এই প্রসঙ্গেই ওর মনে পড়ল সুরেন্দ্র পালিতের কথা। তার স্মৃতিকথা লেখার ব্যাপারটা। ম্যানাস্ক্রিপ্টের কথা। হেন ব্যাপার বোধহয় ছিল না, যা সুরেন্দ্র পালিত না জানতেন। এখন যদি ম্যানাস্ক্রিপ্টটা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়, তা হলে! তা হলে যে সর্বনাশ হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কুমার রণজিৎ একেবারে অথৈ জলে পড়বেন, অথৈ জলে পড়বে লালপাঞ্জা দলের কমরেডরাও। আর হ্যাঁ, আর অসুবিধেয় পড়বে সমর বর্মন। তবে সবচেয়ে বেশি অসুবিধেয় পড়বে সিরাজনগর।
সমর বর্মনকে নিজের লাইনে শিল্পী বলা যেতে পারে। লোকটার সঙ্গে সুচরিতার সামনাসামনি পরিচয় নেই, কিন্তু তার সম্বন্ধে এত কথা শুনেছে যে, তার চরিত্র সুচরিতার কাছে একটুও অচেনা নয়। লোকটা বহুবার প্রমাণ করেছে চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা। এরকম নিখুঁত টাইপের হীরে চোর ও ব্ল্যাকমেলার কেউ বোধহয় কোনওদিন দেখেনি। সুরেন্দ্র পালিত বহুবার সমর বর্মনকে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। অনেক চেষ্টার পর সফলও হয়েছিলেন। সমর বর্মন জেলে গিয়েছিল তিন বছরের জন্য।
কিন্তু এখন? হ্যাঁ, এর মধ্যে তার মেয়াদ সম্পূর্ণ হয়ে সে বোধহয় ছাড়া পেয়ে গেছে। এই বর্মন লোকটা ছদ্মবেশ নিতে এত ওস্তাদ যে, ধারণার বাইরে। এককথায়, সমর বর্মন তার লাইনে সম্রাট। সে যখন সুরেন্দ্র পালিতের হাতে ধরা পড়েছিল তখন সুরেন্দ্র পালিত নিশ্চয়ই তাঁর স্মৃতিকথায় বর্মন সম্পর্কে অনেক কথাই লিখে গিয়েছেন, যা পুলিশ জানতে পারলে বর্মন মুশকিলে পড়বে।
সিরাজনগর যে মুশকিলে পড়বে তারও কারণ আছে। কারণ, কুমার রণজিতের আর্থিক অনটনের কথা বাইরের কেউই বিশেষ জানেন না। জানলে কুমার রণজিৎ সারা ভারতের কাছে ছোট হয়ে যাবেন। কিন্তু সুরেন্দ্র পালিত যদি এই সব ব্যাপারে খোলসা করে লিখে গিয়ে থাকেন ওই পাণ্ডুলিপিতে? নাঃ, পরের ব্যাপার আর ভাবতে পারছে না সুচরিতা। এখন যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে, সত্যিই সাঙ্ঘাতিক।
আবার অমিতের কথা মনে পড়ল সুচরিতার। ভালোবাসা কথাটার প্রকৃত সংজ্ঞা সুচরিতা জানে না। অনেকেই এখন ওকে পাওয়ার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। সুচরিতা তাতে হেসেছে। যদিও অত্যন্ত স্বাভাবিক এই ব্যাপারটা। কারণ ওর তিরিশ বছরের সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব, কটাক্ষ, চেহারা ইত্যাদিকে অবহেলা করা কোনও পুরুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এখনও কোনও-কোনও বিজ্ঞাপনের কাজে সুচরিতা নিজের অমূল্য সময় খরচ করে। নাম করা সিনেমার কাগজেও ওর ছবি মাঝে-মাঝে ছাপা হয়। তবু একটা কিছুর অভাব যেন ও বুঝতে পারে।
এমন সময় ফ্ল্যাটের বেল বেজে উঠল। চটপট উঠে গিয়ে দরজা খুলে দাঁড়াল সুচরিতা। দরজায় মৃদু হাসি মুখে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তরুণ সান্যাল। ছিপছিপে চেহারার যুবক। চেহারার একটা আকর্ষণ আছে। বয়স সুচরিতার চেয়ে কমই। আটাশ কি উনতিরিশ। তবু ছেলেটা ওর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে চায়। সত্যি, কী বিচিত্র!
