• বইয়ের নামঃ আসামী হাজির
  • লেখকের নামঃ বিমল মিত্র
  • প্রকাশনাঃ মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (ভারত)
  • বিভাগসমূহঃ উপন্যাস

 ০. আসামী হাজির’ প্রসঙ্গে – যজ্ঞেশ্বর রায়

আসামী হাজির – উপন্যাস – বিমল মিত্র

‘আসামী হাজির’ প্রসঙ্গে – যজ্ঞেশ্বর রায়

১৯৭১-এর নভেম্বর থেকে “আসামী হাজির” সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হতে থাকে। সেই থেকে শুরু করে ১৯৭৩ সালের মার্চ পর্যন্ত আগাগোড়া আমি ছিলাম উপন্যাসখানির নিয়মিত পাঠক। পড়তে পড়তে এই দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছি যে কত অনায়াসে বিমল মিত্রের কলমে একটি Positive good man জীবন্ত হয়ে ওঠে। অবশ্য এ-ধরনের চরিত্র-চিত্ৰণ তার হাতে এই প্রথম নয়। তাঁর প্রথম উপন্যাস –সাহেব বিবি গোলাম-এ, যে বই থেকে তার খ্যাতির জয়যাত্রা শুরু, তার ভূতনাথ চরিত্র থেকে শুরু করে প্রতিটি উপন্যাসে নানা নামে নানা বেশে এই সক্রিয় ভাল মানুষটির আনাগোনা আমরা দেখেছি। আসলে প্রতিবাদের এই বলিষ্ঠ কণ্ঠ লেখকের মধ্যে সর্বদাই মুখর। হতাশা, গ্লানি অন্যায়কে তিনি নির্দয় ভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেন, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন আমাদের সমাজ-জীবনে রাষ্ট্রে কত দুর্নীতি দুরাচার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে; কিন্তু শুধু ওই দিকটা দেখিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হন না তিনি। আলোর দিকেও তার চোখ আছে। সবাই যখন অন্ধকারের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করছে তিনি তখন দু’হাত প্রসারিত করে ধরেছেন আলোর উদ্দেশে। পরম নৈরাশ্যের মধ্যে এমন করে তিনি বিশ্বাসের প্রদীপটি তুলে ধরেন যে, তাকে সেই মুহূর্তেই মনে হয়, তিনি মানুষের একজন চিরকালের অকৃত্রিম বন্ধু। জনতার কাছ থেকে জনপ্রিয়তার শিরোপা তাই তো তিনি এমন অনায়াসে অর্জন করেছেন।

আজ যখন অন্যান্য সাহিত্যরথিগণ অন্ধকারকেই আমাদের অনিবার্য নিয়তি বলে বলছেন তখন বিমল মিত্রের এই আলোর দিকে, বিশ্বাসের দিকে প্রসারিত অতন্দ্র দৃষ্টিকে আমরা ক্রমশই আরো প্রখর হয়ে উঠতে দেখছি; দেখছি যে –’ভাল মানুষ’ চরিত্রগুলো এতদিন অসহায় বিভ্রান্ত মানুষগুলোর পাশে পাশে প্রদীপ হাতে নিয়ে তাদের আলো দেখিয়ে চলত সেই সীমিত ও খণ্ডিত চরিত্রগুলো ক্রমশঃ অখণ্ড ও সম্পূর্ণ হতে চেয়ে তার উপন্যাসে নায়কের ভূমিকা নিতে শুরু করেছে। যেমন –রাজাবদল-এর গৌর পণ্ডিত মশাই, –শেষ পৃষ্ঠায় দেখুন-এর লোকনাথ এবং আলোচ্য উপন্যাসের সদানন্দ।

Positive good man-কে নায়ক করে উপন্যাস লেখা, দস্তয়েফস্কি বলেছেন, সব চেয়ে কঠিন কাজ। এ কাজে যিনি সফল হন তিনি শ্রেষ্ঠ শিল্পী। শিল্পীর এই শ্রেষ্ঠত্ব বোঝা সহজ নয়। –On the Modern Element in Literature’ গ্রন্থে Mathew Arnold বলেছেনঃ

And everywhere there is connexion, everywhere there is illustration : no single event, no single literature, is adequately comprehended except in relation to other events, to other literature.

ম্যাথু আরনল্ড-এর এই উক্তির তাৎপর্য আমি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি “আসামী হাজির” পড়তে পড়তে। আমার কেবল মনে হয়েছে Positive good man সম্পর্কে আগে থেকে পাঠকের যদি যৎকিঞ্চিৎ ধারণা তৈরি না থাকে তো “আসামী হাজির”-এর নায়ককে সম্যকভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব হবে না। একটা নেলা-ক্ষেপা বোকা-পাগলা মানুষের অধিক বড় জোর একজন ন্যায়নিষ্ঠ মানুষ বলে মনে হবে তাকে। এই এলোমেলো চরিত্রটির যে। একটা “grotesque beauty”–একটা রহস্যময় খেয়ালী সৌন্দর্য আছে, তা না বোঝাই থেকে যাবে। সদানন্দের চেয়ে উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্ররাই তখন মনে ছাপ ফেলবে বেশী করে; এমন দুরূহ শিল্পকৃতিত্বের কিছুই পাঠক বুঝতে পারবেন না।

Positive good man-কে সম্যক আয়ত্ব করতে অনেক লেখকই পারেন নি। Positive good man বলতে সব আগে আমাদের মনে পড়বে চৈতন্যদেব অথবা রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে। ইওরোপের খৃশ্চিয়ান জগৎ একবাক্যে স্মরণ করবেন যীশুকে। কিন্তু এই মহামানবদের আদলে চরিত্র আঁকতে চাইলে তা হয়ে যাবে মহামানব নিয়ে উপন্যাস, তা আর তখন রস-সাহিত্য হবে না। দস্তয়েফস্কি বলেন, রসসাহিত্যের কাজ সাধারণ মানুষের। মধ্যে থেকে সাধারণ নয় এমন একটি মানুষকে উপস্থিত করা। সে হবে শিশুর মতন সরল, পবিত্র এবং স্বভাবতই সৎ অথচ সে থাকবে (যেহেতু মহামানব নয়) –Screened with human weakness. পাঠক তার সম্পর্কে যত জানবেন ততই তার আত্মীয় হয়ে উঠবেন এবং ততই অনুভব করবেন যে এ মানুষটি তার নিজের জাতের নয়, এ মানুষটির ঘনিষ্ঠ হওয়া যায় না, এ যেন কেমন বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ, একলা। একে বন্ধু, সমাজ, বাপ-মা এমন কি শেষপর্যন্ত তার স্ত্রী ও ত্যাগ করে চলে যায়, কারো সঙ্গেই সে সহ-অবস্থান করতে পারে, সমঝোতায় আসতে পারে না। আপোস বলে যে একটা কথা আছে, তা যেন তার অভিধানে থাকতে নেই।

কিন্তু এহেন জটিল চরিত্র প্রথমেই কোন লেখক কল্পনা করেন নি। প্রথমে তাদের কল্পনায় Positive good man হিসেবে একটি সরল বিশ্বাসের অটল মানুষই ধরা পড়েছিল। পৃথিবীর সাহিত্যের ইতিহাসে তার সঙ্গে আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ ষোড়শ শতকে। লেখক একজন স্পেনিস। একাধারে কবি নাট্যকার ও ঔপন্যাসিক সারভাঁতে তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি “ডন কুইক্সট”-এর জন্যে অমর হয়ে আছেন। দস্তয়েফস্কি লিখেছেন—”of all the good characters in christ an literature, Don Quixote stands as the most finished of all. But he is good solely because he is ludicrous at the same time comical.” Comical হওয়াতে চরিত্রটির ওজন কমে গেছে অতিমাত্রায়। তার সততা সারল্য ও নিষ্ঠা পাঠকের ওপরে প্রভাব বিস্তার করতে পারে নি। তথাকথিত হিরোইজমের প্রতি শ্লেষ হিসেবেই চরিত্রটিকে পাঠক ভালবেসেছে কিন্তু তার Positive goodness চোখে পড়ে নি কারো। Tom Jones-এর ভাগ্যেও জুটেছে সেই ক্লাউনেরই জনপ্রিয়তা। নাম চরিত্রের ওই উপন্যাসটি লেখেন হেনরি ফিলডিং। ১৭৪০-এর কাছাকাছি প্রকাশিত এই বইটিতে একটি সরল মানুষের সহজ বিশ্বাসের ক্রিয়াকলাপকে নিয়ে এমন ব্যঙ্গ কৌতুক করা হয়েছে যে এই ভঁড়ামির তলায় একটি বিশুদ্ধ সৎ চরিত্র সমূলে চাপা পড়ে গিয়েছে। অন্যপক্ষে ডিকেনসের ‘পিকউইক’ অনবদ্য চরিত্র হলেও ডন কুইক্সটের তুলনায় অনেক দুর্বল। তবু মোটামুটি ভাবে এ সব চরিত্র পাঠকের মন কেড়েছে কেবল তাদের চারিত্রিক বিশুদ্ধতার জন্যে। সৎ ও সরল মানুষকে সবাই ভালবাসে। সবাই যাকে উপহাস করে কিংবা হুগোর “লে মিজেরাবল”-এর নায়ক জাঁ ভালজার মতন যে কেবল ভাগ্যদোষে অত্যাচারই কুড়োয়, কারো কাছে এটুকু স্নেহ-মমতা পায় না, স্বভাবতই সেই অনন্যোপায় মানুষটির জন্যে পাঠকের মন করুণায় ভরে ওঠে। সেকালের হিউমারের গোপন লক্ষ্যটিও ছিল তাই “…to aroise compassion.” অর্থাৎ পাঠকের মনে করুণা উদ্রেক করা।

কিন্তু অসহায়ের প্রতি এই করুণাকে বড় ভয়ের চোখে দেখেছেন দস্তয়েফস্কি। বলেছেন, নায়কের প্রতি পাঠকের করুণার উদ্রেক হলে তার অন্তর্নিহিত সত্য স্বরূপ করুণার নিচে চাপা পড়ে যায়। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পাঠক তথা সমস্ত আয়োজনটাই তাঁর পণ্ড হয়ে যায় তখন।তাই হুগোর ‘horrible beauty’ হয়েট-এর ‘terrible beauty’র চেয়ে ‘grotesque beauty’-র মধ্যেই দস্তয়েফস্কি দেখলেন “avenue to spiritual reality in art.”

Positive good man-এর প্রসঙ্গে আর্টে রিয়ালিজমের প্রশ্ন যখন এল তখনই এর good man চরিত্রে জটিলতা দেখা দিল। চরিত্র থেকে বাদ চলে গেল নির্বুদ্ধিতা ও ভঁড়ামির। অংশটা, যুক্ত হল মনুষ্যোচিতদুর্বলতা আর উৎকেন্দ্রিকতা। ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই জটিল Positive good man চরিত্রটির সফল চিত্র যিনি আমাদের প্রথম উপহার দিলেন তার নাম দস্তয়েফস্কি। চরিত্রটি ইডিয়ট’-এর প্রিন্স মিসকিন। সেই থেকে এই পজিটিভ চরিত্রে হাত দিয়েছেন অনেকেই, সফলও হয়েছেন কোন কোন লেখক, অবশ্য ততদিনে সাহিত্যও তার কেন্দ্রবিন্দু পরিবর্তন করেছে। যুদ্ধ আর এটম বোমার আঘাতে মানুষের বিশ্বাস গেছে চূর্ণবিচূর্ণ ইয়ে, নিরবলম্ব মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে একটা চাপিয়ে দেওয়া অনিচ্ছার বোঝা, বেঁচে। থাকা হয়ে উঠেছে এক হাস্যকর অবাস্তব ব্যায়াম। এই চিন্তার প্রতিফলক-সাহিত্যে জীবন নেতিবাদের অন্ধকারে তার নিজস্ব চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে। তবু তারই মধ্যে মাঝে মাঝে ক্ষণপ্রভার মতন দু’একটি পজিটিভ চরিত্র আমাদের চোখের সামনে উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেয়। তেমনই একটি চরিত্র ১৯৫৯ সালের রচিত ইয়োনেসকোর নাটক ‘রাইনোসেরাস’ (গণ্ডার) এর নায়ক বেরেজের। বন্ধু, সমাজ, শেষ পর্যন্ত স্ত্রীও তাকে ছেড়ে চলে গেছে তবু আত্মসমর্পণ করে নি বেরেজের। অবমানুষ হবার বিরুদ্ধে শেষ অবধি সে একলা লড়াই করে গেছে। একা লড়াইতে ফাঁকি থাকে না। তাই পজিটিভ চরিত্রে কঁকির অবকাশ নেই। আর realism-এ ফকির সুযোগই বা কোথায়!

পজিটিভ চরিত্র নিয়ে আরও বিস্তৃত আলোচনার আগে এই realism কী ব্যাপার তা একটু খতিয়ে দেখা দরকার। পাঠক নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন, “রাজাবদল”-এর গৌর পণ্ডিত মশায়, “শেষ পৃষ্ঠায় দেখুন”-এর লোকনাথ এবং “আসামী হাজির”-এর সদানন্দ বিভিন্ন কোণ থেকে আমাদের মনে যে ছাপ ফেলেছে, সে আসলে একটি মানুষেরই ছাপ, সে মানুষ ‘a positive good man’! এই যে সাধারণ মানুষ থেকে বেছে অন্য একটি সাধারণ মানুষ খুঁজে বের করা যে সর্বপ্রকারে সাধারণ হয়েও উৎকেন্দ্রিকতাবশত অ-সাধারণ, দস্তয়েফস্কি বলেছেন এটাই আর্টে realism in a higher sense অর্থাৎ “to find the man in a man.”

বিখ্যাত সমালোচক কনসট্যানটিন মাচুল্‌ স্কি realism-এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন,…the new reality created by the artist of genius, real, because, it reveals the very essence of existence.

এখানে বলা দরকার realistic আর realism-এ পার্থক্য আছে। Realistic লেখা হচ্ছে। বাস্তবের ফটোগ্রাফিক অনুকৃতি (কার্বন কপি)। Reality in art অন্য ব্যাপার। এখানে লেখক সংসারে সমাজে নিত্য ঘটা ঘটনার বিবৃতি মাত্র দেন না, তিনি অনুরূপ ঘটনা নির্মাণও করেন। সে ঘটনার ভাষ্যের ভিতর দিয়ে একটি চরিত্র ক্রমাগত বিশিষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। অবশেষে এক বিশেষ আধ্যাত্মিক বাস্তবতায় উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু উত্তীর্ণ হওয়ার কথা যত সহজে বলা হল ব্যাপারটা তত সহজ নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কথাশিল্পের সমস্ত সম্ভাব্য দিকগুলো। বিশেষ করে ভাবতে হবে কী ভাবে বলব। যে ভাবে বললে–idea ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে বাস্তব ও যুক্তিসঙ্গত হয়ে ওঠে, কাহিনীর শেষে নায়কের গা থেকে ঘটনার নামাবলী খসে গিয়ে নিঃসঙ্গ সেই নিরাবরণ মানুষটি পাঠকের মনের দেয়ালে ছবি হয়ে ঝুলে থাকে তাকেই বলি সার্থক রচনা। কিন্তু সে বড় সহজ কাজ নয়। ত য় তার War and peace শেষ করে ডায়েরীতে লিখেছিলেন–I cannot call my composition a tale, because, I do not know how to make my characters act only for the sake of proving or clarifying any one idea or series of ideas.

তল্‌স্‌তয় যা পারেন নি বলে বলেছেন এক্ষেত্রে ‘আসামী হাজির’-এর লেখক কিন্তু তা পেরেছেন। তিনি তাঁর প্রতিটি ঘটনাকে একটি মুল ঘটনার মধ্যে কেন্দ্রীভূত করেছেন এবং একটি প্রত্যয়কে প্রমাণ অথবা প্রাঞ্জল করার জন্যে সব চরিত্র ও ঘটনা সেদিকে সক্রিয় করে তুলেছেন। ঘটনাগুলো বহু শাখা-প্রশাখায় প্রসারিত হতে হতে চতুর্দিক থেকে এগিয়ে এসে শেষে উদ্দিষ্ট কেন্দ্রবিন্দুতে লয় পেয়েছে। এইভাবেই নিজস্ব প্যাটার্ন ও টেকচারের টানাপড়েনে ‘আসামী হাজির’-এর লেখক তার ফিশনাল য়ুনিভার্স অর্থাৎ কাহিনীর বিশাল জগৎ গড়ে তুলেছে। এই বাবদে তিনি বালজাক, ডিকেনস, গোগোল, দস্তয়েফস্কির সঙ্গে তুলনীয়। বিশেষ করে grotesque beauty প্রসঙ্গে দস্তয়েফস্কি তো অবশ্যই। পজিটিভ গুড ম্যান-এর চরিত্র থেকে যখন ব্যঙ্গাত্মক অংশটা বাদ দেওয়া হল, যোগ করা হল উৎকেন্দ্রিকতা, তখনই ব্যঙ্গাত্মক উপস্থাপনার শূন্যস্থান পূর্ণ করল অনৈসর্গিক উপস্থাপনা। যেমন ‘শেষ পৃষ্ঠায় দেখুন’-এ নায়ক লোকনাথ ঈশ্বরের সঙ্গে তর্ক করছে। যেমন ‘আসামী হাজির’-এ সদানন্দ তার দ্বিতীয় সত্তাকে অর্থাৎ হাজারি বেলিফকে খুন করেছে। এইসব অনৈসর্গিক ঘটনার সন্নিবেশ দেখেই সেকালের দস্তয়েফস্কিকে এবং একালের বিমল মিত্রকে অনেক সমালোচক অতিরঞ্জনের দোষে অভিযুক্ত করেছেন; কিন্তু এ দোষ যে দোষ নয় বরং বিশেষ এক ধরনের গুণ দস্তয়েফস্কিই তার জবাব বেঁচে থাকতে দিয়ে গেছেন। যাদের তা মনে নেই কিংবা যাঁরা তা জানেন না তাদের অবগতির জন্যে উদ্ধৃতি দিচ্ছি। তিনি বলেছেন, “All art consist in a certain portion of exaggeration provided…one does not exceed certain bounds.”

এই bounds, এই সীমরেখা নির্দেশ করা বড় কঠিন; তবে সীমা লঙ্ঘিত হয়েছে কিন্তু বোঝা যায় লেখকের বিশেষ আধ্যাত্মিক বাস্তবতার লক্ষ্য অনুধাবন করলে। যদি দেখা যায়। তিনি তাঁর সেই উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পেরেছেন তখন অতিরঞ্জন আর অতিরঞ্জন থাকে না।

পাঠক ও সমালোচকদের স্মরণার্থে বলছি, অতিরঞ্জনের প্রয়োজন হয় তখনই যখন পরিবর্তনশীল উপরিভাগের অব্যবহিত নিচেকার অপেক্ষাকৃত স্থির ও স্থিতিশীল মানবিকভ্‌ অস্তিস্তকে দেখানো আবশ্যক হয়ে ওঠে–কেবল অপেক্ষাকৃত সূক্ষ্ম কিংবা ধূসর জিনিসকে দৃষ্টিগোচরে আনতে হলে তাকে বর্ধিতায়তন করাই দরকার। ডিকেনস্ বলেছেন-What is exaggeration to one class of mind and perception is plain truth to another. দস্তয়েফস্কি–The important thing is not in the object, but in the eye; if you have an eye, the object will be found; if you don’t have an eye, if you are blind–you won’t find anything in any object.

বিষয়ের এই অন্তর্নিহিত গুণটি দেখবার চোখ যাঁর আছে তিনিই realism-এর শিল্পী। তার হাত দিয়েই যুগে যুগে মূর্ত হয়ে উঠবে Positive good man. বিমল মিত্র নিঃসন্দেহে প্রমাণ করেছেন সত্য দর্শনের সেই দুরাসদ দৃষ্টি তার আছে।

শিল্পীর এই দুরাসদ দৃষ্টিগোচর Positive good man প্রসঙ্গে Mochulskey বলেছেন : In the “world of darkness” comes a man not of this world…He is not an active fighter contending in the struggle with evil forces, not a tragic hero challenging fate to combat, he does not judge and does not accuse, but his very appearance provokes a tragic conflict. One personality is set in opposition to the entire world.

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যদি ‘আসামী হাজির’-এব নায়ক সদানন্দর দিকে তাকাই তো সদানন্দর তিনটে ডাইমেনশানই (স্তর) একসঙ্গে আমাদের চোখে পড়বে। তিনজন সদানন্দকে আমরা একটি অবয়বে বিধৃত দেখতে পাব। চোখ মেললেই যেটা চোখে পড়বে সে তার সাধারণ চেহারা। আর পাঁচজন সমবয়সীর মতন স্বাভাবিক আচার-আচরণ। লেখাপড়া করে, স্কুলে যায়। প্রাকৃতিক নিয়মে সকলের মতন তারও বয়েস বাড়ে। কিন্তু এই ওপরের স্তরের নিচে সদানন্দ কিন্তু আসলে অন্য রকম। তার প্রশ্ন সাধারণের প্রশ্ন নয়, তার দেখার চোখও নয় সাধারণের চোখের মতন। সদানন্দর চোখে আরও কিছু, এমন কিছু ধরা পড়ে যা আর কারও চোখে পড়ে না। চোখে পড়লেও যার তাৎপর্য আর কেউ বোঝে না। শেষ স্তরের সদানন্দর এই যে অবহিতি-বোধ, এবং ভ্রষ্টত্ব সম্বন্ধে প্রখর সচেতনতা, এর থেকেই ঘটতে থাকে তার অহং-এর উত্তরণ। সদানন্দর এই তিনটি স্তর কিন্তু পরস্পর-বিচ্ছিন্ন নয়, এই ত্রিস্তর মিলিয়েই সদানন্দ সম্পূর্ণ একটি মানুষ। কী করে জানলাম? বিমল মিত্র সদানন্দ সম্পর্কে কি একটা দার্শনিক বক্তৃতা দিয়েছেন? না। তবে? হ্যাঁ, এইখানেই বিমল মিত্রের শিল্প-বৈদগ্ধ্য। তিনি বক্তৃতা দেন না, তিনি Maupassant-র ভাষায় –To produce the effect he seeks, that is, the feeling of simple reality, and I to bring out the lesson he would draw from it, that is, the revelation of what contemporary man really is to him, he will have to employ facts of constant and unimpeachable veracity…the achievement of such a goal consists, then, in giving the complete illution of reality following the ordinary logic of facts, and not in transcribing slavishly in the pell-mell of their occurance. (Preface to “Pierre et Jean”) অর্থাৎ বিমল মিত্র দৈনন্দিন জীবনের নিত্য-ঘটা সাদামাটা ঘটনার মধ্য দিয়ে তার চরিত্রকে উপস্থিত করেন কিন্তু সে সাদামাটা ঘটনাও আসলে মোপাশ্যাঁর ভাষায় ওই উপরিউক্ত বাস্তবেরই অধ্যাস এবং আদৌ বিশৃংখল কতকগুলি ব্যাপার মাত্র নয়। বিমল মিত্রের উদ্ভাবিত ঘটনা বা সিচুয়েশান বস্তুত ঘটনা নয়, ইলাসট্রেশান অর্থাৎ উদাহরণ। এবং তারও সব সময় থাকে তিনটে স্তর-প্রতিক্রিয়া, তাৎপর্য এবং প্রভাব।

উদাহরণ স্বরূপ কপিল পায়রাপোড়ার ঘটনাটাই উল্লেখ করা যাক। পাঁচ বছরের সদানন্দ কৈলাস গোমস্তার সঙ্গে হাটে গেছে। সেখানে কপিল বেলুন বেচছিল। সদানন্দ বেলুন চাইলে, সে দাম নিলে না, এমনিতেই একটা বেলুন দিয়ে দিল তাকে। কিন্তু কৈলাস গোমস্তা হিসেবের খাতায় চার পয়সা খরচ লিখে সেই পয়সা চারটে নিজে রাখলে। দুদিন বাদে সেই বেলুনটা চুপসে গেলে সদানন্দ বায়না ধরলে তার আর একটা বেলুন চাই। একমাত্র বংশধরের আবদারের কাছে কঞ্জুস জমিদার নরনারায়ণ চৌধুরীর মনে কৃপণর ছিটেফোঁটাও থাকে না। তখুনি চাকর পাঠানো হল রেলবাজারে। চাকর দু’পয়সা দিয়ে একটা বেলুন কিনে নিয়ে এল। বেলুনের দাম দু’পয়সা শুনেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন নরনারায়ণ চৌধুরী, আর একবার হিসেবের খাতাটা মিলিয়ে দেখলেন–হ্যাঁ, কপিল দু’পয়সা বেলুনের দাম চারপয়সা নিয়েছে তার নাতির কাছ থেকে। কপিল ঠগ, কপিল জোচ্চোর! হুকুম হল কপিলকে ধরে নিয়ে আসবার। বিনে পয়সার বেলুনের দাম হিসেবের খাতায় চার পয়সা লিখে যে চুরি করেছিল সেই কৈলাস গোমস্তাই ছুটল তাকে গ্রেপ্তার করে আনতে।

তারপর? কপিল পায়রাপোড়ার আর্তনাদ শুনে সদানন্দ ছুটে গিয়েছিল কিন্তু তার কথায় তার প্রতিবাদে কেউই কান দিলে না, শুনতে চাইলে না কেউ অপরিণত বালকের কথা, টেনে বের করে নিয়ে এল তাকে ঘর থেকে। কপিল পায়রাপোড়া শুধু মারই খেলে না, তার তিন বিঘের সামান্য জমিটুকুও গেল। জমিদারের নির্দয় ক্রোধ তাকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে ছাড়লে। একপাল ছেলেপুলে নিয়ে অসহায় মানুষটা অনন্যোপায় হয়ে শেষমেশ গলায় দড়ি দিয়ে মরল। সে দৃশ্য দু’দিন পরেই সবাই ভুলে গেল। এসব নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা এমনই গা-সওয়া হয়ে গেছে মানুষের যে, এসব ঘটনা কেউই আর মনে রাখলো না।

কিন্তু সদানন্দ বলে, “দেখ প্রকাশ মামা, আজকাল সবাই তার কথা ভুলে গেছে। …….ওই বারোয়ারীতলায় যখন সে আত্মঘাতী হল সবাই তা দেখেছে, দেখে শিউরে উঠেছে, কিন্তু আজকে কারো সে কথা মনে নেই……..”

শুনে প্রকাশ মামা হো হো করে হেসে উঠেছে, বলেছে, “তুই তো দেখছি একটা আস্ত পাগল। অত কথা মনে রাখতে গেলে মানুষের চলে! তুই তো আমায় অবাক করলি সদা।”

সদা বলে, “কিন্তু মামা আমি কেন কিছুই ভুলতে পারি নে? আমার কেন সব মনে পড়ে যায়?”

না–সদানন্দর শুধু মনেই পড়ে না, তার তীব্র বোধের কাছে, তীক্ষ্ণ অবহিতির কাছে চৌধুরীবংশের পাপের ইতিহাস সন্ধ্যার ধূসর ছায়ার মধ্যে পুকুরের জল ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়ায়। তারা তাকে চৌধুরীবংশের পাপের ইতিহাস শোনায়।

কপিল পায়রাপোড়ার এই প্রাসঙ্গিক কথার মধ্যে আমার উপরিউক্ত তিনটি স্তর পর পর এইভাবে সাজানো–(১) চারটে পয়সাও চুরি করতে ছাড়ে না এমনই হীন এই জমিদার সেরেস্তার মানুষ (২) কত তুচ্ছ জিনিস নিয়ে জমিদারের ক্রোধ চরম হয়ে ওঠে (৩) তার ফলে একটি শিশুর সামনে এই জগৎ ও জীবনের ওপরকার পলেসতারাটা কী ভাবে ভেঙে যায়, কী ভাবে ভেতরের বীভৎস চেহারাটা বেরিয়ে আসে। বিমল মিত্র কোন ঘটনা অকারণে তো বলেননি না অধিকন্তু তিনটে ডায়মেনশন না থাকলে তার অবতারণাও করেন না। তার লক্ষ্য সব সময় সেই ঘটনার দিকে যার মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত হয় বাঙালী মানসের যন্ত্রণা, তার নৈতিক সংকট। অন্ধকারটা যত তীব্র হয়ে ওঠে আলোর জন্যে আকূতি ততই ঐকান্তিক হয়। অতএব তার উদ্ভাবিত ঘটনার মধ্যে একটা আলোর আভাসও শেষ-মেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

সদানন্দর এলেবেলে মনোভাব ও ছন্নছাড়া আচার আচরণকে চিরাচরিত পথে সুস্থ করে। তোলার জন্যে প্রকাশ মামা একদিকে তার বিয়ের জন্যে সদানন্দর বাপ-মাকে সুপারিশ করে আর একদিকে তাকে লায়েক করে তোলার জন্যে যাত্রা, কবিগান, ঢপ শোনাতে নিয়ে যায়, নিয়ে যায় বাজারে-মেয়ে মানুষের বাড়িতে। যার হাতে একদিন আট দশ লাখ টাকার। সম্পত্তি আসবে তাকে সেই টাকার সুখভোগ করতে হবে তো! আর তখন তার হাতেও কোন্ দু’এক লাখ টাকা না আসবে! পৃথিবীর সব দালালরাই এই রকম এক এক জন প্রকাশ। মামা।

সদানন্দর অন্তরদৃষ্টি প্রকাশ মামাকে চিনতে ভুল করে না,–প্রকাশ মামাও একজন মানুষ। সদানন্দ ভাবে, কেউ প্রকাশ মামাকে মানুষ ছাড়া জানোয়ার বলবে না। মানুষের মতন দুটো হাত, পা, চোখ, কান। মানুষেরই মতন মুখের ভাষা। সংসারে ওরকম লোককে সবাই মানুষ বলেই জানে। অথচ প্রকাশ মামা কি সত্যিই মানুষ!

সত্যিকারের মানুষ তার দাদু নরনারায়ণ চৌধুরীও না। এবং তার বাপও না। নরনারায়ণ চৌধুরী পনেরো টাকা মাইনের নায়েব ছিলেন কালীগঞ্জের জমিদার হর্ষনাথ চক্রবর্তীর। হর্ষনাথ চক্রবর্তীর শেষ জীবনে চৈতন্যোদয় হয়েছিল, তিনি সজ্ঞানে গঙ্গাজলে দেহত্যাগ। করলেন এবং নরনারায়ণের সৌভাগ্য কয়েক দিনের মধ্যে তাঁর ওয়ারিশানদেরও মৃত্যু ঘটল। রইল শুধু হর্ষনাথের বিধবা, কালীগঞ্জের বউ। সেই বিধবার সর্বস্ব তিলে তিলে গ্রাস করে নায়েব নরনারায়ণ চৌধুরী হলেন কালীগঞ্জ আর নবাবগঞ্জ–এই দুই বিশাল ভূমির একচ্ছত্র জমিদার। শেষ বয়েসে পঙ্গু হয়ে পড়েছিলেন নরনারায়ণ চৌধুরী, তবু টাকার সিন্দুকটা–চুনী পান্না হীরে জহরতে বোঝাই সিন্দুকটা আগলে বসেছিলেন তিনি। এবার তিনি একমাত্র বংশধর নাতি শ্রীমান সদানন্দকে বিয়ে দিয়ে তার ঘাড়ে এই বিশাল জমিদারী আর এই মস্ত সিন্দুকটা সঁপে দিতে পারলে নিশ্চিন্ত; কিন্তু এদিকে যে পাপের বীজটি বিশাল এক মহীরূহ হয়ে উঠেছে তিনি তা গ্রাহ্যই করতে চান নি। কিন্তু সদানন্দ ছাড়লে না। সে যখন জানলে দশ হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে কালীগঞ্জের বউ দাদুর বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিয়েছে, সে দাদুকে চেপে ধরলে,তোমার সিন্দুক বোঝাই টাকা, কেন তুমি তবে বিধবা বুড়ো মানুষটাকে ঘোরাচ্ছ, টাকাটা দিয়ে দাও।

দাদুর যুক্তি–দাও বললেই দেওয়া যায়? আমি কি দেব না বলেছি, দেব, ঠিক দিয়ে দেব। তুই বিয়ে করে আয়…

যার কাছে হিসেবই ধর্ম হিসেবই মোক্ষ, যার কাছে স্বর্গ বলতেও টাকা সে কখনো সহজে টাকা ছাড়ে! অথচ সেই টাকাই মুঠো মুঠো খাওয়াতে হল পুলিসের দারোগাকে। একটা খুন চাপা দিতে আরও পাঁচটা খুন করতে হল। কেননা অর্থনৈতিক সামাজিক রাজনৈতিক স্বার্থ ক্রমাগত মানুষকে এক নিদারুণ ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, যার ফলে নিজের ওপর কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলছে মানুষ। যত সে অসহায় বোধ করছে ততই সে পাপীর গোষ্ঠী বাড়াচ্ছে, সেই দলের পুষ্টিবিধান করছে। একদিকে এভাবে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বলবান হচ্ছে আর একদিকে অসহায় মানুষ তারই শিকার হয়ে হয় আত্মবিসর্জন দিচ্ছে নয় তো তাদের দালাল হয়ে দল ভারী করছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে positive good man ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে, সরে যচ্ছে negation-এর দিকে, বৈরাগ্যের দিকে। শুভ রাত্রির মধুর ক্ষণটিতেই তাই একটি নিষ্পাপ নববধূর জীবনে নেমে এল অন্ধকার।

শোষণভিত্তিক সমাজে যে শোষণ করে না সে শোষিত হয়। আর যে এই শোষণকে পাপ বলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ও শোষিতের জন্যে দুঃখ পায়, সমাজ তাকে কায়দা করে মুঠোয় পুরতে চায়, না পারলে তাকে সেখানে তিষ্ঠতে দেয় না। আসলে তার বিবেকই তাকে সমাজ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। ঘটেও ছিল তাই। নরনারায়ণ চৌধুরী সদানন্দকে আয়ত্তে আনতে পেরেছেন ভেবে খুশী হয়েছিলেন। সে নববধূর ঘরে গিয়ে দরজায় খিল দিয়েছে। এতএব আর চিন্তা কী! এখন থেকে পুত্রপৌত্রাদিক্রমে বংশপরম্পরা তিনি অমর হয়ে থাকবেন, অনন্তকাল ধরে নিজের রক্তের ধারার মধ্যে অখণ্ড পরমায়ু লাভ করবেন। কিন্তু তিনি জানলেন না তাদেরই পাপের প্রতিবাদ ও প্রায়শ্চিত্ত করতে ফুলশয্যার পালঙ্ক থেকে নেমে সকলের অগোচরে আকাশের নিচে কন্টক শয্যা পাততে বেরিয়ে গেছে সে। কিন্তু পাপের বিরুদ্ধে জেহাদ জানিয়ে একটা মানুষ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেই তো তার বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব কাজ থেমে যায় না। থেমে যেতে দিতেও চান না নরনারায়ণ চৌধুরীর। যোগ্যপুত্র হরনারায়ণ চৌধুরী। তাই তিনি নিজেই পরিত্যক্তা পুত্রবধূর গর্ভে সন্তান উৎপাদন। করতে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠলেন। এখানে লেখকের সংযম ও শিল্প-নৈপুণ্য দেখে বিস্মিত হতে হয়। সুপরিচিত এবং সম্পর্কযুক্ত শব্দের মাধ্যমে সাধারণ গ্রাহ্য যুক্তির পথ ধরে তিনি অনায়াসে এক নিদারুণ সংকট উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছেন।

সত্যকে দেখার স্লং সেই সত্যের সামাজিক ও ব্যক্তিগত বাস্তব রূপ তুলে ধরার ক্ষমতা শ্রেষ্ঠ শিল্পীর লক্ষণ সন্দেহ নেই কিন্তু সংকটের সত্যকে টুকরো টুকরো করে দেখলে সংকটের পূর্ণ চেহারা যেমন দেখা যায় না, তেমনি, Positive good man, যাকে কেন্দ্র করে সংকট প্রকট হয়ে ওঠে তাকেও সম্পূর্ণ করে পাওয়া যায় না। লেখকের শ্রেষ্ঠত্বের আর এক প্রমাণ এই তাত্ত্বিক সত্য তাঁর শুধু জ্ঞাতই নয়, এর স্বরূপও তাঁর অনায়াস-আয়ত্ত। তাই তো তিনি সদানন্দর মাধ্যমে স্তরে স্তরে বিন্যস্ত সামাজিক সংকটের জটিল রূপটি। সামগ্রিক ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। আর সামাজিক সংকট সামগ্রিক ভাবে ফুটে ওঠার দরুন সদানন্দ চরিত্রও স্বচ্ছন্দে স্বতঃই পূর্ণবিকশিত হয়ে উঠতে পেরেছে।

এই যে যুগপৎ চিত্র ও চরিত্র আঁকা, এ এক দুর্লভ গুণ। লেখক আমাদের সামনে যুগসংকট তুলে ধরতে চান; কিন্তু কী ভাবে? যুগসংকটকে আমরা নিজেরাই কি দেখতে চাই যে কেউ দেখালেই দেখব? দৈনন্দিন জীবনে এত অসংখ্য অন্যায় আমরা দেখছি আর ভুগছি যে আমাদের বোধশক্তিটাই ভোঁতা হয়ে গেছে, চোখে পড়ে গেছে চালশে। এখন আর কোন অসঙ্গতিই আমাদের চোখে পড়ে না, কোন মর্মান্তিক ঘটনাই আর দাগ কাটে আমাদের মনে। অতএব লেখককে আনতে হয়েছে এমন একজন মানুষকে যে এই সমাজ-সংসারে একেবারেই আগন্তুক। আগন্তুকের চোখে সবই ধরা পড়ে। অথচ আগন্তুক যেহেতু এই সমাজ-সংসারের সুখ-দুঃখের শরিক নয় তাই সে সব কিছু দেখবে খোলা চোখে সাদা মনে, নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে। তাই তার সেই দেখায় কোথাও গাম্ভীর্য বা গুরুত্ব নেই। থাকলেও Positive good man যেহেতু রাজনীতি বোঝে না, তার চোখের দেখা দুরূহ ব্যাপারগুলোও তখন আর গুরুভার হয় না। কৌতুকে-শ্লেষে মিলে মিশে এক উপাদেয় রসবস্তু হয়ে ওঠে, যার নাম দেওয়া যায় grotesque beauty. পাঠক লক্ষ্য করবেন, এই শ্লেষ ও কৌতুক মেশানো রচনার grotesque beauty শুধু নায়ক সদানন্দর মধ্যে নয়, গ্রন্থের সর্বত্র সমস্ত চরিত্র ও ঘটনার মধ্যেই সূক্ষ্মভাবে বিরাজমান।

তবে কি শুধু কৌতুকে বিদ্রুপে আমাদের এই যুগসংকটের অন্ধকারটাকেই প্রকট করার জন্যে positive good man-এর মাধ্যম ব্যবহার? না। তমসো মা জ্যোতির্গময়য়া-উপনিষদের এই প্রার্থনাই লেখকের শিল্প-প্রেরণা। positive good man-এই আলোরই প্রদীপ। যুগ সংকটেই এদের আবির্ভাব ঘটে। এরা এলেই সংকটের সামগ্রিক চেহারাটা আমাদের সামনে প্রকট হয়, আমরা শিউরে উঠি, আমরা আলোতে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রার্থনায় নতজানু হই। আর সেই তো আমাদের পরিত্রাণ।

শ্বশুরের লালসাকে ধিক্কার দিয়ে, তার মর্যাদার মুখোশটাকে খুলে জনতার সামনে দু’পায়ে থেঁতলে দিয়ে নয়নতারা তার স্বামীর ভিটে জন্মের মতন ছেড়ে এসেছিল বটে কিন্তু সেই থেকে তাকে হতে হয়েছিল পরস্পরবিরোধী দুই প্রবণতার শিকার। অসুস্থ সদানন্দকে রাস্তা থেকে বাড়িতে কুড়িয়ে এনে নয়নতারা তাকে প্রাণপাত সেবা করে এবং তজ্জনিত লাঞ্ছনা। সয়ে তাকে সুস্থ করে তোলে অথচ সে নিজে তখন নিখিলেশের স্ত্রী। নিখিলেশ ততদিনে তাকে লেখাপড়া শিখিয়েছে, তাকে অফিসে চাকরি পাইয়ে দিয়েছে। নিখিলেশ তাকে তার অসহায় অবস্থা থেকে রক্ষা করেছে। সে তাই নিখিলেশকে ভালবাসে। কিন্তু সদানন্দকে?…

সদানন্দ নয়নতারাকে অপ্রত্যাশিত ভাবে বিপুল অর্থ দিয়েছিল বটে কিন্তু সে কি নয়নতারা তাকে রোগে সেবা করেছিল বলে? কিম্বা সে কি নয়নতারাকে সে বিনা দোষে ত্যাগ করেছিল বলে? নাকি…

ফাউস্টকে বাজী রেখেছিলেন ঈশ্বর। শয়তান বলেছিল, এই পৃথিবীকে আমি বাড়ি গাড়ি নারী সম্পদ আর খেতাব খয়রাৎ দিয়ে দখল করে ফেলেছি, ব্যভিচার যুদ্ধ আর মহামারী ছড়িয়ে মানুষদের এমন কোণঠাসা করে রেখেছি যে, সবাই আমাকে ষোড়শোপচারে পূজো করছে। অতএব এই দুনিয়াদারী আমার। ঈশ্বর বললেন, তুমি যদি ওই পবিত্র-প্রাণ ফাউস্‌টের আত্মাকেও আয়ত্ব করতে পারো, নিভিয়ে দিতে পারো তার বুক থেকে প্রেমের দীপশিখা তবেই স্বীকার করব এই পৃথিবী তোমার। শয়তান ফাউস্‌টের আত্মা কিনে নিয়েছিল, তাঁকে ভোগ সুখ ও জগতের যাবতীয় বিলাস-ব্যসনের মধ্যে ডুবিয়ে রাখতে পেরেছিল। কিন্তু ফাউসট তাঁর প্রাণের সেই প্রেমের দীপশিখাটি কিছুতেই নিভতে দেন নি। শেষ পর্যন্ত তাই ফাউস্‌টেরই জয় হল। শয়তান আর পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতি হতে পারল না।

ফাউস্‌টের সেই পবিত্র প্রেমের শিখাটিই বুঝি দু’চোখের দৃষ্টি-প্রদীপে ধরে পৃথিবীর অন্ধকার পায়ে পায়ে পার হয়ে সদানন্দও তার লক্ষ্যস্থলের দিকে হেঁটে চলছিল। আর ওদিকে তখন কলকাতার অভিজাত পল্লী থিয়েটার রোডের এক সুরম্য সৌধে পড়ে-পাওয়া বিপুল অর্থে কেনা সুখের কুষ্ঠব্যাধিতে ভুগছিল নয়নতারা।

দিব্য প্রেমের পবিত্র আলোটি নিয়ে আজ থেকে এক হাজার নয়শ তিয়াত্তর বছর আগে পৃথিবীতে এসেছিলেন প্রথম Positive good man. তিনিও ওই সদানন্দর মতই পৃথিবীর পথে পথে সেদিন হেঁটে চলেছিলেন। তিনিও মানুষের কল্যাণই চেয়েছিলেন। মানুষের কল্যাণের জন্যে তিনি তাঁর সারা জীবনের তপস্যার ফল মানুষকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। সে-তপস্যার ফল মানুষের কী কী কল্যাণ করেছে সদানন্দর মতন তিনিও তা দেখতে বেরিয়েছিলেন তখন। হাঁটতে হাঁটতে একদিন তিনি সেদিনের থিয়েটার রোডের এক সুরম্য সৌধে গিয়ে উপস্থিত হলেন। রাজকীয় উৎসবে সেখানে তখন ফরিশীয় পুরোহিতরা সকলে উপস্থিত–দীয়তাং ভূজ্যতাংএর রব উঠছে চারদিকে। হঠাৎ তারই মধ্যে এক ছন্নছাড়া ছিন্নবাস মানুষের উপস্থিতি যেন সব কিছু হঠাৎ তছনছ করে দিলে। কেউ তাঁকে সহ্য করতে পারলে না, কেউ তাঁকে স্বীকার করতেও চাইলে না–এমন কি নয়নতারাও না। কেবল সমবেত পাপের হিংস্র ক্রোধ মুষ্টিবদ্ধ হয়ে ছুটে এল তাঁর দিকে–তাকে রক্তাক্ত করে ছাড়ল। নিহত মানুষটির সেই রক্তে স্নান করে তখন পবিত্র হল নয়নতারা। নয়নতারার সুখের কুষ্ঠব্যাধি মিথ্যের খোলসের মতন সেই মুহূর্তেই খুলে পড়ল তার শরীর থেকে। প্রেমে জ্যোতিষ্মতী হয়ে উঠল সে। পাপের পাথর চাপা সত্য তখন মুক্তি পেল কণ্ঠে নয়নতারা নির্দ্বিধায় প্রকাশ্যে ঘোষণা করল—’ইনি আমার স্বামী’।

কিন্তু একালের যীশু তখনও চিৎকার করে বলে চলেছে—’আমি তোমাদের মতন হতে পারি নি, তোমরা আমার সেই অক্ষমতার বিচার কর, তোমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে না পারার অপরাধের বিচার কর। আমি আসামী, আমি হাজির হয়েছি।’

অনুরূপ আর এক কণ্ঠস্বর শুনি আমরা ইয়োনেসকোর “গণ্ডার” নাটকের নায়কের মুখে—”I’m the last man left, and I’m staying that way until the end, I’m not capitulating.”

***

বিমল মিত্র তাঁর এই উপন্যাসে যে বিশাল জগৎ সৃষ্টি করেছেন তার প্রতিটি ঘটনা এবং প্রতিটি চরিত্র এমনই বিশ্বাসযোগ্য ও হৃদয়গ্রাহী যে আমরা আমাদের অজ্ঞাতসারেই এই জগতের সামিল হয়ে যাই কিংবা কখন যেন, কেমন করে যেন, এ জগৎ আমাদেরই জগৎ হয়ে ওঠে। সব কিছুর মধ্যে এখানে আমরা আমাদের নিজেদেরই দেখতে পাই, আমরা অবহিত হয়ে উঠি। আর এমন করে যিনি আমাদের আত্ম-অবহিত করে তোলেন, নিঃসন্দেহে তিনি আমাদেরই লেখক, আমাদের প্রিয় লেখক।

যজ্ঞেশ্বর রায়
৯ এপ্রিল ১৯৭৩

 ১. মহড়া

“আমি অতি সাধারণ মানুষ। এই সাধারণ মানুষের কথা আজকালকার ক্ষমতালোভী মানুষেরা শুনিবে কিনা জানি না। ক্ষমতা পাইবার লোভে মানুষ যখন আজকাল যে-কোনও অন্যায় আচরণ করিতে প্রস্তুত সেই সময় আমার মত সাধারণ মানুষের কাহিনী শুনিবার মত লোক নাই জানিয়াও আমি আমার এই জীবন লিখিতে বসিয়াছি। এই অবিশ্বাসের যুগেও আমি বিশ্বাস করি পৃথিবীর কোথাও-না-কোথাও একজন বিশ্বাসী-প্রাণ মানুষ আছে। সে মানুষ এখনও সততা এবং সত্যবাদিতাকে বিশ্বাস করে। বিশ্বাস করে ধর্মকে, বিশ্বাস করে ভালবাসাকে এবং বিশ্বাস করে ঈশ্বরকে। এই তিন শক্তিকে যে বিশ্বাস করে না তাহার জন্য আমার একাহিনী নয়। তাহারা আমার এই কাহিনী না পড়িলেও আমি দুঃখ করিব না। ঈশ্বর যদি একজন যিশুখৃষ্টের জন্য হাজার-হাজার বছর অপেক্ষা করিতে পারেন, তাহা হইলে আমার মত নগণ্য লোক একজন সৎ পাঠকের জন্য লক্ষ-লক্ষ বছর অনায়াসেই অপেক্ষা করিতে পারিব। আমার বয়স এখন..”

এই পর্যন্ত লিখেই সদানন্দবাবু থামলেন। বয়েসটা হিসেব করতে হবে। বয়েস কত হলো তাঁর? ভাবতে ভাবতে সদানন্দবাবু ভাবনার তলায় তলিয়ে গেলেন। কম দিন তো হলো না। অত দিনের সব কথা মনে রাখা কি সহজ! অথচ মনে করতেই হবে। মনে না করতে পারলে জীবনী লেখা ব্যর্থ হবে। সব কথাই তাঁকে খুলে লিখতে হবে। কোথাও কথা গোপন করা চলবে না তাঁর। যে-জীবন থেকে সরে এসে তিনি এখানে এই চৌবেড়িয়াতে নির্বাসনদণ্ড ভোগ করছেন সেই ফেলে আসা জীবনের কথা তাকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে আবার মনে করতেই হবে। আবার তাঁর ফেলে আসা জীবনটাকে আগাগোড়া পরিক্রমা করতে হবে।

তাঁর সেই ছোটবেলার কথাটাও তিনি মনে করতে চেষ্টা করলেন।

তিনি লিখতে লাগলেন—“আপাতদৃষ্টিতে সেই ছোট বেলা হইতেই আমার কোনও অভাব ছিল না। যাহাকে সংসারী লোক অভাব বলে তাহা আমার ছিল না। আমি নবাবগঞ্জের প্রবল-প্রতাপ জমিদার নরনারায়ণ চৌধুরীর একমাত্র পৌত্র, আর হরনারায়ণ চৌধুরীর একমাত্র পুত্র সদানন্দ চৌধুরী, যাহা চাহিতাম তাহাই পাইতাম। চাহিয়া না পাওয়ার দুঃখ যে কী ভীষণ অসহনীয় তাহা আমাকে কখনও বুঝিতে হয় নাই। অথচ সেই আমার কপালেই না-চাহিয়া সব পাওয়ার বিপর্যয় যে এমন মর্মান্তিক ট্রাজেডি হইয়া দাঁড়াইবে তাহা আমি সেই অল্প বয়সে উপলব্ধি করিতে পারি নাই।”

লিখতে লিখতে সদানন্দবাবুর ভাবতে বড় ভালো লাগলো। নবাবগঞ্জের সেই বাড়িটা, সেই গাছ-পালা-পুকুর, সেই বারোয়ারি-তলা, আর সেই চণ্ডীমণ্ডপ। কথাগুলো যেন ভোলা যায় না। অথচ ভুলতেই তো চেয়েছিলেন তিনি। ভোলবার জন্যেই তো এই চৌবেড়িয়া গ্রামে এসেছিলেন।

ঘরের মধ্যে একটা ছোট তক্তপোষ। তের টাকায় কিনে এনেছিলেন চৌবেড়িয়ার বাজার থেকে। তার ওপর একটা মাদুর। যখন এখানে এসেছিলেন তখন কিছুই সঙ্গে আনেন নি। তাঁর কিছু থাকলে তবে তো সঙ্গে আনবেন। নবাবগঞ্জ থেকে ট্রেনে উঠে একবার শুধু তিনি সুলতানপুরে গিয়েছিলেন। তারপর সেখান থেকে কেষ্টনগর। কেষ্টনগর থেকে নৈহাটি। আর তারপর ভাসতে ভাসতে কলকাতা হয়ে একেবারে এই এখানে। এখানে তখন কে-ই বা ছিল! একেবারে যেন পৃথিবীর ওপিঠ। না আছে একটা হাট, আর না আছে একটা স্কুল।

প্রথম আশ্রয় পেলেন পালেদের আড়তে। রসিক পাল ধার্মিক মানুষ। তিনি আপাদমস্তক ভালো করে নজর দিয়ে দেখলেন। বললেন–আপনার নাম?

সদানন্দ চৌধুরী!

ব্রাহ্মণ না কায়স্থ?

ব্রাহ্মণ।

ব্রাহ্মণ শুনে খুব খাতির করে বসতে বললেন। তারপর নানা খবরাখবর নিলেন। কোথায় বাড়ি, পিতার নাম কী, কী উদ্দেশ্যে চৌবেড়িয়ায় আগমন, বিদ্যা কতদূর। সব শুনে বললেন–ঠিক আছে, আপনি যখন এসে পড়েছে তখন আর কোনও ভাবনা নেই, আপনি এখানে থাকুন–

রসিক পাল মশাই চৌবেড়িয়ার বনেদী কারবারী। পাট, তিসি, তিল মেস্তার কারবার করে তিনি বড়লোক হয়েছেন। বিরাট আড়ত ছিল তাঁর। সেই আড়তে বসে তিনি কারবার করতেন আর মহাজনী কারবারের নামে নানা লোককে সাহায্যও করতেন। চৌবেড়িয়া গ্রামের সাধারণ মানুষ পাল মশাইকে ছাড়া তাদের জীবনযাপনের কথা কল্পনাও করতে পারত না। বাড়িতে উৎসবে-অনুষ্ঠানে বিবাহে, শ্রাদ্ধে, অন্নপ্রাশনে, পৌষ-সংক্রান্তিতে সব ব্যাপারেই রসিক পাল মশাই-এর কাছে এসে হাজির হতো। বলতো– যাবেন পাল মশাই, আপনি গিয়ে একবার পায়ের ধুলো দেবেন–

সেই রসিক পালের বড় ইচ্ছে হয়েছিল চৌবেড়িয়াতে একটা স্কুল হোক। গ্রামের ছেলেদের বাইরের গ্রামে গিয়ে লেখাপড়া করতে হয়, এটা তাঁর ভালো লাগতো না। নিজে তিনি লেখাপড়ার ধার ধারতেন না। কিন্তু তার জন্যে তাঁর দুঃখ ছিল। ছেলেদের কলকাতার হোস্টেলে রেখে লেখাপড়া শিখিয়েছে বরাবর। কিন্তু গ্রামে স্কুল করতে গেলে মাস্টার দরকার। এমন মাস্টার চাই যার সময় আছে ছাত্র পড়াবার। কিন্তু তেমন বেকার লোক কোথায় পাবেন? কে মাস্টারি করতে রাজি হবে?

তা শেষ পর্যন্ত এই সদানন্দ চৌধুরীকে পেয়ে গেলেন। রসিক পালের আড়তে অনেক লোক খাওয়া-দাওয়া করে। ব্যাপারীরা কাজে কর্মে আড়তে এলে তাদেরও খাওয়া-শোওয়ার বন্দোবস্ত রাখতে হয়। সদানন্দ সেখানেই থাকুক।

কিন্তু সদানন্দ হাত-জোড় করলে। বললে–তার চেয়ে পাল মশাই আমি বরং স্বপাক আহারের ব্যবস্থা করি। আমার চাল-ডাল-নুন-তেলের ব্যবস্থাটা শুধু আপনি করে দিন। আমি বরং মাইনেই নেব না–

রসিক পাল তাজ্জব হয়ে গেলেন কথা শুনে। বললেন–মাইনে নেবে না?

সদানন্দ বললে—না–

–তাহলে তোমার খরচ চলবে কেমন করে?

সদানন্দ বললে–আমার তো খরচের কিছু দরকার নেই। আমি নেশা-ভাঙ করি না, চা খাই না, পান-তামাক-বিড়ি কিছুরই দরকার হয় না আমার। মাছ-মাংস খাওয়া আমার নিষেধ। দু’বেলা দু’মুঠো ভাত আর আলুভাতে পেলেই আমার চলে যাবে–

রসিক পাল অনেক কাল ধরে অনেক লোক চরিয়ে বুড়ো হয়েছে। এমন কথা কারো মুখে কখনও শোনেননি। আবার ভালো করে আপাদ-মস্তক দেখে নিলেন সদানন্দর। তাঁর মনে হলো এখনও যেন তাঁর অনেক দেখতে আর অনেক শিখতে বাকি।

বললেন–আচ্ছা, আজ রাত্তিরটা তো আড়ত-বাড়িতে থাকো, তারপর কাল যা-হয় করা যাবে–

বলে তিনি সেরাত্রের মত বাড়িতে বিশ্রাম করতে চলে গেলেন। আড়তের ক্যাশবাক্সে চাবি পড়লো। চাবি নেবার আগে হরি মুহুরিকে বললেন–ওই লোকটাকে একটু যত্ন-আত্তি কোরো হরি, লোকটা ভালো মনে হচ্ছে–

হরি মুহুরিই সদানন্দের সব বন্দোবস্ত করে দিলে। পরের দিন রসিক পাল হরি মুহুরিকে জিজ্ঞেস করলেন–কালকে রাত্তিরে ওই ছোকরার কোনও অসুবিধে হয়নি তো?

হরি মুহুরি রসিক পালের আড়তের পুরোন লোক। আড়তে বহু লোকের আনাগোনা দেখেছে, বহু লোকের তদবির তদারক করেছে।

বললে–আজ্ঞে অসুবিধে হবে কেন? অসুবিধে হবার কথা তো নয়।

–কী খেতে দিয়েছিলে?

–আজ্ঞে ভদ্দরলোক কিছুই খান না। বলতে গেলে উপোস। উপোসই এক রকম।

–কী রকম?

–আজ্ঞে, একখানা রুটি আর সিকি বাটি ডাল। আর কিছু নিলেন না।

–মাছ হয়নি কাল?

–আজ্ঞে হয়েছিল, কিন্তু উনি মাছ-মাংস-ডিম কিছুই ছোঁন না।

–শোওয়ার কোনও অসুবিধে হয়নি? নতুন জায়গা তো!

–অসুবিধে হলে কি আর গান গাইতেন?

–গান?

রসিক পাল অবাক হয়ে গেলেন। আবার জিজ্ঞেস করলেন–গান? কী গান?

হরি মুহুরি বললে–ঘুমোতে ঘুমোতে অনেকের গান গাওয়া যেমন অভ্যেস থাকে তেমনি আর কি।

–কী, গানটা কী?

হরি মুহুরি বলল কবির গান আজ্ঞে–ছোটবেলায় হরু ঠাকুরের কবির গান শুনেছিলুম, সেই গান

–হরু ঠাকুরের কোন্ গান?

হরি মুহুরি গানটা বললে–

আগে যদি প্রাণসখি জানিতাম।
শ্যামের পীরিতি গরল মিশ্রিত,
কারো মুখে যদি শুনিতাম ॥
কুলবতী বালা হইয়া সরলা
তবে কি ও বিষ ভখিতাম ॥

রসিক পাল সাদাসিধে মানুষ। কবি নয়, কিছু নয়, সহজ সাধারণ মানুষের গানের কথা শুনে অবাক হয়ে গেলেন তিনি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গান গায়, পাগল নাকি হে?

হরি মুহুরি বললে–গানও করতে লাগলেন আবার কথাও বলতে লাগলেন। সারা রাত গান আর কথার জ্বালায় আমাদের কারো ঘুম হয়নি কর্তামশাই–

–গান তো হলো, কিন্তু কথা? কথা কিসের আবার?

হরি মুহুরি বললে–সে সব অনেক কথা, সব কথার মানে বুঝতে পারিনি। কখনও আবার একজন মেয়েমানুষের নাম ধরে ডাকে, আবার কখনও…

–মেয়েমানুষ? মেয়েমানুষ মানে? চরিত্র খারাপ নাকি লোকটার?

হরি মুহুরি বললে–আজ্ঞে তা বলতে পারবো না, তবে যে-মেয়েটার নাম ধরে ডাকছিলেন তার নামটা ভারি নতুন–

–কী রকম?

হরি মুহুরি বললে–নয়ন। কখনও নয়ন বলছিলেন, কখনও আবার নয়নতারা–মনে হলো নিশ্চয়ই কোনও মেয়েমানুষের নাম হবে। রাত্তির বেলা ঘুমোতে ঘুমোতে মেয়েমানুষের নাম ধরে কথা বলে, পীরিতের গান গায়, এ তো ভালো লক্ষণ নয় কর্তামশাই, আপনি কেন অমন লোককে আড়তে ঠাঁই দিলেন বুঝতে পারছি নে, কাজটা কি ভালো হলো?

রসিক পাল তখন আর কিছু বললেন না। মনে মনে ভাবতে লাগলেন। এতদিন সংসারে বাস করে এসে এত লোক চরিয়ে তিনি কি শেষকালে ভুল করলেন নাকি! হরি মুহরির কথার কোনও সোজা উত্তর দিলেন না। শুধু বললেন–ঠিক আছে, তুমি একবার ওঁকে আমার গদিতে পাঠিয়ে দিও তো–

গদিবাড়িতে রসিক পাল রোজ সকালে এসে কয়েক ঘণ্টা বসেন। সেই সময়ে খাতক পাওনাদার পাড়া-প্রতিবেশী নানা রকম লোক নানা আর্জি নিয়ে তাঁর কাছে আসে। কেউ টাকা খয়রাতি চায়, কেউ শুধু মুখটা দেখাতে আসে। তারপর আসে ব্যাপারীরা। কারবারের লেনদেন নিয়ে কথাবার্তা হয় সেই সময়। রসিক পাল মশাই তখন কুঁড়োজালির মধ্যে হাত পুরে মালা জপ্ করেন আর মুখে কথা চলে। রসিক পালের সব কাজই ঘড়ি ধরা। সকাল বেলা উঠেই গঙ্গাস্নান। তখন ঘড়িতে ভোর ছ’টা! পাল মশাইকে দেখেই সবাই বুঝতো তখন ঘড়িতে ছটা বেজেছে। কী গ্রীষ্ম, কী বর্ষা তার কোনও ব্যতিক্রম হতো না। তারপর গদিবাড়িতে এসে যখন বসতেন তখন ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় আটটা। তারপর যখন ঘড়িতে সকাল নটা তখন একবার হাঁচবেন।

এরকম ঘড়ি মিলিয়ে কাজ বড় একটা দেখা যায় না। কিন্তু সেই লোকেরই একদিন সকাল ন’টার সময় হাঁচি পড়লো না।

সে এক বিস্ময়কর কাণ্ড! ঘটনাটা দেখে সবাই অবাক হয়ে গেল। এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলো। এ কী হলো! এমন তো হয় না! সকলেই বুঝলো এবার একটা কিছু সর্বনাশ ঘটবে।

রসিক পাল হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন–হরি–

এক ডাকেই আড়ত থেকে হরি মুহুরি এসে হাজির। হরি মুহুরি আসতে পাল মশাই বললেন–হরি, একবার বলাই ডাক্তারকে ডাকো দিকিনি। বলবে আমার শরীর খারাপ, আমি এখুনি বাড়ির ভেতরে যাচ্ছি–

তারপর ডাক্তার এলো। পাল মশাইকে পরীক্ষা করলো। হয়ত ওষুধ-বিষুধও দিলে। কী ওষুধ দিলে ডাক্তার তা কারো জানবার কথা নয়। কেন ঘড়িতে ঠিক ন’টা বাজবার সঙ্গে সঙ্গে তার হাঁচি সেদিন পড়লো না, ডাক্তারি-শাস্ত্রে তার নিদান আছে কিনা তাও কেউ জিজ্ঞেস করলে না। কিন্তু দু’দিন পরে আবার সবাই দেখলে ঠিক ঘড়িতে যখন কাঁটায়-কাঁটায় ছ’টা তখন তিনি গঙ্গাস্নানে চলেছেন। তারপর ঠিক আটটার সময় গদিবাড়িতে এসে বসলেন। আর ঠিক তারপর যখন ন’টার ঘরে ঘড়ির বড় কাঁটাটা ছুঁয়েছে তখন ‘হ্যাচ-চো’ শব্দে তাঁর হাঁচি পড়লো। তখন সবাই নিশ্চিন্ত।

সদানন্দর ঠাকুরদাদা নরনারায়ণ চৌধুরীরও ঠিক এমনি ঘড়ির কাঁটা ধরা কাজ ছিল। নদীতে স্নান করে এসে বসতেন কাছারি-ঘরে। তখন কৃষাণ, খাতক, পাওনাদার, গ্রামের আরো পাঁচ-দশজন গণ্যমান্য লোক এসে বসতো। বিরাট কাছারি-ঘর। কাছারি-ঘরের পেছনে ঢাকা বারান্দা। সেই বারান্দার লাগোয়া সিঁড়ি দিয়ে নরনারায়ণ চৌধুরী দোতলায় উঠতেন। দোতলায় ছিল তাঁর শোবার ঘর। সেই শোবার ঘরের মধ্যেই ছিল তাঁর লোহার সিন্দুক।

সদানন্দ একদিন বলেছিল–দাদু, তোমার কত টাকা!

টাকা! শুধু টাকা নয়, থাক্ থাক্ নোট। তার পাশে হীরে পান্না চুনি মুক্তো! আরো কত দামী-দামী জিনিস।

নরনারায়ণ যখন সিন্দুক খুলেছিলেন তখন দেখতে পাননি যে তাঁর নাতি কখন নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তখন সদানন্দর বয়েস পাঁচ কি ছয়। পাঁচ ছ’ বছর বয়েস থেকেই নাতি যেন কেমন সব লক্ষ্য করতো। সব জিনিস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে, সব জিনিস সম্বন্ধে কৌতূহল দেখাবে। বলবে–তোমার দাড়ি সাদা কেন দাদু?।

কর্তাবাবু বলতেন–একে নিয়ে তো মহা মুশকিল হলো দেখছি–ওরে কে আছিস, কোথায় গেলি সব–

দীনু চৌধুরী বাড়ীর পুরনো ভৃত্য দীননাথ। দীননাথ এসে তখন নাতিকে টানতে টানতে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যেত।

কর্তাবাবু বলতেন–যা দীনু, ওকে নিয়ে পুকুরের হাঁস দেখা গে যা–

সত্যিই তখন অনেক কাজ নরনারায়ণ চৌধুরীর। একগাদা লোক কাছারি বাড়িতে। টাকাকড়ির কথা হচ্ছে তখন খাতকদের সঙ্গে। সুদের কড়াক্রান্তির চুলচেরা হিসেব। একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলেই লোকসান হয়ে যাবে দাদুর। টাকার ব্যাপারে নরনারায়ণ চৌধুরীর কাছে সব কিছু তুচ্ছ। অন্য সময়ে দাদুর খুব ভালোবাসা। অন্য সময়ে নাতি না হলে দাদুর চলে না। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেন–সদা কোথায় গেল, সদাকে দেখছি নে যে–

রসিক পাল মশাইকে দেখে সদানন্দর সেই কর্তাবাবুকেই মনে পড়তো কেবল। ঠিক তেমনি কারবার, ঠিক তেমনি ব্যবহার।

.

পরের দিন হরি মুহুরি এল।

বললে–কেমন আছেন বাবু, ঘুম হয়েছিল তো?

সদানন্দ বললে—হ্যাঁ–

–আপনাকে কর্তামশাই একবার ডেকেছেন গদিবাড়িতে—

কথাটা শুনেই সদানন্দ সোজা গদি বাড়িতে যাচ্ছিল। হরি মুহুরি বললে–না না, এখন যাবেন না। এখন নয়–

সদানন্দ বললে–কেন, এখন নয় কেন? এখন ঘুম ভাঙেনি বুঝি তাঁর?

হরি মুহুরি বললে–ঘুম? ঘুম কর্তামশাই-এর ভোর চারটেয় ভেঙেছে, তারপর ছটার সময় গঙ্গাস্নান করেছেন, তারপর আহ্নিক সেরে আটটায় গদিবাড়িতে এসে বসেছেন–

সদানন্দ বললে–তা এখন তো সাড়ে আটটা, এখন যাই–

না, এখন না। ন’টা বাজুক, নটার সময় কর্তামশাই হাঁচবেন—

–হাঁচবেন?

–হ্যাঁ।

–হাঁচবেন মানে?

হরি মুহুরি এই বেকুফকে নিয়ে মহা মুশকিলে পড়লো। বললে–আরে আপনি কি বাংলা কথাও বোঝেন না? হাঁচি মশাই হাঁচি। সর্দি হলে যে-হাঁচি মানুষ হাঁচে সেই হাঁচি। আপনি কখনও হাঁচেন না?

সদানন্দ বললে–হাঁচবো না কেন?

–সেই রকম কর্তামশাইও হাঁচেন। ঠিক ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় ন’টার সময় ঘড়ি মিলিয়ে হাঁচেন।

সদানন্দ তখন চৌবেড়িয়াতে নতুন। তাই অবাক হয়ে গিয়েছিল। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল–একেবারে ঘড়ি ধরে ন’টার সময়?

হরি মুহুরির তখন হাতে অনেক কাজ। সে কথার উত্তর দেবার সময় ছিল না তার। সে নিজের কাজে চলে গিয়েছিল আড়তঘর ছেড়ে। তারপর আড়তঘরের ঘড়িতে যখন ন’টা বাজলো ঢং ঢং করে তখন সদানন্দ সবে উঠতে যাচ্ছে এমন সময় পাশের গদিবাড়ি থেকে একটা বিকট হাঁচির শব্দ এলো। একেবারে ঘর-কাঁপানো কান-ফাটানো হাঁচি। ঘড়ির সঙ্গে সদানন্দ আর একবার মিলিয়ে দেখে নিলে হাঁচির টাইমটা। তারপর গদিবাড়ির দিকে পা বাড়ালো।

পাল মশাই-এর ডান হাত তখন কুঁড়োজালির ভেতরে মালা জপতে ব্যস্ত আর বাঁ হাত দিয়ে কাগজপত্র দেখছেন আর সামনে বসা লোকদের সঙ্গে কথা বলছেন। এমন সময় সদানন্দকে দেখেই বাঁ হাতের খাতাটা সরিয়ে পাশে রাখলেন।

বললেন–এই যে, এসো এসো, বোস

সদানন্দ তক্তপোশের ওপর পাতা মাদুরের ওপর পা গুটিয়ে বসলো। যারা এতক্ষণ সামনে ছিল তার একটু নড়ে-চড়ে সরে বসলো।

বলি, তুমি যে সঙ্গীত-সাধনা করো তা তো আমাকে আগে বলোনি, তোমার দেশ কোথায়, দেশে কে কোথায় আছেন, কে নেই সব বলেছ আর আসল কথাটাই বলো নি তো। তুমি গানের চর্চাও করো নাকি আবার?

গান! সদানন্দ কথা বলতে গিয়ে একটু থমকে গেল। বললে–গান?

–হ্যাঁ হ্যাঁ গান। হরি মুহুরি সব বলেছে আমাকে। আড়তঘরে ঘুমোতে ঘুমোতে তুমি গান গেয়েছ, নয়নতারার সঙ্গে কথা বলেছ, আরো কী কী সব করেছ, ও সব বলেছে আমাকে। তুমি কি কবির দলে ছিলে নাকি?

সদানন্দ লজ্জায় পড়ে গেল। কী বলবে বুঝতে পারলে না।

পাল মশাই আবার বললেন–তোমার চেহারা দেখে কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি তুমি গান গাইতে পারো। আমি ভেবেঝিলুম অভাবে পড়ে এখানে এসেছ, আমার কাছে আশ্রয় চাও, তাই তোমাকে ইস্কুলের কথা বলেছিলুম। গাঁয়ের ছেলেরা লেখা-পড়া করতে পারে না…তা নয়নতারা তোমার কে?

সদানন্দ বললে–নয়নতারা? আমি বলেছি?

–হ্যাঁ, গান গেয়েছ, নয়নতারার নাম ধরে কথা বলেছ। ঘুমোতে ঘুমোতে তোমার গান গাওয়ার অভ্যেস আছে বুঝি?

সদানন্দ কোনও উত্তর দিলে না। আর উত্তর দেবেই বা কী? উত্তর দেবার কিছু থাকলে তবে তো উত্তর দেবে?

–কী গানটা যেন বললে–হরি মুহুরি। দাঁড়াও মনে করি। ছোটবেলায় আমিও গানটা—শুনেছি–

আগে যদি প্রাণসখি জানিতাম।
শ্যামের পীরিত গরল মিশ্রিত
কারো মুখে যদি শুনিতাম ॥
কুলবতী বালা হইয়া সরলা
তবে কি ও বিষ ভখিতাম ॥

লজ্জায় মাথা কাটা গেল সদানন্দর। পাল মশাই গানের কলিগুলো বলছেন আর আশেপাশের সবাই শুনছে।

রসিক পাল মশাই আবার বলতে লাগলেন–কিন্তু বাপু, তোমায় বলে রাখছি গান-টান করলে তো আমার চলবে না। গান গাইতে ইচ্ছে করে অন্য জায়গায় চেষ্টা দেখ। আমি গান-টান বিশেষ পছন্দ করি নে। আর গান যদি ভক্তিমূলক গান হয় তাও বুঝি। এসব গান তো চাপল্যের গান হে কী বলল, তোমরা কী বলে?

রসিক পাল সকলের দিকে চেয়ে তাদের মতামত চাইতে তারাও সবাই একবাক্যে বললে–হ্যাঁ কর্তামশাই, আপনি তো হক কথাই বলেছেন–

–ওই দেখ, সবাই আমার কথায় সায় দিলে। আমি অন্যায্য কথা কখনও বলিনে, তা জানো?

তারপর বাঁ হাত দিয়ে আবার হিসেবের খাতাটা কাছে টেনে নিলেন। খাতকরা যে প্রাণের দায়ে তাঁর অন্যায্য কথাতেও সায় দিতে বাধ্য এ-কথা সদানন্দর পক্ষে মুখ ফুটে বলা অন্যায়। তাই আর সে কোনও কথা বললে না। চুপ করে রইল।

রসিক পাল মশাই খাতার হিসেবে মনোযোগ দিতে দিতে এতবার বললেন–যাও, তুমি এবার যাও–

সদানন্দ আর সেখানে বসলো না। তক্তপোশ থেকে উঠে সোজা গদিবাড়ির বাহিরে চলে গেল। রসিক পালের তখন আর ও-সব কথা ভাববার সময় ছিল না। মুহূর্তে হিসেবের গোলকধাঁধার মধ্যে জড়িয়ে পড়লেন। রসিক পাল আর নরনারায়ণ চৌধুরীদের কাছে হিসেবটাই ছিল সব। হিসেবই ধর্ম, হিসেবই অর্থ, হিসেবই ছিল মোক্ষ কাম এবং সব কিছু হিসেব করতে করতেই নরনারায়ণ চৌধুরী একদিন পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে পড়লেন। তখন আর উঠতে পারেন না তিনি।

মনে আছে তখনও পাল্কী করে কালীগঞ্জের বৌ আসতো দাদুর কাছে। সদানন্দ দেখতে পেলেই পাল্কীর কাছে দৌড়ে আসতো। বেশ ফরসা মোটাসোটা মানুষ, সাদা থান পরা। অমন ফরসা মেয়েমানুষ সদানন্দ আর জীবনে দেখেনি। নয়নতারাও ফরসা। সদানন্দর মা, হরনারায়ণ চৌধুরীর স্ত্রী, তিনিও ফরসা। কিন্তু কালীগঞ্জের বৌ শুধু ফরসা নয়, দুধে-আলতায় মেশানো ফরসা। গায়ের রং-এর দিকে একবার চাইলে কেবল চেয়েই দেখতে ইচ্ছে করে। পাল্কীটা উঠোনে থামতেই কালীগঞ্জের বৌ নামতো। মুখের ওপর একগলা ঘোমটা দিয়ে বাড়ির ভেতরে বারান্দায় ঢুকতো। সঙ্গে থাকতো একজন ঝি। ঝি আগে আগে চলতো আর পেছনে কালীগঞ্জের বৌ। চলতে চলতে একেবারে সিঁড়ি দিয়ে সোজা দোতলায় দাদুর ঘরে চলে যেত।

নরনারায়ণ তখন বিছানায় শুয়ে শুয়ে হিসেবের খাতা দেখছেন। আর মাথার কাছে সেই সিন্দুকটা। ওটা তিনি কাছছাড়া করতে পারতেন না।

–কে?

তারপর ঠাহর করে দেখেই যেন বিচলিত হয়ে উঠতেন।

–আমি নায়েব মশাই, আমি। কালীগঞ্জের বৌ।

–ও!

বলে যেন হঠাৎ বিব্রত হয়ে পড়তেন। একটু নড়ে-চড়ে সরে শুতে চেষ্টা করতেন।

বলতেন–তা আপনি আবার কষ্ট করে আসতে গেলেন কেন বৌ-মণি! আমি তো বলেই ছিলুম আপনাকে আর আসতে হবে না–

কালীগঞ্জের বৌ বলতো–কিন্তু আর তো আমি অপেক্ষা করতে পারছি না নায়েবমশাই। আর কত দিন অপেক্ষা করবো? এই দশ বছর ধরে আপনি বলে আসছেন আমাকে আসতে হবে না, আমাকে আসতে হবে না। শেষকালে আমি মারা গেলে কি আমার টাকাগুলো দেবেন? তখন সে-টাকা আমার কে খাবে? সে টাকায় কি আমার পিণ্ডি দেওয়া হবে?

–আঃ, বৌ মণি আপনি বড় রেগে যাচ্ছেন! আমি যখন বলেছি আপনার টাকা দেব তখন দেবই।

–কিন্তু কবে দেবেন তাই বলুন! আজই টাকা দিতে হবে আমাকে। এই আমি এখানে বসলুম। এখান থেকে আমি নড়ছি না আর যতক্ষণ না আমার দশ হাজার টাকা পচ্ছি–

বলে কালীগঞ্জের বৌ সেইখানে সেই মেঝের ওপরেই বসে পড়লো।

হঠাৎ দাদুর নজরে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠেছে–ওরে, খোকা এখানে কেন? ওরে কে আছিস, খোকাকে এখান থেকে নিয়ে যা, ও দীনু–

দীননাথ কোথা থেকে দৌড়তে দৌড়তে এসে সদানন্দর হাত ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে যেত। সদানন্দ আর দেখতে পেত না কালীগঞ্জের বৌকে। কিন্তু মন থেকে দূর করতে পারতো না দৃশ্যটা। থেকে থেকে কেবল কালীগঞ্জের বৌ-এর চেহারাটা চোখের ওপর ভেসে উঠতো। ঘুমের ঘোরেও মনে হতো ওই বুঝি কালীগঞ্জের বৌ এল!

একদিন দীনুকে জিজ্ঞেস করেছিল–ও বউটা কে দীনুমামা?

দীনুমামা বলেছিল–চুপ, ওকথা জিজ্ঞেস করতে নেই–

তবু ছাড়েনি সদানন্দ। জিজ্ঞেস করেছিল–ও দাদুর কাছে টাকা চায় কেন? কীসের টাকা? দাদু ওকে টাকা দেয় না কেন? ও কে?

দীনু বলেছিল–ও-সব কথা তোমার জানতে-নেই। ও কালীগঞ্জের বৌ–

এর বেশী আর কিছু বলতো না দীনু। শুধু দীনু নয়, ওই কালীগঞ্জের বউ বাড়ীতে এলেই বাড়িসুদ্ধ সবাই যেন কেমন গম্ভীর হয়ে যেত। দাদু থেকে শুরু করে বাবা মা সবাই কেমন চুপ করে থাকতো। কারোর মুখে আর কোনও কথা বেরোত না তখন। ও যেন কালীগঞ্জের বৌ নয়, যম। যেন নবাবগঞ্জের চৌধুরী বাড়িতে সাক্ষাৎ যম এসেছে চৌধুরীবাড়ীর সর্বনাশ করতে। যেন সে চলে গেলেই সবাই বাঁচে।

কিন্তু রসিক পাল মশাই-এর এখানে অন্য রকম। রসিক পাল মশাই চৌবেড়িয়ার সুখী মানুষ। ধর্মভীরু। সবাইকে দয়া-দাক্ষিণ্য করেন। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। আড়তে যেমন বহু লোক থাকে খায় শোয়, তেমনি আবার সুদের একটা পয়সা পর্যন্ত ছাড়েন না। বলেন– না হে, ওটি পারবো না। দাতব্য করতে বলো করছি কিন্তু সুদের হিসেবে গরমিল করতে পরবো না–ওটা পাপ–

রসিক পাল মশাই সত্যিই রসিক পুরুষ।

হঠাৎ হঠাৎ তাঁর অনেক কিছু মনে পড়ে যায়। সেদিনও তেমনি। কাজ করতে করতে আবার হঠাৎ ডেকে উঠলেন–হরি–

পাশের আড়তঘর থেকে হরি মুহুরি দৌড়ে এল। বললে–আজ্ঞে ডাকছেন, আমাকে?

রসিক পাল বললেন–দেখ হরি, ওই যে লোকটা, ওর নামটা কী যেন…

–আজ্ঞে কার কথা বলছেন?

–ওই যে, কাল বিকেলবেলা আমার গদিবাড়িতে এসেছিল। রাত্তিরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গান গাইছিল? আমি তাকে ডেকে সব জিজ্ঞেস করেছি। তা আমি ভাবছি কি জানো, আসলে ছেলেটা খারাপ নয়, বুঝলে? ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গান গাইলে ওর কী দোষ বলো? ঘুমোলে তো আর কারো জ্ঞান থাকে না! ঘুম না মড়া।

হরি মুহুরি বললে–আজ্ঞে, তা তো বটেই–

–তবে যে তুমি বললে–ছেলেটা ভালো নয়, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পীরিতের গান গায়, মেয়েমানুষদের নাম ধরে ডাকে!

হরি মুহুরি বললে–আজ্ঞে যা ঘটেছে আমি তাই-ই আপনাকে বলেছি–

না হে, আমি ভেবে দেখলাম ওর কিছু দোষ নেই। ওর জন্যে তোমাদের যদি ঘুমের ব্যাঘাত হয় তো ওর বিছানাটা না-হয় তোমরা অন্য ঘরে করে দাও–

হরি মুহুরি বললে–কিন্তু কর্তামশাই, তিনি তো চলে গেছেন–

–চলে গেছেন মানে?

–আজ্ঞে তিনি যে বললেন আপনি তাকে চলে যেতে বলেছেন।

–আমি? তাঁকে চলে যেতে বলেছি?

–আজ্ঞে তিনি তো তাই বললেন। বলে আড়তঘর ছেড়ে চলে গেলেন।

রসিক পাল রেগে গেলেন। বললেন–তোমাদের কি কোনও আক্কেল বলে কিছু নেই? তিনি বললেন আর তোমরাও তাঁকে যেতে দিলে? কোথায় যাবেন তিনি? তোমরা জানো তাঁর কোনও যাবার জায়গা নেই? তাঁকে জিজ্ঞেস করেছ তিনি যাবেন কোথায়? তার কোনও চুলোয় কি কেউ আছে যে সেখানে তিনি যাবেন?

হরি মুহুরি আর সেখানে দাঁড়াল না। সোজা একেবারে দৌড়তে লাগলো রাস্তার দিকে। সামনের বড় রাস্তাটা একেবারে গিয়ে পড়েছে গঙ্গার কাছে। তখনও সদানন্দ কোথায় যাবে ঠিক করতে পারেনি। গঞ্জের মুখে খানকয়েক দোকান। সেখানে গিয়েই ভাবছিল কোথায় যাওয়া যায়। সেই কোথায় নবাবগঞ্জ আর কোথায় সেই নৈহাটি আর কোথায় সেই সুলতানপুর। সব জায়গা থেকে ভাসতে ভাসতে একেবারে এই অজ গ্রামে চৌবেড়িয়াতে এসে হাজির হয়েছিল। এবার এখান থেকেও চলে যেতে হলো।

হঠাৎ পেছনে হরি মুহুরির গলা শোনা গেল।

–ও মশাই, ও মশাই—

ডাকতে ডাকতে সামনে এসে হাঁফাতে লাগলো বুড়ো মানুষটা।

বলল–আপনি তো খুব ভদ্রলোক মশাই, কর্তামশাইকে কিছু না বলে কয়ে চলে এলেন, এদিকে আমার হয়রানি, চলুন–

তখনও সদানন্দ ব্যাপারটা স্পষ্ট বুঝতে পারেনি।

হরি মুহুরি সদানন্দর হাতটা খপ করে ধরে ফেললে। ধরে টানতে লাগলো। বললে– আর বোঝবার কিছু নেই, চলুন কর্তামশাই আপনাকে ডাকছেন–

বলে টানতে টানতে একেবারে গদিবাড়িতে কর্তামশাই-এর সামনে হাজির করলো।

রসিক পাল বললেন–তুমি চলে যাচ্ছিলে যে?

