, একটু খোঁজো তো এর মধ্যে? তুমি উত্তর দিকটা থেকে দ্যাখো।
নন্দলাল সস্নেহে স্ত্রীকে ধরিয়া দাওয়ার আনিয়া বসাইল। পাতকুয়ার ঠান্ডা জল দিয়া স্নান করাইয়া দিল, নানারকমে বুঝাইল, কিন্তু সেই যে বউটির মস্তিষ্ক-বিকৃতির শুরু হইল—এ আর কিছুতেই সারানো গেল না। পাছে স্বামী বা কেহ টের পায় এই ভয়ে যখন কেউ কোনোদিকে না থাকে, তখন চুপিচুপি ছাইগাদা হাতড়াইয়া খুঁড়িয়া কি দেখিতে থাকিবে! এই একমাত্র ব্যাপার ছাড়া তাহার মস্তিষ্ক-বিকৃতির কিন্তু অন্য কোনো লক্ষণ ছিল না। অন্যদিকে সে যেমন গৃহকর্মনিপুণা, সেবাপরায়ণা কর্মিষ্ঠা গৃহস্থ-বধূ তেমনই রহিল।
একদিন সে মামাশ্বশুরের ঘরে সকালে ঝাঁট দিতে ঢুকিয়াছে, মামাশ্বশুর রাঘব চক্রবর্তী তখন ঘরে ছিলেন না; ঘরের একটা কোণ পরিষ্কার করিবার সময় সে একখানা কাগজ সেখানে কুড়াইয়া পাইল। কে যেন দলা পাকাইয়া কাগজখানাকে কোণটাতে ফেলিয়া রাখিয়াছিল। কাগজখানা দেখিয়া সে অবাক হইয়া গেল। এ যে তার গহনার বাক্সের তলায় পাতা ছিল, পাতলা বেগুনি রঙের কাগজ, সেকরারা এই কাগজে নতুন-তৈয়ারি সোনার গহনা জড়াইয়া দেয়।…এ কাগজখানাও সেইভাবে পাওয়া, সেকরার দোকান হইতে আসিয়াছিল, সেই হইতে তাহার গহনার বাক্সের তলায় পাতা থাকিত—সেই কোণ-হেঁড়া বেগুনি রঙের পাতলা কাগজখানি!…
বউটি কাহাকেও কিছু বলিল না—স্বামীকে নয়। মনের সন্দেহ মুখে কাহারও কাছে প্রকাশ করিতে পারিল না। কিন্তু ভাবিয়া ভাবিয়া শেষে তাহার খুব অসুখ হইল। জ্বর অবস্থায় নির্জন ঘরে একা বিছানায় শুইয়া তক্তপোশের একটা বাঁশের খুঁটিকে সম্বোধন করিয়া সে করজোড়ে বার বার বলিত—ওগো খুঁটি, আমি তোমার কাছে দরখাস্ত করছি, তুমি এর একটা উপায় করে দাও, পায়ে পড়ি তোমার। একটা উপায় তোমার করতেই হবে। আর কাউকে বলতে পারিনে, তোমাকেই বলছি…
বাঁশের খুঁটিটা ছাড়া তার প্রাণের এ আগ্রহ-ভরা কাতর আকুতি আর কেহই শুনিত না। কতবার রাত্রে, দিনে নির্জনে খুঁটিটার কাছে এ নিবেদন সে করিত–কী বুঝিয়া করিত সে-ই জানে।
তাহাদের বাড়ির সামনে প্রকাণ্ড মাঠ গঙ্গার কিনারা পর্যন্ত সবুজ ঘাসে ভরা, তারপরেই খাড়া পাড় নামিয়া গিয়া জল ছুঁইয়াছে। জল সেখানে অগভীর, চওড়াতেও হাত দশ-বারো মাত্র, পরেই গঙ্গার বড়ো চরাটা। সারাবছরেই চরায় জলচর পক্ষীর ঝাঁক চরিয়া বেড়ায়। চরার বাহিরের গভীর বড়ো গঙ্গার দিকে না গিয়া তারা গঙ্গার এই ছোটো অপরিসর অংশটা ঘেঁষিয়া থাকে। কণ্টিকারীর বনে চরার বালি প্রায় ঢাকিয়া ফেলিয়াছে, বারো মাস বেগুনি ফুল ফুটিয়া নির্জন বালির চরা আলো করিয়া রাখে। মাঠে কোনো গাছপালা নাই, ছেলেদের ফুটবল খেলার মাঠের মতো সমতল ও তৃণাবৃত; দক্ষিণে ও বাঁয়ে একদিকে বড়ো রেলওয়ে-বাঁধটা ও অন্যদিকে দূরবর্তী গ্রামসীমার বনরেখার কোল পর্যন্ত বিস্তৃত। দুই-এক সারি তালগাছ এখানে-ওখানে ছাড়া এই বড়ো মাঠটাতে অন্য কোনো গাছ চোখে পড়ে না কোনোদিকে।
এই বিশাল মাঠে প্রতিদিন সকাল হয়, সূর্য মাঝ-আকাশে দুপুরে আগুন ছড়ায়, বেলা ঢলিয়া বৈকাল নামিয়া আসে, গোধূলিতে পশ্চিমদিক কত-কী রঙে রঞ্জিত হয়। চাঁদ ওঠে—সারা মাঠ, চরা, রেলওয়ে বাঁধ, ও-পাশের বড়ো গঙ্গাটা জ্যোৎস্নায় প্লাবিত হইয়া যায়। কিন্তু কখনও কোনো কালে রাঘব চক্রবর্তী বা তাহার প্রতিবেশীরা এই সুন্দর পল্লিপ্রান্তরের প্রকৃতির লীলার মধ্যে কোনো দেবতার পুণ্য আবির্ভাব কল্পনা করেন নাই, প্রয়োজন বোধও করেন নাই—সেখানে আজ সর্বপ্রথম এই নিরক্ষরা বিকৃত-মস্তিষ্কা গ্রাম্যবধূটি বৈদিক-যুগের মন্ত্রদ্রষ্টা বিদুষীর মতো মনেপ্রাণে খুঁটি-দেবতার আবাহন করিল।…
আমি এই মাঠেই বৈকালে দাঁড়াইয়া কথাটা ভাবিতেছিলাম। কথাটার গভীরতা সেদিন সেখানে যতটা উপলব্ধি করিয়াছিলাম, এমন আর বোধহয় কোথাও করিব না।
নন্দলাল স্ত্রীর অবস্থা দেখিয়া বড়ো বিব্রত হইয়া পড়িল। সে স্ত্রীকে ভালোবাসিত; নানারকম ঔষধ, জড়ি, বুটি, শিকড়-বাকড় আনিয়া স্ত্রীকে ব্যবহার করাইল। তিরোলের পাগলি-কালীর বালা পরাইল; যে যাহা বলে তাহাই করিতে লাগিল, কিন্তু কিছুতে কিছু হয় না। একটা সুফল দেখিয়া সে খুশি হইল যে আজকাল স্ত্রী সকালে উঠিয়া ছাইগাদা হাতড়াইতে বসে না। তবুও সংসারের কাজকর্মগুলি কেমন অন্যমনস্কভাবে করে, হয়তো বা তরকারি পুড়াইয়া ধরাইয়া ফেলে, নয়তো ডালে খানিকটা বেশি নুন দেয়, ভালো করিয়া কথা বলে না— ইহাই রহিল তাহার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ।
মাস দুই কাটিয়া গেল। শ্রাবণ মাস। বর্ষার ঢল নামিয়া বড়ো গঙ্গা ও ছোটো গঙ্গা একাকার করিয়া দিল, চর ডুবিয়া গেল। কূলে কূলে গেরিমাটির রঙে জলে ভর্তি। এই সময় নন্দলালের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হইয়া উঠিল। হাতে পূর্বে যাহা কিছু ছিল, সবই খরচ হইয়া গিয়াছে—এদিকে চাকরিও জুটিল না।
রাঘব চক্রবর্তী ভাগিনেয়কে খুঁটিনাটি লইয়া বকুনি শুরু করিলেন। ভাগিনেয়কে ডাকিয়া বলিলেন—কোনো কিছু একটা দেখে নিতে তো পারলে না। তা দিনকতক এখন না-হয় বউমাকে বাপেরবাড়ি রেখে তুমি কলকাতার দিকে গিয়ে কাজকর্মের ভালো করে চেষ্টা করো, নইলে আমি আর কী করে চালাই বলো। এই তো দেখছো অবস্থা—ইত্যাদি।
নন্দলাল পড়িয়া গেল মহাবিপদে। না-আছে চাকরি, না-আছে কোনো সম্বল— ওদিকে অসুস্থ তরুণী-বধূ ঘরে। বীজপুরের কারখানায় কয়েকবার যাতায়াতের ফলে একজন রঙের মিস্ত্রির সঙ্গে বন্ধুত্ব হইয়া গিয়াছিল। তাহাকে বলিয়া-কহিয়া তাহার বাসায় বউকে লইয়া গিয়া আপাতত তুলিল। দুইটি মাত্র ঘর, একখানা ঘরে মিস্ত্রি একলা থাকে, অন্য ঘরখানি নন্দলালকে ছাড়িয়া দিল। মিস্ত্রি গাড়িতে অক্ষর লেখে—সে চেষ্টা করিয়া সাহেবকে ধরিয়া নন্দলালের জন্য একটা ঠিকা কাজ জুটাইয়া দিল। একটা বড়ো লম্বা রেক আগাগোড়া পুরোনো রং উঠাইয়া নতুন রং করা হইবে, নন্দলাল জমির রং করিবার জন্য এক মাসের চুক্তিতে নিযুক্ত হইল।
রাঘব চক্রবর্তী কিছুকালের জন্য হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলেন। হঠাৎ একদিন তিনি অনেকজন মজুর ধরিয়া বাড়ির উঠান পরিষ্কার করাইতে লাগিলেন। শখ করিয়া একজোড়া হরিণের চামড়ার জুতো কিনিয়া আনিলেন, এমনকী পূজার সময় একবার কাশী বেড়াইতে যাইবার সংকল্প করিয়া ফেলিলেন।
আশ্বিনের প্রথম বর্ষা একটু কমিল। রাঘব চক্রবর্তী বাড়ির চারিধারে পাঁচিল গাঁথিবার মিস্ত্রি খাটাইতেছিলেন, সারাদিন পরিশ্রমের পর গঙ্গায় গা ধুইয়া আসিয়া সন্ধ্যার পরই তিনি শুইয়া পড়িলেন।
অত পরিশ্রম করিবার পর তিনি শুইলেন বটে, কিন্তু তাঁহার ঘুম আদৌ আসিল না। ঘুমাইবার বৃথা চেষ্টায় সারারাত্রি ছটফট করিয়া শেষরাত্রে উঠিয়া তামাক খাইতে বাসিলেন। দিনমানেও দুপুরে ঘুমাইবার চেষ্টা করিলেন, কিছুতেই ঘুম হইল না। সারাদিনের মজুর খাটাইবার পরিশ্রমের ফলে শরীর যা গরম হইয়াছে! সেদিনও যখন রাত্রে ঘুম আসিল না, তখন পাঁচিল-গাঁথার জনমজুরকে বলিয়া দিলেন— এখন দিন দুই কাজ বন্ধ থাকুক।
পরদিন রাত্রে সামান্য কিছু আহার করিয়া ঠান্ডা জল মাথায় দিয়া ও হাত-পা ধুইয়া সকাল সকাল শুইয়া পড়িলেন। প্রথমটা ঘুম না-আসাতে ভাবিলেন, ঘুমের সময় এখনও ঠিক হয় নাই কিনা, তাই ঘুম আসিতেছে না। এপাশ-ওপাশ করিতে লাগিলেন। দশটা…এগারোটা বারোটা…রাঘব প্রাণপণে চক্ষু বুজিয়া রহিলেন, নানাভাবে ঘুরিয়া-ফিরিয়া শুইয়া দেখিলেন— ঘুম এখনও আসে না কেন? আরও ঘণ্টা দুই কাটিয়া গেল—ঘুমের চিহ্নও নাই। চাঁদ ঢলিয়া পড়িল, জানালা দিয়া যে বাতাস বহিতেছে তাহা আগেকার অপেক্ষা ঠান্ডা।…রাঘবের কেমন ভয় হইল— তবে বোধহয় আজও ঘুম হইবে না! ভাবিতেও বুকটা কেমন করিয়া উঠিল। আজ রাত্রে না-ঘুমাইলে কাল তিনি বাঁচিবেন কী করিয়া?…উঠিয়া মাথায় আর একবার জল দিলেন—আবার শুইলেন, আবার প্রাণপণে ঘুমাইবার চেষ্টা করিলেন। কিন্তু এই ভাবিয়া তাঁহার মাথা গরম হইয়া উঠিল—ঘুম…ঘুম যদি না-আসে! তাহা হইলে?…রাত্রি ফরসা হইয়া কাককোকিল ডাকিয়া উঠিল, তখনও হতভাগ্য রাঘব চক্রবর্তী বিছানায় ছটফট করিতে করিতে ঘুমাইবার বৃথা চেষ্টা করিতেছেন।
ঠিক এইভাবে কাটিয়া গেল আরও আট দিন। এই আট দিনের মধ্যে কী দিনে, কী রাতে রাঘবের চোখে এতটুকু ঘুম আসিল না পলকের নিমিত্ত—রাঘব পাগলের মতো হইলেন—যে যাহা বলিল তাহাই করিয়া দেখিলেন। ডাব খাইয়া ও পুকুরের পচা পাঁক মাথায় দিনরাত দিয়া থাকিতে থাকিতে নিউমোনিয়া হইবার উপক্রম হইল। অবশেষে বাঁশবেড়ের মনোহর ডাক্তারের ঔষধ ব্যবহার করিয়া দেখিলেন।
কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। আরও দিন ছয়-সাত কাটিয়া গেল। রাঘব সন্ধ্যার পরই হাত-পা ধুইয়া মন স্থির করিয়া শুইতে যান। কিন্তু বালিশে মাথা দিয়াই বুকের মধ্যে গুর গুর করে—আজও বোধহয় ঘুম…
বাকিটা আর রাঘব ভাবিতে পারেন না।
রাজমিস্ত্রির দল কাজ শেষ না-করিয়াই চলিয়া গেল। উঠানে জঙ্গল বাধিয়া উঠিল। রাঘব স্নানাহার করিতে চান না, চলাফেরা করিতে চান না, সবসময়েই ঘরের দাওয়ায় চুপ করিয়া বসিয়া থাকেন। তামাক খাইবার রুচিও ক্রমে হারাইয়া ফেলিলেন। লোকজনের সঙ্গে ভালো করিয়া কথাবার্তা কহিতে ভালোবাসেন না, পয়সার ভাঁড় উপুড় করিয়া গণিয়া দেখিবার স্পৃহাও চলিয়া গেল।
চিকিৎসা তখনও চলিতেছিল। গ্রামের বৃদ্ধ শিব কবিরাজ বলিলেন—তোমার রোগটা হয়েছে মানসিক। ঘুম হবে না এ কথা ভাব কেন শোবার আগে? খুব সাহস করবে, মনে মনে জোর করে ভাববে—আজ ঘুম হবে, নিশ্চয়ই হবে, আজ ঠিক ঘুমুব—এরকম করে দ্যাখো দিকি? আর সকাল সকাল শুতে যেয়ো না—যে সময় যেতে, সেই সময় যাবে।
কবিরাজের পরামর্শ মতো রাঘব সন্ধ্যার পর পুরোনো দিনের মতো রন্ধন করিয়া আহার করিলেন। দাওয়ায় বসিয়া গুনগুন করিয়া গানও গাহিলেন। তারপর ঠান্ডা জলে হাত-পা ও মাথা ধুইয়া শয়ন করিতে গেলেন। মনে মনে দৃঢ় সংকল্প করিলেন—আজ তিনি নিশ্চয়ই ঘুমাইবেন—নিশ্চয়ই—নিশ্চয়ই।
কিন্তু বালিশে মাথা দিয়াই বুকটা কেমন যেন করিয়া উঠিল! ঘুম যদি না হয়?…পরক্ষণেই মন হইতে সে-কথা ঝাড়িয়া ফেলিয়া দিলেন—নিশ্চয়ই ঘুম হইবে। পাশ ফিরিয়া পাশ-বালিশটা আঁকড়াইয়া শুইলেন। ঘরের দেয়ালের একখানা বাঁধানো রাধাকৃষ্ণের ছবি বাতাস লাগিয়া ঠকঠক শব্দ করিতেছে দেখিয়া আবার বিছানা হইতে উঠিয়া সেখানা নামাইয়া রাখিলেন। পুনরায় শুইয়া পড়িয়া জোর করিয়া চোখ বুজিয়া রহিলেন। আধঘণ্টা…এক ঘণ্টা…। এইবার তিনি নিশ্চয়ই ঘুমাইবেন…বুকের মধ্যে গুরগুর করিতেছে কেন?…না, এইবার ঘুমাইবেনই।
দুই ঘণ্টা—তিন ঘণ্টা।…রাত একটা, গ্রাম নিশুতি, কোনোদিকে সাড়াশব্দ নাই —কাওরা-পাড়ায় এক-আধটা কুকুরের ঘেউ ঘেউ ছাড়া।
—রাত বেশি হইয়াছে, আর রাঘব জাগিয়া থাকিবেন না, এইবার ঘুমাইবেন। বাঁ-দিকে শুইয়া সুবিধা হইতেছে না, হাতখানা বেকায়দায় কেমন যেন মুচড়াইয়া আছে, ডানদিকে ফিরিয়া শুইবেন। ছারপোকা?…না, ছারপোকা তো বিছানায় নাই?…যাহা হউক জায়গাটা একবার হাত বুলাইয়া লওয়া ভালো।—যাক, এইবার ঘুমাইবেন। এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হইলেন। রাত দুইটা!
কিন্তু নিশ্চিন্ত হইতে পারিলেন না। একটা হাট কী মেলা কোথায় যেন বসিয়াছে, রাঘব দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া দেখিতেছেন। সব লোক চলিয়া গেল, তবুও দু দশজন এখনও হাটচালিতে ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়া শুটকি চিংড়ি মাছের দরকষাকষি করিতেছে—ইহারা বিদায় হইলেই রাঘব নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাইবেন। একটা লোক ঢলিয়া গেল—দুইটা—তিনটা—এখনও জন সাত পোক বাকি। রাঘব তাহাদের নিকট গিয়া চলিয়া যাইবার অনুরোধ করিতেছেন, অনুনয়বিনয় করিতেছেন—তিনি একটু এইবার ঘুমাইবেন, দোহাই তাহাদের, তাহারা চলিয়া যাক। এখনও জন তিনেক বাকি!…রাঘবের মনে উল্লাস হইল, আর বিলম্ব নাই।…এখনও দুইজন। এই দুইজন চলিয়া গেলেই ঘুমাইবেন। আর একজন মাত্র!…মিনিট পনেরো দেরি—তাহা হইলেই ঘুমাইবেন।
হঠাৎ রাঘব বিছানায় উপর উঠিয়া বসিলেন। হাট তো কোথাও বসে নাই! কীসের হাট কোথাকার হাট?…এসব কী আবোল-তাবোল ভাবিতেছেন তিনি! ঘুম তাহা হইলে বোধ হয়…
রাঘব কথাটা ভাবিতেও সাহস করিলেন না।
কত রাত?…ওটা কীসের শব্দ?…বীজপুরের কারখানায় ভোরের বাঁশি বাজিতেছে নাকি?… সে তো রাত চারটায় বাজে। এখনই রাত চারটা বাজিল? অসম্ভব! যাক, যথেষ্ট বাজে কথা ভাবিয়া রাত কাটাইয়াছেন। আর নয়। এইবার তিনি ঘুমাইবেন।
অল্প একটু ঘোর আসিয়াছিল কিনা কে জানে? ভোরের ঠান্ডা বাতাসে হয়তো একটু আসিতেও পারে। কিন্তু রাঘবের দৃঢ় বিশ্বাস তিনি এতটুকু ঘুমান নাই—চোখ চাহিয়াই ছিলেন। হঠাৎ একটা ব্যাপার ঘটিল। বিস্মিত রাঘব দেখিলেন, তাঁহার খাটের পাশের বাঁশের খুঁটিটা যেন ধীরে ধীরে একটা বিরাটকায় মূর্তি পরিগ্রহ করিয়া তাঁহার মাথার শিয়রে আসিয়া দাঁড়াইল; ব্যঙ্গের সুরে অঙ্গুলি হেলাইয়া বলিল—মূখ! ঘুমোবার ইচ্ছা থাকে তো কালই গহনার বাক্স ফেরত দিস। ভাগনে বউয়ের গহনা চুরি করেছিস, লজ্জা করে না?…
বীজপুরের কারখানার বাঁশির শব্দে রাঘবের ঘোর কাটিয়া গেল। ফরসা হইয়া গিয়াছে। রাঘবের বুক ধড়ফড় করিতেছে, চোখ জ্বালা করিতেছে, মাথা যেন বোঝা, শরীর ভাঙিয়া পড়িতে চাহিতেছে! না, তিনি একটুও ঘুমান নাই—এতটুকু না। বাঁশের খুঁটি-টুটি কিছু না-ও-সব মাথা গরমের দরুন…
কিন্তু ঠিক একই স্বপ্ন রাঘব পর পর দুইদিন দেখিলেন। ঠিক একই সময়ে, ভোররাত্রে, বীজপুরের কারখানার বাঁশি বাজিবার পূর্বে।…ঘুমাই নাই, তবে স্বপ্ন কোথা হইতে আসিবে?
