- বইয়ের নামঃ বেগম মেরী বিশ্বাস
- লেখকের নামঃ বিমল মিত্র
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. আদিপর্ব
বেগম মেরী বিশ্বাস – উপন্যাস – বিমল মিত্র
আদিপর্ব
প্রথমে বন্দনা করি দেব গণপতি।
তারপরে বন্দিলাম মাতা বসুমতি ॥
পুবেতে বন্দনা করি পুবের দিবাকর।
পশ্চিমেতে বন্দিলাম পাঁচ পয়গম্বর ॥
উত্তরেতে হিমালয় বন্দনা করিয়া।
দক্ষিণেতে বন্দিলাম সিন্ধুর দরিয়া ॥
সর্বশেষে বন্দিলাম ফিরিঙ্গি কোম্পানি।
কলিযুগে তরাইল পাপী তাপী প্রাণী ॥
দেওয়ান গেল ফৌজদার গেল গেল সুবাদার।
কোম্পানির সাহেব আইল কলির অবতার ॥
ধর্ম কর্ম ইষ্টিমন্ত্র হইল রসাতল।
হরি হরি বল রে ভাই, হরি হরি বল ॥
এখানেই শেষ নয়, আরও আছে। কোন কালে কোন এক নগণ্য গ্রাম্য কবি ছড়া লিখতে গিয়ে সকলকে বন্দনা করে নিজের খ্যাতি অক্ষয় করতে চেয়েছিল। সবটা পাওয়া যায় না। ছেঁড়াখোঁড়া তুলোট কাগজ। গোটা গোটা ভুষোকালিতে লেখা অক্ষর। পড়বার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু মনটা একেবারে দু’শো-তিনশো বছর পেছিয়ে চলে যায়। মনে হয়, যেন চোখের সামনে সব দেখছি।
শুধু যুগ নয়, মানুষগুলোও সব আলাদা। সেই খালি গা, মালকোঁচা বাঁধা কাপড়। কারও হাতে লাঠি, কারও গায়ে চাদর। মাথায় কারও আবার টিকি, নইলে ব্রাহ্মণ বলে আপনাকে চিনতে পারব কী করে ঠাকুরমশাই?
আমরা কি আজকের মানুষ নাকি হে? সাতশো বছর আগের আমাদের পরিচয় আমরাই আগে জানতাম না। জানতে পারলাম প্রথম ইবন বতুতার বৃত্তান্ত থেকে। খোরাসানবাসীরা এই বাংলাদেশকে বলত–দুজাখস্ত-পুর-ই-নি-আমত। মানে সুখের নরক। এমন সুখের নরক নাকি সেযুগে আর ভূ-ভারতে কোথাও ছিল না। চূড়ান্ত সস্তাগণ্ডার দেশ। যত ইচ্ছে খাও দাও, ফুর্তি করো। বেশি পয়সা খরচ নেই। বছরে বাড়িভাড়া মাত্র আট দিরাম, মানে বারো আনা। বাজারে চাল-ডাল তেল-নুনের সঙ্গে রূপসি মেয়েও বিক্রি হচ্ছে। বেশি দাম পড়বে না। একটা মোহর দিলেই তোমার কেনা বাদি হয়ে রইল। তোমার বাড়িতে এসে তোমার কাজকর্ম করবে, তোমার গা-মাথা-পা টিপে দেবে। দরকার হলে তোমার বিছানাতেও শোবে। বড় ধর্মভীরু জাত আমরা। আমাদের ওপর দিয়ে তাই কত রকম ঝড়ঝাপটা গেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী।
ইবন্ বতুতা লিখেছেন–have seen no country in the world where provisions are cheaper than this.
মার্কো পোলো, ভাস্কোডাগামা সবাই বাংলাদেশ সম্বন্ধে লিখেছে বটে, কিন্তু সশরীরে আসেনি কেউ এখানে। কিন্তু তাদের লেখা পড়ে এখানে একবার যারা এসেছে তারা আর ফিরে যায়নি। এমন সোনার দেশ কোথায় পাবে শুনি?
এখানকার শুয়োরের মাংস খেয়ে পর্তুগিজরা তো আর নড়তেই চায় না। বলে–ভেরি গুড হ্যাম। এখানকার তাঁতিদের হাতে বোনা কাপড় দেখে বলে–আঃ, ভেরি ফাইন ক্লথ। বাদশা জাহাঙ্গির এই কাপড় পরেছে, বেগম নুরজাহানও এই কাপড় পরেছে। এখান থেকে কাপড় চালান গেছে রোমে, প্যারিসে, বার্লিনে। এবার সোরা। কামান দাগতে গেলে বারুদ লাগে। আর সোরা না হলে আবার বারুদ হয় না। সেই সোরা কিনতে এল ফিরিঙ্গি কোম্পানি। ওলন্দাজ, ফরাসি, পর্তুগিজ আর ইংরেজদের দল।
তারা বললে–আমরা এখানে কারবার করতে এসেছি জাঁহাপনা–আমাদের মেহেরবানি করুন–
বাংলার লাটসাহেব হয়ে এসেছিল বাদশার ছেলে সাহ্ সুজা। সুজার মেয়ের অসুখ। সে আর কিছুতে সারে না। হাকিম হার মেনেছে। কবিরাজও হার মেনেছে। শেষকালে সাহেব ডাক্তারের ডাক পড়ল। ডাক্তার গেব্রিয়াল ব্রাউটনকে ডেকে পাঠানো হল রাজমহলে। বাদশা সাহজাহানের মেয়েকে সারিয়েছে। আর বাদশাজাদার মেয়েকে সারাতে পারবে না! তা কি হয়?
তা সেই যে বাদশার মেয়ের রোগ সারল সেই তখন থেকেই শুরু হল ফিরিঙ্গি পত্তন। বাংলা কি আর ছোটখাটো দেশ গো? না বাঙালিরাই ছোটখাটো জাত। সেই সব অঞ্চলের যত নবাবি আমলা ছিল সকলের কাছে গিয়ে হাজির হল বাদশাহি ফার্মান। ফার্মানে লেখা হল–
জমিদার, চৌধুরী, তালুকদার, মাস্কুদ্দেম, রেকায়া প্রভৃতি
বরাবরেষু–
বাদশার ফার্মান অনুসারে এতদ্বারা সকলকে জ্ঞাত করা যাইতেছে যে, এখন অবধি ইংরাজ কোম্পানি যে-সকল পণ্য জলে ও স্থলে আমদানি ও রপ্তানি করিবে তাহার জন্য কোনও প্রকার শুল্কের দাবি যেন কোনও ইংরাজ কুঠিতে না করা হয়। ইংরেজরা রাজ্যের যে-কোনও স্থানে তাহাদের যে-কোনও পণ্য লইয়া যাইবে বা দেশীয় পণ্য কিনিয়া আনিবে, তাহার শুল্ক কম হইয়াছে বলিয়া যেন তাহা খুলিয়া দেখা বা বলপূর্বক বাজেয়াপ্ত করা না হয়। তাহারা সকল স্থানে বিনা শুল্কে অবাধে বাণিজ্য করিবে। এতদিন তাহাদের নিকট হইতে বন্দরে জাহাজ নোঙর করিয়া থাকার জন্য যেরূপ মাশুল আদায় করা হইত এখন যেন আর তাহাদিগকে সেরূপ না করা হয়। ইত্যাদি ইত্যাদি–
অনেক পুরনো কথা, অনেক পুরনো কাহিনী লেখা রয়েছে তুলোট কাগজের পাতায়। বেশ ভারী পুঁথি। অর্ধেকের ওপর পোকায় খাওয়া, ধুলো জমে জমে ময়লা হয়ে নোনা ধরে গেছে। খেরো খাতায় বাঁধানো ছিল পুঁথিখানা। কার লেখা, পুঁথির নাম কী, তা জানবারও উপায় নেই।
আমি জিজ্ঞেস করলাম–এ পুঁথি আপনি কোথায় পেলেন?
বৃদ্ধ ভদ্রলোক। এককালে অবস্থা ভাল ছিল। বিরাট বাড়ি। সরু-সরু পাতলা-পাতলা নোনা-ধরা ইট। একসঙ্গে পুরো বাড়িটা হয়নি। পুরুষানুক্রমে এক মহলের পর আর এক মহল উঠেছে। একদিকটা নতুন করে মেরামত করা হয়েছে, কিন্তু অন্য দিকের শরিকের হয়তো টাকা নেই তাই সেদিকটা ভেঙে ভেঙে পড়ছে। এক ঘরে রেডিয়ো বাজছে। ইলেকট্রিক লাইটের রোশনাই। আবার ঠিক তার পাশের ঘরটাতেই অন্ধকার ঘুরঘুট্টি। কেরোসিন তেলের হারিকেন জ্বলছে টিমটিম করে। সেই টিমটিমে আলোতেই বাড়ির ছেলেরা মাদুরের ওপর বসে দুলে দুলে নামতা পড়ছে। বাড়ির একতলার ঘরগুলো রাস্তা থেকেও নিচু। যেদিন গঙ্গায় বান ডাকে সেদিন জল ঢুকে পড়ে বাড়ির একতলায় শোবার ঘরে। সেই জলের সঙ্গে কখনও কখনও সাপও ঢোকে। ভাঙা ইটের দেয়াল থেকে কাঁকড়া বিছে বেরিয়ে পড়ে। তখন আর একতলার ঘরে কারও থাকা সম্ভব হয় না। বাক্স-প্যাটরা বিছানা নিয়ে পাশের কোনও শরিকের ঘরে গিয়ে তাদের আশ্রয় নিতে হয়।
কবে এই বংশের কোন আদি পুরুষ এখানে একদিন আস্তানা গেড়েছিলেন। সে হয়তো পলাশীর যুদ্ধের পর কোনও একটা সময়ে। তখন লর্ড ক্লাইভের আমল। লাইব্রেরির পুরনো পুঁথি ঘেঁটে দেখছি, বাদশা দ্বিতীয় আলমগিরের রাজত্বের চতুর্থ বছরে হিজরি ১১৭০ ৫ রবি-উল-শানি, ইংরেজি ১৭৫৭ খ্রি অব্দের ২০ ডিসেম্বর, বাংলা ১১৬৪ সালের পৌষ মাসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাব মিরজাফর খাঁ’র কাছ ণেকে জমিদারস্বরূপ ভেট পান এই ২৪ পরগনা। পরগনা মাগুরা, পরগনা খাসপুর, পরগনা ইক্তিয়ারপুর, পরগনা বারিদহাটি, পরগনা আজিমাবাদ, পরগনা মুড়াগাছা, কিসমত সাহাপুর, পরগনা সাহানগর, কিসমতগড়, পরগনা দক্ষিণ সাগর, আর তারপর পরগনা কলিকাতা। সরকার সাতগাঁ’র অধীনেই কিসমত পরগনা কলকাতা। ইত্যাদি ইত্যাদি—
এই কিসমত পরগনা খুঁজে বার করা মুশকিল। এখনকার ম্যাপে এর নিশানা নেই।
বাদশাহ্ আলমগিরের রাজত্বের চতুর্থ বছরে ১৫ রমজান তারিখে ইংরেজ কোম্পানি আর মিরজাফরের মধ্যে যে সন্ধিপত্র লেখা হল সেখানে অষ্টম আর নবম ধারায় লেখা আছে–
Article VIII–Within the ditch, which surrounds the borders of Calcutta, are tracts of land, beloging to several zemindars; besides this I will grant the English Company six hun dred yards without the ditch.
Article IX–All the land lying to the south of Calcutta, as far as Culpee, shall be under the zemindary of the English Company, and officers of those parts, shall be under their jurisdiction.
The revenue to be paid by them (the Company) in the same manner with other zeminders.
এ হল পরোয়ানা।
এতে খুশি হবার লোক নন ক্লাইভ সাহেব। কোম্পানির সুনাম প্রতিপত্তি হলে তার কী লাভ? ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লাভের সঙ্গে তার তো কোনও সম্পর্ক নেই। কথাটা জাফর আলি খাঁ বুঝলেন। তাই যখন দিল্লির বাদশার সনদ এল তখন দেখা গেল তাতে আর কোম্পানির নাম নেই। তাতে ক্লাইভেরই জয়জয়কার। তখন তাতে আর শুধু শুকনো কর্নেল ক্লাইভ নয়। ক্লাইভের তখন একটা লম্বা-চওড়া পদবি। জবদন্ত-উল-মুলক নাসেরাদ্দৌলা সবত-জঙ্গ বাহাদুর কর্নেল ক্লাইভ। তিনিই তখন দিল্লির বাদশার সনদ পেয়ে ২৪ পরগনার জায়গিরদার জবদস্ত-উল-মুল নাসেরাদ্দৌলা সবত-জঙ্গবাহাদুর কর্নেল ক্লাইভ হয়ে গেছে।
ভদ্রলোক বললেন–ওসব হিস্ট্রির কচকচি আমরা শুনতে চাই না মশাই, আমরা চাল-ডাল-মাছ তরকারির ব্যবস্থা করতে করতেই নাজেহাল, জিনিসপত্তরের যা দাম বাড়ছে তাইতেই আমরা মরে আছি, ওসব পড়বার ভাববার শোনবার সময় কোথায় পাই বলুন?
তারপর বললেন–পুঁথিটার মধ্যে কী পেলেন আপনি?
বললাম–একটা অমূল্য জিনিস পেলাম এর মধ্যে। যা এখন পর্যন্ত কোনও ইতিহাসে পাইনি।
কী রকম?
বললাম পেলাম বেগম মেরী বিশ্বাসের নাম—
তিনি কে?
বললাম–এতদিন এই দুশো বছর ধরে আপনাদের বাড়িতে এ-পুঁথিটা রয়েছে আর একবার এটা পড়েও দেখেননি? দেখলেই জানতে পারতেন বেগম মেরী বিশ্বাস কে?
সত্যিই ভদ্রলোক আসল সংসারী মানুষ। নাম পশুপতি বিশ্বাস। সারাজীবন মামলা করেছেন, অর্থ উপায় করেছেন, যৌবনে ফুর্তি করেছেন, সন্তানের জন্ম দিয়েছেন আর ভাল ভাল খেয়েছেন আর পরেছেন। শরিকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাবুয়ানি করেছেন। পাড়ার দশজনের মাথার ওপর মাতব্বরি করেছেন। সাধারণত বাংলাদেশের সেকালের আরও নিরানব্বইজন লোক যা করে থাকেন, পশুপতিবাবুও তাই-ই করেছেন। কোথা থেকে এই বাংলাদেশ এল, এ-দেশ আগে কী ছিল, কী করে এই অজ জলাজমি এখনকার বাংলাদেশে পরিণত হল সেসব জানবার আগ্রহ তার কখনও হয়নি। জেনে কোনও লাভ হবে না বলেই আগ্রহ হয়নি। বেশ আছি মশাই, খাচ্ছিদাচ্ছি, বাত-হাঁপানি-ব্লাডপ্রেশার-ডায়াবেটিস নিয়ে অত সব খবর রাখবার সময় কোথায় আমাদের? জানেন, তিন-তিনটে মেয়ের বিয়ে দিয়েছি তিন কুড়িং ষাট হাজার টাকা খরচ করে? ক’জন পারে বলুন আজকালকার বাজারে? প্রথম জামাই মেডিকেল ডাক্তার, সাতশো টাকা মাইনে পায় ডি-ভি-সি’তে, সেকেন্ড জামাই ইঞ্জিনিয়ার….
বাংলাদেশের ইতিহাস জানার চেয়ে নিজের কীর্তিকাহিনী পরকে জানাবার দিকেই পশুপতিবাবুর আগ্রহটা যেন বেশি। সেকালের পুরনো জমিদার বংশ। মাত্র দুশো বছর আগে পর্যন্তই পশুপতিবাবুদের বংশাবলীর কিছু পরিচয় জানা যায়। কোন এক উদ্ধব দাস নাকি এইখানে এই কিসমত পরগনা কলিকাতায় এসে বসবাস শুরু করেন। এখানে এই গঙ্গার ধারে কান্তসাগরে চোদ্দো বিঘে জমির পত্তনি পেয়ে একটা ছোটখাটো বাড়ি করেন। পশুপতিবাবুরা উচ্চরাঢ়ী কায়স্থ। দিল্লির বাদশার কাছ থেকে উদ্ধব দাস ‘খাস বিশ্বাস’ উপাধি পেয়েছিলেন। কিন্তু নিজেদের নামের শেষে শুধু দাস পদবি লেখেন। ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলেই ওই বিশ্বাস পদবিটা চালু হয়ে গেছে। কিন্তু বিয়ে-শ্রাদ্ধ-অন্নপ্রাশনে খাস বিশ্বাস কথাটা এখনও ব্যবহার করতে হয়। ওটা চলে আসছে এবংশে।
ভদ্রলোক তখন অধৈর্য হয়ে উঠেছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন–বেগম মেরী বিশ্বাস আমাদের কেউ হয় নাকি? কী দেখলেন ওতে?
বললাম–সেইটেই তো খুঁজছি–পাতা তো সব নেই, অর্ধেক ছেঁড়া, পোকায় খাওয়া আমার মনে হচ্ছে আপনাদের বাড়িতে যখন এ-পুঁথি পাওয়া গিয়েছে তখন এই পুঁথির লেখকের সঙ্গে আপনাদের নিশ্চয় কিছু যোগাযোগ আছে–
ভদ্রলোক বললেন–সে তো আছেই, কিন্তু বেগম মেরী বিশ্বাসের সঙ্গে আমাদের কী সম্পর্ক থাকতে পারে? বেগম তো মশাই মুসলমান–
আমি বললাম–শুধু মুসলমান কেন, মুসলমান তো বটেই, আবার ক্রিশ্চানও বটে, তার ওপর মনে হচ্ছে হিন্দুও–
তারপর বললাম–আমি এক মাসের জন্যে এটা নিয়ে গিয়েছিলাম, তাই ফেরত নিয়ে এলাম, আপনি যদি একটু সময় দেন তো আরও কিছুদিন রেখে পড়ে দেখতে পারি।
ভদ্রলোকের তাতেও আপত্তি দেখলাম না। বলতে গেলে ভদ্রলোকের কাছে এ-পুঁথির কোনওই দাম নেই। পুরনো বাড়ি মেরামত করতে গিয়ে মাটির তলায় আরও অনেক কিছু জঞ্জালের মধ্যে এটা পাওয়া গিয়েছিল। দুশো বছরের পত্তনি এঁদের। তখন এ অঞ্চল জঙ্গলে ভরতি ছিল। চোর-ডাকাতদের ভয়ে তখনকার মানুষ অনেক জিনিসই মাটির তলায় পুঁতে রাখত। খাস বিশ্বাস পদবি যাঁরা পেয়েছিলেন তাঁরা জায়গিরের সঙ্গে কিছু ধনসম্পত্তিও পেয়েছিলেন। সেই ধনসম্পত্তি নিয়েই তারা এসেছিলেন এখানে। ধনসম্পত্তি সে-যুগে লুকিয়ে রাখার জিনিস। কেউ কখনও জানতে পারলে তার আর নিস্তার নেই। উদ্ধব দাস এখানে সেই ধনসম্পত্তি নিয়েই হয়তো একদিন গড়ম্বন্দি তৈরি করলেন। চকমিলানো বাড়ি তৈরি করলেন। ভাবলেন খাস বিশ্বাস বংশ যুগ থেকে যুগান্তর ধরে তার কীর্তিগাথা প্রচার করবে। কিন্তু আস্তে আস্তে বিবাদ শুরু হল শরিকদের মধ্যে, ভাগীরথীর জল শুকিয়ে আসতে লাগল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা দেশের রাজা হয়ে বসল, কুইন ভিক্টোরিয়া থেকে শুরু করে একাদিক্রমে এক-একজন রাজা এসেছে আর খাস বিশ্বাসদের অবস্থা ক্রমান্বয়ে খারাপ থেকে আরও খারাপের দিকে গেছে।
বাড়িতে এসে পুথিখানা পড়তে পড়তে আমার চোখের সামনে থেকে যেন ধীরে ধীরে মহাকালের পরদাগুলো আস্তে আস্তে সরে যেতে লাগল। পয়ার ছন্দে লেখা কাব্য। পয়ারের চৌদ্দটি অক্ষর যেন চৌদ্দ হাজার প্রদীপের আলোর প্রার্য নিয়ে আমার চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। এই কলকাতা শহর, এই বিংশ শতাব্দী, এই বাড়ি ঘর রাস্তা, এই সভ্যতা, শিক্ষা, ভণ্ডামি, প্রতিযোগিতা আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জয়ের যুগে আমি সশরীরে যেন আর এক যুগে গিয়ে পৌঁছোলাম। তখন পিচের রাস্তা হয়নি কোথাও। ইলেকট্রিক লাইটও হয়নি। মটর, ট্রেন, প্লেন কিছুই হয়নি। শুধু একটা পালকি চলেছে কালনার মেঠো পথ দিয়ে।
দু’পাশে মাঠ। মধ্যে গোরুর গাড়ি যাবার মতো খানিকটা রাস্তা।
ওপাশ থেকে বুঝি ধুলো উড়িয়ে কারা আসছিল। ঘোড়ার খুরে রাস্তার ধুলো উঠে আকাশ ছেয়ে ফেলেছে। কাছে আসতেই দেখা গেল নবাবের সেপাই তারা। সেপাইরা পালকি থামিয়ে দিলে।
কে? ভেতরে কে আছে?
আজ্ঞে জেনানা!
কাদের জেনানা?
ষণ্ডা-গুন্ডা সেপাই দুটো সোজা কথায় ছাড়বার লোক নয়। মেয়েমানুষের নাম শুনলে জিভ দিয়ে নাল পড়ে ওদের। রোদ টা টা করছে চারদিকে। তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাবার জোগাড়। চারজন চারজন আটজন পালকি-বেহারা। পালা করে বয়ে নিয়ে চলেছে। ফেরিঘাটের কাছে একবার একটু জলটল খেয়ে নিয়েছিল বেহারারা। ফেরিঘাটের নৌকোর মাঝিও একবার কান্তকে একা পেয়ে চুপি চুপি জিজ্ঞেস করেছিল–পালকিতে ইনি কে কত্তা?
এমনিতে সন্দেহ হবারই কথা। অন্তত একটু কৌতূহল। মানে সঙ্গে তো আর কোনও স্ত্রীলোক নেই। একলা-একলা এই পথেঘাটে এমন রূপসি মেয়েমানুষ দেখলে মানুষের জানতে ইচ্ছে হয় বই কী! দিনমানই হোক আর রাতবিরেতই হোক, মেয়েমানুষ যায় নাকি এমন করে!
কান্ত জবাব দিয়েছিল–আমাদের হাতিয়াগড়ের রানিবিবি!
কথাটা শুনে বুড়ো মাঝির কোথায় কৌতূহল নিবৃত্তি হবে, তা নয়; চোখ দুটো যেন আরও বড় বড় হয়ে গেল। হাতিয়াগড়ের জমিদারগিন্নির তো পালকিতে যাবার কথা নয়। গেলে নৌকোতে যাবেন। জমিদারের নিজেরই তো বজরানৌকো আছে। এই ফেরিঘাটেই কতবার বাবুর বজরা বাঁধা হয়েছে।
আপনারা?
কান্ত বললে–আমরা নবাব সরকারের লোক—
কথাটা শুনেই বুড়ো মাঝি গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। লম্বা একটা সেলাম করেছিল সসম্ভ্রমে। সম্ভ্রমে বটে ভয়েও বটে। মুর্শিদাবাদের নিজামত নবাব সরকারের কথা শুনলে কার না ভয় হয়। ভয়েই বোধহয় আর কোনও কথা বলেনি বুড়ো মাঝিটা। ঘন ঘন সেলাম করেছিল। দুটো সেপাই সঙ্গে ছিল। আর ছিল আটজন পালকি-বেহারা। আর কান্ত নিজে। এইসব এত লোকের বহর দেখেই মাঝিটার সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু কথাটা শোনবার পর আর বাক্যব্যয় করেনি। পালকিসুদ্ধ নদীপার করে দিয়ে আর একটা লম্বা সেলাম করেছিল কান্তকে।
তারপর আর কিছু ঘটেনি। এতদূর আসার পর আবার সেই সেপাই।
কাদের জেনানা?
পালকির ভেতরে যে গুটিসুটি মেরে চুপ করে বসে ছিল, কথাটা বুঝি তার কানেও গেল। মাথার ঘোমটাটা সে একটু নামিয়ে দিলে। একলা-একলা চুপ করে বসে থাকতে পা ব্যথা হয়ে গিয়েছিল। এতক্ষণ বাইরে থেকে কেবল পালকি-বেহারাদের হুস-হাস শব্দ ছাড়া আর কিছু ছিল না।
শোনা গেল সঙ্গের লোকটা বলছে–আমাদের হাতিয়াগড়ের রানিবিবি।
কোথায় যাবে?
মুর্শিদাবাদ, চেহেল্-সুতুন।
পাঞ্জা?
বাইরের আর কোনও কথা শোনা গেল না ভেতর থেকে।
হাতিয়াগড়ের জমিদারগিন্নি উদগ্রীব হয়ে কান পেতে রইল। কেউ আর কিছু বললে–না। সেপাই দুটো বোধহয় পাঞ্জা দেখে খুশি। কেউ আর পালকির দরজা খুলে পরীক্ষা করতেও চাইলে না। তারপর কেবল বেহারাদের হুস-হাস শব্দ। সারা শরীরটা দুলছে সেই সকাল থেকে। নদীতে যতক্ষণ ছিল ততক্ষণ বেশি কষ্ট হয়নি। নৌকোর ঘরের মধ্যে একা-একা কেটেছে। ওরা বাইরেই ছিল। বাইরেই ওরা খেয়েছে, বাইরেই ঘুমিয়েছে। আর সেপাই দুটো পাহারা দিয়েছে কেবল বসে বসে।
হঠাৎ দরজাটা ফাঁক হয়ে গেল।
সেই লোকটা সসম্ভ্রমে মুখ বাড়িয়ে বললে–এখানে আপনাকে নামতে হবে রানিবিবি, আমরা কাটোয়ায় পৌঁছে গেছি—
*
সেকালের কাটোয়া কেমন জায়গা, পুঁথির মধ্যে তার বেশ বর্ণনা আছে। চারিদিকে মাঠ। মাঠের মধ্যে একটা জায়গায় এসে কয়েকটা বটগাছ চারিদিকটা বেশ ছায়াচ্ছন্ন করে রেখেছে। দু-একটা আটচালা। একটা শিবমন্দিরও ছিল। ভাঙাচোরা অবস্থা তার। ঠিক তার পাশেই একটা বাড়ি। পোড়া ইটের পাকা বাড়ি। আর পাশেই গঙ্গা।
এককালে এখানে বর্গিরা এসে হাঙ্গামা বাধিয়েছিল! লুঠপাট করে সব শ্মশান করে দিয়ে গিয়েছিল। সে কয়েক বছর আগেকার কথা। এখন কাছাকাছি গ্রামের চিহ্ন নেই। গ্রামের লোক সেই সময়ে এ-গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল আর আসেনি। কয়েকটা বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল বর্গিরা। খেতের ফসল কেটে নিয়ে গিয়েছিল। গোরুছাগল কিছু নিতে বাকি রাখেনি। সেসব এক দিন গিয়েছে। কান্তর মনে আছে সে-সব দিনের কথা।
সে ছিল বড়চাতরা।
খুব ছোট তখন সে। ভাল করে মনে পড়ে না সব কথা। এক-একদিন রাত্রে হইহই করে গা-ময় চিৎকার উঠত। বর্গি এল’ বর্গি এল’ বলে রব উঠত। দিদিমা ঘুম ভাঙিয়ে দিত। বলত–কান্ত ওঠ–
বর্ষার রাত। নাজিরদের ডোবাটার পাশ থেকে ঝিঁঝি পোকার ডাক আসছে অনবরত। গোলপাতার চালের বাতায় দিদিমা বড় বড় কাঁঠাল ঝুলিয়ে রাখত। যে কাঁঠাল পাকেনি, সেই কাঁঠাল বাতি হলেই গোপালকে দিয়ে দিদিমা গাছ থেকে পাড়িয়ে রাখত। তারপর চালের বাতায় দড়ির শিকেয় ঝুলিয়ে রাখত। সেই কাঁঠাল থেকে দু-তিন দিন বাদেই গন্ধ বেরোত। পেকে ভুরভুর করত গন্ধ। গন্ধ পেয়ে হলদে হলদে বোলতা এসে জুটত কোত্থেকে।
তখন কান্ত ছোট। অতদূরে হাত পৌঁছুত না। একটা কচার লাঠি দিয়ে কাঁঠালটার গায়ে লাগাতেই তার মধ্যে লাঠিটা ঢুকে যেত, তখন কাঁঠালটা পেকে একেবারে ভুসভুসে হয়ে গেছে।
দিদিমা দেখতে পেয়ে বলত–কে রে? কাঁঠালটা কে খোঁচালে রে? তুই বুঝি?
শুধু কি কাঁঠাল? আমগাছও ছিল কান্তদের। অত আম কে খাবে তখন! খাবার মধ্যে তো কেবল দিদিমা আর সে! তক্তপোশের তলায় পাকা আমগুলো আমপাতার ওপর সাজিয়ে সাজিয়ে রাখত দিদিমা। রোজ রোজ বেছে বেছে পাকা আমগুলো দিয়ে জলখাবার হত নাতির। সেই পেট-ভরা আম খেয়ে দোয়াত কালিকলম তালপাতা নিয়ে পাঠশালায় যেত কান্ত। স্বরে অ আর স্বরে আ দিয়ে বাংলা হাতের লেখা মকশো করতে হত। কাঁধে আঁকড়ি ক, মুখে বাড়ি খ,…
কিন্তু সেবার সত্যি সত্যিই রাতদুপুরে বর্গিরা এল। নাজিরদের বাড়ির দিকে সকলে দৌড়োচ্ছিল। দিদিমা বুড়ো মানুষ, বেশি জোরে হাঁটতে পারে না। চৌধুরীবাবুদের বুড়ো কর্তা বাতের ব্যথায় পঙ্গু হয়ে পড়েছিলেন বিছানায়। তিনি আর দৌড়োত পারলেন না, ধপাস করে মাটিতে পড়ে মরে গেলেন। চৌধুরীবাড়ির নবউ পেছনে ছিল, শ্বশুরকে পড়ে যেতে দেখে ন’বউ থেমে গেল। শাশুড়ি তখন এক নাতির হাত ধরে আর এক নাতিকে কোলে নিয়ে দৌড়াচ্ছে।
কর্তাকে পড়ে যেতে দেখে শাশুড়ি গিন্নি বললে–উনি থাকুন নবউমা, তুমি চলো, পোয়াতি মানুষ তুমি, তুমি আগে নিজের পেরান সামলাও—
বুড়োকর্তা সেখানেই পড়ে রইলেন। চৌধুরীবাড়ির বড়কর্তা, মেজকা, সেজকর্তা, নকর্তা তখন বাড়ির বড় বড় লোহার সিন্দুকগুলো ধরে ধরে সেই ডোবা পুকুরের মধ্যে ডুবোচ্ছে। চৌধুরীবাবুদের অবস্থা ভাল। রুপোর থালাবাসন ছিল, সোনার বাট ছিল, সমস্ত সেই রাত্তিরে পুকুরের পাকের মধ্যে পুঁতে ফেললে। তারপর লাঠি-সড়কি নিয়ে মাথার ওপর ঘোরাতে ঘোরাতে চার ভাই বেরিয়ে পড়ল।
আর শুধু কি চৌধুরীরা?
বড়চাতরার যত লোক ছিল সব পালিয়ে বাঁচত বাড়িঘর ছেড়ে। চাল-ডাল-নুন তেল ফেলে রেখে শুধু প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে গ্রাম-কে-গ্রাম উজাড় হয়ে যেত! কোথায় যেত তার ঠিক নেই। নাজিরদের বাড়িটায় একতলায় মাটির নীচেও ঘর ছিল। নাজিররা সেখানেই লুকিয়ে থাকত।
দিদিমা বলত–তুই যেবার হলি সেবারও বর্গি এইছিল, তোকে কোলে নিয়ে তোর মা আর আমি নাজিরদের বাড়ির তলায় গিয়ে লুকোলুম–
খুব ছোটবেলায় দিদিমার কাছে এইসব গল্প শুনত। শুধু দিদিমা কেন, সে-গল্প বড় চাতরার সবাই জানত। ওই পাঠশালার পশ্চিম দিকের কালাচাঁদের মঠ পেরিয়ে যেখানে বিরাট একটা ঝাকড়া-মাথা বটগাছ হা হা করে আকাশের দিকে হাত তুলে বোশেখ-জষ্ঠি মাসের বিকেলবেলার দিকে তুমুল কাণ্ড করে বসে, তারও ওপাশে রাজবিবির মসজিদ, সেই রাজবিবির মসজিদ ছাড়ালেই সরকারি সড়ক। সেই সড়ক দিয়ে সোজা হেঁটে গেলেই তিন দিনের মধ্যে রাজমহল পৌঁছিয়ে যাবে। নাজিরবাবুদের সর্দার পাইক দফাদার ওই সরকারি সড়ক দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে আসত। চৌধুরীবাবুরা যখন একবার কাশীধামে গিয়েছিল, তখন ওই পথ ধরেই গিয়েছিল। গিয়ে পাটনার গঙ্গা থেকে নৌকো নিয়েছিল। আর ঠিক ওই রাস্তা বরাবরই বর্গিরা আসত। একেবারে পঙ্গপালের মতো হুড়মুড় করে এসে ঢুকে পড়ত বড়চাতরায়। ঠিক যখন খেতের ধান কাটবার সময় হত, সেই সময়ে কোত্থেকে এসে হাজির হত আর তারা চলে যাবার পর খাঁ খাঁ করত সমস্ত বড়চাতরা।
বড়চাতরার লোকে কান্নাকাটি করত গা দেখে। কতবার ঘর-বাড়ি-গোলা মরাই-খেত-খামার সমস্ত জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে গেছে বর্গিরা।
দিদিমাও কাঁদত। বলত–ওই হারামজাদারা তোর বাবাকেও খুন করে ফেলেছিল রে।
ওই সময়েই কী একটা হাঙ্গামায় মা গেল। রইল শুধু দিদিমা আর সে। দিদিমা বুড়ি মানুষ। কতদিন আর বাঁচবে! তবু যেক’দিন বেঁচে ছিল, ততদিন নাতির জন্যে অনেক করে গেছে। নাজিরদের চণ্ডীমণ্ডপে বরদা পণ্ডিতের পাঠশালা ছিল একদিকে, আর একদিকে ছিল সারদা পণ্ডিতের মক্তব। সারদা পণ্ডিত নিজে পড়াতেন না ছাত্রদের, মৌলবি রেখেছিলেন। মৌলবি ফারসি পড়াত পড়ুয়াদের।
নাজিরবাবু বলেছিলেন–কনেবউ, তুমি আবার নাতিকে ফারসি পড়াতে গেলে কেন বলল তো? সংস্কৃত পড়লে কি বিদ্যে হয় না?
দিদিমা বলেছিল–না কর্তাবাবু, তা নয়, নাতি চিরকাল চাষাভুষো হয়ে থাকবে, তা কি ভাল?
তা ফারসি শিখে তোমার নাতি নবাব সরকারে নায়েব-নাজিম হবে নাকি?
দিদিমা বলেছিল–নায়েব-নাজিম না হোক, নায়েব-নাজিমের খেদমদগার তো হতে পারবে? ফারসিটা শিখলে তবু সরকারি চাকরি অন্তত একটা তো পাবে।
তা নবাব-সরকারের চাকরিতে আর সে-গুড় ছিল না তখন। নবাব আলিবর্দি খাঁ নিজেই নবাব-সরকারের চাকরিতে ঢুকেছিল বলে নবাব হতে পেরেছিল মুর্শিদাবাদের। ওই মহারাজ রাজবল্লভ, পেশকার হয়ে ঢুকে মহারাজ। ওই রামনারায়ণ, জানকীরামের কাছে সরকারি চাকরি করেছিল বলেই পাটনার দেওয়ানি পেয়ে গিয়েছিল।
দিদিমার আশা ছিল অনেক। আশা ছিল নিজের জামাই তার যে-আশা মেটাতে পারেনি, বাপ-মা মরা নাতি তাই পারবে। কিন্তু দিদিমা যদি জানত যে শেষকালে তারই নাতি কিনা চাকরি নেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দপ্তরে!
কিন্তু সে-কথা এখন থাক!
কাটোয়ার কাছে আসতেই পালকি-বেহারারা থেমে গেছে। সেই সক্কালবেলা খেয়া পার হয়ে বেহারারা ছুটতে শুরু করেছে দুটো চিড়ে-মুড়কি মুখে দিয়ে। তারপর আর বিরাম নেই।
নিজামত-সরকারের তলব পেয়ে কাটোয়ার কোতোয়াল সব ব্যবস্থাই করে রেখেছিল। পালকিটা পোঁছোতেই ফৌজি সেপাই দুটো সামনে এসে খাড়া হল।
কান্তও তৈরি ছিল। পাশেই পাকাবাড়িটা। কোতোয়ালের লোক সামনেই হাজির ছিল। কান্ত এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে ঘর সাফ হয়েছে?
কোতোয়ালের লোক কান্তকে সেলাম করে বললে–হ্যাঁ হুজুর—
রান্নাবান্নার কী ব্যবস্থা?
সব তৈরি হচ্ছে হুজুর। বারোজনের রান্নার হুকুম দিয়েছেন কোতোয়াল।
রান্না করছে কারা? হিন্দু না মুসলমান?
হুজুর, মুসলমান!
কান্ত একটু অবাক হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলে–কেন? মুসলমান কেন? হাতিয়াগড়ের রানি তো হিন্দু বিবি, মুসলমানের হাতের রান্না খাবেন কেন? হিন্দু রসুইয়ের বন্দোবস্ত হয়নি?
তা জানিনে হুজুর।
কান্ত বললে–ঠিক আছে, বিকে ডেকে দাও, রানিবিবিকে নিয়ে ভেতরে যাক, তারপরে আমি কোতোয়াল সাহেবের সঙ্গে কথা বলছি–
ঝি নয়, বোরখা পরা বাঁদি বেরিয়ে এল রানিবিবিকে নামিয়ে নিয়ে যেতে। পালকির দরজা ফাঁক হতেই কান্ত দেখলে সলমাচুমকির ওড়না দিয়ে রানিবিবি মাথায় একটা ঘোমটা দিয়েছিল। পালকি থেকে মাথা নিচু করে বেরোতে গিয়েই ঘোমটাটা খসে গেল মুখ থেকে। আর কান্ত এক পলকে দেখে ফেললে রানিবিবির মুখখানা। দুপুরের রোদে মুখখানা লাল হয়ে গেছে। ফরসা রঙের ওপর লালচে আভা বেরোচ্ছে সারা মুখখানাতে। আর কপালের ঠিক মধ্যিখানে সিঁথির ওপর জ্বলজ্বল করছে মেটে সিঁদুর।
ফৌজি সেপাই দুটো সেইদিকে চেয়ে দেখছিল। পালকি-বেহারারাও দেখছিল। সেই তাদের দিকে নজর পড়তেই কান্ত নিজেই যেন কেমন অপরাধী মনে করলে নিজেকে। তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে মুখখানা খানিকক্ষণের জন্যে অন্তত ভোলবার চেষ্টা করলে।
*
সারা পুঁথিখানায় এমনি সব বর্ণনা। ধুলো আর নোনা হাওয়া আর পোকার হাত থেকে পুঁথিখানাকে রক্ষে করা যায়নি। বাংলাদেশের জল-হাওয়াতে মানুষই বলে তাড়াতাড়ি মরে যায়, তায় আবার তুলোট কাগজ।
তুমি আমি এবং আর পাঁচজন যখন দু’শো বছর ধরে ইংরেজ রাজত্বে বাস করে সেকালের সব ইতিহাস ভুলে বসে আছি, তখন এমন একখানা পুঁথি কোথায় মাটির তলায় আমাদের চোখের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে ছিল তার হিসেব রাখবার প্রয়োজন বোধ করিনি! একদিন মুর্শিদাবাদ থেকে রাজধানী কলকাতায় চলে এসেছিল, তারপর কলকাতা থেকে দিল্লি। এই দু’শো বছরে শুধু যে যুগই বদলেছে তাই নয়, মানুষ বদলেছে, মানুষের মতিগতিও বদলেছে। আর মানুষই বা কেন, ভূগোলও বদলে গেছে। এখন যে-গঙ্গা হিমালয় থেকে মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত এসে এখানে পদ্মা নাম নিয়েছে, আসলে তা পদ্মাই নয়। আসলে তা ছিল সমুদ্র। সমুদ্র থেকে একদিন দ্বীপ জেগে উঠেছে, নতুন জনপদ যেমন সৃষ্টি করেছে, নতুন নদীও তাতে সৃষ্টি হয়েছে। রামায়ণের যে-গঙ্গা সাতটা ধারায় বয়ে গিয়েছিল, তার তিনটে স্রোত পুব দিকে গিয়ে নাম নিয়েছিল হ্লাদিনী, পাবনী আর নলিনী। আর পশ্চিম দিকে যে-তিনটে ধারা বয়ে গিয়েছিল, তার নাম সুচক্ষু, সীতা আর সিন্ধু। বাকি স্রোতটা মাঝখান দিয়ে ভগীরথের পেছন-পেছন সমুদ্রে গিয়ে পড়েছিল। এই স্রোতটার নামই গঙ্গা। ইংরেজরা যখন এল তখন গঙ্গার নাম বদলে তার নাম রাখলে কাশিমবাজার নদী। কাশিমবাজার পর্যন্ত কাশিমবাজার নদী, যেখানে ভাগীরথী জলাঙ্গীর সঙ্গে এসে মিশেছে। বাকিটা হল হুগলি নদী। আর এখন তো সবটাই হুগলি নদী।
এই হুগলি নদীরই কি কম নাম-ডাক! এই নদীটা দিয়েই একদিন নবাবের সেপাইয়া বর্গিদের সঙ্গে লড়াই করতে গেছে। এই নদীটা দিয়েই একদিন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সোরার নৌকো জাহাজ বোঝাই করে বিলেতে মাল পাঠিয়ে দিয়েছে। এই নদীটা দিয়েই একদিন হাতিয়াগড়ের জমিদার মুর্শিদাবাদের সরকারে খাজনা জমা দিতে এসেছে। এই গঙ্গার পাড়ের ওপরেই কিরীটেশ্বরীর মন্দির। মুর্শিদকুলি খাঁ’র কানুনগো দর্পনারায়ণ এই কিরীটেশ্বরীর মন্দির নতুন করে গড়ে দিয়ে নিজের দেবভক্তি প্রচার করেছিলেন। ঢাকা থেকে ফিরে যতদিন ডাহাপাড়ায় বাস করেছিলেন ততদিন এই মন্দিরের তত্ত্বাবধানের দিকে লক্ষ রেখেছিলেন। এইখানেই আছে রাঙামাটি। এখানকার মাটি লাল। হিউ-এন-সাং তার ভ্রমণবৃত্তান্তে যাকে বলেছেন কর্ণসুবর্ণ, এই রাঙামাটিই সেই কর্ণসুবর্ণ। মহারাজ দাতাকর্ণের অন্নপ্রাশনের সময় বিভীষণ এখানে স্বর্ণবৃষ্টি করেছিলেন, তাই নাকি এর নাম হয়েছিল কর্ণসুবর্ণ। কে জানে! কত রকম গল্প জড়িয়ে আছে এই দেশকে ঘিরে, সব লিখতে গেলে এ-বইও মোটা হয়ে যাবে, তখন আপনারাও বিরক্ত হয়ে যাবেন, আমারও স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাবে রাত জেগে লিখে লিখে।
এই যে নলহাটি আজিমগঞ্জ লাইনে সাগরদিঘি নামে একটা ইস্টিশন, ওর পেছনেও একটা গল্প আছে। কিন্তু সে-গল্প থাক। এবার অন্য একটা গল্প বলি। সাগরদিঘি থেকে চার ক্রোশ উত্তর-পুবে একটা গাঁ আছে, তার নাম এক-আনি চাঁদপাড়া। গৌড়ের সিংহাসনে একদিন হোসেন সাহ্ জবরদস্ত নবাব বলে বিখ্যাত হয়েছিলেন। সেই হোসেন সাহেবের বাবা এই চাঁদপুরে এসে উঠেছিলেন। কিন্তু অবস্থা বৈগুণ্যে চাকরি নেন এক ব্রাহ্মণের কাছে। চৈতন্যচরিতামৃতে ওই ব্রাহ্মণের নাম সুবুদ্ধি রায় বলে লেখা আছে। লোকে সুবুদ্ধি রায়কে চাঁদ রায় বলে ডাকত। চাঁদপাড়ার কাজি হোসেন সাহের গুণের পরিচয় পেয়ে নিজের মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে দিলেন। একদিন যে ছিল সুবুদ্ধি রায়ের আশ্রিত, সে-ই আবার একদিন গৌড়ের রাজ-সিংহাসন আলো করে বসল। কিন্তু সুবুদ্ধি রায়ের কথা হোসেন সাহ ভোলেননি। নবাব হয়েই চাঁদপাড়া গ্রামটার স্বত্ব সুবুদ্ধি রায়কে এক আনা খাজনায় দিয়ে দিলেন। তখন থেকেই সেই গ্রামের নাম হয়ে গেল এক আনি চাঁদপাড়া।
কিন্তু আজ যে রাজা আবার কালই হয়তো সে ফকির হয়ে যাবে। একদিন সুবুদ্ধি রায়ের ক্ষমতা এমনই বেড়ে উঠল যে, তখন হোসেন সাহই বা কে জগদীশ্বরই বা কে! সেই সুবুদ্ধি রায়ই একদিন চাবুক মেরে হোসেন সাহের গায়ে দাগ বসিয়ে দিলেন। আর যায় কোথায়! হোসেন সাহ কিছু বললেন না, কিন্তু তার বেগম বড় চটে গেলেন।
স্বামীকে বললেন–এত বেয়াদপি কাফেরের?
হোসেন সাহ বললেন–তা হোক, একদিন তো রায়মশাইয়ের খেয়ে-পরেই মানুষ হয়েছি–
ওসব যুক্তিতে ভুললেন না বেগম সাহেবা। তিনি বললেন–সুবুদ্ধি রায় যা-ই হোক, ও হল কাফের, কাফেরকে খুন করলে কোনও গুণাহ হয় না–
শেষে বেগমের কথাও রইল, সুবুদ্ধি রায়ের সম্মানও রইল। হোসেন সাহ একদিন আচমন করতে করতে সুবুদ্ধি রায়ের গায়ে জল ছিটিয়ে দিলেন। সেই জল তার মুখে গিয়ে লাগল। এরপর সুবুদ্ধি রায় আর সংসারে থাকেননি। সংসার ত্যাগ করে মহাপ্রভুর নামে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
এ তো গেল পাঠান আমলের কথা। সেই হোসেন সাহই বা কোথায় তলিয়ে গেল। তার জায়গায় শেষ নবাব এল দায়ূদ খাঁ। পাঠান আমলের ইতি হল এই দায়ূদ খাঁর আমলেই। মানসিংহ এসে হাজির বাংলার সুবেদার হয়ে। মোগল-পাঠানে লড়াই হল এই গঙ্গার ধারেই সেরপুর আতাই-এ! এই সেরপুর আতাইতেই পাঠানদের হাতির দল পালিয়ে বাঁচল। সেই মানসিংহের সঙ্গেই একজন ব্রাহ্মণ বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি কান্যকুজের লোক, জিঝোতিয়া বংশের ব্রাহ্মণ। মানসিংহের সৈন্য তিনিই পরিচালনা করতেন। তাঁর নাম সবিতা রায়। এই সবিতা রায়ই বর্তমান জেমো রাজবংশের আদিপুরুষ। এই বংশের জয়রাম রায় কপিলেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সে-মন্দিরও এই গঙ্গার গর্ভেই চলে গেছে।
এ-গঙ্গা নিয়েছেও যেমন অনেক আবার দিয়েছেও অনেক। এই গঙ্গাই ঘসেটি বেগমকে নিয়েছে, আমিনা বেগমকে নিয়েছে। নানিবেগম, ময়মানা বেগমকে নিয়েছে। লুৎফুন্নিসা বেগমকেও নিয়েছে। আর দিয়েছে এই মরালীকে। এই মরিয়ম বেগমকে। এই বেগম মেরী বিশ্বাসকে। এই যে-বেগম মেরী বিশ্বাসের গল্প এখানে আপনাদের বলতে বসেছি।
তা এই গঙ্গার পাড় ধরেই হাতিয়াগড়ের রানিবিবির পালকিটা এসে থামল কাটোয়ার সরাইখানার সামনে। কোতোয়ালের হেফাজতে ছিল এ-বাড়িটা। নবাব আলিবর্দি খাঁ একবার বর্গিদের তাড়িয়ে দিয়ে এসে নানিবেগমকে নিয়ে এক রাত্রের জন্যে এখানে উঠেছিলেন। সবরকম বন্দোবস্তই আছে এখানে। দরকার হলে এখানকার খিদমদগার গরম জলের ব্যবস্থা করতে পারে স্নানের জন্যে। খাবার বলল খাবার, বিছানা বলো বিছানা, এমনকী তেমন দরকার হলে মদের ব্যবস্থাও করতে পারে।
কান্তর ঘাড় থেকে যেন বোঝাটা নামল।
সেপাই দুজনও ঘাড়ের বন্দুক নামিয়ে গায়ের মুখের ঘাম মুছে নিলে। অনেক দূর পথ হেঁটে এসেছে। তাদের খিদে পাবার কথা। গাছতলাটায় বসল গিয়ে দু’জন।
ও কান্তবাবু! কান্তবাবু—
কান্ত কোতোয়ালের সঙ্গে দেখা করে খাওয়াদাওয়ার বন্দোবস্তের কথা বলতে যাচ্ছিল। হাতিয়াগড়ের রানি হিন্দুবিবি, মুসলমানের হাতের রান্না কেমন করে খাবে! তা ছাড়া, এখানে কতদিন থাকতে হবে, এখান থেকে মুর্শিদাবাদ যাবার আবার কী বন্দোবস্ত করা হয়েছে, তাও জানা দরকার। নবাব সরকারের চাকরির অনেক ল্যাটা। কোথাও কেউ মুখ খুলে কথা বলবে না। সবাই যেন সবাইকে সন্দেহ করে। অথচ যখন ফিরিঙ্গি কোম্পানিতে চাকরি করত তখন এসব ছিল না। বেভারিজ সাহেব তোক ভাল। কান্তকে বাবু বলে ডাকত। তিন টাকা করে মাইনে দিত সাহেব, কিন্তু মাইনেটা কম হলে কী হবে, সাহেব সেটা পুষিয়ে দিত নানাভাবে। সোরা বেচে বেশি লাভ হলে সেবার বকশিশ দিত। তা বকশিশ না দিলেও চাকরি না করে উপায় ছিল না কান্তর। বেভারিজ সাহেব চাকরি না দিলে কোথায় থাকত সে? বাঁচত কী করে? খেত কী? বড়চাতরা থেকে সেই যে সেবার প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছিল, তারপরে কি আর সেখানে গিয়ে ওঠা যেত। গাঁ-কে-গাঁ যেন আগুন জ্বেলে পুড়িয়ে দিয়েছিল তারা।
সে এক ভয়ংকর কাণ্ড!
সেইবারই বেশি করে কাণ্ডটা হল।
ওই রাতদুপুরে আবার একদিন হইহই রইরই চিৎকার উঠল। বড়চাতরার তাবৎ লোক ঘুম ভেঙে যে-যেদিকে পারল ছুটল। কিন্তু সেবার বোধহয় একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। নাজিরদের বাড়িটার ওপর তখন ঝাঁপিয়ে পড়েছে বর্গিরা। নাজিররাই বড়চাতরার বর্ধিষ্ণু লোক। বাড়িতে চিরকাল ধান, চাল, গুড়, নুন মজুত করা থাকে। তা সবাইকার জানা। তাই সেবার আর নাজিররা রেহাই পেতো না। দু-একটা গাদা বন্দুক বোধহয় ছুঁড়েছিল নাজিরবাবুর দিশি সেপাই। কিন্তু সে আর কতটুকু। কান্তরা যখন ঘুম ভেঙে উঠেছে তখন নাজিরদের বাড়িটা দাউদাউ করে জ্বলছে।
সুতরাং পুব দিকে দৌড়োও। পালাও পালাও।
যার যেদিকে চোখ গেছে সেই দিকেই পালিয়েছে। শেষকালে সেই ঘুরঘুটি অন্ধকারে দৌড়োতে দৌড়োতে একেবারে সোজা গঙ্গা। গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটতে কাটতে একেবারে কলকাতায়। কলকাতায় বেভারিজ সাহেবের সোরার গদিবাড়ি গঙ্গার ঘাটের ওপর। সকালবেলা সেখানে গিয়েই দাঁড়িয়েছিল কান্ত। আর তো কেউ নেই তখন তার। আর কলকাতাতে কে থাকবে কার, গোটাকয়েক চালাঘর, কয়েকটা পাকা বাড়ি ফিরিঙ্গিদের কোম্পানি তখন সেই জলাজঙ্গলেই বেশ কায়েম হয়ে উঠেছে।
বেভারিজ সাহেব তখন পালকিতে চড়ে গদিবাড়ি দেখতে এসেছে।
জিজ্ঞেস করলে–হু আর ইউ? টুমি কে?
তখন কান্ত ইংরেজি বুলি জানত না। কিছু ফারসি পড়েছে সারদা পণ্ডিতের মক্তবে, আর কিছু বাংলা বরদা পণ্ডিতের পাঠশালায়। অথচ আশ্চর্য, শেষকালে সেই কান্তই বেশ গড়গড় করে সাহেবদের সঙ্গে ইংরেজি বুলি আউড়ে যেত। চাকরিতে টিকে থাকলে কান্তর আরও উন্নতি হত হয়তো। বেভারিজ সাহেবের নেকনজরে পড়ে অনেক কিছু করে নিয়েছে। কিন্তু কাল হল বশির।
বশির মিঞা একদিন জিজ্ঞেস করেছিল–কত তলব পাস তুই এখেনে?
তিন টাকা।
বশির মিঞা নবাব-সরকারের লোক। নিজামতের পেয়ারের নোকর। চুড়িদার পায়জামার ওপর চুনোট করা মলমলের পিরান পরে। কাঁধে আবার কলকার কাজ। বাহারে টেড়ি, পান-জর্দা কিমাম খেয়ে মুখ লাল করা থাকে সবসময়। তলবের অঙ্ক শুনে হো হো করে হেসে উঠল। বললে–দুর। নবাব-নিজামতের খেদমতগার পর্যন্ত রোজ তিন টাকা আয় করে।
কীসে আয় করে?
রিশশোয়াত! ঘুষ! তোর নোকরিতে ঘুষ আছে?
কান্ত বললে–না, শুধু বকশিশ দেয় সাহেব–
তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে উঠল বশির, ঘুষ না হলে নোকরি করে ফয়দা কী? আমি তো তিনটে বিবি রেখেছি ওই ঘুষের জোরে। তলব তো পাই দশ টাকা। দশ টাকায় তিনটে বিবি পোষা চলে? তুই-ই বল না? তিন বিবির নোকর-নোকরানি আছে, বিবিদের বায়নাক্কা কি কম নাকি? সরাবের একটা মোটা খরচা আছে, পান-তামাকু কোনটা নেই? দশ টাকায় চলে কী করে?
কান্তও বশিরের বড়লোকিপনার বহর শুনে হতবাক।
জিজ্ঞেস করলে–তুই দশ টাকায় চালাস কী করে?
বশির মিঞা বললে–ঘুষ নিয়ে–
তোকে ঘুষ দেয় কেন লোকে?
ঘুষ না দিলে নবাব কাছারিতে কারও কাজ হোক দিকিনি দেখি!
তুই কি কাছারিতে কাজ করিস?
আরে না, নিজামতের খাস মোহরার আমার ফুপা। আমার ফুপাকে বলে দিলে তোরও নোকরি হয়ে যাবে নিজামতে–! তুই নোকরি নিবি?
কিন্তু বেভারিজ সাহেব যে আমাকে খুব ভালবাসে। গদিবাড়ির চাবি যে আমার হাতে থাকে।
বশির মিঞা কান্তর বোকামি দেখে হাসবে কি কাদবে বুঝে উঠতে পারলে না।
আরে নিজামতের নোকরির কাছে ফিরিঙ্গি সাহেবের নোকরি? ওরা তো বিলাইত থেকে কারবার করতে এসেছে। সোরা কিনবে সুতো কিনবে আর দরিয়ার ওপারে চালান দেবে। ওদের কোম্পানি যখন উঠে যাবে তখন কী করবি? তখন বেভারিজ সায়েব তোকে খিলাবে? তখন তো ফ্যা ফ্যা করে নোকরির চেষ্টায় ঘুরে বেড়াবি মুর্শিদাবাদের দফতরে–ওরা তো আর হিন্দুস্তানে মৌরসিপাট্টা নিয়ে জমিনদারি করতে আসেনি–
কান্ত খবরটা শুনে সত্যিই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ফিরিঙ্গি কোম্পানি কারবার গুটিয়ে কালাপানি পাড়ি দিয়ে চলে যাবে?
তা যাবে না? ওরা তো পয়সা লুঠতে এসেছে, পয়সা না পেলেই চলে যাবে। পয়সা না পেলে কেউ ঝুটমুট পড়ে থাকে? আবার যেখানে পয়সা কামাবে সেখানে চলে যাবে। ওদের কী? ওরা বেনের জাত, পয়সা কামিয়ে পাততাড়ি গুটিয়ে একদিন চলে যাবে। তখন ভো-ভ-মাঝখান থেকে তোর নোকরিটা খতম হয়ে যাবে
সেই বশির মিঞার কথাতেই বলতে গেলে কান্ত বেভারিজ সাহেবের চাকরি ছেড়ে দিয়ে এই নিজামত সরকারের চাকরিতে ঢুকেছে।
বশির মিঞা বলেছিল–মন দিয়ে টিকে থাক তুই, এখন নতুন নবাব হয়েছে, আমার ফুপার বড় ইয়ার মনসুর-উল-মুলক সিরাজ-উ-দ্দৌলা শা কুলি খান বাহাদুর হেবাত জঙ আলমগির–
তা সেই চাকরিতে ঢুকতে-না-ঢুকতে প্রথম হুকুম হয়েছে হাতিয়াগড় থেকে সেখানকার রানিবিবিকে মুর্শিদাবাদের হারেমে নিয়ে আসতে হবে। এনে কী হবে, কিছুই বলে দেয়নি বশির মিঞা। নিজামতের হুকুম হচ্ছে হুকুম। দুটো সেপাই দিয়েছে কোতোয়ালি থেকে তার সঙ্গে, পালকি দিয়েছে, পালকি-বেহারা দিয়েছে, নিজামতি পাঞ্জা দিয়েছে।
ও কান্তবাবু!
সেপাই দুটো গাছতলা থেকে ডাকছিল কান্তকে। কিন্তু তার আগেই সরাইখানার ভেতর থেকে মিহি গলায় আর একটা ডাক এল।
বাবুজি!
সেই বাঁদিটা। বোরখার মুখের ঢাকনাটা ঈষৎ খুলে তাকে ডাকছে।
কান্ত কাছে গেল। আমাকে ডাকছ নাকি?
বিবিজি গোসলখানায় গিয়েছিল, খানার কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম, বলছেন, বাবুজিকে ডেকে আন!
আমাকে? কেন?
তা জানি না হুজুর।
মুসলমানি খানা খাবেন না বুঝি? তা আমি তো সেই জন্যেই কোতোয়ালিতে যাচ্ছি হিঁদু খানার বন্দোবস্ত করতে–
বাঁদি বললে–না, তা নয় হুজুর, বিবিজি মুসলমানি খানা খাবেন আমাকে বলেছেন।
মুসলমানি খানা খাবে? হাতিয়াগড়ের রানিবিবি হিন্দুর মেয়ে হয়ে মুসলমানের ছোঁয়া খাবে? তুমি ঠিক বলছ?
জি হাঁ–আপনি ভেতরে আসুন, বিবিজি আপনার সঙ্গে একবার মোলাকাত করবেন আপনি আসুন
কান্ত একটু আড়ষ্ট হয়ে উঠল। তারপর সামলে নিয়ে বলল–আচ্ছা। চলো–
*
ঠিক এই পর্যন্ত এসেই পাতাটা শেষ। এর পর আর নেই। অনেক খুঁজে খুঁজেও আর পাওয়া গেল না। পুরনো পুঁথি পড়ার এই একটা অসুবিধে। যেখানে ঠিক কৌতূহলটা ঘন হয়ে আসছে সেই জায়গাটাই বেছে বেছে পোকায় কাটে, সেই জায়গাটাই বেছে বেছে হারিয়ে যায়।
হঠাৎ পশুপতিবাবুর একটা চিঠি পেলাম।
তিনি লিখেছেন–বাড়ি মেরামত করতে গিয়ে পুঁথির আরও অনেকগুলো পাতা পাওয়া গিয়েছে, আপনি একবার এসে দেখে যাবেন—
পুরনো পুঁথি নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তারা জানেন, এর মধ্যে অনেক রকম ভেজাল থাকে। একজন চণ্ডীদাস শেষকালে দশজন চণ্ডীদাসে পরিণত হতে পারে। তখনকার দিনে ছাপাখানা ছিল না। একহাজার পাতার একখানা পুঁথি একজন নকলনবিশকে পাঁচটা টাকা আর একখানা বাঁধিপোতা গামছা দিলেই নকল করে দিত। তারপর তার মধ্যে নিজের বিদ্যে বুদ্ধি শিক্ষা অশিক্ষা ঢুকিয়ে দিলে কারও
আর কিছু ধরার উপায় থাকত না।
কিন্তু এ-পুঁথি অন্যরকম। এ কবি নিজের হাতেই লিখেছেন বলে মনে হল। এমন কিছু বিখ্যাত কবিও নন। নকলনবিশের হাতের ছোঁয়াচ কোথাও পাওয়া গেল না। আর পশুপতিবাবু নিজেই বলছেন তাদের পূর্বপুরুষ উদ্ধব দাস। খাস বিশ্বাস হলেও দাসই বটে। কিন্তু কবি বিনয়ী। বৈষ্ণব পদকর্তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে উদ্ধব দাসও নিজেকে ভক্ত হরিদাস বলে ঘোষণা করেছেন। দাসানুদাস। তিনি নিজে কিছুই নয়। নিজের জন্যে তিনি কিছুই করেননি। এই জমি, এই সম্পত্তি, এই ভোগ-ঐশ্বর্যবিলাস তার কিছুই তার প্রাপ্য নয়। তিনি এই সংসারে ঈশ্বরের কৃপায় এসেছিলেন আবার একদিন ঈশ্বরের কৃপাতেই বিদায় নেবেন। এ-সংসারে কে কার? এ-সংসারই তো তার লীলাভূমি গো।
আমার খুব আগ্রহ ছিল এই বেগম মেরী বিশ্বাস সম্বন্ধে কিছু জানতে। কে এই মেরী বিশ্বাস। অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার ইতিহাসে লর্ড ক্লাইভের সঙ্গে এই বেগমের কীসের সম্পর্ক। এই হাতিয়াগড়ের রানিবিবিই বা কে? যে কান্ত ছেলেটি নিজামত নবাব-সরকারের হুকুম পেয়ে কোনও হিন্দু রানিবিবিকে নিয়ে কাটোয়ার সরাইখানাতে উঠল, ও-ই বা কে? উদ্ধব দাসই বা এদের কথা জানল কী করে? সে এত বড় মহাকাব্য লিখতে গেল কেন? যে-ইতিহাস ছোটবেলা থেকে পাঠ্যপুস্তকে পড়ে এসেছি এর সঙ্গে তো তা মিলছে না। উদ্ধব দাস এ ইতিহাস কোথায় পেলে?
পড়তে পড়তে অনেক রাত হয়ে এল। তারপর কলকাতার অন্ধকার ঘরের মধ্যে একে একে পৃথিবীর সমস্ত লোক ঘুমিয়ে পড়ল। শুধু আমি একলা জেগে রইলাম, আর জেগে রইল ইন্ডিয়ার অষ্টাদশ শতাব্দী। অষ্টাদশ শতাব্দীর সেই পৃথিবী থেকে আর্তকণ্ঠের এক করুণ চিৎকার ভেসে উঠল। সে কান্না সেদিন কেউ শুনতে পায়নি। আলিবর্দির হারেমের মধ্যে সেই একক-কান্না এত বছর পরে আবার যেন পুঁথির পাতা বেয়ে আমার কানে এসে পৌঁছোল। কে কাঁদছে? আজকে চারিদিকে যখন সবাই হাসছে, তখন কাঁদছে কে?
কোথাও তো কেউ জেগে নেই। অষ্টাদশ শতাব্দী, উনবিংশ শতাব্দী, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পেরিয়ে এসেও আমরা তো সবাই ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। যারা পাহারা দেবার ছিলেন তারা সবাই তো বিদায় নিয়েছেন। রামমোহন বিদ্যাসাগর রবীন্দ্রনাথ, কেউ নেই পাহারা দেবার। মাঝখানে দু’দুটো বড় যুদ্ধ আমরা পার হয়েছি। দু’শো বছর ব্রিটিশের তবে কাটিয়ে আমাদের মেরুদণ্ড বেঁকে গিয়েছে। আমরা নির্বিঘ্নে অনাচার করছি, অত্যাচার করছি, চুরি করছি, ব্ল্যাকমার্কেট করছি, লোক-ঠকানোর কারবারে আমরা বেশ রীতিমতো পাকা হয়ে উঠেছি। ঘটনাচক্রে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে বটে, কিন্তু আমরা তো স্বাধীন হইনি। দারিদ্র্য আর অভাব আর অনাচার থেকে তো মুক্তি পাইনি। কিন্তু তবু তো আমরা কেউ-ই কঁদিনি। তবে এমন করে আজ কাঁদছে কে?
অথচ আমরাই এতদিন খদ্দর পরেছি, চরকা কেটেছি, লবণ সত্যাগ্রহ করেছি। এতদিন মেদিনীপুরে একটার-পর-একটা বিলিতি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবদের গুলি করে মেরেছি। রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ঢুকে সাহেবদের খুন করে কঁসি গিয়েছি। পাড়ায় পাড়ায় লাঠিখেলা কুস্তি করার আখড়া বানিয়েছি। বন্দে মাতরম’ শুনলে আমাদের রক্ত নেচে উঠেছে। সেসব কথা তো স্বাধীন হবার পর আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম। ১৯৪৭ সালের পর থেকে আমি আর পশুপতিবাবুরা তো খদ্দর পরা ছেড়েই দিয়েছি। লুকিয়ে লুকিয়ে বিলিতি জিনিস কিনতে পেলে বর্তে গিয়েছি। লাঠিখেলা আর কুস্তির আখড়া তুলে দিয়ে সেখানে আমরা সরস্বতীপুজো করি। পুজোর ঠাকুরের সামনে আমরা লাউডস্পিকার লাগিয়ে সিনেমার সস্তা গান মাইক্রোফোনে বাজাই। আমরা ধুতি ছেড়ে দিয়ে সরু-পা-ওয়ালা প্যান্ট পরি। ট্র্যানজিস্টার-সেট কাঁধে ঝুলিয়ে মডার্ন হয়ে ঘুরে বেড়াই। কাঁদবার তো আমাদের সময় নেই! তবে এমন করে আজ কাঁদছে কে?
হঠাৎ নজরে পড়ল বিরাট দমদম হাউসের এককোণে বেগম মেরী বিশ্বাস একা জেগে জেগে কাঁদছে।
উদ্ধব দাস তাঁর কাব্যের শেষ সর্গে শান্তিপর্বের ভেতর বেগম মেরী বিশ্বাসের যে-চিত্র এঁকেছেন তা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। অষ্টাদশ শতাব্দীর মানুষ আজ এই বিংশশতাব্দীর মানুষের মতোই সেদিন নিজেদের বুঝতে পারেনি। একদিন হাতিয়াগড়ের রানিবিবিকে পরোয়ানা পাঠিয়ে নবাবের হারেমের মধ্যে এনে পুরেছে। সে ছিল লালসা আর রূপের আকর্ষণ। মেয়েমানুষের দেহ আর অর্থ উপার্জনের কলাকৌশল আয়ত্ত করাকেই সেদিন চরম মোক্ষ বলে জ্ঞান করেছে সবাই। টাকা চাই। যেমন করে হোক টাকা চাই-ই। জীবন অনিত্য। এই জীবদ্দশাতেই আমার ভোগের চরম পরিতৃপ্তি চাই। বাদশার কাছ থেকে পাওয়া খেতাব চাই। নবাবের পেয়ারের পাত্র হওয়া চাই। তা হলেই বুঝলাম আমার সব চাওয়া-পাওয়া মিটল। তা হলেই বুঝলাম আমার মোক্ষ লাভ হল।
ঠিক এই অবস্থায় বেগম মেরী বিশ্বাস কাঁদছে কেন?
মানুষ যা চায় সব তো পেয়েছিল মরিয়ম বেগমসাহেবা। গ্রামের অখ্যাত এক নফরের মেয়ে হয়ে জন্মে একদিন চেহেল-সুতুনের বেগমসাহেবা হয়েছিল। তারপরে হল কর্নেল ক্লাইভের প্রিয়পাত্রী। তখন কর্নেল ক্লাইভ মানেই বাংলা মুলুকের নবাব। তবু কেন সে কাঁদে?
মরিয়ম বেগমসাহেবারা যে কেন কাঁদে তা জানতে হলে উদ্ধব দাসের কাব্যের আরও অনেক পাতা, ওলটাতে হবে।
যে-কান্ত একদিন নিজামতের হুকুমত পেয়ে হাতিয়াগড়ের হিন্দু রানিবিবিকে এই চেহেল্-সুতুনে নিয়ে এসেছিল তাকে আর তখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বশির মিঞা ছুটোছুটি করছে চারদিকে। সেই কাফের কান্তটা কোথায় গেল?
ওদিকে চারদিকে কড়া পাহারা বসেছে। চেহেল সুতুনের ভেতর থেকে কোনও জিনিস না বাইরে বেরিয়ে যায়। মিরজাফর আলি সাহেব কড়া হুকুম দিয়ে দিয়েছে কোতোয়ালিতে। হারেমের ভেতরে খোঁজা-সর্দার পিরালি খাঁ তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে বেগমসাহেবাদের ওপর। বাইরে থেকে জাল পাঞ্জা নিয়ে কেউ যেন না ভেতরে ঢুকতে পারে। যদি কেউ ঢুকে পড়ে তো তাকে সোজাসুজি মিরজাফর আলি সাহেবের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। ফিরিঙ্গি কোম্পানির কাছ থেকে হুকমত এসেছে যতক্ষণ না কর্নেল ক্লাইভ সাহেব নিজে এসে তদন্ত করেন ততক্ষণ একটি জিনিসও কারও সরাবার এক্তিয়ার নেই। এ হুকুমতের নকল বাইরেও পাঠানো হয়েছে। মুৎসুদ্দিয়ান, কানুনগোয়ান, চৌধুরীয়ান, করোরিয়ান, জমিদারান পংনসরৎসাহী ওরফে হাতিয়াগড় সরকার ও পং হোসেন প্রতাপ সরকার সিলেট জায়গির নবাব সমসদ্দৌলা সুবে বাংলা। তোমরা সকলে অবগত হও যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্নেল ক্লাইভ মুর্শিদাবাদে আগত হইতেছেন। উক্ত দিবসে উক্ত মুৎসুদ্দিয়ান, কানুনগোয়ান, চৌধুরীয়ান, করোরিয়ান, জমিদারান, প্রভৃতি সকলে তাহার নিকট হাজিরা দিয়া সরকারি হুকুমতের মর্যাদা নির্বাহ করিবা।
মোতালেক মুসুবাদ কাজির দেউড়ি,
–জনাব মনসুর আলি মেহের মোহরার ॥
এই পরোয়ানা বেরোবার পর থেকেই সবাই উদগ্রীব হয়ে বসে আছে। এবার কী হবে! এবার কে নবাব হবে! যে নবাবকে খুন করেছে তার কী হবে! কিন্তু কারও মুখে কোনও কথা নেই। সবাই ভয়ে। ভয়ে মুখ বন্ধ করে ঘরের ভেতরে দরজায় হুড়কো এঁটে বসে আছে।
তবু রাস্তাতেও ভিড়ের কমতি নেই। মনসুরগঞ্জ-হাবেলিতে এসে উঠেছে মিরজাফর আলি খাঁ। উঠেছে তার ছেলে মিরন আলি খাঁ। ফটকের সামনে কড়া পাহারা বসে গেছে। বন্দুক কাঁধে নিয়ে তারা দিন রাত পাহারা দেয়। জগৎশেঠজি আসে, হাতিয়াগড়ের ছোটমশাই আসে, ডিহিদার রেজা আলি আসে, মেহেদি নেসার আসে। পরামর্শ আর ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হয়। কে নবাব হবে, ক্লাইভ সাবে কাকে নবাব করবে! লোকের কৌতূহলের শেষ নেই!
বহুদিন আগে একদিন একটা পালকি এসে থেমেছিল চেহেল্-সুতুনের ফটকে। নিজামতের চর কান্ত সরকার সেদিন পালকিটাকে চেহেল সুতুনের ফটক পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে নিজের আস্তানায় চলে গিয়েছিল। আর কেউ জানত না সে-ঘটনাটার কথা। বড় গোপনে সে ব্যাপারটা সমাধা হয়েছিল বশির মিঞার সঙ্গে। কিন্তু যারা জানত না তারা একটু কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল। নবাবি হারেম। সে বড় তাজ্জব জায়গা। আগে কান্ত সরকারের এ-সম্বন্ধে কোনও ধারণা ছিল না। এত তার অলিগলি, এত তার কানুন-কিসমত। দুনিয়ার সমস্ত আইন-কানুনের বাইরে যেন চেহেল্-সুতুন। সেখানে খুন হয়ে গেলেও নবাবের খেদমতে তার কোনও আর্জি নেই। অন্ধকারে সেখানে তোমাকে গলা টিপে খুন করে মেরে ফেললেও কেউ প্রতিকার করবার নেই। সেখানে তুমি যদি একবার যাও তা হলে আর কখনও বাইরে আসবার কথা মুখে আনতে পারবে না। ইন্তেকাল পর্যন্ত তুমি সেখানে বন্দি হয়ে রইলে।
পালকিটা গিয়ে চবুতরার সেই কোণের দিকে দাঁড়াল।
কান্ত সেই দিকেই সেদিন হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। বশির মিঞার কথাতে যেন তার ঘুম ভাঙল।
বশির মিঞা বললে–লে চল, ওদিকে আর দেখিসনে, নবাবের মালের দিকে নজর দিতে নেই, কেউ জানতে পারলে তোর গর্দান যাবে!
কথাটা কানে গিয়ে বিধেছিল খট করে।
কী বললি তুই?
বশির হেসে উঠল খিলখিল করে। চোখ মটকে বললে, নবাবের মাল—
তার মানে?
কান্তর আপাদমস্তক রিরি করে উঠল।
কী বলছিস তুই? ও তো হাতিয়াগড়ের রানিবিবি! ও তো হিন্দু বিবি রে—
বশির মজা পেয়ে গেল। বললে–হিন্দুদের বিবিরাই তো মজাদার মাল রে—
কান্তর মনে হল এক চড়ে বশির মিঞার মুখখানা ঘুরিয়ে দেয়। এমন জানলে কি আর সে রানিবিবিকে এমনভাবে এত দূর রাস্তা সঙ্গে করে পাহারা দিয়ে আনত। বশির মিঞা হয়তো রসিকতার চোটে ভুলেই গিয়েছিল যে কান্ত হিন্দু। কান্তর দিদিমা মুসলমানদের ছুঁয়ে ফেললে গঙ্গায় স্নান করে ফেলত। বড়চাতরার জমিদারবাবুরা ফৌজদারের কাছারিতে নাজিরের চাকরি করত বটে, কিন্তু সেরেস্তার কাজ সেরে বাড়িতে এসে কাপড়-পিরেন সব ছেড়ে ফেলত। তারপর স্নান করে শুদ্ধ হত। আর কান্ত আজ নিজামতে চাকরি করতে এসেছে বলে একথাও মুখ বুজে সহ্য করতে হল।
কিন্তু নবাবের কি মেয়েমানুষের অভাব যে হাতিয়াগড়ের রানিবিবিকে খুঁজে এনে এখানে চেহেল্-সুতুনে পুরতে হবে?
অভাব হবে কেন? তুই বড় বেকুবের মতো কথা বলিস! একটা মেয়েমানুষে কি কারও চলে? এই দ্যাখ না, আমার তো তিন-তিনটে আওরাত। একটু একঘেয়ে লাগলেই মুখ বদলে নিই। দুনিয়ায় মেয়েমানুষের পয়দা হয়েছে কেন বল তো?
তার মানে?
এরকম অদ্ভুত প্রশ্ন কান্তর মাথায় কখনও আসেনি। এ নিয়ে আলোচনা করতেও তার যেন একটু লজ্জা হল।
বশির মিঞা বললে–না, তোর জানা দরকার, নবাবদের এত বেগম থাকে কেন! খোদাতালার বেহেস্তে যেমন হুরি-পরি থাকে নবাবদের হারেমেও তেমনি বেগম বাদি থাকে। কেউ আসে খোরাসান থেকে, কেউ কান্দাহার থেকে, কেউ চাটগাঁ থেকে, কেউ কালাপানির ওপার থেকে।আমার তলব বাড়লে। আমি তো ইয়ার ঠিক করেছি একটা ইহুদি আওরাত রাখব। ইহুদি আওরাত দেখেছিস?
কান্তর বিরক্তি লাগছিল। বললে–ওসব কথা থাক এখন–
সেদিন ওই পর্যন্ত কথা হয়েছিল বশির মিঞার সঙ্গে। হাতিয়াগড়ের রানিবিবিকে চেহেল সুতুনের ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে সেদিনকার মতো কান্তর ছুটি হয়ে গিয়েছিল। আবার কোনও নতুন হুকুম হলেই বশির মিঞা তাকে জানাবে বলেছিল। কিন্তু তারপর হুড়মুড় করে সব কী যেন ঘটে গেল। তখন যা কিছু ঘটেছে সব তার চোখের আড়ালে। তখন সে বেগম সেজে বোরখা পরে চেহেল সুতুনের ভেতরে লুকিয়ে আছে মরিয়ম বেগম সেজে।
তখন সবাই জানে কান্তই মরিয়ম বেগম। বোরখা পরার পর কেউ আর তাকে চিনতে পারেনি।
মরিয়ম বেগমকে ধরবার জন্যে তখন সমস্ত মুর্শিদাবাদে তোলপাড় পড়ে গেছে। কোথায় মরিয়ম বেগমসাহেবা? মরিয়ম বেগমসাহেবা কোথায়?
মুর্শিদাবাদে এসে পৌঁছেছে কর্নেল ক্লাইভ। জোর হুকুম দিয়েছে? মরিয়ম বেগমসাহেবাকে চাই।
অথচ চেহেল্-সুতুনের ভেতরে অন্য সব বেগমসাহেবারা তখন সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে সুরমা দিয়েছে। বুকে কাঁচুলি পরেছে। পায়ে পাঁয়জোড়। সবাই সার বেঁধে অপেক্ষা করছে কখন কার ডাক পড়বে আম-দরবার থেকে।
কিন্তু তখনও কাঁদছে কে?
মনে আছে একদিন আবার কান্ত গিয়ে হাজির হয়েছিল বশির মিঞার কাছে।
বশির মিঞা বলেছিল–আবার তোর কীসের দরকার?
কান্ত বলেছিল–একটা কথা ছিল তোর সঙ্গে। একটু আড়ালে আসবি, চুপি চুপি বলব—
বশীরের যেন এসব কথা শোনবার সময়ও ছিল না। আগ্রহও ছিল না। তার তখন অনেক কাজ। তাড়াতাড়ি বললে–তোর নোকরির কথা আমি কিছু বলতে পারব না।
আমি চাকরির কথা বলছি না–
নোকরির কথা বলছিস না তো কী কথা বলছিস?
চাকরির কথা কান্তর কিছু বলবার ছিলও না। বড়চাতরা থেকে একদিন যখন চলে এসেছে তখন তার কাছে ফিরিঙ্গি কোম্পানি যা, নবাব-নাজিমও তাই। চাকরিই হয়তো তার কপালে নেই। যেমন অনেক জিনিসই তার কপালে নেই। এখন মুর্শিদাবাদের মসনদে কেউ বসুক আর না বসুক, তাতে কিছুই আসে যায় না তার।
কী বলবি জলদি বল!
সেই হাতিয়াগড়ের রানিবিবিকে সেদিন নিয়ে এসেছিলাম, তার কথা বলছি—
সে তো হারেমে আছে। তার সঙ্গে তোর কীসের দরকার ইয়ার?
তার সঙ্গে একটু দেখা করতে পারলে ভাল হত—
তোর কি মাথা খারাপ! তুই হারেমের মধ্যে যাবি? খোঁজা-সর্দার তোর গর্দান রাখবে?
কান্তর মুখখানা আরও করুণ হয়ে উঠল। বললে–তুই চেষ্টা করলে পারিস, তোর ফুপা মনসুর আলি সাহেব থাকতে কেউ তোকে কিছু বলবে না–তোর হাত দুটো ধরে বলছি ভাই, একটু দয়া কর তুই–
হঠাৎ বশির মিঞার কেমন সন্দেহ হল।
কেন বল তো? তোর এত টান কেন? তুই কি রানিবিবিকে দেখেছিস নাকি?
হ্যাঁ
কী করে দেখলি? সেপাই দিয়ে বোরখা পরিয়ে আনবার কথা ছিল, দেখলি কী করে? মুখ দেখেছিস?
হ্যাঁ!
বশির মিঞা যেন খেপে লাল হয়ে উঠল। এই জন্যেই তো কাফেরদের দিয়ে এইসব কাজ করাতে চায়নি মনসুর আলি সাহেব। নেহাত পীড়াপীড়ি করলে বশিরটা, তাই এই কাজের ভার দেওয়া। কোথা থেকে কোন হিন্দুর বাচ্চাকে ধরে এনে কিনা বললে–একে নোকরি দাও–!
বশির মিঞার তখন সত্যিই অনেক কাজ। মাথা ঘুরে যাবার মতো অবস্থা। নবাব মারা যাবার পর থেকে চারদিক থেকে শকুনেরা এসে ওত পেতে বসে আছে লুঠের মালে ভাগ বসাবে বলে। মহম্মদি বেগ নিজে মাল সাবাড় করেছে, সুতরাং তারই যেন পাওনাটা বেশি! ওটা কে না করতে পারত? নবাবকে ধরে দুটো হাত দড়ি দিয়ে বেঁধে একটা চাকু বুকের ওপর চালিয়ে দিয়েছে। একবার দু’বার তিনবার। একবারেই মামলা ফতে হয়ে গিয়েছিল। তবু সাবধানের মার নেই। হাত দুটো খুনে লাল। ভেবেছিল, মিরনের যখন দোস্ত সে, তখন দোস্তালির হকদার হতে পারবে সে। কিন্তু সে গুড়ে বালি। হকদার এই কদিনেই অনেক পয়দা হয়েছে। সবাই মিরজাফর আলি খাঁ’র দিকে হা করে চেয়ে আছে। সে-ই যেন বেহেস্তের আফতাব পাইয়ে দেবে!
কান্ত বললে–একটিবার শুধু দেখা করিয়ে দে ভাই বশির আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল রানিবিবি
তোর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল? বলছিস কী তুই? তুই রানিবিবির সঙ্গে কথাও বলেছিস নাকি–?
হ্যাঁ!
যেন অমার্জনীয় অপরাধ করে ফেলেছে কান্ত, এমনি করে তার দিকে চাইলে বশির।
তুই যে কথা বলেছিস এটা কেউ জানে? কেউ দেখেছে?
কান্ত বললে—না—
কেউ দেখেনি তো?
না, আমি লুকিয়ে দেখা করেছি—
কিন্তু তুই তো জানিস নবাবের হারেমের বিবিদের সঙ্গে কারও মোলাকাত করার এক্তিয়ার নেই, দেখা করা গুনাহ–
কান্ত বললে–কিন্তু আমাকে যে রানিবিবি ডেকে পাঠিয়েছিল ভাই–আমার কী দোষ।
তোকে ডেকে পাঠিয়েছিল? কোথায়? কী জন্যে?
কান্ত বললে–কাটোয়াতে!
কী কথা বললে রানিবিবি?
এবার যেন বশির মিঞাও কান্তকে হিংসে করতে লাগল। এমন জানলে বশির মিঞা নিজেই তো হিন্দু কাফের সেজে রানিবিবিকে নিয়ে আসত। কিন্তু ওদিক থেকে হুকুম ছিল, রানিবিবিকে আনতে পাঠাবার জন্যে যেন নবাব-নিজামত সরকারের হিন্দু আমলা পাঠানো হয়। নইলে এসব কাজের জন্যে কখনও লোকের অভাব হয় নাকি।
বলব তোকে সব, আল্লার-কিরে বলছি সব বলব, কিন্তু তার আগে আমাকে একবার দেখা করিয়ে দে রানিবিবির সঙ্গে। হারেমের ভেতরে গিয়ে একবার শুধু বাইরে থেকে একটা কথা বলে আসব–
কী কথা?
