কৈলাস গোমস্তা চলে যাবার পরেও যেন কর্তাবাবু শান্ত থাকতে পারলেন না। তার মনে হলো সেরেস্তার পাশের যে চোর-কুঠুরিটা আছে সেখান থেকে যেন একটা অস্ফুট শব্দ হলো। বংশী ঢালী এতটুকু ভুল করে ফেলে তাহলে সব কিছু যেন আজ ভণ্ডুল হয়ে যাবে। সব যেন পণ্ড হয়ে যাবে। অথচ আজকের উৎসবে এত লোক এসেছে, এরা যদি কেউ দেখে ফেলে! চিফ মিনিস্টার মিস্টার সেন এসেছে, আমেরিকার অ্যামব্যাসাডার মিস্টার হেল্ডারসন এসেছে, এসেছে রাশিয়ার অ্যামব্যাসাডার মিস্টার নবিকভ, এসেছে কলকাতার পুলিস কমিশনার মিস্টার সামন্ত। আসতে কারো বাকি নেই। বাইরের রাস্তায় গাড়ির লাইন পড়ে গেছে। মিস্টার ব্যানার্জির ছেলের আজ বার্থ-ডে। মিসেস ব্যানার্জির প্রথম সন্তান। আজকে সে বারো বছরে পড়লো। প্রথমই আজকে সকলের লক্ষ্য। সকলের উপহারগুলো বিরাট একটা টেবিলের ওপর জড়ো হয়েছে। সবগুলো উপহার সেখানে ধরছে না। অনেকগুলো উপচেও পড়ছে। কিন্তু তবু উপহারের যেন শেষ নেই।
হঠাৎ কে যেন একজন কাছে এল। মিস্টার ব্যানার্জী তখন কাজে ব্যস্ত। কাজ এমন কিছু নয়। কাজ করবার তার লোকের অভাবও নেই। হোটেলকে কনট্র্যাক্ট দেওয়া হয়েছে। খাওয়ার বন্দাবস্ত সব কিছু করছে ওরাই। তারা কেটারিং এক্সপার্ট।
–ব্যানার্জি সাহেব কোথায়?
আর দোতলার একটা হল-এর ভেতর ককটেল-এর ব্যবস্থা। সেখানে ট্রে কোলে করা বয় আর ওয়েটারদের আনাগোনা। অনেকের সঙ্গে আছে সিগারেট-ঢালা একটা ট্রে। তারা সামনে দিয়ে গেলে ইচ্ছে করলে তুমি একটা সিগারেট তুলে নিতে পারো। মিস্টার সেন এর অনেক কাজ। সোজা রাইটার্স বিল্ডিং থেকে চলে এসেছেন। তাঁকে ঘিরেই যত মানুষের ভিড়। সকলের হাতেই গেলাস। একটা গেলাস খালি না হতেই আবার একটা ভর্তি গেলাস নিয়ে দাঁড়ায় বেয়ারা। কারো গেলাস তারা খালি রাখতে দেবে না।
লোকটা তখন নিচেয় সব জায়গায় ঘুরছে। জিজ্ঞেস করছে ব্যানার্জি সাহেব কোথায় রে?
একজন বেয়ারা হনহন করে কোথায় যাচ্ছিল। সে বললে–ব্যানার্জি সাহেব কোথায় তা আমি কি জানি? ওপরে গিয়ে দ্যাখ না–
বাজে কথা বলবার কি কারো আজ সময় আছে! আজ যারা এ বাড়িতে এসেছে তাদের তদ্বির-তদারক করতে এতটুকু ত্রুটি হলেই সর্বনাশ হয়ে যাবে! গেটের বাইরে পাহারার ব্যাবস্থা আছে! আজকের অতিথি-অভ্যাগতরা সবাই ভি-আই-পি। তারা আগেও অনেকবার এ-বাড়িতে এসেছে, আবার আজকেও এসেছে।
কর্তাবাবু ছেলেকে ডেকে পাঠালেন।
চৌধুরী মশাই আসতেই কর্তাবাবু বললেন–খোকা কোথায়?
