ও, এবার বুঝেছি, ব্যঙ্গের হাসি ঠোঁটের কোণে ফুটিয়ে সুচরিতা বলল, তা হলে কবুতরে গিয়ে আমাকে ওই ভদ্রলোককে কবজা করতে হবে, যাতে তিনি আমার ছলাকলায় মুগ্ধ হয়ে ওই ম্যানাস্ক্রিপ্ট পাবলিশার্সের কাছে না দেন!
বুঝতেই তো পারছ, সুচরিতা। এতে তোমারও স্বার্থ আছে। তুমি কি চাও যে, ওই ম্যানাস্ক্রিপ্ট ছেপে বেরোক?
দ্যাখো তরুন, সত্যি কথা বলতে গেলে আমি তা চাই না। কিন্তু তা বলে মনের দ্বিধাকে কাটিয়ে উঠতে পারল না সুচরিতা, বলল, যাকগে, আমি সোজাসুজি মানেকজিকেই আমার মত জানাব।
আচ্ছা, সুচরিতা, একটা কাজ করলে হয় না?
কী? অবাক হয়ে তরুণের মুখের দিকে তাকাল সুচরিতা। পাণ্ডুলিপি সম্বন্ধে তরুণ বোধহয় নতুন কিছু বলবে।
চলো না, আমরা দুজন একটু বেড়িয়ে আসি। মানেকজিকে গিয়ে বললেই হবে যে, আমি এতক্ষণ তোমার সঙ্গে কথা বলছিলাম।
না, তরুণ, আমার ঠিক মুড নেই। তা ছাড়া সময় কোথায়!
হুঁ, সময় তোমার আর কোনওদিনই হবে না। কবে তোমার মত পালটাবে বলতে পারো, সুচরিতা!
আচ্ছা, তরুণ, গতকাল সঁদনী চকের কাছে তোমাকে একটি মেয়ের সঙ্গে দেখলাম…ওই মেয়েটি কে?
মুহূর্তের মধ্যে তরুণ স্যানালের মুখের রং পালটে গেল। আমতা-আমতা করে বলল, ও কিছু নয়। তুমি কি জানো না সুচরিতা, ভালো আমি তোমাকেই বাসি!
মনে-মনে হাসল সুচরিতা। এ ধরনের লোকদের দেখলে ওর রাগ হয়। এইজন্যই আজকাল ওর আর কিছুই ভালো লাগছে না। চারপাশে সব স্তাবকের দল স্বার্থসিদ্ধির জন্য দিনরাত প্রশংসা করে চলেছে। উঃ! মুখে বলল, তরুণ, তুমি এখন যাও। আমাকে একটুখানি একা থাকতে দাও–।
তারপর শোওয়ার ঘরের দিকে পা বাড়াল ও।
তরুণ সান্যাল হতাশভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ঘর ছেড়ে যাওয়ার সময় দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিয়ে গেল।
সুচরিতা শুয়ে-শুয়ে ভাবছিল অমিতের কথা। সুরেন্দ্র পালিতের পাণ্ডুলিপি যদি ছাপা হয় তবে কি ও বিপদে পড়বে? অথবা অমিত চৌধুরীর চরিত্রে দাগ পড়বে? না, কিচ্ছু ভাবতে পারছে
সুচরিতা। এ ছাড়াও কানাঘুষোয় ও আঁচ পেয়েছে যে, সমর বর্মন নাকি ওইদিনের মিটিংয়ে হাজির থাকছে। কারণ? কারণটা ঠিক পুরোপুরি জানে না সুচরিতা। তবে শুনেছিল যে, গত বছরের মিটিংয়ে সুরেন্দ্র পালিত অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিলেন। রানী সুলক্ষণার গলায় যে হীরের নেকলেস ছিল, সেটা কোনওরকমে সরিয়ে সুরেন্দ্র পালিত এতদূরে এসে এই কবুতরেই লুকিয়ে রেখেছিলেন–ওই মিটিংয়ের দিনই। অথচ সেই নেকলেস চুরির দায় চাপিয়ে দিয়েছিলেন সমর বর্মনের ঘাড়ে। সত্যিই সাংঘাতিক কূটবুদ্ধির লোক ছিলেন এই সুরেন্দ্র পালিত।
সুরেন্দ্র পালিত চলে যাওয়ার কিছুদিন পর কবুতরের মালি লাইব্রেরি-ঘরে একজন লোকের মৃতদেহ পায়। মৃত লোকটির পকেটে লালপাঞ্জা দলের প্রতীকচিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল। তার মানে হীরের নেকলেসটার কথা সবাই জানে। আগামী মিটিংয়ে বর্মন যদি কারও ছদ্মবেশে আসে– তবে? নাঃ–এই অশোক বোস নামের ভদ্রলোকটির সঙ্গে একবার দেখা হওয়া দরকার। এবং কালই।
.