কান্ত বললে–কাটোয়ার সরাইখানার সামনে একটা পাগলা নোক এসে সেদিন খুব গান গেয়েছিল, সবাই খুব খুশি তার গান শুনে, রানিবিবি তার নামটা জানতে চেয়েছিল আমার কাছে। আমি নামটা জেনে এসে আর বলতে পারিনি তাকে। বলবার সুযোগ হয়নি–
কে সে লোকটা?
সে একটা পাগলা কছমের লোক। কিন্তু খুব মজাদার গান গাইতে পারে ভাই। আমাকে তার নামটা জেনে আসতে বলেছিল রানিবিবি। নামটা জেনেও এসেছিলাম, কিন্তু রানিবিবিকে তা বলা হয়নি সেইটে একবার হারেমের ভেতরে গিয়ে বলে আসব–একবার শুধু যাব ভেতরে, আর নামটা রানিবিবিকে বলেই চলে আসব–মাইরি বলছি, ভেতরে আমি থাকব না বেশিক্ষণ–
বশির মিঞা চুপ করে কী যেন ভাবতে লাগল।
এই তোর পায়ে পড়ছি ইয়ার, আজকে একবার দেখা না করতে পারলে হয়তো জীবনে আর দেখা করা হবে না। অথচ কথা দিয়ে কথা রাখতে পারলুম না বলে মনটায় বড় আফশোস হচ্ছে ভাই, এ আফশোস আমার মরণেও যাবে না–
কিন্তু লোকটা কে? কার নাম জানবার জন্যে রানিবিবির এত নাফড়া?
কান্ত বললে–বলছি তো একটা পাগলা-ছাগলা লোক—
জাসুস নয়তো?
জাসুস? তার মানে?
ফিরিঙ্গিদের গোয়েন্দা ফোয়েন্দা নয়তো? ওরা তো চর লাগিয়েছে তামাম মুর্শিদাবাদে–
আরে না, জাসুস হতে যাবে কেন? চরই বা হবে কেন?
তা নাম কী তার?
উদ্ধব দাস!
নামটা শুনে কিছুই বোঝা গেল না। মনসুর আলি মেহের সাহেবের মোহরার দফতরে ওনামের কোনও চর তো নেই। সকলের নামই মুখস্থ করে রেখেছে বশির মিঞা। উদ্ধব দাস তা হলে হয়তো কোনও বাউল-ফকির হবে। বাউল-ফকিরদের মুলুক এই বাংলা মুলুক। সব বাঙালির বাচ্চাই বাউল-ফকির ভেতরে ভেতরে। ওরা রাজ্য চায় না, মসনদ চায় না, আওরাত চায় না, দৌলত চায় না, শুধু চায় আল্লাতালার দোয়া। তাজ্জব জাত এই বাঙালির বাচ্চারা। আল্লাতালার নাম করতে করতে বাদশাহি পর্যন্ত চলে গেলেও এদের খেয়াল থাকে না।
বশির মিঞা বললে–আচ্ছা চল, খোঁজা-সর্দারকে বলে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছি তোকে, কিন্তু হুঁশিয়ার, বেশিক্ষণ থাকবি না
কান্ত বললে–না ভাই বশির, কথা দিচ্ছি বেশিক্ষণ থাকব না—
তারপর কোণের ফটকটার কাছে গিয়ে বললে—আয়–
ফটকের সামনে পাহারা দিচ্ছিল কে একজন। বশির মিঞা তাকে পাঞ্জা দেখাতেই ভেতরে যেতে দিলে। লম্বা সুড়ঙ্গ মতন রাস্তা। মাথার ওপরে পাতলা ইটের ছাদ। সেটা পেরিয়ে আর একটা ফটকের কাছে আসতেই আর একজন মুখোমুখি দাঁড়াল। বশির মিঞা বুক ফুলিয়ে এগিয়ে গেল। ভয়ডর কিছু নেই। এই পথ দিয়েই হারেমে যাবার রাস্তা। দু’পাশে ঘুলঘুলির মতন গর্ত। ঘুলঘুলির মধ্যে পায়রা বাসা বেঁধেছে। সামনে দিয়ে কারা আসছে। তারা বাইরে যাবে।
বশির মিঞা পাহারাদারকে জিজ্ঞেস করলে–পিরালি কোথায় রে?
লোকটা কী যেন বললে। বশির মিঞা তাকে একপাশে ডেকে কানে কানে কী বলতে লাগল। হাত-মুখ নেড়ে দু’জনের কী সব কথাও হল। দূর থেকে কান্ত কিছুই শুনতে পেলে না। বশিরের ইঙ্গিতে কাছে যেতেই বশির বললে–দেখিস হুঁশিয়ার, ঝটপট চলে আসবি, আর তোর কাছে টাকা আছে?
কান্ত বললে–টাকা? কীসের টাকা?
টাকা লাগবে না? তোকে ঢুকতে দিচ্ছে যে, পিরালিকে ঘুষ না দিলে যে চেয়েই দেখবে না তোর দিকে–
টাকা তো সঙ্গে নেই, তলব পেয়ে পরে দিতে পারি।
বশির মিঞা বললে–দুর, নগদ ছাড়া ঘুষ হয় কখনও! ঘুষের কারবার কখনও বাকিতে চলে?
বলে নিজের পিরানের জেব থেকে টাকা বার করে লোকটার হাতে দিলে। সঙ্গে সঙ্গে একটা লম্বা সেলাম করলে লোকটা কান্তকে। বললে—চলো–
লোকটার পেছন পেছন কান্ত এগিয়ে যেতে লাগল আর একটা ইট-বাঁধানো রাস্তা দিয়ে।
.
কিন্তু যতই ভেতরে যেতে লাগল ততই অবাক হবার পালা কান্তর। ভেতরে তখন বোধহয় খুব গোলমাল চলছে। কারা বোরখা পরে সামনের দিকে আসছিল। লোকটার পেছনে দাঁড়িয়ে কান্ত তাদের পথ করে দিলে। আবার পেছন থেকেই দৌড়োতে দৌড়োতে দু’জন লোক আসছিল। তারা চেঁচাতে লাগল–ফিরিঙ্গিলোগ আ গয়া।
কে এসেছে?
কলকাতা-কুঠির টুপিওয়ালা সাহেবলোগ!
কথাগুলো যেন বিদ্যুতের মতো ক্রিয়া করল চারদিকে। কোথা থেকে আর এক দল লোক বেরিয়ে আসতে লাগল পিলপিল করে। তাদের কথাবার্তা থেকে কিছু বোঝা গেল না।
*
কিন্তু কান্ত জানতেও পারলে না মুর্শিদাবাদের গঙ্গার এ-পারে তখন মানুষের ভিড়ে কোথাও তিল ধরবার জায়গা নেই আর। সারা দেশ ঝেটিয়ে মানুষ এসেছে ইতিহাসের আর এক মজা দেখতে। এতদিন যারা। ঘরের হুড়কো এঁটে মুখে কুলুপ লাগিয়ে বসে ছিল, তারা সবাই গঙ্গার ঘাটে এসে ভিড় জমিয়েছে। এসেছে! ফিরিঙ্গি-কোম্পানির সাহেবরা এসেছে। আর ভয় নেই। এবার ঘরের মেয়েছেলে নিয়ে। নিশ্চিন্তে গেরস্থালি করব। জোর করে কেউ কলমা পড়াবে না। একসঙ্গে দূর থেকে পালতোলা ক’টা জাহাজ বেশ গম্ভীর চালে এগিয়ে আসতে লাগল। মুর্শিদাবাদের মানুষ আনন্দে লাফিয়ে উঠল সেই দিকে। চেয়ে। কাউকে চিনতে পারবার জো নেই। লাল-লাল মুখ সব। গোরা পল্টন। সবসুদ্ধ গোটা তিরিশেক। লোক হবে, তার বেশি নয়।
ক্লাইভ সাহেবের কেমন ভয় করতে লাগল। সবাই যদি একটা করে ঢিল ছুঁড়ে মারে তা হলেই তো আর তাদের দেখতে হবে না। পাশেই গভর্নর ড্রেক সাহেব। মেজর কিলপ্যাট্রিক, মেজর গ্র্যান্ট, মিস্টার ম্যানিংহাম, অমিয়ট, স্ক্র্যাফটন, ওয়াটসন। আর পেয়ারের মুনশি নবকৃষ্ণ। আরও অনেকে। সামনের ফৌজিদল আস্তে আস্তে শহরে ঢোকবার চেষ্টা করতে লাগল। আর সঙ্গে সঙ্গে মুর্শিদাবাদের মানুষ শাখ বাজাতে, উলু দিতে লাগল।
কান্ত দেখে, ক্লাইভ সাহেব পাশে দাঁড়ানো মিরজাফর আলিকে জিজ্ঞেস করলেওরা কী বলছে? ওরা কারা? ও কীসের সাউন্ড?
মিরজাফর বললে–ও কিছু না কর্নেল, ওরা সবাই হিন্দু, আপনারা আসছেন শুনে ওদের খুবই আনন্দ হয়েছে, আনন্দ হলেই ওরা ওইরকম চিল্লাচিল্লি করে–
তখন সবাই আরও সামনে এগিয়ে এল। আরও জোরে শাঁখ বেজে উঠল। আরও জোরে উলু দিতে লাগল মুর্শিদাবাদের মানুষেরা। উ-লু-লু-লু-লু-লু—
.
সেইখানে সেই নিজামত-হারেমের সামনে দাঁড়িয়েই কান্ত যেন আর এক পৃথিবীতে পৌঁছে গেছে। ছোটবেলা থেকে বড় হওয়ার বৈচিত্র্য দেখতে দেখতে আর অনুভব করতে করতে বিচিত্ৰতর এক জগতের মধ্যে যেন সে ঢুকে পড়েছে। সেই বড়চাতরা, সেই চৌধুরীদের চকমিলানো বাড়ি আর সেই বগি। সে যেন তার অতীত। সেই অতীতটার ভিতের ওপর তার ভবিষ্যতের সৌধ গড়তে গিয়ে দেখেছিল, কলকাতার বেভারিজ সাহেবের সোরার গদিবাড়িটা বেশ মজবুত করে গেঁথে তুলেছে সে। সেটা যখন ভেঙে গেল, তখন আর নতুন করে গড়বার কিছু ছিল না তার। সেও ওই হাতিয়াগড়। হাতিয়াগড়ের একটা বাড়িতে গিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসবার স্বপ্নও দেখেছিল সে। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেই কি সবকিছু হয় না সবকিছু থাকলেই ইচ্ছে হয়। আসল ইচ্ছের সঙ্গে ইচ্ছেপূরণের কোনও সম্পর্কই নেই।
হাতিয়াগড়ের রানিবিবি সেই কথাই জিজ্ঞেস করছিল কাটোয়াতে।
.
সবই যদি ঠিক ছিল তো বিয়ে হল না কেন?
কান্ত বলেছিল–আমার যে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল যেতে
রানিবিবি অবাক হয়ে বলেছিল–সেকী? মানুষের খেতে দেরি হতে পারে, ঘুমোতে যেতেও দেরি হতে পারে, কিন্তু তা বলে তুমি বিয়ে করতে যেতেই দেরি করে ফেললে? ঘুমিয়ে পড়েছিলে বুঝি?
কান্ত লজ্জায় পড়ল। রানিবিবি যে তার সঙ্গে এমন কথা বলবেন, তা সে কল্পনাও করতে পারেনি। রানিবিবির মুখখানা একেবারে খোলা। মানে তার মতো অচেনা পুরুষমানুষের সঙ্গে দেখা করতে এতটুকু সংকোচও নেই। আর তা ছাড়া রানিবিবির বয়েসটা যে এত কম হবে, তাও তো ভাবতে পারেনি সে। বেশ জ্বলজ্বলে টাটকা সিঁদুর রয়েছে মাথার সিথিতে। সকালবেলা স্নান করে চুল এলো করে দিয়েছে পিঠের দিকে। বাঁদিটা বোধহয় তাম্বুলাবহার দিয়ে পান সেজে দিয়েছিল, তাই চিবোচ্ছে।
আপনার খাওয়ার কোনও অসুবিধে হয়নি তো? আমি কোতোয়ালিতে আপনার খাওয়ার কথা বলতে গিয়েছিলাম। শেষকালে হয়তো গোস্তটোত খাইয়ে দেবে, এই ভয় করছিলুম–
আমি গোস্ত খাই তো!
সেকী, আপনি গোরুর মাংস খান?
হেসে উঠল রানিবিবি–মোগলের হাতে যখন পড়েছি, তখন গোরুর মাংস খাওয়ালেই বা কী, আর শুয়োরের মাংস খাওয়ালেই বা কী! ওকথা থাক, তোমার বিয়ের কথাটা বলো—
কান্ত লজ্জায় পড়ল। বললে–কপালে আমার বিয়ে না থাকলে কী হবে!
দোষটা করলে তুমি নিজে আর নিন্দে করছ কপালের!
কিন্তু আপনি তো জানেন না, ফিরিঙ্গি কোম্পানির চাকরি কী জিনিস। কোথায় সেই সুতোনুটি আর কোথায় সেই হাতিয়াগড়। বেভারিজ সাহেবের সোরার নৌকো এল দেরি করে, সেই নৌকোর সব মাল খালাস করে গুদামে পুরে হিসেব না করলে তো ছুটি নেই। তারপরে যে-নৌকোয় করে হাতিয়াগড়ে যাবার বন্দোবস্ত করেছিলাম, তা মাঝপথে চড়ায় আটকে গেল আর বিয়ের লগ্ন ছিল রাত দু’প্রহরের সময়–
শেষপর্যন্ত কী হল?
কান্ত বলল–ভেবেছিলাম আমার জন্যে পাত্রীপক্ষ অপেক্ষা করবে, কিন্তু গাঁয়ের লোক তাড়াহুড়া করলে বলে আর একজনকে ধরে এনে তার সঙ্গে সেই লগেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল পাত্রীর বাপ–
কোথায় বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছিল?
হাতিয়াগড়ে। আপনাদেরই জমিদারিতে। আপনি হয়তো তাদের চিনবেন। পাত্রীর বাবার নাম শোভারাম বিশ্বাস–
রানিবিবি তাদের চিনলেন কিনা কে জানে। সে-সম্বন্ধে আর কিছু বললেন না। একটু পরে জিজ্ঞেস করলেন–সেই দুঃখেই বুঝি ফিরিঙ্গি কোম্পানির চাকরি ছেড়ে দিয়ে নবাব সরকারে চাকরি নিলে?
না, ঠিক তা নয়, ওখানে তিন টাকা তলব পেতাম, এখানে পাব ছ’ টাকা।
শুধু টাকার লোভেই এই চাকরি নিলে না আর কোনও লোভও ছিল?
আর কী লোভ থাকতে পারে বলুন! জিনিসপত্তরের যা দাম বাড়ছে, তাতে তিন টাকা মাইনেতে আর কুলোচ্ছে না। সেই শায়েস্তা খাঁর আমল কি আর এখন আছে!
সংসারে তোমার কে কে আছেন?
কেউ নেই। শুধু আপনি আর কোপনি।
বলে কান্তও হাসল, আর তার সেই হাসিতে রানিবিবিও হাসল। একবার কান্তর ইচ্ছে হল জিজ্ঞেস করে, মুর্শিদাবাদের নবাব-হারেমে কেন যাচ্ছেন রানিবিবি। কিন্তু কথাটা কেমন করে পাড়বে, সেই ভাবতে গিয়েই আর বলা হল না। তারপর নিজেই একটা কারণ অনুমান করে নিয়ে বললে–আপনি হয়তো ভাবছেন, আমি এর মধ্যে আছি–
কীসের মধ্যে?
এই আপনাকে নবাব-হারেমে নিয়ে যাবার মধ্যে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি এর কিছুই জানিনে। বরং আমি বশিরকে জিজ্ঞেস করেছিলুম–
বশির কে?
নিজামত কাছারিতে মোহরার মনসুর আলি মেহের খাঁ সাহেব আছেন, তার সম্বন্ধীর ছেলে। সে আমার বন্ধু। তাকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিলুম, কিন্তু সে কিছু বললে–না। আমি শুধু হুকুম তামিল করছি। এই পাঞ্জা দিয়েছে আমাকে ওরা। বলেছে, এটা দেখালে রাস্তার সেপাই কি ফৌজদারের লোক কেউ কিছু বলবে না–আপনি হয়তো মনে মনে আমাকে দুষছেন।
কেন, তোমাকে দুষতে যাব কেন?
জানি না, হয়তো আপনাকে এইরকম করে নিয়ে গিয়ে আপনার কোনও ক্ষতি করছি। সত্যি বলুন তো, আপনি একা একা সেখানে যাচ্ছেন কেন? আপনার কি কিছু কাজ আছে?
রানিবিবি একবার একটু গম্ভীর হয়ে গেল। তারপর আর-একটা পান মুখে পুরে দিয়ে বললে–এ কথার উত্তর যদি দিই, তা হলে তোমার চাকরিটাই চলে যেতে পারে। আমার কিছু হলে তোমার কিছু যাবে-আসবে না, কিন্তু তোমার চাকরি চলে গেলে তখন কী করবে?
কান্ত এবার রানিবিবির মুখের দিকে সোজাসুজি চেয়ে দেখলে। যেন কথাগুলোর মানে খোঁজবার চেষ্টা করলে রানিবিবির মুখ-চোখ-ঠোঁটের মধ্যে।
রানিবিবি আবার বলতে লাগল–দিনকাল খারাপ, এসময়ে দুটো টাকা যেখান থেকে পায়রা জোগাড় করে জমাতে চেষ্টা করো। টাকাটাই এখন সব আখেরে টাকাই কাজ দেবে!
কেন? ওকথা বলছেন কেন?
দেখছ না, নবাব থেকে শুরু করে সেপাই পর্যন্ত সবাই টাকা টাকা করে মরছে। টাকার জন্যেই তো ফিরিঙ্গিরা সাত-সমুদ্র পেরিয়ে এখানে এসেছে। বর্গিরাও তো টাকার জন্যে আসত এখানে
আপনি বুঝি আমাকে ঠাট্টা করছেন?
ঠাট্টা করব কেন? তুমি নিজেই তো টাকার জন্যে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করলে। টাকাটাই কি সব নয়?
কান্ত অবাক হয়ে গেল।–আর আপনি? আপনিও কি তাই টাকার জন্যে মুর্শিদাবাদ যাচ্ছেন?
আমি কী জন্যে যাচ্ছি, তা তোমাকে বলতে যাব কেন? আর যার জন্যেই যাই, টাকার জন্যে নিশ্চয়ই। নয়। তা ছাড়া, মেয়েমানুষরা অত টাকা-টাকা করে না। বিয়ে হলে তুমি বুঝতে পারতে–
কান্ত বললে–কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন, আমার বিয়ে করবার খুব ইচ্ছে ছিল, ভেবেছিলাম বিয়ে করে বড়চাতরায় নিয়ে যাব আমার বউকে, সেখানকার বাড়িটা সারিয়ে সুরিয়ে সেখানেই সংসার করব, ভেবেছিলাম বর্গি আসা যখন বন্ধ হয়েছে তখন আবার দেশে গিয়ে চাষবাস করব। সত্যি আমার এসব ভাল লাগছে না।
তারপর রানিবিবির দিকে চেয়ে হঠাৎ কথা বলতে বলতে থেমে গেল। বললে–আপনাকে আমার নিজের এত কথা বলছি বলে আপনি বিরক্ত হচ্ছেন না তো?
বিরক্ত হব কেন, বলো না।
বলে হাসলেন রানিবিবি।
সত্যি, কান্ত জীবনে এই প্রথম যেন একজন শ্রোতা পেয়েছে। তার অনেক কথা অনেকদিন ধরে বুকের মধ্যে জমে ছিল, শোনবার লোকই কেউ ছিল না। বেভারিজ সাহেবের সোরার গুদামে কেবল মালের হিসেবই রেখেছে সারাদিন ধরে। তারপর গঙ্গার ধারে খড়ের চালাটায় শুতে-না-শুতে এক ঘুমে। রাত কাটিয়ে দিয়েছে। কোনও কিছু ভাববার সময়ই ছিল না তখন। কিন্তু এক-একদিন যখন কালবোশেখীর ঝড় উঠত, ঝড়ে সোরার নৌকোগুলো, কোম্পানির জাহাজগুলো জলের ঢেউ লেগে ওলোটপালোট করত, সেইসব রাত্রে নিজেকে বড় নিঃসঙ্গ মনে হত তার। এক-একদিন বেভারিজ সাহেবও মদ খেয়ে বেসামাল হয়ে পড়ত। তখন সাহেবের মালী কোথা থেকে সাহেবকে মেয়েমানুষ এনে জুগিয়ে দিত। কোথা থেকে তাদের আনত সে কে জানে! চাকরি বজায় রাখার জন্যে সব কাজই করতে হত তাকে। তখন মনে হত তারও পাশে একজন কেউ থাকলে ভাল হত। তার মুখে গালে চুলে ঠোঁটে হাত দিয়ে আদর করত সে। তাকে নিয়ে বড়চাতরার সেই ঘরখানার তলায় সংসার পাতত। কিন্তু তারপর আবার কখন রাত পুইয়ে যেত। গঙ্গার ঘাটে আবার নৌকোয় পাল খাটানো হত। ভোরবেলাই নৌকোগুলো ছেড়ে দিত বদর-বদর বলে। তখন আর ওসব কিছু মাথায় আসত না। তখন আবার সোরা, তখন আবার হিসেবের খাতা, তখন আবার মোহর-টাকা-কড়া-ক্রান্তির গোলকধাঁধার মধ্যে ডুবে যেত।
তা সেই সময়েই একদিন এক ঘটকমশাই এসে হাজির। হাতে খেরো বাঁধানো খাতা। সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ তার নাম। বেশ ভাল করে কান্তর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে, কুলজিবংশ সবকিছু জেনে নিয়ে বলেছিল–তুমি বিয়ে করবে বাবাজীবন?
আসলে ওইভাবেই শুরু হয়েছিল সম্বন্ধটা। হাতিয়াগড়ের সৎকায়স্থ শোভারাম বিশ্বাস। তার একমাত্র সন্তান। মেয়েটিকে পাত্রস্থ করতে চায় তার বাপ। জমিদারি-সেরেস্তায় কাজ করে সে নিজে। নিজের বাস্তুভিটে আছে হাতিয়াগড়ে। দেবেথোবে ভাল। পৈতৃক সোনাদানা কিছু আছে। জামাই-ই সরকিছু পাবে।
কথা বলতে বলতে কান্ত থামল। বললে–এসব কথা আপনার শুনতে হয়তো ভাল লাগছে না—
না না, বলো! তারপর? পাত্রী কেমন দেখতে?
কান্ত বললে–সে কথাও জিজ্ঞেস করেছিলুম—
ঘটকমশাই কী বলেছিলেন? দেখতে খারাপ?
না, ঘটকমশাই বলেছিলেন পাত্রী খুব সুন্দরী।
খুব সুন্দরী?
কান্ত বললে–হ্যাঁ, খুব নাকি সুন্দরী, অমন সুন্দরী নাকি দেখা যায় না—
কার মতন সুন্দরী?
কান্ত বললে–তা জানিনে, আমি তো নিজের চোখে পাত্রী দেখিনি—
তবু শুনে কেমন মনে হয়েছিল? আমার চেয়েও সুন্দরী?
রানিবিবি যে কতখানি সুন্দরী তা যেন এতক্ষণ দেখবার সুযোগ পায়নি। তাই ভাল করে আর একবার রানিবিবির মুখখানা দেখলে সত্যিই এমন সুন্দরী হয় নাকি কেউ!
কান্ত বললে–আপনি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন—
ওমা, ঠাট্টা করব কেন? আমার চেয়ে সুন্দরী কেউ হয় না?
কান্ত বললে–আপনার চেয়ে সুন্দরী আবার হয় নাকি? আমি তো জীবনে দেখিনি—
রানিবিবি এবার আবার একটা পান মুখে পুরল। বলল–বেশি সুন্দরী হলে কপালে সুখ হয় না, তা জানো তো?
কেন? আপনার কি সুখ হয়নি?
রানিবিবি কী একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই হঠাৎ বাইরে যেন কার গানের আওয়াজ হল। বাইরের গাছতলায় যেখানে সেপাইরা বসে ছিল, সেইখান থেকেই গানের শব্দটা আসছিল। রানিবিবি মন দিয়ে সেই গানটা শুনতে লাগল। কান্তও শুনতে লাগল। গানটা নতুন।
কোথায় শিবে, রাখো জীবে, ত্রৈলক্য-তারিণী।
তোমার চরণ নিলাম শরণ বিপদ-হারিণী ॥
আমি মা অতি দীন।
আমি মা অতি দীন তনু ক্ষীণ, হলো দশার শেষ
কোন দিন মা রবি সুতে ধরবে এসে কেশ ॥
লোকে গান শুনছে আর তারিফ করছে। বলছে–বাঃ বাঃ বলিহারি–বলিহারি—
কে একজন বললে–ও-গান নয় হে, এবার একটা প্রেমসংগীত গাও তো হে—
লোকটা বললে–একটা খেদের গান গাই শুনুন হুজুর—
তাই গাও—
আবার গান হতে লাগল–
আমি রব না ভব-ভবনে–
শুন হে শিব শ্রবণে ॥
যে নারী করে নাথ হৃদিপদ্মে পদাঘাত
তুমি তারই বশীভূত আমি তা সব কেমনে ॥
রানিবিবি হঠাৎ যেন গম্ভীর হয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করলে–ও কে গাইছে ওখানে?
কান্ত বললে–কী জানি, আপনিও যেখানে আমিও সেখানে গানটা থামাতে বলে আসব?
রানিবিবি বললে–না, তুমি জেনে এসো তো লোকটা কে, ওর নাম কী?
কেন, আপনি চেনেন নাকি ওকে?
তুমি জেনেই এসো না—
কান্ত বাইরে যাচ্ছিল, পেছন থেকে রানিবিবি আবার মনে করিয়ে দিলে–নামটা জেনে এসে আমাকে বলবে কিন্তু–
বাইরে তখনও গান হচ্ছে
পতিবক্ষে পদ হানি ও হল না কলঙ্কিনী
মন্দ হল মন্দাকিনী ভক্ত হরিদাস ভনে।
আমি রব না ভব-ভবনে।
তখন গানটা আরও জমে উঠেছে। অশ্বথ গাছতলাটার নীচেয় বেশ গুছিয়ে বসেছে সেপাইরা। আর মধ্যিখানে একটা আধাবয়সি লোক হাত-মুখ নেড়ে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে গান গাইছে। কান্ত সামনে আসতেও যেন লোকটার সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। খানিক পরে গান থামিয়ে লোকটা কান্তর দিকে চাইল।
তোমার নাম কী গো?
লোকটা রসিক খুব। বললে–আমি হরির দাস হুজুর, আমার আবার নাম কী! তাঁর নাম গান করেই তো বেঁচে আছি–
তবু নাম তো একটা আছে, বাপ-মায়ের দেওয়া নাম, আমাদের রানিবিবি জানতে চাইছেন—
রানিবিবি!
রানিবিবির নাম শুনে লোকটার বোধহয় একটু চেতনা হল। বললে–ভেতরে বুঝি রানিবিবিকে নিয়ে লীলেখেলা হচ্ছে? তা ভাল, তা ভাল–আমার নাম উদ্ধব দাস; রানিবিবিকে গিয়ে বলো–
তারপর কথাটা বলেই লোকটা আর একটা গান ধরতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই কোতোয়াল এসে হাজির। কোতোয়ালকে দেখে সেপাই টেপাই যারা ছিল সবাই সসম্ভ্রমে পঁড়িয়ে উঠল।
তুমি আবার এখানে?
বন্দেগি হুজুর, আমি হরির দাস, ভক্ত হরিদাস–আমি আর যাব কোথায় বলুন–অধীনের কি আর যাবার জায়গা আছে?
কথাটা শেষ হবার আগেই কোতোয়াল বললে–ভাগো এখান থেকে, ভাগো–
বলে আর সেদিকে না-চেয়ে সেপাইদের দিকে চাইলে। কান্তকেও একবার দেখলে। তারপর হুকুম হল তখনই রওনা দিতে হবে মুর্শিদাবাদের দিকে। কোতোয়াল সাহেব গম্ভীর স্বভাবের মানুষ। একেবারে যে-কথা সেই কাজ। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে পালকিতে ঘেরাটোপ লাগিয়ে দিয়ে সকলকে রওনা করিয়ে দিয়েছিল। আবার পালকি চলতে লাগল রানিবিবিকে নিয়ে। রানিবিবির সঙ্গে তার কথাই হল না, দেখা তো দূরের কথা। শুধু দূর থেকে ভক্ত হরিদাসের গানের কথাগুলো একটু একটু ভেসে আসছে–
পতিবক্ষে পদ হানি ও হল না কলঙ্কিনী
মন্দ হল মন্দাকিনী ভক্ত হরিদাস ভনে।
আমি রব না ভব-ভবনে।
উদ্ধব দাসকে বুঝি ভব-ভবনে রাখাই যায় না। উদ্ধব দাস তাই কেবল এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। গান গায় আর ঘুরে বেড়ায়। রানিবিবির পালকির পেছন পেছন চলতে চলতে কান্ত তখনও কেবল কথাটা ভাবছিল। খানিকক্ষণের জন্যে দেখা। অনেক কথা জানতে চেয়েছিলেন। কান্তর জীবনের। কান্তর কথা বড় মন দিয়ে শুনেছিলেন রানিবিবি। সকলে কি সকলের কথা শোনে নাকি! বিশেষ করে কান্ত তো তার পর। কান্তর দুঃখের কথা শুনে লাভই বা কী হত তারা বলেছিলেন–নামটা জেনে এসে আমাকে বলবে। অথচ বলা হল না। পুরনো সেপাই বদল হয়ে গেছে। এবার কাটোয়ার কোতোয়ালের নতুন সেপাই চলেছে সঙ্গে।
*
চেহেল্-সুতুনের ভেতরে বোরখায় মুখ ঢেকে সব কথাগুলোই মনে পড়ছিল। অথচ এই তো সেদিন। সবে সঙ্গে করে এনেছে রানিবিবিকে, তারই মধ্যে সমস্ত ওলোট পালোট হয়ে গেল। তারই মধ্যে লড়াই। শুরু হল, লড়াই শেষও হয়ে গেল। মসনদ পর্যন্ত বদলি হব হব। কে নবাব হবে কে জানে! এখন তলবটা পেলে হয় শেষপর্যন্ত! কান্ত সেই অল্প-অল্প আলো-ছায়ার ভেতর দিয়ে রানিবিবির কথাই ভাবতে লাগল। কোথায় সেই কাটোয়া আর কোথায় এই মুর্শিদাবাদ। এই পথ দিয়ে কত নবাব কত বেগম ভেতরে এসেছে, আবার ভেতর থেকে বাইরেও গিয়েছে। এই পথ দিয়েই মুর্শিদকুলি খাঁ এসেছে একদিন এইখানে। এইখানে দাঁড়িয়েই রাজবল্লভ সেন ঘসেটি বেগমের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেছে। কাটোয়ায় ভাস্কর পণ্ডিতকে খুন করে এইখান দিয়েই আলিবর্দি খাঁ এই হারেমে ঢুকেছে। দেখতে দেখতে কান্তর চোখের সামনে দিদিমার কাছে শোনা গল্পগুলো যেন আবার দেখতে পেল। আবার ঘনিয়ে এল সেই সব রাত, সেই সব দিন, সেই সব কাল। একদিনের মধ্যে সব ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে গেল। মনে হল এখনও যেন এখানে-ওখানে নবাবের রক্ত লেগে রয়েছে। কোথায় গেল সেই হোসেন কুলি খাঁ, কোথায় গেল সেই আলিবর্দি খাঁ। ইতিহাসের পাখায় চড়ে যেন সবাই আবার ফিরে আসতে লাগল উড়ে উড়ে। দিদিমা সব জানত। দিদিমার কথাই যেন সত্যি হল। যেন পায়ের তলার শব মাড়িয়ে সে ইতিহাসের সিংহদ্বারে এসে দাঁড়িয়েছে আজ। আজ যদি মসনদই নেই, আজ যার জন্যে এখানে রানিবিবিকে আনা সেই নবাবই যখন নেই, তখন কেন রানিবিবি এখানে থাকবে? কোথাকার কোন খোরাসান, কান্দাহার, চট্টগ্রাম থেকে। আনা বেগমরা যেন এতদিন পরে ইতিহাসের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেয়েছে। একসঙ্গে সবাই বুঝি তাই হেসে উঠেছে। মুক্তির হাসি, আনন্দের হাসি, স্বাচ্ছন্দ্যের হাসি। কান্ত সেইখানে বসেই ইতিহাসের অমোঘ বাণী যেন শুনতে লাগল।
মরিয়ম বেগম, মরিয়ম বেগম!
বাইরের ডাকে যেন হঠাৎ কান্তর সংবিৎ ফিরে এল। কে যেন দরজা ঠেলছে আর ডাকছে–মরিয়ম বেগম, মরিয়ম বেগম—
*
জেনারেল ক্লাইভ ডাকলে—মুনশি–
মুনশিকে সঙ্গেই এনেছিল ক্লাইভ সাহেব। টিকি দোলাতে দোলাতে মুনশি নবকৃষ্ণ সামনে এসে হাজির।
হুজুর!
বশির দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল একপাশে। মনসুর আলি মেহেরও দাঁড়িয়ে ছিল। মিরজাফর খাঁ দাঁড়িয়ে ছিল। জামাই মিরকাশিম খাঁ-ও দাঁড়িয়ে ছিল। ছেলে মিরন দাঁড়িয়ে ছিল। নিজামত সরকারের আমলা-ওমরাহ সবাই হাজির। সারা মুর্শিদাবাদের নোক আজ শহর-গ্রাম-জনপদ ঝেটিয়ে এসে মুর্শিদাবাদের নবাবের আম-দরবারে হাজির। সবাই ভেতরে ঢুকতে পারেনি। সবাইকে চুকতে দেওয়া হয়ওনি। এত মানুষ দেখে কর্নেল সাহেবের লাল চোখ-মুখ আরও লাল হয়ে গেছে। সকাল থেকেই করোরিয়ান, চৌধুরীয়ান, জমিদারানরা হাজির ছিল। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র গোড়া থেকেই সামনে ছিলেন। যা-কিছু নবাবের মালখানার সিন্দুক থেকে পাওয়া গিয়েছে সব জড়ো করে তুলে নিয়েছে ক্লাইভ সাহেব। এত মোহর, এত টাকা, এত হিরে, এত চুনি, এত পান্না, এত কিছু জীবনে দেখেনি সাহেব। প্রথমে সিন্দুকটা খুলতেই চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল সাহেবের। মুনশি নবকৃষ্ণ পাশেই ছিল। তারও চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল। শায়েস্তা খাঁ শুধু নয়। বখতিয়ার খিলিজির আমল থেকেই এই টাকা জমে জমে পাহাড় হয়ে উঠেছিল মুর্শিদাবাদের খাজাঞ্চিখানায়। মুর্শিদকুলি খাঁ’র সময় থেকেই আরও পাকাপাকি রকমের জমা বন্দোবস্ত হতে শুরু করেছিল। তার বন্দোবস্তের নাম ছিল জমা কাসেল তুমারি। সারা বাংলাদেশের টাকা এসে ঢুকত এইসব সিন্দুকে। এসে পুরুষানুক্রমে জমা হয়েছে এখানে। সে-টাকা দেখে চোখ ঘুরে যাবার মতো অবস্থা হল কর্নেলের।
মুনশি নবকৃষ্ণ বললে–এ-সব আপনার হুজুর–আপনি নিন—
কর্নেল সাহেব যা নিলে তা নিলে। তারপর নিলে মুনশি।
আমি যে সঙ্গে কিছু বাক্সটাক্স আনিনি।
আমি সিন্দুকসুষ্ঠু আপনাকে দেব, আপনার নিতে কোনও অসুবিধে হবে না–একেবারে জাহাজে তুলে সুতানুটিতে পাঠিয়ে দেব আপনার হাবেলিতে–
মাসিক সাত টাকা মাইনের চাকরিতে ঢুকে এখানে এসেছিল ক্লাইভ সাহেব। সঙ্গে সঙ্গে রাজত্ব পাওয়া হয়ে গেল। কিন্তু শুধু রাজত্ব তো দেওয়া যায় না। রাজকন্যা দেওয়ারও নিয়ম আছে এ-দেশে। মিরজাফর খাঁ তাও দিলেন। রাজকন্যা নয়, নবাব-বেগম।
ক্লাইভ মুশকিলে পড়লে। বললে–এদের নিয়ে আমি কী করব?
হুজুর, এইটেই যে কানুন। নবাবের যা কিছু আছে সবই আপনার। নবাবের টাকা আপনাকে দিয়েছি, নবাবের এই বেগমদেরও আপনাকে নিতে হবে–
বলে ডাক পাড়ল–নুর বেগম–
সমস্ত বন্দোবস্ত আগে থেকেই করা ছিল। হারেমের খোঁজা-সর্দার পিরালিকে আগে থেকেই হুকুম দেওয়া ছিল। সমস্ত বেগমরা সকাল থেকেই সাজতে গুজতে শুরু করেছে। চোখে সুরমা দিয়েছে, বুকে বুটিদার কঁচুলি পরেছে, ঠোঁটে আলতা মেখেছে, নখে মেহেদি রং লাগিয়েছে; ঘাগরা, চোলি, ওড়নি কিছুই বাদ যায়নি। আজ সবাই হারেম ছেড়ে আর-এক হারেমে গিয়ে উঠবে। এতদিন যাকে মনোরঞ্জন করবার জন্যে তারা জন্মেছিল, সে নেই। এবার অন্য একজনের মনোরঞ্জন করবার জন্যে আবার বেঁচে থাকতে হবে। আবার বিকেল থেকে প্রতিদিন আর একজনের মন ভোলাবার জন্যে তৈরি হতে হবে। সে দিশি নবাব নয়, সে সাহেব। লাল পল্টনদের গোরা সাহেব। লক্কাবাগের লড়াইতে যে-সাহেব নবাবকে হারিয়ে দিয়েছে।
জিন্নৎ বেগম!
আজ আর কারও কোনও অভিযোগ নেই। অবশ্য অভিযোগ ছিলও না কোনওদিন। নবাব হারেমে কোনও অভিযোগ থাকতে নেই কারও। খেতে পরতে পেরেছে একদিন, আবার এবার যেখানে যাবে সেখানেও তারা খেতে পরতে দেবে। আমরা জারিয়া। মানে ক্রীতদাসী। আমাদের আবার জাতকুল কী, আমাদের আবার মান-সম্মান বা কী।
তক্কি বেগম।
এক-একজনের নাম ডাকা হয় আর সে ওড়নি ঢাকা দিয়ে মাথা নিচু করে এসে দাঁড়ায়। একজনের পর আর একজন। তারপর আর একজন। আম-দরবারের শোভা যেন আজ হাজার গুণ বেড়ে গেছে রূপসিদের জেল্লার জৌলুসে! রসুননচৌকিতে এতক্ষণ মিঞা-কী মল্লার বাজাচ্ছিল নবাব নিজামতের বহুদিনের মাইনে-করা পুরনো নহবতি বুড়ো ইনসাফ মিঞা। সে এ-রাগ বহুবার আগে বাজিয়েছে। বুড়ো নবাবসাহেব যেবার কাটোয়াতে বর্গিসর্দার ভাস্কর পণ্ডিতকে খুন করে রাজধানীতে ফিরে এসেছিলেন, সেবারও ইনসাফ মিঞা এই মিঞা-কি-মল্লারই বাজিয়েছিল। যেবার বুড়ো নবাবের নাতি মির্জা মহম্মদের বিয়ে হল সেবারও একবার বাজিয়েছিল এই মিঞা-কি-মল্লার। বড় কড়া রাগ। তানসেনজির নিজের মেজাজের তৈরি জিনিস। তানসেনজি বাদশা আকবর শাহকে এই মিঞা-কি-মল্লার পেশ করেছিলেন। এ-রাগ যখন-তখন যাকে-তাকে শোনানো যায় না।
তাড়াতাড়ি বশির মিঞা দৌড়ে এসেছে রসুনচৌকির ওপরে।
এ কী বাজাচ্ছ মিঞাসায়েব?
কেন জনাব, এ তো মিঞা-কি-মল্লার!
না না, গোরা সাহেবরা ওসব বুঝতে পারবে না। নবাবসাহেব গোসা করছেন—
নবাব? কোন নবাব?
নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা যে নেই তা যেন জানে না ইনসাফ মিঞা। তা যেন শোনেইনি সে। বচপন থেকে মির্জাকে দেখে এসেছে ইনসাফ মিঞা। মির্জা মহম্মদ সেই ছোটবেলাতেই এই নহবতখানায় উঠে এসে বাঁশির ফুটোতে ফুঁ দিতে চেষ্টা করত কতবার। কতবার ইনসাফের চোখের আড়াল থেকে বাঁশি চুরি করে পালিয়েছে। সেই মির্জা মহম্মদই বড় হয়ে তোমাদের সিরাজ-উ-দ্দৌলা হল। তোমরা তার জন্যে না-কাঁদতে পারো, কিন্তু আমি কী করে কান্না থামাই? আমার কি মন কেমনও করতে নেই?
সত্যিই কেউ কাঁদছে না। গোরা সাহেবরা এসেছে বলে মুর্শিদাবাদে যেন মহফিল শুরু হয়ে গিয়েছে। গোরা সাহেবদের জন্যে খানাপিনার বন্দোবস্ত হচ্ছে। সরাবের বন্দোবস্ত হয়েছে। মুরগি-মসল্লমের বন্দোবস্ত হয়েছে। পোলাউ-বিরিয়ানির বন্দোবস্ত হয়েছে। ঠিক মির্জা মহম্মদের বিয়ের সময় যা-যা যেমন-যেমন বন্দোবস্ত হয়েছিল, সব ঠিক তেমনি-তেমনি বন্দোবস্ত হয়েছে। আমি মিঞা-কি-মল্লার বাজাব না তো কি মালগুঞ্জ বাজাব? হোলি বাজাব? খেমটা বাজাব?
গুলসন বেগম!
পেশমন বেগম!
আখতার বেগম!
মুর্শিদাবাদের গ্রামের মানুষ হাঁ করে চেয়ে দেখছিল। এত বেগম একসঙ্গে দেখবার কখনও মওকা মেলেনি তাদের। সমস্ত বেগমই আসবে নাকি রে বাবা! এ তো রূপ নয়, আগুন। আগুনের ডেলা সব পঁড়িয়ে রয়েছে মেয়েমানুষের চেহারা নিয়ে।
ক্লাইভ সাহেব চুপি চুপি মুনশিকে জিজ্ঞেস করলে–এসব ওম্যান কোত্থেকে এসেছে মুনশি?
কেউ এসেছে খোরাসান, কেউ এসেছে কান্দাহার, কেউ এসেছে চট্টগ্রাম থেকে। যেখান থেকে নারী-রত্ন পেয়েছে কুড়িয়ে এনেছিল নবাব।
সমস্ত নিজের ওআইফ?
নবকৃষ্ণ মুনশি বললে–না হুজুর, সব ব্যাডওম্যান, খারাপ মেয়েমানুষ!
মরিয়ম বেগম!
অবাক কাণ্ড! এবার কেউ এল না।
মনসুর আলি মেহের আবার ডাকলে–মরিয়ম বেগম–মরিয়ম বেগম–
এ-ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। এগারোজন বেগম এসে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। আর একজন বাকি আছে। সবসুন্ধু বারোজন বেগম। কিন্তু মরিয়ম বেগম আসছে না কেন? পিরালি তখন হারেমের ভেতরে গোরু-খোঁজা শুরু করে দিয়েছে। এ-ঘরে যায়, ও-ঘরে যায়। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। সাজিয়ে গুছিয়ে তাকেও তো তৈরি করে রেখে দেওয়া হয়েছিল।
বশির মিঞা দাঁড়াতে পারলে না। কোণের ফটকের কাছে গিয়ে ডাকতে লাগল–পিরালি, পিরালি—
পিরালির তখন প্রাণ যায়-যায় অবস্থা। মরিয়ম বেগমকে কোনও ঘরে পাওয়া যাচ্ছে না। এই তো সেদিন হাতিয়াগড় থেকে নবাবের জন্যে সেখানকার রানিবিবিকে নতুন আমদানি করা হল। নিয়মমাফিক তার নতুন নামও দেওয়া হল–মরিয়ম বেগম! এখন কোথায় গেল!
বশির মিঞা তখনও ডাকছে—পিরালি–
এগারোজন বেগম তখন মাথা নিচু করে ওড়নি ঢাকা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর বাকি বেগম আসছে। না। কোথায় গেল মরিয়ম বেগম! জেনারেল সাহেবের কাছে বেইজ্জত হয়ে যাবে নাকি মিরজাফর আলি খাঁ সাহেব। নবাব-নিজামতের বদনামি হবে নাকি?
রসুনচৌকিতে ছোটে শাগরেদ হঠাৎ বলে উঠল–চাচা–
ছোটে শাগরেদ সবে নহবতে ফুঁ দিতে শিখছে। ইনসাফ মিঞা বাজাতে বাজাতেই তার চারদিকে চাইলে একবার।
চাচা, মরিয়ম বেগমকে পাওয়া যাচ্ছে না!
পাওয়া যাচ্ছে না!
বলে ইনসাফ মিঞার কী খেয়াল হল কে জানে, সুরটা সমে এসে থামতেই নহবতের মুখটা একবার আঙুল দিয়ে টিপে নিয়ে তখুনি আবার বাজাতে আরম্ভ করল। এবার মিঞা-কি-মল্লার নয়, মালগুঞ্জ। তবলচি সুরের মুখপাতটা শুনেই তবলায় একটা চটি কষিয়ে দিলে–বাহবা ওস্তাদ–বাহবা–
*
পশুপতিবাবু জিজ্ঞেস করলেন–তারপর মশাই? তারপর?
বললাম-পঁড়ান, একটু সবুর করুন! এই একহাজার পাতার পুঁথি কি এত শিগগির শেষ করা যায়? আপনার পূর্বপুরুষ উদ্ধব দাস এক মহাকবি ছিলেন মশাই। গল্প বড় মোচড় দিয়ে দিয়ে বলেন। একটুখানি পড়লেই পরের পাতা পড়বার জন্যে মনটা ছটফট করে–অথচ আসল খুঁটিটা কিছুতেই ছাড়েন না–হাতে রেখে দেন, শেষকালে চালবেন বলে–
সত্যিই উদ্ধব দাস কদিন ধরে একেবারে নেশাগ্রস্ত করে রেখে দিলে। দেখতে পাগলছাগল মানুষ হলে কী হবে, রসের কারবারে একেবারে রসিকরাজ। রসে টইটম্বুর।
পুঁথি যখন পড়া শেষ হল তখন গভীর রাত। সেই কলকাতার মাঝরাত্রেই যেন সমস্ত অষ্টাদশ শতাব্দীটা চোখের সামনে সশরীরে নেমে এল। সেই হাতিয়াগড়ের রানিবিবি, সেই কান্ত, সেই সিরাজ-উ-দ্দৌলা, সেই লক্কাবাগের লড়াই, সেই রবার্ট ক্লাইভ, সেই মহারাজ নবকৃষ্ণ মুনশি, সেই মরিয়ম বেগম আরও কত অসংখ্য চরিত্র চোখের সামনে সব যেন সজীব হয়ে উঠল।
পুঁথি শেষ করে শান্তিপর্বে’ উদ্ধব দাস লিখছেন–
কোম্পানির রাজ্য হইল, মোগল হইল শেষ।
দমদম-হাউসে আইল ইংরেজ নরেশ ॥
কৃষ্ণভজা বৈষ্ণবেরা আতঙ্কেতে মরে।
ব্রাহ্মণ হইয়া হিন্দু যত পইতা ফেলে ডরে ॥
হিন্দু ছিল মুসলিম হইল পরেতে খ্রিস্টান।
এমন দেশেতে বলো থাকে কার বা মান ॥
কোন দেশেতে ঘর বা তোমার কোন দেশে বা বাড়ি।
মরিয়ম বেগম বলে আমি অভাগিনী নারী ॥
পতি থাকতে পতি নাই মোর অনাথিনী অতি।
মনের মানুষ যেখানে থাক আমি তারই সতী ॥
তার যদি বা মৃত্যু ঘটে আমি কীসে বাঁচি।
তারে কাছে লইয়া আইস থাকি কাছাকাছি ॥
বেগম মেরী বিশ্বাসের অমৃত কথন।
ভক্ত হরিদাস ভনে, শোনে সর্বজন ॥
২.০১ আখ্যান-পর্ব
সর্বজনের শোনবার মতোই কাহিনী বটে। উদ্ধব দাস যেকাহিনী তার পুঁথিতে লিখে গেছেন তার। সত্যি-মিথ্যে ঈশ্বর জানেন। এই কাহিনীর দায়-দায়িত্ব সবই তার। আমি শুধু কথক। তাঁর পুঁথি পাঠ করব আর আপনাদের শোনাব। ওই হাতিয়াগড়ের নামও আমি জানতাম না। হাতিয়াগড় কোথায় তাও আমার জানবার কথা নয়। আমি কলকাতার মানুষ, ককাতার কথাই এতদিন লিখে এসেছি, এবার হাতিয়াগড়। হাতিয়াগড় থেকে মুর্শিদাবাদ, মুর্শিদাবাদ থেকে ঢাকা সুতানুটি দিল্লি সব জায়গাতেই যেতে হবে। উদ্ধব। দাস সব জায়গাতেই নিজে গিয়েছেন। ওই যে হাতিয়াগড়ের বড় রাজবাড়ি, ওর ভেতরে যে অতিথিশালা, ওখানেও উদ্ধব দাস কত দিন রাত কাটিয়েছেন। ওই যে গড়ের দিঘি, ওই গড়ের দিঘির ওপারে শোভারামের ঘর, ওখানেও গিয়েছিলেন। ওই যে গড়ের দিঘির পাশেই উঁচু ঢিবিটা ওর নাম ছাতিমতলার ঢিবি। ছাতিম গাছটা এখন আর নেই, কিন্তু ঢিবিটা আছে। শোভারাম গাই-গোরুটাকে ওখানে গিয়ে বেঁধে দিয়ে আসত। আদর করে আবার তার নাম দিয়েছিল–আদুরি। লোকে বলত আদুরি গোরু নয় গো, শোভারামের মেয়ে। তা আদুরি শোভারামের মেয়েও বটে আবার গোরুও বটে। আদুরিকে শোভারাম মেয়ের আদরে মানুষ করেছিল।
কিন্তু সেই আদুরিই সেবার হঠাৎ মারা গেল।
চোত-বোশেখ মাসে হাতিয়াগড়ের খাল-বিল শুকিয়ে যায়। আগের বর্ষাতেও তেমন বৃষ্টি হয়নি। শোভারাম ছাতিম গাছতলাটায় গিয়ে আদুরিকে বেঁধে রেখে এসেছিল। বেঁধে না রাখলে আবার বড়মশাইয়ের মুসুরির খেতে গিয়ে মুখ দেবে। বিকেল নাগাদ বড়মশাইয়ের বাড়ি থেকে কাজ সেরে এসে আদুরিকে আনতে গিয়ে দেখে আদুরি মরে পড়ে আছে।
ব্যাপারটা সহজে মিটল না। একে গাই-গোরুটা গেল, তার ওপর বড়মশাইয়ের বকুনি। গোবধ গোহত্যার দরুন প্রায়শ্চিত্ত যা করার সবই করতে হল শোভারামকে, কিন্তু তাতেও দুর্গতির শেষ হল না। বউটাও মারা গেল দু’মাস বাদে। পরের আষাঢ়ে। বউ মরল তাতে ক্ষতি নেই, একটা ছ’মাসের মেয়ে রেখে শোভারামকে একেবারে অনাথ করে চলে গেল।
এ-সব এ-গল্প আরম্ভ করার বহু আগের ঘটনা।
হাতিয়াগড়ে এখন সে-সব দিন বদলে গেছে। সে বড়মশাইও নেই। বলতে গেলে বড়মশাই চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সে-হাতিয়াগড়ও আর সে-হাতিয়াগড় নেই। এখন ছোটমশাই আছে, বড়মা আছে, আর ছোটমা আছে। সেই রাজবাড়িটাও আছে, সেই কেল্লাফটকও আছে, সেই ছাতিমতলার ঢিবি আছে, সেই গড়ের দিঘি আছে। আর আছে শোভারাম। আর আছে শোভারামের মেয়েটা।
ছোটমশাই জিজ্ঞেস করেছিলেন–মেয়ের কী নাম রাখলি শোভারাম?
শোভারাম বলেছিল–আজ্ঞে ছোটমশাই, ওর নাম আর কী রাখব, ও মাকে খেয়েছে, আমাকেও খেয়ে তবে ছাড়বে–তাই ওর নাম আর কিছু রাখিনি–
তা ডাকিস কী বলে?
খুকি বলে!
তা হোক, আমি ওর নাম রাখলাম বিন্দুমতী!
শোভারাম বলেছিল–আজ্ঞে ও-নাম আমি উশ্চারণ করতে পারব না ছোটমশাই—
তা উচ্চারণ না করতে পারিস তো বিন্দু বলে ডাকিস!
কী আর করা যাবে, ছোটমশাইয়ের দেওয়া নাম তো আর অপছন্দ করা যায় না। তা তাই-ই সই। বিন্দু বিন্দুই সই। বিন্দুবালা দাসীই না-হয় নাম হল। শোভারাম ভেবেছিল ভারী তো একটো একটা মা-মরা বুড়ো বয়সের মেয়ে, তার আবার অত নামের বাহারেরই বা দরকার কী। কিন্তু পরের দিনই ছোটমশাই আবার ডেকে বললেন–ওরে শোভারাম, ও বিন্দুমতীনামটা চলবে না রে তোর মেয়ের–
কেন হুজুর?
কেন যে বিন্দুমতী নাম চলবে না তা আর খুলে বললেন না ছোটমশাই। রাত্রিবেলাই বড়গিন্নি শুনে বলেছিলেন–সেকী? বিন্দুমতী যে আমার দিদিমার বোনের নাম, নফরের মেয়ের সেই একই নাম দিলে তুমি?
ছোটমশাই বলেছিলেন–তাতে কী হয়েছে? আর সে কি আমার মনে আছে, না কারও মনে থাকে–
বড়মা বলেছিলেন–না না, ছি, ও-নাম দিতে পারবে না, ওকে ডেকে তুমি বলে দিয়ো—
তা শেষপর্যন্ত নাম দেওয়া হল–মরালী!
বড়গিন্নিকে ডেকে ছোটমশাই জিজ্ঞেস করলেন–মরালী বলে তোেমাদের বংশে কারও নাম ছিল তো?
বড়গিন্নি বললেন–না—
ছোটগিন্নিকেও ডাকা হল। তিনিও বললেন–না, ওনামে আমাদের কেউ নেই—
রাজবাড়ির পূর্বপুরুষের কোথাও কোনও কুলে কারও ওনাম পাওয়া গেল না। রাজবাড়ির বউদের সাতকুলেও ওনামের কেউ নেই। সুতরাং আর কোনও আপত্তি নেই। শোভারামের মেয়ের ওই নামই বহাল রইল। সেই মরালী থেকে ক্রমে মরো হল, তারপর হল মরি। ভারী তো রাজবাড়ির নফর শোভারাম। ছোটমশাইয়ের চানের জল জোগানো আর তেল মাখানো কাজ। আর সন্ধেবেলা ছোটমশাই যখন বৈঠকখানায় বসেন, তখন তাঁর পায়ের কাছে বসে পা-হাত-মাথা-পিঠ টিপে দেওয়া। সেই তারই কিনা মেয়ে। তার নাম মরালী’ই হোক কি মরো’ই হোক, কিংবা মরিই হোক, তাতে বাংলাদেশের ইতিহাসের কিছুই হ্রাস-বৃদ্ধি হয় না। তাতে দিল্লির বাদশারও কিছু এসে যায় না, নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলারও কিছু এসে যায় না, লর্ড ক্লাইভ কিংবা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কারওই কিছু এসে যায় না। এমনকী তাতে হাতিয়াগড়ের ছোটমশাই হিরণ্যনারায়ণেরও কিছু আসে যায় না।
কিন্তু ওই মেয়েটাই শেষকালে এক সর্বনেশে কাণ্ড ঘটিয়ে বসল।
অষ্টাদশ শতাব্দীর সমস্ত প্রচ্ছদপটটাই একদিন ওই মরালী যে বদলে দিয়ে যাবে তা যেন কেউই কল্পনা করতে পারেনি। একটা ইতিহাসের আড়ালে যে আর একটা ইতিহাস সৃষ্টি করে বসবে হাতিয়াগড়ের সেই নগণ্য নফর শোভারামের নগণ্যতর মেয়ে মরালীবালা দাসী, তা যেন কারও মাথাতেই আসেনি।
সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ যখন বলেছিলেন নামটা তখন যেন খটকা লেগেছিল প্রথমটায়। এনাম আবার কেমন নাম। এনাম আবার কারও থাকে নাকি। নাম হবে সুরবালা, নাম হবে ব্রজবালা, নাম হবে তরঙ্গিনী। যেমন আর পাঁচজনের নাম হয় আর কী। কিন্তু ছোটমশাই হলেন অন্নদাতা, তার দেওয়া নাম তো আর খামোকা বদলানো যায় না। ও-মেয়ে আদুরিকে খেয়েছে, মাকে খেয়েছে, ও-মেয়ে যে নিজেকেও একদিন খাবে সে সম্বন্ধে শোভারামের আর কোনও সন্দেহ ছিল না। তাই কখনও মরো’ বলে ডাকত, কখনও বা মরি’।
কিন্তু বিয়ের দিনেই নতুন করে নামটা উঠল। পুরুতমশাইকে ওই নামটা উচ্চারণ করতে হবে। সম্প্রদানের সময় কন্যার নামটা দরকার। বরকনের নাম না হলে বিয়ে হয় কী করে। শুধু নাম নয়–গোত্র, বংশ, কুলুজি সবই দরকার হয়।
সন্ধে পেরিয়ে গেছে তখন। রাত দশটায় লগ্ন। একে একে সবাই জুটেছে। শোভারামের মেয়ের বিয়ে। দশটা নয় পাঁচটা নয়, একটিমাত্র মেয়ে। মেয়ে বলো ছেলে বলো ওই এক মরালী। শোভারাম। সকলের বাড়িতে গিয়ে গলবস্ত্র হয়ে সবাইকে নেমন্তন্ন করে এসেছে। সদগোপপাড়া, বামুনপাড়া, কর্মকারপাড়া, মুসলমানপাড়া, সব পাড়ার লোককেই নেমন্তন্ন করা নিয়ম।
শোভারাম বলেছিল–দয়া করে দায় উদ্ধার করবেন হাশেমসাহেব, বুঝতেই তো পারছেন আমার কন্যাদায়–
এরকম চলে। হাশেম আলি হাতিয়াগড়ের পুরনো লোক। দায়ুদ খাঁ’র আমলে বাংলাদেশে এসেছিলেন তার পূর্বপুরুষরা। তারপর মোগল আমলে সরকারি চাকরি চলে যাবার পর থেকে বংশপরম্পরায় ব্যাবসা শুরু করেন। সেই থেকে বংশ-পরম্পরায় এঁরা হাতিয়াগড়ে তুলোর ব্যাবসা করেন। একেবারে বাঙালি হয়ে গেছেন।
বললেন–যাব বই কী শোভারাম, নিশ্চয়ই যাব–তোমার মেয়ের বিয়েতে যাব না!
আবার হাশেম সাহেবের বাড়ির কোনও উৎসবেও অমনি করে শোভারামের বাড়িতে এসে তিনি গলবস্ত্র হয়ে নেমন্তন্ন করে যান। বলেন–এসো কিন্তু ঠিক শোভারাম, বুঝতেই তো পারছ আমার কন্যাদায়–
নিমন্ত্রণ পরস্পর পরস্পরকেই করে। যায়ও। তবে খাওয়াটা চলে না। নিমন্ত্রণে আপত্তি নেই। আপত্তিটা খাওয়ায়। সেই হাশেমসাহেব এসেছিলেন শোভারামের মেয়ের বিয়েতে। শোভারামের খড়ের চালের ঘর। তিনখানা ঘর, সামনে উঠোন, উঠোনটা ঘিরে লোকজনের আপ্যায়নের ব্যবস্থা হয়েছিল। হাশেমসাহেব এসেছিলেন জাব্বাজোব্বা পরে। যেমন ভাবে আসার রীতি। সকলকে আদাব জানালেন। আয়োজন কেমন হয়েছে জিজ্ঞেস করলেন। ছোটমশাই এসেছেন কিনা তাও জিজ্ঞেস করলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন–বর এসেছে নাকি?
আজ্ঞে এই এল বলে। সেই অনেক দূর থেকে আসবে কিনা, তাই একটু দেরি হচ্ছে—
বর কোথায় থাকে?
আজ্ঞে ফিরিঙ্গি কোম্পানির দফতরে চাকরি করে। বিয়ের লগ্ন তো সেই দুই পহরে, তাই একটু দেরি হচ্ছে আর কী–
ভাল ভাল, বেশ–বলে হাশেমসাহেব সব শুনে গেলেন। মুসলমানপাড়া থেকে আরও কয়েকজন এসেছিলেন তারাও নিয়ম রক্ষা করে গেলেন। উঠোনের ওপর তখন খাওয়ার হুড়োহুড়ি চলছে। শোভারাম আয়োজন করেছে ভাল। পাকা ফলার কাঁচা ফলার দু’রকমের বন্দোবস্তই করেছে।
পুরকায়স্থ মশাই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে।
কী গো সচ্চরিত্র, তোমার বর কোথায়?
বর আসছে বিশ্বাসমশাই, আপনি কিছু ভাববেন না, বাবাজির সাহেবের গদিতে মালখালাস করতেই দেরি হয়ে গেল, তাই আমি তড়িঘড়ি চলে এলাম, পাছে আপনি আবার ভাবেন!
তা বর কার সঙ্গে আসছে?
নাপিত বেটাকে রেখে এসেছি, নৌকোও তৈরি হয়ে আছে। আমি বাবাজীবনকে বলে এসেছি দরকার হলে কাজকম্ম ফেলে তুমি চলে আসবে। চাকরি তোমার অনেক হতে পারে, বিয়েটা তো আর রোজ রোজ হয় না কারও–
পুরকায়স্থ মশাই এক জায়গায় চুপ করে থাকার মানুষ নয়। আজ যাচ্ছে মুর্শিদাবাদে, তারপর দিনই আবার ঢাকা। আবার তার পরই বর্ধমান। হাতে খাতাপত্র, খালি-পা। সোজা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে যেখানে একটু আশ্রয় মিলল সেখানেই রাতটা কাটিয়ে নিলে। তারপর আবার রওনা। নৌকোর মাঝিদের ডেকে হয়তো তাতেই উঠে পড়ল। তারপর সে-নৌকো যেখানে যাবে সেখানেই গিয়ে ওঠা। এমনি করেই জীবনটা কাটিয়ে দিলে সচ্চরিত্র।
তবু ভয় গেল না শোভারামের। জিজ্ঞেস করলে–বাবাজীবন ঠিক আসবে তো? মেয়ের বিয়ে আমার, বুঝতেই তো পারছ–
সচ্চরিত্র বললে–ঘটকালি করে করে আমার টাক পড়ে গেল বিশ্বাসমশাই, আর আমাকে আপনি শেখাচ্ছেন–
তা হলে তুমি এগিয়ে যাও সচ্চরিত্র, একটু এগিয়ে গিয়ে দেখো বর আসছে কি না—
তা হলে চটপট খাওয়াটা খেয়ে নিয়ে তারপর না হয় দেখছি! কী আয়োজন হয়েছে?
শোভারাম রেগে গেল। বললে–আগেই তোমার খাওয়া? বিয়ে না হতেই তোমার খাওয়ার দিকে নোলা?
ওদিকে তখন চিঁড়ে-দই পড়ে গেছে। হুমড়ি খেয়ে পড়েছে তেলিপাড়ার লোক। সেই দিকে চাইতে চাইতে সচ্চরিত্র খাতা বগলে করে ছাতিমতলার ঢিবির দিকে বেরিয়ে গেল।
চালাঘরের ভেতরে তখন পাড়ার মেয়েরা মরালীকে নিয়ে পড়েছে। সকালবেলা গায়েহলুদ হয়ে গেছে। তখন থেকেই মেয়েদের ভিড়। ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছে সবাই। এখন বিয়ের কনে হিসেবে সবাই নতুন করে দেখছে।
কী গো, কনে কোথায়?
কথাটা কানে যেতেই সবাই পেছন ফিরল। ওই দুগগা এসেছে। দুর্গাবালা। ছোটমশাইয়ের বড়রানির
নয়ানপিসি বললে–হ্যাঁগো দুগগা, এই তোমার আসবার সময় হল গা?
দুগগা বললে–আমার কি একটা ঝামেলা দিদি, বড়রানিকে দুধ খাইয়ে এখন এলাম–দুগগাকে তোমাদের বলতে হবে না, দুগগা সকালবেলা এসে কনেকে নিয়ে রাজবাড়িতে ছোটমশাইকে দেখিয়ে নিয়ে এসেছে–
ছোটমশাই মুখ দেখে কী দিলে?
ছোটমশাই একজোড়া কঙ্কণ গড়িয়ে রেখেছিল। বড়মশাইয়ের আমলের নফর শোভারাম। তার মেয়ের বিয়েতে ভাল কিছু না দিলে চলে না। ছোটমশাইয়েরও এখন আর সে-অবস্থা নেই। নবাব সরকারের খাজনা আরও বেড়ে গেছে। খালসা সেরেস্তায় কানুনগোর ডাক পড়ে এখন। ছোটমশাইয়ের জমিদারি থেকে পুণ্যাহের দিন নবাব-সরকারের লোক যায়। গুণে গুণে মোহর দিয়ে নবাবের পায়ে নজর-পুণ্যাহ দিতে হয়। আর নজরানা কি একরকমের। মাথট চাই। আলগা খাজনা চাই। বয়খেলাৎ চাই। পোস্তাবন্দি চাই। তারপর আছে পাটোয়ারি, কানুনগো, মুনশি, মুহুরির পাওনা। নবাব সরকারের খাজনা দিতে গেলে শুধু মুখের কথায় হবে না। নবাবি কেল্লার সামনে আর লালবাগে ভাগীরথীতে পোস্তা বাঁধতে হবে–তার জন্যে পোস্তাবন্দি দাও। নবাবের ছেলের শাদি, নাতির শাদি, নাতনির শাদি হবে, সব খরচা দিতে হবে জমিদারদের। অথচ বড়মশাইয়ের সময়ে আগে শুধু ছিল আবওয়া খাসনবিশি। খালসা সেরেস্তার আমিন মুৎসুদ্দিদের পার্বনির নাম করে সেটা নেওয়া হত। তারপর দফায় দফায় বাড়তে লাগল। শেষে কিছু আর বাদ রইল না। কত রকমের আবওয়াব। কত তার দাপট। সরকারি পিলখানার খরচ হিসেবে দাও মাথট পিলখানা। হ্যাঁন ত্যান–কত কী!
যখন আদুরি ছিল, যখন বউ ছিল, তখন শোভারামের এমন দুরবস্থা ছিল না। তখন গায়ের জোর ছিল। তখন শোভারাম বড়মশাইয়ের কোরফা-প্রজা ছিল। কিন্তু তাও সময়মতো খাজনা দিতে না-পারায় ইস্তফাপত্র দিয়ে আসতে হল সেরেস্তায়। টাকায় তিন-চার গুণ চালের দর। খাজনা দেব কী দিয়ে। তারপর একদিন কেঁদে গিয়ে পড়ল বড়মশাইয়ের কাছে। বড়মশাইয়ের মান ছিল খাতির ছিল। প্রজাদের ওপর দয়া-মায়া ছিল। বড়মশাই বললেন–কোরফা ইস্তফা দিয়ে তুমি খাবে কী শোভারাম?
শোভারাম হাত-জোড় করে বড়মশাইয়ের পায়ের কাছে মাথা নিচু করে বলেছিল–হুজুরই আমার মা বাপ, হুজুরের পায়ের তলাতেই পড়ে থাকব–
কাজকর্ম কী জানো?
হুজুর যে-কাজ বলবেন তাই পারব!
তা পাইকের কাজ পারবে?
শোভারাম বলেছিল–আজ্ঞে বয়েস হয়েছে, এখন কি আর তেমন দৌড়ঝাঁপ করতে পারব?
বড়মশাই বলেছিলেন–আগের দিন হলে তোমার খাজনা মকুব করতে পারতাম শোভারাম, এখন নবাব-সরকার থেকে রোজই চিঠি আসছে মাথট দাও, মাথট না দিলে জমিদারি থাকবে না, পাটোয়ারি আর কানুনগোদের যা অত্যাচার–
বহুদিনের লোক শোভারাম। গড়বন্দি যখন মজবুত ছিল তখন থেকেই শোভারাম আছে হুজুরের কাছে। বাড়ির ভেতরে রানিমাদের কাছেও যাবার অধিকার আছে শোভারামের। কতবার রানিমার কাছে গিয়ে হাত-জোড় করে খাজনা মকুব করে এসেছে। সে মা-রানি আর নেই। এখন আর কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে।
বড়মশাই বলেছিলেন–তোমায় চাকরান জমি দেব, এখন থেকে তুমি আমার ঘরের কাজই করবে, বুড়ো বয়সে তোমার আর মেহনত করতে হবে না–
বড়মশাইয়ের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতে গিয়ে সেদিন কেঁদে ফেলেছিল শোভারাম। সে বড়মশাই এখন আর নেই। শেষ জীবনে তীর্থে চলে গিয়েছিলেন। যাবার সময় হাতিয়াগড়ের কাউকে আর অসন্তুষ্ট রেখে যাননি। বড়মশাইয়ের তীর্থে যাবার কথাটা রটে যেতেই সবাই এসে হাজির। যার যা চাইবার চেয়ে নিয়ে গেল। বড়মশাই সামনে বসে থাকতেন নামাবলি গায়ে দিয়ে। পাশে জগা খাজাঞ্চিবাবু টাকার থলি নিয়ে বসে আছে।
কী রে, কী চাই তোর?
মাধব ঢালি মাথায় তেলকুচকুচে চুল নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। নিচু হয়ে প্রণাম করল। বললে–কিছু চাইনে আজ্ঞে, বড়মশাইকে পেন্নাম করতে এসেছি–
ডাকাতি করছিস কেমন?
মাধব ঢালি লজ্জায় মাথা নিচু করল। বললে–হুজুর, ডাকাতি করবার কি আর জো আছে—
কেন, কী হল আবার?
আজ্ঞে, ডাকাতদের ধরে ধরে একেবারে আস্ত কোতল করছে, গোবিন্দপুরে আমাদের আর ঢোকবার সাহসবল নেই–
কেন, গোবিন্দপুরের হোগলাবনেই তো তোদের আড্ডা ছিল। কারা কোতল করছে?
হুজুর ফিরিঙ্গি কোম্পানি! ও-দিকটায় বন কেটে শহর করতে লেগেছে সব, আমাদের অন্ন গেল আজ্ঞে–
বড়মশাই জগা খাজাঞ্চির দিকে চেয়ে বললেন–জগা, মাধব ঢালিকে পাঁচটা মোহর আর পঞ্চাশটা টাকা দিয়ে দাও তো
প্রণাম করে চলে যাচ্ছিল মাধব ঢালি। বড়মশাই বললেন–দেখিস মাধব, আমি কাশী চলে যাচ্ছি, ছোটমশাই রইল তোদের, তোদের হাতেই ছেড়ে দিয়ে গেলাম–
তারপর এল বিশু পরামানিক।
বিশু পরামানিককে কিছু বলতেই হল না। বড়মশাই বললেন–জগা, বিশুর নামে বিলের ধারের দু’বিঘে চাকরান জমি লিখে দাও তো, ওর বাপ আমাদের কামিয়েছে, ছেলেকে রেখে গেলাম রে, দেখিস তোরা, বুঝলি–
বিশু পরামানিক চলে গেল।
তারপর এল শোভারাম।
বড়মশাই বললেন–তোর কী চাই রে শোভারাম?
আজ্ঞে চাইনে কিছু!
বড়মশাই হাসলেন। বললেন–বউ মরে গেছে বলে তুই বিবাগী হয়ে যাবি নাকি? তোর মেয়ে মরালী রয়েছে না? তার বিয়ে দিতে হবে না? কত বয়েস হল মেয়ের?
আজ্ঞে, এই গেল চোত-কিস্তির সময়ে সাত বছরে পা দিয়েছে।
তা হলে? আর দেরি কেন? বিয়ে দিয়ে ফেল? মেয়ে দেখতে কেমন হয়েছে?
আজ্ঞে, বাপ হয়ে আর কোন মুখে বলব?
জগা খাজাঞ্চিবাবু পাশ থেকে বললে–আমি দেখেছি বড়মশাই, খুব সুন্দরী
তবে তো আর ঘরে রাখা ঠিক নয় রে। এখন নবাবি আমল, এ আমলে টাকাই বলো আর মেয়েমানুষই বলো, লুকিয়ে রাখতে না পারলেই সব বেহাত হয়ে যাবে, তুই বিয়ে দিয়ে ফেল–
শোভারাম বলেছিল–বিয়ে দিতে পারলে আমিও বাঁচি হুজুর, ভালমতন একটা পাত্তোর যে পাচ্ছিনে–
তা তোর যেমন অবস্থা তেমনই ঘরে দে, রাজা-মহারাজা খুঁজলে চলবে কেন?
শোভারাম বলেছিল-হুজুর, মেয়ের আমার খুব বুদ্ধি, একটা ভাল বুদ্ধিমান পাত্তোর পেলেই দু’হাত এক করে দেব–
কী নাম রেখেছিস মেয়ের?
ছোটমশাই নাম রেখেছেন মরালী। মরালীবালা।
বড়মশাই বলেছিলেন–মা-মরা মেয়ের অত নামের বাহার তো ভাল নয় রে, ওতে যে মেয়ের অকল্যণ হয়। ওকে মরুনি বলে ডাকিস, তাতে মেয়ে বেঁচে থাকবে, মেয়ের পরমাই বাড়বে—
.
তা সেই মেয়েরই আজ বিয়ে। বড়মশাই বেঁচে থাকলে আজ আনন্দ করতেন খুব। তীর্থ করতে তিনি সেই যে কাশীধামে চলে গেলেন তারপর বেশিদিন বাঁচলেন না আর। আর চিরকাল কে আর বেঁচে থাকতে এসেছে সংসারে। শোভারামও একদিন চলে যাবে। মেয়ের বিয়েটা দিয়ে দিলেই তার কাজ শেষ। তারপর ঝাড়া হাত-পা। কারও আর পরোয়া করবার দরকার নেই।
শোভারামের সেই বিয়েবাড়ির হুজুগের মধ্যেই সেইসব দিনের কথা মনে পড়তে লাগল।
যাবার সাতদিন আগে থেকে হাতিয়াগড়ের হাটের আটচালার নীচে জগা খাজাঞ্চিবাবু থলি-ভরতি টাকাকড়ি নিয়ে বসে থাকত।
চিৎকার করে বলত–হুজুরের কাছে কার কী পাওনা আছে, বলো গো তোমরা–
দেনা রেখে তীর্থে যেতে নেই তাই এই ব্যবস্থা। লেখাপড়া না থাক, হাতচিটেনা থাক, নথিপত্র দলিল দস্তাবেজ কিছুই দাখিল করতে হবে না। শুধু মুখ ফুটে চাইলেই জগা খাজাঞ্চি দিয়ে দেবে। কিন্তু একটা লোকও আসত না টাকা নিতে।
জগা খাজাঞ্চি ডাকত–ও মোড়লের পো, তোমার কিছু পাওনা আছে নাকি গো?
মোড়লের পো জিভ কাটত। বলত–কী যে বলেন খাজাঞ্চিমশাই, মিথ্যে বলে কি নরকে যাব নাকি?
কেউ কিছু নিতে এল না। এমনি করে একদিন তীর্থে চলে গেলেন বড়মশাই। হুজুরের সঙ্গে সঙ্গে যেন গাঁয়ের হাওয়াও বদলে গেল। এখান থেকে গঙ্গার পথ ধরে বজরা ছেড়ে দিলে। ঘাটের ধারে এসে দাঁড়াল সবাই। তর্কপঞ্চানন মশাই সংস্কৃতে কী সব বললেন। আশীর্বাদ করলেন। সঙ্গে মা-রানি। তিনিও মাথায় ঘোমটা দিয়ে বজরার ভেতরে গিয়ে বসলেন। সঙ্গে ঝি-চাকর-দরোয়ান গেল অন্য নৌকোতে।
শোভারাম গিয়ে বড়মশাইয়ের পায়ে হাত দিলে।
বড়মশাই বললেন–কে রে? শোভারাম বুঝি?
তারপর হাসতে হাসতে বললেন–মরুনির বিয়ের সময় নেমন্তন্ন করতে ভুলিসনে রে শোভারাম–
শেষদিকে বড়মশাইয়ের পা-টেপা থেকে শুরু করে তেল-মাখানো পর্যন্ত সমস্ত করত শোভারাম। মা-রানি শোভারামের সামনে বেরোতেন। বলতেন–তোমার মেয়েকে একদিন নিয়ে এসো শোভারাম, দেখব–
তা মরালীকে দেখে মা-রানির কী আহ্লাদ!
বললেন–এ যে দুগগো প্রতিমে রে শোভারাম, এই তোর মেয়ে?
হ্যাঁ, মা-জননী!
তারপর মরালীর দিকে চেয়ে শোভারাম বলেছিল–প্রেনাম কর মা-জননীকে, বল আশীর্বাদ করো মা, যেন তোমার মতো পুণ্যবতী হই, ভাল করে প্রেনাম কর, মাথা ঠেকিয়ে প্রেনাম কর–
নিজের মেয়ে হয়নি বলে মা-রানি বড় আদর করেছিলেন মরালীকে।
বলেছিলেন–এ মেয়ে তোর খুব সুলক্ষণা রে, মেয়েকে যত্ন করিস–
যত্ন আর কী করবে শোভারাম! জীব দিয়েছেন যিনি আহার দেবেন তিনিই। মেয়ে নিজেই খুব সেয়ানা হয়ে উঠল বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে। সাত বছর যখন মরালীর বয়েস, তখন থেকেই সাজবার শখ। পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে পাড়ায় পাড়ায় বেড়াত। রাস্তায় যাকে দেখবে তাকেই ডাকবে। বলবে-ও বিদ্যেধর, বিদ্যেধর।
বুড়ো মানুষ বিদ্যেধর। বড়মশাইয়ের বাড়িতে মাটির হাঁড়িকুড়ি জোগান দেয়। কুমোরপাড়ায় সাত পুরুষের বাস। বাপের বয়েসি মানুষ। ভালমানুষ গোছের চেহারা। সেও অবাক হয়ে যায়।
মরালী বললে–তুমি অমন করে আমার পানে চাইছ কেন গা?
ওমা, তোমার দিকে আবার কখন চাইলাম গো দিদি?
মরালী বললে–না, চেয়োনা, মেয়েমানুষের পানে অমন করে তাকাতে নেই—
বিদ্যাধর তো অবাক হয়ে গেল।
মরালী আবার বললে–তোমরা কেমন বেটাছেলে গা, গাঁয়ে আর দেখবার জিনিস নেই, মেয়েছেলের পানে চাওয়া?
শোভারামের কাছে গিয়েও অনেকে বলত–এ-মেয়ে তোমায় জ্বালাবে অনেক, মেয়ের বিয়ে দিয়ে ফেলো শিগগির
তা বিয়ে অমনি দেব বললেই কি দেওয়া যায়। কথায় বলে হাজার এক কথায় বিয়ে। জাত-কুলবংশ-স্বভাব সবকিছুই দেখতে হবে তো! বড়মশাই জাত নিয়ে বড় মাথা ঘামাতেন। বলতেন–তোরা কী জাত রে শোভারাম?
শোভারাম বলত–আমরা সৎশূদ্র বড়মশাই—
সৎশূদ্র? সে আবার কী রে?
সিদ্ধান্তবারিধি মশাই পাশেই থাকতেন। তিনি বলতেন–আজ্ঞে সৎশূদ্র কথাটা বড় গোলমেলে বড়মশাই, শাস্ত্রে আছে
গোপো মালী চ কাংসার তন্দ্রিসাংখিকাঃ।
কুনাল কর্মকারশ্চ নাপিতো নব শায়কাঃ।
তৈলিকো গান্ধিকো বৈদ্য সচ্ছুদ্রাশ্চ প্রকীর্তিতা।
সচ্ছুদ্রানান্ত সকৈষাং কায়স্থ উত্তম সৃতঃ—
বড়মশাই জিজ্ঞেস করতেন–অর্থ?
ওর অর্থ বড় গোলমেলে বড়মশাই, অর্থাৎ আপনিও যা ও-ও তাই, তবে ওর বাড়িতে ক্রিয়াকর্মে আমরা দক্ষিনে নেব, কিন্তু সিধা গ্রহণ নিষেধ, তার জন্যে অর্থমূল্য ধরে দিতে হবে, আর আপনার বাড়িতে সিধাও নেব, কিন্তু অর্থমূল্যের পরিবর্তে স্বর্ণমূল্য! হিন্দুধর্মের ওই তো মজা হুজুর, এখানে অনাচারটি পাবেন না–
সেই জন্যেই বুঝি তোর মেয়ের পাত্র পাচ্ছিসনে?
শোভারাম বলত–আজ্ঞে পাত্র পাচ্ছি, সুলতানুটিতে আমাদের স্বঘরের একটি পাত্র পাচ্ছি– আপনি যদি হুকুম করেন…
কথা শেষ হবার আগেই বড়মশাই খেপে উঠতেন। ম্লেচ্ছদের সঙ্গে ওঠাবসা করে তাদের কি জাত আছে নাকি? ম্লেচ্ছদের ছোঁয়া জল খায়, ম্লেচ্ছদের কাছে চাকরি করে, তার সঙ্গে শোভারাম মেয়ের বিয়ে দেবে? বরাবর বড়মশাই তাতে বাধা দিয়েছেন। আর পাত্র পেলি না?
তা এখন সেই বড়মশাইও নেই, এদিকে মেয়েরও বয়েস বেড়ে যাচ্ছে। শেষকালে মেয়ের সামনে শোভারামের গলা দিয়ে আর ভাত নামত না। গাঁয়ের লোক শেষকালে শোভারামকে একঘরে করেই ছাড়ত। নেহাত ছোটমশাই ছিলেন বলে এতদিন কেউ ধোপা-নাপিত বন্ধ করেনি। যাক, এতদিনে শোভারামের গলা থেকে কাটা নামল। এখন ভালয় ভালয় সম্প্রদানটা হয়ে গেলে হয়।
হঠাৎ দৌড়োতে দৌড়োতে হরিপদ এসে হাজির।
দাদা, ওদিকে সব্বনাশ হয়েছে–
কী সব্বনাশ রে? বর আসেনি? বরকে দেখলিনে?
হরিপদর মুখের কথা তখন আটকে গেছে। বললে–তুমি একবার ছোটমশাইয়ের কাছে চলো, বিপদ হয়েছে ওদিকে–
বিপদ? বিপদটা আবার দেখলি কোথায়? বর না এলে যে পাতক হয়ে যাব রে! বলছিস কী তুই?
হরিপদ ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললে–সেপাই দেখে আমরা বড্ড ভয় পেয়ে গেছি দাদা! ফৌজদারের সেপাই!
ফৌজদারের সেপাই!
হ্যাঁ দাদা, ছোটমশাইয়ের বাড়ির নিশেনা চাইলে আমাদের কাছে, ঘোড়া ছুটিয়ে আসছিল।
তা ফৌজদারের সেপাই ঘোড়া ছুটিয়ে এল তো আমার কী! আমি কি খাতক না উঠবন্দি প্ৰেজা যে, বাকি খাজনার দায়ে আমায় নিজামতি-কাছারিতে টেনে নিয়ে যাবে! সচ্চরিত্র কোথায় গেল? সে বেটারই তো যত নষ্টামি। সে বরকে সঙ্গে না-নিয়ে আসে কেন? সে কি নেমন্তন্ন খেতে এসেছে? কোথায় গেল সে?
চেঁচামেচিতে কিছু লোকজন এসে দাঁড়াল। কী হল শোভারাম! বর আসছে না? নয়ান পিসিও গোলমাল শুনে এসে হাজির। দুগগাও এসে সব শুনল। গালে হাত দিয়ে বসল সবাই। সর্বনাশের মাথায়। পা। এখন যদি বর সত্যি-সত্যি না-আসে তো কী হবে। শোভারামের জাত কুল কী করে থাকবে। শোভারামের মেয়ের অবস্থাটা কী হবে! এর পর কেউ কি আর তার হাতের ছোঁয়া জল খাবে! কেউ তার মুখদর্শন করবে? আহা গো, বড় যে তার ভাতারের শখ! সেই তোর কপালেই এমন হতে হয়। চারদিকে মরাকান্নার রোল উঠল। জাত-কুল-জন্ম-ধর্মকর্ম সব যে রসাতলে গেল পোড়াকপালির।
পুরুতমশাইও সব শুনছিলেন। তিনি এবার এগিয়ে এলেন শোভারামের কাছে। বললেন–কী করবে এখন ভাবো বাবাজি, এ তো সহজ কথা নয়–।
শোভারামের তখন আর মাথার ঠিক নেই, বললে–দেখি, সেই সচ্চরিত্র ঘটকবেটা কোথায় গেল, বেটা নামেই সচ্চরিত্র কেবল–
পুরুতমশাই বললেন–তাকে পরে খুঁজলে চলবে, এখন লগ্ন বয়ে যাচ্ছে। মেয়ের সদগতি কীসে হবে তাই আগে ভাবো তুমি গাঁয়ে আর পাত্র নেই?