চৌধুরী মশাই বললেন–নিচেই আছে সে–
কর্তাবাবু বললেন–খোকাকে একটু নজরে রাখবে, যেন আবার পালাতে না পারে। গায়ে-হলুদের দিন যেমন পালিয়েছিল তেমনি যেন না করে–একটু দেখো–
চৌধুরী মশাই বললেন–হ্যাঁ নজর রাখা হচ্ছে, প্রকাশ পেছনে-পেছনে রয়েছে–
–খোকাকে খাইয়ে দাইয়ে একেবারে বউমার ঘরে ঢুকেয়ে দেবে। যখন দেখবে যে খোকা ভেতর থেকে খিল দিয়েছে, তখন আমাকে এসে বলে যারে–
আজ এখানেও সেই রকম। কর্তাবাবু সকাল থেকেই হুকুম দিয়েছেন। নজর রাখো ভালো করে। চিফ মিনিস্টার আসবে, ফরেন অ্যামবাসাডাররা আসবে, পুলিস কমিশনার আসবে। তাদের যেন কোনও অযত্ন না হয়, তাদের অভ্যর্থনা-আপ্যায়নে যেন কোনও ত্রুটি না থাকে। মিস্টার ব্যানার্জি সকাল থেকেই ব্যস্ত। শুধু টাকা খরচ করলেই তো কাজ হয় না, চারিদিকে নজর রাখা চাই। যেন কোনও ভাবে বাজে লোক ঢুকে না পড়ে।
দোতলার হলঘরের ভেতর মিস্টার সেন বলেন, না, আর দেবেন না, আর দেবেন না আমাকে–
মিসেস সেন বললে–আমিও আর বেশি নেব না মিসেস ব্যানার্জি–
–না না, একটু স্ন্যাকস নিন–
বলে মিসেস ব্যানার্জি দু’জনকেই আর একটা পেগ দিচ্ছিলেন। কিন্তু চিফ মিনিস্টার হাতটা পিছিয়ে নিলেন। বললেন–না না, আমাকে আবার এখনি একবার রাইটার্স বিল্ডিং-এ ফিরে যেতে হবে
মিসেস ব্যানার্জি বললে–কেন, এখন আবার রাইটার্সে যাবেন কেন?
মিস্টার সেন বললেন–আর বলেন কেন, এই এখানে আসবার একটু আগেই ফোন এল নদীয়া ডিসট্রিক্টে খুব গণ্ডগোল চলেছে–
–নদীয়া? নদীয়ার কোন্ জায়গায়? কী গণ্ডগোল?
–সেখানে স্কুল-কলেজের ছেলেরা বিল্ডিং-এ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। হাসপাতাল ছিল একটা সেখানে, শুনেছি তাতেও নাকি আগুন ধরিয়ে দিয়েছে
–কেন, কী হয়েছিল?
মিস্টার সেন বললেন–ওই যা সব জায়গায় হচ্ছে, আজকাল কেউ তো কারো ডিউটি করছে না। এক ভদ্রলোক লাখ-লাখ টাকা খরচ করে পনেরো বছর আগে সেখানে স্কুল কলেজ আর হাসপাতাল করে দিয়েছিল, সেই সব পুড়িয়ে দিচ্ছে, গ্রামের লোক সব পালিয়ে আসছে–সি-আর-পি পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন গিয়ে আর একবার খবর নেব টেলিফোনে
–জায়গাটা কোথায়? নাম কী জায়গাটার?
–নবাবগঞ্জ।
.
আর এদিকে সমস্ত নবাবগঞ্জটাকেই কেউ যেন আরো বড় আকারে এই কলকাতায় এনে বসিয়ে দিয়েছে। এখানেও বাইরে সেই পরমেশ মৌলিকের মত কাছারি বাড়িতে হিসেবের খাতা নিয়ে বসে থাকে মানদা মাসি। সকালবেলা মানদা মাসির কোনও কাজ থাকে না। এই পার্ক স্ট্রীটের পাড়ায় এই বাড়িটা আরো বড় দশটা বাড়ির মতই আরো একটা। অন্য বাড়িগুলোর সঙ্গে এ বাড়ির চেহারায় কোনও পার্থক্য নেই। এ-পাড়ার সব বাড়িগুলোই বড়। মানদা মাসির বয়স আরো পনেরো বছর বেড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পনেরো বছরের অভিজ্ঞতাও বেড়েছে। এই বয়েসে মাসি সত্যিই অনেক দেখলো। কালীঘাটের মন্দিরের রাস্তায় যে ভিখিরি মেয়েটা একদিন তীর্থযাত্রীদের পেছনে পেছনে ভিক্ষে করে বেড়িয়েছে, তারপর বয়স বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে একদিন আবার গায়ে গয়নাও উঠেছিল যে-মেয়েটার, সেই মেয়েটাই আবার একদিন কালীঘাটের গলিতে একটা ছোট খোলার ঘরে আরম্ভ করে দিয়েছিল এই ব্যবসা।