বীজপুরের বাসায় অন্য কেহ তখন ছিল না। নন্দলাল কাজে বাহির হইয়াছে, নন্দলালের স্ত্রী সাবান দিয়া কাপড় কাচিতেছিল। হঠাৎ রুক্ষ চুল, জীর্ণ চেহারায় মামাশ্বশুরকে বাসায় ঢুকিতে দেখিয়া সে বিস্মিত মুখে একবার চাহিয়াই লজ্জায় ঘোমটা দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। রাঘব চক্রবর্তী একবার চারিদিকে চাহিয়াই কাছে আসিয়া ভাগিনেয়-বধূর পা জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন। বলিলেন—মা তুমি মানুষ নও, তুমি কোনো ঠাকুর-দেবতা হবে। ছেলে বলে আমায় মাপ করো।
তারপর পুটুলি খুলিয়া সব গহনাগুলি ভাগিনেয়-বধূর হাতে প্রত্যর্পণ করিলেন, কিন্তু বাসায় থাকিতে রাজি হইলেন না।
—নন্দলালের কাছে কিছু বলিবার মুখ নেই আমার। তুমি মা—তোমার কাছে বলতে লজ্জা নেই, বুঝলে না? কিন্তু তার কাছে…
ইহার মাস পাঁচ-ছয় পরে রাঘব চক্রবর্তীর গুরুতর অসুখের সংবাদ পাইয়া নন্দলাল সস্ত্রীক গোরুরগাড়ি করিয়া তাঁহাকে দেখিতে গেল। ইহারা যাইবার দিন সাতেক পরে রাঘবের মৃত্যু হইল। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁহার যাহা কিছু জমিজমা সব উইল করিয়া ভাগিনেয়-বধূকে দিয়া গেলেন। কিছু পোঁতা সন্ধানও দিয়া গেলেন।
নন্দলালের স্ত্রীকে কাছে বসাইয়া নিজের স্বপ্নবৃত্তান্ত বলিয়া গেলেন। বলিলেন— এই যে দেখছো ঘর, এই যে বাঁশের খুঁটি, এর মধ্যে দেবতা আছেন মা। বিশ্বাস করো আমার কথা…
ভাগিনেয়-বধূ শিহরিয়া উঠিল। সেই ঘর, সেই বাঁশের খুঁটি!…
রাঘবের মৃত্যুর পরে ষোলো-সতেরো বৎসর নন্দলাল মামার ভিটাতে সংসার পাতাইয়া বাস করিয়াছিল। বধূটি ছেলে-মেয়েদের মা হইয়া সচ্ছল গৃহিণীপনা করিতে করিতে প্রথম জীবনের দুঃখকষ্টের কথা ভুলিয়া গিয়াছিল এবং সঙ্গে সঙ্গে খুঁটি-দেবতার কথাও ভুলিয়াছিল। হয়তো দুঃখের মধ্য দিয়া যে আন্তরিকতাপূর্ণ আবেগকে জীবনে একবার মাত্র লাভ করিয়াছিল, আর কখনও জীবন-পথে তাহার সন্ধান মেলে নাই।…
বছর সতেরো পরে নন্দলালের স্ত্রী মারা গেল। নন্দলালের বড়ো ছেলের তখন বিবাহ হইয়াছে ও বধূ ঘরে আসিয়াছে। বিবাহের বৎসর চারেকের মধ্যে এই বউটি দুরন্ত ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হইয়া পড়িল। ক্যানসার হইল জিহ্বায়, ক্ষত ক্রমে গভীর হইতে লাগিল—কত রকম চিকিৎসা করা হইল, কিছুতে উপকার দেখা গেল না। সে শুইয়া শুইয়া যন্ত্রণায় ছটফট করিত, ইদানীং কথা পর্যন্ত কহিতে পারিত না। তাহার যন্ত্রণা দেখিয়া সকলে তাহার মৃত্যু কামনা করিত। কিন্তু বছর কাটিয়া গেল—মৃত্যুর কোনো লক্ষণ নাই, অথচ নিজে যন্ত্রণা পাইয়া, আরও পাঁচজনকে যন্ত্রণা দিয়া সে জীবত অবস্থায় বাঁচিয়া রহিল।
বউটি শাশুড়ির কাছে খুঁটি-দেবতার গল্প শোনেও নাই, জানিতও না। একদিন সে সারারাত রোগের যন্ত্রণায় ছটফট করিতেছিল। শ্রাবণ মাস। শেষরাতের দিকে ভয়ানক বৃষ্টি নামিল, ঠান্ডাও খুব, বাহিরে জোর বাতাসও বহিতেছিল। মাথার শিয়রে একটা কাঁসার ছোটো ঘটিতে জল ছিল, একচুমুক জল খাইয়া সে পাশফিরিয়া শুইতেই একটু তন্দ্রা মতো আসিল।
তাহার মনে হইল, পাশের খুঁটিটা আর খুঁটি নাই। তাহাদের গ্রামে শ্যামরায়ের মন্দিরের শ্যামরায় ঠাকুর যেন সেখানে দাঁড়াইয়া মৃদু হাসিমুখে তাহার দিকে চাহিয়া আছেন। ছেলেবেলা হইতে কতবার সে শ্যামরায়কে দেখিয়াছে, কতবার বৈকালে উঠানের বেলফুলের গাছ হইতে বেলফুল তুলিয়া মালা গাঁথিয়া ঠাকুরের গলায় দিয়াছে। শ্যামরায়ের মূর্তি তাহার অপরিচিত নয়—তেমনি সুন্দর, সুঠাম, সুবেশ কমনীয় তরুণ দেবমূর্তি!…
বিশ্বাসে মানুষের রোগ সারে, হয়তো বধূটির তাহাই ঘটিয়াছিল। হয়তো সবটাই তাহার মনের কল্পনা। রাঘব চক্রবর্তী যে বিরাটাকায় পুরুষ দেখিয়াছিলেন সে-ও তাঁহার অনিদ্রা-প্রসূত অনুতাপবিদ্ধ মনের সৃষ্টিমাত্র হয়তো—কারণ খুঁটির মধ্যে দেবতা সেই রূপেই তাহার সম্মুখে দেখা দিয়াছিলেন, যার পক্ষে যে রূপের কল্পনা স্বাভাবিক।
সত্য মিথ্যা জানি না—কিন্তু খুঁটি-দেবতা সেই হইতে এই অঞ্চলে প্রসিদ্ধ হইয়া আছেন।
» খুকীর কাণ্ড
হরি মুখুয্যের মেয়ে উমা কিছু খায় না। না-খাইয়া রোগা হইয়া পড়িয়াছে বড়।
উমার বয়স এই মোটে চার। কিন্তু অমন দুষ্টু মেয়ে পাড়া খুঁজিয়া আর একটি বাহির করো তো দেখি!… তাহার মা সকালে দুধ খাওয়াতে বসিয়া কত ভুলায়, কত গল্প করে, সব মিথ্যা হয়। দুধের বাটিকে সে বাঘের মতো ভয় করে—মায়ের হাতে দুধের বাটি দেখিলেই সোজা একদিকে টান দিয়া দৌড়।
মা বলে—রও দুষ্টু মেয়ে, তোমার দুষ্টুমি আমি…দুধ খাবেন না, সুজি খাবেন না, খাবেন যে কী দুনিয়ায় তাও তো জানিনে—চলে আয় ইদিকে…
খুকী নিরুপায় দেখিয়া কান্না শুরু করে। তাহার মা ধরিয়া ফেলিয়া জোর করিয়া কোলে শোয়াইয়া ঝিনুক মুখে পুরিয়া দুধ খাওয়ায়। কিন্তু জোরজবরদস্তিতে অর্ধেকের উপর ছড়াইয়া–গড়াইয়া অপচয় হয়, বাকি অর্ধেকটুকু কায়ক্লেশে খুকির পেটে যায় কী না যায়।
সময়ে সময়ে সে আবার মায়ের সঙ্গে লড়াই করে। চার বছর বয়স বটে, না খাইয়া খাইয়া কাটি কাটি হাত-পাও বটে, কিন্তু তাহাকে কায়দায় ফেলিতে তাহার মায়ের এক-একদিন গলদঘর্ম। রাগ করিয়া মা বলে—থাক আপদ বালাই কোথাকার, না-খাস তো বয়ে গেল আমার সারাদিন খেটে খেটে মুখে রক্ত উঠবে, আবার ওই দস্যি মেয়ের সঙ্গে দিনে পাঁচবার কুস্তি করে দুধ খাওয়াবার শক্তি আমার নেই—মর শুকিয়ে।
খুকী বাঁচিয়া যায়, ছুটিয়া এক দৌড়ে বাড়ির সামনের আমতলায় দাঁড়াইয়া চেঁচাইয়া সমবয়েসি সঙ্গিনীকে ডাকে—ও নেনু-উ-উ–
তাহার বাবা একদিন বাড়িতে বলিল—দেখো, খুকীটাকে আজ দিন পনেরো ভালো ক’রে দেখিনি—আসবার সময় দেখি পথের ওপর খেলা কচ্ছে, এমনি রোগা হয়ে গিয়েছে যেন চেনা যায় না, পিঠটা সরু, কণ্ঠার হাড় বেরিয়েছে, অসুখ-বিসুখ নেই, দিন দিন ওরকম রোগা হয়ে পড়ছে কেন বলো তো?
খুকীর মা বলে—পড়বে না আর রোগা হয়ে? সারা দিনরাতে ক-ঝিনুক দুধ পেটে যায়? মরে মরুক, আমি আর পারিনে লড়াই করতে…কে এখন ওই দস্যি মেয়েকে রোজ রোজ যায় দুধ খাওয়াতে? যাই ওর কপালে থাকে তাই হোক গে…
তাই হয়! দস্যি মেয়ে শুকাইতে থাকে!
ভাদ্র মাস, হঠাৎ বর্ষা বন্ধ হইয়া রৌদ্র বড়ো চড়িয়া উঠিয়াছে, গ্রামের ডোবা পুকুরে সারা গাঁয়ের পাটখেতের পাটের আঁটি ভিজানো। নদীর ধারে কাশের ফুল ফুটিয়াছে।
গ্রামের হীরু চক্রবর্তীর অড়াতে এই সময় কাজকর্মের বড়ো ভিড়। নানা দেশের ধানের ও পাটের নৌকো সব গঙ্গার ঘাটে জড়ো হইয়াছে। হরিশ যুগী অড়াতের কয়ালকাঁটার ফেৰ্তায় এক মণ ধানে, আরও সের দশেক ঢুকাইয়া লওয়া— তাহার কাছে ছেলেখেলামাত্র। হাঙরের মুখখখাদাই বড়ো একখানা মহাজনি নৌকো হইতে ধানের বস্তা নামিতেছে, পটপটি গাছের ছায়ায় উঁচু-করা ধানের স্থূপ হইতে হরিশ সুরসংযোগে কাঁটায় করিয়া ধান মাপিতেছে—রাম—রাম—রাম হে রাম— রাম হে দুই—দুই-দুই—দুই হে তিন—তিন তিনি…
গফুর মাঝি ডাবা হুকায় তামাক টানিতে টানিতে বলিতেছে—তা নেন গো কয়াল মশাই, একটু হাত চালিয়ে নেন দিকি, মোরা একবার দেখি? ইদিকি নোনা গাঙের গোন নামলি কী আর নৌকো বাইতি দেবানে?
হরি মুখুয্যে মহাশয়কে একটু ব্যস্তসমস্তভাবে আসিতে দেখিয়া হীরু চক্রবর্তী বলিলেন—আরে এসো হরি, কী মনে করে?…এসো তামাক খাও…
—না থাক—তামাক—ইয়ে আমার মেয়েটাকে ইদিকে দেখেছ হীরু? …বড়ো মুশকিলে ফেলেছে বাঁদর মেয়ে…বারোটা বাজে, সেই বাড়ি থেকে নাকি বেরিয়েছে সকাল ন-টার সময়…একটু দেখি ভাই খুঁজে, এত জ্বালাতনও করে তুলেছে মেয়েটা, সে আর তোমাকে কী বলব…
অনেক খোঁজাখুঁজির পরে রায়বাড়ির পথে উমাকে ধুলার উপর পা ছড়াইয়া বসিয়া কী একটা হাতে লইয়া চুষিতে ও আপন মনে বকিতে দেখা গেল।
ওরে দুষ্টু মেয়ে…
হরি মুখুয্যে গিয়া মেয়েকে কোলে তুলিয়া লইলেন। বাবার কোলে উঠিতে পাইয়া উমা খুব খুশি হইল, হাত-পা নাড়িয়া বলিতে লাগিল—বাবা, ও বাবা…ওই ওদের নাদু ভারি দুত্ত…এই, এই দুধ এই খায় না…আমি দুধ খাই, না বাবা?
—বেশ মেয়ে, দুধ খেতে হয়। ওটা কী খাচ্ছিস, হাতে কী?
—নেবেথুস, ওই পুঁটির মামা এসেছে, তাই দিয়েছে।
বাড়িতে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উমার শাস্তি শুরু হয়। বাটিভরা দুধ, ঝিনুক, টানাটানি ইত্যাদি। তাহার কান্না, কাকুতি-মিনতি পাষাণী মা শোনে না, জোর করিয়া ঝিনুক মুখে পুরিয়া দিয়া ঢোঁকে ঢোঁকে দুধ খাওয়ায়…শেষের দিকটায় সে পা ছুড়িতে গিয়া খানিকটা দুধসুদ্ধ বাটিটা উলটাইয়া ফেলিয়া দিল।
দুম দুম দুই নির্ঘাত কিল পিঠে। পিঠ প্রায় বাঁকিয়া যায়।
–হতভাগা দস্যি আপদ কোথাকার—ছ-সের করে দুধ টাকায়, ভাত জোটে, দুধের খরচ জোগাতে জোগাতে প্রাণ গেল…দস্যি মেয়ের ন্যাকরা দেখো…আদ্ধেকটা দুধ কিনা ঠ্যাং ছুড়ে মাটিতে দিলে ফেলে!…
খুকী দম সামলাইয়া লইবার পরে পা ছড়াইয়া কাঁদিতে লাগিল। অনেকক্ষণ কাঁদিল।
বেলা পড়িয়া আসে। ওদের উঠোনে পূর্বপুরুষের আমলের বীজু আমগাছের ছায়ায় অপরাহের রোদকে আটকাইয়া রাখে। খুকি বসিয়া বসিয়া ভাবে অপরের বাড়িতে ভালো খাবার খাইতে পাওয়া যায়—মিষ্টি—তাহাদের বাড়িতে শুধু দুধ
আর দুধ!
তাহার মা বলিল—টিপ পরবি ও দস্যি?
খুকী ঘাড় নাড়িয়া মায়ের কাছে সরিয়া আসিল।
—বলে নয়নতারা টিপ, দুটো করে এক পয়সায়, বেশ টিপগুলো—সরে এসে। বোস দিকি।
টিপ পরিয়া খুকী আবার পাড়া বেড়াইতে বাহির হয়। বাঁশবনের তলা দিয়া গুটি গুটি হাঁটে। পুনরায় সে লোভে লোভে রায়বাড়ি যায়, পরের বাড়িতেই যত ভালো খাবার। বিস্কুট, নেবেথুস, কত কী।
নানুদের উঠানে পেঁপেগাছের মাথার দিকে তাহার চোখ পড়িতে সে প্রথমটা অবাক হইয়া গেল। সঙ্গিনীকে ডাকিয়া দেখাইয়া কহিল—ও নানু, ওই পিঁপে।
পেঁপে তাহার মা কাটিয়া খাইতে দেয়, বেশ খাইতে লাগে, কিন্তু তাহা গাছের আগডালে কি অমনভাবে দোলে! চাহিয়া চাহিয়া সে কিছু ঠাহর করিতে পারিল না।
পূজার কিছু পূর্বে খুকীর আপন মামা কলিকাতা হইতে আসিল। এত ধরনের খাবার কখনও সে চক্ষেও দেখে নাই। কিশমিশ দেওয়া মেঠাই, বড়ো বড়ো অমৃতি জিলিপি, গজা, কমলালেবু আরও কত কী।
পাশের গ্রামে মামার এক বন্ধুর বাড়ি। মামা পরদিন সকালে উঠিয়া তাহাকে সাজাইয়া সঙ্গে করিয়া লইয়া চলিল।
পথে কে একজন সাইকেলে চড়িয়া যাইতেছে, খুকী চাহিয়া চাহিয়া দেখিল। মামাকে বলিল—ও কে গেল মামা?
–ও রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে একজন লোক…
উমা বলিল—ফরসা মুখ, ফরসা জামা গায়, না মামা?…চমৎকার!…
তাহার মামা হাসিয়া বলিল—’চমৎকার’ কথাটা তুই শিখলি কী করে?…আচ্ছা খুকু, তুই ওকে বিয়ে করবি?
উমা সপ্রতিভ মুখে ঘাড় নাড়িয়া জানাইল—তাহার কোনো আপত্তি নাই।
ভাদ্রের শেষ, ম্যালেরিয়ার সময়, তবে এখনও খুব বেশি আরম্ভ হয় নাই, বাড়ি বাড়ি কাঁথামুড়ি দেওয়া শুরু হইতে এখনও দেরি আছে। উমার হাঁটুনির বেগ নিস্তেজ হইয়া পড়িতে থাকে, ক্রমে সে মাঝে মাঝে পথের ধারে বসিতে লাগিল, মাঝে মাঝে হাই তুলিতে লাগিল। তাহার মামা বলিল—কী হয়েছে খুকু, রোদুর বড্ড বেশি রে, আর বেশি নেই, চল…
বন্ধুর বাড়ি পৌঁছিবার পূর্বেই উমা বলিল—মামা, আমার শীত লাগছে…
—শীত কী রে? ভাদ্র মাসে এই গরমে শীত? ও কিছু না, চল… খুকী আর কিছু না-বলিয়া বেশ চলিল বটে, কিন্তু খানিক দূর গিয়া তাহার মনে হইল শীত একটু বেশিই করিতেছে। শুধু শীত নয়, তৃষ্ণাও পাইয়াছে। সে সাহসে ভর করিয়া বলিল—মামা, আমি জল খাব।
—বড়ো বিপদ দেখছি তো, আচ্ছা, আগে চল গিয়ে পৌঁছাই—খেও এখন জল…
গন্তব্যস্থানে পৌঁছিয়া উমার মামা তাহার কথা ভুলিয়াই গেল। অনেকদিন পরে পুরাতন বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, গল্পগুজব ও হাসিঠাট্টায় মশগুল হইয়া উমার সুখ দুঃখের দিকে চাহিবার অবকাশ পাইল না। উমা দু-একবার কী বলিল, আলাপের গোলমালে সেকথা কেহ কানে তুলিল না।
খানিকক্ষণ পরে তাহার মামা ফিরিয়া দেখিল, সে গুটিসুটি হইয়া রৌদ্রে বসিয়া আছে, মামার প্রশ্নের উত্তরে বলিল—জল খাব মামা, জলতেষ্টা পেয়েছে…।
—দেখি? তাই তো রে, গা যে বড়ো গরম—উঃ, খুব জ্বর হয়েছে—যে ম্যালেরিয়ার জায়গা! আয়, চল ওদের ঘরে শুইয়ে রাখিগে, ওঠ…
খুকীকে জল খাওয়াইয়া বিছানায় শোয়াইয়া দিয়া মামা পুনরায় পাড়ার দিকে বাহির হইল, স্নানাহার বন্ধুদের বাড়িতেই সম্পন্ন হইল; ক্রমে দুপুর গড়াইয়া গেল, মুখুয্যে পাড়ার হাফ-আখড়াই-এর ঘরে গ্রামের নিষ্কর্মা ছোকরার দল একে একে আসিয়া পৌঁছিল, প্রকাণ্ড কেটলিতে চায়ের জল চড়িল, গল্পে গল্পে বেলা একেবারেই গেল পড়িয়া।
এতক্ষণে হঠাৎ খুকীর কথা মনে পড়িয়া গেল তাহার মামার। সে বলিল—ওই যাঃ, তোমরা বোসো ভাই, খুকীটার অসুখ হয়েছে বলে ডোম্বলদের বাইরের ঘরে শুইয়ে রেখে এসেছি অনেকক্ষণ, দেখে আসি দাঁড়াও…
ভোম্বলদের বাড়ির বাইরের উঠানে গোয়ালের কাছে আসিতে ভোম্বলের বড়ো ছেলে টোনা বলিল—খুকু কোথায় কাকা?
খুকীর মামা বিস্ময়ের সুরে বলিল—কেন, সে তোদের বাইরের ঘরে শুয়ে নেই?
—না কাকা, সে তো অনেকক্ষণ আপনার কাছে যাবে বলে বেরিয়েছে, তখন খুব রোদুর, উঠে কাঁদত লাগল, বললে, মামার কাছে যাব—শুনলে না, তখুনি রোদুরে আপনাকে খুঁজতে বেরুল…
—সে কী রে! আমি কোথায় আছি তা সে জানবে কেমন করে? আর তোরা বা ছেলেমানুষকে ছেড়ে দিলি কী বলে? বেশ লোক তো! আর এ মেয়ে নিয়েও হয়েছে—
মামা অত্যন্ত ব্যস্ত ও উদবিগ্নভাবে পুনরায় পাড়ার দিকে ফিরিল। পরিচিত স্থানগুলিতে খোঁজা শেষ হইল, কোথাও সে নাই, কোন পথ দিয়া কখন চলিয়া গিয়াছিল কাহারও চোখে পড়ে নাই, কেবল মতি মুখুয্যের ছেলে বলিল, অনেকক্ষণ আগে একটি অপরিচিত ছোটো খুকীকে চড়চড়ে রৌদ্রে টলিতে টলিতে ভোম্বলদের বাড়ির উঠোনের আগল পার হইয়া আসিতে দেখিয়াছিল বটে, খুকীকে সে চেনে না, ভাবিয়াছিল ভোম্বলদের বাড়িতে কোনো কুটুম্ব হয়তো আসিয়া থাকিবে, তাহাদের মেয়ে।
অবশেষে তাহাকে পাওয়া গেল গ্রামের বাহিরের পথে। মামাকে খুঁজিতে বাহির হইয়া পথ হারাইয়া ঘুরিতে ঘুরিতে নিরুপায় অবস্থায় পথের উপর বসিয়া কাঁদিতেছিল, বৃদ্ধ হারাণ সরকার দেখিতে পাইয়া লইয়া আসেন।
জিজ্ঞাসা করিয়া জানা গেল, সে সারাদিন কিছু খায় নাই—খাইবার মধ্যে দুপুরবেলা ডোম্বলদের বাড়ির কোন ছেলে এক টুকরা আমসত্ব হাতে দিয়াছিল, জ্বরের ঘোরে সেটুকু শুধু চুষিয়াছে শুইয়া শুইয়া। তাহার মামাকে সকলে বকিতে লাগিল। সরকারমশায় বলিলেন—তোমারও বাপু আক্কেলটা কী—ছোটো মেয়েটাকে নিয়ে দুপুর রোদে এক কোশ হাঁটিয়ে আনলে, পথে এল তার জ্বর, দেখলেও না, শুনলেও না, ওদের চণ্ডীমণ্ডপে কাৎ করে ফেলে রেখে তুমি বেরুলে আড্ডা দিতে—না একটু দুধ, না কিছু—ছিঃ…
তাহার মামা অপ্রতিভ হইয়া বলিল—তা আমি কী আনতে গেছলাম, আমি বেরুবার সময় ছাড়ে না কোনোরকমেই—তোমার সঙ্গে যাব মামা, তোমার সঙ্গে যাব মামা—আমি কী করব?
—বেশ, খুব আদর করেছ ভাগনিকে—এখন চলো আমার বাড়ি, ওকে একটু দুধ খাইয়ে দি, কচি মেয়েটাকে সারাদিন—ছিঃ–
খুকীর মামা একটু দমিয়া গিয়াছিল, বাড়ি ফিরিবার সময় খুকীকে বলিল—কিন্তু বাড়ি গিয়ে কিছু বোলো না যেন খুকু! মার কাছে যেন বোলো না যে জ্বর হয়েছিল, কি হারিয়ে গিয়েছিলে, কেমন তো? লক্ষ্মী মেয়ে, বললে আমি কলকাতা যাব পরশু, সঙ্গে করে নিয়ে যাব না…
—আমি কলকাতা যাব মামা…
—যদি আজ কিছু না বলো, পরশু ঠিক নিয়ে যাব…বলবিনে তো?
কিন্তু বাড়ি পৌঁছিয়া খুকী বুদ্ধির দোষে সব গোলমাল করিয়া ফেলিল। তাহার শুষ্ক মুখ ও চেহারায় তাহার মা ঠাওরাইয়া লইল একটা কিছু যেন ঘটিয়াছে। জিজ্ঞাসা করিল—কী খেলি রে খুকী সেখানে?
