০১. সোনার ঘন্টা

সোনার ঘন্টা– ফ্রান্সিস কাহিনী – অনিল ভৌমিক

অনেকদিন আগের কথা। শান্ত সমুদ্রের বুক চিরে চলেছে একটা নিঃসঙ্গ পালতোলা জাহাজ। যতদূর চোখ যায় শুধু জল আর জল সীমাহীন সমুদ্র।

বিকেলের পড়ন্ত রোদে পশ্চিমের আকাশটা যেন স্বপ্নময় হয়ে উঠেছে। জাহাজের ডেক এ দাঁড়িয়ে সেইদিকে তাকিয়ে ছিল ফ্রান্সিস। সে কিন্তু পশ্চিমের আবিরঝরা আকাশ দেখছিল না। সে ছিল নিজের চিন্তায় মগ্ন। ডেক-এ পায়চারি করতে করতে মাঝে-মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ছিল। ভুরু কুঁচকে তাকাচ্ছিল, কখনো আকাশের দিকে, কখনো সমুদ্রের দিকে। তার মাথায় শুধু একটাই চিন্তা–সোনার ঘন্টার গল্প কি সত্যি, না সবটাই গুজব। নিরেট সোনা দিয়ে তৈরী একটা ঘন্টা–বিরাট ঘন্টা–এই ভূমধ্যসাগরের কাছাকাছি কোন দ্বীপে নাকি আছে সেটা। কেউ বলে সেই সোনার ঘন্টাটা নাকি জাহাজের মাস্তুলের সমান উঁচু, কেউ বলে সাত-আট মানুষ সমান উঁচু। যত বড়ই হোক–নিরেট সোনা দিয়ে তৈরী একটা ঘন্টা, সোজা কথা নয়।

এই ঘন্টাটা তৈরী করার ইতিহাসও বিচিত্র। স্পেন দেশের সমুদ্রের ধারে ডিমেলো নামে ছোট্ট একটা শহর। সেখানকার গীর্জায় থাকতো জনপঞ্চাশেক পাদ্রী। তারা দিনের বেলায় পাদ্রীর কাজকর্ম করতো। কিন্তু সন্ধ্যে হলেই পাদ্রীর পোশাক খুলে ফেলে সাধারণ পোশাক পরে নিতো। তারপর ঘোড়ায় চড়ে বেরুত ডাকাতি, লুটপাট করতে। প্রতি রাত্রে দশ পনেরোজন করে বেরুত। টাকা-পয়সা লুঠ করা তাদের লক্ষ্য ছিল না। লক্ষ্য শুধু একটাই–সোনা সংগ্রহ করা। শুধু সোনাই লুঠ করত তারা।

ধারে কাছে শহরগুলোতে এমন কি দূর-দূর শহরেও তারা ডাকাতি করতে যেত। ভোর হবার আগেই ফিরে আসত ডিমেলোর গীর্জায়। গীর্জার পেছনে ঘন জঙ্গল। তার মধ্যে একটা ঘন্টার ছাঁচ মাটি দিয়ে তৈরি করেছিল। সোনার মোহর বা অলংকার যা কিছু ডাকাতি করে আনত, সব গলিয়ে সেই ঘন্টার ছাঁচে ফেলে দিত। এইভাবে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর সোনা দিয়ে ছাঁচ ভরানো চলল।

কিন্তু ঘন্টা অর্ধেক তৈরি হবার পর কাজ বন্ধ হয়ে গেল। এত ডাকাতি হতে দেখে দেশের সব বড়লোকেরা সাবধান হয়ে গেল। তারা সোনা সরিয়ে ফেলতে লাগল। ডাকাতি করে সিন্দুক ভেঙে পাদ্রী ডাকাতরা পেতে লাগল শুধু রুপার মুদ্রা। মোহর বা সোনার অলংকারের নামগন্ধও নেই।

কি করা যায়? ডাকাত পাদ্রীরা সব মাথায় হাত দিয়ে বসল। সোনার ঘন্টাটা অর্ধেকহয়ে থাকবে? তারা যখন ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছে না, তখন একজন পাদ্রী খবর নিয়ে এল–দেশের সব বড়লোকেরা বিদেশে সোনা সরিয়ে ফেলছে জাহাজে করে। ব্যাস। অমনি পাদ্রী ডাকাতরা ঠিক করে ফেলল, এবার জাহাজ লুঠ করতে হবে। যেমন কথা তেমনি কাজ। এ একটা জাহাজ কিনে ফেলল তারা। তারপর নিজেদের মধ্যে থেকে তিরিশজন বাছাই করা লোক নিয়ে একদিন গভীর রাত্রে তারা সমুদ্রে জাহাজ ভাসাল। বাকি পাদ্রীরা গীর্জাতেই রইল। লোকের চোখে ধুলো দিতে হবে তো! ডিমেলোশহরের লোকেরা জানল-গীর্জার তিরিশজন পাদ্রী বিদেশে গেছে ধর্মপ্রচারের জন্য। কারো মনেই আর সন্দেহের অবকাশ রইল না।

দীর্ঘ তিন-চার মাস ধরে পাত্রী ডাকাতরা সমুদ্রের বুকে ডাকাতি করে বেড়াল। স্পেনদেশ থেকে যত জাহাজ সোনা নিয়ে বিদেশে যাচ্ছিল, কোন জাহাজ রেহাই পেল না। লুঠতরাজ শেষ করে ডাকাত পাদ্রীরা ডিমেলো শহরের গীর্জায় ফিরে এল। জাহাজ থেকে নামানো হল সোনাভর্তি বাক্স। দেখা গেল কুড়িটা কাঠের বাক্স ভর্তি অজস্র মোহরআর সোনার অলংকার। সবাই খুব খুশী হল। যাক এতদিনে ঘন্টাটা পুরো তৈরী হবে।

ঘন্টাটা সম্পূর্ণ তৈরী হল। কিন্তু মাটির ছাঁচটা ভেঙে ফেলল না। ছাঁচ ভেঙে ফেললেই তো সোনার ঘন্টাটা বেরিয়ে আসবে। যদি সোনার ঝকমকানি কালোর নজরে পড়ে যায়।

তারপরের ঘটনা সঠিক জানা যায় না। তবে ফ্রান্সিস বুড়ো নাবিকদের মুখে গল্প শুনেছে, ডাকাত পাদ্রীরা নাকি একটা মস্তবড় কাঠের পাঠাতনে সেই সোনার ঘন্টা তুলে নিয়ে জাহাজের পেছনে বেঁধে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছিল। সোনার ঘন্টার গায়ে ঘন কালো রং লাগিয়ে দিয়েছিল যাতে কেউ দেখলে বুঝতে না পারে যে ঘন্টাটা সোনার। ভূমধ্যসাগরের ধারেকাছে এক নির্জনদ্বীপে তারা সোনার ঘন্টাটা লুকিয়ে রেখেছিল। তারপর ফেরার পথে প্রচন্ড ঝড়ের মুখে ডাকাত পাদ্রীদের জাহাজ ডুবে গিয়েছিল। একজনও বাঁচেনি। কাজেই সেই নির্জন দ্বীপের হদিস আজও সবার কাছে অজানাই থেকে গেছে।

–এই যে ভায়া।

ফ্রান্সিসের চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল। ভুঁড়িওলা জ্যাকব কখন কাছে এসে দাঁড়িয়েছে ও বুঝতেই পারেনি। জ্যাকব হাসতে হাসতে বলল–ভুরু কুঁচকে কি ভাবছিলে অত?

ফ্রান্সিস নিঃশব্দে আঙুল দিয়ে পশ্চিমের লাল লাল আকাশটা দেখল।

–ওখানে কি? জ্যাকব বোকাটে মুখে জিজ্ঞেস করল।

–ওখানে–আকাশে কত সোনা–অথচ সব ধরাছোঁয়ার বাইরে। জ্যাকব এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বাজখাই গলায় হেসে বললো–ফ্রান্সিস তোমার নির্ঘাৎ ক্ষিদে পেয়েছে, খাবে চলো।

খেতে বসে দুজনে কথাবার্তা বলতে লাগল। ফ্রান্সিস জাহাজের আর কোন নাবিকের সঙ্গে বেশী মিশতনা। ওর ভালও লাগত না। কিন্তু এই ভুঁড়িওয়ালা জ্যাকবের সঙ্গে ওর খুব, বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। ও জ্যাকবের কাছে মনের কথা খুলে বলত।

ফ্রান্সিস ছিল জাতিতে ভাইকিং। ইউরোপের পশ্চিম সমুদ্র পথে ভাইকিংদের দেশ। ভাইকিংদের অবশ্য বদনাম ছিল জলদস্যুর জাত বলে। শৌর্যে বীর্যে এবং জাহাজ চালনায় অসাধারণ নৈপুণ্যের জন্যে ইউরোপের সব জাতিই তাদের তারিফ করত। ফ্রান্সিস কিন্তু সাধারণ ঘরের ছেলে না। ভাইকিংদের রাজার মন্ত্রীর ছেলে বিদেশী জাহাজে যাচ্ছিল সাধারণ নাবিকদের কাজ নিয়ে নিজের পরিচয় গোপন করে। এটা জানত শুধু ভুঁড়িওলা জ্যাকব।

মুরগীর ঠ্যাং চিবুতে চিবুতে জ্যাকব ডাকল ফ্রান্সিস?

–তুমি বাপু দেশে ফিরে যাও।

–কেন?

–আমাদের এই দাঁড়বাওয়া, ডেক-মোছা-এসব কমমো তোমার জন্যে নয়।

ফ্রান্সিস একটু চুপ করে থেকে বলল–তোমার কথাটা মিথ্যে নয়। এত পরিশ্রমের কাজ আমি জীবনে করিনি। কিন্তু জানো তো আমরা ভাইকিং–যেকোনোরকম কষ্ট সহ্য করবার ক্ষমতা আমাদের জন্মগত। তাছাড়া–

–কি?

–ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি সেই সোনার ঘন্টার গল্প—

–ও। সেই ডাকাত পাদ্রীদের সোনার ঘন্টা? আরে ভাই ওটা গাঁজাখুরী গপ্পো।

–আমার কিন্তু তা মনে হয় না।

–তবে?

–আমার দৃঢ় বিশ্বাস ভূমধ্যসাগরের ধারে কাছে কোন দ্বীপে নিশ্চয়ই সেই সোনার ঘন্টা আছে।

–পাগল। জ্যাকব খুক খুক করে হেসে উঠল।

ফ্রান্সিস একবার চারিদিকে তাকিয়ে নিয়ে চাপাস্বরে বললো–জানো–দেশ ছাড়বার আগে একজন বুড়ো নাবিকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। বুড়োটা বলত–ও নাকি সোনার ঘন্টার বাজনা শুনেছে।

-এ্যাঁ? বলল কি! জ্যাকব অবাক চোখে তাকাল।

–লোকে অবশ্য বুড়ো নাবিকটাকে পাগল বলে ক্ষেপাত। আমি কিন্তু মন দিয়ে ওর গল্প শুনেছিলাম।

–কি-গল্প?

–ভূমধ্যসাগর দিয়ে নাকি ওদের জাহাজ আসছিল একবার। সেই সময় এক প্রচণ্ড ঝড়ের মুখে ওরা দিক ভুল করে ফেলে। তারপর ডুবো পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা লেগে ওদের জাহাজ ডুবে যায়। ডুবন্ত জাহাজ থেকে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় ও একটা ঘন্টার শব্দ শুনেছিল–ঢং-ঢং। ঝড়জলের শব্দ ছাপিয়ে বেজেই চলেছিল–ঢং-ঢং।

জ্যাকবের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। সে হাঁ করে ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর জিজ্ঞেস করলে–সোনার ঘন্টার শব্দ?

–নিশ্চয়ই। ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকিয়ে বলল।

ভুঁড়িওয়ালা জ্যাকবের মুখ দিয়ে আর কথা সরলো না।

পরের দু’দিন জাহাজের নাবিকদের বেশ আনন্দেই কাটলো। পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশ। জোর বাতাস। জাহাজের পালগুলো হাওয়ার তোড়ে বেলুনেরমত ফুলে উঠল। জাহাজ চলল তীরবেগে। দাঁড়টানার হাড়ভাঙ্গা খাটুনি থেকে নাবিকরা এইদুদিন রেহাই পেল। কিন্তু জাহাজের ডেক পরিষ্কার করা, জাহাজের মালিকের ফাইফরমাস খাটা, এসব করতে হল। তবু নাবিকেরা সময় পেল–তাস খেলল, ছক্কা-পাঞ্জা খেলল, আজ্ঞা দিল, গল্পগুজব করল অনেক রাত পর্যন্ত।

ফ্রান্সিস যতক্ষণ সময় পেয়েছে হয় ডেক-এ পায়চারি করেছে, নয়তো নিজের বিছানায় শুয়ে থেকেছে। ভুঁড়িওলা জ্যাকব মাঝে-মাঝে ওর খোঁজ করে গেছে। শরীর ভালো আছে কিনা, জিজ্ঞেস করেছে। একটু খোশগল্পও করতে চেয়েছে। কিন্তু ফ্রান্সিসের তরফ থেকে কোন উৎসাহ না পেয়ে অন্য নাবিকদের আড্ডায় গিয়ে গল্প জুড়েছে। ফ্রান্সিসের একা থাকতে ভালো লাগছিল, নিজের চিন্তায় ডুবে থাকতে। দেশ ছেড়েছে কতদিন হয়ে গেল। আত্মীয়স্বজন সবাইকে ছেড়ে এক নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরিয়েছে ও। কবে ফিরবে অথবা কোনদিন ফিরবে কি না কে জানে। মাথায় ওর মাত্র একটাই সংকল্প, যে করেই হোক খুঁজে বের করতে হবে সোনার ঘন্টার হদিস।

সোনার ঘন্টার কথা ভাবতে-ভাবতে কখন ঘুমে চোখ জড়িয়ে এসেছিল, ফ্রান্সিস জানে না। হঠাৎ নাবিকদের দৌড়োদৌড়ি উচ্চ কণ্ঠে ডাকাডাকি-হাঁকাহাঁকি শুনে ওর ঘুম ভেঙে গেল। ভোর হয়ে গেছে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু হল কি? এদের এত উত্তেজনার কারণ কি? এমন সময় জ্যাকব ছুটতে ছুটতে ফ্রান্সিসের কাছে এল।

–সাংঘাতিক কাণ্ড। জ্যাকব তখনও হাঁপাচ্ছে।

–কি হয়েছে?

–ওপরে–ডেক-এ চল–দেখবে’খন।

দ্রুতপায়ে ফ্রান্সিস ডেক-এর ওপরে উঠে এল। জাহাজের সবাই ডেক-এর ওপরে এসে জড়ো হয়েছে। ফ্রান্সিস জাহাজের চারপাশে সমুদ্র ও আকাশের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। প্রচন্ড গ্রীষ্মকাল তখন। আর বেলাও হয়েছে। অথচ চারদিকে কুয়াশার ঘন আস্তরণ। সূর্য ঢাকা পড়ে গেছে। চারদিকে কেমন একটা মেটে আলো। এক ফোঁটা বাতাস নেই। জাহাজটা স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে আছে। সকলের মুখেই দুশ্চিন্তার ছাপ। এই অসময়ে কুয়াশা? কোন এক অমঙ্গলের চিহ্ন নয় তো?

জাহাজের মালিক সর্দার নাবিককে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। বোধহয় কি করবে এখন তারই শলা-পরামর্শ করতে। সবাই বিমূঢ়ের মত দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ ফ্রান্সিস খুশীতে শিস্ দিয়ে উঠল। আশ্চর্য! শিসের শব্দ অনেকের কানেই পৌঁছল। এই বিপত্তির সময় কোন বেআক্কেলে শিস দেয় রে? তারা ফ্রান্সিসের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল। দেখল–ফ্রান্সিসের মুখ মৃদু হাসি। এবার ওদের আরো অবাক হবার পালা। ফ্রান্সিসকেওরা কেউ কখনো হাসতে দেখেনি। সব সময় গোমড়া মুখে ভুরু কুঁচকে থাকতেই দেখেছে। মাথায় যেন রাজ্যের দুশ্চিন্তা। সেই লোকটা হাসছে? অবাক কাণ্ড!

ফ্রান্সিসের এই খুশীতে অর্থাৎ শিস দিয়ে ওঠাটা কেউ ভালো চোখে দেখল না। তবে সবাইমনে-মনে গজরাতে লাগল। জ্যাকব গম্ভীরমুখেফ্রান্সিসের কাছে এসে দাঁড়াল। চাপাস্বরে বলল–বেশী বাড়াবাড়ি করো না।

–কেন?

–সবাই ভয়ে মরছি, আর তুমি কিনা শিস দিচ্ছো? ফ্রান্সিস হেসে উঠল। জ্যাকব মুখ বেঁকিয়ে বলল, তোমরা ভাইকিং–খুব সাহসী তোমরা, কিন্তু তাই বলে তোমার কি মৃত্যু ভয়ও নেই?

–আছে বৈকি! তবে আমার খুশী হবার অন্য কারণ আছে।

–বলো কি?

–হ্যাঁ। ফ্রান্সিস জ্যাকবের কানের কাছে মুখ দিয়ে চাপা খুশীর স্বরে বলতে লাগল জানো সেই বুড়ো পাগলা নাবিকটা বলেছিল–ওদের জাহাজ ঝড়ের মুখে পড়বার আগে ডুবো পাহাড়ে ধাক্কা খাওয়ার আগে–এমনি ঘন কুয়াশার মধ্যে আটকে গিয়েছিল ঠিক এমনি অবস্থা, বাতাস নেই, কুয়াশায় চারিদিক অন্ধকার ।

ফ্রান্সিস আর জ্যাকব ডেক-এর কোনায় দাঁড়িয়ে যখন কথা বলছিল, তখন লক্ষ্য করেনি যে, ডেক-এর আর এক কোনে নাবিকদের একটা জটলার সৃষ্টি হয়েছে। ওরা ফিসফিস্ করে নিজেদের মধ্যে কি যেন বলাবলি করছে। দু-একজন চোখের ইশারায় জ্যাকবকে দেখাল। ব্যাপারটা সুবিধে নয়। কিছু একটা ষড়যন্ত্র চলছে। জ্যাকব সজাগ হল। ফ্রান্সিস এতক্ষণ লক্ষ্য করেনি। ও উলটোদিকে মুখ ফিরিয়ে সামনের সাদাটে কুয়াশার আস্তরণের দিকে তাকিয়ে নিজের চিন্তায় বিভোর।

নাবিকদের জটলা থেকে তিন-চারজন ষণ্ডাগোছেরনাবিক ধীর পায়ে ওদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। জ্যাকব ওদের মুখ দেখেই বুঝলো, কিছু একটা কুমতলব আছে ওদের। ফ্রান্সিসকে কনুই দিয়ে একটা গুঁতো দিল। ফ্রান্সিস ঘুরে দাঁড়াল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জ্যাকবের দিকেতাকাল। জ্যাকব চোখের ইশারায় ষণ্ডাগোছের লোকগুলোকে দেখাল। তাদের পেছনে পেছনে আর সবনাবিকেরা দল বেঁধে এগিয়ে আসছে দেখা গেল। ফ্রান্সিস কিন্তু এই থমথমে আবহাওয়াটাকে কাটিয়ে দেবার জন্যে হেসে গলা চড়িয়ে বলল–ব্যাপার কি? আঁ–এখানে নাচের আসর বসবে নাকি? কিন্তু কেউ ওর কথার জবাব দিল না। ষণ্ডাগোছের লোক ক’জন ওদের দুজনের কাছ থেকে হাত পাঁচেক দূরে এসে দাঁড়াল। দলের মধ্যে থেকে ইয়া দশাসই চেহারার একজন গম্ভীর গলায় ডাকল–এই জ্যাকব, শোন্ এদিকে।

ফ্রান্সিস তখন হেসে বলল–যা বলবার বাপু ওখান থেকেই বলো না।

সেই নাবিকটা এবার আঙ্গুল দিয়ে জ্যাকবকে দেখিয়ে পেছনের নাবিকদের বলল এই জ্যাকব ব্যাটা ইহুদী। এই বিধর্মীটা যতক্ষণ জাহাজে থাকবে–ততক্ষণ কুয়াশা কাটবে না–বিপদ আরো বাড়বে! তোমরাই বলল ভাই এই অলুক্ষুণেটাকে কি করবো?

