- বইয়ের নামঃ যুক্তিবাদীর চোখে রাম ও রামায়ণ
- লেখকের নামঃ অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃইতিহাস
যুক্তিবাদীর চোখে রাম ও রামায়ণ – অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
.
উৎসর্গ : আমার জীবনসঙ্গী শ্ৰীমতী তন্দ্রা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আমার সুপুত্র আয়ুধ বন্দ্যোপাধ্যায়কে
.
সূচিমুখ
- গোড়ার কথা : ইতিহাস ও ধর্মকথার দ্বন্দ্ব
- রামায়ণ কি ইতিহাস, নাকি রূপক?
- ‘নরচন্দ্রমা’ শ্রীরামচন্দ্র : ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসক? ভগবান? ঐতিহাসিক মানুষ?
- দশরথ : পক্ষপাতদোষে দুষ্ট, বিষয়াসক্ত, কামার্ত, স্ত্রৈণ রাজা
- সীতা : তেজস্বিনী, পতিব্রতা এবং নার্সিসিস
- রাবণ : প্রাজ্ঞ, বেদজ্ঞ, নির্ভীক বীর, কামুক শিরোমণি এবং অপরিমাণদর্শী।
- লক্ষ্মণ : কর্তব্যনিষ্ঠ, ক্রোধী, বলশালী, অকুতোভয় এবং স্পষ্টবক্তা
- বাল্মীকি : মহাকবি, মহাঋষি এবং আর্যায়নের প্রতিনিধি
- রামায়ণে মুনি-ঋষি-ব্রাহ্মণের আধিপত্য
- রামায়ণের পার্শ্বচরিত্র : ইন্দ্রজিৎ, কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ, মন্দোদরী, শত্রু, শান্তা, মন্থরা, লবকুশ, মারীচ, শূর্পণখা, অহল্যা
- বানর এবং হনুমান : মানুষ না ভগবান, নাকি মানবেতর প্রাণীমাত্র?
- রাক্ষস-খোক্ষস : বাস্তবে এবং অবাস্তবে
- যাঁরা রামায়ণেও আছেন, মহাভারতেও আছেন
- রামায়ণে অস্ত্র এবং শস্ত্র
- রামায়ণের খাদ্যতালিকা
- রামায়ণে বিমানের ব্যবহার
- শেষ পাতে, শেষ কথা
.
কথামুখ
রামায়ণের কাহিনি সমগ্র সমগ্র বিশ্বমানবের চিত্তের রসায়নস্বরূপ এমন কয়েকটি কাহিনির মধ্যে অন্যতম প্রথম শ্রেণির কাহিনি। প্রাচীন ভারতে ভারতবিদ্যার আধুনিক রীতির আলোচকদের মতে অন্তত আড়াই হাজার বছর আগে ভারতে আর্যভাষায় রামায়ণ-কথা তার প্রথম রূপ প্রকাশ করেছে। পরে ভারতের মধ্যেই বিভিন্ন সাহিত্যিক ও মৌখিক রূপভেদকে আশ্রয় করে রামায়ণ কাহিনিটি পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত হয়। ভারতের বিভিন্ন কথ্য ভাষায় প্রচলিত মৌখিক রূপগুলোর বিলোপসাধন না-করে, বরং সেগুলোকে অতিক্রম করে বাল্মীকির নামের সঙ্গে জড়িয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত রামায়ণরূপে এই কাহিনি এমন একটি চিরস্থায়ী মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে, যা কেবল ভারতীয় মানুষের পক্ষে নয়, বিশ্বের সকলের পক্ষেও এক অতি মহৎ সাহিত্যিক আকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের সভ্যতার সঙ্গে রামায়ণের নাড়ীর যোগ আছে। ভারতের ভারতত্ত্ব প্রকাশিত হয়েছে রামায়ণ, সেইসঙ্গে মহাভারতের মাধ্যমেই।
সমগ্র বিশ্বে প্রায় ৩০০ টি রামায়ণের সংস্করণ পাওয়া গেছে বিভিন্ন ভাষায়। প্রতিটি সংস্করণই একে অপরের থেকে পৃথক। ফলে কোন্ রামায়ণ যথার্থ, কোন্ রামায়ণ নয়–সেটা ভক্তিভাবে বোঝা মুশকিল। যুক্তিভাবে বুঝতে হবে। যদিও সবকটি রামায়ণই সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে মান্য, তা সত্ত্বেও গোটা দেশে তুলসীদাসের রামায়ণের মাহাত্ম্যই বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। সংস্কৃত ভাষায় বাল্মীকির রামায়ণ ও বাংলা ভাষায় কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণ এই দুটি পৃথক গ্রন্থ। তুলসীদাসের কোসলী (হিন্দি) রামায়ণ, যাঁর কবিপ্রদত্ত নাম হল শ্রীরামচরিতমানস’, এটিও আর-একটি পৃথক রামায়ণ। এই রামায়ণে বাল্মীকির রামায়ণকে অনুসরণ করা হয়েছে সামান্যই। তুলসীদাস স্বয়ং লিখছেন–“নানা-পুরাণ-নিগমাগম-সম্মতং যদ্/ রামায়ণে নিগদিতং, কচিদন্যতোহপি-/ স্বান্তঃ সুখায় তুলসী রঘুনাথগাথা-ভাষা-নিবন্ধমতিমঞ্জুলমাতনোতি।” অর্থাৎ, শ্ৰীযুক্ত সতীশচন্দ্র দাশগুপ্তের বঙ্গানুবাদ–“অনেক পুরাণ, বেদ ও শাস্ত্রসম্মত যে কথা রামায়ণে আছে, আরও অন্যত্র হইতে (নিজের অনুভব) একত্র করিয়া, নিজের অন্তরের সুখের জন্য রঘুনাথজীর গাথা, ভাষায় মনোহর ছন্দাদিরূপে বিস্তারপূর্বক তুলসী রচনা করিতেছে।” এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, স্বয়ং তুলসীদাস বলছেন ‘নিজ অনুভব ও কবি-কল্পনার প্রয়োগে তাঁর শ্রীরামচরিতমানস’ রচিত হয়েছে। অতএব এইসব কবিদের রামায়ণ থেকে রাম ও রামায়ণের মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। কারণ যে ভক্তিরস এইসব কবিদের রচনা প্রবাহিত হয়েছে, তা দিয়ে প্রকৃত রামকে ছোঁয়া যাবে না। এহেন ভক্তি প্রবাহ বাল্মীকির রামায়ণে নেই। সেই কারণেই আমার এই গ্রন্থটি বাল্মীকির রামায়ণ অনুসারেই মূল্যায়ন করা হয়েছে। বাল্মীকির রামায়ণকে ভিত্তি করেই আমার বিশ্লেষণ।
রামায়ণ–কারোর কাছে ইতিহাস, কারোর কাছে নিছকই রূপকথা, আবার কারোর কাছে শুধুই ধর্মগ্রন্থ। রাম কারোর কাছে মনুষ্যমাত্র, কারোর কাছে ভগবান। মহাকবি বাল্মীকির রামায়ণ যতটাই ইতিহাস, অন্যান্য কবিদের রচিত রামায়ণগুলি ততটাই রূপকথায় পর্যবসিত হয়েছে। অন্যান্য কবিগণ তাঁদের কাব্যে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে বাল্মীকির রামায়ণকে বিকৃত করেছেন। আর আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন রামকে দেবতার বানানোর। শুধু রামই নয়–লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন, সীতা, বশিষ্ট, বিশ্বামিত্র, রাবণ, বানর, হনুমান, রাক্ষস প্রমুখ সমস্ত চরিত্রগুলিকেও ভগবান বা দেবতা বানিয়ে ছেড়েছেন অলৌকিক কাহিনির মধ্যে দিয়ে। এই কারণেই রাম ও রামায়ণকে নিয়ে এত বিভ্রান্তি, এত বিতর্ক। বাল্মীকির রামায়ণে কোনো চরিত্রই ভগবান বা দেবতা নন, এমনকি অবতারও নন৷ সকলেই দোষেগুণে সাধারণের মধ্যে অসাধারণ মানুষ। বাল্মীকি রামায়ণে যে অতিরঞ্জিত নেই, একথাও হলফ করে বলা যায় না। রাজকাহিনি বা রামকাহিনি লিখতে গিয়ে অনেকেই অতিরঞ্জিত করে থাকে নানা কারণে।
এখন প্রশ্ন হল বাল্মীকির রামায়ণ ইতিহাস হতে বাধা কোথায়? আমরা তো অতিরঞ্জিত ইতিহাসই পাঠ করি। চন্দ্রগুপ্তের ইতিহাস, অশোকের ইতিহাস, বাবরের ইতিহাস, আকবরের ইতিহাস, আরঙ্গজেবের ইতিহাসে আমরা যে সূত্র থেকে পাই, সেগুলি তো অনেকটাই অতিরঞ্জিত ইতিহাস। ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহাসিকদের ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাস পাই একই ব্যক্তির একই ঘটনার। সেগুলি যদি ধ্রুবসত্যের ইতিহাস হয়, সেই ইতিহাস পাঠ্যবইতে পড়ানো হয়, তবে বাল্মীকির রামায়ণ কেন ইতিহাস হিসাবে পড়ানো সম্ভব নয়?
আমার এ গ্রন্থটি বাল্মীকির রামায়ণের উপর আধারিত। এই গ্রন্থের চরিত্র ও কাহিনি বিশ্লেষণ বাল্মীকিকে অনুসরণ করে। আমার আলোচনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বাল্মীকির রামায়ণটি হাতে তুলে নিতে হবে, অন্য কোনো মহাকবির রামায়ণ নয়। অন্য প্রাদেশিক মহাকবিদের রামায়ণের খুচরো কিছু কাহিনি আমি এনেছি তুলনামূলক আলোচনার সুবিধার্থে। একঘেয়েমি কাটাতে এই কাহিনিগুলি মনোরঞ্জনে সাহায্য করতে পারে। শুধু মনোরঞ্জন নয়, নিজের যুক্তিটাকেও শান দিয়ে নিতে পারবেন। আমার এ গ্রন্থে ভক্তির কোনো জায়গায় নেই, যুক্তির পালে হাওয়া দিয়েই এ গ্রন্থ শেষ লাইন পর্যন্ত পৌঁছেছে।
ইতিহাস যখন কাব্যে তখন তা অতিরঞ্জিত হয়, তা যুক্তি হারায়। আর সেই মিথ যদি ধর্মীয় কাহিনি হয়ে ওঠে তাহলে তা শেষপর্যন্ত বিশ্বাস ছাড়া কিছু নয়। আর এখানেই জনমানসে বিভ্রাট ঘটিয়েছে। তার উপর অসংখ্য ভিন্ন ভাষায় রচিত অসংখ্য কবিদের কল্পকথার রং-চড়ানো কীর্তি রামায়ণকে বিতর্কের কেন্দ্রে এনে ফেলেছে। এই বিতর্কের অবসান হওয়ার নয়। তবুও একটা মীমাংসার চেষ্টায় আমার এই বিনম্র প্রয়াস। আদি বাল্মীকির থেকে আধুনিক চন্দ্রাবতীর রামায়ণ পর্যন্ত–সবই আপামর মানুষ হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। রামায়ণ কেবল সনাতন ধর্মাবলম্বীরাই নয়–মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলেরই কাছে আগ্রহের বিষয়। যে যাঁর বিশ্বাসমতো সমাদর করে, পাঠ করে। বস্তুত আমাদের ইতিহাস মূলত রাষ্ট্র পরিবর্তনের ইতিহাস। কোন্ রাজার পর কোন্ রাজার শাসনকাল শুরু ও শেষ হয়েছে, তারই ‘অর্ধসত্য’ বিবরণই আমাদের প্রচলিত ইতিহাস। নানারকম কূট ষড়যন্ত্র, দূরভিসন্ধি, কুটিল, প্রতিহিংসা, রাজনৈতিক দাবাখেলার মধ্য দিয়েই রাজাদের উত্থান-পতন রচিত হয়। রামায়ণের ঘটনাও এই সূত্রের বহির্ভূত নয়।
বৃহৎ ভারতের সমাজজীবনের প্রাণভোমরা রামায়ণ। কৃত্তিবাস, তুলসীদাসের মতো কবিদের দাপটে ভারতের মানুষ বাল্মীকিকে ভুলেই গেছেন। ভারতের অনেক মানুষ আবার রামানন্দ সাগরের দূরদর্শন ধারাবাহিক (সব রামায়ণের বাছাই করা কাহিনি একত্রে) রামায়ণকেই প্রকৃত রামায়ণ মনে করেন। গোটা রাম-কাহিনিটাই যেন কেমন গুলিয়ে গেছে। রামের কথা জানতে হলে, প্রকৃত সত্য উদঘাটন করতে হলে বাল্মীকির বিরচিত রামায়ণ অনুসরণ করা ছাড়া আর কোনো উপায়ান্তর নেই।
বস্তুত রামায়ণ নিয়ে যে-কোনো গবেষণা করা মানে মহাসাগরের জল নিয়ে মহাসাগরের গবেষণা করার সামিল। রামায়ণকে কেন্দ্র করে অসংখ্য গ্রন্থ লেখা হয়েছে। নানা দিক থেকে বিশ্লেষণ হয়েছে, নানা দৃষ্টিকোণ থেকে গবেষণা হয়েছে। এখনও থেমে নেই। বিনির্মাণের পর বিনির্মাণ, এ তো চলতেই থাকে।
প্রাচীন যুগের সঙ্গে আধুনিক যুগকে মিলিয়ে দেখা। স্মরণে রাখতে হবে, মহাকবি বাল্মীকি কোনো ধর্মাবলম্বীদের জন্য কোনো ধর্মগ্রন্থ লিখে যাননি৷ রামায়ণ-মহাভারতকে ধর্মগ্রন্থের মান্যতা দিয়েছেন ব্রাহ্মণ্যবাদীরা, প্রোপাগান্ডা করেছেন ব্রাহ্মণবাদীরাই। যেহেতু গ্রন্থটিতে মানবধর্ম অনেকটা অংশ জুড়ে আছে, আছে রাজধর্মও, গার্হস্থ্য ধর্ম। আছে পরমার্থ–ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষের কাহিনি-সংবলিত ব্যাখ্যা। পরবর্তীতে সময়াসময়ে হিন্দুজাতিদের (হিন্দুধর্ম?) ধর্মগ্রন্থ হিসাবে চিহ্নিত হয়ে যায়। বাল্মীকি যে সময় বসে গ্রন্থখানি সংকলিত করেছিলেন, সে সময় হিন্দুধর্ম বা হিন্দুজাতির ধারণাই তৈরি হয়নি। রামায়ণে কোথাও হিন্দু বা হিন্দুধর্মের উল্লেখ নেই। কোনো ধর্মাবলম্বীদের জন্য এ গ্রন্থ লেখা হয়েছে, এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না রামায়ণে, মহাভারতে। বস্তুত ভারতের সংস্কৃতিই হিন্দুজাতির সংস্কৃতি, সেই বহমান ছবিই উঠে এসেছে রামায়ণে, মহাভারতেও। তাছাড়া রামায়ণ কেবল হিন্দুরাই গ্রহণ করেছেন তা তো নয়, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীরাও নিজেদের মতো করে গ্রহণ করেছেন। আমার মনে হয় একেশ্বরবাদী খ্রিস্ট বা ইসলাম ধর্মাবলম্বীরাও নিজেদের মতো করে গ্রহণ করতে পারত, যদি রামায়ণে ঈশ্বরের বহুত্ববাদ না-থাকত। যাই হোক, রামায়ণ সময় থেকে সময়ান্তরে এসে সংযোজিত হয়েছে সংস্কৃতির নতুন নতুন ধারা। সমৃদ্ধ হয়েছে মহাকাব্যিক ইতিহাস।
কৃত্তিবাস, রঙ্গনাথ, তুলসীদাসের মতো গুণি কবিরা মানুষকে স্বনির্মিত গল্প শুনিয়ে বিভ্রান্ত করেছেন একজনের কাহিনির সঙ্গে অন্য মিল তো দূরের কথা, অমিলই দৃষ্ট হয়। ভাবনাও পৃথক পৃথক। গল্পের থিমও পৃথক পৃথক। কেউ-বা একে অপরের কাহিনি নিজের রচনায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন। যেমন পূর্বজ রচয়িতা রঙ্গনাথের স্বকল্পিত প্রচুর কাহিনি হুবহু নিজের রচনায় যুক্ত করে নিয়েছেন পরবর্তী রচয়িতা কৃত্তিবাস। আবার বাল্মীকির রামায়ণ আর অধ্যাত্ম রামায়ণের সংমিশ্রণে রচিত হয়েছে শঙ্কর কবিচন্দ্রের বিষ্ণুপুরী রামায়ণ’।পরবর্তী রচয়িতারা বাল্মীকিকে তো অনুসরণ করেননি, উলটে বিপরীত পথে হেঁটেছেন। প্রকৃত সত্য ঠেলে সরিয়ে দিয়ে নিজের মতো করে মনগড়া গল্প গেঁথেছেন।এর ফলে একই কাহিনির হাজারো পরিণতিতে তামাম মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছেন। এইসব রচয়িতারা কবি হিসাবে অবিসংবাদিত হলেও রামায়ণকার হিসাবে বিশ্বস্ত নন। এইসব রচয়িতাদের অনেকে অনুবাদক বলেন। আমি অনুবাদক বলতে পারছি না। কারণ এঁরা। কেউই মূল রামায়ণের ভাষান্তর করেননি। এঁরা যাঁর যাঁর ভাষায় নবরূপে লিখেছেন, যেখানে বাল্মীকি কম তিনিই প্রকট। প্রখ্যাত সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যাল তাঁর তথাকথিত অনুবাদগ্রন্থ ‘না-মানুষের পাঁচালী’ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন–“কোনো কাহিনিই অনুবাদ করিনি, কাহিনিগুলি অবলম্বনে বঙ্গভাষাভাষী পাঠকদের উপযুক্ত করে পরিবেশনের চেষ্টা করেছি।” বাল্মীকি-পরবর্তী রচিয়তারা সেই কাজটিই করেছেন।বেশি যেটা করেছেন, তা হল মূল ঘটনাকে যথেচ্ছ বিকৃত করেছেন এবং স্বকল্পিত সুপার ন্যাচারাল গল্প বুনেছেন।একেই বলে খোদার উপর খোদগারি!
সাম্প্রতিককালে অমীশ ত্রিপাঠি নামে একজন ‘বেস্ট সেলার’ লেখক ‘সীতা : মিথিলার যোদ্ধা’, মেহুলার মৃত্যুঞ্জয়ীগণ’, ‘বায়ুপুত্রদের শপথ’, ‘নাগরহস্য’, ‘ইক্ষ্বাকু কুলতিলক’ প্রভৃতি কয়েকখানি গ্রন্থ লিখেছেন পৌরাণিক তথা এপিক কাহিনির আধারে। লেখক সমস্ত ঘটনা কাল্পনিক বলে ঘোষণা দিলেও বিশ্বাসী ভক্তরা যে বর্ণিত ঘটনাগুলি সত্যি বলে মেনে নেবেন না, এমন গ্যারান্টি দেওয়া যাবে না।
বর্তমান ভারতে প্রায় সর্বত্রই ‘রাম রাম’ ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। কে এই রাম? এই রাম বাল্মীকির মানুষ রাম নয়, এ রাম গোস্বামী তুলসীদাসের ‘ভগবান রাম। ব্রাহ্মণ্যধর্মের চেনা সমাজব্যবস্থার ছাঁচটা আদি শঙ্করাচার্যের সময় থেকে প্রয় ৩০০/৪০০ বছর ধরে নিষ্প্রাণতার শিকার হয়েছিল। এই নিষ্প্রাণতা থেকে উদ্ধারের জন্য যে প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল অনেকের মধ্যে তুলসীদাসই অগ্রগণ্য। তাই তুলসীদাসে রাম ব্রাহ্মণ্যবাদের চাহিদা পূরণ করেছেন। বাল্মীকির রাম ঈশ্বরপ্রতিম কোনো অধিনায়ক নন। মহৎ, কিন্তু রজোগুণসম্পন্ন একজন মানুষের যা কিছু দোষগুণ থাকে, বাল্মীকির রামের সবই আছে। কিন্তু তুলসীদাসের রাম ‘পুরুষোত্তম’, যিনি মানুষরূপে বিষ্ণুর অবতার। তাঁর সবকিছুই উত্তম, শ্রেষ্ঠ। তাঁর কোনো দোষই থাকতে পারে না। খণ্ডিত রাজপুরুষ রামের চরিত্রটির প্রেক্ষিতই পালটে দিলেন। হিন্দি আগ্রাসনের ফলে আজকের ভারতীয় সমাজব্যবস্থা স্থাপিত হয়েছে তুলসীদাস সৃষ্ট রামভাবনার উপর। আজ ভারত যে রামকে চেনেন তিনি তুলসীদাসে রাম, বাল্মীকির রাম নয়–বিশেষ করে গোবলয়ে।
রামচরিতমানসও কিন্তু বাল্মীকি রামায়ণের অবিকল ‘অনুবাদ’ নয়। কাহিনিসূত্র অনুসরণ করা হয়েছে, কিন্তু নানা ভিন্ন মাত্রা আছে। রামায়ণ নিয়ে তুলসীদাসের নিজস্ব উদ্দেশ্য ছিল, তা হল ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। তিনি সেগুলিকে প্রতিষ্ঠা করেছেন একেবারে ভূমিগত মানুষের ভাষা ও মানসিকতার নিরিখে। ব্রাহ্মণ্যবাদ, ভক্তিবাদ, দারিদ্র্য, অবমাননা ইত্যাদি নানা আপাতভাবে পরস্পর বিরোধী উপাদান দিয়ে তিনি বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য গড়ে তুলেছিলেন একটা নতুন মূল্যবোধ, যার শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত হয়ে আছে। কৃত্তিবাসেরও ব্রাহ্মণ্যবাদের চাপ ছিল, তবে তা ন্যূনতম। কিন্তু তুলসীদাসের ভক্তিযুদ্ধটা ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। একেশ্বরবাদী শাসকের আর্থ-নীতিগত বলপ্রয়োগের প্রতিষেধক হিসাবে রাম চরিত্রটির স্বভাবে শক্তি সঞ্চার করার দায় ছিল তাঁর। তবে তা ছিল ভক্তিবাদী মানসিকতার আধারে। কৃত্তিবাসকে এই দায়টির বোঝা বইতে হয়নি।
আমার রাম বাল্মীকির রাম। অন্য কোনো রাম নয়। না কৃত্তিবাসের রাম, না তুলসীদাসের রাম। এ গ্রন্থটি আমি বিশেষজ্ঞ গবেষকদের জন্য লিখিনি। যাঁরা ভাবছেন এই গ্রন্থ পাঠ করলে প্রভূত পুণ্যার্জন হবে, এ গ্রন্থ তাঁদের জন্যেও লিখিনি এ গ্রন্থ কেবলমাত্র যুক্তিনির্ভর সাধারণ পাঠকদের জন্য লেখার চেষ্টা করেছি।এ গ্রন্থ কেবল তাদেরই জন্য লিখেছি, যাঁরা মহর্ষি বাল্মীকি এবং বাল্মীকির রামকে বুঝতে চান, মান্য করেন।
১৯০০ খ্রিস্টাব্দে ৩১ জানুয়ারি ক্যালিফোর্নিয়ার অন্তর্গত প্যাসাডেনায় ‘শেক্সপিয়র সভায়’ প্রদত্ত বক্তৃতায় স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন–“রামায়ণের কবির নাম মহর্ষি বাল্মীকি। পরবর্তীকালে অপরের রচিত অনেক আখ্যানমূলক কবিতা, ওই প্রাচীন কবি বাল্মিকির পরিচিত নামের সহিত জড়িত হইয়াছে। শেষে এমন দেখা যায় যে, অনেক শ্লোক বা কবিতা তাঁহার রচিত না হইলেও সেগুলি তাঁহারই বলিয়া মনে করা একটা প্রথা হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। এই সকল প্রক্ষিপ্ত অংশ থাকিলেও আমার এখন উহা যে আকারে পাইতেছি, তাহাও অতি সুন্দরভাবে গ্রথিত, জগতের সাহিত্যে উহার তুলনা নাই।”
মোট কথা, রামায়ণ লোকমুখে গীত হওয়ার জন্যই রচিত হয়েছিল, যা কুশীলব তথা গায়কগণ কর্তৃক গীত হিসাবে প্রচারিত হয়েছিল, তাই এটা গীতিকাব্যও। বাল্মীকি এই গ্রন্থের কোনো নামকরণ করেননি। রামায়ণ’ বাল্মীকি কর্তৃক দেয় শিরোনাম নয়। তবে কে বা কারা এই গ্রন্থের নাম ‘রামায়ণ’ রেখেছিলেন, সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। বাল্মীকির রামকথার নাম ‘পৌলস্ত্যবধ কাব্য’–“কাব্যং রামায়ণং কৃৎস্নং সীতায়াশ্চরিতং মহৎ।/পৌলস্তবধ ইত্যেবং চকার চরিত ব্ৰতঃ”–অর্থাৎ রামায়ণ গীতিকাব্যের রচয়িতা মহামুনি বাল্মীকি। পুরাণ মতে পুলস্ত মুনির বংশধর বলে রাবণের পর নাম পৌলস্ত্য। তিনি পৌলস্ত বধ নামে রাম ও সীতার চরিত সংবলিত কাব্য রচনা করেছিলেন এবং সেটি রামায়ণ নামে পরিচিত হয়েছিল। একথা রামায়ণের প্রথম সংগ্রহকারকের লিখিত মুখবন্ধ থেকেই জানা যায়। রামায়ণের রচয়িতা হিসাবে মহাকবি বাল্মীকির পরিচয় তাঁর রচিত এই কাব্যে কোথাও পাওয়া যায়নি। ভাগবতকার বাল্মীকিকে আদি কবি বলে স্বীকার করেননি। তিনি ব্রহ্মাকে আদি কবি বলে অভিহিত করেছেন–“তেনে ব্ৰহ্মহৃদায় আদি কবয়ে”। তবে আদি কবি হিসাবে ব্রহ্মা কোনো গ্রন্থ বা কাব্য লিখেছিলেন কি না তার কোনো উল্লেখ কোনো গ্রন্থে পাওয়া যায় না। তা ছাড়া বেদ ও উপনিষদ ছাড়া রামায়ণের আগে রচিত হয়েছে এমন কোনো গ্রন্থ এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। অবশ্য পাওয়া যায়নি বলে রামায়ণই আদি কাব্য, তাও হলফ করে বলা যায় না। তবে একেবারে প্রথম খ্রিস্টাব্দের কৰি অশ্বঘোষ তাঁর ‘বুদ্ধচরিত’ লিখেছেন, চ্যবনমুনিই রামায়ণ রচনা আরম্ভ করেছিলেন, কিন্তু রামায়ণটি শেষ করা সম্ভব হয়নি। বাল্মীকির পৌলস্ত্যবধ কাব্যের নায়ক-নায়িকা-খলনায়ক-শত্রু-মিত্র সকলেই ছিলেন রক্তমাংসের নিখাদ মানুষ। কালে কালে বহু কবি হাত ধরে রাম যতই অবতারের দিকে উন্নীত হন ততই তাঁর মিত্ররা নখ-লেজ-লোমওয়ালা জন্তুজানোয়ার হতে থাকে। অপরদিকে শত্রুরা রাক্ষস-খোক্ষস-ভূতভূতুমের রূপকথায় পরিণত হয়ে যায়। রামায়ণে সকল চরিত্রই কোনো-না-কোনোভাবে দেবতা, বিপুল অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী–তাঁরা হয়কে নয়, নয়কে হয় করতে দক্ষ। একজন বাদে, তিনি হলেন সীতা–জন্মের ঠিক নেই এমন এক কন্যার কোনো অলৌকিক ক্ষমতা নেই, এক অসহায় মানবী। মূলত এগারো/বারো শতক নাগাদ তামিল কবি কম্বনের (কম্বন রামায়ণ’ নামে পরিচিত) কল্পনায় রামচন্দ্র অর্ধদেবত্ব লাভ করেছেন। এরপর মোলো শতকে এসে তুলসীদাসের (‘রামচরিতমানস’ নামে পরিচিত) কল্পনায় রামচন্দ্র পূর্ণদেবত্ব তথা ভগবানত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন। এতটাই ভগবানত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন যে, গো-বলয়ে একে-অপরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে ‘রাম রাম’ বলে সম্ভাষণ করে থাকেন। এতটাই ভগবানত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন যে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্বাধ্বী নিরাঞ্জন অবলীলায় বলে ফেলতে পারেন–“আপনারা দিল্লিতে রামজাদের সরকার চান, নাকি হারামজাদের সরকার চান?” স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও তাঁকে কঠোর ভাষায় ভর্ৎসনা করেন। অবশেষে তুমূল চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে তিনি সংসদে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেছেন–“ভারতে ‘রামজাদে’ বলতে সব ভারতবাসীকেই বোঝায়। কারণ এদেশে হিন্দুরা তো বটেই, খ্রিস্টান মুসলিমরাও রামেরই সন্তান।”
তর্কের শেষ নেই। এক পণ্ডিত যা বলেন, অন্য পণ্ডিত তা প্রত্যাখ্যান করেন। মূল রামায়ণের থেকেও প্রাদেশিক রামায়ণ এবং তার কবিই হয়ে উঠেছে প্রিয়তম। মূল সংস্কৃত ভাষায় রচিত রামায়ণের খোঁজ কেই-বা রেখেছেন। বাঙালিজীবনে যেমন রামায়ণ বলতে কৃত্তিবাসের প্রভাব, তেমনই হিন্দিবলয়ে তুলসীদাস। অনুরূপ কাশ্মীরে দিবাকর ভট্টের রামায়ণ বা দাক্ষিণাত্যের প্রদেশগুলিতে কম্বনের রামায়ণ অথবা রঙ্গনাথনের রামায়ণ। আছে ভিল রামায়ণ, মোল্লা রামায়ণ এবং দুরন্ত রামায়ণও। ওডিশা, নেপাল, তিব্বত, থাইল্যান্ড, আসাম–প্রত্যেকের একটি করে নিজস্ব রামায়ণ আছে। সেসব রামায়ণ কখনো চমৎকার, কখনো অদ্ভুত, কখনো-বা অর্থহীন–তবুও মান্য।
বেদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, কোরান, বাইবেল ইত্যাদি সারা পৃথিবীর শাস্ত্র তথা কিংবদন্তীগুলি নতুন নতুন ব্যাখ্যায় আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে, জানতে পাচ্ছি নবতম তথ্য। চোখের ঠুলি আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে খোলা চোখের বিশ্লেষণে। কেউ বলেন রামায়ণ ধর্মগ্রন্থ, কেউ বলেন মহাকাব্য, কেউ বলেন ইতিহাস।
বাল্মীকির রাম কোনো দেবতা নন, দৈত্যদানবও নন৷ বাল্মীকির রামায়ণের রাম সুখে-দুঃখে কাতর মর্তমানব। তিনি মানৰশ্রেষ্ঠ, নরচন্দ্রমা। বাল্মীকির তাঁর কাহিনি বর্ণনার মধ্য দিয়ে মানবজীবনের ও মানবগৃহধর্মের বিজয়বার্তা ঘোষণা করেছেন। রামায়ণ গৃহাশ্রমের কাব্য। যাঁরা কথায় কথায় কারও ভাবাবেগে বা বিশ্বাসে আঘাত করা ঠিক নয় বলেন, তাদেরকে বলি–কোপারনিকাস, ব্রুনো, গ্যলিলিও প্রমুখরা খ্রিস্টান ভাবাবেগকে আঘাত দিয়েছিলেন, বলেছিলেন পৃথিবীর চারদিকে সূর্য ঘোরে না, সূর্যের চারদিকেই পৃথিবী ঘোরে। বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, রামমোহন প্রমুখ পূজনীয় ব্যক্তিগণ বহু লোকের ভাবাবেগকে আঘাত দিয়ে সমুদ্রপার করেছিলেন। বিদ্যাসাগর ও রামমোহন প্রমুখ তো বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, সতীদাহ, বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে অসংখ্য মানুষের শতাব্দী প্রাচীন বিশ্বাসকে ভেঙে দিয়েছিলেন। এক শ্রেণির দুষ্কৃতিরা বাবর-ই-মসজিদ ভেঙে, বামিয়ানে বুদ্ধমূর্তি ভেঙে আর-এক শ্রেণির মানুষের বিশ্বাসে কুঠারাঘাত করেছেন। যাঁরা বাইবেল পোড়ায়, যাঁরা বেদ পোড়ায়, যাঁরা কোরান পোড়ায়–তাঁরা কারা? তাঁরা অন্যের ভাবাবেগে বা বিশ্বাসে আঘাত করেন না? লেখকরা কাতোর বিশ্বাসে আঘাত করে না, আঘাত করার জন্যেও লেখেন না–এটা একটা চাপিয়ে দেওয়া অভিযোগ, মূলত ব্যক্তিগত আক্রোশকেই চরিতার্থ করেন। যাঁরা করেন তাঁরা লেখক পদবাচ্যই নয়। লেখক কেবল প্রচলিত মিথ ভাঙে, মিথ ভেঙে সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন পাঠককে। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই লেখক সাধারণ পাঠকদের চিনিয়ে দেয় মিথ্যাসংস্কৃতির ধারক ও বাহকদের। সত্যটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে কারো-না-কারো বিশ্বাসে আঘাত লাগে। লেখক সত্যসন্ধানী। আমি যাকে জন্ম থেকে বিশ্বাস করে এসেছি যে ব্যক্তিটি আমার বাবা, পরে জানতে পারলাম তিনি আমার বাবা নন, আমি তাঁর ঔরসজাত নই, তিনি কেবলই আমার মায়ের স্বামী–এটাও কি বিশ্বাসে বা ভাবাবেগে আঘাত নয়? আঘাত হলেও, এ সত্য সন্তানকে জানাতেই হবে। সত্য উন্মোচনের মাধ্যমে এই আঘাত না-দিলে সমাজ বর্বর তথা অন্ধকার যুগেই স্থির হয়ে থাকত, প্রগতি বলে কিছু থাকত না। তাই প্রগতির স্বার্থে এ বিশ্বাসে আঘাত দেওয়াও আবশ্যক হয়ে পড়ে। কী বিশ্বাস করবেন, কী বিশ্বাস করবেন না–তা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির শিক্ষার উপর। যেমন ধরুন–নারদ বাল্মীকিকে যে রাম-কথা শুনিয়েছিলেন (বালকাণ্ড, প্রথম সর্গ), সেই রামকথা রামের রাজ্যলাভেই ইতি হয়েছে। এরপর ১১,০০০ বছর রাজত্ব করার পর রাম ব্রহ্মলোকে গমন করবেন এবং রাজত্বকালে রাম শত সংখ্যক অশ্বমেধ যজ্ঞ, বর্ণাশ্রম প্রতিষ্ঠা ও ব্রাহ্মণদিগকে প্রচুর সংখ্যক গো ও পর্যাপ্ত ধনাদি দান করবেন–নারদ ভবিষ্যত্বাণী করেছিলেন মাত্র। কিন্তু নারদের ভবিষ্যৎবাণীতে সীতার বনবাস, শক্রম্নর যৌবরাজ্যে অভিষেক, লবকুশের জন্ম, রামের অশ্বমেধ যজ্ঞে পিতাপুরে মিলন, সীতার পাতাল প্রবেশ, কুশকে কোশলের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করা, রামের পরিশেষে লক্ষ্মণকে বর্জন এবং ভরত ও শত্রুঘ্ন সহ সরযূ নদীতে আত্মবিসর্জন–এইসব তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাবলির কোনো উল্লেখ নাই। ভেবে দেখতে বলি।
‘গঙ্গার মতো তীর্থ নেই, মায়ের মতো গুরু নেই, বিষ্ণুর মতো দেবতা নেই আর রামায়ণের মতো শ্রেষ্ঠ কিছু নেই”–পুরাণের আপ্তবাক্যটির ততদিন গ্রহণযোগ্যতা থাকবে, যতদিন ভারত থাকবে, যতদিন ভারতের নদনদী প্রবাহিত হবে, যতদিন ভারতের পর্বতমালা উত্তুঙ্গ মহিমায় বিরাজ, যতদিন সুপ্রাচীন আরণ্যক সভ্যতার মূল মর্মকথাটি অনুপ্রাণিতহতে থাকবে মানুষের হৃদয়ে। জাতিধর্মনির্বিশেষ রামায়ণ থাকবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবেই। আদি বাল্মীকির রামায়ণ থেকে আধুনিক চন্দ্রাবতীর রামায়ণ পর্যন্ত–সবই আপামর মানুষ বুকে করে রেখেছে। রামায়ণ কেবলমাত্র হিন্দুদেরই সম্পদ নয়–সব ধর্মাবলম্বীদের কাছেই আগ্রহের বিষয়। বস্তুত আমাদের প্রধানত রাষ্ট্র-পরিবর্তনের ইতিহাস। কোন রাজার কোন্ রাজার শাসনকাল শুরু এবং শেষ হল তারই ‘অধসত্য’ বিবরণের পুনর্মূল্যায়ণই আমাদের ইতিহাস রচনার কাজ, যা রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ও নৃতত্ত্ববিজ্ঞান দিয়ে বুঝতে হবে। রাজার ইতিহাস ষড়যন্ত্রের ইতিহাস। নানারকম কূট ষড়যন্ত্র, দুরভিসন্ধি, প্রতিহিংসা, রাজনৈতিক দাবাখেলার ভিতর দিয়েই রাজাদের উত্থান-পতন রচিত হয়। রামায়ণের কাহিনিও তার ব্যতিক্রম নয়।
আগেই বলেছি আমার রাম বাল্মীকির রাম। কৃত্তিবাস বা তুলসীদাসের রাম নয়। তাই যাঁরা ভাবছেন এই গ্রন্থ পাঠ করলে পুণ্যার্জন হবে, পরিষ্কার বলে রাখি তাঁরা হতাশ হবেন। এ গ্রন্থ শুধুমাত্র যুক্তিবাদী পাঠকদের জন্য যুক্তিবাদীর উপস্থাপনা। এই গ্রন্থ শুধুমাত্র যাঁরা মহর্ষি বাল্মীকি ও তাঁর রামকে বুঝতে আগ্রহী তাঁদের জন্য। আর-একটা কথা যেটা বলা উচিত, সেটা হল আমি গ্রন্থটি বাল্মীকির রামায়ণের ভাষাগত ও কাঠামোগত বিশ্লেষণ করিনি। তা করতেও এই গ্রন্থের অবতারণা নয়। এই গ্রন্থটি পাঠ করে কোনো পাঠকের যদি মনে হয় এটি বামপন্থী ও বিজেপি-বিরোধী মানসিকতার ফসল, সেটা ভেবে নিলে ভুল হবে বলব। কারণ আমি কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী নই। আমি নিজস্ব মতাদর্শেই আস্থা রাখি। সেই আস্থার ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়েই প্রতিষ্ঠা করেছি আমার মত। একজন প্রাবন্ধিক হিসাবে প্রাবন্ধিকের মতই যে প্রকাশ হবে সেটাই স্বাভাবিক। সেই মতে কেউ সহমত হবেন, কেউ হবেন না। সকলেই লেখকের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত হবেন, এমন প্রত্যাশা কোনো লেখক করেন বলে আমার জানা নেই। অনেক পাঠক বলতে পারেন, রামায়ণের তো বহু সংস্করণ আছে। সেই প্রতিটি সংস্করণে প্রতিফলিত হয়েছে স্থানীয় ইতিহাস, ভূগোল, সমাজ, ধর্মীয় আচার, জীবনযাত্রা ইত্যাদির ভিত্তিতে। সেগুলো যদি বিশ্লেষণ করে রামায়ণী কথার মাধ্যমে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার জাতিগত ইতিহাসের উপর আলোকপাত করতেন, তাহলে ভালো হত। হ্যাঁ, অবশ্যই ভালো হত। কিন্তু এই গ্রন্থে সেই পরিসর নেই। পৃথক একটি গ্রন্থে এ বিষয়ে আলোকপাত করা যেতে পারে।
পরিশেষে জানাই, আমি পণ্ডিত নই। বরং পণ্ডিতগণের আলোয় আমি আলোকিত–এভাবেই নির্ণায়ক। আমার এ লেখা পাঠ করে যদি কোনো পাঠকের মনে হয় তাঁর অনেকদিনের আজন্ম লালিত বিশ্বাসে নাড়া লেগে গেছে, তাহলে তাঁর কাছে আমার বিনম্র নিবেদন রাখি–এ রচনায় সম্পূর্ণভাবে ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান এবং হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য অনূদিত রামায়ণ থেকেই আমার রসদ আহরিত হয়েছে। এই গ্রন্থে কোথাও এমন অক্ষর এমন শব্দ এমন বাক্য উল্লেখ হয়নি, যার ফলে ভক্ত-পাঠকগণের বিশ্বাসে আঘাত লাগতে পারে। এমন কোনো বর্ণনা করা হয়নি, যা কোনো বাল্মীকির রামায়ণে উল্লেখ নেই। তা সত্ত্বেও যদি কোনো পাঠকের হৃদয়ে ন্যূনতম রক্তক্ষরণ হয়, তা আমার অনিচ্ছাকৃত–উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়। কোনো বিশ্বাস ও কল্পনার আশ্রয়ে এ গ্রন্থ গড়ে ওঠেনি। প্রতিটি চরিত্র আলাদা আলাদাভাবে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেছি। এতে চরিত্রগুলিকে অনুধাবন করতে সুবিধা হবে বলে আমার বিশ্বাস। যতটা পেরেছি যুক্তি দিয়ে আলোচনা করেছি। যুক্তির সুরে তার বেঁধেছি, ভক্তির সুরে নয়। আমি অলৌকিকত্ব, ভগবত্তার ভক্তিরসে কলম ডোবাতে পারিনি–এটা যদি আমার ব্যর্থতা বলেন, তাহলে এ ব্যর্থতা স্বীকার করে নিতে দ্বিধা নেই।
সেইসব গ্রন্থ, যেখান থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করেছি, সেইসব গ্রন্থ, লেখক ও প্রকাশকদের কাছে আমি চিরঋণী। সবসময় সেইসব সূত্র উল্লেখ করা সম্ভব না-হলেও যতটুকু পেরেছি উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি। অভিনন্দন জানানোর ভাষা নেই তাঁকে, যিনি এই গ্রন্থের প্রকাশক সেই Exceller Books-এর অঞ্জিতা গাঙ্গুলিকে। অঞ্জিতা আগ্রহী না-হলে আমার এই গ্রন্থখানি আপনাদের মতো বিদগ্ধ পাঠকদের কাছে পৌঁছোত কি না, সে বিষয়ে আমার সন্দেহ ছিল। এছাড়া যে শুভানুধ্যায়ীরা আমাকে অন্তরাল থেকে এ গ্রন্থ রচনায় সাহস জুগিয়েছেন, প্ররোচিত করেছেন, তাঁদের ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করার ধৃষ্টতা আমার আছে বলে মনে করি। শেষ কথা, আমার এ লেখা যদি বিদগ্ধ পাঠকমহলে সমাদৃত হয়, বিন্দুমাত্র চিন্তার খোরাক সরবরাহ করতে সক্ষম হয়, তাহলেই আমার দীর্ঘদিনের ঘাম ঝরানো সার্থক হবে।
–অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
সহায়ক গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা : (১) মনুসংহিতা–সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, (২) বাল্মীকি রামায়ণ–পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত (৩) কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণ, (৪) চন্দ্রাবতীর রামায়ণ (৫) বিষ্ণুপুরী রামায়ণ–শঙ্কর কবিচন্দ্র (৬) বাল্মীকির রাম ও রামায়ণ–নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী, (৭) রামায়ণ ও মহাভারত : নব সমীক্ষা–শ্ৰীমনোনীত সেন, (৮) বাল্মীকির রাম ফিরে দেখা–সুকুমারী ভট্টাচার্য, (৯) প্রাচীন ভারত : সমাজ ও সাহিত্য–সুকুমারী ভট্টাচার্য, (১০) তুলনামূলক আলোচনায় রামায়ণ ও মহাভারত–ড. বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, (১১) বাংলা সাহিত্য ও বাঙ্গালীর জাতীয় জীবনে রামায়ণ–লেখক অজ্ঞাত (১২) বাল্মীকি রামায়ণে রাম আদিবাসী রামায়ণে রাম–বিপ্লব মাজী, (১৩) রামায়ণের উৎস কৃষি–জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, (১৪) রামায়ণের প্রকৃত কথা–শ্রীসতীশচন্দ্র দে, (১৫) রামায়ণের সমাজ–কেদারনাথ মজুমদার, (১৬) রামায়ণ ভোলা চোখে–হরপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (১৭) বাল্মীকির জয়–হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮) ভারতবর্ষের ইতিহাস–রোমিলা থাপার (১৯) ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়–অতুল সুর (২১) রামায়ণ : মিথ অর রিয়ালিটি–হাসমুখ ধীরাজলাল সানকালিয়া (২২) সহজিয়া রামায়ণ–মাহবুব লীলেন (২৩) বর্তমান (শারদ সংখ্যা ১৪১৫), পৃষ্ঠা ৬৪ (২৪) খাসতদন্ত (দ্বিতীয় বর্ষ/দ্বিতীয় সংখ্যা) (২৫) সাপ্তাহিক বর্তমান (১২ মার্চ, ২০১৬) (২৬) রামায়ণী কথা–দীনেশচন্দ্র সেন (২৭) বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (অষ্টম ও নবম খণ্ড)(২৮) রামায়ণে রাক্ষস সভ্যতা–স্বামী বিবেকানন্দ (২৯) অশোকবনে সীতা–জনৈকা দুঃখিনী স্ত্রীলোক (৩০) রামলক্ষ্মণ–গোবিন্দচন্দ্র রায় (৩১) রামবিলাপ–নগেন্দ্রনারায়ণ অধিকারী (৩২) সীতাচরিত্র–কৃষ্ণেন্দ্র রায় (৩৩) ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়–অক্ষয়কুমার দত্ত (৩৪) প্রাচীন ভারতের ইতিহাস (প্রথম খণ্ড)–সুনীল চট্টোপাধ্যায় (৩৫) হেলেন সীতা দ্রৌপদী–শেখর সেনগুপ্ত (৩৬) স্বর্গলোক ও দেবসভ্যতা–শ্রীরাজ্যেশ্বর মিত্র (৩৭) পৌরাণিক অভিধান–সুধীরচন্দ্র সরকার (৩৮) রামায়ণ-মহাভারতের দেব-গন্ধর্বরা কি ভিনগ্রহবাসী?–নিরঞ্জন সিংহ (৩৯) চরিত্রে রামায়ণ মহাভারত–শিপ্রা দত্ত (৪০) মেগাস্থিনিসের ভারতবিবরণ–সম্পাদনায় বারিদবরণ ঘোষ (৪১) হিন্দুদের দেবদেবী উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ–হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য (৪২) রামায়ণ প্রসঙ্গে–লেখক অজ্ঞাত (৪৩) রামায়ণ সারসংগ্রহ–শ্রীকুশদেব পাল (৪৪) রামায়ণে দেবশিবির–বীরেন্দ্র মিত্র (৪৫) রামচরিতমানস–তুলসীদাস (৪৬) হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত–প্রেমময় দাশগুপ্ত (৪৭) আলবেরুনীর দেখা ভারত–প্রেমময় দাশগুপ্ত (৪৮) ইবন বতুতার দেখা ভারত–প্রেমময় দাশগুপ্ত (৪৯) তিব্বতী পরিব্রাজকদের দেখা ভারত–প্রেমময় দাশগুপ্ত। (৫০) দ্বীপময় ভারত–সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। (৫১) ভারতবর্ষ (প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা) (৫২) অনালোকিত অতীত ইতিহাসে ভারতীয় মূলনিবাসীরা ও তাদের ধর্ম ভাবনা (যুদ্ধঃ আর্য বনাম আর্য, দাস ও দস্যু)–মণিমোহন বৈরাগী। (৫৩) দানিকেন প্রমাণ–অজিত দত্ত অনূদিত, (৫৪) রামায়ণ–মহেন্দ্রনাথ দত্ত অনূদিত।
গোড়ার কথা : ইতিহাস ও ধর্মকথার দ্বন্দ্ব
রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণগুলি পাঠ করলে দেখা করা যায়, একই ঘটনা বিভিন্ন রূপে ভিন্ন ভাবনায় বর্ণিত হয়েছে। এমনকি একই গ্রন্থে এক অধ্যায় একরকম অন্য অধ্যায়ে অন্যরকম বর্ণনা করা হয়েছে। এটা থেকে এমন অনুমান করা অন্যায় হবে না যে, গ্রন্থগুলি একাধিকবার বিভিন্ন লেখকের লেখনী দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা ও দর্শনে যুগধর্মের উপযোগী করে কখনো সম্পাদিত ও কখনো পরিবর্তিত হয়েছে। সুযোগ-সুবিধা বুঝে, স্বার্থ রক্ষার্থে এবং বিপদ বুঝে যেভাবে সংবিধান সংশোধন হয়। এ ব্যাপারে সমস্ত ঐতিহাসিকই একমত। যেহেতু গ্রন্থগুলি বেদের অনুগত, তাই এগুলি ধর্মগ্রন্থেরও পর্যবসিত হয়েছে। সনাতন ধর্ম মায় হিন্দুধর্মের সকলেরই এইসব গ্রন্থের প্রতি অচলা ভক্তি প্রদর্শন ও অটল বিশ্বাস অব্যাহত। শাস্ত্রকারদের গা-জোয়ারি, অর্বাচীন কবিদের বানোয়াট, সত্য লুকোনোর প্রয়াস এবং মিথ্যাচারের প্লাবন–এই তিন স্পর্শ মানুষের মনকে শত শত বছর ধরে স্থবির করে রেখেছে। শাস্ত্রে উল্লিখিত বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ বিভিন্ন মধ্যে যথাযথ যুক্তি নির্ণয়ে বিমুখ হয়ে তারই অপরাপর অলৌকিক বিবরণগুলির মানুষের মনকে আকৃষ্ট করে এবং নির্বিচারে তা গ্রহণ করতে প্রলুব্ধ করে। এতটাই প্রলুব্ধ করে যে, বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যাও শুনতে চায় না। কানে আঙ্গুল দেন। যেসব পণ্ডিতগণ শাস্ত্রবচন উদ্ধৃত করে মাহাত্ম-কীর্তন পঞ্চমুখে বিতরণ করেন, তাঁরাই আবার শাস্ত্রসম্মত সত্যভাষণ মনঃপুত না-হলে অগ্নিশর্মা হয়ে তেড়ে আসেন, অসহিষ্ণু হয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নিতেও দ্বিধান্বিত হন না। লজিক নয়, ম্যাজিকের প্রতিই তাঁদের অগাধ আস্থা।
রামায়ণ তেমনই একটি গ্রন্থ, যেখানে মানুষের কাছে লজিকের চেয়ে ম্যাজিকের কদর পায়। লজিক আর ম্যাজিকের চিরন্তন দ্বন্দ্বও আছে। রামের ভক্তরা রামায়ণ’ গ্রন্থটিকে ‘ধর্মশাস্ত্র’ ভাবতেই পারেন, আমার কাছে কেবলই মহাকাব্য’, ইতিহাসের উপাদান-আধার। অনেকে মনে করেন, রামকথা বেদের যুগ থেকেই লোকের মুখে মুখেই ফিরত। পরে বাল্মীকি তাঁর প্রতিভায় রামকথা পরিমার্জিত রূপ দেন, সুচারুভাবে সংকলিত হয় অতিরিক্ত সংযোজনের প্রাবল্যে। রামকথার প্রথম বক্তা নারদ। বাল্মীকি উদগীত শ্লোকের সমর্থনদাতা ব্রহ্মা। গায়ক লব ও কুশ। শ্রোতা প্রথমে ব্রাহ্মণ ঋষিকুল। পরে অযোধ্যার জনগণ এবং সবশেষে রাজা রামচন্দ্র। প্রসঙ্গত জানাই “মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।/যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম৷৷”–এটাই বাল্মীকির মুখনিঃসৃত প্রথম শ্লোক বলে জেনে আসছে অনেকে। অনেকে ব্যাখ্যা করে বলেন–ব্যাধ কর্তৃক কৌঞ্চ নিহত হলে যে শোক উৎপাদন হয়, তা থেকেই নাকি শ্লোকের সৃষ্টি। না, এ জানা সঠিক নয়। শ্লোক আরও আগেই সৃষ্টি হয়ে গেছে। এই শ্লোকটি রামায়ণের প্রথম কাণ্ডের দ্বিতীয় সর্গের পঞ্চদশতম শ্লোক। রামায়ণের আদি বা প্রথম শ্লোকটি হল–“তপঃ সাধ্যায়নিরতং তপস্বী বাগ্বিদাং বরম্।/নারদং পরিপপ্রচ্ছ বাল্মীকিমুনিপুঙ্গব৷৷” বাল্মীকি রচিত রামায়ণের প্রথম পংক্তিজোড়াই যে প্রথম শ্লোক তা কিন্তু বলা যাচ্ছে না। কারণ রামায়ণের বহু আগেই বেদ রচনা হয়েছে। বেদের বহু মন্ত্রে ‘শ্লোক’ শব্দের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। বেদ থেকে একটি শ্লোক দেখুন–“মিনীহি শ্লোক মাস্যে পর্জন্য ইবততনঃ।” অতএব ক্রৌঞ্চ মিথুনের বধ থেকে শোক, শোক থেকে শ্লোক–এ মিথ ধোপে টেকে না।
নিরুক্তকারের মতে, শ্রু ধাতু থেকে উৎপন্নের কারণে শ্রবণযোগ্য যা, তাই-ই শ্লোক। কবি বাল্মীকি স্বধ্যায়সম্পন্ন বেদবিদদের অগ্রগণ্য নারদকে সম্বোধন করে এবং সম্প্রতিকালে লোকে সর্বগুণে বিভূষিত শ্রেষ্ঠ কে সম্যক জেনে রামকথা শুরু করেন। নারদের কাছ থেকে রামকথার বিস্তারিত জেনেই রামায়ণ গ্রন্থের ছয়টি কাণ্ডে (উত্তরকাণ্ড বাদে) প্রসারিত করেছেন। অতএব বাল্মীকি মহাকাব্যের স্রষ্টা বটে, কিন্তু রামকথার স্রষ্টা নন। যিনি গ্রন্থটি সংস্কারের কাজ করেছিলেন তিনি বাল্মীকির সম্পূর্ণ রামকথা বা গীত সংগ্রহ পারেননি। তিনি যা সংগ্রহ পারেননি, সেখানে তিনি নিজ কল্পনার আশ্রয় নিয়ে গ্রন্থখানি সমৃদ্ধ ও বর্ধিত করেছিলেন।
লক্ষ করার বিষয়, রামায়ণ পুথিগুলির পাঠে নানা স্থলে বিভিন্নতা দেখা যায়। শুধু তাই-ই নয়, অনেক জায়গাতেই অনেক পাঠে সাধারণ বিচারবুদ্ধিতে অসংগতিপূর্ণ মনে হয়। বোঝা যায়, বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন যুগের লেখকরা ‘স্বাভিপ্রায়ানুযায়ী পরিবর্তন বা সংযোজন করেছেন। এইসব সংগতিবিহীন পাঠকে বিশেষজ্ঞরা ‘প্রক্ষিপ্ত বলেন। সাহিত্যসম্রাট ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রক্ষিপ্ত বিষয়ে বলেন–“(১) যদি কোনো গ্রন্থে দেখা যায় যে, কোনো ঘটনা দুই বা ততোধিক বার বিবৃত হইয়াছে, অথচ সেই বিবরণ পরস্পর বিরোধী, তাহা হইলে একটি প্রক্ষিপ্ত বিবেচনা করিতে হইবে। কারণ কোনো লেখকই অনর্থক পুনরুক্তি করিয়া আত্মবিরোধ উপস্থিত করেন না। অনাবধানতা বা অক্ষমতা প্রযুক্ত যে পুনরুক্তি বা আত্মবিরোধ উপস্থিত হয়, সে স্বতন্ত্র কথা। সেরূপ ত্রুটি অনায়াসে নির্বাচন করা যায়।(২) শ্রেষ্ঠ কবিদিগের রচনা প্রণালীতে প্রায়ই কতকগুলি বিশেষ লক্ষণ থাকে। যদি ঐরূপ রচনা কোনো শ্রেষ্ঠ কবির কোনো রচনার অংশে এরূপ দেখা যায় যে, সেই সেই লক্ষণ তাহাতে নাই; তৎপরিবর্তে এমন সকল লক্ষণ আছে যে, পূর্বোক্ত লক্ষণ সকলের সঙ্গে সংগতি রক্ষিত হয় না, তবে সেই অসংগত লক্ষণযুক্ত রচনাকে প্রক্ষিপ্ত বিবেচনা করিবার কারণ উপস্থিত হয়। (৩) যদি কোনো শ্লোকে এমন শব্দ প্রযুক্ত থাকে, যে শব্দের মূলীভূত বস্তুর উল্লেখ ঐ গ্রন্থে বা উহার সমসাময়িক গ্রন্থে দৃষ্ট হয় না, তাহা হইলে ঐ শব্দ প্রক্ষিপ্ত বলিয়া সন্দেহ হইবে। (৪) যদি শ্লোকাদিতে গ্রন্থকর্তার সমকালীন পরিজ্ঞাত ও বিশ্বসিত বস্তু অথবা ভাবের অতিরিক্ত কোনো বস্তুর বা ভাবের বর্ণনা বা অভিব্যক্তি দেখা যায়। তবে সেই বস্তু ও ভাবকে প্রক্ষিপ্ত বলিয়া সন্দেহ করিবার বিষয় হইবে। (৫) শ্রেষ্ঠ কবিদিগের বর্ণিত চরিত্রগুলির সর্বাংশ পরস্পর সুসংগত হয়। যদি কোথাও তাহার ব্যতিক্রম দেখা যায়, সে অংশ প্রক্ষিপ্ত বলিয়া সন্দেহ করা যাইতে পারে। (৬) যাহা অপ্রাসঙ্গিক তাহা প্রক্ষিপ্ত হইলেও হইতে পারে, নাও হইতে পারে। কিন্তু অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে যদি পূর্বোক্ত লক্ষণগুলির মধ্যে কোনো লক্ষণ পাওয়া যায়, তবে তাহা প্রক্ষিপ্ত বলিয়া বিবেচনা করিবার কারণ হইবে। (৭) যাহা অনৈতিহাসিক, অথবা অস্বাভাবিক তাহা প্রক্ষিপ্ত হউক বা না হউক, ইতিহাসের আলোচনায় তাহা পরিত্যাগ করা উচিত। তাহা বুঝিবার উপায় সমসাময়িক ইতিহাস, ভাব ও সমাজ৷”
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর প্রক্ষিপ্ত ব্যাপারে কিছুটা ভিন্ন মত। তিনি লিখেছেন–“অনেক অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা করে বাল্মীকি রামায়ণের অগ্র এবং পশ্চাৎ অর্থাৎ আদিকাণ্ড এবং উত্তরকাণ্ড ঘেঁটে ফেলা হয়েছে। এর সবচেয়ে বড়ো কারণ হল–রামকে যে একেবারে ভগবান বিষ্ণুর অবতার করে ফেলা হয়েছে তা নাকি প্রধানত এই কাণ্ড দুটিতেই। অযোধ্যাকাণ্ড থেকে লঙ্কাকাণ্ড পর্যন্ত রামের এই ভগবদ্ উপাধি জোটেনি। ব্যাপারটা প্রথম বোধহয় পণ্ডিতদের মাথায় ঢুকিয়েছিলেন হারমান জ্যাকোবি।” তাঁর মতে–“রামের দেবায়ন এবং ক্রমশঃ বিষ্ণুর সঙ্গে একাত্মতা–এই পুরো বাপারটাই ছিল সেই কবির হৃদয়ে যিনি রামায়ণের আদি এবং উত্তরকাণ্ডটি লিখেছিলেন। মূল কাণ্ডপঞ্চকে দেবায়নী ভূমিকা নেই কোনো, বরঞ্চ তিনি সেখানে অনেক মানুষোচিত।” মূল কাণ্ড-পঞ্চকের কতগুলি শ্লোকে এবং আদিকাণ্ড তথা উত্তরকাণ্ডে তো বটেই, যেখানেই রামকে ভগবানের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে সেই অংশটাই প্রক্ষিপ্ত। এই নিরিখে এমন কথা অবশ্যই বলা যায় যে, পণ্ডিতেরা যদি তাঁদের প্রতিপাদ্য সম্বন্ধে পূর্বাহ্নেই সংকল্পিত থাকেন তাহলে তাঁদের যুক্তিও সেই মতেই চলবে এবং সত্যি কথা বলতে কি, তাই চলেছে। যেখানেই পণ্ডিতদের অসুবিধে হয়েছে সেখানেই শ্লোকের পর শ্লোক বাদ পড়ে গেছে। কনটেকস’ মিলছে না, অন্যরকম, শ্লোক বাদ দিয়ে দাও; অবতারবাদ আছে–সব বাদ দাও।… পণ্ডিতদের কথা শুনে বাল এবং উত্তরকাণ্ডের অলংকৃত শৈলীর নিরিখে মূল কাণ্ড-পঞ্চকের অলংকার দুষ্ট অংশগুলি আমরা পরিত্যাগ করব, নাকি পাঁচ কাণ্ডের স্থল বিশেষ অলংকৃত শৈলীর নিরিখে বাল কিংবা উত্তরকাণ্ডের অংশগুলিও আমরা গ্রহণ করব। আমার ধারণা–গ্রহণ করাই ভালো, কেননা তাতে মহাকাব্যশরীরের হানি হয় না। তা ছাড়া কবি কোথায় অলংকৃত ভাষা ব্যবহার করবেন, কোথায় করবেন না, কোথায় তিনি বড়ো বড়ো সমাসবদ্ধ পদ ব্যবহার করবেন এবং কোথায় লঘু সমাস, কোথায় উপমার মালা তৈরি করবেন, কোথায় রূপক–এসব তো আর তিনি ভবিষ্যৎ ভাষাতাত্ত্বিকের গবেষণায় ফমূলা বুঝে করবেন না।”
প্রক্ষিপ্তকে অস্বীকার করে নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী রামের ‘ভগবান’ তত্ত্ব মেনে নিলেও, রামায়ণে যে প্রক্ষিপ্ত রচনায় গিজগিজ করছে না, এটা মানব কী করে! বাল্মীকি-পরবর্তী কবিরা যেভাবে তাঁদের রামায়ণে ‘ভগবান তত্ত্ব’ প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেটা যে মূল রামায়ণের ক্ষেত্রেও হয়নি, একথা জোর দিয়ে বলা যায় না। প্রক্ষিপ্তকে অস্বীকার করা মানে রাম অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ‘ভগবান’, এটা মেনে নিতেই হয়। আগেই বলেছি, বাল্মীকির আদি রচনা ‘পৌলস্ত্যবধ’, সেই রচনাখানির ঠিক কতটা বিস্তার ছিল তার আর বর্তমানে বিচার করা যায় না। তেমন কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণও নেই। তবে ‘পদ্মপুরাণ’-এর পাতালখণ্ডে রামায়ণের যে শ্লোকসংখ্যার উল্লেখ আছে, তা হল এক কোটি। কিন্তু পদ্মপুরাণের টীকাকারের মতে–এখন আর এক কোটি পাওয়া যায় না, মাত্র ২৪,০০০ পাওয়া যায়। টীকাকার মহাবিভাষা বলেন–মাত্র ১২,০০০। উত্তরকাণ্ডের রচয়িতা উত্তরকাণ্ডকে রামায়ণের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়ে যে তাতে মোট ২৪,০০০ শ্লোক আর ৫০০ সর্গ পেয়েছিলেন, তাঁর প্রমাণ উত্তরকাণ্ডের রচয়িতাই উত্তরকাণ্ডের ১০৭ তম সর্গে উল্লেখ করেছেন। মহাভারতের হরিবংশ’-এর মতো রামায়ণের ‘উত্তরকাণ্ড সম্পূর্ণ একটি আলাদা গ্রন্থ, তা অনেক পণ্ডিতই স্বীকার করেন। “প্রাপ্তরাজ্যস্য রামস্য বাল্মীকিভগবানৃষিঃ।/চকার চরিতং কৃৎস্নং বিচিত্রপদমর্থবৎ।/চতুর্বিংশ সহস্রাণি শ্লোকানামুক্তবানৃষিঃ।/তথা সর্গ শতান্ পঞ্চ ষট্ কাণ্ডানি তথোত্তরম্।/কৃত্বাঃ তু তন্মহাপ্রাজ্ঞঃ সভবিষ্যং সহোত্তরম্।/চিন্তয়মানস্য মহর্ষের্ভাবিতাত্মনঃ। /অগৃহীতাং ততঃ পাদৌ মুনিবেশৌ কুশীলবৌ।/কুশীলবৌ তু ধৰ্ম্মজ্ঞে রাজপুত্রে যশস্বিনৌভ্রাতরে স্বরসম্পন্নৌ দদর্শাশ্রমবাসিনৌ।” কেদারনাথ মজুমদার তাঁর রামায়ণের সমাজ’ গ্রন্থে স্পষ্টতই বলেছেন–“শ্লোকাবলীর চতুর্থ পংক্তি দ্বারা মহর্ষি যে ছয় কাণ্ড রামায়ণ লিখিয়াছিলেন, উহা যেমন স্পষ্ট অবগত হওয়া যায়, ষট কাপ্তানির পরবর্তী ‘তথোত্তরম্’ শব্দটি দ্বারা উত্তরকাণ্ডটি যে জাল বা রামায়ণের পরে যোজনা, তাহাও তেমনই সুস্পষ্ট বুঝা যায়। পঞ্চম পংক্তির ‘সভবিষ্যং সহোত্তরম্’ শব্দদ্বয়ও তেমনই স্পষ্ট প্রক্ষিপ্ত।” “রামঃ সীতামনুপ্রাপ্য রাজ্যং পুনরবাবা।/পিলয়ামাস চৈবেমাঃ পিতৃবনূদিতাঃ প্রজাঃ।/অযোধ্যাপতিঃ শ্রীমান্ রামো দশরথাত্মজঃ।” মহাকবি তাঁর রামচরিত এভাবেই শেষ করেছেন। পরে আর কিছু ছিল না। লঙ্কাকাণ্ডের ১৩০ সর্গের ৯৬ শ্লোকে রামায়ণ শেষ করেছেন মহাকবি বাল্মীকি। এর পর আটটি শ্লোকে রামরাজ্যের কল্যাণকর বিবরণ এবং শেষ আঠেরোটি শ্লোকে রামায়ণ শ্রবণ (কেবল শ্রবণই, কারণ রামায়ণের যুগে মুদ্রণ ব্যবস্থা আবিষ্কার হয়নি, তাই পাঠের প্রশ্নই নেই।) করলে কেমন ফললাভ হবে সে কথাই বলা হয়েছে। বস্তুত নিয়মানুসারে গ্রন্থের পাঠ বা শ্রবণের ফল গ্রন্থের শেষেই নিবন্ধিত হয়।
প্রক্ষিপ্ত যে শুধুমাত্র রামায়ণের ক্ষেত্রেই হয়েছে, তা কিন্তু নয়। মহাভারত, বেদ, পুরাণ, ব্রাহ্মণ, সূত্র, গীতা, স্মৃতি, উপনিষদ–সর্বত্র প্রক্ষিপ্ত রচনা বাধাহীন প্রবেশ করেছে। কপিরাইট নেই, না! কৃত্তিবাস যেমন তাঁর রামায়ণে নিজের কল্পনাজাল বিছিয়েছেন, তেমন তুলসীদাসের রামচরিতমানসে বাল্মীকির ছায়া প্রায় অপসারিত। কয়েকটি উদাহরণ : তুলসীদাস রাম-সীতার পূর্বরাগের কথা বর্ণনা করেছেন, কিন্তু বাল্মীকির রামায়ণে হরধনুভঙ্গের আগে এবং বৈধ বিয়ের আগে রাম-সীতার পূর্বরাগ উল্লেখ করেননি। তুলসীদাস রাম-সীতার বিয়ে স্বয়ংবর সভায় হয়েছে বলে বর্ণনা করেছেন, বাল্মীকির রামায়ণে স্বয়ংবর ছাড়াই দুই পক্ষের অভিভাবকদের কথাবার্তার মধ্য দিয়ে রামসীতার বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। কৃত্তিবাসের রাম-সীতার বিয়ে আবার খুব স্বাভাবিকভাবেই বাঙালিদের মতো৷ কম্বন, কৃত্তিবাস স্বয়ংবর সভা করেই রাম-সীতার বিয়ে দিয়েছেন। বাল্মীকি-পরবর্তী রামায়ণগুলিতে স্বয়ংবর সভা সম্ভবত মহাভারতেরই প্রভাব। মহাভারতের প্রচুর স্বয়ংবর সভায় মাধ্যমে বিয়ের উল্লেখ আছে, বাল্মীকির রামায়ণে একটিও নেই। কৃত্তিবাসের রামায়ণে রাম-সীতাও বাঙালি। তাই রাম-সীতার বিয়ে বাঙালিদের মতো আয়োজন করেন।
অক্ষয়কুমার দত্ত তাঁর ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ গ্রন্থে যথার্থই বলেছেন–“রামায়ণে যে মধ্যে মধ্যে নূতন নূতন শ্লোক ও সর্গবিশেষ সন্নিবেশিত হইয়াছে, এটি একটি প্রসিদ্ধ প্রথা। টীকাকারেরাও তাহা স্বীকার করিয়াছেন ও অনেকানেক বচন ও কোনো কোনো সর্গ প্রক্ষিপ্ত বলিয়া অঙ্গীকার করিয়া গিয়াছেন। যেমন অরণ্য : ৫ স, ২৩; ৩১ স ৩৩ ও ৩৪; কিষ্কিন্ধ্যা : ৫৮ স, ২৪ ও ২৫; সুন্দর : ১ স, ৯৭, ৯৮; ২৪ স, ৪২; ২৭ স, ২০; ২৭ স, ৩১ ও ৩২; ৫৭ স ৯; ৫২ স, ১৮ ও ১৯ ইত্যাদি। রামচন্দ্রের অলৌকিক অথবা দেবসদৃশগুণ বর্ণনাত্মক কতকগুলি শ্লোক ও অবশিষ্ট কয়েকটি সর্গ প্রক্ষিপ্ত বলিয়া কতকাদি টীকাকার তাহার ব্যাখ্যা করেন নাই।”
রামায়ণ গ্রন্থটিকে মহাকাব্যও বলা হয়। এখন দেখব মহাকাব্য কাকে বলে? মহাকাব্য শ্ৰবকাব্যের একটি অংশবিশেষ। যে কাব্যে কোনো দেবতা বা অসাধারণ গুণসম্পন্ন পুরুষের কিংবা একবংশোদ্ভব বহু নৃপতি বা রাজা-বাদশাহর বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হয়, তা মহাকাব্য নামে পরিচিত। যিনি মহাকাব্য রচনা করেন, তিনি মহাকবি। দেবতা বা দেবতুল্য নায়কের বৃত্তান্ত নিয়ে বিশেষ রীতিতে রচিত বৃহৎ কাব্য রচনাকেই মহাকাব্য’ বলা হয়। পাশ্চাত্য আদর্শে অনুসরণের মাধ্যমে আমরা মহাকাব্যের সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে বলতে পারি যে, নানা সর্গে বা পরিচ্ছেদে বিভক্ত যে কাব্যে কোনো সুমহান বিষয়বস্তুকে অবলম্বন করে এক বা বহু বীরোচিত চরিত্র অথবা অতিলৌকিক শক্তি সম্পাদিত কোনো নিয়তি-নির্ধারিত-ঘটনা ওজস্বী ছন্দে বর্ণিত হয়, তাকে মহাকাব্য বলে। মহাকাব্যে প্রাকৃতিক বিবিধ দৃশ্যমালা ও পরিবর্তন বর্ণিত থাকে এবং এতে কমপক্ষে আটটি কিংবা ততোধিক সৰ্গ বা ভাগ থাকে। যেমন–রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড, ওডিসি, গিলগামেস ইত্যাদি।
মহাকাব্য ব্যক্তিনিষ্ঠ নয়, বরঞ্চ বস্তুনিষ্ঠ। লেখকের অন্তর অনুভূতির প্রকাশ নয়, বস্তুপ্রধান ঘটনাবিন্যাসের প্রকাশ। গীতিকাব্যোচিত সুরেলা বাঁশি নয়, রণসজ্জার তুর্য-নিনাদ। মহাকাব্য মহাকায়, মহিমোজ্জ্বল, ব্যাপক হিমাদ্রিকান্তির মতো ধীর, গম্ভীর, প্রশান্ত, সমুন্নত ও মহত্ত্বব্যঞ্জক। এই কাব্যে কবির আত্মবাণী অপেক্ষা বিষয়বাণী ও বিষয়বিন্যাসই আমাদের অধিকতর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এছাড়া সংস্কৃত আলংকারিকদের মতে আশীর্বচন, মস্ক্রিয়া অথবা বস্তুনির্দেশ দ্বারা এই কাব্য শুরু হয়। মহাকাব্যের আখ্যানবস্তু পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক। বৈয়াকরণ বিশ্বনাথ বলেছেন–“ইতিহাসোঙবংবৃত্তমন্যদ্বা সজ্জনাশ্রয়”। নায়ক (কখনো কখনো একাধিক নায়কও থাকতে পারে) ধীরোদাত্তগুণসমন্বিত অর্থাৎ সমস্ত সদ্গুণের সমষ্টিভূত; সর্গসংখ্যা অষ্টাধিক এবং পটভূমি স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল প্রসারী। এতে শৃঙ্গার, বীর, শান্ত–এই তিনটির একটি রস মুখ্য বা প্রধান এবং অন্যান্য রস এদের অঙ্গস্বরূপ হবে।
সংস্কৃত আলংকারিকদের মতে যা মহাকাব্য, তার সঙ্গে পাশ্চাত্য মহাকাব্যের কোনো কোনো বৈসাদৃশ্য থাকলেও এদের মধ্যে ভাবগত সাদৃশ্য বর্তমান। পাশ্চাত্য আলংকারিক এরিস্টটলের মতে, “মহাকাব্য আদি, মধ্য ও অন্ত সংবলিত বর্ণনামূলক কাব্য। এতে বিশিষ্ট কোনো নায়কের জীবনকাহিনি অখণ্ডভাবে বর্ণনা করা হয় এবং বীরোচিত ছন্দের সাহায্যে কীর্তিত হয়। মহাকাব্যের বস্তু উপাদান জাতীয় জীবনের ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক তথ্য সরবরাহ করে। এর অনুপ্রেরণা অধিকাংশ সময়ই ঐশীশক্তি; এতে মানব, দানব, দেবদেবীর চরিত্রের সমাবেশ এবং প্রয়োজনবোধে অতিলৌকিক স্পর্শও উপস্থিত থাকতে পারে। তবে মহাকাব্যের পরিসমাপ্তি সকল সময়েই শুভান্তিক হবে এমন কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। এতে জটিল ঘটনাবর্তের সৃষ্টি এবং বহুবিধ চরিত্র সন্নিবেশ থাকলেও সমগ্র কাব্যটিতে একটি অখণ্ড শিল্প-সংগত সৌন্দর্যবোধ ও মহত্ত্বব্যঞ্জক গাম্ভীর্য থাকবে। এর। ভাষা প্রসাদগুণসম্পন্ন, ওজস্বী এবং অনুপ্রাস-উপমা প্রভৃতি অলংকারবহুল হবে।
এ প্রসঙ্গে আরও কিছু মহকাব্যের খোঁজ নিলে বাহুল্য হবে না নিশ্চয়। প্রাচীন মহাকাব্য (পঞ্চম শতক থেকে পঞ্চদশ শতক)। সপ্তম শতক–‘তায়েন বো কোয়াইলেঞ্জ’ (প্রাচীন আইরিশ); পাণিনি প্রণীত রামায়ণ ও ‘অষ্টদেহী’ অনুসরণে সংস্কৃত ভাষায় পরিমার্জিত ‘ভট্টিকাব্য’; মহাভারত অনুসরণে সংস্কৃত ভাষায় ভারবি রচিত ‘কীরাতাজুনীয়’ ও মাঘ রচিত ‘শিশুপালবধ। অষ্টম থেকে উনবিংশ শতক–‘বিউওল্ফ’ এবং “ওয়ালদেয়ার’ (প্রাচীন ইংরেজি); ডেভিড অব সাসুন (আর্মেনিয়ান)। নবম শতক–সংস্কৃত ভাষায় রচিত ‘ভাগবত পুরাণ’। দশম শতক–শাহনামা’ (ফারসি সাহিত্য); সেন্ট গলের একেহার্ড প্রণীত ‘ওয়াথারিয়াস’ (লাতিন)। একাদশ শতক–‘তাঘরিবাত বনি হিলাল’ (আরবি সাহিত্য); জনৈক জার্মান লেখক রচিত ‘রুডলিয়েব’ (লাতিন); বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের বীরকে ঘিরে ‘ডাইজেনিস একরিটাস’ (গ্রিক); ‘এপিক অব কিং গেসার’ (তীব্বতীয় ভাষায়)। দ্বাদশ শতক–‘চ্যানসন ডি রোল্যান্ড’ (প্রাচীন ফরাসি); শোটা রুসট্যাভেলি প্রণীত’দ্য নাইট ইন দ্য প্যান্থার স্কিন’; ওয়াল্টার অব চাটিলন রচিত ‘আলেক্সান্দ্রিস’ (লাতিন); জোসেফ অব এক্সটার প্রণীত’ডি বেলো ট্রোইয়ানো’ ও ‘দ্য লস্ট এন্টিওচিজ’; কারম্যান ডি প্রোডিসিওন গুইনোনিস (লাতিন); জন অব হভিলে প্রণীত ‘আর্কিট্রেনিয়াস’ (লাতিন বিদ্রুপাত্মক কাব্য); পিটার অব এবোলি প্রণীত “লিবার অ্যাড অনুরেম অগাস্টি’; বাইলিনাস প্রণীত ‘দ্য টেল অব ইগোর’স ক্যাম্পেইন’ (একাদশ থকে ঊনবিংশ শতক)। ত্রয়োদশ শতক–‘নিবেলানজেনলাইড’ (জার্মান ভাষা); ওলফ্রাম ভন ইসেনব্যাচ প্রণীত ‘পার্জিভাল’ (জার্মান ভাষা); লায়ামন প্রণীত ‘ব্রুট’; অকসিটান ভাষায় রচিত ‘চ্যানসন ডি লা ক্রোইসেড আলিবিজিওইস’, ‘অন্তরা ইবনে সাদ্দাদ ও “সিরাত আল-জহির বাইবারস’ (আরবি ভাষা); ‘সান্দিয়েতা কেইতা’; ‘এল ক্যান্টার ডি মাইও সিড’ (প্রাচীন স্পেনিশ); জোহানেস ডি গারল্যাডিয়া প্রণীত ‘ডি ট্রামফিস একক্লেসিয়ে’ (লাতিন); উইলিয়াম অব রেনেস প্রণীত ‘গেস্টা রেগাম ব্রিটানিয়ে’ (লাতিন); ই সিয়াং-হাইও প্রণীত ‘জিওয়াং আংগি’ (কোরিয়ান) চতুর্দশ শতক–জন গাউয়ার রচিত ‘কনফেসিও অ্যাম্যানটিস’; জনৈক পাদ্রি রচিত ‘কার্সর মান্ডি’; দান্তে আলিগিয়েরি রচিত ‘ডিভিনা কমেডিয়া’ বা দ্য ডিভাইন কমেডি(ইতালীয় ভাষায়); পেট্রাখি রচিত ‘আফ্রিকা; জাপানিদের যুদ্ধের পৌরাণিক কাহিনিকে ঘিরে রচিত ‘দ্য টেল অব দ্য হিয়েকি’। পঞ্চদশ শতক–অ্যালিটারেটিভ মোর্তে আর্থার; ম্যাটিও মারিয়া বোয়ার্দো রচিত অরল্যান্ডো ইনামোরাতে (১৪৯৫); স্যামুয়েল বুখ; স্লোখিম বুখ; বুক অব ডিডি কোরকুট।
রামায়ণ কি ধর্মগ্রন্থ? রামায়ণ প্রাচীনকালে রচিত (প্রাচীনকাল’ মানে পণ্ডিতগণের মতে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ বছর আগে, অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৩০০০ হাজার বছর আগে।)। প্রাচীন যুগের পুরো ইতিহাসের না হলেও অংশত আকর (ইতিহাসের অনেক উপাদান এখান থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই বইটির অনেক তথ্য সত্যি প্রতিপন্ন করে ঐতিহাসিকরা তত্ত্বও বানিয়ে নিয়েছেন)। যদিও এইচ জি ওয়েলস, টয়েন বি, কান, রমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ বিখ্যাত ঐতিহাসিকদের ব্যাখ্যানুসারে–“কেবল ঘটনাপঞ্জী ইতিহাসই ইতিহাস নহে। সন তারিখ সহ কোনো রাজারাজড়ার কাহিনিকেই কেবলমাত্র ইতিহাস বলতে পারি না, যুগধর্মের ইতিহাস ও প্রাচীন সমাজজীবনের চিত্রপটকেও ইতিহাসের সংজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে।” গ্রন্থটি হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ হিসাবে মেনে নেওয়া হয়েছে (রাম, সীতা, হনুমানের বিরোধিতা করলেই গর্দান। রামের জন্য বাবরি মসজিদ পর্যন্ত ভাঙা সম্ভব হয়)। রামায়ণ প্রথমে সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয়। পরে তামিল এবং তারও পরে ভারত তথা বিশ্বের অন্যান্য ভাষাতেও ভাবানুবাদ হয়। অবশ্য মূল সংস্কৃত রামায়ণ অন্য ভাষায় কাহিনি সংযোজন ও বর্জন হয়ে বদলাতে থাকল। মূল সংস্কৃত ভাষায় রামায়ণ রচনা করেন বাল্মীকি নামে ঋষিকবি। বইটি রচিত হলেও লিখিত আকারে ছিল না। লিখিত না-থাকার কারণ তখনও লিপির জন্ম হয়নি। তাই মুখে মুখে মুখস্থ করেই বংশানুক্রমে কাব্যটির সংরক্ষণ চলছিল। অন্তত পণ্ডিতেরা এমনই বলেন। দুনিয়ার পণ্ডিতরাও এই ধারণাগুলিকে পরম সত্য বলে মেনেও নিয়েছেন।
তবে সত্যটা কী? শ্রীবিবস্বান আর্য ‘মিথ্যাময় ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে বলেছেন–“রামায়ণ নামটার সঙ্গে রাম বা শ্রীরামচন্দ্রের নামের কোনো সম্পর্ক ছিল না। বইয়ের নাম রাখার ব্যাপারে এ ধরনের অসংগতি ইলিয়াড-ওডিসি নামের প্রাচীন গ্রিক ভাষায় লেখা বলে প্রচার করা দুটি কাব্যগ্রন্থের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। ইলিয়াডের সঙ্গে ইলিয়াম স্থাননামের এবং ওডিসির সঙ্গে অডিসিয়ুস চরিত্ৰনামের সম্পর্ক থাকার কথাটাও কষ্টকল্পিত। স্বভাবতই কিছু প্রশ্ন সামনে এসে পড়ে। সম্পর্ক যদি না-ই থাকবে তবে গ্রন্থ চারটির (রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড ও ওডিসি) নাম রাখার আসল কারণটা কী? তবে কি গ্রন্থগুলির নাম রাখার ব্যাপারে কোনো রহস্য আছে? না-হলে চার চারটি বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থের নাম রাখতে একইরকম অসংগতি থেকে যাবে কেন? কেন ইলিয়াড ও ওডিসি শব্দদুটির তর্জমা করেই রামায়ণ ও মহাভারত নামদুটো উদ্ভাবনের ব্যবস্থা হয়েছে?”
গ্রন্থগুলির রচনাকাল সম্পর্কে ২০০/৪০০ বছর এদিক-ওদিক করার খেলা কেউ কেউ দেখালেও এগুলি যে জিশুখ্রিস্ট্রের জন্মের আগে লেখা হয়েছে সে সম্পর্কে কেউই সন্দেহ প্রকাশ করেননি। তবে রামায়ণ কোন্ সময়ে। রচিত হয়েছিল তা নির্ণয় করা সহজ নয়। কারণ রামায়ণে যেমন মূল’ অংশ আছে, তেমনই আছে প্রক্ষিপ্ত অংশ। আবার এই প্রক্ষিপ্ত অংশগুলিও বিভিন্ন সময়ে যোগ করা হয়েছে। কাজেই কালগত বৈষম্যের ফলে সমগ্র রামায়ণের একটি নির্দিষ্ট রচনাকাল নির্ণয় করা সম্ভব নয়। ইয়াকোবি (Jacobi) ও ম্যাকডাওয়েল (McDowell) মনে করেন, রামায়ণ প্রাক্-যুদ্ধযুগের রচিত কাব্য। এর রচনাকাল ৮০০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। কিথ (Keith) বলেন, রামায়ণ খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে রচিত৷ ভিন্টারনিৎস (Winternitz) ও বুলকে (Bulcke) বলেছেন, রামায়ণের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকেই।
বস্তুত ষষ্ঠ শতকের রামায়ণ গ্রন্থ উদ্ধার করা হয়েছে। রামায়ণ লিখিত পৃষ্ঠাগুলি ভারতের কলকাতার সংস্কৃত ভিত্তিক গ্রন্থাগারে পাওয়া যায়। সংস্কৃত সাহিত্য পরিষদ এ তথ্য বার্তা সংস্থা টাইমস অব ইন্ডিয়াকে জানিয়েছে। রামায়ণের এই সংস্করণে রাম-সীতা ও বিভিন্ন মানুষের কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে। তবে এ সংস্করণের বিশেষত্ব হচ্ছে, রাম-সীতার পৃথক হওয়ার কাহিনি বিশেষভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই সংস্করণ চতুর্থ খ্রিস্টপূর্বে রচিত বাল্মীকির রামায়ণ থেকে ভিন্ন। পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে উদ্ধার হওয়া ওই রামায়ণ। অন্যদিকে বাল্মীকির রামায়ণ সাত খণ্ডে প্রকাশিত। যা এখন পর্যন্ত সবার কাছে গ্রহণযোগ্য।
ইয়াকোবির মতকে স্বীকার করে নিয়ে ওয়েবার (weber) কয়েকটি যুক্তি দেখিয়েছেন–(১) রামায়ণ একটি রূপক মাত্র। ভারতবর্ষে গ্রিক আক্রমণের আগেই রামায়ণ রচিত হয়েছিল। রামায়ণে ‘যবন’ শব্দের ব্যবহার থাকলেও তা গ্রিকদের বোঝায় না। উত্তর-পশ্চিম ভারতে একসময় সমস্ত বৈদেশিক আক্রমণকারী সাম্রাজ্যলোভী জাতিকে ‘যবন’ বলে অভিহিত করা হত। (২) রামায়ণ রচনাকালে পাটলিপুত্ৰ (এখন পাটনা) নগরী স্থাপন হয়নি। মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে তা স্থাপিত হয় এবং মগধরাজ অজাতশত্রুর পৌত্র উদয়ী রাজগৃহ থেকে পাটলিপুত্রে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। রামায়ণে এই বিখ্যাত নগরীর উল্লেখ না-থাকার পাটলিপুত্র প্রতিষ্ঠার পূর্বে রামায়ণ রচিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়।(৩) বাল্মীকির ভাষা বহু ক্ষেত্রে পাণিনি ব্যাকরণের নিয়ম মেনে চলেনি। তাই মনে করা যায়, রামায়ণ পাণিনির আগে রচিত। (৪) রামায়ণে মিথিলা ও বিশালা নামে দুটি পৃথক নগরীর উল্লেখ আছে। বুদ্ধের সময়ে ওই দুই নগরী মিলিত হয়ে একটি রাজ্যে পরিণত হয়, সেই রাজ্যটির নাম বৈশালী। রামায়ণে বৈশালীর উল্লেখ না-থাকার মনে করা যেতে পারে রামায়ণ বৌদ্ধযুগের আগে রচিত।(৫) রামায়ণের কাহিনি অনুসরণ করলে দেখা যায়, সে যুগে ভারতবর্ষ অনেক অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল। বৌদ্ধযুগের পূর্বেই ভারতবর্ষের এই অবস্থা। এ থেকেও প্রমাণিত হয় রামায়ণ বৌদ্ধযুগের আগে রচিত। (৬) বৌদ্ধ ও জৈনযুগের সাকেত নগরী আগে কোশলের রাজধানী ছিল এবং তার নামকরণ করা হয় অযোধ্যা। রামায়ণে সাকেত নগরীর উল্লেখ না-থাকার অনুমান করা যায় যে, বৌদ্ধযুগের বহু আগেই রামায়ণ রচিত হয়। (৭) ইয়াকোবির মতে, রামায়ণে পালি ভাষার কোনো চিহ্ন না-থাকার রামায়ণ বৌদ্ধযুগের আগেই রচিত। (৮) রামায়ণের কোনো চরিত্রই ঐতিহাসিক নয়। সীতা মূলত কৃষির রূপক। রামের দ্বারা রাবণ বধ এবং সীতা উদ্ধারের কাহিনি বস্তুত অনার্যদের আক্রমণের হাত থেকে কৃষিভিত্তিক আর্যসভ্যতা রক্ষা করা। সুতরাং বৌদ্ধযুগের বহু পূর্বেই রামায়ণের মূল অংশের রচনা সম্পূর্ণ হয়েছিল। অতএব ওয়েবার ও ইয়াকোবির গবেষণা থেকে যে সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে, তা হল–রামায়ণ খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের পূর্বে রচিত হয়েছিল। দশরথ জাতক, শ্যাম জাতক, বিশ্বম্ভব জাতক, নলিনীকা জাতক, মহাসুত সোম জাতক প্রভৃতি জাতক কাহিনির সঙ্গে মিল দেখে ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন মনে করেন, বাল্মীকি রামায়ণ রচনা করার পূর্ব থেকেই জাতকে বিভিন্ন রামকাহিনি প্রচলিত ছিল।
‘রামায়ণ’ বইটির নায়কের নাম রাম, নায়িকার নাম সীতা, খলনায়ক রাবণ। প্রায় ত্রুটিহীন চিত্রনাট্য। ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কেউ বলেন রামায়ণ হল আর্য আর অনার্যের দ্বন্দ্ব। কে আর্য? কে অনার্য? কেউ বলেন রাম আর্য, অনার্য রাবণ। কেউ বলেন রাম অনার্য, রাবণ আর্য। অনেকে বলেন রাম অন্ত্যজ, তথা অস্পৃশ্যের প্রতিনিধি। আর্যরাই কৌশলগতভাবে অনার্য রামকে দিয়েই অনার্যদের বিনাশ করেছেন। রাবণ আর্য তথা ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতিনিধি। অনেকে রামকে আর্য তথা দেবতার প্রতিনিধি বলেন এবং রাবণকে রাক্ষস তথা অসুর তথা অনার্যের প্রতিনিধি বলেন।
তবে কি রামায়ণ ইক্ষ্বাকু বংশ আর কেকয় বংশের সংঘাত? বিশ্বামিত্র আর বশিষ্ঠের সংঘাত? ক্ষত্রিয় আর ব্রাহ্মণের সংঘাত? রাম আর ভরতের সংঘাত? দশরথ আর কৈকেয়ীর সংঘাত? এক মহাকাব্য, অনেক অভিমুখ। একটি মহাকাব্য–যে যেদিক দিয়ে পারে ব্যাখ্যা করে, বিশ্লেষণ করে, নির্ণয় করে। রামকে কেউ অলৌলিক ক্ষমতার অধিকারী দেবতা মনে করেন, কেউ কেউ আবার রামচন্দ্রকে দোষেগুণে বিচক্ষণ মানুষ ভাবেন। কেউ কেউ রামকে একটি মহাকাব্যের একটি কাল্পনিক চরিত্রের বেশি ভাবতে চান না।
মূল কাব্যের ভিতরে যাওয়ার আগে গ্রন্থের নামকরণে ব্যাপারটা একটু বুঝে নিতে পারি।”নামে কী আসে যায়, গোলাপকে যে নামেই ডাকো না কেন, সুগন্ধ সে ছড়াবেই”–জুলিয়েটে মুখে শেক্সপিয়রের এই আপ্তবাক্য যে ব্যাপ্তির দিকে মন টানে সেদিকে না এগিয়ে বলা যায় সবক্ষেত্রেই নামের একটা গুরুত্ব আছে। চেনার জন্য, চেনানোর জন্য, জানার জন্য, স্বাতন্ত্রের জন্য নাম চাই। হতে পারে সেই নাম বিষয়ভিত্তিক, বস্তুভিত্তিক, ভাবভিত্তিক, ব্যঞ্জনাভিত্তিক, চরিত্রভিত্তিক ইত্যাদি। রচনাকার তাঁর রচনার নাম অনেক ভেবেচিন্তেই দেন। অনেকে বলেন কাব্যটি রামকেন্দ্রিক বলেই কবি রামায়ণ নামকরণ করেছেন। কেউ কেউ বলেন নায়ক চরিত্রের নাম রাম, সেই কারণেই রামায়ণ নামকরণ করা হয়েছে–এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। রামের ‘অয়ন’, অর্থাৎ যাওয়া। রামায়ণের ‘অয়ন’ অংশটি নিয়ে পণ্ডিতেরা অনেক জল ঘোলা করেছেন। বলা হয়েছে–রামায়ণকে “রামস্য চরিতান্বিতং অয়ন শাস্ত্রম্”। অতএব বোঝাই যাচ্ছে ‘অয়ন’ শব্দের অর্থ শাস্ত্র’, এটা কল্পনার ফসল। এইচ. এইচ. উইলসন তাঁর ‘Sanskrit-English Dictionary’ গ্রন্থে আর-এক কায়দায় নামটির ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করেছেন, বলেছেন–‘অয়ন’ শব্দের অর্থ বাসস্থান, অর্থাৎ রামায়ণ মানে দাঁড়াল রামের বাসস্থান। এল, এ. ওয়াডেল তাঁর “The Makers of Civilization in Race and History’ গ্রন্থে বলেছেন–‘অয়ন’ শব্দের অর্থ ‘দুঃসাহসিক অভিযান’ বা ‘অ্যাডভেঞ্চার’। অর্থাৎ রামায়ণের মানে দাঁড়াল ‘রামের দুঃসাহসিক অভিযান’ বা ‘রামের অ্যাডভেঞ্চার। কেউ কেউ ‘অয়ন’ মানে কীর্তি’ বলেছেন, সেই হিসাবে রামায়ণের অর্থ দাঁড়ায় ‘রামের কীর্তি। পাণিনীর সূত্রানুসারে কেউ কেউ বলেন রামায়ণ’ শব্দের অর্থ ‘রামের বংশধর’, অর্থাৎ ‘রামবংশ। সুকুমার সেন বলেন, “কিন্তু শব্দটি (রামায়ণ) যে খাঁটি তাতে সন্দেহ নেই এবং শব্দটির মূলে যে রাম আছে তাতেও সন্দেহ করা চলে না”। আরও হরেক রকমের অর্থ পাওয়া যায়, পাছে বিরক্তির উদ্রেগ হয়, তাই আর উল্লেখ করলাম না। সহস্র পণ্ডিতের সহস্র মত। অয়ন’ শব্দযোগেই যদি নামটা বানানো হয়ে থাকে, তবে তিন ঘর আগে ‘র’ থাকার কারণে ‘অয়ন’-এর ‘ন’ (দন্ত্য) কীভাবে ‘ণ’ (মূর্ধন্য হয়ে যায়? ব্যাকরণে কোন্ নিয়মে এটা সম্ভব হল? তাহলে ‘রসায়ন’ কেন ‘রসায়ণ’ নয়? প্রশ্ন হল রাম বা। শ্রীরামচন্দ্রের নামে ওই রামায়ণের সম্পর্ক ছিল কি না।
বাংলায় ‘রামধনু’ বা ‘রামদা’-র সঙ্গে কিংবা হিন্দি ভাষায় ‘রামতরোই’ বা ‘রামদানা’-র সঙ্গে কিংবা ওডিশায় ‘রামতালি’ বা ‘রামফল’-এর সঙ্গে অথবা গুজরাতি রামপাতর’ বা ‘রামবাণ’-এর সঙ্গে কিংবা মারাঠি ভাষায় ‘রামপাত্র’ ও ‘রামবাণ’-এর সঙ্গে রামনামের বা রামায়ণের সম্পর্ক থাকলে তা আজগুবি। বস্তুত রামায়ণ’ শব্দটি সংস্কৃত বলে চালানোর চেষ্টা হলেও, এটি মূলত খাঁটি গুজরাতি শব্দ। A long series of woes–অর্থে এই ভাষাতে রামায়ণ লোকচল শব্দ হিসাবে চলে। হিন্দি এবং মারাঠিতেও ‘A long series of woes’ রামকথা বা রামকাহানি লোকচল শব্দ হিসাবে প্রচলিত। মারাঠি ভাষায় রামায়ণ শব্দের অর্থ হয় বিরক্তিকর গল্প’ (Tedious yarn)। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন–“ “রামায়ণ’ শব্দের সংস্কৃতে কোন অর্থ হয় না, কিন্তু বাঙ্গালায় সদর্থ হয়। বোধ হয়, রামায়ণ’ শব্দটি ‘রামা যবন’ শব্দের অপভ্রংশ মাত্র। কেবল ‘ব’-কার লুপ্ত হইয়াছে। রামা যবন বা রামা মুসলমান নামক কোন ব্যক্তির চরিত্র অবলম্বন করিয়া কৃত্তিবাস প্রথম ইহার রচনা করিয়া থাকিবেন। পরে কেহ সংস্কৃতে অনুবাদ করিয়া বল্মীকমধ্যে লুকাইয়া রাখিয়াছিল। পরে গ্রন্থ বল্মীকমধ্যে প্রাপ্ত হওয়ায় বাল্মীকি নামে খ্যাত হইয়াছে।”
‘ব্যাস’ (মহাভারতকার) গুজরাতি পদবি হলেও, বাল্মীকি (রামায়ণকার) পদবিটি কিন্তু মগহি-ভোজপুরী। রামায়ণকে বাংলা ভাষায় শ্রীরামের পাঁচালী’ বলা হত। শ্রীরামের পাঁচালী’ লিখেছেন কৃত্তিবাস ওঝা। কৃত্তিবাস ওঝা ‘রামায়ণ’ নামে কোনো গ্রন্থ লেখেননি। তাতে কী হল? বাজারে তো ‘কৃত্তিবাসের রামায়ণ’ নামেই গ্রন্থ পাওয়া যায়। রামায়ণ’ শব্দের অর্থবহতা বাংলা ভাষায় ছিল না। মারাঠি আর গুজরাতি ভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষায় এর কোনো ব্যঞ্জনা নেই। কবির নিজের মাতৃভাষা এক, কাব্য করতেন অন্য ভাষায়? কেমনভাবে সম্ভব হল? কেন সম্ভব নয়? ঝুম্পা লাহিড়ী, অমিতাভ ঘোষ, অরুন্ধতী ঘোষের মাতৃভাষা বাংলা। সাহিত্য করেছেন ইংরেজি ভাষায়। যেমন শঙ্করাচার্য কেরলিয়ান বা মালয়ালম ভাষায় না-লিখে রহস্যজনকভাবে ‘দুর্বোধ্য’ সংস্কৃত ভাষায় লেখেন। “মিথ্যাময় ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে শ্রীবিবস্বান লিখেছেন–“কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে ভারতের নানান ভাষাভাষী পণ্ডিতদের যে ডাকা হয়েছিল এ খবর ইতিহাসেই পাচ্ছি। ডাকা হয়েছিল আঠারো শতকের সাতের ও আটের দশকে। মারাঠি পণ্ডিতদের, গুজরাতি বিদ্বানদের, ওড়িয়া বিদগ্ধদের অনেকেই সেই ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন।…দুনিয়ার প্রথম রাষ্ট্রায়ত্ত কুটির শিল্পের পত্তন হয়েছিল তথাকথিত ক্লাসিক্যাল ভাষাগুলোয় ক্লাসিক্যাল কাণ্ডকারখানা বানিয়ে রাখার ক্লাসিক্যাল মতলবেই। আর তা হয়েছিল ইউরোপ ও এশিয়ার নানান দেশেই। লাতিন, হিব্রু ও প্রাচীন গ্রিক ভাষা প্রাচীন বলে প্রচার করা নানান কেতাব লেখানোর উদ্যোগ আয়োজন নেওয়া হয়েছিল। ভারতে নেওয়া হয়েছিল সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত, অপভ্রংশ, আরবি, ফারসি কেতাব লেখানোর ব্যবস্থা। সরকারি উদ্যোগে কলকাতা, বেনারস, নদিয়া (নবদ্বীপ) মিথিলায় গড়ে উঠেছিল সংস্কৃত মাধ্যম মিথ্যাসৃষ্টির আঁতেলি কর্মশালা। বেনারস, গাজিপুরে তথাকথিত বৈদিক সংস্কৃত ভাষার নেপথ্য কর্মকাণ্ডও চলেছিল। বাংলা, ওডিশা, মারাঠি (প্রাকৃত), গুজরাতি ও হিন্দি প্রধানত এই পাঁচটি ভাষায় (অন্য ভাষায় শব্দ রাখারও ব্যবস্থা হয়েছিল) বেশ কিছু শব্দ অবিকল একইভাবে কিংবা কিছুটা ঘষেমেজে নিয়ে ওই সংস্কৃত ভাষায় বিশেষ ঠাটের শব্দভাণ্ডার তৈরি করে নেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল, আর এটা ঘটেছিল আঠারো শতকের শেষ চতুর্থাংশে। ইংরেজি শব্দের সংস্কৃত প্রতিশব্দ কী রাখা যায় এই নিয়েও নানান কায়দায় জল্পনাকল্পনা হত। ভারতের নানান ভাষার কোন্ কোন্ শব্দ সংস্কৃতে ঠাঁই দেওয়া যায় সেটা নিয়েও ভাবনাচিন্তা কম হত না।…ব্যাকরণসর্বস্ব লাতিন ও সংস্কৃত ভাষা সৃষ্টির পিছনে যেসব নেপথ্যশিল্পী ছিলেন তাঁদের কেউই প্রাচীন যুগের ছিলেন না। ছিলেন অর্বাচীন যুগের। লাতিন এবং সংস্কৃত দুই ভাষায় লেখা কেতাবগুলির প্রায় সবই উনিশ শতকে প্রকাশিত হয়েছে কেন? কেন আঠেরো শতকে সংস্কৃত একখানা কেতাবও ছাপা হয়নি? সংস্কৃত রামায়ণের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৪৯ সালে। ক্রমশ অন্য খণ্ডগুলির প্রকাশ হতে হতে শেষ খণ্ডটির প্রকাশ ঘটেছিল ১৮৭৫ সালে।… বাংলা রামায়ণ ১৮০৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। অর্থাৎ ৭২ বছর পরে সংস্কৃত। রামায়ণ প্রকাশিত হয়। রামায়ণের সম্পূর্ণ কলেবরে পুথি কেউ কি দেখেছেন?
গোড়াতে রামায়ণ যে রূপে ছিল, যত দিন গেছে তত বিচিত্র সব নতুন নতুন কাহিনি সংযোজিত হয়েছে। যেটাকে বলা হয় প্রক্ষিপ্ত প্রক্ষিপ্ত হল সেটাই, মূল কবি যা লেখেননি–লিখেছেন অস্বীকৃত অন্য কেউ। এই প্রক্ষিপ্ত অংশগুলির বেশিরভাগ অলৌকিক, অপার্থিব। উদ্দেশ্য প্রণিধানযোগ্য। রামায়ণে পরবর্তী সংযোজিত অংশগুলি অভিপৌরাণিক, অর্থাৎ পুরাণে প্রতিফলিত যে সামাজিক মূল্যবোধ ও শাস্ত্রীয় অনুশাসনের সমাবেশে ভারতীয় ধর্মচিন্তা তার বিবর্তিতরূপে ক্রমে হিন্দুধর্ম’ বলে চিহ্নিত হল। যে মূল্যবোধ জনমানসে প্রোথিত হয়ে আছে, তা হল–একটি মূল কাহিনির, অপরটি সংযোজিত বা প্রক্ষিপ্ত অভিপৌরাণিকেরা।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন–“কিংবদন্তী আছে যে, ইহা বাল্মীকি প্রণীত। বাল্মীকি নামে কোনো গ্রন্থকার ছিল কি না, তদ্বিষয়ে সংশয়। বল্মীকি হইতে বাল্মীকি শব্দের উৎপত্তি দেখা যাইতেছে, অতএব আমার বিবেচনায় কোন বল্মীকমধ্যে এই গ্রন্থখানি পাওয়া গিয়াছিল। ইহাতে কি সিদ্ধান্ত স্থির করা যায় দেখা যাউক। রামায়ণ নামে একখানি বাঙ্গালা গ্রন্থ আমি দেখিয়াছি। ইহা কৃত্তিবাস প্রণীত। উভয় গ্রন্থে অনেক সাদৃশ্য আছে। অতএব ইহাও অসম্ভব নহে যে, বাল্মীকি রামায়ণ কৃত্তিবাসের গ্রন্থ হইতে সংকলিত। বাল্মীকি রামায়ণ কৃত্তিবাস হইতে সংকলিত, কি কৃত্তিবাস বাল্মীকি রামায়ণ হইতে সংকলন করিয়াছেন, তাহা মীমাংসা করা সহজ নহে; ইহা স্বীকার করি। কিন্তু রামায়ণ নামটিই এ বিষয়ের এক প্রমাণ।
বস্তুত সাতটি কাণ্ডে বিভক্ত রামায়ণকে আমরা যে আকারে পাই, সেটাই রামায়ণের মূল রূপ কি না এবং মূল কবির রচনা কি না–এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। আধুনিক পণ্ডিতদের মতে রামায়ণের আদি ও সপ্তম কাণ্ড পুরোপুরি প্রক্ষিপ্ত বা সংযোজিত। যুক্তিগুলি কী, সেগুলি একটু দেখে নেওয়া যাক–(১) আদি ও সপ্তম কাণ্ডে রামচন্দ্র হলেন বিষ্ণুর অবতার। কিন্তু বাকি পাঁচটি কাণ্ডেই দেখা যায়–তিনি একজন আদর্শ, অমিতবিক্রমী মানুষ। (২) আদি ও সপ্তম কাণ্ডের রচনাশৈলী ও ভাষা অপর পাঁচটি কাণ্ডের তুলনায় অত্যন্ত নিম্নমানের।(৩) বালিদ্বীপে প্রাপ্ত রামায়ণে উত্তরকাণ্ড অনুপস্থিত। (৪) প্রথম কাণ্ডে যেসব কথা বলা হয়েছে, অন্য পাঁচটি কাণ্ডের মধ্যে কোথাও তার উল্লেখ বা সমর্থন তো নেই-ই, উপরন্তু তার বিরোধিতা বা বৈপরীত্য লক্ষ করা যায়।(৫) প্রথম সূচি অনুসারে উত্তরকাণ্ডে সীতা নির্বাসনরূপ কোনো ঘটনার উল্লেখ নেই। কিন্তু দ্বিতীয় সূচিতে এই ঘটনার উল্লেখ থাকার মনে হয় উত্তরকাণ্ডের যোজনা পরবর্তীকালে হয় এবং তারপরেই দ্বিতীয় বিষয়সূচিতে সন্নিবেশ ঘটে। (৬) আদি ও উত্তরকাণ্ডে নানা প্রকার অলৌকিক ও অপার্থিব আখ্যান ও উপাখ্যান সংযোজিত হওয়ায় মূল ঘটনাপ্রবাহের ধারাবাহিকতায় স্খলন হয়েছে। (৭) যুদ্ধকাণ্ডের শেষে রামায়ণ পাঠের ফলের উল্লেখ আছে। এটাই প্রাচীন মূল গ্রন্থের সমাপ্তি বাক্য বলেই মনে হয়। (৮) উত্তরকাণ্ডের বিস্তৃত পরিসরে রাম-সীতার কাহিনি মাত্র এক-তৃতীয়াংশ, অবশিষ্ট অংশ বিভিন্ন বিচিত্র সব আখ্যানে ভরপুর।(৯) আদিকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ডে বাল্মীকিকে রামচন্দ্রের সমকালীন কবিরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু মূল রামায়ণের বাল্মীকি এক পৌরাণিক ব্যক্তিত্ব। (১০) রামায়ণের দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ কাণ্ডগুলির নামকরণ করা হয়েছে বিষয়বস্তু অনুসারে। যেমন–অযোধ্যা কাণ্ড, অরণ্য কাণ্ড ইত্যাদি। কিন্তু প্রথম ও শেষ কাণ্ডের নাম ‘আদি’ ও ‘উত্তর’ কাণ্ড বিষয়বস্তু অনুসারে হয়নি।(১১) প্রথম এবং সপ্তম কাণ্ডে বাল্মীকি নিজেই গ্রন্থটির একটি চরিত্র। কিন্তু পরবর্তী পাঁচটি কাণ্ডে চরিত্র তো ননই, এমনকি কোথাও তাঁর নাম পর্যন্ত উল্লেখ নেই। (১২) বালকাণ্ডের চতুর্থ সর্গের দ্বিতীয় শ্লোকের উক্তি থেকে জানা যায়, ২৪০০০ শ্লোকে রামায়ণ সমাপ্ত হয়েছে। (“সন্নিবদ্ধৎ হি শ্লোকানাং চতুর্বিংশৎ সহস্রক/উপ্যাখ্যানশতঞ্চৈব ভার্গবেন তপস্বিনা।আদিপ্রভৃতি বৈ রাজন্ পঞ্চসৰ্গশতানি চা/কাণ্ডানি ষটকৃতানী সোত্তরাণি মহাত্মনা।) কিন্তু বর্তমানে পাওয়া বিভিন্ন সংস্করণে শ্লোকসংখ্যা অনেক বেশি। (১৩) রামায়ণের ষষ্ঠ কাণ্ডের অন্তর্গত সীতার অগ্নিপরীক্ষা বৃত্তান্তটিও পরবর্তীকালের সংযোজন। মূল গ্রন্থে সীতার অগ্নিপরীক্ষার দৃশ্যটি ছিল না। (১৪) বালকাণ্ডে দেখা যায়, রামচন্দ্রের বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য ভাইদের (লক্ষ্মণ, ভরত, শত্ৰুগ্ন) বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু অরণ্যকাণ্ডে দেখা যায়, শূর্পণখা যখন রামকে বিয়ে করতে চাইছিল, সেসময় রাম শূর্পণখাকে অবিবাহিত লক্ষ্মণের কাছে যেতে বলেন। মনে হয় তখনও লক্ষ্মণের বিয়ে হয়নি। (১৫) বাল্মীকির রামায়ণ ষষ্ঠ কাণ্ডেই পরিসমাপ্ত হয়েছে। রাবণ বধ করে সীতা ও লক্ষ্মণের সঙ্গে রাম অযোধ্যায় ফিরে রাজসিংহাসনে বসেন। তারপর সুখসমৃদ্ধিতে বসবাস করিতে লাগিল। মিলনান্তক যবনিকা। রাজ্যে সর্বত্র শান্তি বিরাজ করছে। তারপর আবার সপ্তম কাণ্ডের প্রয়োজন কী? কৃত্তিবাস ওঝার শ্রীরাম পাঁচালী’-র শুরুতেই রত্নাকর দস্যু থেকে বাল্মীকি হয়ে ওঠার একটা রোমাঞ্চক গল্প আছে। সেই ‘পাপের ভাগ না-নেওয়ার’ গল্প আর ‘মরা মরা’ থেকে ‘রাম রাম’-এর গল্পটি বাঙালি সমাজে বেশ জনপ্রিয়। অন্যদিকে বাল্মীকির কবি হওয়ার রামকথা শুরুর গল্পটি বিখ্যাত। তমসার তীরে এক ব্যাধের শরাঘাতে মৃত ক্রৌঞ্চপতির বিরহে ক্রৌঞ্চপত্নীর করুণ ক্রন্দন ঋষি বাল্মীকির হৃদয়কে বিদীর্ণ করে এবং তার কণ্ঠ থেকে আসে তীব্র অভিশাপবাণী–“মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতী সমাঃ/যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেমবধীঃ কামমমাহিত৷৷”
রামায়ণে বিভক্ত উত্তরকাণ্ডের ৯৪ সর্গে রামপুত্র লবকুশ রামায়ণগান মাঝপথে থামিয়ে অকস্মাৎ বললেন–“ভগবান বাল্মীকি এই কাব্যের রচয়িতা। ইহার শ্লোকসংখ্যা চতুর্বিংশৎ সহস্র এবং উপাখ্যান একশত। ইহাতে আদি হইতে পাঁচশত সর্গ ছয় কাণ্ড এবং উত্তরকাণ্ড নিবদ্ধ আছে।” এ তো দেখছি ঠাকুরঘরে কে, আমি কলা খাইনি। আগ বাড়িয়ে সাফাই।
কী আছে রামায়ণে? বাঙালি পাঠক-শ্রোতা-ভক্তরা যে রামায়ণ আর রামচন্দ্রকে জানেন, তার একটা রূপরেখা এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক–
(১) বালকাণ্ড বা আদিকাণ্ড : এই অধ্যায়ে ৭৭টি সর্গ আছে। আছে রামায়ণ রচনার সূচনা ইক্ষ্বাকু বংশের অযোধ্যারাজ দশরথ দেবতার বরে রাম, লক্ষ্মণ, ভরত ও শত্রুঘ্ন নামে চার জন্ম হয়। একদিন বিশ্বামিত্র ঋষি এসে যজ্ঞবিঘ্নকারী রাক্ষসদের বধ করার জন্য রাম-লক্ষ্মণকে নিয়ে গেলেন। তাড়কা বধের পর জনকের রাজসভায় হরধনু ভঙ্গ এবং রাম সহ লক্ষ্মণ, ভরত, শত্ৰুগ্ন সকল ভাইয়ের বিয়ে হয় ইত্যাদি।
(২) অযযাদ্ধাকাণ্ড বা অযোধ্যাকাণ্ড : এই অধ্যায়ে ১১৯টি সর্গ আছে। রামের অভিষেকের আয়োজন। দশরথের দ্বিতীয়া পত্নী কৈকেয়ী প্রার্থিত দুটি বরে রামের চোদ্দো বছর বনবাস ও ভরতের রাজ্যাভিষেক। পিতৃসত্য পালনের জন্য রামচন্দ্র স্ত্রী সীতা ও ভাই লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে বনে গেলেন। পুত্রবিরহে দশরথের মৃত্যু, চিত্রকূটে রামকে ফিরিয়ে আনার জন্য ভরতের অনুরোধ। অবশেষে রামচন্দ্রের পাদুকা নিয়ে ভরতের রাজ্যশাসন ইত্যাদি।
(৩) অরণ্যকাণ্ড : এই অধ্যায়েও ৭৫টি সর্গ। এই অংশে আছে দণ্ডকারণ্যে রামের হাজার হাজার রাক্ষস হত্যা, লক্ষ্মণ কর্তৃক রাবণের বোন শূর্পনখার নাক-কান কেটে দেওয়া এবং সেই প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে রাবণ কর্তৃক সীতাহরণ। সীতাকে কুটিরে না-পেরে রাম ও লক্ষ্মণের শোকবিহ্বলতা। এরপর সীতার খোঁজ করতে করতে গভীর অরণ্যে প্রবেশ এবং সেখানে দশরথের বন্ধু রাবণের সীতাহরণ বৃত্তান্ত শোনা ইত্যাদি।
(৪) কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড : এই অধ্যায়ে ৬৭টি সর্গ। এই অংশে বালীকে হত্যা করে সুগ্রীবের সঙ্গে রামের সঙ্গে শর্তসাপেক্ষে বন্ধুত্ব এবং সুগ্রীব রাজা হয়ে হনুমানকে সীতার খোঁজে আদেশ দেন। সেই আদেশ অনুযায়ী হনুমানও সীতার খোঁজে বেরিয়ে পড়েন।
(৫) সুন্দরকাণ্ড : এই অধ্যায়ে ৬৮টি সর্গ। এই অংশে হনুমান সমুদ্র পার হয়ে লঙ্কায় অশোকবনে সীতার দেখা পান এবং স্মারকচিহ্নস্বরূপ রামের দেওয়া আংটি দেখালেন। হনুমান সীতাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য রাবণকে অনুরোধ করলেন এবং রামের বীরত্বকাহিনি শুনিয়ে উপদেশও দিলেন। রাবণ হনুমানের উপদেশ ও অনুরোধ সপাটে প্রত্যাখ্যান করেন। এই অংশে লঙ্কার সৌন্দর্যের বর্ণনাও আছে।
(৬) যুদ্ধকাণ্ড বা লঙ্কাকাণ্ড : ১৩০টি সর্গ। এই অংশে রাম সুগ্রীবের সেনাদের সাহায্যে সমুদ্রসেতু করে লঙ্কায় পৌঁছলেন। ত্রিকুট পর্বতে অবস্থিত লঙ্কায় পৌঁছোনোর পর রাবণের আপন ভাই বিভীষণের সঙ্গে পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হয়। বিভীষণের অকুণ্ঠ সহযোগিতায় রামের সঙ্গে যুদ্ধে রাবণ সবংশে মারা যান। এই কাণ্ডে রাম-সীতা। সুখেই বসবাস করতে থাকলেন। আর বলা হয়েছে, রামগান শ্রবণে কী ফল লাভ হবে তার বিস্তারিত বর্ণনা।
(৭) উত্তরকাণ্ড : ১২৫টি সর্গ। এই কাণ্ডটি পরবর্তী অন্য কোনো কবির সংযোজন বলে অনেক পণ্ডিতগণ মনে করেন। এই অংশের প্রথমদিকে প্রাচীন গল্পকাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে। ষষ্ঠকাণ্ড পর্যন্ত তো রাম-সীতার দাম্পত্যজীবন সুখেই কাটছিল। উত্তরকাণ্ডে এসে অকস্মাৎ বিনামেঘে প্রায় বজ্রপাত। সীতার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলল প্রজারা, অপবাদের গুঞ্জন উঠতে থাকল। এহেন অপবাদ থেকে রেহাই পেতে রামের আদেশে লক্ষ্মণ আশ্রম-দর্শনের ছলনায় সীতাকে বাল্মীকির আশ্রমে দিয়ে এলেন। আশ্রমে থাকাকালীন সীতা দুটি যমজ সন্তানের জন্ম দিলেন–লব ও কুশ। অপরদিকে রাম সোনার সীতা নির্মাণ করে অশ্বমেধ যজ্ঞ শুরু করেন। রক্তমাংসের মাকে বাদ দিয়ে সোনার তৈরি মাকে দিয়ে যজ্ঞের আয়োজন-বার্তা লব-কুশের কাছে পৌঁছে যায়। লব-কুশ যজ্ঞস্থলে এসে রামগান শুরু করে। পরে সীতা অযোধ্যায় ফিরলে তাঁকে আগুনে প্রবেশ করিয়ে তাঁর সতীত্বের প্রমাণ নেওয়া হয়। কিন্তু সীতা অপমানিত হন এবং তাঁর মা বসুন্ধরাকে স্মরণ করলে পাতালপ্রবেশ হয়। লব ও কুশ অযোধ্যার সিংহাসনে বসেন। রাম সরযূর জলে প্রাণত্যাগ করেন। সংকসেংক্ষেপে এই কাণ্ডে পাওয়া যাবে–রামজন্মের পূর্বকাহিনি, রাক্ষস ও বানরদের বিবরণ, বেদবতী ইত্যাদির কথা এবং পূর্বকালের কিছু দেবাসুর যুদ্ধের বিচ্ছিন্ন কাহিনি আছে। আছে রাম কর্তৃক ভাইদের বিভিন্ন রাজ্যজয়ে প্রেরণ এবং ভ্রাতুস্পুত্রদের মধ্যে সেইসব বিজিত রাজ্য ভাগ করে দেওয়া–ইত্যাকার ইতিহাস। এই হল সংক্ষিপ্ত রামায়ণ।
জয়ন্তানুজ বন্দোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে তাঁর মহাকাব্য ও মৌলবাদ’ বইয়ে বলেন : “আদি বাল্মীকি রামায়ণে বালকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ড ছিল না। আর পরবর্তীকালে সংযোজিত এই দুই কাণ্ড এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রক্ষিপ্ত কথা বাদ দিলে আদি বাল্মীকি রামায়ণে রামের অবতারত্বের বিশেষ চিহ্ন পাওয়া যায় না। মহাকাব্য হিসাবেও রামায়ণের সাহিত্যগুণ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু তুলসী রামায়ণে বিষ্ণুকে শ্রেষ্ঠ দেবতা রামকে বিষ্ণুর অবতার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করাই ছিল প্রধান লক্ষ্য। যা এমনকি বালকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ড সহ পল্লবিত বাল্মীকি রামায়ণেরও প্রধান বিষয়বস্তু নয়। “
এক ভারত, কিন্তু বহু সংস্কৃতি। বহু সংস্কৃতি, বিচিত্র তার কল্পনা শাখাপ্রশাখায়। ৩০০টি ভিন্ন রামায়ণের সন্ধান পাওয়া যায়–চরিত্রগুলি যথাযথ–রাম, সীতা, রাবণ সবই আছে–বদলে গেছে ঘটনাপঞ্জি, বদলে গেছে সম্পর্ক, বদলে গেছে কার্য-কারণ, বদলে গেছে পরিণতিও। একই রামের গল্প বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ ফিরে ফিরে লিখেছে–ভিন্ন ভিন্ন অর্থে, ভিন্ন ভিন্ন ভাষ্যে। মূল রামায়ণ লিখিত হয়েছিল ২৪,০০০ শ্লোকে। ছিল ৫০০ সর্গ এবং ছয়টি কাণ্ড–“চতুর্বিংশৎ সহস্রাণি শ্লোকানামুক্তবান্ ঋষিঃ।/তথা সৰ্গৰ্শতা পঞ্চ ষটকাণ্ডানি তথোত্তর”। পরে উত্তরকাণ্ড যুক্ত হয়েছে। বাল্মীকির আগেও রামকথা ছিল, বাল্মীকির পরেও রামকথা আছে এবং থাকবে–ভিন্ন রূপে, ভিন্ন বোধে৷ এইভাবেই রামায়ণ বিপুলায়তন এক মহাসাহিত্যের পরিণত হয়েছে।
স্থানীয় বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে অজস্র গল্প-উপগল্প, কথা-উপকথা, ইতিহাস-অনৈতিহাস। তাই রামায়ণে রাম নিশ্চয়ই আছেন, কিন্তু রামায়ণের রাম সর্বত্র একইভাবে চিত্রিত হয়নি। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদরা একমত যে, বাল্মীকি রচিত রামায়ণের রাম আসলে এক আদর্শ ক্ষত্রিয় রাজার বা একজন আদর্শ মানুষের চরিত্রায়ণ। রামায়ণের জনপ্রিয়তা কোনো ধর্মগ্রন্থ হিসাবে নয়, বরং এক সুকথিত কাহিনি হিসাবে দেখা যায়। অবশ্য একথা অস্বীকার করা যায় না যে, পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ লেখকদের দ্বারা তা কিছুটা ধর্মগ্রন্থের রূপ নেয়। এখন হিন্দুত্ববাদীরা ক্ষমতায়নের অলিন্দ ঢুকে পড়তে রামকেই ঢাল বানিয়েছে। বাংলা, তামিল, তেলেগু, মালয়ালম ভাষায় রামায়ণকে ভুলে গেলে চলবে না–কারণ এখানেই রামকে একজন আদর্শ মানুষমাত্র। হিন্দু ধর্মগ্রন্থে কোথাও রামের উপাসনা করতে হবে এমন আদেশ নেই। তবে দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শুরুতে রামনন্দিনের কথা জানা যায়, যাঁরা রামভজনাকে মুক্তির পথ হিসাবে বর্ণনা করেছে।
বস্তুত ইতিহাসের দৃষ্টির দিক থেকে দেখলে রামায়ণের যুগ বলে কিছু হয় না। এমনকি কোনো সময়কেও চিহ্নিত করা যায় না। কারণ এই সাহিত্য বিশেষ কোনো সময়ে লিখিত হয়নি। দীর্ঘ প্রায় ২০০ বছর ব্যাপী এই মহাসাহিত্য গড়ে উঠেছে। নির্মাণ যখনই শুরু হোক, যখনই শেষ হোক না-কেন বেশ কয়েক শতাব্দী জুড়ে বিবর্তন চলেছিল, একই সময়কালে। সংস্কৃত ভাষায় রামায়ণ কেবল বাল্মীকিই লেখেননি, আছে আরও কিছু সংস্কৃতে লিখিত রামায়ণ। যেমন–আধ্যাত্ম রামায়ণ, আনন্দ রামায়ণ, যোগবাশিষ্ট রামায়ণ, ভুশণ্ডি রামায়ণ ইত্যাদি। আছে একে অপরের সঙ্গে বিস্তর পাঠভেদ। কথকও এক নয়। যেমন–বাল্মীকির রামায়ণের মূল কথক নারদ, অপরদিকে ‘আধ্যাত্ম রামায়ণ’-এর মূল কথক শিব। ভুশণ্ডি রামায়ণ’-এর কথকও নারদ। আনন্দ রামায়ণ’ কিন্তু সাতকাণ্ডে নয়, নয় কাণ্ডে। মিল-অমিল যাই হোক–সব রামায়ণেই কাহিনিবিন্যাস, পরিকাঠামো মায় লোকগাথা একদম ভিন্ন। বাঙালিদের কৃত্তিবাসের শ্রীরাম পাঁচালী’-র রামচন্দ্র নয়নাভিরাম, অসামান্য রূপবান, অলৌকিক শক্তিতে ভরপুর, অপরিসীম করুণা আর ভক্তকুলের মনোবাঞ্ছাপূরণে উদার। বাল্মীকির রামায়ণের রামচন্দ্র মহাশক্তিধর, তাঁর বজ্রকঠিন দু-হাত এবং শত্ৰুসংহারে নির্মম। থাইল্যান্ডের রামায়ণ আর কৃত্তিবাসী রামায়ণ এক নয়, ইন্দোনেশিয়ার রামায়ণী নাচগানের সঙ্গে তুলসীদাসের রামায়ণে বিস্তর ফারাক। আমরা ‘চন্দ্রাবতী রামায়ণ’ নামেও একটি রামায়ণ পাই। বেশ কিছুদিন আগে বইটির পিডিএফ কপি আমার হাতে এল। এই রামায়ণ নারীদের জন্য রচনা করেছেন এক নারী। সেই নারী চন্দ্রাবতী একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর রামায়ণে পুরুষকারকে দমন করেছেন কঠোর লেখনীতে। বর্ণিত হয়েছে সীতার কথা, সীতার জীবনকথা। বড়োই দরদে লিখিত হয়েছে নারী ও নারীত্বের অবমাননার কথা।
সুকুমার সেনের ‘রামায়ণী কথা’ গ্রন্থে অনেক রামায়ণের উল্লেখ পাওয়া যায়। গবেষক ক্যামিল বাল্ক ১৯৫০ সালে ৩০০টি রামায়ণ খুঁজে পেয়েছিলেন। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও প্রাবন্ধিক এ কে রামানুজম তাঁর লেখা ‘Three Hundred Ramayanas : Five Examples and Three Thoughts on Translation’ 21203 vooft রামায়ণের কথা বলেছেন। অসমিয়া ভাষায় মাধব-কণ্ডলীর রামায়ণ’, কম্বন লিখিত তামিল রামায়ণ ‘ইরামবাতায়ম’, তুলসীদাস লিখিত হিন্দি ভাষায় ‘রামচরিতমানস’, ভানুভক্ত লিখিত নেপালি ভাষায় ‘নেপালি রামায়ণ’, কন্নড় ভাষায় তোরবেয় রামায়ণ ইত্যাদি রামায়ণ বহুল প্রচলিত। কৃত্তিবাস ওঝা ছাড়াও বাংলা ভাষায় আর-একজন বিস্মৃতপ্রায় কবি রামায়ণ লিখেছিলেন। তাঁর নাম শঙ্কর কবিচন্দ্র। ছয়টি কাণ্ডে রচিত তাঁর রামায়ণের নাম “বিষ্ণুপুরী রামায়ণ”, এই রামায়ণে উত্তরকাণ্ড অনুপস্থিত।
এছাড়াও প্রচুর ভিন্ন ভিন্ন গল্প পাওয়া যায় বিভিন্ন রামায়ণে। আবার বৌদ্ধদের রামের কাহিনি দশরথ-জাতক এ রাম ও সীতা একে-অপরের ভাইবোন (এই রামকথায় কোনো মুনিঋষি নেই, দণ্ডকারণ্য নেই, বানরগোষ্ঠী নেই, রাবণ নেই, সীতাহরণও নেই)। দশরথ রাজার প্রথমার স্ত্রী কৌশল্যার দুটি পুত্র ও একটি কন্যার জন্ম দিয়ে মারা যান। এঁরাই হলেন যথাক্রমে রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা। কৃষিনির্ভর মাতৃতান্ত্রিক সমাজে ভাইবোনের বিয়ে স্বাভাবিকই ছিল। বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। দশরথ-জাতকে রাম রামপণ্ডিত’ বলে পরিচিত। দশরথ-জাতকে রামের পিতৃসত্য পালনের কোনো ব্যাপার নেই। এখানে রাজা দশরথ বলেছেন, মৃত্যু হলেই তোমরা এসে সিংহাসন দখল করবে। বাল্মীকির রামায়ণে ভরত রামের পাদুকা চেয়ে নিয়েছিলেন সিংহাসনে রেখে অযোধ্যা শাসন করার জন্যে। দশরথ জাতকে ভরত কোনোরূপ পাদুকাই চাননি। বাল্মীকির রামকাহিনি অযোধ্যা হলেও, দশরথ-জাতকের রামকাহিনি বারাণসীর। দশরথ-জাতকের শেষ অংশে বুদ্ধ বলছেন–“সেই সময়ে মহারাজ শুদ্ধোদন ছিলেন দশরথ, কৌশল্যা ছিলেন মহামায়া, রাহুলজননী ছিলেন সীতা, ভরত ছিলেন আনন্দ, সারিপুত্ত ছিলেন লক্ষ্মণ এবং রামপণ্ডিত ছিলাম আমি।” এখানে বোঝাই যাচ্ছে এসব কাহিনি অবতারবাদের প্রভাব। দশাবতার বিষ্ণুর নবম অবতার সিদ্ধার্থ গৌতম বা বুদ্ধদেব। কৃত্তিবাস, রঙ্গনাথন, তুলসীদাসদের মতো দশরথজাতকের রচয়িতাও বাল্মীকির রামায়ণের চরম বিকৃতি ঘটিয়েছেন। নাকি বাল্মীকি দশরথ-জাতকের চরম বিকৃতি ঘটিয়েছেন। কারণ অনেক পণ্ডিত মনে করেন বাল্মীকির রামায়ণের অনেক আগেই দশরথ-জাতক রচিত হয়েছে।
রামায়ণের বৌদ্ধ বা জৈন সংস্করণে রাবণকে একজন ভক্ত জৈন হিসাবে উল্লেখ হয়েছে। আবার থাইল্যান্ডের রামায়ণের সঙ্গে কৃত্তিবাসী রামায়ণের মিল নেই। ইন্দোনেশিয়ার রামায়ণের সঙ্গে তুলসীদাসের রামায়ণে প্রচুর গরমিল। তামিল ভাষায় রচিত কম্বন রামায়ণের সঙ্গে খোটানের রামায়ণেও অনেক অমিল। কন্নড় ভাষায় রচিত রামায়ণে যোগীর তুক করা আমের শাঁস খেয়ে রাবণ গর্ভবান হন। কী আর করা! রাবণ তো আর মহিলা নন যে, নির্দিষ্ট পথে সন্তান প্রসব করবে! অতএব হাঁচির সঙ্গে সন্তান বেরিয়ে আসে বাইরে! এই সন্তানই হলেন সীতা। আদিবাসী সমাজের কোনো-কোন অঞ্চলে রাবণ নায়ক–তাঁকে প্রধান চরিত্র করে রচিত হয়েছে রাবণগাথাও।
থাইল্যান্ডে রাম নামে একাধিক রাজা ছিলেন, এঁরা সকলে বিষ্ণুর অবতারও ছিলেন। আর আয়োধিয়া (অযোধ্যা) নামে রাজ্য ছিল। ১৩৫০ সালে নতুন এক রাজবংশের পরাক্রান্তা রাজা রামাধিপতি নতুন অযোধ্যা (Ayuthia > আইযুথিয়া) নগরী স্থাপন করে সেখানেই নিজের রাজধানী পত্তন করেন। শ্যামদেশের (বর্তমানের থাইল্যান্ড) এখনকার রাজবংশের নাম মহাচক্রীবংশ। এই বংশের প্রত্যেক রাজা রাম’ নামে অভিহিত। ১৭৮২ সালে এই রাজবংশের পত্তন হয়। প্রথম রাজার নাম ছিল ‘রাম ফা বুদ্ধয়োদ ফা চূড়ালোক। এই রাজার শাসনকাল ছিল ১৭৮২ সাল থেকে ১৮০৯ পর্যন্ত। দ্বিতীয় রাম ‘ফ্রা বুদ্ধ সোএস লা নাভালৈ’, তৃতীয় রাম ‘ফ্রা নাঙ ক্লাও’, চতুর্থ রাম ‘ফ্রা চোম ক্লাও মহামংকুৎ’, পঞ্চম রাম চূড়ালংকার’, ষষ্ঠ রাম বজ্ৰায়ুধ’, সপ্তম রাম ‘প্রজাধিপক’, অষ্টম রাম অজ্ঞাত, নবম রাম ‘অদুলদেৎ’। থাইল্যান্ডে ১৭০ বছর ধরে সাতপুরুষ জুড়ে রাম-রাজত্ব চলে আসছে। তাহলে থাইল্যান্ডের অযোধ্যার রাম আর ভারতের অযোধ্যার রাম কি একই ব্যক্তি? নিশ্চয় এক নয়। কারণ ভারতের কোনো পুরাণসাহিত্যে এর সমর্থনে কিস্যু জানা যায় না। থাইল্যান্ডে একটি রামায়ণের সন্ধান মেলে, নাম ‘রামাকিয়েন’। থাই ভাষায় ‘রামাকিয়েন’ শব্দের বাংলা অর্থ ‘রামের পুণ্য হউক’। এটি থাইল্যান্ডের জাতীয় গ্রন্থ। এই রামায়ণে বাল্মীকির রামায়ণের সঙ্গে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। সুখখাতা সরকারের মৃত্যুর পর, অযোধ্যা বা আয়োধিয়া রাজ্যে অষ্টাদশ শতাব্দীতে কিংবদন্তিতে থাই সংস্করণটি প্রথম লিখিত হয়েছিল। তবে ১৭৬৭ সালে বার্মা (আধুনিক মায়ানমার) থেকে সৈন্যবাহিনী দ্বারা আয়োয় শহরটি ধ্বংস হয়ে গেলে অধিকাংশ সংস্করণই হারিয়ে যায়। আজকে স্বীকৃত সংস্করণটি সিয়ামের রাজত্বকালে রাজা রাম আমি (১৭২৬ ১৮০৯) চকরি বংশের প্রতিষ্ঠাতা, তাঁর তত্ত্বাবধানে রচিত হয়েছিল। রামাকিনের রামের নাম ‘ফারারাম’ এবং রাবণের নাম ‘থোত্তকান’। বলা হয়েছে শ্রীলঙ্কার দুষ্টদের রাজা খোকন এবং ফারারামের প্রতিপক্ষের শক্তিশালী। থোকানের দশটি মুখ এবং কুড়িটি হাত এবং একটি অরাজক অস্ত্র আছে।
রামকিয়েনের রামকথা বিভিন্ন বিষয়ে স্বতন্ত্র। বাল্মীকি রামায়ণের কাহিনি মোটামুটি ঠিক থাকলেও ছোটো-বড়ো ঘটনাগুলির বিস্তর পার্থক্য আছে। এছাড়া বাল্মীকির রামায়ণের সুপরিচিত নামগুলোও যথেচ্ছ বিকৃতি হয়েছে। যেমন কৌশল্যা, সুমিত্রা, কৈকেয়ীর নাম যথাক্রমে কৌসুরিয়া, সমুদ্রজা, কৈয়কেশী। বশিষ্ঠের নাম ঠিক থাকলেও বিশ্বামিত্রের নাম বদলে স্বমিত্র হয়ে গেছে। রাবণের স্ত্রী মন্দোদরীর নাম হয়েছে মণ্ডো। চার ভাইয়ের গায়ের রং চার ধরনের। যেমন–রামের গায়ের রং হরিৎ বা সবুজ, ভরতের (থাইভাষায় ‘বরত’) গায়ের রং রক্ত বা লাল, লক্ষ্মণের (থাইভাষায় ‘লক্ষ্মণেব’) গায়ের রং পীত বা হলুদ এবং শত্রুঘ্নের (থাইভাষায় ‘শত্রুদ) গায়ের রং রক্তনীল।
মূল রামায়ণকে কেন্দ্র করে যেমন অনেক ভাষায় রামায়ণ লেখা হয়েছে, ঠিক তেমনই রামায়ণের অংশ নিয়ে প্রচুর গ্রন্থ লেখা হয়েছে। মনের রঙে মাধুরী মিশিয়ে রচিত হয়েছে নতুন নতুন কাহিনি। রঘুনন্দন গোস্বামী, রামানন্দ ঘোষ, জগত্রাম, রামপ্রসাদ প্রমুখ এরকম অনেকেই রামায়ণ অবলম্বনে কাব্য রচনা করে প্রভূত খ্যাতি লাভ করেছেন। কালিদসের ‘রঘুবংশম্’, ভাসের প্রতিমা’ ও ‘অভিষেক’, ভবভূতির মহাবীরচরিত’ ও ‘উত্তররামচরিত’, ভট্টির ‘রাবণবধ’, কুমারদাসের ‘জানকীহরণ’, মুরারির ‘অনর্ঘরাঘব’, ক্ষেমেন্দ্রর ‘রামায়ণমঞ্জরী, রাজশেখরের বালরামায়ণ’, জয়দেবের ‘প্রসন্নরাঘব’, ভোজের ‘চম্পূরামায়ণ’, ঈশ্বরচন্দ্রের ‘সীতার বনবাস’, রবীন্দ্রনাথের বাল্মীকির প্রতিভা’, রামশঙ্করের রামায়ণ’, দ্বিজলক্ষ্মণের ‘শিবরামের যুদ্ধ’, মাইকেল মধূসূদনের ‘মেঘনাদবধকাব্য’ ইত্যাদি গ্রন্থগুলি রামায়ণের অংশ নিয়েই রচিত হয়েছে এবং ভারতীয় সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। উল্লেখ্য, এঁরা কেউই বাল্মীকির রামায়ণকে অবিকৃত রাখেননি। বাংলায় কৃত্তিবাস বেশ জনপ্রিয়। কৃত্তিবাসের রামায়ণের সমাদর আকাশছোঁয়া। কৃত্তিবাসের পরবর্তীকালে আরও কয়েকজন স্বল্পখ্যাত কবি রামায়ণ রচনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই চিরতরে হারিয়ে গেছেন সংরক্ষণের অভাবে। কেউ-বা পড়ে আছেন আমাদের অন্যমনস্কতা ও উদাসীনতার আড়ালে। কেউ আবার খ্যাতিমান কবির সঙ্গে মিশে গেছে; ফলে আমরা যে কবির নাম কখনোই শুনিনি, হয়তো তাঁর পদগুলি পড়ে চলেছি। যেমন কৃত্তিবাসের নামে এমন অনেক পদ চলে আসছে, সেগুলি তিনি কোনোদিনই রচনা করেননি। ক-জন চেনেন শঙ্কর কবিচন্দ্রকে? ক জন পড়েছেন ‘বিষ্ণুপুরী রামায়ণ’? ‘বিষ্ণুপুরী রামায়ণ’ শঙ্কর কবিচন্দ্রের রচিত শেষতম বাংলা ভাষায় মহাকাব্য। তাঁর যা কিছু কৃতিত্ব, যা কিছু গৌরব–সবই অধুনা প্রচলিত কৃত্তিবাসী রামায়ণের সঙ্গে মিশে গেছে।
মাইকেল মধুসূদনের পূর্বে বাংলা কাব্যচর্চা মধ্যযুগেই পড়ে ছিল। তিনিই একমাত্র একক প্রচেষ্টায় এক ধাক্কায় বাংলা কাব্যকে মধ্যযুগীয় কাব্যের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করেন এবং আধুনিকতার আঙ্গিনায় উপস্থাপিত করেন। এরকম উদ্ধত, দ্রোহী, আত্মম্ভর পুরুষ এরকম অবিশ্বাস্য প্রতিভাবান কবি বাংলা সাহিত্যে আর জন্মায়নি। হয়তো কোনোদিন আর জন্মাবেও না। মেঘনাদবধকাব্য’ যখন তিনি লেখেন তখন বাংলা ভাষা ছিল একটি অবিকশিত ও অশক্তিশালী ভাষা। বস্তুত এটি ছিল ক্ষুদ্র একটি জনগোষ্ঠীর আঞ্চলিক ভাষা। মহত্তম ভাবপ্রকাশের জন্য অপর্যাপ্ত এবং অপরিশ্রুত এবং অনাদরণীয় ছিল এই ভাষা। সমাজের চাষাভূষা মানুষের অবহেলিত ভাষা এই বাংলা ভাষা। উঁচুমহলে তো এর কোনো ঠাঁই-ই ছিল না।
‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এ তিনি একটি অচিন্তনীয় এবং অভাবনীয় এক ব্যাপার ঘটিয়েছিলেন। যাঁরা গ্রন্থটি পাঠ করেছেন তাঁদের নিশ্চয় সেই রসাস্বাদন করেছেন যে, রাম এবং রাবণের চরিত্র আমরা যেরকম করে জানি, তিনি সেটিকে উলটে দিয়েছিলেন স্পন্দিত স্পর্ধায়। বাল্মিকীর রামায়ণে রাম সৎ, সাহসী, সত্যনিষ্ঠ এবং দয়াবান। অপরদিকে রাবণ পাপীতাপী, অন্যায়কারী এবং অত্যাচারী। কিন্তু মধুসূদনের রাম ভীরু, শঠ, প্রতারক এবং দুর্বল চরিত্রের মানুষ। অপরদিকে রাবণ দুর্জয় ও সাহসী শাসক, স্নেহময় পিতা, প্রজাহৈতিষী। দেবতাদের চক্রান্ত ও কোপানলে পড়ে তিনি একজন বিরহী ও দুঃখী মানুষ। তিনি রামায়ণ নির্দেশিত পথে না চলে রাক্ষস জাতির প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হয়েছেন। তাঁর রচনায় রাক্ষসেরা কল্পিত কোনো বীভৎস এবং ঘৃণ্য কোনো প্রাণী নয়, বরং আমাদের মতোই আবেগ-অনুভূতিতে পূর্ণ মানুষ। রাবণ চরিত্রের জন্যই ‘মেঘনাদবধকাব্য’ করুণ রসের আধার হয়ে উঠেছে। মেঘনাদবধ অমিত তেজী, বিদ্রোহী রাবণের পরাজয়ের বেদনাবিধুর কাহিনি। রাম কর্তৃক আক্রান্ত, পর্যদস্ত, রাবণ বংশগৌরব এবং জাতীয় মর্যাদা রক্ষার জন্য সর্বস্ব পণ করে বসে আছেন এবং প্রতিকূল দৈবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। রাবণের এই মর্মবিদারক ব্যথাই কাব্যটির বিষয়বস্তু। মেঘনাদবধের রাবণ যেন মধুসূদন নিজেই। তার জীবনেও এই একই দুর্বিনীত সংগ্রাম এবং করুণ পরাজয়ের শোকগাথা লেখা রয়েছে। এই শোকগাথার জন্য অবশ্য অন্যেরা যতটুকু না দায়ী, তিনি নিজেও তার চেয়ে বেশি দায়ী। আজকের এই অস্থির পরিবেশে দাঁড়িয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত যদি ‘মেঘনাদবধ কাব্যটি রচনা করতেন, তাহলে হয়তো কাব্যটি ব্যান হয়ে যেত, কবিকে হয়তো জেলযাত্রা করতে হত কিংবা কবির মুখে কালিলেপন করা হত।
ভারতীয় হিন্দুসমাজে রামায়ণের রাম-সীতা দেবত্বে অধিষ্ঠিত হলেও রামকথার প্রকৃত জনপ্রিয়তা লোকসংস্কৃতির ক্ষেত্রেই। এই কারণেই রামকথা শিল্প, সাহিত্য, সংগীত এবং সাধারণ মানুষের সমাজচিন্তার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে। স্থান-কালভেদে রামকথার বিন্যাস ও চরিত্র অনেকাংশেই সংযোজন-পরিমার্জন হয়েছে–একথা সত্য। কিন্ত কাহিনির মূল কাঠামোটি প্রায় অপরিবর্তনীয় আছে। রামায়ণের নিয়ে রচনাকাল নিয়ে যেমন মতান্তর আছে, তেমনই রাম ও অন্যান্য বিষয়টি ঐতিহাসিক কি না সে বিষয়েও যথেষ্ট সংশয় করেছেন পণ্ডিতগণ।
যদিও আমার আলোচ্য বিষয় রামায়ণ, কিন্তু মহাভারত গ্রন্থটিও এ আলোচনায় প্রাসঙ্গিক! রামায়ণের মতো মহাভারতও ভারতীয়দের কাছে পরম আদরণীয়, মহত্ত্বপূর্ণ–পরম পবিত্রও। রামায়ণ ও মহাভারত উভয় মহাগ্রন্থই ভারতের ইতিহাসের আকর রূপে মর্যাদা পায়। মহাভারতকে বাদ দিয়ে রামায়ণ আলোচনা করলে এই আলোচনা অসমাপ্ত থেকে যাবে। তাই মহাভারত প্রসঙ্গ টানতেই হচ্ছে। বাল্মীকি ও ব্যাস উভয়েই যথাক্রমে রামায়ণ ও মহাভারতের সংকলক। বস্তুত উভয়ই ‘ব্যাস’। কারণ বিষ্ণুপুরাণে রামায়ণ রচয়িতা বাল্মীকিকেও ‘ব্যাস’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ব্যাসের ধারণা যখন জন্মলাভ করে তখন বেদই ছিল। দেবমন্ত্রী স্বয়ং ব্রহ্মাই বেদের সংকলক বলে অভিহিত। তিনিই আদি ব্যাস। ব্যাস তিনিই, যিনি জাতীয় জীবনে যা কিছু শুভকর যা কিছু মঙ্গলদায়ক সেগুলিকে সংকলন করে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়। বিষ্ণুপুরাণে ২৯ জন সংকলক বা ব্যাসের কথা জানা যায়।
মহাভারতের বেশকিছু পর্বে রামায়ণের দশরথ, জনক, রাম, লক্ষ্মণ, সীতা, রাবণ, হনুমান প্রভৃতি কথাপুরুষ উদাহরণ বারবার উল্লেখ আছে। কোনো স্থলে যজ্ঞের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদনের জন্য দশরথের নাম, কখনো-বা স্বামীভক্তির দৃষ্টান্ত দেখাতে সীতার পাতিব্ৰত্যের উল্লেখ আছে, কখনো-বা বিদুর কর্তৃক ধর্মপ্রাণ ভীষ্ম ও দ্রোণের প্রশংসা অথবা অর্জুনের বীরত্বের তুলনা প্রসঙ্গে রামচন্দ্রের কথা, কোনো প্রসঙ্গে রাবণের প্রসঙ্গও এসেছে। এমনকি রামায়ণের রামভক্ত হনুমানকেও পাওয়া গেছে মহাভারতের বনপর্বে। মহাভারতের বিভিন্ন পর্বে রামায়ণে বর্ণিত নানা যুদ্ধের বর্ণনা মেলে। দ্রৌপদী ও অন্যান্য ভাইদের সঙ্গে বনবাস জীবনে দুঃখিত যুধিষ্ঠিরকে সান্ত্বনাদানের জন্য মার্কণ্ডেয় মুনির মুখে রামকথা বর্ণিত আছে।
মহাভারতে রামায়ণের বিভিন্ন ঘটনা বিভিন্ন সময়ে মর্যাদার সঙ্গে উল্লেখ হয়েছে। কিন্তু রামায়ণে মহাভারতের কোনো ঘটনাই উল্লেখ নেই। কেন এরকম? দুটি গ্রন্থ কি সমসাময়িক নয়? আগেই উল্লেখ করেছি রামায়ণ গ্রন্থটির রচনাকাল ৮০০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। কিথ (Keith) বলেন, রামায়ণ খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে রচিত। ভিন্টারনিৎস (Winternitz) ও বুলকে (Bulcke) বলেছেন, রামায়ণের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকেই। কিন্তু মহাভারতের রচনাকাল আনুমানিক ৭০০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে শুরু করে ২০০ থেকে ৩৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। সৌত রচনা (জয়), ব্রাহ্মণ্য রচনা (ভারতসংহিতা) এবং শ্রমণগণের রচনা (মহাভারত)–এই তিনটি স্তরে রচনা হয়েছে। সাম্প্রতিককালের গবেষণায় জানা গেছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ খ্রিস্টপূর্ব ৩১৩৬ অব্দে ঘটেছিল। অতএব মহাভারতের রচনাকাল এই সময়ের কিছু পরে হতে পারে। সেই কারণেই কি মহাভারতের পেটের ভিতর রামায়ণের এত ঘটনা ঢুকে আছে? নাকি দুটি গ্রন্থই সমসাময়িক? ব্যাস কী পূর্বজ গুরু বাল্মীকির শিষ্য, তাই কি রামায়ণের প্রতি এত আনুগত্য, কৃতজ্ঞতা? তাই কি পটভূমি ও উপজীব্য প্রায়ই একই–অন্যায়ভাবে যুদ্ধ আর ভুরি ভুরি অলৌকিকতা? তাই নিপাট ইতিহাস হয়ে উঠতে পারেনি। কুহেলিকাময় ইতিহাস মানুষের কাছে প্রশ্নচিহ্ন তুলে ধরে, যুগে যুগে। অপ্রার্থিতা, অলৌকিকতা, কখনোই ইতিহাস হতে পারে না–তা কেবলই রূপকথা। তাই কি রচনাকাল রহস্যাবৃত? রামায়ণ যদি ইতিহাস হয়, তবে বলা যায়–ইতিহাসকে কখনো বিশ্বাস দিয়ে যাচাই করা ঠিক নয়! একটি বিষয়ের ইতিহাস পাঁচ জন লেখকের বর্ণনায় ভিন্ন পার্থক্যের তৈরি করতে পারে! তৈরি তো হয়ই। তাই ঘটনার নিরপেক্ষতা বোঝার স্বার্থে সকল বিশ্লেষক, গবেষক মায় ঐতিহাসিকের লেখা পড়াটাই যুক্তিযুক্ত!
ধর্মপ্রাণ সকল মুসলমান পণ্ডিতদের লেখা থেকে আমরা জানি, ইসলাম আবির্ভাবের পূর্বে আরবের সমাজ ছিল ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’ বা বর্বরতম যুগ! তখন জীবন্ত কন্যা সন্তানকে কবর দেওয়া হত! কবর দেওয়ার এই বিষয়টি এতই মর্মস্পর্শী যে, মানুষ সেই যুগকে ইতিহাসের সবথেকে নিকৃষ্টতম’ অধ্যায় বলে সহজেই বিশ্বাস করে নেয়! আসলে বিষয়টি অনেক প্রশ্নের দাবি রাখে! আমরা জানি, তখনকার পবিত্র কাবা ঘরের ভিতরে ৩৬০ টি দেবতার মূর্তি ছিল। প্রতিটি দেবতা একেকটি গোত্রের প্রধান ‘দেবমূর্তি’ হিসাবেই সহাবস্থান করত এবং সবাই একই উপাসনালয় ‘কাবাগৃহে’ তাদের পূজা অর্চনার কাজ মিলেমিশে করত৷ এই বিষয়টি থেকে পরিষ্কার হয় যে, তৎকালীন আরবে চমৎকার একটা ধর্মীয় সম্প্রীতি বিরাজমান ছিল। সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় আরব ছিল তখন পৃথিবী বিখ্যাত। কবিদের মধ্যে কাব্য রচনার ‘কবি যুদ্ধ’ হত। ইমরুল কায়েসের মতো প্রাচীন। বিখ্যাত অনেক মানবতাবাদী কবি জন্মেছিলেন তখনকার আরবে! সুতরাং বলা যায়, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক চর্চার ক্ষেত্রে আরব সমাজ ছিল তখন একটি প্রকৃষ্ট সম্প্রীতির উদাহরণ।
প্রফেসর পি কে হিট্টির মতে–“শিশু কন্যাকে জীবন্ত কবর দেওয়ার বিষয়টি হিন্দুদের সতীদাহ প্রথার মতোই খুব অনভিপ্রেত এবং গুটিকয়েক ঘটনা ছিল আরবে!” অতি দরিদ্র এবং অতি মূর্খ কুসংস্কারাচ্ছন্ন কিছু আরব এই জঘন্য কাজটি করত। যেটির সংখ্যাগত দিক বিবেচনায় তৎকালীন গোটা আরবকে ‘জাহেলিয়াত’ জাতি বলে বিবেচনা করা অনুচিত হবে। এছাড়াও মহানবির বেশির ভাগ সাহাবিদের গণ্ডায় গণ্ডায় স্ত্রী ছিলেন। সঙ্গে দাসী, যৌনদাসী তো ছিলই–এইসব ছিল আরব সমাজের একটা সাধারণ প্রচলিত প্রথা। নবিজির নিজের বিবাহ সংখ্যা ছিল কমপক্ষে এগারোটি। প্রশ্ন হল, সবাই যদি কন্যাদের মাটিতে পুঁতে ফেলত, তাহলে আরবের লোক এত ‘আওরত’ তখন পেত কোথায়? পুরুষের থেকে নারীদের সংখ্যার অনুপাত আরবে এখনও পর্যন্ত বেশি, যার প্রকৃষ্ট প্রমাণ বেশিরভাগ আরবের ঘরে কমপক্ষে তিনটি চারটি করে বউ থাকে।
তাই দৃষ্টি নির্মোহ না-হলে সত্য-মিথ্যা সব গুলিয়ে যাবে। যুক্তি না-থাকলে ইতিহাসকে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না। এখনও পর্যন্ত যে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, তা হল–রচনাকালের দিক থেকে দেখলে রামায়ণ খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতকের মধ্যেই রচিত। মহাভারত রচনা সম্ভবত শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম বা চতুর্থ শতক থেকে এবং শেষ হয় খ্রিস্টীয় চতুর্থ বা পঞ্চম শতকে। অর্থাৎ বুদ্ধের পরের ৮০০ বা ৯০০ বছরের মধ্যে এই দুটি মহাসাহিত্য রচিত হয়। এদের মধ্যে মহাভারত আগে শুরু হয়ে পরে শেষ হয়। রামায়ণ পরে শুরু হয়ে আগে শেষ হয়। এরপর রামায়ণ শেষ হওয়ার কাছাকাছি সময়ে কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’, বাৎস্যায়নের কামসূত্র’, ‘শ্রীমদ্ভাগবদগীতা’, ‘মনুসংহিতা’ও রচিত হয়ে যায়।পরপরই পুরাণগুলি রচিত হয়েছে।
ল্যাসেন, ওয়েবার, ইয়াকোবিদের মতো পণ্ডিতগণ মহাভারতকে রামায়ণের আগে বলে যে যে যুক্তি দেখিয়েছেন, সেগুলিও জেনে নিতে পারি। তবে লোকপ্রসিদ্ধি ও অধিকাংশ মতানুসারে রামায়ণকে মহাভারতের পূর্ববর্তী বলেই স্বীকার করা যায়। যুক্তিগুলি দেখা যাক–(১) বাল্মীকি আদিকবি রূপেই প্রসিদ্ধ। তাই তাঁর লেখা রামায়ণ আগে রচিত হয়েছিল বলা যায়। (২) চার যুগের মধ্যে ত্রেতাযুগে রামাবতার এবং তারপরের দ্বাপরে কৃষ্ণাবতার হওয়ার আগে রচিত মনে হয়।(৩) রামায়ণে সহমরণের ঘটনা নেই, মহাভারতে মাদ্রীর সহমরণের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।(৪) রামায়ণের যুদ্ধকাণ্ডের একটি শ্লোক (৮১/২৮) মহাভারতে দ্রোণপর্বে অবিকল উল্লেখ আছে।(৫) মহাভারতে বাল্মীকির নাম পাওয়া যায়, রামায়ণে কিন্তু ব্যাসদেবের উল্লেখ নেই। (৬) সূর্যবংশের উল্লেখ রামায়ণে আছে, যা আগে। পরে চন্দ্রবংশের কথা উল্লেখ আছে, যা মহাভারতে আছে।(৭) মহাভারতে রামায়ণের উল্লেখ আছে। কিন্তু রামায়ণে মহাভারতের কোনো চরিত্র বা ঘটনার কথা কোনোভাবেই নেই।(৮) রামায়ণের সভ্যতা অনাড়ম্বর, সরল ও অরণ্য প্রভাবিত। অপরদিকে মহাভারতের সভ্যতা নগরকেন্দ্রিক, জটিল ও কুটিল। (৯) রামায়ণে আর্যসভ্যতার সঙ্গে বানর ও রাক্ষস সভ্যতা পাই। মহাভারতে এরা অনুপস্থিত।(১০) বৈয়াকরণ পাণিনির কাল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক। মহাভারতে পাণিনীয় অনুশাসন মান্য হলেও রামায়ণে অনুপস্থিত। (১১) আর্যদের অধিকৃত এলাকা রামায়ণে মহাভারত অপেক্ষা কম থাকায় রামায়ণ মহাভারতের রচিত বলে মনে করা হয়। (১২) কলেবর অর্থাৎ আকারের দিক থেকে মহাভারত আগে বৃহৎ হওয়ায় রামায়ণকে রচনার দিক থেকে আগে রাখা যায়। (১৩) রামায়ণ অপেক্ষা মহাভারতের যুগে স্ত্রীশিক্ষার প্রসার বেশি ঘটেছিল। তাই রামায়ণ আগে রচিত হয়েছিল বলে মনে করা যয়া(১৪) রামায়ণে আর্যরাজের (রাজপুত্র) সঙ্গে অনার্যরাজের (রাক্ষস) যুদ্ধ বর্ণিত হয়েছে। অপরদিকে মহাভারতে প্রায় সব রাজাই আর্য। (১৫) রামায়ণের যুগে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। সে যুগে সম্পূর্ণ দাক্ষিণাত্য ছিল রাক্ষস’ অধ্যুষিত এবং অরণ্যাবৃত। কিন্তু মহাভারতের যুগে জরাসন্ধাদি শাসিত সুবিশাল ও সুসংহত রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মেলে। অতএব মহাভারত তার সমাপ্তি পর্বে পৌঁছোনোর আগে রামায়ণ তার পূর্ণতা পেয়েছিল।
রামায়ণের রাম-সীতার মাহাত্ম্য, ভাবের গভীরতায় এবং ভাষার প্রাঞ্জলতায় এমনই হৃদয়গ্রাহী যে, ভারতের আবালবৃদ্ধবনিতা তাঁর দ্বারা চির-অনুপ্রাণিত। রামের অসাধারণ মাতৃশক্তি, ভরত ও লক্ষ্মণের অতুলনীয় ভাতৃভক্তি ও সীতার অনুপম পাতিব্ৰত্য জনমানসকে মুগ্ধ করে এবং অনুপ্রাণিত করে। ত্যাগের মহিমায় এঁরা সকলেই স্বমহিমায় ভাস্বর। ক্ষমা, ত্যাগ, সত্য, সহিষ্ণুতা, প্রজাবৎসল্য ও দৃপ্ত পুরুষকারের জ্বলন্ত বিগ্রহ রামচন্দ্র। সতীকুল শিরোমণি সীতা রমণীকুলের রত্নস্বরূপা। দশরথ ও কৌশল্যার মধ্যে আমরা স্নেহকাতর পিতামাতাকে পাই। আদর্শ প্রভুভক্ত হনুমান তো সকলেরই নমস্য। সেও রাম-সীতার অপেক্ষা কম জনপ্রিয় নয়, তাঁরও ভক্তকুল বিশাল। ভারতের নরনারী পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে রাম, সীতা ও হনুমানের নাম জপ (হনুমান চাল্লিশা) করে। রামের একটি বিশেষ মূর্তিতে তাঁর পাশে তাঁর ভাই লক্ষ্মণ, স্ত্রী সীতা ও ভক্ত হনুমানকে দেখা যায়। এই মূর্তিকে বলা হয় রাম পরিবার। হিন্দু মন্দিরে এই ‘রাম পরিবার’ মূর্তির পুজোই বেশি হতে দেখা যায়। ভারতবাসী আজও ‘রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে। তবে সবটাই বাইরে থেকে নয়, পুরো মাহাত্মটাই রামায়ণের ভিতরে ঢুকে দেখতে হবে। ভক্তের দৃষ্টিতে নয়, দেখতে হবে যুক্তির দৃষ্টিতে।
হিন্দুধর্মের রাম উপাসনাকেন্দ্রিক সম্প্রদায়গুলিতে যে রামকে বিষ্ণুর অবতার না-বলে সর্বোচ্চ ঈশ্বর’ হিসাবে মান্য করার প্রবণতা দেখা যায়, সেই রামের বিষয়ে শুরু থেকেই শুরু করা যাক। ব্যক্তিনাম হিসেবে ‘রাম’ শব্দটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদে (১০৯৩১৪): “দুঃসীম প্রথবনের স্তব গাই, বেণ ও রামের স্তব গাই, বিশিষ্ট অসুরদের স্তব গাই, রাজন্যবর্গের স্তব গাই”। রাম শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ হল ‘রামী’, রাত্রির একটি বিশেষণ। বেদে দুই জন রামের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথম জন হলেন মার্গবেয়’ বা ‘ঔপশ্বিনী’ রাম এবং দ্বিতীয় জন হলেন ‘জামদগ্ন্য’ রাম। উত্তর-বৈদিক যুগে তিন জন রামের কথা জানা যায়–(১) বিষ্ণুর সপ্তম অবতার রাম। ইনি দশরথের পুত্র এবং রঘুবংশে জাত।(২) বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরাম। ইনি ‘জামদগ্ন্য’ বা ‘ভার্গব’ রাম নামে পরিচিত। ইনি অমর।(৩) কৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ও বিষ্ণুর অষ্টম অবতার বলরাম।
বিষ্ণু সহস্রনাম স্তোত্রে বিষ্ণুর ৩৯৪ তম নামটি হল রাম। আদি শঙ্করের টীকা অনুসারে রাম’ শব্দের দুটি অর্থ আছে–যোগীরা যাঁর সঙ্গে রমণ (ধ্যান) করে আনন্দ পান, সেই পরব্রহ্ম বা সেই বিষ্ণু যিনি দশরথের পুত্ররূপে অবতার গ্রহণ করেছিলেন। রামের অন্যান্য নামগুলি হল ‘রামবিজয়’ (জাভানিজ ভাষা), ফ্রেয়াহ রাম (খমের ভাষা), ফ্রা রাম (লাও ভাষা ও থাই ভাষা), মেগাত সেরি রাম (মালয় ভাষা), রাকা বানতুগান (মারানাও ভাষা) ও রামায় (তামিল ভাষা)।
ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে ‘রামাসুর’-এর উল্লেখ আছে। পারসিকদের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ আবেস্তায় উল্লেখিত ‘রামাহুর’ একজন শান্তির দেবতা। অনেকেই মনে করেন আবেস্তার ‘অহুর’-কেই বেদে ‘অসুর’ হিসাবে দেখানো হয়েছে। আরবি ভাষায় ‘রামা’ বলে একটি শব্দ আছে, যার অর্থ নিক্ষেপকারী’ মেঘের মানবিক সত্ত্বা কল্পনা করলে মনে হয় সে যেন বৃষ্টির শর নিক্ষেপ করছে। লৌকিক মেঘবন্দনা গানের দেবতা ‘রামা’ যখন আর্যসমাজে তথা সংস্কৃত ভাষায় স্বীকৃতি পেল, তখন ‘রাম’ শব্দে পরিবর্তিত হল। সংস্কৃত ভাষায় রামা’ শব্দের অর্থ রমণীয়া, শুভ্রা, সুন্দরী স্ত্রী, প্রিয়া। লক্ষ্মীর অন্য নামও রামা। সীতাও লক্ষ্মীর অংশজাতা। রামা’ শব্দের পুংলিঙ্গে রাম’ হতে পারে। যেমন মূলশব্দ ‘বামা’ স্ত্রীলিঙ্গে হলেও পুংলিঙ্গে কিন্তু ‘বাম’। রামা’ শব্দের পুংলিঙ্গে ‘রাম’ ধরে নেওয়া হয়। রাম শব্দের অর্থ অসিত, অর্থাৎ কৃষ্ণবর্ণ। অসিতের বিপরীত সিত, সিত শব্দের অর্থ শুভ্রবর্ণ। সিত শব্দটি স্ত্রীলিঙ্গে সীতা, গৌরবর্ণা। অতএব রাম অসিত, সীতা সিত। অনেকে বলেন রাম হল মেঘদেবতা, সীতা কৃষিশ্রী। রামায়ণের মূল ভিত্তিই কৃষি৷ অতএব রামায়ণ হল রামের অর্থাৎ মেঘের বা মৌসুমী বায়ুর অয়ন, অর্থাৎ আবর্তন। অর্থাৎ, রাম (মেঘ) অথবা রামা (কৃষিশ্রী) হয়েছে অয়ন (আশ্রয়) যার। মেঘদেবতা রাম এবং কৃষিশ্রী সীতা আজ হিন্দুধর্মের দেবদেবী।
নতুন এক গবেষণায় বলা হয়েছে রাম এবং রামায়ণ কোনো কাল্পনিক গাথা নয়, ঐতিহাসিক সত্য ঘটনাই এর মূল উপজীব্য–এক প্রদর্শনীতে এমনটাই দাবি করল দিল্লির ললিত কলা অ্যাকাডেমি। সেইসঙ্গে প্রকাশ্যে এনে ফেলল মিথোলজিক্যাল চরিত্রগুলি সম্পর্কে একাধিক তথ্যও। ইন্সটিটিউটের দাবি, রামচন্দ্রের জন্ম ৫,১১৪ খ্রিস্টপূর্বে। ১০ জানুয়ারি দুপুর ১২ টা ৫ মিনিটে জন্ম হয় তাঁর। সময় উল্লেখ করা রয়েছে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধেরও। ৩১৩৯ খ্রিস্টপূর্বে ১৩ অক্টোবর শুরু হয়েছিল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। আর ৫০৭৬ খ্রিস্টপূর্বের ১২ সেপ্টেম্বর, অশোককাননে সীতার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল হনুমান। এক মার্কিন সফটওয়্যার এই গবেষণায় সাহায্য করেছে বলে জানা গিয়েছে। ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর ললিত বালা জানান–আমাদের ইতিহাস ১০,০০০ বছরের পুরনো। রামায়ণ ও মহাভারতে উল্লিখিত সময়ের হিসাব ধরেই আমরা আসল সময় চিহ্নিত করতে পেরেছি।” সাধারণভাবে রামায়ণের অভ্যন্তরীণ সাক্ষ্যের উপরে নির্ভর করে ঐতিহাসিকরা মনে করেন, রামায়ণের কাহিনি ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ঘটনা। এই গবেষণা সেই সময়কালকে এক ধাক্কায় আরও ৩০০০ বছর পিছিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী। স্বাভাবিকভাবেই এক বাক্যে এই মতকে মেনে নিতে আপত্তি রয়েছে ঐতিহাসিক মহলের। আই-সার্ভের গবেষণা পদ্ধতি সবিস্তার না-জানা পর্যন্ত এই মতের গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারণ সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন তাঁরা। অন্য এক তথ্য বলছে–“রাম, যাঁর জন্ম হয়েছিল ৫০০০ বছর আগে এবং কৃষ্ণ, যাঁর জন্ম হয়েছিল ৩৫০০ বছর আগে।” এইসব গবেষণার সত্যাসত্য আমার পক্ষে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। কোনো নির্ভরযোগ্য সিলমোহর দিয়েছেন কি না তাও জানা সম্ভব হয়নি। অতএব এই গবেষণা আমার কাছে অর্থহীন। আমার আলোচনাতেও এ প্রসঙ্গ কোনোভাবেই আসবে না।
রামায়ণ কী ইতিহাস, নাকি রূপক?