খাওয়ার কথা মামা কিছু শিখাইয়া দেয় নাই, সুতরাং খুকী বলিল—আমসত্ব খুব ভালো—এত বড়ো আমসত্ব…
—আমসত্ব? আর কিছু খাসনি সেখানে সারাদিনে? হ্যাঁ রে ও যতীশ, খুকী সেখানে কিছু খায়নি?
—খেয়েছে বইকী, খেয়েছে বইকী—তা, হ্যাঁ–জানোই তো ওকে, কিছু খাওয়ানোই দায়…
মা একটু অড়ালে গেলে খুকী মুখ নীচু করিয়া হাসিমুখে মামার দিকে চাহিয়া হাত নাড়িয়া বলিল—মাকে কিছু বলিনি মামা—কাল আমায় কলকাতায় নিয়ে যাবে তো?
—ছাই যাব, না-খাওয়ার কথা বললি কেন? বাঁদর মেয়ে কোথাকার…
মামার রাগের কারণ খুকী কিছু বুঝিতে পারিল না।
খাওয়ার কথা সম্বন্ধে মামা তো কিছু বলিয়া দেয় নাই, তবে সে কথা যদি বলিয়া থাকে তাহার দোষ কী?
তাহার মামা এ কথা বুঝিল না। রাগিয়া বলিল—তোমার জন্যে যদি আর কখনো কিছু কিনে আনি খুকী, তবে দেখো বলে দিলাম—কখনো আনব না, কলকাতাতেও নিয়ে যাব না।
তাহার প্রতি এই অবিচারে খুকীর কান্না আসিল। বা রে, তাহাকে যে কথা বলিয়া দেয় নাই, তাহা বলাতেও দোষ? সে কী করিয়া অতশত বুঝিবে?
খুকী খুব অভিমানী, সে চিৎকার করিয়া হাত-পা ছুড়িয়া কাঁদিতে বসিল না, এক কোণে দাঁড়াইয়া চুপ করিয়া নিঃশব্দে ঠোঁট ফুলাইয়া ফুলাইয়া কাঁদিতে লাগিল।
পরদিন সকালে তাহার মামা কলিকাতায় রওনা হইল—যাইবার সময় তাহার সহিত কথাটিও কহিল না।
আবার দিন কাটিতে লাগিল। বর্ষা শেষ হইয়া গেল, শরৎ পড়িল—ক্রমে শরৎও শেষ হয়। পূজা এবার দেরিতে, কার্তিক মাসের প্রথমে, কিন্তু বাড়ি-বাড়ি সবাই জ্বরে পড়িয়া, পূজায় এবার আনন্দ নাই। প্রবীণ লোকেও বলিতে লাগিলেন, এরকম দুর্বৎসর তাঁহারা অনেকদিন দেখেন নাই।
উমা সারা আশ্বিন ধরিয়া ভুগিয়া সারা হইয়াছে। একে কিছু না-খাওয়ার দরুন রোগা, তাহার উপর জ্বরে ভুগিয়া রোগা—তাহার শরীরে বিশেষ কিছু নাই। তবুও জ্বরটা একটু ছাড়িলেই কাঁথা ফেলিয়া উঠিয়া পড়ে…কারুর কথা শোনে না তারপর গয়লাপাড়া, সদগোপপাড়া, কোথায় নবীন ধোপার তেঁতুলতলা—এই করিয়া বেড়ায়। বাড়ি ফিরিলেই দুম দুম কিল পড়ে পিঠে। মা বলে—দস্যি মেয়ে, মরেও না যে আপদ চুকে যায়, কবে যাবে ষষ্ঠীর মাঠে। কবে তোমায় রেখে খুকি খুকি বলে কাঁদতে কাঁদতে আসব…।
ওঘর হইতে বড়ো-জা বলিয়া ওঠে—আচ্ছা, ওসব কী কথা সকাল বেলা ছোটো বউ…বলি মেয়েটার ষষ্ঠীর মাঠে যাবার আর তো দেরি নেই, ওর শরীরে আর আছে কী?…তার ওপর রোগা মেয়েটাকে ওইরকম করে মার?…ছি ছি, একটা পেটে ধরেই এত ব্যাজার, তবুও যদি আর দু একটা হত। এসো উমা, আমার দাওয়ায় এসো তো মাণিক! এসো এদিকে।
তাহার মা পালটা জবাব দিয়া বলে—বেশ করছি, আমি আমার মেয়েকে বলব তাতে পরের গা জ্বলে কেন? যাসনে ওখানে, যেতে হবে না। শৌখিন কথা সকলে বলতে পারে—যখন জ্বর হয়ে পড়ে থাকে, তখন যত্ন করতে তো কাউকে এগুতে দেখিনে—তখন তো রাত জাগতেও আমি, ডাক্তার ডাকতেও আমি, ওষুধ খাওয়াতেও আমি—মুখের ভালোবাসা অমন সবাই বাসে…
দুই-জায়ে তুমুল ঝগড়া বাধিবার কথা বটে এ অবস্থায়, কিন্তু বড়ো-জা হরমোহিনী বড়ো ভালো মানুষ। সাতে-পাঁচে থাকিতে ভালোবাসে না, খুকীর ওপর একটা স্নেহও আছে, সে কিছু না-বলিয়া নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া যায়।
পূজার সময় খুকীর মামা আবার আসিল। তাহারও বয়স এই কুড়ি-একুশের বেশি নয়, এই দিদিটি ছাড়া সংসারে তাহার আর কেহ নাই। এতদিন কলিকাতায় চাকুরির চেষ্টায় ছিল, পূজার কিছুদিনমাত্র পূর্বে কোনো ছাপাখানায় মাসিক আঠারো টাকা বেতনে লিনো টাইপের শিক্ষানবিশি করিতে ঢুকিয়াছে।
অনেক খাবারদাবার, খুকীর জন্যে ভালো ভালো দু-তিনটি রঙিন জামা, ছোটো ডুরে শাড়ি ও জাপানি রবারের জুতা আনিয়াছে। তাহার দিদি বকে—এসব বাপু কেন আনতে যাওয়া, সবে তো চাকরি হয়েছে, নিজের এখন কত খরচ রয়েছে, দু-পয়সা হাতে জমাও, ভালো খাওদাও—শরীর তো এবার দেখছি বড্ডই খারাপ
—অসুখ-বিসুখ হয় নাকি?
ছেলেটি হাসিয়া বলে—না দিদি, অসুখ-বিসুখ তো নয়, বড্ড খাটুনি, সকাল ন-টা থেকে সারাদিন, বিকেল ছ-টা অবধি—এক-একদিন আবার রাত আটটাও বাজে—এক-একদিন আবার রবিবারেও বেরুতে হয়, তবে তাতে ওভারটাইম পাওয়া যায় বারো আনা করে—এবার গুড় উঠলে এক কলসি গুড় নিয়ে যাবই এখান থেকে, ভিজে ছোলা আর গুড় সকালে উঠে বেশ জলখাবার হবে।
তারপর সে চিনামাটির খেলনা বাহির করিয়া খুকীকে ডাকে—ও উমা, দেখে যা কেমন কাচের ঘোড়া সেপাই, এদিকে আয়…
খুকী নাচিতে নাচিতে ছুটিয়া আসিল, মামা আসাতে খুকির খুব আহ্লাদ হইয়াছে, এসব ধরনের খাবার মামা না-আসিলে তো পাওয়া যায় না!…পূজার কয়দিন খুকী মামার কাছেই সর্বদা থাকিল। সকাল হইতে-না-হইতে খুকী চোখ মুছিয়া আসিয়া মামার কাছে বসে, মাঝে মাঝে বলে, এবার কলকাতায় নিয়ে যাবে না মামা?
পূজা ফুরাইয়া গেলে খুকীর মামা দিদির কাছে প্রস্তাবটা উঠায়, দিদি সহোদর বোন নয়, বৈমাত্রেয়, তবুও তাহাকে বেশ ভালোবাসে, যত্ন করে। সেও ছুটি-ছাটা পাইলে এখানে আসে। স্বামী-স্ত্রীতে পরামর্শ করিয়া দিন-দশেকের জন্য আপাতত খুকীকে কলিকাতা ঘুরাইয়া আনিবার সম্মতি দিল।
খুকীর মামা খুশি হইয়া বলে—আমি ওকে লেখাপড়া শেখাব, সেখানে গিয়ে মহাকালী পাঠশালায় ভরতি করে দেব—দেখতে পাই কেমন গাড়ি আসে, বাড়ি থেকে ছেলে-মেয়েদের তুলে নিয়ে যায়—গাড়ির গায়ে নাম লেখা আছে ‘মহাকালী পাঠশালা’।
ভগনিপতি হরি মুখুয্যে বলেন—পাগল আর কী! অতটুকু মেয়ে স্কুলে ভরতি আবার কী হবে?…হুজুগে পড়ে যেতে চাচ্ছে—ছেলেমানুষ, ও কী আর গিয়ে টিকতে পারে? যাও নিয়ে দু-দিন—এখানে তো ম্যালেরিয়ায় ম্যালেরিয়ায় হাড় সার করে তুলেছে—যদি দু-দিন হাওয়া বদলাতে পারলে সেরে যায়…
ট্রেনে কলিকাতা আসিবার পথে উমা খুব খুশি। প্রথমটা তার ভয় হইয়াছিল, রেলগাড়ির জানালার ধারে মামা বসাইয়া দিয়াছে, গাড়িটা চলিতেই খুকির মনে হইল তাহার পায়ের তলা হইতে মাটিটা সরিয়া যাইতেছে, ভয়ে তাহার চোখ বড়ো বড়ো হইল—আতঙ্কে মামাকে জড়াইয়া ধরিতে যাইতেই তাহার মামা হাসিয়া বলিল—ভয় কী, ভয় কী খুকু? এ যে রেলের গাড়ি-দেখ আরও কত জোরে যাবে এখন…
রেলগাড়ি চড়িবার আনন্দকে যে বয়সে বুদ্ধি দিয়া উপভোগ করা যায়, উমার সে বয়স হয় নাই। সে শুধু চুপ করিয়া জানালার বাহিরে চাহিয়া বসিয়া থাকে। মাঝে মাঝে তাহার মামা উৎসাহের সুরে বলে—কেমন রে খুকী, সব কেমন বল
তো? কেমন লাগছে রেলগাড়ি?
খুকী বলে—খুব ভালো…
কিন্তু খানিকক্ষণ পরে তাহার মামা দুঃখের সহিত লক্ষ করে যে খুকী বসিয়া বসিয়া ঢুলিতেছে, দেখিতে দেখিতে সে ঘুমাইয়া পড়ে।
গাড়ি কলিকাতায় পৌঁছিলে একখানা রিকশা ভাড়া করিয়া তাহার মামা তাহাকে বাসায় আনিল। অখিল মিস্ত্রি লেনে একটা ছোটো মেসে বাসা, অফিসের বাবুদের মেস, সকলেই বয়সে প্রবীণ, সে-ই কেবল অল্পবয়স্ক। খুকীর আকস্মিক আবির্ভাবে সকলেরই আনন্দ হইল। বাড়িতে ছেলে-মেয়ে সকলেরই আছে, কিন্তু চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা মাস-মাহিনার বেড়াজালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াইয়া পড়িবার দরুন মাসে একবার কী দুইবার ভিন্ন বাড়ি যাওয়া ঘটে না, ছেলে-মেয়ের মুখ দেখিতে পাওয়া যায় না। খুকীকে পাইয়া একটা অভাব দূর হইল। চার-পাঁচ বছরের ছোটো ফুটফুটে মেয়ে, চাঁদের মতো মুখখানি, কোঁকড়া কোঁকড়া কালো চুল, কালো চোখের তারা আপিসের ছুটির পর তাহাকে লইয়া কাড়াকাড়ি পড়িয়া যায়। এ ডাকে উহার ঘরে ও ডাকে তাহার ঘরে।
কিন্তু তাহার মামার বড়ো দুঃখ, খুকীর বেশভূষা একেবারে খাঁটি পাড়াগেঁয়ে। মাথায় বিনুনি, কপালে কাঁচপোকার টিপ, অতটুকু মেয়ের পায়ে আবার আলতা, ছোটো চুরি শাড়ি পরনে, ওসব সেকেলে কাণ্ড আজকাল শহর-বাজারে কী আর চলে? দিদি পাড়াগাঁয়ে পড়িয়া থাকে, শহরের রীতিনীতি বেশভূষার কি ধার ধারিবে? এখানকার ভদ্রঘরের ছেলে-মেয়েদের কেমন সুন্দর চুলের বিন্যাস, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ফিটফাট সাজানো, দেখিতে যেন কাচের পুতুল। খুকীকে ওই রকম সাজানো যায় না?
ভাবিয়া ভাবিয়া সে খুকীকে সঙ্গে করিয়া ট্রামে ধর্মতলার এক চুল ছাঁটাই দোকানে লইয়া গেল। নাপিতকে বলিল—ঠিক সাহেবদের ছেলে-মেয়েদের মতো যদি চুল কাটতে পারো তবে কাঁচি ধরো, নইলে অমন ঘন কালো চুল নষ্ট কোরো না যেন।
মেস হইতে সে খুকীর মাথার বিনুনি খুলিয়া আনিয়াছিল। চুল ছাঁটিতে উমার বেশ ভালো লাগিতেছিল। সামনে একখানা প্রকাণ্ড আয়না, চার-পাঁচটা বড়ো বড়ো আলো জ্বলিতেছে, নাপিত মাঝে মাঝে আবার ময়দার মতো কী একটা গুঁড়া তাহার ঘাড়ের চুলে মাখাইতেছে…এমন সুড়সুড়ি লাগে!…
তাহাকে সাজাইতে খুকীর মামা পাঁচ-ছয় টাকা খরচ করিয়া ফেলিল। মেসের নিয়োগী-মশায় একে একে কয়েকটি পুত্র-কন্যাকে উপরি উপরি চার-পাঁচ বৎসরের মধ্যে হারাইয়াছেন, উমাকে পাইয়া আর ছাড়িতে চাহিলেন না। সন্ধ্যার পর রঙিন ফ্রক পরা, ববড চুল, মুখে পাউডার, পায়ে জরির জুতো, আর এক উমা যখন তাহার ঘরে আসিয়া দাঁড়াইল, তাহাকে দেখিয়া তো নিয়োগীমশায় বিষম খাইবার উপক্ৰম করিলেন।
তাহার মামা হাসিয়া বলে—গেলই না হয় কিছু খরচ হয়ে, এমন সুন্দর মেয়ে কি ক’রে ভূত সাজিয়ে রেখেছিল বলুন দিকি?…ও কুণ্ডুমশায়, চেয়ে দেখুন পছন্দ হয়?
কী করিয়া খুকীর শীর্ণতা দূর করা যাইতে পারে, এ সম্বন্ধে নানা পরামর্শ চলিল। গলির মোড়ের একজন ডাক্তার কডলিভার অয়েল ও কেপলারের মল্ট এক্সট্রাক্টের ব্যবস্থা দিলেন, তাহা ছাড়া বলিলেন—খাওয়া চাই, না-খেয়ে খেয়ে এমন হয়েছে। —পুষ্টির অভাব, এ বয়েসে এদের খুব পুষ্টিকর জিনিস খাওয়ানো চাই কিনা। সকালে কোয়েকার ওটস খাওয়াবেন দিন পনেরো দেখুন কেমন থাকে।
কিন্তু চতুর্থ দিনে খুকীর কম্প দিয়া জ্বর আসিল। খুকীর মামার লিনোটাইপের কাজে যাওয়া হইল না, সারাদিন খুকীর কাছে বসিয়া রহিল। অন্যদিন বৃদ্ধ নিয়োগী মহাশয়ের তত্বাবধানে রাখিয়া ছাপাখানায় যাওয়া চলিত, আজ আর তাহা হইল ।…সন্ধ্যার পূর্বে জ্বর ছাড়িয়া গেল, খুকী উঠিয়া বসিয়া এক টুকরো মিছরি চুষিতে লাগিল। অফিসফেরতা ফণীবাবু একটা বেদানা ও গোটাকতক কমলালেবু, খুকীর জন্য আনিয়াছেন, সতীশবাবু পোয়াটাক ছোটো আঙুর ও পুনারায় গোটাতিনেক কমলালেবু আরও দু-তিন জনের প্রত্যেকেই কিছু-না-কিছু কিনিয়া আনিয়াছেন।… সকলে চলিয়া গেলে খুকী মামার দিকে একবার চাহিল, পরে ঠোঁট ফুলাইয়া মাথা নীচু করিল। মামা বিস্মিত হইয়া বলিল—কী রে খুকী? কী হয়েছে?
খুকী দুঃখের চাপা কান্নার মধ্যে বলিল—বাড়ি যাব মামা…মার কাছে যাব…
—আচ্ছা কেঁদো না খুকু-জ্বর সারুক, নিয়ে যাব এখন।
দু-তিন দিন গেল। জ্বর সারিয়া গিয়াছে বটে, কিন্তু রাত্রে মাঝে মাঝে সে ঘুমের ঘোরে মায়ের জন্য কাঁদিয়া ওঠে।… ভুলাইবার জন্য তাহাকে একদিন হগ সাহেবের বাজারে খেলনার দোকানে লইয়া যাওয়া হইল, সেখানে একটা খুব বড়ো মোমের খোকা-পুতুল তাহার খুব পছন্দ হইল, কিন্তু দামটা বড়ো বেশি, সাড়ে চার টাকা-খুকীর মামার এক মাসের মাহিনার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। মামা বলিল—
অন্য একটা পুতুল পছন্দ করো খুকু, ওটা ভালো না। কেমন ছোটো ছোটো এইসব কুকুর, হাতি, কেমন না?
খুকী দ্বিরুক্তি না-করিয়া ঘাড় নাড়িল বটে, কিন্তু পুতুলটা ফিরাইয়া দিবার সময় (সে পূর্ব হইতেই পুতুলটাকে দখল করিয়া বসিয়াছিল) তাহার ডাগর চোখ দুটি ছল ছল করিয়া আসিল।
দোকানদার বলিল—বাবু, খুকীর মনে কষ্ট হয়েছে, আপনি বড়ো পুতুলটাই নিন, কিছু কমিশন বাদ দিয়ে দিচ্ছি…
তাহার মামা বলিল—আচ্ছা, আচ্ছা, খুকু তুমি বড়ো খোকা-পুতুলটাই নাও কুকুরের দরকার নেই—ধরো বেশ ক’রে, যেন ভাঙে না দেখো।…
প্রায় এক সপ্তাহ কাটিয়াছে। সেদিন রবিবার, খুকীর মামা বিশেষ কারণে চেতলার হাটে এক বন্ধুর সহিত দেখা করিতে গিয়াছে। এখনি আসিবার কথা, কিছু টাকা পাওনা আছে, তাহারই আদায়ের চেষ্টায় যাওয়া, ততক্ষণ অন্যান্য দিনের মতো নিয়োগী মহাশয়ের তত্বাবধানেই খুকীর থাকিবার কথা।… খানিকক্ষণ খুকীর সহিত গল্পগুজব করিবার পর বৃদ্ধ নিয়োগী মহাশয়ের মাধ্যাহ্নিক নিদ্রাকর্ষণ হইল। কথা বলিতে বলিতে খুকী দেখিল তিনি আর কথা বলিতেছেন না, অল্প পরেই তাঁহার নাসিকা গর্জন শুরু হইল। মেসে কোনো ঘরে কেহ নাই, উমার ভয়-ভয় করিতে লাগিল। একবার সে জানালা দিয়া উঁকি মারিয়া চাহিয়া দেখিল, গলির মোড়ে দুইজন কাবুলিওয়ালা দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া গল্প করিতেছে, তাহাদের ঝোলাঝুলি, লম্বা চেহারায় ভয় পাইয়া সে জানালা হইতে মুখ সরাইয়া লইল।
মামা কোথায় গেল? মামা আসে না কেন?
সে ভয় পাইয়া ডাকিল—ও জ্যাতাবাবু, জ্যাতাবাবু?
তাহার মামা তাহাকে শিখাইয়া দিয়াছে—নিয়োগী মহাশয়কে জ্যাঠাবাবু বলিয়া ডাকিতে।
সাড়া না-পাইয়া সে আর একবার ডাকিল—আমার মামা কোথায় জ্যাতাবাবু নিয়োগী মহাশয় জড়িতস্বরে ঘুমের ঘোরে বলিলেন— আচ্ছা, আচ্ছা।…
তিনি স্বপ্ন দেখিতেছিলেন, দেশের বাটিতে রাত্রিতে শুইয়া আছেন, মালপাড়ার কেতু মাল চৌকিদার লাঠি ঘাড়ে রোঁদে বাহির হইয়া তাঁহার নাম ধরিয়া হাঁক দিতেছে।
খুকী এদিক-ওদিক চাহিয়া উঠিয়া পড়িল—সিঁড়ির দরজা খোলা ছিল, সে নামিয়া নীচে আসিল। ঝি-চাকর রান্নাঘরের তালা বন্ধ করিয়া অনেকক্ষণ চলিয়া গিয়াছে, একটা কালো বিড়াল চৌবাচ্চার উপর বসিয়া মাছের কাঁটা চিবাইতেছে।
বাহির হইয়াই রাস্তা। খুকীর একটা অস্পষ্ট ধারণা আছে যে, এই রাস্তাটা পার হইলেই তাহার মামার কাছে পৌঁছানো যাইবে, এই পথের যেখানটাতে শেষ, সেখান হইতেই পরিচিত গণ্ডীর আরম্ভ।
ঘুরিতে ঘুরিতে সে পথ হারাইয়া ফেলিল, গলি পার হইয়া আর একটা বড়ো গলি, তাহার পর একটা লোহার বেড়া-ঘেরা মাঠ মতো, সেটার পাশ কাটাইয়া আর একটা গলি। ক্রমে খুকীর সব গোলমাল হইয়া গেল, এ পর্যন্ত সে একবারও পিছনের দিকে চাহে নাই, একবার পিছনের দিকে চাহিয়া তাহার মনে হইল সে দিকটাও সে চেনে না।…সামনের পিছনের দুই জগই তাহার সম্পূর্ণ অপরিচিত, কোথাও একটা এমন জিনিস নাই যাহা সে পূর্বে কখনো দেখিয়াছে।…
সে ভয় পাইয়া কাঁদিতে লাগিল। ঠিক দুপুরবেলা, পথে লোকজনও কম, বিশেষত এই সব গলির মধ্যে। আরও খানিকদ্দূর গিয়া একটা লাল রঙের বাড়ির সামনে দাঁড়াইয়া কাঁদিতেছে, তাহাদের বাড়ির মতিঝিয়ের মতো দেখিতে একজন স্ত্রীলোক তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল—কী হয়েছে খুকী, কাঁদছ কেন?…তোমাদের কোন বাড়িটা, এইটে?
খুকী কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল—আমি মামার কাছে যাব…
—তোমাদের ঘর কোথা গো?
খুকী আঙুল তুলিয়া একটা দিক দেখাইয়া বলিল—ওই দিকে।
—তোমার বাপের নাম কী?