হই-হই চীৎকার উঠল নাবিকদের মধ্যে।

কেউ-কেউ তীক্ষ্মস্বরে চেঁচিয়ে বলল–জলে ছুঁড়ে ফেলে দাও।

–খুন কর বিধর্মীটাকে।

–ফাঁসীতে লটকাও।

ভয়ে জ্যাকবের মুখ সাদা হয়ে গেল। কিছু বলবার জন্য ওর ঠোঁট দুটো কাঁপতে লাগল। কিছুই বলতে পারল না। দুহাতে মুখ ঢেকে ও কেঁদে উঠল। দশাসই চেহারার নাবিকটা জ্যাকবের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বার উপক্রম করতেই ফ্রান্সিস জ্যাকবকে আড়াল করে দাঁড়াল। ফ্রান্সিসের তখন অন্য চেহারা। মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে। সমস্ত শরীরটা ইস্পাতের মত কঠিন হয়ে উঠেছে। চোখ জুজু করছে। দাঁতচাপা স্বরে ফ্রান্সিস বলল–জ্যাকব আমার বন্ধু। যে ওর গায়ে হাত দেবে, তার হাত আমি ভেঙ্গে দেব।

একমুহূর্তে গোলমাল হই-চই থেমে গেল। ষণ্ডা ক’জন থমকে দাঁড়াল। কে যেন চীৎকার করে উঠল–দু’টোকেই জলে ছুঁড়ে ফেলে দাও।

আবার চিৎকার, মারমার রব উঠল। ফ্রান্সিস আড়চোখে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে দেখল ডেক-এর কোণার দিকে একটা ভাঙা দাঁড়ের হাতলের অংশটা পড়ে আছে। চোখের নিমেষে সেটা কুড়িয়ে নিয়ে লাঠির মত বাগিয়ে ধরল। চেঁচিয়ে বলল–সাহস থাকে তো এক-একজন করে আয়।

দশাসই চেহারার লোকটা ফ্রান্সিসের দিকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিদ্যুৎগতিতে একধারে সরে গিয়ে ফ্রান্সিস হাতের ভাঙা দাঁড়টা চালাল ওর মাথা লক্ষ্য করে। লোকটার মুখ দিয়ে একটা শব্দ বেরল শুধু—অঁ-ক। তারপরই ডেকের ওপর সে মুখ থুবড়ে পড়ল। মাথাটা দুহাতে চেপে কাতরাতে লাগল। ওর আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে রক্ত গড়াতে লাগল। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই থমকে দাঁড়ালো। কিন্তু একমুহূর্ত। তারপরেই আর একটা ষণ্ডাগোছের লোক ঘুষি বাগিয়ে ফ্রান্সিসের দিকে তেড়ে এল। ফ্রান্সিস তৈরী হয়েই ছিল। ভাঙা দাঁড়টা সোজা লোকটার থুতনি লক্ষ্য করে চালাল। লোকটা বেমক্কা মার খেয়ে দু’হাত শূন্যে তুলে ডেক-এর পাটাতনের ওপর চিৎ হয়ে পড়ল। দাঁত ভাঙল কয়েকটা। মুখ দিয়ে রক্ত উঠল। মুখ চেপে ধরে লোকটা গোঙাতে লাগল। ফ্রান্সিস উত্তেজিত নাবিকদের জটলার দিকে চোখ রেখে চাপাস্বরে ডাকাল–জ্যাকব।

জ্যাকব এতক্ষণে সাহস ফিরে পেয়েছে। বুঝতে পেরেছে ফ্রান্সিসের মত রুখেনাদাঁড়াতে পারলে মরতে হবে। জ্যাকব চাপাস্বরে উত্তর দিল কী?

–ঐ যে ডেকঘরের দেয়ালে সর্দারের বেল্টসুন্ধুতরোয়ালটা ঝোলানো রয়েছে–ঐ দেখছো?

–হ্যাঁ।

–এক ছুটে গিয়ে নিয়ে এসো। ভয় নেই–একবার তরোয়ালটা হাতে পেলে সবকটাকে আমি একাই নিকেশ করতে পারবো–জলদি ছোট–

জ্যাকব পড়ি কি মরি ছুটল ডেক-ঘরের দেয়ালের দিকে। নাবিকদের দল কিছু বোঝবার আগেই ও দেওয়ালে ঝোলানো তরোয়ালটা খাপ থেকে খুলে নিল। এতক্ষণে নাবিকের দল ব্যাপারটা বুঝতে পারল। সবাই হইহই করে ছুটল জ্যাকবকে ধরতে। জ্যাকব ততক্ষণে তরোয়ালটা ছুঁড়ে দিয়েছে ফ্রান্সিসের দিকে। তরোয়ালটা ঝনাৎ করে এসে পড়ল ফ্রান্সিসের পায়ের কাছে। তরোয়ালটা তুলে নিয়েই ও ছুটল ভিড়ের দিকে। ততক্ষণে ক্রুদ্ধ নাবিকের দল জ্যাকবকে ঘিরে ধরেছে। কয়েকজন মিলে জ্যাকবকে ধরে ডেক-ঘরের কাঠের দেয়ালে ওর মাথা ঠুকিয়ে দিতে শুরু করেছে। কিন্তু খোলা তরোয়াল হাতে ফ্রান্সিসকে ছুটে আসতে দেখে ওরা জ্যাকবকে ছেড়ে দিয়ে এদিক-ওদিক ছুটে সরে গেল। ফ্রান্সিস সেই নাবিকদলের দিকে তলোয়ার উঁচিয়ে গলা চড়িয়ে বলল–জ্যাকব বিধর্মী হোক, আর যাই হোক–ও আমার বন্ধু। যদি তোদের প্রাণের মায়া থাকে জ্যাকবের গায়ে হাত দিবি না।

ফান্সিসের সেই রুদ্রমূর্তি দেখে সবাই বেশ ঘাবড়ে গেল! ওরা জানতো–ফ্রান্সিস জাতিতে ভাইকিং। তরোয়াল হাতে থাকলে ওদের সঙ্গে এঁটে ওটা মুশকিল। ডেক-এর ওপরে এত হই-চই চীৎকার ছুটোছুটির শব্দে মালিক আর নাবিকসর্দার ওপরে উঠে এল। ওরা ভাবতেই পারেনি, যে ব্যাপার এতদূর গড়িয়েছে। এদিকে দু’জন ডেক-এর ওপর রক্তাক্ত দেহে কাতরাচ্ছে–ওদিকে ফ্রান্সিস খোলা তরোয়াল হাতে রুদ্রভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে।

জাহাজের মালিক আশ্চর্য হয়ে গেল। সে দু’হাত তুলে চীৎকার করে বলল–শোন সবাই–মারামারি করবার সময় পরে অনেক পাবে, এখন যে বিপদে পড়েছি, তা থেকে উদ্ধারের কথা ভাবো।

এতক্ষণ উত্তেজনা মারামারির মধ্যে সবাই বিপদের কথা ভুলে গিয়েছিল। এখন আবার সবাই ভয়-ভয় চোখে চারদিকে ঘন কুয়াশার দিকে তাকাতে লাগল। কারো মুখে কথা নেই। এমন সময় ষণ্ডাগোছের নাবিকদের মধ্যে একজন চীৎকার করে বলল–এই যে জ্যাকব-–ও ইহুদী ওর জন্যই আমাদের এই বিপদ।

আবার গোলমাল শুরু হল। মালিক দু’হাত তুলে সবাইকে থামাবার চেষ্টা করতে লাগল। গোলমাল কর্মূলে বলল–এটা বাপু জাহাজ–গীর্জে নয়! কার কি ধমমো, তাই দিয়ে আমার কি দরকার। আমি চাই কাজের লোক। জ্যাকব তো কাজকর্ম ভালোই করে।

আবার চীৎকার শুরু হল–আমরা ওসব শুনতে চাই না।

–জ্যাকবকে জাহাজ থেকে ফেলে দাও।

–ফাঁসিতে লটকাও।

জাহাজের মালিক ব্যবসায়ী মানুষ। সে কেন একটা লোকের জন্যে ঝামেলা পোহাবে। সে বলল–বেশ তোমরা যা চাইছ, তাই হবে।

ফ্রান্সিস চীৎকার করে বলে উঠল–আমার হাতে তরোয়াল থাকতে সেটি হবে না।

জাহাজের মালিক পড়ল মহাফাঁপরে! তবে সে বুদ্ধিমান ব্যবসায়ী। খুনোখুনি-রক্তপাত এসবে বড় ভয়। বলল–ঠিক আছে, আর একটা দিন সময় দাও তোমরা। দাঁড়ে হাত লাগাও–জাহাজ চলুক দেখা যাক–যদি একদিনের মধ্যেও কুয়াশা না কাটে তাহলে জ্যাকবকে ছুঁড়ে ফেলে দিও।

নাবিকদের মধ্যে গুঞ্জন চলল। একটু পরে সেই ষণ্ডাগোছের নাবিকটা বলল, ঠিক আছে–আমরা আপনাকে একদিন সময় দিলাম।

–তাহলে আর দেরি করো না। সবাই যে যার কাজে লেগে পড়ো। মালিক নাবিক সর্দারের দিকে ইশারা করল। সর্দার ফ্রান্সিসের কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস একবার সেই নাবিকদের জটলার দিকে তাকাল। তারপর তরোয়ালটা সর্দারের হাতে দিল। চাপাস্বরে জ্যাকবকে বলল–ভয় নেই। দেখো একদিনের মধ্যে অনেক কিছু ঘটে যাবে।

নাবিকদের জটলা ভেঙে গেল। যে যারকাজে লেগে পড়ল। একদল পাল সামলাতে মাস্তুল বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল। ফ্রান্সিসদের দল সর্দারের নির্দেশে সবাই জাহাজের খোলে নেমে এল। সেখানে দু’ধারে সার সার বেঞ্চির মত কাঠের পাটাতন পাতা। সামনে একটা লম্বাদাড়ের হাতল। বেঞ্চিতে বসে ওরা পঞ্চাশজন দাঁড়ে হাত লাগাল। তারপর সর্দারের ইঙ্গিতে একসঙ্গে পঞ্চাশটা দাঁড় পড়ল জলে—ঝপ–ঝপ। জাহাজটা নড়েচড়ে চলতে শুরু করল। ফ্রান্সিসের, ঠিক সামনেই বসেছিল জ্যাকব। দাঁড় টানতে টানতে ফ্রান্সিস ডাকল–জ্যাকব?

–হুঁ।

–যদি সেই বুড়ো নাবিকটার কথা সত্যি হয়, তাহলে—

–তাহলে কী?

–তাহলে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা ঝড়ের মুখে পড়ব।

–তারপর?

–ডুবো পাহাড়ে ধাক্কা লেগে—

–জলের তলায় অক্কা পাবে—

–তার আগে সোনার ঘন্টাটা বাজনা তো শুনতে পাবো।

জ্যাকব এবার মুখ ফিরিয়ে ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল–

–পাগল!

জাহাজ চলল। ছপ-ছপ। পঞ্চাশটা দাঁড়ের শব্দ উঠছে। চারিদিকে জমে থাকা কুয়াশার মধ্য দিয়ে জাহাজ চলছে। কেমন একটা গুমোট গরম। দাঁড়িদের গা দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। একফোঁটা হাওয়ার জন্যে সবাই হা-হুতাশ করছে।

হঠাৎ একটা প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়ার ঝাঁপটায় সমস্ত জাহাজটা ভীষণভাবে কেঁপে উঠল। কে কোথায় ছিটকে পড়ল, তার ঠিক নেই। পরক্ষণেই প্রবল বৃষ্টিধারা আর হাওয়ার উন্মত্ত মাতন। তালগাছসমান উঁচু-উঁচু ঢেউ জাহাজের গায়ে এসে আছড়ে পড়তে লাগল। জাহাজটা কলার মোচার মত ঢেউয়ের আঘাতে দুলতে লাগল। এই একবার জাহাজটা ঢেউ-এর গভীর ফাটলের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে, আবার পরক্ষণেই প্রচণ্ড ধাক্কায় উঠে আসছে ঢেউয়ের মাথায়।

ঝড়ের প্রথম ধাক্কায় ফ্রান্সিস মুখ থুবড়ে পড়েছিল। তবে সামনে নিয়েছিল খুব। কারণ ও তৈরীই ছিল–ঝড় আসবেই। আর সবাই এদিক-ওদিক ছিটকে পড়েছিল। হামাগুড়ি দিয়ে কাঠের পাটাতন ধরে ধরে অনেকেই নিজের জায়গায় ফিরে এল। এল না শুধু জ্যাকব। কিছুক্ষণ আগে যে ধকল গেছে ওর ওপর দিয়ে। তারপর ঝড়ের ধাক্কায় টাল সামলাতে না পেরে পাটাতনের কোণায় জোর ধাক্কা খেয়ে ও অজ্ঞানের মত পড়েছিল একপাশে। ফ্রান্সিস কয়েকবার জ্যাকব কেডাকল। ঝড়ের গো-গোয়ানি মধ্যে সেই ডাক-জ্যাকবের কানে পৌঁছল না। ফ্রান্সিস দাঁড় ছেড়ে হামাগুড়ি দিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে জ্যাকবকে খুঁজতে লাগল। কিন্তু কোথায় জ্যাকব? আর খোঁজা সম্ভব নয়। প্রচণ্ড দুলুনির মধ্যে টাল সামলাতে না পেরে বারবার হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল ফ্রান্সিস।

হঠাৎ শক্ত কিছুতে ধাক্কা লেগে জাহাজের তলাটা মড়মড় করেউঠল। দাঁড়গুলো প্যাকাটির মত মটমট করে ভেঙে গেল। ফ্রান্সিস চমকে উঠল–ডুবোপাহাড়! আর এক মুহূর্ত দেরি না করে ফ্রান্সিস বহু কষ্টে টলতে টলতে ডেক-এর ওপর উঠে এল। দেখল, ঝোড়ো হাওয়ার আঘাতে বিরাট ঢেউ ডেক-এর ওপর আছড়ে পড়ছে। আর সে কি দুলুনি! ঠিক তখনই সমস্ত জল ঝড় বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে শুনতে পেল ঘন্টার শব্দ–ঢং-ঢং-ঢং। ঘন্টা বেজেই চলল। সোনার ঘন্টার শব্দ–ঢং-ঢং।

ফ্রান্সিস উল্লাসে চীৎকার করে উঠল। ঠিক তখনই মড়মড় শব্দে জাহাজের তলাটা ভেঙে গেল, আর সেই ভাঙা ফাটল দিয়ে প্রবল বেগে জল ঢুকতে লাগল। মুহূর্তে জাহাজের খোলটা ভরে গেল। জাহাজটা পেছন দিকে কাৎ হয়ে ডুবতে লাগল। সশব্দে মাস্তলটা ভেঙ্গে পড়ল। জাহাজের রেলিঙের কোণায় লেগে মাস্তুলটা ভেঙে দু’টুকরো হয়ে গেল। উত্তাল সমুদ্রের বুকে মাস্তুলের যে টুকরোটা পড়ল, সেটার দিকে লক্ষ্য রেখে ফ্রান্সিস জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঢেউয়ের ধাক্কা খেতে খেতে কোনোরকমে ভাঙা মাস্তুলটা জড়িয়ে ধরল। বহুকষ্টে মাস্তুলের সঙ্গে বাঁধা দড়িটা দিয়ে নিজের শরীরটা মাস্তুলের সঙ্গে বেঁধে নিল। ওদিকে ঘন্টার শব্দ ফ্রান্সিসের কানে এসে তখন বাজছে–ঢং-ঢং-ঢং।

ভোর হয় হয়। পূর্বদিকে সমুদ্রের ঢেউয়ের মাথায় আকাশটায় লালচে রঙ ধরেছে। সূর্য উঠতে দেরি নেই। সাদা-সাদা সমুদ্রের পাখীগুলো উড়ছে আকাশে। বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ির মধ্যে সমুদ্রের জলের ধার ঘেঁষে ফ্রান্সিস পড়ে আছে মড়ার মতো। কোন সাড়া নেই। ঢেউগুলো বালিয়ারির ওপর দিয়ে গড়িয়ে ওর গা পর্যন্ত চলে আসছে।

সমুদ্র-পাখীর ডাক ফ্রান্সিসের কানে গেল। অনেক দূরে পাখীগুলো ডাকছে। আস্তে আস্তে পাখীর ডাক স্পষ্ট হল। চেতনা ফিরে পেল ফ্রান্সিস। বেশ কষ্ট করেই চোখ খুলতে হল ওকে। চোখের পাতায় নুনের সাদাটে আস্তরণ পড়ে গেছে। মাথার ওপর আকাশটা দেখলও। অন্ধকার কেটে গেছে। অনেক কষ্টে আড়ষ্ট ঘাড়টা ফেরাল। দেখলো সূর্য উঠছে। মস্তবড় থালার মতো টকটকে লাল সূর্য। আস্তে-আস্তে সূর্যটা ঢেউয়ের গা লাগিয়ে উঠতে লাগল। সবটা উঠল না বড় বিন্দুর মত একটা অংশ লেগে রইল জলের সঙ্গে। তারপর টুপ করে উঠে ওপরের লাল থালাটার সঙ্গে মিশে গেল। সমুদ্রে এই সূর্য ওঠার দৃশ্য ফ্রান্সিসের কাছে খুবই পরিচিত। কিন্তু আজকে এটা নতুন বলে মনে হল। বড় ভাল লাগল। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছে-ও।

ফ্রান্সিস জোরে শ্বাস ফেলল–আঃ কি সুন্দর এই পৃথিবী!

বেশ কষ্ট করে শরীরটা টেনে তুলল ফ্রান্সিস। হাতে ভর রেখে একবার চারদিকে তাকাল। ভরসা-যদি জাহাজের আর কেউ ওর মত ভাসতে ভাসতে এখানে এসে উঠে থাকে। কিন্তু বিস্তীর্ণ বালিয়াড়িতে যতদূর চোখ যায় ও কাউকেই দেখতে পেল না। ওদের জাহাজের কেউ বোধহয় বাঁচেনি। জ্যাকবের কথা মনে পড়ল। মনটা ওর বড় খারাপ হয়ে গেল। গা থেকে বালি ঝেড়ে ফেলে ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। হাঁটুদুটো কাঁপছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে। শরীর অসম্ভব দুর্বল লাগছে। তবু উপায় নেই। চলতে হবে। লোকালয় খুঁজতে হবে। খাদ্য চাই, কিন্তু কোন দিকে মানুষের বসতি?

সূর্যের আলো প্রখর হতে শুরু করেছে। ফ্রান্সিস চোখে হাত দিয়ে রোদ আড়াল করে চারদিকে দেখতে লাগল। একদিকে শান্ত সমুদ্র। অন্যদিকে ধুধু বালি আর বালি। জনপ্রাণীর চিহ্নমাত্র নেই। এ কোথায় এলাম? আর ভেবে কি হবে। ফ্রান্সিস পা টেনে সেই ধুধু বালির মধ্যে দিয়ে চলতে লাগল।

মাথার ওপর সূর্য উঠে এল। কি প্রচণ্ড তেজ সূর্যের আলোর। তৃষ্ণায় জিভ পর্যন্ত শুকিয়ে আসছে। হু-হু হাওয়া বইছে বালি উড়ছে। শরীর আর চলছে না। মাথা ঘুরছে। মাথার ওপর আগুন ঝরানো সূর্য। বালির দিগন্ত দুলে-দুলে উঠছে। শরীর টলছে। তবু হাঁটতেই হবে। একবার থেমে পড়লে, বালিতে মুখ গুঁজে পড়ে গেলে মৃত্যু অনিবার্য। জোরে শ্বাস নিল ফ্রান্সিস। অসম্ভব! থামা চলবে না।

একি? মরীচিকা নয় তো? ফ্রান্সিস হাত দিয়ে চোখদুটো ঘষে নিল। নাঃ। ঐ তো সবুজের ইশারা। কয়েকটা খেজুর গাছ। হাওয়ায় পাতাগুলো নড়ছে। কাছে আসতেই নজরে পড়ল তাঁবুর সারি, খেজুর গাছে বাঁধা অনেকগুলো ঘোড়া, একটা ছোট্ট জলাশয়। একটা লোক ঘোড়াগুলোকে দানা-পানি খাওয়াবার তদারকি করছিল। সেই প্রথম ফ্রান্সিসকে দেখতে পেল। লোকটা প্রথমে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। তারপর তীক্ষ্ণস্বরে কি একটা কথা বলে চীৎকার করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে তাঁবুগুলো থেকে অনেক লোক বেরিয়ে এল। তাদের গায়ে আরবীদের পোশাক। ঢোলা জোব্বা পরনে। মাথায় বিড়েবাঁধা সাদা কাপড়। কান পর্যন্ত ঢাকা। ফ্রান্সিসের বুকে আর দম নেই। মুখ দিয়ে হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে তখন। ফ্রান্সিস শুধু দেখতে পেল লোকগুলোর মধ্যে কারো কারো হাতে খোলা তরোয়াল রোদ্দুরে ঝিকিয়ে উঠছে। আর কিছু দেখতে পেল না ফ্রান্সিস। সব কেমন আবছা হয়ে আসছে। ফ্রান্সিস মুখ থুবড়ে পড়ল বালির ওপর। অনেক লোকের কণ্ঠস্বর কানে এল। ওরা নিজেদের মধ্যে কিসব বলাবলি করতে করতে এদিকেই আসছে। তারপর আর কোন শব্দই ফ্রান্সিসের কানে গেল না।

ফ্রান্সিস যখন চোখ মেলল তখন রাত হয়েছে। ওপরের দিকে তাকিয়ে বুঝল, এটা তাবু। আস্তে আস্তে ওর সব কথা মনে পড়ল। চারিদিকে তাকাল। এককোণে মৃদু আলো জ্বলছে। একটা বিছানার মত নরম কিছুর ওপর শুয়ে আছে। শরীরটা এখন অনেক ভাল লাগছে। ওপাশে কে যেন মৃদুস্বরে কথা বলছে। ফ্রান্সিস পাশ ফিরল। লোকটা তাড়াতাড়ি এসে ওর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ল। লোকটার মুখে দাড়ি-গোঁফ। কপালে একটা গভীর ক্ষতচিহ্ন। হয়তো তরোয়ালের কোপের। লোকটা হাসল–কি? এখন ভাল লাগছে?