সদানন্দ বললে–আজ্ঞে আপনি যে চলে যেতে বললেন–

–তুমি বলছো কী? আমি তোমাকে চলে যেতে বলেছি? এই যে এতগুলো লোক এখানে রয়েছে, এরাও তো শুনেছে, এরা কেউ বলুক তো আমি তোমাকে কখন চলে যেতে বললাম? বলুক এরা

তা তার দরকার হলো না। সদানন্দ আবার রয়ে গেল চৌবেড়িয়াতে। তার জন্যে অন্য একটা ঘরের বন্দোবস্ত হলো। ইস্কুল প্রতিষ্ঠা হলো। গভর্নমেন্ট থেকে প্রাইমারি স্কুলের টাকাও ধার্য হলো শেষ পর্যন্ত। সবই করে দিয়েছিলেন সেই রসিক পাল মশাই।

হায়, কিন্তু কোথায় গেলেন সেই রসিক পাল, আর কোথায় রইল তাঁর সেই স্কুল। সে-সব চলে গেছে এখন। সেই নরনারায়ণ চৌধুরী, সেই হরনারয়ণ চৌধুরী, সেই নয়নতারা, সেই নিখিলেশ, সেই কালিগঞ্জের বৌ, সবাই কে কোথায় চলে গেল তা জানবার প্রয়োজন তাঁর ফুরিয়ে গেছে আজ। সেই রসিক পালের দেওয়া ঘরখানাতেই তাঁর দিন কাটে এখন, এই চৌবেড়িয়ার রসিক পালের এস্টেট থেকেই তাঁর ভরণ-পোষণটা এসে যায়। আর সকাল থেকে রাত, রাত থেকে সকাল পর্যন্ত কোথা দিয়ে কেটে যায় কী করে কাটে তারও খেয়াল থাকে না সদানন্দবাবুর! রসিক পালের এস্টেটের টাকায় জীবন চলছে তাঁর। শুধু তাঁর নয়, অনেকেরই জীবন চলে। এ যেন ধর্মশালার মত অনেকটা। এককালের মাস্টার মশাই এখানকার অনেকেরই মাস্টার মশাই, তাঁকে মানে সবাই। ভাত আসে অতিথিশালা থেকে, আর তিনি রুটিন বেঁধে জীবন-যাপন করেন। বেশ শান্তিতেই আছেন তিনি। এই জীবনটার কথাই তিনি লিখে যাবেন। অনেক পাতা লেখা হয়ে গেছে। সেদিন আবার তিনি খাতাটা নিয়ে লিখতে বসেছেন।

তিনি লিখতে লাগলেন—“আমি এখন ঘরেও নাই, ঘরের বাইরেও নাই। ঘরই আমার নিকট পর, আবার পরই আমার নিকট ঘর। আমার চাওয়ারও কিছু নাই, তাই পাওয়ার পর্বও আমার চুকিয়া গিয়াছে চিরকালের মত। আজ এত দূর হইতে বাল্যকালের দিনগুলির দিকে চাহিয়া কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আমার আর কিছু করিবারও নাই। যাহা কিছু ইহ-জীবনে করিয়াছি তাহা ভাল করিবার উদ্দেশ্যেই করিয়াছি। পরের ভালো ব্যতীত আর কিছু ভাবি নাই, তবে…..”

হঠাৎ ঘরের দরজায় একটা টোকা পড়লো।

লিখতে লিখতে থেমে গেলেন সদানন্দবাবু। জিজ্ঞেস করলেন–কে?

বাইরে থেকে কেউ উত্তর দিলে না। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন–কে?

তবু উত্তর নেই।

সদানন্দবাবু এবার উঠলেন। উঠে দরজাটা খুলতেই দেখলেন একজন বৃদ্ধ লোক দাঁড়িয়ে আছেন। প্রায় তাঁরই বয়েসী। হাতে একটা পুঁটুলি।

সদানন্দবাবু জিজ্ঞেস করলেন–কাকে চাই?

–আপনার নাম কি সদানন্দ চৌধুরী?

সদানন্দবাবু বললেন—হ্যাঁ–

–আপনার পিতার নাম কি হরনারায়ণ চৌধুরী?

সদানন্দবাবু আবার বললেন–হ্যাঁ—

–আপনার নিবাস কি নবাবগঞ্জে?

–আজ্ঞে হ্যাঁ।

বলতেই ভদ্রলোক আর কোনও কথা না বলে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লো। বললে– আরে মশাই, আপনাকে আজ পনেরো বছর ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছি, আর আপনি এখানে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছেন–

বলে তক্তপোশের ওপর বসে রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে লাগলো।

সদানন্দবাবু তখনও বুঝতে পারছেন না কিছু। বললেন–আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না আপনার কথা–

–আরে মশাই, আমার নাম হাজারি বেলিফ, আমি ফৌজদারি-আদালত থেকে আসছি। আপনার নামে হুলিয়া আছে। আপনি খুন করে এখানে লুকিয়ে আছেন, ভেবেছেন কেউ টের পাবে না—

সদানন্দবাবু অবাক হয়ে গেলেন। বললেন–আমি খুন করেছি? বলছেন কী আপনি? কাকে?

ভদ্রলোক হো হো করে হেসে উঠলো। যেন বেশ একটা মজার বিষয়বস্তু পেয়েছে সদানন্দবাবুর কথার মধ্যে।

বললে–দাঁড়ান মশাই, আজ এত বছর ধরে আপনার পেছনে লেগে পড়ে আছি, আপনার জন্যে আমার চাকরি যায়-যায় অবস্থা–

সদানন্দবাবু ভদ্রলোকের হাল-চাল দেখে কেমন অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। বললেন–দেখুন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আপনি কী বলছেন

ভদ্রলোক বললে–কেন, আমি তো সোজা বাংলা ভাষাতেই কথা বলছি, আপনি নিজেও তো বাঙালী মশাই। আপনার নিবাস নদীয়া জেলার নবাবগঞ্জ গ্রামে, আপনার পিতামহের নাম নরনারায়ণ চৌধুরী, আপনার পিতার নাম হরনারায়ণ চৌধুরী, আপনারা নবাবগঞ্জের জমিদার, আমি কি কিছু জানি না বলতে চান?

সদানন্দবাবু তখনও অবাক হয়ে দেখছিলেন ভদ্রলোকের মুখখানা। মনে হলো কোথায় যেন আগে দেখেছিলেন লোকটাকে। ভদ্রলোক তখন একটা মোটা ঝাড়নের মত রুমাল দিয়ে ঘাম মুছছে ঘষে ঘষে। অনেক দূর থেকে হেঁটে এসেছে লোকটা মনে হলো।

ভদ্রলোকের যেন হঠাৎ নজরে পড়লো। বললে–আরে, আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন, বসুন না, আপনার তো এখন কোনও কাজকর্ম নেই, কেবল খাচ্ছেন-দাচ্ছেন আর নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন–রসিক পালের পুষ্যিপুত্তুর হয়ে পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে বসে আছেন

কথাগুলো সদানন্দবাবুর ভালো লাগলো না। কিন্তু সে কথা চেপে গিয়ে বললেন আপনাকে যেন কোথায় দেখেছি বলুন তো

–আমাকে কোথায় আর দেখবেন। কোর্টেই দেখেছেন।

–কোর্টে? কোর্টে তো আমি কখনও যাইনি।

–তাহলে কালেক্টরি অফিসে দেখেছেন। আমি কোর্টে যাই, কালেক্টরিতে যাই, দুনিয়ার সব জায়গাতেই যে আমায় যেতে হয় মশাই। দুনিয়াতে যে-যে কিছু সম্পত্তি করেছে তার কাছেই আমাকে যেতে হয়। আমার কাজই তো আসামীকে কোর্টে নিয়ে গিয়ে হাজির করা। যেমন আপনি! আপনি একজন আসামী বলেই আপনার কাছে এসেছি

তারপর একটু থেমে বললে–এক গ্লাস জল দিতে পারেন, বড্ড তেষ্টা পেয়েছে–

সদানন্দবাবু বললেন–আপনি বসুন, আমি জল আনি—

.

রসিক পালের এস্টেটে বন্দোবস্ত সব পাকা। আগে আরো পাকা ছিল। তখন রসিক পাল বেঁচে ছিলেন। কাছারি বাড়িতে পাকা খাতায় সকলের নাম লেখা থাকতো। কে আজ খাবে, কী তার নাম, ক’জন খাবে, কী কাজে তারা চৌবেড়িয়ায় এসেছে, হরি মুহুরির লোক সব কিছু খাতায় লিখে রাখতো। রসিক পালের টাকাও যেমন ছিল, তেমনি আবার সে-টাকার সদ্ব্যবহারও ছিল। যেদিন স্কুল উঠে গেল, সেদিন রসিক পাল বড় কষ্ট পেয়েছিলেন মনে মনে। কিন্তু উঠে যাবার কারণও ছিল। রসিক পাল সুদখোর মানুষ তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু মানুষটাকে যে ভালো ভাবে না চিনেছে সে রসিক পালকে বুঝতে ভুল করবে। রসিক পাল কথায় কথায় বলতেন–আমি কি টাকা নিয়ে দান-ছত্তোর করতে বসেছি হে যে সুদের টাকা ছেড়ে দেব?

কিন্তু হরি মুহুরি যখন এসে খরচের কথা বলতো তখন রেগে যেতেন। বলতেন–খরচ হবে তো খরচ হবে, আমি কি টাকা নিয়ে স্বগ্যে যাবো? আমি সঙ্গে করে টাকা নিয়েও আসিনি, সঙ্গে করে নিয়ে যাবোও না। যা খরচ হবে তা হবে। চালের দাম বাড়ছে বলে কি আমি অতিথিশালা তুলে দেব ভেবেছ?

লোক বলতো–পাগল, পাল মশাই একজন আস্ত পাগল।

সদানন্দবাবু সব ভালো করে দেখতেন। এমন লোক আগে কখনও দেখেননি তিনি। দেখলে তাঁর জীবনটা অন্য রকম করে গড়ে উঠত। হয়ত এমন করে এভাবে জীবনটা শেষ করতে হতো না।

আত্মজীবনীটা লেখবার সময় ওই রসিক পাল সম্বন্ধে অনেকগুলো পাতা লিখতে হবে। যে-পৃথিবী ঘেন্নায় ছেড়ে এসে এখানে এমন করে আশ্রয় পেয়েছেন এখানকার সেই আশ্রয়দাতার কথা না লিখলে তাঁর লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

স্কুল যেদিন উঠে গেল সেদিন রসিক পাল বড় দুঃখ করে বলেছিলেন–মাস্টার, আমি পারলুম না

সদানন্দবাবু বলেছিলেন–আপনি যে পারবেন না পাল মশাই তা আমি জানতুম।

–কী করে জেনেছিলে?

সদানন্দবাবু বলেছিলেন–কারণ কেউ-ই পারেনি। কেউ পারেনি বলেই আপনি পারলেন না।

–তার মানে? রসিক পাল অবাক হয়ে চেয়ে দেখেছিলেন মাস্টারের দিকে।

সদানন্দবাবু বলেছিলেন–মানে হুঁকোর খোল-নলচে খারাপ হয়ে গেলে কি তামাক ধরে, না ধোঁয়া বেরোয়!

রসিক পাল কথাগুলো তবু বুঝতে পারেননি সেদিন। রসিক পাল দেদার টাকাই উপায় করেছিলেন, কিন্তু টাকার ওপর আসক্তি তাঁর কমেনি। টাকার আসক্তি যার আছে তার দ্বারা টাকার সদ্ব্যয় কেমন করে হবে? তাই ছেলেরা স্কুলে আসতো না, সদানন্দবাবু বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের ডেকে আনবার চেষ্টা করতেন।

শেষকালে সদানন্দবাবু একদিন হাল ছেড়ে দিলেন।

বললেন–এবার স্কুল তুলে দিন পাল মশাই, আর আমাকেও মুক্তি দিন–

–কেন? কী বলছো তুমি?

সদানন্দবাবু বললেন–আমি গোড়াতেই আপনাকে বলেছিলুম এসব কাণ্ড আরম্ভ না করতে, কিন্তু আপনি কিছুতেই শুনলেন না। এখন কেউ লেখাপড়া করবে না। এখন লেখাপড়া না করেই ছেলেরা হাজার টাকা মাইনের চাকরি চাইবে–

–ওটা তোমার রাগের কথা মাস্টার, তুমি আর একটু চেষ্টা করে দেখ না। মাসে মাসে আমি এতগুলো টাকা দিচ্ছি, গভর্মেন্টের ঘর থেকেও টাকা আনবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, দেখবে, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে–

কিন্তু ঠিক শেষ পর্যন্ত হলো না। যত দিন যেতে লাগলো ততই যেন কারা সব গ্রামে আসতে লাগলো লুকিয়ে লুকিয়ে। অচেনা সব মুখ তাদের। রাতের অন্ধকারে তারা গঙ্গার ধারে গঞ্জের হোটেলে এসে ব্যাপারী সেজে রইল। তারপর একদিন কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ রসিক পাল মশাই-এর বসত বাড়ির ভেতর থেকে একসঙ্গে একটা আর্তনাদ উঠলো।

সে অনেক রাত তখন!

তারপর পুলিস এল, এনকোয়ারি হলো। কয়েকদিন ধরে চৌবেড়িয়াতে খুব হইচই হলো। লোকজনকে ধরে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ চললো। কয়েকজন গ্রেফতারও হলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুরই ফয়সালা হল না। যে মানুষ একদিন সামান্য অবস্থা থেকে নিজের আর্থিক অবস্থা ফিরিয়ে দশজনের অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁকে থতম করে দেশকে পাপমুক্ত করা হলো।

তারপরও কিছুদিন স্কুল চলেছিল। কিন্তু পাশের গ্রামে আর একটা স্কুল হলো। একদিন তারা এখানকার সব ছেলে ভাঙিয়ে নিয়ে চলে গেল।

রসিক পাল মশাই-এর ছেলে ফকির পাল বললে–মাস্টার মশাই, এবার কী করবো তা হলে?

সদানন্দবাবু বললেন–আর কী করবে? এবার স্কুল বন্ধ করে দাও, আর আমাকেও এবার মুক্তি দাও–

ফকির বললে–কিন্তু আপনি কোথায় যাবেন?

সদানন্দবাবু বললেন–আমি আর কোথায় যাবো বাবা, যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকেই চলে যাবো। তোমাদের ঘাড়ে কতদিন বসে বসে খাবো, বলো?

ফকির বললে–তা হবে না মাস্টার মশাই, আমি জানি আপনার কোথাও যাবার জায়গা নেই–

সদানন্দবাবু বললেন–ওকথা বোল না ফকির; মানুষের সমাজে জায়গা না হোক, বনে জঙ্গলে জানোয়ারের সমাজে তো জায়গা হবেই—

তবু ফকির পাল ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। রসিক পালের সব ক্রিয়াকর্মই ফকির চালিয়ে যাচ্ছে। বার বাড়ির উল্টোদিকে অতিথিশালা ছিলই আগে থেকে। কখনও সেখানে কেউ থাকতো, আবার কখনও কেউ থাকতো না। তীর্থের গুরুমহারাজ কিম্বা পাণ্ডাঠাকুর কেউ এলে তাঁদের অতিথিশালার একটা মহলেই আশ্রয় দেওয়া হতো। তাঁদের জন্যে যেমন ব্যবস্থা ছিল, মাস্টার মশাই-এর জন্যেও ঠিক সেই তেমন ব্যবস্থাই হলো।

সদানন্দবাবুর সেই দিন থেকে আর কোথাও যেতে পারলেন না। এই চৌবেড়িয়াতেই রয়ে গেলেন।

হরি মুহুরি প্রথম দিনেই বুঝতে পেরেছিল।

বলেছিল–আচ্ছা মাস্টার মশাই, নয়নতারা কে?

সদানন্দবাবু একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলেন প্রথমে। বললেন–কেন মুহুরি মশাই? নয়নতারার কথা তুমি জানলে কেমন করে?

–আপনি নিজেই বলেছেন।

বলে হরি মুহুরি হাসতে লাগলো।

সদানন্দবাবু বললেন–ও বুঝতে পেরেছি, আমার ওই এক বদ অভ্যেস, ঘুমোতে ঘুমোতে কথা বলি। আজকে পাল মশাইও তাই বলছিলেন আমাকে। আমি নাকি গান গেয়েছিলুম–

–আমিই তো বলেছি কর্তামশাইকে। আমি তো আপনার পাশের ঘরে শুয়েছিলুম, তাই মাঝরাত্তিরে আপনার হরুঠাকুরের কবিগান শুনে চমকে উঠেছিলুম। ভাবলুম সেকালের গান একালে এত রাত্তিরে কে গায়! তা আপনি কবিগানের দলে ছিলেন নাকি?

সদানন্দবাবুর হাসি পেল। মুখে বললেন–না না, কবির দলে ছিলুম না। কবির দলে থাকতে যাবো কোন্ দুঃখে! গানটা শুনেছি তাই মনে আছে–

–আপনার দেশ কোথায় মাস্টার মশাই? আপনার বাড়ি?

এই চৌবেড়িয়াতে আসর পর থেকে এই প্রশ্ন তাঁকে অনেকবারই শুনতে হয়েছে। আরো যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিনই হয়তো শুনতে হবে। রসিক পালও জিজ্ঞেস করতেন প্রথম প্রথম। অজ্ঞাতকুলশীল মানুষকে নিজের আস্তানায় আশ্রয় দিতে গেলে তার কুলুজি জানতে হয়। কোথায় নিবাস, পিতার নাম, সব কিছু।

রসিক পাল বলতেন–ঠিক আছে বাবা, তোমার কিছু বলতে হবে না। আমি বুঝতে পেরেছি কোথাও তোমার একটা ঘা আছে

–ঘা?

–হ্যাঁ বাবা হ্যাঁ, এতদিন মহাজনী কারবার করছি আর লোক চিনতে পারবো না? তোমায় কিছু বলতে হবে না। কবিগানের কথাও বলতে হবে না, নয়নতারা কে তা–ও বলতে হবে না। আমি সব বুঝতে পেরেছি–

বলেই একটা লম্বা হাঁচি হাঁচলেন। আর সদানন্দবাবু ঘড়িটার দিকে চেয়ে দেখলেন ঠিক কাঁটায় কাঁটায় বেলা নটা।

হাঁচির পরেই মনটা বেশ প্রসন্ন হয়ে উঠলো রসিক পালের। হাঁচির সঙ্গে ঘড়ির কাঁটা মিলে গেছে এমন ঘটনায় রসিক পাল বরাবরই প্রসন্ন হয়ে উঠতেন।

সদানন্দবাবু চৌবেড়িয়াতে যাবার পর থেকেই রসিক পাল মশাই-এর মেজাজ যেন কেমন মিষ্টি হয়ে গেল। তিনি দু’হাতে দানছত্র করতে লাগলেন। ফকির পাল বাবার কাণ্ড দেখে একদিন বাপকে বললে–এখন দিনকাল বদলে গেছে, এখন কি আর এত খরচ বাড়ানো উচিত বাবা?

রসিক পাল আশেপাশের লোকজনদের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন–দেখ দেখ, ফকিরের কথা শুনলে তোমরা! আজকালকার ছেলে তো, কেবল কোট-প্যান্ট পরতেই শিখেছে। আরে, আমি আমার নিজের টাকা খরচ করবো তাতে তোর কী? তুই কথা বলবার কে? আমার রোজগার করা টাকা আমি খরচ করবো তাতে তোর অত মাথাব্যথা কেন শুনি?

.

তা এদিকে তখন ঘরের মধ্যে বসে হাজারি বেলিফ অপেক্ষা করছিল। আসামী কি পালালো নাকি? জল আনতে গেল তো গেলই। এতক্ষণ লাগে এক গেলাস জল আনতে! ভদ্রলোক হাতের পোঁটলাটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর ঘরের বাইরে একবার উঁকি মেরে দেখবার চেষ্টা করলে। কে যেন যাচ্ছিল উঠোন পেরিয়ে।

ডাকলেও গো, কে তুমি? একবার ইদিকে এসো তো ভাই–

অতিথিশালার লোক। ডাক শুনে কাছে এল। ভদ্রলোক বললে–তুমি এ বাড়ির লোক তো?

–আজ্ঞে হ্যাঁ।

–কী নাম তোমার?

–গণেশ।

–গণেশ! বেশ নাম। ভাই গণেশ, তুমি বলতে পারো এই ঘরের সদানন্দবাবু কোথায় গেলেন?

–আমাদের মাস্টার মশাই-এর কথা বলছেন?

ভদ্রলোক বললে–সদানন্দবাবু বুঝি তোমাদের মাস্টার মশাই?

–আজ্ঞে, এখন আর মাস্টারি করেন না, আগে করতেন। তাঁকে দরকার?

–হ্যাঁ ভাই, এক গ্লাস জল চেয়েছিলুম তাঁর কাছে। অনেক দূর থেকে আসছি কিনা আমি। বড্ড জল-তেষ্টা পেয়েছিল

গণেশ বললে–আপনি মাস্টার মশাই-এর কাছে জল চেয়েছিলেন? তবেই হয়েছে! আজকে তাহলে আর জল পেয়েছেন!

–সে কী? কেন? তিনি যে আমাকে বসতে বলে চলে গেলেন?

গণেশ বললে–তাঁকে নিজেকেই কে জল দেয় তার ঠিক নেই, তিনি আনবেন জল! তিনি নিজের হাতে কখনও জল গড়িয়ে খেয়েছেন? তাঁর নিজের জল-তেষ্টা পেয়েছে কি না তাই-ই বলে তিনি বুঝতে পারেন না কখনও।

কথাগুলো শুনে হাজারির বেশ মজা লাগলো। বললে–তাহলে মাস্টারি করতেন কী করে এখানে?

গণেশ বললে–ওই জন্যেই তো কর্তামশাই-এর ইস্কুলটা উঠে গেল।

–পড়াতে পারতেন না বুঝি?

–পড়াতে পারবেন না কেন? বড্ড ভালো মানুষ যে, তাই কেউ তাঁকে মানুষ বলেই মানতো না। একটু ভয়-ভক্তি না করলে কি ইস্কুল চালানো চলে? অত ভালো মানুষ বলেই তো বুড়ো কর্তামশাই ওঁকে অত ভালবাসতেন।

ভদ্রলোক বললে–তাহলে তো দেখছি মুশকিলে পড়া গেল–

গণেশ বললে–-মুশকিলে আর কেন পড়বেন, আমি জল এনে দিচ্ছি—

বলে গণেশ ভেতর দিকে কোথায় চলে গেল। দুপুর বেলা। সাধারণত এমন সময় সকলেরই একটু বিশ্রাম। সকাল থেকে কাজ চলতে চলতে দুপুর বেলাতে এসেই কাজের চাকা যা একটু থামে। তারপর বিকেল বেলা সেই যে শুরু হবে, তার শেষ হবে অনেক রাত্রে পৌঁছিয়ে। নবাবগঞ্জের বাড়িতেও ঠিক এমনি হতো। অথচ সংসার বলতে তো ওই তিনটে প্রাণী। নরনারায়ণ চৌধুরী, বাবা, মা আর ওই সদানন্দ। অনেকে নামটা ছোট করে দিয়ে ডাকতো–সদা।

চৌধুরী বাড়িতে নতুন বউ এসেছে। পালকী আসছে রেলবাজার থেকে। ট্রেন থেকে বর আর বউকে নামিয়ে তোলা হয়েছে পালকীতে। ছ’ ক্রোশ রাস্তা উঁচু-নিচু এবড়ো খেবড়ো মেঠো পথ।

চৌধুরী মশাই-এর শ্যালক ছিল সঙ্গে। সে-ই বর-বৌকে সঙ্গে করে আনছিল। তার সঙ্গে আসছিল নরনারায়ণ চৌধুরীর গোমস্তা, একেবারে সামনের পালকীতে। আর একেবারে সকলের সামনে-সামনে দীনু গোমস্তা আগে আগে চলেছে। কৈলাশ গোমস্তাকে লোকে দূর থেকে নমস্কার করছে। এক-একটা গ্রামে ঢোকে তারা আর গাঁয়ের বৌ-ঝি-ছেলে বুড়ো সামনে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বলে–গোমস্তা মশাই, বউরাণীকে একবার দেখবো

কৈলাস গোমস্তা বলে–আরে না না, এখন না, কাল চৌধুরী বাড়িতে বউরাণীকে সাজিয়ে-গুজিয়ে দেখাবো তোদের

–ওমা, তা এখন কি সাজগোজ নেই?

–তা থাকবে না কেন? এখন সেই কেষ্টনগর থেকে রেলে চড়ে বৌ ঘেমে-নেয়ে আসছে, এখন কি কেউ দ্যাখে রে? কালকে সাজিয়ে-গুজিয়ে রাখবো বউমাকে তখন দেখিস–

এমনি সারা রাস্তা। সকলকে ঠাণ্ডা করতে করতেই কৈলাস গোমস্তা অস্থির।

পেছনের পালকীতে প্রকাশমামা মুখ বাড়িয়ে চিৎকার করে উঠলো–একটু পা চালিয়ে পা চালিয়ে দীনু—

যেন প্রকাশ মামারই বিয়ে। তার সাজগোজের বাহার বরকে পর্যন্ত হার মানিয়েছে। বিয়ের উৎসবের ক’দিন ধরে তার খাটুনিরও যেমন শেষ নেই, আবার উৎসাহেরও তেমনি কামাই নেই।

হইচই করতে করতে বর-বৌ নবাবগঞ্জের চৌধুরীবাড়ির উঠোনে এসে ঢুকলো। গ্রাম ঝেটিয়ে লোকজন এসে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে।

কৈলাস গোমস্তা মার মার করে উঠলো-সরো গো, সরো সবাই, সরো। বৌ-এর দম আটকে আসবে সরো, ভেতরে হাওয়া ঢুকতে দাও–

প্রকাশ মামাও কম যায় না। কোঁচানো ধুতি আর ঢিলে পাঞ্জাবি নিয়ে হিমশিম্ খেয়ে যাচ্ছে। সে–ও বলে উঠলো–যাও, যাও, যাও, ওদিকে যাও ভাই সব, এদিকে ভিড় নয়, এদিকে ভিড় নয়–

গৌরী পিসীর আর তর সইলো না। সে কারো মানা শুনবে না। একেবারে দৌড়ে এসে পালকীর দরজার সামনে নিচু হয়ে বৌ-এর ঘোমটা তুলে মুখখানা দেখলে।

নয়নতারাও চমকে গেছে। এ আবার কে? শাশুড়ী নাকি?

বউ দেখে গৌরী পিসীর খুশীর আর শেষ নেই। গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো– ওলো, জোরে জোরে উলু দে, জোরে জোরে উলু দে তোরা

সত্যিই নয়নতারার রূপের বাহার দেখে গাঁ-সুদ্ধ লোক অবাক। এমন রূপও হয় নাকি! দোতলার ঘরে নরনারায়ণ চৌধুরী তখন পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে পড়ে আছেন। তাঁর প্রথম নাত বৌ বাড়িতে এসেছে। তাঁকেই প্রথমে প্রণাম করতে হবে।

–চলো বৌমা, তোমার কর্তাবাবুকে আগে পেন্নাম করবে চলো—

নরনারায়ণ চৌধুরীর বহুদিনের সাধ পূর্ণ হতে চলেছে তখন। অনেক অভিশাপ তিনি কুড়িয়েছেন! এবার যাবার সময় নাত-বৌ-এর মুখ দেখতে পেলেন। এবার তাঁর বংশের ধারা আবহমান কাল ধরে চলুক। বংশপরম্পরায় নবাবগঞ্জের চৌধুরী বংশের গৌরব আরো বৃদ্ধি হোক। অনাগত কালের মানুষ বলুক–এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা নরনারায়ণ চৌধুরী মানুষের সমাজে সত্যিই ছিলেন এক নরনারায়ণ। তিনি ছিলেন দানবীর, কর্মবীর, দেবদ্বিজে ভক্তিপরায়ণ, মহাপুরুষ! এই তাঁর পৌত্র, এই সদানন্দ চৌধুরীরই একদিন সন্তান হবে, সেই সন্তানেরও আবার একদিন সন্তান হবে। এমনি করে সন্তানের পর সন্তানের জন্ম হয়ে শাখা প্রশাখা বিস্তার করে পুরুষানুক্রমে তাদের বংশাবলীর মধ্যে দিয়েই তিনি চিরদিন অমর হয়ে থাকবেন। এ বয়সে এই পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায় এই-ই তাঁর একমাত্র কামনা, এই-ই তাঁর একমাত্র সান্ত্বনা–এই-ই তাঁর একমাত্র সুখ!

হঠাৎ কৈলাস গোমস্তা এসে খবর দিলে কর্তাবাবু,–কালীগঞ্জের বৌ এসেছে–

–কে?

–আজ্ঞে কালীগঞ্জের বৌ!

–তা কালীগঞ্জের বৌ হঠাৎ আজকে এল কেন? তাকে কি তোমরা নেমন্তন্ন করেছিলে?

–আজ্ঞে, সে কী কথা! তাকে নেমন্তন্ন করতে যাবো কেন? আপনি তো তাকে নেমন্তন্ন করতে বারণ করেছিলেন?

–তাহলে খবর পেলে কী করে যে আজকে আমার নাতির বিয়ে?

–তা জানি নে, তবে নতুন বউয়ের মুখ দেখবার জন্যে একখানা শাড়ি আর এক হাঁড়ি মিষ্টিও এনেছে। নতুন বউ-এর মুখ দেখতে চাইছে–

সমস্ত বাড়িময় খন উৎসবের আবহাওয়া। খাঁটি গাওয়া ঘিয়ের লুচি ভাজার গন্ধে বাড়ি তখন একেবারে ম-ম করছে। আত্মীয়-কুটুম এসে গেছে দূর দূর থেকে। এমন সময় কি না কালীগঞ্জের বউকে এ বাড়িতে আসতে হয়!

নরনারায়ণ চৌধুরী জিজ্ঞেস করলেন–বংশী ঢালী কোথায়?

–ডেকে দেব?

–ডেকে দাও, আর দেখো যেন আমার ঘরের কাছে এখন কেউ না আসে, দরজা আগলে দাঁড়িয়ে থাকবে। যাও–

তা বংশী ঢালী এল। কর্তাবাবুর বাড়ির বিয়েতে সে পরনের কাপড়খানা রঙীন করে ছাপিয়েছে। মাথার চুলগুলো তেল-চকচকে করে আঁচড়ে নিয়ে বাহার করেছে।

সামনে এসে দাঁড়াতেই কর্তাবাবু কৈলাস গোমস্তার দিকে চেয়ে বললেন কালীগঞ্জের বৌ যা-কিছু এনেছে, সন্দেশ শাড়ি সব নেবে, খুব খাতির করে নেবে। বুঝলে?

–বৌ দেখাবো?

–হ্যাঁ। আর দেখ, খাতিরের যেন কমতি না হয়, যেমন করে বাড়ির আত্মীয়-কুটুমদের খাতির করা নিয়ম, কালীগঞ্জের বৌকেও ঠিক তেমনি করে খাতির-যত্ন করবে। যেন কোথাও কোনও ত্রুটি না থাকে। বুঝলে?

–আজ্ঞে হ্যাঁ।

–তাহলে তুমি এখন যাও, গিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকো, দেখবে যেন এদিকে কেউ না আসে–

কৈলাস গোমস্তা চলে যেতেই কর্তাবাবু চাইলেন বংশী ঢালীর দিকে। বললেন– বংশী, আগে তুই তো আমার ইজ্জত অনেকবার বাঁচিয়েছি। আর একবার বাঁচাতে পারবি?

–হ্যাঁ হুজুর, আপনি যখন যা বলবেন তাই করবো। বলুন, কার ঘাড় থেকে কটা মাথা নিতে হবে–

কর্তাবাবু বললেন–তাহলে ঘরে ঢোকবার দরজাটা বন্ধ করে দে, তোকে আজ একটা কাজের ভার দেব–

বংশী ঢালী দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে হুড়কো লাগিয়ে দিলে। আর সঙ্গে সঙ্গে নবাবগঞ্জের চৌধুরী বংশের ঝাড়-লণ্ঠনের সব বাতি যেন এক ফুৎকারে নিবে গিয়ে দিকবিদিক একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল। কর্তা নরনারায়ণ চৌধুরীর একমাত্র পৌত্র, ছেলে হরনারায়ণ চৌধুরীর একমাত্র পুত্র সদানন্দ চৌধুরী তখন উৎসব-অনুষ্ঠানের জাঁকজমকের ঘেরাটোপের মধ্যে থেকে একেবারে দূরে সরে এসেছে। একদিন আগে কেষ্টনগরের একটা বাড়িতে একটা অচেনা মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ের সম্প্রদান হয়েছে, নিমন্ত্রিত অতিথি-অভ্যাগতরা ভুরিভোজে পরিতৃপ্তির উদ্গার তুলতে তুলতে যে যার বাড়িতে চলে গেছে। বাসরঘরের চার-দেয়ালের মধ্যে সে নববধূর মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে দেখেছে। ভেবেছে এ কাকে সে বধূ করে নিয়ে চলেছে তার বাড়িতে! এ–ও কি সংসারের আর পাঁচজন মানুষের মত যান্ত্রিক মানসিকতার একটা অতি সাধারণ প্রতীক! এ–ও কি কলের পুতুলের মত সুতো টানলে হাত পা নাথা নাড়াবে, কল টিপলে খাবে ঘুমোবে আর যান্ত্রিক নিয়মে কেবল সন্তানের জন্ম দিয়ে চৌধুরী বংশের লোকসংখা বাড়িয়ে যাবে!

সেদিন কালরাত্রি। গ্রামের লোক সবাই বৌ দেখে দলে দলে যে যার বাড়ির দিকে চলে যাচ্ছে। সদানন্দ অন্ধকার বারবাড়ির উঠানের পাশ দিয়ে চণ্ডীমণ্ডপের দিকে যচ্ছিল। জায়গাটা বড় নিরিবিলি নির্জন। হঠাৎ মনে হলো সামনের চণ্ডীমণ্ডপের পেছনে চোর-কুঠুরির ভেতর থেকে কে যেন হঠাৎ একটা আর্তনাদ করে উঠলো—আঃ–

একটা মেয়েলী গলার চাপা আর্তনাদ। কিন্তু আর্তনাদটা একবার গলা ছিঁড়ে বার হবার পরেই যেন আবার হঠাৎ মাঝখানে বন্ধ হয়ে গেল। মনে হলো কে যেন কার গলা টিপে ধরেছে।

সদানন্দ খানিকক্ষণ হতবাক হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর চোর কুঠুরিটা থেকে একটা ধস্তাধস্তির আওয়াজ আসতেই তার যেন কেমন সন্দেহ হলো। সদানন্দ চোর কুঠুরির দিকে দৌড়ে যেতেই দেখলে সামনে অন্ধকারের মধ্যে থেকে কে একজন বেরিয়ে আসছে।

সদানন্দ চিনতে পারলে না লোকটাকে। বললে–কে? কে তুই? কে? কে কেঁদে উঠলো চোরকুঠুরির ভেতরে?

প্রথমে কেউই উত্তর দিলে না। চারদিকে অন্ধকার। ওদিকে বিয়েবাড়ির আলোয় পশ্চিম দিকটা ঝলমল করছে। পূর্ব-উত্তর কোণাকুণি দিকটাতেই অন্ধকার বেশি। চণ্ডীমণ্ডপটা পূবদিক-ঘেঁষা। নরনারায়ণ চৌধুরী যখন নবাবগঞ্জে জমিদারি পত্তন করেছিলেন তখন হাতে অনেক কাঁচা টাকা আসতে লাগলো। কিন্তু টাকা এলে কী হবে, মানুষটার ব্যবহার সেই আগেকার মতই রয়ে গেল। এককালে যখন কালীগঞ্জে গোমস্তার কাজ করেছেন, তখনও যেমন, আবার জমিদারি পত্তনের পরও তেমনি। এই নবাবগঞ্জ একদিন কালীগঞ্জের পত্তনির মধ্যেই ছিলো। তখন নরনারায়ণ চৌধুরী এইখানে বসে একটা একতলা বাড়ির বৈঠকখানার মধ্যে গোমস্তাগিরি করতেন। কিন্তু তারপর আস্তে আস্তে নবাবগঞ্জের সেই একতলা বাড়িটার সামনে একটা বিরাট দুমহলা দোতলা বাড়ি উঠলো। তখন আগেকার সেই একতলা বাড়িটা হয়ে গেল চণ্ডীমণ্ডপ। আর তার আধখানায় কাজ চলতে লাগলো চণ্ডীমণ্ডপের। আর বাকিখানায় হলো চোর কুঠুরি। সে সিকিখানা প্রায়ই ব্যবহার হতো না। বছরের বেশির ভাগ সময় তার দরজায় তালা-চাবি দেওয়া পড়ে থাকতো। একটা ঝাঁকড়া-মাথা গাব গাছ সে ঘরখানাকে দিনের বেলায় অন্ধকার করে রাখতো। আর রাত্তিরে তার চেহারা অন্ধকারের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যেত।

লোকটা তখন সামনে এসে পড়েছে একবারে।

সদানন্দ মুখখানা একবার লোকটার মুখের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে।

বললে–কে? কে রে তুই? কথা বলছিস না কেন?

–আজ্ঞে আমি!

এবার গলার আওয়াজে চিনতে পারলে সদানন্দ। বংশী ঢালী।

–বংশী ঢালী?

–আজ্ঞে হ্যাঁ খোকাবাবু।

–তা তুই এই অন্ধকারে এখানে একলা কী করছিস? খেয়েছিস?

বংশী ঢালী বললে–কাঁচা-ফলার খেইচি, একটু পরে পাকা-ফলার খাবো।

তা বটে। কর্তাবাবুর বাড়ির কাজ, সবাই তিন-চারদিন ধরে চারবার পেটভরে খাবে। এটাই রেওয়াজ। জমি-জমার দখল নিয়ে যখন কোথাও কোনও গণ্ডগোল বাধে তখন বংশী ঢালীরই ডিউটি পড়ে। বদমাইশ প্রজাকে ঢিট করতেও বংশী ঢালীর ডিউটি পড়ে।

–তা পাকা-ফলারের পাতা তো পড়েছে, খেতে যা–

সে কথার উত্তর না দিয়ে বংশী ঢালী অন্য কথায় চলে গেল। এক গাল হাসি হেসে বলল–আপনার বৌ খুব সোন্দর হয়েছে খোকাবাবু, একেবারে মা-দুর্গার মত–

কিন্তু বংশী ঢালীর হাসিতে সদানন্দর মন ভুললো না। বললে–তা হবে, তুই আগে খেয়ে নিগে যা—

বংশী ঢালী চলে গেল বটে, কিন্তু সদানন্দর মনের সন্দেহ গেল না। বংশী ঢালী যেতেই সদানন্দ চোর কুঠুরিটার দিকে আরো এগিয়ে গেল। বাইরে থেকে এ দরজায় তালা ঝুলছে তখনও। তাহলে আর্তনাদটা কোন্ দিক থেকে এলো? কে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলো?

মানুষের ইতিহাসে এই রকম করে কতবার কত বংশী ঢালী নিঃশব্দে কত জমিদারের চোর কুঠুরিতে ঢুকেছে, আর নিষ্কলুষ মুখোশ নিয়ে কতবার চোর-কুঠুরির বাইরে বেরিয়ে এসেছে তা কোনও ভাষার ইতিহাসে লেখা থাকতে নেই। কিন্তু হিসেবের কড়ি বাঘে খেয়েছে। এমন কথা যেমন কোথাও লেখা থাকে না, আসল আসামী ধরা পড়েছে এমন নজিরও কোনও আদালতের নথিপত্রে নেই। কারণ আসল আসামীরা ধরা পড়ে না। নকল আসামীদের সামনে এগিয়ে দিয়ে আসল আসামীরা বরাবরই আড়ালে লুকিয়ে থাকে। তাদের কোনও শাস্তি হতে নেই। তারা রায় বাহাদুর হয়, রায়সাহেব হয়, তারা পদ্মশ্রী পদ্মভূষণ হয়, তারা শ্বেতপাথরের মূর্তি হয়ে বাস্তার মোড়ে মোড়ে শহরের শোভা বাড়ায়। কবে একদিন হয়ত নবাবগঞ্জের নরনারায়ণ চৌধুরীও এমনি শোভা হয়ে উঠতো, রায় বাহাদুর হতো, রায়সাহেব হতো, পদ্মভূষণ হতো, পদ্মশ্রী হতো। এ-যুগে জন্মালে তা হবার চেষ্টাও হয়ত করতো। কিন্তু অদৃষ্ট-দেবতার কোন্ এক দুর্লঙ্ঘ্য আইনে আসামী একদিন হঠাৎ ধরা পড়লো। আর ধরা পড়লো বলেই রাত জেগে জেগে তার বংশধরকে নিয়ে এই উপন্যাস লেখবার প্রয়োজন আজকে আমার পক্ষে অনিবার্য হয়ে উঠলো।

.

কিন্তু সন্দেহটা দৃঢ় হলো আরো অনেক পরে। উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে ঘুরে আবার পূর্বদিকে ভেতর-বাড়িতে আসবার কথা। কাল এই সারা বাড়ি অতিথি-অভ্যাগতে ভরে উঠবে। গতকাল থেকেই ভিড় শুরু হয়েছে। মাঝখানে একটা দিন শুধু কালরাত্রি। তারপরেই ফুলশয্যা।

গৌরী পিসী হঠাৎ সদানন্দকে দেখতে পেয়েছে। বললে—হ্যাঁ রে, তুই এখানে, আর ওদিকে যে সবাই তোকে খুঁজছে বাবা! রাত-বিরেতে অন্ধকারে ঘুরে বেড়াচ্ছিস কেন? গাব গাছের তলায় কী করছিলি?

ওদিকে দোতলায় ছেলে হরনারায়ণ কর্তাবাবুর কাছে দাঁড়িয়ে ছিল।

বাবাকে জিজ্ঞেস করলে–বৌমা কেমন দেখলেন?

কর্তাবাবু বললেন–ওসব কথা এখন থাক, তোমার নতুন বেয়াই-বেয়ানকে আনতে যাবে কে?

ছেলে বললে–প্রকাশকে বলেছি।

–প্রকাশ? প্রকাশ কে?

–আমার সম্বন্ধী।

–তোমার সম্বন্ধী! তোমার সম্বন্ধী আবার কবে হলো? তোমার তো সম্বন্ধী ছিল না, বৌমা তো বেয়াই-এর একই সন্তান!

–-আজ্ঞে, আমার আপন সম্বন্ধী নয়, আপনার বৌমার মামার ছেলে। আপনার বৌমার মামাতো ভাই—

–ও–

যেন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন কর্তাবাবু। ছেলের সম্বন্ধীর কথা শুনেই চমকে উঠেছিলেন। তা চমকে ওঠবারই কথা। এত ভেবে-চিন্তে তিনি ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন, মাত্র একটা উদ্দেশ্য নিয়েই। উদ্দেশ্যটা হলো বাড়িতে শুধু যেন বউই না আসে। তার সঙ্গে যেন রাজত্বও আসে। না, অর্ধেক রাজত্ব কথাটা ভুল। কর্তাবাবু যখন ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন, তখন এটা জেনেশুনেই দিয়েছিলেন যে ছেলে একদিন শ্বশুরের সমস্ত সম্পত্তি পাবে।

–চক্রবর্তী মশাই কখন আসছে?

–কাল সকালে আসবার কথা। রজব আলীকে বলেছি রেলবাজারে গাড়ি নিয়ে হাজির থাকতে–

ভাগলপুরে বউমার বাপের যে সম্পত্তি আছে তা কুড়িয়ে বাড়িয়ে পাঁচ-ছ’ লাখ টাকার মতন। তার ওপর কর্তাবাবুর নবাবগঞ্জের নিজের সম্পত্তি। একুনে সব মিলিয়ে আরো কয়েক লাখ। তিনি যখন এ সংসার থেকে বিদায় নেবেন তখন এই ভেবেই নিশ্চিন্ত হয়ে যাবেন যে তার বংশধারা আর তার বংশের ঐশ্বর্য যাবচ্চন্দ্রদিবাকরৌ অক্ষয় অব্যয় অম্লান হয়ে বিরাজ করবে। তারপর যখন তার ছেলেও আর থাকবে না, তখন নাতি থাকবে। সেই নাতিই নরনারায়ণ চৌধুরীর বংশের জয়ধ্বজা চিরকাল আকাশে উঁচু করে তুলে রাখবে।

তা দোতলার একটা ঘরের মধ্যে পঙ্গু হয়ে পড়ে থাকলে কী হবে, তার নজর কিন্তু সব দিকে। একদিন এক জমিদার বাড়িতে সামান্য গোমস্তার কাজ করে প্রথম জীবন কাটিয়েছেন। তখন থেকেই বুঝেছেন কাকে বলে পয়সা। পয়সার যে কী মূল্য তা তখন থেকেই চিনতে শিখেছিলেন তিনি। তখনই বুঝেছিলেন যে প্রচুর পয়সার মালিক না হলে আর বেঁচে থেকে কোনও সুখ নেই। তাই তখন থেকেই পয়সার সাধনাতেই মন দিলেন তিনি। এমন করে মন দিলেন যে লোকে বুঝতে পারলো যে হ্যাঁ সাধক বটে। শেষে একদিন যখন সিদ্ধিলাভ করলেন তখনই পেছনে লাগলো শনি। অত পয়সা করেও তার শান্তি নেই, স্বস্তি নেই। যখন পয়সার পাহাড়ের ওপর বসে আছেন, যখন আত্মীয়-স্বজন, পাইক লাঠিয়াল বরকন্দাজ নিয়ে নবাবগঞ্জের সকলের মাথায় উঠেছেন তখনও মনে শান্তি নেই। হঠাৎ বলা-নেই কওয়া-নেই, একদিন দীনু কাছে এসে দাঁড়ায়। তার মুখের চেহারা দেখেই কর্তাবাবু বুঝতে পারেন কী হয়েছে।

তবু জিজ্ঞেস করেন–কী রে, কী হয়েছে?

দীনু মুখ নিচু করে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলে–আজ্ঞে আবার কালীগঞ্জের বৌ এসেছে–

রেগে যেতেন কর্তাবাবু। গলা চড়িয়ে বলতেন–তা বলা-নেই কওয়া-নেই ওমনি হুট করে এলেই হলো? হঠাৎ আবার এলো কেন? আমি টাকা কোথায় পাবো? আমার কি টাকার গাছ আছে? আমি টাকার চাষ করি? আমি এখন কী করব? তুই গিয়ে কালীগঞ্জের বউকে বল এখন দেখা হবে না–আমার শরীর ভালো নেই–

দীনু বলতো–আজ্ঞে আমি যে বলেছি আপনি ভালো আছেন!

–কেন বললি ভালো আছি? আমি ভালো আছি না খারাপ আছি তুই জানলি কী করে? তুই কি আমায় জিজ্ঞেস করেছিলি?

বুড়ো মানুষ দীনু লোকটা। ফাইফরমাশ খাটাই তার কাজ। সে এত মতলব-ধান্দা ফন্দি ফিকির কিছু বোঝে না।

বললে–না আজ্ঞে, আপনাকে তা জিজ্ঞেস করিনি–

–তাহলে! তাহলে কী করে বুঝলি যে আমার শরীর ভালো আছে?

–আজ্ঞে আমার ভুল হয়েছিল। আমি সেই কথা গিয়ে বলে আসি যে আমার ভুল হয়েছিল। কর্তাবাবুর শরীর ভালো নেই। তার সঙ্গে এখন দেখা হবে না–

–হ্যাঁ, তাই বলে আয়।

দীনু চলে যাচ্ছিল। কর্তাবাবুর আবার কী মনে হলো। ডাকলেন। বললেন–দীনু, শোন্‌, ওকথা বলতে হবে না, তুই বরং তাকে ডেকেই নিয়ে আয়–

এমনি কতবার। কোথায় সেই ইছামতী পেরিয়ে কালীগঞ্জ। আর কোথায় এই নবাবগঞ্জ। পাকা প্রায় পঁচিশ ক্রোশ রাস্তা। তা মধ্যে আবার ইছামতী। কথায় বলে একা নদী বিশ ক্রোশ। এই এতখানি রাস্তা ঠেঙিয়ে আসতো সেই কালীগঞ্জের বৌ। আর এসেই সেই টাকা! টাকার তাগাদা। যেন কর্তাবাবুর কানে স্মরণ করিয়ে দিতে আসতো যে তুমি জমিদারই হও আর যে-ই হও আসলে তুমি আমার অনুগত কর্মচারী। আমার ভৃত্য।

আর সদা এসে ঠিক তখনই দাঁড়াত সেখানে। তখন খুব ছোট সে। পাশের সিন্দুকটা খুলতেই সে দেখতে পেতো ভেতরে কত সোনা, কত মোহর, কত টাকা, কত নোট! দেখতে দেখতে সেই ছোটবেলাতেই সদানন্দর চোখ দুটো পাথর হয়ে যেতো। যত লোক আসে দাদুর কাছে, তাদের সকলের যথাসর্বস্ব এনে ওইখানে ঢেলে দিত। সে সব জমা হয়ে ক্রমে ক্রমে দাদুর সিন্দুকের ভেতরে পাহাড় হয়ে যেত। আর দাদু তত বলতো আমার টাকা কোথায়? টাকা কোথায় আমার? আমার কি টাকার গাছ আছে? আমি কি টাকার চাষ করি?

কালীগঞ্জের বৌ বলতো কিন্তু আমার যে পাওনা টাকা নারায়ণ!

–তা পাওনা টাকা বললেই কি হুট বলতে টাকা দিতে হবে?

–কিন্তু তুমি যে আমাকে আসতে বলেছিলে আজ?

–তখন আসতে বলেছিলুম, ভেবেছিলুম টাকা থাকবে আমার কাছে। কিন্তু এখন দেখছি টাকা নেই আমার।

হঠাৎ পাশ থেকে সদানন্দ বলে উঠলো–না দাদু, তোমার টাকা আছে, আমি দেখেছি তোমার সিন্দুকের ভেতর যে অনেক টাকা আছে–

কর্তাবাবু হঠাৎ পাশের দিকে নজর দিয়ে দেখেন নাতিটা কোন ফাঁকে সেখানে এসে বসে বসে এতক্ষণ তাদের কথা শুনছিল।

বললেন–ওরে, ও দীনু, কোথায় গেলি তুই, ও দীনু, একে এখানে আসতে দিলি কেন? ও দীনু,–

দীনু তাড়াতাড়ি ভেতরে এসে সদাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যেত। কিন্তু সদা যেতে চাইত না, দীনুর টানাটানিতে ঘর থেকে যেতে যেতেও চীৎকার করে বলতো তুমি মিথ্যে কথা বলছো দাদু, তুমি মিথ্যেবাদী–তুমি মিথ্যেবাদী–তোমার অনেক টাকা আছে–

তারপর একসময় কালীগঞ্জের বৌ আবার যেমন এসেছিল তেমনি চলে যেত।

সদানন্দ পালকীটার পেছন পেছন ছুটতো–ও কালীগঞ্জের বৌ, কালীগঞ্জের বৌ, আমার দাদু মিথ্যেবাদী, দাদু তোমায় মিথ্যে কথা বলেছে, দাদুর অনেক টাকা আছে, সিন্দুকের ভেতর দাদুর অনেক টাকা আছে–আমি দেখেছি।

কিন্তু ছুটতে ছুটতে বেশি দূর এগোতে পারতো না। দীনু এসে সদাকে ধরে নিয়ে অন্দরমহলে চলে যেত। আর পালকীটা রাস্তায় নেমে খেয়াঘাটের দিকে এগিয়ে চলতো। তারপর খেয়া পেরিয়ে পঁচিশ ক্রোশ দূরে একেবারে সোজা কালীগঞ্জ—

.

এসব অনেক দিন আগেকার কথা। তারপর মাইনর ইস্কুল থেকে পাশ করে সদানন্দ কেষ্টগঞ্জের রেলবাজারের ইস্কুলে পড়তে গেছে। সে ইস্কুল থেকে পাসও করেছে। তারপর কলেজ। কলেজ থেকে বিএ পাস করেছে। তারপরে তার বিয়ে। এ সেই বিয়ের পরের দিনেরই কাণ্ড।

গৌরী পিসী বললে–সবাই ওদিকে আনন্দ করছে, বাড়িতে নতুন বৌ এসেছে, আর তুই কি না এখানে অন্ধকারে ঘুরে বেড়াচ্ছিস–আয় আয় এদিকে আয়–

বলে সদানন্দকে টানতে টানতে ভেতর বাড়ির উঠোনের দিকে নিয়ে চললো। তখন সত্যিই সেখানে যজ্ঞি বাড়ির ধুম চলেছে। আলোয় আলো হয়ে গেছে জায়গাটা। পাকা ফলার খেতে বসেছে এ-গ্রাম সে-গ্রামের মুনিষরা। তাদেরই তো আসল আনন্দ। কর্তাবাবুর একমাত্র নাতির বিয়ে তো তাদেরই উৎসব। তারা ক’দিন ধরেই খাবে। তাদের নিজেদের বাড়িতে রান্না-খাওয়ার পাট আজ কদিন ধরে বন্ধ থাকবে। সকাল বেলা খাবে আবার রাত্তিরেও খাবে। প্রকাশমামা নিজে দই-এর হাঁড়ি নিয়ে সবাইকে দই দিচ্ছে। কাঁধে তোয়ালে কোমরে গামছা। মুখে খই ফুটছে। বলছে–খা খা খা, পেটভরে খা সবাই–

হঠাৎ সদানন্দর দিকে নজর পড়তেই বলে উঠলো–আরে, এ কী হয়েছে? রক্ত কীসের? রক্ত কেন তোর গেঞ্জিতে?

–রক্ত!

আরো সবাই চেয়ে দেখলে সেদিকে। বললে–সত্যিই তো, রক্ত এল কোত্থেকে? এত রক্ত?

সদানন্দও চেয়ে দেখলে তার গেঞ্জিতে সত্যিই রক্ত লেগে রয়েছে। এত রক্ত এল কোত্থেকে? তার হাতেও রক্ত।

গৌরী পিসীও এতক্ষণে নজর করে দেখলে–এ কী রে, কীসের রক্ত?

হঠাৎ যেন চারদিক থেকে প্রশ্ন উঠলো রক্ত! এ কীসের রক্ত! আকাশ-বাতাস-অন্তরীক্ষ সব জায়গা থেকে একসঙ্গে ঝড়ের মত প্রশ্ন আসতে লাগলো রক্ত, রক্ত! দোতলা থেকে নরনারায়ণ চৌধুরী প্রশ্ন করলেন–রক্ত! রক্ত! হরনারায়ণ চৌধুরীও পাশে এসে দাঁড়িয়ে দেখলেন। বললেন–আরে, এত রক্ত এল কোত্থেকে? দীনু দৌড়ে এল–এ কী খোকাবাবু, এ কীসের রক্ত? কৈলাস গোমস্তাও ভাল করে নজর করে দেখলে–তাই তো, রক্ত কীসের? রজব আলী পাকা-ফলার খাচ্ছিল একমনে। সেও বলে উঠলো–রক্ত! সদানন্দর অতীত জিজ্ঞেস করলে–রক্ত! সদানন্দর বর্তমান জিজ্ঞেস করলে–রক্ত! সদানন্দর ভবিষ্যৎ জিজ্ঞেস করলে রক্ত! সদানন্দর শিক্ষা-দীক্ষা-অস্তিত্বও প্রশ্ন করলে রক্ত! ইতিহাস ভূগোল সমাজ–সমস্ত ঊর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ, অধস্তন উত্তরপুরুষ একযোগে সবাই প্রশ্নের ঝড় বইয়ে দিলে–রক্ত রক্ত রক্ত!!!

.

গণেশ হঠাৎ মাস্টার মশাইকে দেখতে পেয়েছে।

–আরে মাস্টার মশাই, আপনি এখেনে? আর ইনি আপনার জন্যে ভেবে ভেবে অস্থির! আপনি এঁকে ঘরে বসিয়ে রেখে এসেছেন–

সদানন্দ হাজারি বেলিফের দিকে চাইলেন। এতক্ষণে যেন সব মনে পড়লো আবার।

বললেন–আমি আপনার জন্যে জল আনতে এসেছিলুম, কিন্তু গেলাস খুঁজে পাচ্ছিলুম না–

গণেশ বললে–আপনি গেলাস খুঁজে পাবেন কী করে? আপনি কি কখনও নিজের হাতে জল গড়িয়ে খেয়েছেন? যান, আপনি ঘরে যান, আমি জল এনে দিচ্ছি–

যে-গেলাস খুঁজতে সদানন্দবাবুর রাত পুইয়ে গিয়েছিল, সেই গেলাস খুঁজে জল এনে দিতে গণেশের এক মিনিটও লাগলো না।

জল খেয়ে হাজারি যেন একটু ঠাণ্ডা হলো। বললে–যাক্ গে, এবার আর দেরি নয়। মশাই, চলুন। এখন পাঁচ ক্রোশ রাস্তা হাঁটতে হবে, বেলাবেলি বেরিয়ে পড়ুন–

সদানন্দবাবু বললেন–আজকেই যেতে হবে?

হাজারি বেলিফ বললে–তা যেতে হবে না? আপনার নামে হুলিয়া রয়েছে আমার কাছে আজ পনেরো বছর ধরে আর আপনি বলছেন আজকেই যেতে হবে কিনা? শেষকালে হাকিমকে খবর দিলে যে আপনার হাতে হাতকড়া লাগিয়ে নিয়ে যাবে তারা। তখন কি ভালো দেখাবে? তার চেয়ে ভালোয়-ভালোয় আমার সঙ্গে চলুন, বেশী ঝামেলা হবে না। আমি বাজে ঝামেলা পছন্দ করি না–

সদানন্দবাবু বললেন–কিন্তু আমি কী অপরাধ করেছি যে আমার নামে হুলিয়া বেরিয়েছে? বাদী কে?

হাজারি বললে–বাদী কে আবার, পুলিস।

–আর আমার অপরাধ?

হাজারি বললে–অপরাধ? অপরাধের কথা বলছেন? হরনারায়ণ চৌধুরীর নাম শুনেছেন?

–হ্যাঁ, তিনি তো আমার বাবা!

–আপনি তাকে খুন করেন নি?

–খুন? আমি? আমি আমার বাবাকে খুন করেছি?

–হ্যাঁ মশাই, হ্যাঁ, আর শুধু কি তাই? আপনি আট লাখ টাকা তহবিল তছরূপ করেছেন, তারও প্রমাণ আছে কোর্টের কাছে–

–আট লাখ টাকার তহবিল তছরূপ? বলছেন কী আপনি?

–আর নয়নতারা? নয়নতারাকে চেনেন?

–হ্যাঁ।

হাজারি বেলিফ বললে–তার সব্বোনাশ কে করেছে?

–তার সব্বোনাশ হয়েছে! কে সব্বোনাশ করেছে তার? কী সব্বোনাশ হয়েছে?

হাজারি বললে–আপনি ভালো মানুষ সেজে থাকলে কী হবে, এক গেলাস জল পর্যন্ত নিজে গড়িয়ে খেতে পারেন না, কিন্তু আপনার শয়তানি জানতে কোর্টের বাকি নেই মশাই। আজ পনেরো বছর ধরে আপনার নামে হুলিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর আপনি এখানে সাধু সেজে লুকিয়ে বসে আছেন। কী কাণ্ড বলুন দিকিনি!

সদানন্দবাবু হতবাক হয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। তার মুখ দিয়ে যেন আর কোনও কথা বেরোতে নেই।

বললেন–তাহলে আমি আসামী?

হাজারি বললে, আসামী না হলে আপনার নামে হুলিয়া বেরোল কেন? কই, আর কারো নামে তো হুলিয়া বেরোচ্ছে না! আপনি ভেবেছেন লুকিয়ে লুকিয়ে জল খাবেন আর কেউ তা জানতে পারবে না? তাহলে মশাই আর কোর্ট-কাছারির সৃষ্টি হয়েছে কেন? আর তা ছাড়া এখন হয়েছে কী! এখন তো সবে ‘মহড়া’–

–‘মহড়া’ মানে?

হাজারি বললে–কবির গান শোনেন নি? প্রথমে ‘মহড়া’ দিয়ে শুরু হবে, তারপরেই ‘চিতেন’। ওই ‘চিতেনে’ই তো যত মজা। তারপর ‘পর-চিতেন’, তাতে আরো মজা। তারপরে সকলের শেষে আছে ‘অন্তরা’। এখন নিচের ছোট কোর্টে শুরু হবে মামলা, তারপরে যখন সেই মামলা বড়-আদালতে যাবে তখনই তো মজা।

সদানন্দবাবু একটু ভেবে নিয়ে বললেন–একটা কথা রাখবেন আমার?

–কী কথা!

–আমাকে দু-চারদিন সময় দেবেন?

–দু’চারদিন?

–হ্যাঁ, আমি দেখে আসবো একবার সুলতানপুরে গিয়ে যে সত্যিই আমি হরনারায়ণ চৌধুরীকে খুন করেছি কি না। দেখে আসবো আমি আট লাখ টাকা তছরূপ করেছি কি না। তারপর একবার যাবো নবাবগঞ্জে। আর নয়নতারার কথা বললেন? কিন্তু আমি তো তার কোনও সর্বনাশ করিনি। আমি তো বরাবর তার ভালো করবারই চেষ্টা করেছি। তাকেও আমি একবার দেখতে যাবো নৈহাটিতে।

–আর আমি? আমি কি এখানে বসে ভ্যারেণ্ডা ভাজবো নাকি? আপনি যদি মশাই পালিয়ে যান? আপনাকে আর আমার বিশ্বাস নেই–

সদানন্দবাবু বললেন–পালালে তো আগেই পালাতে পারতুম হাজারিবাবু। আর এই তো আমি সংসার ছেড়ে চৌবেড়িয়াতে পালিয়ে এসেছি, কিন্তু জীবনের যন্ত্রণা থেকে কি রেহাই পেয়েছি? এও তো এক জেলখানা। এই জীবনই তো আমার কাছে জেলখানা। এই জেলখানা থেকে না-হয় আর একটা জেলখানাতে গিয়ে ঢুকবো। জেলখানাকে আমি ভয় করি না। কিন্তু আমি জানতে চাই আমি কী অন্যায় করেছি। বুঝতে চাই আমি কী পাপ করেছি। দেখতে চাই আমি কার কী ক্ষতি করেছি, কার কী সর্বনাশ করেছি! নিজের চোখে ভালো করে পরীক্ষা করতে চাই আমার এত চেষ্টা, এত অধ্যবসায়, এত ত্যাগ কেন এমন করে মিথ্যে হয়ে গেল, কে আমার সব ইচ্ছেকে এমন করে পণ্ড করে দিলে? এর কারণটা কী?

–আর আমি?

–আপনিও চলুন আমার সঙ্গে। আজ পনেরো বছর আমার পেছনে নষ্ট করেছেন, এবার আর দুটো দিন নষ্ট করতে পারবেন না?

সঙ্গে নেবার মত কিছুই ছিল না। তবু টুকিটাকি কিছু নিতে হলো। সদানন্দবাবু বেরোলেন। পেছনে ভদ্রলোকও সঙ্গে চলতে লাগলো। বললে–দুগ্যা, দুগ্যা, এ কী এক ঝামেলায় ফেললেন মশাই আমাকে, চলুন চলুন, পা চালিয়ে চলুন–

গণেশ দেখতে পেয়ে দৌড়ে এল।

বললে–কোথায় যাচ্ছেন মাস্টার মশাই? যাচ্ছেন কোথায়?

সদানন্দবাবু বললেন–হরি মুহুরি মশাইকে বলে দিও গণেশ যে দু’দিনের জন্যে আমি একটু বাইরে যাচ্ছি–

–দু’দিন পরে আবার আসছেন তো?

সদানন্দবাবু বললেন–তা কি বলা যায় কিছু! সারা জীবন এত হিসেব করে চলেও যখন একদিন সব হিসেব বেহিসেব হয়ে গেল তখন ঠিক করে কিছুই আর বলতে ভরসা হয় না। তবে এলে তো তোমরা দেখতেই পাবে–

বলে গঙ্গার ঘাটের দিকে পা বাড়িয়ে দিলেন। চলতে চলতে তার মনে হতে লাগলো যেন আকাশ বাতাস অন্তরীক্ষ সব একসঙ্গে ঝড়ের মত প্রশ্ন করে চলেছে–এ কীসের রক্ত! দোতলা থেকে নরনারায়ণ চৌধুরী প্রশ্ন করছেন, প্রশ্ন করছেন হরনারায়ণ চৌধুরী। প্রশ্ন করছে দীনু, কৈলাস গোমস্তা, গৌরী পিসী, রজব আলী, সবাই। সদানন্দবাবুর অতীত বর্তমান ভবিষ্যও যেন একই প্রশ্ন করে চলেছে। একই প্রশ্ন করে চলেছে সদানন্দবাবুর শিক্ষা-দীক্ষা অস্তিত্ব। প্রশ্ন করে চলেছে সদানন্দবাবুর ইতিহাস-ভূগোল-সমাজ। প্রশ্ন করে চলেছে। সদানন্দবাবুর ঊধ্বর্তন পূর্বপুরুষ, প্রশ্ন করে চলেছে সদানন্দবাবুর অধস্তন উত্তরপুরুষ। একযোগে সকলের প্রশ্ন সদানন্দবাবুর মনে ঝড় বইয়ে দিচ্ছে–এ কীসের রক্ত!

আর তাদের সকলের সঙ্গে সুর মিলিয়ে যেন নয়নতারাও সদানন্দবাবুকে জিজ্ঞেস করে চলেছে–এ কীসের রক্ত!

 ২.১ চিতেন

রেল-বাজার থেকে নবাবগঞ্জ পাঁচ ক্রোশ রাস্তা। পাঁচ ক্রোশ রাস্তা হলে কী হবে ওটুকু পথ লোকে হেঁটেই মেরে দেয়। এখন অবশ্য বাস হয়েছে। কুড়িটা নয়া দিলে একেবারে নবাবগঞ্জের আগের গ্রামে পৌঁছে যাবে। সেখান থেকে ওই দেড় মাইলটাক রাস্তা হেঁটে চলে যাও একেবারে সোজা নবাবগঞ্জে পৌঁছে যাবে।

তা সেই রেলবাজারের ইস্টিশানে ট্রেন থেকে একদিন একজন ভদ্রলোক নামলো। বেশ ধোপ-দুরস্ত চেহারা। হাতে একটা ছোট সুটকেসের গায়ে সাদা রং দিয়ে ইংরিজি অক্ষরে লেখা রয়েছে–পি সি রায়। ট্রেনটা চলে যাবার পর ভদ্রলোক কোনও দিকে দৃকপাত না করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে সোজা বাজারের রাস্তায় পড়লো। তারপর বাঁয়ে ঘুরে একটা মিষ্টির দোকানে। দোকানী এগিয়ে এল।

–কী দেব বলুন?

ভদ্রলোক বললে–সন্দেশ কত করে?

–সাড়ে সাত টাকা।

–ওরে বাবাঃ, একেবারে সাড়ে সাত টাকা! গলাকাটা দর করে দিলেন যে। আগে আপনাদের দোকানে কত সন্দেশ-রসগোল্লা-রাজভোগ খেয়েছি, তখন তো আড়াই টাকা করে সের ছিল।

দোকানদার সবিনয়ে বললে–সে-সব দিনের কথা এখন ভুলে যান। তখন সাত টাকা মণ দুধ পাওয়া যেত।

ভদ্রলোকের এ-সব কথা ভালো লাগলো না। বললে–না মশাই, এ একেবারে গলাকাটা দর করে দিয়েছেন। তা সিঙ্গাড়া কত করে?

–তিন আনা পিস্—

ভদ্রলোক বলে উঠলো–তা সিঙ্গাড়া তো আর দুধের খাবার নয় মশাই, সিঙ্গাড়ার এত দাম করেছেন কেন? আমি কি ভেবেছেন নতুন এসেছি এখেনে–আজ কুড়ি-তিরিশ বছর ধরে আসছি। এককালে আপনাদের দোকানে আমি এক টাকা সের সন্দেশ খেয়েছি, তাও আমার মনে আছে–

এতক্ষণে দোকানদারের যেন মন ভিজলো। জিজ্ঞেস করলে আপনার দেশ কি এখেনে?

ভদ্রলোক বললে–আমার নিজের দেশ নয়, আমার জামাইবাবু নবাবগঞ্জের জমিদার–

নবাবগঞ্জের জমিদার?

–আরে হ্যাঁ মশাই, ছোটবেলা থেকে দিদির বাড়ি আসতুম, আর এইখান থেকে কাঁচাগোল্লা কিনে নিয়ে যেতুম। এককালে এখানে রোজ আসতুম।

–আপনার দেশ?

–ভাগলপুর। এখানে নবাবগঞ্জে আমার ভগ্নীপতির বাড়ি। জমিদার হরনারায়ণ চৌধুরীর নাম শুনেছেন? তিনিই ছিলেন আমার ভগ্নীপতি।

–তা তিনি তো নবাবগঞ্জ থেকে জমিজমা বেচে চলে গিয়েছেন। ভাগলপুরে আছেন এখন–

ভদ্রলোক বললে–তাহলে তো সবই জানেন দেখছি। সেই ভগ্নীপতিই এখন মারা গেছেন।

–মারা গেছেন!

ভদ্রলোক বললে–হ্যাঁ, সে এক ভীষণ কাণ্ড! সেই ব্যাপারেই আমরা সব বিব্রত। এখন যাচ্ছি নবাবগঞ্জে আমার ভাগ্নের খবর নিতে–

–ভাগ্নে মানে? সেই সদা! সদানন্দ!

–হ্যাঁ, সদানন্দকে এদিকে দেখেছে নাকি? তাঁকে খুঁজতেই তো যাচ্ছি। যাহোক, তাহলে মশাই আপনার সন্দেশ আর খাওয়া হলো না। সাড়ে সাত টাকা সেরের সন্দেশ খাবার ক্ষমতা নেই আমার–

দোকানদার বললে–তাহলে সিঙ্গাড়া খান, তিন আনার চেয়ে সস্তা দেওয়া যায় না, আলুর যা দাম বাড়ছে–

–তা দু’আনা করে হোক না—

দোকানদারের কী মনে হলো। বললে–ঠিক আছে, আপনি চা খাবেন তো? দু’আনায় এক কাপ চা। চা খেলে একখানা সিঙ্গাড়া দু’আনায় দিতে পারি। আপনি আমাদের পুরোন লোক-দেশের লোক, এতদিন পরে এসেছেন। ওরে, বাবুকে এক কাপ চা আর একটা গরম সিঙ্গাড়া দে–

তা তাই-ই সই। বেশী দরাদরি করা ঠিক নয়। সন্দেশটা সস্তা করে দিলেই ভালো হতো অবশ্য শেষ পর্যন্ত একখানা সিঙ্গারা দিয়ে এক কাপ চা-ই নিলে ভদ্রলোক। বললে–তাহলে চা’য়ে একটু বেশি করে চিনি দেবেন মশাই, আমি আবার চিনি একটু বেশী খাই–

চা আর সিঙ্গাড়া খেয়ে দাম চুকিয়ে দিয়ে ভদ্রলোক উঠলো। ভোরবেলা ট্রেন থেকে নেমেছে। এবার একটু রোদ উঠেছে। এখনও পাঁচ ক্রোশ রাস্তা ঠেঙ্গাতে হবে। রেলবাজারের রাস্তায় তখন মানুষের রীতিমত আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে–

তারপর রাস্তায় নামবার আগে দোকানদারকে লক্ষ্য করে বললে–ফেরবার সময় আবার আসছি, তখন কিন্তু একটু কন্‌শেসন করতে হবে, বুঝলেন–

তা এই হলো প্রকাশ রায়। সদানন্দ চৌধুরীর প্রকাশ মামা। আপন মামা ঠিক নয়। তা হোক, আপন মামার চাইতেও বড়। মার এক মামার ছেলে। ছোট বেলা থেকে নবাবগঞ্জে আনাগোনা করতো। বড়লোক ভগ্নীপতি। দূর সম্পর্কের ভগ্নীপতি হলেও ভগ্নীপতি তো! একটা সম্পর্ক তো আছে, তা সে যত ক্ষীণ সম্পর্কই হোক। সেই ক্ষীণ সম্পর্কটাকে ঘন ঘন দেখা-সাক্ষাৎ আসা-যাওয়া দিয়ে সে রীতিমত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে পরিণত করে তুলেছিল। বলা-নেই কওয়া-নেই হঠাৎ-হঠাৎ এসে উদয় হতো প্রকাশ। বড়লোক দিদি। থাকা-খাওয়ার এলাহি ব্যবস্থা। প্রকাশ এলেই নবাবগঞ্জের লোকেরা বলতো–ওই চৌধুরী মশাই-এর শালা এসেছে–

অনেকে আবার আদর করে শালাবাবুও বলতো।

শালাবাবু এলে নবাবগঞ্জের লোক ধরে বসতো–শালাবাবু, আমাদের বারোয়ারিতলায় যাত্রা হবে, চাঁদা দিন—

তা চাঁদা দিতে কখনও কার্পণ্য করে নি শালাবাবু। বলতো–বেশ তো, কত চাঁদা দিতে হবে আমাকে, বলো–

দশ টাকা চাই আপনার কাছে

তা দশ টাকা দিতেও আপত্তি করত না শালাবাবু। নবাবগঞ্জের জমিদারের শালা, সুতরাং সারা গ্রামের লোকেরই শালা। তার মতন লোকের কাছে দশ টাকা চাঁদা চাইবার হক আছে বইকি গ্রামের লোকের। শালাবাবুর ফিনফিনে পাঞ্জাবি, কোঁচানো ধুতি, আর ঢেউ খেলানো তেড়ি, এ-সব দেখে যে-কোনও লোকই বুঝতে পারতো শালাবাবু পয়সাওয়ালা লোক। আসলে কিন্তু এ পয়সা যোগান দিত দিদি। শালাবাবু এসেই বলতো দিদি, এবার আর তোমার ইজ্জৎ থাকবে না–

দিদি বুঝতে পারতো না। বলতো–কেন রে, কী হলো?

নবাবগঞ্জের ক্লাবের ছেলেরা আবার চাঁদা চাইছে। একেবারে দশ টাকা চাঁদা ধরেছে আমার নামে।

দিদি বলতো–কেন, আবার চাঁদা কীসের? এই তো সেদিন যাত্রার জন্যে তুই দশটা টাকা চেয়ে নিয়ে গেলি। এরই মধ্যে আবার চাঁদা কিসের?

শালাবাবু বললে–আমিও তো তাই জিজ্ঞেস করলুম, আবার চাঁদা কীসের? তা ওরা বললে–এবার বারোয়ারিতলায় কবির গান লাগাবে–

–কবির গান? ওদের বুঝি কাজকম্ম কিছু নেই, কেবল যাত্রা থিয়েটার আর গান!

শালাবাবু বললে–দিয়ে দাও দশটা টাকা। দশটা টাকা তোমার কাছে কিছু না, কিন্তু ওরা আমাকে শালাবাবু বলে এখনও মান্যগণ্য করে তো, টাকা না দিলে সেটাও আর করবে না, তখন তোমারও ইজ্জৎ নষ্ট, বলবে চৌধুরীমশাই কিটে লোক–চৌধুরীমশাই-এর বউও কিপটে, তার শালাটাও কিপটে।

দিদি ভাই-এর কথায় হেসে ফেলতো। বলতো–তোর বুদ্ধি তো খুব প্রকাশ–

প্রকাশ দিদির কাছে তারিফ পেয়ে অহঙ্কারে আরো ফুলে উঠতো। বলতো–তুমি আর আমার বুদ্ধির কতটুকু দেখলে দিদি। জানো, এই যে এতবার ভাগলপুর থেকে এখানে আসি, তুমি কি ভেবেছো আমি রেলের টিকিট কাটি নাকি?

–টিকিট কাটিস না!

প্রকাশ গর্বে বুক ফুলিয়ে দিদির দিকে চেয়ে বলে–না। টিকিট কাটতে যাবো কোন্ দুঃখে বল তো! আমি গাড়িতে চড়লেও রেল চলবে, না-চড়লেও চলবে। আমি চড়ি বলে কি আর রেলের ইঞ্জিনের কয়লা বেশি পোড়ে?

দিদি অবাক। বলে–তাহলে তুই যে আমার কাছ থেকে টিকিটের টাকা নিস?

প্রকাশ বলে–তোমার দেখছি বুদ্ধিসুদ্ধি কিছু নেই দিদি। তোমার কাছ থেকে টিকিটের টাকা নিই বলে সত্যি সত্যি রেলের টিকিট কাটতে হবে? তুমি বলছো কী? ওই রকম বোকা হলেই হয়েছে আর কী! পৃথিবীতে লোকের সঙ্গে একটু ভালোমানুষি করেছ কি সবাই তোমায় পিষে গুঁড়িয়ে চেপটে মেরে ফেলে দেবে। তুমি তো দেশের মানুষগুলোকে এখনও চিনলে না, তাই ওই কথা বলছো! খবরদার খবরদার, ওই বোকামিটি কখখনো কোর না দিদি, রেলে চড়লে কখনো টিকিট কাটবে না। রেলগাড়ি মানে কী জানো তো?

–কী?

–জোচ্চোরের বাড়ির ফলার। পেলে ছাড়তে নেই।

–তা তুই সে টাকাগুলো নিয়ে কী করিস?

প্রকাশ বলে—খাওয়াই–

–খাওয়াই মানে? কাকে খাওয়াস?

প্রকাশ বলে–ওই টিকিট চেকারদের। এক-একদিন যখন ধরে ফেলে তখন চা-সিগ্রেট খাওয়াতে হবে না? সবাই তো আর আমার বউ-এর ভাই নয় যে আমার মুখ দেখে ছেড়ে দেবে! দু’একটা আবার ধর্মপুত্তুর যুধিষ্টির আছে, জানো, তারা মিষ্টি কথাতেও ভুলবে না, চা-সিগ্রেটও খাবে না, আবার ঘুষও নেবে না। সেই সব বেয়াড়া লোকগুলোকে নিয়েই হয় মুশকিল।

–তখন কী করিস?

–তখন কী আর করবো? গাঁট-গচ্চা দিতে হয়—

কথাগুলো বলবার সময় দিদিও যত হাসে, প্রকাশও তত হাসে। ভাইএর বাহাদুরিতে দিদি অবাকও হয়ে যায়। যখন প্রকাশ নবাবগঞ্জে আসে তখন অনেক সময় রেলবাজারের মিষ্টির দোকান থেকে এক হাঁড়ি কাঁচাগোল্লা নিয়ে আসে। দিদি বলে–এ কী রে, তুই আবার কুটুম লোকের মত মিষ্টি নিয়ে আসিস কেন? তুই কি কুটুমবাড়ি আসছিস নাকি?

প্রকাশ বলতো–না দিদি, তুমি কাঁচাগোল্লা খেতে ভালবাসো তাই আনলুম। তিন টাকা সের, বেটারা গলা কাটা দাম রেখেছে–

দিদি সন্দেশটা নেয় বটে, কিন্তু ভাই-এর দেওয়া জিনিসের দামও সঙ্গে সঙ্গে শোধ করে দেয়। আর তা ছাড়া প্রকাশ টাকা পাবেই বা কোথায়? তার তো আর ভগ্নীপতির মত নিজের ঢালাও জমিদারি নেই যে দিদিকে রোজ-রোজ এক সের করে কাঁচাগোল্লা খাওয়াবে! আর প্রকাশও জানতো যে সেই কাঁচাগোল্লা দিদি নিজে যতখানি খাবে, তার চেয়ে বেশি খাবে প্রকাশ নিজে।

ওই সদা যখন হলো তখন ওর ভাতের সময় করা-কর্মা যা কিছু সবই করেছিল ওই প্রকাশ। অবশ্য তখন প্রকাশ নিজেও ছোট। সদানন্দর সেই ছোটবেলা থেকে তার বিয়ে দেওয়া পর্যন্ত সব কাজেই প্রকাশ। জমিদারবাড়ির একমাত্র ছেলে। আদর করবার লোকেরও অভাব যেমন নেই, ছেলের সাধ-আহ্লাদ-শখ মেটাবার জন্যে টাকারও তেমনি অভাব নেই। যত ইচ্ছে খরচ করো না তুমি, ছেলে যদি তাতে সুখী হয় তো আমার কোনও আপত্তি নেই। আরো টাকা নাও নবাবগঞ্জের চৌধুরী বংশের কুল-তিলক সদানন্দ, তার জন্যে নরনারায়ণ চৌধুরীর কোনও কার্পণ্য নেই।

যেদিন সদানন্দ জন্মালো নরনারায়ণ চৌধুরী তখন রাণাঘাটের সদরে মামলার তদ্বির করতে গেছেন। সদরে তার নিজের বাড়ি ছিল। মামলা-মকর্দমার জন্যে তাকে যেতেই হতো। ওখানে গেলে কিছুদিন ওই বাড়িতেই কাটাতেন। লোকজন ছিল তাঁর। কাছারি বাড়ির কাজ হতো ওইখানে। তার জন্যে লোক-লস্কর সব কিছুর ব্যবস্থা ছিল।

সেদিন উকিল-মুহুরি নিয়ে কাছারি-ঘরে তিনি খুবই ব্যতিব্যস্ত। নব্বই হাজার টাকার একটা বিলের মামলার ডিক্রী হয়েছে। তাই নিয়ে সাক্ষী-সাবুদের ঝামেলায় একেবারে নাজেহাল, তখন হঠাৎ নবাবগঞ্জ থেকে দীনু দৌড়তে দৌড়তে গিয়ে খবর দিলে–বউমার ছেলে হয়েছে–

প্রথমটায় যেন মনে হলো ভুল শুনছেন। তারপর উকিল-মুহুরির দিক থেকে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন–কী বললি?

–আজ্ঞে বউমার ছেলে হয়েছে।

তবু যেন কর্তামশাইএর বিশ্বাস হলো না। বললেন–ছেলে, না মেয়ে?

–আজ্ঞে ছেলে।

–তুই ঠিক জানিস–ছেলে?

দীনু বললে–আজ্ঞে হ্যাঁ, মঙ্গলা দাই নিজে আমাকে বলেছে। ছোট-মশাই তাই আমাকে এখানে পাঠিয়ে দিলে।

কথাটা শুনে কর্তামশাই প্রথমে কী করবেন বুঝতে পারলেন না। তারপর কৈলাসকে ডাকলেন। কৈলাস গোমস্তা যে তার পাশেই বসে আছে, উত্তেজনায় সে-খেয়ালও তার ছিল না। আবার ডাকলেন–কৈলাস, কৈলাসের টিকি দেখতে পাচ্ছি নে কেন, সে যায় কোথায়?

পাশ থেকে কৈলাস বলে উঠলো–আজ্ঞে এই তো আমি।

–ও তুমি পাশেই রয়েছ, তা আমি যে এত চেঁচিয়ে মরছি তুমি রা কাড়ছো না কেন? তোমরা কি সব কানে তুলে দিয়ে রেখেছ? তোমাদের কি সব সময় কেবল ফাঁকি! ফাঁকি দেওয়া তোমাদের স্বভাব হয়ে গিয়েছে–

একগাদা নথিপত্র নিয়ে কৈলাস তখন হিমসিম খেয়ে যাচ্ছিল। তিন দিন তিন রাত ধরে সেই সব নথিপত্র নিয়েই কেটেছে সকলের। একবার কাছারি আর একবার কোর্ট করেছে। জমিদারী-সেরেস্তার কাজে তার মত বিশ্বস্ত লোক পাওয়াও কর্তামশাই-এর একটা ভাগ্য। কিন্তু তবু তার বকুনি খাওয়ার কপাল।

কর্তামশাই বললেন–ওসব নথিপত্র এখন রাখো,–

কৈলাস গোমস্তা বললে–আজ্ঞে, কাল যে মুনসিফের কোর্টে এ-মামলার শুনানী আছে– কর্তামশাই বললেন–রাখো তোমার শুনানী। জীবনে অনেক মামলা করেছি, তুমি আমাকে আর কোর্ট দেখিও না। আমি কি কোর্ট-এর নাম শুনলে ভয় পাবো? না-হয় ও বিল্টা যাবে। জীবনে অনেক বিল্ দেখেছি, আবার অনেক সম্পত্তি চলেও গিয়েছে আমার। আর আমি যদি বেঁচে থাকি অমন বিল্ আমি আরো দশটা নীলামে ডেকে নেব। এখন ও সব থাক্‌, শুনছো নাতি হয়েছে আমার, তুমি এখন আমাকে কোর্ট শোনাচ্ছো। যাও, ও সব রাখো। আমি আজকেই নবাবগঞ্জে ফিরে যাবো, তার ব্যবস্থা করো–

–এখুনি যাবেন?

