সাধারণ ধরনের স্মৃতিকথা। সিরাজনগর সম্বন্ধে নানা তথ্য লেখা। পড়তে-পড়তে এক জায়গায় সমর বর্মনের কথা পেলাম। পাণ্ডুলিপিতে লেখা আছে, মানুষ ছদ্মবেশ নিয়ে সর্বাঙ্গে পরিবর্তন আনতে পারে, কিন্তু কানের পরিবর্তন করা অসম্ভব…। তার মানে সমর বর্মনের কানে কি কোনও বিশেষত্ব আছে? নাকি এটা নিছক কল্পনা?
পাণ্ডুলিপিটা প্রায় ঘণ্টাদুয়েক পর শেষ করলাম। এমন সময় ঘরের দরজায় নক করার শব্দ শোনা গেল। পাণ্ডুলিপি আর চিঠির বান্ডিলটা ড্রেসিং টেবিলের ওপর রেখে উঠে গিয়ে দরজা খুললাম।
দেখি ইব্রাহিম দাঁড়িয়ে। ওর হাতের ট্রেতে সাজানো ডিনার।
ও ট্রে-টা এনে টেবিলের ওপর রাখল। হঠাৎ লক্ষ করলাম, ওর চোখের দৃষ্টি ড্রেসিং টেবিলের ওপর।
আমার দেখার ভুল?
ও খাবার রেখে ঘর ছেড়ে চলে গেল। তা হলে কি তা হলে কি…।
খাওয়া-দাওয়া সেরে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। অবশ্য তার আগে চিঠির বান্ডিলটা সুটকেসে বন্ধ করে রাখলাম। আর পাণ্ডুলিপিটা বালিশের নীচে রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম।
অনেক রাতে ঘরের ভেতরে কারও চলাফেরার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। সামান্য চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি ঘরের জানলাটা নেই। শুনতে অবাক লাগলেও ঠিক তাই। জানলার জায়গাটা জমাট অন্ধকারে ঢাকা। হঠাৎ সেই জমাট অন্ধকারটা নড়ে উঠল। জানলাটা আবার দেখা গেল।
ছায়ামূর্তিটা ক্রমশ ড্রেসিংটেবিলের দিকে এগোতে লাগল। আমি চুপিচুপি উঠে গিয়ে একলাফে ঘরের বাতিটা জ্বেলে দিলাম। যে-লোকটি হতভম্ব হয়ে চমকে ফিরে তাকাল, তার হাতে একটা ছুরি ঝিকিয়ে উঠল। লোকটি আর কেউ নয়, স্বয়ং ইব্রাহিম!
আমাকে আলো জ্বালতে দেখেই ও তীরবেগে আমার দিকে ছুটে এল। আমার চোখ ছিল ওর হাতের দিকে। নিমেষের মধ্যে দু-হাতে ওর ডানহাতের কবজি চেপে ধরলাম। দুজনেই মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগলাম। আমার আঁকুনিতে ইব্রাহিমের হাতের ছুরি পড়ে গেল মাটিতে। তারপর কেন জানি না ও হঠাৎই নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়োল জানলার দিকে। এবং মুহূর্তের মধ্যেই জানলা পথে সটকে পড়ল।
ইব্রাহিমের পিছু নিয়ে লাভ নেই জেনে সে-চেষ্টা আর করলাম না। এগিয়ে এসে ছুরিটা তুলে নিলাম। সাধারণ ছুরি একটা, কিন্তু বাঁটের ওপর একটা হাতের পাঞ্জা খোদাই করে আঁকা। এখানেও লালপাঞ্জা! ইব্রাহিমও লালপাঞ্জা দলের কমরেড? তাই হয়তো গত বিকেলের অচেতন লোকটিকে দেখে ও একটু অবাক হয়েছিল।
তাড়াতাড়ি গিয়ে সুটকেসটা খুললাম। সর্বনাশ! চিঠির বান্ডিলটা অদৃশ্য হয়েছে। তবু ভালো যে, পাণ্ডুলিপিটা বালিশের নীচে রেখে শুয়েছিলাম।
কিছুক্ষণ পর আবার আলো নিভিয়ে জানলা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। বুঝতে পেরেছিলাম যে, এই রাতে চেঁচামেচি করেও কোনও ফল হবে না। কারণ, ইব্রাহিম নিশ্চয়ই আর কন্টিনেন্টালের চত্বরে বসে নেই!