মৃদু হেসে ফ্রান্সিস মাথা নাড়ল।

–খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই।

–হ্যাঁ।

লোকটা দ্রুতপায়ে তাবুর বাইরে চলে গেল। ফ্রান্সিস বুঝল–এই লোকটাই তার সেবাশুশ্রূষার ভার নিয়েছে।

পরের দিন বিকেল পর্যন্ত ফ্রান্সিস প্রায় সমস্তক্ষণ বিছানায় শুয়ে রইল। কপালকাটা লোকটাই তার দেখাশুনা করল। ফ্রান্সিস ঐ লোকটার কাছ থেকে শুধু এইটুকুই জানতে পারল, যে এরা একদল বেদুইন ব্যবসায়ী। এখান থেকে কিছুদূরেই আমদাদ শহর। এখানকার সুলতানের রাজধানী। ওখানেই যাবে এরা। সারাদিন এদের দলপতি বারদুয়েক ফ্রান্সিসকে দেখে গেছে। দলপতির দীর্ঘ দেহ, পরনে আরবীয় পোশাক, কোমরে সোনার কাজকরা খাপে লম্বা তরোয়াল। দলপতি বেশ হেসেই কথা বলছিল ফ্রান্সিসের সঙ্গে। ফ্রান্সিসকে তার যে বেশ পছন্দ হয়েছে, এটা বোঝা গেল। দলপতির সঙ্গে সবসময়ই একটা লোককে দেখছিলই বোঝা যায় লোকটা নিষ্ঠুর প্রকৃতির।

তখন সূর্য ডুবে গেছে। অন্ধকার হয়ে আসছে চারদিক। ফ্রান্সিস তাঁবু থেকে বেরিয়ে একটা, খেজুর গাছের নীচে এসে বসল। জলাশয়ের ওপর একজন বেদুইন একা তেড়াবাঁকা তারের যন্ত্র বাজিয়ে নাকিসুরে গান করছে। ফ্রান্সিস চুপ করে বসে গান শুনতে লাগল। হঠাৎফ্রান্সিস দেখল দূরে ছায়া-ছায়া বালি-প্রান্তর দিয়ে কে যেন খুব জোরে ঘোড়াছুটিয়ে আসছে। লোকটা এল। তারপর ঘোড়া থেকে নেমেই সোজা দলপতির আঁবুতে ঢুকে পড়ল। একটু পরেই দলপতির তাঁবু থেকে কয়েকজনকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। কয়েকজন ঢুকল। বেশ একটা ব্যস্ততার ভাব। কিখবর নিয়ে এল লোকা? ফ্রান্সিসের হঠাৎ মনে হল, ওরপাশেই কে যেন এসে দাঁড়িয়েছে। আরে? সেই কপাল কাটা লোকটা। ওর জন্যে অনেক করেছে অথচনাম জানা হয়নি।

–আরে বসো-বসো। ফ্রান্সিস সরে বসবার জায়গা করে নিল। লোকটাও বসল।

–কি কাণ্ড দেখ–তোমার নামটাই জানা হয় নি। ফ্রান্সিস বলল।

–ফজল আলি, সবাই ফজল বলেই ডাকে–লোকটা আস্তে-আস্তে বলল।

এবার কি জিজ্ঞেস করবে ফ্রান্সিস ভেবে পেল না।

ফজলই কথা বলল–তুমি আমার কপালের দাগটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছিলে।

ফ্রান্সিস একটু অপ্রস্তুত হল। বলল–তা ওরকম দাগ তো বড় একটা দেখা যায় না।

–আমার ভাই তরোয়াল চালিয়েছিল। এটা তারই দাগ।

–সে কি!

–হ্যাঁ।

ফ্রান্সিস চুপ করে রইল।

–সেইদিন থেকে তরোয়াল একটা রাখতে হয় তাইরাখি, কিন্তু আজ পর্যন্ত সেটা খাপ থেকে বের করিনি। যাকগে ফজল একটু থেমে বলল–তুমি তো ভাই এখানকার লোক নও।

–ঠিক ধরেছো–আমি ভাইকিং।

–ভাইকিং! বাপরে, তোমাদের বীরত্বের অনেক কাহিনী আমরা শুনেছি।

–তাই নাকি? ফ্রান্সিস হাসল।

–তোমার নাম?

–ফ্রান্সিস।

–কোথায় যাচ্ছিলে?

ফান্সিস একটু ভাবল। সোনার ঘন্টার খোঁজে যাচ্ছিলাম, এ সব বলা বিপজ্জনক। তা ছাড়া ও সব বললে পাগলও ঠাউরে নিতে পারে। বলল—এই–ব্যবসায় ফিকিরে–

–জাহাজ ডুবি হয়েছিল?

–হ্যাঁ।

দু’জনের কেউ আর কোন কথা বলল না। ফ্রান্সিস একবার আকাশের দিকে তাকাল। পরিষ্কার আকাশজুড়ে তারা। কি সুন্দর লাগছে দেখতে। হঠাৎ ফজল চাপাস্বরে ডাকল–ফ্রান্সিস?

–কি?

–যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই দল ছেড়ে পালাও।

ফ্রান্সিস চমকে উঠে বললো–কেন?

ফজল চারিদিকে তাকিয়ে চাপাস্বরে বলল–এটা হচ্ছে বেদুইন মরুদস্যুদের দল।

–সে কি!

–হ্যাঁ।

–তুমিও তো এই দলেরই।

–উপায় নেই ভাই–একবার এই দস্যুদলে ঢুকলে পালিয়ে যাওয়ার সব পথ বন্ধ।

–কেন?

–এই তল্লাটের সব শহরে, বাজারে, মরুদ্যানে এদের চর রয়েছে। তোমাকে ঠিক খুঁজে বার করবে। তারপর

–মানে–খুন করবে?

–বুঝতেই পারছো।

–কিন্তু–ফ্রান্সিসের সংশয় যেতে চায় না। বলল–সর্দারকে তো ভালো লোক বলেই মনে হল।

–তা ঠিক কিন্তু সর্দারকে চালায় কাসেম–কাসেমকে দেখেছ তো? সব সময় সর্দারের সঙ্গে থাকে।

–হ্যাঁ–বীভৎস দেখতে।

–যেমন চেহারা তেমনি স্বভাব। ওর মত সাংঘাতিক মানুষ আমি জীবনে দেখিনি।

–হুঁ। কাসেমকে দেখে আমারও তাই মনে হয়েছে।

–কালকেই দেখতে পাবে, কাসেমের নিষ্ঠুরতার নমুনা।

–তার মানে?

আজকে শেষ রাত্তিরে আমরা বেরুবো। গুপ্তচর খবর নিয়ে এসেছে এইমাত্র–মস্তবড় একটা ক্যারাভান (মরুপথের যাত্রীদল) এখান থেকে মাইল পাঁচেক দূর দিয়ে যাবে।

–ক্যারাভ্যান?

–হ্যাঁ। ব্যবসায়ীদের ক্যারাভ্যান। দামী-দামী মালপত্র নিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া মোহর, সোনার গয়নাগাঁটি এসব তো রয়েইছে। ক্যারাভ্যানে তো শুধু ব্যবসায়ীরাই যায় না অন্য লোকেরাও যায় তাদের পরিবারের লোকজন নিয়ে। দল বেঁধে গেলে ভয় কম।

–তোমরা ক্যারাভ্যান লুঠ করবে?

–সর্দারের হুকুম। কথাটা বলেই ফজল গলা চড়িয়ে অন্য কথা বলতে শুরু করল–শুনেছি তোমাদের দেশে নাকি বরফ পড়ে–আমরা বরফ কোনদিন চোখেও দেখিনি। ফ্রান্সিস কি বলবে বুঝে উঠতে পারল না। তবে অনুমান করলো কাউকে দেখেই ফজল অন্য কথা বলতে শুরু করেছে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখল খেজুর গাছের আড়াল থেকে কে যেন বেরিয়ে এল। কাসেম! কাসেম গম্ভীর গলায় বলল ফজল, শেষ রাত্তিরে বেরুতে হবে-ঘুমিয়েনাও গে যাও।

–হ্যাঁ এই যাচ্ছি। ফজল তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল। চলে যেতে-যেতে গলা চড়িয়ে বলল–তাহলে ঐ কথাই রইল–তুমি ওখান থেকে বরফ চালান দেবে, বদলে আমি এখান থেকে বালি চালান দেবো।

কাসেম এবার কুৎসিত মুখে হাসলো–এই সাদা ভিনদেশী–তুইও যাবি সঙ্গে।

ফ্রান্সিসের সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল। কথা বলার কি ভঙ্গী! কিন্তুও চুপ কবে রইল। শরীর দুর্বল। এখন আশ্রয়ের প্রয়োজন খুবই, চটাচটি করলে নিজেরই ক্ষতি। সময় আসুক। অপমানের শোধ তুলবে।

ফ্রান্সিস কোন কথা না বলে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের তাবুর দিকে পা বাড়াল। পেছনে শুনল এ কাসেমের বীভৎস হাসি–ওঃ শাহজাদার গোঁসা হয়েছে–হা হা।

মরুদস্যুর দল ঘোড়ায় চলে চলেছে। শেষ রাত্রির আকাশটা কেমন ঘোলাটে। তারাগুলো অস্পষ্ট। একটা ঠাণ্ডা শিরশিরে হাওয়া বইছে। ফ্রান্সিস উটের লোমের কম্বলকান অব্দি তুলে দিল। কোমরে নতুন তরোয়ালটার খাপটায় হাত দিল একবার।

বালিতে ঘোড়ার ক্ষুরের অস্পষ্ট শব্দ। ঘোড়ার শ্বাস ফেলার শব্দ। মাঝে-মাঝে ঘোড়ার ডাক। মরুদস্যুর দল ছুটে চলেছে। কাসেমের চীৎকার শোনা গেল–আরো জোরে। ফ্রান্সিস ঘোড়ার রাশ অনেকটা আলগা করে দিল। ঘোড়ার পেটে পা ঠুকলো। সকলেই ঘোড়ার চলা গতি বাড়িয়ে দিল।

পূবের আকাশটা লাল হয়ে উঠেছে। একটু পরেই লাল টকটকে সূর্য উঠল। তারপর নরম রোদ ছড়িয়ে পড়ল ধুধুবালির প্রান্তরে। সেই আলোয় হঠাৎ দুরে দেখা গেল—একা আঁকাবাঁকা সচল রেখা। স্যারাভ্যান চলেছে। কাশেমের উল্লসিত উচ্চস্বর শোনা গেল আরো জোরে।

বিদ্যুৎগতিতে ধূলোর ঝড় তুলে মরুদস্যুর দল ছুটলো ক্যারাভ্যান লক্ষ্য করে। একটু পরেই দেখা গেল ক্যারাভ্যানের আঁকাবাঁকা রেখাটা ভেঙে গেল। ওরা মরুদস্যুর লোকদের দেখতে পেয়েছে। যেদিকে পারছে ছুটছে। কিন্তু মালপত্র আর সওয়ারী পিঠে নিয়ে উটগুলো আর কত জোরে ছুটবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মরুদস্যুর দল ওদের দু’দিক থেকে ঘিরে ধরল। সকালের আকাশটা ভরে উঠল নারী আর শিশুদের ভয়ার্ত চিৎকারে।

শুরু হল খণ্ডযুদ্ধ। ক্যারাভ্যানের ব্যবসায়ীরা কিছু ভাড়াকরা পাহারাদার নিয়ে যাচ্ছিল সঙ্গে। তাদের সঙ্গেই লড়াই শুরু হল প্রথমে। উটের পিঠে কাপড়ের ঢাকনা দেওয়া ছইগুলো থেকে ভেসে আসতে লাগল ভয়ার্ত কান্নার চিৎকার। কিন্তু সেদিকে কারো কান নেই। সকালের আলোয় ঝিকিয়ে উঠল তরোয়ালের ফলা। তারপর তরোয়ালের সঙ্গে তরোয়ালের ঠোকাঠুকি মূমূর্ষদের চীৎকার, গোঙানি।

ফ্রান্সিস একপাশে ঘোড়াটা দাঁড় করিয়ে যুদ্ধ দেখছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে ক্যারাভ্যানের প্রহরীরা প্রায় সবাই বালির উপর লুটিয়ে পড়ল।

এমন সময় ব্যবসায়ীদের মধ্যে থেকে আরো কয়েকজন তরোয়াল হাতে এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস অবাক হয়ে দেখল তার মধ্যে একটি কিশোর ছেলে। ছেলেটি অদ্ভুত দক্ষতার সঙ্গে তরোয়াল চালাতে লাগল। পাঁচ-ছয়জন মরুদস্যু ওকে ঘিরে ধরল। কিন্তু ছেলেটির কোছেও ঘেঁষতে পারছে না কেউ! ছেলেটির তরোয়াল চালানোর নিপুণ ভঙ্গী আর দুর্জয় সাহস দেখে ফ্রান্সিস মনে মনে তার তারিফ না করে পারল না। যারা ওকে ঘিরে ধরেছিল তাদেরই দুজন রক্তাক্ত শরীরে পালিয়ে এল। ছেলেটি তখনও অক্ষত। সবিক্রমে তরোয়াল চালাচ্ছে। কিশোর ছেলেটিকে দেখে ফ্রান্সিসের মনে পড়ল, নিজের ছোটভাইটির কথা। তার ভাইটিও এমনি তেজী, এমনি নির্ভক।

এবার আট-দশজন মরুদস্যু ছেলেটিকে ঘিরে ধরল। কিন্তু ছেলেটির প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের কাছে ওদের বার বার হার স্বীকার করতে হল।

হঠাৎ দেখা গেল, কাসেম ছেলেটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ফ্রান্সিস বুঝল কাসেমের নিশ্চয়, কোন কুমতলব আছে। লড়াই তখন শেষ। ক্যারাভ্যানের দলের মাত্র কয়েকজন পুরুষ তখনও কোনোরকমে টিকে আছে। বাকী সবাই মৃত নয় তো মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। রয়েছে শুধু নারী আর শিশুরা। কাজেই লুঠতরাজ চালাতে এখন আর কোন বাধাই, নেই। কিন্তু কাসেমের মতলব বোধহয় কাউকেই বেঁচে থাকতে দেবে না। ফ্রান্সিস ঘোড়াটা চালিয়ে নিয়ে একটু এগিয়ে দাঁড়ালো।

কাসেম তক্কে তক্কে রইল। ছেলেটি তখন ঘোড়ার মুখ উল্টেদিকে ফিরিয়ে অন্য দস্যু কটার সঙ্গে লড়াই চালাতে লাগল। কাসেম যেন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। সে নিচু হয়ে ছেলেটির ঘোড়র পেটের দিকে জিনের চামড়াটায় তরোয়াল চালাল। জিনটা কেটে দু’টুকরো হয়ে গেল। ছেলেটি জিন সুদ্ধু হুড়মুড় করে গড়িয়ে বালির ওপর পড়ে গেল। ঘোড়ার গা থেকে রক্ত ছিটকে লাগল ওর সর্বাঙ্গে। ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। কাসেম অট্টহাসি হেসে উঠল। ওর কুৎসিত মুখটা আরো বীভৎস হয়ে উঠল। এবার অন্য দস্যুগুলো ঘোড়া নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল। কিন্তু কাসেমের ইঙ্গিতে থেমে গেল।

ফ্রান্সিস বুঝল–কাসেমের নিশ্চয়ই কোন সাংঘাতিকঅভিসন্ধি আছে। ঠিকতাই। কাসেম নিজের ঘোড়াটাকে ছেলেটির কাছে নিয়ে গেল। ছেলেটি তৎক্ষণাৎ তরোয়াল উঁচিয়ে দাঁড়াল। ছেলেটির সর্বাঙ্গে রক্তের ছোপ। সে বেশ ক্লান্ত এটাও বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু মুখ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কাসেম নিচু হয়ে তরোয়ালের ডগায় বালি তুলে ছেলেটির চোখেমুখে ছিটোতে লাগল। দস্যুদলের মধ্যে হাসির ধুম পড়ে গেল। ওরা ছেলেটিকে চারদিক থেকে ঘিরে মজা দেখতে লাগল। একসময় অনেকটা বালি ছেলেটির চোখে ঢুকে পড়ল। সে বাঁ হাতে চোখ রগড়াতে লাগল। কিন্তু হাতের তরোয়াল ফেলল না ঠিক তখনই বালিতে প্রায় অন্ধ ছেলেটির মাথা লক্ষ্য করে কাসেম তরোয়াল তুললো। ফ্রান্সিস আর সহ্য করতে পারলনা। বিদ্যুৎবেগে ঘোড়াটাকে কাসেমের সামনে নিয়ে এল! কাসেম কিচ্ছু বোঝবার আগেই কাসেমের উদ্যত তরোয়ালটায় আঘাত করল। আগুনে ফুলকি ছুটল। বেকায়দায় তরোয়াল চালিয়েছিল ফ্রান্সিস। তাই মুঠি আলগা হয়ে ওর তরোয়ালটা ছিটকে পড়ে গেল। কাসেম তীব্র দৃষ্টিতে ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। তারপর দাঁতে দাঁত ঘষে গর্জে উঠল–কাফের। তারপরেই ছুটল ফ্রান্সিসের দিকে। ফ্রান্সিস বিপদ গুনলো। কাসেম তরোয়াল উঁচিয়ে আসছে। ফ্রান্সিসের সাধ্য নেই, খালি হাতে ওকে বাধা দেয়।

–ফ্রান্সিস। চাপাস্বরে কে ডাকল। ফ্রান্সিস দ্রুত ঘুরে তাকাল। ফজল! ফজল ওর তরোয়ালটা এগিয়ে দিল। তরোয়ালটা হাতে পেয়েই ফ্রান্সিস কাসেমের প্রথম আঘাতটা সামলাল। কাসেম আবার তরোয়াল তুলল। ঠিক তখনই সর্দারের বজ্রনির্ঘোষ কণ্ঠস্বর শোনা গেল–কাসেম ভুলে যেও না, আমরা লুঠ করতে এসেছি।

কাসেম উদ্যত তরবারি নামাল। শিকার হাত ছাড়া হয়ে গেল। দুজনে কি কথা হল। কাসেম তরোয়াল উঁচিয়ে ক্যারাভ্যানের দিকে ইঙ্গিত করল। কি হয় দেখবার জন্যে মরুদস্যুরা এতক্ষণ চুপ করে অপেক্ষা করছিল। সেই স্তব্ধতা খান খান হয়ে ভেঙে গেল তাদের চীৎকার। সবাই চীৎকার করতে করতে ছুটল ক্যারাভ্যানের দিকে। তারপর পৈশাচিক উল্লাসে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ল ক্যারাভ্যানের ওপর। আবার আর্তচীৎকার কান্নার রোল উঠল। অবাধ লুঠতরাজ চলল।

এবার ফেরার পালা। ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত মৃতদেহগুলোর ওপর দিয়েই দস্যুর দল ঘোড়া ছোটাল। ফ্রান্সিস অতটা অমানুষ হতে পারল না। অন্য দিক দিয়ে ঘুরে যেতে লাগল। হঠাৎ দেখল সেই ছেলেটি মাটিতে হাঁটু গেড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ফ্রান্সিস একবার ভাবল নেমে গিয়ে ওকে সান্ত্বনা দেয়। কিন্তু উপায় নেই। মরুদস্যর দল অনেকটা এগিয়ে গেছে। ফ্রান্সিস ঘোড়া ছুটিয়ে দলের সঙ্গে এসে মিশল। ওরা যখন সেই মরুদ্যানে ফিরে–এল তখন সূর্য মাথার ওপরে। চারদিকে বালির ওপর দিয়ে আগুনের হল্কা ছুটছে যেন।

বিকেলে খেজুর গাছটার তলায় ফজলের সঙ্গে দেখা হল। ফজল বললো

–অতগুলো লোকের প্রাণ বাঁচালে তুমি ভাই।

–কেন?

–তোমার কাছে বাধা পেয়েই তো কাসেম আর এগোতে সাহস করেনি।

–তা না হলে কি করতো?

–সব ক’জনকে মেরে ফেলতো।

–সে কি! মেয়েরা বাচ্চাগুলো–ওরা তো নিরপরাধ।

–কাসেমের নিষ্ঠুরতার পরিমাণ করতে পারবে না। জাহান্মামেও ওর ঠাঁই হবে না।

–হুঁ।

–ও কিন্তু তোমাকে সহজে ছাড়বে না। সাবধানে থেকো।

–ও আমার কি করবে?

–জানো না তো ভাই, দলের কেউ ওকে ঘাঁটাতে সাহস করে না, এমন কি সর্দারও না। হঠাৎ পেছনে কাকে দেখে ফজল থেমে গেল। কাসেম নয়। দস্যু দলের একজন। কাছে এসে ফ্রান্সিসকে ডাকল–এই ভিনদেশী–তোমাকে সর্দার এত্তেলা পাঠিয়েছেন।

–চলো, ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। তারপর লোকটার সঙ্গে তাঁবুর দিকে চলল।

একটা মোটা তাকিয়া ঠেস দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় সর্দার রূপোর গড়গড়ায় তামাক খাচ্ছিল। ফ্রান্সিস গিয়ে দাঁড়াতে নল থেকে মুখ না তুলে ইঙ্গিতে তাকে বসতে বললো। জাজিমপাতা ফরাসের ওপর বসতে গিয়ে ফ্রান্সিস দেখল, কাসেমও একপাশে বসে আছে। কাসেম তীব্র দৃষ্টিতে ফ্রান্সিসের দিকে একবার তাকাল। পরক্ষণেই যেন প্রচণ্ড ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে নিল। এতক্ষণে সর্দার কেশে নিয়ে ডাকল–ফ্রান্সিস।

–বলুন।

–তুমি বিদেশী–আমাদের রাজনীতি তোমার জানবার কথা নয়। তুমি আজকে যা করেছ, অন্য কেউ হলে তাকে এতক্ষণে বালিতে পুঁতে ফেলা হত।

ফ্রান্সিস চুপ করে রইল। সর্দার বললো কাশেম তুমি ওর সঙ্গে লড়তে রাজি আছ?

কাসেম সঙ্গে সঙ্গে খাপ থেকে একটানে তরবারিটা বের করে বললো–এক্ষুণি।

সর্দার ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল–তুমি?

ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়িয়ে বলল–আমি রাজী।

–হুঁ। সর্দার গড়গড়ার নলটা মুখে দিল। কয়েকবার টানল। তারপর বলল–রাত্তিরে তোমাকে ডেকে পাঠানো হবে। তৈরী হয়ে আসবে।

* * *

বালিতে কয়েকটা মশাল পুঁতে রাখা হয়েছে। চারদিকে ভীড় করে দাঁড়িয়েছে মরুদস্যু দলের লোকেরা। পরিষ্কার আকাশে লক্ষ তারার ভিড়। অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে বালিতে ফুটফুটে চাঁদের আলো।

ফ্রান্সিসকে আসতে দেখে মরু-দস্যুদলের ভিড়ের মধ্যে গুঞ্জন উঠল। ওরা ভিড় সরিয়ে পথ করে দিল। ফ্রান্সিস সহজ ভঙ্গিতে ভিড়ের মাঝখানকার ফাঁকা জায়গাটায় এসে দাঁড়াল। একদিকে সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে, তার নিচে সর্দার বসে আছে। সেদিকে দাঁড়িয়ে আছে, কাসেম। হাতে খোলা তরোয়ালে মশালের আলো পড়ে চকচক করছে। মশালের আলো কাঁপছে তার টকটকে লাল আলখাল্লায়। ওকে দেখতে আরো বীভৎস লাগছে। ফ্রান্সিস তখনও খাপ থেকে তরোয়াল খোলেনি।

ফজলকে ডেকে সর্দার কি যেন বলল। ফজল কাসেমকে ফাঁকা জায়গার মাঝখানে এগিয়ে আসতে বলল। ফ্রান্সিসকেও ডাকল। ফ্রান্সিস এবার তরোয়াল খুলল। তারপর পায়ে-পায়ে এগিয়ে কাসেমের মুখোমুখি দাঁড়াল। সর্দার হাততালি দিয়ে কি একটা ইঙ্গিত করতেই কাসেম মুখোমুখি দাঁড়াল। সর্দার হাততালি দিয়ে কি একটা ইঙ্গিত করতেই কাসেম তরোয়াল উঁচিয়ে ফ্রান্সিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস এই অতর্কিত আক্রমণে প্রথমে হকচকিয়ে গেল। কাসেমের তরোয়ালের আঘাত ঠেকাল বটে, কিন্তু টাল সামলাতে না পেরে বালির ওপর বসে পড়ল। ভিড়ের কাসেম তরোয়াল উঁচিয়ে মধ্যে থেকে হাসির হররা উঠল। আবার কাসেম তরোয়াল ফ্রান্সিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। চালাল। এবারও একই ভঙ্গীতে ফ্রান্সিস কাসেমের তরোয়ালের ঘা থেকে আত্মরক্ষা করল। তারপর নিজেই এগিয়ে গিয়ে কাসেমকে লক্ষ্য করে তরোয়াল চালাল। শুরু হল দুজনের লড়াই। বিদ্যুৎগতিতেই দু’জনের তরোয়াল ঘুরছে। মশালের কাঁপা কাঁপা আলোয় চকচক করছে তরোয়ালের ফলা। ঠং-ঠং ধাতব শব্দ উঠছে তরোয়ালের ঠোকাঠুকিতে।

রুদ্ধ নিঃশ্বাসে মরুদস্যুর দল দেখতে লাগল এই তরোয়ালের লড়াই। কেউ কম যায় না। দুজনেরই ঘন-ঘন শ্বাস পড়তে লাগল। কপালে ঘামের রেখা ফুটে উঠল। হঠাৎ ফ্রান্সিসের একটা প্রচণ্ড আঘাত সামলাতে না পেরে বালিতে কাসেমের পা সরে গেল। কাসেম কাত হয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস এই সুযোগ ছাড়ল না। দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে তরোয়াল চালাল। কাসেম মরীয়া হয়ে সে আঘাত ফেরাল। কিন্তু মুঠি আলগা হয়ে তরোয়াল ছিটকে পড়ল একটু দূরে। কাসেম চিৎহয়ে বালিতে পড়ে গেল, ফ্রান্সিস তরোয়াল নামিয়ে কাসেমের দিকে তাকাল। কাসেমের চোখেমৃত্যুভীতি। মুখ হাঁকরে সেশ্বাস নিচ্ছে তখন। ফ্রান্সিসও হাঁপাচ্ছে। ফ্রান্সিস তরোয়ালের ছুঁচলো ডগাটা। কাসেমের লাল আলখাল্লায় বিঁধিয়ে একটা টান দিল। লাল আলখাল্লাটা দু’ফালি হয়ে গেল। বুকের অনেকটা জায়গা কেটেও গেল, রক্তে ভিজে উঠল আলখাল্লাটা। মরুদস্যুদের মধ্যে গুঞ্জনধ্বনি উঠল। কোনদিকে না তাকিয়ে ফ্রান্সিস চলল সর্দারের কাছে। ও তো জানে এক রকম দু’জনের মধ্যে তরোয়ালের লড়াইয়ের ক্ষেত্রে বেদুইনদের রীতি কী? সর্দার যা বলবে তাই সে করবে।

ফ্রান্সিস! ফজলের অস্পষ্ট সতর্ক কণ্ঠস্বর শুনে ফ্রান্সিস ঘুরে দাঁড়াল। ভোলা গা, উদ্যত তরোয়াল হাতে কাসেম ছুটে আসছে। ঠিক ওর মাথার ওপর কাসেমের তরোয়াল। পলকমাত্র সময় হাতে। ফ্রান্সিস উবু হয়ে মাটিতে বসে পড়ল। কাসেমের তরোয়াল নামল। বাঁ কাঁধে এক একটা তীব্র যন্ত্রণা। তরোয়ালের ঘা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ফ্রান্সিসের মাথায় খুন চেপে গেল। কাপুরুষ! ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়িয়ে আর এক মুহূর্ত দেরি করল না। উন্মত্তর মত ঝাঁপিয়ে পড়ল কাসেমের ওপর। কাঁধের যন্ত্রণা উপেক্ষা করে আঘাতের পর আঘাত হানল। কাসেম সেই তীব্র আক্রমণের সামনে অসহায় হয়ে পড়ল। পিছিয়ে যেতে-যেতে কোনরকমে আত্মরক্ষা করতে লাগল। কিন্তু বেশীক্ষণ দাঁড়াতে পারল না সেই আক্রমণের মুখে। তার হাত অবশ হয়ে এল। উপুর্যপরি কয়েকবার আঘাত হেনে সুযোগ বুঝে ফ্রান্সিস বিদ্যুৎবেগে তরোয়াল চালাল কাসেমের বুক লক্ষ্য করে। কাসেমের গলা দিয়ে শুধু একটা কাতরধ্বনি উঠল। পরক্ষণেই সে বালির ওপর লুটিয়ে পড়ল। বুকে বেঁধা তরোয়ালটা টেনে খোলবার চেষ্টা করতে লাগল। তারপর শরীর স্থির হয়ে গেল। ফ্রান্সিস বালিতে হাঁটু গেড়ে বসে তখনও হাঁপাচ্ছে।

তরোয়াল যুদ্ধের এই ফলাফল দস্যুদলের কেউই আশা করেনি। কারণ, এর আগে কাসেমের সঙ্গে তরোয়ালের যুদ্ধে হেরে গিয়ে অনেককেই তারা মৃত্যুবরণ করতে দেখেছে। তরোয়াল যুদ্ধে কাসেম ছিল অজেয়। সেই কাসেম আজ একজন ভিনদেশীর কাছে শুধু হার স্বীকার করা নয়, একেবারে মৃত্যুবরণ করবে, এটা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। দস্যুদলে কাসেমের অনুগামীর সংখ্যা কম ছিল না। তারা দল বেঁধে খোলা তরোয়াল হাতে ছুটে গেল। ফ্রান্সিসকে ঘিরে ধরল তারা, কিন্তু ফ্রান্সিসকে আক্রমণ করবার আগেই সর্দার উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলে সবাইকে থামতে ইঙ্গিত করল, তারপর ধীর পায়ে নিজের তাঁবুতে ফিরে গেল।

কাঁধের যন্ত্রণাটা অনেকখানি কমেছে। একটু আগে সর্দার একজন লোক পাঠিয়েছিল। এই দলে হেকিমের কাজ করে লোকটা। কি একটা কালো আঠার মত ওষুধ ক্ষতস্থানে লাগিয়ে ন্যাড়া দিয়ে বেঁধে দিল। রক্ত পড়া বন্ধ হল। একটু পরে ব্যথাটা কমতে শুরু করল। কিন্তু ফ্রান্সিসের চোখে ঘুম নেই। অনেক রাত পর্যন্ত ও জেগে রইল। দেশ ছেড়েছে কতদিন হয়ে গেল, তারপর জাহাজে নাবিকের জীবন বন্ধু জ্যাকব’ জাহাজডুবি, সোনার ঘন্টার ঢংঢং শব্দ, আর আজ কোথায় এসে পড়েছে। নাঃ, এখান থেকে পালাতে হবে। ছেলেবেলা থেকে যে সোনার ঘন্টার স্বপ্ন ও দেখেছে, তার হদিশ পেতেই হবে। ভাবতে ভাবতে কখন একসময়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

হঠাৎ একটা আর্ত চীৎকারে ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেল। কে উচ্চস্বরে কেঁদে উঠল। কাকুতি-মিনতি করতে লাগল। ফ্রান্সিস কান পেতে রইল। আবার চীৎকার। ফ্রান্সিস দ্রুতপায়ে তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়াল।

ভোর হয়–হয় সূর্য উঠতে আর দেরি নেই। আবছা আলোয় ফ্রান্সিস দেখল–চার পাঁচজন ঘোড়সওয়ার দস্যু কাকে যেন দড়িতে হাত বেঁধে বালির ওপর দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে চলেছে। লোকটা হাতে বাঁধা দড়িটা টানছে। কাকুতি মিনতি করছে। ফ্রান্সিস সেই আবছা আলোতেও চিনল। লোকটা আর কেউ না–ফজল। কিন্তু ফজলকে ওরা কোথায় নিয়ে চলেছে? হঠাৎ ঘোড়াগুলো ছুটতে শুরু করল। ফজল বালির ওপর মুখ থুবড়ে পড়ল। পৈশাচিক আনন্দে ওরা ফজলকে বালির ওপর দিয়ে হিঁচড়ে নিয়ে চলল।

ফ্রান্সিস বুঝতে পারল–ফজল ওকে সাহায্য করেছে–প্রাণে বাঁচিয়েছে। সেই অপরাধের শাস্তিটা ওকে পেতে হচ্ছে। ও আর দাঁড়াল না। যে করেই হোক ফজলকে বাঁচাতে হবে। তাঁবুতে ফিরে এসে পোশাক পরে নিল। কোমরে তরোয়াল বাঁধলো। তারপর নিঃসাড়ে খেজুর গাছে বাঁধা ঘোড়াটাকে খুলে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল। নিজে চলল ঘোড়াটার আড়ালে। জলাশয়ের ওপাশ দিয়ে কিছুটা এগোতেই একটা উঁচু বালিয়াড়ির পেছনে মরুদ্যানটা আড়াল পড়তে ঘোড়ার পিঠে উঠে বালি উড়িয়ে ঘোড়া ছোটাল।

সূর্য উঠল। সকালের রোদে তেজ কম। তাই ফ্রান্সিসের পরিশ্রম হচ্ছিল কম। বেশী দূর যেতে হল না। ফ্রান্সিস দেখল–একটা নিঃসঙ্গী খেজুর গাছে ফজলের হাত বাঁধা দড়িটার একটা কোণা বাঁধা রয়েছে। আর ফজলকে ওরা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ফজলের হাত বাঁধা। পা ছুঁড়ে নানাভাবেও বাধা দেবার চেষ্টা করছে। কিন্তু ওদের সঙ্গে পারবে কেন?ফ্রান্সিস ঘোড়া ছুটিয়ে সেই দস্যুগুলোর কাছাকাছি আসতেই সমস্ত ব্যাপারটা বুঝতে পারল। ও শিউরে উঠল। কি সাংঘাতিক। ফজলকে ওরা চোরাবালিতে ঠেলে ফেলে দিতে চাইছে। চোরাবালিতে আটকে গেলেই গাছের সঙ্গে বাঁধা ফজলের হাতের দড়িটা কেটে দেবে। ফ্রান্সিসের অনুমানই সত্যি হল। ফজলের একটা মর্মান্তিক চীৎকার ওর কানে এল। দেখল–ফজলকে ওরা এমন সময় একজন দস্য মাথার ওপর চোরাবালিতে ঠেলে দিয়েছে। ফজল প্রাণপণ শক্তিতে তরোয়াল তুলল দড়িটা কাটবার জন্য। গাছের সঙ্গে বাঁধা দড়িটা টেনে ধরে চোরাবালি থেকে উঠে আসার চেষ্টা করছে। এমন সময় একজন দস্যু মাথার ওপর তরোয়াল তুললো দড়িটা কাটবার জন্যে। এক মুহূর্ত। দড়িটা কেটে গেলে ফজল চোরাবালির অতল গর্ভে তলিয়ে যাবে। ওর চিহ্নমাত্রও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

ফ্রান্সিস উল্কার বেগে ঘোড়া ছোটাল। তারপর চলন্ত ঘোড়া থেকে লাফ দিয়ে সেই দস্যুটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। দড়ি আর কাটা হল না। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়িয়ে আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করল না। ছুটে গিয়ে দড়িটা ধরে প্রাণপণে টানতে লাগল। শুধু ডান হাতেই তাকে টানতে হচ্ছিল। কারণ বাঁ হাতটা তখনও প্রায় অবশ হয়ে আছে। দুটো তিনটে হ্যাঁচকা টান মারতেই ফজল চোরাবালির গহ্বর থেকে শক্ত বালিতে উঠে এল। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। বালিতে শুয়ে পড়ল। এতক্ষণের শারীরিক নির্যাতন, তার ওপর এই মৃত্যুর বিভীষিকা, এই সবকিছু তার দেহমনের শেষ শক্তিটুকু শুষে নিয়েছিল।

এত অল্প সময়ের মধ্যে এত কাণ্ড ঘটে গেল। দস্যুর দল কি করবে বুঝে উঠতে পারল না। ফজলকে চোরাবালি থেকে উঠে আসতে দেখে ওদের টনক নড়ল। এবার ফ্রান্সিসকে ঘিরে ধরল। ফ্রান্সিস একবার চারদিক থেকে ঘিরে ধরা দস্যুদের মুখের দিকে তাকাল। তারপর চীৎকার করে বলে উঠল ফজল আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে। যে ওর গায়ে হাত দেবে, আমি তাকে দু’টুকরো করে ফেলবো।

ফ্রান্সিসের সেই ক্রোধোন্মত্ত চেহারা দেখে দস্যুরদল বেশ ঘাবড়ে গেল। এটা যে ফ্রান্সিসের শূন্য আস্ফালন নয়, সেটা ওরা বুঝল। গত রাত্রে তার প্রমাণও পেয়েছে ওরা। কাজেই ফ্রান্সিসকে কেউ ঘাঁটাতে সাহস করল না। নিজেদের মধ্যে ওরা কী যেন বলাবলি করল। তারপর ঘোড়া ছোটালো সেই মরুদ্যানের দিকে। যতক্ষণ ওদের দেখা গেল ফ্রান্সিস তাকিয়ে রইল। তারপর দ্রুতপায়ে ফজলের কাছে এল। জলের পাত্রটা খুলে ফজলের চোখে-মুখে জল ছিটিয়ে দিল। ফজল দু’একবার চোখ পিটপিট করে ভালোভাবে তাকাল। মুখ হাঁ করে জল খেতে চাইল। ফ্রান্সিস ওর মুখে আস্তে আস্তে জল ঢেলে দিতে লাগল। জল খেয়ে ফজল যেন একটু সুস্থ হল। ফ্রান্সিস ওর হাতের দড়িটা কেটে দিল। তারপর ডাকল ফজল।

ফজল ম্লান হাসল। ফ্রান্সিস বললো–চলো–ঘোড়ায় বসতে পারবে তো?

ফজল মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। ফ্রান্সিস ওকে ধরেধরে কোনরকমে ঠেলেঠুলে ঘোড়ার ওপর বসিয়ে নিল। তারপর নিজে লাফিয়ে উঠে পেছনে বসল। আর সময় নষ্ট না করে ঘোড়া ছোটাল। এ জায়গাটা ছেড়ে পালাতে হবে। বলা যায় না, হয়তো দলে ভারী হয়ে ওরা এখানে আসতে পারে। হলোও তাই। ফ্রান্সিস পেছন ফিরে দেখল বালির দিগন্ত রেখায় কালো বিন্দুর মত কালো ঘোড়সওয়ার দস্যুর দল ছুটে আসছে।

ফজল এতক্ষণে যেন গায়ে জোর পেল। ও একবার ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসল।

–তুমি আমার প্রাণ বাঁচালে ভাই।

ফ্রান্সিস হেসে বললো, এখনও আমাদের প্রাণের ভয় যায় নি ফজল।

–কেন?

–পেছনে তাকিয়ে দেখ।

ফজল ফিরে তাকাল। ধুলো উড়িয়ে দূরন্ত বেগে ছুটে আসছে মরুদস্যুর দল। একে অসুস্থ ফজলকে ধরে রাখতে হচ্ছে, তার ওপর কাঁধের কাটা জায়গাটার যন্ত্রণা। ফ্রান্সিস খুব জোরে ঘোড়া ছোটাতে পারছিল না। ক্রমেই মরুদস্যুদের সঙ্গে তাদের ব্যবধান কমে আসছিল।

–ফ্রান্সিস? ফজল ডাকল।

–হুঁ–

সামনের ঐ যে পাহাড়ের মত একটা বালির ঢিবি দেখছো?

-–হুঁ।

–ঐ টিবিটার ওপাশেই একটা মরুদ্যান আছে।

–ওখানেই যাবে?

–না…. না। ঐ ঢিবিটার আড়ালে আড়ালে আমরা ডানদিকে বাঁক নেব।

–কিন্তু–

–এছাড়া বাঁচবার কোন পথ নেই। ওরা ধরেই নেবে আমরা নিশ্চয়ই ঐ মরুদ্যানে আশ্রয় নেব, কারণ আমরা দুজনেই অসুস্থ–বেশীদূর যেতে পারবো না।

–তা ঠিক।

–কাজেই আমাদের আশ্রয়ের জন্যে অন্য কোথাও যেতে হবে।

–কোথায় যাবে সেটা বলো–

–ডানদিকে মাইল কয়েক গেলেই আমদাদ শহর। একবার ঐ শহরে ঢুকতে পারলে তোমার আর কোন ভয় নেই।

–কেন?

–ওরা অনেকেই দাগী দস্যু–সুলতানের সৈন্যরা চিনে ফেলবে, এইজন্যে ওরা, আমদাদ শহরে ঢুকবে না।

–কিন্তু তুমি?

–আমি আর কোথাও আস্তানা খুঁজে নেব।

কথা বলতে বলতে ওরা পাহাড়ের মত উঁচু বালির ঢিবিটার আড়াল দিয়ে দিয়ে ঘোড়া ছোটাল। অনেকদূর পর্যন্ত আড়াল পেল ওরা। এক সময় ঢিবিটা শেষ হয়ে গেল। সামনে অনেক দূরে দেখা গেল হলদে-সাদা রঙের লম্বা প্রাচীর। ফজল বলল–এই হচ্ছে আমদাদ শহর। আর ভয় নেই।

ফ্রান্সিস পেছনে তাকাল। ধূ-ধূ বালি। মরুদস্যুর চিহ্নমাত্র নেই।

আমদাদ শহরের প্রাচীরের কাছে এসে পৌঁছল ওরা। ফ্রান্সিস দেখল–শহরের পশ্চিমদিকে তামাটে রঙের পাথরের একটা পাহাড়। ফজল আঙুল দিয়ে পাহাড়টা দেখিয়ে বলল–ঐ পাহাড়ের নীচেই সুলতানের প্রাসাদ। আর পাহাড়ের ওপাশে সমুদ্র।

–সমুদ্র?–ফ্রান্সিস অবাক হল।

–হ্যাঁ, কেন বল তো?

–জাহাজডুবি হয়ে ভাসতে ভাসতে ঐ সমুদ্রের ধারেই এসে ঠেকেছিলাম। যদি সমুদ্রের ধারে ধারে পশ্চিমদিকে যেতাম, তাহলে আগেই এই শহরে এসে পৌঁছতাম।

–তুমি তাহলে উলটো দিকে গিয়েছিলে–মরুভূমির দিকে।

গম্বুজঅলা শহরের তোরণ। কাছাকাছি আসতেই ব্যস্ত মানুষের আনাগোনা নজরে পড়ল। উটের পিঠে, ঘোড়ায় চড়ে শহরে লোকজন ঢুকছে, বেরোচ্ছে। ফজল বলল–এবার ঘোড়া থামাও–আমি এখান থেকে অন্যদিকে চলে যাব।

ফ্রান্সিস ঘোড়া থামাল।

–ফ্রান্সিস। –ফজল ডাকল।

–হুঁ।

–তোমার তরোয়ালটা আমাকে দাও। ওপরের জামাটাও খুলে দাও।

–কেন? ফ্রান্সিস একটু অবাক হলো।

–এই পোশাক আর তরোয়াল নিয়ে শহরে ঢুকলে বিপদে পড়বে। এসব মরুদস্যুদের পোশাক। সুলতানের সৈন্যরা তোমাকে দেখলেই গ্রেফতার করবে। আর ভাই কিছু মনে করো না–তোমার ঘোড়াটা আমি নেব। কোথাও আশ্রয় তো নিতে হবে আমাকে।

–বেশ তো।

–আর একটা কথা।

–বলো।

–শহরের সবচেয়ে বড় মসজিদ, মদিনা মসজিদ। যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে। মদিনা মসজিদের বাঁ পাশের গলিতে কয়েকটা বাড়ি ছাড়িয়ে মীর্জা হেকিমের বাড়ি। দেখা করে বলো ফজল পাঠিয়েছে। বিনা খরচে তোমার জখমের চিকিৎসা হয়ে যাবে।

–সে হবে’খন কিন্তু তোমার জন্যে–

-–আমার জন্যে ভেবোনা। হ্যাঁ, ভালো কথা, ফজল কোমর বন্ধনীর মধ্যে থেকে একটা ছোট সবুজ রঙের রুমাল বের করল। রুমালের গিঁট খুলে দুটো মোহর বের করল। বলল–জানো ভাই, এই মোহর দু’টোর পেছনে ইতিহাস আছে। আমাদের কোন এক পূর্বপুরুষ ও বিরাট এক মরুদস্যু দলের সর্দার ছিল। একটা ক্যারাভ্যান লুঠ করতে গিয়ে সে এই মোহর দুটো পেয়েছিল। কিন্তু মজার কথা কি জানো। শুনেছি যে লোকটার কাছে মোহর দুটো ছিল, সে কিন্তু বণিক বা ব্যবসায়ী ছিল না।

–তবে?