–এখুনি যাবো না তো কি একদিন পরে যাবো? পরে গেলে দেরি হবে না? এ কি দেরি করার কাজ? যাও, গাড়ির বন্দোবস্ত করো, আর আমার বাক্স-বিছানা সব দীনুকে দিয়ে গুছিয়ে ফেল। রজব আলীকে ডেকে গাড়িতে গরু জুততে বলো–

এর ওপর আর কথা বলা চলে না। কৈলাস গোমস্তা বাইরে যাচ্ছিল সব বন্দোবস্ত করতে।

কর্তামশাই আবার ডাকলেন–হ্যাঁ, ভালো কথা, তার আগে আর একটা কাজ করো দিকিনি। বাজারের সনাতন স্যাকরাকে চেনো তো, তাকে গিয়ে বলো দশ ভরির সোনার হার যদি একটা তৈরি থাকে তো সেটা নিয়ে যেন এখুনি একবার আমার কাছে আসে–

তা সেইদিনই কর্তামশাই সেই দশভরি সোনার হার নিয়ে রজব আলীর গাড়িতে চড়ে গ্রামের দিকে রওনা দিয়েছিলেন। খাওয়া-ঘুমনো মামলা সব কিছু মাথায় রইলো। সব কিছু ফেলে কর্তামশাই নবাবগঞ্জে এসে ওই দশ ভরির সোনার হার দিয়ে নাতির মুখ দেখেছিলেন। এ নাতি যে তার কত আদিখ্যেতার নাতি তা আর কেউ না জানুক, কর্তামশাইএর অজানা ছিল না। ছেলের বিয়ে তিনি অল্প বয়েসেই দিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল তার বাড়ি নাতি নাতনীতে ভরে যাবে। তার সংসার বিলাস-বৈভবে ঐশ্বর্যে জাঁক-জমকে জমাট হয়ে উঠবে। কিন্তু তা হয় নি। তিনি অনেক খুঁজে-পেতে সুলতানপুরের জমিদার কীর্তিপদ মুখুজ্যের একমাত্র সন্তানকে নিজের ছেলের পাত্রী হিসেবে পছন্দ করে বউ করে নিজের বাড়িতে এনেছিলেন।

কিন্তু বিয়ের পর বহুদিন কেটে গেল, তবু সন্তানাদি কিছু হলো না দেখে বড় মুষড়ে পড়েছিলেন।

এই প্রকাশ তখন সবে হয়েছে। বাপ-মা মারা যাবার পর পিসীমার কাছেই থাকতো। পিসেমশাই কীর্তিপদ মুখুজ্জের ছেলে ছিল না বলে আদর-যত্ন পেত ছেলের মত। তারপর যখন প্রীতিলতার বিয়ে হয়ে সে নবাবগঞ্জে চলে গেল তখন ছোট ছেলের মত প্রকাশও দিদির সঙ্গে দিদির শ্বশুরবাড়িতে এল।

কিন্তু এ-সব জটিলকুটিল বংশতালিকার শুকনো বর্ণনা না দেওয়াই ভালো। তাতে গল্প দানা বাঁধতে পারে না। গল্প আত্মীয়স্বজনের ডালপালার ঘা লেগে হোঁচট খেয়ে খুঁড়িয়ে চলে। তার চেয়ে প্রকাশের যে পরিচয় দিচ্ছিলাম তাই দেওয়াই ভালো। কারণ এ উপন্যাস যাঁরা পড়ছেন তাদের এখন থেকেই জানিয়ে দেওয়া ভালো যে প্রকাশ রায় ভবিষ্যতে এ উপন্যাসে আরো অনেকবার উদয় হবে। পাঠক-পাঠিকারা এই চরিত্রটির সম্বন্ধে যেন একটু বিশেষ অবহিত থাকেন।

এদিকে সদানন্দ যখন বড় হলো তখন প্রকাশ রায় এ বাড়িতে রীতিমত আসর জমিয়ে বসেছে। এখানে একবার আসে একমাস দুমাস থাকে, আর দিদির কাছ থেকে কিছু টাকা হাতিয়ে নিয়ে আবার কিছুদিনের জন্যে অদৃশ্য হয়ে যায়।

যখন নবাবগঞ্জে থাকে তখন সদানন্দকে নিয়ে ঘোরে। কোথায় যাত্রা হচ্ছে, কোথায় কবির লড়াই হচ্ছে, পাঁচালী হচ্ছে, সেখানে ভাগ্নেকে সঙ্গে করে তার নিয়ে যাওয়া চাই।

নরনারায়ণ চৌধুরী হাজার কাজের মধ্যেও নাতির খবর নেন। বলেন–খোকা কোথায় গেল, খোকা? খোকাকে দেখছি নে যে?

কৈলাস গোমস্তা বলে–আজ্ঞে, খোকাবাবু শালাবাবুর সঙ্গে বেরিয়েছে–

জিনিসটা কর্তামশাইএর পছন্দ হয় না। কিন্তু কিছু বলতেও পারেন না। বউমার ভাই। কুটুম সম্পর্ক। শুধু বলেন–তোমাদের শালাবাবু লোকটা সুবিধের নয়, সিগ্রেট-টিগ্রেট খেতে দেখেছি–

কিন্তু প্রকাশের সে-দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। স্টেশন থেকে সোজা এসেই একেবারে কর্তামশাইএর পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায় ঠেকায়।

কর্তামশাই প্রত্যেকবারই হচকিয়ে যান।

বলেন–কে?

–আজ্ঞে আমি প্রকাশ।

–প্রকাশ! নামটা যেন অনেকক্ষণ চিনতে পারেন না। তারপর একেবারে না চিনলে খারাপ দেখায় তাই বলেন–বেয়াই মশাই কেমন আছেন? বেয়ান? সবাই ভালো আছেন তো?

তারপরে আর কর্তামশাইএর সঙ্গে দেখা করা দরকার মনে করে না সে। সোজা চলে যায় দিদির কাছে। একেবারে অন্দর মহলে গিয়ে বলে–দিদি এলুম—

এক একদিন হাসতে হাসতে ঢোকে দিদির ঘরে। বলে–জানো দিদি, তোমার ছেলে খুব ইনটেলিজেন্ট হয়েছে—

দিদি বলে–কি রকম?

প্রকাশ বলে–ওকেই জিজ্ঞেস করো না—

দিদি খোকার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে কী হয়েছে খোকন?

খোকন বলে–আমি গান শিখেছি মা–

–ওমা তাই নাকি? কই গাও দিকি?

প্রকাশও উৎসাহ দিলে ভাগ্নেকে। বললে–গাও গাও, গেয়ে শোনাও মাকে, শোনাও–

খোকন দু’হাত তুলে এঁকে-বেঁকে নাচতে শুরু করে দিলে। তারপর গান গাইতে আরম্ভ করলে–

আগে যদি প্রাণসখি জানিতাম
শ্যামের পীরিত গরল মিশ্রিত
করো মুখে যদি শুনিতাম
কুলবতী বালা হইয়া সরলা
তবে কি ও বিষ ভখিতাম।।

গান শুনে ভেতরবাড়ি থেকে আরো অনেকে দৌড়ে এসেছিল। গৌরী পিসী ছেলের বুদ্ধি দেখে আর থাকতে পারলে না। একেবারে দুই হাতে খোকনকে কোলে তুলে মুখময় চুমু খেতে লাগলো। বললে–ওমা, কী চমৎকার গলা খোকন-মণির, বড় হলে খোকন আমাদের বড় গাইয়ে হবে বউদি–

আরো যারা দেখছিল তারাও সবাই একবাক্যে ধন্য-ধন্য করতে লাগলো!

অহঙ্কারে তখন শালাবাবুর বুক দশ হাত হয়ে গেছে। বললে–এবার সেই গানখানা গাওতো খোকন, সেই যেখানা আমি শিখিয়েছি।

–কোন্ গানটা?

–সেই যে–আর নারীরে করিনে প্রত্যয়—

খোকন গাইতে লাগল–

আর নারীরে করিনে প্রত্যয়
নারীর নাইকো কিছু ধর্মভয়
নারী মিলতে যেমন ভুলতে তেমন
দুই দিকে তৎপর
মজিয়ে পরে চায় না ফিরে
আপনি হয় অন্তর—

শালাবাবু নিজেই গানের তারিফ করতে লাগলো। বললে—বাঃ বাঃ বাঃ—

কিন্তু হঠাৎ হরনারায়ণ ঘরে ঢুকলেন। বললেন–কে গান গাইছিল, খোকা না?

শালাবাবু বললে–হ্যাঁ জামাইবাবু,আপনি আর একবার শুনবেন গানটা?

হরনারায়ণ বললেন–না, ও সব গান ওকে কে শিখিয়েছে?

শালাবাবু বললে–কবির গান শুনতে নিয়ে গিয়েছিলুম, সেখানে শিখেছে। কী ইটেলিজেন্ট হয়েছে খোকন দেখেছেন! একবার মাত্তোর গানটা শুনেছে, আর সঙ্গে সঙ্গে সুরটা মুখস্থ করে ফেলেছে। আমি তো জামাইবাবু আমার বাপের জন্মে এমন ইনটেলিজেন্ট ছেলে দেখি নি, ভেরি ভেরি ইনটেলিজেন্ট বয়–

প্রকাশের সামনে হরনারায়ণ কিছু বললেন না বটে, কিন্তু রাত্রে শোবার ঘরে এসে স্ত্রীর কাছে মুখ খুললেন। বললেন–খোকনকে কি তুমি প্রকাশের সঙ্গে কবির লড়াই শুনতে পাঠিয়েছিলে?

প্রীতিলতা প্রশ্নটা শুনে একটু অবাক হয়ে গেল। বললে–কেন বলো তো?

–না, তাই জিজ্ঞেস করছি। যে-সব গানগুলো খোকন গাইছিল, এগুলো তো খুব ভালো গান নয়। বাবা শুনলে রাগ করবেন। খোকনকে আর যার-তার সঙ্গে যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে দেওয়া ঠিক নয়। অভ্যেস খারাপ হয়ে যাবে–

প্রীতিলতা বললে–কীসের অভ্যেস?

–ওই সব বাজে গান গাওয়ার অভ্যেস।

প্রীতিলতা বললে–ছেলেমানুষ গান শুনেছে আর শিখে ফেলেছে, এতে অভ্যেস খারাপ হবার কী আছে? তোমার সবতাতেই বাড়াবাড়ি। ছেলেমানুষ একটু গান গাইলেই দোষ?

হরনারায়ণ এর পরে আর ও-বিষয়ে কোনও কথা বললেন না। আর তা ছাড়া এ নিয়ে মাথা ঘামানোর মত বেশি সময়ও ছিল না তার। কিন্তু মনে মনে কেমন যেন, চিন্তিত হলেন।

সেদিন খোকনের আর একটা বুদ্ধির অকাট্য প্রমাণ দিলে প্রকাশ। দিদির কাছে খোকনকে নিয়ে এসে বললে–উঃ, তোমায় কী বলবো দিদি! খোকন একটা জিনিয়াস হবে নির্ঘাত, দেখে নিও–

দিদি বুঝতে পারলে না। বললে–জিনিয়াস! তার মানে?

–মানে একটা ধুরন্ধর প্রতিভা।

–কেন, আবার কী করেছে?

–আরে কৈলাস গোমস্তার হুঁকোটো ছিল চণ্ডীমণ্ডপে, কলকেতে তখনও আগুন জ্বলছে। ও একটানে হুঁকো থেকে ধোঁয়া টেনে নাক দিয়ে বার করে ছেড়েছে—

দিদিও অবাক ছেলের বুদ্ধির বহর দেখে। বললে–তাই নাকি?

–হ্যাঁ দিদি, আমি কাণ্ড দেখে তো অবাক। আমি এই বলে দিচ্ছি দিদি, এ ছেলে তোমার বংশের নাম রাখবে, এমন বুদ্ধি আমি বাপের জন্মে কারো দেখি নি, সত্যি–

দিদি খোকনের দিকে চেয়ে বললে–হ্যাঁ রে খোকন, তোর কাশি হলো না?

খোকন ঘাড় নাড়লে। বললে—না–

বলিস কী? একটুও কাশি হলো না?

খোকন গর্বের সঙ্গে ঘাড় নেড়ে আবার বললে—না–

গৌরী পিসীও এসে দাঁড়িয়েছিল। সেও শুনে বললে–না বউদি, আমি তোমাকে বলেছিলুম এ ছেলে তোমার একটা কেষ্ট-বিষ্টু না হয়ে যায় না

রাত্রে হরনারায়ণ ঘরে আসতেই প্রীতি বললে–ওগো, খোকনের কী বুদ্ধি জানো?

হরনারায়ণ বললেন–কী?

–আজকে গোমস্তা মশাইএর হুঁকো টেনে খোকন নাক দিয়ে গল্‌-গল্‌ করে ধোঁয়া ছেড়েছে, একটুও কাশে নি!

খোকন পাশেই ছিল। সেও বাবার দিকে চেয়ে বললে–হ্যাঁ বাবা, আমি একটুও কাশি নি–

হরনারায়ণ কথাটা শুনে কিন্তু হাসতে পারলেন না। আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন। স্ত্রীর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন–কে ওকে হুঁকোয় মুখ দিতে বলেছিল?

স্ত্রী বললে–কে আবার বলবে, ও নিজেই মুখ দিয়েছে।

–কিন্তু ওর সঙ্গে কেউ ছিল?

স্ত্রী বললে–হ্যাঁ, প্রকাশ সঙ্গে ছিল, সে সাক্ষী আছে, সে নিজের চোখে দেখেছে–

হরনারায়ণ এ-কথার কোনও উত্তর দেওয়া দরকার মনে করলেন না। তবে আরো যেন চিন্তিত হয়ে পড়লেন। পরের দিনই কেষ্টগঞ্জের স্কুলের হেডমাস্টার মশাইকে বাড়িতে ডেকে পাঠালেন।

এই সেই প্রকাশ রায়। এককালে এই প্রকাশ রায় যখন-তখন হুট করে এই নবাবগঞ্জে আসতো। আসতো আর নবাবগঞ্জের মানুষজনদের কাছে রাজা-উজির মারতো। ভাগ্নেকে নিয়ে যাত্রা শুনতে যেত, কবির গান শুনে তারিফ করতো। ভাগ্নেকে গান শেখাতো, তামাক খেতে তালিম দিত। তা সে-সব অনেক দিন আগেকার কথা। তারপর সেই নরনারায়ণ চৌধুরী মারা গেলেন, সেই দিদিও আর নেই। আর সেই ভাগ্নে সদানন্দও তখন নেই। ছিল মাত্র এক জামাইবাবু, এবার সেই জামাইবাবুও চলে গেল। প্রকাশ রায়ের সময় এখন খারাপ পড়েছে। সেই খারাপ-সময়ের সুরাহা করতেই প্রকাশ রায় আবার এসেছে রেলবাজারে।

সামনেই বাস দাঁড়িয়ে ছিল। আগে এই রাস্তাটুকু বরাবর হেঁটেই মেরে দিয়েছে সে। কিন্তু এখন বয়স হয়েছে। এখন গতরও আগের চেয়ে অনেক ভারি হয়েছে। সোজা বাসের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন–নবাবগঞ্জে যাবে ভাই, নবাবগঞ্জে?

নবাবগঞ্জে যাবে না। মুবারকপুর থেকে হাঁসখালি চলে যাবে—

–মবারকপুর কত ভাড়া?

–কুড়ি পয়সা।

–কুড়ি পয়সা! কুড়ি পয়সায় এক কাপ চা, আর দুটো সিগারেটও হয়ে যেত। যা গে, কপালে পয়সা নষ্ট আছে, কে খণ্ডাবে? ঠিক আছে, মবারকপুরেই নেমে যাবে সে। প্রকাশ রায় সুটকেসটা নিয়ে বাসে উঠে পড়লো।

মবারকপুরে বাস থেকে নেমে প্রকাশ রায় যখন নবাবগঞ্জে এল তখন আরো বেলা বেড়েছে। নবাবগঞ্জে সেদিন হাটবার। কিন্তু হাট বসতে বসতে সেই যার নাম বেলা দেড়টা। সকাল বেলার দিকে তেমন লোকজন থাকে না। কিন্তু যত বেলা বাড়ে তত চারিদিকের গ্রাম গঞ্জ থেকে ব্যাপারী-চাষা-খদ্দের এসে জোটে। আর আসে ভেনডাররা। কলকাতার কোলে-মার্কেট থেকে সোজা চলে আসে কেষ্টগঞ্জে। কেউ-কেউ নামে মদনপুরে, কেউ আড়ংঘাটায়, আবার কেউ বগুলায়। বেগুন, মূলো, পটল, কপি, কিম্বা আম-কাঁঠাল কিনে ঝুড়ি ভর্তি করে ট্রেনে চাপিয়ে সোজা শেয়ালদা। সেখান থেকে কোলে-মার্কেট।

তখন হাটে আসে ডাক-পিওন। আসে মবারকপুরের ডাক্তার কার্তিকবাবু। আসে কেষ্টগঞ্জ ইস্কুলের হেডমাস্টার। কেউ আসে সাইকেলে চড়ে, কেউ চলে আসে হেঁটে, আবার কেউ বা বাসে চড়ে। এক হপ্তার বাজারটা হয়ে যায় নবাবগঞ্জের হাট থেকে।

–সপ্তাহের ওই দিনটা শুধু হাট করার দিন নয়, পরস্পর দেখা-সাক্ষাৎ করবার দিনও বটে। এ সেই নরনারায়ণ চৌধুরীর আদি আমল থেকেই এমনি চলে আসছিল। বলতে গেলে তিনিই এই হাট বসান এখানে। আগে নবাবগঞ্জের লোকজন বড়-হাট করতে যেত সেই রেলবাজারে আর নয়তো বাজিতপুরে। অবশ্য হাট করার রেওয়াজ তখন এত ছিল না। আলুটা রেলবাজার থেকে নিয়ে এলেই হতো। আলু আর কেরাসিন। বাকি শাক-পাতা-মাছ ওই নবাবগঞ্জের ঘরে বসেই মিলতো সকলের। মালোপাড়া থেকে আসতো মাছ বিক্রি করতে। আর যার যার বাড়ির উঠোনে গজাতে শাক পাতা-কলা-মুলো। তখন কর্তাবাবু নতুন করে বাড়ি করেছেন। পাকা দোতলা বাড়ি। কৃষাণ খাতক ব্যাপারী মহাজন দর্শনার্থী প্রার্থী নানা লোকের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। নবাবগঞ্জের নামধাম হয়েছে এ দিগরে। তিনি বললেন,–এ কী কথা, নবাবগঞ্জে হাট নেই, এটা তো ভালো কথা নয়! দশটা গ্রামে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে জানান দিয়ে দিলেন যে, এবার থেকে প্রত্যেক শনি-মঙ্গলবারে নবাবগঞ্জের বারোয়ারি-তলায় হাট বসবে। ব্যাপারীরা যারা হাটে বেচা-কেনা করতে আসবে, জমিদার তাদের কাছ থেকে কোনও তোলা নেবেন না, ব্যাপারীদের কাজ-কারবারে সব রকমের সুবিধে দেওয়া হবে।

যতদিন কর্তাবাবু ছিলেন ততদিন তিনি দেখে গেছেন নবাবগঞ্জের শনি-মঙ্গলবারের হাট বেশ জমজমাট হয়ে চলছে। তারপর কর্তাবাবুর ছেলে হরনারায়ণের আমলেও হাট রমারম হয়ে উঠেছে। হাটে আরো ব্যাপারী আরো খদ্দের আরো দূর-দূর দেশ থেকে এসে জড়ো হয়েছে। সেই কর্তাবাবু আজ নেই, সেই কর্তাবাবুর ছেলে হরনারায়ণ চৌধুরীও আজ আর নেই। এমন কি হরনারায়ণ চৌধুরীর অত যে আদরের ছেলে, সেও আর নবাবগঞ্জে নেই। ওই হাটের দিন সদানন্দ আসতো দীনুর সঙ্গে, কৈলাস গোমস্তাও আসতো এক-একদিন। কৈলাস গোমস্তা আসা মানেই স্বয়ং হরনারায়ণ চৌধুরীর আসা। কৈলাস গোমস্তা হাটে এলে কারো কোনও জিনিসের জন্যে দরদস্তুরের প্রয়োজন হতো না। অনেক সময় সঙ্গে কর্তাবাবুর নাতি সদানন্দ আবদার ধরতো–কৈলাস কাকা, আমি বেলুন নেব–

রেলবাজার থেকে রবারের বেলুন নিয়ে এসে বেচছিল কপিল পায়রাপোড়া। আবদারের কথা শুনেই সে বললে–এই ন্যান্‌ গোমস্তা মশাই, খোকাবাবুর জন্যে বেলুন ন্যান্‌–

কৈলাস গোমস্তা বেলুন নিলে।

জিজ্ঞেস করলে–কত দাম রে কপিল?

কপিল পায়রাপোড়া বললে–দামের কথা বলে লজ্জা দেবেন না গোমস্তা মশাই, আমি খোকাবাবুকে এমনই খেলতে দিলুম–

–খেলতে দিলুম মানে? খোকাবাবু তোর কাছে ভিক্ষে নেবে নাকি? খোকাবাবুর পয়সার অভাব?

কপিল পায়রাপোড়া বললে–আজ্ঞে, বাবুদের খেয়ে পরেই তো আমরা বেঁচে আছি, খোকাবাবু খেলতে চেয়েছেন তাই দিলুম ওনাকে—

বেলুন পেয়ে মহাখুশী সে। দীনুমামা আর কৈলাস কাকার সঙ্গে সারা হাট ঘুরতে লাগলো বেলুন নিয়ে। সদানন্দ যেখানে যায়, তার সঙ্গে সঙ্গে বেলুনও মাথার ওপর চলতে থাকে। সেই বেলুন নিয়েই কয়েক ঘণ্টা কেটে গেল। বাড়ির ভেতর মাকে গিয়ে বেলুন দেখালে, চণ্ডীমণ্ডপে বাবাকে গিয়ে দেখালে। কাছারি বাড়িতে কর্তাবাবুকে গিয়ে দেখালে। যেন এক মহা সম্পত্তি পেয়েছে সে। বাড়িময় তার বেলুন নিয়ে খেলা। কিন্তু পরের দিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই দেখলে সেটা চুপসে গেছে। তখন শুরু হলো নাতির কান্না।

কর্তাবাবুর কানে কান্না যেতে তিনি জিজ্ঞেস করলেন–খোকা কাঁদে কেন রে? কী হয়েছে? মেরেছে নাকি কেউ?

দীনু বললে–আজ্ঞে, খোকাবাবুর বেলুন চুপসে গেছে…

শেষ জীবনে কর্তাবাবু নাতি-অন্ত প্রাণ হয়ে গিয়েছিলেন। যে বায়না ধরতো তাই-ই যোগান দিতেন। কখনও বেলুন, কখনও পাখি, কখনও ঘুড়ি, কখনও সাইকেল। সুদখোর মানুষ কারো সুদের একটা পয়সা ছাড়তেন না। কিন্তু নাতির জন্যে যত টাকাই হোক তার খরচ হওয়াটাকে খরচ বলে কখনও মনে করতেন না।

বলতেন–আহা, ছোটো ছেলে, আবদার ধরেছে, দাও না ওকে কিনে—

বাবা বলতো–আদর দিয়ে দিয়ে কর্তাবাবুই খোকার সর্বনাশ করবেন দেখছি–

তা কান্নাকাটির কারণ শুনে কর্তাবাবু তখনই লোক পাঠালেন রেলবাজারে। দীনু গেল সেখানে। নাতির আবদার রাখবার জন্যে একটা লোক পাঁচ ক্রোশ হেঁটে দু-পয়সার একটা বেলুন কিনে নিয়ে এল। তখন নাতি ঠাণ্ডা। তখন আবার তার মুখ দিয়ে হাসি বেরোল। তখন আবার সেই বেলুন নিয়ে সারা বাড়িময় মাতামাতি চললো।

কর্তাবাবুর কাছে দীনু আসতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন–এনেছিস, বেলুন এনেছিস?

দীনু বললে–আজ্ঞে হ্যাঁ–

–খোকাকে দিয়েছিস?

–আজ্ঞে হ্যাঁ, দিইছি–

–কত দাম নিলে?

–আজ্ঞে দু’পয়সা।

দু’পয়সা! দু’পয়সা দাম শুনেই চমকে উঠলেন কর্তাবাবু। বললেন–সেদিন কপিল পায়রাপোড়া যে কৈলাসের কাছে চার পয়সা নিয়েছিল!

তবু সন্দেহ হলো। হিসেবের খাতাটা বার করে দেখে নিলেন। হাটে যা কিছু কেনা কাটা হতো তার হিসেব দিতে হতো কর্তাবাবুর কাছে। তিনি সেগুলো নিজের হাতে লিখে সিন্দুকের মধ্যে খাতাটা রেখে দিতেন। হিসেবের খাতায় স্পষ্ট লেখা হয়েছে কপিল পায়রাপোড়ার কাছে চার পয়সা দিয়ে খোকার জন্যে বেলুন কেনা হয়েছে। ডাকলেন– কৈলাস? কৈলাস কোথায় গেল?

কৈলাস গোমস্তা এল। কর্তাবাবু তাকে জিজ্ঞেস করলেন–কৈলাস সেদিন কপিল পায়রাপোড়ার কাছে তুমি বেলুন কিনেছিলে ক’পয়সা দিয়ে?

–আজ্ঞে, আপনাকে তো আমি খরচের হিসেব দিয়েছি।

কর্তাবাবু বললেন–তুমি বলেছ চার পয়সা। আমার খাতাতেও তাই-ই লেখা রয়েছে। কিন্তু আজ দীনু রেলবাজার থেকে খোকার জন্যে আর একটা বেলুন কিনে এনেছে–সেটা দু’পয়সা নিয়েছে। কপিল পায়রাপোড়া লোকটা তো দেখছি চোর। আমাকে দু’পয়সা ঠকিয়ে নিয়েছে। এ কি মগের মুলুক পেয়েছে। আমার পয়সা কি সস্তা ভেবেছে সে!

কৈলাস গোমস্তা সবিনয়ে বললে–আজ্ঞে হুজুর, কী আর বলবো, আজকাল পৃথিবীতে কাউকে বিশ্বাস নেই, সব বেটা চোর।

কর্তাবাবু বললেন–তা চোর বললে তো আমি শুনবো না, চুরি করতে হয় অন্য কারো বাড়িতে সিঁধ কাটো, তা বলে আমার বাড়িতে? সে পেয়েছে কী? ভেবেছে আমি ধরতে পারবো না? আমি বোকা? আর আমার পয়সা বুঝি পয়সা নয়? আমাকে বুঝি মুখে রক্ত উঠিয়ে টাকা উপায় করতে হয় নি?

তারপর একটু থেমে বললেন–ওর কাছে জমি-জমা কী আছে আমার?

কৈলাসের হিসেব সবই মুখস্থ থাকে। বললে–বিলের ধারে এক লপ্তে তিন বিঘে ওর ভাগে আছে, আর ওর কাকার ভাগে বাকি সাত বিঘে–

–ওর আর কী কী সম্পত্তি আছে?

–সম্পত্তি বলতে ওই আমাদের তিন বিঘে জমিই ওর ভরসা। ওতে ওর সারা বছর চলে না। মা-ষষ্ঠীর কৃপায় আবার ওর সংসারও অনেক বড়। একটা বউ মরে যাবার পর আবার নতুন করে একটা বিয়েও করেছে। ও-পক্ষের তেরটা আণ্ডা-গ্যাণ্ডা, তার ওপর এ পক্ষেরও একটা মেয়ে হয়েছে সম্প্রতি–

কর্তাবাবু বললেন– তাহলে তো খুব কষ্টেসৃষ্টে চালায়। খাজনা ঠিক সনসন দিয়ে যাচ্ছে তো?

–আজ্ঞে, দিতে পারবে কী করে? দু’এক সন মাঝে-মাঝে বাকি পড়েও যায়। খুব ধমক টমক দিলে তখন গরু বাছুর বেচে জমিদারের পাওনা-শোধ করে কোনও রকমে। সেইজন্যেই তো হাটবারে কখনও বেলুন কখনও বিস্কুট-ল্যাবেনচুষ নিয়ে বসে, তাতে যা দু’পয়সা হয়–

কর্তাবাবু বললেন–তা বলে আমাকে ঠকাবে? আমারই খাবে পরবে আবার আমাকেই ঠকাবে? এ তো ভালো কথা নয়। তুমি ওর জমি খাস করে নাও–

–খাস করে নেব?

–হ্যাঁ হ্যাঁ, খাস করে নেবে! আমি অত দয়ার অবতার হতে পারবো না। আমার অত পয়সা নেই। আজই খাস করে নেবে–বুঝলে?

তা সেইদিনই খবর গেল কপিল পায়রাপোড়ার কাছে। সে তখন সারা দিনের খাটুনির পর তার বাড়ির চাতরায় ভাত খেতে বসেছে। খবরটা শুনেই খাওয়া তার মাথায় উঠলো। খাওয়া ফেলে তখনই ছুটলো কাছারিতে। কৈলাস গোমস্তা তাকে বললে–তা আমি কী করবো বাপু, আমার কি জমি? যাঁর জমি তিনি যদি হুকুম করেন তো আমি কী করতে পারি? তুই কর্তাবাবুর কাছে গিয়ে তোর আর্জি পেশ কর গে–

কপিলের তখন মাথায় বজ্রাঘাত। বললে–আপনিই সব গোমস্তা মশাই, আপনি বললে–কর্তাবাবু জমি ফিরিয়ে দেবেন। ওই জমিটুকু চলে গেলে আমি কাচ্চা বাচ্চা নিয়ে খাবো কী? আমার সংসার চলবে কী করে?

একটা পাঁচ ফুট লম্বা পুরুষ-মানুষ যে অত গলা ফাটিয়ে হাউ হাউ করে কান্নাকাটি করতে পারে না দেখলে সদানন্দ কল্পনাও করতে পারতো না। বাড়িসুদ্ধ লোক সবাই জানতে পারলো কপিল পায়রাপোড়ার জমি কর্তাবাবু খাস করে নিচ্ছেন। কিন্তু কেন খাস করে নিচ্ছেন তা কেউ জিজ্ঞেস করলে না। সবার কাছেই যেন জিনিসটা স্বাভাবিক। এ তো হবারই কথা। জমিদারের হক আছে জমি খাস করে নেবার। তা সে অন্যায় করুক আর না করুক। খাজনা দিক আর না দিক। আমার মর্জি হয়েছিল তাই তোমায় জমি চাষ করতে দিয়েছিলুম। আবার এখন মর্জি হয়েছে, এখন তোমার কাছ থেকে জমি কেড়ে নেব। জমির মালিক তুমি, না আমি?

সদানন্দ দীনুমামার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে–দীনুমামা, কপিলকে মারছে কেন দাদু?

দীনুমামা বললে–মারবে না? কপিল যে কর্তাবাবুকে ঠকিয়েছে!

–ঠকিয়েছে? কী করে ঠকালো?

–দু’পয়সার বেলুন কেন চার পয়সায় সে বিক্রি করেছে? সেই একই বেলুন আমি রেলবাজার থেকে যে দু’পয়সায় কিনে এনেছি–

সদানন্দ অবাক হয়ে গেল। বললে–কই, বেলুন তো কপিল বেচে নি। আমি বেলুন নেব বলে আবদার ধরেছিলুম বলে ও তো মাগনা দিয়ে দিলে। পয়সা তো নেয় নি ও। আমি নিজের চোখে যে দেখেছি, আমি তো তখন হাটে ছিলুম–

কিন্তু দীনুর কাছ থেকে কোনও প্রতিকার পাবে না জেনে আর সেখানে অপেক্ষা করলে না। একেবারে সোজা দাদুর ঘরে গিয়ে পৌঁছোল। সেখানে তখন বীভৎস কাণ্ড চলছে। ঘরের মধ্যে দাদু নিজের লোহার সিন্দুকটার পাশে বসে আছে, আর একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে কৈলাস কাকা। আর তাদের সামনে বংশী ঢালী কপিল পায়রাপোড়ার মাথার চুলের ঝুঁটি ধরে আছে আর বলছে–বল, কর্তাবাবুকে কেন ঠকালি বল–

কিন্তু কপিল বলবে কী? তাকে কথা বলবার ফুরসৎই দিচ্ছে না বংশী ঢালী। এক হাতে চুলের ঝুঁটি ধরে অন্য হাতে পটাপট মুখে ঘুষি মেরে চলেছে। আর দাদু বংশীকে উৎসাহ দিয়ে চলেছে–মার মার বেটাকে, মেরে ফেল, আমার সঙ্গে শয়তানি, আরো মার–

সদানন্দ আর থাকতে পারলে না। একেবারে ঝাঁপিয়ে গিয়ে পড়লো দাদুর সামনে। বললে–দাদু, ওকে মারছো কেন? ও তো বেলুনের দাম নেয় নি, অমনি দিয়েছে। ওই তো কৈলাস কাকা জানে, কৈলাস কাকাকে জিজ্ঞেস করো না–ও কৈলাস কাকা, তুমি বলছো না কেন, ও কৈলাস কাকা–

কিন্তু কর্তাবাবু বিরক্ত হয়ে উঠলেন নাতির কথায়। প্রথমটায় তিনি যেন একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলে উঠলেন–আরে, এখানে তুই এলি কেন? ও দীনু, দীনু কোথায় গেলি? ও দীনু, খোকাকে এখানে আসতে দিলি কেন, ওরে দীনু ওকে নিয়ে যা এখেন থেকে–

সদানন্দ নাছোড়বান্দা। বললে–আমি যাবো না এখান থেকে, আগে তুমি আমার কথার জবাব দাও

সদানন্দও যাবে না, কর্তাবাবুও ছাড়বে না। ততক্ষণে দীনু এসে গেছে। এসে জোর করে হাত ধরে টানতে টানতে চ্যাংদোলা করে সদানন্দকে ঘরের বাইরে নিয়ে গেল। কিন্তু তখনও ঘরের ভেতর থেকে কপিলের কান্নার আওয়াজ তার কানে আসছিল।

.

এ-সব কতকালকার আগেকার কথা। তবু সদানন্দর যেমন মনে আছে, নবাবগঞ্জের সেকালের যারা আজো বেঁচে আছে তাদেরও মনে আছে। মনে আছে শেষকালে ছেলে মেয়ে-বউকে খেতে না দিতে পেরে সেই কপিল পায়রাপোড়া একদিন নবাবগঞ্জ থেকে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেল কেউ টের পেলে না। কপিল পায়রাপোড়ার কাকা প্রথমে কিছুদিন তার ছেলে-মেয়েদের দেখেছিল। তারপর দেখা গেল একদিন ওই বারোয়ারি-তলার বটগাছের ডালে কপিলের ধড়টা ঝুলছে। একটা গরু বাঁধা দড়ি দিয়ে গলাটা বেঁধে কখন হয়ত ঝুলে পড়েছিল কেউ দেখতে পায় নি।

তারপর পুলিস-থানা-দারোগা-কোর্ট-কাছারি অনেক কিছু হলো তাই নিয়ে। আবার সে ঘটনার ঢেউ একদিন থেমেও গেল। কিন্তু সদানন্দর মন থেকে তা আর মুছলো না।

এ-সব ছোটখাটো ঘটনা। কিন্তু ছোটখাটো ঘটনাগুলোই সদানন্দর মনের ভেতরে জমে জমে পাহাড় হয়ে উঠতে লাগলো। প্রকাশ মামা জিজ্ঞেস করতো–হা রে, তুই কী ভাবিস রে এত?

তখন সদানন্দ একটু বড় হয়েছে। বলতো–আচ্ছা মামা, তোমার এই সব ভালো লাগে?

প্রকাশ মামা তো অবাক। সে শুধু জানে ফুর্তি করা আর খাওয়া-দাওয়া হই-হুল্লোড় করে কাটিয়ে দেওয়া। ভালো খাও, ভালো পরো, দু’হাতে টাকা উপায় করো আবার দুই হাতে সেই টাকা খরচ করো। ভাগ্নের কথা শুনে বললে–কী ভালো লাগে?

সদানন্দ বললে–এই তুমি যা করো সারাদিন?

–আমি সারাদিন কী করি?

–এই আরাম করে খাও, বারোয়ারিতলায় গিয়ে আড্ডা দাও, তাস খেলো, তারপর গাণ্ডে-পিণ্ডে খাও। খেয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোও, তারপরে ঘুম থেকে উঠে সন্ধ্যেবেলা এ-গাঁ ও-গাঁ করে বেড়াও; আর তারপর রাত্তিরে এসে আবার ঘুমিয়ে পড়ো।

প্রকাশ মামা বললে–আমি যা করি এ তো সবাই করে রে। কেন, এতে দোষটা কী? আমি চুরিও করছি না কারো, বাটপাড়িও করছি না। আমার বাপ-কাকা-জ্যাঠা চোদ্দ পুরুষ চিরকাল এই জিনিসই করে এসেছে, আবার আমিও তাই করবো। আবার তুইও যখন বড় হবি তখন তুইও তাই করবি। এই-ই তো নিয়ম রে–

সদানন্দ বললে–কিন্তু আমার যে ও-সব করতে ভালো লাগে না মামা। জানো, কপিল পায়রাপোড়াকে তুমি চিনতে?

–কপিলকে? সেই শয়তানটাকে? চিনবো না? ব্যাটা এক নম্বরের আহাম্মক ছিল একটা। শেষকালে তাই অপঘাতে মরতে হলো। যেমন কম্ম তেমনি ফল!

সদানন্দ বললে–-দেখ প্রকাশ মামা, আজকাল সবাই তার কথা ভুলে গেছে। আমার বাবা-মা কারোরই হয়ত মনে নেই। আমার দাদুরও হয়ত মনে নেই তার কথা। ওই বারোয়ারীতলায় যখন সে আত্মঘাতী হলো সবাই-ই তা দেখেছে। দেখে সবাই-ই শিউরে উঠেছে। কিন্তু আজকে আর কারো সে-কথা মনে নেই, জানো–

প্রকাশ মামা হো হো করে হেসে উঠলো। বললে–তুই তো দেখছি একটা আস্ত পাগল রে, অত কথা মনে রাখতে গেলে মানুষের চলে! সংসারে একদিন তো সবাই মরবে। সকলেরই বাবা মরবে, ঠাকুর্দাদা মরবে, মা মরবে। প্রথম প্রথম লোকে সেজন্যে একদিন কাঁদবে। কিন্তু তারপর? তারপর বেশি কান্নাকাটি চালিয়ে গেলে সংসার চলে? আমার তো বাবা-মা যাবার পর খুব কেঁদেছিলাম, তা এখন কি আর কাঁদছি? আমায় কাঁদতে দেখেছিস কখনও সেজন্যে? তুই যে আমাকে অবাক করলি সদা!

সদানন্দ বললে–কিন্তু মামা, আমি কেন কিছুই ভুলতে পারি না। আমার কেন সব মনে থাকে? কপিল পায়রাপোড়ার কথা আমার সব সময়ে যে মনে পড়ে। রাত্তিরে শুয়ে-শুয়ে ভাবি, দিনের বেলা ইস্কুলে পড়তে পড়তে ভাবি, ভাত খেতে খেতে ভাবি…

প্রকাশ মামা ভাগ্নের কথা শুনে ভয় পেয়ে গেল। বললে–এই রে খেয়েছে…

সদানন্দ বললে––কেন? কী করলুম আমি?

–তোর তো দেখছি মাথা খারাপের লক্ষণ! এ তো ভালো কথা নয়! ডাক্তার দেখাতে হয়–

সদানন্দ বললে–কিন্তু সে তো কোনও দোষ করে নি মামা। তাকে যে দাদু মিছিমিছি মারলে। বংশী ঢালীকে দিয়ে বেকসুর অপমান করলে। সে তো কিছু করে নি

প্রকাশ মামা যেন সব ভেবে-চিন্তে একটা নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে এসেছে। বললে–নাঃ, এবার জামাইবাবুকে তোর বিয়ের কথা বলতে হবে দেখছি।

–বিয়ে? বিয়ে আমি করবো না মামা।

–সে কী রে? তুই ঠাকুর্দার সবেধন নাতি, বাপের চোখের মণি একমাত্র ছেলে। বিয়ে করবি না? তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? জানিস তোর মতন পাত্তোর পেলে মেয়ের বাপরা লুফে নেবে?

সদানন্দর ও-সব কথা ভালো লাগতো না। বিকেল বেলা যখন ইস্কুল থেকে হেঁটে-হেঁটে আসতো, এক-একদিন শীতের দিনে বাড়ি আসতে আসতে চারদিক অন্ধকার হয়ে আসতো। তখন মনে হতো কে যেন তার পেছনে-পেছনে আসছে। শুকনো পাতার ওপর হাঁটতে যেমন মড়মড় শব্দ হয় তেমনি শব্দ করতে করতে তার পিছু পিছু আসছে কেউ। অনেক দিন মনে হয়েছে গাঁয়েরই কোনও লোক ক্ষেত-খামার থেকে ফিরছে। কিংবা কোনও বাড়ির বউ গাঙ থেকে জল নিয়ে ফিরছে। না, তা নয়, অনেক সময় রাস্তার আশেপাশে-সামনে-পেছনে কাছে-দূরে কেউ-ই থাকে না, অথচ কে যেন তার পেছনে-পেছনে হাঁটে।

একদিন ধরে ফেলেছিল। লোকটা একেবারে আসতে আসতে তার গায়ে এসে পড়েছিল। সদানন্দ চমকে উঠেই চেঁচিয়ে উঠেছে–কে?

–আমি!

‘আমি’ কথাটা কেউ বললে কিনা বুঝতে পারলে না সে। কিংবা হয়ত তার নিজের মনের আতঙ্কটাই শব্দ হয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু সে এক মুহূর্ত। এক মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে দিয়ে সে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু সেই অদৃশ্য হওয়ার আগেই যেটুকু দেখতে পেলে তাতে মনে হলো সে আর কেউ নয়, সে হলো কপিল পায়রাপোড়া।

ঘটনাটা প্রকাশ মামাকে বলতেই প্রকাশ মামা আর দেরি করলে না। সোজা জামাইবাবুর কাছে চণ্ডীমণ্ডপে চলে গেল। বললে–জামাইবাবু, সদার বিয়ে দিতে হবে–

–বিয়ে! জামাইবাবু কথাটা শুনে প্রথমে অবাক হয়ে গিয়েছিল। দিদিও তেমনি। বিয়ে তো সদার দিতেই হবে। তা বলে এখনি? এত তাড়াতাড়ি?

প্রকাশ বললে–বিয়ে না দিলে তোমার ছেলে শেষকালে সন্নিসী হয়ে বনে চলে যাবে, তখন ঠ্যালা বুঝবে–

তা প্রকাশের কথায় কেউ কান দেয় নি। গরীবের কথায় প্রথমে কেউ কান দেয়ও না তেমন। তাই কথায় আছে গরীবের কথা বাসি হলে তবে লোকে তার দাম দেয়। শেষকালে কর্তাবাবু যখন কথাটা তুললেন তখন সকলের টনক নড়লো। আর কর্তাবাবুর তখন দুটো পা-ই পড়ে গেছে। একেবারে পঙ্গু। সিন্দুকটার কাছে শুয়ে শুয়েই দৈনন্দিন কাজকর্ম চালান। তার ইচ্ছে চোখ বোজবার আগে তিনি নাতির ছেলের মুখ দেখে যেতে চান। দেখে যেতে চান যে তার বংশের ধারা অক্ষয় হয়ে রইল।

কথাটা শালাবাবুর কানে যেতেই সে লাফিয়ে উঠেছে। দিদির টাকায় সে বসে বসে খায় আর তার বদলে একটু কিছু উপকারও করতে পারবে না? দিদির উপকার করবার সুযোগ পেয়ে সে যেন বেঁচে গেল।

বললে–কুছ পরোয়া নেই, কী রকম পাত্রী চাই সেইটে শুধু আমায় বলে দাও–

কর্তাবাবুর হুকুম পাত্রী হবে ডানা কাটা পরী। ডানা কাটা পরী মানে পরীর মতন দেখতে শুনতে বলতে কইতে হওয়া চাই, শুধু পরীদের যে ডানা থাকে সেটা থাকবে না।

–আর?

–আর পরীর মতন উড়লে চলবে না।

প্রকাশ বললে–তা ডানাই যদি না থাকে তো উড়বে কেমন করে? আর যদি উড়তে চায় তো তুমি না হয় তার পায়ে শেকল লাগিয়ে দিও।

দিদি হাসতে লাগলো। বললে–আজকালকার মেয়ে কি শেকল মানবে ভাই?

হয়ত শ্বশুর-শাশুড়ীকেই মানতে চাইবে না। এ তো আর আমাদের কাল নয়। আমাদের দশ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল, তখন কোমর থেকে কাপড়ের কষি খুলে যেত, শাশুড়ী তাই শেষকালে গেরো দিয়ে বেঁধে দিত তবে লজ্জা রক্ষে হতো–

প্রকাশ বললে–তাহলে সেই রকম দশ বছরের মেয়েই এনে দেব–তুমি যেমন অর্ডার দেবে, তেমনি বউ পাবে–

দিদি বললে–তাই দে ভাই, নইলে কর্তাবাবু আবার কবে আছেন কবে নেই, একটু শিগগির শিগগির কর তুই–

তা শেষ পর্যন্ত সেই রকম মেয়েই পাওয়া গেল। বয়েসও কম, দেখতেও ডানাকাটা পরী। আরও একটু বয়েস কম হলে অবশ্য ভালো হতো। কিন্তু ঠিক তোমার অর্ডার মাফিক পাত্রী কোথায় পাবো? তাহলে তো কুমোরকে ডেকে ফরমায়েশ করতে হয়। কৃষ্ণনগরের কাছে বাড়ি। বাপ পণ্ডিত। সংস্কৃত শাস্ত্র জানা মানুষ। স্বামী আর স্ত্রী, আর সংসার বলতে ওই একটি মেয়ে। সেকালে পূর্বপুরুষকে দেওয়া রাজাদের দু’শো বিঘের মত জমি-জমা আছে। মোটামুটি সচ্ছল পরিবার। নগদ কিছু দিতে পারবো না। যদি মেয়ে পছন্দ হয় তো রাঙা সুতো হাতে দিয়ে নিয়ে যান। তারপর মেয়ের ভাগ্য আর ঈশ্বরের ইচ্ছে।

এই-ই হলো নয়নতারা। এ গল্পের আসামী সদানন্দ চৌধুরীর স্ত্রী। আমাদের নায়িকা।

প্রকাশ রায় এই নতুন বিয়ের কনে নয়নতারাকে নিয়ে এই রাস্তা দিয়েই একদিন নবাবগঞ্জে এসেছিল। নবাবগঞ্জের জমিদার নরনারায়ণ চৌধুরীর বাড়ি যেতে গেলে এই বারোয়ারিতলার হাটের মধ্যে দিয়েই যেতে হয়। এই রাস্তা দিয়েই একদিন নয়নতারা চৌধুরীবাড়ির বউ হয়ে এসেছিল, আবার ঠিক সেই বধূ বেশেই এই রাস্তা দিয়েই চলে গিয়েছিল। এই রাস্তা দিয়েই একদিন সেকালের এক সামন্ততান্ত্রিক ভূস্বামী পরিবারে চূড়ান্ত সমৃদ্ধি এসে উদয় হয়েছিল, আবার নয়নতারার সঙ্গে সঙ্গে এই রাস্তা দিয়েই তা অস্ত গিয়েছিল চিরকালের মত। এই-ই সেই চিরকালের উদয়-অস্তের শাশ্বত পথ, সেই রেলবাজার থেকে নবাবগঞ্জের বারোয়ারিতলার হাট পর্যন্ত। এবার সেই ঘটনার কতকাল পরে প্রকাশ রায় আবার উদয় হলো এই নবাবগঞ্জে। মোবারকপুরে বাস থেকে নেমে পায়ে হাঁটা পথে। এখন আর আগেকার সেই মোবারকপুর নেই। সেই মোবারকপুর কেন, সেই নবাবগঞ্জও নেই। নবাবগঞ্জে চৌধুরীদের সেই বাড়িটাও আর চৌধুরীদের নেই। নরনারায়ণ, হরনারায়ণ, চৌধুরীবাড়ির গিন্নি, প্রকাশ রায়ের দিদি, তারাও কেউ নেই। একদিন রেলবাজারের পাটের আড়তদার প্রাণকৃষ্ণ শা’ মশাই জলের দরে অত বড় তিনমহলা বাড়িটা কিনে নিলে। কিন্তু প্রাণকৃষ্ণ শা’ও তা রাখতে পারলে না। ব্রাহ্মণের সম্পত্তি, বিশেষ করে বসতবাড়ি কিনতে নেই। এমন কি জলের দরে পেলেও না। কিন্তু প্রাণকৃষ্ণ শা’ মশাই সে-কথা শুনলে না। ভাবলে ভারি লাভ করলুম! কিন্তু এখন? সেই প্রাণকৃষ্ণ শা’ও একদিন জন্মাষ্টমীর দিন সাপের কামড়ে অপঘাতে মরলো। তার পর থেকে সেই চৌধুরীবাড়ি এখন ভুতের বাড়ি হয়ে খাঁ খাঁ করছে। দিনের বেলাতেও লোকে সেদিকে মাড়াতে ভয় পায়। বলে–ওবাড়িতে ব্রহ্মদত্যির অভিশাপ আছে, ওদিক মাড়িও না–

পাশের দোকানঘর থেকে কে একজন চেঁচিয়ে উঠলো–মশাই-এর কোত্থেকে আসা হচ্ছে?

প্রকাশ রায় সুটকেসটা নিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল। বললে–আমি আসছি ভাগলপুর থেকে। এই নবাবগঞ্জ এসেছি একটা কাজে–

–এখানে কার বাড়িতে যাওয়া হবে?

প্রকাশ রায় বললে–কারো বাড়িতে যাবো না, আমি এসেছি সদানন্দর খোঁজে, সদানন্দ চৌধুরী–

সদানন্দ চৌধুরীর নামটা উচ্চারণ করতেই দোকানের আশেপাশে যারা ছিল তারা কাছ ঘেঁষে এসে দাঁড়ালো। এ কোথাকার লোক! কী এর পরিচয়। সদানন্দ চৌধুরীর খোঁজ করে, এ তো সাধারণ লোক নয় হে!

চৌধুরী-মশাই চলে যাবার পর নবাবগঞ্জে কেউ তো সদানন্দ বেঁচে আছে কিনা, খেতে পাচ্ছে কিনা সে-খোঁজও কখনও নেয় নি।

–তা আপনি এতদিন পরে সদার খোঁজ করছেন কেন?

–জিজ্ঞেস করতে এসেছি সে কোথায় আছে আপনারা জানেন কিনা। আমাকে তার সন্ধান দিতে পারেন কিনা। তাকে আমার বড় দরকার–

পরমেশ মৌলিক এতক্ষণ একমনে হুঁকো টানছিলেন। এবার তিনি মুখ খুললেন। বললেন–আপনার নিবাস?

প্রকাশ বললে–ভাগলপুর। আমি হচ্ছি সদানন্দর মামা–

–প্রকাশ মামা? শালাবাবু? তাই বলুন, এতক্ষণ বলেন নি কেন? বসুন বসুন, তা এ কী চেহারা হয়েছে আপনার? চুল পেকে গেছে। ওঃ কতকাল পরে দেখা হলো। তা চৌধুরী-কর্তা কেমন আছেন?

চৌধুরীমশাই মানে হরনারায়ণ চৌধুরী। প্রকাশ রায় বললে–জামাইবাবু গেল হপ্তায় মারা গেছেন।

মারা যাওয়ার খবর শুনেই সবাই যেন স্তম্ভিত হয়ে গেল। বললে–মারা গেছেন?

পরমেশ মৌলিক হরনারায়ণ চৌধুরীর কাছারিতেও কিছুদিন কাজ করেছিলেন। খবরটা শুনে তিনি সকলের চেয়ে বেশি চমকে উঠলেন। বললেন–সে কী? মারা গিয়েছেন? শেষকালে কী হয়েছিল?

প্রকাশ রায় বললে–তেমন কিছুই হয় নি, বেশ ভালোই ছিলেন। কদিন ধরে দেখছিলুম তিনি বাইরে বেরোচ্ছিলেন না, একদিন ঘরের দরজা খুলে দেখি তিনি মরে পড়ে আছেন। কেউ জানতেও পারি নি আমরা…

নতুন লোকের আমদানি দেখে ততক্ষণে আরো কিছু লোক এসে জড়ো হয়েছিল। হরনারায়ণ চৌধুরীর মৃত্যুর খবর শুনে অনেকেই দীর্ঘশ্বাস ফেললে। অনেকেই তাকে দেখেছে। যারা দেখে নি তারা নাম শুনেছে। চৌধুরী বংশের কাহিনী শুনেছে। সেই হরনারায়ণ চৌধুরীর মর্মান্তিক পরিণতির বর্ণনা শুনে সবার মুখ দিয়েই অজান্তে একটা ‘আহা’ শব্দ বেরিয়ে এল। এমনিই হয় গো। যত বড়লোকই হও, সকলের পরিণতি ওই মৃত্যুতে। ওর থেকে কারোর মুক্তি নেই। এই পুরোন কথাটাই যেন আবার সকলের নতুন করে মনে পড়ে গেল।

প্রকাশ রায় বললে–তা এখন সে যা হবার হয়ে গেছে, এখন আমি এসেছি সদাকে খুঁজতে। কোথায় গেলে তাকে পাই বলতে পারেন? কলকাতায় গিয়েছিলাম, সেখানে তারাও তার কোনও সন্ধান জানে না, তাই নবাবগঞ্জে এলাম, এখন এর পর কোথায় গেলে তাকে পাবো তাও বুঝতে পারছি না

পরমেশ মৌলিক বললেন–সদা কি আর বেঁচে আছে? আমার তো বিশ্বাস হয় না। শেষকালের দিকে তার অবস্থা বড় খারাপ হয়েছিল। একদিন মাত্র এসেছিল এ-গাঁয়ে–তাও সে অনেক কাল হলো–

–কেন?

নিতাই হালদার পাশেই দাঁড়িয়ে শুনছিল। সে আর থাকতে পারলে না। বললে–কেন ভালো থাকবে? আপনারা কি তার কোনও খোঁজখবর নিয়েছিলেন? নিজের বাপ যাকে দেখতো না, সে কী করে ভালো থাকবে? তাকে কি কেউ খেতে পরতে দিত? এখন তার বাপ মারা গেছে, তাই সম্পত্তির লোভে তার খোঁজখবর নিতে এসেছেন আপনারা। কিন্তু তখন কোথায় ছিলেন?

পরমেশ মৌলিকও তাই বললেন–হ্যাঁ শালাবাবু, শেষকালের দিকে সদার বড় কষ্টে দিন কেটেছে–অত বড় বংশের ছেলে, তার কিনা এই দশা। শেষকালে একটা যাত্রার দল এসেছিল গাঁয়ে, তাদের পেছন পেছন সে চলে গেল–

প্রকাশ রায় যেন এতক্ষণে খানিকটা সুরাহা পেলে। বললে–যাত্রার দলের সঙ্গে? কোথায় গেল তাদের সঙ্গে?

–তা কি ছাই দেখেছি? যাত্রার দল কি আর এক জায়গায় বসে থাকে শালাবাবু? তারা তো ঘুরে বেড়ায় চারদিকে। আজ আছে হুগলী, কালই হয়ত আবার চলে গেল আসামের দিকে

–তবু একটা আপিস তো আছে তাদের কোথাও। যাত্রাদলের নামটা জানতে পারলেও হয় তাদের হেড-অফিসে গিয়ে খোঁজ নিতে পারি–

পরমেশ মৌলিক বললেন–কত যাত্রার দলই তো আসে! ও যাদের সঙ্গে গিয়েছিল তাদের নামটা ঠিক মনে ঠিক মনে পড়ছে না।

তারপর অন্য যারা আশেপাশে ছিল তাদের দিকে ফিরে বললেন–তোমরা জানো নাকি হে কেউ নামটা?

নিতাই হালদার পাশেই ছিল। সে আর থাকতে পারলে না। বললে–তা এতদিন কোথায় ছিলেন আপনারা শালাবাবু? এতদিন তো আপনারা একবারও তার খোঁজ নিতে আসেন নি? এখন চৌধুরী মশাই মারা গেছেন তাই তাঁর অগাধ টাকার ওয়ারিশানকে খুঁজে বার করতে এসেছে। আমরা সব বুঝতে পেরেছি–

প্রকাশ রায় কথাগুলো শুনে যেন কেমন চুপসে গেল।

নিতাই হালদার তবু থামলো না। বলতে লাগলো–চৌধুরী মশাই-এর লাখ লাখ টাকা এখন সবই তো পাবে সদানন্দ, তাই তার জন্যে এখন আপনাদের যত দরদ উথলে উঠেছে, না? তাই এখন খোঁজ পড়েছে তার। ভেবেছেন পাগল ভাগ্নেকে সামনে খাড়া করে টাকাগুলো নিজেদের পেটে পুরবেন। তা মতলোব আপনাদের খুবই ভালো শালাবাবু। কিন্তু একটা কথা বলে রাখছি, সদানন্দর যা হয় হোক, এতে আপনাদেরও কিন্তু কিছু ভালো হবে না। আপনাদের এ টাকা ভোগে আসবে না। কারণ এখনও আকাশে চন্দ্র-সূর্য ওঠে, ভুলে যাবেন না মাথার ওপর ভগবান বলে এখনও একজন আছেন–

পরমেশ মৌলিক নিতাই হালদারকে থামিয়ে দিলেন। বললেন–নিতাই তুই থাম—

নিতাই মুখফোঁড় ছেলে বরাবর। বললে–কেন থামবো খুড়োমশাই? আমি কি কিছু অন্যায় কথা বলেছি? এখানে তো আরো দশজন গায়ের লোক আছে। সদানন্দকে কে না দেখেছে? সবাই জানে কত নাকাল হয়েছে আত্মীয়স্বজনের কাছে। নিজের বাপ যখন তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, এক মুঠো ভাত দিয়ে ছেলেকে বাঁচায় নি, তখন এই মামা তো এসে তাকে নিজের বাড়িতে ঠাঁই দেন নি। যতদিন দিদি ছিল, যতদিন টাকা যুগিয়েছে, ততদিন খুব খাতির, ততদিন শালাবাবু ঘরের লোক, আর যেই দিদি মারা গেল আর উধাও–

প্রকাশ রায়ের কথাগুলো ভালো লাগলো না। সুটকেসটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বললে–আমি তাহলে উঠি–

নিতাই হালদার বললে–আমাদের কথাগুলো শুনতে ভাল লাগছে না কিনা তাই উঠে যাচ্ছেন। কড়া কথা কারই বা শুনতে ভালো লাগে, বলুন?

প্রকাশ রায় আমতা আমতা করে বলতে লাগলো–না, মানে সদানন্দকে খুঁজতেই তো আমি এখানে এসেছিলাম, তা সে যখন এখানে নেই তখন অন্য কোথাও চেষ্টা করে দেখি গে–

নিতাই বললে–হ্যাঁ, অন্য কোথাও গিয়ে খুঁজে বার করবার চেষ্টা করুন, খুঁজে বার করে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলুন, তুলে জামাই-আদরে রেখে তার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে দিয়ে একটা যা-তা কাগজে সই করিয়ে নিন, তারপর তাকে লাথি-ঝাঁটা মেরে দূর করে দিন গে, কেউ কিছু জানতে পারবে না, মাঝখান থেকে জামাইবাবুর লাখ লাখ টাকার সম্পত্তি আপনাদের হাতে এসে যাবে–

সেদিন গ্রামের লোক যে কথাগুলো বললে–তার একটাও কিন্তু মিথ্যে নয়। সবাই জানতো হরনারায়ণ চৌধুরী শ্বশুরেরও অনেক টাকা পেয়েছিলেন। নবাবগঞ্জের অত সম্পত্তি সব কিছু বিক্রি করে যা পেয়েছিলেন সব নিয়ে গিয়ে তিনি ভাগলপুরে উঠেছিলেন। সদানন্দর ঠাকুর্দা মা, সবাই তখন মারা গেছে। নয়নতারাও শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে তখন কেষ্টনগরে তার বাপের বাড়িতে গিয়ে উঠেছে। সমস্ত বাড়িটা যেন তখন রাতারাতি শ্মশান হয়ে গেছে। চৌধুরী মশাই এই নবাবগঞ্জে তখন সারা বাড়িতে একলাই কাটাতেন। আর সদানন্দ তখন কোথায় থাকতো কে জানে! কেউ তার কোনও খোঁজও রাখতো না।

ওই পরমেশ মৌলিক যেখানে বসে আছেন, এই বারোয়ারিতলার মাচার ওপর সদানন্দ অনেক দিন অনেক রাত কাটিয়েছে।

নিতাই হালদার জিজ্ঞেস করতো–ছোটবাবু, আপনি বাড়ি যাবেন না? রাত যে অনেক হলো?

তখন হরনারায়ণ চৌধুরী মশাই মস্ত বাড়িটাতে একলা থাকতেন। নবাবগঞ্জের বারোয়ারিতলা থেকে দেখা যেত চৌধুরীদের বাড়িটা। সারা বাড়িতে অসংখ্য ঘর। চারমহলা বাড়ি। দক্ষিণ দিকে সেই পুকুরটা। একেবারে বাড়ির লাগোয়া। পুকুর থেকে উঠতেই পাড়ের ওপর সার সার ধান চাল ডালের মরাই। পুকুর আর মরাই-র মাঝখানে অনেকখানি লম্বা জায়গা জুড়ে শাক-সজির বাগান। লাউ-কুমড়ো-উচ্ছের মাচা। কয়েকটা পেঁপে গাছ, বেগুনের ক্ষেত। যখন চৌধুরী বাড়ি জমজমাট ছিল তখন ওইখানে বাড়ির মেয়েদের শাড়ি শুকোতো সার সার। শুকোবার পর গৌরী পিসী এসে আবার বিকেলের দিকে সেগুলো তুলে নিয়ে গিয়ে ভেতর বাড়িতে যার যার ঘরে সাজিয়ে রেখে দিত। যখন রাত হতো তখন ও জায়গাটায় আর যেতে পারা যেত না। ভয় করতো। কিন্তু তার পাশেই ছিল গোয়ালঘর। সেই রাতির বেলা অনেকদিন সদানন্দ ওই পুকুরের শানবাঁধানো ঘাটের ওপর চুপ করে বসে থাকতো। তার মনে হতো পুকুরের জলের মধ্যে থেকে যেন কারা দল বেঁধে উঠে আসছে তার দিকে। মানুষের মত চেহারা তাদের, কিন্তু ঠিক যেন আবার মানুষও নয়।

কাছে আসতেই সদানন্দ ভয় পেয়ে যেত। চেঁচিয়ে বলে উঠতোকে তোমরা? তোমরা কারা?

লোকগুলো হাসতো। বলতো–আমাদের তোমরা চিনতে পারবে না গো, আমাদের চিনবে না তুমি–

সদানন্দ বলতো কিন্তু তোমরা এখানে কী করতে এসেছো? বাড়ির ভেতরে যাবে নাকি?

লোকগুলো আরো হেসে উঠতো। বলতো–আমরা সব জায়গায় যেতে পারি–

–কিন্তু তোমরা এখানে কী করতে এসেছ?

–দেখতে।

–কী দেখতে?

–দেখতে এসেছি তোমরা কেমন আছো! দেখতে এসেছি নবাবগঞ্জের সব মানুষ কেমন আছে।

–তোমাদের বাড়ি কোথায়?

–এই নবাবগঞ্জেই আমাদের বাড়ি ছিল একদিন। কিন্তু এখানে আর আমাদের কোনও বাড়ি নেই। এখন সব জায়গাতেই আমাদের বাড়ি, এখন আমরা সব জায়গাতেই যেতে পারি।

–তবে কি তোমরা ভূত?

লোকগুলো সদানন্দর প্রশ্ন শুনে হেসে উঠতো। বলতে–ভয় পাচ্ছো বুঝি? ভয় পেয়ো না। আমরা রোজ রোজ এখানে আসি, আমরা রোজ রোজ এখানে আসবো। আমাদের কেউ আটকাতে পারবে না। এখানে আগে তো আসতে পারতুম না। আমরা চৌধুরী মশাই-এর কাছারিবাড়িতে এসে এককালে তার সামনে হাতজোড় করে বসে থাকতুম। খাজনা মকুব করতে বলতুম। আগে আমরা ছিলুম কালীগঞ্জের জমিদারবাবুর প্রজা, পরে আমরা হলুম চৌধুরী মশাই-এর প্রজা। আমরা খরার সময় খাজনা দিতে পারি নি। যেবার ঝড়ে আমাদের বাড়ি পড়ে গিয়েছিল, আমরা চৌধুরী মশাই-এর ঝাড় থেকে বাঁশ কেটেছিলুম, তার জন্যে আমাদের নামে সদরের কাছারিতে ফৌজদুরি মামলা হয়েছিল।

–তারপর?

–তারপর আমাদের জমি খাস হয়ে গিয়েছে, আমাদের ভিটে-মাটি উচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে। এই দেখ, এর দিকে চেয়ে দেখ, এর গলায় কীসের দাগ দেখছো?

–কীসের দাগ?

সদানন্দ সেই অন্ধকারের মধ্যেই লোকটার গলার কাছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে দেখলে। অস্পষ্ট ছায়া সব। তবু মনে হলো সেখানকার ছায়াটা যেন আরো ঘন, আরো গম্ভীর হয়ে উঠেছে।

–এ গলায় দড়ি দিয়ে মরেছিল।

কথাটা শুনেই সদানন্দ আঁতকে উঠলো। গলায় দড়ি দিয়েছিল?

–হ্যাঁ, বারোয়ারিতলার বটগাছের ডালে গলায় দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়েছিল।

–এর নাম কী?

–কপিল পায়রাপোড়া।

নামটা কানে যেতেই সদানন্দ একটা আর্তনাদ করে সেই ইট বাঁধানো পৈঁঠের ওপরেই অজ্ঞান হয়ে পড়লো। কিন্তু কেউ তা টের পেলে না। সন্ধ্যেবেলা যখন হরিহরবাবু ছাত্রকে পড়াতে এসেছেন তখন খোঁজ পড়লো–খোকাবাবু নেই। খুঁজে বার করো সদানন্দকে। হরিহরবাবু সেই তিন ক্রোশ দূর থেকে সাইকেল ঠেঙিয়ে রোজ নবাবগঞ্জে পড়াতে আসেন। সকলেরই সে কথা জানা। বাড়িময় খোঁজ পড়লো। বড় অন্যমনস্ক ছেলে। খেয়ালী রকমের মানুষ। অনেক সময় ইস্কুল থেকে আসতে আসতেই কারো বাড়িতে ঢুকে পড়ে তাদের ঘানি গাছে চড়ে বসতো। তখন আর বাড়ির কথা ক্ষিধের কথা মনে পড়তো না। সেদিন সব জায়গায় খোঁজা হলো। চণ্ডীমণ্ডপে চৌধুরীমশাই প্রজা পাঠকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তিনি বললেন–কই, আমি তো দেখি নি তাকে। আমার কাছে তো কই আসে নি সে। তবে সে ইস্কুল থেকে এসেছিল তো? গৌরী পিসী নিজের হাতে তাকে মুড়িবাতাসা আর সন্দেশ খেতে দিয়েছে। তাহলে সে যাবে কোথায়? দীনুও ছুটলো বারোয়ারিতলায়, সেখানেও নেই। প্রকাশ মামা দিদির কাছে এসেছিল। বাইরে কোথায় ঘুরছিল। বাড়িতে এসেই শুনলো ভাগ্নেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার দৌড়ো বাইরে। যাবে কোথায় সে? উড়ে তো যেতে পারে না। দিদিকে বললে–কিছু টাকা দাও–

দিদি বললে–টাকা কী হবে রে?

প্রকাশ বললে–নানান জায়গায় যেতে হবে, টাকা হাতে থাকা ভালো, বুঝলে? সব সময় কিছু টাকা হাতে রেখে দিও, দেখবে সঙ্গে সঙ্গে সব সুরাহা হয়ে গেছে।

টাকা নিয়ে প্রকাশ রায় বেরোল। কিন্তু আসলে খুঁজে বার করলে গৌরী পিসী। গৌরী পিসী গোয়ালঘরের দিকে যাচ্ছিল ছুঁটে আনতে। হঠাৎ চাঁদের আলোয় দেখতে পেলে কে যেন ঘাটের পৈঁঠের ওপর চিৎপাত হয়ে শুয়ে গোঙাচ্ছে। একবার যেন কীরকম সন্দেহ হলো। তারপর বললে–কে রে? কে রে ওখানে শুয়ে আছিস? কে তুই?

উত্তর না পেয়ে পায়ে-পায়ে কাছে গিয়ে দেখে খোকা। খোকাকে ওই অবস্থায় দেখে আর সেখানে দাঁড়ালো না। দৌড়তে দৌড়তে বাড়ির মধ্যে এসে খবর দিতেই সবাই দৌড়ে গেছে। চৌধুরী মশাইও চণ্ডীমণ্ডপ ছেড়ে এলেন। প্রজা পাঠক যারা ছিল তারাও এলো। সবাই ধরাধরি করে নিয়ে এসে তুললো ভেতর বাড়িতে। তারপর ডাক্তারবদ্যি আসার পর যখন তার জ্ঞান হলো সবাই জিজ্ঞেস করলে কী হয়েছিল তোর? সন্ধ্যেবেলা ওখানে গিয়েছিলি কী করতে? ভয় পেয়েছিলি?

–হ্যাঁ।

–কে ভয় দেখিয়েছিল?

সদানন্দ বললে–কপিল পায়রাপোড়া।

.

এ-সব সদানন্দর জীবনের ছোটবেলাকার ঘটনা। প্রকাশ মামা যখন কেষ্টনগরে সদানন্দের পাত্রী দেখতে গিয়েছিল তখন এইসব কথাই উঠেছিল। বেয়াই মশাই সরল সাদাসিধে মানুষ। নবাবগঞ্জের চৌধুরী বাড়ির একমাত্র ছেলের সঙ্গে তার মেয়ের বিয়ে হবে শুনে তিনি খুব খুশী হয়েছিলেন। সারা জীবন ইস্কুলে ছাত্রদের সংস্কৃত শিখিয়েছেন। কাকে বলে ধাতুরূপ তা জানেন। কাকে বলে ব্যাকরণ আর কাকে বলে অলঙ্কার তাও জানেন। খাওয়া-পরার কিছু ভাবনা যেমন ছিল না, তেমনি অভাবও ছিল না কিছু। তিনি বলতেন–অভাব বললেই অভাব। নইলে কোনও অভাব নেই আমার। আমি যদি কিছু না চাই তো আমার অভাব থাকবে কী করে? আমার তো ওই একটা মেয়ে নয়নতারা। নয়নতারাকে যে দেখবে তারই পছন্দ হবে। নয়নতারার বিয়ের জন্যে তোমাদের কাউকে ভাবতে হবে না।

গৃহিণী বলতেন–কিন্তু তা বলে বিয়ের চেষ্টা তো করতে হবে–

ব্যকরণতীর্থ পণ্ডিত মানুষ ওই কালীকান্ত ভট্টাচার্য। তিনি বলতেন–চেষ্টা করবার আমি কে বলো তো? যিনি সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মালিক তার যা মনোবাঞ্ছা তাই-ই হবে।

প্রকাশ মামা যখন নিজে সম্বন্ধটা নিয়ে গিয়েছিল তখন কালীকান্ত ভট্টাচার্য তাকেও সেই কথাই বলেছিলেন। বলেছিলেন–আমি কে বলুন? আর আপনিই বা কে? আমরা কেউ-ই কিছু নই। নিমিত্ত মাত্র। নয়নতারার মা আমাকে তাগিদ দেন। বলেন–মেয়ের বিয়ের জন্যে তুমি কিছু ভাবছো না। আমি বলি–মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে আমি ভাববার কে? যিনি ওঁকে আমার সংসারে পাঠিয়েছেন তিনিই ভাবছেন। তা দেখুন, কোথায় ছিলেন আপনি আর আমি কোথায় ছিলাম, হঠাৎ আপনি নয়নতারার সম্বন্ধ নিয়ে এলেন–আর এমন পাত্র পাওয়া তো আমার পক্ষে ভাগ্যের কথা রায় মশাই–

তারপর থেমে আবার জিজ্ঞেস করলেন–তা আপনি হলেন পাত্রের কে?

–মামা!

–হরনারায়ণ চৌধুরী মশাই-এর শ্যালক আপনি?

–আজ্ঞে না। আমি হলাম চৌধুরী মশাই-এর গৃহিণীর মামার ছেলে। অর্থাৎ মামাতো ভাই। তবে আসলে বলতে গেলে নিজের ভাই-এর মতই। ছোটবেলা থেকে চৌধুরী মশাই এর শ্বশুর কীর্তিপদ মুখোপাধ্যায়ের কোনও পুত্রসন্তান না থাকায় আমি তার বাড়িতে ছেলের মতই মানুষ হয়েছি। তাই জন্যেই এত ঘনিষ্ঠতা। দিদি আমাকে বলে দিয়েছিল আমার ভাগ্নের জন্যে একজন ডানা কাটা-পরীর মত পাত্রী চাই। তা অনেক খুঁজেছি। প্রায় শ’খানেক মেয়ে দেখেছি এ পর্যন্ত। আমার ভগ্নীপতির তো টাকার প্রয়োজন নেই, টাকা তার অনেক আছে, কিন্তু তার একমাত্র বাসনা পুত্রবধূটি যেন ডানা কাটা-পরী হয়, আর কিছু নয়–

কালীকান্ত ভট্টাচার্য জিজ্ঞেস করলেন–তা আমার মেয়েকে কেমন দেখলেন?

প্রকাশ মামা বললে–ওই যে এককথায় বললাম ডানা-কাটা-পরী–

–আপনার পছন্দ হয়েছে?

প্রকাশ বললে–আপনার মেয়েকে যার অপছন্দ হবে সে হয় কানা আর নয় তো মিথ্যেবাদী।

কালীকান্ত ভট্টাচার্যের চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইল। তিনি কী করবেন বুঝতে না পেরে বলে উঠলেন–আপনি আর দু’টো সরভাজা নিন্ বেয়াই মশাই–

–তা দিন। খেতে আমার কোনও কালেই আপত্তি নেই। একবার সম্বন্ধটা হয়ে যাক তখন দেখবো আপনি আমাকে কত সরপুরিয়া সরভাজা খাওয়াতে পারেন–

কথাটা বলে প্রকাশও যত হাসতে লাগলো ভট্টাচার্য মশাইও তত। সঙ্গে সঙ্গে আরো সরপুরিয়া এলো, আরো সরভাজা। আরো কথা হলো, আরো হাসি। প্রথম দিনেই প্রকাশ মামা হাসিতে গল্পে পাত্রীর বাবার মন ভিজিয়ে দিলে। সেখান থেকে বেরিয়েই সোজা ট্রেনে উঠে একেবারে রেল বাজারে নামলো। বারোয়ারিতলায় আসতেই লোকজন ধরলে। কী শালাবাবু, কোত্থেকে আসা হচ্ছে?

শালাবাবু বললে–ওহে, তোমাদের সব বলে রাখি, আসছে অঘ্রাণে সদার বিয়ে, এই পাত্রী পছন্দ করে এলুম। তোমরা সব যাবে, তোমাদের সব নেমন্তন্ন রইলো–

কথা শুনে সবাই অবাক। সদানন্দর বিয়ে। চৌধুরী মশাই-এর একমাত্র ছেলের বিয়ে।

–নেমন্তন্ন হবে সকলের, যাওয়া চাই কিন্তু—

কোথায় বিয়ে, কবে কোন্ তারিখে বিয়ে, তার ঠিক নেই, শুধু পাত্রী দেখলুম আর বিয়ে হয়ে গেল! বিয়ে কি অত সহজে হয়? আর তা ছাড়া যার বিয়ে সেই চৌধুরী-মশাই-এর ছেলেই তো বলে বিয়ে করবে না সে। রাস্তায় ঘাটে কত লোক সদানন্দকে দেখেছে। সকলের সঙ্গে নদীতে চান করবার সময়ও অনেকে জিজ্ঞেস করেছে–কীরে সদা, কাল কোথায় ছিলি তুই? সবাই যে তোর খোঁজাখুঁজি করছিল? কোথায় গিয়েছিলি?

সদানন্দ বলেছে—কালীগঞ্জে–

–কালীগঞ্জে? কালীগঞ্জে কী করতে?

–বেড়াতে।

কালীগঞ্জে বেড়াতে যাওয়ার কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে যায়। আর বেড়াবার জায়গা পেলে না সদানন্দ, বেড়াতে গেল কি না কালীগঞ্জে! তার চেয়ে বারোয়ারি-তলায় নিতাই হালদারের দোকানের সামনে মাচায় তাস খেলতে এলেই হয়। কিম্বা নল-দময়ন্তী থিয়েটার করছে ক্লাবের ছেলেরা সেখানে গিয়ে মহড়া শুনলেই হয়। তা নয়, একলা-একলা ক্ষেতে খামারে ঘুরে বেড়ানো!

একজন বললে–এবার চৌধুরী মশাইকে বলবো তোর একটা বিয়ে দিয়ে দিতে, তখন বাড়িতে মন বসবে তোর

সদানন্দ বলেছে–আমি বিয়ে করবো না

–বিয়ে করবি না তো এই এত জমি-জমা, এত টাকা কড়ি কে খাবে?

–আমার দাদু খাবে, আমার বাবা খাবে।

–কিন্তু যখন তোর ঠাকুর্দা থাকবে না, তোর বাবা-মা কেউ থাকবে না, যখন তুইও থাকবি না, তখন কে খাবে?

সদানন্দ বলতো–তাহলে তোমরা আছো কী করতে? তোমরা খাবে!

–আমরা? আমরা খাবো? আমাদের কি অমন কপাল? অমন কপাল হলে তো আমরা বড়লোকের বাড়িতেই জন্মাতুম রে!

লোক হাসতো। চৌধুরী মশাই-এর ছেলের কাণ্ড দেখে সবাই হাসত। বলতো–ছোটবেলায় অমন সবাই বলে হে! তারপর দেখবে যখন বড় হবে, বিয়ে হবে, সংসার হবে তখন ওর বাপ-ঠাকুর্দার মত বাকি খাজনার দায়ে আমাদের নামে আবার কাছারিতে গিয়ে নালিশ ঠুকে দেবে। ওরকম অনেক দেখা আছে হে। অনেক দেখা আছে–

কিন্তু ক্রমে সেই সদানন্দর বয়েস হয়েছে, যাকে বলে সাবালক তাই-ই হয়েছে, স্কুল থেকে পাস করে কলেজে পড়তে গেছে, কিন্তু তখনও সেই একই রকম। আগেও যা ছিল পরেও তাই। তা সেই সদার এখন বিয়ে। বারোয়ারীতলার আড্ডায় রীতিমত সোরগোল পড়ে গেল। হরনারায়ণ চৌধুরীর বাড়ির বিয়ে নয় তো যেন নবাবগঞ্জের সমস্ত লোকেরই বাড়ির বিয়ে। গ্রামসুদ্ধ লোকই কোমর বেঁধে লেগে গেল আলোচনা করতে। কোথা থেকে মিষ্টি আসছে, কোন্ গয়লাবাড়িতে দই-এর বরাত গেছে, কোন্ কুমোরবাড়িতে হাঁড়িকলসী-জালার বায়না গেছে, কোন্ সদর থেকে গোরাবাজনার দল আসছে সব খবর মুখে মুখে ফিরতে লাগলো। তাক্ লেগে গেল শালাবাবুর গরম মেজাজ দেখে। পাত্রী পছন্দ করানো থেকে শুরু করে নুনকলাপাতাটুকু পর্যন্ত সবই যেন তার দায়। নরনারায়ণ চৌধুরী ভেতরে দোতলায় বসে বসে হুকুমজারি করেই খালাস। নাতির বিয়ে হবে, সে-বিয়ে তিনি দেখে যেতে পারবেন, তার কাছে তার চেয়ে বেশি আনন্দ আর কিছু নেই। ছেলে হরনারায়ণ নিজে গিয়ে কন্যাকে হীরের মুকুট দিয়ে আশীর্বাদ করে এসেছে। ওদিক থেকে কালীকান্ত ভট্টাচার্য মশাইও নিজের সাধ্যমত একটা সোনার বোতামের সেট দিয়ে পাত্রকে আশীর্বাদ করে গেছেন। তার নিজের অবস্থার চেয়ে হাজার গুণ বড় অবস্থার বংশের সঙ্গে কুটুম্বিতে করছেন সেটা তার পক্ষেও মহা আনন্দের ঘটনা। দুপক্ষই খুশী। আর দুপক্ষের মাঝখানে যোগসূত্রের মত প্রকাশ মামা একবার কেষ্টনগর আর একবার নবাবগঞ্জ করছে। ছেলে-মেয়ে-বউ সবাইকে নিয়ে এসে তুলেছে এখানে। নরনারায়ণ চৌধুরীর বেয়াই কীর্তিপদ মুখোপাধ্যায়ও সুলতানপুর থেকে অসুস্থ শরীর নিয়ে এসে হাজির হয়েছেন। কিন্তু সব কিছুর দায়িত্ব বলতে গেলে যেন শালাবাবুরই একলার। একবার ভাড়ার ঘরে গিয়ে হাজির হয় আর একবার দিদির কাছে। বলে–শ’পাঁচেক টাকা দাও তো দিদি

দিদি টাকা দিতে দিতে শুধু মাত্র জিজ্ঞেস করে–আবার পাঁচশো টাকা কী হবে? তোর জামাইবাবুর কাছেই চাইলে পারতিস–

টাকাগুলো পকেটে পুরতে পুরতে প্রকাশ বলে–জামাইবাবুকে এখন কোথায় খুঁজে পাই বলো দিকিনি–! আমারই বা অত সময় কোথায়? শেষকালে সব হিসেব দিলেই তো হলো–

বলে হন-হন করে যেমন হঠাৎ এসেছিল তেমনি হঠাৎই কোথায় উধাও হয়ে যায়। নাইবার খাবারও সময় নেই তার। নরনারায়ণ চৌধুরী এক-একবার জিজ্ঞেস করেন–কৈলাস, সব কাজকর্ম ওদিকে ঠিক চলছে তো?

কৈলাস গোমস্তা বলে–আজ্ঞে হা কর্তাবাবু, প্রকাশ মামা আছেন, তিনি সব করছেন–

নরনারায়ণ চৌধুরী চিনতে পারেন না। জিজ্ঞেস করেন–প্রকাশ মামা? সে আবার কে?

–আজ্ঞে আমাদের বৌমার ভাই।

–বৌমার ভাই মানে? নারায়ণের শালা?

–আজ্ঞে হ্যাঁ—

–তা বেয়াই মশাই-এর তো পুত্রসন্তান ছিল না। শালা কোত্থেকে এল?

–আজ্ঞে বৌমার মামাতো ভাই, আমাদের বেয়াই মশাই-এর কাছেই মানুষ, ছেলেবেলাতেই বাবা-মা মারা গিয়েছিল কিনা–

–ও–বলে তিনি চুপ করলেন। অনেকবার শুনেছেন তিনি কথাটা, তবু শেষের দিকে অনেক কিছুই তিনি ভুলে যেতেন।

যখন বিয়ে বাড়ি এমনি জম-জমাট, চৌধুরী বাড়িতে লোকজন গম গম করছে, তখন গ্রামের লোকের কানে গেল শাঁখ বাজার শব্দ। লোকজন সবাই ভিড় করে এল। গায়ে হলুদ এসেছে। গায়ে-হলুদ এসেছে। শাঁখ বাজাও, শাঁখ বাজাও! গায়ে-হলুদের দলের সঙ্গে এসেছে অনেক লোক। এসেছে সকাল আটটার আগেই। পুরুতমশাই পাঁজি দেখে সময় বলে দিয়েছেন। সেই সময়ের মধ্যে ছেলের গায়ে-হলুদ না হলে ওদিকে মেয়ের গায়ে-হলুদও হবে না। এদিকে টাইম দেওয়া হয়েছে সকাল আটটা, আর ওদিকে সেই হিসেব করে মেয়ের গায়ে-হলুদ হবে সকাল ন’টার সময়। হিন্দুর বিয়ে বলে কথা। এর নড়চড় হবার উপায় নেই। হলে অকল্যাণ হবে। অকল্যাণ হবে বর কনের। অকল্যাণ হবে চৌধুরী বংশের, অকল্যাণ হবে ব্যাকরণতীর্থ কালীকান্ত ভট্টাচার্যের বংশেরও।

কৃষ্ণনগর থেকে নবাবগঞ্জ। মাঝখানে রাণাঘাটে একবার ট্রেন বদল করতে হয়। সময়ও লাগে অনেক। তারপর আছে রেলবাজার থেকে এতখানি রাস্তা।

গায়ে-হলুদের দল যখন কেষ্টনগরে ফিরলো তখন বিকেল পুইয়ে গেছে। সামনের রাস্তার দিকে হা-পিত্যেশ করে চেয়ে ছিলেন ভট্টাচার্যি মশাই। বাড়ির ভেতরেও সকলের উদ্বেগ ছিল। কুটুমবাড়ি থেকে ঘুরে আসছে, ওদের মুখ থেকে অনেক খবর শোনা যাবে।

–কি গো বিপিন, গায়ে-হলুদ হলো? কী রকম খাতির করলেন বেয়াই মশাইরা?

বিপিনের মুখটা যেন কেমন গম্ভীর-গম্ভীর।

–কই, কথা বলছ না যে কিছু?

বিপিন বললে–আজ্ঞে পণ্ডিত মশাই, খাতির খুব ভালোই পেয়েছি, পেটভরে খেয়েছি। সবাই আমরা, কিন্তু…

কী বলতে গিয়ে যেন বিপিন থেমে গেল।

পণ্ডিত মশাই বুঝতে পারলেন না। বললেন–কিন্তু কী…

–আজ্ঞে গায়ে-হলুদ হয়নি।

–গায়ে-হলুদ হয়নি মানে? এদিকে নয়নতারার যে গায়ে-হলুদ হয়ে গেল সকাল ন’টার সময়। ওদিকে আটটার সময় ছেলের গায়ে-হলুদ হবার কথা, সেই হিসেব করে আমরাও যে মেয়ের গায়ে-হলুদ দিয়ে দিয়েছি। সেই রকম ব্যবস্থাই তো করা ছিল–

বিপিন মুখ কাচুমাচু করে বললে–আজ্ঞে, বরবাবাজীকে পাওয়া গেল না–

–পাওয়া গেল না মানে?