.
ভোরবেলা ঘুম ভেঙে উঠেই প্রথমে গেলাম ম্যানেজারের ঘরে।
আমাকে দেখেই তিনি বললেন, মিস্টার বোস, (অশোকের নামেই হোটেলে ঘর বুক করেছিলাম আমি। শুনলাম আপনার ঘরে নাকি গত রাতে চোর এসেছিল!
আমি বললাম, না তো! ইব্রাহিম কী একটা জরুরি খবর দিতে ভুলে গিয়েছিল বলে রাত দুটোর সময় খবরটা দিতে একবার এসেছিল।
কী খবর? কী খবর? ব্যগ্র হয়ে উঠলেন ম্যানেজার।
ইব্রাহিমের শাদির নেমন্তন্ন করতে এসেছিল। যাওয়ার সময় ও তাড়াতাড়িতে ওর ছুরিটা নিয়ে যেতে ভুলে গেছে। আপনি কাইন্ডলি ওকে এটা দিয়ে দেবেন। বলে পাশপকেট থেকে ইব্রাহিমের অস্ত্রটা বের করে ম্যানেজারসাহেবকে দিলাম।
এটা যে সত্যি-সত্যিই একটা ছুরি দেখছি! আঁতকে উঠলেন ম্যানেজার।
না, দাঁত খোঁচানোর কাঠি মনে-মনে বললাম আমি, মুখে বললাম, ইব্রাহিম আশা করি হোটেলে আর নেই।
না, পালিয়েছে। সঙ্গে-সঙ্গেই জানালেন তিনি।
চুরি অবশ্য তেমন কিছু যায়নি। তবু খবরটা দিয়ে রাখা ভালো, বললাম আমি, এক বান্ডিল চিঠি নিয়ে গেছে ইব্রাহিম। বোধহয় কোনও নামকরা লোকের নিজের হাতে লেখা এক অমূল্য পাণ্ডুলিপি মনে করেছে ওটাকে। বিবিকে শাদিতে উপহার দেবে হয়তো। চেয়ার ঠেলে উঠলাম আমি।
এমন সময় ম্যানেজার আমতা-আমতা করে প্রশ্ন করলেন, মিস্টার বোস, আপনি কি আমাদের হোটেলে আর থাকবেন?
তার মানে! যেতে গিয়েও ঘুরে তাকালাম আমি।
না, এরকম একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেল…।
ওঃ– হেসে ফেললাম আমি : আপনিশুদ্ধ সবকটা বেয়ারাও যদি আমার ঘরে চুরি করতে ঢোকেন, তবু আমি এ-হোটেল ছাড়ছি না, আন্ডারস্ট্যান্ড?
ম্যানেজারকে উত্তর দেওয়ার কোনও সুযোগ না দিয়েই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম।
ওপরে ঘরে গিয়ে ব্রেকফাস্ট সবে শেষ করেছি, এমন সময় ফোন বেজে উঠল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও রিসিভার তুলে নিলাম।
হ্যালো–
স্যার, ডেস্ক ক্লার্কের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, এক ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।
কী নাম? অবাক হয়ে জানতে চাইলাম আমি।
মিস্টার…। মিনিটখানেক নীরবতার পর আবার গলা শোনা গেল, স্যার, আমি ভদ্রলোকের কার্ড আপনার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
ফোন নামিয়ে রাখার একটু পরেই দরজায় নক করার শব্দ পেলাম। দরজা খুলতেই একজন বেয়ারা একটা কার্ড দিল আমার হাতে। তাতে লেখাঃ
শ্রীনরসিংহ দত্তরায় সেন চৌধুরী
বার-অ্যাট-ল
ডেক্স ক্লার্কের নীরবতার কারণ এখন বুঝতে পারলাম না। যা হোক, মনে-মনে নরসিংহবাবুর বাবাকে ছেলের নামকরণের জন্যে কয়েক হাজার ধন্যবাদ জানিয়ে বেয়ারাটিকে বললাম, বাবুকে ডেকে দাও–আমি দেখা করব।