–তার পরনে নাকি ছিল পাদরীর পোশাক।

–পাদ্রী? ফ্রান্সিস চমকে উঠল।

–হ্যাঁ–তোমাদের ওদিককার লোকই ছিল সে। দাড়ি গোঁফ–কালো জোব্বা পরনে। গলায় চেন বাঁধা ক্রশ।

–হ্যাঁ ঠিকই বলেছো–পাদ্রীই ছিল সে।

–কাণ্ড দেখ–ধর্ম-কর্ম করে বেড়ায়, তার কাছে সোনার মোহর।

–তারপর?

–তারপর থেকে মোহর দুটো বারবার পুরুষানুক্রমে আমাদের কাছেই ছিল। সবশেষে আমার হাতে এসে পড়ে। যাকগে–মোহর দুটো তুমিই নাও।

–না–না।

–ফ্রান্সিস–তুমি তো ঐ দেশেরই মানুষ। ডাকাতি করে পাওয়া জিনিস তুমি নিলে আমাদের পূর্বপুরুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে।

মোহর দুটো হাতে নিয়ে ফ্রান্সিস উলটে-পালটে দেখল। একদিকে একটা আবছা মাথার ছাপ। অন্যদিকে আঁকাবাঁকা রেখাময় নকশারমত কি যেন খোদাই করা। ফ্রান্সিস কোমরবন্ধনী একটু সরিয়ে মোহর দুটো রেখে দিল।

ঘোড়া থেকে নামল দুজন। ফ্রান্সিস ওর তরোয়াল আর ওপরের জামা খুলে দিল। হঠাৎ আবেগ কম্পিত হাতে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল ফজল। বিড়বিড় করে কি যেন বলতে লাগল। বোধহয় ফ্রান্সিসের কল্যাণ কামনা করলো। বিদায় জানিয়ে ফজল উঠল ঘোড়ার পিঠে। তারপর মরুভূমির দিকে ঘোড়া ছোটাল। ফজলের কথা ভেবে ফ্রান্সিসের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। সে ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে তোরণ পেরিয়ে আমদাদ শহরে ঢুকল। তারপর শহরের মানুষের ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল।

আমদাদ শহরটা নেহাৎ ছোট নয়। ফ্রান্সিস বেশিক্ষণ ঘুরতে পারল না! কাঁধটা ভীষণ টনটন করছে। ব্যথাটা কমানো দরকার। ফ্রান্সিস খুঁজে খুঁজে মীর্জা হেকিমের বাড়িটা বের করল। দেউড়িতে পাহারাদার ওর পথ রোধ করে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস অনুরোধ করল–ভাই আমি অসুস্থ, চিকিৎসার জন্যে এসেছি।

–সবাই এখানে চিকিৎসার জন্যেই আসে। গম্ভীর গলায় পাহারাদার বলল–আগে। হেকিম সাহেবের পাওনা জমা দাও–তারপর।

–আমি গরীব মানুষ—

–তাহলে ভাগো–পাহারাদার চেঁচিয়ে উঠল।

ফ্রান্সিস পাহারাদারের কানের কাছে মুখ নিয়ে গেল! লোকটা আঁতকে উঠল। কান কামড়ে দেবে নাকি? ফ্রান্সিস ফিসফিস করে বলল–হেকিম সাহেবকে বললো গেল–একজন রোগী এসেছে ফজল আলি পাঠিয়েছে।

–ফজল আলি কে?

–সে তুমি চিনবে না। তুমি গিয়ে শুধু এই কথাটা বলো।

–বেশ। পাহারাদার চলে গেল। একটু পরেই হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এল। তাড়াতাড়ি বলল–কিমুশকিল আগে বলবে তো ভাই। আমার চাকরি চলে যাবে। শীগগির যাও–হেকিম সাহেব তোমাকে ডাকছে।

ফ্রান্সিস মৃদু হেসে ভেতরে ঢুকল। কার্পেট পাতা মেঝে। ঘরের মাঝখানে ফরাস পাতা। তার ওপর হেকিম সাহেব বসে আছেন। বেশ বয়েস হয়েছে। চুল, ভুরু তুলোর মত সাদা। কানে কম শোনেন। কয়েকজন রোগী ঘরে ছিল। তাদের বিদায় দিয়ে ফ্রান্সিসকে ডাকলেন। ফ্রান্সিস সব কথাই বলল। মাথাটা এগিয়ে সব কথা শুনে জামাটা খুলে ফেলতে বললেন। ক্ষতস্থানটা দেখলেন। তারপর একটা কাঁচের বোয়াম থেকে ওষুধ বের করে লাগিয়ে দিলেন। একটা পট্টিও বেঁধে দিলেন। বললেন দিন সাতেকের মধ্যেই সেরে যাবে। ফ্রান্সিস কোমরে গোঁজা থলি থেকে একটা মোহর বের করল। তাই দেখে হেকিম সাহেব হাঁ-হাঁ করে উঠলেন –না না কিছু দিতে হবে না।

হেকিম সাহেবের বাড়ি থেকে ফ্রান্সিস এবার আমদাদ শহর ঘুরে-ঘুরে দেখতে লাগল। দেখার জিনিস তো কতই আছে। সব কি আর একদিনে দেখা যায়?সুলতানের শ্বেতপাথরের তৈরী প্রাসাদ। প্রাসাদের পিছনে সমুদ্রের ধারে খাড়া পাহাড়ের গায়ে দুর্গ, মন্ত্রীর বাড়ি, বিরাট ফুল বাগিচা, বাজার-হাট এসব দেখা হল। বেড়াতে বেড়াতে খিদে পেয়ে গেল খুব। কিন্তু খাবে কি করে? খাবারের দোকানে তো আর মোহর নেবে না। সুলতানী মুদ্রাও তো সঙ্গে কিছু নেই। ফ্রান্সিস একটা সোনা-রূপো দোকান খুঁজতে লাগল। পেয়েও গেল।

শুটকে চেহারার দোকানী খুব মনোযোগ দিয়ে পাথরে মোহরটা বার কয়েক ঘষল। তারপর জিজ্ঞেস করলে–এ সব মোহর তো এখানে পাওয়া যায় না–আসল জিনিষ। আপনি পেলেন কোথায়?

–ব্যবসার ধান্ধায় কত জায়গায় যেতে হয়।

–তা তো বটেই। যাকগে–আমি আপনাকে পাঁচশো মুদ্রা দিতে পারি।

–বেশ তাই দিন।

শুটকে চেহারার দোকানীটা মনে মনে ভীষণ খুশী হল। খুব দাঁও মারা গেছে। অর্ধেকের কম দামে মোহরটা পাওয়া গেল। ফ্রান্সিস কিন্তু ক্ষতির কথা ভাবছিল না। খিদেয় পেট জ্বলছে। কিছু না খেলেই নয়। সুলতানী মুদ্রা তো পাওয়া গেল। এবার খাবারের দোকান খুঁজে দেখতে হয়। খুব বেশী দূর যেতে হল না। বাজারটার মোড়েই জমজমাট খাবারের দোকান। শিক কাবাবের গন্ধ নাকে যেতেই ফ্রান্সিসের খিদে দ্বিগুণ বেড়ে গেল। খাবার দেবার সঙ্গে সঙ্গেই গোগ্রাসে গিলতে লাগল। যেভাবে ও খেতে লাগল তা দেখে যে কেউ বুঝে নিতো, ওর রাক্ষসের মত খিদে পেয়েছে। ব্যাপারটা একজনের নজরেও পড়ল। সেই লোকটা অন্য জায়গায় বসে খাচ্ছিল।

এবার ফ্রান্সিসের সামনে এসে লোকটি বসল। ফ্রান্সিস তখন হাপুস হুপুস খেয়েই চললে। লক্ষ্যই করেনি, কেউ ওর সামনে এসে বসেছে। কাজেই লোকটা যখন প্রশ্ন করলে–কি আপনিও বোধহয় আমার মতই বিদেশী।

ফ্রান্সিস বেশ চমকেই উঠেছিল। খেতে-খেতে মাথা নাড়ল।

–আমার নাম মকবুল হোসেন কার্পেটের ব্যবসা করি।

-–ও! ফ্রান্সিস সে কথার কোন উত্তর দিল না। খেয়ে চলল। মকবুলও চুপ করে গেল। কিন্তু হাল ছাড়ল না। অপেক্ষা করতে লাগল কতক্ষণে ফ্রান্সিসের খাওয়া শেষ হয়। মকবুলের চেহারাটা বেশ নাদুসনুদুস। মুখে যেন হাসি লেগেই আছে। ওর ধৈর্য দেখেই ফ্রান্সিস বুঝল–একে এড়ানো মুসকিল। লোকের সঙ্গে ভাব জমাবার কায়দাকানুন ওর নখদর্পণে।

খাওয়া শেষ করে ফ্রান্সিস ঢেকুর তুলল। মকবুল এবার নড়েচড়ে বসল। হেসে বলল–আপনার খাওয়ার পরিমাণ দেখে অনেকেই মুখ টিপে হাসছিল।

–হাসুক গে। তাই বলে আমি পেট পুরে খাবো না?

–আমিও তাই বলি–মকবুল একইভাবে হেসে বলল–আপনার মত অত সুন্দর স্বাস্থ্য অটুট রাখতে গেলে এটুকু না খেলে চলবে কেন। আলবৎ খাবেন কাউকে পরোয়া করবেন কেন?

ফ্রান্সিসের খাওয়া শেষ হল। এতক্ষণ মকবুল আর কোন কথা বলেনি। এবার চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিয়ে চাপাস্বরে বলল–জানেন ঠিক আপনার মত আমিও একদিন গোগ্রাসে খাবার গিলেছিলাম। কোথায় জানেন, ওঙ্গালিতে।

–ওঙ্গালি? ফ্রান্সিস কোনদিন জায়গাটার নামও শোনেনি।

–হ্যাঁ–মকবুল হাসল–ওঙ্গালির বাজার। কারণ কি জানেন? তার আগে চারদিন শুধু বুনো ফল খেয়ে ছিলাম।

–কেন?

–বেঁচে থাকতে হবে তো। হীরে তো আর খাওয়া যায় না।

–হীরে? ফ্রান্সিস অবাক হয়ে বেশ গলা চড়িয়েই বলল কথাটা।

–শ-শ। মকবুল ঠোঁটের ওপর আঙুল রাখল। তারপর আর একবার চারদিক তাকিয়ে নিয়ে চাপাস্বরে বলতে লাগল এখানকার মদিনা মসজিদের গম্বুজটা দেখেছেন তো?

-হ্যাঁ!

–তার চেয়েও বড়।

–বলেন কি?

–কিন্তু সব বেফরদা।

–কেন?

–আমরা তো আর জানতাম না, যে হীরেটা নাড়া খেলেই পাহাড়টায় ধ্বস নামবে?

–আপনার সঙ্গে আর কেউ ছিল?

–হ্যাঁ, ওঙ্গালির এক কামারকে নিয়েছিলাম হীরের যতটা পারি কেটে আনবো বলে।

–সেটা বোধহয় আর হল না।

–হবে কি করে, তার আগেই ধস নামা শুরু হয়ে গেল।

–ব্যাপারটা একটু খুলে বলবেন? এতক্ষণে ফ্রান্সিস উৎসুক হল। মদিনা মসজিদের গম্বুজের চেয়েও বড় হীরে। শুধু হীরে না বলে হীরের ছোটখাটো পাহাড় বলতে হয় এও কি সম্ভব?

–তাহলে একটু মুরগীর মাংস হয়ে যাক।

–বেশ! ফ্রান্সিস দোকানদারকে ডেকে আরো মুরগীর মাংস দিয়ে যেতে বললো। মাংস খেতে-খেতে মকবুল শুরু করল কার্পেট বিক্রীর ধান্ধায় গিয়েছিলাম ওঙ্গালিতে জায়গাটা তের বন্দরের কাছে। আমার ঘোড়ায় টানা গাড়ির চাকাটা রাস্তায় পাথরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে গেল ভেঙে! কাজেই এক কামারের কাছে সারাতে দিলাম। এই কামারই আমাকে প্রথম সেই অদ্ভুত গল্পটা শোনাল। ওঙ্গালি থেকে মাইল পনের উত্তরে একটা পাহাড়। গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। পাহাড়টার মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে একটা গুহা। দূর থেকে গাছগাছালি ঝোঁপ-জঙ্গলের মধ্য দিয়ে গুহাটা প্রায় দেখাই যায় না। সূর্যটা আকাশে উঠতে উঠতে যখন ঠিক গুহাটার সমান্তরালে আসে সূর্যের আলো সরাসরি গিয়ে গুহাটায় পড়ে। তখনই দেখা যায় গুহার মুখে আর তার চারপাশের গাছের পাতায়, ডালে, ঝোপে এক অদ্ভুত আলোর খেলা। আয়না থেকে যেমন সূর্যের আলো ঠিকরে আসে–তেমনি রামধনুর রঙের মত বিচিত্র সব রঙীন আলো ঠিকরে আসে গুহাটা থেকে। অনেকেই দেখেছে এই আলোর খেলা। ধরে নিয়েছে ভূতুড়ে কাণ্ডকারখানা! ভূতপ্রেতকে ওরা যমের চেয়েও বেশী ভয় করে। কাজেই কেউ এই রঙের খেলার কারণ জানতে ওদিকে পা বাড়াতে সাহস করে নি।

–আচ্ছা, এই আলোর খেলা কি সারাদিন দেখা যেত।

–উঁহু। সূর্যের আলোটা যতক্ষণ সরাসরি সেই গুহাটায় গিয়ে পড়তো, ততক্ষণই শুধু তারপর আবার যেই কে সেই।

–সেই কামারটা এর কারণ জানতে পেরেছিল।

–না, তবে অনুমান করেছিল। ও বলেছিল–ঐ আলো হীরে থেকে ঠিকরানো আলো না হয়েই যায় না। ও নাকি প্রথম জীবনে কিছুদিন এক জহুরীর দোকানে কাজ করেছিল। হীরের গায়ে আলো পড়লেই সেই আলো কিভাবে ঠিকরোয়, এই ব্যাপারটা ওর জানা ছিল। আমি তো শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম।

–কেন?

–ভেবে দেখুন–অত আলো–মানে আমি তো সেই আলো আর রঙের খেলা পরে দেখেছিলাম মানে–ভেবে দেখুন হীরেটা কত বড় হলে অত আলো ঠিকরোয়।

তা-তো বটেই। ফ্রান্সিস মাথা নাড়ল। বলল–তারপর?

–তারপর বুঝলেন, একদিন তল্পিতল্পা নিয়ে আমরা তো রওনা হলাম। যে করেই হোক গুহার মধ্যে ঢুকতে হবে। কিন্তু সেই পাহাড়টার কাছে পৌঁছে আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। নীচ থেকে গুহা পর্যন্ত পাহাড়টা খাড়া হয়ে উঠে গেছে। কিন্তু ঝোঁপঝাড়, দু-একটা জংলী গাছ আর লম্বা-লম্বা বুনো ঘাস–এছাড়া সেই খাড়া পাহাড়ের গায়ে আর কিস্যু নেই। নিরেট পাথুড়ে খাড়া গা। কামার ব্যাটা বেশ ভেবে চিন্তেই এসেছে বুঝলাম। ও বললো–চলুন আমরা পাহাড়ের ওপর থেকে নামবো ভেবে দেখলাম সেটা সম্ভব। কারণ পাহাড়টার মাথা থেকে শুরু করে গুহার মুখ অবধি, আর তার আশে-পাশে ঘন জঙ্গল। দড়ি ধরে নামা যাবে।

সন্ধ্যের আগেই পাহাড়ের মাথায় উঠে বসে রইলাম। ভোর বেলা নামার উদ্যোগ আয়োজন শুরু করলাম। পাহাড়টার মাথায় একটা মস্ত বড় পাথরে দড়ির একটা মুখ বাঁধলাম। তারপর দড়ির অন্য মুখটা পাহাড়ের গা বেয়ে ঝুলিয়ে দিলাম। দড়ি গুহার মুখ পর্যন্ত পৌঁছল কিনা বুঝলাম না। কপাল ঠুকে দড়ি ধরে ঝুলে পড়লাম। দড়ির শেষ মুখে পৌঁছে দেখি, গুহা তখনও অনেকটা নীচে। সেখান থেকে বাকি পথটা গাছের ডাল গুঁড়ি লতাগাছ এসব ধরে, শ্যাওলা ধরে পাথরের ওপর দিয়ে সন্তর্পণে পা রেখে-রেখে একসময় গুহার মুখে এসে দাঁড়ালাম। বুঙ্গা মানে কামারটাও কিছুক্ষণের মধ্যে নেমে এল। ও যে বুদ্ধিমান, সেটা বুঝলাম ওর কাণ্ড দেখে। বুঙ্গা দড়ির মুখটাতে আরো দড়ি বেঁধে নিয়ে পুরোটাই দড়ি ধরে এসেছে। পরিশ্রমও কম হয়েছে ওর।

–তারপর?

ফ্রান্সিস তখন এত উত্তেজিত, যে সামনের খাবারের দিকে তাকাচ্ছেও না। মকবুল কিন্তু বেশ মৌজ করে খেতে-খেতে গল্পটা বলে যেতে লাগল।

–দু’জনে গুহাটায় ঢুকলাম। একটা নিস্তেজ মেটে আলো পড়েছে গুহাটার মধ্যে। সেই আলোয় দেখলাম কয়েকটা বড় বড়পাথরের চাই–তারপরেই একটা খাদ। খাদ থেকে উঠে আছে একটা ঢিবি। ঠিক পাথরে ডিবি নয়। অমসৃণ এবড়ো-খেবড়ো গা অনেকটা জমাট আলকাতরার মত। হাত দিয়ে দেখলাম, বেশ শক্ত। সেই সামান্য আলোয় ঢিবিটার যে কি রঙ, ঠিক বুঝলাম না। তবে দেখলাম যে ওটা নীচে অনেকটা পর্যন্ত রয়েছে, যেন পুঁতে রেখে দিয়েছে কেউ।

বুঙ্গা এতক্ষণ গুহার মুখের কাছে এখানে ওখানে ছড়ানো-ছিটানো বড়-বড় পাথরগুলোর ওপর একটা ছুঁচালো মুখ হাতুড়ির ঘা দিয়ে ভাঙা টুকরোগুলো মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করে দেখছিল। তারপর হতাশ হয়ে ফেলে দিচ্ছিলো। আমি বুঙ্গাকে ডাকলাম–বুঙ্গা দেখ তো, এটা কিসের টিবি?

বুঙ্গা কাছে এল। এক নজরে ঐ এবড়ো-খেবড়ো ঢিবিটার দিকে তাকিয়েই বিস্ময়ে ওর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। ওর মুখে কথা নেই।

ঠিক তখনই সূর্যের আলোর রশ্মি সরাসরি গুহার মধ্যে এসে পড়ল। আমরা ভীষণ ভাবে চমকে উঠলাম। সেই এবড়ো-খেবড়ো ঢিবিটায় যেন আগুন লেগে গেল। জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ড যেন! যে কি তীব্র আলোর বিচ্ছুরণ। সমস্ত গুহাটায় তীব্র চোখঝলসানো আলোর বন্যা নামল যেন। ভয়ে বিস্ময়ে আমি চীৎকার করে বললাম–বুঙ্গা শীগগির চোখ ঢাকা দিয়ে বসে পড় নইলে অন্ধ হয়ে যাবে।

দু’জনেই চোখ ঢাকা দিয়ে বসে পড়লাম। কতক্ষণ ধরে সেই তীব্র তীক্ষ্ণ চোখ অন্ধ করা আলোর বন্যা বয়ে চলল জানি না। হঠাৎ সব অন্ধকার হয়ে গেল। ভয়ে-ভয়ে চোখ খুললাম। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, নিশ্চিদ্র অন্ধকার চারদিকে। অসীম নৈঃশব্দ। হঠাৎ সেই নৈঃশব্দ ভেঙে দিল বুঙ্গার ইনিয়ে-বিনিয়ে কান্না। অবাক কাণ্ড! ও কাঁদছে কেন? অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে বুঙ্গার কাছে এলাম। এবারে ওর কথাগুলো স্পষ্ট শুনলাম। ও দেশীয় ভাষায় বলছে

–অত বড় হীরে আমার সব দুঃখ-কষ্ট দূর হয়ে যাবে–আমি কত বড়লোক হয়ে যাব–আমি পাগল হয়ে যাবো।

আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। তাহলে ঐ অমসৃণ পাথুরে ঢিবিটা হীরে? অত বড় হীরে। এ যে অকল্পনীয়। বুঝলাম, প্রচণ্ড আনন্দে চূড়ান্ত উত্তেজনায় বুঙ্গা কাঁঁদতে শুরু করেছে। অনেক কষ্টে ওকে ঠাণ্ডা করলাম। আস্তে-আস্তে অন্ধকারটা চোখে সয়ে এল। বুঙ্গাকে বললাম–এসো, আগে খেয়ে নেওয়া যাক।

কিন্তু কাকে বলা। বুঙ্গা তখন ক্ষুধা-তৃষ্ণা ভুলে গেছে। হঠাৎ ও উঠে দাঁড়িয়ে ছুটল সেই হীরের টিবিটার দিকে। হাতের ছুঁচালো হাতুড়িটা নিয়ে পাগলের মত আঘাত করতে লাগল ওটার গায়ে। টুকরো হীরে চারদিকে ছিটকে পড়তে লাগল। হাতুড়ির ঘা বন্ধ করে বুঙ্গা হীরের টুকরোগুলো কোমরে ফেট্টিতে খুঁজতে লাগল। তারপর আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল হাতুড়িটা নিয়ে। আবার হীরের টুকরো ছিটকোতে লাগল। আমি কয়েকবার বাধা দেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু উত্তেজনায় ও তখন পাগল হয়ে গেছে।

–তারপর? ফ্রান্সিস জিজ্ঞাসা করল।

–এবার বুঙ্গা। করল এক কাণ্ড! গুহার মধ্যে পড়ে থাকা একটা পাথর তুলে নিল। তারপর দু’হাতে পাথরটা ধরে হীরেটার ওপর ঘা মারতে লাগল, যদি একটা বড় টুকরো ভেঙে আসে। কিন্তু হীরে ভাঙা অত সোজা? সে কথা কাকে বোঝাব তখন? ও পাগলের মত পাথরের ঘা মেরেই চলল। ঠকঠক পাথরের ঘায়ের শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে লাগল গুহাটায়। হঠাৎ–

–কি হল?