বাপের নাম…কই তাহা তো সে জানে না! বাপের নাম ‘বাবা’—তা ছাড়া আবার কী? সে চোখ তুলিয়া ঝিয়ের মুখের দিকে চাহিল।
স্ত্রীলোকটি একবার গলির দুই দিকে চাহিয়া দেখিল, পরে বলিল—আচ্ছা এসো এসো খুকী, আমার সঙ্গে এসো, আমি তোমার মামার কাছে নিয়ে যাচ্ছি, এসো…।
এ-গলি, ও-গলি ঘুরিতে ঘুরিতে অবশেষে একটা ছোট্ট খোলার বাড়ি। ঝি কাহাকে ডাকিয়া কী একটা কথা নীচুস্বরে বলিল, তারপর দুইজনে খানিকক্ষণ কী বলাবলি করিল, নবাগত স্ত্রীলোকটি হাত দিয়া কী একটা দেখাইল, খুকী সেসব বুঝিতে পারিল না। পরে তাহারা খুকীকে একটা অন্ধকার ঘরের মধ্যে লইয়া গেল। ছোটো ঘুলঘুলির কাছে একটা প্রকাণ্ড মাটির জালা ও তাহার চারিপাশে একরাশ অন্ধকার। খুকীর কেমন ভয়-ভয় করিতে লাগিল—যক্ষিবুড়ি যে জালাতে ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েদের লুকাইয়া পুরিয়া রাখিবার গল্প শুনিয়াছে, যেন সেই ধরনের জালা। সে কাঁদো কাঁদো সুরে বলিল—আমার মামা কোথায়?
নবাগত স্ত্রীলোকটি বলিল—কেউ দেখেনি তো আনবার সময়ে? আমার বাপু ভয় করে। এই সেদিন সৈরভীর বাড়িতে পুলিশ এসে কি তম্বি, আমি থালা ফেরত দিতে গেনু তাই…
খুকীদের বাড়ির মতিঝিয়ের মতো দেখিতে যে স্ত্রীলোকটি সে বিদ্রুপ করিয়া বলিল—নেকু! যাও, সামনের দরজাটা খুলে ঢাক করে রেখে এলে কেন?…নেকু,। জানে না যেন কিছু!
সে খুকীকে চৌকির উপর বসাইয়া তাহার গায়ে হাত বুলাইয়া অনেক আদরের কথা বলিল, তাহাকে একটা রসগোল্লা খাইতে দিল। পরে খুকীর হাতের সোনার বালা দু-গাছা ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া বলিল—এখন তুলে রেখে দি খুকী?…বেশ নক্ষি মেয়ে—দেখি…
খুকী ভয়ে ভয়ে বলিল—বালা খুলো না…আমার মামাকে ডেকে দাও…
কিন্তু ততক্ষণে ঝি তাহার হাত হইতে বালা দু-গাছা অনেকটা খুলিয়াছে, দেখিয়া খুকী কাঁদিয়া উঠিয়া বলিল—আমার বালা নিও না, মামাকে বলে দেব আমার বালা খুলো না…
মতিঝিয়ের ইঙ্গিতে নবাগতা স্ত্রীলোকটি তাহার মুখ চাপিয়া ধরিল। কিন্তু একটা বিষয়ে দুইজনেই বড়ো ভুল করিয়াছিল, উমার কাটি কাটি হাত-পা দেখিয়া তাহার লড়াই করিবার ক্ষমতা সম্বন্ধে সাধারণের হয়তো সন্দেহ হইতে পারে, কিন্তু এ ধারণা যে কতদূর অসত্য, তাহা গত মাসে দুগ্ধপানের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের সময় উমার মা ভালোরূপেই জানিত। ইহারা সেসব খবর জানিবে কোথা হইতে? বেচারিদের ভুল ভাঙিতে কিন্তু বেশি বিলম্ব হইল না, ধস্তাধস্তিতে বিছানা ওলটপালট হইয়া গেল, উমার আঁচড়-কামড়ে মতি-ঝি তো বিব্রত হইয়া উঠিল। গোলমালে একগাছা বালা হাত হইতে খুলিয়া কোথায় চৌকির নীচের দিকে গড়াইয়া গেল। পিছন হইতে তাহার হাত-মুখ চাপিয়া ধরিয়া অন্যগাছা নবাগতা স্ত্রীলোকটি ছিনাইয়া খুলিয়া লইল।
মতি-ঝি বলিল—ছেড়ে দে, ছেড়ে দে—হাঁপিয়ে মরে যাবে—দেখি ও আপদকে রাস্তার ওপর রেখে আসি—বাপরে, কী দস্যি!…
—এখন কোথায় রাখতে যাবি লো? খ্যান্তমণিকে একটা খবর দিবিনে?
—না বাপু, তাতে আর দরকার নেই, ওকে রেখে আসি—কেউ টের পাবে, দেখ না বসে বসে…
তুমুল গোলমাল, খোঁজাখুঁজি, হইচই-এর পরে সন্ধ্যার সময় উমাকে পাওয়া গেল নেবুতলার সেন্টজেমস পার্কের কোণে। কেবিন-ছাঁটাই বড় চুল হেঁড়াখোঁড়া, কপালে ও গালে আঁচড়ের দাগ; হাত শুধু, ফ্রকের কোমরবন্ধ ছিঁড়িয়া ঝুলিতেছে…’মামা’ ‘মামা’ বলিয়া কাঁদিতেছিল, অনেক লোক চারিধারে ঘিরিয়া জিজ্ঞাসাবাদ করিতেছে, একজন গিয়া একটা পাহারাওলা ডাকিয়া আনিয়াছে—ঠিক সেই সময় নিয়োগীমশায়, কুণ্ডুমশায়, সতীশবাবু, অখিলবাবু, খুকীর মামা সবাই গিয়া উপস্থিত হইলেন।
যথারীতি থানায় ডায়েরি ইত্যাদি হইল। কে তাহার বালা খুলিয়া লইয়াছে এ সম্বন্ধে খুকী বিশেষ কোনো খবর দিতে পারিল না। খুকীর মামাকে সকলে যথেষ্ট ভসনা করিল। খবরদারি করিবার যখন সময় নাই, তখন পরের মেয়ে আনা কেন ইত্যাদি। সবাই বলিল—যাও ওকে কালই বাড়ি রেখে এসো ছিঃ, ওইরকম করে কী কখনো…মেসের সকলে চাঁদা তুলিয়া খুকীকে দু-গাছা পালিশ-করা বিলাতি সোনার বালা কিনিয়া দিল।
গাড়িতে যাইবার সময় তাহার মামা বলিল—খুকু, বাড়িতে গিয়ে যেন এসব কথা কিছু বলো না?…কেমন তো? কক্ষনো বলো না যেন?…হ্যাঁ, লক্ষ্মী মেয়ে
তাহলে আর কলকাতায় নিয়ে আসব না…
খুকী ঘাড় নাড়িয়া রাজি হইল। বলিল—আমায় তখন একটা পুতুল কিনে দিও মামা…আর একটা মেমপুতুল…
খেলা
মতিলাল ছেলেকে বললে–বোসো বাবা, গোলমাল করো না। হিসেব দেখছি—
ছেলে বাবার কোঁচার প্রান্ত ধরে টেনে বললে–ও বাবা, খেলা করবি আয়–
-না, এখন টানিসনে—আমার কাজ আছে—
-–ও বাবা, খেলা কববি আয়—ঘোয়া খেলা কববি আয়—
—আঃ জ্বালালে—চল দেখি—
মতিলাল হিসাবের খাতা বন্ধ করে ছেলের পিছু পিছু চলল। ছেলে তার কোঁচার কাপড় ধরে টেনে নিয়ে চলল কোথায় তা সেই জানে।
–কোথায় রে?
—ওভেনে হাত তুলে খোকা একটা অনির্দেশ্য অস্পষ্ট ইঙ্গিত করে–ভালো বোঝা যায়। অবশেষে দেখা যায়, ভাঁড়ারঘরের পেছনে যে ছোটো রোয়াক আছে, বর্ষার জলে সেটা বেজায় পেছল, শ্যাওলা জমে বিপজ্জনক ভাবে মসৃণ—সেখানে নিয়ে এসে দাঁড় করালে মতিলালকে—
—এখানে কী রে?
—আউভাজা খা, আউভাজা খা–নে—
খোকা রোয়াকের নীচেকার কালকাসুন্দে গাছের পাতা এক-একটা করে ছিড়ে নিয়ে আসতে লাগল হাত বাড়িয়ে বাড়িয়ে, তারপর বাবার সামনে সেগুলো এক এক করে বসিয়ে দিলে।
—পড়ে যাবি, পড়ে যাবি, রোয়াক থেকে নীচে পড়ে গেল ইটে কেটে—আঃ।
—আউভাজা খা না–ও বাবা?
মতিলাল ছেলের হাত ধরে রোয়াকের ধার থেকে টেনে নিয়ে এল দেয়ালের দিকে। ছেলে ঘাড় বেঁকিয়ে চোখের তারা একপাশে নিয়ে এসে মতিলালের দিকে চেয়ে বললে—ঠিক বলে—
এ কথা সম্পূর্ণ অর্থহীন ও অবান্তর। ওই কথাটা ছেলে সম্প্রতি শিখেচে সুতরাং স্থানে-অস্থানে সেটা বলতে হবেই। মতিলাল ছেলের কথার দিকে মন না-দিয়ে খড়ের চালার একটা বাঁশের রুয়োর দিকে চেয়ে আপন মনে বলতে লাগল—এ :, উই লেগেচে দেখো-বর্ষাকালে যেটা তুমি নিজে চোখে না-দেখবে, সেটাই লোকসান হবে—
খোকা এবারও বললে—ঠিক বলেচ—
অবিশ্যি খোকার উক্তির প্রয়োগসাফল্য এখানে সম্পূর্ণ আকস্মিক।
মতিলাল বললে—যাঃ যাঃ—ওই এক শিখেচে ‘ঠিক বলেচ’, তা ওর সব জায়গায় বলা চাই। তা খাটুক আর না-খাটুক—থাম—
খোকা ভাবলে, বাবা তাকে বকলে কেন? সে হঠাৎ বড়ো দুঃখিত হল। দেড় বছর মাত্র ওর বয়েস, নাম টুনু, যেমন দুষ্ট, তেমনি বাচাল। মুখের বিরাম একদণ্ড নেই। বিষম পিতৃভক্ত, বাবা ছাড়া জানে না। সর্বদা বাবাকে চায়। ওর মা বলে, কাকে তুমি বেশি ভালোবাসো খোকা?
—বাবা মতিলালকে।
—আর মা অন্নপুন্নোকে নয়?
—হুঁ-উ-উ।
—তবে?
—বাবা মতিলালকে।
—তা তো সবই বুঝলাম। আমি বুঝি ভেসে এইচি? আমি বুঝি ভালোবাসার যুগ্যি নই, হ্যাঁরে—এইবার বল, কাকে ভালোবাসিস?
—বাবাকে, বাবা মতিলালকে।
—বাঃ, বেশ ছেলে দেখচি। থোকন, সোনার খোকন, তুমি কার খোকন?
—বাবা মতিলালের!
—আর কার খোকন?
—মার।
—মার কী ভাগ্যি!
এই ধরনের কথা রোজই প্রায় হয়। এসব থেকে এইটুকুই বোঝা যায় যে, টুনু বাবার একটু বিশেষ রকমের ন্যাওটো। বাবা ছাড়া সে কাউকে চায় না বড়ো একটা, বাবার সঙ্গে নাওয়া, বাবার সঙ্গে খাওয়া, বাবার সঙ্গে ঘুমোনো।
মতিলাল এতে খুব সন্তুষ্ট নয়। তার হিসেবপত্রের খাতা মোটেই এগোয় না, এক দিনের কাজে তিন দিন লাগে।
বিকেলে মতিলাল হয়তো চাইচে নদীর ধারে কী কোনো বন্ধুর বাড়ি একটু বেড়িয়ে আসবে, ছেলে এসে সামনে দাঁড়িয়ে বললেও বাবা, কী করছিস?
—কিছু করিনি। দাঁড়িয়ে আছি।
—বেরিয়ে চলো। আমি যাব।
—না।
—আমি যাব বাবা।
—না। যায় না।
খোকা ততক্ষণ মতিলালের কোঁচার কাপড় হাতের মুঠোর মধ্যে পাকিয়ে ধরে ঠোঁট ফুলিয়েচে। চোখে তার করুণ আবেদন ও আশার চাউনি। কে পারে তার কথা না-শুনে? মতিলালকে সঙ্গে নিতেই হয়। বাবার কাঁধে উঠে স্ফুর্তি তার। তখন সে জেনেছে, বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাচ্চে সে অনেক দূরে কোথাও। তার পরিচিত জগতের ক্ষুদ্র গণ্ডীর বাইরে।
মনের আনন্দে সে বলে যাবে—ও বাবা, ও মতিলাল, কী করচিস? বেরিয়ে চলো? আমি যাই।
—কোথায় যাচ্ছিস রে?
—মুকি আনতে।
—আর কী আনতে?
—চিনি আনতে।
—আর কী আনতে?
—মাছ।
—আর কী?
খোকা ভেবে ভেবে ঘাড় দুলিয়ে বলে–আউভাজা–
—বেশ।
খানিকদূর গিয়ে খোকা আর বাবার কাঁধে থাকতে রাজি হয় না। তাকে পথে নামিয়ে দিলে সে গুটি গুটি হেঁটে চলে। দু-একবার পড়ে যায়, আবার ঠেলে ওঠে। হঠাৎ এক জায়গায় গিয়ে খোকা আর চলে না। সামনের দিকে কী একটা জিনিস সে লক্ষ করে দেখছে।
—চল এগিয়ে, দাঁড়ালি কেন?
খোকা ছোট্ট হাত দুটি প্রসারিত করে বলে নাটকীয় ভঙ্গিতে—বিচন কাদা!
—কোথায় ভীষণ কাদা রে? কাদাই নেই রাস্তায়—চল—
—বিচন কাদা!…
—তবে নামলি কেন কোল থেকে? আয় আবার কোলে আয়—
আবার চলতে শুরু করল খোকা। বেশ খানিকটা গেল গুট গুট করে। একটা জায়গায় পথের পাশে একটা শুকনো কীসের ডাল পড়ে থাকতে দেখে থেমে গেল। আঙুল বাড়িয়ে বললে—বাবা—আটি—আমি নিই—
—যাতে তাতে হাত দিয়ো না—
—বাবা আমি নিই—
—নাও—
খোকার একটা গুণ, বাবার বিনা অনুমতিতে সে কোনো একটা কাজ হঠাৎ করতে চায় না। এইবার সে তুলে নিলে লাঠিটা। আশেপাশের গাছপালার গায়ে সপাসপ মারতে লাগল। ওর বাবা বলে—ফেলে দেও খোকা, এইবার ফেলে দাও লক্ষ্মীটি—
—ও মতিলাল?
—কী?
—কী করছিস?
—বেড়াতে যাচ্ছি বাবা। লাঠিটা ফেলে দে—লক্ষ্মী খোকা, লাঠি ফেলে দে—
খোকা লাঠিটা রাস্তার পাশে ফেলে রেখে আবার দিব্যি গুট গুট করে চলে। এক জায়গায় রাস্তার দু-পাশে ভাঁটুই গাছ বর্ষাকালে খুব বেড়েছে। রাস্তার দু-পাশে অনেক দূর পর্যন্ত ভাঁটুইবন।
খোকা হঠাৎ দু-হাত প্রসারিত করে বললে—কী ধান! কী ধান!
—ধান কই রে? ও হল—
—কী ধান! কী ধান! মতিলাল ভেবে দেখলে, অতটুকু ছেলে ধান এবং ভাঁটুইয়ের পার্থক্য কী করে বুঝবে।
-ও বাবা, কী ওতা?
—কই রে?
—ওই—বসে আছে—
মতিলাল খোকার আঙুলের দিগদর্শন অনুসরণ করে দেখলে, সামনের গাছের ডালে একটা কাঠবেড়ালি বসে আছে। খোকা আর যায় না, সে দাঁড়িয়ে গিয়েছে এবং ভয়ের দৃষ্টিতে চেয়ে আছে একদৃষ্টে সেটার দিকে। বাবার দিকে দু-হাত বাড়িয়ে বললে—বাবা, কোলে—
—কোলে আসবি?
—ভয় কববে—
—কীসের ভয় রে? এটা হল কাঠবেড়ালি—ও কিছু বলে না। ভয় নেই—চল–
মতিলাল যে বন্ধুটির বাড়ি গেল, তারা ওকে এক পেয়ালা চা খেতে দিলে। মতিলালের ছেলেকে দিল একটুকরো মিছরি। খোকা মিছরি একটু মুখে দিয়েই মুখ থেকে বার করে নিয়ে মতিলালের মুখের কাছে নিয়ে গিয়ে বললে—বাবা, খা—
এখন এ ব্যাপারটার ভেতরের কথা এখানে বলা এ সময়েই দরকার। ছেলের বয়স যখন আরো কম, দশ-এগারো মাস কী বছরখানেক, তখন থেকেই সে নিজের মুখে কোনো জিনিস মিষ্টি লাগলেই বাবার মুখের দিকে হাত বাড়িয়ে বলবে
—বাবা, খা—
মতিলালেরও বিশেষ আপত্তি থাকত না তাতে।
অবশ্য একটিবার বাদে।
একবার মাতৃস্তন্য পান করতে করতে খোকা নিকটে উপবিষ্ট মতিলালকে বলেছিল—বাবা, মিস্ত খা—
মতিলালেরা স্বামী-স্ত্রী মিলে খুব হেসেছিল।
নিজের মুখে যা ভালো লাগবে, তাই সে দেবেই বাবার মুখে এবং মতিলাল তা খেয়েও এসেছে, মুশকিলে পড়ে যেতে হয় ওকে, লোকজন থাকলে।
এখানে যেমন হল।
মতিলাল সলজ্জভাবে বললে—না, না—আমি আবার কী, খাও না—
খোকা বাবার রাগের কারণ খুঁজে পেলে না, রোজ যে খায়, আজ খাচ্ছে না কেন? নিশ্চয়ই রাগ করেছে।
সে দ্বিগুণ উৎসাহে বাবার মুখের আরো কাছে হাত নিয়ে গিয়ে বললে—বাবা, খা—
–না না। তুমি খাও—
–বাবা, খা না—
খোকার এবার কান্নার সুর। অমন মিষ্টি জিনিসটা বাবাকে সে খাওয়াবেই।
মতিলাল ধমক দিয়ে বললে—আঃ খাও না? আমার মুখে কেন?
-বাবা, খা না—
এবার বোধ হয় সে কেঁদেই ফেলবে। অগত্যা মতিলাল খোকার হাত থেকে মিছরির টুকরোটা নিয়ে খাবার ভান করে আবার ওর হাতে দিলে। খোকাকে ভোলানো অত সহজ নয়। সে বাবার মুখের দিকে চেয়ে বললে, মিট্টি?
—খুব মিষ্টি।
—আবার খা—
—না রে বাপু, বিরক্ত করলে দেখচি—
বন্ধুর বাড়িতে অনেকে বসে ছিল, তাদের মধ্যে কেউ কেউ বললে—খোকা কী বলচে?
মতিলাল বললে, মিছরি দিচ্ছে খেতে—
ওর বন্ধু বললে—ও খোকা, বাবাকে কী দিচ্চ? মিছরি? তুমি খাও।
এইসব স্থূলবুদ্ধি লোকে কী বুঝবে—খোকা তাকে কতখানি ভালোবাসে বা সে খোকাকে কতখানি ভালোবাসে। এদের কাছে কিছু বলে লাভ নেই। পিতা-পুত্রের সেই সূক্ষ্ম অবিচ্ছেদ্য ভালোবাসার গূঢ় তত্ব, যা মুখে বলা যায় না, যার বলে এক বছরের শিশু তার অত বয়সে বড়ো বাপের মনের ভাব বুঝতে পারে, সে জিনিসের ব্যাখ্যা যার-তার কাছে করে কী হবে?
মতিলাল বললে—খাও তুমি—
খোকা হাত বাড়িয়ে বললে—খা না বাবা—
মতিলাল খোকাকে কোলে নিয়ে বন্ধুর বাড়ি থেকে উঠল। খোকার মনে বার বার কষ্ট দেওয়াও যায় না, অথচ ওদের সামনে খোকার মুখ থেকে বের করা তার লালঝোলমাখা মিছরি খায়ই বা কী করে?
ওরা পথে নামল।
টুনুর ক্ষুদ্র জগতে সন্ধ্যা হয়ে এল। আশেপাশের পথে, বনে, ভাঁটুইবনে অন্ধকার নেমেচে। জোনাকি জ্বলচে কালকাসুন্দে গাছের ঝোপের আশেপাশে, যাঁড়াগাছের নিবিড় পত্র-পুষ্পের মধ্যে, বনমরচে লতার চারু অগ্রভাগে। অন্ধকারের গহ্বর থেকে যেন ফুটে উঠচে একে একে জ্যোতির্লোক, নীহারিকালোক।
মতিলাল আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললে—ও কী জ্বলচে রে?
—জোনা পোকা। নিয়ে এসো বাবা—
—তুই নিবি একটা?
—হ্যাঁ।
খোকা হেঁটেই যাচ্ছিল, অন্ধকার বনঝোপের দিকে তাকিয়ে সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল হঠাৎ।
—কী হল রে?
—বিচন কাদা!
—না মোটেই কাদা নেই, শুকনো পথ—
—ছিয়াল!
—কোথায়? কোথাও নেই, চলো—
—কোলে কর—নে—ভয় কববে—
–এসো তবে—
খানিকটা গিয়ে খোকা বললে—বাবা!
—কী?
—ও বাবা—আমি মুকি খাব—
—বেশ।
—সন্দেশ খাব—
—বেশ।
—ও বাবা!
—বোকো না—চুপ করো। –ও বাবা মতিলাল!
—কী বাবা?
—কী করছিস?
—কী আবার করব, পথ হাঁটচি।
—মা কোথায়—মা?
—বাড়িতে আছে।
—মার কাছে যাই—
—সেখানেই তো যাচ্চি—
মতিলালের স্ত্রী ঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়েছিল। ছুটে এসে ছেলেকে কোলে নিয়ে বললে–ও আমার সোনার খোকন, আমার রুপোর খোকন, আমার এতটুকু একটা খোকন—কোথায় গিইছিলি রে?
—খোকা হাত দিয়ে একটা অনির্দিষ্ট বস্তু দেখিয়ে বললে—ওখেনে—
—ওখেনে? বেশ রে বেশ। হ্যাঁগো, যা-তা খাওয়াওনি তো?
মতিলাল বললে—না না। কী দেবেই বা কে এসব জায়গায়। একটু মিছরি খেয়েছে।
অন্নপূর্ণা ওকে দুধ খাইয়ে শুইয়ে দিলে। খোকা খানিকটা উশখুশ করে বললে— বাবা কোথায়?
-কেন?