বিপিন বললে–আগের রাত্তির থেকেই বরবাবাজী কোথায় বেরিয়ে গেছে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না–

–শেষ পর্যন্ত? শেষ পর্যন্ত কী হলো আগে তাই বলো! শেষ পর্যন্ত বরকে পাওয়া গেল?

–আজ্ঞে না, পাওয়া গেল না। আমরা আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবো, তাই আমরা চলে এলুম–

খবরটা কানে যেতেই ভট্টাচার্য-গৃহিণীও ছুটে বাইরে এলেন। বললেন–কী হলো গো? গায়ে-হলুদ হয়নি? এদিকে যে নয়নতারার গায়ে-হলুদ হয়ে গেছে। তাহলে কি বর আসবে না নাকি?

বলে বিপিনের দিকে চাইলেন তিনি।

ভেতরের একটা ঘরে নয়নতারা তখন চুপ করে বসেছিল। তার কানেও গেল কথাটা। কানে যেতেই সমস্ত শরীরটা অবশ হয়ে এল। বর আসবে না!

কিন্তু না, বোধ হয় পণ্ডিত কালীকান্ত ভট্টাচার্যের পূর্ব-পুরুষের বহু পুণ্যফল ছিল, তাই তার কন্যার বিয়েতে কোনও বিপর্যয় ঘটলো না। কিংবা বিপর্যয়টা সাময়িকভাবে না ঘটলেও হয়ত অদূর ভবিষ্যতের জন্যে মুলতুবী রইল। জীবনে দুর্যোগ যখন আসে তখন আপাতত তার আসার রকমটা দেখে অনেক সময় মনে হয় সেটা বুঝি হঠাৎই উদয় হলো। কিন্তু ঝড় আসবার অনেক আগে থাকে ঝড়ের সঙ্কেত। ঘরের চালে যখন আগুন লাগে, সে আগুনের উদ্ভব যে তার কত আগে কারো তামাক-খাওয়ার নেশার তাগিদে, আমরা তার খোঁজ রাখি না।

কালীকান্ত ভট্টাচার্য মশাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলেন। একেবারে শেষ ট্রেনটাতে বর এসে পৌঁছুলো। বিপিন দৌড়ে এসে খবর দিয়ে গেল পণ্ডিত মশাইকে। পণ্ডিত মশাই আবার খবর দিলেন বাড়ির ভেতরে। বিয়ে বাড়িতে তখন চাপা কান্নার রোল উঠেছিল। সুখবর পেয়ে সেই বাড়িই আবার গমগম করে উঠলো। আবার হাসি ফুটে উঠলো সবার মুখে। কে যেন বলে উঠলো–ওরে শাঁখ বাজা, শাঁখ বাজা, উলু দে,–উলু দে–বর এসেছে–

হ্যাঁ, কালীকান্ত ভট্টাচার্যির বাড়িতে বর এসেছে, নয়নতারার বর এসেছে—

.

স্টেশনের প্ল্যাটফরমে প্রকাশ মামা তখন সদানন্দকে আগলে আগলে আসছে। ভাগ্নে আবার না পালায়! পাশে হরনারায়ণ চৌধুরী ছিলেন। তিনিই বরকর্তা। পেছনে পেছনে নাপিত।

প্রকাশ মামা বললে–আপনি কিছু ভাববেন না জামাইবাবু, আমি সদাকে আগলে আছি–

প্ল্যাটফরমে কিছু লোক বর দেখতে ভিড় করেছিল। প্রকাশ মামা তাদের দিকে চেয়ে তেড়ে গেল। বললে–আপনারা কী দেখছেন মশাই? আপনারা কি বর দেখেন নি কখনও? একটু রাস্তা দিন, রাস্তা দিন আমাদের–সরুন–

কিন্তু সদানন্দর তখন অন্য চিন্তা। প্রকাশ মামা তার দিকে চেয়ে বললে–কিচ্ছু ভাবিস নি তুই। বিয়ে করতে ভয় কীসের? আমি তো আছি। এই দ্যাখ না, বিয়ে কে না করেছে। আমি বিয়ে করেছি, তোর বাবা বিয়ে করেছে, তোর ঠাকুর্দা বিয়ে করেছে, তোর ঠাকুরদার বাবাও একদিন বিয়ে করেছিল। বিয়ে করতে ভয়ের কিচ্ছু নেই। এই আমার কথাই ধর না, আমি তো একবার বিয়ে করেছি, এর পর যদি দরকার হয় আরো দশবার বিয়ে করবার হিম্মত রাখি, আমি কি কাউকে পরোয়া করি?

সেদিন প্রকাশ মামার কথায় মনে মনে হেসেছিল সদানন্দ। প্রকাশ মামাও তো একজন মানুষ। কেউ তাকে মানুষ ছাড়া জানোয়ার বলবে না। মানুষের মত দুটো হাত, পা, চোখ, কান। মানুষেরই মতন মুখের ভাষা। সংসার ওরকম লোককে সবাই মানুষ বলেই জানে। অথচ প্রকাশ মামা কি সত্যিই মানুষ! কতদিন সদানন্দকে সিগারেট খাইয়েছে, তামাক খাইয়েছে, বিড়ি খাইয়েছে। যাত্রা থিয়েটার শুনতে কত দূর দূর গ্রামে নিয়ে গিয়েছে। তারপর অন্য গ্রামে রাত কাটিয়ে সকাল বেলা বাড়ি ফিরিয়ে দিয়েছে। বাড়ি আসবার আগে ভাগ্নেকে সাবধান করে দিয়েছে। বলেছে–খবরদার, কাউকে যেন বলিস নি এসব কথা–

সদানন্দ তখন ছোট। মামার কথা ঠিক বুঝতে পারতো না। জিজ্ঞেস করতো–কী সব কথা?

প্রকাশ মামা বলতো–এই কার ঘরে রাত কাটিয়েছিস—

সদানন্দ জিজ্ঞেস করত–কেন? বললে–কী হয়েছে?

প্রকাশ মামা বকতো। বলতো–দূর হাঁদা। মেয়েমানুষের ঘরে রাত কাটালে কাউকে বলতে নেই–

–কেন? মেয়েমানুষের ঘরে রাত কাটালে দোষ কী? ও মেয়েমানুষটা কে?

প্রকাশ মামা বলতো–দূর, তুই দেখছি সত্যিই একটা হাঁদা-গঙ্গারাম। দেখলি না ওটা একটা বাজারের মেয়েমানুষ!

–বাজারের মেয়েমানুষ মানে?

প্রকাশ মামা অধৈর্য হয়ে উঠতো। বলতো–আরে, তোকে নিয়ে দেখছি মহা মুশকিলে পড়া গেল। বাজারের মেয়েমানুষ কাকে বলে তাও এত বড় ছেলেকে বুঝিয়ে বলতে হবে। দেখলি নে মাগীর কী রকম ঠাঁট?

–ঠাঁট মানে?

প্রকাশ মামা বলতো–নাঃ, তোকে দেখছি আর মানুষ করতে পারলুম না। তুই বড় হয়ে যে কী করবি তা বুঝতে পারছি না। শেষকালে তুই কেলেঙ্কারি না বাধিয়ে বসিস। যখন তোর বাবা মারা যাবার পর লাখ লাখ টাকার সম্পত্তির মালিক হবি, তখন দেখছি সবাই তোকে সব ঠকিয়ে নেবে–

সদানন্দ ছোটবেলায় প্রকাশ মামার কথা শুনে অনেক জিনিস জানতে পারতো। সে জানতে পারতো যে, তাদের অনেক টাকা। তার ঠাকুরদা আর তার বাবা মারা যাবার পরই সে নাকি লাখ লাখ টাকার মালিক হয়ে যাবে! আর শুধু যে তার বাবার টাকা তাই-ই নয়, তার দাদামশাই-এর নাকি অনেক টাকা। দাদামশাই-এর মৃত্যুর পর সে-টাকাও নাকি সদানন্দ একলাই সব পাবে। তখন তার বয়েস পনেরো কি ষোল, সেই সময়েই সে এই সব কথা শুনলো। রানাঘাটের বাজারের একটা বাড়িতে তখন তাকে নিয়ে গেছে প্রকাশ মামা। সারা রাত যাত্রা শুনেছে মামার সঙ্গে। যাত্রা যখন শেষ হয়েছে তখন মাঝরাত। ঘড়িতে বোধ হয় রাত তখন দুটো। সেই অত রাত্রে সদানন্দর খুব ঘুম পেয়েছে। প্রকাশ মামা জিজ্ঞেস করলে–কী রে, খুব ঘুম পেয়েছে?

সদানন্দ বললে–হ্যাঁ।

–তা হলে আয় তোকে বিছানায় শুইয়ে দিই গে। আয় আমার সঙ্গে—

বলে বাজারের গলির ভেতরে একটা বাড়ির সামনে গিয়ে ডাকলে রাধা, রাধা, ও রাধা–

অনেক ডাকাডাকির পর একজন মেয়েমানুষ চোখ রগড়াতে রগড়াতে এসে দরজা খুলে দিলে। জিজ্ঞেস করলে–এ কী, এত রাত্তিরে? এ কে?

প্রকাশ মামার হাব-ভাব দেখে মনে হলো যেন মেয়েমানুষটা তার খুব চেনা। কথা বলতে বলতে একেবারে তার বিছানায় গিয়ে বসে পড়লো। সদানন্দ তখনও মেয়ে-মানুষটার দিকে হাঁ করে চেয়ে আছে। যাত্রা শুনতে শুনতে তখন যে তার অত ঘুম পাচ্ছিল, সেখানে সেই মেয়েমানুষটার বাড়িতে গিয়ে কিন্তু সে-সব যেন কোথায় হাওয়ায় উড়ে গেল।

–কী রে, রাধার দিকে চেয়ে অমন করে কী দেখছিস?

প্রকাশ মামা হাসতে হাসতে সদানন্দকে কথাটা বলতেই সে মাথা নিচু করে নিয়েছিল। তার সেই ওই অল্প বয়সেই মনে হয়েছিল যে, অমন করে কোনও অচেনা মেয়েমানুষের দিকে চেয়ে থাকতে নেই।

তারপর প্রকাশ মামার কথাতেই তার যেন আবার জ্ঞান ফিরে এলো। প্রকাশ মামা তখন মেয়েমানুষটার দিকে চেয়ে বলে চলেছে সদানন্দর কথা। লাখ লাখ টাকার জমিদার এর বাবা। বাবার এক ছেলে, বুঝলে? বাপ মারা গেলে এই ছেলেই সেই অত টাকার সম্পত্তির একচ্ছত্র মালিক হবে।

–তা ওকে নিয়ে আমার এখানে কেন এসেছ? ওর বাবা-মা জানতে পারলে কিছু বলবে না?

প্রকাশ মামা হেসে উঠলো। বললে–কেন, তোমাদের এখেনে আসা কি খারাপ?

রাধা বললে–না, তোমার কথা বলছি নে। তুমি তো এ-লাইনে পাকা ঘুঘু। শেষকালে ভাগ্নেকেও এ-লাইনে নিয়ে এলে, তাই বলছি–

প্রকাশ মামা সদানন্দর দিকে চাইলে। বললে–এ-লাইনে এলে ক্ষতি কী! তোমারও লাভ, আমারও লাভ–

–তোমার কিসের লাভ?

–লাভ নয়? এত টাকা এ একলা খেতে পারবে? পরের গলায় গামছা দিয়ে টাকা করেছে এর ঠাকুর্দা। কালীগঞ্জে এর ঠাকুর্দা পনেরো টাকা মাইনেতে গোমস্তার চাকরি করতো। মাত্তোর পনেরো টাকা। গোমস্তা বললে–খারাপ শোনাতো বলে সবাই এর ঠাকুর্দাকে নায়েবমশাই বলে ডাকতো। সেই পনেরো টাকায় শুরু করে আজ পনেরো লাখ টাকার জমিদারির মালিক তিনি। আর এই নাতিই হলো তার সেই সমস্ত সম্পত্তির একমাত্তোর ওয়ারিশন্‌।

খবরটা যেমন রাধার কাছে বিস্ময়কর, তখন সেই ছোটবেলায় সদানন্দর কাছেও তেমনি। প্রকাশ মামার সেই সেদিনকার কথাতেই সে প্রথম জানতে পারলো যে, তাদের কত টাকা। সে কত বড়লোক।

রাধা বললে–কিন্তু তুমি এই বয়সেই ওকে এই লাইনে নিয়ে এলে! ও তো বয়স হলে সব ওড়াবে–

–সে গুড়ে বালি। বুঝলে গো, টাকা ওদের বংশে কারোর হাত দিয়ে গলে না।

রাধা বললে–তাই নাকি?

–হ্যাঁ, তাই তো আমি আমার দিদির কাছ থেকে যা পারি হাতিয়ে নিই। এর বাবা, আমার জামাইবাবু এক-পয়সার ফাদার-মাদার। সেই জন্যেই তো এই ভাগ্নেটাকে এ লাইনে এনে একটু মানুষ করার চেষ্টা করছি। দেখি, এখন আমার হাতযশ আর এর কপাল–

সদানন্দ তখনও রাধার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। তার মনে হলো মেয়েমানুষটার মধ্যে কিছু যেন অস্বাভাবিকতা রয়েছে একটা। তাদের নবাবগঞ্জের অন্য মেয়েমানুষদের মত নয় যেন। শেষ পর্যন্ত সেদিন আর ঘুমনোই হয়নি সদানন্দর। ওই রকম জায়গায় কারো ঘুম হয় নাকি?

মনে আছে বাড়িতে ফিরে আসতেই মা জিজ্ঞেস করলে কীরে, সমস্ত রাত কোথায় ছিলি? কোথায় ঘুমোলি?

প্রকাশ মামা বললে–ঘুম হবে কী করে? সাধুদের আশ্রমে কি ঘুম হয় কারো? সবাই কেবল খোলকর্তাল বাজাচ্ছিল–

–সাধুদের আশ্রমে? সাধুদের আশ্রমে মানে?

প্রকাশ মামা বললে–যাত্রা তো শেষ হয়ে গেল রাত দুটোর সময়, তখন কোথায় যাই? সদা বললে–ওর ঘুম পেয়েছে। তাই ওকে নিয়ে রাণাঘাটের একটা সাধুদের আশ্রমে গেলুম। কিন্তু সেখানে সবাই এমন হেঁড়ে গলায় ‘রাধাকৃষ্ণ রাধাকৃষ্ণ’ করতে লাগলো যে, বাপ-বাপ বলে আমাদের ঘুম পালিয়ে গিয়ে বাঁচলো–

দিদি হাসতে লাগলো। বললে–তা আমাদের সদরের উকিলবাবুর বাড়ি থাকতে সাধুদের আশ্রমে তোরা গেলিই বা কেন?

প্রকাশ মামা বললে–গেলুম সদাকে দেখাতে। যখন বড় হয়ে হাতে ওর অনেক টাকা আসবে তখন যাতে না ঠকে তাই এখন থেকে জোচ্চোরদের চিনিয়ে রাখলুম–

কথাটা শুনে দিদিও হাসতে লাগলো, প্রকাশ মামা নিজেও হাসতে লাগলো। কিন্তু সদানন্দ সেদিন হাসতে পারেনি প্রকাশ মামার কথা শুনে। তখনও সেই রাণাঘাটের বাজারের মেয়েমানুষটার কথা মনে পড়ছিল তার।

হঠাৎ প্রকাশ মামা জিজ্ঞেস করলে–জামাইবাবুকে তুমি যাত্রা শুনতে যাওয়ার কথা বলোনি তো?

সত্যিই তখনকার দিনে কেউ-ই জানতো না প্রকাশ মামার সঙ্গে বাড়ির বাইরে সে কোথায় কোথায় যেত। চৌধুরী বংশের কুলতিলকের পক্ষে যেখানে যাওয়া নিষিদ্ধ সেখানেও যে সেই বয়েসেই গিয়ে সে সব-কিছু বিধি-নিষেধ অমান্য করে বসে আছে–এ-কথা গুরুজনদের কারোরই তখন গোচরে আসেনি। জীবন দেখা কি এতই সোজা! প্রকাশ মামা না হলে কি জীবনের উল্টো-পিঠটা সে দেখতে পেত? একদিকে নরনারায়ণ চৌধুরীর অর্থ লালসা, আর তার বাবার বৈষয়িক কূট-কৌশলী বুদ্ধি, আর অন্যদিকে প্রকাশ মামার বেপরোয়া জীবনভোগ। একদিকে কালীগঞ্জের বৌ এসে পালকি থেকে নামতো আর দাদুর কাছে গিয়ে টাকা চাইতো, আর একদিকে সেই টাকাই প্রকাশ মামার হাতের ফুটো দিয়ে রাণাঘাটের বাজারের চালাঘরে গিয়ে নিঃশেষ হতো। মানুষের জীবনের এই অঙ্কটা সে কিছুতেই কষতে পারতো না।

এক-একদিন মা’কে জিজ্ঞেস করতো–মা, ও বউটা কে পালকি করে আসে আমাদের বাড়িতে? কেবল দাদুর কাছে টাকা চায় কেন?

মা বলতো–ও কালীগঞ্জের বউ।

–কালীগঞ্জের বউ কালীগঞ্জে থাকে না কেন? আমাদের নবাবগঞ্জে কেন জ্বালাতে আসে?

মা তাড়াতাড়ি ছেলেকে চুপ করিয়ে দিত। বলতো–চুপ, চুপ, ওকথা বলতে নেই, কর্তাবাবু শুনতে পেলে রাগ করবেন।

সদানন্দ বলতো–তা কালীগঞ্জের বৌ-এর পাওনা টাকা দিয়ে দিলেই হয়। যখনই কালীগঞ্জের বউ টাকা চায় তখনই দাদু বলে টাকা নেই। দাদু কেন মিথ্যে কথা বলে? দাদুর তো অনেক টাকা আছে, আমি দেখেছি–

এ-সব কথার কোনও উত্তর তার মা দিতে পারেনি।

প্রকাশ মামাকেও সে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে–তুমি কেন ওখানে যাও মামা?

প্রকাশ মামা ভাগ্নের কাছে এমন প্রশ্নের আশা করতো না। বলতো–তুই কী বুঝবি কেন যাই! তুই যখন বড় হবি তখন তুইও যাবি–

সেই ছোটবেলায় যখন রাধার বাড়িতে প্রথম গিয়েছিল সে তখন সেই গানটা শুনিয়েছিল। সেই গানটা–আগে যদি প্রাণসখি জানিতাম।

আসবার সময় রাস্তায় প্রকাশ মামা তাকে জিজ্ঞেস করেছিল–কী রে, কীরকম গান শুনলি?

সদানন্দ বলেছিল—ভালো–

–ভালো তো বুঝলুম, কিন্তু, কী রকম ভালো তাই বল না—

সদানন্দ বলেছিল–খুব ভালো–

প্রকাশ মামা বলেছিল–তা দ্যাখ, দিদি যদি তোকে জিজ্ঞেস করে কোথায় রাত কাটিয়েছিলি তাহলে কিন্তু রাধার কথা বলিসনি, বুঝলি? তোর বাবাকেও বলবি না, তোর দাদুকেও বলবি না।

সদানন্দ আবার জিজ্ঞেস করেছিল কিন্তু তাহলে তুমি কেন ওখানে যাও মামা?

প্রকাশ মামা বলেছিল–জীবনটাকে ভোগ করতে।

–ভোগ করতে মানে?

প্রকাশ মামা বলেছিল–ওই তো তোর বড় দোষ! বলছি তুই বড় হলে সব বুঝতে পারবি! তবু বারবার সেই এক কথা। তোর ভালোর জন্যেই তোকে এসব শেখাচ্ছি। নইলে তোর হাতে যখন টাকা আসবে তখন তুই খরচ করবি কী করে?

সদানন্দ জিজ্ঞেস করেছিল–কেন? টাকা খরচ করা কি শক্ত?

প্রকাশ মামা বলেছিল–নিশ্চয়ই, টাকা খরচ করা কি সোজা নাকি! তোর দাদুর তো অত টাকা, তাহলে কালীগঞ্জের বৌকে তার পাওনা টাকা দেয় না কেন বল?

সদানন্দ বলেছিল–সত্যিই বলো তো, কালীগঞ্জের বৌকে দাদু টাকা দেয় না কেন?

একটা হাসির শব্দে হঠাৎ যেন সদানন্দর সম্বিৎ ফিরে এলো। চারিদিকে অনেক লোক, অনেক আলো। অনেক বাজনা। ঢোলকাঁসির আওয়াজে জায়গাটা তখন সরগরম হয়ে উঠেছে। তার সঙ্গে আছে শাঁখ আর উলুর শব্দ।

–বেয়াই মশাই, আমি তো খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম—

প্রকাশ মামা এগিয়ে এল ভট্টাচার্যি মশাই-এর দিকে। বললে–কেন, ভয় পেয়েছিলেন কেন?

ভট্টাচার্যি মশাই বললেন–আমাদের বিপিন গিয়েছিল, তার মুখেই শুনলাম বাবাজীকে নাকি পাওয়া যাচ্ছিল না সকাল থেকে।

কথাটা শুনে হো-হো করে হেসে উড়িয়ে দিল প্রকাশ মামা। জামাইবাবুর দিকে চেয়ে বললে–শুনুন জামাইবাবু, বেয়াই মশাই-এর কথা শুনুন, বরকে যদি পাওয়াই না যাবে তাহলে এখন বর এল কী করে?

কালীকান্ত ভট্টাচার্য মশাই বললেন বুঝতেই তো পারছেন, আমি হলুম মেয়ের বাপ, আমার তো একটা দুশ্চিন্তা থাকে–তা গায়ে-হলুদ নির্বিঘ্নেই হয়েছিল তো শেষ পর্যন্ত?

বরকর্তা চৌধুরী মশাই সাধারণত বেশি কথা বলেন না। গায়ে-হলুদের কথা শুনে মুখ খুললেন। বললেন–গায়ে-হলুদ না হলে বিয়ে হবে কী করে বেয়াই মশাই? অশাস্ত্রীয় ব্যাপার তো আমাদের বংশে চলবে না।

নিরঞ্জন পরামাণিক বরের সঙ্গে গিয়েছিল। কনের বাড়ির পরামাণিক বিপিন এসে চুপি চুপি জিজ্ঞেস করলে–শুনছিলাম কী নাকি হয়েছিল আপনাদের ওখানে–?

–কীসের কী?

–আমি তো গায়ে-হলুদ নিয়ে গিয়েছিলুম নবাবগঞ্জে তখন তো বরকে পাওয়া যাচ্ছিল না, তারপর কখন পাওয়া গেল?

নিরঞ্জন বললে–আরে খোকাবাবু তো খেয়ালী মানুষ, হঠাৎ কালীগঞ্জে চলে গিয়েছিল–

–কালীগঞ্জে? তা বিয়ের দিন বরবাবাজী কালীগঞ্জে চলে গিয়েছিলই বা কেন?

কেন যে সদানন্দ সেদিন কালীগঞ্জে চলে গিয়েছিল তা কি সদানন্দ নিজেই জানতো? এ এক বিচিত্র মানসিকতা। আগের দিনও সে জানতো না যে, সে কালীগঞ্জে যাবে। প্রকাশ মামা তাকে সব জায়গাতেই সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। ছোটবেলা থেকে সে মামার সঙ্গে কত জায়গাতেই তো গেছে। কালীগঞ্জেও গেছে। রেলবাজার থেকে নবাবগঞ্জে এসে আরো কয়েক ক্রোশ দক্ষিণে যাও তবে কালীগঞ্জ পড়বে। কালীগঞ্জে পোস্টাফিস আছে, থানা আছে, বাঁধা বাজার আছে। বলতে গেলে নবাবগঞ্জের চেয়ে কালীগঞ্জ আরো বর্ধিষ্ণু গ্রাম। সদানন্দ জানতো ওইখান থেকেই কালীগঞ্জের বউ তার দাদুর কাছে আসতো। জানতো দাদুর কাছে এসে কালীগঞ্জের বউ টাকা চাইতো, আর যতবার টাকা চাইতো ততবার দাদু বলতো টাকা নেই। কেন যে বউ টাকা চাইতো আর কীসের টাকা, তা সদানন্দ জানতো না। কাউকে জিজ্ঞেস করলেও কেউ স্পষ্ট জবাব দিত না।

বিয়েবাড়িতে তখন লোকজনের ভিড় হয়েছে খুব। ভাগলপুর থেকে দাদামশাই এসেছে। তার নাতির বিয়ে। বুড়ো মানুষ। বেশি নড়া-চড়া করতে পারেন না। তিনি বললেন কই, খোকাকে তো দেখতে পাচ্ছিনে–

দীনু ডেকে নিয়ে এল খোকাকে। দাদু শুয়ে ছিলেন সামনে। বললেন–দাদুকে প্রণাম করো–

–থাক থাক–বলে কীর্তিপদবাবু পা-জোড়া সামনের দিকে একটু এগিয়ে দিলেন। তারপর বললেন–বেঁচে থাকো বাবা, আশীর্বাদ করি সুখী হও–

সদানন্দ তখনও সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। কীর্তিপদবাবু আবার বলতে লাগলেন–এসে পর্যন্ত তোমাকে দেখতেই পাইনি মোটে, খুবই ব্যস্ত বুঝি–

নরনারায়ণ চৌধুরী বললেন–না, ও আবার ব্যস্ত কীসের! ও তো বরাবরই ওই রকম। আমিই বলে আজকাল দেখতে পাইনে ওকে, অথচ একই বাড়ির মধ্যে থাকি। ওকে কেউই দেখতে পায় না–

কীর্তিপদবাবু বললেন–তা তো পাবেই না, এখন ওদের বয়েস হয়েছে, বুড়োদের সঙ্গে থাকতে ওদের আর ভালো লাগবেই বা কেন? যাও, যাও, তোমার নিজের কাজে যাও বাবা, কাল তোমার বিয়ে, আর কোথাও বেরিও না–

সদানন্দ ছাড়া পেয়ে বেঁচে গেল যেন। সে চলে যাবার পর কীর্তিপদবাবু বললেন অনেকদিন পরে দেখলাম খোকাকে, খুব বড় হয়ে গেছে–আর চেনা যায় না–

নরনারায়ণ চৌধুরী বললেন বড় হলে কী হবে, বৈষয়িক বুদ্ধি-টুদ্ধি তেমন হয়নি

কীর্তিপদবাবু বললেন–এইবার বিয়ে হচ্ছে, কাঁধে জোয়াল চাপলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, ছোট বয়সে সবাই ওরকম একটু হয়েই থাকে–পরে দেখবেন তখন ও-ই আপনাকে শেখাবে। আমি যখন ছোট ছিলুম তখন আমিই কি জমিদারির কিছু বুঝতুম–

দুই বেয়াই-এর বহুদিন পরে দেখা। দুজনেরই অনেক সম্পত্তি। একদিন এই দুজনের সব সম্পত্তিরই মালিক হয়ে বসবে সদানন্দ। কীর্তিপদবাবুর একমাত্র সন্তান এই সদানন্দর মা। আর নরনারায়ণ চৌধুরীরও একমাত্র সন্তান এই সদানন্দর বাবা। সদানন্দ নিজেও হরনারায়ণ চৌধুরীর একমাত্র সন্তান। সুতরাং দুই বেয়াই-এরই একমাত্র ভরসা এই সদানন্দ। তাই দুজনেরই এক কামনা। দুজনেরই কামনা সদানন্দ দীর্ঘজীবী হোক, সদানন্দ সুখী হোক, সদানন্দ সংসারী হোক, সদানন্দ বৈষয়িক হোক।

কিন্তু হায় রে মানুষের জীবন আর হায় রে মানুষের জীবনের ইতিহাস! নইলে সেদিন নবাবগঞ্জ আর ভাগলপুরের সেই দুই দুর্ধর্ষ জমিদার-পুঙ্গব কি কল্পনা করতেই পেরেছিলেন যে তাদের একমাত্র উত্তরাধিকারী শ্ৰীমান সদানন্দ চৌধুরী লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক হওয়া সত্ত্বেও কপর্দকশূন্য অবস্থায় এক অখ্যাত চৌবেড়িয়া গ্রামের রসিক পালের অতিথিশালায় অন্নদাস হিসেবে শেষ জীবনটা কাটাবে! নইলে ঠিক বিয়ের আগের দিনই কেউ নিজের বাড়ি ছেড়ে পালায়, না নরনারায়ণ চৌধুরীর শেষ জীবনের চরম শত্রু কালীগঞ্জের বৌ-এর কাছে গিয়ে আশ্রয় নেয়!

 ২.২ কালীগঞ্জের বৌ

কালীগঞ্জের বৌ-এরও তখন চরম অবস্থা। নিঃসন্তান বিধবা মানুষ তিনি। এককালে স্বামীর জীবিতাবস্থায় তিনি অনেক সুখ অনেক ঐশ্বর্য দেখেছেন। দুটি ছেলে হয়েছিল তার। তারাও তখন আর নেই। কালীগঞ্জে যেবার কলেরা মহামারী হয়ে দেখা দিয়েছিল সেবার দুই ছেলেই তার চোখের সামনেই মারা গিয়েছিল! স্বামীর মৃত্যু, দুই ছেলের মৃত্যু, সবই তিনি সহ্য করেছেন বুকে পাথর বেঁধে। তখন ওই নরনারায়ণ চৌধুরীই ছিল কালীগঞ্জের জমিদারের নায়েব। তার হাতেই সব কিছুর ভার দিয়ে কালীগঞ্জের বউ বড় নিশ্চিন্ত ছিলেন। পনেরো টাকা মাইনে পেতেন তখন নরনারায়ণ চৌধুরী। সামান্য নায়েব মাত্র। অতি কষ্টেসৃষ্টে সংসার চলতো তার। কিন্তু সন্তান-হারা বিধবার হাতে জমিদারির ভার পড়ার পর থেকেই নরনারায়ণ চৌধুরীর অবস্থা ফিরতে লাগলো। তিনি নায়েবগিরি করেন কালীগঞ্জে কিন্তু একখানা ছোট কোঠাবাড়ি করলেন নবাবগঞ্জে, নিজের গ্রামে। মাসে পনেরো টাকা মাইনে পাওয়া নায়েবের কোঠাবাড়ি করবার সামর্থ্য হয় কী করে সে প্রশ্ন জমিদারির বিধবা মালিক কালীগঞ্জের বৌ-এর মাথায় আসেনি। এলে আর নরনারায়ণ চৌধুরী আজ এত বড়লোক হতে পারতেন না। আর তখন সে-প্রশ্ন উঠলে আজকের এই আসামী সদানন্দ চৌধুরীকে নিয়ে উপন্যাস লেখবার প্রয়োজনও এমন করে অনিবার্য হয়ে উঠতো না।

তা সেদিন সেই সদানন্দ চৌধুরীর বিয়ের আগের দিন সন্ধ্যেবেলা হঠাৎ কালীগঞ্জের বৌ সদানন্দকে তার বাড়িতে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। বুড়ি মানুষ, ভালো করে তখন চোখেও দেখতে পায় না। বিরাট বাড়ি। কিন্তু ওই বিরাট বাড়িটাই শুধু আছে তখন। আর কিছু নেই। সব ঘরগুলোতে ভালো করে ঝাঁটও পড়ে না। আগেকার সেই সব লোক-লস্করও নেই আর তখন। একটা ঝি শুধু হাতের কাজগুলো করে দেয়। আগে গোয়াল-ভরা গরু ছিল, বলদ ছিল চাষবাসের। আর ছিল কিছু লোকজন, যারা এককালে কর্তাদের নিমক খেয়েছে। তারা কৃতজ্ঞতার তাগিদে বাড়ির আনাচে-কানাচে কোনও রকমে তখনও বাসা বেঁধে আছে। দরকার হলে ভাঙা পালকিটায় করে গিন্নীমাকে এখানে–ওখানে নিয়ে যায়। তাও পালকিটার তখন রং চটে গেছে, একটা পায়া ভেঙে গেছে। কোনও রকমে মেরামত করে করে সেটা একটু চালু আছে।

–তুমি কে বাবা?

সদানন্দ একেবারে নিচু হয়ে বুড়ির পায়ে হাত দিয়ে মাথায় ঠেকালে।

–আমি সদানন্দ। আমি নবাবগঞ্জের নরনারায়ণ চৌধুরীর নাতি, আর হরনারায়ণ চৌধুরী আমার বাবা।

কালীগঞ্জের বৌ তখন বিস্ময়ে হতবাক। যেন কথাটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছিল না বুড়ির।

বললে–তা আমার কাছে যে তুমি হঠাৎ? নায়েবমশাই কি তোমার হাত দিয়ে আমাকে টাকা পাঠিয়েছে?

সদানন্দ বললে–না

–তাহলে তুমি কী করতে এয়েছ?

–আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি কালীগঞ্জের বৌ! আমি বাড়ি থেকে চলে এসেছি। আমার কালকে বিয়ে, এবার থেকে আমি তোমার কাছেই থাকবো।

কালীগঞ্জের বৌ কথাগুলো শুনে কেমন যেন আকাশ থেকে পড়লো। কী করবে বুঝতে পারলে না। তখনও আহ্নিক সারা হয়নি তার। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল, এবার বসে পড়লো বুড়ি। বললে–তোমার বিয়ে? কাল?

–হ্যাঁ–

–তা কাল তোমার বিয়ে যদি হয় তো তুমি বাবা আজকে আমার বাড়িতে এলে কেন? কাল সকালেই তো তোমার গায়ে-হলুদ হবে, তখন তো তোমার খোঁজ পড়বে। তখন তো আমার নামেই দোষ পড়বে যে, আমি তোমাকে আমার কাছে আটকে রেখেছি। তা নায়েব মশাই জানে যে, তুমি আমার কাছে এসেছ?

সদানন্দ বললে–না। আমি কাউকেই জানাইনি এখানে আসার কথা। কাউকে আর জানাবোও না। আমি আর ও বাড়িতে যাবোও না।

কালীগঞ্জের বৌ বললে–তোমার হলো কী বাবা? তুমি কি বাড়ির সঙ্গে রাগারাগি করেছ?

–না কালীগঞ্জের বৌ, আমি তোমার এখানে থাকবো বলেই এসেছি। এবার থেকে আমি বরাবর তোমার এখানেই থাকবো। নবাবগঞ্জে আর যাবো না।

কালীগঞ্জের বৌ বললে–তুমি দেখছি ছেলেমানুষ আছ এখনও। আমার এখানে যে তুমি থাকবে তা খাবে কী? তুমি বড়লোকের বাড়ির ছেলে, আমি গরীব মানুষ, আমি কি তোমাকে খাওয়াতে পারবো বাবা? তুমি ছেলেমানুষি কোর না, বাড়ি চলে যাও। একে তো তোমার দাদু আমাকে দেখতে পারে না, এর পরে যদি তোমাকে আমার এখানে দেখতে পায় তো আমাকে আর আস্ত রাখবে না, আমাকে আর তোমাদের বাড়িতেও ঢুকতে দেবে না–

সদানন্দ জিজ্ঞেস করলে–তা তুমি দাদুর কাছে যাও কেন? কেন তুমি দাদুর কাছে ভিক্ষে করতে যাও? ভিক্ষে করতে তোমার লজ্জা করে না?

কালীগঞ্জের বৌ বললে–কিন্তু আমার পাওনা টাকা চাইতে যাওয়াও ভিক্ষে? তোমার দাদু তো আমার সর্বস্ব নিয়েছে। আমার জমি-জমা কিচ্ছু আর বাকি রাখে নি। কেবল এই ভিটেটুকু ছাড়া আর আমার নিজের বলতে কিছু নেই। আমার লাখ-লাখ টাকার সম্পত্তি সব তোমার দাদু নিয়ে নিয়েছে, তাই শেষকালে আমি অনেক কান্নাকাটি করাতে তোমার দাদু বলেছিল আমাকে হাজার দশেক টাকা দেবে। তাই শুনে আমি মামলা তুলে নিয়েছিলুম। তা এখন সেই টাকাটা চাওয়াও নাকি আমার অন্যায়! আমি তো আর দুদিন পরে মরে যাবো, তখন টাকা দিলে আমার কী লাভ হবে বলো বাবা? সে টাকা কি আমার ছেরাদ্দে খরচ হবে?

সদানন্দ বললে–তোমাকে কিছু বলতে হবে না, আমি সব জানি–

–তুমি সব জানো বাবা? সব জানো তুমি? বুড়ির যেন আনন্দে গলা বন্ধ হয়ে এলো।

সদানন্দ বললে–সব জানি বলেই তো আমি এসেছি–

–কী করে জানলে তুমি? কে বললে–তোমাকে? কে আমার এমন শুভাকাঙ্ক্ষী আছে বাবা? আমি জানতুম, আমার কেউ নেই। কর্তা গেছেন, নিজের পেটের দুটো ছেলে থাকলেও আজ আমার এই দুর্দশা হতো না। তাই ভাবি, মানুষ এমনি করেই মানুষের সর্বোনাশ করে? কই, তোমার দাদুর তো কোনও ক্ষতি হয়নি? তার তো ছেলে বেঁচে রয়েছে! তুমি তার নাতি, তোমারও তো কাল বিয়ে হবে, তারপর একদিন তোমারও ছেলে পুলে হবে, ঘর-সংসার ভরে উঠবে তোমাদের। তখন তো একবার কেউই ভাববে না কার টাকায় এসব হলো, কার সর্বোনাশ করে তোমাদের এত বাড়বাড়ন্ত হলো। কিন্তু আমার কী হলো? আমি তোমার দাদুর কাছে কী অপরাধ করেছি যে তিনি আমার এত বড় সর্বোনাশটা করলেন। দেখ বাবা, আমি তাই তাঁকে রাগের মাথায় শাপ দিয়ে এসেছি–

–শাপ দিয়ে এসেছো? কাকে?

–তোমার দাদুকে। ওই নায়েব মশাইকে রাগের মাথায় শাপ দিয়েছিলুম। শাপ দিয়ে বলেছিলুম যে আপনি নির্বংশ হবেনই, বামুনের শাপ নিষ্ফল হবে না। তা রাগ হলে কি মানুষের জ্ঞান থাকে বাবা? আমিও তাই রাগের মাথায় ওই কথা বলে ফেলেছিলুম। তাই আমার ওপর তোমার দাদুর অত রাগ। এখন বলছে আর টাকা দেবে না–

সদানন্দ বললে–আমি তোমার টাকা সব মিটিয়ে দেবো–আমি তোমাকে তো সেই কথা বলতেই এসেছি–

–তুমি আমার টাকা মিটিয়ে দেবে? তা আমি মরে গেলে আমার টাকা মিটিয়ে দিলে আমার কী লাভ? বেঁচে থেকেই যদি খেতে না পেলুম তো আমি মারা গেলে সে টাকা কে খাবে? ভূতে খাবে?

হঠাৎ একটা শব্দে সদানন্দর যেন চম ভাঙলো। হঠাৎ বাইরে কে যেন বলে উঠলো– ওরে বাজনা বাজা–বাজনা বাজা–

সঙ্গে সঙ্গে ঢোল বেজে উঠলো বাইরে। তখন সম্প্রদান হচ্ছে। পুরুতমশাই মন্ত্র পড়তে শুরু করেছেন–

যদিদং হৃদয়ং তব তদিদং হৃদয়ং মম

নয়নতারার হাতের পাতাটা ধরে আছে সদানন্দ আর পুরুতমশাই নিজের মনেই গড় গড় করে মন্ত্র পড়ে চলেছেন। কিন্তু একটা কথাও যেন আর তখন কানে যাচ্ছে না তার। তার তখন কেবল মনে পড়ছে সেই রাধার গাওয়া গানটা। রাণাঘাটের বাজারের রাধা।

আগে যদি প্রাণসখি জানিতাম
শ্যামের পীরিত গরল মিশ্রিত
কারো মুখে যদি শুনিতাম।
কুলবতী বালা হইয়া সরলা
তবে কি ও বিষ ভখিতাম ॥

সদানন্দর মনে হলো প্রকাশ মামার রাধা সেদিন গানটা ঠিক গায়নি। ‘শ্যামের পীরিত’ নয়, ওটা হবে ‘টাকার পীরিত’। টাকার পীরিত গরল মিশ্রিত বললেই যেন ঠিক হতো। টাকার জন্যেই তো আজ তার দাদু বড়লোক, টাকার জন্যেই তো তারা জমিদার, টাকার জন্যেই তো আজ এই সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হচ্ছে। অথচ এ টাকা তারও নয়, তার বাবারও নয়, তার দাদুরও নয়। এই সমস্ত যা কিছু তাদের সম্পত্তি সব তো কালীগঞ্জের বৌ-এর।

পুরুতমশাই তখনও মন্ত্র পড়িয়ে চলেছে–যদিদং হৃদয়ং তব, তদিদং হৃদয়ং মম, যদিদং হৃদয়ং তব তদিদং হৃদয়ং……

কোথা দিয়ে যে সেদিন কী ঘটে গেল তা সদানন্দ জানতেও পারলো না। কিম্বা হয়ত জানতে চাইলোও না। সব সময় প্রকাশ মামা পাশে দাঁড়িয়ে। কানের কাছে মুখ এনে বলতে লাগলো, কী রে, অমন গোমড়া মুখ করে আছিস কেন? কী হয়েছে তোর? দেখছিস কত মেয়েছেলে রয়েছে চারদিকে, একটু চেয়ে দেখ!

.

চৌধুরী মশাই ভোরের ট্রেনেই চলে এলেন। আসবার সময় প্রকাশকে কাছে ডাকলেন। প্রকাশ সারারাত জেগেছে। বিয়ের সম্প্রদান থেকে শুরু করে একেবারে বাসর-ঘর পর্যন্ত। নিরঞ্জন পরামাণিকও ছিল সঙ্গে। নিরঞ্জনের ঘুমোলে চলবে না। একেবারে বাসর-ঘরের দরজার সামনেই কাছাকাছি কোথাও থাকতে হবে। যেন সে নজর রাখে একটু। যেন সদানন্দ পাগলামি না করে।

প্রকাশ বলেছিল–অমিও তো আছি জামাইবাবু, আমি রাত্তিরে ঘুমোব না।

তা নিরঞ্জন আর প্রকাশ মামা দু’জনের ভরসাতেই চৌধুরী মশাই-এর জন্যে ব্যবস্থা-বন্দোবস্তের কোনও ত্রুটি রাখেননি। পাকা বন্দোবস্ত একেবারে। নিজে আলাদা বসিয়ে তাঁকে খাইয়েছেন। চৌধুরী মশাই যে নিজে আসবেন এটা কালীকান্ত ভট্টাচার্যের কাছে কল্পনার বাইরে ছিল। অত বড় রাশভারি মানুষটাকে নেহাৎ বেকায়দায় পড়েই ছেলের বরকর্তা হয়ে এত দূরে আসতে হয়েছে।

রাত্রে শুতে যাবার আগেও জিজ্ঞেস করলেন–তাহলে আমি শুতে যাই প্রকাশ?

প্রকাশ বললে–হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি শুতে যান জামাইবাবু। আপনি কী করতে জেগে থাকবেন? আমি তো আছি, আমি আছি, নিরঞ্জন আছে–

তবু যেন স্বস্তি পাচ্ছিলেন না চৌধুরী মশাই। বললেন–দেখো প্রকাশ, যেন আবার কেলেঙ্কারি না হয়!

প্রকাশ বলেলে–কেলেঙ্কারি? আমি থাকতে কী কেলেঙ্কারি হবে?

চৌধুরী মশাই বললেন–মানে আবার যদি খোকা পালিয়ে যায় সেই কথাই বলছি–

–আর পালাবে না।

চৌধুরী মশাই বললেন কীসে বুঝলে? প্রকাশ একটু ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হাসলো।

বললে–বুঝি জামাইবাবু, আমি বুঝি–

–খুলে বলো না কীসে বুঝলে?

প্রকাশ বললে–সদার বউ পছন্দ হয়েছে–

–তাই নাকি? খোকা তোমায় বললে?

প্রকাশ বিশেষজ্ঞের মত ভঙ্গি করে বলে উঠলো–ও কি আর মুখে বলবার জিনিস জামাইবাবু? ও বুঝে নিতে হয়।

চৌধুরী মশাই বললেন–তাহলে ত আর কোনও ভাবনাই নেই–

প্রকাশ বললে–না, কোনও ভাবনা নেই, আপনি নিশ্চিন্তে নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে যান।

এর পরে চৌধুরী মশাই-এর কোনও দুশ্চিন্তা ছিল না। তিনি তার নির্দিষ্ট বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন। তারপর সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে যাবার আয়োজন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। যাবার আগে আবার ডেকে পাঠালেন প্রকাশকে। শুধু প্রকাশ নয়, তার সঙ্গে নিরঞ্জন পরামাণিকও এলো।

তাদের জন্যেই চৌধুরী মশাই উগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিলেন।

বললেন–কী খবর প্রকাশ?

প্রকাশ বললে–যা বলেছিলুম তাই–

–তার মানে?

প্রকাশ বললে–তার মানে আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না, জিজ্ঞেস করুন এই নিরঞ্জনকে-একে বাসর-ঘরের কাছেই একটা বারান্দায় শুতে বলেছিলুম। ও শুয়ে শুয়ে সব শুনেছে–

চৌধুরী মশাই নিরঞ্জনের দিকে চাইলেন।

নিরঞ্জন বললে–হ্যাঁ বড়বাবু, শালাবাবু যা বলেছেন ঠিক বলেছেন। খোকাবাবু কাল বাসর-ঘরে কথা বলেছেন।

–কী কথা?

–আজ্ঞে বাসর-ঘরে কাল রাত্তিরে মেয়েরা গান গাইছিলেন তো, আমি বারান্দা থেকে সব শুনতে পাচ্ছিলাম। গানের পর মেয়েরা বরকে জিজ্ঞেল করলেন–গান কেমন লাগলো!

–তা খোকা কী উত্তর দিলে?

–খোকাবাবু মনে হলো খুব খুশী। খোকাবাবুর গলা শুনতে পেলুম। খোকাবাবু বললেন–খুব ভালো।

যাক, সুখবরটা শুনে চৌধুরী মশাই খুশী হলেন। তাহলে আর ভয় নেই।

প্রকাশ বললে–আমি তো আপনাকে আগেই বলেছিলুম জামাইবাবু, ও কনের মুখ দেখলে সদার সব পাগলামি বাপ বাপ বলে পালিয়ে যাবে। অমন ডানাকাটাপরী দেখলে মুনি-ঋষিদের ধ্যান পর্যন্ত ভেঙে যায় তো আমাদের সদা তো কোন্ ছার–

ততক্ষণে ট্রেন ছাড়বার সময় হয়ে গিয়েছিল। চৌধুরী মশাই আর থাকতে পারলেন না। ট্রেনে ওঠবার আগে প্রকাশ চৌধুরী মশাই-এর গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। বললে–একটা কথা ছিল জামাইবাবু–

–কী?

–কিছু টাকার দরকার ছিল। আজ তো আবার বর-কনেকে নিয়ে যেতে হবে। অনেক খরচ হবে। মেয়েদের শয্যা-তুলুনি আছে, ওদের পরামাণিককে কিছু টাকা দিতে হবে। তারপর…..

চৌধুরী মশাই বললেন–কিন্তু তোমার হাতে যে কাল তিনশো টাকা দিলুম–

–আজ্ঞে তিনশো টাকায় কী হবে? সে টাকা তো আছে। তবু হাতে একটু বেশি টাকা থাকলে বুকে বল-ভরসা হয়–

চৌধুরী মশাই জামার ভেতরের পকেট থেকে কয়েকখানা নোট বার করলেন। করে এক এক করে গুনতে লাগলেন। বার বার গুনে বললেন–এই নাও—

প্রকাশ টাকাটা নিয়ে বললে–কত?

–আরো একশো দিলাম—

–একশো মোটে? একশোতে কী হবে?

চৌধুরী মশাই বললেন–তা এত টাকা তোমার কীসে লাগবে শুনি? রজব আলী তো ইস্টিসানে এসে হাজির থাকবে, তারপর পালকি-ভাড়া বর-কনে বাড়ি পৌঁছুলে সব মিটিয়ে দেব–

তা তাই-ই সই। নোট ক’খানা গুনে প্রকাশ সেগুলো পকেটে পুরে ফেললে। টাকা নিয়ে বেশি ছেঁড়াছিঁড়ি করতে নেই তা প্রকাশ জানে। তাতে কাজ হাঁসিল হয় না।

তারপর ট্রেন ছেড়ে দিলে।

এসব কবেকার ঘটনা। আজ এতদিন পর অতীতের সমস্ত পথগুলো পরিক্রমা করতে গিয়ে সেদিনকার সব কিছু খুঁটিনাটি ঘটনাগুলো মনে পড়তে লাগলো সদানন্দ চৌধুরীর। সেদিনকার সেই ছেলেটাকে যেন চেষ্টা করলে এখনও চেনা যায়। চেনা যায় তার ছোটখাটো কথা আর মানুষের সঙ্গে ব্যবহারের ঘটনাগুলো। অথচ কেউই তাকে চিনতে পারেনি। তার দাদু, তার বাবা, মা, প্রকাশ মামা, সবাই তাকে তাদের প্রচলিত নিয়মের বেড়াজাল দিয়ে ঘেরা পৃথিবী থেকে নির্বাসন দিয়েছিল। নির্বাসন দিয়ে তার মাথার ওপর শাস্তির বোঝা চাপিয়ে দিয়ে সমস্ত দায় থেকে নিজেদের বিবেককে মুক্ত করতে চেষ্টা করেছিল। তারা ভেবেছিল তাদের ছাঁচে সদানন্দকে ঢালাই করে শুধু বংশবৃদ্ধির প্রয়োজনে তাকে বাঁচিয়ে রাখবে। সদানন্দ তাদের প্রতিনিধি হয়ে দিনের পর দিন সেই একই নিয়মের পুনরাবৃত্তি করে যাবে, যে-নিয়মের প্রবর্তন করে এসেছে সমস্ত মানুষ জাতের পূর্বপুরুষ। সদানন্দ সেই দিন থেকেই ভেবেছিল এতদিনকার সেই নিয়ম সে ভাঙবে। সে ভেবেছিল সে বলবে আমি তোমাদের কেউ নই! তোমাদের পাপের ভাগীদার যেমন আমি নই, তেমনি তোমাদের পুণ্যের ভাগীদারও নই আমি। তোমাদের সমস্ত পাপ-পুণ্যের দুষ্কৃতি-সুকৃতি নিয়ে তোমরা সুখে থাকো, শুধু আমাকে মুক্তি দাও তোমরা। আমি যেমন তোমাদের সাহায্য চাই না তেমনি চাই না তোমাদের উত্তরাধিকারের অধিকারও।

অথচ সমস্ত অপরাধ থেকে দায়মুক্ত হয়েও আজ সে একজন আসামী। ভাগ্যের বোধ হয় এও এক বিচিত্র পরিহাস।

.

ভদ্রলোক পাশে পাশে আসছিল। ভদ্রলোক সারাজীবন আসামী আর ফরিয়াদী নিয়ে জীবন কাটিয়েছে। অনেক আসামী দেখেছে আবার অনেক ফরিয়াদীও দেখেছে। কিন্তু এমন আসামী আর দেখেনি।

বললে–একটু পা চালিয়ে চলুন–পা চালিয়ে চলুন–

সদানন্দবাবু হাসলেন। যেন পা চালিয়ে চললেই বেশি এগিয়ে যাওয়া যায়। তার দাদু, তার বাবা, তার মা, তার প্রকাশ মামা, তার দাদামশাই, সবাই তো সংসারে একটু পা চালিয়েই চলতে চেয়েছিল। তারা সবাই-ই ভেবেছিল পা চালিয়ে চললেই বুঝি তারা আরো একটু এগিয়ে যেতে পারবে। ভেবেছিল আরো টাকা, আরো ক্ষমতা, আরো আয়ু পাবে আর একটু পা চালিয়ে চললেই। তারা পা চালিয়েই চলতে চেয়েছিল, কিন্তু থেমে থেমে এগিয়ে যাওয়ার প্রজ্ঞা তাদের আসেনি। তারা জানতো না যে যারা থেমে থাকে তারাই চলা লোকদের হারিয়ে দিয়ে এগিয়ে যায়।

আশ্চর্য, শেষ পর্যন্ত তাই-ই হয়েছিল তাদের। তাদের সকলের।

সদানন্দর মনে আছে রসিক পালের বাড়িতে যেমন আজকে কাছারির পেয়াদা এসে হাজির হয়েছে সমন নিয়ে, ঠিক তেমনিই একদিন ওই প্রকাশ মামা তার কাছে এসে হঠাৎ হাজির হয়েছিল। সদানন্দ তখনও এখনকার মত নিঃস্ব নিঃসহায়। কলকাতার এক ধর্মশালায় তখন অন্নদাস হয়ে জীবন কাটছে তার।

প্রকাশ মামা তাকে দেখে অবাক। বললে–আমি তো তোকে খুঁজতেই বেরিয়েছি রে? তুই এখানে রয়েছিস?

সদানন্দ বললে–কেন? আমার সঙ্গে আবার তোমার কী দরকার?

প্রকাশ মামা বললে–তোর জন্যে কোথায় কোথায় গিয়েছি জানিস?

সদানন্দ বিরক্ত হয়ে উঠলো প্রকাশ মামার ওপর। বললে–ও-সব কথা থাক, তুমি আমার খোঁজ করছো কেন তাই বলো।

প্রকাশ মামা বললে–কেন, তোর এত তাড়া কিসের? আমি তো তোর ভালোর জন্যেই এসেছি, আমার নিজের তো কিছুই না–

সদানন্দ বললে–আমার তুমি অনেক ভালো করেছ মামা, আর আমার ভালোর দরকার নেই। তুমি আমার ভালোর জন্যেই আমার বিয়ে দিয়েছিলে, আমার ভালোর জন্যেই তোমরা আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলে, তোমরা আমার ভালোর জন্যেই কপিল পায়রাপোড়াকে ভিটে মাটি ছাড়া করেছিলে, আর আমার ভালোর জন্যেই তোমরা কালীগঞ্জের বৌ-এর সর্বনাশ করেছিলে, আবার আমার ভালোর জন্যেই তোমরা সেই বংশী ঢালীকে দিয়ে তাকে খুনও করিয়েছিলে। দয়া করে তোমরা আর ভালো করতে চেয়ো না মামা। আমার যথেষ্ট ভালো করেছ, আর ভালো করতে হবে না

কথাগুলো প্রকাশ মামার ভালো লাগলো না। বললে–তুই তো বেশ কথা বলতে শিখেছিস, অথচ জামাইবাবু বলতো–তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এখন তো বেশ সেয়ানা মানুষের মত কথা বলছিস তুই!

সদানন্দর বেশী কথা বলতে সেদিন ভালো লাগেনি।

বললে–তুমি কি করতে আমার কাছে এসেছ তাই আগে বলো—

প্রকাশমামা হঠাৎ বলে উঠলো–তোর বাবা মারা গেছে–

খবরটা শুনে সদানন্দর চমকে যাওয়া উচিত ছিল। অন্তত কিছুটা হতবাক হওয়া। কিন্তু সেদিন কিছুই হয়নি তার। সে শুধু প্রকাশমামার মুখের দিকে খানিকক্ষণ হাঁ করে চেয়ে রইল। আর যেন কিছু করবার ছিল না তখন তার।

প্রকাশমামা বললে–আমি এখন নবাবগঞ্জ থেকে আসছি। সেখানেও তোকে খুঁজতে গিয়েছিলাম। শেষকালে এলুম কলকাতায়। ভাবলুম এখানে তোকে কোথাও পাবো। তা এখেনেও অনেক জায়গায় খুঁজেছি। শেষে ভাগ্যি ভালো তাই হঠাৎ বউবাজারের সেই পুলিসের বড়বাবুর বাড়িতে গিয়েছিলুম মানদা মাসির খোঁজে। সেখানে তাদের বাড়ির চাকর মহেশের কাছে এই ধর্মশালার খবর পেলুম। তা এখন চল্ আমার সঙ্গে–

–কোথায়?

–ভাগলপুরে। তোর মামার বাড়িতে।

–সেখানে গিয়ে কী হবে? আমার কেউ নেই, আমি কোথাও যাবো না।

প্রকাশমামা বললে–কেউ নাই বা থাকলো, কিন্তু তোর বাবার সম্পত্তি তো আছে। অত লাখ টাকার সম্পত্তি তুই ছেড়ে দিবি! সে-সম্পত্তি তো সবই তোর রে, তুই তো বাবার একমাত্র ছেলে, একমাত্র ওয়ারিশন

–কিন্তু টাকা নিয়ে কী করবো? আমার টাকার দরকার নেই—

কিন্তু সদানন্দ ছাড়তে চাইলেও প্রকাশমামা ছাড়বার লোক নয়। বললে–তুই টাকা না নিলে কে নেবে সে টাকা? এত টাকার সম্পত্তি ছেড়ে দিয়ে তুই ধর্মশালায় বসে বসে ভ্যারেণ্ডা ভাজবি? আর টাকা যদি তুই না নিস তো আর কাউকে দানপত্র করে দে! আমি গরীব লোক, তোর টাকার দরকার না থাকতে পারে, কিন্তু আমার তো টাকার দরকার আছে রে, আমি তো আর তোর মত সন্নিসী হয়ে যাইনি! তোর না হয় মাগ ছেলে কেউ নেই, কিন্তু আমার তো আছে!

এতক্ষণে সদানন্দ বুঝলো কিসের তাগিদে প্রকাশমামা তার খোঁজে সেই ভাগলপুর থেকে বেরিয়ে সারা দেশ ঘুরে কলকাতায় এসেছে। আর কলকাতা কি ছোট জায়গা! কলকাতার মত জায়গায় কি কাউকে খুঁজে বার করা সহজ! যতদিন মা বেঁচে ছিল ততদিন প্রকাশমামার টাকার অভাব হয়নি। দিদির কাছে হাত পেতেছে আর টাকা নিয়ে পকেটে পুরেছে আর রাণাঘাটের বাড়িতে গিয়ে ফুর্তি করেছে। সারা জীবনটাই ফুর্তি করে বেড়িয়েছে প্রকাশমামা। এখন যখন তার জামাইবাবু মারা গেছে এখন এসেছে ভাগ্নের খোঁজে। এখন ভাগ্নের জন্যে দরদ উথলে উঠেছে তার।

সেই জন্যেই তো অনেকদিন ধরে সে ভেবেছিল যে সে তার জীবন কাহিনীটা লিখে যাবে। লিখে যাবে যে, সে পাগল নয়। পাগল তোমরা। যে পৃথিবীতে মানুষ মানুষকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে, যে-মানুষ কেবল কপিল পায়রাপোড়াদের গলায় দড়ি দিতে সাহায্য করে, যে-মানুষ কেবল কালীগঞ্জের বউদের বঞ্চনা করে নিজের পুঁজিপাটা বাড়ায় সেই মানুষ পাগল না হয়ে পাগল হয় কিনা সদানন্দ!

সদানন্দ বলেছিল–তা হলে চলো—

প্রকাশমামা সেদিন আদর করে সদানন্দকে ভাগলপুরে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তখন কি প্রকাশমামা জানতো যে তার জামাইবাবুর সমস্ত সম্পত্তি অন্য একজনের ভোগে লাগবে। জানলে বোধ হয় আর ভাগ্নের সন্ধানে আসতো না প্রকাশ রায়।

কিন্তু সে-সব কথা এখন যাক্। সে-সব অনেক পরের কথা। তখন নয়নতারারও অনেক বয়েস হয়েছে। তারও তখন নতুন করে সংসার হয়েছে। সে-সব কথা বলবার সময় পরে অনেক পাবো। এখন আজকের কথা বলি। এই নয়নতারার বিয়ের কথা।

এই নয়নতারার বিয়ের দিনে সে-সব বিপর্যয়ের কথা ভাবতে নেই। সে-সব অকল্যাণের কথা এই শুভদিনে বুঝি ভাবাও অন্যায়। আজ শুধু আনন্দ করো তোমরা সবাই। আজ শাঁখ বাজাও, আজ উলু দাও, আজ বলো–যদিদং হৃদয় তব তদিদং হৃদয় মম, যদিদং হৃদয়ং তব তদিদং হৃদয়ং মম—

আজ কালীকান্ত ভট্টাচার্যের একমাত্র সন্তানের বিয়ে। যে নয়নতারার রূপ দেখে সকলের চোখের পাতা পড়তে চাইতো না, যে-মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে পণ্ডিতমশাই আর তার গৃহিণীর রাত্রে ঘুম ছিল না, সেই নয়নতারারই আজ বিয়ে। সেই বিয়েতে তোমরা আজ এসো, এসে নয়নতারাকে আশীর্বাদ করো। বলো–তুমি জন্ম-জন্ম স্বামী-সোহাগিনী হয়ে শ্বশুর-শাশুড়ীর সেবা করে অক্ষয় পুণ্য অর্জন করো মা। আশীর্বাদ করো–আমার নয়নতারা যেন সুখী হয়, আমার নয়নতারা যেন স্বামী-সোহাগিনী হয়। আশীর্বাদ করো–আমার। নয়নতারা যেন সিঁথির সিঁদুর নিয়ে জন্ম-জন্ম এয়োস্ত্রী হয়ে কাটায়–

তখন বেলা বেড়েছে।

প্রকাশমামা বেয়াই-মশাইকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। বললে–কোথায়, বেয়াই মশাই কোথায়?

কালীকান্ত ভট্টাচার্য কদিন থেকেই ব্যতিব্যস্ত। তাঁর বিশ্রাম নেই, তাঁর দুশ্চিন্তারও শেষ নেই। কোন্ দিক দেখবেন ঠিক করতে পারছেন না। প্রকাশমামার কাছে আসতেই প্রকাশমামা একেবারে ঠেস দিয়ে বলে উঠলেন কী বেয়াই মশাই, এখন জামাই পেয়ে যে আমাকে একেবারে চিনতেই পারছে না দেখছি–আমি খেলুম কি খেলুম না, কিছুই দেখছেন না আর–

–না না, সে কী কথা বেয়াই মশাই, আপনিই তো সব! আপনি না থাকলে কি এ বিয়ে হতো?

প্রকাশমামা বললে–তা কেমন জামাই হলো বলুন? পছন্দ হয়েছে তো?

–আপনিই বলুন আপনার বৌমা কেমন হলো?

–আপনিই বেয়াই মশাই কেবল আপনার নিজের মেয়ের গর্বেই গেলেন। কেন, আমাদের ছেলে কি ফ্যাল্‌না?

কালীকান্ত ভট্টাচার্য বললেন–না, তা কেন বলবো। আমার নয়নতারার অনেক পুণ্যফল ছিল তাই অমন স্বামী পেয়েছে। আমাদের কেষ্টনগরের সবাই একেবাক্যে বরের প্রশংসা করে গেছেন।

প্রকাশমামা বললে–তা হলে যাত্রার সময়টা কখন?

কালীকান্ত ভট্টাচার্য বললেন–পুরুতমশাই তো পাঁজি দেখে সময় ধার্য করে দিয়েছেন।

–দেখবেন যেন বেশী দেরি না হয়, ওদিকে আবার রাণাঘাট থেকে ট্রেন বদল করতে হবে। সে ট্রেন মিস্ করলেই মুশকিল–

কালীকান্ত ভট্টাচার্য বললেন–না, সেদিকে কোনও গোলযোগ হবে না। আমি আমার লোক দিয়ে ট্রেন ধরিয়ে দেব

তারপর হঠাৎ যেন কী মনে পড়ে গেল। বললেন–আপনি সিগারেট-টিগারেট ঠিক পাচ্ছেন তো?

–কোথায় আর পাচ্ছি! আপনি জামাই পেয়ে গেছেন, এখন আর আমাকে কে দেখবে, আমি তো এখন পর হয়ে গেছি

কালীকান্ত ভট্টাচার্য মশাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন।

–ওরে কে আছিস? ও নিতাই, ও কেষ্টধন, ও বিপিন, কে রে ওদিকে? বেয়াই মশাইকে সিগারেট দেয়নি কেউ? যেদিকে আমি দেখবো না সেই দিকেই গাফিলতি, ওরে কেষ্টধন………

বলতে বলতে ভেতর বাড়ির দিকে সিগারেটের সন্ধানে চলে গেলেন।

নিরঞ্জন এতক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সে এতক্ষণে কাছে এল। বললে–শালাবাবু, এদিকে এক কাণ্ড হয়েছে–

–কাণ্ড? কীসের কী কাণ্ড?

নিরঞ্জন বললে–তেমন কিছু কাণ্ড নয়। ছোটবাবু এয়োদের সব বলে দিয়েছে–

–কী বলে দিয়েছে সদা?

–বলে দিয়েছে যে, পরশু ছোটবাবু কালীগঞ্জের বৌ-এর কাছে গিয়েছিল, সেইজন্যে গায়ে হলুদের সময় বাড়ি ছিল না।

প্রকাশমামা অবাক হয়ে গেল সদার বোকামি দেখে। বললে– সে কি রে? বলে দিয়েছে?

–হ্যাঁ।

–তুই জানলি কী করে?

–আমাকে ওদের নাপিত বিপিন জিজ্ঞেস করছিল। ছোটবাবুকে নাকি বাসরঘরে মেয়েরা জিজ্ঞেস করেছিল– গায়ে-হলুদের সময় তুমি কোথায় গিয়েছিলে? তা ছোটবাবু নাকি বলেছে–কালীগঞ্জের বৌ-এর কাছে। তাই মেয়ে-মহলে কানাঘুষো হয়েছে। তাই বিপিন জানতে চাইছিল আমার কাছে কালীগঞ্জের বউ কে? কালীগঞ্জের বৌ-এর বয়েস কত, এই সব…..

–তা তুই কী বললি?

নিরঞ্জন বললে–আমি আর কী বলবো। আমি শুধু বললুম সে এক বুড়ি থুত্থুড়ি মেয়েমানুষ।

তা জিজ্ঞেস করলে না বর কেন গিয়েছিল সেখানে?

–না, তা জিজ্ঞেস করেনি। আর জিজ্ঞেস করলেও তো আমি কিছু বলতে পারতুম না! আমি বলতুম বর কালীগঞ্জের বৌ-এর কাছে কেন গিয়েছিল তা আমি নাপিত মানুষ কী করে জানবো?

প্রকাশমামা কথাটা শুনে নিশ্চিন্ত হতে পারলো না। নিরঞ্জনকে সেখানে ছেড়ে ভেতর বাড়ির দিকে ছুটলো। ভেতরে তখন অনেক মেয়ে-পুরুষের ভিড়। প্রকাশমামা সেই দিকে যেতেই মেয়েরা মাথার ঘোমটা টেনে দিলে।

কে একজন দৌড়ে এসে প্রকাশমামার দিকে সিগারেট বাড়িয়ে দিলে। বললে–নিন সিগারেট নিন–

সিগারেট নিয়ে প্রকাশমামা বললে–সিগারেট নিচ্ছি, কিন্তু বর কোথায় গো তোমাদের? একবার ডেকে দাও তো আমার কাছে–কী করছে এখন বর?

সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ের মধ্যে রাস্তা হয়ে গেল বেয়াই মশাইয়ের জন্যে। বরকর্তা বরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। একটু জায়গা ছাড়ো গো, রাস্তা দাও। ও রাঙাদিদি, একটু নড়ে বোস, একটু গতর ওঠাও। বরকর্তা বরের সঙ্গে কথা বলতে এসেছে–

চারিদিকে বাসি লুচি আর তরকারির গন্ধ। ছোট বাড়িতে লোক বেশি হলে যা হয় সেই অবস্থা। শেষকালে বরের ঘরে যেতেই দেখলে সদানন্দ একটা তাকিয়া হেলান দিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে আছে। সারারাত ঘুম না হলে যেমন হয় সেই রকম চেহারা। উস্কোখুস্কো চুল। স্রিয়মাণ হয়ে বসে ছিল সে আর সামনে অনেকগুলো মহিলা।

–সদা!

প্রকাশমামার গলা শুনে যেন অকূলে কূল পেলে সদানন্দ। মুখ তুলে চাইলে। বললে–কী?

প্ৰকাশমামা বললে–একবার আমার সঙ্গে এদিকে আয় তো।

সদানন্দ সমস্ত রাত এতটুকুও ঘুমোয়নি। সমস্ত রাতই মেয়েরা বিরক্ত করেছে, কথা বলেছে। গান গাইবার জন্যে পীড়াপীড়ি করেছে। এক-একবার তার মনে হয়েছে এখান থেকে সে অন্য কোথাও চলে যায়। কিন্তু কেমন করে যাবে! এতগুলো অচেনা লোকের মধ্যে কাটিয়ে খুব আড়ষ্ট হয়ে ছিল। এবার প্রকাশমামাকে দেখে যেন একটু সহজ হলো।

প্রকাশমামা আগে আগে চলতে লাগলো। সদানন্দও তার পেছন-পেছন।

প্রকাশমামা চলতে চলতে পেছন না ফিরেই জিজ্ঞেস করলে–রাত্তিরে তোর ঘুম হয়েছিল রে?

সদানন্দ বললে–-না–

–ঘুম হয়নি ভালোই হয়েছে। আমার বিয়ের সময় আমারও বাসর-ঘরে ঘুম হয়নি। ওর জন্যে ভাবিসনি। কেমন বৌ দেখলি? পছন্দ হয়েছে তো?

বাসর-ঘরের মধ্যে একজন কে বলে উঠলো–ও লো, ও লোকটা বরের কে লো?

কনের এক মাসী বললে–ওই তো হলো আসল কর্তাগো, বরকর্তা, বরের মামা। ওই মামাই তো এই বিয়ের সম্বন্ধটা করেছে–

প্রকাশমামা সদানন্দকে নিয়ে তখন বার বাড়ির একটা ঘরের একান্তে এসে দাঁড়ালো। আশে-পাশে কেউ নেই দেখে প্রকাশমামা বললে–আয় বোস, এখানটা একটু নিরিবিলি মতন আছে—

.

কালীগঞ্জের জমিদার হর্ষনাথ চক্রবর্তী প্রায়ই গৃহিণীকে বলতেন–তোমার ভাবনা কী, দুই ছেলে রইলো, তারাই তোমাকে দেখবে–

চক্রবর্তী মশাই-এর একবার শরীর ভেঙে গিয়েছিল। প্রায় যায়-যায় অবস্থা। তখন গৃহিণী বড় মুষড়ে পড়েছিলেন। তখন থেকেই কেমন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন জমিদারিই থাক আর টাকাকড়ি থাক মানুষের জীবন এই আছে এই নেই। বুঝতে পেরেছিলেন এই এত শক্ত-সমর্থ মানুষটা এ ক-দিনের অসুখেই যদি এমন কাতর হয়ে পড়েন তা হলে আসল হচ্ছে স্বাস্থ্য, আসল হচ্ছে পরমায়ু। আর সব চেয়ে আসল সত্য হচ্ছে ভগবান। তাই তখন থেকেই চক্রবর্তী-গৃহিণী পূজো-পাঠ নিয়ে মেতে উঠলেন।

অসুখ মানুষের হয় বটে, কিন্তু আবার সেরেও ওঠে একদিন। সেই মানুষ গৃহিণীর কাতরতা দেখে অভয় দিতেন। বলতেন–তোমার ভাবনা কী বৌ, আমি না-ই বা থাকলুম, তোমার দুই ছেলে তো রইল, ওরাই তোমাকে দেখবে–

গৃহিনী বলতেন–ওরা আর কত বড়, ওরা কী-ই বা বোঝে–

চক্রবর্তী মশাই বলতেন–যতদিন ওরা বড় না হয় ততদিন নারায়ণ আছে, আমার নায়েবমশাই আছে–

চক্রবর্তী মশাই নরনারায়ণকে নারায়ণ বলে ডাকতেন।

কিন্তু আশ্চর্য মানুষের জীবন, আর আশ্চর্য মানুষের বিশ্বাস! মানুষের জীবনেরও যেমন স্থিরতা নেই, মানুষের বিশ্বাসেরও তেমনি কি কোনও স্থিরতা থাকতে নেই? সত্যিই কত না বিশ্বাস করতেন তিনি নায়েব মশাইকে! আর নিজের নায়েবকেই যদি বিশ্বাস না করতে পারবো তো কাজকর্মই বা চলবে কেমন করে!

আর নরনারায়ণও ছিলেন তেমনি বিশ্বস্ত নায়েব। হিসেবের একটা পয়সা যেন তার এদিক ওদিক হতে নেই। নিজের ছেলেকেও বোধ হয় অমন করে বিশ্বাস করা যায় না যতখানি বিশ্বাস করা যেত নরনারায়ণ চৌধুরীকে। সেই পনেরো টাকা মাইনের কর্মচারী সেদিন যে শুধু বিশ্বাসী ছিলেন তাই-ই নয়, পিতার মতন ভক্তিশ্রদ্ধাও করতেন চক্রবর্তী মশাইকে।

যখন সেই চক্রবর্তী মশাই একদিন হঠাৎ মারা গেলেন তখন তাঁর গৃহিণীর মাথায় আকাশ থেকে একেবারে বাজ ভেঙে পড়লো। দুইটি মাত্র নাবালক ছেলে তখন তাঁর। কিন্তু তারা জমি-জমার কাজকর্ম কিছুই বোঝে না। ওই নরনারায়ণই তখন একমাত্র ভরসা। ওই নরনারায়ণই তখন গৃহিণীর কাছে এসে সান্ত্বনা দিয়েছিল। বলেছিল–আপনি কাঁদবেন না মা, আমি তো আছি, আপনার ভাবনা কী! আমি আপনার ছেলের মতন

তাই সেদিন রাত্রে যখন সেই নায়েব-মশাইয়ের নাতিই তার কাছে এসে হাজির হলো তখন তার মনে পড়তে লাগলো সেইদিনকার কথাগুলো। সেই কথাগুলো যেন তখনও তাঁর কানে বাজছে–আপনি কাঁদবেন না মা, আমি তো আছি, আপনার ভাবনা কী, আমি আপনার ছেলের মতন–

তা সেদিনকার সেই নারায়ণ এখন নরনারায়ণ হয়ে নবাবগঞ্জের জমিদার হয়েছে। নারায়ণ তখন সকাল বেলা রোজ এসে চক্রবর্তী মশাই-এর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতো। আপত্তি করলে নারায়ণ বলতো–আপনি আমাকে পায়ে হাত দিতে আপত্তি করবেন না, আমার বাবা-মা নেই, আপনারাই আমার বাবা-মা, সব কিছু–

তখন কত বিনয়ী ছিল নারায়ণ। মাঝে মাঝে নানান কাজে বাড়ির মধ্যেও আসতো। এসে বাড়ির ছেলের মত ব্যবহার করতো। চক্রবর্তী মশাই-এর গৃহিণীর কাছে এসে ছেলেমানুষের মত খেতে চাইতো।

বলতো-মা-জননী, কিছু খেতে দিন আমাকে, আমার বড় ক্ষিদে পেয়েছে–

তখন অনেক সময় দিনের পর দিন কালীগঞ্জেই থেকেছে নারায়ণ, জমি-জমা-হিসেব পত্র কিংবা মামলা-মকর্দমার কাজে অনেক সময় আহার-নিদ্রা ত্যাগ করে বুক দিয়ে খেটেছে। কখনও মাইনে বাড়াতে পর্যন্ত বলেনি। চক্রবর্তী মশাই তার মাইনে বাড়ানও নি। তা মাইনের দরকারই বা তার কী ছিল? খাওয়া-দাওয়া-থাকা-শোওয়া থেকে শুরু করে জামা কাপড় সবই তো তিনি দিতেন। পাল-পার্বণে নারায়ণের কাপড়-জামা-গামছা ছিল বাঁধা।

কিন্তু সেই নারায়ণই আবার অন্য রকম হয়ে গেল চক্রবর্তীমশাই-এর মৃত্যুর পর। মাঝে মাঝে মা-জননীর মনে হতো অমন করে নায়েব মশাইকে বিশ্বাস না করলেই ভালো হতো হয়তো। কিন্তু তখন সেই বিপদের দিনে তিনি মেয়েমানুষ হয়ে বিশ্বাস না করেই বা কী করতেন!

একদিন গিয়েছিলেন নবাবগঞ্জে। দেখে অবাক হয়ে গেলেন। এত বড় বাড়ি করেছে নারায়ণ! এত লোকজন! মনিবের বিধবা গৃহিণীকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল নারায়ণ।

বললে–আপনি আবার এলেন কেন মা-জননী?

মা-জননী বললেন–না এসে কী করবো বাবা, কতবার তোমার কাছে লোক পাঠিয়েছি, তুমি একবার দেখাও করলে না। তাই নিজেই এলুম–আমার জমিজমার হিসেব-টিসেবগুলো একবার দেখতুম। আমার কী আছে না-আছে তাও বুঝতে পারছি না। আমার যদি টাকা কড়ি থাকতো ব্যাঙ্কে তাহলে তোমাকে আর এমন করে বিরক্ত করতাম না বাবা-নেহাত বিপাকে পড়ে তোমার কাছে এসেছি–

নারায়ণ বললে–আপনি আজকে যান, আমি আপনাকে যা বোঝাবার একদিন কালীগঞ্জে গিয়ে সব বুঝিয়ে দিয়ে আসবো। আপনাকে আর কষ্ট করে আসতে হবে না–

নায়েবমশাই-এর কথায় বিশ্বাস করে সেদিন চক্রবর্তী গৃহিণী ফিরে চলে গেলেন। কিন্তু নারায়ণ আর এলো না। তাঁর কথা রাখলো না। তার স্বামীর অত বড় সম্পত্তি যে কোথায় কর্পূরের মত উড়ে গেল কেমন করে সব অদৃশ্য হয়ে গেল তা তিনি জানতেও পারলেন না। লোকে বলতে লাগলো–কালীগঞ্জের নায়েব জমিদারকে ঠকিয়ে নবাবগঞ্জে নিজের জমিদারি করেছে।

যারা ভালোমানুষ লোক তারা জিজ্ঞেস করলে কালীগঞ্জের বৌকে নায়েব ঠকালে কী করে? বৌ জানতে পারলে না?

লোকে বললে–আরে, বউ তো ভালো মানুষ, তার ছেলে মেয়ে-জামাই কেউ নেই, কী করে জানতে পারবে?

তা সত্যি কথা। কালীগঞ্জের বউ কি কোর্ট-কাছারি করবে? নায়েবের নামে কাছারিতে নালিশ করবে?

কিন্তু নরনারায়ণ চৌধুরীকে যত খারাপ লোক ভাবা গিয়েছিল তত খারাপ সে নয়। কালীগঞ্জের বউ যখন টাকার তাগাদায় আসতো তখন তাকে নারায়ণ একেবারে খালি হাতে ফিরিয়ে দিত না। কখনও দশ টাকা, কখনও পাঁচ টাকা, আবার কখনও বা পঞ্চাশ টাকাও দিয়েছে। বলেছে–আর তোমার এখানে আসতে হবে না মা জননী, এবার আমি সব টাকাটা নিজে গিয়ে তোমাকে দিয়ে আসবো

কথাটা শুনে কালীগঞ্জের বউ-এর চোখে জল এসে গিয়েছিল।

বলেছিল–তুমি নিজে গিয়ে দিয়ে এলে তো খুবই ভালো হয় বাবা, আমার তাহলে আর এ হেনস্থা হয় না।

নরনারায়ণও ভেবেছিলেন বুড়ি আর কদিনই বা বাঁচবে! এই রকম স্তোক বাক্য দিয়ে দিয়ে যতদিন কাটানো যায়। তারপর একদিন বউ মারা যাবে। তখন আর কেউই তাগাদা করতে আসবে না। তখন একেবারে চিরকালের মত নিশ্চিন্ত।

কিন্তু কালীগঞ্জের বউ-এরও বোধ হয় অক্ষয় পরমায়ু। তারপর সেই নারায়ণের সন্তান হলো। সেই সন্তানের আবার বিয়েও হলো। তারও আবার ছেলে হলো। কিন্তু পাওনা টাকা কালীগঞ্জের বউ পেলে না। তখনও আসতো সেই কালীগঞ্জের বউ। তার আসার খবর পেয়েই নরনারায়ণ চৌধুরী রেগে যেতেন।

বলতেন–আবার এসেছে বুড়ি?

কৈলাস গোমস্তা বলতো–চলে যেতে বলবো?

কর্তাবাবু বলতেন–হ্যাঁ হ্যাঁ চলে যেতে বলো। বলো আমার শরীর খারাপ, এখন দেখা হবে না।

সেই সময়েই একদিন ছোট একটা ছেলে পালকির কাছে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। বলেছিল– আমি পালকিতে চড়বো–

কালীগঞ্জের বউ বলেছিল–এ কে গো? কার ছেলে?

দীনু বলেছিল–এই তো কর্তাবাবুর নাতি–

কালীগঞ্জের বউ সদানন্দকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করে বলেছিল–তুমি পালকি চড়বে?

সদানন্দ বলেছিল—হ্যাঁ–

সেদিন সদানন্দকে পালকিতে চড়িয়েছিল কালীগঞ্জের বউ। পালকি চড়ে সদানন্দ খুব সুখী। বলেছিল–আমাকে আরো দূরে নিয়ে চলো একেবারে নদীর ঘাটের দিকে।

নদীর ধারে গেলে যদি তোমার দাদু বকে?

সদানন্দ বলেছিল–বকুক গে। আমি দাদুকে ভয় করি না–

সেইদিনই কালীগঞ্জের বউ ছোট ছেলেটার সাহস দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। দীনু বলেছিল–খোকাবাবু কাউকে ভয় করে না, খুব দুষ্টু হয়েছে–

সেই-ই প্রথম পরিচয়। তারপর যতবার কালীগঞ্জের বউ নবাবগঞ্জে তাদের বাড়িতে এসেছে, ততবারই পালকি চড়বার বায়না ধরেছে। আর তাকে পালকিতে চড়িয়ে ঘুরিয়ে দিয়েছে কালীগঞ্জের বউ। পালকি চড়বার কেমন একটা নেশা হয়েছিল সদানন্দর। এলেই দৌড়ে যেত সদানন্দ। পালকিটা আসতে দেখলেই সদানন্দ চিনতে পারতো। ডাকত–ও কালীগঞ্জের বউ, কালীগঞ্জের বউ–

কালীগঞ্জের বউ পালকি থেকে নেমেই সদানন্দকে কোলে করতো।

বলতো–আমি যে কালীগঞ্জের বউ তা তোমাকে কে বললে–খোকাবাবু?

সদানন্দ বলতো–তোমার নাম তো কালীগঞ্জের বউ। আমাকে গৌরী পিসি সব বলেছে–তুমি কালীগঞ্জেই তো থাকো–

–তুমি কালীগঞ্জে যাবে? যাবে আমাদের কালীগঞ্জে?

–যাবো। তুমি আমাকে নিয়ে চলো।

–কিন্তু কালীগঞ্জে গেলে তোমার দাদু যে বকবে!

–দাদু বকুক! দাদু খুব দুষ্টু, দাদু তো আমাকে রোজ বকে! তবু আমি ভয় পাই না।

–তোমাকে কেন বকে দাদু?

সদানন্দ বলতো–আমি দুষ্টুমি করি বলে!

–কেন তুমি দুষ্টুমি করো?

সদানন্দ বলতো–বেশ করবো দুষ্টুমি করবো! দাদু তোমাকে টাকা দেয় না কেন?

কালীগঞ্জের বউ অবাক হয়ে যেত সদানন্দর কথা শুনে।

সদানন্দ বলতো–জানো, দাদু কাউকে টাকা দেয় না। দাদুর অনেক টাকা, তবু দাদু টাকা দেয় না কাউকে।

কালীগঞ্জের বউ কেমন অবাক হয়ে যেত বাচ্চা ছেলের মুখের কথা শুনে। বলতো কী করে বুঝলে দাদু আমাকে টাকা দেয় না?

সদানন্দ বলতো–গৌরী পিসী বলেছে–

গৌরী পিসী! কালীগঞ্জের বউ এ বাড়ির মেয়েদের বিশেষ কাউকেই চিনতো না। অন্দর মহলেও কোনও দিন ঢোকবার সুযোগ হয়নি। এ বাড়ির সমস্ত লোকজন বরাবর তাকে দেখলেই যেন কেমন গম্ভীর হয়ে যেত। জিজ্ঞেস করতো–গৌরী পিসী কে?

সদানন্দ বলতো–এ মা, গৌরী পিসীকে তুমি চেনো না? সে তো আমাকে খাইয়ে দেয়! ভাত খাইয়ে দেয়, দুধ খাইয়ে দেয়, মাছ খাইয়ে দেয়। আমি যদি না খাই তাহলে গৌরী পিসী আমাকে ভয় দেখায়–

–কী ভয় দেখায়?