–সমস্ত পাহাড়টা যেন দুলে উঠল। গুহার ভিতর শুনলাম, একটা গম্ভীর গুড়গুড় শব্দ। শব্দটা কিছুক্ষণ চলল। তারপর হঠাৎ কানে তালা লাগানো শব্দ। শব্দটা এলো পাহাড়ের মাথার দিক থেকে। গুহার মুখের কাছে ছুটে এলাম। দেখি পাহাড়ের মাথা থেকে বিরাট বিরাট পাথরের চাই ভেঙে ভেঙে পড়ছে। বুঝলাম, যে কোন কারণেই হোক পাহাড়ের মধ্যে কোন একটা পাথরের স্তর নাড়া খেয়েছে, তাই এই বিপত্তি। এখন আর ভাববার সময় নেই। গুহা ছেড়ে পালাতে হবে। অবলম্বন একমাত্র সেই দড়িটা। ছুটে গিয়ে দড়িটা ধরলাম। টান দিতেই দেখি–ওটা আগলা হয়ে গেছে। বুঝলাম–যে পাথরের চাইয়ে ওটা বেঁধে এসেছিলাম, সেটা নড়ে গেছে। এখন দড়িটা কোন গাছের ডালে বা ঝোপে আটকে আছে। একটু জোরে টান দিলাম। যে ভেবেছি তাই। দাঁড়ির মুখটা ঝুপ করে নীচের দিকে পড়ে গেল। এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে খোদাতাল্লাকে ধন্যবাদ জানালাম। কিন্তু আর দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছেনা। পায়ের নীচের মাটি দুলতে শুরু করেছে। ভালোভাবে দাঁড়াতে পারছি না। টলেটলে পড়ে যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি দড়ির মুখটা একটা বড় পাথরের সঙ্গে বেঁধে ফেললাম। এখন দড়ি ধরে নামতে হবে। কিন্তু বুঙ্গা? ও কি সত্যিই পাগল হয়ে গেল? এত কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে, বুঙ্গার হুঁশও নেই। ও পাথরটা ঠুকেই চলছে। ছুটে গিয়ে ওর দু’হাত চেপে ধরলাম। বুঙ্গা শীগগির চল–নইলে মরবে। কে কার কথা শোনে। এক ঝটকায় ও আমাকে সরিয়ে দিল। আবার ওকে থামাতে গেলাম। তখন হাতের পাথরটা নামিয়ে ছুঁচালো মুখ হাতুড়িটা বাগিয়ে ধরল। বুঝলাম, ওকে বেশী টানাটানি করলে ও আমাকে মেরে বসবে। ওকে আর বাঁচানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। গুহার মধ্যে তখন পাথরের টুকরো, ধুলো ঝুপঝুপ করে পড়তে শুরু করেছে। আর দেরি করলে আমারও জ্যান্ত কবর হয়ে যাবে। পাগলের মত ছুটলাম গুহার মুখের দিকে।

তারপর গুহার মুখে এসে দড়িটা ধরে কিভাবে নেমে এসেছিলাম, আজও জানি না। পর পর পাঁচদিন ধরে বুনো ফল আর ঝরনার জল খেয়ে হাঁটতে লাগলাম। গভীর জঙ্গলে কতবার পথ হারালাম, বুনো জন্তু জানোয়ারের পাল্লায় পড়লাম। তারপর যেদিন এক সন্ধ্যার মুখে ওঙ্গালির বাজারে এসে হাজির হলাম, সেদিন আমার চেহারা দেখে অনেকেই ভূত দেখবার মত চমকে উঠেছিল।

মকবুলের গল্প শেষ। দু’জনেই চুপ করে বসে রইল। দু’জনের কারোরই খেয়াল নেই যে রাত হয়েছে। এবার দোকান বন্ধ হবে।

–এই দেখুন–মকবুল ডান হাতটা বাড়াল। মাঝের মোটা আঙুলটায় একটা হীরের আংটি।

–সেই হীরের টুকরো নাকি? ফ্রান্সিস বিস্ময়ে প্রশ্ন করল।

মকবুল মাথা ঝাঁকিয়ে হাসল, বলল–বুঙ্গা যখন হাতুড়ি চালাচ্চিল তখন কয়েকটা টুকরো ছিটকে এসে আমার জামারআস্তিনে আটকেগিয়েছিল। তখন জানতে পারিনি, পরে দেখেছিলাম।

দোকানী এসে তাড়া দিল, রাত হয়েছে দোকান বন্ধ করতে হবে।

দু’জনে উঠে পড়ল। দোকানীর দাম মেটাতে গিয়ে ফ্রান্সিস ওর থলিটা বের করল। সুলতানী মুদ্রাগুলোর সঙ্গে মোহরটাও ছিল। মোহরটা দেখে মকবুল যেন হঠাৎ খুব চঞ্চল হয়ে পড়ল। থাকতে না পেরে বলেই ফেলল–মোহরটা একটু দেখব?

–দেখুন না–ফ্রান্সিস মোহরটা ওর হাতে দিল। ফ্রান্সিস দাম মেটাতে ব্যস্ত ছিল। তাই লক্ষ্য করল না মোহরটা দেখতে দেখতে মকবুলের চোখ দুটো যেন জ্বলে উঠল। কিন্তু নিজের মনের ভাব গোপন করে ও মোহরটা ফিরিয়ে দিল।

-সুন্দর মোহরটা, রেখে দেওয়ার মত জিনিস।

–হুঁ, –রাখতে আর পারলাম কই? ফ্রান্সিস সখেদে বলল।

–কেন?

–আর একটা ঠিক এরকম দেখতে মোহরও ছিল।

–কি করলেন সেটা?

–এখানকার বাজারে এক জহুরীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছি।

–ইস, –মকবুল মাথা নাড়ল–ও ব্যাটা নিশ্চয়ই ঠকিয়েছে আপনাকে।

–কি আর করব, নইলে না খেয়ে মরতে হত।

–কোন্ জহুরীর কাছে বিক্রি করেছেন?

–রাস্তায় নেমে মকবুল জিজ্ঞেস করল–কোথায় থাকেন আপনি?

–এখনো কোন আস্তানা ঠিক করিনি।

–বাঃ, –বেশ–মকবুল হাসল–চলুন আমার সঙ্গে।

–কোথায়?

–সুলতানের এতিমখানায়।

–এতিমখানায়!

–নামেই এতিমখানা–গরীব মানুষেরা থাকতে পায় না। আসলে বিদেশীদের আড্ডাখানা ওটা।

–চলুন–মাথা তো গোঁজা যাবে।

রাস্তায় আসতে-আসতে ফ্রান্সিস মকবুলকে জহুরীর দোকানটা দেখাল। মকবুল গভীরভাবে কি যেন ভাবছিল। দোকানটা দেখে মাথা নেড়ে শুধু বলল–ও।

ফ্রান্সিস আন্দাজও করতে পারেনি মকবুল মনে মনে কি ফন্দি আঁটছে।

মকবুলের কথা মিথ্যে নয়। সত্যিই এতিমখানা বিদেশী ব্যবসায়ীদের আড্ডাখানা। কত দেশের লোক যে আশ্রয় নিয়েছে এখানে। আফ্রিকার কালো কালো কোঁকড়া চুল মানুষ, যেমন আছে, তেমনি নাক চ্যাপ্টা কুতকুতে চোখ মোঙ্গল দেশের লোকও আছে।

মকবুল একটা ঘরে ঢুকল। দু’জন লোক কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। আর একটা বিছানা খালি, ওটাই বোধহয় মকবুলের বিছানা। ঘরের খালি কোণটা দেখিয়ে মকবুল বলল–ওখানেই আপনার জায়গা হয়ে যাবে, সঙ্গে তো আপনার বিছানা পত্তর কিছুই নেই?

–না।

–আমার বিছানা থেকেই কিছু কাপড়-চোপড় দিচ্ছি, পেতে নিন। ফ্রান্সিস বিছানামত একটা করে নিল। সটান শুয়ে ক্লান্তিতে চোখ বুজল। ঘুম আসার আগে পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছিল ঘরের দু’জন লোকের সঙ্গে মকবুল মৃদুস্বরে কি যেন কথাবার্তা বলছে। সে সব কথার অর্থ সে কিছুই বুঝতে পারে নি।

ঘুম ভাঙতে ফ্রান্সিস দেখল বেশ বেলা হয়েছে। লোকজনের কথাবার্তায় এতিমখানা সরগরম। ফ্রান্সিস পাশ ফিরে মকবুলের বিছানার দিকে তাকাল। আশ্চর্য! কোথায় মকবুল? মকবুলের বিছানাও নেই। পাশের বিছানায় লোকটি তখন দু’হাত ওপরে তুলে মুখ হাঁ করে মস্ত বড় হাই তুলছিল। ফ্রান্সিস তাকেই জিজ্ঞাসা করল–আচ্ছা, মকবুল কোথায়?

লোকটা মৃদু হেসে হাতের চেটো ওল্টাল, অর্থাৎ সে কিছুই জানেনা। মরুক গে এখন হাত মুখ ধুয়ে কিছু খাওয়ার চেষ্টা দেখতে হয়, ভীষণ খিদে পেয়েছে। হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে এসেফ্রান্সিস দেখল, ঘরের আর একজন তখন ফিরছে। কিন্তু মকবুল একেবারেই বেপাত্তা। ফ্রান্সিস খেতে যাবে বলে থলেটা কোমর থেকে বের করল, কিন্তু এ কি? থলে যে একেবারে খালি। সুলতানী মুদ্রাগুলো তো নেই-ই, সেই সঙ্গে মোহরটাও নেই। সর্বনাশ! এই বিদেশ বিই। কে চেনে ওকে? মাথা গোঁজার ঠাঁই না হয় এই এতিমখানায় জুটল। কিন্তু খাবে কি? খেতে তো দেবে না কেউ। তার ওপর কাঁধের ঘাটা এখনও শুকোয় নি। শরীরের দুর্বলতাও সবটুকু কাটিয়ে উঠতে পারে নি। এই অবস্থায় ও একেবারে সর্বশান্ত হয়ে গেল। ফ্রান্সিস চোখে অন্ধকার দেখল।

ওর চোখমুখের ভাব দেখে ঘরের আর দু’জনেও বেশ অবাক হল–কি ভিনদেশী লোকটার? ওদের মধ্যে একজন উঠে এল। লোকটার চোখের ভুরু দুটো ভীষণ মোটা। মুখটা থ্যাবড়া। ভারী গলায় জিজ্ঞেস করল–কি হয়েছে?

ফ্রান্সিস প্রথমে কথাই বলতে পারল না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। লোকটা আবার জিজ্ঞেস করল–হল কি? ও-রকম ভাবে তাকিয়ে আছেন?

–আমার সব চুরি গেছে।

–ও, তাই বলুন। লোকটা নির্বিকার ভঙ্গিতে আবার বিছানায় গিয়ে বসল। বলল—

–এটা এতিমখানা–চোর, জোচ্চোরের বেহেস্ত মানে স্বর্গ আর কি? তা কত গেছে? ফ্রান্সিস আন্দাজে হিসেব করে বলল। মোহরটার কথাও বলল।

–ও বাবা। মোহর-ফোহর নিয়ে এতিমখানায় এসেছিলেন? কত সরাইখানা রয়েছে, সেখানেই গেলে পারতেন।

–মকবুলই তো যত নষ্টের গোড়া।

–কে মকবুল?

–কাল রাত্তিরে যার সঙ্গে আমি এসেছিলাম।

–কত লোক আসছে-যাচ্ছে।

–কেন, আপনারা তো কথাবার্তা বলছিলেন মকবুলের সঙ্গে বেশ বন্ধুর মত।

–হতে পারে। হাত উল্টে লোকটা বলল।

ফ্রান্সিস লোকটার ওপর চটে গেল। একে ওর এই বিপদ কোথায় লোক্টা সহানুভূতি দেখাবে তা নয়, উলটে এমনভাবে কথা বলছে যেন সব দোষ ফ্রান্সিসের।

ফ্রান্সিস বেশ ঝাঁঝের সঙ্গেই বলল–আপনারা মকবুলকে বেশ ভাল করেই চেনেন, এখন বেগতিক বুঝে চেপে যাচ্ছেন।

অন্য বিছানায় আধশোয়া লোকটা এবার যেন লাফিয়ে উঠল। বলল–তাহলে আপনি কি বলতে চান, আমরা গাঁট কাটা?

–আমি সেকথা বলিনি।

–আলবৎ বলেছেন। ভুরু মোটা লোকটা বিছানা ছেড়ে ফ্রান্সিসের দিকে তেড়ে এল। ফ্রান্সিস বাধা দেবার আগইে ওর গলার কাছে জামাটা মুঠো করে চেপে ধরল। কাঁধে জখমের কথা ভেবে ফ্রান্সিস কোন কথা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

–আর বলবি? লোকটা ফ্রান্সিসকে ঝাঁকুনি দিল।

–কি?

–আমরা গাঁটাকাটা।

–আমি সেকথা বলিনি।

–তবে রে! লোকটা ডান হাতের উল্ট পিঠ ঘুরিয়ে ফ্রান্সিসের গালে মারল এক থাপ্পড়। অন্য লোকটি খ্যাখ্যা করে হেসে উঠল। ফ্রান্সিস আর নিজেকে সংযত করতে পারল না। ওর নিজের গেল টাকা চুরি, আর উল্টে ওকেই চোরের মত মার খেতে হচ্ছে। ফ্রান্সিস এক ঝটকায় নিজেকে মুক্ত করে নিল। তারপর লোকটা কিছু বোঝবার আগেই হাঁটু দিয়ে ওর পেটে মারল এক গুঁতো। লোকটা দুহাতে পেট চেপে বসে পড়ল। অন্য লোকটা এরকম কিছু একটা হতে পারে, বোধহয় ভাবতেই পারেনি। এবার সে তৎপর হল। ছুটে ফ্রান্সিসকে ধরতে এল। ফ্রান্সিস ওর চোয়াল লক্ষ্য করে সোজা ঘুষি চালাল। লোকটা চিৎ হয়ে মেঝের ওপর পড়ে গেল। ফ্রান্সিস বুঝল–এর পরের ধাক্কা সামলানো মুশকিল হবে। কাজেই আর দেরি না করে এক ছুটে ঘরের বাইরে চলে এল। ভুরু মোটা লোকটাও পেছনে ধাওয়া করল। ফ্রান্সিস ততক্ষণে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে হুড়কো তুলে দিয়েছে। বন্ধ দরজার ওপর দুমদাম লাথি পড়তে লাগল। ফ্রান্সিস আর দাঁড়াল না। দ্রুত পায়ে এতিমখানা থেকে বেরিয়ে এল।

এতবড় আমদাদ শহর। এত লোকজন, বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, কোথায় খুঁজবে মকবুলকে কিন্তু ফ্রান্সিস দমল না। যে করেই হোক মকবুলকে খুঁজে বের করতে হবে। সব আদায় করতে হবে। তারপর বন্দরে গিয়ে খোঁজ করতে হবে ইউরোপের দিকে কোন জাহাজ যাচ্ছে কি না। জাহাজ পেলেই উঠে পড়বে। কিন্তু মকবুলকে না খুঁজে বের করতে পারলে কিছুই হবে না। এই বিদেশ বিভুঁইয়ে না খেয়ে মরতে হবে।

সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়াল ফ্রান্সিস। বাজার, বন্দর, অলি-গলি কিছুই বাদ দিল না। কিন্তু কোথায় মকবুল? একজন লোককে তো মকবুল ভেবেও উত্তেজনার মাথায় কাঁধে হাত রেখেছিল। লোকটা বিরক্ত মুখে ঘুরে দাঁড়াতে ফ্রান্সিসের ভুল ভাঙল। মাফ-টাফ চেয়ে সে ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে পড়েছিল। উপোসী পেটে সারাদিন ওই ঘোরাঘুরি। দুপুরে অবশ্য, একফালি তরমুজ চালাকি করে খেয়েছিল।

বাজারের মোড়ে একটা লোক তরমুজের ফালি বিক্রি করছিল। খিদেয় পেট জ্বলছে। সেই সঙ্গে জলতেষ্টা। একফালি তরমুজ খেলে খিদেটাও চাপা পড়বে সেই সঙ্গে তেষ্টাটাও দূর হবে। কিন্তু দাম দেবে কোত্থেকে? অগত্যা চুরি। ফ্রান্সিস বুদ্ধি ঠাওরাল। রাস্তার ধারে এক দল ছেলে খেলা করছিল। ফ্রান্সিস ছেলেগুলোকে ডাকল। ছেলেগুলো কাছে আসতে বলল

–ঐ যে তরমুজওলাটাকে দেখছিস, ও কানে শুনতে পায় না। তোরা গিয়ে ওর সামনে বলতে থাক–এক ফালি তরমুজ দাও তাহলেই কানে শুনতে পাবে। লোকটা খুশী হয়ে ঠিক তোদের একফালি করে তরমুজ দেবে।

ব্যাস! ছেলের দল হল্লা করতে করতে ছুটে গিয়ে তরমুজওলাকে ঘিরে ধরল। তারপর তারস্বরে চাঁচাতে লাগল–

এক ফালি তরমুজ দাও তাহলে তুমি কানে শুনতে পাবে। তরমুজওলা পড়ল মহা বিপদে। আসলে ওর কানের কোন দোষ নেই। ও ভালই শুনতে পায়। ও হাত নেড়ে বারবার সেকথা বোঝাতে লাগল। কিন্তু ছেলেগুলো সেকথা শুনবে কেন?