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে তরুণ বলল, সুচরিতা, একটা জরুরি খবর নিয়ে এসেছি। মানেকজি পাঠিয়েছেন আমাকে বুঝতেই তো পারছ।
দরজা বন্ধ করে সুচরিতা এসে চেয়ারে বসল। বলল, কী জরুরি খবর, শুনি?
মানেকজি আমাকে আজ সকালে বললেন, তোমাকে ফোন করে একটা খবর দিতে। আমি ফট করে বলে দিলাম ফোন খারাপ আছে, যাতে তোমার সঙ্গে অন্তত দেখাটা হয়। তখন তিনি আমাকে পাঠালেন কুরিয়ার হিসেবে।
তরুণ সান্যাল মানেকজিপ্রসাদজি ফার্মের পার্টনার মানেকজির প্রাইভেট সেক্রেটারি। সারাদিনে বেচারা একদম ছুটি পায় না, খালি ডিক্টেশন আর টাইপ।
রাবিশ বিরক্ত গলায় বলল তরুণ, আমার আর ভালো লাগছে না, সুচরিতা।
কেন, বেশ তো আছ। যাকগে, জরুরি কথাটা নিশ্চয়ই তোমার অজানা নয়? মুচকি হেসে জানতে চাইল সুচরিতা। ও জানে তরুণ সান্যাল বোকা নয়।
তা, মোটামুটি জানি বইকী। ইতস্তত করে বলল তরুণ, তুমি বরং মানেকজির কাছ থেকেই শুনে নিয়ো।
তরুণ! ঈষৎ ভৎর্সনা, কটাক্ষ, চোখের ইশারা-ব্যস ওইটুকুই যথেষ্ট ছিল তরুণের পক্ষে। গড়গড় করে বিগলিতকণ্ঠে বলতে শুরু করল তরুণ, সুচরিতা, ব্যাপারটা সিরাজনগরের সঙ্গে, সুরেন্দ্র পালিতের সঙ্গে কানেক্টেড। অশোক বোস নামে এক ভদ্রলোক দিল্লি আসছেন আগামীকাল। সুরেন্দ্র পালিতের স্মৃতিকথার পাণ্ডুলিপিটা তার কাছেই আছে। তিনি সেটা এখানকার কোনও এক পাবলিশার্সের কাছে পৌঁছে দেবেন। তুমি তো বুঝতেই পারছ–ওই পাণ্ডুলিপি এখন ছেপে বেরোলে সর্বনাশ হবে। সেইজন্যেই মানেকজি আর প্রসাদজি খুব আপসেট হয়ে পড়েছে। তোমার মনে আছে, গত বছর মিস্টার পালিত একবার কবুতর-এ এসেছিলেন, কিছু গোপন ব্যাপার আলোচনা করার জন্যে?
হ্যাঁ মনে আছে। উত্তর দিল সুচরিতা।
কবুতর! প্রসাদজির বাগানবাড়ি। শহরতলিতে বিরাট জায়গা নিয়ে তৈরি এই কবুতর। মাঝে মাঝে গোপন মিটিং থাকলে প্রসাদজি ওই কবুতরকেই ব্যবহার করেন। এবারও সেই তেলের ব্যাপারটা, টাকার ব্যাপারটা, আলোচনার জন্য একটা ঘরোয়া মিটিং ডাকা হয়েছে ওই কবুতরে।
এবারের মিটিংয়ের আলোচনার বিষয় কিন্তু অন্য। কুমার রণজিতও আসছেন। মানেকজি তোমাকেও ওই মিটিং-এ থাকতে বলেছেন। আর…।
তরুণকে ইতস্তত করতে দেখে সুচরিতা হাসল, বলল, শ্রীঅশোক বোসও আশা করি ওই মিটিং-এ আসছেন!
না, এখনও বোধহয় তাঁকে বলা হয়নি। আগামীকাল তিনি এসে হোটেল কন্টিনেন্টালে উঠছেন। তারপর নিশ্চয়ই বলা হবে।