–বলে জুজুবুড়িকে ডেকে ধরিয়ে দেবে।

এত দুঃখের মধ্যেও কালীগঞ্জের বউ-এর মুখে হাসি আসতো ছোট ছেলের মুখে পাকা পাকা কথা শুনে।

কালীগঞ্জের বউ-এর পালকিতে বসে সদানন্দর মুখে যেন কথার খই ফুটতো। অনেক কথা বলে যেত গড়গড় করে। বলতো–জানো, আমি যখন বড় হব তখন তোমাকে টাকা দেব।

–আমাকে তুমি টাকা দেবে?

হ্যাঁ তোমাকে টাকা দেব, মানিক ঘোষকে টাকা দেব, দুলে ষাটকে, কপিল পায়রা পোড়াকে সবাইকে টাকা দেব। তোমাদের জমি আমি খাস করে নেব না। জমি দেব তোমাকে, ধান দেব, গুড় দেব, তোমাকে সব দেব!

আশ্চর্য ছোট বয়েসের মন আর ছোট বয়সের সঙ্কল্প। কালীগঞ্জের বউ-এর মনে হতো ছোট বয়েসে বোধ হয় সবাই এই রকমই থাকে। ছোট বয়েসে সবাই-ই উদার হতে পারে, দাতা হতে পারে। তারপর বয়েস বাড়বার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝি যত গোল বাধে আর যত স্বার্থচিন্তা আর জটিলতা এসে হাজির হয়। ছোট বয়েসে কালীগঞ্জের বউও তো সকলকে বিশ্বাস করতো। শুধু ছোট বয়েসে কেন, অনেক বেশি বয়েস পর্যন্ত যে-যা চেয়েছে সবাইকে সব কিছু দিয়েছে কালীগঞ্জের বউ। সকলকেই বিশ্বাস করেছে। নইলে এই নায়েব মশাই ই কি এমন করে তার সর্বস্ব কেড়ে নিতে পারতো! দশটা আমবাগান তিনটে বড় বড় বিল, আর জমি যে কত বিঘে তার কোনও হিসেবই রাখবার দরকার হতো না। আর তার হিসেব যে কোনও দিন রাখতে হবে তাও কখনও কালীগঞ্জের বউ স্বপ্নেও ভাবেনি। নায়েব মশাই ই সব দেখতো আর নায়ের মশাই-ই সব আদায় করতে। খাজনা যেমন আদায় করতো তেমনি খাজনা দিতও সরকারী কাছারিতে। জমিতে কত ধান হচ্ছে আর কত পাট, কত ছোলা, কত সরষে তার হিসেব নেবার দরকারও কখনও হয়নি কালীগঞ্জের বউয়ের।

কিন্তু শেষকালের দিকে কালীগঞ্জের বউ-এর শরীর একেবারে ভেঙে পড়েছিল। তবু সেই ভাঙা শরীর নিয়ে নবাবগঞ্জে আসতো!

একবার বড় রাগ হয়ে গিয়েছিল কালীগঞ্জের বউ-এর। আর থাকতে পারে নি। বলে ফেলেছিল–তবে কি আমার টাকাটা তুমি ঠকিয়েই নিলে নায়েব মশাই? এই-ই ছিল তোমার মতলব? তাহলে আগে বললে না কেন?

নরনারায়ণ চৌধুরী বললেন–কেন, আগে বললে–কী করতে?

–আগে বললে–এই হয়রানিটা আর হতো না আমার। এই পনেরো-কুড়ি বছর ধরে আমায় ঘোরাচ্ছো, ভাবছো মাথার ওপর ভগবান নেই?

নরনারায়ণ তখন শয্যাশায়ী হয়ে থাকেন সব সময়ে। কথাটা শুনে তার ভালো লাগলো না।

বললেন–কেন, ভগবান থাকলে আমার কী করতো?

কালীগঞ্জের বউ বললে–ভগবান তুমি মানো আর না মানো, আমি মানি। আমি সেই ভগবানের নাম করে বলে যাচ্ছি বামুনের মেয়েকে তুমি ঠকিয়েছ, এতে তোমার ভালো হবে না নারাণ, তোমার সর্বনাশ হবে–

–তার মানে?

–তার মানে তুমি আমার যেমন সর্বনাশ করেছ তেমনি তোমারও সর্বনাশ হবে।

নরনারায়ণ চৌধুরীর চোখ দুটো রাঙা হয়ে উঠলো। বললেন–তুমি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও, বেরিয়ে যাও বলছি–

তারপর ডাকতে লাগলেন–দীনু, ও দীনু–

কালীগঞ্জের বউ বসে ছিল। এবার উঠে দাঁড়ালো। বললে–দীনুকে ডাকছো কেন? আমাকে সে গলা ধাক্কা দিয়ে তাড়াবে বলে?

কী জন্যে ডাকছি তা দীনু এলেই দেখতে পাবে, আমাকে আর মুখে বলতে হবে না। ও দীনু দীনু–ও দীনু–

কালীগঞ্জের বউ বললে–তার আর দরকার হবে না। আমার দশ হাজার টাকার জন্যে তোমাকে আর মহাপাতক হতে হবে না। তার আগেই আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু…..

বলতে বলতে যেন একটু দম নিয়ে নিলে কালীগঞ্জের বউ। বললে–কিন্তু আমি যদি বামুনের বংশে জন্মে থাকি, আর আমি যদি এক বাপের মেয়ে হই তো আমি এই তোমাকে শাপ দিয়ে গেলুম যে তুমি নির্বংশ হবে নারাণ, তুমি নির্বংশ হবে। তুমি যাদের জন্যে টাকা জমিয়ে রাখছো এ কারো ভোগে লাগবে না, কারো ভোগে লাগবে না–

বলে কালীগঞ্জের বউ এক নিমেষে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু ঠিক সেই সময় দীনুর সঙ্গে সদানন্দ এসে ঢুকলো।

–কালীগঞ্জের বউ, ও কালীগঞ্জের বউ!

কর্তাবাবু দীনুকে দেখে ধমকে উঠলেন–এই দীনু, আমি তোকে ডাকলাম তা তুই আবার খোকাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলি কেন এখেনে?

সদানন্দ বললে–বেশ করেছে আমাকে নিয়ে এসেছে, তুমি বলবার কে? আমি কালীগঞ্জের বউকে দেখতে এসেছি–

তারপর কালীগঞ্জের বউ-এর দিকে চেয়ে বললে–আমাকে পালকি চড়াবে না কালীগঞ্জের বউ? পালকি চড়াবে না আমাকে?

কালীগঞ্জের বউ সদানন্দকে দেখে একটু থমকে দাঁড়ালো। কিন্তু তারপরই আবার যেমন সিঁড়ি দিয়ে নামতে যাচ্ছিল তেমনি সোজা সিঁড়ি দিয়ে নিচেয় নেমে গেল। সদানন্দও তার পেছন-পেছন ডাকতে ডাকতে চলতে লাগলো–ও কালীগঞ্জের বউ……

নরনারায়ণ চৌধুরী রেগে উঠলেন–হাঁ করে দাঁড়িয়ে কী দেখছিস দীনু? খোকাকে ধর, খোকা যে চলে গেল রে, খোকা যে চলে গেল কালীগঞ্জের বউ-এর সঙ্গে, ধর ওকে– হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছিস কী? ওকে ধরে আন–কিন্তু ততক্ষণে কালীগঞ্জের বউ বারবাড়ির উঠোনে গিয়ে তার পালকিতে উঠে পড়েছিল। চারজন বেহারা পালকিটা কাঁধে তুলতে যাচ্ছে।

এমন সময় সদানন্দও পেছনে গিয়ে ডাকলো–আমাকে আজ পালকি চড়ালে না কালীগঞ্জের বউ?

বেহারা চারজন পালকিটা তুলতে গিয়ে একটু বুঝি থেমে গিয়েছিল। কিন্তু ভেতর থেকে কালীগঞ্জের বউ ধমক দিয়ে উঠলো–কইরে দুলাল, পালকি তোল–

–আজ্ঞে মা ঠাকরুণ, খোকাবাবু যে পালকিতে উঠতে চাইছে।

কালীগঞ্জের বউ ধমকে উঠলো–যে সে পালকিতে উঠতে চাইলেই অমনি ওঠাবি তোরা? না, ওঠাতে হবে না–আমি যা বলছি তাই কর–

দুলালরা আর দেরি করলে না। পালকি কাঁধে তুলে নিয়ে চলতে আরম্ভ করলে।

সদানন্দ কাঁদতে কাঁদতে পেছনে-পেছনে ছুটতে লাগলো–ও কালীগঞ্জের বউ, কালীগঞ্জের বউ–

ছুটতে ছুটতে বোধ হয় সদানন্দ পালকির সঙ্গে বার বাড়ির উঠোন পেরিয়ে বাইরে চলে যাচ্ছিল। চৌধুরী মশাই চণ্ডীমণ্ডপে বসে ব্যাপারটা দেখতে পেয়েছেন। চিৎকার করে বলে উঠলেন–ওরে, খোকা যে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে, কেউ ধর ওকে, ওরে কে আছিস, দীনু

গৌরী ভেতর বাড়ি থেকে দৌড়ে এল–ও খোকা, খোকা, কোথায় যাচ্ছো?

ওদিকে যেতে নেই, আমি তোমাকে পালকি চড়াবো, তুমি এসো আমার কাছে–

বলে খপ করে সদানন্দকে ধরে ফেলেছে। সদানন্দও কেঁদে উঠেছে–কালীগঞ্জের বউ চলে গেল, আমাকে পালকি চড়ালে না–

গৌরীর কোলে উঠেও সে কাঁদতে লাগলো। আর ততক্ষণে দীনুও কর্তাবাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বার বাড়ির উঠোনে এসে হাজির হয়েছে।

চৌধুরী মশাই চণ্ডীমণ্ডপ থেকে দীনুকে দেখে বলে উঠলেন–কোথায় থাকিস রে তুই দীনু, আর একটু হলেই খোকা এখখুনি রাস্তায় বেরিয়ে যাচ্ছিল—

কিন্তু তাঁর কথা শেষ হবার আগেই কৈলাস গোমস্তা চণ্ডীমণ্ডপে এল দৌড়তে দৌড়তে। বললে–ছোটবাবু, কর্তাবাবু কেমন করছেন, আপনি একবার আসুন–

–বাবা? বাবার কী হয়েছে?

কৈলাস গোমস্তা তখনও হাঁপাচ্ছিল। বললে–এই কালীগঞ্জের বউ-এর সঙ্গে রাগারাগি করে কথা বলতে গিয়েই কর্তাবাবু কেমন হাঁপিয়ে উঠেছেন, আমার সুবিধে মনে হচ্ছে না—

চৌধুরী মশাই আর দাঁড়ালেন না। সোজা ভেতর বাড়িতে ঢুকে একেবারে কর্তাবাবুর ঘরে চলে গেলেন। দেখলেন কর্তাবাবু চিৎপাত হয়ে শুয়ে আছেন, চোখ দুটো বোঁজা। বুকটা জোরে জোরে উঁচু-নিচু হচ্ছে। যেন নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর। কৈলাস গোমস্তাও পাশে এসে দাঁড়ালো। দীনু এল। গৌরী পিসি এল। বাড়িময় খবর রটে গেল কর্তাবাবুর অসুখ হয়েছে।

তারপর রাণাঘাট থেকে ডাক্তার এল, কবিরাজ মশাই এল। ওষুধের বন্যা বয়ে গেল। ডাক্তার কবিরাজ দুজনেই বলে গেল একেবারে পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে।

তারপর থেকে নিয়ম হলো কালীগঞ্জের বউ যদি এর পর আসে তো আর তাকে কর্তাবাবুর কাছে যেতে দেওয়া হবে না। কালীগঞ্জের বউ-এর জন্যেই এই বিপর্যয় ঘটলো।

কিন্তু সেই থেকেই সদানন্দের কৌতূহল হলো–ওই কালীগঞ্জের বউ কেন দাদুর কাছে আসে? কীসের টাকা চায়? কার টাকা? দাদু কালীগঞ্জের বউকে টাকা দেয়ই না বা কেন?

এমন প্রশ্নের কেউই ঠিকমত জবাব দিত না।

দীনু বলতো–কালীগঞ্জের বউ খুব দুষ্টু-

সদানন্দ জিজ্ঞেস করতো–কেন, কেন দুষ্টুমি করে কালীগঞ্জের বউ?

দীনু বলতো–যারা দুষ্টু লোক তারা তো কেবল দুষ্টুমিই করে, আর তো কিছু করে না।

–কিন্তু দাদু তার টাকা দেয় না কেন? টাকা না পেলে কালীগঞ্জের বউ চাল কিনবে কী করে? কাপড় কিনবে কী করে?

যত দিন যেতে লাগলো এই সব প্রশ্নই তার মাথায় ঢুকতে লাগলো। তারপর বয়েস হবার সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই সে জানতে পারলো। জানতে পারলো দাদু শুধু কালীগঞ্জের বউকেই ঠকায় নি, কপিল পায়রাপোড়াকেও ঠকিয়েছে, মানিক ঘোষকেও ঠকিয়েছে, ফটিক প্রামাণিককেও ঠকিয়েছে। জানতে পারলো রাণাঘাটের সদরে তাদের উকিল-বাড়ি আছে, সেখানে তাদের উকিলটা কেবল মামলা করে। মামলা করে করে নবাবগঞ্জের লোকদের জমি-জমা নিলেমে ডেকে নেয়, বাকি খাজনার দায়ে প্রজাদের জমি খাস করে নেয়। বংশী ঢালীকে দিয়ে লাঠিবাজি করায়। তারপর চণ্ডীমণ্ডপের পাশের ঘরে অনেককে তালাচাবি বন্ধ করে উপোস করিয়ে মারে। সে-সব কেউ টের পায় না। সদানন্দ অনেক দিন সেই দিকে যেতে চেয়েছে। কিন্তু জায়গাটা ঝোপ-ঝাড়-ঘেরা বলে সন্ধ্যেবেলা যেতে ভয় করতো তার খুব। আর যখন বংশী ঢালীকে ওদিক থেকে আসতে দেখতো তখন সদানন্দরও যেন কেমন গা ছমছম করে উঠতো।

সে বংশী ঢালীকে জিজ্ঞেস করতো–হ্যাঁ গো বংশী, এ-ঘরে থাকতে তোমার ভয় করে না?

বংশী ঢালী হাসতো সনানন্দর কথা শুনে।

বলতো–ভয় করবে কেন খোকাবাবু, ওখানে তো আমি রাত্তিরে ঘুমোই–ওই তো আমার ঘর–।

সদানন্দ আবদার ধরতো–আমি তোমার ঘরে যাবো বংশী–

–আমার ঘরে কী করতে যাবে? আমি গরীব লোক, আমার ঘরে থাকতে তোমার কষ্ট হবে–

বলে ও প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেত। তারপর বলতো—চলো খোকাবাবু, তোমাকে আমি মাছ ধরা দেখতে নিয়ে যাই

বলে বিলের ধারে খ্যাপ্‌লা জাল দিয়ে মাছ ধরা দেখাতে নিয়ে যেত।

এতদিন পরে কালীগঞ্জের বউ-এর সঙ্গে সদানন্দর সেই সব কথা বলতে বলতেই অনেক রাত হয়ে গেল। কালীগঞ্জের বউ নিজের হাতে রান্না করে খাইয়ে দিলে সদানন্দকে। বললে–এবার বাবা তুমি নবাবগঞ্জে ফিরে যাও–তোমার দাদু এতক্ষণে তোমাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছে–

–না, আমি আর যাবো না।

কালীগঞ্জের বউ বললে–কিন্তু তুমি যদি না যাও বাবা তো শেষকালে আমার নামেই দোষ পড়বে। সবাই বলবে আমিই তোমাকে আটকে রেখেছি–আর তা ছাড়া কাল তোমার বিয়ে। সকাল-বেলাই গায়ে-হলুদ হবে, তোমার শ্বশুরবাড়ি থেকে অধিবাসের তত্ত্ব আসবে–

সদানন্দ বলল–সে আসুক, কিছুতেই যাবো না, আমি এখানেই শুয়ে রইলুম।

বলে কালীগঞ্জের বউ-এর বিছানাতেই গা এলিয়ে দিলে। একগুঁয়ে পাগল ছেলেকে নিয়ে মহা মুশকিলে পড়লো কালীগঞ্জের বউ। দুলালকে ডেকে তোশক বালিশ পেড়ে আবার তার জন্যে নতুন করে বিছানা করে দিতে হলো।

সে রাতটা একরকম করে কাটলো। কালীগঞ্জের বউ ভাবলে ভোরবেলাই না-হয় দুলালকে দিয়ে নবাবগঞ্জে খবর পাঠিয়ে দেবে যে খোকা এখানে এই কালীগঞ্জে এসে উঠেছে।

দুলালও সেই রকম তৈরি হয়ে ছিল।

কিন্তু সকাল বেলা থেকেই দুলালের নানা কাজ থাকে। সে কাজের মানুষ। ভোররাত্রে উঠে তাকে গরুকে শানি দিতে হয়। তারপর তিন ক্রোশ পথ হেঁটে গিয়ে বাঁশের ক’টা খুঁটি তৈরি করে আনবার কথা ছিল। তখন রাত অনেক। দুলাল ভেবেছিল সকাল হবার আগেই বাঁশ কেটে আবার ফিরে আসতে পারবে। কিন্তু বাঁশঝাড়ের মালিক বাড়ি ছিল না। তিনিও বুঝি কোন জরুরী কাজে রাত থাকতে বেরিয়ে গিয়েছেন। তাঁর জন্যে বসে বসে যখন শেষ পর্যন্ত মালিক এল তখন রোদ উঠে গেছে।

সেই বাঁশ বাছাই করে কেটে যখন দুলাল আবার বাড়িতে ফিরে এল তখন দেখলে বাড়িতে হইচই পড়ে গেছে।

দুলালকে দেখেই গিন্নীমা বলে উঠলো–হ্যাঁ রে দুলাল, তোকে আমি পইপই করে বলেছিলুম নবাবগঞ্জে গিয়ে নায়েব বাড়িতে খবরটা দিয়ে আসবি যে খোকাবাবু এখানে এসেছে। আর তুই কিনা বাঁশ আনতে গিয়েছিলি? আজই তোর বাঁশ আনবার জন্যে এত জরুরী দরকার পড়ে গেল? এখন আমি লোককে কী বলে কৈফিয়ত দেব? নবাবগঞ্জ থেকে যে লোক এসে হাজির হয়েছে সে আমাকেই দুষছে….

সত্যিই, দুলাল দেখলে এক ভদ্রলোক বসে আছে বাড়ির উঠোনে একটা চৌকিতে–

কালীগঞ্জের বউ বললে–এই দেখ বাবা, এই দুলালকে আমি ভোরবেলা নবাবগঞ্জে গিয়ে কর্তাবাবুকে খবর দিতে বলেছিলুম যে খোকাবাবু এখানে আছে তা আমার তো ওই এক দুলাল ভরসা, আর তো কোনও লোক নেই যে তাকে পাঠাবো–

ততক্ষণ সদানন্দ উঠে এসে দাঁড়ালো।

প্রকাশমামা রেগে আগুন।

–কী রে, তুই এখেনে এসে লুকিয়ে আছিস! আজ তোর বিয়ে! অধিবাস নিয়ে কেষ্টনগর থেকে লোক এসে হাজির হয়েছে, গায়ে-হলুদের সব রেডি আর তুই কিনা এই রকম পাগলামি করছিস! চল-চল –আর কথা বলবার সময় নেই আমার। চুড়ান্ত বেইজ্জতি হয়ে গেছে। কুটুমবাড়ির লোক সেখানে গিয়ে কী বলবে বল্ দিকিন, তারা কী ভাববে?

সদানন্দ বললে–ভাবুক গে, আমার কী? আমি যাব না, আমি এখানে থাকবো–

প্রকাশমামা বললে–ইয়ারকি করার আর জায়গা পাসনি–

বলে সদানন্দর হাত ধরে টান দিলে একটা। টেনে বাইরের রাস্তার দিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতে লাগলো।

সদানন্দ হাত ছাড়িয়ে নিলে। বললে–তুমি কি আমাকে ছেলেমানুষ পেয়েছ প্রকাশমামা? অমি যাবো না তোমার সঙ্গে কী করবে তুমি?

কালীগঞ্জের বউ বললে–আমি কাল থেকে ওই কথা ওকে বোঝাচ্ছি বাবা যে বিয়ের ব্যাপারে এমন করতে নেই। এখন সব যোগাড় যন্তর হয়ে গেছে। এখন লোক-হাসাহাসির ব্যাপার করা উচিত নয়। তা….

প্রকাশমামা ধমক দিয়ে উঠলো। বললে–তুমি থামো, আমি তোমার সব মতলব ফাঁস করে দেব, দাঁড়াও, আগে বিয়েটা হয়ে যাক্, তখন যা করতে হয় আমি করবো–সে আমার মনেই আছে–

কালীগঞ্জের বউ বললে–তা আমি কী করলুম বাবা? আমার কী দোষ হলো?

–বলছি তুমি থামো, তবু আবার কথা বলছো? ভেবেছিলে আমার ভাগ্নেকে নিজের বাড়িতে ফুসলে এনে বিয়েটা ভেঙে দেবে? এত শয়তানি বুদ্ধি তোমার?

সদানন্দ কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলে উঠলো-খবরদার বলছি প্রকাশমামা, কালীগঞ্জের বউকে তুমি অমন করে যা-তা বলতে পারবে না। তা হলে কিন্তু আমিও সব ফাঁস করে দেব।

প্রকাশমামা বললে–তার মানে?

–তার মানে তুমি জানো না? তুমি জানো না এই কালীগঞ্জের বউ-এর কত সম্পত্তি দাদু গ্রাস করেছে? জানো, এই কালীগঞ্জের বউ এককালে কত সম্পত্তির মালিক ছিল? কে তার সম্পত্তি ঠকিয়ে নিয়েছে, কে-তাকে পথের ভিখিরি করেছে, আমি সে-সব কথা জানি না বলতে চাও?

প্রকাশমামা কথাগুলো শুনে প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেল। তারপর একটু দম নিয়ে বললে–এই সব কথা তোকে বুড়ি বলেছে বুঝি? এই সব ফুসমন্তর বুঝি ঢুকিয়ে দিয়েছে তোর মাথায়?

–আমাকে ফুসমন্তর দিতে হবে না প্রকাশমামা। বোঝবার মত যথেষ্ট বয়েসও হয়েছে আমার। বরং তুমি একটু বোঝ। যার পয়সায় তুমি এতদিন বাবুয়ানি করছে, জেনো সেটা তোমার ভগ্নিপতির পয়সা নয়, সে-সব এই কালীগঞ্জের বউ-এর–

প্রকাশমামা বললে–দ্যাখ, এসব কথার জবাব দেবার সময় নেই এখন, ওদিকে কুটুমবাড়ির লোক বসে আছে, তারপরে বিকেল বেলার ট্রেন ধরে আবার কেষ্টনগরে বিয়ে করতে যেতে হবে। পরে আমরা তোর এসব কথার জবাব দেব–

সদানন্দ বললে–না, জবাব দিলে এখনি জবাব দিতে হবে। আগে এর জবাব চাই তবে আমি তোমার সঙ্গে যাবো–

–তা কীসের জবাব চাস্ তুই বল? কবেকার পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটবার এই কি সময়? এ সব কাসুন্দি তো পরে ঘাঁটলেও চলতো।

–না চলতো না। আগে আমি এর জবাব চাই। আগে তুমি বলো, আগে তুমি কথা দাও, দাদু এই কালীগঞ্জের বউ-এর পাওনা দশ হাজার টাকা মিটিয়ে দেবে?

–দশ হাজার টাকা?

–হ্যাঁ, দাদু পনেরো বছর আগে কথা দিয়েছিল দশ হাজার টাকা দিয়ে সাহায্য করবে এই কালীগঞ্জের বউকে। এখনও কেবল ঘোরাচ্ছে। এখন দাদু এই কালীগঞ্জের বউ-এর সঙ্গে একবার দেখাও করে না। আগে তুমি কথা দাও সেই টাকা মিটিয়ে দেবে?

প্রকাশমামা বললে–তোর দাদু টাকা মেটাবে কি না তার কথা আমি দেব কি করে? আমি নিজে কি টাকা নিয়েছি যে কথা দেব?

সদানন্দ বললে–তা হলে আমিও বিয়ে করতে যাবো না–

প্রকাশমামা বললে–ঠিক আছে, তা হলে তুই বাড়ি চল, বাড়ি গিয়ে তোর দাদুকে সব বল্ গিয়ে। দাদু যদি তখন টাকা দিতে রাজী না হয় তখন না-হয় বিয়ে করতে যাস্ নি। আমাকে বাপু তুই এই দায় থেকে বাঁচা–

কালীগঞ্জের বউ এতক্ষণে কথা বললে। সদানন্দর দিকে চেয়ে বললে–সেই ভালো কথা বাবা। তোমার মামা তো ঠিক কথাই বলেছে। আর আমার টাকা? আমার তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে, এখন আমার টাকা দিলেও যা, না-দিলেও তাই। ও টাকার পিত্যেশ আর আমি করি না। কিন্তু তুমি বাবা আর দেরি করো না, যাও, তোমার গায়ে-হলুদের দেরি হয়ে যাবে–

সদানন্দ এতক্ষণে রাজী হলো। বললে—চলো—

তারপরে কালীগঞ্জের বউ-এর পায়ের কাছে মাথা নিচু করে প্রণাম করে বললে–তোমার টাকা আমি নিজের হাতে দিয়ে যাবো কালীগঞ্জের বউ, তুমি কিছু ভেবো না। টাকা না দিলে আমি বিয়ে করতেই যাবো না–

মনে আছে সদানন্দর মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করতে গিয়ে কালীগঞ্জের বউ-এর দু’চোখ জলে ভরে উঠেছিল। সদানন্দর চোখের সামনেই আঁচল দিয়ে চোখ-মুখ ঢেকে ফেলেছিল।

.

কেষ্টনগরে বিয়েবাড়ির একান্তে একটা ঘরের ভেতরে প্রকাশমামা সেই কথাটাই জিজ্ঞেস করলে। বললে–কীরে, তুই কালীগঞ্জের বউয়ের ব্যাপারটা বাসরঘরে সকলকে বলে দিস নি তো? নিরঞ্জন বলছিল–

সদানন্দ গম্ভীর মুখে বললে–না, বলি নি।

প্রকাশমামা সাবধান করে দিলে। বললে–না, বলিস, নি।

সদানন্দ বললে–কিন্তু কালীগঞ্জের বউ-এর সেই দশ হাজার টাকা? সেটা কিন্তু এখনও দাদু দিলে না, তুমি কথা দিয়েছিলে কিন্তু–

প্রকাশমামা বললে–তুই মিছিমিছি ও-সব নিয়ে ভাবছিস কেন? তোর দাদুর কাছে দশ হাজার তো হাতের ময়লা রে, দেবে যখন কথা দিয়েছে তখন নিশ্চয়ই দেবে। দশ হাজার টাকা মেরে দিয়ে কি তোর দাদু বড়লোক হবে? নিশ্চয়ই দেবে, আমি তো সাক্ষী আছি–

সদানন্দ বললে–কিন্তু কালীগঞ্জের বউ-এর টাকা যদি দাদু না দেয়, তখন কিন্তু সর্বনাশ হবে, এই আমি বলে রাখছি–

ওদিক থেকে কন্যাকর্তার গলা শোনা গেল–কই, বেয়াই মশাই কোথায়? সিগারেট পেয়েছেন তো?

বলতে বলতে কালীকান্ত ভট্টাচার্য এসে পড়লেন। বললেন–এই যে, এখানে বাবাজীবনও আছে দেখছি। তা সিগারেট-টিগারেট সব পাচ্ছেন তো বেয়াই মশাই?

প্রকাশমামার মুখে তখন সিগারেট জ্বলছিল। সুতরাং উত্তর আর তাকে দিতে হলো না। শুধু বললে–এবার যাত্রার বন্দোবস্ত করুন বেয়াই মশাই, আমি বর-কনেকে একবার নবাবগঞ্জে পৌঁছিয়ে দিতে পারলেই আমার ছুটি। তারপর আপনার ভাগ্য আর আপনার মেয়ের হাতযশ–

তা প্রকাশমামা করিতকর্মা লোকই বটে। করিতকর্মা লোক না হলে কি এ বিয়ে হত নাকি? বিয়ে তো প্রায় আটকেই গিয়েছিল কাল সকালবেলা। বাড়িময় সোরগোল উঠেছিল। নবাবগঞ্জে কথাটা প্রায় ছড়িয়েই গিয়েছিল। সবাই-ই জানতে পেরেছিল যে চৌধুরী মশাই এর ছেলে পালিয়ে গিয়েছে। তাকে আর কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। একে গ্রাম-দেশ তার ওপর ছোট গ্রাম নবাবগঞ্জ। কার বাড়িতে জামাই এসেছে, কার বাড়ির মেয়ে কার সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করেছে, তা আর কারো জানতে বাকি থাকে! তা ছাড়া নেমন্তন্ন হয়েছে মোটামুটি সব বাড়িতেই। তারা কদিন ধরেই খাবে। শুধু খাবে না, একেবারে গণ্ডেপিণ্ডে খাবে। তার ওপর ছাঁদা বেঁধে নিয়ে যাবে। ক’দিন আগে থেকেই তারা বাড়িতে কম খেয়ে খেয়ে চালাচ্ছে, যাতে খাবার জন্যে পেটে কিছু জায়গা খালি থাকে। কিন্তু সদানন্দর পালিয়ে যাবার খবর পাওয়ার পর তাদের সব উৎসাহে যেন ভাঁটা পড়লো। তাহলে? তাহলে খাওয়াটা কি মাটি হলো?

বারোয়ারিতলায় নিতাই হালদারের দোকানের মাচার ওপর রীতিমত সভা বসলো।

পরমেশ মৌলিক তখন সবে খবরটা নিয়ে এসেছে। খবরটা শুনে সকলের মুখই ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বললে–তাহলে খুড়ো মশাই, আজকে কি খাওয়া হবে না?

পরমেশ মৌলিক বললে–কী জানি হে কপালে কী আছে! মাছ-দই-মিষ্টি সব কিছুর বন্দোবস্ত হয়ে গেছে।

–কী কী কী মিষ্টি হয়েছিল? শুনলুম নাকি কেষ্টনগর থেকে সরভাজার অর্ডার দেওয়া হয়েছিল?

শুধু সরভাজা নয়। কদিন থেকেই খাওয়ার আইটেমগুলো নিয়ে আলোচনা করে করে সকলের সব মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। মাছ, মাংস, মাছের মুড়িঘণ্ট, ধোকার ডালনা, বেগুন ভাজা, নিরামিষ আর আমিষ দু’রকম চপ, দই, রসগোল্লা, পানতুয়া আরো অনেক কিছু।

এমন সময়ে দেখা গেল হন্তদন্ত হয়ে শালাবাবু আসছে। সবাই হাঁ করে চেয়ে রইল সেদিকে। কাছাকাছি আসতেই সবাই এগিয়ে গেল।

–শালাবাবু কী খবর? পেলেন সদাকে?

শালাবাবুর মুখটা গম্ভীর। বললে–না হে, পেলুম না, দেখি একবার কালীগঞ্জের দিকে গিয়ে–

কালীগঞ্জে? কালীগঞ্জে সদা কী করতে যাবে?

শালাবাবু বললে–রাণাঘাট-ফানাঘাট, রেলবাজার, নবাবপুর, সব তো দেখে এলুম, এবার কালীগঞ্জের দিকটাই বা বাকি থাকে কেন?

বলে আর দাঁড়াল না। হন্ হন্ করে সামনের দিকে চলতে লাগলো।

কেদারের হঠাৎ কথাটা মনে পড়ে গেল। এতক্ষণ খেয়াল ছিল না। আসল কথাটা জিজ্ঞেস করতে ভুল হয়ে গেল। বললে–ওই যাঃ, আসল কথাটাই তো জিজ্ঞেস করতে ভুল হয়ে গেল–

নিতাই জিজ্ঞেস করলে–কী কথা?

–খাওয়ার কথা?

বলে দৌড়তে লাগলো। শালাবাবু তখন অনেক দূর চলে গেছে। কেদার দৌড়তে দৌড়তে গিয়ে ডাকলে–ও শালাবাবু, শালাবাবু–

শালাবাবু পেছন ফিরে তাকালো। ভাবলে হয়ত সদাকে পাওয়া গেছে, সদার সন্ধান দিতে আসছে কেদার। বললে–কী রে, সদাকে পেইছিস?

কেদার কাছে গিয়ে হাঁপাচ্ছিল। হঠাৎ কথা বেরোল না মুখ দিয়ে। তারপর বললে– না, সদার কথা নয়, নেমন্তন্নর কথা বলছি। আমাদের নেমন্তন্নটার তাহলে কী হবে? সেটাও মারা যাবে নাকি?

কেদারের কথা শুনে শালাবাবুর পিত্তি জ্বলে গেল। বললে–দূর হ, ভোর রাত থেকে সদাকে খুঁজে খুঁজে আমার পায়ের রং-খিল গেল আর উনি এসেছেন নেমন্তন্নর খবর নিতে–দূর হ, দূর হ–

বলে রাগে গর গর করতে করতে শালাবাবু আরো জোর পায়ে এগোতে লাগলো। সভার সবাই খুব ম্রিয়মান হয়ে গেল কথা শুনে। বরকে না পাওয়া যাক, কিন্তু খাওয়াটা বন্ধ হবার কথা ভেবে সবাই যেন কেমন নিঝুম হয়ে গেল। এ ক’দিন অনেক ছিলিম তামা পুড়েছে, অনেক সময় তর্কাতর্কি করেছে। রেলবাজারের গৌরের দোকানের রসগোল্লা ভালো না রাণাঘাটের হরিহরের দোকানের রসগোল্লা ভালো তাই নিয়ে তর্ক করে কতদিন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে, কতদিন সেই তর্ক করতে করতে শেষকালে সেটা মারামারিতে পরিণত হয়েছে, তবু তর্কের মীমাংসা হয় নি। সকলেই ওই বিয়ের তারিখটার দিকে চোখ রেখে এতদিন জীবন-যাপন করে এসেছে, হঠাৎ সেই পরম লক্ষ্য ভ্রষ্ট হওয়াতে সবাই বিমর্য হয়ে রইল।

কিন্তু বিকেল পড়বার আগেই সবাই আবার চাঙ্গা হয়ে উঠলো। কেদারই খবর পেয়েছিল প্রথমে। সে দৌড়তে দৌড়তে এসে খবর দিলে গোপাল ষাটকে। গোপাল ষাট তখন গোয়াল ঘরে গরুকে জানা দিচ্ছে। কেদারের গলা শুনেই চেঁচিয়ে উঠলো–কী রে, কী খবর রে?

কেদার রাস্তা থেকেই চেঁচিয়ে উঠলো–ওরে, সদাকে পাওয়া গেছে–আর ভয় নেই—

গোপাল ষাট বললে–পাওয়া গেছে? তাহলে খাওয়া?

-–খাওয়া হবে।

বলে আর দাঁড়ালো না। অন্য দিকে চলে গেল। বললে–যাই নিতাইকে খবরটা দিয়ে আসি, সে খুব মনমরা হয়ে গেছে–

কথাটা শুনে পর্যন্ত গোপাল ষাটের বুক থেকে যেন একখানা ভারি পাথর নেমে গেল। গরুর জানা দেওয়া ফেলে রেখে তাড়াতাড়ি কোঁচার খুঁটটা গায়ে দিয়ে রাস্তায় বেরোল। এতক্ষণে সবাই-ই নিশ্চয় জেনে গেছে। সোজা বারোয়ারি তলার দিকে পা বাড়ালো। কিন্তু সেখানে তখন আগেই সভা বসে গেছে। নিতাই, কেদার সবাই হাজির। সবার মুখেই উত্তেজনা। নেমন্তন্ন খাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে সবাই-ই যেন বেশ ধাতস্থ। সবাই-ই জেনে গেছে সদাকে পাওয়া গেছে। কালীগঞ্জ থেকেই শালাবাবু নাকি তার ভাগ্নেকে ধরে এনেছে।

–কিন্তু পালিয়েছিল কেন? কিছু বলছে না সদা?

কথাটা সবাইকে ভাবিয়ে তুললো। বিয়ের নামে কেউ পালায়? সদাকে ছোট্টবেলা থেকেই দেখে এসেছে। কিন্তু তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে পারেনি কেউ কখনও। ইস্কুল থেকে ফেরবার পথে এই বারোয়ারিতলা দিয়েই সে বাড়ি ফিরেছে। হাটের দিনেও অনেক সময় হাটে এসেছে সে। কিন্তু কেমন যেন ভুলো-ভুলো মন সব সময়ে। আর বেশির ভাগই শালাবাবু সঙ্গে থাকতো। চৌধুরী মশাই অনেকদিন ছেলেকে এনে চণ্ডীমণ্ডপে বসিয়েছেন। বলেছেন–একদিন তো তোমাকে কাজকর্ম বই দেখতে হবে, এখন একটু জেনে-শুনে নাও–

অতি সুবোধ বালকের মত সদানন্দ চুপচাপ শুনে গেছে বাবার কথা।

চৌধুরী মশাই বলতেন–এই দেখ, এইগুলোর নাম পরচা, এই হচ্ছে দাখলে, আর এই হলো নকশা। এই নকশার ওপর নম্বর দেওয়া রয়েছে। এইগুলো হচ্ছে দাগনম্বর–

এক এক করে চৌধুরী মশাই সেরেস্তার নথিপত্র সব বোঝাতেন। কীসের কী মানে, কীসের কী গুরুত্ব। এককালে যখন দাদু থাকবে না, বাবা-মা কেউই থাকবে না, তখন তাকে নিজেকেই তো এই সব দেখতে হবে। নায়েব-গোমস্তার ওপর ভরসা করে আর যা-ই করা যাক জমিদারি সেরেস্তার কাজ চলে না। তোমার নিজের জিনিস, তোমাকে নিজের হাতেই সব করতে হবে। উকিল তোমাকে ঠকাতে চাইলেও তুমি কেন ঠকবে? মামলা-মকর্দমার সময় তোমাকে নিজেকে কাছারিতে যেতে হবে। কাঠগড়ায় সাক্ষী হয়ে দাঁড়াতে হবে। এ রকম চুপ করে থাকলে চলবে না। উকিলের জেরায় ভয় পেলে চলবে না। নিজের স্বার্থ কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নিতে শিখবে। আর প্রজা ঠ্যাঙাতে যদি না পারো তো জমিদারি কোর না। এ ভালোমানুষির কাজ নয়, বুঝলে?

এত যে উপদেশ, এত যে পাখি-পড়ানো, সব কিন্তু বৃথা হয়েছিল।

চৌধুরী মশাই বলতেন–কিছু বুঝলে? কথার জবাব দিচ্ছ না কেন? বুঝলে কিছু?

সদানন্দ বলতো–না–

চৌধুরী মশাই চটে যেতেন। বলতেন–কেন? এতে না-বোঝবার কী আছে? লেখাপড়া শিখেছ তুমি, তোমার কাছে এ-সব কথা তো শক্ত হবার কথা নয়। ওই কৈলাস গোমস্তাকে দেখ তো, ও তো লেখা পড়ার কিছুই জানে না, কিন্তু আমাদের কত নম্বর পরচায় কত বিঘে কত ছটাক জমি আছে সব ওর মুখস্থ, ও ম্যাট্রিক পাসও নয়, আই-এ পাসও নয়, তোমার মত বি-এ পাস ছেলে যদি এ-সব বুঝতে না পারে তো এতগুলো পয়সা নষ্ট করে কী লাভ হলো?

তারপর যেন চৌধুরী মশাই-এর খেয়াল হতে খোকা কিছুই শুনছে না, অন্য দিকে চেয়ে আছে। তারপর ছেলের দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলেন চণ্ডীমণ্ডপের উঠোনে রজব আলি তাঁদের গোরুটাকে জোরে জোরে মারছে।

চৌধরী মশাই ধমকে উঠতেন–ওদিকে কী দেখছো? আমি কাজের কথা বলে যাচ্ছি। আর তুমি রজব আলিকে দেখছো! রজব আলির দিকে দেখে তোমার কী লাভ?

কিন্তু না, তার লাভ ছিল। রজব আলিকে দেখেও তার লাভ ছিল। কথা নেই বার্তা নেই সেই অবস্থাতেই সদানন্দ সেখান থেকে উঠে গেল। উঠে রজব আলির হাত থেকে লাঠিটা এক মিনিটের মধ্যে কেড়ে নিলে। বললে–মারছিস কেন গরুটাকে? কী করেছে গোরুটা?

রজব আলি তো ভয়ে অস্থির। গাড়ির গোরুকে মেরেছে তাতে এমন কী কসুর করেছে সে যে খোকাবাবু তার পাঁচন-বাড়ি কেড়ে নিলে!

কিন্তু ব্যাপার বুঝে চৌধুরী মশাই সেখানে এসে হাজির হলেন।

বললেন–এ কী করছো? এ কী করছো?

সদানন্দ বলল–ও গোরুটাকে মারছে কেন? গোরুটা কী করেছে ওর?

চৌধুরী মশাই বললেন–তা দরকার হলে গোরুকে মারবে না? বদমায়েসি করেছে তাই মেরেছে। তুমি ও নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছো কেন?

সদানন্দ বললে–তাহলে আমিও রজবকে মারবো, ও-ও তো বদমায়েসি করেছে–

চৌধুরী মশাই ছেলের বেয়াড়া বুদ্ধি দেখে অবাক হয়ে গেলেন। তাঁর ছেলে হয়ে এ রকম বেয়াড়া বুদ্ধি কেন হলো? এমন বুদ্ধি হলে এত সম্পত্তি রাখবে কী করে? চিরকাল তো আর তিনি থাকছেন না। একদিন তো এই ছেলের হাতে এই সমস্ত সম্পত্তি তুলে দিয়ে তাঁকে চলে যেতে হবে। তখন?

সেইদিন থেকেই চৌধুরী মশাই-এর আর এক ভাবনা শুরু হলো। সেইদিন থেকেই তিনি ছেলেকে নিজের কাছে কাছে রাখবার চেষ্টা করতে লাগলেন। চণ্ডীমণ্ডপে নিজের কাছে বসিয়ে সব কিছু দেখাতে বোঝাতে লাগলেন। সদানন্দ কিছুক্ষণ কাছে বসে থাকতো বটে, কিন্তু তার মন কোথায় পড়ে থাকতো কে জানে।

খানিকক্ষণ পরেই বলতো–আমি যাই—

চৌধুরী মশাই বলতেন–কোথায় যাবে আবার?

সদানন্দ বলতো–আমার ভালো লাগছে না–

–ভালো লাগছে না তো যাবে কোথায়?

সদানন্দ বলতো-বাইরে–

–বাইরে কোথায় তা বলবে তো?

কিন্তু সদানন্দ বাইরে যে কোথায় যাবে তা সে নিজে জানলে তবে তো বলবে! রাত্রে চৌধুরী মশাই গৃহিণীকে বলতেন–খোকা কি এখনও প্রকাশের সঙ্গে মেশে নাকি? গৃহিণী অবাক হয়ে যেতেন। বলতেন–প্রকাশের সঙ্গে মিশলে কী হয়েছে?

চৌধুরী মশাই বলতেন–না, প্রকাশের সঙ্গে যেন বেশি মেলা-মেশা না করে খোকা। এই তোমাকে সাবধান করে দিলুম।

প্রীতিলতাও জমিদারের মেয়ে। বাপের বাড়ির লোকের নিন্দে সহ্য করবার মত মেয়ে সে নয়।

বলতো–তুমি তো প্রকাশকে দেখতে পারবেই না। তা সে তোমার কী ক্ষতি করেছে শুনি?

চৌধুরী মশাই একটু নরম হয়ে বলতেন–না, আমি তা বলছি না। চিরকাল ওই রকম আড্ডা দিয়ে বেড়ালেই চলবে? সেরেস্তার কাজকর্মও তো একটু-একটু করে রপ্ত করে নিতে হবে! আমি আর ক’দিন–

এর পরে এ-প্রসঙ্গ আর বেশিক্ষণ চলতো না। কিন্তু চৌধুরী মশাই মনে মনে অস্বস্তি বোধ করতেন সদানন্দকে নিয়ে। ঠিক যেমন ছেলে তিনি চেয়েছিলেন সদানন্দ তেমন ছেলে হলো না। বাবার কাছে আসতেই যেন তার অনিচ্ছে। বাবার চোখে পড়বার ভয়ে সে যেন কোথাও লুকিয়ে থাকে। তাঁর দৃষ্টির আড়ালে সে ঘুরে বেড়াতে পারলে যেন বাঁচে।

চৌধুরী মশাই প্রায়ই গৃহিনীকে প্রশ্ন করতেন–খোকা কোথায় গেল?

প্রীতিলতা বলতো–গেছে নিশ্চয়ই কোথাও—

চৌধুরী মশাই বলতেন–কিন্তু কোথায় গেছে সেটা বলবে তো?

প্রীতিলতা বলতো কিন্তু কোথায় গেছে তা আমি কী করে বলবো? তার বয়েস হয়েছে, সে নিজের খুশীমতো যেখানে ইচ্ছে ঘুরে বেড়াবে। আমাকে সে বলে যাবে নাকি?

এর জবাবে চৌধুরী মশাই কী আর বলবেন! নিজের অভিলাষের অপূর্ণতার দুঃখটা নিজের মনেই হজম করবার চেষ্টা করতেন। কিন্তু এমনি করে আর বেশিদিন চললো না। শেষকালে সমস্ত রোগের একমাত্র উপশম হিসেবে যখন খোকার বিয়ের প্রসঙ্গটা উঠলো, তিনি এক কথাতেই রাজি হয়ে গেলেন। ভাবলেন, হয়ত বিয়ের পরই সব কিছু সহজ স্বাভাবিক হয়ে যাবে। যেমন সবার হয়ে থাকে।

কিন্তু সেই বিয়ের দিনেই যে খোকা এমন কাণ্ড করে বসবে তা কে কল্পনা করতে পেরেছিল! প্রকাশই বিয়ের সম্বন্ধ করেছিল সুতরাং তারই যত দায়িত্ব। সে-ই ছুটলো চারিদিকে। চারিদিকে সকলকে নেমন্তন্ন করা হয়েছে, দই, মাছ, মিষ্টি সব কিছু তৈরি। অধিবাস নিয়ে কুটুমবাড়ি থেকে লোক এসে গেছে অথচ বর নেই। নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হলো চৌধুরী মশাই-এর। কুটুমবাড়ির লোককে কী জবাব দেওয়া হবে!

কিন্তু না, প্রকাশ করিতকর্মা লোক বটে। বেলা তখন দ্বিতীয় প্রহর উৎরে গেছে। হঠাৎ খোকাকে নিয়ে এসে হাজির!

চৌধুরী মশাই খবর পেয়েই দৌড়ে নিচেয় গেছেন।

গিয়ে বললেন–কী হলো, কোথায় পেলে ওকে?

প্রকাশ বললে–সে সব কথা এখন থাক জামাইবাবু, সে অনেক কাণ্ড!

–অনেক কাণ্ড? অনেক কাণ্ড মানে কী, খুলে বলো! বেলা তিনটেয় বাড়ি থেকে বর নিয়ে বেরোতে হবে। হাতেও আর সময় নেই। এদিকে কুটুমবাড়ি থেকে লোক এল, অধিবাসের তত্ত্ব নিয়ে যারা এসেছিল তারা দেখে গেছে যে বরের গায়ে-হলুদ হয়নি

প্রকাশ বললে–তাদের বললেন কেন যে গায়ে-হলুদ হয়নি?

চৌধুরী মশাই বললেন বলতে হবে কেন? তাদের চোখ নেই? তারা তো সবই দেখতে পেলে–

প্রকাশ তাতেও ভয় পাবার লোক নয়। তার হাতে যখন সব কিছুর ভার দেওয়া হয়েছে তখন সেটা তারই দায়। বললে–ঠিক আছে, কুছ পরোয়া নেই, আমি বরকে কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সময়ে হাজির করবোই, আমার ওপর ভর দিয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন–

দিদিও খবর শুনে কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। বললে–হ্যাঁ রে প্রকাশ, খোকাকে কোথায় পেলি তুই শেষ পর্যন্ত?

প্রকাশ বললে–তুমি এখন কথা বলতে বসো না দিদি, তুমি গায়ে-হলুদের যোগাড় করো গে, বিকেল তিনটেয় আমরা বর নিয়ে যাত্রা করবো। নইলে ট্রেন ধরতে পারবো না। আমার একটা জরুরী কথা আছে জামাইবাবুর সঙ্গে, তুমি এখান থেকে যাও–

তারপর চৌধুরী মশাইকে একপাশে ডেকে নিয়ে গেল প্রকাশ।

বললে–একটা কথা আছে জামাইবাবু, সদাকে পেয়েছি কোথায় জানেন, কাউকে যেন বলবেন না, পেয়েছি কালীগঞ্জে-

কালীগঞ্জে?

–হ্যাঁ, কালীগঞ্জের বউ-এর কাছে গিয়ে উঠেছিল সদা। জানি না কালীগঞ্জের বউ সদাকে কী ফুস মন্তর দিয়েছে, দশ হাজার টাকা না দিলে সদা বিয়ে করতে যাবে না–

–দশ হাজার টাকা? কালীগঞ্জের বউকে দিতে হবে?

–হ্যাঁ, তা না দিলে সদা বিয়ে করতেই যাবে না। ওর দাদু কালীগঞ্জের বউকে কথা দিয়েছিল। সেই কথা এখন রাখতে হবে!

চৌধুরী মশাই-এর বিস্ময়ের ঘোর যেন তখনও কাটেনি। বললেন–সে সব তো অনেক কাল আগেকার কথা। ওই কালীগঞ্জের বউ-ই তো আমাদের নামে মামলা করছিল। তখন বাবা কথা দিয়েছিল দশ হাজার টাকা দিয়ে সব মিটিয়ে নেবে–তা খোকা এ সব জানলে কী করে?

প্রকাশ বললে–কী জানি কী করে জানলে। সেখান থেকে তো সদা কিছুতেই আসতে চায় না, শেষে আমি বললুম যেনবাবগঞ্জে গিয়ে তোকে টাকা দেওয়া হবে, তবে এলো। এখন টাকাটার একটা বন্দোবস্ত করুন–

চৌধুরী মশাই বললেন–এখনই টাকা দিতে হবে?

প্রকাশ বললে—হ্যাঁ–

–টাকা না দিলে?

–টাকা না দিলে ও বিয়ে করতে যাবে না।

–তা টাকা পরে দিলে চলবে না? বিয়ে-টিয়ে আগে মিটে যাক তারপর না হয় ভেবে চিন্তে টাকা দেওয়া যাবে।

প্রকাশ বললে–তা বোধ হয় শুনবে না সদা, ও যা বেয়াড়া ছেলে আপনার। একবার যখন গোঁ ধরেছে তখন টাকা না দিলে ছাড়বেই না।

মহা ভাবনায় পড়লেন চৌধুরী মশাই। ওদিকে বেশি ভাববারও সময় নেই। বেলা তিনটেয় ট্রেন, সেই ট্রেন ধরে রাণাঘাটে যেতে হবে। সেখান থেকে আবার কেষ্টনগর।

শেষকালে আর কিছু না ভেবে পেয়ে বললেন–দেখি, একবার বাবাকে গিয়ে বলে আসি–

বলে চৌধুরী মশাই ওপরে চলে গেলেন।

প্রকাশ মামা সদানন্দর কাছে এল। সদানন্দ জিজ্ঞেস করলে–কী হলো?

প্রকাশ মামা বললে–হচ্ছে, টাকার ব্যবস্থা হচ্ছে। জামাইবাবু তোর দাদুর কাছে টাকা আনতে গেছে। তুই কিচ্ছু ভাবিস নি, তোর টাকা পেলেই তো হলো। তোর দাদুর কি টাকার অভাব? দশ হাজার টাকা তোর দাদুর হাতের ময়লা–

সদানন্দ বললে–ঠিক আছে, দাদু যদি টাকা দেয় তো ভালো, কিন্তু টাকা না দিলে আমি কিন্তু বিয়ে করতে যাবো না, এ আমি তোমায় জানিয়ে রাখছি–ততক্ষণে ওপর থেকে ডাক এলো। ওপরে যেতে হবে দু’জনকে।

সদানন্দ আগে আগে পেছন-পেছন প্রকাশ মামা। দাদুর ঘরে তখন কৈলাস গোমস্তা আর চৌধুরী মশাই রয়েছে। বিছানার ওপর আধ-শোওয়া অবস্থায় দাদু।

সদানন্দকে দেখেই দাদু বললেন–কী সব পাগলামির কথা শুনছি তোমার? তোমার না বয়েস হয়েছে? এই বয়সে কি তোমার ছেলেমানুষী এখনও গেল না?

সদানন্দ কিছু উত্তর দিলে না। চুপ করে রইল।

–কথা বলছো না যে? যাও, বিয়ে করতে যাও। শেষকালে কি ট্রেন ফেল করবে নাকি?

সদানন্দ বললে–কিন্তু টাকা?

নরনারায়ণ চৌধুরীও তেমনি লোক। বললেন–টাকা কি হুট বললেই আসে?

তুমি বললে–টাকা দাও আর আমিও অমনি টাকা দিয়ে দিলুম, তাই কখনও হয়, না হয়েছে? টাকা দেওয়া হবেখন। তুমি এখন যা করতে যাচ্ছো তাই করতে যাও–শেষকালে কি লোক হাসাবে নাকি?

সদানন্দর মুখে সেই একই জবাব। বললে–টাকা না দিলে আমি যাবো না–

নরনারায়ণ চৌধুরীর জমিদারি মেজাজ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো–বলছি তো টাকা আমি দেব। আমার কথার একটা দাম নেই? তোমার জিদটাই বজায় থাকবে?

–কিন্তু কখন টাকা দেবেন?

নরনারায়ণ চৌধুরী বললেন–তুমি কাল বিয়ে করে ফিরে এলেই দেব–

–যদি না দেন?

এতক্ষণে চৌধুরী মশাই কথার মধ্যে মুখ খুললেন। বললেন–আর তুমি কথা বাড়িও না খোকা, দাদু যখন বলছেন টাকা দেবেন তখন তার ওপরে আর কথা বলো না। আর এ নিয়ে কথা কাটাকাটি করলে ওদিকে গায়ে-হলুদের দেরি হয়ে যাবে, ট্রেনও ফেল করবো আমরা–

সদানন্দ বোধ হয় এতক্ষণে একটু নরম হলো। বললে–তোমরা সবাই কথা দিচ্ছ তাহলে? আমি এখন যাচ্ছি বটে, কিন্তু তোমরা সাক্ষী রইলে। টাকা না দিলে কিন্তু সর্বনাশ হয়ে যাবে,–এই বলে রাখলুম, চলো–

এতক্ষণে যেন চৌধুরী মশাই নিশ্চিন্তের হাঁফ ছাড়লেন। সব মিটে গেল। কর্তাবাবু ছেলেকে আলাদা করে ডেকে বলে দিলেন–তুমি সঙ্গে যাচ্ছো তো, একটু নজর রেখো, যেন আবার কোনও গণ্ডগোল না করে বসে সেখানে। তুমি কন্যে-কর্তার বাড়িতে রাত্তিরে থেকো

চৌধুরী মশাই বললেন–হ্যাঁ, আমি তো সঙ্গে যাচ্ছিই, রাত্রে সেখানেই থাকবো, সম্প্রদান পর্যন্ত দেখবো, তারপর নিরঞ্জন রইল, প্রকাশ রইল, তাদেরও একটু পাহারা দিতে বলবো–

নরনারায়ণ চৌধুরী বললেন–ছেলেমানুষের মন, কেউ হয়ত নানা রকম মতলব দিয়ে ওর মাথাটা গরম করে দিয়েছে, ও নিয়ে তুমি ভেবো না। ছেলেবয়সে বিয়ের আগে ওরকম সকলেরই মাথা গরম হয়। তারপর বিয়ে-থা হয়ে গেলে আবার যেমন-কে-তেমন, ও-সব আমার অনেক দেখা আছে—

তা এর পর আর কোন গণ্ডগোল হয় নি। তাড়াহুড়ো করে গায়ে-হলুদ হয়েছে সদার, জামা-কাপড় বদলে নিয়ে সবাই দুর্গা দুর্গা বলে যাত্রা করেছে। তারপর বিয়েও হয়েছে, বাসর ঘরও হয়েছে। সদানন্দ কোনও বেয়াড়াপনা করে নি।

একবার শুধু প্রকাশ মামাকে সদানন্দ জিজ্ঞেস করেছে–দাদু টাকা দেবে তো ঠিক প্রকাশ মামা?

প্রকাশ মামা বলেছে–আরে তুই অত ঘাবড়াচ্ছিস কেন? টাকা পেলেই তো তোর হলো?

নতুন বউকে নিয়ে ট্রেনে উঠেছে সবাই। সঙ্গে প্রকাশ মামা আছে। প্রকাশ মামা বরকর্তা। আর আছে নিরঞ্জন। আসবার সময় বেয়াই মশাই-এর চোখ দুটোও জলে ভরে এসেছিল। একমাত্র সন্তান, এই নয়নতারাই ছিল তাঁর সব। মেয়েও যত চোখের জল ফেলেছে, মেয়ের মা বাবাও তত। ট্রেনে ওঠবার সময় কালীকান্ত ভট্টাচার্য আর থাকতে পারেন নি। একেবারে প্রকাশ মামার হাত দুটো জাপটে ধরেছিলেন।

বলেছিলেন–আমার মেয়েকে একটু দেখবেন বেয়াই মশাই, ও-মেয়ে সংসারের কিছুই জানে না, দোষ-ত্রুটি যা-কিছু সব ক্ষমা করে নেবেন।

প্রকাশ মামা বলেছিল–আপনি কিছু ভাববেন না বেয়াই মশাই, আপনার মেয়ের অনেক পুণ্যফলে অমন শ্বশুর-শাশুড়ী পেলে। অমন শ্বশুর-শাশুড়ী কোনও মেয়ে পায় না।

তারপর ট্রেন ছেড়ে দিলে। নয়নতারা অনেকক্ষণ ধরে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে রইল। তারপর যখন বাবাকে আর দেখা গেল না তখন ঘোমটার আড়ালে কান্নায় ভেঙে পড়লো।

তারপর বর-কনে যখন নবাবগঞ্জে এসে পৌঁছুলো তখন বেলা পড়ো-পড়ো। বাড়ির ভেতর থেকে উলুর শব্দ উঠলো, শাঁখ বেজে উঠলো। নতুন বউ এসেছে চৌধুরীবাড়িতে। চৌধুরীবাড়ির প্রথম লক্ষ্মী এসেছে। এ-গ্রাম ও গ্রাম থেকে লোকজন মেয়ে-পুরুষ একবারে ভেঙে পড়লো।

বারোয়ারীতলার নিতাই হালদারের দোকানের মাচায় তখন রীতিমত সভা বসে গেছে।

কেদার বললে–বউ কী রকম দেখলি রে গোপাল?

গোপাল ষাট বললে–আমি আর কখন দেখলুম, আমার বউ গিয়েছিল, বললে–একেবারে জগদ্ধাত্রীর মত রূপ। বড়লোকের ছেলের বউ, আমাদের মতন শাঁকচুন্নী বউ হবে নাকি?

–কেন, তোর বউকে কি খারাপ দেখতে?

গোপাল ষাট বললে–খারাপ বলে খারাপ, একেবারে রক্ষেকালীর বাচ্চা ভাই, যখন আমার সঙ্গে ঝগড়া করে তোরা সে-চেহারা দেখিস নি–

সবাই হেসে উঠলো। নিতাই বলে উঠলো–ওরে তা নয়, আসলে পরের বউকে সকলেরই ভালো লাগে। যার সঙ্গে ঘর করতে হয় সে তো পুরোনো হয়ে যায়–

কেদার বললে–ওরে, এই আমার কথাই ধর না। আমি যখন বিয়ে করেছিলুম তখন সবাই বউ দেখে বললে–পরী। তারপর বছর বছর ছেলে বিইয়ে বিইয়ে চেহারাটা এমন করে ফেললে যে তার দিকে এখন চাইতে ঘেন্না করে আমার বউ তো নয় যেন কাঁঠাল গাছ–

নিতাই বললে–তা কাঁঠাল গাছের কী দোষ, কাঁঠাল গাছের গোড়ায় অত জল ঢাললে ফলন তো হবেই।

কথাটা-শুনে আর এক চোট হাসি উঠলো।

কিন্তু তখন চৌধুরি বাড়ির ভিড় একটু করে পাতলা হয়ে আসছে। প্রকাশ মামাই সকলকে তাড়া দিতে লাগলো। বললে–সরো সরো বাপু তোমরা, একটু ভিড় পাতলা করো, কাল সারা রাত বউ ঘুমোয় নি–সরো, একটু হাঁফ ছাড়তে দাও–

সদানন্দ একটা ফাঁকা জায়গায় খোলা আকাশের নিচেয় গিয়ে দাঁড়ালো। একটা অস্বস্তিকর অবস্থার আবহাওয়া তাকে যেন এতক্ষণ গ্রাস করেছিল। এবার সে মুক্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো।

হঠাৎ একটা আওয়াজ কানে এলো-আরে, তুই এখানে? আর আমি তোকে খুঁজে খুঁজে মরছি–

প্রকাশ মামা কাছে এসে দাঁড়ালো। বললে–তোকে যে সবাই খোঁজাখুঁজি করছে—আর—

সদানন্দ জিজ্ঞেস করলে–আমাকে কী দরকার, এখন তো বিয়ে হয়ে গেছে।

প্রকাশ মামা বললে–তোর মেজাজ এমন তিরিক্ষে কেন রে? বিয়ে করে এলি সুন্দরী বউ হলো তবু তোমার তিরিক্ষে মেজাজ গেল না, আয় আয়–

সদানন্দ বললে–কিন্তু আমার টাকা?

প্রকাশ মামা বললে–আরে, টাকা কি তোর পালিয়ে যাচ্ছে?

সদানন্দ বললে–না, দাদু বলেছিল আমি বিয়ে করে আসার পর টাকা দেবে। আমি সেই টাকা নিয়ে এখনই কালীগঞ্জের বউকে গিয়ে দিয়ে আসবো–

প্রকাশ মামা বললে–তাহলে তোর দাদুকে গিয়ে তুই বল–দাদু তো বলেই ছিল টাকা দেবে–

সদানন্দ বললে–আমি এখনই যাচ্ছি–

নরনারায়ণ চৌধুরীর মেজাজটা বেশ ঠাণ্ডা ছিল। এমনিতে সম্পত্তির ঝঞ্ঝাটে মেজাজ তাঁর সহজে ঠাণ্ডা থাকে না। নতুন বউ তাঁকে এসে প্রণাম করে গেছে। তিনি তাকে আশীর্বাদ করেছেন। আশীর্বাদ করেছেন যেন সে এবংশের সুখ-সমৃদ্ধি করে। যেন বংশ পরম্পরায় চৌধুরী বংশের অক্ষয়কীর্তি অমর করে রাখে। আর নতুন বউ-এর রূপ দেখেও তিনি খুশী হয়েছিলেন। রূপ বটে! যেমন রূপ তিনি আশা করেছিলেন ঠিক তেমনি। আর শুধু রূপ নয়, লক্ষণও ভালো। তিনি ভালো করে বউ-এর মুখখানা খুঁটিয়ে দেখছিলেন। সুলক্ষণা যাকে বলে ঠিক তাই, এ পারবে। এ তাঁর নাতির বেয়াড়াপনা দূর করবে।

হঠাৎ সামনে যেন ভূত দেখলেন। বললেন–কে?

সদানন্দ বললে–আমি সদানন্দ–

–ও, তা কী চাও?

সদানন্দ বললে–আমার টাকা–

–টাকা?

টাকার কথা শুনে নরনারায়ণ চৌধুরী চমকে উঠলেন। টাকা! যেন কিছুই জানেন না তিনি। যেন কিছুই তার জানবার কথা নয়। যেন কাউকে তিনি টাকা দেবার কথা বলেনও নি। কথাটা শুনে তিনি বাবার মত তাঁর নাতির মুখের দিকে চেয়ে রইলেন।

তারপর বললেন–কিসের টাকা?

সদানন্দ বললে–আপনার মনে নেই আপনি দশ হাজার টাকা দেবেন বলেছিলেন? আপনি বলেছিলেন আমি বিয়ে করে এলেই আপনি কালীগঞ্জের বউকে দশ হাজার টাকা দেবেন

কর্তাবাবুর যেন এতক্ষণে মনে পড়লো। বললেন–তা দেব যখন বলেছি তখন দেব। আমি কি বলেছি দেব না?

সদানন্দ বললে–তাহলে দিন টাকা আমি তাকে দিয়ে আসি–

কর্তাবাবু এতক্ষণে চটে গেলেন। বললেন তুমি কেন দিতে যাবে? তুমি এখন বাড়ি ছেড়ে যাবে কী করে? আর তুমি ছাড়া কি টাকা দিয়ে আসবার লোক নেই? আমি কি লোক দিয়ে টাকা পাঠাতে পারি না?

সদানন্দ বললে–কেন পাঠাতে পারবেন না, কিন্তু আমি জানি আপনি তা পাঠাবেন না। পাঠালে অনেক আগেই তা পাঠাতেন।

কর্তাবাবু নাতির কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। এমন সুরে তো সদানন্দ কখনও কথা বলে না। কথার এত তেজ কোথায় পেলে সে? অবশ পা দুটো সামনের দিকে টানবার চেষ্টা করতে গিয়ে তিনি মনে মনে ছটফট করতে লাগলেন। বললেন–তুমি হঠাৎ এত কড়া কড়া কথা বলছো যে? কে তোমাকে এসব কথা শিখিয়েছে?

সদানন্দ বললে–কে আবার শেখাবে? আপনি বলেছিলেন টাকা দেবেন, তাই আপনার কথাই আপনাকে মনে করিয়ে দিতে এসেছি—

কর্তাবাবু বললেন–মনে করিয়ে তোমাকে দিতে হবে না। তুমি তোমার নিজের ধান্দা নিয়ে থাকো। এখন বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন লোকজন এসেছে, তাদের দেখাশোনা করো তাহলেই যথেষ্ট করা হবে। এখন যাও–

সদানন্দ তবু নড়লো না, বললে–কিন্তু আপনি তো আপনার কথা রাখলেন না দাদু, আমি আপনার কথাতেই বিয়ে করতে গিয়েছি, এখন আপনি আপনার কথা রাখুন। টাকা দিন–

–আরে, এ তো মহা মুশকিলে পড়া গেল দেখছি। বাড়িতে নতুন বউ এসেছে, কোথায় সেই নিয়ে সবাই ভাবছে, আর এখন কি না বলে টাকা দাও! অমনি টাকা দিলেই হলো?

তারপর কী করবেন বুঝতে পারলেন না। বললেন–এখন আমি ব্যস্ত আছি, পরে তোমার সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলবো, তুমি এখন ভিতরে যাও

–না আমি যাবো না। আগে আমার টাকা চাই—

কর্তাবাবু বললেন–কী বললে–তুমি?

সদানন্দ বললে–আগে আপনি টাকা দেবেন তবে এখেন থেকে নড়বো—

কর্তাবাবু কৈলাসের দিকে চেয়ে বললেন–কৈলাস একবার ছোটবাবুকে ডাকো তো–

কৈলাস গোমস্তা উঠে নিচেয় চলে গেল। সদানন্দও সেই ঘরের মধ্যে কাঠের পুতুলের মত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। সেই ঠিক করেই ফেলেছিল যে সে টাকা না নিয়ে ঘর থেকে আর বেরোবে না। সমস্ত বাড়ি তখন উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজনে মুখর। আজ চৌধুরীবাড়ীতে নতুন বউ এসেছে। মেয়েরা উলু দিয়েছে, শাঁখ বাজিয়েছে। বাড়ির সব লোকজন নতুন কাপড় পেয়েছে। কৈলাস গোমস্তা থেকে শুরু করে রজব আলী পর্যন্ত কেউ বাদ যায় নি। এমন ঘটনা তো রোজ রোজ ঘটে না। আবার কত বছর পরে এ বাড়িতে এমন ঘটনা ঘটবে কে বলতে পারে! বউ আসবার সঙ্গে সঙ্গে পাড়ার সব বউ-ঝিরা এসে– ভিড় করেছে। কেদার, গোপাল ষাট সবাই নিজের নিজের বউদের আগাম পাঠিয়ে দিয়েছে। বউভাতের দিন সবাই তো বউ দেখতে পাবেই। কিন্তু তার তো অনেক দেরি। চব্বিশ ঘণ্টা না গেলে তো আর বউভাত হচ্ছে না। শুধু বউভাতই নয়, ফুলশয্যাও হবে, বাড়ির উঠোন জুড়ে শামিয়ানা খাটানো হয়েছে। যেদিকে পুকুরঘাট সেই দিকটাতেই বসেছে ভিয়েন। সেখানে বড় বড় দশখানা উনুন তৈরি হয়েছে। দুদিন আগে থেকে সেখানে মিষ্টি তৈরি শুরু হয়ে গিয়েছে। রসগোল্লা তৈরি হবার পর গামলায় তুলে রাখতে হবে। সেই সব গামলাও এসে গিয়েছে। সেগুলো সার সার বসানো হয়েছে পুকুরের ধার ঘেঁষে। কিন্তু আসল বড় সামিয়ানাটা খাটানো হয়েছে বাড়ির সামনে। সেখানে বসবে বিশিষ্ট অতিথিরা।

প্রকাশ মামার এসে পর্যন্ত সময় নেই, পরশু থেকে নাইবার খাবার সময় ছিল না। দু’রাত নাগাড়ে জাগা। তার ওপর কেষ্টনগর থেকে বর কনে নিয়ে আসার পর দেখেছে যোগাড় যন্তর কিছুই হয় নি, অথচ রাত পোহালে সব লোকজন এসে হবে। তারপর আছে সদানন্দকে নিয়ে ভাবনা। সে কোথায় কখন কী করে বসে তার ঠিক নেই। রাস্তায় আসতে আসতে সদানন্দ অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে–টাকা পাওয়া যাবে তো ঠিক, প্রকাশ মামা?

প্রকাশ মামা বলেছে–তুই অত ভাবছিস কেন? তোর দাদু তো নিজের মুখে তোকে বলেছে টাকা দেবে, তাহলে আর তোর এত ভাবনা কীসের?

সদানন্দ বলেছে–না, কথা না রাখলে কিন্তু আমি দেখে নেব, তা বলে রাখছি

প্রকাশ মামা বলেছে টাকা না দিলে তুই কী করবি?

সদানন্দ বলেছে–কী করবো তা আমিই জানি–

–কী করবি তুই বল্ না। এখন তো বিয়ে তোর হয়েই গেছে। এখন তো আর তা বলে বউকে ফেলে দিতে পারবি না–

–সে আমি যা করবো, তুমি তা দেখতেই পাবে।

প্রকাশ মামা ভাগ্নের কথা শুনে হেসেছে। বলেছে–ওরে, প্রথমে সবাই ওরকম বলে রে! তারপর বউ-এর মুখ দেখে সবাই ভুলে যায়। আর এ তোর যে-সে বউ নয়। এ বউকে তুই ফেলতে পারবি? এই রকম সুন্দরী বউকে?

উত্তরে সদানন্দ কিছু কথা বলে নি। কিন্তু প্রকাশ মামা বুঝেছে বউ-এর মুখ দেখে তার ভাগ্নে গলে গেছে। এক রাত্রের মধ্যেই ভাগ্নের মুখের চেহারা বদলে গেছে। তার পরে ফুলশয্যার রাতটা একবার কাবার হোক তখন আবার সদানন্দ অন্য মানুষ হয়ে যাবে। তখন আর বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতেই চাইবে না। প্রকাশ মামা পাকা লোক। অনেক পুরুষ অনেক মেয়েমানুষকেই চরিয়েছে। সুতরাং সদানন্দ যা-কিছু টাকা-টাকা করেছে একটা রাত কাটলেই সব থিতিয়ে আসবে, এ সম্বন্ধে প্রকাশ মামার আর কিছু সন্দেহ ছিল না।

রাস্তায় ট্রেনের কামরায় প্রকাশ মামা ভাগ্নের কানের কাছে মুখ নিয়ে গেল।

বললে–কী রে, কী ভাবছিস?

সদানন্দ বললে–ভাবছি দাদু টাকাটা দেবে তো ঠিক?

প্রকাশ মামা বললে–তুই দেখছি আস্ত পাগল! কালীগঞ্জের বউ তোর কে শুনি যে তার টাকার জন্যে তুই মাথা ঘামচ্ছিস? আর বুড়িটা ক’দিনই বা বাঁচবে? ও টাকা পেলেই বা কী আর না পেলেই বা কী! তোর এমন বিয়ে হয়েছে, তুই এখন বিয়ের কথা ভাব। তুই এখন ভাব ফুলশয্যার রাত্তিরে বউ-এর সঙ্গে প্রথমে কী কথা বলবি–

সদানন্দ এ কথার কোনও উত্তর দিলে না।

প্রকাশ মামা বললে–দ্যাখ, তুই তো একটা আনাড়ির ডিম। তোকে আমি অনেক চেষ্টা করেও তো মানুষ করতে পারলুম না। রাধার ঘরে তোকে নিয়ে গিয়েই আমি তা বুঝেছি। মেয়েমানুষ দেখলে তুই অত ঘাবড়ে যাস কেন? কাল ফুলশয্যার রাত্তিরে যেন ঘাবড়ে যাস নি, বুঝলি?

সদানন্দ সে কথারও কিছু উত্তর দিলে না।

প্রকাশ মামা বললে–কী রে, কথা বলছিস না যে, ফুলশয্যার রাত্তিরে বউ-এর সঙ্গে প্রথমে কী কথা বলবি সব ভেবে রেখেছিস তো?

তবু সদানন্দর মুখে কোনও জবাব নেই।

প্রকাশ মামা তবু ছাড়লে না। বললে–কী রে, বুঝলি কিছু? কি বলছি তা বুঝতে পারলি?

সদানন্দ বললে—না–

–আরে, এই সোজা কথাটাও বুঝতে পারলি নে? জীবনে একটা অচেনা মেয়ের সঙ্গে প্রথম কথা বলবার আগে একটু ভেবে-চিন্তে নিতে হয়, বুঝলি? কিছু ভেবেছিস তুই?

সদানন্দ বললে–ভাববো আবার কী?

প্রকাশ মামা বললে–এই মরেছে! তুই দেখছি এখনও আনাড়ি আছিস! শোন, তোকে আমি বুঝিয়ে দিই, প্রথমে তো ঘরে ঢুকবি। ঢুকে দরজার খিল দিয়ে দিবি। তোর বউ যদি তখন চুপ করে খাটের বাজু ধরে দাঁড়িয়ে থাকে তো তুই আস্তে আস্তে তার কাছে গিয়ে…..

সদানন্দ হঠাৎ বলে উঠলো–কিন্তু একটা কথা প্রকাশ মামা, তোমার কথাতেই কিন্তু আমি বিয়ে করেছি, তা মনে থাকে যেন

অন্য প্রসঙ্গ আসতে প্রকাশ মামা বিরক্ত হয়ে উঠলো, বললে–তার মানে?

সদানন্দ বললে–তার মানে তুমি ভালো করেই জানো, দুবার করে তা আর শুনতে চেয়ো না। আমার কিন্তু দশ হাজার টাকা চাই।

প্রকাশ মামা বললে–দশ হাজার টাকা আমি কোথায় পাবো? তোর দাদু সে-টাকা দেবে।

–হ্যাঁ, আমি বাড়ি ফিরে গিয়েই টাকা চাইবো। তখন দাদু টাকা না দিলে কিন্তু তোমাকে সেটা পাইয়ে দিতে হবে। তোমার দায়িত্ব সেটা। শেষকালে যেন বোল না তোমার কোনও দায়িত্ব নেই–

–আরে, তুই দেখছি সেই যাকে বলে মালে ভুল তালে ঠিক।

সদানন্দ বললে–সে তুমি যাই বলো, আমি কিন্তু তখন তোমাকে ছাড়বো না। তখন যেন বলো না যে তুমি কিছু জানো না!

প্রকাশ মামা বলে উঠলো–দ্যাখ দিকিন, এখন কি ও সব কথা ভাববার সময়? কোথায় তুই বউ-র ঘোমটার ভেতর উঁকি মেরে দেখবার চেষ্টা করবি, কোথায় ফুলশয্যার রাত্তিরে কী কথা বলবি সেই কথা ভাববি, তা নয় যত সব…

ট্রেনের কামরার মধ্যে নতুন বর-কনে চলেছে তখন। অন্য প্যাসেঞ্জাররা নতুন কনের ঘোমটার ফাঁক দিয়ে তার মুখ দেখবার চেষ্টা করছে। হু-হু করে চলেছে ট্রেনটা। তারপর একসময় এসে থামলো রেলবাজারে। রজব আলি গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের সঙ্গে পালকীর বন্দোবস্তও ছিল। এর পরে আর কোনও গণ্ডগোল হয় নি। নবাবগঞ্জে বর কনেকে দিদির হেপাজতে রেখে ভিয়েন আর শামিয়ানা নিয়ে পড়েছিল। যেদিকে প্রকাশ মামা না দেখবে সেই দিকেই তো চিত্তির!

হঠাৎ কৈলাস গোমস্তা এসে ডাকলে–শালাবাবু, ছোটবাবু একবার ডাকছেন আপনাকে–

–ছোটবাবু? কেন? কোথায়?

–ওপরে।

–আচ্ছা, যাচ্ছি,–তুমি যাও—

বলে আর দাঁড়ালো না। কাজকর্ম ফেলে দোতলায় সিঁড়ির দিকে চলতে লাগলো। কিন্তু ওপরে তখন আর এক নাটকের অভিনয় চলছে। চৌধুরী মশাই গিয়ে হাজির হয়েছেন সেখানে। সদানন্দও রয়েছে। প্রকাশ যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছুল তখন কর্তাবাবু বেশ রেগে উঠেছেন। –বলছেন তাহলে তোমার কথাই ঠিক থাকবে? আর আমি কেউ নই? আমার কথার কোনও দাম নেই? আমি তো বলছি ফুল-শয্যা-টয্যা হয়ে যাক তখন টাকার বন্দোবস্ত করবো। হুট করে বললেই কি টাকা বেরোয়? আর অত টাকা কি এক সঙ্গে কেউ ঘরে রাখে? ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলতেও তো সময় চাই?

সদানন্দ বললে–কিন্তু তখন কেন বললেন যে, আমি বিয়ে করে ফিরে এলেই টাকা দেবেন? আপনি তো এতক্ষণে আজকের মধ্যে কাউকে দিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে রাখতে পারতেন!

কর্তাবাবু বললেন–তার কৈফিয়ৎ কি তোমাকে দিতে হবে নাকি?

সদানন্দ বললে–কিন্তু আপনি তো জানতেন আমি বিয়ে করে ফিরে এসেই টাকাটা চাইবো।

কর্তাবাবু বললেন–গুরুজনদের সঙ্গে কেমন করে কথা বলতে হয় তাও দেখছি তুমি শেখো নি–

সদানন্দ বললে–আপনারা গুরুজন বলে কি আপনাদের সাতখুন মাফ? আমি তার প্রতিবাদ করতেও পারবো না?

চৌধুরী মশাই এবারে ছেলের দিকে চাইলেন। বললেন–তুমি চুপ করো। কার সঙ্গে কেমন করে কথা বলতে হয় তাও জানো না। যাও যাও, নিচেয় যাও, এখন আমাদের অনেক কাজকর্ম পড়ে আছে। কালকে আত্মীয়-স্বজন কুটুমরা আসবে, তাদের ব্যবস্থা করতে হবে, এই সময়ে কিনা তুমি দাদুকে এই রকম বিরক্ত করতে এলে, দুদিন সবুর করতে পারলে না? এখন যাও, পরে ওসব ব্যাপার হবে–

সদানন্দ বললে–তুমি এটা কী বলছো বাবা? যখন দাদু কথা দিয়েছিলেন, তখন তুমিও তো শুনেছ! এমন করবে জানলে তো তখন আমি বিয়ে করতেই যেতুম না।

–থামো!

কর্তাবাবু বিছানায় শুয়ে শুয়েই চিৎকার করে উঠলেন–থামো, থামো, বেয়াদপিরও একটা সীমা আছে।

বেয়াদপি আমি করছি না আপনি করছেন? আপনি কেন এমন করে একজন বিধবার সর্বনাশ করলেন? কেন তার সর্বস্ব কেড়ে নিলেন? কেন তাকে কথা দিয়ে কথা রাখলেন না?

হঠাৎ সমস্ত বাড়ির লোকজন বেশ সচকিত হয়ে উঠলো। কর্তাবাবুর ঘরের ভেতরে একটা গোলমালের আওয়াজ হতেই সবাই কান পেতে গোলমালের কারণটা জানতে চাইল। গৌরী পিসী সিঁড়ির তলা দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ চমকে উঠলো। কীসের আওয়াজ? ভেতরে বাড়ির ঘরে তখন নতুন বউকে ঘিরে অনেক অভ্যাগতের ভিড়। কাছে গিয়ে ডাকলে–বউদি ও বউদি–

সদানন্দর মা ব্যস্ত ছিল। বললে–কী? কী বলছিস?

গৌরী বললে–কর্তাবাবুর ঘরে অত চেঁচামেছি হচ্ছে কীসের বলো তো?

–চেঁচামেচি হচ্ছে কীসের তা আমি কী করে জানবো?

গৌরী বললে–না, মনে হলো খোকার গলা শুনতে পেলাম। খোকাবাবুর সঙ্গে কর্তাবাবুর যেন কথা কাটাকাটি হচ্ছে–

–তাই নাকি?

এই এক ঘণ্টা আগে যে নতুন বউকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে এসেছে সে কী নিয়ে ঠাকুরদাদার সঙ্গে চেঁচামেচি করবে। সাধারণত সদানন্দ তো কারো সঙ্গে চেঁচিয়ে কথা বলে না। সে তো বরাবর চুপচাপই থাকে। সাধারণত কেউ তার মুখই দেখতে পায় না। সে যে কখন কোথায় থাকে কী করে কেউই তা জানতে পারে না। খেতে হয় তাই খায়। তারপর তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়েই আবার কোথায় বেরিয়ে যায় তাও কেউ জানতে পারে না। সে কেন গোলমাল করবে বাড়ির ভেতরে।

কিন্তু তখন ও-সব ভাবনা ভাববার সময় নেই বাড়ির গিন্নীর। প্রীতি বাড়ির গিন্নী। এই সমস্ত অন্দরমহলের মানুষগুলোর দায়িত্ব সমস্ত তার ওপর। কে খেতে পাচ্ছে, আর কে খেতে পাচ্ছে না তাও ভাবা তার দায়িত্ব। এতদিন পরে তার বাবা এসেছে ভাগলপুর থেকে। তিনি বুড়ো মানুষ। তাঁর একমাত্র নাতির আজ বিয়ে। এই প্রথম আর এই-ই বোধ হয় শেষ। কীর্তিপদবাবু সুলতানপুরে একলা পড়ে থাকেন। তারও অনেক সম্পত্তি। সেই সম্পত্তি দেখা-শোনার কাজেই তাঁর দিন কেটে যায়। অথচ তিনি চলে যাবার পর ওই সমস্ত সম্পত্তি তাঁরই মেয়ে-জামাই-নাতি পাবে। তখন এই নাতিকে যেমন নবাবগঞ্জের সম্পত্তি দেখতে হবে, তেমনি দেখতে হবে সুলতানপুরের সম্পত্তিও। তিনি যা কিছু করছেন সবই এদের জন্যে–এই মেয়ে জামাই আর নাতি! তাই নাতির বিয়ের সময় নবাবগঞ্জে না এসে পারেন নি।

এসেই মেয়ের সঙ্গে দেখা করেছেন। অনেকদিন পরে দেখা।

কীর্তিপদবাবু বললেন–কেমন আছিস রে প্রীতি? সব খবর ভালো তো?

প্রীতি বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালো। বললে–তুমি কত রোগা হয়ে গেছ বাবা–

কীর্তিপদবাবু বললেন–রোগা তো হবোই, বুড়ো হচ্ছি না? এখন তোদের রেখে যেতে পারলেই তো হয় রে–

প্রীতি জিজ্ঞেস করলে–আসতে তোমার কোনও কষ্ট হয় নি তো বাবা?

কীর্তিপদবাবু বললেন–আমার কষ্টর কথা রাখ। কুটুম কেমন হলো তাই বল? মেয়ে দেখতে-শুনতে ভালো তো?

প্রীতি বললে–শুনেছি তো মেয়ে দেখতে-শুনতে ভালো। আমি তো টাকা চাই নি। একটা পয়সা নেওয়া হয় নি, শুধু দেখতে-শুনতে সুন্দরী আর স্বভাব-চরিত্রটা ভালো হবে এই-ই চেয়েছিলুম। এখন কালকে বউ আসবে তখন বুঝবো।

খোকা কোথায়? তাকে তো দেখছি নে?