যে অবস্থায় আমরা বাল্মীকির রামায়ণ গ্রন্থখানিকে পেয়েছি, সেই অবস্থায় এ গ্রন্থখানিকে ‘নির্জলা ইতিহাস’ শিরোপা দিলে আমার কিঞ্চিৎ আপত্তি আছে। কেননা রামায়ণ যে নিখাদ ইতিহাস এমন অথেনটিক ইতিহাস তো সমসাময়িক ইতিহাসবিদরা লিখে রেখে যাননি। তা ছাড়া বাল্মীকি বা অন্যান্য কবিরাও কিন্তু তাঁদের রচনাকে ইতিহাস বলে দাবি করেননি। রামায়ণের সত্যতা এবং ঐতিহাসিকতা নিয়ে এ পর্যন্ত বহু আলোচনা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। ভারতীয় সাহিত্যে রাম বিষয়ক নানা বিচিত্র কাহিনি পাওয়া যায়, কিন্তু সেগুলিতে একে অপরের সঙ্গে সামঞ্জস্য না-থাকায় বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে, সত্যতা বিচার কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেকের মতে রামায়ণের কাহিনি সত্য নয়, নিছক রূপকমাত্র। আবার কেউ কেউ মনে করেন, বাল্মীকি রামকথার ক্ষীণসূত্র ধরেই গোটা রামায়ণটি রচনা করেছেন।দ্বিতীয় মতটি বেশি গ্রহণযোগ্য। কারণ রামকথায় কোনো সত্য ঘটনার বীজ না-থাকলে এত রূপান্তর চোখে পড়ত না। বাল্মীকির রামায়ণের সূচনাতেও এর ইঙ্গিত আছে। রাম না হতে রামায়ণ’ প্রবাদটি নিছক প্রবাদরই, অতিরঞ্জিত। রাম না-জন্মাতেই রামায়ণ রচিত হয়নি। অযোধ্যার সিংহাসনে রামচন্দ্রের অভিষেকের পরেই রামায়ণ রচিত হয়েছে। বাল্মীকির রামায়ণে সেকথা উল্লেখ আছে–”প্রাপ্তরাজ্যস্য রামস্য বাল্মীকিৰ্ভগবান্ ঋষিঃ।/চকার চরিতং কৃতং বিচিত্রপদমর্থবৎ”। রামায়ণ, মহাভারত যথার্থভাবে জানা না-থাকলে ভারতের ইতিহাস জানা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
বাল্মীকি ‘ইতিহাস’ উল্লেখ করে রামায়ণ রচনা করেননি ঠিকই, তাই বলে ইতিহাস নয় একথাও জোর গলায় বলা যায় না। রামও বাল্মীকির মনোভূমে উদিত হওয়া সম্পূর্ণভাবে কাল্পনিক চরিত্র নয়। রবীন্দ্রনাথ রামায়ণকে কেবল কাব্য বলেই ছেড়ে দেননি, তিনি পাশাপাশি ইতিহাসও বলেছেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়–“রামায়ণ মহাভারত কেবলমাত্র মহাকাব্য বলিলে চলিবে না, তাহা ইতিহাসও বটে; ঘটনাবলির ইতিহাস নহে, কারণ সেরূপ ইতিহাস সময় বিশেষকে অবলম্বন করিয়া থাকে। রামায়ণ মহাভারত ভারতবর্ষের চিরকালের ইতিহাস।” বস্তুত ভারতীয়রা সে সময় দর্শন, ভূগোল, গণিত, বিজ্ঞান নিয়ে প্রভূত চর্চা করলেও সাল-তারিখ সহ ইতিহাস চর্চা শুরু করেননি। তবে সাল-তারিখ না-থাকলেও বাল্মীকির রামায়ণে শুরু থেকে শেষপর্যন্ত যেরকমভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভৌগোলিক স্থানের বিবরণ আছে এবং প্রায় সমস্ত ঘটনার তিথি-নক্ষত্রের উল্লেখ আছে, তাতে এ গ্রন্থকে ইতিহাস না-বলে উপায় নেই। রামায়ণে উল্লিখিত বিভিন্ন স্থাপত্য এখনও রক্ষিত আছে। সাল-তারিখ না থাকার কারণে যদি বাল্মীকির রামায়ণকে ইতিহাস বলতে আপত্তি থাকে–তাহলে মেগাস্থিনিস, টলেমি, প্লিনি, সলিনাস, আম্ব্রোসিয়াস, এরিয়ান, স্ট্রাবো প্রমুখের বিবরণগুলিকে ইতিহাস বলা যায় না। এদের যে গ্রন্থগুলি আমাদের ইতিহাসের উপাদান জোগান দেয়, সেখানেও সাল-তারিখ পাওয়া যায় না। বস্তুত খ্রিস্টাব্দ ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকেই নির্দিষ্টভাবে সাল-তারিখের উল্লেখ হতে শুরু করে। তার আগের ঘটনাগুলিকে খ্রিস্টপূর্বাব্দ বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়। রামায়ণ খ্রিস্টাব্দ ব্যবস্থা চালু হওয়ার বহু বহু আগে রচিত। সময়কালটা খেয়াল রাখতে হবে। ভারতীয়রা অনেক অনেক যুগ পরে প্রকৃত ইতিহাস লিখতে করতে শুরু করেন। ভারতের প্রাচীন ইতিহাস যেটুকু জানতে পারি সেগুলি সবই বিদেশি পরিব্রাজকদের লেখা থেকে। যেমন–মেগাস্থিনিস, টলেমি, প্লিনি, সলিনাস, আস্ত্রোসিয়াস, এরিয়ান, স্ট্রাবো প্রমুখ। প্রাচীন যুগের ভারতে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণে গল্পের মাধ্যমে ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। সেসময় এমনই রীতি ছিল। অতএব রামায়ণকে নিছক এক কবিকল্পনাপ্রসূত কাহিনি ভাবলে মস্ত বড়ো ভুল হয়ে যাবে।
অপরদিকে বাল্মীকির রামায়ণ প্রসঙ্গে শ্রীপ্রবোধচন্দ্র সেন লিখেছেন–“রামায়ণ হচ্ছে প্রত্যক্ষতঃ কবিকল্পনার সৃষ্টি, তৎকাল প্রচলিত কাহিনী ও জনশ্রুতিকে সংকলন করার কোনো প্রত্যক্ষ অভিপ্রায় এই গ্রন্থ রচনার মূলে নেই। বরং কবি সচেতনভাবেই প্রচলিত কাহিনীকে কাব্যসৃষ্টির প্রয়োজনে রূপান্তরিত করে নিয়েছেন। যে কহিনী অবলম্বন করে রামায়ণ কাব্য রচিত সে কাহিনী অবশ্য কবিকল্পনা নয়।” অর্থাৎ ঐতিহাসিক উপন্যাসে যেমন ইতিহাসের যথার্থ অনুসরণ না হলেও তা ইতিহাসের ওপরেই রচিত, রামায়ণও তেমনি অনেকাংশে ঐতিহাসিক কাহিনিকাব্য। তুলনীয় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবীচৌধুরানী’, ‘রাজসিংহ’; দ্বৈপায়নের মীরজাফর’, ‘মহারাণা প্রতাপ’, ‘পৃথ্বীরাজ চৌহান’; শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের শাহজাদা দারাশুকো’ ইত্যাদি।
রামায়ণ ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের বিরোধের ইতিহাস, রামায়ণ আর্য ও অনার্যের আধিপত্যের ইতিহাস, রামায়ণ শৈবধর্ম ও বৈষ্ণব ধর্মের সংঘাতের ইতিহাস, রামায়ণ উত্তর ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতে রাজ্যবিস্তারের ইতিহাস, রামায়ণ অরণ্যচারীদের সঙ্গে কৃষিজীবীদের বিকাশের ইতিহাস–যেভাবেই দেখা হোক না-কেন ইতিহাস নয় কেন? শুধু রামায়ণ কেন–মহাভারত, পুরাণ সবই কাব্যের মোড়কে ইতিহাস তো বটেই। মানুষের সমীহ আদায়ের জন্য, মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য অলৌকিক ঘটনার অবতারণা করা হয়েছে এবং দেবত্ব আরোপ করা হয়েছে। মানুষ যা পারে না, তাই-ই দেবতারা পারে! তাই মহাভারত-রামায়ণে যখনই অতিশক্তি অলৌকিকতার প্রয়োজন হয়েছে তখনই দেবতার ম্যাজিক উত্থাপন হয়েছে। আসলে এর মাধ্যমে ক্ষত্রিয় আর ব্রাহ্মণদের আধিপত্য বিস্তার করেছে। ব্রাহ্মণদের ভয় করতে শুরু করেছে বাকিরা। রামায়ণ যতটা না ইতিহাস, তার চেয়ে বেশি অলৌকিক হয়ে উঠেছে। যুক্তিবাদী সত্যসন্ধানীরা রাজহাঁসের মতো দুধ থেকে জল বাদ দিয়ে পান করতে পারলে লাভবান হবেন। ভক্তি থাক বা না-থাক, রামায়ণ ইতিহাসের আকর হয়েই থাকবে।
কবি বা লেখক কেউই সমাজের বাইরের সদস্য নয়, সমাজ বহির্ভূত অলৌকিক কেউ নন। তাই যিনিই লিখুন, যখনই লিখুন তাঁর রচনার সমাজের কিছু চিত্র লিপিবদ্ধ হবে এতে আশ্চর্যের কী আছে! ইতিহাসে অলৌকিক বিষয় লিপিবদ্ধ হয় না, অপরদিকে সাহিত্যে অলৌকিকত্ব লিপিবদ্ধ করার অবাধ স্বাধীনতা রয়েছে। কোনো সাহিত্যিকের সাহিত্যে বা কাব্যে অলৌকিকত্ব প্রমাণ করার কোনো দায় নেই। কিন্তু ইতিহাস সে দায় এড়িয়ে যেতে পারে না।
আমাদের যে ইতিহাস জ্ঞান তার সবই বিদেশি ঐতিহাসিকদের থেকে অর্জন করেছি। প্রাচীন যুগ ও মধ্যযুগের কোনো ইতিহাস ভারতীয়রা লিখে উঠতে পারেননি। সেই ইতিহাসটা সম্পূর্ণই অন্ধকারে। মুসলমান আক্রমণের আগে ভারতের বহু ইতিহাস পাওয়া যায় না ভারতীয়রা দর্শন, কাব্য, বিজ্ঞান বিষয়ক ভুরি ভুরি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা লিখেছেন, কিন্তু একটিও ইতিহাস লেখেননি। প্রাচীন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ব্রাহ্মণরাই পণ্ডিত ও উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। কিন্তু তাঁরা পরম পিতার ধ্যানেই লিপ্ত থাকতেন। আধ্যাত্মিকতায় বিভোর থাকবেন। এতটাই বিভোর থাকতেন যে, তাঁরা অত্যাবশ্যক ঘটনাগুলি লিপিবদ্ধ করে উঠতে পারেননি। ভারতীয় প্রাচীন ইতিহাস গভীর তমসাচ্ছন্ন ছিল। ম্যাক্রিন্ডল বলেন, গ্রিক ও রোমান গ্রন্থকারের বর্ণনা না-থাকলে তৎকালীন ভারতীয় ইতিহাসের কোনো উপাদানই পাওয়া যেত না। সেলুকাসের দূত মেগাস্থিনিসের ‘ভারতের বিবরণ থেকে আমরা বেশকিছু প্রাচীন তথ্য জানতে পারি। যদিও মেগাস্থিনিসের ইতিহাসে প্রচুর অলৌকিক, উদ্ভট বর্ণনা আছে। সেসব মেগাস্থিনিস কোথায় পেলেন সেটা মেগাস্থিনিসই জানেন। তবে মেগাস্থিনিসের ইতিহাস পাঠ করলেই বোঝা যায়, প্রাচীন যুগে মানুষদের মধ্যে সুপারন্যাচারাল উদ্ভট কাহিনি লেখার সংক্রমণ ছিল। রামায়ণ, মহাভারত, ৩৬টি পুরাণ ইত্যাদি সব কাহিনিই একইভাবে ভয়ানক সংক্রমিত। শুধুমাত্র প্রাচীন যুগেই নয়, মধ্যযুগের অনেকটা সময় পর্যন্ত সুপারন্যাচারাল কাহিনির রমরমা। এমনকি মেগাস্থিনিস, হিউয়েন সাঙ, ফা হিয়েন, ইবনবতুতার গ্রন্থগুলিতে এমনই সব সংখ্য সুপারন্যাচারাল কাহিনি পাওয়া যায়। সেই উর্বর মস্তিষ্কের চাষবাস মানুষ এখনও অন্ধের মতো বিশ্বাস করেন। মেগাস্থিনিস, হিউয়েন সাঙ, ফা-হিয়েন, ইবান বতুতা, আবুল ফজল, বাণভট্ট, কনুন, বিহুন–এঁরা যাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় থাকতেন, তাঁরা তাঁদের প্রভুদেরই গুণগান লিখে গেছেন অতিরঞ্জিত করে।
যেসব ইতিহাস আর জীবনী নিয়ে আমাদের ইতিহাসজ্ঞান ও ইতিহাসের উপাদান বলে মাথায় করে রেখেছি, সেগুলি মিথ্যাকথন আর অলৌকিকতার সাজানো। প্রাচীন যুগ ও মধ্যযুগের শেষদিক পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত ছিল। হিউয়েন সাঙ তাঁর ভারতভ্রমণ নিয়ে যে গ্রন্থটি লিখেছেন সেখানে কীভাবে অলৌকিকত্ব ও মিথ্যাচার লিপিবদ্ধ হয়েছে, তা একটু দেখে নিতে পারি। হিউয়েন সাঙের ভারত বিবরণ থেকে জানা যায়, হিউয়েন সাঙ ভারতে এলে কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মন তিন-তিনবার নিমন্ত্রণ পাঠালেও হিউয়েন তাঁর রাজ্যে যাননি। হিউয়েন সাঙ যাতে তাঁর রাজ্যে যায়, সেজন্য নালন্দার আচার্য শীলভদ্রের কাছে দু-দুবার দূত মারফত সংবাদ পাঠান ভাস্করবর্মন। কিন্তু খুব শীঘ্রই দেশে ফিরে যাবে এই অজুহাতে হিউয়েন সাঙ না-গেলে, ভাস্করবর্মন ক্ষেপে গিয়ে হুমকি দিয়ে পত্র পাঠিয়ে বলেন, যদি হিউয়েন না-আসেন তবে শশাঙ্ক রাজা যেভাবে বৌদ্ধধর্মের নাশ করেন এবং বোধিবৃক্ষ ধ্বংস করেন তিনিও ওইভাবে সেনা ও হাতি পাঠিয়ে নালন্দা মহাবিহার ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবেন। পাঠক বিশ্বাস করব, নাকি যাচাই করব? আসুন, যাচাই করি–এ ঘটনা ব্রাহ্মণ্যধর্ম বা হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে বৌদ্ধধর্মের নির্জলা মিথ্যাচার। প্রথমত, একজন বৌদ্ধ শ্রমণের জন্য ভাস্করবর্মণ নালন্দা মহাবিহারই গুঁড়িয়ে দিতে চাইবেন? ভাস্করবর্মন গবেট নাকি? দ্বিতীয়ত, মহাবিহার নিজের রাজ্যে নয়, সম্রাট হর্ষবর্ধনের রাজ্যে। কেউ অন্য রাজ্যে মহাবিহার ভেঙে দিয়ে যাবে, মামদোবাজি নাকি! এছাড়া ধর্মীয় অলৌকিকত্বে বিশ্বাসী হিউয়েন সাঙ অলৌকিকতার ক্ষেত্রেও কিন্তু কোনোরূপ ত্রুটি রাখেননি তাঁর লেখায়। তিনি যেমন বৌদ্ধ বোধিসত্ব মূর্তি, বুদ্ধমূর্তি, স্তূপ, দেহাবশেষের অলৌকিকত্বের বর্ণনা করেছেন, তেমনই হিন্দু দেবদেবী, বিগ্রহ বা মন্দিরের অলৌকিকত্ব ও মহিমা ব্যক্ত করতে কুণ্ঠিত হননি। তবে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে ধর্ম কোন্ অতলে খসে গিয়েছিল, কীরূপ পসরা সাজিয়েছিল, তা এইসব গ্রন্থে অজস্র উদাহরণ পাওয়া যায়। শুধু হিন্দুধর্মেই নয়, সব ধর্মগ্রন্থগুলিতেই এইসব চরম অলৌকিকতা সমানভাবে বর্ণিত হয়েছে। ভারতীয় তৎকালীন সমাজ তথাকথিত ধর্মীয় পরিবেশে ধর্মের মহিমা ও মাহাত্ম্য বাড়াতে গিয়ে নানা গালগল্পের আষাঢ়ে গোরুর মতো অতিরঞ্জিত করে ইতিহাসকে বিকৃত করে সত্যকে অতলে তলিয়ে দিতে পিছপা হননি কেউ। পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতও এর বাইরে নয়। মনে রাখতে হবে, প্রাচীন যুগে মানুষ ভারত উপমহাদেশকে ভারত নয়, ‘ব্রাহ্মণের দেশ’ বলেই চিনত।
প্রথম অলৌকিকতামুক্ত ইতিহাস রচিত হয় সম্ভবত ব্রিটিশদের হাত ধরেই। অলৌককতা মুক্ত হলেও মিথ্যাচার অব্যাহতই ছিল। ইংরেজরা ভারতে উপনিবেশ গড়ার পর ব্রিটিশ ইতিহাসবিদরা অলৌকিকতা বর্জন করলেও মিথ্যাচারের পথেই ইতিহাস রচনার ব্রতী হয়েছিলেন। বিশেষ করে উদ্দেশ্যপ্রোণদিতভাবে হিন্দু-মুসলমানের ঘটনা লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ভুড়িভুড়ি মিথ্যাবর্ণন করে সমাজে বিদ্বেষ ছড়িয়েছে। তাঁদের শাসনকার্য নিরঙ্কুশ করতেই ‘ভাগ করো, শাসন করো’ (divided and rule policy) প্রয়োগ হল শুরু থেকেই, জাতিকে দুইভাগে ভাগ করে নির্বিঘ্নে ২০০ বছর টিকেছিল এবং জাতিকে দুইভাগ করেই তাঁরা ভারত ছেড়েছেন। যাই হোক, আমরা কিন্তু সেই মিথ্যাচারগুলি বিশ্বাস করি! সেই যে বিদ্বেষের বীজ বপন করে গেছেন তাঁরা, আজ তা বিষবৃক্ষ।
ইতিহাস কাকে বলে? ইতিহাসবিদরা বলেন–ইতিহাস সেটাই, যেখানে বিশেষ রাজবংশ বা ঘটনাবলির নামমালা বা যুদ্ধকৌশলের বর্ণনামাত্র। আমি মনে করি না ইতিহাস বলতে এটুকুই বোঝায়। বরং এই তত্ত্বে বলা যায়, এটা ইতিহাসের সংযোগস্থলমাত্র। কিন্তু ইতিহাসের তো এটুকুই ধর্ম হতে পারে না। হলে তা আংশিক হয়, অর্ধ-ইতিহাস হয়। এই ইতিহাস মানুষের কাজে আসে না, যতক্ষণ-না মানবজীবন বা তৎসমষ্টির উত্থাপন, উন্নতি, অবনতি এবং তার পুনরুদয় ও তৎসহ আনুষঙ্গিক বৃত্তিসমূহ যথার্থ প্রতিকৃতি দ্বারা প্রদর্শিত হয়। ততক্ষণ পর্যন্ত ইতিহাসও নয়। অনেকে বলে থাকেন, প্রাচীন ভারতের কোনো ইতিহাস নেই। একথা পুরোপুরি সত্য নয়। কারণ প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান রয়েছে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণগুলিতে। মুনি-ঋষি মহাকবিরা এই কাহিনিগুলিতে গালগপ্পো রচনা করেননি। অলৌকিক ও অ-পার্থিব বর্ণনার সংমিশ্রণে অতিকল্পনার স্বপ্নপূরণে তাঁরা ইতিহাসকেই সংরক্ষণ করে গেছেন। রামায়ণকে কেবল কল্পনা-কাব্য বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। আখ্যানময় ইতিহাসের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানময় ইতিহাসে প্রবেশার্থে সচ্ছল পথস্বরূপ। এইসব রচনায় অ-জাগতিক বর্ণনা উপস্থিত থাকলেও ইতিহাস নয় একথা বলা যায় না। সর্বাঙ্গীণ ইতিহাস নয় ঠিকই। কোন্ প্রাচীন ইতিহাসই-বা সর্বাঙ্গীণ! গ্রিসের প্রাচীন ইতিহাস, মিশরের প্রাচীন ইতিহাস, রোমের প্রাচীন ইতিহাসকে সর্বাঙ্গীণ ইতিহাস বলা যায়? অতিরঞ্জন ও অতিকথন কি নেই? ইউরোপীয়রা যদি ট্রয়ের যুদ্ধকে ইতিহাস পদবাচ্য করে তৃপ্তিসাধন করতে পারে, তবে আমরা কেন রাম-রাবণের যুদ্ধকে, কৌরব-পাণ্ডবের যুদ্ধকে কালনির্ণয়পূর্বক ইতিহাস বলে মেনে নিতে দ্বিধান্বিত হব।
অতিরঞ্জিত, অতিকথন, অতিশোয়াক্তি, দেবতারোপ, অধ্যাত্মবাদ তথা সুপারন্যাচারাল বিষয়গুলি দূরে সরিয়ে রাখলে রামায়ণের ইতিহাস হয়ে উঠতে বাধা কোথায়? একটু তলিয়ে দেখা যেতে পারে–রামায়ণ মূলত শিববিদ্বেষী আর্যদের (শ্রীরামচন্দ্র) সঙ্গে শিবভক্ত অনার্যদের (রাবণ) বিরোধের ইতিহাস। প্রাবন্ধিক হরপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলছেন–“হরধনুতে জ্যা আরোপণ করতে যে সক্ষম হবে অর্থাৎ শিবভক্ত অনার্যদের প্রতিরোধ করতে সক্ষম ব্যক্তির হস্তেই তিনি নিজ কন্যা তথা এই কৃষিবিদ্যা সমর্পণ করবেন, এটাই ছিল রাজা জনকের সংকল্প।” দক্ষিণ ভারতে শ্রীরামচন্দ্র কৃষিকার্যের বিস্তার করেছেন এমন কোনো কোনো প্রমাণ বাল্মীকি রামায়ণে নেই। ভারতের প্রাচীন ইতিহাসের অনেক উপাদান রামায়ণ, মহাভারতে কখনো রূপক হিসাবে কখনো-বা সরাসরিই পাওয়া যায়। প্রাগৈতিহাসিক, অনৈতিহাসিক সমস্ত লুপ্ত ইতিহাস উদ্ধারের জন্য পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণের উপর নির্ভর করতেই হয়। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণগুলিতে ভারতের অনেক লুপ্ত ইতিহাস আলোকিত হয়েছে। শুধু রামই নয়, রাম সহ রামায়ণের অন্যান্য চরিত্রগুলিও সমান ঐতিহাসিক। হ্যাঁ, অতিরঞ্জিত হয়েছে কোথাও কোথাও। হতেই পারে, ইতিহাসে অতিরঞ্জন তো হয়ই। ঐতিহাসিক রচিত্র চন্দ্রগুপ্ত, অশোক, আকবর, ঔরঙ্গজেব, বুদ্ধ, মোহম্মদ, জিশু, শাহজাহানের ইতিহাস কি অতিরঞ্জিত হয়নি! এরা যথার্থ ইতিহাস হলে রাম রাবণ-সীতা নয় কেন? বস্তুত বাল্মীকির রামায়ণ (অন্য কোনো রামায়ণ নয়) আর্য সাম্রাজ্যবাদীদের দাক্ষিণাত্যে ও সাগরপারে দক্ষিণী দ্বীপ লঙ্কাবিজয়ের কাব্যরূপ ইতিকথা। এর সঙ্গে অলৌকিক অপার্থিব দেবদেবতাদের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রাচীন যুগে রাজা ও পুরোহিত সম্প্রদায়কে জগৎ-স্রষ্টার সমকক্ষ ভাবা হত, ভাবানো হত। তা ইতিকথা আর নির্জলা ইতিহাস হয়ে যায়। সময়ান্তরে অবয়বে জমতে থাকে রূপকথার শ্যাওলা। সেই রীতি অনুসারে ইতিহাসের সঙ্গে রূপকথার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে রামকথার কথকরা পরবর্তীকালে রাজা রামচন্দ্রকে ঈশ্বরের অবতার এবং কালক্রমে স্বয়ং ঈশ্বররূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বাল্মীকি, বেদব্যাসরা তাঁরা তাঁদের মহাকাব্যে কোনো সত্যই গোপন করেননি। গোপন করেছি আমরা, সুবিধাবাদী ধান্ধাবাজেরা। বাল্মীকির রামায়ণকে অবমাননা করে অগ্রাহ্য করে প্রকৃত সত্যকে আড়াল করে চলেছি। সত্য সামনে এসে পড়লেই মারমুখী। বাল্মীকি, বেদব্যাসরা সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা বলেছেন, ন্যায়কে ন্যায়, অন্যায়কে অন্যায় বলেছেন। ঘোঁট পাকাচ্ছি আমরা, আমরা মানে ভণ্ড ধার্মিকেরা। বেশি ভক্তিরস দেখাতে গিয়ে ইতিহাসকেই অস্বীকার করে ফেলছি, সত্যকে অস্বীকার করছি। প্রাবন্ধিক হিসাবে আমি বলব–মূল সংস্কৃত ভাষায় লেখা বাল্মীকির রামায়ণ পড়ন। সংস্কৃত ভাষা যাঁরা জানেন না, তাঁরা হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের অনূদিত বাংলা ভাষায় রামায়ণ পড়ুন। পণ্ডিতপ্রবর হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয় তাঁর অনুবাদ গ্রন্থটিতে বাল্মীকি রচিত সংস্কৃত রামায়ণের মূলানুসারী অনুবাদক্রিয়ায় অসাধারণ কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন। একদিকে তিনি যেমন মূল রামায়ণের প্রতিটি তথ্যকে যথাযথভাবে তুলে ধরেছেন বাংলা প্রতিশব্দের মাধ্যমে, তেমনি অপরদিকে মহাকাব্যকে উপমা অলংকার সংবলিত বিরাট রসৈশ্বর্যটিকেও অবিকৃতভাবে পরিবেশন করেছেন। কোথাও ন্যূনতম সংযোজন ও বর্জন করার ধৃষ্টতা দেখাননি। তাঁর অনূদিত রামায়ণ অনেক চিরাচরিত ভুল ধারণারও নিরসন হয়েছে। আমার গ্রন্থের মূল হাতিয়ারই হল হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের রামায়ণ।
বীরেন্দ্র মিত্র তাঁর ‘রামায়ণে দেবশিবির’ গ্রন্থে স্পষ্ট করে বলেছেন–“ধর্মাধর্মের সঙ্গে নিঃসম্পর্কিত রামকথায় প্রতিভাসিত হয়েছে যে আশ্চর্য পুরাবৃত্ত, সেটি যেমন রাবণের তেমনিই আবার রামচন্দ্রেরও করুণ পরিণতির ধারাবাহিক প্রতিবেদন। আর্য দেববাহিনী এবং ব্রহ্মাবাদী ব্রাহ্মণদের চরম বিশ্বাসঘাতকতা ও নিষ্ঠুরতা তদানীন্তন ভারতবর্ষে যে ভয়াল এক রাষ্ট্রব্যবস্থার পত্তন করেছিল, উত্তরকাণ্ড সহ বাল্মীকি রামায়ণে তারই পর্বানুক্রমিক চিত্ৰণ অনুসন্ধিৎসু পাঠককে অভিভূত করে। রামায়ণ সম্পর্কিত বিভ্রান্তির মূলে আছে রামস্তুতিমূলক বাজার-চালু রামচরিতগুলি–সাধারণ্যে সেই নবরূপায়িত কল্পিত কাহিনিমালাই রামায়ণ’ নামে প্রচলিত, কিন্তু সেগুলির কোনোটিই প্রকৃত রামকথা নয়, প্রাচীন পুরাবৃত্তের অপব ঘটিয়ে এই স্তবকুসুমাঞ্জলি বিরচিত। ঐ সব গ্রন্থে ইতিহাস অবলুপ্ত হয়েছে উপন্যাসের কথা-আবর্জনার তলায়। রামচন্দ্রের জীবনাবসানের কয়েক সহস্রাব্দ পরে গ্রন্থিত হয় বাল্মীকি রামায়ণ। আবার সেই আদি মহাকাব্য বিরচিত হওয়ারও কয়েক শতক পরে হয়েছিল রামচন্দ্রের অবতারি প্রতিষ্ঠা। তৎপরবর্তী আমলে যথেচ্ছ ভক্তিমূলক প্রক্ষিপ্ত রচনার দ্বারা সম্ভবত মূল রামকথায়ও বিকৃতি ঘটতে শুরু করে। যে আগ্রাসী ব্রাহ্মণরা ক্ষমতা লালসায় অযোধ্যাকে শ্মশান বানিয়ে দীর্ঘকাল রামের পিতৃরাজ্যকে জনশূন্য করে রাখেন, সেই ব্রাহ্মণনেতৃত্বেরই পাহারাদার দুর্বুদ্ধিজীবী মতলবী ব্রাহ্মণ কথকরা পুনরায় রামকে ভগবান বানিয়ে এককালে ব্রাহ্মণ্যশোষণের বনিয়াদটি পাকাঁপোক্ত করে নেন।”
রামায়ণের ভিতরে ঢোকার আগে স্পষ্ট করে বলে নিতে চাই–কৃত্তিবাস, রঙ্গনাথন, তুলসীদাস রচয়িতাদের ভক্তিরসে ভোবানো রামায়ণ বা রামকথা যথার্থ রামায়ণ নয়। সেইসব রামায়ণ নিয়ে আমার আগ্রহ নেই। আমার আগ্রহ বাল্মীকি বিরচিত রামায়ণেই। হতাশ হবেন না, কোথাও কোথাও আঞ্চলিক অন্য কবিদের রূপকথাগুলি উল্লেখ করেছি তুলনামূলক সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য তুলে ধরার জন্য। ইতিহাসের সন্ধানে আমি বাল্মীকির রামায়ণেই থাকব। বাল্মীকির রামায়ণ কি কিংবদন্তি, না মিথ? বাল্মীকির যে রামায়ণটি আমরা পাই, সেটির সম্পূর্ণ অংশ কিংবদন্তি নয়। আবার সম্পূর্ণ অংশ মিথও নয়। আদি বাল্মীকি বিরচিত অযোধ্যাকাণ্ড থেকে যুদ্ধকাণ্ড এই পাঁচটি কাণ্ড কিংবদন্তি। প্রক্ষিপ্ত রচনা বালকাণ্ড বা আদিকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ড দুটিকে আংশিক কিংবদন্তি বলাই যায়। কিংবদন্তি হল সেটাই, যা–(১) এই ধরনের কাহিনিতে মানুষের কর্মকাণ্ড ও শক্তির উপর বেশি আরোপ করা হয়। মানুষ হল কিংবদন্তি কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্র, এক অসামান্য ব্যক্তিচরিত্র এবং তাঁর কার্যাবলিই কিংবদন্তির বিষয়বস্তু। (২) কিংবদন্তি কাহিনিগুলিতে ঐতিহাসিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক ভিত্তি থাকে। পুঙ্খানুপুঙ্খ ভৌগোলিক বিবরণ থাকে। কোনো একটি বিশেষ অঞ্চলের সংস্কার, সামাজিক রীতিনীতি, লোকাঁচার, লোকবিশ্বাসের উপর করে গড়ে ওঠে। (৩) সম্পূর্ণ যথার্থ না-হলেও বর্তমান সময়ের ভিত্তিতে কিংবদন্তির ঘটনাগুলির একটি আনুমানিক কালপঞ্জি থাকে। (৪) কিংবদন্তির গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনে সহায়ক উপাদান হিসাবে বিভিন্ন কাল্পনিক উপাদানকে ব্যবহার করা হয়। অপরদিক মিথ হল সেটাই, যা–(১) এই ধরনের কাহিনিতে ঈশ্বর বা দেব-দেবতাদের কর্মকাণ্ড ও শক্তির উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এই কাহিনিগুলিতে অলৌকিক জগতের ঈশ্বর বা দেব-দেবতারাই নায়িকা। (২) মিথের কাহিনিগুলি মূলত ধর্মভিত্তিক, ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয় সংস্কার, ধর্মীয় রীতিনীতি, পুজো-প্রার্থনা, ধর্মোৎসব, উপাচার ইত্যাদির ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। (৩) মিথে বর্তমান সময়ের নিরিখে ঘটনাভিত্তিক ধারাবাহিক সময়কালের উল্লেখ বা কালপঞ্জি থাকে না। (৪) মিথে ব্যক্তি বা ঘটনার সঠিক কোনো প্রমাণ বা ঐতিহাসিক ভিত্তি থাকে না। ভিত্তি থাকলেও তা অত্যন্ত দুর্বল হয়। যেমন–হিন্দু পুরাণোক্ত সৃষ্টির পর পৃথিবী একটি কচ্ছপের মাথার উপর অবস্থান করত। কিংবা ক্ষুধার্ত হনুমানের সূর্যকে ফল ভেবে খাওয়ার জন্য লাফ দেওয়া, বাইবেলে নোয়ার কাহিনি, রোমের রোমুলাসের জীবনকাহিনি ইত্যাদি। (৫) মিথের গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পিছনে সহায়ক উপাচার হিসাবে উপমার ব্যাপক করা হয়। কিংবদন্তিতে বাস্তব চরিত্রে কাল্পনিক রূপ পায়, মিথের সব চরিত্রই কাল্পনিক।
‘নরচন্দ্রমা’ শ্রীরামচন্দ্র : ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসক? ভগবান? ঐতিহাসিক মানুষ?
বাল্মীকির রাম কেবল ক্ষত্রিয় রাজা, কোনো অবতার বা ভগবান নন। বিভিন্ন পৌরাণিক সূত্র থেকে জানা যায়, রাম রাজত্ব করেছিলেন ত্রেতা যুগেত্রেতা যুগের সময়কাল ১২ লাখ ৯৬ হাজার বছর। অনেকে বলেন, রাম বেঁচেছিলেন ১০,০০০ বছর, “দশবর্ষ সহস্রাণি দশবর্ষ শতানিচ/রামোরাজ্য মুপাসিত্বা ব্রহ্মলোকং প্রস্যতি”। উচ্চতায় ছিলেন তাঁর নিজের হাতের মাপে ১৪ হাত। রামায়ণে মানুষের এরকম বিশাল বিশাল আয়ুর কথা নানা জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক কেদারনাথ মজুমদার বলেছেন–“এইরূপ বৃহৎ সংখ্যাবাচক নির্দেশগুলি যে পৌরাণিক যুগের কল্পনাসম্ভুত, তাহা বলাই বাহুল্য।” শ্রীরামচন্দ্রের জন্ম আর জন্মভূমি নিয়ে এ দেশে তুমুল বিতর্ক। শ্রীরামের জন্মকাল সুনির্দিষ্ট সাল-তারিখ দিয়ে নির্ধারণের প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা বিশেষ নেই। রাম দশরথ-কৌশল্যার জ্যেষ্ঠ পুত্র-সন্তান। তবে সন্তান হিসাবে জ্যেষ্ঠ নন। তার কারণ দশরথের প্রথমটি কন্যা-সন্তান, শান্তা৷ রামায়ণের মুখ্য পুরুষ চরিত্র রাম ও তার অনুজ ভরত, লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্নের জন্ম বেশ বিতর্ক আছে। অনেক গবেষক-পণ্ডিত বলেন শ্রীরামচন্দ্র দশরথের ঔরসজাত সন্তান নন। তিনি এবং তার অন্যান্য ভ্রাতৃসকল ঋষ্যশৃঙ্গেরই ‘ক্ষেত্রজ’ সন্তান। অতএব রামের জন্মদাতা পিতা ঋষ্যশৃঙ্গ, দশরথ পালকপিতা। বাল্মীকির রামায়ণে বলাই হয়েছে–“বিপ্রবর ঋষ্যশৃঙ্গ হইতে তাঁহার এই পুত্রেষ্টি পূর্ণ হইবে এবং তাঁহার ঔরসে ত্রিলোক বিখ্যাত অতুল বলসম্পন্ন বংশধর চারিপুত্র উৎপন্ন হইবে।” (রামায়ণ/হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যভারবি/প্রথম সংস্করণ/পৃষ্ঠা ৩৯) সারথী সুমন্ত্রও একই আশ্বাস দিয়েছিলেন–“ঋষ্যশৃঙ্গই আপনার (দশরথের) সন্তানকামনা পূর্ণ করিবেন।” (রামায়ণ/হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যভারবি/প্রথম সংস্করণ/পৃষ্ঠা ৩৫) অশ্বমেধ যজ্ঞের আস্থা না-থাকায় দশরথও যজ্ঞশেষে ঋষ্যশৃঙ্গকে বিনীতভাবে অনুরোধ করেছিলেন–“সুব্রত! যাহাতে আমার বংশরক্ষা হয়, আপনি এইরূপ কার্য অনুষ্ঠান করুন।”(পৃষ্ঠা ৪৬) এত বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের পিতা হওয়ার ব্যাপারটায় পাছে প্রজাদের সন্দেহ হয়, সেই সন্দেহ নিরসনের জন্য একটি লোক-দেখানো অশ্বমেধ (এই অশ্ব পক্ষবিশিষ্ট বলে বাল্মীকির রামায়ণে উল্লেখ হয়েছে। ঋগবেদে বলা হয়েছে এই অশ্ব সমুদ্র থেকে জায়মান। বেদ বলছে, শ্যেনপক্ষীর মতো এদের পাখা ছিল। যেসব প্রাণীতত্ত্ববিদ এই অশ্ব সম্বন্ধে গবেষণা করেন তাঁরাই বলতে পারবেন এমন পক্ষযুক্ত অশ্বের উদ্ভব সম্ভব ছিল কি না। তবে ঋগবেদের সময় থেকে রূপকথার পক্ষীরাজ ঘোড়া পর্যন্ত এই পক্ষবিশিষ্ট অশ্ব সম্বন্ধে কিংবদন্তি চলে আসছে। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে আছে–“অপসু যোনির্বা অশ্বঃ”, অর্থাৎ জল থেকে অভ্যুদয় হয়েছে বলেই একে অশ্ব বলা হয়।)
যজ্ঞেরও আয়োজন করলেন দশরথ। নিয়ম অনুযায়ী যজ্ঞের উদ্দেশে সেই অশ্ব বিভিন্ন দেশ বা রাজ্য সসৈন্যে ঘুরে বেড়াবে এবং যে যে দেশ বা রাজ্য বিনা বাধায় অতিক্রম করে যাবে সেই সেই দেশই যজ্ঞকারী রাজার অধীন হবে। কিন্তু দশরথ তা করেননি। কারণ দশরথ ছিলেন অত্যন্ত ক্ষুদ্র ক্ষমতার রাজা বা নরপতি। তাঁর পক্ষে ব্যয়বহুল তথা যথার্থ অশ্বমেধ যজ্ঞ করা প্রায় অসম্ভব। তাই নিজের রাজ্যের চারদিকে অশ্বকে ঘুরিয়ে এনে যজ্ঞ সমাপন করেছিলেন। যুদ্ধবিগ্রহও রাজা দশরথের একেবারেই না-পছন্দ। তাই রাজা দশরথের রাজ্যও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়নি। ওই ক্ষুদ্র রাজ্য নিয়েই রাজা দশরথ সন্তুষ্টই ছিলেন। যাই হোক, সংশ্লিষ্ট অশ্ব ফিরে এলে প্রধানা মহিষীকে তাঁর সঙ্গে রাত্রিযাপন করতে হত, কৌশল্যাও রাত্রিযাপন করলেন। পরদিন সেই যজ্ঞপূত অশ্বকে প্রধানা মহিষী কর্তৃক কর্তন করে ভক্ষণ করা হত। অশ্বদের পুরুষের পুত্রস্বরূপ বলা হয়েছে। তাই পুত্রার্থে অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করতেন অপুত্রক রাজারা।
মনে রাখতে হবে কৌশল্যার জ্যেষ্ঠ সন্তান শান্তা। শান্তার স্বামী ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি। আবার ঋষ্যশৃঙ্গের পিতা রোমপাদ। রোমপাদের স্ত্রী বর্ষিণী হলেন কৌশল্যার বোন। রোমপাদের দ্বারা ক্ষেত্রজ সন্তান শান্তাকে লাভ করেন কৌশল্যা। সেই হিসাবে ঋষ্যশৃঙ্গ যেমন রোমপাদের নিজের ঔরসজাত সন্তান, অপরদিকে শান্তা ক্ষেত্রজ হলেও নিজের ঔরসজাত সন্তান। তাহলে সম্পর্কটা দাঁড়াল ঋষ্যশৃঙ্গ কৌশল্যার ভগ্নীপুত্র। ভগ্নীপুত্র মানে ঋষ্যশৃঙ্গ কৌশল্যার সন্তানতুল্য। আবার কন্যার স্বামী হিসাবে জামাইও বটে। এমন এক সম্পর্কের পুরুষ, সে আবার শান্তা ও দশরথের অনুরোধে কৌশল্যাকে ‘পুত্রকামাষ্টি যজ্ঞ’ বা ‘পুত্রেষ্টি যজ্ঞ’-এর মাধ্যমে চার ক্ষেত্রজ সন্তান উপহার দেয়। সেই চার সন্তান হলেন–রাম, লক্ষ্মণ, ভরত ও শত্রুঘ্ন। অর্থাৎ চরম অজাচার। ( ‘immortal Love of Rama’–G. B. Kanuga) এসব ঘটনা বাল্মীকি রামায়ণের বালকাণ্ডে পাবেন।
যেসব পণ্ডিতেরা বলেন বালকাণ্ড প্রক্ষিপ্ত, সেসব পণ্ডিতেরা কেন দশরথের পুত্রলাভে ঋষ্যশৃঙ্গকে টেনে আনলেন? ঋষ্যশৃঙ্গকে তো কেবলমাত্র বাল্মীকির রামায়ণে বালকাণ্ডতেই পাওয়া যায়। অন্য কোথাও নেই। দু-দিক নয়–হয় প্রক্ষিপ্ত, নয় প্রক্ষিপ্ত। যদি প্রক্ষিপ্ত হয় ঋষ্যশৃঙ্গ দ্বারা পুত্র-কন্যার জন্মবৃত্তান্তকে অগ্রাহ্য করতেই হয়। আর যদি বালকাণ্ডকে আদি বাল্মীকির স্বরচিত বলে মেনে নিই, তাহলে তো অজাচার সম্পর্ককে মেনে নিতেই হবে। ক্ষেত্রজই বলি আর পুত্রকামাষ্টি যজ্ঞই বলি, মৈথুন ছাড়া, শুক্রাণু-ডিম্বাণুর নিষেক ছাড়া সন্তানের জন্ম কোনোদিন কোনোভাবেই হয়নি। সম্ভবও নয়। অতীতে হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না।
শ্রীরামচন্দ্র পিতৃসত্য পালনকারী হিসাবে বেশ প্রসিদ্ধ। পিতৃসত্য পালনের জন্য শ্রীরামচন্দ্র ভারতীয়দের মনে আদর্শ হয়ে আছেন। কেমন ছিল সেই পিতৃসত্য পালন? আসলে শ্রীরামচন্দ্রের কাছে বনবাসে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না। শ্রীরামচন্দ্র বনবাসে যেতে বাধ্য। শ্রীরামচন্দ্র যদি বিনা প্রশ্নে বনবাসে না যেতেন, তাহলে দশরথের প্রতিজ্ঞাভঙ্গ হত। যদি না যেতেন কী হত? বাল্মীকির রামায়ণে বিশ্লেষণ করলে যেটা পাওয়া যায়, সেটা হল, রাজ্য ও রাজত্বের জন্য শ্রীরামচন্দ্রের সঙ্গে ভরতের যুদ্ধ অনিবার্য হত। রাম ছাড়লেও ভরত শত্রুঘ্ন-বশিষ্ঠ-কেকয়রাজ কেউ ছেড়ে দিত না। মহাভারতের মতো ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ হত। তদুপরি দশরথের সঙ্গে কেকয়রাজ অশ্বপতির যুদ্ধ হত এবং দশরথ পরাজিত হত। দশরথ যে যুদ্ধবাজ ছিলেন না, তা বোঝা যায় মাত্র ৪৯৫ বর্গমাইল ভূখণ্ড নিয়ে তাঁর খুশি থাকায়। দশরথ এবং শ্রীরামচন্দ্র দুজনেই ছিলেন শান্তিকামী মানুষ। অনাবশ্যক যুদ্ধ-সংঘর্ষ এড়াতে একবাক্যে বনবাস গমনই একমাত্র পথ। (অথচ এই শান্তিকামী রামচন্দ্রকেই পরবর্তী সময়ে দেখব আর্যদেবতাদের প্ররোচনায় পা দিয়ে কীভাবে নৃশংস যুদ্ধবাজে পরিণত হলেন)। বনবাস গমনই একমাত্র পথ ভাবার কারণ এর প্রস্তুতি পূর্বেই ছিল। হঠাৎ করে মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়েনি। কৈকেয়ীর পুত্রই ভবিষ্যতে অযোধ্যার সিংহাসনে আরোহণ করবে, এই প্রতিশ্রুতি বিয়ের আগেই দশরথ দিয়েছিলেন কৈকেয়ীর পিতাকে। কৈকেয়ীর বিয়ের সময় থেকেই দশরথ এই প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে সত্যবদ্ধ। ছিলেন। দশরথ-পরবর্তী ভরত অযোধ্যার রাজা হলে শ্রীরামচন্দ্রের আর কাজ কী বনবাসে যাওয়া ছাড়া! দশরথের সঙ্গে শ্বশুর অশ্বপতির প্রতিজ্ঞাকে দুইজন মাত্র অস্বীকার করতেই পারতেন। একজন কৈকেয়ী, তিনি যদি দশরথের কাছ থেকে ভরতের জন্য অযোধ্যার সিংহাসন না-চাইতেন। দ্বিতীয়ত ভরত, তিনি যদি দাদার অগ্রাধিকারকে মূল্য দিয়ে অযোধ্যার সিংহাসন গ্রহণ করতে অস্বীকার করতেন। বস্তুত ভরতও সেই সত্য জেনে জেনেই বড়ো হয়েছেন যে, তিনিই অযোধ্যার রাজা হচ্ছেন। জেনেছেন মা কৈকেয়ী ও দাদু অশ্বপতির কাছ থেকেই। দশরথকেও সর্বক্ষণ এই প্রতিজ্ঞা তাড়া করে নিয়ে বেড়াত। রামচন্দ্রসহ নিকটবর্তী সকলেই এ প্রতিজ্ঞার কথা জানতেন। দশরথ ভরতকে একেবারেই পছন্দ করতেন না। দশরথ মনে করতেন রামের জন্য ভরতের ভূমিকা মারাত্মক হতে পারে। তাই দশরথ ভরত ও তাঁর দোসর শত্রুঘ্নকে মাতুলালয়ে পাঠিয়ে দেন ১২ বছরের জন্য। এই বারো বছরে একবারের জন্যেও ভরতের খোঁজ নেননি বিচক্ষণ রাজা দশরথ।
শুধু তাই নয়–মাতা কৈকেয়ী, পিতা দশরথ এবং স্বদেশ অযোধ্যা ত্যাগ করে যাওয়ার পর ১২ বছরের মধ্যে একবারের জন্যেও অযোধ্যায় ফেরেননি ভরত। এর ফলে রাজঅন্তঃপুরে ভরতের জনপ্রিয়তা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যায়। অপরদিকে রামচন্দ্রের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠে আসে। এই দীর্ঘ ১২ বছর ব্যাপী দশরথ রাজ্যাভিষেকের নিমিত্তেই রামকে প্রস্তুত করছিলেন। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারেননি। রামের ২৮ বছর সমাপ্তি এবং রামের রাজ্যাভিষেকের সময় আসন্ন। আয়োজনের আগের দিন অন্দরমহলের ষড়যন্ত্রের শিকার হলেন দশরথ। দশরথ বন্দি হলেন কৈকেয়ীর গৃহনজরে। অন্তরীণ করে রাখা হল তাঁকে। কৈকেয়ী দশরথকে জানিয়ে দিলেন রামকে চোদ্দো বছরের জন্য বনবাসে যেতে হবে এবং ভরতই হবে অযোধ্যার রাজা। নিরূপায় দশরথ ভেঙে পড়লেন, মুহ্যমান হলেন। দশরথ কৈকেয়ীর ভয়ে ভীত, সন্ত্রস্ত। কৈকেয়ীকে অগ্রাহ্য করা মানে স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানানো। দশরথ বুঝে গিয়েছিলেন কুলগুরু বশিষ্ঠের নেতৃত্বে অযোধ্যার সিংহাসন দখলের অতঃসলিলা ষড়যন্ত্র চলছে। বশিষ্ঠ ছিলেন ভরতের প্রবল সমর্থক এবং রামের বিরোধী। ভরত কুলগুরু বশিষ্ঠের দ্বারা দীক্ষিত হন এবং রাম দীক্ষিত হন বিশ্বামিত্রের দ্বারা। বিশ্বামিত্র আর বশিষ্ঠ একে অপরের জাতশত্রু। সেই বিশ্বামিত্রকে ভ্যানিশ (অন্তর্হিত?) করে দিয়েছেন বশিষ্ঠ অনেক আগেই, যেদিন ষোলো বছর বয়সে রামচন্দ্রকে বিয়ে করিয়ে ফিরছিলেন বিশ্বামিত্র। গোটা রামায়ণে বিশ্বামিত্রকে আর দেখা যায়নি সেদিন থেকে। কেকয়রাজ বশিষ্ঠের সমর্থক। কেকয়রাজ অশ্বপতির কন্যা কৈকেয়ী এবং ভরত দৌহিত্র। অতএব চক্রান্তের গভীরতা বুঝতে দশরথের এতটুকু অসুবিধা হয়নি। ভরতের রাজা হওয়ার পথে রাম ছিলেন সাক্ষাৎ কাঁটা। কৈকেয়ী চেয়েছিলেন রামকে চিরতরে সরিয়ে ফেলতে। আর তাই তিনি রামকে কেবল বনবাসে পাঠিয়েই ক্ষান্ত হননি, বনটিও তিনিই নির্বাচন করলেন–দণ্ডকারণ্য, দণ্ডকারণ্য যে এক ভয়াল-ভয়ংকর শ্বাপদসংকুল এবং হিংস্র মানুষখেকো রাক্ষস অধ্যুষিত জঙ্গল কৈকেয়ী তা বিলক্ষণ জানতেন। এখানে বসবাস তো দূরের কথা, প্রবেশের পর কারোর পক্ষেই জীবন্ত ফিরে আসা সম্ভব নয়। অতএব ভরতের সিংহাসন আজীবনকাল নিরঙ্কুশ।
কৈকেয়ী যখন দশরথকে ডেকে জানিয়ে দিলেন চতুর্দশ বর্ষ দণ্ডকারণ্যে রামের বসবাস এবং ভরতের অভিষেক, একথা শ্রবণ করে ক্রোধে দশরথ কৈকেয়ীকে তুই-তোকারি করে ব্যাকালাপ করতে দ্বিধা করেননি৷ বলেছেন–“এক্ষণে তোকে ও আমার ঔরসজাত পুত্র তোর ভরতকে পরিত্যাগ করিলাম। রজনী প্রভাত হইয়াছে। আমি কিছুতেই তোর কথা শুনিব না। তোকে অবমাননা করিব ও রামকে রাজ্য দিব।” অতএব দশরথ রামকে বনবাসে পাঠাতে একদম পাঠাতে রাজি নন। ভরতকেও রাজা করতে চান না। কিন্তু কৈকেয়ীও সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নন, কড়া ভাষায় হুকুম দিলেন–“তুমি এখন রামকে এ স্থানে আনাও এবং তাহাকে বনবাসে দিয়া ভরতকে রাজা করো। তুমি আমার শত্রু দূর না করিয়া এ স্থান হইতে এক পদও যাইতে পারিবে না।” (রামায়ণ/ভারবী/প্রথম সংস্করণ/পৃঃ ১৬৫) দশরথ কার্যত কৈকেয়ীর ক্রোধাগারে বন্দি হলেন। ইতিমধ্যে সুহৃদ অমাত্য ও সারথি সুমন্ত্র দশরথকে জানিয়ে দিয়ে গেছেন পরিস্থিতি খুবই প্রতিকূল। রাজদরবার এখন ব্রাহ্মণ বশিষ্ঠ তাঁর সঙ্গীদের দখলে, ক্ষত্রিয়রা নেই। আগের রাতে দশরথ রামকে জীবনসংশয় আছে বলে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। রামও পিতার আসন্ন বিপদের ব্যাপারে সম্পূর্ণ অনবহিত ছিলেন।
দশরথের আদেশে সুমন্ত্র রামকে নিয়ে যেতে আসেন। রামের আজ অভিষেক হওয়ার কথা। যাওয়ার সময় জানকীকে তিনি বলে গেলেন–“প্রিয়ে, আমার নিমিত্ত পিতা দেবী কৈকেয়ীর সহিত সমাগত হইয়া আমারই অভিষেকের পরামর্শ করিতেছেন সন্দেহ নাই।.. পিতা নিশ্চয়ই আজ আমাকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করিবেন।” রাম খুশি খুশি মনে দশরথের কাছে পৌঁছোলেন। কিন্তু পিতার অবস্থা দর্শন করে রাম চুপসে গেলেন। হাওয়া ভালো নয় বুঝে গেলেন বিচক্ষণ রাম। রামের দর্শনমাত্রই দশরথ কেবল ধরা-ধরা গলায় ‘রাম’ শব্দটিই উচ্চারণ পারলেন। দশরথের চোখে জল, বাঁধ মানে না। এতই জল যে রামকে দেখতেই পারছেন না, নির্মম কথাগুলিও রামকে বলতে পারলেন না। যে কথা বলতে দশরথ কষ্ট পাচ্ছেন, সে কথা কৈকেয়ী অবশ্যই অবলীলায় বলে ফেললেন।
রাম বিচক্ষণ পুরুষ। তিনি বুঝলেন প্রাসাদের পরিবেশ খুবই ভয়ংকর। প্রাসাদ-বিপ্লবের শিকার তাঁরা। প্রাসাদ এখন দেবী কৈকেয়ীর দখলে। পিতা বন্দি। উচ্চবাচ্য করলেই পিতার জীবনহানি তো হতে পারে, উপরন্তু মাতা কৌশল্যা ও তাঁদেরও ক্ষতির আশঙ্কা আছে। ভরত বশিষ্ঠের কাছে দীক্ষিত হয়েছেন, রাম নয়। রাম দীক্ষিত বিশ্বামিত্রের কাছে। বিশ্বামিত্রের পথই রামের পথ। অতএব কুলগুরু বশিষ্ঠ ভরতের পক্ষ নিয়ে ষড়যন্ত্রের খুঁটি সাজাচ্ছেন, এ ভাবনায় সন্দেহের অবকাশ কোথায়! তার উপর যখন বশিষ্ঠের সঙ্গে কৈকেয়ীর মতো দুরাচার রাজমাতা, পরম বন্ধু কেকয়রাজ ও তাঁর পুত্র যুধাজিৎ আছেন, তখন দশরথকে শুইয়ে দিতে কঠিন কোথায়? পূর্বে ভরতকে নিষ্কণ্টক করতে প্রতিপক্ষ রামকে বিশ্বামিত্রের সঙ্গে বনে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন বশিষ্ঠই। বশিষ্ঠ ভেবেছিলেন প্রতিপক্ষ রাম আর শত্রুপক্ষ বিশ্বামিত্রের বিনাশ হবে ভয়ংকর নিশাচরদের বিনাশ করতে গিয়ে। ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ করলে একথা স্পষ্ট হয় যে, বশিষ্ঠ ভরতের সমর্থক এবং রামচন্দ্রের বিরোধী। কেকয়রাজ বশিষ্ঠের সমর্থক, কৈকেয়ীর পিতা এবং ভরত তাঁর দৌহিত্র। দশরথ এদের একদম পছন্দ করতেন না। কোনো শুভাশুভ কাজে এদের আমন্ত্রণ জানাতেন না, সোজা ইগনোর করতেন। রামের বিয়ে বা রামের রাজ্যাভিষেক–এমন গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানেও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি দশরথের পক্ষ থেকে। দশরথ জানতেন রাম নয়, ভরতেরই দল ভারী। রামের ছিল কেবল রাজশক্তির প্রতি প্রজাগণের নিরঙ্কুশ আনুগত্য। রামচন্দ্রের প্রতি প্রজাদের এই নিরঙ্কুশ আনুগত্য বশিষ্ঠদের ভীত করেছিল৷ বিবাহসূত্রে রাম যদি জনকরাজা সীরধ্বজের আনুকূল্যে অধিক শক্তিশালী হয়ে ওঠেন, সেই পথও বন্ধ করতে প্রয়াস চালালেন এবং সফলও হলেন। মিথিলায় বশিষ্ঠ, যুধাজিৎ, ভরত, শত্রুঘ্ন নিমন্ত্রিত ছিলেন না, তা সত্ত্বেও তাঁরা অনাহূত হয়ে পৌঁছে গেলেন মিথিলায় বিয়ের আসরে। বশিষ্ঠ ভাবলেন রাম ও লক্ষ্মণ মিথিলাপতির সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়ে গেলে রামচন্দ্রের শক্তি বৃদ্ধি হবে। ভরতের কী হবে! কিন্তু মিথিলাপতি সীরধ্বজের মাত্র দুটি কন্যা–সীতা ও ঊর্মিলা। সীতা রামের স্ত্রী হবেন, ঊর্মিলা লক্ষ্মণের। ভরতের তো কিছু একটা ব্যবস্থা করে দিতে হবে! ভরতকে মিথিলার যুক্ত করতেই হবে। অতএব সীরধ্বজের কন্যা নেই তো তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা কুশধ্বজের দুটি কন্যা আছে তো–মাণ্ডবী ও শ্রুতকীর্তি। তাঁর উপর আবার কুশধ্বজ বশিষ্ঠপন্থী। এক্কেবারে সোনায় সোহাগা! শেষপর্যন্ত পনেরো কলা পূর্ণ হল বশিষ্ঠের–রাজর্ষি সীরধ্বজের কন্যা সীতা ও ঊর্মিলার সঙ্গে যথাক্রমে রাম ও লক্ষ্মণের এবং কুশধ্বজের কন্যা মাণ্ডবী ও শ্রুতকীর্তির সঙ্গে ভরত ও শত্রুঘ্নের বিয়ে সম্পন্ন হল।
এ পর্যন্ত ক্ষমতার লড়াইয়ে জয় বশিষ্ঠরই হল, বিশ্বামিত্রের পরাজয়৷ পনেরো আনা পূর্ণ হয়েছে, ভরতরকে নিরঙ্কুশ করতে আর-একটি কাঁটা উপড়ে ফেলতে পারলেই ষোলো আনা পূর্ণ। সেই কাঁটার নাম বিশ্বামিত্র। যে বশিষ্ঠের পরম শত্রু, সে রামের পক্ষে। বিবাহের পরদিন সকালে কী এমন হল, বিশ্বামিত্র অযোধ্যায় ফিরলেন না। মহর্ষি বিশ্বামিত্র রাজা দশরথ ও জনককে সম্ভাষণ জানিয়ে হিমাচলে প্রস্থান করলেন। হিমাচলে কেন? তাহলে বিশ্বামিত্রও কি ষড়যন্ত্রের শিকার? বশিষ্ঠদের তরফ থেকে কোনো জীবনহানির ‘গ্রেড’ ছিল কী বিশ্বামিত্রের উপর? বিশ্বামিত্রের এটা প্রস্থান, না অন্তর্ধান? জনকপুরীতে অবস্থানকালেই বিশ্বামিত্রকে অন্তর্হিত হতে হল। বিদায়কালে দশরথ ও জনকরাজাকে যথাযথ সম্ভাষণ জানালেও, বশিষ্ঠকে কোনো সম্ভাষণ বিশ্বামিত্র জানাননি। এরপর থেকে বিশ্বামিত্রকে আমরা আর পাইনি গোটা রামায়ণে। তাহলে কি বশিষ্ঠ নিজের শতপুত্র হত্যার প্রতিশোধ নিয়ে নিলেন সুযোগ বুঝে। সেই সুযোগ, যে সুযোগে এক ঢিলে তিন পাখি মারা যায়। পুত্রহত্যার প্রতিশোধ, রামকে শক্তিহীন করে দেওয়া এবং ভরতের নিরঙ্কুশ রাজ্য প্রদান করা। কারণ ভরতকে অযোধ্যার রাজা করতে পারলেই রাজদরবারে বশিষ্ঠের আধিপত্য থাকবে, রামের ক্ষেত্রে সেটা উলটো হবে। রাম অযোধ্যার রাজা হলে বিশ্বামিত্রের আধিপত্য রক্ষা হত। বশিষ্ঠ কোণঠাসা হয়ে পড়ত। এ অপমান বশিষ্ঠের সহ্য হবে কেন? ব্রাহ্মণ বলে কথা!
অযোধ্যার পরিস্থিতি বড়ই জটিল। রাজা দশরথ ভয়ে জুজু, অসহায়। লোকবল, সৈন্যবল সবই কৈকেয়ীর নিয়ন্ত্রণে। এমতাবস্থায় রামের যত দ্রুত সম্ভব অযোধ্যা ত্যাগ করাই বিধেয়। তাতে পিতা দশরথ, মাতা কৌশল্যা এং নিজের প্রাণ রক্ষা করতে পারবেন। বাল্মীকির রামায়ণে রাম সরাসরিই বলেছেন–“লক্ষ্মণ আমার বোধ হইতেছে যে, ভরতকে রাজ্যে নিয়োজিত, আমাকে নির্বাসিত ও পিতার প্রাণান্ত করিবার নিমিত্তেই কৈকেয়ী আসিয়াছেন।” অযোধ্যা ত্যাগ তথা বনবাসে যাওয়ার সিদ্ধান্তের ঘটনায় রামচন্দ্র যতটা-না পিতাকে মান্য করেছেন, তার চেয়ে বেশি মান্য (?) করেছেন বিমাতা কৈকেয়ীকে। বাল্মীকির রামায়ণে রামের মনোভাবকে স্পষ্ট করেছে, ক্ষোভে রাম বলছেন লক্ষ্মণকে–“ভার্যার সহিত ভরতই সুখী, তিনি একাকী অধিরাজের ন্যায় সমগ্র কোশল রাজ্য উপভোগ করিবেন। পিতা জীর্ণ হইয়াছেন, আমিও অরণ্য আশ্রয় করিলাম, সুতরাং তিনি একাকীই রাজা হইবেন।” পিতা দশরথের উদ্দেশে বলেন–“যিনি ধর্ম ও অর্থ পরিত্যাগ করিয়া কামের অনুসরণ করেন, তিনি শীঘ্রই রাজা দশরথের ন্যায় এইরূপ বিপন্ন হন, সন্দেহ নাই।” নির্বাসন-ক্ষুব্ধ রাম পিতা দশরথকে কামের অনুসরণকারী বলে উল্লেখ করেছেন। পিতা দশরথকে কামুক’ বলেছেন লক্ষ্মণও। বাল্মীকির রামায়ণে কৈকেয়ীর মুখের কথাতেই রামচন্দ্র বনবাসগমনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। দশরথ তো তাঁর নিজের মুখে শ্রীরামচন্দ্রকে বনবাসেই যেতে বলেননি। দশরথ সেকথা কোনোদিন বলতেও পারতেন না এমন কঠিন কথা। পিতা দশরথ একবারের জন্যেও রামকে বনবাসে যেতে আজ্ঞা করেননি–জনসমক্ষেও নয়, একান্তিকেও নয়। কারণ রামচন্দ্রকে দশরথ নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি স্নেহ করতেন। সেই কঠিন কথা অন্য কেউ বলে ফেলেছেন তা শুনেই দশরথ অসুস্থ হয়ে পড়েন। দশরথ যতই রামচন্দ্রকে অন্ধের মতো স্নেহ করুক না-কেন, রামচন্দ্র যে পিতার প্রতি অন্ধভক্ত ছিলেন তার কিন্তু কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না৷ এক, বনবাসের যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পিতার অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকেননি। সিদ্ধান্তটা তিনি একাই চূড়ান্ত করে ফেলেছেন। দুই, বনবাসের আগে মাত্র ষোলো বছর বয়সে যখন যজ্ঞবিনাশকারীদের বিনাশ করতে বিশ্বামিত্রের সঙ্গে অরণ্যে রওনা দিয়েছিলেন, তখনও দশরথের ওজর-আপত্তিকে রামচন্দ্র গ্রাহ্য করেননি। বস্তুত রামচন্দ্র বড়ো ও উপযুক্ত হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দশরথ খুব চাপের মধ্যে কাটাচ্ছিলেন। দশরথ যে কেকয়রাজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন, তা তিনি নিজেই মনে রাখার প্রয়োজন মনে করেননি। সেই প্রতিজ্ঞাকে স্বয়ং দশরথই পাত্তা দেননি। পাত্তা দেননি তার প্রমাণ মিথিলা থেকে রামের বিয়ে করে আসার পর দশরথ ভরত ও তাঁর অঙ্গরক্ষক শত্রুঘ্নকে ১২ বছরের জন্য মাতুলালয় কেকয়রাজের কাছে কৌশল করে পাঠিয়ে দেন। দশরথ জানতেন ভরত রামের জন্য বিপজ্জনক। পরবর্তী ১২ বছর ব্যাপী পিতা দশরথ পুত্র রামচন্দ্রকে অযোধ্যার পরবর্তী রাজা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এই ১২ বছর দশরথ ভুলেও ভরতকে অযোধ্যায় আসতে বলা তো দূরের কথা, স্মরণ পর্যন্ত করেননি। বাস্তবিক ক্ষেত্রে শেষরক্ষা করতে পারেননি দশরথ। তীরে এসে তরী ডুবে যায়। শ্রীরামচন্দ্রের রাজা হতে না-পারাটা দশরথ মানসিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। রাজা দশরথ অসুস্থ হয়ে পড়েন। কৈকেয়ীর নির্দেশে সত্যাসত্য পিতার কাছ থেকে যাচাই করার সাহস দেখালেন না পুত্র রামচন্দ্র।
কয়েকদিনের মধ্যেই দশরথ প্রাণত্যাগ করলেন। রামচন্দ্র পিতা দশরথের মানসিক বিপর্যস্ততা উপলব্ধি করতে পারলেন না। রামের বনবাস এবং ভরতের রাজত্বলাভ দশরথ কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। পিতার সত্যরক্ষা করতে গিয়ে পিতারই মৃত্যুর কারণ হলেন রামচন্দ্র। যাঁর জন্য রামচন্দ্র মহত্বের পরিচয় দিলেন, সেই ব্যক্তির মৃত্যু হল বনগমনের পর। যাঁর জন্য সত্যরক্ষা, তিনিই থাকলেন না। তাহলে কি এটাই বোঝায় প্রাণ দিতে হলেও সত্যরক্ষা করতেই হবে? দশরথ তো সত্যরক্ষা করতে পারেননি। দশরথের যৎসামান্য সত্যরক্ষা হয়েছে রামের বনবাসের মাধ্যমেই। রাম বনবাস মেনে না নিলে দশরথের মৃত্যু হত না। আর দশরথের মৃত্যু না-হলে ভরত কোনোদিনই রাজা হতে পারতেন না। দশরথ কখনোই ভরতের হাতে রাজত্ব তুলে দিতেন না।
শুধু এটুকুই নয়, ভরতের রাজা হওয়া আর শ্রীরামচন্দ্রের বনবাসে যাওয়ার পিছনে এক শক্তিশালী ‘বি’ কাজ করেছে। ভরতের পক্ষে বশিষ্ঠের লবি এবং শ্রীরামচন্দ্রের পক্ষে বিশ্বামিত্রের লবি। বিশ্বামিত্র আর বশিষ্ঠের মধ্যে বিরোধের কাহিনি সর্বজনবিদিত (দুই ঋষি বিরোধের কাহিনি বিশ্বামিত্রের আলোচনার সময়ে বিস্তারিত বলব।)। এই দুই ঋষির ব্যক্তিগত বিরোধই রাম-ভরতের মধ্যে আপাতনিরীহ সংঘর্ষ। রামও যথাসময়ে সেই বিপদের গন্ধ পেয়েছিলেন। রাম বুঝেছিলেন এঁদের সঙ্গে যুঝে ওঠা কোনোমতেই সম্ভব নয়। সিংহাসনের জন্য গা-জোয়ারি করলে দশরথ ও রাম গুপ্তখুনও হয়ে যেতে পারেন। রামকে বনবাসে পাঠানোর উদ্দেশ্যও কৈকেয়ীর সেই কারণেই। তিনি বনবাসে পাঠিয়েও ক্ষান্ত হননি, ভয়ংকর জঙ্গল দণ্ডকারণ্য নির্বাচন করে দিলেন। দণ্ডকারণ্য এমন এক গভীর জঙ্গল, যা শ্বাপদসংকুল ও নরমাংসখেকো রাক্ষস-খোক্ষস অধ্যুষিত–যেখানে প্রবেশ করলে আর প্রাণ নিয়ে ফিরে আসা সম্ভব নয় কারোর পক্ষে। কৈকেয়ীরা ভেবেছিলেন রামচন্দ্র আর প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবে না, ভরতও সারাজীবন নিরঙ্কুশ থাকবে। রামচন্দ্রও সমস্ত ক্ষোভ উগরে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন (নির্গত হইলে আজ কৈকেয়ী কৃতকার্য হইয়া নিষ্কণ্টক আপনার পুত্র ভরতকে রাজ্যে অভিষেক করিবেন। আমি জটাবল ধারণপূর্বক অরণ্যে প্রস্থান করিলে তিনি মনের সুখে কালযাপন করিতে পারিবেন।” ((রামায়ণ/হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য/ভারবি/প্রথম সংস্করণ/পৃষ্ঠা ১৮১)
তবে দেবী কৈকেয়ীর সাধ পূরণ করবেন, এমন সাধও শ্রীরামচন্দ্রের ছিল না। তাই কৈকেয়ীর আদেশমতো রামচন্দ্র দণ্ডকারণ্যে যাওয়ার কথা মনেই রাখেননি। কারণ রাম বিলক্ষণ জানতেন, দণ্ডকারণ্য কোনোভাবেই মনুষ্যের উপযুক্ত নয়। তাই অযোধ্যা থেকে বেরিয়ে সারথী সুমন্ত্রকে নিয়ে দণ্ডকারণ্যে নয়, গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্থল প্রয়াগে ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে পৌঁছে সুমন্ত্রকে অযোধ্যায় ফিরে যেতে আদেশ করেন। সুমন্ত্রও এদিক ওদিক ঘুরে সময় অতিবাহিত করে অযোধ্যায় পৌঁছে যান। রাম-লক্ষ্মণ-সীতা মুনির কাছে রাত কাটিয়ে পরদিন দশ ক্রোশ দূরে চিত্রকুট পর্বতের কাছে পৌঁছোলেন। এখানে অসংখ্য মুনিঋষিদের বাস, খাদ্য-খাবার-পানীয়ও সহজলভ্য। অতএব রাম সিদ্ধান্ত নিলেন–“ইহা বসবাস করিবার যোগ্য স্থান৷” তিনি লক্ষ্মণকে নির্দেশ দিলেন–“দৃঢ় উৎকৃষ্ট কাষ্ঠ আনিয়া গৃহ প্রস্তুত করো। চিত্রকুটে বাস করিতে আমার অত্যন্তই অভিলাষ হইয়াছে।” বিশ্বস্ত মুনি ভরদ্বাজের গৃহে বা আশেপাশে গৃহনির্মাণ করে বসবাস করতেই পারতেন। পারতেন ঠিকই, কিন্তু সে স্থান রামেদের জন্য নিরাপদ ছিল না বলেই রামের আশঙ্কা ছিল। লোকমুখে কোনোভাবে তার এই অবস্থানের খবর অযোধ্যায় পৌঁছোলে তিনি বিপদগ্রস্ত হতে পারেন–এই ছিল আশঙ্কা। দণ্ডকারণ্যে মৃত্যুর ফাঁদে নিজেদের সঁপে না-দিয়ে, চিত্রকুটেই আত্মগোপন করে নিরাপদে থাকতে চেয়েছিলেন। বনবাসকালীন রাম সারাক্ষণই আতঙ্কে ছিলেন। এই বুঝি ভরত অরণ্যে ঢুকে পড়ে এবং তাঁকে হত্যা করে। এই আশঙ্কার কথা নিজ বন্ধু নিষাদরাজ গুহককে জানিয়ে রাখতে ভোলেননি। গুহকও রামকে রক্ষা করতে তাঁর সৈন্যদের পরোক্ষভাবে প্রস্তুত থাকতেও বলেছিলেন।
চিত্রকুট পর্বতশৃঙ্গে অবস্থানও রাম যখন দগ্ধ মৃগমাংস সহযোগে সীতার মনোরঞ্জন করছিলেন, তখন দিগন্তব্যাপী ধুলো উড়িয়ে তুমূল কোলাহল কানে এলো। লক্ষ্মণ ক্ষিপ্রতার সঙ্গে একটা দীর্ঘ শালগাছে উঠে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে রামকে বললেন–“আর্য, এক্ষণে অগ্নি নির্বাণ করিয়া ফেলুন, জানকী গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হউন, আর আপনি বর্ম ধারণ কামুকে জ্যা আরোপণ ও শর গ্রহণ করিয়া প্রস্তুত হইয়া থাকুন।… আর্য, কৈকেয়ীর পুত্র ভরত অভিষিক্ত হইয়া রাজ্য নিষ্কণ্টক করিবার বাসনায় আমাদের নিধন কামনায় উপস্থিত হইয়াছে।.. যাহার নিমিত্ত আপনি রাজ্যচ্যুত হইলেন, এক্ষণে সেই শত্ৰু উপস্থিত হইয়াছে। সে আমাদের বধ্য, তাহাকে বধ করিতে আমি কিছুমাত্র দোষ দেখি না।… এক্ষণে আপনি ঐ দুষ্টকে বধ করিয়া সমগ্র পৃথিবী শাসন করুন।” চতুরঙ্গ সৈন্যবাহিনী নিয়ে রামকে ফিরিয়ে আনতে (লোক-দেখানো) অযোধ্যার রাজা ভরত চিত্রকুটে পৌঁছেলে এবং পিতার মৃত্যুসংবাদ দিয়ে রামকে অযোধ্যায় ফিরে যেতে অনুরোধ করলে, রাম স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে–বনবাসের কাল অতিক্রান্ত হলেও দশরথবিহীন অযোধ্যায় আর ফিরবেন না। কোনোভাবেই তিনি ভরতের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চান না। এরপর সুদীর্ঘ চোদ্দো বছরে একবারের জন্যেও ভরতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার প্রয়োজন বোধ করেননি রাম।
ভরত চিত্রকুট থেকে বিদায় নিলে ভরতের চোখে ধুলো দিতে রাম অকুস্থল ত্যাগ করে অবশেষে দণ্ডকারণ্যের পথেই পাড়ি দিলেন। এর ফলে পিতৃসত্যও রক্ষা হল, ভরতের চোখের আড়াল করা গেল নিজেদেরকে। বাল্মীকি বলেছেন–“অনন্তর নানা কারণে রামের তথায় বাস করিতে আর প্রবৃত্তি রহিল না৷” অবশ্য ভরতও রামকে মনে করিয়ে দিতে ভোলেননি যে, চিত্রকুট পর্বতের মতো মনোরম স্থানে বসবাসের জন্য বনবাস নয়, নির্বাসন দণ্ডাদেশ হয়েছিল রাক্ষস অধ্যুষিত দণ্ডকারণ্যে। কাজেই সেই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হওয়া প্রয়োজন। অতএব অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাম প্রায় বাধ্য হয়েই দণ্ডকারণ্যের গভীর অরণ্যে প্রবেশ করলেন এবং নানা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে থাকলেন–যা অনভিপ্রেত। গভীর অরণ্যে ভিনদেশি মানুষকে অরণ্যবাসীরা খুব স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিতে পারেনি। তার উপর তাঁরা আবার সশস্ত্র! ফলে প্রতিমুহূর্তে রাম-লক্ষ্মণদের সংঘর্ষের মুখোমুখি হতে হয়েছে। দণ্ডকারণ্যে প্রবেশ থেকে শুরু করে সীতার খোঁজে পম্পা নদীর তীরে সুগ্রীবের কাছে পৌঁছোতে পৌঁছোতে টিকে থাকার তাগিদে প্রায় ১০,০০০ রাক্ষস-খোক্ষস-নিশাচরদের নির্বিচারে হত্যা করতে হয়েছিল আত্মরক্ষার তাগিদে।
ইতিমধ্যে এক স্বর্ণময় হরিণীকে কেন্দ্র করে ঘটে যায় অঘটন। সেই স্বর্ণময় হরিণ দেখতে পেয়ে সীতা প্রলুব্ধ হয়ে পড়লেন। রামকে অনুরোধ করলেন তিনি যেন জীবিত অবস্থায় হরিণটিকে ধরে এনে দেন, তিনি পুষবেন। স্ত্রীর মনোরঞ্জনের খাতিরে, আগুপিছু কিছু না-ভেবে রামও ছুটলেন হরিণ ধরতে। হরিণের ছদ্মবেশে মারীচ পরিকল্পনামাফিক রামের কণ্ঠ নকল করে সীতা’ ‘লক্ষ্মণ’ বলে আর্ত চীৎকার করতে শুরু করে দিল। রামের কণ্ঠে আর্ত চীৎকার শুনে সীতা বিচলিত হয়ে পড়ে। লক্ষ্মণকে প্ররোচনা দিয়ে স্বামীর কাছে পাঠিয়ে দেন। লক্ষ্মণও বাধ্য হয়ে সীতাকে অরক্ষিত (কৃত্তিবাস লক্ষ্মণকে দিয়ে লক্ষ্মণরেখা’ও টানিয়েছিলেন।) রেখে দাদার খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন। ইত্যবসরে রাবণ ব্রাহ্মণের বেশ ধরে অকুস্থলে এসে সীতাকে অপহরণ করে স্বদেশে পালিয়ে যান। যাত্রাপথে সীতা রাবণ কর্তৃক নিদারুণভাবে লাঞ্ছিত হলেন। এ ঘটনাটি ঘটল এমনি এমনি নয়, এ ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল শূর্পণখাকে কেন্দ্র করে। গোদাবরী নদীর কাছে এক রমণীয় সরোবর তীরে অবস্থিত পঞ্চবটিতে সুরম্য পর্ণকুঠীর তৈরি করে বেশ দিব্যি কাটছিল রামচন্দ্রদের। শূর্পণখা এই অরণ্যেই বিচরণ করতেন। সৌম্যদর্শন দুই সুঠাম সুপুরুষকে দেখে শূর্পণখা আর ঠিক থাকতে পারেননি। কামজ্বরে জর্জরিত হয়ে প্রথমে রামকে বিয়ের প্রস্তাব দেন শূর্পণখা। তিনি বিবাহিত জানিয়ে রাম তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং লক্ষ্মণ অবিবাহিত এই সংবাদ দিয়ে লক্ষ্মণকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার পরামর্শ দিলেন। শূর্পণখা অতি উৎসাহিত হয়ে লক্ষ্মণের কাছে যান এবং তাঁকে বিবাহের জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। লক্ষ্মণও প্রত্যাখ্যান করলে শূর্পণখা ক্ষিপ্ত হয়ে সীতা উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এমতাবস্থায় লক্ষ্মণ নিজেকে সামলাতে পারলেন না। অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে খড়গ দিয়ে শূর্পণখার নাক ও কান উভয়ই ছিন্ন করে দিলেন। রক্তাক্ত অবস্থায় শূর্পণখা কোনোরকমে প্রাণ বাঁচিয়ে সেই স্থান ত্যাগ করলেন। ক্রোধের থেকে বড়ো এ পৃথিবীতে আর কিছু নেই।
লক্ষ্মণের এই ক্রোধ ভয়ংকর এক পরিণতিকে আমন্ত্রণ করে ফেললেন। শূর্পণখা তো এলিতেলি কেউ নন, তিনি স্বয়ং লঙ্কেশ্বর কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ, রাবণের আদরের ভগিনী। অপমানিত শূর্পণখা লঙ্কায় ফিরে গিয়ে দাদা রাবণকে সব ঘটনা বিস্তারিত জানালেন, সঙ্গে এও জানালেন যে জঙ্গলে রামের সঙ্গে আছেন তাঁর বউ। সে অতীব পরমা সুন্দরী। যেমন তাঁর রূপ, তেমন তাঁর দেহবল্লরী। ভগিনীর অপমানের প্রতিশোধ নিতে, রামকে উচিত শিক্ষা দিতে এবং সীতাকে ভোগ করার বাসনায় রাবণ বিন্দুমাত্র কালবিলম্ব না-করে দণ্ডকারণ্যে পৌঁছে। গেলেন। কোনো দোর্দণ্ড পুরুষকে উচিত শিক্ষা দিতে তাঁর বউ কিংবা বোন কিংবা মাকে বন্দি করে ফেলা বহু প্রাচীন কৌশল। এখনও সিনেমাগুলিতে দেখবেন হিরোকে কবজা করতে মা, বোন অথবা স্ত্রী বা প্রেমিকাকে নিজের ডেরায় এনে ফেলেন ভিলেন। রাবণও অনুরূপ করলেন। রাবণ জানতেন সীতাকে লঙ্কায় এনে ফেলতে পারলে রাম-লক্ষ্মণও সুড়সুড় করে ধরা দেবেন। তবে গল্প কতটা বাস্তব সেটা ভেবে দেখা দরকার। এক কোপে নাক-কান একসঙ্গে কেটে ফেলা সম্ভব? যদি সম্ভব হয়, তবে তো মাথার অর্ধেকটাই কাটা পড়ে যাবে। যদি অর্ধেক মাথা কাটা পড়ে যায়, তবে সেই অবস্থায় রক্তাক্ত শূর্পণখা কীভাবে পঞ্চবটি থেকে লঙ্কার সুদীর্ঘ পথ প্রাণ নিয়ে পৌঁছোলেন কীভাবে? আসলে পঞ্চবটিতে কী হয়েছিল? কী হয়েছিল তা শূর্পণখা অধ্যায়ে আলোচনা করেছি।
এদিকে তো রাম তো বউয়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন। এক্ষেত্রে বলতেই হয়–রাম পুত্র হিসাবে যত মহান, ভাই হিসাবে যত মহান, বন্ধু হিসাবে যত মহান–স্বামী হিসাবে তিনি গোল্লা পেয়েছেন। তিনি স্ত্রীকে কখনোই গুরুত্ব দেননি, তাই স্ত্রীকে কোনোদিনই রক্ষা করতে পারেননি। অরণ্যে প্রবেশের মুখেই বিরাধ রাক্ষসের খপ্পরে চলে যায় যায় সীতা। সে যাত্রা কোনোক্রমে রক্ষা পেয়ে গেলেও এবার সত্যিই রাখালপালে বাঘ পড়েছে। শূর্পনখাও তো সীতার উপর হামলে পড়েছিল। রাম তো বটেই, লক্ষ্মণ দাদা রামকে সবসময় রক্ষা করতে সমর্থ হলেও বউদি সীতাকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
তো সীতার খোঁজে পথে দেখা হয়ে যায় জঘন্যভাবে আহত জটায়ুর সঙ্গে। সীতা অপহরণকালে রাবণকে বাধা দিতে গিয়ে জটায়ুর এই করুণ পরিণতি। জটায়ু রাবণের বন্ধু, পরিচিত। রামের সঙ্গে দেখা হলে জানিয়ে দেন রাবণ সীতাকে অপহরণ করে এই পথ দিয়ে দক্ষিণ দিকে চলে গেছেন। রাম রাবণকে চেনেন না, কোনোদিন নামও শোনেননি। জটায়ুর বয়ান অনুযায়ী রাম-লক্ষ্মণ ভারতের দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হলেন। অগ্রসর তো হলেন, কিন্তু যাবেন কোথায়? কিছুই তো চেনেন না! রাবণের নামটা শুনলেন বটে, কিন্তু রাম পূর্বে রাবণকে চিনতেন না–কী তাঁর রূপ, কত তাঁর বয়স, কোথায় তাঁর দেশ, কেমন তাঁর শক্তি–কিছুই তিনি জানেন না। এক আঁধার যেন! এক নিরুদ্দিষ্ট দিগশূন্য পথচলা। কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বিমর্ষ পথ চলতে চলতে সৌভাগ্যবশত দেখা হয়ে গেল কবন্ধের সঙ্গে। কবন্ধ রাম-লক্ষ্মণের উপর হামলা করলে রাম-লক্ষ্মণ তাঁকে বধ করেন। মৃত্যুপথযাত্রী কবন্ধ রাম-লক্ষ্মণকে দিশা দিয়ে বলেন–“এই সময় কোনো বিপন্ন মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করো। এছাড়া আমি ভেবেও তোমার কার্যসিদ্ধির উপায় খুঁজে দেখছি না।”
রামও বুঝলেন এত ক্ষুদ্র ক্ষমতা নিয়ে ভার্যা-উদ্ধার কোনোমতেই সম্ভব নয়। প্রয়োজন রাজার বিরুদ্ধে রাজশক্তি। প্রয়োজন প্রচুর লোকবল, প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র। লঙ্কার খুব কাছেই পম্পা নদীর তীরে তাঁরা পৌঁছোলেন। সেইসময় ঋষ্যমূক পর্বতে বিষণ্ণ হৃদয়ে স্বরাজ্য থেকে বিতারিত পত্নীহারা সুগ্রীব অবস্থান করছিলেন। সুগ্রীব কিন্তু সেনাবাহিনীসহ সশস্ত্র রাম-লক্ষ্মণকে দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। ভেবেছিলেন বালীর চর। বালী সুগ্রীবের আপন ভাই। অবশেষে হনুমানের মধ্যস্থতায় সুগ্রীব সংশয়মুক্ত হলেন। সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত হনুমান ছিলেন সুগ্রীবের মহামন্ত্রী। কী হয়েছিল সুগ্রীবের সঙ্গে সে কাহিনি রাম-লক্ষ্মণকে জানানো হল–পিতার মৃত্যুর পর বড়োভাই বালী স্বাভাবিক নিয়মে কিষ্কিন্ধ্যার (বর্তমানের মহিশূরের উত্তরে পম্পা নদর কাছেই বালীর সমৃদ্ধিশালী রাজ্য কিষ্কিন্ধ্যা। স্বর্ণখচিত, যন্ত্রপূর্ণ বানরসংকুল ও ধ্বজশোভিত।) রাজা হলেন আর সুগ্রীব হলেন বালীর পদানত দাস। একসময় নারীঘটিত এক কেলেংকারীতে জড়িয়ে পড়েন বালী। এ নিয়ে মায়াবী নামে এক বিক্রমশালী অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয় এবং বালী পরাজিত হন। সে যুগে যুদ্ধে পরাজিত হলে হয় মৃত্যু নয় বন্দি হতে হত। বিপদ বুঝে এক বিস্তীর্ণ জঙ্গলে দুর্গম গর্তে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়েন বালী। মায়াবীও বালীর পিছু নিয়েছিলেন। সে সময় উপায়ান্তর না-দেখে গুহার মুখে সুগ্রীবকে প্রহরায় রেখে বালী গুহার ভিতর গা-ঢাকা দিয়ে বাঁচে। গুহার ভিতর ঢোকার আগে সুগ্রীবকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নেয়–তিনি না-ফেরা পর্যন্ত সুগ্রীব যেন দ্বাররক্ষা করেন। দিন যায় মাস যায় বালী আর ফেরে না। এমতাবস্থায় সুগ্রীব গুহামুখে এক বিশাল পাথর চাপা দিয়ে কিষ্কিন্ধ্যায় ফিরে আসেন। কিষ্কিন্ধ্যায় ফিরে এসে সুগ্রীব সারাদেশ রটিয়ে দিলেন যুদ্ধে বালীর মৃত্যু হয়েছে। অবশেষে সুগ্রীবকেই কিষ্কিন্ধ্যার রাজা করলেন মন্ত্রী-অমাত্যরা। চালাকির দ্বারা মহৎ কাজ হয় না। সুগ্রীবেরও সুখের দিন ফুরোলো। বালী দ্বারমুক্ত করে কিষ্কিন্ধ্যায় ফিরে এসে দেখেন সুগ্রীব কিষ্কিন্ধ্যার রাজা হয়ে বসে আছেন। খুব ক্ষেপে গেলেন বালী। সুগ্রীবকে একবস্ত্রে দেশ থেকে বহিষ্কার করলেন। সুগ্রীব তাঁর বিশ্বস্ত বান্ধবদের ঋষ্যমুক পর্বতে ঠাঁই নিলেন। এই বিশ্বস্ত বান্ধবেরা হলেন–হনুমান, নল, নীল প্রমুখ ব্যক্তি। শুধু বহিষ্কারই করলেন না, সেইসঙ্গে সুগ্রীবের স্ত্রী রুমাকে অপহরণ করে ভোগ করতে থাকলেন বালী।
তো এই হল সুগ্রীবের রাজ্য ও স্ত্রী হারানোর গল্প। রামও শুনিয়ে দিলেন তাঁর রাজ্য ও স্ত্রী হারানোর গল্প। দুই সমব্যথী বন্ধুত্ব স্থাপন করলেন এবং চুক্তিবদ্ধ হলেন। চুক্তি হল রাম সুগ্রীবের রাজ্য ও স্ত্রীকে ফিরিয়ে দেবেন, বিনিময়ে সুগ্রীব রামের স্ত্রীকে ফিরিয়ে বন্দোবস্ত করবেন। তবে তাঁর আগে যাচাই করে নেওয়া দরকার, রাম কি সত্যিই পারবে তাঁর রাজ্য ও স্ত্রীকে ফিরিয়ে দিতে–বিচক্ষণ সুগ্রীব এমনই ভাবলেন। যেই ভাবা সেই কাজ। রামচন্দ্রকে শক্তিপরীক্ষা দিতে বললে রাম একটিমাত্র তীক্ষ্ণ শরে সাত-সাতটি তালগাছ ছেদ করে শক্তিপরীক্ষায় সফল হলেন। সুগ্রীব অঙ্গীকারবদ্ধ হলেন। কিন্তু রামের এই অধীত শক্তি খুব খারাপভাবে প্রয়োগ হল। যে ঘটনা রামকে কলঙ্কময় কলুষিত করে দিল। গিভ অ্যান্ড টেক’ পলিসিতে রামকে দিয়ে আগেই অঙ্গীকার অনুযায়ী কাজ করতে অগ্রসর হতে হল। কীভাবে? রামের পরামর্শে সুগ্রীব কিষ্কিন্ধ্যায় ফিরে গিয়ে বালীকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করলেন। বালী নিশ্চয়ই এ আহ্বান শুনে উপলব্ধি করলেন–শত্রুর শেষ রাখতে নেই! শত্রুর শেষ রাখতে গিয়ে কত রাজা যে নিজের মৃত্যু ডেকে এনেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। ইতিহাস সাক্ষী। প্রসঙ্গত পৃথ্বীরাজ চৌহানের কাহিনিটা স্মরণ করতে পারেন। পৃথ্বীরাজ চৌহান পরাজিত মোহম্মদ ঘুরিকে মুক্তি না-দিলে শক্তিসঞ্চয় করে মোহম্মদ ঘুরি ফিরে এসে পৃথ্বীরাজকে হত্যা করতে পারতেন না। পৃথ্বীরাজ এমন ভুল না-করলে ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হত। সেই একই ভুল বালীও করেছিল এবং মাসুল গুণতে হল।
কিন্তু রাম কীভাবে সুগ্রীবকে তাঁর রাজ্য ও স্ত্রী ফিরিয়ে দেবেন–তাঁর না-আছে লোকবল, না-আছে অস্ত্রবল! অতএব “বুদ্ধিস্য বলংতস্য নৈবতুল্যং কদাচন। এক্ষেত্রে অবশ্য কুবুদ্ধি। কথা হল বালী যখন সুগ্রীবের সঙ্গে দ্বন্দ্ব করবেন তখন রাম গাছের আড়ালে লুকিয়ে এবং সেখান থেকে গোপনে বালীকে লক্ষ করে প্রাণান্তকর তীর ছুঁড়ে বালীকে হত্যা করবেন। নাঃ, সব প্ল্যান ভেস্তে গেল। বালীকে রাম হত্যা করতে পারলেন না। উল্টে সুগ্রীবকে মেরে পিঠ ফাটিয়ে দিল বালী। প্রাণেই মেরে ফেলত, যদি-না সেখান থেকে পালিয়ে পুনরায় ঋষ্যমূক পর্বতে ঠাঁই মিলত। কিংকর্তব্যবিমূঢ় রাম সুগ্রীবের কাছে গিয়ে তাঁর অপারগতার কারণ বললেন এবং বালীর কাছে গিয়ে পুনরায় দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করতে বললেন সুগ্রীবকে। সেইসঙ্গে বলে দিলেন সুগ্রীব যেন নাগপুষ্পী লতার মালা পরে নেন। তাহলে চিনে নিতে সুবিধা হবে। কারণ দুজনেই একইরকম দেখতে৷ পৃথক দেখাতেই এই মালা। ঘোর দ্বন্দ্বযুদ্ধ শুরু হল। এবার আর ভুল করলেন না রাম। দ্বন্দ্বযুদ্ধে সুগ্রীবের পরাজয় আসন্ন হলে রামচন্দ্র আড়াল থেকে তীর ছুঁড়ে বালীকে হত্যা করলেন। জীবনের সবচেয়ে জঘন্যতম কাজটি করে ফেললেন স্বয়ং রাম। বালী রামের শত্রু ছিলেন না। রামের কোনো অনিষ্ট তিনি করেননি। একটা হীন চরিত্রের লোকের হয়ে কিষ্কিধ্যার রাজাকে হত্যা করে ফেললেন রাম। গুপ্তঘাতকের মতো বিনা অপরাধে বালীকে হত্যা করে রাম নিজের চরিত্রকেই কলঙ্কিত করলেন। মুমূর্ষ মৃতপ্রায় বালী ভগবান রামের উদ্দেশে কী বললেন, পড়ুন–“রাম!.. তুমি অতি দুরাত্মা, ধর্মধ্বজী ও অধার্মিক। তুমি ধর্মের আবরণ ধারণপূর্বক তৃণাচ্ছন্ন কূপ ও ভস্মাবৃত অগ্নির ন্যায় রহিয়াছ। তুমি দুরাচার ও পাপিষ্ঠ, কিন্তু সাধুর আকার পরিগ্রহ করিতেছ।” বালীর এহেন তিরস্কারে রাম বিন্দুমাত্র অনুতপ্তে দগ্ধ হয়ে যাননি, লজ্জায় নতমস্তক হয়ে যাননি। বরং ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে মিথ্যাচার করলেন–“এই শৈলকাননপূর্ণ ভুভাগ ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজগণের অধিকৃত, এই স্থানের মৃগপক্ষী ও মনুষ্যগণের দণ্ডপুরস্কার তাঁহারাই করিয়া থাকেন। … রাজা ভরত এই ভূমির রক্ষার স্বয়ং গ্রহণ করিয়াছেন।… সেই মহাবীরই পৃথিবীর রাজা।”
কোথায় ভরতের অযোধ্যা, আর কোথায় বালীর কিষ্কিন্ধ্যা! কিষ্কিন্ধ্যা কবে ইক্ষ্বাকুবংশীয়দের অধিকৃত রাজ্য হয়ে গেল? অন্যায়ভাবে বালীকে হত্যার অপরাধ ঢাকতে মিথ্যাচারের অপরাধ! ভরত পৃথিবীর অধীশ্বর? ভরতের পৃথিবীর আয়তন কতটুকু? ইক্ষ্বাকুবংশীয়রা তো কোশলরাজ বলেই জানা যায়! কোশল কোথায়? রামায়ণ উল্লিখিত কোশল বর্তমানে উত্তরপ্রদেশের কাশীর উত্তরে সরযূ নদী সন্নিহিত সমগ্ৰ অঞ্চল। সমগ্র অঞ্চল বলতে–এই কোশল রাজ্যটি দুইভাগে বিভক্ত–উত্তর কোশল ও দক্ষিণ কোশল। উত্তর কোশল কৌশল্যার পিত্রালয় এবং দক্ষিণ কোশল দশরথের। দুই কোশলের মাঝে সরযূ নদী। দক্ষিণ কোশলের রাজধানী অযোধ্যা। আয়তন দৈর্ঘ্যে ৪৮ ক্রোশ, প্রস্থে ৮ ক্রোশ। পাপ ঢাকতে মিথ্যা আধিপত্য!
দ্রোণাচার্য বধে যেমন সারা পৃথিবী যেমন চিরকাল যুধিষ্ঠিরের অপশের কীর্তন করে, তেমনই বালী বধে রামেরও অপযশ হয়েছে। রাম অধার্মিক উপারে কাপুরুষের মতো বালীকে হত্যা করেছিলেন। বালী এত বড়ো বীর ছিলেন যে, সম্মুখ সমরে তিনি পরাজিত হতে পারেন এমন আশঙ্কা রামের ছিলই। তাই ক্ষাত্রধর্ম, বীরধর্ম জলাঞ্জলি দিয়ে যেনতেনপ্রকারেণ স্বার্থসিদ্ধি করেছেন। অতঃপর ড্যামেজ কন্ট্রোলের তাগিদে রামচন্দ্র বালীকে নিজের প্রজা বলে শাসন করেছেন বলেছেন, যা নিতান্তই অযৌক্তিক। তখনও পর্যন্ত রাম রাজা ছিলেন না, তিনি বনবাসী। কিষ্কিন্ধ্যার রাজাও তিনি নন, এমনকি কিষ্কিন্ধ্যা অযোধ্যার অন্তর্ভুক্তও নয়। কিষ্কিন্ধ্যা দাক্ষিণাত্যের দেশ, অযোধ্যা আর্যাবর্তের দেশ। তার উপর বালী হত্যাকে ‘মৃগয়া’ বলা হয়েছে, বানর মাংস অভক্ষ্য তবুও বালী হত্যাকে ‘মৃগয়া’ বলার মতো প্রভূত কুযুক্তির অবতারণা করেছেন। রামায়ণের বালীই মহাভারতের জরা নামক ব্যাধই নাকি দ্বাপর যুগে কৃষ্ণের হত্যার কারণ হয়েছিলেন–এমন গল্পও বলা হয়েছে। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা রামকে বিষ্ণুর অবতার বলেছেন, কৃষ্ণকেও বিষ্ণুর অবতার বলেছেন–তাই বুঝি রাম আড়াল থেকে বালীকে হত্যা করলেও বালী জরারূপে কৃষ্ণকেও আড়াল থেকে হত্যা করে গায়ের ঝাল মিটিয়ে নিলেন? তবে ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে রামায়ণের উত্তরকাণ্ডের কবি জুড়ে দিয়েছেন–সীতাহরণের সংবাদ পাইবার পর ভরত অযোধ্যা এবং আর্যাবর্তের সমস্ত সৈন্য একত্র করিয়া লঙ্কা অভিযানে প্রেরণ করেন–“অক্ষৌহিণণ্যাহি তত্রাস রাঘবার্থে সমুদ্যতাঃ”। বোঝাই যাচ্ছে রাম কর্তৃক বালীবধকে বৈধতা দেওয়ার জন্যেই এই সংযোজন হয়েছে। অর্থাৎ রামচন্দ্র সুগ্রীবের সৈন্য-সাহায্য ছাড়াই রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হতেন। তাহলে রামও কলুষ থেকে মুক্ত হয়। স্বার্থসিদ্ধির পর অকৃতজ্ঞতার শেষ নেই যেন!
অবশ্য এছাড়া রাম আর কিই-বা করতে পারতেন! রাজশক্তি যে তাঁর বড়াই প্রয়োজন, নাহলে আর্য-উপনিবেশ কীভাবে সম্ভব! কিষ্কিন্ধ্যাকে এড়িয়ে লঙ্কায় পৌঁছোনো একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু সেখানেও কাঁটা। মৃত্যুপথযাত্রী বালী রামকে বলেছিলেন, অন্যায়ের পথে কেন, “যদি পূর্বে জানকীর আনয়নার্থ আমার কহিতে, তবে আমি এক দিবসেই তাহাকে (রাবণকে) আনিয়া দিতে পারিতাম।” হয়তো পারত কিংবা নয়। বালী এখন মৃত, একথার আর কোনো দাম নেই। তা ছাড়া স্বার্থ ছাড়া কেউ কোনো কাজ করেন না, বালীও করতেন না। নাহলে এক অপরিচিত ব্যক্তির জন্য বালী কেন সৈন্যক্ষয়, অর্থক্ষয় করতে যাবেন?
বালীর মৃত্যুতে সুগ্রীব এবার সত্যি সত্যিই কিষ্কিন্ধ্যার নিরঙ্কুশ রাজা হলেন। নিজের স্ত্রী রুমাকে তো ফিরে পেলেনই, উপরি হিসাবে পেলেন বালীর স্ত্রী তারাকেও।
দিন যায় মাস যায়, সুগ্রীবের কোনো খবর নেই। বিলাসব্যসনে মত্ত সুগ্রীব সীতা উদ্ধারের অঙ্গীকারের কথা বেমালুম ভুলে গেলেন। মহামন্ত্রী হনুমান সুগ্রীবকে মনে করিয়ে দিলেন অঙ্গীকারের কথা। চার মাস অতিক্রান্ত। রাম হতাশ, লক্ষ্মণ ক্রুব্ধ। ক্রুব্ধ লক্ষ্মণ রামকে জানালেন, প্রয়োজনে সুগ্রীবকে হত্যা করে তাঁর পুত্র অঙ্গদের সাহায্যে জানকীর সন্ধান করা হোক। বাঁধনহারা লক্ষ্মণ সুগ্রীবের অন্তঃপুরে ঢুকে ধনুকে টঙ্কার দিলেন। সুগ্রীব বেজায় ভয়ে ভীত হয়ে পড়লেন। পরিস্থিতি সামলাতে সুগ্রীব তারা সহ সুন্দরী মেয়েদের লেলিয়ে দিলেন। লক্ষ্মণকে কামার্ত করতে। কিন্তু লক্ষ্মণের রক্তচক্ষুর সামনে কোনো সুন্দরী নারীই ঘেঁষতে পারলেন না। অবশেষে সুগ্রীব লক্ষ্মণকে জানিয়ে দিলেন, তিনি সৈন্য সংগ্রহে মনোনিবেশ করেছেন। মাত্র দশদিনের মধ্যেই সেই কাজ শেষ হয়ে যাবে। রামও খুশি। (বালী আর সুগ্রীবের পরিচয় একটু নেওয়া যেতে পারে–বর্ণিত আছে যে, বালী ছিলেন ইন্দ্রের পুত্র, আর সুগ্রীব ছিলেন সূর্যের পুত্র। ঋক্ষরজার চুলে ইন্দ্রের বীর্যপাতে এঁর জন্ম হয়েছিল। ঋক্ষরজার মৃত্যুর পর বালী রাজা হন। ইনি অত্যন্ত শক্তিশালী ছিলেন। এঁর স্ত্রীর নাম তারা এবং পুত্র অঙ্গদ। একবার রাবণ দিগ্বিজয়ে বের হয়ে বালীর সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য কিষ্কিন্ধ্যায় উপস্থিত হন। সেখানে পৌঁছে ইনি জানতে পারলেন যে বালী চার সমুদ্রে সন্ধ্যাবন্দনা করতে গিয়েছেন। রাবণ বালীর সন্ধানে দক্ষিণ সমুদ্রে উপস্থিত হলে বালী অতর্কিতে তাঁকে মুঠোয় পুরে আকাশে উঠে গেলেন। এরপর পরপর চার সমুদ্রে সন্ধ্যাবন্দনা শেষ করলেন। রাবণ বালীর এরূপ শক্তি দেখে তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন এবং ফিরে আসেন। দুন্ধুভি নামক এক মহিষরূপী অসুর তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করতে এলে ইনি উক্ত অসুরের শিং ধরে ভূমিতে আছড়ে খুন করেন। পরে এই অসুরের শরীর দূরে আছাড় দিলে অসুরের মুখ থেকে রক্ত বেরিয়ে মাতঙ্গ মুনির আশ্রমকে সিক্ত করে দেয়। ফলে মাতঙ্গ মুনি অভিশাপ দেন–আশ্রমদুষিতকারী তাঁর আশ্রমের এক যোজনের মধ্যে উপস্থিত হলে তাঁর মৃত্যু হবে।)
তার পরের ঘটনা তো ইতিহাস। একটু বলে নিই–আগেই বলেছি রামায়ণ যদি হয় বশিষ্ঠ আর বিশ্বামিত্রের বিরোধ, তবে মহাভারতও ব্রাহ্মণ দ্রোণাচার্যের সঙ্গে ক্ষত্রিয় দ্রুপদরাজের বিরোধ। সেই বিরোধ থেকেই সংঘর্ষ, মহাভারতের কুরু-পাণ্ডব বংশের পরিণতি। এখানেও লড়াইটা ক্ষত্রিয়-ব্রাহ্মণের, কৌরব-পাণ্ডবরা এ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। এই দ্বন্দ্বকে তরান্বিত করতে সাহায্য করেছিলেন তাঁদের কুচক্রী মামা শকুনি। তবে রামায়ণের এই আপাতনিরীহ সংঘর্ষে কেবল বিশ্বামিত্র-বশিষ্ঠকে দায়ী করা যায় না। ফাঁক ছিল রাজপরিবারেই। দুই ঋষি কেবল এই ফাঁকটাকেই কাজে লাগাতে সমর্থ হয়েছিলেন। বশিষ্ঠ ছিলেন কুলগুরু। বশিষ্ঠ জানতেন রাজসভায় শ্রীরামচন্দ্রের আধিপত্য থাকলেও, রাজঅন্তঃপুরে ভরত তথা কেকয়বংশীয়দের আধিপত্য ছিল অপ্রতিরোধ্য। রামের পক্ষে যেমন লক্ষ্মণ ছিলেন, তেমনই ভরতের পক্ষে শত্রুঘ্ন ছিলেন। বস্তুত লক্ষ্মণ ছিলেন শ্রীরামের অঙ্গরক্ষক, যে কর্তব্য থেকে তিনি একবার জন্যেও বিচ্যুত হননি৷ অরণ্যে যত নারীহত্যা সব লক্ষ্মণই সম্পন্ন করেছেন। অপরদিকে শত্রুঘ্ন ছিলেন ভরতের অঙ্গরক্ষক, সেই কারণে লক্ষ্মণ শ্রীরামের সঙ্গে বনবাসে গেলেও, শত্রুঘ্ন কিন্তু কর্তব্যের খাতিরে ভরতের সঙ্গেই থেকে গেলেন। লক্ষ্মণ যতটা-না শ্রীরামচন্দ্রের ভাই ছিলেন তার চেয়ে বেশি ছিলেন দাদার দেহরক্ষী। বাল্মীকির গোটা রামায়ণে লক্ষ্মণকে দেহরক্ষী রূপকেই পাওয়া গেছে। এটা বুঝতে পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। শুধু বনবাসেই নয়, লক্ষ্মণ শ্রীরামের বিপদসঙ্কুল পথের ছায়াসঙ্গী হয়েছিলেন আরও আগে। রামচন্দ্র মাত্র ষোলো বছর বয়সে যখন যজ্ঞবিনাশকারী নিশাচরদের বিনাশ করতে গিয়েছিলেন, তখনও লক্ষ্মণ দেহরক্ষীর কর্তব্য পালন করেছিলেন। অরণ্যে যত হত্যাকাণ্ড সব লক্ষ্মণের দ্বারাই সাধন হয়েছিল, যা একজন দেহরক্ষীরা কাজ। রামের সামনে দাঁড়িয়ে লক্ষ্মণই বুক চিতিয়ে যুদ্ধ করেছেন, এভাবে রামকেও সুরক্ষা দিয়েছেন যতদিন পেয়েছেন।
পিতৃসত্য পালনের দৃষ্টান্ত স্থাপন কেবল রামায়ণের শ্রীরামচন্দ্রই নয়, মহাভারতের ভীষ্মও (দেবব্রত) পিতৃসত্য পালন করার চরম দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন। ভীষ্মের পিতৃসত্য পালন শ্রীরামচন্দ্রের পিতৃসত্য পালন ছাপিয়ে যায়। নিম্নবর্গীয় ধীবরকন্যা সত্যবতাঁকে বিয়ে করার সময় শান্তনুকেও দশরথের মতো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হয়েছিল। প্রতিজ্ঞা ছিল সত্যবতীর সন্তানই হস্তিনাপুরের পরবর্তী রাজা হবেন। সত্যবতীর পিতা জানতেন শান্তনু পূর্বে বিবাহিত এবং তাঁর একটি পুত্রসন্তান আছে। বিচক্ষণ পিতা তাই শান্তনুকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন। এ কথা শুনে ভীষ্মও প্রতিজ্ঞা করলেন যে তিনি চিরকুমার থাকবেন। অতএব তিনি তো দূরের কথা, তাঁর উত্তরসুরীরাও হস্তিনাপুরের সিংহাসনের দাবি করবেন না। এই প্রতিজ্ঞার জন্য ভীষ্মকে চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। অম্বাকে প্রত্যাখ্যান করায় অপমানিত অম্বাই (শিখণ্ডী রূপে) তার মৃত্যুর কারণ হয়। সে তো না-হয় হল, কিন্তু সিংহাসনে বসবেন কে? সত্যবতী-শান্তনুর ঔরসজাত সন্তান চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য। বিচিত্রবীর্য ও চিত্রাঙ্গদ তো মারাই গিয়েছিলেন। তাহলে বংশরক্ষাই-বা হবে কীভাবে? পরবর্তীতে রাজাই-বা কে হবেন? সত্যবতীও তাঁর পুত্রবধূ অম্বিকা ও অম্বালিকাকে পর্যায়ক্রমে মিলিত হওয়ার অফারও দিয়েছিলেন ভীষ্মকে। এইভাবে অম্বিকা আর অম্বালিকা গর্ভবতী হয়ে পড়লে মহান কুরুবংশের ধারাও অক্ষুণ্ণ থাকবে। ভীষ্ম সেই অফার প্রত্যাখ্যান করেন, কারণ সত্যবতী-শান্তনুর বিবাহকালে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। তিনি তাঁর জীবৎকালে কোনো নারীসংসর্গ করবেন না। এক্ষেত্রে সত্যবতী বা সত্যবতীর পিতা ভীষ্মের রাজা হওয়ার অধিকার কেড়ে নিলেও বনবাস চাননি, তাই ভীষ্ম রাজধর্ম পালন করতে সক্ষম ছিলেন।
বীর হিসাবে রামের ক্ষমতা কতটা ছিল? : বিশ্বামিত্র রামের প্রতি তুষ্ট হয়ে যে অস্ত্রগুলি দিয়েছিলে তার। তালিকা অনেক লম্বা। অস্ত্রগুলি হল : বলা, অতিবলা, ধর্মচক্র, কালচক্র, বিষ্ণুচক্র, ইন্দ্রচক্র, ব্রহ্মশির, ঐষিক, ব্রহ্মাস্ত্র, ধর্মপাশ, কালপাশ, বরুণ পাশ, শুষ্ক অশনি, আর্দ্র অশনি, পৈনাক, নারায়ণ, শিখর, বায়ব্য হয়শির, ক্রৌঞ্জ, কঙ্কাল, মুষল, কপাল, শক্তি, খড়গ, গদা, শূল, বস্ত্র, কিঙ্কিণী, নন্দন, মোহন, প্রস্বাপন, প্রশমণ, বর্ষণ, শোষণ, সন্তাপন, বিলাপন, মাদন, মানব, তামস, সৌমন, সংবর্ত। আরও অনেক নাম-না-জানা অস্ত্র! তা এমন বিপুল অস্ত্র কারও কাছে থাকলে এ গ্রহে তাঁকে রুখবে এমন সাধ্যি কার! এমন অস্ত্রে সজ্জিত একজনকে ‘মহামানব’ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, সাধারণ হলেই চলে। কেবল এক ব্রহ্মাস্ত্রই নাকি যথেষ্ট। এটা একবার ছুঁড়লে ফিরিয়ে নেওয়া যায় না।)।
বস্তুত আমরা মানবজাতির বড়ো অংশই বিজয়ীর পক্ষেই থাকি, বিজেতার পক্ষে নয়। বিজয়ীর সব ন্যায়, বিজেতার সবই অন্যায় হিসাবেই দেখি। তাই বেশির ভাগ মানুষ রামের পক্ষে, রাবণের নয়। তাই অক্ষশক্তির বিজেতা হিটলার বিশ্বাস হয়, মিত্রশক্তি আমেরিকানরা নয়। হিরোসিকা নাগাসাকিতে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করলেও নয়। অনুরূপ বিজেতা সাদ্দাম হোসেনেরও বিপক্ষে থাকি, বিজয়ী আমেরিকার বিপক্ষে নয়। বিজয়ীর পক্ষে সবাই থাকেন না, কেউ কেউ বিজেতার পক্ষেও থাকেন তাঁদের বিচারে। তাই দক্ষিণ ভারতে অনেকেই বিজেতা রাবণকে বীর হিসাবে পুজো করেন। তাই অনেকেই মিত্রপক্ষ এবং আগ্রাসী আমেরিকার বিপক্ষেও ধিক্কার জানায়। মিথিলা থেকে বিয়ে করে অযোধ্যায় ফেরার পথে দেখা হয়ে যায় অন্য এক রামের সঙ্গে, যিনি ভৃগুনন্দন ‘পরশুরাম’ বলে পরিচিত। ‘পরশু’ কথার অর্থ কুঠার। ক্ষত্রিয় রাজা কার্তবীর্যাজুনের সঙ্গে তাঁর মা রেণুকা প্রেমাসক্ত হয়েছিলেন। সেই অপরাধে বাবার নির্দেশে কুঠার দিয়ে মায়ের মুণ্ডুচ্ছেদ করেছিলেন তিনি। তাঁর এই গুণকীর্তির জন্য হয়ে যান পরশুরাম। এই বিদ্রোহী ব্রাহ্মণ সন্তান পৃথিবীকে একুশবার নিঃক্ষত্রিয় করেছিলেন বলে কাহিনিতে জানা যায়। এখন দাশরথি রামকে হত্যা করে বাইশতম ক্ষত্রিয় হত্যা করার ইচ্ছা পোষণ করেন পরশুরাম। অতএব রামের পথ অবরোধ করেন এবং যুদ্ধের আহ্বান করেন। রামের উদ্দেশ্যে পরশুরাম বলেন–“তুমি আমার পূর্বপুরুষগণের শরাসনে শর যোজনায় যদি সক্ষম হও তবে আমি তোমার সঙ্গে প্রবল রূপে দ্বন্দ্ব যুদ্ধ করব। শর সংযোজন করো।” ‘নরচন্দ্রমা’ শ্রীরাম শর ও শরাসন গ্রহণ করে ধনুতে গুণ সংযোগ ও শর সংযোগ করে পরশুরামকে বলেন–“তুমি ব্রাহ্মণ, বিশেষত বিশ্বামিত্র আমার পূজনীয়। কেবল সেই কারণেই আমি এই প্রাণহরণকারী শর পরিত্যাগ করতে পারছি না। আমি এই শর কোথায় নিক্ষেপ করব?” শ্রীরাম প্রথম আলাপে পরশুরামকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করলেও কিছুক্ষণ পরেই অবজ্ঞাভরে ‘তুমি’ সম্বোধন করতে থাকলেন। যাই হোক শ্রীরামের পরাক্রম দর্শন করে পরশুরাম স্তম্ভিত এবং ভীত হয়ে পড়লেন। তিনি শ্রীরামের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইলেন। বললেন–“হে রাম, তুমি আমাকে পলায়ণ করতে দাও। এক্ষণে তুমি এই অসম শর শরাসন থেকে মোচন করো।” রাম পরশুরামকে পলায়ণের সুযোগ দিলেন। পরশুরামে দ্রুতবেগে স্থান ত্যাগ করলেন। যঃ পলায়তি সঃ জীবতি।
রামচন্দ্রের বীরত্বই শুরু হয়েছে দুর্বল নিশাচরদের বধের মধ্যে দিয়ে, যখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৬ বিশ্বামিত্রের মতো ব্যক্তির আদেশে বেশ কিছু নিশাচর হত্যা করেই শুরু হয়ে যায় রামচন্দ্রের বীরত্বপ্রকাশ। পরে অবশ্য দণ্ডকারণ্যে আসার পর রাম হাজার হাজার রাক্ষস জাতি হত্যা করেছেন বলে কাহিনি শোনা যায়, তা সবটা সত্য নয়। এই হত্যাকাণ্ডের বেশিরভাগ কৃতিত্ব আর্যদেবতাদের, যাঁরা রামকে শিখণ্ডী করে দাক্ষিণাত্যে আর্য-উপনিবেশ ঘটাতে চাইছিলেন। দণ্ডকারণ্যে খরদূষণের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় রাম-লক্ষ্মণ-সীতা সকলেই ভয়ে ভীত হয়ে গুহায় লুকিয়ে পড়েছিলেন। খরদূষণের আবির্ভাবে রাম নিজেই লক্ষ্মণকে বলেছিলেন জানকীকে নিয়ে গুহায় লুকিয়ে পড়তে। খরদূষণকে কে বা কারা পরাস্ত করেছিলেন, সে বিষয়ে বাল্মীকি স্পষ্ট করে উল্লেখ না করলেও, যেভাবে আর্যদেবতাদের সমারোহ ঘটিয়েছিলেন এবং তাঁদেরকে দিয়ে খরদূষণের বিরুদ্ধে অস্ত্রপ্রয়োগ করেছিলেন, এ থেকে বুঝে নেওয়া খুব কষ্ট নয় যে এ সংঘর্যে রামের কোনো প্রয়োজন পড়েনি। শূর্পণখাকেও কেউ আহত কিংবা হত্যা করেননি। করবেই-বা কেন? শূর্পণখা তাঁর স্বামীহত্যার বদলা নিতে দাদা রাবণের বিরুদ্ধে ফুঁসছেন। যে-কোনো উপারে দাদা রাবণের বিনাশ চান তিনি। আর সেই কারণেই শূর্পণখা আর্যদেবতাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন এবং রাবণকে প্ররোচনা দিয়ে সীতার অপহরণের জন্যে উজ্জীবিত করেছে। বাকিটা তো ইতিহাস।
রামের অস্ত্রে প্রথম খুন হওয়া রাক্ষস জাতি তাড়কা। লক্ষ্মণ অবশ্য তার আগে তাড়কার নাসিকা-কৰ্ণ ছেদন করে দিয়েছিলেন। তাড়কা নারী, তাই রাম কিঞ্চিত ইতস্তত করলেও বিশ্বামিত্র সেই মুহূর্তে বুঝিয়ে দিতে পেরেছেন–“এই নারী হত্যার কোনো অন্যায় হবে না। যুক্তি–বনে রাক্ষসরা যখন-তখন ব্রাহ্মণদের আক্রমণ করে, ব্রাহ্মণ তথা মুনি-ঋষিদের যজ্ঞ এবং তপস্যায় বিঘ্ন ঘটায়। এসব ঘটনা ব্রাহ্মণরাই মোকাবিলা করতে পারত, কিন্তু তা না-করে ক্ষত্রিয়দের এই অপকর্মে লেলিয়ে দিত। এর ফলে সাপ তো মরতই, লাঠিও ভাঙত না। খুনের সব দায় ক্ষত্রিয়দের ঘাড়ে, ব্রাহ্মণগণ নিষ্কলুষ। অবশ্য এতে ক্ষত্রিয়গণও গর্বিত বোধ করত। এতে শৌর্য-বীর্যও প্রকাশ পেত। ব্রাহ্মণদের সন্তান যেমন বয়সে ছোটো হলেও পূজ্য, তেমনই ক্ষত্রিয়ের সন্তান বয়সে ছোটো হলেও ক্ষত্রিয়-তেজ দেখাতে পারত। রামও তার ব্যতিক্রম নয়। মনে রাখতে হবে রাম যখন রাক্ষসদের হত্যা করা শুরু করেছে তখন কিন্তু রাম রাজা নন, রাজদণ্ডও তাঁর নেই–তাই কারোকে দণ্ড দেওয়ার অধিকারও তাঁর থাকার কথা নয়। রাম অবশ্যই রাজপুত্র। রাজা দশরথের জ্যেষ্ঠ পুত্র।
বীর তো সেই, যে বীরদের হত্যা করতে সক্ষম হয়। দু-চারটে ক্ষুদ্র রাক্ষসহত্যায় কি বীর বলা সমীচীন? লঙ্কাযুদ্ধে রাম কয়টা বীর হত্যা করেছেন বা হত্যা করতে পেরেছেন? প্রতিপক্ষ যুদ্ধক্ষেত্রে এক একবার সহস্র সহস্র রাম দেখছেন, কখনো-বা একজন রামই দেখছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে ‘সহস্র সহস্র’ রামের ড্যামি কেন? আসলে রাম যাতে কঠিন লড়াই থেকে নিজেকে গোপন রাখতে পারেন, সেই কারণে দেবসেনারা রামবেশী হয়ে আসল রামকে আড়াল করে রেখেছেন। রাম আদৌ যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলেন না, উপস্থিত ছিলেন রামের ছদ্মবেশে দেবসেনারা, প্রতিপক্ষের চোখ থেকে রামকে রক্ষা করতে। পুরো যুদ্ধটাই করে দিয়েছেন বানরসেনা ও আর্যদেবতারা। যুদ্ধকালীন বেশিরভাগ সময়ই রামকে রণক্ষেত্রে খুঁজেই পাওয়া যায়নি। প্রতিপক্ষের একটি বীরও রাম হত্যা করতে পারেননি, বরং যখনই তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করেছেন তখন প্রতিপক্ষের আঘাতে মৃতপ্রায় হয়েছেন। অথচ প্রতিপক্ষে পুরো যুদ্ধটাই সর্বদা একজন করে বীরই লড়াই করতে আসতেন, কখনোই সমস্ত বীর একযোগে লড়াই করেননি। অপরপক্ষে রামশিবিরের সমস্ত বীরেরা একযোগে লড়াই করেছেন। হনুমান, জাম্ববান, সুগ্রীব, অঙ্গদ, নীল, নল, দ্বিবিদ, লক্ষ্মণ এবং আর্যদেবতারা একযোগে যুদ্ধ করছেন প্রতিপক্ষের একজন বীরের বিরুদ্ধে। এতগুলি বীর একসঙ্গে নিয়ে রাম একটি বীরের মোকবিলা করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন বারবার। তারপরেও রাম ও তাঁর বীর যোদ্ধরা বারবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। প্রতিপক্ষের একটি বীরও রামচন্দ্র নিকেশ করতে পারেননি।প্রতিপক্ষের বীর অকম্পন ও বীর ত্রিশিরাকে হত্যা করেছেন বীর হনুমান; বীর প্রহস্তকে হত্যা করেছেন বীর নীল; বীর মহাপার্শ্ব, বীর নরান্তক ও বীর বজ্রদংষ্টকে হত্যা করেছেন বীর অঙ্গদ; বীর ইন্দ্রজিৎ ও বায়ুর সহায়তায় বীর অতিকায়কে হত্যা করেন বীর লক্ষ্মণ; বীর বিরূপাক্ষ ও বীর মহোদয়কে হত্যা করেছেন বীর সুগ্রীব। বীর রাম কাকে হত্যা করলেন? মহাবীর রাবণকে? রাবণের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী মন্দোদরী কী বলছেন, পড়ন–“বোধ হয় স্বয়ং কৃতান্ত ছদ্মবেশে রামরূপে আসিয়া থাকিবেন, তিনি তোমাকে বধ করিবার জন্য এইরূপ অতর্কিত মায়াজাল বিস্তার করিয়াছেন। অথবা বোধহয় ইই তোমাকে বধ করিলেন।” এই সংলাপ-অংশ বাল্মীকির রামায়ণে পাবেন। কোনো কৃত্তিবাসী, তুলসীদাসে পাবেন না।
কেমন ছিল রাম-রাবণের সরাসরি যুদ্ধ? প্রাবন্ধিক বীরেন্দ্র মিত্রের বয়ান আমরা দেখে নিতে পারি–“রামচন্দ্র যখন ভয়ে কাতর, ঠিক তখনই ইন্দ্র-বিমান এসে উপস্থিত। চালক মাতলি রামচন্দ্রকে বিমানে তুলে নিলেন। মাতলি রামকে বিভিন্ন ঐন্দ্রাস্ত্রও দিলেন। রামকে ঘিরে বিমানচারী দেব, দানব, গন্ধর্ব, উরগ, ঋষিরাও রণস্থলের উপর অবস্থান করতে লাগলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন দাক্ষিণাত্যে আর্য-উপনিবেশ স্থাপনের মহাস্থপতি অগস্ত্য।… রামচন্দ্র ধনুকের (যে-কোনো অস্ত্রই ‘ধনু’ নামে অভিহিত হয়েছে রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণে) ছিলায় টান দেওয়ার আগেই দেবতারা রাবণের বিমান ঘিরে আক্রমণ চালিয়েছেন। ওই ভিড়ের মধ্যে রামচন্দ্র হারিয়ে গেছেন। যদি-বা কোথাও তিনি থেকে থাকেন, তবে বহু যুদ্ধে অভিজ্ঞ ইন্দ্র-বিমান রথের চালক মাতলিই তাঁকে পরিচালিত করেছেন। অথবা স্বয়ং ইন্দ্র ওই বিমানে বসে ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করেছেন। বাল্মীকি রামায়ণটি পাঠ করলে ভগবান রামচন্দ্রকে নেহাতই নাবালক মনে হয়।
মনুর মতে রাজা ভগবান বা ভগবানের অংশ–“যস্মাদেং সুরেন্দ্রাণাং মাত্রাভ্যো নির্মিত নৃপঃ।/তস্মাদভিভবত্যেষ সর্বভূতানি তেজসা।/সো অগ্নিৰ্ভবতি বায়ুশ্চ সো অর্কঃ সোমঃ স ধর্মরাটা/স কুবেরঃ স বরুণঃ স মহেন্দ্রঃ প্রভাবতঃ৷” অতএব রাজাও যা, ভগবানও তাই। সে হিসাবে রামচন্দ্র হলেন ভগবানের সন্তান ভগবান। সেই কারণেই হয়তো রাম বনবাসী হয়েও রাজার মতো আচরণ করেছেন, যা ঔদ্ধত্যেরই। প্রকাশ। অনুসন্ধিৎসু পাঠকগণ রাজা ও রাজদণ্ডের বিষয়ে যদি আরও জানতে চান, তাহলে মনুসংহিতার সপ্তম অধ্যায় পাঠ করে দেখতে পারেন। সীতা উদ্ধার করে অযোধ্যায় ফিরে রাজা হওয়ার পরও রাম কোনো হত্যা (উত্তরকাণ্ডে শম্বুক ছাড়া, এ হত্যাও ব্রাহ্মণদের প্ররোচনায় পড়ে। প্রক্ষিপ্ত) করেছেন বলে শুনিনি। শুধু তাই-ই নয়, রাম তাঁর জীবনে যত হত্যা করেছেন, তার সবটাই ভিন রাজ্যে ভিন দেশে–অযোধ্যায় কিন্তু নয়। নিজরাজ্য অযোধ্যায় তিনি একটাও খুনখারাপি করেননি। এটাও নীতিগতভাবে অন্যায় কাজ। অন্য রাজ্যে, অন্য দেশে ঢুকে সেই দেশের সার্বভৌম নষ্ট করে সেখানকার প্রজাদের হত্যা করা অবশ্যই অন্যায় কাজ। আমেরিকা যেমন এ-দেশে ও-দেশে তাঁদের সেনা পাঠিয়ে যুদ্ধ করে বেড়ায়, নিজের ক্ষমতা বুঝিয়ে দেয়! বনবাস মানে অকাল বানপ্রস্থ। বানপ্রস্থ মানে ফলমূল আহার করা এবং খোলা আকাশের নীচে ঘাসে শয্যা করা। অনেকে মনে করেন, অনার্য রাক্ষসদের উপর্যুপরি কচুকাটা করার পরিণতিই রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ। রাবণ সহ রাক্ষসগণ তো অযোধ্যায় গিয়ে গায়ে পড়ে হামলা করেনি! তাহলে কেন এই সংঘর্ষ? এই সংঘর্ষের হোত রামচন্দ্রও নয়, রাবণও নয়–এই সংঘর্ষের হোতা আর্যদেবতারা। রামকে সামনে রেখে আর্যদেবতারা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছেন। সংঘর্ষের কারণ একটাই–উত্তর ভারত থেকে দক্ষিণ ভারতে নিরঙ্কুশ আর্য-উপনিবেশ বিস্তার করা। দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন নয়। বাল্মীকি অন্তত এরকম বক্তব্য রাখেননি তাঁর রামায়ণে। প্রকৃত উদ্দেশ্য আড়াল করে রামকে শ্রেষ্ঠত্ব দিতেই ব্রাহ্মণ্যবাদীরা নানা মিথ্যা ব্যাখ্যা করেছেন। বাল্মীকিকে অগ্রাহ্য করে মিথ্যা গল্প ফেঁদেছেন অন্য কবিরা। তাঁদের বর্ণনা অনুসারে রাবণকে বধের যে কারণগুলি দেখানো হয়েছে, তা কেবল রাবণই নয়, প্রাচীনযুগ থেকে মধ্যযুগের শেষভাগ পর্যন্ত প্রায় সব রাজাই এমন চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। তাহলে তো সব রাজাকেই কোতল করতে হয়। তাহলে রাম কেবল রাবণকে হত্যা করেই থেমে যাবেন কেন? নারী ধর্ষণ, নারী হরণ, নারী রক্ষণ (হারেমে রক্ষিতা), অন্য রাজ্যের রাজকে হত্যা করা বা বন্দি করে সেই রাজ্য দখল করা–এসব সব রাজাই কমবেশি করতেন। রাবণ কি কোনো ব্যতিক্রম রাজা, যে তাঁকে ঘিরে তাঁকে হত্যা এত আয়োজন?
রাম যখন স্বামী, সেই স্বামী হিসাবে স্ত্রী সীতার প্রতি রামের কেমন আচরণ ছিল, কেমন মর্যাদা দিয়েছেন। প্রাণাধিকা স্ত্রীকে? স্বামী হিসাবে রাম পাবেন গোল্লা। যাঁরা রামের মতো স্বামী চান তাঁদের ভালো লাগবে। মেঘনাদের শক্তিশেল খেয়ে লক্ষ্মণ যখন অজ্ঞান হয়ে ভূলুণ্ঠিত হলেন, তখন রাম বিলাপ করতে থাকলেন–“প্রাণ পেয়ে সীতা পেয়ে কী লাভ আমার? মর্তলোকে খুঁজলে সীতার মতো নারী আরও পাওয়া যাবে। কিন্তু লক্ষ্মণের মতো সচিব ও যোদ্ধা ভাতা কোথাও পাওয়া যাবে না।” এখানেই শেষ নয়, রাম আরও বলেন–“দেশে দেশে স্ত্রী পাওয়া যায়, বন্ধুও পাওয়া যায়, কিন্তু তেমন দেশ মেলে না যেখানে সহোদর ভাই পাওয়া যায়।… তুমি যখন মৃত্যুমুখে পতিত তখন আমার জীবন নিরর্থক, সীতা বা বিজয়লাভ করাও নিরর্থক।” ভ্রাতৃস্নেহে পত্নীপ্রেম ভ্যানিস! স্ত্রী সুলভে মেলে, ভাত ছড়ালে কাকের অভাব! তাই ইচ্ছামতো ত্যাগ করা যায়।
সহোদর ভাই ভরত যৌবরাজ্যে অভিষেক হবেন শুনে রামের একটিই মাত্র অভিযোগ–“আমি পিতার কথায় অগ্নিতে প্রবেশ করতে পারি। কেন পিতা আগের মতো আমায় অভিনন্দন করছেন না? একটি অলীক ব্যাপার আমার চিত্তকে দগ্ধ করছে; রাজা নিজে কেন আমাকে ভরতের অভিষেকের সংবাদ দিলেন না? বললে আমি খুশি হয়েই ভাই ভরতের জন্য সীতা, রাজ্য, প্রাণও দিতে পারতাম।” স্ত্রীকে ত্যাগ করাই নয়, স্বামী হিসাবে রাম স্ত্রী সীতাকে ভাই ভরতের ভোগ্য পর্যন্ত করতে পারেন। সীতা তো কোনো ব্যক্তি নন, নিরেট বস্তুমাত্র।
অথচ ভাবুন তো, যে স্বামী (রাম) স্ত্রীকে (সীতা) ভাইয়ের (ভরত) হাতে তুলে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। যে স্ত্রী বলেন–“তোমাকে বাদ দিয়ে আমার স্বর্গে বাস করতেও অভিরুচি নেই। তোমার বিরহে আমি এখানে প্রাণত্যাগ করব।” এহেন পতিব্রতা স্বামী-সোহাগিনী নারীকে মন্দোদরী, তারা, কুন্তীদের (“অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরী তথা/পঞ্চকন্যা স্মরে নিত্যং মহাপাতক নাশনম্৷৷”) মতো এক কাতারে প্রাতঃস্মরণীয় করেননি সমাজপতিরা। সীতা সেই স্ত্রী, যাঁকে লঙ্কাধিপতি রাবণ বিবাহের প্রস্তাব দিলে তিনি স্বামীর প্রতি অগাধ আস্থা জ্ঞাপন করে রাবণকে চরম দৃঢ়তায় বলেন–“তুমি শৃগাল হয়ে সিংহীকে পেতে চাইছ? কাল সাপের মুখে হাত দিয়ে তার বিষদাঁত উপড়াতে চাইছে। কালকূট বিষপান করে স্বস্তিতে থাকতে চাইছ? সূচী দিয়ে চক্ষুভেদ করতে বা জিহ্বা দিয়ে ক্ষুরলেহন করতে চাইছ? রাঘবের প্রিয়াকে তুমি পেতে চাইছ? কণ্ঠে শিলাখণ্ড বেঁধে সমুদ্র উত্তরণ করতে চাইছ? দুই হাত দিয়ে চন্দ্র সূর্য ধরতে চাইছ? তুমি রামের প্রিয়া বধূকে ধর্ষণ করতে চাইছ? জ্বলন্ত অগ্নিকে কাপড় দিয়ে আহরণ করতে চাইছ, তাই রামের কল্যাণী বধূকে হরণ করতে চাইছ? লৌহমুখ শূলের সামনে বিচরণ করতে চাও, তাই রামের অনুরূপ বধূকে পেতে চাইছ? বনে সিংহ ও শিয়ালের যে পার্থক্য, ছোটো খাল ও সমুদ্রের যে পার্থক্য, শ্রেষ্ঠ বীর ও কাপুরুষের যে পার্থক্য, হাতি ও বিড়ালের যে পার্থক্য, গোরুড় ও সাপের যে পার্থক্য, পানকৌড়ি ও ময়ূরের যে পার্থক্য, হাঁস ও শকুনের যে পার্থক্য–দাশরথি রামের সঙ্গে তোমারও সেই পার্থক্য।
যদন্তরং সিংহশৃগালোর্বনে..যদন্তরং কাঞ্চনসীসলোহয়োঃ…যদন্তরং বায়সবৈনতেয়য়োঃ…।”
তবুও সীতা অপমানিত হয়েছেন নিজের প্রাণাধিক স্বামীর কাছে। যুদ্ধশেষে স্বামী-স্ত্রীর প্রথম সাক্ষাতে দীর্ঘ অদর্শনে সীতার প্রতি রামের প্রেম বিলীন হয়ে গিয়েছিল। সীতাকে লঙ্কাপুরীর বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন বটে, কিন্তু রাম সেইসঙ্গে একথাটাও সীতাকে জানাতে ভোলেনি যে, “যুদ্ধ তাঁর জন্য হয়নি। যুদ্ধে শত্রুকে জয় করেছি। তোমাকেও মুক্ত করেছি। আমার পৌরুষ দিয়ে যা করার আমি তা সব করেছি। বৈরীভাবের এক্কেবারে শেষপ্রান্তে পৌঁছেছি, ধর্ষণ প্রমার্জনা করেছি। শত্রু এবং অপমান একসঙ্গে খতম করেছি। আজ আমার পৌরুষ প্রকাশিত হয়েছে, আজ আমার শ্রম সফল হয়েছে। প্রতিজ্ঞা থেকে উত্তীর্ণ হয়েছি এবং নিজের প্রভূত্ব ফিরে পেয়েছি।”
‘আদর্শ স্বামী’ রাম আরও বলেন–“তোমার কুশল হোক। জেনে রাখো, এই যে যুদ্ধের পরিশ্রম, বন্ধুদের বীরত্বের সাহায্যে যা থেকে উত্তীর্ণ হয়েছি, তা তোমার জন্যে নয়। আমার চরিত্র মর্যাদা রক্ষা করার জন্যে এবং প্রখ্যাত আত্মবংশের কলঙ্ক মোচন করার জন্যেই তা করেছি। তোমার চরিত্র সন্দেহজনক হয়ে উঠেছে। আমার সামনে তুমি আছ, চক্ষুপীড়াগ্রস্তের সামনে প্রদীপ যেমন পীড়াদায়ক হয় তেমনই। তাই জনকাত্মজা, এই দশদিক পড়ে আছে, যেখানে ইচ্ছা তুমি চলে যাও, আমি অনুমতি দিলাম–তোমাকে আমার প্রয়োজন নেই। কোন্ সদ্বংশজাত তেজস্বী পুরুষ বন্ধুত্বের লোভে পরগৃহবাস করেছে যে, স্ত্রী, তাকে ফিরিয়ে নেবে? রাবণের কোলে বসে পরিক্লিষ্ট, তার দুষ্ট দৃষ্টিতে দৃষ্টা তুমি, তোমাকে গ্রহণ করে আমি আমার উজ্জ্বল বংশের গৌরব নষ্ট করব?–“অঙ্ক, আরোপ্য তু পুরা রাবণেন বলা ধৃতাম”। যেজন্য যুদ্ধ করেছি তা পেয়েছি, তোমার প্রতি আমার কোনো অভিলাষ নেই, যেখানে খুশি চলে যাও তুমি। আমি তোমাকে বলছি লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন, সুগ্রীব বা বিভীষণ এদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা মনোনীত করে নাও।” অথচ এ তো সেই সীতা, যিনি বনবাসের প্রাক্কালে শাশুড়িমাতা কৌশল্যাকে বলেছিলেন–“নাতন্ত্রী বাদ্যতে বীণা নাচক্রো বিদ্যতে রথঃ।/নাপতিঃ সুখমেধতে যা স্যাদপি শতাত্মজা।” অর্থাৎ, তন্ত্রীহীন বীণা বাজে না, চক্ৰহীন রথ হয় না। পতিহীনা নারী শতপুত্রের জননী হলেও সুখ পায় না।
রামের মতো সূক্ষ্ম ধর্মবুদ্ধিযুক্ত ব্যক্তি পরহস্তগতা নারীকে মুহূর্তের জন্যে হলেও কী করে গ্রহণ করবেন! সীতা দুশ্চরিত্র হোন বা না-হোন, সচ্চরিত্র হোন বা না-হোন–তাঁকে ‘ভোগ’ করা রামের পক্ষে অসম্ভব। কুকুরে চাটা ঘি’ যেমন কোনো পুজোয় লাগে না, দুধে কেরোসিন পড়লে যেমন সেই দুধ পানের অযোগ্য হয়ে যায়, মাছের মাথায় পচন ধরলে যেমন সেই মাছ অখাদ্য হয় পরহস্তগত স্ত্রী তথা নারীও তেমন স্বামীর অঙ্কশায়িনী হতে পারে না। রাবণ সীতাকে স্পর্শ করেছিল কি না তা জেনে নেওয়ার প্রয়োজন নেই, রাবণ সীতাকে বলাৎকার করেছিল কি না সেটাও জানার প্রয়োজন নেই। সতীত্ব নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠেছে, তখন ত্যাগই একমাত্র সমাধানের পথ। কারণ সীতাকে নিয়ে অযোধ্যায় ফেরার পর প্রজারা রামচন্দ্রকে বলেছে–“কীদৃশং হৃদয়ে তব সীতাসম্ভোগজং সুখম্।/অঙ্কমারোপ্য তু পুরা রাবণেন বলাক্বতাম্।” অর্থাৎ “রাবণ যাকে অঙ্কে আরোপণ করে সবলে হরণ করেছিল, সেই সীতার সম্ভোগে তোমার হৃদয়ে কেমন সুখ হয়?” স্বামীর একনিষ্ঠতায় অভাব থাকলে কেউ আঙ্গুল তোলে না ঠিকই, কিন্তু স্ত্রীকে শুধুমাত্র সন্দেহের বশে ত্যাগ করা চলে! সীতা চরমভাবে অপমানিত হন এবং লক্ষ্মণকে আদেশ করেন চিতা সাজাতে–“অপ্রীতেন গুণৈর্ভর্তা ত্যজায়াঃ জনসংসদি।/যা ক্ষমা মে গতির্গন্তং প্রবেক্ষ্য হব্যবাহন৷৷” অর্থাৎ “স্ত্রীর গুণে যে প্রীত নয় এমন স্বামী যখন জনসভায় স্ত্রীকে ত্যাগ করে তখন সেই স্ত্রীর যে পথে যাওয়া সম্ভব তাই করব, আগুনে প্রবেশ করব।” অর্থাৎ আত্মহননের পথ বেছে নেবেন। বেদনাহত সীতা আগুনে প্রবেশ করেছিল এবং ভেবেছিলেন রাম একাজে বাধা দেবেন। না, রামচন্দ্র বাধা দেননি। লক্ষ্মণও ছিলেন নীরব দর্শকের ভূমিকায়। একথা না বললেই নয় যে, সীতাকে দাহ করার সিদ্ধান্তে লক্ষ্মণ অসন্তুষ্ট ছিলেন। সে কথা লক্ষ্মণ ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছেন রামকে। এই অংশে এসে দেখা যায়, রাম বা সীতা কেউই একে অপরকে স্বামী-স্ত্রী বলে সম্বোধন করেননি। সীতা রামকে ‘মহাবাহু বলে সম্বোধন করেছেন এবং রাম সীতাকে ‘বৈদেহী’, ‘মৈথিলী’, ‘ভদ্রা’ বলে সম্বোধন করেছেন। স্পষ্টত বোঝা যায় সম্পর্কটার মৃত্যু হয়ে গেছে। কবি বলেছেন–“ন হি রামং তদা কশ্চিৎ কালান্তকসমোপমম।/অনুনেতুমথো বতুং দ্রষ্টুং বাপ্যশকৎ সুহৃদ৷৷”–রামকে তখন কালান্তক এবং যমের মতো দেখাচ্ছিল, তাঁকে অনুনয় করা তাঁকে কিছু বলা বা তাঁর দিকে চেয়ে দেখার সাধ্যও কোনো বন্ধুর ছিল না।
রাবণের স্পর্শ করার অনেক আগেই অনার্য বিরাধ সীতাকে স্পর্শ করেছিল। আর তখন কিন্তু রামের কিছু মনে হয়নি, যে ঘটনা তিনি স্বয়ং চাক্ষুষ করেছেন। তখন কিন্তু রামের মনে হয়নি তাঁর স্ত্রী পরপুরুষ কর্তৃক ধর্ষিত হয়েছেন। তখন কিন্তু তাঁর স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেননি। বনবাসকালে দণ্ডকারণ্যে বিচরণ করতে করতে রাম লক্ষ্মণ-সীতা বীভৎস রাক্ষস বিরাধের মুখোমুখি। সুন্দরী সীতাকে কোলে তুলে নিলেন ক্রুব্ধ বিরাধ। এবং বলতে থাকলেন–“তোরা জটাধারী ও চীরপরিধারী, অথচ হাতে ধনুক, বাণ, তলোয়ার ব্যবহার করেছিস কেন? সে যা হোক, স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যখন তোরা দণ্ডকারণ্যে ঢুকেছিস, তখন তোদর আর বাঁচার আশা নেই। তোরা কে? আমি রাক্ষস, আমার নাম বিরাধ। এই সুন্দরী আমার স্ত্রী হবে।” লক্ষণীয়, বিরাধ রাক্ষস কর্তৃক সীতা চরম নিপীড়া হলেও রামচন্দ্র একবারের জন্যেও ‘ধর্ষণ’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। একবারের জন্যেও বলেননি ‘কুকুরে চাটা ঘি’, অভোগ্য, অভক্ষ্য। প্রকৃতিও বিচলিত হননি৷ কেন বলেননি? সাইকোলজিটা কিন্তু পরিষ্কার–বিরাধ যখন সীতাকে কাঁধে তুলে চম্পট দিচ্ছিল, তখন সীতা ‘সতীত্ব’ নিয়ে রামের কোনোরূপ প্রশ্নের উদয় হয়নি। অথচ রাবণ যখন জটায়ুর কাছ থেকে জানতে পারলেন রাবণ তাঁর স্ত্রীকে কোলে বসিয়ে নিয়ে গেছে, তখন সীতার ‘সতীত্ব’ নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। বিরাধ যখন সীতাকে কোলপাঁজা করে কাঁধে তুলে নিল তখন রাম সাধারণ মানুষ, বিপদগ্রস্ত, অসহায়, তাঁর অনিশ্চিত ভবিষ্যত–এ অবস্থায় এমন দুষ্টভাবনা মাথায় আসার কথা নয়। বরং বিপদের এই দিনগুলিতে একে অপরকে আঁকড়ে ধরে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করতে হচ্ছিল। অপরদিকে যখন রাম সীতাকে ‘অসতী’ হিসাবে অভিযুক্ত করছেন এবং তাঁকে পরিত্যাগ করছেন, তখন তিনি নিরঙ্কুশ বিজয়ী, তখন তাঁর সামনে-পিছনে-ডানে-বায়ে অসংখ্য সুহৃদ মানুষ, তখন তিনি রাজাধিরাজ–এ সময় সীতার মতো ‘অসতী’ নারীর আর কোনো প্রয়োজন নেই রামের। যে সাহস তিনি বিরাধরাক্ষসের সময় দেখাতে পারেননি, তার চেয়ে অধিক সাহস লঙ্কা বিজয়ের পর রামচন্দ্র দেখাতেই পারেন! বস্তত রাম সীতার সতীত্ব নিয়ে যতটা বাড়াবাড়ি করেছেন, দ্রৌপদীর সতীত্ব নিয়ে তাঁর কোনো স্বামীই বিন্দুমাত্র প্রশ্ন তোলেননি। তাই বোধহয় পরে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা পঞ্চসতীর তালিকায় দ্রৌপদীকে রেখেছেন, সীতাকে নয়।
তবে এ ঘটনায় রামকে পুরোপুরি দোষারোপ করা যায় না। নেতা-মন্ত্রীদের দুর্নীতিগ্রস্ত বলে যেসব নাগরিকরা নিজেদেরকে চরিত্রবান বলে ভাবতে পছন্দ করেন তাঁদের বলব আয়নার সামনে দাঁড়ান এবং নিজের চোখে চোখ রেখে বলুন আপনি কতটা দুর্নীতিমুক্ত! এক্ষেত্রে স্ত্রীকে ঘৃণা আর পরিত্যাগের জন্য রামের সমালোচনা করলে সেইসব প্রজা তথা নাগরিকদেরও সমালোচনা করতে হবে। কারণ প্রজারাই রামকে খুব বিশ্রীভাবে প্ররোচিত করেছেন, যে প্ররোচনায় রাম পা দিয়ে ফেলেছেন। সব বিষয়েই যে প্রজাদের মতামত নেওয়ার নেই, সেটা ভুলে যাওয়ার জন্যই রামকে মাশুল গুনতে হয়েছে।
সীতাকে প্রাপ্তির পর প্রজাবৎসল রাম যখন প্রজাদের জিজ্ঞাসা করলেন–আমার বিষয়ে প্রজারা তেমন কোনো সমালোচনা করছে কি না (“কাঃ কথা নগরে ভদ্র বৰ্তন্তে বিষয়েষু চা/মামাশ্রিতানি কান্যাহঃ পৌরা জানপদা জনাঃ”)। রাম এমন একটা সমাজে অবস্থান করছেন, সে সমাজ যে রামের সমালোচনা করবেন সেটা তিনি বিলক্ষণ জানতেন। তা ছাড়া রাম নিজেও সীতার ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন, নাহলে এতটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না। রামের এই দুর্বলতা প্রজারাও বুঝতে পেরেছিলেন নিশ্চয়ই। আর তাই অনধিকার চর্চার’ সুযোগ হাতছাড়া করেননি প্রজারা। ভদ্র নামক জনৈক ধুরন্ধর প্রজা ফরফর করে বলতে শুরু দিলেন–
“হত্বা চ রাবণং সখ্যে সীমান্ধত্য রাঘবঃ।
অমর্যং পৃষ্ঠতঃ কৃত্বা স্ববেশ পুনরানয়ৎ।
কীদৃশং হৃদয়ে তস্য সীতাসম্ভোগজং সুখ।
অঙ্কমারোপ্য তু পুরা রাবণেন বলদ্ধৃতাম৷৷
লঙ্কামপি পুরীং নীতামশোকবনিকাং গতাম্।
রক্ষসাং বশমাপন্নাং কথং রামো ন কুৎস্যতি৷৷
অস্মাকমপি দারেষু সহণীয়ং ভবিষ্যতি৷
যথা হি কুরুতে রাজা প্রজাস্তমনুবৰ্ত্ততে৷৷
এবং বহুবিধা বাচো বদন্তি পুরবাসিনঃ।
নগরেষু চ সর্বেষু রাজন্ জনপদেষু চা।”
অর্থাৎ–রঘুনন্দন রাম, রাবণকে যুদ্ধে হত্যা করেছেন এবং যে সীতাকে রাবণ স্পর্শ করেছেন, সেজন্য কিছুমাত্র ক্ষুব্ধ না-হয়ে পুনরায় সীতাকে নিজঘরে এনেছেন। রাবণ আগেই সীতাকে বলপ্রয়োগে অপহরণ করে লঙ্কাপুরীতে নিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও রামের হৃদয়ে সীতাসম্ভোগসুখ কীভাবে হচ্ছে? সীতা রাক্ষসদের বশীভূতা হয়ে অশোকবনে দিনরাত অতিবাহিত করেছেন, তা সত্ত্বে রাম কেন সীতাকে ঘৃণা করেন না? যা রাজা করেন, প্রজারা তাই-ই অনুসরণ করে। এরজন্য আমাদেরও আমাদের স্ত্রীদের এহেন দোষ মেনে নিতে হবে। জনপদের সমস্ত নাগরিক এমনই নানা কথা বলছেন।
তা ছাড়া রাম কি কোনোভাবে জেনে গেছেন যে, যে সীতাকে লংকা থেকে উদ্ধার করে আনা হয়েছে সে সীতা নয়, বেদবতী। তাই কি রামের এমন রুক্ষ্ম আচরণ, এমন দুর্বিনীত, এমন অমানবিক মুখ তাঁর। পঞ্চবটিতে সীতাহরণে নাটকটা আর্যদেবতারাই রচনা করেছিলেন। রাম-লক্ষ্মণের অনুপস্থিতিতে আর্যদেবতারা পঞ্চবটিতে জানকীকে নিরাপদ আশ্রয়ে লুকিয়ে রেখে বেদবতীকে বসিয়ে রেখেছিলেন। যে নারীকে রাবণ অপহরণ করেছিলেন, সেই নারী স্বৰ্গবেশ্যা বেদবতী–সীতা নয়। তাই পঞ্চবটিতে রাবণের সঙ্গে বেদবতীর সাক্ষাৎ হলে রাবণ যে ভাষায় আদিরসাত্মক শরীর বিষয়ক বর্ণনা করছিলেন এবং যে নারী আপ্যায়নের সঙ্গে সঙ্গে মজিয়ে শুনছিলেন, সে কখনোই সীতা হতে পারে না। এখানেই শেষ নয়, রাবণের সঙ্গে লঙ্কায় যাওয়ার পথে এবং অশোকবনে অবস্থানকালে যে ভাষায় তিনি বাক্যালাপ করেছেন, তা কোনো সাধারণ নারী করতে পারেন না। এ তো এক কথা। কিন্তু লঙ্কা থেকে ফেরার পর আর্যদেবতারা সকলের অলক্ষ্যে বেদবতীকে সরিয়ে আসল সীতাকে হাজির করেছিলেন। তারপরেও কেন স্ত্রীর প্রতি রামের কু-আচরণ? যিনি রাবণের কাছেই ছিলেন না, তাঁকে কেন রাবণ দ্বারা ধর্ষিতা হওয়ার অপবাদ দেওয়া হবে? তাহলে কি রামচন্দ্র আর্যদেবতাদেরও বিশ্বাস করতেন না? নাকি পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রভাব?
