- বইয়ের নামঃ যুক্তিবাদীর চোখে রাম ও রামায়ণ
- লেখকের নামঃ অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃইতিহাস
যুক্তিবাদীর চোখে রাম ও রামায়ণ – অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
.
উৎসর্গ : আমার জীবনসঙ্গী শ্ৰীমতী তন্দ্রা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আমার সুপুত্র আয়ুধ বন্দ্যোপাধ্যায়কে
.
সূচিমুখ
- গোড়ার কথা : ইতিহাস ও ধর্মকথার দ্বন্দ্ব
- রামায়ণ কি ইতিহাস, নাকি রূপক?
- ‘নরচন্দ্রমা’ শ্রীরামচন্দ্র : ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসক? ভগবান? ঐতিহাসিক মানুষ?
- দশরথ : পক্ষপাতদোষে দুষ্ট, বিষয়াসক্ত, কামার্ত, স্ত্রৈণ রাজা
- সীতা : তেজস্বিনী, পতিব্রতা এবং নার্সিসিস
- রাবণ : প্রাজ্ঞ, বেদজ্ঞ, নির্ভীক বীর, কামুক শিরোমণি এবং অপরিমাণদর্শী।
- লক্ষ্মণ : কর্তব্যনিষ্ঠ, ক্রোধী, বলশালী, অকুতোভয় এবং স্পষ্টবক্তা
- বাল্মীকি : মহাকবি, মহাঋষি এবং আর্যায়নের প্রতিনিধি
- রামায়ণে মুনি-ঋষি-ব্রাহ্মণের আধিপত্য
- রামায়ণের পার্শ্বচরিত্র : ইন্দ্রজিৎ, কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ, মন্দোদরী, শত্রু, শান্তা, মন্থরা, লবকুশ, মারীচ, শূর্পণখা, অহল্যা
- বানর এবং হনুমান : মানুষ না ভগবান, নাকি মানবেতর প্রাণীমাত্র?
- রাক্ষস-খোক্ষস : বাস্তবে এবং অবাস্তবে
- যাঁরা রামায়ণেও আছেন, মহাভারতেও আছেন
- রামায়ণে অস্ত্র এবং শস্ত্র
- রামায়ণের খাদ্যতালিকা
- রামায়ণে বিমানের ব্যবহার
- শেষ পাতে, শেষ কথা
.
কথামুখ
রামায়ণের কাহিনি সমগ্র সমগ্র বিশ্বমানবের চিত্তের রসায়নস্বরূপ এমন কয়েকটি কাহিনির মধ্যে অন্যতম প্রথম শ্রেণির কাহিনি। প্রাচীন ভারতে ভারতবিদ্যার আধুনিক রীতির আলোচকদের মতে অন্তত আড়াই হাজার বছর আগে ভারতে আর্যভাষায় রামায়ণ-কথা তার প্রথম রূপ প্রকাশ করেছে। পরে ভারতের মধ্যেই বিভিন্ন সাহিত্যিক ও মৌখিক রূপভেদকে আশ্রয় করে রামায়ণ কাহিনিটি পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত হয়। ভারতের বিভিন্ন কথ্য ভাষায় প্রচলিত মৌখিক রূপগুলোর বিলোপসাধন না-করে, বরং সেগুলোকে অতিক্রম করে বাল্মীকির নামের সঙ্গে জড়িয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত রামায়ণরূপে এই কাহিনি এমন একটি চিরস্থায়ী মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে, যা কেবল ভারতীয় মানুষের পক্ষে নয়, বিশ্বের সকলের পক্ষেও এক অতি মহৎ সাহিত্যিক আকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের সভ্যতার সঙ্গে রামায়ণের নাড়ীর যোগ আছে। ভারতের ভারতত্ত্ব প্রকাশিত হয়েছে রামায়ণ, সেইসঙ্গে মহাভারতের মাধ্যমেই।