প্রীতি বললে–তার কথা আর বোল না।

কীর্তিপদবাবু জিজ্ঞেস করলেন–কেন? তার আবার কি হলো?

প্রীতি বললে–তাকে তো আমি চোখেই দেখতে পাই না। কখন সে থাকে, কখন থাকে, কোথায় যায়, কী করে, কেউ জানতে পারে না।

–তা কলেজে তো বি-এ পড়ছিল, পাস-টাস করেছে?

–পাস করলে কী হবে, বুদ্ধিসুদ্ধি ভালো হয় নি। বাড়ির কাজকর্ম এখন থেকে বুঝে নেওয়া উচিত, তা সেদিকেও মন নেই। টাকা-পয়সার দিকেও কোনও টান নেই।

কীর্তিপদবাবু মেয়ের কথা শুনে নিশ্চিন্ত হলেন। বললেন–ও কিছু না, ও নিয়ে তুই ভাবিস নি। ওর মতন বয়েসে সবাই ওই রকমই থাকে। তারপর এই এখন বিয়ে হচ্ছে, দেখবি কাঁধে জোয়াল পড়লেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ছোটবেলায় আমিও ওই তোর খোকার মতন ছিলুম–

বলে হাসতে লাগলেন। কিন্তু মেয়ের তখন বাবার সঙ্গে কথা বলবারও সময় ছিল না। ভাঁড়ারের চাবি যার শাড়ির আঁচলে তাকে সব দিকে নজর দিতে হয়। যাবার আগে বাবার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে অন্য কাজে মন দিতে হলো। খোকা যখন বিয়ে করতে গেল সেদিনও গণ্ডগোলের সৃষ্টি হলো। প্রকাশকে কাছে ডাকলেন কীর্তিপদবাবু। জিজ্ঞেস করলেন–গোলমালটা কীসের প্রকাশ? খোকা কোথায় ছিল?

প্রকাশও তখন অনেক কাজে ব্যস্ত। কালীগঞ্জ থেকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে সদানন্দকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে কোনও রকমে। তারপর বেলা করে গায়ে-হলুদ হয়েছে, যাত্রার জন্যে সবাই তৈরী হচ্ছে।

বললে–সে-সব আপনাকে পরে সব বলবো পিসেমশাই, সে অনেক কাণ্ড–এখন বলবার সময় নেই–

–অনেক কাণ্ড মানে?

প্রকাশ বললে–সদানন্দ এখন বায়না ধরেছে টাকা দিতে হবে, দশ হাজার টাকা দিলে তবে সে বিয়ে করতে যাবে–

দশ হাজার টাকা? দশ হাজার টাকা কাকে দেবে? নিজে নেবে?

–না।

–তবে কাকে দেবে?

–কালীগঞ্জের বউকে।

কীর্তিপদবাবু কিছুই বুঝতে পারলেন না। কালীগঞ্জের বউ আবার কে? খোকার বিয়ের সঙ্গে কালীগঞ্জের বউ-এর কীসের সম্পর্ক?

প্রকাশ বললে–পরে আপনাকে সব বুঝিয়ে বলবো, এখন আমার সময় নেই, দেরি হয়ে গেছে, আর দেরি হলে ট্রেন মিস করবো–

বলে প্রকাশ চলে গেল। তারপর শাঁখের শব্দ শোনা গেল। মেয়েদের উলু দেওয়ার শব্দ শোনা গেল। বর বিয়ে করতে চলে গেল। কীর্তিপদবাবু সবই দেখলেন, সবই শুনলেন।

এসব গতকালের ঘটনা। তারপর আজ নতুন বউ এসেছে। এসে নরনারায়ণ চৌধুরীর ঘরে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করে এসেছে। কীর্তিপদবাবুকেও প্রণাম করেছে। বাড়িতে অনেক লোকজনের ভিড়। বাইরে শামিয়ানা খাটানো হচ্ছে। প্রীতির বিয়ের সময় ভাগলপুরে এমনি হয়েছিল। এমনি করেই হয়ত এক পুরুষ থেকে আর এক পুরুষে বংশের ধারা গড়িয়ে চলে।

হঠাৎ বেয়াই মশাই-এর ঘর থেকে চেঁচামেচি-চিৎকারের শব্দ হতেই তিনি যেন চমকে উঠলেন। বাইরে বেরিয়ে এলেন। কাউকে কোথাও দেখতে পেলেন না। কাকে জিজ্ঞেস করবেন বুঝতে পারলেন না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হচ্ছে। সবাই নতুন বউকে দেখতেই ব্যস্ত। কিন্তু তখনও ওপরে চেঁচামেচি চলছে।

চৌধুরী মশাই বললেন–আমি কথা দিচ্ছি ফুলশয্যা মিটে গেলেই কালীগঞ্জের বউকে টাকা দিয়ে দেওয়া হবে। আমি নিজে তোমাকে কথা দিচ্ছি–

প্রকাশ মামা বললে–এবার হলো তো, এবার তাহলে তোর আর বলবার কিছু রইল না–তুই আর গোলমাল করিস নি—

নরনারায়ণ চৌধুরী অনেক কথা বলার পর ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন।

বললেন–তোমরা সবাই এখন যাও এখান থেকে আমার শরীর খারাপ লাগছে–

প্রকাশ মামা সদার দিকে চেয়ে বললে–চল্ চল্ এখান থেকে, দাদুকে আর বিরক্ত করিস নে। এখন তোর সব বায়না মিটলো তো।

সদানন্দ বললে–কিন্তু দাদু আগেও তো বলছিল টাকা দেবে, সে কথা কি রেখেছে?

–এবার ঠিক দেবে, আর একবার দ্যাখ। এবার না দিলে তোর যা ইচ্ছে তাই করিস।

সদানন্দর চোখ দিয়ে তখন কান্না বেরিয়ে আসছিল। ঘরের বাইরে যেতে যেতে বলতে লাগলো–জানো প্রাকাশ মামা, ও টাকা না দিতে পারলে আমি কালীগঞ্জের বউ এর কাছে মুখ দেখাতে পারবো না।

প্রকাশ মামা বললে–তা কালীগঞ্জের বউ-এর কাছে তোকে মুখ দেখাতে কে বলেছে? আর সে বুড়িই বা ক’দিন বাঁচবে? তারও তো আর বেশিদিন নেই।

সদানন্দ বললে–কিন্তু আমি? আমি নিজেকে কী বলে বোঝাব? আমার নিজের কাছেও তো আমার একটা দায়-দায়িত্ব আছে–

–তোর নিজের কাছে আবার কীসের দায়-দায়িত্ব? তুই বলছিস কী? এখন তুই বিয়ে করলি এখন যে কদিন বাঁচিস ফুর্তি করে যা! যতদিন তোর টাকা আছে কেবল পেট ভরে ফুর্তি করে যা। আমার যদি তোর মতন টাকা থাকতো দেখতিস আমি ফুর্তির ঘোড়দৌড় ছুটিয়ে দিতুম–

–না প্রকাশ মামা, তুমি জানো না, আমার দাদুর যত টাকা আছে, সব পাপের টাকা –

–পাপের টাকা? কী যা-তা বলছিস তুই?

সদানন্দ বললে–হাঁ, জানতে আমার কিছু বাকি নেই। কপিল পায়রাপোড়া গলায় দড়ি দিয়ে যে পাপ করছে, সে পাপ দাদুর। কালীগঞ্জের বউ-এর সর্বনাশ করেছে দাদু। মাখন ঘোষ, ফটিক প্রামাণিক, তাদেরও দাদু খুন করেছে। এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত না করতে আমারও সুখ-ভোগ করবার কোনও অধিকার নেই

প্রকাশ মামা সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলল–তোর দেখছি লেখাপড়া শিখে মাথাটার একেবারে বারোটা বেজে গেছে। আমরা তোর জন্যে ভেবে ভেবে মরছি, কালকে লোকজনকে কেমনভাবে খাতির-যত্ন করবো সেই ভাবনায় আমরা সবাই অস্থির হয়ে যাচ্ছি, আর তুই কি না যত আবোল-তাবোল কথা নিয়ে মাথা খারাপ করছিস–

সদানন্দ বললেন,–না, তুমি জানো না প্রকাশ মামা, তোমরা কেউই বুঝতে পারবে না, আমি যা বলছি তা সকলের ভালোর জন্যেই বলছি–এতে তোমাদের সকলের ভালো হবে। কালীগঞ্জের বউকে টাকাটা না দিলে বরং আমাদের ক্ষতি–

-কী ক্ষতি হবে শুনি? ক্ষতিটা কী হবে?

সদানন্দ বললে–টাকাটা না দিলে আমাদের সব কিছু নষ্ট হয়ে যাবে।

–নষ্ট হয়ে যাবে মানে?

–আমাদের চৌধুরীবাড়িটা নষ্ট হয়ে যাবে। আমাদের এই নবাবগঞ্জ নষ্ট হয়ে যাবে। আমাদের এই দেশ আমাদের এই জাত নষ্ট হয়ে যাবে। আমরা সবাই মারা যাবো। তুমি আমি বাবা দাদু মা কাউকেই তাহলে আর বাঁচাতে পারবো না।

প্রকাশ মামা আর থাকতে পারলে না। বললে–তুই থাম দিকিনি। যত সব তোর বাজে কথা। সত্যিই লেখাপড়া শিখে তোর মাথার ব্যানো হয়েছে! তাই-ই যদি হতো তাহলে আর এতদিন পৃথিবী টিকে থাকতো না। জমিদারি চালাতে গেলে লাঠিবাজি খুনখারাবি না করলে চলে? চল, চল ও-সব কথা মাথায় ঢোকাস নি। ওসব যত ভাববি তত মাথাখারাপ হবে। তার চেয়ে চিরকাল সবাই যেমন করে এসেছে তেমনি করে যা, দেখবি তাতে অনেক আরাম। একটা জিনিস জেনে রাখিস ফুর্তির চেয়ে দুনিয়ায় বড় জিনিস আর কিছু নেই—

তখন আর প্রকাশ মামার নিজেরও দাঁড়াবার সময় নেই। সদানন্দ চলে যেতেই চৌধুরী মশাই কাছে এলেন।

বললেন কী হলো প্রকাশ, খোকাকে বোঝালে?

প্রকাশ বললে—হ্যাঁ–

–কী বললে খোকা? বুঝলো?

প্রকাশ মামা বললে–বুঝবে না? আমি সব বললুম বুঝিয়ে। বুঝিয়ে বললুম জমিদারি রাখতে গেলে লাঠিবাজি জালজোচ্চুরি না করলে জমিদারি থাকে? আর জমিদারির কথা না হয় ছেড়েই দিলুম, গভর্নমেন্ট চলে? গভর্নমেন্ট লাঠিবাজি করে না? গভর্নমেন্টও তো বন্দুকবাজি করে। কে না ওসব করে? ক্ষমতা রাখতে গেলে ওসব জালজোচ্চুরি করতেই হবে। আকবর বাদশা থেকে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট পর্যন্ত সবাই ওই লাঠিবাজি বন্দুকবাজি করে এসেছে। তোর ঠাকুর্দা যা করেছে তোর দাদামশাইও তাই করেছে। না করলে এত সম্পত্তি আর এত জমির মালিক হওয়া যায়?

–তা শুনে কী বললে খোকা?

প্রকাশ বললে–কী আর বলবে? বলবার মুখ রইল না। বোবার মত চুপ করে শুধু শুনলো আমার কথাগুলো।

–তারপর?

প্রকাশ বললে–তারপর যখন বুঝলো তখন মাথা ঠাণ্ডা হলো। আসলে জামাইবাবু, অত লেখাপড়া শিখেই যত গণ্ডগোল হয়েছে। তার চেয়ে আমরা বেশ আছি। আমরা পেট পুরে খেলুম আর নাক ডাকিয়ে ঘুমোলুম। আমি দেখেছি মাথায় একটু বিদ্যে ঢুকলেই সব তালগোল পাকিয়ে যায়–

বলে আর সেখানে দাঁড়ালো না। শামিয়ানা খাটানো তখনও শেষ হয় নি। ওদিকে পুকুরের ধারে ভিয়েন চড়েছে। সেদিকেও তদারকি করতে যেতে হবে। আর একটু চোখের আড়াল হয়েই রসগোল্লা পানতুয়া টপাটপ দু’চারটে মুখে পুরে দেবে বেটারা।

আস্তে আস্তে সন্ধ্যে নেমে আসছিল। অগ্রহায়ণ মাসের বিকেল বেলা ছোট হয়ে আসতে শুরু করেছে। সন্ধ্যে হলেই হ্যাজাগ বাতি জ্বলে উঠবে উঠোনে। সমস্ত বাড়ির সামনে ভেতরে আলোয় আলো হয়ে উঠবে।

প্রকাশ মামারই যেন যত জ্বালা। বিয়ে করবে সদা আর জ্বলেপুড়ে মরবে প্রকাশ মামা। কেন রে বাপু? আমি কে? আমি গরীব মানুষ, আমার বিয়ের সময় এই এত জাঁকও হয় নি, এত জমকও হয় নি। তবু দিদি টাকা দিয়েছে, সেই টাকা দু’হাতে খরচ করার মধ্যেই যা সুখ। পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিলেই হলো। করকরে নোট বেরিয়ে আসবে। সেই টাকার লোভেই সবাই খাতির করছে শালাবাবুকে। সবাই শালাবাবু বলতে অজ্ঞান। কদিন ধরে সবাই-ই একবার করে এসে প্রণাম করে যাচ্ছে। কাছে এসে পায়ে হাত দিয়ে বলছে-পেন্নাম হই শালাবাবু–

হঠাৎ প্রকাশ মামা সদরের দিকে চেয়ে চমকে উঠলো।

কে?

একটা পালকি এসে ঢুকলে সদরের বার বাড়িতে। পালকির চেহারা দেখেই প্রকাশ মামার চক্ষু চড়ক গাছ। কালীগঞ্জের বউ এলো নাকি?

আর কথাবার্তা নেই। প্রকাশ আর দাঁড়ালো না সেখানে। সোজা ভেতর বাড়িতে গিয়ে ঢুকলো। গিয়ে ডাকলে–দীনু, দীনু কোথায়, দীনু–

কাজের বাড়ি। সবাই-ই নাকে দড়ি দিয়ে খাটছে। অনেক ডাকাডাকির পর দীনু হাতের কাজ ফেলে এলো। প্রকাশ মামা বললে–দীনু, সিগগির কর্তাবাবুকে খবর দিয়ে এসো, কালীগঞ্জের বউ এসেছে–

–কালীগঞ্জের বউ?

নামটা শুনে দীনুরও যেন কেমন ভালো লাগলো না। আবার এসেছে মাগী!

–যাও, যাও খবরটা দিয়ে এসো শিগগির। তাড়াতাড়ি বিদেয় করে দেওয়া ভালো।

দীনু গিয়ে ওপরে খবরটা দিতেই কর্তাবাবু উঠে বসলেন। বললেন–কে? কে এসেছে বললি?

যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো না দীনুর কথাটা।

দীনু আবার বললে–কালীগঞ্জের বউ।

নামটা শুনে নরনারায়ণ চৌধুরীর মুখ দিয়ে কিছুক্ষণ কোনও কথা বেরোল না। তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। আজ তাঁর নাতির বিয়ে আর আজকেই কিনা কালীগঞ্জের বউকে নবাবগঞ্জে আসতে হয়!

দীনু তখনও দাঁড়িয়ে আছে। কর্তাবাবু তার দিকে চেয়ে বললেন–তুই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিস কী?

দীনু বললে–তাঁকে কী বলবো তাই জিজ্ঞেস করছি–

সেকথার উত্তর না দিয়ে কর্তাবাবু কৈলাস গোমস্তার দিকে চাইলেন। বললেন–কৈলাস, কালীগঞ্জের বৌকে তুমি নেমন্তন্ন করেছিলে নাকি?

কৈলাস গোমস্তা বললে–আজ্ঞে না, আমি কেন নেমন্তন্ন করতে যাবো?

কর্তাবাবু সঙ্গে সঙ্গে দীনুর দিকে চাইলেন। বললেন–দীনু, যা তো একবার বংশী ঢালীকে ডেকে নিয়ে আয় তো, বংশী ঢালী আছে এখানে?

–আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি ডেকে আনছি–

দীনু তাড়াতাড়ি চলে গেল। আর তার পরেই বংশী ঢালী এসে ঘরে ঢুকলো। মাথায় জড়ানো একটা লাল পাগড়ি। কালো কুচকুচে গায়ের রং। পরনের কাপড়টাকে বাসন্তী রং-এ ছুপিয়ে নিয়েছে।

বললে–কী হুকুম কর্তাবাবু?

কর্তাবাবু কৈলাস গোমস্তার দিকে চাইলেন। বললেন–কৈলাস, তুমি একবার বাইরে যাও তো। বংশীর সঙ্গে আমার একটা কাজের কথা আছে–দেখো, যেন এ সময়ে আমার ঘরে কেউ না ঢোকে—

কৈলাস গোমস্তা বাইরে চলে যেতেই কর্তাবাবু বংশীর দিকে চেয়ে বললেন–একটু কাছে সরে আয়, আমার মুখের কাছে–

বংশী কর্তাবাবুর মুখের কাছে মুখ নিয়ে গেল।

–একটা কাজ করতে পারবি বংশী? মোটা বখশিশ পাবি। কালীগঞ্জের বউ এসেছে, দেখেছিস তো? তাকে সরাতে হবে। পারবি? হবে তোর দ্বারা?

–পারবো হুজুর।

–কিন্তু দেখিস। খুব সাবধান, কেউ যেন জানতে না পারে! পারবি তো?

বংশী ঢালীকে এ-প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা অবান্তর। তবু ঘটনার গুরত্বটা বোঝানোর জন্যেই বোধ হয় এই প্রশ্ন করলেন কর্তাবাবু।

বংশী ঢালী শুধু কর্তাবাবুরই নয়, এককালে কালীগঞ্জের জমিদারের লোক ছিল। কর্তাবাবু যখন এখানে এই নবাবগঞ্জে আসেন তখন বংশী ঢালীও তার সঙ্গে এসেছিল। এইটেই তার পেশা, এইটেই তার নেশা। তাই এ ধরনের কোনও কাজে না বলার অভ্যেস তার নেই। বরং কাজ না পেলেই যেন সে অখুশী হয়। তখন তার শরীর ভালো থাকে না, হজম হয় না, ঘুম হয় না, গা ম্যাজম্যাজ করে।

এবার এতদিন পরে কর্তাবাবুর মুখে কাজের কথা শুনে বংশী বেশ সতেজ হয়ে উঠলো। বললে–বলুন কর্তাবাবু কী কাজ, নিজের জান দিয়ে আপনার কাজ করে দেব–

কর্তাবাবু বললেন–খুব সাবধানে করতে হবে কিন্তু, কেউ যেন জানতে না পারে।

কথাটা শুনে বংশীর যেন অপমান বোধ হলো। বললে–আগে কি কখনও অসাবধান হয়েছি যে আপনি ওকথা বলছেন?

কর্তাবাবু নিজেকে শুধরে নিলেন। সত্যিই তো, বংশী ঢালীকেই যদি তিনি অবিশ্বাস করেন তাহলে তো তার নিজেকেই অবিশ্বাস করতে হয়। বললেন–ওরে, তা বলছি নে। বলছি আবার একটা ঝামেলা হয়েছে, সেই ঝামেলাটা তোকে কাটাতে হবে–

–বলুন না কাকে খতম করতে হবে?

কর্তাবাবু বললেন–এই এখখুনি খবর পেলাম কালীগঞ্জের বৌ নাকি এসেছে–

–তা যাচ্ছি আমি, এখুনি খতম করে দিচ্ছি–

–কী করে খতম করবি? সবাই যে জানতে পারবে। আজ যে কুটুমবাড়ির লোকজন এসেছে সব–

বংশী ঢালীর মুখটা একটা পৈশাচিক আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। মাথায় লাল কাপড়ে বাঁধা পাগড়িটা খুলে আর একবার জমপেশ করে বেঁধে নিলে। তারপর এক লাফে ঘরের বাইরে চলে গেল।

 ২.৩ নবাবগঞ্জের ইতিহাস

এই নবাবগঞ্জের ইতিহাসে এ এক মর্মান্তিক কাহিনী। জমিদারি উঠে গেছে ইণ্ডিয়া থেকে। সেই ১৯৫৮ সালের আইনে জমিদারি রাখা এখন বেআইনী হয়ে গেছে। কিন্তু নবাবগঞ্জ থেকে বুঝি তা তখনও নিঃশেষ হয় নি। নিঃশেষ হয় নি সেই জমিদারির দাপট। জমি আর তখন জমিদারের নয়, সরকারের। সরকারের বিনা অনুমতিতে বেশি জমি রাখা নিষিদ্ধ। কিন্তু আইন যেমন আছে আইনের ফাঁকও তো আছে তেমনি। সেই আইনের ফাঁক দিয়ে কোনও জমিদারের কোনও জমিই হাতছাড়া হয় নি। শুধু জমির মালিকের নাম বদলিয়েছে। আগে যেখানে ছিল নরনারায়ণ চৌধুরীর নাম সেখানে বসেছে কুল-বিগ্রহের নাম। বাড়িতে কুল বিগ্রহও আবার একটা নয়, একশোটা। একশোটা কুল-বিগ্রহের নাম বসেছে মালিকানার খতিয়ানে। সব কুল-বিগ্রহের প্রত্যেকের ভাগে পড়েছে পঁচাত্তর বিঘে জমি। অর্থাৎ জমির মালিক সেই মালিকই আছে, শুধু দাখলে কাটা হয় বেনামে। কুল-বিগ্রহরা পাথরের ঠাকুর। ঠাকুরের না আছে পেট না আছে ক্ষিধে। এমন কি খাবার হজম করবার ক্ষমতাও নেই কোনও ঠাকুরের। কিন্তু বেনামদার যারা তাদের মোটা মোটা পেট আছে, বাঘের মত ক্ষিধেও আছে। আর আছে হজম করবার অমানুষিক ক্ষমতা।

একদিন নরনারায়ণ চৌধুরী তিন পুরুষ আগে যখন এখানে এই সম্পত্তির পত্তন করেন তখন কল্পনাও করেন নি যে, একদিন আবার এই সম্পত্তি-বিলোপ আইন হবে। কিন্তু আইনটা যখন হলো তখন প্রথমে একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তবে কি গভর্নমেন্ট সব জমি গ্রাস করে নেবে নাকি?

কিন্তু অভয় দিলেন উকিলবাবু। উকিলবাবু হাসলেন–গভর্নমেন্ট আইন করলেই বা, আমরা আছি কী করতে কর্তাবাবু? আইন তৈরি করা যেমন গভর্মেন্টের কাজ, আমাদের কাজ তেমনি আইন ভাঙার রাস্তা বাতলে দেওয়া–

কর্তাবাবু বললেন–তাহলে আইন বাতলে দিন–

উকিলবাবু হাসতে হাসতে বললেন–আমাকে কত দেবেন বলুন? আমার পাওনাটা?

কর্তাবাবু বললেন–যা চাইবেন তাই-ই দিতে হবে। শতকরা পাঁচ টাকা খরচ না-হয় দেব আপনাকে–

তা সেই ব্যবস্থাই হলো। উকিলবাবুই বুদ্ধি দিলেন–তাড়াতাড়ি কিছু মন্দির আর ঠাকুর তৈরি করে ফেলুন কর্তাবাবু। মাটির ঠাকুর করলে তেমন কিছু খরচ হবে না। রোজ বাড়িতে ঠাকুর-সেবা আরম্ভ করে দিন। পুরুত রাখুন আলাদা আলাদা–আর তারপর সেই সব ঠাকুরের নামে পঁচাত্তর বিঘে করে জমি-জমার দলিল করে ফেলুন। দেখি, গর্ভমেন্ট কী করে। আর তখন আমি তো আছিই–

তা চৌধুরীবাড়িতে আগে থেকেই কুল-বিগ্রহ ছিল। পরে তাদের সংখ্যা বেড়ে একশো হলো। শেষ পর্যন্ত আইন যখন চালু হলো দেখা গেল মাত্র পঁচাত্তর বিঘে জমি-জমার মালিক হলেন নরনারায়ণ চৌধুরী আর বাকি ছেলে, পুত্রবধূ আর ঠাকুরদের নামে এমনভাবে জমি জমা ভাগ হলো যাতে এক তিল জমি সরকারের ভাগে না পড়ে।

সুতরাং কাগজে-কলমে জমিদারি-প্রথা বিলোপ হয়ে গেল বটে, কিন্তু জমিদার যেমন ছিল তেমনিই রয়ে গেল। রয়ে গেল আগেকার সেই আয়-আদায় আর সঙ্গে সঙ্গে রয়ে গেল তাদের দাপট। আর তার সঙ্গে রয়ে গেল বংশী ঢালীরাও।

বংশী ঢালীদের কাজ কিছু থাকুক আর না-থাকুক তাদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করতে হয়, মাসোহারা দিয়ে যেতে হয়। কাজ দিলাম তো ভালো আর যখন কাজ দিলাম না তখন বসে থাকো।

এমনি অনেকবার অনেক কাজের ভারই পড়েছে বংশী ঢালীর ওপর।

বড় বিশ্বাসী কর্মচারী বংশী ঢালীরা। সুখ-শান্তির দিনে তারা খেতে পাচ্ছে কি না তা দেখবার দায় নেই কর্তাবাবুদের। কিন্তু বিপদের দিনে তারাই ভরসা। তারাই বুক দিয়ে বাঁচায় কর্তাবাবুদের।

আজ এতদিন পরে আবার ডাক পড়েছে সেই বংশী ঢালীর।

বাড়িতে যখন সবাই কাজে ব্যস্ত তখন কেবল তারই কাজ ছিল না। এখন যেন সেও একটা কাজ পেলে। এতক্ষণ শুধু বাড়ির শোভা হয়ে সে ঘুরে বেড়িয়েছে। কাজের লোক যে সে চুপ করে থাকেই বা কী করে!

কর্তাবাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে সে নিচেয় এল। চারিদিকে হৈ চৈ। লোকজনের আনাগোনায় সমস্ত বাড়িটা তখন গমগম করছে। কিন্তু তাতে তার কিছু আসে যায় না। তার কাজ সকলের চোখের আড়ালে। সে কাজ কেউ দেখতে পাবে না। জানতে পারবে না তার বাহাদুরি। জানবে শুধু সে আর তার সাকরেদরা। আর জানতে পারবে তার অন্নদাতা মালিক। যে জানলে তার খাওয়া-পরা জুটবে, তার চাকরি বজায় থাকবে।

নিচেয় নেমেই আর দাঁড়াল না সেখানে বংশী ঢালী। একেবারে সোজা গিয়ে হাজির হলো বার বাড়িতে। বার বাড়িতে পালকি থেকে নেমে কালীগঞ্জের বউ তখন মাথার ঘোমটাটা ভালো করে টেনে দিলে।

প্রকাশ মামা সামনে গিয়ে অভ্যর্থনা করলে–আসুন আসুন মা জননী–

কালীগঞ্জের বউ-এর পরনে একটা গরদের পাটভাঙা থান। আজকে একটা বিশেষ দিন বলে বিশেষ ভাবেই সেজেগুজে এসেছে। আসবার তার ইচ্ছে ছিল না তেমন। কিন্তু আবার না এসেও থাকতে পারে নি। একবার মনে হয়েছিল বিনা নিমন্ত্রণে যাওয়াটা ঠিক হবে কি। কিন্তু কে তাকে নেমন্তন্ন করবে! নারায়ণ তার নাতির বিয়েতে তাকে নেমন্তন্ন করবে। এটা আশা করাও অন্যায়। কালীগঞ্জের বাজার থেকে একটা শাড়ি কিনে নিয়ে এসেছিল নতুন বউকে দেবার জন্যে। পনেরো টাকা দাম নিয়েছে শাড়িটার।

কালীগঞ্জের বউ-এর তেমন পছন্দ হয় নি শাড়িটা। বলেছিল–হ্যাঁ রে দুলাল, এর থেকে ভালো শাড়ি একটা পেলিনে?

দুলাল বললে–এর চেয়ে ভালো শাড়ি আর দিতে হবে না মা, কেউ তো আপনাকে এ বিয়েতে নেমন্তন্নও করে নি–

কালীগঞ্জের বউ বলেছিল–নেমন্তন্ন না-করলেই বা, নায়েব মশাই না-হয় আমাকে নেমন্তন্ন করে নি, কিন্তু তার নাত-বৌ কী দোষ করলো, বল্? সে তো এর মধ্যে নেই। তাকে কেন খারাপ শাড়ি দিতে যাবো?

তা তখন আর সে-শাড়ি বদলাবার সময়ও ছিল না বলতে গেলে। তাড়াতাড়ি সেই শাড়িখানাই একটা কাগজে মুড়ে নিয়ে চলে এসেছিল। পালকির ভেতরে আসতে আসতে কালীগঞ্জের বউ-এর কেবল মনে পড়ছিল খোকার সেই কথাগুলো–তোমার টাকা আমি ফেরত দেবই কালীগঞ্জের বউ, তোমার টাকা না দিলে আমি বিয়েই করতে যাবো না–

আহা! ঠাকুর্দা যাই হোক, তার নাতিটা তো কোন দোষ করে নি।

পালকির ভেতরে বসেই কালীগঞ্জের বউ বলেছিল–তোরা একটু পা চালিয়ে চল দুলাল, নতুন বউ বিকেল বেলা নবাবগঞ্জে আসবে, তাকে শাড়িটা দিয়ে সন্ধ্যের আগেই ফিরে আসতে চাই–

সত্যিই সন্ধ্যের আগেই ফিরে আসতে চেয়েছিল কালীগঞ্জের বউ। হয়ত মন বলছিল সন্ধ্যের আগে ফিরে না এলেই বুঝি কোনও বিপদ ঘটবে। কিন্তু কে জানত সে-বিপদ এমন ভয়াবহ বিপদ হয়ে উঠবে! কে জানতো সে-বিপদ এমনই বিপদ যে এ-জন্মের মত তা কাটিয়ে তার কালীগঞ্জে ফিরে আসা হবে না। আর কে-ই বা জানতো কালীগঞ্জের সেই বিপদই নবাবগঞ্জের চৌধুরী-বংশের বিপদ হয়ে এমন করে সমস্ত কিছু ধ্বংস করে দেবে!

সত্যিই, এমনি করেই হয়ত ইতিহাস তার আপন গতিপথ পরিবর্তন করে। নইলে একদিন যে-সূর্য কালীগঞ্জের আকাশে উদয় হয়ে কালীগঞ্জেই অস্ত গিয়েছিল তা যে আবার একদিন নবাবগঞ্জের আকাশকেও অন্ধকার করে দেবে তা-ই বা কে ভাবতে পেরেছিল। নইলে হর্ষনাথ চক্রবর্তী হয়ত যাবার আগে তাঁর স্ত্রীকে সাবধান করে দিয়ে যেতেন। যাবার সময় হয়ত সহধর্মিণীকে বলে যেতেন–ওগো, ওই আমার নায়েবকে তুমি বিশ্বাস কোর না। নায়েব নরনারায়ণ চৌধুরীকে বিশ্বাস করলে একদিন তোমার সর্বস্ব নিঃশেষ হয়ে যাবে। বলে যেতেন–সম্পত্তি রক্ষা করতে গেলে কাউকেই বিশ্বাস করতে নেই। বলে যেতেন–আত্মবিশ্বাসের চেয়ে বড় বিশ্বাস আর কিছু নেই। আরো বলে যেতেন–সম্পত্তি এমনই জিনিস যা শুধু নায়েব কেন নিজের ছেলেকেও বিশ্বাসহন্তা করে তোলে।

কিন্তু সেদিন হর্ষনাথ চক্রবর্তীর গৃহিণী বড় সহজ সরল মানুষ ছিল। সংসারে যে তাকে একদিন এমন করে একলা হয়ে যেতে হবে তাও কখনও কল্পনা করতে পারে নি সে। কর্তা ছিলেন মহাপ্রাণ মানুষ। গৃহিণীও তাই। নদীতে যখন স্নান করতে যেতেন তিনি সঙ্গে লোক যেত মাথায় ছাতি ধরে। যেন রোদ না লাগে কর্তার শরীরে। কোঁচানো কাপড় যেত স্নান করে উঠে পরবার জন্যে। আর যেত কাঁসার বাটিতে আধ সের তেল।

গৃহিণী দেখতে পেয়ে একদিন বলেছিল–অত তেল কি তোমার নিজের গায়ে মাখো নাকি?

কর্তা শুনে হাসতেন। বলতেন–না গো, ঘাটে যারা আসে তারা বড় গরীব মানুষ, তাদের তেল কেনবার পয়সা নেই। আমি তেল মাখি, তারাও মাখে–

শুধু তেল নয়। একবার গৃহিণীর ব্রত উদ্যাপন উপলক্ষে গ্রামের সব লোককে খেতে নেমন্তন্ন করা হয়েছিল। খেতে যাবার আগে হঠাৎ কর্তার নজরে পড়লো গামলা-ভর্তি রসগোল্লা ভাসছে। বললেন–দেখি দেখি, খেয়ে দেখি একটা কেমন পাক হয়েছে—

রসগোল্লা খেলেন একটা।

কিন্তু রসগোল্লাটা মুখে দিয়েই থু-থু করে ফেলে দিলেন।

বললেন–না, এ মিষ্টি কাউকে খেতে দিতে পারবে না, এ বাসি মিষ্টি, টক হয়ে গিয়েছে। ফেলে দাও–

শুধু ফেলে দেওয়া নয়। পাছে কাক-পক্ষীতেও খায় সেই জন্যে মাটিতে গর্ত করে সেই আড়াই মণ ছানার তৈরি রসগোল্লা সব পুঁতে ফেলা হলো। তারপর আবার রাতারাতি নতুন করে তৈরি হলো রসগোল্লা। তবে সকলেরই পাতে মিষ্টি পরিবেশন করা হলো।

এ-সব ঘটনা কালীগঞ্জের লোক যেমন জানে, এই নরনারায়ণ চৌধুরীও তেমনি জানেন। অথচ সেই চক্রবর্তী মশাই-এর গৃহিণীর এমন সর্বনাশ করতে তাঁরও কিনা বাধলো না।

শেষ সময়ে নরনারায়ণকেই ডেকেছিলেন সেদিন হর্ষনাথ চক্রবর্তী। বলেছিলেন–এবার আমার যাবার বন্দোবস্ত করো নারায়ণ

নরনারায়ণ যাওয়ার কথা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন–কোথায় যাবেন খুঁজুর?

হর্ষনাথ বলেছিলেন–নবদ্বীপ—

নবদ্বীপের কথা শুনে নরনারায়ণ সেদিন একটু অবাকই হয়ে গিয়েছিলেন।

বলেছিলেন–নবদ্বীপে যাবেন কেন হুজুর?

হর্ষনাথ বলেছিলেন–যা বলছি তাই করো, গাড়ি যুততে বলো–

তাই সেই ব্যবস্থাই হয়েছিল। কর্তা নবদ্বীপে যাবেন হুকুম হয়েছে। কর্তার হুকুমের আর নড়চড় নেই। গাড়ি চললো। সমস্ত দিন চলে সন্ধ্যেবেলা একটা নদীর ধারে এসে গাড়ি পৌঁছুল। জিজ্ঞেস করলেন–এ কোথায় এলাম?

নরনারায়ণ বললেন–আজ্ঞে কেষ্টগঞ্জ—

কর্তা বললেন–আমি তামাক খাবো–আমার কলকে গড়গড়া নিয়ে এসো–

সঙ্গের লোক আবার ছুটলো কালীগঞ্জে। কর্তার তামাক খাবার ইচ্ছে হয়েছে। তার নিজের গড়গড়া, ফরসি, সব কিছু আনা চাই। তিনি সেই কেষ্টগঞ্জের নদীর ঘাটেই আস্তানা গাড়লেন। পরের দিন সব কিছু এসে হাজির হলো। তখন সেই নিজের অভ্যস্ত গড়াগড়ার ওপর কলকে বসিয়ে তামাক খেলেন। দুচার টান দিলেন গড়গড়ায়। ধোঁয়া বেরোল। আর তারপর সেটা নরনারায়ণের হাতে দিলেন। বললেন–আর না, আমার এইটুকু আসক্তি ছিল, এবার তাও গেল, এখন চলো–

তখন গাড়ি আবার চললো নবদ্বীপের পথে—

কিন্তু এসব কথা আজকে আর কে শুনবে? কাকে শোনাবে কালীগঞ্জের বউ? একজন যে এসব ঘটনার সাক্ষী ছিল সেও আজ সব ভুলে বসে আছে। সেদিনকার সেই নায়েব আজ আর সেদিনকার সেই মনিবকে মনে রাখতে চায় নি। মনে রাখলে নবাবগঞ্জের সেই সব কিছু সম্পত্তি সোজা কালীগঞ্জের বউ-এর কাছেই ফিরিয়ে দিতে হয়। কিন্তু তা তো আর সম্ভব নয়। তাই কালীগঞ্জের বউকে দেখলেই তার মেজাজটা বিগড়ে যায়। বলে–যা যা দীনু, বল্ আমার শরীরটা খারাপ, আমার সঙ্গে দেখা হবে না–

আর তা ছাড়া নিজের সৌভাগ্যের দিনে কে আর অতীতের সেই অন্ধকার দাসত্বের দিনগুলোর কথা মনে রাখে! কালীগঞ্জের বউ-এর নাম শুনলেই যেন কেবল মনে পড়ে যায় সেই পনেরো টাকা মাইনের চাকরিটার কথাগুলো। কে যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চায় তার পুরানো চোহারাটাকে। বলে–ওই দ্যাখ, ওকে চিনতে পারিস!

নরনারায়ণ চৌধুরী চিৎকার করে ওঠেন–কৈলাস–কৈলাস—

কৈলাস গোমস্তা বলে–আজ্ঞে, এই তো আমি, আমি তো আপনার পাশেই রয়েছি–

–ও–বলে যেন শান্ত হন। যেন আবার তিনি বাস্তব জগতে ফিরে আসেন। বলেন–দেখ কৈলাস, আজকাল কেবল আমার এই রকম হয়। মনে হয় যেন আমার কাছে কেউ নেই। তুমি আমার কাছে কাছে থাকবে সব সময়–

কিন্তু সেদিন বংশী ঢালী ঘরের বাইরে চলে যাবার পরই কর্তাবাবু আবার ডাকলেন—কৈলাস–

কৈলাস বাইরেই দাঁড়িয়েছিল। ডাক পেয়েই ভেতরে এল। বললে–আমাকে ডাকছিলেন?

–হ্যাঁ, তুমি কোথায় যাও? আমি তোমাকে বলেছি না সব সময় তুমি আমার কাছে কাছে থাকবে?

কৈলাস বললে–আজ্ঞে, আপনি যে এখুনি আমাকে বাইরে যেতে বললেন

কর্তাবাবু বললেন–দেখ কৈলাস তক্কো কোর না, তোমার ওই বড় দোষ, তুমি বড় মুখে মুখে তক্কো করো। তোমাকে আমি বারবার বলেছি আমার কাছাকাছি থাকবে। দেখছো, আমার সিন্দুকটা পাশে রয়েছে, এতে টাকাকড়ি আছে, কখন কে আসে তার ঠিক নেই– তুমি…….

তারপর হঠাৎ থেমে গিয়ে কী যেন কান পেতে শুনতে লাগলেন।

বললেন–একটা কীসের যেন শব্দ হলো না কৈলাস

কৈলাস গোমস্তাও শব্দটা শুনতে চেষ্টা করলে। বললে–হ্যাঁ, ও তো মেয়েরা শাঁক বাজাচ্ছে নিচেয়–

কর্তাবাবু ধমকে উঠলেন–মেয়েরা শাঁখ বাজাচ্ছে সে তো আমিও শুনতে পাচ্ছি। সে শব্দ নয়, আর একটা শব্দ শুনতে পেলে না?

কৈলাস গোমস্তা বললে–আজ্ঞে না।

কর্তাবাবু বললেন–তুমি দেখছি দিন-দিন কানে কালা হয়ে যাচ্ছে। যাও, শুনে এসো কীসের শব্দ হলো ওখানে–

কৈলাস গোমস্তা তাড়াতাড়ি উঠে নিচেয় চলে যাচ্ছিল, কিন্তু কর্তাবাবু ধমক দিলেন। বললেন–তুমি আবার কোথায় যাচ্ছো?

–আজ্ঞে নিচেয়।

–আজ্ঞে নিচেয়! তোমাকে বলেছি না তুমি সব সময় আমার কাছে কাছে থাকবে। আমার কাছে সিন্দুকে টাকা রয়েছে, বলেছি না তোমাকে?

কৈলাস গোমস্তা কথাটা শুনে আবার তার নিজের জায়গায় এসে বসলো। কিন্তু ওদিকে হর্ষনাথ চক্রবর্তী মশাই তখন নবদ্বীপে চলেছেন। তাঁর জীবনের কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। তাঁর আর কোনও আসক্তি নেই তখন। নাবালক ছেলে দু’জন রইলো, গৃহিণী রইলো। আর রইলো- নায়েব নরনারায়ণ! জমি-জমাও রইল অনেক। অনেক কিছুই তিনি রেখে গেলেন। কিন্তু যাবার সময় কিছুই সঙ্গে নিলেন না। যাবার সময় কারো সঙ্গে কিছু থাকেও না। একলাই এসেছিলেন সংসারে, সেই সংসার ফেলে একলাই আবার চলে যাচ্ছেন। আসক্তি নেই, কামনা নেই, আকাঙ্খাও আর নেই। একমাত্র আসক্তি ছিল তাঁর ওই তামাকটার ওপর। তা সেটাও গেল। সেটাও তিনি ত্যাগ করলেন। এবার মুক্তি। এবার আর কোনও কিছুই তাঁকে আকর্ষণ করতে পারবে না।

নায়েব নরনারায়ণ সঙ্গে চলেছেন। চলতে চলতে একদিন নবদ্বীপ শহরে এসে পৌঁছুলো।

কর্তা বললেন–চলো, আমাকে রাধামাধবের আশ্রমে নিয়ে চলো।

তাঁর কথামত সেই রাধামাধবের আশ্রমেই তাঁকে তোলা হলো। কিন্তু সেখানেও বেশি দিন তাঁকে থাকতে হলো না। দুদিন পরেই কর্তা বললেন–এবার আমার সময় হয়েছে নরনারায়ণ, আমাকে গঙ্গায় নিয়ে চলো

নায়েব নরনারায়ণ তাকে গঙ্গার ধারে নিয়ে গেলেন। কর্তা সিঁড়ি দিয়ে গঙ্গার জলে নামলেন। প্রথমে হাঁটু-জল। তারপর কোমর। তারপর বুক। সেই বুক-জলেই দাঁড়ালেন কর্তা।

সত্যিই, এ-সব কথা আজ এই বিয়েবাড়ির উৎসবের মধ্যে ভাবা অন্যায়। ওই ওপরের দোতলায় যে পঙ্গু মানুষটি লোহার সিন্দুক আঁকড়ে ধরে জীবন কাটাচ্ছেন তারও এ-সব কথা ভাবতে নেই। ভাবলে আজ এই তার নাতির বিয়ে পণ্ড হয়ে যাবে। এই অতিথি-অভ্যাগতে ভরা জমজমাট ঐশ্বর্যের ওপর কালো ছায়া পড়বে। জীবনের সার সত্য মোক্ষ নয়, শান্তি নয়, ত্যাগও নয়। আসল সত্য হলো এই ঐশ্বর্য, এই জাঁকজমক আর এই সিন্দুক। কালীগঞ্জের হর্ষনাথ চক্রবর্তী নির্বোধ ছিলেন তাই তিনি আসক্তি ত্যাগ করেছিলেন। নবদ্বীপের গঙ্গার ঘাটে গিয়ে নিজের মুক্তি চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি ত্যাগে বিশ্বাস করি না, মুক্তিতে বিশ্বাস করি না, অনাশক্তিতেও বিশ্বাস করি না। আমি বাঁচতে চাই। এই জমি-জমা জাঁকজমক-ঐশ্বর্য-বিলাস সব কিছুর মধ্যে জড়িয়ে থেকে বাঁচতে চাই। আমি বাঁচতে চাই আমার আমির মধ্যে দিয়ে। বাঁচতে চাই আমার সন্তানের মধ্যে দিয়ে। আমি বাঁচতে চাই আমার বংশ-পরম্পরার উত্তরাধিকারের মধ্যে দিয়ে। যে সেই বাঁচার পথে অন্তরায় হবে তাকে আমি নিপাত করবো, নিঃশেষ করবো। আমার বংশী ঢালী সেই নিঃশেষ করার পথে আমাকে সাহায্য করবে। সেই জন্যেই তো আমি তাকে মাসোহারা দিয়ে রেখেছি।

বংশী ঢালী যখন বার বাড়ির উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালো, তখন কালীগঞ্জের বউ সেখানে নেই। এমন কি তার সেই পালকিটারও চিহ্ন নেই সেখানে।

প্রকাশ মামা মা-জননীকে নিয়ে তখন একেবারে ভেতর-বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে। কালীগঞ্জের বউ সম্বন্ধে চৌধুরীবাড়িতে যত অশ্রদ্ধাই থাক, তার সঙ্গে চৌধুরী বংশের ঐশ্বর্যের ক্ষীণ সূত্রটার কথা জানতে কারো বাকি ছিল না। অন্ততঃ আর কেউ না-জানুক চৌধুরী বাড়ির গিন্নী সে কথা জানে।

–কোথায় গো, বৌমা কোথায়?

কালীগঞ্জের বৌ এতবার এবাড়িতে এসেছে টাকার তাগাদা করতে কিন্তু এমনি করে কখনও অন্দরমহলের চৌহদ্দির মধ্যে আসে নি।

বৌমা ব্যস্ততার মধ্যেও চিনতে পেরেছে। বললে–আসুন আসুন মা–

–কালীগঞ্জের বৌ বললে–আমাকে তুমি চিনতে পারবে না বৌমা। আমার নাত-বৌ এসেছে বাড়িতে তাই আশীর্বাদ করতে এলুম। তুমি আমাকে তাড়িয়ে দেবে না তো বৌমা?

–ওমা, তাড়িয়ে দেব কেন আপনাকে!

কালীগঞ্জের বৌ বললে–না, আমাকে তো আসতে কেউ নেমন্তন্ন করে নি বৌমা, আমি এমনিই এসেছি, আমাকে তুমি এত খাতির কোর না। আমি শুধু নাতবউকে আশীর্বাদ করেই চলে যাবো…কই, নাত-বউ কোথায়?

নয়নতারা তখন একটা ঘরের মধ্যে ঘোমটা দিয়ে চুপ করে বসে ছিল। আশেপাশে আরো ক’জন পাড়ার বৌ-ঝি বসে আছে।

গৌরী পিসী সঙ্গে করে নিয়ে গেল। বললে–বৌমা, এঁকে প্রণাম করো, ইনি হচ্ছেন কালীগঞ্জের জমিদারের বৌ, তোমার গুরুজন–

কালীগঞ্জের বৌ হাতের পাট করা শাড়িখানা এগিয়ে দিতেই নয়নতারা সেখানা হাত বাড়িয়ে নিলে। তারপর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে।

–থাক্‌ থাক্ মা, আশীর্বাদ করি সুখী হও, শ্বশুর-শাশুড়ী-স্বামী-ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখে সংসার করো–

বলে আর দাঁড়ালো না সেখানে। যেন চলে আসতে পারলেই বাঁচে। যেন সকলের চোখের আড়ালে চলে যেতে পারলেই তৃপ্তি পায়। মুখ নিচু করে যেমন এসেছিল তেমনি আবার বার বাড়ির দিকে চলে গেল।

গৌরী পিসি বাইরে আসতেই প্রীতি জিজ্ঞেস করলে–কী রে, মাগী চলে গেছে?

গৌরী পিসী বললে–হ্যাঁ, বিদেয় হয়েছে–

–কী দিয়ে বৌ-এর মুখ দেখলে রে?

–সে আর বলো না বৌদি। একটা বাঁদি-পোতার গামছা–

–সে কী রে? গামছা? গামছা দিয়ে আমার ছেলের বৌ-এর মুখ দেখলে?

গৌরী বললে–তা সে গামছাই একরকম বলতে পারো। আমাদের বিবিগঞ্জের হাটে জোলাদের হাতে বোনা যেমন শাড়ি পাওয়া যায় তেমনি।

–কত দাম হবে?

–তা তিন টাকাও হতে পারে, পাঁচ টাকাও হতে পারে—

প্রীতি বললে–ঢং, ঢং দেখে আর বাঁচিনে, তবু যদি নেমন্তন্ন করে ডেকে আনা হতো তো তাও বুঝতুম–

গৌরী বললে–অথচ মাগীর দেমাক দেখ না, কর্তাবাবুকে সেবার কত গালাগালি দিয়ে গেল, এখন আবার এসেছে ভাব-ভালবাসা দেখাতে–লজ্জাও করে না মা, ছিঃ!

প্রীতির সেসব মনে ছিল না। বললে–গালাগালি দিয়েছিল? কর্তাবাবুকে? কী গালাগালি দিয়েছিল রে?

–ওমা তোমার মনে নেই, ওই বার বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে সেবার বলে নি–তুমি নিব্বংশ হবে নারাণ, আমি বামুনের মেয়ে হয়ে তোমাকে শাপমন্যি দিয়ে গেলুম তোমার বংশ থাকবে না–কত কী কথা বলে যায় নি?

প্রীতি বললে–ওমা, তুই আমাকে আগে মনে করিয়ে দিলিনে কেন? আমি তাহলে আজ ঝাটা ঘষে দিতুম মাগীর মুখে?

তা বটে। গৌরীও সেই কথাই বললে। কালীগঞ্জের বউ-এর মুখে খ্যাংরা ঝাঁটা ঘষে দিলেই বুঝি ভালো হতো! এই সদানন্দর বিয়ের ব্যাপারেই কি কম বাগড়া দিয়েছে কালীগঞ্জের বউ? যাতে বিয়ে ভেঙে যায় সেই জন্যে খোকাকে পর্যন্ত নিজের বাড়িতে সমস্ত রাত আটকে রেখেছিল। এখন লজ্জা নেই তাই আবার ঢং করে একটা তিন টাকা দামের গামছা দিয়ে বৌ-এর মুখ দেখতে এসেছে।

কিন্তু ভেতর বাড়িতে যখন এসব মন্তব্য চলেছে কালীগঞ্জের বউ তখন সোজা বার বাড়ির উঠোনে গিয়ে দুলালকে খুঁজছে। কোথায়, দুলালরা কোথায় গেল! তাদের পালকি! পালকিটাই বা গেল কোথায়?

প্রকাশ মামা বাইরে শামিয়ানা খাটানো নিয়ে ব্যস্ত ছিল। হঠাৎ পালকিটা দেখতে পেয়ে বললে–তোমরা এখেনে কেন হে? এখানে পালকি রেখে আমার জায়গা আটকে রেখেছে। কেন? যাও যাও, বাইরে যাও

দুলালরা পালকি সরিয়ে নিয়ে একেবারে রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। আর ভেতরের দিকে চেয়ে দেখছিল। মা-জননী এখনও আসছে না কেন? কালীগঞ্জে ফিরে যেতে যে রাত পুইয়ে যাবে!

সদানন্দ সামনে দিয়ে যেতে গিয়েই পালকিটা তার নজরে পড়লো। এ তো চেনা পালকি!

বললে–হ্যাঁ গো, এ পালকি কার? কালীগঞ্জের বউ এসেছে নাকি?

দুলাল বললে–আজ্ঞে হ্যাঁ, মা-জননী এসেছে–

–তা কোথায় তিনি?

–ভেতরে গেছেন–

সদানন্দ আর দাঁড়াল না। এক দৌড়ে ওপরে দাদুর ঘরে চলে গেল। কালীগঞ্জের বৌ এখানে এসেছে নাকি কৈলাস কাকা?

কৈলাস গোমস্তা কী বলবে ভেবে পেলে না। তারপর বললে–আমি তো ঠিক জানি নে খোকাবাবু–

কর্তাবাবুর কানেও কথাটা গিয়েছিল। বললেন–কে? কে কথা বললে–কৈলাস? খোকা না?

কিন্তু সদানন্দ আর সেখানে দাঁড়ালো না। তাহলে নিশ্চয় ভেতর-বাড়িতে গেছে।

–মা!

–কী রে খোকা?

–হ্যাঁ মা কালীগঞ্জের বউ এসেছে বুঝি? কোথায়?

–এই তো এখুনি বউর মুখ দেখে চলে গেল।

সদানন্দ বললে–কিন্তু এখানেই কোথাও আছে, পালকি যে বাইরে রয়েছে দেখলুম–

বলে তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে গেল আবার। কীর্তিপদবাবু তার ঘরের মধ্যে বসে তামাক খাচ্ছিলেন। নাতিকে দেখে বললেন–এই যে খোকা, কোথায় গিয়েছিলে?

কিন্তু ও-সব বাজে কথা বলবার তখন সময় ছিল না সদানন্দর। সেখান থেকে সোজা বার বাড়িতে গিয়ে একেবারে প্রকাশ মামার সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়ালো।

–মামা, কালীগঞ্জের বৌ এসেছে বুঝি?

–হ্যাঁ, দেখলাম তো তাই।

–কিন্তু গেল কোথায়? কোথাও তো দেখতে পাচ্ছিনা–বাবার কাছে চণ্ডীমণ্ডপে আছে নাকি?

সেখান থেকে চণ্ডীমণ্ডপে। সদানন্দর মনে হলো এক মুহূর্ত দেরি হলে যেন আর কালীগঞ্জের বউকে দেখতে পাবে না সে। কিন্তু বিয়েবাড়িতে তো আসবার কথা ছিল না কালীগঞ্জের বউ-এর। তবে কি দাদুর কাছে টাকা চাইতে এসেছে? দাদু কি টাকা দিয়েছে তাহলে? দাদু কি তাহলে কথা রেখেছে? সেই দশ হাজার টাকা!

ভাবতে ভাবতে সমস্ত বাড়িটা চষে ফেলতে লাগলো সদানন্দ। এত ভিড় চার দিকে! সমস্ত লোকের মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে খুঁজতে লাগলো তার সেই আসল লক্ষ্যবস্তুটাকে। কই, কোথায় গেল কালীগঞ্জের বউ? পালকি থাকতে তো হেঁটে ফিরে যাবে না এখান থেকে।

শেষকালে সে আবার ফিরে এল সদরে। তখনও দুলালরা বার বাড়ির দিকে হা করে চেয়ে আছে।

–কী গো, তোমাদের মা-জননী এসেছে?

–আজ্ঞে হ্যাঁ, আমরা তো মা-জননীর জন্যেই হা-পিত্যেশ করে তখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি। সন্ধ্যের আগেই রওনা দেবার কথা আমাদের–

–তাহলে দেখি, কোথায় গেল—

বলে সদানন্দ আবার ভেতরের দিকে ঢুকলো। হ্যাজাগ বাতি লাগানো হচ্ছে গেটের ওপর। প্রকাশ মামা কোমরে তোয়ালে বেঁধে সেই তদারক করতেই ব্যস্ত। বাজে কাজে সময় নষ্ট করবার অবসর নেই তার। চারিদিকে তীক্ষ্ণ নজর। সদানন্দকে দেখেও যেন দেখলে না প্রকাশ মামা।

কিন্তু বংশী ঢালী তার কাজে কখনও ঢিলে দেয় নি জীবনে। সে যে কখন নিঃশব্দে সকলের চোখের আড়ালে তার ডিউটি শেষ করে বসে আছে তা কেউ জানতে পারে নি। কিন্তু এটাও যে খুব সোজা কাজ তা নয়। কালীগঞ্জে যখন চক্রবর্তী মশাই-এর কাছে সে কাজ করতো তখন সে এই কালীগঞ্জের বউকেই একদিন মা-জননী বলে ডেকেছে। একদিন এরই নিমক খেয়েছে। কিন্তু বংশী ঢালীরা টাকার জন্যে সব করতে পারে। টাকার বদলে তাদের নিমকহারামী করতেও বুঝি বাধে না?

–কে? ওখানে কে?

বংশী ঢালীরা তখন নিঃশব্দে তাদের কাজ সমাধা করে ফেলেছে।

–কে? কে ওখানে?

সদানন্দর মনে হলো চণ্ডীমণ্ডপের পেছনে আতা গাছের ঝোঁপের তলার অন্ধকারে যেন ফিসফিস করে কারা কথা বলছে।

সদানন্দ কাছে যেতেই বংশী ঢালী অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল।

সদানন্দ জিজ্ঞেস করলে–বংশী, এখানে অন্ধকারে কীসের একটা আওয়াজ হলো না? যেন মেয়েমানুষের গলার মত আওয়াজ পেলাম–

বংশী অবাক হয়ে গেল–মেয়েমানুষের গলার আওয়াজ! এখানে মেয়েমানুষের গলার আওয়াজ কোত্থেকে আসবে খোকাবাবু?

–তা তুমি এখেনে এখন কি করছিলে? সবাই কাজ করছে আর তুমি এই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কী দেখছো?

বংশী বললে–না, এই আমার ঘরে ঢুকেছিলাম, এখন বেরোচ্ছি–

বলে কথা এড়াবার জন্যে তাড়াতাড়ি বার বাড়ির লোকজনের ভিড়ের দিকে চলে গেল। কিন্তু সদানন্দর কেমন সন্দেহ হলো। এ জায়গাটা একেবারে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার ঘুরঘুট্টি। বংশী চলে যাবার পর সদানন্দও চলে আসছিল। কিন্তু আবার সেই অন্ধকারের দিকেই ফিরে গেল। বংশীকে দেখলেই কেমন ভয় করতে সদানন্দর। ও এমন সময় এখানে একলা থাকবার লোক তো নয়। আর এদিক থেকেই তো আওয়াজটা এসেছিল। মেয়েমানুষের গলার মত আওয়াজ।

বংশীর ঘরের দরজাটা ঠেলে খুলতে গেল সে। কিন্তু মনে হলো যেন তালা ঝুলছে। অন্ধকারের মধ্যে তালাটায় হাত দিলে। হাত দিয়ে নাড়ালে। আর বোধ হয় তাড়াতাড়িতে ভালো করে তালায় চাবি লাগানো হয় নি। সঙ্গে সঙ্গে সেটা খুলে গেল। সদানন্দ ঘরের মধ্যে চেয়ে দেখবার চেষ্টা করলে। মনে হলো ভেতরে যেন তখনও কার গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে

কিন্তু বংশী তারই মধ্যে আবার এসে হাজির হয়েছে তখন।

–এখানে কি করছো খোকাবাবু?

–ঘরের ভেতরে কী বংশী? গোঙ্গাচ্ছে কে?

বংশী ঢালী সেকথার উত্তর না দিয়ে বললে–কর্তাবাবু তোমাকে ডাকছে খোকাবাবু, লোক এসেছে, তাড়াতাড়ি ডেকেছে–

–আমাকে? আমাকে ডেকেছে?

বংশী ঢালী বললে–হ্যাঁ–এখুনি দেখা করে এসো–

–কিন্তু তোমার এই ঘরের মধ্যে কে?

বংশী ঢালী বললে–ঘরের মধ্যে আবার কে থাকবে? আমি তো তালা-চাবি দিয়ে রেখেছিলাম। খুললে কে? বলে ট্যাঁকের ঘুনসী থেকে একটা চাবি বার করে বোধ হয় তালাটা আবার বন্ধ করবার চেষ্টা করতে লাগলো।

–কিন্তু ঘরের মধ্যে কার গলার আওয়াজ শুনলুম, ওখানে কে আছে বলো তো? বলো ওখানে কি হয়েছে? কে আছে ওখানে?

কিন্তু বংশী ঢালী অত সহজে ভাঙবার পাত্র নয়। বললে–তুমি ভূত দেখেছ খোকাবাবু, ভূতের ভয় লেগেছে তোমার নিশ্চয়।

সদানন্দ বললে–বাজে কথা রাখো, বলো ভেতরে কী হয়েছে? বলো ভেতরে কে আছে? তুমি নিশ্চয় কালীগঞ্জের বউকে ভেতরে আটকে দিয়েছ–এখনও বলল কে ওখানে?

বংশী ততক্ষণে দরজায় বেশ করে তালাচাবি বন্ধ করে আবার চলে যাচ্ছিল। সদানন্দ ছাড়লে না, বললে–বলো, কে ওখানে আছে? কাকে তালাচাবি বন্ধ করে রেখেছ?

বলতে বলতে বংশীর পেছন-পেছন একেবারে সদরের বার বাড়ির কাছে এসে পড়েছিল। প্রকাশ মামা দেখতে পেয়েছে। বললে–এ কী রে, তোর গেঞ্জিতে এত রক্ত কেন?

.

এসব অনেক দিন আগেকার ঘটনা। তবু এতকাল পরে চৌবেড়িয়া থেকে বেরিয়ে নবাবগঞ্জের পথে যেতে যেতে সেইদিনকার সেই সব কথাগুলোর যেন নতুন মানে করবার চেষ্টা করতে লাগলো সদানন্দ। এতকাল পরে নবাবগঞ্জে গেলে সেখানে কী দেখবে কে জানে! সেই নবাবগঞ্জ কি আর সেরকম আছে! ইতিহাসের কষ্টিপাথরে যখন সব জিনিসেরই আসল নকল যাচাই হয়ে যায় তখন নবাবগঞ্জেরও হয়ত একটা নতুন যাচাই হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। সেই ফুলশয্যার আগের রাত্রের সেই দুর্ঘটনার কথা আজ সে ছাড়া কি আর কারো মনে আছে! আর মনে থাকলেও তার জীবনে এ ঘটনার তাৎপর্য যেমন করে ছায়াপাত করেছে তেমন করে আর কার জীবনে ছায়াপাত করবে? শুধু নবাবগঞ্জ কেন, পৃথিবীতে কোনও দুর্ঘটনাই তো কাউকে চিরকালের মত এমন অভিভূত করে রাখে না। সংসারে বোধ হয় তাই সে-ই একমাত্র ব্যতিক্রম। সে তো আর সকলের মত সুখে-স্বচ্ছন্দে স্ত্রী-পুত্র-সংসার নিয়ে আপোস করে চললেই পারতো! কেন তবে সব থাকতে সে এই চৌবেড়িয়ার অতিথিশালায় অজ্ঞাতবাসের দুর্ভোগ সইছে!

পরের দিন কেষ্টগঞ্জ থেকে পুলিস এসে সেই কথাই জিজ্ঞেস করেছিল।

বলেছিল–আপনি কেমন করে বুঝলেন যে এখানে খুন হয়েছিল? খুন হলে তো রক্তের দাগ থাকবে!

সদানন্দ বলেছিল–কিন্তু আমার গেঞ্জিতে রক্তের দাগ লেগে রয়েছে, আমার কাপড়ে রক্তের দাগ লেগে রয়েছে, আমার হাতেও তখন রক্তের দাগ লেগে ছিল। সে দাগ সবাই দেখেছে–

পুলিসের দারোগাবাবু তার আগেই কর্তাবাবুর সঙ্গে দরজা বন্ধ ঘরের মধ্যে আধ ঘণ্টারও বেশি কথাবার্তা বলেছে। সদানন্দ জানতো না ফয়সালা যা হবার তা সেখানেই সব কিছু হয়ে গেছে। এসব ব্যাপারে ফয়সালার জন্যে কর্তাবাবুর সিন্দুকের ভেতরে সব সময়েই মশলা মজুদ থাকে। সেই মশলা দিয়েই নরনারায়ণ চৌধুরী এতদিন রাজত্ব করে আসছেন। প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা প্রতাপ সব কিছু কায়েম করে সকলের মাথার ওপরে বসে আছেন। শুধু পুলিসের দারোগা কেন কোর্টের জজ থেকে শুরু করে আদালতের পেয়াদা পর্যন্ত ওই মশলার জোরে তাঁর কাছে মাথা নীচু করেছে।

তাই কেষ্টগঞ্জের দারোগার কানে সেদিন সদানন্দর কথাগুলো ভালো লাগে নি।

দারোগাবাবু জিজ্ঞেস করেছিল–কিন্তু কাকে খুন করা হয়েছে?

সদানন্দ বলেছিল–কালীগঞ্জের বউকে। কালীগঞ্জের জমিদারের বিধবা স্ত্রী–

–কিন্তু তাঁকে তো নেমন্তন্ন করা হয় নি। তিনি কেন ফুলশয্যার আগের দিন বিনা নিমন্ত্রণে আসতে যাবেন?

সদানন্দ বলেছিল–তাই যদি হয় তাহলে তিনি গেলেন কোথায়? কালীগঞ্জেও তো তিনি নেই। তিনি তো কালীগঞ্জেও ফিরে যান নি। তার পালকি-বেহারাদেরও তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এমন কি তার পালকিটাও তো কোথাও নেই।

সত্যিই এ বড় আশ্চর্য কাণ্ড! কালকে যে মানুষটাকে সবাই দেখেছিল, একখানা শাড়ি নিয়ে এসে নতুন বউকে আশীর্বাদ করে গেছে, সে মানুষটা এমন করে অদৃশ্য হলোই বা কী করে! এমন কি তার পালকিটা পর্যন্ত রাতারাতি অদৃশ্য হয়ে গেল কী করে!

কিন্তু সাক্ষ্য দেবার সময় সবাই বললে–কই, আমি তো পালকি দেখি নি!

দারোগাবাবু বারবার সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন–আপনারা কেউই দেখেন নি কালীগঞ্জের বউকে?

সবাই একবাক্যে বললে–আজ্ঞে না, আমাদের কাজকর্ম ছিল, কারো দিকে দেখবার মত সময় ছিল না তখন।

–আর আপনি? আপনি দেখেছেন? আপনিই তো সদরে দাঁড়িয়ে শামিয়ানা খাটাচ্ছিলেন। সবাই বললে।

প্রকাশ মামার কাজের তখনও শেষ হয় নি। পুলিস দেখে তার পিত্তি জ্বলে গিয়েছিল। বললে–আমি? আমাকে বলছেন দারোগাবাবু? আমার কি মরবার ফুরসৎ আছে? যতক্ষণ না ফুলশয্যা কাটে ততক্ষণ আমার মরবার পর্যন্ত ফুরসৎ নেই

সদানন্দ মাঝখানে বলে উঠলো–কিন্তু মামা তুমি তো কালীগঞ্জের বউকে পালকি থেকে নামতে দেখেছ, তুমিই তো বেয়ারাদের সদর থেকে পালকি সরিয়ে নিয়ে যেতে বলছে! এখন তুমি সব বেমালুম ভুলে গেলে?

দারোগাবাবু বললে–আপনি থামুন, আমি যাকে জিজ্ঞেস করছি তিনিই উত্তর দেবেন।

তারপর প্রকাশ মামার দিকে চেয়ে দারোগাবাবু আবার বলতে লাগল–তারপর কখন আপনার শামিয়ানা খাটানো শেষ হলো?

প্রকাশ মামা বললে–ধরুন তখন মাঝ-রাততির–

–তখনও কি কিছু সন্দেহ করেছিলেন যে এ বাড়িতে কেউ খুন হয়েছে?

প্রকাশ মামা বললে–রাম, সে সন্দেহ করতে যাবো কেন? ওই আমার, ভাগ্নেই কেবল সকলকে বলে বেড়াতে লাগলো কালীগঞ্জের বউ কোথায় গেল, কালীগঞ্জের বউ কোথায় গেল! তা আমি বললুম কালীগঞ্জের বউ কোথায় আবার যাবে? কালীগঞ্জেই আছে কিন্তু ও কিছুতেই তা শুনবে না। শেষ পর্যন্ত সেই রাত্তিরে আমার ভাগ্নে কালীগঞ্জে গেল। গিয়ে যখন ফিরে এল তখন আমার ঘড়িতে রাত প্রায় একটা। সেখানেও নেই। তখন পাগলের মতন ছটফট করতে লাগলো। তখন আমি বললুম–এতই যদি তোর সন্দেহ তাহলে পুলিসে খবর দে! আমার কথাতে তখন ও আপনার কাছে গেল–

–আপনি তাহলে বলতে চান এ বাড়িতে কেউই খুন হয় নি?

প্রকাশ মামা বললে–তা হলে তো আমিই আগে জানতে পারতুম। তখন সকলের আগে আমিই আপনাকে গিয়ে খবর দিতুম।

পুলিসের কাজ বড় নিখুঁত। বিশেষ করে কেষ্টগঞ্জের পুলিসের। তারা নবাবগঞ্জের নরনারায়ণ চৌধুরীর কোনও কাজেই কোনও দিনই খুঁত পায় নি। এর আগে নবাবগঞ্জে যতবার লাঠিবাজি হয়েছে, জমি দখল হয়েছে, বিশেষ করে সেই যেবার বারোয়ারিতলার অশ্বথ গাছের ডালে কপিল পায়রাপোড়া গলায় দড়ি দিয়েছিল, কোনও বারেই কেষ্টগঞ্জের দারোগারা কোথাও কোনও খুঁত পায় নি। প্রত্যেকবারই নবাবগঞ্জে এসেছে, এসে কর্তাবাবুর দোতলার দরজা বন্ধ ঘরে বসে বসে নিরিবিলিতে সব মামলার ফয়সালা হয়ে গেছে, কোর্ট পর্যন্ত আর সে-সব গড়ায় নি।

আর আশ্চর্য ওই বংশী ঢালীর দল! তাদের যেন কোনও যুগেই শাস্তি হতে নেই। তারা যেমন সেই ইতিহাসের আদি যুগেও ছিল, তেমনি এখনও আছে, আবার সুদূর ভবিষ্যতেও তারা থাকেবে। তাদের জন্যে পেনাল-কোড তৈরী হয়েছে, থানাপুলিস, কোট-কাছারির ব্যবস্থা হয়েছে, জজ-ম্যাজিস্ট্রেটদের মোটা মাইনে দিয়ে পোষা হয়েছে। তবু তারা নিঃশেষ হয় নি। তাদের বংশ বেড়েই চলেছে বরাবর। এ যে কেমন করে সম্ভব হয় তা হয়ত ওই নরনারায়ণ চৌধুরীরাই একমাত্র বলতে পারেন, আর বলতে পারে তাদের সিন্দুকের টাকা। আর টাকা তো মানুষ নয়, আর টাকার মুখও নেই, তাই হয়ত সে মুখের ভাষাও নেই। যদি ভাষা থাকতো তা হলে বলতো–আমিই সব, আমিই সৃষ্টি, আমিই স্থিতি, আবার আমিই প্রলয়। একাধারে আমিই নরনারায়ণ চৌধুরী, আমিই বংশী ঢালী আবার আমিই পুলিস। উকিল-জজ-আসামী-ফরিয়াদী সব কিছুই আমি। সুতরাং আমাকেই তোমরা মনে-প্রাণে ভজনা করো।

সেইজন্যেই সেদিন বংশী ঢালীর ভয় ছিল না। খোকাবাবু যখন কালীগঞ্জের বউকে সারা বাড়ির ভেতরে খুঁজে বেড়াচ্ছে তখন বংশী ঢালীরা গা-ঢাকা দিয়ে আতা গাছের অন্ধকারে চণ্ডীমণ্ডপের দরজার তালা আবার খুলেছে। তাদের সব কাজ পাকা হাতের কাজ। আগের বারে তাড়াতাড়িতে কাজটা কেঁচে গিয়েছিল। তাই খোকাবাবুর গেঞ্জিতে-ধুতিতে রক্ত লেগে গিয়েছিল। এবার আর তা নয়। এবার সমস্ত ঘরের মেঝে, দেয়াল, দরজা-জানলা জল দিয়ে ধুয়ে একেবারে সাফ করে ফেললে। তারপর সেই চণ্ডীমণ্ডপের খিড়কী দিয়ে লাশটা নিয়ে উধাও হয়ে গেল একদল। আর গেল পালকি বেহারাদের অদৃশ্য করে দিতে। বেহারারা তখনও সদরের সামনে মা-জননীর জন্যে হা-পিত্যেশ করে দাঁড়িয়ে ছিল।

একজন কাছে গিয়ে বললে–হ্যাঁ গো, কালীগঞ্জের লোক এখানে কারা?

দুলাল বললে–আমরা গো বাবু, আমরা–

লোকটা বললে–আরে, তোমাদেরই তো খোঁজাখুঁজি হচ্ছে। এতক্ষণ তোমাদের খুঁজে খুঁজে হয়রান। তোমরা বার বাড়ির উঠোনে ছিলে, তোমাদের আবার বাইরে আসতে কে বললে?

–আজ্ঞে, একজন বাবুমশায় তো আমাদের এখেনেই দাঁড়াতে বললে। আমাদের জন্যে তাঁর কাজের অসুবিধে হচ্ছিল।

–কী মুশকিল দেখ দিকিনি। আর এদিকে মা-জননী তোমাদের খুঁজে খুঁজে মরছে। খুব লোক যা’হোক তোমরা।

–তা মা জননী কোথায়?

–আরে, তিনিই তো ডেকে পাঠিয়েছে তোমাদের। এসো, আমার সঙ্গে এসো, পালকি তুলে নিয়ে এসো–

–কিন্তু কোথায় মা-জননী? কোন দিকে?

তখন চৌধুরীবাড়িতে হ্যাজাগবাতি জ্বলে উঠেছে। পুকুরপাড়ে মিষ্টির ভিয়েন বসেছে, তারও ও-পাশে আলোর ব্যবস্থা হয়েছে। মাছ-মাংস কাটা হচ্ছে। আর একদিকে লোহার কড়ায় গরম ঘিয়ের ওপর ময়দার লুচিগুলো ফোস্কার মত ফুলে ফুলে উঠছে। বাড়ির লোকজন খাবে, খাবে বাড়ির কর্তা-গিন্নিকুটুম। তার সঙ্গে খাবে নতুন বউ।

নয়নতারা বিকেল থেকে এসে ঘরের মধ্যে এক জায়গায় বসে আছে। আগের রাতে বাসর-ঘরে ঘুমোতে পারে নি। তারপর সকাল বেলা কাঁদতে কাঁদতে ট্রেনে উঠেছে। তখন থেকে ঘোমটা দেওয়া অবস্থায় সমস্ত রাস্তাটা কাটিয়েছে। এ বাড়িতে এসে যে বেশি করে যত্ন করেছে সে হলো গৌরী পিসী।

গৌরী পিসীরই যেন যত জ্বালা। বললে–ওলো, তোরা একটু সর তো বাছা, বউমাকে একটু হাঁফ ছাড়তে দে। সর বাছা তোরা সব–এখন তোরা যার-যার বাড়ি যা, কালকে আবার বউ দেখতে আসিস–

তারপর নয়নতারার হাতখানা ধরলে।

বললে–এসো বউমা এসো, মুখ-হাত-পা ধুয়ে নাও, কুয়ো-পাড়ে চলো—

তা ব্যবস্থা ভালোই করেছিল। কুয়োর কাছে একপাশে খানিকটা জায়গা চাটাই দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছিল নতুন বউ-এর জন্যে। একটু আড়াল হবে। নতুন বউ তো আর আমাদের মত গা খুলে চান করতে পারবে না। তার জন্যে আড়াল চাই। চান করবে, সাবান মাখবে, গা ডলবে।

গৌরী পিসী বললে–তুমি বউমা লজ্জা করো না যেন। খিদে-টিদে পেলে বলবে। এ এখন থেকে তোমারই বাড়ি মনে করে নাও। প্রথম প্রথম বাপ-মায়ের জন্যে একটু মন কেমন করবে বটে, কিন্তু তারপর দেখবে যখন সেয়ামীর ওপর মন বসে যাবে তখন আর কেষ্টনগরে যেতেই মন চাইবে না। সোয়ামী এমন জিনিস গো–

সমস্ত অচেনা পরিবেশের মধ্যে নয়নতারার কাছে তখন সব কিছুই খারাপ লাগছিল। শুধু ভালো লাগছিল গৌরী পিসির কথাগুলো।

গৌরী পিসী বলল–আমি তোমার আপন পিস-শাশুড়ী নই গো, আপন পিস-শাশুড়ী নই! তুমি বুঝি ভাবছো আমি তোমার আপন পিস-শাশুড়ী?

নয়নতারা কী আর উত্তর দেবে! ‘হ্যাঁ’ ‘না’ কিছুই তার মুখ দিয়ে বেরোল না।

গৌরী পিসী বললে–আমার সামনে লজ্জা করো না বউমা, তোমার গায়ের বেলাউজ খুলে ফেল, আমি পিঠে সাবান মাখিয়ে দিই–

তবু নয়তারার কেমন লজ্জা করতে লাগলো।

গৌরী পিসী বললে–খোল খোল, লজ্জা কী, কাক-পক্ষীতে দেখতে পাবে না তোমাকে, তোমার চানের জন্যেই তো এই জায়গা তৈরি হয়েছে–

এবার নয়নতারা প্রথম কথা বলে উঠলো। বললে–আপনারা কোথায় চান করেন?

–আমরা? আমরা সবাই ওই পুকুরে। পুকুরে বাঁধানো ঘাট আছে। তোমার শাশুড়ীও সেখানে চান করে। প্রথম প্রথম তুমি এই কুয়োপাড়ে চান করো। শেষকালে একটু পুরোন হয়ে গেলে তুমিও আমাদের মত পুকুরের ঘাটের পৈঁঠেতে বসে চান করবে–

নয়নতারার পিঠে তখন গৌরী পিসী ঘষ ঘষ করে সাবান ঘষতে আরম্ভ করেছে।

সাবান ঘষতে ঘষতেই গৌরী পিসী বললে–আমাদের এইটুকু জায়গায় চান করে সুখ হয় না মা। তোমার শাশুড়ী আর আমি তো আগে সাঁতার কেটেছি কত…তা তুমি সাঁতার জানো তো বউমা?

–সাঁতার? আমি তো সাঁতার জানি না?

–সাঁতার জানো না? তা তোমাদের কেষ্টনগরে বুঝি বাড়িতে পুকুর-ঘাট নেই?

নয়নতারা বললে–না, আমাদের টিউবওয়েল আছে—

গৌরী বললে–ও আমি দেখেছি, ওই সদার মামার বাড়িতে ওই কল আছে, টিউবকল। ঢেঁকির মত পাড় দিতে হয়, বুঝতে পেরেছি। তা তোমার ভাবনা নেই বউমা, আমি তোমাকে সাঁতার শিখিয়ে দেব। এই দু’চার দিন ঝাঁপাই ঝুড়লেই তোমার রপ্ত হয়ে যাবে, তখন দেখবে জল ছেড়ে আর উঠতে ইচ্ছে করবে না–

তারপর গা-ধোওয়া, ভিজে কাপড় ছেড়ে শুকনো কাপড় বদলানো, মুখে পাউডার মাখা, চুল আঁচড়ে নতুন খোঁপা বাঁধা সবই করিয়ে দিলে গৌরী পিসী। নয়নতারার জন্যে নতুন ঘর। ঘরের ভেতর নতুন খাট, নতুন আলমারি, নতুন গদি-বিছানা।

গৌরী পিসী নয়নতারাকে সেই ঘরের মধ্যে নিয়ে গেল।

বললে–এই দেখ, এই হলো তোমার শোবার ঘর। কালকে এইখানে তোমার ফুলশয্যে হবে–

নয়নতারা দেখলে।

গৌরী পিসী বললে–আজ একটা রাত কোনও রকমে নাক-কান বুঁজে কাটাও, কাল রাত থেকে এখেনে তোমরা দুজনে শোবে।

নয়নতারা এর জবাবেও কিছু বললে–না। শুধু কান দিয়ে কথাটা শুনলো।

কিন্তু বেশিক্ষণ সে ঘরে থাকা হলো না। পেছন থেকে শাশুড়ীর গলা শোনা গেল –ওলো, ও গৌরী, বউমাকে খেতে দিয়েছিস?

সত্যিই খাবার কথা মনে ছিন না গৌরী পিসীর। বললে–চলো বউমা, ওদিকে তোমার শাশুড়ী আবার রাগ করবে, এসো এসো। এখন আর এসব দেখে কী হবে! কাল থেকে তো এখেনেই চিরকাল কাটাতে হবে তোমাকে। তখন দরজায় হুড়কো দিয়ে থাকবে তোমরা, কাউকেই আর ভেতরে ঢুকতে দেবে না। এসো–

ভেতরে জলখাবারের বন্দোবস্ত হয়েছিল। শাশুড়ী বললে–এখন এই মিষ্টি কটা খেয়ে নাও বউমা, তারপরে রাত্তিরের খাওয়া পরে খেও। তখন পেট ভরে লুচি তরকারি মাছ মাংস খেও–গৌরী, ঠাণ্ডা জল দে বাছা বউমাকে–

মিষ্টিগুলোর দিকে চেয়ে নয়নতারা ভাবছিল অত খাবে কী করে! হঠাৎ বাইরে যেন কীসের আওয়াজ হলো। কীসের আওয়াজ! মুখটা তুলতেই হঠাৎ চোখে চোখ পড়ে যাওয়াতে মাথায় ঘোমটা টেনে দিলে। সদানন্দ!

সদানন্দ ভেতরে এসে নয়নতারাকে দেখে প্রথমে একটু দাঁড়ালো। তারপর ডাকলে–মা, মা কোথায়?

মা আসবার আগেই গৌরী পিসীকে দেখে বললে–পিসী, কালীগঞ্জের বউ এখানে এসেছে?

গৌরী পিসী তো অবাক। বললে–হ্যাঁ এসেছিল, কিন্তু সে তো চলে গেছে–

–কোথায় চলে গেছে? কোন দিকে?

ততক্ষণে মা এসে গেছে ভাঁড়ার ঘরের দিক থেকে। বললে–কী রে খোকা? কী চাস?

সদানন্দ বললে–কালীগঞ্জের বউ ভেতরবাড়িতে এসেছিল?

–কেন? তার সঙ্গে তোর কী দরকার?

সদানন্দ বললে–দরকার আছে। তুমি বলো না কোন্ দিকে গেল?

–তা কী দরকার তাই বল না। তাকে তো নেমন্তন্ন করা হয় নি, কিছুই না, তবু সে কেন আসে এ বাড়িতে? আবার বুঝি তোকে টেনে নিয়ে গিয়ে তার বাড়িতে আটকে রাখবে? ভারি তো একটা তিন টাকা দামের বাঁধিপোতার গামছা দিয়ে আদিখ্যেতা করতে এসেছে। যেন আমরা গামছা কিনতে পারি না, আমাদের গামছা কেনবার যেন পয়সা নেই! ঢং, মাগী ঢং দেখাতে এসেছে

সদানন্দ রেগে গেল। বললে–তোমার ওসব কথা শুনতে চাই নি আমি, আমি যা জিজ্ঞেস করছি তারই জবাব দাও তুমি, বলো কালীগঞ্জের বউ ভেতর-বাড়িতে এসেছিল কি না–

মা বললে–তা সে যদি এসেই থাকে তো তোর কী? তোর সঙ্গে তার কীসের সম্পর্ক?

সদানন্দ বললে–আমার সম্পর্কের কথা আমি বুঝবো, আমি যা জিজ্ঞেস করছি আগে তার জবাব দাও তুমি—

নয়নতারা চুপ করে সব শুনছিল। এরই সঙ্গে তার কাল বিয়ে হয়েছে। মানুষটাকে খুব রাগী লোক বলে মনে হলো তার কাছে। কিন্তু কালীগঞ্জের বউ কে! বাসর-ঘরে তো এরই কথা হয়েছিল, এখন মনে পড়লো। অথচ আশ্চর্য, এ যে এত রাগী মানুষ চেহারা দেখে তো তা বোঝা যায় না।

কিন্তু ততক্ষণে সদানন্দ সেখান থেকে চলে গিয়েছে। তারপরে আরো রাত হলো। মেয়েদের ভিড়ের মধ্যে বসে বসে আরো অনেক মেয়েলী কথা কানে এল। সবাই তার রূপ দেখে প্রশংসা করছে। সবাই বলছে এমন বউ নাকি হয় না। কথাগুলো শুনতে খুব ভালো লাগলো নয়নতারার। নিজের রূপের প্রশংসা আগেও সে অনেক শুনেছে। বাপের বাড়ির লোকেরা বলতো এ মেয়ে যে বাড়িতে যাবে সে বাড়ি আলো করে রাখবে। বলতো যার সঙ্গে এ মেয়ের বিয়ে হবে সে নাকি বড় ভাগ্যবান। তাহলে এমন রাগারাগি কেন করলে তার সামনে? আর চব্বিশ ঘণ্টা পরেই তো ওই মানুষটার সঙ্গে তাকে একটা বিছানায় এক ঘরে কাটাতে হবে? তাহলে তারই সামনে মার সঙ্গে কেন অত রাগারাগি করতে গেল? তার রূপ দেখে তো তার ভুলে যাওয়া উচিত ছিল! একটা দিনের জন্যেও সে তার রাগ সামলাতে পারলে না? তাহলে কীরকম চরিত্রের মানুষ ও!