ভুললে চলবে না, রামও পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থারও শিকার। দেবর্ষি নারদ কথিত বাল্মীকির রামচন্দ্র ‘দেবতা নন, মানুষ। সে কথা বাল্মীকি রামকাহিনি রচনার শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছেন। বাল্মীকি নরশ্রেষ্ঠ রামচন্দ্রের কাহিনি লিপিবদ্ধ করেছেন। এ ব্যাপারে মতান্তরের কোনো জায়গা নেই। সীতার প্রতি রামের যে আচরণ ও ব্যবহার তাতে বোঝা যায় ত্রেতাযুগেও নারীর সম্মান ছিল না, দ্বাপর যুগেও ছিল না, কলিযুগেও নেই। মানুষ’ রামও সেই ব্যবস্থা থেকে মুক্ত নন, মুক্ত নন রামের প্রজারাও। রামায়ণের যুগে নারীর অবস্থান নারীর সম্মান মোটেই সুখকর ছিল না। মুনিবর বাল্মীকি সে ঘটনা বড়ো দরদ দিয়ে বর্ণনা করেছেন। সে যুগে পুরুষ তথা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীদের যে চোখে দেখতেন কবি সেই ছবিই চিত্রিত করেছেন। রামচন্দ্র ‘পুরুষ’ বই তো নয়। এ প্রসঙ্গে নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীও স্পষ্টত বলেছেন–“রাম পুরুষমানুষ, পুরুষশাসিত সমাজে মেয়েদের দাম ছিল না। প্রেম বলে কোনো জিনিস তারা বুঝত না–অতএব রাম সীতাকে পরিত্যাগ করেছেন।” এ যুগেও কি সেই চিত্র বিন্দুমাত্র বদলেছে? এখনও কি ঘরের বউ মাসকে মাস তো দূরের কথা একদিন বাড়ির বাইরে অচেনা কারোর সঙ্গে রাতযাপন করলে বিনাপ্রশ্নে ঘরে তুলবেন কোনো পুরুষ? বলা হয়–বউ আর বই একবার অন্যের হাতে গেলে তা পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে না। অতএব বোকার মতো কেবলমাত্র রামের দিকে আঙুল তোলা অর্থহীন। যদি সত্যিই রামের দিকে আঙুল তোলার সাধ জাগে তবে আমি বলব আগে নিজেকে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ান। নিজের দিকেও আঙুল ঘোরান। আসলে শতশত বছর আগেও রামচন্দ্র যেখানে ছিলেন; শতশত বছর পরেও আমরা রামের ভক্তরা সেখানেই পড়ে আছি। এতটুকু বদলাইনি।
তা ছাড়া সীতা অভিযুক্ত, প্রাচীন যুগের বিচারে তাঁকে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি নির্দোষ। রাম রাজা রাজার কাছে রাজার পিতা, মাতা, ভ্রাতা, পুত্র, ভার্যা সম্পর্ক সব তুচ্ছ। কেমন ছিল প্রাচীন যুগে বিচার? হিউয়েন সাঙের ভারত বিবরণ থেকে জেনে নিলে দোষের হবে না নিশ্চয়–কেউ আইন ভাঙলে বা ক্ষমতার অপব্যবহার করলে বিষয়টিকে খুঁটিয়ে বিচার করে তবে অপরাধীকে কারাদণ্ড দেওয়া হত। কোনরূপ দৈহিক শাস্তি দেওয়া হয় না। অপরাধীকে সোজাসুজি বাঁচতে বা মরতে ছেড়ে দেওয়া হয় ও মানুষের মধ্যে ধরা হয় না। যদি নীতি নিয়ম ভাঙা হয়, যদি কোনো লোক স্ত্রীর প্রতি বিশ্বাস ভঙ্গ করে বা জনক-জননীর প্রতি কর্তব্য উপেক্ষা করে তবে তার নাক বা কান বা হাত-পা কেটে দেওয়া হয়, অথবা দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয় বা তাকে জনহীন অরণ্যে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। কোনো দোষী লোককে প্রশ্ন করার বেলায় যদি সে ভোলা মনে সব কথার উত্তর দেয় তবে তদনুযায়ী দণ্ড লঘু করা হয়। যদি অপরাধী একগুঁয়ের মতো অপরাধ অস্বীকার করে চলে বা দোষ-স্খলনের চেষ্টা করে, তবে সত্য খুঁজে বের বিচার নিষ্পত্তির জন্য চার রকমের পরীক্ষার আশ্রয় নেওয়া হয়–(১) জলের দ্বারা, (২) শক্তি প্রয়োগের দ্বারা, (৩) পরিমাপের দ্বারা এবং (৪) বিষের দ্বারা।
জলের দ্বারা : যখন জলের দ্বারা পরখ করা হয় তখন অভিযুক্তকে একটি বস্তার মধ্যে ভরা হয়। বস্তাটি একটি পাথরের পাত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকে। তারপর ওই অবস্থায় তাকে জলে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। যদি সে ডুবে যায় ও পাথরটি ভাসে তবে সাব্যস্ত হয়–সে দোষী। যদি লোকটি ভাসে ও পাথরটি ডুবে যায় তবে সাব্যস্ত হয়–সে নির্দোষ।
শক্তি প্রয়োগ : যখন শক্তি প্রয়োগের দ্বারা পরখ করা হয় তখন সাহায্য নেওয়া হয় আগুনের। তারা একটি লোহার পাত গরম করে ও অভিযুক্তকে তার উপর বসতে বাধ্য করে। তারপর তার পা-দুটি তার উপর রাখা হয়। পরে তার হাতের পাতায় এটি রাখা হয়। আবার জিভ দিয়েও তাকে এটি চাটতে বাধ্য করা হয়। এর ফলে যদি কোথাও কোনো পোড়া দাগের সৃষ্টি না হয় তবে প্রমাণ হয়–সে নির্দোষ। যদি পোড়া দাগের সৃষ্টি হয় তাহলে প্রমাণ হয়–সে দোষী। যারা দুর্বল ও ভীতু লোক, যাদের সহন ক্ষমতা এ ধরনের পরখের অন্তরায় তাদের বেলায় একটি ফুলের কুঁড়ি নিয়ে তাকে আগুনে ছুঁড়ে দেওয়া হয়। যদি আগুনের তাপে এটি ফুলের মতো ফোটে, তবে প্রমাণ হয় যে অভিযুক্ত ব্যক্তি নির্দোষ। যদি কুঁড়িটি পুড়ে যায়, তবে সাব্যস্ত হয় সে দোষী।
পরিমাপের দ্বারা : একজন মানুষ ও একটি পাথরকে সমানভাবে পাল্লায় রাখা হয়। তারপর তুলনামূলকভাবে কে ভারি আর কে হালকা তাই দেখে দোষী নির্দোষী স্থির হয়। যদি অভিযুক্ত লোকটি নির্দোষ হয় তাহলে তার ওজন পাথরের চেয়ে বেশি হবে। যদি দোষী হয় তবে তবে পাথরটি তুলনায় তার ওজন কম হবে।
বিষের দ্বারা : একটি ভেড়া নিয়ে এসে তার ডান উরুতে একটি ক্ষত করা হয়। তারপর অভিযুক্তের খাবার থেকে খানিকটা নিয়ে তাতে সব রকমের বিষ মিশিয়ে তা সেই ক্ষতের মধ্যে ভরে দেওয়া হয়। যদি সেই বিষের ক্রিয়ায় প্রাণীটি মারা যায় তাহলে প্রমাণ হয় যে মানুষটি দোষী। যদি প্রাণীটি বেঁচে থাকে তবে মানুষটি নির্দোষ সাব্যস্ত হয়।
লক্ষ করুন পাঠক, এগুলি কোনোটাই বিচার বা যাচাই নয়, এগুলি নেহাতই প্রহসন। অভিযুক্তের নিশ্চিত মৃত্যু ঘটানোই এসব হাস্যকর পরীক্ষার উদ্দেশ্য। এতক্ষণ যে অভিযুক্তের শাস্তি বিষয়ে আলোচনা করলাম তার একটাই কারণ, অভিযুক্ত সীতাকে আগুনে ঠেলে দেওয়ার বিষয়টাও দেখতে হবে। কারোকে আগুনে ঠেলে দিলে তাঁর বেঁচে থাকার কথা নয়। আগুনে পুড়ে অভিযুক্ত যে এর ফলে মারা যাবে, এটা জেনেই এহেন যাচাইয়ের বিধান। সতী কি না এটা যাচাইয়ের জন্য সীতাকেও লেলিহান আগুনে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। প্রথমবার যাচাইয়ের পরীক্ষায় বিভীষণ আর লক্ষ্মণের কৌশলে সীতা সে যাত্রায় বেঁচে যান। শ্বাপদসংকুল গভীর অরণ্যে সীতাকে নির্বাসন দেওয়া হলে এবং বাল্মীকি আশ্রয় না-দিলে, সেদিনও সীতার কোনো হিংস্র প্রাণীর পেটে চলে যেত। সীতার তৃতীয় ও শেষবারের মতো সতীত্ব যাচাইয়ে পরীক্ষার সময় লক্ষ্মণ আর বিভীষণ উপস্থিত নেই, ফলে আগুন থেকে বাঁচানোর কৌশল কে প্রয়োগ করবে! তাই আর আগুনে প্রবেশ নয়, মাটির নীচে চলে গেলেন তিনি। এটাই বাস্তব–কোনো অলৌকিক বা ভেলকি নয়।
তা মাটির নীচে কীভাবে গেলেন? ‘হে ধরণী দ্বিধা হও’ বা ‘পৃথিবী বিদীর্ণা হও’–আর অমনি ধরণী দু-ভাগ হয়ে গেল। ধরণী দু-ভাগ হয়ে গেল আর সীতা মাটির নীচে চলে গেল! মাটির নীচে কী আছে? মাটির নীচে কেউ গেলে তাঁর তো পঞ্চত্ব সুনিশ্চিত হয়! তাহলে সীতার পাতালপ্রবেশের যুক্তিটা কী, উদ্দেশ্যটাই-বা কী? যুক্তিবাদী প্রাবন্ধিক বীরেন্দ্র মিত্র লিখেছেন–“সভাস্থ সাধারণ যখন স্তম্ভিত তখন হড়হড় করে পৃথিবী বিদীর্ণ। হলেন, সীতাও রথে চেপে নেমে গেলেন। সর্বসমক্ষে সাধ্বী সীতার পাতালপ্রবেশ ঘটল। আমাদেরও উদ্বেগেরও অবসান হল। কেবল একটি প্রশ্ন, দেবতারা কি আধুনিক কায়দায় একটি নাট্যমঞ্চ আগেই প্রস্তুত রেখেছিলেন, যার সুইচ টিপলে দুই পাটাতন সরে গিয়ে দৈব-আসন সেই গহ্বর থেকে ওঠে নামে? এসব ব্যাপার সেকালে দৈব প্রহেলিকা ছিল, একালে হিন্দি ছায়াছবির সেটে হরদম দেখা যায়।” মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
আমরা লব ও কুশকে পাচ্ছি উত্তরকাণ্ডে। যে কাণ্ডটি মহর্ষি বাল্মীকির রচনা করেননি বলে অনেক পণ্ডিত মনে করেন। এই লব ও কুশ যে রামচন্দ্রেরই ঔরসজাত সন্তান তেমন কোনো জোরালো ঘটনায় কথা কবি বলেননি। ফলে লব-কুশের পিতৃপরিচয় নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন রয়েই গেছে, সেটা বোধহয় রামচন্দ্রও বিলক্ষণ জানতেন। তাই বোধহয় সীতার সতীত্ব যাচাই। প্রজাদের চাপ নয়, নিজেও সন্দিহান ছিলেন। তাই বোধহয় অবলীলায় বলে ফেলতে পারেন–“নোসাহে পরিভোগায় শ্বাবলীঢ়ং হব্যির্থ।” কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা নয়। লব ও কুশ যখন রামের রাজসভায় রামগান করছিলেন, তখন সভার সকলে বলছিলেন, বালক দুটি অবিকল রাজা রামের মতো দেখতে। তাহলে এত সন্দেহ কেন স্ত্রীকে? সভার উপস্থিত ব্যক্তিদের কথা কি রামের কানে ঢোকেনি, নাকি ঢোকাননি? রাম ঠিক, না সীতা ঠিক? সীতা কি সত্যিই ধর্ষিতা হয়েছিলেন? সীতা প্রসঙ্গে আলোচনার সময় বিস্তারিত বলব।
তাহলে কি রাম “রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম কামগন্ধ নাহি তায়”? অনেকে বলেন রাম সীতার প্রতি তেমন সুবিচার না-করতে পারলেও, রাম দ্বিতীয় কোনো নারীতে উপগত হননি। রাম চরিত্রবান পুরুষ। আমি বলি–রাম পনেরো কিংবা ষোলো বছর বয়সে বিয়ে করেন। বারো বছর দাম্পত্যজীবন ভোগ করেন অযোধ্যাতেই। তখন তিনি রাজপুত্র, রাজা নন। রাজপুত্রের একাধিক নারীসঙ্গের সুযোগ নেই। এরপর যখন রামের বয়স সাতাশ কিংবা আঠাশ, তখন দণ্ডকারণ্যে নির্বাসন। চোদ্দো বছর শ্বাপদসংকুল অরণ্যেই কেটে যায়। রাক্ষস মারতে মারতেই সময় অতিবাহিত হয়। এ অরণ্যে সংগ্রামীজীবনে অন্য নারীতে আসক্ত হওয়ার কোনো সুযোগই নেই। লঙ্কাযুদ্ধের শেষে যখন রাম অযোধ্যায় ফিরলেন, তখন রামের বয়স বিয়াল্লিশ কিংবা তেতাল্লিশ। এ সময় সীতাকে বিসর্জন দিয়ে অন্য নারীকে গ্রহণ করা সময়ানুগ ছিল না। অতএব বাল্মীকির রাম সীতা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো নারী আসক্ত নন। স্ত্রীকে বর্জনের পর অশ্বমেধ যজ্ঞে স্ত্রীকে প্রয়োজন হলেও দ্বিতীয় বিয়ের কথা তিনি ভাবেননি। কাজ মিটিয়েছেন স্বর্ণসীতা নির্মাণ করে।
তা ছাড়া রাম কখনো ভোলেননি পিতা দশরথের কামুকতার কথা। বাতাসে কান পাতা দায় হত পিতার কামুকচরিত্রের জন্য। রাস্তাঘাটের লোকেরা পর্যন্ত যার সম্বন্ধে বলেছে ‘কামাত্মা’, ‘কামবেগবশানুগ’ লক্ষ্মণ যেমন পিতাকে কামুক’ বলে তিরস্কার করেছিলেন, রামও অনুরূপ ভাষায় তিরস্কার করেছিলেন। দশরথ নিজেও বেশ স্পষ্ট করেই জানতেন যে তিনি কামুক। তিনি কৈকেয়ীকে কী বলছেন শুনুন–
“বালিশে বত কামাত্মা রাজা দশরথথা ভৃশ। স্ত্রীকৃতে যঃ প্রিয়ং পুত্রং বনং প্রস্থাপয়িষ্যতি।”
অর্থাৎ পুত্র রাম বনে গেলে লোকে কী বলবে? বলবে কামুক রাজা স্ত্রীর কথায় পুত্রকে বনে পাঠাল। লোকে যে বলে লোকে যে বলবে সে বিষয়ে দশরথ বিলক্ষণ অবগত।
কৈকেয়ী-কামুকত্বেই দশরথ শেষ হয়েছে। রামের বনবাসও সেই কামুকতারই ফল। কামজৰ্জর রাজা তথা পিতা কৈকেয়ীর বিরুদ্ধে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে পারেননি। সেই কারণেই হয়তো রামও কঠোরভাবে নিজের চরিত্রকে রক্ষা করেছেন। আর যাই-ই বলুক, পিতার মতো কেউ যেন কামুক’ না-বলে, সে ব্যাপারে রাম সদা সতর্ক ও কঠোরব্রত পালন করেছিলেন। পিতার কার্বন-কপি হননি। শুধু রাম নয়–লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন কারোর বিরুদ্ধেই নারীঘটিত চরিত্র নিয়ে কেউ আঙুল তোলার সুযোগ পাবে না। সে যুগে একপত্নীতে সন্তুষ্ট চার ভাই-ই, এ দৃষ্টান্ত বড়োই বিরল। তবে বাল্মীকির রাম ‘একপত্নী’ হলেও, চন্দ্রাবতী রামায়ণ, জৈন রামায়ণে অন্যভাবে রামের আরও তিনখানি স্ত্রীর কথা উল্লেখ আছে।
তাই বলে রাম কামগন্ধহীন ছিলেন, একথা কোনো নিন্দুকও বলবেন না–বাল্মীকিও বলেননি। বাল্মীকির রাম অরণ্যজীবনে বারবার কামাতুর হয়েছেন। সীতাহারা হয়ে রাম যখন জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তখন প্রকৃতির কোলে পশুপাখির কামক্রীড়া দর্শন করে বারবার কামদগ্ধ হয়েছেন। অবশ্য পশুদের কামকেলি দর্শন করতে করতে সীতার কথাই মনে পড়ছিল বিরহী রামের। লক্ষ্মণকে ডেকে বলেছেন–“ম্মদনেনাভিবৰ্ত্তেত যদি নপেহৃতা ভবেৎ।” তিনি খোলামনে স্বীকার করেছেন যে, প্রাণীদের রমণ দর্শন করে তাঁরও কাম জেগে উঠছে–
“রমতে কাস্তয়া সার্ধং কামম্ উদ্দীপয়ন্নিব।”
এ হল রাম কামবেপথু বিলাপ। কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডে জানা যাচ্ছে, দীর্ঘ অরণ্যজীবনে স্ত্রীসংসর্গবঞ্চিত লক্ষ্মণকে নিজের কামজ্বরের কথা বলছেন ‘ভগবান রাম–“হে লক্ষ্মণ! আমি কামার্ত। … সীতা ব্যতীত বাস করা আমার পক্ষে অত্যন্ত সুকঠিন।… এক্ষণে যদি আমি পম্পাতটে তাঁহার সহবাসে কালক্ষেপ করি তাহা হইলে ইন্দ্রত্ব কি অযোধ্যা কিছুই চাই না।” লক্ষ্মণ যারপরনাই বিরক্ত হন এবং জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে তিরস্কার করেন–“আপনি শোককে দূরে ফেলুন এবং কামুকতাও পরিত্যাগ করুন।” যে কথা না-বললেই নয়, তা হল–তিনি কখনোই কামের দাস হয়ে পড়েননি। দুরন্ত কামরিপু তাঁর চরিত্রকে কখনোই কালিমালিপ্ত করতে পারেনি। এএখানেই শেষ হয়নি। রামের আদেশে সমুদ্রসৈকতে সৈনাশিবির গড়ে উঠল। তিন ভাগে ভাগ হল সৈন্যদল। নেতৃত্বে সেনাপতি নীল। সবাই যখন যুদ্ধের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, রাম সেই অবকাশযাপনে স্ত্রী সীতার কথা ভাবছেন এবং স্ত্রীসুখবঞ্চিত ছোটো ভাই লক্ষ্মণের কাছে প্রকাশও করলেন–“কবে আমি তাঁহার রজোষ্ঠ চারুদর্শন মুখমণ্ডল কিঞ্চিত উন্নত করিয়া উৎফুল্ল মনে চুম্বন করিব। কবেই-বা তিনি তালফলবৎ বর্তুল স্তনযুগল ঈষৎ কম্পিত করিয়া আমাকে গাঢ়তর আলিঙ্গন করিবেন।” এইখানেই শেষ নয়, আরও আছে। শিকার শেষে রাম যখন ঘরে ফেরেন, তখন দেখেন সীতা নেই। সীতার খোঁজে বেরলে জটায়ুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, তখন জানতে পারেন সীতা রাবণ কর্তৃক অপহৃত হয়েছেন। এ সময় সীতাহারা হয়ে রাম বিলাপ করছেন। সাক্ষাৎ বিপদাবস্থায় রামবিলাপ শুনুন–
“যাঁহার স্তনযুগল শ্রীফলের তুল্য, সর্বাঙ্গ নবপল্লববৎ কোমল … হে মরুবক! জানকীর উরুদ্বয় তোমারই ত্বকের ন্যায় সুদৃশ্য, এক্ষণে তিনি কোথায় … তাল! প্রেয়সীর স্তনযুগল সুপক্ক তাল ফলের তুল্য, যদি তুমি তাহাকে দেখিয়া থাকো তো কৃপা করিয়া বলো … হা! জানকীর নাসিকা কী সুদৃশ্য, দন্ত কী সুন্দর এবং ওষ্ঠই বা কী মনোহর। …তাঁহার বর্তুলস্তনযুগল সতত রমণীয় হরিচন্দন রাগে রঞ্জিত থাকিত, এক্ষণে পঙ্কে লিপ্ত হইয়া গিয়াছে।”
যুক্তিবাদী প্রাবন্ধিক বীরেন্দ্র মিত্রের বক্তব্য অনুধাবনযোগ্য–“রামচন্দ্র কামনিপুণা রসবতী দেবলক্ষ্মীদের দ্বারা মোহিত হয়ে সে সব পরামর্শে কান দেননি। বলেছিলেন, অমন দেবনারী ভোগ করতে পেলে তিনি অযোধ্যা কেন, হিমালয় স্বর্গের প্রভুত্বও কামনা করেন না। এহেন ক্ষত্রিয় পুত্রের দুর্বলতা কোথায়, দেবতারা তা বিলক্ষণ জানতেন। এ সব মানুষকে তাঁরা ঐ দেবনারী দিয়েই বশ করতেন। যতকাল রামকে ব্যবহার করা হয়েছে। দেবতাদের স্বার্থের প্রয়োজন ছিল, ততকাল ঐ দেবনারীদের তাঁরা যোগান দিয়েছেন। বনপথে জানকী ও বেদবতী নানা রঙে ঢঙে মুগ্ধ করে রেখেছিলেন রামকে। শেষ পর্যায়ে যখন মাথার ওপর, তখন দুই স্বনারীকেই তাঁরা রণক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নিয়ে নিরাপদ স্থানে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। কারণ এইসব কামনিপুণা নারীরাই দেবতাদের মূলধন। এই মানুবী-ব্রহ্মাস্ত্র ব্যবহার করে রামচন্দ্রের মতো বহু আত্মসুখপরায়ণ ভারতীয় রাজাকে মাতাল করে তাঁরা আপন কাজ গুছিয়ে নিয়েছেন। ফলে রামের ওপর শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলেছেন প্রজাসাধারণ। ভরত ও লক্ষ্মণের মধ্যেও অশ্রদ্ধার ভাব সুস্পষ্ট হয়েছে ক্রমশ। অতঃপর রামকে দেবনারী দিয়ে তুষ্ট রাখার প্রয়োজনও ফুরিয়েছে। সেই রমণী-অস্ত্র দেবতাদেরই ভোগ্যা। সুতরাং তাঁরা কেড়ে নিয়েছেন জানকী।”
সে যাই বলুক রাম, অনেক পণ্ডিতদের মতে রাম সীতার প্রতি যথার্থ আচরণই করেছেন। গোটা রামায়ণে রাম ক্রীড়নকমাত্র। বনবাস গমন থেকে অযোধ্যায় রাজা হয়ে বসা পর্যন্ত যে যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে রামের ভূমিকাই-বা কতটুকু! এর পিছনে ছিল আর্যদেবতাদের সক্রিয় কার্যক্রম। এমন অনেক ঘটনাই ঘটে গেছে, যা রামচন্দ্র অনেকক্ষেত্রে নিজেও বুঝে উঠতে পারেননি। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, ইন্দ্র, নারদ–এরকম মহাশক্তিধর পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিরাই ছিলেন রামচন্দ্রের ঘটনাবহুল বনবাসজীবনের নেপথ্য-কারিগর। আর প্রচুর মারণাস্ত্র সরবরাহের জন্য বিশ্বামিত্র, অগস্ত্যের মতো ধুরন্ধর ব্রাহ্মণরা তো ছিলেনই। না-হলে কেন তাঁরা এত এত মারণাস্ত্র রামচন্দ্রকে দিতে যাবেন! সেই কারিগররাই শূর্পণখাকে কাজে লাগিয়ে রাবণকে দণ্ডকারণ্যে টেনে এনেছিলেন ‘ডবকা’ সীতার লোভ দেখিয়ে। রামের প্রতিশোধ নিতে রামের বউকে রাবণ অপহরণ করবেন, সেটাই ছিল স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। সকলের সামনে দাঁড় করিয়ে রাম যে মহিলাটিকে অপমান করছিলেন তিনিও সীতা নন, তিনি বেদবতী। রাবণ ভুল করে সীতাকে না-এনে বেদবতীকে নিয়ে এসেছিলেন। রাম-লক্ষ্মণ অন্তরালে যেতেই সীতাকে সরিয়ে দিয়ে বেদবতীকে বসিয়ে রেখেছিলেন আর্যদেবতারা, ‘টোপ’ হিসাবে। আর এসবই ছিল পূর্বপরিকল্পিত।
পুরাণকারদের অবশ্য বাল্মীকির সীতার অগ্নিপরীক্ষার বর্ণনা পছন্দ হয়নি। তাই তাঁরাও আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে অন্য গল্প শুনিয়েছেন। উদ্দেশ্য স্পষ্ট : রামচন্দ্রকে নিষ্কলুষ করা। পদ্মপুরাণে জানকী সীতাও নেই, স্বৰ্গবেশ্যা বেদবতীও নেই। বস্তুত বল্মীকির রামায়ণের যেসব ঘটনাগুলি ব্রাহ্মণ্যবাদী পুরাণকারদের পছন্দ করেননি সেইসব ঘটনাগুলি পুনঃনির্মাণ করেছেন। অনেক ক্ষেত্রেই এমন সব ঘটনা এবং তার ব্যাখ্যা করেছেন, যা বাল্মীকি স্বপ্নেও ভাবতে পারতেন না। তিনি সে সময় বেঁচে থাকলে ঠাটিয়ে চড় কষিয়ে দিতেন। আর পুরাণের সেইসব ঘটনাবলি শিরোধার্য করে বাল্মীকি-পরবর্তী কবিরা কাব্য করেছেন। পদ্মপুরাণে লেখা হয়েছে–অগ্নিপরীক্ষায় যে সীতাকে লেলিহান আগুনে প্রবেশ করতে হয়েছিল, তিনি প্রকৃতই সীতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন ‘মায়াসীতা’ সেই সীতা রামের আদেশ পালনার্থে আগুনে প্রবেশ করেন এবং অদৃশ্য হয়ে যান। বনবাসের আগেই অগ্নিদেবের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, তাঁকে রক্ষা করার জন্য। অগ্নি এক মায়াসীতা নির্মাণ করেন। আসল সীতাকে তিনি রক্ষা করেন। মায়াসীতাকেই রাবণ অপহরণ করেছিলেন। লঙ্কা থেকে ফিরে রামচন্দ্র যে সীতাকে অগ্নিপরীক্ষার নির্দেশ দেন, তিনি মায়াসীতা। তিনি অগ্নি দ্বারা সৃষ্ট। ফলে আগুনে তাঁর কোনো ক্ষতি হতে পারে না। অতএব মায়াসীতা আগুনেই অদৃশ্য হয়ে যায়। পদ্মপুরাণ দাবি করেছে, রামচন্দ্র এসব পূর্বেই জানতেন। তিনি প্রজাদের আবদারে সীতাকে ঠেলে দেননি। অবশ্য রাম যে গর্ভবতী সীতাকে বনবাসে পাঠিয়েছিলেন, তিনি কিন্তু জানকী সীতা।
সীতা, ভরত, লক্ষ্মণ, সুগ্রীব, বিভীষণদের ত্যাগ করে রামচন্দ্র এ সময় প্রায় একা। ক্ষমতা পাওয়ার আগের রাম আর ক্ষমতা পাওয়ার পরের রামের মধ্যে বিস্তর ফাঁক। রাবণ হত্যার পরেই রাম বদলে গেলেন, এ যেন এক অন্য মানুষ। আধুনিক রাজনীতিতেও আমরা লক্ষ করে থাকব–নেতা বা নেত্রীরা বিরোধীতে থাকার সময় এক রূপ, ক্ষমতায় আসার পর সেই নেতা বা নেত্রীদের আর-এক রূপ। কাউকেই আর তোয়াক্কা করেন না তিনি। সংকটকালের সঙ্গীরাও ব্রাত্য হয়ে যায়। যেমন রামের কাছে ব্রাত্য হয়ে যায় লক্ষ্মণ, সুগ্রীব, বিভীষণ, হনুমান, জাম্বুবান প্রমুখেরা। এমনকি সহধর্মিনী সীতাও পর হয়ে যায়। আপন হয়ে যায় একদা শত্রুরা। শত্রুরাও পেয়ে যায় মন্ত্রীসভার গুরু দায়িত্বগুলি। প্রাদেশিক কবিদের হাতযশে এ রামকে আমরা অনেকেই চিনি না।
ভরত যেমন চতুরঙ্গ সৈন্যবাহিনী নিয়ে রামের সাক্ষাতে গিয়েছিলেন, রামও তেমনি অযোধ্যায় ফিরলেন সুগ্রীব, বিভীষণের মতো মিত্র ও বিশাল বানরসেনাদের নিয়ে। অযোধ্যায় একা ফেরা সাহস রামের হচ্ছিল না। তাই সসৈন্যে অযোধ্যায় প্রবেশ করতে হবে। ভরতকে বিশ্বাস নেই। যদিও রাম চিত্রকুট অবস্থানকালে ভরতকে নিশ্চিত করেছিলেন যে, তিনি আর দশরথবিহীন রাজ্য অবোধ্যায় ফিরবেন না। রাম বলেছিলেন–
“এক্ষণে বনবাসকাল অতিক্রান্ত হইলেও আমি আর সেই নিরাশ্রয় বহুনায়ক অযোধ্যায় ফিরব না।”
তখন তো রাম নির্বাসিত, কিন্তু এখন নির্বাসনের সময় উত্তীর্ণ। নানা ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে এই নির্বাসিত চোদ্দো বছরে উপলব্ধি করেছেন, সিংহাসন-রাজত্ব বড়োই প্রয়োজন। এই চোদ্দো বছরে ভরতকে হাড়েহাড়ে চিনেছেন রাম। নির্বাসনের চোদ্দো বছর তো নয়ই, এমনকি নির্বাসন উত্তীর্ণের আট মাস পরও ভরত একবারের জন্য রামের খোঁজ করেননি। রামের অযোধ্যায় ফেরার পর ভরতের আত্মসমর্পণ করার কথা। কিন্তু ভরত ভুলেই গিয়েছিলেন রাম নামে কেউ এ পৃথিবীতে কেউ আছেন। এ ভরতকে কীভাবে বিশ্বাস করা যায়, কীভাবে আস্থা আর ভরসা করা যায়?
যে বিভীষণ ছাড়া সীতা উদ্ধার কার্যত অসম্ভব ছিল, সেই বিভীষণকেও রাম এখন বিশ্বাস করতে পারছেন না। যুদ্ধশেষে বিভীষণ বলেছিলেন–
“যদি আমার প্রতি তোমার স্নেহ ও সৌহার্দ্য থাকে তবে ভ্রাতা লক্ষ্মণ ও জানকীর সহিত বিবিধ ভোগসুখে। একদিন মাত্র এই লঙ্কায় বাস করে। পশ্চাৎ অযোধ্যা যাইও।”
রাম ভ্রূক্ষেপ করেননি। আসলে রাম ভিতরে ভিতরে রাজায় রূপান্তরিত হচ্ছিলেন বোধহয়। তাই তাঁর কাছে। কেউই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। বিভীষণ, সুগ্রীব কেউই বিশ্বস্ত বন্ধু নন। বিভীষণ আর সুগ্রীবের উপকার কাজ মিটে যেতেই ভুলে গেলেন। অতএব সীতা এমন কোনো অমূল্য সম্পদ নয় যে, তার জন্যে বিভীষণ আর সুগ্রীবের কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। বিনিময়ে বিভীষণ লঙ্কারাজ্য পেয়েছেন, মন্দোদরীকেও পেয়েছেন। সুগ্রীব কিষ্কিন্ধ্যা রাজ্য পেয়েছেন, নিজের স্ত্রীর সঙ্গে বালীর স্ত্রীকেও পেয়েছেন। হিসাব বরাবর। উঁহু, হিসাব বরাবর এখনও হয়নি। আসল কাজটাই তো বাকি। অযোধ্যায় এখনও ভরতরাজ চলছে, এমতাবস্থায় রামের পক্ষে একা যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। ভরত ঝাঁপিয়ে পড়তে পরে। তাই এদের প্রয়োজন যতক্ষণ-না মিটছে ততক্ষণ পর্যন্ত মিষ্টি কথায় চিড়ে ভেজাতে হবে। রাম চললেন অযোধ্যায়, এক মুহূর্তও বিলম্ব নয়। বিভীষণকে রথ আনার আদেশ দিলেন। সুসজ্জিত রথে চেপে রাম চললেন অযোধ্যার পথে। সঙ্গী অবশ্যই সসৈন্যে বিভীষণ, সুগ্রীব, হনুমান, রণক্লান্ত রাক্ষসখোক্ষ, বানরসেনাও। লঙ্কা থেকে সুদূর অযোধ্যা। দক্ষিণের শেষপ্রান্ত থেকে উত্তরে। সেকি এমনি এমনি! ভরতকে চমকাতে। একদা ভরতও যে চমকেছিলেন চিত্রকুটে চতুরঙ্গ সৈন্যবাহিনী নিয়ে গিয়ে! প্রথমেই ভরত নয়, পৌঁছোলেন নিকটবর্তী ভরদ্বাজ আশ্রমে। এখানে অবস্থান করে হনুমানকে আদেশ দিলেন, বললেন ভরতের কাছে গিয়ে বলল–
“তুমি অযোধ্যায় গিয়া ভরতকে জানকী, লক্ষ্মণ ও আমার কুশল জানাইয়া কহিও, আমি পূর্ণকাম হইয়াছি। পরে রাবণের সীতাহরণ, সুগ্রীবের সহিত পরিচয়, বালীবধ, সমুদ্র উল্লঙ্ঘন, সীতার অন্বেষণ, সসৈন্য সমুদ্রতীরে গমন, সমুদ্রদর্শন, সেতুনির্মাণ, রাবণবধ; ইন্দ্র ও ব্রহ্মার বরপ্রদান; শঙ্করপ্রসাদে পিতৃসমাগম ও অযোধ্যার নিকট আগমন এই সমস্ত কথা ভরতকে আনুপূর্বিক কহিও।”
রাম আরও বললেন–
“বলিও, রাম শত্রুগণকে পরাজয় ও উৎকৃষ্ট যশোলাভ করিয়া, বিভীষণ, সুগ্রীব ও অন্যান্য মহাবল মিত্রের সহিত আসিতেছেন।”
রাম এও বললেন–
“এই সংবাদ পাইলে ভরতের যেরূপ মুখাকার হয় তাহা এবং আমার প্রতি তাহার কিরূপ মনের ভাব তাহাও জানিও। তিনি কি করিতেছেন এবং তাহার আকার-ইঙ্গিতই-বা কিরূপ ইহা মুখ, বর্ণ, দৃষ্টি ও বাক্যালাপে যথার্থতঃ জানিয়া আইস।”
ভরত সম্বন্ধে রামের এই ভাবনা অমূলক নয়। ভরতের প্রতি রামের ভ্রাতৃপ্রেম এক্কেবারে তলানিতে।
হনুমানের মুখে রামের প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে বিস্তারিত শুনে ভরত অজ্ঞান হয়ে গেলেন। ভরত বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না রাক্ষস-খোক্ষসদের হাত থেকে বেঁচে রাম অযোধ্যায় ফিরতে পারেন। কিছু বিশ্বাস করার আগেই ভরত দেখতে পেলেন দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হয়ে গেছেন রাম, বানর, সুগ্রীব, বিভীষণ সকলে। রাম ভরতের কোনো প্রতিক্রিয়াকেই পাত্তা দিতে চাইলেন না। ভরতও বিচক্ষণ ব্যক্তি। দণ্ডকারণ্য থেকে কেউ ফিরতে পারে না, রাম ফিরেছেন। অতএব বিষয়টা হালকা করে দেখা যায় না। এঁরা মহাপরাক্রান্ত। কালবিলম্ব না-করে অনিচ্ছা সত্ত্বেও অযোধ্যা রাজ্য ফিরিয়ে দিলেন রামকে। রামের অভিষেকের দিন অবশ্য ভরতের আত্মীয়রা উপস্থিতই ছিলেন না। হয়তো নিমন্ত্রিত হননি। তবে সীতার পিতা সীরধ্বজ উপস্থিত ছিলেন।
সে যুগে শাসন-ক্ষমতা নিরঙ্কুশ রাখতে ভাই-ব্রাদার কিচ্ছু না। প্রয়োজনে পিতাকেও হত্যা করা যেত, নৈতিক বৈধতাও ছিল। সেই মর্মে লক্ষ্মণ দশরথকে হত্যার প্রস্তাব দিয়েছিলেন–
“অদ্য মহারাজের প্রভূত্ব নাশ এবং আপনার প্রভূত্ব সংস্থাপন–এই উভয় কারণে আমার অস্ত্রপ্রভাব প্রদর্শিত হইবে। আমি আপনার চিরকিঙ্কর।” “দেবী পশ্যতু মে বীর্যং রাঘবশ্চৈব পশ্যতু৷৷হনিষ্যে পিতরং বৃদ্ধং কৈকেয়াসক্ত মানসম্।/কৃপনং চ স্থিতং বাল্যে বৃদ্ধাভাবে গহির্তম।”
কৌশল্যারও দশরথকে হত্যা করার প্রস্তাবে সমর্থন ছিল। রামকে কৌশল্যা বললেন–
“বৎস! লক্ষ্মণ যাহা কহিল, তুমি তো তাহা শ্রবণ করিলে। এক্ষণে যদি তোমার অভিপ্রেত হয়, তবে ইহার মতাবর্তী হও।”
অসাধারণ বলশালী ও অস্ত্রনিপুণ লক্ষ্মণ এটুকুতেই ছাড়লেন না। তিনি রামকে আরও বললেন–
“আর্য, আপনার এই নির্বাসন-সংবাদ প্রচার না হইতেই আপনি আমার সাহায্যে সমস্ত রাজ্য হস্তগত করুন।”
রাম বিচক্ষণ ব্যক্তি, স্থান-কাল-পাত্রভেদ বিবেচনায় রেখে প্ররোচনায় পা দিলেন না। রাম জানতেন সে শক্তি তাঁর বর্তমানে নেই, যা দিয়ে এই কার্য সমাধা করা সম্ভব। উল্টে প্রাণসংশয় পর্যন্ত হতে পারে। এই মুহূর্তে আওরঙ্গজেবের কথা মনে পড়ছে, যিনি ভাইদের হত্যা করে পিতাকে গারদে চেলে দিয়ে ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করেছিলেন। রাজতন্ত্রের রাজাদের সিংহাসন দখলের রাজনীতি মোটামুটি এইরকমই (আওরঙ্গজেবের তুলনা টানলাম বলে আবার রেগে যাবেন না যেন! তুলনা টানলাম এই কারণে যে, ভারতে রাজতন্ত্রের প্রথম প্রতিনিধি যদি রামচন্দ্র হন তো আওরঙ্গজেব শেষতম রাজতন্ত্রের প্রতিনিধি বলাই যায়)। খারাপ লাগার কিছু নেই। ইতিহাস দিয়েই ইতিহাসর বিচার করা ছাড়া উপায় কী! এটাই রাজতন্ত্রের দস্তুর। রামচন্দ্রও সেই রাজতন্ত্রের লাইনকে বিন্দুমাত্র অন্যথা করেননি।
রামচন্দ্রের অযোধ্যায় ফিরে আসার সংবাদ শুনে ভরত অজ্ঞান হয়ে গেলেন কেন?
(এক) ভরত ভেবেই নিয়েছিলেন রামচন্দ্র কোনোদিনই রাক্ষসখোক্ষসদের হাত থেকে বেঁচে অযোধ্যায় ফিরতে পারবেন না। তা ছাড়া ভরত চিত্রকূটে এলে রামচন্দ্র নিজের মুখেই বলেছিলেন, তিনি আর কোনোদিনই অযোধ্যায় ফিরবেন না। অতএব ভরত নিশ্চিন্তেই ছিলেন। দীর্ঘ চোদ্দো বছরের মধ্যে একবারের জন্য ভরত রামচন্দ্রের খোঁজখবর নেননি, এমনকি চোদ্দো বছর পরও আর প্রায় অতিবাহিত হয়ে গেলেও দাদার খোঁজে ভাই বেরোননি। এতদিন পর রামচন্দ্রের ফিরে আসার যেন ভরতের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়া।
(দুই) মৃত্যুভয়। ভরত প্রয়োজনে রামকে হত্যা করতে হবে এই ভেবে অযোধ্যা থেকে চিত্রকূটে চতুরঙ্গ সৈন্যদল নিয়ে পৌঁছেছিলেন, সে ব্যাপারে ভরত নিশ্চয় সচেতন। অতএব রামও একই পদ্ধতিতে সিংহাসন দখল করতে পারে সেই কথা ভেবেই ভীত-সন্ত্রস্ত। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বলে কথা।
যাই হোক, সদলবলে সৈন্যসামন্ত নিয়ে রাম অযোধ্যায় প্রবেশ করেছিলেন। রামের প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই ভরত সিংহাসন ছেড়ে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। যদিও এমন শর্ত ছিল না যে, রাম বনবাস থেকে ফিরে এলেই রাজ্যলাভ করবেন। ভরত দিলে তবেই রাজ্য পাবেন। তবে প্রতিশোধ তো নিতেই হবে। অতএব বলপ্রয়োগ নয়, বল প্রদর্শনেই রামের কার্যসিদ্ধি হল। কিন্তু রাম এতটুকুতেই খুশি হবেন কেন? রাজার সিংহাসনে কাঁটা থাকলে চলে! ভরতকে নয়, লক্ষ্মণকে রাম যৌবরাজ্যের দায়িত্ব দিতে চাইলেন। বারবার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু লক্ষ্মণ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন রামের অনুরোধ। রামচন্দ্র যদি ভরতের প্রতি আস্থা রাখতে পারতেন, তবে কখনোই লক্ষ্মণকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করতে চাইতেন না। প্রথা অনুযায়ী যুবরাজ পদটির জন্য ভরতই একমাত্র দাবিদার। তা ছাড়া লক্ষ্মণও আর রামের অনুগত নন। সীতাকে দাহ করার পর থেকে রাম-লক্ষ্মণের সম্পর্কে ভাঙন ধরেছিল। সীতাকে আগুনে জ্বালানো লক্ষ্মণ মেনে নিতে পারেননি। তারপর অনেক জল গড়িয়ে গেছে যমুনা দিয়ে। লক্ষ্মণ এখন এক স্বতন্ত্র সত্তা। অগত্যা অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভরতকেই যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। তবে তা সাময়িক, লোক-দেখানো। ভরত কখনোই বিশ্বস্ত নন। যুবরাজ করেছেন বটে, সেইসঙ্গে তাঁকে নজরবন্দিও করে রেখেছেন। অযোধ্যা নগরীর বাইরে পর্যন্ত বেরতে দেননি ভরতকে।
রামচন্দ্র অযোধ্যার উপযুক্ত রাজা। উপযুক্ত রাজার সিংহাসন কখনো কাঁটাযুক্ত হতে পারে না। রাজারা কখনো কাঁটা পছন্দ করেন না। কাঁটা নির্মূল করাটাই রাজার প্রথম কাজ। না-হলে সুষ্ঠুভাবে রাজ্য পরিচালনা সম্ভব নয়। অতএব কাঁটা মুক্ত করার অভিযানে সক্রিয় হতে হবে। নিরঙ্কুশ ক্ষমতাই রাজার মনোবা। প্রথম টার্গেট ভরত, বড়ো কাঁটা। যৌবরাজ্যে অধিষ্ঠিত করার কয়েকদিনের মধ্যেই অযোধ্যা থেকে বহু দূর অন্য একটি ভূখণ্ডের দায়িত্ব অর্পণ করে পাঠিয়ে দিলেন। কূটনীতিতে বালখিল্যতার কোনো জায়গা নেই। রামচন্দ্র সেটা বিলক্ষণ জানতেন। কেকয় রাজ্যের রাজা যুধাজিৎ (ভরতের মামা) কেকয় রাজ্যের পার্শ্ববর্তী গন্ধর্বদের পরাজিত করে গন্ধর্বদেশ অধিকার করতে বললেন। কারণ ওই যুদ্ধ প্রাণঘাতী ছিল, রামের সেটা বুঝতে কোনো অসুবিধা হয়নি। অতএব এমন মরণযুদ্ধে ভরতই শ্রেয়। পাঠিয়ে দিলেন ভরত ও ভরতের দুই পুত্রকে। অযোধ্যা চিরকালের জন্য ভরতমুক্ত হল। এমনিতেই লঙ্কাযুদ্ধের পর রামচন্দ্র আর কোনো যুদ্ধেই অংশগ্রহণ করেননি। যুদ্ধের প্রয়োজন হলে ভরত ও তাঁর শাকরেদ শত্রুঘ্নকে ঠেলে দিয়েছেন। রাজত্বকালের প্রথম বছরেই শত্রুঘ্নকে পাঠিয়ে দিলেন মথুরায় লবণাসুরকে হত্যা করতে৷ অযোধ্যা শত্রম্নমুক্ত হল। ভরতের কাছ থেকে শত্রুঘ্নকে বিচ্ছিন্ন করেও দেওয়া গেল। ভরতের শক্তিক্ষয় হল। ভরত গন্ধর্বদেশ জয় করে ওখানেই থেকে গেলেন এবং শত্রুঘ্নকে মথুরার রাজপদে রাম অভিষিক্ত করে দিলেন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে। সঙ্গে লবণকে হত্যা করার জন্য চার হাজার ঘোড়া, দুই হাজার রথ আর একশো হাতি পাঠিয়ে দিলেন। সেনাদের একমাস আগে পাঠিয়ে দিয়ে শত্রুঘ্নকে একা শরাসন হাতে দিয়ে পাঠালেন। অযোধ্যায় ফিরে আসার কোনো অনুমতি ছিল না শত্ৰুগ্নর। পাছে অযোধ্যা আক্রমণ করে বসে সেই সতর্কতায় কি সৈন্যবাহিনীসহ শত্ৰুগ্নকে অযোধ্যায় অবস্থান করতে দেননি?
এর মধ্যে অবশ্য গর্ভলক্ষণ দেখে সীতাকেও পরিত্যাগ করা হয়ে গেছে গভীর ও শ্বাপদসংকুল জঙ্গলে। পত্নীপ্রেমে পাগল রামচন্দ্রের কাছে সীতা হলেন চক্ষুশূল। বাল্মীকি রামকে বললেন ‘নেত্ররাগী’। লক্ষ্মণকে দিয়েই সীতাকে পরিত্যাগ করার মতো পাপ কাজটি করানো হয়েছিল। লক্ষ্মণ জানতেন না যে, সীতা গর্ভবতী ছিলেন। যখন জানতে পারলেন তখন সীতা গভীর জঙ্গলে পরিত্যক্ত। লক্ষ্মণ বাকরুদ্ধ হলেন।
রামের নজরে রইল বাকি এই লক্ষ্মণ। না না, বাকি থাকবে কেন? ভ্রাতৃবৎসল রামের ভ্রাতৃপ্রেমও উধাও হল। লক্ষ্মণও হলেন চক্ষুশূল। অতএব লক্ষ্মণকেও অযোধ্যায় রাখা যায় না। তিনি নিরাপদ নয় মোটেই। কারণ–লঙ্কাযুদ্ধ-পরবর্তী সময় থেকে লক্ষ্মণ রামের কাজকর্মকে অপছন্দ করেছেন। সীতাকে আগুনে ঠেলে দেওয়ায় বিরক্ত হয়েছেন, সীতাকে পরিত্যাগ করার বিরক্ত প্রকাশ করেছেন, সীতাকে পোড়ানোর জন্য লক্ষ্মণকে চিতা প্রস্তুতের আদেশ দেওয়ার জন্য ক্রোধী হয়েছেন। রামের এইসব গর্হিত কাজ লক্ষ্মণ মন থেকে অনুমোদন করতে পারেননি। এহেন আনুগত্যহীনতায় রামও ক্ষিপ্ত। অতএব এহেন লক্ষ্মণকে পরিত্যাগ করাই শ্রেয়। রাজার কাজে দ্বিমত পোষণ! কিন্তু কীভাবে লক্ষ্মণকে বর্জন করা সম্ভব? লক্ষ্মণের মতো সর্বক্ষণের সঙ্গী ও সহযোদ্ধাকে ত্যাগ করা তো সহজ কথা নয়! লোকে কী বলবে? রাজ্য-সিংহাসন-রাজা হওয়ার লোভও লক্ষ্মণের কখনোই ছিল না। অতএব লক্ষ্মণকে রাজ্য ধরিয়ে অযোধ্যা থেকে সরানো যাবে না। অতএব–মহর্ষি অতিবলের দূত কাল তাপসের বেশে রাজদ্বারে এসে তাঁর নিজের পরিচয় দিলেন এবং দ্বাররক্ষী লক্ষ্মণকে জানালেন তিনি রাজা রামের সঙ্গে একান্তে সাক্ষাতে আগ্রহী। কাল যাতে রামের সঙ্গে একান্তে সাক্ষাৎ করতে পারেন তার সব ব্যবস্থাই করে দিলেন। কে এই অতিবল? কেই-বা অতিবলের দূত কাল? গোটা রামায়ণ, গোটা মহাভারত, সমগ্র পুরাণ তন্নতন্ন করেও এঁদের দেখা মেলে না। শুধু রামায়ণের এই অংশটুকুতেই তাঁদের পরিচয়। উদ্দেশ্য কী? দ্বাররক্ষীর মতো নিকৃষ্ট কাজে কেন লক্ষ্মণকে নিয়োগ করলেন রাজা রাম? অন্য দ্বাররক্ষী তো আগেই ছিল। তাকে কেন অপসারণ করে লক্ষ্মণকে নিয়োগ করা হল? এটা তো মর্যাদাহানি! অকারণে রাজা রাম লক্ষ্মণকে দ্বাররক্ষীর দায়িত্ব দেননি। এই দায়িত্বের মধ্য দিয়েই লক্ষ্মণের যবনিকা পতন সম্ভব। কারণ দ্বাররক্ষীর দায়িত্ব দিয়ে রাম লক্ষ্মণকে এটাও জানিয়ে দিলেন–
“স্বয়ং দ্বারে দণ্ডায়মান থাকো। এই ঋষি ও আমার সঙ্গে নির্জনে যাহা কথাবার্তা হইবে যদি কেহ তাহা দেখে বা শুনে সে আমার বধ্য হইবে।”
কী বুঝলেন পাঠক? লক্ষ্মণ বলিপ্রদত্ত! লক্ষ্মণের পরিণতির ক্ষেত্র প্রস্তুত করাই ছিল। লক্ষ্মণ যখন দ্বাররক্ষীর দায়িত্ব পালন করছিলেন, ঠিক তখনই হাজির সেই ভয়াল ভয়ংকর ক্ৰোধী ব্রাহ্মণ-পুরুষ, তিনি দুর্বাসা। গোটা রামায়ণে তিনি কোথাও নেই, শুধু এইটুকু অংশ ছাড়া। রাজদ্বারে এসে লক্ষ্মণকে দুর্বাসা বললেন–
“তুমি শীঘ্রই রামের সহিত আমার দেখা করাইয়া দাও।”
লক্ষ্মণ জানালেন রাম এখন বিশেষ রাজকার্যে ব্যস্ত আছেন। দেখা করা সম্ভব নয়। একথা শুনে দুর্বাসা স্বভাবদোষে ক্ষিপ্ত হলেন এবং বললেন–
“আমি সবংশে তোমাদের চারভ্রাতার উপর এবং গ্রাম নগর সকলেরই অভিসম্পাত করিব।”
উভয় সংকট–রামরক্ষা না দুর্বাসারক্ষা, দুর্বাসারক্ষা না আত্মরক্ষা! দ্বাররক্ষী হিসাবে তাঁর আত্মরক্ষার কোনো জায়গা নেই। ওটা অনৈতিক, অশাস্ত্রীয়! অতএব স্বেচ্ছায় হাড়িকাঠে গলা বাড়িয়ে দেওয়াই একমাত্র উপায়। রামের অনুমোদন আদায়ের জন্য লক্ষ্মণের প্রবেশ করা মানে মৃত্যুদণ্ডকে বরণ করে নেওয়া। যদি অনুমোদন আদায়ের জন্য লক্ষ্মণ রামের কাছে নাও যান এবং দুর্বাশা যদি রামের সঙ্গে দেখা করতে এসে বিমুখ হয়ে ফিরে যান, তাহলে কি রাম লক্ষ্মণকে ক্ষমাচোখে দেখতেন? উঁহু, ক্ষমাচোখে দেখতেন না। তাহলে দ্বাররক্ষীর শর্ত অত কঠোর ও নিশ্চিদ্র করতেন না, দ্বাররক্ষীর যখন তাঁর প্রাণপ্রিয় ভাই! পৃথিবী খুঁজলে এরকম হাজার সীতা পাওয়া যায়, লক্ষ্মণ তোমার মতো একটিও ভাই পাওয়া যায় না। সেই ভাইয়ের আজ কী পরিণতি! মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও এ যেন বাঘের গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়া! লক্ষ্মণ রামের আলোচনাকক্ষে ঢুকে দুর্বাসার আগমনবার্তা দিলেন রামকে। অতিবলের দূতকে বিদায় দিয়ে দুর্বাসাকে অভিবাদন জানালেন রাজা রাম৷
সত্যাশ্রয়ী রাম। এখন তিনি রাজা। তিনি তো প্রতিজ্ঞাভঙ্গের দোষে দুষ্ট হতে পারেন না। একদা শত্রু বশিষ্ঠও রামচন্দ্রকে মনে করিয়ে দিলেন শাস্ত্রকথা–
“প্রতিজ্ঞাভঙ্গে ধর্মক্ষতি। ধর্ম নষ্ট হলে স্থাবর জঙ্গমাত্মক বিশ্ব নিশ্চয়ই ধ্বংস হইবে।”
প্রজারাই-বা কী বলবেন! অতএব তিনি নিরুপায়। নিজের সত্যপালনের জন্য লক্ষ্মণের হত্যা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে। লক্ষ্মণ রামচন্দ্রের বধ্য। আদতে রাজা রাম সত্যনিষ্ঠ থাকতে পারেননি। লক্ষ্মণকে হত্যা করেননি, বর্জন করলেন। কারণ নিজের ভাইকে হত্যা করলে দুর্নাম হতে পারে। হিতে বিপরীত হতে পারে। তা ছাড়া বশিষ্ঠ যখন ভিন্ন উপায় বাতলেছেন, তখন খামোকা ঝামেলা বাড়ানোর কী দরকার! ব্রাহ্মণ-পুরুষ বশিষ্ঠ নিদান দিয়েছেন–
“আপনার জনের পক্ষে ত্যাগ বা বধ উভয়ই সাধুগণের চক্ষে সমান।”
অতএব আর দেরি কেন! এক্ষণে লক্ষ্মণকে পরিত্যাগ করো। আজীবন অনুচর লক্ষ্মণকে রাজা রাম বর্জন করলেন। এতে লক্ষ্মণ আত্মহত্যা করেন তো অতি উত্তম। সাপও মরল, লাঠিও অক্ষত রইল। রামও জানতেন লক্ষ্মণকে হত্যা না করলেও লক্ষ্মণশূন্য হবে অযোধ্যা। লক্ষ্মণ আত্মহত্যাই করবেন। রামায়ণের কবি বলছেন–
“লক্ষ্মণ সগৃহে আর প্রবেশ না করিয়া জলধারাকুললোচনে প্রস্থান করিলেন এবং সরযূতীরে উপস্থিত আচমনপূর্বক সমস্ত ইন্দ্রিয়দ্বার রুদ্ধ করিলেন। তাহার শ্বাসপ্রশ্বাস আর পড়িল না।”
তবে কি লক্ষ্মণ বিষপান করে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন? সেকালে তো রাজপুরুষদের আংটির মধ্যে মারণবিষ রাখার প্রচলন ছিলই।
সব শেষ। রাজা রামচন্দ্র প্রকৃতই নিরঙ্কুশ, একাকী। রামের রাজত্বে ‘প্রাণপ্রিয় ভাই’ লক্ষ্মণ নেই, ‘অনুরাগী ভাই’ ভরত নেই, ‘সতীসাধ্বী স্ত্রী সীতা নেই–ব্রাহ্মণ পরিবৃত হয়ে রাম সিংহাসন অলংকৃত করে বসে আছেন। উঁহু, তিনি একাকী নন। রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনরা না-থাকলেও, তাঁর চারধার ঘিরে আছেন ব্রাহ্মণকুল। কে নেই রামচন্দ্রের রাজসভায়! যে অগস্ত্যকে রামচন্দ্র কোনোদিন পাত্তা দিতেন না, সেই অগস্ত্যও রামচন্দ্রের। রাজসভা আলোকিত করে বসে আছেন। আলোকিত বসে আছেন বশিষ্ঠ, বামদেব, আঙ্গিরস, কাশ্যপ, ভৃগু, মার্কণ্ডেয়, কাত্যায়ন, কুৎসের মতো অসংখ্য ব্রাহ্মণকুল। গোটা রামায়ণে অগস্ত্য মুনির তেমন উপস্থিতি লক্ষ করা যায় না। রামের অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন হওয়াতেই তিনি আবির্ভাব হয়ে গেছেন। রাজদরবারে পাকাপাকি জায়গা করে নেওয়ার জন্যই। যাতে রাজার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তটা পাকা হয়ে যায়। চোদ্দো বছরের মধ্যে একবারের জন্যও অগস্ত্য মুনি অযোধ্যায় আসেননি ভরতের রাজসভায় স্থান পাওয়ার জন্য। কারণ তিনি জানতেন ভরতের রাজসভায় এসে তেমন সুবিধা করতে পারতেন না। ভরত অত সহজ সরল নন। তিনি জানতেন ভরতকে বশ করার মতো কোনো উপায় তাঁর জানা নেই। কিন্তু রামকে বশ করার মতো হাজার উপায় আছে। সেই কাজটাই শুরু দিলেন মুনি অগস্ত্য। কাজটা অবশ্যই আপ্ত-সহায়ক বা স্তাবকের। অর্থাৎ রাজা রাম ঠিক কতটা বীর তারই ফোলানো-ফাঁপানো গল্প। বলতে থাকলেন তাঁরা কত বড়ো বীর ছিলেন, সেই শত্রুপক্ষকে করেন যিনি হত্যা করেছেন সে তো ততধিক বীর। এমন বীরদের তিনি হত্যা করেছেন, পরাস্ত করেছেন, পর্যদস্ত যে তাঁকে দেবতারাও কাবু করতে পারেননি। যে কাজ দেবতারাও পারেন না, সেই কাজ রাম পেরেছেন। অতএব রাম বীরশ্রেষ্ঠ। লঙ্কাকাণ্ডে রাবণ প্রায় এলিতেলিই ছিল। সুগ্রীবের রাজশক্তির প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় রাবণবধ রামের গরিমা তেমন উজ্জ্বল হয় না। এমন মানুষকে মেরে রাজার বীরত্ব প্রকাশ পায় না। তাই উত্তরকাণ্ডে এসে অগস্ত্য বলতে থাকলেন রাবণের পূর্বজন্ম, রাবণ কীভাবে ক্রমশ ভয়াল-ভয়ংকর হয়ে উঠতে থাকল। এই পূর্বজন্ম বর্ণনার মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব হল রাবণ কতটা ভয়ংকর এবং অবধ্য ছিল। শুধু রাবণ বা রাবণের বংশপরিচয় নয়, একই সঙ্গে বানরদেরও পূর্বজন্মের কাহিনি শোনানো হল রামকে। এখানেই শেষ হয় না–মুনিঋষিরা রামচন্দ্রকে নারায়ণ, বিষ্ণু পর্যন্ত বলতে থাকলেন। নিজের প্রশংসা শুনতে কার না ভালো লাগে। পারিষদবর্গ, অগস্ত্য ও অন্যান্য মুনিরা ঢাক পিটাচ্ছেন, আর রাজা রাম নিষ্ঠাভরে শুনছেন। রাজার গুণগান করে রাজাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে কিছু প্রাপ্তির আশা করার মতো মানুষ প্রাচীন যুগেও ছিল, আজও আছে।
যে বশিষ্ঠের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সক্রিয়তায় রামকে বনবাসে গিয়ে অশেষ দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিল, জীবন বাজি রাখতে হয়েছিল, যে রামচন্দ্র বিশ্বামিত্রের সান্নিধ্যে ব্রাহ্মণদের একাধিপত্যের বিরোধী ছিলেন–সেই বশিষ্ঠই এখন রামের সবচেয়ে কাছের মানুষ, প্রধান উপদেষ্টা। এ সেই বশিষ্ঠ, যিনি তাঁর ব্রাহ্মণ সেনাপতিদের রাজপুরিতে প্রবেশ ঘটিয়ে দশরথকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন, যেদিন রামের রাজপদে অভিষেক হওয়ার কথা। বশিষ্ঠ রামের জমানাতেও মন্ত্রী, পুরোহিত এবং কুলগুরু। রামচন্দ্র বিলক্ষণ জানেন, বশিষ্ঠ অতীব শক্তিধর। তাঁকে অবজ্ঞা করলে ফল ভালো হবে না। নিজের সিংহাসন বাঁচানোও সম্ভব হবে না। অবস্থাভিজ্ঞ রাম বুঝেছিলেন কালোপযযাগিতা ও উদ্দেশ্যসিদ্ধিই একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। বশিষ্ঠের বিরোধিতা মানে নিজের পায়ে নিজেই কুড়োল মারা। অতএব ব্রাহ্মণদের দাসত্ব স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। সেই ব্রাহ্মণদের সংস্পর্শে ও সহাবস্থানে রাজা রাম ব্রাহ্মণ্যবাদের পূজারী হয়ে গেলেন, হলেন চতুর্বর্ণের ধারক ও বাহক।
রামচন্দ্রের এই পরিবর্তনের প্রভাব উত্তরকাণ্ডের কবির লেখনীতে। যেখানে ব্রাহ্মণদের মঙ্গলার্থে শম্বুকের গলা কেটে হত্যা করলেন রাম। রামচন্দ্রের খুনি হাত দিয়ে ব্রাহ্মণ্যধর্মের নব-অভ্যুত্থান হল। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া গেল ব্রাহ্মণদের টক্কর দিলে শম্বুকদের এই দশাই হবে। এটাই উত্তরকাণ্ডের শিক্ষা। শম্বুকরা আজও অবনত হয়েই রইলেন। সে যুগের মানুষরা অস্পৃশ্য শূদ্রদের চুমো খেতেন এটা কেউ আগুন ছুঁয়ে বললেও বিশ্বাসযোগ্য হয় না। রামও ব্যতিক্রম নন। চতুবর্ণ সৃষ্টিকারী ব্রাহ্মণগণ এই বিভাজনে সদা ব্যস্ত ছিলেন। সে যুগেও, এ যুগেও।
শম্বুককে রাম হত্যা করেছিলেন এক ব্রাহ্মণের অকাল মৃত পুত্রকে বাঁচাতে। অতএব ব্রাহ্মণ-পুত্র অপেক্ষা শূদ্র পুত্রের জীবনের দাম কানাকড়ি–এ কাহিনি পাওয়া যায় রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে রামের সঙ্গে চণ্ডালের বন্ধুত্ব কেবল কথায়, প্রয়োগে নয়। যে ফল-জল ব্রাহ্মণ-ঋষিদের কাছ থেকে গ্রহণ করা যায়, তা একজন অস্পৃশ্য চণ্ডালের কাছ থেকে গ্রহণ করা যায় না। তাই শূদ্রের সন্তান শম্বুক তপস্বী কৃচ্ছসাধনের অপরাধে তাঁর মুণ্ডুখানি এক কোপে নামিয়ে দেওয়া যেতেই পারে। সে আবার এমন কী! শূদ্রের জীবনের মূল্য আর ব্রাহ্মণের জীবনের মূল্য তো এক হতে পারে না! ব্রাহ্মণ্যবাদের সমর্থক ব্রাহ্মণদের প্ররোচনায় শূদ্র হত্যা করে নিজেকে কলঙ্কিত করেছেন রাম রাম যে সময় শম্বুককে হত্যা করছেন, সে সময় রামের রাজসভা তাবড়তাবড় ব্রাহ্মণদের রমরমা অবস্থা। রামও সে সময় ব্রাহ্মণদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিলেন।
রামায়ণের যুগে শূদ্র-নির্যাতন তেমনভাবে না-হলেও মহাভারত-পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় শূদ্রদের ক্রমশ ঘৃণার যোগ্য করে তুলেছিলেন। সেই বিষ আজও সেবন করে চলেছেন মানুষ। তবে কেউ কেউ বলতেই পারেন ভালো কাজ করলে শূদ্রও ব্রাহ্মণ হতে পারে। কীভাবে হবে? নিয়ম আর প্রয়োগে যে যোজন-দূর পার্থক্য। ব্রাহ্মণ হতে চাইলেই শূদ্রের ব্রাহ্মণ হওয়া সম্ভব! সম্ভব নয়, তাই চুনি কোটালদের মরতে হয়। সম্ভব নয়, তাই রোহিত ভেমুলাদের আত্মহত্যা করতে হয়। পৌরাণিক যুগ হলে বলা হত চুনি কোটাল, রোহিত ভেমুলারা পূর্বজন্মে দেবতা বা গন্ধর্ব বা কিন্নর-কিন্নরী ছিলেন–এই জন্মে ব্রাহ্মণ্যবাদের স্পর্শ পেয়ে মুক্তি লাভ করে স্বর্গে গেছেন।পৌরাণিক যুগে সব গল্পেই অনার্যদের হত্যা করার পিছনে এরকম মুক্তির গল্প আছে। বিরাধ, শূর্পণখা, মারীচ, বালী, মেঘনাথ, রাবণ সকলেই পূর্বজন্মে হয় দেবতা, নয় গন্ধর্ব ছিলেন। যেমন বিরাধ ছিলেন গন্ধর্ব। গন্ধর্বজীবনে তাঁর নাম ছিল তুম্বুক। কুবেরের অভিশাপেই নাকি তাঁর এই অনার্যজীবন, নাম হয় বিরাধ। রাম বধ করলেই নাকি তিনি গন্ধর্বজীবন ফিরে পাবেন।
গন্ধর্বরা কোথায় থাকতেন? স্বর্গে? কোথায় সেই স্বর্গ? কাবুলের উপত্যকাই গন্ধর্বদেশ–হিন্দুকুশ পর্বতের দক্ষিণে জালালাবাদ, কান্দাহার, পাঞ্জাব ও কাশ্মীরের কিছুটা অংশ। আর্যদের প্রবেশ ঘটেছিল এই অঞ্চল দিয়েই। তাঁরাই অনার্য বিতারিত করেছিল দাক্ষিণাত্যের শ্বাপদসংকুল গভীর জঙ্গলে। বিরাধের সঙ্গে রামের মুখোমুখি হয় দণ্ডকারণ্যে। দণ্ডকারণ্য দাক্ষিণাত্যের পূর্বভাগ। এই মুড়িমুড়কির মতো অন্যায়ভাবে অনার্য হত্যা কাবোর কারোর মনে পুলক আনলেও, ধর্মভাবের উদয় হলেও–আমার হয় না। বাল্মীকি নিজে অনার্যদের প্রতিনিধি হয়েও আর্যদের পৃষ্ঠপোষকতায় আর্যদেরই ঢাক পিটিয়ে গেছেন। পৃষ্ঠপোষকতায় এমনই বাধ্যবাধকতা। সেটাই স্বাভাবিক। যাঁর নুন খাবে তাঁর গুণ তো গাইতেই হবে। আর সেইজন্যই বাল্মীকির রামায়ণ নয়, অন্য রামায়ণের এত কদর, আর সেইজন্যেই রামায়ণকে ঘিরে এত ইমোশন ব্রাহ্মণ্যবাদীদের। সেসব রামায়ণে রাম কেবলই ভগবান, শমিত্র সকলেই রামের ভক্ত। সকলেই রামের হাতে মরে উদ্ধার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করে আছেন। অন্য রামায়ণগুলিতে রাম যে বিষ্ণুর অংশ! এত বছর পরেও তাই রামকে ঘিরে দাঙ্গা। রাম-গ্রহণ রাম বর্জনের লড়াই জারি আছে। রামায়ণ’ যদি অনার্যদের জয়ের ইতিহাস হত, তাহলে এই গ্রন্থ আঁতুরঘরেই বিনাশ করা হত।
ঈশ্বরের চোখে যদি সবাই সমান হত তাহলে তিনি ব্রাহ্মণদের মাথা থেকে আর শুদ্রদের পা থেকে তৈরি করতেন না, কী বলেন? আর মনুসংহিতায় তো বর্ণভেদ আছে ছত্রে ছত্রেই। যেমন, মনু বলেছেন–
“দাসত্বের কাজ নির্বাহ করার জন্যই বিধাতা শূদ্রদের সৃষ্টি করেছিলেন” (৮ : ৪১৩)।
এমন কী হিন্দুধর্মের দৃষ্টিতে শূদ্রদের উপার্জিত ধনসম্পত্তি তাদের ভোগেরও অধিকার নেই। সব উপার্জিত ধন দাস-মালিকেরাই গ্রহণ করবে–এই ছিল মনুর বিধান–
“ন হি তস্যাস্তি কিঞ্চিত স্বং ভর্তৃহার্যধনো হি সঃ” (৮ : ৪১৬)।
এ ধরনের শত শত বর্ণবিদ্বেষী শ্লোক হিন্দু ধর্মগ্রন্থে ছড়িয়ে আছে। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণেও। মহাভারতের কৃষ্ণ যেমন জাত-বিভাজন সমর্থন করতেন, রামায়ণের রামও একই পথে হেঁটেছেন। অবশ্য রামায়ণ মহাভারতেরও অনেক আগের রচনা। মর্যাদা পুরুষোত্তম’, পুরুষের উৎকর্ষের সীমায় উন্নীত রাম এ কেমন পুরুষ! উত্তরকাণ্ডে শম্বুক হত্যায় যে স্বর্গের দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করেছিলেন! কেবল পুষ্পবৃষ্টিতেই থেমে থাকেননি দেবতারা, রামকে সাধুবাদ দিয়ে বলেছেন–
“রাম তুমি দেবতাদের কার্য সম্পন্ন করলে। তোমারই জন্য এই শূদ্রটি স্বর্গভাক হতে পারল না।”
এই আহ্লাদে রাম যে সারা পৃথিবী শূদ্রহীন করতে অভিযানে নামেননি, এই রক্ষে! শূদ্র হত্যায় দেবতারা সকলেই তো রামেরই দলে। এমনিতেই শূদ্রের স্থান স্বর্গ তো দূরের কথা, মর্তেও নেই। নিষাধ জাতি গুহক নাকি রামের বন্ধু, বন্ধুর আতিথ্য কি প্রত্যাখ্যান করা যায়? রাম পেরেছেন। বনবাসের প্রথম পর্বেই রাম প্রত্যাখ্যান করেছিলেন বন্ধু গুহকের আতিথ্য। যুক্তি হিসাবে রাম বলেছিলেন–তাঁরা বনবাসী, খাদ্য গ্রহণ করবেন না। বরং রথের ঘোড়াদের খাদ্য দিলেই উপকার হয়। বনবাসের ১৪ বছর রাম-লক্ষ্মণরা এক্কেবারে নির্জলা উপবাসে কাটিয়েছিলেন, এমন গল্পো কিন্তু নেই। বরং পরবর্তী সময়ে অত্রি, অনসূয়া, ভরদ্বাজ এবং অন্যান্য মুনিঋষিদের আতিথ্য গ্রহণ করতে তাঁদের আপত্তি ছিল না। মুনিঋষিদের আতিথ্য অবশ্যই গ্রহণ করা যায়, তাই বলে চণ্ডালের ঘরে ‘পুরুষোত্তম’! তবে আমি মনে করি এই শম্বুক হত্যার কাহিনি মুনিবর বাল্মীকি রচনা করেননি। এটি কোনো দুষ্ট ব্রাহ্মণ কর্তৃক প্রক্ষিপ্ত প্রবেশের সম্ভাবনা প্রবল। অনেকে মনে করেন বাল্মীকি নিজেও একজন অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষ। তিনি নিজগুণে ব্রাহ্মণত্ব লাভ করে মহাকবি হয়েছেন। যোগ্যতম না-হলে দেবমন্ত্রী ব্ৰহ্মার আদেশে দেবর্ষি নারদ কখনোই বাল্মীকিকে দিয়ে রামকাহিনি রচনা করাতেন না।
গোটা রামায়ণের circumstances বিচার করলে রাম বা বাল্মীকি কারোরই এ ধরনের আচরণ মানানসই হয় না। তা ছাড়া রামচন্দ্রের পিতা দশরথের যে ৩৫০ পুরস্ত্রীর কথা মুনিবর বাল্মীকি জানিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে বেশ কিছু পুরস্ত্রী শূদ্রই ছিলেন। অন্তঃপুরের শূদ্র মাতাদের সঙ্গে সহাবস্থানে থাকা রামের নিশ্চয় শূদ্রদের প্রতি ঘৃণা জন্মানোর কথা নয়। মানুষ যে পরিবেশে বেড়ে ওঠে সেই পরিবেশ থেকেই সে শিক্ষিত হয়, দীক্ষিত হয়। এমনকি বিশ্বামিত্র রামচন্দ্রের শিক্ষাগুরু, ব্রাহ্মণবিরোধী এমন গুরুর কাছ থেকে শ্রীরামের এমন শিক্ষা হতেই পারে না। নিজেরা ব্রহ্মার মুখ থেকে জন্ম নিয়েছেন বলে প্রচার করে হাঁটু থেকে জন্ম নেওয়া শূদ্রদের ঘৃণা করতেন ব্রাহ্মণরাই, ক্ষত্রিয়রা নন।
শম্বুকহত্যার কাহিনির মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মণ গোষ্ঠীকে মহিমান্বিত করার জন্যই কোনো ব্যক্তি পরবর্তীকালে সংযোজন করেছেন, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। শূদ্র যে বধযোগ্য সেটা প্রতিষ্ঠা করতেই এই কাহিনির অবতারণা, একথা স্পষ্ট হয়। একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে রাম মনুর (বৈবস্বাত) বংশধর। তাই মনুর পথই রামের পথ–এর মধ্যে অস্বাভাবিকতার কী আছে! রাম সূর্যবংশের (ইক্ষ্বাকুবংশ বলেও পরিচিত) উত্তরপুরষ। সূর্যবংশীয় প্রথম রাজা বৈবস্বত মনু। মনুর পুত্র ইক্ষ্বাকু। ইক্ষ্বাকুর জন্ম হয়েছে মনুর নাকের ভিতর থেকে! সে নাক থেকে নিক বা অন্য কথাও থেকে, মনুই জন্ম দিক বা মনুর বউ–ইক্ষ্বাকুর জন্ম হয়েছিল। সেই ইক্ষ্বাকু বংশ-তালিকা হল, যথাক্রমে–(১) ইক্ষ্বাকু (২) কুক্ষি (৩) বিকুক্ষি (৪) বাণ (৫) অনরণ্য (৬) পৃথু (৭) ত্ৰিশংকু (৮) ধুন্ধুমার (৯) যুবনাশ্ব (১০) মান্ধাতা (১১) সুসন্ধি (১২) ধ্রুবসন্ধি (এঁর এক ভাই ছিলেন, তার নাম প্রসেনজিৎ) (১৩) ভরত (১৪) অসিত (১৫) সগর (১৬) অসমঞ্জ (১৭) অংশুমান (১৮) দিলীপ (১৯) ভগীরথ (২০) ককুৎস্থ (২১) রঘু (২২) কল্মষপাদ (১৩) শঙ্খণ (২৪) সুদর্শন (২৫) অগ্নিবর্ণ (২৬) শীঘ্রগ (২৭) মরু (২৮) প্রশুশ্রুক (২৯) অম্বরীষ (৩০) নহুষ (৩১) যযাতি (৩২) নাভাগ (৩৩) অজ (৩৪) দশরথ (৩৫) রাম এবং লক্ষ্মণ। লক্ষণীয় যে এক্ষেত্রে ভরত ও শত্রুঘ্নর কোনো উল্লেখ নেই। ইক্ষ্বাকুর জন্মদাতা মনু, মনুর পিতা সূর্য। অতএব রাম যে মনুবাদের ধারক ও বাহক হবেন, এ আবার নতুন কথা কী! এ তো পরম্পরা!!
রাম সীতাকে বিসর্জন দিয়ে নিজেও বিসর্জিত হয়েছিলেন সরযূ নদীর জলে। রামের বয়স তখন কত হয়েছিল সে বিষয়ে রামায়ণে স্পষ্ট কোনো উল্লেখ নেই। থাকার কথাও নয়, কারণ রাম সিংহাসনে থাকাকালীনই কবিবর বাল্মীকি রামায়ণ রচনা করেছিলেন। রাম না-জন্মাতেই রামায়ণ লেখেননি বাল্মীকি! বাল্মীকি প্রত্যক্ষদর্শী। রাম ও বাল্মীকি উভয়ই সমসাময়িক। রামায়ণ যে রামের জন্মের আগেই লিখিত হয়েছিল তার কোনো আভাস কোথাও পাওয়া যায় না। এটি একটি ভিত্তিহীন উড়ো কথা। বরং বলা যায়, রামায়ণ বাল্মীকির সমসাময়িক ঘটনার চিত্র নিয়েই হয়েছিল। বাল্মীকি যে রামের সমসাময়িক ঋষিকবি, তা রামায়ণের অন্য স্থানে স্বীকৃত আছে। রামের সঙ্গে বাল্মীকির সাক্ষাৎও হয়েছে। বাল্মীকি লঙ্কাকাণ্ডে রামায়ণ সমাপ্ত করেছিলেন, রামের অনুরোধে বাল্মীকি উত্তরকাণ্ড লিখতে শুরু করেন বলে অনেক পণ্ডিত মনে করেন। তবে বর্তমানে যে কলেবরে আমরা উত্তরকাণ্ডকে পাই, সেই উত্তরকাণ্ড বাল্মীকির নয়। অতএব রাম জন্মানোর অনেক অনেক পরেই রামায়ণ রচিত হয়েছে।
আগেই বলেছি, রামকথা বহু আগে থেকেই মানুষের মুখে মুখে ফিরত, বর্ধিত হতে হতে বাল্মীকির কাছে লিপিবদ্ধ হয়েছে। বস্তুত পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এত বড়ো রচনা এই যুগে প্রায় অসম্ভব, সেই যুগে তো কল্পনাই করা যায়। কিন্তু রামায়ণ রচনায় পৃষ্ঠপোষক কারা ছিল, সেইটা বের করা কিন্তু খুবই জটিল কাজ। প্রাচীন যুগে বেশির ভাগ সাহিত্য বা কাব্যচর্চা রাজা-সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই সৃষ্টি হত। এইসব মহান কবি রাজসভা অলংকৃত করে রাখত। বাল্মীকিও হয়তো রামের রাজসভায় কবি ছিলেন। এটা আমার নিরীক্ষণ, বাল্মীকির রামায়ণে বা অন্য কোথাও এমন তথ্য পাইনি। তবে রামজীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিতে বাল্মীকি কার্পণ্য করেননি। অনার্য রাবণকে রাক্ষস, মানুষখেকো ইত্যাদি বানাতে ‘রাজকবি’ কার্পণ্য করেননি। বাল্মীকি নয়, অন্যান্য কবিয়া রামকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী করেছেন। তাই তাঁরা একজন এলিতেলি লোককে পরাজিত করলে তো রাম হয় না, তাই প্রতিপক্ষকেও বিরাট করে নির্মাণ করতে হয়। তাই রাবণের দশমাথা কুড়ি হাত ইত্যাদিও বলতে হয়। বাল্মীকির রাবণের মাথা একটাই, হাত দুটোই। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দ্বন্দ্ব থেকে রাম-রাবণকে দেখা হয়েছে। তাই কেউ কেউ মনে করেন হতে পারে কোনো বৈষ্ণব রাজা, যে কৃষ্ণ ঘরানার বৈষ্ণব থেকে আলাদা একটা বৈষ্ণব ঘরানা খুঁজছিল (যদিও এখন রাম আর কৃষ্ণ দুইজনেই একই বৈষ্ণব ঘরানার অবতার)। শাস্ত্ৰ-পুরাণগুলি লক্ষ করলেই বোঝা যায়, এগুলি ব্যাপক চালাচালি হয়েছে সমসাময়িক উদ্ভূত পরিস্থিতিতে। রাম আর কৃষ্ণের ঘরানা নিয়ে যখন দ্বন্দ্ব, তখন বিষ্ণুর দশাবতারে রাম ও কৃষ্ণ দুজনেই উপস্থিত। অর্থাৎ যাহা রাম তাহাই কৃষ্ণ–একজনই, তিনি বিষ্ণু যখন বৈদিক ধর্ম আর বৌদ্ধধর্মে সংঘাত চরমে, তখনও বিষ্ণুর দশাবতারে বুদ্ধদেবের প্রবেশ ঘটল। অর্থাৎ যাহাই বৈদিক ধর্ম, তাহাই বৌদ্ধধর্ম!
রাম কি ‘ভগবান’ কিংবা লর্ড কিংবা ‘দেবতা কিংবা ‘ঈশ্বর’ ছিলেন? বাল্মীকির রাম কিন্তু মানুষই, ভগবান নন। রাম ভগবান হলে যুদ্ধক্ষেত্রে এভাবে অসহায় হয়ে পড়তেন না। রামের হয়ে অন্য কেউ যুদ্ধ করে দিতেন না। ভয়ে ভীত হয়ে রণক্ষেত্রে আত্মগোপন করে থাকতে হত না। বাল্মীকির রাম যদি ভগবান হতেন, তাহলে সীতার উদ্দেশে রামের মুখ দিয়ে একাধিকবার অশ্রাব্য বাক্য বের করাতেন না। পিতা দশরথের প্রতি কটুক্তি করাতেন না। পিতার উদ্দেশে লক্ষ্মণ যেমন কটুক্তি করেছেন, তেমনি রামও করেছেন। ভগবানের মুখে অশ্রাব্য ভাষা সামঞ্জস্য নয়। এখানেই শেষ নয়, সীতার মুখ দিয়ে সীতার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা এবং রাবণের
মুখ দিয়ে সীতার শরীরের বর্ণনাও ভগবানোচিত নয়। বাল্মীকির রামায়ণের বালকাণ্ডে ও উত্তরকাণ্ডে (অনেক গবেষক মনে করেন বালকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ড বাল্মীকির রচনা নয়, প্রক্ষিপ্ত) রামকে বিষ্ণুর অবতার’ বলে উল্লেখ করলেও, কবিবর বাল্মীকি স্বয়ং গোটা রামায়ণে (অযোধ্যাকাণ্ড থেকে লঙ্কাকাণ্ড) কোথাও রামকে ‘ভগবান’ বা ‘ভগবানের অংশ’ বা ‘অবতার’ বলেননি। অথচ উত্তরকাণ্ডের কবি রামচন্দ্রকে নারায়ণ, বিষ্ণু বলে সম্বোধন করেছেন।
“রামায়ণ কোনো ধর্মগ্রন্থ নয়”–একথা পণ্ডিত নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন। অতএব ধর্মগ্রন্থ। যখন নয়, তখন দেবদেবতাও প্রাসঙ্গিক নয়। যদি বালকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ডে রামায়ণের সকল চরিত্রে দেবত্ব আরোপ না হত, তাহলে রামায়ণকে কে মনে রাখত? অবশ্য রামায়ণের চরিত্রগুলিতে চরমভাবে দেবত্ব আরোপ হয়েছে কৃত্তিবাস, তুলসীদাস, রঙ্গনাথন, দিবাকর ভট্ট প্রমুখের হাত ধরেই।
মূল কাণ্ডপঞ্চকে বাল্মীকি রামচন্দ্রকে ‘নরশ্রেষ্ঠ’ বা ‘নরচন্দ্রমা’-র অতিরিক্ত মর্যাদা দেননি৷ মহর্ষি নারদ বাল্মীকিকে মহাকাব্য রচনা করতে বললে বাল্মীকি সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “দেবর্ষে, এক্ষণে এই পৃথিবীতে কোন্ ব্যক্তি গুণবান, বিদ্বান, মহাবল পরাক্রান্ত, মহাত্মা, ধর্মপরায়ণ, সত্যবাদী, কৃতজ্ঞ, দৃঢ়ত ও সচ্চরিত্র আছেন? কোন্ ব্যক্তি সকল প্রাণীর হিতসাধন করিয়া থাকেন? কোন্ ব্যক্তি লোকব্যবহারকুশল, অদ্বিতীয়, সচতুর ও প্রিয়দর্শন? কোন ব্যক্তিই-বা রোষ ও অসূয়ার বশবর্তী নহেন? রণস্থলে জাতক্রোধ হইলে কাহাকে দেখিয়া দেবতারাও ভীত হন? হে তপোধন! এইরূপ গুণসম্পন্ন মনুষ্য কে আছেন, তাহা আপনিই বিলক্ষণ জানেনে। এক্ষণে বলুন, ইহা শ্রবণ করিতে আমার একান্ত কৌতূহল উপস্থিত হইয়াছে।” ত্রিকালদর্শী নারদ বাল্মীকির কৌতূহলে যারপরনাই পুলকিত হলেন এবং বললেন–
“তাপস! তুমি যে সমস্ত গুণের কথা উল্লেখ করিলে তৎসমুদয় সামান্য মনুষ্যে নিতান্ত সুলভ নহে। যাহাই হউক, এইরূপ গুণবান মনুষ্য এই পৃথিবীতে কে আছেন, এক্ষণে আমি তাহা স্মরণ করিয়া কহিতেছি, শ্রবণ করো।”
এই বলে মহর্ষি নারদ ইক্ষ্বাকুবংশীয় এক নরপতি রামের বিবরণ শোনাতে থাকলেন। অতএব বাল্মীকির রামায়ণ এক অনন্যসাধারণ মানুষের রাজকাহিনি, এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত থাকার কথা নয়। তাই বিতর্কেরও কোনো অবকাশ নেই। ‘রসজলনিধি’ গ্রন্থের রচয়িতা ভূদেব মুখোপাধ্যায় বলেছেন–শোনা যায়, ত্রেতাযুগে শ্রীরামচন্দ্র বনবাসকালে কালনাথ নামে মহর্ষির কাছে রসবিদ্যা শিক্ষা করে রামরাজীয়’ ও ‘রমেন্দ্রচিন্তামণি’ দু খানি গ্রন্থও লিখেছেন। গ্রন্থাদি তো মানুষই রচনা করে, তথাকথিত অলৌকিক অশরীরি দেবতারা নিশ্চয়ই নয়।
ভারতীয় পুরাণে তিনজন রামকে আমরা পাই। যেমন–পরশুরাম, রাম ও বলরাম। পরশুরাম কুঠারধারী, রাম ধনুর্ধারী এবং বলরাম লাঙ্গলধারী। ত্রেতাযুগের রামায়ণে পরশুরাম চরিত্রটি পাওয়া গেলেও বলরামকে পাওয়া যায় না। কারণ বলরাম চরিত্রটি দ্বাপরযুগের মহাভারতে পাওয়া যায়, যিনি কৃষ্ণের বৈমাত্রেয় বড়ো ভাই। পরশুরামকে রামের পূর্ববর্তী বলে ভাবা যেতে পারে। পরবর্তীকালে পুরাণ রচয়িতারা এবং জয়দেব এই তিনজন রামকেই বিষ্ণুর দশাবতারের তিন অবতার বলে বর্ণনা করেছেন। গবেষকগণ বলছেন পরশুরাম, রাম, বলরামকে বিবর্তনের ধারা হিসাবে দেখলে পরশুরাম ছিলেন কুঠারধারী, তিনি মানব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। এ সময় মানুষ কৃষিকাজ জানতেন না। কাঠ কাটার যুগ, অর্থাৎ কুঠারের সাহায্যে কাঠ কাটত এবং কাঠে আগুন সংযোগ করত। বন্যপ্রাণী দ্বারা আক্রান্ত হলে এই কুঠারের সাহায্যে আঘাত হেনে আত্মরক্ষা করত। মানবসভ্যতার এটাই কি প্রাথমিক স্তর? অপরদিকে রামচন্দ্র ধনুর্ধারী ছিলেন। এ যুগে মানুষ প্রস্তরখণ্ড, বৃক্ষ, কাঠ, কুঠার ত্যাগ করে তীর-ধনুক হাতে তুলে নিয়েছেন। তীর-ধনুকের মধ্য দিয়ে মানুষের হাতে এল আয়ুধ, আয়ুধ মানে যুদ্ধাস্ত্র। তীর-ধনুক কেবল আত্মরক্ষার হাতিয়ার নয়, আক্রমণেরও হাতিয়ার। বলরাম হল বা লাঙ্গলধারী, ইনি কৃষিকাজের প্রতীক। অর্থাৎ এ সময় মানুষ কৃষিকাজ আয়ত্ত করেছে ধরে নেওয়া যায়। প্রতীকি অর্থে এই বিশ্লেষণে যথেষ্ট অর্থে বহন করে বইকি!
যাই হোক, ‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম’–সেকালে রাজাই ছিলেন সব অগতির গতি, ত্রাতা। সেই কারণেই হয়তো রাজা ‘পতিতপাবন হে ভগবান’। প্রাচীনকালে রাজাদের ভগবান বা ভগবান তুল্য ভাবা হত বা মান্য করা হত। ‘মনুসংহিতা’ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে মনু খুব উঁচুতে রেখেছেন ক্ষত্রিয় বা শাসক বা রাজাকে এবং ব্রাহ্মণদের। ঋষিবর মনু রাজাদের দেবতা বা ভগবান কেমনভাবে ভাবিয়েছেন সেটা দেখে নিতে পারি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যাঁরা ছাত্র তাঁরা জানেন রাষ্ট্রর উৎপত্তির বিষয়ে ঐশ্বরিক মতবাদ। যাঁরা জানেন না তাঁদের জন্য বিষয়টি পুনরায় উল্লেখ করলে অত্যুক্তি হবে না বোধকরি। প্রাচীনকালে রাষ্ট্রের ঐশ্বরিক মতবাদ বহুল প্রচলিত ছিল। মধ্যযুগে সেন্ট অগাস্টাইন, সেন্ট পল, সেন্ট টমাস অ্যাকুইনাসের লেখনীতে এই মতবাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে ১৬৮৮ সালের ইংল্যান্ডের গৌরবময় বিপ্লবের পর থেকে এই মতবাদের গুরুত্ব হ্রাস পেতে শুরু করে। ঐশ্বরিক মতবাদের মূল বক্তব্য ছিল–
(১) রাষ্ট্র ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন। এই সৃষ্টির পিছনে মানুষের কোনো ভূমিকা নেই।
(২) রাজা হলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি। তাই ঈশ্বরের ইচ্ছা রাজার মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হয়। সেইজন্য রাজার আদেশ বা নির্দেশ, যা আইনরূপে গণ্য হয়ে থাকে, তা মান্য করা সকল মানুষের একান্ত কর্তব্য। রাজার আইন মান্য না-করার অর্থ হল ঈশ্বরকে অবমাননা করা।
(৩) ঈশ্বরের বিধান অনুসারে রাজপদ উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করা যায়। রাজার মৃত্যু হলে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজা হবেন।
(৪) রাজা যেহেতু ঈশ্বরের প্রতিনিধি সেইহেতু তিনি কখনোই অন্যায় করতে পারেন না। ঈশ্বর ছাড়া তিনি আর কারও কাছে তাঁর কাজের জন্য জবাব দিতে বাধ্য নন।
(৫) ঈশ্বরের প্রতিনিধি এই রাজার বিরুদ্ধে কোনো বিদ্রোহ করা যায় না। এই ধারণা বা তত্ত্ব শুধু ভারতবর্ষের হিন্দুধর্মেই নয়–এই তত্ত্ব মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি ইত্যাদি সব ধর্মেই প্রচার করা হয়েছে।
মনুর বলছেন রাজা কে? রাজশূন্য এই জগতকে রক্ষার জন্য ইন্দ্র, বায়ু, যম, সূর্য, অগ্নি, বরুণ, চন্দ্র এবং কুবের–এই দেবতার সারভূত অংশ নিয়ে পরমেশ্বর রাজাকে সৃষ্টি করেছেন। যেহেতু এই শ্রেষ্ঠ দেবগণের অংশ থেকে রাজার সৃষ্টি হয়েছিল সেইজন্য তিনি সকল জীবকে তেজে অভিভূত করেন।
“অরাজকে হি লোকেহস্মিন্ সর্বতো বিদ্রুতে ভয়াৎ।
রক্ষার্থমস্য সর্বস্য রাজানমসৃজৎ প্রভুঃ।
ইন্দ্রানিলমার্কাণামগ্নেশ্চ বরুণস্য চ।
চন্দ্রবিত্তেশয়োশ্চৈব মাত্রা নিত্য শাশ্বতীঃ।।
যস্মাদেং সুরেন্দ্রাণাং মাত্রাভ্যো নির্মিতো নৃপঃ।
তস্মাদভিভবত্যেষ সর্বভূতানি তেজসা”। (মনুসংহিতা, সপ্তম অধ্যায়, শ্লোক ৩-৪-৫)
রাজা কী? মনু বলছেন–
(১) তিনি সূর্যের মতো চোখ ও মন সন্তপ্ত করেন। পৃথিবীতে কেউ তাঁকে মুখোমুখি অবলোকন করতে পারে না।
(২) বালক হলেও রাজাকে মানুষ মনে করে অবজ্ঞা করা উচিত নয়। ইনি মানুষের রূপে মহান দেবতা।
(৩) অতি নিকটে গেলে আগুন একমাত্র সেটাই দগ্ধ করে, কিন্তু রাজারূপ আগুন বংশ-পশু-সম্পত্তি সহ দগ্ধ করে।
(৪) রাজার অনুগ্রহে বিশাল সম্পত্তি লাভ হয়, যাঁর বীরত্বে জয়লাভ হয়, যাঁর ক্রোধে মৃত্যু বাস করে, তিনি প্রকৃতই সর্বতেজোময়। ইত্যাদি ইত্যাদি।
অর্থাৎ যিনিই রাজা, তিনিই ভগবান। ভগবানের প্রতি যেমন আনুগত্য থাকা প্রয়োজন, তেমনই রাজার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনও বিধেয়। অন্যথায় সে বিদ্রোহী, দেশদ্রোহী। হিন্দি বলয়ে রামই একমাত্র আরাধ্য দেবতা, যিনি একাধারে রাজা এবং ভগবান। একাধারে রাজা ও ভগবান, এমন ‘ভগবান’ তেত্রিশ কোটি দেবতাদের মধ্যে দ্বিতীয়টি নেই। মনুর নির্দেশ বা বিধান অনুসারে রাজা এবং ব্রাহ্মণ উভয়ই ভগবান। এদের ফতোয়ার ভয়ে সাধারণ প্রজা-মানুষরা সর্বদা তটস্থ থাকতেন।
পণ্ডিত অক্ষয়কুমার দত্ত ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ গ্রন্থে কী বলেছেন, সেটা দেখি–যুদ্ধকাণ্ডের ১১৯ সর্গে রাম যে স্বয়ং পূর্ণব্রহ্ম ভগবান, এ কথাটি ব্রহ্মা তাঁকে জানিয়ে দেন–এই অংশটি প্রক্ষিপ্ত বলেই তিনি মনে করেন। তিনি বলেন–কোনো ভক্তব্যক্তি রামায়ণের মধ্যে তাঁর ভাবনা প্রবেশ করিয়েছেন, রামকে বিষ্ণু ও সীতাকে লক্ষ্মী বলে প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে। এমনকি এই অংশে কৃষ্ণের নাম উল্লেখ থাকাতে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়, অভিপ্রায়টিও প্রকট হয়। রামের অনেককাল পরে কৃষ্ণকে আমরা পাই। রাম ত্রেতা যুগের, কৃষ্ণ দ্বাপর যুগের–মাঝে কয়েক হাজার বছরের ব্যবধান। পণ্ডিত যোগেশচন্দ্র রায় তাঁর ‘পৌরাণিক উপাখ্যান’ গ্রন্থে লিখেছেন–“রামায়ণে যে কত কবি পরে পরে শ্লোক জুড়িয়া দিয়াছেন, তাহার নির্ণয় দুঃসাধ্য। এক কবি একটা গোটা কাণ্ড, উত্তরকাণ্ড জুড়িয়া দিয়াছেন। বোধহয় তিনিই শ্রীরামকে বিষ্ণুর অবতার করিয়াছিলেন এবং মৃত্তিকা হইতে সীতার জন্ম কল্পনা করিয়াছেন। কিন্তু রামায়ণে শ্রীরাম কুত্রাপি বৈষ্ণবী শক্তি প্রদর্শন করেন নাই।” তা ছাড়া রামায়ণের যুগে আমাদের প্রচলিত দেবদেবতার, অর্থাৎ দুর্গা-কালী-গণেশ-লক্ষ্মী ইত্যাদি দেবদেবীরা আবিষ্কৃত হয়নি। বাল্মীকির যুগ বৈদিক ভাবাপন্ন। তাই হনুমানের কার্যারম্ভের আগে বেদে উল্লিখিত তেত্রিশটি দেবতাদের মধ্য থেকেই স্মরণ করেছেন, অন্য কোনো দেবতা নয়। তাই ত্রিমূর্তি ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের উল্লেখ নেই রামায়ণে৷ উল্লেখ আছেন কেবল বৈদিক দেবতা–বসুগণ, রুদ্রগণ, আদিত্যগণ, মরুদগণ, অশ্বিনীকুমারদ্বয়। এঁরা রামায়ণের যুগে পূজ্য হলেও, হিন্দুরা পুজো করেন না। হনুমান প্রণাম জানিয়েছেন রাম, সীতা, লক্ষ্মণ, রুদ্র, ইন্দ্র, যম, অনিল, চন্দ্র, অগ্নি, মরুদ এবং সুগ্রীবকে–
“নমোহস্তু রামায় সলক্ষ্মণায় দেব্যৈ চ তস্যৈ জনকাত্মজায়ৈ।
নমোহস্তুরুদ্ৰেন্দ্ৰমানিলেভ্যো নমোহস্তু চন্দ্রাগ্নিমরুদগণেভ্যা৷
স তেভ্যস্ত নমস্কৃত্য সুগ্রীবায় চ মারুতি।
দিশঃ সৰ্ব্বাঃ সমালোক্য সোহশোকবনিকাং গতঃ৷৷”
যেটুকু আছে, তা প্রক্ষিপ্ত প্রবেশ হয়েছে বলে অনেক পণ্ডিতগণ মনে করেন। তবে রাবণ হত্যায় আগে রাম সূর্যের আরাধনা করেছিলেন। সূর্যপুজো বহু প্রাচীন, আজও সূর্য অনেকের উপাস্য। পৃথিবীর বহু দেশে সূর্যোপসনার প্রচলন আছে। চন্দ্র, সূর্য, অগ্নি, বায়ু, বরুণদের যে একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন এবং তিনিই পাপপুণ্যের বিচার করবেন, এমন আধ্যাত্মিকতা রামায়ণে অনুপস্থিত। মহাভারতে রামকে প্রথমেই বিষ্ণুর অবতার বলে স্বীকার করে নিয়েছে–“বিষ্ণু মানুষরূপেণ”। কোথাও কোথাও রামকে বিষ্ণুই বলা হয়েছে। রামায়ণের আদিকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ডেও রামকে বিষ্ণু বলেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
বিষ্ণুর দশমাবতারে রামের কথা উল্লেখ আছে। অবতারবাদ নতুন কিছু নয়। ভারতের সনাতন ধর্মে অবতারবাদ বহু প্রাচীন যুগ থেকেই শুরু। বেদ, উপনিষদ, ব্রহ্মসূত্র, পঞ্চরাত্র–সবখানেই অবতারবাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। অবতারবাদ হচ্ছে এক ধরনের মতবাদ যেখানে সৃষ্টিকর্তা মানবকুলকে সঠিক পথে পরিচালিত করার উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝে মানুষ বা অপর কোনো জাগতিক রূপ নিয়ে বা অবতার হয়ে পৃথিবীতে আবির্ভূত হন। অন্যভাবে বলতে গেলে মানুষ বা জাগতিক কোনো প্রাণীকে সকল দোষ-ত্রুটির ঊর্ধ্বে এবং সর্বজ্ঞ ও মহাক্ষমতার অধিকারী হিসাবে বিবেচনা করার নাম ‘অবতারবাদ। যুগে যুগে রাজনৈতিকভাবে এই অবতারবাদকে ব্যবহার করা হয়েছে কোনো নেতা বা রাজাকে তাঁদের অনুসারীরা সকল দোষ-ত্রুটির ঊর্ধে এবং সর্বজ্ঞ ও মহাক্ষমতার অধিকারী হিসাবে বিবেচনা করে অন্ধ অনুসরণ করত এবং অনেক সময় সৃষ্টিকর্তার আসনে বসিয়ে পুজোও করত, এ ধরনের অন্ধ অনুসারীদেরকে অবতারবাদের অনুসারী হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এ ধরনের নেতা বা রাজাকেও অবতার হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ভারতবর্ষে বুদ্ধকে বৈদিক দেবতা বিষ্ণুর সঙ্গে সমীকরণ করা হয়। মৎসপুরাণে এ বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। ভগবত পুরাণেও বুদ্ধকে বিষ্ণুর সঙ্গে সমীকরণ করা হয়। বুদ্ধকে ভারতীয় ধর্মীয় ঐতিহ্যে বিষ্ণুর নবম অবতার মনে করা হয়। এরকমভাবে পরশুরাম, কৃষ্ণ, চৈতন্য, রামকৃষ্ণও অবতার হিসাবে পূজিত।
অবতারদের দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়–(১) সাক্ষাৎ এবং (২) অবেস। যখন বিষ্ণু স্বয়ং অবতীর্ণ হন, তখন তাকে সাক্ষাৎ বা শাক্ত্যবেসাবতার বলা হয়। কিন্তু যখন তিনি নিজে অবতীর্ণ না-হয়ে কারোর মাধ্যমে প্রকাশিত হন, তখন তাকে বলা হয় অবেস অবতার। মনে করা হয়, অবেস অবতারের সংখ্যা অনেক। অবেস অবতারগণ পরমেশ্বর রূপে পূজিত হন না। কেবলমাত্র প্রত্যক্ষ ও প্রধান অবতারগণই ওইরূপে পূজিত হন। প্রকৃতপক্ষে যে সকল প্রত্যক্ষ অবতার আজ পূজিত হন তাঁরা হলেন পূর্ণ অবতার–নৃসিংহ, রাম ও কৃষ্ণ।
হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর সঙ্গেই অবতারবাদের বিশেষ সম্পর্ক। যদিও এই মতবাদ কিছু ক্ষেত্রে অন্য কয়েকজন দেবদেবীদের ক্ষেত্রেও প্রযুক্ত হয়। হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলিতে বিষ্ণুর অবতারগুলির ভিন্ন ভিন্ন তালিকা পাওয়া যায়। গরুড় পুরাণ গ্রন্থে বিষ্ণুর দশাবতার ও ভাগবত পুরাণ গ্রন্থে বিষ্ণুর বাইশটি অবতারের বর্ণনা পাওয়া যায়। যদিও শেষোক্ত পুরাণটিতে এও বলা হয়েছে বিষ্ণুর অবতারের সংখ্যা অগণিত। বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্বে অবতারবাদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মতবাদ। হিন্দুধর্মের দেবীকেন্দ্রিক শাক্তধর্মে মহাশক্তির বিভিন্ন অবতারের রূপ বর্ণিত হয়েছে। তাঁদের মধ্যে কালী, দুর্গা ও ত্রিপুরাসুন্দরী সর্বাধিক পরিচিত। মধ্যযুগে রচিত কয়েকটি হিন্দু ধর্মগ্রন্থে গণেশ ও শিব প্রমুখ অন্য কয়েকজন দেবতার অবতারের কথা উল্লিখিত হলেও সেই গ্রন্থগুলি অপ্রধান ও স্বল্পপরিচিত। উল্লেখ্য, হিন্দুধর্মের বৈষ্ণব ও শৈব সম্প্রদায়ের মধ্যে অন্যতম প্রধান পার্থক্যই হল এই অবতারবাদ। ভাগবত পুরাণের প্রথম স্কন্দে সংখ্যাক্রম অনুসারে বিষ্ণুর যে বাইশ অবতারের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তা হল–(১) চতুর্সন [ভাগবত ১।৩।৬] (ব্রহ্মার চার পুত্র) (২) বরাহ [ভাগবত ১।৩।৭] (বন্য শূকর) (৩) নারদ [ভাগবত ১।৩৮] (ভ্রাম্যমাণ ঋষি) (৪) নর-নারায়ণ [ভাগবত ১।৩।৯] (যমজ) (৫) কপিল [ভাগবত ১।৩।১০] (দার্শনিক) (৬) দত্তাত্রেয় [ভাগবত ১।৩।১১] (ত্রিমূর্তির যুগ্ম অবতার) (৭) যজ্ঞ [ভাগবত ১।৩।১২] (সাময়িকভাবে ইন্দ্রের ভূমিকা গ্রহণ করা বিষ্ণু) (৮) ঋষভ [ভাগবত ১।৩।১৩] (রাজা ভরত ও বাহুবলীর পিতা) (৯) পৃথু [ভাগবত ১।৩।১৪] (যে রাজা পৃথিবীকে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে তুলেছিলেন) (১০) মৎস্য [ভাগবত ১।৩।১৫] (মাছ) (১১) কূর্ম [ভাগবত ১।৩।১৬] (কচ্ছপ) (১২) ধন্বন্তরী [ভাগবত ১।৩।১৭] (আয়ুর্বেদের জনক) (১৩) মোহিনী [ভাগবত ১।৩।১৭] (সুন্দরী নারী) (১৪) নৃসিংহ [ভাগবত ১।৩।১৮] (নর-সিংহ) (১৫) বামন [ভাগবত ১।৩।১৯] (খর্বকায়) (১৬) পরশুরাম [ভাগবত ১।৩।২০] (পরশু অর্থাৎ কুঠার সহ রাম) (১৭) ব্যাসদেব [ভাগবত ১।৩।২১] (বেদ সংকলক) (১৮) রাম [ভাগবত ১।৩।২২] (অযোধ্যার রাজা) (১৯) বলরাম [ভাগবত ১।৩।২৩] (কৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা) (২০) কৃষ্ণ [ভাগবত ১।৩।২৩] (রাখাল বা স্বয়ং ভগবান) (২১) বুদ্ধ [ভাগবত ১।৩।২৪] (জ্ঞানী) (২২) কল্কি [ভাগবত ১।৩।২৫] (ধ্বংসকারী)। এই বাইশ অবতার ছাড়াও উক্ত গ্রন্থের পরবর্তী অংশে আরও তিন অবতারের কথা আছে–(১) প্রশ্নিগর্ভ [ভাগবত ১।৩।৪১] (প্রশ্নির সন্তান) (২) হয়গ্রীব [ভাগবত ২৭।১১] (অশ্ব) (৩) হংস [ভাগবত ১১।১৩।১৯] (রাজহংস)। কল্কি অবতারের বর্ণনা দেওয়ার পর ভাগবত পুরাণে ঘোষিত হয়েছে, বিষ্ণুর অবতার অসংখ্য। যদিও উপরি উল্লিখিত পঁচিশ অবতারের গুরুত্বই সর্বাধিক। বোঝাই যাচ্ছে বিষ্ণু নামক ব্যক্তিটি অত্যন্ত প্রভাবশালী ও দোর্দণ্ডপ্রতাপ ‘দেবতা’ ছিলেন। তাঁর নাম জড়িয়ে অসংখ্য মানুষ অবতার হয়েছেন। তবে রাম নয়, বেশিরভাগ পুরাণগুলিতে কৃষ্ণেরই আধিপত্য বেশি। বালকাণ্ডের অনেক উপাখ্যান ও ঘটনা যথা গঙ্গোৎপত্তি ও কার্তিকেয় জন্ম, বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্র দ্বন্দ্ব, অহল্যা উদ্ধার, ইন্দ্র কর্তৃক দিতির গর্ভ-ছেদন ইত্যাদি–এগুলি বাদ দিলেও রামায়ণে রামকথার মূল কাহিনিটি বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ হত না। বস্তুত এই সমস্ত উপাখ্যানের পরিপ্রেক্ষিতে রামচরিত্রটি দৈবত্ব লাভ করেছে।
অতএব রাম ‘অবতার’ হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। শ্রীরামচন্দ্রের ভগবত্তা নিয়ে আমার শেষ কথা–বুদ্ধ, অশোক, সাঁইবাবা, ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র, রজনীশ, রবিশঙ্কর, বালক ব্রহ্মচারী, বাবা লোকনাথ, চন্দ্রস্বামী, রামকৃষ্ণ প্রমুখরা যদি ভগবান বা ভগবানতুল্য বা অবতার হতে পারেন–তাহলে শ্রীরামচন্দ্রের মতো মহান ব্যক্তির ভগবান বা অবতার হতে বাধা কোথায়! এক আশারামেরই ভক্তসংখ্যা ১০ কোটি। চাট্টিখানি কথা! বাকি অবতারের ভক্তসংখ্যা তো ঈর্ষণীয়। মনে রাখতে হবে প্রাচীন যুগে বাল্মীকি ও ব্যাসদেব পরবর্তী কবিয়া তাঁদের সংস্কৃত ভাষার কাব্য-সাহিত্যে কোনো-না-কোনোভাবে দেবতাদের টেনে আনতেন। তাঁদের সব কাহিনির সব চরিত্ররাই হয় দেবতা, নয় মুনি-ঋষি। দেবতা, মুনি-ঋষিরা নেই, এমন কোনো সংস্কৃত সাহিত্যই নেই। আর আছে অলৌকিক, অবাস্তব, অপার্থিব কাণ্ডকারখানা। কোনো ধর্মগ্রন্থ নয় এমন একটি সংস্কৃত সাহিত্যের সংখ্যা কম নেই। পাঠকবন্ধুরা, পড়ে দেখতে পারেন ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের কবি দণ্ডী বিরচিত ‘দশকুমারচরিতম্। বাস্তুশাস্ত্রমের মতো কিছু কেজো গ্রন্থ সহ যৌনমূলক গ্রন্থ (বাৎসায়নের কামশাস্ত্র’, কোক্কাচার্যের ‘রতিরহস্য’, জ্যোতির্মল্লের ‘পঞ্চসায়ক’, বীরভদ্র দেবের ‘কন্দর্পচূড়ামণি’) ছাড়া বাকি সব সংস্কৃত সাহিত্যেই অপার্থিব ঘটনার ঘনঘটা। শুধু কাহিনিই নয়, কাহিনিকারও অলৌকিক হয়। যেমন মহাভাষ্যকার পতঞ্জলি জন্ম, ইনি স্বর্গ থেকে সাপের রূপে মহাবৈয়াকরণ পাণিনির অঞ্জলিতে পতিত হয়। অঞ্জলিতে পতিত হলেন বলে তিনি পতঞ্জলি। পতৎ (পতনশীল) + অঞ্জলি = পতঞ্জলি।
মোট কথা, রামচন্দ্রের অবতার হিসাবে প্রতিষ্ঠা অনেক পরবর্তীকালের। পণ্ডিত হরিপদ চক্রবর্তী তাঁর ‘The Murder of Vali’ প্রবন্ধে লিখেছেন, একাদশ শতকের (AD 11) আগে অবতার রামের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা হয়নি।
পণ্ডিত হরিপদ চক্রবর্তী লিখেছেন–
“Although almost from the beginning of the Christion era Rama began to be identified with the same divinity as Visnu is, he was not fully established as so before the eleventh century AD. On the other hand, Krishna-baSED VAISNAVA-sect had always been in eminence.”
পণ্ডিত উপেন্দ্র নায়ক বক্তব্য এখানে উল্লেখ করা জরুরি। তিনি তাঁর রচিত ‘Impact of Ramayana on the Socio-Cultural Life of Orissa’ প্রবন্ধে লিখেছেন–
“…erudite scholars are unable to ascertain accurately the exact date of the incarnation of Sri Rama. Moreover, whereas innumerable temples have been built for the worship of ‘Siva’, ‘Visnu’, ‘Durga’ since time immemorial, temples for worship of Rama are comparatively new, recently built … Ramkrishna Vandarkar opines that there was no Rama temple nor even the image of Rama before the 11th century AD. … Madhabacarya, the spokesman of Bramha sect of Vaisnavism, had introduced the Rama worship in South India by bringing for the first time the idol of warrior Rama from Badrikasram.”
বাল্মীকির রামায়ণে রাম নিজেই বলেছেন–
“আমি রাজা দশরথের পুত্র রাম। আমি আপনাকে মনুষ্য বোধ করিয়া থাকি। এক্ষণে আমি কে এবং আমার স্বরূপই-বা কী, আপনারা তাহাই বলুন।”
সুপরিকল্পিতভাবে রামচন্দ্র এমন স্মরণ করালেন ব্রহ্মাকে। ব্রহ্মাও চিত্রনাট্য মোতাবেক প্রত্যাশিত এবং অনিবার্য উত্তরটি দিয়ে দিতে দেরি করলেন না। ব্রহ্মা বললেন–
“তুমি ত্রিলোকের আদিকতা, কেহ তোমার নিয়ন্তা নাই,… তুমি আদ্যন্তমধ্যে বর্তমান।”
ব্রহ্মা আরও বোঝালেন–
রামচন্দ্র জন্মমৃত্যুরহিত নিত্য, অক্ষয় সত্যস্বরূপ ব্রহ্ম। তিনি খড়াধারী বিষ্ণু ও কৃষ্ণ, ত্রিলোকের আদিস্রষ্টা।
ব্যস, সব কালি ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার। আর্যদেবতাদের আগ্রাসনের চক্রান্ত, রামচন্দ্রের নীতিহীন কার্যকলাপ ‘সব দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন’ মাহাত্ম পেয়ে গেল।
জীবনের শেষদিন পর্যন্ত রামচন্দ্র প্রতিদ্বন্দ্বীহীন অযোধ্যার রাজা ছিলেন। সে রাজ্য যতই ক্ষুদ্র বা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হোক না-কেন রাম কিন্তু সেই ‘রামরাজ্য’-এর উত্তরাধিকার পুত্রদ্বয় লব ও কুশ একজনকেও দেননি৷ লব ও কুশ কেউ কোনোদিনই অযোধ্যার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হতে পারননি। জ্যেষ্ঠ কুশ, কনিষ্ঠ লব। তবে অযশ এড়াতে রামচন্দ্র অযোধ্যার রাজসিংহাসনের পরিবর্তে লব ও কুশকে অন্যত্র ‘সেটেল্ড’ করে দিয়েছিলেন। কুশকে প্রতিষ্ঠা করা হল বিন্ধ্যপর্বতের প্রান্তে কুশাবতীর সিংহাসনে এবং লবকে প্রতিষ্ঠিত করা হল শ্রাবস্তীপুরীর সিংহাসনে। পিতা হয়ে পুত্রদের অযোধ্যা না-দিলেও অন্য রাজ্য দিলেন বটে, কিন্তু প্রথামাফিক অভিষেক করলেন না কেন? কেন সম্পূর্ণভাবে অনাড়ম্বর হল এ রাজ্যদান? নাকি ‘উড়ো খই গোবিন্দায় নমঃ। প্রশ্ন হল, রামচন্দ্র কীভাবে কুশাবতী ও শ্রাবস্তীপুরী ভূখণ্ডে যথাক্রমে কুশ ও লবকে প্রদানে সমর্থ হলেন? কুশাবতী ও শ্রাবস্তীপুরী কি রামরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল? যদি থাকে সেটা কীভাবে থাকল? রাম তো লঙ্কাযুদ্ধের পর আর কোনো যুদ্ধ করে রাজ্য করেছেন বলে তো কোনো উল্লেখ নেই। বিনাযুদ্ধে রাজ্য বাড়ে কীভাবে? যদি না-থাকে তাহলেই-বা বিনাযুদ্ধে কুশাবতী ও শ্রাবস্তীপুরী কুশ ও লব প্রাপ্ত করলেন কীভাবে? ভরত ও শত্রুঘ্নকে তো নতুন রাজ্য পেতে রীতিমতো মারণযুদ্ধ করতে হয়েছিল। প্রশ্ন থাকলেও উত্তর নেই!
যদি প্রশ্ন করেন রাম কোন্ দেশের রাজা ছিলেন? উত্তর ভারত’ বললে ডাহা ভুল। রাম ভারত উপমহাদেশের অন্তর্গত অতি ক্ষুদ্র এক দেশ অযোধ্যার রাজা ছিলেন, ভারত কখনোই নয়। তখনকার সময়ে ভারত কোনো একটি দেশের নাম ছিল না। অসংখ্য দেশগুচ্ছ নিয়েই ভারত উপমহাদেশ। তখন ভারত উপমহাদেশের সঙ্গে পারস্যও সংযুক্ত ছিল। সেই দেশগুচ্ছের মধ্যে অযোধ্যা একটি অতি ক্ষুদ্র দেশ। রাম এই অতি ক্ষুদ্র দেশেরই রাজা ছিলেন। তৎকালীন ভারত উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের নাম এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, তাতে খানিকটা ধারণা তৈরি হবে–লম্পক, নগরহার, গান্ধার, উদ্যান, বোলর-গান্ধার, তক্ষশীলা, সিংহপুর, উরস, কাশ্মীর, পুনচ, রাজপুরী, টক্ক, চীনাপতি, জালন্ধর, কুলুত, শতদ্রু, পারিযাত্র, মথুরা, স্থানেশ্বর, শ্রু, মতিপুর, ব্ৰহ্মপুর, হিরণ্যগোত্র, গোবিসান, অহিক্ষেত্র বা অহিচ্ছত্র, বীরসান, কপিঙ্খ, কনৌজ, অযোধ্যা, হয়মুখ, প্রয়াগ, কৌশাম্বী, বিশাখা বা বিশোক, শ্রাবস্তী, কপিলাবস্তু, বারানসী, গর্জপুর বা ঘাজিপুর, বৈশালী, বৃজি, নেপাল, মগধ, হিরণ্য পর্বত, চম্পা, কজুঘীরা, পুণ্ড্রবর্ধন, কামরূপ, তাম্রলিপ্ত, কর্ণসুবর্ণ, উড্র, কঙ্গোদ, কলিঙ্গ, কোশল, ধনকণ্টক, চোল, দ্রাবিড়, ভরুকচ্ছ, মালব, কাম্পিল্য, গুর্জর, উজ্জয়িনী ইত্যাদি।এই দেশগুলি প্রত্যেকটিই ছিল স্বাধীন, ছিল স্বাধীন রাজা। একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ কারোর শাসনাধীনে ছিলেন না, কোনো কেন্দ্রীয় শাসন ছিল না। এক সাম্রাজ্যের শাসক অন্য সাম্রাজ্যের শাসককে রাজস্ব দিতেন না। প্রাচীন ভারতীয় বলা যায় কোনো কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা ছিল না।
রাজা হওয়ার আগে রাম মাত্র দুটি দেশ জয় করেন বলা যায়–একটি কিষ্কিন্ধ্যা, অপরটি লঙ্কা। যদিও এই যুদ্ধগুলি শর্তসাপেক্ষে হয়েছিল, যথাক্রমে প্রথমটি সুগ্রীবের হাতে এবং দ্বিতীয়টি বিভীষণের হতে তুলে দিতে হয়। সুগ্রীব প্রতিজ্ঞা খেলাপ করলে তাঁকে হত্যা করে বালী-পুত্র অঙ্গদকে কিষ্কিন্ধ্যর রাজা হওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছিল।
এই হল সংক্ষিপ্ত রামকাহিনি৷ রাম-রাবণের যুদ্ধ নয়, রামের সঙ্গে রাবণের যুদ্ধটা জাস্ট ইনসিডেন্ট মাত্র। মোটেই পূর্বপরিল্পিত নয়। রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য রামচন্দ্র অযোধ্যা থেকে চিত্রকুট, চিত্রকুট থেকে দণ্ডকারণ্য, দণ্ডকারণ্য থেকে লঙ্কায় পৌঁছোননি। এই অকারণ যুদ্ধ রামের প্রয়োজনও ছিল না। চাইলে সেই যুদ্ধ অযোধ্যা থেকেই পরিচালনা করা সম্ভব ছিল। লোকের দোরে দোরে করুণাপ্রার্থী হয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে হত না। দুষ্টের দমন শিষ্ঠের পালনও নয়। রামায়ণ হল রাজতন্ত্রের ইতিহাস। ষড়যন্ত্রের ইতিহাস। ষড়যন্ত্রের শিকার দশরথপুত্র রামচন্দ্র। যাই হোক, রামচন্দ্রকে সাধ্যমতো তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। এবার রামায়ণের অন্যান্য চরিত্রগুলিও বিশ্লেষণ করা যাক।
দশরথ : পক্ষপাতদোষে দুষ্ট, বিষয়াসক্ত, কামার্ত, স্ত্রৈণ রাজা
বিভিন্ন গ্রন্থ ঘেঁটে দশরথকে পাওয়া যায় ইক্ষ্বাকু বা সূর্যবংশীয় রাজা অজের পুত্র হিসাবে। ইনি অযোধ্যার রাজা এবং রাম লক্ষ্মণাদির পিতা হিসাবে সর্বজনবিদিত। কৌশল্যা, কৈকেয়ী ও সুমিত্রা নামে এঁর তিনজন প্রধান মহিষী ছিলেন। মুনিবর বাল্মীকি বলেছেন এছাড়াও প্রায় ৩৫০ টি স্ত্রী ছিল দশরথের–
“অর্ধসপ্তশস্তত্র প্রমদাস্তাম্রলোচনাঃ”।
মহাকবি কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর লেখা রামায়ণে দশরথের সাতশো স্ত্রীর কথা উল্লেখ করেছেন। অনেক প্রকৃত ঘটনার মতো ‘অর্ধ’ শব্দটি কৃত্তিবাস নজরের বাইরেই রেখে দিলেন। দশরথের প্রধান স্ত্রী তিনজনই–জ্যেষ্ঠা কৌশল্যা, দ্বিতীয়া কৈকেয়ী এবং কনিষ্ঠা সুমিত্রা। মূল বাল্মীকির রামায়ণে কৈকেয়ীকে ছোটো রানি হিসাবে উল্লেখ করা হলেও কৃত্তিবাস বলেছেন মেজো রানি। কৈকেয়ী কেকয়দেশের পাঞ্জাবি মেয়ে। কেকয় দেশ শতদ্রু ও বিপাশার মধ্যবর্তী অঞ্চলকে বোঝায়, যা বর্তমান পাঞ্জাব। বাল্মীকির রামায়ণে সুমিত্রার কোনো পিতৃপরিচয় জানা যায় না। তবে কৃত্তিবাস সুমিত্রাকে সিংহলের মেয়ে বললেও, মহাকবি কালিদাস তাঁর “রঘুবংশম’-এ মগধের মেয়ে বলে উল্লেখ করেছেন। কৃত্তিবাস এসব অসমর্থিত তথ্য কোথায় পেলেন তাঁর কোনো সূত্র তিনি দেননি। তিনশো স্ত্রীর বিষয়ে রামায়ণে মাত্র একবারই উল্লেখ হয়েছে, তা শ্রীরামচন্দ্রের বনবাসের বিদায় দেওয়ার সময়। এদের নাম-পরিচয় কিছুই জানা যায়নি।
বাল্মীকির রামায়ণ ছাড়া অন্য প্রাদেশিক কিছু রামায়ণে কৌশল্যাকে কোশল রাজার কন্যা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ পরিচয় কোথায় পেয়েছেন সেটা তাঁরাই বলতে পারেন। বাল্মীকি তাঁর গোটা রামায়ণের কোথাও এ পরিচয় দেননি। কোশলরাজের যে উল্লেখ বাল্মীকি করেছেন, সেখানে কোথাও কৌশল্যার পিতা বা দশরথের শ্বশুর এমন উল্লেখ নেই। কৌশল্যা কোশলরাজের কন্যা না-হলেও কোশল দেশের মেয়ে হয়তো ছিলেন। সেই কারণেই তিনি কৌশল্যা। বাল্মীকির রামায়ণে মাত্র একবারই কোশলরাজকে পাই, যখন দশরথ অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন।তিনি এ যজ্ঞে নিমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে ছিলেন। বাল্মীকি কৌশল্যার পিতৃ-পরিচয় উল্লেখ না-করলেও, দশরথের দ্বিতীয় স্ত্রী কৈকেয়ীর পিতৃ-পরিচয় সযত্নে দিয়েছেন। কৈকেয়ী ছিলেন কেকয়রাজ অশ্বপতির কন্যা, অতএব তিনি রাজকন্যা। কৈকেয়ীর ভাই যুধাজিৎ। এই অশ্বপতি ও যুধাজিতের প্রসঙ্গ বাল্মীকির রামায়ণে বহুবার আছে। দশরথের কনিষ্ঠা স্ত্রী সুমিত্রা অভিজাত বংশের কন্যা ছিলেন, এমন পরিচয় বাল্মীকির রামায়ণে পাওয়া যায় না। তাহলে কি নিন্মবর্গীয়া ছিলেন? এর প্রমাণ পেতে গেলে শ্রীরামচন্দ্রের সম্ভাষণ অনুসরণ করতে হবে। শ্রীরামচন্দ্র বিমাতা কৈকেয়ীকে ‘আর্যা কৈকেয়ী’, ‘দেবী কৈকেয়ী’, ‘কৃষ্ণলোচনা কৈকেয়ী’ ‘জননী কৈকেয়ী’ বা ‘দেবী কৈকেয়ী’ প্রভৃতি সম্মানসূচক বিশেষণে সম্ভাষণ করতেন। অপরদিকে সুমিত্রাকে সম্মানসূচক বিশেষণ ছাড়াই নাম ধরে ডাকতেন। ন্যূনতম মা বলে ডাকতেন না। অতএব সুমিত্রা নিম্নবর্গীয় এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকছে না। প্রমাণ চান? শ্রীরামচন্দ্র তাঁর মা কৌশল্যাকে বলছেন–“দেখুন আপনি, আমি, জানকী, লক্ষ্মণ ও সুমিত্রা … পিতা যাহা বলিবেন তাহাই করিব।”
দশরথ অযযাদ্ধা বা অযোধ্যার রাজা ছিলেন। অযোধ্যা একটি অতি ক্ষুদ্র রাজ্য বা দেশ ছিল, যার আয়তন ৭৪৩ বর্গমাইল। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ ছিল আরও কম, মাত্র ৪৯৫ বর্গমাইল। যদিও প্রাদেশিক কিছু রামায়ণে বলা হয়েছে, বসুন্ধরায় যতদূর সূর্যকিরণ পৌঁছোয় ততদূর পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য। বাল্মীকি কিন্তু দশরথকে অত বড়ো সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হিসাবে দেখাননি। তাঁকে বরং অতি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের নরপতি হিসাবে দেখিয়েছেন। দশরথের সাম্রাজ্যকে ‘নগররাষ্ট্র’ বলা হত। দশরথ আটজন মন্ত্রী এবং ঋত্বিক, বামদেব, বশিষ্ঠের সাহায্যে তাঁর স্বাধীন রাজ্য চালাতেন। সে যুগে এমন রাষ্ট্র অসংখ্য ছিল। রামায়ণের যুগে তো বটেই, মহাভারতের যুগেও এমন ‘নগররাষ্ট্রের সংখ্যা প্রচুর পাওয়া যায়।
দশরথ যখন কৈকেয়ীকে বিয়ে করছেন, তখন পর্যন্ত অপুত্রক ছিলেন। একে অপুত্রক মায় ক্ষুদ্র নরপতি, তায় আবার দোজবর। কেকয়রাজ অশ্বপতি এমন বিয়েতে রাজি হলেন কেন? রাজি হলেন এই কারণে যে ভবিষ্যতে কৈকেয়ীর সন্তানই হবে অযোধ্যার রাজা। হিসাবমতো (প্রথা) প্রথমা মহিষীর পুত্রই রাজত্বলাভ করে থাকে। যদিও তখনও পর্যন্ত দশরথ অপুত্রক, তা সত্ত্বেও কেকয়রাজ অশ্বপতি কোনো ঝুঁকি নিতে চাননি। তাই তিনি বিয়ের আগেই প্রতিজ্ঞা বা চুক্তি করিয়ে নিলেন দশরথকে দিয়ে। বলা হল পরিস্থিতি যেমনই থাক, কৈকেয়ীর পুত্রকেই দশরথ সমস্ত রাজ্য লিখে দেবেন।
যদিও কৌশল্যাকে দশরথ পুত্রসন্তান দিতে পারেননি, কৈকেয়ীকেও পুত্রসন্তান দিতে পারেননি। সুমিত্রাকেও নয়। অতএব এটা বুঝতে হবে, দশরথ সন্তান জন্মদানে অক্ষম ছিলেন। তবে যৌনতায় অক্ষম ছিলেন একথা বলা যায় না। যৌনতা না-থাকলে তিনি এতগুলি বিয়ে করতেন না, ‘কচি’ বউ কৈকয়ীর কাছে সর্বক্ষণ লেপটে থাকতেন না। নারীই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। নারীই তাঁর সর্বনাশ।
তিন-তিনটে প্রধানা থাকা সত্ত্বেও দশরথ সন্তানের পিতা হতে পারেননি। বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত তিনি নিঃসন্তান বা অপুত্রক ছিলেন। সে যুগে রাজা নিঃসন্তান হলে সেই রাজার মুখ দেখাও অমঙ্গল ছিল। তা ছাড়া পরবর্তী রাজা কে হবেন, সেই চিন্তায় অপুত্রক রাজার বিনিদ্র রজনি কাটত। তার উপর চারিদিক কানাঘুষোও চলত। রাজা দশরথকে লাঞ্ছিতও হতে হয়েছিল। সেকালে পুত্র-সন্তানের আশায় রাজারা যেমন একাধিক বিয়ে করতেন, তেমনই একই কারণে সাধারণ পুরুষরাও একাধিক বিয়ে করতেন–“পুত্ৰৰ্থে ক্রিয়তে ভাৰ্য্যা”। সন্তান বা পুত্র সন্তান জন্ম দিতে না-পারার সমস্ত দায় মাথায় নিয়ে মেয়েদেরকে অসংখ্য সতীনদের সঙ্গে সংসার করতে হত।
এত সংখ্যক রমণীকে বিয়ে করেও রাজা দশরথ পুত্র-সন্তানের স্বাদ পাননি। তাহলে কি দশরথে নিজেই পুত্র সন্তান উৎপাদনে অসমর্থ ছিলেন। শান্তার জন্মের ব্যাপারটাও তো রহস্যাবৃত। শান্তাই দশরথের একমাত্র কন্যা সন্তান। সন্তান বা পুত্র-সন্তান জন্ম দিতে না-পারার জন্য পুরুষ বা স্বামীদের কোনো দায় নিত না–সেকালেও নয়, একালেও নয়। শুধু দশরথই নয়–রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণগুলিতে অসংখ্য সন্তান জন্মদানে অক্ষম ক্ষত্রিয় রাজাদের পরিচয় আমরা পাই। এরা কেন সন্তান জন্মদানে অক্ষম ছিলেন তার ব্যাখ্যা সবক্ষেত্রেই পাওয়া যায়নি।
দশরথ, দিলীপ, ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু–এঁরা এরকমই অক্ষম পুরুষ ছিলেন। তবে দশরথ মোটেই ধ্বজভঙ্গ বা লিঙ্গ উত্থানরহিত (Improtent) ছিলেন না। স্মর্তব্য, এইসব অক্ষম পুরুষরা ক্ষত্রিয় রাজা ছিলেন। অথচ ব্রাক্ষণকুল এবং দেবতাকুল এরা বলে বলে পুত্র-সন্তানের জন্ম দিতেন, এই প্রক্রিয়ায় তাঁরা কোনো কন্যা-সন্তান জন্ম দিয়েছেন বলে শুনিনি৷ অক্ষম ক্ষত্রিয় রাজাদের স্ত্রীগণ হয় দেবতাদের দ্বারা, নয় ব্রাহ্মণ-ঋষিদের দ্বারা গর্ভবতী হয়েছেন। মহাকবি কালিদাসের ‘রঘুবংশম’-এ দিলীপ-ভার্যা সুদক্ষিণা বশিষ্ঠমুনি কর্তৃক গর্ভবতী হয়েছিলেন বলেই অনুমান করা যায়। দশরথ-ভার্যা তিন রানিই ঋষ্যশৃঙ্গ ঋষি কর্তৃক গর্ভবতী হয়েছিলেন বলে অনেক গবেষক বলেন। পাণ্ডু-ভার্যা কুন্তি ও মাদ্রির গভরক্ষা হয় যথাক্রমে সূর্য (পুত্র কর্ণ), ধর্ম (পুত্র যুধিষ্ঠির), পবন। (পুত্র ভীম), ইন্দ্র (পুত্র অর্জুন), অশ্বিনীদ্বয় (পুত্র নকুল ও সহদেব) কর্তৃক। এরকম অসংখ্য উদাহরণ উল্লেখ করা যায়। অলৌকিকের মোড়কে এই সমস্ত জন্মকে বর্ণনা করা হয়েছে প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে।
শিবের গলগল করে ঝরে-পড়া বীর্যে মনসা, কার্তিক ইত্যাদি শিশুদের জন্ম এবং অবশেষে পরিত্যক্তও হতে হয় সেইসব অসহায় সন্তানদের। ব্রাহ্মণ মুনিঋষিরা তো রানিদের গর্ভবতী করার মহান দায়িত্ব নিতেন, বেশ্যাদেরও গর্ভবতী করতে তাঁরা ছাড়েননি। অনভিপ্রেত যৌনসম্ভোগ করে বিশ্বামিত্র স্বৰ্গবেশ্যা মেনকাকেও গর্ভবতী করেছেন এবং সন্তান শকুন্তলাকে পরিত্যক্তা করেছেন। গবেষক-প্রাবন্ধিক মাহবুব লীলেন তাঁর সহজিয়া রামায়ণ রচনায় বলেছেন–
“দশরথ সাড়ে তিনশোখান বিবাহ করছে কি খালি শালা-শ্বশুরের প্রদর্শনী দিবার লাইগা? মোটেও তা না। এক বাপের এক পুতের অতখান বিবাহের মূল উদ্দেশ্য হইল পোলা জন্মাইয়া নিজের ঘরেই একখান সেনাবাহিনী গইড়া তোলার পাশাপাশি আশপাশের রাজ্যগুলায় পোলা-মাইয়া বিবাহ দিয়া বন্ধুত্ব কিংবা নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা। তয় একলা এক মানুষের পক্ষে অতগুলা বৌর ঘরে পোলাপান জন্ম দিতে খাটনিও লাগে, সময়ও লাগে। তার থাইকা পুত্রেষ্টী যজ্ঞে রাজার বৌদের একলগে গর্ভবতী কইরা একলগে একগাদা পোলাপানের বাপ হইয়া যাওয়া শাস্ত্রসম্মত সহজ উপায়। পুত্রেষ্টী যজ্ঞে রাজার বৌরা আমন্ত্রিত বামুন দ্বারা গর্ভবতী হইয়া রাজার ঘরে পোলাপানের জন্ম দেন, শাস্ত্রমতে রাজার পোলাপান হিসাবেই গণ্য হয়।”
এ কাহিনিগুলি যদি ইতিহাস হয়, যদি সমসাময়িক বর্ণনা হয়–তাহলে বলতেই হয় সে যুগে এ ধরনের যৌনমিলন এবং জন্ম দেওয়া স্বীকৃত ছিল। এ নিয়মকে বলা হত নিয়োগ প্রথা। প্রাচীন হিন্দুসমাজে প্রচলিত ছিল নিয়োগ বিধি, এটি একটি সংস্কার। বিধবা মহিলা অর্থাৎ যেসব মহিলার স্বামী মারা গেছেন, অথচ তার কোনো সন্তানসন্ততি নেই এবং যেসব মহিলার স্বামী আছেন কিন্তু তিনি সন্তান জন্মদানে অক্ষম সেই মহিলা তার স্বামী ও বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির অনুমতিক্রমে একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে সন্তান জন্মদানের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানানোকেই ‘নিয়োগ প্রথা’ বলে।
এখানে উল্লেখ্য যে–(১) বিষয়টির সঙ্গে স্বামী ও অন্যান্য বয়োজ্যষ্ঠ ব্যক্তির অনুমতির ব্যাপার আছে এবং (২) এই প্রথাটি যৌন পরিতৃপ্তির সঙ্গে মোটেই সম্পর্কযুক্ত নয়। বরং এটা সমাজ ও পরিবারের একান্ত প্রয়োজন অনুসারেই শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের জন্যই এই প্রথা অনুশীলন করা হয়। নারী-শরীরের সুস্থ বীর্য-স্থাপনাই এই প্রথার উদ্দেশ্য। তৎকালীন সময়ে নিয়োগ প্রথায় কিছু শর্ত শক্তভাবে পালিত হত। এটা সাধারণত কেন এবং কোন্ অবস্থায় করা হত, সেটা জেনে নেওয়া যেতে পারে–
নরক থেকে পূর্বপুরুষদের উদ্ধার করার জন্য পুত্র উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তার উপর স্মৃতিকাররা বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই যুগে যুগে ‘পুত্রেষ্টি যজ্ঞ চলছেই, পাশাপাশি চলছে কন্যাভ্রণ হত্যা। এই কারণে বিবাহিত জীবনে যদি সন্তান উৎপন্ন না-হয়, কী নিঃসন্তান অবস্থায় যদি কেহ মারা যায়, তা হলে তার স্ত্রী বা বিধবার ক্ষেত্রে’ অপরের দ্বারা সন্তান উৎপাদনের বিধান স্মৃতিকাররা দিয়েছিলেন। প্রধানত রাজপরিবারগুলিতে এবং অধিক ভূসম্পত্তির অধিকারী পরিবারগুলিতে বংশপরম্পরা রক্ষা এবং উত্তরাধিকারীর জন্যই এ প্রথা পালন করা হত। সাধারণত হিন্দুসমাজ পিতৃতান্ত্রিক এবং পিতার দিক থেকেই বংশ পরিচয় এবং উত্তরাধিকার নির্ধারিত হয়। এই অবস্থায় ধনাঢ্য পরিবারগুলির স্ত্রীদেরকে অন্যত্র বিয়ে দেওয়া হলে সেই স্ত্রীলোকের গর্ভে জন্ম নেওয়া সন্তানেরা পরবর্তীতে ওই (দ্বিতীয়বার বিবাহিত) নারীর দ্বিতীয় স্বামীর উত্তরাধিকারীরূপে পরিচিতি লাভ করবে। এ অবস্থায় ওই নারীর প্রথম স্বামীর পরিবার বিনাশের পথে যেতে পারে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্যই এহেন বিধি পালন করা হত।
কারা নিয়োগ প্রথার অধিকারী ছিলেন?
(১) একজন নারী এই প্রথা অনুসরণ করবে শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের জন্য, যৌন আনন্দ লাভের জন্য নয়।
(২) নিয়োগকৃত পুরুষ এই কাজটি করবেন ধর্মের জন্য, নারীকে সন্তান উৎপাদনে সাহায্যের জন্য–যৌন আনন্দ উপভোগের জন্য নয়।
(৩) এই উপায়ে জন্মগ্রহণকৃত সন্তান স্বামী-স্ত্রীর সন্তানরূপে বিবেচিত হবে, নিয়োগকৃত পুরুষ সেই সন্তানকে নিজের সন্তানরূপে দাবি করতে পারবে না।
(৪) ভবিষ্যতে নিয়োগকৃত পুরুষ সন্তানের পিতৃত্ব দাবিও করতে পারবে না।
(৫) অপব্যবহার রোধের জন্য একজন পুরুষ তার সারাজীবনে মাত্র তিনবার নিয়োগকৃত হয়ে যৌনমিলন করে গর্ভবতী করতে পারবে।
(৬) এই কাজকে ধর্ম হিসাবে দেখা হবে, যাতে নারীর মনে বা পুরুষের মনে এই ব্যাপারে কোনো আকাঙ্ক্ষা বা লোভ জন্ম না নেয়–একজন পুরুষ এই কাজটি নারীকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে করবে, আর নারী এই কাজটি করবে তার ও তার স্বামীর জন্য সন্তান লাভের উদ্দেশ্যে।
(৭) এই প্রথায় কোনো শৃঙ্গার হবে না, কোনোরূপ যৌনক্রিয়া হবে না, শুধুমাত্র যোনিতে লিঙ্গ প্রবেশ ছাড়া।
(৮) সেখানে একটা অর্ধস্বচ্ছ আচ্ছাদন থাকবে, যা দিয়ে নারীর উর্ধাঙ্গ ঢেকে দেওয়া হবে এবং নিয়োগকৃত পুরুষ শুধুমাত্র নারীর যৌনাঙ্গ দেখার অনুমতি লাভ করবে, যাতে সে শুধুমাত্র নিয়োগ-কর্ম সমাধা করতে পারে।
মহাভারতের একস্থানে ভীষ্ম বলেছেন–“দেবতারা পাঁচ প্রকারে সন্তান উৎপাদন করেন–বাসনা দ্বারা, বাক্য দ্বারা, দর্শন দ্বারা, স্পৰ্শন দ্বারা ও যৌনসঙ্গম দ্বারা”। বেদ, মনুসংহিতায় নিয়োগ প্রথার স্পষ্ট উল্লেখ আছে। কিন্তু রামায়ণ ও মহাভারত যখন লেখা হল তখন নিশ্চয় এ ধরনের প্রথা এবং জন্মদান নিশ্চয় বৈধতা হারায়। আর সেই কারণেই বোধহয় এহেন যৌনমিলন অলৌকিকতার মোড়কে মুড়ে দেওয়া হয়। না-হলে কেন ‘আপস্তম্ভ ধর্মসূত্র’-এ বলা হয়েছে–
“সন্তান প্রজননের জন্য স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে অপরের হস্তে সমর্পণ করা কলিযুগে নিষিদ্ধ হয়েছে। কলিযুগে এরূপ যৌনমিলন ব্যভিচাররূপে গণ্য হয় এবং এরজন্য স্বামী ও স্ত্রী উভয়েরই নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।”
এই উক্তি থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, পূর্ববর্তীকালের সমাজে ‘নিয়োগ’ প্রথা অনুমোদিত হলেও, পরবর্তীকালের সমাজে এ প্রথা নিষিদ্ধ হয়েছিল। প্রাচীনকালে দেবতা ও ঋষিদের পক্ষে যা বৈধ এবং প্রশস্ত ছিল, পরবর্তীকালের মানুষের পক্ষে তা গর্হিত ও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। আপস্তম্ভ বললেন যে, ব্যভিচার অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির লিঙ্গ ও অণ্ডকোশ কর্তন করে শাস্তি দেওয়া হবে এবং যদি সে কোনো অনুঢ়া কন্যার সঙ্গে ব্যভিচার করে থাকে, তাহলে তার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে এবং তাঁকে দেশ থেকে বহিস্কৃত করা হবে। বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট নারী বা কুমারীকে রাজা সমস্ত কলঙ্ক থেকে মুক্ত করবেন এবং তাঁর অভিভাবকদের হাতে তাঁকে প্রত্যর্পণ করবেন, যদি অভিভাবক তাঁর দ্বারা যথোচিত প্রায়শ্চিত্ত সম্পাদনের ব্যবস্থা করেন। ব্যভিচারীর শাস্তিস্বরূপ নারদ যে দণ্ড বিধান করেছেন তা হচ্ছে–১০০ পণ অর্থদণ্ড, সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ, লিঙ্গ কর্তন ও মৃত্যু। বৃহস্পতিও বলেছেন যে, কলিযুগে ‘নিয়োগ’ প্রথা যথাযথ নয়। নিয়োগ’ প্রথানুযায়ী অপর পুরুষের দ্বারা গর্ভসঞ্চারণ করানোর রীতি যখন বিলুপ্ত হল, তখন নারীর সতীত্ব সম্পর্কে হিন্দুসমাজে এক নতুন ধারণা কল্পিত হল। সে আর-এক অধ্যায়।
মহাভারতে নিয়োগ প্রথার অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। যেমন দীর্ঘতমা মুনি বঙ্গদেশের রাজা বলির রানি সুদেষ্ণার গর্ভে এই পদ্ধতিতেই কয়েকটি পুত্র উৎপাদন করেছিলেন। ঋষি পরাশর সত্যবতীর গর্ভে ব্যাসদেবকে উৎপাদন করেছিলেন। আবার ব্যাসদেব কুরুরাজ বিচিত্রবীর্যের দুই বিধবা পত্নী অম্বিকা এবং অম্বালিকার গর্ভে যথাক্রমে ধৃতরাষ্ট্র এবং পাণ্ডুকে জন্ম দিয়েছিলেন। এছাড়া তাঁর দ্বারাই অম্বিকার অনাম্মী দাসীর গর্ভে বিদুরের জন্ম হয়। পাণ্ডুরাজার দুই স্ত্রী কুন্তী ও মাদ্রীর গর্ভে পঞ্চপাণ্ডবের জন্ম হয় নিয়োগ পদ্ধতিতেই। অগ্নিপুরাণে ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু এবং পঞ্চপাণ্ডবের নিয়োগ প্রথা অনুসরণে জন্মগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। রাজা সুদাসের পুত্র সৌদাসের রানি দময়ন্তীর গর্ভে ঋষি বশিষ্ট অশ্যককে জন্ম দেন।
গরুড়পুরাণে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জাত সন্তানকে বৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ঋকবেদে ১০/৪০/২ নম্বর শ্লোকটি বৈদিক যুগে নিয়োগ প্রথা চালু থাকার কথা বলেছে। গৌতম বশিষ্ট, বৌধায়ন, নারদ এবং মনু নিয়োগ সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। বৃহন্নারদীয় পুরাণের মতে নিয়োগ পদ্ধতি কলিযুগে কার্যকরী নয়। আদি পুরাণ এই নির্দেশিকা সমর্থন করেছে।
যাই হোক, রাজা দশরথকে কলঙ্কমুক্ত করতে এবং তাঁর মৃত্যুর পর পিতৃপুরুষের উদ্ধারের জন্যই উৎপাদন করা হয়েছে জন্ম বিষয়ক এই অলৌকিক কাহিনি। বাস্তবে যখন স্বাভাবিক উপায়ে রাজাকে পুত্রের স্বাদ দেওয়া সম্ভব নয়, তখনই অলৌকিকতার আশ্রয় এসেছে। প্রাদেশিক কবিরা ফল বা চরু বা পায়েস খাইয়ে স্ত্রীদের গর্ভবতী করানোর গল্প বলেছেন। বাল্মীকি কিন্তু বালকাণ্ডে (প্রক্ষিপ্ত?) সোজাসাপটাই বলেছেন দশরথের স্ত্রীদের গর্ভবতী হওয়ার প্রকৃত কাহিনি। রাজা দশরথ পুত্র সন্তানের জন্য ‘পুত্রেষ্টি যজ্ঞ’ করেন। পুত্রের জন্য শেষপর্যন্ত ঋষ্যশৃঙ্গকে দশরথ আহ্বান করেন–
“ততঃ প্রণম্য শিরসা তং বিপ্রং দেববর্ণিনম্।/যজ্ঞায় বরয়ামাস সন্তানার্থং কুলস্য চ৷৷”
যজ্ঞের মুনি ঋষ্যশৃঙ্গ যজ্ঞ থেকে একটা ফল পান এবং সেই ফল রাজাকে দিয়ে তাঁর পত্নীদের খাওয়াতে বলেন। সেই মোতাবেক দশরথ ফল নিয়ে দুই ভাগ করে তাঁর প্রধান দুই রানী কৌশল্যা আর কৈকেয়ীকে খেতে দেন। এমন সময় তৃতীয় রানী সুমিত্রা এসে কান্নাকাটি করল পুত্রলাভের ফলের জন্য। তখন কৌশল্যা দয়াবতী হয়ে তার ভাগের আর্ধেকটা ফল আরও দু-ভাগ করে একভাগ সুমিত্রাকে দেন। যথাসময়ে কৌশল্যার ঘরে রাম জন্ম নিলেন। কয়েকদিন পর কৈকেয়ীর ঘরে ভরত জন্ম নেন আর সুমিত্রার ঘরে যমজ পুত্র লক্ষ্মণ আর শত্ৰুগ্ন জন্ম নেন। অন্য এক কাহিনি থেকে জানা যায়–ভারতবর্ষের সরযু নদীর কাছে অযোধ্যা নামের এক নগরে দশরথ নামের এক রাজা ছিলেন। তাঁর কোনো সন্তান ছিল না। মনের দুঃখে একদা মন্ত্রীদের বললেন–আমি দেবতাদের তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করব। যজ্ঞের আয়োজন সম্পন্ন করা হল। প্রথমেই করা হল ‘অশ্বমেধ যজ্ঞ’। ঘোড়ার মাংস দিয়ে এই যজ্ঞ করা হয়। জটিল এক প্রক্রিয়া, প্রথমে ঘোড়াটা ছেড়ে দেওয়া হয়। এই ঘোড়া এক বছর যেখানে খুশি সেখানে ঘুরে বেড়ায়, তারপর এটাকে ফিরিয়ে আনা হয়৷ ‘অশ্বমেধ যজ্ঞ’-তে যে ঘোড়াটা ছেড়ে দেওয়া হত সেটাকে নিজ রাজ্যে না-ফেরা পর্যন্ত কোথাও বাধা দেওয়া হত না। এই সময়টায় ওই ঘোড়ার পিছন পিছন খুব শক্তিশালী একটা সৈন্যদল থাকত। ঘোড়াটা ঘুরতে ঘুরতে অনেকগুলি রাজ্যে ঢুকে পরত এবং নিয়মটা ছিল ঘোড়াটা যেসব রাজ্যে ঢুকে পরত সেসব রাজাকে যজ্ঞকারী রাজার ‘জয়’ বলে মেনে নিতে হত৷ না-মানলে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হত।
যাই হোক, অশ্বমেধ যজ্ঞের পর ঋষ্যশৃঙ্গ বললেন–
“এরপর পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করিলে মহারাজের ছেলে হইবে”।
যজ্ঞের ফলে অলৌকিক ‘পায়েস’ এল। সেই পায়েস রানিদের খেতে দেওয়া হল। দশরথের তিন রানি কৌশল্যা, কৈকেয়ী, সুমিত্রা। কিছুদিন পর তাঁদের ছেলে হল। কৌশল্যার পুত্র রাম। কৈকয়ীর পুত্র ভরত। সুমিত্রার দুই পুত্র–লক্ষ্মণ এবং শত্রুঘ্ন। দশরথ নয়, দশরথের কোনো ভূমিকাতেও নয়–সন্তানের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব রানি-ত্রয়ী এবং অবশ্যই ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি৷ যুক্তিবাদী প্রাবন্ধিক প্রবীর ঘোষ স্পষ্টত বলেছেন–
“ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির সঙ্গে মিলনের ফলে জন্ম হয় দশরথের চার পুত্রের”।
অতএব রাম, লক্ষ্মণ, ভরত ও শত্রুঘ্নের ‘বায়োলজিক্যাল ফাদার’ দশরথ নন, মুনি ঋষ্যশৃঙ্গ। ‘ছাল’, ‘পায়েস’ খেয়ে কৌশলা রামের জন্ম দিয়েছেন–এটা যদি বিশ্বাস করতে বলেন, তাহলে রাম এবং রামায়ণ কিছুতেই ঐতিহাসিক হতে পারে না। অতএব অলৌকিক নয়, লৌকিক উপায়েই রাম ও অন্যান্য পুত্রদের জন্ম হয়েছিল। মুনিবর বাল্মীকি রামের জন্মতিথিও বলে দিয়েছেন–
“ততো যজ্ঞে সমাপ্তে তু ঋতুনাং ষট্ সমতায়ুঃ।
ততশ্চ দ্বাদশে মাসে চৈত্রে নাবমিকে তিথৌ৷৷
নক্ষত্রেদিতিদৈবততা স্বোচ্চসংস্থে্যু পঞ্চসু।
গ্রহেষু কর্কটে লগ্নে বাকপবিন্দুনা সহ৷৷”
এবং “পুষ্যে জাতন্তু ভরতো মীনলগ্নে প্রসন্নধীঃ।
সার্পে জাতৌ তু সৌমিস্ত্রী কুলীরে অ্যুদিতে রবো৷”
অসংখ্য বিয়ে করলেও, ৩৫০ টি স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও একটি স্ত্রীকেও তিনি সন্তান উপহার দিতে সক্ষম হননি। বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত তাঁর কোনো পুত্রসন্তান হয়নি।
তবে রাম ও ভ্রাতৃসকল ঋষ্যশৃঙ্গের ক্ষেত্রজ সন্তান একথা আমি মানছি না। দশরথ বৃদ্ধ বয়সেই পুত্র-সন্তান লাভ করেন এবং বৃদ্ধ বয়সেও সন্তানের পিতা হওয়া সম্ভব। এমন উদাহরণ ঝুড়ি ঝুড়ি আছে। দশরথ বৃদ্ধ হলেও তাঁর স্ত্রীরা বৃদ্ধা ছিলেন না। তাঁরা বয়সে দশরথের চেয়ে অনেক নবীন ছিলেন। অতএব রানিদের সন্তানধারণে কোনো অসুবিধা নেই। রানিরা সন্তানের মা হলেন, তবে তা স্বামীর দ্বারা নয়, অন্য পুরুষ দ্বারা। কৌশল্যার জ্যেষ্ঠ সন্তান শান্তা রোমপাদ মুনির দ্বারা। শান্তার স্বামী রোমপাদের ছেলে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি। রোমপাদের স্ত্রী বর্ষিণী হলেন কৌশল্যার বোন। রোমপাদের দ্বারা ক্ষেত্রজ সন্তান শান্তাকে লাভ করেন কৌশল্যা। সেই হিসাবে ঋষ্যশৃঙ্গ যেমন রোমপাদের নিজের ঔরসজাত সন্তান, অপরদিকে শান্তা ক্ষেত্রজ হলেও নিজের ঔরসজাত সন্তান।
রাজা দশরথের এই স্ত্রীরা সকলেই ক্ষত্রিয় ছিলেন, তা কিন্তু নয়। ছিলেন প্রচুর বৈশ্যা ও শূদ্রা স্ত্রীও। প্রধানা মহিষী কৌশল্যাকে অশ্বমেধের ফিরে আসা ঘোড়ার সঙ্গে রাত কাটাতে হয়েছিল, তেমনি যজ্ঞের পুরোহিতরা দশরথের অন্যান্য সকল (ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্রা) রানিদেরও ঘোড়ার সঙ্গে রাত কাটানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তবে জাতপাতের মূল্যায়নে এইসব স্ত্রীদের ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ও ছিল, তাতেই বোঝা যেত কোন্ রানি ক্ষত্রিয়া কোন্ রানি শূদ্রা। যেমন ক্ষত্রিয়া রানিদেরকে বলা হত মহিষী’, বৈশ্যা রানিদের বলা হত ‘বাবা’ এবং শূদ্রা রানিদের বলা হত ‘পরিবৃত্তি’। দশরথের যে বৈশ্যা-শূদ্রা স্ত্রী ছিল সে কথা বাল্মীকি তাঁর রামায়ণে অকপটে উল্লেখ করলেও কৃত্তিবাস, তুলসীদাস, কম্ব, রঙ্গনাথনের মতো স্বনামধন্য কবিরা ভুলেও উল্লেখ করেননি। কারণ ইতিমধ্যে সমাজে ব্রাহ্মণ্যবাদ জাঁকিয়ে বসেছিল। সমাজের ঘৃণার জিনিস ক্ষত্রিয়রাজার স্ত্রী শূদ্র হলে তো সত্যনাশ হয়ে যাবে যে!
যাই হোক, রামের বনবাসে বিদায় দেওয়ার সময় রাজা দশরথ সুমন্ত্রকে তাঁর সমগ্র স্ত্রীদের ডেকে আনতে বললেন এবং তিনি জানান সমগ্র স্ত্রীপরিবৃত হয়ে রামকে দর্শন করতে চান–“দারৈঃ পরিবৃতঃ সর্বৈঃ দ্রষ্টুমিচ্ছামি রাঘবম”। রাম বনে যাওয়ার সময় কৌশল্যা সহ আরও ৩৫০ মাতাকে প্রণাম করেছিলেন। দশরথের কিন্তু রামের বনবাসের ব্যাপারে একদম রাজি ছিলেন না। “বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা’ বলে কৈকেয়ীর প্রতি দশরথের যারপরনাই দুর্বলতা ছিল। কৈকেয়ী সরাসরি বর চেয়ে বসলে দশরথও সরাসরি ‘না’ বলতে পারেননি। এই দুর্বলতার কথা কৈকেয়ী যে জানতেন না, তা কিন্তু নয়। এমন প্রাণঘাতী বর চেয়ে বসলে যে বৃদ্ধ স্বামী মর্মাহত হবেন, সেকথা কৈকেয়ী জানতেন। সেই কারণেই কৈকেয়ী বরদুটো চাইতে গিয়ে দোনোমনো করছিলেন। কিন্তু মন্থরার জব্বর ব্রেনওয়াশে শেষপর্যন্ত বরদুটি চাইলেন কৈকেয়ী। দশরথের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। দশরথ বললেন–
“বালিশো বত কামাত্মা রাজা দশরথো ভৃশ৷
স্ত্রীকৃতে যঃ প্রিয়ং পুত্রং বনং প্রস্থাপয়িষ্যতি।”
কামুক রাজা, স্ত্রীর কথায় ছেলেকে বনে পাঠাল? রাস্তাঘাটের লোকেরা পর্যন্ত যার সম্বন্ধে বলেছে ‘কামাত্মা’, ‘কামবেগবশানুগ’। লক্ষ্মণ যেমন পিতাকে ‘কামুক’ বলে তিরস্কার করেছিলেন, রামও অনুরূপ ভাষায় তিরস্কার করেছিলেন। দশরথ নিজেও বেশ স্পষ্ট করেই জানতেন যে তিনি কামুক। লোকে যে বলে লোকে যে বলবে সে বিষয়ে দশরথ বিলক্ষণ অবগত। কৈকেয়ী-কামুকত্বেই দশরথ শেষ হয়েছে। রামের বনবাসও সেই কামুকতারই ফল। কামজৰ্জর রাজা তথা পিতা কৈকেয়ীর বিরুদ্ধে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে পারেননি। তবে প্রিয়পুত্র রামের জন্য দশরথ গর্জে উঠেননি, তা নয়–
“ন নাম তে কেন মুখাৎ পতত্যধো বিশীমানা দশনা সহস্রধাঃ।”
এইখানেই শেষ হয় না ক্রোধ, দশরথ বলেন–
“মা স্বাক্ষীঃ পাপনিশ্চয়ে…ন হি ত্বাং দ্রষ্টুমিচ্ছামি ন ভার্যা ন চ বান্ধবী…সকামা ভব কৈকেয়ী বিধবা রাজ্যমাবস।”
এটা রাজার মনের কথা, কঠিন বাস্তব। কৈকেয়ীর প্রেমে রাজা এতটাই ডগমগ ছিলেন যে, কৌশল্যা-সুমিত্রাদের এক্কেবারেই পাত্তা দিতেন না। কিন্তু অবস্থাকালে দশরথ স্বমূর্তি ধারণ করলেও কেকেয়ীর কাছে হারই মানতে হয় শেষপর্যন্ত।
কৈকেয়ীকে সবসময় তুষ্ট করে চলতেন স্বামী দশরথ। স্বামী দশরথ সেই কারণেই বড়ো রানি কৌশল্যাকে চরম অবহেলা করতেন, সেকথা কৌশল্যার আত্মকথনেই জানা যায়–
“ত্বয়ি সন্নিহিতে প্যেমহমাসং নিরাকৃতা। কিং পুনঃ প্রোষিতে তাত ধ্রুব মরণমেব মো… অত্যন্তং নিগৃহীতাস্মি ভর্তুর্নিত্যমসম্মতা… পরিবারেণ কৈকেয়্যাঃসমা বাপ্যথবাবরা.. তদক্ষয়ং মহ দুঃখং নোৎসহে সহিতুং চিরম্। বিপ্রকারং সপত্নীনামেবং জীর্ণাপি রাঘব”
অর্থাৎ “বাবা, তুই কাছে কাছে থাকতেই তোর বাবা আমার এই দশা করলেন, সেখানে তুই বনে গেলে আমার কপালে মরণ লেখা আছে।… তুই জানিসনে, বাবা, আমি সহ্য করেছি, কত অত্যাচার মাথা পেতে নিয়েছি, আসলে তোর বাবা আমায় দেখতেই পারে না।… এই যে ছোটোবৌ কৈকেয়ী, তার দাসীর চেয়েও অধম করে আমাকে রেখেছে।… এখন বুড়ি হয়ে গেছি, এই বয়সে আর সতীনের মুখ-ঝামটা সহ্য করতে পারব না, আমাকে তুই সঙ্গে নিয়ে চল বাবা।”
দশরথ জানতেন তাঁর প্রতিজ্ঞার কথা রামকে জানালে রাম বিনা কৈফিয়তে তা মেনে নেবেন, সে তাঁর বাধ্য সন্তান। রামের এই আত্মত্যাগ দশরথ সহ্য করতে পারবেন না, সেই কারণে দশরথও নিজের মুখে রামকে সেকথা বলতে পারেননি–সেকথা বলেছেন স্বয়ং কৈকেয়ী। রামও বিনা বাক্যব্যয়ে বনের পথে বাড়ালেন। এ কেমন পিতৃসত্য পালন! যেকথা ভেবে পিতা দশরথ বলতে পারলেন না, সেকথা পালন করার আগে একবারও পিতার কথা ভাবলেন না রাম! কার কথা রাখলেন রাম–পিতা দশরথের কথা, না বিমাতা কৈকেয়ীর? রামের (লক্ষ্মণ ও সীতা সহ) বনবাস যে পিতা হজম করতে পারবেন না, সেকথা কী একবারও রামচন্দ্রের মনে হয়নি? পিতৃসত্য পালন করতে গিয়ে তিনিই পিতার মৃত্যুর কারণ হলেন? নিজের মায়ের দুরবস্থার কী একবারও কানে ঢোকেনি রামচন্দ্রের? কেমন পুত্র তিনি? সেদিক থেকে লক্ষ্মণকে অবশ্যই ‘হ্যাটস অফ” জানাতে হয়। স্পষ্টবাদী লক্ষ্মণ সোজাসাপটা কথা বলেন। বাবা বলে দশরথকেও রেয়াত দেননি পুত্র লক্ষ্মণ। বলেছেন–
“এই নাকি আমার বাবা, বুড়ো বয়সে খোকা সেজেছেন।… ওঁর ভীমরতি ধরেছে।… মেনিমুখো পুরুষ, যিনি মেয়েছেলের কথায় ছেলেকে বনে পাঠান। এই বয়েসে এত কামুক হলে তিনি কিই-না বলতে পারেনা.. কৈকেয়ীর ওপরে গদগদ হয়ে তিনি যদি আমাদের সঙ্গেও শত্রুতা করেন, তবে মেরে ফেলাই উচিত।”
কী পাঠকবন্ধু আহত হলেন? পড়ন, মহাকবি বাল্মীকির ভাষায়–
“পুনর্বাল্যমুপেয়ুষঃ… বিপরীতশ্চ বৃদ্ধশ্চ স্ক্রিয়ো বাক্যবশং গতঃ .. নৃপঃ কিমিব ন ক্ৰয়াচ্চোদ্যমানঃ সমন্মথঃ।… বধ্যতাং বধ্যতামপি।”
লক্ষ্মণ এখানেই থেমে থাকেননি। ক্রোধ আরও ঊর্ধ্বগামী হয় তাঁর–
“হনিষ্যে পিতরং বৃদ্ধং কৈকয্যাসক্তমানসম্। কৃপণঞ্চ স্থিতং বাল্যে বৃদ্ধভাবেন গর্হিতম”।
অর্থাৎ “আমি মেরেই ফেলব; আমাদের উপর যার একটুও মায়া নেই আর কৈকেয়ীর উপর যাঁর এত মোহ, সেই কুচুটে কুৎসিত বুড়ো বয়সের রামখোকাটিকে আমি মেরেই ফেলব।”
লক্ষ্মণের এই প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক, কিন্তু রাম কীভাবে সব মুখ বুজে বেমালুম হজম করে গেলেন সেটা বোধের বাইরে। তা সত্ত্বেও লক্ষ্মণকে কোনোরূপ শাস্তি দেননি দশরথ। শাস্তি দিয়েছেন ভরতকে, ত্যাজ্যপুত্র করে বসলেন ভরতকে–
“সন্ত্যজামি স্বজঞ্চৈব তব পুত্ৰং ত্বয়া সহ।”
অযোধ্যায় বসে রামচন্দ্র তাঁর পিতা দশরথকে কটু কথা না-বললেও, চিত্রকুটে অবস্থানকালে গায়ের ঝাল মিটিয়ে লক্ষ্মণকে বলেছেন–
“কিং করিষ্যতি কামাত্মা কৈকেয্যা বশমাগতঃ”।
অর্থাৎ পিতাকে রামও ‘কামুক’ বললেন। কেবল পিতাই নয়, বিমাতা কৈকেয়ী উদ্দেশেও বললেন–
“অপি ন চ্যায়েৎ প্রাণান্ দৃষ্ট, ভরতমাগতম্”। এখানে বিমাতাকেও ‘খুনি’ বললেন রাম।
দশরথ পক্ষপাতদোষে দুষ্ট ছিলেন। পিতা হিসাবে রামের প্রতিই তাঁর একমাত্র দুর্বলতা। রামের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত স্নেহশীলতাই অন্যান্য পুত্রদের প্রতি উদাসীনতা দেখিয়েছেন চরমভাবে। শর্তানুযায়ী রাজ্যের অধিকার ভরতকে ছেড়ে দিতে হবে জেনেও তিনি অত্যন্ত গোপনে রাজ্যাভিষেকের জন্য রামকে প্রস্তুত করেছেন। এই প্রস্তুতি নিচ্ছিদ্র করার জন্য ভরতকে বছরের পর বছর মাতুলালয়ে ফেলে রেখেছিলেন। রামের বনবাসের আগে শেষ বারো বছর তো ভরতকে অযোধ্যা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলেন। ভরতের সঙ্গে সামান্য যোগাযোগ পর্যন্ত করেননি তিনি। রামকে বনবাসে পাঠিয়ে দশরথ যতটা ব্যথিত হয়েছিলেন, ভরতকে বনবাসে পাঠালে বিন্দুমাত্র ব্যথিত হতেন না, এ সিদ্ধান্তে আসাই যায়। লক্ষ্মণ, শত্রুঘ্ন তো অনেক দূরের কথা। রাম দশরথের কাছে এত প্রিয় ছিলেন যে, রামের অভিষেকের কথা পরম প্রিয়তমা কৈকেয়ীর কাছেও গোপন রেখেছিলেন। কৈকেয়ী, রাজ্যপাট ছেড়ে তিনি যাঁর ঘরেই সারাক্ষণ পড়ে থাকতেন। এর পরেই শেষরক্ষা করতে পারেননি দশরথ। “এই ক্রোধাগারে হয় প্রাণত্যাগ করিব, না-হয় ভরতকে রাজ্য দিব।”–প্রিয়তমা কৈকেয়ীর এমন কঠিন কথায় দশরথ টু ফাঁ পর্যন্ত করতে পারলেন না। কৈকেয়ী রণমূর্তি ধারণ করলেন, বললেন–
“তুমি এখন রামকে এই স্থানে আনাও এবং তাহাকে বনবাস দিয়া ভরতকে রাজা করো। তুমি আমার শত্রু দূর না-করিরা এ-স্থান হইতে এক পদও যাইতে পারিবে না।”
দশরথ বন্দি হলেন কৈকেয়ীর ক্রোধাগারে, অন্তরীণ হলেন। নিঃস্ব, অসহায় রাজা। যদিও একবার শেষবারের মতো গর্জে উঠে কৈকেয়ীকে ইতরভাষায় বলেছিলেন–
“এক্ষণে তোকে ও আমার ঔরসজাত পুত্র তোর ভরতকে পরিত্যাগ করিলাম। … আমি কিছুতেই তোর কথা শুনিব না৷ তোকে অবমাননা করিব এবং রামকে রাজ্য দিব।”
ওই পর্যন্তই। তারপর বুঝলেন রাজঅন্তঃপুর তাঁর জন্য প্রতিকূল। শেষপর্যন্ত একেবারে চুপসে গেলেন। গলার স্বর মিইয়ে গেল। শুধু পুত্রদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব ছিল না, পক্ষপাতিত্ব ছিল কমবয়সি স্ত্রী কৈকেয়ীর প্রতিও। কৈকেয়ীর প্রতি বেশি প্রেমপিরিতির কারণে কৌশল্যাকে তো অবজ্ঞা করেছেই, সুমিত্রার কোনো খোঁজখবর নিতেন বলে তো শুনিনি। কৈকেয়ীর সঙ্গে দশরথের বেশি ‘ঢলাঢলি’ তাঁর পুত্রদেরও চোখও এড়ায়নি।
রাম চোদ্দো বছরের বনবাসে গেলে দশরথ চরম আহত হন। সারথি সুমন্ত্র কৈকেয়ীর কাছ থেকে দশরথকে মুক্ত করে আনতে সমর্থ হন। রামের বনবাসের ষষ্ঠ দিন তাঁর মৃত্যু হয়। প্রাদেশিক রামায়ণে বলা হয়েছে পুত্রশোকেই নাকি পিতা দশরথের মৃত্যু হয়েছে। শোক কীসের? রাম তো মারা যাননি! তবে শ্বাপদশঙ্কুল দণ্ডকারণ্যে রামের নিশ্চিত মৃত্যু হবে, সেই আশঙ্কাতেইও শোক হতে পারে। শোক নয়, বলা যেতে পারে বিরহ। দশরথের অতি প্রিয় পুত্র ছিলেন রাম। রামকে যতটা স্নেহ করতেন দশরথ, তার ছিটেফোঁটা স্নেহও করতেন না অন্য পুত্রদের ক্ষেত্রে। বিরহ তো ছিলই, কিন্তু বিরহে মৃত্যু! বাল্মীকির রামায়ণে ঘটনার পারিপার্শ্বিক বিচার বলছে কিন্তু দশরথের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। চলে যাই বাল্মীকির রামায়ণে অযোধ্যা কাণ্ডে–
কৈকেয়ীর কবল থেকে মুক্ত দশরথ কৌশল্যার ভবনে অবস্থান করছেন। ভরতকে তিনি যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করতে একবিন্দুও রাজি নন। রাম বনবাসে চলে গেছেন। কিন্তু রামকে ফিরিয়ে আনা যায়, ফিরিয়ে এনে তাঁকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করবেন বলে দশরথ সিদ্ধান্তও নিলেন। অন্যদিকে কৈকেয়ীর অনুগামীরা রাজাদেশ ব্যতীত ভরতকে মাতুলালয় থেকে অযোধ্যায় ফিরিয়ে আনাও সম্ভব নয়৷ রাম ইতোমধ্যে বনবাসে চলে গেলেও দশরথ কিন্তু এখনও ভরতকে রাজ্যানুশাসনের দায়িত্ব সঁপে দেননি। কৈকেয়ীর অনুগামীদের এটাও বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, দশরথ যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন পর্যন্ত ভরতের পক্ষে অযোধ্যার রাজা হওয়া সম্ভব নয়। অতএব ভরতকে অযোধ্যার রাজা হতে হলে দশরথে মৃত্যু অনিবার্যই। রামের সন্দেহ অমূলক নয়। বনবাসের পথে রাম লক্ষ্মণকে সেই আশঙ্কাও প্রকাশ করে ফেললেন–
“কৈকেয়ীর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইয়াছে। ভরত উপস্থিত হইলে তিনি তাহাকে রাজ্যে অভিষেক করিবার নিমিত্ত রাজাকে আর প্রাণে বাঁচিতে দিবেন না।…ভরতকে রাজ্যে নিয়োজিত, আমাকে নির্বাসিত ও পিতার প্রাণান্ত করিবার নিমিত্তই কৈকেয়ী আসিয়াছেন।”
ষড়যন্ত্রের আঁধারে রাজান্তঃপুর থমথমে। দশরথ কৈকেয়ীর ঘরে ঢুকতে সাহস পাচ্ছেন না। কৌশল্যার ভবনে অবস্থান করেই তিনি রাজ্য চালাচ্ছেন। কেন? মৃত্যুভয়ে? বনবাসে এই মুহূর্তে রামের অবস্থান দশরথ উদগ্রীব হয়ে আছেন। সারথি সুমন্ত্র ফিরে এলেই জানবেন সব সংবাদ। বনবাসের ষষ্ঠদিনে সুমন্ত্র ফিরে এলেন অযোধ্যায়, দশরথের কক্ষে। সুমন্ত্রকে দশরথ বললেন–
“এক্ষণে তুমি আমাকে শীঘ্র রামের নিকট লইয়া চলো, তাহাকে না-দেখিয়া আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত হইয়াছে। আমি আজ্ঞা দান করিতেছি, তুমি রামকে প্রত্যায়ন করো।”
যে সাহস কৈকেয়ীর গৃহবন্দি থাকাকালীন অর্জন করতে পারেননি, সেই সাহস কৌশল্যার ঘরে বসে দেখিয়ে দিলেন দশরথ।
রাজাজ্ঞা মোতাবেক সুমন্ত্র রামকে অযোধ্যায় প্রত্যানয়ন করবেন এমনই কথা হয়ে রইল। রাত্রি নেমে আসায় তক্ষুনি যাওয়া সম্ভব হল না। অতএব পরদিন সকালে যাত্রা শুরু হবে। অতএব বিরহক্লান্ত দশরথ ঘুমিয়ে পড়লেন। সেই রাতেই দশরথের মৃত্যু হল, ষষ্ঠ রজনীর অধ্যামে। রামকে ফিরিয়ে আনা হবে এই আশ্বাসে যখন দশরথ ঘুমোতে গেলেন, তখন পুত্রশোকে কেন মরতে যাবেন! পুত্রশোকে মৃত্যু হয়েছে এমন পিতা এ পৃথিবীতে খুবই বিরল। এ মৃত্যু স্বাভাবিক হতে পারে না। ভরতের যে রাজা হওয়ার সম্ভাবনা নেই একথা কৈকেয়ী এবং কৈকেয়ীর অনুগামীরা নিশ্চয়ই ওয়াকিবহাল। কিন্তু দশরথ যে রামকে ফিরিয়ে এনে অযোধ্যার যৌবরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করার সংকল্প করেছেন সেকথা জানবে কী করে! এ সংকল্প তো কৈকেয়ীর ঘরে বসে হয়নি, এ ব্লুপ্রিন্ট তৈরি হয়েছে কৌশল্যার ঘরে বসেই–যেখানে সুমিত্রা, কৌশল্যা আর সুমন্ত্র ছাড়া কেউই। ছিলেন না। কেউ ছিলেন না মানে যে কেউ বুঝবেন না তা তো হয় না। সারা রাজবাড়ি যেখানে দশরথের প্রতিকূল, যেখানে ষড়যন্ত্র ছড়িয়ে আছে ইটপাথরের কোনায় কোনায়–তখন এ খবর চাপা থাকে কীভাবে! দশরথ যে শেষপর্যন্ত ভরত নয় রামকেই পছন্দ করেন, সেকথা কৈকেয়ীরা বিলক্ষণ জেনে গেছেন।
রাত্রি গভীর হয়েছে। দশরথ রানিদের অন্ধমুনির কাহিনি শুনিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। ঘুমিয়ে পড়েছেন কৌশল্যা, সুমিত্রাও। এত ঘুম! ঘুম এত গম্ভীর হল কেন যে, পরদিন ভোরের পরেও ঘুম ভাঙল না! বাল্মীকি বলছেন–“প্রাতঃকালে সুশিক্ষিত সুত, কুলপরিচয় দক্ষ মাগধ, তন্ত্ৰীনাদ নির্ণায়ক গায়ক ও স্মৃতিপাঠকগণ রাজভবনে আগমন করিল এবং স্ব স্ব প্রণালী অনুসারে উচ্চৈঃস্বরে রাজা দশরথকে আশীর্বাদ ও স্তুতিবাদ করিয়া প্রাসাদ প্রতিধ্বনিত করিতে লাগিল।” রাজার না-হয় মৃত্যু হয়েছে, তিনি আর উঠবেন না। কিন্তু এত কোলাহল আর হৈ হুল্লোড়ে কৌশল্যা, সুমিত্রার ঘুম ভাঙবে না! তাহলে কি গভীর রাতে কেউ এ ঘরে ঢুকে ঘুমের কিছু প্রয়োগ করে দিয়েছিলেন? দশরথের মৃত্যু কি তবে ঘুমের মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ প্রয়োগে মৃত্যু হয়েছে? রাম তো এরকমই সন্দেহ করেছিলেন–“অপি ন চ্যায়েৎ প্রাণান্ দৃষ্টা ভরতমাগতম্”–“ভরত অযোধ্যায় এসে গেছে। তাকে দেখে জোর পেয়ে কৈকেয়ী আবার দশরথকে প্রাণে মেরে না-ফেলেন।” না, ভরতের অযোধ্যায় ফিরে আসা পর্যন্ত কৈকেয়ী অপেক্ষা করেননি। তার আগেই অযোধ্যাকে কাঁটামুক্ত করে রেখেছেন ভরতমাতা। রাজবাড়ির সেই অস্বাভাবিক ঘটনার পোস্টমর্টেম হয়নি, ফরেনসিক রিপোর্ট নেই, সিবিআই তদন্ত হয়নি। উত্তর খোঁজাও আজ তাই বৃথা। যাই-ই হোক, দশরথের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই প্রাসাদ-বিপ্লবের পরিসমাপ্তি ঘটে। মনে হতে প্রাসাদ-বিপ্লবের শেষ হয়ে গেছে। প্রাসাদ-বিপ্লব এত সহজেই শেষ হয়ে যায় না। বনবাস উতরে রাবণের সঙ্গে যুদ্ধশেষে অযোধ্যায় ফিরে এসে পুনরায় প্রাসাদ-বিপ্লব হয়ে গেল। সে কথা অন্য অধ্যায়ে আলোচনা করা যাবে।
সীতা : তেজস্বিনী, পতিব্রতা এবং নার্সিসিস
সীতা কে? একটাই উত্তর, রামের স্ত্রী। বড়োজোর জনকরাজার দুহিতা। উত্তরকাণ্ডকে বাদ রাখলে সীতার আর কোনো পরিচয় বাল্মীকি দেননি। সীতার বিবাহের সময় বরকর্তা বিশ্বামিত্রকে সীতার যেটুকু জন্মবৃত্তান্ত জনকরাজা সীরধ্বজ প্রয়োজন মনে করেন, সেটুকু হল হলকর্ষণ করে এ কন্যাকে পেয়েছেন। আসলে সীতা যে জনকরাজা সীরধ্বজের ঔরসজাত কন্যা নয়, সেটাই কায়দা করে পাত্রপক্ষকে জানিয়ে দেওয়া আর কী। সীতা হল রামের স্ত্রী। বাল্মীকির রামায়ণে বালকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ডে রামকে নারায়ণ, বিষ্ণু বা বিষ্ণুর অবতার হিসাবে মেলে ধরা হয়েছে। রাম পূজ্য, তাই তাঁর হিসাবে সীতাদেবীও পূজ্যা! রাম বিষ্ণুর অবতার হলে, সীতা স্বাভাবিক নিয়মেই লক্ষ্মীর অবতার। বিষ্ণু কে? বিষ্ণুপুরাণে পরাশর বলছেন–
“এই বিশ্বের উৎপত্তি বিষ্ণু থেকে। এর স্থিতিও তাঁরই মধ্যে, এটি এক ছন্দোময় সুসম্বন্ধ ব্যবস্থা। বিষ্ণুই এর একমাত্র রক্ষাকর্তা, একমাত্র নিয়ন্তা, আর আসলে এই বিশ্বই তিনি৷”
বাল্মীকি রামায়ণে সীতা ক্ষত্রিয়াণী, বীরাঙ্গনা, বঙ্গে এসে কৃত্তিবাস প্রমুখ বাঙালি কাছে সীতা হয়ে গেলেন গৃহস্থ ঘরের কোমলমতি অসহায় বধূ। অপরদিকে রাজস্থানে তিনি মধ্যযুগের রাজপুতানি, কেরলে তিনি কেরল সীমন্তিনী, তুলসীদাস প্রমুখ কবিদের কাছে তিনি উত্তর ভারতের লজ্জাশীলা অথচ তেজোদৃপ্তা কুলবধূ। সীতা মহিয়সী বীরাঙ্গনা–অথচ আমরা বাঙালি ঘরের ‘জনম-দুখিনী’ লাজুক বধূ সীতাকেই জানি।
রামায়ণের কেন্দ্রীয় বা প্রধান নারী চরিত্র যিনি সেই সীতা নেপালে অবস্থিত জনকপুরে জন্মগ্রহণ করেন। কোথাও-বা বলা হয়েছে জনক মিথিলার রাজা। প্রাচীন ভারতে মিথিলা কি জনকপুরের অন্তর্ভুক্ত ছিল? মিথিলাই-বা কোথায় ছিল? একটু খোঁজার চেষ্টা করব। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, রামায়ণে যেমন মিথিলার কথা জানতে পাই, তেমনই মিথিলার কথা জানতে পারি বিদ্যাপতির কল্যাণে। পঞ্চদশ শতকের মিথিলার কবি ছিলেন বিদ্যাপতি। প্রাচীন ভারতের পূর্বদিকে ছিল বিদেহ রাজ্য, মিথিলা ছিল বিদেহ রাজ্যের রাজধানী। বর্তমানে উত্তর বিহারের তিরহুত জেলা ও দক্ষিণ নেপালের জনকপুর মিলিয়ে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন বিদেহ রাজ্য। এই বিদেহ রাজ্যের রাজা ছিলেন সীরধ্বজ, যিনি জনকরাজা নামেই পরিচিত। অতএব সীতা মিথিলাবাসী, ভাষা মৈথিলী। বিদেহ রাজ্যের কন্যা বলে সীতার অন্য নাম ‘বৈদেহী’। আবার অনেকে বলেন সীতার পালক পিতা জনক বিশেষ শক্তিবলে নিজের দেহকে অদৃশ্য করে রাখতে পারতেন, তাই তাঁর নাম বিদেহ। বিদেহর কন্যা বলে সীতা হলেন ‘বৈদেহী’।
হিন্দুসমাজে তাকে আদর্শ স্ত্রী তথা আদর্শ নারীর উদাহরণ হিসাবে মনে করা হয় সীতাকে। সীতা মূলত তাঁর উৎসর্গীকরণ, আত্মবিসর্জন, সাহসিকতা এবং বিশুদ্ধতার জন্যে পরিচিত হয়। বাল্মীকির রামায়ণে হলকর্ষণ করতে গিয়ে জনকরাজা সীরধ্বজ জমি থেকে সীতাকে পেয়েছেন। এর বেশি কাহিনি বাল্মীকি শোনাননি। বিবাহের আসরে জনকরাজা বলেছেন–
“অনন্তর একদা আমি হল দ্বারা যজ্ঞক্ষেত্র শোধন করিতেছিলাম। ওই সময় লাঙ্গল পদ্ধতি হইতে এক কন্যা উখিতা হয়। ক্ষেত্র শোধনকালে হলমুখ হইতে উত্থিত হইল বলিয়া আমি উহার নাম সীতা রাখিলাম। এই অযোনিসম্ভবা তনয়া আমার আলয়েই পরিবর্ধিত হইতে লাগিল।”
অর্থাৎ সীতার জন্ম স্বাভাবিকভাবে মাতৃগর্ভে হননি বলে সাব্যস্ত করার চেষ্টা। সীতা সীরধ্বজের দত্তককন্যা?