লোকটির অচেতন দেহটা নিয়ে কী করব তাই ভাবছিলাম, এমন সময় ঘরে ঢুকল ইব্রাহিম।
ইব্রাহিম হোটেল কন্টিনেন্টালের বেয়ারা। ও-ই আমার ঘর অ্যাটেন্ড করে। ও ঘরে ঢুকে অত্যন্ত অবাক হয়ে গেল, বলল, স্যার–এ কী কাণ্ড!
আমি কেটে যাওয়া ঠোঁটের কোনাটা রুমাল দিয়ে মুছে নিচ্ছিলাম, বললাম, তুমি এসেছ ভালোই হয়েছে। আমি আর-একটু হলেই একে জানলা দিয়ে ফেলে দিতাম। একে নিয়ে গিয়ে হোটেলের বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দাও।
ইব্রাহিম চায়ের কাপ টেবিলে নামিয়ে রেখে লোকটির উপুড় হয়ে পড়ে থাকা দেহটিকে চিত করে দিল। আমি আয়নায় দেখছিলাম কতখানি আহত হয়েছি। হঠাৎ আয়নাতেই লক্ষ করলাম, ইব্রাহিম লোকটিকে দেখে খুব অবাক হয়ে গেছে। কে জানে! হয়তো আমার দেখার ভুল।
একটু পরেই লোকটিকে কোথায় যেন রেখে ইব্রাহিম আমার ঘরে ফিরে এল। এসে ঘর পরিষ্কার করতে শুরু করল। ঘর সাফসুতরো হয়ে গেলে ওকে পাঁচটা টাকা দিলাম। ও চলে গেল।
হাতঘড়ির দিকে তাকালাম। সন্ধে ছটা। দারুণ কৌতূহল হচ্ছে ওই পাণ্ডুলিপি আর চিঠিগুলো নিয়ে। আজ পড়ব, কাল পড়ব, করেও সময় করে উঠতে পারিনি। এখন হাতমুখ ধুয়ে দরজা বন্ধ করে সুটকেশ খুললাম। দুটো প্যাকেটই বের করলাম।
প্রথমে চিঠির বান্ডিলটা ধরলাম। দু-একটা চিঠি উলটেপালটে দেখলাম। নিছকই প্রেমপত্র। আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে ভরা। লেখিকা মিসেস সুচরিতা চৌধুরী। আর চিঠির ওপরে কোনও নাম উল্লেখ করে সম্বোধন নেই। শুধু মাই ডিয়ার দিয়ে শুরু। তবে একটা বিশেষ চিঠির মধ্যে একটা বাড়ির নামের উল্লেখ করা হয়েছে। কবুতর থেকে চিঠিটা লেখা হয়েছে। আর চিঠির ওপরে দিল্লি শব্দটি লেখা আছে। তার মানে দিল্লিরই কবুতর নামের কোনও বাড়ি থেকে চিঠিটা লেখা। কেউ কি এই চিঠিগুলো নিয়ে সুচরিতা চৌধুরিকে ব্ল্যাকমেল করছিল? সেইজন্যেই কি এগুলো দামি বলেছিল নেপালীটি? যাকগে, যার চিঠি তার দেখা যদি পাই তবে এ-ভার থেকে মুক্ত হওয়া যাবে। বলা যায় না, ভদ্রমহিলা হয়তো আতঙ্কে পাগল হয়ে নিশিদিন কোনও ব্ল্যাকমেলারের অপেক্ষা করছেন।
চিঠিগুলো রেখে পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে পড়লাম।
প্রথম থেকে পড়তে শুরু করলাম।