সমগ্র বিশ্বে প্রায় ৩০০ টি রামায়ণের সংস্করণ পাওয়া গেছে বিভিন্ন ভাষায়। প্রতিটি সংস্করণই একে অপরের থেকে পৃথক। ফলে কোন্ রামায়ণ যথার্থ, কোন্ রামায়ণ নয়–সেটা ভক্তিভাবে বোঝা মুশকিল। যুক্তিভাবে বুঝতে হবে। যদিও সবকটি রামায়ণই সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে মান্য, তা সত্ত্বেও গোটা দেশে তুলসীদাসের রামায়ণের মাহাত্ম্যই বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। সংস্কৃত ভাষায় বাল্মীকির রামায়ণ ও বাংলা ভাষায় কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণ এই দুটি পৃথক গ্রন্থ। তুলসীদাসের কোসলী (হিন্দি) রামায়ণ, যাঁর কবিপ্রদত্ত নাম হল শ্রীরামচরিতমানস’, এটিও আর-একটি পৃথক রামায়ণ। এই রামায়ণে বাল্মীকির রামায়ণকে অনুসরণ করা হয়েছে সামান্যই। তুলসীদাস স্বয়ং লিখছেন–“নানা-পুরাণ-নিগমাগম-সম্মতং যদ্/ রামায়ণে নিগদিতং, কচিদন্যতোহপি-/ স্বান্তঃ সুখায় তুলসী রঘুনাথগাথা-ভাষা-নিবন্ধমতিমঞ্জুলমাতনোতি।” অর্থাৎ, শ্ৰীযুক্ত সতীশচন্দ্র দাশগুপ্তের বঙ্গানুবাদ–“অনেক পুরাণ, বেদ ও শাস্ত্রসম্মত যে কথা রামায়ণে আছে, আরও অন্যত্র হইতে (নিজের অনুভব) একত্র করিয়া, নিজের অন্তরের সুখের জন্য রঘুনাথজীর গাথা, ভাষায় মনোহর ছন্দাদিরূপে বিস্তারপূর্বক তুলসী রচনা করিতেছে।” এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, স্বয়ং তুলসীদাস বলছেন ‘নিজ অনুভব ও কবি-কল্পনার প্রয়োগে তাঁর শ্রীরামচরিতমানস’ রচিত হয়েছে। অতএব এইসব কবিদের রামায়ণ থেকে রাম ও রামায়ণের মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। কারণ যে ভক্তিরস এইসব কবিদের রচনা প্রবাহিত হয়েছে, তা দিয়ে প্রকৃত রামকে ছোঁয়া যাবে না। এহেন ভক্তি প্রবাহ বাল্মীকির রামায়ণে নেই। সেই কারণেই আমার এই গ্রন্থটি বাল্মীকির রামায়ণ অনুসারেই মূল্যায়ন করা হয়েছে। বাল্মীকির রামায়ণকে ভিত্তি করেই আমার বিশ্লেষণ।
রামায়ণ–কারোর কাছে ইতিহাস, কারোর কাছে নিছকই রূপকথা, আবার কারোর কাছে শুধুই ধর্মগ্রন্থ। রাম কারোর কাছে মনুষ্যমাত্র, কারোর কাছে ভগবান। মহাকবি বাল্মীকির রামায়ণ যতটাই ইতিহাস, অন্যান্য কবিদের রচিত রামায়ণগুলি ততটাই রূপকথায় পর্যবসিত হয়েছে। অন্যান্য কবিগণ তাঁদের কাব্যে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে বাল্মীকির রামায়ণকে বিকৃত করেছেন। আর আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন রামকে দেবতার বানানোর। শুধু রামই নয়–লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন, সীতা, বশিষ্ট, বিশ্বামিত্র, রাবণ, বানর, হনুমান, রাক্ষস প্রমুখ সমস্ত চরিত্রগুলিকেও ভগবান বা দেবতা বানিয়ে ছেড়েছেন অলৌকিক কাহিনির মধ্যে দিয়ে। এই কারণেই রাম ও রামায়ণকে নিয়ে এত বিভ্রান্তি, এত বিতর্ক। বাল্মীকির রামায়ণে কোনো চরিত্রই ভগবান বা দেবতা নন, এমনকি অবতারও নন৷ সকলেই দোষেগুণে সাধারণের মধ্যে অসাধারণ মানুষ। বাল্মীকি রামায়ণে যে অতিরঞ্জিত নেই, একথাও হলফ করে বলা যায় না। রাজকাহিনি বা রামকাহিনি লিখতে গিয়ে অনেকেই অতিরঞ্জিত করে থাকে নানা কারণে।