—ঘুম দেবে।
—আমি ঘুম দিচ্ছি।
—বাবা দেবে—বাবা দেবে।
মতিলালকে খোকার শিয়রে বসে বসে ঘুম পাড়াতে হয়। প্রতি সন্ধ্যাতেই এ রকম। আজ নতুন কিছু নয়। খোকা বলে—বাবা, জন্তি গাছটি—
—কী? জন্তি গাছটি? তবে শোনো—
ওপারের জন্তি গাছটি জন্তি বড়ো ফলে—
গোজন্তির মাথা খেয়ে প্রাণ কেমন করে—
খানিকটা পরে খোকা নিস্তব্ধ ও নীরব হয়ে গেল। ঘুমিয়ে পড়েছে মনে করে মতিলাল যেমন বাইরে এসে বসে তামাক ধরিয়েছে, খোকা এমন সময়ে কেঁদে উঠল—ও বাবা, কোথায় গেলি? ও বাবা—
মতিলাল তামাক খেতে খেতে হুঁকো নামিয়ে রেখে ছুটল ছেলের কাছে।
অন্নপূর্ণা হেসে বলে—ও ঘুমের ঘোরে মাঝে মাঝে পেছন দিকে হাত দিয়ে দেখে তুমি আছ কিনা। যদি বোঝে নেই, তবে ওর ঘুম অমনি ভেঙে যায়—
বাইরের তামাকের ধোঁয়া পুড়ে পুড়ে শেষ হয়, মতিলালকে ঠায় বসে থাকতে হয় শিশুর শিয়রে।
পরদিন নাইতে যাচ্ছে তেল মেখে মতিলাল। খোকা বললে—আমি যাব—বাবা —নদীতে যাই।
সে রোজই যায়। তাকে তেল মাখিয়ে নিয়ে গিয়ে ডাঙায় দাঁড় করিয়ে রাখে। যে ঘাটে মতিলাল যায়, সেটাতে লোকজন বড়ো-একটা যায় না। বড্ড বনজঙ্গল। খোকা জলে নামবার জন্যে ব্যস্ত হয়।
মতিলাল ওকে কোলে করে জলে নামে। মহাখুশিতে দু-হাত দিয়ে খোকা খলবল করে জলে। কিছুতেই উঠতে চায় না। ওকে দুটো ডুব দেওয়ায় মতিলাল। এক-একটা ডুবের পর খোকা শিউরে আড়ষ্টমতো হয়, নাকে-মুখে জল ঢুকে যায়। খানিক পরে সামলে নিয়ে চারিদিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে। নদীতে বর্ষার ঢল নেমেচে, বড়ো বড়ো শ্যাওলা, কচুরিপানা টোপাপানার দাম তির বেগে ভেসে চলেচে।
খোকা বলে—ও কী বাবা?
—শ্যাওলা।
-–ও বাবা, গান করি, গান কয়ি—
–করো।
—এ-এ-এ-এ, ঘটি বধনন—
খেলারাম বাবাজি বাবাজি—
—বেশ, বেশ গান। এবার জল থেকে ওঠো। হ্যাঁরে, তোকে ও গান শেখালে কে রে?
—ফুছু।
—হ্যাঁ—যতো সব কাণ্ড! আবার গান করো তো?
—ঘটি বধনন—
খেলারাম বাবাজি—
—বেশ গান শিখিচিস—জয় যদু-নন্দন, ঘটিবাটি-বন্ধন,
তুলোরাম খেলারাম বাবাজি—
খোকার বহু আপত্তি সত্বেও মতিলাল খোকাকে গা মুছিয়ে ঘাটের ওপরে কুলগাছের ছায়ায় দাঁড় করিয়ে রেখে নাইতে নামল। ঢল-নামা বর্ষার নদীতে কামট-হাঙরের ভয়, জেলেরা প্রায়ই দেখতে পায়। কুমির তো কাল না পরশু একটা দেখা দিয়েছিল বেলেডাঙার বাঁকে। খোকাকে বেশিক্ষণ জলে রাখা ঠিক নয়। ডাঙার কুলতলা থেকে বাবাকে জলে ডুব দিতে ও হাত-পা ছুড়তে দেখে। খোকা খুব খুশি। ক্রমে খোকাকে খুশি করবার জন্য মতিলাল খরস্রোতা বর্ষার নদীতে সাঁতার দিতে শুরু করলে।
খোকা ডাঙা থেকে ডাকলেও বাবা–বাবা—
দূর থেকে মতিলাল উত্তর দিলে—কী?
—আমি যাই—
—না, আর নদীতে নামে না। ঠিক থাকো।
-–ও বাবা—
—থাক দাঁড়িয়ে ওখানে—
খানিকটা পরে বাবাকে আদৌ আর না-দেখতে পেয়ে খোকা ডাকতে লাগল— বাবা-–বাবা–
কোনো সাড়া নেই।
–-ও বাবা–ও মতিলাল—
কোনো দিকে মতিলালের দেখাও নেই।
—ও মতিলাল, ভয় কববে—
খানিকটা চুপ করে থেকে সে ভয়ের সুরে বললে—ছিয়াল! বাবা, ও বাবা–
অনেকক্ষণ পরে কে-একজন তরকারিওয়ালা নৌকো পার হবার জন্যে এসে দেখে, কুলতলায় একটা ছোটো ছেলে দাঁড়িয়ে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে কাঁদছে। অনেক দূর থেকেই সে শিশুকণ্ঠের আর্ত কান্না শুনতে পেয়েছিল। সে কাছে এসে বললে —কে গা? কী হয়েচে খোকা? তুমি কাদের ছেলে? এখানে কেন?
খোকা আকুল কান্নার মধ্যে হাত বাড়িয়ে নদীর দিকে দেখিয়ে বলে—বাবা মতিলাল—ভয় কববে—
এ আজ পাঁচ-ছ-বছরের কথা।
মতিলাল সান্যাল বাজিতপুরের ঘাটে বর্ষার নদীতে কুমির বা কামটের হাতে প্রাণ হারান, তখন তাঁর শিশুপুত্র একা নদীর ঘাটে কুলতলায় বসে ‘বাবা মতিলাল’ বলে কাঁদছিল, এ কথা অনেকেই জানেন বা শুনে থাকবেন। জেলার ম্যাজিস্ট্রেট পর্যন্ত শুনে দেখতে এসেছিলেন জায়গাটা। কেউ কেউ খোকার ফোটো তুলে নিয়ে গিয়েছিল সেই ঘাটের সেই কুলতলায় তাকে আবার দাঁড় করিয়ে। তার পিতৃহারা প্রাণের আকুল কান্না বাইরে কতটুকু বা প্রকাশ হয়েছিল। তিনদিন পরে মতিলালের অর্ধভুক্ত দেহ পাওয়া যায় সর্ষেখালির বাঁকে মাছধরা কোমরজলে। পুলিশের হাতে দেওয়া হয় মৃতদেহ।
খোকা আজ কোথায়, এ প্রশ্ন অনেকে করবেন জানি।
টুনু নেই। এক বছর পরে সেও বাবার সন্ধানে অজানা পথে বেরিয়ে পড়ে।
অন্নপূর্ণা আছেন। গাঁয়ের লোকে দেখাশোনা করে, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কলমের জোরে গবর্নমেন্ট মাসিক কিছু বৃত্তি দেয়।
জনসভা
জনসভা
আমার তখন বয়স নয় বছর। গ্রামের উচ্চ-প্রাইমারি স্কুলে পড়ি এবং বয়সের তুলনায় একটু বেশি পরিপক্ক। বিনু একদিন ক্লাসে একখানা বই আনিল, ওপরে সোনালিফুল হাতে একটি মেয়ের ছবি (ত্রিশ বছর আগেকার কথা বলিতেছি মনে রাখিবেন), রাঙা কাগজের মলাট, বেশি মোটা নয়, আবার নিতান্ত চটি বইও নয়।
আমি সেই বয়সেই দু-একখানা সুগন্ধি তেলের বিজ্ঞাপনের নভেল পড়িয়া ফেলিয়াছি; পূর্বেই বলি নাই যে বয়সের তুলনায় আমি একটু বেশি পাকিয়াছিলাম! সেজন্য বিনু আমাকে ক্লাসের মধ্যে সমঝদার ঠাওরাইয়া বইখানি আমার নাকের কাছে উঁচাইয়া সগর্বে বলিল, “এই দ্যাখো, আমার দাদা এই বই লিখেছেন, দেখেছিস?”
বলিলাম, “দেখি কী বই?”
মলাটের ওপরে লেখা আছে ‘প্রেমের তুফান’। হাতে লইয়া দেখিলাম, লেখকের নাম, শ্রীভূষণচন্দ্র চক্রবর্তী। দিনাজপুর, পীরপুর হইতে গ্রন্থকার কর্তৃক প্রকাশিত, দাম আট আনা।
“তোর দাদার লেখা বই, কীরকম দাদা?”
বিনু সগর্বে বলিল, “আমার বড়োমামার ছেলে, আমার মামাতো ভাই।”
এই সময় নিতাই মাস্টার মহাশয় ক্লাসে ঢোকাতে আমাদের কথা বন্ধ হইয়া গেল। নিতাই মাস্টার আপন মনে থাকিতেন, মাঝে মাঝে কী এক ধরনের অসংলগ্ন কথা বলিতেন আর আমরা মুখ-চাওয়াচাওয়ি করিয়া হাসিতাম। জোরে হাসিবার উপায় ছিল না তাঁর ক্লাসে।
অমনি তিনি বলিয়া বসিতেন, “এই তিনকড়ি, এদিকে এসো, হাসছ কেন? ছানা চার আনা সের, কেরোসিন তেল ছ-পয়সা বোতল—”
এইসব মারাত্মক ধরনের মজার কথা শুনিয়াও আমাদের গম্ভীর হইয়া বসিয়া থাকিতে হইবে, হাসিয়া ফেলিলেই মার খাইয়া মরিতে হইবে।
বর্তমানে নিতাই মাস্টার ক্লাসে ঢুকিয়াই বলিলেন, “ও-খানা কী বই নিয়ে টানাটানি হচ্ছে সব? তিনটের গাড়ি কাল এসেছিল তিনটে পঁচিশ মিনিটের সময়, পঁচিশ মিনিট লেট—অমুক বিস্কুট পয়সায় দশখানা—”
আমরা হাসি অতিকষ্টে চাপিয়া মেঝের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া বসিয়া রহিলাম।
নিতাই মাস্টার বইখানা হাতে লইয়া বলিলেন, “কার বই?”
বিনু সগর্বে বলিল, “আমার বই, স্যার। আমার দাদা লিখেছেন, আমাদের একখানা দিয়েছেন—”।
নিতাই মাস্টার বইখানা নাড়িয়া-চাড়িয়া দেখিয়া বলিলেন, “হু, থাক, একটু পড়ে দেখব।”
পরের দিন বইখানা ফেরত দিবার সময় মন্তব্য করিলেন, “লেখে ভালো, বেশ বই। ছোকরা এর পর উন্নতি করবে।”
বিনু বাধা দিয়া বলিল, “ছোকরা নন স্যার তিনি, আপনাদের বয়সি হবেন—”
নিতাই মাস্টার ধমক দিয়া বলিলেন, “বেশি কথা কইবে না, চুপ করে বসে থাকবে। আমার কথার ওপর কথা! পুরোনো তেঁতুলে অম্বলের ব্যথা সারে, আশ্বিন মাসে দুর্গাপুজো হয়।”
পুরোনো তেঁতুলে অম্বলের ব্যথা সারুক আর নাই সারুক, নিতাই মাস্টারের সার্টিফিকেট শুনিয়া বিনুর দাদার বইখানা পড়িবার অত্যন্ত কৌতূহল হইল; বিনুর নিকট যথেষ্ট সাধ্যসাধনা করিয়া সে-খানা আদায় করিলাম। বাড়িতে বাবা ও বড়োদার চক্ষু এড়াইয়া বইখানাকে শেষ করিয়া বিনুর এই অদেখা দাদাটির প্রতি মনে মনে ভক্তিতে আপ্লুত হইয়া গেলাম। একটি মেয়েকে কী করিয়া দুষ্ট লোক ধরিয়া লইয়া গেল, নানা কষ্ট দিল, অবশেষে মেয়েটি কীভাবে জলে ডুবিয়া মরিল, তাহারই অতিমর্মন্তুদ বিবরণ। পড়িলে চোখে জল রাখা যায় না।
কয়েক মাস কাটিয়া গিয়াছে, একদিন বিনু বলিল, “জানিস পাঁচু, আমার সেই দাদা, যিনি লেখক, তিনি এসেছেন কাল আমাদের বাড়ি।”
অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া উঠিলাম, “কখন এসেছেন? এখনও আছেন?”
“কাল রাতের ট্রেনে এসেছেন, দু-তিনদিন আছেন।”
“সত্যি? মাইরি বল—”
“মা-ইরি, চল বরং, আয় আমাদের বাড়ি।’
আমার ন-দশ বত্সর বয়সে ছাপার বই কিছু কিছু পড়িয়াছি বটে, কিন্তু যাহারা বই লেখে তাহারা কীরূপ জীব কখনো দেখি নাই। একজন জীবন্ত গ্রন্থকারকে স্বচক্ষে দেখিবার লোভ সংবরণ করিতে পারিলাম না, বিনুর সহিত তাহার বাড়ি গেলাম।
বিনুদের ভেতর-বাড়িতে একজন একহারা কে বসিয়া বিনুর মার সঙ্গে গল্প করিতেছিল, বিনু দূর হইতে দেখাইয়া বলিল, ‘উনিই’। আমি কাছে যাইতে ভরসা পাইলাম না। সম্ভমে আপ্লুত হইয়া দূর হইতে চাহিয়া চাহিয়া দেখিতে লাগিলাম। লোকটি একহারা, শ্যামবর্ণ, অল্প দাড়ি আছে, বয়সে নিতাই মাস্টারের চেয়ে বড়ো হইবে তো ছোটো নয়, খুব গম্ভীর বলিয়াও মনে হইল। লোকটি সম্প্রতি কাশী হইতে আসিতেছে, বিনুর মায়ের কাছে সবিস্তারে সেই ভ্রমণকাহিনিই বলিতেছিল। প্রত্যেক কথা আমি গিলিতে লাগিলাম ও হাত-পা নাড়ার প্রতি ভঙ্গিটি কৌতূহলের সহিত লক্ষ করিতে লাগিলাম।
লেখকরা তাহা হইলে এইরকম দেখিতে।
সেইদিনই গ্রামে বেশ একটা সাড়া পড়িয়া গেল, বিনুর বাবা মুখুজ্যেদের চণ্ডীমণ্ডপে গল্প করিয়াছেন, তাঁহার বড়ো শালার ছেলে বেড়াইতে আসিয়াছে, মস্ত একজন লেখক, তার লেখার খুব আদর। ফলে গ্রামের লোক দলে দলে দেখা করিতে চলিল। বিনুর মা মেয়েমহলে রাষ্ট্র করিয়া দিলেন, ‘প্রেমের তুফানে’-র লেখক তাদের বাড়ি আসিয়াছেন। উক্ত বইখানি ইতিমধ্যে পুরুষেরা যত পড়ুক আর না-পড়ক, গ্রামের মেয়েমহলে হাতে হাতে ঘুরিয়াছে খুব, অনেক মেয়ে পড়িয়া ফেলিয়াছে, বিনুর মা ভ্রাতুস্পুত্রগর্বে স্ফীত হইয়া নিজে যাচিয়াও অনেককে পড়াইয়াছেন, সুতরাং মেয়েমহলও ভাঙিয়া আসিল একজন জলজ্যান্ত লেখককে দেখিবার জন্য। বিনুদের বাড়ি দিনরাত লোকের ভিড়; একদল যায়, আর একদল আসে। অজ পাড়াগাঁ, এমন একজন মানুষের—যার বই ছাপার অক্ষরে বাহির হইয়াছে, দেখা পাওয়া আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতোই দুর্লভ।
ক-দিন কী খাতির এবং সম্মানটাই দেখিলাম বিনুর দাদার! এর বাড়ি নিমন্ত্রণ, ওর বাড়ি নিমন্ত্রণ, বিনুর মা সগর্বে মেয়েমহলে গল্প করেন, “বাছা এসে ক-দিন বাড়ির ভাত মুখে দিলে? নেমন্তন্ন খেতে খেতেই ওর প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছে—’
ভাবিলাম—সত্যি, সার্থক জীবন বটে বিনুর দাদার! লেখক হওয়ার সম্মান আছে।
ভূষণদার সহিত এইভাবে আমার প্রথম দেখা।
অত অল্প বয়সে অবশ্য ভূষণদাদার নিকটে ঘেঁষিবার পাত্তা পাই নাই—কিন্তু বছর দুই পরে তিনি যখন আবার আমাদের গ্রামে আসিলেন, তখন তাঁহার সহিত মিশিবার অধিকার পাইলাম—যদিও এমন কিছু ঘনিষ্ঠভাবে নয়। তিনি যে মাদৃশ বালকের সঙ্গে কথা কহিলেন, ইহাতেই নিজেকে ধন্য মনে করিয়া বাড়ি গিয়া উত্তেজনায় রাত্রে ঘুমাইতে পারিলাম না।
সে-কথাও অতিসাধারণ ও সামান্য। দাঁড়াইয়া আছি দেখিয়া ভূষণদাদা বলিয়াছিলেন, “তোমার নাম কী হে? তুমি বুঝি বিনুর সঙ্গে পড়ো?”
শ্রদ্ধা ও সমজড়িত কণ্ঠে উত্তর করিলাম, “আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“কী নাম তোমার?”
“শ্রীপাঁচকড়ি চট্টোপাধ্যায়।”
“বেশ।”
কথা শেষ হইয়া গেল। দুরু দুরু বক্ষে বাড়ি ফিরিয়া আসিলাম। প্রথম দিনের পক্ষে এই-ই যথেষ্ট। পরদিন আরও ভালো করিয়া আলাপ হইল। নদীর ধারে বিনু, আমি, আরও দু-একটি ছেলে তাঁর সঙ্গে বেড়াইতে বাহির হইয়াছিলাম। ভূষণদাদা বলিলেন, “বলো তো বিনু, ‘এ দম্ভোলি বৃত্রাসুর শিরচ্ছিন্ন যাহে’—দম্ভোলি মানে কী? পারলে না? কে পারে?”
পূর্বেই বলিয়াছি, আমি বয়সের তুলনায় পাকা ছিলাম। তাড়াতাড়ি উত্তর করিলাম, “আমি জানি, বলব…বর্জ।”
“বেশ বেশ, কী নাম তোমার?”
কালই নাম বলিয়াছি; এ দীনজনের নাম তিনি মনে রাখিয়াছেন, এ আশা করাও আমার মতো অর্বাচীন বালকের পক্ষে ধৃষ্টতা। সুতরাং আবার নাম বলিলাম।
“বেশ বাংলা জানো তো! বই-টই পড় নাকি?”
এ সুযোগ ছাড়িলাম না, বলিলাম, “আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনার বই সব পড়েছি।”
বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি, ইতিমধ্যে ভূষণদার আরও দুইখানি উপন্যাস ও একখানি কবিতার বই বাহির হইয়াছিল—বিনুদের বাড়ি সেগুলিও আসিয়াছিল; বিনুর নিকট হইতে আমি সবগুলিই পড়িয়াছিলাম।
ভূষণদাদা বিস্ময়ের সুরে বলিলেন, “বলো কী? সব বই পড়েছ? নাম করো তো?”
“প্রেমের তুফান, বেণুর বিয়ে, কমলকুমারী আর দেওয়ালি।”
“বাঃ বাঃ, এ যে বেশ দেখছি। কী নাম বললে?”
বিনীতভাবে পুনরায় নিজের নাম নিবেদন করিলাম।
“বেশ ছেলে। দ্যাখ তো বিনু, তোর চেয়ে কত বেশি জানে!”
গর্বে আমার বুক ফুলিয়া উঠিল। একজন লেখক আমার প্রশংসা করিয়াছেন। তারপর ভূষণদাদা (বিনুর সুবাদে আমিও তাঁহাকে তখন ‘দাদা’ বলিয়া ডাকিতে আরম্ভ করিয়াছি) নবীন সেন এবং হেমচন্দ্রের কবিতা আবৃত্তি করিয়া শুনাইলেন। সাহিত্য, কবিতা এবং তাঁহার নিজের রচনা সম্বন্ধে অনেক কথা বলিলেন; তার কতক বুঝিলাম কতক বুঝিলাম না—এগারো বছরের ছেলের পক্ষে সব বোঝা সম্ভব ছিল না।
বছরের পর বছর কাটিয়া গেল। আমি হাইস্কুলে ভর্তি হইলাম। একদিন ভূষণদাদা সম্বন্ধে আমি এক বিষম ধাক্কা খাইলাম আমাদের স্কুলের বাংলা মাস্টারের নিকট হইতে। কী উপলক্ষ্যে মনে নাই, মাস্টারমশায় আমাদের ক্লাসের ছেলেদের জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাংলার দেশের আরও দু-একজন বড়ো লেখকের নাম করতে
কে পারে?”
একজন বলিল, ‘নবীনচন্দ্র,’ একজন বলিল, ‘সুরেন ভটচাজ’ (তখনকার কালে মস্ত নাম), একজন বলিল, ‘রজনি সেন’ (তখন সবে উঠিতেছেন)—আমি একটু বেশি জানিবার বাহবা লইবার জন্য বলিলাম—’ভূষণচন্দ্র চক্রবর্তী।‘
মাস্টারমশায় বলিলেন, “কে?”
“ভূষণচন্দ্র চক্রবর্তী। আমি পড়েছি তাঁর সব বই, আমার সঙ্গে আলাপ আছে।”
“সে আবার কে?”
আমি মাস্টারমশায়ের অজ্ঞতা দেখিয়া অবাক হইলাম।
“কেন ভূষণচন্দ্র চক্রবর্তী খুব বড়ো লেখক–প্রেমের তুফান, কমলকুমারী, দেওয়ালি, বেণুর বিয়ে—এইসব বইয়ের—”।
মাস্টারমশায় হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন, ক্লাসের ছেলেদের বেশিরভাগই না-বুঝিয়া সে হাসিতে যোগ দিল। উহাদের সম্মিলিত হাসির শব্দে ক্লাসরুম ফাটিয়া পড়িবার উপক্রম হইল।
আমার কান গরম হইয়া উঠিল, রীতিমতো অপদস্থ বিবেচনা করিলাম নিজেকে। কেন, ভূষণদাদা বড়ো লেখক নন? বা রে!