বাল্মীকি সরাসরি কিছু না-বললেও সীতা কখনোই অযোনিসম্ভবা নন, তাঁর জন্ম কোনো-না-কোনো মাতৃগর্ভেই হয়েছে। দিবাকর ভট্টের ‘কাশ্মীরি রামায়ণ এবং কৃত্তিবাসের ‘শ্রীরাম পাঁচালি’ এবং ‘অদ্ভুত রামায়ণ’ থেকে জানা যায়, সীতা হলেন রাবণ ও মন্দোদরীর মেয়ে। প্রত্যেকের কাহিনি অল্পবিস্তর হলেও কাহিনির অভিমুখ প্রায় একই। প্রাদেশিক এইসব কবিরা বলেছেন, তাঁর জন্মের আগে গণকরা জানিয়েছিলেন, সীতা রাবণের মৃত্যু এবং বংশের ধ্বংসের কারণ হবেন। দেবীভাগবত পুরাণ’-এ বলা হয়েছে–রাবণ যখন মন্দোদরীকে বিবাহ করতে চান, তখন ময়াসুর রাবণকে সাবধান করে বলেন যে, মন্দোদরীর কোষ্ঠীতে আছে, তাঁর প্রথম সন্তান তাঁর বংশের ধ্বংসের কারণ হবে। তাই এই সন্তানটিকে জন্মমাত্রই হত্যা করতে হবে। ময়াসুরের উপদেশ অগ্রাহ্য করে রাবণ মন্দোদরীর প্রথম সন্তানকে একটি ঝুড়িতে করে জনকের নগরীতে রেখে আসেন। জনক তাঁকে দেখতে পান এবং সীতারূপে পালন করেন। বাসুদেবহিন্দি, উত্তরপুরাণ ইত্যাদি জৈন রামায়ণেও সীতাকে রাবণ ও মন্দোদরীর কন্যাই বলা হয়েছে। এই সব গ্রন্থেও উল্লেখ আছে যে, সীতা রাবণ ও তাঁর বংশের ধ্বংসের কারণ হবেন বলে ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছিল, তাই রাবণ তাঁকে পরিত্যাগ করেন।
মালয় ‘সেরি রামা’ ও জাভানিজ ‘রামা কেলিং’ গ্রন্থে রয়েছে, রাবণ রামের মা মন্দোদরীকে বিবাহ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর পরিবর্তে তাঁরই মতো দেখতে এক ছদ্ম-মন্দোদরীকে রাবণ বিবাহ করেন। রামের পিতা সেই ছদ্ম-মন্দোদরীকে সম্ভোগ করেছিলেন। তাঁর ঔরসে ছদ্ম-মন্দোদরীর গর্ভে সীতার জন্ম হয়। এইভাবে সীতা নামেমাত্র রাবণের কন্যারূপে পরিচিত হন। “আনন্দ রামায়ণ অনুসারে, রাজা পদ্মাক্ষের পদ্মা নামে এক কন্যা ছিল। তিনি ছিলেন লক্ষ্মীর অবতার। যখন পদ্মার বিবাহ স্থির হয়, তখন রাক্ষসরা রাজাকে হত্যা করে। শোকাহত পদ্মা আগুনে ঝাঁপ দেন। রাবণ যখন পদ্মার দেহটি পান তখন তা পাঁচটি রত্নে পরিণত হয়েছিল। রাবণ একটি পেটিকায় ভরে সেটিকে লঙ্কায় নিয়ে আসেন। মন্দোদরী পেটিকা খুলে ভিতরে পদ্মাকে দেখতে পান। তিনি রাবণকে উপদেশ দেন পিতার মৃত্যুর কারণ দুর্ভাগিনী পদ্মা সহ পেটিকাটি জলে ভাসিয়ে দিতে। রাবণ যখন পেটিকার ঢাকনা বন্ধ করছিলেন, তখন পদ্মা রাবণকে অভিশাপ দিয়ে বলেন যে, তিনি লঙ্কায় ফিরে আসবেন এবং রাবণের মৃত্যুর কারণ হবেন। রাবণ পেটিকাটি জনকের নগরীতে প্রোথিত করেন। জনক পদ্মাকে পেয়ে সীতারূপে পালন করেন।
বাল্মীকি রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে অগস্ত্যমুনি রামকে যে রাবণের কাহিনি শোনাচ্ছিলেন তাতে বেদবতী নামে এক সুন্দরী কন্যাকে পাওয়া যায়। সীতা পূর্বজন্মে ছিলেন বেদবতী নামে এক পুণ্যবতী নারী। রাবণ তাঁর শ্লীলতাহানি করতে চাইলে তিনি রাবণকে অভিশাপ দেন যে, তিনি পরবর্তী জন্মে রাবণকে হত্যা করবেন। বেদবতী হলেন বৃহস্পতির পুত্র কুশধ্বজের কন্যা। ইনিই জন্মান্তরে মিথিলার রাজা জনকের গৃহে সীতা রূপে জন্ম লাভ করেন। ব্রহ্মর্ষি কুশধ্বজ লক্ষ্মীকে নিজের কন্যা হিসাবে পাওয়ার জন্য কঠোর তপস্যা শুরু করেন। তাঁর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে লক্ষ্মী তাঁর কন্যা রূপে জন্ম নিতে রাজি হন। একদিন যখন কুশধ্বজ বেদ পাঠ করছিলেন, সেই সময় লক্ষ্মী বাত্ময়ী মূর্তিতে জন্মগ্রহণ করেন। ইনি অযযানিসম্ভবা ছিলেন! কুশধ্বজ ও তাঁর স্ত্রী মালাবতী তাঁকে নিজের কন্যা রূপে স্বীকার করেন। বেদ পাঠকালে জন্ম লাভ করায় এঁর নাম হয় বেদবতী। একদিন রাবণ পায়চারী করতে করতে লক্ষ করলেন দেবীর মতো সুন্দরী কন্যা তপস্যা করছেন। রাবণ তাঁর পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে তিনি তাঁর সবিস্তারে জানিয়ে দেন। তিনি রাবণকে অতিথি হিসাবে সম্মান প্রদর্শনও করেন। কিন্তু ‘লেডিকিলার’ রাবণ তাঁকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। কিন্তু বেদবতী রাবণের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। রাবণ ক্ষুব্ধ হলেন, অপহরণ করার জন্য যেই-না বেদবতীর কেশস্পর্শ করলেন, তৎক্ষণাৎ বেদবতীর হাতখানি তরবারি হয়ে যায়। রাবণের যে হাত তাঁর কেশস্পর্শ করেছিল সেই হাত কর্তন করে দিলেন। এরপর নিজেই চিতা জ্বালিয়ে আত্মাহুতি দিলেন এবং হুঁশিয়ারি দিয়ে বললেন–
“বর্বর রাক্ষস, তোর হাতে ধর্ষিত হয়ে আমি আর জীবিত থাকতে চাই না। তোর সবংশে নিধনের জন্য আমি কোনো ধার্মিকের গৃহে অযযানিজা কন্যা রূপে পুনরায় জন্ম নেব।”
সেই কন্যাই সীতা রূপে রামের ঘরে রামের স্ত্রী হলেন।
সীতার পূর্বজন্মের বেদবতীর সম্বন্ধে আর দু-চারটে কথা না বললেই নয়। বেদবতীও লক্ষ্মীর অবতার ছিলেন। বেদবতী বিষ্ণুর অপেক্ষায় ছিলেন আমৃত্যুকাল। বিষ্ণুকেই তিনি পতিরূপে কল্পনায় গ্রহণ করেছেন। বিষ্ণু ছাড়া তিনি আর কারোকেই পতি বলে স্বীকার করতে পারবেন না। বেদবতী অতীব সুন্দরী ছিলেন। কেমন সুন্দরী ছিলেন? শেখর সেনগুপ্ত বলেছেন–
“কৃষ্ণবর্ণ হরিণচর্মে উর্ধাঙ্গ ও নিম্নঙ্গ আচ্ছাদিত। প্রশস্ত জঘা, ক্ষীণ কটিদেশ, সুপক্ক আম্রের ন্যায় স্তনযুগল, বিশাল তৃষ্ণার্ত মেঘসমান কেশসম্ভার, দুই আয়ত লোচনে নারীর চিরন্তন প্রণয়তৃষ্ণা।”
জঙ্গলে যেসব রাজা-যক্ষ-দক্ষ-দৈত্য-দানো মৃগয়ায় আসতেন তারাই তপোবনের কন্যা দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়তেন, কামসিক্ত হতেন। কেবল রাবণই নয়, এর আগে বহু পুরুষ বেদবতীকে কামনা করে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। কারণ বেদবতীর স্বামী একমাত্র বিষ্ণুই, দ্বিতীয় অন্য অন্য কেউ হতে পারে না। সীতার সঙ্গে বেদবতীর চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্যটির খুব সাদৃশ্য। রাবণের আগে দৈত্যরাজ শম্ভ বেদবতীকে কামনা করে। দৈত্যরাজ শম্ভ সমুদ্র মন্থনকালে অসুরদের সঙ্গে দেবতারা বেইমানি করেছিলেন বলে দেবতাদের স্বর্গ শুধু নয়, মর্ত্য ও পাতালের অধিকার পেতে বদ্ধপরিকর। তো এহেন দৈত্য অরণ্যে পরিভ্রমণকালে বেদবতীকে দেখে কামাতুর হয়ে পড়লেন। বেদবতীকে কামনা করলেন পিতা কুশধ্বজের কাছে। প্রত্যাখ্যাত হলে ক্রোধে অগ্নিশর্মা হলেন শম্ভু। অনিয়ন্ত্রিত হুঙ্কার ছাড়লেন শম্ভ। সেই হুঙ্কারে বেদবতীর পিতা ও মাতা উভয়রই মৃত্যু হয়। এরপর অনেক খুঁজেও বেদবতীকে পাননি। সেদিন পালিয়ে দৈত্যরাজ শম্বুর হাত থেকে রক্ষা পেলেও ভুবনবিজয়ী লঙ্কার রাজা রাবণের হাত থেকে নিজেকে আর রক্ষা করতে পারলেন না বেদবতী। রাবণ সরাসরি বেদবতীকে প্রস্তাব দিলে প্রত্যাখ্যাত হন। কামক্ষিপ্ত অপমানিত রাবণ বেদবতীর কেশরাশি ধরে টেনে আনলে বেদবতী কেশত্যাগ করেন। এরপর চারধারে আগুন জ্বালিয়ে বেদবতী স্বেচ্ছামৃত্যুবরণ করলেন। আত্মবিসর্জনের সময় রাবণকে বলে গেলেন–“তুই আমাকে যেভাবে অপমান করলি, তার শাস্তি তোকে পেতেই হবে।”
এখন প্রশ্ন–বেদবতীও লক্ষ্মী বা লক্ষ্মীর অবতার, বিষ্ণুর বাগদত্তা। সেই বেদবতীকে দৈত্যরাজ শম্ভ ও রাক্ষসরাজরাজ রাবণের হাত থেকে রক্ষা করতে পারলেন না বিষ্ণু, এমনকি এদের বধ পর্যন্ত করতে পারলেন না। সেই রাবণকে বধ করতে বেদবতীকে সীতা হয়ে জন্মানোর প্রয়োজন কোথায়? কী এমন হল যেটা সীতার ক্ষেত্রে সম্ভব হল, অথচ বেদবতীর ক্ষেত্রে হল না! সীতাকে লাঞ্ছনা করার জন্য যদি রাবণকে বধ করা ন্যায্যত করা হয়, তাহলে এত যুদ্ধ-ফুদ্ধের কী প্রয়োজন! যুদ্ধ মানে তো উভয়পক্ষের অসংখ্য প্রাণের বিনাশ। যদি রাবণকে হত্যা করাই উদ্দেশ্য হয়, তাহলে এত প্রাণের বিনাশ কেন! কেনই-বা বালীকে হত্যার মতো এমন জঘন্য কাজ করতে হবে? কেন বিভীষণকে ভ্রাতৃঘাতীতে পরিণত করতে হবে? কেন মেঘনাদ, কুম্ভকর্ণদের মতো বীরদের হত্যা করতে হবে? এঁরা তো সীতা বা অন্য কোনো নারীকে টেনে এনে অপমান করেননি! বিষ্ণুকে প্রতিষ্ঠা করতেই রাম-লক্ষ্মণ-ভরত-শত্রুঘ্নর কাঁধে বিষ্ণুকে চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস?
সীতাও লক্ষ্মী, সীতামাঈ। একথা কিন্তু মানতেই হবে, অগস্ত্যমুনির গল্প অনুসারে সীতা নয়, বেদবতীই রাবণের মৃত্যুর কারণ। তাই-বা বলি কী করে, তাহলে তো স্বৰ্গবেশ্যা পুঞ্জিকস্থলী ও রম্ভার অভিশাপবাণীর গল্পটির কোনো মানেই হয় না। প্রথমজনে হয়ে অভিশাপ দিলেন স্বয়ং ব্রহ্মা, দ্বিতীয়জনের ক্ষেত্রে অভিশাপ দিলেন নলকুবর। অভিশাপটি ছিল এইরকম–রাবণ যদি জোর করে কোনো রমণীকে উপভোগ করে তাহলে সেই মুহূর্তে তাঁর মাথা ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। পুঞ্জিকস্থলী সীতাহরণের আগের কাহিনি, রম্ভা সীতাহরণের পরের কাহিনি। এর আগে-পরে-মাঝে রাবণ অসংখ্য নারীকে জোর করে ভোগ করেছেন বা ভোগ করার চেষ্টা করেছেন, তা সত্ত্বেও কিন্তু রাবণের মাথা ফেটে চৌচির হয়ে যায়নি। অনিয়ন্ত্রিত কল্পনায় পাখা মেলা বোধহয় একেই বলে! তাহলে কী বুঝব বিষ্ণুর মাহাত্ম্য প্রচার করতেই এইসব ‘অপার্থিব’ গল্পের অবতারণা?
‘রামায়ণ’-এর কিছু অন্য এক রচনা থেকে জানা যায়, রাবণ সীতাকে হরণই করেননি। যাকে রাবণ হরণ করেছিলেন, সে নাকি মায়াসী। দেবী পার্বতী আসল সীতাকে লুকিয়ে রেখেছিলেন এবং রাম-রাবণের যুদ্ধের পরে আসল সীতা প্রকট হন। মায়াসীতা নাকি পরে দ্রৌপদী হিসাবেও জন্মগ্রহণ করেন। তাহলে লক্ষ্মী থেকে বেদবতী, বেদবতী থেকে সীতা, সীতা থেকে দ্রৌপদী, দ্রৌপদী থেকে….। না, এরপর আর কোনো এমন মহাকাব্য লেখা হয়ে ওঠেনি, যাতে আর কোনো ধ্বংসের কারণ’ নারীর জন্ম নিতে পারে। এমনও হতে পারে, যেহেতু পৃথিবীতে আর কোনো রাবণ বা রাবণের মতো দুশ্চরিত্র’ পুরুষ জন্মায়নি, তাই এমন ‘অগ্নিকন্যা’রও জন্ম নেওয়ার প্রয়োজন হয়নি।
রামায়ণ অনুসারে, সীতা পৃথিবীর কন্যা এবং জনকের পালিতা কন্যা। জনক কারোর নাম নয়, জনকপুর থেকে জনক–দেশের নাম। আধুনিক নেপালের দক্ষিণ সীমান্ত এবং পাটনার প্রায় চল্লিশ ক্রোশ উত্তর-পূর্বে জনকপুর অবস্থিত। মিথিলার রাজাদেরকে ‘জনক’ উপাধিতে সম্মানিত করা হত। সীতার পালিত পিতা জনকপুরার রাজার নাম সীরধ্বজ (ধর্মধ্বজ?)। কেউ বলেন জানকীকুণ্ড নামে একটি পুকুরের কাছে মিথিলেশ্বর সীতাকে পেয়েছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেন সীতামাড়ীর তিন মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে পনৌড়া গ্রামে ‘জনক’ সীরধ্বজ সীতাকে পেয়েছিলেন। রামায়ণে বর্ণিত আছে, ক্ষেত্ৰকৰ্ষণকালে জনকরাজা সীরধ্বজ লাঙ্গলের ফালে এক কন্যাশিশু পান। এই ক্ষেত্ৰকৰ্ষণকে বলে ‘লাঙ্গল-পদ্ধতি। লাঙ্গল-পদ্ধতির অন্য নাম ‘সীতা। সীতার জন্মসূত্রকে রহস্যাবৃত রেখে বলা হয়েছে যে সীতা ‘অযোনিজা’। মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠ বলেছেন–
“ত্বষ্টা প্রজাপতিঃ স্বয়মেব সঙ্কল্পেন চকার, ন তু মৈথুনদ্বারা, অযোনিজাম্ ইত্যর্থ।
সীতা যে অযোনিজা, তার কোনো সমর্থন অন্য রামায়ণে মেলে না। এই মুহূর্তে মন্দোদরীর দুটো কাহিনি উল্লেখ করতে পারি। এক, মন্দোদরীর প্রথম সন্তান ছিল বিয়ের আগে। যাকে সে জঙ্গলে ফেলে এসে রাবণকে বিয়ে করে। দুই, রাবণকে বিয়ের পরেই সে প্রথম সন্তান। রাবণ আর মন্দোদরী দুইজনে পরামর্শ করে সেই সন্তানকে জঙ্গলে ফেলে আসে। সংস্কৃত ভাষায় রচিত ‘অদ্ভূত রামায়ণ’ গ্রন্থে এ বিষয়ে এক ব্যাপক গপ্পো আছে, সেটা একটু শোনাতে ইচ্ছে করছে–রাবণ ত্রিভুবন (স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল) জয় করে দণ্ডকারণ্যে (দাক্ষিণাত্যের পূর্বভাগ) অবস্থান করলেন। জয়ের দম্ভে এবার তাঁর মনে হল ঋষিদের পিছনে লাগলে কেমন হয়! এঁরা কেমন অগ্নিতেজী একটু চেখে দেখা যাক। যেই ভাবা সেই কাজ। না, তাঁদের হত্যা করার কথা ভাবলেন না, ঋষিদের শরীরে বাণের খোঁচা মেরে রক্তাক্ত করতে থাকলেন। শুধু রক্তাক্তই করলেন না, সেই রক্ত সংগ্রহ করে একটি কলসীতে ধারণ করলেন। কলসীটি কিন্তু পূর্বে ফাঁকা ছিল না, তাতে ছিল মন্ত্রপূত’ দুধ। এই মন্ত্রপূত দুধ সংগ্রহ করে রেখেছিলেন ঋষি গৃৎসমদ, ইনি শতপুত্রের পিতা। ইনি স্বয়ং লক্ষ্মীকে কন্যা হিসাবে পাওয়ার জন্যই সেই কলসীটিতেই প্রতিদিন মন্ত্রপূত দুধ সংগ্রহ করছিলেন, যেই কলসীটিতে রাবণ ঋষিদের রক্ত সংগ্রহ করছিলেন। যাই হোক, রাবণ তো এর দুধ মিশ্রিত রক্ত নিয়ে চলে এলেন লঙ্কায়। লঙ্কায় এসে রাবণ স্ত্রী মন্দোদরীকে পইপই করে বলে দিলেন–সাবধান গিন্নি, এই কলসীর ভিতর মুনিঋষিদের রক্ত আছে, যা বিষের থেকেও ভয়ংকর! এই বলে তিনি পর্বতে পর্বতে বেরিয়ে পড়লেন সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে কামকেলি করার জন্যে। এ ঘটনায় মন্দোদরীর খুব মনঃকষ্ট হল। দীর্ঘকাল যুদ্ধ করে ফেরার পর কোথায় তাঁর সঙ্গে আদর-সোহাগ করবে, সেখানে তাঁকে অবজ্ঞা করে অন্য মেয়েদের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি! কষ্ট সহ্য করতে না-পেরে তিনি নিজের জীবন শেষ করে দেবেন ভাবলেন। অতএব হাতে আছে এই বিষের চেয়ে ভয়ংকর রক্ত, যা পান করলেই এক লহমায় মৃত্যু। উঁহু, মৃত্যু তো হলই না, উল্টে রক্ত পান করে মন্দোদরী গর্ভবতী হয়ে গেলেন–পান করার মুহূর্তেই পূর্ণমাস। লজ্জায়-ঘৃণায় তিনি তীর্থদর্শনের বাহানা দিয়ে পথে বেরিয়ে পড়লেন। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলেন কুরুক্ষেত্রে, এখানেই তিনি গর্ভমুক্ত হলেন। কী করবেন তিনি এ সন্তান নিয়ে, অতএব ‘ফেক দে কাঁচড়া মে’। না, তিনি সদ্যোজাত সন্তানকে কাঁচড়াতে ফেলেননি, তিনি সেখানেই মাটি তে চাপা দিয়ে দিলেন সদ্যোজাতকে এবং কাছেই সরস্বতীর জলে স্নান সেরে শুদ্ধটি হয়ে বাড়ি ফিরলেন। মহারাজ জনক হলকর্ষণ করতে এসে তাঁর লাঙ্গলের উঠে এল একটি কন্যা সন্তান, নাম দিলেন সীতা।
পণ্ডিত নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী তাঁর ‘সীতা’ প্রবন্ধে লিখেছেন–
“ক্ষত্রিয় রাজা নিজে লাঙল হাতে কৃষিকার্য করছেন, এটা তৎকালীন সমাজে প্রায় অসম্ভব এক কল্পনা। বিশেষত খোদ রামায়ণের মধ্যেই যেখানে স্বধর্ম ত্যাগ করে শূদ্র শম্বুক ব্রাহ্মণোচিত তপস্যা করার জন্য শাস্তি লাভ করেন, সেখানে রাজর্ষি জনক ধর্মধ্বজ লাঙল দিয়ে জমির ফসলযোগ্যতা তৈরি করছেন, এটা খুব স্বাভাবিক কথা নয়, সমাজসংগত তো নয়ই সেকালের দিনের নিরিখে। জনক ধর্মধ্বজ এই ব্যবহারের মধ্যে যে একটা সামাজিক বৈপরীত্য আছে এবং সেটা যে আমরা ঠিক ধরেছি, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে পরম্পরাবাহী রামায়ণ-টীকাকারদের চেষ্টাকৃত সমাধান-কল্পনার মধ্যে। ওঁরা বলেছেন–না, না, জনক ধর্মধ্বজ সাধারণ কৃষকের মতো লাঙল দিয়ে জমি চাষ করছিলেন না, তিনি অগ্নিচয়নের জন্য যজ্ঞভূমি কর্ষণ করছিলেন। টীকাকারেরা শাস্ত্র উদ্ধার করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের কাছে যজ্ঞভূমির একটা অন্য মর্যাদা ছিল। যজ্ঞের জন্য যজ্ঞভূমি চাষ করাটা কোনো হেয় কাজ নয়, বিশেষত অগ্নিচয়নের জন্য এটা-ওটা শস্যেরও প্রয়োজন হত, অতএব তার জন্য একেবারে ছ-ছটা গোরু জুড়ে লাঙল হাতে চাষ করতে লজ্জা পেতেন না। ব্রাহ্মণেরা এবং রাজ-রাজড়ারাও। এখনকার পণ্ডিত গবেষকরা জানিয়েছেন যে, এই যজ্ঞভূমিতে লাঙল ছোঁয়ানোর ব্যাপারটা অনেকটাই প্রতীকী। কেননা ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের মতো উচ্চবর্ণের জাতকেরা জমি চাষ করার ব্যাপারটা খুব মর্যাদাসম্পন্ন মনে করতেন না। কিন্তু যজ্ঞভূমি বলে কথা, সেখানে যজ্ঞকর্মের মর্যাদায় একটু আধটু লাঙল ছুঁয়ে হলকর্ষণের আরম্ভটুকু করে দিলেই অধস্তন কৰ্ষক-চাষিরা লাঙল ধরে নিত। এত কথা বলছি। এই জন্য যে, সীতাকে জনক ধর্মধ্বজ নিজেই লাঙলের রেখাদীর্ণ ভূমিতে আবিষ্কার করেছিলেন, নাকি অন্য কেউ, নাকি তেমন কোনো কঠিন-হৃদয় মানুষ জনকের যজ্ঞভূমিতে রেখে গিয়েছিল এক শিশুকন্যাকে, সেই সন্দেহটা বড়ো প্রবল হয়ে ওঠে। অলৌকিকতায় বিশ্বাস করলে ঠিক আছে–তাহলে তো জনক ধর্মধ্বজের যজ্ঞভূমির মাটির তলায় এক শিশুকন্যা নিশ্বাসান্ধ অবস্থায় পড়ে ছিলেন, আর লাঙলের ফলায় নিচের মাটি উপরে উঠতেই পুরাতন প্রত্নমূর্তির মতো ভূমিকন্যা সীতা উঠে এলেন উপরে। ধর্মধ্বজ তাঁকে কোলে করে নিয়ে রানির কোলে দিলেন। ব্যস! নটে গাছ মুড়িয়ে গেল। কিন্তু ব্যাপারটা অত সহজ নয় বলেই এবং তেমন বিশ্বাসযোগ্য নয় বলেই হয়তো সীতার জন্ম নিয়ে এত গল্প, এত রহস্য তৈরি হয়েছে। রহস্য তৈরি হওয়ার মূল কারণ অবশ্যই এই যে, সীতা ধর্মধ্বজ জনকের নিজের মেয়ে নন।”
কাহিনিগুলি থেকে জানা যায়, সেই জঙ্গলে বা জলে বা জমিতে পরিত্যাগ করা সন্তানটি ছিল কন্যা। সেই ট্র্যাডিশন আজও চলছে। আজও কন্যাসন্তান জঙ্গলে-আস্তাকুড়ে-ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে যায় স্বয়ং মা, কিংবা বাবা কিংবা মা-বাবা উভয়ই। পরিত্যক্ত কন্যাসন্তান যত্রতত্র কুড়িয়ে পাওয়া যায়–বর্তমানেও এটা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়, অতীতেও ছিল না। কার্তিক, শকুন্তলা, কৃপ, কৃপীর মতো অজস্র ‘নাজায়েজ’ সন্তান কুড়িয়ে পাওয়ার ঘটনা আমরা জানি।
নারী-পুরুষের যৌনমিলন (শুক্রাণু ও ডিম্বাণু) ছাড়া কখনোই সন্তান উৎপাদন সম্ভব নয়। অতীতেও হয়নি, বর্তমানেও হয় না, ভবিষ্যতেও হবে না। যিনি জন্মেছেন তিনি অবশ্যই নারী-পুরুষের যৌনমিলনের ফলেই জন্মেছেন। তা বৈধ পথেই হোক বা অবৈধ পথে? ‘অযোনিস্যুতা’ একটি মিথ্যাচারের নাম, সত্য লুকোনোর পথ। এখনও অনেককে বলতে শুনি অমুক ঠাকুরবাড়ির কলা-পড়া খেয়ে নাকি অমুক গর্ভবতী হয়েছে। আরে ভাই, কলা-পড়া খেয়েই যদি গর্ভবতী হওয়া যায়, তাহলে যৌনমিলনের আর প্রয়োজন কী! পটাপট কলা খেয়ে নিলেই তো হয়। কত নিঃসন্তান দম্পতি একটি সন্তানের জন্য কত কীই-না করে বেড়ান, ধরে ধরে কলা খাইয়ে দিলেই তো হয়!
‘লাঙ্গল’ কথাটি এখানে গভীর দ্যোতনাবাহী। কেননা সংস্কৃতে ‘লাঙ্গল’ শব্দটি একদিকে যেমন ভূমিকৰ্ষণের যান্ত্রিক রূপ, তেমনই তা পুরুষের লিঙ্গকেও বোঝায়। লাঙ্গল’ শব্দটি প্রতীকী অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। ফুলের মতো কমনীয় ও গৌরবর্ণা হওয়ার কারণেই জনকদুহিতার নাম সিতা’। অভিধানকার বামন শিবরাম আপ্তের অভিধানে ‘সি’ শব্দের অর্থ মনোরমা স্ত্রী (a graceful woman) বলা হয়েছে। সত্যকে আড়াল করে সীতার জন্মকে গূঢ় রহস্যাবৃত করা হয়েছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই। কারণ রামচন্দ্র যখন ভগবান, ভগবান নারায়ণের অংশ তখন তাঁর স্ত্রী কুড়িয়ে পাওয়া, অজ্ঞাত পরিচয়, অতি সাধারণ, এটা হজম করা যায় কীভাবে! সুতরাং ‘অযোনিজ’ কল্পনা জারিয়ে নিজের বক্তব্যকে ‘সত্যগন্ধী করে তুলতেই ‘সি’ রূপান্তরে সীতা’য় বদলে যায়। জনকরাজা সীরধ্বজ নিজের মুখেই সে কথা বলছেন। বলছেন বরকর্তা বিশ্বামিত্রকে–“বীর্যশুক্লেতি মে কন্যা স্থাপিতেয়মযোনিজা।/ভূতিলাদুখিতাং তান্তু বর্ধমানাং মমাত্মজাম্।”
সীতার জন্মেতিহাস বাল্মীকি রামায়ণে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। সেটির খোঁজ করতে হবে পরবর্তী পুরাণগুলিতে। কারণ দেবতার ভাবমূর্তিকে রক্ষার জন্য সীতার লক্ষ্মীস্বরূপী একটি মূর্তি গড়া হয়েছে সেখানেই। যেমন স্কন্দপুরাণে বলা হয়েছে–
“পুরা ত্রেতাযুগে পুণ্যে রাবণং হতবানহম্।
তদা বেদবতী কন্যা সাহায্যমকররাচ্ছিয়ঃ।
সীতারূপাভবল্লক্ষ্মীর্জনকস্য মহীতলাৎ।”
একসময় রাক্ষসদের হত্যা করার জন্য বিশ্বামিত্র ঋষির রামকে মনে পড়ল। অভিযোগ, রাক্ষসদের উপদ্রবে তাঁরা যজ্ঞ সম্পাদন করতে পারছিলেন না। হত্যাকার্য সম্পাদনের জন্য ঋষি বিশ্বামিত্র দশরথের কাছ থেকে রামকে ১০ দিনের জন্য চাইলেন। রামের বয়স তখন মাত্র ১৫। দশরথ শঙ্কিত হলেন, বললেন–
“উনষোড়শবর্ষো মে রামমা রাজীবলোচনঃ।
ন যুদ্ধযোগ্যতামস্য পশ্যামি সহ রাক্ষসৈঃ।”
দশরথের একথা শুনে বিশ্বামিত্র ক্রোধে জ্বলে উঠল। এতটাই সেই ক্রোধ যে, পৃথিবী কম্পিত হল, দেবতারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। অবশেষে দশরথ বিশ্বামিত্রের হাতে রামকে সঁপে দিলেন। কৃত্তিবাস অবশ্য রাম-লক্ষ্মণকে বিশ্বামিত্রের সঙ্গে ভয়ংকর সব রাক্ষসবধ করতে পাঠাননি, পাঠিয়েছেন ভরত-শত্রুঘ্নকে। অর্থাৎ গিনিপিগ হওয়ার জন্য ভরত-শত্রুঘ্নই আদর্শ। অর্থাৎ ভরত-শত্রুঘ্নদের চেয়ে রাম-লক্ষ্মণের জীবনের দাম অনেক গুণ বেশি। এই ভাবনা বাল্মীকির সঙ্গে কৃত্তিবাসের খুব মিলে যায়।
যাই হোক, নয়দিন ব্যাপী কয়েকশো রাক্ষস-খোক্ষস হত্যা করে দশম দিনে মিথিলায় উপস্থিত হলেন এবং এগারোতম দিনে সীতাকে স্ত্রী হিসাবে লাভ করেন। রামায়ণের আদি কাণ্ডের ৬৬ তম সর্গে জানা যায়, বিবাহের পূর্বেই সীতা যৌবনাসম্পন্নাই ছিলেন। এমনকি বিবাহের বয়সের থেকে আরও দুই বছর অতিক্রান্ত হয়েছিল। মহাভারতের আদিপর্বের ৬৪ অধ্যায়ে উল্লেখ আছে, সে সময় যৌবনাবস্থায় পদার্পণ না করলে কেউ বিয়ে করত না। বিয়ের সময়ে সীতার বয়স যখন ১৮ ছিল, তখন রামের বয়স ১৫। অর্থাৎ রামের চাইতে সীতা ৩ বছরের বড়ো। সীতার বিয়ের পর ইক্ষ্বাকু বংশে ১২ বছর সংসার করার পর রামের সঙ্গে ১৪ বছর বনবাস যাপন। অরণ্যকাণ্ডে ৪৭ তম সর্গে সীতা রাবণকে বলছেন–
“উষিত্বা দ্বাদশ সমা ইক্ষ্বাকুণাং নিবেশনে।
ভুঞ্জানা মানুষ ভোগা সর্বকামসমৃদ্ধিনী।”
রামায়ণে রাম ও সীতার বয়স নিয়ে বিস্তর গোলমেলে ব্যাপার আছে। অনেক বলেন রাম যখন সীতার পাণিগ্রহণ করেন তখন তাঁর বয়স ছিল ১৩ বছর, আর সীতার বয়স ৬। কোনটি গ্রহণীয়, কোনটি বর্জনীয় তা পণ্ডিতগণ ভাবুন–আমি সেই জটিলতায় যেতে চাই না। তবে এটুকু বলতে চাই–৬ বছর বয়সি একটি মেয়েকে স্ত্রী হিসাবে পাওয়ার জন্য পরাক্রমশালী রাজরাজড়ারা দেশ-দেশান্তর থেকে মিথিলায় জমায়েত হয়েছেন, একথা বিশ্বাসযোগ্য হয় কি? এ যুগে নিশ্চয় বিশ্বাসযোগ্য নয়, অতি প্রাচীন এমন ঘটনা তো আকছারই ঘটত। সমাজে যখন গৌরীদানে অক্ষয় স্বর্গপ্রাপ্তি এবং কন্যার একাদশ বয়সে না-হলে মাতা-পিতা এবং জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার নরকে যাওয়ার বন্দোবস্ত হয়ে যায়, এমন প্রথার প্রচলন আছে। অপরাপর পুরাণ গ্রন্থগুলিতে সীতার বয়স কখনো ৬, কখনো ৮ বছর লিপিবদ্ধ হয়েছে।
বিবাহের সময় সীতার স্তন কেমন পুষ্ট হয়েছিল সেটাও উল্লেখ করেছেন মুনিবর বাল্মীকি–“স্তনৌ চাবিরলৌ পীনৌ মগ্নচুচুকৌ”। এহেন স্তন কখনোই ছয় বছর বয়সে হতে পারে না। লঙ্কাকাণ্ডে ৪৮ তম সর্গে সীতার নিজের মুখে তাঁর শরীর ও উদ্ভিন্ন যৌবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেছেন, বলেছেন–
“আমার কেশসকল সূক্ষ্ম, সমান নীলাবর্ণ। জ্বজোড়া পরস্পর অসংশ্লিষ্ট। জঙ্ঘাদ্বয় সুগোল এবং লোমহীন। দন্ত সকল বিরল। কটাক্ষ, চোখ, হাতজোড়া, পাজোড়া, গোড়ালি, উরুদ্বয় পরস্পর সংযুক্ত। আমার সবকটি আঙ্গুলের মধ্যভাগ হল অক্ষ ও আনুভূমিক, বর্তুলনখশোভিত। আমার স্তনজোড়া পরস্পর অসংসক্ত পীন ও উন্নত এবং স্তনের বোঁটা দুটি মধ্যনিমগ্ন। অধিকন্তু আমার স্তন নিকটবর্তী পার্শ্বদেশ ও বক্ষঃস্থল বিশাল, নাভিপার্শ্ব উন্নত ও সুগভীর।”
অপ্রাসঙ্গিক হলেও জেনে রাখা যায়–আদিকাণ্ডে রামের জীবনের ১৫/১৬ বছরের কথা, অযোধ্যা কাণ্ডে রামের জীবনের অনুমান ১ সপ্তাহের কথা, কিকিন্ধ্যাকাণ্ডে অনুমান ১০ মাস, সুন্দরকাণ্ডে মাসাধিক কাল এবং লঙ্কাকাণ্ডে মাসাধিক সময়ের কথা বর্ণিত হয়েছে।
রামচন্দ্র চোদ্দো বছরের জন্য বনবাসে গেলে সীতা তাঁর সঙ্গী হন। মনে রাখতে হবে, কেবলমাত্র রামকেই চোদ্দো বছরের জন্য বনবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সীতা ও লক্ষ্মণ স্বেচ্ছায় রামের সঙ্গে বনবাসে গিয়েছিলেন। লক্ষ্মণ তো রামের সঙ্গী হবেনই, এটা লক্ষ্মণের কর্তব্য। নতুন কিছু ব্যাপার নয়। কিন্তু সীতা কেন রামের সঙ্গী হলেন? সীতা রামের পিছু নিলে, রাম সীতাকে জঙ্গলের বিপদের কথা বর্ণনা করেছিলেন। বলেছিলেন–বন নয়, অযোধ্যায় অবস্থান করে শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করে জীবন কাটিয়ে দাও। রাজা ভরতের অনুবর্তিনী হয়ে থাকো। একথার উত্তরে সীতা রামকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন–
“ন পিতা নাত্মজো নাত্মা ন মাতা ন সখীজনঃ … কিমিদং ভাষষে রাম বাক্যাং লঘুতয়া ধ্রুবম্। .. স্ক্রিয়ং পুরুষবিগ্রহ। … শৈলুষ ইব মাং রাম পরেভ্যো দাতুমিচ্ছসি। … ত্বং তস্য ভব বশ্যশ্চ বিধেয়শ্চ সদানঘ।”
এ থেকে প্রমাণ হয় সীতা মিনমিনে মুখচোরা ছিলেন না, রীতিমতো মুখরাই ছিলেন। স্পষ্ট কথা স্পষ্ট করে বলে দিতেন সীতা। একথা যেমন রামের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তেমনি রাবণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। রাম কিংবা রাবণ–কারোকেই তিনি ছেড়ে কথা বলেননি।
নিয়ম অনুসারে বনে বাসের জন্য রাজপপাশাক ত্যাগ করে মুনি-পরিধেয় চীর ধারণ করতে হবে। অর্থাৎ গাছের ছাল পরে থাকতে হবে। সীতার ঘোরতর আপত্তি থাকলেও লক্ষ্মণ রামের অনুসরণে বিধিসম্মতভাবেই চীরবসন ধারণ করেন। এবং এই চীরবসন দশরথের সামনেই গ্রহণ করেন। কিন্তু কৌশেয়-সীতা চীরবসন দেখে আঁতকে উঠলেন। ভীত হয়ে পড়লেন। এই এক চিলতে গাছের ছালে একজন উদ্ভিন্নযৌবনা নারীর লজ্জা নিবারণ হবে কীভাবে! বাষ্পপূর্ণ চোখে স্বামী রামের কাছে তাঁর কৌতূহল প্রকাশ করলেন–বনবাসীরা কীভাবে এই বসন পরিধান করেন? রাম স্বয়ং সীতার অঙ্গে কৌশেয় বসনের উপরেই চীরবসন বন্ধনের চেষ্টা করতে থাকেন। এ দৃশ্য দেখে কুলগুরু বশিষ্ঠ বললেন “যেহেতু সীতা এই বনবাসে নিযুক্ত হননি, তাই তাঁর চীরবসনও অনাবশ্যক।” ব্রাহ্মণ যা বলেন, তাই-ই বিধান (আইন)। অতএব চীরসনকে সরিয়ে দিয়ে উত্তম আভরণ ও বসন পরিধানের ব্যবস্থা করে দিলেন। বনবাস যাত্রায় সীতা অলংকারে সেজে উঠুক, সেটা স্বয়ং দশরথই অনুমোদন করেছিলেন। স্বয়ং দশরথই কোষাধ্যক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিলেন–
“বাসাংসি চ বরাহণি ভূষণানি মহান্তি চ।
বর্ষাণ্যেতানি সংখ্যায় বৈদেহ্যাঃ ক্ষিপ্রমানয়।
নরেন্দ্রেণৈবমুক্তস্তু গত্বা কোশগৃহং ততঃ।
প্রাযচ্ছৎ সর্বহৃত্য সীতায়ৈ ক্ষিপ্রমেব তৎ।
সা সুজাতা সুজাতানি বৈদেহী প্রস্থিতা বনম্।
ভূষয়ামাস গাত্রাণি তৈর্বিচিত্রৈবিভূষণৈঃ।
ব্যরাজয়ত বৈদেহী বেশ্ম তৎ সুবিভূষিতা।
উদ্যতোহংশুমতঃ কালে খংপ্রভেব বিবস্বতঃ।”
কোশাধ্যক্ষ নরেন্দ্র দশরথ কর্তৃক মহামূল্য বসন ও উৎকৃষ্ট ভূষণ আনার ব্যবস্থা করা হল এবং মহামূল্যবান অলংকারে সেজে উঠলেন সীতা। অযোধ্যাকাণ্ডের ৩৯ তম সর্গ পাঠ করে দেখতে পারেন। রামের সহধর্মিনী সীতাদেবী রাজবধূর বেশবিন্যাস ত্যাগ করে রাম-লক্ষ্মণের মতো গাছেল ছাল পরিধান করেছিলেন, এমন কথা মহাকবি বাল্মীকি কোথাও বলেননি। পতিব্রতার সংজ্ঞা বদলে নাকি!
রাবণ সীতাকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার সময় এই অলংকারগুলো ছড়ানোর কাজে লাগিয়েছিল, যা দেখে রাম-লক্ষ্মণ বিপদের আন্দাজ করতে পেরেছিল। সোনার অলংকারের চেয়ে নিজের প্রাণ ও মান উভয়ই দামি। বলাই বাহুল্য, এই সীতাকে অপহরণ করে লঙ্কায় নিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করেই রাম ও রাবণের মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত হয়। তাঁকে উদ্ধার করতেই রাম, লক্ষ্মণ, সুগ্রীব, হনুমানের যারপরনাই উদ্যোগ সহ বিশাল বাহিনী লংকা আক্রমণ ও লঙ্কা ধ্বংস করে। সীতাকে উদ্ধারের পরেও স্বয়ং রাম লঙ্কাতেই সীতার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। সীতার চরিত্রের পবিত্রতা প্রমাণের জন্য রাম অগ্নিপরীক্ষার আয়োজন করেন। অগ্নিপরীক্ষার অংশ হিসাবে সীতাকে অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করতে হয়। সীতা ‘সতীসাধ্বী’ হলে আগুন তাঁর কোনো ক্ষতি করবে না, এটাই প্রমাণ করানোর চেষ্টা। অপমানের পর অপমানিত হয়েছেন সীতা। লক্ষ্মণ এবং বাইরের লোক বিভীষণ, সুগ্রীব, হনুমান, জাম্ববান ও বানরদের সামনেই সীতা অপমানিত হলেন স্বামী রামের দ্বারা, যাচ্ছেতাইভাবে মাথা নিচু হয়ে গেল সীতার। উপস্থিত অসংখ্য অনার্যদের সামনে আর্যভার্যার এই অপমান কারোর জন্যই সহনীয় হতে পারে না। সীতা আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণ করতে চাইলেন। ভাবলেশহীন রাম সীতার সেই ইচ্ছাকে অনুমোদন দিলেন, সীতা লক্ষ্মণকে চিতা সাজানোর আদেশ দিলেন। জ্বলন্ত চিতায় সীতা প্রবেশ করলেন, কিন্তু তিনি দগ্ধ হলেন না। অগ্নিপরীক্ষার মাধ্যমে সীতার চরিত্রের পবিত্রতা প্রমাণ হলে রামচন্দ্র সীতাকে অযোধ্যায় নিয়ে যান। অগ্নিপরীক্ষা প্রসঙ্গে পণ্ডিত হরপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য–
“প্রকৃত প্রস্তাবে যা ঘটেছিল তা অনেকটা এইরকম বলে অনুমান করা যায় : রামচন্দ্র চিতা প্রস্তুতের আজ্ঞা দিলে লক্ষ্মণ ও অন্যান্যরা রুষ্ট হয়েছিলেন। তারা সরাসরি রামের ইচ্ছায় বাধা দিতে পারেননি বটে, কিন্তু সুকৌশলে মৃত্যুর হাত থেকে সীতাকে রক্ষা করেছিলেন। রাক্ষসেরা জাদুবিদ্যায় পারদর্শী ছিল। মায়া সীতা, মায়া রামের কাহিনি রামায়ণের যুদ্ধকাণ্ডে এইভাবে উল্লিখিত আছে : রাবণের আহ্বানে বিদ্যুৎজ্জিত্ব রামের মায়ামুণ্ড, শরাসন সীতার সামনে নিক্ষেপ করেছিল। সীতা রামের ছিন্নমুণ্ড ও ধনুক স্বচক্ষে দেখলেন।…সীতা এই মায়ামূর্তিকে রামচন্দ্র বলে বিশ্বাস করেছিলেন। রাক্ষসরা এই মায়ামূর্তি নির্মাণে এমনই পারদর্শী ছিল যে, ওই মায়ামুণ্ড রামের নয়–সীতার পক্ষেও বোঝা সম্ভব হয়নি। শুধু তাই নয়, রথের উপর ইন্দ্রজিৎ সমস্ত বানরসৈনদের সামনে মায়াসীতা বধ করেছিলেন। হনুমান খুব ভালোভাবেই সীতাকে চিনতেন। তা সত্ত্বেও প্রবল সাদৃশ্যের জন্য তিনি এই মায়াসীতা’কে প্রকৃত সীতা বলে মনে করেছিলেন। কিন্তু রাক্ষস বিভীষণ বিভ্রান্ত হননি। প্রকৃত ব্যাপার তার অজানা ছিল না। … রাক্ষসরা মায়ামূর্তি নির্মাণে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। এই পটভূমিকায় ধরে নেওয়া বোধহয় অসংগত হবে না, সীতার অগ্নিপ্রবেশের ব্যাপারটি সাজানো এবং সে ব্যাপারে রাক্ষসরাজ বিভীষণ অগ্রণীর ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁরই নির্দেশে সীতার পরিবর্তে রাক্ষস-নির্মিত আর-একটি ‘মায়াসীতাকে চিতায় প্রবেশ করানো হয়েছিল।”
পূর্বেই বিভীষণ অনুমান করে নিতে পেরেছিলেন পরপুরুষের কাছে থাকা স্ত্রী সীতাকে স্বামী হিসাবে রাম কী চোখে দেখবেন। রাম যে সীতার ঘৃণার চোখে দেখবেন সেটা অনুমান করেই বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভেবে রেখেছিলেন বিভীষণ।
কিন্তু পরবর্তীতে আবারও সীতার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। প্রশ্ন ওঠে অযোধ্যায় পৌঁছোনোর পর। রামচন্দ্রের কাহিনিকারের মতে চোদ্দো বছর বনবাসান্তে রামচন্দ্র দেশে প্রত্যাবর্তন করে নির্বিঘ্নে সংসারধর্ম তথা রাজ্যশাসন করেছিলেন দীর্ঘ ২৭ (?) বছর। অতঃপর প্রজাবিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। কেননা লঙ্কার অশোককাননে বন্দিনী থাকাকালীন রাবণ সীতাদেবীর অঙ্গ স্পর্শ করে সতীত্ব নষ্ট করেছিলেন এবং অসতী সীতাকে গৃহে স্থান দেওয়ায় প্রজাগণ ছিল অসন্তুষ্ট। উপরোক্ত বিবরণটি শুনে স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্নের উদয় হয় যে, মরার দু-যুগের পরে শোকের কান্না কেন? বনবাসান্তে রামচন্দ্র স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলে তাঁর বনবাসের বিবরণ তথা লঙ্কাকাণ্ড দেশময় ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর দেশে ফেরার সংগে সঙ্গেই এবং সীতাকলঙ্কের কানাকানিও চলছিল দেশময় তখন থেকেই। আর গুজবের ভিত্তিতে সীতাকে নির্বাসিত করতে হলে তা করা তখনই ছিল সংগত। তাহলে দীর্ঘ ২৭ বছর পর কেন? তারাকান্ত কাব্যতীর্থকৃত মূল বাল্মীকি রামায়ণের বঙ্গানুবাদে বলা আছে রাম বহুবছর সীতার সঙ্গে বিহার করে ও রাজ্যপালন করে কাটালেন। ২৭ বছর করেছিলেন তা কিন্তু বলা নেই। যাই হোক, রাম সীতাকে আবারও বনবাসে পাঠান এবং কোনোরূপ বিবেচনা না-করেই (“তস্মাত্ত্বং গচ্ছ সৌমিত্রে নাত্ৰ কাৰ্য্যা বিচারণা।/অপ্রীতিৰ্হি পরা মহং ত্বয়ৈতৎ প্রতিবারিতে।”)। রামের আদেশানুসারে লক্ষ্মণ পরদিনই ভোরে নৌকোযোগে তমসা নদীর তীরে বাল্মীকির আশ্রমে পরিত্যাগ করে আসেন। ফেরার সময় লক্ষ্মণের উদ্দেশ্যে সীতা তাঁর অপমানের কথা গোপন রাখেননি, বুক-ফাটা যন্ত্রণা নিয়ে তিনি বলেছেন–“লক্ষ্মণ! আমার গর্ভে সন্তান বড়ো হচ্ছে, এক্ষণে প্রাণত্যাগ করলে আমার স্বামীর বংশলোপ হবে। তা না-হলে আজই জাহ্নবীর জলে প্রাণ বিসর্জন করতাম (“ন খন্বদ্যৈব সৌমিত্রে জীবিতং জাহ্নবীজলে।ত্যজেয়ং রাজবংশস্তু ভর্তুর্মে পরিহাস্যতে।”)। নারীর এই মর্মভেদী যন্ত্রণা এই অপমান রামভক্তদের হৃদয়ে পৌঁছোয় না। প্রাণত্যাগ, অর্থাৎ আত্মহত্যার ইচ্ছা আরও-একবার প্রকাশ করেছেন সীতা, উত্তরকাণ্ডে–“চিতাং মে কুরু সৌমিত্রে ব্যসনস্যাম্য ভেষজম্।/মিথ্যাপবাদোপহতা নাহং জীবিতুমুৎসহে।/অপ্রীতেন গুণৈর্ভর্তা ত্যক্তায়া জনসংসদি।/যা ক্ষমা মে গতির্গন্তুং প্রবেক্ষ্যে হব্যবাহন।” (সৌমিত্রে! এমন মিথ্যাপবাদগ্ৰস্তা হয়ে আমি আর প্রাণধারণ করতে ইচ্ছা করি না। এখনই চিতাই আমার এই ঘোরতর বিপদকালের একমাত্র ওষুধ। অতএব তুমি চিতা প্রস্তুত করো। স্বামী আমার গুণে অসন্তুষ্ট হয়ে জনগণের মধ্যেই আমাকে পরিত্যাগ করলেন। সুতরাং আমি এখনই আগুনে প্রবেশ করে আমার কর্মানুরূপ গতি লাভ করতে প্রস্তুত।) লক্ষ করুন পাঠক, সীতাদেবী দু-বার প্রাণত্যাগ ইচ্ছা পোষণ করেছেন, দু-বারই দেবর লক্ষ্মণের কাছে–স্বামী রামের কাছে নয়।
স্বামী রামের চোখে সীতা কেমন ছিল? কার হাতে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন সীতা? দেখুন কয়েকটা নমুনা–মেঘনাদের শক্তিশেল খেয়ে লক্ষ্মণ যখন অজ্ঞান হয়ে ভূলুণ্ঠিত হলেন, তখন রাম বিলাপ করতে থাকলেন–
“প্রাণ পেয়ে সীতা পেরে কী লাভ আমার? মর্তলোকে খুঁজলে সীতার মতো নারী আরও পাওয়া যাবে। কিন্তু লক্ষ্মণের মত সচিব ও যোদ্ধা ভাতা কোথাও পাওয়া যাবে না।”
এখানেই শেষ নয়, রাম আরও বলেন–
“দেশে দেশে স্ত্রী পাওয়া যায়, বন্ধুও পাওয়া যায়, কিন্তু তেমন দেশ মেলে না যেখানে সহোদর ভাই পাওয়া যায়।… তুমি যখন মৃত্যুমুখে পতিত তখন আমার জীবন নিরর্থক, সীতা বা বিজয়লাভ করাও নিরর্থক।”
এইখানেই শেষ নয়, “বললে আমি খুশি হয়েই ভাই ভরতের জন্য সীতা, রাজ্য, প্রাণও দিতে পারতাম।” স্ত্রীকে ত্যাগ করাই নয়, স্বামী হিসাবে রাম স্ত্রী সীতাকে ভাই ভরতের ভোগ্য পর্যন্ত করতে পারেন। সীতা তো কোনো ব্যক্তি নন, নিরেট মাংসপিণ্ডমাত্র। অথচ ভাবুন তো, যে স্বামী (রাম) স্ত্রীকে (সীতা) ভাইয়ের (ভরত) হাতে তুলে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। যে স্ত্রী বলেন–
“তোমাকে বাদ দিয়ে আমার স্বর্গে বাস করতেও অভিরুচি নেই। তোমার বিরহে আমি এখানে প্রাণত্যাগ করব।”
এহেন পতিব্রতা স্বামী-সোহাগিনী নারীকে মন্দোদরী, তারা, কুন্তীদের (“অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরী তথা/পঞ্চকন্যা স্মরে নিত্যং মহাপাতক নাশনম্৷”) মতো এক কাতারে প্রাতঃস্মরণীয় করেননি সমাজপতিরা। সীতা সেই স্ত্রী, যাঁকে লঙ্কাধিপতি রাবণ বিবাহের প্রস্তাব দিলে তিনি স্বামীর প্রতি অগাধ আস্থা জ্ঞাপন করে রাবণকে চরম দৃঢ়তায় বলেন–
“তুমি শৃগাল হয়ে সিংহীকে পেতে চাইছ? কাল সাপের মুখে হাত দিয়ে তার বিষদাঁত উপড়াতে চাইছে। কালকূট বিষপান করে স্বস্তিতে থাকতে চাইছ? সূচী দিয়ে চক্ষুভেদ করতে বা জিহ্বা দিয়ে ক্ষুরলেহন করতে চাইছ? রাঘবের প্রিয়াকে তুমি পেতে চাইছ? কণ্ঠে শিলাখণ্ড বেঁধে সমুদ্র উত্তরণ করতে চাইছ? দুই হাত দিয়ে চন্দ্র সূর্য ধরতে চাইছ? তুমি রামের প্রিয়া বধূকে ধর্ষণ করতে চাইছ? জ্বলন্ত অগ্নিকে কাপড় দিয়ে আহরণ করতে চাইছ, তাই রামের কল্যাণী বধূকে হরণ করতে চাইছ? লৌহমুখ শূলের সামনে বিচরণ করতে চাও, তাই রামের অনুরূপ বধূকে পেতে চাইছ? বনে সিংহ ও শিয়ালের যে পার্থক্য, ছোটো খাল ও সমুদ্রের যে পার্থক্য, শ্রেষ্ঠ বীর ও কাপুরুষের যে পার্থক্য, হাতি ও বিড়ালের যে পার্থক্য, গোরুড় ও সাপের যে পার্থক্য, পানকৌড়ি ও ময়ূরের যে পার্থক্য, হাঁস ও শকুনের যে পার্থক্য–দাশরথি রামের সঙ্গে তোমারও সেই পার্থক্য।”
যদন্তরং সিংহশৃগালয়োর্বনে..যদন্তরং কাঞ্চনসীসলোহয়োঃ…যদন্তরং বায়সবৈনতেয়য়োঃ..
তবুও সীতা অপমানিত হয়েছেন নিজের প্রাণাধিক স্বামীর কাছে।
যুদ্ধশেষে স্বামী-স্ত্রীর প্রথম সাক্ষাতে দীর্ঘ অদর্শনে সীতার প্রতি রামের প্রেম বিলীন হয়ে গিয়েছিল। সীতাকে লঙ্কাপুরীর বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন বটে, কিন্তু রাম সেইসঙ্গে একথাটাও সীতাকে জানাতে ভোলেনি যে–
“যুদ্ধ তাঁর জন্য হয়নি। যুদ্ধে শত্রুকে জয় করেছি। তোমাকেও মুক্ত করেছি। আমার পৌরুষ দিয়ে যা করার আমি তা সব করেছি। বৈরীভাবের এক্কেবারে শেষপ্রান্তে পৌঁছেছি, ধর্ষণ প্রমার্জনা করেছি। শত্রু এবং অপমান একসঙ্গে খতম করেছি। আজ আমার পৌরুষ প্রকাশিত হয়েছে, আজ আমার শ্রম সফল হয়েছে। প্রতিজ্ঞা থেকে উত্তীর্ণ হয়েছি এবং নিজের প্রভূত্ব ফিরে পেয়েছি।”
‘আদর্শ স্বামী রাম আরও বলেন–
“তোমার কুশল হোক। জেনে রাখো, এই যে যুদ্ধের পরিশ্রম, বন্ধুদের বীরত্বের সাহায্যে যা থেকে উত্তীর্ণ হয়েছি, তা তোমার জন্যে নয়। আমার চরিত্র মর্যাদা রক্ষা করার জন্যে এবং প্রখ্যাত আত্মবংশের কলঙ্ক মোচন করার জন্যেই তা করেছি। তোমার চরিত্র সন্দেহজনক হয়ে উঠেছে। আমার সামনে তুমি আছ, চক্ষুপীড়াগ্রস্তের সামনে প্রদীপ যেমন পীড়াদায়ক হয় তেমনই। তাই জনকাত্মজা, এই দশদিক পড়ে আছে, যেখানে ইচ্ছা তুমি চলে যাও, আমি অনুমতি দিলাম–তোমাকে আমার প্রয়োজন নেই। কোন্ সদ্বংশজাত তেজস্বী পুরুষ বন্ধুত্বের লোভে পরগৃহবাস করেছে যে, স্ত্রী, তাকে ফিরিয়ে নেবে? রাবণের কোলে বসে পরিক্লিষ্ট, তার দুষ্ট দৃষ্টিতে দৃষ্টা তুমি, তোমাকে গ্রহণ করে আমি আমার উজ্জ্বল বংশের গৌরব নষ্ট করব? যেজন্য যুদ্ধ করেছি তা পেয়েছি, তোমার প্রতি আমার কোনো অভিলাষ নেই, যেখানে খুশি চলে যাও তুমি। আমি তোমাকে বলছি লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন, সুগ্রীব বা বিভীষণ এদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা মনোনীত করে নাও।”
অথচ এ তো সেই সীতা, যিনি বনবাসের প্রাক্কালে শাশুড়িমাতা কৌশল্যাকে বলেছিলেন–
“নাতন্ত্রী বাদ্যতে বীণা নাচক্রো বিদ্যতে রথঃ।নাপতিঃ সুখমেধতে যা স্যাপি শতাত্মজা৷৷”
অর্থাৎ, তন্ত্রীহীন বীণা বাজে না, চক্ৰহীন রথ হয় না। পতিহীনা নারী শতপুত্রের জননী হলেও সুখ পায় না।
রামের মতো সূক্ষ্ম ধর্মবুদ্ধিযুক্ত ব্যক্তি পরহস্তগতা নারীকে মুহূর্তের জন্যে হলেও কী করে গ্রহণ করবেন! সীতা দুশ্চরিত্র হোন বা না-হোন, সচ্চরিত্র হোন বা না-হোন–তাঁকে ‘ভোগ’ করা রামের পক্ষে অসম্ভব। কুকুরে চাটা ঘি’ যেমন কোনো পুজোয় লাগে না–পরহস্তগত স্ত্রী তথা নারীও তেমন স্বামীর অঙ্কশায়িনী হতে পারে না। রাবণ সীতাকে স্পর্শ করেছিল কি না তা জেনে নেওয়ার প্রয়োজন নেই, রাবণ সীতাকে বলাৎকার করেছিল কি না সেটাও জানার প্রয়োজন নেই। সতীত্ব নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠেছে, তখন ত্যাগই একমাত্র সমাধানের পথ। কারণ সীতাকে নিয়ে অযোধ্যায় ফেরার পর প্রজারা রামচন্দ্রকে বলেছে–
“কীদৃশং হৃদয়ে তব সীতাসম্ভোগজং সুখ।
অঙ্কমারোপ্য তু পুরা রাবণেন বলাক্বতাম্।”
অর্থাৎ “রাবণ যাকে অঙ্কে আরোপণ করে সবলে হরণ করেছিল, সেই সীতার সম্ভোগে তোমার হৃদয়ে কেমন সুখ হয়?”
এই হল রাম, ভারতের রাজা রাম। সীতার প্রতি রামচন্দ্রের এহেন আচরণে যদি ভেবে বসেন যে, সীতার প্রতি রামের বিন্দুমাত্র প্রেম ছিল না, তাহলে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বরং বলা যায়, রাম-সীতার প্রেম এতটাই ছিল যে, যা অত্যন্ত বিরল। বিবাহের পর থেকে পঞ্চবটিতে সীতার অপহরণের আগে পর্যন্ত রামের প্রেম অবিসংবাদিত। অরণ্যযাপনকালে খাবার, পানীয় ভাগ করে খাওয়াসহ সোনার হরিণ অসম্ভব অবাস্তব বুঝেও সীতাকে খুশি দেখতে ছুটে গিয়েছিলেন বিপদের ঝুঁকি নিয়ে।
উত্তরকাণ্ড থেকে জানা যায়, বাল্মীকির আশ্রমে সীতার নির্বাসন হওয়ার কিছুদিন পরেই সীতার দুই পুত্র সন্তান–লব ও কুশের জন্ম হয়। সে পুত্রযুগল জন্মেছিল তখন নাকি রামচন্দ্রের বিবাহের তেপ্পান্ন বছর পর (বাস্তব ১২ + ১৪ = ২৬ বছর পর)। বছরের এ হিসেবটা প্রিয় পাঠকদের কাছে একটু বেমানান বোধ হতে পারে। তাই বছরগুলির একটা হিসাব দিচ্ছি। বিবাহন্তে রামচন্দ্র গৃহবাসী ছিলেন ১২ বছর, বনবাসী ১৪ বছর এবং গৃহে প্রত্যাবর্তন করে রাজাসনে কাটান নাকি ২৭ বছর (ওই ২৭ বছর উদ্দেশ্যমূলক, কাল্পনিক)। এরপর ‘কলঙ্কিনী বলে অন্তঃসত্ত্বা সীতাকে নির্বাসিত করা হয় বাল্মীকির তপোবনে। সেখানই লব ও কুশের জন্ম হয় বলে উত্তরকাণ্ডে বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ সীতাদেবী বন্ধ্যা ছিলেন না এবং উক্ত তেপ্পান্ন বছরের মধ্যে বনবাসকালের। দশ মাস (অশোককাননে রাবণের হাতে সীতা বন্দিনী ছিলেন ১০ মাস) ছাড়া বাহান্ন বছর দু-মাস সীতা ছিলেন রামচন্দ্রের অঙ্কশায়িনী। অন্য হিসাবে সীতার যখন গর্ভসঞ্চার হয় তখন তাঁর বয়স ছিল (১৮+১২+১৪+২৭) ৭১ বছর, মতান্তরে (৬+১২+১৪+২৭) ৫৯ বছর। বাস্তবিক কোনো নারী এই বয়সে গর্ভধারণ করতে পারেন না। নারীর গর্ভধারণের সময় কিছু কমবেশি ১২ বছর থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। মেনোপোজ বা পিরিয়ড বন্ধ হয়ে গেলে কোনো নারীর পক্ষেই সন্তানধারণ সম্ভব নয়। এ ভুল মহাকবি বাল্মীকি করতে পারেন না। তাহলে প্রাচীনযুগে নারীর মেনোপোজ আরও দেরিতে আসত! না, তা নিশ্চয়ই নয়। চরক সেকথা বলছেন না। তা ছাড়া অনেক গবেষক মনে করেন, লব-কুশ চরিত্র দুটি বাল্মীকি সৃষ্টি করেননি, প্রয়োজনও মনে করেননি। আষাঢ়ে গল্প বানাতে গিয়ে উত্তরকাণ্ডের কবি এই বিপত্তি ঘটিয়েছেন। কারণ তিনি জানতেন না চিকিৎসার জনক চরক কী বলেছেন–
“দ্বাদশাদ্বৎসরাদূর্ধমা পঞ্চাশৎসমাঃ স্ত্রীয়ঃ।/মাসি মাসি ভগদ্বারা প্রকৃত্যৈবার্তবংসেবেৎ”
অর্থাৎ “স্ত্রীলোকের ১২ বছর বয়স থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত স্বভাবতই প্রতিমাসে তিনদিন করে আর্তব (রজঃ) যযানিমুখ দিয়ে প্রশ্রুত হয়। এ সময়কালেই গর্ভধানের উপযুক্ত সময়, এই সময়কালের আগে বা পরে নয়। এরপর কলঙ্কিনী’ বলে অন্তঃসত্ত্বা সীতাকে নির্বাসিত করা হয় বাল্মীকির তপোবনে। সেখানই লব ও কুশের জন্ম হয় বলে উত্তরকাণ্ডে বর্ণিত হয়েছে।
রামচন্দ্রের সন্তানের ব্যাপারে কেউ কেউ বলেন–“সন্তান কামনা করে না, এমন কোনো লোক বা জীবজগতে নেই। কারও সন্তান না-থাকলে তার দুঃখের অবধি থাকে না; বিশেষত ধনিক পরিবারে। আর রাজ্যেশ্বর রামচন্দ্রের বৈবাহিক জীবনের দীর্ঘ ২৬ বছর পরে আসন্ন সন্তান পরিত্যাগ করলেন শুধু কি প্রজাদের মনোরঞ্জনের জন্য? নিশ্চয়ই তা নয়। তিনি জানতেন যে, সীতার গর্ভস্থ সন্তান তাঁর ঔরসজাত নয়, ঔরসজাত রাবণের। আর সংগত কারণেই সীতার গর্ভজাত সন্তানের প্রতি তাঁর কোনো মায়ামমতা ছিল না, বরং ছিল ঘৃণা ও অবজ্ঞা। তাই তিনি সীতা-সুতের কোনো খোঁজখবর নেননি বহু বছর যাবৎ। বিশেষত ঋষি বাল্মীকির আশ্রম অযোধ্যা থেকে বেশি দূরেও ছিল না, সেই আশ্রম তিনি চিনতেন। অতঃপর সীতাসহ কুশ-লব বিনা নিমন্ত্রণে (বাল্মীকির নিমন্ত্রণও ছিল) ঋষি বাল্মীকির সঙ্গে শ্রীরামের অশ্বমেধ যজ্ঞে উপস্থিত হয়ে যেদিন রামায়ণ কীর্তন করে, সেদিন কুশ-লবের মনোরম কান্তি ও স্বরে-সুরে মুগ্ধ হয়ে রামচন্দ্র তাদের দত্তকরূপে গ্রহণ করেন। হয়তো তখন তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে, ঘটনাক্রমে ফেলনা হলেও ছেলে দুটো (কুশ-লব) রাজপুত্র তো বটে। কুশ-লবকে গ্রহণ করলেও সীতাকে গ্রহণ করেননি রামচন্দ্র সেদিনও। সীতাদেবী হয়তো আশা করেছিলেন যে, বহু বছরান্তে পুত্ররত্ন-সহ রাজপুরীতে এসে এবার তিনি সমাদর পাবেন। কিন্তু তা তিনি পাননি, বিকল্পে পেয়েছিলেন যত অনাদর-অবজ্ঞা। তাই তিনি ক্ষোভে-দুঃখে হয়তো আত্মহত্যা করেছিলেন। নারীহত্যার অপবাদ লুকোনোর উদ্দেশ্যে এবং ঘটনাটি বাইরে প্রকাশ পাওয়ার ভয়ে শোনে দাহ করা হয়নি সীতার শবদেহটি, হয়তো লুকিয়ে গ্রোথিত করা হয়েছিল মাটির গর্তে। আর তা-ই প্রচারিত হয়েছে–“স্বেচ্ছায় সীতাদেবীর ভূগর্ভে প্রবেশ বলে। সে যা হোক, অযোধ্যেশ্বর রাম ও লঙ্কেশ্বর রাবণের সন্তান-সন্ততি সম্বন্ধে পযালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, রাবণ ছিলেন শত শত সন্তানের জনক, আর রামের ছিল না একটিও পুত্র। তিনি ছিলেন ‘আঁটকুড়ো’। লঙ্কেশ্বর রাবণের যাবতীয় গুণগরিমা ও সৌরভ-গৌরব গুপ্ত রাখার হীন প্রচেষ্টার মুখ্য কারণ–তিনি আধ্যাত্মবাদী ছিলেন না, ছিলেন জড়বাদী বিজ্ঞানী। বিশেষত তিনি আর্যদলের লোক ছিলেন না, ছিলেন অনার্যদলের লোক।” এরূপ অনুমান করা হয়তো সংগত নয়। সীতা রাবণকে কতটা ঘৃণা করতেন তা অশোকবনে সীতা রাবণের কথোপকথন থেকে জানা যায়। আসলে রামের সঙ্গে সীতার মিলন হয়েছিল বনবাস ছেড়ে অযোধ্যায় ফিরে আসার পরে। এইসব ঘটনা উত্তরকাণ্ডে আছে। রাম নিজে বহু বছর সীতার সঙ্গে মিলন করার পর নিজে সীতাকে গর্ভবতী দেখে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। যদি লব-কুশ রাবণের ছেলে হত, তাহলে লঙ্কায় সীতার উদ্ধারের সময়ই রাম সীতার গর্ভলক্ষণ দেখতে পেতেন। তা তিনি পাননি। সুতরাং ওরা যে রাবণের ছেলে নয় তা অনুমান করাই যায়।
পাশাপাশি ঐতিহাসিকভাবে যুগটার কথাও মনে রাখতে হবে। সেটা হল, সীতাকে জানছেন রামায়ণের যুগে। রামায়ণের যুগ ও মহাভারতের যুগ–দুইয়ের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। এই দুই যুগের দুই মহাকাব্যের নিরিখে যদি তুলনা করি তাহলে দেখব–রামায়ণের যুগে (ত্রেতা) নারীর একাধিক পতিত্ব এবং পরপুরুষের সঙ্গে যৌনসংসর্গ ছিল নিষিদ্ধ ও নিন্দনীয়। রামায়ণের নারীরা পরপুরুষ থেকে শতহস্ত দূরে অবস্থান করেন। জান দেবেন কিন্তু মান দেবেন না। সীতাও সম্মত হননি রাবণের বিলাস-বৈভবে ভেসে যেতে। রাবণের কোলে সীতা ধর্ষিতা হয়েছেন এমন সন্দেহ যদি রামের মতো পুরুষের হয়, যদি সীতা ধর্ষিতাও হন–যা যথাসাধ্য গোপন রাখাই সেই সমাজের রীতি। রামায়ণের কবিরা সেই চেষ্টা সর্বত্র করেছেন। রক্ষণশীল সমাজে নারীরা বিয়ের আগে তো দূরের কথা বিয়ের পরেও অন্য কোনো পুরুষের অঙ্গশায়িনী হয়ে গর্ভবতী হতে পারতেন না। পুরুষও সন্তানদানে অক্ষম হলে তাও গোপন রাখার প্রয়াস ছিল। তাই দশরথের পুত্রলাভের ব্যাপারটায় অলৌকিকতার প্রলেপ দিতে হয়েছে। রামায়ণের কাহিনি নিয়ে রচিত কালিদাসের ‘রঘুবংশম্’-এও দিলীপ সুদক্ষিণার পুত্রলাভের ঘটনাতেও অলৌকিকতা প্রদান করা হয়েছে। সত্য চেপে দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে মহাভারতের যুগে (দ্বাপর) এসে অনেকটাই খুল্লামখুল্লা। এ যুগে এত রাখঢাক নেই। নিয়োগপ্রথার প্রয়োগ মহাভারতের যুগে এসে ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। পরপুরষে যৌনসংসর্গ ব্যাপারটা বেশ খোলাখুলিই। এমনকি বিয়ের আগে যৌনসংসর্গও গ্রহণযোগ্য। ধরুন সত্যবতীর কথা। সত্যবতী অবিবাহিত সময়ে পরাশরের সঙ্গে নির্জনে যৌনসংসর্গ করে গর্ভবতী হয়েছিলেন। গর্ভের সেই সন্তানই কৃষ্ণদ্বৈপায়ন, দ্বৈপায়ন ব্যাস। সমাজ স্বীকৃত সন্তান, যিনি মহাভারতকার। তারপরেও সত্যবতীর প্রেমে পড়ে এবং তাঁকে বিয়ে করতে শান্তনুর কোনো সংস্কারে বাধেনি। সত্যবতাঁকে কখনোই তিনি বলেননি ‘কুকুরে চাটা ঘি’ ভোগ করা যাবে না সত্যবতাঁকে। রামায়ণের যুগে রাম কিন্তু সীতাকে লঙ্কা ফিরিয়ে আনার পর সীতাকে বলেছিলেন–“তুমি সচ্চরিত্রই হও আর অসচ্চরিত্রই হও, মৈথিলি, তোমাকে আমি ভোগ করতে পারি না, (তুমি) যেন কুকুরে চাটা ঘি।” না, এ ব্যাপারে শান্তনুর কোনো সমস্যা হয়নি। মৎস্যগন্ধা’ সুন্দরী সত্যবতীর মোহে স্বপুত্র ভীষ্মকে রাজ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত করলেন। ভীষ্মকেই শুধু বঞ্চিত করলেন না, ভীষ্মের কোনো বংশধরই রাজ্যের অধিকার দাবি করতে না-পারেন সে ব্যবস্থাও করে ফেললেন। ভীষ্ম চিরব্রহ্মচারী পালন করলেন। সত্যবতীর দই পুত্র বিচিত্রবীর্য ও চিত্রাঙ্গদের যখন অকালমৃত্যু হল তখন সত্যবতীর স্বপ্নকে পূরণ করতে ভীষ্মকে অনুরোধ করলেন তিনি যেন তার দুই পুত্রবধু অম্বিকা ও অম্বালিকার সঙ্গে যৌনসংসর্গ করে সন্তান দেন। সত্যবতী কাকে অনুরোধ করছেন, যিনি শান্তনু-গঙ্গার সন্তান ভীষ্ম। শান্তনু-গঙ্গার সন্তান ভীষ্মকে সত্যবতী অনুরোধ করছেন। শান্তনু-সত্যবতীর পুত্রবধুদের যৌনসংসর্গ করতে। সত্যবতী বিমাতা হলেও ভীষ্মের মা তো! কারণ রাজসিংহাসনের দাবিদার তো একমাত্র সত্যবতীর পুত্রেরই। তো পুত্রদের অকালমৃত্যু হয়েছে বলে হাল ছাড়লে চলবে! যে কোনো উপায়েই হোক নাতিই এখন শেষ ভরসা। কিন্তু ভীষ্ম প্রত্যাখ্যান করলে ভীষ্মেরই পরামর্শে সত্যবতী অগত্যা তাঁর কুমারীকালের জন্ম-দেওয়া বুড়োপুত্র দ্বৈপায়নকে দিয়ে অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভে সন্তান রোপন করালেন। দ্বৈপায়নও অম্বিকা ও অম্বালিকাকে নারাজ সত্ত্বেও গর্ভবতী তো করালেনই, উপরি হিসাবে এক অজ্ঞাতনামা দাসীকেও একই সঙ্গে গর্ভবতী করে দিলেন। সেই পুত্ররাই হলেন যথাক্রমে ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুর। মহাভারতে এরকম ঘটনা অজস্র আছে, উল্লেখে শেষ করা যাবে না। মহাভারতকার কোনোরূপ লুকোছাপা করে এসব ঘটনায় বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন। কারোর কোনো ছুৎমার্গ নেই। কিন্তু রামায়ণে বাল্মীকি এমন ঘটনা ঘটলেও জাহির করে বলার সাহস পাননি। কিন্তু ঘটনাগুলি যে ঘটেনি সে কথা জোর দিয়ে বলা যায় না, সেগুলি আড়াল করার চেষ্টা হয়েছে তা স্পষ্টতই অনুমিত হয়। এসব কর্ম করতে মহাভারতে নীতির আগমার্কা ছাপ পেলেও, রামায়ণে কিন্তু তা এক অতি ভয়ংকর অপরাধ। ফলে সীতার প্রতি রামের তিরস্কার, অপমান, অবমাননার বিষয়গুলি এযুগের নিরিখে ভাবলে হবে না–রামায়ণের যুগটাকে স্বীকার করতে হবে।
সীতাকে বিসর্জনের পর রাম মহাসমারোহে এক বিরাট যজ্ঞানুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, সীতাবর্জনের পর রামের কোনোরূপ অপরাধবোধ সৃষ্টি হয়নি, বিমর্ষ হয়ে পড়েননি, বিন্দুমাত্র যন্ত্রণাকাতর হননি। সীতাকে ফিরিয়ে আনা যায় কীভাবে সে ব্যাপারেও তিনি ভাবিত ছিলেন না। ত্যাগ মানে ত্যাগই! সীতার সতীত্ব প্রসঙ্গে সাহিত্যসম্রাট ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর রামায়ণের সমালোচনা নিবন্ধে লিখেছেন–
“ভারতবর্ষীয় স্ত্রীলোক যে, স্বভাবতই অসতী, এই সীতার ব্যবহারই তাহার উত্তম প্রমাণ। সীতা যেমন গৃহের বাহির হইল, অমনই অন্য পুরুষ ভজনা করিল। রামকে ত্যাগ করিয়া রাবণের সঙ্গে লঙ্কায় রাজ্যভোগ করিতে গেল। নির্বোধ রাম পথে পথে কাঁদিয়া বেড়াইতে লাগিল। হিন্দুরা এই জন্যই স্ত্রীলোকদিগকে গৃহের বাহির করে না।”
রামচন্দ্রের এই মহাযজ্ঞে বিভিন্ন দেশের রাজনগণ, মুনিঋষিগণও নানাবিধ উপহার নিয়ে এলেন। মহাকবি বাল্মীকিও এসেছিলেন লব-কুশ সহ তাঁর অন্যান্য শিষ্যদের নিয়ে। উদ্দেশ্য, সমগ্র রামগান শোনানো। তদুপরি ঋষিবর বাল্মীকি লব-কুশকে পইপই করে বলে দিলেন–
“যদি পৃচ্ছেৎ স্ কাকুৎস্থে যুবাং কস্যেতি দারকৌ।
বাল্মীকেরথ শিষ্যৌ ঘৌ ব্রতমেবন্নরাধিপম্।”
অর্থাৎ, “রামচন্দ্র যদি তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করে তোমরা কার পুত্র, তাহলে বলবে–আমরা বাল্মীকির শিষ্য।” একসময় রাম জানতে পারেন লব-কুশ সীতারই সন্তান। অতঃপর তিনি আশ্রমের শুদ্ধাচারী দূতদের বললেন–
“তোমরা ভগবান বাল্মীকির কাছে গিয়ে বলল, জানকীর চরিত্র যদি বিশুদ্ধ এবং নিষ্পাপ হয় তাহলে তিনি মহর্ষির অনুমতি নিয়ে তাঁর বিশুদ্ধতার পরিচয় দিন। সীতা যদি বিশুদ্ধতার প্রমাণ দিতে সম্মত হন তাহলে আগামীকাল প্রভাতেই তিনি সভামধ্যে শপথ করুন।”
হাড় হিম হয়ে আসা পরিবেশ, পরিস্থিতি! পরে ঋষিবর বাল্মীকি সীতাকে মহাযজ্ঞানুষ্ঠানের আসরে এনে উপস্থিত জনসমূহের মধ্যে বললেন–
“দাশরথি রাম! সীতা পতিব্রতা ধৰ্মচারিণী হলেও তুমি লোকনিন্দার ভয়ে তাঁকে আমার আশ্রমে ত্যাগ করেছিলে। লোকাপবাদের ভয়ে ভীত তুমি। অতএব যাতে লোকপবাদ দূর হয়, সীতা তোমাকে এমন প্রত্যয় দেবেন। রাম, তুমি অনুমতি দাও। আমি সত্য বলছি–“জানকীর গর্ভজাত এই দুর্ধর্ষ যমজসন্তান তোমারই পুত্র। আমি শপথ করে বলছি–যদি সীতা দুশ্চরিত্রা হন, তবে আমার বহু সহস্র বছরের তপস্যার ফল সব নষ্ট হবে। জানকী যদি নিষ্পাপ হন, তাহলে আমি কায়মনোবাক্যে যে পাপকর্ম করিনি তার ফলভোগ করব।”
এসব কথা শুনে রাম বললেন–
“এই যমজ সন্তান লব ও কুশ আমারই, আমি জানি।”
তা সত্ত্বেও রাম তাঁর সতীত্ব তথা বিশুদ্ধতার পরীক্ষার আয়োজন করলেন। সীতা কিন্তু সে সুযোগ রামকে আর দেননি। বল এবার সীতার কোর্টে। অনেক হয়েছে, আর নয়! এসময় বিভীষণ নেই, বিভীষণের মায়াবলও নেই। সীতাকে রক্ষা করার মতো কেউ নেই অযোধ্যায়। অশ্রুসজল চোখে সীতা বসুন্ধরাকে আহ্বান করলেন–
“যথাহং রাঘবাদন্যং মনসাপি ন চিন্তয়ে।
তথা মে মাধবী দেবী বিবরং দাতুমহতি।
মনসা কমণা বাঁচা যথা রামং সমৰ্চয়ে।
তথা মে মাধবী দেবী বিবরং দাতুমহতি।”
সীতার চরিত্র নিয়ে প্রজাদের সামনে নিন্দা শুরু হলে লজ্জায় ও ক্ষোভে সীতা পাতালে প্রবেশ করেন। নারীকে এভাবে অপমান করার মতো বাড়াবাড়িটা উত্তরকাণ্ডের কবি না-করলেই পারতেন!
অগ্নিপরীক্ষার ব্যাপারে একটি মত পাওয়া যায়। সেই মতানুসারে আমরা দেখব অগ্নিপরীক্ষা ব্যাপারটা কেমন? দাউদাউ জ্বলতে থাকা লেলিহান শিখার ভিতর প্রবেশ করা? তারপর পূণ্যবান ব্যক্তির সেই আগুনের ভিতর থেকে অবিকৃতরূপে বেরিয়ে আসা? একদম না। বিষ্ণুসংহিতায় একাদশ অধ্যায়ে অগ্নিপরীক্ষা ব্যাপারটা স্পষ্ট করেছে। পণ্ডিতপ্রবর শ্রীমনোনীত সেনের ভাষায় বলি–
“অগ্নিপরীক্ষার কথা কথিত হইতেছে। ষোড়শ-অঙ্গুলি-পরিমিত ষোড়শ-অঙ্গুলি অন্তর অন্তর সাতটি মণ্ডল করিবে। অনন্তর পূর্বমুখপ্রসারিত-বাহু অভিযুক্ত ব্যক্তির করদ্বয়ে সাতটি অশত্থাপত্র দিবে। দুই হস্তের সহিত সেই সকল পত্র সূত্র দ্বারা বেষ্টন করিবে। তৎপরে, অর্থাৎ পত্ৰাচ্ছাদিত হস্তদ্বয়ে পঞ্চাশৎপল-পরিমিত সমতল অগ্নিবর্ণ জ্বলন্ত লৌহপিণ্ড স্থাপন করিবে। (অভিযুক্ত ব্যক্তি) তাহা লইয়া সেই সকল মণ্ডলে নাতিশীঘ্র-নাতিবিলম্বিতভাবে পদক্ষেপ করত গমন করিবে। তৎপশ্চাৎ সপ্তম মণ্ডল পার হইয়া হস্তস্থিত লৌহপিণ্ড ভূমিতে ফেলিয়া দিবে। যে ব্যক্তির দুই হাতের মধ্যে কোন স্থল দগ্ধ হয়, তাহাকে অশুদ্ধ বলিয়া নির্দেশ করিবে। আর যে ব্যক্তি সর্বথা অদগ্ধ, সেই ব্যক্তি বিশুদ্ধ হইবে। যে ব্যক্তি ভয়ক্রমে লৌহপিণ্ড ফেলিয়া দেয়, অথবা যে ব্যক্তি দগ্ধ হইল কি না ঠিক করা যায় না, শপথক্রিয়ার অশুদ্ধিবশতঃ অর্থাৎ তাহা ঠিক না হওয়ায় তাহাকে পুনর্বার লৌহপিণ্ড গ্রহণ করিতে হইবে, অভিযুক্ত ব্যক্তি উভয় কর দ্বারা ব্রীহি মর্দন করিলে তাহার উভয় করতল অগ্রেই (অর্থাৎ অশ্বথপত্র দিবার পূর্বেই) লক্ষ্য করিবে (কোনো চিহ্ন আছে কি না দেখিবে)। অনন্তর মন্ত্রপাঠ করিয়া ইহার (অর্থাৎ অভিযুক্ত পুরুষের হস্তদ্বয়ে লৌহপিণ্ড (স্থাপন কর্তব্য। হে অগ্নি! তুমি সাক্ষীর ন্যায় সর্বভূতের অন্তরে বিচরণ করিতেছ; অতএব হে অগ্নি! যাহা মনুষ্যের অজ্ঞাত, তাহা তুমিই অবগত আছ। ব্যবহারস্থলে আরোপিত কলঙ্ক হইতে এই মনুষ্য শুদ্ধি আকাঙ্ক্ষা করিতেছে, অতএব ইহাকে এই সংশয় হইতে ধর্মতঃ পরিত্রাণ করা তোমার উচিত।”
সীতা কি সত্যিই ধর্ষিতা হয়েছিল? নাকি কেবলই অপবাদ! অমন পিলে চমকানো সুন্দরী রমণীকে দীর্ঘ দশ মাস নিজের কবজায় পেয়েও ‘দুঃশ্চরিত্র’, কামুক’ ও ‘ধর্ষকামী’ রাবণ ছেড়ে দিল! একথা ঠিক যে, বাল্মীকি বলেছেন সীতার চেয়েও পরমা সুন্দরী নারী রাবণের অন্দরমহল ভরপুর ছিল। প্রধানা মহিষী মন্দোদরীও ডাকসাইটে সুন্দরী। সুন্দরী নারী সংগ্রহে রাবণের জুড়ি মেলা ভার। সেইসব সুন্দরীদের দেখে হনুমানের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া–
“ন তত্র কাশ্চিৎ প্রমদা প্ৰসহ্য, বীর্যোপপন্নেন গুণেন লন্ধা।”
তাঁর সংগ্রহে সবর্ণেরই নারী নয়, জাতিবর্ণনির্বিশেষে নারীরা আছেন–“রাজর্ষি-বিপ্র-দৈত্যানাং গন্ধর্বনাঞ্চ ঘোষিতঃ।” তা সত্ত্বেও রাবণের বিশ্বস্ত অনুচর মহাপার্শ্ব লঙ্কাকাণ্ডের ১৩ তম সর্গে রাবণকে স্পষ্টত বলেছিলেন–
“হে মহাবল, যদি রমণকালে সীতা আপনার অনুকূল না-হয়, তাহলে আপনি কুকুটবৃত্তিতে অর্থাৎ বলপ্রয়োগ করে আক্রমণ করবেন, তাকে উপভোগ ও রমণ করুন।” (বলাৎ কুকুটবৃত্তেন প্রবর্তস্ব মহাবল।/আত্রুম্যাক্রম্য সীতাং বৈ তাং ভুং চ রমস্য চ) রাবণ নিজেও বলেছেন–
“দ্বৌ মাসৌ রক্ষিতবৌমে যো অবধিন্তে ময়াকৃতঃ।
ততঃ শয়নমারোহ মম ত্বং বরবৰ্ণিনি।”
অন্যথা হলে খণ্ড খণ্ড করে কেটে খাওয়ার কথাও বলা হয়েছে–
“দ্বাভ্যামূর্ধন্তু মাসাভ্যাং ভর্তারং মামনিচ্ছতীম্।
মম ত্বাং প্রাতরাশার্থে সূদাচ্ছেৎস্যন্তি খণ্ডশঃ।”
অপহৃত হয়ে সীতাও রাবণকে বলেছিলেন–তুই আমাকে ধর্ষণ করেছিস। সেই হেতু তোর নিজের, রাক্ষসদের এবং অন্তঃপুরের বিনাশকাল আসছেই। “মাং প্রধৃষ্য স তে প্রাপ্তো অয়ং রাসসাধম্।/আত্মনো রাক্ষসানাঞ্চ বধায়ান্তঃপুরস্য চ।” রাবণের স্ত্রী মন্দোদরীও লঙ্কাকাণ্ডের ১১৩ তম সর্গে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছেন–
“তদৈব যন্ন দগ্ধস্তং ধর্ষংস্তনুধম্যমাম্।
দেবা বিভ্যতি তে সর্বে সেন্দ্রাঃ সাগ্নিপুনরাগমাঃ।”
অর্থাৎ তুমি যে সেই জানকী ধর্ষণ করতে করতেই দগ্ধ হওনি, তার কারণ ইন্দ্রাদি দেবগণও তোমাকে ভয় করে চলেন। মন্দোদরী বিলক্ষণ জানতেন রাবণের চরম ‘আলুর দোষ আছে। সীতা ছাড়া অন্য কোনো নারীদের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করার দোষে মন্দোদরী রাবণকে তিরস্কার করেছেন এমন কোনো কাহিনি জানা নেই। যদিও সে যুগে ব্রাহ্মণ আর রাজরাজড়াদের একাধিক নারীসঙ্গ নিন্দিত ছিল না–তার উপর রাবণ কেবল রাজাই ছিলেন না, তিনি চতুর্বেদী ব্রাহ্মণও ছিলেন। তবে রাবণ পূর্বে যাঁকেই ধর্ষণ করুন-না কেন, সীতাকে ধর্ষণ করার উদ্দেশ্য তাঁর ছিল না। উদ্দেশ্য কী ছিল, সেটা বরং রাবণের মুখ থেকেই শোনা যাক। সীতা অপহরণের অব্যবহিত পরেই নিজেকে ছদ্মবেশ মুক্ত করে রাবণ বলছেন–আমি বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক নারী এনেছি, তুমি আমার মহিষী হয়ে তাঁদের সকলের প্রধান হও। তুমি যদি আমার স্ত্রী হও, তবে সবরকমের অলংকার ভূষিতা ৫০০০ দাসী তোমার সেবা-পরিচর্যা করবে। মিলিয়ে নিন পাঠকবন্ধু–
“বীনামূত্তমন্ত্ৰিণামাহৃতানামিতস্ততঃ।
সর্বাত্ৰামেষ ভদ্রং তে মমার্গমহিষী ভব।
… পঞ্চ দাস্যঃ সহস্রাণি সর্বাভরণভূষিতাঃ।
সীতে পরিচারষ্যন্তি ভার্যা ভবসি মে যদি।”
রাবণকে মানুষ যতটা ‘ছোটোলোক’ ভাবেন, রাবণ ঠিক ততটা ছোটোলোক নন। সেই উদারতা নিয়ে উত্তরকাণ্ডের ৪৬ সর্গে মহাতেজা অগস্ত্য কী বলছেন সেটাও জেনে নিতে পারি–
“লঙ্কামানায় যত্নেন মাতেব পরিরক্ষিতা।
এবমেতৎ সমাখ্যাতং তব রাম মহাযশ।”
অর্থাৎ, রাবণ সীতাকে লঙ্কায় এনে সযত্নে মায়ের মতো সবরকমভাবে রক্ষা করেছিলেন। মহাযশা রাম, এই সমস্ত বিবরণ তোমার কাছে বর্ণনা করলাম। কম্বনের রামায়ণে রাবণ সীতাকে অপহরণ করেননি, বলপ্রয়োগ করেননি, স্পর্শ করেননি–যেমনভাবে বাল্মীকি রাবণ কর্তৃক সীতাকে অপহরণ করিয়েছেন। কম্বন রামায়ণে রাবণ সীতাকে স্পর্শ না-করে যেখানে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন সেখানকার মাটি সমেত তাঁকে তুলে নিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, কোনো আকাশযানে নয়। রাবণ যাকে অপহরণ করেছিলেন তিনি আসল সীতা নন, মানে রক্তমাংসের নারী নন। মায়া-সীতা।
রাবণ যেদিন অপহরণ করেছিলেন সেদিন থেকেই অশোকবনে রাখেন। কিন্তু হরিশঙ্কর জলদাস এক লেখায় বলেছেন–সীতাকে অপহরণের পর রাবণ তাঁর নিজ প্রাসাদের সবাইকে বাইরে বের করে দিয়ে এক রাত্রি সীতার সঙ্গে থাকে। তার পরের দিন মন্দোদরীর তীব্র বাধায় সীতাকে অশোকবনে সরিয়ে দেয়। মন্দোদরী যে জবরদোস্ত বাধা দিয়েছিল তা প্রায় সব রামায়ণেই পাওয়া যায়। বাধা দিয়েছিল কেন? শুধুই কি একজন নারী অপমানিত হচ্ছিল বলে বাধা? নাকি তাঁর মুখের আদলের সঙ্গে সীতার মুখের আদলে মিল পাওয়া গিয়েছিল বলে! রাবণ কেন তড়িঘড়ি অশোকবনে সীতাকে রেখে এসেছিল? রাবণের সঙ্গে সীতার সম্পর্ক কি সেটা মন্দোদরী রাবণকে বলে দিয়েছিলেন? অশোকবনে রাখার পর রাবণ কিন্তু ভুলেও একবারের জন্যেও সীতাকে স্পর্শ করেননি। হনুমানও কিন্তু লঙ্কায় পৌঁছে দূর থেকে মন্দোদরীকে সীতা বলে ভুল করেছিল। যদিও বেশিরভাগ রামায়ণ থেকে জানা যায় সীতা অপহরণের পর সুগ্রীবের সঙ্গে দেখা হওয়ার প্রাক্কালে হনুমানের সঙ্গে পরিচয় হয়। অর্থাৎ তার আগে সীতাকে দেখার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু খটকা লাগে যে কারণে, সেটা হল, যদি পূর্ব-পরিচয় না-ই থাকে তবে রাম-লক্ষ্মণের সঙ্গে হনুমানের যে সম্পর্ক এবং আনুগত্য পরিলক্ষিত হয়, তাতে তো অন্য রহস্য আছে মনে হয়। না-হলে সুগ্রীবের আদেশ পেয়ে রাম-লক্ষ্মণকে দেখে ভক্ত হয়ে যায় কোন্ আদরে! যে হনুমানের বয়সের গাছপাথর নেই, যাকে মহাভারতেও দেখা মেলে–তাঁর কাছে যে সীতার সঙ্গে পূর্ব-পরিচয় থাকবে না, তা মেনে নেওয়া কঠিন। সেই কারণেই সীতার আদলের সঙ্গে মন্দোদরীর আদল গুলিয়ে ফেলছিল হনুমান। মেয়ের সঙ্গে মায়ের চেহারা মিল থাকাটা তো অস্বাভাবিক নয়।
চন্দ্রাবতী রামায়ণে আছে দেবতাদের চমকিয়ে রাবণ যখন লঙ্কায় ফিরল, সে সময় প্রভূত পরিমাণে দেবকন্যা অপহরণ করে নিয়ে এসেছিল। তাঁদেরকে নিয়ে অশোকবনে ফুর্তি করতে লাগল। এই কথা শুনে মন্দোদরী মনঃকষ্টে বিষপান করল। বিষপান করলেও মৃত্যু হয়নি, হল গর্ভবতী। দশমাস পর তিনি ডিম প্রসব করলেন। এই ঘটনায় গণকেরা নিদান দিল এই ডিম রাক্ষসদের ধ্বংস করবে। অতএব ধ্বংস করো। একথা শুনে মন্দোদরী কান্নায় ভেঙে পড়লেন এবং রাবণকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যাতে ডিমটি ধ্বংস না-করে যেন সোনা-রুপোর খাঁচায় বন্দি করে সমুদ্রে ফেলে দেয়। যেই কথা সেই কাজ। ডিমটি সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হল। একদিন গরীব জেলে মাধবের জালে সেদিন কোনো মাছ ধরা পরে না। হঠাৎ তাঁর জালে এই সোনা-রুপোর খাঁচায় ভরা ডিম পায়। সোনা-রুপো বিক্রি করে বড়লোক হয় সে। মাধবের বউয়ের নাম সতা। সতা স্বপ্ন দেখে ডিমের ভিতরে এক নারী আছে, যে তাকে বলছে জনকের কাছে নিয়ে যেতে, জনক তার পিতা। এইভাবে সীতার জন্ম। সতার নামে মিলিয়ে তার নাম সীতা রাখা হয়। তবে সীতা যাঁর গর্ভে যেখানে যেভাবেই জন্মাক না-কেন, প্রাপ্তি কিন্তু হলকর্ষণেই। এ ব্যাপারে সব কবিই একমত।
কবিবর বাল্মীকি রাবণ কর্তৃক সীতার অপহরণের সময় যে বর্ণনা দিয়েছিলেন, তাও বিবেচনা করার বিষয়–“সীতা রাবণ কর্তৃক ধর্ষিতা হলে স্থাবর ও জঙ্গম প্রাণীগণ সহ সমগ্র পৃথিবী মর্যাদাবিহীন ও ভীষণ অন্ধকারে আড়াল হল। সেখানে বায়ুপ্রবাহ স্তব্ধ হল এবং সূর্য নিষ্প্রভ হল। ব্রহ্মা দিব্যচক্ষে সীতাকে রাবণ কর্তৃক ধর্ষিতা হতে দেখে ‘কার্যসিদ্ধি হল’ বলেন।” তবে একথা মনে রাখা দরকার, প্রজাবৎসল রাজা রামচন্দ্র প্রজাদের সন্দেহ দূর করতে সীতাকে আগুনের ভিতর ঠেলে দিলেও, সে সময় রাম বলেছিলেন–
“ন চ শক্ত স দুষ্টাত্মা মনসাপি চ মৈথিলীম্।
প্ৰধর্ষয়িতুমপ্রাপ্যাং দীপ্তমগ্নিশিখামিব৷৷”
এই সংলাপে সীতাকে যে দুষ্টাত্মা ধর্ষণ করতে পারেনি সেই আত্মবিশ্বাস পরিলক্ষিত হলেও, এই রামই যখন অবলীলায় সীতার উদ্দেশে বলে ফেলেন ‘কুকুরে চাটা ঘি’, তখন বিস্ময়াভিভূত হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকে না। লঙ্কাকাণ্ডের ১১৭ তম সর্গে ১৩ থেকে ২৪ নম্বর শ্লোক পর্যন্ত সীতাকে রাম যে ঘৃণ্য ভাষায় অপমান করেছেন, আক্রমণ করেছেন, তা কোনো আদর্শ মানবের কাছ থেকে আশা করা যায় না। একজন প্রাণপ্রিয় স্বামীর কাছ থেকে এহেন আচরণ একজন পতিব্রতা স্ত্রীর কাছে অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এ ঘটনায় সীতা এতটাই আহত হয়েছিলেন যে তা প্রকাশে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি।
হে পাঠক, সীতার কথা শুনুন–
“বীর, ভদ্রেতর ব্যক্তি যে ভাষায় আর্যেতর নারীকে বলে থাকে, সেই ভাষাতে কেন আমাকে এমন নিদারুণ রূঢ় বাক্য শোনাচ্ছেন? আপনি আমাকে যেমনটা ভাবছেন, আমি তেমনটা নই। আমি আমার চরিত্রের দিব্যি দিয়ে বলছি, আপনি আমাকে বিশ্বাস করুন। আর্যেতরা সাধারণী নারীর চরিত্র দেখে আপনি স্ত্রীজাতির উপর আশঙ্কা করছেন, কিন্তু আপনি অনেকবার পরীক্ষা করেছেন। সুতরাং এ আশঙ্কা পরিহার করুন। আমি আত্মবশে না থাকায় রাবণের সঙ্গে আমার যে শরীরের স্পর্শ ঘটেছিল, তা আমার ইচ্ছাকৃত নয়। অপরাধী সে তো দৈবই। যা আমার অধীন, সেই হৃদয় তো কেউ স্পর্শ করতে পারেনি। সেই হৃদয় আপনার জন্যই সমানভাবেই অনুরাগী আছে। কিন্তু শরীর আমার বশীভূত নয়, অতএব রক্ষক না-থাকায় রাবণ তা স্পর্শ করেছে। এতে আমার দোষ কোথায়? হায়, বহুদিন একসঙ্গে থেকে আমাদের উভয়ের অনুরাগ একসময় তৈরি হয়েছিল। কিন্তু আপনি যে তাতেও আমার চরিত্রকে বুঝতে পারেননি, তাতেই আমি প্রচণ্ড দুঃখ প্রাপ্ত হয়েছি। আপনি যখন লঙ্কায় হনুমানকে পাঠিয়েছিলেন আমাকে দেখতে, তখনই কেন সেদিন আমাকে প্রত্যাখ্যান করেননি? হনুমান আমাকে আপনার সেই প্রত্যাখ্যানের খবর শোনালে আমি সেই মুহূর্তেই প্ৰাণত্যাগ করতাম। তাহলে আপনাকে আর প্রাণসংশয় হয় এমন যুদ্ধশ্রম করতে হত না।”
এরপর সীতা লক্ষ্মণকে আদেশ করলেন–
“সৌমিত্রে, এমন মিথ্যা অপবাদগ্রস্ত হয়ে আমি আর প্রাণধারণ করতে চাই না। এখনই চিতা প্রস্তুত করো, চিতাই আমার এই বিপদের একমাত্র ওষুধ। স্বামী আমার গুণে অসন্তুষ্ট হয়ে লোকজনদের মধ্যে আমাকে ত্যাগ করলেন। সুতরাং এক্ষুনি আগুনে প্রবেশ করে আমার কর্ম অনুসারে মুক্তিপ্রাপ্ত হই।”
এত কথার পরেও বরফ গলেনি। স্ত্রীর শরীরে অগ্নিসংযোগ করা হলই। স্বামী রাম গো-হারা হারলেন, কলঙ্কিত হলেন, তিরস্কৃত হলেন, নিন্দনীয় হলেন–রাজা রাম সার্থক হলেন, প্রজানুরঞ্জক হলেন, রামরাজত্ব দৃষ্টান্ত হল। বস্তুত এই অগ্নিপরীক্ষা নাট্যাংশে কী ঘটেছিল? অনেক গবেষক বলেন–সীতাবদল। হ্যাঁ, সীতাবদলই হয়েছিল। সবার সামনেই তা ঘটেছিল। যজ্ঞকুণ্ডও প্রজ্জ্বলিত হল। রাম যাকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে বললেন তিনি সীতা নন, বেদবতী। যে বেদবতীকে রাবণ অপহরণ করে লঙ্কায় এনেছিলেন। রাম উদ্ধার করেছেন বেদবতীকে, সীতাকে নয়। যাই হোক, যাঁরা বদলাবদলি করে বেদবতীকে পঞ্চবটিতে রেখে সীতাকে নিয়ে গিয়েছিলেন নিরাপদ স্থানে, তাঁরাই এখন প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডের পিছনে বেদবতীকে সরিয়ে সীতাকে আবির্ভূত করালেন অগ্নি পদাধিকারী ব্যক্তিটি। এ সব ঘটনাই লক্ষ্মণ, বিভীষণ, হনুমান চাক্ষুষ করলেও প্রকাশ্যে কিছু বলার সাহস পাননি। বাল্মীকি তাঁর বর্ণনায় স্পষ্ট করেছেন দুই নারীর উপস্থিতি। বেদবতীর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন ‘নীলকুঞ্চিতকেশা’, আর সীতার বর্ণনা বলেছেন ‘কেশকলাপ কৃষ্ণ ও কুঞ্চিত’। রামও বেদবতীকে ‘ভদ্রে’ (madam) সম্বোধন করেছেন।
রামায়ণের সবচেয়ে মজার বিষয়ই হল সীতার সতীত্ব প্রমাণ। রামের চরিত্র বিনির্মাণের জায়গায় সীতার চরিত্র প্রধান হয়ে যায়। কোনোভাবেই একজন অনার্যর সঙ্গে সীতাকে বিছানায় নামানো যায় না। দশমাস পার হলেও। রামের বউ একজন আদিবাসীর সঙ্গে ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় সময় অতিবাহিত করেছে, এটা কোনোভাবেই ইতিহাসে রাখা যাবে না। এই কারণেই রামায়ণে রামের চেয়ে সীতা অনেকাংশে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। রামের বউকে যে কোনো মূল্যে গরিব-গুরবো অনার্য রাক্ষসদের সংস্পর্শমুক্ত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা রামায়ণের কবি। রামায়ণ শেষপর্যন্ত যতটা-না রামের হয়েছে, বাধ্য হয়েই সেটা শেষপর্যন্ত সীতার চরিত্র নির্মাণের ঝাণ্ডা হয়েছে। তাই বলা হয়, রাবণ যে সীতাকে অপহরণ করেছিলেন সে আসল সীতা নয়, সে মায়া-সীতা। তা সেই মায়া-সীতার জন্য শ্রীরামের এত লঙ্কাকাণ্ড’! মায়া-সীতার ধারণা সম্ভবত মধ্যযুগের রচনাকারদের আবিষ্কার। যেমনটা আমরা হেলেনের ক্ষেত্রে দেখতে পাই। ইউরিপিদেস, স্তেসিকোরাস এবং হেরোডোটাস আসল হেলেনকে মিশরে পাঠিয়ে দিয়ে তার প্রতিরূপকে ট্রয়ে পাঠিয়েছিলেন। গ্রিকদের এই পিউরিটান ধারণা (নারী অপহৃতা হলে বা পরপুরুষের অনুগামিনী হলে ওই পুরুষের সঙ্গে তার যৌনসংসর্গ হতে পারে, তাতে তাঁকে আর গ্রহণ করা যাবে না) গ্রিকদের ভারতে আগমনের সঙ্গে সঙ্গে আমদানি হয়ে থাকতে পারে। পিউরিটান ধারণার উৎস যাই-ই হোক ভারতীয় প্রক্ষিপ্ত রচনাকাররাই সীতার সতীত্ব বজায় রাখার উদ্দেশ্যেই মায়া-সীতার আমদানি করেছেন। বস্তুত উত্তরকাণ্ডের কবি সীতার আত্মসম্মান শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। নারীর সতীত্ব সম্পদ নেই, স্বামী ছাড়া স্বাতন্ত্র্যতা নেই।
ব্যতিক্রম কবিবর বাল্মীকি, রাম-রাবণ-বান্দর-ব্রাহ্মণ যখন সকলেই সীতাকে ‘অপবিত্র’ সাব্যস্ত করেই চললেন, তখন বাল্মীকিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি বললেন–
“সীতা যদি অপবিত্র হয়, তবে আমার সমস্ত ঋষিত্বের পূণ্য যেন শূন্য হয়ে যায়।”
বাল্মীকির এই হুংকারে কর্ণপাত করেননি উত্তরকাণ্ডের কবি। অগ্নিপরীক্ষার সিদ্ধান্তে অটুট থেকে সীতাকে মাটির নিচে সেঁধিয়ে দিলেন, বাল্মীকিকে অগ্রাহ্য করে। বস্তুত বাংলা রামায়ণটা তাই মূলত সীতায়ণ, আর বেশিরভাগ রামায়ণ মূলত হনুমানায়ণ।
রাবণ : প্রাজ্ঞ, নির্ভীক বীর, কামুক এবং অপরিমাণদর্শী
বাল্মীকির রামকথায় রাবণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, যাকে বাদ দিলে রামের অস্তিত্ব নেই, রামায়ণও অর্থহীন। রাবণ ছাড়া রামের যশ নেই, খ্যাতিও নেই। রাম ঐতিহাসিক ব্যক্তি হলে রাবণও অবশ্যই ঐতিহাসিক ব্যক্তি। কোনো অলৌকিক অস্বাভাবিক কিম্ভুতকিমাকার কোনো বস্তু নয়। দশগ্ৰীব বিংশতিভুজ কোনো আজব প্রাণী নন তিনি। রাবণের জন্মবৃত্তান্ত বর্ণনা করতে গিয়ে কোনো অর্বাচীন কবি গঞ্জিকাসেবনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার প্রভাবে রাবণের দশ মুণ্ডু বিশ হাতবিশিষ্ট অবয়ব বলে লিপিবদ্ধ করেছেন। বাল্মীকির রামায়ণে রাবণ সুশ্রী, সুপুরুষ, দ্বিভুজ। বিশ্বাস না হয়, মন্দোদরীর মুখেই শুনুন–
“উজ্জ্বলতায় সূর্য, কমনীয়তায় চন্দ্র এবং শোভায় পদ্মের তুল্য, ইহার জ্বযুগল, উন্নত নাসা ও ত্বক সুন্দর, ইহা রত্নকিরীট ও দীপ্ত কুণ্ডলে শোভিত।”
রাবণের মৃত্যুর পর একক মাথা কোলে নিয়ে শোকার্তা মন্দোদরীর এটাই ছিল বিলাপ-সংলাপ। হনুমান সর্বসুলক্ষণযুক্ত সুপুরুষ রাবণকে দর্শন করে মুগ্ধ হয়েছেন। এমনকি রামও যুদ্ধক্ষেত্রে রাবণকে দর্শন করে মুগ্ধ হয়ে বলেছেন–
“উঁহার যেমন দেহভাগ্য, দেব ও দানবেরও এইরূপ নহে।”
অতএব যাঁরা রাবণকে দশ মাথা কুড়ি হাতের অতিকায় রাক্ষস ভেবে রেখেছেন, তাঁরা কল্পনার দেশ থেকে বাস্তব মাটিতে নেমে আসুন।
সবদিক দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে বলা যায় রাবণ অনার্যই ছিলেন। শিবভক্ত শৈব্য। শিব আদিতে অনার্য দেবতাই ছিলেন, পরে আর্যরা তাঁকে আত্মসাৎ করে নেয়। মিথ্যা অপপ্রচারে রাবণ দশমুণ্ডধারী, পাপিষ্ঠ। বাল্মীকির রামায়ণে তিনি সুপুরুষ, ন্যায়নিষ্ঠ, ক্ষমাশীল, দুই হাতবিশিষ্ট, একটি মাথা সর্বস্ব এক দিগ্বিজয়ী শৈব রাজা। বস্তুত শৈব হওয়ার অপরাধে ব্ৰহ্মাবাদী বর্ণাশ্রমধর্মী জাতিভেদপ্রধান সমাজ-সংস্থাপক আর্যসমাজে রাবণ ব্রাত্য হন। রাম-রাবণের সংঘাত আদতেই আর ভার্সেস আর্যের সংঘাত। শিব আর ব্রহ্মার বিবাদ। আদিতে শিব অনার্য দেবতা, পশুপতি। শিব রাবণের সহায়ক ছিলেন। যতদিন শিব রাবণের সহায়ক ছিলেন, ততদিনই রাবণ অপরাজেয় ছিলেন। যেদিন থেকে অনার্য দেবতা শিবকে আর্ব দেবতারা নিজেদের দলে টেনে নিলেন (আর্য দেবতারা শুধু টেনেই নিলেন না, তাঁকে ‘মহাদেব’ ‘মহেশ্বর’ শিরোপা দিয়ে ব্রহ্মা আর বিষ্ণুর সঙ্গে এক পংক্তিতে বসালেন), সেইদিন থেকে রাবণের পতন ধীরে ধীরে অনিবার্য হয়ে উঠল।
রাবণ মহাকাব্য ও পুরাণে বর্ণিত লঙ্কা দ্বীপের রাজা। এই লঙ্কা কি বর্তমানের শ্রীলঙ্কা? শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে রাবণ তথা স্বর্ণলঙ্কার কোনো ইতিহাস পাওয়া যায় না। রামায়ণে উল্লিখিত রাবণের দেশ লঙ্কা আজকের শ্রীলঙ্কা কি না তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যেও বিতর্ক আছে। দক্ষিণ সমুদ্রের তীরে ত্রিকুট নামে একটি পর্বতের কথা জানা যায়। তার কাছে আরেকটি পর্বত, নাম সুবল। ওই পাহাড়ের উপর লঙ্কা নির্মাণ করেছিলেন স্বয়ং বিশ্বকর্মা। অতএব লঙ্কা যে সমুদ্রের ভিতর কোনো দ্বীপ বা বর্তমানের শ্রীলঙ্কা নয় একথা স্পষ্ট। তবে জম্মু-কাশ্মীরেও একটি ত্রিকুট পর্বতের সন্ধান পাওয়া যায়। এটির গুহায় বৈষ্ণোদেবীর মন্দির।
লঙ্কায় ভূগোল-ইতিহাসটা একটু দেখা যাক। রাবণের জন্মের বহু আগে মালী, সুমালী ও মাল্যবান এই তিন রাক্ষস ভাই স্বর্গের দখলদারির স্বার্থে দেবতাদের উপর খুব অত্যাচার শুরু করেছিল। সৰ্বলোক জয় করে তাঁরা এবার তাঁদের জন্য একটি প্রাসাদ বানালেন বিশ্বকর্মাকে দিয়ে। কেউ কেউ বলেন লঙ্কা রাক্ষস-স্থপতি ময়দানবের সৃষ্টি। ময়দানব অনার্যদের স্থপতি। ময়দানবের রচিত গ্রন্থের নাম ময়মত। কথিত আছে, ময়দানব ছিলেন বিশ্বকর্মারই পুত্র, অন্যদিকে আর্যদের স্থপতি বিশ্বকর্মা। অবশ্য বিশ্বকর্মা গোড়াতে অনার্যদেরই সভাপতি ছিলেন, পরে আরও বেশি সুযোগের সন্ধানে আর্যদেবতাদের মহাস্রষ্টা আসন অলংকৃত করেন, আর্যরাও তাঁর পরিচয় আর্যরূপেই প্রচার করতে থাকেন। বিশ্বকর্মার রচিত গ্রন্থের নাম ‘বিশ্বকর্মাস্তুশাস্ত্রম্ বিশ্বকর্মা “স্থাপত্য বেদ’ নামক একটি উপবেদের রচয়িতা। বিশ্বকর্মার নামে অন্ততপক্ষে দশখানি বাস্তুবিদ্যার গ্রন্থ পাওয়া যায়। বিশ্বকর্মার আর-এক পুত্র ছিলেন, তিনি বানর যুথপতি নল। পৌরাণিক মতে বিশ্বকর্মাও বানর জাতীয় বলা হয়েছে।
লঙ্কায় সৌন্দর্য বর্ণনায় বাল্মীকি অকৃপণ। ত্রিভুবন খুঁজলেও লঙ্কার মতো সৌন্দর্য-বৈভব পাওয়া যাবে না। লঙ্কার উত্তর দ্বার ছিল সুরক্ষিত। গৃহগুলো বহুতল ও গগনস্পর্শী। হনুমান লঙ্কায় পৌঁছে তো থ। লঙ্কাগৃহের স্থাপত্য দর্শন করে হনুমান তো বুঝতেই পারছেন না, এটা স্বর্গপুরী নাকি ইন্দ্রপুরী!–
“স্বর্গোহয়ং দেবলোকোহয় ইন্দ্রস্যাপি পুরী ভবেৎ।”
হনুমান দেখলেন মেঘাকার লম্ব পর্বতে প্রতিষ্ঠিত লঙ্কায় সমস্ত পথই অতি প্রশস্ত। সর্বত্র প্রাসাদ, স্বর্ণস্তম্ভ ও স্বর্ণজাল। কোনো কোনো সাপ্তভৌমিক ভবন, কোথাও-বা অষ্টতল গৃহও দেখা গেছে। স্থানে স্থানে স্বর্ণময়। তোরণ। এ যেন যথার্থই স্বর্ণলঙ্কা।
চন্দ্রাবতী রামায়ণে এইভাবে বর্ণিত হয়েছে–
“স্বর্গপুরে আছে যথা ইন্দ্রের নন্দন।
সেইমতে লঙ্কাপুরে গো অশোকের বন।”
কিংবা “সোণার পালঙ্কে তারা গো শুইয়া নিদ্রা যায়।
দেবের অমৃত তারা গো সুখে বৈসা খায়।
বিচিত্র সুবর্ণ লঙ্কা গো নিৰ্মাইল বিশাই।
এমন বিচিত্র পুরী গো তিরভুবনে নাই।”
রামচন্দ্রের স্ত্রী সীতাকে অপহরণ করে রাবণ এই লঙ্কাতেই নিয়ে আসেন। সীতার উদ্ধারকল্পে কিষ্কিন্ধ্যার বানরসেনার সাহায্যে রামচন্দ্র লঙ্কা আক্রমণ করলে রাবণের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ হয়। রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে অগ্যস্ত মুনির মুখ দিয়ে তাঁর পূর্বজীবনের কথা বলা হয়েছে।
রাবণ কোনোদিনই অপরাজেয় ছিলেন না। মৃত্যু না-হলেও বহু যুদ্ধে বহুবার তিনি পরাজিত হয়েছেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে–নর্মদা নদীর তীরে মাহিষ্যতি নগরী, সেখানকার রাজা হলেন সহস্রহাতসর্বস্ব (সহস্রহাতসর্বস্ব হাত শুনে ভেবে নেওয়ার কারণ নেই যে, কোনো ব্যক্তির ১০০০ টি হাত। বাস্তবে সেটা কখনোই হয় না। এই সহস্রহাত মানে কার্তবীর্যাজুনের ৫০০ দেহরক্ষীর কথা বোঝানো হয়েছে। ৫০০ দেহরক্ষীর ১০০০ হাত। সেটাই বাস্তব) কার্তবীর্যাজুন। যুদ্ধ করতে গিয়ে রাবণ কার্তবীর্যাজুনের সেই হাজার হাতের মাঝে বন্দি হন, কার্তবীর্যাজুন রাবণকে জাপটে ধরে বন্দি করে রাখেন। রাবণের বাবা বিশ্রবা এসে কার্তবীর্যাৰ্জুনকে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেন। বিশ্রবার অনুরোধে রাবণ মুক্তি পান। রাবণ বালীর কাছেও পরাজিত হয়েছিলেন। বালি আহ্নিক করছিলেন, এমন সময় রাবণ তাই পা টিপে টিপে নিঃশব্দে তার পিছনে এসে দাঁড়ান এবং আচমকাই চেপে ধরবেন। নির্বিকার বালী রাবণকে বগলে চেপে ধরে চার সমুদ্র ঘুরে সন্ধ্যা আহ্নিক সমাপ্ত করলেন। রাবণের আর-একটি পরাজয়ের গল্প মনে পড়ছে। রাবণ নারদকে জিজ্ঞাসা করলেন কোথায় গেলে একটি মনের মতো যুদ্ধ করতে পারবেন। বহুদিন তিনি তেমন যুদ্ধ করে তৃপ্তি পাননি। নারদ বললেন, সমুদ্রের মধ্যে শ্বেতদ্বীপ। সেখানকার অধিবাসীরা সবাই সাদা রঙের। তুমি সেখানে গিয়ে যুদ্ধ করতে পারো। সময় নষ্ট না-করে রাবণ দ্রুত শ্বেতদ্বীপে চলে গেলেন। কিন্তু সেই দ্বীপে একজনও পুরুষ নেই যে! কেবলই নারী। তবুও রাবণ যুদ্ধ করতে চাইলেন। রাবণের সেই ইচ্ছার কথা শুনে সেইসব নারীরা তো হেসেই কুটিপুটি। তাঁরা রাবণকে কোলে তুলে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। দশ মাথা কুড়িটা হাত দেখে তাঁরা খুব মজা পাচ্ছিলেন। মান্ধাতার সঙ্গেও রাবণের যুদ্ধ হয়। তবে এ যুদ্ধ অমীমাংসিত ছিল–কারোর হার বা জিৎ হয়নি। ব্রহ্মা মহর্ষি পুলস্ত্যরা এসে মান্ধাতাকে ক্ষান্ত করেন ও রাবণকে তিরস্কার করে দুজনের সখ্যতার আয়োজন করেন।
‘রাবণ’ নামটি শিবের কাছ থেকে পাওয়া। কোথাও কোথাও মূর্তিশিল্পে বা চিত্রশিল্পে তার দশটি মাথা, কুড়িটি হাত ও দশটি পা দেখানও হয়। অন্য রামায়ণে ‘কামুক’ ও ‘ধর্ষকামী’ বলে নিন্দিত হলেও বাল্মীকির রামায়ণে রাবণকে মহাজ্ঞানী ও তাপসও বলা হয়েছে। রাবণকে যে দশানন বা দশমাথা বলা হয় সেটা হল তার দশ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, জ্ঞানের জন্য। তার মাঝে আছে ছয়টি শাস্ত্র আর চারটি বেদ–মোট দশটা জ্ঞান। মহাকাব্য ‘রামায়ণ’-এ লঙ্কাধিপতি রাবণকে কখনোই সম্পূর্ণ ভিলেন হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়নি। বরং বলা যায়, রাবণ রামায়ণ-কাহিনির অ্যান্টাগনিস্ট। এই বিশেষ চরিত্রটিকে ঘিরে এত বেশি কথা, উপকথা এবং অতিকথা এই ভারতভূমে আবর্তিত হয়েছে যে, রামায়ণের বর্ণনাই অনেক সময়ে চলে গিয়েছে অন্তরালে। সামনে এসে গেছে রাম, সীতা ও হনুমান–ইতিহাস ছাপিয়ে দেবত্বে। বীরপূজাই যে আমাদের রোগ! আর সেই বীর যদি দেবতা হয়, তাহলে তো পোয়া বারো। তাই রাবণ হয়ে উঠেছেন এক পরিপূর্ণ খলনায়ক। কারোকে খলনায়কের তকমা দেগে দিলে তার গুণগুলি আর দেখা যায় না, দেখা গেলেও সেটা আড়ালে রাখতেই বেশি তৃপ্ত বোধ করি। অথচ রামায়ণকে অনুসরণ করেই বলা যায়, রাবণ অজস্র গুণে গুণান্বিত এক ব্যক্তিত্ব। কিছু দুর্বলতা হেতু তাঁর পতন ঘটে এই মাত্র।
রাবণ চরিত্রের তেমন কয়েকটি দিকের কথা তুলে ধরা হল, যা সাধারণত আলোচনার আওতায় আসে না। যেমন–
(১) শাসক হিসাবে রাবণকে কোথাও অপশাসক বা নিষ্ঠুর বলা হয়নি। তিনি স্বর্ণলঙ্কার অধিপতি। স্বর্ণ বা সোনার রূপকে সমৃদ্ধ লঙ্কা এমনি এমনি হয় না। ফলে বোঝাই যায়, তিনি সমৃদ্ধ এক সাম্রাজ্য শাসন করতেন। আর এ কথা কে না জানে, সুশাসন ছাড়া সমৃদ্ধি সম্ভব নয়! বাল্মীকির রামায়ণে হনুমান যখন সীতার খোঁজে লঙ্কায় পৌঁছোন, সে সময় লঙ্কাদর্শন করে হনুমান বিহ্বল হয়ে যান, মুগ্ধ হওয়ার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।
(২) যুদ্ধক্ষেত্রে আহত অবস্থায় পড়ে থাকাকালীন রাবণকে দেখতে যান লক্ষ্মণ। রাবণ তাঁকে বিবিধ বিষয়ে জ্ঞান দান করেন। রাবণের সেই আলোচনার প্রধান বিষয় ছিল ‘রাজধর্ম’ কী এবং কীভাবে তা পালন করতে হয়। ভাবুন তো, একেই তো বলে সুশাসক। শুধু তাই নয়–
(৩) রাবণ ছিলেন এক অসামান্য বীণাবাদক। তিনি নিজেই তাঁর বীণার নকশা করেছিলেন। তিনি ‘শিব তাণ্ডব’ স্তোত্রেরও রচয়িতা।
(৪) রাবণ একনিষ্ঠ শিবভক্ত ছিলেন। রাবণকে শিব এক আশ্চর্য বর দান করেন। সেই বরে তিনি প্রায় অমরত্ব। প্রাপ্ত হন।
(৫) রাবণ ছিলেন দক্ষ চিকিৎসক। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে তাঁর বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল। নাড়ি পরীক্ষা’, ‘অর্ক শাস্ত্র’, ‘অর্ক পরীক্ষা’ প্রভৃতি বিখ্যাত আয়ুর্বেদ শাস্ত্রগ্রন্থ রাবণ কর্তৃক লিখিত বলে প্রচলিত। ক্ষত চিকিৎসায় তাঁর অবদানের কথা আজও আয়ুর্বেদ স্বীকার করে।
(৬) রাবণের পাণ্ডিত্যের খ্যাতি ছিল ভুবনবিদিত। চার বেদ এবং ছয় উপনিষদ তাঁর নখদর্পণে ছিল।
(৭) জ্যোতির্বিদ্যায় রাবণের বিশেষ দখল ছিল। একথা রামায়ণে বার বার উল্লিখিত হয়েছে যে, তিনি নাকি গ্রহতারকাদের নির্দেশ দিতেও পারতেন। আসলে তিনি গ্রহতারকার ভবিষ্যৎ অবস্থান অনর্গল বলে যেতে পারতেন। তাঁর রচিত ‘রাবণসংহিতা’ নামে একটি গ্রন্থ আছে।
(৮) রাবণ এবং তাঁর ভাই কুম্ভকর্ণ ছিলেন বিষ্ণুর দ্বাররক্ষক। তাঁরা ব্ৰহ্মকুমারদের দ্বারা অভিশাপগ্রস্ত হন। তাতেই তাঁদের রাক্ষসজন্ম ঘটে বলে উল্লেখ আছে।
(৯) রাবণকে ত্রিলোকের অধীশ্বর হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে বহু রামায়ণে। সুতরাং তাঁর ক্ষমতা যে-কোনো রাজার থেকে অনেক বেশি ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
(১০) রাবণ কেবল লঙ্কারই অধীশ্বর ছিলেন না, তিনি সমগ্র দক্ষিণ ভারতে রাজ করতেন।
(১১) অন্ধ্রপ্রদেশের কাকিনাড়ায় রাবণ ও শিবলিঙ্গ একত্রে পূজিত হন। এ থেকে বোঝা যায়, মানুষের রাবণ চিরকালই খলনায়ক ছিলেন না।
লঙ্কায় রাজা রাবণের জন্ম হয় বিশ্রবা মুনির ঔরসে কৈকসীর (অন্য নাম নিকষা) গর্ভে। কৈকেসী মোট চারটি সন্তানের জন্ম দিয়েছিল। এই চারটি সন্তানের মধ্যে পুত্র হল–রাবণ, কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ ও কন্যা শূর্পণখা। বিভিন্ন রামায়ণে বলা হয়েছে–রাবণের দশটি মাথা, কুড়িটি হাত। গায়ের রং ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, উজ্জ্বল চুল ও দাঁত এবং টকটকে লাল ঠোঁট ছিল। ইনি স্থপতি ময়দানবের কন্যা মন্দোদরীকে বিবাহ করেন। কথিত আছে, তাঁর প্রায় এক লক্ষ পুত্র ও সোয়া লক্ষ নাতি ছিল। প্রাচীন যুগে প্রজাদের সন্তানের চোখে দেখা হত। রাজা নিজেকে প্রজাদের পিতৃতুল্য বা অভিভাবক ভাবত। এটাই ছিল রীতি। রাবণের উল্লেখযোগ্য পুত্র ছিলেন মেঘনাদ বা ইন্দ্রজিৎ। বিশ্রবার প্রথমা স্ত্রী দেবর্ণিনীর সন্তান কুবের ছিলেন যক্ষদের রাজা। কুবের অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারী ছিলেন বলে কৈকসী ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁর পুত্রদেরকে অনুরূপ ঐশ্বর্য এবং সেই সঙ্গে অমিত তেজ অর্জনের জন্য তপস্যা করতে আদেশ দিলেন। এঁরা ব্রহ্মার গভীর উপাসনা শুরু করলে ব্রহ্মা তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে বর প্রার্থনা করতে বললেন। রাবণ অমরত্বের বর প্রার্থনা করলেন এবং ব্রহ্মা তা দিতে অসম্মত হলেন। পরে ইনি দেব, দানব, দৈত্য, যক্ষ, রক্ষ ইত্যাদির কাছে অজেয় ও অবধ্য হওয়ার বর প্রার্থনা করলেন। মানুষকে তিনি এই তালিকায় রাখলেন না। ব্রহ্মা এই বর মঞ্জুর করলেন।
এসময় কুবের লঙ্কার রাজা ছিলেন। কুবের রাবণের দাদা। প্রথমে রাবণ কুবেরকে লঙ্কা থেকে বিতারিত করে সেখানে রাক্ষসরাজ্য স্থাপন করেন। এই সময় ইনি কুবেরের পুষ্পক রথ অধিকার করেন। এরপর তিনি দিগ্বিজয়ে বের হয়ে নর্মদা নদীতীরে শিবপুজো আরম্ভ করলেন। সেখানে হাজার হাতবিশিষ্ট কার্তবীর্য নামক এক রাজা জলক্রীড়া করছিলেন। এর ফলে নদীর জল ঘোলা হতে থাকলে ক্রুদ্ধ রাবণ তাঁকে আক্রমণ করেন। এই যুদ্ধে রাবণ পরাজিত ও বন্দি হন। পরে রাবণের স্বর্গীয় পিতামহ পুলস্ত্যের অনুরোধে কার্তবীর্য তাঁকে মুক্তি দেন।
মহর্ষি নারদের প্ররোচনায় ইনি যমরাজের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করেন। পরে অবশ্য ব্রহ্মার অনুরোধে এই যুদ্ধ বন্ধ হয়। কৈলাসের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রাবণের রথের গতি রুদ্ধ হয়। এই সময় মহাদেবের অনুচর নন্দী রাবণকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, এখানে হর-পার্বতী আছেন। নন্দীর বানর মুখ দেখে রাবণ অবজ্ঞায় হাস্য করলে নন্দী অভিশাপ দেন যে, তাঁর মতো বানরদের হাতেই রাবণবংশ ধ্বংস হবে। রাবণ এরপর ক্ষিপ্ত হয়ে কৈলাস মাটি থেকে উপরে তুলতে থাকলে পার্বতী চঞ্চল হয়ে উঠেন। তখন মহাদেব পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে রাবণকে চেপে ধরেন। রাবণ সে চাপ সহ্য করতে না-পেরে প্রচণ্ড চিৎকার করতে থাকেন। পরে মহাদেবের স্তব গুণগান করে মুক্তি পান। এই সময় মহাদেব তাঁকে ‘চন্দ্রহাস’ নামে একটি দীপ্ত খড়া উপহার দেন। স্বর্গে গিয়েও রাবণ দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে ইন্দ্র সহ সকলকে পরাজিত করেন। রাবণের পুত্র মেঘনাদ কপট যুদ্ধে ইন্দ্রকে পরাজিত ও বন্দি করে লঙ্কায় নিয়ে আসেন। এই কারণে মেঘনাদ ইন্দ্রজিৎ’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেন। পরে ব্রহ্মার অনুরোধে ইনি ইন্দ্রকে মুক্তি দেন। এরপর রাবণ ধীরে ধীরে অত্যন্ত অত্যাচারী রাজায় পরিণত হলেন। ইনি দেব, দানব ও ঋষি কন্যাদের হরণ করতে থাকেন। একবার ইনি বৃহস্পতির পুত্র মহর্ষি কুশধ্বজের কন্যা বেদবতীকে হরণ করতে উদ্যত হলে, ইনি অগ্নিতে আত্মাহুতি দেন। আত্মাহুতিকালে ইনি রাবণকে জানান যে, পরে ইনি কোনো ধার্মিক পুরুষের ‘অযোনিজ’ কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করবেন এবং রাবণ বধের কারণ হবেন। এই কন্যাই পরে সীতারূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
স্বৰ্গবেশ্যা রম্ভা নলকুবেরের কাছে অভিসারে যাওয়ার সময় রাবণ তাঁকে ধর্ষণ করেন। ফলে নলকুবের তাঁকে অভিশাপ দেন যে, কোনো নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা করলে রাবণের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হবে। এমনকি রাবণ সমুদ্রে প্রবেশ করে প্রথমে নাগদের পরাজিত করেন, পরে নিবাতকবচ নামক দৈত্যের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন। রাম এবং নিবাতকবচ উভয়ই ব্রহ্মার বরে অজেয় ছিলেন। সে কারণে ব্রহ্মার মধ্যস্থতায় এই যুদ্ধ নিবারিত হয়। পরে রাবণ এঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। পরে ইনি নিবাতকবচের কাছ থেকে বহুবিধ মায়াবিদ্যা অর্জন করেন। এরপর তিনি জলদেবতা বরুণের পুত্রদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং তাঁদের পরাজিত করেন। এরপর ইনি অশ্মনগরে চারশত কালকেয় দানবের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাঁদেরকে পরাজিত করেন। এই যুদ্ধে রাবণের বোন শূর্পণখার স্বামী বিদ্যুৎজিহ্বা নিহত হন। রাবণ তাঁর এই বিধবা বোনকে সান্ত্বনা দিয়ে দণ্ডকারণ্যে বাসবাস করার জন্য প্রেরণ করেন। এই সময় রাম পিতৃসত্য রক্ষার্থে সীতা ও লক্ষ্মণসহ পঞ্চবটী বনে কুটির নির্মাণ করে বসবাস করছিলেন। শূর্পণখা রাম ও লক্ষণের কাছে তাঁর প্রণয়ের কথা ব্যক্ত করলে, লক্ষ্মণ শূর্পণখার নাক ও কান কেটে দেন। এরপর শূর্পণখার অধীনস্থ খর ও দূষণ নামক সেনাপতিদ্বয়কে রামের বিরুদ্ধে প্রেরণ করলে তাঁরা সসৈন্যে নিহত হন। ক্ষুব্ধ শূর্পণখা লঙ্কায় গিয়ে সমস্ত বিষয়ে রাবণকে জানান এবং সীতার অপহরণের জন্য রাবণকে উত্তেজিত করে তুললেন।
রাবণ পঞ্চবটীতে পৌঁছে তাড়কার পুত্র মারীচের সাহায্যে সীতা অপহরণের পরিকল্পনা নেন। মারীচ সোনার হরিণের ছদ্মবেশে সীতার সামনে ঘোরাঘুরি করতে থাকলে সীতা রামের কাছে উক্ত হরিণ ধরে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। রাম ওই সোনার হরিণ ধরতে যান। এরপর মারীচ রামের কণ্ঠ নকল করে কাঁদতে থাকল। রামের বিপদ হয়েছে মনে করে সীতা লক্ষণকে পাঠান। এরপর লঙ্কেশ্বর রাবণ পরিব্রাজকের ছদ্মবেশে এসে সীতার কাছে আসেন এবং সীতার শরীরের প্রশংসা করতে থাকেন–
“বিশালং জঘনং পীনমূরূ করিকরপমৌ।
এতাবুপচিতৌ বৃত্তৌ সংহতৌ সংগলভিতৌ।
পীনোন্নতমুখে কান্তৌ স্নিগ্ধতালফলপমৌ।
মণিপ্রবেকাভরণৌ রুচিরৌ তৌ পয়ধরৌ।”
পরে ইনি সবলে সীতাকে অপহরণ করে লঙ্কার পথে অগ্রসর হন। পথে জটায়ু পাখি তাঁকে বাধা দিলে রাবণ তাঁর পাখা কেটে পথে ফেলে রেখে অগ্রসর হন। সীতাকে নিয়ে যাওয়ার পথে তাঁর অলংকার ঋষমূকপর্বতে বানরদের উদ্দেশ্য নিক্ষেপ করেন। লঙ্কায় গিয়ে রাবণ সীতাকে বশ করার বহু চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে, ইনি সীতাকে অশোকবনে বন্দিনী করে রাখেন। রাবণ জানিয়ে দেন, দশ মাসের মধ্যে সীতা বশীভূত না-হলে তাঁকে খণ্ড খণ্ড কেটে খেয়ে ফেলা হবে।
রাম-লক্ষণ কুটিরে ফিরে এসে সীতাকে দেখতে না-পেয়ে, অন্বেষণে বেরিয়ে পড়েন। পথে আহত জটায়ু পাখির মুখে রাবণ কর্তৃক সীতাহরণের সব কাহিনি শুনে ঋষমূকপর্বতে বানরদের কাছ থেকে সীতার অলংকার দেখতে পান। সেখানে একে অপরের স্বার্থে কিষ্কিন্ধ্যার অধিপতি সুগ্রীবের সঙ্গে রামের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এখান থেকে রাম হনুমানকে লঙ্কায় পাঠান সীতার সংবাদ আনার জন্য। হনুমান লঙ্কায় পৌঁছে সীতার সংবাদ রামকে পৌঁছে দেন। তারপর রাম বানরসৈন্যদের সহায়তায় সমুদ্রের উপর সেতু নির্মাণ করে লঙ্কায় পৌঁছে যান। এই সময় রাবণের কনিষ্ঠ ভাই বিভীষণ সীতাকে ছেড়ে দিতে পরামর্শ দিলে, রাবণ তাঁর সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং বিভীষণকে অপমান করেন। রাবণ বললেন,–
“ন তু মিত্রপ্রবাদেন সংবসেৎ শত্রুসেবিনা”।
অর্থাৎ “শত্রু ও সাপের সঙ্গেও আমি ঘর করব, কিন্তু নামেমাত্র বন্ধু এই শত্রুসেবী বিভীষণের সঙ্গে থাকব না।”
‘রাজদ্রোহী’, ‘গৃহভেদী’ বিভীষণকে কেবল অপমান করেই রাবণ ছেড়ে দিলেন, হত্যা করলেন না–যেটা প্রয়োজন ছিল। বিভীষণ তাঁর চারজন বন্ধুর সঙ্গে রাবণের রাজসভা ছেড়ে শত্রুপক্ষ রামের সঙ্গে যোগ দেন। সেদিন যদি ‘রাজদ্রোহী’ বিভীষণ হত্যা করতেন, তাহলে রামের পক্ষে যোগদান করে রাবণের সর্বনাশকে তরান্বিত করতে পারতেন না। বিভীষণকে বুকে লাথি মেরে ফেলে দেওয়া এবং খড়গ তুলে হত্যা করতে যাওয়ার ঘটনা বাল্মীকি বলেননি, বলেছেন কৃত্তিবাস ওঝা। রাম-রাবণের চূড়ান্ত যুদ্ধ আরম্ভের পূর্বে বিভীষণ রামের পক্ষে যোগ দেন। যুদ্ধে রাবণের পুত্র মেঘনাদ অসাধারণ বিক্রম প্রদর্শন করেন।
সাম্রাজ্যবাদী রাবণ বিভিন্ন দেশে গিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করতেন। বলতেন–হয় পরাজয় স্বীকার করো, নয় মৃত্যবরণ করো। দুষ্কন্ত, সুরথ, গাধি, পুরুরবা পরাজয় স্বীকার করেন। কিন্তু পরাজয় স্বীকার করলেন না অযোধ্যার অধিপতি অনুরণ্য। অস্ত্রাঘাতের পর রাবণ অনুরণ্যকে সজোরে এক থাপ্পর মারেন। সেই থাপ্পরেই অনুরণ্যের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সময় অনুরণ্য রাবণকে অভিশাপ দেন এই বলে যে, আমার বংশেই তোর ঘাতক জন্মাবে। রাম-রাবণের যুদ্ধ প্রায় ষোলোসতেরো দিন ব্যাপী হয়েছিল। প্রতিপদে যুদ্ধ শুরু হয়। এই রাতেই মেঘনাদ কর্তৃক নাগপাশে আবদ্ধ হন রাম-লক্ষণ, দুজনেই। পরে অবশ্য গরুড়ের সাহায্যে এই বন্ধন থেকে উভয়ই মুক্তি লাভ করেন। দ্বিতীয়ায় ধুম্রাক্ষ হত্যা, তৃতীয়ায় বজ্রদংষ্ট্রা হত্যা, চতুর্থীতে অকম্পন হত্যা, পঞ্চমীতে প্রহস্ত হত্যা, ষষ্ঠীতে রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ এবং রাম-লক্ষ্মণের পরাজয়, সপ্তমীতে কুম্ভকর্ণ হত্যা, অষ্টমীতে নরান্তক ও অতিকায় প্রমুখদের হত্যা, নবমীতে মেঘনাদ বা ইন্দ্রজিতের সঙ্গে যুদ্ধ, দশমীতে নিকুম্ভ হত্যা, একাদশীতে পুনরায় ইন্দ্রজিতের সঙ্গে যুদ্ধ, দ্বাদশীতেও পুনরায় ইন্দ্রজিতের সঙ্গে যুদ্ধ, ত্রয়োদশীতে ইন্দ্রজিৎ হত্যা, চতুর্দশীতে রাবণ শোকবিহ্বল ও পুনরায় যুদ্ধের প্রস্তুতি। অবিরাম তিনদিন ব্যাপী যুদ্ধের পর রাবণের মৃত্যু হয়।
রামায়ণের বানরেরা যেমন monky নয়, তেমনই রাক্ষসরাও man-eater নন। রাবণ রীতিমতো ব্রাহ্মণদের মতো যাগযজ্ঞ করতেন। বেদান্ত শাস্ত্রে তিনি সুপণ্ডিত ছিলেন। “এষ আহিতাগ্নিশ্চ মহাতপাশ্চ বেদান্তগঃ কর্মসু চাগ্রশূরঃ”–বৈদিক কর্মকাণ্ডেও তিনি অগ্রণী পুরুষ। রাক্ষস বলতে যেমন কল্পনা করা হয় কুলোর মতো কান, মুলোর মতো দাঁত, বড়ো বড়ো চুল, লম্বা লম্বা নখ, বিশালাকার দেহ, চরমভাবে হিংস্র, কিম্ভুতকিমাকার–তা কিন্তু নয়। আমি দেখেছি চলচ্চিত্র, ধারাবাহিকে এইরকম রূপে বোঝানো হয়, ওরা কী কুৎসিত! ওরা এক্কেবারে মানুষের মতো, অন্য কোনোরকম নয়। মানুষ যেমন কুৎসিত সুন্দর হয়, ওরাও তেমনই। লঙ্কায় প্রবেশের পর হনুমান যেমন কুৎসিত রাক্ষস দেখেছেন, তেমনই সুন্দর-সুন্দর রাক্ষসদের দেখেছেন। বাল্মীকি বলেছেন–“ননন্দ দৃষ্টা চ স তান্ সুরূপান, নানাগুণান্ আত্মগুণানুরূপান্।”। আর লঙ্কার নারীরা তো অতীব সুন্দরী। রাবণের অন্দরমহলের নারীরা যেন বিশ্বের সেরা সুন্দরীদের সমাবেশ। হনুমানের দেখা সেরা সুন্দরী বালীর স্ত্রী তারার সৌন্দর্যও ম্লান হয়ে যায়–
“তেষাং স্ত্রিয়স্তত্র মহানুভাবা, দদর্শ তারা ইব সুস্বভাবাঃ”।
চন্দ্রাবতীর রামায়ণেও উল্লেখ আছে–
“রূপেতে রূপসী যত গো রাক্ষস-কামিনী।
পারিজাত ফুলে তারা গো বিনাইয়া বান্ধে বেণী।
মণি-মাণিক্যেতে কেউ গো চাঁচর কেশ বান্ধে।
বায়ু সুরভিত হয় গো শ্রীঅঙ্গের গন্ধে।”
রাবণের স্ত্রীদের দেখে হনুমান বলেছেন–
“ন তত্র কাশ্চিৎ প্রমদা প্রসহ্য, বীর্যোপপন্নেন গুণেন লক্কা”।
অর্থাৎ, সব সুন্দরী মহিলারাই রাবণের গুণে কিংবা বীরত্বে আপন-ইচ্ছায় ধরা দিয়েছে।
জাতবর্ণনির্বিশেষে সেইসব সুন্দরীদের মধ্যে কী ছিল না–রাজার কন্যা, ব্রাহ্মণের কন্যা, দৈত্যের কন্যা, ঋষির কন্যা, গন্ধর্বের কন্যা প্রমুখ। যে মানুষটিকে ব্রাহ্মণ তো বটেই–রাজা, ঋষির কন্যারাও পতি বলে স্বেচ্ছায় বরণ। করে নিয়েছেন–সেই রাবণকে রাক্ষস’ বলা ধৃষ্টতা নয় কি! সীতা এমন কোনো আহামরি সুন্দরী ছিলেন না, রাবণের অন্দরমহলে যে বিশ্বসেরা সুন্দরী ছিল সেই নিরিখে তো নয়ই। আসলে সীতার ‘না’ বলাটা তথা প্রত্যাখ্যান করাটা রাবণের হজম হয়নি। যে রাবণের বাহুডোরে বিশ্বের তাবড় তাবড় সুন্দরী নারীরা স্বেচ্ছায় সমর্পণ করেন, সেখানে সামান্য এই বনবাসিনী নারী কিনা প্রত্যাখ্যান করবে, ঔদ্ধত্য দেখাবে! সীতাকে ভোগের ব্যাপারে রাবণের যতটা-না আগ্রহ ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল জেদ। সীতার প্রত্যাখ্যানের স্পর্ধাই রাবণকে ক্রোধী করে তুলেছিল। অহংকারী রাবণ সেই ক্রোধে বশবর্তী হয়ে নিজের মৃত্যুকেই দাওয়াত এবং দস্তক দিয়েছিলেন। রাবণের একটাই মহাদোষ, রাবণ বিশ্বধর্ষণবাজ। একদিকে যেমন গাদা গাদা সুন্দরীদের বিয়ে করে অন্দরমহলে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছেন, অপরদিকে যেসব সুন্দরীরা বেগড়বাই করেছেন রাবণ তাঁদের ধর্ষণ করেছেন। রাবণ শুধু ধর্ষণবিলাসীই ছিলেন, তিনি ব্রহ্মার প্রশ্রয়ে ও পৃষ্ঠপোষকতায় যাঁর-তাঁর ধড় থেকে মাথা নামিয়ে ফেলতে চাইতেন। রাবণকে সারাজীবন এইসব বদামোর জন্য প্রচুর মাশুল গুণতে হয়েছে।
লঙ্কেশ্বর রাবণ বেশকিছু কাজ করতে চেয়েছিলেন। যে কাজগুলি করতে চেয়েছিলেন, তা নানা কারণে করা হয়ে ওঠেনি–সে কাজগুলি একনজরে দেখে নিতে পারি। মহাকাব্য রামায়ণ’-এ রাবণকে এমন এক তুলিতে এঁকেছিলেন কবি বাল্মীকি, যাতে তাঁকে একেবারে খলনায়ক’ বলে কিছুতেই মনে হয় না। সত্যি বলতে, রাবণের উপরে আরোপিত হয়েছে এমন কিছু বিরল গুণাবলি, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা যায় না। তবে এটাও ঠিক, রাক্ষসরাজ রাবণ তো মানুষ ছিলেন না। তাঁর জন্ম এবং সাধনা তাঁকে এক প্রবল পরাক্রমশালী ‘অর্ধ-দেবতা হিসাবেই তাকে স্থিত করে। রামায়ণ’-এ রাবণকে এভাবেই দেখানো হয়েছে যে, তিনি পারেন না এমন কোনো কাজ নেই। চূড়ান্ত আত্মম্ভরিতার কারণে এমন কিছু সংকল্প রাবণ করে বসেন, যা প্রবল পরাক্রমশালী হওয়া সত্ত্বেও তিনি পূরণ করতে ব্যর্থ হন। কী সেসব কাজ, যা রাবণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু করতে পারেননি? ইচ্ছে হলেই সব কাজ করা সম্ভব হয় না। রাবণও সম্ভব করতে পারেনি।
কল্পনায় সব সম্ভব, বাস্তবে নয়। গল্পের গোরু গাছে চড়লেও, বাস্তবে সে মাটিতেই বিচরণ করে। একটু পর্যবেক্ষণ করা যাক, রামায়ণের পথে–
(১) দোর্দণ্ডপ্রতাপ এবং পরাক্রান্ত রাবণ চেয়েছিলেন একটা সম্পূর্ণ নতুন ওয়ার্ল্ড অর্ডার নির্মাণ করতে। যার বেশিরভাগই ছিল প্রকৃতিবিরুদ্ধ। রাবণ চেয়েছিলেন মানুষ ঈশ্বরের উপাসনা বন্ধ করুক। তবে কি রাবণ নাস্তিক ছিলেন? নিশ্চয়ই ‘ঈশ্বর’ বলতে রাবণ ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিবদের বলেননি। কারণ ব্ৰহ্মা-বিষ্ণু-শিব প্রমুখ ঈশ্বর নন, দেবতা। দেবতা আর ঈশ্বর এক নয়। দেবতা আকার, ঈশ্বর নিরাকার। রাবণ ঈশ্বরকে অগ্রাহ্য করে দেবতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। কারণ দেবতাদের দ্বারা তিনি নানাভাবে উপকৃত হয়েছেন নানা সময়ে। আত্মরক্ষার ভয়ানক ভয়ানক অস্ত্র পেয়েছেন। দেবতাদের সহায়তাতেই ভুবনজুড়ে দৌরাত্ম্য দেখাতে পেরেছেন। তাই রক্তমাংসের দেবতাদের প্রতিই তাঁর বিশেষ দুর্বলতা তৈরি হতে পারে। ভেবেছিলেন তিনিই দেবতা হবেন। কিন্তু তার এই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। কারণ মহাকবির সর্বৈ চেষ্টায় তিনি খলনায়কই, দেবতা নন।
(২) রাবণ সারাজীবন প্রচুর যুদ্ধ করেছিলেন, শত্রুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছেন। লঙ্কার দিকে চোখ তুলে তাকাতে দেননি কোনো শত্রুকে। রক্তপাতও তাঁর কোমল অন্তরকে বারবার নাড়া দিয়েছিল, ভাবিত করে তুলেছিল। রক্তের লাল রংয়ে তাঁর ট্রমার সৃষ্টি হয়েছিল বলেই হয়তো তিনি রক্তের রং বর্ণহীন হয়ে যাক চেয়েছিলেন–যাতে তার রক্তলোলুপতাকে কেউ আঙুল তুলে দেখাতে পারবে না। সেই ইচ্ছাও পূরণ হয়নি। কারণ এটা প্রকৃতিবিরুদ্ধ।
(৩) রাজারাজড়াদের নানারকমের ‘অবসেশন’ থাকে। রাবণেরও ছিল, সোনার প্রতি। তিনি চেয়েছিলেন সোনা গন্ধযুক্ত হয়ে যাক, যাতে খুব সহজেই সোনা খুঁজে পাওয়া যায়। পৃথিবীর সব সোনার মালিক তিনি হতে চেয়েছিলেন। এটাও প্রকৃতি-বিরুদ্ধ। তাই এই ইচ্ছাও পূরণ হয়নি।
(৪) রাবণ সরাসরি স্বর্গে পৌঁছনোর জন্য একটা সিঁড়ি নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। সিঁড়িটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। স্বর্গ কোথায়? বাস্তবিক স্বর্গের কোনো অস্তিত্ব নেই। তাই সিঁড়িও অধুরা।
(৫) রাবণ মদ্যপানে শৌখিন ছিলেন। সেই কারণে তিনি চেয়েছিলেন, মদ যেন দুর্গন্ধমুক্ত হোক। এই কামনাও পূরণ হয়নি। রাবণের যুগে দুর্গন্ধমুক্ত মদ তৈরি করা না-গেলেও, এখন কিন্তু গন্ধহীন মদ পাওয়া যায়।
(৬) রাবণের গায়ের রং ছিল কালো। তিনি চেয়েছিলেন পৃথিবীর সমস্ত পুরুষের গায়ের রং ফরসা হয়ে যাক। যাতে কোনো নারী আর পুরুষের গায়ের রং নিয়ে মজা করতে না পারে। এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় যেটা, তা হল তিনি কেবল নিজের গায়ের রং ফর্সা চাইতে পারতেন। স্বার্থপরের মতো তিনি তা চাইতেই পারতেন। কিন্তু তিনি সমগ্র পৃথিবীর পুরুষের ফর্সা রং চেয়েছেন। এখানে তাঁর উদারতা প্রকাশ পেলেও ইচ্ছাপূরণ হয়নি।
(৭) সমুদ্রের জল লবণাক্ত, বিস্বাদ, অপেয়। রাবণের চেয়েছিলেন সমুদ্রের জল যদি মিষ্টি হয়ে যায়, তাহলে পানীয় জলের সমস্যা মিটে যাবে। এটাও প্রকৃতিবিরুদ্ধ। তাঁর এই ইচ্ছাও পূরণ হয়নি।
(৮) রাবণ চেয়েছিলেন সীতা তাঁর প্রতি অনুরক্তা হয়ে উঠুন। চেয়েছিলেন সীতা তাঁর অঙ্কশায়িনী হোক। সীতা পূর্বেই রামচন্দ্রের স্ত্রী। অতএব এ ইচ্ছাও পূরণ হয়নি।
অনেকে বলেন, রাবণ আর রাম মূলত দুই সময়ের মানুষ। রাবণের কাহিনিগুলি আলাদাভাবে খুঁজলে রামের সময়কার কনটেক্সটের সঙ্গে মেলে না। হতে পারে বাল্মিকী একটা সমকাল থেকে রাবণকে নিয়ে রামের চরিত্র বড়ো করে তুলেছেন। রাবণের কাহিনি কিন্তু সমান্তরালভাবে শিবের কাহিনির সঙ্গেই যায়। তাকে বলা হয় শিবের সর্বশ্রেষ্ঠ ভক্ত। তার সত্তাই কুবের হল শিবের বান্ধব। ভারতীয় পুরাণে নারায়ণ/বিষ্ণুর কাহিনি থেকে কিন্তু শিবের কাহিনিগুলিই বেশি প্রাচীন। মহাভারত পুরোটাই শৈব, কৃষ্ণকে সেইখানে বিষ্ণু অবতার বলা হলেও সমস্ত পুজো কিন্তু হয়েছে শিবের। রামায়ণের রামকেও দেখতে পাই শিব পূজারী হিসাবে। কিন্তু এটা বেশ আরোপিত মনে হয়। রাম শিবের ধনুক ব্যবহার করতেন, যেটা আবার অন্য কাহিনিতে দেখা যায় শিব নিজে ব্যবহার করেছেন ত্রিপুরাসুরকে হত্যা করতে। এরপরে সেই ধনুক দান করেছেন পরশুরামকে। সমাজকে আর্য অনার্য হিসাবে ভাগ করা বোধ হয় বৈষ্ণবযুগের (বৈষ্ণব রাজাদের) কাজ। দ্বাদশ শতক পর্যন্ত শৈব আর বৈষ্ণব পুরো আলাদা ধর্মই ছিল। আর শৈব ঘরানায় কিন্তু আর্য-অনার্য ভেদ নেই। শিবের ভক্ত যেমন দেবগুরু বৃহস্পতি, তেমনই নন্দী ত্রিপুরাসুর কিংবা রাবণ। অথচ নারায়ণের ভক্তরা আবার বেশ সম্ভ্রান্ত মানুষ।
রাবণের আধিপত্য ছিল লঙ্কা ছাড়িয়ে সমগ্র দক্ষিণ ভারতে। শুধু দক্ষিণ ভারতই নয়, তিনি কায়েম করেছিলেন। দক্ষিণবঙ্গও। রাবণ সদলবলে সাগরদ্বীপে বেড়াতে এসেছিলেন। ভেবেছিলেন সাগরদ্বীপ সহ সমগ্র এই ভূখণ্ডটি করায়ত্ত করবেন। বিশ্বজয়ী রাবণ ভাবতে পারেননি এখানে সুবিধা করতে পারবেন না। এই ভূখণ্ডে থাকেন এক শক্তিমান ও দীর্ঘদেহী পুরুষ। তিনি কপিল, কপিল মুনি। মুনি দেখলেই রাবণের উৎকট উল্লাস হয়। মুনিঋষিদের পর্যস্ত করতে পারলেই রাবণের পৈশাচিক উল্লাস হয়। এই কপিলের সঙ্গে রাবণের তুমূল সংঘর্ষ হয়। বজ্রের সমান দুই হাতে কপিল মুনি জাপটে ধরলেন রাবণকে। রাবণের প্রায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার উপক্রম হল। এরপর কপিল মুনি রাবণকে দু-হাতে মাথার উপর তুলে সবেগে মাটিতে আছাড় মারলেন। এক আছাড়েই রাবণের মাথা ঘুরে গেছে। দর্প চূর্ণ হয়েছে। বিভিন্ন বীরদের কাছে বারবার পর্যদস্ত হয়েছেন। অবশেষে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর রাম ও বানরবাহিনির কাছে রাবণের মৃত্যু হয় এবং বৈদিক রীতিনীতি মেনে অগ্নি প্রজ্বলন করে তাঁর সত্ত্বার সম্পন্ন হয়। রাক্ষস বিরাধকে কবর দেওয়া হলেও রাক্ষসরাজ রাবণের মরদেহ আনুষ্ঠানিকভাবে দাহ করা হয়েছিল (৬.১১৩.১২০)৷ স্বয়ং রাম এবং মিত্রপক্ষ অকুস্থলে দাঁড়িয়ে থেকে রাবণের দাহকর্ম সম্পন্ন করেন। শত্রুর সত্ত্বার করে রাম মহান’ হলেন, আর্তের সেবক হলেন। রামায়ণে কবর ও দাহ উভয় প্রথার নির্দেশ পাওয়া যায়। শবদাহ প্রথা–আর্যদেরই “ভস্মান্তং শরীরম্” (ঈশোপনিষৎ-যজুর্বেদ)। অনার্যদের কবর দেওয়াই প্রথা–রামায়ণে (অরণ্যকাণ্ড, চতুর্থ সর্গ ২২ শ্লোক) প্রমাণ পাওয়া যায়–
“রাক্ষসাং গতসত্ত্বানুমেষ ধৰ্ম্ম সনাতনঃ।
অবটে যে নিধীয়ন্তে তেষাং লোকাঃ সনাতনাঃ।”
ভূগর্ভে যাঁদের দেহ প্রোথিত হয়, তাঁদের নিত্যলোক প্রাপ্তি হয়, গতপ্রাণ রাক্ষসদের (অনার্যদের) এটাই চিরন্তন ধর্ম।
স্বদেশ ও প্রজাদের রক্ষার স্বার্থে তাঁর শক্তি নিয়োজিত। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে রাবণ রামকে বলেছিলেন–একজন শাসকের কীভাবে চললে সফল ও প্রাণবন্ত অবস্থায় থাকা সম্ভব। রাবণকে মূল্যায়ণ করতে হলে মনে রাখতে হবে পৃথিবীর সব রাজা-মহারাজা-মুখ্যমন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী নিজের দাপট দেখাতে পছন্দ করেন। বাঘে-গোরুতে এক ঘাটে জল খাওয়াতে না-পারলে কীসের রাজা! শুধু রাবণই নয়–রাম, ভরত, কৌরবগণ, পাণ্ডবগণ, সগররাজা প্রত্যেকেই তাঁদের সর্বোচ্চ দাপট দেখাতে কার্পণ্য করেননি।
রাবণকে নিয়ে লেখা শেষ করার আগে তাঁর সম্বন্ধে আরও দু-চারটা কথা না-লিখলেই নয়। প্রক্ষিপ্ত কবিরা সহ অন্যান্য রামায়ণের কবিরাও তাঁকে একজন ভয়ংকরতম অত্যাচারী শাসক সাব্যস্ত করে দিলেন। সীতা তথা নারীহরণ নতুন কিছু তো নয়! তখনকার সময়ে রাবণ কেন, প্রায় সমস্ত রাজরাজারা ও দেবপ্রধানরা নারীহরণ ও পরনারী ভোগ করাটা বীরত্ব বলেই গণ্য করা হত। সেইসব রাজাদের স্ত্রীরাও এইসব ব্যাপার ধর্তব্যের মধ্যেই রাখতেন না। দেবরাজ ইন্দ্রের তো প্রচুর সুনাম নারীহরণ আর নারীভোগের ব্যাপারে। ইন্দ্র পদাধিকারী ব্যক্তিরা বারবার সুযোগ পেলেই পরনারী ভোগ করছেন। ব্রাহ্মণ-নেতারাও পরস্ত্রী ভোগে পিছপা হননি। রাজারা নারীর অধিকারের জন্য যুদ্ধ বাধিয়ে নিরপরাধ লক্ষ লক্ষ প্রজার মৃত্যু এবং সর্বনাশের কারণ সৃষ্টি করেছেন। এরকম দাপট নবাবী আমল পর্যন্ত চলেছিল। অতএব সীতাকে লঙ্কায় টেনে নিয়ে গিয়ে রাবণ বিরাট পাপকর্ম করেছেন এমন কথা বলা কতটা যুক্তিসংগত, তা ভেবে দেখার দরকার। তা ছাড়া রামায়ণের যুগে সারা পৃথিবীতে তো শুধু রাবণ বাস করতেন না। একমাত্র রাবণই কি ভয়ানক পাপী ছিলেন? সে সময়ে অন্য রাজারা কি সাধুপুরুষ ছিলেন? তাঁদেরও হত্যা না-করে শুধু রাবণে হত্যা করেই রাম ক্ষান্ত হলেন কেন? উদ্দেশ্য কি দুষ্টের দমন, নাকি যেনতেনপ্রকারেণ অনার্য ও প্রতিপক্ষদের নির্বংশ করে আর্যসম্প্রসারণের জন্য। উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত দখল নেওয়া?
