একটু পরেই ঘরে যিনি প্রবেশ করলেন তাঁকে এক কথায় জলহস্তীর ছানা বলা যায়। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, আসুন, আসুন
একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে-বসতে তিনি বললেন, আমার নাম।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাধা দিলাম আমিঃ প্লিজ, আর বলার প্রয়োজন নেই। কার্ড পড়েই মাথা ঘুরছে। তার ওপর আবার বললে হয়তো হার্টফেল করব।
ভদ্রলোক একটু হাসলেন, বললেন, যদি ভুল না আমার হয়ে থাকে, তবে বোধহয় অশোক বোস আপনিই?
আমি মৃদু হেসে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম। বললাম, আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না ।
লয়ালিস্টদের তরফ থেকে আমি আসছি। শুনেছি আপনার কাছে সুরেন্দ্র পালিতের স্মৃতিকথার ম্যানাস্ক্রিপ্টটা আছে।
ঠিকই শুনেছেন। জানালাম আমি। ওঁর কথা বলার ভঙ্গিতে ক্রমশ অবাক হচ্ছিলাম।
চাই না আমরা যে, পাণ্ডুলিপিটা ছাপা এখন হোক। কুমার রণজিতও চাইবেন না সেটা। আপনি আশা করি রাখবেন কথা আমাদের এবং প্রকাশ এখন পাণ্ডুলিপিটা করবেন না।
মোটেই না–মোটেই না। বরং আজকালের মধ্যেই আমি মেহেতা অ্যান্ড সন্সের হাতে পাণ্ডুলিপিটা তুলে দিচ্ছি। নির্বিকারভাবে জানালাম আমি।
করতে এটা পারেন না আপনি। এতে বিপদ অনেক হবে।
আমি কথা দিয়েছি।
আপনি তা হলে শুনবেন না অনুরোধ আমাদের? এই শেষ কথা আপনার তা হলে?
আমি নিরুপায়–।
বেশ, উঠে দাঁড়ালেন শ্রীনরসিংহ : জানি অন্য আমরা উপায়। আমরা এটা ছাপানোর ব্যাপারটা করবই যেভাবে হোক বন্ধ। নমস্কার।
শ্রীনরসিংহ থপথপ করে বিদায় নিলেন।
আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। অন্য উপায় মানে! ইব্রাহিমের মতোই কাউকে তিনি ব্যবহার করবেন নাকি!
প্রায় ঘণ্টাখানেক ডুবে রইলাম নানান চিন্তায়।
হঠাৎই সমস্ত চিন্তা ছিন্নভিন্ন করে ফোন বেজে উঠল।
চিন্তিত হলাম। এ আবার কে ফোন করল! এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তুলে নিলাম।
হ্যালো।
মিস্টার অশোক বোস?
আপনি?
মেহেতা অ্যান্ড সন্সের শ্রী জগদীশকিশোর মেহেতা।
ও কী ব্যাপার? ভীষণ অবাক হলাম আমি।
মিস্টার বোস, ম্যানাস্ক্রিপ্টটা কি আপনি আজ দেবেন?
হ্যাঁ, আমি একটু পরে গিয়ে দিয়ে আসব। ভাবলাম ঝামেলা চুকিয়ে দেওয়াই ভালো।
পাগল হয়েছেন আপনি! আমি ডেফিনিটলি বলতে পারি ওই ম্যানাস্ক্রিপ্ট নিয়ে আপনি কোনওদিনই আমাদের অফিসে সুস্থ অবস্থায় পৌঁছোতে পারবেন না।
তা হলে?