তাদের চীৎকারে কানে তালা লেগে যাওয়ার অবস্থা। একদিকের ছেলেগুলোকে তাড়ায় তো অন্যদিকের ছেলেগুলো মাছির মত ভিড় করে আসে। আর সেই নামতা পড়ার মত চীৎকার। অতিষ্ট হয়ে তরমুজওলা ঝোলা কাঁধে নিয়ে অন্যদিকে চলল। ছেলের দলও চাঁচাতে চাঁচাতে পিছু নিল। এবার ফ্রান্সিস এগিয়ে এল। তরমুজওলাকে ডেকে দাঁড় করাল, বলল–তোমার ঝোলায় সব চাইতে বড় যে তরমুজটা আছে, বের কর। তরমুজওলা বেশ বড় একটা তরমুজ বের করল।

–এবার কেটে সবাইকে ভাগ করে দাও। ছেলেরা তো তরমুজ খেতে পেয়ে বেজায় খুশী। ফ্রান্সিসও একটা বড় টুকরো পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে কামড় দিল, আঃ কি মিষ্টি! হাপুস হুপুস করে খেয়ে ফেলল তরমুজের টুকরোটা। তরমুজওলা এবার দাম চাইলে ফ্রান্সিস অবাক হবার ভঙ্গি করে বলল–বাঃ, এই যে তুমি বললে কানে শুনতে পেলে সবাইকে তরমুজ খাওয়াবে।

–ও কথা আমি কখন বললাম? তরমুজওলা অবাক।

–এই তো তুমি কানে শুনতে পাচ্ছো।

ছেলেগুলো আবার চেঁচাতে শুরু করল–কানে শুনতে পাচ্ছে।

তরমুজওলা ছেলেদের ভিড় ঠেলে আসার আগেই ফ্রান্সিস ভিড়ের মধ্যে গা ঢাকা দিল।

একফালি তরমুজে কি আর খিদে মেটে? তবু সন্ধ্যে পর্যন্ত কাটাল। যদি ওর দূরবস্থার কথা শুনে কারো দয়া হয়, এই আশায় ফ্রান্সিস কয়েকটা খাবারের দোকানে গেল। সব চুরি হয়ে যাওয়ার কথা বলল। অনেক করে বোঝাবার চেষ্টা করল, কিন্তু কেউই ওকে বিশ্বাস করল না।

সন্ধ্যার সময় শাহীবাগের কোণার দিকে একটা পীরের দরগার কাছে এসে ফ্রান্সিস দাঁড়াল। একটু জিরানো যাক। দরগার সিঁড়িতে বসল ফ্রান্সিস। ভেতরে নজর পড়তে দেখল অনেক গরিব-দুঃখী সার দিয়ে বসে আছে। সবাইকে একটা করে বড় পোড়া রুটি আর আলুসেদ্ধ দেওয়া হচ্ছে। তাই দেখে ফ্রান্সিসের খিদের জ্বালা বেড়ে গেল। সেও সারির মধ্যে বসে পড়ল। যে লোকটা রুটি দিচ্ছিল, সে কিন্তু ফ্রান্সিসকে দেখে একটু অবাকই হল। খাবার দিল ঠিকই, কিন্তু মন্তব্য করতেও ছাড়ল না–অমন ঘোড়ার মত শরীর–সুলতানের সৈন্যদলে নাম লেখাও গে যাও। ফ্রান্সিস কোন কথা বলল না। মুখ নীচু করে পোড়া রুটি চিবুতে লাগল। হঠাৎ দেশের কথা, মা’র কথা মনে পড়ল। কোথায় এই অন্ধকার খোলা উঠোনে ভিখিরিদের সঙ্গে বসে পোড়া রুটি আলুসেদ্ধ খাওয়া আর কোথায় ওদের সেই ঝাড়লণ্ঠনের আলোয় আলোকিত খাওয়ার ঘর, ফুলের কাজকরা সাদা টেবিল ঢাকনা, ঝকঝকে পরিষ্কার কঁটা-চামচ, বাসনপত্র। খাওয়ার জিনিসও কত। কত বিচিত্র স্বাদ সে সবের। সেই সঙ্গে মা’র সস্নেহ হাসিমুখ–ফ্রান্সিস চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়াল। না–না–এসব ভাবনা মনকে দুর্বল করে দেয়। এসব চিন্তাকে প্রশ্রয় দিতে নেই। বাড়ির নিশ্চিন্ত বিলাসী জীবনের নাম জীবন নয়। জীবন রয়েছে বাইরে অন্ধকার ঝড়-বিক্ষুব্ধ সমুদ্রে, আগুন ঝরা মরুভূমিতে তরবারির ঝলকানিতে, দেশবিদেশের মানুষের স্নেহ-ভালবাসার মধ্যে।

তখনও রাত বেশী হয় নি। ফ্রান্সিস এতিমখানায় এসে ঢুকল। খুঁজে খুঁজে নিজের ঘরটার দিকে এগোল। সেই লোক দুটো কি আর আছে? ব্যবসায়ী লোক হয় তো এক রাত্রির জন্য আশ্রয় নিয়েছিল। সকালে নিশ্চয়ই দরজায় ধাক্কাধাক্কি লাথি মারার শব্দে আশেপাশের ঘরের লোক এসে দরজা খুলে দিয়েছে। তারপর দুপুর নাগাদ পাততাড়ি গুটিয়ে চলে গেছে।

দরজাটা বন্ধ। ফ্রান্সিস নিশ্চিন্ত মনেই দরজাটা ঠেলল। দরজা খুলে গেল। এই সেরেছে। সেই মূর্তিমান দু’জনেরই একজন যে। মোটা ভুরু নাচিয়ে লোকটা ডাকল এসো ভেতরে। ফ্রান্সিস নড়ল না। লোকটা এবার হেসে ফ্রান্সিসের কাঁধে হাত রাখতে গেল। ফ্রান্সিস এক। ঝটকায় হাতটা সরিয়ে দিল। ঘরে চোখ পড়তে দেখল অন্য লোকটাও রয়েছে।

–তোমার এখনও রাগ পড়েনি দেখছি। লোকটা হাসল।

ফ্রান্সিস ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে রইল। লোকটি বললো–বিশ্বাস করো ভাই সকালে তোমার সঙ্গে আমরা যে ব্যবহার করেছি, তার জন্যে আমরা দুঃখিত।

ফ্রান্সিস তবু নড়ল না।

–ঠিক আছে, তুমি ভেতরে এসো। যদি মাফ চাইতে বলো–আমরা তাও চাইবো।

ফ্রান্সিস আস্তে-আস্তে ঘরে ঢুকল। লোকটা দরজা বন্ধ করতে উদ্যোগী হতেই ফ্রান্সিস ঘুরেদাঁড়াল। বললো দরজা বন্ধ করতে পারবে না।

–বেশ। লোকটা হেসে দরজা খোলা রেখেই ওর কাছে এগিয়ে এল। বলল–এবার বিছানায় বসো।

ফ্রান্সিস নিজের বিছানায় গিয়ে বসল। অন্য লোকটি তখন একটা পাত্র হাতে এসি, এল। পাত্রটা ফ্রান্সিসের সামনে রেখে বলল–খাও। সারাদিন তো তরমুজের একটা ফালি ছাড়া কিছুই জোটেনি।

ফ্রান্সিস বেশ অবাক হল। এসব এই লোকটা জানলো কি করে? মোটা ভুরুওলা লোকটা এবার বলল–তুমি ঠিকই ধরেছো। মকবুল আমাদের খুবই পরিচিত। ওকে আমরা ভালো করেই জানি। গাঁট কাটার মত নোংরা কাজ ওর পক্ষে করা সম্ভব নয়। কাজেই আমাদের উল্টে তোমাকেই সন্দেহ হয়েছিল।

–আমাকে?

–হ্যাঁ। তাই দুপুরবেলা আমরা দুজন তোমাকে খুঁজতে বেরিয়ে ছিলাম। পেলামও তোমাকে। বাজারের মোড়ে তুমি তখন তরমুজ খাচ্ছিলে।

ফ্রান্সিস হাসল। লোকটা বললো খুব বেঁচে গেছো। তুমিও গা ঢাকা দিলে আর ঠিক তক্ষুণি সুলতানের পাহারাদার এল। অবশ্য কোন বিপদ হলে আমরাও তৈরী ছিলাম তোমাকে বাঁচাবো বলে–

–তাহলে তো তোমরা সবই দেখেছো। ফ্রান্সিস বলল।

–হ্যাঁ তখনি বুঝলাম–তুমি মিথ্যে বলোনি। সত্যি তোমার সব চুরি হয়েছে–নইলে ওরকম চুরির ফন্দী আঁটো। খাও ভাই–এবার হাত চালাও–খেয়ে নাও আগে।

ফ্রান্সিস আর কোন কথা বললো না নিঃশব্দে খেতে লাগল। পরোটা, মাংস। উটের দুধ দিয়ে তৈরী মিষ্টি চেটেপুটে খেয়ে নিল সব।

এবার মোটা ভুরুওলা লোকটা বলল–শোন ভাই–আমার নাম হাসান। কাল সকালেই এখান থেকে চলে যাচ্ছি। আমরাও খোঁজে থাকব-মকবুলের দেখা পেলেই সব আদায় করে লোক মারফত তোমার কাছে পাঠিয়ে দেব। তুমি তো এখানেই থাকবে?

–হ্যাঁ, যতদিন না জাহাজের ভাড়া যোগাড় করতে পারি।

–বেশ। এবার তাহলে ঘুমোও। অনেক রাত হল।

ফ্রান্সিসও আর জেগে থাকতে পারছিল না। পরদিন কি খাবে, কি ভাবে জাহাজের ভাড়া সংগ্রহ করবে–এইসব সাতপাঁচ ভাবতে-ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন ঘুম ভাঙতে ফ্রান্সিস দেখল হাসান আর তার বন্ধু দুজনেই চলে গেছে! ঘরে শুধু ও একা। শুয়ে-শুয়ে ভাবতে লাগল এবার কি করা যায়? কি করে প্রতিদিনের খাবার যোগাড় করবে, অর্থ জমাবে, মকবুলকে খুঁজে বের করবে? দেশে তো ফিরতে হবে? তারপর নিজেদের একটা জাহাজ নিয়ে সোনার ঘণ্টা খুঁজতে আসতে হবে। সঙ্গে আনতে হবে সব বিশ্বস্ত বন্ধুদের। কিন্তু সেসব তো পরের কথা। এখন কিরা যায়? ভাবতে-ভাবতে হঠাৎ ফ্রান্সিসের একটা বুদ্ধি এল। আচ্ছা মকবুলের সেই মস্ত বড় হীরের গল্পটা বাজারের কুয়োর ধারে বসে লোকদের শোনালে কেমন হয়? কত বিদেশী বণিকই তো বাজারে আসে। এমন কাউকে পাওয়া যাবে না, যে গল্পটা আগে শুনেছে। তাহলেই মকবুলের খোঁজ পাওয়া যাবে। কারণ মকবুল ছাড়া এই গল্প আর কে বলবে? ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। এতক্ষণে বাজারে লোকজন আসতে শুরু করেছে নিশ্চয়ই! কুয়োর ধারে খেজুর গাছটার তলায় বসতে হবে।

সে এক প্রকাণ্ড হীরে! মদিনা মসজিদের গম্বুজের চেয়েও বড়! কি চোখ ধাঁধানো আলো তার! দু’হাতে চোখ ঢেকে আমরা শুয়ে পড়লাম। সমস্ত গুহাটা তীব্র আলোর বন্যায় ভেসে যেতে লাগল। ফ্রান্সিস গল্পটা বলে চলল। লোকেরা ভীড় করে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগল। কেউ কেউ বিরূপ মন্তব্য করে গেল গাঁজাখুরী গপ্পো–অত বড় হীরে হয় নাকি? কিন্তু বেশির ভাগ লোকই হাঁ করে গল্পটা শুনল। প্রথম দিন তো। ফ্রান্সিস খুব একটা গুছিয়ে গল্পটা বলতে পারল না। তবু লোকের ভাল লাগল। গল্প বলা শেষ হলে একজন বৃদ্ধ এগিয়ে এসে ফ্রান্সিসের হাতে কিছু মুদ্রা দিল। দেখাদেখি আরো কয়েকজন কিছু মুদ্রা দিল। ফ্রান্সিস মনে-মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিল। যাক, প্রাণে বেঁচে থাকার একটা সহজ উপায় পাওয়া গেল। গল্প বলে যদি এইরকম রোজগার হয়, তাহলে খাওয়ার ভাবনাটা অন্তত মেটে।

পরের দিন থেকে ফ্রান্সিস আরো গুছিয়ে গল্পটা বলতে লাগল। কয়েকদিনের মধ্যেই সে বেশ ভালো গল্প বলিয়ে হয়ে গেল। গল্পটাকে আরো বাড়িয়ে, আরো নানারকম রোমহর্ষক ঘটনা যোগ করে লোকদের শোনাতে লাগল। রোজগারও হতে লাগল। কিন্তু এতদিনে কি এমন কাউকে পেল না, যে গল্পটা আগে শুনেছে। তবু ফ্রান্সিস হাল ছাড়ল না। প্রতিদিন গল্পটা বলে যেতে লাগল। সেই বাজারের কুয়োটার ধারে, খেজুরগাছটার নীচে বসে।

একদিন ফ্রান্সিস গল্পটা বলছে–সব সময় নয়, যখন সূর্যের আলো সরাসরি গুহাটায় এসে পড়ে, তখন দেখা যায় আলোর খেলা, কত রঙের আলো–

ভিড়ের মধ্য থেকে কে একজন বলে উঠল এ গল্পটা আমার শোনা।

ফ্রান্সিস গল্প বলা থামিয়ে লোকটার দিকে এগিয়ে গেল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বিদেশী ব্যবসায়ী। ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল–কোথায় শুনেছেন গল্পটা?

–হায়াৎ-এর সরাইখানায়।

–যে লোকটা গল্পটা বলেছে, তার নাম জানেন?

–না, সে নাম বলেনি।

–দেখতে কেমন?

–মোটাসোটা গোলগাল, বেশ হাসিখুশী।

ফ্রান্সিসের আর বুঝতে বাকি রইল না–লোকটা আর কেউ নয়, মকবুল। কিন্তু হায়াৎ? সে তো অনেকদূর। তিনদিনের পথ। উটের ভাড়া গুনবে, সে ক্ষমতা তো নেই। এদিকে শ্রোতারা অস্বস্তি প্রকাশ করতে লাগল। গল্পটা শেষ হয় নি। ফ্রান্সিস ফিরে এসে আবার গল্পটা বলতে লাগল।

কিছুদিন যেতেই কিন্তু গল্পটা লোকের কাছে পুরোনো হয়ে গেল। কে আর একই গল্প প্রতিদিন শুনতে চায়? বিদেশী বণিক-ব্যবসায়ী যারা আসত, তারাই যা দু-চারজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে শুনত। ফ্রান্সিস ভেবে দেখল–রোজগার বাড়াতে হলে আরও লোক জড়ো করতে হবে। নতুন গল্প শোনাতে হবে। এবার তাই সে সোনার ঘন্টার পর বলতে শুরু করল। চারিদিকে ভিড় করে দাঁড়ানো শ্রোতাদের উৎসুক মুখের দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সিস সুন্দর ভঙ্গীতে গল্পটা বলতে থাকে–নিশুতি রাত। ডিমেলোর গীর্জার পেছনে ঘন জঙ্গলে আগুনের আভা কিসের? সোনা গলানো চলছে। বিরাট কড়াইতে সোনা গলিয়ে ফেলা হচ্ছে। কেননা সোনার ঘন্টা তৈরী হবে। কবে তৈরী শেষ হবে? ডাকাত পাদরীরা সোনা গলায় আর ছাঁচে ঢালে। খুব জমে যায় গল্পটা। শ্রোতারা অবাক হয়ে সোনার ঘণ্টার গল্প শোনে, কেউ-কেউ মন্তব্য করে যত সব বাজে গল্প। চলেও যায় কেউ-কেউ। কিন্তু নতুন লোক জড়ো হয় আরো বেশী। এক সময় গল্পটা শেষ হয়। শ্রোতাদের উৎসুক মুখের দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সিস বলে–সোনার ঘণ্টা এখনও আছে, এই সমুদ্রের কোন অজানা দ্বীপে। তোমরা ভাই খুঁজে দেখতে পাব।

গল্প শেষ। শ্রোতাদের ভিড় কমতে থাকে। ফ্রান্সিস হাত পাতে। যাবার আগে অনেকেই কিছু কিছু সুলতানী মুদ্রা হাতে দিয়ে যায়। গল্পটা শুনে সবাই যে খুশী হয়েছে–ফ্রান্সিস বোঝে। ও আরও উৎসাহ পায়, কিন্তু বিপদ হল, এই গল্পটা বলতে গিয়েই।

জোব্বাপরা নিরীহ গোছের লম্বামত চেহারার একজন লোক মাঝে-মাঝে ফ্রান্সিসের পেছনে দাঁড়িয়ে গল্প শুনত। ফ্রান্সিস যেদিন থেকে প্রথম সোনার ঘন্টার গল্প বলতে লাগল, সেদিন থেকে লোকটা প্রত্যেক দিন আসতে লাগল। অনেকেই গল্প শুনতে জড়ো হয়। সবাইকে তো আর মনে রাখা যায় না। ফ্রান্সিস আপন মনে গল্পই বলে যায়।

একদিন ফ্রান্সিস যেই গল্পটা শেষ করেছে, পেছন থেকে লোকটা জিজ্ঞেস করল–তুমি সেই সোনার ঘন্টা দেখেছ?

ফ্রান্সিস পেছনে ফিরে লোকটাকে দেখল। গোবেচারা গোছের চেহারা। রোগা আর বেশ লম্বা। ফ্রান্সিস ওকে আমলই দিল না। হাত বাড়িয়ে শ্রোতাদের দেওয়া মুদ্রাগুলো নিতে লাগল।

–সেই সোনার ঘন্টা তুমি দেখেছ? লোকটা একই সুরে আবার করল প্রশ্নটা।

–না। ফ্রান্সিস বেশ রেগেই গেল।

–সেই ঘন্টার বাজনা শুনেছো?

–তোমার কি মনে হয়?

–আমার মনে হয় তুমি সব জান।

ফ্রান্সিস এবার অবাক চোখে লোকটার দিকে তাকাল। ঠাট্টা করে বলল–সবই যদি জানব, তাহলে কি এখানে গল্প বলে ভিক্ষে করি?

–তুমি নিশ্চয়ই জানো সেই সোনার ঘন্টা কোথায় আছে।

ফ্রান্সিস ওকে থামিয়ে দিতে চাইল। বিরক্তির সুরে বলল–বারে, গল্প গল্পই–গল্পের ঘন্টা সোনাই হোক আর রুপাই হোক, তাকে চোখেও দেখা যায় না তার বাজনাও শোনা যায় না।

হঠাৎ লোকটা পরনের জোব্বাটা কোমরের একপাশে সরাল। ফ্রান্সিস দেখল—তরোয়ালের হাতল। লোকটা একটানে খাপ থেকে খুলে চকচকে তরোয়ালের ডগাটা ফ্রান্সিসের থুতনির কাছে চেপে ধরে গম্ভীর গলায় বলল–আমার সঙ্গে চলো।

নিরীহ চেহারার মানুষটা যে এমন সাংঘাতিক, ফ্রান্সিস আগে সেটা কল্পনাও করতে পারেনি। কয়েক মুহূর্ত ও অবাক হয়ে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। টুকটাক কথা থেকে একেবারে থুতনিতে তরোয়াল ঠেকান। ফ্রান্সিস ভাবল, আজকে কার মুখ দেখে উঠেছিলাম।

–চল। লোকটা তাড়া লাগল।

–কোথায়?

–গেলেই দেখতে পাবে।

এ আবার কোন ঝামেলায় পড়লাম। কিন্তু উপায় নেই। লোকটা যেমন তেরিয়া হয়ে আছে, গাঁইগুঁই করলে হয়তো গলায় তরোয়ালই চালিয়ে দেবে।

–বেশ, চল। ফ্রান্সিস লোকটার নির্দেশমত বাজারের পথ দিয়ে হাঁটতে লাগল। লোকটা খোলা তরোয়াল হাতে নিয়ে ওর পেছনে-পেছনে যেতে লাগল।

পথে যেতে-যেতে ফ্রান্সিস কোনদিকে যেতে হবে, তা বুঝতে না পেরে মাঝে-মাঝে থেমে পড়ছিল। লোকটা ওর পিঠে তরোয়ালের খোঁচা দিয়ে পথ দেখিয়ে দিতে লাগল। ফ্রান্সিস মনে-মনে কেবল পালাবার ফন্দি আঁটতে লাগল। কিন্তু পেছনে না তাকিয়েও বুঝতে পারল, লোকটা ভীষণ সতর্ক। একটু এদিক-ওদিক ওর পা পড়লেই লোকটা ধমক দিচ্ছে–সোজা হাঁট। পালাবার চেষ্টা করলেই মরবে। ফ্রান্সিস আবার সহজভাবে হাঁটতে লাগল। এবার খুব সরু গলি দিয়ে যেতে লাগল ওরা।

হাত বাড়ালেই বাড়ির দরজা, এত সরু গলি সেটা। ফ্রান্সিস নজর রাখতে লাগল কোন খোলা দরজা পায় কি না। পেয়েও গেল। সঙ্গে সঙ্গে একটা যন্ত্রণাকাতর শব্দ করে ফ্রান্সিস বসে পড়ল। লোকটা তরোয়াল নামিয়ে ওর গায়ের ওপর ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল কি হল?