নতুন পাত্র এক্ষুনি কোথায় পাই?
কেন, হরিশ তো রয়েছে, কুমোরপাড়ার হরিশ জোয়াদ্দার—
শোভারাম আগুন হয়ে উঠল–তার সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দেব, আপনি বলছেন কী? তার ছটা বউ, তা জানেন–
তা ছ’টা বউ আছে, না-হয় সাতটাই হবে, সে-সব এখন ভাবলে চলে? আগে জাত, না আগে মান!
তার চেয়ে আমার মেয়েকে আমি জলে ডুবিয়ে মারব না! সাতটা নয় পাঁচটা নয়, ওই আমার একটা মাত্তর মেয়ে। আমি কি জেনেশুনে মেয়েকে মেরে ফেলব?
তা হলে তুমি যা ভাল বোঝো তাই করো! তোমার বাড়িতে তা হলে কিন্তু যাগ-যজ্ঞ ক্রিয়াকলাপ সব আমাদের বন্ধ–আমি তা হলে আসি–
শোভারামের মাথায় তখন বজ্রাঘাত হলেও বুঝি ভাল ছিল। তাড়াতাড়ি পুরুতমশাইয়ের সামনে হাতজোড় করে বললে–আপনি আমাকে একটু ভাবতে দিন ঠাকুরমশাই, আমি একবার নিজে গিয়ে দেখি বর আসছে কিনা–
পুরুতমশাই বললেন–কিন্তু লগ্ন তো আর তোমার মেয়ের জন্যে বসে থাকবে না বাবাজি–লগ্ন উতরে গেলে যে মহাসর্বনাশ হয়ে যাবে, তার খেয়াল আছে–
কিন্তু পাত্র তো খুঁজে বার করতে হবে, তাতেও তো সময় লাগে–
পুরুতমশাই বললেন–পাত্রের কি অভাব, ছোটমশাইয়ের অতিথিশালায় গিয়ে একবার খোঁজ করে কাউকে ধরে-বেঁধে নিয়ে এসো না–আগে জাতটা তো রক্ষে হোক, তারপরে না-হয় স্বভাব-চরিত্র বংশকুলুজি দেখবে–
হরিপদর মাথায় আসেনি কথাটা। তাড়াতাড়ি বলে উঠল–তাই যাই দাদা, অতিথিশালাটা একবার দেখে আসি–
বলে আর কারও কথায় কান না দিয়ে হরিপদ সোজা রাজবাড়ির দিকে ছুটল।
*
হাতিয়াগড়ের ছোটমশাইয়ের বাড়িতে অতিথিশালা ছিল। বড়মশাইয়ের আমলেই নতুন করে অতিথিশালাটা সারিয়ে বড় করা হয়। বাংলাদেশের নানা জায়গা থেকে হাঁটা-পথে যে-সব বাউল-ফকির-উদাসী-ভবঘুরে লোক হাতিয়াগড়ে আসত তাদের থাবার জন্যে সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তারা সিধে পেত। মাথাপিছু ডাল-চাল-কাঁচকলা-নুন-তেল কাঠ-হাঁড়ি-মশলা সবই বরাদ্দ ছিল।
বড়মশাইয়ের জগা খাজাঞ্চিবাবুকে রোজকার হিসেব দিতে হত। রামেশ্বর সরকার নিজে গিয়ে সামনে বসে হিসেব বুঝিয়ে দিত জগা খাজাঞ্চিবাবুকে।
আজ ক’জন?
আজ্ঞে, আজ এককুড়ি দু’জন।
তা এককুড়ি দু’জনে আমন চাল খেয়ে ফেললে?
বড়মশাই বলতেন–থাক জগা, ও নিয়ে আর তুমি সময় নষ্ট কোরো না, রামেশ্বর তো মিছে কথা বলছে না।
আজ্ঞে হুজুর, আধমন চালে যে পরশুদিন চল্লিশজন লোক ভাত খেয়েছিল।
তা খাক, দুটো পেটে খাবে তাও দিতে পারব না আমি? পেটেই তো খেয়েছে, কোচড়ে করে তো বাড়ি নিয়ে যায়নি।
আবার এক-একদিন হয়তো কেউ-ই আসত না। সেদিন অতিথিশালা খাখা করত। অতিথিশালার দাসী-মুনিষরা সেদিন কেউ রোদ্দুরে পা ছড়িয়ে কথা সেলাই করত, কেউ বা চাল-ডাল বাছতে বসত। বিরাট রাজবাড়ি। এ-মহল থেকে ও-মহলে যেতে গেলে পাড়া-বেড়ানো হয়ে যায়। কিন্তু এক-একদিন যখন অতিথিশালায় ঝগড়া বাধে সেদিন বাড়ির ভেতরে সকলের কানেই যায়। ঝগড়া বাধে অতিথিদের মধ্যেই। কর্তাভজার সঙ্গে হয়তো ঝগড়া বাধে বলরামভজার দলের। কিংবা সাহেব-ধনীদের সঙ্গে আউলাদের দলের ঝগড়া। কত রকম সাধু কত রকম ধর্ম। ধর্মের বিচার অত সহজ নয়। কর্তাভজারা বলে—’লোকের মধ্যে লোকাচার, সদ্গুরুর মধ্যে একাকার।’
লোকে জিজ্ঞেস করত–আপনি কে গো?
তারা বলত–আমরা কর্তাভজা বাবা–আমরা হলাম বরাতি—
বরাতি মানে?
বাউলরা বলত–ওদের কথা ছেড়ে দাও বাবাজি, ওদের মধ্যে ওইসব আছে, কে গুরু কে বরাতি তাই নিয়ে ওরা মাথা ঘামায়–আমাদের ওসব বালাই নেই–
ওসব নেই বটে, কিন্তু ঝগড়া যখন বাধে তখন হয়তো একটা সামান্য জিনিস নিয়েই বাধে। একই উঠোনের মধ্যে কেউ আলখাল্লা কেচে শুকোতে দিয়েছে, তা আর পাওয়া যায় না। সামান্য একটা আলখাল্লা। ভেঁড়া তালিমারা জিনিস। কারটা একদিন কে গায়ে দিয়ে ভোর-ভোর অতিথিশালা ছেড়ে চলে গিয়েছে। তখন সেই নিয়েই চিৎকার শুরু হয়ে যায়। গলা ছেড়ে চিৎকার করে–যত বেটা চোর-ছ্যাঁচড়ের আমদানি হয়েছে অতিথিশালায়,–সাধু-সন্নিসীদের আর থাকা যায় না এখেনে–
আর একজন এককোণে এতক্ষণ শুয়ে ছিল। সে চেঁচিয়ে উঠল–চোর-ছ্যাঁচড় বলছ কাকে শুনি, আমি চোর–?
তুমি চুপ করো তো হে, তুমি তো বলরামভজার লোক—
লোকটা আউলচাঁদের দলের। চিৎকার করে ঘুষি বাগিয়ে লাফিয়ে আসে–তবে রে শালা–
তারপর সেই অতিথিশালার মধ্যে যে কাণ্ড শুরু হয় তাতে সকলের জড়ো হবার পালা। হাতাহাতি মারামারি পর্যন্ত গিয়ে ওঠে। কর্তাভজার সঙ্গে বলরামভজার, আউলচাঁদের সঙ্গে সাহেবধনীর ঝগড়া। তখন সকলের ভেতরের মানুষটা বেরিয়ে আসে। এমনিতে কেউ কারও ছোঁয়া খায় না, ছায়া মাড়ায় না। কিন্তু মারামারি হলে তখন আর জ্ঞানগম্যি থাকে না কারও। তখন জগা খাজাঞ্চিবাবু পর্যন্ত দৌড়ে আসে। বলে–বেরোও এখান থেকে, বেরোও–
একজন বলে আমি কেন বেরোব, আমি কি জাত ভাঁড়িয়ে বোষ্টম? ও আগে চাড়াল ছিল তা জানেন খাজাঞ্চিবাবু? ওর মেসো এখনও ঢাকায় শ্মশানঘাটে মড়া পোড়ায়–
আর তুই বুঝি ভাল জাত? তুই যে পোদ! পোদ থেকে হইছিস কর্তাভজা? পোদের জল চলে? বলুন তো খাজাঞ্চিবাবু, পোদের জল চলে?
যেদিন উদ্ধব দাস থাকে, সেদিন সবাই তাকে সাক্ষী মানে। বলে–তুমি বলো তো বাবা, তুমি বলো তো, পোদ কি ছোট জাত?
তা চাঁড়ালের থেকে তো ছোট বটে! বলো না উদ্ধব দাস, বলো না—
উদ্ধব দাস শুধু হাসে। অনেক পীড়াপীড়ি করলে বলে–আমার এখন খিদে পেয়েছে ভাই, এখন ঝগড়া করবার ক্ষেমতা নেই তোমরা ঝগড়া করো আমি শুনি–
তারপর হঠাৎ গান গেয়ে ওঠে–
হরি কে বুঝে তোমার লীলে।
ভাল প্রেম করিলে।
হইয়ে ভূপতি, কুবুজা যুবতী পাইয়ে শ্রীপতি,
শ্ৰীমতী রাধারে রহিলে ভুলে।
শ্যাম সেজেছ হে বেশ, ওহে হৃষীকেশ,
রাখালের বেশ এখন কোথা লুকালে।
মাতুল বধিলে প্রতুল করিলে।
গোপ-গোপীকুলে, অকূলে ভাসায়ে দিলে ।।
উদ্ধব দাস গান গাইলে সবার ঝগড়া থেমে যায়। উদ্ধব দাসের গানের আদর সর্বত্র। ওই গানের জন্যেই তার খাতির। একটা যন্ত্র নেই, ডুগি-তবলা নেই, একতারাও নেই। শুধু-গলায় গান গায় উদ্ধব দাস। উদ্ধব দাস বামুনও নয়, চাঁড়ালও নয়, পোদও নয়। উদ্ধব দাস বলে আমি কর্তাভজা-বলরামভজা আউল-বাউল-সাহেবধনী কিছুই নই গো
তা হলে তুমি কী?
আজ্ঞে আমি উদ্ধব দাস। হরির দাস–
শুধুই উদ্ধব দাস! অতিথশালায় এলে কেউ জিজ্ঞেস করলেই ওই নামটা শুধু বলে। কোত্থেকে আসছ, কোথায় যাবে, তারও উত্তর নেই। কোথায় যাব তা কি কেউ বলতে পারে ঠাকুর? আজকে এখানে এসেছি, কাল বাঁচব কি না কে বলতে পারে?
এই অতিথিশালাতেই হরিপদর সঙ্গে ভাব হয়ে গিয়েছিল উদ্ধব দাসের। উদ্ধব দাসের না আছে। কোনও শখ, না আছে কোনও বিকার। যা দাও তাই খাবে। দুটি খেতে পেলে আর কিছু চায় না। এইখানেই হরিপদ প্রথম দিন এসে ধরেছিল উদ্ধব দাসকে।
বলেছিল–তুমি কে গো?
আমি উদ্ধব দাস।
হরিপদ বলেছিল–শুধু উদ্ধব দাস বললে–চলবে না, তোমার বাড়ি কোথায়, তুমি কী করো–
উদ্ধব দাস রেগে গিয়ে বলেছিল–এই দেখো, তুমি তো আমাকে জ্বালালে হে! যখন যেখানে থাকি। সেই-ই আমার বাড়ি, সেই আমার ঘর।
কী করো তুমি?
দুনিয়াতে কে কী করে শুনি? করনেওয়ালা তো মাথার ওপর। সে যা করাচ্ছে তাই সবাই করছি। আকবর বাদশা যা করে গেছে, তোমার ছোটমশাই যা করছে, আমিও তাই করছি–খাচ্ছি দাচ্ছি আর ভ্যারেন্ডা ভাজছি–
সেই থেকেই হরিপদ মজা করত উদ্ধব দাসকে নিয়ে। অতিথিশালায় যারা আসে তাদের মতো জ্বালাতন করে না হরিপদকে। দাও খাব, না-দাও খাব না। খুশি হয়ে একখানা গান শুনিয়েছিল উদ্ধব দাস। তার পরদিনই হরিপদ এসে বললে–দাসমশাই, তোমাকে চুপি চুপি একটা কথা বলব, সেই গানটা একবার গাইতে হবে–
কী গান?
ওই যে কালকে গেয়েছিলে? আমাদের দুগগা তোমার গানটা শুনতে চেয়েছে!
দুগগা? দুগগা কে গো? মা-দুগগা?
আরে দুর, আমাদের দূগগা। আমাদের বড়রানির পেয়ারের ঝি।
দুগগার কথা সেই প্রথম শুনল উদ্ধব দাস। দুগগা হল রাজবাড়ির পাট-ঝি। দুগগা না হলে কোনও কাজই হবে না অন্দরমহলে। বড়রানির বিয়ের সময় বাপের বাড়ির থেকে নতুন বউয়ের সঙ্গে সঙ্গে এসেছিল। তারপর ছোটমশাই আবার একটা বিয়ে করেছে, কিন্তু সেই ছোটরানিও দুগার হাতের মুঠোর মধ্যে।
উদ্ধব দাস বললে–তা সেটা যে রসের গান গো হরিপদ, সে গান মেয়েছেলে শুনবে?
হরিপদ চোখ মটকে বলেছিল রসের গান বলেই তো শুনবে। তুমি তো জানোনা দাসমশাই, দুগগার বড় রস–
কী রকম?
হ্যাঁ, যা বলছি তাই। ওই রসেই তো একেবারে মজিয়ে দিয়েছে রানিদের। তুমি বিয়েথা করোনি। ওসব বুঝবে না–
তা সেইদিন দুপুরবেলাই ব্যবস্থা হয়েছিল গানের। কেউ ছিল না তখন। রান্নাশালার বামুনঠাকুর কাজকর্ম সেরে বাইরে গিয়েছে। বেশ করে কড়াইয়ের ডাল দিয়ে ভাত মেখে পেট ভরে খেয়ে একটু তন্দ্রা মতন এসেছিল, এমন সময় হরিপদ এসে ঠেলা মারলে। বললে–ওঠো দাসমশাই চলো–
কোথায় গো?
চলো, দেরি কোরো না, ছোটরানি গান শুনবে বলে বসে আছে দরদালানে–
উদ্ধব দাস এমনিতে উদাসী মানুষ কিন্তু কথাটা শুনে ভয় পেয়ে গেল। রসের গান শুনে যদি ছোটমশাই রাগ করে। রসের গান কি যাকে-তাকে শোনানো যায়। রসিক ছাড়া কি রস বোঝে কেউ?
হরিপদ বললে–আরে, রসের গান শুনতেই তো ছোটরানি চায়, ওই তোমার ভক্তিরসের গান নয়, ছোটরানির কাঁচা বয়েস এখন, রস করবে না তো কি হরিনামের মালা জপবে?
ছোটরানির কাঁচা বয়েস?
হরিপদ বলেছিল–কাঁচা বয়েস হবে না? ছোটমশাইয়ের যে দ্বিতীয় পক্ষের বউ–বড়রানির ছেলে হল না, তাই তো ছোটরানিকে ঘরে এনে তুলেছে–
ছোটরানির ছেলে হয়েছে?
এবার বিরক্ত হয়ে গেল হরিপদ। কথা যদি বলবে তো গান গাইবে কখন দাসমশাই। ততক্ষণে ভেতর-বাড়ি পেরিয়ে রানিবিবি এসে গেছে। সেই কোথায় অন্দরমহল। একটা মহলের পর আর একটা মহল। এমনি সাতটা মহল পেরিয়ে তবে অতিথিশালার দোতলার দরদালানে আসতে হয়। সেখানে পঙ্খের কাজ করা ইটের জাফরির ফাঁক দিয়ে উঠোনের ভেতরটা সব দেখা যায়। ভেতর থেকে কার গলা শোনা গেল–কই রে হরিপদ, গান করতে বলো–
হরিপদ বললে–ওই দুগা আরম্ভ করে দাও গো ছোটরানি দরদালানে এসে হাজির হয়েছে–
কোন গানটা গাইব?
রসের গান, মেয়েছেলেরা রসের গানই চায় যে দাসমশাই—
উদ্ধব দাস আরম্ভ করলে প্রাণ রে, পিরিতের কথা আর বোলো না–
হরিপদ বাহবা দিয়ে উঠল–বাঃ বাঃ, খাসা–
প্রাণ রে, পিরিতের কথা আর বোলো না।
পিরিত করলাম প্রাণ জুড়াতে
বুকে ধরলাম প্রাণনাথে
তাতে আমার বুকের জ্বালা বাড়ল বই কমল না।
প্রাণ রে পিরিতের কথা আর বোলো না।
হরিপদ আর থাকতে পারল না। চিৎকার করে উঠল–বা দাসমশাই, বেশ—বেশ–
প্রাণ রে, তুষের আগুন ছিল ভাল।
আমিও ছিলাম প্রাণও ছিল।
এই যে আমিও গেলাম প্রাণও গেল
সবই হল ভস্মীভূত, আমার কিছুই রইল না।
প্রাণ রে, পিরিতের কথা আর বোলো না।
হরিপদ আবার বাহবা দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই উদ্ধব দাস গান থামিয়ে দিয়েছে। মুখ ফিরিয়ে বললে–গড় হই গো খাজাঞ্চিমশাই—
কে তুই?
জগা খাজাঞ্চিবাবু এমনিতে এখানে আসে না। কিন্তু হয়তো নির্জন দুপুরবেলায় গানের শব্দ শুনে ঢুকে পড়েছে।
নটবর বললে–ও উদ্ধব দাস, খাজাঞ্চিমশাই–
খাজাঞ্চিমশাই বললে–ওইসব গান দুপুরবেলা এখানে কে গাইতে বলেছে তোকে, বেরো এখান থেকে বেরিয়ে যা–কে ঢুকতে দিয়েছে তোকে–
উদ্ধব দাস বললে–অভাজনের নিবেদন শুনুন প্রভু–
শুনো ভাই সভাজন, অভাজনের নিবেদন।
একে একে শ্রীরামচন্দ্রের কহি বিবরণ।
দেখো ভাই শ্রীরামচন্দ্র জগৎচন্দ্র কোথা হবেন রাজা।
তাহাতে কৈকেয়ী মাগি দিলেন আচ্ছা সাজা।
পরিয়ে জটা বাকল আর সকল ত্যজি অলংকার।
পাঠাইল অরণ্যেতে চতুর্দশ বৎসর।
রাম নিজ গুণে ভ্রমেণ বনে যথায় তথায়।
সীতা সতী গুণবতী দারুণ কষ্ট পায়।
শুনো একদিন দৈবাধীন আসি বসুন্ধরা…
খাজাঞ্চিবাবু আর থাকতে পারলে না। বললে–ওরে বাবা, এ যে আবার ছড়া কাটে রে—
হরিপদ বললে–আজ্ঞে, কালকে ও আমাদের মানভঞ্জনের পালা শুনিয়েছে–
উদ্ধব দাস বললে–আমি মানভঞ্জন পালা গাইতে পারি, কালীয়দমন পালা গাইতে পারি, অধীনের গুণের সীমে নাই প্রভু, আজ্ঞা হয় তো গাই এখন–
খাজাঞ্চিবাবুর তখন অত সময় নেই। বললে–এ কোত্থেকে আমদানি হল রে হরিপদ?
হরিপদ বললে–আজ্ঞে সেবার সেই এক সন আগে একবার এসেছিল, আবার এসে জুটেছে, গানটান গায় বলে আর তাড়িয়ে দিইনি, ভারী নির্ঞ্ঝাট লোক, দুটো ভাত পেলেই খুশি আর অতিথিশালায় পড়ে থাকে–
তারপর উদ্ধব দাসের দিকে চেয়ে বললে–দাসমশাই, তোমার সেই মাথুরটা শোনাও না একবার খাজাঞ্চিমশাইকে–
উদ্ধব দাসকে আর দু’বার বলতে হয় না। বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে এক কানে হাত চাপা দিয়ে গায়–
এ যমুনা পারে কে আনিতে পারে
আমরা ব্রজের কুলবালা।
খাজাঞ্চিমশাই চেঁচিয়ে উঠলদুর হ, দুর হ-বড় বউরানির কানে গেলে হয়েছে আর কী—
উদ্ধব দাস বললে–সবই আমার নিজের তৈরি প্রভু—
হরিপদ বললো খাজাঞ্চিবাবু, মুখে মুখে হেঁয়ালি বানায় আবার—
উদ্ধব দাস বলতে লাগল বলুন তো প্রভু কী?
সূর্য বংশে জন্ম তার অজ রাজার নাতি।
দশরথ পুত্র বটে নয় সীতাপতি।
রাবণের অরি নয় লক্ষ্মণের জ্যেষ্ঠ।
ভনে কবি উদ্ধব দাস হেঁয়ালির শ্রেষ্ঠ।
হরিপদ জিজ্ঞেস করলে–-বলুন তো খাজাঞ্চিমশাই, এর উত্তর কী হবে?
খাজাঞ্চিমশাই বললে–দুর, এসব ভাববার সময় আছে আমার! তোর দেশ কোথায়?
উদ্ধব দাস ছড়া কেটে উঠল–
আমার কাজ কী সংসারে হরি।
আমি রাধার দুঃখে গোকুল ছেড়ে হইলাম দেশান্তরী।
দেখলেন তো খাজাঞ্চিমশাই, ছড়ার নমুনা দেখলেন তো। গরিব লোক, অতিথিশালায় উঠেছে, থাক না ক’দিন, আপনি যেন আর কিছু বলবেন না—
খাজাঞ্চিবাবু আর কিছু বললে না। ব্যাজার হয়ে চলে গেল। সব রস মাটি। ভেতরে দুগাও বোধহয় ছোটরানিকে নিয়ে অন্দরমহলে চলে গিয়েছে। সেদিক থেকেও আর কোনও সাড়াশব্দ নেই। আর গান জমবে না।
উদ্ধব দাস বললে–আমিও যাই হে—
কেন? তুমি আবার যাবে কী করতে?
নেমন্তন্ন খেতে ইচ্ছে করছে। অনেক দিন নেমন্তন্ন খাইনি—
তা কী খাবে বলো না; ভোগবাড়িতে বলে দিচ্ছি, রান্না করে দেবে!
উদ্ধব দাস বললে–মুগের ডাল—
আরে এই সামান্য কথা, তার জন্যে ভাবনা, আজই মুগের ডাল বেঁধে দেব তোমায়—
উদ্ধব দাস পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে উঠল। বললে–দুর, তোমাদের মুগের ডাল আর খাচ্ছি আমি, আমি চললুম
কী গো? সত্যি সত্যিই যাচ্ছ? কোথায় যাচ্ছ?
কেষ্টনগরে।
হঠাৎ কেষ্টনগরে কেন?
ওই যে মুগের ডালের কথা মনে পড়ে গেল, যাই, কেষ্টনগরের রাজাবাবুদের বাড়ি যাই, অমন মুগের ডাল কোত্থাও খাইনি গো–
এমনি করে উদ্ধব দাস এই হাতিয়াগড়ের অতিথিশালায় অনেকবার এসেছে গেছে। হরিপদর সঙ্গে হাসিতামাশা করেছে। বাড়ির ছোটরানিকে গানও শুনিয়েছে। যেমন মুগের ডাল খেতে একদিন হঠাৎ কেষ্টনগরে চলে যায়, তেমনই আবার হয়তো কয়েকদিন এখানেই পড়ে থাকে। অতিথিশালায় দুটো ভাত পেলেই খুশি। তাড়িয়ে দিলেও ব্যাজার নেই। আবার হয়তো একদিন পোটলা-পুঁটলি নিয়ে কোথায় বেরিয়ে পড়ে। যদি কেউ জিজ্ঞেস করে–কী গো, কোথায় চললে দাসমশাই–
উদ্ধব দাস বলে–গুপ্তিপাড়ায়–
গুপ্তিপাড়ায় কেন গো?
গুপ্তিপাড়ায় চড়ক দেখে আসি—
তা আমাদের পাড়াতেও তো চড়ক হবে, থাকো না–
উদ্ধব দাস বলে–না গো, সেখানে মূল সন্নিসি এবার পিঠে বাণ ফুড়বে, পিঠে বাণ ছুঁড়ে চড়ক গাছে উঠে ঘুরপাক খাবে, যেতে বলেছে–
তারপর আবার বহুদিন উদ্ধব দাসের দেখা নেই।
তা উদ্ধব দাস এইরকম। শোভারামের মেয়ের বিয়েতে অতিথিশালার কথাটা উঠতেই হঠাৎ উদ্ধব দাসের কথাটা মনে পড়ল হরিপদর। রাত তখন অনেক। দাসমশাই তখন হয়তো খেয়েদেয়ে নাক ডাকাচ্ছে।
অতিথিশালার উঠোনের পাশে খালি বোয়াকের ওপর অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছিল। হরিপদ এসে গায়ে ঠেলা দিলে।
ও দাসমশাই, ওঠো ওঠো—
ধড়মড় করে উঠে বসেছে উদ্ধব দাস। উঠে বসেই সামনে চেয়ে দেখে দু’জন লোক। হাতে মশাল জ্বলছে। প্রথমটায় চিনতে পারেনি। কারা আবার এল বিরক্ত করতে। চোখ দুটো রগড়ে ঠিক করে দেখলে।
আমি গো দাসমশাই, আমি। আমি হরিপদ, তোমায় নিয়ে যেতে এসেছি।
শোভারাম তখন একদৃষ্টে চেয়ে দেখছে উদ্ধব দাসের দিকে। এই তার জামাই। তার যে একমাত্র মেয়ে। মেয়েকে যে অনেক আদরে মানুষ করেছে শোভারাম। সেই মেয়েকে এই এর হাতে তুলে দেবে শেষকালে!
হরিপদ শোভারামকে সান্ত্বনা দিয়ে বললে–উদ্ধব দাস আমাদের সৎসুস্থ, কোনও কিছুতে আটকাবে না দাদা, আমি বলে দিচ্ছি তোমার মেয়ে সুখে থাকবে—
শোভারামের তখন জীবন-মরণ সমস্যা। তার তখন আর ভাববার সময় নেই। বললে–আমি আর ভাবতে পারছিনে হরিপদ, যাতে আমার জাতটা থাকে তাই দেখো–
হরিপদ উদ্ধব দাসের সামনে নিচু হয়ে জিজ্ঞেস করলে–নতুন কাপড় পরতে হবে তোমাকে দাসমশাই, তোমার নতুন কাপড় আছে?
উদ্ধব দাস বললে–নতুন কাপড় কী হবে?
শোভারাম বললে–থাক থাক, আমার কাছে নতুন কাপড় আছে, আমি নতুন কাপড় দেবো’খন–চলো, চলো–
উদ্ধব দাস তবু জিজ্ঞেস করলে–নতুন কাপড় কী হবে তাই বলো না—
হরিপদ বললে–হবে আবার কী ছাই, যা বলছি করো, চলো আমাদের সঙ্গে, আর সময় নেই–
অথচ এই কালই শোভারাম মেয়েকে নিয়ে এখানে এসেছিল। ভোরবেলা তখনও ঘুম থেকে ওঠেননি ছোটমশাই। গোকুল দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল–কে? শোভারাম? এত সকালে কী করতে?
এই মরালীর বিয়ে কিনা আজ, তাই নিয়ে এলাম, ছোটমশাইকে প্রেম করে যাবে—
মরালীকে শাড়ি পরিয়ে আলতা পরিয়ে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। মরালীরও ভয়-ভয় করছিল। এত বড় বাড়ি। কত গড় কত মহল পেরিয়ে রাজবাড়ির ভেতরে আসতে হয়। গড়জাত পেরিয়ে বুড়োশিবের মন্দির। পাশে ঠাকুরবাড়ি। আর তার পাশেই ছোট একটা পুকুর। ভেতরের গড়ের দিকে কেল্লা। এই দুই গড়ের মাঝখানের জমিতে কানুনগো কাছারি। বড় গড় পেরিয়েই সামনের সিংদরজা। সিংদরজার মধ্যে ছোট দরজাটা খুলে লোলাকজন যাতায়াত করে। তারপরেই উঠোন। উঠোনের উত্তর দিকে একটা দক্ষিণদ্বারী একতলা কোঠা। এই কোঠার সামনে খাঁজকাটা খিলেন দেওয়া বারান্দা। আর উঠোনের দক্ষিণ দিকে একটা মন্দির। মন্দির পেরিয়ে পুব দিকের দেয়ালের মাঝখানে একটা দরজা। এই দরজা পেরিয়ে ভেতরে গেলেই আর একটা উঠোন। সে উঠোনের এক পাশে ভোগ রাঁধবার রান্নাবাড়ি আর একদিকে অতিথিশালা। তারপর পুবের দরজা দিয়ে সামনাসামনি ঢুকলে ভেতরের গড়। এই গড়ের ওপরেই ছোটমশাইয়ের বসতবাড়ি। বসতবাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালে ভেতরের দরজা খোলা দেখা যাবে। সেখান দিয়ে ভেতরবাড়ির লোক আসা-যাওয়া করে। ভেতরের গড়ের মধ্যে বিরাট রাজবাড়ি। এ-দিগর থেকে ও-দিগর পর্যন্ত লোক আর জন। মহলের পর মহল। প্রথম মহলের পর বড় বউরানির মহল পড়বে।
ওধার থেকে কেউ প্রশ্ন করবে–কে?
শোভারাম বলবে–আমি শোভারাম–
তারপর পরের মহলের সীমানায় গিয়ে সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। সেখানে বাঁধানো চাতাল আছে। পাশেই পুকুর। পুকুরের শান বাঁধানো ঘাট। এইখানে এই চাতালেই আগে বড়মশাই তেল মাখতে বসতেন। আর খেউরি করত বিশু পরামানিক। তারপর পুকুরের মধ্যে অনেকক্ষণ ডুবে ডুবে চান করবার পর গা মুছতেন রোদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
কাল সকালেও এইখানে এসে ছোটমশাইকে প্রণাম করেছিল।
মরালীকে চুপি চুপি বলেছিল–আজকে বড়রানি ছোটরানি সকলকে পেন্নাম করে আসবি জানিস, বলবি–কাল আমার বিয়ে–
এইখান দিয়েই মরালী এই গড়বন্দির মধ্যে ঢুকেছিল।
শোভারাম বলেছিল–যাও মা যাও, ভেতরে গিয়ে রানিমাদের পেন্নাম করে এসো–
কোথা দিয়ে ঢুকে কোথা দিয়ে ভেতরে গিয়েছিল তা আর মনে নেই। ওই দুগগাই প্রথমে দেখতে পেয়েছিল তাকে। ওমা, ওমা, এ যে শোভারামের মেয়ে গো–
চিবুকে ছোঁয়া লাগতেই চোখ খুলে গেল। মরালী দেখলে সামনেই ছোটরানি দাঁড়িয়ে। আর সঙ্গে সঙ্গে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে ফেললে।
ওমা, গড় করছ কেন আমাকে?
দুর্গা বললে–তা করুক না রানিমা, তোমাকে গড় করবে না তো কাকে করবে! কাল ওর বিয়ে, সুলতানুটি থেকে ওর বর আসছে, আশীর্বাদ করো যেন সতীলক্ষ্মী হয়ে সিথির সিঁদুর নিয়ে সোয়ামির সংসার করে–
না না, আমাকে গড় করতে হবে না, আমি তো তোমার চেয়ে বড় নই—
মরালী বললে–আমার বাবা যে বলে দিয়েছে—
তা দিক বলে–তোমার-আমার তো সমানই বয়েস, কী বল দুগগা?
দুর্গা বলেছিল–এই মেয়েকে তো এখন দেখছ এমনি, আগে কী দজ্জাল ছিল মা, রাস্তার লোক দেখলে খোয়র করত, বিয়ের জল পড়তে না পড়তেই একেবারে ঠান্ডা হয়ে এসেছে, বিয়ে বলে এমনি জিনিস–
এতক্ষণে ঘরের চারপাশটা দেখে নেবার শক্তি হয়েছে মরালীর। দুটো পালঙ। দুটো হাতি দু’পাশ থেকে শুড় ঠেকিয়ে আছে মাথার দিকে। বিছানার ওপর দুটো মাথার বালিশ। পাশাপাশি রাখা। ছোটমশাই আর ছোটরানি পাশাপাশি শোয়। মাথার কাছে ফুল ছড়ানো। বাগান থেকে ফুল দিয়ে যায়। মালীরা। অনেকক্ষণ ধরে দেখতে লাগল মরালী। কী সুখই না বড়মানুষের বউদের। দেয়ালে দেয়ালে পট টাঙানো। নল-দময়ন্তী, রাম-সীতা, হর-পার্বতী, আর সাবিত্রী-সত্যবানের পট।
দুর্গা বললে–কী দেখছিস লা মেয়ে, তোরও হবে এমনি, বরের সঙ্গে এমনি পাশাপাশি শুবি, বরের সঙ্গে গপপো করে কোথা দিয়ে রাত পুইয়ে যাবে টের পাবিনে–
শুনতে শুনতে যেন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল সমস্ত শরীরে। লজ্জায় মুখ রাঙা হয়ে উঠল মরালীর।
দুর্গা বলতে লাগল–বরকে আঁচলে গেরো দিয়ে রাখবি লা, নইলে ফসকে পালিয়ে যাবে, এই বলে রাখলাম মেয়ে, রাতের বেলায় সোহাগ করবি, দিনের বেলা শাসন করবি, তবে বেটাছেলে বশে থাকবে–
ছোটরানি ধমক দিলে–তুই চুপ কর দুগগা–
দুর্গা বললে–কেন চুপ করব ছোটরানি, বিয়ের আগে আমরা শিখিয়ে পড়িয়ে না দিলে কে দেবে বলল, মুখপুড়ি যে মাকেও খেয়েছে–
হঠাৎ এই পরিস্থিতিতে মার কথা মনে আসতেই যেন ছাত করে উঠল বুকটা। এমন করে কেউ তো তাকে শোনায়নি। নয়ানপিসি অনেক কথা বলেছিল। অনেক দিন অনেক উপদেশ দিয়েছে, অনেক ব্রতকথা মুখস্থ করিয়েছে, কিন্তু এসব কথা এমন করে তো কেউ বলেনি।
দুর্গা বলতে লাগল–আমাদের গাঁয়ে, জানো ছোটরানি, এক বেনের মেয়ের সতিনের ঘরে পড়ে কী হল। মা ছিল না তো, কেউ শিখিয়ে দেয়নি, সোয়ামি সতিনের ঘরে শুত, আর ছুঁড়িটা সোনাদানা পেয়ে খুশি থাকত। শেষে যখন ঘুড়ির বয়েস হল, জ্ঞানগম্যি হল, সতিনাটা বুঝতে শিখলে, তখন সোয়ামিকে বললে–সতিনের ঘরে তোমাকে এবার থেকে শুতে দেব না–
ছোটরানি বললে–রাখ তোর কেচ্ছা দুগগা, বড় বউরানির ঘরে নিয়ে যা একে—
বলে মরালীর দিকে হাত বাড়িয়ে বললে–এই নাও ভাই, পান খাও–
তারপর দুর্গাই মরালীর হাত ধরে ঘরের বাইরে নিয়ে এল। বললে–চল, বড় বউরানিকে গড় করে আসবি চল–
বড় বউরানি! বড় বউরানির নাম শুনে ঘাবড়ে গিয়েছিল মরালী! সে আবার কে!
সতিন লো সতিন, ছোট বউরানির সতিন!
এবার দরজা পেরিয়ে পাশের বারান্দায় যেতে হল। এ কত বড় বাড়ি। এবারান্দা ওবারান্দা। দূরে বুড়োশিবের মন্দিরটা দেখা যায় জাফরির ফোকর দিয়ে। বড়মশাইয়ের বাবা বুড়ো শিবের মন্দিরের চুড়োটা সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন ছেলে হবে বলে। এই ছোটমশাই তখন হননি। যেবার বর্গিরা এসে ভাগীরথীর পশ্চিম পারে হানা দিয়েছিল তখন লাঠিয়ালরা পাহারা দিয়েছিল এই মন্দির। কাল যখন মরালী বিয়ের পর বরের সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি যাবে তখন ওই বুড়োশিবের মন্দিরে গিয়ে প্রণাম করে যাবে। এই-ই রীতি। ছোটমশাইয়ের যখন বিয়ে হয়েছে তখনও বউ নিয়ে এসে ওই বুড়োশিবের মন্দিরে প্রণাম করে তবে বাড়িতে ঢুকেছে।
দুর্গা বলেছিল–খুব ভাল করে পায়ে মাথা ঠেকিয়ে গড় করবি বড় বউরানিকে, বড় কড়া মানুষ, বুঝলি?
মরালী জিজ্ঞেস করলে–আমার ওপর রাগ করবে না তো?
রাগ করবে কেন? তুই কি তার সতিন যে রাগ করবে তোর ওপর?
তবে? ছোটরানির ওপর খুব রাগ নাকি?
দুর্গা বললে–রাগ না পিন্ডি। পিরিত লো পিরিত। ছোটমশাইকে খোসামোদ করতে সতিন আনালে–বললে–দেখো আমি কত সতী। তোর যখন সোয়ামি হবে তখন তুইও বুঝবি, তাই তো তোকে অত শেখালুম পড়লুম। রোজ ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে বাসিমুখে বলবি ময়না ময়না ময়না, সতিন যেন হয় না–তা হলে আর সতিন হবে না তোর–
চলতে চলতে মরালী বললে–ছোট বউরানির বুঝি তাই খুব কষ্ট?
দূর পাগলি, দেখলিনে, বিছানার ওপর দুটো মাথার বালিশ, ফুলের তোড়া, রাত্তিরবেলা আবার আতর-গোলাপজল ছিটিয়ে দিই বিছানায়। তারপরে ছোট বউরানিকে যা এনে দিয়েছি তোকেও তাই এনে দেব, দরকার হলে আমাকে বলিস–
কী?
তোর ভাতার যদি তোকে অপগেরাহ্যি করে কি সতিন ঘরে আনে তো তোকেও দেব—
মরালী আবার জিজ্ঞেস করলে, কী, জিনিসটা কী?
ছোট বউমাকে তাই এনে দিয়েছি বলেই তো আর সোহাগের সীমে নেই ছোট বউরানির, ছোটমশাই এক-পা ঘরের বাইরে যায় না, মুখে মুখ দিয়ে পড়ে থাকে দিন রাত। বিছানায় তো দেখলি এক রাশ ফুল, ওই সব হয়েছে আমার জন্যে–
মরালী আবার জিজ্ঞেস করলে–কী করে হল? কী দিয়েছিলে তুমি?
সে বলব’খন তোকে, মন্তর আছে তার আর শুধু একটু করে আদা আর আকের গুড় লাগে যে-মেয়েমানুষ সোয়ামির কাছে শুতে ভয় পায়, কি যে-সোয়ামি মাগের কাছে শুতে আসে না–
তারপর হঠাৎ থেমে গম্ভীর হয়ে বললে–চুপ কর, বড় বউরানি আসছে–
সত্যি, বড় বউরানিকে দেখে কেমন যেন মনে হল মরালীর। একটু বয়েস হয়েছে। পুজো করে আসছিলেন বোধহয়। রেশমের শাড়ি। লাল পাড়। বাঁ হাতে পুজোর থালা।
দুর্গা বললে–এই তোমাকে গড় করতে এসেছে বউরানি, শোভারামের মেয়ে, কাল ওর বিয়ে—
শান্ত ঠান্ডা গলার স্বর। মাথায় হাত দিলেন মরালীর। বললেন–বেঁচে থাকো মা, স্বামীর সংসারে অচলা হয়ে থাকো–
কেমন যেন জুড়িয়ে গেল সমস্ত শরীরটা। বড় শান্ত সুখী মানুষটা। আবার বললেন–হ্যাঁ রে দুগগগা, ছোটমশাই উঠেছে রে? উঠলে আমার ঘরে একবার ডেকে দিস তো–
বলে যেমন আসছিলেন তেমনই আবার চলে গেলেন।
গরান কাঠের খুঁটি আর গোলপাতার ছাউনি দেওয়া ঘরের ভেতর মরালী তখনও চুপ করে বসে ছিল। পাটের শাড়িতে ঘেমে নেয়ে চান করে উঠেছিল। কাল সকালবেলার সেই সব কথাই মনে পড়ছিল। বাইরে লোকজনের গলা শোনা যাচ্ছে। ঘরের মধ্যে এতক্ষণ নয়ানপিসি ছিল, অনন্তদিদি ছিল, পাড়ার সবাই ছিল। তারা সবাই বাইরে চলে গেছে। বর আসেনি লগ্ন বয়ে যাচ্ছে। বর যদি না আসে তো কী হবে?
হঠাৎ কানে এল–বর এসেছে, বর এসেছে—
*
তা বিপদ কি শুধু শোভারামের মেয়ের একলার। বিপদ সকলের। রাজবাড়িতে তখন সব অন্ধকার। অতিথিশালার ভেতরে সেদিন তেমন লোক ছিল না। যা দু-একজন এসেছিল তারা দিনমানে-দিনমানে চলে গেছে। রেড়ির তেলের পিদিমটা নিভে গিয়েছিল প্রথম রাত্রেই। কাছারির লোক কিছু কিছু এপাশে-ওপাশে শুয়ে ছিল। তাদের পাশ কাটিয়ে উদ্ধব দাস, হরিপদ আর শোভারাম দরজার কাছ পর্যন্ত এল।
উদ্ধব দাস আবার জিজ্ঞেস করলে–সত্যি বলো না গো, নতুন কাপড় কী হবে?
হরিপদ বললে–হবে আবার কী ছাই, যা বলছি করো–আর সময় নেই–
সেদিন হরিপদ যে কী বিপদেই ফেলেছিল। সন্ধেবেলাও কিছু বলেনি হরিপদ। উদ্ধব দাস নেচেছে, গেয়েছে। কড়াইয়ের ডাল দিয়ে ভাত খেয়েছে কলাপাতায়। ছড়া কেটেও শুনিয়েছে।
সেদিনও হরিপদ জিজ্ঞেস করেছিল–নতুন রসের গান বানিয়েছ নাকি দাসমশাই?
উদ্ধব দাস জিজ্ঞেস করেছিল–কেন, তোমাদের দুগগা জানে নাকি আমি এইচি?
তা আর জানে না? তবে আজকে আর গান শুনবে না
কেন? আজ কী হল?
আজ এ-পাড়ায় আমাদের শোভারামের মেয়ের বিয়ে, সেখানে নেমন্তন্ন খেতে যাবে
তা সে তো রাত্তিরে?
তারপর হরিপদ বলেছিল–আচ্ছা দাঁড়াও, দেখি, দুগগাকে জিজ্ঞেস করে আসি গান শুনবে কিনা। আমাকে বলে রেখেছিল, তুমি এলে খবর দিতে। ভারী দেমাক কিনা দুগার। আগে জিজ্ঞেস না করলে যদি আবার খোয়ার করে–
উদ্ধব দাস বলেছিল-ঝিউড়ির আবার অত খোয়ার কেন গা?
ওমা, খোয়ার হবে না? ছোট বউরানির আদর পেয়ে পেয়ে দুগগার খোয়ার যদি একবার দেখো তো তুমিই অবাক হয়ে যাবে দাসমশাই–তুমি বোসো, আমি দেখে আসি ভেতরে
এ-সব বিকেলবেলার ঘটনা। বিকেলও হয়নি ভাল করে। ভেতর বাড়ির প্রথম দরজা পেরিয়ে বড়
বউরানির মহল। তার পাশের বারান্দা দিয়ে গিয়ে তবে ছোট বউরানির মহল পড়বে। কেমন যেন। ভয়-ভয় করতে লাগল হরিপদর। পাশে ছোটমশাইয়ের খেউরি হবার জলচৌকি। সকালবেলা সেখানে বসে খেউরি করে বিশু পরামানিক। জলচৌকিটার পাশে দাঁড়ালে ছোট বউরানির ঘরের বারান্দাটা দেখা যায়। ঘরের দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। আশেপাশে দুগাকে কোথাও দেখতে পাওয়া গেল না। এইসময় ছোট বউরানির জন্যে খাবার নিতে আসে দুগগা। রান্নাবাড়িতে গিয়ে খাবার ফরমাজ দিয়ে আসে। সেদিন যা খেতে ইচ্ছে হবে তা আগে থেকে বলে আসতে হয়। বড় আয়েশি মানুষ। ছোট বউরানির ঘুম বড় গাঢ়। সকালবেলা ছোটমশাই উঠবার পরও বিছানায় শুয়ে পড়ে থাকে। তখন দুগগা গিয়ে গা-হাত-পা টিপে দেয়, মাথায় সুড়সুড়ি দেয়। দুগগা না হলে ছোট বউরানির চলে না। সন্ধেবেলা হয়তো ঘি দিয়ে চিড়েভাজা খেতে ইচ্ছে হয়। বাগানের সেরা সেরা আম আসে ছোট বউরানির জন্যে। ভাড়ার ঘরে গিয়ে দুগগা ঝগড়া করে আদায় করে নিয়ে আসে।
দুর্গা বলে খেতে পরতে দেবার মালিক যে, তার যদি একটু তোমোদ করি, তাতে কী এমন অন্যায় করি মা
তরঙ্গিনী ভাঁড়ারের লোক। বলে–বড় বউরানির জন্যে আমের আচার করেছিলুম তাও নিয়ে গেলি
দুর্গা বলে নিজের জন্যে নিইনি গো, নিজের জন্যে নিইনি। খেতে পরতে দেবার মালিকের জন্যেই নিয়েছি। ছোট বউরানির জন্যে জিনিস নিলে তোমাদের এত চোক টাটায় কেন গা?
তরঙ্গিনীও কম নয়। বলে ছোট বউরানি তোর সগ্যে বাতি দেবে লা, তোর পরকালের গতি করবে, ভাল করে পা টিপিস বাপু
এর পর আর ধৈর্য থাকে না দুর্গার। বলে আমার সগ্যে কেন বাতি দেবে না, দেবে তোর সগ্যে। তুই বউরানির খাতির করিস, বাঁজা মেয়েমানুষের পায়ে তেল দিস, মুদ্দোফরাসেও তোর গতি করবে না, করুণাময়ীর ঘাটে তোকে শ্যাল-কুকুরে খাবে! তুই কবে মরবি লা, আমি ঘাটে বসে দেখব
তারপরেই ঝগড়া বেধে যায়। তুমুল ঝগড়া। রান্নাবাড়ি থেকে লোক জড়ো হয় ভাঁড়ারের উঠোনে। সধবা বিধবা কেউ বাকি থাকে না। গালে হাত দিয়ে ক্ষেন্তির মা বলে–অবাক করলি মা। দুগগা, তোর না মাসি হয় তরি। তরিকে তুই ওই কথা বললি?
তরঙ্গিনী তখন সত্যিই কাঁদতে শুরু করেছে।
বলে–তোমরা পাঁচজনে দেখো মা, এই অ্যাটুকু বয়েসে রাড় হল যখন, তখন আমি এনে ঢোকালুম ওকে চাকরিতে, সেই চাকরিতে ঢুকে বড় বউরানির সঙ্গে রাজবাড়িতে এল; ভাবলুম ভাতার যায় যাক, মুখপুড়ি দু’বেলা দু’মুঠো খেতে তো পাবে পেট ভরে। এখন আমার কপাল মা, আমার কপাল–আপন বোনঝি আমার, সেও আমায় কিনা খোয়ার করে
এসব রাজবাড়ির ভেতরকার ব্যাপার। অন্দরমহলের ঘটনা। কিন্তু বাইরে কাছারি, কানুনগো কাছারি, চণ্ডীমণ্ডপ, খাজাঞ্চিখানাতে অন্য চেহারা। হাতিয়াগড়ের রাজবংশের সে ইতিহাস সবাই জানে। পাঠান আমলের শেষ দফায় সুলেমান কররানির সময়ে কালাপাহাড়ের অত্যাচারে সমস্ত ভূভাগ যখন জর্জর হয়ে আছে, তখনকার কথা। এক-একজন সর্দার এক-একটা এলাকায় প্রধান হয়ে উঠেছে। কেবল মদিপুর, চট্টগ্রাম আর এই সুন্দরবনের প্রত্যন্ত প্রদেশ তখনও বিবাদী স্বরূপ স্বাধীন সত্তায় বিরাজ করছে। তখন বাইরে থেকে বারবার অত্যাচার আর আঘাতের ঢেউ এসেছে। কখনও অর্থলোভে, কখনও ভূমির লোভে, কখনও নারীর লোভে সে অত্যাচার দুর্দম আকার নিয়েছে। অত্যাচারের পর অত্যাচারে হয়তো অনেক সময়ে ভূমির অংশ ছেড়ে দিতে হয়েছে, অর্থ দিয়ে অত্যাচারীকে বশীভূত করতে হয়েছে। দেশও পুরনো, এ-দেশের অতীতও পুরনো। সেই সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী থেকেই মুসলমানদের অত্যাচার শুরু হয়েছে। মহম্মদ বিন কাশিম আর দ্বিতীয় খলিফ ওমরের সময় থেকেই এর সূত্রপাত। তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল এ-দেশের মেয়েমানুষ। আরবের মরুভূমির দেশের চোখে এ-দেশের মেয়েমানুষেরা ছিল স্বপ্ন। তারপর যুগের পর যুগ কেটে গেছে। লুঠতরাজের শেষ হয়নি কোনওদিন। মহম্মদ বিন কাশিম থেকে সবক্তজিন। সবজিন থেকে সুলতান মামুদ পর্যন্ত তার জের চলল। সঙ্গে সঙ্গে মন্দির ভাঙল, বিগ্রহ ভাঙল। দেশের ক্ষাত্রশক্তির আর তখন জাগবার কথা নয়। পুবে বারানসী আর দক্ষিণে সোমনাথ পর্যন্ত অত্যাচারের উত্তাল ঢেউ চলল গড়িয়ে গড়িয়ে। লুঠের পর লুঠ, রক্তপাতের পর রক্তপাত। কান্নায় ভারী হয়ে উঠল বাতাস, রক্তে পঙ্কিল হয়ে উঠল পৃথিবী। সুলতান মামুদ অত্যাচার করতে করতে একদিন নিজের অত্যাচারের বীভৎসতায় নিজেই দু’হাতে নিজের দু’চোখ বুজে ফেললেন। কিন্তু নবাব বাদশাদের মেয়েমানুষের লোভ তবু গেল না।
সিং-দরজার সামনেই মাধব ঢালি পাহারা দেয়।
উদ্ধব দাসকে নিয়ে হরিপদ আর শোভারাম সেখানে এসে দাঁড়াতেই অবাক হয়ে গেল। নবাবের ফৌজি সেপাই দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। আর মাধব ঢালির সঙ্গে কী যেন কথা বলছে।
কী হল? এখানে কী?
কথাটা জিজ্ঞেস করেই কিন্তু হরিপদ শিউরে উঠেছে। ছোটমশাইকে খুঁজতে এসেছে ফৌজি সেপাই।
মাধব ঢালি বললে–ছোটমশাই তো এখন শুয়ে পড়েছেন হুজুর
তা নায়েব, নায়েব কোথায়? হাতিয়াগড়ের নায়েব-নাজিম?
আজ্ঞে হুজুর, নায়েবমশাই তো বাড়িতে আছেন।
কোথায় তার বাড়ি?
কাছারি বাড়ির পাশে। ওই দিকে, ওই দিকে সোজা নাক বরাবর চলে যান হুজুর।
ফৌজি সেপাই দুটো আর বাক্যব্যয় না করে সোজা সেই দিকে চলে গেল।
হরিপদর এতক্ষণে সাহস হল। জিজ্ঞেস করলে সেপাই এসছিল কেন গো মাধব?
মাধব ঢালি ডাকাতি করত এককালে। বড়মশাই যাবার আগে ওকে এই পাহারাদারির চাকরি দিয়ে গিয়েছিলেন। বললে–পরোয়ানা আছে বোধহয়
কীসের পরোয়ানা?
নবাব-নিজামতের পরোয়ানা, আবার কার?
তা বলে এত রাত্তিরে?
শোভারাম বাধা দিয়ে বললে–ওসব নবাবি ব্যাপারের কথা এখন থাক হরিপদ, ওদিকে সময় বয়ে যাচ্ছে, তুই চল
বিয়েবাড়ির ভেতরে তখনও গোলমাল চলছে। যারা খেতে বসেছে, তারা তখনও কিছু টের পায়নি। সিদ্ধান্তবারিধি মশাই একবার ঘরের মধ্যে এসেছিলেন। কনে দেখে বলেছিলেন বেশ হয়েছে। শোভারাম, তোর মেয়ে সুখে থাক, সতীলক্ষ্মী হয়ে স্বামীর সংসার আলো করে থাকুক।
শোভারাম বলেছিল–সবই ছোটমশাইয়ের দয়াতে হল ঠাকুরমশাই।
শেষকালে একবার সিদ্ধান্তবারিধি মশাই মরালীর মাথায় হাত দিয়ে কী সব শ্লোক বলে আশীর্বাদ করে গিয়েছিলেন। আয়োজনের ত্রুটি কিছুই হয়নি। বড় বড় কলাপাতা এসেছিল ছোটমশাইয়ের বাগান থেকে। হরিপদ মাছ এনে দিয়েছিল ছোটমশাইয়ের পুকুর থেকে। নয়ানপিসি রাঁধতে বসেছে সকাল থেকে। একা মানুষ। পাড়ার সকলেরই পিসি। কাজেকর্মে শূদ্রদের বাড়ি রাঁধবার সময় তার ডাক পড়বেই। আর শুধু কি রান্না! কনে সাজানো, জামাইষষ্ঠীর তত্ত্ব সাজানো সবই তার কাজ।
নয়ানপিসি বলে গিয়েছিল চুপ করে বসে থাক মেয়ে, আমি অম্বলটা সাঁতলে আসি—
পাড়ার মেয়েরা তখন পাশেই বসে ছিল। মরালীর জানাশোনা সব মেয়েদেরই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। অনন্তদিদি বলেছিল–বর কী দ্রব্য তা আর জীবনে জানতে পারলুম না
মরালী জিজ্ঞেস করেছিল বরের সঙ্গে প্রথমে কী কথা বলব অনন্তদিদি?
অনন্তদিদি বলেছিল আমার আবার বর, আমার আবার বিয়ে, সেই বিয়ের পর আর তো দেখিনি বরকে–
অনন্তবালার বিয়ে, সে-এক ঘটনা বটে। বর এল গ্রামে। সবাই করুণাময়ীর ঘাটে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনন্তবালার বর দেখতে। বোশেখ মাসের সকাল। যে-যার ব্রত সেরে সকাল থেকে ঘাটে গিয়ে পৌঁছেছে। যখন বর এল, দেখা গেল কাঁধে পুঁটলি, হাতে খড়ম। নৌকো থেকে বর নামল।
অনন্তবালার বাবা জগদীশ বাঁড়ুজ্জেমশাই খাতির করে বরকে নামিয়ে নিতে গেলেন।
বর বললে–নৌকোর ভাড়াটা মিটিয়ে দিন
হন্তদন্ত হয়ে জগদীশ বাঁড়ুজ্জে বললেন–কত?
পাঁচ টাকা।
পাঁচা টাকা শুনেই চমকে গিয়েছেন বাঁড়ুজ্জেমশাই। কুলীন জামাইয়ের জন্যে গুনে চারশো টাকা আগাম দিতে হয়েছে, আবার পাঁচ টাকা তার ওপর। অথচ জামাইয়ের নিজেরই নৌকো।
বললেন–নৌকোভাড়াটা পরে দিলে হবে না বাবাজি?
বর বললে–পরে আর কখন দেবেন। আমি তো আজই চলে যাব পলাশপুরে, সেখানে আর একটি কন্যার পাণিগ্রহণ করে তারপর যাব ঘুষুটি। সেখানেও একটি কন্যা আছে। বোশেখ মাসে লগনসার বাজারে কি আমাদের কোথাও বেশি তিষ্ঠুবার সময় আছে?
সেই পাঁচ টাকাই শুধু নয়, আরও পঞ্চাশটি টাকা চাদরে বেঁধে দানের সামগ্রী ঘড়া থালা পিলসুজ সমস্ত কাঁধে তুলে নিয়ে উঠল নৌকোতে। নৌকো সারা দিনই ঘাটে দাঁড়িয়ে ছিল।
বাঁড়ুজ্জেমশাই বলেছিলেন–একটা রাত কন্যার সঙ্গে এক ঘরে বাস করলে হত না বাবাজি?
অনন্তবালার মা-ও ঘোমটার আড়াল থেকে বলেছিল–অনন্ত আমার বড় আদরের মেয়ে, আমার বড় সাধ ছিল জামাই-মেয়েকে একসঙ্গে দেখে চোখ জুড়োব, তা-ও হল না
বলে কাঁদতে লাগলেন তিনি।
বর বললে–থাকলে আরও হাজার টাকা দিতে হবে, এই আমার নিয়ম করে দিয়েছি
হাজার টাকা! হাজার টাকা দেবার মতো অবস্থা নয় বাঁড়ুজ্জেমশাইয়ের। সামান্য জমিজমা আর ক’ঘর বামুন কায়েত যজমান। তাদেরই ওপর ভরসা। হাজার টাকা তাকে খুঁড়ে ফেললেও আসবে না।
বললেন–এর পর যখন আসবে বাবাজি, তখন না-হয় ধারকর্জ করে যেমন করে তোক
বর বললে–তা তো বুঝতেই পারছি, কিন্তু নগদ-ছাড়া কাজ করব না ঠিক করেছি। বড় ঠকায় সবাই আজকাল। আর তা ছাড়া বোশেখ মাস পড়ে গেছে যে, বড় ক্ষেতি হয়ে যাবে, চারদিক থেকে ডাক আসছে, বয়েসও বাড়ছে, সব কন্যার পাণিগ্রহণ করে উঠতে পারিনে আজকাল
বলে নৌকোয় উঠে পড়েছিল বর। আর বাক্যব্যয় করেনি
বাঁড়ুজ্জেমশাই শেষপর্যন্ত জিজ্ঞেস করেছিলেন–তা হলে আবার কবে আসছ বাবাজি!
বর বলেছিল–পত্র দেবেন রাহা-খরচ দেবেন, সময় করে যদি আসতে পারি দেখব
অনন্তবালার পর নন্দরানি। দুই মেয়ে জগদীশ বাঁড়ুজ্জের, নন্দরানির কপালে বরই জোটেনি। নন্দরানিও এসেছিল মরালীর বিয়েতে। শেষপর্যন্ত নন্দরানির বিয়ে হয়েছিল কলাগাছের সঙ্গে। এয়োতির মতো মাথার সিঁথিতে সিঁদুর দিত। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়েস হয়েছে। তবু ছেলেমানুষের মতো বাসর জাগতে পারে। ফুলশয্যের রাত্রিতে বর কনের শোবার ঘরে আড়ি পাতে। পুকুরঘাটে গিয়ে পরের বর। নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে। বর ঠকাতে নন্দরানির ডাক পড়ে সব বাড়িতে।
নন্দরানির নিজের বিয়েতে শুভদৃষ্টিও হয়নি, ফুলশয্যেও হয়নি, বাসরঘরও হয়নি। কিন্তু পাড়ার সব বিয়ের বাসর জেগেছে।
নন্দরানির মা বলতেন–মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছ, সব মুখ বুজে সহ্যি করতে হবে মা তোমাকে
নন্দরানি কিন্তু মার কথা শুনে হাসত। বলত–মা যেন কী! দিদির চেয়ে তো আমার কপাল ভাল। আমার বর তবু আমার বাড়িতেই থাকে, কিন্তু দিদির বর যে আসেই না একেবারে
তা অনন্তদিদির বর কিন্তু আর একবার এসেছিল। যথারীতি নিজের নৌকো করে পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে রাত দেড়-প্রহরের সময় এসে হাজির। জগদীশ বাঁড়ুজ্জে বাড়ির ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন–কে?
অনন্তবালার বর বলেছিল–আমি আপনাদের জামাই বাবাজীবন
কথাটা শুনেই জগদীশ বাঁড়ুজ্জে লাফিয়ে উঠেছিলেন। গিন্নিও উঠেছিলেন। সেই রাত্রে আবার উনুনে আগুন দেওয়া হল। ভাল চাল আনা হল বাবুদের মরাই থেকে। সেই অত রাত্রে আবার পাশের ডোবা থেকে বড় বড় কই মাছ ধরা হল। গাছের কলার কাদি থেকে কলা পেড়ে, সরের ঘি, নারকেল নাড়ু, দুধ-ক্ষীর খেতে দেওয়া হল জামাইকে। জামাইয়ের জন্যে কাঁঠাল কাঠের সিন্দুক খুলে বগি থালা, জামবাটি, রেকাবি বার করা হল।
জামাই বাবাজীবন খেতে বসবার আসনে খেতে বসল কিন্তু ভাতে হাত দিলে না।
বললে–আমি তো খেতে আসিনি, কিছু টাকার দরকারে এসেছিলাম আপনার কাছে
বাঁড়ুজ্জেমশাই অবাক হয়ে বললেন–টাকা!
অনন্তবালা ততক্ষণে তোরঙ্গ থেকে একখানা পোশাকি পাটশাড়ি বার করে পরে নিয়েছে। খোল দিয়ে মুখখানা মেজে চকচকে করে নিয়েছে। মা বিছানা করে দিয়ে গেছে। কনে-জামাই এই প্রথম এক ঘরে শোবে। তাম্বুল দিয়ে পান সেজে ডিবে ভরতি করে দিলেন। তারপর মেয়ের কাছে গিয়ে চুপি চুপি ফিসফিস করে বললেন–এইটে খোঁপায় বেঁধে রাখ।
ছোট একটা ন্যাকড়ায় বাঁধা পুঁটলির মতন।
কী এটা?
মা বলেছিল–দুগাকে বলেছিলাম কিনা, দিয়েছে সে, অচ্ছেদ্দা করিসনে—
কী আছে এতে?
মা বলেছিল–কী জানি মা কী আছে, দুৰ্গ দিয়েছে, দুগাই জানে–বলছিল সাপের গায়ের এঁটুলি আর দানকাকের রক্ত,
অনন্তবালা বললে–কী হবে এ দিয়ে?
মা রেগে গিয়েছিল–তুই আর জ্বালাসনে বাপু, মেয়ের এত বড় বয়েস হল, এখনও জামাইকে বশ করতে পারলিনে, তোর জন্যে আমার মাথা খুঁড়ে মরতে ইচ্ছে করে মা
তারপর অনন্তবালা সেজেগুজে বিছানায় বসেই রইল। জামাই খেয়ে ঘরে শুতে আসবে। কিন্তু গোল বাধল খাবার আগেই। জামাই বললে–আমি খেতে তো আসিনি, টাকা নিতে এসেছি।
মা আড়াল থেকে বললে–এত দিন পরে এলে বাবাজি, না খেলে কি চলে? খেয়েদেয়ে ঘরে একটু বিশ্রাম করো, টাকা তোমায় দেবই যেমন করে থোক–
কী জানি কী হল! জামাই খেলে সবকিছু চেটেপুটে। কিন্তু খাওয়ার পর আর ওঠে না আসন ছেড়ে।
বললে–এবার টাকা ছাড়ুন, খাইয়েদাইয়ে নিয়ে শেষে টাকা দেবেন না, আমার এসব অনেক দেখা আছে
তা বাবাজীবন বিশ্রাম তো করবে একটু, অনন্তবালার সঙ্গে একটু দেখাও তো করবে–
জামাই নাছোড়বান্দা। বললে–ওসব কথা সবাই বলে, শেষে কলা দেখিয়ে দেয়, আমি ওসব অনেক দেখেছি, কথায় আর ভুলছে না এ শর্মা
জগদীশ বাঁড়ুজ্জের কিছু টাকা ছিল লুকোনো। কাঁঠাল গাছের তলায় বহুদিন আগে লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি। অবরেসবরে বিপদেআপদে কাজে লাগতে পারে। সেই অত রাত্রে আবার শাবল নিয়ে গিয়ে খুঁড়ে বার করে আনলেন। পাঁচটি মাত্র টাকা। কাদামাটি মাখানো। জামাইয়ের হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন যৎসামান্য এই যা ছিল সব তোমায় দিলাম বাবাজীবন, এইটি নিয়ে একটু বিশ্রাম করে যাও শুধু
জামাই টাকা ক’টি ট্র্যাকে খুঁজে নিলে। কিন্তু বিশ্রাম করতে শোবার ঘরে আর গেল না।
বললে–তবে আর থাকা হল না আমার, ঘুষুটির চাটুজ্জে মশাইয়ের বাড়িতেই যাওয়া ভাল ছিল দেখছি
বলে উঠল জামাই। তারপর সেই নিজের এঁটো বগি থালা, জামবাটি, রেকাবি সবকিছু পোঁটলায় বেঁধে নিয়ে আবার গিয়ে উঠল নৌকোতে। অনন্তবালা তখনও সেজেগুজে বসে ছিল বিছানায়। মা ঘরের ভেতর ঢুকে চিৎকার করে উঠল–তোর মরণ হয় না মুখপুড়ি, তুই মরিসনে কেন, আমি দেখে চোখ জুড়োই, এত ধিঙ্গি বয়েস হল, জামাই বাড়ি বয়ে এল আর তুই ঠুটো জগন্নাথ হয়ে বসে রইলি? জামাইয়ের পা দুটো জড়িয়ে ধরতে পারলিনে?
সেদিন অত বকুনি খাওয়ার পরও অনন্তবালা পাথরের মতো চুপ করে বসে ছিল।
কিন্তু নন্দরানির বেলায় আর সে-সব কোনও আয়োজন অনুষ্ঠান করেননি জগদীশ বাঁড়ুজ্জে। আর তখন টাকাকড়িও ছিল না তার।
নয়ানপিসি পরামর্শ দিয়েছিল তার চেয়ে নন্দরানির গাছবরে বিয়ে দাও দাদা, মেয়ে এমনিতেও ঘরে থাকবে, অমনিতেও ঘরে থাকবে, জাত-কুলও বজায় থাকবে
তা তাই-ই হল শেষপর্যন্ত। শুভদিনে পাঁজি দেখে বরণডালা কুলো পিদিম সুপুরি হলুদ আর দুধের সর নিয়ে কলাগাছের তলায় গিয়ে সাত পাক দিলে নন্দরানি। পুরুতমশাই মন্ত্র পড়তে লাগল।
নয়ানপিসি বললে–এবারে কলাগাছটাকে দুহাতে জড়িয়ে ধর
নন্দরানি তাইই করল।
নয়ানপিসি বললে–এবার এই কড়ি আর সুপুরি নিয়ে শেকড়ের কাছে রাখ, রেখে মনে মনে তিনবার বল
কলাগাছ বর,
হলাম স্বয়ংবর,
কড়ি দিলাম, সুপুরি দিলাম,
দিলাম দুধের সর।
তুমি আমার বর।
এমনি করে একদিন জগদীশ বাঁড়ুজ্জের ছোট মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেল। আর শুধু কি নন্দরানি। এ-গাঁয়ের আরও অনেক মেয়েরই এমনি করে বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এমনি করেই নন্দরানির মতো বাপের বাড়িতে হাঁড়ি ঠেলে তারা। এমনি করেই বাড়ি বাড়ি বর দেখে বেড়ায়, কারও বাড়ি জামাই এলে ঘটা করে দেখতে যায়, বরের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করে। বরকে হাসায়, নিজেরাও হেসে গড়িয়ে পড়ে। তারপর একদিন খবর আসে গুপ্তিপাড়া কিংবা বর্ধমান কিংবা পূর্বস্থলী কিংবা বড়চাপড়ার শ্রীযুক্ত দেবনারায়ণ দেবদর্শন: সময়োচিত নিবেদনমিদং ৩ বৈশাখ শুক্রবার বেলা আড়াই প্রহরের সময় আমার পিতা লোকান্তর হইয়াছে জ্ঞাত কারণ লিখিলাম, ইতি। আর সঙ্গে সঙ্গে একশো মেয়ের শাঁখা ভাঙে, সিঁদুর মোছে, শাড়ি ছেড়ে থান কাপড় পরে। তাদের সবাই আজ জড়ো হয়েছে মরালীর বিয়েতে। সবাই বাসর জাগবে বলে এসেছে। নয়ান পিসিরও কবে বিয়ে হয়েছিল কে জানে। নিজেও নয়ানপিসি কখনও শ্বশুরবাড়ি যায়নি। পাড়া-প্রতিবেশীর বিয়ে উৎসব অনুষ্ঠানে খেটে খেটে পরিশ্রম করে উপদেশ দিয়েই নয়ানপিসি নিজের জীবনটা কাটিয়ে দিলে।
শোভারাম দৌড়াতে দৌড়োতে ঘরে এসে ঢুকেছে।
বললে–নয়ান
ঘরে একলা মরালী বসে ছিল। আর কেউ নেই। মেয়ের দিকে চেয়ে যেন সান্ত্বনা দিয়ে বললে–কিছু ভাবিসনে মা, আর ভাবনা নেই, এবার সব ঠিক হয়ে গেছে।
বলেই আবার বাইরে চলে গেল।
*
বশির মিঞার সঙ্গে আবার সেদিন দেখা। সারাদিন সোরার গদিতে বসে কাজ করে করে যখন আর মাথা। তোলবার সময় থাকত না, ঠিক তখনই এক-একদিন বশির মিঞা এসে হাজির হত। বেভারিজ সাহেব থাকলে আর বশির মিঞা ঢুকত না। কিন্তু একলা দেখলেই ঢুকে পড়ত। চেনা নেই শোনা নেই মানুষটার সঙ্গে। কিন্তু বশির মিঞা একদিনেই বেশ ভাব করে নিয়েছিল। আর কান্তও ছিল সেইরকম। একটু মিষ্টি কথা শুনলে গলে যেত একেবারে।
কী খবর ভাইয়া?
কান্ত বলত–এসো ভাই, এসো, বোসো
তক্তপোশের ওপর কাটি-মাদুর পাতা থাকত। সেই জায়গাটা পরিষ্কার করে দিয়ে বসতে বলতকান্ত। পান দিত, জর্দা আনিয়ে দিত। বন্ধু মানুষ, খাতিরের কোনও কমতি রাখতনা কান্ত। ভারী মজাদার মানুষ ছিল বশির মিঞা। তেজি জোয়ান ছেলে। মুসলমান জাতে। তা হোক। কিন্তু খবর রাখত অনেক, নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াত, আবার নানান লোকের সঙ্গে মেলামেশা ছিল।
কী কাজ তোমার এত? সারা বাংলা মুলুক ঘুরে বেড়াতে হয়?
বশির মিঞা বলত–নবাব সরকারের কাজের তো এই মজা ইয়ার। মাঝে মাঝে দিল্লি যাই, মাঝে মাঝে ঢাকা যাই, আবার তারপর হয়তো আগ্রা, ফতেপুর সিক্রি চলে যাই–আমার ফুপা মনসুর আলি সাহেবের নাম শুনেছিস তো?
কান্ত বলেছিল-না; কে সে?
আরে আমার ফুপা। মির্জা মহম্মদ সাহেবের ইয়ার।
মির্জা মহম্মদ কে?
মির্জা মহম্মদের নামই শোনেনি কান্ত। অথচ এই দুনিয়ায় বেঁচে আছে। তাজ্জব বাত আর কাকে বলে। আরে মির্জা মহম্মদের নামই তো সিরাজ-উ-দ্দৌলা। কিছুই জানিস না তুই। এত বড় নবাব আর হয়নি যে হিন্দুস্তানে। তুই কাজ করছিস ফিরিঙ্গি কোম্পানির কাছে। তোর সাহেব নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলার পা চাটে, তা জানিস। এই যে দেখছিস সুতোনুটি, এই যে দেখছিস তোর সোরার গদি, নবাব ইচ্ছে করলে একটা কামান দেগে সব উড়িয়ে দিতে পারে। তোর সায়েবের মুন্ডু উড়ে যাবে এককথায় তা জানিস। তখন তুই তো তুই, তোর বাপজানের বাপজান ড্রেক সায়েব পর্যন্ত কোথায় উড়ে যাবে তার ঠিক নেই। তুই রহিম খাঁর নাম শুনেছিস? জবরদস্ত খাঁর নাম শুনেছিস?
না।
নবাব জাফর মুর্শিদকুলি খাঁর নাম শুনেছিস?
না।
আরে তোর মতন বেওকুফ তো আমি দেখিনি।
দিনের পর দিন বশির মিঞার কাছে মোগল বাদশা আর নবাব দেওয়ানদের গল্প শুনে শুনে নিজেকে কেমন ছোট মনে করেছে কান্ত। বশির মিঞা রাজার জাতের লোক। আর সে ফিরিঙ্গি কোম্পানির তিন টাকা তলবের ক্রীতদাস। কত বড় বড় লোক সব জন্মেছে মুসলমানদের মধ্যে। এই যে মুর্শিদকুলি খাঁ। ও-ও তো কাফের ছিল আগে। বামুনের ছেলে। খেতে পেত না। ইস্পাহানের হাজিসুফি মেহেরবানি করে খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করেছিল বলেই তো সুবে বেরারের দেওয়ান হাজি আবদুল্লা খোরাসানির দফতরে নোকরি পেল। আমাদের বাদশা তো গুণের কদর করত–বাদশা আওরঙ্গজেব।
বলে বশির মিঞা নিজের নাক আর দুটো কান মলে দিল।
বললে–অমন বাদশা আর হিন্দুস্তানে হবে না রে। দীন-দুনিয়ার বাদশা আওরঙ্গজেব বাদশা। জাফর খাঁ সায়েবকে গুণ দেখে নিজের খাস-দরবারে এত্তালা দিলে। দিয়ে তার খেলাত দিলে কারতলব খা। মনসবি দিলে। তোকে তোর কাজ দেখে খেলাত দেবে বেভারিজ সায়েব? গুণের কদর করবে ফিরিঙ্গি বাচ্চা?
এমনি গল্প করত বশির মিঞা। তারপর আবার কোথায় চলে যেত। কী কাজ যে করত বশির তা কোনওদিন বলেনি। মাঝে মাঝে কান্তকে জিজ্ঞেস করত–বেভারিজ সায়েবের কাছে কোন কোন সায়েব আসে, তাদের নাম কী। সোরা বেচে সাহেবের কত মুনাফা থাকে। গঙ্গার কিনারায় কেল্লা বানাচ্ছে কেন ফিরিঙ্গিরা। তাদের মতলব কী!
যা জানত কান্ত তাই বলত। কান্ত বলত–আমি তো ইংরিজি জানি না তাই সব কথা ওদের বুঝতে পারি না
তা এতদিন নোকরি করছিস আর ইংরিজি শিখিসনি? শিখে নে। কী কথা হয় ওদের আমাকে বলবি, তোকে ইনাম পাইয়ে দেব, বকশিশ পাইয়ে দেব–ফিরিঙ্গিদের যত খবর দিতে পারবি তার জন্যে তুই টাকা পাবি। কেল্লাতে ফিরিঙ্গিদের কত পল্টন আছে, কত কামান আছে, আমাকে খবরটা দিতে পারিস?
এসব কথা শুনতে শুনতে কান্তর কেমন সন্দেহ হত। বেভারিজ সাহেব তাকে কতবার সাবধান করে দিয়েছিল। কোম্পানির এলাকায় স্পাই ঘুরে বেড়াচ্ছে। খুব হুঁশিয়ার থাকবে মুনশি। স্পাই মানে চর। গেরুয়া পরা সন্ন্যাসী দেখলে বুঝবে ওরা মারাঠিদের চর। ওরা মুসলমানদের হঠিয়ে হিন্দু রাজাকে দিল্লির মসনদে বসাতে চায়। তাদের সঙ্গে বেশি কথা বলবে না। অনেকে বাউল ফকিরের মতো গান শোনাবে গদিতে এসে। ভিক্ষে চাইবে। তাদের আমল দেবে না। আর তারপর আছে মুর্শিদাবাদের স্পাই। তারাও কলকাতায় ঢুকে পড়েছে। খুব হুঁশিয়ার থাকবে।
কিন্তু বশিরকে কিছুতে এড়ানো যেত না। বশির বলত–তোর ডর কীসের? আমি তো আছি, আমার ফুপা তো আছে–
একদিন রাত্তিরবেলার কথা মনে আছে। অনেকদিন আগেকার কথা। সাহেব সকালবেলা একবার গদিতে আসত। তারপর মাল-চালান দিয়ে বাড়িতে খেতে চলে যেত। দুপুরবেলা বাড়িতে গিয়ে ঘুমোত। দিবানিদ্রা দেওয়াটা বেভারিজ সাহেবের ছিল স্বভাব। সেসময়ে সাহেবকে বিরক্ত করা চলবে না। তারপর বিকেলবেলা যখন ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে বেরোত তখন এক-একদিন আসত। কিন্তু সেদিন রাত্তিরবেলাই পালকি চড়ে এসে হাজির। অত রাত্তিরে সাহেব কখনও আসে না। সাহেবের মুখ গম্ভীর। এসেই কান্তর হাত দিয়ে একটা চিঠি পাঠালে কেল্লাতে। সাহেবের সঙ্গে আরও দু’জন লোক। তারা চুপি চুপি কী সব কথা বলতে লাগল। কান্ত অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারলে না।
বাইরে আসতেই পালকি-বেহারারা রয়েছে। কান্ত আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলে–হ্যাঁগো, কে এসেছে এখানে? বেভারিজ সাহেবের সঙ্গে কারা এনারা?
উমিচাঁদ সাহেব! আমরা উমিচাঁদ সাহেবের লোক।
আর সঙ্গে কে?
লোকগুলো সাদাসিধে মানুষ। বেশি ঘোরপ্যাঁচ বোঝে না। বললে–নারায়ণ সিং
নারায়ণ সিং কে?
আজ্ঞে তা জানিনে, রাজধানী থেকে এয়েচে
কে নারায়ণ সিং, কে উমিচাঁদ সাহেব, কিছুই জানত না কান্ত। দিনমানে না এসে এত রাত্তিরেই বা গদিতে এল কেন সাহেব, তাও বুঝতে পারল না। হঠাৎ যেন সব ওলোটপালোট হয়ে গেল। কদিন আগেই কান্তর কানে এসেছিল নবাব মারা গেছে। সে ছিল ভোর পাঁচটার সময়। তখন বলতে গেলে ভাল করে ঘুমও ভাঙেনি। সেই খবর শোনার পর থেকেই যেন সাহেবদের রকমসকম সব বদলে গেল। মনে আছে, বেভারিজ সাহেব কতদিন গদিতেই আসেনি। একলা কান্তকেই কাজ চালাতে হয়েছে। তারপর ক’দিন যেতে-না-যেতেই এই কাণ্ড। সাহেবের হুকুম। কান্ত সেই অত রাত্তিরে কেল্লার ফটকে গিয়ে পল্টনের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াল।
হু কামস দেয়ার?
আমি কান্ত সরকার, বেভারিজ সায়েবের মুনশি। চিঠি এনেছি ড্রেক সাহেবের জন্যে।
তবু পল্টন বেটা কথায় কান দেয় না। বললে–লাটসাব বারাসাত গিয়া
বোঝা গেল ড্রেক সাহেব কেল্লায় নেই! বারাসতে গিয়েছে কাজে।
ফিরে এসে খবরটা বেভারিজ সাহেবকে দিতেই সাহেব একেবারে রেগে খুন। ড্রেক সাহেব কেল্লায় নেই তা যেন কান্তরই অপরাধ। আরও কী সব কথাবার্তা হতে লাগল তিনজনে অনেকক্ষণ। কান্ত সেই দরজা বন্ধ গদি-বাড়ির সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তখন বেশ গরম পড়েছে। এপ্রিল মাস। তারিখটাও মনে আছে কান্তর। ১৩ রজব। তারপর অনেকক্ষণ কথা বলে আবার তিনজনে পালকি করে। যেদিক থেকে এসেছিল, সেই দিকেই চলে গেল।
আর ঠিক তার খানিক পরেই বশির এসে হাজির। বশির মিঞাকে সেই সময়ে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল কান্ত। তুই, এত রাত্তিরে?
তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকেই বশির মিঞা দরজায় হুড়কো দিয়ে দিয়েছিল। বললে–কে এসেছিল রে তোর এখানে?
আমার সায়েব।
আর দু’জন কে?
ওদের আমি চিনি না।
নামও শুনিসনি? পালকি-বেহারাদের তুই যে জিজ্ঞেস করলি দেখলুম!
তুই সব দেখেছিস নাকি?
সব দেখেছি আমার কাছে চাপতে কোসিস করিসনি। সচ-বাত বলবি, ঝুটা বললে–তোর নুকসান হবে বলে রাখছি। যা-যা শুনেছিস সব বিলকুল খোলসা করে বল।
কান্ত বললে–সত্যি বলছি, আমি ওদের চিনি না, শুনলাম একজনের নাম উমিচাঁদ আর একজন নারায়ণ সিং
নারায়ণ সিং! নামটা শুনেই বশির মিঞা তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল। শালা হারামিকা বাচ্চা। বেওকুব, বেতমিজ, বেশরম। শালাকে আমি দেখে লেব। ওর বাপের নাম ভুলিয়ে দেব তবে আমি মুসলমানের বাচ্চা। ওর ভাই রামরাম সিংয়ের শির কাটিয়ে দেব। শালা আমাকে চেনে না হিন্দুর বাচ্চা। তুই কিছু মনে করিসনি হিন্দুর বাচ্চা বলছি বলে। তুই আমার দোস্ত। তোর সঙ্গে আমার দোস্তালি হয়ে গেছে ইয়ার। কিন্তু ওরা নিমকহারাম। ওই রামরাম সিং, ওই নারায়ণ সিং, ওই ঘসেটি বেগমও নিমকহারাম–শালা মুসলমানের মধ্যেও হারামির বাচ্চা আছে অনেক
বলতে বলতে বশির মিঞা চিৎকার করে উঠতে যায় আর কী।
কান্ত বললে–ওরে থাম ভাই বশির, একটু চুপি চুপি কথা বল, কেউ শুনতে পাবে, আমার চাকরি চলে যাবে
কিন্তু বশির মিঞা রেগে তখন টং হয়ে গেছে। তার মুখে তখন খই ফুটতে আরম্ভ করেছে। যাকে পাচ্ছে তাকে গালাগালি দিচ্ছে। কোথাকার রাজা জানকীরাম, রাজা দুর্লভরাম, রাজবল্লভ, তার ছেলে কৃষ্ণবল্লভ, কারওই নাম শোনেনি কান্ত। গড়গড় করে সকলের কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি বলে গেল বশির মিঞা। বশির মিঞা বললে–নারায়ণ সিংকে আর বেশিদিন বাঁচতে হবে না, দেখে নিস–
কেন?
আমার হাতে খুন হয়ে যাবে শালা। আমি আমার ফুপাকে গিয়ে কাল খবরটা দিচ্ছি—
কিন্তু, নারায়ণ সিং কে? কী করতে এসেছে সাহেবের কাছে?
ওই শালা উমিচাঁদ এনেছে সঙ্গে করে। ও শালা হল চর। শালা রাজবল্লভের চর। রাজবল্লভের ছেলে কেষ্টবল্লভ এখেনে ফিরিঙ্গিদের কাছে রয়েছে, তা জানিস তো। এ ওই রাজবল্লভের কাণ্ড। নবাব মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হারামিরা নেমকহারামি শুরু করেছে।
কান্ত এবার আর থাকতে পারলে না। বললে–তুই এখন যা বশির, সাহেব আবার কোন সময়ে এসে পড়বে, তখন আমার চাকরি চলে যাবে
যাক না তোর নোকরি, আমি তো আছি, বশির মিঞা থাকতে, বশির মিঞার ফুপা থাকতে তোর ডর কীসের?
না ভাই, এবার আমি বিয়ে করছি, এখন আর ছেলেমানুষি করলে চলবে না।
বিয়ে! শাদি? শাদি করছিস? কোথায়?
হাতিয়াগড়ে। সব ঠিক হয়ে গেছে, দিনটিন সমস্ত ঠিক হয়ে গেছে!