তাই সব অপরাধ বিজেতারাই করেন, সব অন্যায় বিজেতাই করে থাকেন। তাই প্রাজ্ঞ রাবণ বিশ্বধর্ষক, বিশ্বখুনি, বিশ্ব-অত্যাচারী। অপরদিকে জয়ী নিষ্পাপ, আর্তের ত্রাতা। জয়ীর পক্ষে সব সমর্থন। না-হলে দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন দেখানো যাবে কী করে! এ নতুন কিছু নয়। যুগে যুগে এটাই হয়ে আসছে। কোথাও অন্যথা হয়নি। আসুন, ঠিক এরকমই দুটি সাম্প্রতিককালের ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখি। প্রথমটি ইরাকের শাসক সাদ্দাম হোসেইন। “খুব খারাপ মানুষ সাদ্দাম’–এরকমই প্রচার হয়ে গেল বিশ্বজুড়ে। বিশ্বের জনসমর্থন আদায়ের জন্য বুঝিয়ে দেওয়া হল–ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম ১৯৯১ সালের চুক্তি অমান্য করে গণবিধ্বংসী অস্ত্র নির্মাণ করছে এবং তাঁদের কাছে এ ধরনের অস্ত্রের মজুতও আছে। তখন সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছিল, ইরাক যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ এবং মিত্র রাষ্ট্রগুলির জন্য বড় ধরনের হুমকি। আগ্রাসনের পরে পরিদর্শকরা ইরাকে গিয়ে কোনো ধরনের গণবিধ্বংসী অস্ত্র খুঁজে পায়নি। তাঁরা জানায়, ইরাক ১৯৯১ সালেই গণবিধ্বংসী অস্ত্র নির্মাণ ত্যাগ করেছে, ইরাকের উপর থেকে আন্তর্জাতিক অনুমোদন সরিয়ে নেওয়ার আগে পর্যন্ত তাঁদের নতুন করে গণবিধ্বংসী অস্ত্র নির্মাণের কোনো পরিকল্পনাও ছিল না। কোনো কোনো মার্কিন কর্মকর্তা দাবি করেন যে, সাদ্দাম হোসেন আল-কায়েদাকে সহযোগিতা করছেন, কিন্তু এর পক্ষেও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি৷ কুয়েত এবং ইরাকের তেল অবৈধভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে আমেরিকা সাদ্দাম হোসেইনের বিরুদ্ধে নোংরা ষড়যন্ত্র করে। মিথ্যা আরোপ করা হয় হোসেইন বায়ো-কেমিক্যাল অস্ত্র মজুত রেখেছে। কিন্তু ইরাক দেশ পুরো ছারখার হয়ে যাওয়ার পরও সেই রকম কোনো অস্ত্র পাওয়া যায়নি।
সাদ্দাম গ্রেফতার হলেন, গ্রেফতার করল আমেরিকা। আন্তর্জাতিক আদালতে সাদ্দামের ফাঁসির হুকুম শোনানো হয়। প্রকৃত সত্য হল সাদ্দাম মোটেই নিষ্ঠুর ছিলেন না। ফাঁসির রায় ঘোষণার পর জীবনের শেষ দিনগুলিতে তাঁকে পাহারা দিয়েছিলেন ১২ জন মার্কিন সেনা। এই ১২ জন সাদ্দামের শেষ সময়ের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। আক্ষরিক অর্থেই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁরাই ছিলেন সাদ্দামের সঙ্গী। তাঁদেরই একজন উইল বার্ডেনওয়ার্পার। উইল বার্ডেনওয়ার্পার তাঁর “The Prisoner in is Palace, his American guards and what history left unsaid” গ্রন্থে লিখলেন–
“আমরা কখনও সাদ্দামকে মানসিক বিকারগ্রস্ত হত্যাকারী হিসাবে দেখিনি। নিজের জীবনের শেষ দিনগুলিতে সাদ্দাম তাঁদের সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করতেন। ওই ব্যবহার দেখে বোঝাই যেত না যে সাদ্দাম হোসেন কোনো একসময়ে একজন অত্যন্ত নিষ্ঠুর শাসক ছিলেন।”
বার্ডেনওয়ার্পার স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে লিখেছেন–“একবার সাদ্দাম তাঁর ছেলে উদয় কতটা নিষ্ঠুর ছিল, সেটা বোঝাতে গিয়ে বীভৎস একটা ঘটনার কথা বলেছিলেন। ওই ব্যাপারটায় সাদ্দাম প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলেন। উদয় কোনো একটা পার্টিতে গিয়ে গুলি চালিয়ে দিয়েছিলেন। তাতে বেশ কয়েকজন মারা গিয়েছিলেন। গুলিতে আহত হয়েছিলেন আরও কয়েকজন। সাদ্দাম ব্যাপারটা জানতে পেরে উদয়ের সবকটি গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ওই ঘটনাটা বলতে গিয়ে সেনা-প্রহরীদের সাদ্দাম ভীষণ রেগে গিয়ে শুনিয়েছিলেন উদয়ের দামি রোলস রয়েস, ফেরারি, পোর্শে গাড়িগুলিতে তিনি আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সাদ্দাম হোসেনের নিরাপত্তার জন্য নিযুক্ত আমেরিকান সেনারাই তাঁকে একদিন জানিয়েছিলেন যে তাঁর ভাই মারা গিয়েছেন। যে সেনা-সদস্য খবরটা দিয়েছিলেন, সাদ্দাম তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, আজ থেকে তুমিই আমার ভাই।’ আরেকজন প্রহরীকে বলেছিলেন, ‘যদি আমার সম্পত্তি ব্যবহার করার অনুমতি পাই, তাহলে তোমার। ছেলের কলেজে পড়তে যা খরচ লাগবে, সব আমি দিতে রাজি।’ বার্ডেনওয়ার্পারের গ্রন্থটিতে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক যা উল্লেখ রয়েছে, তা হল সাদ্দামের মৃত্যুর পরে তাঁর প্রহরীরা রীতিমতো শোক পালন করেছিলেন, যদিও তিনি আমেরিকার কট্টর শত্রু ছিলেন। প্রহরীদেরই একজন অ্যাডাম রজারসন উইল বার্ডেনওয়ার্পারকে বলেছিলেন, “সাদ্দামের ফাঁসি হয়ে যাওয়ার পরে আমার মনে হচ্ছে আমরা ওর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। নিজেদেরই এখন তাঁর হত্যাকারী বলে মনে হচ্ছে। এমন একজনকে মেরে ফেললাম আমরা, তিনি যেন আমাদের খুব আপনজন ছিলেন।” ওই ১২ জনের অন্যতম স্টিভ হাচিনসন সাদ্দামের ফাঁসির পরেই আমেরিকার সেনাবাহিনী থেকে ইস্তফা দেন। হাচিনসন এখন জর্জিয়ায় বন্দুক চালনা আর ট্যাকটিক্যাল ট্রেনিং দেওয়ার কাজ করেন। তাঁর মনে এখনও ক্ষোভ বর্তমান, কারণ সেদিন যেসব ইরাকি সাদ্দামের মৃতদেহকে অপমান করছিল, তাঁদের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে না-পড়ার আদেশ দেওয়া হয়েছিল তাঁদের।
দ্বিতীয় ঘটনা আফগানিস্তান। ওসামা বিন লাদেনকে খোঁজার বাহানায় আফগানিস্তান আক্রমণ করল আমেরিকা। আক্রমণ করার আগে আমেরিকা ঘোষণা করে বসল–“সন্ত্রাসবাদ দমনে কারা আমেরিকার সঙ্গে আছেন বলুন। যারা আমেরিকার সঙ্গে থাকবেন তাঁরা সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের পক্ষে, যাঁরা আমেরিকার সঙ্গে থাকবেন না, তাঁরা সন্ত্রাসবাদীর সমর্থক। সার্বিক সমর্থন নিয়ে আমেরিকা ঝাঁপিয়ে পড়ল আফগানিস্তানের উপর। তছনছ করে দিল আফগানিস্তান ভূখণ্ড। লাদেন কোথায়! আমেরিকার উদ্দেশ্য সফল হল, আফগানিস্তানের তালিবান সরকারকে ফেলে দিয়ে আমেরিকার তাবেদার সরকার বসিয়ে দিল। দীর্ঘ ১৩ বছর যাবৎ আফগানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে গেল ন্যাটো বাহিনী। আফগান যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করা হলেও দেশটিতে ১৩,৫০০ ন্যাটো সেনা অবস্থান করবে বলে আমেরিকার তরফ থেকে জানানো হল, যার মধ্যে থাকবে ১১,০০০ মার্কিন সেনা। তাঁরা কেবল প্রশিক্ষণের কাজ করবে বলে জানানো হয়েছে। মার্কিন সেনারা ২০০১ সালে আফগানিস্তান থেকে তালিবান ও আল-কায়দা গোষ্ঠীসহ সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের দোহাই দিয়ে দেশটি দখল করে নেয়। আসলে ওয়াশিংটন সন্ত্রাস দমনের জন্য আফগানিস্তানে সেনা পাঠায়নি, বরং সন্ত্রাস দমনের অজুহাতে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এই দেশটিকে নিজের সামরিক ও গোয়েন্দা ঘাঁটিতে পরিণত করতে চেয়েছে। ২০১১ সালের মে ২ তারিখে দিবাগত রাতে পাকিস্তানের আবোটাবাদ শহরে মার্কিন কমান্ডোদের হামলায় (অপারেশন জেরোনিমো) ওসামা বিন লাদেন নিহত হন। তার জন্য পাকিস্তান ভূখণ্ডকে তছনছ করতে হয়নি। আমেরিকা নিজেদেরকে ‘বিশ্বের ত্রাতা’ ভাবতে এবং ভাবাতে শুরু করে দিলেন।
রাবণের পূনর্মূল্যায়নের সুযোগ হয়নি। তাই রাবণের ভাবমূর্তিকে যেভাবে ভাবানো হল, সেভাবেই রয়ে গেল। রামও নিছক সীতাকে পাওয়ার জন্য রাবণের সঙ্গে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ করেননি। সীতার খোঁজ যে বাহানামাত্র, তা রাম নিজের মুখেই স্বীকার করেছেন। সীতাকে ফিরিয়ে দিলেও যুদ্ধটা হতই। আর অহংকার? দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রায় অপরাজেয় রাজা, যাঁর সঙ্গে স্বয়ং ব্রহ্মা আর শিবের মদত রয়েছে, তাঁর অহংকার থাকবে না তো কার থাকবে! এখন প্রশ্ন হল রাম কেন রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন? উদ্দেশ্য স্পষ্ট : উত্তরভারত থেকে সুদূর। দক্ষিণ ভারতের শেষ সীমা পর্যন্ত আর্যসভ্যতার আধিপত্য বিস্তার।
এখন প্রশ্ন করা যেতেই পারে–লঙ্কাযুদ্ধে রাবণের পতনের কারণ কী? রাবণে বিরুদ্ধে আর্যদেবতা ও ব্রাহ্মণদের অভিযোগ–তিনি ধর্ষক, তিনি নারী লোভী, তিনি অন্যের রাজ্য আক্রমণ করেন এবং রাজাদের হত্যা অথবা বন্দি করেন, তিনি স্বর্গের দখল নিতে চান, তিনি নারীকে রক্ষিতা (হারেম) করেন ইত্যাদি। এগুলি অভিযোগ, না অজুহাত? এগুলি যদি রাবণের অপরাধ হয়, তাহলে বলব প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগের শেষদিক পর্যন্ত প্রায় সব রাজা তো এরকমই ছিল। শত্রুরাজ্যের নারী হরণ করা, নারী ধর্ষণ করা, শত্রুরাজাকে হত্যা বা বন্দি করা এ তো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। প্রাচীন যুগে এক গোষ্ঠীর সঙ্গে অন্য গোষ্ঠীর সংঘর্ষে যে গোষ্ঠী। পরাজিত হত, তাঁদের সম্পত্তি দখল করা হত এবং তাঁদের দাস হিসাবে ব্যবহার করা হত, এমনকি নারীও বিজয়ীর অধিকারে চলে যেত। রাবণ ব্যতিক্রম কী করল? আসলে তোকে আমি মারবই, তুই জল ঘোলা করিসনি তো তোর বাপে করেছে, নাহলে তাঁর তাঁর বাপে জল ঘোলা করেছে। উদ্দেশ্য যখন দাক্ষিণাত্যে আর্য উপনিবেশন, তখন প্রতিপক্ষের দোষ মাপা না-মাপায় কী যায় আসে। রাবণের কিছু ত্রুটি ছিল তো অবশ্যই, তাই তাঁর পরাজয় হল। প্রাচীনকালে রাজায় রাজায় সম্মুখ সমর হত। একপক্ষের হয় মৃত্যু হত, অথবা বন্দি হয়ে দাসত্ব মেনে নিতে হত। তা ছাড়া রাবণের অপরাধ তো বিরল থেকে বিরলতম অপরাধ’ নয় যে, তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে! রাজার পরাজয় তখনই হয়, যখন রাজা একের এক ভুল করে যায়। আর সেই ভুলের মাশুল গুনতে হয় রাজাকেই। রাবণের পরাজয় রাম ও রামশিবিরের দৈবশক্তি নয়, রাবণের পরাজয়ের জন্য দায়ী রাবণের অবিমৃষ্যকারিতা। পতনের কারণগুলি এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক–
(১) চারিত্রিক ত্রুটি : রাবণ অহংকারী, চরম আত্মবিশ্বাসী এবং ঔদ্ধত্য। অহংকার থেকে জন্ম নেয় চরম আত্মবিশ্বাস এবং চরম আত্মবিশ্বাস থেকে জন্ম নেয় ঔদ্ধত্য। ঔদ্ধত্যই চেতনা লুপ্ত করে, বুদ্ধিনাশ করে। গঠনমূলক পরিকল্পনা করতে ব্যর্থ হন।
(২) মিত্রহীন : লঙ্কেশ্বর রাবণ একা। যুদ্ধের জন্য তিনি অক্ষশক্তি তৈরি করেননি বা করতে পারেননি। মিত্রশক্তি রামচন্দ্র যখন আর্যদেবতা ও তাঁর দেবসেনাবাহিনী, অগস্ত্যের মতো যুদ্ধবিশারদ, কিষ্কিন্ধ্যার রাজা সুগ্রীব ও তাঁর পরাক্রমী সেনাবাহিনী, বিভীষণের মতো বিশ্বাসাতক, শূর্পণখার মতো ঘরশত্রু গুপ্তচর–তখন রাবণ একক শক্তি। আর কোনো রাজা বা শক্তিকে একত্রিত করতে পারেননি তিনি। নিজেকে সর্বশক্তিমান ভেবে ফেলার এটাই ফল। রাম কিন্তু নিজেকে কখনোই সর্বশক্তিমান ভাবেননি, আর ভাবেননি বলেই যেখানে যত শক্তি আছে যথাসম্ভব সংগ্রহ করে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছেন। তাই এ যুদ্ধ অসম হয়েছে। হারও অনিবার্য।
(৩) ভ্রান্ত রণনীতি : রামশিবিরে যখন দুর্ধর্ষ দেবসেনাপতি ইন্দ্র সহ সমগ্র দেবসেনা, দক্ষ বীর লক্ষ্মণ, ধুরন্ধর বীর সুগ্রীব, মহাশক্তিশালী হনুমান, দুর্ধর্ষ অঙ্গদ, বীর চিকিৎসক জাম্ববান, যুদ্ধ বিশারদ অগস্ত্য, পরম সহযোগী ‘ঘরশত্রু বিভীষণ, বীর নীল ও অসংখ্য বীর এবং আত্মনিয়জিত বানরসেনা চারদিক ঘিরে একযোগে যুদ্ধ করছেন–সেখানে রাবণ যুদ্ধক্ষেত্রে একজন করে বীর সেনাপতিদের পাঠাচ্ছেন মিত্রপক্ষের মোকাবিলা করতে! কখনো ইন্দ্রজিতের মতো মহাবীর একা যুদ্ধ করতে আসছেন, কখনো কুম্ভকর্ণের মতো মহাবীর একা যুদ্ধ করতে আসছেন, কখনো অকম্পনের মতো মহাবীর একা যুদ্ধক্ষেত্রে আসছেন–এটা ক্রিকেট খেলা নাকি? একজন করে ব্যাটসম্যান আসছেন, রান করছেন আর বোল্ড আউট হচ্ছেন। অথচ মিত্রপক্ষ রামশিবির ফুটবল টিম নিয়ে মাঠে নেমেছেন আর চারদিক ঘিরে খেলছেন। যদি ইন্দ্রজিৎ, অকম্পন, প্রহস্ত, বজ্রদংষ্ট, কুম্ভকর্ণ, নান্তক, ত্রিশিরা, মহাপার্শ্ব, অতিকায়, বিরূপাক্ষ, মহোদরের দুর্ধর্ষ মহাবীরেরা একযোগে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করতেন, তাহলে রামশিবিরের বীরসেনারা পালানোর পথ খুঁজে পেতেন না। এমনিতেই অক্ষশক্তির এক বীরের দাপটেই রামশিবিরের অবস্থা বহুবার ল্যাজেগোবরে হয়েছেন–ইন্দ্রজিতের বাণ ও নাগপাশে রাম-লক্ষ্মণের দুই দুইবার মৃতপ্রায় অবস্থা হয়েছিল। রামশিবিরের যুদ্ধক্ষেত্র প্রায় শ্মশান করে দিয়েছিলেন ইন্দ্রজিৎ। কুম্ভকর্ণের অস্ত্রাঘাতে বিশ্রীভাবে আহত হয়েছিলে হনুমান, এমনকি রাবণের অস্ত্রাঘাতেও হনুমান জ্ঞান হারিয়েছিলেন। কুম্ভকর্ণের আঘাতে অঙ্গদ জ্ঞান হারান ও সুগ্রীব বন্দি হন। যুদ্ধনীতিতে ভুল থাকলে পরিকল্পনাহীন সেই যুদ্ধে জয় অসম্ভব।
(৪) বিদ্রোহ দমনে অক্ষমতা : রাবণের সাধের রাজপরিবারের অন্দরমহলে রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদ্রোহ, সেই বিদ্রোহের নাটের গুরু জ্ঞাতিদ্রোহী বিভীষণ। এত কাণ্ড, তবুও রাবণ টের পাননি। সেই বিদ্রোহ দমন করতে সচেষ্ট হননি তিনি। নিজের বোন শূর্পণখা তাঁকে ও তাঁর রাজ্য ধ্বংস করতে রামশিবিরের আর্যদেবতাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন, সে ব্যাপারেও লঙ্কেশ্বর উদাসীন। রাজার এই উদাসীনতা পরাজয়ের জন্য যথেষ্ট।
(৫) বিশ্বাসঘাতকদের শাস্তি না-দেওয়া; জ্ঞাতিদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক বিভীষণের মতো কালসাপকে দুধকলা দিয়ে পুষেছিলেন তিনি। যাঁর বুকে বসেছিলেন তিনি তাঁরই বুকে বসে তাঁরই শিলনোড়া দিয়ে তাঁরই দাঁতের গোড়া ভেঙেছেন। লঙ্কায় বসে লঙ্কার রাজার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রচনা করছেন। রাজার অপশাসনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র নয়, সিংহাসন আর মন্দোদরীকে ভোগ করার লোভেই রামের পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন বিভীষণ। একথা রামশিবিরে যোগ দিয়ে রামকে খোলাখুলিই বলেছেন বিভীষণ। কোনো ঢাককাক গুড়গুড় ছিল না। সেই শর্তেই তিনি রামকে বলেছিলেন–
“আমি রাক্ষস বধ ও লঙ্কাপরাভব বিষয়ে যথাশক্তি তোমায় সাহায্য করিব এবং রাবণের প্রতিদ্বন্দ্বী হইব।”
বিভীষণও রামভক্ত নন, ক্ষমতাভক্ত। ইন্দ্রজিতের সঙ্গে দ্বিতীয় দিনের যুদ্ধে রাম-লক্ষণ মৃতপ্রায় হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে ইন্দ্রজিতের মতো বিভীষণ ভেবেছিলেন রাম-লক্ষ্মণ মারা গেছেন। এই ভেবে বিভীষণ মরাকান্না জুড়ে দিলেন–
“হায়, আমি যাঁহাদের বাহুবলে রাজ্যপদ কামনা করিয়াছিলাম, এক্ষণে তাঁহারাই মৃত্যুর জন্য শয়ান। বলিতে কি আজ আমার জীবনমৃত্যু, রাজ্যকামনা দূর হইল এবং পরমশত্রু রাবণেরও জানকীর অপরিহার সংকল্প পূর্ণ হইল।”
শুধু বিভীষণই নয়, রাবণের জন্মশত্রু ছিল নিজের ভাই কুবের। এই কুবেরই ছিলেন একদা লঙ্কার শাসনকর্তা। রাবণের সঙ্গে হেরে গিয়ে আর্যদেবতাদের দলে যোগ দিয়ে ‘লোকপাল’ পদে নিযুক্ত হন। আর্যদেবতারা এই কুবেরের মাধ্যমেই লঙ্কার অলিগলি জেনেছেন। কুবেরের থেকে রাবণের যথেষ্ট সাবধান থাকা উচিত ছিল। কথায় বলে আহত সাপ বাঁচিয়ে রাখা উচিত নয়।
রাবণের সভায় বসে বিভীষণ শত্রুপক্ষের হয়ে ঢাক পেটাতে থাকলে রাবণ ভর্ৎসনা করেন–“রে কুলকলঙ্ক! তোরে ধিক্! যদি অন্য কেহ এইরূপ কহিত, তবে তদ্দণ্ডেই তাহার মস্তক দ্বিখণ্ড করিতাম।” ‘অন্য কেহ’ নয়, নিজের ভাই। ক্ষমাশীল দাদা রাবণ, হত্যা না-করে সামান্য তিরস্কার করে ছেড়ে দিলেন। ঘাড় ধাক্কা খেয়ে কালসাপ বিভীষণ সোজা শত্রুশিবিরে যোগ দিলেন। ভাইয়ের প্রতি স্নেহবশত বিশ্বাসঘাতককে মৃত্যুদণ্ড দিলেন না। তাঁকে দেশত্যাগ করার সুযোগ দিয়ে দিলেন। রাবণ একবারের জন্যেও খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন না যে, বিভীষণ দীর্ঘদিন ধরে লঙ্কার কোথায় কোথায় ছিদ্র করে রেখে গেছেন। লঙ্কেশ্বর রাবণ যদি এহেন রাজদ্রোহীর মৃত্যুদণ্ড দিতেন, তাহলে মাশুল অনেক কম গুনতে হত রাবণকে। বালীর মতো ভুল রাবণও করলেন। তাঁকে হত্যা করার জন্য গোকুলে যিনি বাড়ছেন, তাঁকে চিহ্নিত করে নিকেশ করতে পারলেন না রাবণ। চরম মূল্য দিতে হল।
(৬) গুপ্তচরের অপদার্থতা : বিশ্বস্ত গুপ্তচর কি রাবণের ছিল না? থাকলে কী করছিলেন তাঁরা? বিভীষণ কি সব গুপ্তচরকেই নিজের পক্ষে টেনে নিয়েছিলেন? নাকি শূর্পণখার মতো রাবণের গুপ্তচরগুলিও রামবাহিনী কবজা করে নিয়েছেন?
(১) রামচন্দ্র দলবল নিয়ে লঙ্কায় রাবণকে হত্যা করতে আসছেন, সে খবর রাবণের গুপ্তচরেরা জানাতে পারেননি।
(২) টানা পাঁচদিন ধরে সমুদ্রের উপর শত্রুপক্ষ বিনাবাধায় একটা আস্ত সেতু গড়ে ফেলল, সে খবর রাবণের গুপ্তচরেরা জানতে পারলেন না?
(৩) তীব্র শাব্দিক বিমান নিয়ে সমুদ্র পেরিয়ে মহাবীর হনুমান লঙ্কায় ঢুকে পড়ল, অশোকবনে ঘুরল, সীতার সঙ্গে দেখা করল–এত কাণ্ড হয়ে গেল, অথচ রাবণের গুপ্তচর কিছুই জানাতে পারল না। (৪) রামের নির্দেশে বানরসেনারা দলে দলে লঙ্কায় ঢুকে ঘরে ঘরে আগুনে দিয়ে আবালবৃদ্ধ পুড়িয়ে দিল, সেই খবরও রাবণের গুপ্তচরের কাছে ছিল না? গুপ্তচরেরা কি সব বিভীষণের পক্ষে চলে গিয়েছিল? তাই যদি হয়, তাহলে রাবণের পরাজয় কে ঠেকাবে?
লক্ষ্মণ : কর্তব্যনিষ্ঠ, ক্রোধী, বলশালী, অকুতোভয় এবং স্পষ্টবক্তা
লক্ষ্মণ রামের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী। অযোধ্যার রাজা দশরথের কনিষ্ঠা মহিষী সুমিত্রার দুই যমজ পুত্র হলেন লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্ন। মূল রামায়ণে লক্ষ্মণের মাতা সুমিত্রার কোনো পিতৃপরিচয় উল্লেখ করেননি কবি। কিন্তু মহাকবি কালিদাস বলেছেন সুমিত্রা মগধের মেয়ে। আবার কৃত্তিবাস বলেছেন সিংহলে সুমিত্রার বাপের বাড়ি।
লক্ষ্মণ রামের অত্যন্ত অনুগত ছিলেন। বিশ্বামিত্র রাক্ষসবধের জন্য রামকে আমন্ত্রণ জানালে লক্ষ্মণ তাঁর সঙ্গী হন। পরবর্তীকালে তিনি রামকে পিতার আদেশের বিরুদ্ধে বনগমনে না-যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু রাম বনবাসে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকলে, লক্ষ্মণও তাঁর সঙ্গে বনে যান। বনবাসকালে তিনি একাধারে রামের ভাই, বন্ধু ও সহায়কের ভূমিকা পালন করেছিলেন। লঙ্কার যুদ্ধে তিনি রাবণের পুত্র মেঘনাদ সহ আর অনেক বীরপুরুষদের হত্যা করেছিলেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র ষষ্ঠ সর্গে বলেছেন, লক্ষ্মণের হাতে অন্যায় যুদ্ধে মৃত্যু ঘটে অসমসাহসী বীর মেঘনাদের। মায়াদেবীর আনুকূল্যে এবং রাবণের অনুজ বিভীষণের সহায়তায়, লক্ষ্মণ শত শত প্রহরীর চোখ ফাঁকি দিয়ে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে প্রবেশে সমর্থ হয়। কপট লক্ষ্মণ নিরস্ত্র মেঘনাদের কাছে যুদ্ধ প্রার্থনা করলে মেঘনাদ বিস্ময় প্রকাশ করে। শত শত প্রহরীর চোখ ফাঁকি দিয়ে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে লক্ষ্মণের অনুপ্রবেশ যে মায়াবলে সম্পন্ন হয়েছে, বুঝতে বিলম্ব ঘটে না তার। ইতোমধ্যে লক্ষ্মণ তলোয়ার কোশমুক্ত করলে মেঘনাদ যুদ্ধসাজ গ্রহণের জন্য সময় প্রার্থনা করে লক্ষ্মণের কাছে। কিন্তু লক্ষ্মণ তাকে সময় এবং সুযোগ না দিয়ে আক্রমণ করে। লক্ষ্মণের মেঘনাদবধ প্রসঙ্গে অন্য কবিরা ‘তস্কর’ কাপুরুষ’ শিরোপা দিলেও, বাল্মীকির রামায়ণে এর কোনো সমর্থন পাওয়া যায় না। বাল্মীকির রামায়ণে লক্ষ্মণ রীতিমতো বীরত্ব প্রদর্শন করে মেঘনাদ সহ অসংখ্য বীরপুরুষদের হত্যা করেছেন বাহুবলেই এবং রণক্ষেত্রেই। অর্থাৎ নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে লক্ষ্মণ নিরস্ত্র অসহায় মেঘনাদকে চোরের মতো হত্যা করেছেন, একথা সত্য নয়–এটা কাহিনি কষ্টকল্পনা। লক্ষ্মণ মেঘনাদকে হত্যা করেছেন বানরসৈন্য ও রাক্ষসসৈন্যের সঙ্গে সংগ্রামে এক দ্বৈত শরযুদ্ধে।
মেঘনাদের এমন বর ছিল যে, যে ব্যক্তি ১৪ বছর না খেয়ে, না ঘুমিয়ে ব্রহ্মচর্য পালন করবেন তিনি শুধু মেঘনাদকে বধ করতে পারবেন। বনবাসের সময় ১৪ বছর শ্রীরামের ভ্রাতা লক্ষণ এই মহা কঠিন কার্য ও শক্তি অর্জন করেন। লক্ষ্মণ ১৪ বছর না খেয়ে না ঘুমিয়ে ছিলেন কোন্ দুঃখে! অরণ্যে প্রবেশের পর লক্ষ্মণ জানতেন বউদি সীতাকে রাবণ অপহরণ করবেন? যদি জানতেন তবে কেন সীতাকে একা অরক্ষিত রেখে রামের আর্ত চীৎকার শুনে গভীর অরণ্যে প্রবেশ করলেন? ‘লক্ষ্মণের গণ্ডি’ একটি পরিকল্পিত প্রক্ষিপ্ত, মনগড়া। বাল্মীকির রামায়ণে এমন ঘটনার উল্লেখ নেই। নারীর স্বাধীনতা এবং সীমাবদ্ধতাকে নির্দিষ্ট করে দিতেই পুরুষতান্ত্রিক সংযোজন।
সীতাকে অপহরণের ফলে তাঁকে লঙ্কায় যেতে হবে এবং মেঘনাদকে হত্যা করতে হবে জানতেন? রামের ১৪ বনবাস হলে তাঁর সঙ্গে লক্ষ্মণের বেরিয়ে আসাটা কি সেই কারণে? কোথায়, এমন আভাস তো বাল্মীকি সহ অন্য কবিরা রামায়ণে দেননি! মেঘনাদকে হত্যা করতেই যদি ১৪ বছর না-খেয়ে না-ঘুমিয়ে থাকতে হয়, তাহলে এত ছলনা আর চালাকির কী ছিল? মেঘনাদের মৃত্যু যখন ১৪ বছর না-খেয়ে না-ঘুমিয়ে থাকা ব্যক্তির। হাতেই নিশ্চিত, তবে কেন কাপুরুষের মতো নিরস্ত্র মেঘনাদকে না-মেরে সশস্ত্র মেঘনাদকে বীরের মতো লক্ষ্মণ হত্যা করেননি। এর আগে তিন তিনবার মেঘনাদের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ করে লক্ষ্মণ পরাজিতও হয়েছিল, লক্ষ্মণ জয়ী হল তখনই যখন মেঘনাদ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নয়, সমরসজ্জায় সজ্জিত নয়। তাছাড়া ১৪ বছর না-খেয়ে না-ঘুমিয়ে লক্ষ্মণ কী করতেন? দাদা-বউদিকে পাহারা দিতেন? ভাই না-খেয়ে না-ঘুমিয়ে থাকতেন, আর দাদা বউদি স্বার্থপরের মতো নিশ্চিন্তে ঘুমোতেন কীভাবে? অভুক্ত ভাইয়ের সামনে মুখে কীভাবে খাবার তুলতেন তাঁরা? উত্তর নেই।
লক্ষ্মণের স্ত্রী ঊর্মিলা ছিলেন মিথিলারাজ জনক এবং রানি সুনয়নার মেয়ে, অর্থাৎ সীতার বোন। লক্ষ্মণ জানান, রামের ১৪ বছর বনবাসের কথা। এবং এও জানান তিনিও রাম সীতার সঙ্গে বনবাসে যাবেন। ঊর্মিলা যখন লক্ষ্মণের কাছ থেকে রামের ১৪ বছর বনবাসের কথা জানতে পারেন এবং এও জানতে পরেন যে তিনিও রাম ও সীতার সঙ্গে বনবাসে যাবেন। তখন এই কথা শুনে নিজের মনকে যতটা সম্ভব শান্ত রাখেন ঊর্মিলা। অবিচলিত থাকেন স্বামীর সামনে। জানিয়ে দেন, তাঁরও উচিত স্বামী লক্ষ্মণের পথ অনুসরণ করা। কিন্তু তিনি তা করবেন না। কারণ তিনি গেলে লক্ষ্মণ সেভাবে মন দিয়ে রাম-সীতার সেবা করতে পারবেন না। লক্ষ্মণ যাতে দাদা-বৌদির সেবা করতে পারেন, সেজন্য স্ত্রী ঊর্মিলা অযোধ্যাতেই থেকে যান।
শুধু তাই নয়। নিদ্রাদেবীর কাছে তিনি প্রার্থনা করেন, যাতে এই ১৪ বছর, লক্ষ্মণের সব ঘুম তাঁকে দিয়ে দেন দেবী। এবং বনবাসে গিয়ে অতন্দ্র প্রহরীর হয়ে থাকতে পারেন রামানুজ লক্ষ্মণ। সেই প্রার্থনা মঞ্জুর হয়। রাম লক্ষ্মণ-সীতার বনবাসের ১৪ বছর বা ৫১১০ দিন ঘুমিয়ে ছিলেন ঊর্মিলা। এবং লক্ষ্মণ ছিলেন রাম-সীতার সেবায় নিবেদিত। ৫১১০ দিন লক্ষ্মণের না-ঘুমোনোর ব্যাপারটা না-হয় মেনে নেওয়া গেল গল্পের খাতিরে, কিন্তু না-খেয়ে থাকার ব্যাপারটা! কৃত্তিবাস আর রঙ্গনাথের রামায়ণেই এসব আষাঢ়ে গপ্পো পাওয়া যায়। বাল্মীকির রামায়ণে এসব অবাস্তব গাঁজাখুরি গপ্পো নেই। আসলে বাল্মীকি-পরবর্তী কবিরা আষাঢ়ে গপ্পো ফাঁদতে গিয়ে সব গুলিয়ে ফেলেছেন, মেলাতে পারেননি। অসংলগ্নতার কথা মাথায় রাখেননি। এইসব অর্বাচীন বিদগ্ধ কবিদের কারণেই রামায়ণ আজ বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লক্ষ্মণ প্রসঙ্গে সাহিত্যসম্রাট ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘রামায়ণের সমালোচনা’ নিবন্ধে লিখেছেন–
“হিন্দুস্বভাবের জঘন্যতার লক্ষ্মণ আর একটি উদাহরণ। তাহার চরিত্র এরূপে চিত্রিত হইয়াছে যে তদ্বারা লক্ষ্মণকে কর্মক্ষম বোধ হয়। অন্যজাতীয় হইলে সে একজন বড় লোক হইতে পারি, কিন্তু তাহার এক দিনের জন্যও সে দিকে মন যায় নাই। সে কেবল রামের পিছু পিছু বেড়াইল, আপনার উন্নতির কোন চেষ্টা করিল না। ইহা কেবল ভারতবর্ষীয়দিগের স্বভাবসিদ্ধ নিশ্চেষ্টতার ফল।”
লক্ষ্মণ স্পষ্টবক্তা। কাউকে তিনি উচিত কথা বলতে ছাড়েননি। অপ্রিয় হলেও সত্য কথা উচ্চকণ্ঠে বলতে পারতেন। সে রামই হোক কিংবা দশরথ–কেউই বাদ যাননি। হ্যাঁ, রামও বাদ যাননি। যুক্তিবাদী লক্ষ্মণ তাই প্রণম্য। বিমাতা কৈকেয়ীর বর চাওয়ার প্রসঙ্গটি অস্বীকার করে যুক্তিবাদী লক্ষ্মণ বলেছেন–
“যদি বর প্রসঙ্গ সত্য হইত, অভিষেক আরম্ভের পূর্বেই কেন তাহার সূচনা না হইল?”
লক্ষ্মণ বুঝেছিলেন রাম ষড়যন্ত্রের শিকার। এই ষড়যন্ত্রের নেপথ্য কারিগর আর্যদেবতারাই। তাই তিনি রামকে বলেন–
“আপনি অনায়াসেই দৈবকে প্রত্যাখ্যান করিতে পারেন, তবে কি নিমিত্ত … দৈবের প্রশংসা করিতেছেন। … এই জঘন্য ব্যাপার আমার কিছুতেই সহ্য হইতেছে না। . আপনি যে ধর্মের মর্ম অনুধাবন করিয়া মুগ্ধ হইতেছেন, যাহার প্রভাবে আপনার মতদ্বৈধ উপস্থিত হইয়াছে, আমি সেই ধর্মকেই দ্বেষ করি।”
পিতা দশরথকে বলেছেন, মেনিমুখো’। বলেছেন–বুড়ো বয়সে খোকা হয়েছেন–“পুনর্বাল্যমুপেয়ুষঃ”। বুড়ো বয়সে ভীমরতি হয়েছে–“বিপরীতশ্চ বৃদ্ধশ্চ স্ত্রিয়ো বাক্যবশং গতঃ”। রামের বনবাসযাত্রাকাল চূড়ান্ত হলে দশরথের উদ্দেশেও লক্ষ্মণ বলেছেন–“মহারাজ বৃদ্ধ হইয়াছেন, তিনি বিষয়াসক্ত কামার্ত ও স্ত্রৈণ, সুতরাং স্ত্রীলোকমন্ত্রণায় তিনি কি না বলিবেন।” এখানেই শেষ নয়, ক্রোধী লক্ষ্মণ এ সময় রামের উদ্দেশে বলেছেন–“আর্য, আপনার এই নির্বাসন-সংবাদ না হইতেই আপনি আমার সাহায্যে সমস্ত রাজ্য হস্তগত করুন। … যে ব্যক্তি ভরতের পক্ষে, যে তাহার হিতাভিলাষ করিয়া থাকে, আমি আজ তাহাদের সকলকেই বিনষ্ট করিব। অধিক আর কী কহিব, পিতা কৈকেয়ীর প্রতি সন্তুষ্ট হইয়া তাঁহারই উৎসাহে যদি আমাদিগের বিপক্ষতা করেন, তবে তাহাকেও সংহার করিতে হইবে। আপনার ও আমার সহিত শত্রুতা করিয়া অদ্য কেহই ভরতকে রাজ্যদান করিতে পারিবে না।” লক্ষ্মণ পিতার উদ্দেশে বলেছেন–“হনিষ্যে পিতরং বৃদ্ধং কৈকয্যাসক্তমানসম্। কৃপণঞ্চ স্থিতং বাল্যে বৃদ্ধভাবেন গর্হিতম।” অতএব পিতাকে হত্যার করার ব্যাপারে লক্ষ্মণের কোনোরূপ দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না।
শুধু পিতা দশরথ ও দাদা রামকে নয়, বউদি সীতাকেও তুলোধুনো করতে ছাড়েননি লক্ষ্মণ। পঞ্চবটি বনে রামের চিন্তায় উদ্বিগ্ন সীতা যখন লক্ষ্মণকে বারবার অনুরোধ করছিলেন এবং তাঁর প্রতি লোভ এই অপবাদ দেন, তখন লক্ষ্মণ বলেছিলেন–“ধিক্ ত্বা অদ্য বিনশ্যন্তীং যন্মামেবং বিশঙ্কসে। স্ত্রীত্বাদ দুষ্টস্বভাবেন।” অর্থাৎ এইসব সন্দেহ করছ! তবে মরো তুমি। স্ত্রীলোক তো, আর কী হবে! ভরতও বাদ যাননি। চতুরঙ্গ সৈন্যবাহিনি নিয়ে ভরত চিত্রকুটে পৌঁছেলে লক্ষ্মণ গর্জে উঠে রামকে উদ্দেশ্য করে বললেন–“যাহার নিমিত্ত আপনি রাজ্যচ্যুত হইলেন, এক্ষণে সেই শত্ৰু উপস্থিত হইয়াছে। সে আমাদের বধ্য, তাহাকে বধ করিতে আমি কিছুমাত্র দোষ দেখি না। … এক্ষণে আপনি ওই দুষ্টকে বধ করিয়া সমগ্র পৃথিবী শাসন করুন। আর বসুমতী মহাপাপ হইতে বিমুক্ত হউন। … আমি নিশ্চয় কহিতেছি, ভরতকে সসৈন্যে নিহত করিয়া অদ্য শর-কামুকের ঋণ পরিশোধ করিব।”–“ভরতস্য বধে দোষং নাহং পশ্যামি রাঘব”।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে লক্ষ্মণ সবসময়ই মারমুখী। এরপর ঝাড়লেন সুগ্রীবকে। সুগ্রীবের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন রাম। শর্ত একে অপরের বউ ফিরিয়ে দেওয়া হবে, উপরন্তু সুগ্রীব পাবে হৃতরাজ্য। সেই সূত্রেই বন্ধুত্ব। সেই শর্তেই রাম অন্যায়ভাবে বালীতে আড়াল থেকে হত্যা করেছিলেন। না-হলে আর্য হয়ে কোনোমতে অনার্যদের সঙ্গে পিতলা করতে যেতেন না। সেই সুগ্রীব কিনা ভাইকে হত্যা করিয়ে ভাইয়ের স্ত্রীকে ভোগদখল করে, নিজ স্ত্রীকে ফিরে পেয়ে, তদুপরি হৃতরাজ্য ফিরে পেয়ে মাসের মাস নিশ্চিন্তে আছেন! রাম ছেড়ে দিলেও লক্ষ্মণ ছাড়বেন কেন! তাঁর তো মাটি দিয়ে গড়া হৃদয় নয়! তিনি যে লৌহহৃদয়ের অধিকারী। বালীবধের পর চার মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, সীতার অনুসন্ধানে তদন্ত একচুলও নড়েনি। রাজ্য ও রমণীভোগে মাতোয়ারা হয়ে আছেন সুগ্রীব। সুগ্রীবের মহামন্ত্রী হনুমানের অনুরোধে সৈন্যসংগ্রহের আদেশ দিয়েই সুগ্রীব তাঁর কাজ শেষ করে অন্তঃপুরে ঢুকে পড়েন। আর কোনো উদ্যোগই তিনি নেননি। উল্কণ্ঠিত রামকে লক্ষ্মণ জানিয়ে দেন, প্রয়োজনে–“সুগ্রীবকে হত্যা করে বালীপুত্র অঙ্গদকে রাজা করে তাঁর সাহায্য নিয়ে জানকীর খোঁজ করব।” বলেছেন–“মিথ্যাবাদীকে বিনাশ করিব। এক্ষণে বালীর পুত্র অঙ্গদ বানরগণকে লইয়া জানকীর অন্বেষণ করুন।” অঙ্গদকে দিয়ে মধ্যস্থতা করার পর যখন সুগ্রীবের হুঁশ আসে না, তখন লক্ষ্মণ নিজেই পৌঁছে যান। সুগ্রীবের অন্তঃপুরে। রক্তচক্ষু লক্ষ্মণ ধনুকের টঙ্কার শুনিয়ে দিলেন সুগ্রীবকে, সেই টঙ্কার শুনে সুগ্রীবের গলা মুখ শুকিয়ে উঠল। লক্ষ্মণকে কামবশে বিবশ করার জন্য নৃত্যরত গণিকা ও পরমাসুন্দরী তারাকে লেলিয়ে দিলেন। কিন্ত লক্ষ্মণকে কামবাণে বিদ্ধ করা অত সহজ কাজ নয়। উলটে লক্ষ্মণ আরও ক্রুব্ধ হলেন। ঘাবড়ে গিয়ে সুগ্রীব জানালেন, আগামী দশদিনের মধ্যেই সৈন্য সংগ্রহের কাজ শেষ যাবে। সৈন্য সংগ্রহই নয়, সৈন্যবাহিনীদের হুশিয়ারিও দিলেন–“একমাস পূর্ণ হইলে আসিও, নচেৎ বধদণ্ড বহিতে হবে।” লক্ষ্মণ তেড়ে না-গেলে অকৃজ্ঞ সুগ্রীব কিছুতেই কর্তব্য পালন করতেন না। শেষপর্যন্ত কর্তব্যে নয়, লক্ষ্মণের নিশিত শরে বিদ্ধ হয়ে মৃত্যুভয়ে রামচন্দ্রকে সাহায্য করেছেন।
লক্ষ্মণের কাছে রাম ছিলেন একাধারে যেমন পিতার মতো, তেমনই প্রভু-ভাই-বন্ধুও। রামের অনুপস্থিতিতে লক্ষ্মণ সুগ্রীবকে রাম সম্পর্কে বলেছিলেন–“আমি এই কৃতজ্ঞ বহুদর্শী গুণগ্রামে বশীভূত হইয়া, দাসত্ব স্বীকার করিয়া আছি।” আর বলবেন নাই-বা কেন–বনবাসজীবনের একেবারে গোড়ার দিকে এই লক্ষ্মণই যে রামকে নিজের মনের কথা বলে দিয়েছেন–“জল হইতে মৎস্য উদ্ধৃত হইলে যেমন জীবিত থাকিতে পারে না, সেইরূপ আপনার বিয়োগে আমরা ক্ষণকালও প্রাণধারণ করিতে পারিব না। আপনাকে পরিত্যাগ করিয়া পিতা, মাতা, ভ্রাতা ও স্বর্গই-বা কী, কিছুই অভিলাষ করি না।” সেই লক্ষ্মণ অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সময় বদলে যেতে একদণ্ডও সময় নেন না। রামের তীব্র ভাষা শুনে যখন সীতা যখন অপমানিত হচ্ছেন এবং সীতা যখন অগ্নিতে আত্মাহুতি দেবেন বলে ইচ্ছা প্রকাশ করেন, লক্ষ্মণ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। লক্ষ্মণ রামের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। রোষপূর্ণ চোখে রামের দিকে দৃষ্টিক্ষেপণ করেছেন। লক্ষ্মণ রীতিমতো রামের সিদ্ধান্ত ও আচরণে রামের উপর রুষ্ট হয়েছিলেন। এই কারণে লক্ষ্মণকে চরম শাস্তিও পেতে হয়েছিল। চির অনুগত লক্ষ্মণের সঙ্গে রামের সম্পর্কে গভীর ফাটল দেখাল। এখানেই শেষ হয় না। ছল করে রাজা রাম অযোধ্যা থেকে লক্ষ্মণকে বহিষ্কার করে দেন। এই লক্ষ্মণ বর্জন এবং পরিণতির ঘটনা পূর্বে বিস্তারিত উল্লেখ করেছি। অনিচ্ছাসত্ত্বেও লক্ষ্মণকে দুটি অপ্রীতিকর কাজ করতে হয়েছিল–(১) সীতার অগ্নিপরীক্ষার জন্য চিতা সাজানো এবং (২) সীতাকে একাকী জঙ্গলে রেখে আসা। লক্ষ্মণ জানতেন না কী কারণে সীতাকে জঙ্গলে রেখে আসতে হল, লক্ষ্মণ জানতেন না সীতা আসন্নপ্রসবা। যখন জেনেছেন তখন তিনি হাউহাউ করে কেঁদেছেন। গহীন অরণ্যে সীতাকে রেখে ফিরে আসার সময় বারবার পিছন ফিরে দেখছিলেন–“মুহুর্মুহু পরাবৃত্য দৃষ্টা সীতামনাথবৎ”। শুধু দেখলেনই না, দেখলেন বাল্মীকির আশ্রম পর্যন্ত সীতা নিরাপদে পৌঁছোলেন কি না–“দৃষ্টা, তু মৈথিলীং সীতামাশ্রমে সম্প্রবেশিতা”।
যাই হোক, বনবাসের শেষে রাম অযোধ্যার রাজা হলে লক্ষ্মণ তাঁর মন্ত্রী নিযুক্ত হন। অরণ্যে যত হত্যাকাণ্ড সব লক্ষ্মণের দ্বারাই সাধন হয়েছিল, যা একজন দেহরক্ষীরা কাজ। রামের সামনে লক্ষ্মণই বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছেন, এভাবে রামকে সুরক্ষা দিয়েছেন যতদিন পেরেছেন। প্রতিজ্ঞাভঙ্গের অপরাধে রাম তাঁকে পরিত্যাগ করলে, তিনি সরযূ (বালিয়ার কাছে ছেটি-সরযূ নদী গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই সরযূকেই তমসা বলা হত।) নদীর জলে মৃত্যুবরণ করেন। কথিত আছে, লখনউ শহরটি (বর্তমান উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের রাজধানী)। লক্ষ্মণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
লক্ষণের দুই ছেলে অঙ্গদ ও চন্দ্রকেতু। প্রথম জন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কারুপদ রাজ্য এবং চন্দ্রকেতু প্রতিষ্ঠা করেন মালব প্রদেশের চন্দ্ৰকান্তি নগর।
ভরত : সুচতুর, সাবধানী, দক্ষ রাজনীতিক
রামচন্দ্রের দ্বিতীয় ভাই ভরত, কৈকেয়ীর সন্তান। দশরথের বৃদ্ধ বয়সের বউ কৈকেয়ী। কবি বলেছেন–
“স বৃদ্ধস্তরুণীং ভার্যাং প্রাণেভ্যোহপি গরীয়সীম”।
ভরত রাজা জনকের ভাই কুশধ্বজের কন্যা মাণ্ডবীকে বিবাহ করেন।
কৃত্তিবাস, তুলসীদাস, রঙ্গনাথন প্রমুখ কবিদের রামায়ণে ভরত যেন সাক্ষাৎ ভ্রাতৃভক্তির পরাকাষ্ঠা। তিনি দাদার খড়ম মাথায় করে এনে ভগ্নহৃদয়ে অযোধ্যায় ফিরেছেন! ফিরে তিনি রাজসিংহাসনে উপবিষ্ট হননি, রাজসিংহাসনে দাদার খড়মজোড়া রেখে রাজ্যশাসন করেছেন। নিজে কখনোই সেই রাজসিংহাসনে উপবিষ্ট হননি। ব্যস, এইটুকুতেই বাজিমাত। এইটুকুতেই ভরতের ভাতৃভক্তির চরম নিদর্শন হয়ে গেছে মানবসমাজে। গোটা রামায়ণে আর তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেই ভরতের। একেই বলে সেন্টিমেন্ট, এই সেন্টিমেন্ট বাঙালিকুল সবটাই আত্মস্থ করে নিয়েছে।
বাল্মীকি রামায়ণে কিন্তু ভরতকে এক ভিন্নরূপে পাওয়া যায়। বাল্মীকির রামায়ণে ভরতের কতটুকু ভ্ৰাতৃভক্তি আছে সেটা পাঠকই বিচার করুন। রামচন্দ্রের বিয়ে করার কয়েকদিন পর দশরথ ভরতকে মাতুলালয় কেকয় দেশে পাঠিয়ে দিলেন বায়ো বছরের জন্য। এই দীর্ঘ বারো বছরের একবারের জন্যেও ভরতের মুখদর্শন করেননি দশরথ। এই বারো বছরে অযোধ্যায় তোলপাড় হয়ে গেল, বয়ে গিয়েছে অনেক জল–ভরত কিছুই জানতে পারেনি। মাতা কৈকেয়ী দশরথের কাছ থেকে রামের চোদ্দো বছর বনবাস এবং ভরতের রাজ্যলাভের বর চেয়ে নিলেন। কোনো বরই দশরথ কৈকেয়ীকে না-দিলেও রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা স্বেচ্ছায় চলে গেলেন। দণ্ডকারণ্যে। যেভাবেই হোক, রামের বনবাসের ষষ্ঠদিনে দশরথের মৃত্যু হয়। দশরথ তাঁর জীবদ্দশায় ভরতকে রাজা করার ব্যাপারে কোনোরূপ উদ্যোগ নেননি। কারণ দশরথ কখনোই চাননি ভরত রাজা হোক। তাই কেকয় রাজ্য মাতুলালয় থেকে ভরতকে ফিরিয়ে আনারও কোনো বন্দোবস্ত তিনি করেননি।
দশরথের মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহ তেলভরতি বড়ো পাত্রে সংরক্ষণের জন্য রাখা হল। কারণ এখনই মৃতদেহ সৎকার সম্ভব নয়। পিতার মৃতদেহ সৎকারের দায়িত্ব যেহেতু পুত্রদের উপর বর্তায়, পুত্ররা যখন কেউই অযোধ্যায় নেই, তখন সংরক্ষণ ছাড়া অন্য উপায় কী! এমতাবস্থায় ঋষি মার্কণ্ডেয়, বামদেব, গৌতম, মৌদগল্য, কাশ্যপ, প্রমুখ ব্রাহ্মণেরা বৈশিষ্ঠকে পৌরহিত্য করে এক জরুরি বৈঠকে বসলেন এবং সিদ্ধান্ত নিলেন ভরতকে রাজপদে নিযুক্ত করা হবে। দশরথের অবর্তমানে ভরতকে রাজা করতে দৃঢ়সংকল্প বশিষ্ঠই। বশিষ্ঠের নির্দেশে ভরতকে অযোধ্যায় ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা হল। ভরত অযোধ্যায় ফিরে এসে অনুভব করে পরিস্থিতি সুবিধার নয়, চারদিক থমথমে ভাব। কেউ তাঁকে সম্ভাষণ জানাচ্ছেন না। কিন্তু কেন এমন মরা-বাড়ি হয়ে আছে। অযোধ্যাপুরী! ভরত কিছুই জানে না, কিছুই জানানো হয়নি তাঁকে। অযোধ্যায় আসার অনেক পর ভরতকে পিতার মৃত্যুসংবাদ দেওয়া হয়। তাঁকে রাজা করার বন্দোবস্ত হচ্ছে বুঝতে পেরে বললেন–“আমি রাজ্য কামনা করি না এবং গ্রহণার্থ জননীকেও প্রেরণ করি নাই।”
অতঃপর বশিষ্ঠ ভরতের পিতার প্রেতকৃত্য সাধনে তৎপর হলেন। গোপন করলেন দশরথের মনোবা। দশরথ ভরতকে ত্যজ্যপুত্র করেছেন, কৈকেয়ীকে বলেছেন–“আমার ঔরসজাত পুত্র তোর ভরতকে পরিত্যাগ করিলাম।” কেড়ে নিয়েছেন পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মের অধিকার, বলেছেন–“আমি মরিলে রামই সমস্ত উপকরণ লইয়া আমার অন্ত্যোষ্ঠি ক্রিয়া করবে। এই বিষয়ে ভরত ও তোর কিছুতেই অধিকার থাকবে না।”
না, দশরথের কথা রাখা হয়নি। বশিষ্ঠরাও এই ব্যাপারটায় একেবারেই পাত্তা দেননি। অতএব দশরথের মৃত্যুর ত্রয়োদশ দিবসের মধ্যে দশরথের অগ্নিসংস্কার ও বিভিন্ন পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম সম্পন্ন হয়ে গেল। বশিষ্ঠের ব্যবস্থাপনাতেই সম্পন্ন হল। করলেনও ভরত, নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও।
পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম তো হলই। এবার হাতে রইল অযোধ্যার সিংহাসন। ভরত অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তি। হঠকারিতা তাঁর কোষ্ঠীতে লেখা নেই। ভরত বিলক্ষণ জানেন রাজসভার অমাত্যদের মধ্যে বেশিরভাগই রামের অনুরাগী। রামের দণ্ডকারণ্যে নির্বাসনে চলে যাওয়াটা তাঁরা মেনে নিতে পারেননি। সব মিলিয়ে অযোধ্যার রাজসভা থমথম করছে। তাঁদের আগে নিজের দলে টানতে হবে। ধপাস করে সিংহাসনে বসে গেলেই তো হল না! অতএব ফন্দির বিকল্প নেই। যিনি রাজা হতে চলেছেন তাঁর ফন্দি থাকবে না, বিশেষ করে যাঁর রাজা হওয়ার অধিকার নেই! অতএব দশরথের মৃত্যুর চতুর্দশ দিনে ভরত সকলের মুখোমুখি হলেন, যাঁরা বিচক্ষণ। মানুষ এবং ঘোষণা দিলেন–
“আর্য রাম আমাদিগের জ্যেষ্ঠ, অতঃপর তিনিই রাজা হইবেন, আর আমি গিয়া অরণ্যে চতুর্দশ বৎসর অবস্থান করিব; এক্ষণে চতুরঙ্গ সৈন্য সুসজ্জিত করো, আমি স্বয়ং বন হইতে রামকে আনয়ন করিব।”
বর্ণে বর্ণে চাতুরতা, অতএব বাজিমাত। লক্ষ করুন, তিনি বললেন–এক, তিনি স্বয়ং চোদ্দো বছর বনবাস যাপন করবেন এবং দুই, রামকে ফিরিয়ে এনে অযোধ্যার সিংহাসনে বসাবেন। তা রামকে ফিরিয়ে আনতে চতুরঙ্গ সেনাবাহিনীর প্রয়োজন কী? যুদ্ধ নাকি? চতুরঙ্গ সেনাবাহিনী তো যুদ্ধের কাজেই ব্যবহৃত হয়! তাহলে এ যুদ্ধ কার বিরুদ্ধে? ভরতের চোদ্দো বছর বনবাসযাপনই-বা কোন্ কারণে? দুটো প্রস্তাবই অবাস্তব, কিন্তু কার্যকারিতা আছে। রাজসভার বিচক্ষণ ব্যক্তিগণ তথা প্রজাদের চিত্ত নিজের পক্ষে অনুকূল করে নেওয়া মসৃণ হল।
চতুরঙ্গ সৈন্যবাহিনি নিয়ে অরণ্যপথে যেখান-সেখান দিয়ে তো নিয়ে যাওয়া যায় না! শুরু হয়ে গেল প্রস্তুতি। দীর্ঘদিন ব্যয় করে যাত্রাপথ উঁচুস্থান ভেঙে সমতল করে ফেলা হল। যেখানে যত গর্ত খানাখন্দ, সেখানে ভরাট করা হল। তৈরি হল নতুন রাস্তা, নির্মাণ হল সেতু। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে যেখানে যত বাধা সব সরিয়ে ফেলা হল। যখন এসব কর্মকাণ্ড চলছে, তখন বশিষ্ঠও বসেছিলেন না। তিনি বসে থাকার মানুষও নন। সময় বা সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে তিনি জানতেন। একদিকে ভরত যখন রামের কাছে পৌঁছোতে পথ তৈরির কাজে ব্যস্ত, অপরদিকে বশিষ্ঠ ভরতের অভিষেক ক্রিয়ার আয়োজন করতে ব্যস্ত। তিনি দূতদের জানালেন–
“দেখো, তোমরা এক্ষণে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, অমাত্য, সেনাপতি ও যোদ্ধাদের সহিত ভরত শত্ৰুগ্ন ও অন্যান্য রাজপুত্র এবং যুধাজিৎ, সুমন্ত্র ও অপরাপর হিতকারী ব্যক্তিকে শীঘ্র আনয়ন করো। বিলম্বে বিঘ্ন ঘটিতে পারে এমন কোনো কার্য উপস্থিত হইয়াছে।”
দশরথ ভরতকে রাজ্য প্রদান করেছে কি না সে ব্যাপারে কোনোরূপ উচ্চবাচ্য করলেন না বশিষ্ঠ।
তিনি ভরতকে বললেন–
“এক্ষণে তুমি অভিষিক্ত হইয়া পিতা ও ভ্রাতার প্রদত্ত রাজ্য নির্বিঘ্নে উপভোগ করো। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম দেশের রাজাগণ ও দ্বীপবাসী ও সামুদ্রিক বণিকেরা তোমায় দিবার নিমিত্ত অসংখ্য ধনরত্ন আনয়ন করুক।”
ভরতের অভিষেক ক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে গেল রাম ফেরার আগেই। ভরত রাজা হলেন রামকে ফিরিয়ে আনার আগেই। রাজা হয়ে ভরত চললেন রামের খোঁজে। সঙ্গে চললেন নানাবিধ যুদ্ধাস্ত্রধারী রথী, শস্ত্রধারী বীরপুঙ্গব, মন্ত্রী ও পুরোহিতেরা। চলল অসংখ্য হাতি ও ঘোড়া। যেন মনে হচ্ছে রাজা ভরত কারোর বিরুদ্ধে করতে যাচ্ছেন।
সৈন্যদের কোলাহল, হাতি-ঘোড়ার পদশব্দ আর গর্জনে লক্ষ্মণ সতর্ক হয়ে গেলেন। অন্বেষণে লক্ষ্মণ অনুমান করলেন ভরত সৈন্যবাহিনী নিয়ে এসেছেন। রাম ও সীতা তখন দগ্ধ মৃগমাংস ভোজনে ব্যস্ত ছিলেন। লক্ষ্মণ তৎক্ষণাৎ রামকে বললেন–
“আর্য, এক্ষণে অগ্নি নির্বাণ করিয়া ফেলুন, জানকী গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হউন। আর আপনি বর্ম ধারণ, কামুকে জ্যা আবোপণ ও শর গ্রহণ করিয়া প্রস্তুত হইয়া থাকুন।… কৈকেয়ীর পুত্র ভরত অভিষিক্ত হইয়া রাজ্য নিষ্কণ্টক করিবার বাসনায় আমাদের নিধন কামনায় উপস্থিত হইয়াছে।..যাহার নিমিত্ত আপনি রাজ্যচ্যুত হইলেন, এক্ষণে সেই শত্ৰু উপস্থিত হইয়াছে। সে আমাদের বধ্য, তাহাকে বধ করিতে আমি কিছুমাত্র দোষ দেখি না।… ভরতকে সসৈন্যে নিহত করিয়া অদ্য শর-কামুকের ঋণ পরিশোধ করিব।”
লক্ষ্মণ ক্রোধী, রাম নয়। প্রথমত সৈন্যবাহিনী ভরতরই কি না তা এখনও জানা যায়নি। দ্বিতীয়ত ভরত না-হয়ে যদি অন্য কেউও হয় এই বিপুল সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে যুঝা এতটা সহজ নয়। অতএব এমতাবস্থায় রাম লক্ষ্মণকে ক্রোধ থেকে বিরত থাকতে বললেন। ভরত এখন সসৈন্যে চিত্রকুটে। সৈন্যদের দূরে দাঁড় করিয়ে রেখে রাম লক্ষ্মণের মুখোমুখি। পথে রাজপোশাকে থাকলেও চিত্রকুটে রামের পর্ণকুটিরে প্রবেশের আগে বেশভূষা বদলে চীরবল্কল, কৃষ্ণাজিন পরিহিত জটাভার সংবলিত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে ভরত রামের পায়ের নীচে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। এরপর ভরত পিতা দশরথের মৃত্যুসংবাদ, সেইসঙ্গে নিজেকে ‘দাস’ ঘোষণা করে রামকে রাজ্যভার গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করলেন। রাম জানিয়ে দিলেন পিতার প্রতিজ্ঞার কারণে তাঁর ফিরে না-যাওয়ার কথা। পিতৃসত্য পালনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাম অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তনে অসম্মত হলেন এবং বললেন তোমার দাদু কেকয়রাজ অশ্বপতির কাছে পিতা দশরথ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছেন যে আমাদের মাতা কৈকেয়ীর গর্ভে যে সন্তান। হবে তাঁকেই তিনি রাজ্য সমর্পণ করবেন–
“পুরা ভ্রাতঃ পিতা নঃ স মাতরং তে সমুদবহন।
মাতামহে সমাশ্রৌষীদ রাজ্যশুল্কম্ অনুত্তমম্।”
এমনকি বনবাসযাপন পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর তিনি অযোধ্যায় ফিরবেন না একথাও তিনি জানিয়ে দেন। রামের প্রশংসাপূর্বক ভরত বারবার রামকে অযোধ্যায় ফেরার জন্য অনুরোধ করতে থাকেন।
ভরত বিলক্ষণ জানতেন রাম ফিরবেন না। ফিরলে বিনাবাক্যব্যয়ে বিনাদ্বন্দ্বে তিনি অযোধ্যা ত্যাগ করতেন না। তবুও ভরত কোনোরূপ ঝুঁকি নেননি। সত্যিই যদি ভরতের অনুরোধে রাম সত্যিই ফিরে আসেন, সেই অপ্রীতিকর সম্ভাবনা নিকেশ করার জন্য চতুরঙ্গ সৈন্যবাহিনীর আয়োজন। রামের সৌভাগ্য যে রামও অযোধ্যায় ফিরতে চাননি, না-হলে ভরত সেদিনই রামকে চিত্রকুটেই খবর করে দিতেন, অযোধ্যায় আর আসতে হত না। অনুরোধ আর অনুরোধ পর্ব শেষ হলে রামের আজ্ঞানুসারে অযোধ্যায় ফিরে যেতে ও রাজ্যশাসনে সম্মত হলেন এবং রামের পাদুকা প্রার্থনা করলেন। বললেন–
“আপনি পদতল হইতে এই কনকখচিত পাদুকাযুগল উন্মুক্ত করুন, অতঃপর ইহাই লোকের যোগক্ষেম বিধান করিবে।”
রামও ভরতের অনুরোধ রেখে পাদুকাযুগল ভরতকে দিলে ভরত রামকে প্রণাম করে পাদুকা গ্রহণ করলেন এবং বললেন–
“আপনার প্রতীক্ষায় চতুর্দশ বৎসর নগরের বহির্দেশে বাস করিব। পঞ্চদশ বৎসরের প্রথম দিবসে যদি আপনার দর্শন না পাই, তাহা হইলে নিশ্চয়ই আমায় হুতাশনে আত্মসমর্পণ করিতে হইবে।”
এরপর রামের পাদুকাদুটি নিয়ে অযোধ্যায় ফিরে আসেন এবং নির্বিবাদে, নিঃঝঞ্ঝাটে দাবিহীন, নিষ্কণ্টক সিংহাসনে দাদার পাদুকা রেখে দীর্ঘ চোদ্দো বছর রামের নামে রাজত্ব করে গেলেন। তবে দশরথ শাস্তি দিয়েছেন ভরতকে, ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন ভরতকে–“সন্ত্যজামি স্বজঞ্চৈব তব পুত্রং ত্বয়া সহ।” একটাও যুদ্ধটুদ্ধ করতে হয়েছে বলে শুনিনি। দাদার পাদুকা বহন করে রাজত্ব চালানো ছাড়া আর কোনো গুরুত্বই নেই। বিমাতা কৌশল্যাও ভরতকে বিশ্বাস করেননি, সেটা তিনি গোপন রাখেননি–
“জহ্যাদ রাজ্যঞ্চ কোষঞ্চ ভরতো নোপলক্ষ্যতে।… তথাহাত্তমিমং রাজ্যং হৃতসারাং সুরামিবা নাভিমন্তুমলং রামো নষ্টসোমমিধ্বর।”
অর্থাৎ, “রাম যদি বনবাসের পর ফিরে আসেও ভরত তাঁকে রাজ্য, রাজকোশ কিছুই ফেরত দেবে বলে মনে হয় না।… যে মদের সারবস্তু খাওয়া হয়ে গেছে, যে যজ্ঞে সুরা বা মদ (সোমরস) বিনষ্ট হয়ে গেছে, সেইরকম রাজ্য নিয়ে রাম কী করবে? ভরত প্রসঙ্গে সাহিত্যসম্রাট ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর রামায়ণের সমালোচনা’ নিবন্ধে লিখেছেন–“অসভ্য মূর্খ ভরত। আপন হাতে রাজ্য পাইয়া ভাইকে ফিরাইয়া দিল। ফলতঃ রামায়ণ অকৰ্ম্মা লোকের ইতিহাসেই পূর্ণ। ইহা গ্রন্থকারের একটি উদ্দেশ্য।”
ভরত এখন কেবল রামের ভাই নয়, তিনি এখন রাজা। ভরত ভাই হলেও রাম তাঁকে বিশ্বাস করতে পারেননি। লক্ষ্মণও বিশ্বাস করেন না। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও চিত্রকুট ছেড়ে দণ্ডকারণ্যের গভীর অরণ্যে চলে গেলেন। কারণ রাম ভেবেছিলেন বাকি দিনগুলিতে চিত্রকুটেই থেকে যাবেন। তাই চিত্রকুট পর্বতেই বাসগৃহ নির্মাণ ও বাস্তুশান্তি করেছিলেন। কিন্তু চোদ্দো বছরের মধ্যে একটিবারের জন্যেও রাম, লক্ষ্মণ, সীতার খোঁজ করেননি ভরত। চোদ্দো বছর পর আরও মাস আটেক অতিক্রান্ত হয়েছিল, তখনও কোনো উৎকণ্ঠা দেখা যায়নি ভরতের মধ্যে। শ্বাপদসংকুল রাক্ষস অধ্যুষিত দণ্ডকারণ্যে থেকে কারোর পক্ষেই ফিরে আসা সম্ভব নয়। ভরতও সেটাই মনে করে নিশ্চিন্তেই ছিলেন। তাই খোঁজখবর নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তা ছাড়া গভীর অরণ্যে প্রবেশের পর নানাবিধ বিপদের মধ্যে পড়লেও রাম বা লক্ষ্মণের একবারের জন্যেও ভরতকে মনে পড়েনি, তাঁর সশস্ত্র সাহায্যও তাঁরা কামনা করিনি৷
ভরত স্বপ্নেও কখনো ভাবতে পারেননি যে, রাম কোনোদিন দণ্ডকারণ্য থেকে ফিরবেন বা ফিরতে পারবেন। ভেবেছিলেন রাক্ষসখোস কিংবা হিংস্র জন্তুর পেটে চলে যাবে। তার উপর রাম নিজের মুখেই বলেছেন, তিনি আর কখনোই অযোধ্যায় ফিরবেন না–“ভরত! পিতা স্বর্গারোহণ করিয়াছেন, এক্ষণে আমি অযোধ্যায় গিয়া কী করিব? …এক্ষণে বনবাস অতিক্রান্ত হইলেও আমি আর সেই নিরাশয় বহুনায়ক অযোধ্যায় যাইব না”। রামের এহেন জবাবে ভরত খুশি হলেন। বলপ্রয়োগ নয়, বলপ্রদর্শনেই কাজ হল। এবার সাপ মরবে, লাঠিও ভাঙবে না। পাদুকা সিংহাসনে রেখে রাজ্যশাসন করলে প্রজারাও ভরতকে ভুল বুঝবেন না, আবার নিজের রাজা হওয়ার স্বপ্নটাও পূরণ হবে। ভরত বিলক্ষণ জানেন, পাদুকা বা খড়ম কখনো রাজ্যশাসন করে না। খড়ম কেবল ভেকমাত্র। আই ওয়াশ! বিচক্ষণ ভরত জানতেন রাজা হয়ে বসে পড়া আর প্রজাদের মনোরঞ্জন করা এক জিনিস নয়। যে রাজ্যের জন্য রামের বনবাস, সেই রাজ্যের দখলি-সত্ত্ব তাঁর নিজের হাতে থাকলে রামভক্ত প্রজাদের মুখের উপর সেই রাজ্য প্রেমানন্দে ভোগ করা মোটেই সম্ভব নয়। তাই এত ফন্দিফিকির!
চোদ্দো বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর নানা ঘাতপ্রতিঘাতে উত্তীর্ণ হয়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুর মতো রামও বদলে গেলেন। লঙ্কাকাণ্ড তথা রাবণ বধেরই শেষে রাম যখন বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে অযোধ্যায় ভরতের মুখোমুখি হন ভুত দেখার মতো ভরত অজ্ঞান হয়ে যান। ভরত ভেবেছিলেন রাম হয়তো এবার তাঁকে হত্যা করে অযোধ্যায় সিংহাসনে বসবেন। ভাবাটাও অমূলক নয়। বেগড়বাই করলে রাম অবশ্যই ভারতকে হত্যা করতেন, এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। লঙ্কাযুদ্ধে সবে ব্যাপক হত্যালীলা সাঙ্গ করে এসেছেন। তাঁর হাত দুটো রক্তে লাল হয়েছে। চোখে এখন তাঁর রক্তের নেশা। সিংহাসন ছেড়ে না-দাঁড়ালে ভরত অবশ্যই রামের হাতে হত্যা হয়ে যেতেন। ভরত বিচক্ষণ, দূরদর্শী, পোড়খাওয়া–অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে রামকে রাজ্যভার সব বুঝিয়ে দিলেন। লক্ষ্মণের ছেড়ে দেওয়া যুবরাজের পদটা ভরত পেলেন বটে, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই অযোধ্যা ছেড়ে চলে যেতে হল রাজা রামের আদেশে। রাম বুঝিয়ে দিয়েছেন আরামের দিন শেষ। এবার খুঁটে খাও। রাজ্য মুফতে পাওয়া যায় না, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাজা হওয়া যায় না। রাজা যদি হতে চাও রক্ত ঝরাও, ঘাম ঝরাও। মরো, না-হয় রাজ্যভোগ করো। গন্ধর্বদেশে গিয়ে গন্ধবদের সঙ্গে তুমূল যুদ্ধ করে ভরত নিজের রাজ্য কায়েম করতে হয়েছিল। একবারের জন্যেও তিনি আর অযোধ্যায় ফিরে আসেননি। তবে উত্তরকাণ্ডের শেষ দিকে ভরতকে দেখা গিয়েছিল রামের সঙ্গে সহমরণে যাত্রার সময়। ভরতের দুই পুত্র–তক্ষ ও পুষ্কল। তক্ষ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রাচীন ভারতের শিক্ষার পীঠস্থান তক্ষশিলা, যা ছিল সিন্ধু নদের পূর্বপ্রান্তে। এই তক্ষশিলা দিয়েই ভারতে প্রবেশ করেছিলেন আলেকজান্ডার। পুষ্কল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পুষ্কলাবতী নগর, যা সিন্ধু নদের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত। অর্থাৎ ভরতের দুই ছেলে সমগ্র সিন্ধ নগরের সিন্ধু নদের দুই তীরেই নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল। শোনা যায় খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক পর্যন্ত এই সাম্রাজ্য টিকে ছিল।
বাল্মীকি : মহাকবি, মহাঋষি এবং আর্যায়নের প্রতিনিধি
মহর্ষি বাল্মীকি চলেছেন আশ্রম ছেড়ে আচমনের পথে, সঙ্গে আছেন যোগ্য শিষ্য ভরদ্বাজ। প্রকৃতি রূপে বিমুগ্ধ হতে হতে বাল্মীকি উচ্চারণ করছিলেন বেদমন্ত্র। হঠাৎ তাঁর পায়ের সামনে লুটিয়ে পড়ে তীরবিদ্ধ রক্তাক্ত এক বিষণ্ণ ক্রৌঞ্চ। আবেশ আর মন্ত্রপাঠে ছন্দপতন ঘটে গেল মহর্ষির। এ দৃশ্যে মহর্ষি বেদনাহত হলেন, বেদমন্ত্রের পরিবর্তে উচ্চারিত মহর্ষির মৌলিক শ্লোক–
“মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কমমোহিতম্।”
মহর্ষি বাল্মীকি নিষাদ বা ব্যাধকে অকারণে অভিসম্পাত করলেন।
প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক বীরেন্দ্র মিত্র তাঁর ভাষ্যে বলেছেন–“আসলে এই কাহিনিটি বাল্মীকি-প্রবর্তিত নবীন। শ্লোকচ্ছন্দ ও অপূর্ব কাব্যরচনার জন্মবৃত্তান্ত। এ কাহিনির সঙ্গে বাল্মীকির অনন্যসুলভ কবিত্ব উন্মেষের কথা সংশ্লিষ্ট আছে, নেই রামকাহিনির কোনো সম্পর্ক। কিন্তু রামায়ণ কথাকাব্যের মধ্যে কৌশলে এই বিচ্ছিন্ন ঘটনাটি সংযুক্ত করে দিয়েছেন কোনো বুদ্ধিমান পুরাণকার, যাঁর উদ্দেশ্য ছিল মহাকবি বাল্মীকির উপরে আর্য দেবায়নের মহামন্ত্রী ব্রহ্মার ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করা।”
স্বরাজ্যর প্রজাপতি হলেন ব্রহ্মা। তাই দেবস্তাবক পুরাণকার চাননি ব্রহ্মাকে অতিক্রম করে মহাকবির প্রতিষ্ঠা হোক। সেই উদ্দেশ্যেই তিনি রামকাহিনির সঙ্গে নবছন্দের উৎপত্তি-কথাকে জুড়ে দিয়ে ব্রহ্মাকেই পরমস্রষ্টা নির্মাণ করলেন। আর্য দেবায়তনপ্রধান ব্রহ্মা যখন বলছেন, আমার ইচ্ছাতেই তোমার দ্বারা এমত শ্লোকসৃষ্টি সম্ভব হয়েছে, তখন বাল্মীকি নতমস্তকে ব্রহ্মার সেই আত্মস্তুতি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন, আপন মেধা ও কৃতিত্বের অস্বীকৃতি হজম করে। হজম না-করেই-বা উপায় কী! কার ঘাড়ে কটা মাথা আছে যে, ব্রহ্মাসহ ব্রহ্মাবাদীদের তুচ্ছতাছিল্য করবে? তাঁদের মান্য না-করার ফল যে ভয়ংকর। তার এমন শোচনীয় অবস্থা হবে যে, গাছের লতাপাতা-পাখিপক্ষীরাও কাঁদতে থাকবে। ব্রাহ্মণ্যশক্তির সামান্যতম প্রতিবাদ যাঁরাই করেছেন, তাঁদেরই ঝাড়েবংশে সাফ করে দিয়েছে ব্রাহ্মণ্য-সন্ত্রাস। সেই ব্রাহ্মণ্য-সন্ত্রাসের মর্মন্তুদ কাহিনি রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণগুলির ছত্রে ছত্রে বর্ণিত আছে। যদুবংশের ধ্বংস, মহাপ্রস্থানের পথে পাণ্ডবদের রহস্যমৃত্যু, ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারী-কুন্তীর জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু, কৃষ্ণের নির্জন-মৃত্যু, লক্ষ্মণের আত্মহনন, শাম্বের নির্বাসন সবই ব্রাহ্মণ্য-সন্ত্রাসের নমুনা। ব্রাহ্মণ্যবাদের শর্ত একটাই–কেবলমাত্র বিশ্বাস করো, কৈফিয়ত চেয়ো না, তর্ক করার দুঃসাহস দেখিয়ো না, নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করো। অন্যথায় সমূলে বিনাশ।
যাঁরা মনে করেন রামায়ণ একটি কল্পগল্প, বাল্মীকি বলে কেউ কোথাও কোনোদিন ছিলেন না, তাঁদের সঙ্গে আমি একমত নই। বাল্মীকি নিছক কোনো কল্পিত পুরষ নন, তিনি সম্পূর্ণ রক্তমাংসের সাধক মানুষ। বাল্মীকির রামায়ণও কবির মনোজগতের কল্পিত কাহিনি নয়, ব্রহ্মার সুপারিশ ও পৃষ্ঠপোষকতায় রাজা ও ব্রাহ্মণ্যবাদের বাল্মীকির স্তুতি। এমনই হুকুম ছিল।
তাহলে এত তর্ক কেন রামায়ণ আর রামকে নিয়ে? তর্কে অবকাশ তখনই এসে যায়, যখন বিকৃতি আসে। বিকৃতি? হ্যাঁ, বিকৃতি। বাল্মীকিকে সামনে রেখে পরবর্তী কবিরা যথেচ্ছভাবে বিকৃতি করেছেন অনুবাদের ছলনায়। কেউ অনুবাদ করেননি, সকল কবিই নিজের নিজের মনগড়া কাহিনি ফেঁদে বাল্মীকির কাহিনি বলে প্রচার করেছেন। কৃত্তিবাস, তুলসীদাস, রঙ্গনাথন প্রমুখ কবিরা বাল্মীকির রামায়ণে আমূল বিকৃতি করে ফেলেছেন। রামের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর করতে বাল্মীকির রামায়ণের বিকৃতি ঘটিয়েছেন তা নয়, তাঁরা নির্দ্বিধায় বাল্মীকির পরিচিতিকেই কালিমা লেপন করে দিয়েছেন। মহর্ষি মহাকবিকে ঠাঙাড়ে দস্যু, খুনি বানাতে একবারের জন্য কৃত্তিবাসের হাত কাঁপেনি। এ সময় হলে এদের বিরুদ্ধে অনুবাদের নামে তথ্য বিকৃতির অভিযোগ আনা যেত। যাঁরা মূল রামায়ণের বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছেন তাঁরা মহান হলেন কী করে! মিথ্যার আবরণে প্রকত সত্য চিরকালের জন্য চাপা পড়ে গেল, তথাকথিত ধর্মবেত্তা ও বুদ্ধিজীবীরাও মুখ বুজে মেনে নিলেন। কেউ একটা প্রতিবাদ, একটা অভিযোগ করেননি। তাঁরাও গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসিয়ে দিলেন। আর তার ফলেই যত বিপত্তি, যত বিড়ম্বনা।
এ প্রসঙ্গে বীরেন্দ্র মিত্র লিখেছেন- “ইতিহাস কোনোকালেই অবশ্য অবিকৃত থাকে না। কোনো যুগেই সে যুগের অবিকৃত ইতিহাস রচিত ও প্রাপ্তব্য নয়। তা আগেও হয়নি, আজও হচ্ছে না। কারণ, যখনই যিনি অথবা যে বংশ ক্ষমতায় থাকেন, পুরাণ বা ইতিহাস তখন তাঁর অথবা সেই ক্ষমতাধীশ বংশের গুণকীর্তনকারী মিথ্যাভাষণের বিকৃত স্কুপে পরিণত হয়। যশ-পুরস্কারলোভী বুদ্ধিজীবীরা সেই বিকৃতি ঘটিয়ে নিজেদের আখের গোছান। ক্ষমতাধীশের শত্রুপক্ষ এবং সমকক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রকৃত কীর্তি গায়েব হয়ে যায়, ফলে জাতীয় ইতিহাস সর্বযুগেই গদীনসীনের কীর্তিঘোষক পুরাণে পর্যবসিত হয়।”
মূল সংস্কৃত ভাষায় রচিত রামায়ণটিই বাল্মীকির। যদিও বোর মনে করেন, বাল্মীকির রামায়ণের আগে দশরথজাতক’ নামে বৌদ্ধগ্রন্থটি রচিত হয়েছে। বর্তমানে সংস্কৃত ভাষার যে রামায়ণটির সর্বশেষ সংস্করণ আমরা পাই তা যে আদিরূপে নয়, তা প্রায় সব গবেষকই মেনে নিয়েছেন। রামায়ণ একক কোনো বাল্মীকির রচিত নয়। অসংখ্য কবিদের বিভিন্ন সময়ে সংযোজন-বর্জনের মধ্য দিয়েই আজকের রামায়ণ। তবে ভাবতে অবাক লাগে, প্রায় সমমানের কবি আমাদের দেশে এত ছিল। অনেকে মনে করেন, বাল্মীকি বা নারদ কেউ নয়, রামকথার স্রষ্টা রাম নিজেই। পর্যটক নারদ সেটাই প্রত্যক্ষভাবে জানিয়াছেন, বাল্মীকি তাঁর মুখে শুনতে চাইলেন। মনে হয় বাল্মীকি লোকমুখে যা শুনেছিলেন তা সত্য কি না জানার জন্য (verify) সর্বজ্ঞ যোগী নারদকে জিজ্ঞাসা করলেন। অনেকে বলেন, বাল্মীকি নারদের মুখে রাম কাহিনি প্রথম শুনেছিলেন, সুতরাং বাল্মীকি রাম কাহিনির স্রষ্টা নন। প্রচলিত একটি কাহিনি ইত্যাদি। একথা বোধহয় বলা যায় না। কারণ বাল্মীকি জিজ্ঞাসা করলেন
“কো স্বস্মিন্ সাম্প্রতং লোকে গুণবান কশ্চ বীৰ্য্যবান।।
ধর্মজ্ঞশ্চ কৃতজ্ঞশ্চ সত্যাবাক্যো দৃঢ়তঃ” ইত্যাদি।
‘সাম্প্রতম’–বর্তমান সময়ে, ইহলোকে এই ভূখণ্ডে কে এমন ব্যক্তি আছেন যিনি গুণবান বীর্যবান প্রভৃতি গুণসম্পন্ন? নারদ তপঃ স্বাধ্যায়রত’, বাল্মীকিও তপস্বী–উভয়ই জ্ঞানী। যেমন প্রশ্ন–এর উত্তর কি একটি ‘প্রচলিত কাহিনি’ হবে? এটা কি বর্তমান ব্যক্তি, না কল্পিত ব্যক্তি? দশরথ-তনয় রাম যে বাল্মীকির সমসাময়িক, সেটি পূর্বাপর ঘটনাবলির দ্বারাই প্রমাণিত।
কে এই বাল্মীকি? ইনি কি ভার্গব বংশজাত স্বয়ং বাল্মীকি চ্যবণ? ইনি কি অনার্য বংশজাত মহাকবি বাল্মীকি? বস্তুত তাঁর সম্বন্ধে ভরসা করার মতো ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। কৃত্তিবাসের রত্নাকর দস্যু থেকে বাল্মীকিতে পরিণত হওয়ার গল্প তো আগেই আলোচনা করেছি। মূলত হাতের কাছে নিজাম দস্যু বা ডাকাতের নিজামউদ্দিন আউলিয়া হওয়ার ঘটনাকে ঝেড়ে রত্নাকর দস্যু থেকে বাল্মীকির হয়ে যাওয়ার গল্প ফেঁদেছেন কৃত্তিবাস–পাপে পরিপূর্ণ (কতটা পাপ করলে পরিপূর্ণ হয় এবং ‘রাম’ শব্দটি উচ্চারণ করা যায় না, সে ব্যাপারে কোনো নির্দেশিকা কোনো শাস্ত্রে পাই না। রত্নাকর তো কেবলই ডাকাতি করতেন। এবং হত্যা করতেন। অবশ্য মহাপাতক’ বলে একটি শব্দ পাওয়া যায়, বলা হয়েছে তাঁরাই মহাপাতক যাঁরা ব্রহ্মহত্যা, সুরাপান, ব্রাহ্মণের ধন অপহরণ, গুরুপত্নী গমন ইত্যাদি করে।) দস্যু ‘রাম’ উচ্চারণ করতে পারে না। তাই মরা মরা বলতে বলতে উলটো উচ্চারণে ‘রাম রাম’ বলতে শিখেছেন। আসলে বোধহয় কৃত্তিবাস বলতে চেয়েছেন জীবনভর ‘রাম রাম’ জপ করলে শত মহাপাতকও মুক্তি পায়। বাল্মীকি যেকথা লঙ্কাকাণ্ডের শেষ অধ্যায়ে বলেছেন, সেটাই কৃত্তিবাস শুরুতেই বলে নিয়েছেন, যাতে ভক্তপাঠকগণ শুরু থেকেই রামকে ‘ভগবান’ হিসাবে সমীহ করেন। অথচ বাংলা ভাষা ছাড়া আর অন্য কোনো ভাষাতেই, বিশেষ করে সংস্কৃত ভাষাতে মরা’ শব্দ উচ্চারণ করতে করতে মরে গেলেও ‘রাম’ বলার সুযোগ নেই।
বেশিরভাগ বাঙালির কাছে রামায়ণজ্ঞান হল কৃত্তিবাসের শ্রীরাম পাঁচালী’ বা ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ’। বাল্মীকির রামায়ণের সঙ্গে পরিচয় খুব বাঙালিরই আছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণকে যেভাবে পাই কৃত্তিবাস নামক কোনো একজন বিশিষ্ট কবি যে তাঁর কাব্যপুথি গুণগ্রাহীদের হাতে তুলে দিয়ে গেছেন, গবেষণায় এমন কোনো সূত্র পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া পল্লবগ্রাহিতা এবং প্রক্ষিপ্ত রচনার বাহুল্যের জন্য কৃত্তিবাসী রামায়ণ’ অপ্রামাণিকতা দোষে দুষ্ট।
বাল্মীকি যেহেতু রামচন্দ্রের সমসাময়িক, সেই কারণে তাঁর জীবনের বহু ঘটনার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত। তা ছাড়া সীতার শেষ জীবনও কেটেছিল বাল্মীকির আশ্রমে। সুতরাং ধ্যান করার প্রয়োজন নাই, সীতার মুখে বাল্মীকি অবশ্যই রামচন্দ্রের বনবাস জীবনের সকল ঘটনা জেনেছেন। গর্ভবতী অবস্থায় সীতার নির্বাসন ও বাল্মীকির আশ্রমে আশ্রয়লাভ হয়েছিল। সেখানে লবকুশের জন্ম ও কৈশোরকাল অতিবাহিত হয়। যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত শত্রুয় লবণবধের উদ্দেশ্যে মধুপুরী যাওয়ার কালে শ্রাবণ মাসে লবকুশের জন্ম। মথুরায় (মধুপুর) শাসন প্রতিষ্ঠিত করে দশ বছর পরে শত্রুঘ্ন যখন রামচন্দ্রকে দর্শনের উদ্দেশ্যে অযোধ্যা যান তখন একরাত্রি বাল্মীকির আশ্রমে বাস করার কালে রামায়ণ গান শুনেছিলেন। বাল্মীকি স্বয়ং ঐতিহাসিক রামচন্দ্রের সকল ঘটনার সঙ্গে সম্যকভাবে পরিচিত ছিলেন। এরপর আর প্রয়োজন হবে কেন নারদের কাছ থেকে রামকথা শুনে যাচাই করে নেওয়ার?
বাল্মীকি সংস্কৃত সাহিত্যের আদিকবি নামে কথিত। বাল্মীকিকে আদিকবি বা কবিগুরু বলার কারণ, প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, তিনিই প্রথম সংস্কৃত কাব্যে শ্লোকের রচয়িতা। তাঁকে ‘রামায়ণ’ ছাড়াও যোগবাশিষ্ঠ’ নামক অপর এক হিন্দু ধর্মগ্রন্থের রচয়িতাও মনে করা হয়। বাল্মীকিধর্ম ‘রামায়ণ’ ও ‘যোগবাশিষ্ঠ গ্রন্থদ্বয়ে বর্ণিত বাল্মীকির শিক্ষা অবলম্বনে সংগঠিত একটি ধর্মীয় আন্দোলন। মুনিবর শিষ্যগণকে নিয়ে আশ্রমে উপবিষ্ট আছেন, এমন সময়ে ব্রহ্মা উপস্থিত হলেন। তিনি ব্রহ্মাকে ব্যাধ-বৃত্তান্ত বলে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। ব্রহ্মা বললেন–“শোকের সময় এটি তোমার মুখ হতে নিঃসৃত হয়েছে। অতএব, এটি শ্লোক নামে অভিহিত হোক”। তুমি এরূপ শ্লোকে রামচরিত আখ্যায়ক রামায়ণ গ্রন্থ রচনা করো। সেই অনুসারে মুনিবর বাল্মীকি রামায়ণ রচনা করেন। শোক থেকে উৎপন্ন এই সংস্কৃত সাহিত্যের প্রথম শ্লোক। পরবর্তীকালে এই শ্লোকের ছন্দেই বাল্মীকি সমগ্র রামায়ণ রচনা করেন। এই কারণে এই শ্লোকটিকে সংস্কৃত সাহিত্যের প্রথম শ্লোক, রামায়ণকে প্রথম কাব্য ও বাল্মীকিকে ‘আদিকবি’ নামে অভিহিত করা হয়।
এই রামায়ণ ছয়টি (মতান্তরে সাতটি) কাণ্ড বা খণ্ডে বিভক্ত ছিল। রামায়ণের উপজীব্য অযোধ্যার রাজকুমার রামের জীবনকথা। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ থেকে ১০০ অব্দের মধ্যে কোনো এক সময়ে এই মহাকাব্য রচিত হয়। এই মহাকাব্য মহাভারতের পূর্বসূরি। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দী থেকেই বাল্মীকিকে ধ্রুপদি সংস্কৃত সাহিত্যের জনক মনে করা হতে থাকে। অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’ কাব্যে আছে–“বাল্মীকির কণ্ঠস্বর এমন এক কাব্য উচ্চারণ করেছিল যা মহাদার্শনিক চ্যবনও রচনা করতে পারেননি।’ এই উক্তি ও তার পূর্বাপর শ্লোকগুলির বক্তব্য থেকে বাল্মীকি ও চ্যবনের মধ্যে একটি পারিবারিক সম্পর্কের কথা অনুমিত হয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাল্মীকি কর্তৃক রামায়ণ রচনার নেপথ্য-আখ্যান অবলম্বনে ‘বাল্মীকি-প্রতিভা গীতিনাট্যটি রচনা করেছিলেন। তবে বাল্মীকির রামায়ণের শেষভাগে জানা যাচ্ছে যে রামচন্দ্র যশোলাভেই বাল্মীকিকে রামকাহিনি লিখতে বলেছিলেন–“ভগবান! এই সমস্ত ব্ৰহ্মলোকাই ঋষি আমার ভবিষ্যচরিত শুনিতে উৎসুক হইয়াছেন, অতএব আগামীকল্য হইতে তাহা আরম্ভ করুন।”
জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর “রামায়ণের উৎস কৃষি” গ্রন্থে বলেছেন–“শোকবিহ্বল বাল্মীকির কণ্ঠ হতে শ্লোক উগ্নীত হওয়ার পরক্ষণেই ছন্দোবদ্ধ তন্ত্ৰীলয়সমন্বিত অভিশাপ বাণীর মধ্যে বাল্মীকি ‘বেদ অপৌরুষেয়’ এই নির্ণয় করে বিস্মিত হলেন ভেবে নিতে একটু অসুবিধা হচ্ছে। কেননা অভিশাপকালে কি কেউ অভিশাপ বাণীটি ছন্দোবদ্ধ ও তন্ত্ৰীলয়সমন্বিত করে তোলার জন্য সচেতন থাকেন? এও যদি সম্ভব হয় তাহলে বাণীটি উদ্গীত হওয়ার পরক্ষণেই তাৎক্ষণিক পরিবেশ ও ঘটনা ভুলে বাণীটির ছন্দ ও সুর নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করতে পারেন?”
রামায়ণ তথা পৌলস্ত্যবধ কাব্য রচয়িতা বাল্মীকি ছাড়াও আরেকজন বাল্মীকির কথা জানা যায়। তিনি ভৃগুপুত্র চ্যবণ। চ্যবণই হলেন আদি বাল্মীকি। অনেক পণ্ডিতগণ মনে করেন, রামায়ণের রচনা শুরু হয়েছিল আদিকবি চ্যবণেরই হাতে। অশ্বঘোষের মতে, রামায়ণের বাল্মীকি হলেন চ্যবণ অথবা চ্যবণপুত্র অথবা চ্যবণ বংশজাত ভার্গবাকেউ বলেন বাল্মীকি বরুণের পুত্র। বল্মীক মানে উইপোকার ঢিবি, উইপোকার ঢিবি বা বল্মীক আকৃতির মাটির ঘরে বাল্মীকি বাস করতেন এ কাহিনি অনেক জায়গায় পাওয়া যায়। এমন ঘরে বাস করতেন বলেই চ্যবণ মুনি বাল্মীকি নামে পরিচিত ছিলেন। ভারতের একটি অনার্য জাতি বাস করেন, তাঁরা বাল্মীকি, তাঁদের পদবি বাল্মীকি–রামায়ণ রচয়িতা এঁদেরই পূর্বপুরুষ কি না, ভাবা যেতে পারে। অপরদিকে ‘ভিল রামায়ণ’-এর ভিলরা বাল্মীকির বংশধর বলে দাবি করেন। ভিল রামায়ণে বাল্মীকির নাম রত্নাকর ভিল। রামায়ণে উল্লিখিত দক্ষিণ কোশলের (বর্তমানে ছত্রিশগঢ়) যে অঞ্চলে বাল্মীকির আশ্রয় ছিল বলে দাবি করা হয়, সেই অঞ্চলটি মূলত ভিল জাতির আদি বাসস্থান, বিন্ধ্যপার্বত্য অঞ্চল। ঐতিহাসিক রোমিলা থাপার সহ অনেক ঐতিহাসিকই মনে করেন, রামায়ণের রাম-রাবণের যুদ্ধের মূল কাহিনি এসেছে বিন্ধ্য পার্বত্য অঞ্চলের দুই গোষ্ঠীর লড়াই থেকে। তবে নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী বাল্মীকিকে আদিবাসী বা বনবাসী মানুষ বলে স্বীকার করেন না, তাঁর মতে বাল্মীকি ভার্গব ব্রাহ্মণ। অপরদিকে মহাভারতের দ্রোণপর্বের চতুর্থ অধ্যায়ে উল্লেখ আছে–বাল্মীকি একটি জাতিবিশেষের নাম। বাল্মীকি মানে বল্মীকভব। বাল্মীকি কোনো ব্যক্তিবিশেষের নাম নয়। বাল্মীকি হল একটি পদবি এবং বাল্মীকি পদবির মানুষরা ভারতের মুক্তিসংগ্রামের কাহিনি লিখেছেন। বর্তমানে ওরা মেথরের কাজ করেন। বল ধাতু আর কীক প্রত্যয় জুড়ে বল্মীক শব্দটি নিষ্পন্ন হয় (বল + কীক = বল্মীক)। বল ধাতুর সঙ্গে কীক জুড়তে গেলে মাঝে একটি ম আসে, একে বলে বর্ণের আগম বা বর্ণাগম। বল্মীক মানে শুধু উইঢিবি নয়, এখানে বল্মীক মানে সংগৃহীত ঘটনাপরম্পরার স্তূপ।পাণিনি বলেছেন–‘বাল্মীকি বাৎস্যায়ন গোত্রের নাম। বাল্মীকি জাতিরা অধুনা দিল্লির কাছে বসবাস করে এবং এঁরা অস্পৃশ্য। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন–তিনি রাজা দশরথের সমসাময়িক ভৃগুবংশীয় আর্য ব্রাহ্মণ। তাঁর কবিখ্যাতিও সম্প্রসারিত ছিল। সেই খ্যাতি শুনে আর্যদেবতা ব্রহ্মা পদাধিকারী স্বয়ং আসেন তাঁকে রামায়ণ রচনার ভার অর্পণ করতে। কারও মতে বাল্মীকির আগে রামায়ণ রচনার চেষ্টা করেন শতপথ ব্রাহ্মণ ও মহাভারতের পৌরাণিক ঋষি চ্যবন। আচার্য সুনীতিকুমারের মতে, ভৃগুবংশীয় ঋষি চ্যবন বাল্মীকির পূর্বপুরুষ এবং তপস্যাকালে তাঁর বল্মীকস্তূপে পরিণত হওয়ার অলৌকিক কাহিনিটি বাল্মীকির কবিখ্যাতির সুন্দরভাবে মিশে গেছে। মহাভারতের চ্যবনকে ভৃগুপুত্র ভার্গব বলা হয়েছে। ডঃ ভবতোষ দত্ত এ বিষয়ে বলেছেন–ভৃগুবংশে বল্মীকাচ্ছাদিত হওয়ায় কিংবদন্তী থাকায় প্রত্যেকেই বাল্মীকি নামে পরিচিত হতেন। না-হলে বাল্মীকি যুদ্ধকাণ্ডের শেষে কেন লিখবেন–“আদিকাব্যমিদং চার্যং পুরা বাল্মীকি কৃত”, অর্থাৎ পুরাকালে ঋষি বাল্মীকি এই আদিকাব্য রচনা করেছিলেন। স্বয়ং গ্রন্থ রচনা করে বাল্মীকি একথা লিখলেন কেন? তাহলে কি এটি পরবর্তী সংযোজন? নাকি মহাকবি বাল্মীকি স্মরণ করেছেন আর-এক বাল্মীকিকে? তাহলে এই বাল্মীকি কি উত্তরকাণ্ড ও বালকাণ্ডের প্রথমাংশের রচয়িতা, যিনি অযোধ্যাকাণ্ড থেকে লঙ্কাকাণ্ডের বাল্মীকির কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন বা ঋণ স্বীকার করছেন? উত্তরকাণ্ডে বাল্মীকির আশ্রমে সীতার অবস্থান, লবকুশের জন্ম এবং তাঁদের রামায়ণ শিক্ষা, লক্ষ্মণবর্জন, শম্বুক হত্যা, সদলবল মিলে সরযূ নদীতে প্রাণবিসর্জনই প্রধান ঘটনা। দুটো ঘটনাকে মেলানো যায় না। পরের বাল্মীকি হয়তো কেবলমাত্র উত্তরকাণ্ডেরই দর্শক। এই অংশে তাই বাল্মীকির উপস্থিতি লক্ষ করা যায়, যিনি ব্রাহ্মণ্যবাদের পৃষ্ঠপোষক। যেমন অধ্যাত্ম রামায়ণের বাল্মীকি অরণ্যকাণ্ড থেকেই স্বয়ং দর্শক হয়ে উপস্থিত আছেন। সাম্প্রতিককালের পণ্ডিতরা বলছেন সমগ্র উত্তরকাণ্ড এবং বালকাণ্ডের চারটি সর্গ পরে সংযোজিত হয়েছে। এই দুই অংশের ভাষা ও রচনারীতিও স্বতন্ত্র। এ বাল্মীকি নিশ্চয় আদিকবি বাল্মীকি নন। আদিকবি বাল্মীকির রচনা কেবলমাত্র অযোধ্যাকাণ্ড থেকে লঙ্কাকাণ্ড।
গোটা রামায়ণে বাল্মীকি রচিত মহাকাব্য পেলেও, একেবারে শেষ অংশে (উত্তরকাণ্ডে) এসে আমরা বাল্মীকিকেই পেয়েছি। বাল্মীকি এ পর্যায়ে এসে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। গর্ভ লক্ষণাক্রান্ত সীতাকে নির্জন শ্বাপদসংকুল জঙ্গলে লক্ষ্মণ পরিত্যাগ করে এলে তখন বাল্মীকির সঙ্গে সীতার দেখা হয়। পরিত্যক্ত সীতাকে তাঁর আশ্রমে এনে কন্যাস্নেহে পালন করেছিলেন। সীতা এই আশ্রমে প্রায় দশ বছর ছিলেন। এই দশ বছরে সীতার খবর অযোধ্যার কেউ নেয়নি, রামও নয়। তবে কুশ ও লবের জন্মরাত্রে শত্রুয় এসেছিলেন বাল্মীকির আশ্রমে। না, বউদি সীতা এবং ভাইপো দেখতে তিনি আসেননি, এসেছিলেন নিজের কাজে। রাত্রিযাপনের জন্যই কেবল বাল্মীকির আশ্রমকে তিনি ব্যবহার করেছিলেন।
বাল্মীকি সীতার গর্ভজাত যমজ সন্তান কুশ ও লবকে রামায়ণ গানে পারদর্শী করে তুলেছিলেন। একদিন সেই প্রশস্তিমূলক রামায়ণ গান শোনাতে লবকুশকে সঙ্গে নিয়ে রামের যজ্ঞসভায় পৌঁছে যান বাল্মীকি। সীতার ‘আত্মশুদ্ধি’-র পরীক্ষার সময়েও বাল্মীকি রামচন্দ্রের রাজসভায় স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন। বাল্মীকির কাছে দশ বছর যাবৎ আশ্রিতা সীতা দশমবর্ষীয় দুই বালকের মাকে আবার সন্দেহ। যজ্ঞসভায় উপস্থিত সকলের সামনে রামচন্দ্র বললেন–সীতাকে যদি পাপস্পর্শ না-করে থাকে, তাহলে তিনি যেন এখানে উপস্থিত হয়ে আত্মশুদ্ধি করেন। আসলে সীতা বিসর্জনের দশ বছর পরও সীতা এখনও বেঁচে আছেন, এটাই তো রামের কাছে অবিশ্বাস্য। বিগত দশ বছরে রাম একবারের জন্যেও খবর নেননি স্ত্রী বেঁচে আছেন না মরে গেছেন। মনে মনে সীতাহীন জীবন মেনে নিয়েই রাম উদবেগহীন দশ-দশটা বছর কাটিয়ে দিল! তাই সীতাদেবী চোখের আড়াল যেমন হয়েছেন, মনের আড়ালও হয়ে গেছেন।
সীতাকে নিয়ে সভায় আসতে বাল্মীকি সম্মত হয়েছেন। বাল্মীকি সভাস্থলে প্রবেশ করলেন, সঙ্গে সীতাও। সীতাকে শপথ নিয়ে আজ আত্মশুদ্ধি করে সতী কি না প্রমাণ দিতে হবে। বাল্মীকি রামচন্দ্রের অমূলক সন্দেহ নিরসনের চেষ্টা করতে লাগলেন। রাম-রাবণ-বান্দর-ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-শূদ্র সকলেই যখন সীতাকে ‘অপবিত্র’ সাব্যস্ত করেই চললেন, তখন বাল্মীকিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি বললেন–“এই দুই যমজ কুশীলব জানকীর গর্ভজাত। আমি সত্যই কহিতেছি, ইহারা তোমারই ঔরসজাত পুত্র। দেখো, আমি পুত্ৰপরম্পরায় প্রচেতা হইতে দশম। আমি যে কখনও মিথ্যা কহিয়াছি, ইহা আমার স্মরণ হয় না। এক্ষণে আমার বাক্যে বিশ্বাস করো, ইহারা তোমারই ঔরসজাত পুত্র। আমি বহুকাল তপস্যা করিয়াছি, এক্ষণে যদি জানকীর চরিত্রগত অনুমাত্রও ব্যতিক্রম ঘটিয়া থাকে, তবে আমায় যেন সেই সঞ্চিত তপস্যার ফলভোগ করিতে না-হয়। আমি এ যাবৎকাল কায়মনোবাক্যে কখনও পাপাঁচরণ করি নাই; এক্ষণে যদি জানকী নিষ্পাপ হন, তবে সেই পাপ না-করিবার ফল আমায় যেন ভোগ করিতে হয়।…জানকীকে শুদ্ধাচারিণী বুঝিয়া বন হইতে লইয়া আসি। এক্ষণে এই পতিপরায়ণা তোমার মনে আত্মশুদ্ধির প্রত্যয় উৎপাদন করিবেন।” মহামুনি বাল্মীকির শপথবাক্যকে রামচন্দ্র এভাবে হেলায় দূরে ঠেলে দেবে সে কথা স্বয়ং ভাবতে পারেননি। রামচন্দ্র অবিচল, সিদ্ধান্তে অটল। সীতাকে আর কোনো প্রয়োজন নেই। সীতার থাকা আর সীতার যাওয়ার মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই। অতএব চিতা সাজাও এবং পোড়াও। সীতার শেষতম আশ্রয়দাতা বাল্মীকিও সীতাকে রক্ষা করতে পারলেন না। তবে বাল্মীকির উপস্থিতিতেই সীতা রামের আদেশকে অগ্রাহ্য করলেন। তিনি পরীক্ষা দিলেন না। স্পর্শাস্পর্শের বিষয়ে কোনো কৈফিয়ত পর্যন্ত দিলেন না। পৃথিবী বিদীর্ণ হলে তার মধ্যে সীতা প্রবেশ করলেন। এই পাতাল প্রবেশের ঘটনা হরপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মতে, “বাস্তব অবস্থার পটভূমিকায় একথা মনে করা বোধহয় অসংগত হবে না যে, যজ্ঞস্থলের কোনো খনিত কূপে অথবা কোনো যজ্ঞকুণ্ডে আত্মবিসর্জন দিয়েছিলেন সীতা।” বাল্মীকির আশ্রমে বাস করেও সীতা রেহাই পেলেন না৷ আসলে লঙ্কা জয়ের পর (ভুল বললাম। লঙ্কা জয়ের পর নয়, আরও অনেক আগে রাবণ কোলে চাপিয়ে সীতাকে হরণের কাহিনি জটায়ুর কাছ থেকে শোনার পর থেকেই। “অঙ্ক, আরোপ্য তু পুরা রাবণেন বলা ধৃতা”–ওহে সীতা, তোমাকে তো রাবণ কোলে তুলে নিয়ে গিয়ে তাঁর রথে চাপিয়ে ছিল। সুতরাং তোমার সতীত্ব তো প্রশ্নাতীত নয়া) থেকে রাম সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন যে তিনি আর স্ত্রীকে গ্রহণ করবেন না। তাই তিনি তিন-তিনবার নিজের স্ত্রীকে সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন। একবার শ্বাপদসংকুল গভীর জঙ্গলে, দু-বার লেলিহান আগুনে। সিদ্ধান্ত যখন পূর্বেই স্থির হয়ে আছে, তখন বাল্মীকি কেন স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু এলেও তা নড়চড় হওয়ার উপায় নেই। এ কোন্ রাম, যিনি বাল্মীকিকে অপমান করেন, নিজপুত্রদের স্বীকার করেন না! নিশ্চয় এ রাম সেই প্রেমিক রাম নয়, রাজা রাম বটে! অবাক হই না, কারণ পূর্বে তিনি সর্বসমক্ষে বলেই দিয়েছেন “কুকুরে চাটা ঘি ভোগ করা যায় না”। অতএব ‘আপ রুচি খানা, পর রুচি পরনা। তবে অনেকে মনে করেন উত্তরকাণ্ডের বাল্মীকি আদি কবি নন, ইনি তৎকালীন জনৈক প্রচেতা বংশীয় দশম পুরুষ। অতএব উত্তরকাণ্ডের ঘটনাগুলি ইতিহাস বলে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া যায় কি? কেন নয়? প্রক্ষিপ্ত হতেই পারে। তাই বলে ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই একথা বলা যায়। ব্রাহ্মণ্যবাদের উত্থান এই পর্বতেই, যা ঐতিহাসিকভাবে সত্য।
মুনিবর বাল্মীকির শেষ পরিণতি বা মৃত্যু সম্বন্ধে কিছুই জানা যায় না।
রামায়ণে মুনি-ঋষি-ব্রাহ্মণের আধিপত্য
বাল্মীকির রামায়ণে বেশকিছু মুনিঋষিদের উপস্থিতি লক্ষ করি আমরা। এই মুনিঋষিরা শুধু রামায়ণেই আছেন, তা নয়। এঁরা মহাভারতে যেমন আছেন, তেমনই বিভিন্ন পুরাণেও আছেন। কী করে থাকেন যুগ থেকে যুগান্তরে? তাহলে তো তাঁদের বয়স হাজার হাজার হওয়ার কথা। বার্ধক্য নিয়ে অমরত্ব বলেও কিছু হয় না। সেটা ভাবলে কি বাস্তবোচিত হয়? লক্ষ করবেন পাঠক, এইসব মুনিঋষিরা সকলেই একই সঙ্গে বয়োবৃদ্ধ, জ্ঞানবৃদ্ধ। অতএব বিশ্বামিত্র, বশিষ্ঠ, অগস্ত্য প্রমুখ ব্যক্তি মনে হয় না কোনো একজন ব্যক্তি নন, একাধিক ব্যক্তির পদ (Designation)। এই ধরনের পদে একমাত্র বয়োবৃদ্ধ ও জ্ঞানবৃদ্ধ ব্যক্তিরাই উন্নীত হতে পারেন। যেমন আধুনিক সময়ে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, রাজ্যপালের মতো পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিরা বয়োবৃদ্ধ ও জ্ঞানবৃদ্ধই হয়ে থাকেন। তাই ব্যক্তি না-থাকলেও পদ থেকে যায় যুগে যুগে। সেই পদে অন্য যোগ্যতম ব্যক্তি আসীন হন। বশিষ্ঠ, অগস্ত্য ইত্যাদি পদগুলি প্রাচীন যুগে ব্রাহ্মণদের সর্বোচ্চ পদ। অসীম ক্ষমতা ভোগ করতেন তাঁরা। শুধু মুনিঋষিরাই নয়–ব্রহ্মা, ইন্দ্র, শিব, মনু, বেদব্যাস, এমনকি পোপ, শঙ্করাচার্য, দলাইলামাও পদের নাম। কোনো একজন ব্যক্তি নয়।
বিশ্বামিত্র, বশিষ্ঠ, অগস্ত্য, দ্রোণাচার্য, মার্কণ্ডেয় প্রমুখ মুনিঋষিরা ছিলেন প্রচণ্ড যুদ্ধবাজ। এঁদের কাছে প্রচুর মারণাস্ত্র মজুত থাকত। এঁরা নির্জনে বসে আর্যদেবতাদের অস্ত্রাগার (সামরিক ঘাঁটি) পাহারা দিতেন। রামচন্দ্র বনবাসজীবনে এইসব মুনিঋষিদের ঘাঁটিতে গেছেন, আর প্রচুর মারণাস্ত্র সংগ্রহ করেছেন। আশ্রম তো নয়, যেন এক-একটা কেল্লা। কোনো গল্পকথা নয়, এসব বিবরণ পুরাণেই স্পষ্ট করে উল্লেখ আছে। এইসব অস্ত্রাগার লুঠ করার জন্যই নিশাচররা অতর্কিতে হামলা করতেন। নিজেরা নিরুপদ্রব রাখতেই অযোধ্যা থেকে বিশ্বামিত্র বয়ে এনেছিলেন রামচন্দ্রকে, নিশাচরদের হত্যা করার জন্য। হত্যা করার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র বিশ্বামিত্রই দিয়েছিলেন। মুনি-ঋষিদের আমি ‘ঘাঁটি’ বলেছি। ঘাঁটি কেন বললাম? আশ্রম বলা হয় লোকমুখে, এইসব আশ্রম মানে কোনো পর্ণকুটীর নয়। আশ্রম মানে শুধু ধ্যান করার নির্জন স্থান বোঝায় না। এখানে রীতিমত শ্রম দিতে হয়। আশ্রমগুলি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বলা যেতে পারে। এখানে এক বা একাধিক শিক্ষাগুরু থাকতেন। এখানকার শিক্ষার্থীদের শাস্ত্র, সাহিত্য, ব্যাকরণ, রাজনীতি, যুদ্ধবিদ্যা ইত্যাদি শিক্ষাদানের ব্যবস্থা হত। ছিল অস্ত্রাগার। মারাত্মক সব অস্ত্রের ভাণ্ডার ছিল আশ্রম। এই আশ্রমগুলোর ব্যয়ভার সংশ্লিষ্ট রাজ্যের রাজা বহন করতেন। কিংবা রাজপ্রদত্ত ভূসম্পত্তি ও গোসম্পত্তি থেকে আহূত সম্পদের মাধ্যমে মেটানো হত।
বিশ্বামিত্র : ঋগ্বেদ রচয়িতা হিসাবে এক ঋষি বিশ্বামিত্রের নাম পাওয়া যায়, যাকে মোট ১৮ সূক্তের একক ও ৬ সূক্তের রচয়িতা হিসাবে পেয়েছি। পরবর্তীকালে ভারতীয় সংস্কৃত পুরাণ ও সাহিত্যের কাহিনিতে এ নামে প্রচুর কল্পগাথা বর্ণিত হয়েছে। ইনি যেমন আছে ত্রেতাযুগের বাল্মীকির রামায়ণের বালকাণ্ড অধ্যায়ে, তেমনই আছে দ্বাপরযুগের কৃষ্ণদ্বৈপায়ণের মহাভারতের আদি পর্বেও। ব্ৰহ্মর্ষি বলেই তিনি খ্যাত। কারণ ক্ষত্রিয়কুলে জন্মগ্রহণ করেও কঠোর তপস্যাবলে ইনি ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেন। ইনি সপ্তর্ষিদের তৃতীয় মণ্ডলের সমস্ত সূক্তের মন্ত্রগুলির অভিবক্তা। বিশ্বামিত্র কখনোই ব্রাহ্মণ্যধর্মকে অস্বীকার করেননি। বরং যজ্ঞ ও দক্ষিণার ব্যাপারে ক্ষত্রিয়দের ভাগীদার করতে চেয়েছিলেন। এই ইস্যুতে সমস্ত ক্ষত্রিয়দের নিয়ে জোট বেঁধেছিলেন তিনি। ব্রাহ্মণদের একা খেতে দিতে নারাজ ছিলেন তিনি। বারবার তিনি ব্রাহ্মণদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছেন। হরিবংশ প্রভৃতি পুরাণে বিশ্বামিত্র পৌরব, কৌশিক, গাধিজ ও গাধিনন্দন প্রভৃতি নামে অভিহিত হয়েছেন। রাজা হরিশ্চন্দ্রের চণ্ডাসত্বপ্রাপ্তি ও রাজ্যনাশ, স্ত্রী-পুত্র বিক্রয় ইত্যাদি ঘটনার পিছনে বিশ্বামিত্রই দায়ী ছিলেন।
জানা যায় মহর্ষি বিশ্বামিত্র ছিলেন প্রাচীন ভারতে একজন রাজা ছিলেন। এছাড়া তিনি ‘কৌশিক’ নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি অসমসাহসী যোদ্ধা। ইনি ব্রহ্মার মানসপুত্র প্রজাপতি কুশ নামক এক রাজার প্রপৌত্র ও ধার্মিক কুশনাভ রাজার পুত্র গাধির সন্তান ছিলেন মহর্ষি বিশ্বামিত্র। বাল্মিকীর রামায়ণের বালকাণ্ডের ৫১ চরণে এ বিষয়ে লেখা আছে। গাধিরাজের মৃত্যুর পর বিশ্বামিত্র রাজসিংহাসনে আরোহণ করেন এবং বীরবিক্রমে রাজ্যশাসন করতে থাকেন। তিনি অতুল ঐশ্বর্য ও বিপুল ধন-সম্পদের অধিকারী ছিলেন। এছাড়াও তাঁর শতাধিক পুত্র ও অসংখ্য সৈন্য ছিল জানা যায়। বিশ্বামিত্রের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠের সঙ্গে বিরোধ। বিশ্বামিত্র-বশিষ্ঠের এই বিরোধের জল যে কতদূর গড়াতে পারে, তা বাল্মীকির রামায়ণেই প্রমাণ পেয়েছি। শুধু বাল্মীকির রাময়ণেই নয়, এই বিরোধের কথা ঋগ্বেদে অনেকবার উল্লিখিত হয়েছে। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের মধ্যে যে আধিপত্য ও শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব চলেছিল, তা রক্তপাত ও বিচ্ছেদেই শেষ হয়েছে।
বিশ্বামিত্র কোনো একদিন এক অক্ষৌহিণী সেনা (১০৯৩৫০ পদাতিক, ৬৫৬১০ ঘোড়া, ২১৮৭০ হাতি এবং ২১৮৭০ রথ) ও পুত্রদেরকে সঙ্গে নিয়ে মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রমে উপস্থিত হলে বশিষ্ঠ মুনি কামধেনু নন্দিনীর। (আর-এক নাম সবলা) সাহায্যে উপস্থিত সকলকে পূর্ণ তৃপ্তিসহকারে ভোজন করান। একটি সাধারণ আশ্রমে এত বিপুলসংখ্যক লোকের খাদ্য সরবরাহের বিষয়ে বিশ্বামিত্র আগ্রহী হয়ে কামধেনুর অবিশ্বাস্য গুণাবলি জেনে বশিষ্ঠের কাছে তা প্রার্থনা করেন। বশিষ্ঠ জানান যে, নন্দিনী হচ্ছে ইন্দ্রের কামধেনুর কন্যা, এর সাহায্যে যখন যা চাওয়া হয় তাই-ই পাওয়া যায়। বিশ্বামিত্র সবলাকে নিতে চাইলে বশিষ্ঠ কামধেনুকে দান করতে অস্বীকার করেন এবং উভয়ের মধ্যে তুমূল বাদানুবাদ ও তীব্র বিবাদের সৃষ্টি হয়। বিশ্বামিত্র তাঁর সুদক্ষ সৈনিকদের সহায়তায় বলপূর্বক কামধেনুকে কেড়ে নিতে উদ্যত হলে ঋষিবর সবলার সাহায্যে অসংখ্য সৈন্য সৃষ্টি করে রাজার সমস্ত সৈন্যদল ধ্বংস করে ফেলেন। এছাড়াও অন্যান্য রাজপুত্র বশিষ্ঠকে আক্রমণ করতে এগিয়ে এলে। মহর্ষি ব্রহ্মতেজে বিশ্বামিত্রের শতপুত্রকে দগ্ধ করে মেরে ফেলেন। বিশ্বামিত্র এরূপে সৈন্যবিহীন অবস্থায় ও শতপুত্রশোকে কাতর হয়ে নিজ রাজধানীতে ফিরে এসে অবশিষ্ট এক পুত্রের কাঁধে রাজ্যের শাসনভার প্রদান করে বনে চলে যান এবং শিবের কঠোর তপস্যায় মনোনিবেশ করেন। শিব বিশ্বামিত্রের তপস্যায় অতি সন্তুষ্ট হয়ে বর প্রদানে উপস্থিত হলে বিশ্বামিত্র তার কাছে মন্ত্রসহ সাঙ্গোপাঙ্গ ধনুর্বেদ সম্পূর্ণ আয়ত্ত করে নেন। পয়ে তিনি মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রমে পুনরায় গিয়ে পোবন নষ্ট করে ফেলেন এবং পরে ঋষিবরের উপর পুনরায় অস্ত্রবর্ষণ করেন। কিন্তু বশিষ্ঠ ব্ৰহ্মদণ্ড হাতে নিয়ে বিশ্বামিত্রের সমস্ত অস্ত্রের মোকাবিলা করেন। এরূপে হতমান ও হতদর্প হয়ে বিশ্বামিত্র অস্ত্রবলের চেয়ে ব্রহ্মবলের শ্রেষ্ঠত্ব উপলদ্ধি করেন এবং নিজে ব্রাহ্মণত্ব লাভ করার জন্য চেষ্টা করতে লাগলেন। সেজন্য তিনি পত্নীসহ দক্ষিণে গমন করে কঠোর তপস্যা করতে লাগলেন। এ সময়ে তাঁর আরও তিন পুত্রের জন্ম হয়। অনেক অনেক বছর পরে ব্রহ্মা স্বয়ং উপস্থিত হয়ে বিশ্বামিত্রকে রাজর্ষিত্ব প্রদান করেন। দীর্ঘকাল পরে ব্রহ্মা বিশ্বামিত্রের কাছে উপস্থিত হয়ে তাকে মহর্ষিত্ব প্রদান করেন। কিন্তু ব্রহ্মা তাকে বললেন, “তোমার সিদ্ধিলাভের বহু বিলম্ব আছে, কারণ তুমি এখনও ইন্দ্রিয় জয় করতে পারনি।” এ কথা শুনে মহর্ষি পুনরায় চূড়ান্ত তপস্যায় প্রবৃত্ত হলেন। এ সময়ে বিশ্বামিত্রের তপোভঙ্গ করার লক্ষ্যে দেবরাজের আদেশে স্বৰ্গবেশ্যা রম্ভা সমাগতা হলে মহর্ষি তাকে শাপ প্রদানে দীর্ঘকালের নিমিত্ত পাষাণে পরিণত করেন। উপরন্তু ক্রোধের কারণে তপস্যার ফল নষ্ট হয়েছিল।
অতঃপর বিশ্বামিত্র পূর্বদিকে গিয়ে পুনরায় তপস্যা করতে লাগলেন। এর অনেক বছর পরে ব্রহ্মা তাঁর সামনে এসে উপস্থিত হন এবং তাঁকে ব্রাহ্মণত্ব প্রদান করেন। বিশ্বামিত্র ক্ষত্রিয় থেকে ব্রাহ্মণে কনভার্ট হলেন। বিশ্বামিত্র ব্ৰহ্মর্ষিত্ব প্রাপ্ত হয়ে দীর্ঘ পরমায়ু, চতুর্বেধ এবং ওঙ্কার লাভ করে মনোরথসিদ্ধি হওয়ায় আনন্দসাগরে ডুবে রইলেন। এইসময় ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজা ত্রিশঙ্কু সশরীরে স্বর্গে গমন করার অভিলাষে বশিষ্ঠের শরণাপন্ন হন। কিন্তু বশিষ্ঠ ও তাঁর পুত্ররা তাঁকে সাহায্য করতে অসম্মত হন। এর ফলে রাজা ত্রিশঙ্কু বিশ্বামিত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিস্তারিত জানান। বিশ্বামিত্র নিজ পুণবলে ত্রিশঙ্কুকে সশরীরে স্বর্গে প্রেরণ করেন বটে, কিন্তু কোনো লাভ হয় না। কারণ ইন্দ্রাদি দেবগণ ক্রুব্দ হয়ে ত্রিশঙ্কুকে নতমস্তকে স্বর্গ থেকে মর্ত্যে ফেরত পাঠিয়ে দেন। ত্রিশঙ্কুর এহেন পতনে বিশ্বামিত্র ক্রুব্ধ হয়ে স্বীয় তপোবলে তাঁকে শূন্যে স্থাপন করে দ্বিতীয় স্বর্গ সৃষ্টি করতে আরম্ভ করে দিলেন। বিশ্বামিত্রের এই কাজে দেবতারা আধিপত্য খোয়ানোর ভয়ে বিপন্ন হয়ে পড়ার ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে। পড়েন এবং যথারীতি তারা থরহরিকম্পে বিশ্বামিত্রের শরণাপন্ন হন। অবশেষে এক ড্রিল হয়–আকাশে জ্যোতিশ্চক্রের বহির্দেশে অধঃশিরা ত্রিশঙ্কু দেবতুল্যরূপে অবস্থান করবেন এবং নক্ষত্রগণ তাঁর অনুসরণ করবে।
ব্ৰহ্মার ঋষিত্ব প্রদানে সন্তুষ্ট না-হয়ে বিশ্বামিত্র আরও উগ্রতর তপস্যায় প্রবৃত্ত হলেন। দেবতারা ভয় পেয়ে মহাসুন্দরী স্বৰ্গবেশ্যা মেনকাকে লেলিয়ে দিলেন বিশ্বামিত্রের তপস্যা ভাঙতে। মুনি-ঋষি হলেও তাঁরা যে সর্বদাই কাম দ্বারা বশীভূত, সে-কথা তথাকথিত দেবতারাও জানতেন। যাই হোক, বিশ্বামিত্র যখন তপস্যায় প্রবৃত্ত হলেন, তখন মেনকা সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে পুষ্করতীর্থে স্নান করতে থাকলেন। বিশ্বামিত্র তাঁর রূপে কামজ্বরে বিচলিত হয়ে পড়েন এবং টানা ১০ বছর সহবাস করেন। এই সহবাসের ফলে মেনকা গর্ভবতী হয়ে পড়েন। মেনকার গর্ভের সেই সন্তানই শকুন্তলা। এই কন্যাসন্তান শকুন্তলাকে জঙ্গলে পরিত্যক্ত করে মেনকা স্বর্গে ফিরে যান, আর বিশ্বামিত্র ওই স্থান ত্যাগ করে উত্তরদিকে হিমালয়ের কৌশকী নদীর তীরে আবার তপস্যায় বসেন এবং অবশেষে ব্রহ্মার বরে মহর্ষিত্ব প্রাপ্ত হন।
মার্কণ্ডেয় ও অন্যান্য পুরাণে আছে–হরিশ্চন্দ্রকে কেন্দ্র করেও একবার বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্রের উপর ক্ষুব্ধ হন। ফলে পরস্পর পরস্পরকে অভিশাপ দেন এবং সেই অভিশাপের ফলে দুজনেই পক্ষীতে পরিণত হয়ে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন। অতঃপর ব্রার মধ্যস্থতায় এঁদের বিরোধের অবসান ঘটে। ব্রাহ্মণকুলের প্রাণভোমরা “ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ তৎ সবিতুর্বরেণ্যং ভর্গো দেবস্য ধীমহিধিয়ো যো নঃ প্রচোদ্দয়াৎ।” (বাংলা তর্জমা : আমরা সেই পরম সৃষ্টিকর্তার প্রশংসা করছি–যিনি যুদ্ধের শক্তিদায়ক, যিনি সমস্ত জ্ঞানের উৎসস্থল, যিনি উজ্জ্বল আলোকবর্তিকাস্বরূপ। তিনি যেন আমাদেরকে প্রভূত বিচার বুদ্ধি শক্তি প্রয়োগ করার ক্ষমতা দেন।)–এই প্রসিদ্ধ গায়ত্রী মন্ত্রটির রচয়িতা ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র।
বিশ্বামিত্রের যজ্ঞনাশের জন্য রাক্ষসজাতিরা সর্বদা সচেষ্ট ছিল। রাক্ষসদের অত্যাচারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে অযোধ্যায় এসে রাজা দশরথের সঙ্গে দেখা করেন বিশ্বামিত্র এবং দশরথের অনুমতিগ্রহণপূর্বক তিনি রাম ও লক্ষ্মণকে দশ রাত্রির মেয়াদে নিজের আশ্রমে নিয়ে গিয়ে তাঁদের অবলা ও অতিবল মন্ত্র শিক্ষা দেন এবং দিব্যাস্ত্র সকল দান করেন। এর ফলে রাম ও লক্ষ্মণ তাড়কা রাক্ষুসী সহ অসংখ্য রাক্ষস হত্যা করেন। এরপর দুই ভাইকে নিয়ে বিশ্বামিত্র চললেন জনকপুরীতে। পথে অবশ্য গৌতম মুনির আশ্রমে রামকে দিয়ে অহল্যার পাষাণমুক্তির কাজটাও করিয়ে নেন বিশ্বামিত্র।
দশরথের কুলগুরু ছিলেন বশিষ্ঠ। তা সত্ত্বেও বিশ্বামিত্রের কাছেই রামকে দীক্ষিত করেছিলেন দশরথ। এই কাহিনির মধ্যে বিশ্বামিত্রের এইভাবেই আকস্মিক প্রবেশ ঘটেছে। বশিষ্ঠকে অগ্রাহ্য করে দশরথ বিশ্বামিত্রকে কতটা পাওয়ার দিয়েছিলেন, তা বোঝা যায়, দশরথের অজ্ঞাতসারে বিশ্বামিত্রের রামের বিবাহ সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার মধ্য দিয়ে। রামের বিবাহের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন কে পিতা দশরথ নয়, গুরু বিশ্বামিত্র। বশিষ্ঠ কুলগুরু হওয়া সত্ত্বেও রাজা দশরথ ছিলেন বিশ্বামিত্রের সমর্থক। অবশ্য একথা বশিষ্ঠ যে বোঝেননি, তা নয়। তাই বিশ্বামিত্রের সঙ্গে রামকে পাঠানোর জন্য দশরথকে নির্দেশ দিয়েছিলেন বশিষ্ঠ। কেন এত উদার হলেন বশিষ্ঠ? বিশ্বামিত্র তো তাঁর মিত্র নন, বরং চরম শত্রু। তাঁর শতপুত্র হত্যাকারী বিশ্বামিত্রের সঙ্গে পাঠাতে দ্বিমত পোষণ করলেন না কেন? হরপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এ বিষয়টা স্পষ্ট করে দিলেন–“রাম যেহেতু বিশ্বামিত্রের সমর্থক, রাক্ষসদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে রামকে প্রেরণের ব্যাপারে বশিষ্ঠ তাই বিন্দুমাত্র দ্বিধা করলেন না। বালক রামের মরা-বাঁচা, মঙ্গল-অমঙ্গলের চিন্তা তাঁর মনে স্থান পেল না। সম্ভবত রামের প্রতিপক্ষ সিংহাসনের ন্য দাবিদার ভরতের ভবিষ্যৎ নিষ্কণ্টক করার জন্যই বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্রের প্রস্তাবকে স্বাগত জানালেন।” কারণ বশিষ্ঠ ছিলেন ভরতের সমর্থক এবং রামের বিরোধী।
রাম বিশ্বামিত্রের একান্ত অনুগত। রাম এখন বিশ্বামিত্রের ছায়াসঙ্গী। হ্রস্বরোমনের পুত্র জনকরাজা সীরধ্বজ ঘোষণা দিয়েছেন–“যে ব্যক্তি এই হরকামুকে জ্যা আরোপণ করিতে পারিবেন আমি তাহাকেই এই কন্যা দিব।” এ ঘোষণা বিশ্বামিত্রের কানেও পৌঁছোয়। বিশ্বামিত্রের অগাধ বিশ্বাস, এ কাজ অপরিসীম বলশালী রামের পক্ষেই সম্ভব। অতএব রাম-লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্বামিত্র মিথিলায় চললেন। রামচন্দ্র হরধনু ভঙ্গ করতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং সীরধ্বজের কন্যা সীতার পাণিগ্রহণ করেছিলেন। এখানে ভাবার বিষয়, বিশ্বামিত্র দশদিনের জন্য রাম-লক্ষ্মণকে অরণ্যে এনেছিলেন যজ্ঞ রক্ষার জন্য রাক্ষসদের শায়েস্তা করতে। তারপর কাজ মিটে গেল যথারীতি দশরথের কাছে রামকে প্রত্যপর্ণ করার কথা। অযোধ্যার রাজসভায় এমনই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বিশ্বামিত্র। কিন্তু তাই বলে বিয়ে? এটা কি পুরোনো সেই ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের বিরোধটাকে খুঁচিয়ে তোলা? রামের বিবাহের ব্যাপারে দশরথ কোনো দায়িত্ব বিশ্বামিত্রে দেননি। এ দায়িত্ব নিয়ম অনুযায়ী পিতা হিসাবে দশরথের। কুল-পুরোহিত বামদেব বা কুলগুরু বশিষ্ঠের উপর সে দায়িত্ব অর্পণ হতে পারে। তবে কি সুযোগ বুঝে বশিষ্ঠকে এক হাত নিয়ে নেওয়া? বুদ্ধিমানরা সুযোগই হাতছাড়া করেন না, তবে শেষরক্ষা না-হলে সব মাঠে মারা যায়। ঘোড়া যেন আগেই ফুঁ না দিয়ে দেয়! বিশ্বামিত্রেরও শেষরক্ষা হয়নি।
দশরথ কিংবা বামদেব কিংবা বশিষ্ঠের অনুমতির অপেক্ষা না-করেই জনকরাজা সীরধ্বজের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে দিলেন বিশ্বামিত্র। তাই বলে দশরথকে তিনি অন্ধকারেও রাখেননি। অতএব দূত প্রেরণ করে দশরথকে সংবাদ পাঠান–“আপনি মিথিলা রাজ্যে আগমন করিলে পুত্রদ্বয়েরই বিবাহ মহোৎসব উপভোগ করিতে পারিবেন। সংবাদ শুনে অনুযোগ তো দূরের কথা, উলটে খুবই আনন্দিত হয়ে দশরথ পাত্রমিত্র সমভিব্যাহারে মিথিলার পথে রওনা দিলেন। পরে অবশ্য বিনা নিমন্ত্রণে অনাহূতের মতো অযোধ্যায় বিবাহের আসরে হাজির ভরত-মাতুল যুধাজিৎ, ভরত, শত্রুঘ্ন, বশিষ্ঠ প্রমুখেরা। তাই জনককন্যা সীতা ও ঊর্মিলার সঙ্গে যথাক্রমে রাম লক্ষ্মণের বিবাহ হলেও বশিষ্ঠপন্থী কুশধ্বজের কন্যাদ্বয় মাণ্ডবী ও শ্রুতকীর্তির সঙ্গে যথাক্রমে ভরত ও শত্রুঘ্নর বিবাহ সম্পন্ন হয়ে যায়। এর ফলে বশিষ্ঠের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে বিশ্বামিত্রের হটে যাওয়া। হটে যাওয়া এখানেই শেষ নয়, শুরু।
বশিষ্ঠকে পঙ্গা! ভরতপন্থী বশিষ্ঠের পরাজয় হলে তো এতদিনের প্রয়াস সব ব্যর্থ হয়ে যাবে! বিশ্বামিত্র যদি একটিবার রাম-লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে অযোধ্যায় পৌঁছে যেতে পারে তাহলে তো সব চক্রান্তে জল পড়ে যাবে। ভরতদের অযোধ্যায় এনে বিবাহ দিয়ে বশিষ্ঠ অনেকটাই সফল। এতটা এসে মাঝপথে নৌকা উল্টে যাবে! অযোধ্যা পথে রওনা দেওয়ার সময় বিশ্বামিত্র হঠাৎই অন্তর্ধান হলেন। যাত্রার প্রাক্কালে বশিষ্ঠকে ন্যূনতম সৌজন্য পর্যন্ত দেখাননি বিশ্বামিত্র। রামায়ণকার জানালেন–“পরদিন প্রভাতে মহর্ষি বিশ্বামিত্র রাজা দশরথ ও জনককে সম্ভাষণপূর্বক হিমাচলে প্রস্থান করিলেন।” যিনি এত উদ্যোগ করে এত কিছু করলেন তাঁর হঠাৎ বৈরাগ এলো কেন? রহস্য কী? বশিষ্ঠ-যুধাজিৎ-ভরতের থ্রেড? কী এমন ভয়ংকর পরিণতি ঘটে গিয়েছিল যে, বিশ্বামিত্রকে অন্তর্হিত হতে হল? গোটা রামায়ণে বিশ্বামিত্র আর ফিরে আসেননি। এমনকি রাম যখন রাজা হয়ে ব্রাহ্মণ পরিবৃত্য সারা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণরা যখন রামের রাজসভা অলংকৃত করে আছেন, তখনও বিশ্বামিত্র নেই। রামও বিশ্বামিত্রের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। রাম-সীতার বিবাহের মুখ্য যোগাযোগকারী বিশ্বামিত্র পরিশেষে মহাকাব্যে উপেক্ষিত হলেন কেন? এ ঘটনা কি রামচন্দ্রের অকৃতজ্ঞতাই প্রকটিত হয়নি! রাজনীতিতে সব সম্ভব।
বশিষ্ঠ জানতেন, অতি সত্বর অযোধ্যায় ক্ষমতা হস্তান্তর হবে, এসময় বিশ্বামিত্রের উপস্থিতি মোটেই সুখকর হবে না। একথা নিশ্চিত, কোনোভাবে বিশ্বামিত্র অযোধায় পৌঁছোতে পারলে তাঁর প্রভাব খাঁটিয়ে দশরথের মৌনতাকে সরিয়ে দিয়ে রামের বনবাসে স্থগিত ঘটিয়ে রাজ্যভার রামের হাতে তুলে দিতেন। কারোর কিছু বলার থাকত। কারণ প্রথা অনুযায়ী রামই যোগ্যতম এবং প্রধান দাবিদার। এর ফলে দশরথের অকাল মৃত্যু হত না, সীতা অপহরণ ও সতীত্বহানি হত না, বালীর অনর্থক মৃত্যু ও সুগ্রীবের রাজ্যলাভ এবং বউদি-ভোগ হত না, রাম রাবণের বিধ্বংসী যুদ্ধও হত না, বিভীষণের রাজ্যলাভ ও বউদি-ভোগ হত না। সবচেয়ে বড়ো কথা ভরতের এ জন্মে আর রাজা হওয়া হত না। বশিষ্ঠও কোণঠাসা হয়ে পড়ত। বিশ্বামিত্র অযোধ্যা ফিরলে অযোধ্যার যা পরিস্থিতি ছিল, তাতে রামায়ণ না-হয়ে আর-একটা মহাভারত হয়ে যেত। আরও একটি ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের মহাকাব্য রচিত হত। কারণ বশিষ্ঠ-ভরত-কেকয়-যুধাজিৎ-কৈকেয়ী বিনাযুদ্ধে এক ইঞ্চি জমি ছাড়তেন না। ফলে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ সংঘটিত হত এবং সেই যুদ্ধে রাম অবশ্যই জয়লাভ করতেন।
মিথিলায় বিশ্বামিত্রের অন্তর্ধানের ফলে সে ঘটনা ঘটতে পারেনি। ঠিক ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাক্কালে বিশ্বামিত্রের অন্তর্ধান নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তর্ধানের ঘটনাটা মনে পড়িয়ে দেয়। নেতাজিও অন্তর্হিত হয়েছিলেন ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রায় প্রাক্কালেই। নেতাজির প্রতিপক্ষ তখন নেহরু, গান্ধি, জিন্নাহ। স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান কে হতেন, যদি নেতাজির অন্তর্ধান না-হতেন? দেশভাগ হয়ে পাকিস্তানের জন্মও হয়তো সম্ভব হত না।
বশিষ্ঠ : বশিষ্ঠ মুনিকে রামায়ণ, মহাভারত, বেদ, বিভিন্ন পুরাণে সর্বত্র বিচরণ করতে দেখা যায়। যুগ থেকে যুগান্তরে এইসব মুনিঋষিদের যেন বয়সের কোনো গাছপাথর নেই। ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য যে কতটা তীব্র ছিল, তা মুনিঋষিদের দৌরাত্ম্য দেখেই অনুধাবন করা যায়। এতটাই দৌরাত্ম্য যে, কখনো কখনো দোর্দণ্ডপ্রতাপ ক্ষত্রিয়রাও পুতুলে পরিণত হয়ে যায়। বাল্মীকি রামায়ণেও তিনি সক্রিয় অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছেন।
বশিষ্ঠ মিত্রাবরুণের পুত্র, তাই বশিষ্ঠের অন্য নাম মৈত্রাবরুণি। অথর্ববেদের আধার মহর্ষি বশিষ্ঠ ছিলেন সূর্যবংশীয় অযোধ্যা-রাজগণের কুলগুরু। হরিবংশ মতে ইনি ব্রহ্মার মানসপুত্র। পুরাণান্তরে ইনি আবার সপ্তর্ষিগণের মধ্যেও একজন। জানা যায়, বশিষ্ঠের সহযোগিতায় অভিশাপে রাক্ষসযোনিপ্রাপ্ত ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজা সৌদাস শাপমুক্ত হন। কোথাও উল্লেখ আছে, রামচন্দ্রের কাছে যে রামায়ণ কীর্তন করেন, তা ‘যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণ’ বলে খ্যাত।
বিষ্ণুপুরাণ থেকে জানা যায়–রাজর্ষি নিমি একবার দীর্ঘ যজ্ঞানুষ্ঠানের জন্য বশিষ্ঠকে পুরোহিতরূপে বরণ করেন। কিন্তু তার আগেই বশিষ্ঠ ইন্দ্রের এক যজ্ঞে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন বলে নিমিকে অপেক্ষা করতে বলেন। বলেন–ইন্দ্রের যজ্ঞকার্য সম্পন্ন হলেই নিমির যজ্ঞে নিযুক্ত হবেন। বহু বছর বাদে ইন্দ্রের যজ্ঞ থেকে ফিরে এসে জানতে পান যে, নিমি ইতিমধ্যেই গৌতম মুনিকে দিয়ে যজ্ঞকর্ম সম্পন্ন করে নিয়েছেন। বশিষ্ঠ মুনি ক্রুদ্ধ হন। তারপর যা হয়–তেড়ে অভিশাপ–নিমির শরীর চেতনাবিহীন হবে। তবে নিমিই-বা ভড়কাবেন কেন! ক্ষত্রিয় বলে কথা, তিনিও একটা অভিশাপ ঠেলে দিলেন বশিষ্ঠের শরীরে, বললেন–বশিষ্ঠও চেতনাবিহীন হবেন। যেই বলা সেই কাজ! বশিষ্ঠ তখন অশরীরী হয়ে অন্য দেহ ধারণের জন্য ব্রহ্মার সাক্ষাতে যান। ব্রহ্মা যাতে একটি দেহ তাঁকে দান করেন, তাঁর জন্য প্রার্থনা করেন। ব্রহ্মা তখন তাঁকে মিত্রাবরুণের তেজে প্রবিষ্ট হয়ে পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে বলেন।
মার্কণ্ডেয় পুরাণেই বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্রের বিরোধের কাহিনি জানা যায়। বশিষ্ঠ মুনি রাজা হরিশ্চন্দ্রেরও কুলপুরোহিত ছিলেন। মহাভারতে রাজা হরিশ্চন্দ্রের চণ্ডাসত্বপ্রাপ্তি ও রাজ্যনাশ, স্ত্রী-পুত্র বিক্রয় ইত্যাদি ঘটনার জন্য বিশ্বামিত্রই দায়ী ছিলেন। এই সংবাদ জানতে পেরে বশিষ্ঠ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বিশ্বামিত্রকে অভিশাপ দিয়ে বকপক্ষীতে পরিণত করেন। বিশ্বামিত্রও অভিশাপ দিয়ে বশিষ্ঠকেও অন্য এক পক্ষীতে পরিণত করে। তারপর শুরু হয়ে যায় তুমুল যুদ্ধ। অবশেষে ব্রহ্মার মধ্যস্থতায় দুজনেই পূর্বদেহ ফিরিয়ে দিয়ে দুজনের মধ্যে আপাত শান্তি স্থাপন হয়।
বাল্মীকির রামায়ণে দেখা যায়, বশিষ্ঠ সূর্যবংশ তথা ইক্ষ্বাকুবংশের কুলপুরোহিত ছিলেন। দশরথের পুত্রদের জাতকর্মাদিতে পৌরোহিত্য করেন। বশিষ্ঠ মূলত ভরত-সমর্থক ও রামচন্দ্র বিরোধী ছিলেন। কুলপুরোহিত হলেও বশিষ্ঠ মুনিকে দশরথ বিশেষ পছন্দ করতেন বলে কোনো নমুনা পাই না। নমুনা যা পাই তা এরকম–রামের যখন ১৬ বছর বয়স, তখন দশরথের রাজসভায় বিশ্বামিত্র উপস্থিত হলে দশরথ তাঁকে মহাসম্মান প্রদর্শন করেন। এ ঘটনাটি যখন ঘটে তখন মহর্ষি বশিষ্ঠ রাজসভায় উপবিষ্ট ছিলেন। শত্রুকে বড়ো আসন দেওয়াটা বশিষ্ঠের কাছে সন্মানের ছিল না। বিশ্বামিত্রের প্রতি দশরথের যদি নিছক সম্মান প্রদর্শনও হয়, তবুও বিষয়টি সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, দশরথ কিন্তু কুলগুরু বশিষ্ঠের কাছে রামচন্দ্রকে দীক্ষিত করেননি, রামচন্দ্র দীক্ষিত হয়েছিলেন বিশ্বামিত্রের কছে। রাম ও লক্ষ্মণের বিবাহের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বিশ্বামিত্র, বশিষ্ঠ নয়। কিন্তু বশিষ্ঠ অনাহূত হয়ে অযোধ্যায় পৌঁছে ভরত ও শত্রুম্নকে বিবাহের ব্যবস্থা করেছিলেন বশিষ্ঠপন্থী কুশধ্বজের কন্যাদের সঙ্গে। কিন্তু ভরতপন্থী বশিষ্ঠ এখানেই থেমে থাকবেন কেন? থেমে থাকলে তো নিজের লবির ভরতকে অযোধ্যার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করা দুষ্কর হয়ে যাবে! প্রাসাদ বিপ্লবের পিছনে যে বশিষ্ঠেরও হাত আছে! অতএব বিবাহের শেষে অযোধ্যায় ফেরার আগেই পথের কাঁটা বিশ্বামিত্রকে সরিয়ে দিতে বশিষ্ঠ সক্রিয় হলেন।
এরপর বশিষ্ঠ অযোধায় ফিরে এসে বিন্দুমাত্র সময় অতিবাহিত করেননি। অযোধ্যার রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলে অতি দ্রুত কিছু ঘটনা ঘটে গেল। দশরথের কাছ থেকে রামের বনবাস ও ভরতের রাজ্যলাভের বর চেয়ে নিলেন কৈকেয়ী, যদিও দশরথ ভরতকে রাজা করতে নারাজ। দশরথকে গৃহবন্দি করলেন কৈকেয়ী, রাম লক্ষ্মণ-সীতা দণ্ডকারণ্যের গভীর জঙ্গলে চলে গেলেন, দশরথের অকালমৃত্যু হল, ভরত অযোধ্যার রাজা হলেন। বশিষ্ঠ জানতেন দশরথ ভরতকে ত্যাজপুত্র করেছেন এবং ভরতকে অযোধ্যার রাজা হওয়ার কোনো অনুমতিই দেননি, ক্ষমতা হস্তান্তর করেননি। তা সত্ত্বেও বশিষ্ঠ সমস্ত বাধানিষেধ অগ্রাহ্য করে ভরতকে অযোধ্যার সিংহাসনে বসিয়েছেন। দীর্ঘ ১৪ বছরের বেশি বশিষ্ঠের পৃষ্ঠপোষকতায় ভরত অযোধ্যায় রাজত্ব করে গেলেন। লঙ্কাযুদ্ধের শেষে সসৈন্যে রামচন্দ্র অযোধ্যায় পৌঁছোলে ভরত ভীত হয়ে রামের জন্য সিংহাসন ছেড়ে দেন। বশিষ্ঠও ভোল বদলে রামচন্দ্রের প্রধান উপদেষ্টা হয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকলেন।
দুর্বাসা : মহর্ষি অত্রির ঔরসে ও অনসূয়ার গর্ভে দুর্বাসার জন্ম হয়। তপঃপ্রভাবে ইনি তেজের আধার ছিলেন বটে, কোপনস্বভাব ছিলেন বলে অনেকেই তাঁর কোপানলে দগ্ধ হন। ঔর্বমুনির কন্যা কন্দলীকে দুর্বাসা বিবাহ করেন। দুর্বাসা এতটাই কোপনস্বভাবা ও অভিশাপপ্রিয় ছিলেন যে, দুর্বাসাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নেওয়া হয়েছিল–স্ত্রীর শত অপরাধ পর্যন্ত তিনি মার্জনা করবেন। সেই অনুসারে শত অপরাধের পরের অপরাধে দুর্বাসা স্ত্রীকে অভিপাশ দিয়ে ভস্ম করে দেন। মনে পড়ে গেল মহাভারতের শিশুপালের কথা–শিশুপালকেও ১০০টি অপরাধের পর ১০১ নম্বর অপরাধে শ্রীকৃষ্ণ শিশুপালকে হত্যা করেন। কার্যক্রমে কী মিল!
মহাভারতে পাণ্ডবজননী কুন্তী যখন কুন্তীভোজের গৃহে ছিলেন, তখন তাঁর সেবায় তুষ্ট হয়ে দুর্বাসা তাঁকে ‘আহ্বান মন্ত্র’ দান করেন। যার ফলে সূর্য, ধর্ম, পবন, ইন্দ্র প্রভৃতি উর্বর রাজাকে আহ্বান করে কুন্তী বিয়ের আগের কর্ণ এবংবিয়ের পরে যুধিষ্ঠির, ভীম ও অর্জুনকে জন্ম দেন।
একবার দুর্বাসা ভ্রমণ করতে করতে এক অপ্সরার হাত থেকে ‘সন্তানক’ নামে পুষ্পমাল্য লাভ করেন। ওই মালা তিনি ইন্দ্রের ঐরাবতের মাথায় স্থাপন করলে ঐরাবত সেই মালা ছিন্নভিন্ন করে মাটিতে ফেলে দেয়। এই কারণে দুর্বাসা ইন্দ্রকেই অভিশাপ দিয়ে শ্রীভ্রষ্ট করেন। অতিথি আপ্যায়নে উদাসীন হওয়ায় ইনি শকুন্তলাকে অভিশাপ দিলে দুষ্মন্ত কর্তৃক পরিত্যক্ত হন। দুর্বাসার অভিশাপেই শাম্ব যদুবংশনাশক মুষল প্রসব করেন। এর ফলে যদুবংশ ধ্বংস হয়।
এহেন মুনি দুবার্সা মহাভারতের যুগে অভিশাপ-টভিশাপ দিয়ে দাপটের সঙ্গে সবাইকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে রেখেছিলেন। কিন্তু গোটা রামায়ণে দুর্বাসার দেখা পাওয়া যায়নি। দেখা পাওয়া গেল উত্তরকাণ্ডে এসে, রামের শাসনামলে। দ্বাররক্ষীর মতো নিকৃষ্ট কাজে লক্ষ্মণকে নিয়োগ করলেন রাজা রামা দ্বাররক্ষী আগেই ছিল, তাকে অপসারণ করে লক্ষ্মণকে নিয়োগ করা হল। দ্বাররক্ষীর দায়িত্ব দিয়ে রাম লক্ষ্মণকে এটাও জানিয়ে দিলেন–“স্বয়ং দ্বারে দণ্ডায়মান থাকো। এই ঋষি ও আমার নির্জনে যাহা কথাবার্তা হইবে যদি কেহ তাহা দেখে বা শুনে সে আমার বধ্য হইবে।” লক্ষ্মণ যখন দ্বাররক্ষীর দায়িত্ব পালন করছিলেন, ঠিক তখনই হাজির সেই ভয়াল ভয়ংকর ক্রোধী এই ব্রাহ্মণ-পুরুষ, তিনি দুর্বাসা। রাজদ্বারে এসে লক্ষ্মণকে দুর্বাসা বললেন–“তুমি শীঘ্রই রামের সহিত আমার দেখা করাইয়া দাও।” লক্ষ্মণ জানালেন–রাম এখন রাজকার্যে ব্যস্ত আছেন। দেখা করা সম্ভব নয়।
একথা শুনে দুর্বাসা স্বভাবদোষে ক্ষিপ্ত হলেন এবং বললেন–“আমি সবংশে তোমাদের চার ভ্রাতার উপর এবং গ্রাম নগর সকলেরই অভিসম্পাত করিব।” দ্বাররক্ষী হিসাবে আত্মরক্ষার কোনো জায়গা নেই লক্ষ্মণের। ওটা অনৈতিক, অশাস্ত্রীয়! রামের অনুমোদনের জন্য লক্ষ্মণের প্রবেশ করা মানে মৃত্যুদণ্ডকে বরণ করে নেওয়া। যদি অনুমোদনের জন্য লক্ষ্মণ রামের কাছে নাও যান এবং দুর্বাশা যদি রামের সঙ্গে দেখা করতে এসে বিমুখ হয়ে ফিরে গেলেও সর্বনাশ। অতএব মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও এ যেন হিংস্র বাঘের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া! লক্ষ্মণ রামের আলোচনাকক্ষে ঢুকে দুর্বাসা আগমনবার্তা দিলেন রামকে। অতিবলের দূতকে বিদায় দুর্বাসাকে অভিবাদন জানালেন রাজা রাম।
রামের সত্যপালনের স্বার্থে লক্ষ্মণের হত্যা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ল। লক্ষ্মণ রামচন্দ্রের বধ্য। আদতে রাজা রাম সত্যনিষ্ঠ থাকতে পারেননি। লক্ষ্মণকে হত্যা করেননি, বর্জন করলেন। ব্রাহ্মণ-পুরুষ বশিষ্ঠ নিদান দিয়েছেন–“আপনার জনের পক্ষে ত্যাগ বা বধ উভয়ই সাধুগণের চক্ষে সমান।” অতএব আর দেরি কেন! এক্ষণকে লক্ষ্মণকে পরিত্যাগ করো। আজীবন অনুচর লক্ষ্মণকে রাজা রাম বর্জন করলেন। এতে লক্ষ্মণ আত্মহত্যা করেন তো অতি উত্তম। লক্ষ্মণ আত্মহত্যাই করবেন। দুর্বাসা সব জেনেশুনে লক্ষ্মণ বর্জন ও লক্ষ্মণের আত্মহননের প্ররোচনায় অংশীদারী হলেন। আআসলে দুর্বাসা সম্প্রদায় অতীব নিষ্ঠুর। এঁরা অত্যাচারী মুনিবেশী সেনা। এই সম্প্রদায়কে অমান্য করা মানে সমূলে নির্বংশ হওয়া। দুর্বাসা অতিবলের দূতের পিছনে পিছনে এসেছিল বদমাইসি করার জন্যে। উদ্দেশ্য, লক্ষ্মণকে মন্ত্রণা কক্ষে পাঠিয়ে রামের প্রতিজ্ঞা অনুসারে তাঁর মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা করা। দুর্বাসা সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা বড়োই সাংঘাতিক। এঁরা চুলমাত্র অসম্মানিত বোধ করলেই বিনামেঘে বজ্রপাত ডেকে আনতেন!
অগস্ত্য : অগস্ত্য সম্বন্ধে বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে যা জানা যায়, আগে সেটুকু বলে নিতে পারি। সর্বজনভাবে জানা যায়, ইনি বেদের একজন মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি। ঋকবেদে বলা হয়েছে, ইনি মিত্র (সূর্য) ও বরুণের পুত্র। আদিত্য-যজ্ঞে মিত্র ও বরুণ স্বৰ্গবেশ্যা উর্বশীকে দেখে যজ্ঞকুম্ভের মধ্যেই বীর্যপাত করে ফেললেন। সেই কুম্ভেই সেই বীর্য থেকেই বশিষ্ঠ ও অগস্ত্যের জন্ম হয়। ভাগবতে অগস্ত্যকে পুলস্তের পুত্র বলা হয়। কুম্ভে জন্মেছেন বলে অগস্ত্যের অন্য নামগুলি হল–কলসীসূত, কুম্ভসম্ভব, ঘটোৎভব, কুম্ভযোনী। মিত্র ও বরুণের পুত্র বলে নাম হয় মৈত্রাবরুণি। সমুদ্র পান করেছিলেন বলে নাম হল পীতাব্ধি। বাতাপিকে ধ্বংস করেছিলেন বলে নাম হয় বাতাপিদ্বীট। বিন্ধ্যপর্বতকে শাসন করেছেন বলে বিন্ধ্যকূট।
চিরকৃতদার থাকবেন বলে অগস্ত্য প্রতিজ্ঞা করে বসলেও পিতৃপুরুষদের কষ্ট সহ্য করতে না-পেরে লোপামুদ্রাকে বিবাহ করলেন। বিবাহের ফলে তিনি দৃড়স নামে এক শক্তিশালী পুত্রের পিতা হলেন। পুত্রের জন্মের পর অগস্ত্য কিছুদিন আশ্রমে বাস করে দেহত্যাগ করেন। জনশ্রুতি আছে, অগস্ত্য দক্ষিণাকাশে নক্ষত্ররূপে চির উজ্জ্বল হয়ে আছেন। মানুষ বিশ্বাস করেন, তিনি শরৎকালের প্রথমে দক্ষিণাপথে গিয়েছিলেন বলে ভাদ্রের ১৭ বা ১৮ তারিখে আকাশে নক্ষত্ররূপে তাঁর আবির্ভাব ঘটে থাকে। কারণ অগস্ত্য আর্যদেবতাদের প্রতিনিধি হয়ে বিন্ধ্যপর্বত অতিক্রম করে দক্ষিণ ভারতে পাড়ি দিয়েছিলেন সাম্রাজ্য বিস্তার করতে। কেউ কেউ বলেন, দক্ষিণ ভারত থেকে তিনি আর ফিরে আসেননি। অনেকে মনে করেন, পণ্ডিত ও প্রাজ্ঞ মানুষ পেয়ে দক্ষিণ ভারতের অনার্য মানুষরা তাঁকে বন্দি করে রাখেন এবং শাস্ত্রজ্ঞান অর্জন করেন। দক্ষিণ ভারতে আর্ব উপনিবেশ স্থাপনে অগস্ত্যই ছিলেন মুখ্য রূপকার। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন–“অগস্ত্য কোনো এক ব্যক্তিবিশেষের নাম ছিল না। সেকালে ‘অগস্তি’ নামে একটি বিশেষ সম্প্রদায় ছিল। সেইসম্প্রদায় থেকে যে একাধিক কীর্তিমান পুরুষের আবির্ভাব ঘটে এবং তাঁরাই ‘অগস্ত্য হিসাবে সম্মানিত হন।” প্রথম অগস্ত্যকে আমরা পাই খ্রিস্টপূর্ব দশম শতকের সময়কালে। ঋগবেদেও আর-এক অগস্ত্যের কথা জানতে পারি, আগেই বলছি তিনি এখানে মিত্রা ও বরুণের পুত্র, উর্বশী তাঁর মা। স্কন্দপুরাণে যে অগস্ত্যের কথা জানতে পাই, তিনি কাবের কন্যা কাবেরীকে বিয়ে করে ‘কুতমুনি’ নাম নিয়ে সেখানেই থেকে যান। কুতক থেকেই কুতমুনি, কুতক কুৰ্গদেশের প্রাচীন নাম। অন্য এক অগস্ত্য সর্বপ্রথম বিন্ধ্যপর্বত অতিক্রম করে বিদর্ভ রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন যাদব রাজা বিদর্ভের সাহায্যে। অগস্ত্যের কাছে তামিলরা খুবই কৃতজ্ঞ। তামিলে অগস্ত্যের গুণপনার স্বীকৃতি আছে। অসংখ্য অগস্ত্যের মধ্যে কেউ গ্রন্থকার অগস্ত্য, কেউ-বা তামিল ব্যাকরণ-প্রণেতা, কেউ পূর্তবিদ্যাবিদ, যন্ত্রবিদ, কেউ-বা সমরদক্ষ। এক অগস্ত্য বৌদ্ধধর্মে আকৃষ্ট তো, অন্যজন শৈবধর্মে। গ্রন্থপ্রণেতা অগস্ত্য প্রণীত গ্রন্থগুলি হল–অগস্ত্যসংহিতা, অগস্ত্যগীতা, সকলাধিকারিকা প্রভৃতি।
বনবাসকালে লক্ষ্মণ যখন অগস্ত্যের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন, তখন বুঝলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করা অত সহজ ব্যাপার নয়। অগস্ত্যের আস্তানা কঠোর ও কড়া সামরিক প্রহরায় মোড়া ছিল। দ্বাররক্ষীর অনুমতি ছাড়া অগস্ত্যের দর্শন পাওয়া সম্ভব নয়। দশরথপুত্র রাম এসেছেন এই সংবাদ প্রেরণ করলে অবশেষে অনুমতি মিলল এবং রক্ষীরা সসম্মানে অগস্ত্যের কাছে নিয়ে গেলেন। সারি সারি সজ্জিত প্রাসাদ দর্শন করতে করতে ব্রহ্মাস্থান, রুদ্রস্থান, ইন্দ্রস্থান, সূর্যস্থান ইত্যাদি সর্বশেষে ধর্মস্থান পেরিয়ে রামচন্দ্র পৌঁছে গেলেন গন্তব্যস্থলে। রামায়ণে অগস্ত্যের আবাসস্থলটি ছিল গোদাবরী নদীতীরে নাসিক থেকে ২৪ মাইল দূরে।
নিখুঁত এক সামরিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা অগস্ত্যের এই ডেরা। দণ্ডকারণ্যের বিশাল অঞ্চল জুড়ে তাঁর এই সুশৃঙ্খল সামরিক ঘাঁটি।তাই অগস্ত্যের এলাকাভুক্ত অরণ্য সম্পূর্ণভাবে সুরক্ষিত। যতদূর পর্যন্ত অগস্ত্যের প্রভাব প্রসারিত ততদূর পর্যন্ত নিরাপদ। এখানে ব্রাহ্মণ ও আর্যদেবতারা নিশ্চিন্ত অবস্থান করেন।
রামচন্দ্রের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর অগস্ত্য বাছাই করা প্রচুর মারাত্মক সব মারণাস্ত্র প্রদান করলেন, ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে। না, কোনো সাধনভজনে আধ্যাত্মিক উপদেশ-পরামর্শ তিনি রামকে দেননি। যুদ্ধবাজ ব্যক্তি যুদ্ধাস্ত্রই প্রদান করবেন এতে আর অস্বাভাবিকতা কী! সাধু-সন্ন্যাসীদের কাছে এত অস্ত্র কেন? কী করতেন ভয়ানক সব অস্ত্র দিয়ে? রাক্ষসদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে? মুনিঋষিদের রাক্ষসরা অত্যাচার করতেন একথা সর্বৈ সত্য নয়। সুতীক্ষ মুনি নিজেই স্বীকার করেছেন, তাঁর আশ্রমে রাক্ষসরা হামলা করেন না। শুধুমাত্র শত শত নির্ভয় হরিণের উপদ্রব ছাড়া আশ্রমে আর কোনো উপদ্রব নেই। তা সত্ত্বেও সুতীক্ষ মুনির আশ্রমে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র মজুত ছিল। তিনি রাম-লক্ষ্মণকে তূণ, ধনুক, খদি দিয়েছিলেন।অগস্ত্যের আশ্রমেও রাক্ষসরা উপদ্রব করতেন না। তা সত্ত্বেও অগস্ত্যেরও বিশাল অস্ত্রভাণ্ডার।
এরপর তাঁকে যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা যায় রামশিবিরে। যুদ্ধ করেছেন। তারপর পাওয়া যায় এক্কেবারে উত্তরকাণ্ডে এসে। এসময় রাম অযোধ্যার রাজা। রাজার কাছে প্রচুর ক্ষীর-মধু, সেই ক্ষীর-মধুর প্রাপ্তির আশায় ভারত উপমহাদেশের তাবড় তাবড় পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্রাহ্মণের দল অযোধ্যায় এসে ভীড় করেছেন। জল ছাড়া যেমন মাছ বাঁচে না, তেমনই রাজা ছাড়া ব্রাহ্মণরা বাঁচেন না, ব্রাহ্মণ ছাড়াও রাজার কীর্তি ছড়ায় না। যে যার মতো করে গুণকীর্তন করতে থাকেন। রাজাও গদগদ হয়ে লোভনীয় পদ থেকে মণি-কাঞ্চন সবই অকাতরে দান করতে থাকেন তাঁদের। এ পর্যায়ে সমস্ত ব্রাহ্মণকে টপকে গেছেন অগস্ত্য। অগস্ত্য রামমাহাত্ম্য শুনিয়েছেন। রাজা রাম প্রশ্ন করছেন, আর অগস্ত্য এক কাহিনি থেকে আর-এক কাহিনিতে অবাধে চলে গেছেন। রামকে স্বয়ং বিষ্ণু হিসাবে ঘোষণা করে দিলেন। শুধু তাই-ই নয়, বনবাস ও যুদ্ধকালীন রাম যে অন্যায়গুলি করেছেন সেগুলি থেকে কলঙ্কমুক্ত করতে বা মাহাত্ম্য দিতে রাবণকেও ভগবান বানিয়েছেন। রাবণ ও অন্যান্য লঙ্কা-নায়করা অভিশাপের ফলেই এই রাক্ষস-জন্ম। আর রাক্ষস-জন্মে রাবণ ভয়ংকর অপরাধী, কামুক, অহংকারী, ধর্ষক। এহেন মানুষকে হত্যা করে ‘ভগবান রাম উচিত কাজই করেছেন। শুধু উচিত কাজই করেননি, তিনি রাবণকে অভিশাপ থেকে মুক্ত করেছেন এবং পৃথিবীর সাধারণ মানুষকে অনাচার থেকে রক্ষা করেছেন।
জাস্টিফাই। ব্যস, সাতখুন মাফ! সাতখুন মাফ করতে গিয়ে রাম হয়েছেন নিমিত্তমাত্র, যা হয়েছে যা করেছে। সবই বিষ্ণু তথা আর্যদেবতারা করেছেন। তাই নানা উদ্ভট ও অতিকল্পনার কাহিনি সংবলিত করে বানরাও দেবতা, হনুমানও দেবতা, এমনকি সমগ্র রাক্ষসদেরও দেবতা বলে ঘোষণা করতে হয়েছে। যা হয়েছে তা সমাজকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য হয়েছে, রামকাণ্ড সবই ভগবান-দেবতাদের গটআপ গেম। অরণ্যকাণ্ড, সুন্দরকাণ্ড, লঙ্কাকাণ্ডে রামকে প্রায় কিছুই করতে হয়নি, সবই নেপথ্য থেকে রামকে সামনে রেখে আর্যদেবতারাই করেছেন। অগস্ত্য তাঁর বক্তব্যে এটা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন যে তাঁরা জগতকে শিক্ষা দিতে লীলা করেছেন এবং স্বর্গে রওনা দিয়েছেন। যুদ্ধের আগ পর্যন্ত রাম নিপাট নিরীহ অতি সাধারণ মানুষই ছিলেন, রাজা হওয়ার পর রাম ভগবান হলেন। রামের সব অপরাধ স্থালিত হল, আমরা সবাই রামভক্ত হলাম! উত্তরকাণ্ডে অগস্ত্যের আবির্ভাব না-ঘটলে রামেরও ভগবান হওয়া হত না, রামায়ণ ধর্মগ্রন্থও হতে পারত না।
আসলে রামকে ‘ভগবান’ বলে ঘোষণা করে নতুন কিছুই করেননি অগস্ত্য। রামকে যখন অগস্ত্য বলছেন, রাম তখন রাজা–অযোধ্যার রাজা। রাজা তো ভগবানই। রাম একা নন, যে যুগে সব রাজাই ভগবান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যাঁরা ছাত্র তাঁরা জানেন রাষ্ট্রর উৎপত্তির বিষয়ে ঐশ্বরিক মতবাদ।
মনুর বলছেন রাজা কে? রাজশূন্য এই জগতকে রক্ষার জন্য ইন্দ্র, বায়ু, যম, সূর্য, অগ্নি, বরুণ, চন্দ্র এবং কুবের–এই দেবতার সারভূত অংশ নিয়ে পরমেশ্বর রাজাকে সৃষ্টি করেছেন। যেহেতু এই শ্রেষ্ঠ দেবগণের অংশ থেকে রাজার সৃষ্টি হয়েছিল সেইজন্য তিনি সকল জীবকে তেজে অভিভূত করেন।(অরাজকে হি লোকেহস্মিন্ সর্বতো বিদ্রুতে ভয়াৎ।/রক্ষার্থমস্য সর্বস্য রাজানমসৃজৎ প্রভুঃ।/ইন্দ্রানিলমার্কাণামগ্নেশ্চ বরুণস্য চা/চন্দ্রবিত্তেশয়োশ্চৈব মাত্রা নিৰ্দ্ধত্য শাশ্বতীঃ।/যস্মদেষাং সুরেন্দ্রাণাং মাত্রাভ্যো নির্মিততা নৃপঃ।/তস্মাদভিভবত্যেষ সর্বভূতানি তেজসা”।(মনুসংহিতা, সপ্তম অধ্যায়, শ্লোক ৩-৪-৫) রাজা কী? মনু বলছেন–(১) তিনি সূর্যের মতো চোখ ও মন সন্তপ্ত করেন। পৃথিবীতে কেউ তাঁকে মুখোমুখি অবলোকন করতে পারে না। (২) বালক হলেও রাজাকে মানুষ মনে করে অবজ্ঞা করা উচিত নয়। ইনি মানুষের রূপে মহান দেবতা। (৩) অতি নিকটে গেলে আগুন একমাত্র সেটাই দগ্ধ করে, কিন্তু রাজারূপ আগুন বংশ-পশু সম্পত্তি সহ দগ্ধ করে। (৪) রাজার অনুগ্রহে বিশাল সম্পত্তি লাভ হয়, যাঁর বীরত্বে জয়লাভ হয়, যাঁর ক্রোধে মৃত্যু বাস করে, তিনি প্রকৃতই সর্বতেজোময়। ইত্যাদি ইত্যাদি। রাজার নিষ্কণ্টক সিংহাসনও পাক্কা।
যবদ্বীপে (বর্তমানে জাভা। জাভা ভারত মহাসাগরের একটি দ্বীপ। এটি ইন্দোনেশিয়ার একটি অংশ। প্রাচীনকালে জাভা নিকটবর্তী অঞ্চলগুলির মতো হিন্দু রাজাদের অধীনে ছিল) ঋষি অগস্ত্যের খুব নাম-ডাক। দক্ষিণ ভারতে তামিল দেশেও অগস্ত্যের পুজো হয়। অগস্ত্য ঋষিকে কোথাও কোথাও শিবের অভিন্ন রূপে কল্পনা করা হয়। বস্তুত দক্ষিণ ভারত থেকেই যবদ্বীপে অগস্ত্যপুজো প্রচারিত হয়েছিল বলে মনে করেন ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। প্রাচীন যবদ্বীপে অষ্টম-নবম শতকে কয়েকটি তারিখ দেওয়া শিলালেখ পাওয়া যায়। সেইসব শিলালেখে অগস্ত্যের উল্লেখ আছে।
রামায়ণের পার্শ্বচরিত্র : ইন্দ্রজিৎ, কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ, মন্দোদরী, শত্রুঘ্ন, শান্তা, মন্থরা, লবকুশ, মারীচ, শূর্পণখা, অহল্যা, মহিরাবণ
রামায়ণে রাম-লক্ষ্মণ-সীতা-রাবণ ছাড়াও অসংখ্য ব্যক্তির গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতি আছে, জনমানসে তাঁরা প্রায় অনুচ্চারিতই থেকে গেছেন। কিন্তু তাঁদেরকে বাদ দিলে, তাঁদেরকে স্মরণ না-করলে রামায়ণ অসমাপ্ত থেকে যাবে। বাল্মীকি রাময়ণে যেমন ইন্দ্রজিৎ, মন্দোদরী, শত্রুঘ্ন, শান্তা, মন্থরা, লবকুশ, মারীচ, শূর্পণখাদের পাই, তেমনই অন্য রামায়ণে অহল্যা, মহিরাবণের মতো ব্যক্তিদেরও পাই। আসুন পাঠকবন্ধু, রামায়ণে বিস্মৃতপ্রায় হয়ে আছেন, এমন কয়েকজন প্রায় অপ্রধান অথচ শক্তিশালী কিছু চরিত্রের উপস্থিতি বুঝে নিই। কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ,
ইন্দ্রজিৎ : গোটা রামায়ণে ‘প্রকৃত বীর’ বলে যদি কেউ থেকে থাকেন, তিনি ইন্দ্রজিত। ইন্দ্রজিৎ, ওরফে মেঘনাথ। যুদ্ধে তাঁর মৃত্যু হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাঁকে বীর শিরোপা দিতে কার্পণ্য করা উচিত হয় না। ইন্দ্রজিৎ বা মেঘনাদ বা মেঘনাথ রামায়ণে বর্ণিত এক যোদ্ধা। তিনি সমগ্র মানব, দানব, অন্যান্য সৃষ্টি ও দেবদেবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বীরযোদ্ধা ও একমাত্র অতি মহারথী দানবদের গুরু শুক্রের শিষ্য ত্রিমূর্তিধারী ইন্দ্রজিৎ রাবণের পুত্র। মেঘনাদ রাম ও রাবণের মধ্যে সংঘটিত লঙ্কার যুদ্ধে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি দুইবার রাম ও লক্ষ্মণকে পরাভূত করেন। কিন্তু তৃতীয় বারে বিভীষণের সহায়তায় লক্ষ্মণ নিকুম্ভিলায় উপস্থিত হয়ে মেঘনাদকে অসহায় ও নিরস্ত্র অবস্থায় হত্যা করেন।
মেঘনাদের জননী ছিলেন মায়াসুরের কন্যা তথা রাবণের রাজমহিষী মন্দোদরী। জন্মের সময় মেঘনাদ বজ্ৰনাদের ন্যায় চিৎকার করেছিলেন। সেই কারণে তাঁর নাম মেঘনাদ। অন্যমতে, মেঘের আড়াল থেকে ঘোর যুদ্ধ করতেন বলে তাঁর নাম হয় মেঘনাদ। আবার দেবরাজ ইন্দ্রকে পরাভূত করেছিলেন বলে তিনি ইন্দ্রজিৎ নামেও অভিহিত হন।
মেঘনাদের জন্মসংক্রান্ত আর-একটি কাহিনি প্রচলিত আছে : সমুদ্রমন্থনকালে সুলক্ষণা নামে এক সুন্দরী নারী উঠেছিলেন। তিনি পার্বতীর সখি হন। একদিন স্নানান্তে পার্বতী সুলক্ষণাকে তাঁর পরিধেয় বস্ত্র আনতে বলেন। বস্ত্র আনতে গেলে শিব সুলক্ষণাকে একা পেয়ে সম্ভোগ করেন। সুলক্ষণা বিব্রত হয়ে পড়লে শিব বর দেন যে তাঁর বিবাহের পরই পুত্রের জন্ম হবে। এদিকে পার্বতীর কাছে পরে বস্ত্র নিয়ে গেলে তিনি সব বুঝতে পারেন। তিনি সুলক্ষণাকে অভিশাপ দেন। সুলক্ষণা মন্দোদরীতে পরিণত হন। এই কারণে মেঘনাদের অপর নাম হয় কানীন।
মেঘনাদের দুই সহোদরের নাম অতিকায় ও অক্ষয়কুমার। বাল্যকালেই মেঘনাদ ব্ৰহ্মাস্ত্র, পাশুপতাস্ত্র, বৈষ্ণবাস্ত্র প্রভৃতি দৈব অস্ত্রশস্ত্রের অধিকারী হয়েছিলেন। তাঁর গুরু ছিলেন দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য। মেঘনাদ নাগরাজ শেষনাগের কন্যা সুলোচনাকে বিবাহ করেছিলেন। যুদ্ধে মেঘনাদের মৃত্যুর পর সুলোচনার কী হল জানা যয় না।
যেসব অস্ত্রশস্ত্র ইন্দ্রজিতের কাছে ছিল তার একটু পরিচয় নেওয়া যাক–কালচক্র (সময়ের চক্র, শত্রুর শোচনীয় অবস্থা করে, ভয়ংকর ক্ষমতাসম্পন্ন, আগুনের গোলা উৎপন্ন করে), বিষ্ণুচক্র ( অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত করে, অত্যুজ্জ্বল দীপ্তিসমৃদ্ধ, প্রতি পদক্ষেপে এক লক্ষ শত্রু সংহার করার ক্ষমতা রাখে, এর প্রয়োগ অতি ভয়ানক), ইন্দ্রচক্র (দেবরাজের চক্র), দণ্ডচক্র (দণ্ডদাতার চক্র), ধর্মচক্র (গুণচক্র), মোদক দণ্ড (অত্যাচারের অস্ত্র), শিখরী দণ্ড (দণ্ডের উচ্চ শিখর), ধর্মপাশ (ধর্মরাজের রজ্জ/বন্ধন), কালপাশ (সময়ের পাশ), নাগপাশ (সর্পের রঞ্জু, এর ফলে শত্ৰু বিষধর সর্পের কুণ্ডলিতে আবদ্ধ হয়), বরুণপাশ (আর্যদেবতা বরুণের পাশ, দেব-অসুর-মানুষ সকলকে বন্ধনে সক্ষম, এর বন্ধন হতে মুক্তিলাভ অসম্ভব), যমপাশ (যমের পাশ, ত্রিমূর্তি ব্যতীত সকলেই এর দ্বারা আবদ্ধ হতে পারে, যার বন্ধন হতে মুক্ত হওয়া অসম্ভব), সংবর্ত (যমের দেওয়া অস্ত্র, রাজা ভরত এটি ব্যবহার করে এক মুহূর্তে তিন লক্ষ গন্ধর্ব হত্যায় প্রয়োগ করেন), বজ্র (দেবরাজ ইন্দ্রের দেওয়া অস্ত্র, যা অব্যর্থ ও অজেয়), বাসবী শক্তি (ইন্দ্রের দেওয়া অব্যর্থ বাণ), কঙ্কালম (দৈত্যদের ভয়ংকর শস্ত্র), কপালম (দৈত্যদের ভয়ংকর শস্ত্র), কঙ্কণম (দৈত্যদের ভয়ংকর শস্ত্র), চন্দ্রহাস ( শিবের দেওয়া অসি, শিব এই অস্ত্রটি রাবণকে দিয়েছিলেন এবং রাবণ মেঘনাদকে দেন), ত্রিশূল (শিবের দেওয়া শূল, বলা হয় এর তুল্য কোনো শস্ত্র আর নেই), পিনাক (শিবের দেওয়া বাণ)।
প্রথম দিনের যুদ্ধ : নিজের ভ্রাতৃগণের মৃত্যুর পর ইন্দ্রজিৎ যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। রাম ও লক্ষ্মণের সঙ্গে তাঁর তিন দিন যুদ্ধ হয়েছিল। প্রথম দিন রামের বাহিনীর সঙ্গে ইন্দ্রজিতের যুদ্ধ হয়। দক্ষ রণকৌশলে তিনি সুগ্রীবের বাহিনীকে হটিয়ে দেন। রাম ও লক্ষ্মণের সঙ্গে মেঘনাদের ভয়ংকর যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে অঙ্গদ জয়লাভ করলেও ইন্দ্রজিতের মারণাস্ত্র আঘাত করলে রাম ও লক্ষ্মণ দুজনেই মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে। এই মৃতপ্রায় রাম-লক্ষণকে নিয়ে রামশিবিরের সকলেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। সংগতকারণেই সবচেয়ে বেশি চিন্তায় পড়ে গেলেন বিভীষণ। রাম-লক্ষ্মণ যদি মরেই যায় তাহলে তাঁর রাজ্যলাভের কী হবে? লঙ্কার সিংহাসনলাভ কী অধরাই থেকে যাবে। হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বিলাপ করলেন–“হায়, আমি যাঁহাদের বাহুবলে রাজ্যপদ কামনা করিয়াছিলাম, এক্ষণে তাঁহারাই মৃত্যুর জন্য শয়ান।” ইন্দ্রজিৎ যত বড়ো বীরই হন, বিচারবুদ্ধিতে নালায়েক। তাই পরাস্ত মৃতপ্রায় শত্রুকে চিরতরে বিনাশ না-করে যুদ্ধক্ষেত্রেই শত্রুদের রেখে তিনি ফিরে আসেন। সেই ভুলের মাশুল দিতে হয়েছে তাঁকে। অহংকার আর আস্ফালনই তাঁদের রাজনৈতিকবুদ্ধি বিনাশ করেছে। নয়তো এ যাত্রাতেই যুদ্ধের যবনিকা পতন হয়ে যেত। এই বিধ্বস্ত মুহূর্তটিকে কাজে লাগিয়ে রামের সেনাসমষ্টিকে তছনছ করে দিতে পারতেন।
দ্বিতীয় দিনের যুদ্ধ : গরুড়ের চিকিৎসায় রাম-লক্ষ্মণ উভয়ই সুস্থ হয়ে উঠলেন। অতএব পুনরায় যুদ্ধের প্রস্তুতি। সামরিক মূঢ়তা, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও অনুমাননির্ভর রাজনীতির জন্য আবার যুদ্ধ। বীর অতিকায়ের মৃত্যুর পর ইন্দ্রজিৎকে দ্বিতীয়বার যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হল। এবার আরও ভয়ানক যুদ্ধ। রাম-লক্ষ্মণ তো বটেই–সেইসঙ্গে ইন্দ্রজিতের কালাস্ত্রে ভয়ানকভাবে ক্ষতবিক্ষত হলেন হনুমান, সুগ্রীব, অঙ্গদ, জাম্ববান, সুষেণ, গবাক্ষ, নীল, মৈন্দ, দ্বিবিদ, গবয়, কেসরী, সূর্যানন, দধিমুখ, নল, পাবকক্ষ, জ্যোতিমুখ, কুমুদ, বিদ্যুদ্দ প্রমুখ। রামশিবিরে মৃত্যুর মিছিল। অসংখ্য বানরসেনার লাশ পড়ে আছে যুদ্ধক্ষেত্রে। শুধু বানরসেনাই নয়, অসংখ্য অপ্রধান আর্যদেবতাদের মুড়িমুড়কির মতো গ্রাসে গ্রাসে নিঃশেষ করেছেন। কিষ্কিন্ধ্যা রাজ্য ও ভ্রাতৃবধু তারা লাভের আশায় সুগ্রীব মাশুল গুনছেন। অনর্থক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে তিনি তাঁর বানরসেনাদের মৃত্যুমুখে ঠেলে দিলেন। এবার আর গরুড় এলেন না রাম-লক্ষ্মণদের বাঁচাতে। অসুস্থ জাম্ববানের পরামর্শে বিষক্রিয়ায় দুর্বল হনুমান গন্ধমাদন পর্বত থেকে বিশল্যকরণী ইত্যাদি ওষধি আনার পর, সেই ওষুধের যথাযথ প্রয়োগে সবাই সুস্থ হয়ে ওঠেন।
তৃতীয় দিনের যুদ্ধ : এবার ইন্দ্রজিৎ আবার মহা ভুল করে বসলেন। তিনি আবারও ভুলে গেলেন, শত্রুর শেষ রাখতে নেই। যেমন ঋণ, অগ্নি এবং ব্যাধির শেষ রাখতে নেই, তেমনি শত্রুর মৃত্যুকে নিশ্চিত না-করে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করা ইন্দ্রজিতের বুদ্ধিমানের কাজ হয়নি। একটুর জন্য ইন্দ্রজিৎ শেষরক্ষা করতে পারলেন না। তাই শমন তাঁর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য রণক্ষেত্রে নয়, নিকুম্ভিলায়। সুস্থ হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে লক্ষ্মণ চললেন নিকুম্ভিলায়, ইন্দ্রজিৎকে হত্যা করতে। একা নন–সঙ্গে গেলেন ইন্দ্রজিতের খুল্লতাত বিভীষণ, চারজন বীর অমাত্য, সুগ্রীবের মহামন্ত্রী এবং হাজার হাজার বানরসেনা। নিকুম্ভিলা অবরুদ্ধ। নিকুম্ভিলা যুদ্ধে বিভীষণই হর্তাকর্তাবিধাতা। বিভীষণ লক্ষণকে বললেন–“তুমি সেনাদের ছিন্নভিন্ন করিতে যত্নবান হও। উহারা ছিন্নভিন্ন হইলে ইন্দ্রজিৎ নিশ্চয়ই দৃষ্ট হইবে।” হল। বিভীষণের পরামর্শে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল ইন্দ্রজিতের সেনাদের সঙ্গে। অবশেষে ইন্দ্রজিৎ রথে চড়ে যুদ্ধক্ষেত্রে এলেন। দেখতে পেলেন খুল্লতাত বিভীষণকে। চরম তিরস্কার করলেন খুল্লতাতকে। ইন্দ্রজিৎ রাবণের মতোই ক্ষমাশীল, তাই জ্ঞাতিদ্রোহী খুল্লতাত বিভীষণকে হত্যা করতে পারলেন না। এটাও ছিল ইন্দ্রজিতের ভয়ানক ভুল। অথচ উলটোদিকে নিজের সশস্ত্র দলবল নিয়ে নিজের ভাইপোকে হত্যা করতে এসেছেন আপন কাকা বিভীষণ।
লক্ষমণ এবং ইন্দ্রজিৎ উভয়ই আকাশপথেই যুদ্ধ করতে লাগলেন–এমন তথ্যই দিয়েছেন স্বয়ং বাল্মীকি। তবে লক্ষ্মণ একা নন–এই যুদ্ধে সঙ্গ দিচ্ছেন ঋষিগণ, পিতৃগণ, ইন্দ্রাদি দেবগণ, গন্ধর্ব প্রমুখ। লক্ষ্মণকে ঘিরে রক্ষা করছেন দেবসেনাগণ। ইন্দ্রজিৎ শত্ৰুবেষ্টিত হয়ে অসহায়ের মতো যুদ্ধ করছেন। অবশেষে ইন্দ্রজিতের মস্তক দেহচ্যুত হল লক্ষ্মণের ঐন্দ্রবাণে।
“ভাই লক্ষ্মণ! আজ বড়ো পরিতুষ্ট হইলাম। … যখন ইন্দ্রজিৎ বিনষ্ট হইল, তখন জানিও আমরাই জয়ী হইলাম। … আজ আমি বিজয়ী … লক্ষ্মণ তুমি আমার প্রভু, তোমার সাহায্যে অতঃপর সীতা ও পৃথিবী আমার অসুলভ থাকিবে না।”–ইন্দ্রজিতের মৃত্যুর পর রাম এই প্রথম লক্ষ্মণকে ‘প্রভু’ বলে সম্বোধন করলেন। এ থেকে বোঝা যায় ইন্দ্রজিৎ কতটা প্রতিরোধ্য ছিলেন। এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায় ইন্দ্রজিতের কাছে রামচন্দ্র কত অসহায় ছিলেন, চাপে ছিলেন। রাবণ নয়, ইন্দ্রজিৎই ছিলেন দাক্ষিণাত্যে আর্য-উপনিবেশের প্রধান ও প্রথম অন্তরায়। তাই ইন্দ্রজিতের পতনের সঙ্গে সঙ্গে বিজয়ভেরী বাজতে থাকল।
অন্য রামায়ণে এরকমভাবে ঘটনাকে বিকৃত করা হয়েছে–লক্ষ্মণ পুনরুজ্জীবিত হয়েছেন জানতে পেরে মেঘনাদ নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে যজ্ঞ সম্পাদনা করতে যান। বিভীষণ তাঁর গুপ্তচর মারফত সেই সংবাদ পেয়ে রামকে সতর্ক করেন। কারণ এই যজ্ঞ সম্পূর্ণ হলে মেঘনাদ অজেয় হয়ে যাবেন। বিভীষণ লক্ষ্মণকে যজ্ঞাগারে নিয়ে যান। যজ্ঞাগারে মেঘনাদ অস্ত্র স্পর্শ করতেন না। তিনি প্রথমে যজ্ঞের বাসন ছুঁড়ে লক্ষ্মণকে অচেতন করে দেন। কিন্তু অস্ত্রাগারে যাওয়ার সময় পান না। তার পূর্বেই লক্ষ্মণের জ্ঞান ফেরে এবং তিনি নিরস্ত্র মেঘনাদকে হত্যা করেন। এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। যজ্ঞাগারে নিরস্ত্র অবস্থায় ইন্দ্রজিতের মৃত্যু হয়নি। এ গল্প মাইকেল মধুসূদনের মস্তিষ্কপ্রসূত।
১৮৬১ সালে রামায়ণের কাহিনি নিয়ে একই ছন্দে তিনি রচনা করেন তার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘মেঘনাদবধকাব্য’। এটি বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক মহাকাব্য। আর কোনো রচনা না-থাকলেও মধুসূদন এই একটি কাব্য লিখে অমর হয়ে থাকতে পারতেন। এই কাব্যের মাধ্যমে তিনি মহাকবির মর্যাদা লাভ করেন এবং তাঁর নব আবিষ্কৃত অমিত্রাক্ষর ছন্দেও বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। এই কাব্য ভাব ও ভাবনায় আধুনিকতায় প্রকাশভঙ্গির অভিনবত্বে এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের উপকরণের সংমিশ্রণে মধুসূদন বাংলা কাহিনি কাব্যের গতানুগতিক ধারায় এক আমূল পরিবর্তন আনেন। তিনি সংস্কৃতি থেকে আখ্যানভাগ গ্রহণ করলেও সংস্কৃতি ও অলংকারশাস্ত্রের বিধান পালন করেননি, বরং ভাবগাম্ভীর্য, ভাষা ও ছন্দের ওজস্বিতা এবং জীবন-ভাবনার ব্যাপকতা ও প্রগাঢ়তায় ‘মেঘনাদবধকাব্য’ গ্রিক মহাকাব্যের মহিমা লাভ করেছে। বস্তুত এটি গ্রিক আদর্শে রচিত প্রথম সার্থক বাংলা মহাকাব্য।
রামায়ণের নায়ক ‘দেবতা’ রামচন্দ্র। এখানে পররাজ্য আক্রমণকারী এবং দৈববলে বলিয়ান লক্ষণ। অন্যায় যুদ্ধে হন্তারকরূপে চিহ্নিত। রামায়ণের পরস্ত্রী অপহরণকারী রাক্ষস রাবণকে এখানে পাওয়া যায় মহাবীর ও প্রজাপালক রাজা, স্নেহময় পিতা ও ভ্রাতা হিসাবে। ভগ্নির অপমানে প্রতিশোধ নিতে তিনি সীতাকে অপহরণ করেন। কিন্তু কোনো অবমাননা করেননি৷ রাবণ পুত্র মেঘনাদ অসীম সাহসীরূপে বীরযোদ্ধা ও সত্যাশ্রয়ী নিরস্ত্র ও যজ্ঞরত অবস্থায় তাকে তার পিতৃব্য বিভীষণের সহায়তায় লক্ষ্মণ হত্যা করেন। মেঘনাদের স্ত্রী প্রমিলা নারীর ব্যক্তিত্ব, স্বতন্ত্র ও বীরের উজ্জ্বল। বিতাড়িত রাবণের অসহায় পরাভবের কাহিনি মূলত ঔপনিবেশ শক্তির পদানত পরাধীন ভারতবাসীর বেদনায় শিল্পরূপ। গ্রিক ও শেক্সপিয়ারের ট্র্যাজেডি শিল্পাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মধুসূদন সর্বমোট নয়টি স্বর্গ, মর্ত, পাতালরূপী কাহিনি পরিকল্পনা, ঘটনা সংস্থাপন, উপমা বিশ্লেষণের অভিনবত্ব, অমিত্রাক্ষর ছন্দের কুশলী প্রয়োগ এবং বর্ণনায় দ্রুতময়তায় এই মহাকাব্য রচনা করেন। রামায়ণে বর্ণিত অধর্মাচারী, অত্যাচারী ও পাপী রাবণকে একজন দেশপ্রেমিক বীরযোদ্ধা ও বিশাল শক্তির আধাররূপে চিহ্নিহ্নত করে মধুসূদন দত্ত ঊনবিংশ শতকের বাঙালি নবজাগরণের শ্রেষ্ঠ কবির মর্যাদা লাভ করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ভারতবাসীর চিরাচরিত বিশ্বাসের মূলে আঘাত হেনে প্রকৃত সত্য সন্ধান ও দেশপ্রেমের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন বাংলা সাহিত্যে তা তুলনাহীন।
কুম্ভকর্ণ : বাল্মীকির উত্তরকাণ্ড থেকে জানতে পারি কেকসীর যখন প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হল তখন আকাশে নাকি বিনা মেঘে বজ্রপাত, রক্তবৃষ্টি, চিল-শকুনের রব, শেয়াল, গাধার কান্না, নানা রকম অশুভ চিহ্ন ইত্যাদি হয়েছিল। জন্মেই সেই শিশু এমন চিৎকার বা রব করতে থাকল যে চতুর্দিক কম্পিত হতে লাগল। তুমূল রব করার জন্য তার নাম হল রাবণ। এরপর কেকসি আর-একটি শক্তিশালী পুত্রের জন্ম দেন, তাঁর নাম কুম্ভকর্ণ। কুম্ভকর্ণের মতো ঘুম! কুম্ভকর্ণ আর গভীর ঘুম যেন সমার্থক। যেন শুধু ঘুমের কারণেই কুম্ভকর্ণের প্রসিদ্ধি। তারপরে শুভ লগ্নে যখন নানা শুভ চিহ্ন দেখা গেল তখন কেকসির গর্ভ থেকে একটি শিশু প্রসব হল, তাঁর নাম বিভীষণ। এরপর পুনঃ অশুভ লগ্নে কেকসি একটি কন্যার জন্ম দেন, তাঁর নাম শূর্পণখা। জন্মগ্রহণের অব্যবহিত পরেই সে ক্ষুধার্ত হয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য সহস্র প্রজা খেয়ে ফেলেছেন বলে খ্যাতি আছে। এই জাতিকে সকলের কাছে ঘৃণ্য করে তুলতেই জন্মের এহেন কুৎসিত বর্ণনা। যাই হোক, কুম্ভকর্ণ দৈত্যরাজ বলির দৌহিত্রী বজ্রমালাকে বিয়ে করেন। বজ্রমালার গর্ভে কুম্ভ ও নিকুম্ভ নামে দুই পুত্রের জন্ম হয়।
গোকর্ণ আশ্রমে উগ্র তপস্যার পর ব্রহ্মার বর চাইতে গেলে কুম্ভকর্ণ প্রত্যাখ্যাত হন। কারণ দেবতারা ব্রহ্মার কান ভাঙিয়ে বলে দিয়েছেন–কুম্ভকর্ণ সাতটি অপ্সরা, ইন্দ্রের দশটি অনুচর এবং বহু ঋষি ও মনুষ্য খেয়ে ফেলেছেন। বরপ্রাপ্তির ফলে সে ত্রিভুবন খেয়ে ফেলবে! এদিকে কুম্ভকর্ণের কঠোর তপস্যায় পৃথিবী এমন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যে, মনে হয় সমস্ত যেন অগ্নিদগ্ধ হয়ে ছাইয়ে পরিণত হবে। দেবতারা দেবী সরস্বতীর শরণাপন্ন হলেন। দেবী সরস্বতী অভয় দিয়ে কুম্ভকর্ণের জিহ্বায় অধিষ্ঠান করলেন। এই সুযোগে ইন্দ্র তাঁর গায়ের ঝাল মেটাতে সরস্বতীর সঙ্গে জোট বাঁধলেন। বললেন, কুম্ভকর্ণের জিভ বেঁধে রাখতে। সরস্বতীও সেই মতো কাজ করলেন। বর চাইতে পারলেন না কুম্ভকর্ণ, ব্রহ্মার কাছে বর চাইতে গিয়ে জড়িয়ে গেল কুম্ভকর্ণের জিভ। তিনি চেয়েছিলেন ইন্দ্রাসন’ কামনা করবেন। জিভের আড়ষ্টতার কারণে অশুদ্ধ উচ্চারণ করে ফেললেন। ইন্দ্রাসন জিহ্বার আড়ষ্টতার হয়ে গেল ‘নিদ্রাসন’। ছয় মাস ঘুমোবেন, আর ছয় মাস জেগে থাকবেন। জাগার সময়ে কুম্ভকর্ণকে কেউ হত্যা করতে পারবেন না। কিন্তু নিদ্রার সময়কালে কেউ যদি অকালনিদ্রা ভঙ্গ করেন, তবে তাঁর মৃত্যু অনিবার্য। সরস্বতী প্রভাবে কুম্ভকর্ণ বর চাইলেন–“হে প্রজাপতি। তপস্যা করে আমি ক্লান্ত। আমাকে বর দিন যেন আমি ছয় মাস ঘুমাই আর একদিন মাত্র জাগি।” ব্রহ্মা বললেন- “তথাস্তু। কিন্তু অকালে তোমার নিদ্রাভঙ্গ করলে তোমার মৃত্যু নিশ্চিত।”
যাই হোক, যখন ঘুম ভাঙত, পাগলের মতো খিদে পেত তাঁর। হাতের কাছে যা পেতেন ধরে কপাকপ মুখে পরে দিতেন। দীর্ঘ ছয় মাসের খিদে বলে কথা! জানা যায়, মানুষও সেই খাদ্যতালিকায় এসে পড়ত। রাবণ কুম্ভকর্ণের নিদ্রার জন্য দুই যোজন দীর্ঘ ও এক যোজন বিস্তৃত এক বিচিত্র ভবন নির্মাণ করে দেন। সেখানে ছয় মাসান্তে নিদ্রাভঙ্গের পর কুম্ভকর্ণ প্রচুর পান ও ভোজন করতেন। যে সময়টায় রাম-রাবণের যুদ্ধের সময়, তখন। কুম্ভকর্ণ তো নিদ্রার কাল। হাজার চেষ্টাতেও সেই ঘুম ভাঙানো সম্ভব হচ্ছে না। উপায়ান্তর না-পেয়ে অবশেষে ১০০০ হাতি তাঁর শরীরের উপর দিয়ে হাঁটিয়ে দেওয়া হল, ঘুম ভাঙল রাবণের এই ভাইয়ের। ছয় মাস ঘুমিয়ে থাকা আর ছয় মাস জেগে থাকা এবং ভোজনের বর্ণনা–এসব রূপকথার গপ্পো। বাড়াবাড়ি রকমের বানোয়াট।
রামশিবিরের যোদ্ধারা যখন সমুদ্রসৈকতে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন কুম্ভকর্ণ রীতিমতো জেগে ছিলেন। কেউ তাঁর অসময়ের কাঁচা ভাঙিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে টেনে আনেননি। যুদ্ধের নিমিত্ত রামশিবির যেসময় যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন রাবণ যুদ্ধকালীন কুম্ভকর্ণ, ইন্দ্রজিৎ, বিভীষণ, মহাপার্শ্ব সহ সকলকে নিয়ে সভা করছিলেন। রাবণের সভায় কুম্ভকর্ণই ছিলেন অন্যতম বক্তা। শত্রুর বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধ করবেন বলে অঙ্গীকারবদ্ধ হলেন। তর্কের খাতিরে যদি রূপকথাটি মান্য করি, অকালে ঘুম ভাঙিয়ে কুম্ভকর্ণকে হত্যা করা হয়েছে। এ সময়টায় জাগিয়ে কুম্ভকর্ণের স্বাভাবিক মৃত্যুর সময়। এ সময়ে কুম্ভকর্ণকে হত্যার মধ্যে কোনো বীরত্ব আছে বলে হয় না। বীরত্ব তখনই প্রকাশ পেত যদি কুম্ভকর্ণকে জাগার ছয় মাসের যে-কোনো সময়ে হত্যা করতেন।
অতিশয় ধার্মিক, বুদ্ধিমান এবং সাহসী ছিলেন। এতটাই যে তাঁকে স্বয়ং ইন্দ্র পর্যন্ত ঈর্ষা করতেন। রাম ও রাবণের যুদ্ধে লঙ্কা বীরশূন্য হয়ে পড়লে রাবণ বহু অনুচর পাঠিয়ে কুম্ভকর্ণকে ডেকে পাঠান। সীতা অপহরণ এবং রামেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য রাবণকে তিরস্কার করেন। রাবণের কামুকতা আর অহংবোধকে মহামতি কুম্ভকর্ণ অনুমোদন করতে পারেননি। বলেছেন–“দিষ্ট্যা ত্বাং নাবী রামো বিষমিশ্রমিবামিষ”।
দাদার প্রতি কর্তব্য পালনে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে যান। বহু বানরকে হত্যা করেন, গিরিশৃঙ্গের আঘাতে সুগ্রীবকে সংজ্ঞাহীন করে দেন এবং লঙ্কায় ধরে নিয়ে যান। কুম্ভকর্ণের আক্রমণে ছত্রখান হয়ে যায় রামচন্দ্রের সেনা। আহত হন হনুমান। অজ্ঞান হয়ে যান সুগ্রীব। কুম্ভকর্ণের দুই পুত্র কুম্ভ এবং নিকুম্ভকেও এ যুদ্ধে প্রাণ হারাতে হয়। শিবপুরাণ অবশ্য বলছে, কুম্ভকর্ণের ভীম নামে তৃতীয় পুত্রও ছিলেন।
বিভীষণ : যিনি না-থাকলে রামের পক্ষে কিছুতেই রাবণ ও রাবণের সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করা সম্ভব হত না, তিনি ‘একমেব অদ্বিতীয়ম’ বিভীষণ। ঘরশত্রু বিভীষণ’, ‘বেইমান বিভীষণ’, ‘ঘর জ্বালানি পর ভুলানি বিভীষণ, ‘বিশ্বাসঘাতক’ বিভীষণ। বিশ্বাসঘাতক মিরজাফরকে আমরা প্রাণ খুলে গাল পাড়ি, আবার বিশ্বাসঘাতকের ইতিহাসকে (যদি ইতিহাস বলেন) কুর্নিশও করি। চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতার জন্যই পরাজয়, বীরত্বে নয়। রামায়ণে বিভীষণের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় যেমন লঙ্কা ধ্বংস হয়েছে, তেমনই মহাভারতেও নিজেদেরই সেনাপতিদের বিশ্বাসঘাতকতায় কৌরব বংশ ধ্বংস হয়েছে। আঠেরো দিনের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৌরবদের পক্ষে সেনাপতির দায়িত্বে ছিলেন যথাক্রমে ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, কর্ণ, শল্য প্রমুখ অপ্রতিরোধ্য বীরপুরুষরা শত্রুপক্ষের শিবিরের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসলেন। প্রতিরোধ তো দূরের কথা, যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র ত্যাগ করে কৌরবদের ধ্বংসের পথ নিশ্চিত করেছিলেন। সেনাপতি হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে এই ধরনের নিষ্ক্রিয় অবস্থানে পাণ্ডবদের প্রায় আয়েশেই যুদ্ধজয় হাতে তুলে নিয়েছেন। বিশ্বাসঘাতকতা না-করলে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ফলাফল অন্যরকম হত অবশ্যই। বেইমান, বিশ্বাসঘাতক সেনাপতিদের চিনতে না-পারার মাশুল যেমন কৌরবদের। গুণতে হয়েছে, তেমনই বিভীষণকে কারাবন্দি বা মৃত্যুদণ্ড না-দিয়ে রাবণকেও একই মাশুল গুণতে হয়েছে।
‘রামায়ণ’ গ্রন্থখানির প্রধান খলনায়ক (?) চরিত্র রাবণের ‘অপদার্থ’ ভাই বিভীষণ। পৌরাণিক কাহিনি মতে বিশ্রবার ঔরসে নিকষা বা কৈকসী গর্ভে ইনি জন্মগ্রহণ করেন। বিভীষণের অপর দুই ভাইয়ের নাম রাবণ ও কুম্ভকর্ণ, স্ত্রীর নাম সরমা। দুটি সন্তান–পুত্র তরণীসেন ও কন্যা কলা। সুমালী কুবেরের মতো দৌহিত্র লাভের আশায় তাঁর কন্যা কৈকসীকে বিশ্রবা মুনির কাছে পাঠান। ধ্যানস্থ অবস্থায় বিশ্রবা, তাঁর কাছে কৈকসীর আসার কারণ অবগত হয়ে কৈকসীর সঙ্গে যৌনমিলন করেন। তবে ইনি ভবিষ্যৎ বাণী করেন যে, অসময়ে যৌনসম্ভোগ করার কারণে কৈকসী রাক্ষসের জন্ম দেবেন। এরপর কৈকসী উত্তম পুত্র প্রদানের জন্য বিশ্রবাকে অনুরোধ করলে, বিশ্রবা সন্তুষ্ট হয়ে বলেন যে, তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র ধর্মানুরাগী হবে। সেই বাণী মতে কৈকসীর প্রথম দুই পুত্র রাবণ ও কুম্ভকর্ণ রাক্ষস হয়ে জন্মান। শেষ পুত্র বিভীষণ রাক্ষস হলেও ধর্মানুরাগী হন। এই হল। এঁদের জন্মবৃত্তান্ত।
বস্তুত পৌরাণিক কাহিনি শুধুমাত্র বিভীষণকে ‘ধর্মানুরাগী’ বলে চিহ্নিত করলেও রাবণ ও কুম্ভকর্ণও কিছু কম ধর্মানুরাগী ছিলেন না। আসলে পক্ষপাতিত্বেই বিভীষণকে কবি এগিয়ে রেখেছেন। বস্তুত রাবণের পরিবর্তে বিভীষণ যদি লঙ্কার রাজা হতেন তাহলে রাবণ যা করেছেন বিভীষণও তাই-ই করতেন। বিরোধী হিসাবে মহান’ থাকতে পারলেও শাসক হিসাবে থাকতে পারতেন না। সরকার বা শাসনে থাকার সঙ্গে বিরোধীদের ব্যবধান অনেক যোজন দূর। বিরোধী টেবিলে বসে কাঠি দেওয়া অনেক সহজ। বিভীষণও ব্যতিক্রম নন। কারণ তিনি ছিলেন রাজার বিরোধী, দেশদ্রোহী তো বটেই। বিভীষণের ষড়যন্ত্র ব্যতীত লঙ্কা কিছুতেই ছারখার হত না।
রামায়ণ মহাকাব্যে তাঁর ভূমিকা কী, কতটুকু? খর, দূষণ, শূর্পণখা ও রাক্ষসদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে রাবণ সীতাকে অপহরণ করে লঙ্কায় নিয়ে আসেন। বছর দুয়েক হল রাবণ সীতাকে তুলে এনেছেন। প্রতিবাদ তো দূরের কথা, আপত্তিটুকু পর্যন্ত কোনোদিন করেননি বিভীষণ। যখন জানতে পারলেন রাম অপরাজেয় বানরবাহিনী নিয়ে লঙ্কার কাছাকাছি এসে উপস্থিত হয়েছেন লঙ্কেশ্বরের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য, তখন কেমন যেন বিভীষণ বিদ্রোহ করতে শুরু করে দিলেন লঙ্কালাভের সুপ্ত বাসনায়। রাবণকে সীতাকে ফিরিয়ে দেওয়ার উপদেশ দেন। রামের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে রাবণ ও রাক্ষসবংশের সমূহ ক্ষতি হবে–এমন বক্তব্যও রাখলেন। এমন কোনো কথা তিনি আগে কখনো বলেননি, রাম-লক্ষ্মণরা যে তাড়কা-শূর্পণখা সহ হাজার হাজার রাক্ষসদের বিনা প্ররোচনায় মেরে ফেলছে তার কী হবে বিহিত! নিজের দেশের কথা না-বলে বিদেশি রামের পক্ষে সওয়াল করায় রাবণ বিভীষণকে অপমান এবং পদাঘাত করেন। “ন তু মিত্রপ্রবাদেন সংবসেৎ শত্রুসেবিনা”–রাবণ বললেন। এই অপমানের বদলা নিতে বিভীষণ তাঁর চারজন অনুগতকে রাক্ষস নিয়ে স্বদেশ ত্যাগ করেন এবং শত্রুপক্ষ রামের দলে সরাসরি যুক্ত হয়ে যান। কিন্তু বিভীষণ তো শত্রুপক্ষের, সুগ্রীব আর সুগ্রীবের সেনারা তাঁকে বিশ্বাস করবেন কেন? সুগ্রীব, জাম্ববান প্রমুখেরা যথারীতি সন্দেহ প্রকাশ করলেন। এমতাবস্থায় হনুমান এগিয়ে এলেন। হনুমান সুগ্রীবের মহামন্ত্রী, তাই বিভীষণের মতলব পড়ে নিতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয়নি। হনুমান বললেন–“বালিনং তু হতং ত্বা সুগ্রীবঞ্চাভিষেতি। রাজ্যং প্রার্থয়মানস্তু বুদ্ধিপূর্বমিহাগতঃ”। অর্থাৎ “বালিকে হত্যা করে রাম যে সুগ্রীবকে কিষ্কিন্ধ্যার রাজা করেছেন, সে খবর বিভীষণ রেখেছেন। তাই বিভীষণ ভেবেছেন এ যুদ্ধে রাবণে মৃত্যু হলে তিনিই লঙ্কার রাজা হবেন। এটাই তাঁর আশা।” একথা অবগত হলেন রাম। বুঝলেন বিভীষণের সাধই রামশিবিরের সাধ্য পূরণ করতে পারে। রাম বিভীষণকে দলে নিলেন। গৃহভেদী’ বিভীষণ রাবণের শত্রুপক্ষে নাম লিখিয়েই জানিয়ে দিলেন–“ভবদগতং হি মে রাজ্যং জীবিতঞ্চ সুখানি চ।” অর্থাৎ “এখন আমার রাজ্যলাভ, জীবন ও সুখ সবই আপনার উপর।” বিনিময়ে বিভীষণ প্রতিশ্রুতি দিলেন–“রাক্ষসানাং বধে সাহং লঙ্কায়াশ্চ প্ৰধর্ষণে।” অর্থাৎ “রাক্ষস হত্যায় সাহায্য করব, লঙ্কার অধিকারে সাহায্য করব”।
রাম আর দেরি করলেন না। শুভস্য শীঘ্রম্। প্রতিশ্রুতি বিভীষণের মুখ থেকে বেরলো কি বেরলো না, তৎক্ষণাৎ বিভীষণের রাজ্যাভিষেকের আয়োজন করলেন। লঙ্কার নকল রাজা হলেন বিভীষণ। রাবণের সিংহাসন পেতে বিভীষণের এখন সময়ের অপেক্ষা। অনায়াসে রাবণ বধের সমস্ত অন্ধিসন্ধি রামকে জানিয়ে দিলেন বিভীষণ। রাবণ ও রাক্ষসবংশকে ধ্বংস করতে বিভীষণ নির্লজ্জের মতো রামকে সাহায্য করেছিলেন। রাজ্য ও সিংহাসনের লোভ বিভীষণের এতটাই যে, মেঘনাদের আঘাতে রাম-লক্ষ্মণ যখন মৃতপ্রায় হন, তখন বিভীষণ হাউহাউ করে কেঁদেছিলেন। কেঁদেছিলেন কারণ, রাম-লক্ষ্মণ মরেই যায়, তাহলে তিনি লঙ্কেশ্বর হবেন কী করে–“যয়োর্বীর্যমুপাশ্ৰিত্য প্রতিষ্ঠা কাঙ্ক্ষিতা ময়া”। বিভীষণ বলছেন–“হায়, আমি যাঁহাদের বাহুবলে রাজ্যপদ কামনা করিয়াছিলাম, এক্ষণে তাঁহারাই মৃত্যুর জন্য শয়ান।” কিষ্কিন্ধ্যারাজ সুগ্রীব বোঝালেন বিভীষণকে–“রাজ্যং প্রান্সসি ধর্মজ্ঞ লঙ্কায়াং নেহ সংশয়”।
বিভীষণ অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তি, ক্ষুরধার তাঁর বুদ্ধি। তিনি বুঝে নিয়েছেন রাম যে সৈন্যবাহিনী নিয়ে লঙ্কার কাছাকাছি এসে উপস্থিত হয়েছেন, যুদ্ধ হলে লঙ্কার কেউ বেঁচে থাকবেন না। নিজের ‘জান’ বাঁচাতে হলে শত্রুশিবিরে যোগ দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। বহুদিন ধরেই তক্কে তক্কে ছিলেন বিভীষণ, রাবণকে সরিয়ে লঙ্কার সিংহাসন তিনি অলংকৃত করবেন। রাবণও কুবেরকে হটিয়ে লঙ্কার দখল নিয়েছিলেন। তবে সীতাকে ইস্যু করে এসে গেল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সেই সুযোগের পিছনে বিভীষণকে দৌড়োত হয়নি, সুযোগ বিভীষণের কাছে এসে ধরা দিল। না-হলে দু-বছর যাবৎ সীতা লঙ্কায় আটক ছিলেন রাবণ, কোনোদিন বিদ্রোহ তো দূরের কথা ন্যূনতম অভিযোগ পর্যন্ত করেননি। যেই-না শুনেছেন রাম তাঁর সৈন্যসামন্ত নিয়ে লঙ্কায় হাজির, অমনি তিনি নীতিবাগীশ হয়ে উঠলেন। সীতার জন্য কাতর তিনি।
এসবই বিভীষণের পূর্বপরিকল্পিত। তাই ক্রমে ক্রমে রাবণে উত্যক্ত করেছেন বিভীষণ। নানা অকথা কুকথা বলেছেন। বলেছেন–“তুমি গিয়া রামকে ধনরত্ন ও বসনভূষণের সহিত সীতা সমর্পণ করো, তাহা হইলেই আমরা এই লঙ্কাপুরীতে নির্ভয়ে বাস করিতে পারিব।” অন্যথায় রামের হাতেই তাঁর পরাজয় এবং মৃত্যু অপেক্ষা করে আছে। এমনকি শত্রুপক্ষের যোদ্ধা রামের জয়গানে মুখর হয়ে উঠলেন বিভীষণ। রাবণ এবার সত্যিই উত্তেজিত হয়ে পড়লেন, তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো কঠিন-কঠোর বাক্যবাণ–“বরং শত্রু ও রুষ্ট সর্পের সহিত বাস করিব, কিন্তু মিত্ররূপী শত্রুর সহিত সহবাস কদাচ উচিত নয়। .. রে কুলকলঙ্ক! যদি আমাকে অন্য কেহ এইরূপ কহিত, তবে দেখিতিস তদ্দণ্ডেই তাহার মস্তক দ্বিখণ্ড করিতাম।” বিভীষণ সফল। রাবণের মুখ থেকে চরম প্রতিক্রিয়াটি বের করতে পেরেছেন। বিভীষণ চেয়েছিলেন লঙ্কেশ্বর এরকম কিছুই বলুক। নাহলে বিভীষণের স্বপ্নপূরণ হবে না। রাজ্যলাভ হবে না। আর রাজ্যলাভ করতে হলে অবশ্যই শত্রুপক্ষে যোগ দেওয়া প্রয়োজন। ছুঁতো না-পেলে শত্রুপক্ষে যোগ দেওয়াটা বড়োই নগ্ন হয় পড়বে! শত্রুপক্ষে যোগ দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হলে এক মুহূর্তের জন্যেও বিভীষণ দেরি করেননি। যেখানে রাম-লক্ষ্মণ ও বানরসেনারা অপেক্ষা করে আছেন, সেখানে উপস্থিত হয়ে গেলেন। রামের ভক্ত হিসাবে নয়, লঙ্কায় ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য নয়–বিভীষণ রামের কাছে এসেছেন রাবণকে হত্যা করে লঙ্কার পরবর্তী রাজার হওয়ার বাসনায়। রামও স্পষ্টত বলেছেন–“তিনি স্বয়ং রাজ্যলাভার্থী, স্বার্থরক্ষার জন্য আমাদের সহিত সদ্ভাব স্থাপনই তাঁহার উদ্দেশ্য। সুতরাং বিভীষণকে সংগ্রহ করা কর্তব্য।”
ভাবুন, শত্রুপক্ষের সঙ্গে সাক্ষাতের প্রথম আলাপেই বিভীষণ সরাসরি তাঁর সুপ্ত ইচ্ছার কথা বলতে লজ্জাবোধ করেনি। লজ্জাবোধ থাকার কথাও নয়। কারণ নীতিগতভাবে তিনি তার বিনিময়ে রাবণের ধ্বংস সুনিশ্চিত করবেন। রামের জয় এনে দেবেন। গিভ অ্যান্ড টেক পলিসি। “বিষ্ণুর অবতার” রামকে দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন অপারেশনে সাহায্য করার জন্য বিভীষণ শত্রুপক্ষে যোগ দেননি। সুগ্রীব যদি কিষ্কিন্ধ্যা রাজ্য ও বালীর স্ত্রীকে পেতে পারে, তবে তিনি কেন লঙ্কারাজ্য ও মন্দোদরীকে পাবেন না! অতএব হাত মেলাও বন্ধু হও।
মাইকেল মধুসূদনের মহাকাব্যে বিভীষণ নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারের গোপন অবস্থানে লক্ষণকে নিয়ে গিয়ে ভাইপো মেঘনাদের হত্যায় সহায়তা করেন। ইনিই লঙ্কার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, রাবণের শক্তি ইত্যাদি সমস্ত তথ্য রামের কাছে পাচার করেন। যুদ্ধে রাবণ সবংশে নিহত হলে রাম বিভীষণকে প্রতিদান ফিরিয়ে দিতে ভোলেননি। রাম লঙ্কার শাসনভার বিভীষণের হাতে শাসনভার তুলে দেন। ধর্মানুরাগী বিভীষণ নিজের সদ্য বিধবা বউদি মন্দোদরীকে (রাবণের স্ত্রী) বিবাহ করতে দেরি করেননি। না, কবি অবশ্য একথা কোথাও বলেননি যে, বিভীষণ বউদিকে নিজের করে ভোগ করার জন্য নিজের দাদা রাবণের মৃত্যুকে তরান্বিত করতে রামের পক্ষ নিয়ে কাজ হাসিল করেছিলেন। সুগ্রীবও একই পথে নিজের বউদিকে ভোগ করতে নিজের ভাইকে হত্যা করিয়েছিলেন রামকে দিয়ে। বউদিরা কি এতই সুস্বাদু!
সুবিপুল বানরসেনা, রাম-লক্ষ্মণের অস্ত্র-নিপুণতা আর বিভীষণের জ্ঞাতিবিরোধিতায় রাবণ পরাজিত হলেন। গুপ্তপথ, গুপ্তচর, গুপ্তঅস্ত্র–সবই রামকে চিনিয়ে দিয়েছিলেন বিভীষণ। বিভীষণ না-থাকলে রামের পক্ষে রাবণ নিকেশ অত সহজে সম্ভব হত না। বিভীষণ থাকলে একটা মামুলি বানরও রাবণ হত্যায় সক্ষম হতেন। রামের প্রয়োজন হত না। রাবণ রামের অপেক্ষা কয়েকশো গুণ শক্তিশালী ও বীর ছিলেন। একথা রামই স্বীকার করেছেন–“মহাত্মা বলসম্পন্নো রাবণো লোকরাবণঃ”। সেইজন্যই বোধহয় কবি রাবণের দশ মাথা কুড়ি হাত কল্পনা করেছেন। উত্তরকাণ্ডে রামের আত্মহননের সময় বিভীষণও সঙ্গী হয়েছিলেন।
এই বিভীষণকেই আমরা মহাভারতেও দেখা পাই। সেটা আবার কীভাবে সম্ভব হল!! মহাভারত বলছে–পাণ্ডবরা যখন রাজাসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন, তখন বিভীষণ তাঁদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। এবং তাঁদের বহুমূল্য সমস্ত সামগ্রী ও উপহার প্রদান করেন।
মন্দোদরী : মন্দোদরী প্রথমে রাবণের স্ত্রী এবং পরে বিভীষণের স্ত্রী। মন্দোদরী ছিলেন অ-সুররাজ ময়দানবের ও স্বর্গবশ্যা হেমার কন্যা। ময়দানব অ-সুর জাতির প্রখ্যাত স্থপতি। রামায়ণের কোনো কোনো সংস্করণ অনুযায়ী বলা হয়েছে–মন্দোদরী রামের স্ত্রী সীতারও গর্ভধারিণী মা। উল্লেখ্য, এই সীতাকেই তাঁর স্বামী রাবণ অপহরণ করে লঙ্কায় এনেছিলেন। সীতা, না বেদবতী? মন্দোদরী বারবার সীতাকে রামের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য রাবণকে পরামর্শ দিয়েছিলেন এই কারণেই। কিন্তু রাবণ তাঁর কথায় কর্ণপাত করেননি। তবে রামায়ণগুলিতে রাবণের প্রতি মন্দোদরীর ভালোবাসা ও আনুগত্যেরই প্রশংসা করা হয়েছে। রামায়ণের একাধিক সংস্করণে রামের বানরসেনার হাতে মন্দোদরীর হেনস্থার উল্লেখ পাওয়া যায়। হেনস্থার ব্যাপারটা অস্বাভাবিক কিছু ভাবার অবকাশ নেই, এমন তো আজও হয়! কৃত্তিবাসের রামায়ণেও তো বলা হয়েছে,–বানরেরা মন্দোদরীকে টেনে এনে তাঁর পোশক পর্যন্ত ছিঁড়ে দিয়েছিলেন। বিচিত্র রামায়ণ’-এর বর্ণনা অনুযায়ীও হনুমান মন্দোদরীকে হেনস্থা করেছিলেন। থাই রামায়ণ ‘রামাকিয়েন’-এ মন্দোদরীর প্রতীকী ধর্ষণের উল্লেখ আছে। রামাকিয়েনে বলা হয়েছে–হনুমান রাবণের রূপ ধরে এসে মন্দোদরীর সঙ্গে যৌনসম্ভোগ করেন। এর ফলে মন্দোদরীর সতীত্ব নষ্ট হয় এবং যেহেতু মন্দোদরীর সতীত্বই রাবণের জীবন রক্ষা করছিল, সেহেতু এই ঘটনা রাবণের মৃত্যুর কারণ হয়।
আবার রামায়ণের কোনো কোনো সংস্করণে বলা হয়েছে, তাঁকে ব্যবহার করে বানরেরা রাবণের যজ্ঞ ভণ্ডুল করেছিল। হনুমান কৌশলে তাঁর কাছ থেকে রাবণের মৃত্যুবাণের অবস্থান জেনে নিয়েছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর জন্য হনুমানকে পথ দেখিয়েছিলেন মন্দোদরীই। জানিয়েছিলেন স্বামীর মৃত্যুবাণ কোন্ স্তম্ভে (Pillar) সুরক্ষিত আছে। রাবণের মৃত্যুর পরে বিভীষণ বিধবা মন্দোদরীকে বিবাহ করেন। যদিও বিভীষণের নিজেরও এক স্ত্রী ছিল, তাঁর নাম সরমা। একটি তত্ত্ব অনুযায়ী, রাবণ মাতৃতান্ত্রিক জাতির প্রতিনিধি ছিলেন। তাই তাঁর মৃত্যুর পর শাসনক্ষমতা পেতে বিভীষণ রাজমহিষীকে বিবাহ করেন। অপর একটি মতে, রাজমহিষীকে বিবাহ করা সম্ভবত অনার্য সভ্যতার লক্ষণ। মন্দোদরী ও বিভীষণের বিবাহ ছিল ‘রাজনৈতিক কূটবুদ্ধিপ্রসূত বলা হয়, এই বিবাহ কোনোভাবেই ‘পারস্পরিক দৈহিক আকর্ষণের ভিত্তিতে হয়নি। সম্ভবত রাজ্যের উন্নতি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে এবং রাজকীয় ক্ষমতা ভোগ করতে মন্দোদরী বিভীষণকে বিবাহ করতে রাজিও হয়েছিলেন। বিবাহের অপর একটি কারণ ছিল রাম মন্দোদরীকে ‘সতী’ হতে বারণ করেছিলেন।
বাল্মীকি রামায়ণে মন্দোদরীকে সুন্দরী নারীর রূপে চিত্রিত করা হয়েছে। রামের বানর বার্তাবাহক হনুমান সীতার সন্ধানে লঙ্কায় এলে, তিনি মন্দোদরীর সৌন্দর্যে বিস্মিত হয়ে প্রথমে তাঁকেই সীতা বলে ভুল করেন। ভুল কেন করবেন সেটা বোধগম্য নয়, হনুমান যে স্বয়ং দেবতা’! রাবণ সীতার মুণ্ডচ্ছেদ করতে উদ্যত হলে মন্দোদরী সেই সময় রাবণকে বাধা দিয়ে সীতার প্রাণরক্ষা করেন। মন্দোদরী উপদেশ দেন, রাবণ সীতাকে বিবাহের ইচ্ছা ত্যাগ করে তাঁর অন্যান্য মহিষীদের সম্ভোগ করতে পারেন। মন্দোদরী সীতাকে তাঁর অপেক্ষা কম সুন্দরী ও নিচকুলজাত মনে করলেও, রামের প্রতি সীতার ভক্তি সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন এবং সীতাকে দেবী শচী ও রোহিণীর সঙ্গে তুলনা করেন। যুদ্ধের আগে মন্দোদরী শেষবারের মতো রাবণকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছিল। শেষপর্যন্ত মন্দোদরী বাধ্য ও বিশ্বস্ত স্ত্রীর মতো রাবণের পাশে এসে দাঁড়ান স্বামীকে রক্ষাকরতে। যদিও তিনি তাঁর পুত্র মেঘনাদকেও রামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করার উপদেশ দিয়েছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর মন্দোদরী করছেন–“নাথ! সীতা অপেক্ষাও তো তোমার বহুসংখ্যক রূপবতী রমণী আছে। … সীতা ও রূপগুণে কিছুতেই আমার অনুরূপ বা অধিক নয়।”
রামায়ণে মন্দোদরীর ভূমিকা সংক্ষিপ্ত। তাঁকে এক ধর্মপ্রাণা ও নীতিপরায়ণা রাজমহিষীরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের মতে, পঞ্চকন্যার অন্যান্যদের তুলনায় মন্দোদরীর জীবন ‘কম বর্ণময় ও কম ঘটনাবহুল। তিনি আরও বলেছেন, “মন্দোদরী বিশেষ গুরুত্ব পাননি। তাঁর ছবিটিতে বস্তুগত অভাব বোধ হয় এবং তা শীঘ্রই ক্ষীণ হয়ে আসে। যদিও স্বামীর প্রতি তাঁর ভালবাসা ও আনুগত্য বিশেষ গুরুত্বের দাবি রেখেছে।” ‘পঞ্চকন্যা উইমেন অফ সাবস্ট্যান্স গ্রন্থের রচয়িতা প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেছেন, “বাল্মীকি তাঁর (মন্দোদরী) সম্পর্কে বিশেষ কিছু লেখেননি। শুধু এটুকুই উল্লেখ করার মতো যে তিনি সীতাকে ফিরিয়ে দিতে বলেছিলেন এবং সীতাকে ধর্ষণ করার থেকে রাবণকে নিরস্ত করেছিলেন।” মন্দোদরী যতটুকু সীতাকে রক্ষার জন্য ডুকরে উঠেছিলেন, তার একবিন্দুও তেমন করে ডুকরে উঠেননি রাম-লক্ষ্মণ কর্তৃক বিরাধ-তাড়কা-শূর্পণখামারীচ সহ ১৪ হাজার স্বজাতির মৃত্যুতে। তখন কোথায় ছিল তাঁর মানবিক মুখ, সে বিষয়ে উল্লেখ নেই রামায়ণে। তবে মন্দোদরী বিশ্বাস করেন না যে রামই তাঁর স্বামীকে হত্যা করতে পারেন। তাঁর দৃঢ় ঘোষণা, ইন্দ্রই রাবণকে হত্যা করেছেন।
শত্রুঘ্ন : রাজা দশরথের স্ত্রী সুমিত্রার গর্ভজাত যমজ পুত্রের মধ্যে লক্ষ্মণ জ্যেষ্ঠ ও শত্রুঘ্ন কনিষ্ঠ। ইনি লক্ষ্মণ ও রামের অনুগত ও সহায় ছিলেন। রামের বনগমনে পুত্রশোকে দশরথ দেহত্যাগ করেন। তখন শত্রুঘ্ন ভরতের সঙ্গে ভরতের মাতুলালয়ে ছিলেন। শত্রুঘ্নের সঙ্গে জনকরাজার কনিষ্ঠ ভ্রাতার অন্যতমা কন্যা শ্রুতকীর্তির বিবাহ হয়। রামের নির্বাসনে ইনি এতদূর বিরক্ত ও মর্মাহত হয়েছিলেন যে সকল অনর্থের মূল কৈকেয়ীর দাসী মন্থরাকে নিগৃহীত করেন এবং কৈকেয়ীকে কঠোর ভর্ৎসনা করেন। কবিবর বাল্মীকি শত্রুঘ্নর জন্য এটুকু কাজই। বরাদ্দ করেছিলেন। এর বেশি নয়। প্রায় ঠুটো জগন্নাথ!!
পরবর্তী প্রক্ষিপ্ত-সংসোজক রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে শত্রুঘ্নর কিছু কাজ সংযোজন করে দিলেন। তা না-হলে যে শত্রুঘ্নর নামের প্রতি সুবিচার হয় না! বন-ফেরত রামের রাজত্বকালের প্রথম বছরেই শত্রুঘ্নকে পাঠিয়ে দিলেন মথুরায় লবণাসুরকে হত্যা করতে। অযোধ্যা শত্রম্নমুক্ত হল। ভরতের কাছ থেকে শত্রুঘ্নকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া গেল। ভরত গন্ধবদেশ জয় করে ওখানেই থেকে গেলেন এবং শত্রুঘ্নকে মথুরার রাজপদে রাম অভিষিক্ত করে দিলেন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে। সঙ্গে লবণবধের জন্য চার হাজার ঘোড়া, দুই হাজার রথ আর একশো হাতি পাঠিয়ে দিলেন। সেনাদের একমাস আগে পাঠিয়ে দিয়ে শত্রুঘ্নকে একা শরাসন হাতে দিয়ে পাঠালেন। অযোধ্যায় ফিরে আসার কোনো অনুমতি ছিল না শত্রুঘ্নর। পাছে অযোধ্যা আক্রমণ করে বসে সেই সতর্কতায় কি সৈন্যবাহিনীসহ শত্রুঘ্নকে অযোধ্যায় অবস্থান করতে দেননি? শত্রুঘ্ন মধুদৈত্যের পুত্র লবণাসুরের মুখোমুখি হলেন। এসময় যমুনাতীরবাসী মহর্ষিরা অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে উঠছিল। শত্রুঘ্ন রামের আদেশে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযান করেন। লবণাসুর শত্রুঘ্নকে হুংকার দিলেন, বললেন–“পূর্বে অনেক বীরকে তৃণের মতো তুচ্ছ করে যমালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি।” জবাবে শত্রুঘ্নও বললেন–“শত্রুঘ্ন ন তদা জাতো যদান্যে নির্জিতস্তয়া।/তদদ্য বাণাভিহত ব্ৰজ ত্বং যমসদন।” অর্থাৎ, “তুমি যখন বীরদের যমালয়ে পাঠিয়েছিলে তখন শত্রুঘ্নর জন্ম হয়নি। এখন তুমি আমার বাণে যমালয়ে যাও।” এরপর তাঁকে শূলহীন অবস্থার সুযোগ নিয়ে আক্রমণ করেন এবং বিনষ্ট করেন। দেবতা প্রদত্ত শূলের জন্যই মধুদৈত্যের মতো তাঁর পুত্র লবণও অজেয় ছিল। লবণবধের পর শত্রুয় লবণের মথুরারাজ্য নিজের পুত্র সুবাহু ও শত্রুঘাতাঁকে অর্পণ করেন। সুবাহু পরবর্তীকালে মথুরার রাজা হিসাবে অভিষিক্ত হন। শত্রুঘাতী ছিলেন বিদিশার রাজা। এরপর শত্রুঘ্ন রামের সঙ্গে সরযু নদীতে প্রবেশ করে দেহত্যাগ করেন। মোদ্দা কথা, একটিমাত্র শত্রু হত্যা করে তিনি শত্রু।
শান্তা : রামায়ণে শান্তা নামে একটি চরিত্র পাওয়া যায়। রাজা দশরথের ও দশরথের পরম বন্ধু অঙ্গাধিপতি রাজা রোমপাদের পালিতা কন্যা। রাজা লোমপাদ যজ্ঞ করার জন্যে বিভাণ্ডক মুনির পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গকে নিজের রাজধানীতে নিয়ে আসেন। যজ্ঞশেষে তিনি নিজের পালিতা কন্যা শান্তাকে ঋষ্যশৃঙ্গের হাতে তুলে দেন। শান্তার সঙ্গে ঋষ্যশৃঙ্গের বিবাহ হয়।
কিন্তু কবিরা তাঁর প্রতি বিন্দুমাত্র সুবিচার করেননি। অযোধ্যাপতি দশরথ ও তার প্রধানমহিষী কৌশল্যার প্রথম সন্তান হলেন শান্তা। সম্ভবত শান্তাই হলেন রামায়ণের সবথেকে স্বল্পত চরিত্র। শান্তা রামচন্দ্রের অগ্রজা, বড়ো দিদি। যথাক্রমে শান্তা, রাম, লক্ষ্মণ, ভরত ও শত্রুঘ্ন–এই হল চার ভাই, এক বোন। শান্তা রামচন্দ্রের দিদি নিশ্চয়ই, কিন্তু দশরথের ঔরসজাত সন্তান নয় বলেই অনেকে মনে করেন। রাজা দশরথের সন্তানদানে অক্ষমতা ও দুর্বলতাকে নানা গল্পে জড়ানো হয়েছে। শান্তা কৌশল্যার ক্ষেত্রজ সন্তান–যা রাম-লক্ষ্মণদের মতো নিয়োগ প্রথার ফসল। অনেক পণ্ডিত মনে করেন, ঋষ্যশৃঙ্গের নিয়োগে বা কৃপায় (কৃপা = করে যা পাওয়া) রাম, লক্ষ্মণ, ভরত ও শত্ৰুগ্নদের জন্ম হয়েছে। শান্তার জন্মবৃত্তান্ত নিয়েও বহু গল্প আছে। কোনও কোনও রামায়ণ বলে, রাবণ যখন জানলেন, দশরথের পুত্রের হাতে তাঁর বিনাশ, তিনি নতুন উপায় বের করলেন। শিবের কাছে বর প্রার্থনা করলেন, দশরথের যেন কোনও পুত্র না জন্মায়। তাঁর বর মঞ্জুর হল।
শান্তার জন্ম হয়েছে রোমপাদের নিয়োগে। রোমপাদ পুত্রসন্তানের জন্ম দিতে না-পারার ব্যর্থতায় সম্ভবত পরবর্তীতে ঋষ্যশৃঙ্গের ডাক পড়ে। ঋষ্যশৃঙ্গ হতাশ করেননি। ঋষ্যশৃঙ্গ রোমপাদের পুত্রসন্তান। একটি নয়, দুটি নয়–চারটি পুত্রসন্তান উপহার দিলেন। দশরথ ও কৌশল্যার মেয়ে হয়ে জন্মালেও অঙ্গরাজ রোমপাদ ও তাঁর মহিষী ভার্ষিণী (যে সম্পর্কে কৌশল্যার বোন) তাকে দত্তক নেয়। ঋষি বিভাণ্ড ও স্বৰ্গবেশ্যা উর্বশীর পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গকে বিবাহ করে উনি উনার পিতার রাজ্যকে খরামুক্ত করেছিলেন। পরবর্তীকালে উনার ও রাজা দশরথের অনুরোধে ঋষ্যশৃঙ্গ পুত্রকামাষ্টি যজ্ঞ করেন। যার ফলে কৌশল্যা ও দশরথের অন্য দুই স্ত্রী কৈকেয়ী ও সুমিত্রাও গর্ভধারণ করেন। ঋষ্যশৃঙ্গকে বাল্মীকির রামায়ণে আমদানি করিয়ে প্রক্ষিপ্ত-কবিরা বড়োই দ্বন্দ্বে ফেলে দিয়েছেন। জটিলতা বাড়িয়েছেন। তবে গোটা রামায়ণে আর কোথাও শান্তাকে পাওয়া যায়নি।
কথিত আছে বিভাণ্ডক মুনির তপস্যা ভঙ্গ করতে দেবরাজ ইন্দ্র স্বৰ্গবেশ্যা উর্বশীকে পাঠালে উর্বশী মুনিকে প্রেমজালে আবদ্ধ করেন ও মুনির ঔরসে উর্বশীর গর্ভে ঋষ্যশৃঙ্গ জন্মায়। পুত্রের জন্মের পর স্বর্গের বেশ্যা (অপ্সরা) স্বর্গে ফিরে গেলে বিভাণ্ডকের খুব ক্ৰোধ জন্মায়। তাই সে নিজের পুত্রকে নারীদের সংস্রব থেকে দূরে রাখার জন্য এক নির্জন ও গভীর অরণ্যে প্রবেশ করেন। সেই থেকে ঋষ্যশৃঙ্গ একা বেড়ে ওঠে প্রকৃতির কোলে। রোমপাদ একবার এক ব্রাহ্মণকে অপমান করায় সে তাকে অভিশাপ দেয় যে রাজ্যে খরা নেমে আসুক। তখন শান্তা অনেক অনুনয় করলে ব্রাহ্মণ বলেন যে জন্মের পরমূহুর্ত থেকে যে পুরুষ কোনো নারীকে দর্শন করেনি সে যদি অঙ্গরাজ্যে এসে শান্তাকে বিবাহ করে তবেই বৃষ্টি নামবে। ফলে অনেক তপস্যা ও কষ্ট স্বীকার করে শান্তা ঋষ্যশৃঙ্গকে পরিণয় করে ও অবশেষে ব্রাক্ষ্মণের অভিশাপ থেকে রাজ্যকে রক্ষা করেন। শুধু রামায়ণে নয়, মহাভারত-পুরাণগুলিতে অবশ্য এরকম অজাচার সম্পর্কের কাহিনি পাওয়া যায়। বৌদ্ধ দশরথজাতকে তো রাম সীতা একে অপরের ভাই-বোন। এই রামায়ণে দশরথ অযোধ্যা নয়, বারানসীর রাজা। রাম পণ্ডিত, লক্ষ্মণ পণ্ডিত এবং সীতা দশরথের বড়ো রানির গর্ভে জন্ম নেন। বড়ো রানির মৃত্যু হলে দশরথ পুনরায় বিয়ে করেন এবং সেই নতুন রানির আবদারে ভাই-বোনদের হিমালয়ে নির্বাসনে পাঠাতে বাধ্য হন। অবশ্য বৌদ্ধদের রামায়ণে বানর নেই, মুনিঋষি নেই, রাবণ নেই, সীতার অপহরণও নেই। এ রামায়ণে হিমালয়ের নির্বাসন জীবন কাটিয়ে বারানসী ফিরে রাম রাজা হন, সীতা রানি হন। জাতক অনুসারে সীতা একদিকে রামের সহদোরা, অপরদিকে ভার্যাও। আবার অন্য এক রামকাহিনিতে পাওয়া যায় সীতা মন্দোদরীর কন্যা, মন্দোদরীর কন্যা হলে তো রাবণেরও কন্যা। যদি তাই-ই হয় তবে কি রাবণ সীতাকে ধর্ষণ করেছেন এ সন্দেহ ন্যায্যত হয়? সেযুগে হয়তো হত, না-হলে রাম সন্দেহ করবেন কেন! তবে অবশ্য রামায়ণে ঋষ্যশৃঙ্গ ঋষির ভূমিকা আর বিশেষ কিছু নয়। রামজন্মের পর কোনো ঘটনাতেই এই ঋষির উল্লেখ করা হয়নি। সেটার একটা কারণে হতে পারে–চিত্রনাট্যের ডিমান্ডে শান্তাকে বিয়ে এবং রামের জন্ম যে উপায়ে হয়েছে, সেটা কবি চাননি মানুষ মনে রাখুক। তাই হয়তো ঋষ্যশৃঙ্গকে আর ফিরিয়ে আনা হয়নি। শান্তাকেও বিশেষ কেউ মনে রাখেনি।
মন্থরা : দশরথ যে অত্যন্ত গোপনে রামের রাজ্যাভিষেকের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, সে কথা যেভাবেই হোক মন্থরার মাধ্যমে অন্দরমহলের কৈকিয়ের কাছে পৌঁছে যায়। দশরথের পরিকল্পনাকে কেঁচিয়ে দিতে দশরথের কাছ থেকে বর চাওয়ার ব্যাপারটা কৈকেয়ীকে মনে করিয়ে দেন মন্থরাই। রাজপ্রাসাদের ভিতরে রাম ও ভরতের বিভাজন–রাজনীতিটা মন্থরাও জানতেন, সেইজন্যই কৈকেয়ীর কানে মন্ত্র দেওয়ার সাহসটা তিনি পেয়েছেন।
মন্থরা হলেন রাজা দশরথের স্ত্রী রানি কৈকেয়ীর বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা কুজা দাসী। তিনি বিকৃতাকার, বক্ৰদেহা, ঈর্ষাপরায়ণা এবং কূটবুদ্ধিসম্পন্না ছিলেন। কুমন্ত্রণা দানে নিপুণ হলেও তিনি কৈকেয়ীর প্রকৃত হিতৈষী ছিল। স্বৰ্গবেশ্যাদের নৃত্যের সঙ্গে এঁরা বাদ্যযন্ত্রাদি বাজাতেন ও গাইতেন। হাহা, হুহু, চিত্ররথ (অঙ্গারপর্ণ), হংস, বিশ্বাবসু, গোমায়ু, নন্দি, তুম্বুরু ও মাদ্য–গন্ধর্ব হিসেবে প্রসিদ্ধ। গন্ধর্বীদের মধ্যে কুম্ভীনসী (অঙ্গারপর্ণের পত্নী), দুন্দভী (ইনিই মন্থরা’ নাম নিয়ে পিঠে কুঁজ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন দশরথপত্নী কৈকেয়ীকে কুমন্ত্রণা দিয়েছিলেন)। কুজা মন্থরা কৈকেয়ীর মাতৃসমা, আবার ভরতের ধাত্রীমাতাও। কেকয়রাজ অশ্বপতির স্নেহভাজন গুপ্তচরী। মন্থরা প্রিয়ভাষিণী কৌতুকপ্রিয়া, এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। রঙ্গকৌতুকে রাজপ্রাসাদের প্রতিটি মানুষকেই সহজেই আপন করে নিয়েছিলেন। গোপন সংবাদ সংগ্রহের জন্যে যে সকলেরই প্রয়োজন! মন্থরা অতি সুচতুর রাজনীতিক, ক্ষুরধার বুদ্ধিমতী ধৈর্যশীলা এবং চারুদর্শিনী। দশরথ জ্যেষ্ঠপুত্র রামকে রাজ্যাভিষিক্ত করতে চাইলে কৈকেয়ীকে মন্থরা নানাভাবে উত্তেজিত করতে থাকে। প্রথমদিকে কৈকেয়ী এসবে কান না দিলেও অবশেষে মন্থরার যুক্তিতে তাঁর বুদ্ধি নাশ হয়। তিনি কৈকেয়ীকে মনে করিয়ে দেন দশরথ শম্বুরাসুরের সঙ্গে যুদ্ধে আহত হলে কৈকেয়ী তাঁকে রণভূমি থেকে সরিয়ে এনেছিলেন এবং সেবা দিয়ে সুস্থ করেছিলেন। তখন দশরথ তাঁকে একই সঙ্গে দুটি বর দিতে রাজি হয়েছিলেন। এখন সেইসময় উপস্থিত হয়েছে, তাঁর উচিত প্রথম বরে ভরতকে রাজ্যে অভিষিক্ত করা এবং দ্বিতীয় বরে রামকে চোদ্দো বছরের জন্য বনবাসে পাঠানো। রাম বনের পথে লক্ষ্মণ ও সস্ত্রীক যাত্রা করলে ভরতের উপস্থিতিতে শত্রুঘ্নর হাতে লাঞ্ছনার পর মন্থরার আর কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। অথচ মন্থরাই রামকথার অন্যতম নিয়ন্ত্রকই ছিলেন। কৈকেয়ী তো বরের কথা ভুলেই গিয়েছিল। মন্থরাই মনে করিয়ে দিয়েছে উপর্যুপরি কান ভাঙানিতে। মন্থরা যে মন্ত্র কৈকেয়ীর কানে দিয়েছিলেন, তা দশরথ নিজের মুখে রামকে বলতে পারেননি। কৈকেয়ীর মুখ থেকে সব শুনে রাম বনবাসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। শুধু পিতৃসত্য পালনই নয়, বিমাতার মনোবাঞ্ছাও পূরণ করেছেন রামচন্দ্র।
লবকুশ : বাল্মীকি যে উত্তরকাণ্ড রচনা করেননি, সে ইঙ্গিত মেলে রামায়ণের চতুর্থ সর্গের সপ্তম শ্লোকে। বাল্মীকি নারদের নির্দেশে যে রামকথা লিখেছিলেন, তার নাম ছিল ‘পৌলস্ত্যবধ কাব্য’–“কাব্যং রামায়ণং কৃৎস্নং সীতায়াশ্চরিতং মহৎ।/পৌলস্ত্যবধ ইত্যেবং চকার চরিতঃ৷” লবকুশকে আমরা উত্তরকাণ্ডেই পাই। উত্তরকাণ্ডের কবিই এই চরিত্র দুটি সৃষ্টি করেছেন। বাল্মীকি লবকুশ সৃষ্টি করেননি বলেই অনেক পণ্ডিতগণ মনে করেন। এখন প্রশ্ন লবকুশ যদি রাম-সীতার সন্তান হন, তবে কীভাবে বাল্মীকির চোখ এড়িয়ে গেল? বাল্মীকির কিছুই চোখ এড়ায় না, এক্ষেত্রেও এড়ায়নি। চোখ এড়িয়েছে উত্তরকাণ্ডের কবির। আগেপিছে কিছু না-দেখে একটা আষাঢ়ে গপ্পো ফেঁদে বসলেন। সীতার যখন গর্ভসঞ্চার হয় তখন তাঁর বয়স ছিল ১৮ + ১২ + ১৪ + ২৭ (১৮ বছর বয়সে বিয়ে + ১২ বছর স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে অযোধ্যার রাজগৃহে বাস + ১৪ বছর বনবাস + ২৭ বছর। বনবাসোত্তর স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে বসবাস) = ৭১ বছর, মতান্তরে ৬ + ১২ + ১৪ + ২৭ = ৫৯ বছর। সীতাকে পরিত্যাগ করার পর বাল্মীকির আশ্রমে ১০ বছর যাপন। অশ্বমেধ যজ্ঞের সময়কালে রাম যখন দেখেন তখন লব ও কুশের বয়স ১০ বছর। এই ১০ বছর পিতার স্নেহ তো দূরের কথা, পিতার মুখ পর্যন্ত দেখার সুযোগ হয়নি দুর্ভাগা পুত্রদ্বয়ের।
বিজ্ঞান বলছে, বাস্তবিক কোনো নারী এই বয়সে গর্ভধারণ করতে পারেন না। নারীর গর্ভধারণের সময় কিছু কমবেশি ১২ বছর থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। মেনোপোজ বা পিরিয়ড বন্ধ হয়ে গেলে কোনো নারীর পক্ষেই সন্তানধারণ করা সম্ভব নয়। চরকসংহিতার পঞ্চম অধ্যায়ের চিকিৎসাস্থানে বলা হয়েছে–“দ্বাদশাদ্বৎসরাদূর্ধমা পঞ্চাশৎসমাঃ স্ত্রিয়ঃ।/মাসি মাসি ভগদ্বারা প্রকৃত্যৈবার্তবংস্রেবেৎ।” অর্থাৎ, স্ত্রীলোকের বারো বছর বয়সের পর থেকে পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত স্বভাবতই প্রতিমাসে তিনদিন করে রজঃ যোনিমুখ দিয়ে প্রস্রত হয়। চরক মুনি আরও বলেছেন–“দিনে ব্যতীতে নিয়তং সঙ্কুচিত্যম্বুজং যথা/ঋতৌ ব্যতীতে নাৰ্য্যাস্তু যোনিঃ সংব্রিয়তে তথা।” অর্থাৎ, দিনের শেষে যেমন পদ্ম সংকুচিত হয়, তেমনই ঋতুকাল অতিক্রান্ত হলে নারীদের যোনিও (জরায়ুপথ) সংকুচিত হয়ে যায়। অতএব এমন ভুল মহাকবি বাল্মীকি করতে পারেন না।
“রামঃ সীতানুপ্রাপ্য রাজ্যং পুনরবাপ্তবান্।/পিলয়ামাস চৈবেমাঃ পিতৃবনূদিতাঃ প্রজাঃ/অযোধ্যাপতিঃ শ্রীমান্ রামো দশরথাত্মজঃ।” মহাকবি তাঁর রামচরিত এভাবেই শেষ করেছেন। পরে আর কিছু ছিল না বলাই যায়। তবে পণ্ডিতগণ বলেন, মহাকাব্য এভাবে শেষ হয় না। অতএব উত্তরকাণ্ড বাল্মীকি লিখতেই পারেন। যেভাবে হোমারকে ইলিয়াডের পরেও ওডিসি গ্রন্থটি লিখতে হয়েছিল।
কিন্তু বাল্মীকি যে স্বয়ং বলেছেন–“প্রাপ্তরাজ্যস্য রামস্য বাল্মীকিৰ্ভগবানৃষিঃ।/চকার চরিতং কৃৎস্নং বিচিত্রপদমর্থবৎ।/চতুর্বিংশ সহস্রাণি শ্লোকানামুক্তবানৃষিঃ।/তথা সৰ্গ শতা পঞ্চ ষট্ কাণ্ডানি তথোত্তরম্।/কৃত্বাঃ তু তন্মহাপ্রাজ্ঞঃ সভবিষ্যং সহোত্তরম্।/চিন্তয়মানস্য মহর্ষের্ভাবিতাত্মনঃ।/অগৃহীতাং ততঃ পাদৌ মুনিবেশৌ কুশীলবৌ।/কুশীলবৌ তু ধৰ্ম্মজ্ঞে রাজপুত্রৌ যশস্বিনৌভ্রাতরৌ স্বরসম্পন্নৌ দদশাশ্রমবাসিনৌ।” কেদারনাথ মজুমদারের “রামায়ণের সমাজ” গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি উল্লেখ করতে পারি–“কুশীলবকে যে সীতার পুত্রদ্বয় বলিয়া পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা হইয়াছে, এবং নবম ছত্রে ঐ কুশীলবকে ‘রাজপুত্রৌ ও দশম ছত্রে ‘ভ্রাতরৌ’ বলিয়া যে নির্দেশ করা হইয়াছে, তাহা নারদ কথিত রামচরিত উপাখ্যানের বহির্ভূত। মুনিবেশৌ কুশীলবৌ’ প্রয়োগে আমাদের মোটেই কোনো আপত্তির কারণ নেই। ইহার অর্থ মুনিবেশধারী গায়কদ্বয়। বাল্মীকি রামচরিত গীতের জন্য রচনা করিয়াছিলেন এবং তাহা কুশীলব (গায়ক) দ্বারাই গান করাইয়া প্রচার করিয়াছিলেন। আমরা ‘কুশীলবৌ’ প্রয়োগটিকে সংগ্রাহকের প্রয়োগ বলিয়াই মনে করি; ইহার অর্থ ‘গায়কদ্বয়।এইএএএএ এই ‘কুশীলবৌ’ শব্দটিকে সীতার ‘রাজপুত্রৌ ও সেই প্রয়াস প্রসূত নবম ও দশম পংক্তির ‘পুত্রদ্বয়’ করিবার যে প্রয়াস ‘ভ্রাতরৌ’ ইত্যাদি শব্দ প্রয়োগকে উত্তরকাণ্ড রচয়িতার প্রয়াস বলিয়া নির্দেশ করিতেছি। উত্তরকাণ্ড রচয়িতা উক্ত কাণ্ডটিকে মূল রামায়ণের অঙ্গরূপে গণ্য করাইবার জন্য, এই সকল শব্দ প্রয়োগ করিয়াছিলেন এবং কোন কোন পংক্তি ও সর্গ নূতন করিয়া লিখিয়া দিয়াছিলেন।”
রাম-সীতার বিবাহের পর দীর্ঘ সাতাশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এর মাঝে অবশ্য বছর দুয়েক রামকে ছাড়াই সীতার একাকী জীবন লঙ্কায়। বিবাহের পর স্বামী-স্ত্রী যেমন একত্রে একশয্যায় বসবাস করেন, রাম-সীতাও সেইভাবেই বসবাস করেছেন। তা সত্ত্বেও তাঁরা নিঃসন্তান। অন্যদিকে ভরত, লক্ষ্মণ, শত্রুয় সকলেই দুটি করে পুত্রসন্তানের পিতা হয়ে গেছেন। এঁরা কীভাবে জোড়া জোড়া পুত্রের পিতা হয়েছিলেন, সে ব্যপারে রচয়িতা অবশ্য নীরব। রামভক্তরা হয়তো বলতে পারেন শ্রীরামচন্দ্র আর পাঁচটি পাতি মানুষের মতো নয়, রামচন্দ্র স্বয়ং বিষ্ণু। তিনি ব্রহ্মচর্য পালন করতেন। তাই তিনি নিঃসন্তান। এখন প্রশ্ন, রাম কেন ব্রহ্মচর্য পালন করতে যাবেন? রামকে তো কেউ ব্রহ্মচর্য পালন করতে শর্ত দেননি। বাল্মীকি তো তেমন কিছু বলেননি। রাম তো ভীষ্ম নয়। রাম তো সেই বিরল পুরুষ চরিত্র ভীষ্ম নয়, যিনি শত প্রলোভনেও ত্যাগ করতে পারেন নারীসঙ্গ, কামতেজ। রামভক্তদের বলি, লবকুশের বিষয়ে আপনারা যদি রামকে বাঁচাতে যান, তাহলে সীতা মারা যাবেন। সীতা কলঙ্কিত হবেন। সীতার সন্তানদের পিতাকে নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন উঠে আসবে। রাবণ সন্দেহজনক হবে। আর যদি রামের বিপক্ষে থাকেন তাহলে বিবাহ-পরবর্তী সাতাশ বছরের হিসাবটাও মিলিয়ে দিতে হবে, তাই না? কারণ যাঁদের দীর্ঘ সাতাশ বছরে কিছু হল না, সেখানে সীতা লঙ্কা-ফেরত হয়েই গর্ভবতী! যদি এটা সংগত না-হয়, গোটা উত্তরকাণ্ডও সংগত হতে পারে না।
বাল্মীকির বিরচিত রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ড পর্যন্ত কোথাও সীতার নির্বাসন, লক্ষ্মণ-বর্জন, লবকুশের কোনো উল্লেখ নেই। মহাভারতের বনপর্বে যে রামোপাখ্যান বর্ণিত হয়েছে, সেখানেও সীতার বনবাস তৎসহ লবকুশের কোনো প্রসঙ্গই উল্লেখ হয়নি। উল্লেখ হয়নি, কারণ মহাকবি বাল্মীকি তাঁর গীতিকবিতায় যেটুকু বর্ণনা করেছেন, ঠিক ততটুকুই মহাভারতের কবি চয়ন করেছেন। অতএব লবকুশ বানোয়াট, অলীক মস্তিষ্কপ্রসূত, অর্থহীন, অপ্রাসঙ্গিক, বাতুলতা। উত্তরকাণ্ডে এসেও দেখতে পাচ্ছি রামচন্দ্র পুত্রদের অযোধ্যার সিংহাসনে বসিয়ে যাননি, অযোধ্যার পরিবর্তে অন্য পৃথকরাজ্যে দুই পুত্রকে দুটি রাজ্যে অনাড়ম্বর অভিষিক্ত করে যান।
উত্তরকাণ্ড অনুসারে রাম মারা যাওয়ার আগে কোশল সাম্রাজ্যটি দুটি ভাগে আলাদা হয়ে যায়। একটি শ্রাবস্তী নামে আত্মপ্রকাশ করে, এই রাজ্যটি লবের জন্য নির্দিষ্ট হল। অপর রাজ্যটি কুশাবতী নামে পরিচিত হয়, এই রাজ্যটি কুশের জন্য বরাদ্দ হয়। লব কিন্তু শ্রাবস্তী পেয়েই থেমে থাকেননি, তিনি ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে তাঁর রাজ্য বিস্তার করে নেন এবং লাভাপুরী নামে একটি শহর প্রতিষ্ঠা করেন। এই লাভাপুরীই এখনকার লাহোর (বর্তমানে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্গত)। লবের আর-এক নাম লোহ লোহ থেকেই লাহোর নামকরণ। লাহোর ফোর্টের ভিতরে তাঁর নামে একটি মন্দিরও আছে। প্রসঙ্গত জানাই–কাশী ও মৌর্য রাজবংশ নাকি কুশেরই বংশধর। অপরদিকে রাজস্থানের মেবার রাজবংশ নাকি লবের বংশধর। এরকমই দাবি। সত্যাসত্য যাচাইয়ের কোনো সুযোগ নেই।
মারীচ : মারীচ, যিনি রামায়ণের স্বর্ণমৃগ। সোনার হরিণ, যাঁর ছলনায় রাবণ কর্তৃক সীতা অপহৃত হয়েছিলেন। লক্ষ্মণ বাণ ছুঁড়ে তাঁর নাক-কান কেটে দিলে শূর্পনখা ছুটে পালায়। এরপর বহু রাক্ষসরা দল বেঁধে যুদ্ধ করতে আসে। রাক্ষস দূষণ ও খরকে রামপক্ষ হত্যা করেন। শুধু তাই নয়, দণ্ডক বনে যত রাক্ষস জাতি ছিল প্রায় সবই মারা গেল। বেঁচে রইল অকম্পন ও শূর্পণখা। গতিক মন্দ দেখে তাঁরা লঙ্কায় গিয়ে রাজা রাবণকে খবর দেন। তখনি বোনের অপমানের প্রতিশোধ নিতে সীতাহরণের পরিকল্পনা করেন রাবণ এবং মারীচের শরণাপন্ন হন। রাক্ষসবংশের হয়েও যে মুনিদের মতোই তপস্যা করছে–সে হল মারীচ। রাবণ পুষ্পক রথে চেপে রওনা হল মারীচের সঙ্গে দেখা করার জন্য। মারীচের কাছে এসে রাবণ সমস্ত জানায় তাঁকে। মারীচ বহুদিন তপস্যার পরে মুনিসুলভ ধীর। সে রাবণকে বলে, যা হয়েছে তা দুঃখজনক, কিন্তু এই মানুষ জাতিদের অনেক খবর আমরা এখনও জানি না। রামের কাছে যে কী ধরনের অস্ত্র আছে সেটাও আমাদের জানা নেই। মারীচ নারাজ হলে রাবণ তাঁকে হত্যার ভয় দেখান।
মারীচ প্রথমে একটি স্বর্ণমৃগের রূপ ধরে সীতার সামনে ভ্রমণ করতে থাকলে, সীতা উক্ত স্বর্ণমৃগকে ধরে দেওয়ার জন্য রামের কাছে আবদার করলে, রাম স্বর্ণমৃগের অনুসরণ করে শরাঘাত করেন। এরপর বনের মধ্য থেকে হরবোলা মারীচ রামের কণ্ঠস্বর অনুকরণ করে, “হা লক্ষ্মণ, হা সীতা” বলে বিলাপ করতে লাগলে, সীতা লক্ষ্মণকে রামের সাহায্যের জন্য পাঠালেন। এই অবসরে রাবণ ভিখারির বেশে সীতার সামনে উপস্থিত হয়ে প্রথমে সীতাকে বিভিন্নভাবে ঘরের বাইরে আনার চেষ্টা করলেন। শেষপর্যন্ত কার্যসিদ্ধ না-হওয়ায়, রাবণ জোর করে সীতাকে রথে উঠিয়ে লঙ্কার পথে রওনা হলেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে মারীচ কি সত্যিই ২৪ ক্যারেট সোনার নিরেট হরিণ হয়েছিলেন? সোনা তো ধাতু, ধাতুতে প্রাণসঞ্চার হল কীভাবে? সেটা কি সম্ভব? নাকি চিরাচরিত সোনা-লোভী নারীকেই এ ঘটনার মাধ্যমে প্রতীতী উপস্থাপন করা হয়েছে? মারীচ কেমন মৃগরূপ ধারণ করেছিল সেটা একবার দেখে নিতে পারি। সেইসঙ্গে দেখে নেব স্বর্ণমৃগের বাস্তবতা কতটা। মহাকবি বাল্মীকি ‘স্বর্ণমৃগ’ মারীচ সম্পর্কে কী বলেছেন পণ্ডিত শ্ৰীমনোনীত সেনের ভাষায় দেখব–“তাঁহার শৃঙ্গ উৎকৃষ্ট মণিসদৃশ, মুখ রক্তপদ্ম ও নীলোৎপল-সবর্ণ, বদনমণ্ডল শুক্ল ও কৃষ্ণপ্রভাময়, কর্ণ ইন্দ্রনীল মণিতুল্য ও গ্রীবা কিঞ্চিৎ উন্নত, উদর-বর্ণ ইন্দ্রনীলমণিতুল্য, গাত্রের বর্ণ পদ্মকেশর সদৃশ ও মনোহর চিক্কণ, উভয় পার্শ্বের বর্ণ মধুক পুষ্পসদৃশ, খুর বৈদূর্যমণিতুল্য, জঙ্ঘা ক্ষীণ, সন্ধিস্থল নিমগ্ন এবং পুচ্ছ ইন্দ্রধনুর ন্যায় বিচিত্র বর্ণ ও ঊর্ধ্বে উত্থিত; সেই রাক্ষস ক্ষণকাল-মধ্যে তাদৃশ বিবিধ রত্ন-পরিবৃত অতীব শোভান্বিত এক মৃগ হইল এবং বিবিধ ধাতুসমূহে চিত্রিত সুদৃশ্য সেই মনোহর মৃগরূপ ধারণপূর্বক সেই রম্য বন ও রামের আশ্রম উজ্জ্বল করিয়া বিদেহরাজ-দুহিতা সীতাকে প্রলোভিত করিবার নিমিত্ত আশ্রমের চতুর্দিকে ভ্রমণ করিতে লাগিল।” অতএব কল্পিত হরিণটি স্বর্ণনির্মিত ছিল না, বরং প্রচুর মণিমুক্তখচিত হয়ে নারী-সুলভ সাজুগুজু করেছিলেন মারীচ। এহেন জাগতিক (অলৌকিক নয়) সাজুগুজু করা হরিণীকে দেখে কীভাবে প্রলোভিত হওয়া যায়! কিন্তু সীতাদেবী প্রলোভিত হয়েছেন। এত মণিরত্ন সীতাদেবী জীবনে কখনো চোখে দেখেননি, তা তো নয়। সীতা রাজদুহিতা, তদুপরি রাজবধূ–ভিখিরি তো নয়! বনবাসকালেও তিনি অলংকারসজ্জিতাই ছিলেন। তা ছাড়া বনবাসে আসার সময় আগে উনি হরিণী দেখেননি, এই প্রথমবার দেখলেন–তাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। বনবাসে আসার সময় তাঁর অঙ্গেও মহামূল্যবান রত্নখচিত অসংখ্য অলংকার ছিল, অন্তত মারীচকে দর্শন এবং রাবণের অপহরণ পর্যন্ত ছিল। অনার্য মারীচের হরিণে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়াটা অবশ্যই কল্পনাপ্রসূত, অবাস্তব। শব্দকল্পদ্রুমে মৃগ’ প্রসঙ্গে যা লেখা আছে একটু দেখি–মৃগঃ (মৃগয়তে অন্বেষয়তি তৃণাদিকং মৃগ্যতে বা ইতি। মৃগ + ইগুপধত্বাৎ কৰ্ত্তরি চকঃ) পশুমাত্র। (যথা, মনুঃ। ৫৯) অন্বেষণম্। (যথা, সাহিত্যদর্পণে) যাচঞা–ইতি মেদিনী। রামচন্দ্রও লোভী হয়ে পড়লেন এহেন মহামূল্যবান রত্নখচিত হরিণীকে দেখে। আশ্চর্য, স্বয়ং বিষ্ণুর অবতার হয়ে এই জাগতিক লোভ সংবরণ করতে পারলেন না! এমনকি লক্ষ্মণের সতর্কবার্তাও কানে নিলেন না! যা রাম অনুধাবন করতে পারেননি, তা লক্ষ্মণ পেরেছেন। লক্ষ্মণ শ্রীরামকে বলেছিলেন–হে রঘুনন্দন মহীপতে! ভূতলে ঈদৃশ রত্নচিত্রিত মৃগ নেই। ইহা নিশ্চয়ই মায়ার কার্য, ইহাতে অনুমাত্রও সংশয় নেই–“মৃগো হেবংবিধো রত্ন-বিচিত্রা নাস্তি রাঘব।/জগত্যাং জগতীনাথ মায়ৈষা হি ন সংশয়ঃ।” মহামূল্যবান রত্ন দর্শনে রামও বিহ্বল হয়ে যান! এটা মনুষ্য বৈশিষ্ট্য বটে। তাই বিপদের আভাস পেয়েও রাম হরিণের পিছু নেয়। “অসম্ভবো হি হেমমৃগস্য জন্ম তথাপি রামো লোভে মৃগায় প্রায়ঃসমাপন্নে বিপত্তিকালে ধিয়ো অপি পুংসা মলিনা ভবন্তি।” প্রাবন্ধিক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর ভাষ্য অনুযায়ী–“রাবণের বেশ তপস্বীর মতো, অথচ তিনি সামনা-সামনি সীতার স্তন-জঘনের প্রশংসা করতে থাকলেন–তবু সীতার কোনো সন্দেহ হল না। মারীচের ডাক শুনে যাওয়ার আগে লক্ষ্মণের সঙ্গে সীতার একচোট বচসাও হয়। রাম মায়ামৃগের সন্ধানে যাওয়ার পূর্ববর্তীকালে লক্ষ্মণ মৃগের ছলনা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন এবং মারীচের ডাক শুনে সীতাকেও তিনি বুঝিয়েছিলেন যে, বনের মধ্যে রাক্ষসেরা এরকমধারা শব্দ করেই থাকে–রাক্ষসা বাচো ব্যাহরন্তি মহাবনে। লক্ষ্মণের এত সন্দেহ, এত বচসা সত্ত্বেও, তপস্বীর মুখে কুলবতীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বর্ণনা শুনেও সীতার কোনো সন্দেহ হল না কেন? তাতেই বুঝি এই স্বর্ণমৃগের অংশ মূল রামায়ণে ছিল না। যা ছিল, তা সরলা কুলবতীর আত্মকথা–সীতা নিশ্চিন্ত মনে রাবণকে দশরথের কথা, তাঁর কৈকেয়ী-কামিতার কথা সবিস্তারে শুনিয়েছেন। রামের বনবাস, পিতৃসত্য রক্ষার দৃঢ়-প্রতিজ্ঞতা সবই তাঁকে বলেছেন। সবার শেষে রাবণকে যে কথাটা বলে তিনি একটু সবুর করতে বললেন সেই কথাটাই আমাদের সবচেয়ে বিস্মৃত করে। যেখানে এত বলশালী রাম মহাবিপদে পড়েছেন বলে দেওরের সঙ্গে প্রচণ্ড ঝগড়া করে তাঁকে সাহায্যের জন্য পাঠানো হল, সেখানে কোনো দুশ্চিন্তার ছায়ামাত্র সীতার ভাষায় ফুটে উঠল না। বরঞ্চ তিনি বললেন–এই আর একটুখানি বসুন–সমাশ্বস মুহূর্তং তু”, এই আমার স্বামী এলেন বলে। আমার স্বামী এখনওই অনেক বনজাত খাদ্যদ্রব্য, অনেক রুরু-মৃগ, গোসাপ, শুয়োর–সব মেরে প্রচুর মাংস নিয়ে আসবেন, আপনি এই একটুখানি বসুন–আগমিষ্যতি মে ভর্তা বন্যমাদায় পুষ্কল। রুরূ গোধা বরাহাংশু হত্বদায়ামিষং বহু।… নিহত্য পৃষতঞ্চান্যং মাংসমাদায় রাঘবঃ। ত্বরমানো জনস্থানং সসারাভিমুখং তদা।” এই ঘটনা থেকেও মনে হয় শিকারে বেরিয়ে একটা হরিণ মেরে এবং তারপরে আরও একটা হরিণ মেরে ছুটলেন ঘরের পানে, কারণ সীতা একা আছেন। এইরকম একটা অসংরক্ষিত অবস্থায় সীতাহরণ সম্পন্ন হয়েছে–এর মধ্যে মায়ামৃগ-কল্পনার অবকাশ নেই।”
শূর্পণখা : ভাগবতে এক কুজাকে পাওয়া যায়। এ কুজা অবশ্য কৈকেয়ীর দাসী ‘কুজা মন্থরা নন, ইনি রামায়ণে রাবণের বোন। বস্তুত কুজা ছিলেন দ্বাপর যুগের নারী। কাহিনি বলছে–কৃষ্ণ যখন জগৎ উদ্ধারের জন্য জন্মগ্রহণ করেন, তখন কুজাও মথুরা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বয়সকালে কুজা ছিলেন সৈরিষ্ক্রী বা দাসী। ইনি রাজা কংসের সারা শরীরে গন্ধদ্রব্য মাখিয়ে দেওয়ার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে কুজা ছিলেন খুবই কুরূপা এক নারী। কৃষ্ণ যখন মথুরায় কংস বধের জন্য আসেন, তখন তাঁর সঙ্গে কুজার দেখা হয়। একদিন এক শুভক্ষণে হাজার হাজার নারীদের মাঝখানে দাঁড়িয়েছিলেন কুৎসিত কুজা। কৃষ্ণের দৃষ্টি গেল তাঁর দিকে। অমনি ঘটে গেল অলৌকিক ও অদ্ভুত কাণ্ড! কৃষ্ণের দৃষ্টিপাতে কুৎসিত কুজার স্বাভাবিক শরীরসম্পন্না ও পরমাসুন্দরী হয়ে গেলেন। এ ঘটনায় কৃষ্ণের বান্ধব উদ্ধব বিস্ময় প্রকাশ করলেন, জানতে চাইলেন এর রহস্য কী! তখন কৃষ্ণ বলেন–“শোনো উদ্ধব, আমি শুধু শুধু এই নারীর প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করিনি। এই নারীর পিছনে একটা বিরাট ইতিহাস আছে৷ ইনি কুজা ত্রেতা যুগে আমি রাম অবতার হয়ে পৃথিবীতে জন্ম নিই। এ সময় রাবণও জন্ম নেয়। রাবণ নিধনের নিমিত্তেই আমার এই জন্ম। আর কুজা হলেন রাবণের বোন৷ এই কুজার নাম হয় শূর্পণখা। যিনি পঞ্চবটি বনে সীতা ও আমাকে দেখে মুগ্ধ হলেন। রামকে কামনা করে বসলেন। আমি বিবাহিত বারবার বলা সত্ত্বেও সে নারী কোনোরূপ কর্ণপাত করলেন না। ঈর্ষাকাতর হয়ে সীতার উপর আক্রমণ করতে গেলে লক্ষ্মণ তাঁর নাক-কান দুটোই কেটে দিয়েছিল। শূর্পণখা এমতাবস্থায় স্থান ত্যাগ করে পলায়ণ করলেন এবং দাদা রাবণকে সবিস্তারে বর্ণনা করলেন। রাবণ ক্রুব্ধ হলেন এবং সীতাকে অপহরণ করেন। এই নারীর কারণেই রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছিল। রাম-রাবণের যুদ্ধ হলেও আমাকে না-পাওয়ার খেদ শূর্পণখার যায়নি। সে রাম হিসাবে আমাকে না-পাওয়ায় যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে পড়েন এবং পরজন্মেও যাতে রামকে তিনি পান সে কারণে তিনি তপস্যায় গেলেন। অবশেষে তাঁর তপস্যাকে সম্মান। দিতে আমি কুজার গৃহে গেলাম।” শূর্পণখার সঙ্গে এক যুবকের ভালোবাসা হয়েছিল, তাঁরা পালিয়ে বিবাহ করেছিল। কারণ সেই রাক্ষস রাবণের সমকক্ষ ছিলেন না, ফলে উভয়ের প্রকাশ্যে বিবাহ হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। এরপর রাবণ তাঁদের খুঁজে বোনের স্বামীকে হত্যা করে। শূর্পণখা প্রতিশোধের বীজ বুকে নিয়ে বিধবা হয়ে লঙ্কায় থাকতে লাগলেন।
ভাগবতে কুব্জা চরিত্রের বর্ণনা হয়েছে এভাবে–কুব্জা ছিলেন ‘কৃষ্ণ কামতপ্তা’। তিনি কৃষ্ণের কাছ থেকে কেবল কামই চেয়েছিলেন। কৃষ্ণ যখন কুব্জার গৃহে গিয়েছিলেন, সেই সময় কুব্জার গৃহ ছিল অশ্লীল ছবিতে পরিপূর্ণ এবং বিভিন্ন কামোদ্দীপক দ্রব্যে ভরপুর ছিল। ত্রেতাযুগের সময়কাল ছিল ১২,৯৬,০০০ এবং দ্বাপরযুগের সময়কাল ৮,৬৪,০০০–মাঝে ৪,৩২,০০ বছরের ব্যবধান। যদিও কৃষ্ণেরও মৃত্যু (দ্রষ্টব্য মহাভারত) হয়েছে, সুতরাং কৃষ্ণের আয়ুও নির্দিষ্ট৷ তবে ত্রেতাযুগের কুব্জা দ্বাপরে পাওয়া যায় কীভাবে? তবে কি জন্মান্তরবাদ তত্ত্বে পুনর্জন্মের প্রতিষ্ঠা! মনুসংহিতায় বলা হয়েছে সত্যযুগে মানুষের আয়ু ছিল ৪০০ বছর। পরবর্তী তিনযুগে ১০০ বছর করে পরমায়ু কমে যায়। সেই হিসাবে ত্রেতাযুগে ৩০০, দ্বাপরযুগে ২০০ এবং কলিযুগে ১০০ বছর মানুষের পরমায়ু হয়।
বিভিন্ন রামায়ণে শূর্পণখার নানারকম মুখরোচক বর্ণিত হয়েছে। আসল ঘটনা কী, সেটা কী কতটা গোপন রাখা হয়েছে? প্রকৃত ঘটনা হল–শূর্পণখা আসলে আর্যদেবতাদের টোপ। এ টোপ কোথায় ফেলা হয়েছিল? রাবণকে সিংহাসন থেকে অপসারণ করার জন্য শূর্পণখাকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই ষড়যন্ত্রের পুরোধায় ছিলেন দেবমন্ত্রী ব্ৰহ্মা। বহুদিন ধরে লঙ্কায় রাবণের রাজসভার অন্দরমহলে বিদ্রোহ দানা বাঁধছিল। একটা গোষ্ঠী চাইছিল লঙ্কার সিংহাসন থেকে রাবণকে হঠিয়ে বিভীষণকে রাজা করতে। সুযোগ খুঁজছিলেন রাবণ-বিরোধীরা। শূর্পণখাও দাদার বিরুদ্ধে প্রতিহিংসায় ফুসছিলেন, মনের মধ্যে আগুন জ্বলছিল দাউদাউ করে। ফুসছিলেন, কারণ রাবণ তাঁর দিগ্বিজয় পর্বে শূর্পণখার শ্বশুরবাড়ি কালকেয় রাক্ষসজাতির দেশ অতর্কিতে আক্রমণ করলে শূর্পণখার স্বামীর ভাইয়ের মৃত্যু হয়। সেই মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে শূর্পণখার স্বামী বিদ্যুৎজিহ্ব রাবণের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করলে রাবণের হাতে তাঁর মৃত্যু হয়। পতিব্রতা শূর্পণখা স্বামীর এই মৃত্যুর জন্য দাদা রাবণকেই দায়ী করেন। অতএব রাবণ-বিরোধী গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মেলালেন শূর্পণখা। রামের ছায়াসঙ্গী আর্যদেবতারাও কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে শূর্পণখার শরণাপন্ন হলেন এবং সফলও হলেন। সুপরিকল্পিতভাবে শূর্পণখাকে শিখিয়ে পড়িয়ে যেমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল শূর্পণখা তেমন-তেমনভাবেই কাজগুলো করেছিলেন। শুধু শূর্পণখাই নয়, আর্যদেবতাদের দ্বারা এক পদস্থ সেনাপ্রধান অকম্পনকেও কবজা করা সম্ভব হয়েছিল।
শূর্পণখা প্রথমেই নিজেকে নিজেই বিধ্বস্ত করে খর রাক্ষসের কাছে রামের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, রাম তাঁকে ব্যাপক অপমান করেছেন এবং খরকে উপর্যুপরি উত্তেজিত করে পঞ্চবটিতে পাঠিয়ে দেন। শূর্পণখা স্বয়ং খরকে পথ দেখিয়ে পঞ্চবটিতে নিয়ে যান এবং আর্যদেবতাদের সঙ্গে সংঘর্ষে খরের মৃত্যু হয়। খর রাক্ষসের দুর্ভেদ্য দুর্গ শূর্পণখার কৃতিত্বে আর্যদেবতাদের হস্তগত হয়ে গেল। শূর্পণখার কোনো ক্ষতি হল না। কারণ শূর্পণখার এখনও আসল কাজই হয়নি।
এরপর যাতে সীতাকে অপহরণ করা হয়, সে ব্যাপারে রাবণকে প্ররোচনা দিতে থাকেন শূর্পণখা ও অকম্পন। শূর্পণখা যথাসম্ভব নিকৃষ্টভাবে রাবণকে প্ররোচনা দিতে থাকলেন, শত্রুর প্রশংসা করতে থাকলেন–“শোনা গেছে সীতার সৌন্দর্যবর্ণনা, যেমন সীতার নেত্র আকর্ণ আয়ত। মুখ পূর্ণচন্দ্র সদৃশ এবং বর্ণ তপ্ত কাঞ্চনের ন্যায়। সে সুনাসা এবং সুরূপা। উহার কটিদেশ ক্ষীণ, নিতম্ব নিবিড় এবং স্তনদ্বয় স্কুল ও উচ্চ… এইরূপ নারী আমি পৃথিবীতে আর কখনো দেখি নাই।… রাবণ! সেই সুশীলা তোমারই যোগ্য … আমি তোমারই জন্য উহাকে আনিবার উদযোগে ছিলাম।“ আর এই মহান কাজটি করতে গিয়েই রাম তাঁকে প্রচণ্ড অপমান করেছেন। অতএব কেল্লা ফতে!
শূর্পণখা আর অকম্পনের প্ররোচনার ফাঁদে পা দিলেন রাবণ এবং প্রচণ্ড ক্ষুবধ হলেন। রাবণ অকম্পনের কাছে জানতে চাইলেন–“অকম্পন! রাম কি ইন্দ্রাদি দেবগণের সঙ্গে জনস্থানে আসিয়াছে?” অকম্পন স্বীকার করলেন না যে, রাম নয়, পঞ্চবটিতে আর্যদেবতারাই শেষ কথা–রাম উপলক্ষ্যমাত্র। বললেন–“উহার (রামের) সহিত যে সুরগণ (দেবতারা) আইসে নাই ইহা নিশ্চয় জানিবেন।”
অনেক কবি শূর্পণখাকে কুৎসিত কিম্ভুতকিমাকার করে চিত্রায়িত করেছেন। বাল্মীকির রামায়ণে শূর্পণখা বিকৃতদর্শনা নন, তিনি প্রকৃতই অপরূপ সুন্দরী। রক্তোৎপলবর্ণ কখনোই কুরূপা বোঝায় না। যদি কুরূপাই হতেন, তাহলে তাঁকে বিরূপা করার আদেশ দিতেন না লক্ষ্মণকে। বিরূপা হলে কীভাবে আবার বিরূপা করা সম্ভব! বাল্মীকি ছাড়া অন্যান্য কবিয়া রাক্ষস মানেই বোঝাতে চেয়েছেন বিশালাকৃতির শরীর, কুলোর মতো কান, মূলোর মতো দাঁত, আলকাতরা-কালো গায়ের রং, মানুষখেকো ইত্যাদি। রাক্ষস মানে অদ্ভুত কিছু নয়–দৈত্য, নাগ, বানর, ভল্লুক, কুকুর জাতীয় ভিন্ন ভিন্ন মানবগোষ্ঠীমাত্র। মনুষ্যেতর অপর কোনো জীব তারা ছিলেন না। শ্রীকৃষ্ণের জ্ঞাতিগোষ্ঠী যদুবংশের এক শাখা কুকুর জাতি ছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ বিয়েই করেছিলেন ভল্লুক জাতির মেয়ে জাম্ববতাঁকে। শাম্ব কৃষ্ণ-জাম্ববতীরই সন্তান।
কুন্তী, তুলসী, অহল্যাদের মতো শূর্পনখা পরপুরুষে আসক্ত ও দ্বিচারিণী ছিলেন না। তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ প্রেমিকা। তিনি রামকে বলছেন ‘আমাকে ভোগ করো, একথা অতি কষ্টকল্পনা, অসভ্য কবিরাই এমন বর্ণনা লিপিবদ্ধ করতে সক্ষম হবেন। স্বামী বিদ্যুৎজিহ্বার মৃত্যুর পর রাবণ বহু চেষ্টা করেও বোন শূর্পণখার বিয়ে দিতে পারেননি। খর আর দূষণ তাঁকে নিয়ে দেশে দেশে ঘুরেছেন, কিন্তু কোনো পুরুষকেই তিনি পছন্দ করে উঠতে পারেননি। কারণ তাঁর স্মৃতি আর প্রেমে স্বামী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের জায়গা নেই যে! এমন এক পতিব্রতার চরিত্রহনন করে একমাত্র বিভিন্ন নোংরা যৌন আবেদনপূর্ণ রচনার কথকতাতেই শূর্পণখা চরিত্রটি কুশ্রী কামুকি চরিত্রে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। আসলে এক শ্রেণির অর্বাচীন কবি বাল্মীকির রামায়ণকে বিকৃতি করে রামচন্দ্রকে ‘দেবতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা এবং শূর্পণখার সঙ্গে দেবতাদের ষড়যন্ত্রের ইতিহাসটি চাপা দেওয়ার সার্থক চেষ্টা। সুনীতি চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘দ্বীপময় ভারত’ গ্রন্থে লিখেছেন–প্ৰাম্বানানের মন্দিরের রামকথা দেখা যায় .. শূর্পণখার একসঙ্গে আট আটটি রাক্ষস স্বামীর কল্পনা (প্রত্যেকেরই মুখ মোষ এবং শুয়োরের ভাব মিলিয়ে তৈরি করা মুখোশে ঢাকা–এই মহিষশৃঙ্গ শুয়োরের আটটি রাক্ষস যেন বর্বরতা ও মূর্খতার প্রতীক)–শূর্পণখার বিরহে আটজন স্বামীর নাচগানেরমাধ্যমে চিত্তের অধৈর্য প্রকাশ এবং দণ্ডকারণ্য থেকে শূর্পণখার ফিরে আসার যুগপৎ আট স্বামীর সোল্লাস নৃত্য–অদ্ভুত ও বীভৎস মিশ্র হাস্যরসের এক অনপ্রেক্ষিত পরিবেশ সৃষ্টির দ্বারা এইভাবে পল্লবিত রামকথা যবদ্বীপে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
অহল্যা : রামায়ণে অন্তর্ভুক্ত অহল্যার কাহিনিটি বেশ জনপ্রিয়। ‘ভগবান’ রামের পাদস্পর্শে ‘অভিশপ্ত’ অহল্যার পাষাণমুক্তির জন্যই হয়তো। ভক্তিরসে পরিপূর্ণ।
বাল্মীকির রামায়ণে মহর্ষি গৌতম স্নানে গেছেন। কিন্তু কে জানে কী হয়েছিল অহল্যার, তিনি শৃঙ্গারোচিত প্রসাধনে চঞ্চলা হৃদয়ে বসেছিলেন–“সঙ্গমোচিতরূপ-প্রসাধনবতি”। পর্ণশালায় স্বামী গৌতম নেই, কামজর্জরিতা অহল্যা একা। এই অবসরে ইন্দ্রও চলে এসেছেন তাঁর ঘরে, কামনিবৃত্তিতাৰ্থে। কামমোচনের কোনো সময় হয় না। মানুষের কামমোচনের সময় সব ঋতুতে সবসময়–“সঙ্গমং তু অহমিচ্ছামি ত্বয়া সহ সুমধ্যমে”। অহল্যা পূর্বেই ইন্দ্রকে চিনতেন, ইন্দ্রও অহল্যাকে চিনতেন। বাল্মীকি এ সত্য লুকাননি। অহল্যাও জানতেন ইন্দ্র তাঁকে বহুকাল ধরে তাঁর শরীরী সঙ্গ চান–“বহুকালম্ অভিলাষশ্রবণাৎ”। ইন্দ্রের দর্শনমাত্রই অহল্যার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল, মিলিত হলেন ইন্দ্রের শরীরে–“মতিং চকার দুর্মেধা দেবরাজকুতূহলাৎ”। ইন্দ্রের সঙ্গে যৌনমিলনে তীব্র কামেচ্ছা পূর্ণ হওয়ার পর তৃপ্ত অহল্যা বললেন–“আমি আজ কৃতার্থ হয়েছি, সুরশ্রেষ্ঠ। এখন আমি এবং আপনি এই নিন্দাপঙ্ক থেকে উদ্ধার পাই, সেইজন্য এই মুহূর্তে আপনি পলায়ন করুন–“কৃতার্থাস্মি সুরশ্রেষ্ঠ গচ্ছ শীঘ্রমিতঃ প্রভো”। না, কামরসিক ইন্দ্র পালাতে পারেননি। গৌতমের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলেন। কপালে ছিল হেনস্থা হওয়ার! ইন্দ্র খুব করে হেনস্থা হলেন গৌতমের কাছে। শুধু হেনস্থাই নয়, গৌতমের অভিশাপও খেলেন–“বিফলঃ ত্বং ভবিষ্যসি”। ইন্দ্রের অণ্ডকোষ খসে পড়ল মাটিতে। খসে পড়ল, নাকি শাস্তিস্বরূপ কেটে নেওয়া হল ইন্দ্রের অণ্ডকোষ! কিন্তু এই ধরনের শাস্তি? অণ্ডকোষ কেটে নিলে সে ব্যক্তি নিশ্চয় সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা হারাবে, কিন্তু কারোর যৌনক্ষমতা হারাবে না। সে যাই হোক, প্রাদেশিক কবিরা ইন্দ্রের শরীর থেকে যোনিচিহ্ন মুছে দিয়ে ‘সহস্রলোচন’ করে দিলেও, বাল্মীকি ইন্দ্রের অণ্ডশূন্য স্থানে মেষের অণ্ডকোষ শল্য করে দিলেন, ইন্দ্রের নতুন নাম হল ‘মেষবৃষণ’।
অহল্যাকেও তিনি অভিশাপ দেন, তাঁকে বহু সহস্র বছর বায়ুভক্ষা, নিরাহারা, ভস্মশায়িনী, তপন্তী ও অদৃশ্যা হয়ে থাকতে হবে। রাম তাঁকে আতিথ্য দিলে তবেই তিনি পবিত্র হবেন ও কামরহিত হয়ে স্বামীর সঙ্গে পুনরায় মিলিত হবেন। এরপর গৌতম পর্বতের চূড়ায় গিয়ে তপস্যায় নিমগ্ন হন। মিথিলার পথে এই উপাখ্যান শুনতে শুনতে রাম ও লক্ষ্মণ গৌতম মুনির আশ্রমে এসে উপস্থিত হন, যেখানে অহল্যা পাষাণ হয়ে অবস্থান করছেন। রামের স্পর্শে অহল্যার শাপমুক্তি ঘটে। তিনি ভস্মশয্যা থেকে উঠে এসে অতিথি সৎকার করে। রাম ও লক্ষ্মণও তাঁর পদধূলি নেন। দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি ঘটান ও অহল্যার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। গৌতম ঋষি ফিরে আসেন এবং রামকে পুজো করে স্ত্রীকে নিয়ে তপস্যা করতে চলে যান।
শাস্ত্র ঘেঁটে অহল্যার নানাবিধ কাহিনি পাই। অহল্যা ব্রহ্মার মানস কন্যা ও গৌতম ঋষির স্ত্রী ও শতানন্দের মা। প্রজা সৃষ্টির পর সেই প্রজাদের বিশিষ্ট প্রত্যঙ্গ নিয়ে ব্রহ্মা এক কন্যা সৃষ্টি করেন। অদ্বিতীয়া সুন্দরী ও সত্যপরায়ণা বলে ব্রহ্মা তাঁর নাম রাখেন অহল্যা। ব্রহ্মা তাঁকে গৌতম ঋষির কাছে গচ্ছিত রেখেছিলেন। ইন্দ্র অহল্যার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিয়ের কথা ভাবেন। কয়েক বছর বাদে গৌতম অহল্যাকে ব্রহ্মার কাছে ফিরিয়ে দেন। এর ফলে ব্রহ্মা খুশি হয়ে অহল্যার সঙ্গে গৌতমের বিয়ে দেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে ইন্দ্র অহল্যাকে ধর্ষণ করেছিলেন। এই ধর্ষণের অপরাধে গৌতম ইন্দ্রকে অভিশাপ দেন। বলেন যে, যুদ্ধে তাঁকেও ধর্ষিত হতে হবে এবং যে ধর্ষণ প্রথার সূচনা জগতে ইন্দ্র করলেন তাঁর অর্ধেক পাপ তাঁকেই বহন করতে হবে। শুধু তাই-ই নয়, জগতে দেবরাজের স্থানও স্থাবর হবে না। এক্কেরে হাতে হাতে ফল, ইন্দ্রজিৎ ইন্দ্রকে যুদ্ধে পরাস্ত করে লঙ্কায় বন্দি করে আনেন, সেইসঙ্গে নির্যাতনও করেন। গৌতম অহল্যাকেও ছাড়েননি। তাঁকেও অভিশাপ দেন–“মমাশ্রমা সমীপতঃ যিনিধ্বংস” এবং অহল্যা অপেক্ষাও অধিক সুন্দরী পৃথিবীতে তাঁর রূপের গৌরব খর্ব করতে জন্মগ্রহণ করবেন। অহল্যা স্বামীকে বোঝান যে তিনি নির্দোষ, ইন্দ্ৰ গৌতমের রূপ ধারণ করে তাঁকে ধর্ষণ করেছেন। গৌতম তখন শান্ত হন। অভিশাপ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না, মুক্তির পথ বাতলে দেওয়া যায়। তিনি অহল্যাকে বলেন, রামের দর্শনে তিনি পবিত্র হবেন।
‘কথাসরিৎসাগর’-এ অহল্যার সঙ্গে ছুপেছুপে যৌনমিলন করে নিলেও ইন্দ্র ধরা পড়েননি। তিনি মার্জার বা বিড়ালের রূপ ধারণ করে স্থান ত্যাগ করেন। গৌতম স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন–“মার্জার চলে গেছে”। মার্জার’ কথাটি দ্ব্যর্থক–এক অর্থে ‘মৎ-জার’ অর্থাৎ আমার নিষিদ্ধ প্রেমিক, অন্য অর্থে বিড়াল। অন্য একটি মতে, গৌতমের অভিশাপে অহল্যা পাথর হয়ে যান। রামচন্দ্রের পাদস্পর্শে তাঁর মুক্তি ঘটে। আর-এক কাহিনিতে গৌতমের শাপে ইন্দ্রে সারা দেহ যোনিচিহ্নে ভরে যায়। অপর একটি মতে, অহল্যার রূপে মুগ্ধ হয়ে ইন্দ্র মোরগের বেশে মধ্যরাতে আশ্রমে উপস্থিত হন ও ডেকে ওঠেন। ভোর হয়েছে মনে করে ঋষি স্নানে চলে যান। ইন্দ্র গৌতমের ছদ্মবেশে ফিরে এসে অহল্যাকে সম্ভোগ করেন। আবার অন্য একটি মতে জানা যায়, শাপমোচনের পর গৌতম পুত্র শতানন্দকে নিয়ে আশ্রমে ফিরে এসেছিলেন এবং একসঙ্গে বসবাসও শুরু করেন। পদ্মপুরাণেও রামের পাদস্পর্শে অহল্যার মুক্তির কথা আছে।
বালী ও সুগ্রীবের উপাখ্যানে জানা যায়–গরুড়ের দাদা অরুণের দুই পুত্র অহল্যার কাছে পালিত হতে থাকে। গৌতম এঁদের সহ্য করতে না-পেরে শাপ দিয়ে বানরে পরিণত করেন। এরপর ইন্দ্র এঁদের সন্ধানে এলে অহল্যা তাঁকে গৌতমের শাপের কথা জানান। দেবরাজ ছেলেদুটিকে খুঁজে আনেন। বড়োটির লেজ বড়ো বলে নাম হয় বালী ও ছোটোটির গ্রীবা সুন্দর বলে নাম হয় সুগ্রীব। অহল্যা যখন অপ্সরা, তখন আবার গল্পও বদলে যায়–রাজা ইন্দ্রদ্যমের স্ত্রী হলেন অহল্যা। তিনি ছিলেন অপ্সরা, অপ্সরারা হলেন স্বর্গের বেশ্যা। অহল্যার উপাখ্যান শুনে অপ্সরা অহল্যা ইন্দ্র নামে এক অসুরের প্রতি আকৃষ্ট হলে রাজা তাঁকে বিতাড়িত করেন। মহাকবি কালিদাস লিখেছেন–কিছুক্ষণের জন্য অহল্যা যেন ইন্দ্রের পত্নীপদ লাভ করেছিলেন–“বাসবক্ষণকলত্রতাং যযৌ”। অতএব যা হয়েছে তার কোনোকিছুই অহল্যার অমতে হয়নি। তাই প্রণয়ীকে এবং প্রণয়ীর মানসম্ভ্রম বাঁচাতে অহল্যা ইন্দ্রকে পালাতে বললেন–“কৃতার্থাস্মি সুরশ্রেষ্ঠ গচ্ছ শীঘ্রমিতঃ প্রভৈ”।
মীমাংসা দার্শনিক কুমারিলভট্টের মতে, অহল্যার উপাখ্যানটি হল একটি রূপক। ইন্দ্র সূর্য ও অহল্যা রাত্রি বা অন্ধকারের প্রতীক। অহল্যার ধর্ষণ অন্ধকার জয়ের প্রতীক। অন্য মতে, অহল্যা উষার প্রতীক। দিনে ইন্দ্ররূপী সূর্যের উদয় হলে অহল্যারূপী উষা অসূর্যম্পশ্যা হয়। আবার একটি মতে, অহল্যা অনুর্বর জমির প্রতীক।
পণ্ডিত নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী অহল্যা প্রসঙ্গে লিখেছেন–“মূল রামায়ণে অহল্যা গৌতমের শাপে পাষাণী হননি, মুনির কোপাগ্নিতে এবং অনুতাপে তিনি হয়েছিলেন ভস্মশায়িনী, সকলের অদৃশ্যা–বাতভক্ষ্যা নিরাহারা তপন্তী ভস্মশায়িনী। অদৃশ্যা সর্বভূতানাং আশ্রমে অস্মিন বসিষ্যসি। রাম আশ্রমে আসামাত্রই অদৃশ্যা অহল্যা তপঃপ্রভায় উদ্ভাসিতা হয়ে উঠলেন, অথচ প্রাদেশিক রামায়ণগুলির সর্বত্রই অহল্যা হয়ে গেছেন পাষাণী, এবং এর উৎস বোধহয় মহাকবি কালিদাস, যিনি প্রথম বলেছিলেন, “গৌতমবধূঃ শিলাময়ী”। অহল্যার কাহিনি নিয়ে মূল। রামায়ণের সঙ্গে দেশজ রামায়ণগুলির পার্থক্য বিস্তর।”
বস্তুত অহল্যার কোনো পাষাণমূর্তি রামচন্দ্র দেখেননি। অহল্যার পাষাণীরূপের কথা গল্পমাত্র। সম্ভবত রামের ভাবমূর্তি ঐশ্বরিক করতেই এ ধরনের গল্পের অবতারণ করা। বাল্মীকির রামায়ণে অহল্যার পাষাণী মূর্তিতে পরিণতি লাভ ও রামচন্দ্রের পাদস্পর্শে পুনর্জীবন অর্জনের কোনো গল্পই নেই।
মহিরাবণ : মহিরাবণ, রামায়ণে মহিরাবণ নামে একটি চরিত্রের সন্ধান পাই। তবে মহিরাবণ চরিত্রটি বাল্মীকি সৃষ্টি করেননি। তাঁকে পাওয়া যায় কৃত্তিবাসের রামায়ণে। কৃত্তিবাস বলেছেন–মহিরাবণ রাবণের পুত্র ছিলেন। তাঁর নয়টি মাথা ছিল। তিনি শক্ৰধনু নামের এক গন্ধর্ব দেবসভায় নৃত্য করার সময় এক অপ্সরাকে দর্শন করে মুগ্ধ হয় ও তালভঙ্গ করে। ফলে ব্রহ্মা ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে রাক্ষস রূপে পৃথিবীতে জন্ম নেওয়ার অভিশাপ দেন। রাবণ বলির কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ফেরার সময় পথের মাঝে গৌতমের স্ত্রী অহল্যাকে দেখে এমনই কামমোহিত হন যে, সেখানেই তাঁর বীর্যপাত (এটা লক্ষণীয়, সেযুগের দেবতা-মুনি-ঋষিদের যখন-তখন গলগল করে সমুদ্র-প্রমাণ বীর্যপাত হয়ে যেত। সেই বীর্য ধারণ করার স্থান খুঁজতেই সংকট উপস্থিত হত। জন্ম নিত জারজ সন্তান। উল্টোদিকে রাজা বা ক্ষত্রিয়দের অবস্থা খুবই করুণ। তাঁদের বীর্যের খবর পাওয়া যায় না। সন্তানের পিতা হতেও অপারগ।) হয়ে যায়। সেই বীর্যে অভিশপ্ত গন্ধর্ব শক্রধনু জন্ম নেন। পৃথিবী থেকে জন্ম নেওয়ায় নাম হয় মহিরাবণ। রাবণ মহিরাবণকে লঙ্কায় এনে তাঁকে মন্দোদরীকে প্রতিপালন করতে দেন। পরে রাবণ ইন্দ্রজিতের সহায়তায় বলিকে পরাজিত করে পাতালের অন্তর্গত কাঞ্চনা নগরী অধিকার করে মহিরাবণকে তাঁর রাজা করেন। মহিরাবণ পিতা রাবণের কাছে প্রতিজ্ঞা করেন তাঁকে যে-কোনো বিপদে স্মরণ করলেই উপস্থিত হবেন। মহিরাবণ নিজের রাজধানীতে উগ্রতারার পুজো করতেন। তাঁরই বরে মহিরাবণ মায়াবিদ্যায় অর্জন করেন। মানুষ ও বানর ব্যতীত কারও হাতে তাঁর মৃত্যু হবে না–এমনই বর পান। মহিরাবণ।
গন্ধমাদন পর্বত থেকে প্রাপ্ত ঔষধি গুণে সবাই পুনর্জীবিত হলে রাবণ তাঁর পুত্র মহিরাবণকে ডাকেন। মহিরাবণকে সব ঘটনা বিস্তারিত বললে মহিরাবণ রাম ও লক্ষ্মণকে পাতালে নিয়ে গিয়ে হত্যা করবে বলে কথা দিলেন। এসময় বিভীষণ পাখির রূপ ধরে সব কথা শুনে রামকে তা জানিয়ে দেন। বিভীষণের পরামর্শে একটি গড় নির্মিত হয়। তার মাঝে রাম ও লক্ষ্মণকে রেখে চারিদিকে পাহারার ব্যবস্থা করলেন। মহিরাবণ বিভীষণের রূপ ধরে সবাইকে মায়াগ্রস্ত করে গড়ে প্রবেশ করেন এবং সুড়ঙ্গ পথে তাঁদের পাতালে নিয়ে যান। বিভীষণ এই সময় সেই স্থানে ছিলেন না। তিনি ফিরে এলে সবাই খুব অবাক হয়ে যায়। কারণ সবাই তাঁকে এইমাত্র গড়ে প্রবেশ করতে দেখেছেন। তাঁরা সবাই গড়ে গিয়ে দেখেন রাম ও লক্ষ্মণ সেখানে নেই। জাম্ববান এক সুড়ঙ্গ লক্ষ করেন। হনুমান সেই সুড়ঙ্গপথে গিয়ে এক বৃদ্ধার কাছে জানতে পারেন দুই সুদর্শন যুবককে পাতালে আনা হয়েছে, যাঁদের দেবী মহামায়ার কাছে বলি দেওয়া হবে। হনুমান মাছির রূপ ধরে কারাবন্দি রাম ও লক্ষ্মণের কাছে গেলেন। অতঃপর নিজের আসল রূপে তাঁদের অভয় দিলেন। পুনর্বার হনুমান মাছির রূপ। ধরে প্রাসাদে স্থাপিত দেবীর কানের কাছে বসে তাঁর অভিমত জানলেন। দেবীও মহিরাবণের বিনাশ চান। হনুমান ফিরে এসে রাম ও লক্ষ্মণকে বললেন মহিরাবণ যখন তাঁদের দেবীকে প্রণাম করতে বলবে তাঁরা যেন বলেন আমরা প্রণাম জানি না। এরপর মহিরাবণ দুই ভাইকে বলি দেওয়ার জন্য মন্দিরে নিয়ে চললেন। তিনি তাঁদের দেবীকে প্রণাম করতে বললেন, কিন্তু তাঁরা হনুমানের নির্দেশমতো কথা বললেন। মহিরাবণ তখন ভূমিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম কীভাবে করে তা দেখাতে লাগলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে হনুমান নিজের রূপ ধরে দেবীর খড়া দিয়ে তাঁর মস্তক দ্বিখণ্ডিত করলেন। অত্যন্ত অন্যায়ভাবে হত্যা করা হল মহিরাবণকে। এমন হত্যা কোনো মাহাত্ম থাকে না হনুমানের, রাম-লক্ষ্মণেরও। রাম-লক্ষ্মণ যুদ্ধের মাধ্যমে মহিরাবণকে হত্যা না-করে কেন চালাকির আশ্রয় নিলেন? কেন নিজেরা হত্যাটা না-করে হনুমানকে দিয়ে করালেন? হনুমানের পিছন দিক থেকে মহিরাবণকে হত্যাই রামদের বাঁচানো গেল, বিনা যুদ্ধেই। আবারও নৈতিকভাবে পরাজিত রাম, বীরধর্মচ্যুত। না-হলে সবই ঠিকঠাক ছিল, সেদিনই রাম-লক্ষ্মণ নিকেশ হয়ে যেত নিশ্চিত।
উপেক্ষিত হয়েছেন লক্ষ্মণের স্ত্রী ঊর্মিলা, ভরতের স্ত্রী মাণ্ডবী এবং শত্রুঘ্নর স্ত্রী শ্রুতকীর্তিও। ঊর্মিলা ছিলেন সীতার বোন, জনকরাজার কন্যা। কুশধ্বজের দুই কন্যা মাণ্ডবী ও শ্রুতকীর্তির সঙ্গে যথাক্রমে ভরত ও শত্রুঘ্নের বিবাহ হয়। স্বয়ং লক্ষ্মণ রামের সঙ্গে ১৪ বছর বনবাসকালে একবারের জন্যেও স্মরণ করেননি। মাণ্ডবী আর শ্রুতকীর্তিকে তো বিবাহ অনুষ্ঠানে ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায়নি৷ চরিত্র সৃষ্টি করেও পরিণতি প্রাপ্ত হল না কেন? সেই উত্তর কবি কোথাও দেননি। আসলে দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি হয়তো। রামকে নিয়েই কবির সমগ্র চিন্তা এবং ব্যস্ততা। তাই রামের মাথার উপরই সার্চ লাইট, তাই সর্বত্র সমানভাবে আলোকপাত করতে ব্যর্থ হয়েছেন বলা যায়। অন্য কবিরাও বাল্মীকির পথেই নিরাপদে হেঁটেছেন।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘কাব্যে উপেক্ষিতা’ রচনায় লিখেছেন–“কবিগুরু ইহার প্রতি অনেক অবিচার করিয়াছেন, কিন্তু দৈবক্রমে ইহার নাম যে মাণ্ডবী অথবা শ্রুতকীর্তি রাখেন নাই সে একটা বিশেষ সৌভাগ্য। মাণ্ডবী ও শ্রুতকীর্তি সম্বন্ধে আমরা কিছু জানি না, জানিবার কৌতূহলও রাখি না। ঊর্মিলাকে কেবল আমরা দেখিলাম বধূবেশে, বিদেহনগরীর বিবাহসভায়। তার পরে যখন হইতে সে রঘুরাজকুলের সুবিপুল অন্তঃপুরের মধ্যে প্রবেশ করিল তখন হইতে আর তাহাকে একদিনও দেখিয়াছি বলিয়া মনে হয় না। সেই তাহার বিবাহসভার বধূবেশের ছবিটিই মনে রহিয়া গেল। ঊর্মিলা চিরবধূ-নির্বাকুণ্ঠিতা নিঃশব্দচারিণী। ভবভূতির কাব্যেও তাহার সেই ছবিটুকুই মুহূর্তের জন্য প্রকাশিত হইয়াছিল-সীতা কেবল সস্নেহকৌতুকে একটিবার মাত্র তাহার উপরে তর্জনী রাখিয়া দেবরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, বৎস, ইনি কে?’ লক্ষ্মণ লজ্জিতহাস্যে মনে মনে কহিলেন, “ওহহ, ঊর্মিলার কথা আর্যা জিজ্ঞাসা করিতেছেন।’ এই বলিয়া তৎক্ষণাৎ লজ্জায় সে ছবি ঢাকিয়া ফেলিলেন; তাহার পর রামচরিত্রের এত বিচিত্র সুখ-দুঃখ-চিত্ৰশ্রেণীর মধ্যে আর একটিবারও কাহারো কৌতূহল-অঙ্গুলি এই ছবিটির উপরে পড়িল না। সে তো কেবল বধূ ঊর্মিলা-মাত্র।”
রামায়ণে রামের মতো যেমন স্বামী আছেন, তেমনই লক্ষ্মণের মতো স্বামীও আছেন। সীতার মতো যেমন স্ত্রী আছেন, তেমনই ঊর্মিলা-মাণ্ডবী-শ্রুতকীর্তিদের মতো স্ত্রীও আছেন। কৌশল্যা-কৈকেয়ী-মন্দোদরী-সরমার মতো স্ত্রী বা মায়েরাও আছেন। বিভীষণের মতো ভাই যেমন আছেন, তেমনই লক্ষ্মণের মতো ভাইও আছেন। দশরথের মতো পিতা আছেন, রামের মতোও পিতা আছেন। কোনটা ধর্ম? কোনটা অধর্ম? কার ধর্ম অনুসরণযোগ্য?
মহাভারতে বহু জায়গায় রামায়ণের চরিত্র, রামায়ণের পুনরুল্লেখ হয়েছে। রামায়ণের কাছে মহাভারত ঋণী হয়ে আছে। কেবল উপাখ্যান, চরিত্র, ধর্মনীতিই নয়–মহাভারতের শ্লোকের সঙ্গে রামায়ণের বহু শ্লোক হুবহু মিলে যায়। বহু জায়গায় মহাভারতের বহু চরিত্র রামায়ণকে রামায়ণে আদর্শ চরিত্রগুলিকে অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। মহাভারতের বন পর্ব, দ্রোণ পর্ব, শান্তি পর্বে রামোপাখ্যানের উল্লেখ আছে। রামায়ণ গ্রন্থটি সামনে রেখে মহাভারত পাঠ করলে চোখে আঙুল দিয়ে বোঝা যায় কেবল গল্পগুলিই নেওয়া হয়নি–রামায়ণে শ্লোক, শ্লোকাংশ, শ্লোকার্ধ সবই নেওয়া হয়েছে। এমনকি বেশকিছু চরিত্রও যেমন রামায়ণে আছে, মহাভারতেও পেয়েছি। মহাভারতের বনপর্বে রামের উপাখ্যানের বক্তা মহর্ষি মার্কণ্ডেয়৷ এই বনপর্বে মোট আঠারোটি অধ্যায়ে রাম বিষয়ক উপাখ্যান বর্ণিত হয়েছে। রাবণ প্রমুখ রাক্ষস জাতির জন্ম ও তপস্যার কাহিনি রামায়ণে উত্তরকাণ্ডেই বর্ণিত হয়েছে, যা প্রক্ষিপ্ত হিসাবে আলোচিত। কিন্তু মহর্ষি মার্কণ্ডেয় সেই কাহিনি মহাভারতের বর্ণনা করেছেন। রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে উল্লিখিত রাক্ষস প্রমুখদের বিষয়ে আলোচিত হলেও, আদিকাণ্ডের অশ্বমেধ যজ্ঞ, দশরথের পুত্রলাভ, পুত্রেষ্টি যাগযজ্ঞ, তাড়কা হত্যা, রামের হরধনু ভঙ্গ, সীতার সঙ্গে বিবাহ, অহল্যার পাষাণমুক্তির উপাখ্যানের মতো জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি মহাভারতে বর্ণিত হয়নি। এই উপাখ্যানে যেমন অনেক গৌণ বিষয় বাদ পড়েছে, তেমনই উভয়ের ঘটনামূলক অনৈক্যও লক্ষ করা যায়। সেই রামোপাখ্যানে নতুন নতুন চরিত্রও সংযোজিত দেখা যায়। রামায়ণের আদিকাণ্ড কি তবে মহাভারত রচনার পর সংযোজিত হয়েছে!! তাই-বা বলি কী করে! দণ্ডকারণ্যে বিরাধ হত্যা দিয়ে রামায়ণের অরণ্যকাণ্ডের শুরু হয়েছে, সেই কাহিনিও মহাভারতে আসেনি–অথচ এ কাহিনিতেই সীতা প্রথম পরপুরুষ দ্বারা নিগৃহীতা হন, লাঞ্ছিত হন। শরভঙ্গ মুনির আগুনে প্রবেশ এবং কুমারে পরিণত হয়ে ব্রহ্মলোকে যাওয়ার রোমাঞ্চকর কাহিনিও মহাভারতে নেই, যা রামায়ণে উজ্জ্বলভাবে আছে।
মহাভারতে দশরথের কথা স্মরণ করেছেন, তেমনি রামের কথাও উচ্চারণ করেছেন সঞ্জয়–
“মরুং মনুমিক্ষবাকুং গয়ং ভরতেমব চ।
রামং দাশরথিঞ্চৈব শশবিন্দু ভগীরথ৷৷”(মহাভারত ১/১/২২৭)
কিংবা রাবণকেও দেখা যাচ্ছে “রামায়ণমুপাখ্যানমত্রৈব বহুবিস্তরম।/যত্র রামেণ বিক্রম্য নিহতো রাবণো যুধি।”(১/২/২০০) রামায়ণের দশরথ ও রামচন্দ্রের অনুষ্ঠিত ‘অশ্বমেধ যজ্ঞ’-এর ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। মহাভারতের ৩১ অধ্যায়ে ঘটোৎকচ অস্ত্রপ্রয়োগে অর্জুকে জামদগ্যের সমান এবং যুদ্ধে রামের সমকক্ষ বলা হয়েছে–
“কার্তবীর্যসমো বীর্যে সাগরপ্রতিমো বলে।
জামদগ্ন্যসমো হ্যন্ত্রে সংখ্যে রামসমোঅর্জুনঃ।”
লোমশমুনি যুধিষ্ঠিরের কাছে রাম কর্তৃক পরশুরামের তেজ কীভাবে নষ্ট করেছিলেন, সেই বর্ণনা করেছেন। যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন–
“শৃণু রামস্য রাজেন্দ্র ভার্গবস্য চ ধীমতঃ।
জাতত দশরথস্যাসীৎ পুত্রো রামো মহাত্মনঃ।”
গন্ধমাদন পর্বতে ভীমের সঙ্গে হনুমানের দেখা হলে হনুমান ভীমের পরিচয় জানতে চান।ভীম সীতার জন্য সমুদ্রলঙ্ঘনকারী হনুমানের ভাই বলে পরিচয় দেন–“রামপত্নীকৃতে যেন শতযোজনবিস্তৃতঃ।/সাগরঃ প্লবগেণে ক্রমেণৈকেন লঙ্ঘিতঃ।” মহাভারতের কাছে রামায়ণ যেন একমাত্র দৃষ্টান্ত। রামায়ণের কাছ শিক্ষা নিয়েছে মহাভারত, বারবার–বাঁকে বাঁকে। দ্রৌপদী যখন কীচকের দ্বারা অপমানিতা হন, তখন ভীম সীতার কথা বলেন, বলেন–“রক্ষসা নিগ্রহং প্রাপ্য রামস্য মহিষী প্রিয়া। ক্লিশ্যমানাপি সুশ্রোণ রামমেবান্ধপদ্যত।” এমনকি ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়ের কাছে অশ্বত্থামার গুণাবলির বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন–অশ্বত্থামা বেদবিদ, ব্রতপরায়ণ, ধনুর্বেদ বিশারদ এবং দাশরথি রামের মতো সমুদ্র-গম্ভীর প্রকৃতির।
বানর এবং হনুমান : মানুষ না ভগবান, নাকি মানবেতর প্রাণীমাত্র?
রামায়ণের বানর কখনোই আমাদের গাছে-গাছে লাফিয়ে বেড়ানো বাঁদর বা শাখামৃগ নয়। যে হনুমানকে দেখে আমরা বলি এই হনুমান কলা খাবি?’–এ হনুমান রামায়ণের হনুমান নয়। রাগ করবেন না, ব্যাখ্যায় আসছি। রামায়ণের উল্লখযোগ্য বানর-চরিত্র বালী ও সুগ্রীব। পৌরাণিক মতে বিশ্বকর্মাকেও বানর জাতীয় বলা হয়েছে। বিশ্বকর্মার আর-এক পুত্র ছিলেন, তিনি বানর যুথপতি নল। এই নল রাম-রাবণের যুদ্ধের প্রাক্কালে সেতুবন্ধনের কাজে বড়ো ভূমিকা পালন করেছিলেন। এঁদেরকে রামায়ণে ‘বানর’ বলেই পরিচয় দেওয়া হয়েছে, বাঁদর নয়। এই বানর কি শাখামৃগ? আমরা সিনেমা-টিনেমাতে দেখেছি এঁদের মুখটা বাঁদর বা হনুমানের মতো, সারাক্ষণ চোখ পিটপিট করে। অনেকটা সুকুমার রায়ের হাঁসজারু কিংবা বকচ্ছপের মতো কিছু একটা–আধা বানর, আধা মানুষ। অর্থাৎ পুরোপুরি মানুষও নয়, আবার পুরোপুরি বাঁদরও নয়। মুখটা বাঁদর বা হনুমানের মতো হলেও বাকি শরীর মানুষের মতো–আবার দীর্ঘ লেজও আছে। এই বানরেরা মানুষের মতো কথা বলে বটে, কিন্তু বাঁদরের মতো লাফায়–এমনকি সমুদ্র-টমুদ্রও পার করে ফেলে! অনেকে এই বানরদের একপ্রকার মনুষ্য প্রজাতি’ মনে করেন। তবে এটা তো ঠিক, একদা ভারতে নানা জাতি প্রজাতির মানুষ বসবাস করতেন, এখনও বসবাস করেন। তাঁদের দেখতেও আলাদা, আকৃতিও আলাদা। প্রাচীন যুগে বহু জাতি থাকলেও আজ হয়তো কিছু জাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
পুরাণশাস্ত্রাদি ঘেঁটে জানা যায়, হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের ফর্সা-ফর্সা অপ্সরা এবং দাক্ষিণাত্যের কালা-কালা সুন্দরীদের সঙ্গে দেবসম্প্রদায়ের পুরুষদের অবাধ যৌনমিলনের ফলেই দেব-ঔরসজাত বানর জাতীয়রা জন্ম হতে থাকে। এর ফলে আর্য-অনার্য সংমিশ্রণে এইসব বানরপ্রজাতিরা বিভিন্ন দেহবর্ণ লাভ করে। বস্তুত সুগ্রীব ও অন্যান্য বানরদের গায়ের রং ছিল হেমপিঙ্গল। অবশ্য জিনগত কারণে কিছু বানর কৃষ্ণবর্ণও ছিল। দেবমন্ত্রী ব্রহ্মা এঁদেরকে নিয়েই কিষ্কিন্ধ্যায় একটি সেনাদলও তৈরি করে রাখলেন, যাতে প্রয়োজনে রামকে সাহায্য করতে পারে।
বাল্মীকি তাঁর রচিত রামায়ণে ১০৮০ বার ‘বানর’ শব্দটি উচ্চারণ করেছেন। ৪২০ বার বানরদের ‘কপি’ সম্বোধন করেছেন। বানরদের ‘হরি’ সম্বোধন করা হয়েছে ৫৪০ বার। ছদ্মবেশ ধারণে পটু হওয়ায় বানরদের ‘কামরূপীন’ও বলা হয়েছে। হেমপিঙ্গল ও কৃষ্ণকায় দুই রঙেরই বানর ছিল। কৃষ্ণকায় বানরদের বলা হয়েছে ‘গোলাঙ্গুলা’। বলা হয়, আর্যদেবতাদের আনুকূল্যেই আর্য-অনার্য মিশ্রণে বানরদের জন্ম হয়েছে। বলা হয়েছে, রাবণের সঙ্গে রামচন্দ্রের যুদ্ধের কাজে লাগে, সেই কারণে দেবমন্ত্রী ব্রহ্মা বানরদের নিয়ে সহায়ক বাহিনী তৈরি করেছেন। রামায়ণে উল্লেখিত বানররা শাখামৃগ নয়। আসলে এরা টোটেমীয় বানর সম্প্রদায়। কোনো দেবদেবতা বা দেবদেবতাদের ঔরসজাত হতেই পারে।
মনুসংহিতায় এই ধরনের বিজাতীয় যৌনসম্পর্কের ফলে সন্তান জন্মের উল্লেখ আছে। যেমন–চণ্ডাল পুরুষের সঙ্গে নিষাদ স্ত্রীর যৌনমিলনের সন্তানকে বলা হত ‘অন্ত্যাবসায়ী’, বৈদেহক ও কারাবরের মিলনজাত সন্তান ‘অন্ধ্র’, ব্রাহ্মণ পুরুষ ও বৈশ্য স্ত্রীলোকের মিলনজাত সন্তান ‘অন্বষ্ঠ’, ব্রাহ্মণ পুরুষ ও অম্বষ্ঠ স্ত্রীর মিলনজাত সন্তান ‘আভীর’, শূদ্র ও বৈশ্যার সন্তান ‘আয়োগব’, ব্রাত্য ব্রাহ্মণ ও সবর্ণা স্ত্রীর সন্তান আবষ্য’, ব্রাহ্মণ পুরুষ ও উগ্র স্ত্রীর সন্তান আবৃত’, ক্ষত্রিয় পুরুষ ও শূদ্রার সন্তান ‘উগ্র’, শূদ্র পুরুষ ও ক্ষত্রিয় স্ত্রীর সন্তান ‘ক্ষত্তা’, চুচুক পুরুষ ও ব্রাহ্মণ স্ত্রীর সন্তান ‘তক্ষক’ ইত্যাদি। অনুরূপ আর্য পুরুষ ও অনার্য স্ত্রীর অথবা অনার্য পুরুষ ও আর্য স্ত্রীর মিলনজাত সন্তান ‘বানর’ হলে অবাক হব কেন? অতএব এঁরা কিলকিলা রকারী প্রজাতি শাখামৃগ মোটেই নয়। অবাঙালিরা যেমন বাঙালিদের ‘কিচিরমিচির’ রবকারী প্রজাতি বলত, পাখি বলত। আর্যদেবতারা তো কেউ বানর ছিলেন না–তাহলে ঔরসজাত সন্তানরা বানর হবে কেন? ‘বানর’ আর্যদেবতাদেরই দেওয়া নামকরণ। প্রখ্যাত স্থপতি বিশ্বকর্মা বানর জাতির কৃতিপুরুষ। কেউ কেউ বলেন অনার্যদের স্থপতি ময়দানব বিশ্বকর্মারই পুত্র। বিশ্বকর্মার দুই পুত্র–ময়দানব ও নল। বানর-স্থপতি নলই লঙ্কা পৌঁছোনোর জন্য সমুদ্রের সেতুনির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন। ময়দানব ও নল দুজনেই পিতার মতো স্বনামধন্য স্থপতি। অনার্য বানর প্রজাতির বিশ্বকর্মা পরে আর্যদের কুক্ষিগত হয়। ঠিক যেমনভাবে অনার্য পশুপতি আর্যদের কৈলাশপতি হয়ে যান।
রামায়ণে উল্লিখিত বানরজাতির বাসস্থানের নিখুঁত বর্ণনা বাল্মীকি দিয়েছেন–“অন্যে ঋক্ষবতঃ প্রস্থানুপতস্তুঃ সহস্রশঃ।/অন্যে নানাবিধাচ্ছৈলান্ কাননানি চ ভেজিরে।” অর্থাৎ বহু সহস্র বানর ঋক্ষবা পর্বতের উপত্যকায় বসবাস শুরু করলেন, বাকি নানা পর্বতে ও কাননে আশ্রয় নিলেন। ঋক্ষবান পর্বতের অবস্থান মনুষ্য-কল্পিত স্বর্গ আকাশে নয়, ঋক্ষবান পর্বত এই ধরাধামেই বিন্ধ্য পর্বতমালার পশ্চিমাংশ। এই পর্বত তুঙ্গভদ্রার তীরে অবস্থিত। এই বানরজাতির স্বতন্ত্র গোষ্ঠী ও গোষ্ঠীপতিদের পরিচয় পাওয়া যায়–“সূর্যপুত্রং চ সুগ্রীবং শত্রুপক্ষং চ বালিনম্।/ভ্রাতরাবুপতস্তুস্তে সর্বে চ হরিযুথপাঃ।/নলং নীলং হনুমন্তমন্যাংচ হরিযুথপান্।”
রামায়ণে গল্পে বানরের সেতুবন্ধনের ব্যাপারটি বেশ জনপ্রিয়। এ গল্পে আছে সমুদ্রকে দু-দিকে সরিয়ে দেওয়া, শিলা যাতে জলে ভাসে সেজন্য প্রতিটি শিলায় শ্রীরাম’ লিখে দেওয়া, কাঠবিড়ালির শিলা বহন করা ইত্যাদি। এখন প্রশ্ন তর্কের খাতিরে যদি ধরেই নিই সমুদ্র দু-দিকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাহলে ‘শ্রীরাম’ লিখে দেওয়া শিলা কোথায় ভাসল? সমুদ্র দু-দিকে সরিয়ে দেওয়া কি আদৌ সম্ভব? যদি সম্ভব হয় এমন কোনো জলযান নির্মাণ করা গেল না, যাতে চড়ে লংকায় পৌঁছোনো সম্ভব। রামায়ণে প্রচুর আকাশযান বা বিমানের কথা উল্লেখ আছে। যে বিমান রাবণ ব্যবহার করেছেন, হনুমান ব্যবহার করেছেন, রাম ব্যবহার করেছেন, আর্যদেবতারা ব্যবহার করেছেন। আকাশযানের ব্যবহার যাঁরা জানেন, তাঁদের জলযান ছিল না! খামোকা সমুদ্র ফাঁক করে, শ্রম নষ্ট করে, সময় নষ্ট করে এ কর্মযজ্ঞের প্রয়োনীয়তা কী? হাজার হাজার বানরসেনা থাকতে সেতুবন্ধনের জন্য কাঠবিড়ালির ভূমিকা কতটকু? কাঠবিড়ালির পক্ষে কি সম্ভব শিলা বহন করা? সেতুবন্ধনের কাজে কাঠবিড়ালিকে আমদানি করেছেন কৃত্তিবাস, বাল্মীকি নয়। আর রামের কোমল স্পর্শে কাঠবিড়ালির পিঠের উপর লম্বা লম্বা দাগগুলি, যা রামচন্দ্রের নখের আঁচড় বল হয়, এটি আমদানি করেন রঙ্গনাথ, বাল্মীকি নয়। তাছাড়া কালাপানি বা সমুদ্র পার করা তো নিষিদ্ধই ছিল, তাহলে কেন সমুদ্র অতিক্রম করার প্রসঙ্গ?
