বললাম, তারপর?
তারপর আর কী, সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন, আপনি কি জানেন, আপনি আজ কার জীবনরক্ষা করলেন? আমি বললাম, না–আমি এখানে নতুন এসেছি। তিনি বললেন, আমার নাম সুরেন্দ্র পালিত।…চমকে উঠলাম আমি। কারণ ওই ভদ্রলোক সম্পর্কে কানাঘুষোয় অনেক কথাই শুনেছিলাম। শুনেছিলাম সুরেন্দ্র পালিতই নাকি রাজা শুদ্ধসত্ত্বের পেছনে বসে সবকিছুর কলকাঠি নাড়তেন। যাকগে, তিনি বললেন, আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ–আমার মনে থাকবে। এরপর তিনি আমার নাম-ঠিকানা নিয়ে চলে গিয়েছিলেন।
এতদিন পর হঠাৎ সেদিন–এই দিনদশেক আগে তিনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। খবরের কাগজেই দেখেছিলাম, তিনি কলকাতায় আছেন। গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি তখন ভীষণরকম অসুস্থ। আমাকে দেখে বললেন, মিস্টার বোস, আপনার ওপর আমি খুব বড় একটা কাজের দায়িত্ব দিয়ে যেতে চাই। সিরাজনগরের রাজনীতির সমস্তরকম খেলারই সাক্ষী ছিলাম আমি। প্রচুর গুপ্তকথাও জানতে পেরেছিলাম। আমি আজ আমার স্মৃতিকথার পাণ্ডুলিপিটা আপনার হাতে তুলে দিতে চাই। আপনি দিল্লি যাবেন। সেখানে এক পাবলিশার্স আছে– মেহেতা অ্যান্ড সন্স। তাদের হাতে আপনি এই পাণ্ডুলিপিটা সামনের মাসের মধ্যে তুলে দিলে তারা আপনাকে পনেরো হাজার টাকা দেবে। এইরকমই কথা আছে। আপনি না করবেন না, মিস্টার বোস। আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। সেই কৃতজ্ঞতা শোধ দেওয়ার এই আমার শেষ সুযোগ। আপনি আমাকে নিরাশ করবেন না। কথা দিন আপনি।
আমি কথা দিয়েছিলাম। তখন তিনি আমাকে একটা মোটা পাণ্ডুলিপি দেন। আমি সেটা নিয়ে আমার কাছে রাখি। কিন্তু তারপর থেকে একদম সময় করে উঠতে পারছি না। এর ওপর পরশুদিনই অফিসের কাজে একবার রাজস্থান যেতে হবে। এখন তুই এই কাজের ভারটা নিতে পারিস। পনেরোর মধ্যে পাঁচ হাজার তুই নিস, আর আমাকে বাকিটা দিয়ে দিস–রাজি? অশোক হাসিমুখে তাকাল আমার দিকে।
অশোকের কথাগুলোর মধ্যে কেমন একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছিলাম। তাই সঙ্গে-সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম বললাম, আপত্তির কী আছে! কিন্তু রণজিৎ সেন এখন কোথায়, দিল্লিতে?
ঠিকই ধরেছিস, বলল অশোক, সেখানে কুমার রণজিৎ কয়েকজন বিরাট বিজনেস ম্যাগনেটের সঙ্গে কথা বলতে গেছেন, রাজ্যের অর্থসঙ্কট কাটিয়ে ওঠার জন্যে। কয়েকজন বিজনেসম্যান সিরাজনগরে তেলের কোম্পানি খোলার জন্যে আবেদন জানিয়েছিলেন। সেই ব্যাপারেই রফা করে একটা চুক্তি হবে আর কী। ও চাই তেল, আর এ চায় টাকা। বলে অশোক হাসল।
আচ্ছা, অশোক, রণজিৎ সেন শুদ্ধসত্ত্ব রায়ের ঠিক কীরকম রিলেটিভ হন?
