এই bounds, এই সীমরেখা নির্দেশ করা বড় কঠিন; তবে সীমা লঙ্ঘিত হয়েছে কিন্তু বোঝা যায় লেখকের বিশেষ আধ্যাত্মিক বাস্তবতার লক্ষ্য অনুধাবন করলে। যদি দেখা যায়। তিনি তাঁর সেই উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পেরেছেন তখন অতিরঞ্জন আর অতিরঞ্জন থাকে না।
পাঠক ও সমালোচকদের স্মরণার্থে বলছি, অতিরঞ্জনের প্রয়োজন হয় তখনই যখন পরিবর্তনশীল উপরিভাগের অব্যবহিত নিচেকার অপেক্ষাকৃত স্থির ও স্থিতিশীল মানবিকভ্ অস্তিস্তকে দেখানো আবশ্যক হয়ে ওঠে–কেবল অপেক্ষাকৃত সূক্ষ্ম কিংবা ধূসর জিনিসকে দৃষ্টিগোচরে আনতে হলে তাকে বর্ধিতায়তন করাই দরকার। ডিকেনস্ বলেছেন-What is exaggeration to one class of mind and perception is plain truth to another. দস্তয়েফস্কি–The important thing is not in the object, but in the eye; if you have an eye, the object will be found; if you don’t have an eye, if you are blind–you won’t find anything in any object.
বিষয়ের এই অন্তর্নিহিত গুণটি দেখবার চোখ যাঁর আছে তিনিই realism-এর শিল্পী। তার হাত দিয়েই যুগে যুগে মূর্ত হয়ে উঠবে Positive good man. বিমল মিত্র নিঃসন্দেহে প্রমাণ করেছেন সত্য দর্শনের সেই দুরাসদ দৃষ্টি তার আছে।
শিল্পীর এই দুরাসদ দৃষ্টিগোচর Positive good man প্রসঙ্গে Mochulskey বলেছেন : In the “world of darkness” comes a man not of this world…He is not an active fighter contending in the struggle with evil forces, not a tragic hero challenging fate to combat, he does not judge and does not accuse, but his very appearance provokes a tragic conflict. One personality is set in opposition to the entire world.
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যদি ‘আসামী হাজির’-এব নায়ক সদানন্দর দিকে তাকাই তো সদানন্দর তিনটে ডাইমেনশানই (স্তর) একসঙ্গে আমাদের চোখে পড়বে। তিনজন সদানন্দকে আমরা একটি অবয়বে বিধৃত দেখতে পাব। চোখ মেললেই যেটা চোখে পড়বে সে তার সাধারণ চেহারা। আর পাঁচজন সমবয়সীর মতন স্বাভাবিক আচার-আচরণ। লেখাপড়া করে, স্কুলে যায়। প্রাকৃতিক নিয়মে সকলের মতন তারও বয়েস বাড়ে। কিন্তু এই ওপরের স্তরের নিচে সদানন্দ কিন্তু আসলে অন্য রকম। তার প্রশ্ন সাধারণের প্রশ্ন নয়, তার দেখার চোখও নয় সাধারণের চোখের মতন। সদানন্দর চোখে আরও কিছু, এমন কিছু ধরা পড়ে যা আর কারও চোখে পড়ে না। চোখে পড়লেও যার তাৎপর্য আর কেউ বোঝে না। শেষ স্তরের সদানন্দর এই যে অবহিতি-বোধ, এবং ভ্রষ্টত্ব সম্বন্ধে প্রখর সচেতনতা, এর থেকেই ঘটতে থাকে তার অহং-এর উত্তরণ। সদানন্দর এই তিনটি স্তর কিন্তু পরস্পর-বিচ্ছিন্ন নয়, এই ত্রিস্তর মিলিয়েই সদানন্দ সম্পূর্ণ একটি মানুষ। কী করে জানলাম? বিমল মিত্র সদানন্দ সম্পর্কে কি একটা দার্শনিক বক্তৃতা দিয়েছেন? না। তবে? হ্যাঁ, এইখানেই বিমল মিত্রের শিল্প-বৈদগ্ধ্য। তিনি বক্তৃতা দেন না, তিনি Maupassant-র ভাষায় –To produce the effect he seeks, that is, the feeling of simple reality, and I to bring out the lesson he would draw from it, that is, the revelation of what contemporary man really is to him, he will have to employ facts of constant and unimpeachable veracity…the achievement of such a goal consists, then, in giving the complete illution of reality following the ordinary logic of facts, and not in transcribing slavishly in the pell-mell of their occurance. (Preface to “Pierre et Jean”) অর্থাৎ বিমল মিত্র দৈনন্দিন জীবনের নিত্য-ঘটা সাদামাটা ঘটনার মধ্য দিয়ে তার চরিত্রকে উপস্থিত করেন কিন্তু সে সাদামাটা ঘটনাও আসলে মোপাশ্যাঁর ভাষায় ওই উপরিউক্ত বাস্তবেরই অধ্যাস এবং আদৌ বিশৃংখল কতকগুলি ব্যাপার মাত্র নয়। বিমল মিত্রের উদ্ভাবিত ঘটনা বা সিচুয়েশান বস্তুত ঘটনা নয়, ইলাসট্রেশান অর্থাৎ উদাহরণ। এবং তারও সব সময় থাকে তিনটে স্তর-প্রতিক্রিয়া, তাৎপর্য এবং প্রভাব।
উদাহরণ স্বরূপ কপিল পায়রাপোড়ার ঘটনাটাই উল্লেখ করা যাক। পাঁচ বছরের সদানন্দ কৈলাস গোমস্তার সঙ্গে হাটে গেছে। সেখানে কপিল বেলুন বেচছিল। সদানন্দ বেলুন চাইলে, সে দাম নিলে না, এমনিতেই একটা বেলুন দিয়ে দিল তাকে। কিন্তু কৈলাস গোমস্তা হিসেবের খাতায় চার পয়সা খরচ লিখে সেই পয়সা চারটে নিজে রাখলে। দুদিন বাদে সেই বেলুনটা চুপসে গেলে সদানন্দ বায়না ধরলে তার আর একটা বেলুন চাই। একমাত্র বংশধরের আবদারের কাছে কঞ্জুস জমিদার নরনারায়ণ চৌধুরীর মনে কৃপণর ছিটেফোঁটাও থাকে না। তখুনি চাকর পাঠানো হল রেলবাজারে। চাকর দু’পয়সা দিয়ে একটা বেলুন কিনে নিয়ে এল। বেলুনের দাম দু’পয়সা শুনেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন নরনারায়ণ চৌধুরী, আর একবার হিসেবের খাতাটা মিলিয়ে দেখলেন–হ্যাঁ, কপিল দু’পয়সা বেলুনের দাম চারপয়সা নিয়েছে তার নাতির কাছ থেকে। কপিল ঠগ, কপিল জোচ্চোর! হুকুম হল কপিলকে ধরে নিয়ে আসবার। বিনে পয়সার বেলুনের দাম হিসেবের খাতায় চার পয়সা লিখে যে চুরি করেছিল সেই কৈলাস গোমস্তাই ছুটল তাকে গ্রেপ্তার করে আনতে।