বানররা সত্যিই সমুদ্র বন্ধন করেছিল? রামবাহিনী কি সমুদ্র পেরিয়ে লঙ্কায় পৌঁছেছিলেন? রামায়ণে উল্লিখিত রাবণের লঙ্কা কি বর্তমানের শ্রীলঙ্কা। যদি শ্রীলঙ্কা হয়, তাহলে নিশ্চয় সমুদ্রবন্ধনের মতো দূরহ কাজ করার প্রয়োজন আছে। এখানেও প্রশ্ন, লঙ্কা লক্ষ করে শত্রুপক্ষ সেতুবন্ধনের মতো কর্মজ্ঞ হয়ে গেল, আর রাবণ ঘৃণাক্ষরেও জানতে পারলেন না? না, সমুদ্রবন্ধনের মতো কোনো কর্মকাণ্ডই ঘটেনি। দুস্তর সমুদ্রও কারোকে অতিক্রম করতে হয়নি, লঙ্কা পৌঁছোতে যদি দুস্তর সমুদ্র পেরতে হত, তাহলে সেই সমুদ্র অতিক্রম করে দাক্ষিণাত্য জুড়ে রাক্ষসদের অবাধ বিচরণ থাকত না, এত আসা-যাওয়া থাকত না।
রামায়ণে উল্লিখিত লঙ্কা বর্তমানের শ্রীলঙ্কা নয়। তাই সমুদ্রবন্ধনের অতিরঞ্জিত গল্পটিও ধোঁপে টেকে না। কোনো ইতিহাসবিদ কিন্তু কখনোই এই তত্ত্বে বিশ্বাস করে না। কারণ শ্রীলঙ্কা বা ‘লঙ্কা’ নামটি আধুনিক, ১৯৩৫ সালে সিংহলের নামকরণ করা হয় শ্রীলঙ্কা। এর আগে শ্রীলঙ্কার নাম ছিল ‘সিংহল’, আর সিংহল নামটি এসেছে বঙ্গদেশের রাঢ়ের নির্বাসিত রাজপুত্র বিজয় সিংহের নামানুসারে। এই রাজপুত্র নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে খ্রিস্টজন্মের ৫৪৩ বছর আগে এই দেশ জয় করেন ও নিজনামে এর নামকরণ করেন, ‘সিংহল’। এর আগে অর্থাৎ ৫৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিংহলের নাম ছিল ‘তাম্রপর্ণী’। রামের লঙ্কাজয়ের কাহিনি আমরা বাল্মীকি রচিত মহাকাব্য রামায়ণ থেকে জানতে পারি, আর রামায়ণের রচনাকাল Buckner B.Trawick–এর মতে খ্রিস্টজন্মের ২০০-ঊর্ধ্বে ৫০০ বছর আগে। তার মানে রামায়ণ রচনাকালে শ্রীলঙ্কা বলে কোনো দেশ ছিল না, ছিল ‘সিংহল। রামের লঙ্কা জয়ের কয়েক শত বছর পর রামায়ণ লেখা হয়েছে ধরে নিলেও বলতে হয় তখন এর নাম ছিল “তাম্রপর্ণী’ নিশ্চিত। আর আধুনিক শ্রীলঙ্কাই যে রামায়ণে বর্ণিত লঙ্কা নয়, তার সবথেকে শক্ত প্রমাণ দক্ষিণ ভারতের এত দূর পর্যন্ত কস্মিনকালেও আর্য অধিকারভুক্ত ছিল না। দক্ষিণ ভারতের একমাত্র আর্য জনপদ হচ্ছে অস্মক। মালায়লাম, কানাড়ি, তামিল, তেলেগু এসব দক্ষিণ ভারতীয়দের গায়ের রং ও শারীরিক আকার নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে এদের শরীরে বিন্দুমাত্রও আর্যরক্ত নেই। নৃবিজ্ঞান মতেও এরা অবিমিশ্র অনার্য দ্রাবিড় জাতি, আর্যরা যদি সত্যিই শ্রীলঙ্কা জয় করত তাহলে তার আগে তাঁদের নিশ্চিতভাবে দক্ষিণ ভারতের বিশাল ভূখণ্ড জয় করতে হত।
বস্তুত লঙ্কা একটি লম্ব বা ত্রিকূট পর্বতে অবস্থিত ক্ষুদ্র পার্বত্য রাজ্য, যার চতুর্দিক বিস্তীর্ণ পরিখা দিয়ে ঘেরা। লঙ্কা সম্ভবত কোনো বিশেষ দেশের নাম ছিল না, সোনায় মোড়া লঙ্কা ছিল প্রাসাদের নাম। যাই হোক, প্রাচীন যুগে রাজারা নিজের রাজ্যকে সুরক্ষিত রাখতে এবং শত্রুরা যাতে অতর্কিতে আক্রমণ করতে না-পারে সেজন্যই রাজ্যের চারদিকে গভীরভাবে পরিখার সৃষ্টি করে রাখতেন সেই রাজ্যের রাজারা, রাবণ হয়তো সেই পরিখা সমুদ্র কেটে রাজ্যের চারদিক ঘিরেছিলেন। রামবাহিনী যথাসম্ভব সেই পরিখাই অতিক্রম করেছেন সেতু নির্মাণ করে। বাল্মীকির যুদ্ধকাণ্ডে বলা হয়েছে, মহাবল বানরগণ সমুদ্রবন্ধনের জন্য হস্তীতূল্য বৃহৎ পাথর উৎপাটিত করেছেন। না, কাঁধে তুলে নয়। যন্ত্রযোগেই সেই কাজ সমাধা হয়েছিল–
“হস্তিমাত্রান মহাকায়াঃ পাষাণাংশ্চ মহাবলাঃ/পর্বতাংশ্চ সমুৎপাট্য যন্ত্রৈঃ পরিবহন্তি চ।”
পার্শ্ববর্তী জঙ্গল থেকে ভারি ভারি গাছের গুঁড়ি কেটে আনা হয়, আনা হয় বড়ো বড়ো পাথর। নলের নেতৃত্বে শুরু হল সেতু তৈরি কাজ–“পাষাণ ও পর্বত বেগে যেমন প্রক্ষিপ্ত হইতেছে সমুদ্রের জল অমনি উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিতেছে এবং ঊর্ধ্ব হইতে আবার তৎক্ষণাৎ নিম্নদিকে নামিতেছে।” অবিশ্রান্ত কর্মতৎপরতার পর পাঁচদিনে সেতুনির্মাণ করে দিলেন বানরসেনাপতি নল। ভাবুন, টানা পাঁচদিন ধরে তুমূল কলরবে সেতু তৈরি হয়ে গেল, অথচ রাবণ জানতে পারল না, দ্বাররক্ষীরা জানতে পারল না। সবাই পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিলেন নাকি? গুপ্তচরেরা কী করছিলেন?
রামায়ণের লঙ্কাকে একটি দ্বীপ বলা হয়েছে। আর এই দ্বীপে যাওয়ার জন্য রাম বানরসেনাদের দ্বারা নির্মিত সেতুর উপর দিয়েই সাগর পার হয়েছিলেন। ভারত ও শ্রীলঙ্কার মাঝে অবস্থিত আদমসেতু (Adam’s Bridge)-কে ‘রামসেতু’ নামে আখ্যায়িত করে থাকেন। রামায়ণ মতে, “রাম বানরের সেতুর সাহায্যে সাগর পেরিয়ে লঙ্কায় পৌঁছান”। অথচ রামেশ্বরমের মন্দিরের রেকর্ড অনুযায়ী, ১৪৮০ সালেও এই রামসেতুর সাহায্যে পায়ে হেঁটে শ্রীলঙ্কা যাওয়া যেত। তাদের কথাটা কি সাংঘর্ষিক নয়? পায়ে হেঁটেই যদি যাওয়া যেত ১৪৮০ সাল পর্যন্ত তাহলে তো ১ কোটি ২০ লাখ বছর আগেও রাম তাঁর সেনাদল ও বানরসেনাদের নিয়ে পায়ে হেঁটেই শ্রীলঙ্কা যেতে পারতেন, তাহলে আর বানরদের এত কষ্ট করে সেতু বানানোর কী প্রয়োজন ছিল? কিছু বিশেষজ্ঞ নামধারী ব্যক্তি সম্প্রতি দাবি করেছে যে আদম সেতুই বানরদের তৈরি করা সেই সেতু।
বাংলাদেশের ইতিহাসবেত্তারা বলেন, বাংলাদেশের কুমিল্লাই রামায়ণের লঙ্কা। এই কুমিল্লা’ শব্দটি এসেছে। ‘কমলঙ্কা’ শব্দ থেকে। শ্রী শ্রী ভঙ্গাল মৃগাঙ্কস্য পট্টিকেরা রণবঙ্কমল্ল দেবের তাম্রশাসনে এটিকে ‘কমলঙ্কা’ নামেই আখ্যায়িত করা হয়েছে। কিন্তু এই কমলঙ্কা আধুনিক কুমিল্লা শহর ছিল না। বরং এর অবস্থান লালমাই ময়নামতি পাহাড়ের অদূরেই এর দুর্গপ্রাচীরের ধ্বংসাবশেষের দৈর্ঘ্যই ১ মাইল। নলীনকান্ত ভট্টশালী ও আয়েশা বেগমের মতে এটিই প্রাচীন কমলঙ্কা, আর রাবণের রাজধানী লঙ্কাই বিবর্তনের মাধ্যমে কমলঙ্কায় রূপান্তরিত হয়। সম্প্রতি মেহেরকুল দুর্গের ধ্বংসাবশেষে বড়ো দাঁত ও চোখের গর্তের চারিপাশের লাল রঙের চিহ্নবিশিষ্ট ‘রাক্ষস মুখোস’ এই কথাকেই সমর্থন দেয়। সে যুগে প্রত্যেক দুর্গের চারিপাশে গভীর ও চওড়া পরিখা খনন করা হত, পরিখাগুলি এত গভীর করে খনন করা হত যে ১২ মাস তাতে জল থাকত। আর সেকারণেই এগুলিকে দ্বীপ বলেই মনে হত। কমলঙ্কা দুর্গনগরীর তিনদিকে পরিখার চিহ্ন আজও দেখা যায়। আর-এক দিকে বয়ে যেত ক্ষিরোদা নদী, যার খাত আজও দেখা যায়। লঙ্কা যদি শ্রীলঙ্কাই হত তাহলে ভারত থেকে শ্রীলঙ্কা যাওয়ার পথে ছিল পক প্রণালী ও আদমসেতু। একটা প্রণালীর উপর দিকে কি আদৌ সেতু তৈরি করা। সম্ভব? প্রকৃতপক্ষে প্রাচীন ও মধ্যযুগে পরিখা, নদী পেরুবার জন্য কাটারি ও মানিকী এই দুই ধরনের নৌকার সাহায্যে সেতু নির্মাণ করা হত। এধরনের নৌকার সেতু বাংলাদেশে এখনও দেখা যায়।
বর্তমান কুমিল্লার আগের নাম রওশানাবাদ। নাওয়াব শুজা-উদ-দাওলাহ ত্রিপুরা অধিকার করে এর নাম রাখেন আলোরনগরী বা রওশানাবাদ। ত্রিপুরা ব্রিটিশ যুগেও দুই ভাগে বিভক্ত ছিল–(১) ত্রিপুরা (বৃহত্তর কুমিল্লা) এবং (২) পার্বত্য ত্রিপুরা (বর্তমান ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য)। এরও আগে এর নাম ছিল এই কুমিল্লাই।
এ তো গেল বানরের কথা, এবার আসি হনুমানের প্রসঙ্গে। হনুমান নামটি এসেছে হনু (চোয়াল’) এবং মান (বিশিষ্ট’ বা ‘কদাকার’) শব্দদ্বয় থেকে। অর্থাৎ হনুমান’ শব্দার্থ ‘কদাকার চোয়ালবিশিষ্ট। অপর একটি সূত্র বলে ‘হনুমান’ নামটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘হন’ (হত্যা) এবং মানা’ (গ) থেকে। অর্থাৎ হনুমান অর্থ যাঁর গর্ব হত হয়েছে।
রামায়ণে উল্লেখিত রামের সহযোদ্ধারা সকলেই বানর। তবে একজন ভাল্লুক জাম্ববান এবং হনুমানের কথাও জানতে পারি। বীর হনুমান, বজরংবলি। ইনি সর্বশাস্ত্রবিদ, রাজনীতিজ্ঞ, রণনিপুণ। ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক এফ. ই. পাজ্জিটার ১৯১১ সালে হনুমানের পরিচয় খুঁজতে ব্যস্ত হয়েছিলেন। তিনি হনুমানের পরিচয় রহস্য প্রকাশ করতে গিয়ে দেখিয়েছেন, ঋগ্বেদের বৃষাকপি ও রামায়ণের হনুমন্ত (হনুমান) উভয়েই গোদাবরী নদীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হনুমান যে দাক্ষিণাত্যের মানুষ তা সুস্বীকৃত এবং বৃষাকপিও যে সেই দেশের ব্যক্তি, তা সুসংগতভাবে অনুমতি এবং এই দুইজনের মধ্যে কোনো একটা সংশ্রব আছে। গোদাবরী তীরে বৃষাকপি তীর্থ আছে আর হনুমানের কৃপাতেই তীর্থরূপে গণ্য হয়েছে।
বৃষাকপি একটি নামবাচক হলেও বৃষ ও কপি এই শব্দযোগেই উৎপত্তি। কেবল শব্দার্থ ধরে নিলে এর অর্থ পুরুষ বানর বোঝায়। এখন বৃষাকপিকে দাক্ষিণাত্যবাসী বলা যায়, তবে এই যৌগিক শব্দটি কোনো দুটি দ্রাবিড়ীয় শব্দের সংস্কৃতানুবাদ হবে হনুমান। যখন নিশ্চয়ই দাক্ষিণাত্যবাসী তখন এই সংস্কৃত নামটিও কোনো দ্রাবিড়ীয় নামের সংস্কৃতানুবাদ হবে। সংস্কৃত ‘হনুমান’ শব্দের অর্থ হনু-বিশিষ্ট। এমন অর্থ দিয়ে শব্দটিকে আসলে সংস্কৃত শব্দ বোঝা যায় না। কিন্তু কাহিনি অনুসারে মূলত কোনো দ্রাবিড়ীয় শব্দের সংস্কৃতরূপ হতে পারে, এরকম অনুমান করা যায়।
রামায়ণে হনুমান ও বানরদের দেশ কিষ্কিন্ধ্যা বলা হয়েছে। এটি গোদাবরীর দক্ষিণ-পশ্চিমে কিছুটা দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। এই স্থানটি কর্ণাটি ভাষার দেশের দক্ষিণে এবং তামিল ভাষার দেশের উত্তরে অবস্থিত। অতএব ওই দুই ভাষা থেকে এই নামের উৎপত্তির মূল যদি কিছু থাকে তা পাওয়া যাবে।
‘বৃষা’-পুরুষ, দ্রাবিড়ীয় ভাষায় সাধারণত ‘আণ’ শব্দের সঙ্গে মিলতে পারে। কর্ণাটী, তামিল ও মালয় ভাষায় ওই শব্দটি আছে। তেলগু ভাষায় এই শব্দটির পরিবর্তে ‘মগ’ শব্দ আছে। আণ’ শব্দ অন্য শব্দের পূর্বে বসে তার পুংস্তু নির্দেশ করে। কর্ণাটী, তামিল, তেলগু ও মালয় এই চারটি ভাষায় ‘কপি’ বাচক দুটি শব্দ দেখা যায়–কুরঙ্গু ও মণ্ডি। কেবল তামিল ভাষায় কুরুঙ্গু’ শব্দে কপি বোঝায়। অন্য তিন ভাষায় এর অর্থ কেবল হরিণ। মালয় ভাষায় কুরঙ্গ’ শব্দে হরিণ ও ‘কুরম্ন’ শব্দে বানর বোঝায়। মণ্ডি’ শব্দে তামিল ভাষায় বানর, বিশেষত বানরী বোঝায়। মালয় ভাষায় কৃষ্ণমুখ বানর বোঝাতে ‘মণ্ডি’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। কর্ণাটীতে মানুষ বা ব্যক্তি বোঝাতে ‘মণ্ডি’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। তেলগুতে অন্য শব্দযোগে ‘মণ্ডি’ শব্দে ব্যক্তি বোঝায়। কর্ণাটী ও তেলগুতে ‘কোটি’ ও ‘তিস্মা’ শব্দে বানর বোঝায়। কিন্তু তামিল ও মালয় ভাষায় এর সমশব্দ নেই। অতএব দ্রাবিড়ীয় ভাষায় বানরার্থ ‘মণ্ডি’ শব্দ সবচেয়ে প্রাচীন শব্দ। এই সমস্ত সাদৃশ্য উপস্থাপন করে পুরাতাত্ত্বিক পাজ্জিটার বলছেন–যদি এইসব কথা গ্রহণীর হয়, তবে ‘আণ মণ্ডি’ শব্দ বৃষাকপি শব্দবোধক হতে পারে। আণমণ্ডির শব্দার্থ করে সংস্কৃতানুবাদ বৃষাকপি হতে পারে। তারপর ‘আণ মণ্ডি’-কে সংস্কৃত করে নিতে হলে সহজেই “হনুমান’ হয়ে যায়। কারণ আর্যরা যেখানে দ্রাবিড়ীয় শব্দকে সংস্কৃত করে নিয়েছেন, সেইখানেই অনেক ক্ষেত্রে ‘হ’ মিশিয়ে দিয়েছেন। এইভাবে আণমণ্ডি > অনমন্ত > হনুমন্ত হয়েছে। অতঃপর পাজ্জিটার বলেছেন–বৃষাকপি > আণমণ্ডি > হনুমন্ত যদি ঠিক হয়, তবে বলতে হয় ঋগ্বেদের আগেই দাক্ষিণাত্যে এর বিস্তৃতি হয়েছিল। বানরপুজো দাক্ষিণাত্যের সম্পত্তি এবং ঋগ্বেদ সংগ্রহের আগেই বানর স্তুতিমন্ত্র সমস্ত দেশে রচিত হয়েছিল। (ভারতবর্ষ/প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা)
বিভিন্ন পুরাণ ও বিভিন্ন রামায়ণে এই হনুমানকে নিয়েই প্রচুর অলৌকিক ও সুপারন্যাচারাল কাহিনি প্রচলিত আছে। কয়েকটা কাহিনি এ আলোচনায় উল্লেখ করা যায় বিনোদনের জন্য। শাস্ত্রপুরাণাদি ঘেঁটেঘুঁটে হনুমানের জন্ম নিয়ে চারটি ভিন্ন স্বাদের গল্প পাওয়া যায়। কোনো গল্পে হনুমান পবন বা বায়ুর ঔরসজাত, কোনো গল্পে তিনি শিবের ঔরসজাত। শিবের দাঁড়িপাল্লাই ভারী। হনুমান কি বানর? বানর হলে ভীম তবে কে? হনুমানের মতো ভীম পবনপুত্র হয়েও ভীম ‘বানর’ এমন কথা তো কোথাও পাইনি! তবে হনুমানের জন্মকাহিনিতে যতই ভিন্নতা থাক–পিতা পৃথক পৃথক হলেও মাতা একই। মাতার নাম অঞ্জনা, অঞ্জনা কেশরীর স্ত্রী। কিন্তু হনুমানকে অনেকক্ষেত্রে ‘কেশরীনন্দন’ বলা হলেও, তিনি কেশরীর ঔরসজাত নন।
এক নম্বর গল্প : অঞ্জনা একাকিনী পাহাড়াঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। একে সুন্দরী নারী, তার উপর পরস্ত্রী–পরস্ত্রী বড়োই উপাদেয় বোধহয়! অঞ্জনাকে একাকিনী পেয়ে পবনদেবতা ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাঁর উপর। বলাৎকারে বিবস্ত্র হয়ে গেলেন অঞ্জনা। পরস্ত্রী অঞ্জনার সঙ্গে মিলিত হলেন ‘দেবতা’ পবন। এই বলাৎকারের ফল হল হনুমানের জন্ম। অতএব অঞ্জনাও বানরী নয়, পবনও বানর নয়। এটি একটি বানোয়াট গল্প।
দুই নম্বর গল্প : নানা গল্পে বিষ্ণুকে মোহিনী রূপে দেখা গেছে। অর্থাৎ পুরুষশরীরে নারীর সাজসজ্জা–রূপান্তরকামীরা যেমন সাজেন! এবার মোহিনী বেশধারী বিষ্ণু এতটাই মোহময়ী হয়ে উঠছিলেন যে, তাঁকে দেখে শিবের বীর্যপাত হয়ে যায়। শিবে তেজোময় বীর্যপাত হলে তা কোথায় স্থাপন করবেন, তা নিয়ে শিব বহুবার বিব্রত বোধ করেছেন। এবারও শিবের একই অবস্থা। তবে শিবের এই পতিত বীর্য পরস্ত্রী অঞ্জনার গর্ভে স্থাপন করে দিলেন। অঞ্জনা গর্ভবতী হলেন, গর্ভের সেই সন্তানই হনুমান। প্রাচীন ভারতে বাইরে থেকে বীর্য নিয়ে নারীর গর্ভে স্থাপন করে নারীকে গর্ভবতী করানো যেত। এ তথ্যের সত্যতা নিয়ে কোনো গ্রন্থ মুনিঋষিরা লিখে যাননি।
তিন নম্বর গল্প : অঞ্জনার স্বামী কেশরীর গর্ভে শিব তাঁর তেজ’ প্রবেশ করালেন। এরপর কেশরী ও পবন উপর্যুপরি অঞ্জনার সঙ্গে মিলিত হলেন। এই সঙ্গমের ফলও হনুমানের জন্ম।
চার নম্বর গল্প : বিভিন্ন পুরাণের নানা ঘটনায় হর-পার্বতীর যৌনমিলনের কাহিনি পাওয়া যায়। সেসব কাহিনি বড়োই রসালো। এখানেও হর-পার্বতীর যৌনমিলনের যে গর্ভসঞ্চার হয়, শিব সেই গর্ভ পবনদেবকে দান করেন। পবন সেই গর্ভ বহন করে অঞ্জনার গর্ভে চালান করে দেন। এই গর্ভই হনুমানের জন্ম দেয়।
উপরে উল্লিখিত গল্পগুলি কি বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে? বিজ্ঞানসম্মত? হনুমানের জন্মদানে শিব কমন (Common)। কে এই শিব? একই ব্যক্তি, নাকি পৃথক কেউ? অনার্য পশুপতি শিব? নাকি কৈলাশপতি শিব? পশুপতি শিব আর কৈলাশপতি শিব কি এক ব্যক্তি? এসব অস্তিত্ব প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক বীরেন্দ্র মিত্র বলেছেন–“শিব, বিষ্ণু, ব্রহ্মা, ইন্দ্র ইত্যাদি দেবপ্রধানদের পদবিমাত্র ছিল। এক দেবতার উত্তরাধিকারী গদিপ্রাপ্ত পরবর্তী দেবতাও ওই পদবি দ্বারা পরিচিত হতেন। শিবকে শাসন করতে হত ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল এবং হিমালয়ের বেশিতম প্রদেশগুলি। কোনো মানুষের পক্ষেই এত বড়ো সাম্রাজ্য একা শাসন করা সম্ভব ছিল না। শিবের প্রতিনিধি শাসক বা দেবতা থাকতেন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং তাঁরাও ‘শিব’ উপাধি দ্বারাই পরিচিত ছিলেন।”
সে জন্ম যেই-ই দিক, জন্ম তো হয়েছেই। গোবলয়ের মানুষ হনুমানকে ‘বজরংবলি’ বলে থাকেন। বজরংবলি বলতে বোঝানো হয় একক শক্তিশালী, যার শরীরের রং বজ্রের মতে, অথবা যার বজ্রের মতো পা আছে।
হনুমান হলেন গোবলয়ের হিন্দুধর্মের একজন দেবতা হিসাবে পূজ্য। বাল্মীকির রামায়ণের না-হলেও কৃত্তিবাস রঙ্গনাথন-তুলসীদাসের রামায়ণে তিনি রামের একনিষ্ঠ ভক্ত, কতটা ভক্ত সেটা বোঝাতে তিনি তাঁর বুকের ছাতি ফাটিয়ে রাম-সীতাকে দেখিয়েছেন স্বয়ং রামকেই। তাই বুক চিরে রাম-সীতাকে দেখানো হাঁটু মুড়ে বসা হনুমানের মূর্তি পুজো করতে দেখা যায়। পুরাণাদিতে হনুমানকে বিশেষ স্থান দেওয়া হয়েছে। রামায়ণ বর্ণিত হনুমান পবননন্দন হিসাবে হিন্দুদের কাছে পূজনীয়। রামায়ণের মূল চরিত্র রাম, যাকে হিন্দুরা ভগবান বিষ্ণুর ‘অবতার’ হিসাবে দাবি করে, তাঁর অনুগত চরিত্র হিসাবে পাওয়া যায় এই হনুমানকে। তবে অবশ্য বাল্মীকির রামায়ণে নয়, প্রাদেশিক কবিদের রামায়ণে হনুমান রামভক্ত। সেই সূত্রে হিন্দুদের কাছে হনুমান ‘রামভক্ত’ হিসাবেই পরিচিত।
অন্য একটা গল্পে জানা যাচ্ছে–মহাদেব বানরকুলে জন্ম নিয়েছিলেন। কেন জন্ম নিলেন? এর একটা কারণও উল্লেখ আছে। একবার রাবণ জোর করে কৈলাশে প্রবেশ করতে গেলেন। দ্বার পাহারায় ছিলেন নন্দী মহারাজ। এক প্রস্থ হাতাহাতিও হয়ে গেল। রাবণ নন্দীকে দেখে পশু, মানুষ বলে উপহাস করাতে নন্দী রেগে রাবণকে অভিশাপ দিলেন–নরবানরের হাতেই তোর ধ্বংস’। তাই বানরকুলে মহাদেব ছাড়া অন্যান্য দেবতারাও জন্ম নিলেন বানর রূপে। কার্তিক মাসের শুক্লা চতুর্দশীতে অঞ্জনা এক গুহার মধ্যে হনুমানকে প্রসব করেন। একে বলা হয় অনকচতুর্দশী। এই উপলক্ষেই কাশীতে প্রতি বছর এই তিথিতে মেলাও অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
রামায়ণের কাহিনি অনুসারে হনুমান সীতাকে উদ্ধারের জন্য লঙ্কায় অভিযান চালান। লঙ্কায় পৌঁছে অশোকবনে উপবিষ্ট সীতার সঙ্গে দেখা করেন, কিছু শলাপরামর্শও করেন। এরপর সামান্য গাছপালা এটাওটা ভাঙচুর করেন, কয়েকজন লঙ্কার নাগরিকদের সঙ্গে মারপিটও করেন। তাঁর বিরুদ্ধে যে অক্ষ নামে একজন এবং একাধিক সেনাপতি হত্যা করার যে কাহিনি আছে তা সত্য নয়, বনোয়াট। না, তিনি হত্যাটত্যা কিছু তিনি করেননি। যাই হোক, বিদেশি হনুমান নামক দূত লংকায় প্রবেশ করে উৎপাত করছেন, এ সংবাদ রাবণের কানে পৌঁছেলে তাঁকে বিচারের জন্য ধরে আনতে দুইজন লোক পাঠালেন। হনুমান ওই দুজনকে খুব করে মনের সুখে পিটিয়ে দিলেন। এরপর ইন্দ্রজিৎ কয়েকজন সহচর হনুমানের কাছে এলেন এবং শণের দড়ি আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেললেন। বেঁধে সোজা রাবণের বিচারসভায়। রাবণ হনুমানকে মৃত্যুদণ্ড দিলেন। কিন্তু বিভীষণের মধ্যস্থতায় সেই মৃত্যুদণ্ড রদ হয়ে গেল। বিভীষণ রাবণকে বললেন–“দূত অবধ্য, তাঁকে হত্যা করলে আপনার মতো বীরের অপযশ হবে।” রাবণ বিভীষণের পরামর্শে খুশি হলেন এবং রায় পরিবর্তন করে বললেন, এই দূত বানরজাতি। এঁদের প্রিয় ভূষণ লেজ। এই লেজেই আগুন ধরিয়ে রাজ্যের বাইরে ছেড়ে দাও। ক্ষমার পূজারি রাক্ষস রাবণ, যার মূল্য ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে চোকাতে হয়েছে তাঁকে। গুপ্তচর বা দূতের সঙ্গে শলাপরামর্শ করার অভিযোগে সীতাকেও কোনো শাস্তির নিদান দিলেন না। তবে এটা স্বীকার করতেই হয় যে, সেদিন বিভীষণ সভায় উপস্থিত না-থাকলে হনুমান ধড়-মাথায় দু-টুকরো হয়ে যেতেন।
রাক্ষসরাজ রাবণের রায়ে হনুমানের লেজে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল এবং রাজপথে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাঁকে নিয়ে বিস্তর মজাও করা হল। লঙ্কার নাগরিকেরা ভিড় করে দেখতে থাকলেন গুপ্তচরের অপমানজনক সাজা। তারপর একাকী পরিত্যক্ত অপমানিত লঙ্কা অতিক্রম করে রামশিবিরে চলে আসেন।
না, হনুমান তাঁর লেজের আগুন দিয়ে লঙ্কা পুড়িয়ে ছারখার করেননি। অন্তত বাল্মীকি এমন অবাস্তব কাজ হনুমানকে দিয়ে করাননি। সত্যিই যদি তাই হত, তাহলে রামের যুদ্ধ করার জন্য কেউই বেঁচে থাকতেন না। লঙ্কা পুড়ে ছারখার হলে রাবণ সহ লঙ্কার অন্যান্য বীরপুরুষরাও মরে ভূত হয়ে যেত। এই অগ্নিকাণ্ডে সীতা যদি ভাগ্যক্রমে বেঁচে থাকেন, তাহলে নিরঙ্কুর প্রতিদ্বন্দ্বীহীন লঙ্কা থেকে সীতাকে হনুমান কাঁধে তুলে রামশিবিরে নিয়ে আসতেন। যুদ্ধের আর অবকাশ কোথায় থাকত? লঙ্কায় কি পুলিশ, সামরিকবাহিনী, প্রতিরোধবাহিনী রক্ষীরা ছিলেন না, যাতে হনুমান অবরুদ্ধ হতে পারে? লঙ্কা যদি পুড়ে ছাই হয়ে যেত, তাহলে রাবণ পরবর্তীতে রাজত্ব করলেন কীভাবে? যে বিভীষণের প্ররোচনায় পড়ে রাবণ হনুমানে জীবন্ত মুক্তি দিলেন, আর সেই হনুমান লঙ্কায় ভস্ম করে দিলে, বিভীষণকে জবাবদিহি না-করেই রাবণ ছেড়ে দেবেন? কই, জবাবদিহি তো করেননি! যাঁর বুদ্ধিতে হনুমান লঙ্কায় হাজার হাজার নর-নারী-শিশু দগ্ধ হয়ে মারা গেলেন, তা সত্ত্বেও লঙ্কেশ্বর নিস্তরঙ্গ নিরুদ্বেগ থাকলেন কীভাবে? এটা বাস্তব? তা উপর কোনো কোনো কবি বলেছেন হনুমানের লেজের আগুন নাকি নিভছিলই না। উপায়ান্তর না-পেয়ে সীতার পরামর্শ নিতে গেলেন, সীতাও পরামর্শ দিলেন লেজটি ঘুরিয়ে মুখে ধরতে। মুখে লেজ ঘুরিয়ে লাগাতেই সেই আগুন নিভেছিল। নিভেছিল বটে, হনুমানের মুখটা পুড়ে কালো হয়ে গেল। মুখ কালো হয়ে গেলে হনুমান খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। সেই পথও বাতলে দিলেন সীতা। বললেন–কালো মুখের জন্য লজ্জার কিছু নেই। শুধু তোমারই মুখ কালো থাকবে না, পৃথিবীর সব হনুমানের মুখ কালো হয়ে যাবে! সেই থেকেই পৃথিবীর সব হনুমানের মুখ নাকি কালো। আষাঢ়ে গপ্পো আর কাকে বলে! তবে হ্যাঁ, লঙ্কা অবশ্যই পোড়ানো হয়েছিল, তাও স্বয়ং রামেরই হুকুমে। ইন্দ্রজিতের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে রামশিবিরের সকলেই যখন ধরাশায়ী, মৃতপ্রায়–হনুমানের তৎপরতায় যখন সকলেই সুস্থ হয়ে উঠলেন, তখন রামচন্দ্র ক্রোধে মাঝরাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত লঙ্কানগরী চারদিক থেকে অবরুদ্ধ করে আবালবৃদ্ধবনিতাকে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়ার হুকুম দিয়েছিলেন। বানরসেনারা সেই হুকুমমতোই পুড়িয়েছিলেন নিরীহ লঙ্কাবাসীদের। কীভাবে পারলেন? নগরদ্বারগুলি কে খুলে দিল? লঙ্কারাজ্যে কোন্ বিশ্বাসঘাতক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই অগ্নিদাহন প্রত্যক্ষ করলেন? রামই-বা কেন মাঝরাতে, তার উপর ঘুমন্ত নিরীহ মানুষদের পুড়িয়ে মারলেন? এত বীরের কাপুরুষতা!
বিনোদনের জন্য আর-একটা আজগুবি গল্প শোনাই–হনুমান প্রসবের পর অঞ্জনা ক্ষুধার্ত হয়ে বনে ফল আনতে গেল। হনুমান ভোরের সূর্যকে (জানি না হনুমান কোথা থেকে সূর্যের দিকে লাফ মারে। যদি পৃথিবী থেকে লাফ মারে তাহলে বিষয়টা ভাবতেই হয়। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব আনুমানিক ১৪.৯৬ কোটি কিলোমিটার এবং সূর্যের কেন্দ্রভাগে তাপমাত্রা প্রায় ১ কোটি ৩৬ লক্ষ কেলভিন। সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা মাত্র ৫৮০০ ডিগ্রি কেলভিন) ফল মনে করে খাবারের জন্য লাফ দিয়ে বহু শত যোজন অতিক্রম করল। এইসময় পবনদেবতা বাতাসকে শীতল করে দেন, যাতে সূর্য তেজহীন তাপহীন হয়ে যায়। সূর্য তাঁকে দগ্ধ করল না, কারণ হনুমান তো শিশু! ঘটনাচক্রে সেইদিনই সূর্যকে গ্রাস করার জন্য রাহু অগ্রসর হলে হনুমান সূর্যকে গ্রাস না-করে রাহুকে গ্রাস করতে ছুটলেন। রাহু তো ভীষণ ভয় পেয়ে গেল, অগত্যা তিনি ইন্দ্রের আশ্রয় নিলেন। এরপর ইন্দ্র রাহুকে সঙ্গে নিয়ে সূর্যের কাছে উপস্থিত হয়ে মধ্যস্থতা শুরু করেন, সঙ্গে ইন্দ্রের ঐরাবতও ছিল। সেই ঐরাবতকে হনুমান গ্রাস করতে ছুটে আসার চেষ্টা করলে ইন্দ্র তাঁর বজ্র দিয়ে হনুমানকে আঘাত করেন। বজ্রের আঘাতে হনুমানের হাড় ভেঙে যায় এবং ইনি পর্বত শিখরে উঠে নীচে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। পুত্রের এহেন পরিণতি দেখে পিতা পবন পর্বতগুহায় প্রবেশ করে পুত্রের জন্য বিলাপ করতে করতে স্থবির হয়ে যান। বায়ু বা বাতাস থমকে যাওয়ায় সমগ্র চরাচরে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। তখন সমস্ত দেবতা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলে ব্রহ্মা পবনের কাছে উপস্থিত হন এবং হনুমানকে পুনরুজ্জীবিত করেন। পবন খুশি হন এবং পুনরায় বাতাস প্রবাহিত করেন। এই শিশু হনুর হাড় বজ্রের আঘাতে ভেঙেছিল বলেই এর নাম রাখা হয় হনুমান। এরপর বিভিন্ন দেবতা হনুমানকে বিবিধ প্রকার বর প্রদান করেন। ইন্দ্র বর দেন যে বজ্রের আঘাতে তাঁর মৃত্যু হবে না এবং ইচ্ছামৃত্যু হবে। সূর্য তাঁর শতাংশ তেজ দান করেন। ব্রহ্মা বলেন, হনুমান ব্ৰহ্মজ্ঞ ও চিরজীবী হবেন এবং সকল ব্ৰহ্মশাপের অবধ্য হবেন। মহাদেব ও বিশ্বকর্মা বলেন, ইনি সকল অস্ত্রের অবধ্য। একসময় এমন এল যে, শিশু হনুমান বিভিন্ন ঋষিদের আশ্রমে উপদ্রব করতে শুরু করেন। অতঃপর ঋষিদের অভিশাপে ইনি দীর্ঘদিন তাঁর নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে বিস্মৃত হয়ে থাকেন।
হনুমান কর্তৃক সাগর লঙ্ঘনের পূর্বে ভল্লুকরাজ জাম্ববান হনুমানকে তাঁর ক্ষমতা সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন। এরপর থেকে ইনি তাঁর ক্ষমতা সম্পর্কে আর বিস্মৃত হননি। রাবণ সীতাকে অপহরণ করলে, সীতার খোঁজে রাম-লক্ষ্মণ কিষ্কিন্ধ্যায় উপস্থিত হন। এই সময় সুগ্রীব তাঁদের পরিচয় জানার জন্য হনুমানকে পাঠান। হনুমান এঁদের পরিচয় লাভ করার পর, এঁদেরকে পিঠে চড়িয়ে সুগ্রীবের কাছে এনেছিলেন। এরপর রাবণ ও সীতার অনুসন্ধানে সুগ্রীব বিভিন্ন দিকে চর পাঠান। হনুমানও দক্ষিণ দিকে চলে যান। এই অনুসন্ধানকালে সম্পাতির কাছে সীতার অবস্থান জানতে পেরে ইনি সাগর টপকে লঙ্কায় পৌঁছে যান। পথের মাঝে দেবতা, গন্ধর্ব ও ঋষি প্রমুখ হনুমানের শক্তি পরীক্ষার জন্য নাগমাতা সুরসাকে পাঠান। পরীক্ষায় জয়লাভ করে হনুমান পৌঁছে গেলেন সোজা লঙ্কায়। অঅন্য রামায়ণের যে অলৌকিক গল্প মানুষ বিশ্বাস করে, সেটা এখানে উল্লেখ খেই রাখার জন্য। সুরসা রাক্ষস রূপে হনুমানের পথ অপরুদ্ধ করে দাঁড়িয়ে বলেন যে, দেবতারা তাঁকে তাঁর খাদ্যরূপে নির্দিষ্ট করেছেন। উত্তরে হনুমান বললেন যে, তিনি সীতাকে উদ্ধার করতে লঙ্কায় রামের দূত হয়ে যাচ্ছেন। সীতার সংবাদ রামকে দেওয়ার কাজ সম্পন্ন করেই তিনি সুরাসার মুখে খাদ্যের জন্য প্রবেশ করবেন। এরপর সুরসা বলেন যে, দেবতার বরে কেউই আমাকে অতিক্রম করে যেতে পারবে না। কার্যসিদ্ধির পর হনুমানকে মুখে প্রবেশ করা কথা বলেন সুরসা এবং তার মুখ প্রসারিত করেন। হনুমান তাঁর দেহকে ১০ যোজন বিস্তৃত করেন, সুরসাও মুখ ১০ যোজন বিস্তৃত করলেন। সুরসা ২০ যোজন মুখ বিস্তৃত করলে হনুমানও ৩০ যোজন বিস্তৃত করেন। এইভাবে দুইজনের আয়তন ক্রমশ বিস্তৃত হতে থাকেন। এরপর হনুমান অকস্মাৎ নিজেকে আঙ্গুলের আকারে ধারণ করলেন। পরে সুরসার মুখে প্রবেশ করে আবার বেরিয়ে এলেন। এরপর সুরসা নিজমূর্তি ধারণ করে হনুমানকে আশীর্বাদ করেন। এরপর পথে সিংহিকা নামক এক রাক্ষসীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। এই রাক্ষসী জীবের ছায়া আকর্ষণ করে আহার করতেন। অতএব হনুমানেরও ছায়া আকর্ষণ করে তাঁকে আহার করার চেষ্টা করলে হনুমান প্রথমে তাঁর শরীর বৃদ্ধি করেন। সেই কারণে সিংহিকাকেও মুখ বিস্তার করতে হয়। পরে হনুমান হঠাৎ করে তাঁর শরীর সংকুচিত করে সিংহিকার শরীরে প্রবেশ করেন এবং হৃদপিণ্ড ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে তাঁকে হত্যা করেন। লঙ্কায় প্রবেশ করে ইনি তাঁর দেহ বিড়ালের মতো ছেটো করে সীতাকে খুঁজতে শুরু করেন। শেষপর্যন্ত অশোকবনে সীতাকে দেখতে পান। হনুমান সীতাকে রামের আংটি দেখালে সীতা আশ্বস্ত করেন। প্রতিদানে সীতা তাঁকে চূড়ামণি দান করেন এবং রামের বিশ্বাস উৎপাদনের জন্য সীতা তাঁকে তাঁর মাথার মণি প্রদান করেন। ফেরার সময় হনুমান অশোকবনটাও ধ্বংস করে আসেন। তাঁকে ধরার জন্য রাবণ তাঁর পাঁচ সেনাপতি ও পুত্র অক্ষয়কুমারের অধীনে এক বিশাল সেনাবাহিনী পাঠান। হনুমানের সঙ্গে যুদ্ধে অক্ষয়কুমার সহ সমস্ত সেনাদেরই মৃত্যু হয়। রাবণের নাতি জঘুমালীও নিহত হন। বুঝি, হনুমান-পরাক্রম বোঝাতেই এরকম অ্যাতো অ্যাত অতিরঞ্জিত গল্প।
আরও একটি আষাঢ়ে গল্প। হনুমান বিশাল সমুদ্র লাফিয়ে পার হয়ে লঙ্কায় পৌঁছোন, এমনটাই বিশ্বাস রাখেন ভক্ত মানুষরা। সত্যিই কি হনুমান সমুদ্র লাফিয়ে পার হয়ে লঙ্কায় পৌঁছেছিলেন? শত যোজন, অর্থাৎ চারশো ক্রোশ পরিমাণ বিস্তৃত মহাসাগর অতিক্রম করা কি সম্ভব? কবি বলেছেন–“সাগর স্যোম্মিজালানামুরসা শৈলবর্মনা অভিঘুংস্তু মহাবেগঃ পুপুরে স মহাকপিঃ।” কাহিনিটি এমন–সীতাকে উদ্ধারের জন্য সুগ্রীবের সহায়তায় বানরসৈন্য নিয়ে হনুমান লঙ্কার দিকে অগ্রসর হলেন। যাত্রাপথে সামনে সমুদ্র থাকায় তাঁদের গতি রুদ্ধ হল। তখন জাম্ববানের উপদেশে অঞ্জনার গর্ভজাত সন্তান হনুমান সমুদ্র টপকে লঙ্কায় যেতে রাজি হলেন। এরপর হনুমানের শরীর বিকট ও বিশালাকার ধারণ করলেন এবং জানালেন–“লাফানোর জন্য উদ্যত হলে ইহলোকে কেউ তাঁর গতি রুদ্ধ করতে পারবে না। একমাত্র মহেন্দ্র পর্বতই তাঁর গতি রোধ করতে সক্ষম হবে।” হনুমানের শরীরের এত বেগ যে, সমুদ্রের যে অঞ্চল দিয়ে যাচ্ছিলেন, সেই সেই অঞ্চল পাগলের মতো উত্তাল হচ্ছিল। সমুদ্রতরঙ্গমালা এতটাই উত্থিত হচ্ছিল যে, আকাশপথে যাওয়ার সময় সমুদ্রতরঙ্গ হনুমানের বুক পর্যন্ত স্পর্শ করছিল। মনে রাখতে হবে, ভারতের সর্বশেষ দক্ষিণ সীমান্ত রামেশ্বরম দ্বীপ থেকে লঙ্কার সর্বশেষ উত্তর সীমান্তের মান্নার উপসাগর বর্তমান দূরত্ব ৫০ কিলোমিটার (৩০ মাইল)। মাঝে অনেকটা অংশ ফাঁকা (ধনুষ্কোটি থেকে তালাইমান্নার), যা আদম ব্রিজ দিয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। ৩০ মাইল সমুদ্র অতিক্রম করে লঙ্কায় সীতার কাছে পৌঁছতে বীর হনুমান কি সত্যিই লম্ফন করেছিলেন? যদিও এর আগে হনুমানের ব্যাপক এক রেকর্ড আছে–তিনি পৃথিবী থেকে সূর্যের দিকে (আনুমানিক দূরত্ব ১৪.৯৬ কোটি কিলোমিটার) লাফ দিয়েছিলেন, যেখানকার তাপমাত্রা ৫৮০০ ডিগ্রি কেলভিন–৫০ কিলোমিটার দূরত্ব তো সেখানে নস্যি! পরিব্রাজক মেগাস্থিনিস লিখেছেন–
“অকাইপোদিস জাতি এত দ্রুতগামী যে অশ্বও তাঁদের সঙ্গে দৌড়তে পারে না, ইন্টোকোটাইদের কান তাঁদের পায়ের নীচ পর্যন্ত বিলম্বিত হত এবং সেইজন্য তাঁরা কানের উপর শুয়ে পড়তে পারত এবং এঁরা এমন বলবান যে, বৃক্ষোৎপাটন ও স্নায়ুনির্মিত ধনুগুণ ছিন্ন করতে পারত। এঁদের পায়ের গোড়ালির সম্মুখভাগে এবং পদাঙ্গুলি পিছনদিকে অবস্থিত।”
তবে কি মেগাস্থিনিস বর্ণিত এই জাতিগণই রামায়ণ-মহাভারতের বানর-হনুমান? মেগাস্থিনিস অবশ্য তাঁর গ্রন্থে। অবশ্য প্রচুর উদ্ভট উদ্ভট জাতির কথা উল্লেখ করেছেন। এমনই আর-একটি জাতির কথা মনে পড়ছে, যা মেগাস্থিনিস উল্লেখ করেছেন–‘মনোমোটাই’ তেমনই এক জাতি, যাঁরা একচক্ষুবিশিষ্ট এবং যাঁদের কুকুরের মতো কান। এঁদের একটি চোখ নাকি কপালের মাঝখানে অবস্থিত। এঁরা ঊর্ধকেশী এবং বক্ষস্থল রোমশ। ভারতবর্ষ এক অসভ্য ও বর্বরজাতির দেশ, এমন সাব্যস্ত করতেই বোধহয় এহেন উদ্ভট বিবরণ। মেগাস্থিনিসরা এসব তথ্য কোথায় পেলেন সেই সূত্র তিনি দিয়ে যাননি। তবুও এসব বর্ণনায় ভক্ত-মানুষের কী প্রশ্নহীন এবং অগাধ আস্থা, বিশ্বাস!
মেগাস্থেনিস লিখেছেন–“ভারতে পঞ্চবিঘস্ত দীর্ঘ মানুষ আছে, তাহাদিগের মধ্যে কাহারও নাক নাই, কেবল মুখের উপরে দুইটি রন্ধ্র আছে, তাহার দ্বারা নিশ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণ করে। ত্রিবিঘস্ত জাতির সহিত সারসেরা যুদ্ধ করে, তিতির পক্ষীও যুদ্ধ করে, এগুলি রাজহংসের ন্যায় বৃহৎ।… বনমানুষগুলিকে চন্দ্রগুপ্তের নিকট আনা পারা যায় নাই। ইহাদের পায়ের গোড়ালি সম্মুখের দিকে, পাতা ও আঙ্গুলগুলি পশ্চাদ্দিকে। ভারতীয় মহাকাব্যে এরা ‘পশ্চাদলয়ঃ’ নামে পরিচিত। কয়েকটা মুখবিহীন মানুষ আনীত হইয়াছিল, তাহারা শান্ত ছিল।” আর-একটি যে জাতির উল্লেখ পাওয়া যায়, এরা হল ‘okupodas’। এই জাতির একটিমাত্র পা এবং ঘোড়ার চেয়েও দ্রুতগামী। রামায়ণ ও হরিবংশেও একপদ জাতির উল্লেখ আছে। একচরণ’ নামও পাওয়া যায়। Enoctokoital বা কর্ণবরণগণ জাতির কথা জানা যায়, তাদের শারীরিক বর্ণনা এরকম–এদের কান পা পর্যন্ত লম্বা, বিলম্বিত কানের উপরই তারা ঘুমোয়। এরা এতটাই বলবান যে, তারা বিশাল বিশাল বৃক্ষ উৎপাটন করতে পারে, ধনুগুণ ছিন্ন করতে পারে। মহাভারতে কর্ণপ্রাবরণ কথা জানা যায়–“বশে চক্রে মহাতেজা দণ্ডকাশ্চ মহাবলঃ।/সাগরদ্বীপবাসাংস্ট নৃপতি ম্লেচ্ছযযানিজান।/নিষাদা পুরুষাদাশ্চ কর্ণপ্রাবরণানপি।/যে চ কালমুখো নাম নররাক্ষসযোনয়ঃ।”(সভাপর্ব/৩১ অধ্যায়/৬৬-৬৭ শ্লোক) ক্টিসিয়সও বলেন–“বামনজাতি ভারতবাসী। এই বামনেরা কিরাতজাতি। কিরাত বলতে বামনই বুঝায়। প্রবাদ এই যে, তাহারা গৃধ্র ও গরুড়ের (ঈগলের) সহিত যুদ্ধ করে, সেজন্য বিষ্ণুর বাহন গরুড়ের একটি নাম, কিরাতগণ মঙ্গোলীয় জাতি। এজন্য ভারতবর্ষীয়েরা ইহাদিগকে মঙ্গোলীয় জাতির ন্যায় বর্ণনা করিয়া যাইয়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কদর্যতা তুলিয়াছে। মুখবিহীন’ প্রভৃতি অভিধানের ইহাই মূল।” এ ধরনের বর্ণনা থেকে এটাই প্রমাণ করে যে, আর্যরা প্রবেশের আগে ভারত উপমহাদেশ জুড়ে এরকম শারীরিক বৈচিত্র্যপূর্ণ মানুষের বসবাস ছিল। আর্যরা প্রবেশের পর তাঁদের রচনায় এঁদেরই বিচিত্র শারীরিক গড়নের বর্ণনা পাওয়া যায়, যাঁদের তাঁরা রাক্ষস-খোক্কস, অসুর, দৈত্য দানো, দাস-দস্যু হিসাবে উপস্থাপন করেছেন। আর্যদেবতাদের মধ্যে সেইরকম শারীরিক গড়নের প্রভাব পড়েছিল। তাই বোধহয় আর্য দেবদেবীদের মধ্যে চার মাথা, তিন চোখ, একাধিক হাতের রূপ পাওয়া যায়। আমরা গ্রিক ও রোমের দেবদেবীদেরও এরকম বিচিত্র রূপে দেখতে পাই।
অবশ্য স্ট্রাবো দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লিখেছেন–“ডিমখস ও মেগাস্থেনিস একেবারেই বিশ্বাসের অযোগ্য। ইঁহারা নানা। অলৌকিক জাতির উপাখ্যান রচনা করিয়াছেন। কোনো জাতির কর্ণ বৃহৎ যে তাহাতে শয়ন করা যায়, কোনোটির মুখ নাই, কোনোটির নাসাবর্জিত, কোনোটির পদ ঊর্ণনাভের পদের ন্যায়, কোনোটির আঙ্গুল পশ্চাদ্দিকে। বামন সারসের যুদ্ধ সম্বন্ধে হোমরের যে আখ্যায়িকা আছে, ইহারা পুনরক্তি করিয়াছেন, ইঁহারা বলেন যে, এই বামনেরা ত্রিবিঘস্ত দীর্ঘ ছিল। স্বর্ণখননকারী পিপীলিকা, কীলকাকার মস্তকবিশিষ্ট নরপশু (Pans), সশৃঙ্গ গো ও হরিণ উদরসাৎ করে, এই প্রকার অজগর ইত্যাদি অনেক উপাখ্যান হঁহারা লিপিবদ্ধ করিয়াছেন।” এরাটস্থেনীয় বক্তব্য স্মতব্য–“ইঁহারা এই সকল বিষয়ে একে অন্যকে মিথ্যাবাদী বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন।”
উত্তর খুঁজতে আমরা সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার সম্পাদিত ‘টলেমির প্রাচীন ভারত’ গ্রন্থটি অনুসরণ করতে পারি। টলেমি ছিলেন সুপ্রসিদ্ধ ভৌগোলিক এবং জ্যোতির্বিদ। টলেমির মতে লঙ্কা পেরোবার জন্য কোনো দুস্তর সাগর পারাপারের প্রশ্নই ছিল না। লঙ্কা আর ভারতের ভূখণ্ড সংযোগ ছিলই। হেঁটে অনায়াসেই লঙ্কায় চলে যাওয়া সম্ভব। ভূগোলবিদ স্ট্রাবো ও প্লিনির ১০০ বছর পরে টলেমি তাঁর পূর্ববর্তী ভৌগোলিকদের গ্রন্থাবলি অনুশীলন এবং অন্যান্য উপায় অবলম্বন করে পুরাবৃত্ত বিষয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা লাভ করেন। টলেমির ‘ভূগোল’ নামক গ্রন্থটি অতি মূল্যবান। টলেমি লিখেছেন–তিনেভেলির প্রধান নদী তাম্রপর্ণী। এই নদী কখইয়ের দক্ষিণে সমুদ্রে এসে মিশত, যার বর্তমান পরিচয় মান্নার উপসাগর। তামিল কাব্যে এটাই আবার পরুনী, পালি ভাষায় তম্বপন্নি বা তপ্রবেন নামে পরিচিত। প্রাচীন যুগে মান্নান উপসাগরের অদূরে অর্গালিক উপসাগর ছিল, এটা রামেশ্বর দ্বীপ দ্বারা বিছিন্ন ছিল এবং ভারতবর্ষের সঙ্গে ছোটো ছোটো দ্বীপমালা দিয়ে সিংহল তথা লঙ্কা প্রায় যুক্ত ছিল। ভৌগোলিক প্লিনি সিংহলের অতি কাছে ভারতীয় সূচ্যগ্র ভূখণ্ড একটি ক্ষীণ প্রবাল (চুনাপাথর?) সাগর দ্বারা বিচ্ছিন্ন ছিল। তবেন দ্বীপ ক্রমশই তার নাম পালটেছে। রামায়ণে এবং অন্যান্য সংস্কৃত গ্রন্থে এই দ্বীপকেই ‘লঙ্কা’ বলা হয়েছে। আলেকজান্ডারের সময়ে ‘ট্যাপ্ৰেবন’ বলা হত, আলেকজান্ডারের আগে গ্রিকরাই বলত ‘অ্যান্টিচথোনাস’। মেগাস্থিনিসই এই দ্বীপকে ‘ট্যাপ্ৰেবন’ বলেছেন, বলেছেন এই ট্যাপ্ৰেবন একটি নদী দিয়ে দ্বিধাবিভক্ত ছিল। অতএব ভারতবর্ষ ও লঙ্কার মধ্যস্থিত সমুদ্রকে যেরকম দুষ্কর ও দুস্তর বলে রামায়ণে বর্ণনা করা হয়েছে, বিষয়টি তেমন কিছু নয়–এ ব্যাপারে সুনিশ্চিত হওয়াই যায়। অতএব বলাই বাহুল্য, লঙ্কেশ্বর রাবণ এবং তাঁর অনুগামীরা অনায়াসেই ভারতবর্ষে যথা-তথা ইচ্ছা বিচরণ করত। তাঁর প্রমাণ তথাকথিত রাক্ষসরাজ সহ শূর্পণখা, মারীচ, বিরাধরা দণ্ডকারণ্যে এসে সারাক্ষণ ঋষিদের বিরক্ত করত কীভাবে? রাবণ না-হয় বিমানে চেপে সীতাকে অপহরণ করেছেন, কিন্তু রাবণের বাকি অনুগামীরা কীভাবে ভারত ভূখণ্ডে বিচরণ করত? বিভীষণ কীভাবে লঙ্কা থেকে এসে রামের পক্ষে যোগ দিলেন? হনুমানের মতো সমুদ্রলঙ্ঘন করে নিশ্চয় নয়? অতএব এ থেকে প্রমাণ হয় লঙ্কা থেকে ভারতে অবাধেই যাতায়াত করা যেত, লম্ফঝম্ফ-উলম্ফনের কোনো প্রয়োজন ছিল না। হনুমানের সমুদ্রলঙ্ঘনের গল্পটি অতিরঞ্জিত, অতিকল্পিত।
২০০৭ সালে শ্রীলঙ্কা পর্যটনের উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রিন্স রামের কিংবদন্তি উদযাপন ভারতে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের থেকে ধর্মীয় পর্যটন প্রচার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে অনেক ঐতিহাসিক প্রতিবাদ জানায়। ২০০২ সালে নাসা উপগ্রহ চিত্রের একটি গবেষণা উপর ভিত্তি করে জানিয়েছে, এটা একটি প্রাকৃতিক গঠন, মানুষের তৈরি কাঠামো ছিল না। নাসা বলছে যে, ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই sandbanks প্রাকৃতিকভাবে শৃঙ্খল ছাড়া আর কিছুই নয়। ভারত সরকার, ভারতের সুপ্রিম কোর্টের একটি হলফনামায় বলেন, রামের দ্বারা সেতু নির্মিত হয়েছে এর কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ থেকে জানা যায়, এটা মানুষের বানানো হয়েছে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ২০০৮ সালে ভারত সরকারের জন্য একজন মুখপাত্র বলেন, এটি মনুষ্যসৃষ্ট গঠন ছিল না। এটা একটি অতিমানব বানানো কাঠামো হতে পারে, কিন্তু একই অতিমানবই এটা ধ্বংস করেছে। তাই কি ধনুষ্কোটি থেকে তালাইমান্নার পর্যন্ত ফাঁকা, ভূখণ্ডহীন সমুদ্র! তবে অতিমানব নয়, অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন এ অংশটি ভারত-শ্রীলঙ্কার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয় সাইক্লোন বা সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ে। এই চুনাপাথর প্রাচীর প্লেট টেকটোনিক্স তত্ত্বের ফলেও বিচ্ছিন্ন হতে পারে বলে আমার মনে হয়। বস্তুত প্যানথালাসা ও প্যানজিয়ার যুগে ভারত ও শ্রীলঙ্কা ভূখণ্ড দুটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
যাই হোক, কাব্যের খাতিরে কবি লঙ্কা যুদ্ধের সময় হনুমানকে দিয়ে এককভাবে অসীম বীরত্ব প্রদর্শন করিয়েছেন। তাঁর হাতে–ধুম্রাক্ষ, অকম্পন, দেবান্তক, ত্রিশিরা, নিকুম্ভ নামক রাক্ষস সেনাপতি নিহত হয়। ইন্দ্রজিৎ হত্যার সময় ইনি লক্ষ্মণকে বহন করেছিলেন। রাবণের নিক্ষিপ্ত শক্তিশেলের আঘাতে লক্ষ্মণ মৃতপ্রায় হলে বিশেষজ্ঞ জাম্বুবানের (মহাভারতে কবিরাজ সুষেণ) পরামর্শে বিশল্যকরণী’ নামক ঔষধি আনার জন্য গন্ধমাদন পর্বতে যান। বিবিধ গাছপালার মধ্যে ইনি এই গাছটি খুঁজে না-পেরে গোটা পর্বতটাই তুলে আনেন বলে বর্ণিত হয়েছে। সত্যিই কি বীর হনুমান গোটা গন্ধমাদন পর্বতটাই তুলে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন? তা কি সত্যিই সম্ভব? তুলতে না-পারার কী আছে! হনুমান তো এলিতেলি কেউ নন, দেবতা–দেবতার পুত্র দেবতা।
উদ্ভিদ থেকে নির্গত গন্ধ সমস্ত অঞ্চলকে সুবাসিত করে রাখে যে ঔষধি পর্বত, তাকেই গন্ধমাদন পর্বত বলা হয়। গন্ধ + মাদন, যা গন্ধে মাদয়িত (মত্ত) করে। মহাকবি বাল্মীকি এই পর্বতকে ঔষধি পর্বত বলেছেন। এই পর্বতাঞ্চলে যে যে ঔষধি বৃক্ষলতা পাওয়া যেত, তা হল–
(১) মৃতসঞ্জীবনী (যা মৃতপ্রায় ব্যক্তিকে পুনর্জীবন দান করে),
(২) বিশল্যকরণী (যা শরীর থেকে ক্লেদ, কালিমা, টক্সিন দূর করে),
(৩) সুবর্ণকরণী (যা দেহকে স্বাস্থ্যজ্জ্বল ও লাবণ্যময় করে) এবং
(৪) সন্ধানকরণী (যা ভগ্ন অস্থিকে সংযুক্ত করে)।
এ সমস্ত ভেষজ আজও পাওয়া যায়, কাল্পনিক নয়। এইসব ঔষধি বৃক্ষ ভারত উপমহাদেশের মহান সম্পদ। অভিধান মতে ‘গন্ধমাদন’ শব্দের অর্থ গন্ধক (Sulpher) এবং পর্বত শব্দের অপর একটি অর্থ একপ্রকার শাক বা উদ্ভিদ। ওই সময়ে বিশল্যকরণী, গন্ধক এবং শাকবিশেষের সংমিশ্রণে যে ওষুধ তৈরি হত, তা ক্ষতরোগের মহৌষধি বলে খ্যাত ছিল। এটি হিমালয় সন্নিহিত আলপাইন সদৃশ অরণ্য এবং কৈলাস ও স্বর্ণাভ ঋষভ পর্বতের প্রায় ১০০ যোজন বা আট মাইল জুড়ে বিস্তৃত। কোনো কোনো পণ্ডিত বলেন গন্ধমাদন হল যমকোটিপত্তন থেকে নীল ও নিষধ পর্বত পর্যন্ত মাল্যবান পর্বত। রোমকপত্তন থেকে নীল ও নিষধ পর্বত পর্যন্ত। আবার কোনো কোনো পণ্ডিত বলেন, এই পর্বত ইলাবৃত বর্ষ ও ভদ্রাশ্ব বর্ষের সীমাপর্বত এবং মেরুর পূর্বে অবস্থিত। প্রাবন্ধিক শ্ৰীমনোনীত সেন বলেন, রামায়ণে উল্লিখিত গন্ধমাদন পর্বতই কারাকোরাম পর্বত। প্রাবন্ধিক বীরেন্দ্র মিত্র বলেছেন–“গন্ধমাদন পর্বত গাড়োয়াল হিমালয়ের একটি বৃহদংশের নাম। রুদ্র হিমালয় এবং কৈলাস পর্বতমালার অংশীভূত। এই পর্বতে মন্দাকিনী প্রবাহিত। মন্দাকিনী নেমেছে কেদার অঞ্চল ছুঁয়ে।” তা হনুমান যখন গন্ধমাদন পর্বতটাই উৎপাটন করে লংকায় নিয়ে গিয়েছিলেন, তখন মন্দাকিনী নদীটি কোথায় রেখে গিয়েছিলেন?
রাম-রাবণের যুদ্ধকালে হনুমান একবারই (দু-বার নয়) এই ঔষধি পর্বত উৎপাটন করে এনেছিলেন। প্রথমবার ইন্দ্রজিতের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে রাম ও লক্ষ্মণ যখন মৃতপ্রায় হয়। রাম কিছুক্ষণ পর সুস্থ হয়ে উঠলেও লক্ষ্মণ অচৈতন্য। রামশিবিরে যখন কবিরাজ সুষেণের সঙ্গে বিশল্যকরণী আনানোর জন্য পরামর্শ চলছে, ঠিক তখনই গড়র ওষুধপত্র নিয়ে অকুস্থলে হাজির হয়ে যান। রাম ও লক্ষ্মণ উভয়ই ওষুধ সেবনে চাঙা হয়ে উঠলেন। এক্ষেত্রে বিশল্যকরণী গরুড়ই এনেছিলেন, হনুমান নয়। দ্বিতীয়বার ইন্দ্রজিতের সঙ্গে যুদ্ধে আবার রাম, লক্ষ্মণ, হনুমান, জাম্ববান মৃতপ্রায় হলেন ও অন্যান্য প্রচুর বানরসেনারা লাশ হয়ে গেলেন। রণক্ষেত্র শ্মশানে পরিণত হল। শবপ থেকে হনুমান জ্ঞান ফিরে পান। জ্ঞান ফিরলেই অন্ধকারে খুঁজতে খুঁজতে বিভীষণকে পেয়ে গেলেন। হনুমান ও বিভীষণ আবিষ্কার করলেন জাম্ববানকে। জাম্ববান হনুমানকে নির্দেশ দিলেন ঋষভগিরি কৈলাসের মাঝে গন্ধমাদনের বিশল্যকরণী, সুবর্ণকরণী ও সন্ধানী ও ঔষধি আনতে। হনুমান এই চারপ্রকার ওষুধও এনে দিলেন।
ঔষধির গন্ধে রাম, লক্ষ্মণ শল্যমুক্ত হন এবং বানরেরা (লঙ্কার যুদ্ধে ইন্দ্রজিৎ মন্ত্রপূত শাণিত প্রাস, শূল এবং অন্যান্য বাণ দ্বারা হনুমান, সুগ্রীব, অঙ্গদ, গন্ধমাদন, জাম্ববান, সুষেণ, বেগদর্শী, মৈন্দ, দ্বিবিদ, নীল, গবাক্ষ, গবন্ধু, কেশরী, হরিলোম, বিদ্যুদ্দংষ্ট্র, সূর্যানন, জ্যোতিমুখ, দধিমুখ, পাবকাক্ষ, নল ও কুমুদ প্রভৃতি হরিশাদূলগণকে বিদ্ধ করে মৃতপ্রায় করে দিয়েছিল।) সুস্থ হয়। ঔষধি চিনতে না-পেরে গোটা পর্বতটাই তুলে আনেন! শুধু গাছগাছালিই নয়, অসংখ্য জন্তুজানোয়ারও নিশ্চয় উঠে আসে। হনুমানে এত ক্ষমতা, অথচ কটা গাছ চিনতে পারলেন না। হনুমান চেনেন বলেই তো জাম্ববান তাঁকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। যাঁর উপর বিষ্ণুর অংশ রামের জীবন ফিরে পাওয়ার সম্পর্ক এবং যুদ্ধে পরজয়ের গ্লানি সরিয়ে পুনরায় যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে রাবণকে বিনাশ করতে হবে, সেখানে এই অনাবশ্যক শক্তি ক্ষয় করে গোটা পর্বতটাই উপড়ে উড়িয়ে আনতে গেলেন কোন যুক্তিতে! সত্যিই কি পর্বতটি উপড়ে আকাশপথে (যুদ্ধক্ষেত্র তথা দক্ষিণের ত্রিকূট পর্বত থেকে উত্তরের গন্ধমাদন পর্বতের দূরত্ব প্রায় ৩২১৪ কিলোমিটার বা ১৯৯৭ মাইল) উড়িয়ে এনেছিলেন? যদি তর্কের খাতিরে মেনেই নিই গন্ধমাদন পর্বত তুলে এনে যুদ্ধক্ষেত্রে এনেছিলেন, তবে বলব কাজ মিটে গেলে পর্বতটি কে যথাস্থানে রেখে গিয়েছিল? সেই গল্পটি কোনো রামায়ণে পাইনি। এমন পর্বত তুলে আনার গপ্পোই তো বাল্মীকি বলেননি।
সমগ্র ঘটনাটি ঘটেছিল রাতেই। ঔষধিগুলি সরাসরি শরীরে প্রয়োগ করা হয়নি, গন্ধ আঘ্রান করেই সবাই চাঙা হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। রাম-রাবণের এই যুদ্ধে শুধু রাম-লক্ষ্মণ-বানরাই মৃত বা মৃতপ্রায় হননি, রাবণের প্রচুর অনুগামীরাও মৃত বা মৃতপ্রায় হয়েছিলেন–তাহলে কি তাঁরাও চাঙা হয়ে উঠেছিল? উঁহু, তা হওয়ার জো নেই! মহাকবি বলেছেন–যখন থেকে বানর-রাক্ষসদের যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল, সেই সময় থেকেই রাবণের আদেশে মৃত সৈন্যদের পরিমাণ বিষয়ে হিসাব রাখার জন্য রণমধ্যে বানরের হাতে মৃত ও আহত নিশাচরেরা সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। মৃত রাক্ষসদেহ সেখানে ছিলই না, ঔষধির আঘ্রাণ তাঁরা নিতে পারেনি, অতএব জীবিত হওয়ারও সুযোগ ছিল না। শ্ৰীমনোনীত সেন বলেছেন–“আষাঢ়ে গল্প”। গন্ধমাদন তুলে আনার গপ্পোটি আষাঢ়ে, তা আমরা না-মানলেও মহাভারতকার এই আষাঢ়ে গপ্পোটিকে এক্কেবারেই পাত্তা দেননি। তাই মহাভারতে মার্কণ্ডেয় মুনির বর্ণিত রামোপাখ্যানে গন্ধমাদন পর্বতের কথা ভুলেও উচ্চারণ করেননি। বনপর্বের ২৮৮ নম্বর অধ্যায়ে শুধুমাত্র বলেছেন–“বানররাজ সুষেণ দিব্য মন্ত্রপ্রযুক্ত মহৌষধি বিশল্যা দ্বারা অতি সত্বরে তাঁহাদিগকে শল্যনিমুক্ত করিয়ে দিলেন। মহারথ রাম-লক্ষ্মণ লব্ধসংজ্ঞ ও শল্যনিমুক্ত গাত্রোত্থানপূর্বক ক্ষণকাল মধ্যেই গতক্রম হইলেন।”
হনুমানকে এভাবে বোকা বানানোর অর্থ কী? ধরে আনার কাজ যদি কেউ বেঁধে আনে, তাঁকে তো সবাই বোকাই বলে গাছ চিনতে পারেনি বলে তাই পর্বতটাই তুলে এনেছে–এটা হেঁদো যুক্তি নয়? জাম্ববান বিচক্ষণ ব্যক্তি, সামান্য সুস্থ হওয়ার পর তিনি হনুমানকেই খুঁজেছিলেন, “ভগবান রামকে বা অন্য কাউকে নয়। কারণ তিনি জানতেন হনুমানই চিনতেন এইসব ওষুধিগুলি। কাজেই এইসব গপ্লোগাছা দৃষ্টিহীন’-রাই বিশ্বাস করেন, ‘চক্ষুষ্মন’-রা নয়। এমন গপ্পোগাছা বিশ্বাস করতে হলে হনুমান আর জাম্ববানকে “বোকার হদ্দ” প্রতিপন্ন করতে হয়। সেটা কি সমীচীন হবে? হনুমান নিঃসন্দেহে মহাশক্তিমান, বীর। এহেন মহাশক্তিমান অমাত্য মন্ত্রীসভায় থাকতে সুগ্রীব কেন যে তাঁর দ্বারা বালীকে হত্যা করে কিষ্কিন্ধ্যা দখল করতে পারল না, সেটাই ভাবাচ্ছে।
যুদ্ধশেষে ইনি সীতার কাছে রাবণবধের সংবাদ দেন এবং সীতাকে রামের কাছে পৌঁছে দেন। অযোধ্যায় রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা ফিরে আসার সময় রাম হনুমানকে নন্দীগ্রামে ভরতের মনোভাব জানার জন্য পাঠিয়েছিলেন। অযোধ্যা থেকে ফেরার সময় রাম তাঁর শরীরের সমস্ত অলংকার হনুমানকে প্রদান করেন। সেই সঙ্গে রাম হনুমানকে বর দেন যে, যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন হনুমানও জীবিত থাকবেন। বাবাল্মীকির রামায়ণে লংকাযুদ্ধের সময় হনুমান কিছু রাক্ষস মেরেছিলেন বটে, সেই সঙ্গে গুটিকয়েক মহারথী মহাবীরও হত্যা করেছিলেন। যেমন–অকম্পন, ত্রিশিরা।
এ তো গেল রামায়ণের হনুমান। এই হনুমানকে মহাভারতেও পাওয়া যাচ্ছে। রামায়ণের রাম ও হনুমান ত্রেতাযুগের, ত্রেতাযুগের সময়কাল ১২,৯৬,০০০ বছর। মহাভারত ও মহাভারতের হনুমান দ্বাপরযুগের, দ্বাপরযুগের সময়কাল ৮,৬৪,০০০ বছর। পাঠকগণ দুই যুগের ব্যবধানটা আপনারা নিজেরাই হিসাব করে নিন। আমি বলি দ্বাপরযুগের হনুমানের কথা–তো দ্বাপর যুগে ভীম যখন দ্রৌপদীর অনুরোধে পদ্ম সংগ্রহের জন্য ভুল করে মানুষের অগম্য স্বর্গপথে রওনা দেন, তখন হনুমান তাঁর পথরোধ করে বসেছিলেন। উল্লেখ্য হনুমান এবং ভীম দুজনেই পবনপুত্র। সেদিক থেকে দেখলে, তাঁরা একে অপরের ভাই। পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের সময়ে হনুমান এক অসুস্থ এবং বৃদ্ধ বানরের বেশে ভীমকে দেখা দেন। ভীম ছিলেন অসম্ভব আত্মগর্বী। তাঁকে শিক্ষা দেওয়াই ছিল হনুমানের উদ্দেশ্য। ভীমের পথ রুদ্ধ করে অসুস্থ বৃদ্ধের ছদ্মবেশে হনুমান শুয়ে ছিলেন। ভীম তাঁকে অতিক্রম করতে চাইলে তিনি ভীমকে বলেন তাঁর লেজটি সরিয়ে চলে যেতে। ভীম বহু চেষ্টাতেও সেই লেজ সরাতে পারেননি। শেষে তিনি অনুভব করেন, এই ব্যক্তি কোনও সাধারণ বানর নন। তিনি হনুমানের শরণ নেন। এরপর ভীম তাঁর অগ্রজের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং সমুদ্র লঙ্ঘনের পূর্বে হনুমানের রূপ কেমন ছিল তা দেখার জন্য আবেদন জানান। হনুমান তাঁকে বিন্ধ্যাপর্বতের মতো বিশাল রূপ দেখান। এরপর হনুমান পদ্মবনের প্রকৃত পথ দেখান। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ইনি আড়ালে থেকে ভীমকে সাহায্য করেছিলেন। এছাড়াও প্রসঙ্গত বলতে ইচ্ছে করছে, হনুমান যখন জানতে পারেন যে রামের দীর্ঘায়ু কামনায় সীতা সিঁথিতে সিঁদুর পরেন তখন তিনি সারা গায়ে ‘কুমকুম’ বা সিঁদুর মেখে ফেলেন। মেটে সিঁদুরের রঙে তাঁর গায়ের রং হয়ে ওঠে কমলা। এজন্যই হনুমানের আর এক নাম বজরংবলি, কারণ ‘বজরং’ কথার অর্থ কমলালেবু। নারদ মুনির প্ররোচনায় একবার ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে হনুমানকে বধ করতে গিয়েছিলেন রাম। তখনই হনুমান একমনে রামনাম জপ করতে থাকেন। আর সেই নামজপেই অকেজো হয়ে যায় রামের সবচেয়ে শক্তিশালী এই দৈব অস্ত্র।
হনুমানের সঙ্গে অর্জুনেরও দ্বৈরথ ঘটেছিল। সেতুবন্ধ রামেশ্বরমে অবস্থানকালে অর্জুন এক ক্ষুদ্র বানরের সম্মুখীন হন। অর্জুন সেই বানরের সামনে গর্ব ভরে বলেন, বানরদের সাহায্য না-নিয়ে রামচন্দ্র একাই সেই সমুদ্র-সেতু নির্মাণ করতে পারতেন। তির যোজনা করেই তো সেটা করা সম্ভব ছিল। ক্ষুদ্র বানর অর্জুনকে চ্যালেঞ্জ জানায় ওই কাজ করে দেখাতে। অর্জুন ব্যর্থ হলে ক্ষুদ্র বানরের ছদ্মবেশ ত্যাগ করে হনুমান প্রকট হন। অর্জুন তাঁর শরণ নিলে, তিনি অর্জুনের রথশীর্ষে অধিষ্ঠান করবেন বলে বর দেন। অর্জুনের রথের উপরে তাই ‘কপিধ্বজ’ শোভা পায়। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষ হলে অর্জুন রথ থেকে নেমে আসেন। কৃষ্ণ হনুমানকে ধন্যবাদ জানান রথশীর্ষে অবস্থান করার জন্য। হনুমানও ধ্বজা-রূপ ত্যাগ করে স্বমূর্তি ধারণ করেন। তিনি বিদায় নিলে রথটি ভস্মে পরিণত হয়। হতবাক অর্জুনকে কৃষ্ণ জানান, ভয়ানক সব অস্ত্র এই রথের উপরে বর্ষিত হয়েছে। হনুমান রক্ষা না-করলে রথটি অনেক আগেই ভস্মীভূত হত। মাত্র চারজন ব্যক্তি শ্রীকৃষ্ণের মুখ থেকে ভগবদগীতা শুনেছিলেন এবং বিশ্বরূপ দর্শন করেছিলেন। এঁরা হলেন–অর্জুন, সঞ্জয়, বরিক এবং ঘটোৎকচ। কিন্তু একথা মনে রাখতে হবে, ধ্বজ হিসাবে রথশীর্ষে অবস্থানের কারণে হনুমানও ছিলেন সেই তালিকায়।
একটি আশ্চর্য রামায়ণের সন্ধান পাওয়া যায়, যার রচয়িতা হিসাবে চিহ্নিত করা হয় স্বয়ং হনুমানকেই। ‘হনুমদ রামায়ণ’ নামে পরিচিত এই গ্রন্থ সম্পর্কে যে কিংবদন্তিটি চলিত রয়েছে, তা সত্যিই কৌতূহলোদ্দীপক। এই মিথ অনুসারে, রাবণবধের পরে হনুমান আধ্যাত্মজীবন যাপনের উদ্দেশ্যে হিমালয় গমন করেন। সেখানে তিনি পর্বতগাত্রে নখের আঁচড় কেটে লিখতে শুরু করেন তাঁর নিজস্ব রামায়ণ। এই রামায়ণে তিনি রামের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ রাখেন। হনুমান চেয়েছিলেন, বাল্মীকি তাঁর রামায়ণ সম্পর্কে মন্তব্য করুন। মহর্ষি বাল্মীকিকে তিনি আমন্ত্রণ জানান। বাল্মীকি হনুমানের রামায়ণ পড়ে বেশ ভেঙে পড়েন। হনুমান তাঁর বিষাদের কারণ জানতে চাইলে মহর্ষি জানান, তিনিও রামকথা লিখছেন। কিন্তু হনুমানের রচনা এত প্রাণবন্ত যে, তাঁর কীর্তি এর কাছে ম্লান হয়ে যাবে। উদারচেতা মহাবলি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর রচনাকে বাতিল করেন। তাঁর দ্বারা খোদিত প্রস্তরখণ্ডগুলিকে তিনি একে একে নদীতে নিক্ষেপ করেন। বাল্মীকিও হনুমানের উদারতায় প্রসন্ন হয়ে তাঁর আশ্রমে ফিরে আসেন। গল্প কিন্তু এখানে শেষ নয়। বহুকাল পরে মহাকবি কালিদাস নাকি ‘হনুমদ রামায়ণ’-এর একটি প্রস্তর খুঁজে পান। তিনি উজ্জয়িনী নগরের এক প্রকাশ্য স্থানে এই প্রস্তরলিপিটা ঝুলিয়ে দেন। হনুমান যে লিপিতে এই রামকথা লিখেছিলেন, সেটি একটি অতি প্রাচীন এবং অবলুপ্ত লিপি। কালিদাস চেয়েছিলেন, তাঁর সহনাগরিক পণ্ডিতরা এই লিপির পাঠোদ্ধার করুন। কিন্তু তা কেউ করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। এই লিপিই কি কালিদাসকে ‘রঘুবংশম’ লিখতে প্রাণীত করেছিল? ইতিহাস কিন্তু মিথের ব্যাপারে সায় দেয় না।
এই হল আমাদের সবার প্রিয় বানর বা বাঁদর বা হনুমান। ভগবান বা দেবতাও। ইতিহাস কি? পাঠককুল কি এই কাহিনিগুলির মধ্যে ইতিহাসের কোনো উপকরণ বা উপাদান পেলেন?
“ধৰ্মার্থকামমোক্ষানামুপদেশসমন্বিতম্।/পূৰ্ব্ববৃত্তকথাযুক্তমিতিহাস প্রচক্ষতে।”
অর্থাৎ যে গ্রন্থে ধর্ম-অর্থ-কাম ও মোক্ষ প্রাপ্তির উপদেশ সহ (রাজাদের) পূর্ব-বৃত্তান্ত বিবৃত হয়, ইতিহাস বলে। রামায়ণ এই সংজ্ঞা অনুসারে ইতিহাসশ্রেণিভুক্ত হওয়ার অধিকারী নয়। কারণ ধর্ম-অর্থ-কাম ও মোক্ষের উপদেশ থাকলেও যে রাজাদের কথা এই গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, তাতে তাঁদের পূর্বপুরুষের কোনোরূপ বিবরণ নেই। বস্তুত রাজা দশরথের পিতৃ-পিতামহের তথা ইক্ষ্বাকুবংশের প্রাচীন কথা না-থাকাতেই ঋষিদের মতে রামায়ণ ইতিহাসের শিরোপা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। কবি নিজেই বলেছেন–“মহদুৎপন্নমাখ্যানং রামায়ণমিতি তম।” তবে আখ্যানের ইতিহাস হতে তো বাধা নেই। আখ্যানেও দেশ-কাল-পাত্রের প্রভাব থাকবেই। প্রায় সব সাহিত্যেই ইতিহাস নথিভুক্ত হয়ে যায়, অজান্তেই। সমসাময়িক চিত্রপট আঁকা হয়ে যায় সাহিত্যে। ধরা পড়ে সামাজিক ও সমাজজীবনের বর্ণনা। রামায়ণ ভারতে বসেই রচিত হয়েছে, তাই ভারতের স্থান-কাল-পাত্র ঘটনা নথিভুক্ত থাকবে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। তবে রামায়ণে যতটা-না ইতিহাস আশ্রয় পেয়েছে, তার চেয়ে বেশি আশ্রয় পেয়েছে যুক্তিহীন অলৌকিকতা। অলৌকিকতা ছাড়া কোনো ঘটনাই সম্পন্ন হয়নি। রামায়ণে (মহাভারতেও) এমন বিষয়, ঘটনা ও চিত্রনাট্য আছে যা অসম্ভব, অপ্রাকৃতিক, অপ্রার্থিব ও অনৈতিহাসিক। সকল অলীক, অস্বাভাবিক ও অনৈতিহাসিক বর্ণনা থাকলে ইতিহাসের আলোচনা থেকে ত্যাগ করতেই হবে। তবেই লিবির রোমের ইতিহাস, হিরোডোটাসের গ্রিস ও মিশরের ইতিহাসের মতো রামায়ণও কিঞ্চিৎ ইতিহাস হতেই পারে। কবির কাব্য ইতিহাস নয় বটে, কিন্তু কাব্যের উপাদানে ঐতিহাসিকদের ভাববার অবকাশ আছে।
রামায়ণ বা মহাভারতের উল্লিখিত বানর বা হনুমান সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসূত কিংবা প্রাইমেট অন্তর্গত কোনো জাতি নয়। প্রাইমেট অন্তর্গত কোনো প্রাণী হলে এই ধরনের কর্মকাণ্ড করে ফেলা সম্পূর্ণতই অবাস্তব। রামায়ণের বানর-হনুমানেরা একপ্রকার প্রজাতির মানুষ। দাক্ষিণাত্যে বানর, রাক্ষস, নাগ ইত্যাদি প্রজাতি মানুষের আধিপত্য ছিল। এরা খুব হিংস্র ও শক্তিশালী ছিল। আর্যাবর্তের অনেক আর্যরা বিন্ধ্যপর্বতকে পিছনে রেখে দাক্ষিণাত্য অতিক্রম করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সফল হয়নি। এমনই এ অসফল ব্যক্তি হলেন অগস্ত্য। অগস্ত্য দাক্ষিণাত্যে পৌঁছেছিলেন, কিন্তু আর ফিরে আসতে পারেননি। একেই বলে অগস্ত্য যাত্রা! রামের পক্ষেই কেবল দাক্ষিণাত্যে পৌঁছোনো সম্ভব হয়েছিল। তার কারণ রামের বিচক্ষণতা, প্রাজ্ঞতা, আস্থাভাজন এবং বীরতা।
পরবর্তীতে এইসব বানর, রাক্ষস-খোক্ষস, দানো-দৈত্য, নাগজাতিরা হয়তো বিলুপ্ত হয়ে গেছে কোনো কারণে, অথবা আজও আছে অন্য রূপে। প্রাচীন ভারতে এরকম অনেক প্রজাতির জীব ছিল, যাঁরা আজ লুপ্ত। প্রাণী বিশেষজ্ঞদের মতে, সভ্য মানুষের অসভ্য আচরণ আর নৃশংস মনোভাব, তদুপরি পরিবর্তিত জলবায়ুর কারণে ৫০০-রও বেশি প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও পাখি লুপ্ত হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী ৯০ বছরের মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির আরও ১২ শতাংশ প্রাণী লুপ্ত হয়ে যাবে। আজও এরকম অনেক প্রজাতির মানবগোষ্ঠী আছেন এ ভারতে, যারা বিলুপ্তির পথে। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী, তাঁরা নিজেদের মতো করে বেঁচে আছে, তাঁরা বিপন্ন। কালের নিয়মে একদিন পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে। সভ্য মানুষের আগ্রাসনে দাক্ষিণাত্যের বহু আদিম প্রজাতির মানবগোষ্ঠী লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায়। এই মুহূর্তে জাবোয়া ও আওয়া উপজাতিরা বিলুপ্তির পথে অপেক্ষারত।
বানর নিয়ে আর-একটি পৌরাণিক কাহিনি পাওয়া যায়। যেখানে ভগবান শিব একজন মাদারি (বাঁদর খেলা যে দেখায় তাকে মাদারি বলে) সেজে আর হনুমানকে এক বাঁদর সাজিয়ে অযোধ্যাতে গেল। রামের ইষ্ট শিব, আবার শিবের ইষ্ট রাম। অযোধ্যা নগরীতে নেমে ডুগডুগি বাজিয়ে শিব বাঁদর খেলা দেখাতে লাগল। রাজবাড়িতে বাঁদর নাচানো দেখাতে গেলেন স্বয়ং পশুপতি। চার ভ্রাতা সেই খেলা দেখে আনন্দিত হলেন। শিশু রাম, দশরথকে অনুরোধ জানালেন তাঁকে ওই বাঁদরটি দিতে। দশরথ রাজা মাদারিকে বললেন–“কত মূল্যে তুমি বাঁদরটি দেবে?” মাদারি রূপধারী হর জানালেন–“মহারাজ, এর কোনো মূল্য লাগবে না। খালি একটি প্রতিজ্ঞা করতে হবে, যেন সারাজীবন আপনার পুত্র এই বাঁদরটিকে তাঁর সেবক রূপে রাখেন।” রামচন্দ্র কথা দিলেন। মাদারিরূপী শিব সেখানে বাঁদরটি দিয়ে চলে গেলেন। চার ভাই যখন খেলা করতেন, তখন বানররূপী হনুমান তাঁদের সঙ্গে খেলা করতেন। রাম খুবই স্নেহ করতেন হনুমানকে। আর হনুমান সর্বদা রামচন্দ্রের ছায়াসঙ্গী হয়ে ঘুরতেন। রামচন্দ্রের খেলনাসামগ্রী যেমন কন্দু, ঘুড়ির লাটাই, তির ইত্যাদি এনে এনে দিতেন। গাছে উঠে সুগন্ধি ফুল বা মিষ্টি ফল পেড়ে দিতেন।
উত্তরকাণ্ডের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, একই কারণে দেবতাদের বানর হয়ে জন্মগ্রহণ করতে হয়, রামকে রাবণবধে সাহায্য করার জন্যে। বালকাণ্ডে সেইসব বীভৎস কাহিনি আছে যেখানে ভগবানের আদেশে দেবতারা নাকি গন্ধর্বী, যক্ষী, অপ্সরা, বিদ্যাধরী ও বানরীদের গর্ভে স্বাভাবিক পদ্ধতিতেই অসংখ্য বানর সৃষ্টি করলেন। কিন্ত রাবণকে ব্রহ্মার এই বর দেওয়ার কাহিনি শুধুমাত্র উত্তরাকাণ্ডেই আছে, যা বিশেষজ্ঞদের মতে নিঃসন্দেহে প্রক্ষিপ্ত।
“অপ্সরঃসু চ মুখ্যাসুগন্ধবীণাং তনুষু চ। যক্ষপন্নকন্যাসু ঋক্ষবিদ্যাধরীষু চ। কিন্নরীণাং চ গাত্রে বানরীণাং তনুষু চ। সৃজধ্বং হরিরূপেণ পুত্ৰাংস্তুল্য পরাক্রমান্।”–পৌরাণিক সমর্থনে বিষ্ণুকে যে কারণে রাবণবধের জন্য মানুষ হয়ে জন্মাতে হল, তা হচ্ছে ব্রহ্মা কর্তৃক অতীতে রাবণকে দেওয়া বর, যার ফলে নর আর বানর ছাড়া আর কারও পক্ষেই রাবণকে বধ করা সম্ভব নয়। অতএব রাবণের সঙ্গে এঁটে উঠতে হলে রামচন্দ্রকে বানরসেনাদের সাহায্য নিতে হবে এটা দেবমন্ত্রী ব্রহ্মার পূর্ব-পরিকল্পিত। এ থেকেই বোঝা যায় রাবণের শক্তির কাছে রামের একক শক্তি এতটাই ক্ষুদ্র ছিল যে, সশস্ত্র আর্যদেবতাদের প্রত্যক্ষ সাহায্য দ্বারাও রাবণ ও দাক্ষিণাত্যে কবজা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই কৃজ্ঞতায় আবদ্ধ করে দাক্ষিণাত্যের অন্যতম শক্তিশালী কিষ্কিন্ধ্যার রাজা সুগ্রীবকে দলে টানতে হল অন্যায়ভাবে। উপরি হিসাবে শূর্পণখার পরে বিশ্বশ্রেষ্ঠ বিশ্বাসঘাতক বিভীষণকেও পাওয়া গেল। ফলে আর্যদেবতাদের দাক্ষিণাত্য জয় জলবৎ তরলং হয়ে গেল।
বস্তুত ‘বন’ শব্দের সঙ্গে ইক প্রত্যয় যগে ‘বান’ শব্দ হয়, যেমন বানপ্রস্থ শব্দে। তারপর ‘বান’ শব্দের সঙ্গে ‘নর’ শব্দের সন্ধি করলে, বনে বসবাসকারী মানুষ অর্থে বানর হতে পারে। লঙ্কার বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে তথাকথিত রাক্ষসেরা প্রকৃতপক্ষে সুসভ্য এবং নগরবাসী অনার্য ছিল। অর্থাৎ উত্তর ভারতীয় জনপদগুলি থেকে আর্যরা দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে থাকলে প্রথমে বনাঞ্চলের আদিবাসী এবং পরে আরও দক্ষিণে সুসভ্য নগরবাসী অনার্যদের সম্মুখীন হয়েছিলেন। নারদ বিবৃত রামকথায় হনুমান-বানরদের কোনো উল্লেখ ছিল না। মহাকবি বাল্মীকি তাঁর মহাকাব্যে এই চরিত্রগুলি কল্পনা করেছেন যুদ্ধের প্রয়োজনে। যেহেতু রাম-লক্ষ্মণ রাজা নন, তাই তাঁদের সেনাবাহিনীও নেই। সসৈন্য রাবণের সঙ্গে সৈনহীন রামের যুদ্ধ সম্পন্ন কীভাবে হবে? অতএব বানরদের মতো কাল্পনিক ভাড়াটে সৈন্যদের প্রয়োজন হয়ে পড়ে, কাহিনির প্রয়োজনে। যেহেতু বানরদের যুদ্ধ করতে পারার কথা নয়, তাই বানরদের প্রায় সব ক্রিয়াকর্মই অলৌকিক পথেই করাতে হয়েছে। পরবর্তী কবিরা এবং পুরাণগুলিতে এই অলৌকিকতাগুলিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য বানরদের উপর ‘দেবত্ব’ আরোপ করেছেন। কারণ দেবতারা সব পারেন, অলৌকিকতাকেও ইতিহাস করে দেওয়া যায়। লক্ষ করা যায় রামায়ণ ও রামের যুগে যুদ্ধাস্ত্র বলতে একমাত্র সম্বল তীর-ধনুক। রাম-রাবণ উভয়ই তীর-ধনুকের সাহায্যে যুদ্ধ করেছেন। একমাত্র বানরসেনারাই যুদ্ধে গদা ব্যবহার করেছেন, এটাই বোধহয় স্বাতন্ত্রতা। ১৯০০ সালের ৩১ তে জানুয়ারির উল্লিখিত ভাষণে স্বামী বিবেকানন্দ রামায়ণ ও মহাভারতের কল্পকাহিনিকে পরিষ্কারভাবেই বহিরাগত আর্যদের সঙ্গে যুক্ত করেন এবং বানরদের বনবাসী আদিমজাতি বলে চিহ্নিত করেন, যাদের সঙ্গে বহিরাগত আর্যদের কোনো যোগাযোগ ছিল না। তিনি এও বলেন যে এই বনবাসী আদিমজাতির মধ্যে যেসব মানুষ খুব বলশালী ছিল, তাঁদেরই আর্যেরা রাক্ষস বলতেন। বানরসেনা প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ এটাও বলেন–
“The Aryans did not know who were the inhabitants of these wild forests. In those days the foresttribes they called ‘Monkey’ and some of the so called “Monkey’, if unusually strong and powerful were called ‘demons’.”
হনুমান প্রসঙ্গে যা উল্লেখ না করলে নয়, তা হল–মুণ্ডা উপজাতিরা দুটি দাবি করে। (১) তাঁরা হনুমানের বংশধর। রামায়ণে উল্লেখিত বানর বা হনুমানের যে লেজ সেটা বায়োলজিক্যাল লেজ নয়, এটা ধুতি বা নেংটির বাড়তি খুঁট (লক্ষ করে দেখবেন মুণ্ডারা ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে আজও তাঁদের উৎসব-অনুষ্ঠানে লেজ বের করে ধুতি পরেন)।(২) তাঁরা হলেন রাবণের বংশধর। তাঁদের এ দাবি মেনে নিলে রাবণ ও হনুমান একই গোত্রের জাতি। অতএব রোমিলা থাপার, অতুল সুর প্রমুখের হিসাবমতে এঁরা সেই বিন্ধ্যপর্বত অঞ্চলেরই মানুষ। যাঁদের একদল বাস করত বলে বন-নর (বানর), আর-এক দল গর্জনশীল ঝর্ণা বা সরব নদী মোহনার কাছে বা কিংবা দ্বীপে বাস করত বলে রাবণ। তবে শুধুমাত্র দাক্ষিণাত্যের বানর প্রজাতিদের মধ্যেই লেজপ্রীতি ছিল, তা নয়। শিক্ষিত মিশরীয়গণ ছাড়াও লেজ সজ্জা’ হিসাবে আকৃষ্ট ছিল প্রাচীনকালের বেশকিছু আদিম জনগোষ্ঠী। বিশাখাপত্তনমের বাসিন্দাদের মধ্যে সবরজাতি পোশাকের সঙ্গে লেজও ব্যবহার করত। প্রাচীনযুগে বেশকিছু অরণ্যবাসী আদিমজাতিদের মধ্যেও লেজপ্রীতি ছিল। অরণ্যবাসীদের এই লেজপ্রীতির কারণ বোধহয় অরণ্যে বসবাসকারী অন্যান্য প্রাণীদের লেজ দেখেই তাঁরাও আসল না-থাকায় নকল লেজ লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কোনো কোনো গবেষক বলেন, অভিষেককালে কোনো কোনো ভারতীয় রাজপরিবারে লেজকে ভূষণধারণের প্রথা হিসাবে অবশ্যপালনীয় ছিল। আন্দামানের একটি আদিমগোষ্ঠীদের মধ্যেও পিছনে লেজ লাগানোর অভ্যেস ছিল।
তবে রামায়ণ যে সময় রচিত হয়েছে, সে সময় বা তার আশেপাশে সময়ে কোনো বানর-মানুষ থাকার সম্ভাবনা নেই। দেখে নেওয়া যেতে পারে নৃতাত্ত্বিক রিপোর্ট–জিঞ্জিই হল বানর-মানুষ। জিঞ্জি, মানে জিঞ্জানথ্রোপাস (পূর্ব আফ্রিকার মানুষ)। ১৯৫৯ সালে ব্রিটিশ পুরাতত্ত্ববিদ Dr. Louis Leakey ও তাঁর স্ত্রী Mary পূর্ব আফ্রিকার একটি হ্রদের বুক থেকে একটি খুলির জীবাশ্ম আবিষ্কার করলেন। নাম দিলেন জিঞ্জানথ্রোপাস। এই প্রজাতি ২০,০০,০০০ বছর আগে পৃথিবীতে বাস করত। জিঞ্জানথ্রোপাসের সমসাময়িক অস্ট্রেলোপিথিকাস, এ প্রজাতি দক্ষিণ আফ্রিকার বানর-মানুষ। এরপর কেটে যায় কুয়াশাচ্ছন্ন ১০,০০,০০০ বছর। এই লক্ষ বছরের মধ্যে আমরা আর কোনো বানর-মানুষ পাচ্ছি না। এরপর যাদের সন্ধান পাওয়া গেল, তাঁরা সিনানথ্রোপাস বা পিকিং মানুষ। এরপর পাই হোমোনিয়ানডার্থাল মানবগোষ্ঠী। প্রায় ৫,০০,০০০ বছর আগে এঁদের ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকায় আবির্ভূত হয়েছিল। এরা কিন্তু বানর-মানুষ নয়। অর্থাৎ অনেককাল আগেই বানর-মানুষের ইতি হয়ে গিয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫,০০০ বছর আগেই এই নিয়ানডারথাল মানুষরা পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। এর পরবর্তীকালের নিয়ানডারথাল মানুষদের কোনো কঙ্কাল আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। অপরদিকে ১০,০০,০০০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর বুকে কেটে গেছে চার-চারটি তুষার যুগ, শেষ হয় খ্রিস্টজন্মের ১৩,০০০ বছর আগে। নিয়ানডারথাল মানুষদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার সময় এ পৃথিবীতে আবির্ভাব হয় ক্রোম্যাগনন মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই ক্রোম্যাগনন মানুষই নাকি আমাদের আমাদের পূর্বপুরুষ। হিন্দু শাস্ত্রকারেরা বলেন রাম জন্মেছিলেন ৫০০০ বছর বছর আগে। অতএব রামায়ণে উল্লিখিত যে বানরজাতির কথা বর্ণিত হয়েছে, তা সম্পূর্ণ কল্পকথা। বানর-মানুষের অস্তিত্ব ২০,০০,০০০ আগেই খতম হয়ে যায়। ৫০০০ বছর আগে তা কল্পনাই করা যায়, বাস্তবিক নয়।
বানর বা হনুমান প্রসঙ্গে বাল্মীকি তাঁর রামায়ণে কীভাবে উপস্থাপন করেছেন তা দেখে নিতে পারি পণ্ডিত নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর ভাষ্যে–“এরা মোটেই আমাদের দৃষ্ট-ত বানরদের মতো ছিল না। তাদের বুদ্ধি, হৃদয় ক্ষমতা এবং চেহারার যে পরিচয় খোদ রামায়ণ থেকেই মেলে তাতে বোঝা যায়, এরা মানুষই ছিল, তবে অবশ্যই অনার্য সম্প্রদায়ভুক্ত। প্রথম কথা, প্রাচীন সংস্কৃতে ‘বা’ শব্দটি উপমার্থে ব্যবহৃত হত এবং ভাষাগত দিক দিয়ে বানর মানে দাঁড়ায় নরের মতে, মানুষের মতো৷…দেবতাদের ঔরসে এইসব বানরদের জন্ম দিয়ে বাল্মীকি নিজের জন্য অদ্ভুত এক বৈজ্ঞানিক ফাঁপর তৈরি করেছেন। এতে প্রমাণিত হয় এঁরা আক্ষরিক অর্থে বানর ছিলেন না। যদি লেজের কথা বলেন, তা হলে প্রথমে মনে রাখতে হবে–বালীর বৌ তারা, সুগ্রীবের বৌ রুমা কিংবা অন্য কোনো বানরীর লেজের কথা ভুলেও উচ্চারণ করেননি। তবে হ্যাঁ, বালী, সুগ্রীব, হনুমান অথবা কাপড়চোপড়-পরা রামায়ণের সব বানরেরাই একটা করে লেজ নিজের দেহে লাগিয়ে নিতেন। সুন্দরকাণ্ডে হনুমান যখন সমুদ্র পার হওয়ার জন্য বিরাট এক লম্ফ দিলেন, তখন তাঁর পশ্চাৎদেশে লাগানো লেজটি গোরুড়ের মুখে লটকানো সাপের মতো লাগছিল–তস্য লাঙ্গুলম্ আবিদ্ধ অতিবেগস্য পৃষ্ঠতঃ দদৃশে গরুড়েনের হ্রিয়মানো মহোরগঃ। ‘আবিদ্ধ’, ‘সমাবিদ্ধ’–এইসব শব্দগুলি তো ‘আটকানো’, ‘লাগানো’ অর্থেই সংস্কৃতে ব্যবহৃত হয়। যদি-বা পণ্ডিতেরা শব্দের নানার্থ ভাবনায় ‘আবিদ্ধ’ শব্দের অন্য মনে করেন, তা হলে বলি বাল্মীকি রাবণের মুখ দিয়েই পরিষ্কার জানিয়েছেন যে রামায়ণী বানরদের লেজটা হল সম্মানের এবং সৌন্দর্যের প্রতীক।” অতএব এই লেজ বানর-হনুমানদের শরীরের অঙ্গও নয়, প্রত্যঙ্গও নয়৷ ওইসব বানর-হনুমানদের লেজ যে সম্মানের এবং সৌন্দর্যের প্রতীক, তা সহজেই অনুমেয় হয় যখন লঙ্কায় হনুমান রাক্ষসসৈন্যদের হাতে ধরা তাঁর লেজটিতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়–“তদস্য দীপ্যতাং শীঘ্রং তেন দগ্ধেন গচ্ছতু”। পুড়িয়ে দেওয়ার অর্থ হনুমানের সম্মান হানি করা, তার উপর তিনি আবার প্রতিপক্ষ রামচন্দ্রের প্রতিনিধি। আমরা ভারতের কোনো জাতির মধ্যে দেখব গোঁফ বা পাগড়ি সম্মানের প্রতীক। এঁদের প্রতিপক্ষ কেউ গোঁফ কেটে নিলে বা পাগড়ি খুলে নিলে তাঁদের সম্মান মান-মর্যাদা ধুলোর সঙ্গে মিশে যায়। বানর-হনুমানদের লাগানো লেজ মর্যাদারই প্রতীক ছিল।
প্রাবন্ধিক বীরেন্দ্র মিত্রও প্রায় একই বিশ্লেষণ করেন। তিনি বলেছেন–“বাল্মীকি রামায়ণে চতুস্পদ এবং সহজাত লাঙ্গুলধারী বানর-বানরীর উল্লেখ নেই। বরং বানরজাতি কর্তৃক লাঙ্গুল শোভা ধারণের অর্থাৎ লাঙ্গুল সজ্জা গ্রহণের স্বীকৃতিই চোখে পড়ে। মানুষের বানরত্ব ঘটেছে মুনিদের বানানো প্রক্ষিপ্ত কল্পকাহিনির মধ্যে। মহাকাব্যে যদিও স্পষ্টতই বলা হয়েছে, ‘দেবগণ ভগবান স্বয়ম্ভর আদেশ শিরোধার্য করিরা বানররূপী পুত্র সকল উৎপাদন করিতে লাগিলেন’।–কথকঠাকুররা কায়দা করে সেই ‘বানররূপী’ বা ‘বানর রূপসজ্জাধারী’ দেবপুত্রদের ‘কিলকিলা’ রবকারী বৃক্ষশাখাবাসী বানরে সরাসরি রূপান্তরিত করে গেলেন। একটি সুশিক্ষিত মানবজাতিকে অবমাননা এমন নজির বিস্ময়কর।.. যাত্রাপালাগানে এবং নব নব রামায়ণকথায় বেদজ্ঞ, রাজনীতিপ্রাজ্ঞ, প্রখর বুদ্ধিবিদ্যাসম্পন্ন এক দক্ষিণী মহাবীর একটি অতিপ্রাকৃত হনুমার রূপেই চিত্রিত হয়ে আছেন।”
বাল্মীকির রামায়ণে বানর, হনুমান প্রজাতি ছাড়াও আর-একটি প্রজাতি কথাও জানা যায়, তাঁরা হলেন ভাল্লুক। আগের শ্লোকে আমরা ‘ঋক্ষ’ শব্দটা পেয়েছি। ঋক্ষ ও ভাল্লুক সম্প্রদায় সম্ভবত একই গোত্রীয়। রামায়ণে সুগ্রীবের বানরসেনাদের মধ্যে জ্ঞানবৃদ্ধ জাম্ববানকে পেয়েছি। ভাল্লুক সম্প্রদায়ের রাজা জাম্ববান ছিলেন ঋক্ষরাজ। মহাভারতের জাম্ববান-কন্যা জাম্ববতাঁকে বিয়ে করেন কৃষ্ণ। জাম্ববতীর প্রথম পুত্র শাম্ব। রামায়ণে জাম্ববান রাম-সহায়ক বানররাজ সুগ্রীবের মন্ত্রী ও সেনাপতি ছিলেন। এই জাম্ববান ভাল্লুক সম্প্রদায়গণের আদি নিবাস হিমালয়। পরে দেবমন্ত্রী ব্রহ্মার আদেশে দাক্ষিণাত্যে বসবাস শুরু করেন।
প্রাচীন ভারতে বিভিন্ন টোটেমি জাতি ছিল। শুধু ভারতে কেন, সারা পৃথিবীতেই টোটেমী অস্তিত্ব ছিল। সাধারণত জন্তু-জানোয়ারের নামেই টোটেমী-পরিচিত হত। সেই টোটেম নামেই হত গোষ্ঠীর নাম, পরম্পরায়। ভারতে সর্প টোটেম (নাগ), ঋক্ষ টোটেম (ভাল্লুক), কপি টোটেম (বানর), সারমেয় টোটেম (কুকুর), মহিষ টোটেম, শৃগাল টোটেম ইত্যাদি। স্যার হারবার্ট রিসলের ‘এথনোগ্রাফিক সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে সাঁওতাল, হোম, মুণ্ডা, ভিল প্রভৃতি জাতির মধ্যেই টোটেমি প্রথার প্রাধান্য ছিল। ফ্রয়েড জানিয়েছেন, অস্ট্রেলিয়ায় টোটেম হচ্ছে ক্যাঙারু, এমু। মেলানেশিয়া, পলিনেশিয়া, আফ্রিকার নিগ্রোদের মধ্যেও অনুরূপ টোটেমী ছিল। স্কটল্যান্ডবাসী জে ফারগুসন ম্যাকলেন্নান মাউদের প্রাচীন ইতিহাসে টোটেম প্রথার বৈশিষ্ট্যকে স্বীকার করেছিলেন। অস্ট্রিলিয়ার বাইরে উত্তর আমেরিকার ইন্ডিয়ানদের মধ্যে, পলিনেশীয় দ্বীপের বিভিন্ন জাতির মধ্যে, পূর্ব ভারতে, আফ্রিকার নানা জায়গায় টোটেমীয় প্রথা ছিল। আদিম আর্যদের মধ্যেও এবং ইউেরোপের সেমিটিক জাতিদের মধ্যেও টোটেম ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। ওল্ডেনবার্গ লক্ষ করেছেন মাছ ও কুকুর টোটেমও আর্যসম্প্রদায় বিশেষে মান্য ছিল ঋগ্বেদীয় আমলে। প্রাচীন ভারতে ‘ভালুকি’ নামে এক রসায়নশাস্ত্রবিদের কথা যায়। অষ্টম শতকের আর এক রসায়নবিদ ‘কাকচণ্ডেশ্বর’-এর পরিচয়ও আমরা জানতে পারি। জানতে পারি ‘শাদূল’ নামের এক নৃত্যচার্যের কথা। বহু গবেষক মনে করেন, টোটেম ব্যবস্থা মানবীয় বিকাশের একটি অবশ্য প্রয়োজনীয় স্তর, যা প্রত্যেক জাতিই তার ক্রমবিকাশের পথে অতিক্রম করেছে। আর্য পুরাণকাররা টোটেমী অনার্য জাতিগোষ্ঠীকে তাঁদের টোটেম দ্বারাই অভিহিত করে মানুষের উপর জান্তব প্রাণীর অবয়ব নির্মাণ করেছেন। আর্য বা আর্যদেবতারা তো বাঙালি প্রজাতিতে পাখি বলত, বাঙালিদের ভাষা পাখির ভাষায় মতো। আর্যরা ভারত উপমহাদেশের মানুষদের নিয়ে তাদের ঘৃণা ও নিন্দার কোনো শেষ ছিল না। তাঁরা এদের অভিহিত করেছে দাস, দস্যু, অসুর, রাক্ষস ইত্যাদি নামে। আবার কোথাও বলেছে মাছখেকো, বয়াংসি বলে। বাঙালি ‘বয়াংসি’ অর্থাৎ পাখির জাত, কারণ আর্যদের মতে এঁরা পাখির মতো কিচির-মিচির ভাষায় কথা বলে। মোদ্দা কথা, সীতা উদ্ধার তথা দাক্ষিণাত্যে আর্য-উপনিবেশের জন্য রামচন্দ্রকে এক ফোঁটাও আর্যরক্ত খরচ হয়নি সবই হয়েছে বানরদের উপর দিয়ে। হাজার হাজার বানর প্রাণ দিয়েছেন সুগ্রীবের স্বপ্নপূরণের মূল্য হিসাবে।
রাক্ষস-খোক্ষস : বাস্তবে এবং অবাস্তবে
দণ্ডকারণ্যে এসে সীতা রামকে সতর্ক করে বলছিলেন–“ঋষিরা বললেন, আর সঙ্গে সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করে বসলে ‘আমি দণ্ডকারণ্যের সমস্ত রাক্ষস বধ করব’, কেন? রাক্ষসেরা তোমার কী ক্ষতি করেছে? বিনা কারণে কেন তাঁদের মারবে?” এখন প্রশ্ন, মহাকবিরা এত রাক্ষস পেলেন কোথায় সে যুগে! মহাভারতে রাক্ষসদের উল্লেখ তেমন একটা পাওয়া যায় না। কিন্তু রামায়ণে রাক্ষস যেন কিলবিল করছে, দণ্ডকারণ্য থেকে লঙ্কা। সেই ধারা অক্ষুণ্ণ রেখেছে পুরাণকারেরাও। বেদের যুগে একটি রাক্ষসদের কথা পাই না। পাই অনার্য তথা দাস বা দস্যুদের। এরাই কি তবে রামায়ণ-মহাভারতের যুগে এসে রাক্ষসে প্রতিপন্ন হয়েছে! যত রাক্ষস সবই যে রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণগুলিতে। বনবাসকালীন রামচন্দ্র প্রায় ১৪,০০০ নিরীহ নিরস্ত্র রাক্ষসদের হত্যা করেছেন কখনো মুনিঋষি তথা ব্রাহ্মণদের রক্ষার্থে, কখনো-বা আত্মরক্ষার তাগিদে, কখনো-বা দাক্ষিণাত্যে আর্য উপনিবেশ ঘটাতে।
মহাভারত মহাকাব্যে আমরা অবশ্য হিড়িম্বা সহ কয়েকজন রাক্ষসের সন্ধান পাই। তিনি হিড়িম্বা, হিড়িম্বক বনের রাক্ষস অধিপতি হিড়িম্বর বোন হিড়িম্বা। হিড়িম্বার আরও একটি পরিচয় আছে–ইনি মধ্যম পাণ্ডব ভীমের স্ত্রী এবং ভীমের ঔরসজাত ঘটোৎকচের মা। কাম্যক বনে ভীমকে দেখে হিড়িম্বা নামে এক রাক্ষুসী মোহিত হয়ে গেলেন। মায়া করে সুন্দর এক যুবতী হয়ে ভীমের কাছে এলেন। আসলে এই রাক্ষসরাও মানুষ, বনবাসী। এঁরা বনে-জঙ্গলে থাকত, তাই সেজেগুজে থাকত না। কিন্তু ভীমকে হিড়িম্বা তাঁর প্রেমে ফেলার জন্য যখন সে সুন্দর করে সাজলেন তখন তো তাঁকে সত্যি সত্যি মানুষের মতোই সুন্দরী ছাড়া অন্য কিছু মনে হয়নি ভীমের। এই সেজে আসাটাকেই ব্যাসগণ একটু অলংকরণ করে বলেছেন মায়া করেছেন। আর আকাশে উড়ে যাওয়া বিষয়টিও অতিরঞ্জিত করা। ভীমকে বিয়ে করার পরে তাঁকে নিয়ে নির্জন জায়গার দিকে নিয়ে গেলেন যেখানে কোনো মনুষ্যবাস নেই। এই পথটি হিড়িম্বারই জানা ছিল–ভীমের নয়। রচনাকারী এই নির্জন জায়গার দিকে যাওয়াটাকেই আকাশে উড়ে যাওয়া বলে চালিয়ে দিয়েছেন।
ভারতের ধর্ম-সাহিত্যে একেবারে শুরুর কথা বলা যায়। বেদ সাহিত্যে দাস, অনার্যদের কথা জানতে পারি। রামায়ণ-মহাভারতে রাক্ষসদের কথা জানতে পাই। আবার পুরাণগুলোতে অসুর, দৈত্য-দানোদের কথা জানতে পাই। মনুসংহিতায় শূদ্রদের কথা জানতে পাই। এরা কেউ পৃথক নয়। সবাই একই জাতি। এরা সবাই ভারত উপমহাদেশের ভূমিপূত্র তথা আদি বাসিন্দা। বর্তমানে যে জাতি শূদ্র তথা দলিত তথা পিছড়ে বর্গ তথা মূলনিবাসী বলে পরিচিত। এরাই প্রাচীন যুগের রাক্ষস-খোক্ষস, দৈত্য-দানো-অসুর প্রমুখ। প্রাচীন যুগে এই বিশাল ভারত উপমহাদেশে এশিয়া মাইনর হয়ে বহিরাগত আর্যরা প্রবেশ করে। অন্য কোনো ভূখণ্ডের ভিনদেশি জাতি এসে বিনা রক্তপাতে অন্য কোনো ভূখণ্ডে প্রবেশ করবে এবং দখল নেবে, সেটা কি সম্ভব? খুব স্বাভাবিকভাবেই ভারত উপমহাদেশের মূলনিবাসী তথা ভূমিপুত্রদের সঙ্গে সংঘর্ষ সংঘটিত হয়েছে বারবার। এই আর্যরা শক্তিতে, বুদ্ধিতে এবং আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে অনেক বেশি এগিয়ে ছিল। ফলে তাঁদের সঙ্গে ভারতের ভূমিপুত্ররা সংঘর্ষে পরাস্ত হয়েছে। সেই সংঘর্ষের কাহিনি লিখেছেন আর্যরাই। আর্যদের সেই অতিরঞ্জিত ইতিহাসই সনাতন ধর্ম তথা হিন্দুধর্মগ্রন্থগুলির মূল বিষয়, যা আসলে আর্যবিজয়ের ইতিহাস। আর বিজয়ীরা বিজিতদের ঘৃণ্য ভাষায় সম্বোধন করবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বিদেশি উপনিবেশিকরা যখনই অন্য ভূখণ্ড দখল ও শাসন করত, তখনই ভূমিপুত্র বা মূলনিবাসীদের ঘৃণ্য ভাষায় সম্বাধন করত, অসভ্য বর্বর বলত। ভূমিপুত্রদের অসুর, রাক্ষস, শূদ্র, নিগ্রো এসব বলে নিজেদেরকে কৃষ্টিবান, সংস্কৃতিবান, বুদ্ধিমান, সুশিক্ষিত, সুসভ্য বলে জাহির করত। যেমন আফ্রিকান ভূমিপুত্রদের উপনিবেশিক মাতব্বররা ‘নিগ্রো’ বলে সম্বোধন করত। নিগ্রো একটি অপমানজনক ঘৃণ্য পরিচিত। নিগ্রো আর অসভ্য যেন সমার্থক শব্দ। বর্তমানে কিছু লোকের দ্বারা আপত্তিজনক হিসাবে বিবেচিত’ থেকে ‘সাধারণভাবে অবমাননাকর’ রূপান্তরিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। নিগ্রো শব্দ দ্বারা এখন আর আফ্রিকানদের চিহ্নিত করা যায় না। নিগ্রো শব্দে আফ্রিকানরাও প্রতিবাদ করেন। বহু দেশে এখনও সেই আদিম মানুষরা আছেন নিজেদের মতো করে। নারী-পুরুষ উভয়েরই ঊৰ্ধাঙ্গ অনাবৃত। নিন্মাঙ্গ আংশিক অনাবৃত।
এইসব যাঁরা সম্বোধন করত তাঁরা সকলেই সাদা চামড়ার মানুষ। এই সাদা চামড়ার মানুষগুলোই দেবতার মর্যাদা পেতে থাকল। সাদা রংয়ের কারণে কালো মানুষদের সমীহ আদায় করে নিল আর্যরা। এর সঙ্গে আরও একটা জিনিস হল, সাদা চামড়ার প্রতি কালো মানুষদের মোহ জন্মাতে শুরু করল। সাদা মানেই সুন্দর, কালো মানেই কদাকার–এমন ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল উপনিবেশিক ভূখণ্ডগুলিতে। কালো চামড়ার মানুষগুলোও কালো চামড়ার মানুষদের ঘৃণা করা শুরু করল। সেই ট্র্যাডিশন আজও চলছে।
রাক্ষস বা নরখাদক বলা হয়েছে রাবণকেও। প্রিয় পাঠকবৃন্দের কাছে একটি প্রশ্ন না-রেখে পারছি না। রাবণের দাদা হচ্ছেন পুলস্ত্য, পিতা বিশ্রবা, ভ্রাতা কুম্ভকর্ণ ও বিভীষণ, বৈমাত্রেয় ভ্রাতা কুবের এবং পুত্র ইন্দ্রজিৎ–এরা সকলেই ছিলেন সভ্য, ভব্য, সুশিক্ষিত, গুণী ও জ্ঞানী ব্যক্তি। এঁরা কেউই রাক্ষস বা কাঁচামাংসভোজী মানুষ ছিলেন না। রাবণও তার শৈশবকালাবধি মাতা-পিতার রান্না করা খাবারই খেয়েছেন নিশ্চয়। অতঃপর যৌবনে হঠাৎ করে একদিন তিনি খেতে শুরু করলেন জীবের কাঁচামাংস। বিমান বিহার, শক্তিশেল নির্মাণ ও অশোক কানন তৈরি করতে জানলেও তিনি রান্নার পাকপাত্র গড়তে বা রান্না করতে জানেননি। বেশ ভালো। কিন্তু তিনি কোথায় বসে, কোনদিন, কাকে খেয়েছেন–তার একটিরও নামোল্লেখ নেই কেন? রাবণ নরমাংস খেতেন না। এটা বানোয়াট।
মহাকবিদ্বয় বীরদের দিয়ে যেসব রাক্ষসদের হত্যা করিয়েছেন তাঁদের কতিপয় রাক্ষসগণ আবার পূর্বজন্মে হয় দেবতা, নয় গন্ধর্ব বীরদের অস্ত্রে খুন হওয়া যে রাক্ষস, সেই রাক্ষসদের পূর্বজন্ম কী ছিল, আদৌ ছিল কি না তা জানাননি। লক্ষণীর, এইসব বীরেরা এমনকি তথাকথিত রাক্ষসরা পর্যন্ত একটি মানুষ হত্যা করেছেন এমন কাহিনি কিন্তু পাওয়া যায় না। মহাভারতের সময় মানুষের কিছু সন্ধান পাওয়া গেলেও রামায়ণের সময় কিন্তু দণ্ডকারণ্য থেকে লঙ্কা পর্যন্ত শুধুই রাক্ষসদের পাচ্ছি। সেই রাক্ষসদের হত্যা করার জন্য রাম-লক্ষ্মণদের আহারনিদ্রা ছুটে গিয়েছে। একটা মানুষের সঙ্গেও রামচন্দ্রের সাক্ষাৎ হয়নি। মানুষ বলতে শুধুই মুনিঋষি তথা ব্রাহ্মণেরা? এঁরাও তো এক-একজন দেবতা বলেই জেনেছি। আচ্ছা, সাধারণ মানুষরা তখন কী করত! ভগবানরা সব সারাজীবন ধরে রাক্ষস-খোক্ষস মেরে বেরালেন কেন! একটাও মানুষ মারেননি। আসলে ভূমিপুত্র মানুষগুলিই রাক্ষস, অসুর ইত্যাদি। রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণের বাইরে রাক্ষসরা সব কোথায় গেল। তবে পরবর্তীতে আমরা রাক্ষস-খোক্ষসদের পাই রূপকথার গল্পগুলিতে। লালকমল আর নীলকমলদের রূপকথায় রাক্ষস-খোক্ষসদের সেই ‘হাউমাউ খাউ মানুষের গন্ধ পাউ’ গোছের।
শ্ৰীযুক্ত যোগীন্দ্রনাথ সমাদ্দার তাঁর প্রাচীন-ভারত’ গ্রন্থে বলেছেন–“অন্য এক জাতীয় ব্যক্তিগণ ভ্রমণশীল এবং ইহারা অসিদ্ধ মাংস ভোজন করে। ইহাদের মধ্যে যখন কোনো ব্যক্তি পীড়িত হয়, তখন পীড়িত ব্যক্তি পুরুষ হইলে তাহার আত্মীয়বর্গ তাহাকে হত্যা করে; কারণ, তাহারা মনে করে যে ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তি অনেকদিন পীড়িত থাকিলে উহার মাংস নষ্ট হইয়া যায়। যদি পীড়িত ব্যক্তি নিজের ব্যাধির কথা অস্বীকার করে, তবে তাহার আত্মীয়গণ, তাহার সহিত অমত হইয়া শীঘ্র শীঘ্র তাহাকে শমন-সদনে প্রেরণ করে। স্ত্রীলোক পীড়িতা হইলে, তাহার আত্মীয়গণ, পূর্বোক্তপ্রকারে ঐ স্ত্রীলোককে মৃত্যুমুখে প্রেরণ করিয়া তাহার মাংস ভোজন করে। তাহারা বৃদ্ধগণকেও এই প্রকারে ভক্ষণ করে; কিন্তু এই জাতির মধ্যে কাহাকেও অধিক বয়স্ক হইতে দেখা যায় না। কারণ, সামান্য ব্যাধিগ্রস্ত হইলেই তাহার জ্ঞাতিবর্গ তাহাকে শমন-সদনে প্রেরণ করিয়া, মহানন্দে তাহার মাংস ভক্ষণ করে। এরাই কি তবে রামায়ণ-মহাভারতে বর্ণিত রাক্ষস? এরাই তবে ভারতের আদি ও আদিম বাসিন্দা, প্রাচীন অনার্য জাতি। কোনোকালেই আর্যদের মধ্যে মানুষের মাংস ভক্ষণের কথা শোনা যায় না। ভারতের সীমান্তপ্রদেশের বসবাসকারী বন্যজাতি তথা নর্মদা নদীতীরস্থ প্রদেশে পার্বত্য বনচরগণ মানুষের মাংস ভোজন করত বলে মনে হয়।
নিরঞ্জন সিংহ তাঁর “রামায়ণ-মহাভারতের দেব-গন্ধর্বরা কি ভিনগ্রহবাসী” প্রবন্ধে বলেছেন–আর্যদের চোখে মহেঞ্জোদড়োবাসীরা ছিলেন অনার্য। রামায়ণে এদেরকেই বলা হয়েছে গন্ধর্ব। গন্ধর্ব ও রাক্ষসরা ছিল দুটি গোষ্ঠী। একরম যক্ষরাও ছিল আর-একটি গোষ্ঠী। রামায়ণের প্রক্ষিপ্ত অংশ উত্তরকাণ্ডে বলা হয়েছে–“পুরাকালে ভূমির অপোভাগবর্তী জল সৃষ্টি করিরা তাহাতে সলিল সম্ভব প্রজাপতি জন্মগ্রহণ করেন। পদ্মযোনি–স্বসৃষ্ট প্রাণীপুঞ্জের রক্ষার জন্য কতকগুলি প্রাণীর সৃষ্টি করেন। সেই প্রাণীগণ, ক্ষুধা, পিপাসা এবং ভয়ে প্রপীড়িত হইয়া, আমরা কী করিব? এইরূপ কহিতে কহিতে বিনীতভাবে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার কাছে আসিল। ব্রহ্মা হাসি হাসি মুখে তাহাদিগকে বলিলেন, হে জীবগণ! তোমরা যত্ন সহকারে মানবগণকে রক্ষা করো। তাহাদের মধ্যে কতকগুলি ক্ষুধার্ত জীব রক্ষাম অর্থাৎ রক্ষা করিব এবং কতকগুলি অক্ষুধার্ত জীব রক্ষাম স্থলে যক্ষাম উচ্চারণ করিল। তখন ব্রহ্মা বলিলেন–রক্ষামেতি চ যৈরুক্তং রাক্ষসাস্তে ভবন্তু বঃ।/যক্ষাম ইতি যৈরুক্তং যক্ষা এব ভবন্তু বঃ৷৷ আসলে দেবতা, দানব, রাক্ষস, গন্ধর্ব, নাগ–এরা সবাই একই জায়গার উন্নত সভ্য বিভিন্ন গোষ্ঠী। ভুলে যাবেন না, যক্ষ কুবের ছিলেন রাক্ষস রাবণের বৈমাত্রেয় ভাই। রাক্ষসদের সঙ্গে যক্ষদের বহুবার যুদ্ধবিগ্রহ হয়েছে।
সে যাই হোক, ভারতে আগমনকারী আর্যরাই ছিল সবথেকে অসভ্য। কারণ আর্যজাতীর অন্যান্য শাখাগুলি যেখানেই গিয়েছে সেখানেই সাম্রাজ্য বা সভ্যতা গড়ে তুললেও একমাত্র ভারতে আগমনকারী আর্যরাই কোনো সভ্যতা বা সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে পারেনি। পারস্যে আগমনকারী আর্যরা একামেনিড সাম্রাজ্য গড়ে তোলে, ইতালিতে আগমনকারী আর্যরা গড়ে তোলে রোমান সাম্রাজ্য, গ্রিসে আগমনকারী আর্যরা গড়ে তোলে হেলেনিক সাম্রাজ্য এবং জার্মানিতে আগমনকারী আর্যরা গড়ে তোলে ফার্সট রাইখ (অটো দ্য গ্রেটের)।
ভারতের এই আর্যরা ছিল ধ্বংসকারী শক্তি, এরা ক্রমশ প্রায় সমগ্র উপমহাদেশে আধিপত্য বিস্তার করে। কিন্তু তাঁদের সবথেকে প্রবল বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় ৫ টি জনপদ। আর্যরা এগুলি পদানত করতে ব্যর্থ হয়ে শ্লোক রচনা করে–“অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গেযু সৌরাষ্ট্র মগধে চতীর্থ যাত্ৰাং বিনা গচ্ছন পুনঃ সংস্কারঃ হতি শুদ্ধিতরং” (ঐতরেয় আরণ্যক) অর্থাৎ অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, সৌরাষ্ট্র ও মগধে তীর্থযাত্রা ভিন্ন গমন করিলে প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে। এসব জনপদে কোনো আর্য ভুলেও পা রাখলে সে ভ্রষ্ট আর্য বা পতিত আর্য বলে গণ্য হতো, এবং এজন্যে তাঁকে ‘পুনোষ্ঠম’ নামে পুজো করে শুদ্ধ হতে হত। এই জনপদগুলির ভিতরের অঙ্গ, বঙ্গ ও মগধ আমাদের বৃহৎ বঙ্গদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর্যরা শ্লোকে উল্লেখিত এই পাঁচটি দেশের অধিবাসীদেরই ‘অসুর’ নামে আখ্যায়িত করত। আর্যরা প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির অধিকারী এসব দেশের অধিবাসীদের সঙ্গে লড়াইতে পেরে না উঠেই এদের অসুর’ বলে চিহ্নিত করে। এই পাঁচটি দেশের দুটি (সৌরাষ্ট্র ও কলিঙ্গ) দেশকে পরাভূত করতে পারলেও বঙ্গদেশের অধিবাসীদের পরাভূত করতে আর্যদের ২,১০০ বছর লেগে যায়! হ্যাঁ, এটাই সত্যি, এদেশের অধিবাসীরা আর্যদের সুদীর্ঘ ২,১০০ বছর ধরে বাঁধা দিয়ে আসছিল। আর আর্যরা ‘রাক্ষস’ বলতে এদেরকেই বোঝাত।
মেগাস্থিনিস তাঁর গ্রন্থে স্পষ্ট করে বলেছেন–“যে সকল জাতি ককেসাস পর্বতে বাস করে, তারা প্রকাশ্যেই সঙ্গম করেন এবং তাঁদের আত্মীয়স্বজনদের দেহ ভক্ষণ করেন। সর্বভূক আমিকটারিস জাতি কাঁচা মাংস ভক্ষণ করত। এঁরা স্বল্পজীবী, বৃদ্ধত্ব প্রাপ্ত হওয়ার আগেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এঁদের ওষ্ঠ অধরের নিম্নদেশ পর্যন্ত বিলম্বিত।” এ ইতিহাস, প্রায় ২০০০ বছর আগের। মহাকবি শেক্সপিয়রের সাহিত্যেও একপ্রকার রাক্ষস খোক্ষসদের বর্ণনা পাওয়া যায়।ওথেলোতে এরকম এক ধরনের বর্বর জাতি, নরখাদক (Cannibal) মানুষদের কথা জানা যায়, যাঁদের মাথা ঘাড়ের নীচে।ওথেলো সেইসব গল্প শোনাতেন তাঁর প্রেমিকা ডেসডিমোনাকে। হরপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেছেন–“রামায়ণ প্রভৃতি গ্রন্থে যাদের রাক্ষস, বানর, পক্ষী, যক্ষ, কিন্নর, গন্ধর্ব বলে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রকৃত প্রস্তাবে তারা বিভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ। আর্যের সম্প্রদায়ের মানুষদের আর্যরা দাস, বানর, রাক্ষস, পক্ষী ইত্যাদি অবজ্ঞাসূচক নামে অভিহিত করতেন।”
রাক্ষস বলতে যদি আমরা নরখাদকদের বুঝি, তাহলে বলাই যায় সেই নরখাদক রাক্ষস আজও আছে পৃথিবীতে। ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আন্দামানের রহস্যঘেরা আদিম দ্বীপ নর্থ সেন্টিনেল। ২৮ বর্গকিলোমিটারের এই দ্বীপটিতে বাস করেন নরখাদক আদিম জাতি সেন্টিনেল। সেখানে কেউ গেলে তাঁকে হত্যা করে খেয়ে ফেলে এই সেন্টিনেলরা। কয়েক বছর আগে এক আমেরিকান নাগরিক সেখানে গেলে তাঁকে হত্যা করে সেন্টিনেলরা। এরপর পুলিশ এ ঘঠনায় খুনের মামলা দায়ের করেছে। ওই আমেরিকান নাগরিককে দ্বীপে পৌঁছে দেওয়ার দায়ে সাত জেলেকে গেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে সেই দ্বীপে গিয়ে ঘটনার তদন্ত করার দুঃসাহস দেখায়নি কেউ।
এই অঞ্চলে যাঁরাই গিয়েছেন, হয় সেন্টিনেলদের দেখা পাননি, নয়তো তিরের মুখে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বেঁচেছেন অথবা প্রাণ দিয়ে খাদ্য হয়েছে। ভাগ্যক্রমে যাঁরা তাঁদের দু-একজনকে দেখেছেন তাঁরা বলেছেন, ওদের গলায়-বুকে-পিঠে হাড় আর খুলির গয়না। কঙ্গোর জঙ্গলের কিগ্যানি বা অস্ট্রেলিয়ার বুশম্যানদের মতো সেন্টিনেলরা বিশ্বের বিরলতম উপজাতিগুলোর একটি। এঁরা গত ৬৫ হাজার বছর ধরে এই দ্বীপের বাসিন্দা। আমেরিকান মিশনারি জন অ্যালেন চাও প্রাণ হারানোর পর বিশ্বের অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম ওই দ্বীপকেই বলছে ‘বিশ্বের ভয়ংকরতম’। ভয়ংকরতম এই দ্বীপের কুখ্যাতি বহুদিনের। দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত রোমান জ্যোতির্বিদ টলেমি লিখেছিলেন বঙ্গোপসাগরের এই নরখাদকদের দ্বীপ নিয়ে। ১২৯০ সালে মার্কো পোলোও বর্ণনা দেন এমন এক দ্বীপের, যেখানে হিংস্র ও বর্বর আদিবাসীরা বসবাস করেন, যাঁরা তথাকথিত সভ্য মানুষ পেলেই খেয়ে ফেলে।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী তাঁদের জনসংখ্যা ৫০-এর মধ্যে। তবে বহির্বিশ্ব থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন। নিজেদের এলাকায় বাইরে কারও প্রবেশ একেবারেই পছন্দ নয় তাঁদের। কোনো মুদ্রা ব্যবহার করে না সেন্টিনেলরা। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে না সরকারও। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন বা তাদের এলাকায় প্রবেশ বে-আইনি। এমনকি ভিডিও ক্যামেরায় তাদের গতিবিধি রেকর্ড করাও নিষিদ্ধ। গোটা বিশ্ব যখন এঁদের দমন করতে চরমভাবে ব্যর্থ, তখন রামচন্দ্র এঁদের সফলতার সঙ্গে দমন করে ফেলেছিলেন, এটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে, তা নিয়ে ভাবার অবকাশ থেকে যাবে
নরমাংস ভক্ষণ মানে হল মানুষের এমন এক ধরনের আচরণ যেখানে একজন মানুষ আর-একজনের মানুষের মাংস ভক্ষণ করে। তবে এর অর্থ আরও বাড়িয়ে প্রাণীতত্ত্বে বলা হয়েছে, এমন কোনো প্রাণীর এমন কোনো আচরণ, যেখানে সে তাঁর নিজের প্রজাতির মাংস ভক্ষণ করে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি তার সহযোগীও হতে পারে। ক্যানিব্যালাইজ শব্দটি ক্যানিবালিজম থেকে এসেছে এর মানে হল সামরিক অংশের পুনোৎপাদন।
ক্যানিবালিজিমের চর্চা হয়েছে লিবিয়া ও কঙ্গোতে বেশ কিছু যুদ্ধে। করোওয়াই হল এমন একটি উপজাতি, যাঁরা এখনও বিশ্বাস করে যে নরমাংস ভক্ষণ সংস্কৃতিরই একটি অংশ। কিছু মিলেনেশিয়ান উপজাতিরা এখনও তাঁদের ধর্মচর্চায় ও যুদ্ধে এই চর্চা করে। এছাড়াও এর একটি বড়ো কারণ হল মানসিক সমস্যা বা সামাজিক আচরণের বিচ্যুতি। নরমাংস ভোজের সামাজিক আচরণে দুই ধরনের নৈতিক পার্থক্য আছে। একটা হচ্ছে একজনকে হত্যা করা ও তাঁর মাংস খাওয়ার জন্য ও আর-একটি হচ্ছে স্বাভাবিকভাবে মৃত মানুষের মাংস খাওয়া।
সপ্তম শতকে আরবে কোরাইশদের যুদ্ধের সময় এ ধরনের ঘটনার সূত্রপাত ঘটে। ৬২৫ সালে উঁহুদের যুদ্ধের সময় হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব হত্যা হলে তাঁর কলিজা ভক্ষণের চেষ্টা করেন কোরাইশ নেতা আবু। সুফিয়ান ইবনে হার্বের স্ত্রী হিন্দু বিনতে উতবাহ। হাঙ্গেরির মানুষরাও মানুষের মাংস খেত মূর্তিপুজো করার জন্য। পরিব্রাজক ইবনে বতুতা বলেন যে, তাঁকে এক আফ্রিকান রাজা সতর্ক করে বলেছিলেন সেখানে নরখাদক আছে। জেমস ডব্লিউ ডেভিডসন ১৯০৩ সালে তাঁর লেখা বই ‘The Island of Formosa’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন যে, কীভাবে তাইওয়ানের চিনা অভিবাসীরা তাইওয়ানের আদিবাসীদের মাংস খেয়েছিল ও বিক্রি করেছিল। ১৮০৯ সালে নিউজিল্যান্ডের মাওরি উপজাতিরা নর্থল্যান্ডে ‘The Boyd’ নামের একটি জাহাজের প্রায় ৬৬ জন যাত্রী ও ক্রুকে হত্যা করে এবং তাঁদের মাংস খেয়ে নেয়। মাওরিরা যুদ্ধের সময় তাঁদের প্রতিপক্ষের মাংসও খেয়ে ফেলে। অনেক সময়ে সাগরযাত্রীরা ও দুর্যোগে আক্রান্ত অভিযাত্রীরাও টিকে থাকার জন্য অন্য সহযাত্রীদের মাংস খেয়েছে এমন ঘটনা জানা যায়। ১৮১৬ সালে ডুবে যাওয়া ফেঞ্চ জাহাজ মেডুসার বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা টানা চার দিন সাগরে ভেলায় ভেসে থাকার পর মৃত যাত্রীদের মাংস খেয়ে বেঁচে থাকেন। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির প্রায় ১,০০,০০০ যুদ্ধবন্দি সেনাকে রাশিয়ার সাইবেরিয়াতে পাঠানোর সময় তাঁরা ক্যানিবালিজমের আশ্রয় নেন। কারণ একদিকে তাঁদের জন্য বরাদ্দকৃত খাবারের পরিমাণ ছিল খুবই কম, অপরদিকে নানা ধরনের অসুখে আক্রান্ত হয়ে সৈন্যরা মারা পড়ছিল। এঁদের মধ্যে মাত্র ৫,০০০ জন বন্দি স্ট্যালিনগ্রাডে পৌঁছতে সক্ষম হয়। ল্যান্স নায়েক হাতেম আলি নামে একজন ভারতীয় যুদ্ধবন্দি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিউ গিনিতে জাপানি সেনাদের মানুষের মাংস খাওয়ার কথা বলেন। তাঁরা জীবন্ত মানুষের শরীর থেকে মাংস কেটে নিত ও এরপর ওই ব্যক্তিকে খালেবিলে ফেলে মেরে ফেলত। ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাপানি সেনারা চিচিজিমাতে পাঁচজন আমেরিকান বিমানসেনাকে হত্যা করে তাঁদের মাংস খেয়ে ফেলেন।
আঘোরি নামে উত্তর ভারতের একটি ক্ষুদ্র উপজাতিরা মানুষের মাংস খায়। মাংস খায় তাঁদের ধর্মীয় উপাসনার অংশ হিসাবে ও অমরত্ব অর্জনের জন্য। তাঁরা মনে করে এভাবে অতিপ্রাকৃতিক শক্তিও লাভ করবে। তারপর তাঁরা সেই মানুষের মাথার খুলিতে রেখে অন্য খাবার খায়। বয়স বেড়ে যাওয়া রোধ করতে ও ধর্মীয় পূণ্য অর্জন করতেই মানুষের মাথার খুলিতে খাবার রেখে খায়। ভারতের বারাণসীতে এখনও একটি সম্প্রদায়ের। মধ্যে মানুষ খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। আঘোরি সাধু নামে বিশেষ এক সন্ন্যাসী সম্প্রদায় আছে, যাঁরা মৃত মানুষের মাংস খেয়ে থাকে। যদিও প্রচলিত আছে এই সম্প্রদায় বিশেষ মার্গ সাধনার পদ্ধতি হিসাবে মানুষের মাংস খেয়ে থাকে।
২০১১ সালে পাপুয়া নিউগিনি পুলিশ ২৯ জন মানুষ খেকো আটক করে, যাঁরা ৭ জন ডাক্তার হত্যা ও ভক্ষণের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল। তাঁরা আদালতে স্বীকার করে যে, এই হত্যার জন্য তাঁরা কোনোভাবে অনুতপ্ত নয়। কারণ এই ডাক্তাররা কালোজাদু করত। গ্রামবাসীদের কাছ থেকে খাবার ও মেয়েদের ছিনিয়ে নিয়ে যেত। আর তাঁরা বিশ্বাস করত কুমারী মেয়েদের কালোবিদ্যা উপাসনায় কাজে লাগালে ভয়ংকর বিপদ নেমে আসে। তাই তাঁরা সেই ডাক্তারদের হত্যা করে তাঁদের মগজ ভক্ষণ করেছে ও পুরুষদের লিঙ্গের স্যুপ করে খেয়েছে। তাঁরা বিশ্বাস করে এই কারণেই ডাক্তারদের সেই কালোবিদ্যা তাঁদের মাঝেও চলে এসেছে এবং এমন এক আধ্যাত্মিক ক্ষমতার লাভ করেছে যে, তাঁদেরকে আর কোনো রোগ স্পর্শ করতে পারবে না। এমনকি এদের মধ্যে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নিজ সন্তান হত্যা করে খাওয়ার ঘটনাও আছে।
ফিজির সিগাটোকা অঞ্চলে একসময় মানুষখেকোরা থাকলেও এখন তাঁদের দেখা পাওয়া যায় না। সিগাটোকার নাইহেহে গুহায় যেসব নিদর্শন মিলেছে, তাতে স্পষ্টই বোঝা যায় যে মানুষখেকোরা আসলে মিলিয়ে যায়নি। আফ্রিকার মধ্যাঞ্চলীয় দেশটির আদিবাসীদের মাঝে এখনও মানুষ খাওয়ার প্রবণতা কমেনি। প্রকাশ্যে না-হলেও গোপনে মানুষের মাংস খাওয়ার অভ্যাস আছে তাঁদের। ২০০৩ সালের গোড়ার দিকে কঙ্গোর বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে মানুষ খাওয়ার অভিযোগ তোলে খোদ জাতিসংঘ। দ্বিতীয় কঙ্গো যুদ্ধের পর সরকারের এক প্রতিনিধি তাদের কর্মীদের জীবন্ত ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পর্যন্ত তোলেন। জার্মানিতে মানুষের মাংস খাওয়া কোনো অপরাধ নয়। আর সেজন্যই ২০০১ সালের মার্চে আৰ্মিন মাইভাস নামের এক জার্মান নাগরিক রীতিমতো বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষ খেলেও তাঁর বিরুদ্ধে খুনের মামলা ছাড়া কোনো অভিযোগ আনেনি পুলিশ। মানুষ খাওয়ার উদ্দেশে “The Cannibal Cafe’ নামের একটি ওয়েবসাইটে সুঠামদেহী, জবাইযোগ্য এবং আহার হতে চাওয়া মানুষের সন্ধান চেয়ে বিজ্ঞাপন দেন আর্মিন। অনেকে আগ্রহী হলেও বার্ল্ড জুর্গেন ব্রান্ডিসকে পছন্দ করেন আর্মিন। এরপর জার্মানির ছোট্ট গ্রাম রটেনবার্গে দুজনে মিলিত হন। এক পর্যায়ে ব্রান্ডিসকে হত্যা করে প্রায় ১০ মাস টানা তাঁর মাংস খান আর্মিন মাইভাস। ২০০২ সালে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বিচারে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। রাশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমের ক্রাসনোদার শহরে এক মানুষখেকো। দম্পতি প্রায় ৩০ জনকে হত্যা করেছে বলে স্বীকার করেছে। ৩৫ বছর বয়সি দিমিত্রি বাকশেভ এবং তাঁর স্ত্রী নাতালিয়া যে জায়গায় বসবাস করেন, সেই সামরিক ঘাঁটিতে কাঁটা-ছেঁড়া ও অঙ্গহীন একটি লাশ পাওয়া গেলে তাঁদের গ্রেফতার করা হয়। রাশিয়ার গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী তাঁদের বাড়ির ভিতরে ও মোবাইল ফোনে পাওয়া ছবিগুলো দেখে মনে হচ্ছে এসব হত্যাকাণ্ড প্রায় বিশ বছর আগের। এঁদের মধ্যে একটি ছবি ১৯৯৯ সালের ২৮ শে ডিসেম্বর মাসে তোলা। যেখানে দেখা যাচ্ছে, একটি বড়ো থালায় বিভিন্ন রকমের ফলের সঙ্গে মানুষের একটি রক্তাক্ত কাটা মাথা পরিবেশন করা হয়েছে। বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ৩ এপ্রিল দৈনিক বাংলার একটি বক্স নিউজের ছবিতে দেখা যায় এক যুবক মরা একটি লাশের চেরা বুক থেকে কলিজা খাচ্ছে। সে মরা মানুষের কলজে মাংস খায়!’ জানা যায়, প্রতি দুই সপ্তাহ পরপর সে মানুষের কলিজা খেত। উত্তর ২৪ পরগনার নিউ ব্যারাকপুরে কেদার নামে এক খুনির কথা জানা যায় তাঁর অনুগামীদের কাছ থেকে। এই কেদার ছিল খুবই নৃশংস ব্যক্তি। বিনা প্ররোচনাতেই যখন-তখন যে কারোকেই খুন করে দিত। খুন করার পর সেই মৃতদেহের বুক চিরে পাকস্থলি, যকৃত, ফুসফুস, হৃদপিণ্ড বাইরে বের করে এনে কাঁচাই খেতে নিত। পরে এক এনকাউন্টারে তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে জানা যায়।
উগান্ডার স্বৈরাচারী রাষ্ট্রনায়ক ইদি আমিনও নাকি নরখাদক ছিলেন। তবে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর নরখাদকের খেতাবটি ফিজির সর্দার রাতু উদ্রের দখলে। প্রত্যেকটি মানুষকে খাওয়ার পর সর্দার রাতু উদ্রে তাঁর শিকারের স্মৃতিতে একটি করে পাথর সাজিয়ে রাখত। তারপর খেয়ালখুশি মতো গুনতে বসত। গুনতে বসত কারণ এ পর্যন্ত তিনি কটা মানুষ খেল সেই হিসাব রাখতে। সে চাইত তাত্র মৃত্যুর পর তাঁকে যেন এই পাথরগুলির পাশে কবর দেওয়া হয়। হয়েছিলও তাই। মৃত্যুর পর উদ্রেকে উত্তর ভিটিলেসুর রাকিরাকি এলাকায় সেই পাথরের স্কুপের মধ্যে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। ১৮৪০ সালে মিশনারি রিচার্ড লিথ আসেন ফিজিতে। উদ্রের ছেলে ছিল রাভাতু। সে তাঁর বাবার মতো নরখাদক ছিল না। লিথ সাহেবের কাছে স্বীকার করেছিল তাঁর বাবা সর্দার রাতু উদ্রে সত্যিই নরখাদক ছিল। উদ্রের পেটে যাওয়া সমস্ত হতভাগ্যই ছিল, ফিজির আদিবাসী গোষ্ঠী সংঘর্ষে হেরে যাওয়া যুদ্ধবন্দি। এছাড়া উদ্রের দলে থাকা রাকিরাকির অনান্য আদিবাসী সর্দাররা তাঁদের জীবিত বন্দি ও মৃত শত্রুর দেহ উদ্রের হাতে তুলে দিত। মৃতদেহগুলির সত্যকারের জন্য নয়, স্রেফ খাওয়ার জন্য। লিথকে উদ্রের ছেলে রাভাতু বলেছিল, তাঁর বাবা মানুষের মাংস ছাড়া আর কিছু খেত না এবং তাঁর নরখাদক বাবা হতভাগ্য মানুষদের পুরো শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গই আগুনে ঝলসে খেত। একেবারে একটা দেহের সব মাংস খেতে না পারলে অর্ধভুক্ত দেহটি একটা বাক্সে তুলে রাখত। কিন্তু পরে পুরোটা খেয়ে নিত। অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর লরেন্স গোল্ডম্যান নরখাদক মানুষদের নিয়ে লিখেছিলেন একটি বই। সেই বইটিতে উদ্রে সম্পর্কে বিশদে লিখেছিলেন গোল্ডম্যান। “The Anthropology of Cannibalism’ নামক বইটির শেষ লাইনে লিখেছেন একটি গা শিউরে ওঠা ভয়ংকর মন্তব্য–“নরখাদক মানুষগুলোকে আমরা সবাই ভয় পাই। কিন্তু আমি একই সঙ্গে তাঁদের প্রশংসা করব। কারণ ওঁরা শক্তির প্রতীক। নিজেদের বীরত্ব ওঁরা এভাবেই প্রমাণ করতে চেয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে।” নরখাদকদের প্রশংসা করা নিয়ে ঝড় উঠেছিল পৃথিবীতে। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড’ পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংসতম নরখাদক মানুষ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে উদ্রেকে। পিটার ব্রায়ান নামের একজন ব্রিটিশকে ইস্ট লন্ডনে ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্রেফতার করা হয়, যিনি তাঁর বন্ধুকে খুন করেন ও খেয়ে ফেলেন।
যাঁরা রামায়ণেও আছেন, মহাভারতেও আছেন
বেশকিছু চরিত্রকে আমরা রামায়ণ ও মহাভারত উভয় মহাকাব্যেই পাই। যেমন–(১) রামায়ণে জাম্ববান ভাল্লুক সেনা। রামের সেনার এক অন্যতম সদস্য। সীতার খোঁজ নিতে যখন হনুমানকে পাঠানোর কথা হয় তখন কোনও এক অভিশাপের জেরে নিজের শক্তি সম্পর্কে ভুলে গিয়েছিলেন হনুমান। তখন জাম্ববানই হনুমানকে তাঁর পরিচয় ও শক্তি সম্পর্কে অবহিত করেন। মহাভারতে কৃষ্ণর আসল পরিচয় না-জেনেই তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করেন জাম্ববান। যখন কৃষ্ণ নিজের পরিচয় প্রকাশ করে বলেন রাম ও তিনি একই, তখন লজ্জায় মাথা নিচু করে ক্ষমা চান জাম্ববান এবং নিজের মেয়ে জামবতীর সঙ্গে কৃষ্ণর বিবাহ দেন। (২) রামায়ণে হনুমানের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ভগবান রামের একনিষ্ঠ ভক্ত হনুমান। রাবণের স্বর্ণলঙ্কা জ্বালিয়ে দেওয়া থেকে সীতা উদ্ধারে হনুমান ছিলেন খুবই প্রাসঙ্গিক। মহাভারতে সুগন্ধিকা পুষ্প আনার সময় পথে এক বৃদ্ধ হনুমানকে দেখেন ভীম। ভীম দেখে ওই বৃদ্ধ হনুমানের লেজে রাস্তা আটকে রয়েছে। ভীম ওই বৃদ্ধ হনুমানকে লেজ সরানোর অনুরোধ করেন। হনুমান বলেন, তিনি বৃদ্ধ, নিজের লেজ নাড়ানোর ক্ষমতাও তাঁর নেই। তাই ভীমকেই সেই লেজ সরিয়ে দিতে হবে। ভীমের নিজের শক্তির উপর অগাধ বিশ্বাস ও অহংকার ছিল। সেই অহংকার চূর্ণ হয় যখন সে বৃদ্ধ হনুমানের লেজ নড়াতে অপারগ হয়। ভীম বৃদ্ধ হনুমানের আসল পরিচয় জানতে চান। তখন নিজের পরিচয় দেন ভগবান হনুমান। (৩) রামায়ণে সীতার স্বয়ম্বর সভায় রাম মহাদেব শিবের ধনুক ভেঙেছেন এই খবর জানতে পেরে উদ্বিগ্ন পরশুরাম রামকে প্রতিযোগিতার জন্য আহ্বান জানান। কিন্তু পরে যখন তিনি জানতে পারেন রাম আসলে শিবেরই অবতার, তখন তিনি ক্ষমাপ্রার্থনা করেন, পাশাপাশি রামকে আশীর্বাদও দেন। মহাভারতেও পিতামহ ভীষ্ম ও কর্ণের গুরু হিসাবে পরশুরামের উল্লেখ আছে। (৪) রামায়ণের রাবণের ছোটো ভাই বিভীষণ, যিনি রামের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর লঙ্কার পরবর্তী রাজাও হন বিভীষণ। মহাভারতে পাণ্ডবরা যখন রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন, তখন বিভীষণ তাঁদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। এবং তাঁদের বহুমূল্য সমস্ত সামগ্রী ও উপহার প্রদান করেন। সভাপর্বে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের সময় সহদেব কর গ্রহণের জন্য বিভিন্ন রাজ্যে যান। এই দিগবিজয়কালে তিনি কচ্ছদেশে অবস্থান করে বিভীষণের কাছ থেকে কর আদায়ের জন্য ঘটোৎকচকে দূতরূপে পাঠান। বিভীষণ সহদেবের শাসন মেনে নেন। এবং বহু মূল্যবান সামগ্রী পাঠান। দাক্ষিণাত্য পাঠে আরও বেশ কয়েকটি জায়গায় বিভীষণকে পাওয়া যায়। (৫) রামায়ণে মায়াসুর রাবণের শ্বশুর। রাবণের স্ত্রী মন্দোদরী আসলে মায়াসুরের কন্যা। মহাভারতে পাণ্ডবরা যখন দণ্ডকারণ্য জ্বালিয়ে দিয়েছিল তখন একমাত্র মায়াসুরই বেঁচে গিয়েছিল। কৃষ্ণ তাঁকে মারতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে অর্জুনের কাছে প্রাণভিক্ষা চায়। পরে এই মায়াসুরই ইন্দ্রপ্রস্থ তৈরি করেন। (৬) রামায়ণে মহর্ষি দুর্বাসাই সেই ব্যক্তি যিনি রাম ও সীতার বিচ্ছেদের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। মহাভারতে মহর্ষি দুর্বাসার মন্ত্রেই কুন্তী পাঁচ সন্তানের (পাণ্ডব) মা হয়েছিলেন।
তবু আছে অনেক কিছু–মহাভারতে রামায়ণ আছে ঠিকই, রামায়ণে মহাভারত নেই। রামায়ণ মহাভারতের চেয়ে জনপ্রিয় বোধহয় এই কারণেই। সেই কারণেই বোধহয় রামায়ণের শত শত ভার্সান, মহাভারতে নেই। শ্রীরামচন্দ্র আর শ্রীকৃষ্ণের জনপ্রিয়তা এবং দেবত্ব প্রায় সমান সমান হলেও রামকে নিয়ে হিন্দুবাদীদের যতটা উন্মাদনা, শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে ততটা নয়। রাম ও হিন্দুত্ব যতটা সমার্থক হয়ে গেছে, কৃষ্ণ ও হিন্দুত্ব ততটা সমার্থক নয়। কৃষ্ণ যেন কেবলমাত্র বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদেরই সম্পদ। রাম জন্মভূমি আর বাবরি মসজিদ যেন এক কলঙ্কিত ইতিহাসের স্রষ্টা, কৃষ্ণকে ঘিরে তেমন কোনো কলঙ্কময় ইতিহাস রচিত হয়নি। অথচ রাম অপেক্ষা কৃষ্ণের জনপ্রিয়তা অনেক গুণ বেশি, সারা বিশ্বেই। কৃষ্ণ সারা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়, রাম নয়।
.১৫. রামায়ণে অস্ত্র এবং শস্ত্র
বশিষ্ঠের ‘ধনুর্বেদসংহিতা’ গ্রন্থের ২০৭ টি শ্লোকে প্রাচীনকালের যুদ্ধ সংক্রান্ত নানা বিষয় আলোচিত হয়েছে। ‘ধনুর্বেদ’ শব্দটি প্রাথমিকভাবে ধনুর্বিজ্ঞান বোঝালেও ব্যাপক অর্থে সমস্ত আয়ুধবিদ্যাকে বোঝায়। সেখানে বলা হয়েছে, ধনুর্বেদ শিক্ষার ব্যাপারে ব্রাহ্মণই হবেন শিক্ষাগুরু–“ধনুর্বেদগুরুবিঃ “। বশিষ্ঠ বলেছেন–ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যকে এই বিদ্যাকে শিখতে হবে এবং শূদ্র শিকারের জন্য এবং বিপদের সময় রাজ্যরক্ষার্থে শূদ্রও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন। প্রাচীন ভারতে অস্ত্রবিদ্যায়ে উন্নত ছিল তার প্রমাণ এই গ্রন্থ। আধুনিক বিচারে বশিষ্ঠের ‘ধনুর্বেদসংহিতা’ তেমন উন্নতমানের না-হলেও, প্রাচীন ভারতে সমরবিদ্যা জানার ক্ষেত্রে এই গ্রন্থের গুরুত্বকে ছোটো করে দেখা যায় না। যাই হোক, সংস্কৃত ভাষায় রচিত এরকম বেশকিছু গ্রন্থে অস্ত্রশস্ত্র এবং অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা আছে। তবে অস্ত্রশস্ত্র যত-না রাজরাজড়ার কাছে ছিল, তার চেয়ে কয়েকশো গুণ বেশি অস্ত্রশস্ত্র ছিল মুনি-ঋষি-ব্রাহ্মণদের কাছে। এঁদের কাছেই ছিল বিশাল অস্ত্রভাণ্ডার। রাজরাজড়াদের প্রয়োজন হলে এঁরাই ভয়ানক ভয়ানক সব অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করতেন।
রামায়ণে বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড এবং যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে। এইসব আয়ুধের নাম যেমন অর্থবহ, কার্যক্ষমতাও তেমনই ভয়ংকর। আয়ুধ বা যুদ্ধাস্ত্রগুলি নিয়ে এবার একটু খোঁজখবর নেওয়া যেতে পারে। অস্ত্র এবং শস্ত্র এক জিনিস নয়, সম্পূর্ণ পৃথক। অস্ত্র হল ঐশ্বরিক ক্ষমতা, দৈবিক শক্তির বলে যা প্রাপ্ত হত, যা কোনও দেবদেবী কৃপায় বরপ্রাপ্ত হত। এইসব হাতিয়ারের ক্ষমতা ছিল অসীম, শুধু বিপক্ষের মানুষজন কেন, গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকেও গুঁড়িয়ে দেওয়া যেত বলে গল্পেসল্প পড়েছি। দেবতাদের কৃপায়’ রামও অনেক অস্ত্রলাভ করেছিলেন। কিন্তু সমস্ত অস্ত্রই যে রাম তপস্যাবলে পেয়েছেন, এমন তথ্য কোথাও পাই না। অস্ত্রের জন্য বা অমরত্বের জন্য রামকে তপস্যা-টপস্যা করতে হয়নি। এমনিই সবাই অস্ত্রশস্ত্র গুছিয়ে দিয়েছেন, যেহেতু রাম ক্ষত্রিয়। প্রভাব যাঁর বেশি, তাবেদারদের সংখ্যাও তাঁদের বেশি। অতএব নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র দান করেছেন মুনিঋষি, দেবদেবতারা। কিন্তু রাক্ষস-খোক্ষস, দৈত্যদানোদের দৈব অস্ত্রশস্ত্র কেউ এমনি এমনি দান করেননি, দিতে বাধ্য হয়েছেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই সেইসব অস্ত্রশস্ত্রের অধিকারী হয়েছিলেন তাঁরা। যদিও অস্ত্রের প্রয়োজন এবং ব্যবহার রামকেই বেশি করতে হয়েছিল। কারণ সেই বিরাধ রাক্ষস থেকে রাবণ হত্যা পর্যন্ত প্রচুর হত্যা তাঁকে করতে হয়েছে। তা ছাড়া রামের প্রতিপক্ষরা ছিলেন অসমসাহসী, প্রবল শক্তিমান এবং যথার্থ বীর। এই দুই বীরকে পরাস্ত করতে গিয়ে অনেক সময়ই রাম এবং লক্ষ্মণ উভয়ই পরাস্ত ও বিপর্যস্ত হয়েছেন একাধিকবার। রামের এত ভয়ানক অস্ত্রশস্ত্র থাকা সত্ত্বেও বীরত্ব দ্বারা নয়, অবশেষে চালাকির দ্বারা প্রতিপক্ষ পরাস্ত করা সম্ভব হয়েছে। তদুপরি যুদ্ধক্ষেত্রে বহিঃশক্তি তথা আর্যদেবতাদের কৃপা তো রয়েছেই। শক্তি এবং দৈব অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও রামচন্দ্র কিছুতেই রাবণকে কবজা করতে পারেনি, তিনদিন তুমূল যুদ্ধের পরেই রাবণকে হত্যা করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
অস্ত্র কেমন? রামের এরকমই একটা অস্ত্রের ব্যবহারের কথা বলি–একদিন রাম তপোবনে সীতার সঙ্গে বিশ্রম্ভালাপে ব্যস্ত ছিলেন। কিছুক্ষণ পর রাম নিদ্রামগ্ন হলে সীতা রামের মাথা নিজের কোলে নিয়ে বসে থাকলেন। এক কাক, যা কিনা ছদ্মবেশী রাক্ষস! সীতার মাথা বারবার ঠুকরে দিচ্ছে। সীতার শরীরে আঘাত লাগলেও পাছে রামের ঘুম ভেঙে যায়, সেই কারণে তিনি আঘাত সহ্য করছেন। এরকম দাসী-বউই বোধহয় বেশিরভাগ পুরুষ পছন্দ করেন! যাই হোক, হঠাৎ সীতার মাথা থেকে রক্তক্ষরণ হতে থাকে এবং সেই রক্ত গড়িয়ে পড়ে রামের শরীরে। উষ্ণ রক্তের স্পর্শে রামের ঘুম ভেঙে গেল। রাম একমুঠো দূর্বা ঘাস ছিঁড়ে তাঁকে মন্ত্রপূত করে উপরের কাকটির দিকে ছুঁড়ে দিলেন। কাকটির মৃত্যু হল সেই দূর্বার প্রয়োগে, এটাও অস্ত্র বটে। এই অস্ত্র দেবতার কাছ থেকে বর হিসাবে পেয়েছিলেন, যা কিনা অ্যুৎ এবং অকিঞ্চিৎকর রাক্ষসকে হত্যার উদ্দেশ্যে এই অস্ত্রের প্রয়োগ করতে হল! অবশ্য এ ইতিহস বাল্মীকি লেখেননি।
এবার শস্ত্রের কথায় আসি। শস্ত্র হল লোহা, কাঠ ইত্যাদি পদার্থ জাতীয়। যেমন গদা, ধনুক, তলোয়ার ইত্যাদি, যা দিয়ে সরাসরি আঘাত করা যায় বা হত্যা করা যায় অন্য একজন বা একাধিক ব্যক্তিকে। আধুনিক যুগের যেমন গাদার রাইফেল, একে-৪৭, কালাশনিকভ অ্যাসল্ট, রিভলভার, গ্রেনেড ইত্যাদি সবই শস্ত্র। কিন্তু প্রশ্ন হল, সে যুগের দৈবাস্ত্র কি এখনও কেউ পান তপস্যাবলে? দেবতারা কি বর দেন? পাওয়া যায় অভীষ্ট সিদ্ধির অস্ত্র? পাওয়া যায় বইকি। পুরাণ যুগে সবচেয়ে বেশি দৈবাস্ত্র ও অমরত্বের বর প্রদান করেছেন স্বয়ং অনার্য ‘দেবতা’ শিব। এরপর সেই তালিকায় আছেন যথাক্রমে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্র।
এ সময়ের শিবের ভূমিকা পালন করছেন আমেরিকা এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্টরা। তাঁরা তাঁবেদার দেশগুলিকে ভয়ংকর ভয়ংকর সব অস্ত্রশস্ত্র প্রদান করছেন, সেইসব অস্ত্রশস্ত্রে বলীয়ান হয়ে বিভিন্ন শক্তিশালী দেশ তুলনামূলক দুর্বল দেশের উপর আক্রমণ করছে এবং হত্যালীলা সম্পন্ন করছে। এইসব অস্ত্রশস্ত্র দেবতাদের অস্ত্রের চেয়ে কয়েকশো গুণ বেশি ধ্বংসকারী। এক লিটল বয়’ নামে নিউক্লীয় বোমার আঘাতেই হিরোসিমায় মৃত্যু হয়েছে ২ লাখ ৩৭ হাজার নিরীহ সাধারণ মানুষ। নাগাসাকিতে মৃত্যু হয়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজার নিরীহ সাধারণ মানুষ, অস্ত্রের নাম ‘ফ্যাট ম্যান’। এমন বিধ্বংসী অস্ত্র তৈরির ক্ষমতা দেবতাদেরও হয়নি। অতএব আজকের এই মানুষগুলো দেবতাদের চেয়েও ভয়ংকর এবং শক্তিশালী। দেবতারা অত্যাচারী শাসকদের হত্যা করত, মানুষ অসামরিক মানুষদের হত্যা করে। শুধু আমেরিকাই নয়–যুদ্ধাস্ত্র প্রদান করেন ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইটালি, জার্মান–এমনকি ভারতও। অস্ত্র প্রদানের বাজার তৈরি করার সাধনায় ব্রতী থাকেন এরা, সারা বছর। দেশে দেশে শত্রুতা আর যুদ্ধ জিইয়ে রাখেন তাঁরা। এদের ভয়ে সারা বিশ্ব থরথর করে কাঁপছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কায়। যেমন পুরাণে ব্ৰহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের ভয়ে সবাই থরথর করে কাঁপত। এখন আর অস্ত্র ও শস্ত্রের মধ্যে কোনো তফাত নেই।
অস্ত্রধারণ করেন যিনি তাঁকে বলা হয় অস্ত্রধারী। রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণকাহিনিতে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার হতে দেখা যায়। এইসব অস্ত্রের নাম, ব্যবহারের রীতিনীতি, ফলাফল সম্বন্ধে অনেক কিছু জানা যায়। বিশ্বামিত্র রামের প্রতি তুষ্ট হয়ে যে অস্ত্রগুলি দিয়েছিলেন সেগুলি হল–বলা, অতিবলা, ধর্মচক্র, কালচক্র, বিষ্ণুচক্র, ইন্দ্রচক্র, ব্রহ্মশির, ঐষিক, ব্রহ্মাস্ত্র, ধর্মপাশ, কালপাশ, বরুণ পাশ, শুষ্ক অশনি, আর্দ্র অশনি, পৈনাক, নারায়ণ, শিখর, বায়ব্য হয়শির, ক্রৌঞ্জ, কঙ্কাল, মুষল, কপাল, শক্তি, খড়গ, গদা, শূল, বজ্র, কিঙ্কিণী, নন্দন, মোহন, প্রস্বাপন, প্রশমণ, বক্ষণ, শোষণ, সন্তাপন, বিলাপন, মাদন, মানব, তামস, সৌমন, সংবর্ত। আরও অনেক নাম-না-জানা অস্ত্র! বিশ্বামিত্রের কি অস্ত্রের কারখানা ছিল আমেরিকার মতো? শুধু বিশ্বামিত্রই নন, অস্ত্র দিয়েছেন অগস্ত্যও। এঁরা তথাকথিত মুনিঋষি হলেও প্রত্যেকেই এক একজন বিপুল অস্ত্রভাণ্ডারের মালিক।
অনার্যদেবতা শিবের পৃষ্ঠপোষকতায় রাবণ ছিলেন অপ্রতিরোধ্য, অপরাজেয় শক্তিমান। তিনি ছিলেন শিবের ও ব্রহ্মা পদাধিকারীদের একনিষ্ঠ ভক্ত। পুরাণে আছে, অমরত্ব লাভের জন্য শিবের কাছে তপস্যা তথা দরবার করেছেন। শিব যতবারই তাঁকে পরীক্ষা করছেন, রাবণ নিজ মস্তক তরবারির আঘাতে কেটে গুরুর পায়ের কাছে ফেলে দিচ্ছেন। প্রতিবারই শিবের কৃপায় রাবণের মস্তক আবার যথাস্থানে ফিরে যাচ্ছে। এইভাবেই রাবণ দশ মস্তকের অধিকারী হলেন। নাম হলো দশানন। আসল কথা হল, দশানন বা দশ মস্তকের অধিকারী কথাটির মধ্যেই নিহিত রয়েছে রাবণের শক্তি, সামর্থ্যের কথা। জৈন মতে রাবণের ছিল দশমুখ। বাল্মীকির রামায়ণে রাবণের একটাই মাথা, দুটি হাত, দুটি পা।
রাবণের মৃত্যু হয়েছিল রাম নয়, ইন্দ্রের হাতে। এ ইঙ্গিত রাবণের মৃত্যুর পর মন্দোদরীই দিয়েছেন। পুরাণ বলছে, পরবর্তী জীবনে রাবণ তীর্থঙ্কর হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্মীকির রাবণ শিবের কাছে তপস্যার পর শিব। সন্তুষ্ট হয়ে বর দিতে চাইলে রাবণ অমরত্ব চাইলেন। শিব অমরত্ব দিলেন না। রাবণের নাভির নিচে লুক্কায়িত। রইল অমৃত, যার উপস্থিতিতে রাবণ হলেন অপরাজেয়। অমৃত বিনষ্ট না-করে রাবণকে বধ করা যাবে না। লাভ করলেন অনন্ত শক্তি, যাতে মানুষ ছাড়া দেবকুল, অসুরকুল ইত্যাদি যত কুল আছে, সকলেই তাঁর কাছে পরাজিত হবেন। অবধ্য, অপরাজেয় হবেন রাবণ। আর দিলেন চন্দ্রহাস তরবারি। কিন্তু অকারণে এই শস্ত্রের প্রয়োগে তা কার্যকরী হবে না, পুনরায় ফিরে যাবে দেবতার কাছে। এছাড়াও শিব ও ব্রহ্মা অনেক অস্ত্র দিয়েছিলেন তাঁকে, যা দিয়ে তিনি লাভ করবেন সসাগরা পৃথিবীর আধিপত্য। এই সব অস্ত্রই ব্যবহৃত হয়েছিল লঙ্কার যুদ্ধে। সাধারণের মানুষের প্রতি তাঁর কোনো ভয় ছিল না। মানুষকে তিনি শত্রু বলেই মনে করেন না। তাঁর প্রধান শত্রু ছিলেন দেবকুল এবং অসুরকুল। তাই তিনি কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার কথা ভেবে শিবকে তুষ্ট করতেন। বিভীষণ রাবণের মৃত্যু কীভাবে সম্ভব একথা রামকে জানালে রামচন্দ্র প্রসাভপন অস্ত্র দিয়ে রাবণের অমৃতকে বায়বীয় পদার্থরূপে হাওয়ায় উড়িয়ে দেন।
ইন্দ্রজিৎ বা মেঘনাদ ইন্দ্রলোক জয় করেছিলেন। ইন্দ্রলোক, দেবলোক জয় করা তো সামান্য বীরের কাজ নয়! এহেন মেঘনাদকে পরাজিত এবং হত্যা করার আগে লক্ষ্মণ ও রাম পরাস্তই হয়েছিলেন তাঁর কাছে। একবার নয়, দু-দুইবার। বহিঃশক্তি আর্যদেবতাদের সহায়তা এবং কৌশল অবলম্বন না-করলে সেই যুদ্ধে মেঘনাদকে পরাস্ত করা সহজসাধ্য ছিল না।
আবার রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণকাহিনিতে এমন কিছু মন্ত্রও আছে, যা নকি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে হাজির হয় শস্ত্র হিসাবে। কখনও-বা সেই শস্ত্রের আঘাতে বিপক্ষের জীবনহানিও হয়ে যায় নিমেষে। আবার কখনও ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে সেই সকল অস্ত্রের দ্বারা অহেতুক ক্ষতিসাধনও হয়ে থাকে। আর-একটি প্রসিদ্ধ অস্ত্রের কথাও আমরা জানি, তা হল ‘ব্রহ্মাস্ত্র’। এই অস্ত্রের ব্যবহার ছিল একেবারে শেষ পর্যায়ে। আধুনিক যুগে পরমাণু বোমার মতো। যুদ্ধের শেষ অস্ত্র। এই অস্ত্র ব্যবহারের কিছু বিধিনিষেধও ছিল। বিপক্ষকে কোনওভাবেই পরাস্ত করতে না-পারলে, বিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধে মৃত্যু আসন্ন হলে এবং সমগ্র বাহিনী পরাজয়ের সম্মুখীন হলে তবেই এই অস্ত্র ব্যবহার করা হত। তবে কি এই অস্ত্র ছিল একালের নিউক্লিয়ার বোমা বা পরমাণু অস্ত্র, যার প্রয়োগ সম্বন্ধে আছে অনেক বিধিনিষেধ! হঠকারিতা যে হয় না, তা নয়–সেযুগেও হয়েছে, এযুগে হয়। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট হিরোসিমা ও নাগাসাকির বিরুদ্ধে ব্ৰহ্মাস্ত্র (নিউক্লীয় বোমা) প্রয়োগ করে এমনই হঠকারিতা করেছিল আমেরিকা।
এছাড়া ছিল ‘যমাস্ত্র’। নাম শুনেই মনে হয় একেবারে ইহলীলা সাঙ্গ করার জন্যই এর ব্যবহার। যম মানেই যে মৃত্যু, শমন। এই অস্ত্রটি মেঘনাদ বিভীষণের প্রতি ব্যবহৃত হয়েছিল। বিভীষণ রাম-লক্ষ্মণদের জানিয়ে দিয়েছেন মেঘনাদকে তাঁদের শক্তি দিয়ে হত্যা করা সহজ কাজ নয়। মেঘনাদ এখন যজ্ঞে বসেছেন এবং যজ্ঞ সম্পন্ন হলে তিনি অমরত্ব লাভ করবেন–কেউ আর তাঁকে পরাস্ত করতে পারবেন না। এদিকে রাম-লক্ষ্মণ মেঘনাদের অস্ত্রপ্রয়োগে যারপরনাই বিপর্যস্ত। লক্ষ্মণকে দু-বার এবং রামচন্দ্রকেও একবার পরাস্ত করেছেন ইন্দ্রজিৎ মেঘনাদ। কোনোপ্রকারে মৃত্যুর কোল থেকে ফিরে এসেছেন রাম-লক্ষ্মণ দুই ভাই। অতএব মেঘনাদের যজ্ঞ পণ্ড করে মেঘনাদকে হত্যা করা যদি আসান হয়, সেই সুযোগ আর হাতছাড়া করা কেন! যজ্ঞ পণ্ড করলেই যদি তিনি আর অমরত্ব লাভ করতে না-পারেন, তাহলে আর দেরি কেন–অতএব শুভস্য শীঘ্রম। লক্ষ্মণ ও বিভীষণ সদলবলে মেঘনাদের যজ্ঞক্ষেত্রে হানা দিলেন। তখনই বিভীষণের বিরুদ্ধে যমাস্ত্রের প্রয়োগ করেছিলেন মেঘনাদ।
‘নাগপাশ’ আর-এক ভয়ংকর অস্ত্র। মেঘনাদের কাছে রাম এবং লক্ষ্মণ বারেবারেই পরাস্ত হচ্ছিলেন। মেঘনাদ নাগপাশ অস্ত্রের প্রভাবে রাম এবং লক্ষ্মণকে সর্পবন্ধনে বেঁধে ফেলেছিলেন। পরে গরুড়ের সাহায্যে তাঁরা মুক্ত হন। গরুড় (বিষ্ণুর বাহন বলা হয়) না-থাকলে সেদিন রাম-লক্ষ্মণ মুক্তি অসম্ভব ছিল। বহিঃশক্তি দেবতাদের পক্ষপাতিত্ব না-থাকলে রাম-লক্ষ্মণরা বড়োই অসহায়। আর-একটি ভয়ংকর অস্ত্র হল ‘শক্তি অস্ত্র বা ‘শক্তিশেল। এই অস্ত্র মেঘনাদ প্রয়োগ করেছিলেন লক্ষ্মণের বিরুদ্ধে। একপ্রকার মৃত বলেই ঘোষিত হয়েছিলেন লক্ষ্মণ। হনুমান সঞ্জীবনী’ এনে না-দিলে সেবারেই ‘খবর’ হয়ে যেতেন তাঁরা। এছাড়া সূর্যাস্ত্র, বরুণাস্ত্র, ইন্দ্রাস্ত্র ইত্যাদি অস্ত্র একা মেঘনাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হয়েছিল। এক এক দেবতার এক একরকমের অস্ত্র, তার পাল্লা এবং বীভৎসতাও এক একরকম।
ইন্দ্রজিৎ বা মেঘনাদ এবং রামচন্দ্র ‘ব্ৰহ্মাস্ত্র’, ‘পাশুপত অস্ত্র’, ‘বৈষ্ণবাস্ত্র’ এই তিনটি অস্ত্রের অস্ত্রধারী বীর ছিলেন। এছাড়াও ছিল ‘গান্ধর্বাস্ত্র’, যা বহু সৈন্যকে একসঙ্গে হত্যা করার মতন ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্র ছিল। রাম এবং রাবণ এই দুজন শক্তিধর ব্যক্তি ছাড়া আর কোনও বীরেরই এই অস্ত্রচালনা করার ক্ষমতা ছিল না।
শুধু রামায়ণ নয়, মহাভারতেও আমরা ভয়ানক সব সামরিক পরিচয় পাই। যে ধরনের অস্ত্রশস্ত্র তাঁদের কাছে ছিল, সে ধরনের অস্ত্রশস্ত্রের মারণক্ষমতা ছিল প্রলয়ংকর। মহাভারতের আদি পর্বে অগ্নিদেব বাসুদেবকে ‘সুদর্শন চক্র’ দিয়ে বলছেন–‘এই অস্ত্র শত্রু নিপাত করবে এবং কাজ শেষ হলে তাঁরই হাতে ফিরে আসবে’। সেই বাসুদেব শিশুপালের হাতে যখন প্রায় নিগৃহীত, তখন তিনি সেই সুদর্শন চক্র ব্যবহার করেছিলেন এবং সেই ‘চক্র তাঁহার দেহ হইতে মস্তক বিচ্ছিন্ন করিয়া বাসুদেবের হস্তে ফিরিয়া আসিল’। দুর্দান্ত ক্ষুরধার ব্যুমেরাং! এত বছর আগে ব্যুমেরাং!
ক্রৌঞ্চবিরহী মহাকবি বাল্মীকি তাঁর রামচরিতে প্রকৃতি থেকে শুরু করে ভৌগোলিক স্থানের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ যেমন দিয়েছেন, ঠিক তেমনই নারীর শরীরসৌন্দর্য থেকে ভোজনদ্রব্যের বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। কোথাও তিনি ফাঁকি দেননি। রাম, রাবণ, রাক্ষস, বানররা কী ধরনের খাদ্য ভোজন করতেন তারও উল্লেখ আছে। এই প্রবন্ধে সেই খাদ্যাদি উল্লেখ করলে প্রাচীন যুগের ভারতীয়দের খাদ্যাভাসের খানিকটা আভাস পাওয়া যাবে।
বাল্মীকির রামায়ণে রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা নিরামিষভোজী ছিলেন না। তাঁরা কেবলই ফলমূল খেয়েই জীবন ধারণ করত না। না, মহামুনিরা সে কথা বলছেন না। যা সত্য তাইই বলেছেন। তাঁরা যে সত্যদ্রষ্টা। রামচন্দ্র নিজেই। আমিষ খাবার পছন্দ করতেন। ভরত যেদিন রামকে ফিরিয়ে আনতে চিত্রকূটে পর্বতে এলেন, সেদিন রাম দগ্ধ মৃগমাংসের সাহায্যে সীতা বিনোদন করছিলেন। অর্থাৎ রাম-সীতা উভয়ই হরিণের মাংস ভক্ষণ করছিলেন। লক্ষ্মণ তখন খাচ্ছিলেন না। কারণ তখন তিনি প্রহরায় ব্যস্ত ছিলেন। প্রহরায় ব্যস্ত থাকলেও এই মৃগমাংস খাদ্যাদির ব্যবস্থা তিনিই করেছিলেন। কাঠ সংগ্রহ করা, আগুন জ্বালানো, পশুপাখি মারা, খাবার বানানো, ঘর বানানো এসব কাজ লক্ষ্মণই করতেন। শুধু মাংস নয়, রামচন্দ্র মাছ খেতেও খুব পছন্দ করতেন। বাল্মীকি বলেছেন–“ঘৃতপিণ্ডেপমান্ স্থূলাংস্তান্ দ্বিজান্ ভক্ষয়িষ্যথ।/রোহিতাংশ্চক্ৰতুণ্ডাংশ্চ নলমীনাংশ্চ৷৷” অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে–চক্রতুণ্ড, নলমীন এবং রোহিত বা রুই এই তিন রকমের মাছ তিনি খেয়েছেন। পম্পা সরোবরের কাছে মাতঙ্গ ঋষির আশ্রম, কাছেই ঋষ্যমূক পর্বত, যে পর্বতে কিষ্কিন্ধ্যা থেকে বহিষ্কৃত সুগ্রীব অবস্থান করছিলেন। এই পম্পা সোবর থেকে বর্শা বা ওই ধরনের কোনো তীক্ষ্ণ কিছু দিয়ে রাম ও লক্ষ্মণ মাছ শিকার করেছেন, একথা বাল্মীকি রামায়ণে উল্লেখ আছে–
“পম্পায়ামিমুভিমৎস্যাংস্তত্র রাম বরা হতা।
নিকপক্ষানয়স্তপান্ কৃশানৈক কণ্টকা।”
রান্নাবান্না করতেন লক্ষ্মণ। খাদ্যতালিকায় ভাত যেমন থাকত, তেমনি জ্বলন্ত কাঠের উপর দই ও লবণ দিয়ে ম্যারিনেট করা ঝলসানো মাছও ছিল–
“তব ভক্ত্যা সমযুক্তো লক্ষ্মণঃ সম্প্রদাস্যতি।
ভৃশংতা খাদতো মৎস্যান পম্পায়া পুষ্পসঞ্চয়ে।
…স্থানং প্রপচতাং তত্র দৃষ্টা, নীবারতণ্ডুলা।
পিপ্পলী লবণাভ্যাং চ মৎস্যান সম্পাদপিষ্যথঃ।”
পঞ্চবটি বটে সীতা রাবণকে বলেছেন যে, আমার স্বামী এখনই অনেক বনজাত খাদ্যদ্রব্য, অনেক রুরু মৃগ, গোসাপ, শুয়োর সব মেরে মাংস নিয়ে আসবেন–
“আগমিষ্যতি মে ভর্তা বন্যমাদায় পুষ্কল।
রুরূ বরাহাংশু হত্বাদায়ামিষং বহু।”
এ প্রসঙ্গে বাল্মীকি বলেছেন–
“নিহত্য পৃষতঞ্চান্যং মাংসমাদায় রাঘবঃ।
ত্বরমাণে জনস্থানং সসারাভিমুখং তদা।”
অর্থাৎ রাম হরিণ হত্যা করে সেই মাংস কাঁধে নিয়ে ঘরের দিকে ছুটলেন।
রামায়ণের চরিত্ররা কি গো-মাংস ভক্ষণ করত? অনেকে দাবি করেন স্বয়ং রামচন্দ্রই নাকি গো-মাংস ভক্ষণ করতেন। আসুন দেখি রামায়ণ কি বলে। রামায়ণে সীতা গঙ্গা নদী পার হওয়ার সময় গঙ্গাকে গোরু নিবেদন করার কথা বলেন। বাল্মীকি রামায়ণের অযোধ্যা কাণ্ড (৫২ সর্গ)-এ বলা হয়েছে–“জানকি গঙ্গার মধ্যস্থলে গিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, “গঙ্গে! এই রাজকুমার তোমার কৃপায় নির্বিঘ্নে এই নির্দেশ পূর্ণ করুন। ইনি চতুর্দশ বৎসর অরণ্যে বাস করিয়া পুনরায় আমাদের সহিত প্রত্যাগমন করিবেন। আমি নিরাপদে আসিয়া মনের সাধে তোমার পূজা করিব। তুমি সমুদ্রের ভার্যা, স্বয়ং ব্রহ্মলোক ব্যাপিয়া আছ। দেবী! আমি তোমাকে প্রণাম করি। রাম ভালোয় ভালোয় পৌঁছিলে এবং রাজ্য পাইলে আমি ব্রাহ্মণগণকে দিয়া তোমারই প্রীতির উদ্দেশ্যে তোমাকে অসংখ্য গো ও অশ্ব দান করিব, সহস্র কলস সুরা ও পলান্ন দিব। তোমার তীরে যেসকল দেবতা রহিয়াছেন, তাহাদিগকে এবং তীর্থস্থান ও দেবালয় অর্চনা করিব।” (বাল্মীকি রামায়ণ/অযোধ্যা কাণ্ড/২৫০ সর্গ; অনুবাদক হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য)। না, এই সংলাপে গো-মাংস ভক্ষণের কোনো আভাস পর্যন্ত নেই। গো-দানের উল্লেখই পাচ্ছি।
যমুনা নদী অতিক্রম করার সময় সীতা যমুনাকেও গোরু নিবেদন করার কথা বলেন–“এই বলিয়া রাম সীতাকে অগ্রে লইয়া লক্ষ্মণের সহিত যমুনাভিমুখে চলিলেন এবং ওই বেগবতী নদীর সন্নিহিত হইয়া উহা কি প্রকারে পার হইবেন ভাবিতে লাগিলেন। অনন্তর তাহারা বন হইতে শুষ্ক কাষ্ঠ আহরণ এবং উশীর দ্বারা তাহা বেষ্টন করিয়া ভেলা নির্মাণ করিলেন। মহাবল লক্ষ্মণ জম্বু ও বেতসের শাখা ছেদন পূর্বক জানকীর উপবেশনার্থ আসন প্রস্তুত করিয়া দিলেন। তখন রাম সাক্ষাৎ লক্ষ্মীর ন্যায় অচিন্ত্যপ্রভাবা ঈষৎ লজ্জিতা প্রিয় দয়িতাকে অগ্রে ভেলায় তুলিলেন এবং তাহার পার্শ্বে বসন ভূষণ, খন্ত্রি এবং ছাগচর্ম সংবৃত পেটক রাখিয়া লক্ষ্মণের সহিত স্বয়ং উত্থিত হইলেন এবং সেই ভেলা অবলম্বন করিয়া প্রীতমনে সাবধানে পার হইতে লাগিলেন। জানকি যমুনার মধ্যস্থলে আসিয়া তাহাকে প্রণাম করিয়া কহিলেন, “দেবী আমি তোমায় অতিক্রম করিয়া যাইতেছি, এক্ষণে যদি আমার স্বামী সুমঙ্গলে ব্রত পালন করিয়া অযোধ্যায় প্রত্যাগমন করিতে পারেন, তাহা হইলে সহস্র গো ও শত কলস সুরা দিয়া তোমার পূজা করিব। সীতা কৃতাঞ্জলিপুটে এইরূপ প্রার্থনা করত তরঙ্গবহুলা কালিন্দীর দক্ষিণ তীরে উত্তীর্ণ হইলেন।” (বাল্মীকি রামায়ণ/অযোধ্যা কাণ্ড/৪৯ সর্গ; অনুবাদক হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য) পঞ্চানন তর্করত্নের অনুবাদ করেছেন এভাবে, বলা হয়েছে–“অনন্তর সম্যক জ্ঞানবতী সীতা দেবী সেই যমুনা নদীর। অধ্যদেশে যাইয়া তাহাকে বন্দনা করিলেন। “দেবী! আমি আপনার উপর দিয়া পরপারে যাইতেছি; আপনি আমার মঙ্গল কামনা করুন,–আমার পাতিব্রাত্য ব্রতের রক্ষাকারী হউন। ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজগণ পালিতা অযোধ্যা নগরীতে রাম মঙ্গলে মঙ্গলে ফিরিয়া আসিলে, আমি আপনাকে সহস্র গো ও একশত সুরাপূর্ণ কলসদ্বারা পূজা করিব।” এই বলিয়া তিনি কৃতাঞ্জলিপুটে প্রার্থনা করত দক্ষিণতীরে গিয়া উপস্থিত হইলেন।” (বাল্মীকি রামায়ণ/ অযোধ্যাকণ্ড/ ৫৫ সর্গ; অনুবাদক পঞ্চানন তর্করত্ন)।
এছাড়া রাম যখন ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে গিয়ে উপস্থিত হন তখন ভরদ্বাজ তাঁকে গোরু দ্বারা আপ্যায়ণ করেছিলেন—
“তস্য তদ্বচনং শ্রুত্বা রাজপুত্রস্য ধীমতঃ।
উপিনয়ত ধর্মাত্মা গামৰ্ঘমুদকং ততঃ। ১৭
নানাবিধাননুরসান বন্যমূলফলায়ান। ভেভ্যো দদৌ তপ্ততপা বাসঞ্চৈবাভ্যকল্পয়ৎ। ১৮
মৃগপক্ষিভিরাসীনো মুনিভিশ্চ সমন্ততঃ।
রামমাগতমভ্যচ্চ স্বাগতেনাগতৎ মুনিঃ। ১৯
প্রতিগৃহ্য তু তামর্জাপুবিষ্টং স রাঘবম্।
ভরদ্বাজোহব্ৰবীদ্বাক্যং ধৰ্ম্মযুক্তমিদং তদা। ২০
চিরস্য খলু কাকুৎস্থ পশ্যাম্যহমুপাগতম্।
তং তব ময়া চৈব বিবাসনমকারণম্। ২১”
– অর্থাৎ “মুনি, পক্ষী ও মৃগগণে চতুর্দিকে পরিবৃত হইয়া সমাসীন সেই সতত-তপোনুষ্ঠায়ী ধর্মাত্মা ভরদ্বাজ ঋষি সম্যক পরিজ্ঞাত ধীমান রাজনন্দন রামের কথা শুনিয়া তাহাকে “তুমি তো সুখে আসিয়াছ?” বলিয়া অর্চনা করত অর্ঘ্য উদক ও গো উপঢৌকন দিলেন। পরে তিনি তাহাদিগকে ফলমূলসস্তৃত নানাবিধ ভোজ্য প্রদান করিয়া তাহাদিগের বাসস্থান নিরূপণ করিলেন। পরে রঘুনন্দন রাম সেই সকল দ্রব্য প্রতিগ্রহ করিয়া উপবিষ্ট হইলে, ভরদ্বাজ ঋষি তাহাকে এই ধর্মযুক্ত কথা বলিলেন–“ কাকুৎস! তোমাকে সমাগত দেখিয়া, আমার বহু কালের ইচ্ছা পূর্ণ হইল! তুমি যে অকারণে বিবাসিত হইয়াছ, তাহাও আমি শুনিয়াছি… (বাল্মীকি রামায়ণ/ অযোধ্যা কাণ্ড/ ৫৪ সর্গ; অনুবাদক পঞ্চানন তর্করত্ন)। হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের অনুবাদে আছে–“মহর্ষি ভরদ্বাজ রামের এইরূপ বাক্য শ্রবণ করিয়া তাহাকে স্বাগতপ্রশ্ন পূর্বক অর্ঘ্য, বৃষ, নানাপ্রকার বন্য ফলমূল ও জল প্রদান করিলেন এবং তাহার অবস্থিতির নিমিত্ত স্থান নিরূপণ করিয়া অন্যান্য মুনিগণের সহিত তাহাকে বেষ্টনপূর্বক উপবিষ্ট হইলেন।” রাজশেখর বসু এই অংশের অনুবাদে লিখেছেন–“কিছুদূর যাওয়ার পর তাঁরা ভরদ্বাজ ঋষির আশ্রমে উপস্থিত হলেন। শিষ্য পরিবৃত ভরদ্বাজকে প্রণাম করে রাম নিজের পরিচয় দিলেন। ভরদ্বাজ তাঁদের স্বাগত জানিয়ে অর্ঘ্য, বৃষ, জল ও বন্য ফলমূল প্রভৃতি আহার্য দিয়ে বললেন–কাকুৎস, বহুদিন পরে তোমাকে এখানে দেখছি। তোমার নির্বাসনের কারণ আমি শুনেছি। দুই মহানদীর এই সঙ্গমস্থান অতি নির্জন, পবিত্র ও রমণীয় তুমি এখানে সুখে বাস কর।”
রাজশেখর বসুর এই অনুবাদে আমরা বৃষকে (ষাঁড়) আহার্য হিসাবে পাচ্ছি, যা রামচন্দ্র ও তাঁর সঙ্গীদের ভক্ষণের জন্য প্রদান করছেন ভরদ্বাজ ঋষি। তবে প্রাচীন যুগে গোরুকে মূল্যবান সম্পদ হিসাবে দেখা হত, বলা হত ‘গো-ধন’। যাঁর গোরু যত সংখ্যক, সে তত ধনবান বলে মনে করা হত। গোরু চুরি এবং গোরু চুরিকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ পর্যন্ত বেধে যেত। সম্পদ হিসাবে গো-দানকে শ্রেষ্ঠ দান বলে মনে করা হত। তাই কোনো শুভ কাজে ব্রাহ্মণদের রাজারা প্রচুর গো-দান করত আনুষ্ঠানিকভাবে এই কাজকে পুণ্যকাজ বলে মনে করা হত। কিছুদিন আগে পর্যন্ত শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে ব্রাহ্মণদের স্ববৎস গো-দানের রীতি প্রচলন ছিল।
প্রাচীন যুগে গো-দানের মতো গো-মাংস ভক্ষণেরও রীতি ছিল। বেদের যুগ থেকে গো-মাংস ভক্ষণের সূত্র পাওয়া যায়। বেদ-পরবর্তী রামায়ণ যুগে গো-মাংস নিষিদ্ধ হয়েছিল, এমন কোনো সূত্র পাওয়া যায় না। রামায়ণ-পরবর্তী মহাভারত যুগে মহাভারতের নানাস্থানেই গো-হত্যা ও গো-মাংস ভক্ষণের কথা পাওয়া যায়। রন্তিদেবের ভোজনশালায় রন্তিদেব নামে এক ধার্মিক রাজার কথা বারবার মহাভারতে উল্লেখ আছে। তিনি প্রচুর পশু হত্যা করে মানুষদের খাওয়াতেন। আশ্চর্যজনকভাবে সেই পশুগুলোর মধ্যে প্রচুর গোরুও ছিল। আর সেই গো-মাংস খাওয়ার জন্য মানুষের লাইন পড়ে যেত। পাঁচকেরা তখন বাধ্য হয়ে বলতেন বেশি করে ঝোল নিতে, কারণ খুব বেশি মাংস নেই।
কালিপ্রসন্নের মহাভারতের বনপর্বের ২০৭ তম অধ্যায়ে বলা হয়েছে–“পূর্বে মহারাজ রন্তিদেবের মহানসে প্রত্যহ দুই সহস্র পশু হত্যা করিয়া প্রতিদিন অতিথি ও অন্যান্য জনগণকে সমাংস অন্নদানপূর্বক লোকে অতুল কীর্তি লাভ করিয়াছেন।” কালিপ্রসন্নের মহাভারতের দ্রোণ পর্বের ৬৭ তম অধ্যায়ে বলা হয়েছে–“নারদ কহিলেন, হে সৃঞ্জয়! সংস্কৃতিনন্দন মহাত্মা রন্তিদেবকেও শমনসদনে গমন করিতে হইয়াছে। ঐ মাহাত্মার ভবনে দুইলক্ষ পাঁচক সমাগত অতিথি ব্রাহ্মণগণকে দিবারাত্র পক্ক ও অপক্ক খাদ্যদ্রব্য পরিবেশন করিত। মহাত্মা রন্তিদেব ন্যায়োপার্জিত অপৰ্য্যাপ্ত ধন ব্রাহ্মণগণকে প্রদান করিয়াছিলেন। তিনি বেদাধ্যয়ণ করিয়া ধর্মানুসারে শত্রুগণকে বশীভূত করেন। ঐ মহাত্মার যজ্ঞসময়ে পশুগণ স্বর্গলাভেচ্ছায় স্বয়ং যজ্ঞস্থলে আগমন করিত। তাহার অগ্নিহোত্র যজ্ঞে এত পশু বিনষ্ট হইয়াছিল যে, তাহাদের চর্মরস মহানস হইতে বিনির্গত হইয়া এক মহানদী প্রস্তুত হইল। ঐ নদী চর্মনবতী নামে অদ্যপি বিখ্যাত রহিয়াছে।” এরপরে বলা হয়েছে–“সংস্কৃতিনন্দনের ভবনে (রন্তিদেবের) এত অধিক অতিথি সমাগত হইত যে মণিকুণ্ডলধারী সুদগণ একবিংশতিসহস্র বলীর্দের মাংস পাক করিয়াও অতিথিগণকে কহিত, অদ্য তোমরা অধিক পরিমাণে সুপ ভক্ষণ করো, আজি অন্যদিনের ন্যায় অপর্যাপ্ত মাংস নাই।” (দ্রোণপর্ব/৬৭) মহাভারতের অনেক জায়গাতে গো-মেধ যজ্ঞের কথা বলা আছে–(১) “এই পৃথিবীতে যে সমস্ত তীর্থ আছে, নৈমিষেও সেই সকল তীর্থ বিদ্যমান রহিয়াছে। তথায় সংযত ও নিয়তাসন হইয়া স্নান করিলে গো-মেধ যজ্ঞের ফলপ্রাপ্তি ও সপ্তম কুল পর্যন্ত পবিত্র হয়।” (বনপর্ব/৮৪) (২) “মনুষ্যের বহুপুত্র কামনা করা কর্তব্য; কারণ তাহাঁদিগের মধ্যে কেহ যদি গয়ায় গমন, অশ্বমেধ যজ্ঞানুষ্ঠান অথবা নীলকায় বৃষ উৎসর্গ করে, তাহা হইলে বাঞ্ছিত ফল লাভ হয়।” (বনপর্ব/ ৮৪) (৩) “তৎপরে তত্রস্থ শ্রান্তিশোক বিনাশন মহর্ষি মতঙ্গের আশ্রমে প্রবেশ করিলে গো-মেধযজ্ঞের ফল লাভ হয়।” [বন/৮৪]।
মহাভারতে শ্রাদ্ধেও গো-মাংস দেওয়ার কথা বলা আছে–“শ্রাদ্ধকালে যে সমস্ত ভোজ্য প্রদান করা যায়, তন্মধ্যে তিলই সর্বপ্রধান। শ্রদ্ধে মৎস্য প্রদান করিলে পিতৃগণের দুই মাস, মেষমাংস প্রদান করিলে তিন মাস, ও শশ মাংস প্রদান করিলে চারি মাস, অজমাংস প্রদান করিলে পাঁচ মাস, বরাহ মাংস প্রদান করিলে ছয় মাস, পক্ষীর মাংস প্রদান করিলে সাত মাস, পৃষৎ নামক মৃগের মাংস প্রদান করিলে আট মাস, রুরু মৃগের মাংস প্রদান করিলে নয় মাস, গবয়ের মাংস প্রদান করিলে দশমাস, মহিষ মাংস প্রদান করিলে একাদশ মাস এবং গো-মাংস প্রদান করিলে এক বৎসর তৃপ্তি লাভ হইয়া থাকে। ঘৃত পায়স গো-মাংসের ন্যায় পিতৃগণের প্রীতিকর; অতএব শ্রাদ্ধে ঘৃতপায়েস প্রদান করা অবশ্য কর্তব্য। …” (অনুশাসন/ ৮৮)
রাজশেখর বসুর মহাভারতের সারানুবাদেও গো-মাংসের উল্লেখ মেলে। রাজশেখরের সারানুবাদে (সভাপর্ব/২) আছে, দেবর্ষি নারদ পারিজাত, রৈবত, সুমুখ ও সৌম্য এই চারজন ঋষির সাথে পাণ্ডবদের সভায় উপস্থিত হলে যুধিষ্ঠির তাদের গো-মধুপর্ক দিয়ে আপ্যায়ণ করেন–“একদিন দেবর্ষি নারদ পারিজাত, রৈবত, সুমুখ ও সৌম্য এই চারজন ঋষির সাথে পাণ্ডবদের সভায় উপস্থিত হলেন। যুধিষ্ঠির যথাবিধি অর্ঘ্য, গো-মধুপর্ক ও রত্নাদি দিয়ে সংবর্ধনা করলে নারদ প্রশ্নচ্ছলে ধর্ম, কাম ও অর্থ বিষয়ক এই প্রকার বহু উপদেশ দিলেন–মহারাজ, তুমি অর্থচিন্তার সাথে ধর্মচিন্তাও কর তো? কাল বিভাগ করে সমভাবে ধর্ম, অর্থ ও কামের সেবা করো তো?”
বিষ্ণুপুরাণের তৃতীয় অংশের ১৬ তম অধ্যায়ে আছে—
“ঔৰ্ব্ব উবাচ। “হবিষ্যমৎস্যমাংসৈস্তু শশস্য শকুনস্য চ।
শৌকরচ্ছাগলৈরৈণৈ-রৌরবৈর্গবয়েন চ।১
ঔরভ্রগব্যৈশ্চ তথা মাংসবৃদ্ধ্যা পিতামহাঃ।/প্রয়ন্তিতৃপ্তিং মাংসৈস্তু নিত্যং বার্ধণসামিষৈঃ।২
খামাংসমতিবাত্র কালশাকং তথা মধু।/শস্তানি কৰ্ম্মণ্যত্যন্ততৃপ্তিদানি নরেশ্বর। ৩”
অর্থাৎ, ঔৰ্ব্ব কহিলেন, শ্রাদ্ধের সময় ব্রাহ্মণদিগকে হবিষ্য করাইলে পিতৃগণ একমাস পরিতৃপ্ত থাকেন, মৎস্য দিলে দুইমাস, শশমাংস দিলে তিনমাস, পক্ষী মাংস দিলে চারি মাস, শূকর মাংস দিলে পাঁচ মাস, ছাগমাংস দিলে ছয়মাস, এণ নামক হরিণ মাংস দিলে সাত মাস, রুরুমৃগমাংস দিলে আট মাস, গবয় মাংস দিলে নয় মাস, মেষ মাংস দিলে দশ মাস, গোমাংস দিলে এগারো মাস পিতৃগণ পরিতৃপ্ত থাকেন। পরন্তু যদি বার্ধীণস মাংস দেওয়া যায়, তাহা হইলে পিতৃলোকের তৃপ্তির আর শেষ নাই। রাজন! গণ্ডারের মাংস, কৃষ্ণশাক ও মধু এই সমস্ত দ্রব্য শ্রাদ্ধ কর্মে অত্যন্ত প্রশস্ত ও যারপরনাই তৃপ্তিদায়ক। ( শ্রীবরদাপ্রসাদ বসাক কর্তৃক প্রকাশিত) এই অংশের টীকায় যা বলেছেন অনুবাদক, তা বেশ আগ্রহোদ্দীপক–“গব্য শব্দ থাকাতে কেহ কেহ গো-মাংস না-বলিয়া পায়স অর্থ করেন। এ অর্থ অযৌক্তিক, কারণ পায়স বা দুগ্ধ কখনো মাংস মধ্যে পরিগণিত হইতে পারে না। বিশেষত যখন গবয় মাংস, শূকর মাংস ভক্ষণ করিয়া পরিতৃপ্ত হইতেছেন, তখন গোমাংস ভক্ষণে বাঁধা কী? ফলত কলির পূর্বে গো-মাংস ভক্ষণ প্রচলিত ছিল। মহাভারতে ষোড়শ রাজিক স্থলে কথিত আছে, রন্তিদেব প্রতিদিন দুই সহস্র গো হত্যা করিয়া তাহার মাংস ব্রাহ্মণদিগকে ভোজন করাইতেন। বশিষ্ঠ বাল্মীকির আশ্রমে গমন করিলে তাঁহাকে একটি বৎসতরী ভোজনার্থ দেওয়া হয়। জনমেজয়ও বেদব্যাসকে একটি বৎস ভোজনার্থ দিয়াছিলেন, বেদব্যাস দয়া করিয়া তাহাকে ছাড়িয়া দিলেন। এরূপ গোমাংস ভক্ষণের অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়।” পণ্ডিতপ্রবর শ্রীযুক্ত পঞ্চানন তর্করত্ন কর্তৃক সম্পাদিত বিষ্ণুপুরাণের অনুবাদ করে লিখেছে–“ ঔৰ্ব্ব কহিলেন, শ্রাদ্ধের দিনে ব্রাহ্মণদিগকে হবিষ্য করাইলে, পিতৃগণ একমাস পর্যন্ত পরিতৃপ্ত থাকেন, মৎস্য প্রদানে দুইমাস, শশক মাংস প্রদানে তিন মাস, পক্ষী মাংস প্রদানে চারিমা, শূকর মাংস প্রদানে পাঁচ মাস, ছাগ মাংস প্রদানে ছয় মাস, এণ মাংস দিলে সাত মাস, রুরুমৃগমাংস প্রদান করিলে আট মাস, গবয় মাংস প্রদানে নয় মাস, মেষমাংস প্রদানে দশ মাস, গো-মাংস প্রদান করিলে এগার মাস পর্যন্ত পিতৃগণ পরিতৃপ্ত থাকেন। পরন্তু যদি বাণস মাংস দেওয়া যায়, তাহা হইলে পিতৃলোক চিরদিন তৃপ্ত থাকেন। হে রাজন! গণ্ডারের মাংস, কৃষ্ণশাক ও মধু এই সমুদায় দ্রব্য শ্রাদ্ধকর্মে অত্যন্ত প্রশস্ত ও অত্যন্ত তৃপ্তিদায়ক।” (শ্রীনটবর চক্রবর্তী দ্বারা মুদ্রিত ও প্রকাশিত) শ্রী রাম সেবক বিদ্যারত্ন বিষ্ণু পুরাণের আলোচ্য অংশের অনুবাদে লিখেছেন–“হে মহারাজ! যে যে মাংস দ্বারা পিতৃগণের তৃপ্তি লাভ হয়, তাহা আপনার নিকট কীর্তন করিতেছি শ্রবণ করুন। শশক, শকুল, বন্য শূকর, ছাগ, হরিণ, রুরু নামক মৃগ, গবয়, মেষ, গো, বার্ধণস ও গণ্ডারদিগের মাংস পিতৃগণের অতিশয় প্রীতিকর।”
রাজশেখর বসুর মহাভারতের সারানুবাদে (উদ্যোগ পর্ব/৮) আছে প্রহ্লাদ সুধম্বাকে গো-মাংস দিয়ে সংবর্ধনা করতে চেয়েছিলেন। সেখানে বলা হয়েছে–“… দুজনে প্রহ্লাদের কাছে উপস্থিত হলেন। প্রহ্লাদ বললেন তোমরা পূর্বে কখনো একসঙ্গে চলতে না, এখন কি তোমাদের সখ্য হয়েছে? বিরোচন বললেন, পিতা সখ্য হয়নি, আমরা জীবন পণ রেখে তর্কের মীমাংসার জন্য আপনার কাছে এসেছি। সুধম্বার সংবর্ধনার জন্য প্রহ্লাদ পাদ্য জল, মধুপর্ক ও দুই স্কুল শ্বেত বৃষ আনতে বললেন। সুধম্বা বললেন, ওসব থাকুক, আপনি আমার প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিন–ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ না বিরোচন শ্রেষ্ঠ? “
মহাভারত অনুসারে, যোগবলে যাঁরা বিশুদ্ধচিত্ত লাভ করেছেন তাঁরা গো-হত্যা করলে কোনো পাপ হয় না–“যাহারা যোগবলে এইরূপ বিশুদ্ধচিত্ত হইয়াছেন, তাহারা যোগবলে গো-হত্যা করিলেও করিতে পারেন। কারণ তাহাদিগকে গো-বধজনিত পাপে লিপ্ত হইতে হয় না।” (শান্তিপর্ব/২৬৩) নহুষের গো-বধ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে–“রাজপুরোহিত, স্নাতক ব্রাহ্মণ, গুরু ও শ্বশুর এক বৎসর গৃহে বাস করিলেও মধুপর্ক দ্বারা তাহাদিগের পূজা করা কর্তব্য”। (অনুশাসন/৯৭) প্রাচীনকালে অতিথিদের মধুপর্ক দ্বারা আপ্যায়ণ করার বিধান ছিল। মধুপর্কে গো-মাংসের প্রয়োজন হত। মহাভারতে মধুপর্কের জন্য নহুষের গো-বধ করার কথা পাওয়া যায়। তবে নহুষের সময়ের ঋষিরা নহুষের এই কর্মের বিরোধিতাও করেন–“পূর্বে মহারাজ নহুষ মধুপর্ক দান সময়ে গো-বধ করাতে মহাত্মা তত্ত্বদর্শী ঋষিগণ তাহারে কহিয়াছিলেন, মহারাজ তুমি মাতৃতুল্য গাভী ও প্রজাপতিতুল্য বৃষকে নষ্ট করিয়া যাহার পর নাই গর্হিত কার্যের অনুষ্ঠান করিয়াছ; অতএব তোমার যজ্ঞে হোম করিতে আমাদের প্রবৃত্তি নাই, তোমার নিমিত্ত আমরা অতিশয় ব্যথিত হইলাম।” (শান্তিপর্ব/২৬২)
শান্তিপর্বের ২৬৮ তম অধ্যায়েও নহুষের গোবধের কথা পাওয়া যায়। এখানে নহুষ গোহত্যা করতে গেলে কপিল ঋষি তাঁর বিরোধ করেন। তা নিয়ে স্মরশ্মি ঋষি ও কপিল ঋষির মধ্যে এক দীর্ঘ তর্কের সূচনা হয়–“একদা মহর্ষি তৃষ্টা নরপতি নহুষের গৃহে আতিথ্য স্বীকার করিলে তিনি শাশ্বত বেদ বিধানানুসারে তাহারে মধুপর্ক প্রদানার্থ গো-বধ করিতে উদ্যত হইয়াছেন, এমন সময়ে জ্ঞানবান সংযমী মহাত্মা কপিল যদৃচ্ছাক্রমে তথায় সমাগত হইয়া নহুষকে গো-বধে উদ্যত দেখিয়া স্বীয় শুভকরি নৈষ্ঠিক বুদ্ধিপ্রভাবে, “হা বেদ!” এই শব্দ উচ্চারণ করিলেন। ঐ সময় স্মরশ্মি নামে এক মহর্ষি স্বীয় যোগবলে সেই গো-দেহে প্রবিষ্ট হইয়া কপিলকে সম্বোধনপূর্বক কহিলেন, “মহর্ষে! আপনি বেদবিহিত হিংসা অবলোকন করিয়া বেদে অবজ্ঞা প্রদর্শন করিলেন, কিন্তু আপনি যে হিংসাশূন্য ধর্ম অবলম্বন করিয়া রহিয়াছেন, উহা কি বেদবিহিত নহে? ধৈর্যশালী বিজ্ঞানসম্পন্ন তপস্বীরা সমুদায় বেদকেই পরমেশ্বরের বাক্য বলিয়া কীর্তন করিয়াছেন। পরমেশ্বরের কোনো বিষয়েই অনুরাগ, বিরাগ বা স্পৃহা নাই। সুতরাং কী কর্মকাণ্ড, কী জ্ঞানকাণ্ড তাহার নিকট উভয়ই তুল্য। অতএব কোনো বেদই অপ্রমাণ হইতে পারে না।” স্মরশ্মির কথার প্রত্যুত্তরে কপিল বলেন–“আমি বেদের নিন্দা করিতেছি না এবং কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড এই উভয়বিধ বেদের তারতম্য নির্দেশ করাও আমার অভিপ্রেত নহে। কী সন্ন্যাস, কী বানপ্রস্থ, কী গার্হস্থ, কী ব্রহ্মচর্য লোকে যে ধর্ম অনুসারে কার্য করুন না-কেন, পরিণামে অবশ্যই তাহার গতিলাভ হইয়া থাকে। সন্ন্যাসাদি চারিপ্রকার আশ্রমবাসীদিগের চারি প্রকার গতি নির্দিষ্ট আছে। তন্মধ্যে সন্ন্যাসী মোক্ষ, বানপ্রস্থ ব্ৰহ্মলোক, গৃহস্থ স্বর্গলোক এবং ব্রহ্মচারী ঋষিলোক লাভ করিয়া থাকেন। বেদেকার্য আরম্ভ করা ও না-করা উভয়েরই বিধি আছে। ঐ বিধি দ্বারা কার্যের আরম্ভ ও অনারম্ভ উভয়ই দোষাবহ বলিয়া প্রতিপন্ন হইতেছে। সুতরাং বেদানুসারে কার্যের বলাবল নির্ণয় করা নিতান্ত দুঃসাধ্য। অতএব যদি তুমি বেদশাস্ত্র ভিন্ন যুক্তি বা অনুমান দ্বারা অহিংসা অপেক্ষা কোনো উৎকৃষ্ট ধর্ম স্থির করিয়া থাক, তাহা কীর্তন করো।”
তবে ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বীরা একটা সময় গো-মাংস খাওয়া ত্যাগ করেছিল, সেটারও উল্লেখ পাই মহাভারতে।
উল্লেখ আছে–“পূর্বকালে মহাত্মা রন্তিদেব স্বীয় যজ্ঞে গোসমুদায়কে পশু রূপে কল্পিত করিয়া ছেদন করাতে উহাদিগের চর্মরসে চর্মণবতী নদী প্রবর্তিত হইয়াছে। এক্ষণে উহারা আর যজ্ঞীয় পশুত্বে কল্পিত হয় না। উহারা এক্ষণে দানের বিষয় হইয়াছে।” (অনুশাসন/৬৬)।
রামায়ণের মুনিঋষিরাও ব্যাপক মাংস পছন্দ করতেন এবং ভক্ষণ করতেন। মৃত্যুশয্যায় কিষ্কিন্ধ্যার রাজা বালী রামকে বলেছেন–আমাকে মেরে তোমার কী লাভ হল? আমার মাংস তোমার খাওয়া চলবে না। কারণ ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা একযোগে যে পাঁচনখওয়ালা প্রাণীর মাংসগুলি খায়–তা হল শজারু, গোসাপ, খরগোস আর কচ্ছপের মাংস (“পঞ্চ পঞ্চখা ভক্ষ্যা ব্ৰহ্মক্ষত্রেণ রাঘব।/শল্যকঃ শ্বাবিধো গোধা শশঃ কূর্মশ্চ পঞ্চম্।”)। বনবাসের তৃতীয় দিনে সারথি সুমন্ত্র ও বন্ধু গুহককে বিদায় দিয়ে অরণ্যের গভীরে প্রবেশ করে হরিণ, শুয়োর মেরে নিলেন–
“তৌ তত্র হত্বা চতুরো মহামৃগান্ বরাহমৃষ্যং পৃষং মহাররুম।”
রাম মদও খেতেন। বাল্মীকি তাই-ই বলছেন। লঙ্কার অশোকবনে সীতাকে রামের খবর দিয়ে হনুমান বলছেন–
“ন মাংসং রাঘববা ভুঙক্তে ন চৈবং মধু সেবতে।”
সীতা নেই মদ খাওয়াও নেই। অর্থাৎ সীতা যখন কাছে ছিলেন তখন মদ-মাংস দুইই চলত। রামই শুধু নয়–সীতা, কৌশল্যা, কৈকেয়ী সকলেরই মদ্যপানের অভ্যেস ছিল। রামায়ণে বাল্মীকি অন্যান্য সম্প্রদায়ের খাদ্যাভাস কী ছিল, সেটাও বর্ণনা করেছেন।
রাক্ষসদের খাদ্য (লঙ্কার বাসিন্দা) : গন্ডারের মাংস, গিরগিটি, হরিণের মাংস, ময়ূরের মাংস, কুকুটের মাংস, ছাগলের মাংস, শুয়োরের মাংস, খরগোশ, মাছ, মহিষের মাংস, মদ, ভাত, রক্ত ইত্যাদি। পাঠক লক্ষ করুন, রাক্ষসদের খাদ্যতালিকায় যেসব খাদ্য রামায়ণের কবি উল্লেখ করেছেন, তা তো মানুষেরই খাদ্য। মানুষ তো সাপ, ব্যাঙ, আরশোলা, মুরগি তিমি, হাঙর, কচ্ছপ, শুয়োর সব খায়। তাহলে রাক্ষস কী অপরাধ করল! রাক্ষসরা তো মানুষই।
আর্যসমাজের খাদ্য : তণ্ডুল সিদ্ধ বা ভাত, সঙ্গে নানাবিধ ব্যঞ্জন, যব, গম, মিষ্টি, হরিণ, ময়ূর, শর্করা, আখের রস, মধু, মদ, দই, দুধ, ডাল, চণক বা ছোলা, কুলখ বা কলাই, কৃশর বা খিচুড়ি, পিষ্টক বা পিঠা, ভোজ্যতেল, সুগন্ধি তেল, সৌরের মদ, সৌরীক মদ, সুরা ইত্যাদি। রাম-লক্ষ্মণরা মৃগয়া থেকে প্রাপ্ত শুয়োর, ঋষ্য বা কৃষ্ণসার হরিণ, পৃষৎ, গন্ডার, শল্যকী বা শজারু, গোধা বা গোসাপ, খরগোশ, কচ্ছপ, মহারুরু ও পাখির মাংস খাওয়ার প্রচলন ছিল।”পঞ্চ পঞ্চক্ষা ভক্ষ্যা ব্ৰহ্মক্ষত্রেণ রাঘবা/শল্যকঃ শ্বাবিধো গোধা শশ কূৰ্মশ্চ পঞ্চম৷”–এই পাঁচটি ছাড়া অন্য পঞ্চনখ বিশিষ্ট প্রাণী অভক্ষ্য ছিল। ছাগলের মাংস, পায়েস, খিচুড়ি যজ্ঞ ছাড়া নিষিদ্ধ, অভক্ষ্য–“পায়সং কৃশরং ছাগং বৃথা সোহশ্নাতু নির্ঘণঃ।” হুইলার প্রমুখ সাহেবরা রামায়ণের যুগে যে গো-মাংস ভক্ষণের ব্যবস্থা ছিল, একথা উল্লেখ করতে দ্বিধা করেননি।
বানরদের খাদ্য : মধু, ফলমূল, নিবার ধানের কাঞ্জিক, মদ, পশুপক্ষীর মাংস ইত্যাদি।
মুনিঋষিদের খাদ্য : বিশ্ব বা বেল, কপিঙ্খ বা কয়েতবেল, পনস বা কাঁঠাল, বীজপুরক, আমলকী, আম, কন্দমূল, মেষ, হবিষ্যান্ন, মাংস ইত্যাদি।
রামায়ণে বিমানের ব্যবহার
রামায়ণের যুগে কি বিমানের ব্যবহার ছিল? বাল্মীকির রামায়ণের কিন্তু বহু জায়গায় বিমানের উল্লেখ আছে। ২৪,০০০ শ্লোকে লেখা রামায়ণ দেবতাদের মহাকাশ পরিক্রমা বিবরণে সমৃদ্ধ। রামায়ণে এমন একটি আশ্চর্যজনক রথের উল্লেখ আছে, তা পাঠ করে মনে হয় রথ এক মহাকাশযান। সেই রথ আকাশে বিচরণ। করছে একসঙ্গে অনেকগুলো লোক নিয়ে। সেই যানের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে ‘উড়ন্ত পিরামিড’ বলে, যা উল্লম্বভাবে আকাশে উঠত। নিঃসন্দেহে মাটি ছেড়ে আকাশে ওঠার সময় সেই যান বিকট শব্দ করত। বাল্মীকি রামায়ণের বর্ণনায়–“প্রভাত উদয়ে রামচন্দ্র সেই স্বর্গীয় বিমানে আরোহণ করিলেন। যানের অসীম শক্তি। বিমানটি দ্বিতল, তাহাতে বহু বিভাগ এবং অসংখ্য গবাক্ষ ছিল। … বিমানটি সুশোভিত এবং শক্তিশালী ছিল। … তাহা যখন আকাশমার্গে গমন করিল, তখন তাহা হইতে স্বর্গীয় শব্দ প্রকাশিত হইতে লাগিল।” সংস্কৃত ভাষায় রচিত ‘সমরাঙ্গনসূত্রধার’ নামে এই প্রাচীন গ্রন্থটি বিমান নিয়ে লিখেছে–“দেহটি যেন বেশ শক্তসামর্থ্য, টেকসই এবং যথেষ্ট স্বল্পভার বস্তু দিয়ে গঠিত হয়। … পারদে যে শক্তি সুপ্ত রয়েছে, তাকে জাগিয়েই মানুষ দূর-দূরান্তের আকাশ পাড়ি দিতে পারে। পারদই বিমানের চালিকাশক্তি। চেষ্টা করলে দেবমন্দিরের মতো বিশাল বিমানও গঠন করা সম্ভব। বিমানের মধ্যে পারদের চারটি আধার থাকবে। তারপর লৌহের আধার থেকে নিয়ন্ত্রিত অগ্নিসংযোগে পারদ থেকে বিদ্যুৎশক্তি লাভ করে বিমান যখন ঊধ্বাকাশে উঠে যাবে, তখন তাকে দেখলে মনে হবে যেন একটি উজ্জ্বল মুক্তাবিন্দু।”
রামায়ণে কোথাও উড্ডীন যন্ত্র, কোথাও স্বর্গীয় যান বা কোথাও দেবযান বলে উল্লেখ আছে। অরণ্যকাণ্ডে বলা হয়েছে, দুবৃত্ত রাবণ ঠিক কেমন করে সূর্য সদৃশ বিমানে মনোরমা সীতাকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল। সেই বিমান উড়ল উপত্যকা, বন-উপবন, পাহাড়-পর্বত অতিক্রম করে। বানররাজ হনুমান ছিলেন ব্যোমযান চালক হিসাবে অসমসাহসী। বাল্মীকির বয়ানে রামায়ণ বলছে–“তিনি যখন পর্বত শীর্ষ হইতে ব্যোমযান চালনা করেন, তখন পর্বতশীর্ষ ভাঙিয়া পড়ে, তাহার ভিত্তি কম্পিত হইতে থাকে, সুবিশাল তরুশ্রেণি শাখাপ্রশাখাহীন হইয়া ভাঙিয়া পড়ে, শাখা-প্রশাখা-কাণ্ড-পত্রের বৃষ্টি ঝরিতে থাকে, পর্বতের পক্ষিকুল এবং জীবজন্তু তাহাদের গুপ্ত আশ্রয়ে পলাইয়া যায়।”
আর্য, অনার্য, রাক্ষস, বানর, হনুমান সকলেই বিমানের ব্যবহার করেছেন বলে জানা যাচ্ছে বাল্মীকির রামায়ণে। বাল্মীকির রামায়ণে কুম্ভকর্ণ, রাবণ, ইন্দ্রজিৎ প্রমুখরা বিমানে চড়ে যুদ্ধ করেছেন বলে জানা যায়। ইন্দ্রজিতের সঙ্গে লক্ষ্মণের যুদ্ধ উভয় উভয়ের বিমান থেকেই হয়েছে। ইন্দ্রজিতের অন্য নাম মেঘনাদ। তার কারণ তিনি মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ করতে পারতেন। মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ করা সম্ভব একমাত্র বিমানে চড়লেই–বিমান কখনো মেঘের নীচে, কখনো মেঘের নীচে, এ তো হয়েই থাকে। রাবণও রামের (মতান্তরে ইন্দ্রের সঙ্গে) সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন বিমানে চড়েই। হনুমান লঙ্কায় অশোকবনে সীতার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে অপদস্থ হয়ে ফেরার সময় বিমানে চড়ে রামশিবিরে ফেরেন বলে জানা যায়। বাল্মীকির রামায়ণ থেকে আরও জানা যায়, তাড়কার সঙ্গে যুদ্ধের সময় আর্যদেবতারা তাঁদের ‘উড়ন্ত রথে চেপে সমরাঙ্গনের উপর চক্কর দিচ্ছিলেন। আকাশপথ থেকে তাঁরাও তাড়কাসৈন্যদের হত্যা করেছেন। দণ্ডকারণ্যে অগ্নিদাহনের সময়ও উড়ন্ত অবস্থায় ইন্দ্র নাগকুল নিকেষ করেছিলেন। মরু ও গন্ধর্বরাও আকাশপথ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র নিক্ষেপ করতেন। মরুরা তো জলে-স্থলে-আকাশে বিচরণশালী দুর্ধর্ষ যোদ্ধারূপেই প্রাচীন যুগে প্রসিদ্ধি লাভ করে। বিষ্ণুরও আকাশযান বা বিমান ছিল, তাঁর বিমানচালক গরুড়। বাল্মীকির রামায়ণে বিরাধ-যানেরও উল্লেখ আছে, যে যানের চালক গন্ধর্বজাতি তুম্বুরু। ‘উড়ন্ত যান’ পরশুরামেরও ছিল, যে যান ‘প্রচুর হাওয়া ছুটিয়ে গাছের ডালপালা ভেঙে মেঘগর্জনের গম্ভীর শব্দ তুলে’ অবতরণ করেছিল।
ভোজরাজ রচিত ‘সমরাঙ্গনসূত্ৰধার’ গ্রন্থের যন্ত্রবিধান অধ্যায়ে ‘ব্যোমচারী বিহঙ্গযন্ত্র’, ‘আকাশগামী দারুময় বিমানযন্ত্র’-এর উল্লেখ আছে। তবে রামায়ণে পুষ্পক রথ ও মহাভারতে অপূর্ব নানা যন্ত্রের বর্ণনা থাকলেও তাতে ততটা বাস্তবসম্মত বর্ণনা নেই, যা এখানে আছে। এখানে পারদ ব্যবহার করে বিমান চালানোর কথা বলা হয়েছে। এই গ্রন্থে আকাশযানের বিবরণে শূন্যমার্গে যন্ত্রচালনার সমস্যা, শূন্যে অবস্থান এমনভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, তখনকার দিনে শিক্ষাদান পদ্ধতি হাতেকলমে হত বোঝা যায়। ভরদ্বাজ ঋষির বিমানশাস্ত্রের উপর একটি পুরো গ্রন্থই রচনা করে রেখেছেন। গ্রন্থটির নাম ‘বৈমানিকশাস্ত্রম্’। এই গ্রন্থটি থেকে বেশ কিছু পৌরাণিক বিমানের কারিগরি সংবাদ পাওয়া যায়। বিমানের সংজ্ঞা দিয়ে ভরদ্বাজ বলেছেন–
“পৃথিব্যপস্বন্তরীক্ষে খগবদ্বেগত স্বয়ম্।
যসসমর্থো ভবদ্বম্ভং স বিমান ইতি মৃতঃ।”
অর্থাৎ যা আপন শক্তিতে পাখির মতো জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে বিচরণ করতে পারে তারই নাম বিমান। বিমানকে শূন্যপথে একই জায়গায় স্থির করে রাখার কৌশলের নাম–“বিমানস্তম্ভনক্রিয়ারহস্যম”। এরকম বেশ কিছু সংস্কৃত ভাষায় গ্রন্থ পাওয়া যায়, যেখানে বিমান বিষয়ক আলোচনা করা হয়েছে।
রামায়ণের যেরূপ যুদ্ধের বর্ণনা পাওয়া যায়, তা স্থলযুদ্ধ ছাড়াও বৈমানিক যুদ্ধেরও পরিচয় পাওয়া যায়। রামায়ণে উল্লেখ আছে–“ওই সময় দেবতা, গন্ধর্ব, সিদ্ধ ও চারণগণ তথায় বিমানে আরোহণপূর্বক অবস্থান করিতেছিলেন।” আর্যদেবতারা তাঁদের বিমান থেকে কী ধরনের অস্ত্র নিক্ষেপ করে খরের সেনাবাহিনী ধ্বংস করেছিলেন, সেকথা স্পষ্টতই রামায়ণে উল্লেখ আছে। খরের কাছেও বিমানযুদ্ধ মোকাবিলা করার মতো অস্ত্র যে ছিল, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। খর অবিচলিতভাবে আকাশপথের আর্যদেবতাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে করতে পঞ্চবটিতে প্রবেশ করেছেন এবং শেষপর্যন্ত রামশিবির আক্রমণ করতে সমর্থ হয়েছেন। যদিও শেষরক্ষা তিনি করতে পারেননি। সীতা অপহরণের সময় জটায়ুও রাবণের সঙ্গে বিমানে চেপে যুদ্ধ করেছিলেন। জটায়ুর ভগ্ন আকাশযানটি রাবণের সঙ্গে আকাশযুদ্ধের সাক্ষ্যস্বরূপ তখনও পড়ে ছিল। উল্লেখ্য, জটায়ু কোনো পাখিবিশেষ নয়। জটায়ু সম্পূর্ণভাবে মানুষ। তিনি আর্যদেবতা অরুণের ঔরসে স্যেনী বা মহাশ্বেতা নামক নারীর গর্ভজাত। জটায়ুর বড় ভাই সম্পাতি, ইনিও দক্ষ বিমানচালক ছিলেন। প্রসঙ্গত। উল্লেখ্য, জটায়ু অযোধ্যার রাজা দশরথের বিশ্বস্ত বন্ধু ছিলেন।
রামায়ণের বিমানের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে নানাভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। বিমানের কম্পন এবং শব্দ বা গর্জনের কথা উল্লেখ আছে। বলা হয়েছে–“ওই প্রদীপ্ত পাবকতূল্য মহাবল ঘনঘন কম্পিত হইতেছেন এবং সর্বাঙ্গের নোম স্পন্দন পূর্বক জলদগম্ভীর রবে গর্জন করিতেছেন।” ‘জলদগম্ভীর’ বলতে মেঘগর্জনই বোঝায়। বিমানের ইঞ্জিন চালু হলে মেঘগর্জনের মতোই শোনায়। রামায়ণকার হনুমানের বিমানের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন–“উহার কক্ষ্যান্তরাগত বায়ু জলবৎ গম্ভীর রবে গর্জন করিতেছে।” একজন বিমানযাত্রী যেভাবে উড়তে উড়তে অপসৃয়মাণ নীচের দৃশ্যাবলি দেখেন, ঠিক সেইভাবেই হনুমান লঙ্কা দেখছিলেন। হনুমানের লংকা দেখার বিবরণ ঠিক সেইভাবেই দেওয়া হয়েছে। হনুমানের ক্ষুদ্র থেকে বৃহদাকার এবং বৃহদাকার থেকে ক্ষুদ্র হয়ে যাওয়াটি বিমানের ভিতর প্রবেশ ও প্রস্থানের চিত্রটিই প্রকট হয়। সীতার অন্বেষণ করে ফেরার পথে হনুমান বিমানে চড়েছেন কথা বর্ণনাতেই আছে। গমনে আর আগমনে এরকম বর্ণনা বিমানে চেপে সমুদ্র লঙ্ঘন করেছিলেন এটাই প্রমাণ হয়। সেই বিমানের শব্দ শুনে অঙ্গদবাহিনী কী বলছে কবির লেখনীতে জানা যাক–“দূর হইতে বায়ু ক্ষুভিত মেঘের গভীর নির্ঘোষের ন্যায় উহার … সিংহনাদ শুনিতে পাইল। এই শব্দ শুনিবামাত্র সকলেই উহাকে দেখিবার নিমিত্ত ব্যগ্র হইয়া উঠিল।”
কুম্ভকর্ণও ‘কুম্ভকর্ণ’ নামক বিমানে চড়েই হনুমানের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন এমন বর্ণনাই আছে। প্রাচীনকালে যিনি বিমানের মালিক বা চালক তাঁর নামেই বিমানের নাম হত। যেমন কুম্ভকর্ণ-বিমান, ইন্দ্রজিৎ-বিমান, হনুমান বিমান, গরুড়-বিমান, ইন্দ্র-বিমান ইত্যাদি। ইন্দ্রজিৎও বিমানে চড়ে যুদ্ধ করেছিলেন এবং বিমানেই ‘ড্যামি’ সীতাকে এনেছিলেন রণক্ষেত্রে এবং বিমানেই তাঁকে খাঘাত করে হত্যা করেছেন। লক্ষ্মণ হনুমান-বিমানে চড়ে বিমানারূঢ় ইন্দ্রজিতের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। বাল্মীকি বলেছেন–“উঁহারা অন্তরীক্ষগত দুইটি গ্রহের … ঘোরতর যুদ্ধ করিতে লাগিলেন।” রাবণও বিমানে চড়েই যুদ্ধ করেছেন। সে সময় ইন্দ্র-বিমানে চড়ে ইন্দ্র উপস্থিত হলে ইন্দ্রের চালক মাতলি রামকে বিমানে তুলে নিয়েছিলেন। রামকে ঘিরে “বিমানচারী দেব, দানব, গন্ধর্ব, উরগ, ঋষি”-রাও রণস্থলের উপর অবস্থান করছিলেন। লঙ্কাযুদ্ধের পর সীতাকে নিয়ে রাম বিমানেই। অযোধ্যায় ফিরেছিলেন। শুধু রাম-সীতাই নয়, অন্য বিমানে চড়ে হনুমান-লক্ষ্মণ-সুগ্রীব-জাম্ববান-বিভীষণ সকলেই রামের সঙ্গে এসেছিলেন। এ বিষয়ে বাল্মীকির রামায়ণে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা আছে।
রাম-সীতা অযোধ্যায় ফেরার পথে যে যে দৃশ্য দেখে সীতাকে বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তা উপর থেকে দেখেই বলা সম্ভব, নীচ থেকে কোনোভাবেই নয়। সামান্য নমুনা দিই। রাম বলছেন–“পুষ্পকরথ মহানাদে গমনমার্গে উত্থিত হইল। তখন রাম চতুর্দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপপূর্বক চন্দ্রাননা জানকীকে কহিলেন, প্রিয়ে ঐ দেখ … ত্রিকূটশিখরে বিশ্বকর্মানির্মিত লঙ্কাপুরী। ঐ দেখ … যুদ্ধভূমি।” ইত্যাদি ইত্যাদি। আর-একটু পড়ুন–“ঐ যে সমুদ্রে একটি অবতরণ পথ দেখিতেছ, আমরা সমুদ্র পার হইয়া ঐ স্থানে রাত্রিবাস করিয়াছিলাম। ঐ দেখ … লবণ সমুদ্রে সেতুবন্ধন করিয়াছি, ইহা নল নির্মিত ও অন্যের অসাধ্য। এই দেখ … মহাসমুদ্র … ঐ স্বর্ণবর্ণ গিরিবর মৈনাক। এই দেখ সমুদ্রের উত্তর তীরবর্তী সেনানিবেশ।” এরপর কিষ্কিন্ধ্যা নগরী, রাম দেখালেন কোথায় বালীকে হত্যা করেছিলেন। দেখা গেল ঋষ্যমূক পর্বত, যেখানে তিনি সুগ্রীবের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। এরপর দৃশ্যমান হল পম্পা নদী, সীতাকে এখানে শবরী ও কবন্ধের কথা বললেন। এরপর দৃশ্যমান হল তাঁদের আশ্রমশিবির, যা এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। একে একে গোদবরী, অগস্ত্যের আশ্রম, শরভঙ্গের ডেরা, চিত্রকূট পর্বত, যমুনা নদী, ভরদ্বাজের আশ্রম, পুণ্যসলিলা গঙ্গা, শৃঙ্গবের পুর, অবশেষে গন্তব্য অযোধ্যা।
বিমান যত সামনে এগিয়েছে, দৃশ্য তেমনই পালটে পালটে গেছে। বিমান বিষয়ে বিস্তারিত জানতে অবশ্যই বাল্মীকির রামায়ণটি পাঠ করতে হবে। বিকল্পে হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের অনূদিত বাংলা রামায়ণ পড়া যেতে পারে। এর সঙ্গে যুক্তিবাদী প্রাবন্ধিক ও রামায়ণ গবেষক বীরেন্দ্র মিত্রের রামায়ণে দেবশিবির’-ও পড়ে নিন। এরপর যদি কেউ বলেন রামায়ণের যুগে বিমান তো দূরের কথা, বিমানের জ্বণও ছিল না–তাহলে মেনে নিতে হয় রামায়ণ প্রাচীন যুগে হয়নি, এটি রচিত হয়েছে ১৯০৩ সালের পর। কারণ ১৯০৩ সালের পরই বর্তমানে যে বিমান দেখি সেই বিমান আবিষ্কার করেছেন রাইট ভ্রাতৃদ্বয়।
দানিকেন বলেন–“প্রাচীন ভারতের পুঁথিপত্রে যে বিমানের বর্ণনা পাওয়া যায়, সেই বর্ণনাকে যাঁরা নেহাত বুজরুকি মনে কতটা ভাবতে জানে সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। প্রাচীন পুঁথিপত্রে যেসব ‘উদ্ভট বস্তুর দেখা মেলে, অভিব্যক্তিবাদের সঙ্গে যাদের খাপ খাওয়ানো যায় না, তা থেকে আর-একটি তত্ত্বের হদিস মিললে তাকে বাজে বলে বাতিল করা হয়ে থাকে। নতুন সেই তত্ত্ব মতে মানবকদের ‘মানুষ’ করেছিল বহির্জাগতিকেরা, তাদের মস্তিষ্ককে। কিন্তু সুদীর্ঘ মানবেতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে সে উন্নতি ঘটেছিল, বলতে গেলে, একেবারেই হঠাৎ।”
রামায়ণের যুগে যদি বাস্তবিক বিমানের অস্তিত্ব না থাকত, তাহলে সে সময়কার মানুষ কীভাবে স্বর্গীয় যানের বর্ণনা করতে পারল এত নিখুঁতভাবে? আকাশে অর্থাৎ শূন্যে বিমানের মতো যান ওড়াতে কী কী বস্তুর প্রয়োজন, সেটাই-বা জানল কীভাবে? বিমান চালানোর যন্ত্রপাতিই-বা আসত কোথাও থেকে? যেসব ব্যোমযান স্বর্গকেও চমকে দিত, সে সব তো ছেলেখেলার বিষয় ছিল না। প্রাচীন পুঁথিগুলোতে যে স্বর্গীয় ব্যোমযানের বর্ণনা পাওয়া যায়, সেগুলি ছিল বহুতলবিশিষ্ট, সেই যানের ভিতরটা ছিল মন্দিরের মতো বিশাল। এসব তো ঘরে নিত্য ব্যবহৃত হাতা-খুন্তি-সাঁড়াশি দিয়ে বানানো সম্ভব নয়! দানিকেন বলেছেন–“নির্মাণকৌশলের দিক থেকে বিচার করলে আধুনিক স্পেস শাটলের চেয়ে ভারতীয় পুঁথিপত্রে বর্ণিত বিমানের ক্ষমতা ছিল অনেক বেশি। পৃথিবীর চারদিকে তাঁরা ঘুরে বেড়াতে পারত, আকাশে দাঁড়িয়ে থাকতে পারত, মিশে যেতে পারত তারাদের সঙ্গে এবং এমন তীব্র আলো ফেলতে পারত যে, মনে হত আকাশে দুটো সূর্য রয়েছে।” আক্ষেপের বিষয় এটাই যে, সেইসব প্রাচীন প্রযুক্তিবিদরা তাঁদের প্রযুক্তির নির্মাণ-কৌশলের বিবরণ কোথাও রেখে যাননি।
মানুষ সেই সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যেসব স্বপ্ন দেখে আসছে তার মধ্যে আকাশে ডানা মেলার স্বপ্নই সবচেয়ে বেশি প্রাচীন। সভ্যতার শুরুতে অনেক জীবনযাপন পশুপাখির কাছ থেকে শিখেছে। মানুষের অনেক আগে পশুপাখিরা পৃথিবীতে এসেছে। মানুষই সর্বশেষ প্রাণী, যাঁরা পৃথিবীতে এসেছেন। যাই হোক, পাখিকে আকাশে উড়তে দেখে মানুষেরও সাধ হয়েছে পাখির মতোই তাঁরাও আকাশে অবাধে উড়ে বেড়াবে। তারপর দীর্ঘদিন অনেক মানুষের অনেক কষ্ট, পরিশ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে আজ মানুষ আকাশে চড়ে বেড়াচ্ছে। মহাশূন্য, চাঁদ জয় করে চলেছে। তবুও তার সেই প্রাচীনতম আকাঙ্ক্ষার মৃত্যু হয়নি। সে চায় আরও দৃপ্ত, আরও নিরাপদ, আরও সুনিয়ন্ত্রিত উপায়ে আকাশে ডানা মেলে বেড়াতে। আর এজন্য যথারীতি চলছে বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টা কীভাবে আকাশ আরও নিরাপদ, আনন্দদায়ক ও দ্রুত করা যায় তার জন্য। আর বিজ্ঞানীদের নিরলস চেষ্টায় প্রতিনিয়তই নতুন নতুন সাফল্য এসে ধরা দিচ্ছে। তৈরি হচ্ছে বিশালাকার, দ্রুতগতির ও আরামদায়ক বিমানের।
ভেবে দেখুন, প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ উড়ার জন্য যে কতটা ব্যাকুল ছিল তা বোঝা যায় বিভিন্ন প্রাচীন উপকথার দিকে তাকালেই। সেখানেও বিভিন্নভাবে এসেছে মানুষের আকাশে ভ্রমণের কথা। গ্রিক পুরাণের একটি গল্প শোনাই–প্রাচীন যুগে ডিডালুস ও তার ছেলে ইকারাস পাখির পালক দিয়ে ডানাসদৃশ বস্তু তৈরি করে তা মোম দিয়ে পরস্পরকে দিয়ে আকাশে উড়তে সক্ষম হয়েছিল। এইভাবে একসময় ইকারাস বেশি উপরে উঠে গেলে সূর্যের উত্তাপে তার ডানার মোম গলে গেলে তা থেকে থেকে পালক খসে পড়ে গেলে সে নদীতে পড়ে যায়।
গ্রিকরা যে শুধু রূপকথা নিয়েই পড়ে ছিল তা কিন্তু নয়। এই রূপককে বাস্তবে রূপ দিতেও তাঁদের দেশে সেই সময়ে অনেকেই কাজ করে গেছেন। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ সালে আর্কিটাস, যিনি ছিলেন একাধারে দার্শনিক, গণিতবিদ, জ্যোতিষী। তিনি প্রথম উড়ুক্কু মানের ডিজাইন ও মডেল নির্মাণ করেছিলেন এবং এটি নাকি ২০০ মিটার পর্যন্ত উড়তে সক্ষম হয়েছিলে। তিনি এই যন্ত্রের নাম দিয়েছিলেন পিজিয়ন।
উন্নত উড্ডয়ন যন্ত্রের চিত্র অংকন করেছিলেন শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। প্রাজ্ঞজন বলেন, তিনিই সর্বপ্রথম আকাশে উড়ার একটি তাত্ত্বিক ধারণা দেন। তাঁর ডিজাইন করা গস্নাইডারে ডানার ভিতরের অংশ ছিল মূল কাঠামোর সঙ্গে শক্তভাবে লাগানো। আর ডানার নড়তে সক্ষম অংশগুলি নিয়ন্ত্রণের জন্য ছিল আলাদা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। এর নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘ওরনিথপ্টার। ১৪৯৬ সালে তিনি এর পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের চেষ্টা করলেও তা সফল হয়নি। কেননা এ যন্ত্রের সাহায্যে আকাশে পাখির মতো মুক্তভাবে উড্ডয়নের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি অর্জন করা সম্ভব ছিল না সেই সময়। অনেকে অবশ্য বাহুবলেই এই যন্ত্রের সাহায্যে উড়তে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেই চেষ্টায় কেউ সফল হয়েছে বলে শোনা যায়নি কখনো। কেননা মানুষের বুকের ও কাঁধের পেশিগুলি এই কাজ করার মতো যথেষ্ঠ শক্তিশালী নয়। ভিঞ্চির মৃত্যুর পর অনেকদিন আর আকাশে ডানা মেলার ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। ১৬৩০ সালের দিকে তুরস্কের ইস্তাম্বুলের ৬২.৫৯ মিটার উঁচু গালাতা টাওয়ার থেকে হিজাফেন আহমেদ সালাবি নামক এক ব্যক্তি নিজের তৈরি উড়ুক্কু এক যানে করে ৩ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৬৩৩ সালে তার আর-এক ভাই হাসান সালাবি সাতটি ডানার এক রকেটে করে আকাশ উড্ডয়ন করেছিলেন। এর উপরের অংশ ছিল গান পাউডারে পূর্ণ। এটিই মানুষের বানানো প্রথম রকেট বলে মনে করা হয়। তিনি গান পাউডার শেষ হওয়ার পর ডানাগুলিকে প্যারাসুটের মতো ব্যবহার করে নিরাপদেই অবতরণ করেছিলেন। তিনি আকাশে ছিলেন প্রায় ২০ সেকেন্ড আর ৩০০ মিটার মতো উঁচুতে উঠেছিলেন বলে জানা যায়।
বাতাসের চেয়ে ভারি কোনো উড়ুক্কু যান সম্পর্কে কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রথম প্রকাশিত হয় ১৭১৬ সালে, ‘স্কেচ অফ এ মেশিন ফর ইন দা এয়ার’। লিখেছিলেন ইমানুয়েল সুইডেনবর্গ। তিনি এই বইয়ে তাঁর ফ্লাইং মেশিনের বর্ণনায় বলেছিলেন এটি হাল্কা কাঠামোর শক্ত ক্যানভাসে ঢাকা একটি যন্ত্র যার দুটি বড়ো ডানা ছিল। কিন্তু তিনি জানতেন যে, এই কাঠামো আকাশে উড়ার মতো প্রয়োজনীয় শক্তির জোগান দেওয়ার মতো ব্যবস্থা এতে ছিল না। ১৯০১ ও ১৯০৩ সালে দুটি পরীক্ষামূলক ফ্লাইড পরিচালনা করলেও এগুলির ইঞ্জিনের কার্যক্ষমতা তেমন আশানুরূপ ছিল না। পরে তিনি ৫২ হর্সপাওয়ারের দুটি শক্তিশালী ইঞ্জিন ব্যবহার করে পরীক্ষা চালালেও তার এই মডেল এইক্ষেত্রে সফলতার মুখ দেখেনি। ইনিই প্রথম উড়ুক্কু যান নিয়ে আকাশে উড়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন।
অবশেষে অরভিল রাইট আর উইলবার রাইট ভ্রাতৃদ্বয় নতুন যুগে আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনার কিল ডেভিল হিলসে ১৯০৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর তারা ফ্লায়ার ওয়ানের সফল উডডয়ন করান। প্রথম ফ্লাইটের পাইলট ছিলেন অরভিল রাইট। তিনি প্রথম ফ্লাইটে ১২ সেকেন্ড ৩৭ মিটার পথ পাড়ি দেন। একই দিনের চতুর্থ ফ্লাইটে উইলবার রাইট ৫৯ সেকেন্ডের ফ্লাইটে ২৬০ মিটার পথ পাড়ি দেওয়ার কৃতিত্ব দেখান। চারটি ফ্লাইটই মাটির ১০ ফুট উপর দিয়ে পরিচালনা করা হয়। প্রথম উড্ডয়নে আকাশযানের সামনের রাডার বহনকারী কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মূল কাঠামোটি সম্পূর্ণ অক্ষত ছিল। ১৯০৫ সালের ৫ অক্টোবর উইলবার রাইট ৩৯ মিনিট ২৩ সেকেন্ডে ২৪ মাইল পথ পাড়ি দেবার গৌরব অর্জন করেন।
শুধু রামায়ণেই তো নয়, মহাভারত ও বাইবেল পুরাণাদিতেও বারবার বিমান বিষয়ে উল্লেখ আছে। পৌরাণিক বিবরণসমৃদ্ধ বাইবেল গ্রন্থেও আকাশপথ থেকে মিশ্ৰীয় সেনাবাহিনীর উপর বিশ্বপ্রভুর আক্রমণের বর্ণনা আছে, যা আকাশযুদ্ধেরই বর্ণনা। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, বাইবেলে যেভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিমানের উল্লেখ আছে, সেটা বিমান বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না-থাকলে কখনোই বর্ণনা করা সম্ভব হত না। পৌরাণিক যুগে ভয়ংকর ভয়ংকর যুদ্ধাস্ত্র আবিষ্কার হয়ে গেল, বিমান আবিষ্কারটাও কিন্তু দুঃসাধ্য হতে পারে না।
তাহলে এমন তো নয় পৌরাণিক যুগের পর বিমান নিয়ে কোনো গবেষণা বা প্রচেষ্টা হয়নি! মাঝের সময়গুলি কি বিজ্ঞান গবেষণায় অন্ধকারময় যুগ ছিল? তাই কি আরও অনেক সময় লেগে গেল আধুনিক বিমানে পৌঁছোতে! দানিকেন এক সংগত প্রশ্ন তুলেছেন–ক্রমবিকাশের ধারায় সেই যানগুলো আরও উন্নত হল না কেন? পারে পায়ে তাহলে তো কয়েক হাজার বছর আগেই আমরা চাঁদে যেতে পারতাম। বস্তুত ইতিহাস বলে প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও প্রাচ্যের মানুষরা ছিলেন খুবই বিজ্ঞানমনস্ক। তাঁরা বহু আবিষ্কারের হোতা হলেও তা তাঁরা সংরক্ষণ করে রাখতে পারেননি। ফলে পাশ্চাত্যের মানুষেরা যেভাবেই সেসব জ্ঞান চুরি করে নিজেদের বলে চালিয়ে দিয়েছে। ক্রুসেডের সময় খ্রিস্টান ও ইহুদি যোদ্ধারা প্রচুর তথ্য, জ্ঞান, পুঁথিপুস্তক নিয়ে চলে এসেছিল মুসলিম পণ্ডিতদের হত্যা করে। একটা বড়ো অংশের মানুষ প্রাচীন পুঁথির মূল পাঠ করতে পারেনি দুর্বোধ্য ভাষায় কারণে। আক্রমণকারীরা সেসব পুঁথি ভাবানুবাদ করেছিল নিজেদের সুবিধামতো বর্জন সংযোজন করে। বিশেষ করে প্রাচীন প্রযুক্তগত জ্ঞান নিজেদের কাছে রেখে দিয়েছিল। আমরা যে অনুবাদ পাঠ করি, তা মূল গ্রন্থের হুবহু নয়। এমনকি আমাদের দেশীয় অনুবাদরা মূল গ্রন্থকে হুবহু অনুবাদ না করে নিজেদের মতো রচনা করেছেন। যে কারণে আমরা বহু মূল্যবান জ্ঞান থেকে বঞ্চিত। বিদেশি অনুবাদকরাও ‘উদ্ভট’ বলে বহু তথ্য সরিয়ে ফেলেছে। রামায়ণের একটা জার্মান অনুবাদ আছে। সেই অনুবাদ আক্ষরিক মোটেই নয়। অনুবাদটি পরিচ্ছেদেও বিভক্ত নয় কোনো পংক্তিরও ছাড় নেই তাতে। অনুবাদকে নাম হেরমান জ্যাকোবি। কোথাও কোনো জটিল দুর্বোধ্য অংশ দেখলেই সেই অংশ বাতিল করেছেন। যেমন–কোনো উডডীন যন্ত্রের কথা দেখতে পেলেই তিনি ভেবেছেন সেগুলো অর্থহীন। বাতিল তো করেছেই, উপরন্তু উদ্ধতভাবে বলেছেন–“ওসব অর্থহীন কচকচি’, না হয় বলেছেন ‘এ জায়গাটাকে অনায়াসে বাদ দেওয়া যেতে পারে, এখানে যত উদ্ভট কথা ছাড়া আর কিছু নেই।” পৌরাণিক যুগে আবিষ্কৃত বিমান যদি গবেষণার মধ্য দিয়ে ভারতীয়রা যেত, তাহলে রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের অনেক অনেক আগেই ভারতীয়রাই বিমান আবিষ্কারের কৃতিত্ব অর্জন করত। পাশ্চাত্য আবিষ্কারকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে প্রাচ্যকে অস্বীকার করা তো অনেক পুরোনো অসুখ। পাশ্চাত্য অ্যালোপ্যাথিককে যেমন প্রাধান্য দিতে গিয়ে প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদকে সুচারুভাবে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। চিকিৎসাশাস্ত্রে চরক ও সুশ্রুতের আয়ুর্বেদ প্রাচীন ভারতীয়দেরই কৃতিত্ব, সেটা অস্বীকার করা যাবে কি?
শেষ পাতে, শেষ কথা
এতক্ষণ রামায়ণ ও রামায়ণ গ্রন্থে বিভিন্ন চরিত্রগুলো বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হল। যে আলোচনায় নানা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে রামায়ণ ও রামের অস্তিত্ব নিয়ে। রামায়ণকে নানা পণ্ডিত নানাদিক থেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে দেবতার তত্ত্ব। সেই হিসাবে পুরো ঘটনাকেই সত্য বলে মানে সাধারণ মানুষ। সত্যি তো বটেই। এ আমি মোটেই দ্বিমত নই। আমি অতিরঞ্জিত সত্য। অলৌকিক কাণ্ডগুলি বা উপাদানগুলি সরিয়ে পাঠ করলে সত্যের ইতিহাস বিরিয়ে আসব। যেই সত্যকে বলতে পারেন ‘আর্যসত্য’।
সেই আর্যসত্যকে বুঝতে হলে পিছন দিকে ফিরে যেতে হবে। অনেকটা পিছনে। প্রাচীন ভারতকে না চিনলে রামায়ণকে মূল্যায়ন করা যাবে না। সেই প্রাচীন ইতিহাসের আলোর নিচে রামায়ণকে ফেলে যদি পোস্টমর্টেম করতে পারেন, তাহলেই বেরিয়ে আসবে প্রকৃত সত্য।
হিমালয় পর্বত থেকে নিঃসৃত তিনটি নদীজলধারা বিধৌত বিশাল অঞ্চল সাধারণভাবে আর্যাবর্ত নামে পরিচিত, যা মুসলিম আগমনে হিন্দুস্তান বলে পরিচিত হয়েছে। এই অঞ্চলের পশ্চিমাংশ সিন্ধু ও তার পাঁচটি শাখা–শতদ্রু, বিপাশা, বিতস্তা, চন্দ্রভাগা ইরাবতী। মধ্যমাংশ গঙ্গা, যমুনা ও তার উপনদী। পূর্বাংশে ব্ৰহ্মপুত্র প্রবাহিত। আর্যাবর্তের প্রতীচ্য ভাগে একটি অববাহিকার পাশে সুপ্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার উন্মেষ ও বিকাশ হয়েছিল। ভারতে আর্যরা নদীর মাহাত্ম্যে মোহিত হয়ে নদীগুলিকে দেবতাজ্ঞানে পুজো করতেন। তাই ভারতভূমির জলই গঙ্গাদেবতার মর্যাদা পায়। প্রাচীন গ্রন্থগুলি ঘাঁটাঘাঁটি করলে বেশকিছু তথ্য উঠে আসে, সেগুলি এখানে আলোচনা বা উল্লেখ করলে বিষয়টা একটু স্পষ্ট হয়।
প্রাচীনকাল থেকেই ভারতের রাজনৈতিক (পৌরাণিক সহ) ইতিহাসে উত্তর ভারতের গুরুত্ব সর্বাধিক। আর্য সভ্যতার উন্মেষ ও বিকাশ এবং প্রথম সাম্রাজ্যের বিস্তার ও প্রকাশ এখান থেকেই হয়েছিল। আর্য কারা? ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা বলেন, আর্যরা প্রথমে পশুপালন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাঁরা দলবদ্ধ হয়ে অনেকগুলো পশু সঙ্গে নিয়ে ঘাস আচ্ছাদিত অঞ্চল বা প্রদেশের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তেন। পরে সে স্থানের ঘাস পশু খাদ্য হিসাবে নিঃশেষিত হলে তাঁরা পুনরায় অন্য অঞ্চল বা প্রদেশে যেতেন। এভাবে তাঁরা প্রতিনিয়ত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে আসতেন বলে আর্য (অর্থাৎ গমনশীল) নামে পরিচিত হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে আর্যরা নিরন্তর এরূপ স্থান পরিবর্তন খুবই কষ্টদায়ক বিবেচনায় এনে এক স্থানে অবস্থানের উপর গুরুত্ব আরোপ করে এবং এ সমস্যা সমাধানের উপায় বের করার চেষ্টা চালায়। উপায় হিসাবে কৃষিকাজকেই তাঁরা অধিক গুরুত্ব দিয়ে ফসল উৎপাদনে নিযুক্ত হয়। এজন্যই তাঁরা আর্য (অর্থাৎ কৃষিজীবী) নামে প্রসিদ্ধ হন। শেষোক্ত পক্ষের মতবাদে আর্য শব্দের অর্থ দাঁড়ায় কৃষিকর্মকারী, কারণ ও ধাতুর কর্ষণার্থও আছে।
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন গ্রন্থগুলির কতগুলোতে উৎকৃষ্ট গুণসম্পন্ন ব্যক্তিকে ‘আর্য’ শব্দে নির্দেশ করা হয়েছে। কোনো কোনো গ্রন্থে হিন্দুধর্মাবলম্বী লোকমাত্রেই অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র–এই চার বর্ণের লোকই ‘আর্য’ বলে লিপিবদ্ধ আছে। আবার, কোনো কোনো গ্রন্থে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য–এ তিন বর্ণকে আর্য এবং চতুর্থ বর্ণকে শূদ্র হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। এতে কেউ কেউ অনুমান করেন যে, শূদ্র গোষ্ঠী আর্যবংশের নয়; আর্যেরা ভারতবর্ষে এসে ভারতের স্থানীয় ভূমিপুত্রদের শূদ্র তথা অনার্য চিহ্নিত করেছেন।
আর্য গোষ্ঠী খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে বাংলা অঞ্চলে প্রবেশ করতে শুরু করে। তৎকালে বাংলা অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বা উপরাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। প্রত্যেক রাষ্ট্র স্বশাসিত নৃগোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। পূর্ববর্তী বৈদিক আর্যরা উপনিবেশ গড়ার ক্ষেত্রে নানা কারণে এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে আসার ব্যাপারে অনাগ্রহী ছিল। কারণ তাঁদের দৃষ্টিতে পূর্বাঞ্চলীয় ভূখণ্ডে ছিল রাক্ষস, অশুচি ও দস্যু বা বর্বর জনগোষ্ঠীর বাস।
মৎস্য পূরাণের এক বর্ণনায় দেখা যায় যে, এক অন্ধ বৃদ্ধ সাধু ভুলবশত নিম্নগাঙ্গেয় উপত্যকার স্রোতে ভেলা ভাসিয়েছিলেন। বালী নামের এক নিঃসন্তান রাজা বংশ রক্ষা ও রাজ্যের উত্তরাধিকারীর জন্য বৃদ্ধ সাধুকে আশীর্বাদ করার অনুরোধ করেন। সাধুর আশীর্বাদে রাজা তাঁর বৃদ্ধা রানীর গর্ভজাত পাঁচটি পুত্র সন্তানের জনক হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। পাঁচ পুত্রের নাম রাখা হয় অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুন্ড্র ও সূক্ষ্ম। রাজার পাঁচ পুত্র সন্তানের নামে বাংলার পাঁচটি ভূখন্ডের নামকরণ হয়। বাংলা ভূখণ্ড আর্যদের নিকট এতোটাই অপবিত্র ছিল যে, তাঁরা সতর্কতার সঙ্গে এতদঞ্চলে প্রবেশ ও স্থায়ী বসবাস গড়া থেকে নিজেদের বিরত রেখেছিল। সবচেয়ে কৌতুহোলদ্দীপক হল, আরও পরবর্তী সময়ের বৈদিক সাহিত্যের বিষয়াবলিতেও ভারত তথা বাংলার জনগোষ্ঠীকে দস্যু, দৈত্য-দানো, রাক্ষস-খোক্ষস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মহাভারত এ বাংলার উপকূলবর্তী। অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে ম্লেচ্ছ হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। ভগবত পুরাণে ও বাংলার জনগণকে বলা হয়েছে ‘পাপী। ধর্মশাস্ত্রে পুন্ড্র ও বঙ্গীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংস্পর্শে আসার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে মৃত্যুর পরবর্তী শেষ কৃত্যানুষ্ঠান আয়োজনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আর্যরা আর্যাবর্তের বাইরে বসবাস গড়ে তুললেও স্থানীয় ভূমিপুত্র তথা জনগণের সঙ্গে মেলামেশার ক্ষেত্রে তারা নানা ধরণের বিধিনিষেধ বজায় রেখে চলত।
আর্যসমস্যা ইতিহাসের একটি জটিল সমস্যা। একটি মত অনুসারে আর্ব বলতে একটি বিশিষ্ট ভাষাগোষ্ঠীর মানুষকে বোঝায়। অন্য মত অনুযায়ী আ কথাটি জাতি অর্থে ব্যবহার করা উচিত। বর্তমানে প্রথম মতের সমর্থকদের সংখ্যা বেশি হলেও, দ্বিতীয় অভিমতটি পুরোপুরি পরিত্যক্ত করা হয়নি।
আর্যরা বহিরাগত না ভারতেই আধিবাসী এ প্রশ্নকে কেন্দ্র করেও পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে–(১) গঙ্গানাথ ঝাঁ, ত্রিবেদ, কাল্লা, এ.সি. দাস, পুসলকারের মতো ভারতীয় পণ্ডিতরা মনে করেন ভারতই আর্যদের আদি বাসস্থান, যদিও ভারতের কোন্ অঞ্চলে তারা বসবাস করত তা নিয়েও বিতর্ক আছে। (২) দ্বিতীয় মত অনুসারে (গাইলস, হার্ট ইত্যাদি ইউরোপীয় পণ্ডিত) ইউরোপই আর্যদের আদি বাসস্থান। এ ক্ষেত্রেও ইউরোপের কোন্ অঞ্চলে তাঁরা বসবাস করত, তা নিয়েও মত পার্থক্য আছে। (৩) তৃতীয় একটি মত অনুসারে (ব্রান্ডেনস্টিয়েন) মধ্য এশিয়ায় স্তেপি অঞ্চলেই ছিল আর্যদের আদি নিবাস এবং এখান থেকেই তাঁদের একটি শাখা ইউরোপে ও অপর একটি শাখা পারস্য হয়ে ভারতে প্রবেশ করে। বর্তমানে তৃতীয় অভিমতই অধিকাংশ পণ্ডিত গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন।
সংস্কৃত ভাষায় লিখিত প্রাচীন শ্লোক অনুসারে “সর্বে গত্যৰ্থাঃ জ্ঞানার্থাঃ প্রাপ্ত্যর্থাশ্চ”–সমূদায় গমনার্থক ধাতু জ্ঞানার্থক ও প্রাপ্ত্যর্থক। সুতরাং, যারা জ্ঞানশীল অথবা যারা (শাস্ত্রসীমায়) গমন করেন কিংবা যারা (শাস্ত্রের পার) প্রাপ্ত হন, তাঁরাই আর্ব। যাস্কাচার্যের মতে “আর্য’ শব্দের নিরুক্তগত অর্থ ‘ঈশ্বরপুত্র’। অর্থাৎ ঈশ্বরের যথার্থ পুত্রকে ‘আর্য’ নামে সম্বোধন করা হয়। মানবমাত্রেই ঈশ্বরের পুত্র, তথাপি সদাচারপরায়ণ পুরুষকেই ঈশ্বরপুত্র অর্থাৎ ‘আর্য’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। আর্যরা ভারতবর্ষে বিদেশি অনুপ্রবেশকারী এটি ইংরেজ আমলে প্রচারিত একটি ধারণা বলেও অনেকে মনে করেন।
বাল্মীকি রামায়ণে বলা হয়েছে–
“সর্বদাভিগতঃ সদ্ভিঃ সমুদ্র ইব সিন্ধুভিঃ। আর্যসবসমশ্চৈব সদৈব প্রিয়দর্শন।” (বাল্মীকি রামায়ণ ১/১/১৬)
অর্থাৎ, রামচন্দ্র সদাসর্বদা সৎপুরুষদের সাহচর্যে থাকতেন, যেরূপ সমুদ্র সদা নদীসমূহের সঙ্গে মিশে থাকে তথা তিনি আর্য, সমদর্শী ও সকলের প্রিয় ছিলেন।
বিদুর নীতিতে বলছে–
“আর্য কর্মাণি রজ্যন্ত ভূতি কর্মাণি কুৰ্বতে হিতং চ নাভ্যসূযন্তি পণ্ডিতা ভরতভ।
ন স্বে সুখে বৈ কুরুতে প্রহর্ষ। নান্যস্য দুঃখে ভবতি প্রহৃষ্টঃ।
দত্ত্বা ন পশ্চাৎ কুরুতেহনুতাপং স কথ্যতে সৎপুরুষার্য শীলঃ।” (বিদুর নীতি ১/৩০/১/১৮)
এই শ্লোকে অত্যন্ত ধার্মিককেই ‘আর্য’ বলা হয়েছে। চাণক্যনীতিতে উল্লেখ আছে–“অভ্যাসাদ ধার্যতে বিদ্যা কুলং শীলেন ধার্যতে। গুণেন জ্ঞাযতে আর্যঃ কোপো নেত্রেণ গম্যাতে।” (চাণক্য নীতি ৫/৮) এখানেও গুণীজনকে ‘আর্য’ বলা হয়েছে। মহাভারতের আছে–“স বাল এবামতিপোত্তমঃ।” (মহাভারত আদিপর্ব ৪০/৭) এই শ্লোকে উত্তম রাজকুমারের সাথে ‘আর্যমতি’ বিশেষণ যুক্ত করা হয়েছে যার অর্থ শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধিমান। কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে পাচ্ছি–“ব্যবস্থিতামর্যাদাঃ কৃতবর্ণাশ্রমস্থিতঃ।” আর্যগণের মর্যাদাকে যে ব্যবস্থিত করতে সমর্থ সেই রাজ্যাধিকারী, এরূপ বর্ণিত হয়েছে।
মোদ্দা কথা, আর্য হচ্ছে একটি ভাষা গোষ্ঠীর নাম। আর একাধিক মানবগোষ্ঠীই এই ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। ভাষাগত দিক দিয়ে ভারতবর্ষে দুটি আর্য জাতির অস্তিত্ব মেলে। আর গোষ্ঠীগত দিক দিয়ে যাদের একটি হল–আলপাইন মানবগোষ্ঠীভুক্ত এবং অন্যটি নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত। এই আলপাইন মানবগোষ্ঠীভুক্ত লোকেরা যেমন অসুর, রাক্ষস, শূদ্র নামে পরিচিত, তেমনি নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত লোকেরা ছিল ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত। অনেক চিন্তাশীল লেখকেরাই ব্যাপারটাকে গুলিয়ে ফেলেন। তাঁরা বলেন, ডঃ আম্বেদকর বলেছেন বৈদিক আর্যরা। বহিরাগত বা অনুপ্রবেশকারী নয়। আসলে তাঁরা আম্বেকরের ব্যাখ্যাকে সঠিকভাবে বুঝতে পারেননি বলে মনে হয়। আসলে ডঃ আম্বেদকর বলেছেন, আলপাইন বা অসুর মানবগোষ্ঠীর আর্যভাষীরা বহিরাগত নয়। কিন্তু নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত আর্য ভাষীরা হলেন বহিরাগত। যদিও বর্তমানে আর্য বলতে আমরা কেবল নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত আর্য ব্রাহ্মণদেরই বুঝে থাকি। যারা হলেন ভারতবর্ষে অনুপ্রবেশকারী বা বহিরাগত। নর্ডিক মানবগোষ্ঠীর আর্যভাষী ব্রাহ্মণ এবং অন্যটা আলপাইন মানবগোষ্ঠীর আর্যভাষী অসুর, যা ডঃ আম্বেদকর তাঁর গবেষণা দ্বারাই প্রমাণ করেছেন।
নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত লোকেরা যেহেতু তাঁরা ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত; তাই তাঁরাই মূলনিবাসীদের মধ্যে অত্যন্ত সুকৌশলে বিভেদ সৃষ্টি করে ইন্দো-ইরানি দাস এবং দস্যু সহ দেশীয় আলপাইন মানবগোষ্ঠীভুক্ত আর্যদেরও যুদ্ধে পরাজিত করে ভারতবর্ষে আধিপত্য বিস্তার করেন। কারণ ইন্দো-ইরানী দাস এবং দস্যু ও দেশীয় আলপাইন মানবগোষ্ঠীভুক্ত আর্যরা ছিলেন অযাজকীয় বা ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে বিশ্বাসী। কিন্তু নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত আর্যরা ছিলেন যাজকীয় মতবাদে বিশ্বাসী। আর জয়ের পরিকল্পনাটি ঠিক এ কারণেই।
একথার সমর্থনে বলা যায় যে নর্ডিক আর্যরাই দাস এবং দস্যুসহ মূলনিবাসী আলপাইন আর্যদেরও জয় করেছিল। যার প্রমাণ ঋগবেদের উদাহরণ থেকেই পাওয়া যায়। অর্থাৎ ঋগবেদে দেখা যায় দাস এবং দস্যুরা আলপাইন আর্যদের পক্ষ নিয়ে নর্ডিক আর্যদের বিরুদ্ধে সর্বদাই যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। আর নর্ডিক আর্য ব্রাহ্মণেরা যে সত্যিই দাস, দস্যু, রাক্ষস, অসুর এবং আলপাইন আর্যদের জয় করেছিলেন তা অনুপ্রবেশকারী বৈদিক নর্ডিক আর্য ব্রাহ্মণের নিত্যনতুন বৈদিক আইন প্রনয়ণ এবং বৈদিক ধর্মের উপর পরবর্তীকালীন প্রাধান্য থেকেই পরিষ্কার। অতএব ডঃ আম্বেদকরের সদ্ধান্ত থেকে প্রমাণিত নর্ডিক আর্য ব্রাহ্মণেরা বিদেশি ইউরোপিয়ান অনুপ্রবেশকারী। কিন্তু আলপাইন আর্যরা দেশীয় অসুর জাতি বলেই পরিচিত। যে আলপাইন বা অসুর জাতি নর্ডিক আর্য আগমনের অনেক পূর্বেই নগরকেন্দ্রিক সিন্ধু সভ্যতা গড়ে তুলেছিলেন।
প্রাচীন ভারতে হিন্দু বলে কোনো ধর্ম ছিল না। প্রকৃত অর্থে হিন্দুধর্ম বলে কোনো কথার মানেও হয় না। ভারত উপমহাদেশে এরকম কোনো ধর্মের আবির্ভাবও হয়নি। হিন্দুধর্ম বলতে বুঝতে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দ্বারা রচিত ব্রাহ্মণ্য অনুশাসন। বলা যায় ব্রাহ্মণ্যধর্ম। যেহেতু ব্রাহ্মণ্যধর্মের নির্দিষ্ট কোনো মুখ নেই, বহুমুখী–সেই কারণেই হিন্দুধর্মকে সনাতন ধর্ম বলাটাই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ, সামগ্রিক।
রামায়ণ ও মহাভারতই ভারতীয় মহাদেশের ভারতত্ব। রামায়ণ ও মহাভারতেই লুকিয়ে আছে হিন্দুজাতির অস্তিত্ব, অনস্তিত্ব। ভারত উপমহাদেশে বহিরাগত আর্য তথা ব্রাহ্মণরা তাঁদের রচিত শাস্ত্র-সাহিত্য নিয়ে বহু বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এইভাবে ভারতের ভারতীয়তার প্রসারের ফলে এশিয়া ভূখণ্ডের কয়েকটি দেশকে Greater India বা বৃহত্তর ভারত নাম দিয়ে বিশালতর ভারতবর্ষের এক একটি অংশ বলে ধরে নেওয়া হয়। সেই বৃহত্তর ভারতের অংশগুলি হল ব্রহ্ম, শ্যাম, কম্বোজ, কোচিন-চিন বা চম্পা এবং লাওস। মালয় উপদ্বীপ ও ইন্দোনেশিয়া অর্থাৎ দ্বীপময় ভারত বা দ্বীপান্তরের দ্বীপ। যেমন–সুমাত্রা, যবদ্বীপ, লম্বক, সুম্বাওয়া, তিমোর, সুলাবেশি, বোর্নিও প্রভৃতি।
ভারতবর্ষ থেকে যেসব দেশে ভারত-ধর্মের ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের প্রচার হয়েছে, সেইসব দেশে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণাদি পৌঁছে গেছে। এর ফলে দক্ষিণ ব্ৰহ্ম, দক্ষিণ শ্যাম, কম্বুজ দেশ (Cambodia), উত্তর ও মধ্য ব্রহ্মের থুল চুক (Thul-Cuk), উত্তর শ্যামের দৈ (Dai) বা থাই (Thai) জাতি, চম্পার চাম (Cham) জাতি, মালয় উপদ্বীপের মালাই জাতি এবং যবদ্বীপের সুন্দা, মাদুরা ও যবদ্বীপীয় জাতি বা বলিদ্বীপের ও লম্বক দ্বীপের অধিবাসীরা সকলেই এককালে ব্রাহ্মণ্য আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ধর্ম ও সমাজ গড়ে তোলে। এই ধর্মপ্রসারে বেদ, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণাদিই ছিল একমাত্র অস্ত্র। ব্রাহ্মণ তথা আর্যরা যে কত মহান’ জাতি, তা এই গ্রন্থগুলিতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণিত হয়েছে। পরে অবশ্য ব্রাহ্মণ্য অনুশাসনের বিরোধিতা করে প্রতিস্পর্ধী বৌদ্ধধর্মের উত্থান হলে ব্রাহ্মণধর্ম অনেকটাই খর্ব হয়ে যায়। একদা ব্রাহ্মণ্য অনুশাসন বা ধর্মে যেসব দেশ সমাজ গড়েছিল, সেইসব দেশ এখন বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের বৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ। সেইসব দেশগুলি হল–চিন, থাইল্যান্ড, জাপান, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া প্রভৃতি। ভারত উপমহাদেশের মানুষ ব্রাহ্মণ্যধর্ম ত্যাগ করে কিঞ্চিৎ বৌদ্ধ এবং অনেকটাই ইসলাম ধর্মকে গ্রহণ করে নিয়েছে।
রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণাদি যদি যথাযথভাবে সংরক্ষিত করা না যেত, যদি এইসব গ্রন্থে প্রক্ষিপ্তভাবে ব্রাহ্মণদের আধিপত্য প্রবেশ ঘটানোনা যেত, তাহলে তথাকথিত হিন্দুধর্মের বিলোপ ঘটে যেত। ব্রাহ্মণদের মাহাত্মও প্রচার পেত না। যে রামায়ণ গ্রন্থটি নিয়ে এতক্ষণ আলোচনা করা হল সেই রামায়ণ কি একজন বাল্মীকির রচনা? না, এই বাল্মীকি রামকথাকার আদিকবি নন। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, রাম আমলের প্রচেবংশীয় পুরুষ বলে নিজের পরিচয় দিয়েছে। ভারতীয় ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় রামকে সামনে রেখে একটির পর একটি অন্যায় করে গেছেন, আর সেই অন্যায়গুলি যে অন্যায়ই নয় সেটা বোঝানোর জন্য অলৌকিক ঘটনা প্রবেশ ঘটিয়ে মাহাত্ম প্রচার করে গেছেন। তাই রাম হয়েছেন সমস্ত অপবাদ ও অপ্রশংসার লক্ষ্য। তাই রাম সমালোচনার উর্ধ্বে থাকতে পারলেন না কোনোভাবেই।
রাম অসহায় রাজা, বেবশ মানুষ। গোটা রামায়ণ জুড়ে রামের যে কার্যকলাপ রামের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল না। সীতাকে একাকী পঞ্চবটিতে ফেলে গভীর অরণ্যে শিকারে যাওয়া; বালীকে হত্যা করা; সুগ্রীবের সঙ্গে দোস্তি করা; পায়ে পা লাগিয়ে রাবণের যুদ্ধ করে তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করা; সীতার সতীত্ব যাচাই করার জন্য আগুনে ঠেলে দেওয়া; সীতাকে অপমান করা; সীতাকে জঙ্গলে পরিত্যাগ করা; লক্ষ্মণকে বর্জন করা; লব, কুশ, ভরত ও শত্রুঘ্নকে ভিনরাজ্যে ঠেলে দেওয়া; রামের সদলবলে সরযূ নদীতে আত্মবিসর্জন দেওয়া কোনোকিছুই রামের ইচ্ছামতো হয়নি–রাম ব্রহ্মাবাদী নিষ্ঠুর ব্রাহ্মণ্য-চক্রান্তে বন্দি। রাম নিজেও এসবের কিছু বোঝেননি, তা কিন্তু নয়। রাম নিজের মুখেই বলেছেন–“দেবগণের সকল কার্যে আমি ব্ৰহ্মার বশবর্তী”। বুঝলেও কিছু করারও ছিল না রামচন্দ্রের। এসব কাজে রামের যে বিন্দুমাত্র আপত্তি ছিল না একথা বলা যায় না। কে শোনে তাঁর আপত্তি! আপত্তি শোনার জন্যই কি এত পরিকল্পনা! ব্রাহ্মণ্য-চক্রান্ত যে কত নির্মম আর। নিষ্ঠুর রামকথা তারই জলন্ত প্রমাণ। এই ব্রাহ্মণ নেতাদের হুকুমেই রাম সর্বসমক্ষে সরযূ নদীতে জীবন বিসর্জন বাধ্য হয়েছেন। রামের জীবন সুখে কাটেনি, শেষ জীবন তাঁর বড়োই কঠিন অবস্থা দিয়ে গেছে। মমর্যাতনায় দিনগুলি শেষ হয়েছে তাঁর। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে অবাধে লুণ্ঠনে পরিতৃপ্ত হয়েছেন নেপথ্যের পরিচালকবৃন্দ ব্রাহ্মণগণ। রামচন্দ্র কর্তৃক সমস্ত কর্মকাণ্ডের উপর ব্রাহ্মণদের তীক্ষ্ণ নজর ছিল। ছিল স্পষ্ট নির্দেশ। গোটা রামায়ণে ব্রাহ্মণদের অঙ্গুলিহেলন ছাড়া গাছের একটি পাতাও নড়েনি। রামের শেষ পরিণতির জন্য ব্রাহ্মণরাই দায়ী। ব্রাহ্মণরাই রামের জীবন থেকে সমস্ত প্রিয়পরিজনদের একে একে সরিয়ে দিয়েছেন। এঁদেরই অঙ্গুলিহেলনে রাম বিধ্বস্ত, রাম একাকী। আর এক ব্রাহ্মণ গোষ্ঠীরাই নয়, ব্রাহ্মণদের সঙ্গে ছিল বৃহৎ শক্তির ধারক সম্প্রসারণবাদী তথা সাম্রাজ্যবাদী আর্যদেবতাদের সেনাদল! অথচ নিজেদের গায়ে কোনো কাদাই লাগতে দেননি তাঁরা।
রামায়ণের কেবলমাত্র রামকথাই নয়, রামকথা ধর্মকথাও। অনুশাসনই ধর্মকথা, বাল্মীকি সামাজিক নানা অনুশাসনও উল্লেখ করেছেন, যা অত্যন্ত মূল্যবান। এই কারণেই বোধহয় মহাকাব্য ধর্মগ্রন্থ হয়ে উঠেছে। ধর্মশাস্ত্রের মতোই রামায়ণেও অনুশাসন উচ্চারিত হয়েছে। মহাভারতও সেই কারণেই ধর্মগ্রন্থ। রামায়ণের ছত্রে ছত্রে অনুশাসনের বিবরণ নির্দেশিত হয়েছে–কখনো গল্পের মাধ্যমে, কখনো-বা সরাসরি নির্দেশনা। কোনো প্রতিষ্ঠানকে সুনিয়মে পরিচালিত করতে হলে তার জন্য বিধিবদ্ধ নিয়মের প্রয়োজন হয়। অন্যায়ের পরিহার ও নিয়ম সংরক্ষণই সেই বিধিবিধানের উদ্দেশ্য। স্মৃতিও এই উদ্দেশ্যের জন্যই রচিত হয়েছিল। মনে রাখতে হবে প্রাচীন যুগে রাজনৈতিক, সমাজনৈতিক ইত্যাদি সকল বিষয়ে স্মৃতির অনুশাসন নিয়ন্ত্রণ করত। পাপের পরিহার ও পুণ্যের প্রতিষ্ঠাই সমাজ অনুমোদিত ধর্মশাস্ত্রের উদ্দেশ্য। তবে পক্ষপাতিত্ব যে ছিলই একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। বর্ণভেদে একই অপরাধের শাস্তি ভিন্ন হত। আইন সকলের জন্য সমান–এ অঙ্গীকার প্রাচীন যুগের অনুশাসনে ছিল না। তবে সূর্যাভিমুখে মলমূত্র ত্যাগ করা, সন্তানের মতো পালনকারী রাজার বিরুদ্ধাচরণ বা বিদ্রোহ করা, গুরুর উপদেশ ভুলে যাওয়া, গুরুনিন্দা করা, গুরুকে অবজ্ঞা করা, পা দিয়ে গোরুকে স্পর্শ করা, কাজ করিয়ে ভৃত্যকে বেতন না-দেওয়া, পরনিন্দা করা, পায়েস ও খিচুড়ি ভক্ষণ করা, বন্ধুর সঙ্গে শত্রুতা করা, প্রত্যুপকার না-করা, পুত্রহীন হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হইয়া, লাক্ষা-মধু-মাংস-লৌহ-বিষ বিক্রয় করা, শিশু ও বৃদ্ধদের হত্যা করা, অনুগত ভৃত্যকে পরিত্যাগ করা, মদ-নরী-অক্ষক্রীড়ায় আসক্ত হওয়া, কাম ও ক্রোধে অভিভূত হওয়া, স্বধর্মে অনাসক্তি হওয়া, গৃহ দগ্ধ করা, গুরুপত্নী ভোগ করা, পিতামাতার শুশ্রূষা না-করা, নিজের পত্নীকে পরিত্যাগ করে পরস্ত্রীতে আসক্ত হওয়া ইত্যাদি ছিল দণ্ডনীয় অপরাধ।
রামায়ণ প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক প্রবোধচন্দ্র সেন লিখেছেন–“সব বিবর্তনের ন্যায় এই বিবর্তনের মধ্যেও একটি ঐক্য অপরিবর্তিত রূপে নিত্য বিরাজমান আছে। এই সূক্ষ্ম ঐক্যসূত্রই ভারতবর্ষের অতীতের সঙ্গে তার বর্তমানকে অচ্ছেদ্য রূপে গেঁথে রেখেছে। এই রূপেই রামায়ণ কাব্যখানি ভারতবর্ষের যথার্থ ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। তথ্যগত ইতিহাস নয়, সত্যগত ইতিহাস, নিছক তথ্যগত হলে রামায়ণের প্রভাব কখনো এমন গম্ভীর হতে পারত না। কেননা তথ্য হচ্ছে বাইরের জিনিস, জাতির অন্তরাত্মাকে স্পর্শ করবার ক্ষমতা তার নেই এবং আপনার কালের সীমাকে অতিক্রম করে নিত্যকালকে সে অধিকার করতে পারে না।” রামায়ণ বা রামকথা ভারতবর্ষের প্রাণস্বরূপ। ভারতের প্রায় সব ভাষায় বাল্মীকির রামায়ণকে নতুন করে লিখেছেন বহু প্রণম্য কবি। রাম পরমপুরুষত্বের কথা স্পষ্টভাবে স্বীকার করেননি। তিনি সবসময় নিজেকে মানুষ বলেই পরিচয় করেছেন। বাল্মীকিও রামকে দেবতা বা ভগবান বলেননি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন–”এই মহাকাব্যে রাম নিজেকে অবতার মনে করেননি, তাই তিনি মর্থ্য নায়ক। এখানে উচ্চ আধ্যাত্মিকতা অনুপস্থিত।”
অনেকে মনে করেন রামায়ণ কেবল কাহিনিমাত্র নয়, রামায়ণ একটি রূপক, প্রতীকী। কৃষি বিস্তার উপলক্ষ্যে আর্য ও অনার্যদের মধ্যে সংঘাত হল রামায়ণ বর্ণিত রাম-রাবণের যুদ্ধের মূলকথা। রাম-লক্ষ্মণ-সীতা হলেন কৃষি সভ্যতার প্রতিভূ। বিশ্বামিত্র ও জনক হলেন তাঁদের সহায়ক। রাবণ ও তাঁর স্বর্ণলঙ্কা হল শিল্প সভ্যতার প্রতীক। দক্ষিণ ভারত থেকে শিল্প সভ্যতার প্রাধান্য হ্রাস করে কৃষি সভ্যতার বিস্তার করতে গিয়ে আর্য ও অনার্যদের মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দেয়। পরিণামে বিজয়ী আর্যরা দক্ষিণ ভারতে কৃষিনির্ভর নব সভ্যতার প্রসার করে। প্রাবন্ধিক প্রবোধচন্দ্র সেন রামায়ণের রূপকাৰ্থ নির্ণয় করে লিখেছেন–আর্যরা প্রথমে পূর্ব ভারতে ও পরে দক্ষিণ ভারতে অনার্য শক্তিকে প্রতিহত করে কৃষিনির্ভর নব সভ্যতার বিস্তার করেন।
আবার অনেকে মনে করেন–রাম, লক্ষ্মণ, জনক, রাবণ প্রভৃতি চরিত্রগুলি আসলে কোনো ঐতিহাসিক ব্যক্তিবিশেষ নয়, সত্তা মাত্র। রামচন্দ্র মানে ক্রীড়াকারী পুঁজি। রাবণ মানে যে শাসক রব করে, অর্থাৎ প্রজাদের জন্য অনেককিছু করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় কিন্তু বাস্তবে করে দেয় না। রামায়ণে সেই শাসক পরাজিত হয় এবং দেশে লক্ষ্মীপুঁজির বিকাশ ঘটে। বৈদিক ভারতের বৌদ্ধ ভারতে উত্তরণের সঙ্গে রামায়ণের কাহিনির মিল রয়েছে। বৌদ্ধযুগেও পুঁজির বিকাশ ঘটে এবং বৈদিক যুগের অবসান ঘটে। পুরোহিত শ্রেষঠ রাবণকে বৈদিক যুগের প্রতিভু বলে বিবেচনা করা যায়। রাম তার শাসনের অবসান ঘটিয়ে রামরাজত্ব গড়ে তুলেন। রামরাজত্ব। বলতে যোড়শ মহাজনপদকে বুঝেছেন। রামায়ণের লঙ্কা আসলে শ্রীলঙ্কা দেশ নয় বরং তা ভারতের শাসনকেন্দ্রের প্রতীক যা জনসমুদ্রের মধ্যে দ্বীপ রূপে প্রতিষ্ঠিত থাকে। রামায়ণের হনুমান আসলে দক্ষ পণ্ডিতদের প্রতীক, যারা বৌদ্ধবিপ্লবে সহায়তা করেছিলেন। তার লেজটিকে সেক্ষেত্রে ডিগ্রির লেজ বলে বুঝে নিতে হবে। আর জনক মানে যিনি জন (কৃষিশ্রমিক) করে পাইকারি হারে কৃষিকার্য শুরু করেছিলেন। প্রসঙ্গত, যৌথ সমাজে একজন মানুষ আর একজন মানুষকে জন করে খাটাবে এমন ব্যাপারটি অকল্পনীয়। সীতা আসলে জনকের কৃষি মজুরদেরই প্রতিভু। ওরা অন্ন উৎপাদন করে বলে ওরাই লক্ষ্মী। রামের সঙ্গে ওদের বিবাহ মানে কাজের চুক্তি বলে বুঝতে হবে।
পণ্ডিত শুভাশিস চিরকল্যাণ পাত্র মনে করেন–“রামায়ণের কাহিনি আসলে ভারতের মানুষের মুক্তিসংগ্রামের কথা। রামায়ণে আছে দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের কথা, মৌলবাদী প্রাচীন শাসককে তার ক্ষমতার কেন্দ্র (লঙ্কা) থেকে বের করে রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠার কাহিনি। এখানে রামরাজত্ব মানে বড়ো রাজত্ব বুঝতে হবে যে রাজত্বে লক্ষ্মীপুঁজির বিকাশ হয়েছিল এবং প্রজারা আরামে ছিল। লঙ্কা মানে শ্রীলঙ্কা দেশ নয় বরং রাক্ষসের রমণস্থান’ (রাক্ষস মানে দুষ্ট শাসক/ যে জনগণের সম্পদ রক্ষা করার নামে ভক্ষণ করে) তথা দেশের তৎকালীন শাসনকেন্দ্র। নিম্নবর্ণের মানুষ যেমন চণ্ডাল, শবর প্রভৃতিরাও রামরাজত্বে সম্মান পেয়েছিল। বাল্মীকিরা ছিলেন এই পরিবর্তনের হোতা। সবাই জানেন কয়েক বছর মাত্র আগে বাঙালি কবি ও বিদ্বজনেরাও শ্লোগান তুলেছিলেন ‘পরিবর্তন চাই’। তারপর আমাদের রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটেছিল। তেমনিভাবে বাল্মীকিরা রামায়ণ রচনা করার পর এই দেশে রামরাজত্ব এসেছিল বলে ভাবা যায়। কবিরা শুধু বসে বসে কবিতা লেখেন না, তাঁরা যে সমাজপরিবর্তনের কারিগর হতে পারেন সে কথা বলাই বাহুল্য। বাল্মীকিরা রামায়ণ লিখে ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসনের অবসান ঘোষণা করেন। তারপর আসে বৌদ্ধযুগ। বৌদ্ধযুগে বর্ণভেদের তীব্রতা হ্রাস পায়। রামচন্দ্রকে আমরা চণ্ডালের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে এবং তার বাড়ি গিয়ে খাবার খেতে দেখি। নিম্নবর্ণের শবর প্রভৃতিদেরও তিনি বন্ধুরূপে চিত্রিত। শম্বুক হত্যা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং কেবলমাত্র তাই দিয়ে রামচন্দ্রের বিচার করা চলে না। হতে পারে এই ঘটনা রামায়ণে প্রক্ষিপ্ত অথবা বেদবাদীদের চাপে এই কাহিনি রামায়ণে ঢুকানো হয়েছিল।”
এক রামায়ণ, অনেক দৃষ্টিভঙ্গি, অনেক অভিমুখ। যদিও খুব কম সংখ্যক মানুষ বাল্মীকির রামায়ণ পাঠ করেছেন। বেশিরভাগ ভাগ মানুষ অতিরঞ্জিত আঞ্চলিক ভাষার রামায়ণ পাঠ করে রাম ও রামায়ণ বিষয়ে জ্ঞানধারণ করেন। তবে একটা বড়ো অংশের মানুষ রামায়ণ পাঠ করা তো দূরের কথা, রামায়ণ ছুঁয়ে দেখারও উৎসাহ বোধ করেননি। এরকম মিশ্র ভারতীয়দের কাছে রাম নানারূপে বর্ণিত হয়ে আছে। আঞ্চলিক রামায়ণগুলিতে যতই অতিরঞ্জিত থাক না-কেন, ভারতবাসীর কাছে রামায়ণ চিরনতুন। কোনোদিন পুরোনো হয়নি, হয় না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘রামায়ণ’ নিবন্ধে কী লিখেছেন, দেখা যাক–“দেবতার অবতারলীলা লইয়াই যে এ কাব্য রচিত তাহাও নহে। কবি বাল্মীকির কাছে রাম অবতার ছিলেন না, তিনি মানুষই ছিলেন–পণ্ডিতেরা ইহার প্রমাণ করিবেন। এই ভূমিকায় পাণ্ডিত্যের অবকাশ নাই; এখানে এইটুকু সংক্ষেপে বলিতেছি যে, কবি যদি রামায়ণে নরচরিত্র বর্ণনা না করিয়া দেবচরিত্র বর্ণনা করিতেন তবে তাহাতে রামায়ণের গৌরব হ্রাস হইত, সুতরাং তাহা কাব্যাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হইত। মানুষ বলিয়াই রামচরিত্র মহিমান্বিত।”
তিনি মানুষ হোক কিংবা দেবতা, অথবা অবতার হোক–আধুনিক ভারতবর্ষে তাঁর রাজত্বকাল ফিরে চায় দেশের একটা অংশ, একটা রাজনৈতিক দল। রাম-রাজত্ব’ শব্দযুগল আমরা প্রথম শুনতে পেয়েছিলাম গান্ধিজির মুখে, বোধ হয়। ব্রিটিশ-মুক্ত ভারতবর্ষে নাকি রাম-রাজত্ব চলবে। কিন্তু কী সেই রাম-রাজত্ব? কেমন সেই রাম-রাজত্ব? রাম-রাজত্বে কী এমন বৈশিষ্ট্য আছে, যা নেতা-নেত্রীরা বারবার স্বপ্ন দেখায়, সাধারণ মানুষ বারবার স্বপ্ন দেখে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বেশিদূর যাওয়ার প্রয়োজন নেই। যে হিন্দুর ঘরে বাল্মীকির রামায়ণ’ আছে তাঁরা পাতা উলটাতে পারেন। আমিও উলটাচ্ছি আসুন। আমি এখন বালকাণ্ডমের (অনেকের মতে এই কাণ্ডটি বাল্মীকি রচনা করেননি, এই কাণ্ডটি উত্তরকাণ্ডের মতোই প্রক্ষিপ্ত) প্রথম সর্গে আছি। কী উল্লেখ আছে? আসুন মহর্ষি নারদের বয়ানটি বাংলা তর্জমায় পড়ি।
নারদের মুখে রামচন্দ্রের শাসিত রাজ্য অযোধ্যার এক মনোরম সুখসমৃদ্ধির ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। দেবর্ষি নারদ বাল্মীকিকে বলছেন, “রাম-বিরহে এতকাল প্রজারা দুর্বিষহ মনঃকষ্ট ভোগ করেছিল। এখন রাম অযোধ্যার সিংহাসনে বসেছেন। তাঁর আদর্শ সুশাসনে প্রজাদের সুখসমৃদ্ধির সীমা থাকবে না। প্রথম তাদের মনের কষ্ট দূর হওয়ায় প্রজারা আদিমুক্ত হল। শ্রীরামের রাজত্বে আধ্যাত্মিক আধিদৈবিক এবং আধিভৌতিক সন্তাপ থেকে মুক্ত হবে অযোধ্যার নগরবাসী। নীরোগ দেহে তারা রামকে রাজা হতে দেখে অত্যন্ত সন্তুষ্ট, আনন্দে, রোমাঞ্চে অত্যুচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ হল। কারণ রাম প্রজাপালনে সদা ব্রতী, সর্বজনরক্ষক। তাঁর সুশাসনে সকল প্রজা ধনসম্পদে সমৃদ্ধ হয়ে ক্ষোভমুক্ত, আনন্দিত, সন্তুষ্ট। কোনো প্রজাকেই দারিদ্র্যের জ্বালা ভোগ করবে হবে না। রামের সতর্ক দৃষ্টির ফলে প্রজারা সকলে নিজের নিজের কর্মে লিপ্ত থাকবে। তাদের অপুষ্টিজনিত রোগ কোনোদিন থাকবে না। শরীর নীরোগ থাকার সুস্থদেহে তারা সুন্দরভাবে ধর্মাচরণ করতে পারবে। দুর্ভিক্ষের ভয় না-থাকার সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ রাম-রাজত্বে আকালের কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। পিতৃহৃদয়ের আকুলতা নিয়ে তিনি প্রজাদের রক্ষণাবেক্ষণ করতে থাকবেন। ফলে সকল প্রজা শারীরিক ও মানসিক সর্বপ্রকার ব্যাধিমুক্ত, নীরোগ, সুস্থ জীবনযাপন করবে। চারদিকে শান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি হবে।”
এখানেই শেষ নয়, রাম-রাজত্বে কখনও অকালমৃত্যু ঘটবে না। কোথাও কোনো স্থানে পিতা তাঁর পুত্রের মৃত্যু দেখে দুঃখকষ্ট পাবেন না। অর্থাৎ রামশাসিত রাজ্যে কোথাও কারও পুত্রশোক থাকবে না। কারণ শ্রীরামচন্দ্র হলেন নিষ্পাপ মহাপুণ্যবান রাজা। সব রমণী স্বামীর প্রতি একান্ত অনুরক্ত থাকবেন। পতিই তাঁদের ধ্যান ও জ্ঞান হবে। তাঁরা ব্যভিচারিণী হয়ে কখনও পরপুরুষে আসক্ত হবেন না। তাঁরা কখনও বৈধব্য যন্ত্রণা ভোগ করবে না। সকল নারী রাম-রাজত্বে সতীসাধ্বী পতিব্রতা হয়ে দিনযাপন করবেন। “ন পুত্রমরণং কোচিৎ দ্রক্ষ্যন্তি পুরুষা ক্কচিৎ।/নাশ্চাবিধবা নিত্যং ভবিষ্যন্তি পতিব্রতাঃ তথা”(বালকাণ্ডম–প্রথম সর্গ, শ্লোক-৯১)। রামশাসিত রাজ্য আধিদৈবিক সন্তাপমুক্ত করতে হবে। তাঁর রাজ্য অগ্নি, বায়ু এবং জলে কখনও বিপন্ন হবে না। কোনো প্রাণী বা কোনো ব্যক্তি অগ্ন্যুৎপাত, বন্যার জলোচ্ছাসে অথবা প্রবল ঝঞ্ঝায় কখনও পীড়িত হবে না। “ন চাগ্নিজন ভয়ং কিঞ্চিন্নাসু মজ্জন্তি জন্তবঃ।/ন বাতজং ভয়ং কিঞ্চিন্নাপি জ্বরকৃতং তথা”(বালকাণ্ডম–প্রথম সর্গ, শ্লোক-৯২)। রাজা, দস্যু, তস্কর, হিংস্র প্রাণী প্রভৃতির হাত থেকে রক্ষা পাবে। তাঁর রাজত্বকালে রাজ্যের কোথাও কোনো প্রাণী অনাহারে কষ্ট পাবে না। কারও ক্ষুধা-তৃষ্ণার ভয় থাকবে না। দেশ, জনপদ, নগরগুলি ধনধান্যে এমনই সমৃদ্ধ থাকবে যে লোকে চুরি করার প্রয়োজনই বোধ করবে না। ফলে চোর বা তস্কর, ডাকাতের ভয় থাকবে না। “তন চাপি ক্ষুদভয়ং তত্র ন তস্করভয়ং তথা।/নগরাণি রাষ্ট্রাণি ধনধান্যযুতানি চ তথা”(বালকাণ্ডম–প্রথম সর্গ, শ্লোক-৯৩)। ত্রিতাপমুক্ত সর্বসাধারণ পরিশুদ্ধ সত্যযুগের মতোই ত্রেতাযুগেও রাম-রাজত্বে চূড়ান্ত আনন্দে দিনযাপন করবে–“নিতং প্রমুদিতাঃ সর্বে যথা কৃতযুগে তথা”।
নারদের কথন কেবল কথার কথা, অলীক কল্পনা। ভেবে দেখুন, নারদ বলছেন–রামের রাজত্বে কোনো নারী বিধবা হন না, রামের রাজত্বে কোনো শিশুর মৃত্যু হয় না, কোনো মানুষের রোগশোক হয় না, মানুষ এহেন রাজত্বে প্রমসুখে গণ্ডায় গণ্ডায় পুত্র জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। রামরাজত্বে সবাই সহস্ৰজীবী। চোরডাকাত নেই। মানে জরামৃত্যুহীন এক কল্পনার রাজত্ব। আসলে বাস্তবে এমন কিছু ঘটেইনি। ঘটতে পারে না। জন্ম-মৃত্যু জীবনের ধর্ম, নিয়ম। এ নিয়ম কখনোই স্তব্ধ হতে পারে না, হয়ওনি। যৌক্তিকও নয়, প্রলাপমাত্র। মূলত রামরাজত্বে প্রজারা কেমন ছিলেন, সে ব্যাপারে রামায়ণে কোনো যথার্থ চিত্র মেলে না। প্রকৃত ঘটনা, রাম-লক্ষ্মণ-ভরত প্রমুখ সরযূ নদীতে আত্মঘাতী হলে অযোধ্যা জনশূন্য হয়ে পড়েছিল।
এরপর কত যুগ কেটে গেল। রামায়ণের যুগের পর মহাভারতের যুগ, বৌদ্ধযুগ, দীর্ঘ ৮০০ বছরের মুসলিম যুগ, প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ যুগ সবই তো অতীত হয়ে গেল, রাম-রাজত্ব কোথায় গেল! নাকি সবটাই রাম রাজত্বের মধ্য দিয়েই যাচ্ছি, এখনও সেই রাম-রাজত্বটাই চলছে। রামায়ণের রাজ্যটা ঠিক কেমন তার একটা রূপরেখা তো দেওয়া গেল। রামায়ণে ‘রাজত্ব’ বলতে যা পাই, তা হল–(১) দশরথের রাজত্বের বর্ণনায়, (২) গ্রন্থখানি লেখার আগে নারদ কর্তৃক বাল্মিকীকে রামচন্দ্রের ব্যাপারে যেটুকু রূপরেখা দিয়েছিলেন। বাল্মীকির “রামায়ণম”- এ মহর্ষি নারদ বলছেন–“দশবর্ষসহস্রাণি দশবর্ষশতানি চ।/রামো রাজ্যমুপাসিত্বা ব্রহ্মলোকং গমিষ্যতি তথা”(বালকাণ্ডম–প্রথম সর্গ, শ্লোক-৯৭)। অর্থাৎ, রামচন্দ্র এগারো হাজার বছর ধর্মবোধের সঙ্গে রাজত্ব করে ব্রহ্মলোকে প্রয়াণ করবেন। তাহলে হিসাবমতো রামচন্দ্র এখনও রাজত্ব চালাচ্ছেন। এ কেমন রাম-রাজত্ব চলছে? অবশ্য ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের পূর্বেই ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়েছে। এরপর ব্রিটিশমুক্ত স্বাধীন ভারতে এ পর্যন্ত ১৮টি শাসক বা প্রধানমন্ত্রীর আবির্ভাব লক্ষ করেছি। রাম বা রামের মতো কোনো শাসককে পেলুম কী! কেমন হবে রাম-রাজত্বের আধুনিক রূপরেখা?
‘রামরাজ্য’ শব্দটির মধ্যে বর্তমানে অনেকে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ খুঁজে পেলেও প্রকৃতপক্ষে শান্তিময় পৃথিবীর সমার্থক হিসাবেই ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্র এ শব্দটি বাগধারা হিসাবে মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। তবে এ শব্দটি সবচেয়ে বেশি শুনতে পাওয়া যায় ভারতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বক্তৃতায় এমন কি নির্বাচনী ইশতেহারেও। তারা অনেকেই একবিংশ শতাব্দীতে ভারতকে রামরাজ্যে পরিণত করতে প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন। দেন না কেবল কেমন হবে রাম-রাজত্ব, তার ধারণা। সনাতন ধর্মবিশ্বাসমতে কলিযুগের শেষে আরেকবার সত্যযুগের আবির্ভাব হওয়ার কথা। অনেক ভারতীয় জ্যোতিষ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, সে সময় অত্যাসন্ন। সে যাই হোক, মোদ্দা কথা হচ্ছে ১০ হাজার বছর পরও রামরাজত্বের মতো একটি শান্তিময় রাষ্ট্রব্যবস্থা মানুষের কাছে অতি আকাঙ্ক্ষিত বস্তু। শান্তিময় রাষ্ট্র’ মানে তো জনশূন্য অযোধ্যা, চলতি কথায় যাকে ‘শ্মশান-শান্তি’। বাল্মীকিও সেই সত্য আড়াল করেননি।
মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, দেশ স্বাধীন হলে ভারতে ‘রামরাজত্ব’ ফিরে আসবে। যখনই তিনি তার স্বপ্নের আদর্শ রাষ্ট্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতেন, তিনি রামরাজ্যের কথা বলতেন। রামরাজ্যের শ্লোগানের মাধ্যমে গান্ধীজি বোঝাতে চেয়েছিলেন এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ থাকবে না, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত থাকবে, মানুষে মানুষে কোনো বৈষম্য থাকবে না, কেউ কোনো কাজের কৃতিত্ব দাবি করবে না, সর্বত্র আত্মত্যাগের চর্চা হবে। রামরাজ্যের যেন কোনো অপব্যাখ্যা না-করতে পারে বা একে কেবল হিন্দু সাম্প্রদায়িক শ্লোগান হিসাবে মনে না করা হয়, এজন্য গান্ধীজি নিজেই এর ব্যাখ্যা প্রদান করেন তার লেখায় এবং বক্তব্যে–বলাই বাহুল্য, সোনার পাথরবাটি। গান্ধীজি এও বলেছিলেন, “কেউ যেন ভুলবশত মনে না-করেন যে রামরাজ্য মানে হিন্দুর শাসন। আমার কাছে রাম হচ্ছে আল্লাহ বা ঈশ্বরের অপর নাম। আমি প্রকৃতপক্ষে চাই খোদার শাসন, যা পৃথিবীর বুকে আল্লাহর রাজত্বেরই সমার্থক।”
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রতিটি জনসভায় রাম মন্দিরের কথা সযত্নে এড়িয়ে গেলেও বারাণসীতে রামরাজ্যের কথা শোনা গেল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গলায়। উন্নয়নের কথা বলতে গিয়ে তিনি ‘রামরাজ্য’ প্রসঙ্গ তোলেন। তাঁর সাফ কথা, মানুষই একদিন এই রাজ্যে ‘রামরাজ্য’ প্রতিষ্ঠা করবে। তাঁর বক্তব্যকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল। ‘রামরাজ্য’ বানাতে চান উমা ভারতীও। তুলসীদাসের রামচরিতমানসে রামচন্দ্রের যে ছবি আঁকা হয়েছে, সেই রামচন্দ্রই উত্তরপ্রদেশ ছাড়িয়ে সমগ্র গো-বলয়ে চরম জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। তুলসীদাসই তাঁর রামায়ণে রামরাজ্যের মহিমা কীর্তন করে অনেক চৌপদী গেয়েছেন। ধনিক-বণিকদের হিতার্থে পরিচালিত শাসনব্যবস্থাকে রামরাজ্য আখ্যা দিয়ে করপাত্রী মহারাজও খুব প্রচার করেছেন। করপাত্রী মহারাজের রামরাজ্য ধর্ম-নিয়ন্ত্রিত।
রাহুল সাংকৃত্যায়নের রামরাজ্যের ধারণা সামান্য উল্লেখ করি–“সেই ধর্ম অনুসারে যদি কোনো শূদ্র বেদ শুনে ফেলে, তাহলে তার কানে গলন্ত সিসা ঢেলে দিতে হবে। আর কেউ যদি বেদ উচ্চারণ করে, তাহলে সেই বেদ উচ্চারণকারী শূদ্রের জিভ কেটে ফেলতে হবে।” প্রাচীন বস্তুবাদীরা বলতেন–“ভণ্ড, ধূর্ত এবং নিশাচরেরাই কেল তিন বেদের কর্তৃত্ব মেনে চলে। (ত্রয়ো বেদস্য কর্তারো ভণ্ড-ধূর্ত-নিশাচরাঃ)” করপাত্র মহারাজের রামরাজ্য এরকম–“রামরাজ্যবাদী জড় এবং চেতন উভয়কেই আধ্যাত্মিকভাবে সমন্বিত করে। তেমনভাবেই রাজতন্ত্র প্রজাতন্ত্র, ব্যক্তি-সমষ্টি, বিত্ত-বিভেদ এবং শ্রম-বিভেদেরও সমন্বয় সাধন করে। এভাবে অধ্যাত্মবাদের উপরে প্রতিষ্ঠিত, আরম্ভ থেকে অন্ত পর্যন্ত ধর্ম নিয়ন্ত্রিত, ধর্ম সাপেক্ষ, পক্ষপাতহীন শাসনতন্ত্রই সর্বোচ্চ মানব কল্যাণকারী এবং এই ব্যবস্থাই প্রগতির চরমতম সীমা৷”
আবার রাহল সাংকৃত্যায়নের কাছে যাই–“দক্ষিণ ভারত প্রাচীন রামরাজ্যের বড়ো সমর্থক। ছুৎমার্গের বিচারে তারা উত্তর ভারতের লোকের কান কাটে। বড়ো বড়ো বৈদান্তিক, মীমাংসক, বৈদিক প্রভৃতির জন্ম হয়েছে এখানকার ব্রাহ্মণকুলে। আজও এখানে লোকে হাজারে হাজারে ভগিনী-কন্যাকে অর্থাৎ ভাগ্নীকে বিয়ে করে, তাদের গর্ভে সন্তানের জন্ম দেয় এবং ধর্ম, দেশাচার পরম্পরা এই প্রথাকে সমর্থন করে। যদি বিশ্বাস না-হয়, মহারাজ স্বয়ং সেখানে গিয়ে চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন করে আসতে পারেন।”
কিন্তু সে না-হয় হল একটা রামরাজ্য, কিন্তু রাম ছাড়া রামরাজ্য কীভাবে সম্ভব! রামচন্দ্রকে কোথায় পাওয়া যাবে? আচ্ছা, স্বয়ং রামচন্দ্রই যদি আসেন ভারতের শাসনকার্যের দায়িত্ব নিয়ে, তবে কেমন হবে সেই শাসন? রাহুল সাংকৃত্যায়ন মনে করিয়ে দেন–“আজকাল হাজার নয় লাখো লাখো তথাকথিত শূদ্র তপস্যা করে ব্রাহ্মণের কান কাটছে, বলার কেউ নেই। এক শম্বুকের তপস্যায় ব্রাহ্মণের পুত্রের মৃত্যু হল। রাজা রামের কাছে অভিযোগ গেল। রাজা রাম কিন্তু শম্বুককে তপস্যায় বিরত হতে বললেন না, তিনি শম্বুকের মুণ্ডুটাকেই ধড় থেকে আলাদা করে দিলেন। করপাত্রী মহারাজের আকাঙিক্ষত রামরাজ্যে এরকম রাজারই প্রয়োজন।”
না, রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতো আমি নৈরাশ্যবাদী নয়। রামরাজত্বকে শুধুমাত্র শূদ্ৰহত্যা দিয়ে বিচার করলেই হবে না–সত্যনিষ্ঠা, পাতিব্রতা, পত্নীপ্রেম, সৌভ্রাত্র, প্রভুভক্তি, আশ্রিতরক্ষা, প্রজানুকূল্য, পিতৃভক্তি, ভরতের ভ্ৰাতৃভক্তি, দাদার প্রতি আনুগত্য, বিমাতা কৈকেয়ীর সপত্নী পুত্রের প্রতি আচরণ, সন্তান স্নেহকাতরা জননী কৌশল্যার মাতৃহৃদয়ের বেদনা, রামের প্রতি দশরথের অন্ধস্নেহ, স্ত্রীর জন্য হাহাকার এসবও নিশ্চয় ভারতের নাগরিকগণ আয়ত্ত করবেন। আর সাম্রাজ্যবাদীর আগ্রাসন তো আমাদের শাসকদের রক্তেই আছে। অবশ্যই সেই ত্রেতা যুগ ফিরে আসবে কী, যে যুগে মূর্তিপুজোর প্রচলন ছিল না? ভারতীয়রা নিশ্চয় আর মূর্তিপুজো করবেন না। মিসাইল, গ্রেনেড, বোফর্স কামান, অ্যাটম বোমা ছেড়ে নিশ্চয়ই তীর-ধনুকে ফিরে যাবেন। বলা, অতিবলা, ধর্মচক্র, কালচক্র, বিষ্ণুচক্র, ইন্দ্রচক্র, ব্রহ্মশির, ঐষিক, ব্রহ্মাস্ত্র (এই নামে অবশ্য আধুনিক ভারতে ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করা হয়েছে।), ধর্মপাশ, কালপাশ, বরুণ পাশ, শুষ্ক অশনি, আর্দ্র অশনি, পৈনাক, নারায়ণ, শিখর, বায়ব্য হয়শির, ক্রৌঞ্জ, কঙ্কাল, মুষল, কপাল, শক্তি, খড়গ, গদা, শূল, বজ্র, কিঙ্কিণী, নন্দন, মোহন, প্রস্বাপন, প্রশমণ, বর্ষণ, শোষণ, সন্তাপন, বিলাপন, মাদন, মানব, তামস, সৌমন, সংবর্ত–এসব অস্ত্র কোথায় পাবেন এযুগের রামচন্দ্র। নিশ্চয় দেবতারাই দেবেন!
অনেকে বলেন সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংস হয়েছে। কীভাবে ধ্বংস হয়েছে সে ব্যাপারে বহুমত। ধ্বংস হয়েছে, না পরিত্যক্ত হয়েছে? পরিত্যক্ত কেন হল? এমন হতে পারে, সেচব্যবস্থা ধ্বংসের পর কৃষি উৎপাদন হ্রাস পেতে শুরু করে এবং নদীগুলির গতিপথ পরিবর্তনসহ কিছু নদী ও খালের মৃত্যু এ অঞ্চলে ক্রমাগত মরুকরণ শুরু হয় যা কৃষি উৎপাদনকে চরমভাবে ব্যাহত করে। মনে রাখতে হবে ওই সমসাময়িককালেই সরস্বতী নদী ভ্যানিশ হয়েছিল। সরস্বতী নদীর উৎপত্তিস্থল হিমালয়ের সিমুর পর্বতে। এখান থেকে পাঞ্জাবের আম্বালা জেলার আদবদ্রী নামক স্থানে সমভূমিতে অবতরণ করেছিল। যে প্রস্রবন থেকে এই নদীর উৎপত্তি হয়েছিল তা ছিল প্লক্ষাবৃক্ষের কাছে, তাই একে বলা হত প্লাবতরণ। সে যুগে গঙ্গা-যমুনা ছিল অপ্রধান নদী। সরস্বতীই ছিল সর্বপ্রধান ও সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় নদী। সেই নদী মহাভারতের যুগেই রাজপুতনার মরূভূমিতে অদৃশ্য হয়ে গেলেও কয়েকটি স্রোতধারা অবশিষ্ট ছিল। এই স্রোতধারা চমসোদ্ভেদ, শিবোদ্ভেদ ও নাগোদ্ভেদ নামে পরিচিত। রাজস্থানের মরূভূমির বালির মধ্যে চলুর গ্রামের কাছে সরস্বতী শুষ্ক হয়ে হারিয়ে যায়। ভারতের বর্তমান উদয়পুর, মেওয়াড় ও রাজপুতনার পশ্চিম প্রান্তে মরূ অঞ্চলে সিরসা অতিক্রম করে ভুটানের মরূভূমিতে সরস্বতীর বিলোপ স্থানই বিনশন নাম প্রাপ্ত হন।
অতএব নদীমৃত্যুই সভ্যতা পরিত্যাগের কারণ। কারণ নদীঘিরেই মানুষের সভ্যতা। সভ্যতার কারণেই নদীকে কাটিয়ে আনা হয়েছিল উত্তর থেকে দক্ষিণে, যা ভাগিরথী বা গঙ্গা বা হুগলি নদী বলে পরিচিত। নদীকে কেন্দ্র করে নগর গড়ে ওঠে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। উৎপাদন হ্রাসের সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে খাদ্যচাহিদা খুব চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এরকম অবস্থায় নগরগুলি পরিত্যাগ করে বিভিন্নদিকে ছড়িয়ে পড়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না। শুধু সিন্ধুনগরই নয়, নানা কারণে এরকম বহু নগরই পরিত্যক্ত হয়ে আছে, আজও। দু-একটা নমুনা দিই–(১) জাপানের গানাকানজিমা দ্বীপ। এই দ্বীপের আসল নাম হাসিমা দ্বীপ। কিন্তু এই দ্বীপকে গানাকানজিমা নামে ডাকা হয় যার অর্থ হল ‘রণতরী দ্বীপ’। বিশ্বের ৫০৫ টি জনমানবহীন দ্বীপের মধ্য জাপানের গানাকানজিমা দ্বীপ অন্যতম। এটি নাগাসাকি থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ১৮১০ সালে প্রথম এই দ্বীপে কয়লা পাওয়া যায় এবং পরবর্তী ৫০ বছরের মধ্যে গানাকানজিমা দ্বীপ হয়ে উঠে বিশ্বের সব চেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দ্বীপ। ১৯৫৯ সালে ১৬ একর আয়তনের দ্বীপটির জনসংখ্যা পৌঁছোয় ৫৩০০ জনে। তবে ১৯৭৪ সালের দিকে কয়লা ও অন্যান্য জীবাশ্ম কমতে থাকে এবং মানুষ ধীরে ধীরে এই দ্বীপ ছেড়ে চলে যেতে থাকে এবং দ্বীপটি এক সময় জনমানব শূন্য হয়ে পড়ে। দ্বীপটি এখনও পরিত্যক্ত। (২) নামিবিয়ার কোলমানসকোপ ঘোস্ট টাউন। এই শহর দক্ষিণ নামিবিয়ার লুদেরিটজ সমুদ্রবন্দর থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ১৯০৮ সালে এখানে হিরে পাওয়া যায়। সেই কারণে মাত্র দুই বছরের মধ্যে এই গ্রামীণ এলাকাটি জাঁকজমকপূর্ণ দৃষ্টান্তমূলক জার্মান শহরে রূপান্তরিত হয়। গ্রাম থেকে শহর–অতি দ্রুত এমন একটা শহর, যেখানে ছিল ক্যাসিনো, স্কুল, হাসপাতাল, স্টেডিয়াম, বিলাসবহুল আবাসিক ভবন। খুব স্বাভাবিকভাবেই সকলে এই হিরের উৎস সম্পর্কে উচ্চ সমৃদ্ধি ও দীর্ঘায়ু আশা করেছিল। কিন্তু হায়! অতি দ্রুতই হিরের উৎস হ্রাস পেতে থাকে এবং মানুষ এই শহর ত্যাগ করে এদিক-ওদিক চলে যেতে শুরু করে। জল আর বালুঝড়ের সমস্যার জন্যও মানুষ এই শহর পরিত্যাগ করে। ১৯৫৪ সালের মধ্যে শহরটি সম্পূর্ণভাবে পরিত্যক্ত হয়ে যায়। (৩) ইউক্রেনের রাইপিয়াট। রাইপিয়াট হল উত্তর ইউক্রেনের একটি পরিত্যক্ত শহর, যাকে বলা হয় ‘জোন অব এলিয়েন’। পরিত্যক্ত শহরটি চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে দুই মাইল দূরে অবস্থিত। ১৯৮৬ সালে চেরনোবিল পারমাণবিক প্ল্যান্টের দুর্যোগের পর শহরটি পরিত্যক্ত হয়। এই শহরটিকে দেখলে পারমাণবিক শক্তির ভয়ংকর ক্ষমতার চিত্রই ফুটে ওঠে।
ঋগ্বেদের বহু ঋকেই যে যুদ্ধের বিবরণ পাই সে যুদ্ধ খুব বড়ো ধরনের যুদ্ধ যে নয় তা সহজেই বোঝা যায়। অনেক ঐতিহাসিকগণ এগুলিকে যুদ্ধ না-বলে সংঘর্ষ বলতেই পছন্দ করেন। তথাকথিত ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত’ পরিত্যক্ত সভ্যতাটিতে তেমন কোনো যুদ্ধাস্ত্র পাওয়া যায়নি। সিন্ধু সভ্যতাটি একটি সাম্যবাদী সভ্যতা ছিল যেখানে যুদ্ধ বিগ্রহবিমুখ একটি সভ্যতাই বিকাশ লাভ করেছিল। পূর্বের ইতিহাসবিদরা অনেকে আবার এই যুদ্ধকে আর্য এবং অনার্যদের যুদ্ধ বলে চিহ্নিত করেছেন। এই যুদ্ধকে বৈদিক ও অবৈদিক সম্প্রদায়ের যুদ্ধও বলা যেতে পারে। এই যুদ্ধে বৈদিক সম্প্রদায়রা বা আর্যদেবতারাই যে জয়যুক্ত হন, তা বেদ-রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণগুলি পাঠ করলেই অনুধাবন হয়। এর জন্য পণ্ডিত হতে হয় না। যাঁরা চোখ বন্ধ করে থাকতে ভালোবাসেন তাঁরা অন্ধকার ছাড়া অন্য কিছু দেখবেন এটা আশা করা বিজ্ঞানভিত্তিক হয় না। যাই হোক, সম্ভবত অবৈদিক সম্প্রদায়ের যে অংশ বৈদিক সম্প্রদায়ের ধর্মসংস্কারকে মেনে নিতে পারেনি তাঁরাই দেশত্যাগ করেছিল এবং তাঁদেরই একাংশ ইরানে আবাস গড়ে।
ভারতে উপমহাদেশে দুটি মহাগ্রন্থে দুটি বিশাল মহাযুদ্ধের কথা উল্লেখ হয়েছে। একটি রাম-রাবণের ‘লঙ্কাযুদ্ধ’ বলে খ্যাত, অন্যটি কৌরব-পাণ্ডবের ‘কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ’ বলে খ্যাত। রাম-রাবণের ‘লঙ্কাযুদ্ধ’ তো দুটি যুযুধান গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, মহাভারতের যুদ্ধ রীতিমতো বিশ্বযুদ্ধ–এ যুদ্ধেও ছিল মিত্রপক্ষ এবং শত্রুপক্ষ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমরা যেভাবে মিত্রশক্তি এবং অক্ষশক্তিদের পাই। সত্যিই কি রামায়ণেও আমরা রাম-রাবণের যুদ্ধটি বিশাল-বৃহৎ ছিল? এ যুদ্ধ রাম-বিরাধের দণ্ডকারণ্য যুদ্ধ হয়ে কাহিনি থেমে যাওয়ার একটা সুযোগ ছিল, কিন্তু তা হয়নি।
ছোটোখাটো যে-কোনো যুদ্ধই কালে কালে পরিবর্তিত হতে হতে শেষপর্যন্ত রামায়ণ নামক এক বিশাল মহাকাব্যে লিপিবদ্ধ হয়। এরকম কোনো ছোটখাট ঘটনাই মানুষের মুখে মুখে পরিবর্তিত হতে হতে মিথে রূপান্তরিত হয়। কবিরা সবসময়ই কোনো ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে রূপকের আশ্রয় নেন। কেবল প্রাচীনকালেই নয়, সবকালেই। কালের পরিবর্তনে তাঁদের মস্তিষ্কপ্রসূত রূপক আর রূপকথাগুলিই বাস্তবতার দাবি করতে থাকে। কবির কল্পনায় বিকশিত চরিত্র ও রূপকের সঙ্গে মিথের মিশ্রণ এবং আমাদের সমাজের ধর্মান্ধতা এ দুটি গ্রন্থকে আজ দিয়েছে ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা। তবুও মিথকে সত্য না-ভেবে একে বাস্তবতার আলোকে ঐতিহাসিক উপাদান হিসাবে বিচার করা উচিত। নিছক গল্পকথা ভেবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলে ইতিহাসের প্রতি অবিচার করা হবে। তবে মেনে নেওয়ার কাজ যতটা আয়েশে করা সম্ভব, মিথ ভেঙে সত্য উঘাটন করার কাজটা তত সহজ কাজ নয়। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ সমুদায় হল রাজা ও রাজত্ব, রাজ্যজয় ও গণহত্যার ইতিবৃত্ত। সেভাবেই পাঠগ্রহণ নিরাপদ। রামায়ণের গর্ভ থেকে রূপকথাগুলিকে ঠেলে সরিয়ে দিতে পারলেই প্রাচীন ইতিবৃত্ত হাতের মুঠোয় চলে আসবে।
রামায়ণকে অলৌকিক বা বানোয়াট ভেবে দূরে সরিয়ে না-দিয়ে এ কাহিনিকে ভারত উপমহাদেশের ভূমিপুত্রদের বিরুদ্ধে বহিরাগত আর্যজাতির আগ্রাসনের ইতিহাস, অনার্যদের বিরুদ্ধে আর্য কর্তৃক সন্ত্রাসের রক্তাক্ত ইতিহাস হিসাবে দেখলে সব বিতর্কের অবসান ঘটা সম্ভব। দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন’ নয়, এই আগ্রাসনের ইতিহাস সন্ত্রাসের ইতিহাস, যে ইতিহাসে দেবত্ব আরোপ করা হয়েছে। রামায়ণ হল অনার্যদের রক্তে লেখা আর্য তথা ব্রাহ্মণদের ইতিহাস। সেই ইতিহাস ভক্তিরসে উপস্থাপন করলেও ইতিহাসটা মিথ্যা হয়ে যায় না।