কুমার রণজিৎ শুদ্ধসত্ত্ব রায়ের শ্যালক। ওহ্-হো, আর-একটা কথা তোকে বলতেই ভুলে যাচ্ছিলাম, কাঞ্চন। আমার কাছে কতকগুলো চিঠি আছে। আশ্চর্যভাবেই পেয়েছিলাম ওগুলো। একবার একজন নেপালিকে আমি খুব রিস্ক নিয়ে একটা অ্যাক্সিডেন্ট থেকে বাঁচিয়েছিলাম। কৃতজ্ঞতায় সে একটা চিঠির বান্ডিল আমাকে দিয়েছিল।
হেসে বাধা দিলাম আমি : মাইরি, একটা বই লেখ তুই, যাহাদের আমি প্রাণরক্ষা করিয়াছি।
শোনই না আগে! লোকটি আমাকে যা বলল, তা হল যে, ওই চিঠিগুলো সে একটি লোকের কাছ থেকে পায়। লোকটির পকেটে সে নাকি একটা লালপাঞ্জার ছাপওয়ালা কাগজ দেখতে পায়। লোকটি গুরুতর অসুস্থ ছিল। সে মারা যাওয়ার আগে শুধু বলেছিল ভীষণ দামি চিঠি এগুলো। তাই সে কৃতজ্ঞতায় এগুলো আমাকে দিচ্ছে। যা হোক, পরে আমি এক আশ্চর্য ব্যাপার লক্ষ করি যে, পাণ্ডুলিপির হাতের লেখা আর চিঠির হাতের লেখা একেবারে এক। তবে কি সুরেন্দ্র পালিতই চিঠিগুলো লিখেছেন? কিন্তু চিঠির নীচে সই আছে দিল্লির কোনও এক মিসেস সুচরিতা চৌধুরির। অনেকগুলো চিঠি–আমি আর পড়ে দেখিনি। ওগুলোও তুই নিয়ে আমাকে রেহাই দিস। আর পারলে ওই সুচরিতা চৌধুরীকে চিঠিগুলো ফেরত দিয়ে দিস।
এরপর আমি অশোকের সঙ্গে গিয়ে পাণ্ডুলিপি আর চিঠি নিয়ে অশোকেরই বুক করা এয়ার টিকেটে দিল্লি রওনা হই। তা এই অতি সামান্য কাজের জন্যে পাঁচ হাজার টাকা বা মন্দ কী? কিন্তু তখন কি জানতাম, কী সাঙ্ঘাতিক বিপদ হায়েনার মতো হাঁ করে বসে রয়েছে আমারই জন্যে– দিল্লিতেই!
.
ঘরের জানলা দিয়ে বিষণ্ণ দৃষ্টি মেলে রাস্তার দিকে তাকিয়েছিল সুচরিতা চৌধুরী। এ-জীবন আর ভালো লাগছে না। ওর মনে পড়ছিল সিরাজনগরের দিনগুলোর কথা। সেখানে সামরিক বাহিনীর অধিনায়ক ছিল অমিত-অমিত চৌধুরী। ওর কথা মনে পড়লে মাঝে-মাঝে এই পোড়া মনটা বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। হয়তো একথা সত্যি যে, অমিত সুচরিতাকে ভালোবাসেনি– যন্ত্র হিসেবেই দেখেছে চিরকাল। অথচ কী যে হয়েছিল ওই আঠেরো বছর বয়েসটায়! সব ছেড়ে ছুঁড়ে দিয়ে অমিতকেই হৃদয়ের সিংহাসনে বসিয়েছিল ও। বিয়ের পর স্বামীর জন্য সবরকম কাজই করেছে। উঃ–সেই বিপ্লবের রক্তাক্ত দিনগুলো, যেদিন শেষবারের মতো আর্তনাদ করে উঠেছিল অমিত। ওর মনে পড়ল লালপাঞ্জা দলের কথা। আজ পর্যন্ত ও সে-দলের কাউকেই দেখেনি। তবে একটা কাগজ দেখেছিল অমিতের কাছে তাতে একটা পাঞ্জার ছাপ ছিল লাল রঙের। সেটা নিশ্চিত বিপদের ইশারা বয়ে এনেছিল।
অমিতের মৃত্যুর পর যখন ও সিরাজনগর ছেড়ে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য দিল্লির দিকে পা বাড়িয়েছিল, সেইসময় ওকে রণজিৎ সেন ডেকে পাঠিয়েছিলেন। অমিত চৌধুরীর একনিষ্ঠ সাহায্যের প্রতিদান দিতে তিনি যে অক্ষম সে কথাই জানিয়েছিলেন। বারবার করে। সুচরিতা লজ্জা পেয়েছিল। এর পরই ও দিল্লিতে চলে আসে। টাকার অভাব ওর ছিল না–এখনও নেই। কিন্তু একটা ব্যাপারে ও ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছে।