ছায়ামূর্তিটা মন দিয়ে কথা শুনছিল। শেষে সে বলল, আমাকে কি করতে হবে বলো?
-কি আর করবা। যদি কিছু ধার হিসাবে দিতে পার দাও। আমি শোধ দিয়ে দেব।
-টাকা আমি দিতে পারি কিন্তু তোমার কাছ থেকে ঘুরোণ নেব না। তুমি আমার কোথায় আছে তা আমি কি করে তোমাকে বোব। লোকটা ব্যাকুল হয়ে উঠল মেয়েমানুষের হাতটাকে বুকের কাছে টেনে এনে।
হাত ছাড়িয়ে নিল না মহিলা। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, আর আসে না কেন? বউদি বুঝি মানা করেছে।
–তার মানা আমি শুনব না। সে কে? সে আমাকে ভালোবাসে না। লোকটির গলায় উত্তেজনা ছেয়ে গেল।
বউটি নির্দ্ধিধায় বলল, বউদি বড়ো হিংসুটে। শুধু তাই নয়-দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝে না। তোমার সাথে কথা বলি বলে আমাকে তো দু-চোখে দেখতে পারে না।
লোকটি সাদা জামার পকেট হাতড়ে পঁচিশ টাকা বউটির হাতে ধরিয়ে দিল।
বউটি টাকাটা স্পর্শ করে কেঁদে উঠল, আজ আমি ভিখিরি, অথচ একদিন আমার সব ছিল। আসলে কি জান, এসব হল ভগবানের মার। হরিয়া আমাকে জান দিয়ে ভালোবাসত, একদিন পুকুরে সে আমাকে ডুব দিয়ে জড়িয়ে ধরল। জলের মধ্যে আমি তাকে বাধা দিতে পারছি না। সে-ও আমাকে ছাড়বে না। দিলাম ওর হাত কামড়ে। দাঁত বসে গেল। শিরা কেটে গিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত। হরিয়া জলের উপর উঠে আমার দিকে ভ্যাল ভ্যাল করে তাকাল। ওর চোখে জল। আমাকে অভিশাপ দিল। তুই কুনোদিন সুখী হবি না। আমাকে কাদালি, তুইও কাঁদবি। হরিয়া চলে গেল। সেই থেকে আমি কাঁদছি।
-হরিয়াকে তো এখন আর দেখি না?
-সে আছে। তবে তার মাথার ঠিক নেই। আমার যেদিন বিয়ে হল সেদিনও মরতে গিয়েছিল। যমরাজ ওকে নেয়নি। আমবাগানে ফাস নিতে যাওয়ার সময় বাহ্যি করতে যাওয়া একজন মুরুব্বি তাকে দেখে ফেলে। সে-ই বাঁচায় তাকে। তারপর থেকে ও পাগল। রাত বেরাতে গান গেয়ে গেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ফেরে। জানো, ওর অভিশাপ আমার গায়ে লেগেছে। মাঝে সে আমার কাছে এসেছিল মদ খেতে। আমি ওকে ফিরিয়ে দিয়েছি। মহিলাটি চোখের জল মুছে নিয়ে ক্লান্ত স্বরে বলল, এবার আমি যাই। ছেলেটাকে পড়শির ঘরে রেখে এসেছি। তুমি কবে আসবে। তুমি না এলে আমার মন কাঁদে।
বউটি চলে যাওয়ার পর লোকটি দেশলাই ঠুকে একটা বিড়ি ধরাল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে কি সব বিড়বিড় করতে করতে কোয়ার্টারের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
প্রথমেই গলার স্বর শুনে অবনীকে চিনতে পেরেছে শুভ। বউটিও তার চেনা, দাসপাড়ার স্বামী খেদানো পদ্ম। পদ্মর সাথে তার বাবার এই অযাচিত ঘনিষ্ঠতার কোনো অর্থ বুঝতে পারে না শুভ। মার ব্যবহারে বাবা যে তিতিবিরক্ত এটা সে টের পেয়েছে। মাঝে মাঝে মাকে তার নিষ্ঠুর বা পাথরের নারী বলে মনে হয়। মানুষ এত নির্দয়, হৃদয়হীন হয় কি করে? দয়ামায়া শরীর থেকে হারিয়ে গেলে মানুষের আর কি অবশিষ্ট থাকে?