মাস্টারমশায় বলিলেন, “তোমার গাঁয়ের আত্মীয় বলে আর তোমার সঙ্গে আলাপ আছে বলেই তিনি বড়ো লেখক হবেন তার কী মানে আছে? কে তাঁর নাম জানে? ওরকম বলো না।’
ভূষণদাদার সাহিত্যিক যশ ও খ্যাতি সম্বন্ধে আমি এ পর্যন্ত কেবল একতরফা বর্ণনাই শুনিয়া আসিয়াছি বিনুর মায়ের মুখে, বিনুর বাবার মুখে, ভূষণদাদার নিজের মুখে। তাহাই বিশ্বাস করিয়াছিলাম, সরল বালক মনে। এই প্রথম আমার তাহার উপর সন্দেহের ছায়াপাত হইল।
এতদিন গাঁয়ে থাকিয়া কেবল সুগন্ধি তেলের বিজ্ঞাপনের নভেলই পড়িয়াছি— ক্রমে স্কুল লাইব্রেরি হইতে বঙ্কিমচন্দ্রের ও আরও অন্যান্য বড়ো লেখকের বই লইয়া পড়িতে আরম্ভ করিলাম। বয়স বাড়িবার সঙ্গে সঙ্গে ভালো মন্দ বুঝিবার ক্ষমতাও জন্মিল—ফলে বছর চার-পাঁচ স্কুলে পড়িবার পরে আমার উপরে ভুষণচন্দ্র চক্রবর্তীর প্রভাব যে অত্যন্ত ফিকে হইয়া দাঁড়াইবে, ইহা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার।
আমি যে-বার ম্যাট্রিক পাস করিয়া কলেজে ভর্তি হইয়াছি, সে-বার শ্রাবণ মাসে বিনুর ভগ্নীর বিবাহ উপলক্ষ্যে ভূষণদাদা আবার আমাদের গ্রামে আসিলেন। তখন আমার চোখে তিনি আর ছেলেবেলার সে বড়ো লেখক ভূষণচন্দ্র নন, বিনুর ভূষণদাদা, সুতরাং আমারও ভূষণদাদা। তখন বেশ সমানে সমানে কথাবার্তা। বলিলাম, দাদারও আর সে মুরুব্বিয়ানা চাল নাই, থাকিবার কথাও নয়। তিনিও সমানে সমানেই মিশিলেন।
একখানা বই দেখিলাম, বিবাহ-বাটীর কুটুম্বসাক্ষাৎদের হাতে হাতে ঘুরিতেছে, কবিতার বই, নাম—’প্রতিমা-বিসর্জন’। দ্বিতীয় পক্ষের পত্নীর মৃত্যুতে শোকোচ্ছাস প্রকাশ করিয়া ভূষণদাদা কবিতা লিখিয়া বই ছাপাইয়াছেন বিনামূল্যে বিতরণের জন্য।
বিনুও তো আর বাল্যের সেই বিনু নাই। সে বলিল—”মজার কথা শোন, আগের বউদিদি ষোলো বছর ঘর করে ছেলেপুলের মা হয়ে মরে গেল বেচারি, তার বেলা শোকের কবিতা বেরুল না। দ্বিতীয় পক্ষের বউদি—দু-তিন বছর ঘর করে ডবকা বয়সেই মারা গেল—দাদার তাই শোকটা বড্ড লেগেছে—একেবারে। প্রতিমা—বি স র্জ-ন!”
ভূষণদাদা আমাকেও একখানা বই দিয়াছিলেন, দু-তিন দিন পরে আমায় বলিলেন, “প্রতিমা-বিসর্জন কেমন পড়লে হে?”
অতিসাধারণ ধরনের কবিতা বলিয়া মনে হইলেও বলিলাম, “বেশ চমৎকার!’’ ভূষণদাদা উৎসাহের সহিত বলিলেন, “বাংলা দেশে ‘উদভ্রান্ত-প্রেম’-এর পরে আমার মনে হয়, এ ধরনের বই আর বেরোয়নি। নিজের মুখে নিজের কথা বলছি বলে কিছু মনে কোরো না-তবে তোমাদের ছোটো দেখেছি, তোমাদের কাছে বলতে দোষ নেই।”
ভূষণদাদার দাড়ি চুলে বেশ পাক ধরিয়াছে, তাঁহাকে সমীহ করিয়া চলি, সুতরাং প্রতিবাদ না-করিয়া চুপ করিয়া গেলাম। যদিও ‘উদ্ভান্ত-প্রেম’-এর প্রতি আমার যে খুব শ্রদ্ধা ছিল তাহা নয়, তবুও ভূষণদাদার কথা শুনিয়া সমলোচনা-শক্তির প্রতি বিশ্বাস হারাইলাম।
ভূষণদাদার আর্থিক অবস্থা খুব ভালো নয়, অনেকদিন হইতেই জানি। তিনি ক্যাম্বেল স্কুল হইতে ডাক্তারি পাস করিয়া দিনাজপুরের এক সুদূর পল্লিগ্রামে জমিদারদের দাতব্যচিকিৎসালয়ে চাকুরি করিতেন, স্বাধীন ব্যাবসা কোনোদিন করেন নাই।
এবার শুনিলাম ভূষণদাদার সে চাকুরিটাও যায় যায়। বিনুই এ সংবাদ দিল।
ভূষণদাদা আসার পরদিন জিজ্ঞাসা করিলেন, “ওহে, তোমরা তো কলকাতায় ছাত্রমহলে ঘোরো, পাঁচটা কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে দেখা হয়, ছাত্রমহলে আমার
বই সম্বন্ধে কী মতামত কিছু শুনেছ?” |||||||||| হঠাৎ বড়ো বিব্রত হইয়া পড়িলাম, আমতা আমতা সুরে বলিলাম, “আজ্ঞে হ্যাঁ—তা বেশ ভালোই—’
বলেন কী ভূষণদাদা! বিব্রত ভাবটা কাটিয়া গিয়া এবার আমার হাসি পাইল। কলকাতায় ছাত্রমহলে ভূষণ চক্রবর্তী নামই কেউ জানে না, তার বই পড়া! আর সে সম্বন্ধে মতামত।
ভূষণদাদা উত্তেজিত স্বরে বলিলেন, “কী কী, কীরকম বলে? আমার কোন বইটার কথা শুনেছ? পাষাণপুরী না দেওয়ালি?”
অকূলে কূল পাইলাম। ভূষণদাদার বইয়ের নাম কী আমার একটাও মনে ছিল ছাই! বলিলাম, “হ্যাঁ, ওই পাষাণপুরীর কথাই যেন শুনেছি।”
ভূষণদাদা আর আমায় ছাড়িতে চান না। কী শুনিয়াছি, কোথায় শুনিয়াছি, কাহার কাছে শুনিয়াছি? পাষাণপুরী তাঁর উপন্যাসগুলির মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট। তবুও তো তিনি পাবলিশার পান নাই, সব বই-ই নিজে ছাপাইয়াছেন, দিনাজপুরের অজ পাড়াগাঁয়ে বসিয়া বই বিক্রি ও বিজ্ঞাপনের কোনো সুবিধা করিতে পারেন নাই।
বিনু আমায় আড়ালে বলিল, “এই অবস্থা, পঞ্চাশটি টাকা মাইনে পান ডাক্তারি করে, সংসারই চলে না, তা থেকে খরচ করেন ওইসব বাজে বই ছাপতে। ভূষণদাদার চিরকালটা একরকম গেল। বাতিক যে কতরকমের থাকে!”
ইহার পর আরও ছ-সাত বছর কাটিয়া গেল।
আমি পাস করিয়া বাহির হইয়া নানারকম কাজকর্ম করি এবং সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু লিখিও।
ভুষণদাদার প্রভাব আমার জীবন হইতে সম্পূর্ণ যায় নাই, মনের তলে কোথায়। চাপা ছিল, লেখক হওয়া একটা মস্ত বড়ড়া কিছু বুঝি! সেই যে আমাদের গ্রামে বাল্যকালে সেবার ভূষণদাদাকে সম্মান পাইতে দেখিয়াছিলাম, সেই হইতেই বোধ হয় লেখক হওয়ার সাধ মনে বাসা বাঁধিয়া থাকিবে, কে জানে?
আমার লেখকজীবন যখন পাঁচ-ছ বছরের পুরাতন হইয়া পড়িয়াছে, দু-চারখানা ভালো মাসিক পত্রিকায় লেখা প্রায়শ বাহির হয়, কিছু কিছু আরও হইতেছে, সে সময় কী একটা ছুটিতে দেশে গেলাম। বিনুদের বাড়িতে গিয়া দেখি, ভূষণদাদা অসুস্থ অবস্থায় সেখানে সপরিবারে কিছুদিন হইতে আছেন। আমায় বলিলেন, “পাঁচু, শুনলাম আজকাল লিখছ? কোন কোন কাগজে লেখা বেরিয়েছে?”
কাগজগুলির কয়েকখানি আমার সঙ্গেই ছিল, ইতিমধ্যে গ্রামের অনেকেই সেগুলি দেখিয়াছে। ভুষণদাদাকেও দেখাইলাম—দেখাইয়া বেশ একটু গর্ব অনুভব করিলাম।
ভূষণদাদা কাগজ ক-খানা উলটাইয়া দেখিয়া বলিলেন, “এইসব কাগজে লিখছ? বেশ বেশ। এসব তো বেশ নাম-করা পত্রিকা। একটু ধরাধরি করতে হয়, না? তুমি কাকে ধরেছিলে? একটু ধরাধরি না-করলে আজকাল কিছুই হয় না। গুণের আদর কী আর আছে? এই দেখো না কেন, আমি পাড়াগাঁয়ে থাকি বলে নিজেকে পুশ করতে পারলাম না। আমার ‘নারদ’-কাব্য পড়োনি? দু-বছর ধরে খেটে লিখেছি, প্রাণ দিয়ে লিখেছি। কিন্তু হলে হবে কী, ওই ধরাধরির অভাবে বইখানা নাম করতে পারছে না।”
বৈকালে নদীর ধারে বসিয়া ভূষণদাদার মুখে তাঁহার ‘নারদ’-কাব্যের অনেক ব্যাখ্যা শুনিলাম। অমিত্রাক্ষর ছন্দ হইলেও তাহার মধ্যে নিজস্ব জিনিস কী একটা ঢুকাইয়া দিয়াছেন ভূষণদাদা, অমন দার্শনিকতা আধুনিক কোনো বাংলা গ্রন্থে নাই, এ কথা তিনি জোর করিয়া বলিতে পারেন।
বলিলাম, “বইখানা ছেপেছে কারা?”
“আমিই ছেপেছি। লোকের দোরে দোরে বেড়িয়ে ছাপানোর জন্যে খোশামোদ করা—ওসব আমার দ্বারা হবে না।”
মনে হইল ভূষণদাদা আমারই প্রতি যেন বক্রকটাক্ষ করিতেছেন এইসব উক্তি দ্বারা। যাহা হউক, কিছু না-বলিয়া চুপ করিয়া রহিলাম।
বছরখানেক পরে আমি আমার কর্মস্থলে একটা বুকপোস্ট পাইলাম। খুলিয়া দেখি, ভূষণদাদা সেই ‘নারদ’-কাব্যখানি আমায় পাঠাইয়াছেন, সঙ্গে একখানা বড়ো চিঠি। ‘নারদ’-কাব্যখানির উচ্চ প্রশংসা করিয়া বহুলোক ইতিমধ্যে চিঠি লিখিয়াছেন। চিঠিগুলি তিনি পুস্তিকাকারে ছাপিয়া ওই সঙ্গে আমায় পাঠাইয়াছেন। আমি যেন কলিকাতার কোনো নামকরা কাগজে বইখানির ভালো ও বিস্তৃত সমালোচনা বাহির করিয়া দিই, এই ভূষণদাদার অনুরোধ।
ছাপানো প্রশংসাপত্রগুলি পড়িয়া আমার খুব ভক্তি হইল না। একজন মফসসলের কোন শহরের প্রধান ডাক্তার লিখিয়াছেন, কবি নবীনচন্দ্রের ‘রৈবতক’ কাব্যের পরে আর একখানি উৎকৃষ্ট কাব্য আবার বাংলা সাহিত্যে বাহির হইল বহুকাল পরে। আর একজন কোথাকার প্রধান উকিল লিখিতেছেন, কে বলে বাংলা ভাষার দুর্দিন? বাংলা সাহিতের দুর্দিন? যে দেশে আজও ‘নারদ’-কাব্যের মতো কাব্য রচিত হয়ে থাকে (মনে ভাবিলাম, ভদ্রলোক কী বাংলা কবিতার কিছুই পড়েন নাই?), সে দেশে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
মন দিয়া ‘নারদ’-কাব্য পড়িলাম। নবীনচন্দ্রের ‘বৈবতক’-এর ব্যর্থ অনুকরণ। লম্বা লম্বা বক্তৃতা—মাঝে মাঝে ‘ভূমা’, ‘প্রপঞ্চ,’ ‘ক্ষর’, ‘অক্ষর,’ ‘শাশ্বত’, ‘অব্যয়’ প্রভৃতি শব্দের ভীষণ ভীড়—ইহাকে ‘নারদ’-কাব্য না-বলিয়া গীতা বা শ্রীমদ্ভাগবতের পদ্যে ব্যাখ্যা বলিলেও চলিত।
আমি চিঠির উত্তরে লিখিলাম, ‘নারদ’, বেশ লাগিয়াছে, তবে কলিকাতার কোনো নামকরা মাসিক পত্রিকায় ইহার বিস্তৃত সমালোচনা বাহির করা আমার সাধ্যায়ত্ত নয়। সে চিঠির উত্তরে ভূষণদাদা আমায় আরও দুই-তিনখানি পত্র লিখিলেন—যদি বইখানি আমার ভালো লাগিয়া থাকে, তবে সে-কথা ছাপাইয়া প্রকাশ করিবার সৎসাহস থাকা আবশ্যক ইত্যাদি। সে-সব চিঠির উত্তর দিলাম না।
ইহার বছরখানেক পরে আমি আমার বিদেশের কর্মস্থান হইতে কলিকাতায় আসিয়াছি। শ্রাবণ মাস, তেমনি বর্ষা আরম্ভ হইয়াছে। দিনেরাত্রে বৃষ্টির বিরাম নাই। এ-বেলা একটু ধরিয়াছে বলিয়াই বাহির হইয়াছি। গোলদিঘির কাছাকাছি আসিয়া একখানা হ্যান্ডবিল হাতে পড়িল। হ্যান্ডবিলখানা ফেলিয়া দেওয়ার পূর্বে অন্যমনস্কভাবে সে-খানার উপর একটু চোখ বুলাইয়া লইতে গিয়া দস্তুরমতো বিস্মিত ও উত্তেজিত হইয়া উঠিলাম। উহাতে লেখা আছে—
‘নারদ’-কাব্যের খ্যাতনামা কবি
বঙ্গভারতীর কৃতী সন্তান
শ্রীযুক্ত ভূষণচন্দ্র চক্রবর্তীকে (বড়ো বড়ো অক্ষরে)
সংবর্ধনা করিবার জন্য কলিকাতাবাসীগণের
জনসভা (আধইঞ্চি লম্বা অক্ষরে)
স্থান-ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হল, সময় সন্ধ্যা ৬ টা।
সভাপতিত্ব করিবেন
একজন খ্যাতনামা নামজাদা প্রবীণ সাহিত্যিক।
ব্যাপার কী? চক্ষুকে যেন বিশ্বাস করিতে পারিলাম না—ভূষণদাদাকে সংবর্ধনা করিবার জন্য কলিকাতাবাসীগণ (কী ভয়ানক ব্যাপার!) জনসভা আহ্বান করিয়াছেন ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে অতবড়ো নামজাদা সাহিত্যিকের সভাপতিত্বে! কই ‘নারদ’-কাব্যের এতাদৃশ জনপ্রিয়তা তো পূর্বে মোটেই শুনি নাই? যাহা হউক, হইলে খুব ভালো কথা, কিন্তু কলিকাতাবাসীগণ কী ক্ষেপিয়া গেল হঠাৎ?
হ্যান্ডবিলের তারিখ লক্ষ করিয়া দেখিলাম, সেই দিনই সন্ধ্যাবেলা সভা। সাড়ে ছ-টার বেশি দেরি নাই, যদি লোকের খুব ভিড় হয়, পৌঁনে ছটায় ইনস্টিটিউটে গিয়া ঢুকিলাম। তখনও কেহ আসে নাই—অতবড়ো হল একেবারে খালি। এক পাশে গিয়া বসিলাম। ছ-টা বাজিল, জনপ্রাণীরও দেখা নাই—এই সময় আবার জোরে বৃষ্টি নামিল, সওয়া ছ-টা— কেহই নাই, সাড়ে ছটার দু-এক মিনিট পূর্বে দেখি ভূষণদাদা অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে একতাড়া কাগজ বগলে হলে প্রবেশ করিতেছেন, পিছনে চার পাঁচটি ভদ্রলোক—তাঁহাদের কাহাকেও চিনি না। তখন সভার সাফল্য সম্বন্ধে আমার ঘোর সন্দেহ উপস্থিত হইয়াছে, এ অবস্থায় ভূষণদাদার সহিত দেখা করিলে তিনি অপ্রতিভ হইতে পারেন—সুতরাং হলের বাহিরে গা-ঢাকা দিয়া রহিলাম।
পৌঁনে সাতটা—জনপ্রাণী না, সভাপতিও অনুপস্থিত। সাতটা, তথৈবচ। এমন জনশূন্য জনসভা যদিও-বা কখনো দেখিয়াছি! ভূষণদাদার অবস্থা দেখিয়া বড়ো কষ্ট হইল। তিনি ও তাঁহার সঙ্গের ভদ্রলোক কয়জন কেবল ঘর-বাহির করিতেছেন, নিজেদের মধ্যেই উত্তেজিত ভাবে কী পরামর্শ করিতেছেন—আবার একবার করিয়া ইনস্টিটিউট-এর গেটের কাছে যাইতেছেন। সওয়া সাতটা—কাকস্য পরিবেদনা। সাড়ে সাতটা—পূর্ববৎ অবস্থা। কলিকাতাবাসীগণের জনসভায় কলিকাতাবাসীগণই আসিতে ভুলিয়া গেলেন কেমন করিয়া!
পৌঁনে আটটার সময় ভূষণদাদা সঙ্গীদের লইয়া বাহির হইয়া গেলেন—অল্পক্ষণ পরে আমিও হল পরিত্যাগ করিলাম।
পরদিন বিনুর মেলোমশায় তারিণীবাবুর সঙ্গে দেখা। তিনি আমাকে চেনেন খুব ভালোই বিনুর সঙ্গে কতবার সিমলা স্ট্রিটে তাঁর বাড়িতে গিয়াছি। কুশল প্রশ্নাদির পরে তিনি বলিলেন, “ভূষণ যে এখানে এসেছে হে, আমার বাসাতেই আজ আট দশ দিন আছে। কী একখানা বই নিয়ে খুব ঘোরাঘুরি করছে। ওর মাথা আর মুণ্ডু। এদিকে এই অবস্থা, সতেরো-আঠারো বছরের মেয়ে একটা, পনেরো বছরের
মেয়ে একটা—পার করবে কোথা থেকে তার সংস্থান নেই—আবার কাল দেখি নিজের পয়সায় একগাদা কী মিটিং না ফিটিং-এর হ্যান্ডবিল ছেপে এনেছে। আর বলো কেন, একেবারে মাথা খারাপ!”
বলিলাম, “হ্যাঁ-হ্যাঁ, দেখেছিলুম বটে একখানা হ্যান্ডবিলে—জনসভা না কী—”
— “জনসভা না ওর মুণ্ড! ও নিজেই তো পরশু দুপুরে বসে বসে ওখানা লিখলে! আমার বাড়িতে দুজন বেকার ভাইপো আছে, তাদের নিয়ে কোথায় সব ঘুরছে ক দিন দেখতে পাই—সাড়ে সতেরো টাকা প্রেসের বিল কাল দিলে দেখলাম আমার সামনে—এদিকে শুনি, বাড়িতে নিতান্ত দুরবস্থা…অতবড়ো সব আইবুড়ো মেয়ে গলায়, এক পয়সার সংস্থান নেই—তার বিয়ে!”
মাঘ মাসের শেষে আমি কার্যোপলক্ষ্যে জলপাইগুড়ি যাইতেছি, পার্বতীপুর স্টেশনে দেখি, ভূষণদাদা একটি ব্যাগ হাতে প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করিতেছেন। আমি গিয়া প্রণাম করিতেই বলিলেন, “আরে পাঁচু যে! ভালো তো? সেই পশ্চিমেই আজকাল চাকুরি করো তো? কোথায় যাচ্ছ এদিকে?”
“আজ্ঞে একটু জলপাইগুড়িতে। আপনি কোথায়?”
“আমি একটু যাচ্ছি কলকাতায়। হ্যাঁ, তোমাকে বলি—শোনোনি বোধ হয়, আমার ‘নারদ’-কাব্যের খুব আদর হয়েছে। এর মধ্যে কলকাতায় ইনস্টিটিউট হলে প্রকাণ্ড সভা হয়ে গেল তাই নিয়ে। অমুকবাবু সভাপতি ছিলেন। খুব উৎসাহ দেখলাম লোকজনের মধ্যে, খুব ভিড়—দেখবে? এই দেখো।” বলিয়াই ভূষণদাদা ব্যাগ খুলিয়া জনসভায় ছাপানো হ্যান্ডবিল একখানা আমার হাতে দিয়া বলিলেন, “পড়ে দেখো।”
জলসত্র
বৃদ্ধ মাধব শিরোমণিমশায় শিষ্যবাড়ি যাচ্ছিলেন।
বেলা তখন একটার কম নয়। সূর্য মাথার উপর থেকে একটু হেলে গিয়েছে। জ্যৈষ্ঠমাসের খররৌদ্রে বালি গরম, বাতাস একেবারে আগুন, মাঠের চারিধারে কোনোদিকে কোনো সবুজ গাছপালার চিহ্ন চোখে পড়ে না। এক-আধটা বাবলা গাছ যা আছে তাও পত্রহীন। মাঠের ঘাস রোদপোড়া—কটা। ব্রাহ্মণের কাপড়চোপড় গরম হাওয়ায় আগুন হয়ে উঠল, আর গায়ে রাখা যায় না। এক একটা আগুনের ঝলকের মতো দমকা হাওয়ায় গরম বালি উড়ে এসে তাঁর চোখে মুখে তীক্ষ হয়ে বিঁধছিল। জ্যৈষ্ঠমাসের দুপুরবেলা এ-মাঠ পার হতে যাওয়া যে ইচ্ছে করে প্রাণ দিতে যাওয়ার শামিল, এ কথা নবাবগঞ্জের বাজারে তাঁকে অনেকে বলেছিল, তবুও যে তিনি কারুর কথা না-শুনে জোর করেই বেরুলেন, সে কেবল বোধহয় কপালে দুঃখ ছিল বলেই।
পশ্চিম দিকে অনেক দূরে একটা উলুখড়ের খেত গরম বাতাসে মাথা দোলাচ্ছিল। যে–দিকে চোখ যায়, সেদিকেই কেবল চকচকে খরবালির সমুদ্র। ব্রাহ্মণের ভয়ানক তৃষ্ণা পেল, গরম বাতাসে শরীরের সব জল যেন শুকিয়ে গেল, জিব জড়িয়ে আসতে লাগল। তৃষ্ণা এত বেশি হল যে, সামনে ডোবার পাতা-পচা কালো জল পেলেও তা তিনি আগ্রহের সঙ্গে পান করেন। কিন্তু নবাবগঞ্জ থেকে রতনপুর পর্যন্ত সাড়ে চার ক্রোশ বিস্তৃত এই প্রকাণ্ড মাঠটার মধ্যে যে কোথাও জল পাওয়া যায় না, তা তো তাঁকে কেউ কেউ বাজারেই বলেছিল। এ কষ্ট তাঁকে ভোগ করতেই হবে।
ব্রাহ্মণ কিন্তু ক্রমেই ঘেমে-নেয়ে উঠতে লাগলেন। তাঁর কান দিয়ে, নাক দিয়ে নিঃশ্বাসে যেন আগুনের ঝলক বেরুতে লাগল। জিব জোর করে চুষলেও তা থেকে আর রস পাওয়া যায় না, ধুলোর মতো শুকনো। চারিদিকে ধু-ধু মাঠ খররৌদ্রে যেন নাচছে…চকচকে বালিরাশি রোদ ফিরিয়ে দিচ্ছে…মাঝে মাঝে ছোটো ছোটো ঘূর্ণি হাওয়া গরম বালি-ধুলো-কুটো উড়িয়ে নাকে-মুখে নিয়ে এনে ফেলছে।…অসহ্য পিপাসায় তিনি চোখে ধোঁয়া-ধোঁয়া দেখতে লাগলেন। মনে হতে লাগল—একটু ঘন সবুজ মতো যদি কোনো পাতাও পাই তাহলে চুষি…জীবনে তিনি যত ঠান্ডা জল খেয়েছিলেন তা এইবার তাঁর একে একে মনে আসতে লাগল। তাঁর বাড়ির পুকুরের জল কত ঠান্ডা…পাহাড়পুরের কাছারির ইদারার জল সে তো একেবারে বরফ…কবে তিনি শিষ্যবাড়ি গিয়েছিলেন, বৈশাখ মাসের দিন তারা তাঁকে বড়ো সাদা কাঁসার ঘটি করে নতুন কলসীর জল খেতে দিয়েছিল, সে জল একেবারে হিম, খাবার সময় দাঁত কনকন করে। আচ্ছা, এখন যদি সেই রকম এক ঘটি জল কেউ তাঁকে দেয়?…তাঁর তৃষ্ণাটা হঠাৎ বেড়ে গিয়ে বুকের কলজে পর্যন্ত যেন শুকিয়ে উঠল। এ মাঠটাকে এ অঞ্চলে বলে কচু-চুষির মাঠ। তাঁর মনে পড়ল তিনি শুনেছিলেন, এ জেলার মধ্যে এত বড়ো মাঠ আর নেই; আগে আগে অনেকে নাকি বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসের দুপুরে এ-মাঠ পার হতে গিয়ে সত্যি প্রাণ হারিয়েছে, গরম বালির ওপর তাদের নির্জীব দেহ লুটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। অসহ্য জল-তৃষ্ণায় তারা আর চলতে অক্ষম হয়ে গরম বালির ওপর ছটফট করে প্রাণ হারিয়েছে।…সত্যিই তো!…এখনও তো দু-ক্রোশ দূরে গ্রাম…যদি তিনিও?…
শুধু মনের জোরে তিনি পথ চলতে লাগলেন। এই পথ-হাঁটার শেষে কোথায় যেন এক ঘটি ঠান্ডা কনকনে হিমজল তাঁর জন্যে কে রেখে দিয়েছে, পথ-হাঁটার বাজি জিতলে সেই জলঘটিটাই যেন তাঁর পুরস্কার, এই ভেবেই তিনি কলের পুতুলের মতো চলছিলেন। আধক্রোশটাক পথ চলে উলুখড়ের বনটা ডাইনে ফেলেই দেখলেন, বোধহয় আর আধক্রোশ পথ দূরে একটা বড়ো বটগাছ। গাছটার তলায় কোনো পুকুর হয়তো থাকতে পারে, না-থাকে, ছায়াও তো আছে?