ঠিক করছিস! মরদের কাম করছিস। শাদি করবি, লেড়কা পয়দা করবি, তবে না মরদ! আরে মরদের পয়দাই হয়েছে শাদি করবার জন্যে, আর মর্দানার পয়দা হয়েছে লেড়কা পয়দা করবার জন্যে। খোদাতালার দেমাগ আছে ইয়ার, খোদাতালা অনেক ভেবে ভেবে তবে এই কানুন করেছে। দুনিয়ার
বলতে বলতে বশির মিঞা সেদিন সেই রাত্রের অন্ধকারের মধ্যেই বেরিয়ে গিয়েছিল। বশির মিঞা। সেদিন চলে যাবার পর থেকেই আরও অনেক কাণ্ড শুনেছিল কান্ত। ভেতরে ভেতরে যে এত ব্যাপার চলছে তা এতদিন টের পায়নি সে। কোথায় সে বিয়ে করবে, বিয়ে করে বউ নিয়ে বড়চাতরায় তাদের বাড়িতে গিয়ে উঠবে, পাড়ার বউ-ঝিরা তার বউ দেখতে আসবে, এইসব স্বপ্নই দেখত সারাদিন। গদিবাড়ির কাজের ফাঁকেও বউয়ের মুখটা কল্পনা করে নিয়ে চোখ বুজিয়ে ভাবতে ভাল লাগত। কিন্তু হঠাৎ যেন কোম্পানির সব সাহেবরা চারদিকে ছুটোছুটি আরম্ভ করে দিলে। ড্রেক সাহেবের শরীর ভাল ছিল না, বালেশ্বরের বন্দরে বেড়াতে গিয়েছিল। তারপরেই কলকাতায় এসে হাজির হয়েছিল কৃষ্ণবল্লভ। ঢাকার রাজবল্লভ সেনের ছেলে। টাকাকড়ি-গয়নাগাঁটি, বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে এসে হাজির। সঙ্গে ছিল কাশিমবাজার কুঠির ওয়াটস সাহেবের চিঠি। সেই তাকে যদি এখানে সাহেবরা না থাকতে দিত তো কোনও গণ্ডগোল হত না আর।
কেন?
আজ্ঞে, কেষ্টবল্লভ যে রাজবল্লভ সেনের ছেলে। রাজবল্লভ সেনকে চেনেন তো? ঢাকার দেওয়ান, আলিবর্দি খাঁ’র পেয়ারের লোক ছিল। ঘসেটি বেগমের সঙ্গে যে তার খুব ইয়ে–
ইয়ে মানে?
ষষ্ঠীপদ একটু বেঁকা হাসি হেসে বললে–ইয়ে মানে ইয়ে। আপনি তো কিছুই খবর রাখবেন না, কেবল চাকরি আর ঘুম। দুনিয়ায় কত কী ঘটে যাচ্ছে খবর রাখবেন তো!
ষষ্ঠীপদ কান্তর নীচে চাকরি করত। কান্ত মালের হিসেব রাখে, আর ষষ্ঠীপদ মালের বস্তা গোনে। কিন্তু খবর রাখে সব। কী করলে চাকরিতে উন্নতি করা যায় তার চেষ্টা ষষ্ঠীপদ করে। ষষ্ঠীপদ বলে–কোম্পানির চাকরি, এই আছে এই নেই, চিরকাল তো কোম্পানির চাকরি করলে চলবে না, কোম্পানিও চিরকাল থাকছে না। যদি নবাব কাছারিতে চাকরি পেতাম একটা তো আমার কী আর ভাবনা
তা বিয়ের দিন সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ এল। ভোরবেলাই এসে হাজির। সেদিন আবার কাজও খুব। চোখে-মুখে দেখবার সময় নেই কান্তর।
ঘটক মশাই বললে–চলো বাবাজি, আমার সঙ্গে চলো
কান্ত বললে–এখন যাব কী করে, এখনও ছুটি পাইনি যে ক’দিন ধরে আমার সাহেব আসছে না।
সে কী কথা? সাহেব যদি না আসে ততো তোমার বিয়ে বন্ধ হয়ে যাবে? একটি মেয়ের জীবন-মরণ সমস্যা, আর তোমার চাকরিটাই সেখানে বড় হল?
কান্ত বললে–না, তা বলছি না, আপনি এখোন, আমি নাপিতকে নিয়ে যাচ্ছি। আজ সাহেব আসবার কথা আছে
তুমি যাবে তো ঠিক বাবাজি?
কিছুতেই আর ঘটক মশাইয়ের সন্দেহ যায় না। কান্ত সমস্ত দেখালে। বিয়ের তোড়জোড় সমস্ত ঠিক করে রেখে দিয়েছে। গায়ে-হলুদের জন্যে তেল-হলুদ পাঠিয়ে দিয়েছে। সারাদিন উপোস করে আছে আর বিয়ে হবে না মানে। বড়চাতরায় চিঠি পর্যন্ত লিখে দেওয়া হয়েছে। সেখানকার বাড়ি-ঘরদোর পরিষ্কার করা হয়েছে। জঙ্গল কেটে রাস্তা করা হয়েছে। নতুন বউকে নিয়ে যাবে, দেশে দশজনকে বউ দেখাবে। পিতৃপুরুষের ভিটে! নতুন বউ নিয়ে হাতিয়াগড় থেকে সোজা নৌকো করে তো সেখানে গিয়েই উঠতে হবে।
তারপরেই একটা কাণ্ড ঘটল। ঘটকমশাইকে বুঝিয়েসুঝিয়ে বিদায় করে দিয়ে ষষ্ঠীপদকে সব মালের হিসেব বুঝিয়ে দিলে। নাপিত তৈরিই ছিল। কান্ত সেজেগুজে নৌকোয় উঠতে যাবে, হঠাৎ বশির এসে পড়লে।
কোথায় যাচ্ছিস?
বিয়ে করতে। আর সময় নেই
তা আজকেই বিয়ে করতে চললি? এদিকে যে সব পয়মাল হয়ে গেল রে। তোর নোকরি হয়তো থাকবে না।
কেন?
তখন সত্যিই আর কথা বলবারই সময় ছিল না। মাঝি-মাল্লারা পাল খাঁটিয়ে দিয়েছে নৌকোয়। নাপিতও গিয়ে উঠে বসেছে পোঁটলাটা নিয়ে।
বশির মিঞা বললে–তোর সাহেবদের ওপর নবাব খুব গোঁসা করেছে। আমাদের কাশিমবাজারে ফিরিঙ্গিদের কুঠির ওয়াটস্ সাহেবকে নবাব ডেকেছিল, ডেকে খুব হল্লা করেছে, বলেছে রাজা রাজবল্লভের ছেলেকে যদি ফিরিঙ্গিরা না ফিরিয়ে দেয় তো কোম্পানির গুষ্টি তুষ্টি করে ছাড়বে।
কান্ত জিজ্ঞেস করলে–কেন, সাহেবদের কী দোষ?
দোষ নয়? ফিরিঙ্গির বাচ্চারা পঞ্চাশ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছে তার কাছ থেকে, তা জানিস? তোর সাহেবের দোস্ত ওই হলওয়েল আর ম্যানিংহাম, ওই দুটো ফিরিঙ্গি।
কান্তর মনে আছে সেসব কথা। বশির মিঞাই বলেছিল সব। উমিচাঁদই হচ্ছে নাকি আসল। তার সঙ্গেই সাহেবদের দোস্তালি। নারায়ণ সিং-কে সে-ই নিজের বাড়িতে থাকতে দিয়েছিল। কেষ্টবল্লভ যে কলকাতায় এসে ফিরিঙ্গিদের কাছে থাকতে পেয়েছিল তাও রাজা উমিচাঁদের জন্যেই। রাজা উমিচাঁদকে প্রায়ই বেভারিজ সাহেবের কাছে আসতে দেখেছে কান্ত। সব সাহেবই আসত বেভারিজ সাহেবের বাড়িতে। ওই হলওয়েল সাহেব, ম্যানিংহাম সাহেব। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে এক কাণ্ড চলেছে তা জানত না। নবাবের মাসি যে নবাবের শত্রু, তাও জানত না।
তা হলে কী হবে?
বশির মিঞা বললে–লড়াই হবে। নবাব যখন একবার রেগে গেছে, তখন আর তো সহজে ঠান্ডা হচ্ছে না, ফিরিঙ্গিদের দরিয়ার ওপারে না-পাঠিয়ে আর ছাড়ছে না। ফিরিঙ্গিরাও বাঁচবে না, ও রাজা রাজবল্লভও বাঁচবে না, ওই ঘসেটি বেগমও বাঁচবে না। মির্জা সাহেবের একবার গোসা হলে তখন আর কারও পরোয়া করবে না
তা হলে আমার চাকরির কী হবে?
বশির মিঞা বললেআরে নোকরির কথা তুই পরে ভাবিস, আগে তুই বাঁচিস কি না তাই দ্যাখ। লড়াই হলে তোর কলকাতা থাকবে নাকি? তোর লাটসাহেব ওই ড্রেক সাহেবই বাঁচে কি না তাই আগে ভাব। একলকাতাও থাকবে না, এই ফিরিঙ্গিদের কেল্লাও থাকবে না, এই ফিরিঙ্গি বাচ্চারাই সব মরে মামদো ভূত হয়ে যাবে। তখন আমার কথা মনে রাখিস, তোকে আমি হুশিয়ার করে দিচ্ছি, বশির মিঞা কখনও ঝুট বলে না–
বশির মিঞা চলে যাবার পর কান্ত তাড়াতাড়ি গিয়ে নৌকোয় উঠল। বদর বদর।
*
যেমন দেশের ঊর্ধ্বে আর একটা দেশ আছে, তার নাম মহাদেশ, যেমন কালের ঊর্ধ্বে আর একটা কাল আছে তার নাম মহাকাল, তেমনই ইতিহাসের ঊর্ধ্বেও আর একটা ইতিহাস আছে তার নাম মানুষ। মানুষই ইতিহাস। এই মানুষই মহাদেশ সৃষ্টি করেছে, এই মানুষই মহাকাল সৃষ্টি করেছে, এই মানুষই ইতিহাসের সৃষ্টিকর্তা। পৃথিবীর ইতিহাস মানুষেরই ইতিহাস। এই মানুষই একদিন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হয়ে সাত সাগর তেরো নদী পেরিয়ে নোনা জলে হাবুডুবু খেতে খেতে ইন্ডিয়াতে এসে পৌঁছেছিল, আবার এই মানুষই একদিন আলিবর্দি খাঁ হয়ে তাকে আশ্রয় দিয়েছিল। বলেছিল তোমরা থাকো এখানে, থেকে কারবার করো। আমাদের শুধু সামান্য কিছু কারবারের মুনাফার অংশ দিয়ো। আর হিন্দুরা মারাঠা দেশ থেকে এসে আমাদের বড় জ্বালাতন করছে, তাদের শায়েস্তা করতে তোমাদের মদত চাই। হিন্দুদের সঙ্গে লড়াই করতে করতে আমার সারা জীবনটা কেটে গেছে। আমার টাকা ফুরিয়ে গিয়েছে। তোমরা টাকা দিয়ে বন্দুক দিয়ে কামান দিয়ে আমাকে সাহায্য করা, যাতে আমি আয়েশ করে মসনদে বসে রাজ্য শাসন করতে পারি। আমরা মোগল, আমরা সেই বারোশো বছর আগে আরব দেশ থেকে বেরিয়েছিলাম জেহাদ করতে, হজরত মহম্মদের বাণী প্রচার করতে। সারা পৃথিবী আমরা কবুল করেছি। শেষকালে এখানে এসে এই মারাঠি ডাকাতদের হাতে বুড়িগঙ্গায় ডুবে মরব নাকি! তোমাদের কাছে আমি মদত চেয়েছিলাম, তার বদলে তোমরা আমার লোকসান করেছ। আমার গদি কেড়ে নেবার মতলব করেছ। তোমরা বাগবাজারে পেরিং-পয়েন্টে কেল্লা বানিয়েছ, কেশাল সাহেবের বাগানবাড়ির মধ্যে গড়বন্দি তৈরি করেছ। তাই আমরা তোমাদের ওয়াটস্ সাহেবকে, কলেট সাহেবকে, আর ব্যাটসন সাহেবকে ধরে গারদে পুরেছি। তাই আমরা তাদের দিয়ে মুচলেকা লিখিয়ে নিয়েছি–মুচলেকায় লেখা আছে–প্রজাগণের মধ্যে কেহ রাজদণ্ড হইতে অব্যাহতি পাইবার জন্য কলিকাতায় পলায়ন করিলে, আদেশ দেওয়ামাত্র তাহাদিগকে নবাবের হস্তে সমর্পণ করিতে হইবে। গত কয়েক বৎসরের বাণিজ্যের দস্তকের হিসাব দিতে হইবে এবং ওই সকলের অপব্যবহারজনিত রাজকোষের যে-পরিমাণ ক্ষতি হইয়াছে তাহার ক্ষতিপূরণ করিতে হইবে। পেরিং-পয়েন্টে যে-কেল্লা নির্মিত হইয়াছে তাহা ভাঙিয়া ফেলিতে হইবে এবং কলিকাতার হলওয়েল সাহেবের ক্ষমতা বিশেষ সংকুচিত করিতে হইবে। ইতি, বিনীত বশংবদ ওয়াটস, কালেট ও ব্যাটসন।
.
সচ্চরিত্র ঘটক তখনও ছাতিমতলার ঢিবির ওপর দাঁড়িয়ে দূরের বাঁকটার পানে চেয়ে আছে। নদীটা ওখানেই বাঁক নিয়েছে। যেন সেই দিকেই একটা টিমটিমে আলো নজরে পড়ল। বরবাবাজি এত দেরি করবে কে জানত। আজকালকার ছোকরাদের একটা দায়িত্বজ্ঞান বলে কিছু নেই। আগেকার মতো ক্ষমতায় থাকলে ঘটকমশাই আবার চলে যেত সেই কলকাতায়। একবার হাতিয়াগড় একবার কলকাতা। দেনাপাওনার কথা তো সবই হয়ে গিয়েছিল। আগেকার দিনে এমন ছিল না। আগে গ্রামের মধ্যেই বর, গ্রামের মধ্যেই কনে। আর এখন যদি সন্ধান পাও তো যাও কাটোয়া, যাও পূর্বস্থলী, যাও বর্ধমান। কঁহা বীরভূম, কঁহা ঢাকা, সোনারগাঁ, বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ। কোনও জায়গায় আর যেতে বাকি নেই সচ্চরিত্রর।
সচ্চরিত্র বলে–আমার নাম সচ্চরিত্র ঘটক, আমি হলাম ঈশ্বর ইন্দিবর ঘটকের পুত্র, ঈশ্বর কালীবর ঘটকের পৌত্র, ঈশ্বর সিদ্ধেশ্বর ঘটকের প্রপৌত্র। সমস্ত ঘটককারিকা আমার মুখস্থ গো, আমরা হলাম। সাতপুরুষের ঘটক, যদি কলকাতায় কখনও যান হুজুর, আমার নাম করবেন
লোকে বলে কলকাতায় কে তোমায় চিনবে?
আজ্ঞে বড় বড় যজমান সব আমার আছেন সেখানে, নানান জাতের গেরস্থ সব। বাহাত্তুরে কায়েত কৃষ্ণবল্লভ সোম আমার যজমান, মৌলিক কায়েত গোবিন্দশরণ দত্ত, কুলীন কায়েত গোবিন্দরাম। মিত্তির, শ্রোত্রিয় বামুন কন্দর্প ঘোষাল, কুলীন বামুন মনোহর মুখুজ্জে, সুবর্ণ বণিক শুকদেব মল্লিক, সদগোপ আত্মারাম সরকার, তিলি কালীচরণ পাল, কৈবর্ত গৌরহরি হালদার, সব আমার যজমান। শুধু কলকাতা কেন, বর্ধমান, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, নদীয়ায় পর্যন্ত যজমান আছে আমার হুজুর। যাদের কাজকর্ম একবার করে দিয়েছি আর কোনও ঘটকের কাজ পছন্দ হয় না তাদের
এই সচ্চরিত্রর কথাতেই বিশ্বাস করে শোভারাম মেয়ের সম্বন্ধ করেছিল। সারা মুলুকটাই ঘুরে বেড়াত সচ্চরিত্র পোঁটলাটি কাঁধে নিয়ে। এ-গ্রাম থেকে সে-গ্রাম। তারপর দুমাস-তিনমাস কোথায়। কোথায় কেটে যায় কেউ জানতে পারে না। বাড়ির ছেলেমেয়ে বউয়ের সঙ্গে হয়তো ছ’মাস পরে একদিন দেখা হয়। তারপর আবার একদিন বেরিয়ে পড়ে। এমনই রাজমহল থেকে বর্ধমান, বর্ধমান থেকে হুগলি, হুগলি থেকে কলকাতা। কলকাতাই কি ছোট জায়গা নাকি। কায়েতই যে কতরকম এখানে। জেলে-কায়েত, ছুতোর-কায়েত, চাষাকায়েত। পইতে কি চেহারা দেখে আর কাউকে চেনবার উপায় নেই। একমাথা বাবরি চুল, গাল পর্যন্ত টানা জুলপি, ওপর ঠোঁটে একটুখানি গোঁফ শুধু। মাথায় পাগড়ি, গায়ে জোব্বা আর পায়ে চামড়ার চটি, দেখেই বোঝা যায় কলকাতার নতুন সম্প্রদায়ের লোক।
শোভারাম যেবার প্রথম সচ্চরিত্রর সঙ্গে পাত্র দেখতে এসেছিল, জিজ্ঞেস করেছিল–ওসব কারা ঘটকমশাই?
সচ্চরিত্র বলেছিল–সাবধান, আস্তে কথা বলুন বিশ্বাসমশাই, কোম্পানির দালাল ওরা। ওদের অমন কথা বলবেন না, ওদের দোরে লক্ষ্মী বাঁধা, কঁচা টাকা ওদের হাতে জমেছে, ও আপনার মুর্শিদাবাদও নয়, হাতিয়াগড়ও নয়, আপনি আজ্ঞে করে কথা বলতে হয় এখেনে–
সচ্চরিত্র বলত ও চিৎপুর সিমলে মির্জাপুর আরপুলি কলিঙ্গা বির্জিতলাই বলুন আর ওদিকে বেলগেছে উলটোডিঙি কামারপাড়া কঁকুড়গাছি বাগমারি ট্যাংরাই বলুন, সব আমার এলাকার মধ্যে
রাস্তার মধ্যে কাউকে দেখলেই ঘটকমশাই ডাকত–ওগো, ও-মশাই শুনছেন
কে গো, আমাকে ডাকছ?
বলি এখানে বিয়ের যুগ্যি পাত্তোরটাত্তোর আছে? আমি সচ্চরিত্র ঘটক, আমার পিতা ঈশ্বর ইন্দিবর ঘটক, পিতামহ কালীবর ঘটক, প্রপিতামহ সিদ্ধেশ্বর ঘটক, ঘটকালি আমাদের সাতপুরুষের পেশা–
ভদ্রলোক বারকয়েক দেখলেন সচ্চরিত্রর দিকে। দেখে কী ভাবলেন কে জানে। বললেন–ওদিকে দেখুন, এদিকে নেই
ইন্দিবর ঘটক সচ্চরিত্রকে ছোটবেলাতেই বলে গিয়েছিলেন। এবার আমাদের ধর্মকর্ম সব যাবে সচ্চরিত্র–
সচ্চরিত্র তখন ছোট। বুঝতে পারেনি কথাটা। জিজ্ঞেস করেছিল কেন?
যাবেই তো! ইদিকে নবাব হল ম্লেচ্ছ, উদিকে ফিরিঙ্গিরাও হল ম্লেচ্ছ, জাতজন্ম আর ক’দিন বাঁচবে? হিন্দু আর কেউ থাকবে না
তা বটে! কিছুই আর থাকবে না। এরকম করে আর জাত-পেশা রাখা চলবে না। হঠাৎ দূর থেকে আলোটা যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। ছাতিমতলার ঢিবিটা পেরিয়ে একেবারে করুণাময়ীর ঘাট বরাবর গিয়ে হাজির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সচ্চরিত্র। হ্যাঁ, ঠিক এসেছে। হুমড়ি খেয়ে পড়ল নৌকোর গলুইয়ের ওপর। পড়েই কান্তর হাতখানা ধরে ফেলেছে। তুমি আমাকে কী বিপদে ফেলেছিলে বলল দিকিন বাবাজি, আমি কাউকে মুখ দেখাতে পারিনে, এদিকে খিদে পেয়েছে, আর ওদিকে কী কাণ্ড বলল দিকিনি তোমার, ছি ছি ছি আমি হলাম ঈশ্বর ইন্দিবর ঘটকের পুত্র, ঈশ্বর কালীবর ঘটকের পৌত্র…।
কান্ত যেন মুশকিলে পড়ল। বশির মিঞাই তো আসলে গণ্ডগোল বাধালে। তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েই তো ভাটা এসে গেল নদীতে। চড়ায় আটকে গেল নৌকো।
তাড়াতাড়ি কান্তকে নিয়ে ছুটেছে সচ্চরিত্র। বিয়েবাড়ির সামনে গোলমাল শুনে শোভারামও ছুটে এসেছে। মনটা বড় খারাপ ছিল তার। এত সাধের মেয়ে তার। একেবারে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললে কান্তকে দেখে।
কান্ত বললে–নদীতে ভাটা পড়ে চড়ায় আটকে গিয়েছিল আমার নৌকো,
গোলমাল শুনে সিদ্ধান্তবারিধিমশাইও এসে পড়েছিলেন। বললেন–তা এখন তো আর উপায় নেই। শোভারাম, সম্প্রদান তো হয়ে গেছে–
তা হলে?
বশির মিঞাই তো গোল বাধালে। নৌকো আটকে যাবার পর কী করবে বুঝতে পারেনি কান্ত। নাপিত বলেছিল–চলুন বাবু, হাঁটা-পথেই যাই, যদি ঘোড়াটোড়া ভাড়া পাওয়া যায় তো তাই নেওয়া যাবে
শাহি রাস্তার অবস্থাও ভাল নয়। কোথায় ঘোড়া! হাঁটা-পথে হেঁটে গেলেও এক প্রহর লাগবার কথা। কী করবে বুঝতে পারেনি কেউ। শেষে ভাগ্য ভাল, জোয়ার আসতে দেরি হয়নি। সেই নৌকোতেই চারজনে মিলে বৈঠা বাইতে বাইতে এসেছে। ঘেমে নেয়ে একেবারে প্রাণ বেরিয়ে গিয়েছে।
শোভারাম তাড়াতাড়ি ভেতর বাড়ির দাওয়ার কাছে গিয়ে ডাকলে–নয়ান
নয়ানপিসি এল। সব শুনে বললে–তা এখন আর কী করবে দাদা, এখন তো আর করবার কিছু নেই
বলে আবার বাসরঘরে গিয়ে ঢুকল। বললে–ওরে মেয়েরা, তোরা বরকে বিরক্ত করিসনে বাছা, বর এখন একটু ঘুমুবে–
নন্দরানি বললে–তুমি যাও তো এখেন থেকে নয়ানপিসি, বর এখন আমাদের, আমরা যা করাব। তাই করবে
নয়ানপিসি চলে যেতেই নন্দরানি বললে–আজকের রাত্তিরে বর কি একা মরির, বর আজকে আমাদের সকলের, কী ভাই বর, রাজি তো?
উদ্ধব দাস বললে–ঠাকরুনরা যেমন নিবেদন করবেন, তেমনই হবে
ও মা, বর যে দেখছি খুব সেয়ানা রে, বলি হ্যাঁ গো বর, কনেকে কোলে করতে পারবে তো?
উদ্ধব দাস বললে–কোলে তো আগে করিনি কখনও, ঠাকরুনরা বললে–করতে পারি
ওলো, বরের কথা শোন, তা তোমার বুঝি আগে আর বিয়ে হয়নি?
উদ্ধব দাস বলে–না।
নন্দরানি বললে–সকলের সামনে মরিকে কোলে করতে হবে কিন্তু, আমরা সকলে দেখব
উদ্ধব দাস বলে উঠল–তা আপনারা যদি নিবেদন করেন তো আপনাদের কোলে তুলতে পারি
সবাই হেসে লুটোপুটি খেতে লাগল। তারাময়ী বললে–ওমা, কী অসভ্য বর ভাই
তা হোক, কথাটা তারাময়ী বললে–বটে, তবু বরকে নিয়ে মেয়ে-মহলের যেন আনন্দ কৌতূহলের শেষ নেই।
নন্দরানি এগিয়ে এসে বললে–তা আমাকে কোলোকরা দিকি ভাই, দেখি তোমার কত ক্ষমতা
তারপরেই হঠাৎ ভয় পেয়ে সরে এল। বললে–ওমা, এবর যে সত্যি সত্যি হাত বাড়ায় গো, না, অত রসে কাজ নেই, নে লো তারা, মরিকে ধরে বরের কোলে বসিয়ে দে তো
মরালী এতক্ষণ ঘোমটায় মুখ ঢেকে চুপ করে বসে ছিল। একজন কানে কানে গিয়ে কী বললে। বলতেই মরালী কান সরিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রইল
ওমা, মরি যে কাঁদছে লো!
সবাই অবাক হয়ে গেল। এমন এক-বিয়েওলা বর পেয়েও মন ভরেনি মেয়ের। বুড়ো হোক, যাই হোক, এবরের সঙ্গে তো ঘর করতে পারবে তবু। এবরের সঙ্গে এক ঘরে তো শোবে। তবু কান্না! আর আমাদের!
নন্দরানি বুঝিয়ে বললে–আজকের দিনে বরের কোলে বসতে হয় রে, বরের কোলজোড়া রূপ দেখে আমরাও নয়ন সাখক করি, আয় ভাই মরি, ছিঃ
তবু কিছুতে মরালী নড়ে না। পাথরের মতন শক্ত হয়ে বসে রইল একপাশে।
অনন্তদিদি বললে–রাত পোয়ালে তখন তো আর আমরা কেউ আসব না রে, আর আসতে চাইলেও তোরা কেউ আসতে দিবিনে, আজকের মতো আমরা একটু আনন্দ করে নিই আমাদের নিজেদের তো সাদ-আহ্লাদ সব ঘুচে গেচে ছি, কথা শোন, আজ শুনতে হয়–
কিন্তু টানাটানি করেও কিছু ফল হল না। সকলকে আঁচড়ে কামড়ে একাকার করে দিলে মরালী। কিছুতেই সে বরের কোলে বসবে না।
এবার নন্দরানি এগিয়ে এল। বললে–তোরা সর দিদি, আমি দেখি
বলে–কোমরে কাপড় জড়িয়ে মরালীকে টেনে বরের কোলে বসাতে যেতেই এক কাণ্ড ঘটে গেল। নন্দরানির বুড়ি মা বাইরে থেকে আর্তনাদ করে উঠল–ও মা, অনন্ত, অনন্ত রে–
সমস্ত ঘরখানা যেন অকস্মাৎ এক নিমেষে স্তব্ধ পাথর হয়ে গেল সে কান্নার শব্দে। কী হল। কী হয়েছে! মেয়েরা সবাই এক অজ্ঞাত আতঙ্কে শিউরে উঠেছে।
কী হয়েছে জ্যাঠাইমা? কে বুঝি জিজ্ঞেস করলে।
আমার অনন্তর কপাল পুড়েছে মা! অনন্ত যে আমার মাছ না হলে খেতে পারে না গো! ও অনন্ত, অনন্ত রে–
বাসরঘর থেকে বেরিয়ে এল অনন্তবালা। সঙ্গে নন্দরানিও বেরিয়ে এল। বেরিয়ে এল তারাময়ী, বেরিয়ে এল সবাই। বাইরে ভিড় হয়ে গেল এক নিমেষে। শোভারাম ছুটে এল। জিজ্ঞেস করলে কী হয়েছে বামুনদিদি?
নয়ানপিসিও এসে দাঁড়িয়েছিল। বললে–মেয়েকে করুণাময়ীর ঘাটে নিয়ে গিয়ে সিঁদুরশাখা ভেঙে দাও গে, ও আর কেঁদে কী করবে দিদি, কপালের লিখন তো কেউ খণ্ডাতে পারবে না–
ভিড় জমে গেল বাড়ির উঠোনে। বরের সঙ্গে কোনওদিন কথাও হয়নি অনন্তবালার। কথা হওয়া দূরে থাক, ভাল করে দেখেওনি বরকে কোনওদিন। সেই স্বামীর মৃত্যুসংবাদ শুনে কাতর হওয়া স্বাভাবিক কি অস্বাভাবিক সেকথাও কারও মনে এল না। স্বামীর মৃত্যু মানে জীবনের সব সাধ-আহ্লাদ থেকে বঞ্চিত হওয়া, পাথর যদি হয়েই থাকে তো সে শোকে না লোকাঁচারের সংস্কারে, কে জানে? আর কোনওদিন মাছ খেতে পারবে না অনন্তবালা। আর কোনওদিন শাঁখা-সিঁদুর-শাড়ি পরে বেরোতেই পারবে না, এ-ও কি কম ক্ষোভ, কম ক্ষতি! এর পর থেকে এই নয়ানপিসির মতো পরের বাড়ির উৎসবে-আনন্দে শুধু গতরে খেটে আনন্দ দিতে হবে। অথচ নিজেরই যেন এতদিন আনন্দ করবার কিছু ছিল!
তবু সহানুভূতির কথা শোনাল সবাই! অনন্তবালাকে নিয়ে যখন বামুনদিদি বাড়ি চলে গেল তখন সকলের মুখ দিয়েই শুধু একটা শব্দ বেরোল–আহা!
আর মেয়েরা যে-যেখানে ছিল সবাই সেই আহা’ শব্দের সঙ্গে নিজেদের জীবনের মর্মান্তিক সত্যিটাই প্রকাশ করে দিলে। অথচ এ-ঘটনা এত সত্য, এত স্বাভাবিক, এত সাধারণ যে তার কোনও প্রতিকারই নেই যেন কারও হাতে! নিতান্ত কার্যগতিকেই জামাই যাচ্ছিল নৌকো করে কোন দেশে, যাচ্ছিল হয়তো আর কোনও কন্যার পাণিগ্রহণ করতে–পথে ডাকাত পড়ে খুন করে ফেলেছে। ঘটনাটা ঘটেছে কতদিন আগে। তার পরেও কতদিন ধরে অনন্ত শাঁখা-সিঁদুর পরেছে, মাছ খেয়েছে, স্বামীর আসার প্রতীক্ষায় দিন গুনেছে, বছর গুনেছে, এতদিন পরে সে খবর হাতিয়াগড়ে এসে পৌঁছেছে। বাংলার গ্রামে গ্রামে যত বধূ ছিল সবাই একসঙ্গে অনাথা হয়ে গেল। এর বুঝি কোনও প্রতিকার নেই, কোনও সান্ত্বনাও নেই কোথাও। সেদিনকার উৎসবের মধ্যে হঠাৎ যেন কোনও অশনিপাতে সব নিঃশেষ হয়ে গেল।
সচ্চরিত্র ঘটক এতক্ষণ খাইখাই করেও খেতে পারেনি। যেন তার খাবার জায়গাও হঠাৎ ফুরিয়ে গিয়েছে। হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে কান্তর সঙ্গে দেখা।
একী বাবাজি, তুমি এখনও আছ? খাওয়া হয়েছে?
কান্ত কিছু উত্তর দিলে না।
সচ্চরিত্র বললে–সেকী, বিয়ে হল না বলে খেতে কীসের আপত্তি, চলো, আমারও খাওয়া হয়নি–
তারপর নাপিতের দিকে চেয়ে বললে–চলো হে, তুমিই বা কেন মাঝখানে থেকে উপুসি থাকবে, চলো, চলো–
*
ওদিকে মুর্শিদাবাদেও অনেক রাত হয়েছে। রাত হলেই আজকাল কেমন সব থমথম করে। এই মহিমাপুর থেকেই শাহিবাগটার সামনের বড় মসজিদটা দেখা যায়। মসজিদের মাথায় সবুজ নিশান ওড়ে। হাওয়ায় দোল খায়, পতপত করে। তার ওপরে একটা বাতি জ্বলে। বাতির আলোটা আরও অনেক দূর থেকে দেখা যায়। ভাগীরথী দিয়ে যেতে যেতে নৌকোর মাঝিমাল্লারা আলোটা দেখে নিশানা ঠিক করে নেয়। বলে মসজিদের আলো
ফতোদ জগৎশেঠের বাড়ির লোহার দরজার সামনে বন্দুক নিয়ে বসে পাহারা দেয় ভিখু শেখ।
ভিখু শেখ বলে–মহারাজ ফতোদ জগৎশেঠকা হাবেলি।
মনিবের গৌরবে গোলামেরও গৌরব বাড়ে। সামনে দিয়ে কেউ গেলে কিছু বলে না। যার-তার সঙ্গে কথা বললে–ভিখু শেখের ইজ্জত চলে যায়। শাহি সড়কের পদাতিক মানুষের ওপর তার বড় তাচ্ছিল্য। তাচ্ছিল্য করে বলেই তাদের সঙ্গে কথা বলে নিজেকে ছোট করে না। বরং একলা চুপচাপ সব দেখে। দুনিয়াদারি দেখতে ভিখু শেখের বেশ লাগে। যখন নবাব মঞ্জিলের নহবতখানায় ইনসাফ মিঞা ভোরবেলা আশাবরীর সুর তোলে তখন ভিখু শেখ মাঝে মাঝে চোখ বুজে দিওয়ানা হয়ে যায়। দুনিয়ার দৌলত, খানদান, জৌলুস, জমজমা, আওরাত, তনখা, এমনকী বেহেস্তের খোদাতালা পর্যন্ত তার কাছে বরবাদ হয়ে যায়। যেন ইনসাফের নহবতের ফুটোগুলোতে মিছরি মাখানো আছে। ভিখু শেখের মতো পাঠানকেও জাদুর মোহে ভুলিয়ে দেয়। আর ঠিক তার পরেই বুঝি হঠাৎ সচেতন হয়ে ওঠে। চোখ দুটো খোলে। বন্দুকটাও সামলে নেয়। গোঁফজোড়া পাকিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসে নিজেকে যেন অপরাধী মনে হয় তার। রাজা দৌলতরাম ফতোদ জগৎশেঠজির সে খাস নৌকর। রাজা দৌলতরাম নামটা তার নিজের দেওয়া। তার মনে পড়ে যায়, তার ওপর নির্ভর করে এত বড় দৌলতরাম আরাম করে ঘুমুচ্ছে। তার একটু গাফিলতিতে সবকিছু লোকসান হয়ে যেতে পারে। মারাঠি ডাকুরা লুঠপাট করে নিতে পারে। চোট্টা ডাকুর তো কমতি নেই দেশে। দৌলত দৌলত করে তামাম দুনিয়া মস্তানা হয়ে গেছে। আরে, হারামি দৌলতের মতো খতরনাক চিজ আছে নাকি আর? দৌলতের জন্যেই তো বেগমের সঙ্গে নবাবের, নবাবের সঙ্গে নবাবজাদার লড়াই চলছে দুনিয়ায়। দৌলত আর আউরত। দুটোই খতরনাক চিজ। ভিখু শেখের চোখের সামনেই এই দুটো জিনিসের পাহাড় জমে আছে। দৌলত ভি দেখেছে, আউরত ভি দেখেছে, ঘসেটি বেগম, আমিনা বেগম, মনি বেগম সবাইকে দেখেছে ভিখু শেখ। ঢাকার দেওয়ান নোয়াজিস মহম্মদ সাহেবকে দেখেছে, পূর্ণিয়ার দেওয়ান সৈয়দ আহম্মদ সাহেবকে দেখেছে। শেঠ মানিকচাঁদ সাহেবকে দেখেছে, ফতেচাঁদ জগৎশেঠজিকে দেখছে। মহারাজ স্বরূপচাঁদকে দেখেছে, এখন মহতাপচাঁদ জগৎশেঠজিকে দেখছে। সবই দৌলত আর আউরত। সেই দৌলত আর আউরতের খাতিরেই সবাই মহারাজার কাছে দরবার করে। কাশ্মীরিরা আসে, মুলতানিরা আসে, পাঠানরা আসে, শিখরা আসে। তাতার, মোগল, ফিরিঙ্গি, ইংরেজ, দিনেমার, আর্মানি সবাই আসে। এসে টাকা চায়, হুন্ডি কেনে। ভিখু শেখ শেঠজির ফটকে পঁড়িয়ে সবাইকে দেখে। সব লক্ষ করে। কিন্তু কথা বিশেষ বলে না।
কিন্তু সেদিন হাঁক দিয়ে উঠল ভিখু শেখ–কৌন?
বশির মিঞা বলে–আমি রে বাপু, আমি
আমি কৌন?
আরে বাবা, আমাকে চিনিস না? মোহরার মনসুর আলি মেহের আমার ফুপা, নবাব-নিজামতের মোহরার
ভিখু শেখ আজকের লোক নয়। মির হবিব খাঁ যখন বর্গির সেপাই নিয়ে শেঠজির বাড়ি চড়াও হয়েছিল, তখনও এই বন্দুক দিয়ে দশটা মারাঠি ডাকুকে খুন করেছিল। ফতেচাঁদ জগৎশেঠজির আমলের লোক সে। অত সহজে তাকে দলে টানা যায় না।
বললে–হুকুম নেই—
বশির মিঞা বললে–আরে হুকুম নেই মানে, তোমার শেঠজির দোস্ত আমাদের নবাব, আমাদের অন্দরে যেতে দেবে না?
তারপর হঠাৎ সোজা কথায় কাজ হবে না দেখে আদর করে বললে–কেন গোসা করছ শেখজি, তুমিও মুসলমান আমিও মুসলমান, এক জাত, এক আল্লা আমাদের
ভাগো নেড়ি কুত্তা!
এর পর আর দাঁড়ানো যায় না। জগৎশেঠজির হুকুম হয়েছে কাউকেই বিনা পাঞ্জায় ঢুকতে দেওয়া হবে না এই হাবেলিতে! দুনিয়ার হালচাল ভাল নয়। দিল্লির বাদশা না-থাকারই মতো। পাঠান, আফগান, মারাঠি সবাই টাকা লুঠতে বেরিয়েছে। আর জগৎশেঠজির মতো টাকা কার আছে? শাহানশা বাদশা দিল্লির বাদশার চেয়েও বেশি দৌলত জগৎশেঠজির। তাই মহিমাপুর হাবেলির সব ফটকে বন্দুকওয়ালা পাহারাদার বসেছে। কোথাকার কোন নবাবের মোহরার তার রিস্তাদারকে ঢুকতে দেবে জগৎশেঠজির বাড়িতে! ভিখু শেখ আবার বন্দুকটা খাড়া করে ধরে গোঁফে তা দিতে লাগল।
কৌন?
এবার দুটো পালকি এগিয়ে আসছিল। সামনে সামনে আসছিল আর-একজন আদমি। আদমিটা কাছে আসতেই ভিখু শেখ হাতটা ধরে ফেলেছে। ফির দিল্লাগি!
বশির মিঞা এবার বুকটা চিতিয়ে দাঁড়াল।
পাঞ্জা?
পাঞ্জাও ফেলে দিলে চিত করে ভিখু শেখের চোখের সামনে।
পালকিতে কে আছে?
জেনানা!
এবার আর আটকানো যায় না। ফটকটা ফাঁক করে রাস্তা করে দিলে ভিখু শেখ। দিতেই পালকি দুটো ভেতরে গিয়ে ঢুকল। মহিমাপুরের এই বাড়িতে কত নবাব এসেছে। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ এসেছে, নবাব সুজাউদ্দিন খাঁ এসেছে, নবাব সরফরাজ খাঁ এসেছে, নবাব আলিবর্দি খাঁ এসেছে। জগৎশেঠজিরা কি নবাবের চেয়ে কিছু ছোট? লড়াই করতে যখন টাকার কমতি পড়বে তখন তো জগৎশেঠজির কাছেই হাত পাততে হবে। দিল্লির বাদশার কাছেও যখন খাজনা পাঠাতে হবে তখন তো এই জগৎশেঠজির কাছেই হুন্ডি কাটতে হবে। পালকি ভেতরে চলে যাবার পর ভিখু শেখ আবার গোঁফজোড়া পাকিয়ে নিলে। ভিখু শেখ নিজে পাঠান, আর জগৎশেঠজি জৈন। তা হোক, ভিখু শেখের কাছে ইমানদারি আগে, তারপর জাত। ভিখু শেখ ইমানদারির জন্যে একবার নিজের জানের ঝুঁকি নিয়েছিল। দরকার হলে আবার নেবে। রাস্তার সামনে একটা ঘেয়ো কুকুর সামনের দিকে আসছিল। ভিখু শেখ বন্দুকটা জমিনের ওপর ঠুকল–ভাগো, নিকাল
শালা নেড়ি কুত্তার বাচ্চা! জগৎশেঠজির অন্দরে ঘুষতে এসেছে। নবাব সরফরাজ খাঁ এইরকম করে একদিন জগৎশেঠজির হারেমে ঘুষতে চেয়েছিল। তার ফল পেয়েছে নবাব। তোরও সেই দশা হবে। ভাগ ভাগ নিকাল যা–ভিখু শেখ বন্দুকটা নিয়ে আবার জমিনের ওপর ঠুকে দিলে।
ওদিকে দেউড়ি পেরিয়ে পালকি দুটো গিয়ে থামল দরদালানের সামনে। পালকির দরজা খুলে ঘোমটা দেওয়া জেনানা নামল একজন। পেছনের পালকিতেও জেনানা। আর নামল মোহরার মনসুর আলি মেহের। বশির মিঞা বুকটা আরও চিতিয়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। জগৎশেঠজির অন্দরের দরোয়ান গদির দরজা খুলে দিলে। তারপর সকলকে বসতে বলে অন্দরে চলে গেল।
মনসুর আলি সাহেব বশিরকে বললে–তুই বাইরে যা
বশির মিঞা দরজার বাইরে এসে একটা বিড়ি ধরালে। তারপর চারদিকে চেয়ে দেখলে কেউ কোথাও নেই। মুর্শিদাবাদ থেকে অনেক দূরে এই মহিমাপুর। সারাদিন খেটে খেটে পরেশান হয়ে গিয়েছিল। তা জাসুসের কাজই এইরকম। ভেতরে কী কথা হচ্ছে শোনা যাচ্ছে না। ভিখু শেখ তখন নেড়ি কুত্তাটাকে তাড়া করছে। বশির মিঞা বললে–আহ্যাঁ হ্যাঁ, ওকে তাড়াচ্ছ কেন শেখজি, ও তো কুত্তা, ছাড়া আর কিছু নয়
তারপর ভাল করে ভাব করবার জন্যে জেব থেকে একটা বিড়ি বার করলে একটা বিড়ি পিয়ো খাঁ সাহেব
ভিখু শেখ এরকম অনেক বশির মিঞাকে বগলে টিপে মেরে ফেলতে পারে। কিছু বললে–না মুখে, বশিরের দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে একবার চাইলে। অর্থাৎ আমি যার-তার নোকর নই ছোকরা, আমি শাহানশা বাদশা দিল্লির আলমগির বাদশার চেয়েও রেইস আদমি জগৎশেঠ মহাতাপজির নোকর! আমি কুত্তাদের সঙ্গে বাতচিত করি না–।
বশির মিঞা ভয়ে ভয়ে পেছিয়ে এসে বিড়িটাতে লম্বা লম্বা টান দিতে লাগল।
জগৎশেঠজি ঘরে ঢুকতেই সবাই উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে আদাব করলে। ততক্ষণে মনসুর আলি ঘরের সব জানালা দরজা বন্ধ করে দিয়ে এসেছে।
হুজুর, ইনিই সেই হলওয়েল সাহেব আর এঁকে তো চেনেনই, মিরজাফর আলি সাহেব।
জেনানার বোরখা খুলেছে তখন দুজনেই। জগৎশেঠজি বসতেই হলওয়েল সাহেব বসল, পাশে বসল মিরজাফর আলি খাঁ।
জগৎশেঠজি সোজা কথার লোক। ফতোদজি যতদিন বেঁচে ছিলেন, সব হাতেকলমে মহাতাপজিকে শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়ে গেছেন। মহাতাপজি নিজেও ছিলেন দিল্লির বাদশার দরবারে। তামাম দুনিয়ায় কোথায় কী ঘটছে তা জগৎশেঠজির জানতে বাকি নেই। দিল্লির বাদশাই হোক আর তাতারের খুদে চামড়ার কারবারিই হোক, জগৎশেঠজির কাছে টাকার জন্যে হাত পাততেই হবে। ফতোদজি রেখে গিয়েছিলেন দশ কোটি টাকা, মহাতাপজি আর স্বরূপচাঁদজি দুই ভাই মিলে তাকে এই কদিনেই বাড়িয়ে করেছেন বারো কোটি টাকার জন্যেই বরাবর ওয়াটস্ সাহেব, কলেট সাহেব, হলওয়েল সাহেব, ব্যাটসন সাহেব সবাই তার কাছে এসেছে হুন্ডির জন্যে। কিন্তু এবার অন্য কারবার। এবার টাকা নয়, দুনিয়াদারি।
হলওয়েল সাহেব বললে–না হুজুর, দুনিয়াদারি নয়–
জগৎশেঠজি বললেন–তা দুনিয়াদারি নয় তো কী? আমার সঙ্গে টেক্কা দিয়ে আপনাদের কাউন্সিল কলকাতায় ঠাকশাল করেছে, আমি খবর পেয়েছি।
হলওয়েল ইংরেজ বাচ্চা। গরম হতে জানলেও নরম হতেও জানে। বললে–আপনি যদি বলেন হুজুর তো মিন্ট আমরা তুলে দেব, আপনার মিন্ট থেকেই আগেকার মতন আর্কট টাকা ম্যানুফ্যাকচার করে দেব! আপনি হুজুর যা বলবেন তাই-ই করব, আমাদের কোম্পানি ইন্ডিয়াতে ব্যাবসা করতে এসেছে, পিসফুলি ব্যাবসা করতে পারলে আমরা তো আর কিছু চাই না। কিন্তু নবাব আমাদের তাও করতে দেবেন না
তারপর একটু থেমে আবার বললে–সেই জন্যেই আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, আমি শুনেছি আপনি হুজুর এব্যাপারে কোম্পানির কাউন্সিলকে হেল্প করবেন
মিরজাফর আলি এতক্ষণ চুপ করে ছিল। জগৎশেঠজির সামনে বহুবার এসেছে আগে আলিবর্দি খাঁ’র সময়ে। কিন্তু তখনকার কথা আলাদা। হজরত আলির শেষ বংশধর। নবাব আলিবর্দির সৎ বোনের স্বামী। বড় ভালবাসত আলিবর্দি খাঁ তাকে। কিন্তু শেষের দিকে চটে গিয়েছিলেন নবাব তার ওপর।
জগৎশেঠজি হঠাৎ বললেন–শরবত আনতে বলব?
হলওয়েল সাহেব মাথা নিচু করে সবিনয়ে বললে–আপনার খেয়েই আপনার মেহেরবানিতেই কাউন্সিল এখানে টিকে আছে হুজুর আর আপনাকে তকলিফ দেব না
মিরজাফর আলিও সুরে সুর মিলিয়ে বললে–হুজুরের অনেক কষ্ট হল, আর কষ্ট দিতে চাই না
কিন্তু আমি আপনাদের কী মদত দিতে পারব?
হলওয়েল সাহেব বললে–আপনি শুধু একটু নবাবকে বুঝিয়ে বললেই আমাদের উপকার হবে
কী বুঝিয়ে বলব?
যেন আমাদের ওপর আর টরচার না হয়, অত্যাচার না হয়। তারপরে গলাটা একটু নিচু করে বললে–নবাব আমাদের চারিদিকে স্পাই লাগিয়েছেন, আমাদের এখানকার কাশিমবাজার কুঠির ওয়াটস, কলেট, ব্যাটসনকে ধরে নিয়ে গিয়ে নজরবন্দি করে রেখেছিলেন, তাদের দিয়ে জোর করে বন্ড লিখিয়ে নিয়েছেন, মুচলেকায় সই করতে হয়েছে তাদের। তাদের জেনানাদের পর্যন্ত ইনসাল্ট করেছেন-নবাবের অর্ডারে কোম্পানির কুঠির সব মাল লুঠ করেছে। নিজামতের লোকেরা…
বলতে বলতে হলওয়েল সাহেব বোধহয় উত্তেজিত হয়ে উঠছিল। মিরজাফর বললে–আস্তে সাহেব, আস্তে, অত চেঁচিয়ো না, কেউ শুনতে পাবে–
জগৎশেঠজি বললেন–না, বলুন আপনি। তারপর?
সে ইতিহাস তো এক দিনের নয়, এক যুগেরও নয়। ১৭৩০ সালে নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌল্লার জন্ম। তারও আগের কাহিনী সব। তখন এই জগৎশেঠ মহাতাপজিও জন্মাননি। মহারাজ স্বরূপচাঁদও জন্মাননি। তখন থেকেই তো ফিরিঙ্গি কোম্পানির আমদানি হয়েছে হিন্দুস্থানে। তখন থেকেই বিষনজরে পড়েছিল কোম্পানি। আওরঙ্গজেব মারা যাবার পর থেকে পাঁচজন মাত্র বাদশা হয়েছে। বলতে গেলে দিল্লির মসনদ তখন ফাঁকা। মারাঠারা উঠেছে পশ্চিমে আর শিখরা উঠতে চেষ্টা করছে। উত্তরে। এই অবস্থায় আমরা নিশ্চিন্তে কেমন করে ব্যাবসা করব হুজুর।
রাত আরও গভীর হয়ে আসছে। পালকি-বেহারারা বাইরে বসে বসে ঢুলছে। বশির মিঞা আর থাকতে পারলে না। তার নিজের বিড়ি তখন খতম হয়ে গেছে। বেহারাদের কাছে গিয়ে বললে–ভাইয়া, বিড়ি আছে তোমাদের কাছে?
ভিখু শেখ ধমক দিয়ে উঠল ফটক থেকে–এই উন্মুখ, চিল্লাও মাত
গদির ভেতরে তখন জগৎশেঠজি বললেন–আপনারা মিথ্যে কথা কেন বললেন নবাবকে?
কী মিথ্যে কথা?
আপনারা কেল্লা বানাচ্ছেন কলকাতায়, এ-খবর নবাব পেয়েছিলেন। নবাবের চিঠির উত্তরে
আপনাদের ড্রেসাহেব লিখলেন–গঙ্গার ধারে পোস্তা ভেঙে যাওয়ায় মেরামত করছেন! এটা তো মিথ্যে কথা!
হলওয়েল সাহেব কী বলতে যাচ্ছিল, জগৎশেঠজি বাধা দিয়ে বললেন–আর কাশিমবাজার কুঠির ওয়াটস্ সাহেবের মুচলেকা আপনারা মেনে নিলেন না কেন? আর একটা কথা
জগৎশেঠজির কাছে সব খবরই আসে। বোঝা গেল তার জানতে কিছুই বাকি নেই।
ঢাকার নায়েব রাজা রাজবল্লভের ছেলে কেষ্টবল্লভকে আপনারা কলকাতায় থাকতে দিলেন কেন? তার সঙ্গে অত টাকাকড়ি ছিল। আপনারা তার কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে নবাবের সঙ্গে বেইমানি করলেন কেন? রামরাম সিংয়ের ছেলে নারাণ সিংকে আপনারা ধরে রাখলেন কেন? তাকে অপমান করলেন কেন? উমিচাঁদ একটা ঠগ, ওকে আপনারা অত আমল দেন কেন? কলকাতার সোরার কারবারি বেভারিজ সাহেবের সঙ্গে উমিচাঁদের অত দোস্তালি কেন?
মিরজাফর এতক্ষণ চুপ করে ছিল। বললে–হুজুর, এইসব কথার জবাব দেবার জন্যেই আমরা এসেছি আপনার কাছে আপনি নবাবের তরফের কথাগুলো শুনেছেন, এবার আমাদের তরফের কথাও শুনুন।
জগৎশেঠজি বললেন–বলুন–আমি যখন জবান দিয়েছি, তখন কাউকেই আমি এসব কথা বলব–এক আমি ছাড়া কেউই এসব জানবে না।…
কী বিড়ি রে? বড় কড়া মাল মালুম হচ্ছে—
ভিখু শেখ বন্দুক নিয়ে এগিয়ে এসেছে এই কুত্তা, নিকাল ইহাসে–
হঠাৎ বোধহয় বাইরের রাস্তার দিকে নজর পড়েছে। আর একটা পালকি। ঘন ঘন দম ফেলবার শব্দ কানে আসতেই ভিখু শেখ পেছন ফিরল। আজ হল কী! এত পালকি আসছে এখানে।
পাঞ্জা!
পাঞ্জা দেখালে আর ভিখু শেখের করবার কিছু নেই। পাঞ্জা দেখলে ভিখু শেখ বন্দুকটা জমিনের ওপর রেখে খাড়া হয়ে দাঁড়ায়। পালকিটা দেউড়ির ভেতরে ঢুকল। বশির মিঞা তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল। কোথাকার কে ভেতরে ঢুকছে নির্বিবাদে পাঞ্জা দেখিয়ে। পালকি থেকে পালকির দরজা খুলে কে নামল একজন। ঢাকাই মসলিনের পিরান গায়ে। চটকদার চেহারা। নেমে সোজা সিঁড়ি দিয়ে দরদালানের দিকে এগিয়ে গেল। বশির মিঞা কিছু বলতে পারলে না। ভদ্রলোক ভেতরে যেতেই পালকি-বেহারাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে–এ কৌন হ্যায় ভাইয়া? জমিনদার?
ভিখু শেখ ওধার থেকে আবার ধমক দিয়ে উঠল–এই কুত্তা, ফিন?
জগৎশেঠজির কাছে খবর গেল। খতটা দেখে বললেন–এখন তো দেখা হবে না। বলে দে, কাল সকালে দেখা করতে
মিরজাফর জিজ্ঞেস করলে কে হুজুর, এত রাত্তিরে?
হাতিয়াগড়ের জমিদার!
মিরজাফর যেন হাতে ইদের চাঁদ পেয়ে গেল। বললে–হাতিয়াগড়ের জমিদার? ও এলে কোনও লোকসান নেই হুজুর, ওকে আসতে বলুন, হাতিয়াগড়ের রাজা আমাদের দলে–
যে-লোকটা চিঠি নিয়ে এসেছিল সেও থমকে দাঁড়াল।
মিরজাফর আবার বলতে লাগল–শুধু হাতিয়াগড় নয় হুজুর, সবাই আমাদের দলে। নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র, নাটোরের মহারানি, সবাইকে আপনার কাছে নিয়ে আসব হুজুর। হাতিয়াগড়ের জমিদারের কাছেও যে ফৌজি-সেপাই গিয়ে পরোয়ানা দিয়ে এসেছে
কেন?
হাতিয়াগড়ের রাজার কাছেই আপনি সব শুনতে পাবেন হুজুর। আমি নিজে মুসলমান হয়ে বলছি, নবাবের কাছে হিন্দু মুসলমান খ্রিশ্চান কিছু নেই, তামাম বাংলা মুলুক নবাবের দুশমন হয়ে গেছে!
জগৎশেঠজি বললেন–যাও, জমিদার সাহেবকে এত্তেলা দাও
আর সঙ্গে সঙ্গে হাতিয়াগড়ের জমিদার হিরণ্যনারায়ণ রায় ঘরের ভেতরে ঢুকলেন। প্রথমে বুঝতে পারেননি। তারপর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল– আপনারা?
*
নয়ানপিসি তখন মরালীকে খাওয়াচ্ছিল। সারাদিন বিয়ের ধকল গেছে। উদ্ধব দাস শুভদৃষ্টির সময়েই লক্ষ করেছিল।
হরিপদ কানে কানে বলেছিল–একটু কান্নাকাটি করছে বটে, কিন্তু তা করুক, মেয়েমানুষের মন, ও দু’দিনেই ঠিক হয়ে যাবে দাসমশাই, ওর জন্যে কিছু ভেবো না
তারপর শোভারামের দিকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছিল–এ তোমার অনেক ভাল হল শোভারাম, কলকাতার বর আসেনি, এ অনেক ভাল হয়েছে। বড়মশাই শুনলে রাগ করতেন, ম্লেচ্ছদের চাকরি, জাত-জন্ম কি আর থাকত তোমার মেয়ের?
শোভারাম বলেছিল কিন্তু মরি যে আমার বড় সোহাগি মেয়ে হরিপদ, পাশা খেলে, পান খায়, চুলে গন্ধ তেল দেয়, গান গায়
হরিপদ বলেছিল–তা পাশা খেলবে। দাসমশাইও তো শৌখিন মানুষ, জানো, রসের গান জানে কত
শোভারাম বলেছিল কিন্তু রসের গান শুনলে তো আর পেট ভরবে না। শেষে কি বাঁড়ুজ্জে মশাইয়ের মেয়ের মতো বাপের বাড়িতেই কাটিয়ে দেবে চের-জন্ম, শ্বশুরঘর করবার কপাল হবে না। আর
তারপর শোভারাম হরিপদকে জিজ্ঞেস করেছিল–আচ্ছা, মরি অত কাঁদছিল কেন বলো তো হরিপদ?
আহা, মেয়েছেলে হয়ে জন্মেছে, কাঁদবে না? মায়ের কথা মনে পড়ছিল হয়তো! বিয়ের দিনে মেয়েছেলে কাদবে না তো কি বেটাছেলে কাদবে? সেই যে কথায় বলে না, মেয়েছেলের মন যেখানে যেমন! দেখবে দাসমশাইয়ের কাছে গিয়ে তখন তোমার কাছে আসতেই চাইবেনা, দেখে নিয়ে তুমি
ঠিক এই ঘটনার পরেই কান্ত এসে গিয়েছিল। কতদূর থেকে কেমন করে হাঁফাতে হাঁফাতে সে এসেছে। ঘেমে নেয়ে চান করে উঠেছে বর। সচ্চরিত্র ঘটক রাস্তা থেকেই চিৎকার করতে করতে আসছিল–বর এসে গেছে। বর এসে গেছে, উলু দাও গো, উলু দাও
চারদিকে হইহই কাণ্ড তখন। লোকজন খেতে বসেছিল উঠোনের মাঝখানে। সিদ্ধান্তবারিধিমশাই তখন সম্প্রদান সেরে গামছা দিয়ে গায়ের ঘাম মুছছেন। সব কথা কানে গিয়েছিল মরালীর। সব দেখা দেখে নিয়েছে। অনন্তদিদির বর দেখে একদিন ঘেন্না হয়েছিল মরালীর। নন্দদিদির বিয়েও দেখেছিল। আজও অশোক-ষষ্ঠীর দিন নন্দদিদি উপোষ করে কলাগাছের পায়ে তেল-সিঁদুর দিয়ে এসে তবে জল খায়। তাদের পাশাপাশি তার নিজের বরের দিকে চেয়েও যেন কেমন ঘেন্না হল। হঠাৎ তার দুর্গাদিদির কথা মনে পড়ল। দুগ্যাদি কত ওষুধবিষুধ জানে। ছোট বউরানিকে ওষুধ দিয়ে ছোটমশাইকে বশ করে রেখেছে।
চুপি চুপি বললে–পিসি—
নয়ানপিসি বললে–কী রে? কান্না থামল তোর?
মরালী বললে–দুগ্যাদি আসেনি পিসি?
হ্যাঁ, কেন রে? ওই তো উঠোনে বসে খাচ্ছে—
একবার ডেকে দেবে পিসি?
তারপর খাওয়াদাওয়ার পর দুর্গা এল। বললে–ডাকছিলিস নাকি রে মরি আমাকে?
আদর করে মাথায় হাত বুলোত বুলোতে বললে–বেশ ভাতার হয়েছে লো তোর, দেখলুম, বেশ ভাতার।
হঠাৎ মরালীর চোখে জল দেখে বললে–ওমা, কঁদছিস কেন লা? ভাতার বুঝি পছন্দ হয়নি?
মরালী যেন ডুকরে কেঁদে উঠল। বললে–দুগ্যাদি, তুমি যে সেই আমাকে ওষুধ দেবে বলেছিলে?
কীসের ওষুধ লা?
মরালী বলে উঠল আমি মরব দুগ্যাদি, আমি বিষ খেয়ে মরব—
চুপ কর মুখপুড়ি, চুপ কর–
দুর্গা চারদিকে চেয়ে একবার দেখে নিলে। কেউ শুনতে পেয়েছে কি না কে জানে। নিজের আঁচল দিয়ে মরালীর চোখ দুটো মুছিয়ে দিলে। কোলে টেনে নিয়ে বোঝালে। বললে–মুখপুড়ি, তোর কপালে অনেক দুঃখু আছে, মেয়েমানুষের অত অসৈরন হলে চলে?
মরালী কাঁদতে কাঁদতে বললে–আমায় মরবার একটা ওষুধ দাও দুগ্যাদি, তোমার দুটি পায়ে পড়ি আমি
দুর্গা কেমন যেন বোবা হয়ে গেল। অনেককে দুর্গা ওষুধ দিয়েছে। থুনকোর ওষুধ দিয়েছে গিরিরানির মাকে, বাধকের ওষুধ দিয়েছে বৈরাগীদের বউকে, বশীকরণের ওষুধ দিয়েছে অনন্তবালাকে। আরও কত কাজে কত ছেলেমেয়ে এসেছে তার কাছে। দুর্গার ওষুধ আজ পর্যন্ত কখনও ব্যর্থ হয়নি। জলপড়া, আগুনে পোড়া, নখদর্পণ, বাঘের মুখখিলানি, বাটি চালানো ওষুধ তো কম জানে না দুর্গা। কিন্তু এমন ওষুধ তো দুর্গার জানা নেই। স্বামীকে যার পছন্দ হয় না বিয়ের রাত্রে, তার প্রতিকার কেমন করে করবে দুর্গা!
তা হ্যাঁ লো, বর বুঝি তোর পছন্দ হয়নি?
মরালী বললে–আমি গলায় দড়ি দেব দুগ্যাদি
দুর্গা বললে–মেয়েমানুষের অত পছন্দর বালাই কেন বল তো মরি? মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছিস, অত অসৈরন হলে চলে?
মরালী বললে–তা হলে কালকে আমার মরা মুখ দেখো তুমি দুগ্যাদি
দুর্গা যেন কী ভাবলে। বললে–বোস, দাঁড়া দেখি কী করতে পারি
তারপর একটু ভেবে বললে–তুই এখন থেকে পালাতে পারবি?
আমি চুলোয় যেতে পারি দু্যাদি, আমাকে তুমি বাঁচাও
আর তার পরেই সেই রাত্রে যখন বাসরঘর থেকে সবাই বাইরে খেতে গেছে, উদ্ধব দাস মরালীর হাতটা চেপে ধরে ছিল। ঠিক তখনই বলা কওয়া নেই, নিজের হাতটা টেনে নিয়ে খিড়কির দরজাটা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। দুগ্যাদি বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল। হাত ধরে নিয়ে বললে–চেঁচাসনে, আয়,-সব ব্যবস্থা করে রেখেছি
মাধব ঢালি পাহারা দিচ্ছিল রাজবাড়ির সদর দরজায়। একমুখ দাড়ি-গোঁফ। মাথায় গামছা বেঁধে, সড়কি আর লাঠিটা পাশে পাশে রেখে একটু বুঝি ঢুলছিল। একবার খুট করে শব্দ হতেই বাঘের মতো লাফিয়ে উঠেছে।
কে?
দুর্গা আঁচলের আড়াল দিয়ে মরালীকে নিয়ে আসছিল। বললে–দূর মুখপোড়া, চেঁচাচ্ছে দেখো, তোকে বলে গেলাম না–
তারপর মাধব ঢালির পাশ দিয়ে যাবার সময় বললে–সরে দাঁড়াতে পারিসনে, মেয়েমানুষের গায়ে ঢলে পড়বি নাকি মুখপোড়া
তখনও ভেতরের বারমহলের উঠোনে ঢোকেনি। হঠাৎ মনে হল যেন ঘোড়র পায়ের শব্দ কানে এল। দুর্গা মরালীকে আড়াল করে বুড়োশিবের মন্দিরে এসে দাঁড়াল। তারপর একবার চারদিকে চেয়ে নিয়ে পা বাড়াল। অতিথিশালার ভেতরে কেউ আছে কি না কে জানে। ভোগবাড়ির দিকেও সমস্ত অন্ধকার। দক্ষিণ দিকের দরজাটা খোলা রেখেছিল দুর্গা। সেটা পেরিয়ে ভেতরবাড়ির ছোট গড়বন্দি। সেখানে তখনও টিমটিম করে আলো জ্বলছিল।
দুর্গা বললে–আয়, তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে আয়, কেউ দেখে ফেলবে—
মরালী বললেও কীসের শব্দ দুগ্যাদি? ছোটমশাই বুঝি?
দূর, ছোটমশাই তো মহিমাপুর গেছে
কেন?
দুর্গা বললে–ডিহিদারের পরওয়ানা এসেছে
কীসের পরওয়ানা?
তা জানিনে, তুই চুপ কর, কেউ জানতে পারলে তুইও মরবি আমিও মরব–
তারপর কয়েকবার ঝনঝন করে দরজার হুড়কো খোলার শব্দ হল। আলো, ফিসফিস কথা, হাঁক-ডাক, সিঁড়িতে ওঠা-নামা। অন্ধকার সিঁড়ির তলায় একটা ঘরে মরালীকে পুরে দিয়ে দুর্গা বললে–এখানে থাক তুই, আমি দরজায় তালা চাবি দিয়ে যাচ্ছি, কিচ্ছু ভাবিসনে, আমি এক্ষুনি আবার আসব—
*
মেহেদি নেসার খানদানি লোক। তামাম মুর্শিদাবাদে মেহেদি নেসারের নাম জানে না, এমন মানুষ পাবে না। মেহেদি নেসার মানেই খেলাত মির্জা মহম্মদ নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা। যারা নেহাত গরিব মানুষ, তারা নবাব পর্যন্ত পৌঁছোতে পারে না। শুধু নবাব কেন, নবারের কাছারি পর্যন্তও পৌঁছাতে পারে না। কারও বাড়িতে চুরি হয়েছে, কারও স্বামীকে কোতোয়াল গ্রেপ্তার করেছে, দারোগা-ই-আদালতে গিয়ে ফরিয়াদ কবুল করতে হবে। কিন্তু তার আগে টাকা দাও। টাকা দিলে তবে তোমার আর্জি পেশ হবে। আর কত টাকা দিতে হবে, তারও আইন কায়েম আছে নিজামত-কাছারিতে।
সেরেস্তায় গেলেও সেই একই নিয়ম। খাসনবিশ থেকে শুরু করে পরগনা কানুনগো আর পেশকার মুনশি মোহরার পর্যন্ত সবাই বাঁ হাতটা পেতেই বসে আছে। বলে টাকা দাও তবে খালাস দেব।
লোকে মিনতি করে বলে–জনাব, আগে আর্জিটা তো নেন, তার পরে আপনার পাওনা-গণ্ডা যা লাগে দেব
হুজুর-নবিশরা চটে যায়। বলে–পাওনাগণ্ডা আবার বাকিতে চলে নাকি?
গরিব প্রজারা তবু পীড়াপীড়ি করে, বলে পরে দেব হুজুর, পরে দেব, এবার খেতের ধান বেচেই আপনার পাওনা-গণ্ডা মিটিয়ে দেব
কিন্তু এত ল্যাঠায় দরকার কী! সোজা যদি কোনওরকমে মেহেদি নেসারকে ধরতে পারো তো তুমি যা চাও, তাই পাবে। আকাশের আফতাব থেকে শুরু করে ইদের চাঁদ পর্যন্ত আদায় করে দিতে পারে মেহেদি নেসার। আর যদি মেহেদি নেসার পর্যন্ত না পৌঁছোতে পারো তো সেরেস্তার মুনশি মোহরার মনসুর আলি মেহের সাহেব পর্যন্ত পৌঁছোত পারলেই চলবে। আর যদি তা-ও না পারো তো বশির মিঞা আছে। বশির মিঞার ফুপা মনসুর আলি মেহের। বশির মিঞা চেষ্টা করলেও তোমার আর্জি হাসিল করতে পারে।
আসলে নবাব-নিজামতে কেতাদুরস্তের কোনও কমতি নেই। পাঠানদের সময়ে যা-থাক তা-থাক, কিন্তু মোগল আমলে কানুন কায়দার সবকিছু আছে। নায়েব সুবাদার আছে, দারোগা-ই-আদালত আছে, সিপাহশালার আজম আছে, খাসনবিশ, হুজুরনবিশ, দারোগা কাছারি, আমিন কাছারি, ফৌজদার, থানাদার, ডিহিদার, কোতোয়াল, কোতোয়াল-ই-দাগ সবই আছে। কিন্তু এসব ডিঙিয়েও তুমি আর্জি হাসিল করতে পারো, যদি মেহেদি নেসার তোমার সহায় হয়। মেহেদি নেসারের সবচেয়ে বড় গুণ, সে খেলাত মির্জা মহম্মদের ইয়ার। নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলার দোস্ত।
মেহেদি নেসার খুশি হলে হুকুম তো হুকুম, হাকিমও নড়ে যায়।
সেই মেহেদি নেসারের কাজের মধ্যে কাজ সকালবেলা নাস্তা করেই মির্জা মহম্মদের সঙ্গে মোলাকাত করা। আর যতদিন বুড়ো আলিবর্দি বেঁচে ছিল, ততদিন তো মেহেদি নেসারকে কেউ পরোয়া করেনি। কিন্তু এখন? এখন তামাম দুনিয়ার দৌলত মেহেদি নেসারের মুঠোর মধ্যে। এখন মেহেদি নেসারের এক কথায় জমিদারদের নসিব ওঠে আর নামে।
মুর্শিদাবাদের রাস্তায় মেহেদি নেসারের পালকি চলেছে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে। বেহারারা হুম হাম করতে করতে চলেছে। সামনে তোক দেখে হাঁকে হুঁশিয়ার
মেহেদি নেসার সারা রাত মহফিল করেছে কাল। ইয়ার-দোস্তদের নিয়ে খানাপিনা করেছে। কিন্তু মহফিল তেমন জমেনি। জুতসই হয়নি নেশাটা। মির্জার মাথায় যত বদ ভাবনা ঢুকেছে। মেহেদি নেসার মির্জাকে বলেছে–আরে এখন তুই গদি পেয়েছিস, এখন কাকে ডরবি তুই? ওই ফিরিঙ্গিদের? তুই অত ডরপোক কেন রে? আমাকে বল, আমি ওই শালা উমিচাঁদকে শায়েস্তা করে দিচ্ছি। ও শালা দুমুখো সাপ। ও তোরও খাবে, ফিরিঙ্গিদেরও খাবে। ওকে আমি এখুনি ঢিট করে দিতে পারি। ফুর্তির সময় ওসব কথা ভাবিসনি, ওতে টাকাও নষ্ট, মহফিলও নষ্ট
নাচ হয়েছে, পান হয়েছে, সরাব হয়েছে। তবু মির্জার মন ওঠেনি।
মির্জা বলেছে–এবার খতম করে দে ইয়ার, ঘুম পাচ্ছে
ঘুম পাচ্ছে? সেকী রে? বাংলা মুলুকের নবাব ঘুমোবে কী রে? তোরই তো দুনিয়া। দিল্লির বাদশা তো তোর কাছে জবাবদিহি চাইছে না। খাজনা পাঠাতেও বলছে না। আর আলিবর্দি খাঁ কখনও দিল্লির দরবারে খাজনা পাঠিয়েছে? এখন আলমগির বাদশা আছে দিল্লির তখত-এ-তৌস-এ যে ভয় পাচ্ছিস?
তবু কিছুতেই জমেনি মহফিল। মির্জা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে গেছে। নবাবের আবার অত বেগমের ওপর টান কেন? নবাব তো নবাব সুজাউদ্দিন খাঁ, নবাব তো নবাব সরফরাজ খা। ফুর্তি করতে জানত, মহফিল করতে জানত। সেসব দিনের কথা শুনেছে মেহেদি নেসার। নবাব সুজাউদ্দিন বুড়ো বয়েস। পর্যন্ত ফুর্তি করে গেছে নবাবের বাচ্চার মতো। হ্যাঁ, জানত কাকে বলে হররা। ইরান তুরান থেকে জেনানারা আসত সুজাউদ্দিনের ফররাবাগে হোলির দিন। নবাব মসনদ ফেলে রেখে হোলি খেলত সুন্দরীদের সঙ্গে। সঙ্গে থাকত বেগমরা। দুনিয়ার সেরা সব রূপসি। নবাবি দেখত দেওয়ানই আলা, দেওয়ান-খালসা-শরিফা আর নায়েব সুবাদাররা। যেদিন নবাবের জন্মদিন পড়ত, সেদিন তুলট হত। সেদিন ইয়ারবকশিরা ইনাম পেত, খেলাত পেত, বকশিশ পেত। আর সরফরাজ খা? সরফরাজ খা তো। গদি পেয়েই ফররাবাগে হররা উড়িয়ে দিয়েছিল। নিজের মেয়েমানুষের অসুখ হলে সরফরাজ রোজা রেখে মাথায় কোরান নিয়ে টাটা রোদের তলায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত। আর তুই নবাব হয়েছিস কি লড়াই করবার জন্যে? লড়াই-ই যদি করবি তো বাংলার মসনদ নিয়ে কেন?
হঠাৎ পালকিটা দুলে উঠতেই মেহেদি নেসার চমকে উঠেছে কে?
পালকি-বেহারারা পালকি থামিয়ে বললে–খোদাবন্দ
আর দেখতে হল না। একেবারে চকবাজারের মধ্যিখানের রাস্তা। চার দিকে প্রজাদের ভিড়। একটা কসাইখানার পাশে মস্ত গর্ত। তারই ওপর পায়ে হোঁচট খেয়ে একজন বেহারা পড়ে গেছে। পা ভেঙে গেছে। বোধহয়। আর উঠতে পারছে না। পালকিটা আর-একটু দুললেই মেহেদি নেসারের পালকি উলটে যেত।
ক্যা হুয়্যা?
হুজুর খোদাবন্দ, পা ভেঙে গেছে ওর, উঠতে পারছে না–
উঠতে পারছে না মানে? তা হলে কি পালকি চলবে না? মেহেদি নেসার এই বাজারের ময়লা গলির মধ্যে আটকে পড়ে থাকবে? ওঠ উল্লকা-পাটঠা! ওঠ–চল জলদি
লোকটা হাত জোড় করে কাদো কাদো হয়ে ক্ষমা চাইল।
মেহেদি নেসার রেগে তখন টং। একে কাল রাতে মহফিল জমেনি, তার ওপর এই ছোটলোকের দিগদারি। চাবুকটা পালকি থেকে নিয়ে এসে পিঠের ওপর সপাং-সপাং করে বসিয়ে দিতে লাগল।
সপাং সপাং সপাং
হুজুর খোদাবন্দ
আর কোনও কথা নয়। মেহেদি নেসারের সঙ্গে দিল্লাগি। আবার সপাং সপাং সপাং।
আশেপাশে রাস্তার লোকের অনেক ভিড় জমেছিল। মেহেদি নেসার একজনের গর্দানটা খপ করে ধরে ফেললে। তারপর জোর করে পালকিতে জুতে দিয়ে বললে–চল, লে চল–
মানুষ নয় তো সব। শুয়োরের বাচ্চা। শুয়োরের বাচ্চার মতো রাস্তার ওপর পিলপিল করে পয়দা হচ্ছে সব। রেইস আদমিদের নড়বার জায়গা নেই, রাস্তায় চলবার পর্যন্ত উপায় নেই। রাস্তায় সবাই হাঁ করে মজা দেখতে বেরিয়েছে। নতুন লোকটা মামলার নথি নিয়ে কানুনগো কাছারিতে এসেছিল দরবার করতে। তিন দিন ধরে হেঁটে হেঁটে সদর কাছারিতে এসেছিল। হঠাৎ মামলা করা ঘুচে গেল, পালকি বয়ে নিয়ে যেতে হল।
নটবর!!
নটবর বেহারাদের সর্দার। মেহেদি নেসারের তলব পেয়েই পালকির দরজার মুখে এসে দাঁড়াল।
ও ছুকরিটা কে রে? জানিস?
কোন ছুকরিটা হুজুর?
ওই যে চৌকের পাশে একটা বাড়ির ঘুলঘুলি দিয়ে এদিকে চেয়ে দেখছিল? খোঁজ নিস তো কার মেয়ে! ওর বাপ কী করে?
এসব ইঙ্গিত বুঝতে পারে নটবর। বললে–হুজুর, বলেন তো কালকে মতিঝিলে হাজির করব?
পারবি?
বান্দা কী না পারে!
মির্জা মহম্মদ বড় মুষড়ে পড়েছে কদিন। আবার নয়া দাওয়াই দিতে হবে। নবাবজাদাদের এই মুশকিল। গদিতে বসবার পর থেকে কেবল ভাবছে কোথায় কী হচ্ছে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও স্বপ্ন দেখছে, কে বুঝি চাকু মারল কলিজায়। কোথায় মহম্মদাবাদ, বাংলা, ঘোড়াঘাট, সোনারগাঁতে কী ঘটছে, অমনি টনক নড়ে ওঠে। সেই জন্যেই তো মেহেদি নেসার ফুর্তির মধ্যে ডুবিয়ে রাখতে চায় মির্জাকে। এত ভাবলে মারা যাবি যে! সে কথা বুঝত নবাব সুজাউদ্দিন খাঁ, সরফরাজ খাঁ। নবাব আলিবর্দি খাঁ বোঝেনি, তাই জিন্দগি-ভর কেবল লড়াই করতে হয়েছে। লড়াই করতে করতেই জওয়ানি বরবাদ হয়ে গেছে।
বাজার পেরিয়েই গঙ্গা। পালকির দরজার ফাঁক দিয়ে গঙ্গা দেখা যায়। গঙ্গায় নৌকো চলেছে দাঁড় বেয়ে বেয়ে। হঠাৎ একটা নৌকোর দিকে চেয়েই কেমন চমকে উঠল মেহেদি নেসার সাহেব। চেনা চেনা যেন নৌকোটা। ছাড়ের নৌকো। ময়ূরপঙ্খীর গলুই। তার লাগোয়া ছইঢাকা ঘর। তার সামনেই একজন বসে আছে।
নটবর।
নটবর আবার সামনে এল। মেহেদি নেসার জিজ্ঞেস করল–ওটা কার বজরা যায় রে নটবর? হাতিয়াগড়ের জমিদার না?
আজ্ঞে হ্যাঁ হুজুর, আপনি ঠিক বলেছেন।
মেহেদি আবার ভাবতে লাগল। রাত্রে এসেছে, সকালবেলা চলে যাচ্ছে। সব ওই জগৎশেঠজির কাণ্ড! জগৎশেঠজির কাছে দরবার করতে এসেছিল। বাংলা মুলুকের যত জমিদার সব জগৎশেঠজির দলে। সবাই নিমকহারামি করতে চাইছে।
পালকিটা মতিঝিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। যথারীতি যারা ফটকে পাহারা দিচ্ছিল তারা হাত তুলে আদাব করল। পালকি আরও ভেতরে চলল। লম্বা ঝিল। ঝিলের শেষে শ্বেতপাথরে বাঁধানো চবুতর। মেহেরুন্নিসা বেগম বানিয়েছিল। জাহাঙ্গিরাবাদের টাকা দিয়ে জলের মতো খরচ করেছে মতিঝিল বানাতে, রাজবল্লভ পেছনে আছে। শালারা ভেবেছিল মির্জা ছেলেমানুষ, কিছু বোঝে না। সামনের সিংফটক দিয়ে ঢুকেই বড় দোতলা কুঠি। মাথার ওপর নহবতখানা। কাল অনেক রাত পর্যন্ত এখানেই মহফিল হয়েছিল মেহেদি নেসারদের। মেহেদি নেসার সিঁড়ি দিয়ে সোজা ওপরে উঠতে লাগল। বড় ঘরটার মাথায় আলোর ঝড় ঝুলছে। কালকের মহফিলের সব চিহ্নই সাফ করে ফেলেছে বান্দারা। মেহেদি নেসার সাহেব আবার তাকিয়া-ফরাসের ওপর কাত হয়ে পড়ল। হুজুতেই কাটল ক’টা দিন।
সামনে দরজার বাইরে পায়ের আওয়াজ হতেই মেহেদি নেসার সাহেব বললে–দে দে, শরবত দে
তারপর ভাল করে দেখে বুঝলে শরবত নয়, মনসুর মেহের আলি মোহরার এসে হাজির। সামনে এসে মাথা নিচু করে তিনবার হাত ঠেকালে মাথায়।
আমাকে ডেকেছেন হুজুর?
কী খবর পেলি তুই? মিরজাফর সাহেবের হালচাল কী? বশির কোথায়?
বশির মিঞা বোধহয় আড়ালেই ছিল। তার নাম উঠতেই সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকে কুর্নিশ করলে হুজুর, খবর সব বিলকুল ঠিক হ্যায়। দেওয়ান-ই-আলা মিরজাফর সাহেব…
বাধা দিয়ে মেহেদি নেসার সাহেব বললে–দূর বেল্লিক, মিরজাফরকে আবার দেওয়ান-ই-আলা বলছিস কেন? ও তো বরখাস্ত হয়ে গেছে। এখন কী করছে তাই বল। কার সঙ্গে শলা-পরামর্শ করছে তাই স্রেফ বল? নজর রাখছিস?
হ্যাঁ জনাব, রাখছি? মিরজাফর খাঁ সাহেবের বাড়ির সামনে চর রেখেছি, জগৎশেঠজির বাড়ির সামনে ভি চর রেখেছি। কলকাতায় বেভারিজ সাহেবের বাড়ির সামনে ভি রেখেছি, উমিচাঁদের বাড়ির সামনেও নজর রাখবার জন্যে চর রেখেছি, আমি খুদ নিজে ভি ঘুমছি তামাম বাংলা মুলুক–
তারপর একটু থেমে বললে–কিন্তু হুজুর, একটা বাত আছে, ওই ভিখু শেখ শালা বেল্লিকের বাচ্চা বড় খতরনাক আদমি হুজুর, শালা হারামি আমাকে কুত্তার বাচ্চা বলে গালাগালি দেয়–
কে ভিখু শেখ? ভিখু শেখ কে?
আজ্ঞে হুজুর, ওই জগৎশেঠজির ফটকের সেপাই—
ওই পাঠানটা?
জি হাঁ, হুজুর!
আচ্ছা তুই যা,–
বলে মেহেদি নেসার সাহেব মোহরার মনসুর আলি মেহেরের দিকে চাইলে। তারপর হঠাৎ কী মনে পড়ে গেল। আবার ডাকলে–শোন বশির
বশির ঘুরে দাঁড়াল। মেহেদি নেসার সাহেব বললে–ারে, হাতিয়াগড়ের জমিদার কেন এসেছিল রে মুর্শিদাবাদে? আজ তার বজরা দেখলুম। মহিমাপুরের দিক থেকে আসছে। জগৎশেঠজির কাছে গিয়েছিল নাকি শল্লা করতে?
কই, না হুজুর, আমি তো জগৎশেঠজির বাড়ির সামনে নজর রাখার ইন্তেজাম করেছি, কেউ তো আসেনি সেখানে
কেউ আসেনি?
না হুজুর,–
মিরজাফর আলি, হলওয়েল, ওয়াটস, ব্যাটসন, কলেট, উমিচাঁদ, কি কোনও জমিদার, জায়গিরদার, পাট্টাদার, তালুকদার, কেউ না?
আজ্ঞে হুজুর, সে তো আসছে হুন্ডি কাটাতে। তারা তো হামেশা আসছে!
নিজামতের মহাফেজখানা কি সেরেস্তার কেউ যাচ্ছে?
না, কেউ যাচ্ছে না হুজুর!
তারপর আসল কথাটা মনে পড়ল এতক্ষণে। ভেতর থেকে মতিঝিলের খিদমদগার এক গেলাস ঠান্ডা শরবত এনে দিয়েছিল। তাতে একবার চুমুক দিয়ে বললে–আর সেই হাতিয়াগড়ের রানিবিবির কী হল? ডিহিদারের পরওয়ানা পৌঁছে গেছে।?
একেবারে ভুলে গিয়েছিল বশির মিঞা একথাটা। ইস! লজ্জায় মাথা কাটা গেল বশির মিঞার। তামাম বাংলা মুলুকের জাসুসি কাজ একলা বশির মিঞার মাথার মধ্যে। দুনিয়ার কাজ সব তার ঘাড়ে। ক’টা দিকে দিকদারি করবে সে। সেই কবেকার ব্যাপার। এখনও কোনও বন্দোবস্ত করা হয়নি। তখন বুড়ো নবাব বেঁচে। মির্জা মহম্মদের শাদির সময় মুর্শিদাবাদের ভিড় ছিল দেখবার মলে। জলের মতো টাকা উড়িয়েছিলেন আলিবর্দি খাঁ। সারা মুলুক ঝেটিয়ে জমিদাররা এসেছিল এখানে। জিন্নতাবাদ, চাঁড়া, ফতেবাদ, মহম্মদাবাদ, বাকলা, পূর্ণিয়া, তাজপুর বাজুহা, হাতিয়াগড়–সব সরকারের জমিদাররা এসে জুটেছিল এখানে। মুর্শিদাবাদের ঘাটে বজরার গাদি লেগে গিয়েছিল। মেহেদি নেসার তখনই প্রথম দেখেছিল হাতিয়াগড়ের রানিবিবিকে। নয়া জওয়ানি মেয়ে। চোখ দুটো যেন আসমানের জমিন। মেঘ-মেঘ রোদ-রোদ। বজরার খিড়কির ভেতর দেখা। মির্জাকেও দেখিয়েছিল। বলেছিল–ইয়া আল্লা, ওকে চাই ইয়ার। খোঁজ নাও কে ও! মেহেদি নেসারও সব খোঁজখবর নিলে। জানা গেল হাতিয়াগড়ের দোসরা তরফের রানিবিবি। আগের রানির বাচ্চা পয়দা হয়নি বলে দোসরা বিবি ঘরে এনেছে। তা হোক, তাতে মির্জার ইয়ারের কোনও লাভলুকসান নেই। আরে, আওরতের আবার জাত-বিচার কী! যেমন মসনদ হল মসনদ, তেমনি আওরত হল আওরত। মসনদ কেড়ে নিতে পারলেই নিজের। আলিবর্দি খাঁ মুর্শিদাবাদের মসনদ কেড়ে নিতে পেরেছিল সরফরাজ খাঁকে খুন করে। তাই তা তার নিজের হয়েছে। মেয়েমানুষও তেমনি। কেড়ে নিতে পারলে আমি তোমার। আবার আমাকে যে কেড়ে নেবে আমি তার হব। মসনদ মেয়েমানুষ টাকা–এদের তো এই-ই কানুন।
মনসুর আলি মেহের সাহেব তখনও দাঁড়িয়ে ছিল।
তুই আবার ঝুটমুট দাঁড়িয়ে কেন?
আজ্ঞে, আপনি কিছু ফরমায়েশ করুন
মেহেদি নেসার বললে–সেরেস্তায় যা-কিছু শুনবি, সব আমাকে বলে যাবি। মোহনলাল দেওয়ান-ই-আলা হয়েছে বলে সকলের বুক জ্বলছে খুব, না?
আজ্ঞে, না হুজুর।
হলে বলে যাবি আমাকে। রাজবল্লভটা কাফের বাচ্চা, ওটাকেও শায়েস্তা করতে হবে। আর ওই বাঁদির বাচ্চা, মেহেরুন্নিসা, ঘসেটি বেগম! সকলকে শায়েস্তা করে তবে দেওয়ানি কাবিল করব। তুই যা–
ততক্ষণে একটু নেশার ঘোর লেগেছে নেসারের মগজে। একটু একটু করে লাল হয়ে আসছে চোখ। এমনি লাল আরও লালচে হবে। যত বেলা বাড়বে তত মেহেদি নেসার সাহেব রঙিন হয়ে উঠবে। সারা মতিঝিলে তখন রোশনাই জ্বলে উঠবে। মতিঝিল যেন বুঝতে পারে সব। মতিঝিলেরও যেন প্রাণ আছে। এই মতিঝিলে কত রোশনাই হয়েছে একদিন। এখানেই রাজবল্লভ এসে চুপি চুপি বুড়ো নবাবের বড় মেয়ে ঘসেটি বেগমের সঙ্গে রাত কাটিয়েছে। আবার সেই বিছানা থেকেই ঘসেটি বেগম মাঝরাতে উঠে গিয়ে শুয়েছে হুসেনকুলি খাঁ’র ঘরে। এখানকার প্রতিটি পাথরে যেন আলিবর্দির পাপের দাগ লেগে আছে। তুমি একদিন তোমার অন্নদাতাকে মেরেছ, তোমার অন্নদাতার একমাত্র ছেলে সরফরাজকে খুন করেছ। তোমার পাপের কি শেষ আছে জাঁহাপনা! তুমি কেবল রাজনীতিই মেনেছ, আর কোনও নীতিই তো মানোনি। তাই চোখের সামনে দেখেছ তোমার মেয়েদের কীর্তি-কেচ্ছা। তারপর আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে আরও দেখে যেতে পারতে! দেখে যেতে পারতে নজর আলির কীর্তি। তখন ঘসেটি বেগমের এই মতিঝিল তোমার নাতির অত্যাচারে থরথর করে কাঁপছে। তোমার বড় আদরের মির্জা মহম্মদ হুকুম দিয়েছে মতিঝিল লুট করে যা পাবে নিয়ে আসবে। ঘসেটি বেগমের অনেক টাকা, অনেক দৌলত, অনেক ঐশ্বর্য। জাহাঙ্গিরাবাদের সব টাকা নিয়ে এখানকার সিন্দুকে লুকিয়ে রেখেছে। একদিন রাত থাকতে নবাবি ফৌজ গিয়ে সকালবেলা মতিঝিল ঘিরে ফেললে।
তখনও বুঝি ঘসেটি বেগমের ঘুম ভাঙেনি। নবাব-বেগমদের সকাল সকাল ঘুম ভাঙা যেন অপরাধ। আর সকাল সকাল ঘুম ভাঙবেই বা কেন? কীসের দায়? কিন্তু ঘুম ভেঙেছে নজর আলির। নজর আলি সত্যিই নজর আলি। মেয়েরা তার দিকে একবার নজর দিলে আর চোখ ফেরাতে পারে না। হুসেনকুলি খার চেয়েও সুন্দর দেখতে। চারদিকে নবাবি ফৌজের নিশানা টের পেয়েই ঘুম ভেঙে গেছে। তাড়াতাড়ি পিরেন-পায়জামা সামলে নিয়ে ঘসেটি বেগমকে ডাকতে লাগল–মেহেরুন্নিসা, মেহেরুন্নিসা
ঘসেটি ধড়ফড় করে উঠেই সব দেখে শুনে তাজ্জব হয়ে গেছে।
কী হবে এখন নজর? মির্জা তো সহজে ছাড়বে না।
ততক্ষণে নবাবি ফৌজ তোপ দাগবার জন্যে তৈরি হয়ে গেছে। মতিঝিলের আমলা-নোকর-নোকরানিরা সবাই ভয় পেয়ে যে-যেদিকে পারে দৌড়োচ্ছে।
মিরজাফরকে খবর দেব?
নজর আলি বললে–তাকে এত্তেলা দিলে কিছু হবে না, মোহনলালকে হাত করতে হবে। সে-ই তো এখন সেপাহশালার
তা হাত করো না, কত টাকা লাগবে মোহনলালকে হাত করতে?
নজর আলি জিজ্ঞেস করলে কত টাকা আছে তোমার কাছে এখন?
তা কি মনে আছে না গুনে রেখেছে ঘসেটি বেগম। তাড়াতাড়ি সিন্দুক খোলা হল। জাহাঙ্গিরাবাদের দেওয়ানি করা টাকা। শুধু টাকাই নয়, সোনা আছে, মুক্তো আছে, হিরে আছে, চুনি পান্না মতি সব আছে ঘসেটি বেগমের। সব তুলে নিলে নজর আলি। টাকাও নিলে গয়নাও নিলে। সব দিতে হবে মোহনলালকে। যে যা চাইবে তাকে তাই দিতে হবে। বারো লাখও হতে পারে পনেরো লাখও হতে পারে। সেই টাকা নিয়েই সেই ভোরবেলা বেরিয়ে গেল নজর আলি। বললে–আমি ফিরে আসছি মেহেরুন্নিসা বিবি, তুমি ঘাবড়িয়ো না–
সে নজর আলি তারপর আর আসেনি। ঘসেটি বেগম যাকে পেরেছে দু’হাতে টাকা বিলিয়েছে তার মতিঝিল বাঁচাবার জন্যে। কিন্তু মতিঝিল বাঁচেনি। আজও দুপুরবেলা মাঝে মাঝে বোধহয় তাই। মতিঝিলের চোখে তন্দ্রা নামে আর তার মধ্যে খাপছাড়া স্বপ্ন দেখে।
কৌন?
কোথায় যেন একটা গোলমাল উঠল। মতিঝিলের ঘরগুলোর মধ্যে যেন আর্তনাদ করে উঠল কেউ! মেহেদি নেসারের তন্দ্রা ভেঙে গেল। কৌন? কে? নজর আলি কি আবার ফিরে এল ফৌজ নিয়ে। দুপুরবেলার মতিঝিলে তো এত আওয়াজ হওয়ার নিয়ম নেই। তবে কি মির্জার ভাই শওকত জঙ? পূর্ণিয়া থেকে নবাবির খবর পেয়ে দৌড়ে এসেছে? নাকি কাশিমবাজার কুঠির ওয়াট। ফিরিঙ্গিদের পলটন নিয়ে সোজা গঙ্গা বেয়ে এসে হাজির হয়েছে মতিঝিলে।
নেশার মধ্যেই উঠে দাঁড়াল নেসার। মৌতাত এরা জমাতে দেবে না কেউ।
খোদাবন্দ!
মেহেদি নেসার চোখ তুলে দেখলে, মতিঝিলের সেপাইরা কাকে ধরে এনেছে। সমস্ত শরীর দিয়ে ঝরঝর করে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। পেছনে পেছনে মতিঝিলের নোকর-নোকরানি বান্দা-খোঁজা সবাই এসেছে।
হুজুর, একে খুন করে ফেলেছি।
মেহেদি নেসার চিৎকার করে উঠল–কে এ? কী করেছিল?
হুজুর, এর নাম কাশেম আলি। লস্করপুরের তালুকদার। নিজামত আদালতে পেশক দিতে এসেছিল, চকবাজারের কাছে হুজুর আপনার পালকিতে জুতে দিয়েছিলেন, তাদের সঙ্গে সঙ্গে একেবারে মতিঝিলের অন্দরে ঢুকে পড়েছিল–মনে হচ্ছে মতলব খারাপ। সিঁড়ির নীচে লুকিয়ে ছিল, তাই কোতল করে দিয়েছি–
বেশ করেছিস! আচ্ছা করেছিস!
লোকটার দিকে আবার চাইলে মেহেদি নেসার। সারা শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। লোকটাকে ধরে জুতে দিয়েছিল পালকিতে। একটা কথা পর্যন্ত বলেনি, প্রতিবাদও করেনি তখন। এখন মনে হল যেন কথা বলতে চাইছে। যে-কথা হুসেনকুলি খাঁ বলতে চেয়েছিল মরবার সময়, সেই কথা বলবার জন্যেই যেন লস্কপুরের তালুকদার কাশেম আলিও নড়ে নড়ে উঠছে। তামাম বাংলা মুলুকের মুখের কথা একা সে-ই মরার আগে বলে যাবে।
ওরে, নড়ছে যে, কোতল কর, কোতল কর ওকে এখনও জিন্দা আছে–
আর নিজের চিৎকারে নিজেরই ঘুম ভেঙে গেছে মেহেদি নেসারের। মতিঝিলেরও ঘুম ভেঙে গেছে। চারদিকে লাল চোখ দিয়ে চেয়ে দেখলে মেহেদি নেসার। কেউ কোথাও নেই। এতক্ষণ কেবল স্বপ্ন দেখছিল তবে! মিছিমিছি ভয় পেয়ে গিয়েছিল মেহেদি নেসার। মুর্শিদাবাদের চেহেল্-সুতুন কায়েম হয়ে গেছে, মসনদও কায়েম হয়ে গেছে। ঘসেটি বেগম, মিরজাফর, ওয়াটস, ফিরিঙ্গি কোম্পানি, শওকত জঙ, সব খতম। এবার আর কীসের ভয়। কাকে ভয়? মেহেদি নেসার হল–শরবত
খিদমদগার হঠাৎ ঘরে ঢুকেছে–হুজুর, নবাবের তাঞ্জাম এসেছে—
২.০২ হাতিয়াগড়ের অন্ধকার
সেদিন সেই হাতিয়াগড়ের অন্ধকার ঘরের চারটে দেয়ালের মধ্যে গাঁয়ের একটি মেয়েই শুধু পালিয়ে আসেনি। পালিয়ে এসেছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রাণলক্ষ্মীও। মাঠে ঘাটে একদিন যে-লক্ষ্মী বায়ু হয়ে অগ্নি হয়ে জল হয়ে ঘরে ঘরে ক্ষুধা তৃষ্ণা কামনা বাসনা মিটিয়েছে, পৌষের শিশির হয়ে, বৈশাখের রৌদ্র হয়ে, নীড়ের শান্তি, গৃহকোণের স্নেহ, পিতার আশীর্বাদ, মায়ের বাৎসল্য, স্বামী-স্ত্রীর প্রেম হয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী প্রাণরস জুগিয়েছে, তার বুঝি শেষ হল। একদিন ধর্মপাল-দেবপালের দেশে যে সূর্য উঠেছিল, বখতিয়ারের আবির্ভাবে সেই সূর্যই বুঝি মধ্য আকাশে ভাস্বর হয়ে উঠেছিল তারপর। তখনও মানুষকে ঘর ছেড়ে বেরোতে হয়নি। গৌড়ের সিংহাসনে বাংলার প্রাণলক্ষ্মী নিরাপদই ছিল সেদিন। পঞ্চাশ বছরের ইলিয়াস-শাহি বাদশা বাংলার বুকে অচল-অটল হয়ে বসে ছিল। হিন্দুদের হিন্দুত্ব বজায় ছিল, তবু গৌড়ীয় সুলতানদের তাতে কিছু এসে যায়নি। গঙ্গা যমুনার মধ্যে সপ্তগ্রামে এসে জাহাজ। ভিড়ত। তিন দিনারে দুগ্ধবতী একটা গোরু, এক দিরহামে আটটা মুরগি, দুই দিরহামে একটা ভেড়া। দুই দিনারে তিরিশ হাত মসলিন, আর নগদ একটা মোহর দিলে সুন্দরী একটি মেয়ে বাঁদি। যারা এখানে। এসেছে তারা সস্তার বহর দেখে অবাক হয়ে গেছে। এখানে চাঁদ উঠেছে রাত্রে আর ধানের খেতে বাড়ির চালে আর রাজার প্রাসাদে তা সমান হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। অম্বুবাচীর দিন সিদ্ধান্তবারিধিরা শাস্ত্রের নির্দেশ দিয়েছেন, রোজার দিন নির্দেশ দিয়েছেন মৌলানা-মৌলবিরা। হাঁচি কাশি টিকটিকি চামচিকে নিয়ে জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ নিষ্পন্ন হয়েছে নির্বিঘ্নে। শোক দুঃখ আনন্দ নিয়ে জীবন এগিয়ে গেছে অব্যাহত। কিন্তু তখনও প্রাণলক্ষ্মী চঞ্চল হয়নি। দোল দুর্গোৎসব চড়কের গাজনে বারবার উজ্জীবিত হয়েছে। বাংলার সেই প্রাণরস।
কিন্তু এবারই প্রথম নিরুদ্দেশ হয়েছে সে। সেই মরালী।
বাবুদের পাঁচমহলা গড়বন্দি বাড়িতে সে এসে উঠল এবার। কেউ জানতে পারলে না। না মাধব ঢালি, না হরিপদ, না গোকুল, না শোভারাম, না উদ্ধব দাস, না কান্ত, না বশির মিঞা, কেউ নয়। মেহেদি নেসার, মনসুর আলি, হরিপদ, নয়ানপিসি, এমনকী ছোটমশাইও জানতে পারলে না। সবাই তখন ঘুমিয়ে অজ্ঞান অচৈতন্য।
হঠাৎ শেষ রাত্রের দিকে বড় বউরানি ছোটমশাইয়ের ডাকে দরজা খুলে দিলেন।
কী হল? তুমি? কখন এলে?
এই এখুনি। মিরজাফর আলির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ফিরিঙ্গি হলওয়েল সাহেবও ছিল সেখানে।
জগৎশেঠজি কী বললে?
ছোটমশাই বললেন সব কথা আমি খুলে বললুম। আমি একলা নয়, মিরজাফর সাহেবও তো রেগে আছে নবাবের ওপর, ওকেও সরিয়ে দিয়েছে কিনা নিজামত থেকে। সেই জায়গায় নিজের শালা মোহনলালকে করেছে সিপাহশালার
বউ বউরানি বললেন–সে তো হল, কিন্তু এদিকে পরওয়ানার কথা কী বললে?
জগৎশেঠজি সব শুনলেন। তারপর বললেন, এসব মেহেদি নেসারের কাণ্ড, নবাবকে বলব–
বউ বউরানি রেগে গেলেন। বললেন–নবাবকে বললে–কী হবে? কিচ্ছু হবে না, বললে–না কেন? যেনবাব ইয়ারবকশিদের কথায় চলে তাকে বলে কী লাভ হবে! পরের মেয়েমানুষের দিকে যাদের লোভ তাদের হাতে রাজ্য পড়েছে আজকেও তো ডিহিদার ফৌজের সেপাই পাঠিয়েছিল–
কী বললে?
কী আবার বলবে, সেই পুরনো পরওয়ানা।
–আমি মুর্শিদাবাদে গিয়েছি জানতে পেরেছে নাকি?
বড় বউরানি বললেন–নায়েব মশাইয়ের হাতে পরওয়ানা দিয়ে গেছে, মাধব ঢালিকে জিজ্ঞেস করেছিল ছোটমশাই কোথায় সে বলে দিয়েছে তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ, তখন নায়েব মশাইকে গিয়ে পরওয়ানাটা দিয়েছে–
আমি মুর্শিদাবাদে গিয়েছি তা কেউ জানে না তো?
না, কে আর জানবে! কেউ জানে না।
তা হলে এখন কী হবে?
তা হলে কী যে হবে তাই-ই ক’মাস ধরে ভাবছেন ছোটমশাই। আবওয়াব মাথ আর নজর–এর সঙ্গেই যা-কিছু সম্পর্ক নবাবের। প্রাসাদের সুখসুবিধের দায়িত্ব সব জমিদারদের। নবাবের তা দেখবার দরকার হয় না। দেখবার সময়ও নেই। ডিহিদার, ফৌজদার, পরগনাদার আছে বটে। কিন্তু সে তো শুধু নবাবের স্বার্থ দেখতে। জমিদারদের স্বার্থ দেখতে হবে তাদের নিজেদেরই। এক-একদিন খাতাপত্র সুদ্ধ তলব করেন খাজাঞ্চিমশাইকে। বলেন–বড়মশাইয়ের সময় যেমন সব চলছিল, তেমনই চলা চাই খাজাঞ্চিমশাই
জগা খাজাঞ্চি বলে কিন্তু তেমন যে আর চলছে না–এখন যে সব আইনকানুন বদলে যাচ্ছে। প্রজারাও যে সব একটু জো পেলে চলে যাচ্ছে কলকাতায়। সেখানে সব সেপাইয়ের কাজ দিচ্ছে ফিরিঙ্গিরা
তা নবাব-সরকারে নালিশ করেছ? আমাদের উকিল বরদা মজুমদারকে চিঠি লিখে দাও তুমি, কিংবা সুবেদারের কাছে নালিশ পেশ করতে বলো তাকে
খাজাঞ্চিমশাই বলে–তাতে কিছু হবে না
আগে হত আর এখন হবে না কেন?
শুনছি লড়াই বাধবে।
লড়াই!
হাতিয়াগড় থেকে সব খবর প্রথম দিকে পাওয়া যেত না। তারপরে যেবার মুর্শিদাবাদ গেলেন নজর-পুণ্যাহের সময়, সেখানে গিয়েই সব খবর পেলেন। ফরাসিদের সঙ্গে ইংরেজদের ঝগড়ার কথা শুনলেন। মিরজাফরের সঙ্গে নবাবের ঝগড়ার কথা শুনলেন। উমিচাঁদের ব্যাপার শুনলেন। ওয়াটস্ সাহেবকে নিজামতে ধরে নিয়ে এসে অত্যাচারের কথাও শুনলেন। তারপর নিজের পরওয়ানার কথাও জানলেন। ডিহিদারকে দিয়ে মেহেদি নেসারই এই কাণ্ড করিয়েছে।
ডাকলেন—গোকুল—
গোকুল পেছনেই ছিল। বললেন–যা তো, নায়েবমশাইকে একবার ডেকে নিয়ে আয় তো।
রাত তখন বুঝি পুইয়ে আসছে। বজরায় সারারাত ভাল ঘুম হয়নি। সমস্ত শরীরটা টনটন করছে।
ওদিকে অন্ধকার ঘরের মধ্যে রাত্রি তখনও আকাশ-পাতাল ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঝনাত করে চাবিতালার শব্দ হতেই দরজা খুলে গেল। দুর্গা বলল–ভয় পেয়েছিলি নাকি মুখপুড়ি? যখন বলেছি তোকে বাঁচাব তখন কোনও ভয় নেই তোর ছোট বউরানিকে তাই বললুম
মরালী জিজ্ঞেস করলে ছোট বউরানি কী বললে–শুনে? বললে, দেখিস দুগগা, যেন সব্বোনাশ না হয়, বউ বউরানি যেন জানতে না পারে। আমি বললাম আমি ঠিক সামলে নেব–এই নে, তোর জন্যে ছোট বউরানির কাছ থেকে শাড়ি চেয়ে নিয়ে এসেছি, চেলি ছেড়ে এইটে পর খাবি কিছু? খিদে পেয়েছে?
মরালীর তখন সত্যিই চোখে জল এসে গেছে। সত্যি, এমন করে কে তার কথা ভাবে? দুর্গা আবার বললে–এখুনি তোর বরকে তোর কাছে এই ঘরে এনে দিতে পারি, দেখবি? মরালী অবাক হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলে কী করে? কিন্নরসাধন করে। কিন্নরসাধন-মন্তর পড়লে তোর বর এখুনি এসে পড়বে এখানে–মরালী বললে–না দুগগাদি, তোমার দুটি পায়ে পড়ি। বরের কাছে আমি আর যাব না দুর্গা বললে–দূর, তোর ওবর কেন রে, সেই বর, সেই কলকাতার বর। দেখবি কিন্নরসাধন মন্তর পড়লেই সেই বর এসে একেবারে এই ঘরের মধ্যে হাজির হবে, এসেই তোকে প্রাণেশ্বরী বলে জড়িয়ে ধরবে। তখন দুজনে গলাগলি জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকবি
মরালী বললে–কিন্তু আমার বড় ভয় করছে দুগগাদি, যদি কেউ দেখে ফেলে
দেখতে পাবে কেমন করে? এ-ঘরে কি কেউ আসে? এ-দিক কেউ মাড়ায় না। খিড়কির পুকুরের দিকে এ-ঘর। এখানে চেঁচিয়ে বললেও কেউ টের পাবে না। তোকে আমি এখানে ভাত এনে দেব, তুই থাকবি খাবি ঘুমোবি–তোর বরও থাকবে তুইও থাকবি–
মরালী কী ভাবতে লাগল আবার।
দুর্গা বললে–তোর বর তো এখন অতিথশালায় উঠেছে, এই আমার অতিথশালায়
কোন বর?
তোর কলকাতার বর লো। তুই রোস একটু, আমি ডেকে আনছি
এই ছোটমশাইয়ের অতিথশালায়?
হ্যাঁ লো, হ্যাঁ। এখেনে এসে উঠেছে। ওই বুড়ো ঘটকটা, নাপিত আর তোর বর, দাঁড়া আমি এখুনি ডেকে আনছি
দুর্গা চলে গেল। যাবার সময় আবার দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়ে গেল। মরালীর মনে হল সব যেন নিস্তব্ধ হয়ে এল চারিদিকে। সব চুপচাপ। জানালার পাশে কোথায় বুঝি একটা ঝিঁঝিপোকা শুধু শব্দের করাত দিয়ে বিকট শব্দ করতে করতে সে-অন্ধকার চিরে খানখান করে ফেলছে। এই সব অন্ধকার রাতেই মুর্শিদাবাদের নবাবের বিরুদ্ধে যত ষড়যন্ত্র মুখর হয়ে ওঠে। মতিঝিলের ওপর একটা দোদুল্যমান বাতাস বুঝি এইসব রাতেই কেঁপে কেঁপে প্রহর ঘোষণা করে। মেহেদি নেসার, ইবলিস, মহম্মদ, ইয়ারজান, সফিউল্লা সাহেবরা তখন তাদের কোটর থেকে বেরিয়ে ফণা তুলে ধরে আকাশে। তারা নবাবকে পরামর্শ দেয় কলকাতা একেবারে সোনায় মোড়া জাঁহাপনা, কলকাতা লুঠ করলে চাদি, জহরত, আর মোহরের কোনও কিফায়েত হবে না
তারা বলে–জাঁহাপনার চারদিকে দুশমন, ওদিকে জাঁহাপনার মাসতুতো ভাই শওকত জঙ আর এদিকে ঘসেটি বেগমসাহেবারা আর ফিরিঙ্গিরা, সকলকে ঠান্ডা করে মসনদে বসে মহফিল করবেন
তারা বলে আর মেয়েমানুষ? জেনানা? তাও আমরা জাঁহাপনাকে জোগাড় করে দেব। নবাব সরফরাজ খা’র পনেরোশো বাঁদি বেগম ছিল, জাঁহাপনারও অভাব হবে না জেনানার, একটা ফৈজি বেগম গেছে যাক, আমরা জাঁহাপনাকে আরও হাজার হাজার ফৈজি বেগম জোগাড় করে দেব
নায়েব মশাইয়ের হাত থেকে তখন পরওয়ানাটা নিয়ে ছোটমশাই পড়ছেন–বদরগাহ রসুল নেয়ামত উসুল কোনেন্দা বান্দে নবাব মির্জা মহম্মদ মনসুরউল-মুলুক সিরাজ-উ-দৌল্লা শা কুলি খান বাহাদুর নেবাং জঙ আলমগির বজন্দিগি তোমার খেয়ের খোবি দারুদ সুরাতে বান্দার খোয়ের খোবি সোদ…’
পড়তে পড়তে যেন হাত কাঁপতে লাগল ছোটমশাইয়ের। মনে হল তিনি যেন আর দাঁড়াতে পারছেন না। মাথাও ঘুরতে লাগল। পাশে গোকুল ছিল, নায়েবুমশাই ছিল। তারা হঠাৎ ছোটমশাইকে ধরে ফেললে।
আর ওদিকে কলকাতার কেল্লার মধ্যে হলওয়েল সাহেবও রেডির তেলের আলোর সামনে কেদারায় বসে ডেসপ্যাঁচে লিখে চলেছে
… বাঙালি হিন্দুরা সব আমাদের পক্ষে আছে জানবেন। কলকাতায় এসে তাদের অবস্থাও ভাল করে দিয়েছি আমরা। তারা জানে আমরা তাদের টাকাকড়ি কেড়ে নিই না। দেনার দায়ে তাদের খ্রিস্টান করি না। কাজ করিয়ে ন্যায্য দাম দিই তাদের। বেগার দিতে হয় না এখানে। শহর তাই অনেক বেড়ে গিয়েছে। কারণ সবাই জানে আমরা শুধু এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেই এসেছি। নবাবের মা আমিনা বেগমও আমাদের সঙ্গে মাল বেচা-কেনা করে। উমিচাঁদ আমাদের দলে। নদিয়ার রাজা কিষণচন্দর আমাদের দলে। সম্প্রতি মিরজাফর আলি খাঁ-কে কম্যান্ডার ইন চিফের চাকরি থেকে নবাব তাড়িয়ে দিয়েছে। এখন সেও আমাদের দলে চলে এসেছে। সেদিন আমি ব্যাঙ্কার মহাতাপ জগৎশেঠের বাড়িতে গিয়ে লুকিয়ে দেখা করে এসেছি। সেখানে হাতিয়াগড়ের রাজা হিরণ্যনারায়ণের সঙ্গে দেখা হয়েছে। সেও আমাদের দলে। তার ছোট রানিকে জোর করে নবাবহারেমে পাঠাবার জন্যে ডিহিদার পরোয়ানা পাঠিয়েছিল। তাই সেও আমাদের দলে যোগ দিতে রাজি হয়েছে। আগে কলকাতায় পাকা বাড়ি কেউ বানাত না, পাছে টাকা হয়েছে মনে করে কেউ কুনজর দেয়। এখন কিছু কিছু পাকাবাড়ি হচ্ছে। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর আমলে রেভিনিউ আদায় হত চার হাজার টাকা। এখন বেড়ে সতেরো হাজারে উঠেছে। ট্যাক্স বাবদ আরও নব্বই হাজার টাকা আয় হচ্ছে। আমরা সইয়ে সইয়ে আদায় করছি। নবাবদের মতো জোরজবরদস্তি করি না। আমরা নবাবদের মতো কাফেরদের কাছ থেকে বেশি ট্যাক্স নিই না। আমরা মুসলমান-হিন্দু দু’দলকেই সমান চোখে দেখি। তাই আমাদের ওপর হিন্দুরা খুব খুশি। নবাবের যারা বিশ্বাসী আমির-ওমরাহ তারাও নবাবের ধ্বংসই চায়। এই বাঙালিদের স্বভাবই এইরকম। এদের কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। তাই খুব সাবধানে কাজ করতে হচ্ছে। আমরা এদের বলেছি যে আমরা ব্যাবসাদার মানুষ, ব্যবসা করে টাকাকড়ি পেলেই খুশি, মসনদে কে বসবে তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। এই বাঙালিরা এত বোকা যে এরা আমাদের সেই কথায় বিশ্বাস করেছে…
দুর্গা হঠাৎ দৌড়োতে দৌড়োতে আবার ঘরে ঢুকেছে, ঢুকেই হাঁপাতে লাগল।
মরালী বললে–কী হল দুগগাদি?
সর্বেনাশ হয়েছে রে। অতিথশালার দিকে যাচ্ছিলুম তোর বরকে ডাকতে, হঠাৎ এক কাণ্ড হয়ে গেছে–
কী কাণ্ড?
ছোটমশাই হঠাৎ মুর্শিদাবাদ থেকে বাড়ি ফিরে নায়েব কাছারির কাছে অজ্ঞান হয়ে গেছে বড় বউরানি তাই শুনে নীচেয় নেমে আসছে–
তারপর একটু থেমে বললে–তুই বোস চুপ করে, আসছি
বলে দুর্গা আবার দরজা বন্ধ করে বাইরে চলে গেল।
*
কী রে, তুই?
মতিঝিল থেকে বেরিয়েই হঠাৎ কান্তর সঙ্গে দেখা। বশির মিঞা কান্তর চেহারা দেখে অবাক হয়ে গেছে। চেহারা শুকিয়ে একেবারে চামড়া হয়ে গেছে।
তোর শাদি হয়ে গেছে? সেদিন যে শাদি করতে গেলি?
না ভাই, আমার দেরি হয়ে গেল যেতে, আর অন্য বরের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে তারা। কী করব আর, সেখান থেকে কলকাতায় গিয়েছিলাম। আমার সে চাকরিও নেই আর। তাই তোর খোঁজেই মুর্শিদাবাদে এলুম।
ভাল করেছিস। একটা নোকরি খালি আছে। ছ’টাকা তলব। হাতিয়াগড়ে যেতে হবে তোকে।
হাতিয়াগড়ে? হাতিয়াগড়েই তো বিয়ে করতে গিয়েছিলাম আমি।
তা হলে আবার যা।
কী কাজ?
বশির মিঞা বললে–বলছি তোকে সব। আমার সঙ্গে আয়, সব বলব–হাতিয়াগড়ের রানিবিবিকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হবে তোকে—
.
সচ্চরিত্র পুরকায়স্থর লজ্জাও নেই। আবার খাতাপত্র নিয়ে পুঁটলি ঘাড়ে করে অন্য জায়গায় ঘটকালি করতে যায়। হাঁটতে হাঁটতে যায়, আবার কোথাও কোনও সরাইখানা থাকলে সেখানে রাতটার মতন জিরোয়। আর যেখানে কোনও জমিদারবাড়িতে অতিথিশালা থাকে, সেখানে দিন দুই বিশ্রাম করে আবার বেরিয়ে পড়ে। আজিমাবাদ হয়ে রাজমহল গিয়ে একেবারে সুতি পর্যন্ত চলে যায়। তারপর সেখান থেকে মুর্শিদাবাদ, জঙ্গি, অগ্রদীপ হয়ে গঙ্গার ওপারের গাজিপুর পর্যন্ত।
কিংবা বর্ধমান থেকে বীরভূম পর্যন্ত গিয়ে মাঝখানে বক্রেশ্বর হয়ে পুবে কাশিমবাজার। তারপর রামপুর বোয়ালিয়ার দক্ষিণে হাজরাহাট দিয়ে করতোয়ার তির ঘেঁষে ঘেঁষে সেরপুর মুরচা পর্যন্ত যায়। বর্ধিষ্ণু একটা গ্রাম দেখলেই একটু জিরিয়ে নেয়। একে ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করে আপনাদের গায়ে ভাল পাত্তোর টাত্তোর আছে মশাই?—
কিন্তু যারা খবরটা পেয়েছে তারা বলে–না বাপু, তোমাকে দিয়ে ঘটকালি করাব না–
কেন আজ্ঞে, আমি কী দোষ করলুম?
দোষ করো নাই? হাতিয়াগড়ের শোভারাম বিশ্বাসের মেয়েটার কী সব্বোনাশ করলে বলল দিকিনি? তার ইহকালও গেল পরকালও গেল
সচ্চরিত্র বোঝে খরবটা জানাজানি হয়ে গেছে। এ-খবর জানাজানি হতে বেশিদিন লাগে না। এক সরকার থেকে আর এক সরকারে লোক যায়, নৌকো যায়, হাতি যায়। সচ্চরিত্র চলতে চলতে হয়তো একেবারে কেষ্টনগর চলে গেছে। কেষ্টনগরে অতিথিশালা আছে। যজমানও কিছু আছে সেখানে সচ্চরিত্রর। তবু কেষ্টনগরের রাজবাড়িতে খাওয়াটা ভাল দেয়। নবদ্বীপের রাজা। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের খাতিরটা হয় ভালমতন।
কেষ্টনগরের কাছাকাছি এলেই লোকে খেপায়। বলে–এই সচ্চরিত্র—
ছেলেছোকরার কথায় না খেপলেই ল্যাঠা চুকে যায়। কিন্তু সচ্চরিত্র খেপে ওঠে। খেপে গিয়ে দৌড়োয়। তাদের পেছন পেছন তাড়া করে। বলে–তবে রে হাড়হাবাতের দল
কিন্তু ছেলেছোকরাদের সঙ্গে পারবে কেন সচ্চরিত্র। তারা দৌড়োতে দৌড়োতে কোথায় গিয়ে লুকিয়ে পড়ে তখন আর কাউকে দেখতে পাওয়া যায় না। এমনি করেই দিন কেটে যায় সচ্চরিত্রর। এমনি করেই শোভারামের মেয়ের বিয়ের ব্যাপারটা ভুলতে চেষ্টা করে। কেষ্টনগর থেকে শিবনিবাস যায়। শিবনিবাস থেকে মোল্লাহাটি। মোল্লাহাটিতে গিয়ে হয়তো একটা পুকুরের ধারে গাছের ছায়ায় বসে জিরিয়ে নেয়। তারপর পোঁটলাটা মাথায় নিয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
সেদিন সচ্চরিত্র একেবারে ধড়মড় করে উঠে পড়েছে। কে? কে যেন ডাকলে আমাকে?
মনে হল দূরে যেন কার পালকি যাচ্ছে। পালকির দরজাটা খোলা। কেউ ডাকেনি তাকে। পালকির বেহারাদের হুম হাম শব্দেই হয়তো তন্দ্রাটা ভেঙে গেছে। হয়তো কোনও জমিদার হবে। যাচ্ছে। কেষ্টনগর রাজবাড়িতে। ভাল পাত্রের সন্ধান পেলেও পাওয়া যেতে পারে। তাড়াতাড়ি গিয়ে রাস্তার ওপর দাঁড়াল। কে যায় গো? কে?
পালকি-বেহারারা ঘেমে নেয়ে উঠেছে।
খুব যে গ্যাদা হয়েছে গো। বলি কে আছে ভেতরে? তবু কেউ উত্তর দিলে না। সচ্চরিত্রকে চেনে তারা। পাগল-ছাগলের কথায় উত্তর দেয় না। খিদে পাচ্ছিল খুব। পেটের ভেতর নাড়িভুঁড়িগুলো বাটনা বাটতে শুরু করেছে। পুঁটলিটা নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলে সচ্চরিত্র। মোল্লাহাটির শ্রীধর বাঁড়ুজ্জে মশাইয়ের একটা ছেলে ছিল। বহুদিন আগের কথা। ছেলে তখন সবে জন্মেছে। প্রায় ন’বছর হয়ে গেল। সেই পাত্রটির সন্ধানে গেলে হয়। পুঁটলিটা নিয়ে উঠল সচ্চরিত্র। উঠে আবার পথ চলা। হঠাৎ দূর থেকে আবার দেখা গেল সেই পালকিটা আবার আসছে।
পালকিটা পাশ দিয়ে চলে যাবারই কথা। সচ্চরিত্র রাস্তার একপাশে সরে দাঁড়াল। কিন্তু অবাক কাণ্ড, পালকিটা সামনে এসেই থেমে গেছে।
শিবনিবাসের পথটা কোন দিকে কত্তা?
সচ্চরিত্র বললে–কেন বলতে যাব শুনি? আমার কথার উত্তর দিয়েছিলে তোমরা? আমি ঈশ্বর ইন্দিবর ঘটকের পুত্র, ঈশ্বর কালীবর ঘটকের পৌত্র…
হঠাৎ পালকির ভেতর থেকে একটা মুখ বেরোতেই সচ্চরিত্র একবারে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে করজোড়ে বলে উঠল–ছোটমশাই আপনি? অধীনকে মার্জনা করবেন হুজুর
হাতিয়াগড়ের ছোটমশাইয়ের হয়তো তখন অত কথা শোনবার সময় ছিল না। চেহারাটা কেমন শুকনো-শুকনো। গরমকাল। ছোটমশাইকে হাতিয়াগড়ে অনেকবার দেখেছে সচ্চরিত্র। ছোটমশাইয়ের অতিথিশালাতেও গিয়ে অনেক দিন রাত কাটিয়ে এসেছে। ছোটমশাইয়ের মতো ভালমানুষ ক’টা আছে বাংলাদেশে। শুধু ছোটমশাই কেন, বড়মশাইকেও চিনত সচ্চরিত্র। রথের সময় পুণ্যাহের সময় নতুন কাপড় দিতেন তিনি। সেসব দিনের কথা সচ্চরিত্রর মনে আছে।
ছোটমশাই বললেন–শিবনিবাসের রাস্তা জানো তুমি?
আজ্ঞে, শিবনিবাসের রাস্তা আমি চিনব না? আমি হলুম ঈশ্বর ইন্দিবর ঘটকের পুত্র, ঈশ্বর কালীবর ঘটকের পৌত্র…
ওসব কথা থাক, আমার সময় নেই, শিবনিবাসে যাবার সোজা রাস্তাটা কোন দিকে গেলে পড়ে তুমি গেছ তো ওদিকে!
আজ্ঞে, এই তো শিবনিবাস থেকেই আসছি আমি ছোটমশাই। ওভেনে মহারাজ কেষ্টচন্দ্র আছেন, তস্য মন্ত্রী কালীপ্রসাদ সিংহ মশাই আছেন, গোপাল ভাড় মশাই আছেন, রায় গুণাকর কবিভূষণ ভারতচন্দ্র আছেন। আমি গেলুম, মহারাজ আমাকে পাঁচটি টাকা দিলেন, আমাকে খুব স্নেহ করেন কিনা–আর আমি তো যে-সে ঘটক নই ছোটমশাই, ঈশ্বর ইন্দিবর ঘটকের…
ওসব কথা শোনবার বোধহয় সময় ছিল না ছোটমশাইয়ের। বেহারাদের ইঙ্গিত করতেই তারা চলতে লাগল
সচ্চরিত্র চেঁচিয়ে বলে উঠল–আজ্ঞে, সোজা নাক বরাবর গিয়ে বাঁ দিকে মোড় নেবেন, সেখানে চুয়োডাঙার মধ্যে পড়ে ইচ্ছামতীর পাড় ধরে একেবারে…
ছোটমশাই শুনতে পেলেন কি না কে জানে। পালকিটা হনহন করে চলে গেল। আহা, ছোটমশাইকে ভাল করে পথটা বলে দেওয়া হল না। সচ্চরিত্রর মাথার মধ্যে সবসময় যেন চরকির পাক চলছে। শোভারামের মেয়ের বিয়ের পর থেকেই জিনিসটা হচ্ছে। আর সে-যুগ নেই। এখন যেন ঘটক দেখলে ঠাট্টা করে সবাই। যেন ঠাট্টার বস্তু সচ্চরিত্র। আমি মরছি পেটের জ্বালায়, আর সবাই ঠাট্টা ধরে নিয়েছে। কুলশীল মিলিয়ে, মেলগোত্র যাচাই করে বিবাহ দেওয়া কি যার-তার কাজ কর্তা? আমার পিতা ঈশ্বর ইন্দিবর ঘটক, পিতামহ কালীবর ঘটক…
হঠাৎ পেছন থেকে কে একজন নবাবি নিজামতের লোক একেবারে চেঁচিয়ে উঠেছে এই পণ্ডিত–পণ্ডিত
মহা মুশকিলে পড়া গেল। সচ্চরিত্রকেও চেনে নাকি! আমার পিতা ঈশ্বর ইন্দিবর ঘটক, আমার পিতামহ কালীবর ঘটক….
পরিচয় দিতে দিতেই জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। নবাবি কেতায় প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।
আমি রে বাবা, আমি! আমি কোথায় যাই তাতে তোমার কীসের দরকার বাপু! তুমি নিজের চাকায় তেল দাও না ভাইসাব! আমি পণ্ডিত নই, আমি ঘটক, ঘটককারিকা আমার মুখস্থ
চলো, মেহেদি নেসার সাহেব তলব দিয়েছে। চলো
সচ্চরিত্রর বুকটা ধক করে উঠেছে মেহেদি নেসার সাহেবের নাম শুনে। এরপর কেঁচোর মতো হয়ে। গেল সচ্চরিত্রর মুখখানা। সেপাইটার পেছন পেছন যেতে হল। মোল্লায় ধরলে মসজিদ পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে তবে ছাড়বে। কোথা দিয়ে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কে জানে। জিজ্ঞেস করবার সাহস পর্যন্ত নেই সচ্চরিত্রর। পুঁটলিটা বগলে করে একেবারে নদীর ধারে নিয়ে গেল। ঘাটে নৌকো বাঁধা। ভেতরে মেহেদি নেসার সাহেব। সঙ্গে ইয়ারবকশি সবাই আছে।
নৌকোর সামনে যেতেই সচ্চরিত্র ঢিপ করে একটা প্রণাম ঠুকে দিলে।
মেহেদি নেশার মদ খেলেও কাজের কথা ভোলে না।
জিজ্ঞেস করলো–হ্যাঁ রে পণ্ডিত, সড়ক দিয়ে পালকি করে কাউকে যেতে দেখেছিস তুই
দেখেছি হুজুর
মেহেদি নেসার শুধু একলা নয়। ইবলিশ সাহেব, সফিউল্লা সাহেব, ইয়ারজান সাহেব। নবাবের সব শাগরেদরা হুল্লোড় করছে ভেতরে।
বহুত আচ্ছা পণ্ডিত, বহুত আচ্ছা
ইবলিশ সাহেব বললে–ওকে একটু দারু দাও নেসার মিঞা, পণ্ডিতের গলাটা শুকিয়ে গিয়েছে। ইয়ার
দারু খাবি পণ্ডিত? গলা ভিজিয়ে নিবি?
শুধু মদ নয়, ভেতর থেকে মাংসর গন্ধও আসছে। হো হো করে সবাই হেসে উঠল কথাটায়। সচ্চরিত্র কাপড়টা দিয়ে নাক চাপা দিলে। গন্ধতে পেটের নাড়িভুড়িগুলো পর্যন্ত বমি হয়ে আসছে।
পালকিতে কে ছিল দেখেছিস?
আজ্ঞে হ্যাঁ, জনাব।
কে?
হাতিয়াগড়ের ছোটমশাই হুজুর
বলেই সচ্চরিত্র বুঝলে বলাটা ঠিক হয়নি৷ ছোটমশাইয়ের কী ক্ষতি করবে কে জানে!
কোন দিকে গেল?
ততক্ষণে একজন সত্যি সত্যিই গেলাসে মদ ঢেলে টলতে টলতে সামনে নিয়ে এসে মুখে দেয় আর কী। আর একজন মাংসের বাটিটা নিয়ে এসেছে খাওয়াবে বলে।
সচ্চরিত্র তখনও মুখে কাপড় চাপা দিয়ে আছে। কোনওরকমে মুখ ফাঁক করে বললে–ওসব আমি খাই না হুজুর। আমি হিন্দু হুজুর
মেহেদি নেসার জিজ্ঞেস করলে–শিগগির বল, জমিদারবাচ্চা কোন দিকে গেল–তা হলে গোস খাওয়াব না, না বলতে পারলে তোকে গোস খাইয়ে দেব
হুজুর, জমিদারবাবু মোল্লাহাটের দিকে গেল!
মোল্লাহাট?
হ্যাঁ হুজুর, মোল্লাহাটের রাস্তা জিজ্ঞেস করলেন আমাকে আমি তাই রাস্তা বলে দিলুম।
কে জানে, কী সদবুদ্ধি উদয় হল সচ্চরিত্রর মনে। ছোটমশাইয়ের অতিথিশালায় অনেক দিন আশ্রয় পেয়েছে সচ্চরিত্র। হয়তো শিবনিবাসের নাম করলে কোনও সর্বনাশ হবে ছোটমশাইয়ের। কে জানে! এ মিথ্যে কথায় কোনও পাপ নেই।
মোল্লাহাটের নাম শুনে যেন খানিকটা নিশ্চিন্ত হল সবাই। নৌকো আবার মোল্লাহাটের দিকেই ফিরল। মোল্লাহাটে পৌঁছোতে রাত পূইয়ে ভোর হয়ে যাবে। কিন্তু ইয়ারজান ছাড়লে না। বললে–পণ্ডিত উবকার করেছে, তা হলে পণ্ডিতকে একটু দারু খাইয়েই দে ইয়ার, পণ্ডিতের গলা ভিজিয়ে দে–
তারপর সে এক কাণ্ড! তিনজনে মিলেই সচ্চরিত্রকে জাপটে ধরলে। তারপর নাকের কাপড়টা খুলে দিয়ে একজন মুখটা হাঁ করিয়ে মদ ঢেলে দিলে। গলা দিয়ে কিছুতেই ঢোকে না। তারই ওপর আর
একজন মাংস নিয়ে মুখের মধ্যে পুরে দিয়ে বললে–খা পণ্ডিত, খা খা–
সচ্চরিত্রর মনে হল মাথাটা যেন তার ঘুরছে। হাত থেকে ঘটককারিকার পুঁটলিটা মাটিতে পড়ে গেল। বোধহয় তার তখন আর জ্ঞানই নেই। সেই টাটা করা রোদ, সেই দুপুরবেলা মাথার ব্রহ্মতালু ভেদ করে যেন প্রাণটা বেরিয়ে আসতে চাইল বাইরে। সঙ্গে সঙ্গে সবাই হো হো করে পৈশাচিক হাসি হেসে উঠেছে।
হঠাৎ অনেকক্ষণ পরে জ্ঞান হতেই চোখ তুলে দেখলে কে যেন তার মাথায় জল দিচ্ছে। চিনতে পারলে না লোকটাকে। একমুখ পাকা দাড়ি। বেশ বুড়ো মানুষ।
সচ্চরিত্র চোখ চাইতেই লোকটা বললে–এমন গরমে কি বেরোতে হয় বাবা। মাথা ঘুরে পড়ে তো যাবেই–
তবু কথা বলছে না দেখে লোকটা বললে–আমি এখানকার মসজিদের ইমামসাহেব বাবা, আমার মসজিদে হেঁটে যেতে পারবে?
সচ্চরিত্রর তখনও ভয় যায়নি। বললে–ইমামসাহেব, ওঁরা কোথায়?
ওঁরা কারা বাবা?
নাম উচ্চারণ করতেও যেন ভয় হল সচ্চরিত্রর। পাশেই বমি পড়ে রয়েছে তার। এতক্ষণে গন্ধটা যেন নতুন করে নাকে লাগল। মনে পড়ল সব ঘটনাগুলো। রাম রাম থুঃ থুঃ–সচ্চরিত্র ছেলেমানুষের মতো হাউহাউ করে কেঁদে ফেললে। আমার সর্বনাশ হয়েছে ইমামসাহেব, আমার জাত গেছে-আমার সব গেছে।
বলতে বলতে কান্নায় আর কথা বলতে পারলে না সচ্চরিত্র। ইমামসাহেব এ-অঞ্চলের বহু পুরনো লোক। এসব জিনিস দেখা আছে। নদী থেকে জল তুলে এনে সচ্চরিত্রর মাথায় দিতে লাগল। সচ্চরিত্রর কান্না যেন কিছুতেই আর থামতে চায় না। আমার যজমানদের কাছে আমি মুখ দেখাব কেমন করে ইমামসাহেব—
*
শিবের নিবাস বোধহয় শিবনিবাসও। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র যখন কোথাও যাবেন একলা যাবেন না। সঙ্গে পারিষদরাও যাবে। লোকে বলত–মহারাজ তো মহারাজ, নদীয়ার মহারাজ। উদ্ধব দাস কতবার ছড়া কেটেছিল কৃষ্ণচন্দ্রকে নিয়ে। একবার ডেকেছিলেন মহারাজ। বলেছিলেন–লোকটাকে একবার আনিস তো আমার কাছে
উদ্ধব দাস গেয়েছিল
আমি রব না ভব-ভবনে!
শুনে হে শিব শ্রবণে!
যে-নারী করে নাথ পতিবক্ষে পদাঘাত
তুমি তারই বশীভূত
আমি তা সব কেমন!
মহারাজ রসিক লোক। বললেন–তার পর? তার পর? কার লেখা? তোমার?
উদ্ধব দাস বললে–আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ, এই অধীনের রচনা। তারপর গাইতে শুরু করলে
পতি বক্ষে পদ হানি ও হল না কলঙ্কিনী
মন্দ হল মন্দাকিনী ভক্ত হরিদাস ভণে।
আমি রব না ভব-ভবনে।
উদ্ধব দাসের গান শুনে সেবার খুব ভাল লেগেছিল মহারাজার। পাশে মন্ত্রী কালিপ্রসাদ সিংহ বসে ছিলেন। তিনি বললেন–ওর আর একটা গান আছে, সেইটে শোনাও তো দাসমশাই তোমার সেই ছড়াটা?
উদ্ধব দাস বললে–তবে শুনুন আজ্ঞে শোভার কথা
বলি বলে উদ্ধব দাস আরম্ভ করলে–
শুনো শুনো সভাজন অভাজনের নিবেদন।
শোভার কথা সভা মধ্যে করি বিবরণ ॥
ঐরাবতের ইন্দ্র শোভা, যোগীর শোভা জটা ॥
ব্রাহ্মণের পইতে শোভা, কপালের শোভা ফোঁটা ॥
আহা বেশ বেশ বেশ ॥
রায় গুণাকর ভারতচন্দ্র শুনছিলেন। সভাকবি! তার মুখ দিয়ে হাসি বেরোল। বললেন–বাঃ, বেশ বেশ
উদ্ধব দাস আবার আরম্ভ করলে–
নিশির শোভা শশী আর নভের শোভা তারা।
ব্রজের শোভা কৃষ্ণচন্দ্র, নদের শোভা গোরা ॥
আহা বেশ বেশ বেশ ॥
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র খুব খুশি। বললেন–রায়গুণাকর, এ যে তোমাকেও হার মানালে হে—
উদ্ধব দাস আবার গাইতে শুরু করেছে
যুবতীর পতি শোভা আর।
গৃহের শোভা নারী।
উদ্ধবচন্দ্র দাস বলে যাই বলিহারি–
আহা যাই বলিহারি ॥
আহা বেশ বেশ বেশ ॥
সঙ্গে সঙ্গে যারা শুনছিল সবাই বলে উঠল–আহা বেশ বেশ বেশ–তার পর?
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র হঠাৎ ডাকলেন–ও গোপালবাবু, গোপালবাবু
গোপালবাবু এতক্ষণ একপাশে মুখ চুন করে শুনছিলেন। একটা কথাও বলেননি। কৃষ্ণচন্দ্র বললেন–লোকে তোমাকে ভাঁড় বলে গোপালবাবু, কিন্তু উদ্ধব দাস যে তোমাকে হারিয়ে দিলে দেখছি
উদ্ধব দাসের তখন উৎসাহ বেড়ে গেছে। বললে–তা হলে আমি একটা ছড়া বলব রাজামশাই বলুন তো দেখি কী উত্তর হয়–
সূর্যবংশ জন্ম তার অজ রাজার নাতি।
দশরথ পুত্র বটে নয় সীতাপতি ॥
রাবণের অরি নয় লক্ষ্মণের জ্যেষ্ঠ।
ভণে কবি উদ্ধব দাস হেঁয়ালির শ্রেষ্ঠ।
বলুন তো প্রভু, কী?
মহারাজ গোপালবাবুর দিকে চাইলেন। বললেন–বলো গোপালবাবু, উত্তর দিতে হবে তোমাকে! নইলে তোমার চাকরি থাকবে না আর
গোপালবাবু ক্ষীণ একটু হাসলেন। বললেন–আজ্ঞে, ভরত—
উদ্বব দাস বললে–তা হলে আর একটা বলুন দিকি, কেমন বিদ্যে আপনার দেখি–
পিতৃগৃহে লজ্জাবতী থাকে অতিশয়।
কিন্তু পরগহে গেলে সে ভাব না রয় ॥
মুখেতে করিলে তারে জুড়ায় পরান।
সভাস্থলে সবাকার রাখয়ে সম্মান ॥
রমণী কুলেতে তার কর্ম ভাল জানে।
কী নাম তাহার প্রভু বলো মম স্থানে ॥
গোপালবাবু, চুপ করে রইলে কেন, বলো? উত্তর দাও
মন্ত্রী কালিপ্রসাদ সিংহ বললেন–আমি বলব? পান—
তুমি হেরে গেলে গোপালবাবু–উত্তর দিতে পারলে না—
গোপালবাবু বললেন–তা হলে আমি একটা বলি–উত্তর দাও তো হে–
অলি অলি পাখিগুলি গলি গলি যায়।
সর্ব অঙ্গ ছেড়ে দিয়ে ডোখ খুবলে খায় ॥
উদ্ধব দাস বললে–প্রভু, এ তো সহজ প্রশ্ন, ধোঁয়া—
মহারাজ খুব খুশি। বললেন–তুমি একটা চাকরি নেবে উদ্ধব দাস আমার কাছে?
উদ্ধব দাস গান গেয়ে উঠল–আমি রব না ভব-ভবনে
মহারাজ চাকরকে ডাকলেন–ওরে বৈকুণ্ঠ, এই উদ্ধব দাসকে কিছু খেতে দে–কিছু খেতে ইচ্ছে করছে? খিদে পেয়েছে? কী খাবে?
উদ্ধব দাস বললে–আজ্ঞে, মুগের ডাল—
কালিপ্রসাদ সিংহ হঠাৎ তাড়াতাড়ি কাছে ঘেঁষে এলেন। কানে কানে বললেন তিনি এসেছেন
কার আসার কথা শুনেই যেন মহারাজ উঠলেন। অনেক দিন এসব ষড়যন্ত্রের মধ্যে ছিলেন না। এসব আগে করা গেছে। ক’মাস থেকেই ভাল লাগছিল না কিছু। দিল্লির বাদশাদের সঙ্গে আপস করে চলতে চলতেই জীবন কেটে গেল। আবার এখন মুর্শিদাবাদের নবাবকে নিয়ে ওরা ঘোঁট পাকিয়ে তুলছে। যেন অনিচ্ছের সঙ্গে বললেন–চলো–আমি আসছি—
*
বড় বউরানি ছোটমশাইকে ভাল করে সব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। কী কী কথা বলতে হবে তাও গুছিয়ে শিখিয়ে দিয়েছিলেন।
বলেছিলেন–তুমি যেন আবার শুধু হাতে এবার ফিরে এসো না—
ছোটমশাই বলেছিলেন–তুমি যে কী বলো! আমি কিছু বলতে পারি না ভেবেছ?
না, ওরকম মিউমিউ করে কথা বললে–চলবে না।
আমি মিউমিউ করে কথা বলি?
তা বলো না? বললে–আজকে এই দশা হয়? এত বড় আস্পর্ধা নবাবের? নবাব হয়েছে বলে কি একেবারে আমাদের মাথা কিনে নিয়েছে? আমি যদি পুরুষ হতুম তো কবে দূর করে দিতুম না গদি থেকে–
ছোটমশাই বলেছিলেন–এসব কাজ কি অত তাড়াহুড়ো করলে চলে? সবাই মিলে পরামর্শ করছি, দেখতে পাচ্ছ তো
তা নিজের বউকে তা হলে দিয়ে এসো নবাবের হাতে তুলে!
তখনও জানাজানি হয়নি ব্যাপারটা। ছোটমশাই ভেবেছিলেন একদিন সব চাপা পড়ে যাবে। একবার যদি ফিরিঙ্গিরা মাথা চাড়া দেয় তো তখন হয়তো সব ওলোটপালট হয়ে যাবে। সেদিন রাত্রে পরওয়ানাটা পড়ে তাই মাথাটা কেমন ঘুরে গিয়েছিল। তারপর থেকেই কী করবেন, কার কাছে যাবেন বুঝতে পারছিলেন না। একবার চিঠি পাঠান মহিমাপুরে। জগা খাজাঞ্চি বুড়ো মানুষ। তাকে দিয়ে সব কাজ হয় না। আর কার কাছেই বা বিশ্বাস করে সব বলা যায়। সে-চিঠি আসার জন্যে হাঁ করে পথের দিকে চেয়ে বসে থাকেন। জগা খাজাঞ্চি খালি হাতে ফিরে আসে। শেঠজি খবর দেন–সব বন্দোবস্ত হচ্ছে। কিন্তু কতদিন আর তার জন্যে অপেক্ষা করে থাকা যায়।
বউ বউরানি বলেন–আমি কিন্তু বলে রাখছি, কিছুতেই ছোটকে পাঠাব না সেখানে
তা আমিই কি সাধ করে পাঠাচ্ছি! আমার কি কোনও কষ্ট হয় না?
কষ্ট? কষ্টটাই তুমি দেখলে আর মানসম্মানের কথা তো ভাবলে না একবার! তোমার কষ্টটাই তোমার কাছে বড় হল? মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছি বলে কি এত অপমান সইতে হবে?
ছোটমশাই বলেছিলেন–তুমি এত চেঁচাচ্ছ কেন, শুনতে পাবে যে
বেশ করব চেঁচাব। হাতিয়াগড়ের রাজবাড়ির মানসম্মান বলে একটা জিনিস নেই! আমি ওকে খুন করব তবু ওকে যেতে দেব না, দেখি ওই মেহেদি নেসার বেটা কী করতে পারে–
আসলে তো মেহেদি নেসার একলা নয়!
একলাই হোক আর দোকলাই হোক, আমি কি ভয় করি নাকি কাউকে–? ভেবেছে গদি পেয়েছে বলে যা ইচ্ছে তাই করবে! ভগবান বলে কেউ নেই নাকি ভেবেছে? পরকাল নেই! পরকালে নরকে গিয়ে জবাবদিহি করতে হবে না এর জন্যে!
বড় বউরানি যখন রাগেন তখন ছোটমশাইয়ের ভয় হয়। চুপ করে থাকেন।
আজ ওকে নিচ্ছে, কাল আবার গাঁয়ের আর কাউকে চাইবে! তখন কী করবে? তোমার মুখের দিকে না চেয়ে আছে সব লোক? তাদের হিত তুমি দেখবে না?
ছোটমশাই বললেন–দেখো, বাড়ির মধ্যে অমন অনেক চেঁচানো যায়, দেশের অবস্থা তো জানো, সবাই ভয়ে ভয়ে কাঁপছে হিন্দু মুসলমান ফিরিঙ্গিরা পর্যন্ত ভয় করে আছে
তারপর বড় বউরানি কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই ছোটমশাই বললেন–শুনলুম সেদিন লস্করপুরের তালুকদার কাশিম আলি সাহেব নাকি নিজামত কাছারিতে মকর্দমার তদবির করতে গিয়েছিল, মেহেদি নেসার তাকে ধরে তার পালকিতে জুতে দিয়েছে আবার শুনলাম কাকে নাকি ধরে রাস্তায় কোন হিন্দুকে জোর করে গোরুর মাংস খাইয়ে দিয়েছে
বউ বড়রানি বললেন–তা তো হবেই, জমিদাররা যত হয়েছে ভেড়ার দল
ছোটমশাই বললেন–তুমি তো বলেই খালাস, কিন্তু জলে বাস করে কি কুমিরের সঙ্গে ঝগড়া করা যায়? তা হলে তো সেই লড়াই বেধে যাবে
তা লড়াই করবে! এমন করে গোরু-ভেড়ার মতো বেঁচে থাকার চেয়ে লড়াই করে মরে যাওয়াও যে ভাল
তুমি মেয়েমানুষ বাড়ির মধ্যে থাকো, লড়াইয়ের কী বুঝবে! লড়াই মানেই তো কতকগুলো নিরীহ মানুষ মারা যাবে মাঝখান থেকে
বড় বউরানি খেপে গেলেন–তা কয়েকশো মানুষ মারা যাবে বলে লড়াই না করে অন্যায় সহ্য করবে?
ছোটমশাই আর থাকতে পারলেন না। গলাটা একটু উঁচু করে বললেন–অন্যায় সহ্য করার কথা বারবার বলছ কেন মিছিমিছি? আমি কি আমার কথা বলছি? আমি তোমাদের কথা ভেবেই ভয় পাচ্ছি
তা আমরা কি মরতে জানিনে ভেবেছ? না আমরা কখনও মরিনি? আমার ঠাকুমা আমার ঠাকুরদার চিতেয় উঠে পুড়ে মরেনি? মেয়েরা যা পারে তোমরা তা পারো?
ছোটমশাই বললেন–কেন মিছিমিছি তুমি ওসব কথা তুলছ! এখন কী করা যায় তাই ভাবো
ভেবে আমি ঠিক করে ফেলেছি। আমি ছোটকে খুন করব তবু নবাবের হাতে তুলে দেব না!
সেটা তো একটা কথার মতো কথা হল না। যা করা সম্ভব তাই বলো!
সব সম্ভব! মেয়েমানুষের কাছে কিছুই অসম্ভব নয়।
রেগে যেয়ো না, রেগে গেলে কোনও সমাধান হয় না। ভাল করে ভেবেচিন্তে বলো
বড় বউরানি বললেন–আমি সবদিক ভেবেই বলছি। যেদিন থেকে ডিহিদারের পরওয়ানা এসেছে, সেইদিন থেকেই ভাবছি, আমি মাধব ঢালিকে বলে রেখেছি, এবার ডিহিদারের লোক এলেই আমি আমার কাজ সেরে ফেলব। তারপর দরকার হলে না-হয় আমিও আত্মঘাতী হব। যে-দেশে পুরুষমানুষ। নেই, সে-দেশে মরা ছাড়া আমাদের আর কী গতি আছে বলো?
সত্যি বলছি বড়বউ, এসব কথা আমি সমস্ত বুঝিয়ে বলেছি শেঠজিকে
শেঠজি কী করবে? তার কীসের ভাবনা? তার টাকার জোর আছে, নবাব বাদশা থেকে শুরু করে পাইক-পেয়াদা পর্যন্ত তার দলে। আমাদের কথা শেঠজিরা বুঝবে কেন?
ছোটমশাই বললেন–না না, শেঠজি বুঝেছে সব। সমস্ত তোড়জোড় হচ্ছে। ওদিকে ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে ফরাসডাঙার ফিরিঙ্গিদের লড়াই হচ্ছিল বলে এতদিন কিছু করতে পারেনি এবার যে মেমসাহেবদের ধরে নবাবের হারেমে পুরে অপমান করেছে, এবার তাদের গায়েও লেগেছে– ।
কিন্তু ততদিন তো এখানকার ডিহিদার বসে থাকবে না। সে তো আবার এল বলে। তখন তাকে কী বলে ঠেকাবে?
ছোটমশাই বললেন সেই কথাই তো আমি ভাবছি। তা হলে আমি একবার কেষ্টনগরে যাই, বলি গিয়ে মহারাজকে সব খুলে
বড় বউরানি বললেন–সে তোমার যা-খুশি করো গে যাও, আমি কিছু বলতে যাচ্ছি না, তার আগে যদি ডিহিদারের লোক আসে তো একটা রক্তারক্তি কাণ্ড বাধিয়ে তুলব, তা তোমায় বলে রাখছি
ছোটমশাই বললেন কিন্তু সে তুমি তখন যাই করো, এখন যেন তুমি কিছু বলতে যেয়ো না ওকে বড়বউ। তা হলে কেঁদেকেটে একশা করবে ও লোক জানাজানি হয়ে যাবে
বলব না মানে! নিশ্চয়ই বলব, আমি এখুনি গিয়ে বলে আসছি বলে ঘর থেকে বড়বউ তাড়াতাড়ি ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গিয়েছিল–
ছোটমশাই পেছন থেকে ডেকেছিলেন–বড়বউ, শোনো, শুনে যাও–ও বড়বউ বড়বউ
নিজের মহল ছেড়ে বড় বউরানি বারান্দা পেরিয়ে একেবারে সোজা ছোট বউরানির মহলে গিয়ে পড়লেন। কদিন থেকেই মাথার ঠিক ছিল না। ভাল করে পুজোতেও মন বসছিল না তার। এত সাধের সংসার তার। কত সাধ করে ছোটকে এনেছিলেন তিনি। নিজের হাতে ছোটকে তুলে দিলেন স্বামীর হাতে। নিজে পছন্দ করে বিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন–আমার ছেলে হল না। আমি এসেই হাতিয়াগড়কে নির্বংশ করে গেলাম। তুই এলে তবু যদি আবার হাতিয়াগড় বেঁচে ওঠে! অনেকদিন আগে বজরা করে মহালে যেতে যেতে চাকদহের ঘাটে প্রথম দেখেন ছোটকে। দূর থেকে বজরার জানালা। দিয়ে দেখা। ছোট তখন চান করতে নেমেছে ঘাটে। কত আর বয়েস। বউ হয়ে ঘোমটা দিয়ে সংসার। করবার বয়েস তখনও হয়নি ঘোটর। কিন্তু চোখ জুড়িয়ে গিয়েছিল দেখে। কাঁচা হলুদের মতো রং। গায়ের। মাথার চুলগুলো পিঠের ওপর এলিয়ে পড়েছে। বদর মিঞা বজরার হাল ধরে ছিল। বড় বউরানি বদর মিঞাকেই পাঠালেন।
বললেন–দেখে এসো তো বদর, ও মেয়েটি কাদের?
চাকদহর শ্রীনিবাস মুখুটির একমাত্র মেয়ে। মা নেই, ভাই নেই, বোন নেই। সংসারে আপন বলতে কেউ নেই।
তা না থাক, সেইখানেই ঘাটে বজরা বাঁধা হল সেদিনকার মতো। শ্রীনিবাস মুখুটি মশাইকে বজরায় ডেকে পাঠানো হল। শ্রীনিবাস মুখুটি প্রথমে বুঝতে পারেননি। পরে বুঝলেন পাত্র হাতিয়াগড়ের রাজা হিরণ্যনারায়ণ রায়। তিনি কেঁদে ফেললেন আনন্দে। আনন্দও হল কষ্টও হল। কুলীন হয়ে অকুলীনের হাতে নিজের মেয়েকে দেবেন। যেন মেয়ের কথা ভেবেই চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে পড়ল।
সেই এতটুকু মেয়ে রাসমণি। সেই এ-বাড়ির ছোট বউরানি। তাকেই আজ ম্লেচ্ছদের হাতে তুলে দিতে হবে। তাড়াতাড়ি ছোটর মহলে দরজায় গিয়ে ঘা দিতে লাগলেন–ছোট, ও ছোট ওঠ ওঠ–
ঘরের ভেতরে তখন ছোট বউরানি আর মরালী পাশা খেলতে বসেছে। এমন সময় কারও আসবার কথা নয়। দুর্গা গিয়ে ডেকে এনেছিল মরালীকে।
বউ বউরানির গলা পেয়েই ভয়ে সকলের গলা কাঠ হয়ে গেছে।
ওমা, বড় বউরানি যে, কী হবে?
দুর্গা তাড়াতাড়ি মরালীকে পালঙের নীচে ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ভেতরে যা শিগগির, বড় বউরানি দেখতে পেলে অনগ্ধ বাধবে—যা–
বড় বউরানি ভেতরে ঢুকেই একেবারে রণচণ্ডী মূর্তি ধরলে।
মুখপুড়ি, তুই নিজেরও মুখ পোড়ালি আর রায় বংশেরও মুখ পোড়ালি! কেন তুই মরতে গিয়েছিলি মুর্শিদাবাদে?
ছোট বউরানি এমনিতে হাসিখুশির মানুষ। কিন্তু বড়দিকে একটু ভয় করে। বড়দিকে দেখেই কেমন চোখ মুখ শুকিয়ে গেল।
বড় বউরানি তখনও বলে চলেছে–এত যদি তোর রূপের দেমাক, তা পরপুরুষকে সেরূপ না দেখালে তোর চলছিল না? পরপুরুষই তোর কাছে এত মিষ্টি হল রে? তুই একবার তোর স্বামীর কথা ভাবলি না, আমার কথা ভাবলি না, এই রায়বংশের কথাও ভাবলি না মুখপুড়ি?
ছোট বউরানির চোখ দুটো ছলছল করে উঠল।
এখন আমার বাপের বাড়ির লোকের কাছে মুখ দেখাব কেমন করে বল তো? আমার হাতিয়াগড়ের প্রজাদের কাছে আমি কী কৈফিয়তটা দেব? আমি সাধ করে তোকে আস্তাকুঁড় থেকে রাজসিংহাসনে বসালুম, তাতেও তোর মন বসল না? তোর এত দেমাক?
ছোট বউরানি কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল–তুমি আমাকে অমন করে বোকোনাবড়দি, তুমি আমার মায়ের মতন আমার মা নেই–তুমিই আমার মা…
তা মায়ের মুখ খুব রাখলি তো ছোট! মায়ের মুখ একেবারে পুড়িয়ে ছাড়লি তুই–এমন মেয়ে নিয়ে এসেছিলুম সতিন করে যে আমার হাড়মাস পর্যন্ত ছাই করে দিলে! কেন তুই মরতে গিয়েছিলি, বল মুখপুড়ি বল
ছোট বউরানি বললে–তুমি তো জানো বড়দি, আমি যেতে চাইনি–
তুই যেতে চাসনি তো তোকে হাতে দড়ি বেঁধে ধরে নিয়ে গিয়েছিল ছোটমশাই? কেন, বাড়ির ভেতর ঘরের জানালা-দরজা বন্ধ করে রুপোর পালঙে শুয়েও তোর পিরিত হয় না? এত গরম তোর? তবু যদি বুঝতুম একটা ছেলে বিয়োতে পারতিস–
ছোট বউরানি দু’হাতে নিজের মুখ ঢেকে তখন কাঁদছে।
আবার কাঁদছে। ভেবেছে কাদলে সুরাহা হবে! ছেনালি কান্না রাখ তো তুই। ও কান্নায় আমি ভুলছিনে!
ছোট বউরানি হঠাৎ ডুকরে উঠল–কিন্তু আমার কী দোষ বলো তুমি?
তোর দোষ নয়? কেন তুই নবাবজাদার বিয়েতে মুর্শিদাবাদে গেছলি? আর যদি গেলিই তো কেন নবাবজাদার ইয়ারবকশিদের দিকে চোখ তুলে চাইলি? একলা ছোটমশাইতে তোর মন ভরছিল না–?
ছোট বউরানি আর পারলে না। হঠাৎ বড় বউরানি পায়ের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। বললে–আর অত বোকো না বড়দি, আমাকে তুমি তার চেয়ে খুন করে ফেলল, আমি সহ্য করতে পারছি না
তোকে খুন করতে পারলেই তো আমি শান্তি পেতাম, কিন্তু.. তা শেষপর্যন্ত হয়তো তাই-ই..
এতক্ষণ দুর্গা একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল চুপ করে। তার দিকে নজর পড়তেই বড় বউরানি ধমক দিলেন–তুই এখেনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী শুনছিস; অ্যাঁ? তুই যা এখান থেকে যা
দুর্গা ঘরের বাইরে চলে গেল। তারপর বড় বউরানির হঠাৎ পালঙের তলার দিকে নজর পড়ল। বলে উঠলেন–ওখানে কে রে? কে ওখানে? খাটের তলায়?
ওদিকে শিবনিবাসের একটা ঘরের মধ্যে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র তখন সব শুনছেন; শুনতে শুনতে মুখটা কঠোর হয়ে এল তার। তারপরে হাতের চিঠিটা নিয়ে আর একবার পড়তে লাগলেন।
‘নবদ্বীপাধিপতি মহারাজ শ্রীল শ্রীযুক্ত কৃষ্ণচন্দ্র রায়।
বরাবরেষু—
বাংলার নবাবের অত্যাচারে শিক্ষিত, অশিক্ষিত, বিদ্বান, মূর্খ, পণ্ডিত সকলেই স্ব স্ব ঘর-দ্বার ত্যাগ করিয়া পলাইতে উদ্যত। নবাব কাহারও কোনও কথা শুনেইনা। এ-বিষয়ে কী কর্তব্য বুঝিতে না পারিয়া আপনাকে আমরা আহ্বান করিতেছি। আপনি সত্বর আসিয়া সুচিন্তিত মতামত দিয়া সহায়তা করিলে বাংলাদেশ রক্ষা হয়। ইতি—’
নীচে সই করেছেন মিরজাফর, জগৎশেঠ, রাজা দুর্লভরাম, রাজা রামনারায়ণ, রাজা রাজবল্লভ, রাজা কৃষ্ণদাস, রাজা হিরণ্যনারায়ণ।
*
কান্ত কী করবে বুঝতে পারলে না। ষষ্ঠীপদ তাকে যে এমনভাবে ডোবাবে তা সে বুঝতে পারেনি। যতদিন চাকরি করেছে বেভারিজ সাহেবের কাছে, ষষ্ঠীপদ মাথা হেঁট করে সব কাজ করে গেছে। পেটে। পেটে তার যে এমন বুদ্ধি তা জানা যায়নি।
সে-রাতটা সেই হাতিয়াগড়েই কাটল। ওদিকে বিয়েবাড়ির গোলমাল তখন চলছে। রান্নার গন্ধ আসছেনাকে। সচ্চরিত্র নিজেই তিনটে পাতা করে নিয়েছিল। একটা নিজের জন্যে, একটা কান্তর জন্যে, আর একটা নাপিতের জন্যে।
কোথায় যেন একটা ক্ষোভ, একটা লজ্জা, একটা পরাজয়ের কলঙ্ক সারা শরীর আর মনটাকে পিষে থেঁতলে নিঃশেষ করে দিচ্ছিল।
খেয়ে নাও বাবাজি, খেয়ে নেবে চলো, কলাপাতা পেতে দিয়েছি, বৃহৎ ব্যাপারে কারও ওপর নির্ভর করলে চলে না, নিজেরাই করে নিতে হয়। এখানে লজ্জা করলে নিজেরাই উপোষ করে মরব–
সচ্চরিত্র উৎসাহ দিয়ে কান্তকে চাঙ্গা করতে চেয়েছিল খুব। তারও অন্যায় নেই কিছু। সে এরকম অনেক বিয়ে দেখেছে, অনেক বিয়ে ভাঙতেও দেখেছে। নাপিতও এসব দেখে ঠেকে শিখেছে। বিয়েবাড়িতে খেতে সংকোচ করলে শেষকালে ঠকতে হয়।
আপনারা খেতে বসুন, আমি খাব’খন, আমার খিদে নেই
বিয়ে উপলক্ষে সারাদিনই উপোষ করে ছিল। তবু খিদের কথা যেন মনেই পড়ল না। সঙ্গে ঘোট একটা পোটলা ছিল। একটা বাড়তি ধুতি, আর একটা চাদর। সেই পোঁটলাটা নিয়েই সে সেদিন আবার নৌকোর আশায় নদীর ঘাটে এসে দাঁড়াল। কোথায় এতক্ষণ একটা বাড়ির অন্দরমহলে তাকে ঘিরে আনন্দের কলগুঞ্জন মুখর হয়ে উঠবে, তা নয়, সেই মাঝরাত্রের নির্জন পাথরধাঁধানো ঘাটের ওপরেই বুঝি একটুখানি তন্দ্রা এসেছিল। তারপর শেষরাত্রের দিকে ঘুম ভেঙে যেতেই দেখলে, নদীতে একটা নৌকো চলেছে। গহনার নৌকো। তারপর সেই তাদের বলেকয়ে সোজা কলকাতা। কিন্তু সেখানে যখন গিয়ে পৌঁছোল তখন রীতিমতো দেরি হয়ে গেছে। যার নাম বিকেল।
ষষ্ঠীপদ দেখতে পেয়ে হাঁ হাঁ করে উঠল-হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি ঢুকবেন না কান্তবাবু, সাহেব মানা করে গেছে
মানা করে গেছে মানে!
ষষ্ঠীপদ বললে–আপনি কাল যাবার পরেই যে সাহেব রাত্তিরে এসেছিল। সাহেব একলা নয়, সাহেবের সঙ্গে কেল্লা থেকে পল্টনরাও এসেছিল।
কেন?
আপনাকে ধরতে।
ধরতে মানে? আমি কী করেছি?
ষষ্ঠীপদ বললে–তা তো জানিনে। উমিচাঁদ সাহেবের লোক সাহেবকে বলেছে যে, আপনার কাছে। নাকি মুর্শিদাবাদের চর বশির মিঞা আসে। আপনার কাছ থেকে সব খবর নিয়ে সে মুর্শিদাবাদে পাচার করে।…
কান্ত কেমন অবাক হয়ে গেল। বশির মিঞা যে চর একথা কে বললে! ভাল করে ভেবে দেখল, কবে তাকে কী কথা সে বলেছে। কী কী জানতে চেয়েছে সে। অনেক সময় ষষ্ঠীপদর সামনেও অনেক কথা হয়েছে তার সঙ্গে। বশির মিঞা যে এখানে আসে এ কথা ষষ্ঠীপদ ছাড়া আর কে-ই বা জানে।
তা হলে আমি কি দেখা করব গিয়ে সাহেবের সঙ্গে?
না, তা করবেন না কান্তবাবু। শেষকালে আপনাকে হয়তো কেল্লার ফাটকে পুরে ফেলবে সাহেব। সাহেব বড় রেগে গেছে কিনা। সাহেব আমাকে বলে রেখেছে আপনি এলেই যেন তাকে খবর দিই। তা আমি তেমন নেমকহারাম নই কান্তবাবু। অন্য লোক হলে এত কথা বলত না, সাহেবকে গিয়ে চুপি চুপি খবরটা দিয়ে আসত
তা হলে আমি এখন কী করি বলো তো ষষ্ঠীপদ?
আমি আপনার ছোটভাইয়ের মতো কান্তবাবু, আমি বলছি আপনি এখান থেকে পালিয়ে যান। আপনার ভাবনা কী কান্তবাবু! এ ছোটলোকদের চাকরি কে সাধ করে করে? আমার যদি জানাশোনা থাকত তো আমি কবে নিজামতকাছারিতে গিয়ে চাকরি নিতুম! আপনাকে কত খোশামোদ করছে ওরা আর আপনি কিনা হেলায় হারাচ্ছেন! আপনি না নিন, আমাকে একটা চাকরি করে দিন ওখানে
কান্ত অনেক ভাবল। কাল থেকে খাওয়া নেই। কাল থেকে ঘুম নেই। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। সত্যিই তো৷ ষষ্ঠীপদ তো ঠিক কথাই বলেছে। নবাব মারা গেছে। তারপরেই ফিরিঙ্গি সাহেবদের মধ্যে তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। লড়াই-ই বেধে যাবে হয়তো। তখন কোথায় থাকবে ফিরিঙ্গি কোম্পানি আর কোথায়ই বা থাকবে তার চাকরি!
তা হলে আমি আসি ষষ্ঠীপদ।
হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি আর দাঁড়াবেন না, আপনি চলে যান। আপনি থাকলে আমার একটু সুবিধে হত, কিন্তু আমার সুবিধের চেয়ে আপনার সুবিধেটাই বড় বলে মনে করি আমার নিজের কষ্ট হোক, কিন্তু আপনার ভাল হোক, এই আমি চাই কান্তবাবু
কান্ত আর দাঁড়াল না। আর কোনও কথা না বলে সোজা আবার পথে পা বাড়াল পুঁটলিটা হাতে নিয়ে। মিছিমিছি অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে গেল। বিয়ের গায়ে-হলুদের কিছু জিনিসপত্র কিনতে হয়েছিল। নাপিতকেও রাহা খরচ দিতে হয়েছিল। বড়চাতরার বাড়িটা পরিষ্কার করবার জন্যেও নায়েববাবুদের গোমস্তাকে কিছু টাকা পাঠাতে হয়েছিল। একদিন বহু আগে সব ছেড়ে এখানে এই কলকাতায় এসে আশ্রয় পেয়েছিল, আজকে আবার এখান থেকেও চলে যেতে হল। সবাই যখন নিজের নিজের দেশ ছেড়ে কলকাতায় এসে নতুন করে বসবাস পত্তন করতে শুরু করছে, তখন কান্তকেই একলা এ-জায়গা ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। তবু তো মুর্শিদাবাদ রাজধানী! এই জলা-জঙ্গল ভরা কলকাতার থেকে তো সেই মুর্শিদাবাদ ভাল। মুর্শিদাবাদ হল শহর, আর এ তো গ্রাম। গণ্ডগ্রাম! ভাগ্যে থাকলে হয়তো সেই রাজধানীতে গিয়েই তার ভাগ্য উদয় হবে। কোথায় কবে কেমন করে কার ভাগ্য উদয় হয় কেউ কি বলতে পারে!
আশ্চর্য, কান্ত যদি জানত একদিন তার এই রাজধানীতে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার ইতিহাস এমন করে বদলে যাবে! যদি জানত একদিন তার ভাগ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের ভাগ্য জড়িয়ে একাকার হয়ে যাবে। যদি জানত শুধু বাংলাদেশ নয়, সমস্ত ভারতবর্ষের ভাগ্যলক্ষ্মীকে এমন করে পরের হাতে তুলে দেবে!
কান্ত গদি ছেড়ে চলে যাবার পরই বেভারিজ সাহেব এসে হাজির হল। সহজে বেভারিজ সাহেব কাউকে কিছু বলে না। কারবার করতে এসেছে কালাপানি পেরিয়ে। প্রথমে রাইটার হয়ে এসেছিল। তখন বছর কুড়ি বয়েস সাহেবের। নিজের দেশে কিছু হল না। বাপ-মা ছেলের জন্যে ভেবে ভেবে অস্থির। চাকরিবাকরি পায় না। এদিকে বেয়াড়া হয়ে যাচ্ছে ছেলের স্বভাব। মেয়েদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বেড়ায় দিনরাত। শেষকালে একদিন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজে উঠে ইন্ডিয়ায় এসে হাজির হল। যে বেভারিজ সাহেব নিজের দেশে খেতে পেত না ভাল করে, এই সস্তা-গণ্ডার দেশে এসে তার হাতে টাকা এল, মেয়েমানুষ এল। চাকর বাকর-ঝি-বেয়ারা নিয়ে একেবারে নবাবপুত্তুর হয়ে বসল। গড়গড়ায় তামাক খেতে লাগল। বারুইপুরের পান খেতে লাগল। চুলে তেল মাখতে লাগল। তখন ঘুমোবার সময় দু’জন চাকর পায়ে সুড়সুড়ি দিলে তবে বেভারিজ সাহেবের ঘুম আসে। সে ঘুম ভাঙে পরদিন বেলা বারোটায়! একজন তামাক সাজে, একজন জামা পরিয়ে দেয়, একজন আবার জুতো পরিয়ে দেয়। কুড়িটা চাকর না হলে বেভারিজ সাহেবের অসহায় বলে মনে হয় নিজেকে। তারপর খেয়েদেয়ে নাক ভাকিয়ে ঘুমিয়ে বিকেলবেলা পালকি নিয়ে বেরোয়। বেরিয়ে একবার পেরিন সাহেবের কেল্লায় যায়,
তারপর আসে সোরার গদিতে। সাহেব এলেই কান্ত হিসেবপত্র নিয়ে সাহেবের সামনে ধরে। সাহেব একবার দেখে। তারপর যথাস্থানে সইসাবুদ করে পকেটে টাকাকড়ি পুরে নিয়ে আবার পালকি করে চলে যায়।
কিন্তু সেদিন ষষ্ঠীপদকে দেখে সাহেব অবাক হয়ে গেল। কান্তবাবু কোথায়? হোয়ের ইজ কান্টোবাবু?
ষষ্ঠীপদ বললে–আজ্ঞে হুজুর, কান্তবাবু আসবে না
হোয়াই? কেন?
হুজুর, কান্তবাবু তো চাকরি করতে আসেনি এখানে, অন্য কাজে এসেছিল।
কী কাজ?
আজ্ঞে হুজুর, এতদিন আপনাকে আমি বলিনি, কান্তবাবু নবাবের স্পাই হুজুর!
হোয়াট!
বেভারিজ সাহেব যেন ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠেছে কেদারা থেকে। সামনে কেউটে সাপ দেখলেও কেউ এমন করে চমকে ওঠে না। নবাবের স্পাই এতদিন তার গদিতে কাজ করছে আর সাহেব কিনা কিছুই জানত না।
এতদিন আমাকে বলোনি কেন কিছু?
হুজুর, আমার কসুর হয়ে গেছে। আমি রোজ দেখতাম কান্তবাবুর কাছেনবাবের লোক আসত, এসে গুজগুজ ফিসফিস করত!
সাহেব বুঝতে পারলে না। জিজ্ঞেস করলে গুজগুজ ফিসফিস কী?
আজ্ঞে, এখানকার কেল্লার সব খবর নিত!
কে সে? লোকটার নাম কী?