আমি বরং গজানন শিকদার নামে আমার এক অতি বিশ্বস্ত কর্মচারীকে পাঠাচ্ছি। আপনি ম্যানাস্ক্রিপ্টটার মতো একটা নকল প্যাকেট তৈরি করে হোটেলের কাস্টডিতে জমা দিন। তা হলে সবার নজর ওইদিকেই থাকবে। আর বাই দ্যাট টাইম পনেরো হাজার টাকার একটা চেক দিয়ে আমি গজানন শিকদারকে আপনার ওখানে পাঠাচ্ছি। আপনি ওর হাতে সুরেন্দ্র পালিতের ম্যানাস্ক্রিপ্টটা দিয়ে দেবেন। আচ্ছা, রাখছি।
প্রায় আধঘণ্টা পর একজন ভদ্রলোক এলেন। বললেন, আমি মেহেতা অ্যান্ড সন্সের গজানন শিকদার। বলে একটা পনেরো হাজার টাকার চেক পকেট থেকে বের করলেন।
আমি ইতিমধ্যে সব ব্যবস্থা করে ফেলেছিলাম। চেকটা নিয়ে পাণ্ডুলিপিটা তার হাতে তুলে দিলাম। বললাম, মিস্টার শিকদার, সাবধানে যাবেন। আমার কিন্তু আর কোনও দায়িত্ব নেই।
মৃদু হেসে গজানন শিকদার চলে গেলেন।
তিনি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই একটা বয় এসে একটা কার্ড আর চিঠি দিয়ে গেল। অবাক হয়ে সেটা নিলাম, দেখি তাতে লেখা?
শ্রী অশোক বোস সমীপেষু,
মহাশয়, আগামী রবিবার কবুতরে যে-পার্টি দেওয়া হচ্ছে তাতে আপনাকে সম্মানিত অতিথি হতে অনুরোধ করছি। বয়টির কাছে আপনার উত্তর দিলে বাধিত হব। ইতি–
সঙ্গের কার্ডে মানেকজিপ্রসাদজির ফার্মের নাম ও কবুতরের ঠিকানা ছিল। বয়টিকে ডেকে ওগুলো ফেরত দিয়ে বললাম, দুঃখিত, তোমার মালিককে বোলো, আমি বিশেষ কারণে পার্টিতে যেতে পারছি না।
বয়টি চিঠি ও কার্ড নিয়ে চলে গেল।
আমি এবার হাত-পা ছড়িয়ে বসলাম। সব কাজ শেষ। এখন শুধু জানতে হবে কে ওই সুচরিতা চৌধুরী। নামটার মধ্যেই যেন কেমন এক প্রচ্ছন্ন ব্যক্তিত্ব লুকিয়ে আছে।
হঠাৎ আমার চোখ গেল ড্রেসিং টেবিলের ওপর খোলা অবস্থায় রাখা একটা ফিল্ম ম্যাগাজিনের দিকে। এখনও পর্যন্ত নেড়েচেড়ে দেখিনি। হাওয়ায় ম্যাগাজিনটার কতকগুলো পাতা উলটে গেছে। সেখানে একজন মহিলার ফটো দেখা যাচ্ছে। নীচে লেখা : শ্ৰীমতী সুচরিতা চৌধুরী, মোতিবাগ।
লাফিয়ে উঠলাম আমি। ইস, যদি এঁরই হয়ে থাকে চিঠিগুলো! নাঃ, এক্ষুনি ওঁকে একবার সাবধান করে দিতে হবে। নয়তো বলা যায় না, চিঠিগুলো নিয়ে কেউ হয়তো মিসেস চৌধুরীকে ব্ল্যাকমেল করবে। ভদ্রমহিলা তা হলে এখানে বেশ পরিচিত দেখছি!
ভাবলাম শহর দেখতে বেরোব। উঠে দাঁড়িয়ে জামাকাপড় পালটাতে লাগলাম। মনে-মনে নিজের পিঠ চাপড়ে বললাম, এখন শ্রীযুক্ত অশোক বোস মঞ্চ থেকে প্রস্থান করবেন এবং তার পরিবর্তে মঞ্চে আবির্ভূত হবেন একমেবাদ্বিতীয়ম, আদি ও অকৃত্রিম, শ্ৰীযুক্ত কাঞ্চন মৈত্র!
.
সুচরিতা প্রসাধন সেরে বেরোতে যাচ্ছিল। উদ্দেশ্য, তরুণের কাছ থেকে ঠিকানা জেনে শ্ৰীযুক্ত বোসের সঙ্গে দেখা করা। কী জানি কেমন দেখতে হবে ভদ্রলোককে! তিনি কি জানেন যে, সঙ্গে অ্যাটমবোমার মতো একটি ম্যানাস্ক্রিপ্ট নিয়ে তিনি ঘুরছেন! বোধহয় না।
বেরোনোর আগে কাজের লোককে ডেকে সুচরিতা বলল, যতীন, আমি একটু বেরোচ্ছি।