তারপর সবাই খেতে বসলো। তাদের মধ্যে নয়নতারাও খেতে বসেছে। খেতে খেতে কত লোকের কত কথা তার কানে এল। কত হাসাহাসি, কত গল্প। সকলেরই নজর নতুন বউ-এর দিকে। ভালো ভালো জিনিস তার পাতে দিয়েছে শাশুড়ী। নয়নতারার মনে হলো শাশুড়ী মানুষটা কিন্তু ভালো।

একবার শাশুড়ী বললে–কই বউমা, তুমি তো কিছু খাচ্ছো না? খাও, এরকম না খেলে চলবে কেন? মাছ খাচ্ছো না যে, ঝাল হয়েছে বুঝি? তুমি বুঝি ঝাল খাও না?

নয়নতারা ঘাড় নেড়ে ইঙ্গিতে জানালে সে ঝাল খায়। আর তা ছাড়া ঝাল সে খাক আর নাই খাক, সব জিনিস ‘হ্যাঁ’ বলতেই সে শিক্ষা পেয়েছে মার কাছে।

মা বলতো–শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে শাশুড়ী যা বলে তাই শুনবে মা, ‘না’ বোল না যেন।

–ঝাল খাও? তা হলে আর একখানা মাছ দেব, খাবে?

গৌরী পিসী বললে–জিজ্ঞেস করছো কেন বউদি, দাও না আর একখানা মাছ।

খেতে খেতে কেবল মার কথাই মনে পড়তে লাগলো নয়নতারার। এমন করে মাও তাকে খাওয়াতো আর বকতো। বলতো–কোথায় কাদের বাড়িতে পড়বি তখন হয়ত পেটই ভরবে না তোর। এখন দিচ্ছি খেয়ে নে। মেয়েমানুষ হয়ে যখন জন্মেছ তখন সব রকম অবস্থার জন্যে তোমাকে তৈরি হয়ে থাকতে হবে মা। বিয়ের আগে আমার কত বায়নাক্কা ছিল, এখন সে-সব কোথায় চলে গেল মনেও পড়ে না আর–

অচেনা মুখ অজানা দেশ, অদেখা পরিবেশ। তাই মার কথাগুলোই বারবার মনে পড়তে লাগলো নয়নতারার।

গৌরী পিসী হঠাৎ ভাবনার মাঝখানে বললে–চলো বউমা। শোবে চলো—

একটা বড় খাট। শ্বশুরের শোবার ঘর। সেখানেই সেদিনকার মত নয়নতারার শোবার ব্যবস্থা হয়েছে। একপাশে শাশুড়ী আর তার পাশে নতুন বউ। বাপের বাড়িতেও বয়েস হবার সঙ্গে সঙ্গে মা তাকে পাশে নিয়ে শুতো। আজই প্রথম অন্য বিছানায় অন্য লোকের পাশে শোওয়া। কাল থেকে আবার আর একজনের পাশে শুতে হবে তাকে।

আস্তে আস্তে চারদিকের সমস্ত শব্দ থেমে এল। রাত বাড়ছে। একটা পাতলা তন্দ্রার মধ্যে মনে হোল যেন কেষ্টনগরে মাও তাকে ভাবছে। মারও তার মতন একলা শুয়ে শুয়ে ঘুম আসছে না হয়ত। মারও যেন মনে হচ্ছে খুকুর কথা। খুকু সেখানে খেলে কিনা, খুকুর চোখে ঘুম এল কিনা। খুকু সেখানে এতক্ষণে হয়ত শাশুড়ীর পাশে শুয়ে মার কথা ভাবছে। আশ্চর্য, মেয়েমানুষের জীবনটাই ভগবান এক আশ্চর্য ধাতুতে গড়েছে! ছোটবেলা থেকে খাইয়ে-পরিয়ে মানুষ করে অন্য লোকের হাতে তুলে দিতে হয়। তারপর সেখানেই সে থাকবে। চিরকালের মত থাকবে। বাবা মার কথা আর ভাববে না। তখন তার নতুন সংসার নিয়েই মেতে থাকবে। তার সেই সংসারকেই সে নিজের সংসার বলে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে থাকবে। এই-ই নিয়ম। সংসারে আদিকাল থেকে বুঝি এই নিয়মই চলে আসছে মানুষের জীবনে।

–কই বউমা, তোমার ঘুম আসছে না বুঝি?

নয়নতারা একটু নড়তেই শাশুড়ী বোধ হয় বুঝতে পেরেছে।

শাশুড়ী বললে–নতুন জায়গা তো, তাই অসুবিধে হচ্ছে। দুদিন বাদে তখন আবার সব অভ্যেস হয়ে যাবে। ঘুমোও, ঘুমোতে চেষ্টা করো। কাল আবার বউভাত, সকাল থেকেই হই-চই শুরু হয়ে যাবে। তখন আর এক দণ্ডের জন্যে দু’চোখ এক করতে পারবে না। যতটুকু এখন পারো একটু ঘুমিয়ে নিতে চেষ্টা করো—

নয়নতারা দু’চোখ বুজে মার কথাগুলোই আবার ভাবতে শুরু করলে। মার কথা ভাবলেই মনটা কেমন আনন্দে ভরে যায়। সেই অন্ধকারের মধ্যে মার কথা ভাবতেই তার ভালো লাগলো তখন। সঙ্গে সঙ্গে নয়নতারার দু’চোখ যেন কখন ঘুমে জড়িয়ে এল।

নয়নতারা স্বপ্ন দেখতে লাগলো। ঠিক স্বপ্ন নয়, অথচ যেন স্বপ্নই! মন খারাপ দেখে বাবা যেন সান্ত্বনা দিচ্ছে–খুকুর কথা ভেবো না তুমি, সে খুব ভালো জায়গায় পড়েছে গো, সে কত বড় বাড়ি, কত জমি-জমা তাদের। তার সেখানে কোনও কষ্ট নেই, সে খুব আরামে আছে, তুমি তার কথা ভেবে মন খারাপ করো না

আসবার সময় মা নয়নতারাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়েছিল। বলেছিল–জন্ম এয়োস্ত্রী হয়ে থাকো মা, স্বামীর মন যুগিয়ে চলো, আশীর্বাদ করি হাতের শাঁখা সিঁথির সিঁদুর যেন তোমার অক্ষয় হয়…।

কথাগুলো বলছিল বটে মা কিন্তু মেয়েও যত কাঁদছিল মাও তত কাঁদছিল। তাদের দেখাদেখি আশেপাশে যারা দেখছিল তাদের চোখও আর শুকনো ছিল না। তারপর ট্রেনের টাইম হয়ে যাচ্ছিল। ঘন ঘন তাগাদা দিচ্ছিল বরকর্তা–কই বেয়াই মশাই, এত দেরি হচ্ছে কেন, ওদিকে যে ট্রেন ছেড়ে দেবে–মা-লক্ষ্মীকে একটু তাড়াতাড়ি করতে বলুন—

হঠাৎ যেন তন্দ্রাটা ভেঙে গেল। তন্দ্রাটা ভাঙতেই নয়নতারা ধড়মড় করে চারদিকে চেয়ে দেখলে। একেবারে অন্য পরিবেশ। এখানে কেষ্টনগরের মত দেরি করে ঘুম থেকে উঠলে চলবে না। পাশের দিকে চেয়ে দেখলে জায়গাটা খালি। শাশুড়ী কখন বিছানা ছেড়ে উঠে চলে গেছে টের পায় নি। আর দেরি করলে না সে। বিছানা ছেড়ে উঠলো। হঠাৎ মনে পড়লো ঘোমটা দিতে হবে। আগের মত আর মাথা খালি রাখলে চলবে না।

–ওমা, তুমি উঠেছ?

গৌরী পিসী চুপি চুপি ঘরে উঁকি মেরে দেখতে এসেছিল বউ উঠেছে কিনা। উঠেছে দেখে বললে–ঘুম হয়েছিল তো বউমা? চা খাবে? চা খাওয়া অভ্যেস আছে তোমার?

নয়নতারা বললে–না–

–অভ্যেস নেই? অভ্যেস থাকলে বলল। বলতে লজ্জা করো না। আমাদের এখানে চা হয়। চা খাওয়ার লোক আছে এখানে। তোমার যে মামা-শ্বশুরকে দেখেছো, তোমাকে কেষ্টনগর থেকে এখানে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন, উনি চা খান, চা না হলে ওঁর একদণ্ড চলে না–

বাড়িটাতে তখন আবার লোকজনের গোলমাল শুরু হয়ে গেছে। আজ বউভাত। বিকেলের পর থেকেই লোকজনের আসা শুরু হবে। তার জন্যে চারদিকে ম্যারাপ বাঁধা হয়ে গেছে। তারপর কেষ্টনগর থেকে বাবা ফুলশয্যের তত্ত্ব পাঠাবে। বিপিন আসবে। তার কাছ থেকেই মা-বাবার খবর পাওয়া যাবে। হয়ত মা-বাবা আসতেও পারে। এখন থেকে সারা দিন আর বিশ্রাম নেই কারো।

–নাও নাও বউমা, কুয়োপাড়ে জল দিয়েছে, কাপড়-চোপড় নিয়ে যাও, চান করতে হবে। চলো আমি দেখে দিচ্ছি কোন্ শাড়িটা পরবে তুমি–

সকাল বেলা এবাড়িটার আবার অন্য চেহারা। কাল রাত্রে এখানকার অন্য চেহারা দেখেছে সে। তখন চারদিকের এই গাছপালাবাগান-পুকুর দেখে কেমন যেন জঙ্গল জঙ্গল মনে হয়েছিল তার কাছে। আর আজ রোদ ওঠবার পর সব যেন ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। সব কিছু যেন তার কাছে ভালো লাগতে লাগলো।

ততক্ষণে গ্রাম থেকে আরো কজন বউ-ঝি তাকে দেখতে এসেছে। কাল সন্ধ্যেবেলা যারা আসতে পারে নি তারা আজ দিনের আলোয় নতুন বউকে দেখবে। গরীব গ্রামের বউ-ঝি সব। খালি গা, খালি পা। জমিদার বাড়ির নতুন বউকে তারা দূর থেকে একবার শুধু দেখে যাবে। আর তারপর সন্ধ্যেবেলা এসে পাতা পেতে পেট ভরে খাবে আর ছাঁদা বেঁধে নিয়ে যাবে।

হঠাৎ কে যেন একজন দৌড়তে দৌড়তে ভেতরে এল।

–খুড়ীমা, পুলিস এসেছে বার বাড়িতে–

–পুলিস? পুলিসকে আবার কে নেমন্তন্ন করতে গেল রে? পুলিস কী করতে এল রে আবার? বউ দেখবে নাকি?

কথাটা তখন চারদিকেই রটে গেছে। পুলিস-দারোগা কী করতে আসে এখানে! কোনও চুরি ডাকাতি হয়েছে নাকি! না খুনখারাবি!

খবর এল–দারোগাবাবু ওপরে কর্তাবাবুর ঘরে বসে কথা বলছে–

–তাহলে উনি কোথায়? তোদের চৌধুরী মশাই?

–ছোটবাবুও তো সঙ্গে রয়েছেন।

–আর প্রকাশ? প্রকাশ কোথায় গেল। তাকে একবার আমার কাছে ডেকে আন তো বাবা–

সঙ্গে সঙ্গে একজন দৌড়লো শালাবাবুকে ডাকতে। নয়নতারার কানে সব কথাই যাচ্ছিল। তারও কেমন অবাক লাগলো। চুরি! ডাকাতি! খুন! কে কী চুরি করলো! আর যদি খুনই হয় তো কে-ই বা কাকে খুন করলো!

ছেলেটা আবার দৌড়তে-দৌড়তে ভেতরে এল। শাশুড়ী জিজ্ঞেস করলে–কী রে শালাবাবু কী বললে? আসছে?

–হ্যাঁ খুড়ীমা, শুনলাম কে নাকি এখেনে খুন হয়েছে, তাই পুলিস এয়েছে–

–খুন!

নয়নতারার মাথাটা এক মুহূর্তে যেন বোঁ-বোঁ করে ঘুরে উঠলো। খুন! খুন এখানে কখন হলো! কে খুন হলো! কে খুন করলো! কাকে খুন করলো!

নতুন জায়গায় এসে নতুন পরিবেশে কেমন যেন ভয় করতে লাগলো নয়নতারার। এ কেমন বাড়িতে তার বিয়ে হলো! বিয়ের পরের দিনই খুন! গৌরী পিসী সামনে দিয়ে যেতেই নয়নতারা তাকে ডাকলে–পিসীমা, পুলিস এসেছে শুনলুম, শুনলুম কে নাকি খুন হয়েছে?

গৌরী পিসী কথাটা হেসে উড়িয়ে দিলে। বললে–কে জানে বৌমা কে খুন হয়েছে, কার কপাল পুড়েছে–

নয়নতারা তবু ছাড়লে না। বললে–ওই যে কে এসে বলে গেল, তুমি শোন নি?

গৌরী পিসী বললে–আমার কি শোনবার সময় আছে বৌমা, যত ঝক্কি সব আমার ঘাড়ে চাপিয়েছে সবাই। তুমি ও-নিয়ে মাথা ঘামিও না বৌমা, ও-সব ভাববার অনেক লোক আছে এবাড়িতে। খানিক পরেই ফুলশয্যের তত্ত্ব আসবে, তাদের খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে, তারপর গাঁ-সুদ্ধ নেমন্তন্ন হয়েছে, তাদের ঝামেলা সমস্ত আমাকে পোয়াতে হবে–

বলতে বলতে আবার কোন্ দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল গৌরী পিসী।

বাড়ির ভেতরে তখন তুমুল কাজের ব্যস্ততা। কারোর যেন সময় নেই। শুধু কয়েকজন গ্রামের বউ-ঝি গিন্নীবান্নী মানুষ তার মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে আছে। যেন এক আজব বস্তুর সন্ধান পেয়েছে তারা নয়নতারার মধ্যে! যেন নয়নতারা তাদের মত মেয়েমানুষ নয়! যেন নয়নতারা অন্য জগতের জীব! তারা তার শাড়ি দেখছে, গয়না দেখছে, গায়ের রং দেখছে। মাথার খোঁপা দেখছে, চোখে চোখ রেখে যেন নয়নতারাকে গিলতে চাইছে সবাই।

হঠাৎ সেই মানুষটার গলা শোনা গেল আবার–মা, মা, মা কোথায়?

নয়নতারা মাথার ঘোমটাটা আরো বড় করে নিচের দিকে টেনে দিলে।

.

জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর একটা সহজ সম্পর্ক থাকেই। আমরা তা স্বীকার করি আর না-ই করি। একদিন সদানন্দর জন্ম হয়েছিল এই বাড়িতে। সেদিন এখানে উৎসব হয়েছিল বেশ ঘটা করে। ওই দাদুই সেদিন একটা সোনার হার দিয়ে নাকি নাতির মুখ দেখেছিল! রাণাঘাট থেকে মামলার শুনানী ছেড়ে নবাবগঞ্জে চলে এসেছিল। ভেবেছিল এই জন্ম এই আবির্ভাব এক শুভ-সূচনা। নিজের বংশকে চিরকালের মত সুপ্রতিষ্ঠিত করতেই এই জন্ম। কিন্তু সেদিনকার সেই শুভ-সূচনাকে এই এতদিন পরে এই হত্যা দিয়ে এই মৃত্যু দিয়ে কেন অভিষিক্ত করতে হলো। এও কি সদানন্দর জীবনের ক্রমবিকাশের পক্ষে এতই অপরিহার্য ছিল? কে জানে? নইলে হয়ত সদানন্দর জীবন এমন হতো না। সদানন্দ হয়ত আর পাঁচজনের মত এই নবাবগঞ্জের বংশধর হয়ে দাদু আর চৌধুরী মশাই-এর মত প্রজা খাতক আর সেরেস্তার কাগজপত্রের মধ্যেই জীবন কাটিয়ে দিত।

তাই সেদিন যখন চৌধুরীবাড়িতে সবাই বৌভাতের উৎসব-অনুষ্ঠানের আয়োজনে হিম সিম খেয়ে মরছে তখন সদানন্দ একবার কালীগঞ্জ আর একবার থানা-পুলিস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আকাশ-পাতাল পরিশ্রম করে বেড়াচ্ছিল।

কিন্তু দারোগাবাবু কোথাও কিছু খুঁত পেলে না। আতা গাছের তলায় চণ্ডীমণ্ডপের পেছনে বংশী ঢালীর যে আস্তানা ছিল সেখানেও সরেজমিনে তদন্ত করলে। কিন্তু সেখানে সব কিছুই স্বাভাবিক। কোথাও কিছু ব্যতিক্রম নেই।

অথচ এখানেই কাল মেয়েমানুষের গলার আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিল সদানন্দ। অন্ধকারের মধ্যে অবশ্য স্পষ্ট কিছু দেখতে পাওয়া যায়নি। কিন্তু তার মনে হয়েছিল যেন কেউ কাউকে সেখানে খুন করে ফেলে রেখে গেছে। তখন যেন মানুষটা পুরোপুরি জ্ঞান হারায়নি। তখনও যেন চেষ্টা করলে তাকে বাঁচানো যায়। আর সেখানেই তার হাতে আর গেঞ্জিতে রক্তের ছাপ লেগেছিল।

দারোগাবাবু বললে–কিন্তু আমি তো কিছু অস্বাভাবিক দেখছি না এখানে–

বংশী ঢালীকেও জেরা করলো দারোগাবাবু। বংশী ঢালী বললে–হুজুর, আমি তো রাত্তিরে এখানেই শুয়েছি, আমার হাতে পায়ে তো রক্তের দাগ লাগেনি–

–তাহলে সদানন্দবাবুর গেঞ্জিতে রক্তের দাগ কোত্থেকে এলো?

–তা আমি কী করে জানবো হুজুর।

–বাড়িতে আর কোথাও কি মাছ মাংস কাটা হচ্ছিল?

–হ্যাঁ হুজুর, বাড়িতে অনেক লোক খাবে, খোকাবাবু সেখানে গিয়েছিলেন, হয়ত সেখানেই রক্ত লেগে থাকবে–

–শুধু বংশী ঢালী নয়, প্রকাশ মামাও সেই একই কথা বললে—

সদানন্দ বললে–তাই-ই যদি হবে দারোগাবাবু, তাহলে কালীগঞ্জের বউ গেল কোথায়? কালীগঞ্জে আমি কাল রাত্তিরেই গিয়েছিলুম, সেখানে তো তিনি ফিরে যাননি। সঙ্গের পালকি বেহারারাও ফিরে যায়নি কেউ। তারা তাহলে সবাই গেল কোথায়?

দারোগাবাবু বললে–সে এনকোয়ারি করবে কালীগঞ্জের দারোগা। কালীগঞ্জ আমার এক্তিয়ারের বাইরে।

–তাহলে? তাহলে একটা লোক খুন হয়ে যাবে আর আপনারা কেউ তার কোনও প্রতিকারই করবেন না? একজন নির্দোষ মানুষ অকারণে তার প্রাণ হারাবে? আপনি তাহলে একবার নিজে কালীগঞ্জে চলুন। নিজে সেখানে গিয়ে একবার একোয়ারি করুন–

কিন্তু সদানন্দ তখন জানতো না যে পাপেরও শেকড় থাকে। গাছের শেকড়ের মত পাপের শেকড়ও সারা দেশময় সারা পৃথিবীময় শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখে। আরো জানতো না যে দারোগা নবাবগঞ্জের খুনের তদন্ত করতে এসে কোনও খুঁত পায় না, কালীগঞ্জের দারোগার চরিত্রেও এই দারোগার পাপের রক্ত তার শেকড়ের শাখা বিস্তার করে রেখে দিয়েছে। বংশী ঢালীদের পাপ আবিষ্কার করে এমন সাধ্য শুধু নবাবগঞ্জের দারোগার কেন পৃথিবীর কোনও গঞ্জের দারোগারই বুঝি নেই।

কিন্তু তবু হাল ছাড়বার পাত্র নয় সদানন্দ। তবু সদানন্দ বললে–না, আমি তাহলে কালীগঞ্জের দারোগার থানায় যাই–

প্রকাশ মামা বললে–আরে তুই কি সত্যিই পাগল হলি সদা?

সদানন্দ বললে–পাগল আমি, না তোমরা? তোমরা সবাই পাগল। শুধু পাগল নয়, তোমরা শয়তান….

কথাটা বলে সদানন্দ বাইরে বেরিয়ে চলে যাচ্ছিল। প্রকাশ মামা তাকে ধরে ফেললে। বললে–কোথায় চললি তুই?

সদানন্দ বললে—কালীগঞ্জে–

প্রকাশ মামা বলে উঠলো-কালীগঞ্জে যাবি? কিন্তু বাড়িতে যে আজ তোর বৌভাত রে? তোর ফুলশয্যে

–বৌভাত ফুলশয্যা তো আমার কী?

–তার মানে? তোর বৌভাত তোর ফুলশয্যা, তোর জন্যেই তো এই সব কিছু! আমি যে এই খেটে মরছি, এ কার জন্যে? তোর জন্যেই তো! এই যে হাজার হাজার টাকা খরচ হচ্ছে, এ সবই তো তোর জন্যে আর তোর বউ-এর জন্যে! তুই-ই তো মজা মারবি, আর আমরা তো শুধু বুড়ো আঙুল চুষবো–

সদানন্দ বললে–কিন্তু আমার জন্যেই যদি এত সব, তাহলে আমার টাকা দিলে না কেন তোমরা?

–টাকা?

–হ্যাঁ, কালীগঞ্জের বৌকে যে দশ হাজার টাকা দেবার কথা ছিল তা দিলে না কেন দাদু? টাকা দিলে তো কোনও গণ্ডগোলই হতো না আর! তাহলে আমিও কিছু বলতুম না। টাকা তো দিলেই না, তার ওপর পাছে টাকা দিতে হয় তাই কালীগঞ্জের বৌকে খুন পর্যন্ত করলে বংশী ঢালীকে দিয়ে–

প্রকাশ মামা বললে–খুন? খুন হলে তুই বলতে চাস পুলিস-দারোগা টের পেত না? খুন বললেই ওমনি খুন করা যায়? তুই যা-তা বলছিস কেন?

সদানন্দর চোখ দিয়ে ততক্ষণে জল গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে।

প্রকাশ মামা সদানন্দর চোখে জল দেখে থমকে গেল। বললে–এ কি রে, তুই কাঁদছিস? আজকে এত বড় একটা শুভদিনে তুই চোখের জল ফেলছিস! ছিঃ…

সদানন্দর তখন আর কথা বলবার ক্ষমতা নেই যেন। বললে–আমাকে ছাড়ো তুমি মামা, আমাকে ছাড়ো–-ছেড়ে দাও–

প্রকাশ মামা তখন আরো জোরে জাপটে ধরলে সদানন্দকে। বললে–পাগলামি করিস নে সদা, ছেলেমানুষি করবার তোর বয়েস নেই আর। এ সব জিনিস দশ বছর আগে করলে তখন মানাতো। এখন লোকে নিন্দে করবে তোর। তা ছাড়া এখুনি ফুলশয্যের তত্ত্ব আসবে। কেষ্টনগর থেকে, তারপর তোর শ্বশুর-শাশুড়ী আসবে–তারপর গা-সুষ্টু লোককে নেমন্তন্ন করা হয়েছে, তারা সব শুনে কী ভাববে বল তো…

হঠাৎ কীর্তিপদবাবু সেখান দিয়ে যেতে গিয়ে ঘটনাটা দেখে অবাক হলেন। প্রকাশ তার নাতিকে অমন করে জাপটে ধরে আছে কেন? সঙ্গে সঙ্গে কাছে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন–কী রে প্রকাশ, খোকাকে অমন করে ধরে কী করছিস? ও কী করেছে?

প্রকাশ সদানন্দকে তেমনি করে জড়িয়ে ধরেই বললে–দেখুন না পিসেমশাই আপনার নাতির কাণ্ড! পালিয়ে যাচ্ছে বাড়ি ছেড়ে–

–পালিয়ে যাচ্ছে মানে? কেন পালাচ্ছে? কোথায় পালাচ্ছে?

প্রকাশ মামা বললে—কালীগঞ্জে–

–কালীগঞ্জে? কালীগঞ্জে কার কাছে? আচ্ছা, ব্যাপারটা কী বল্ তো রে প্রকাশ? কাল থেকে কালীগঞ্জের বৌ-এর কথা শুনছি, কে সে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

প্রকাশ মামা বললে–সে পিসেমশাই পরে আপনাকে সব বুঝিয়ে বলবো, এখন একে ধরে না রাখলে সব কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে–

কীর্তিপদবাবু বললেন–পরে আর তোর সময় হয়েছে। পুলিসের দারোগা কেন এসেছিল তাও তো কেউ কিছু বললি নে। সবাই বলছে এখন সময় নেই, পরে বলবে! আর পরে কখন সময় হবে? আমি মরে গেলে তখন কে শুনতে আসবে–

প্রকাশ মামা সে কথায় কান না দিয়ে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলো–দীনু, ও দীনু–

দীনু আসবার আগে চৌধুরী মশাই-এর কানে গেল প্রকাশের চিৎকারের শব্দ। বারান্দায় মুখ বাড়িয়ে দেখেই বেরিয়ে এলেন। শুধু তিনি একাই নন্। কাণ্ড দেখে অনেকেই এসে জুটলো। বিয়েবাড়ির ভিড়ের মধ্যে এমন কাণ্ড দেখে অনেকেই এসে জটলা করলো।

দীনু দৌড়তে দৌড়তে এসে জিজ্ঞেল করলে–আমায় ডাকছিলেন শালাবাবু–

কিন্তু ততক্ষণে জায়গাটা ভিড়ে ভিড় হয়ে গেছে। সাধারণ লোক যারা কাজকর্ম করতে ব্যস্ত তারাও হাতের কাজ ফেলে এসে কাছে দাঁড়ালো। ওদিকে ভিয়েনের জায়গায় পুরোদমে কাজ চলছিল। মিষ্টিগুলো তৈরি করে গামলায় তুলে এক-এক করে ভাঁড়ারে গিয়ে জমা করে আসছে। আর পুকুরের পাড়ে ময়দা মাখা হচ্ছিল। সন্ধ্যে হবার পর লুচি ভাজতে আরম্ভ করবে। তার আগে ডাল, মাছের কালিয়া, মাংস রান্না করে ভাঁড়ারে তোলা হচ্ছে।

চৌধুরী মশাই বিচক্ষণ লোক। তিনি কোনও দিনই বেশি কথা বলেন না। সামান্য একটুখানি শুনেই বললেন–প্রকাশ, এখান থেকে সরে এসো, বড় লোকের ভিড়–চণ্ডীমণ্ডপে নিয়ে এসো খোকাকে, ওখেনে গিয়ে শুনবো সব–

কীর্তিপদবাবু একবার শুধু বলতে চেষ্টা করলেন ব্যাপারটা কী তাই খুলে বলো না তোমরা, আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না–

চৌধুরী মশাই শ্বশুরের দিকে চেয়ে বললেন–ও কিছু না, ও নিয়ে আপনি কিছু ভাববেন না —

বলে প্রকাশের সঙ্গে চণ্ডীমণ্ডপের দিকে সদানন্দকে নিয়ে চললেন। কিন্তু কীর্তিপদবাবু জামাই-এর কথায় খুশী হলেন না। তিনিও জামাই-এর পেছন পেছন চলতে লাগলেন। বললেন–ভাববো না মানে? সব কাজে তোমরা কেবল আমাকে ভাবতে বারণই করছে, তা আমিও তো একটা মানুষ, না কী? আমি বুড়ো হয়েছি বলে আমায় কিছু জানতে নেই?

কিন্তু কে আর তাঁর মত বুড়ো মানুষের কথায় কান দেয়। তিনি যে এত সম্পত্তি করেছেন, তিনি যে এত টাকার মালিক, তার জন্যেও কেউ তাঁর কোনও মূল্য দিচ্ছে না। তিনিও পেছনে-পেছনে চণ্ডীমণ্ডপে গিয়ে সকলের সামনে দাঁড়ালেন। বললেন–আমাকে তোমরা কেউ কিছু বলছো না কেন? আমি বুড়ো হয়েছি বলে কি তোমাদের কিছু সাহায্যও করতে পারবো না?

চৌধুরী মশাই শ্বশুরের এই অন্যায় কৌতূহল বরদাস্ত করতে পারছিলেন না। বললেন– আপনি বৃদ্ধ হয়েছেন, আপনাকে আমরা এ-সব ব্যাপারের মধ্যে কষ্ট দিতে চাই না। আপনি তামাক খান না নিজের ঘরে বসে–দীনু আপনাকে তামাক সেজে দিচ্ছে–

–তুমি থামো! সব কথায় কেবল আমার বয়েস দেখাও কেন?

কীর্তিপদবাবু রেগে গেলেন এবার। বলতে লাগলেন কী হয়েছে তাই বলো!

তারপর সকলকে অগ্রাহ্য করে একেবারে সোজা সদানন্দকে ধরলেন।

বললেন–কী হয়েছে বলো তো দাদা? তোমার কী হয়েছে? তুমি কাঁদছো কেন? আমি এসে পর্যন্ত দেখছি তুমি যেন কী রকম হয়ে গেছ! গায়ে-হলুদের দিনে তুমি কোথায় লুকিয়ে রইলে। তারপর সকাল বেলা পুলিস-দারোগা এসে কী সব তদন্ত করে গেল। তারপর এখন আবার এই কাণ্ড। বলো তো এসব কী ব্যাপার? আমার কাছে কিছু লুকিও না–

হঠাৎ কৈলাস গোমস্তা এসে হাজির হলো।

বললে–বেয়াই মশাই, আপনাকে কর্তাবাবু একবার ডেকেছেন—

কীর্তিপদবাবু বললেন–দাঁড়াও বাপু, এখন এই ব্যাপারটার একটা ফয়সালা হয়ে যাক্‌–

ওদিকে ভিড়ের লোকজন আস্তে আস্তে সবাই এসে হাজির হয়েছিল চণ্ডীমণ্ডপের সামনে। প্রকাশ মামার এতক্ষণে সেদিকে নজর পড়েছে। তাদের দিকে চেয়ে তেড়ে গেল–এই, তোরা এখানে কী করতে এসেছিস, যা বেরিয়ে যা এখেন থেকে। কাজকর্ম কিছু নেই তোদের? যা, এখান থেকে ভাগ–

ক্রমে ক্রমে খবরটা বাড়ির ভেতরেও পৌঁছে গেল। খোকা নাকি বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছিল, শালাবাবু তাকে ধরে রেখেছে। ছোটবাবু সকলকে ডেকে নিয়ে গেছে চণ্ডীমণ্ডপে।

প্রীতি ভাঁড়ার ঘরের কাজে ব্যস্ত ছিল।

কথাটা শুনেই বললে–কেন, চলে যাচ্ছিল কেন খোকা? কোথায় যাচ্ছিল?

গৌরী পিসী বললে–চুপ করো বউদি, অত চেঁচিও না। নতুন বউ-এর কানে যাবে শেষকালে, একটু গলা নামিয়ে কথা বলো–

কর্তাবাবু নিজের ঘরে বসে তখন ছটফট করছিলেন। কৈলাস গোমস্তা ফিরে আসতেই বললেন কী হলো? বেয়াই মশাই এলেন না?

–হ্যাঁ, আসছে।

–খোকাকে আটকে রাখতে বলেছো তো? যেন পরশু দিনের মত বেরোতে না পারে!

–হ্যাঁ বলেছি। ছোটবাবু ধরে রেখেছেন খোকাবাবুকে।

–যদি কোনোও ফাঁকে বেরিয়ে যায়? শেষকালে ফুলশয্যার দিন যেন কেলেঙ্কারি করে না বসে।

কৈলাস গোমস্তা বললে–না, সে ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেছে। খোকাবাবুকে আর একলা ছাড়া হবে না। বংশীকেও বলে দিয়েছেন ছোটবাবু, যেন তার ওপর নজর রাখে।

ততক্ষণে কীর্তিপদবাবু এসে গেলেন। এসেই বললেন–বড় চিন্তায় পড়লুম বেয়াই মশাই, খোকা তো আগে এরকম ছিল না। ছোটবেলায় কত মজার মজার কথা বলতো। আর এখন একেবারে অন্য রকম হয়ে গিয়েছে দেখছি

কর্তাবাবু বললেন–বড় বেয়াড়া হয়ে গেছে আজকাল। কারো কথা শোনে না–

কীর্তিপদবাবু বললেন–ভালোই করেছেন যে বিয়েটা দিয়ে দিয়েছে, বিয়েটা কম বয়সে দিয়ে দেওয়াই ভালো

কর্তাবাবু বললেন–আরো আগে বিয়ে দিয়ে দিলেই ভালো হতো। কিন্তু ভালো-মতো পাত্রী তো এতদিন পাওয়া যাচ্ছিল না–তাই–

কীর্তিপদবাবু প্রবীণ বিচক্ষণ মানুষ। বললেন–দেখুন বেয়াই মশাই, বয়েস হয়েছে বলে কেউ আমাদের কথাই শুনতে চায় না আর, যেন আমরা কখনও কম বয়েসের ছিলাম না। এই-ই হয় বেয়াই মশাই, এই-ই হয়–

কর্তাবাবু বললেন–ওসব আর ভাববেন না বেয়াই মশাই, আমাদের যুগ চলে গেছে, আমরা বাতিল–

কীর্তিপদবাবু বললেন–কিন্তু কী ব্যাপারটা বলুন তো, খোকা ওরকম বেয়াড়া হলো কেন? কে কালীগঞ্জের বউ? তার কী হয়েছে?

কর্তাবাবু বললেন–পাগলের কথার কি মনে আছে? সেই কথায় আছে না, পাগলে কী-ই না বলে আর ছাগলে কী-ই না খায়! আপনি তামাক খান, কৈলাস, বেয়াই মশাইকে তামাক দিতে বলো–

কিন্তু এ প্রসঙ্গ বেশিক্ষণ চললো না। কথার মধ্যেই বাধা পড়লো। হঠাৎ নিচে থেকে শাঁখ বাজার আওয়াজ হলো।

–ওই ফুলশয্যার তত্ত্ব এসেছে বোধ হয় কেষ্টনগর থেকে। কৈলাস যাও যাও, দেখে এসো–

সত্যিই তখন একতলায় হই-হই ব্যাপার। বিপিনই ফুলশয্যার তত্ত্ব নিয়ে এসেছে দলের মাথা হয়ে। অনেক দূর থেকে তত্ত্ব এসেছে। শাঁখ বাজার শব্দ শুনেই গ্রাম থেকে ছেলে বুড়ো ছুটে এসেছে। অন্তত বারোজন লোক হবে। সকলের হাতেই জিনিসপত্র। রেল বাজার থেকে চারখানা গরুরগাড়ি ভর্তি জিনিসপত্র তারা নিয়ে এসেছে। বড় বড় বারকোষ, হাঁড়ি, থালা, ফলের ঝুড়ি, ছানার মিষ্টি, ফুলের ঝোড়া, দই-এর হাঁড়ি, কোচানো শাড়ি। জামাই এর ধুতি-পাঞ্জাবি।

–ঠাকুর, কড়ায় লুচি ছেড়ে দাও, বারোজন লোকের মতন। একসঙ্গে খেতে বসবে–

ভেতর বাড়িতেও সাজ-সাজ রব পড়ে গেল। চওড়া জরির শান্তিপুরে শাড়ি পরে বাড়ির গিন্নী সমস্ত কিছু তদারক করছে। আশেপাশের বাড়ি থেকে পাড়ার বুড়ী গিন্নী বান্নি মানুষেরা এসে পরামর্শ দিচ্ছে। কেউ পান সাজতে বসেছে। কেউ তরকারি কুটছে।

বেহারী পালের বউ ক’দিন থেকেই আসছে। বিয়েবাড়ির কাজ-কর্ম করে দিয়ে অনেক রাত্রে আবার নিজের বাড়ি চলে যায়।

সেদিন বললে–হ্যাঁ বউমা, সদার নাকি কী হয়েছে?

প্রীতি বললে–কী আবার হবে মাসীমা? কই, সদার তো কিছু হয়নি–

–শুনলুম নাকি সদা বলছে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে। গাঁয়ে কত রকমের কথা উঠেছে, উনি নাকি বারোয়ারিতলা থেকে শুনে এসেছেন–

প্রীতি বললে–কী জানি মাসীমা, তুমি তো এ কদিন আসছো, নিজের কানে কিছু শুনেছ?

বেহারী পালের বউ সেই কথা বললে। বললে–আমি তো কর্তাকে তাই-ই বললুম, বললুম সদার যদি বউ পছন্দ না হয়ে থাকে তো আমার কানে সে-কথা একবার আসতোই–

প্রীতি বললে–পাড়ার লোকের কথা ছেড়ে দাও মাসীমা। পাড়ার লোকে তো অনেক কথাই বলে। তুমি নিজের চোখেই তো বউ দেখলে। অমন বউ কজনের বাড়িতে দেখেছ বলতে পারো? ছেলের অপছন্দ হবার মত কি বউ করেছি আমি? বলুক দিকিনি কেউ–

কিন্তু তখন অত কথা বলবার আর সময় নেই কারো। তবু বেহারী পালের বউ বললে–তোমার গুণের ছেলে বউ, পাস করা ছেলে, তুমি যদি এমন বউ ঘরে না আনবে তো কে আনবে বলো? কার এমন সাধ্যি আছে?

কথার মাঝখানেই গৌরী পিসী এসে বাধা দিলে। বললে–শুনেছ বউ, কেষ্টনগর থেকে তোমার বেয়াই-বেয়ান কেউই আসছে না–

–কেন?

–তাই তো শুনলুম। ফুলশয্যের লোকেরা এসে তাই তো বলছে। বলছে পণ্ডিত মশাই এখানে এসে তো কিছু খাবেন না। তাই আর আসেননি। আর অনেক দূরের রাস্তা। ওরা সবাই বউমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে–

–তা বউমার কাছে নিয়ে যা না ওদের।

নয়নতারা তেমনি করেই চুপ-চাপ বসে ছিল। তার আগেই সাজানো-গোছানো হয়েছে বউকে। নতুন একখানা বেনারসী পরেছে। গা-ভর্তি গয়না। বিপিন আসতেই নয়নতারা চোখ তুলে চাইলে।

জিজ্ঞেস করলে–বাবা আসবে না বিপিন?

বিপিন বললে–না দিদিমণি, তা তুমি ভালো আছে তো? কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?

সেকথার উত্তর না দিয়ে নয়নতারা বললে–আর মা? মা কেমন আছে?

–মা একটু কান্নাকাটি করছিল। কিন্তু এখন চুপ করেছে। বলছে মেয়ে যখন হয়েছে তখন তো পর হয়ে যাবেই।

নয়নতারা বললে–তুমি গিয়ে মাকে বোল আমি এখানে খুব ভালো আছি, আমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। তোমাদের খাওয়া-দাওয়া হয়েছে?

–হ্যাঁ দিদিমণি। খুব খেয়েছি পেট ভরে। বড় বড় মাছ, মাংস, মিষ্টি, দই খুব খেয়েছি। তোমার শাশুড়ী খুব ভালোমানুষ, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের খাইয়েছেন। এখানকার সবাই-ই খুব ভালো লোক। সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্যে আবার চার হাঁড়ি মিষ্টি দিয়েছেন এঁরা–

কিন্তু বেশিক্ষণ কথা বলবার সময় হলো না। বাইরে ততক্ষণে আবার শানাই বেজে উঠলো। একে একে আবার লোকজন আসতে লাগলো নয়নতারার ঘরে। নবাবগঞ্জ ঝেটিয়ে লোক আসবে আজ। এ তারই সূচনা। সব অচেনা মুখ। তারা এসে ঘর জোড়া করে বসলো। সকলের চোখই নয়নতারার দিকে। নয়নতারা বুঝতে পারলো সবাই তার মুখের দিকেই হাঁ করে দেখছে। আজকে বুঝি সমস্ত সন্ধ্যেটাই এই রকম চলবে। আজকে নয়নতারাই বুঝি এবাড়ির সব চেয়ে বড় আকর্ষণ!

কর্তাবাবু একসময় ছেলেকে ডেকে পাঠালেন। চৌধুরী মশাই আসতেই কর্তাবাবু জিজ্ঞেস করলেন–কী খবর, ও-দিকের খবর কী?

চৌধুরী মশাই বললেন–সব তো ঠিকই চলছে। ফুলশয্যার লোকদের সকলকে খাইয়ে দাইয়ে পাঠিয়ে দিলুম। তাদের তো আবার ট্রেন ধরতে হবে–

কর্তাবাবু বললেন না, আমি ও কথা বলছি না, বলছি খোকা কোথায়?

চৌধুরী মশাই বললেন–খোকা আর তো কোনও গণ্ডগোল করছে না–

–ওই তোমাদের বুদ্ধি! গণ্ডগোল না করলেও, কখন কী করে ফেলে তা কি বলা যায়? আমি যে বলেছিলাম একটু চোখে চোখে রাখতে, রেখেছ?

চৌধুরী মশাই বললেন–হ্যাঁ, তার জন্যে তো প্রকাশকে বলে রেখেছি–

–প্রকাশ কে?

–আমার শালা। সে পাকা লোক। তার চোখ এড়াতে পারবে না খোকা—

কর্তাবাবু বললেন–তবেই হয়েছে। তোমাকে বলেছি না তুমি নিজে একটু নজর রাখবে। একলা ছাড়বে না ওকে মোটে, আর বংশীদেরও বলে রেখেছ?

–হ্যাঁ, বলেছি।

–বংশীরা যেন সবাই মিলে ওর আশেপাশে থাকে। যেন চোখের আড়াল না করে, বলে দিও–

চৌধুরী মশাই বললেন–হ্যাঁ, বলে রেখেছি

–ঠিক আছে, যাও, তুমি ও-দিকটায় দেখ গিয়ে, আমার এদিকে তোমাকে বেশি আসতে হবে না–

চৌধুরী মশাই আর দাঁড়ালেন না। চলে গেলেন। নিচের অনেক লোকজনের শব্দ কানে এল। সকলে খেতে বসেছে। সমস্ত বাড়িটাতেই অতিথি-অভ্যাগতের ভিড়। বাইরে থেকে শানাই বাজতে শুরু করেছে। কর্তাবাবু যেন খানিকটা নিশ্চিন্ত হলেন মনে মনে। ফুলশয্যাটা কাটলেই পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারবেন। তারপর একটা রাত কাটলেই আর ভয় নেই। তখন খোকা আস্তে আস্তে সংসারী হয়ে উঠবে। তখন পাগলামি চলে যাবে তার। ওই বেয়াই মশাই যা বলেছেন তাই হবে। কাঁধে জোয়াল পড়লেই মানুষের দায়িত্ববোধ আসে।

ক্রমে আরো লোকের ভিড় বাড়লো। আওয়াজের মাত্রা আরো বেড় গেল। নবাবগঞ্জের আকাশে অঘ্রাণ মাসের রাত আরো ঘন হলো। তার মনে পড়তে লাগলো সেই নবদ্বীপের ঘাটে বুক-জলে নেমে হর্ষনাথ চক্রবর্তীর শেষ কথাগুলো। আশ্চর্য! প্রথমে হাঁটু-জল, তারপরে কোমর-জল। তারপরে বুক-জল, তারপরে গলা-জল। তখন সূর্য উঠেছে নতুন। গঙ্গার ঘাটে আরো কিছু স্নানার্থী এসেছে। তারাও ব্যাপারটা লক্ষ্য করছিল।

–নারাণ!

কর্তাবাবু বললেন–বলুন হুজুর–

হর্ষনাথ চক্রবর্তী বললেন–আমি চললুম নারাণ। ওদের ভার তোমার ওপর রেখে দিয়েই চললুম। তুমি ওদের দেখো—বুঝলে–

কর্তাবাবু বলেছিলেন–আপনি কিছু ভাববেন না হুজুর, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন–

হর্ষনাথ চক্রবর্তী বললেন–তুমি যদি না–ও দেখো, তবু আমার কিছু বলবার নেই নারাণ, আমার কিছু করণীয়ও নেই, আমার সব আসক্তি আজ দূর হয়ে গেছে। ভেবেছিলাম তামাকের আসক্তিটাই আমি কাটিয়ে উঠতে পারব না। তা এখন সে আসক্তিটাও দূর করেছি। এখন চলি-বলে তিনি সংস্কৃত শ্লোক আবৃত্তি করতে লাগলেন।

জবাকুসুমসংকাশং
কাশ্যপেয়ম্ মহাদ্যুতিং…

সূর্যস্তব পাঠ করতে লাগলেন হর্ষনাথ চক্রবর্তী মশাই অনেকক্ষণ ধরে। কর্তাবাবু ওসব সংস্কৃত বোঝেন না। তিনি তখনও জলের ভেতর দাঁড়িয়ে হুজুরকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর একসময় হঠাৎ তিনি নির্বাক হয়ে গেলেন। চোখ দুটো ঊর্ধনেত্র হলো। আর তারপরেই সব শেষ!

কোথায় গেলেন তিনি। আর কোথায় রইলেন নরনারায়ণ চৌধুরী। তিনি আসক্তি ত্যাগ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু কর্তাবাবু কোন্ দুঃখে আসক্তি ত্যাগ করবেন। তাঁর যে এখনও অনেক কামনা-বাসনা বাকি! এখনও অনেক আকাঙ্খা তার। এই আজ খোকার বউ-ভাত। এখনই খোকা সংসারী হলো। তারপর একদিন তার সন্তান হবে। তারপরে সেই সন্তানেরও আবার একদিন সন্তান হবে। এমনি করে তিনিই এই বংশধারার পরিক্রার মধ্যে অনন্তকাল ধরে বেঁচে থাকবেন। তাঁর বংশের শাখা-প্রশাখার মধ্যেই তিনি অজর-অমর হয়ে নিঃশ্বাস প্রশ্বাস ত্যাগ করবেন। তবেই হয়ত তখন তাঁর চিরকালের সাধ-আহ্লাদ-আশা মিটবে। তার আগে কিছুতেই নয়।

অনেক রাত্রে বাইরের কল-কোলাহল স্তিমিত হয়ে এল। নয়নতারাকে ফুলশয্যায় বসিয়ে দিলে বেহারী পালের বউ।

বললে–বেশি রাত কোর না মা আজ, ঘুমিয়ে পড়, নইলে তোমারও শরীর খারাপ হবে, সদার শরীরও খারাপ হবে, কাল থেকেই তো তোমাদের শরীরের ওপর দিয়ে ধকল যাচ্ছে–

ফুলের গন্ধ এসে নাকে লাগছিল নয়নতারার। চারিদিকেই ফুল। ফুলের পাহাড় চারদিকে। অনেক ফুল যোগাড় করা হয়েছিল। পদ্মফুল এসেছিল চৌধুরীদের বিল থেকে। নয়নতারার কেমন যেন ভয় করতে লাগলো। মা বাবা কেউই এল না। এ বাড়িতে সবাই পর। কেউই তার আপন নয়। তবু শ্বশুর-শাশুড়ী সবাই-ই কাল থেকে খুব ভালো ব্যবহার করে আসছে–

শাশুড়ী বার বার বলেছে–লজ্জা করো না বউমা। পেট ভরে খাও। মনে করো না যেন এখানে তোমার কেউ নেই। তোমার শ্বশুরও আমাকে তোমার কথা বার বার জিজ্ঞেস করেছেন। আর একটা সন্দেশ দেব?

তারপর যখন আরো রাত হলো হঠাৎ ঘরের দরজাটা আবার খুলে গেল। নয়নতারা আন্দাজে বুঝতে পারলে কে ঘরে ঢুকেছে। কিন্তু সাহস করে চোখ তুলে চাইতে পারলে না। বুকটা থর-থর করে কাঁপতে লাগলো। মনে হলো যেন সে অজ্ঞান হয়ে যাবে।

সদানন্দ সবে ঘরে ঢুকেছে।

পেছন থেকে প্রকাশ মামা বললে–দরজায় খিল দিয়ে দে রে, খিল দিয়ে দে—

কিন্তু তবু যেন তার হাত উঠতে চাইল না। প্রকাশ মামা আবার পেছন থেকে তাগিদ দিলে–কই রে সদা, খিল দিলি নে?

খাওয়া-দাওয়ার পর থেকেই প্রকাশ মামা কানে কানে বলছিল–আমি যা বলেছি, সব তোর মনে আছে তো? ভুলিস নি তো?

সদানন্দ বললে–কী?

–মনে নেই? তোকে এত করে পাখি-পড়ানো করে শিখিয়ে দিলুম আর এখন কিনা তুই বলছিস কী? তোকে নিয়ে আমি কি করবো বল দিকিনি।

সদানন্দ এ-কথার কিছু জবার দিলে না।

প্রকাশ মামা বললে–আরে ফুলশয্যের রাত একবারই তো আসে মানুষের জীবনে, তুই দেখছি শেষকালে সব গুবলেট করে ফেলবি। আমার মান-ইজ্জৎ সব ডোবাবি। ভাগ্নেবউ শেষকালে আমার নামেই খোঁটা দেবে। বলবে এমন বরের সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়েছে যে একটা আস্ত আনাড়ির ডিম–

কিন্তু সদানন্দ সেই ঘরের মধ্যে ঢুকতেই যেন তার মাথার ওপর বিকট শব্দে একটা বাজ ভেঙে পড়লো। সামনের দিকে চাইতেই মনে হলো কে যেন ছাদের কড়িকাট থেকে ঝুলছে। মুখটা যেন চেনা-চেনা। যেন ঠিক কপিল পায়রাপোড়া…… পরনের কাপড়টা গলায় ফাঁস দেওয়া….. ঝুলছে…..

পেছন থেকে প্রকাশ মামা আবার তাগিদ দিলে কই রে, সদা, দিলি নে? খিল দে–

কর্তাবাবুর কাছে রিপোর্ট দিতে গেলেন চৌধুরী মশাই। বললেন–সব নিশ্চিন্তে চুকে গেছে বাবা–

কর্তাবাবু এই খবরটার আশাতেই রাত জেগে বসেছিলেন। বললেন–আর খোকা?

পেছনে প্রকাশ মামাও ছিল। সে এগিয়ে গিয়ে বাহাদুরি নেবার চেষ্টা করলে।

বললে–আমি এই এখুনি তাকে ঘরের মধ্যে ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়ে তবে সেখান থেকে আসছি–আর যেতে কি চায়, ঠেলে ঘরে ঢুকিয়ে দিলাম–

–ঘরে খিল দিয়েছে তো?

প্রকাশ মামা বললে–খিল দিতে কি চায়? প্রথমে দিচ্ছিল না, তারপর আমি পিছন থেকে তাগিদ দিয়ে দিয়ে খিল্ বন্ধ করিয়ে তবে ছেড়েছি…

কর্তাবাবু নিশ্চিন্ত হলেন। একটা আত্মতৃপ্তির দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তাঁর বুক থেকে। অবশ পা দুটো অভ্যাসমত ছড়াবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ব্যর্থ চেষ্টা করেও পারলেন না।

তারপর বললেন–আচ্ছা, ঠিক আছে, যাও, এবার তোমরা বিশ্রাম করো গে—

.

শুধু যে তাতে কর্তাবাবুই নিশ্চিন্ত হলেন তা-ই নয়, হয়ত নবাবগঞ্জের চৌধুরীবাড়ির সবাই-ই নিশ্চিন্ত হলেন। চৌধুরী মশাইও নিশ্চিন্ত হলেন। যাক, আর কোনও দুর্ভাবনা নেই। ঈশ্বরের ইচ্ছেই পূর্ণ হলো। সদানন্দ এতক্ষণে নতুন বউ-এর আকর্ষণে গা ঢেলে দিয়ে অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ সব ভুলে গিয়েছে। আর কোনও দুর্ভাবনা কারো নেই, আর কোনও আশঙ্কাও নেই কারো। যা ভয় ছিল সকলের তা হলো না। সব সমস্যা নির্বিঘ্নে সমাধা হয়ে গেল। তিন দিন আগেও যে সমস্যা সকলের অশান্তির কারণ হয়ে উঠেছিল তার সমাধি হলো। কোথা থেকে এক পুরোন ইতিহাসের কুটিল স্মৃতি সাপ হয়ে ফণা তুলেছিল। মনে হয়েছিল সেই ফণা বুঝি এ সংসারের সুখ-শান্তি-ঐশ্বর্যের মাথায় ছোবল মেরে সব কিছু ধ্বংস করে দেবে। কিন্তু আর তা হবার সম্ভাবনা নেই। এবার নয়নতারা এসেছে। ফুলশয্যার ওপর নয়নতারার চোখ-ভোলানো রূপ আর মন-ভোলানো ভালবাসা সব কিছু সন্দেহের কাঁটা নির্মূল করে দিয়েছে। আর ভয় নেই। এবার ঘুমোও। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ো সবাই। তোমাদের অনেক ঝঞ্ঝাট গেছে এ কদিন ধরে। গায়ে-হলুদের আগের দিন রাত্রে যেদিন থেকে সদানন্দ নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল সেই দিন থেকেই তোমাদের অনেক ঝঞ্ঝাট গেছে। তারপর অনেক ঝড়-ঝাপটা অতিক্রম করে শেষরক্ষা করেছে বংশী ঢালী। যেটুকু বংশী ঢালী পারেনি, সেটুকু শেষ করবে নতুন বউ নয়নতারা। নয়নতারাই আজ ফুলশয্যার রাত্রে সদানন্দকে জীবনের আসল মানে বুঝিয়ে দেবে। নয়নতারাই বুঝিয়ে দেবে মহাপুরুষরা যা কিছু বলে গিয়েছেন তা বইতে ছাপাবার জন্যে, স্কুলে কলেজে পড়াবার জন্যে, পড়ে পরীক্ষায় পাস করবার জন্যে, কিন্তু জীবন আলাদা জিনিস। সে জীবনে একমাত্র সত্য হলো ভোগ। ভোগ তার সংসারের বিলাসের মধ্যে দিয়ে, তার অর্থ উপার্জনের মধ্যে দিয়ে। আর সেই ভোগের পথে যত বাধা আসে তা যে-কোনও উপায়ে অপসারণের মধ্যে দিয়ে। এরই নাম হলো জীবন!

কর্তাবাবুও ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তার ঘোরটা যেন চট করে একটু ভেঙে গেল। মনে হলো কে যেন কাঁদছে। যেন কাছাকাছি থেকে কারো কান্নার আওয়াজ আসছে!

এই আনন্দের দিনে এত রাত্রে কে আবার কাঁদে! অভ্যাসগত ডাকলেন—দীনু–

অন্য সময় হলে দীনু সঙ্গে সঙ্গে এসে হাজির হতো। হুকুম তামিল করবার জন্যে দীনুর মত অত বাধ্য মানুষ তিনি আর দেখেন নি। কালীগঞ্জের কর্তাবাবুর কাছে যখন তিনি কাজ করতেন তিনি নিজেও অত বাধ্য হয়ে হুকুম তামিল করেন নি কখনও।

কর্তাবাবুর ডাকে কেউ-ই সাড়া দিলে না। তা না সাড়া দিক। আহা সারা দিন খাটুনির পর বোধ হয় দীনু ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমোক। ঘুমোক সে। কিন্তু জানতে ইচ্ছে করছিল কে কাঁদছে! অথচ কাঁদার তো কথা নয় কারো। আজকে তো আনন্দের দিন। আজকে তাঁর নাতির বিয়ে। বিয়ে ঠিক নয়, ফুলশয্যে। আজকে তো তাঁর প্রজারা এসে তাঁর নাতবউকে আশীর্বাদ করে গেছে। আজকে সবাই তাঁর বাড়িতে এসে পাত পেতে পেট ভরে খেয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ খাবার পর ছাঁদা বেঁধেও নিয়ে গেছে। গ্রামে তো আজ আর কেউই উপবাসী নেই। সবাই পরিতৃপ্ত, সবাই পরিশ্রান্ত। এখন তারা যে-যার বাড়িতে গিয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। এখন কেন তারা কাঁদতে যাবে! কীসের দুঃখ তাদের!

কর্তাবাবু আবার চোখ দুটো জোর করে বুজিয়ে প্রাণপণে ঘুমোবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কর্তাবাবু তখনও জানতেন না যে তিনি ঘুমোতে চেষ্টা করলেও ইতিহাসের কখনও ঘুমোতে নেই। ইতিহাস ঘুমোয় না বলেই আজ কালীগঞ্জের বউকে বেঘোরে প্রাণ দিতে হয়। ইতিহাস ঘুমোয় না বলেই এত রাত্রে তার কানে চাপা আর্তনাদ ভেসে আসে। ইতিহাস ঘুমোয় না বলেই তাঁর নাতি বিয়ের দিন বাড়ি থেকে পালিয়ে কালীগঞ্জে গিয়ে আশ্রয় নেয়। আবার ইতিহাস ঘুমোয় না বলেই তাঁর নাতি বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেই টাকা চায়!

কিন্তু সে-সব কথা এখন থাক। এখন সবাই সুখী, এখন সকলের শান্তি। এখন সবাই ঘুমোও। আমি অসুস্থ লোক, আমার বয়েস হয়েছে, আমি জেগে থাকলেও তোমরা ঘুমোও।

 ২.৪ বংশধারা রক্ষা

–মা!

সমস্ত বাড়িময় যে যেখানে পেরেছে শুয়ে পড়েছে। অনেকের একটা চাটাই কিংবা বালিশও জোটেনি। কোঁচার খুঁটটা গায়ে দিয়ে একটা ছাদের তলা খুঁজে নিয়ে গড়িয়ে পড়েছে। কাজ শেষ হতে রাত প্রায় একটা বেজে গিয়েছিল। মাছের কাঁটা আর মাংসের এঁটো হাড়ের লোভে কিছু বেওয়ারিশ কুকুর পুকুরপাড়ে এসে অনেকক্ষণ কাড়াকাড়ি করে তখন পেট শান্ত করে ঘুমিয়ে পড়েছিল। বলতে গেলে কেউ আর তখন জেগে ছিল না। চৌধুরী মশাইও ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। বড় খাটুনি গিয়েছিল তাঁর। যখন সদানন্দ ফুলশয্যার ঘরে শুতে গেল তখনই শুধু একটা নিশ্চিন্তের দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়েছিলেন তিনি। যাক, বাঁচা গেল। চৌধুরী-পরিবারের বংশধারা রক্ষা পেল। আর কোনও দিন কোনও কালীগঞ্জের বউ এসে তাঁর কোনও ক্ষতিসাধন করতে পারবে না। এই বংশ শাখাপ্রশাখা মেলে যাবচ্চন্দ্রদিবাকরৌ বিস্তারলাভ করবে। ওই সদারও আবার একদিন সন্তান হবে। সেই সন্তানের আবার একদিন গায়ে-হলুদ হবে, একদিন বিয়ে হবে, একদিন ফুলশয্যাও হবে।

আর তারপর? তারপরের কথা ভাবতে গিয়েই চৌধুরী মশাই-এর দু’চোখ কখন ঘুমে জড়িয়ে এসেছিল।

–মা!

চৌধুরী মশাই চমকে উঠলেন। কে যেন কাকে ডাকছে! মেয়েলি গলা! তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন তিনি। পাশেই বিছানার ওপর গৃহিণী ঘুমোচ্ছিল। বড় অঘোর ঘুম তার। আহা, ঘুমোক। অনেক দিন ধরে অনেক পরিশ্রম করে আজ সবে একটু বিশ্রাম করবার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু কে-ই বা ডাকছে তাকে! এত রাত্রে তাকে কেনই বা ডাকছে!

তিনি গৃহিণীর গায়ে ঠেলা দিলেন। বললেন–ওগো, ওগো, শুনছো–

ধড়মড় করে উঠে পড়লো প্রীতি। বললে–কী হলো?

চৌধুরী মশাই বললেন–দেখ দিকিনি, কে যেন ডাকছে তোমাকে–

–আমাকে? ডাকছে? কে ডাকছে।

–কী জানি! একজন মেয়েমানুষের গলা মনে হলো—

মেয়েমানুষের গলা! এত রাত্তিরে কে মেয়েমানুষ তাকে ডাকবে! এই তো সবাইকে খাইয়ে-দাইয়ে ভাঁড়ারের চাবি আঁচলে বেঁধে তিনি ঘরে এসে শুয়ে পড়েছেন।

জিজ্ঞেস করলেন–রাত কটা হলো গো?

চৌধুরী মশাই ঘড়িটার দিকে চেয়ে বললেন–রাত তিনটে—

রাত তিনটে মানে ভোর হয়ে এল। এত রাত পর্যন্ত ঘুম হয়েছে। তবে তো অনেকক্ষণ ঘুম হয়েছে। কিছুই টের পায়নি সে।

আবার বাইরে থেকে ডাক এল—মা–

প্রীতি তাড়াতাড়ি কাপড়টা গুছিয়ে নিতে নিতে ঘরের খিল খুলে বাইরে এলো। চারদিকে অন্ধকার। সামনের বারান্দায় যে-যেখানে যেমন ভাবে পেরেছে গড়া-গড়া শুয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে যেন মনে হলো কে একজন অন্ধকারে তার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

প্রীতি তাড়াতাড়ি সামনের দিকে এগিয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলে কে? কে ওখানে দাঁড়িয়ে?

মূর্তিটা বললে—আমি–

–আমি? আমি কে?

প্রীতি একেবারে মূর্তিটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো, মূর্তিটার মুখের কাছে মুখ নিয়ে যেতেই চমকে উঠেছে। বউমা? তুমি? তুমি হঠাৎ এত রাত্তিরে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছ কেন? কী হয়েছে তোমার?

নয়নতারা তখন থরথর করে কাঁপছিল। বললে–আমার ভয় পাচ্ছে–

–কেন? ভয় পাচ্ছে কেন? খোকা কোথায়?

নয়নতারা এ-কথার কোনও জবাব দিলে না।

শাশুড়ী বললে–কী হলো, জবাব দিচ্ছ না কেন? খোকা কোথায় গেল? খোকা ঘরে নেই?

এবারও নয়নতারা কোন কথার উত্তর দিলে না।

কেমন যেন একটা সন্দেহ হলো শাশুড়ীর মনে। বললে–চলো, চলো, তোমার ঘরে চলো, কিছু ভয় নেই। চলো–

নয়নতারাকে হাতে ধরে নিয়ে প্রীতি তার শোবার ঘরের দিকে গেল। নয়নতারার শোবার ঘরের দরজা তখন হাট করে খোলা পড়ে ছিল। ভেতরে একরাশ ফুলের গন্ধ। দেয়ালের গায়ে টিমটিম করে তখনও দেয়ালগিরিটা জ্বলছে। বিছানা যেমন ছিল তেমনিই রয়েছে। চাদরে বালিশে এতটুকু ভাঁজও পড়েনি কোথাও। বিছানায় যে কেউ শুয়েছিল তার সামান্যতম চিহ্নও কোথাও নেই। বিছানাটা যেন ব্যবহারও করা হয়নি এক মূহূর্তের জন্যে।

চারিদিকে চেয়ে প্রীতি খানিকক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে রইল। যেন সমস্ত অবস্থাটা বোঝবার চেষ্টা করলে। তারপর নয়নতারার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললে–খোকা কোথায় গেল?

নয়নতারা কথা বলতে গিয়েও কথা বলতে পারলে না। শাশুড়ীর চোখের দৃষ্টি এড়াবার জন্যে মুখটা নিচু করে নিলে।

–বলো, খোকা কোথায় গেল? বলো?

নয়নতারা চুপ। তার চোখ দিয়ে তখন টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে।

–খোকা ঘরে শোয়নি?

এবার প্রীতি আর পারলে না। নয়নতারার চিবুকটা ধরে উঁচু করে নিজের মুখোমুখি ধরলে। নয়নতারা শাশুড়ীর সে দৃষ্টি সহ্য করত না পেরে চোখ দুটো বুঁজিয়ে ফেলল। বোঁজা চোখ দুটো দিয়ে তখন জলের ধারা আর বাধা মানছে না। দরদর করে গালে বেয়ে শাশুড়ীর হাতের পাতার ওপর পড়তে লাগলো।

–বলো বউমা, আমি তোমার শাশুড়ী হই, আমার কাছে লজ্জা করো না, খোকা তোমার বিছানায় শোয়নি?

নয়নতারার মুখে তখন যেন জবাব দেবার মত কোনও ক্ষমতাই আর নেই।

–বলো, জবাব দাও, খোকা শোয়নি?

এতক্ষণে নয়নতারার ঠোঁট দিয়ে একটা ছোট কথা বেরোল—না–

–শোয়নি? তা হলে কোথায় গেল সে?

নয়নতারা বললে–তা জানি না।

–কিন্তু তাকে তো আমরা তোমার ঘরে ঢুকিয়ে দিলুম। সে দরজায় খিল দিলে, তাও জানি। তারপর কী হলো? তারপর কখন সে বেরিয়ে গেল?

নয়নতারা এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

প্রীতি বললে–বলল বউমা, আমার কথার জবাব দাও, তারপর কখন সে বেরিয়ে গেল? তোমার সঙ্গে কী কথা হলো? তুমি কি কিছু বলেছিলে তাকে? কী বলেছিলে?

নয়নতারা কাঁদতে কাঁদতেই বললে–কিছু বলিনি–

–কিছু বলোনি?

–না।

–সে তোমাকে কিছু বলেছিল?

–না।

প্রীতি একটু ভেবে নিলে। তারপর বললে–তোমাদের দু’জনের মধ্যে কোন কিছুই কথা হয়নি?

নয়নতারা বললে–না–

–তোমার গায়ে হাত দিয়েছিল সে?

নয়নতারা হঠাৎ এ-কথার জবাব দিতে পারলে না।

প্রীতি বললে–বলো বউমা, আমি তোমাকে বলছি, আমি তোমার শাশুড়ী হই, আমি তোমার মায়ের মত। এখানে তোমার মা থাকলে যেমন তাকে সব কথা বলতে, তেমনি আমাকেও তুমি বলো। মনে করে নাও এবাড়িতে আমিই তোমার মা আমাকে কোন কিছু বলতে তুমি লজ্জা করো না। বলল, তোমার গায়ে হাত দিয়েছিল সে?

নয়নতারা এবার শাশুড়ীর বুকের মধ্যে ভেঙে পড়লো। শাশুড়ী বউকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। বললে–কেঁদো না বউমা, চুপ করো, কেঁদো না। আমাকে সব খুলে বলো তুমি। তোমার কিছু ভয় নেই। আমি তো রয়েছি, তোমার কী ভয়? মার কাছে কি কেউ কিছু বলতে লজ্জা করে? বলো তো লক্ষ্মী মেয়ে, সদা বুঝি তোমার গায়ে হাত দিয়েছিল, আর তুমি বুঝি আপত্তি করেছিলে?

নয়নতারা শাশুড়ীর বুকের মধ্যেই মাথা নেড়ে বললে–না–

–তবে? তবে কেন খোকা চলে গেল?

এর উত্তর কী দেবে নয়নতারা? নয়নতারা কি নিজেই এর উত্তর জানতো! সে কি কল্পনা করতে পেরেছিল এমন করে তার ফুলশয্যা রাত্রের সমস্ত স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে? কত দিন কত মেয়ের কাছে তাদের ফুলশয্যা রাত্রের মুখরোচক গল্প শুনেছে সে। তারাও তার সঙ্গে এক স্কুলে এক ক্লাসে পড়েছে। তাদের বিয়ে হবার পরে তারাই গল্প করেছে সে-সব ঘটনার। বিয়ের আগে নয়নতারাও নিজের ফুলশয্যার রাত্রের অনেক স্বপ্ন তিলে তিলে মনের ভেতরে পুষে রেখেছিল। ভেবেছিল তার ফুলশয্যার রাত্রের ঘটনা তাদের বলবে। অন্তত বলবার মত একটা কিছু ঘটনা ঘটবে। কিন্তু এ কী হলো? কারো বাড়িতে কি বউভাতের রাত্রে পুলিস আসে! এমন ঘটনা তো তার কোনও বন্ধুর বিয়েতে ঘটেনি। পুলিসই বা কেন হঠাৎ আসতে গেল, আর খুনই বা হলো কে? সব কিছু মিশিয়ে যেন এক রহস্যজনক বিপর্যয় ঘটে গেল তার জীবনে। কান্না কি মানুষের চোখে সহজে আসে! আজ যদি মা এখানে থাকতো তো নয়নতারা তাকে জিজ্ঞেস করতো–মা, তুমি এমন জায়গায় আমার বিয়ে দিলে কেন? একটু খোঁজখবরও নিতে পারলে না ভালো করে?

প্রীতি কী করবে তখন বুঝতে পারছিল না। বললে–কেঁদো না বউমা, আমার সঙ্গে কথা বলো, আমি যে কথা বলছি তার জবাব দাও–

বলে নয়নতারাকে বুক থেকে সরিয়ে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করালো। নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে বউমার চোখ মুখ মুছিয়ে দিয়ে বললে–এবার বলো তো বউমা, সত্যিই কী হয়েছিল? সব সত্যি করে বলবে, কিছু লুকোবে না–বলো–

নয়নতারা বললে–কিছু হয়নি মা—

শাশুড়ী বললে–কিছু হয়নি তো শুধু শুধু খোকা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল? ফুলশয্যার রাত্তিরে বর কখনও মিছিমিছি বউকে ছেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়? এমন কথা কখনও কেউ শুনেছে? নিশ্চয় কিছু হয়েছে? তুমি আমার কাছে লুকোচ্ছ। বলল সত্যিই কী হয়েছিল?

নয়নতারা বললে–সত্যি বলছি মা, কিছু হয়নি–

–কিছু না হলে খোকা এমনিই বেরিয়ে গেল? আমার ছেলে তো পাগল নয়। পাগল হলে না-হয় বুঝতাম, তবু তার একটা মানে ছিল। শুধু শুধু সে বেরিয়ে গেল কেন? তুমি নিশ্চয়ই তাকে কিছু বলেছিলে!

–বিশ্বাস করুন মা, আমি কিছু বলিনি!

–তুমি বললেই আমি বিশ্বাস করবো? যখন তুমি দেখলে যে সে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে তখন তুমি তাকে জিজ্ঞেস করলে না কেন যে সে বেরিয়ে যাচ্ছে কেন, কোথায় যাচ্ছে?

নয়নতারা অপরাধীর মত বললে–আমি জিজ্ঞেস করিনি—

কেন জিজ্ঞেস করোনি?

–আমার ভয় করেছিল!

–ভয়? কীসের ভয়?

কীসের যে ভয় তা নয়নতারা নিজেই জানে না তো শাশুড়ীকে বোঝাবে কেমন করে? বললে–আমি জানি না কীসের ভয়!

প্রীতি এবার যেন একটু অসন্তুষ্ট হলো। বলে উঠলো–তা তুমি যখন দেখলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে তখন তাকে ধরে রাখলে না কেন? তাহলে কীসের জন্যে ভগবান এত রূপ দিয়েছিল তোমাকে? তাহলে অন্য এত মেয়ে থাকতে কেন তোমাকেই বা এ বাড়ির বউ করে নিয়ে এলুম? আর এইটুকুই যদি তুমি না করতে পারবে তো এত রূপ নিয়ে কি আমি ধুয়ে খাবো? আমি রূপসী বউ চেয়েছিলুম কি আমার নিজের জন্যে?

কিন্তু কথাগুলো বলেই প্রীতি বুঝলো ঠিক এই সময়ে এ কথাগুলো বলা যেন তার উচিত হচ্ছে না।

নয়নতারা তখনও শাশুড়ীর বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে কাঁদছিল। প্রীতি বললে–আর কেঁদো না বউমা, আমি বুঝতে পেরেছি তোমার কিছু দোষ নেই। আর সত্যিই তো, তুমিই বা কী করবে! তুমি তো নতুন এ বাড়িতে! এক কাজ করি, এখনও কিছুক্ষণ রাত আছে, আমি এসে তোমার কাছে শুচ্ছি। সারারাত জাগলে তোমার শরীর খারাপ হবে–তুমি একটু থাকো এখানে, আমি আসছি–

বলে নয়নতারাকে বিছানার ওপর বসিয়ে আবার নিজের ঘরে চলে এলো।

চৌধুরী মশাই তখন নিজের ঘরের ভেতর ছটফট করে পায়চারি করছিলেন। ঠিক বুঝতে পারছিলেন না, কোথায় কী গোলমাল বেধেছে। এখন যদি সমস্ত বাড়িময় জিনিসটা জানাজানি হয়ে যায়, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে একেবারে। সমস্ত নবাবগঞ্জময় লোক জেনে যাবে যে, তাঁর ছেলে ফুলশয্যার রাত্রে বাড়ি থেকে পালিয়েছে! কথাটা হয়ত শেষ পর্যন্ত কেষ্টনগরে বেয়াইবাড়িতেও গিয়ে পৌঁছোবে! তখন?

হঠাৎ গৃহিণী এসে ঘরে ঢুকল।

চৌধুরী মশাই সঙ্গে সঙ্গে গৃহিণীর দিকে এগিয়ে গেলেন কী হলো? বউমা কী বললে?

–যা ভেবেছিলাম তাই-ই হয়েছে, খোকা ঘরে নেই।

–ঘরে নেই?

গৃহিনী বললে–হ্যাঁ, বউমার একলা থাকতে ভয় করছিল, তাই আমাকে ডাকতে এসেছিল। আমি যাই বউমার কাছে। তোমাকে তাই বলতে এলুম–

–কিন্তু খোকা গেল কোথায়?

গৃহিণী বললে–তা কী করে ও জানবে? বউমার সঙ্গে খোকার কোনও কথাও হয়নি, ঘরে ঢুকেছে আর সঙ্গে সঙ্গে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে–

–খোকা বেরিয়ে গেল আর বউমা আটকাতে পারলে না?

গৃহিণী বললে–কী যে তুমি বলো! নতুন বউ, এখনও খোকার সঙ্গে একটা কথাও হয়নি, আর খোকাকে আটকাবে? নতুন বউ-এর অত সাহস থাকে? অচেনা জায়গা, অচেনা মানুষ, একেবারে বলতে গেলে প্রথম রাত, এর আগে কোনও দিন একটা কথাও হয়নি, তাকে কী বলে বাধা দেবে? তোমার এত বয়েস হলো আর তুমি এই কথা বলছো? আমার ফুলশয্যার রাতে যদি তুমি অমনি করতে তো আমি তোমাকে বাধা দিতে পারতুম? তা কি কোনও মেয়ে পারে? কী যে তোমার বুদ্ধি

চৌধুরী মশাই বললেন–তাহলে কী হবে?

গৃহিণী বললে–এখন কী হবে তাই-ই ভাবছি। বউমা একেবারে ভেঙে পড়েছে। বেচারী এই রাত তিনটে পর্যন্ত একলা কী করবে ভেবে পায়নি, শুধু ভয়ে কেঁপেছে, শেষকালে আর কোনও উপায় না পেয়ে লজ্জা সরম সব ঠেলে ফেলে আমাকে ডাকতে এসেছে

–তা তুমি কী বলে এলে বউমাকে?

–কী আর বলবো! আর আমারই কি ছাই মাথার ঠিক আছে এখন! প্রথমে খুব বকলুম, কিন্তু শেষে বুঝলুম বউমারই বা কী দোষ! খুব কাঁদছিল, আমি তার মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বসিয়ে রেখে দিয়ে এলুম। এখন যাই, যে রাতটুকু আছে, পাশে গিয়ে শুই, চেষ্টা করে দেখি যদি একটু ঘুম পাড়াতে পারি, তারপর সকাল হলে যা-হয় ঠিক করা যাবে–

চৌধুরী মশাই বললেন–ঠিক আর কী করবে তুমি! খোকা কি আর ফিরে আসবে?

–সে-সব এখন আর ভাবতে পারছি না আমি। আমারও মাথায় সব গোলমাল হয়ে গেছে। আমিও আর দাঁড়াতে পারছি না–

বলে গৃহিণী চলে যাচ্ছিল।

চৌধুরী মশাই পেছন থেকে ডাকলেন। বললেন–আর একটা কথা শোন—

গৃহিনী ফিরলো। বললে–কী?

–দেখ, বউমাকে বলে দিও যেন এ-সব কথা কাউকে না বলে। বাইরের লোক এ-কথা শুনলে নানান কেলেঙ্কারি রটবে। কেষ্টনগরের বেয়াই-বেয়ানের কানেও যেন কথাটা না ওঠে।

গৃহিণী বললে–বউমাকে না হয় বারণ করবো, কিন্তু তোমার ছেলে? তোমার ছেলেই যদি দশজনকে বলে বেড়ায়। আর যদি না–ও বলে তো এ-সব কথা তুমি কদ্দিন চেপে রাখতে পারবে?

চৌধুরী মশাই বললেন–সে পরের কথা পরে ভেবে দেখা যাবে। এখন আজকের কাণ্ডটা যেন দুকান না হয়। তোমার বাবা রয়েছে এখানে, আত্মীয়-কুটুম্ব সবাই এসেছে, এই অবস্থায় বাইরে জানাজানি হওয়া ভালো নয়, তারপর বাবার কানেও যেন না যায় কথাটা, তুমি একটু বউমাকে ভালো করে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলে দিও–

গৃহিণী বুঝলো কি বুঝলো না তা বোঝা গেল না। তাড়াতাড়ি ঘরের বাইরে চলে গেল। চৌধুরী মশাই তখন ঘরের মধ্যে ছটফট করতে করতে পায়চারি করতে লাগলেন।

নয়নতারা তখনও পাথরের মত ঠাণ্ডা শরীরে বিছানার ওপর কাঠ হয়ে বসে ছিল। শাশুড়ী ঘরে ঢুকেই বললে–ওমা, তুমি এখনও শোওনি? এসো, এসো, শুয়ে পড়ো–বলে নয়নতারাকে পাশে নিয়ে শুইয়ে দিলে। তারপর পায়ের দিকে পাট করে রাখা চাদরটা তার গায়ে ঢাকা দিয়ে নিজেও তার পাশে শুয়ে পড়লো।

বললে–কিছু ভয় নেই বউমা, খোকাকে তুমি ভুল বুঝো না, ও ওইরকম। একটু খেয়ালী ছেলে। আজকে ওইরকম ব্যবহার করলে বটে, কিন্তু দু’এক দিন পরে সব ঠিক হয়ে যাবে–তখন দেখবে ওরকম স্বামী হয় না। আমি ওর মা, তবু আমার সঙ্গে ওই রকম করে। তুমি কিছু ভেবো না বউমা, লক্ষ্মীটি।

বলে প্রীতি নয়নতারার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।

তারপর আস্তে আস্তে বললে–একটা কথা বউমা, তুমি এসব কথা কাউকে বোল না যেন, আমি সব ঠিক করে দেব। এখনও তো তোমাদের ভালো করে জানাশোনা হয়নি, তাই একটু লজ্জা হয়েছে আমার খোকার। বড় লাজুক ছেলে কিনা আমার সদা-দু’দিন ঘর করলেই বুঝতে পারবে সব। তুমি যেন তোমার বাবা-মাকে এসব কথা কিছু বোল না, বুঝলে–

নয়নতারা বুঝলে না তা ঠিক বোঝা গেল না। বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে রইল। শাশুড়ী তখনও নয়নতারার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রাত তখন শেষ হয়ে আসছে। সমস্ত বিয়েবাড়ি নিস্তব্ধ। বিকেল থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত যে কোলাহল চলছিল-তার চিহ্নমাত্র নেই আর কোথাও। সবাই ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন। দূরে কোন্ পাড়ায় কাদের মুর্গী ডেকে উঠলো। এইবার ভোর হবে। এইবার একে একে আবার সবাই ঘুম ভেঙে উঠবে। আবার ডাক পড়বে প্রীতির। তার আঁচলে বড়-ভাঁড়ারের চাবি। এতগুলো লোক জলখাবার খাবে, কারো দুধ, কারো লুচি, কারো চা, কারো বা চিড়ে-মুড়ি। সকলের সব ফরমাস তামিল করতে হবে একা তাকেই। যেন কেউ না বলতে পারে চৌধুরী মশাই-এর ছেলের বিয়েতে নেমন্তন্ন খেতে এসে পেটই ভরেনি আমাদের।

না, আর দেরি করা নয়। এরপর যদি একটু তন্দ্রা এসে যায় তখন বেলা গড়িয়ে যাবে। তখন জানাজানি হয়ে যাবে যে চৌধুরী মশাই-এর ছেলের ফুলশয্যা হয়নি। ছেলের বদলে শাশুড়ী এসে নতুন বউএর পাশে শুয়ে রাত কাটিয়েছে। আস্তে আস্তে প্রীতি উঠলো। একবার নিচু হয়ে দেখবার চেষ্টা করলে বউমা ঘুমিয়ে পড়েছে কি না। কিন্তু কিছু বোঝা গেল না। বউমা তখনও ঠিক সেই ভাবে বালিশে মুখ গুঁজে স্থির হয়ে শুয়ে আছে।

প্রীতি আর শব্দ না করে টিপি টিপি পায়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর আস্তে আস্তে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে আবার নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। বারান্দার ওপর তখনও মানুষ-জন গড়া গড়া শুয়ে আছে। তখনও যেন তাদের কাছে গভীর রাত।

কিন্তু সকলের আগে উঠেছে প্রকাশ মামা। প্রকাশ মামার ঘুম থেকে উঠেই চা খাওয়ার রোগ আছে। ঘুম থেকে উঠে সেইটেই তার প্রধান কাজ। বৃষ্টি হোক, ঝড় হোক, বন্যা, অগ্নিকাণ্ড, ভূমিকম্প, যা কিছু হোক, ওটি তার প্রথমেই চাই।

আগের রাতে শেষ নিমন্ত্রিত ব্যক্তিটি চলে না-যাওয়া পর্যন্ত প্রকাশ মামার শান্তি ছিল। সকলকে নিজে দাঁড়িয়ে খাইয়েছে প্রকাশ মামা। জোর-জবরদস্তি করে পেট ভরে সকলকে খাইয়েছে। যে দশখানা লুচির বেশি খেতে পারবে না, তাকে জোর-দবরদস্তি করে তিরিশ-চল্লিশখানা লুচি খাইয়েছে। মনে মনে সবাই বাহবা দিয়েছে শালাবাবুকে। হ্যাঁ, কেউ বলতে পারবে না যে সদানন্দর বিয়েতে ভালো করে খাতির-যত্ন হয়নি, পেট ভরে খেতে পায়নি। গাঁ-গঞ্জে এই-ই নিয়ম। বিয়ে বাড়ির এমন খাওয়া বছরে ক্বচিৎ কদাচিৎ কপালে জোটে। চাষাভুষোদের বিয়েবাড়িতে সাধারণত চিড়ের ফলারের বন্দোবস্ত।

প্রকাশ মামা কোথায় ছিল কেউ জানে না। চোখ মেলেই চেঁচিয়ে উঠলো–কই রে, চা হয়েছে?

কিন্তু কথাটা বলেই বুঝলো আজকে শালাবাবুর হুকুম তামিল করবার কেউ নেই আশেপাশে। আজকে সবাই ঘুমোচ্ছে। কালকের খাটুনির পর সকলেরই গায়ে-গতরে ব্যথা হয়ে বিছানায় গড়াচ্ছে। কিন্তু তা বললে তো নেশা শুনবে না। নেশার রসদ যোগাতেই হবে।

আস্তে আস্তে আড়ামোড়া খেয়ে প্রকাশ মামা উঠলো। উঠে একবার রান্নাবাড়ির দিকে গেল। কিন্তু সেদিকে সব ভোঁ-ভোঁ। কারোর টিকির পাত্তা নেই। একেবার পুকুরপাড়ের দিকে গেল। সেখানেই কালকে ভিয়েন চড়েছিল। মোটা-মোটা কাঠগুলো পুড়ে কাঠকয়লা হয়ে রয়েছে। কিন্তু ঠাকুর-চাকরদের কারো দেখা নেই। ঘুমোতে যেতে সেই রাত একটা বেজে গিয়েছিল কাল।

হঠাৎ একটা চেনা লোকের মুখ দেখেই খুশীতে লাফিতে উঠলো। লোকটা মাঠের দিক থেকে আসছিল।

প্রকাশ মামা তাকেই ধরলো–এই যে হে, উঠেছ? কী নাম যেন তোমার?

–আজ্ঞে বিন্দাবন?

–বৃন্দাবন! বেশ বেশ! বেশ নাম তোমার! চা খেয়েছো তুমি?

–আজ্ঞে চা আমি খাইনে।

প্রকাশ মামা যেন একটু হতাশ হলো কথাটা শুনে। বললে–চা খাও না? তা না-ই বা খেলে, চা তৈরি করতে পারো তো?

