কর্তাবাবু বললেন–তাহলে ঘরে ঢোকবার দরজাটা বন্ধ করে দে, তোকে আজ একটা কাজের ভার দেব–
বংশী ঢালী দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে হুড়কো লাগিয়ে দিলে। আর সঙ্গে সঙ্গে নবাবগঞ্জের চৌধুরী বংশের ঝাড়-লণ্ঠনের সব বাতি যেন এক ফুৎকারে নিবে গিয়ে দিকবিদিক একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল। কর্তা নরনারায়ণ চৌধুরীর একমাত্র পৌত্র, ছেলে হরনারায়ণ চৌধুরীর একমাত্র পুত্র সদানন্দ চৌধুরী তখন উৎসব-অনুষ্ঠানের জাঁকজমকের ঘেরাটোপের মধ্যে থেকে একেবারে দূরে সরে এসেছে। একদিন আগে কেষ্টনগরের একটা বাড়িতে একটা অচেনা মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ের সম্প্রদান হয়েছে, নিমন্ত্রিত অতিথি-অভ্যাগতরা ভুরিভোজে পরিতৃপ্তির উদ্গার তুলতে তুলতে যে যার বাড়িতে চলে গেছে। বাসরঘরের চার-দেয়ালের মধ্যে সে নববধূর মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে দেখেছে। ভেবেছে এ কাকে সে বধূ করে নিয়ে চলেছে তার বাড়িতে! এ–ও কি সংসারের আর পাঁচজন মানুষের মত যান্ত্রিক মানসিকতার একটা অতি সাধারণ প্রতীক! এ–ও কি কলের পুতুলের মত সুতো টানলে হাত পা নাথা নাড়াবে, কল টিপলে খাবে ঘুমোবে আর যান্ত্রিক নিয়মে কেবল সন্তানের জন্ম দিয়ে চৌধুরী বংশের লোকসংখা বাড়িয়ে যাবে!
সেদিন কালরাত্রি। গ্রামের লোক সবাই বৌ দেখে দলে দলে যে যার বাড়ির দিকে চলে যাচ্ছে। সদানন্দ অন্ধকার বারবাড়ির উঠানের পাশ দিয়ে চণ্ডীমণ্ডপের দিকে যচ্ছিল। জায়গাটা বড় নিরিবিলি নির্জন। হঠাৎ মনে হলো সামনের চণ্ডীমণ্ডপের পেছনে চোর-কুঠুরির ভেতর থেকে কে যেন হঠাৎ একটা আর্তনাদ করে উঠলো—আঃ–
একটা মেয়েলী গলার চাপা আর্তনাদ। কিন্তু আর্তনাদটা একবার গলা ছিঁড়ে বার হবার পরেই যেন আবার হঠাৎ মাঝখানে বন্ধ হয়ে গেল। মনে হলো কে যেন কার গলা টিপে ধরেছে।
সদানন্দ খানিকক্ষণ হতবাক হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর চোর কুঠুরিটা থেকে একটা ধস্তাধস্তির আওয়াজ আসতেই তার যেন কেমন সন্দেহ হলো। সদানন্দ চোর কুঠুরির দিকে দৌড়ে যেতেই দেখলে সামনে অন্ধকারের মধ্যে থেকে কে একজন বেরিয়ে আসছে।
সদানন্দ চিনতে পারলে না লোকটাকে। বললে–কে? কে তুই? কে? কে কেঁদে উঠলো চোরকুঠুরির ভেতরে?
প্রথমে কেউই উত্তর দিলে না। চারদিকে অন্ধকার। ওদিকে বিয়েবাড়ির আলোয় পশ্চিম দিকটা ঝলমল করছে। পূর্ব-উত্তর কোণাকুণি দিকটাতেই অন্ধকার বেশি। চণ্ডীমণ্ডপটা পূবদিক-ঘেঁষা। নরনারায়ণ চৌধুরী যখন নবাবগঞ্জে জমিদারি পত্তন করেছিলেন তখন হাতে অনেক কাঁচা টাকা আসতে লাগলো। কিন্তু টাকা এলে কী হবে, মানুষটার ব্যবহার সেই আগেকার মতই রয়ে গেল। এককালে যখন কালীগঞ্জে গোমস্তার কাজ করেছেন, তখনও যেমন, আবার জমিদারি পত্তনের পরও তেমনি। এই নবাবগঞ্জ একদিন কালীগঞ্জের পত্তনির মধ্যেই ছিলো। তখন নরনারায়ণ চৌধুরী এইখানে বসে একটা একতলা বাড়ির বৈঠকখানার মধ্যে গোমস্তাগিরি করতেন। কিন্তু তারপর আস্তে আস্তে নবাবগঞ্জের সেই একতলা বাড়িটার সামনে একটা বিরাট দুমহলা দোতলা বাড়ি উঠলো। তখন আগেকার সেই একতলা বাড়িটা হয়ে গেল চণ্ডীমণ্ডপ। আর তার আধখানায় কাজ চলতে লাগলো চণ্ডীমণ্ডপের। আর বাকিখানায় হলো চোর কুঠুরি। সে সিকিখানা প্রায়ই ব্যবহার হতো না। বছরের বেশির ভাগ সময় তার দরজায় তালা-চাবি দেওয়া পড়ে থাকতো। একটা ঝাঁকড়া-মাথা গাব গাছ সে ঘরখানাকে দিনের বেলায় অন্ধকার করে রাখতো। আর রাত্তিরে তার চেহারা অন্ধকারের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যেত।
লোকটা তখন সামনে এসে পড়েছে একবারে।
সদানন্দ মুখখানা একবার লোকটার মুখের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে।
বললে–কে? কে রে তুই? কথা বলছিস না কেন?
–আজ্ঞে আমি!
এবার গলার আওয়াজে চিনতে পারলে সদানন্দ। বংশী ঢালী।
–বংশী ঢালী?
–আজ্ঞে হ্যাঁ খোকাবাবু।
–তা তুই এই অন্ধকারে এখানে একলা কী করছিস? খেয়েছিস?
বংশী ঢালী বললে–কাঁচা-ফলার খেইচি, একটু পরে পাকা-ফলার খাবো।
তা বটে। কর্তাবাবুর বাড়ির কাজ, সবাই তিন-চারদিন ধরে চারবার পেটভরে খাবে। এটাই রেওয়াজ। জমি-জমার দখল নিয়ে যখন কোথাও কোনও গণ্ডগোল বাধে তখন বংশী ঢালীরই ডিউটি পড়ে। বদমাইশ প্রজাকে ঢিট করতেও বংশী ঢালীর ডিউটি পড়ে।
–তা পাকা-ফলারের পাতা তো পড়েছে, খেতে যা–
সে কথার উত্তর না দিয়ে বংশী ঢালী অন্য কথায় চলে গেল। এক গাল হাসি হেসে বলল–আপনার বৌ খুব সোন্দর হয়েছে খোকাবাবু, একেবারে মা-দুর্গার মত–
কিন্তু বংশী ঢালীর হাসিতে সদানন্দর মন ভুললো না। বললে–তা হবে, তুই আগে খেয়ে নিগে যা—
বংশী ঢালী চলে গেল বটে, কিন্তু সদানন্দর মনের সন্দেহ গেল না। বংশী ঢালী যেতেই সদানন্দ চোর কুঠুরিটার দিকে আরো এগিয়ে গেল। বাইরে থেকে এ দরজায় তালা ঝুলছে তখনও। তাহলে আর্তনাদটা কোন্ দিক থেকে এলো? কে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলো?
মানুষের ইতিহাসে এই রকম করে কতবার কত বংশী ঢালী নিঃশব্দে কত জমিদারের চোর কুঠুরিতে ঢুকেছে, আর নিষ্কলুষ মুখোশ নিয়ে কতবার চোর-কুঠুরির বাইরে বেরিয়ে এসেছে তা কোনও ভাষার ইতিহাসে লেখা থাকতে নেই। কিন্তু হিসেবের কড়ি বাঘে খেয়েছে। এমন কথা যেমন কোথাও লেখা থাকে না, আসল আসামী ধরা পড়েছে এমন নজিরও কোনও আদালতের নথিপত্রে নেই। কারণ আসল আসামীরা ধরা পড়ে না। নকল আসামীদের সামনে এগিয়ে দিয়ে আসল আসামীরা বরাবরই আড়ালে লুকিয়ে থাকে। তাদের কোনও শাস্তি হতে নেই। তারা রায় বাহাদুর হয়, রায়সাহেব হয়, তারা পদ্মশ্রী পদ্মভূষণ হয়, তারা শ্বেতপাথরের মূর্তি হয়ে বাস্তার মোড়ে মোড়ে শহরের শোভা বাড়ায়। কবে একদিন হয়ত নবাবগঞ্জের নরনারায়ণ চৌধুরীও এমনি শোভা হয়ে উঠতো, রায় বাহাদুর হতো, রায়সাহেব হতো, পদ্মভূষণ হতো, পদ্মশ্রী হতো। এ-যুগে জন্মালে তা হবার চেষ্টাও হয়ত করতো। কিন্তু অদৃষ্ট-দেবতার কোন্ এক দুর্লঙ্ঘ্য আইনে আসামী একদিন হঠাৎ ধরা পড়লো। আর ধরা পড়লো বলেই রাত জেগে জেগে তার বংশধরকে নিয়ে এই উপন্যাস লেখবার প্রয়োজন আজকে আমার পক্ষে অনিবার্য হয়ে উঠলো।