আজ্ঞে বশির মিঞা! আসলে কান্তবাবু আপনার কাছ থেকেও মাইনে নিত, আবার নবাব-নিজামতের কাছারি থেকেও মাইনে নিত। দুমুখো সাপ হুজুর। তা ছাড়া আপনার গদির টাকাই কি কম মেরেছে। নাকি? আপনি তো কিছু দেখেন না হুজুর, হাজার হাজার টাকা মেরে নিয়েছে তবিল থেকে
স্ট্রেঞ্জ! বেভারিজ সাহেবের যেন চোখ খুলে গেল এতদিনে। হলওয়েল সেদিন বলেছিল বটে যে বাঙালিদের বিশ্বাস করতে নেই।
বলে হিসেবের খাতাটা বার করে খুলে ধরে দেখালে ষষ্ঠীপদ। এই দেখুন, এইখানে একান্ন টাকার খেলাপ লেখা আছে, আর এখানে জমার বেলায় শূন্য। আর এই দেখুন দু’শো তিরাশি টাকা জমা লেখা আছে, আর আয়ের ঘরে জমা করা হয়নি।
বেভারিজ সাহেব দেখলে নজর দিয়ে।
বললে–আগে এসব আমাকে বলেনি কেন?
আজ্ঞে আমি কী করে বলি? মুনশি হল কান্তবাবু, আমি তো গোমস্তা মাত্তোর, আমি খাস মুনশির বিরুদ্ধে বলব?
ঠিক আছে। বেভারিজ সাহেব বললে–ঠিক আছে, কান্তবাবুকে আমি ডিসচার্জ করে দিলাম। তুমিই মুনশির কাজ করবে এবার থেকে। মুনশির কাজ করতে পারবে তুমি?
ষষ্ঠীপদ হাসলে। সাহেব বুঝল সে হাসির মানে। জিজ্ঞেস করলে–মুনশির কে আছে কলকাতায়?
আজ্ঞে কান্তবাবু তো বেওয়ারিশ লোক, কে আর থাকবে? সাত কুলেও কেউ নেই–নো-ওয়ান ইন সেভেন কুল
সাহেব জিজ্ঞেস করলে কুল? হোয়াট ইজ কুল?
হুজুর, কুল মানে খাবার কুল নয়–কুল মানে ইয়ে..মানে…
আর বোঝাতে পারলে না ষষ্ঠীপদ। শেষকালে হাত মুখ নেড়ে বললে–সাত কুল মানে সাতপুরুষ, মানে স্যার সেভেনম্যান
সাহেব বোধহয় কিছুটা বুঝতে পারলে। সেভেন জেনারেশন। আর বুঝতে চাইলে না বিশদ করে। ষষ্ঠীপদ তবু বোঝাতে লাগল। মুর্শিদাবাদে পালিয়ে যাবে বলেই কলকাতায় একটা আস্তানা করেনি কান্তবাবু। আপনার এখান থেকে যত টাকা লুঠ করেছে সেই সমস্ত দিয়ে রাজধানীতে দালান-কোঠা বানিয়েছে, বিবি রেখেছে। আসলে খুলে বলি আপনাকে, কান্তবাবু হিন্দু নয় হুজুর। মুসলমান!
হিন্দু নয়? সাহেব যেন আবার অবাক হয়ে গেল।
না হুজুর। হিন্দু হলে কি আর অত নেমকহারাম হয় হুজুর? দেখছেন না হুজুর, আমি হিন্দু বলে কত অনেস্ট। আমাদের গড হল শিব। আমাদের শিবের গাজন হয়, আপনি দেখেছেন তো–চড়কের সময় পিঠে বান ছুঁড়ে কত কষ্ট করতে হয় বলুন তো
আর তুমি? তুমি শিবপুজো করো?
কী বলছেন হুজুর? করব না? আমি যে ব্রাহ্মণ হুজুর। এই দেখুন–আমার পইতে দেখুন বলে ষষ্ঠীপদ নিজের পইতেটা বুড়ো আঙুলে আটকে রেখে সাহেবের চোখের সামনে ধরলে।
আমি রোজ গঙ্গামাটি দিয়ে এই পইতে পরিষ্কার করি হুজুর। আপনি এবার থেকে যত চাকর রাখবেন সব এই পইতে দেখে রাখবেন, আপনার কোনও জিনিস চুরি হবে না। জাতের মধ্যে সবচেয়ে বড় জাত হচ্ছেন হুজুর, আপনারা, তারপরেই আমরা, এই ব্রাহ্মণরা। এটা আপনি জেনে রাখবেন হুজুর
ঠিক আছে, আজ থেকেই তুমি তা হলে মুনশির কাজ করো–
সাহেবের বোধহয় খুব তাড়া ছিল। তাড়াতাড়ি হিসেবের খাতায় সই করে, টাকাকড়ি পকেটে পুরে উঠছিল। পেছন থেকে ষষ্ঠীপদ এগিয়ে গিয়ে বললে–হুজুর, তা হলে গোমস্তার কাজ কে করবে? আমি তো মুনশি–
সাহেব বললে–আর একজন খুঁজতে হবে
তার চেয়ে হুজুর, একটা কাজ করি, আমার এক ব্রাদার-ইন-ল আছে, সে একেবারে পিয়োর ব্রাহ্মণ, যাকে বলে হজুর একেবারে খাঁটি ব্রাহ্মণ, তার পইতে আমার চেয়েও সাদা, একেবারে সাদা ধপধপ করছে, তাকে রাখবেন? তারও গড শিব
অলরাইট, তাকেই রাখো, কিন্তু ব্রাহ্মিণ যেন হয়—
বলে সাহেব তাড়াতাড়ি আবার পালকিতে গিয়ে উঠল। নইলে ওদিকেও দেরি হয়ে যাবে। সাহেবের সন্ধেবেলা ড্যান্স চাই, ওয়াইন চাই, ওম্যান চাই। এসব নিয়ে বেশি সময় নষ্ট করবার সময় থাকে না বেভারিজ সাহেবের।
সাহেব চলে যেতেই ভৈরব গুটিগুটি ভেতরে ঢুকল। ষষ্ঠীপদ দেখেই বললে–ঠিক গন্ধ পেয়েছিস তো! তোর চাকরি হয়ে গেল, কাল থেকে এখেনে গোমস্তার কাজ করবি
তা মাইনে? মাইনে কত পাব কত্তা?
কেন, তোর সঙ্গে তো কথা হয়ে আছে। দু’টাকা মাইনে, তার থেকে এক টাকা আমার। কিন্তু কথার খেলাফি যদি করো বাপু এখন, তা হলে কিন্তু তোমার চাকরি হবে না, তা বলে রাখছি। আর ওই যা বলেছিলুম–যা হাতসাফাই করব, তার দশভাগের একভাগ তোমার, বাকিটা সব আমার–রাজি তো? আমি কান্তবাবুকেও ওই কথাই বলেছিলুম, তা কান্তবাবু তো রাজি হয়নি, তাই এখন সরে যেতে হল। আমার সঙ্গে চালাকি করে পারবিনে, তা বলে রাখছি
তারপর একটু থেমে বললে–আর একটা কথা, তোকে বাপু গলায় একটা পইতে দিতে হবে
ভৈরব জিভ কেটেছে। সেকী হুজুর? আমি যে নমশূদ্র
নমশূদ্র তো কী হয়েছে? আমিও তো বাহাত্তরে কায়েত, আমি কী করে পইতে পরি? এ কি আমার দেশ না তোর দেশ? এখেনে বেটা ম্লেচ্ছদের হাতে মাইনে নিলে জাত যায় না, আর পইতে নিলেই একেবারে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? টাকা বড় না জাত বড়? বল, বল তাই আমাকে–
আজ্ঞে টাকা!
তবে? তবে যে পইতে পরতে ভয় পাচ্ছিস? যখন এককাঁড়ি টাকা নিয়ে দেশে-গাঁয়ে যাবি তখন পইতেটা ছুঁড়ে ফেলে দিস, কে দেখতে যাচ্ছে? চিরকাল তো আর ফিরিঙ্গি কোম্পানি থাকবে না, দু’দিনের জন্যে এসেছে, কারবার করছে, আবার একদিন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাবে। কিন্তু টাকাটা তো আর ফিরিয়ে নিতে পারবে না। আমাদের টাকা আমাদেরই থেকে যাবে। তখন টাকা দিয়ে তিনটে বামুন খাইয়ে কালীঘাটে পুজো দিলেই প্রাশ্চিত্তির হয়ে যাবে
কথাটা ভৈরবের তখনও ভাল করে উপলব্ধি হয়নি।
ষষ্ঠীপদ বললে–তিনগাছা ফরসা সুতো নিয়ে গলায় দিয়ে আয়, আজ থেকেই তোর চাকরি হয়ে গেল ধরে নে–আর সাহেব এসে যদি তোর নাম জিজ্ঞেস করে, যেন বলিসনি তোর নাম ভৈরব দাস, বলবি ভৈরব চক্কোত্তি, বুঝলি?
ভৈরব বুঝল কি বুঝল না, কে জানে!
অত তখন ভাববার সময় নেই ষষ্ঠীপদর। ভৈরব ঘাড় নেড়ে পইতে জোগাড় করতে চলে গেল।
*
বশির মিঞার ফুপা মনসুর আলি মেহের মোহরারের সঙ্গে কান্তর সেই প্রথম দেখা। বশির মিঞাই নিজে নিয়ে গেল তার কাছে। এলাহি কাণ্ড চারদিকে। এর আগে কখনও নিজামতকাছারি দেখেনি কান্ত। মনটাও খারাপ হয়ে গিয়েছিল তার। এত সৎভাবে চাকরি করেও চাকরি রইল না তার। সাহেব তাকে ভুল ভাবলে। সাহেব কিনা ভাবলে তার মুনশি নবাবের নিজামতের চর। স্পাই। কলকাতা থেকে হাতিয়াগড়, হাতিয়াগড় থেকে কলকাতা। আবার কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ। হাতে একটা বাড়তি টাকাও নেই।
বশির মিঞা বললে–ফুপা, এই হল আমার দোস্ত–এর কাছ থেকেই ফিরিঙ্গিদের সব খবর পেতাম খুব সাচ্চা আদমি, একেই হাতিয়াগড়ে পাঠাচ্ছি
মনসুর আলি মেহের সাহেব একবার কান্তর আপাদমস্তক দেখে নিলে। সারা বাংলা মুলুক চালাতে হয় মনসুর আলিকে। একদিকে মেহেদি নেসার সাহেব, আর একদিকে মিরজাফর আলি, জগৎশেঠ। দু’বজরায় পা দিয়ে চলতে হচ্ছে। বড় ঝকমারির নতিজা হয়েছে কাছারির কাজ।
কাফের তো?
হ্যাঁ হ্যাঁ ফুপা, কাফের। হিন্দু কাফের। বেইমানি করবে না।
মনসুর আলি সাহেব কান্তর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলে–পারবে তো কাজ?
কী কাজ তাই জানে না কান্ত, তার আবার পারাপারির কী আছে! আর সাহেবের গদির মুনশিগিরি করে এসেছে এতদিন, কোন কাজটা না পারার আছে
তুই বলেছিস তো ওকে, কাজটা কী?
বশির মিঞা বললে–সে আমি সব সমঝিয়ে দেব, কিন্তু ওকে আমি বলেছি ছ’টাকা তলব দিতে হবে। ইমানদার আদমি যখন, ছ’টাকা তলব দিলে কী আর নুকসান!
এর বেশি আর কথা হল না মনসুর আলির সামনে। তারপর কাছারির বাইরে বেরিয়ে এসে বশির মিঞা সব বুঝিয়ে বললে। সব শুনে কান্তর হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে এল! আবার সেই হাতিয়াগড়ে যেতে হবে!
কিন্তু রানিবিবিকে এখানে কেন আনবে?
তা জেনে তোর ফয়দা কী? তোকে যা হুকুম করছি তাই-ই কর। কী কাম, কেন করতে হবে, এসব কখনও পুছিস না। জাসুসি কাম এই রকম। আর তোর তো কিছু ঝক্কি নেই। তুই শুধু সঙ্গে সঙ্গে থাকবি। তোর সঙ্গে টাকা থাকবে, পাঞ্জা থাকবে, ফৌজি সেপাই থাকবে, বাকি কাজ সব ডিহিদারের আদমি আছে, তারা করে রাখবে। তুই গেলেই হাতিয়াগড়ের বাপের বাপও গররাজি হবার সাহস করবে না।
কিন্তু তুই যাচ্ছিস না কেন?
বশির মিঞা বললে–আরে মেহেদি নেসার সাহেব যে আমাকে দিয়ে ভরসা করতে পারবে না। আমি যদি মেরে দিই? আমি যদি লবাবের মাল লুটেপুটে খাই?
তার মানে?
বশির মিঞা চটে গেল। বললে–তুই ওসব বুঝবি না এখন। আরও দিনকতক কাম কর নিজামতে তখন হালচাল বুঝে ফেলবি। আমরা শালারা আমাদের নিজের জাতের ওপরেই ভরসা করি না হিন্দুদেরও ভরসা করি না, মোসলমানদেরও ভরসা করি না
কিন্তু তোদের দলে তা হলে কে আছে?
মেহেদি নেসার আছে, আর আরও অনেকে আছে
বলে আর কিছু বলতে চায়নি বশির মিঞা। কান্তও জিজ্ঞেস করেনি৷ টাকা নিয়ে পাঞ্জা নিয়ে সোজা হাতিয়াগড়ে এসে পৌঁছেছিল। গরমে টা ঐটা করছে মাটি। আসবার সময় হাঁটা রাস্তা। রানিবিবিকে নিয়ে ফেরবার সময় তখন আর হাঁটা পথে ফিরতে হবে না। তখন ডিহিদার বজরা দেবে, পালকি দেবে। কাশিমবাজার থেকে সোজা পশ্চিম দিকে গেলে বক্রেশ্বর, তারপর বক্রেশ্বর থেকে সোজা বর্ধমান। সেখান থেকে হাতিয়াগড় দেড় দিনের পথ।
যখন হাতিয়াগড় পৌঁছোল কান্ত, তখন বেশ বেলা। ডিহিদারের দফতরে যাবার রাস্তাটা জেনে নিয়েছিল রাস্তার লোকজনদের কাছে। এই ক’দিন আগেই এখানে এসেছিল বিয়ে করতে। আবার এখানেই তাকে আসতে হবে কে জানত। যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে, তার সঙ্গেই হয়তো শ্বশুরবাড়িতে চলে গেছে সেবউ। হয়তো এতদিন বউভাতও হয়ে গেছে। তারপর হয়তো ধুলো পায়ে লগ্ন সারতে মাথায় সিঁদুর পরে ঘোমটা দিয়ে আবার হাতিয়াগড়েই ফিরে এসেছে, কে জানে!
হ্যাঁগো, এখানে ডিহিদারের দপ্তর কোন পাড়ায় গো?
আপনি কে?
কেমন যেন সন্দেহভরা দৃষ্টি দিয়ে লোকটা তার দিকে চেয়ে দেখলে। তার আসল উদ্দেশ্যটা লোকে জেনে গেছে নাকি! লোকটারও তাড়া ছিল। সেও আর দাঁড়াল না। তখনও বেশ বেলা রয়েছে। সোজা চলতে চলতে নদীর ঘাটে এসে দাঁড়াল। এইখানেই নেমেছিল সেদিন নৌকো থেকে। এইখানেই সেই সচ্চরিত্র ঘটকটা দাঁড়িয়ে ছিল। পুরনো সব কথাগুলো মনে পড়তে লাগল। সেদিন আর এ-দিনে কত তফাত। দূরেই মন্দিরটা দেখা যাচ্ছে। বশির মিঞা বলে দিয়েছিল বুড়ো শিবের মন্দির ওটা। ওরই পেছনে হাতিয়াগড়ের রাজবাড়ি। কোথাকার কোন রাজার বউকে কোন একনবাবের কাছে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। চাকরির এও এক বিড়ম্বনা।
হঠাৎ দূরে যেন একটা ভিড় দেখা গেল।
ওইটেই তো তার সেই শ্বশুরবাড়ি। ওই বাড়িটার সামনেই তো সে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কত লোক উঠোনে খেতে বসেছিল। আজ আবার সেই বাড়িটার সামনেই ভিড়ে ভিড়। আজ আবার ওখানে কী হল।
তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে এগিয়ে গেল কান্ত।
ভিড়ের ঠেলায় ভেতরে কিছু দেখা যায় না। হঠাৎ নজরে পড়ল তার সেই শ্বশুর। শোভারাম বিশ্বাস। চোখ দুটো ছলছল করছে। কাদোক্কাদো মুখ। কী হল আবার এ বাড়িতে! এখন মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে, এখন তো মুখে হাসি বেরোবার কথা!
হ্যাঁগো, এবাড়িতে কী হয়েছে?
চাষাভুষো লোক একজন। কেন, আপনি জানেন না? আপনি কোন গাঁয়ের লোক? হাতিয়াগড়ের সব লোক জেনে গেছে যে! কোন সরকার থেকে আসছেন আপনি? সাত-গাঁ, না বাজুহা?
আমি পরদেশি, কিছু বিপদআপদ হয়েছে বুঝি?
লোকটা বললে–ওই যে দেখছেন বুড়োপানা লোক, ওর মেয়ে পালিয়ে গিয়েছে, বিয়ের রাত্তিরে। বাসরঘর থেকে কিনে পালিয়ে গেছে!
মাথায় যেন বজ্রাঘাত হল কান্তর! কোথায় পালিয়ে গেছে?
ভগমান জানে! তাই তো দুগ্যা হাত চালাচ্ছে–দেখছেন না?
দুগ্যা কে?
রাজবাড়ির ঝি দুগ্যা যে গুণ করতে জানে, নয়ানপিসি মাটিতে হাত পেতে আছে, ওই হাত চলতে আরম্ভ করবে
সত্যিই দুর্গা তখন বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ছে। পুবপাড়া, দক্ষিণপাড়া, তাঁতিপাড়া, কৈবর্তপাড়া, মুসলমানপাড়া–সব পাড়ার লোক হাত-চালা দেখতে এসেছে। উঠোন-দাওয়া-ঘর ভরে গেছে। দুর্গা একটা নতুন থান শাড়ি পরেছে। পুজো তখন সবে বুঝি আরম্ভ হচ্ছে। চালে হলুদে মেখে সাজালে পুজোর জায়গাটা। তারপর জিজ্ঞেস করলে কুলকাঠ কই, কুলকাঠ?
শোভারাম কুলকাঠ একগাছা এগিয়ে দিলে সামনের দিকে। সেই কুলকাঠে আগুন জ্বালানো হল। দাউদাউ করে জ্বলে উঠল শুকনো কুলকাঠ।
তারপর দুর্গা সেই কুলকাঠের আগুনের ওপর একটু একটু করে চাল ছড়ায় আর মন্ত্র পড়ে
আচাল চাল ওচাল চালম, চালম গোরক্ষনাথ।
পাতালের বাসুকী চালম, চালম পিসির হাত।
নয়ানপিসি এতক্ষণ মাটির ওপর নিজের হাতের পাতাটা উপুড় করে রেখেছিল। দুর্গা গুনে গুনে একশো আটবার তার হাতের ওপর আরও কী সব মন্ত্র পড়তে লাগল। শেষে অবাক কাণ্ড! পিসির হাতখানা আস্তে আস্তে চলতে শুরু করল। উঠোন পেরিয়ে দাওয়ায় গিয়ে উঠল হাত। মানুষের ভিড়ও আস্তে আস্তে এগোতে লাগল। কান্তও এগোল। সামনের ভিড় সরে গেল। ভিড়ের ফাঁক দিয়ে নয়ানপিসিও চলতে লাগল হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে। আর পেছন পেছন দুর্গাও চলতে লাগল সঙ্গে সঙ্গে।
শোভারাম কেমন যেন তখনও বিমর্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। পাশের একজনকে জিজ্ঞেস করলে ও হরিপদ, মাকে আমার পাওয়া যাবে তো?
হরিপদ বললে–তুমি চুপ করো তো, দুগ্যা তোমার মরিকে নির্ঘাত বার করে দেবে–তুমি চুপ করে দেখোনা
নয়ানপিসির হাত দাওয়া ছাড়িয়ে ঘরের ভেতরে গিয়ে ঢুকল। ওই ঘরেই মরালীর বাসরঘর হয়েছিল বুঝি। তখনও বাসরঘরের বালিশ-বিছানা তেমনি পড়ে আছে। কেউ হাত দেয়নি।
শোভারামের বুকটা বুঝি ঢিপঢিপ করে উঠল।
কান্ত পাশের লোকটাকে আবার জিজ্ঞেস করলে–যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল, সে কোথায় গো? সে এখেনে আছে?
লোকটার এ কথার উত্তর দেবার সময় নেই তখন। সবাই তখন মজা দেখছে একমনে। কান্তও সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল। জানালার আড়াল থেকে অনেক মেয়েমানুষ হাত-চালা দেখতে এসেছে। এখানে না এলে তো এ-খবর জানতেও পারত না কান্ত! তবে কি বর পছন্দ হয়নি। তবে কি আত্মঘাতী হল মনের দুঃখে!
কান্ত দেখলে, নয়ানপিসি বলে সেই বিধবা মেয়েমানুষটা হাত চালিয়ে যেতে যেতে একেবারে খিড়কির দিকের দরজার কাছে এসে আটকে গেছে।
দুর্গা চিৎকার করে উঠল-ইদু পিদু কুড়ি স্বাহা
আর নয়ানপিসি সঙ্গে সঙ্গে সেইখানেই দড়াম করে অজ্ঞান হয়ে পড়ল। সঁতকপাটি লেগে গেল তার।
দুর্গা এবার শোভারামের দিকে চেয়ে বললে–মাথায় জল ঢালো নয়ান পিসির
কে একজন ঘড়া এনে জল ঢালতে লাগল নয়ান পিসির মাথায়।
শোভারাম ভয় পেয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলে কী হল দুগ্যা? পেলে না?
দুর্গা বললে–মেয়েকে তোমার পাওয়া যাবে না শোভারাম
শোভারামের যেন তখন মাথায় বজ্রাঘাত হল। পাওয়া যাবে না?
ততক্ষণে দুর্গা সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বললে–না
কোথায় গেল?
দুর্গা বললে–দেব-নর-গন্ধর্ব কারও সাধ্যি নেই জানতে পারে।
তবু শোভারামের সন্দেহ গেল না। জিজ্ঞেস করলে কেন?
দুর্গা বললে–তোমার মেয়ে পুষ্যানক্ষত্রে শ্বেতজয়ন্তীর শেকড় খেয়েছে তার সন্ধান আর কেউ পাবে না
কথাটা শুনে শোভারাম হাউহাউ করে কেঁদে ফেললে। আশেপাশের লোকজনও এতক্ষণ শুনছিল। তাদেরও মন বুঝি ভারী হয়ে এল। শ্বেতজয়ন্তীর শেকড় তাকে বাসরঘরে কে এনে দিতে গেল কে জানে। আর তখন যে পুষ্যানক্ষত্র ছিল তাই বা কার জানার কথা!
শোভারাম কেঁদে পড়ল। বললে–তুমি যেমন করে পারো আমার মেয়েকে বার করে দাও দুগ্যা
দুর্গা বললে–আমি তো আমি, আমার চোদ্দোপুরুষের সাধ্যি নেই তাকে খুঁজে বার করে–ছোটমশাই আজ রাত্তিরে বাড়ি নেই, আমার অনেক কাজ, আমি চলি–
একটা কিছু ব্যবস্থা করবে না দুগ্যা? আমার যে ওই এক মেয়ে
দেখি কী করতে পারি, পরে ভেবে বলব
বলে দুর্গা কোমর দুলিয়ে রাজবাড়ির দিকে হনহন করে চলে গেল
.
ওদিকে শিবনিবাসের প্রাসাদে গোপালবাবু তখনও উদ্ধব দাসকে নিয়ে মশকরা করছিল। বলছিল তা বউ তোমার পালাল কেন হে উদ্ধব দাস?
উদ্ধব দাস গান গেয়ে উঠল। হাত মুখ নেড়ে বললে–
কেন শ্যামা গো তোর পদতলে স্বামী।
তুই সতী হয়ে পতি-পরে করিলি বদনামী ॥
পাশের ঘর থেকে উদ্ধব দাসের গানের সুরটা কানে আসতেই মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। তারপর চিঠি থেকে মুখ তুললেন।
ছোটমশাই অধীর হয়ে একটা কিছু উত্তর শোনবার প্রতীক্ষায় ছিলেন।
এবার বললেন–তা হলে আমি এখন কী করি বলুন আপনি?
একটা উপায় আছে।
কী উপায়? আমার যে আর সময় নেই। আজ নবাব আমার স্ত্রীর দিকে নজর দিয়েছে, কাল হয়তো আবার আর কারও স্ত্রীর দিকে নজর দেবে, তখন? তা ছাড়া, আমি হয়তো ফিরে গিয়েই দেখব। ডিহিদারের লোক এসে গেছে
কী করে জানলেন?
ছোটমশাই বললেন–মুর্শিদাবাদে মিরজাফর আলি সাহেবের কাছে শুনলাম, মেহেদি নেসার নাকি একজন হিন্দুকে ভার দিয়ে দিয়েছে তাকে আনবার জন্যে।
কেন, হিন্দুকে কেন?
মুসলমানদের যে মেহেদি নেসার বিশ্বাস করে না। দেখলেন না মিরজাফরকে তাড়িয়ে দিয়ে সেই জায়গায় দেওয়ান-ই-আলা করে দিলে মোহনলালকে
পাশের ঘরে তখন উদ্ধব দাসের গলা আবার শোনা গেল। উদ্ধব দাস বলছে এই হেঁয়ালিটার সমাধান করুন তো প্রভু
ব্যবসায় ছয়গুণ হয় যেই জন।
পুরুষ অপেক্ষা করে দ্বিগুণ ভোজন।
বুদ্ধিতে যে চারিগুণ অসত্য এ নয়।
রমণেতে আটগুণ জানহ নিশ্চয়
পুরুষ অপেক্ষা যারা এত গুণ ধরে।
তত্ৰাচ জগৎ তারে অবিশ্বাস করে ॥
বলুন তো প্রভু, কী?
*
ডিহিদার সব ব্যবস্থাই করে রেখেছিল। ডিহিদার রেজা আলি দোর্দণ্ডপ্রতাপ লোক। মেহেদি নেসার সাহেবের দূরসম্পর্কের রিস্তাদার। কোথায় কার টাকা হল, কে কারবার করে দুটো পয়সা উপার্জন করেছে, সেদিকে খবর রাখাই তার আসল কাজ। মেহেদি নেসার মেহেরবানি করলে একদিন রেজা। আলি ফৌজদার পর্যন্ত উঠতে পারে। কাগজে কলমে ফৌজদাররা দিল্লির বাদশার লোক হলেও, আসলে তো নবাবই সব। তারপর আল্লার দোয়া থাকে তো সুবাদার হতেও আটকাবে না। তখন এক-হাজারি থেকে দশ-হাজারি মনসবদারি পর্যন্ত সবকিছুই রেজা আলির মুঠোর মধ্যে। তখন নবাবও যা, রেজা আলিও তাই। তখন রেজা আলি চেহেল্-সুতুনে নবাবের সামনে গিয়ে কুর্নিশ করে কথা বলবে। তখনকার কথা ভেবেই রেজা আলি নিজের দফতরে বসে মৌচে তা দেয়। তখনকার কথা ভেবেই রেজা আলি নিজের ঘোড়াটার পিঠে সপাং করে চাবুক কষিয়ে দেয়। বলে জোর কদম ফিরিঙ্গি
রেজা আলি আদর করে নিজের ঘোড়ার নাম দিয়েছে ফিরিঙ্গি।
সেদিন সন্ধেবেলাও রেজা আলি নিজের এলাকায় টহল দিয়ে ফিরে এসেছে। ফিরে এসেই দফতরে একজন কাফেরকে দেখে জিজ্ঞেস করলে–তুমি কে? তুম কৌন?
কান্তর কাছে সবই ছিল। পরিচয় দেবার যা যা সরঞ্জাম, সমস্তই মনসুর আলি মেহের সাহেবের কাছ থেকে জুগিয়েছিল বশির মিঞা। একটা খও দিয়ে দিয়েছিল সঙ্গে। কিছু অসুবিধে হবার কথা নয়। নবাবি নিজামতে সব পাকা কাজ। রেজা আলি সমস্ত দেখলে, ঠিক আছে। মেহেদি নেসার সাহেব এত লোক থাকতে কেন একজন কাফেরকে পাঠিয়েছে, তাও বুঝতে পারলে। মেহেদি নেসার সাহেবের এই এক গলত। সব কাজে নিজের জাতভাইকে সন্দেহ করবে। কিন্তু রেজা আলির মনে হয়, কাফেরদের এত বিশ্বাস করা ভাল নয়। নবাব আলিবর্দি খাঁ সাহেবেরও এই দোষ ছিল। জগৎশেঠজিকে বড় বেশি বিশ্বাস করেছে। এখন? এখন সেই জগৎশেঠজি যে ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে দহরমমহরম করছে, কারবার চালাচ্ছে!
ঠিক আছে, তুমি তৈরি থাকবে, আমার পালকি তৈরি আছে, বজরা আছে, ভোরাত্রেই কাম ফতে হয়ে যাবে!
কান্ত তো তৈরিই ছিল। নতুন করে আর কী তৈরি হবে। নবাবি-নোকরিতে যখন যেখানে পাঠাবে, সেখানেই যাবার জন্যে তৈরি হয়ে থাকতে হবে। আজ বলবে ইসলামাবাদ যাও, কালই হয়তো আবার জেলালগড়। আকবরনগরই হোক আর বক্সবন্দরই হোক, কিংবা দিল্লিই হোক, কান্ত সবসময়ই তৈরি।
সেই ডিহিদারের দফতরের একপাশেই সারাটা রাত একরকম জেগেই কাটল তার। শুয়ে শুয়েও কেবল মনে পড়তে লাগল সেই বিকেলবেলার ঘটনাটা। কোথায় গেল মেয়েটা। আর বিয়ের বাসর থেকে পালালই বা কেন? মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল নাকি? যার তার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল বলে রাগ করে পালিয়েছে? দেবনর-গন্ধর্ব কেউ টের পাবে না, এই-ই বা কেমন পালানো! পুষ্যানক্ষত্রে শ্বেতজয়ন্তীর শেকড় খেলে কি কেউ খুঁজে পাবে না? কান্তরও যেন কেমন পালাতে ইচ্ছে করল। কেউ টের পাবে না, সে বেশ হবে! বেশ পেট চালানোর দায়িত্ব থেকে বেঁচে যাবে। সে এর থেকে অনেক ভাল। কোথাকার কোন রাজার রানি তাকে নিয়ে যাবার দুর্ভোগ থেকে তো অন্তত বাঁচবে।
মনে আছে, তখন অনেক রাত। শেষ রাতের তারাটা তখন ডিহিদারের দফতরের জানালা দিয়ে স্পষ্ট উঁকি মারছিল। একজন সেপাইয়ের ডাকে কান্ত ধড়মড় করে উঠে পড়ল।
ভাইয়া, উঠো উঠো, জলদি উঠো
রেজা আলির কাজ পাকা কাজ। সব বন্দোবস্ত করে রেখে তবে খবর দিয়েছে। দু’জন সেপাই, একটা বজরা নদীর ঘাটে তৈরি। সেই মাঝরাতেই কখন যে সব সেপাইরা রাজবাড়িতে গিয়ে পৌঁছেছে, কখন। তারা তোড়জোড় করে সব ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছে, কেউ টের পায়নি। হাতিয়াগড়ের প্রজা-পাঠকরা তখন সবাই সারাদিন খেত-খামারে খেটে ঘুমে অচৈতন্য। তারা জানতেও পারলে না, কোথায় কখন কার কলকাঠিতে অত বড় রাজবাড়ির সাতমহল থেকে কী রাহাজানি হয়ে গেল। যে-হাতিয়াগড়ের বড়মশাই একদিন খাজনা দিয়ে, নবাবের বিপদে-আপদে, অর্থ-ঐশ্বর্য-স্বার্থ দিয়ে বাংলায় নবাবি মসনদ কায়েম করে দিয়েছিল, তারই প্রাসাদ থেকে আর-এক নবাব তার লজ্জা-সম্মান-সম্ভ্রম সমস্ত অপহরণ করে নিয়ে গেল।
বুড়োশিবের মন্দিরের তলায় অন্ধকারে গিয়ে দাঁড়াল কান্ত।
সেপাই দুটো সিংদরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। কান্তর দিকে চেয়ে বললে–আরে উধার কাহে, ইধার আও, ডরনা মাত
ডিহিদার রেজা আলি নিজে তখন সরকারমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে ভেতরে গেছে। সেখানে দাঁড়িয়েই দু’জনে কী কথা হচ্ছে ওদের। রেজা আলির ফিরিঙ্গি’দরজার সামনে দু-একবার পা ঠুকল। তার যেন আর দেরি সইছে না। সেও যেন অস্থির হয়ে উঠেছে মেহেদি নেসারের মতো। সেও যেন পা-কে বলছে–আর দেরি কোরো না-নবাবের শান্তির দরকার,নবাবের একটু মহফিলের দরকার। নবাব মসনদে বসে যন্ত্রণায় ছটফট করছে। তার চারদিকে দুশমন। তাড়াতাড়ি তোমার রানিবিবিকে পাঠিয়ে দাও। নতুন মেয়েমানুষ দিয়ে তাকে আমরা ঠান্ডা রাখব। আমরা তাকে শান্তি দেব। মনসুর-উল-মুলক খেলাৎ মির্জা মহম্মদ সিরাজ-উ-দ্দৌলা শা কুলি খান বাহাদুর খুশি থাকলে তবেই তো আমরা খুশি থাকব। আমরা খুশি থাকলে তবে তো বাংলা মুলুক খুশি থাকবে। বাংলা মুলুক খুশি থাকলে। দিল্লির বাদশা শাহানশাও খুশি থাকবে। তখন যত ইচ্ছে ফুর্তি করো, মহফিল করো, আমরা কাউকে কিছু বলব না।
সেই অন্ধকার রাতে রাজবাড়ির কোথায় বুঝি কোন কোণে একবার একটু চাপা মেয়েলি গলার শব্দ হল। একটা অস্ফুট আর্তনাদ। মহলে মহলে বুঝি একটা ত্রস্ত পদক্ষেপ। তারপর পালকিটা ঢুকে গেল সিংদরজার ভেতরের চবুতরে। একটা ফিসফিস শব্দ। অস্পষ্ট অনুচ্চারিত একটা দীর্ঘশ্বাস। কাউকে জানাবার দরকার নেই কী দুর্ঘটনা ঘটে গেল। কাল সকালে বাড়ির ভেতরে বাইরে কেউ যেন টের না পায়। যেমন খাজাঞ্চিখানায় রোজ সকালবেলায় খাতক-প্রজা-পাইকের ভিড় থাকে, কালও তেমনই ভিড় থাকবে। রোজ সকালবেলা শোভারাম যেমন ছোটমশাইকে স্নান করাতে আসে, তেমনই আসবে। ছোটমশাইয়ের জলচৌকিটার ধারে দাঁড়িয়ে বুকে-পিঠে-পায়ে সরষের তেল মাখিয়ে দেবে। কাল সকালেও বিশু পরামানিক এসে খেউরি করে দিয়ে যাবে ছোটমশাইকে। কাল সকালেও বড় বউরানি সাজিতে করে ফুল সাজিয়ে বুড়োশিবের মন্দিরে পুজো করতে যাবেন গলায় আঁচল দিয়ে। কেউ জানবে না, কোথায় কখন কী ব্যতিক্রম হল। হাতিয়াগড়ের প্রজারা আজ মাঝরাত্রে যেমন ঘুমিয়ে আছে, কাল দিনের প্রখর সূর্যের আলোতেও তেমনি করেই ঘুমিয়ে থাকবে।
অন্ধকারের সুড়ঙ্গ বেয়ে দুটো আলতা-পরা পা আর জাহাঙ্গিরাবাদের জরি-পাড় শাড়ি দিয়ে মোড়া একটি যৌবন পালকির ভেতরে এসে ঢুকল আর পালকির দরজার দুটো পাল্লা সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল। অন্ধকারের সুড়ঙ্গ বেয়েই আবার সে-যৌবন বেহারাদের কাঁধে চড়ে নিঃশব্দে এগিয়ে চলল আর এক অন্ধকার সুড়ঙ্গের দিকে। সে-সুড়ঙ্গে পাপ-পুণ্য, ন্যায়-অন্যায়, ধর্ম-অধর্ম সব একাকার হয়ে গেছে। সে সুড়ঙ্গের ভেতরে ষড়যন্ত্র আর ষড়যন্ত্রণা নিঃশব্দ আর্তনাদ করে মাথা কুটে মরলেও কেউ প্রতিকার করবার নেই। সেখানেই তার ভূমি-সমাধি হয়ে যাবে চিরকালের মতো। তাকে আর কেউ চিনবে না, জানবে না। বাইরের পৃথিবীতে তার নাম-ধামকুল-গোত্র-পরিচয় চিরকালের মতো মুছে গিয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে।
অন্ধকারে কেউ সেদিন শাঁখও বাজাল না, উলুও দিল না। একদিন যে এ-বাড়িতে বধূ হয়ে এসেছিল, অনেক আচার-অনুষ্ঠানের অনেক মাঙ্গলিক-মন্ত্রের অনুশাসন পালন করে, সে-ই আবার আজ নিঃশব্দে গোপনে সিংদরজা পেরিয়ে উলটোপথে বাড়ির বাইরে চলে গেল। তাকে বার করে দিয়েই, তাকে দূরে তাড়িয়ে দিয়েই যেন এই হাতিয়াগড়ের রাজবাড়ির পবিত্রতা সুনাম সম্মান বেঁচে গেল। তার ছোঁয়াচ থেকে এবাড়ির প্রত্যেকটা পাথর, প্রত্যেকটা ইট, প্রত্যেকটা প্রাণী যেন নিরুপদ্রব হল।
সেদিন সেই রাত্রের পঞ্চম প্রহরে কোথায় কোন গাছের কোটর থেকে একটা তক্ষক হঠাৎ কর্কশ স্বরে ডেকে রাত্রির স্তব্ধতাকে ভেঙেচুরে খানখান করে দিলে। আর সে-ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইল শুধু বুঝি সেই নিস্তব্ধ রাত্রির একটা তক্ষক। আর কেউ নয়। আর যদি কেউ কিছু শুনে থাকো, কিছু দেখে থাকো, কিছু বুঝে থাকো তো সমস্ত ভুলে যাও। এ-ঘটনা যদি কখনও তোমার মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয় তো সেদিন বুঝবে, তোমারও চরম সর্বনাশ। সেদিন তোমাকেও এ-পৃথিবী থেকে সেই অবধারিত সুড়ঙ্গের অন্ধকারে নির্বাসনদণ্ড ভোগ করতে হবে। তুমিও এই আজকের রানিবিবির মতো নাম-ধাম-গোত্র পরিচয়হীন হয়ে মুর্শিদাবাদের হারেমের মধ্যে নিঃশেষ হয়ে যাবে!
হঠাৎ যেন একটা শব্দে কান্ত চমকে উঠল।
চুপ করে খাড়া রইলে কেন বাবুজি, চলো, চলো
সেপাই দুটোর কথায় যেন এতক্ষণে ঘুম ভাঙল কান্তর। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই যেন এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল সে৷ তারপর স্বপ্নের ঘোরেই আবার সকলের পেছন পেছন চলতে লাগল। যেখানে বর্তমান মুহূর্ত ইহকালে গিয়ে মিশেছে, যেখানে আজকের বাস্তবতা আগামীকালের ইতিহাস হয়ে উঠেছে, সেইদিকে লক্ষ করেই যেন চলতে লাগল কান্ত। সেই বুড়োশিবের মন্দির পেরিয়ে ছোটমশাইয়ের তরকারির খেত, তার পাশ দিয়েই রাস্তা। সেই রাস্তা পেরিয়েই ছাতিমতলার ঢিবি। তারপর জায়গাটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে সোজা একেবারে নদীর ঘাটে। সেখানে ডিহিদারের বজরা দাঁড়িয়ে আছে। বজরার পাল খাঁটিয়ে মাঝিমাল্লারা তৈরি। রানিবিবি বজরায় উঠলেই তারা বদর-বদর বলে কাছি খুলে দেবে। আর ইতিহাসের পাখায় ভর করে হাতিয়াগড়ের যৌবন নিরুদ্দেশের দিকে উধাও হয়ে যাবে
একটু দাঁড়ান, শাড়িটা আটকে গেছে। ঘাট থেকে বজরায় ঠিকই উঠেছিল রানিবিবি। কিন্তু বজরায় উঠে ছই-ঢাকা ঘরের মধ্যে ঢুকতে গিয়েই জাহাঙ্গিরাবাদের শাড়ির জরির পাড়টা আটকে গেছে ছইয়ের বাঁশের খোঁচায়।
কান্ত তাড়াতাড়ি নিচু হয়ে শাড়িটা খুলে দিলে। সেই অন্ধকারেও নজরে পড়ল সুগোল একটা টুকটুকে ফরসা পায়ের গোছ, আর সেই পায়ের পাতারই চারপাশ ঘিরে টাটকা আলতার রেখা।
রানিবিবি বোধহয় একটু লজ্জায় পড়ে গিয়েছিল। লজ্জায় মাথার ঘোমটাটা আর একটু টেনে দিয়ে ভেতরে গিয়ে ঢুকে পড়ল। তারপর বজরা ছেড়ে দিলে।
এ-ঘটনার অনেকদিন পরে কান্ত যখন রানিবিবির জীবনের সঙ্গে ষড়যন্ত্রের জালে আরও জড়িয়ে গিয়েছিল, তখন একদিন বলেছিল–জানো, সেদিন তোমার পা দেখে আমার খুব ভাল লেগেছিল
আমার পা?
কথাটা শুনে রানিবিবি প্রথমটায় অবাক হয়ে গিয়েছিল।
হ্যাঁ, তোমার পা। তোমার শাড়ির জরির পাড়টা বাঁশের খোঁচায় আটকে যেতেই আমি ধরে ফেলেছিলাম, নইলে দামি শাড়িটা সেদিন ছিঁড়ে যেত–
রানিবিবি বলেছিল–কিন্তু পা কখন দেখলে তুমি?
তখনই তো। তোমার শাড়িটা আটকে যেতেই খানিকটা পা বেরিয়ে পড়েছিল, নজরে পড়ল তোমার আলতা-পরা একটা পায়ের পাতা আর গোল পায়ের গোছ, সেদিন এত ভাল লেগেছিল যে কী বলব…
রানিবিবি বলেছিল–ছিঃ, ওকথা বলতে নেই–অমন করে বোলো না
কান্ত বলেছিল–বলতুম না, কিন্তু তখন তো জানতুম না তুমি কে, তোমার আসল পরিচয় কী! তখন জানতুম, হাতিয়াগড়ের রানিবিবিকেই বুঝি নিয়ে চলেছি আমি! অথচ দেখো, তোমাকে নিয়ে যাবার ভার আর কারও ওপর পড়তেও তো পারত, তা না পড়ে কপালের দোষে আমার ওপরই বা সে-ভার পড়ল কেন?
তা কপালের দোষ বলছ কেন?
কপালের দোষ নয়? কপালের দোষ না থাকলে কেউ বিয়ে করতে গিয়ে দেরি করে ফেলে? কপালের দোষ না থাকলে কারও নিজের ঠিক করা বউয়ের সঙ্গে অন্য লোকের বিয়ে হয়ে যায়?
কপালের দোষ না থাকলে এত চাকরি থাকতে শেষকালে আমাকে এই চরের চাকরি করতে হয়? আর তা ছাড়া কপালের দোষ না থাকলে…
রানিবিবি বলেছিল–থাক, আর কপালের দোষ দিতে হবে না–আমি অত কপালটপাল মানিনে তোমার মতো!
কান্ত বলেছিল–তা মানবে কেন? তোমাকে তো আর ভুগতে হয়নি আমার মতো! আমার মতো কষ্ট পেলে তুমিও কপাল মানতে
রানিবিবি বলেছিল–কিন্তু মনে কষ্ট পুষে রেখে মুখে হাসি ফোঁটানো যে কত শক্ত তা যদি তুমি জানতে গো!
কান্ত তখন সাহস পেয়ে আরও কাছে ঘেঁষে বসেছিল। বলেছিল–সত্যি? তোমারও কষ্ট হয়? সত্যি বলল না, তোমারও কষ্ট হয় তা হলে আমার মতো?
রানিবিবি এবার যেন একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিল। বলেছিল–না বাপু, তুমি একটু সরে বোসো, আমার ভয় করে, অত বাড়াবাড়ি ভাল নয়, শেষকালে তুমি দেখছি আমার গা ছুঁয়ে ফেলবে
ছুঁয়ে ফেললেই বা, তাতে কি খুব অন্যায় হবে?
রানিবিবি রেগে গিয়েছিল। বলেছিল–আবার ওইসব কথা? আমি বলেছি না ওসব কথা বললে–আর তোমাকে আমার কাছেই আসতে হবে না–
আচ্ছা আচ্ছা, এই আমি সরে বসলুম! কিন্তু আমি যে কিছুতেই ভুলতে পারি না।
কী ভুলতে পারো না?
কান্ত বলেছিল–সেদিনের সেই তোমাকে বজরায় করে নিয়ে আসার মুখে তোমার সেই শাড়ির পাড় আটকে যাওয়া, আর সেই তোমার শাড়িটা খুলে দিতে গিয়ে তোমার সেই পা…
আবার?
বলে রানিবিবি খপ করে কান্তর মুখখানা নিজের নরম হাত দিয়ে চাপা দিয়ে দিয়েছে।
রেগে গিয়ে বললে–বলেছি না, ওসব আমার শুনতে ভাল লাগে না, ওসব কথা আমাকে বলতে নেই, ওসব কথা আমার শোনাও পাপ
কিন্তু কান্ত যেন তখন নিজের শরীরের মধ্যেই হঠাৎ নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। রানিবিবি তার মুখটা ছেড়ে দেওয়ার পরও যেন অনেকক্ষণ অভিভূত হয়ে পড়েছিল। তারপর একটু জ্ঞান ফিরে পেয়েই বলেছিল–এই তো তুমি আমার গা ছুঁলে মরালী, আর আমি তোমাকে ছুঁলেই যত দোষ? আমি ছুঁলেই তুমি অশুদ্ধ হয়ে যাবে?
তা তুমি এই সহজ কথাটাও কেন বোঝে না যে আমার সিঁথিতে সিঁদুর রয়েছে, আমি পরের বউ?
তা এই এখানেও কি তুমি পরের বউ? এই নবাবের হারেমের মধ্যে? এই মদ, জুয়া, জাল, জোচ্চুরি, রেষারেষি আর বেলেল্লাগিরির মধ্যেও তুমি কি মনে করো তুমি পরের বউ হয়ে নিজেকে বাঁচাতে পারছ?
খবরদার বলছি, মুখ সামলে কথা বলো!
কান্ত আর পারেনি। চিৎকার করে বলে ফেলেছিল কিন্তু সেই-ই যদি বাসরঘর ছেড়ে পালালে তো আর একটু আগে পালাতে পারলে না তুমি? সম্প্রদান হবার আগে পালাতে পারলে না? লগ্ন বয়ে গেলে কি এর চেয়েও বেশি সর্বনাশ হত? তা হলে কি তোমাকেই আজ সিথির সিঁদুর নিয়ে এই পাপপুরীর মধ্যে আসতে হত, না ভদ্রঘরের ছেলে হয়ে আমাকেই এই নবাবের চরের কাজ করে টাকা রোজগার করতে হত, বলো?
কথাটা যে কত চেঁচিয়ে বলেছিল কান্ত তা তার খেয়াল ছিল না। হারেমের দেয়ালের ইটগুলোরও যে এক একটা করে কান আছে, তাই বোধহয় ভুলে গিয়েছিল সে। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ থেকে শুরু করে। নবাব আলিবর্দি খাঁ পর্যন্ত যত খুন, যত অত্যাচার, যত পাপ, যত কলঙ্ক জমা হয়ে ছিল মাটির তলায়, সেই সমস্ত দিয়েই যেন ইট তৈরি করে, সেই ইট দিয়ে গেঁথে গেঁথে তৈরি হয়েছিল এই চেহেল্-সুতুন। প্রত্যেকটা অলিন্দে অলিন্দে, প্রত্যেকটা কোটরে কোটরে, প্রত্যেকটা প্রকোষ্ঠে প্রকোষ্ঠে, প্রত্যেকটা গবাক্ষে গবাক্ষে কান্তর সেদিনকার হাহাকার যেন প্রতিধ্বনিত হয়ে বারবার নিজের ভাগ্যের রাজয়ের
প্রতিশোধ নিজের হাতেই নিতে চেয়েছিল। আর শব্দটা কানে যেতেই ওদিক থেকে দৌড়ে এসেছিল পিরালি খাঁ। পিরালি খাঁ খোজা সর্দার। ঘরের ভেতরে ঢুকেই…
কিন্তু সে কথা এখন থাক। পরের কথা পরে বলাই তো ভাল।
.
সেই অন্ধকারে দক্ষিণের হাওয়ায় বজরায় পাল তুলে দিয়ে তখন মাঝিমাল্লারাও তন্দ্রায় ঢুলছে। মাথার ওপর চিরকালের একঘেয়ে আকাশটা রোজকার মতো তারাফুল ফুটিয়ে নির্জীব নিঃসাড় হয়ে আছে। সেপাই দুটো বন্দুক নিয়ে সামনেই ঘুমে অজ্ঞান অচৈতন্য। ছই-ঢাকা ঘরটার মধ্যে রানিবিবিও হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। কে জানে! হয়তো কেন, নিশ্চয়ই ঘুমোচ্ছে। সেদিক থেকে কোনও সাড়াশব্দ নেই একটুকু! শুধু কান্ত একলা আকাশ-পাতাল তোলপাড় করে বেড়াচ্ছে। সেইখানে সেই বজরার গলুইতে হেলান দিয়ে বসে বসে নিজের সমস্তটা জীবন পরিক্রমা করছে বারবার। এ কেমন চাকরি তার। এ কেমন পেশা! কাকে ধরে নিয়ে চলেছে সে! কার সম্পত্তি কার হাতে তুলে দেবে। কেন তুলে দেবে? ছটা টাকার জন্যে? ছটা টাকার এত দাম? ছ’টা টাকার দাম দিয়ে সে আর একজন পুরুষের শান্তি হরণ করবে? আর একজনের অভিশাপ বরণ করবে? আর একজনের সর্বনাশ করে সে তার নিজের খোরাকি রোজগার করবে? কত কথা তার মনে পড়েছিল সেদিন। এক-একবার কল্পনা করতেও ইচ্ছে হচ্ছিল রানিবিবির মুখখানা। জাহাঙ্গিরাবাদের জরি-পাড় শাড়ির ঘোমটা দিয়ে ঢাকা ছিল সর্বাঙ্গ। শুধু দৈবাৎ একটা পায়ের একটুখানি অংশ নজরে পড়েছিল। তাও এক মুহূর্তের জন্যে। কিন্তু মনে পড়তেই ভাবনাটা মন থেকে দূর করে দিয়েছিল। এ অন্যায়, এ পাপ! রানিবিবির কথা ভাবাও পাপ। চাকরির জন্যে এ-পাপের যতটুকু অংশীদার হবার দায় তার, তার বেশি দায়িত্ব তার নেই। তার চেয়ে যেন বেশি সে কিছু না ভাবে। মুর্শিদাবাদের নবাবের যা সাজে, কান্তর তা সাজে না।
বাবুজি, হুশিয়ার!
চমকে উঠেছে কান্ত! বুড়ো মাঝিটা এতক্ষণ ঢুলছিল। এবার বুঝি সজাগ হয়েছে। কেন? হুঁশিয়ার কেন?
বাবুজি, দাঁড়ের ঝপঝপ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন না! বদরগঞ্জের কাছে এসেছি, এটা ডাকাতের আচ্ছা!
কান্ত মাঝির নির্দেশ লক্ষ করে দূরের দিকে চেয়ে দেখলে। অনেক অনেক দূরে অন্ধকারের বুক চিরে যেন একটা আলোর বিন্দুর মতো কী দেখা গেল। একেবারে নদীর বুক বরাবর। আলোটা যেন ক্রমেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে।
সেপাই দুটো তখনও ঘুমোচ্ছে।
কান্ত বললে–ওদের ডেকে দেব? ওদের কাছে বন্দুক আছে
কিন্তু ডাকতে হল না। তারা নিজের থেকেই উঠে পড়ল। এ যেন তারা জানত। বদরগঞ্জে অনেকবার ডাকাতি হয়েছে। অনেকবার ডাকাতদের সঙ্গে তাদের মুখোমুখি সওয়াল করতে হয়েছে। তারা উঠেই বন্দুক তাগ করে তৈরি হয়ে রইল। ঈড় ফেলার ঝপঝপ শব্দ ক্রমেই আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছে। যেন তাড়াতাড়ি ঝড়ের গতিতে কাছে এগিয়ে আসতে চাইছে।
কান্তর কেমন ভয় করতে লাগল। যদি সত্যিই ডাকাত পড়ে, তা হলে রানিবিবির কী হবে! রানিবিবি হয়তো কিছুই টের পাচ্ছে না, অঘোরে ঘুমোচ্ছে!
কান্ত ছইয়ের দরজার কাছে গিয়ে ডাকতে লাগল–শুনছেন–
ভেতর থেকে কোনও সাড়াশব্দ এল না। হয়তো শুনতে পায়নি। দরজা-জানালা সব বন্ধ করে দিয়ে ভেতরে একলা রয়েছে।
কান্ত এবার দরজায় টোকা দিতে লাগল–শুনছেন–শুনছেন–আমি কান্ত-শুনছেন—
*
মুর্শিদাবাদে তখনও মতিঝিল থেকে মির্জা ফেরেনি। রাত শেষ হয়ে আসছে। চেহেল্-সুতুনের অন্দরমহলে সব আলো নিভে গেছে। কিন্তু নানিবেগমের ঘরে তখনও একটা আলো জ্বলছে টিমটিম করে।
বাইরে থেকে ডাক এল–বেগমসাহেবা
সন্ধে থেকেই নানিবেগমের খারাপ লাগছিল। লুৎফাও ঘুমোতে পারে না, নানিবেগমও ঘুমোতে পারে না। চেহেল্-সুতুনের ভেতরে একবার এলে ঘুম না-হওয়া যেন রোগে দাঁড়ায়। ছোট্ট রোগা রোগা মেয়েটা। তার দিকে চাইলেই নানিবেগমের বুকটা হুহু করে ওঠে। এমন বউ যেন এখানে মানায় না। নানিবেগম বউকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে মাঝে মাঝে। যখনই সব পুরনো কথা মনে পড়ে যায়, তখন আর কাউকে ভাল লাগে না। নিজের পেটের মেয়েরাও তখন যেন বিষ হয়ে ওঠে নানিবেগমের চোখে। মেয়ে নয়তো, সব কাটা। এক-একটা কাটা হয়ে সব নানিবেগমের বুকে ফুটে আছে। তোরা সব মানুষ না কী? তোদের মান-ইজ্জৎ-সম্মান-মর্যাদা কিছু নেই? তবুনানিবেগমের যদি নিজের ছেলে থাকত তো আজ ভাবনা! সারা জীবনটাই তো নানিবেগমের কেটে গেছে আলিবর্দি সাহেবের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে। একটা দিনের জন্যে নানিবেগম মনে শান্তি পায়নি। চেহেল্-সুতুনের মধ্যে রাতের পর রাত কেটে যায় সেই সব পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে। পাশে কেউ বিশেষ থাকে না। শুধু লুৎফা কাছে আসে। কাছে। এসে বসে আর কাঁদে।
নানিবেগম বলে-তুই কেন কাঁদিস মা, কেন আমার পেছন পেছন ঘুরিস?
মেয়েটা কথাও বলে না বেশি, কথা বললেই যেন সে কেঁদে ভাসিয়ে দেবে। এখানেই একদিন নাচতে এসেছিল এই মেয়ে এই মুর্শিদাবাদে। সেই মেয়ে যে তার নাতবউ হবে তা-ই বা কে ভেবেছিল।
নানি বলত–দেখলি তো এখন নবাবি হারেমে কত সুখ! আমারও এক এক সময় মনে হয় মা, বোধহয় মুর্শিদাবাদের গরিব প্রজার ঘরে জন্মালে এর চেয়ে অনেক সুখ পেতাম
লুৎফা সব শোনে। শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে নানির বুকে মাথা গুঁজে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে।
হারেমের ওপাশে যখন সারেঙ্গি বাজে, ঘুঙুর বাজে, সরাবের হা চলে, পেশমন বেগম, দুলহান বেগম, বব্বু বেগম সবাই মিলে যখন পাশা খেলে ঘুটি খেলে রাত কাবার করে দেয়, তখন নানিবেগমের ঘরের ভেতরে দুটি প্রাণী শুধু প্রহর গোনে। কখন মির্জা আসবে তার তো ঠিক নেই। গদিতে বসবার পর থেকেই ইয়ারবকশিরা নাতিকে আরও ঘিরে রেখে দিয়েছে। নানিবেগমের সঙ্গে দেখা করবারই সময় হয় না তার। একবার যদিই বা আসে, একটুখানির জন্যে এসেই আবার চলে যায়। বলে আমি আবার আসব নানি
কিন্তু, কী নিয়ে আবার এত ব্যস্ত তুই? তুই কি একদণ্ড শান্তিতে ঘুমোতে পারবিনে?
মির্জা বলে কিন্তু সবাই মিলে যে আমার দুশমনি করছে নানি, আমি কী করব?
তা তোর নানার কি দুশমন ছিল না? তোর নানা আমার সঙ্গে দেখা করবার ফুরসুত পেত কী করে?
মির্জা বলত–সে জমানা আর নেই নানি, তোমার মেয়েরাই আমার সবচেয়ে বড় দুশমন! নিজের ঘরের মধ্যে যার দুশমন, তার শান্তি কী করে হবে? আমার যে ঘরে-বাইরে দুশমন!
কথা বলে আর দাঁড়াত না মির্জা। আবার কোথায় বেরিয়ে চলে যেত।
আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লুৎফা সব শুনত। এক ফোঁটা মেয়েটা পাতলা লিকলিকে চেহারা, তাকে দেখতে পেয়েই নানিবেগম বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরত। কিছু ভাবিসনে মা, নবাবের বিবি হলে সুখ হতে নেই। নবাবের বেগমদের ওপর খোদাতালার অভিশাপ আছে। সাজাহানাবাদের বেগমদেরও সুখ হয়নি জীবনে। আকবর বাদশা, জাহাঙ্গির বাদশা, শাহজাহান বাদশা, ঔরঙ্গজেব বাদশা–সকলের বেগমেই কেঁদে কেঁদে কাটাতে হয়েছে
বেগমসাহেবা!
বাঁদি এসে বললে–মেহেদি নেসার সাহেব সেলাম ভেজিয়েছেন
ডাক এখেনে, ডেকে আন।
মেহেদি নেসারকে আজ ডেকে পাঠিয়েছিল নানিবেগম। ডেকে না পাঠালেও মেহেদি নেসার সাহেব নানিবেগমকে সেলাম জানিয়ে যায় মাঝে মাঝে। নবাবের নানি, তাকে হাতে রাখা ভাল। এসে বলে বন্দেগি বেগমসাহেবা
এসব বিনয়ের ব্যাপারে মেহেদি নেসারের আবার জুড়ি নেই। কোনও কাজ থাকলেও মেহেদি নেসার আসে, আবার না থাকলেও আসে। এসে বলে গোস্তাকি মাফি হয় বেগমসাহেবা। আমি বেগমসাহেবার খিদমদগার। বান্দাকে একটু দোয়া করবেন হুজুরাইন। নানান ভাষায়, নানান কায়দায় সেলাম জানাতে মেহেদি নেসার ওস্তাদ! ঘরের ভেতরে রদার আড়ালে নানিবেগম থাকে আর বাইরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে কথা বলে। মাঝখানে দরওয়াজার মধ্যে থাকে নানিবেগমের খাস বাঁদি আর খোজা সর্দার পিরালি খাঁ। দু’তরফের কথা সেই বলে শোনায়।
জিজ্ঞেস করো মেহেদি নেসার সাহেবকে, কী দরকার।
পিরালি বলে–বেগমসাহেবা জিজ্ঞেস করছেন আপনার কী দরকার–
মেহেদি নেসার মাথা নিচু করে বলে বলল, দরকার আমার কিছু নেই, শুধু রোজার দিনে বেগমসাহেবার দোয়া নিতে এলাম। বেগমসাহেবার দোয়া না পেলে তো আমি রোজা ভাঙতে পারি না–
তারপর সেই নানিবেগমের দোয়া পাবার পর মেহেদি নেসার সেই মেঝের শ্বেত পাথরের ওপরেই নিজের নাক চুঁইয়ে কুর্নিশ করতে করতে চলে যায়।
এক-একদিন নানিবেগম বলত–মির্জাকে তোমরা একটু শোধরাতে পারো না বাবা, দিনরাত এত মদ খেলে তবিয়ত টিকবে কী করে, দেমাক যে বরবাদ হয়ে যাবে। বয়েস তো বেশি নয়–
মেহেদি নেসার বলত–না বেগমসাহেবা, আমরা তো বোঝাই তাই ওকে! আমরা তো বলি এখন আপনি মুর্শিদাবাদের নবাব জাঁহাপনা, এখন কি আর আগের মতো ছেলেমানুষি করা পোয়! আমরা তো ওকে বারবার সেই কথাই বলি
আমার ওই একটি নাতি বাবা, তোমরা ওর ইয়ার, তোমরা যদি ওকে না দেখো তো কে দেখবে? আমার সঙ্গে তো দেখাই হয় না মির্জার, আমার কথা শোনেই না, তোমাদের সঙ্গে মেশে, তোমাদের কথা শুনেই ও চলে। তোমরা একটু সৎ পরামর্শ দিয়ে বাবা ওকে–
তাই তো দিই বেগমসাহেবা! আমরা ওকে কোরান পড়তে বলি–ও তো নানার সামনে বাত দিয়েছিল সরাব আর খাবে না, সরাব তো আর ছোয়ও না ও। আমরা বলেছি ওকে–কোরান পড়লে দেমাক ঠিক হয়ে যাবে। এই দেখুন না বেগমসাহেবা, আমার কাছেই তো কোরান রয়েছে।
বলে নিজের জোব্বার জেব থেকে কোরানটা বার করে দেখালে। বললে–এই আজকেও ওকে কোরান পড়িয়েছি বেগমসাহেবা, এই জায়গাটা অনেক বার করে পড়িয়েছি–লা এলাহি এল আল্লা মহম্মদ রসুল আল্লা…
তারপর যাবার সময় বলত–তা হলে বান্দা এবার আসছে বেগমসাহেবা—
আচ্ছা, যাও বাবা তুমি, যাও ।
এমনি করেই মেহেদি নেসার এখানে বহুদিন এসেছে, বহুবার বেগমসাহেবার দোয়া নিয়ে চলে গেছে। এবার শেষ রাত্রের দিকে হঠাৎ ডাক পেয়ে মেহেদি নেসার সত্যিই তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল। এমন অসময়ে তো নানিবেগম কখনও মেহেদি নেসারকে এত্তেলা দেয় না।
আমাকে ডেকেছিলেন বেগমসাহেবা?
নানিবেগম ভেতর থেকে উত্তর দিলে হ্যাঁ, শুনছি আবার নাকি কোন জমিদারের বউকে মতিঝিলে আনবার ব্যবস্থা করেছ তোমরা?
মেহেদি নেসার বাইরে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল।
শুনছি, আমাদের হাতিয়াগড় সরকারের জমিদারের দোসরা তরফের রানিবিবিকে আনবার জন্যে এখান থেকে ডিহিদারকে পরওয়ানা পাঠাতে বলা হয়েছে। নাকি লোকও চলে গেছে আনতে? এটা কি সত্যি? জবাব দিচ্ছ না কেন, উত্তর দাও
সেকী? হাতিয়াগড়ের রানিবিবি?
হ্যাঁ! তাকে এনে তোমরা আমার নাতির মাথা খাবে বলে মতলব করেছ! একজন হিন্দুকে পাঠিয়েছ তাকে আনতে! মির্জার মন ভোলাবার জন্যে তোমরা সবাই মিলে পরামর্শ করে এই কাজ করেছ! ভেবো না আমি হারেমের ভেতরে থাকি বলে আমার কানে কোনও খবর পৌঁছোয় না। তোমরা তার ইয়ার হয়ে কোথায় সৎ পরামর্শ দেবে, না এইসব করে নবাববংশ ছারখার করে দিতে চাও? তোমরা কি চাও মুর্শিদাবাদের গদি আবার অন্য কারও হাতে চলে যাক? আমি তার নানি, আমি বেঁচে থাকতে থাকতেই তোমরা আমার এই সর্বনাশ করে যাবে?
মেহেদি নেসারকে এবার বড় শক্ত পালা অভিনয় করতে হল।
বললে–আমি আপনার বান্দা বেগমসাহেবা, এসব আপনি কী বলছেন আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না! হাতিয়াগড়ের রানিবিবিকে আনব আমি?
তুমি নয়, তোমার দলবল! ও একই কথা! এমনি করে একদিন সরফরাজের নবাবি গিয়েছে, আমার নাতির নবাবিও তোমরা এমনি করে খোয়াতে চাও? চারদিকে যখন সবাই আমার নাতির বিরুদ্ধে, তখন তোমরাও আমার নাতিকে পথে বসাবে? আর আমাকে বেঁচে থেকে সেই সর্বনাশ দেখে যেতে হবে এই-ই তোমরা চাও!
মেহেদি নেসার হঠাৎ কোরান ছুঁয়ে বললে–এই কোরান ছুঁয়ে বলছি বেগমসাহেবা, আমি এর কিছুই জানি না। আমি আপনাদের নিমক খেয়ে আপনাদেরই নিমকহারামি করব, এ কখনও হতে পারে?
তা হলে আমি যা শুনেছি, সব মিথ্যে!
ডাহা মিথ্যে কথা বেগমসাহেবা! জলজ্যান্ত মিথ্যে কথা! কে এসব আপনাকে বলেছে? আমাদের তো দুশমন আছে চারদিকে, তারাই হয়তো আপনাকে এইসব বলে গিয়েছে।
নানিবেগম বললে–না, আমার কাছে খত আছে, আমার কাছে চিঠি আছে, তাতেই সব লেখা আছে—
কার চিঠি? কে লিখেছে বেগমসাহেবা? নাম কী তার?
হাতিয়াগড়ের বড়রানি! বেচারা কোনও উপায় না পেয়ে আমাকে চিঠি দিয়েছে।
দেখি বেগমসাহেবা, চিঠিখানা দেখি। চিঠিখানা জাল কিনা দেখি!
না, এ-চিঠি তোমরা পাবে না। এ যদি সত্যি হয় তো সেদিন তোমাকে এর জবাবদিহি করতে হবে মনে রেখো। একদিন এমনি করে ওই পেশমন বেগমকে এনেছ এখানে, গুলসন বেগমকে এনেছ, তক্কি বেগমকে এনেছ, নুর বেগম, জিন্নত বেগম, আরও একগাদা বেগমকে এনেছ আবার আর একটা বেগমকে আনতে চাও? আবার আর একজনের সর্বনাশ করতে চাও? এততেও তোমাদের আশ মেটেনি? আমার মির্জাকে না খুন করে কি…
মেহেদি নেসার বললে–নবাবদের তো বেগম থাকেই বেগমসাহেবা, সে তো নতুন কিছু নয়। নবাব সরফরাজ খাঁর পনেরোশো বেগম ছিল কিন্তু আমাদের কেন দায়ী করছেন তার জন্যে বেগমসাহেবা!
হঠাৎ কথা শেষ হবার আগেই দূর থেকে খোজা বরকত আলির ঘোষণা শোনা গেল–নবাব মনসুর-উল-মুস্ক শা কুলি খান বাহাদুর মির্জা মহম্মদ সিরাজ-উ-দ্দৌলা হেবৎ জঙ আলমগির-র-র-র-র…
কথাটা কানে যেতেই লুৎফুন্নিসা নানিবেগমের কোল থেকে উঠে নিজের মহলের দিকে দৌড়ে পালিয়ে গেল।
ওই মির্জা আসছে, ওকেই আমি চিঠিটা দেখাচ্ছি, তুমি এখন যাও বাবা এখান থেকে যাও তুমি
মেহেদি নেসার আ-ভূমি মাথা ঠেকিয়ে ঠিক আগেকার মতোই কুর্নিশ করতে করতে পেছনে হটে অন্য দিক দিয়ে চলে গেল। চলে গিয়ে যেন বাঁচল সে। হাতিয়াগড়ের বউরানি খত্ লিখেছে? এত বড় বেড়েছে কাফেরের বাঁদি?
*
শুনছেন! শুনছেন!
তখন সকাল হয়ে গেছে বেশ! বদরগঞ্জ পেরিয়ে মিরপুরে এসে ডিহিদারের বজরা থামবে। সেখানেই সব ব্যবস্থা করা আছে। পুরনো সেপাই ছেড়ে দিয়ে নতুন দু’জন সেপাই এসে উঠবে। রানিবিবির দরজা তখনও খোলেনি। দরজায় ঠেলা দিতেও সংকোচ হতে লাগল। রাত্তিরে একফোঁটা ঘুম হয়নি কান্তর। অথচ রানিবিবিকে ডাকতেই হবে। কত দরকার থাকতে পারে। মিরপুরের ঘাটে এখানকার ডিহিদারের লোক খাবারের ব্যবস্থা করবে।
শুনছেন! আমি কান্ত। শুনছেন!
সত্যিই রাত্তিরে বড় ভয় পেয়ে গিয়েছিল কান্ত। ডাকাতি হয় বদরগঞ্জে এটা জানা কথা। বদরগঞ্জে অনেকবার অনেক বজরা লুঠপাট করে নিয়েছে তারা। আলোটা কাছে আসতেই সেপাই দুটো বন্দুক তাক করে রেখেছিল। নৌকোটা কাছে আসতেই সেদিকের মাঝিরা হাঁক দিলে-কার বজরা?
কান্তদের বুড়ো মাঝি হাঁক দিলে ডিহিদারের তোমরা?
হাতিয়াগড় সরকার।
কথা বলতে বলতেই নৌকোটা তিরের গতিতে এগিয়ে চলে গেল। আটজন মাঝি প্রাণপণে বজরা নিয়ে দাঁড় ফেলতে ফেলতে যাচ্ছে! যাক, তখন যেন একটু হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল কান্ত। কিন্তু হাতিয়াগড়ের জমিদার যদি জানতে পারতেন, এবজরাতেই তার রানিবিবি আছে।
শুনছেন! শুনছেন!
মাঝিটা বললে–হুই মিরপুরের বাঁধাঘাট দেখা যাচ্ছে–হুই যে
এতক্ষণে দরজাটা খোলবার একটা শব্দ হল–খুট!
দরজার সামান্য একটু ফঁক দিয়ে দেখা গেল সেই শাড়িটা। রাত্রের সেই জরিপাড় জাহাঙ্গিরাবাদের শাড়ির আঁচলটা।
কান্ত সেই আড়াল থেকে দাঁড়িয়েই বললে–আমরা মিরপুরে এসে গেছি, এখানে আমরা নৌকো বাঁধব। আপনার জলটল কিছু দরকার থাকলে আমাকে বলতে পারেন। আমি নিজে হিন্দু, আপনার কিছু ভয় করবার নেই–আমার নাম কান্ত সরকার
.
আর ওদিকে হাতিয়াগড়ের রাজবাড়িতে তখন সবে ভোর হয়েছে। বড় বউরানির দরজায় টোকা পড়তেই বড় বউরানি উঠে পড়েছেন।
একী, তুমি? তুমি কখন এলে?
এই তো এখন! মহারাজকে সব বলে এলাম। আর কোনও ভাবনা নেই। মহারাজ এবার নিজে এর সমস্ত ভার নিলেন। আমাকে বললেন–আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন রায়মশায়, মিরজাফর যখন আমাদের দলে আছে, তখন আমি এর একটা বিহিত করবই
তবু বড় বউরানি কোনও কথা বললেন না।
মহারাজ আজই মহিমাপুরে গিয়ে জগৎশেঠের সঙ্গে দেখা করবেন বললেন, তারপর সেখান থেকে কালীঘাটে পুজো দেবার নাম করে হলওয়েল সাহেবের সঙ্গে দেখা করবেন, উমিচাঁদের সঙ্গে দেখা করবেন, ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে একটা পাকা বন্দোবস্ত করে আর ফিরবেন না আমাকে কথা দিলেন।
তারপর বড় বউরানির মুখের দিকে চেয়ে বললেন–কী, তুমি কিছু কথা বলছ না যে?
বড় বউরানি তবু কিছু কথা বললেন না।
কী হল তোমার, শরীর খারাপ? না, আমার কথায় বিশ্বাস হচ্ছে না! কথা বলো, অমন চুপ করে রইলে কেন? ছোটবউ কোথায়? ছোটবউ কেমন আছে? আমি তো মহারাজের সঙ্গে মহিমাপুরেই যাচ্ছিলুম, কিন্তু তোমাদের একা ফেলে গেছি ভেবে তাড়াতাড়ি চলে এলুম। ডিহিদারের লোক আর এসেছিল নাকি?
এতক্ষণে বড় বউরানির মুখ দিয়ে কথা বেরুল। বললে–হ্যাঁ!
তারপর? কী বলে গেল? কোনও হিন্দু এসেছিল সঙ্গে? তুমি কী বললে?
বড় বউরানি যেন পাথর হয়ে গেছে। পাথরের মতো শুকনো গলায় বললে–আমি ছোটবউকে খুন করে ফেলেছি।
চেহেল্-সুতুনের ভেতর রাত্রির যে-চেহারা, হাতিয়াগড়ের রাজবাড়ির রাতের চেহারা সেরকম নয়। মুর্শিদাবাদের হারেমে যখন রাত তখন বাংলাদেশের সমস্ত ষড়যন্ত্র সেখানে সজাগ হয়ে ওঠে। জাহাঙ্গিরাবাদ থেকে যেদিন মুর্শিদকুলি খাঁ মুর্শিদাবাদে এসে রাজধানী বসালেন সেইদিন থেকেই সেখানে দিন রাত একাকার হয়ে গেল। ভোরবেলা যখন ইনসাফ মিঞা নহবতে ভৈরোর তান ধরে, তার অনেক আগে থেকেই সকলে জেগে ওঠে। কবর থেকে উঠে আসে নবাববাদশাদের কঙ্কাল। তারা একে একে এসে আবার এখানে পদচারণা শুরু করে। এ-মহল থেকে ও-মহলে যায়। তারপর আর-এক মহলে। এক একটা দৃশ্য দেখে আর মুখ ফিরিয়ে নেয় আতঙ্কে। বহু যুগ আগে মোগলদের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে আমরা যা-কিছু শুরু করেছিলাম, এখনও ঠিক তাই। মদের গেলাস মেঝের ওপর গড়াগড়ি চলেছে আর তারই পাশে নেশায় অসাড় হয়ে পড়ে আছে পেশমন বেগম। তার গায়ের ওড়নি আর কোমরের ঘাগরা বেসামাল। আলো নিভোতে ভুলে গেছে তার ইরানি বাঁদি।
হঠাৎ স্বপ্নের ঘোরেই কেউ বা হেসে ওঠে খিলখিল করে। কেউ বা আবার কেঁদে ওঠে। হাসিকান্নার পান্না-মুক্তোর ঝলসানি লেগে ছাদের ঝাড়লণ্ঠনগুলো পর্যন্ত যেন লজ্জা পায়। খোজা সর্দার পিরালি এক-একদিন নিজেই তদারক করতে বেরোয়। কার ঘরে কে ঢুকেছে, কে জেগে আছে, কে ঘুমায়নি, কে হাসছে, কে কাঁদছে, সব দেখে বেড়ায়। কারও ঘাগরাটা পরিয়ে দিয়ে বলে। বেগমসাহেবা, রাত হয়েছে, দরওয়াজা বন্ধ করে দিন
আবার কারও ঘরে যেতেই সেতারের তার ছিঁড়ে বাজনা বন্ধ হয়ে যায়।
নিদ নেই বেগমসাহেবা?
সারাদিন সারারাত অবসর যেখানে, সেখানে ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করে লাভ কী! ঘুমোবার জন্যে তো আল্লা রাত পয়দা করেনি। রাত তো ফুর্তি করবার জন্যে। দুনিয়ার মালিক যাদের অটুট যৌবন দিয়েছে, অফুরন্ত অবসর দিয়েছে, তাদের ঘুমোবার দরকার কী! কিন্তু তবু পিরালি খাঁ-কে সমীহ করে চলতে হয় সকলের। কার কখন কী দরকার পড়ে কে বলতে পারে। পিরালিই তো চেহেল্-সুতুনের জাগ্রত আল্লা!
পিরালির যারা শাগরেদ তারা বেগমসাহেবাদের কাছ থেকে মোহর নেয়, টাকা নেয়, তার বদলে তাদের অনেক বেআইনি কাজ করে দেয়। বাইরের লোককে সুড়ঙ্গ দিয়ে লুকিয়ে ভেতরে আনতে হবে, তাতে বেশি কিছু করতে হবে না। বরকত আলি কি নজর মহম্মদের বাঁহাতে একটা কিছু গুঁজে দিলেই চলবে। সঙ্গে সঙ্গে রাত গম্ভীর হয়ে আসবার পরই ঘরের ভেতর এসে হাজির হবে মুর্শিদাবাদের নতুন কোনও উঠতি জওয়ান। সারারাত এ চেহেলসূতুনে কাটিয়ে আবার ভোর হবার আগেই সে নিঃশব্দে সুড়ঙ্গ পথে বাইরে চলে যাবে। হারেমের টিকটিকি আরশোলা কিংবা মাছিটা পর্যন্ত তা টের পাবে না। এখানে যত কড়াকড়ি তত ফসকা গেরো। এখানে বসে যদি কেউ বাইরের জগতের সঙ্গে কারবার করতে চায় তো তাতেও কিছু আটকাবে না। এখানে বসেই বেগমসাহেবারা পূর্ণিয়া থেকে সোরা কিনবে, গন্ধক কিনবে, এখান থেকেই সেই কেনার টাকা যাবে। আবার সেই সোরা সেই গন্ধক কলকাতায় বেভারিজ সাহেবের গদিতে বিক্রি হয়ে যাবে। সেই বিক্রির টাকা আবার যথাস্থান দিয়ে বেগমসাহেবার হাতে এসে পৌঁছোবে। নবাবের বাবারও সাধ্যি নেই তা টের পায়। এখান থেকে টাকা যায় জগৎশেঠজির বাড়িতে সুদে খাটাবার জন্যে, এখান থেকে হিরে-মুক্তো-পান্নার গয়না যায় শেঠবাড়িতে বন্ধক রাখবার জন্যে। সেই বন্ধকি মাল আবার ছাড়ান পেয়ে চলে আসবে সকলের চোখের আড়ালে। জানলে শুধু জানবে পিরালি কি বরকত আলি কিনজর মহম্মদ, কি তাদের মধ্যে কয়েকজন।
কিন্তু সেই পিরালিই যখন আবার নানিবেগমের মহলে আসে তখন সে অন্য মানুষ। তখন তাকে দেখলে আর চেনা যায় না। যদি দেখে নানিবেগম কোরান পড়ছে, সকলকে গিয়ে সাবধান করে দেয়। বলে চিল্লাও মাত, চিল্লাও মাত, চিল্লাচিল্লি কোরো না কেউ
ওমহলের সারেঙ্গির শব্দ এ-মহলে এলে গিয়ে জোর করে থামিয়ে দেয়। বলে আভি বন্ধ কিজিয়ে, বেগমসাহেবা কোরান পড়ছে।
বিধবা হবার পর থেকেই নানিবেগমের যেন কোরান পড়ার হিড়িক পড়ে গেছে। সারাজীবন নবাবের সঙ্গে কাটিয়ে এসে এখন এই বয়েসে চেহেল্-সুতুনের দুরবস্থা দেখে কোনও প্রতিকার করতে পারে না। নিজের মেয়েরা কী করে, কী ভাবে জীবন কাটায় সব জানতে পারে। জেনেও যখন তার কথা কেউ শোনে না, তখন বোধহয় খোদাতালার দরবারে নিজের আর্জি পেশ করে মনটার মধ্যে শান্তি খোঁজে।
পিরালি বুড়ো হয়ে গেছে এসব দেখতে দেখতে। কিন্তু তার কাছে কোরানও যা, মোহরও তাই। তাকে একটা মোহর দাও সে তোমাকে যা চাইবে তাই-ই দেবে। আবার কোরান ছুঁয়েও যদি প্রতিজ্ঞা করে যে তোমার কথা কাউকে বলবেনা, একটা মোহর পেলে আবার সেই কথাই সে পাচার করে দেবে তোমার দুশমনের কাছে।
নানিবেগম বলত–মেহেরুন্নিসার মহলটা দেখছিস তো ভাল করে?
দেখছি বেগমসাহেবা, কড়া নজর রাখছি!
শুধু কড়া নজর রাখা নয়, মির্জার হুকুম ছিল ঘসেটি বেগমের সঙ্গে কেউ যেন মুলাকাত না করে। সে যে-মহলে আছে সেখানে যেন জনপ্রাণীটি না যেতে পারে।
কেউ আসে না তো তার মহলে?
না, বেগমসাহেবা!
দেখিস, নইলে মির্জা বড় গোঁসা করবে।
না বেগমসাহেবা, আমি কোরান ছুঁয়ে বলতে পারি কেউ আসে না সেখানে।
হুঁ, দেখিস, খুব হুঁশিয়ার।
কিন্তু যখন অনেক রাত হয় তখন রাজা রাজবল্লভ কতদিন পিরালির হাতে মোহর গুঁজে দিয়ে ঘসেটি বেগমের ঘরে ঢুকেছে। দিনের পর দিন এক ঘরে বসে এক ডিবেতে পান খেয়েছে, এক গড়গড়ায় তামাকু খেয়েছে, তারপর যখন নেশা হয়েছে এক বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি দিয়েছে। তবু কেউ জানতে পারেনি। মোহরের এমনই মোহ যে পিরালি মহলের দরজায় জেঁকের মতো বসে বসে পাহারা দিয়েছে।
কিন্তু মেহেদি নেসারের কথা আলাদা। তাকে মোহর দিতে হয় না। মেহেদি নেসার চেহেল্-সুতুনে এলেই পিরালি খাঁ সসম্ভ্রমে তাকে আদাব দেয়। বলে-বন্দেগি জনাব
মেহেদি নেসার সেদিন আবার এল। এসেই পিরালিকে ডাকলে।
একটা কাজ করতে পারবে পিরালি?
বান্দা জনাবের কোন কাজ করেনি?
না পিরালি, আগেকার জমানার কথা গুলি মারো, এখন জমানা বদলে গিয়েছে। কেউ যেন জানতে পারে, নানিবেগমও যেন টের না পায়–
বলুন জনাব, কেউ জানতে পারবে না। জান থাকতে বান্দা কাউকে বলবে না, বলেন তো কোরান ছুঁয়ে জবান দিতে পারি
না না, তোমাকে আমি চিনি, কোরান ছুঁতে হবে না, একজন রানিবিবি আসবে চেহেল্-সুতুনে, তোমার কোনও নতুন মহল খালি আছে?
পিরালি বললে–জনাব, ক’টা খালি মহল বলুন না, ক’টা রানিবিবি আনবেন?
ক’টা নয়, একটা। কাফের রানিবিবি
পিরালি বললে–কাফের হোক আর মুসলমান হোক, আমার কাছে জনাব সব বিলকুল সমান–বান্দা তামাম দুনিয়ার নোকর
কোন মহলটা দেবে তাকে?
কেন জনাব, কাশিমবাজার কোঠির মেমসাহেবদের যে-মহলে রেখেছিলাম, সেই মহলে রাখব। ওয়াট মেমসাহেব, কলেট মেমসাহেব সবাই তো ওই মহলেই ছিল জনাব–। মহলটার পেছন দিয়ে গুপ্তি সড়ক আছে, বাইরে যাবার
কিন্তু একটা বাত আছে, নানিবেগমসাহেবা যেন টের না পায়।
পিরালি এবার জবাব দিতে দেরি করলে। নানিবেগমের কাছ থেকে খবর লুকিয়ে রাখা একটু শক্ত। সব দিকেই যেন নানিবেগমের কড়া নজর। নানিবেগম যে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব খবর জেনে নিতে চায়। কোথায় কে রাত্রে কার ঘরে গিয়ে কী ষড়যন্ত্র করছে, কার কীসের কষ্ট, কার কী অসুখ, কী দুঃখ, কে হারেমের ভেতরে লুকিয়ে লুকিয়ে কোম্পানির সাহেবদের সঙ্গে কারবার করছে, জগৎশেঠজির কাছ থেকে হুন্ডি কাটছে, সব নানিবেগমের নখদর্পণে। কোরান নিয়ে পড়লে কী হবে, সমস্ত চেহে সুতুনটা যেন নানিবেগমের সংসার। কে বেশি মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়ে আছে, কে গোসা করে উপোস করছে, কে রোজার দিন লুকিয়ে-ছাপিয়ে কী খাচ্ছে, তারও খবর চাই নানিবেগমের!