–আজ্ঞে, তা পারি।

–ভেরি গুড। চা এক বাটি তৈরি করো দিকিনি।

লোকটা জানতো শালাবাবুর হাতেই সব ক্ষমতা। মজুরি নেবার সময় এই শালাবাবুকেই ধরতে হবে। তখন চায়ের কথাটা মনে থাকবে। প্রকাশ মামা বললে–বেশ কড়া করে বানাবে, বুঝলে? দুধ-ফুদ যদি না পাও তো ক্ষতি নেই, রংটা যেন লঙ্কার মত লাল হয়। এই চায়ের জন্যে মাঠে যেতে পারছি না, সব আটকে গেছে, পেট-টেট সব বোম্ মেরে আছে–

লোকটা অদ্ভুত করিতকর্মা বটে! কোথা থেকে কাকে ধরে চা, দুধ, চিনি যোগাড় করে নিয়ে এল। তারপর কাঠকয়লার আগুন ধরিয়ে তার ওপর জল চড়িয়ে দিলে।

প্রকাশ মামা বললে–দুবাটির মত জল দাও, আমি খাবো, আর আমার পিসেমশাই খাবে। পিসেমশাইকে চেনো তো? ওই যে বরের দাদামশাই, ওঁকেও এক বাটি দেব। কুটুম মানুষ, লজ্জায় চায়ের কথা মুখ ফুটে বলতে পারবেন না। তবে আমার ও-সব লজ্জা-ফজ্জা নেই ভাই, আমি দিল-খোলা মানুষ। খাওয়ার ব্যাপারে লজ্জা-সরম করি নে; পেট হচ্ছে সকলের চেয়ে বড়, জানো বৃন্দাবন। পেটের জন্যেই দুনিয়া চলছে। আরো বড় একটা জিনিস আছে অবিশ্যি, কিন্তু পেট তার চেয়েও বড়। সেটা না হলেও চলে, কিন্তু পেট তো না হলে চলে না–

বৃন্দাবন জল গরম করছে আর প্রকাশ মামা উনুনের সামনে তাই দেখছে। হঠাৎ সদরের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে গেল। আরে সদা না! এত ভোরে কোথায় গিয়েছিল!

আর বসা হলো না প্রকাশ মামার। উঠে দাঁড়ালো। সদানন্দ ভেতরের দিকেই ঢুকছিল। প্রকাশ মামাও তার দিকে যেতে লাগলো।

একেবারে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে কী রে, তুই? আজ এত সকালে উঠে পড়েছিস যে?

সদানন্দর মুখের ভাব দেখে প্রকাশ মামার কেমন সন্দেহ হলো।

বললে–তোর চেহারা ওরকম হলো কেন রে? কী হয়েছে বল তো?

সদানন্দ বললেন, কিছু হয়নি–

প্রকাশ মামা বললে–কিছু না হলেই ভালো। কাল তুই যা ভাবিয়ে তুলেছিলি সকলকে! আমি তো ভেবেছিলাম তুই একটা কিছু কাণ্ড করে বসবি। নতুন বউ বাড়িতে এসেছে। এই সময়ে কিছু করলে কেলেঙ্কারি হয়ে যেত মাইরি। তা যাক শেষ পর্যন্ত তোকে শোবার ঘরে ঢুকিয়ে তবে আমি খেইছি, জানিস! তোর দাদুও তোর জন্যে খুব ভাবনায় পড়েছিল। আমি যখন গিয়ে বললুম যে সদা ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিয়ে দিয়েছে, তখন বুড়ো নিশ্চিন্ত হলো–

তারপর একটু থেমে বললে–তা যাক সে-সব বাজে কথা, রাতটা কেমন কাটালি বল্–কে প্রথম কথা বললে? তুই, না তোর বউ?–

সদানন্দ কোনও জবাব দিলে না।

প্রকাশ মামা তবু পীড়াপীড়ি করতে লাগলো–কী রে? কথার জবাব দিচ্ছিস নে যে? বল না, বল্! আমাকে বলতে তোর লজ্জা কীসের? মাইরি বলছি আমি কাউকে বলবো না। আমাকে বলতে তোর দোষ কীসের? আমি না তোর বিয়ে দিয়ে নিয়ে এলাম, আজ আমার সঙ্গেই তুই বেইমানি করছিস!

সদানন্দ বললে–বলছি তো কিছু বলবার নেই–

–বলবার নেই মানে? তুই কি সারারাত নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়েছি নাকি? অ্যাঁ? ছিঃ ছিঃ, তুই দেখছি একটা আস্ত হাঁদারাম! মেয়েটা কী ভাবলে বল্ দিকিনি? বেচারা কতদিন ধরে এই রাতটার দিকে চেয়ে বসে ছিল, আর তুই কিনা সারারাত নাক ডাকিয়ে ঘুমোলি?

সদানন্দ বললে–এখন ও-সব কথা ভাল লাগছে না প্রকাশ মামা, পরে সব বলবো–

বলে অন্যদিকে চলে যাচ্ছিল, কিন্তু প্রকাশ মামা ছাড়লে না। বললে–ওরে শয়তান, আজ আমি পর হয়ে গেলুম, না? অথচ আমিই এত কাঠ-খড় পুড়িয়ে তোর বিয়ে দিয়ে নিয়ে এলুম, আর আজ আমি কেউ নয়! বেইমান তুই, জাত বেইমান–

কিন্তু কথার মধ্যেখানে বাধা পড়লো। ওদিক থেকে চৌধুরী মশাই যাচ্ছিলেন। হঠাৎ সদানন্দকে দেখে এগিয়ে এলেন।

বললেন–খোকা, তুমি একবার ভেতরে আমার সঙ্গে দেখা করো তো—

বলে আর দাঁড়ালেন না। সোজা যেদিকে যাচ্ছিলেন সেই দিকেই চলতে লাগলেন।

সদানন্দও তাঁর পেছনে-পেছনে সেই দিকে চলতে লাগলো।

.

মনে আছে সেদিন সদানন্দ বাবার সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে একটু আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল। চৌধুরী মশাই সোজা গিয়ে উঠলেন তাঁর চন্ডীমন্ডপে। আসলে কর্তাবাবু যেদিন পঙ্গু হয়ে পড়েছিলেন সেইদিন থেকেই তিনি নিজের আসন করে নিয়েছিলেন ওইখানে। ওইখানে বসেই তিনি ক্ষেতের কাজকর্ম পরিচালনা করতেন। সেই যে সকালবেলা গিয়ে সেখানে বসতেন, তখন থেকে বেলা একটা দুটো পর্যন্ত তাঁর ওই চণ্ডীমণ্ডপে কাটতো। এক-এক করে সবাই আসতো নানান কাজে। তিনি চাইতেন তাঁর সঙ্গে খোকাও ওখানে বসুক, তাঁর কাজ কর্ম আস্তে আস্তে দেখেশুনে নিক। তিনি থাকতে থাকতে ছেলে তাঁর কাছে সব কিছু কাজ-কর্ম শিখে নিক।

কিন্তু ছেলের মতিগতি তাঁর ভালো লাগতো না কোনও দিনই। বাপের কথা ছেলে অমান্য করত না বটে, কিন্তু তেমন মান্যও ঠিক করতো না যেন। যেন কাজকর্ম না করতে হলেই সে বেঁচে যেত।

কীর্তিপদবাবু জামাইকে বলতেন–এখন থেকে তোমার ছেলেকে সব কিছু বুঝিয়ে টুঝিয়ে দিচ্ছ তো বাবাজী?

জামাই বলতো–আমি তো বুঝিয়েই দিতে চাই, কিন্তু তার তো এসব দিকে একেবারেই মন নেই–

শ্বশুর বলতেন–এ-বয়সে মন তো থাকবেই না, আমারও ছিল না। আমার বাবা আমাকে কত বুঝিয়েছেন, তখন ওসব ভালো লাগতো না, কিন্তু পরে তাই নিয়েই তো মেতে আছি। এখন ও ছাড়া আর কিছু বুঝিই না–

কিন্তু আজ মনে হলো এবার আর দেরি নয়। যে ছেলে বিয়ের দিনে এই কাণ্ড করতে পারে সে বড় সাধারণ ছেলে নয়। তাকে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার যে জীবন ছেলেখেলার জিনিস নয়। শুধু লেখাপড়া আর আড্ডা দিয়ে বেড়ালে আর যাই চলুক সংসার চলে না। সংসার মানে দায়িত্ব কাঁধে নেওয়া।

চণ্ডীমণ্ডপের মধ্যে একটা তক্তপোশ পাতা ছিল। তার ওপরে মাদুর পাতা। মাদুরের ওপর সামনের দিকে একটা কাঠের ক্যাশবাক্স। চৌধুরী মশাই সেই ক্যাশবাক্সের পেছনে গিয়ে বসলেন। তারপর ছেলের দিকে চেয়ে বললেন–বোস–

সদানন্দ বসলো না। তেমনি আড়ষ্ট হয়েই দাঁড়িয়ে রইলো।

–কই, বসলে না যে! বোস! তোমার কানে কি কথা যাচ্ছে না?

সদানন্দ এবার তক্তাপোশের ওপরেই পা ঝুলিয়ে বসলো।

কাল রাত্রেই চৌধুরী মশাই কথাগুলো ভেবে রেখেছিলেন। সেই রাত তিনটের সময়। গৃহিণী যখন বউমার ঘরে চলে গিয়েছিল। অনেক ভেবে-চিন্তে ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। অবশ্য বিয়ে তিনিও একদিন করেছিলেন। জীবনে বিয়ে করার কী মর্ম তা তিনি জানেন। মর্মও যেমন জানেন তেমনি তার সঙ্গে দায়িত্বের কথাটাও তিনি কখনও হালকা করে দেখেননি। কর্তাবাবুর মত তিনিও একদিন বুড়ো হয়ে যাবেন। তখন হয়ত ঠিক তাঁরই মত পঙ্গু হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে থাকবেন। তখন এই খোকাই এসে এই চণ্ডীমণ্ডপে বসে দৈনন্দিন কাজ চালিয়ে যাবে। কিন্তু যে ফুলশয্যার রাতে এইরকম কাণ্ড করতে পারে তার ওপর কতটা নির্ভর করা যায়।

হঠাৎ তাঁর মুখ দিয়ে আসল প্রশ্নটা বেরোল। বললেন–কোথায় ছিলে সমস্ত রাত?

সদানন্দও জবাব দিতে দেরি করলে না। বললে–বাইরে—

চৌধুরী মশাই থমকে রইলেন। জিজ্ঞেস করলেন–বাইরে মানে?

সদানন্দ বললে–বাইরে-মানে বাইরে। আমি বাড়িতে ছিলুম না সারারাত–

আরো অবাক হয়ে গেলেন চৌধুরী মশাই। তাঁর মুখের সামনে এমন করে তো কখনও আগে কথা বলেনি খোকা! হঠাৎ এত সাহস পেলে সে কোথা থেকে?

বললেন–তুমি জানো যে বাড়ির বাইরে থাকা এবাড়ির নিয়ম নয়! আর শুধু এবাড়ি কেন, কোন বাড়িতেই নিয়ম নেই বাড়ির ছেলে রাত্রে বাইরে রাত কাটাবে। কাটালে নিন্দে হয়, দশজনে দশ কথা বলে–

সদানন্দ উঠে দাঁড়ালো। বললে–আপনি কি আমাকে এই কথা বলতেই এখানে ডেকে এনেছেন?

সদানন্দর হাব-ভাব দেখে চৌধুরী মশাই তাজ্জব হয়ে চেয়ে রইলেন ছেলের দিকে। খানিক পরে বললেন–কেন, তোমাকে এখানে ডেকে এনে এই কথা বলা কি আমার অন্যায় হয়েছে?

সদানন্দ বললে–ন্যায়-অন্যায়ের কথা আপনারা তুলবেন না। কাকে ন্যায় বলে আর কাকে অন্যায় বলে তা আমি ভালো করেই জানি। আমি কি এখন যেতে পারি?

চৌধুরী মশাই বললেন–তুমি উঠে দাঁড়ালে কেন, বোস না–

সদানন্দ বললে, আমি এখানে বসব না। যা শোনবার আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই শুনতে পারবো

চৌধুরী মশাই বললেন–তাহলে বলো তুমি কেন এরকম করলে? বউমা তোমার কাছে কী অপরাধ করেছে? আর আমি আর তোমার মা, আমরাই বা তোমার কাছে কী অপরাধ করলুম যে দশের কাছে তুমি আমাদের বে-ইজ্জত করতে চাও! আমাদের বংশমর্যাদা, কোনও কিছুর কথাই কি তুমি ভাববে না?

সদানন্দ কথা না বলে চুপ করে রইল।

–কথা বলছো না যে, একটা কিছু জবাব দাও—

তবু সদানন্দ কিছু কথা বললে না। তেমনি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।

এবার চৌধুরী মশাই উঠলেন। উঠে সদানন্দর কাছে এলেন। তারপর বললেন–চলো, ভেতর বাড়িতে তোমার মার কাছে চলো, তোমার সঙ্গে কথা আছে–

বলে সদানন্দকে হাতে ধরে চণ্ডীমণ্ডপের বাইরে নিয়ে এলেন। বাইরে তখন বেশ স্পষ্ট সকাল হয়েছে। বিয়েবাড়ির লোকজন তখন এক-এক করে জেগে উঠেছে। তাদের সকলের দৃষ্টির সামনে দিয়ে একবারে সোজা তাকে ভেতর বাড়িতে নিয়ে এলেন। সেখানে মেয়েদের আনাগোনা। তখন তারাও উঠেছে ঘুম থেকে। চারদিক অগোছালো। চৌধুরী মশাই-এর পেছন-পেছন সদানন্দ যাচ্ছিল। অনেকেই ছোটবাবুকে দেখে ঘোমটা টেনে সামনে থেকে সরে গেল।

রাত্রে ভাল করে ঘুম হয়নি, তাই প্রীতি ভোরবেলাতেই তৈরি হয়ে নিয়েছিল। রাত তিনটের সময় সবেমাত্র একটু দু’চোখ জুড়ে এসেছিল এমন সময় ওই দুর্যোগ। মনটাও বিষিয়ে ছিল তার পর থেকে। নতুনবউ এর কাছে মুখ দেখাতেও যেন লজ্জা হচ্ছিল তার। ছেলে ফুলশয্যার রাতে বউ-এর সঙ্গে একঘরে শোয়নি, এ লজ্জা যেন ছেলেরও নয় বউ এরও নয়, এ লজ্জা যেন শাশুড়ীরই নিজের। অথচ এমন এক ঘটনা যা বাইরের লোককে বলাও যাবে না। যা বলে কারোর কাছ থেকে সহানুভূতিও পাওয়া যাবে না। নিজের মনে মনে জিনিসটাকে পুষে রেখে তুষের আগুনে জ্বলতে হবে।

হঠাৎ কর্তাকে সেই অসময়ে ঘরে আসতে দেখে প্রীতি অবাক হয়ে গেল। বললে–কী হলো, খোকার খোঁজ পেয়েছ?

কিন্তু তার কথা শেষ হওয়ার আগেই দেখলে, পেছনে খোকাও রয়েছে।

চৌধুরী মশাই সদানন্দকে ঘরে ঢুকিয়ে নিয়ে দরজার পাল্লা দুটো ভেজিয়ে দিলেন।

বললেন–এই তো খোকাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলুম তোমার কাছে—

সদানন্দ তখন অপরাধীর মত মা’র সামনে দাঁড়িয়ে ছিল।

চৌধুরী মশাই বললেন–আমি ওকে অনেক কথা জিজ্ঞেস করেছি, তবু কোনও কথার জবাব দিচ্ছে না, দেখ, তুমি যদি কিছু কথা আদায় করতে পারো–

প্রীতি ছেলের মুখের দিকে সোজাসুজি চোখ রেখে বললে–হ্যাঁ রে খোকা, কোথায় ছিলি তুই সারারাত?

চৌধুরী মশাই বললেন–আমি ওকে সেই কথাই জিজ্ঞেস করেছি। সমস্ত রাত বাইরে বাইরে কাটালো, অথচ নতুন বউমা, সে বেচারি নতুন জায়গায় ভয়ে কেঁপে অস্থির–সে কী দোষ করলে?

প্রীতি ছেলের কাঁধে হাত দিয়ে সান্ত্বনা দিতে চাইলে। বললে–কী হয়েছিল তোর বল্ তো বাবা? বউমাকে পছন্দ হয়নি? আমাকে সত্যি করে মন খুলে বল, কী হয়েছিল তোর, বল কী হয়েছিল তোর? আমি কাউকে কিছু বলবো না। আমাদের কাছে বলতে তোর কীসের আপত্তি? আমাকে তো তুই আগে সব বলতিস, এখন তোর কী হলো যে আমাকে একবারও কিছু বললি না–না আমি তোর পর? তুই কি আমাদের পর মনে করিস?

সদানন্দ তখনও চুপ।

চৌধুরী মশাই বলতে লাগলেন–গায়ে-হলুদের সময় তুই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলি, ভাবলুম বিয়ের পর সব মিটে-টিটে যাবে। তারপর থানা-পুলিস কত কী হলো। তাও তো একরকম করে সব মিটলো, এখন পরের মেয়ে এ বাড়িতে এসেছে, সে বেচারি কী ভাবছে বল্ দিকিনি

মা ছেলের দিকে চেয়ে বললে–কী রে, কথা বলছিস নে যে? বাড়িত এখন এত লোকজন এসেছে, এদের কানে যদি কথাটা যায় তো তারাই বা কী ভাববে বল্ দিকিনি।

এতক্ষণে সদানন্দর মুখ দিয়ে কথা বেরোল।

বললে–মা…

কিন্তু কথা বলতে গিয়েও যেন সব কথা তার মুখের মধ্যে আটকে গেল।

মা বললে–কী রে, কী বলছিলি বল্, থামলি কেন?

সদানন্দ এবার মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

হঠাৎ বাইরে থেকে কৈলাস গোমস্তার গলা শোনা গেল—ছোটবাবু—

গৃহিণী বললে–ওই, গোমস্তা মশাই তোমাকে ডাকছে, যাও—

কিন্তু এই অবস্থায় চৌধুরী মশাই-এর ঘর থেকে চলে যাবার ইচ্ছে ছিল না।

চৌধুরী মশাই দরজা খুলে বাইরে আসতেই গোমস্তা মশাই বললে–রেলবাজার থেকে প্রাণকৃষ্ণ সা মশাই এসেছেন–

প্রাণকৃষ্ণ সা! প্রাণকৃষ্ণ সা রেলবাজারের আড়তদার মানুষ। মহাজনও বটে। টাকার দরকার হলে চৌধুরী মশাইকে ওই প্রাণকৃষ্ণ সা’র কাছেই হাত পাততে হয়।

জিজ্ঞেস করলেন–তা তিনি এই অসময়ে কেন?

কৈলাস বললে– কাল সন্ধেবেলা বউভাতে আসতে পারেননি, এখন এসেছে, বউমার মুখ দেখবেন।

চৌধুরী মশাই বিরক্ত হলেন মনে মনে। ঘরের ভেতর ঢুকে গৃহিণীকে বললেন–দেখেছ আক্কেলখানা! এই অসময়ে প্রাণকেষ্ট সা এসে হাজির, নতুন বউ-এর মুখ দেখবে! মুখ দেখবার আর সময় পেলে না! এখন কী করি বলো দিকিনি!

গৃহিণী বললেন–তা এসেছেন যখন তখন তো আর ফিরিয়ে দিতে পারবে না। কিন্তু একটু বসতে বলো গে। বউমা এখন ঘুমোচ্ছে, বউমা উঠবে, উঠে মুখ হাত ধোবে, তারপর সাজিয়ে-গুছিয়ে তবে বউ দেখাবো–তার আগে নয়–

চৌধুরী মশাই বিরক্ত হলেন। নিজের মনেই বললেন–আড়তদার মানুষ তো, তাই আক্কেলের মাথা খেয়ে বসে আছে একেবারে। সাত-সকালে বউ দেখতে চাইলেই অমনি দেখানো যায়! এখনও কারো বাসি কাপড় ছাড়া হয়নি–

আবার বাইরে এসে কৈলাসকে বললেন–সা মশাইকে বসিয়েছো তো!

–আজ্ঞে, তিনি তো কর্তাবাবুর কাছে বসে আছেন। কর্তাবাবুই আপনাকে ডাকতে পাঠালেন।

চৌধুরী মশাই বললেন–আচ্ছা ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি–তুমি যাও–

সেখানেও কিছু লোকজন বসে আছে। তারা প্রাত্যহিক প্রয়োজনে আসে। হুকুম নেয় ছোটবাবুর কাছে। কোথায় কোন্ জমিতে লাঙল দিতে হবে, কোন্ জমির সর্ষে কাটতে হবে; কোন্ ক্ষেতের বেড়া বাঁধতে হবে–সব নির্দেশ ছোটবাবু সকালবেলাই দিয়ে দেন। তারপর আছে মজুরি দেওয়ার কাজ। রোজকার মজুরিটা ছোটবাবু রোজই দিয়ে দেন। ওটা পড়ে থাকে না। তার ওপর আছে উকিল-মুহুরি-মোক্তারের আনাগোনা।

ওপরে কর্তাবাবুর ঘরে তখন প্রাণকৃষ্ণ সা মশাই বেশ আসর জাঁকিয়ে বসেছে। নাতির বিয়েটা দিয়ে দিয়েছেন বলে খুব বাহবা দিচ্ছে কর্তাবাবুকে। বলছে–খুব ভাল কাজ করলেন কর্তাবাবু, একটা কাজের মত কাজ করে গেলেন–

কর্তাবাবু বললেন–আমার তো এই একটা কাজই বাকি ছিল, এবার রাস্তা ক্লিয়ার হয়ে গেল, এখন যেতে পারলেই হয়–

প্রাণকৃষ্ণ সা বললে–ওকথা বলবেন না কর্তাবাবু, নাতির তো এই সবে বিয়ে হলো, এখন তার ছেলে হোক, অন্নপ্রাশন হোক, আমরা পাত পেড়ে ভোজ খাই, তবে তো…

প্রাণকৃষ্ণ সা’র সঙ্গে কর্তাবাবুর পুরোন সম্পর্ক! সম্পর্কটা লেনদেনের হলেও কালক্রমে সেটা বন্ধুত্বের বন্ধনে নিবিড় হয়েছে। তাকে চৌধুরী বংশ সহজে অস্বীকার করতে পারে না। তাই তার অত্যাচার সহ্য করতে হয় এদের মুখ বুঁজে।

ততক্ষণে চৌধুরী মশাই এসে গেলেন।

বললেন–আপনি কাল আসেননি, তাই খুব ভাবছিলুম—

প্রাণকৃষ্ণ সা বললে–তা শুভ কাজ নির্বিঘ্নে মিটে গেছে তো, তাহলেই হলো বাবাজী…

কর্তাবাবুও তাই বললেন। বললেন–হ্যাঁ, আমার বড় উদ্বেগ ছিল সা মশাই। আমার নাতি যেমন বেয়াড়া, ভেবেছিলুম একটা কাণ্ড না আবার বাধিয়ে বসে। আজকালকার ছেলে ছোকরা তো আর আমাদের মত নয়, এরা সব অন্য রকম!

চৌধুরী মশাই কথার মাঝখানে বললেন–আপনাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে কিন্তু, বউমা আমার সবে ঘুম থেকে উঠেছে তো, একটু মুখ-হাত-পা ধুয়ে তৈরি হয়ে নেবেন–

প্রাণকৃষ্ণ সা মশাই বললে–না, না, তার জন্যে ব্যস্ত হতে হবে না, আমার তাড়া নেই, আমি ততক্ষণ গল্প করছি–

কিন্তু ওদিকে সদানন্দ তখনও মার সামনে কাঠের পুতুলের মত দাঁড়িয়ে আছে।

মা বললে–কই, বল কী হয়েছে তোর, বল–

সদানন্দ এতক্ষণে আবার কথা বলে উঠলো। বললে–কেন তুমি বারবার এক কথা জিজ্ঞেস করছো, বলো তো?

মা বললে–তা তুই কেন বউমার কাছে শুবি নে তা বলবি তো?

সদানন্দ বললে–আমি তো বলেছি

–কী বলেছিস?

–আমি তো বলেছি তুমি বার বার ওকথা জিজ্ঞেস কোরনা আমাকে। আমি বলবো না।

মা বললে–তা আমাকে না বলিস, তুই বউমাকে বল্! বউমার সঙ্গে তুই একবার কথা বল্ গিয়ে। সে বেচারি কাল রাত তিনটের সময় ভয় পেয়ে আমাকে ডাকতে এসেছে, আমি গিয়ে তখন তার পাশে শুই, তবে বেচারি একটু ঘুমোতে পারে। জানিস আমাকে জড়িয়ে ধরে কী কাঁদাটা সে কেঁদেছে! তাকে আমি কী বোঝাই বল তো? বল, তাকে আমি কী বলে বোঝাব?

–তুমি কী বোঝাবে তা আমি কী করে জানবো?

–তুই যদি তা না জানবি তো ঘর থেকে পালিয়ে গেলি কেন? বউমা তোর কাছে কী দোষ করলো?

সদানন্দ বললে–তা আমি তো তোমাদের আগেই বলেছিলুম আমি বিয়ে করবো না!

মা বলে উঠলো–তা বিয়ে করবিই বা না কেন? বিয়ে কে না করে শুনি?

সদানন্দ বললে–তুমি সব কথা জানো না মা। তুমি যা জানো না তা নিয়ে কথা বলতে এসো না।

মা এবার ছেলের মুখের দিকে অনেকক্ষণ সোজাসুজি চেয়ে রইল। যেন কী একটা আতঙ্ক জেগে উঠলো মনে। বললে–তুই তাহলে কি কোনও দিনই বউমার কাছে শুবি নে নাকি?

সদানন্দ বললে–না–

–তাহলে পরের মেয়েকে বাড়িতে এনে তুই এত কষ্ট দিবি?

–তা সেজন্যে তো আমি দায়ী নই।

–কিন্তু সে বেচারি তাহলে এখানে কী করবে? সে এমন কী পাপ করলে যে তাকে তুই এমন শাস্তি দিবি? তোর ধর্ম বলেও কি কিছু নেই? দয়া মায়া ভগবান–কিছুই তুই মানবি নে? তুই তার দিকটা একটু ভেবে দেখবি নে? তার কথা না ভাবলেও আমাদের কথাও কি তুই একবার ভাববি নে? আমরাই বা লোকের কাছে কুটুমদের কাছে মুখ দেখাবো কী করে? চিরকাল তো আর এ-কথা চাপা থাকবে না, একদিন না একদিন তো এ দশ কান হবেই, তখন?

সদানন্দ বলে উঠলো–তা এসব কথা তোমরা আগে ভাবোনি কেন? যখন কালীগঞ্জের বউকে দাদু টাকা দিলে না, তখন এসব কথা কেন একবার ভাবলে না? যখন দাদু তাকে খুন করে মারলে তখনও তো কেউ একটা কথা পর্যন্ত বললে না তোমরা!

মা ছেলেকে চুপ করিয়ে দিলে। বললে–তুই আস্তে কথা বল বাবা, একটু আস্তে, বাইরের সবাই শুনতে পাবে

সদানন্দ আরো চেঁচিয়ে উঠলো–কেন, চুপ করে থাকলেই কি চিরকাল সব চাপা থাকবে তুমি বলতে চাও?

মা বললে–তোর দেখছি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। চল, আমার সঙ্গে চল্, বউমার কাছে গিয়ে তুই এই কথাগুলো বলবি চ!

সদানন্দ বললে–কেন, বউমার কাছে আমি যাবো কেন? তোমরা তাকে বউ করে নিয়ে এসেছ, তোমরাই তার সঙ্গে ঘর করো, আমাকে ছেড়ে দাও, আমাকে ওর মধ্যে টেনো না

–পাগলামি করিস নে, আয় আমার সঙ্গে আয়—

বলে ছেলেকে হাত ধরে টানতে লাগলো প্রীতি।

সদানন্দ জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিলে। বললে–তুমি কি আমাকে এতদিনেও চিনলে না? ভেবেছ তুমি হাত ধরে টানলেই আমি যাবো? আমি ছেলেমানুষ?

–তা তুই না যাস আমি বরং বউমাকে ডেকে তোর কাছে নিয়ে আসছি, তার কাছেই সব কথা পরিষ্কার হয়ে যাক।

সদানন্দ ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই মা খপ করে তার হাতখানা ধরে ফেললে। বললে–কোথায় যাচ্ছিস?

সদানন্দ বললে–কোথায় যাচ্ছি তার কৈফিয়ৎ আমি তোমাকে দিতে বাধ্য নই–

মা বললে–তা আমাকে যদি না-ই বলিস তো বউমাকে বলে যা! বউমাকে বলে যা কেন তুই তার ঘরে থাকবি না! আমার দায়িত্বটা অন্তত কাটুক। আমি অন্তত মুক্তি পাই। তোরা দু’জনে নিজেদের মধ্যে যা ইচ্ছে বোঝাপড়া করে নে, আমি কেন মাঝখানে থেকে পাপের ভাগী হই?

সদানন্দ এ কথার কোনও উত্তর দিলে না।

মা এবার ছেলের আরো কাছে সরে এলো। বললে–কে কী দোষ করলো, তার জন্যে হেনস্তা হবে আমার আর ওই এক ফোঁটা দুধের মেয়ের? এই-ই কি তোর বিধান?

সদানন্দ বললে–তুমি বড় বড় কথা বোল না মা, ও-সব বড় বড় কথায় আমি ভুলবো না, তা জেনে রেখো। আমি যা করবো তা আমি ঠিক করেই রেখেছি–

–কী ঠিক করে রেখেছিস?

–কী ঠিক করেছি তা তুমি দেখতেই পাবে। আমাকে আর জিজ্ঞেস কোর না।

মা বললে–তাহলে তুই কোনও দিনই বউমার ঘরে শুবি নে?

সদানন্দ চুপ করে রইল।

মা আবার জোর দিয়ে জিজ্ঞেস করলে কী রে, উত্তর দিচ্ছিস নে যে? কথা বল, জবাব দে–

সদানন্দর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। তাড়াতাড়ি ডান হাত দিয়ে সেটা মুছে নিতে যাচ্ছিল, মা সঙ্গে সঙ্গে হাতটা ধরে ফেলেছে।

বললে–তুই আমার কাছে লুকোচ্ছিস? ভেবেছিস আমার কাছে মনের কথা লুকিয়ে তুই পার পাবি? তাহলে কেন আমি তোর মা হয়েছিলুম? কেন আমি তোকে দশমাস দশ দিন পেটে ধরেছিলুম? তোর জেদটাই বড় হবে রে, আর আমি কেউ নই? আমার কথার কোনও দাম নেই তোর কাছে? এই-ই তোর বিচার?

সদানন্দ মার কথা শুনতে শুনতে আর থাকতে পারলে না। দেখলে মার চোখ দিয়েও জল পড়ছে। সদানন্দ মার দিকে চেয়ে বললে–মা….

মা বলে উঠলো–না, আমি তোর মা নই। আজ থেকে আমি তোর কেউ নই, আমাকে তুই এখন থেকে আর মা বলে ডাকিস নে—যা–

বলে প্রীতি এক-পা পিছিয়ে গেল। সদানন্দ মার দিকে এগিয়ে গেল। বললে–মা–

প্রীতি বললেন, আমাকে তুই মা বলে আর ডাকিস নে, আমার ঘর থেকে তুই বেরিয়ে যা। আমি আর তোর মুখ দেখতে চাই নে–যা, বেরিয়ে যা–

সদানন্দ তবু মার দিকে এগিয়ে গেল। বললে–মা, তুমি আমার ওপর রাগ কোর না, আমার কথা শোন–

–তোর কোনও কথা শুনতে চাই নে, তুই আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যা—

এবার সদানন্দ মা’র সামনে গিয়ে মাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরলে। বললে–মা, তুমি আমার কথা শোন মা, আমার কথাগুলো শোন

মা ছেলের হাত দুটো ধরে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে লাগলো। বললে–না, তুই চলে যা আমার সামনে থেকে, চলে যা–আমি তোর মুখ দেখতে চাই নে–

সদানন্দ বললে–না না, তুমি আমার ওপর রাগ কোর না, তুমি আমার দিকটা মোটে ভেবে দেখছ না। শুধু তোমাদের দিকটাই দেখছে। কিন্তু আমি কী করবো বলো তো, আমি কী করবো তুমি বলে দাও, আমি যে আর পারছি না–

মা বললে–কেন, কী হয়েছে তোর?

সদানন্দ বললে–কী হয়নি আমার, তাই আমাকে জিজ্ঞেস করো! আমি তোমাদের এই পাপের সংসারে কী করে থাকবো! কী করে তোমাদের সঙ্গে আমি মানিয়ে চলবো তাই শুধু আমি ভাবছি। আমার যে বুক ফেটে যাচ্ছে মা, সেটা তুমি দেখতে পাচ্ছো না?

–কেন? কীসের জন্যে তোর বুক ফেটে যাচ্ছে?

সদানন্দ বললে–তুমি তো বাড়ির ভেতরে থাকো, তুমি সেসব কথা জানবে কী করে? কপিল পায়রাপোড়াকে জানো? মানিক ঘোষকে জানো? ফটিক প্রামাণিক? কত লোকের নাম জানো তুমি? তারপরে এই কালীগঞ্জের বউ? মা, তুমি কেবল আমার নামেই দোষ দিতে পারো, আর কই, এতকাল ধরে যে এ বাড়িতে এত অন্যায় চলে আসছে, তার বিরুদ্ধে তো তোমরা কিছুই বলোনি?

মা বললে–তা ওসব কথা নিয়ে তুই অত মাথা ঘামাস কেন? ওসব নিয়ে তোর ভাববার দরকারই বা কী? ওসব ব্যাপারে তুই কানে তুলো দিয়ে রাখলেই পারিস–

সদানন্দ বললে–তা আমি যদি মাথা না ঘামাই তো ওরা কি এমনি করেই মরে যাবে? কেউ ওদের দেখবে না?

বাইরে থেকে ডাক এল হঠাৎ–ও বউদি, বউদি–

মা বললে–ওই তোর গৌরী পিসী ডাকছে। আমি যাই, কাজের বাড়ি, তোর সঙ্গে এতক্ষণ ধরে আমার কথা বলবার কি সময় আছে! যাই, আমি বাইরে যাই–

বলে একটু থেমে ছেলের দিকে চেয়ে বললে–তাহলে এবার থেকে আমার কথা শুনবি তো?

কিন্তু বাইরে থেকে আবার দরজা ঠেলার শব্দ–ও বউদি, বউদি–

প্রীতি দরজা খুলে দিতেই গৌরী পিসী বললে–কী করছিলে বউদি ঘরের ভেতর? তারপর সদানন্দকে দেখে আর কিছু বললে না। সদানন্দ খোলা দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। সদানন্দ চলে যেতেই গৌরী বললে–খবর শুনেছ?

–কী খবর?

গৌরী গলা নিচু করে বললে–বউমার বাপের বাড়ি থেকে লোক এসেছে–

–কেন? এই তো কাল বিকেলেই ফুলশয্যের তত্ত্ব নিয়ে লোক এসেছিল। এই সাত সকালে আবার কী হলো?

গৌরী বললে–সব্বনাশ হয়েছে বউদি, খারাপ খবর নিয়ে এসেছে কেষ্টনগরের লোক–

–কী খারাপ খবর?

–বউমার মা’র নাকি খুব অসুখ।

–অসুখ? বউমাকে নিতে এসেছে নাকি? দেখ দিকিনি, কী কাণ্ড! তুই ওঘরে গিয়ে দেখেছিলি? বউমা কী করছে?

গৌরী বললে–আমি এ খবর দিতে পারবো না বাপু বউমাকে। তুমি দাও গে—

প্রীতি বললে–তা ছোট মশাই কোথায়? ছোট মশাই জানে?

–ছোট মশাই-এর কাছে তো বউমার বাপের বাড়ির লোক চিঠি নিয়ে দিয়েছে। বউমার বাপ নাকি চিঠিতে সব কথা লিখেছে–

প্রীতির মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়লো। সারারাত এত কাণ্ডের পর প্রাণকৃষ্ণ সা’ মশাই এসে হাজির হয়েছে বউ দেখবে বলে। তাঁকে বসিয়ে রাখা হয়েছে এতক্ষণ। এরপর বউমাকে মুখ-হাত পা ধুইয়ে সাজিয়ে গুজিয়ে সা’ মশাইকে দেখাতে হবে। এরই মধ্যে আবার বেয়ানের কিনা অসুখ! অসুখের কি সময় অসময় নেই গো? আর অসুখই যদি হলো তো এখনি সে খবর পাঠাতে হয়। একদিন পরে খবর পাঠালে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? এই সবে ফুলশয্যের রাত কাটলো, এখনও বাসি মুখে জল পড়েনি, এর মধ্যে খবরটাই বা বউমাকে দেওয়া যায় কী করে? হয়ত কেঁদে-কেটে একসা করবে।

–আচ্ছা তুই যা, আমি দেখছি—

বলে সোজা বউমার ঘরে গেল। বাইরে থেকে যেমন দরজা ভেজিয়ে রেখে দিয়েছিল, তখনও ঠিক তেমনি ভেজানোই রয়েছে।

প্রীতি আস্তে আস্তে নিঃশব্দে দরজার ফাঁক দিয়ে ঘরের ভেতরে উঁকি দিলে। উঁকি দিয়ে দেখলে বউ বিছানার ওপর শুয়ে বালিশের ওপর মুখ গুঁজে পড়ে রয়েছে। মনে হলো বোধ হয় জেগেই আছে।

আস্তে আস্তে প্রীতি ভেতরে ঢুকলো। তারপর বিছানার কাছে গিয়ে বোঝবার চেষ্টা করলে বউমা সত্যিই জেগে আছে না ঘুমোচ্ছে।

বোধ হয় প্রীতির পায়ের আওয়াজ নয়নতারার কানে গিয়েছিল। নয়নতারা মাথা তুলে দেখতেই প্রীতি বললে–তুমি জেগে আছ বউমা?

শাশুড়ীর কথার উত্তরে নয়নতারা ধড়মড় করে উঠে বসলো। বললে—হ্যাঁ–

–একটুও ঘুম হয়নি? তোমাকে ঘুম পাড়িয়েই তো গেলাম। একটু ঘুমোতে চেষ্টা করলে না কেন?

নয়নতারা কোনও উত্তর দিলে না।

প্রীতি বললে–ঠিক আছে বউমা, তুমি একটু বোস, কিছু ভেবো না। আমি এখুনি আসছি। তোমার চা খাওয়া অভ্যেস আছে তো? তুমি চা খাও?

নয়নতারা বললে—হ্যাঁ–

তাহলে আমি চা তৈরি করে নিয়ে আসছি। তারপর একজন ভদ্রলোক এসেছেন। তিনি কালকে আসতে পারেননি, আজকে ভোর থেকে এসে বসে আছেন। তোমার মুখ দেখে আশীর্বাদ করেই চলে যাবেন। তার আগে তোমাকে মুখ-হাত-পা ধুয়ে তৈরি হয়ে নিতে হবে–

তারপর একটু থেমে বললে–তুমি একটু অপেক্ষা করো বউমা আমি এখুনি আসছি, আমি যাবো আর আসবো–

বলে প্রীতি বাইরে চলে গেল। যাবার আগে দরজার পাল্লা দু’টো ভেজিয়ে দিয়ে গেল।

বাইরে গিয়ে নিজের ঘরের দিকে যাওয়ার পথে আবার চৌধুরী মশাই-এর সঙ্গে দেখা। চৌধুরী মশাই হনহন করে আসছিলেন। গৃহিণীকে দেখেই বললেন–ওগো শুনছো, কোথায় ছিলে তুমি?

গৃহিণী বললে–বউমার কাছে, কেন?

–বউমা কেমন আছেন এখন?

–থাকা-থাকি আর কী! সারারাতই ঘুমোয়নি। না-ঘুমিয়ে চোখ দুটো জবাফুলের মত লাল হয়ে রয়েছে। বউমার জন্যে চা তৈরি করতে আসছি। তা শুনছি নাকি বউমার মায়ের খুব অসুখ? বউমার বাপের বাড়ি থেকে নাকি লোক এসেছে-বেয়াই মশাই-এর চিঠি নিয়ে? বেয়ানের নাকি অসুখ?

–তোমায় কে বললে?

–গৌরী। তা অসুখের খবরটা কি আজকেই না-পাঠালে হতো না?

চৌধুরী মশাই হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। গলাটা নিচু করে বললেন–তোমাকে চুপি চুপি বলি। কাউকে যেন এখন বোল না। এই দেখ, বেয়াই মশাই এই চিঠি দিয়েছেন। খুবই দুঃখের খবর। বউমার মায়ের অসুখ নয়, ওটা আমি গৌরীকে ঘুরিয়ে বলেছি। আসলে বউমার মা কাল মারা গেছেন

–অ্যাঁ?

প্রীতির মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়লো। বললে–বলছো কী তুমি? কখন মারা গেলেন? কী হয়েছিল? কালও তো কিছু বলেনি ওদের লোকেরা!

এ বাড়ির যে গৃহিণী তারই যেন সব দায়, নতুন বউ বাড়িতে এলে গৃহিণীর দায়িত্ব কোথায় কমবে, তা নয়। যেন আরো বেড়ে গেল। একে ক’দিন থেকেই ঝঞ্ঝাট চলেছে, তার ওপর আছে ছেলের বেয়াড়াপনা। এখন বউকে সামলাবে, না ছেলেকে সামলাবে, সেই ভাবনাতেই অস্থির। তার ওপর আবার এই নতুন ঝঞ্ঝাট। মাথা ঠিক রাখাই দায় হয়ে পড়েছিল প্রীতির।

প্রীতি বললে–এখন কী করি তাহলে আমি? বউমাকে কথাটা বলি কী করে? খবরটা শুনে তো বউমা একেবারে কেঁদে ভাসাবে। তখন আমি সামলাবো কী করে?

চৌধুরী মশাই বললেন–আমিও তো তাই ভাবছি। কী যে করি আর কার সঙ্গেই বা পরামর্শ করি তাও বুঝতে পারছি না–

–তা বেয়াই বাড়ির লোক কী বলছে?

–ওরা আর কী বলবে? ওরা তো আমাদের খবর দিতে এসেছে। বেয়াই মশাই নিজেও কিছু ঠিক করতে পারেন নি, ওদিকে লোকজন সবাই শ্মশানে গেছে, আর এদেরও পাঠিয়ে দিয়েছেন এখানে। এখন যা করার হয় আমরা করবো।

বলে চৌধুরী মশাই কিছু সমাধান বার করতে না পেরে দু’হাতে মাথার চুলগুলোকে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। যেন মাথার চুলগুলোই সমস্যা সমাধানের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু অত কথা শোনবার বা ভাববারও সময় তখন কারো ছিল না। না প্রীতির না চৌধুরী মশাইয়ের। চৌধুরী মশাই বললেন–ওদিকে আবার প্রাণকৃষ্ণ সা’ মশাই বসে আছে, বউমা তৈরি আছে তো?

প্রীতি রেগে গেল কী করে তৈরি থাকবে? যখন-তখন ওমনি বউ দেখতে এলেই হলো? মানুষের শরীর-গতিক বলে একটা জিনিস নেই?

চৌধুরী মশাই বললেন–না, আমি তা বলছি না। তাঁকে তো আমি বসিয়েই রেখেছি।

প্রীতি বললে–হ্যাঁ, তিনি বসে থাকুন। যখন বউমা তৈরি হবে তখন দেখাবো, তার আগে নয়। আর আমারও তো শরীর-গতিক আছে! সারারাত তো আমিও ঘুমোতে পারিনি। আমার মাথা টলছে, আমিও আর কিছু ভাবতে পারছি না–

বলে গৃহিণী তার নিজের কাজে চলে গেল।

চৌধুরী মশাই খানিকক্ষণ সেখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর তিনিও বারবাড়ির দিকে এক-পা এক-পা করে এগোতে লাগলেন।

.

এ এক অদ্ভূত পরিস্থিতি সেদিন সমস্ত বাড়িটার মধ্যে সৃষ্টি হলো। কেউ জানলো না কোথায় সংসারের কোন্ কোণে একট ফাটল ধরেছে। সবাই উৎসবের আনন্দে উন্মত্ত। যারা নেমন্তন্ন খেয়ে গেছে তারা খাওয়ার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। যারা বউ-এর মুখ দেখে গেছে তারাও বউ এর রূপের প্রশংসায় মুখর। ঐশ্বর্যের প্রাচুর্যের আর বিলাসের জাঁকজমকের ঝলমলানিই তারা দেখলে। তার অন্তরের দুর্যোগের দুর্দশাটির চেহারা তারা উপলব্ধি করতে পারলে না। ওটা চাপা থাক, ওটাকে পুলটিশ দিয়ে ঢেকে রাখো। তোমার বাইরের ঐশ্বর্যটাই তাদের কাছে সত্যি হোক, কেউ যেন তার দারিদ্রটা না দেখতে পায়। ওটা দেখতে পেলে তোমার সম্মান সমৃদ্ধি আর সম্পদের সৌধটা ভেঙে গুঁড়িয়ে চুরমার হয়ে যাবে। তাহলে কেউ আর তোমায় সেলাম করবে না, কেউ তোমাকে হিংসেও করবে না। অথচ সংসারে তোমাকে কেউ হিংসে না করলে তোমার মাথাই বা উঁচু থাকবে কী করে? তুমি যে তাহলে সাধারণ হয়ে যাবে। একেবারে সাধারণ। আর সাধারণ হয়ে বেঁচে থাকা মানেই তো নিচু হওয়া। অর্থাৎ অন্য সবাইয়ের সমান হওয়া, সকলের সঙ্গে একাকার হওয়া।

যখন উৎসবের বাড়িতে আবার সবাই আগেকার বউভাতের জের টেনে সকালবেলা থেকেই খুশির হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দিয়েছে, যখন সবাই বাসি লুচি-বেগুনভাজার ভোজে। বেসামাল, বাড়ির গিন্নির তখন মেজাজ সপ্তমে চড়ে উঠেছে। অথচ কাল রাত্রেও এমন ছিল না। বাড়ির গৃহিণী তখন শান্তিপুরের চওড়া জরির পাড়ওয়ালা শাড়ি পরে সবাইকে অভ্যর্থনা করছে। কিন্তু আজ তারই আবার তখন অন্য চেহারা, অন্য মেজাজ। গৌরী পিসী কী একটা আর্জি জানাতে এসে বকুনি খেয়ে ফিরে গেল।

প্রীতি বলে উঠলো–আমার একটা তো মাথা, আমি কোন দিক সামলাবো শুনি! না খেল তো বয়ে গেল! দরকার নেই কারো খেয়ে। আমার নতুন বউয়ের মুখে এখনও জল পড়েনি, আগে আমি তাই ভাববো না তোদের কথা ভাববো!

গৌরী পিসী বললে–আমি তো সে কথা বলিনি বউদি। বলছি রাঁধুনী বামুনরা জিজ্ঞেস করছে কত ময়দা মাখব–

প্রীতি ঝাঁঝিয়ে উঠলো–কত ময়দা মাখবে তা আমি এত আগে থেকে কী করে বলবো, আমি কি গুনতে জানি যে আগে গুনে বলবো আমার এতজন বাড়িতে খাবে…

এর পরে আর কথা চলে না। কিন্তু শুধু এই-ই শেষ নয়, সামান্য-সামান্য ব্যাপারেই সকাল থেকে বাড়ির গিন্নীর মেজাজটা সকলের নজরে পড়লো।

প্রকাশ মামা এসেই বললে–দিদি, শুনলুম বউমাকে নাকি বাপের বাড়ি পাঠানো হচ্ছে?

দিদি বললে–কেন, কে তোকে বললে?

–তুমি কথাটা সত্যি কি না তাই বলো না! কথা নেই বার্তা নেই ওমনি বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেই হলো? এখনও তো আট দিনও কাটলো না!

প্রীতি বললে–কিন্তু এ-সব কথা কে বললে তোকে?

–কে আবার বলবে, বলেছে জামাইবাবু!

–তা যে বলেছে তাকেই জিজ্ঞেস করগে কেন বউমাকে পাঠানো হচ্ছে।

প্রকাশ মামা বললে–তা হলে যা শুনছি তা সত্যি!

প্রীতি বললে–সত্যি-মিথ্যে আমি জানি নে। আমার অত জানবার সময় নেই বাপু

বলে আবার তার নিজের কাজে চলে গেল। কিন্তু প্রকাশ মামা ব্যাপারটা নিয়ে চুপ করে বসে থাকতে পারলে না। আসলে চুপ করে বসে থাকা তার স্বভাবেই নেই। আবার দৌড়ে গেল চৌধুরী মশাইয়ের কাছে। বললে–-জামাইবাবু, দিদি তো কই কিছু বললে না–

চৌধুরী মশাই তখন নিজের ঝঞ্ঝাট নিয়েই ব্যস্ত। প্রকাশের কথাটা বুঝতে পারলেন না। বললেন–কীসের কী?

–ওই যে আপনি বললেন বউমাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে!

চৌধুরী মশাই চটে গেলেন। বললেন–তা বউমা একবার বাপের বাড়িও যাবে না? বিয়ে হয়েছে বলে কি একেবারে চিরকাল শ্বশুরবাড়িতেই বাঁধা হয়ে থাকবে? বাপ-মার জন্যে একটু মন-কেমন করে না? ছেলেমানুষ বউ, বেশি তো বয়েস নয়–

–কিন্তু এখানে কিছুদিন তো অন্তত থাকবে। একটা হপ্তা থাকুক, আপনি এত তাড়াতাড়ি কেন ফেরত পাঠাচ্ছেন?

চৌধুরী মশাইয়ের কেমন যেন সন্দেহ হলো। বললেন–তা বউমার জন্যে তোমার এত মাথাব্যথা কেন হে? বউমা কিছু বলেছে তোমাকে?

–বউমা? বউমা কেন বলতে যাবে। আপনি কী যে বলেন!

–তা হলে? তা হলে কে তার হয়ে তোমাকে ওকালতি করতে বললে? বলো, কে বললে?

প্রকাশ মামা আর কী বলবে! হঠাৎ বলে ফেললে–সদা! সদা বলছিল—

চৌধুরী মশাই অবাক। বললেন–সদা? সদা তোমাকে বলেছে?

প্রকাশ মামা বললে–হ্যাঁ–

–কী বলেছে সদা?

–বলছিল এরই মধ্যে কেন বাবা বউকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছে, সেই কথা জিজ্ঞেস করছিল।

–জিজ্ঞেস করেছে তোমাকে?

প্রকাশ মামা বললে–তা জিজ্ঞেস করবে না। সবে কাল ফুলশয্যে হয়েছে। এখনও ভালো করে ভাব-ভালবাসা হয়নি, এরই মধ্যে কিনা আপনি বউমাকে কেষ্টনগরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন!

–সদা কোথায়? তাকে একবার ডেকে নিয়ে এসো তো আমার কাছে!

প্রকাশ মামা সদাকে আনতে চলে গেল। আসলে খবরটা কেউই বলেনি প্রকাশ মামাকে। ঘুম থেকে উঠে ঠাকুরদের বলে চা তৈরি করিয়ে নিয়ে খেয়েছিল। পিসে মশাইকেও গিয়ে এক কাপ খাইয়ে এসেছিল। বিরাট বাড়ি। বারবাড়ি, ভেতর বাড়ি। বার বাড়ির উঠোন, ভেতর-বাড়ির উঠোন। কাল বউভাতের রাত্রে সমস্ত বাড়িটা লোকজনে ভরে গিয়েছিল। তারপর কখন কে খেলে, কে না খেলে, সব তদারক করেছে সে। সঙ্গে সঙ্গে পাহারা দিয়েছে সদাকে। যেন কোথাও পালিয়ে না যায় সে। তারপর যখন সব শেষ হলো তার আগেই শোবার ঘরে সদাকে ঢুকিয়ে তবে নিশ্চিন্ত হয়েছে। কিন্তু তখন আর শরীর বইছে না তার। সবাই-ই ক্লান্ত। শেষকালে একটা জায়গা বেছে নিয়ে দু-চোখ বুজতেই ঘুমিয়ে পড়েছে অঘোরে তারপর সকালবেলাই দীনুর সঙ্গে দেখা। তখন বেশ বেলা হয়েছে। চা খেয়ে চাঙ্গা হয়েছে শরীর।

প্রকাশ মামা দীনুকে জিজ্ঞেস করলে কী খবর দীনু? কাল রাত্তিরে কেমন খেলে? দীনুর তখন কথা বলবার সময় ছিল না। বললে–ভালো–

বলেই চলে যাচ্ছিল। কিন্তু প্রকাশ মামা বললে–কী গো, অত সাতাড়াতাড়ি যাচ্ছো কোথায়? কর্তাবাবু উঠেছে নাকি?

দীনু যেতে যেতে বললে–না, কুটুমবাড়ির লোক এসেছে, তাদের খাওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে।

–কুটুমবাড়ির লোক! কেষ্টনগর থেকে এসেছে? কালই তো ফুলশয্যের তত্ত্ব নিয়ে এসে খেয়ে-দেয়ে চলে গেল! আবার আজ সকালেই এসেছে? হঠাৎ এল কেন?

দীনু বললে–বউমাকে নিয়ে যেতে–

–সে কী? বউমাকে নিয়ে যাবে মানে?

আসলে দীনুও ভালো করে কিছুই জানতো না। কুটুমবাড়ির লোক যখন এসেছে তখন বউমাকে নিয়ে যাবার জন্যেই এসেছে। তা ছাড়া আর কী হতে পারে?

–কোথায় তারা? কোথায় কুটুমবাড়ির লোক?

দীনু বললে–এই চণ্ডীমণ্ডপে বসে রয়েছে–

কিন্তু প্রকাশ মামা যখন চণ্ডীমণ্ডপে গেল তখন তারা চলে গেছে।

চৌধুরী মশাই প্রকাশকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন–কী দেখছো?

–আজ্ঞে শুনলুম কুটুমবাড়ির লোক এসেছে বউমাকে নিয়ে যেতে। দীনু বলছিল। কোথায় গেল তারা?

চৌধুরী মশাই বললেন–তারা চলে গেছে–কেন, তোমার কী দরকার?

–তা বউমাকে নিয়ে যাবার কথা আছে নাকি শুনলুম?

চৌধুরী মশাই নিজের মনেই তখনও ভাবছিলেন। কিছুই সিদ্ধান্ত করতে পারেন নি। এত বড় বিপর্যয়টা গেল, কেমন করে সমস্ত দিক সামলাবেন বুঝতে পারছিলেন না। সমস্ত জিনিসটাই যেন জটিল হয়ে আসছিল। এমনই ব্যাপার যে কাউকে বলাও যাবে না কিছু। ছেলে ফুলশয্যার রাত্রে বউয়ের ঘরে রাত কাটায়নি এও যেমন কাউকে বলার নয় তেমনি বউমার মায়ের মৃত্যুর খবরটাও এখন কাউকে বলা যাবে না। বউমার কানে যদি কোনও রকমে কথাটা ওঠে তো সে এক মর্মান্তিক কাণ্ড ঘটে যাবে তখনই।

প্রকাশ মামা তখনও জিজ্ঞেস করলে–তা বউমাকে আপনি সত্যি-সত্যিই পাঠিয়ে দেবেন নাকি?

চৌধুরী মশাই অন্যমনস্ক ভাবেই বলে ফেললেন–হ্যাঁ, তুমি এখন যাও, আমার কাজ আছে–

তখন থেকেই ছটফট করতে লাগলো প্রকাশ মামা। সদাকে খুঁজতে লাগলো। কোথাও নেই সে। ভেতরবাড়িতে দিদির কাছে গিয়েও কোনও সুরাহা হলো না। যাকে দেখে তাকেই জিজ্ঞেস করে–হ্যাঁ রে, সদাকে দেখেছিস? সদা কোথায় গেল?

কেউই দেখেনি সদাকে। যাকে ঘিরে এত কাণ্ড সে এই সময়ে কোথায় পালালো! পিসেমশাই-এর ঘরে গিয়ে দেখলে তিনি তামাক ধরিয়েছেন। প্রকাশ মামা তাকে গিয়েও জিজ্ঞেস করলে–সদাকে দেখেছেন নাকি পিসেমশাই?

কীর্তিপদবাবু অবাক হয়ে গেলেন–সদা? খোকার কথা বলছো? তা সে আবার কোথায় যাবে? আবার পালালো নাকি?

–না, তাকে আমার দরকার।

কীর্তিপদবাবু বললেন–তা দেখ গিয়ে সে হয়ত এখন নতুন নাতবউ-এর কাছে ঘুর ঘুর করছে–সে কি আর আজকে বুড়ো মানুষের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করবে!

তা বটে। প্রকাশ মামা আবার ভেতর বাড়িতে ঢুকলো। দিদি তখন ভাড়ার নিয়ে ব্যস্ত। একেবারে সোজা গিয়ে সদার শোবার ঘরের ভেতর দিকে চেয়ে দেখলে। নতুন বউ চুপ করে বসে ছিল। পাশে গৌরী পিসী তাকে পাথরের বাটিতে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে।

–হ্যাঁ গো গৌরী, আমাদের সদা কোথায় গেল? সদা এখানে আছে?

নয়নতারা মামাশ্বশুরকে দেখেই মাথার ঘোমটাটা একটু টেনে দিলে। গৌরী পিসী বললে–খোকা এখেনে থাকতে যাবে কেন গো, বারবাড়িতে গিয়ে দেখ–দিনের বেলা বর মানুষ কখনও বউ-এর কাছে থাকে?

প্রকাশ মামা সদাকে না পেয়ে আবার অন্য দিকে চলে গেল।

কর্তাবাবুর কাছে খবর গেল প্রাণকৃষ্ণ সা’ মশাই এবার বউ-এর মুখ দেখতে আসতে পারেন। আড়তদার লোক। অনেক টাকা নিয়ে নাড়াচাড়া করা মানুষ। টাকাও যেমন তিনি দেখেছেন, মানুষও দেখেছেন তেমনি অনেক। নতুন বউ খাটের ওপর বসে ছিল; আবার তাকে বেনারসী পরানো হয়েছে। আবার সারা গায়ে গয়না উঠেছে।

গৌরী পিসী বললে–বউমা, তুমি ওই কার্পেটের আসনের ওপর বোস–সা’ মশাই এলে তাকে প্রণাম করবে–

ওদিকে প্রাণকৃষ্ণ সা’ মশাইকে নিয়ে চৌধুরী মশাই ভেতর বাড়িতে এসে পড়েছেন। তাদের কথাবার্তা কানে আসছে। গণ্যমান্য লোক, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলে বৈষয়িক ব্যাপারে ক্ষতি হবে এবাড়ির। যেন আদর-আপ্যায়নের কোন ত্রুটি না হয় কোথাও।

বাইরে এসে চৌধুরী মশাই গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন–গৌরী, বউমা তৈরী? আমরা যাবো?

ভেতরে গৌরী পিসী নয়নতারাকে নিয়ে আসনের ওপর বসিয়ে দিতে দিতে বললে– হ্যাঁ, আসুন–

কিন্তু বসতে গিয়েই একটা কাণ্ড ঘটে গেল। পাথরের জলখাবারের গেলাসটা নয়নতারার পায়ে লেগে উল্টে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে গেলাসটা ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে গেল। গিয়ে ঘরের মেঝেয় সেই টুকরোগুলো চারদিকে ছড়িয়ে গেল। গেলাসের জলটুকুও ছড়িয়ে ছিটিয়ে চারদিকে জলে জলময় হয়ে গেল।

চৌধুরী মশাইএর সঙ্গে প্রাণকৃষ্ণ সা’ মশাই তখন ঘরে ঢুকে ওই দৃশ্যের সামনে দাঁড়িয়ে হতবুদ্ধি হয়ে গেছেন।

কারোর মুখেই তখন কোনও কথা নেই।না  নয়নতারার, না গৌরী পিসীর। দুজনেরই মনে হলো যেন চরম সর্বনাশ ঘটে গেল তাদের চোখের সামনে। যেন আজকের সমস্ত অনুষ্ঠানের কেন্দ্র চরিত্র নয়নতারারও অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ সমস্ত কিছু ভেঙেচুর ছত্রখান হয়ে গেল হঠাৎ।

বাইরে প্রীতির কানে গেল শব্দটা। প্রীতি বুঝতে পারলে ঘরের ভেতর যেন কী একটা ভারি জিনিস হাত থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে গেল।

–কী যেন ভাঙলো না?

বেহারী পালের বউ সকালবেলাই এসেছিল। সেও বললে–ওমা, কী ভাঙলো ঘরের ভেতরে?

প্রাণকৃষ্ণ সা’ মশাই ওই পরিস্থিতির মধ্যে আর দাঁড়ালো না। যা সঙ্গে করে এনেছিল সেটা তাড়াতাড়ি নতুন বউএর হাতে তুলে দিয়েই বিদায় নিতে পারলে যেন বাঁচে। যেন তার অপরাধেই দুর্ঘটনাটা ঘটলো।

মাঝখানে ভাঙা পাথরের টুকরোগুলো, আর জল। আর একপাশে নতুন বউ দাঁড়িয়ে, আর একপাশে প্রাণকৃষ্ণ সা’ মশাই। নতুন বউ দু’হাত পেতে উপহারটা নিয়ে সা’ মশাইকে নমস্কার করতে যাচ্ছিল। কিন্তু সা’ মশাই বলে উঠলো–থাক, থাক, আমি চলি–

সত্যিই, তার অপরাধ-বোধ তাকে আর সেখানে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকতে দিলে না। পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন চৌধুরী মশাই। তিনিও ঘটনার আকস্মিকতায় তখন স্তব্ধ হতচকিত।

–চলো বাবাজী, চলো—

দুজনেই তাড়াতাড়ি ঘটনাস্থল থেকে বাইরে বার বাড়ির দিকে চলে গেলেন। তাঁরা চলে যেতেই প্রীতি ঘরে ঢুকলো। চোখের সামনে যে দৃশ্য তার নজরে পড়লো তা দেখে তার মুখ দিয়ে তখন আর কোনও কথা বেরোল না।

নতুন বউ তখনও তার কার্পেটের আসনটার ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। তার সমস্ত শরীর তখন থরথর করে কাঁপছে। ভাঙা পাথরের গেলাসের টুকরোগুলো যেন তখনও তার বুকে গিয়ে ফুটছে। তার যন্ত্রনাতেই যেন সে ছটফট করতে আরম্ভ করেছে।

বেহারী পালের বউও পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল।

বললে–ওমা, এ কী, পাথরের গেলাসটা ভেঙে গেল নাকি?

কিন্তু কে আর তখন তার কথার উত্তর দেবে! সকলেই ঘটনার আকস্মিকতায় যেন মুহ্যমান।

প্রীতি চাইলে গৌরীর দিকে। বললে–হ্যাঁরে, গেলাসটা ভাঙলি?

গৌরী বললে–বউমার পায়ে লেগে ভেঙে গেল বৌদি–

ঝাঁঝিয়ে উঠলা প্রীতি। বললে–বউমার পায়ে লেগে ভেঙে গেল, তো তুই কোথায় ছিলি? তুই দেখতে পাসনি? তুই কি চোখের মাথা খেয়েছিলি? তুই গেলাসটা একপাশে সরিয়ে রাখতে পারিসনি?

গৌরী বললে–সা’ মশাই আসছিল তাই আমি তাড়াতাড়ি বৌমাকে আসনের ওপর বসাতে গেলুম…

–তা যখন দেখলি পায়ের সামনে গেলাসটা রয়েছে তখন ওটা সরাতে পারলি নে? দিন দিন তোর কী হচ্ছে কী? আজকের এই দিনে পাথরের জিনিস কি ভাঙা ভালো হলো?

বেহারী পালের বউও পেছনে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। বললে–-বেস্পতিবারের বারবেলায় ব্যাপারটা ভালো হলো না বউ।

কথাটা সকলেরই মনে গিয়ে লাগলো। এমনিতেই পাথরের জিনিস। তার ওপর বৃহস্পতিবার। একটা অজ্ঞাত আতঙ্কে সকলের বুকই ধকধক করে উঠলো। এ যে কত বড় অমঙ্গল সে-কথাটা যেন কারো হৃদয়ঙ্গম হতে আর বাকি রইলো না। সকলেরই মনে হলো এত বড় দুর্ঘটনা যেন ভাবী কোনও অমঙ্গলের সূচক। অথচ এর কী প্রতিবিধান তাও সেই মুহূর্তে কারো যেন মাথায় এলো না।

বাইরে এসে বেহারী পালের বউ বললে–কাজটা ভালো হলো না বউ, নতুনবউ বাড়িতে এসেই পা দিয়ে পাথরের গেলাসটা ভেঙে ফেললে এটা কিন্তু ভালো না।

প্রীতির তখন চোখ দুটো ছলছল করে উঠেছে। বললে–আমি কত দিক সামলাই বলো তো মাসীমা? আমার কি একটা জ্বালা? আর মানুষদেরও আক্কেল কী রকম দেখ, কালকে বউভাত গেল, কাল আসতে পারেনি বলে আজ এই অসময়ে আসতে হয়? আসবার আর সময় পেলে না কেউ? বউ তো পালিয়ে যাচ্ছে না বাড়ি থেকে! আর একটু বেলা করে এলে কী এমন ক্ষেতি হতো?

বেহারী পালের বউ বললে–তা কী আর করবে বলল, মঙ্গলচণ্ডীতলায় গিয়ে পূজো দিয়ে আসতে হবে।

–পূজো?

বেহারী পালের বউ বললে–ওমা, তা পূজো দেবে না? অন্য কেউ হলে তত কিছু না করলেও চলতো, কিন্তু নতুন বউ বলে কথা! তোমার নতুন বউকেও নিয়ে যেতে হবে।

–কিন্তু মাসীমা, ওদিকে আর এক বিপদ হয়ে গেছে আমার।

বলতে বলতে প্রীতির গলাটা যেন বন্ধ হয়ে এল। বললে–কাউকে যেন বোল না মাসীমা। তোমার দুটি পায়ে পড়ি এখন কাউকে বোল না। বউমার কানে গেলে আবার কেঁদেকেটে একসা করেবে

বেহারী পালের বউ গোপন কথার ইঙ্গিত পেয়ে আরো কৌতূহলী হয়ে উঠলো।

বললে–আমার কাউকে বলতে বয়ে গেছে, কথাটা কী শুনি না?

–তোমাকে আমার ঘরের লোক মনে করি বলেই বলছি, এখনও কেউ জানে না..

–আরে কথাটা কী তা-ই বলো না?

–বউমার মা মারা গেছে।

–ওমা, সে কী? কবে? কখন? কোত্থেকে খবর এল?

প্রীতি বললে–এই সকালবেলা বেয়াই মশাই খবর পাঠিয়েছেন। এখন আমি যে কী করি, কার সঙ্গে পরামর্শ করি তাই ভাবছি। বউমা জানে না কথাটা। পুরুতমশাইকে ডেকে পাঠানো হয়েছে, কর্তারা সে-সব করছেন। এখন বাড়ির মধ্যে আমি কী করবো তা বুঝতে পারছি নে!

বেহারী পালের বউ বললে–বলেছ ভালোই করেছ বউমা। তাহলে এক কাজ করো। আজকে আর মাছ-টাছ কিছু খেতে দিও না বউমাকে। নিরিমিষ খাক, তারপর চতুর্থী করার ব্যবস্থা করতে হবে

–কিন্তু ওরা তো বৌমাকে নিয়ে যেতে এসেছিল। তা বাপের বাড়িতে তো মা ছাড়া আর দ্বিতীয় মেয়েমানুষ কেউ নেই। বেয়াইমশাই খুবই ভেঙে পড়েছেন। আমি ভাবছি বউমাকে কেষ্টনগরে পাঠিয়ে দিই।

বেহারী পালের বউ ভেবে-চিন্তে বললে–তা তাই-ই দাও বরং–

তারপর যেন কী ভাবলে! বললে–একে মা মারা যাওয়ার খবর এলো, তার ওপর বেস্পতিবারে পা দিয়ে পাথরের জিনিস ভাঙলে, এসব তো ভালো লক্ষণ নয় বউমা, এতে কারোর ভালো হবে না, তোমার ছেলের পক্ষেও ভালো নয়। অবিশ্যি তোমার ছেলের একটু কষ্ট হবে বটে। কদিন বউকে ছেড়ে খোকা থাকতে পারবে তো?

প্রীতি বললে–আমার ছেলের কথা ছেড়ে দাও

–তা ছেলে যদি তোমার রাগ না করে তো বউমা সেখানেই থাক। তারপর শ্রাদ্ধ শান্তি হয়ে গেলে, তখন না হয় ফিরবে। এই সময়ে বাপের কাছে থাকলে বাপও মনে একটু শান্তি পাবে–আর না-হয় ছেলেকেও বউ-এর সঙ্গে সেখানে পাঠিয়ে দাও। ছেলে যদি বউকে ছেড়ে থাকতে না পারে তো তাই-ই না হয় করো–

প্রীতি কিছু ভাঙলে না। মুখে বললে–দেখি, কী করি কিন্তু বউমাকে খবরটা আমি কী করে দেব তাই ভাবছি মাসীমা–বউমা তো এখনও কিছু জানে না–

তা আমি গিয়ে খবরটা দেব?

প্রীতি বললে–না মাসীমা, আমি বলি এখন থাক। কর্তাও বলছিলেন খবরটা এখন বউমাকে দিয়ে দরকার নেই। শেষকালে কান্নাকাটি করলে আমি আর বউমাকে সামলাতে পারবো না–

–তা তোমার ছেলে কী বলছে? সদা?

–ছেলের কথা তুমি ছেড়ে দাও মাসীমা। সে শুধু বিয়ে করেই খালাস। সে কারো সাতেও নেই পাঁচেও নেই। ভোরবেলা থেকে কোথায় যে সে ঘুরছে কেউ তার মুখও দেখেনি। খবরটা যে তাকে বলবো, তা তার দেখা পেলে তবে তো?

বেহারী পালের বউ বললে–তাহলে কর্তা যেমন বলেন সেই রকমই করো তুমি বউমা। ছেলের কানে গেলে যদি আবার সে বউমাকে বাপের বাড়ি যেতে না দেয়!

হঠাৎ চৌধুরী মশাই ভেতর বাড়িতে এলেন। প্রীতি কাছে এগিয়ে গেল। গলা নিচু করে জিজ্ঞেস করলে, কী খবর ওদিকের?

চৌধুরী মশাই বললেন–সা’ মশাইকে বিদেয় করে দিয়ে এলুম। লোকের আক্কেল দেখে অবাক। আর সময় পেলে না, এই অসময়ে এসে হাজির! পাথরের গেলাসটা ভেঙে গেল মাঝখান থেকে! দেখ দিকিন কী অমঙ্গলের ব্যাপার

–সে আর ভেবে কী হবে! কিন্তু পুরুত মশাই কী বললেন? বউমা আজ নিরিমিষ খাবে তো?

–তা সব জেনে-শুনে আর আঁশ খেতে দেওয়া যায় কী করে বলো!

–কিন্তু কেষ্টনগরে যাওয়া?

চৌধুরী মশাই বললেন–পুরুত মশাই তো বলছেন সেখানে পাঠিয়ে দিতে! দুদিন পরে তো পাঠাতেই হতো সেখানে। না হয় একদিন আগেই গেল! আমি ভাবছি সেইটেই ভালো হবে। খোকা যে কাণ্ড করছে, আজকেও যদি খোকা বউমার ঘরে না শোয় তো তাতেও বউমার মনে সন্দেহ হবে। তার চেয়ে বরং বউমাকে সেখানে পাঠিয়ে দেওয়াই ভালো হবে–

–সঙ্গে কে যাবে?

চৌধুরী মশাই বললেন–খোকা গেলেই ভালো হতো। কিন্তু কোথায় সে?

–থাকলেই কি সে সেখানে যেত? খোকা যদি না যায় তো প্রকাশ আর গৌরী সঙ্গে যাক। এখানকার আমাদের তরফের কেউ গেলেই ভালো হতো।

–কিন্তু সঙ্গে খোকা গেলেই সব চেয়ে ভালো হয়। তাহলে আর কারো যাবার দরকার হয় না।

প্রীতি বললে–তা দেখ না তাকে খুঁজে। যদি রাজি করাতে পারো–

চৌধুরী মশাই বললেন–সে না-হয় আমি দেখছি। কিন্তু তুমি ততক্ষণে বউমাকে তৈরি করিয়ে রাখো। খাইয়ে-দাইয়ে সাজিয়ে-গুজিয়ে রেখে দাও। বেরোলে এখুনি বেরোতে হবে। রজব আলীকে বলেছি গাড়ী তৈরি করতে। বেলাবেলির ট্রেনে পাঠানোই ভালো, প্রকাশ আর গৌরীকেও আমি তৈরি হতে বলেছি

বলে তিনি যেমন এসেছিলেন আবার তেমনি বারবাড়ির দিকে চলে গেলেন।

.

হায় রে কপাল! তখনও নয়নতারা জানতো না যে যে বাড়ি থেকে তাকে একদিন চিরকালের মত চলে যেতে হবে এই-ই বুঝি তার সূত্রপাত। এই ফুলশয্যার রাতই বুঝি তার জীবনের এক অমোঘ সূচনা। নইলে অমন করে পাথরের গেলাসটা পায়ে লেগে ভেঙে গেলই বা কেন? অথচ এসব কথা যখন মা বলেছে তখন বিশ্বাসই করে নি সে। ভেবেছে মা’র যত সব মনের কুসংস্কার। কোথায় কত দূরে রইল তার মা, আর কোথায় চিরকালের মত বিচ্ছিন্ন হয়ে সে চলে এল নবাবগঞ্জে। আর এই নবাবগঞ্জেই হয়ত তাকে সারাজীবন কাটাতে হবে।

সারাজীবন এখানে কাটাবার কথাটা মনে হতেই কেমন যেন আতঙ্কে শিউরে উঠলো সে। কাল রাত থেকেই সে ভয়ে কাঁপছে। কীসের ভয়? তার তো এখানে ভয় পাবার কোনও কারণ নেই! তার শাশুড়ী মানুষটা তো ভালো। শ্বশুরও তো ভালো। আর…

আর সেই তার স্বামীর কথাটা ভাবতে গিয়েই যেন সব কিছু তার কাছে অস্পষ্ট হয়ে গেল! কে সে? কী রকম মানুষ! কী রকম স্বভাবচরিত্র সে মানুষটার! শুধু বিয়ের সময় হাতে তার হাতের ছোঁয়া লেগেছিল কিছুক্ষণ। কেষ্টনগরের সবাই-ই বলেছিল–ওরকম বর নাকি সাধারণত দেখা যায় না।

আসবার সময় নয়নতারা যখন খুব কাঁদছিল তখন মা নিজের আঁচল দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলেছিল–কাঁদিস নে মা, তোর কীসের দুঃখু, তুই যেমন স্বামী পেয়েছিস অমন স্বামী ক’জনের আছে বল তো! কাঁদিস নে–

তা সত্যি, বিয়ের দিন বাপের বাড়িতে একে একে সবাই তাকে এই কথাই বলে গেছে। যাদের বিয়ে হয় নি, কিম্বা যাদের বিয়ে হয়েছে সবাই তার বরের রূপ দেখে হিংসে করেছে।

হঠাৎ গৌরী পিসী ভাতের থালা নিয়ে ঘরে ঢুকলো। বললো–এই নাও বউমা ভাত খেয়ে নাও

নয়নতারা অবাক হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলে–এত সকাল-সকাল যে ভাত দিচ্ছ পিসীমা? কটা বাজলো এখন?

গৌরী পিসী বললে–সকাল-সকাল খেয়ে নাও, তুমি আবার কেষ্টনগরে যাবে যে আজ

–কেষ্টনগরে? আজকে? কেন?

গৌরী পিসী বললে–তোমার শ্বশুরের ইচ্ছে যে তোমার বাবা-মার সঙ্গে তুমি একবার দেখা করে আসবে। তুমি নাকি আসবার সময় সেদিন খুব কেঁদেছিলে, তাই। মাকে দেখতে তোমার খুব ইচ্ছে করছে না?

নয়নতারা বললে–হ্যাঁ, খুব ইচ্ছে করছে পিসীমা। মা’র জন্যে খুব মন-কেমন করছে আমার। কিন্তু তোমরা কী করে তা জানতে পারলে? আমি তো তোমাদের কিছু বলি নি!

গৌরী পিসী বললে–আহা, মন কেমন করবে না? মা কি যেমন-তেমন জিনিস বউমা?

নয়নতারা বললে–জানো পিসীমা, আমি কালকে রাত্তিরে মাকে স্বপ্ন দেখেছি। মা যেন আমার বউভাতের দিনে এই নবাবগঞ্জে এসেছে, এসে আমাকে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করছে। আমি জিজ্ঞেস করলুম-মা, তুমি যে খবর দিয়েছিলে আসবে না! তবে এলে কেন? শুনে মা কী বললে জানো? মা বললে–তোর বউভাতের দিনে আমি না এসে কি থাকতে পারি রে? তারপর হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল। চেয়ে দেখি আমি বিছানায় শুয়ে আছি, আমার চোখ দুটো জলে ভেসে গেছে। কখন কেঁদেছি মনেও নেই

গৌরী পিসী বললে–তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও বউমা, দেরি হয়ে যাবে আবার। আজকে কিন্তু মাছ নেই, খেতে পারবে তো?

–মাছ নেই কেন পিসীমা?

গৌরী পিসী বললে–আজকে তোমার মাছ খেতে নেই–

–কেন পিসীমা, আজকে কী?

গৌরী পিসী সেকথার উত্তর না দিয়ে বললে–তোমার জন্যে আর একটু দুধ এনে দিই বউমা–

খেতে খেতে নয়নতারা কেবল মার কথাই বলতে লাগলো। মা কেমন চমৎকার রান্না করে, মা কেমন সেলাই করে, মা কেমন কথা বলে। মার কথা বলবার লোক পেয়ে নয়নতারা যেন বেঁচে গেল।

গৌরী পিসী বললে–তোমার শাশুড়ীও খুব ভালো বউমা, তোমার শাশুড়ীর মত মানুষও হয় না–

নয়নতারা বললে–মাও আমাকে তাই বলেছে। বলেছে–এখন থেকে শাশুড়ীকেই মায়ের মত ভক্তি করবি–

গৌরী পিসী বললে–ও কটা ভাত দুধ দিয়ে খেয়ে নাও বউমা, আমি একটা সন্দেশ আনছি।

গৌরী পিসী বাইরে চলে গেল। কেষ্টনগরে যাওয়ার কথা ভাবতেই নয়নতারার সব দুঃখ যেন কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। আবার যেন নতুন করে বেঁচে উঠলো সে। আবার যেন সে নিজের সত্তা ফিরে পেলে। বেঁচে থেকে যে এত সুখ তা যেন সে এতদিন এমন করে আর কখনও উপলব্ধি করতে পারে নি। পাখিদের মত যদি পাখা থাকতো তার তাহলে বেশ উড়ে যাওয়া যেত। কেষ্টনগরে যেতে তাহলে আর তার এত দেরি হতো না।

হঠাৎ যেন বাইরে তার সেই মামাশ্বশুরের গলা শোনা গেল।

–হ্যাঁ গো গৌরী, বউমা হঠাৎ বাপের বাড়ি যাচ্ছে কেন গো? কী হয়েছে?

গৌরী পিসীর গলা শোনা গেল তারপর। গৌরী পিসী বললে–অত জোরে কথা বোল মামাবাবু, একটু আস্তে, বউমার কানে যাবে। বউমার কানে গেলে অনত্থ বাধবে–

–কেন, কী হয়েছে? বউমার কানে গেলে ক্ষতি কী?

গৌরী পিসী বললে–বউমার মা যে মারা গেছে–

–অ্যাঁ? মা মারা গেছে? সদার শাশুড়ী? কীসে মারা গেল? কখন খবর এল? আমি তো কিছুই টের পাই নি, আমাকে তো কেউ কিছু বলে নি–

গৌরী পিসী বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো–আঃ, বলছি আস্তে! বউমা ঘরের ভেতরে রয়েছে, শুনতে পাবে যে–

কিন্তু ততক্ষণে যা হবার তা হয়ে গেছে। গৌরী পিসী ঘরে ঢুকতেই দেখলে বউমার চোখ দুটো কেমন বিহ্বল হয়ে শূন্যের দিকে চেয়ে রয়েছে। হয়ত এখুনি ঢলে পড়ে যাবে।

গৌরী পিসী তাড়াতাড়ি পাশে গিয়ে তাকে ধরে ফেললে। বললে–কী হলো বউমা, তোমার শরীর খারাপ হলো নাকি!

নয়নতারার মুখে যেন তখন কথা বলবারও শক্তি নেই। কোনও রকমে বলে উঠলো– আমার মা মারা গেছে? তোমরা তো আমাকে কিছু বলো নি পিসীমা…

বলতে বলতে নয়নতারা সেইখানে বসেই ভেঙে পড়লো।

.

সংসারে যার জীবনের যাত্রাপথের সূচনাটাই মৃত্যু দিয়ে অভিষিক্ত হলো তার শেষ পরিণতি যে কোথায় কেমন করে কোন্ চোরাবালিতে গিয়ে পূর্ণচ্ছেদ টানবে তা যেমন তার সৃষ্টিকর্তাও বলতে পারে না, তেমনি কোনও ইতিহাস-লেখকও বলতে পারে না। তবু তো সৃষ্টির কাজ ব্যাহত হয় না সৃষ্টিকর্তার, আর লেখককেও তাই লিখে যেতে হয়। কারণ বিন্দু বিন্দু রক্ত দিয়ে যেমন একজন মানুষ, তেমনি এক একটি মানুষ নিয়েই সমাজ দেশ ভূগোল আর ইতিহাস। যাকে সেই ইতিহাস সৃষ্টি করতে হয় তাকে কখনও বা মধুর আবার কখনও বা নিষ্ঠুর হতে হয়। কারো মনোরঞ্জন করার দায় তার নেই, আবার কারো মুখ চাওয়ার দায়িত্ব নিলেও তার চলে না। সে যে নিষ্ঠুর, নিরাসক্ত, নির্বিকার!

অন্তত নয়নতারার সেদিন সেই কথাই মনে হয়েছিল। কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে সে? কার কাছে সে প্রতিকার প্রার্থনা করবে? মাকে সে দুদিন আগেও দেখেছে। দুদিন আগেও মা তাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিয়েছে। মা বলেছে–দেখিস মা, আসছে বেস্পতিবারেই আবার তোকে নিয়ে আসবো, বেয়াই মশাইকে উনি বলে দিয়েছেন–

বৃহস্পতিবার মার কাছে যাবার প্রতীক্ষাতেই সে ছিল। ভেবেছিল এটা এই শ্বশুরবাড়িটা তার সাময়িক আশ্রয়, কেষ্টনগরের বাড়িটার আশ্রয়ই তার শাশ্বত। সেখানে সে আবার ফিরে যাবে। আবার তার বাবা-মাকে ঘিরে তার জীবনের পরিক্রমা আগের মতই সুচারুভাবে চলবে।

কিন্তু হঠাৎ অদৃশ্য দেবতার কোন অমোঘ নির্দেশে তার সব কিছু এমন হঠাৎ বানচাল হয়ে গেল।

নয়নতারা মনে মনে ভাবতে চাইলে হয়ত সে যা শুনেছে তা ভুল। ভাবতে ভালো লাগলো যে আসলে তার মা আছে। হে ভগবান, তার ভাবনাটাই যেন সত্যি হয়। যেন সে কেষ্টনগরে গিয়ে মাকে দেখতে পায়। তাহলে মাকে গিয়ে সে বলবে–মা, আমি আর নবাবগঞ্জে যাবো না, আমি এবার এই কেষ্টনগরে তোমার কাছেই থাকবো–

মা তাকে হয়ত বলবে–না মা, ও কথা বলতে নেই, এখন তোমার বিয়ে হয়েছে, এখন থেকে স্বামীর ঘরই তোমার ঘর, স্বামীই তোমার আপন, স্বামীই তোমার সব–

আশ্চর্য! কে জানতো এই স্বামীই তার কাছে একদিন সব চেয়ে পর হয়ে যাবে, সব চেয়ে দূর হয়ে যাবে। একদিন যার হাতে নয়নতারাকে তুলে দিয়ে তার মা সব চেয়ে নিশ্চিত বোধ করেছিল সেই সদানন্দই তাকে এমন করে দূরে ঠেলে দেবে–এ কথা কি তারা-ই কোনও দিন কল্পনা করতে পেরেছিল!

কালীকান্ত ভট্টাচার্য মশাই জীবন আরম্ভ করেছিলেন বড় মহৎ আদর্শ নিয়ে। তাঁর আদর্শ ছিল ছেলে মানুষ করবার। শুধু একজন ছেলে নয়, হাজার হাজার ছেলে। আর শুধু ছেলেই নয়, ভেবেছিলেন ছেলে মেয়ে সবাইকে তিনি মানুষ করে যাবেন নিজের আদর্শের মত করে। তিনি বলতেন–জীবনে পাওয়াটাই বড় কথা নয় নিখিলেশ, পেয়ে যেমন অনেকের হারিয়ে যায়, তেমনি হারিয়েও আবার অনেকে অনেক কিছু পায়। তথাগত বুদ্ধদেব রাজার ঐশ্বর্য হারিয়ে সম্রাটের ঐশ্বর্য পেয়েছিলেন। তাকেই বলে সত্যিকারের পাওয়া।