পদ্ম অবনীকে দুর্দিনে ছায়া দেয়। এই ছায়াটাই ভালোবাসা। এই ভালোবাসা একদিন আগুন হয়ে জ্বালিয়ে দেবে সুস্থির সংসার। ভুসোকালির মতো সারা গায়ে জড়িয়ে যাবে কলঙ্ক। এত জেনেও মানুষ তবুও ভালোবাসে, সে লটকান ঘুঘুপাখির মতো ছটফট করে।
আজ অবনীর সেই ছটফটানি প্রত্যক্ষ করেছে শুভ। পদ্মও বিচলিত ছিল নানা কারণে। হরিয়ার অভিশাপ তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। হরিয়াকে সে আজও ভুলতে পারেনি।
হাবাগোবা অবনীকে শুভর এখন কেমন অন্যরকম লাগছে। ভালোবাসা কি তাহলে কদবেল গাছের আশেপাশে আত্মগোপনকরে থাকা বেতরিস সাপ? এই শেতবরিস সাপ কি সবার বুকের ভেতর ফণা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে? হাসপাতালের সামনে এসে শুভর মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। সে দৌড়াতে দৌড়াতে হাজির হল আজারবাবুর কোয়ার্টারের সামনে। মাধুরীকে এত কঠিন কথা বলা তার উচিত হয়নি। মাধুরী দুখ পেয়েছে। সে কারোর দুঃখের কারণ হতে চায় না। তার পৃথিবীতে সামান্য হলেও মাধুরীর একটা জায়গা আছে। সেই জায়গাটাকে সে কিছুতেই নষ্ট হতে দেবে না। যত দিন বাঁচবে, আগলে রাখবে যেমন নদীর জলকে আগলে রাখে পাড়, মাটি, শেকড় সমেত বৃক্ষ।
শুভ অধীর হয়ে ডাকল, মাধুরী, মাধুরী, আমিই-ই-ই-ই। দরজা খোল। ঘেরা বারান্দায় ঠোঁটে হাসি ফোঁটাল বনশ্রী, আয়, ঘরে আয়।
সংকোচের সঙ্গে শুভ বলল, আজ আর ঘরে ঢুকব না। মাধুরীর সঙ্গে দেখা করে চলে যাব।
-বাপ রে, এত কিসের তাড়া?
শুভ উত্তর না দিয়ে নীরব চোখে তাকাল।
বনশ্রী বললেন, তোদের মধ্যে কি হয়েছে রে? তোদের ওখান থেকে ফিরে মাধুরী একেবারে হলো বেড়ালের মতো মুখ ফুলিয়ে বসে আছে।
-কিছু হয়নি তো।
-লুকাচ্ছিস? বনশ্রী চাপা গলায় শুধালেন, তোরা আজকালকার ছেলেমেয়েরা বড্ড বেশি নিজেদের চালাক ভাবিস–তাই না?
শুভ রীতিমতো অপ্রস্তুত, না, তা নয়। ওর সাথে আমার কিছু হয়নি। মাধুরী এত ভালো মেয়ে, ওর সাথে ঝগড়া করা যায় না।
তাই নাকি? অদ্ভুত কায়দায় চোখ নাচালেন বনশ্রী, অথচ ঘরে ও প্রতি কথায় ঝগড়া করে। আমাকে মোটে পাত্তা দেয় না। আমি ওর মা। অথচ ওকে ঠিক বুঝতে পারি না।
কাউকে চেনা কি সহজ কথা? ভাবল শুভ। অবনীকে সে কি চিনত–আজ একটু আগে যেমন চিনল। রাত্রি চেনা সহজ, মানুষ চেনা কঠিন। সব মানুষের মনে হাজারটা জানলা থাকে। তার কোনোটা দিয়ে আলো আসে তো-অন্যটা দিয়ে অন্ধকার। এর হিসাব রাখা বড়ো কঠিন।