কিন্তু এ-খবর যদি নানিবেগমসাহেবা জানতে পারে তো তোমার নোকরি থাকবে না পিরালি।
জনাব খোদাবন্দ, বান্দা তো নবাবের নিমক খায়, নিমকহারামি কী করে করবে জনাব?
তা রানিবিবি তো নবাবের খেদমতের জন্যেই আসছে, তুমি যেমন নবাবের খিদমদগার, বেগমরাও তো খিদমদগার ছাড়া আর কিছু নয়!
তা তো বটেই হুজুর। নবাবের খেদমতি করতেই তো বেগমদের পয়দা হয়েছে। খোজাদেরও পয়দা হয়েছে।
তা হলে সেই কথাই রইল!
পিরালি জিজ্ঞেস করলে রানিবিবি কবে নাগাইদ আসবে হুজুর?
আর দু-তিন রোজের মধ্যেই এসে যাবে। হাতিয়াগড় থেকে আসতে তার বেশি সময় লাগবে না, তারা সেখান থেকে রওয়ানা করে দিয়েছে। আমি খবর পেয়ে গিয়েছি ডিহিদারের কাছ থেকে–।
তা হলে জনাব এক কাজ করুন। কাফের বিবি তো? মসজিদের ইমাম সাহেবকে দিয়ে শুরুতেই কলমা পড়িয়ে আগে মুসলমান বানিয়ে নিন। নাম ভি বদলে দিন–নাম দিয়ে দিন মরিয়ম বেগম
শোহনআল্লা! তোমার তো খুব বুদ্ধি পিরালি
তা না থাকলে এতদিন বান্দার ঘাড়ের ওপর শিরটা আছে কেমন করে জনাব?
তা হলে নানিবেগম যদি জিজ্ঞেস করে, ও কে, কোথা থেকে এল? তুমি কী জবাব দেবে পিরালি?
আমি বলব ও মরিয়ম বেগম, লস্করপুরের তালুকদার কাশিম আলির লেড়কি, বেগম বনবার জন্যে নবাবের কাছে দরবার করেছিল
বহুত আচ্ছা, তা হলে এক কাম করো…
কথাগুলো ফিসফিস করেই হচ্ছিল, হঠাৎ দেয়ালের ওপাশে যেন কার গলার আওয়াজ শোনা গেল–উধার কৌন? পিরালি?
জি বেগমসাহেবা!
একেবারে খাস নানিবেগম! কিন্তু ততক্ষণে মেহেদি নেসার জাফরির থামের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেছে। নানিবেগমসাহেবা সারা রাতই হয়তো কোরান পড়ে কাটিয়েছে। তারপর মসজিদে গিয়েছিল নমাজ করতে। এখন ফিরছে।
কার সঙ্গে বাতচিত করছিলে পিরালি?
বরকত আলির সঙ্গে বেগমসাহেবা। আজকে রাত-পাহারা ছিল বরকত আলির, বেতমিজটা ঘুমিয়ে পড়েছিল তাই বকাবকি করছিলুম। কেউ পাহারায় গাফিলতি করলে মেজাজ শরিফ থাকে?
মনে হল নানিবেগম যেন খুশ হল কথাটা শুনে।
আমার মেহেরুন্নিসা শরবত খেয়েছে? গোঁসা কেটেছে মেয়ের?
খেয়েছেন বেগমসাহেবা। বড্ড গোঁসা হয়েছিল, আমি বুঝিয়ে-সুজিয়ে খাইয়ে এসেছি। এখন আরামসে ঘুমোচ্ছেন দেখে এসেছি–আপনি কিছু ভাববেন না বেগমসাহেবা।
আর পেশমন? সেই ছোঁড়াটা আসে না তো আর পেশমনের কাছে?
তাকে তো কোতল করা হয়ে গেছে বেগমসাহেব! বাঘের বাচ্চাকে কি জিন্দা রাখতে আছে?
তারপর আরও অনেক খবর নিলে নানিবেগম। গোসলমহলে পানি ঠিক আছে কিনা, তকিবেগমের তবিয়ত কেমন আছে, আমিনার গয়না খোয়া গিয়েছিল সেটা সে পেয়েছে কিনা, ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক খবর। তারপর খুশি হয়ে নামিবেগম চলে গেল। আস্তে আস্তে ভোর হচ্ছে। চেহেল্-সুতুনের বাইরে যখন ভোর হয় তখনও এর ভেতরে গভীর রাত, সেই সময়েই নহবতখানার ওপর থেকে ইনসাফ মিঞা ভৈরবীর তান ধরে নহবতেএকেবারে উদারার কোমল রেখাব থেকে মোচড় দিতে দিতে কোমল। গান্ধার ছুঁয়েই আবার নেমে যায় উদারার সুরে। তারপর আস্তে আস্তে মুদারার কোমল ধৈবতটা একটুখানি ছুঁয়ে এসেই জমে যায় কোমল গান্ধারে। এইরকম করতে করতে ভোর হয়। গঙ্গার ওপারে কাশিমবাজারের দিক থেকে সূর্যের আলোটা ঠিকরে এসে পড়ে চেহেলসূতুনের মিনারের চূড়ায়। তখন নানিবেগমের কোরান পড়া শেষ হয়ে গিয়েছে। তখন আড়মোড়া খেয়ে ঘুম ভাঙে চেহেলসুতুনের।
মেহেদি নেসার বাইরে আসতেই খাস-দরবারের কাছেই নেয়ামত দৌড়োত দৌড়োত এসেছে।
হুজুর, নবাব এত্তেলা দিয়েছে।
সেকী! মেহেদি নেসার অবাক হয়ে গেছে। এত সকালেই মির্জা মতিঝিলে পৌঁছে গেছে?
নবাব একলা, মা আর কেউ আছে?
হুজুর, সফিউল্লা সাহেব আছে, ইয়ারজান সাহেব আছে, মোহনলালজি আছে, মিরমদন সাহেব ভি আছে
নেয়ামত মতিঝিলের খিদমদগার। সে সবাইকে চেনে। কিন্তু এত সকালে তো মির্জার আসার কথা নয়। চল, চল, জলদি চল। মির্জার তলব মানে যে খোদাতালার তলব!
জনাব, আর একটা বাত, মিরবকশিকে যখন নবাব তলব দিয়েছে, তখন মালুম হচ্ছে শায়েদ লড়াই হবে।
লড়াই? মেহেদি নেসার ফুঃ শব্দ করলে মুখ দিয়ে। লড়াই হবে কী রে! এখন সবে হাতিয়াগড়ের রানিববিকে এনে মরিয়ম বেগম বানাচ্ছি, এখন লড়াই করতেই দেব না মির্জাকে। এখন লড়াই করবার ফুরসত কোথায়?
বলে বাইরে দাঁড়ানো পালকির ভেতর উঠে বসল মেহেদি নেসার। বললে–জলদি হাঁকা—
*
ছোটমশাই আসার খবর পেয়েই বিশু পরামানিক এসে সকাল থেকে বসে ছিল। এখানকার ভোর হওয়ারও একটা রীতি আছে। সে মুর্শিদাবাদের চেহেল-সূতুনের ভোর হওয়া নয়। এখানে সমস্ত শান্ত। বড় পুকুরঘাটের ওপর আমগাছটার ছায়া আস্তে আস্তে হেলে যায় পশ্চিমদিকে। খোলা মাঠময় রোদ ছড়িয়ে পড়ে রাজবাড়ির ছাদে, দরদালানে, খাজাঞ্চিখানায়, কাছারিবাড়িতে, অতিথিশালার উঠোনে, আর পুকুরঘাটের পাথর-বাঁধানো পইঠের ওপর। বিশু পরামানিক বড়মশাইকে খেউরি করবার জন্যেও ঠিক ওইখানে এসে বরাবর বসে থাকত। তারপর গোকুলকে দেখলেই জিজ্ঞেস করত–ও গোকুল, বড়মশাই উঠেছেন নাকি?
তারপর আসত শোভারাম। গোকুল সরষের তেলের পাথরবাটি এনে দিত। গামছা, তেল, দাঁতন জোগান নিয়ে শোভারামের অপেক্ষা করে থাকাই কাজ।
খবর এসে গিয়েছিল ছোটমশাই শেষরাত্রের দিকে বাড়ি ফিরেছেন। দু’জনে বসে আছে তো বসেই আছে ঠায়।
বিশু পরামানিক জিজ্ঞেস করে-কী গো শোভারাম, তোমার মেয়ের কিছু হদিশ পেলে?
একথা শুনে শুনে আর একথার জবাব দিয়ে দিয়ে মুখ পচে গেছে শোভারামের। তবু মানুষের যেখানটায় ব্যথা সেইখানেই ঘা দেওয়া যেন মানুষের স্বভাব। কেন বাপু, অন্য কথা বললেই হয়। আর কি কোনও কথা নেই?
যেকদিন ছোটমশাই ছিলেন না সেকদিন বিশু পরামানিকেরও এখানে আসতে হয়নি, শোভারামকেও আসতে হয়নি। কোনও ঝঞ্জাটই ছিল না কোথাও। শোভারাম নিজের ঘরের মধ্যে খিল এঁটে পড়ে থাকত। সেই মরালী পালিয়ে যাবার পর থেকেই এমনি। শুধু আর একদিন গিয়েছিল দুর্গার কাছে। দুর্গা বলেছিল–না বাপু, মেয়েকে তোমার পাওয়া যাবে না শোভারাম, ও দেবের অসাধ্যি
শোভারাম বলেছিল–তা জলজ্যান্ত মেয়েটা তো আর আকাশে উড়ে যেতে পারে না তাই বলে?
দুর্গা বলেছিল–কেন পারবে না, তুমি বলো না, তোমাকেই আমি আকাশে উড়িয়ে দিচ্ছি বকভৈরবী মন্তর পড়ে-মন্তরের ওপর তোমার অত অচ্ছেদ্দা বলেই মেয়ে তোমার পালিয়ে গেছে, তা জানো
তা হলে মন্তর পড়েই আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দে দুগ্যা–আমি যে একদণ্ড সুস্থির থাকতে পারছিনে।
এইরকম করেই বলত রোজ শোভারাম। আর ঠিক তার পরেই সেই কাণ্ড ঘটল। ছোট বউরানির সঙ্গে পাশা খেলতে খেলতে হঠাৎ বড় বউরানি একেবারে পালঙের তলা থেকে হাতেনাতে ধরে ফেললে মরালীকে!
এ কে? কে এখেনে?
ছোট বউরানি তখন বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছে। বললে–ওর সঙ্গে আমি পাশা খেলছিলুম বড়দি
বড় বউরানি ধমক দিয়ে উঠল–ওলো, তা আমি দেখতে পাচ্ছি, আমি এখনও চোখের মাথা খাইনি, কিন্তু কে এ?
দুর্গা ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল। বললে–ওকে কিছু বোলোনা বড় বউরানি, আমি ওকে নিয়ে এইচি এখেনে, ও বড় দুঃখী!
তবু সেই এক কথা! আমি জিজ্ঞেস করছি, এ কে, তার জবাব দিবি তো?
দুর্গা তখন বড় বউরানির পা দুটো জড়িয়ে ধরেছে। বললে–তুমি কাউকে বলতে পারবে না বউ বউরানি, ও আমাদের শোভারামের মেয়ে, বিয়ের সময় বর পছন্দ হয়নি বলে পোড়ারমুখি আত্মঘাতী হতে যাচ্ছিল, আমিই ওকে এখানে এনে লুকিয়ে রেখেছি, ও-বেচারির কোনও দোষ নেই–ওর কোনও দোষ নেই
তা ওর বাপ যদি টের পায়?
শোভারামকে আমি বলেছি তার মেয়েকে আর পাওয়া যাবে না, পুষ্যানক্ষত্রে শ্বেতজয়ন্তীর শেকড় খেয়ে হাওয়ায় উড়ে গেছে
রাখ তোর বুজরুকি! ধমক দিয়ে উঠল বড় বউরানি।
বুজরুকি নয়, বড় বউরানি, পুষ্যা নক্ষত্রে শ্বেতজয়ন্তীর শেকড় খেলে সত্যি সত্যি উড়ে যায়—
থাম তুই! ওর বর কোথায়?
বরের কাছে ও যাবে না, বর আসতে দেরি হয়েছিল বলে আমাদের অতিথশালা থেকে একটা পাগলা-ছাগলা মানুষের সঙ্গে ওর বিয়ে দিয়ে দিয়েছে ওর বাপ এখন বাপের কাছে পাঠালেই ওর বাপ সেই পাগলা বরের কাছে পাঠিয়ে দেবে
বড় বউরানি কী যেন ভাবলে খানিকক্ষণ। একবার ছোট বউয়ের দিকে তাকালে, আর একবার মরালীর দিকে তাকালে। তারপর বললে–এ যে এ বাড়িতে লুকিয়ে আছে তা কেউ জানে?
না বড় বউরানি, মা কালির দিব্যি, বলছি কেউ জানে না। আমি জানি আর ছোট বউরানি জানে!
ওর নাম কী?
মরালী। ছোটমশাই ওই নাম রেখেছিলেন ওর
তারপর একটু থেমে বড় বউরানি বললেন–তা হলে ওকে তুই আমার মহলে পাঠিয়ে দে, তোকে আসতে হবে না–ও একলা আমার ঘরে আসুক–
বলে বড় বউরানি চলে গেলেন। চলে যেতেই মরালী বড় ভয় পেয়ে গিয়েছিল। বলেছিল–কী হবে দুগ্যাদি?
কী আর হবে! কচুপোড়া হবে। আমি যতক্ষণ আছি ততক্ষণ তোর ভয় কী?
আমাকে যদি বরের কাছে পাঠিয়ে দেয়?
ওমনি পাঠিয়ে দিলেই হল? আমি উচাটন করব না? তোর কোনও ভয় নেই, তুই যা—
মরালী তবু নড়ে না। বললে–কিন্তু আমার বড় ভয় করছে যে দুগ্যাদি—
তবে আয়, উচাটন করে দিই
বলে মরালীকে হাত ধরে কাছে টেনে আনলে। বললে–তোর মাথার একগাছা চুল দেখি—
মরালী দুর্গার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। দুর্গা তার মাথা থেকে একগাছা চুল ছিঁড়ে নিয়ে তাতে কী সব মন্ত্র পড়তে লাগল। ওঁ নমো ভগবতে রুদ্রায় দংষ্ট্রাকরালায় উদ্ধব দাসৈঃ হনহন দহদহ পচপচ উচ্চাটায় উচ্চাটায় হুঁ ফট স্বাহা ঠং ঠঃ। মন্ত্রটা অনেকবার বলতে লাগল বিড়বিড় করে। তারপর সেই একগাছ চুল পুঁটলি পাকিয়ে তার ওপর একদলা থুতু দিয়ে মাথার খোঁপার মধ্যে বেঁধে দিলে।
বললে–যাঃ, উচাটন করে দিলাম। যে তোর ক্ষেতি করতে যাবে তার সব্বোনাশ নিঘ্যাত যাঃ, চলে যা, কিচ্ছু ভয় নেই–আমি উচাটন করে দিয়েছি, আর কীসের ভয় তোর–
বলে ঠেলে ঠেলে নিয়ে গেল বড় বউরানির মহলের দিকে। ঘরের ভেতর যেতেই বড় বউরানি ঘরের দরজায় খিল লাগিয়ে দিয়েছে।
তারপর যখন সন্ধে হয়ে এসেছে, পুজোবাড়িতে কাঁসর-ঘণ্টা বেজে উঠেছে, তখনও ছোট বউরানির ভয় যায়নি। তখনও ঘর থেকে বেরোয় না কেউ। দুর্গাও ছিল। ছোট বউরানির জলখাবার এনে দিলে। ছোট বউরানিকে খাইয়ে দাইয়ে রোজকার মতো পা ধুইয়ে আলতা পরিয়ে চুল বেঁধে দিলে, তখনও বড়। বউরানির মহল থেকে কোনও সাড়া শব্দ নেই।
ছোট বউরানি জিজ্ঞেস করলে কী হল রে দুগ্যা, মেয়েটাকে খুন করে ফেললে নাকি বড়দি?
খেপেছ তুমি? আমি উচাটন করে দিয়েছিনা। দেখো তুমি, মরি’র কোনও ক্ষতি কেউ করতে পারবে না —
এতক্ষণ ধরে কী করছে ঘরের দরজা বন্ধ করে? যদি ওকে ওর বাপের কাছে পাঠিয়ে দেয়? তুই একবার গিয়ে দেখে আয় না
দুর্গা যাচ্ছিল, কিন্তু ওদিক থেকে তরঙ্গিনীও আসছিল এদিকে। তরঙ্গিনী বললে–ছোট বউরানিকে একবার ডেকে দে তো দুগ্যা–ডাকছে বড় বউরানি
সেখানেই সেই দিন সেই বন্ধ ঘরের মধ্যে বাংলাদেশের সেই মেয়ে এক অমোঘ প্রতিজ্ঞা করে বসল! এর চেয়ে যে সে-মৃত্যু অনেক ভাল। মৃত্যুর মধ্যেও তো ছোট মৃত্যু আর মহৎ মৃত্যু আছে। যে মৃত্যু মহৎ তার কাছে জীবন তত তুচ্ছ। যে-জীবন শুধু খাওয়া-পরা সাজাগোজার নামান্তর, সে জীবন তো মরালীর কাছে বিড়ম্বনা। মৃত্যুই তো সে কামনা করেছিল, বিষ খেয়েই তো সে জীবনকে আত্মসাৎ করতে চেয়েছিল। তার চেয়ে এ যে অনেক বেশি ভাল হল। যখন একবার ঘর ছেড়ে বেরিয়েছি, তখন সসাগরা পৃথিবীই তো আমার ঘর। আমি ওই অনন্তদিদি আর রাধারানিদিদির মতো সংসার করতে যে চাইনি। চাইনি বলেই তো পালিয়ে এসেছিলাম এখানে। এখানেও আমি এমন থাকতে পারতুম না। একদিন আমাকে এখান থেকেও বেরোতে হত, এখান থেকেও পালাতে হত। একদিন আমি এই হাতিয়াগড়ের ছাতিমতলায় ঢিবির ওপর ছুটোছুটি করে খেলে বেড়িয়েছি, এখন না হয় পৃথিবীর ঢিবিটার ওপরেই খেলে বেড়াব। ওরা আমাকে মদ খাওয়াবে? ওরা আমার গায়ে হাত দেবে? আমাকে গোরুর মাংস খাওয়াবে? খাওয়াক না, ওরা তো তাতে আর আমাকে পাবে না, পাবে আর একজনকে, সে-মেয়েটা যতই কলমা পড়ুক, তাতে আমি তো আমিই থেকে যাব। তবু তো মনে মনে জানব আমি আর একজনকে বাঁচিয়েছি। আর একজনের সুখের কারণ হয়েছি। একদিন বেহুলা যেমন করে তার স্বামীর শব নিয়ে মহাসাগর পাড়ি দিয়েছিল, আমি না হয় আমার শবটা নিয়ে তেমনি করে মহাজীবন পাড়ি দেব! যদি নিজের এই শবদেহটাকে বেহুলার মতো কোনওদিন বাঁচিয়ে তুলতে পারি, সেদিন তো তবু আমার শব-সাধনা সার্থক হবে!
তা হলে আমার কাছে কথা দে, প্রাণ গেলেও কারও কাছে নিজের নাম বলবিনে?
মরালী বললে–এই তোমার পা ছুঁয়ে দিব্যি গালছি বড় বউরানি, প্রাণ গেলেও আমি তোমাদের কাউকে দায়ী করব না, এই তোমার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে দিব্যি গালছি
তারপর ছোট বউরানির দিকে চেয়ে বড় বউরানি জিজ্ঞেস করলেন–আর তুই?
মরালী বললে–কাক-পক্ষীতেও জানতে পারবে না বড় বউরানি আমি মরালী, সবাই জানবে আমি হাতিয়াগড়ের ছোট বউরানি–
আর ও? ওই মুখপুড়ি?
ছোট বউরানি তখন আঁচলে চোখ ঢেকে কাঁদছে। দুর্গা বললে–ছোট বউরানিকে আমি দেখব, ছোট বউরানিকে আমি লুকিয়ে রাখব মন্তর পড়ে–তুমি কিছু ভেবো না বড় বউরানি
আবার তোর ওই বুজরুকি?
বিশ্বাস করো বড় বউরানি। ছোট বউরানির গায়ে কারও আঁচড় লাগবে না–আমি উচাটন করব
কিন্তু তার আগে ছোটমশাই এলে কী বলব তাই বল–ছোটমশাই হয়তো আজই এসে যাবেন–
তুমি বোলো ছোট বউরানিকে তুমি খুন করে ফেলেছ
তার মানে?
তুমি তাই-ই বলো না, তারপর আমি তো আছি
যদি জিজ্ঞেস করেন লাশ কোথায় গেল?
বোলো নদীতে লাশ ভাসিয়ে দিয়েছ!
বড় বউরানি রেগে গেল–তা মাথা-মুন্ডু যাহোক একটা কিছু বললেই হল? নবাব টের পাবে না? নবাবের শাগরেদরা যদি কাউকে বলে দেয়?
নবাবের হারেমে একবার গেলে কি আর তাকে কাক-পক্ষীতে দেখতে পায় বউরানি! তখন কি আর তার নামধাম কোথাও লেখা থাকে? তখন যে তার কুলুজি পর্যন্ত ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায় তখন কি আর কেউ জানতে পারবে যে ও হাতিয়াগড়ের না লস্করপুরের, কোথাকার?
কিন্তু ছোটমশাইকে ছেড়ে ও-মুখপুড়ি থাকতে পারবে? ও যে একদিন এক বিছানায় শুতে না পারলে হাঁসফাস করে–
তা কিছুদিন একটু কষ্ট করুক না বউরানি, প্রাণের চেয়ে সে তবু তো ভাল।
কী রে, তুই ছোটমশাইকে ছেড়ে থাকতে পারবি মুখপুড়ি?
মুখপুড়ি তখন চোখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদছে।
দুর্গা বললে–সে তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও বড় বউরানি, আমি সামলে রাখব সব–এ-ছাড়া তো আর গতিই নেই–
তারপর সেই রাজবাড়িতে রাত আরও গম্ভীর হয়ে এল। আমগাছটার কোটরে তক্ষক সাপটা কয়েকবার কটকটকটাস করে ডেকে উঠল। তারপর রাত যখন আরও গম্ভীর হল, রাজবাড়ির সদর মহলে ডিহিদারের লোক এল পালকি নিয়ে। বড় বউরানি দুর্গাকে ডাকলেন নিঃশব্দে। দুর্গাও ঘুমোয়নি। ছোট বউরানিকে ডেকে আস্তে আস্তে সিঁড়ির নীচের ঘরে ঢুকিয়ে দরজায় চাবি বন্ধ করে দিয়ে এল।
ছোট বউরানি একবার শুধু জিজ্ঞেস করলে আমি এখানে কী করে থাকব দুগ্যা
তুমি থাকো না ছোট বউরানি, আমি তো আছি, আমি থাকতে তোমার ভাবনাটা কী!
কিন্তু কতদিন থাকতে হবে?
দুর্গা বললে–দেখো না, আমি সব ঠিক করে দিচ্ছি, তুমি যেন আবার কথাটথা বোলো না, ডিহিদারের সেপাইরা চলে যাক, তখন আমি আবার আসব–
ছোটমশাই যদি আজ এসে আমাকে খোঁজে?
দুর্গা রেগে গেল। বললে–তা হলে তুমি চলো, তোমাকেই আমি ডিহিদারের পালকিতে তুলে দিয়ে আসছি
না না, তুই রাগ করছিস কেন দুগ্যা? আমি কি তাই বলেছি?
তা একটা রাত আর আলাদা কাটাতে পারবে না তুমি? তোমার ভালর জন্যেই তো এসব করছি গো!
ছোট বউরানি বললে–যদি ওই মেয়েটা ধরা পড়ে?
ধরা পড়বে কেন? তার জন্যে তো আমি দায়িক আছি। আমি তো উচাটন করে দিয়েছি ওকে, দেখলে না ওর মাথার চুল ছিঁড়ে থুতু দিয়ে মন্তর পড়ে দিয়েছি। দেবনর-গন্ধর্ব কেউ ওর কিছু করতে পারবে
তা আমাকেও তাই কর না-তুই! আমিও বেঁচে যাই তা হলে?
দুর্গা বললে–তা আমি যা বলব, তাই করবে তুমি?
তাই করব রে, তাই করব। তুই আমাকে বাঁচা!
দুর্গা বললে–তা হলে তুমি একটু বোসো, আমি মরালীকে পালকিতে তুলে দিয়ে আসি
তারপর সেই অন্ধকারের আড়ালে জাহাঙ্গিরাবাদের জরিপাড় শাড়ি-ঢাকা একটি যৌবন এসে পালকিতে উঠল। কে উঠল, কেন উঠল, তা কেউ জানল না। মাধব ঢালির পাহারা দেওয়া কাজ; সে শুধু জানল ভেতরবাড়ির রানিমহল থেকে কেউ উঠে চলে গেল। কে গেল, কেন গেল তা প্রশ্ন করা পাহারাদারের কাজ নয়। রাজা-রানির ব্যাপারে মাথা ঘামানো তার কাজ নয়। দুর্গা যখন নিজে এসেছে, তখন কৌতূহল প্রকাশ করা তার এক্তিয়ারের বাইরে।
.
আর ঠিক তার কিছুক্ষণ পরেই আবার ছোটমশাই এসে হাজির।
গোকুলকে দেখেই ব্যাপারটা বুঝে নিয়েছিল মাধব ঢালি। সিংদরজাটা ফাঁক করে পাশে দাঁড়িয়ে সেলাম করলে।
সরে দাঁড়া না, দেখছিস ছোটমশাই এসেছেন।
ছোটমশাই ভাবতে ভাবতেই আসছিলেন সারা রাস্তা। মাধব ঢালিকে দেখেই আর কৌতূহল চাপতে পারলেন না। জিজ্ঞেস করলেন–কেমন আছিস সব?
আজ্ঞে, ভাল ছোটমশাই।
কোনও গণ্ডগোল টণ্ডগোল ঘটেনি তো?
আজ্ঞে, গণ্ডগোল হবে কেন? আমি আছি কী করতে?
এরপর আর দাঁড়ালেন না। গোকুলের পেছন পেছন ভেতরে ঢুকে গেলেন। আসবার সময়। বদরগঞ্জের কাছে ডাকাতের উৎপাতের ভয় ছিল। তাই তাড়াতাড়ি বজরা চালিয়ে আসতে বলেছিলেন। বাড়ির ভেতর ঢুকে যেন নিশ্চিন্তির নিশ্বাস ফেললেন একটা। তখনও কেউ জাগেনি। ছোটবউয়ের মহলের দিকটায় অন্ধকার। ওদিকে পরে গেলেই চলবে। তার আগে বড়বউকে খবরটা দেওয়া দরকার। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র নিজে কালীঘাটে যাচ্ছেন, গিয়ে একটা কিছু ব্যবস্থা করবেন কথা দিয়েছেন।
বউবউয়ের ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিলেন–বড়বউ, বড়বউ–আমি…
*
ওদিকে কালীঘাটের মন্দিরের ঘাটেও মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের বজরা এসে ভিড়েছে। এখানে পুজোর ভিড় লেগেই আছে। শুধু কালীঘাটে নয়। কালীমন্দির আরও আছে। সেখানেও লোকেরা পুজো দেয়। রাত যখন গম্ভীর হয়, চিৎপুরের খালটা পেরিয়ে পেরিন সাহেবের বাগানটা ছাড়িয়ে আরও দূরে অন্ধকারের মধ্যে কারা যেন নিঃশব্দে কালীমন্দিরটায় গিয়ে ঢোকে। অন্ধকারের মধ্যেই তারা হড়িকাটের সামনে কাকে যেন ধরে নিয়ে আসে। গঙ্গাজল এনে তাকে স্নান করায়। টু শব্দটি পর্যন্ত করবার উপায় থাকে না। তার। চোখ-মুখ-কান-নাক কাপড়ের ফেটি দিয়ে বাঁধা। তারপর যখন সব শেষ হয়ে যায়, সবাই রক্তের ফোঁটা কপালে লাগিয়ে বেরিয়ে পড়ে। চণ্ডালের রক্ত। হাতে থাকে সড়কি বল্লম বর্শা আর রণ-পা। ঘোড়ার চেয়েও জোরে ছুটে চলে তারা সেই রণ-পা দিয়ে। তারপর সকালের সুতোনুটির লোক অবাক হয়ে দেখে কাণ্ডকারখানা। চিত্রেশ্বরী মন্দিরের মধ্যে সকালবেলা পুজো দিতে গিয়ে সাত হাত পেছিয়ে আসে পুরোহিত। নরবলি। নরবলিতে শান্ত হবার বদলে মায়ের জিভ আরও লকলক করে ওঠে। ফিরিঙ্গিদের সেপাই সান্ত্রি আরও তৎপর হয়ে ওঠে। পেরিন সাহেবের বাগানের বাদুড় আর চামচিকেরা। আরও কিচমিচ করে ওঠে।
কিন্তু সকাল হলেই আবার অন্য দৃশ্য। সাহেবরা যখন পুজো দিতে আসে তখন বড় জাকজমক হয়। সেদিন গণ্ডা গণ্ডা পাঁঠা বলি হয়। প্রসাদের পুষ্পবৃষ্টি লেগে যায়। চিৎপুরে কালীঘাটে পাণ্ডাদের পাড়ায় হাঁকডাক পড়ে যায়। এ-পাড়া ও-পাড়া সরগরম হয়ে যায়। চেতলা থেকে গঙ্গা পেরিয়ে সাঁতরে সবাই ও-পারে গিয়ে হাজির হয়।
কীসের পুজো গো? কীসের পুজো?
সাহেবরা পুজুরিদের ডেকে গণেশ পুজো করে, সরস্বতী পুজো করে। গোবিন্দপুর সুতানুটির লোক সে-প্রসাদ ভক্তিভরে মাথায় চুঁইয়ে খায়। বলে বেঁচে থাকো বাবা কোম্পানির সাহেব, অক্ষয় পেরমায়ু হোক সাহেব কোম্পানির
কিন্তু এবার আরও জাঁক। এবার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র এসেছেন কেষ্টনগর থেকে মায়ের পুজো দিতে। সঙ্গে সাত-সাতটা বজরা। এক হাজার পাঁঠা বলি হবে। বহুদিন আগে মহারাজার মানত ছিল, তারই উদ্যাপন। দান-ধ্যান-দক্ষিণার ছড়াছড়ি হবে। যে যত পারো কুড়িয়ে নাও। সঙ্গে সবাই এসেছে। রায় গুণাকর ভারতচন্দ্র এসেছেন, গোপাল ভাড় মশাই এসেছেন। কিন্তু মহারাজ তবু নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। কালীপ্রসাদ সিংহ তখনও আসেননি। বারবার খবর নিচ্ছেন তার।
বেলা পুইয়ে যখন তিন প্রহর তখন কালীপ্রসাদ সিংহ এলেন। মুর্শিদাবাদ থেকে সোজা নদীপথে এসে হাজির।
মন্ত্রীকে দেখেই আড়ালে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন-কী খবর?
খবর খুব খারাপ শুনে এলুম। আপনার কথা সব বুঝিয়ে বলে এলুম। বললুম ইংরেজদের সাহায্যটা বড় কথা নয়, যদি মিরজাফর দলে থাকে সত্যি সত্যি তবেই ভরসা
শুনে শেঠজি কী বললেন?
শেঠজি বললেন, মিরজাফরকে অপমান করেছ নবাব, সে দলে থাকবেই।
কী অপমান করেছে?
মিরজাফরকে নবাব হুকুম দিয়েছিল মোহনলালকে দেখলেই সেলাম করতে হবে।
শুনে মহারাজ কী যেন ভাবতে লাগলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন–আর হাতিয়াগড়ের জমিদার? তার সেই খবরটা সত্যি?
সত্যি বলেই তো শুনলুম। শুনলুম, ডিহিদারের লোক গিয়ে তাঁর দ্বিতীয়পক্ষের বউকে নাকি নিয়ে এসেছে
নিয়ে এসেছে মানে?
মানে, খবর পেলুম তাদের বজরা নাকি এতক্ষণে কাটোয়ায় পৌঁছে গেছে
মহারাজ গম্ভীর হয়ে গেলেন আরও। তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন–তুমি এক কাজ করো, উমিচাঁদকে খবর দাও যে, আমি এখানে এসে গেছি, আর রাজবল্লভ সেনকেও একবার দেখা করতে বলল আমার সঙ্গে দেখো, খুব সাবধানে যাবে, কেউ যেন টের না পায়–
*
দুটো নদী এসে মিশেছে কাটোয়াতে। একদিকে অজয় আর একদিকে গঙ্গা। ডিহিদারের বজরা এসে পঁড়াল। এখান থেকে পালকিতে যেতে হবে। ডিহিদারের বজরা আবার খালি ফিরে যাবে ডিহিদারের কাছে। এবার আবার নতুন সেপাই, নতুন বন্দুক নিয়ে এসে হাজির হয়েছিল নতুন ডিহিদার।
কিছু কিছু লোক বজরা থেকে মেয়েমানুষ নামতে দেখে ভিড় করেছিল। ডিহিদারকে দেখে তারা সরে গেল।
তারপর সরাইখানার ভেতর রানিবিবি ঢুকে গিয়েছিল। সে এক অস্বস্তিকর অবস্থায় কেটেছে। নদীর ঘাটে, রাস্তায় যে দেখেছে সে-ই কেবল জিজ্ঞেস করেছে–পালকিতে কাদের বউ যাচ্ছে গো?
কান্ত কোনও উত্তর দেয়নি। সেপাইরা, পালকির বেহারারাও কোনও উত্তর দেয়নি। হাতিয়াগড় থেকে বেরিয়ে সমস্তটা রাস্তা ঘুম হয়নি কান্তর। সরাইখানার একদিকটা জেনানামহল, আর একদিকটা মর্দানাদের জন্যে। বোরখাপরা বাঁদির ব্যবস্থাও করে রেখেছিল কোতোয়াল সাহেব। আগে দেখেছিল শুধু রানিবিবির একটা পায়ের গোছ। পালকি থেকে নামবার সময় দেখা গেছে। কিন্তু আজ পালকি থেকে নামবার সময় দেখা গেল মুখখানা। পালকি থেকে মাথা নিচু করে নামতে গিয়েই ঘোমটাটা খসে গিয়েছিল মাথা থেকে। কাটোয়ার সেই খাঁ খাঁ দুপুরের রোদে মুখখানা বুঝি আরও লাল হয়ে গেছে।
হঠাৎ বাঁদিটা এসে ডাকতেই কান্ত অবাক হয়ে গিয়েছিল। ধড়মড় করে বসে জিজ্ঞেস করেছিল আমায় ডেকেছেন? কেন?
তা জানিনে হুজুর।
তুমি ঠিক বলছ?
জি হাঁ।
তারপরে পেছন পেছন গিয়ে যেখানে পৌঁছুল সেখানে আর কেউ নেই। ঘরের মধ্যে একটা গালচের ওপর রানিবিবি একা বসে ছিল। কান্ত দরজার সামনে গিয়ে বললে–আপনি আমায় ডেকেছেন?
রানিবিবি পানের ডিবেটা হাতে তুলে নিয়ে বললো, কাল রাত্তিরে আমাকে ডাকছিলেন কেন?
কান্ত বললে–ডাকতুম না, আপনি আরাম করে ঘুমোচ্ছিলেন, আমার ডাকতে সত্যিই ইচ্ছে হচ্ছিল না, কিন্তু আমার ভয় হচ্ছিল হয়তো ডাকাত পড়বে, বদরগঞ্জের কাছে খুব ডাকাতির ভয় কিনা–তাই আপনাকে ডেকেছিলুম
ডাকাত? ডাকাতের কথা শুনে রানিবিবি যেন একটু হাসলেন।
আপনি হয়তো বিশ্বাস করছেন না, কিন্তু সত্যিই আমি বড় ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম
কিন্তু ভয় পেয়েছিলেন কার জন্যে? আমার জন্যে না আপনার জন্যে?
এর উত্তর দিতে গিয়ে কান্ত একটু বিব্রত হয়ে পড়ল। বললে–আপনার জন্যে?
রানিবিবি হাসতে হাসতে বললে–আমার জন্যে? আমার আবার ভয় কী? আমি তো এক ডাকাতের হাতেই যাচ্ছি, তা বদলে না-হয় বদরগঞ্জের ডাকাতের হাতেই যেতাম। আমার কাছে মুর্শিদাবাদের ডাকাতও যা, বদরগঞ্জের ডাকাতও তাই। বদরগঞ্জের ডাকাতরা কি আর বেশি খারাপ
কান্ত কথাটার ইঙ্গিত বুঝল।
বললে–দেখুন, আপনি হয়তো আমাকেও সেই ডাকাতদের দলে ফেলেছেন, কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি শুধু হুকুম তামিল করতে এসেছি, আমার মাত্র সাত দিনের চাকরি, পেটের দায়ে আমাকে এই চাকরি নিতে হয়েছে–আগে জানলে আমি একাজ নিতুমই না, কাল সারারাত আমি কেবল এই কথাই ভেবেছি
কেন? আপনি ঘুমোননি? সারারাত জেগে ছিলেন?
কান্ত বললে–ঘুম যে এল না, আমি কী করব? আমার কেবল মনে হচ্ছিল ক’টা টাকার জন্যে আমি হয়তো আপনার সর্বনাশ করছি
রানিবিবি পানের ডিবেটা খুলে একটা পান তুলে নিলেন।
কান্ত আবার বললে–ফিরিঙ্গি কোম্পানির চাকরিটা থাকলে, আমি সত্যি বলছি, এ চাকরিটা নিতুম । তা ছাড়া আমার তো আর কেউ নেই যে, তার কাছে গিয়ে থাকব! এক বুড়ি দিদিমা ছিল, বর্গিদের হাতে সে-দিদিমাও মারা গিয়েছে, তাই আমার এ-চাকরি নেওয়া ছাড়া কোনও উপায় ছিল না
তারপর একটু থেমে বললে–আমার কথায় যদি বিশ্বাস না হয় তো আর কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারেন! বশির মিঞা সব জানে!
বশির মিঞা? সে কে?
নিজামতের চর, সে-ই তো আমাকে এ চাকরিটা করে দিলে। কিন্তু আপনি মেয়েমানুষ, জিজ্ঞেস করবেনই বা কী করে। নইলে জানতে পারতেন আমার কথা সত্যি কি না। সে সব জানে! তাকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারতেন, আমি বেভারিজ সাহেবের সোরার গদিতে মুনশির কাজ করতাম, তিন টাকা মাইনে পেতাম, আমার নামও জানে সে, আমি মুসলমান নই, হিন্দু। আমরা বড়চাতরার সরকার, আমার বাবার নাম ঈশ্বর শশধর সরকার, আমার নাম কান্ত সরকার
কী নাম?
কান্ত আবার বললে–কান্ত সরকার
সঙ্গে সঙ্গে রানিবিবির হাত থেকে পানের ডিবেটা পাথরের মেঝের ওপর পড়ে ঝনঝন আওয়াজ করে উঠল। কান্তর মনে হল কাছাকাছি কোথাও কেউ তার নামটা শুনে আর্তনাদ করে উঠল যেন।
.
সরাইখানার সামনে তখন বেশ ছায়া-ছায়া। সোজা কেষ্টনগর থেকে হাঁটতে হাঁটতে সেদিন উদ্ধব দাস সেখানে এসে হাজির। উদ্ধব দাসের এই-ই নিয়ম। যখন যেখানে থাকে সেখানেই তার ঘর। গাছতলাই হোক আর একটা বোস্টমদের আখড়াই হোক, কিংবা রাজবাড়ির অতিথিশালাই হোক, একটা কিছু হলেই হল। না-হলেও কিছু আসে-যায় না। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র একবার বলেছিলেন–উদ্ধব, একটা চাকরি নেবে নাকি হে
উদ্ধব বলেছিল–চাকরি তো করি আমি মহারাজ
তার মানে?
উদ্ধব বলেছিল–আমি আপনার এখানে পড়ে থাকি বলে আপনি কি ভাবেন আমি বেকার? আমি যেখানে যাব সেখানেই সবাই আমার গান শুনে আমায় ঠাই দেবে–
তা নয়, আমার কাছে চাকরি করলে তোমাকে আর চিরকাল এরকম টো টো করে ঘুরে বেড়াতে হবে না–এই দেখো না, ভারতচন্দ্রকে রায়গুণাকর উপাধি দিয়েছি, মুলাজোড়ে ছ’শো টাকা আয়ের সম্পত্তি ইজারা দিয়ে দিয়েছি, সে আয়েশ করে পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে বসে বিদ্যাসুন্দর লিখেছে, অন্নদামঙ্গল লিখেছে–
উদ্ধব বলেছিল–কিন্তু আমি তো আপনার খোশামোদ করতে পারব না ভারতচন্দ্রের মতো
তা ভারতচন্দ্র কি আমায় খোশামোদই করে বলতে চাও?
না করলে তার চাকরি আছে কী করে? আপনি তো আর মিছিমিছি তাকে তার গুণ দেখে উপাধি দেননি!
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র মজা পেয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন–শুধু গুণের বুঝি কদর নেই?
আজ্ঞে আপনি নিজেই তা ভালরকম জানেন, দিল্লির বাদশার খোশামোদ না করলে কি আপনিই মহারাজ হতে পারতেন।
তুমি তো বড় মুখফোঁড় হে!
না হুজুর, আমি যার কাছে চাকরি করি, তাকে খোশামোদ করতে হয় না, খোশামোদনা করেই আমি উপাধি পেয়েছি একটা।
তোমার আবার উপাধি আছে নাকি? তাজ্জব কথা তো! কী উপাধি?
আজ্ঞে, আমার উপাধি ভক্ত-হরিদাস!
তোমার মালিক কে?
উদ্ধব দাস এবার গেয়ে উঠল
ওই দেখো শ্যামনবঘন উদয় গগনে।
এলেন আমার জগবন্ধু রথ-আরোহণে ॥
ওই-পদে রেখেছে মতি, ব্রহ্মা ইন্দ্র পশুপতি।
ভবভার্যা ভাগীরথীর জন্ম ওই চরণে ॥
গলে বনফুল হার, শিরে শিখিপুচ্ছ যার,
দ্বিভুজ মুরলীধর পীতবাস পরনে ॥
গান থামিয়ে উদ্ধব দাস বললে–শুনলেন তো প্রভু, আমার মালিক কে? সেইজন্যে আমি কারও কাছে কিছু চাই না প্রভু, চাইলে চাই মুগের ডাল, কিংবা পান্তা ভাত, কি একদলা নুন
যেখানে যেত উদ্ধব দাস, সেখানেই এইরকম করে কথা বলত। খলু সংসারে কে কাকে কী দিতে পারে গো! তোমরা সবাই খেতাব চাও, মনসবদারি চাও, টাকা চাও, মেয়েমানুষ চাও, আর আমি কিছুই চাই না। চাইলেই দুঃখ, না-চাইলেই সুখ। আমি কিছুই চাই না, তাই সব পাই। তোমরা সব কিছু চাও বলেই তোমাদের কষ্টের আর শেষ নেই।
মোল্লাহাটির মধুসূদন কর্মকার বলেছিল–তা হলে তুমি বিয়ে করতে গেলে কেন দাসমশাই?
উদ্ধব দাস বলেছিল-মতিভ্রম ভায়া, মতিভ্রম-
-তা তোমার কষ্ট হয় না মাগের জন্যে!
হয় বই কী!
কী রকম কষ্ট হয়?
উদ্ধব দাসের তখনই আবার ছড়া পেয়ে যায়। বলে তবে শোনো হে ভায়া–
বিষয়-শূন্য নরবর, বারি-শূন্য সরোবর, বস্ত্র-শূন্য বেশ।
দেবীশূন্য মণ্ডপ, কৃষ্ণশূন্য পাণ্ডব, গা-শূন্য দেশ ।
জলশূন্য ঘট, শিব-শূন্য গেহ, কর্পূর-শূন্য ভাণ্ড ॥
শিকল-শূন্য তালা, ভজনশূন্য মালা, দৃষ্টি শূন্য নয়ন।
ভূমি-শূন্য রাজার রাজ্য, বিদ্যা শূন্য ভট্টাচার্য, নিদ্রা-শূন্য শয়ন । ছড়াটা বলেই উদ্ধব দাস হোহো করে হেসে উঠল। বললে–দেখলে তো, আমি খোশামোদ করিনে তাই, নইলে আমিও রায়গুণাকর হতে পারতাম গো। আমারও বিদ্যে আছে–
তারপর হঠাৎ পোঁটলটা বগলে নিয়ে উঠে বললে–যাই গো অনেক দূর যেতে হবে
কোথায় যাবে, এত সকালে?
যেখানে দু’চোখ যায়। শ্বশুরবাড়ি নেই বলে কি খলু সংসারে যাবার জায়গার অভাব আছে ভায়া?
সেই হাঁটতে হাঁটতেই এখানে এসে পড়েছিল উদ্ধব দাস। এই কাটোয়ার সরাইখানার সামনে। তখন সরাইখানার সামনে সেপাই দুটো গাছতলায় খেয়েদেয়ে জিরোচ্ছে। বন্দুকটা পাশে রেখে সেপাই দুটো মাটিতে চিতপাত হয়ে শুয়ে পড়েছে।
উদ্ধব দাসের পেট তখন খিদেয় চো চো করছে। বললে–কী গো, সেপাই বাবাজীবন, কার পালকি? কোন বিবিজান চলেছে?
সেপাইরা উদ্ধব দাসকে চিনত। বেশ মানুষ। গান না শুনতে চাইলেও গান গাইবে, কিংবা ছড়া কাটবে, হেঁয়ালি বলবে। খেতে দাও আর না-দাও হৃক্ষেপ নেই। উদ্ধব দাস কাউকে হৃক্ষেপ করে না। তার কাছে রাজা-মহারাজ নবাব বাদশাও যা, রাস্তার বোস্টম ভিখিরিও তাই। একেবারে বলা-নেই কওয়া-নেই সটান তাদের মধ্যেই বসে পড়ে বললে–একটা নতুন গান বানিয়েছি—শোনো–
বলে আরম্ভ করলে
আমি রব না ভব-ভবনে
শুনো হে শিব শ্রবণে ॥
যে-নারী করে নাথ হৃদিপদ্মে পদাঘাত
তুমি তারই বশীভূত আমি তা সব কেমনে।
একজন সেপাই বলে উঠল–আরে দাসমশাই যে আবার খেদের গান গাইছে, কেউ বুঝি তোমার বুকে লাথি মেরেছে গো?
আর একজন বললে–তা জানিস না বুঝি, ওর বউ যে বাসরঘর থেকে পালিয়ে গেছে!
তাই নাকি? তারপর? তারপর?
পতিবক্ষে পদ হানি ও হল না কলঙ্কিনী
মন্দ হল মন্দাকিনী ভক্ত হরিদাস ভণে।
গান তখন বেশ জমে উঠেছে। সেপাইরা শুনছে আর হাতে তাল দিচ্ছে। আশপাশের গাঁয়ের লোকও জুটেছে। পালকি-বেহারারাও জুটেছে। কান্ত ঠিক সেই সময়ে এসে হাজির হল। রানিবিবির ঘরে এতক্ষণ কথা বলতে বলতেই গানটা কানে গিয়েছিল। বলেছিল–দেখে আসুন তো কে গান গাইছে ওখানে?
বেড়ে গান বানিয়েছ তো দাসমশাই! তা তোমার বউ পালাল কেন হে?
কান্তর কানে কথাটা গিয়েছিল। সোজা গিয়ে জিজ্ঞেস করলে কার বউ পালিয়েছে বললে–সেপাইজি?
উদ্ধব দাস হাসতে হাসতে বললে–আমার আজ্ঞে।
সেপাইটা তার আগেই বললে–হুজুর, ও পাগলা-ছাগলা লোক, ও গিয়েছে বিয়ে করতে! তা ওর বউ পালাবে না তো কার বউ পালাবে!
উদ্ধব দাস হাসতে হাসতে বললে–তা পালিয়েছে বেশ করেছে, আমার বউ পালিয়েছে তোত তোমাদের কী? বউ না পালালে কি এমন গান বাঁধতে পারতুম?
কান্ত জিজ্ঞেস করলে কোথায় বিয়ে করতে গিয়েছিলে তুমি?
আজ্ঞে হাতিয়াগড়ে!
হাতিয়াগড়ের নামটা শুনেই কান্তর বুকটা ধক করে বেজে উঠল।
আমি কি বিয়ে করতে গিছলাম বাবাজীবন, আমি গিছলাম রাজবাড়ির অতিথশালায় দুটো খেতে আর হাতিয়াগড়ের ছোটরানি আছেন, তাকে দুটো রসের গান শোনাতে!
হাতিয়াগড়ের ছোটরানি?
কান্ত আরও অবাক হয়ে গিয়েছে। যেন এক মুহূর্তে উদ্ধব দাস কান্তর একান্ত আপন লোক হয়ে গেল। কান্ত এবার আরও কাছে সরে এল। তারপর উঁচু হয়ে সামনে বসে পড়ল। বললেছোটরানি বুঝি রসের গান শুনতে ভালবাসে?
খুব ভালবাসে! রসের গান শুনতে কার না ভাল লাগে আজ্ঞে! আমি রসের গান শুনিয়েছিলুম পিরিতের কথা আর বোলো না, দ্বিতীয় পক্ষের রানি যে! বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা যে, ও কম্মে তো ঢুঁ ঢুঁ, তাই কেবল রসের গান শুনেই পেট ভরায়
তুমি দেখেছ ছোটরানিকে?
আমি কী করে দেখব আজ্ঞে, আমি যে অতি দীন-হীন ব্যক্তি
বলেই হঠাৎ গান গেয়ে উঠল–
আমি মা অতি দীন, তনু ক্ষীণ, হল দশার শেষ।
কোন দিন মা রবি-সুতে ধরবে এসে কেশ!
কান্ত ততক্ষণে অধীর হয়ে উঠেছে। বললে–তোমার গান থামাও, আমার কথার উত্তর দাও। আগে–ছোটরানিকে তুমি দেখেছ?
দেখিনি, হরিপদর কাছে ছোটরানির কথা শুনিচি।
কী শুনেছ?
উদ্ধব দাস সেই সব পুরনো কথা বলে গেল। হরিপদর কাছেই কথাগুলো শোনা। চাকদহর শ্রীনিবাস মুখুটির একমাত্র মেয়ে রাসমণি! ছোটমশাই বজরায় করে যাচ্ছিলেন। এমন সময় বড় বউরানির নজর পড়ল ঘাটের দিকে। ঘাটে তখন চান করছিল রাসমণি। মা নেই, ভাই নেই, বোন নেই। সংসারে আপন বলতে আর কেউ নেই। সেই বউ শ্বশুরবাড়ি এসে পর্যন্ত আর বাপের বাড়ি যেতে পায়নি। বাপ শ্রীনিবাস মুখুটি মেয়ের বিয়ের পরই মারা গিয়েছিল। তারপর সেই যে ছোটরানি হাতিয়াগড়ের রাজবাড়িতে এসে ঢুকল, আর বেরোতে পারেনি। একবার শুধু কী শখ হয়েছিল, ছোমশাইয়ের সঙ্গে মুর্শিদাবাদে গিয়েছিল নবাবের নাতির বিয়েতে। সেই তখন থেকেই দুর্গা আছে সঙ্গে। দুর্গাই চুল বেঁধে দেয়, দুর্গাই ছোটরানিকে পুতুলের মতো দিনরাত সাজাত গোজাত।
দুর্গা ছোটরানির চুল বাঁধতে বাঁধতে বলত–কী চুলই হয়েছে তোমার বউরানি, যেন মেঘ, মেঘলা চুল তোমার
পিঠের ওপরে কাপড়টা সরে যেতেই দুর্গা একদিন বললে–ওমা, দেখি দেখি, পিঠে তোমার দাগ কীসের বউরানি?
ছোটরানি খিলখিল করে হেসে উঠেছিল। বলেছিল–ও আর তোকে দেখতে হবে না, তুই চুল বাঁধ
ওমা, এ যে দাঁতের দাগ গো!
ছোট বউরানি হাসছে দেখে দুর্গা বলেছিল–ছোটমশাই কি তোমার পিঠেও দাঁত বসায় নাকি গো?
ছোট বউরানি বলেছিল–তোর ছোটমশাইয়ের গুণের ঘাট নেই তো
দুর্গা বলেছিল–আহা, তুমি আদর চেইছিলে, জন্ম জন্ম এমন আদর পাও তুমি বউরানি! সোয়ামির আদর কি যে-সে জিনিস গো, বলে সোয়ামি হেন জিনিস যে হতভাগী পায়নি সে এর কদর কেমন করে বুঝবে বলো–
বউরানি বলেছিল–মোটে ঘুমুতে দেয় না তোর ছোটমশাই, এমন বজ্জাতি করে—
আহা, তা না-ই বা দিলে ঘুমোতে, এয়োতি মানুষ, মেয়েমানুষের আর কী চাই?
তা ঘুম না হলে মানুষ বাঁচে? তাই তো সকালবেলা গা ম্যাজম্যাজ করে, উঠতে পারিনে বিছানা ছেড়ে
কান্তর শুনতে খুব ভাল লাগছিল। বললে–তারপর?
আজ্ঞে, হরিপদর তো কোনও কাজ নেই, আমি অতিথিশালায় গেলেই আমার কাছে এসে গল্প করত। আমি বলতাম–বাড়ির ভেতরের গল্প আমার কাছে কেন করো বলল তো? তা হরিপদ বলত–দুর্গা যে আমাকে সব এসে বলে গো, আর শুনে কারও কাছে তো বলা চাই! তা ওই সব শুনতাম আর রসের গান বাঁধতুম! কিন্তু একদিন নিজেই বাঁধা পড়ে গেলুম–
সেপাইরা এ-গল্প আগেই শুনেছিল। কান্ত জিজ্ঞেস করলে–কী রকম?
সে এক কাণ্ড প্রভু। একদিন ছোটমশাইয়ের নফর শোভারামের মেয়ের বিয়ে। বর আসবার কথা ছিল কলকাতা থেকে, সেবর ঠিক সময়ে আসতে পারেনি।
কেন? আসতে পারেনি কেন?
উদ্ধব দাস বললে–না এলে যে আমার সর্বনাশ হয় তাই আসতে পারেনি। আমি ঘুমোচ্ছিলাম অতিথশালার দাওয়ায়, সে-ই আমাকে এসে ডেকে নিয়ে গিয়ে সেই মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলে সেই রাত্তিরে–! কপালের গেরো না থাকলে এমন সর্বনাশ হয় কারও প্রভু?
তা তুমি তাকে বিয়ে করলে?
আজ্ঞে, সে প্রভু ওই নামে মাত্তরই বিয়ে। সম্প্রদানটাই শুধু হল, তারপর বাসরঘরে একপাল মেয়ের মধ্যে বসে আছি, আমাকে প্রভু তারা সবাই বললে–কিনা বউকে কোলে করতে
তারপর? তুমি কোলে করলে নাকি?
উদ্ধব দাস বললে–আত্তে প্রভু, আমি তখন ভাবছি, কার ভোগ্য জিনিস কে ভোগ করবে। অমন সুন্দর বউ কি বাঁদরের গলায় মানায় প্রভু? আপনিই বলুন?
তা তুমি কোলে করলে কি না তাই বলো না!
কোলে করব কী করে আজ্ঞে, তার আগেই দেখি কী বউ তখন হাপুস নয়নে কাঁদছে গো
কাঁদছে? কাঁদছে কেন?
প্রভুই জানে কেন কাঁদছে। ওই কান্না দেখে কি আর তখন বউকে কোলে করতে কারও ইচ্ছে করে আজ্ঞে? আমারও তো মন বলে একটা পদার্থ আছে! কান্না দেখে আমার বড় মায়া হল প্রভু! আবার লোভও হল!
লোভ হল কেন?
আজ্ঞে, লোভ হবে না? আমি কুচ্ছিত হলে কী হবে, আমারও তো কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ মদ-মাৎসর্য আছে! অমন গোলাপ ফুলের মতো বউ পাশে বসে কাদবে আর আমি চুপ করে দেখব? আমার বুঝি কান্না আসতে নেই?
উদ্ধব দাস জীবনে কখনও কাঁদে না। কথা বলতে বলতে তারও হয়তো চোখ দুটো ছলছল করে উঠছিল। হঠাৎ হেসে ফেললে। বললে–আমি তখন মনে মনে ওই গানটা বাঁধলুম আজ্ঞে আমি রব না ভব-ভবনে–
তারপর?
তারপর প্রভু, ভাবলুম আমাকে পছন্দ হয়নি বউয়ের। আমাকে তো আজ্ঞে কারওই পছন্দ হয় না, আমার পছন্দ হবারই কিছু নেই। আবার ভাবলুম হয়তো কলকাতার বরের জন্যে মন-কেমন করছে
কেন? কলকাতার বরকে বুঝি ভাল দেখতে?
আমার চেয়ে সবাইকে ভাল দেখতে প্রভু! আমি কি মানুষ আজ্ঞে, আমার না আছে চাল, না আছে চুলো। আমি মানুষই নই। তাই বউটা পালিয়ে যাবার পরই প্রভু আমি রাস্তায় বেরিয়ে পড়লুম। সোজা কেষ্টনগরে গিয়ে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় গেলুম। শিবনিবাসে নিয়ে গেলেন মহারাজ বললেন, চাকরি নেবে তুমি উদ্ধব দাস? আমি বললুম-আমার বউ পালিয়ে গেছে, চাকরি আমি কার জন্যে নেব প্রভু? কার জন্যে দাস বৃত্তি করব। সেখানে গিয়ে গোপাল ভাঁড় মশাইকে হেঁয়ালিতে হারিয়ে দিলুম, রায় গুণাকর ভারতচন্দ্র আমার ছড়ার তারিফ করলেন। আমাকে মহারাজ জিজ্ঞেস করলেন-তুমি কী চাও উদ্ধব! আমি বললুম-মুগের ডাল
সেপাই দু’জন হো হো করে হেসে উঠেছে।
তুমি মহারাজের কাছে কিনা চাইতে গেলে মুগের ডাল? আর কোনও দামি চিজ চাইতে পারলে না দাসমশাই?
উদ্ধব দাস বললে–আমার কাছে সেপাইজি মুগের ডালও যা নবাবের নবাবিও তাই। মুগের ডাল খেয়ে আরাম করে আমি তো তবু ঘুমিয়ে পড়তে পারি, কিন্তু নবাবি? নবাবি পেলে কি কারও ঘুম থাকে আজ্ঞে? বশির মিঞাকে তো তাই বলেছিলুম
কান্ত যেন লাফিয়ে উঠেছে বশির মিঞাকে তুমি চেনো?
চিনব না? আমিও রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াই, বশির মিঞাও ঘুরে বেড়ায়। আমাকে বশির মিঞা বললে–তুমি তো হিল্লি দিল্লি ঘুরে বেড়াও উদ্ধব দাস, চরের চাকরি নেবে? আমি জিজ্ঞেস করলাম–কীসের চাকরি? বশির বললে–নিজামতের চরের চাকরি! শুনে আমি বললাম আমি তোর চাকরির মুখে পেচ্ছাব করে দিই!
সেপাই দুটো ভয়ে চারদিকে চেয়ে দেখলে। কেউ শুনতে পায়নি তো!
জিজ্ঞেস করলে–হ্যাঁগো, তুমি বললে–ওই কথা?
তা বলব না? আমি কি কাউকে ভয় করি নাকি? আমি ভয় করতে যাব কোন দুঃখে শুনি? আমার মাগ আছে, না ছেলেপুলে আছে যে ভয় করতে যাব? শেষকালে কোন দিন হুকুম হবে–যাও, মহারাজ কেষ্টচন্দ্রের দ্বিতীয় পক্ষের বউকে ধরে নিয়ে এসো গে। তখন?
উদ্ধব দাসের কথাগুলো শুনতে শুনতে কান্তর যেন কেমন নিজেকে বড় নিঃসহায় নিঃসম্বল মনে হল। মনে হল এই উদ্ধব দাসও হয়তো তার চেয়েও সুখী! এই উদ্ধব দাসও জীবনের সার তত্ত্বটা জেনে গেছে। উদ্ধব দাসের কিছু না থেকেও যেন সে সকলের সব থাকার গৌরবকে ম্লান করে দিয়েছে। যে-চাকরি সে বশির মিঞার কাছে সেধে নিয়েছে, সেই চাকরিই উদ্ধব দাস লাথি মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। উদ্ধব দাসের বাইরের ভাড়ামির আড়ালে যেন আর একটা নিরাসক্ত মানুষ বড় বড় দুটো চোখ নিয়ে পৃথিবীকে দেখতে বেরিয়েছে। উদ্ধব দাসের এই ঘুরে বেড়ানোও যেন তার আর একরকমের দর্শন। সে পৃথিবীকে দেখে দেখে যেন আরও অনেক কিছু জানতে চায়।
উদ্ধব দাসকে আড়ালে ডাকলে কান্ত। আড়ালে ডেকে চুপি চুপি জিজ্ঞেস করলে একটা কথা তোমাকে জিজ্ঞেস করতাম উদ্ধব দাস। তুমি ঠিক ঠিক উত্তর দেবে?
বলুন প্রভু?
আমার মনে হচ্ছে, তোমার বউ কোথাও পালায়নি উদ্ধব দাস, নিশ্চয় কোথাও লুকিয়ে আছে। কারও বাড়িতে কি কোনও আত্মীয়স্বজনের কাছে। একদিন না একদিন সে বেরোবেই। ধরো যদি কখনও তাকে খুঁজে পাও, তখন তুমি তাকে নেবে?
উদ্ধব দাস যেন এতক্ষণে স্পষ্ট করে প্রথম কান্তর দিকে চেয়ে দেখল।
কিন্তু আপনি কে প্রভু? আপনি কেন একথা জিজ্ঞেস করছেন?
কান্ত একটু ভেবে বললে–আমার স্বার্থ আছে বলেই জিজ্ঞেস করছি
কিন্তু সবাই তো প্রভু আমার বউ পালিয়ে গেছে বলে আমাকে নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করে, কেউ তো এমন করে বলেনি কখনও
তা না বলুক, তাদের কথা আলাদা! তুমি নেবে কি না বলো! আমি একটা কাজে এখন মুর্শিদাবাদে যাচ্ছি। তারপরই হাতিয়াগড়ে যাব, তখন যদি খুঁজে পাই তো তুমি তাকে নেবে?
কিন্তু আপনি প্রভু কেন আমার জন্যে খামোক কষ্ট করতে যাবেন? আপনার কীসের দায়? বউ পালিয়ে গেছে বলে তো আমার কোনও কষ্ট হচ্ছে না–
কান্ত বললে–তোমার কষ্ট না হোক, তোমার সেই বউয়ের তো কষ্ট হতে পারে। তার জীবনটা তো চিরকালের মতো নষ্ট হয়ে গেল
তার জীবন নষ্ট হয়ে গেলে আপনার কীসের দায় প্রভু?
কান্ত একটু ভেবে বললে–দায় আছে বলেই তো বলছি তোমাকে, তোমাদের দুজনের চেয়ে আমারই যে বেশি দায়?
কেন? আপনার দায় কেন প্রভু?
হঠাৎ পেছন থেকে ডাক এল-রানিবিবি আপনাকে এত্তেলা দিয়েছেন বাবুজি!
রানিবিবি! কান্ত উদ্ধব দাসকে বললে–তুমি এখানে একটু দাঁড়াও দাসমশাই, আমি এক্ষুনি আসছি বুঝতেই তো পারছ নিজামতের চাকরি, আমি আসছি এখুনি
বলে কান্ত সরাইখানার ভেতরে চলে গেল।
২.০৩ বেভারিজ সাহেব
বেভারিজ সাহেবের সোরার গদিতে তখন ষষ্ঠীপদ ঘুম থেকে সবে উঠেছে। হিসেবত্তরটা ঠিক না রাখলে আখেরে বড় মুশকিল হয়। একবার যদি সাহেবের সন্দেহ হয় তো মুনশিগিরি ঘুচে যাবে। তিরিশ টাকাকে কী করে তিন টাকা করতে হয় তার কসরত ষষ্ঠীপদ জানে।
ষষ্ঠীপদ মুখে বলে–আমি বাপু ধর্ম করতে এসেছি, ধর্ম করে যাব! তাতে যদি আমার লোকসান হয় তো হোক! আমার বাপের কাছে আমি একটা জিনিস শিখেছি বাপু যে, অধর্মের পয়সা থাকে না
সেই অধর্মকেই ধর্ম বানাতে হলে কিন্তু হিসেবটি পাকা রাখা চাই। হিসেবের গোলমালটি করেছ কি তোমার সব নষ্ট!
ভৈরব দাস ওইটে বোঝে না।
ভৈরব বলে–ধর্ম আবার কী কত্তা? পয়সাকড়ি কামিয়ে গঙ্গাস্নান করে তবে তো ধম্ম করব। এটা তো আপনিই শিখিয়ে দিয়েছেন! এটা কি ধর্ম করবার বয়েস?
দুর হ, দুর হয়।
ষষ্ঠীপদ তাড়া দেয় ভৈরবকে। বলে–তুই নরকে যাবি ভৈরব, ডাহা নরকে যাবি তোর আর মুক্তি নেই রে
কিন্তু সেদিন এক কাণ্ড ঘটল। সকালবেলা ভৈরব আসবার আগেই হিসেবের খাতাগুলো নিয়ে বসেছিল ষষ্ঠীপদ। এমন সময় ভৈরব দৌড়তে দৌড়োতে এল। তখনও হাঁফাচ্ছে। বললে–শিগগির পালান কত্তা, শিগগির পালান–শিগগিরবেভারিজ সাহেব পালিয়েছে, কেল্লার সেপাইরাও পালিয়েছে, লাটসাহেবও পালিয়ে গেছে–আপনি পালান কত্তা, পালান।
সত্যিই ষষ্ঠীপদ প্রথমে বুঝতে পারেনি অতটা। শুধু ষষ্ঠীপদকে দোষ দিয়েই বা কী হবে, কলকাতার কেউই তখন বুঝতে পারেনি। এমন যে হবে, এ-যেন সকলের ধারণার বাইরে। গভর্নর ড্রেক, ক্যাপ্টেন গ্র্যান্ট, জেনারেল লিসবন, বেভারিজ সবাই হতবাক হয়ে গিয়েছিল। ষষ্ঠীপদ অনেক দিন ধরে মুনশিগিরির চাকরিটার জন্যে হাঁ করে ছিল। সবে হাতে দুটো মাগনা পয়সা আসতে শুরু করেছিল, এমন সময় এ কী বলে ভৈরব!
পালাব কেন? কী দোষটা করলুম?
ভৈরব বললে–না পালালে আমার কী? আমি পালালুম
বলে ভৈরব নিজের তলপিতলপা নিয়ে চলে যাচ্ছিল। ষষ্ঠীপদ সামনে এসে পথ আটকে দাঁড়াল। বললে–এই পালাচ্ছিস যে বড়? আমার পাওনাগণ্ডার কী হবে?
আপনার আবার পাওনাগণ্ডার কী মুনশিবাবু, অ্যাদ্দিনের মাইনে নিলুম না, এর মধ্যে আপনার পাওনাগণ্ডাটা হল কীসের? হাতে কি একটা পয়সা পেইছি আমি?
সেই সোরার গদির মধ্যে ষষ্ঠীপদ ভৈরবের গলায় গামছা দিয়ে আটকে ধরেছে।
আজ্ঞে, পাওনাগণ্ডা যা হিসেব হয়, পরে আপনি নেবেন গুনে, এখন তো আগে প্রাণে বাঁচতে দিন।
হঠাৎ এতক্ষণে নজরে পড়ল আধো-অন্ধকারের মধ্যে মাঠের ওপর দিয়ে সব লোক গঙ্গার দিকে দৌড়োচ্ছে। কোলে ছেলে, হাতে পোঁটলা, মাথায় ঝুড়ি। কী হল গো? কী হল? কোথায় যাওয়া হবে? তাদের তখন আর উত্তর দেবার সময় নেই। একদিন বর্গিদের অত্যাচারে গ্রাম থেকে পালিয়ে এসে এখানে ঘরবাড়ি বেঁধে বসবাস শুরু করেছিল, আবার এখান থেকেও নবাবের অত্যাচারে পালিয়ে যেতে হচ্ছে। গরিব প্রজাদের কোথাও গিয়েই শান্তি নেই গো, কোনও যুগেই শান্তি নেই রাজায় রাজায় লড়াই বাধলেই উলুখড়ের প্রাণ যাবে। উলুখড়েরা এ-দেশ থেকে ও-দেশে প্রাণ বাঁচাতে প্রাণান্ত করবে। আর ষষ্ঠীপদরা সেই সুযোগে ভৈরবদের গলায় গামছা দিয়ে টাকাকড়ি সব শুষে নেবে।
আবার ওদিক থেকে কারা যেন সব হইচই করে চেঁচিয়ে উঠল।
ওই শুনুন কত্তা, নবাবের সেপাইরা এসে পড়ল বলে! এখন ছেড়ে দ্যান আমাকে
ষষ্ঠীপদর কী মনে হল। বললে–তবে তোর ট্যাঁকে কী আছে দেখি—
ট্যাঁকে কী থাকবে কত্তা কানাকড়িটাও তাঁকে নেই আজ এই দেখুন
ভৈরব নিজের ট্যাঁক উপুড় করে দেখালে। ট্যাঁকটা ঝেড়ে দেখেও ষষ্ঠীপদর যেন সন্দেহ গেল না। বললে–তা হলে সেদিন যে তোকে তিনটে টাকা দিলুম, সেটা কোথায় গেল?
আজ্ঞে, সে তো আমার হক্কের টাকা, সে আমি খরচা করে ফেলেছি!
এই সাত দিনের মধ্যে তিন টাকা খরচা হয়ে গেল? তুই যে দেখছি বেভারিজ সাহেবের ঘাড়ে…
আজ্ঞে, দেনা ছিল কিছু, তাই শোধ করেছি তিন টাকা!
ততক্ষণে গোলমাল আরও বেড়ে উঠেছে। গঙ্গার ঘাটের দিকে কয়েকটা জাহাজ পাল তুলে দিয়েছে। ফিরিঙ্গি সাহেবরা হুড়মুড় করে উঠছে সবাই তাইতে। দূর গোবিন্দপুরের দিকেও সবাই দৌড়োচ্ছ।
ষষ্ঠীপদর হঠাৎ কী মনে হল। ভৈরবকে একটা লাথি মারলে পা দিয়ে, বললে–যাঃ–তোকে ছেড়ে দিলুম–
তারপর মনে পড়ল এ-সময়ে মাথা ঠিক না রাখলে সব গোলমাল হয়ে যায়। বিপদের দিনে যে মাথা ঠিক রাখতে পারে, সে-ই তো জেতে। তাড়াতাড়ি ষষ্ঠীপদ তহবিলটা ভাল করে দেখলে। সাহেব আগের দিন এসে সব টাকাকড়ি হিসেব করে দিয়ে গিয়েছে। মনে হল, আর তো কিছুক্ষণ, তারপরেই নবাবের ফৌজি সেপাই এসে পড়বে। তখন হয়তো দাউদাউ করে জ্বলবে এই গদি। ষষ্ঠীপদ আর দাঁড়াল না। মালকেঁচা মেরে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। এই তো সুযোগ। বর্গিদের সময়েও লোকে যখন গাঁ ছেড়ে পালাত, ষষ্ঠীপদ তখন তাদের সঙ্গে পালাত না। ছেড়ে ফেলে যাওয়া ফাঁকা বাড়িগুলোর মধ্যে ঢুকে পড়ত ষষ্ঠীপদ। ঢুকে খুঁজে বেড়াত কোথায় বাসনকোসন আছে, কোথায় সোনাদানা আছে; এমনি করে অনেকবার অনেক জিনিস পেয়েছে ষষ্ঠীপদ। জীবনের শুধু একটা মানেই জানত সে। টাকা থাকাটাই যে জীবনের একমাত্র থাকা এই চরম জ্ঞানটাই বুঝে নিয়ে ষষ্ঠীপদ রীতিমতো জ্ঞানী হয়ে উঠেছিল। তাই আর দেরি করলে না। সেই ভোর-ভোর অন্ধকারেই ষষ্ঠীপদ চকমকি ঠুকে আগুন জ্বালাল। তারপর পেছনের দরজা দিয়ে নিঃশব্দে বাইরে বেরিয়ে এল। সেখান থেকে সোজা একেবারে শেঠের বাগান। শেঠেদের গঙ্গার জল বিক্রি করবার ব্যাবসা। বৈষ্ণবচরণ শেঠ সিলমোহর করা গঙ্গাজল ত্রৈলঙ্গ দেশে মোটা দরে বিক্রি করে অনেক টাকার মালিক হয়েছে। ষষ্ঠীপদ পেছনের খিড়কির দরজার কাছে গিয়ে কান পেতে রইল। তারপর হঠাৎ চিৎকার করে উঠল–আল্লা হো আকবর
ওদিক থেকে পালে পালে যারা আসছিল তারা যেন একটু থমকে দাঁড়াল। কিন্তু অন্য এক দিক থেকে তুমুল চিৎকার উঠল আল্লা হো আকবর
শেঠের বাগানের বুড়ো মুনশি হীরালাল সরকারের আচমকা ঘুমটা ভেঙে গেছে। চাকরবাকর-বেয়ারা সবাই জেগে উঠেছে। বৈষ্ণব শেঠের এলাহি কারবার। লাখ লাখ টাকার কারবার করে শেঠেরা শেষকালে ফিরিঙ্গি কোম্পানির দালালও হয়েছিল।
হীরালাল মুনশি ষষ্ঠীপদকে দেখে হতবাক।–আরে তুই? তুই এই অসময়ে কোত্থেকে?
যষ্ঠীপদ তখন মরিয়া হয়ে উঠেছে–হুজুর, সর্বনাশ হয়ে গেছে। নবাব লড়াই শুরু করে দিয়েছে–সেপাই এসে গিয়েছে ওই শুনুন
হীরালাল চারদিকে চেয়ে দেখলেন।
তোদের গদিতে আগুন জ্বলছে না?
হা হুজুর, সাহেব গদিতে ছিল রাত্তিরে, সেপাইরা সাহেবকে খুন করে গদিতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে, তাই আপনাকেও সাবধান করে দিতে এলাম
ষষ্ঠীপদ আগে থেকেই হাঁফাচ্ছিল, এবার খবরটা শুনে হীরালাল সরকারও থরথর করে কাঁপতে লাগল।
তাই আমি বলতে এলাম আজ্ঞে, যদি কর্তারা কেউ থাকে গদিতে—
তুই বেঁচে থাক বাবা, খবরটা দিলি ভাল করলি! এখন কী করি? তহবিলে যে অনেক টাকা রয়েছে–
ষষ্ঠীপদ বললে–ওগুলো সঙ্গে করে নিয়ে যান টাকা কি ফেলে রেখে যেতে আছে? চাকরবাকরদের বলুন, সিন্দুক খুলে পোঁটলা বেঁধে সঙ্গে নিয়ে যেতে
আরে বাবা, সে-যে অনেক টাকা রে, সে-সব নিতে গেলে যে আর প্রাণে বাঁচবনা-ও থাক, কপালে থাকে তো থাকবে, নয়তো থাকবে না
বৈষ্ণবচরণ শেঠবাবুরা বহুদিনের তাঁতের কারবারি। ফিরিঙ্গি সাহেবরা তাঁতিদের, আরমানিদের, হিন্দুদের, শিখদের সকলকে তোয়াজ করে ভেতরের গুপ্ত কথা আদায় করতে চায়। বেছে বেছে এমন। মুনশি রাখে যারা ফিরিঙ্গিদের দেবতার আসনে বসিয়ে পুজো করবে। এমন লোককে দালালি দেয় যে, বিপদের দিনে ফিরিঙ্গিদের দলে আসবে।
সেদিন শেঠবাবুদের বাগানের গদিবাড়িতেও তাই যখন হীরালাল মুনশি প্রাণের ভয়ে সবকিছু ছেড়ে পালিয়ে বাঁচল, তখন গদির সম্পত্তি টাকাকড়ি দেখবার জন্যেও কেউ রইল না। যে-আগুন বেভারিজ সাহেবের সোরার গদিতে জ্বল, সে-আগুন বৈষ্ণবচরণ শেঠের গদিতেও লাগল। নবাব ফৌজ নিয়ে আসবার আগেই সমস্ত কলকাতায় আগুন লেগে গেল। যখন সবাই পালিয়েছে, তখন ষষ্ঠীপদই একলা শেঠবাবুদের গদির ভেতর সিন্দুক ভেঙে কোচড় ভরতি করেছে। ষষ্ঠীপদর কাছে নবাবও যা, ফিরিঙ্গি কোম্পানিও তাই। হিন্দুও যা, মুসলমানও তাই। ষষ্ঠীপদরা শুধু টাকাটাই জানে! টাকাই তো আসল জিনিস রে। তোর টাকা হোক ভৈরব, তখন তোর হাতের ছোঁয়া বামুনরাও খাবে, মোছলমানও খাবে, ফিরিঙ্গি বেটারাও খাবে।
ষষ্ঠীপদর মনে হল, সমস্ত কলকাতাটাই যেন সে কিনে নিয়েছে। এত টাকা। এত মোহর, এত সোনা। সোনা দিয়ে আমি কলকাতা মুড়ে দেব। তখন দেখব, জগৎশেঠ তুমি বড়লোক, না আমি। তুমি আর আমি তখন এক জাত। কলকাতা ছেড়ে সবাই পালিয়ে গেছে। আমি কলকাতার নবাব আর সিরাজ-উ-দ্দৌলা মুর্শিদাবাদের নবাব। তোমার যদি বেশি টাকা থাকে তো আমাকে কিনে নাও। আর আমার যদি বেশি টাকা থাকে তো আমিও তোমাকে কিনে নেব কিন্তু। এখন কলকাতার জমিদারির ৫৭৮৬ বিঘে ১৯ কাঠা জমির মালিক আমি। আমি আবার ওই পোড়া কলকাতায় তোমাদের জমি পত্তনি দেব। ফৌজদারি বালাখানা বানাব, তারপর…
ও কত্তা, কত্তা
হঠাৎ ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেল ষষ্ঠীপদর। চারদিকে একবার চেয়ে দেখলে। এ তো সেই বেভারিজ সাহেবেরই গদিবাড়ি। তা হলে গদিবাড়ির তক্তপোশের ওপর ছেঁড়া মাদুরে শুয়ে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল নাকি সে। নিজের কেঁচড় দেখলে, নিজের হাত দুটো দেখলে। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে দেখলে। কী আশ্চর্য, কোথাও তো আগুন দেখা যাচ্ছে না। কলকাতা তো সেই কলকাতাই আছে। তার নিজের ধুতিখানাও তো সেই একই ধুতি।
ও কত্তা, কত্তা
দুরতেরিকা! সক্কালবেলা জ্বালাতে এসেছে। কে? কে তুই? তাড়াতাড়ি দরজা খুলে ভৈরবকে দেখেই মুখটা বেঁকিয়ে উঠল ষষ্ঠীপদ!
ভোরবেলাই তোর মুখটা দেখতে হল তো! আর সময় পেলি না আসবার! দিনটা একেবারে মাটি, তোর জন্যে দেখছি একটা টাকারও মুখ দেখতে পাব না আজকে! তোর জ্বালায় কি আমি বনবাসী হব রে ভৈরব? সক্কালবেলা তোদের মুখ দেখতে আছে?
ভৈরব অবাক হয়ে গিয়েছিল।
কেন হুজুর, আমি তো ভৈরব দাস নই আর, ভৈরব চক্কোত্তি–নমশুদ্র নই কত্তা, বামুন! আমি তো পইতে পরেছি
ষষ্ঠীপদ রেগে দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিলে। বললে–যা এখন এখান থেকে, ওদিকে মুখ করে দাঁড়া, আমি ঘাটে গিয়ে আগে গঙ্গাজলে মুখ ধুয়ে আসি, তখন আসিস
ষষ্ঠীপদর সমস্ত শরীরটা ঘেন্নায় ঘিনঘিন করতে লাগল। ভোরবেলার স্বপ্ন হয়তো সত্যি হত, কিন্তু বেটার জ্বালায় সব মাটি করে দিলে।
ভেতর থেকেই চেঁচিয়ে বলে–ও-মুখ করে দাঁড়া শিগগির, দাঁড়িয়েছিস?
আজ্ঞে হ্যাঁ, কত্তা
দেখিস, যেন আমাকে দেখে ফেলিসনি! তোকে রেখে তো দেখছি আমার মহা বিপদ হল। আমি এবার বেরোচ্ছি, বুঝলি?
আজ্ঞে হ্যাঁ, বেরোন, কোনও ভয় নেই কত্তা আপনার
ষষ্ঠীপদ আবার সাবধান করে দিলে। বললে–আমি গঙ্গায় গিয়ে মুখ ধুয়ে গদিতে ফিরে এলে তখন মুখ ফেরাবি, বুঝলি তো?
আজ্ঞে হ্যাঁ কত্তা, বুঝেছি!
ষষ্ঠীপদ মাথা নিচু করে দরজাটা খুলে গঙ্গার ঘাটের দিকে গেল। তারপর ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে নেমে দু’হাতের আঁজলা ভরে জল দিয়ে মুখ ধুতে ধুতে বলতে লাগল–মা, পতিতোৰ্ধারিণী গঙ্গে, রাজা। করো মা আমাকে, রাজা করো–
ওদিকে তখন বোধহয় ভোর হচ্ছে। অন্ধকার কেটে আসছে। গঙ্গার নৌকোগুলোর ভেতরে তখন মাঝিরা জেগে উঠেছে। ফিরিঙ্গি কোম্পানির দু-একটা হাতি তখন ঘাটের ধারে চরতে বেরিয়েছে। ষষ্ঠীপদ চোখ দুটো বুজে আবার তখন মন দিয়ে গঙ্গাস্তব করতে লাগল একমনে। মা, পতিতোদ্ধারিণী, গঙ্গে…
*
চকবাজারে তখন সন্ধে হয়-হয়। সড়কের দু’ধারের দোকানে দোকানে রোশনাই। খুশবু তেল তৈরি করত সারাফত। সারাফত আলির তিনপুরুষের খুশবু তেলের দোকান। গুলাবি আতর মাখানো তুলে কানের ভেতর লাগিয়ে দোকানে আগরবাতি জ্বেলে দিয়েছে। জ্বেলে দিয়ে গড়গড়ায় তামাক খাচ্ছে। আগরবাতির ধোঁয়া আর তামাকের ধোঁয়া মিশলে আর একরকম নতুন গন্ধের সৃষ্টি হয়। সেই গন্ধতেই মৌতাতটা জমে সারাফত আলির। হঠাৎ তামাক টানতে টানতে একটা স্বপ্নের ঘোর যেন সারাফতের চোখের ওপর নেমে এল। কেয়াবাত কেয়াবাত! সামনে দিয়ে যেন ঝালরদার পালকি চলেছে একটা। আর তার ভেতরে যেন এক জরিদার ওড়নি ঢাকা চাঁদনি চলেছে বাইরে উঁকি দিতে দিতে।
স্বপ্নই বটে! আগরবাতির ধোঁয়ার স্বপ্ন। খুশবু তেলের স্বপ্ন। আগরাইয়া তামাকুর ধোঁয়ার স্বপ্ন। কেয়াবাত! কেয়াবাত।
কিন্তু হঠাৎ নেশাটা কেটে গেছে। স্বপ্ন নয় তো৷ এ যে চলেছে আসলি ঝালরদার পালকি, নবাবের ফৌজি সেপাই চলেছে।
সত্যি আসলি চিজ কিনা জানতে কৌতূহল হল সারাফত আলির। একবার চিল্লিয়ে উঠল-বাদশা, দেখে আয় তো কৌন–
বাদশা সারাফত আলির নৌকর। সারাফত আলির কেনা বান্দা। তাকে বেশি আর বলতে হয় না। সে দৌড়ে রাস্তায় গিয়ে হাজির। একেবারে তাঞ্জামের সামনে। যাকে সামনে পেলে তাকেই জিজ্ঞেস করলে তাঞ্জাম মে কৌন হ্যায় জি?
সেপাইটা বন্দুক ঘাড়ে করে চলছিল। বললে–নয়াবেগম
নয়াবেগম! কোথায় চলেছে নয়াবেগম এই সাঁঝবেলায়? সন্ধেবেলায় তো বেগমরা রাস্তায় বেরোয় । কোথায় চলেছে গো নয়াবেগম?
জাহান্নম!
বোধহয় রাগ করেই কথাটা বলেছিল সেপাইজি? আর তা ছাড়া রাগ তো হবারই কথা! উল্লুকদের কথার জবাব দিতে সেপাইদের ইজ্জত বাধে।
কী রে, কী বললে–সেপাইজি? কে?
বাদশা বললে–হুজুর নয়াবেগম!
ফিন নয়াবেগম! শালা বেগমে বেগমে ভরে গেল চেহেল সুতুন! তবু শালার বেগমের কমতি নেই! বড় খতরা হয়ে গেল দুনিয়াটা! ব্যাকোয়াশ হয়ে গেল জিন্দিগিটা! মুর্শিদাবাদ আবার ডুববে রে! সঙ্গে আবার কাফের যাচ্ছে একটা! ওটা কে রে? সঙ্গে সঙ্গে ওটা যাচ্ছে কেন রে? আমাদের কান্তবাবুনা?
কান্ত একমনে ভাবতে ভাবতে পালকির পেছন পেছন যাচ্ছিল। পাশ থেকে সারাফত আলির কথাগুলো কানে এল। এতক্ষণে যেন জ্ঞান ফিরে এল কান্তর। এতক্ষণ যেন খেয়ালই ছিল না কোথায় চলেছে, কোথায় এসে পৌঁছেছে। চকবাজার। এখান থেকেই হাতিয়াগড়ে রওনা হয়েছিল সে। এই সেই সড়ক, এখানে এসেই বশিরের সঙ্গে দেখা করেছিল সে! রাস্তার লোকগুলো পর্যন্ত তাকে আজ আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। ওই দেখো নবাবের চর! চর যখন ছিল না, তখনই চর বলে ধরে নিয়েছিল বেভারিজ সাহেব। ষষ্ঠীপদ খুব বাঁচিয়ে দিয়েছে। ষষ্ঠীপদ লোকটা ভাল। বড় সরল। ইচ্ছে করলেই তো তাকে ধরিয়ে দিতে পারত। সাহেবকে গিয়ে চুপি চুপি খবরটা দিলেই পারত যে মুনশিবাবু নিজামতের চর। তখন গোরা-পল্টন এসে কান্তকে ধরে নিয়ে গেলেই বা তার কী বলবার থাকত।
মাথার মধ্যে সমস্ত অতীতটা তোলপাড় করতে লাগল কান্তর। সড়কটা উঁচু নিচু। এখান দিয়ে পালকি যেতে যেতে কতবার বেহারারা পা ভেঙে পড়ে গেছে। দিদিমার সঙ্গে বড়চাতরার রাস্তায় চলতে চলতে এমনি অন্যমনস্ক হয়ে যেত কান্ত। দিদিমা বলত–রাস্তার দিকে নজর দিয়ে চল, পড়ে যাবি যে
অথচ ভাবনা নাম করলে চলে! সারাফত আলি হয়তো তাকে দেখতে পেয়েছে। মৌতাতের মৌজে হয়তো ঠিক চিনতে পারেনি। চিনতে না-পারলেই ভাল। চিনতে পারলেই কাল আবার জিজ্ঞেস করত মিঞাসাহেব কাল তাঞ্জামে চড়িয়ে কাকে নিয়ে যাচ্ছিলে বাবুসাহেব?
কাটোয়ার সেই উদ্ধব দাসও সেপাইদের জিজ্ঞেস করেছিল–পালকিতে কোন বিবিজান যাচ্ছে গো?
সত্যিই বড় অদ্ভুত লোক ওই উদ্ধব দাস। কোনও বিকার নেই কোনও দুঃখ নেই। কেবল ঘোরে। ঘুরে বেড়িয়েই সারা পৃথিবীটা প্রদক্ষিণ করতে চায়। উদ্ধব দাস বলেছিল–আমি মানুষ নই প্রভু, আমি মানুষ নই আমার বউ পালাবে না তো কার বউ পালাবে বলুন?
তারপর বোধহয় কী মনে হয়েছিল, বলেছিল–তোমরা হাসছ সেপাইজান, কিন্তু হাসি নয়, খাঁটি কথা বলছি আমি! বউ পালিয়েছে বেশ করেছে। পালিয়ে গিয়ে বেঁচেছে হে! সে-মেয়ের আমার সঙ্গে বনবে কেন গো? সে মেয়ে যে ঠোঁটে আলতা লাগায়, তাম্বুল-বিহার না হলে মুখে পান রোচে না তার, পাশা খেলে! বাউন্ডুলে বরের সঙ্গে তার বনবে কেন প্রভু?
কান্ত আর থাকতে পারেনি। জিজ্ঞেস করেছিল তোমার বউকে কেমন দেখতে ছিল গো?
উদ্ধব দাস কান্তর দিকে চেয়ে হঠাৎ বলেছিল–আজ্ঞে প্রভু, আপনার সঙ্গে মানাত তার
সেপাই দুটো খুব হেসে উঠেছিল হোহো করে দূর বুড়ো, তুই থাম–
আজ্ঞে না সেপাইজি, আমি ঠিক বলছি, এই বাবুর সঙ্গে খুব মানাত, বাবুও দেখতে সুন্দর, আমার বউও দেখতে সুন্দর, দু’জনে মিলে সংসার আলো করে থাকত
কী ভেবে উদ্ধব দাস সেদিন কথাগুলো বলেছিল কে জানে! হয়তো রসিকতা করেছিল। কিংবা হয়তো রসিকতা করেনি। হয়তো সে সত্যি কথাই বলেছিল। কিন্তু উদ্ধব দাসের কথাটা এখনও ভুলতে পারেনি কান্ত, পরে একবার মরালীকে বলেছিল। মরালী প্রথমে কিছু উত্তর দেয়নি।
কান্ত বলেছিল সত্যি বলছি, তুমি বিশ্বাস করো, সত্যি সত্যিই দাসমশাই আমাকে সেই কথা বলেছিল–
মরালী তখন মরিয়ম বেগম। বলেছিল–তার কথা থাক–
কান্ত আর সে কথা নিয়ে বেশি পীড়াপীড়ি করেনি। শুধু বলেছিল–তার কথা সত্যি হলেই বোধহয় ভাল হত, না গো?
মরালী বলেছিল–ছিঃ, তোমার মুখে দেখছি কোনও কথাই আটকায় না—
কান্ত বলেছিল কিন্তু আমি যে কিছুতেই সে-সব কথা ভুলতে পারি না।
তা ভুলতে চেষ্টাও তো করবে। আমি তো ভুলে গেছি!
তোমার মতন মন হলে আমিও হয়তো ভুলতে পারতাম। কিন্তু আমার মনের গড়নটাই যে অন্যরকম। তোমার সঙ্গে তাই আমার কিছুই মেলে না দেখছি।
মরালী বলেছিল–মেলেই তো না। মিললে তুমি বিয়ের দিন ঠিক সময়ে এসে হাজির হতে! আমাকেও আর তা হলে এখানে এসে মরিয়ম বেগম হতে হত না!
কান্ত বলেছিল–তুমি মরিয়ম বেগমই হও আর যে-ই হও, আমার কাছে তুমি কিন্তু সেই মরালীই আছ!
মরালী ভয়ে ভয়ে চারদিকে চেয়ে বলেছিল–অত চেঁচিয়ো না, শেষকালে কেউ শুনে ফেললে মুশকিল হয়ে যাবে
মনে আছে, প্রত্যেক দিন কান্ত লুকিয়ে লুকিয়ে গিয়ে হাজির হত মরালীর কাছে। আর তারপর যখন না এসে উপায় থাকত না তখন পেছনের সুড়ঙ্গ দিয়ে বাইরে চলে আসত। বাইরে এসে আবার সেই সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকানের পেছনে গিয়ে নিজের আস্তানার মধ্যে চিতপাত হয়ে শুয়ে পড়ত। সে-সব একদিন গেছে। চকবাজারের ছোট্ট একটা দোকানঘরের মধ্যেই কান্তর জীবন-যৌবন-জীবিকা সবকিছু কেটে গিয়েছিল। কাটোয়ার সরাইখানার সামনে সেদিন উদ্ধব দাসের সঙ্গে পরিচয় না-হয়ে গেলে হয়তো এমন হত না। এমন করে ঘনিষ্ঠ হওয়াও যেত না মরালীর সঙ্গে। হয়তো পালকিতে করে রানিবিবিকে চেহেলসূতুনে পৌঁছিয়ে দিয়েই সে একথা ভুলে যেত। একেবারে। তার জীবন অন্য দিকে মোড় ফিরত! কিন্তু উদ্ধব দাসই তার সব বানচাল করে দিলে। উদ্ধব দাসকে দেখে উদ্ধব দাসের সঙ্গে কথা বলেই কান্তর জীবনের গতি অন্য দিকে ঘুরে গেল।
হঠাৎ রানিবিবির ডাকেই কান্ত আবার ফিরে গিয়েছিল সরাইখানার ভেতরে। রানিবিবিও তার জন্যে বোধহয় উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিল। জিজ্ঞেস করলে–দেখে এলেন? কে ও?
কান্ত বললে–ওর নাম উদ্ধব দাস–অদ্ভুত মানুষ!
কেন? কী করে জানলেন?
কান্ত বললে–আপনি শুনলে অবাক হয়ে যাবেন, যার সঙ্গে আমার বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছিল, তার সঙ্গেই ওর বিয়ে হয়ে গেছে!
তারপর? ওর বউ কোথায় গেল?
সেই জন্যেই তো বলছি অদ্ভুত মানুষ। আমার ওরকম হলে আমি কিন্তু আত্মহত্যা করতুম। কিন্তু ও বেশ দিব্যি হেসে-খেলে গান গেয়ে বেড়াচ্ছে–
তা ওর বউ কোথায় পালাল?
তা হলে শুনুন!
কান্ত বলতে লাগল তা হলে শুনুন, তাকে আর পাওয়া যাবে না।
কী করে জানলেন পাওয়া যাবে না?
আমি যেদিন আপনাকে আনতে হাতিয়াগড়ে গিয়েছিলুম না, সেইদিনই দেখলুম সেই বউকে খোঁজবার জন্যে হাতচালা হচ্ছে। আপনাদের বাড়ির ঝি দুর্গাকে চেনেন আপনি? আপনারই তো ঝি সে? চেনেন?
খুব চিনি! সে তুকতাক করে!
হ্যাঁ, দেখি সেই দুগ্যা নয়ানপিসি বলে একজন বিধবার হাত চালাচ্ছে আর বিড়বিড় করে মন্তর পড়ছে। কিন্তু সেই মরালীকে আর পাওয়া গেল না–
মরালী কে?
যার সঙ্গে আমার বিয়ে হবার কথা হয়েছিল তারই নাম। তা দুগ্যা বললে–সে নাকি পুষ্যানক্ষত্রে শ্বেতজয়ন্তীর শেকড় খেয়েছে, তাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। দেবনর-গন্ধর্ব কেউ খুঁজে পাবে না। কথাটা দুগ্যা বললে–বটে, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে সব বুজরুকি। নিশ্চয়ই সে কোথাও লুকিয়ে আছে। আপনি কি তুকতাকে বিশ্বাস করেন?
কেন করব না। দুগ্যার দেওয়া মাদুলি পরে কত লোকের রোগ সেরে যেতে দেখেছি।
কিন্তু তা বলে অদৃশ্য হয়ে যাবে একেবারে? তাই কখনও হয়? আমি তো উদ্ধব দাসকে বলে এলাম, নিশ্চয়ই সে কোথাও লুকিয়ে আছে, আমি তাকে খুঁজে বার করব। আপনাকে মুর্শিদাবাদে পৌঁছিয়ে দিয়েই আমি আবার হাতিয়াগড়ে ওর বউকে খুঁজতে যাব–
ওর বউয়ের জন্যে আপনার তো দেখছি খুব মাথাব্যথা!
কান্ত বললে–আহা, আমি তো বুঝতে পারি বউ পালিয়ে গেলে মানুষের কীরকম কষ্ট হয়! ও অবশ্য মুখে কিছু বলছে না, হেসে হেসে ছড়া বানাচ্ছে আর গান গাইছে–কিন্তু মনে মনে তো কষ্ট হচ্ছে।
রানিবিবি বললে–ওর কষ্টের চেয়ে দেখছি আপনার কষ্টটাই যেন বেশি।
কিন্তু আমার জন্যেই তো ওর বউ পালাল!
আপনার জন্যে পালিয়েছে কে বললে?
ওই উদ্ধব দাসই তো বললে। বললে–আমার সঙ্গেই নাকি মরালীকে বেশি মানাত! ওর মতে ওকে পছন্দ হয়নি বলেই সে পালিয়েছে। আপনি নিজে রাজরানি, আপনি তো সাধারণ মানুষের মনের খবর রাখেন না।
রানিবিবি বললে–আমি রাজরানি হলেও সাধারণ গরিব ঘরেরই মেয়ে, আমি বুঝি
আপনি সাধারণ ঘরের মেয়ে?
আমি চাকদা’র মুখুটি বংশের মেয়ে। আমাদের বাড়িতে এক-একদিন ভাতই রান্না হত না–এত গরিব ছিলাম আমরা
কেন?
চাল থাকত না বলে। বাবা ছিলেন পণ্ডিত মানুষ। এঁরা আমাকে আমার রূপ দেখে পছন্দ করে বউ করে নিয়ে এসেছিলেন। আমি সাধারণ লোকের দুঃখকষ্ট খুব ভাল করেই বুঝি
কান্ত বললে–অথচ, কাল রাত থেকে আপনার সঙ্গে কথা বলতে আমার খুব ভয় করছিল। ভাবছিলাম হয়তো আপনি আমার মতো গরিব লোকদের সঙ্গে কথাই বলবেন না। তাই মাঝিরা যখন কাল রাত্তিরে ডাকাতের ভয় দেখাল তখন আমি আর আপনাকে না ডেকে পারিনি
তারপর একটু থেমে আবার বললে–আচ্ছা, আর একটা কথা জিজ্ঞেস করছি। কিছু মনে করবেন না–
বলুন না
আপনি কেন মুর্শিদাবাদ যাচ্ছেন? নবাবের ডিহিদার পরওয়ানা দিলে আর আপনিও চললেন? হাতিয়াগড়ের ছোটমশাই কিছু আপত্তি করলেন না? আমি হলে তো আমার স্ত্রীকে কিছুতেই পরের হাতে তুলে দিতে পারতুম না, প্রাণ গেলেও না। সত্যিই কি নবাবকে আপনাদের এত ভয়?
রানিবিবি একটু হাসলেন। রানিবিবির হাসিটা খুব ভাল লাগল কান্তর। রানিবিবি বললেন–সকলে কি আপনার মতো সাহসী?
কান্ত বললে–সাহসের কথা হচ্ছে না, কেউ যদি কাউকে ভালবাসে তা হলে বিপদের দিনে তাকে ছাড়তে পারে? আর আমার কথা ছেড়ে দিন, চাকরির জন্যেই তো আমাকে এই পাপ করতে হচ্ছে–
পাপ যদি মনে করেন তো এ-চাকরি করতে গেলেন কেন?
আগে কি জানতুম চাকরি নিলে এই পাপ কাজ করতে হবে?
এখন তো জানলেন, এখন ছেড়ে দিন।
কান্ত বললে–ছাড়তে আমি এখনই পারি! না-হয় উপোসই করব। কিন্তু আপনার তাতে তো কোনও লাভ হবে না। আমি না হলে অন্য কেউ আপনাকে নিয়ে গিয়ে পুরে দেবে হারেমের ভেতরে। তখন?
আমার কথা ছেড়ে দিন! আমার যা হবার তা হবেই। আমি সবকিছুর জন্যেই তৈরি
কান্ত বললে–কিন্তু আমি বলছি আপনাকে, আপনি না এলেই ভাল করতেন-নাটোরের মহারানি রানিভবানীর নাম শুনেছেন তো?
হ্যাঁ!
তা হলে চুপি চুপি আপনাকে একটা কথা বলি। কাউকে বলবেন না, তার মেয়েকেও একদিন আপনার মতন ডেকে পাঠিয়েছিল নবাব–তা জানেন?
তাই নাকি?
হ্যাঁ, আমাকে চকবাজারের গন্ধতেলের দোকানের মালিক সারাফত আলি সব বলেছে! নবাব তো লোক ভাল নয়। তা ছাড়া তার ইয়ারবকশি যারা আছে, তারাও খারাপ লোক। সেই রানিভবানী নবাবের পরোয়ানা পেয়েই এক কাণ্ড করলেন–
কিন্তু রানিভবানীর মেয়েকে নবাব দেখলে কী করে?
নবাব নৌকো করে যাচ্ছিল আর ওদিকে রানিভবানীর মেয়ে বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে রোদ্দুরে চুল শুকোচ্ছিল, তখনই নবাবের নজরে পড়ে গেছে। তা তারপর রানিভবানী করলেন কী, দু’দিন পরেই শ্মশানে একটা খালি চিতা সাজিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দিলেন। রটিয়ে দিলেন যে তার মেয়ে হঠাৎ অসুখ হয়ে মারা গেছে আর ওদিকে মেয়েকে এক সাধুর আশ্রমে লুকিয়ে রাখলেন! আপনিও তো সেই রকম কিছু করতে পারতেন। কেন আপনি আসতে গেলেন এমন করে? ওখানে গেলে আপনার ধর্ম থাকবে না তা বলে রাখছি–আপনি হিন্দু আমিও হিন্দু আপনাকে বিশ্বাস করে সব কথা বললুম!
তারপর আবার গলা নিচু করে বললে–দেখুন, এখনও সময় আছে, আপনি পালিয়ে যান
তার মানে?
সামনের দিকে আমগাছতলায় সেপাই দুটো উদ্ধব দাসের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিয়েছে। বেহারারাও গা এলিয়ে দিয়েছে সেখানে। আপনি এই পেছনের দরজাটা দিয়ে বেরিয়ে যান না। ওই বাদিটা আছে, ওকে কোনও কাজের ছুতো করে কোথা থেকে জলটল আনতে বলে দিন। সেই ফাঁকে আপনি বেরিয়ে যান। এখান থেকে সামনে গঙ্গা পাবেন, সেই গঙ্গার পাড় ধরে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যান–আর যদি কেউ আপনার দামি শাড়ি দেখে সন্দেহ করে তো একটা না-হয় ময়লা আটপৌরে শাড়ি পরে নিন। সঙ্গে আটপৌরে শাড়ি নেই আপনার?
কিন্তু তাতে আপনার কিছু ক্ষতি হবে না?
আমার ক্ষতি হোক গে! আপনি তো আগে বাঁচুন! আমি আমার একটা পেট যে-কোনও রকমে হোক চালিয়ে নেব। তার চেয়ে আপনার ধর্মটাই বড়।
বড় দেরিতে আপনার জ্ঞান হল দেখছি।
কান্ত বললে–না, কাল রাত্তিরেই আমার মনে হয়েছিল এ আমি কী করছি। আজ উদ্ধব দাসকে দেখেও এই কথাই আমার মনে হচ্ছিল–এ আমি কী করছি! না, আমি বলছি আপনি পালান ওই খিড়কির দরজাটা খুলে চলে যান, আমি বাইরেটা একবার দেখে আসছি
কিন্তু আপনি? আপনি কী বলবেন ডিহিদারকে? ডিহিদার যখন আপনাকে জিজ্ঞেস করবে রানিবিবি কোথায়, কেমন করে পালাল, তখন!
আমার কথা আমি পরে ভাবব। সে ভাববার অনেক সময় আছে। আপনি আগে যান, আমার কথা আপনাকে ভাবতে হবে না
রানিবিবি খানিকক্ষণ কী যেন ভাবতে লাগলেন। তারপর বললেন তার চেয়ে দুজনে মিলে একসঙ্গে পালালে কেমন হয়?–আপনিও আমার সঙ্গে চলুন না আপনি থাকলে অনেক সুবিধে হত!
কান্ত একটু মনে মনে ভাবতে লাগল।
কিন্তু আমাকেই বা আপনি বিশ্বাস করতে পারলেন কী করে? আমিও তো আপনার ক্ষতি করতে পারি!
কী ক্ষতি? আপনি আমার কী ক্ষতি করবেন?
না, আমাকে তো আপনি ভাল করে চেনেন না এখনও।
রানিবিবি বললেন–না, আপনাকে আমি চিনি।
আমাকে চেনেন আপনি?
আপনি যে ভোরবেলা নিজের নাম বললেন। আপনার নিজের পরিচয় দিলেন!
কান্ত বললে–সে তো ভারী, সেইটুকুতেই কি একজন মানুষকে চেনা যায়? আর আমি কোথায় নিয়ে যাব আপনাকে? হাতিয়াগড়ে?
রানিবিবি বললেন–না, সেখানে গেলে জানাজানি হয়ে যাবে! তাদের সকলের সর্বনাশ হবে!
তা হলে কোথায় যাবেন?
রানিবিবি বললেন–অন্য যে-কোনও জায়গায়। যেখানে গিয়ে লুকিয়ে থাকতে পারব।
কেন? আপনার বাপের বাড়ি নেই? কোনও আত্মীয়স্বজন?
আমি তো বললুম আমি গরিবের মেয়ে। বিয়ের পরই বাবা মারা গেছেন, আর কেউ কোথাও নেই, এক শ্বশুরবাড়ি ছাড়া!
কান্ত যেন মুশকিলে পড়ল। রানবিবিকে নিয়ে কোথায় যাবে সে। তার নিজেরই কি কোনও জায়গা আছে যাবার! এক আছে বড়চাতরা! কিন্তু সেখানে গেলেও হয়তো নবাবের চর পেছন পেছন গিয়ে পৌঁছোবে। আর বড়চাতরার লোকেরাই যদি জিজ্ঞেস করে সঙ্গে কে? তখন কী উত্তর দেবে কান্ত! কী পরিচয় দেবে!
হঠাৎ কান্ত একটা কাণ্ড করে বসল। বললে–দাঁড়ান, আমি বাইরে গিয়ে দেখে আসি ওরা কী করছে। এখন আর খিড়কির দিকটাও দেখে আসি আপনি ততক্ষণে শাড়িটা বদলে নিন–
বলে কান্ত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
*
রাজবাড়ি থেকে তখন ফিরছিল শোভারাম। কাজ থাক আর না-থাক শোভারামকে গিয়ে নিয়ম করে হাজরে দিতে হয়। সকাল থেকে তেল-গামছা নিয়ে ছোটমশাইয়ের জন্যে বসে থাকতে হয়। তারপর গোকুল হোক কি হরিপদ হক, কাউকে দেখলেই জিজ্ঞেস করে হ্যাঁগো, ছোটমশাই নীচেয় নামবেন না?
সেই সেদিন থেকেই ছোটমশাইয়ের অসুখ। কাছারি বাড়িতেও আসেন না। দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়া করে আবার আর একবার যায় রাজবাড়িতে। তখন দুপুরবেলা ঘুম থেকে উঠে একবার ছোটমশাই নীচেয় নামেন। কাছারিবাড়িতে আসেন। খাতাপত্র দেখেন। কদিন ধরে তা-ও করছেন না।
পথে দুর্গার সঙ্গে হঠাৎ দেখা। দুর্গাই আগ বাড়িয়ে বললে।
বললে–আর ভাবনা নেই গো শোভারাম, তোমার মেয়েকে পাওয়া গিয়েছে
শোভারাম তো অবাক! এতদিন পরে পাওয়া গেল?
একেবারে দুর্গার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াল। কোথায় পেলে গো? কী করে পেলে?
দুর্গা বললে–বড় কষ্ট হয়েছে গো! তিন দিন তিন রাত অষ্টসিদ্ধি জপ করলাম। জপ করতে করতে দেবলোক নরলোক গন্ধর্বলোক সব খুঁজে খুঁজে হয়রান। শেষকালে গেলাম, দৈত্যলোকে, গিয়ে দেখি ছুঁড়ি ঘাপটি মেরে বসে আছে। তখন চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে এলুম। বললুম চল ঘুড়ি চল, তোর বাপ এদিকে কান্নাকাটি করে মরছে, আর তুই এখেনে ঘাপটি মেরে বসে আছিস। চল
কথাগুলো শুনতে শুনতে শোভারাম একেবারে মাটিতে বসে পড়ল। শোভারামের কাণ্ড দেখে এতদিন সবাই তাকে পাগল বলেছে। পাগল ছাড়া আর কী। মেয়ে পালিয়ে গেছে বলে মানুষ বিবাগী হয়েছে এমন ঘটনা কেউ আগে শোনেনি। আর চলে গেছে তো বেশ করেছে। মেয়ে তো গলার কাটা গো। তার বিয়েও দিতে হবে, আবার চিরকাল তার ভালমন্দ দেখতে হবে।
শোভারাম সেই অবস্থাতেই যেন কেঁদে ফেলবার জোগাড় করলে। জিজ্ঞেস করলে–মরি আমার কেমন আছে দুগ্যা? আমাকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে তো তার?
তা কষ্ট হবে না? বাপ বলে কথা! আমি খুব শুনিয়ে দিলুম তাকে, বললুম-হালা ছুঁড়ি, তোর বাপ ওদিকে কেঁদে কেঁদে হন্যে হয়ে বেড়াচ্ছে আর তুই এখেনে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছিস? তোর আক্কেল তো খুব লা?
তুমি বললে–তাকে এই কথা?
বলব না তো কি ভয়ে চুপ করে থাকব?
শোভারাম বললে–তা তো বটেই, তা জিজ্ঞেস করলে না কেন যে, পুষ্যানক্ষত্রে শ্বেতজয়ন্তীর শেকড় খেতে গেল কেন সে? কেন মরতে ও-বিষ খেতে গিয়েছিল? আমি কী অপরাধটা করেছিলুম?
জিজ্ঞেস করেছি। আমি ছাড়িনি। মুখপুড়িকে আমি জিজ্ঞেস করলুম–তুই আর খাবার জিনিস পেলিনে? পুষ্যানক্ষত্রে শ্বেতজয়ন্তী শেকড় কেউ খায় রে?
তা কী বললে–সে?
কিছুতেই জবাব দেয় না সে কথার। আমাকে তো চেনে না। আমিও তেমনি মেয়ে। আমি তখন স্তম্ভন আরম্ভ করলুম। আমার কাছে দুধ-অপরাজিতার শেকড় ছিল, তাই মুখে পুরে দিয়ে আটবার পরি-সাধন মন্তরটা জপ করতে লাগলুম। তখন যাবে কোথায়, গড়গড় করে সব বলে ফেললে
কী বললে?
বললে–আমি যা ভেবেছি তাই ঠিক–বর পছন্দ হয়নি!
শোভারাম আরও অবাক হয়ে গেল। বললে–তা বর পছন্দ হয়নি বলে নিজের বাপকে ত্যাগ করে গেল সে? অ্যাদ্দিন যে তাকে খাওয়ালুম পরালুম, মানুষ করলুম, তার কিছু দাম নেই রে? আমার কথাও একবার তার মনে পড়ল না? এই যে আমার খাওয়া নেই দাওয়া নেই ঘুম নেই, সেটাও কিছু নয়?
দুর্গা বললে–আমি তাও বলিছি, আমি ছাড়িনি। বললুম–তুই নিজের বাপকে যে এত কষ্ট দিলি এতে কি তোর ভাল হবে ভেবেছিস? তোর মেয়ে হলে তোকেও যে সে এমনি করে ভোগাবে রে!
না না দুগ্যা! আমি যেমন ভুগছি, মরি যেন এমন করে না ভোগে। আমাকে ছেড়ে যদি সে সুখী থাকে তো তাও ভাল। এমন কষ্ট যেন কেউ না পায়। তা থাকগে, মরি কোথায় আছে এখন
দুর্গা বললে–সেই কথাই তো তোমাকে বলছি শোভারাম, মেয়েকে তো তোমার এনেছি, কিন্তু একটা কথা আছে…
কী কথা?
দৈত্যলোক থেকে তোমার মেয়েকে তো ছাড়িয়ে আনছি, এমন সময় দৈত্যরাজ ধরলে আমাকে, বললে–মরালীকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস? আমি বললুম–মহারাজ, এর বাপ কান্নাকাটি করছে, একে একবার দেখতে চায় সে। সে বড় দুঃখী মানুষ। এই মেয়ে ছাড়া তার কেউ নেই। অনেক করে বলতে তবে বোধহয় একটু মায়া হল বেটার। বললে–নিয়ে যা তার মেয়েকে, কিন্তু খবরদার বলছি, এর বাপ যদি এর মুখের দিকে একবার চেয়ে দেখে তো আবার এখেনে টেনে নিয়ে আসব
তা নিজের মেয়ের দিকে মুখ তুলে চাইতে পারব না?
না বাপু না, চাইতেও পারবে না, আর তোমার মেয়েকে যে ফিরে পেয়েছ তাও কাউকে বলতে পারবে না।
শোভারাম কেঁদে ফেললে ও দুগ্যা, তা হলে আমি বাঁচব কী নিয়ে?
দুর্গা বললে–তা হলে তুমি নিজেই বাঁচো, মেয়ের কথা আর মুখে এনো না। আমাকে বাপু দৈত্যরাজ পইপই করে ওই কথা বলে রেখেছে, আমি কী করব, আমি তবু অনেক কষ্ট করে তোমার মেয়েকে যে খুঁজে বার করতে পেরেছি এই-ই যথেষ্ট! আমি এখন চলি গো, আমার অনেক কাজ ওদিকে….
শোভারাম পেছন পেছন গেল। বললে–তা সে কোথায় আছে তা তো বললে–না গো!
কোথায় আবার, রাজবাড়িতে! রাজবাড়িতেই লুকিয়ে রেখেছি, নইলে তো তোমারই বিপদ, তুমি আবার কোনদিন মেয়েকে দেখে ফেলবে তখন তোমারও সব্বোনাশ, মরিরও সব্বোনাশ
তা তার সঙ্গে একবার কথাও বলতে পারব না আমি?
দুর্গা বললে–কথা আমি তার সঙ্গে বলিয়ে দেব, কিন্তু দেখা না করলেই হল!
কখন কথা বলব?
সে তোমায় আমি খবর দেবখন–বলে খরখর করে দুর্গা রাজবাড়ির দিকে চলে গেল। শোভারামও পেছন পেছন গেল, কিন্তু দুর্গার তখন আর সময় নেই। সেই রাজবাড়ির দেউড়ির সামনে দাঁড়িয়েই খানিকক্ষণ বোবার মতন চারদিকে চেয়ে রইল শোভারাম।
জগা খাজাঞ্চি হন্তদন্ত হয়ে আসছিল রাজবাড়ির দিকে। সে শোভারামের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে গেল। বললে–কী রে, এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী করছিস, একলা?
শোভারাম তবু উত্তর দেয় না। সে যেন জগা খাজাঞ্চিকে চিনতেই পারলে না। দেখা হলে জগা খাজাঞ্চিকে বরাবর প্রণাম করে এসেছে আগে। আজ যেন জগা খাজাঞ্চি কে-না-কে!
কী রে, কথা বলছিস না কেন? কী হল তোর? ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে দেখছিস কী?
তবু উত্তর দেয় না শোভারাম। সরকারমশাই আসছিল খাত্তাপত্তর নিয়ে। সে-ও দাঁড়িয়ে গেল।
শোভারামের কী হয়েছে বলে তো সরকারমশাই? পাগল হয়ে গেল নাকি?
সরকারমশাইও থমকে দাঁড়াল। ভাল করে চেয়ে দেখলে শোভারামের দিকে। জিজ্ঞেস করলে কী রে শোভারাম, কী হয়েছে তোর? অসুখ করেছে?
শোভারাম বিড়বিড় করে বললে–দৈত্যরাজ…
দৈত্যরাজ? সে আবার কে রে বাবা? কোথায় দৈত্যরাজ? দৈত্যরাজ কী করেছে তোর?
দেখতে দেখতে আরও কয়েকজন লোক জড়ো হয়ে গেল দেউড়ির সামনে। অতিথিশালায় যারা সেদিন এসে জুটেছিল তারাও বাইরে এসে মজা দেখতে লাগল। হরিপদ, গোকুল তারাও এসে দাঁড়াল।
শোভারাম তখন হঠাৎ বলে উঠল–অষ্টসিদ্ধি..
একজন বললে–পাগল বুঝি লোকটা?
আর একজন চিনতে পেরেছে। সে বললে–এ শোভারাম না? সেবার তো এমন ছিল না! এমন হল কী করে?
তা পাগলাকালীর বালা পরিয়ে দেয় না কেন? এর কে আছে গা?
কে আর থাকবে, কেউই নেই। এক মেয়ে ছিল, সে পালিয়ে যাবার পর থেকেই অমনি। এবার বেড়েছে দেখছি। আহা
জগা খাজাঞ্চিবাবু তখন শোভারামের সামনে গিয়ে হাত-মুখ নেড়ে বললে–তুমি বাড়ি যাও শোভারাম, বাড়িতে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকো গে, বুঝলে?
সরকারমশাই বললেইস, মাথাটা একদম খারাপ হয়ে গেল গো
গোকুলও দেখছিল সব। সামনে এগিয়ে এসে বললে–ও শোভারাম, শোভারাম–
অ্যাঁ?
শোভারাম চাইলে গোকুলের মুখের দিকে।
গোকুল জিজ্ঞেস করলে কী হয়েছে তোমার বলো তো? কী হয়েছে? আমাকে চিনতে পারছ? আমি কে বলো তো?
শোভারাম আবার বিড়বিড় করে বলে উঠল–অষ্টসিদ্ধি.
সরকারমশাই বলে উঠল–এই রে, মাথাটা খেয়েছে একেবারে, যা গোকুল, ওকে বাড়িতে পৌঁছে। দিয়ে আয়
ভিড়ের মধ্যে এতক্ষণ একজন চুপি চুপি সব শুনছিল। অতিথিশালার লোজন, গোকুল, হরিপদ, জগা খাজাঞ্চিবাবু, সরকারমশাই সবাই যখন একবার পর একটা প্রশ্ন করে চলেছে তখন সে লোকটা সকলের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে চেয়ে দেখছিল। তারপর যখন গোকুল শোভারামকে নিয়ে তার বাড়ির দিকে পৌঁছিয়ে দিতে গেল তখনও সে-লোকটা সঙ্গে সঙ্গে চলেছে।
গোকুল বলছিল–তুমি একটু মেয়ের কথা ভাবা ছেড়ে দাও দিকিনি ধরে নাও না মেয়ে তোমার মরে গেছে শোভারাম। চিরটা কাল কি আর সবাই বাঁচে। তোমার নিজের শরীরটার দিকেও তো দেখতে হবে। ধরে নাও না মেয়ে তোমার সুখে আছে, ধরে নাও না মেয়েকে তোমার নবাবের লোক চুরি করে নিয়ে গেছে। চুরি কি হয় না? তা হলে তাই নিয়ে ভেবে ভেবে তুমি নিজের মাথাটা খারাপ করবে?
শোভারাম বললে–দৈত্যরাজ…
কী ছাই বাজে কথা বলছ? দৈত্যরাজের মাথায় মারি ঝাটা! কোথায় দৈত্যরাজ? দৈত্যরাজ তোমার মেয়েকে চুরি করে নিয়ে গেছে, কে বললে? কে বলেছে শুনি? বিশু? হরিপদ? দুগ্যা?
শোভারাম হঠাৎ বলে উঠল–দুগ্যা…
গোকুল এক ধমকানি দিলে ধ্যেত, দুগ্যা আর বলবার লোক পেলে না, তোমাকে বলতে গেছে। দুগ্যা কি নবাবকে দেখেছে? দুগ্যার চোদ্দোপুরুষ নবাবকে দেখেছে? আর নবাবের কি মেয়েছেলের অভাব যে তোমার একফেঁটা মেয়েকে চুরি করে নিয়ে যাবে?
শোভারাম আবার দুম করে বলে উঠল–অষ্টসিদ্ধি…
গোকুল সেকথায় কান না দিয়ে বাইরে থেকে ডাকলে ও নয়ানপিসি, পিসি–
ডাকতে ডাকতে দু’জনেই বাড়ির ভেতরে চলে গেল। সঙ্গে অন্য যারা ছিল তারাও সদর পেরিয়ে বাড়ির উঠোনে ঢুকল।
লোকটা এতক্ষণ সব দেখছিল, শুনছিল, তারপর সবাই যখন ভেতরে গেল, তখন সোজা উলটোদিকে চলতে লাগল। তারপর যখন খানিকটা এসে মুসলমান পাড়ায় পা দিয়েছে, তখন আরও জোরে পা চালিয়ে দিয়েছে। তারপর এক দৌড়ে সোজা একেবারে ডিহিদারের দফতরে গিয়ে হাজির। বাইরে ফিরিঙ্গি’কে দেখেই বোঝা গিয়েছিল, রেজা আলি ভেতরে আছে। লোকটা ভেতরে যেতেই রেজা আলি তাকিয়ে দেখলে।
কী রে জনার্দন, হাঁপাচ্ছিস কেন? কেউ তাড়া করেছে?
জনার্দন বললে–হুজুর, খবর আছে
কী খবর? নেসার সাহেবের সঙ্গে মোলাকাত হল?
হয়েছে হুজুর, কিন্তু মুর্শিদাবাদে বড় গোলমাল চলছে। গুজব রটেছে যে ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে লড়াই বাধবে।
রেজা আলি জিজ্ঞেস করল–নবাবের এখন মেজাজ কেমন?
হুজুর, নবাব তো সকলকে তলব দিয়েছিল মতিঝিলে। মেহেদি নেসার সাহেব, মোহনলালজি, মিরমদনজি, মিরজাফর সাহেব, সবাইকে ডেকে একটা ফয়সালা করবার চেষ্টা করেছে। মিরজাফর সাহেবকে খুব বুঝিয়ে বলেছে নবাব যে, তুমি হচ্ছ আমার পুরনো আত্মীয়, আমার ঘরের লোক, তুমি যদি আমার এই বিপদের দিনে না দেখো তো কে দেখবে? তোমার ওপর ভরসা করেই তো আমি মসনদে বসেছি।
মিরজাফর সাহেবের সঙ্গে তা হলে নবাবের দোস্তি হয়ে গেছে আবার?
জনার্দন বললে–হুজুর, আমি তো শুনলুম সকলের সামনে নবাব মিরজাফর সাহেবের হাত ধরে নাকি কেঁদেছে নাকি কাঁদতে কাঁদতে মিরজাফর সাহেবকে দুই হাত দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেছে–
এত দূর গড়িয়েছে তা হলে?
হুজুর, নেয়ামত তো তাই আমাকে বললে।
নেয়ামত কে?
আজ্ঞে, মতিঝিলের খিদমদগার। তাকে খুব পান জরদা কাশীর খুশবু কিমাম খাইয়ে তো হাত করেছিলাম। খুব তোয়াজ করে তাকে জিজ্ঞেস করলুম-ইয়ার, সেদিন মতিঝিলের জমায়েতে কী সব সল্লা হল বলল আমাকেও তো সব আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে শোনে, মেহেদি নেসার সাহেবকে তো ও-ই চেহেল্-সুতুন থেকে ডেকে এনেছিল। ও বলছিল–মালুম হচ্ছে শায়েদ লড়াই হবে। নবাবের কথায় মিরজাফরের মন টলেছে, নবাবের কান্না দেখে মিরজাফর সাহেব আর চুপ করে থাকতে পারেনি, মিরজাফর সাহেবের চোখ দিয়েও নাকি পানি পড়ছিল–
রেজা আলি কথাটা শুনে নিজের মনেই কী যেন মতলব আঁটতে লাগল।
জনার্দন হঠাৎ আবার বললে–হুজুর, আর একটা কথা
বলে আরও কাছে সরে এল–
আর একটা কথা। কথাটা কারও সামনে বলতে চাই না হুজুর। হুজুরের নিমক খাই, তাই হুজুরকেই। বলছি। হাতিয়াগড়ে এসে দেখি রাজবাড়ির সামনে খুব ভিড়।
কেন? জানাজানি হয়ে গেছে নাকি?
সেই কথাই তো বলছি। সেই যে মেয়েটা পালিয়ে গিয়েছিল বিয়ের রাত্তিরে, শুনেছেন তো? সেই যে সেই মরালী? তার বাপ শোভারাম, সেই শোভারামটা হঠাৎ দেখি পাগল হয়ে গেছে, একেবারে বদ্ধ। পাগল। এতদিন মেয়েটা পালিয়ে গিয়েছে, তাতে কিছু হয়নি, হঠাৎ এখন অ্যাদ্দিন পরে পাগল হল কেন? আমার তো হুজুর একটা সন্দেহ হচ্ছে।
কী?
হুজুর, আমরা সেদিন রানিবিবিকে বজরা করে কাটোয়া পাঠিয়ে দিয়েছি, কিন্তু কাকে পাঠাচ্ছি তা তো পরখ করে দেখিনি হুজুর! অন্ধকারে ঘোমটা দিয়ে তাঞ্জামে তোলবার পর দরওয়াজা বন্ধ করে দিলুম। কিন্তু মুখ তো দেখিনি, যদি ভেজাল মাল পাঠিয়ে থাকে দুশমনি করে?
কে দুশমনি করবে? হাতিয়াগড়ের রাজা? ওটা তো একটা আসলি উজবুক রে। আর ও তো তখন কোঠিতে ছিল না কেষ্টনগরে মহারাজার সঙ্গে সল্লা করতে গিয়েছিল
কিন্তু বড় রানিবিবি তো ছিল হুজুর। সে তো দুশমনি করতে পারে? আর ওই ঝি-টা! দুগ্যা! ওই দুগ্যামাগিটি হুজুর কুটনি! ও সব পারে। ভেজাল মালকে আসল মাল বলে অনায়াসে চালিয়ে দিতে পারে! নইলে শোভারাম হঠাৎ পাগল হয়ে যাবে কেন, হুজুর, তাই বলুন!
রেজা আলি ডিহিদার মানুষ। হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় কাজ করে না কখনও। অনেক দিন থেকে ডিহিদারি করে আসছে। আরও প্রথম জীবনে মুর্শিদাবাদের নিজামতে আমিন কাছারি ছিল। তারপর নিজের বুদ্ধির কেরামতিতে একদিন দারোগা-কাছারি হয়েছিল। তারপর ধাপে ধাপে হুজুর-নবিস, খাসনবিস, মসরেফ, মুস্তোফি হয়ে শেষ পর্যন্ত ডিহিদার। এর পরে যদি ফৌজদার হতে পারে তবেই জিন্দগি খুশ হয়ে যাবে রেজা আলির। সেই পথটাই এতদিন খুঁজে পাচ্ছিল না। জনার্দনের কথায় যেন আবার বিদ্যুৎ চমকে উঠল মগজের মধ্যে! তোবা! তোবা! এই তো সুযোগ!
আর হুজুর, এত বড় কাণ্ড ঘটে গেল, জগা খাজাঞ্চি কি কানুনগো কাছারির সরকার কিছুই জানতে পারলে না, এতেও আমার বড় সন্দেহ হচ্ছে হুজুর!
তা হলে এক কাজ কর তুই জনার্দন!
কী কাজ, বলুন হুজুর!
রেজা আলি নিজের ডান হাতের একটা আঙুল দিয়ে নিজের কপালে টোকা মারলে। অর্থাৎ মতলবটা মগজে এবার পাকা হয়ে বসে গেছে। বললে–তুই এক কাজ কর,–ওই শোভারাম বেটা তো মস্তানা হয়ে গেছে, ঠিক তো?
আজ্ঞে হ্যাঁ হুজুর! আমি নিজের চোখেই তো সেটা দেখে এলুম–
তা হলে ছোটমশাইয়ের নোকোরের কাম করবে কে? ওকে দিয়ে তো আর কাম চলবে না। অন্য নোকর তো দরকার। তুই গিয়ে ওর নোকরিটা নে। আমিও তোর তলব দেব, রাজবাড়ি থেকেও তলব পাবি। দুনো আয় করবি–আর ভেতরের খবর জেনে নিবি–যা–
জনার্দন ভক্তিতে গদগদ হয়ে বারবার মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করতে লাগল রেজা আলিকে হুজুর, দেখবেন হুজুর গরিবকে, এ-গরিব কাফের বটে, কিন্তু হুজুরের নিমক খায়, নিজামতের একটা পাকা নোকরি আমাকে করে দিতে হবে হুজুর, বড় গরিব আমি হুজুর, হুজুর মেহেরবান…।
আচ্ছা তুই এখন যা, দেখি তুই কেমন কাম হাসিল করিস বলে রেজা আলি আবার মৌচে তা’ দিতে লাগল। মনে মনে আবার বলতে লাগল তোবা! তোবা! এই তো সুযোগ! মেহেদি নেসার সাহেবকে কেরামতি দেখাবার এই-ই তো সুযোগ!
*
বাংলার অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধের ইতিহাস বড় বেদনার ইতিহাস। মুর্শিদকুলি খাঁ থেকে শুরু করে, সুজাউদ্দিন, রায়-রায়ান আলমচাঁদ, সরফরাজ খাঁ, আলিবর্দি, হাজি মহম্মদের পর যে-ইতিহাস সে-ইতিহাস নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌল্লা, রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের ইতিহাস। মিরজাফর, মোহনলাল, ক্লাইভ, ড্রেক, উমিচাঁদ, ম্যানিংহাম, কিলপ্যাট্রিক, ওয়াটস্-এর ইতিহাস। ফরাসি ডাচ পর্তুগিজদেরও ইতিহাস। বাংলার ইতিহাসই ভারতবর্ষের ইতিহাস। এই শোভারাম জনার্দন, ষষ্ঠীপদ, সচ্চরিত্র, কান্ত, উদ্ধব দাস, মেহেদি নেসার, দুর্গা, নয়ানপিসি, নন্দরানিরাই সে-ইতিহাস সেদিন কালের খাতায় পাতার পর পাতা লিখেছিল। আর উদ্ধব দাস শুধু লিখেছিল বেগম মেরী বিশ্বাস।
আজ থেকে প্রায় দু’শো বছর আগের মানুষ আজকের মতোই ভালবেসেছিল, ষড়যন্ত্র করেছিল, খুন করেছিল আর স্বার্থসিদ্ধি করেছিল। সেদিনও দেশের মানুষ এমনি করেই অসহায়ের মতো ভাগ্যের হাতে নিজেদের ছেড়ে দিয়ে নিরাপদ মনে করেছিল। যেনবাব সে-দেশের কথা ভাবুক, যে-মন্ত্রী সে-মন্ত্রণা দিক, তোমার আমার কিছু করবার নেই। এসো আমরা সবাই মিলে দুটো পয়সা উপায়ের চেষ্টা দেখি। তুমি রাজা, তুমি আমাকে জায়গির দাও, আমাকে খেতে পরতে দাও, আমি তোমাকে নিয়ে অন্নদামঙ্গল’ মহাকাব্য লিখব। আমি লিখে দেব–ভবানন্দ মজুমদার দেবীর বরপুত্র। তুমি অন্যায় করো, অত্যাচার করো, উৎপীড়ন করো, তাতে কিছু ক্ষতি নেই। আমি আমার মহাকাব্যে তোমাকে। দেবতা করে তুলব।
তাই উদ্ধব দাস বলত–আমিও এক কাব্য লিখব গো, আমিও লিখব—
মোল্লাহাটের মধুসূদন কর্মকার জিজ্ঞেস করত তা তুমিও কি রায়গুণাকর ভারতচন্দোরের মতো অন্নদামঙ্গল লিখবে নাকি?
আজ্ঞে না প্রভু, রায়গুণাকর তো ঘুষ খেয়ে মিথ্যে কথা লিখেছে-
-ঘুষ খেয়ে? তুমি বলছ কী দাসমশাই?
হ্যাঁ গো, আমি ঠিক বলছি। রায়গুণাকর তো ঘরের ভেঁকি কুমির। নইলে প্রতাপাদিত্য গেল, কেদার। রায় গেল, চাঁদ রায় গেল, ভবানন্দ মজুমদারকেই বীরস্য বীর তৈরি করলে রায়গুণাকর।
তা তুমি কাকে নিয়ে লিখবে?
উদ্ধব দাস বলত–তাকে তোমরা জানো না, তার নাম বেগম মেরী বিশ্বাস!
ওমা, সে আবার কে গা?
সে যখন লিখব তখন তোমরা দেখতে পাবে।
উদ্ধব দাস হাসত আর বলত–সেসব কী দিন গেছে, তোমরা তো জানো না, এখন তো ফিরিঙ্গি রাজত্ব, এখন তো তোমরা সে-সব কথা ভুলে গেছ। কিন্তু আমি ভুলিনি গো! সে ভোলবার নয়–
সত্যিই উদ্ধব দাস কিছুই লিখতে ভোলেনি। যা দেখেছে, যা শুনেছে, সব লিখেছে। কাটোয়ার গঙ্গার ঘাট থেকে অনেক দূর যেতে যেতে হঠাৎ মনে হল এদিকে গিয়ে আর লাভ কী! ডিহিদারের লোক পালকি নিয়ে আসতেই উদ্ধব দাসকে তাড়িয়ে দিয়েছিল।
আরে এখানে লোকটা কেন? ভাগো, ভাগো হিয়াসে—
ঠিক আছে! উদ্ধব দাসকে খাতির করলেও যা, তাড়িয়ে দিলেও তাই। নির্বিকার। একদিন আমাকে তাড়িয়ে দিয়ে তোমরা রাজত্ব করছ, আবার একদিন তোমাদের তাড়িয়ে দিয়ে আর-একজনরা রাজত্ব করবে! কেউ এখানে চিরটা কাল রাজত্ব করতে আসেনি। এইটেই যে নিয়ম গো। চিরটা কাল রাজত্ব করবে শুধু সেই একজন। সে-ই মালিক। তা তুই এত বড় ঘুষখোর, সেই আসল মালিককে ছেড়ে দিয়ে ভবানন্দ মজুমদারের গুণ গাইলি?
যশোর নগর ধাম
প্রতাপ আদিত্য নাম
মহারাজ বঙ্গজ কায়স্থ।
নাহি মানে পাতশায়।
কেহ নাহি আঁটে তায়
ভয়ে যত ভূপতি দ্বারস্থ।
তার খুড়া মহাশয়।
আছিল বসন্ত রায়,
রাজা তারে সবংশে কাটিল।
তার বেটা কচু রায়,
রানি বাঁচাইল তায়,
জাহাঙ্গিরে সে-ই জাঁনাইল।
ক্রোধ হইল পাতশায়
বান্ধিয়া আনিতে তায়
রাজা মানসিংহে পাঠাইলা।
বাইশি লস্কর সঙ্গে
কচু রায় লয়ে বঙ্গে
মানসিংহ বাঙ্গালা আইলা।
কচু লেখা। নিমকহারাম মানসিংহের দাস ভবানন্দকে দেবতা বানিয়ে কী লাভ হল শুনি তোর? সত্যি। কথা লিখলে তোকে উপাধি দেবে না বলে? ছাই, ছাই, উপাধির মুখে ঝাটা মারি! আমি কাকে ভয় করি গো? আমার কাউকে ভয় করতে বয়ে গেছে। আমি লিখব সত্যি কথা। আমি লিখব আর একখানা অন্নদামঙ্গল।
এমনি করেই পাটুলির রাস্তা দিয়ে চলছিল উদ্ধব দাস। হঠাৎ সামনে কাকে দেখে থমকে গেল। কে গো তুমি মশাই। তোমাকে চেনা চেনা ঠেকছে যেন?
উলটো দিক দিয়ে আর একটা নোকও আসছিল। হাতে কতকগুলি পুঁথিপত্র। উদ্ধব দাসকে দেখে মুখটা আড়াল করে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। কী গো? অমন করে আমাকে দেখে পালিয়ে যাচ্ছ কেন?
লোকটা এবার দৌড়োত লাগল। উদ্ধব দাসও দৌড়োতে লাগল। ধরো ধরো ওকে। ধরো!
চিৎকার শুনে খেতের কিছু লোক দৌড়ে এসেছে। তারাই ধরে ফেললে লোকটাকে! লোকটা বুড়ো মতন। ধরতেই কেঁদে ফেলেছে একেবারে হাউহাউ করে। একেবারে অঝোর ধারায় কান্না।
আরে, সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ না?
চিনতে পেরেছে উদ্ধব দাস। এই সচ্চরিত্রই ঘটকালি করেছিল বিয়েটার।
আজ্ঞে আমাকে ছুঁয়ে দিলেন? আমার যে জাত গেছে! আমার জাত কুল-পেশা সব যে গেছে, আমার বউ-ছেলে-মেয়ে সব গেছে–
বলে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল সচ্চরিত্র।
উদ্ধব দাস হেসে উঠল হো হো করে। বললে–কেন গো? কীসে গেল তোমার জাত, শুনি?
সচ্চরিত্র বললে–আমাকে ম্লেচ্ছ-মাংস খাইয়ে দিয়েছে গো ধরে-বেঁধে; আমি খেতে চাইনি গো, জোর করে আমার মুখে পুরে দিয়েছে…
পাটুলির যে-লোকগুলো এতক্ষণ শুনছিল তারা কানে আঙুল দিলে। আস্তে আস্তে সরে পড়বার চেষ্টা করতে লাগল।
আমাকে ছেড়ে দাও গো বাবাজি, আমাকে ছেড়ে দাও
উদ্ধব দাস বললে–তোমার জাত তো বড় ঠুনকো পুরকায়স্থ মশাই, আমি তো যেখানে-সেখানে যা-তা খাই, আমার তো জাত যায়নি। এই তো তোমাকে আবার ঘূচ্ছি, আমার তো জাত যাচ্ছে না, কই
তা হলে আমার কী হবে বাবাজি! আমাকে যে মুর্শিদাবাদের মসজিদের ইমামসাহেব নিজের বাড়িতে রেখে সারিয়ে তুলেছে, আমি যে সেখানে তিন রাত্তির কাটিয়েছি সবাই যে সেকথা জানে। আমার কী হবে?
উদ্ধব দাস বললে–কলা হবে, কচু হবে–
তুমি তো বললে–কলা হবে, কিন্তু আমাকে দিয়ে যে কেউ আর ঘটকালি করাবে না, আমি কী খাব? আমি যে ঈশ্বর কালীবর ঘটকের পৌত্র, ইন্দীবর ঘটকের পুত্র…
উদ্ধব দাস বললে–আমাকে কে খাওয়ায়? আমি কার পুত্র? আমি কার পৌত্র?
সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ খানিকক্ষণ হাঁ করে চেয়ে রইল উদ্ধব দাসের দিকে। তারপর জিজ্ঞেস করলে তা হলে গাঁয়ের লোক আমাকে তাড়িয়ে দিলে কেন? সিদ্ধান্তবারিধি মশাই আমাকে একঘরে করলেন কেন? আমার বউ-ছেলে-মেয়ে আমাকে বাড়িতে ঢুকতে দিলে না কেন? আমি অপরাধ না করলে কি শুধু শুধু তারা আমাকে নাকাল করলে?
উদ্ধব দাস হঠাৎ গান গেয়ে উঠল
তারা, আর কী ক্ষতি হবে।
তুমি নেবে যবে, সবই নেবে, প্রাণকে আমার নেবে।
থাকে থাকবে, যায় যাবে, এ-প্রাণ গেলে যাবে।
যদি অভয় পদে মন থাকে তো কাজ কী আমার ভাবে ।
তুমি নিজেই যদি আপন তরি ডুবাও ভবার্ণবে।
আমি ডুব দিয়ে জল খাব তবু, অভয় পদে ডুবে
সচ্চরিত্র পুরকায়স্থর হাতটা তখনও ধরে আছে উদ্ধব দাস। হঠাৎ একটা ঝটকা মেরে সচ্চরিত্র নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলে। তারপর এক দৌড়ে দূরে পালিয়ে গেল। চেঁচিয়ে বলতে লাগল–আমাকে পাগল পেয়েছ বাবাজি, আমি কি পাগল? আমার সংসারধর্ম নেই? আমাকে পাগল করতে
উদ্ধব দাস হেসে উঠল। চেঁচিয়ে উঠল। বললে–সবাই পাগল গো, সবাই পাগল, এ সংসারে সবাই পাগল, কেউ বিষয়-পাগল, কেউ মেয়েমানুষ-পাগল, কেউ নাম-পাগল। পাগলা বদনাম শুধু এই পাগল উদ্ধব দাসের
কিন্তু যার উদ্দেশে বলা সে তখন পাঁইপাঁই করে দৌড়োচ্ছে। উদ্ধব দাস হেসে উঠল খানিকটা সেই দিকে চেয়ে চেয়ে! গান গাইলেই পাগলামি বলে। আসলে সবাই পাগল হয়ে গেল। দেশটা পাগলে ভরে গেল, তবু উদ্ধব দাসকেই সবাই পাগল ভাবে। তাজ্জব দেশ প্রভু, তাজ্জব দেশ।
সারাদিন খাওয়া হয়নি উদ্ধব দাসের। মাথার ওপর রোদ উঠছে। বড় চড়া রোদ। কাঁধের চাদরটা মাথায় বেঁধে নিয়ে আবার পায়ে হাঁটা দিলে। কিন্তু কিছু দূর যেতেই হঠাৎ আবার কার দপদপ পায়ের শব্দ হল। পেছন ফিরেই দেখে সচ্চরিত্র আবার সেই দিকেই দেীড়োতে দৌড়োতে আসছে। একেবারে ঊর্ধ্বশ্বাসে উদ্ধব দাসের দিকেই দৌড়ে আসছে
উদ্ধব দাস একটু থমকে দাঁড়াল। সচ্চরিত্র কাছাকাছি আসতেই বললে–কী গো, আবার কী হল?
সচ্চরিত্র সে-কথার উত্তর না দিয়ে পাইপাই করে তখনও সামনের দিকেই দৌড়ে আসছে—
কী হল গো? আবার ফিরলে কেন?
এবার সচ্চরিত্র উদ্ধব দাসকে পাশে রেখে সোজা দৌড়োচ্ছ। কথার উত্তর দিলে না। অবাক কাণ্ড! এমন কাণ্ড তো করে না লোকটা! সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে গেল নাকি নোকটা! দেখতে দেখতে দূরে গাছপালা মাঠের ধুলোর মধ্যে সচ্চরিত্র অদৃশ্য হয়ে গেল। সত্যিই অবাক হবার মতো ঘটনা। পেছনে তো কেউ তাড়া করছে না। তবে?
হঠাৎ অনেক দূরে মনে হল যেন আকাশের গায়ে খুব মেঘ করেছে। কেমন হল? এই দুপুরবেলা কি ঝড় উঠবে নাকি? তাই সচ্চরিত্র পালাচ্ছিল? অনেকক্ষণ দেখতে দেখতে হবে যেন খানিকটা স্পষ্ট হল। প্রথমে মনে হয়েছিল মেঘ। তা নয়। আসলে হাতির পাল। হাতিগুলো সার সার এগিয়ে আসছে। তারপর ঘোড়ার সার। তারপর হাজার হাজার সেপাই। পাটুলির জনকয়েক লোক রাস্তায় নেমে দেখতে এসেছিল। তারাও অবাক।
ও দাসমশাই, দাঁড়িয়ে দেখছ কী? নবাব আসছে, পালিয়ে যাও গো
উদ্ধব দাস জিজ্ঞেস করলে–কেন? পালাব কেন? কী করেছি আমি?
ঠিক আছে, বুঝবে মজাটা। নবাব লড়াই করতে যাচ্ছে কলকাতায় গাঁয়ে যা পাবে সব নেবে, আর কিছু আস্ত রাখবে না–
সত্যিই তাই। পাটুলির লোকরা সব গ্রাম ছেড়ে নবাবের রাস্তার উলটোদিকে একেবারে গঙ্গার ওপারে গিয়ে হাজির। উদ্ধব দাস ঠায় সেখানে পঁড়িয়ে রইল। নির্জন জনহীন রাস্তা দিয়ে নবাবের সৈন্যরা এগিয়ে চলেছে। হাতি, ঘোড়া, কামান, বন্দুক, সেপাই সার সার চলেছে। মুর্শিদাবাদ থেকে সেই কোন রাত থাকতে বেরিয়েছে। গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে চলেছে বাংলাদেশের নবাব। এবার সবাই দেখুক নবাবেরও ক্ষমতা আছে, নবাবেরও সৈন্যসামন্ত আছে। ডাচ, পর্তুগিজ, ফরাসিরাও একটু শিক্ষা পাক। এ-দেশটা যে নবাবের তার প্রমাণ না দিলে সবাই বড় বেড়ে উঠবে। এই সময়েই সকলকে শিক্ষা। দিয়ে দেওয়া ভাল। বুড়ো নবাব আলিবর্দি খাঁ সাহেব যা পারেনি, নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা তাই পেরে দেখিয়ে দেবে।
আর শুধু পাটুলিই নয়। কলকাতাতেও হুলস্থুল কাণ্ড বেধে গেছে। কেল্লার ভেতরে হলওয়েল সাহেব তখন হোমে আর্জেন্ট ডেসপ্যাঁচ লিখছে–এই-ই হয়তো আমাদের শেষ ডেসপ্যাঁচ। আমরা অনেক রকম করে লড়াই ঠেকিয়ে রাখবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হল না। শুনছি নবাব আর্মি নিয়ে কলকাতার দিকে আসছে। এদিকে চিফ স্পাই রাজারাম সিং একটা চিঠি পাঠিয়েছিল উমিচাঁদের কাছে। সে-চিঠি আমরা ধরেছি। সে-চিঠিতে উমিচাঁদকে কলকাতা ত্যাগ করে পালিয়ে যাবার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছিল। উমিচাঁদ লোকটা একটা আস্ত স্কাউড্রেল। তাকে আমরা অ্যারেস্ট করে ফোর্টে রেখে দিয়েছি। তার প্রপার্টি যাতে কলকাতা থেকে সরিয়ে ফেলতে না পারে সেজন্যেও আমরা কুড়ি জন গার্ড বসিয়েছি তার বাড়িতে। উমিচাঁদের চিফ বরকন্দাজ-জমাদার জগমন্ত সিং সে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল, পাছে আমাদের হাতে পড়ে। বাড়ির জেনানার ভেতরে তেরোজন লেডিকে খুন করে। ফেলেছিল নিজের হাতে, পাছে আমরা তাদের মলেস্ট করি। শেষকালে নিজেও সে সুইসাইড করতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আমরা তা করতে দিইনি। তাকে ধরে ফেলেছি। ওদিকে রাজা রাজবল্লভের ছেলে কৃষ্ণবল্লভকেও অ্যারেস্ট করে রেখে দিয়েছি। কারণ ইন্ডিয়ানদের বিশ্বাস নেই। এরা ভয়ানক বিশ্বাসঘাতক লোক। আর বাগবাজারের খালের উলটোদিকে হুগলি-রিভারের ওপর একটা জাহাজে আঠারোটা কামান সাজিয়ে রেখেছি। দেখি কী হয়। আমরা যুদ্ধ করবই। এত কষ্ট করে এসে এখান থেকে আমরা সহজে এখন হটব না। কেবল মুশকিল হয়েছে একটা। আমাদের সবই দেশি সোলজার। তাদের ওপর ভরসা, আর ম্যাড্রাস থেকে কিছু ইউরোপীয় সোলজার চেয়ে পাঠিয়েছি। আমাদের আর্মিতে বারোজন সোলজার শুধু ইউরোপীয়ান। তাদের সবাইকে পেরিং-পয়েন্টের পাঁচিল আর ব্রিজ গার্ড দেবার জন্য রাখা হয়েছে। দেখা যাক কী হয়। সবই অনিশ্চিত। যদি আমরা টিকে থাকি তো আবার ডেসপ্যাঁচ পাঠাব। গড সেভ দি কিং।
*
মুর্শিদাবাদের চকবাজারেও তখন সব গোলমেলে অবস্থা। সকালবেলাও কেউ কিছু জানত না। ভোররাত্রে কখন কী ঘটছে, কেউ কিছু জানে না। বেলা হলে তখন জানা গেল। সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকানে মৌতাত তখন বেশ জমে উঠেছে। তামাকের সঙ্গে আফিম মেশালে আর তার সঙ্গে আগরবাতি জ্বালিয়ে দিলে যা মৌতাত হয় তার মজা সারাফত আলিই জানে!
সন্ধেটা কেটে রাত বাড়ল। তখন সারাফত আলির বেশ ঘোর লেগেছে।
হঠাৎ ডাকলে–বাদশা
কান্তও এতদিন ধরে কত রাস্তা হেঁটে সবে একটু বিশ্রাম করবে বলে নিজের আস্তানায় এসে ঢুকেছিল। অন্ধকার ঝুপড়ি ঘর। ঘরের না আছে শ্রী না আছে ছাদ। তা হোক, তবু তো একটা আশয়। আজ হয়তো এখানে আসতেই হত না শেষপর্যন্ত। কায়োয়ায় রানিবিবির সঙ্গে পালিয়ে গেলেই হয়তো ভাল হত। অন্তত রানিবিবিকে এই অপমানের হাত থেকে তো বাঁচানো যেত। উদ্ধব দাসের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবার পর থেকেই মনটা কেমন বিকল হয়ে গিয়েছিল। শেষপর্যন্ত কাটোয়ার ডিহিদার সাহেব এসে যাওয়াতে আর পালিয়ে যাওয়া হয়নি। তারপর থেকে রানিবিবির সঙ্গে কথাও হয়নি। দেখাই হয়নি তো কথা হবে কী করে। ডিহিদার সাহেব নিজে তাগাদা দিয়ে সেপাই দিয়ে কড়া পাহারা দিতে বলে মুর্শিদাবাদে পাঠিয়ে দিলে।
নিজের ময়লা বিছানার ওপর শুয়েও ভাল করে ঘুম এল না। চকবাজারে ঢুকেই লড়াইয়ের খবরটা শুনেও বেশ খারাপ লেগেছে। বেভাজির সাহেবের সেই সোরার গদিটার কথাও মনে পড়ল। যদি সে-গদি নবাবের কামানের গোলা লেগে পুড়ে যায়! ক’টাই বা সৈন্য আছে ফিরিঙ্গিদের। নবাবের সঙ্গে কেন ঝগড়া করতে গেল। আহা, ষষ্ঠীপদর চাকরিটাও চলে যাবে। কান্ত এখন মুনশি থাকলে কান্তর চাকরিটাও চলে যেত। শুধু চাকরি নয়, প্রাণটাও হয়তো যেতে সেই সঙ্গে সঙ্গে।
বাবুজি।
বাদশার গলা।
কী রে বাদশা?
হুজুর, মালিক আপনাকে একদফে এত্তেলা ভেজিয়েছে।
ধড়মড় করে তাড়াতাড়ি উঠে সারাফত আলির কাছে যেতেই খুশবুর গন্ধতে কান্তর সমস্ত শরীর অসাড় হয়ে এল।
সড়ক দিয়ে কোথায় যাচ্ছিলি রে? তাঞ্জামে কোন বিবি ছিল? নবাব হারেমের মাল?
সে কথার উত্তর দিতেও যেন ঘেন্না হতে লাগল। চরের চাকরি করে বলে সারাফত আলি সাহেবও তাকে যেন তাচ্ছিল্য করতে শুরু করেছে। শুধু বললে–জি, মিঞাসাহেব!
সারাফত আলি বললে–জাহান্নমে যাবি, তা বলে রাখছি, কান্তবাবু। বেশক জাহান্নমে যাবি, দুশমনের লড়াই ফতে হলে ভাবিসনি জিন্দগি খুশ হয়ে যাবে, জিন্দগির লড়াই ফতে করতে পারিস তো তখন বুঝব তুই বাহাদুরের বেটা
আরও কিছু কথা হয়তো বলত সারাফত আলি সাহেব। কিন্তু নেশার ঝেকে তখন চোখ দুটো বুড়োর লাল জবাফুল হয়ে উঠেছে। বেশি কথা বলার হয়তো ক্ষমতাই নেই মিঞা-সাহেবের।
হঠাৎ ওপাশ থেকে বশির মিঞার গলা শুনে একটু অবাক হয়ে উঠল। বশির মিঞা আবার এত রাত্রে কী জিজ্ঞেস করতে এসেছে। রানিবিবিকে তো চেহেল্-সুতুনের হারেমে পৌঁছিয়েই দিয়েছে। আবার কাউকে আনতে হবে নাকি? একটা কাজ হাসিল হতে-না-হতে আবার একটা কাজ?
কী রে? কী করছিলি? আমি ভাবছিলুম ঘুমিয়ে গেছিস
তুই হঠাৎ? আবার কোনও কাজ আছে নাকি?
বশির মিঞা বলল–না রে, না।–তোর সঙ্গে একটা বাত আছে, এখানে কেউ নেই তো?
বলে ঘরটার চারদিকে দেখে নিলে। তারপর গলাটা নিচু করে বললে–একটা বাত বলি তোকে, আজকে যে রানিবিবিকে এনেছিস, ও আসলি রানিবিবি তো? নাকি দুসরা কাউকে পাঠিয়ে দিয়েছে?
কান্ত অবাক হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলে–কেন?
তাই তো জিজ্ঞেস করছি তোকে।
কান্ত বললে–কেন? অন্য কোনও রানিবিবি এসেছে নাকি তার বদলে? অন্য কোনও মেয়ে?
আরে না, হাতিয়াগড়ের ডিহিদার রেজা আলি শালা বুড়বাক আছে। আমার ফুপাকে খপর পাঠিয়েছে। নাকি রানিবিবির বদলে হাতিয়াগড়ের রাজবাড়ির একটা নফরের ডপকা মেয়েকে পাঠিয়েছে। শোভারাম নাকী তার নাম, তারই নাকি মেয়ে। তুই কিছু জানিস? ফুপা আমাকে গালাগাল করছে। মেহেদি নেসার
সাহেব জানলে তো বেত্তমিজি করবে! জানিস কিছু তুই?
*
মনে আছে কান্ত সে-রাত্রে ঘুমোতে পারেনি। সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকানের পেছন দিকে একটা ছোট ঘরে আস্তানা নিয়েছিল কান্ত। আস্তানাটা নামেই আস্তানা। ওর ভেতরে মানুষ কোনওরকমে থাকতেই শুধু পারে, বেঁচে থাকতে পারে না। কিন্তু সারাফত লোকটা ভাল। একজন গরিব মানুষকে দেখে দয়া করে থাকতে দিয়েছিল শুধু, কিরায়া নিত না। কতকগুলো কড়ির জার আর মাটির হাঁড়ি-কলসির গুদাম ছিল সেটা। সেটাই মালপত্র সরিয়ে কান্তকে থাকবার জন্য খালি করে দিয়েছিল। সেই অন্ধকার ঘুপসি ঘরের বিছানার ওপর চিতপাত হয়ে গা এলিয়ে দিয়ে আকাশ-পাতাল শুধু চষে বেড়িয়েছিল। যাকে সে রানিবিবি ভেবেছিল সেই-ই তা হলে শোভারামের মেয়ে! আশ্চর্য না আশ্চর্য! একবারও যদি জানতে পারত সে আগে। একবারও যদি কেউ কথাটা বলত তাকে।
ভোরবেলা বড় মসজিদের আজানের শব্দ শুনেই উঠে পড়ল কান্ত। সময় যেন আর কাটতে চায় না। যেন সূর্য আর উঠবে না চকবাজারে।
বশির মিঞা বলেছিল–রেজা আলি শালা ফৌজদার হতে চাইছে, বুঝলি! তাই মেহেদি নেসার সাহেবকে খুশামুদ করতে চাইছে এই করে
কান্ত বলেছিল–তা হলে কি আসল রানিবিবিই এসেছে?
আলবত! হাতিয়াগড়ের জমিনদারের এত বুকের পাটা হবে না যে ঝুটা মাল চালিয়ে দেবে, জমিনদারবেটা জানে যে নবাবের গোঁসা হলে তার জমিনদারিই লোপাট হয়ে যাবে।
কান্ত হঠাৎ বললে–কিন্তু ভাই, আমার মনে হচ্ছে হয়তো ডিহিদারের কথাই ঠিক, ওরা বোধহয় শোভারামের মেয়েকেই পাঠিয়ে দিয়েছে ষড়যন্ত্র করে
দুর, দুর–ওসব রেজা আলির শয়তানি রে! রেজা আলিকে তুই তো চিনিস না। শালা খুব জাঁহাবাজ লোক, কেবল ফৌজদার হতে চাইছে কেরামতি দেখিয়ে
বশির মিঞা চলে যাবার পর সমস্ত রাত ধরে কান্ত কেবল ভেবেছিল। ও রানিবিবি না মরালী! কে? কাকে সঙ্গে করে এনেছে সে? দু’জনের কাউকেই দেখেনি আগে। শোভারামের মেয়ের সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধই হয়েছিল শুধু। সেই পর্যন্ত। ঘটক সচ্চরিত্র পুরকায়স্থর মুখের কথা শুনেই বিয়েটায় রাজি হয়েছিল। শুধু শুনেছিল খুব শৌখিন মেয়ে, ঠোঁটে আলতা লাগায়, দিনরাত তাম্বুল-বিহার দিয়ে পান খায়, পাশা খেলতে ভালবাসে। তার বেশি আর কিছু শোনেনি মরালীর সম্বন্ধে। আর হাতিয়াগড়ের ছোটরানি? তার সম্বন্ধেও যা কিছু শুনেছিল সেসবই উদ্ধব দাসের কাছ থেকে। খুব নাকি রসিক বউ। উদ্ধব দাসের মুখে রসের গান শুনতে ভালবাসে। তা ছোটরানিও নিশ্চয়ই সুন্দরী। নইলে এক বউ থাকতে আবার বিয়ে করতে গেলেন কেন ছোটমশাই? গরিবঘর থেকে কেন আনতে গেলেন আবার একটা বউ? সত্যিই কে ও? কাকে এনেছে সে সঙ্গে করে? রানিবিবি, না মরালী?
তখনও সারাফত আলির নাক ডাকছে পাশের ঘর থেকে। বড় মসজিদ থেকে আজানের শব্দ কানে আসছে। কান্ত উঠল বিছানা ছেড়ে। তারপর রাস্তায় বেরোল। কান্তর ধারণা ছিল এ সময়ে চকবাজারের রাস্তায় এমনিতে কেউ থাকে না। এত ভোরে কেউ ঘুম থেকে ওঠে না। কিন্তু তবু দেখা গেল রাস্তায় রাস্তায় কোতোয়ালের লোক পাহারা দিচ্ছে। কাল মুর্শিদাবাদে এসেই শুনেছিল,নবাব ফৌজ নিয়ে লড়াই করতে গেছে। মিরবকশি গেছে, বকশি আহাদিয়ান গেছে, বকশি সুবাজারাও সবাই গেছে। জমাদার, হাজারি কেউই বাদ নেই। ফৌজখানা একেবারে ফাঁকা রেখে গেছে। শুধু আছে কোতোয়ালের লোকরা নগরের তদারকিতে। পেছন থেকে যদি কেউ হঠাৎ মুর্শিদাবাদে হামলা করে তার জন্যেই এই কড়া পাহারা।
একটা রাস্তার চৌমাথায় আসতেই ওধার থেকে হাঁক এল–কৌন? আমি।
আমি বললেও কিছু সুরাহা হল না। কোতোয়ালের লোক সামনে এগিয়ে এল। এসে অন্ধকারের মধ্যেই কান্তর মুখখানা ভাল করে পরখ করে দেখলে। তুম কৌন?
আমি কান্ত সরকার। নিজামতের চর
লোকটা আর কিছু বললে–না। শুধু জিজ্ঞেস করলে-কাহা যানা হ্যায়?
কান্ত বললে–বশির মিঞার বাড়িতে, নিজামতের কাজে
পাঠান নিশ্চয়ই লোকটা। জগৎশেঠজির মহিমাপুরের বাড়িতে যেমভিখু শেখ পাঠান, এও তেমনি। দিল্লি সাজাহানাবাদ আগ্রা থেকে সব বেছে বেছে পাঠানদের এনেছে কোতোয়ালের কাজে। এদের গায়েও যেমন জোর, মনেও তেমনি ভয়-ভীত কিছু নেই। হুকুম করলেই বুকের ওপর গুলি করতে পারে নির্বিচারে। এরা বর্গিদের দলেও কাজ করেছে, আবার মোগলদের দলেও আছে। কান্তর মতোই টাকা পেলে সকলের নিমক খেতে রাজি।
সদর কাছারির পাশে মনসুর আলি মেহের সাহেবের আস্তানা। তার বাড়িতেই বশির থাকে। এত ভোরে সেখানে হয়তো পাঠান পাহারাদার আছে। হয়তো ঢুকতে দেবে না। এত ভোরে না এলেই ভাল হত। কিন্তু মনটা কেবল ছটফট করছিল। বশিরের কাছে কথাটা শোনার পর থেকেই মনে হচ্ছিল যদি আর একবার কোনওরকমে রানিবিবির সঙ্গে দেখা করা যায়। যদি কোনওরকমে একবার চেহেল্-সুতুনের ভেতরে যেতে দেয় বশির মিঞা। কিন্তু ঢুকতে দেবেই বা কেন? বাইরের লোককে ঢুকতে দেখলে তো খোজারা কোতল করে ফেলবে তাকে। বাইরে থেকে দেখে তো কিছু বোঝা যায় না। অত বড় প্রাসাদ! মতিঝিল দেখেছে কান্ত, মনসুরগঞ্জ দেখেছে, হিরাঝিলও দেখেছে। কিন্তু চেহেলসুতুনের কথাটা ভাবলেই যেন ভয় লাগে। কত মানুষ, কত বেগম, কত রহস্য, কত রোমাঞ্চ জড়িয়ে আছে চেহেল সুতুনের সঙ্গে। কত গল্প শুনেছে কান্ত। ভেতরে শুধু মহলের পর মহল। কত ষড়যন্ত্র, কত চোখের জল নিয়ে গড়ে উঠেছে চেহেল্-সুতুন। মুর্শিদকুলি খাঁর আমলের বাড়ি। ইটের তৈরি। ভেতরে নাকি দরবার ঘর আছে। চল্লিশটা বড় বড় থামের ওপর ছাদটা দাঁড়িয়ে আছে। তারই তলায় দরবার করতেন মুর্শিদকুলি খাঁ। কালো পাথরের বিরাট একটা মসনদ। আকবরনগরের এক মিস্ত্রির তৈরি, বশির মিঞা বলেছিল–মুঙ্গেরের নামজাদা কারিগর বোখারার খাজা নজর নিজে তৈরি করেছিল মসনদটা। মুর্শিদকুলি খাঁর সঙ্গে সঙ্গে সব জায়গায় ঘুরেছে সেটা।
বশির মিঞা, বশির মিঞা
হঠাৎ একটা লাঠি ঠোকার শব্দ হল পাশে। বাড়িটার চারপাশে ঘুরে ঘুরে পাহারা দিচ্ছিল কে একজন। কান্তর গলা শুনেই অন্ধকার থেকে ভূতের মতন সামনে এসে হাজির হয়েছে। লোকটা কান্তর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বোধহয় চিনতে পারলে। বিশেষ কিছু জিজ্ঞেস করলে না। শুধু বললে–মিঞাসাহেব কোঠিতে নেই
কোথায় গেছে? কখন দেখা হবে?
এ-প্রশ্নটা অবান্তর। প্রশ্নটা করেই কান্ত নিজের ভুল বুঝতে পারলে। কে কখন কোথায় যাচ্ছে তা জিজ্ঞেস করতে নেই নিজামতের চাকরিতে। কারণ সবাই নিজের নিজের ধান্ধায় ঘুরছে। আর দিনকাল যা পড়েছে তাতে তো কেউ কাউকে বিশ্বাসই করে না। বিশ্বাস করা উচিতও নয়। কে কার সর্বনাশ করার কথা ভাবছে কে বলতে পারে। সবাই তো নিজের নিজের উন্নতির কথা ভাবছে। রেজা আলি ভাবছে কী করে কার সর্বনাশ করে, কাকে তোয়াজ করে ফৌজদার হওয়া যাবে। মিরজাফর ভাবছে কী করে মোহনলালকে খাটো করতে পারবে। উমিচাঁদ ভাবছে কী করে নবাবের বিরুদ্ধে ফিরিঙ্গিদের উসকে দিয়ে তাদের কাছ থেকে বেশি টাকা আদায় করবে। জগৎশেঠজি ভাবছে কী করে নবাবকে জব্দ করা যাবে। মুর্শিদাবাদের রাস্তার লোকগুলো পর্যন্ত সোজা করে কথা বলতে জানে না। সবাই যেন কথা চেপে যায়। অথচ কলকাতা এমন নয়। কেন যে এখানে এল চাকরি করতে! না এলেই ভাল হত। বড়চাতরায় গিয়ে নায়েব-নাজিরবাবুদের সেরেস্তায় কাজ নিলেই এর চেয়ে তার অনেক ভাল হত।
বশির মিঞা বলেছিল–এ হল শহর। মুর্শিদাবাদ, এ তো আর তোর কলকাতার মতো পাড়াগাঁ নয়
তা বটে। শহরের লোকগুলোই বোধহয় এমনি। এ-চাকরিটা ছাড়তে পারলেই হয়তো ভাল হত। শুধু শুধু একটি পাপ কাজ করতে হল। অবশ্য পাপটা তার নিজের নয়। কিন্তু যারই হুকুম হোক, এ-পাপের ভাগীদারও তো সে। এ-পাপের কিছু ভাগ তো তার গায়েও লাগবে। রানিবিবিকে চেহেল্-সুতুনের ভেতরে পৌঁছে দিয়ে আসা এস্তক মনটা কেমন ভারী হয়ে রয়েছে। কাজটা ভাল করেনি সে। মোটেই ভাল করেনি। রানিবিবি তো পালিয়েই যেতে চেয়েছিলেন তার সঙ্গে। তাকে নিয়ে সেদিন পালিয়ে গেলেই হত। কথার খেলাপ হত বটে। কিন্তু তার চেয়ে তো আরও বড় পাপ করলে তাঁকে এখানে নিয়ে এসে। রানিবিবিই তো পালিয়ে যাবার কথাটা তুলেছিলেন নিজে। কান্তরই শুধু সাহস হয়নি! আর কোতোয়ালের লোকজনও ঠিক সেই সময়ে সেখানে এসে পড়েছিল।
সারা মুর্শিদাবাদ শহরটাই আস্তে আস্তে টহল দিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল কান্ত। চেহেল্-সুতুনের পুব দিকে তোপখানা। সেদিকটায় শুধু যায়নি। আজ পাহারাদাররা ওদিকে কড়া পাহারা লাগিয়েছে। কাউকে ওদিকে যেতে দেখলেই নানান কথা তুলবে। তার পাশেই জাহানকোষা। বিরাট একটা কামান। তার ওপাশে গঙ্গা। গঙ্গার ধারে গিয়ে দাঁড়াল কান্ত। কিছুই ভাল লাগছে না। মনে হচ্ছিল এখুনি যদি একবার চেহেল্-সুতুনের ভেতরে গিয়ে রানিবিবির সঙ্গে দেখা করে আসতে পারত। রাত্রে কী খেলে, কী করে কাটালে, সব জানতে ইচ্ছে করছে। হিন্দুর জন্যে কি আর আলাদা রান্নার ব্যবস্থা করেছে! কান্ত থাকলে হয়তো কাটোয়ায় যেমন ব্যবস্থা করেছিল, সেই রকম ব্যবস্থা করতে পারত। তারপর শুধু কি খাওয়া? হয়তো রানিবিবিকে বেগমদের মতো ঘাগরা-ওড়নি পরতে হবে। হয়তো মদ খেতেও দেবে!
কিন্তু রানিবিবি না হয়ে সত্যি সত্যি যদি সেই মরালীই হয়, তখন? আর যদি মরালীই হয় তো আসল রানিবিবি কোথায়? হাতিয়াগড়ের জমিদারের সেই ছোট বউরানি? তাকে কোথায় রেখে দিয়েছে? তাকে তো আর বাড়িতে রাখতে পারবে না। তা হলে সবাই তো জেনে ফেলবে। তাকে তো নাটোরের রানি ভবানীর মতো কোনও আশ্রমে কি আখড়ায় লুকিয়ে রাখতে হবে। নইলে ডিহিদার রেজা আলি তো টের পেয়ে যাবে। টের পেয়ে গেলেই আবার ধরে আনবে। তখন তো মরালীকে ছেড়ে দিতে হবে। কিংবা এও হতে পারে, দুজনকেই ধরে রাখবে। দু’জনকেই চেহেল্-সুতুনে আটকে রাখবে।
হঠাৎ দূরে কোথায় ঘণ্টা বাজতে লাগল। ঢং ঢং করে দু’বার বাজল।
কেমন যেন সন্দেহ হল। তবে কি রাত দুটো বাজল নাকি! তবে কি ভোর হয়নি? সন্দেহ হতেই আবার নিজের আস্তানার দিকে ফিরল। নিজের ঝুপড়িতে আসতেই বুঝি শব্দ হয়েছে। শব্দ হতেই পাশের ঘর থেকে বাদশা চেঁচিয়ে উঠেছে কৌন?
আমি বাদশা, আমি কান্তবাবু
কোথায় গিয়েছিলেন বাবুজি?
বেড়াতে। আমি ভেবেছিলাম রাত বুঝি কাবার হয়ে গেছে। ঘণ্টা শুনে এখন খেয়াল হল।
বাদশা আর কিছু বলল না। কিন্তু খানিক পরে কান্ত আবার ডাকলে–বাদশা
জি!
কান্ত জিজ্ঞেস করলে–আচ্ছা বাদশা, তুমি চেহেল-সুতুনের অন্দরে কখনও গেছ?
এত রাত্রে এ-প্রশ্ন শুনে বাদশা বোধহয় অবাকই হয়ে গিয়েছিল। বললে–নেহি জি–নেহি গয়া কাহে?
মানে, তুমি কিছু জানো, ভেতরে কেমন করে জীবন কাটায় বেগমরা? মানে যে-সব হিন্দু বেগম ভেতরে যায় তাদের কি গোরুর মাংস খেতে হয়? ঘাগরাটাগরা পরিয়ে দেয়? মানে তাদের কি খুব কষ্ট?
বাদশার বোধহয় তখন খুব ঘুম পাচ্ছিল। কিংবা হয়তো কান্তর প্রশ্নটা বুঝতে পারল না।
কান্ত এ-ঘর থেকে আবার জিজ্ঞেস করল–মানে, ধরো হিন্দু সধবাদ