বটতলায় পৌঁছে দেখলেন একটা জলসত্র। চার-পাঁচটা নতুন জালায় জল, একপাশে একরাশি কচি ডাব! এক ধামা ভিজে ছোলা, একটা বড়ো জায়গায় অনেকটা নতুন আখের গুড়, একটা ছোটো ধামায় আধ ধামা বাতাসা! বাঁশের চেরা একটা খোল কাতার দড়ি দিয়ে আর একটা বাঁশের খুঁটির গায়ে বাঁধা। একজন জালা থেকে জল উঠিয়ে চেরা বাঁশের খোলে ঢেলে দিচ্ছে। আর লোকে বাঁশের খোলের এ-মুখে অঞ্জলি পেতে জল পান করছে।
গাছতলায় যারা বসেছিল, ব্রাহ্মণ দেখে শিরোমণি মহাশয়কে তারা খুব খাতির করলে। একজন জিজ্ঞাসা করলে—ঠাকুরমশায়ের আগমন হচ্ছে কোথা থেকে?
একজন বলল—আহা, সে-কথা রাখো, বাবা-ঠাকুর আগে ঠান্ডা হোন। শিরোমণিমশায় যেখানে বসলেন, সেখানে প্রকাণ্ড বটগাছটা প্রায় দু-তিন বিঘা জমি জুড়ে আছে। হাতির শুড়ের মতো লম্বা ঝুরি চারিদিকে নেমেছে!…একজন তাঁকে তামাক সেজে দিয়ে একটা বটপাতা ভেঙে নিয়ে এল নল করবার জন্যে।…আ:, কী ঝিরঝিরে হাওয়া। এই অসহ্য পিপাসা ও গরমের পর এমন ঠান্ডা ঝিরঝিরে বাতাস ও তৈরি-তামাকে তাঁর তৃষ্ণাও যেন অনেকটা কমে গেল।
তামাক খাওয়া শেষ হল। একজন বললে—ঠাকুরমশায়, হাত-পা ধুয়ে ঠান্ডা হোন। ভালো সন্দেশ আছে ব্রাহ্মণদের জন্যে আনা, সেবা করে একটু জল খান, এই রোদে এখন আর যাবেন না—বেলা পড়ুক।
তারপর শিরোমণিমশায় জিজ্ঞাসা করলেন—এ জলসত্র কাদের?
—আজ্ঞে ওই আমডোবের বিশ্বেসদের। শ্ৰীমন্ত বিশ্বেস আর নিতাই বিশ্বেস নাম শুনেছেন? শিরোমণিমশায় বললেন—বিশ্বেস? সদগোপ?
–আজ্ঞে না, কলু।
সর্বনাশ! নতুন মাটির জালা ভর্তি জল ও কচি ডাবের রাশি দেখে পিপাসার্ত শিরোমণিমশায় যে আনন্দ অনুভব করেছিলেন, তা তাঁর এক মুহূর্তে কপূরের মতো উবে গেল। কলুর দেওয়া জলসত্রে তিনি কী করে জল খাবেন? তিনি নিজে এবং তাঁর বংশ চিরদিন অশূদ্রে প্রতিগ্রাহী; আজ কি তিনি—ওঃ! ভাগ্যে কথাটা জিজ্ঞাসা করেছিলেন।নইলে, এখনি তো…
শিরোমণিমশায় জিজ্ঞাসা করলেন—এ জলসত্র কতদিনের দেওয়া?
—তা আজ প্রায় পনেরো-ষোলো বছর হবে। শ্ৰীমন্ত বিশ্বেসের বাপ তারাচাঁদ বিশ্বেস এই জলসত্র বসিয়ে যায়। সে হয়েছিল কী বলি শুনুন। বলে লোকটা সেই কাহিনি বলতে আরম্ভ করলে।
আমডোবের তারাচাঁদ বিশ্বেস যখন ছোটো, চোদ্দো-পনেরো বছর বয়স, তখন তার বাপ মারা যায়। সংসারে কেবল ন-দশ বছরের একটি বোন ছাড়া তারাচাঁদের আর কেউ ছিল না। ভাই-বোনে মাথায় করে কলা-বেগুন-কুমড়ো এইসব হাটে বিক্রি করত; এতেই তাদের সংসার চলত। সেবার বোশেখ মাসের মাঝামাঝি তারাচাঁদ ছোটো বোনটিকে নিয়ে নাবাবগঞ্জের হাটে তালশাঁস বিক্রি করতে গিয়েছিল। ফেরবার সময় তারাচাঁদ মাঠের আর কিছু ঠিক পায় না—নবাবগঞ্জ থেকে রতনপুর পর্যন্ত এই মাঠটা সাড়ে চার ক্রোশের বেশি হবে তো কম নয়। কোথাও একটা গাছ পর্যন্ত নেই। বোশেখ মাসের দুপুর রোদে মাঠ বেয়ে আসতে তারাচাঁদের ছোটো বোনটা অবসন্ন হয়ে পড়ল। তারাচাঁদের নিজের মুখে শুনেছি ছোটো বোনটি মাঠের মাঝামাঝি এসে বললে—দাদা, আমার বড়ো তেষ্টা পেয়েছে, জল খাব।
তারাচাঁদ তাকে বোঝালে, বললে—একটু এগিয়ে চল, রতনপুরের কৈবর্ত পাড়ায় জল খাওয়াব।
সেই ‘একটু এগিয়ে’ মানে দু-ক্রোশের কম নয়। আর খানিকটা এসে মেয়েটা তেষ্টায় রোদে অবসন্ন হয়ে পড়ল। বারবার বলতে লাগল—ও দাদা, তোর দুটি পায়ে পড়ি, দে আমায় একটু জল…
তারাচাঁদ তাকে কোলে তুলে নিয়ে এই বটগাছটার ছায়ায় নিয়ে এসে ফেললে। ছোটো মেয়েটা তখন আর কথা বলতে পারছে না। তারাচাঁদ তার অবস্থা দেখে তাকে নামিয়ে রেখে ছুটে জলের সন্ধানে গেল। এখান থেকে আধক্রোশ তফাতে রতনপুরের কৈবর্তপাড়া থেকে এক ঘটি জল চেয়ে এনে দেখে, তার ছোটো বোনটা গাছতলায় মরে পড়ে আছে, তার মুখে একটা কচুর ডগা! এই বটগাছটা তখন ছোটো ছিল, ওরই তলায় অনেক কচুবন ছিল। তেষ্টার যন্ত্রণায় মেয়েটা সেই বুনো কচুর ডগা মুখে করে তার রস চুষেছিল—সেই থেকে এই মাঠটার নাম হোল কচু-চুষির মাঠ।
তারাচাঁদ বিশ্বেস ব্যাবসা করে বড়োলোক হয়েছিল। শুনেছি নাকি তার সে বোন তাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলত—দাদা, ওই মাঠের মধ্যে সকলের জল খাবার জন্য তুই একটা জলসত্র করে দে।…তাই তারাচাঁদ বিশ্বেস এখানে এই বটগাছ পিতিষ্ঠে করে জলসত্র বসিয়ে গেছে—সে আজ পনেরো-ষোলো কী বিশ বছরের কথা হবে। ঠাকুরমশায়, কচু-চুষির মাঠের এ-জলসত্র এদিকের সকলেই জানে। বলব কি বাবা ঠাকুর, এমনও শুনেছি যে মাঠের মধ্যে জলতেষ্টায় বেঘোরে পড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে, এমন লোক নাকি কেউ কেউ দেখেছে একটা ছোটো মেয়ে মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে বলছে—ওগো আমি জল দেব, তুমি আমার সঙ্গে এসো।…
লোকটা তার কাহিনি শেষ করলে; তারপর বললে—সত্যি-মিথ্যে জানিনে ঠাকুরমশায়, লোকে বলে তাই শুনি, বোশেখ মাসের দিন ব্রাহ্মণের কাছে মিথ্যে বলে কী শেষকালে…
লোকটা দুই হাতে নিজের কান মলে কপালে দু-হাত ঠেকিয়ে এক প্রণাম করলে।
বেলা পড়ে এল। কত লোক জলসত্রে আসতে-যেতে লাগল। একজন চাষা পাশের মাঠ থেকে লাঙল ছেড়ে বটতলায় উঠল। ঘেমে সে নেয়ে উঠেছে। একটু বিশ্রাম করে সে তৃপ্তির সঙ্গে ছোলা, গুড় আর জল খেয়ে বসে গল্প করতে লাগল।
এক বুড়ি অন্য গ্রাম থেকে ভিক্ষা করে ফিরছিল। গাছতলায় এসে সে ঝুলি নামিয়ে একটু জল চেয়ে নিয়ে হাত-পা ধুলে। একজন বললে—আবদুলের মা, একটা ডাব খাবা?
আবদুলের মা একগাল হেসে বললে—তা দ্যাও দিকি মোরে, আজ অ্যাকটা খাই। মরব তো, খেয়েই মরি।
একজন লোক পরনে টাটকা কোরা কাপড়ের ওপর নতুন পাটভাঙা ধপধপে সাদা টুইলের শাট, হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তোলা পায়ে এক-পা ধুলো, বটতলায় এসে হাতাশভাবে ধপ করে বসে পড়ল। কেউ জিজ্ঞাসা করলে—ছমিরুদ্দি মিঞা যে, আজ ছানির দিন ছিল না?
ছমিরুদ্দি সম্পূর্ণ ভদ্রতাসংগত নয় এরূপ একটি বাক্য উচ্চরণ করে ভূমিকা ফেঁদে তার মোকদ্দমার একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণনা করে গেল এবং যে উকিলের হাতে তার কেস ছিল, তার সম্বন্ধে এমন কতকগুলো মন্তব্য প্রকাশ করলে যে, তিনি সেখানে উপস্থিত থাকলে ছমিরুদ্দির বিরুদ্ধে আর একটা কেস হত। তারপর সে পোয়াটাক আখের গুড়ের সাহায্যে আধসের আন্দাজ ভিজে ছোলা উদরসাৎ করে একছিলিম তামাক খেয়ে বিদায় নিলে।
ক্রমে রোদ পড়ে গেল। বৈকালের বাতাসে কাছেরই একটা ঝোপ থেকে ডাঁশা খেজুরের গন্ধ ভেসে আসছিল। হলুদ রং-এর সোঁদালি ফুলের ঝাড় মাঠের পেছনটা আলো করে ছিল। একটা পাখি আকাশ বেয়ে ডানা মেলে চলেছিল—বউ কথা-ক–বউ কথা-ক।
শিরোমণি মশায়ের বসে বসে মনে হল, বিশ বছর আগে, তাঁর আট বছরের পাগলি মেয়ে উমার মতোই ছোটো একটি মেয়ে এই বটতলায় অসহ্য পিপাসায় জল অভাবে বুনো কচুর ডাঁটার কচু রস চুষেছিল, আজ তারই স্নেহ করুণা এই বিরাট বটগাছটার নিবিড় ডালপালায় বেড়ে উঠে এই জলকষ্টপীড়িত পল্লি-প্রান্তরের একধারে পিপাসার্ত পথিকদের আশ্রয় তৈরি করেছে।… এরই তলায় আজ বিশ বছর ধরে সে মঙ্গলরূপিণী জগদ্ধাত্রীর মতো দশহাত বাড়িয়ে প্রতি নিদাঘ-মধ্যাহ্নে কত পিপাসাতুর পল্লি-পথিককে জল জোগাচ্ছে!…চারিধারে যখন সন্ধ্যা নামে…তপ্ত মাঠ যখন ছায়া-শীতল হয়ে আসে…তখনই কেবল সমস্ত দিনের পরিশ্রমের পর সে-মেয়েটি অস্ফুট জ্যোৎস্নায় শুভ্র-আঁচল উড়িয়ে কোন অজ্ঞাত ঊর্ধ্বলোকে তার নিজের স্থানটিতে ফিরে চলে যায়।…তার পৃথিবীর বালিকা-জীবনের ইতিহাস সে ভোলেনি।…
যে-লোকটা জল দিচ্ছিল, তার নাম চিনিবাস, জাতে সদগোপ। শিরোমণিমশায় তাকে বললেন—ওহে বাপু, তোমার ওই বড়ো ঘটিটা বেশ করে মেজে একঘটি জল আমায় দাও, আর ইয়ে—ব্রাহ্মণের জন্য আনা সন্দেশ আছে বললে না?
ঝগড়া
সন্ধ্যার সময় কেশব গাঙ্গুলীর ভীষণ ঝগড়া হয়ে গেল দুই কন্যা ও স্ত্রীর সঙ্গে। কন্যা দুটিও মায়ের দিকে চিরকাল। এদের কাছ থেকে কখনো শ্রদ্ধা ভালোবাসা পাননি কেশব।
শুধু এনে দাও বাজার থেকে, এই আক্রা চাল মাথায় করে আনো দেড়কোশ দূরের বাজার থেকে। তেল আনো, নুন আনো, কাঠ আনো—এই শুধু ওদের মুখের বুলি। কখনো একটা ভালো কথা শুনেছেন ওদের মুখ থেকে?
ব্যাপারটা সেদিন দাঁড়াল এইরকম।
সন্ধ্যার আগে কেশব গাঙ্গুলী হাট করে আনলেন। তাঁর বয়েস বাহাত্তর বছর, চলতে আজকাল যেন পা কাঁপে—আগের মতো শক্তি নেই আর শরীরে। আড়াই টাকা করে চালের কাঠা। দু-কাঠা চাল কিনে, আর তা ছাড়া তরিতরকারি কিনে ভীষণ কর্দমময় পিছল পথে কোনোরকমে পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়ে কেশব গাঙ্গুলী তো হাটের বোঝা বাড়ি নিয়ে এলেন।
স্ত্রী মুক্তকেশী বললে—দেখি কীরকম বাজার করলে? পটলগুলো এত ছোছাটো কেন? কত করে সের?
—দশ আনা।
—ও বাড়ির পন্টু এনেচে ন-আনা সের। তুমি বেশি দর দিয়ে নিয়ে এলে, তাও ছোটো পটল। ও কখনো দশ আনা সের না।
—বাঃ, আমি মিথ্যে বলছি?
—তুমি বড্ড সত্যবাদী যুধিষ্ঠির—তা আমার ভালো জানা আছে। আচ্ছা রও, ও পটল আমি ওজন করে দেখব।
—কেন আমার কথা বিশ্বাস হল না?
—না, তোমার কথা আমার বিশ্বাস তো হয়ই না—সত্যি কথা বলব তার আবার ঢাক-ঢাক গুড়গুড় কী?
এই হল সূত্রপাত। তারপর কেশব গাঙ্গুলী হাত-পা ধুয়ে রোজকার মতো বললেন—ও ময়না, চালভাজা নিয়ে আয়—
ময়না কথা বলে না, চালভাজার বাটিও আনে না। তাতে বুঝি কেশব বলেছিলেন—কৈ, কানে কী তুলো দিয়ে বসে আছ নাকি, ও ময়না?
ছোটো মেয়ে ময়না নীরস সুরে বললে—চাল ভাজিনি।
-কেন?
–রোজ রোজ চালভাজা খাওয়ার চাল জুটছে কোথা থেকে? তা ছাড়া আমার শরীরও ভালো ছিল না।
—কেন, তোর দিদি?
—দিদি সেলাই করছিল।
এটা খুবই স্বাভাবিক যে বাহাত্তর-তিয়াত্তর বছরের বৃদ্ধ কেশব গাঙ্গুলী দশ সের ভারী মোট বয়ে এনে মেয়েদের এ উদাসীনতায় বিরক্ত হবেন, বা প্রতিবাদে দু-কথা শোনাবেন। কিন্তু তার ফল দাঁড়াল খুবই খারাপ।
পাঁচজনের সামনে বলবার কথা নয়, বলতেও সংকোচ হয়। ছোটো মেয়ে ময়না তাঁকে একটা ভাঙা ছাতির বাঁট তুলে মারতে এল। মেজো মেয়ে লীলা বললে— তুমি মরো না কেন? মলে তো সংসারের আপদ চোকে—
স্ত্রী মুক্তকেশী বললে—অমন আপদ থাকলেও যা, না-থাকলেও তা কেশব গাঙ্গুলী রেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে বললেন, আমি তোদের ভাত আর খাব না—চললাম।
মুক্তকেশী ও ছোটো মেয়ে ময়না একসঙ্গে বলে উঠল—যাও না—যাও।
ময়না বললে—আর বাড়ি ঢুকো না। মনে থাকে যেন।
শুনে বিশ্বাস হবে না জানি, কিন্তু একেবারে নির্জলা সত্যি। আপন মেয়ে বুড়ো বাবাকে ছাতি তুলে মারতে যায়!
কেশব গাঙ্গুলী রাত্রে বাইরের ভাঙা চণ্ডীমণ্ডপে শুয়ে রইলেন। কেউ এসে খেতে ডাকলে না—মাও না, মেয়েরাও না। সত্যিই কেউ ডাকতে আসবে না, এটা কেশব বুঝতে পারেননি, ধারণা করতে পারেননি। তাই ঘটে গেল অবশেষে। না খেয়ে সমস্ত রাত কাটল কেশব গাঙ্গুলীর—নিজের পৈতৃক ভিটেতে, স্ত্রী ও দুই কন্যা বর্তমানে। উঃ, এ কথা ভাবতে পারা যায়?
কেশব গাঙ্গুলী সত্যি কখনো ভাবেননি যে, এতটা তিনি হেনস্থার পাত্র তাঁর সংসারে। মেয়েরা বা স্ত্রী তাঁকে কেউ ভালোবাসে না, এ তিনি অনেকদিন থেকেই জানেন। কিন্তু তার বহর যে এতটা, তা তিনি ধারণা করবেন কীভাবে?
ক্ষুধায় ও মশার কামড়ের যন্ত্রণায় সারারাত কেটে গেল ছটফট করে। সকালে উঠে আগে কেশব নদী থেকে স্নান করে এসে সন্ধ্যাহ্নিক ও জপ করে নিয়ে প্রতিবেশী যদুনন্দন মজুমদারের বাড়ি চা খেতে গেলেন।
যদুনন্দন বললেন—কী কাকা, আজ এত সকালে কী মনে করে?
এ কথার উত্তরে কেশব গাঙ্গুলী বললেন কাল রাত্রের কথা। পরিবার ও মেয়ে দুটির দুর্ব্যবহারের কাহিনি। যদুনন্দনের কাছে এ কথা নতুন নয়, পাড়ার মেয়েদের কানাকানির মধ্যে দিয়ে কেশব গাঙ্গুলীর দুরবস্থার কথা অনেকদিন শুনেছেন তিনি।
তবুও বিস্ময়ের ভান করে বললেন—সে কী কাকা, বলেন কী? কাল রাত্রে খাননি? এ বড় অন্যায় কাকিমার। ছিঃ ছিঃ—এ বেলা আপনি আমার বাড়ি খাবেন। বসুন।
কেশব গাঙ্গুলী আর বাড়ি এলেন না। সেখানেই দুপুর পর্যন্ত থেকে আহারের পর যখন বাড়ি এলেন, তখন এক ভীষণ কাণ্ড বেধে গেল। মুক্তকেশী বললে— আবার বাড়িতে কেন? যাও দূর হও, যে বাড়িতে গিয়ে নিন্দে রটনা করে এক পাথর ভাত মেরে এলে, সেখানেই যাও না, কতদিন খেতে দ্যায় দেখি একবার।
মেয়েরাও বললে—বেশ তো, পরের বাড়ি টোকলা সেধে কদ্দিন চলে, দেখি না? এখানে আবার কেন? যাও না—
—কাকে কি বলেছি আমি?
—আহা! ন্যাকা! আমরা আর জানিনে! এই তো যদুদার মেয়ে ঘাটে আজ ব্যাখ্যান করেছে সবার কাছে। ওই বুড়ো মানুষ ওঁকে খেতে দ্যায়নি, দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে, মেরেছে—সে কত কথা! আমরা শুনিনি কিছু?
—তা তো মিথ্যে কিছু বলিনি।
—মেরেছিলাম তোমাকে আমরা? খেতে দিইনি আমরা? তুমিই না তেজ করে চণ্ডীমণ্ডপে গিয়ে শুয়ে রইলে! আবার লাগানি-ভাঙানি পাড়ায় পাড়ায়। বেশ লাগাও, লাগিয়ে করবে কী? যাও না, যেখানে খুশি—আমরা তো বলেছি, বেরোও না–
ছোটো মেয়ে বললে—মরে যাও না, মলেই তো বাঁচি—
কেশব গাঙ্গুলী ঘরের মধ্যে ঢুকে কাপড়জামা পরে এবং একটা থলের মধ্যে কাপড়-গামছা পুরে নিয়ে তেড়েফুঁড়ে বাড়ি থেকে বেরুলেন!
বলে গেলেন—বেশ তাই যাচ্ছি—আর তোদের বাড়ি আসব না—চললাম।
মুক্তকেশী চেঁচিয়ে বললে–তেজ করে যেমন বেরুনো হল তেমনি আর ঢুকো বাড়িতে কালামুখ নিয়ে—দেখব তেজ—কে জ্বর হলে দেখে, তা দেখব।
কেশব গাঙ্গুলী হনহন করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন। হোক জ্বর। নৈহাটী থেকে এখানে এসে পর্যন্ত ম্যালেরিয়ায় ভুগছেন। দুর্বল করে ফেলে দিয়েছে বড়ো। তা হোক। যা হয় হবে।
কেশব গাঙ্গুলী রেলে চাকুরি করতেন। চাকুরি থেকে অবসর নিয়ে নৈহাটিতে বাড়ি করেছিলেন, কিন্তু বারো-চোদ্দো বছর বসে খেয়ে প্রভিডেন্ট ফন্ডের সামান্য টাকা যা বাড়ি তৈরির পর অবশিষ্ট ছিল, ক্রমে ক্রমে ফুরিয়ে যেতে লাগল— এখনো ছোটো মেয়ের বিয়ে বাকি। টাকা ফুরিয়ে গেলে কী খাবেন?
অগত্যা নৈহাটির বাড়ি বিক্রি করে পৈতৃক গ্রামে এসে এই দু-বছর বাস করছেন। শরিকদের সঙ্গে ঝগড়া করে দু-ঝাড় বাঁশ ও বিঘে-দুই ধানের জমির ভাগ পেয়ে যা-হোক একরকম চালিয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু মেয়ে দুটি আর পরিবারের জন্যে সত্যি তাঁর সংসারে বিতৃষ্ণা হয়ে গিয়েছে। মেজে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু স্বামীর চরিত্র ভালো নয়, সে মেয়ে তাঁর কাছেই আছে বিয়ের দু-বছর পর থেকেই। সব দিক থেকেই তাঁর গোলমাল।
ভেবেছিলেন ছোটো মেয়েটার বিয়ে দিয়ে একরকম নিঝঞ্জাট হবেন, কিন্তু আর সংসারে তাঁর দরকার নেই। যাদের জন্য চুরি করেন, তারাই বলে চোর। সে সংসার আর ধরতে আছে?
কেশব গাঙ্গুলী রেলের বোতাম বসানো সাদা কোট একটা নিয়ে বেরিয়েছেন, রেলের ভাড়া লাগবে না। রেলের বোতামওয়ালা কোট দেখলে ছেলেছোকরা টিকিট-চেকাররা একবার চেয়ে দেখে চলে যায়, কিছু জিগ্যেস করে না।
একটি পয়সা তাঁর নিজের হাতে নেই। হাজার চারেক টাকা আছে স্ত্রীর নামে আর হাজার তিনেক আছে অবিবাহিত ছোটো মেয়ের নামে। যদি তিনি মারা যান মেয়ের বিয়ে দেওয়ার আগেই, কারণ বয়স তাঁর যথেষ্ট হয়েছে, তাই বন্ধুবান্ধবদের পরামর্শে নৈহাটিতে থাকতে বাড়ি বিক্রির টাকা থেকে ছোটো মেয়ের নামে টাকাটা রেখেছিলেন। আজ চাইলে কেউ একটা পয়সা তাঁকে দেবে? না-স্ত্রী, না-মেয়ে।
তাই হাটের পয়সা থেকে দু-চার আনা এদিক-ওদিক করতেন কেশব গাঙ্গুলী।–করলে চলে না। তাঁর নিজের একটু নস্যি, একটু তামাক, হয়তো বা ইচ্ছে হল দু-পেয়ালা চা কিনে খেলেন—এ পয়সা আসে কোথা থেকে।
মুক্তকেশী এ সন্দেহ করেছিল আগে থেকেই। তাই স্বামী হাট থেকে ফিরলে জিনিসপত্রের ওজন, দরদস্তুর সম্বন্ধে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিগ্যেস করে, দাঁড়ি ধরে আলু, পটল, চাল, ডাল ওজন করে নেয়। পাড়ার ছেলেদের জিগ্যেস করে—হ্যাঁরে, আজ হাটে পটল কত করে সের?
—ও নিতাই, আজ হাটে মাছ কত করে সের?
তবুও কেশব গাঙ্গুলীকে সামলানো অত সহজ নয়। চল্লিশ বছর তিনি রেলে কাজ করে এসেছেন। মুক্তকেশী যতই কৌশল করুক, যতই সতর্ক হোক, কেশব গাঙ্গুলীর ফাঁক ধরতে পারা অত সহজ কাজ বুঝি?
পটলের মধ্যে বাসি তাজা নেই?
দেখলে হয়তো ঠিক ধরা যায় না, কিন্তু দর বিভিন্ন। মাছের মধ্যেও দরের তারতম্য নেই? কত ধরবে মুক্তকেশী? না-করলেই বা কেশব গাঙ্গুলীর বাজে খরচ চলে কোথা থেকে? চাইলে স্ত্রীর হাত থেকে পয়সা বার করা শক্ত। ওই নিয়েই তো যত ঝগড়া।
কেশব গাঙ্গুলী বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্টেশনে এসে পৌঁছালেন বেলা তিনটের সময়। কাল হাট থেকে ফিরবার সময় ছ-আনা পয়সার হেরফের করেছিলেন, সেই পয়সা পকেটে খুচরো আছে—আর আছে গুপ্তস্থান থেকে সন্তর্পণে বার করা তিন টাকা সাত আনা। এই তিন টাকা তেরো আনা ছাড়া জগতে তাঁর বলতে আর কোথাও কিছু নেই। হ্যাঁ, অবিশ্যি পকেট ঘড়িটা আছে। সেটাও রেলের জামার বুকপকেটে এনেছেন। বিক্রি করলে ত্রিশ-চল্লিশ টাকা হবে! সেকালের কুরুভাইজার ফ্রেরিসের ঘড়ি। এখনকার মতো ফঙ্গবেনে জিনিস নয়।
স্টেশনের কাছে একটা জামগাছের তলায় পাকিস্তানের উদবাস্তুদের পানবিড়ির দোকান। পান কিনলেন দু-পয়সার। বিড়িও দু-পয়সার। দেশলাই একটা কত? চার পয়সা? দাও একটা।
পান খেয়ে বিড়ির ধোঁয়া টেনে কেশব গাঙ্গুলীর শরীরের কষ্ট খানিকটা দূর হল। এতক্ষণ চিন্তা করবার মতো অবস্থা তাঁর ছিল না।
তিনি আপাতত যাবেন কোথায়?
সেটা কিছু ঠিক করেননি, না-করেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন অবিশ্যি। এখনো ট্রেনের ঘণ্টাখানেক বিলম্ব আছে। যাবেন কোথায়? যেখানে যান, যেতে তো হবে? তিন টাকা তেরো আনায় স্বাধীনভাবে খাওয়া কতদিন চলবে?
মেয়ের বাড়ি যাবেন? জামাই কাজ করে টিটাগড়ের কাগজের কলে। টিটাগড়েই বাসা। সেখানে যেতে লজ্জা করে। এই গত জ্যৈষ্ঠ মাসে সেখানে গিয়ে দু-দিন ছিলেন। অবিশ্যি জামাইষষ্ঠীর তত্বস্বরূপ নিয়ে গিয়েছিলেন কিছু আম ও দুটো কাঁঠাল। বার বার জামাইবাড়ি যেতে আছে?
বিশেষ করে আজকাল রেশনের চালের দিনে কারো বাড়িতেই একবেলার বেশি দু-বেলা থাকতে নেই। কী মনে করবে। যে কাল পড়েছে।
ট্রেন এসে পড়ল। উঠে বসলেন এক কোণে। রেলের জামা আছে, টিকিট লাগবে না।
হু হু করে ট্রেন চলল। কাশফুলের খেতে কাশফুল ফুটতে শুরু করেছে। খুব বৃষ্টি হওয়ায় ধানের খেত জলে ডুবুডুবু। অনেক জায়গায় এখনো ধান বুনছে। আমন ধান এবার নাবি।
খুব ভালো করেছেন কেশব। যখন কাজ থেকে অবসর নিলেন, তখন প্রভিডেন্ট ফন্ডের দরুন ন-হাজার টাকা পেয়েই যদি তা থেকে কিছু ধানের জমি কিনতেন নিজের নামে, তবে আজ স্ত্রী আর মেয়েরা এমন হেনস্থা করতে পারত?
স্ত্রী আর মেয়েদের দুর্ব্যবহারের কথা মনে আসায় চোখ দিয়ে জল পড়ল, কোঁচার খুঁটে মুছলেন। কী না করেছেন ওদের জন্যে? ওই ছোটো মেয়েটার নৈহাটিতে থাকতে একবার টাইফয়েড হয়েছিল, কেশব গাঙ্গুলী রাত জেগে ঘণ্টায় ঘণ্টায় থার্মোমিটার দেখেছেন, ওষুধ খাইয়েছেন, কই অবহেলা করতে পেরেছিলেন? একশো ষাট টাকা খরচ হয়ে যায় সেই অসুখে।…
ওই স্ত্রী মুক্তকেশীর সে-বার হাঁপানির মতো হল। চুচুড়ায় নিয়ে গিয়ে সপ্তাহে সপ্তাহে কবিরাজ দেখানো, অনুপানের ব্যবস্থা করা, পাছে আগুনের তাতে কষ্ট হয় বলে রাঁধতে দিতেন না, রান্নাঘরের কাছে যেতে দিতেন না। রাত্রে শুয়ে ভাবতেন, এই বয়সে হাঁপানি হল, মুক্তকেশী বড়ো কষ্ট পাবে, কী করা যায়? রঘুনাথপুরের পীতাম্বর দাসের কাছে হাঁপানির মাদুলি পাওয়া যায়, তাই কি আনবেন? কত ভেবেছেন। কত ব্যস্ত হয়েছিলেন।
সেই মুক্তকেশী তাঁকে আজ বললে—বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও, আর এসো না–
ছোটো মেয়ে বললে—মরো না তুমি, মলেই বাঁচি। তুমি মলেই বা কী?
কেন তিনি কি ওদের জন্যে কিছু করেননি? চিরকাল রেলে টরেটক্কা করেছেন তবে কাদের জন্যে? খাইয়ে মাখিয়ে বড়ো না-করলে ওরা অত বড়ো হল কী করে? আজ কিনা তিনি মরে গেলে ওরা বাঁচে! তিনি আজ সংসারের আপদ, এই তিয়াত্তর বছর বয়সে!
এই তিয়াত্তর বছর বয়সেও গত আষাঢ় মাসে যখন কাঠের ভয়ানক অভাব হল, নিজে বাঁশঝাড় খুঁজে খুঁজে শুকনো বাঁশ আর কঞ্চি কেটে গোয়ালে ডাং করেননি, পাছে স্ত্রীর বা মেয়েদের রান্নার এতটুকু অসুবিধে হয় সেজন্যে? এই ভীষণ জলকাদার পথে মোট বয়ে নিয়ে যাননি?
যাক, এসব কথা তিনি বলতে চান না। তবে মনে কষ্ট হয় এই ভেবে যে, সংসার কীরকম অকৃতজ্ঞ! যাদের জন্যে সারাজীবন খেটে খেটে গায়ের রক্ত জল করেছেন, তারাই আজ বলে কিনা তিনি মলেই তারা বাঁচে, তাদের কোনো ক্ষতি হবে না।
কেশব গাঙ্গুলীর মনের মধ্যেটা হা হা করে উঠল দুঃখে। চোখে আবার হু হু করে জল এল, কোঁচার খুঁটে মুছলেন। আজ যদি
—টিকিট?
—কেশব গাঙ্গুলী মুখ তুলে চমকে চাইলেন। একটি ছোকরা টিকেট-চেকার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কেবশ গাঙ্গুলী বললেন—রেলওয়ে সার্ভেন্ট—
ছোকরা চলে গেল।
বেশ ছেলেটি। ওই রকম একটি ছেলে যদি আজ তাঁর থাকত! তা হলে ওরা এমন কথা বলতে সাহস পেত না। সবই অদৃষ্ট। ছেলে তাঁর হয়নি? হয়েছিল। তখন তিনি তিনপাহাড় স্টেশনের তারবাবু। ছেলের নাম ছিল সান্টু! প্ল্যাটফর্মে হেলেদুলে চলে বেড়াত। আজও বেশ মনে আছে, তাঁকে বলত—বাবা, আমাকে পুরোনো টিকিট দেবে? পুরোনো টিকিট হাতে পেলেই সে হঠাৎ মুখে ‘পু-উ উ-উ’ শব্দ করে ট্রেন ছেড়ে দিত…তারপর ঝক ঝক ঝক ঝক শব্দ করতে করতে প্ল্যাটফর্মের ধারে ধারে খানিকদ্দূর মাথা নাড়তে নাড়তে কেমন যেত।
টরেটক্কার টেবিলে কাজ করতে করতে তিনি বসে দেখতেন আর হাসতেন। মাল-কুলি রামদেওকে বলতেন—শিশুকে ধরে বাসায় দিয়ে আসতে। শিশু বুঝতে পারত, রামদেও তাকে ধরে নিয়ে যেতে আসছে, সে ছোটো পায়ে ছুট দিত আর রামদেও পেছনে পেছনে ‘এ খোঁকাবাবু, এ খোঁকাবাবু’ বলে ছুটত—এ দৃশ্য আজও এই এখুনি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন কেশব।
দেড় বছর বয়সে সান্টু মারা যায়।…আজ ছত্রিশ বছর আগেকার কথা। তবুও যেন মনে হয়, সেই সাহেবগঞ্জ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বড়ো ঘোড়ানিম গাছটার ছায়ায় আজও সান্টু সেই রকম ছুটে ছুটে খেলা করে বেড়াচ্ছে।…সান্টু থাকলে আজ বোধ হয় এমন কষ্ট কেশব গাঙ্গুলীর হত না। চোখ দিয়ে এবার ঝরঝর করে জল পড়ল, মনের মধ্যে—বুকের মধ্যে কী একটা যেন ঠেলে ফুলে ফেঁপে উত্তাল হয়ে উঠল। কেশব জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটা রাখাল বালক একটা গোরুকে কী নির্দয়ভাবেই না প্রহার করছে। খুব বৃষ্টির জল বেধেছে ডোবায়, পুকুরে। এক জায়গায় ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েরা গামছা দিয়ে হেঁকে কুঁচোমাছ ধরছে। টেলিগ্রাফের তারে একটা কি পাখি বসে রয়েছে।
নৈ-হা-টি!
কেশব গাঙ্গুলীর চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল। তিনি তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন।
সন্ধ্যার আর বিলম্ব নেই। এখানে সাবেক বাসা ছিল। দু-চারজন বন্ধুর সঙ্গে আলাপ আছে। তাদের কারো বাড়ি যাবার ইচ্ছে নেই, তবুও না-গেলে রাত্রে থাকবেন কোথায় এই অভদ্রা বর্ষাকালে, খাবেনই বা কী? রমাপতির বাড়ি যাবেন?
রমাপতি কুণ্ডুর বড়ো গোলদারি দোকান ও রেস্টুরেন্ট। নাম, দি কমলাপতি মডার্ন রেস্টোরান্ট। রমাপতির বড়ো ছেলের নাম কমলাপতি। তার ছেলে শান্তি ওই রেস্টোরেন্টে বসে! খুব বিক্রি। চার-পাঁচটা ছোকরা চা-খাবার দিতে দিতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে।
শান্তি তাঁকে দেখে বললে—এই যে দাদু, আসুন! দেশ থেকে? ভালো সব? ওরে, ভালো করে গরম জলে ধুয়ে এক কাপ চা দে দাদুকে। আর কী খাবেন? একটা চপ দেবে? ভালো চপ আছে। না? টোস্ট দিক? তবে থাক।
কেশব গাঙ্গুলী জানেন, এখানে যা খাবেন তার নগদ দাম দিতে হবে এখুনি। আর একবার এ রকম হয়েছিল, তাঁকে খাতির করছে ভেবে চপ, কাটলেট, ডিম যা নিয়ে আসে তাই খান। শেষে হাসিমুখে আপ্যায়িত করে বিদায় নেবার জন্যে টেবিলের কাছে যেতেই শান্তি হাসিমুখে বললে—এক টাকা সাড়ে তেরো আনা—
আজ আর সে ভুল করবেন না। হাতে পয়সা কম। চায়ের ছ-পয়সা দাম দিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। শান্তিকে বললেন, তোমার বাবা ভালো? তোমার দাদু বাড়িতে আছেন?
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
—একবার যাব দেখা করতে?
—যান না। এখন বৈঠকখানাতেই বসে আছেন, আর শশী কাকা আছেন।
—আচ্ছা আসি। কেশব গাঙ্গুলীর মনটা খারাপ হয়ে গেল। ব্যাবসাদারের চক্ষুলজ্জা নেই। সংসার বড়ো কঠিন জায়গা।
তবুও রমাপতির বাড়িতেই গেলেন। রমাপতি কুণ্ডু তাঁর সমবয়সি। তাঁকে দেখে খুশি হল। যত্ন করলে খুব। রাত্রে লুচি, তরকারী, মিষ্টি খাওয়ালে। ভালো গদিপাতা নেটের মশারি খাটানো বিছানায় শুয়ে কেশব মশারির চালের দিকে চেয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। পরের এমন সুন্দর বিছানাতে ক-দিন তিনি শোবেন? তাঁর আশ্রয়স্থল তো বৃক্ষতল। এরা না-হয় আজ রাত্রেই খাতির করে আশ্রয় দিয়েছে।
কেন অপরের অদৃষ্টে এত সুখ থাকে, আর তাঁর অদৃষ্টে এমন ধারা?
এই তো রমাপতিকে দেখলেন, তার নাতনিরা কত যত্নে বাতাস করতে লাগল খাওয়ার সময়ে। খাওয়ার পর এক বড়ো নাতনি আমলা নাকি রোজ তেল মালিশ করে দাদুর পায়ে। পুত্রবধূরা ‘বাবা’ বলতে অজ্ঞান।
সেটা হয়তো পয়সাওয়ালা বলে, রমাপতির নামেই ব্যাবসা, লক্ষপতি লোক। আজ তাঁর হাতে যদি পয়সা থাকত, তবে কী আর মেয়েটা তাঁকে অমন কথা বলতে সাহস করত? তিনি নিঃস্ব, কাজেই তাঁকে হেনস্থা করে। পয়সা এমন জিনিস।
কত কী ভাবতে ভাবতে কেশবের ঘুম এল। একটা বড় ব্যথার জায়গা খচ খচ করে। যখন তিনি চলে যাচ্ছেন বাড়ি থেকে বেরিয়ে, তখন মেয়েরা কেন দৌড়ে এসে পথ আটকালে না? স্ত্রী কেন ছুটে এল না?
সব মিথ্যে। সব ভুয়ো। সব স্বার্থের দাস। দয়া, মায়া, স্নেহ, মমতা পৃথিবীতে নেই। রমাপতি কুণ্ডু লক্ষপতি, তাই আজ নাতি-নাতনি তার পায়ে তেল মালিশ করে, পুত্রবধূরা দুধের বাটি মুখে ধরে। যদি তাঁর টাকা থাকত, তাঁর আদরও ওই রকমই হত।
সকালে উঠে রমাপতি কুণ্ডু বললেন–গঙ্গাস্নান করবেন না গাঙ্গুলীমশায়? গঙ্গাহীন দেশে থাকেন, গঙ্গাস্নানটা করলে ভালো হত!
দুজনে গঙ্গাস্নান করে এলেন। তারপর রমাপতির ছোটো নাতনি তাঁদের দুজনের জন্যে শ্বেতপাথরের রেকাবিতে কাটা পেঁপে, কলা, নাশপাতির টুকরো আর সন্দেশ, রসগোল্লা ও চমচম নিয়ে এল। কেশব গাঙ্গুলীকে বললে—দাদু, আপনার রান্নার জোগাড় কী এক্ষুনি করে দেব? না একটু দেরি হবে?
অর্থাৎ এরা গন্ধবণিক। ভাত বেঁধে দেবে না ব্রাহ্মণের পাতে। রাত্রে লুচি খাওয়াতে পারে, কিন্তু দিনে ভাত বেঁধে খেতে হবে।
কেশব বললেন—আমি চলে যাব আজ দিদি–
রমাপতি কুণ্ডু বললে—সে কী কথা গাঙ্গুলীমশায়? আজ ওবেলা আপনাকে নিয়ে হরিসভায় ভাগবতপাঠ শুনতে যাব ঠিক করে রেখেছি–
রমাপতির নাতনি টুনিও বললে—আজ যাবেন কী দাদু? আজ আমরা ওবেলা তালের ফুলুরি, তালের ক্ষীর করব, আপনি আজ চলে যাবেন—যেতে তো দিলাম?
কেমন সুখের সংসার! কেমন মিষ্টি কথাবার্তা, মিষ্টি ব্যবহার! লক্ষ্মী যেখানে বিরাজ করেন, সেখানে কি কোনো জিনিসের ত্রুটি থাকে?
সারাদিন বড়ো আনন্দে কাটল। খাওয়া-দাওয়ার প্রচুর ব্যবস্থা। সন্ধ্যার দিকে গঙ্গার ধারের হরিসভায় ‘অজামিলের উপাখ্যান’ শুনতে গেলেন দুজনে। ব্যাখ্যাকারী নবদ্বীপের গোস্বামী বংশের লোক, বড়ো সুন্দর বোঝাবার ও বর্ণনা করবার ক্ষমতা।
ভগবান অমন মহাপাপী অজামিলকে কৃপা করেছিলেন, শুধু বিপন্ন হয়ে সে কাতরে তাঁকে মৃত্যুকালে ডেকেছিল বলে।
তিনি কি এতই পাপ করেছেন?
ভগবান নিশ্চয় তাঁকে ঠেলে ফেলে দেবেন না দূরে।
কিন্তু কোথায় কীভাবে স্থান দেবেন ভেবে পাওয়া যাচ্ছে না। আহা, জগতে এত সুখ, এত আনন্দ চারিদিকে, অথচ তাঁরই ভাগ্যে সব এমন হল কেন?
আসবার সময় রমাপতি কুণ্ডুকে বললেন—বেশ আছেন কুণ্ডুমশাই, না?
—আপনার আশীর্বাদে
—আমায় একটা চাকরি করে দিন না?
—কী রকম চাকরি?
—এই ধরুন, কারো বাড়িতে থেকে ছেলে পড়ানো, কী হাটবাজার করা।
—পাগল! আমাদের এই বয়সে কি পরের চাকরি করা চলে দাদা? কেন, চিরকাল চাকরি করে এসে বুঝি বাড়ি থাকতে ভালো লাগছে ন