ফ্রান্সিস এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল, তড়িৎগতিতে মাথা দিয়ে লোকটার পেটে গুতো মারলো লোকটা টাল সামলাতে পারল না, সেই পাথুরে গলিটায় চিৎ হয়ে পড়ে গেল। ফ্রান্সিস আর এক মুহূর্ত দেরি করল না। বাঁদিকের খোলা দরজাটা দিয়ে ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপরেই ছুটল ভিতরের ঘরের দিকে। বোঝাই যাচ্ছে গৃহস্থ বাড়ি, কিন্তু লোকজন কেউ নেই সে ঘরে। পাশের একটা ঘরে লোকজনের কথাবার্তা শোনা গেল, বোধহয় ওঘরে খাওয়া-দাওয়া চলছে। হঠাৎ ফ্রান্সিসের নজরে পড়ল দেয়ালে একটা বোরখা ঝুলছে। যাক আত্মগোপনের একটা উপায় পাওয়া গেল। ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি বোরখাটা পরে নিল, তারপর এক ছুটে ভিতরে উঠোনে চলে এল। দেখল ছাদটা বেশী উঁচু নয়। জানলার গরাদে পা রেখে তাড়াতাড়ি ছাদে উঠে পড়ল। তারপর ছাদের পর ছাদ লাফিয়ে লাফিয়ে পার হতে হতে বেশ দূরে চলে এল। এবার নামা যেতে পারে। এই জায়গায় ফ্রান্সিস মারাত্মক ভুল করল। আগে থেকে দেখে নিল না গলিটা ফাঁকা আছে কিনা। কাজেই লাফ দিয়ে পড়বি তো পড়, একটা লোকের নাকের ডগায় সে পড়ল। লোকটা বোধহয় গানটান করে। আপন মনে সুর ভাঁজতে-ভাঁজতে যাচ্ছিল। একটা বোরখা পরা মেয়ে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ল দেখে তো ওর গান বন্ধ হয়ে গেল। লোকটা হাঁ করে প্রায় চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল। ফ্রান্সিস তার আগেই ওর ঘাড়ে এক রদ্দা মারল। ব্যস! লোকটার মুখ দিয়ে আর টু শব্দটি বেরুল না। সে বেচারা কলাগাছের মত ধপাস করে পড়ে গেল।

ফ্রান্সিস দ্রুতপায়ে ছুটল গলি পথ দিয়ে। একটু পরেই একটা পাতকুয়ো। কুয়োটার ওপরে কপিকল লাগানো। দড়ি দিয়ে চামড়ার থলিতে করে মেয়েরা জল তুলছে। কুয়োটার চারপাশে বোরখা পরা মেয়েদের ভিড়। সবাই জল নিতে এসেছে। ফ্রান্সিসও সেই ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ল, কিন্তু হলে হবে কি? সেদিন ফ্রান্সিসের কপালটা সত্যিই মন্দ ছিল। সে তখনও জানত না সমস্ত এলাকাটাই সুলতানের সৈন্যরা ঘিরে ফেলেছে।

বাড়ি-বাড়ি ঢুকে তল্লাশি, জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। একটু পরেই সুলতানের সৈন্যরা কুয়োতলায় এসে হাজির। কুয়োতলার চারপাশের বাড়িতে তল্লাশি শেষ হল। ঠিক তখনই সৈন্যরা একজন লোককে ধরে নিয়ে এল। লোকটা হাত মুখ নেড়ে কি যেন বলতে লাগল। বোরখার আড়াল থেকে ফ্রান্সিস সবই দেখছিল। সে লোকটাকে চিনতে পারল। ছাদ থেকে লাফ দিয়ে সে এই লোকটার সামনেই পড়েছিল। এবার আর রক্ষে নেই। সৈন্যদের দলনেতা চীৎকার করে কি যেন হুকুম দিল। সব সৈন্য দল বেঁধে তরোয়াল উঁচিয়ে কুয়োতলার দিকে আসতে লাগল। মেয়েরা। ভয়ে তারস্বরে চীৎকার করে উঠল। সৈন্যদের নেতা হাত তুলে অভয় দিল। কিন্তু ততক্ষণে মেয়েদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। দুতিনজনের জলের পাত্র ভেঙে গেল। যে যেদিকে পারল পালাতে চেষ্টা করল। কিন্তু সৈন্যরা ছুটে গিয়ে ধরে ফেলতে লাগল। ফ্রান্সিস দেখল এই সুযোগ।

ফ্রান্সিস কুয়োতলার পাথর বাঁধানো চত্বর থেকে একলাফ দিয়ে নেমেই ছুটল সামনের বাড়িটা লক্ষ্য করে। দরজার কাছে পৌঁছেও গেল। কিন্তু–শন্ ন্‌-ন্‌ একটা ছুরিটা সামনের কাঠের দরজায় লাগল। একটা ছুরি ওর কানের পাশ দিয়ে বাতাস কেটে বেরিয়ে গেল ও দাঁড়িয়ে পড়ল। ছুরিটা সামনের কাঠের দরজায় গভীর হয়ে বিঁধে গেল। একটুর জন্যে ওর ঘাড়ে লাগেনি।

পালাবার চেষ্টা করো না। পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল। ফ্রান্সিস আর নড়ল না। দাঁড়িয়ে রইল। ওর গা থেকে কেউ যেন বোরখা খুলে নিল। ফ্রান্সিস দেখল সেই রোগা লম্বামত লোকটা।

লোকটা হেসে বলল–আর হেঁটে নয়–এবার ঘোড়ায় চেপে চল।

ফ্রান্সিসের আর পালান হল না। ফ্রান্সিসকে রাখা হল মাঝখানে। চারপাশে সৈন্যদল। ওকে ঘিরে নিয়ে চলল। ওর পাশেই চলল সেই রোগা লম্বামত লোকটা। আমাদের পাথর বাঁধানো রাজপথে অনেকগুলো ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ উঠল। ওরা চলল সদর রাস্তা দিয়ে। ফ্রান্সিস তখনও জানতে পারেনি, তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ও সব কিছু ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিল। তবু কৌতূহল যেতে চায় না।

ব্যাপার কি? ওকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেন?

সৈন্যদলের সঙ্গে ফ্রান্সিসও এগিয়ে চলল। আড়চোখে একবার লম্বামত লোকটাকে দেখে নিল! লোকটা নির্বিকার। কোন কথা না বলে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। ফ্রান্সিস এবার লোকটাকে জিজ্ঞেস করল–আচ্ছা, আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?

–গেলেই দেখতে পাবে। লোকটা শান্ত স্বরে বলল।

–তবু আগে থেকে জানতে ইচ্ছে করে।

–সুলতানের কাছে।

ফ্রান্সিস ভীষণভাবে চমকে উঠল। বলে কি? দেশের সুলতান! দোর্দণ্ডপ্রতাপ তার। ফ্রান্সিসের মত নগণ্য একজন বিদেশীর সঙ্গে কি সম্পর্ক তার?

–কিন্তু আমার অপরাধ?

–সোনার ঘন্টার হদিশ তুমি জান।

–আমি কিছুই জানি না।

–সুলতানকে তাই বলো! এখন বকবক বন্ধ কর, আমরা এসে গেছি!

বিরাট প্রাসাদ সুলতানের। ফ্রান্সিস প্রাসাদটা দেখেছে আগে, কিন্তু সেটা বাইরে থেকে। আজকে প্রাসাদে ঢুকছে। স্বপ্নেও ভাবেনি কোনদিন সে এই প্রাসাদে ঢুকবে।

মস্তবড় খিলানওলা দেউড়ি পেরিয়ে অনেকক্টা ফাঁকা পাথর বাঁধানো চত্বর। চত্বরটায় ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ উঠল—ঠকঠক্ এক কোণার দিকে ঘোড়াশাল। সেখানে ঘোড়া থেকে নামল সবাই। এবার সামনে সেই লম্বামত লোকটা চলল। তারপর ফ্রান্সিস। পেছনে তরোয়াল হাতে দু’জন সৈন্য। ওরা প্রাসাদের মধ্যে ঢুকল।

বিরাট-বিরাট দরজা–ঘরের পর ঘর পেরিয়ে চলল ওরা। সবগুলো ঘরই সুসজ্জিত দামী কার্পেট মোড়া মেঝে । রঙীন কাঁচ বসানো শ্বেতপাথরের দেয়াল। এখানে-ওখানে সোনালী রঙের কাজকরা লতা-পাতা ফুল। লাল টকটকে গদিতে মোড়া ফরাস, বসবার জায়গায় বড়-বড় ঝাড়লণ্ঠন ঝুলছে ছাদ থেকে। দরজা জানালা মীনে করা। সুন্দর কারুকাজ তাতে। দরজায় দরজায় ঝকঝকে বর্শা হাতে দ্বাররক্ষীরা দাঁড়িয়ে আছে। লম্বামত লোকটাকে কী দেখেই ওরা পথ ছেড়ে দিতে লাগল। একটা লোক ঘরে ঢুকে হাততালি দিল। সৈন্য দুজন দাঁড়িয়ে পড়ল। ওরা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল।

ঘরটা অন্য ঘরের তুলনায় ছোট। মাঝখানে লাল গদিমোড়া বাঁকানো পায়ার টেবিল দু’পাশের বসবার জায়গাগুলোও লাল গদিমোড়া। দেয়ালে, দরজায়, জানালায় অন্য ঘরগুলোর চেয়ে বেশী কারুকাজ। লোকটা ফ্রান্সিসকে বসতে ইঙ্গিত করল। ফ্রান্সিস বসল। লোকটা ভেতরের দরজা দিয়ে কোথায় চলে গেল। একটু পরেই ফিরে এল। কেমন সন্ত্রস্ত ভঙ্গি। ফ্রান্সিসের কাছে এসে মৃদুস্বরে বলল সুলতান আসছেন। উঠে দাঁড়িয়ে আদাব করবে।

ভেতরের দরজা দিয়ে সুলতান ঢুকলেন। ফ্রান্সিস সুলতান রাজা-বাদশাহের কাহিনী শুনেছেই। এতদিন। চোখে দেখেনি কোনদিন। আজকে প্রথম দেখল। সুলতান বেশ দীর্ঘদেহী, গায়ের রঙ যেন দুধে-আলতায় মেশান। দাড়ি-গোঁফ সুন্দর করে ছাঁটা। মাথায় আরবীদের মতই বিড়েবাঁধা সাদা দামী কাপড়ের টুকরো। তবে পরনে জোব্বানয়, একটা আঁটোসাঁটো পোশাক। তাতে সোনা দিয়ে লতাপাতার কাজ করা। বুকে ঝুলছে একটা মস্তবড় হীরে বসানো গোল লকেট। গলায় মুক্তোর মালা। সুলতানকে দেখেই লম্বামত লোকটা মাথা নুইয়ে আদাব করল। লোকটার দেখাদেখি ফ্রান্সিসও আদাব করল। সুলতান ফ্রান্সিসকে বসতে ইঙ্গিত করে নিজেও বসলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন–তোমার নাম কি?

–ফ্রান্সিস।

ফ্রান্সিস এতক্ষণে ভাল করে সুলতানের মুখের দিকে তাকাল। সুলতানের চোখের দৃষ্টিটা ফ্রান্সিসের ভাল লাগল না। কেমন ক্রুরতা সেই দৃষ্টিতে। বড় বেশী স্থির, মর্মভেদী।

–তুমি বাজারে যে গল্পটা বল–সোনার ঘন্টার গল্প—

–আজ্ঞে হ্যাঁ–মানে পেটের দায়ে—

–গল্পটা কোথায় শুনেছ?

–দেশে বুড়ো নাবিকদের মুখে।

–তোমার কি মনে হয়? গল্পটা সত্যি না মিথ্যে?

–কি করে বলি? তবে সত্যিও হতে পারে।

সুলতানের চোখ দুটো যেন জ্বলে উঠল। বললেন–ওকথা বলছ কেন?

–আমি সেই সোনার ঘন্টার বাজনা শুনেছি।

সুলতান ক্রুর হাসি হাসলেন, বললেন–শুধু বাজনা শোনা যায়, একমাত্র তুমিই জানো সেই সোনার ঘন্টা কোথায় আছে, কেমন করেই বা ওখানে যাওয়া যায়।

ফ্রান্সিস সাবধান হল। বেশী কিছু বলে ফেললে বিপদ বাড়বে বই কমবে না। বলল–বিশ্বাস করুন সুলতান, আমি এসবের বিন্দুবিসর্গও জানি না।

–তুমি নিজের চোখে সোনার ঘন্টা দেখেছ। সুলতান দাঁত চেপে কথাটা বললেন।

ফ্রান্সিস চমকে উঠল। বুঝল–ভীষণ বিপদে পড়েছে সে। এমন লোকের খপ্পরে পড়েছে, যার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। যে যাই বলুক না কেন, যতই বোঝাবার চেষ্টাই করুক না কেন–সুলতান কিছুতেই সে কথা বিশ্বাস করবেন না। তবু ফ্রান্সিস বোঝাবার চেষ্টা করল সুলতান আমি বললাম তো সোনার ঘন্টার বাজনা আমি শুনেছি। তখন প্রচণ্ড ঝড়ে আর ডুবো পাহাড়ের ধাক্কায় আমাদের জাহাজ ডুবে যাচ্ছিল। তখন নিজের প্রাণ বাঁচাতেই প্রাণান্তকর অবস্থা। কোত্থেকে বাজনার শব্দটা আসছে, কতদূর সেটা, এসব ভাববার সময় কোথায় তখন?

–মিথ্যেবাদী ফেব্বেবাজ। সুলতান গর্জন করে উঠলেন। তারপর আঙুল নেড়ে লম্বামত লোকটাকে কি যেন ইশারা করলেন। লোকটা দ্রুতপায়ে এগিয়ে এসে ফ্রান্সিসের পিঠে ধাক্কা দিল চলো।

ঘরের বাইরে আসতেই সৈন্য দুজন পেছনে দাঁড়াল। সামনে সেই লোকটা। ফ্রান্সিস ভেবেই পেল না, তাকে ওরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে।

প্রাসাদের পেছন থেকেই শুরু হয়েছে পাথরে বাঁধানো পথ। দুপাশে উঁচু প্রাচীর টানা চলে গেছে দুর্গের দিকে। কালো থমথমে চেহারার সেই বিরাট দুর্গের দিকে তারা ফ্রান্সিসকে নিয়ে চলল। ফ্রান্সিসের আর কিছুই বুঝতে বাকি রইল না। এই দুর্গেই তাকে বন্দী করে রাখা হবে। কতদিন কে জানে? ফ্রান্সিসের মন দমে গলে। সব শেষ। সোনার ঘন্টার স্বপ্ন দেখতে দেখতেই এই দুর্গের অন্ধকার কোন ঘরে লোকচক্ষুর অন্তরাল অনাহারে অনিদ্রায় তাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। এই তার ভাগ্যের লিখন। আর তার মুক্তি নেই। কডুকডু শব্দ তুলে দুর্গের বিরাট লোহার দরজা খুলে গেল। ফ্রান্সিস বাইরের মুক্ত পৃথিবীর হাওয়া বুক ভরে টানল। তারপর অন্ধকারে স্যাঁতসেতে দুর্গের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করল!

যে ঘরে ফ্রান্সিসকে রাখা হল, সেই ঘরটার দেওয়াল এবড়োখেবড়ো পাথর দিয়ে গাঁথা। দুপাশে দুটো মশাল জ্বলছে। তাতে অন্ধকারটা যেন আরো ভীতিকর হয়ে উঠেছে। দেয়ালে দুটো মস্তবড় আংটা লাগানো। তাই থেকে শেকল ঝুলছে। সেই শেকল দিয়ে ফ্রান্সিসের দুহাত বেঁধে রাখা হয়েছে।

সারারাত ঘুমুতে পারেনি ফ্রান্সিস। দুটো হাত শেকলে বাঁধা ঝুলছে। এ অবস্থায় কি ঘুম আসে? তন্দ্রা আসে? শরীর এলিয়ে পড়তে চায়। কিন্তু লোহার শেকলে টান পড়তেই ঝনঝন শব্দ ওঠে। তন্দ্রা ভেঙে যায়। যে কজন পাহারাদার দরজার কাছে আছে, যে পাহারাদার খাবার দিয়ে গেছে–সবাইকে সে চীৎকার করে জিজ্ঞাসা করছে আমাকে এই শাস্তি দেবার মানে কি?কিঅপরাধ করেছি আমি? কিন্তু পাহারাদারগুলো বোধহয় বদ্ধ কালা আর বোবা। শুধু ওর দিকে তাকিয়ে থেকেছে অথবা আপন মনে নিজেদের কাজ করে গেছে। কথাও বলেনি, তার কথা যে ওদের কানে গেছেমুখ দেখেও তা মনে হয়নি। ঘুম হল না। হবার কথাও নয়। শেকলে ঝুলে ঝুলে কি ঘুম হয়? তন্দ্রার মধ্য দিয়ে রাত কাটাল। একসময় ভোর হল। সামনে একটা জানালা দিয়ে ভোরের আলো দেখা গেল। সারারাত ঘুম নেই। চোখ দুটো জ্বালা করছে।

একটু বেলা হয়েছে তখন। হঠাৎ লোহার দরজায় শব্দ উঠল ঝন ঝনাৎ। কাঁচ-কোচ শব্দ তুলে দরজাটা খুলে গেল। ফ্রান্সিস দেখল–সুলতান ঢুকছে। পেছনে সেই লম্বামত লোকটা। তার পেছনে মাথায় কালো কাপড়ের পাগড়ি, কালো আলখাল্লা পরা আর একটা লোক। তার হাতে চাবুক। সে চাবুকটা পেঁচিয়ে মুঠো করে ধরে রেখেছে।

–এই যে সাহেব–কেমন আছো? সুলতান ঠাট্টার সুরে জিজ্ঞাসা করলেন।

ফ্রান্সিস কোন কথা বলল না।

–যাক গে, সুলতান ব্যস্তভাবে বললেন–আমার তাড়া আছে। কি ঠিক করলে? সারারাত ভাবার সময় পেলে।

–কোন ব্যাপারে? ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল।

সুলতান হো-হো করে হেসে উঠলেন–তুমি তো বেশ রসিক হে সব জেনেশুনে রসিকতা করছো–তাও আমার সঙ্গে।

–আমি যা জানি বলেছি–এর বেশি আমি আর কিছুই জানি না।

সুলতান একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন–সোনার ঘন্টা আমার চাই। তার জন্যে যদি তোমার মত দু চারশ লোকের মৃতদেহ ডিঙিয়ে যেতে হয়

–আমি তাই যাবো। তবু সোনার ঘন্টা আমার চাই।

ফ্রান্সিস চুপ করে রইল। সুলতান আঙ্গুল তুলে ইঙ্গিত করলেন। চাবুক হাতে লোকটা এগিয়ে এল। কপাল পর্যন্ত ঢাকা কালো পাগড়ি। মুখটা দেখা না গেলেও শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। যেন খুশীতে জ্বলজ্বল করছে। কি নিষ্ঠুর! ফ্রান্সিস ঘৃণায় মুখ ফেরাল।

ঝপাৎ–চাবুকের আঘাতটা পেটের কাছ থেকে কাঁধ পর্যন্ত যেন আগুনের ছ্যাকা লাগিয়ে দিল। ফ্রান্সিসের সমস্ত শরীরটা শিউরে উঠল। ঝপাৎ–আবার চাবুক। তার সবটুকু শরীরে লাগল না। তবু হাতটা জ্বালা করে উঠল; সুলতান হাত তুলে চাবুক থামাতে ইঙ্গিত করলেন। বললেন–এখনও বলল কোথায় আছে সেই সোনার ঘন্টা?

–আমি যা জানি বলেছি।

ঝপাৎ–আবার চাবুক। বন্ধ মুখ কি করে খুলতে হয় আমি জানি। কথাটা বলে সুলতান চাবুকওয়ালার দিকে তাকালেন। বললেন, যতক্ষণ না কথা বলতে চায় ততক্ষণ চাবুক চালাবে। কিছু বলতে চাইলে সুলতান আঙ্গুল দিয়ে লম্বামত লোকটাকে দেখালেন–রহমানকে খবর দেবে। কালো পোশাক পরা চাবুকওলা মাথা ঝুঁকিয়ে আদাব করল। সুলতান দ্রুতপায়ে দরজার দিকে এগোলেন। রহমানও পেছনে-পেছনে চলল।

ঝপাৎ–চাবুকের শব্দে ফ্রান্সিস চমকে উঠল।

কিন্তু আশ্চর্য! এবারের চাবুকটা ওর গায়ে পড়ল না–দেয়ালে পড়ল। আবার ঝপাৎ–এবারও দেওয়ালে লাগল। লোকটা কি নিশানা ঠিক করতে পারছে না? ঝপাৎ–ঝপাৎ হঠাৎ কয়েকবার দ্রুত চাবুকটা দেয়ালে মেরে লোকটা চাবুক হাতে ফ্রান্সিসের কাছে। এগিয়ে এল। যেন ফ্রান্সিসকে পরীক্ষা করেছে, অজ্ঞান হয়ে গেছে কিনা–এমনি ভঙ্গিতে ফ্রান্সিসের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ল। তারপর কপালের কাছ থেকে পাগড়িটা ওপরের দিকে তুলল। কপালে একটা গভীর ক্ষতচিহ্ন। ফ্রান্সিস ভীষণভাবে চমকে উঠল–ফজল! এবার ফ্রান্সিস ভালোভাবে লোকটার মুখের দিকে তাকাল। আরে? এ তো সত্যিই ফজল! মুখে ভুযোমত কি মেখেছে তাই চেনা যাচ্ছিল না। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে ডাকল–ফজল।

ফজল ঠোঁটে হাত রাখল। তারপর ফিসফিস করে বলল–সামনে জানালাটা দেখেছো!

–হ্যাঁ। ফ্রান্সিসও চাপাস্বরে উত্তর দিলো।

–গরাদ নেই।

–হ্যাঁ।

–সোজা ওখান দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। খাড়া পাহাড়ের গা–কোথাও ঘা খাবার ভয় নেই–নীচে সমুদ্রের জল, তারপর ডুব সাঁতার, পারবে তো?

–নিশ্চয় পারবো।

এমন সময় দুজন সৈন্য ঘুরে ঢুকল। ফজল সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়ে চাবুক চালাল। এবারে চাবুকের ঘাটা ফ্রান্সিসের গায়ে লাগল। ফ্রান্সিসের মুখ দিয়ে কাতরোক্তি বেরিয়ে এল। সৈন্যদের একজন বলল–কি হল এখনও যে মুখ থেকে শব্দ বেরুচ্ছে।

ফজল ফ্রান্সিসের দিকে চেয়ে-চেয়ে চোখ টিপে বলল–এই শেষ ঘা, এটা আর সহ্য করতে হচ্ছে না বাছাধনকে। বলেই চাবুক চালাল–ছপাৎ। ফ্রান্সিসের গায়ে লাগল না। দেয়ালে লেগেই শব্দ উঠল।

ফ্রান্সিস অজ্ঞান হবার ভঙ্গি করল। হাত ছেড়ে দিয়ে শেকলে ঝুলতে লাগল।

–এঃ। নেতিয়ে পড়েছে–একজন সৈন্য ফজলকে লক্ষ্য করে বলল–আর মেরো না। ফজল চটে ওঠার ভান করল–তোমরা নিজেরা নিজেদের কাজ করো গে যাও। আমি এই ভিনদেশীটাকে একেবারে নিঃশেষ করে ছাড়বো।

–তাহলে তোমারই গর্দান যাবে। একজন সৈন্য বলল।

–কেন?

–সুলতান বলেছেন, যে করেই হোক এই ভিনদেশীটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে–নইলে সোনার ঘন্টার হদিশ দেবে কে?

–হুঁ, তা ঠিক। তাহলে এখন থাক, কি বল?

দু’জন সৈন্যই মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল। ফজল চাবুকটা হাতে পাকাতে-পাকাতে ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল–যাঃ জোর বেঁচে গেলি।

সবাই চলে গেল। ক্যাঁচ-কোঁচ শব্দ তুলে দরজাটা বন্ধ হল। পাহারাদার দরজায় তালা লাগাল।

ফ্রান্সিস এবার আস্তে আস্তে শব্দ না করে উঠে দাঁড়াল। জানালাটার দিকে ভালো করে তাকাল! ফজল ঠিকই বলেছে। জালানাটায় কোন গরাদ নেই। পাহাড়ের খাড়া গা বেয়ে কেউ নেমে যাবে এটা অসম্ভব। তাই বোধহয় সুলতান জানালাটাকে সুরক্ষিত করবার প্রয়োজন মনে করেননি। জানালার ওপাশে রাত্রির অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সিস কেবল পালাবার ফন্দি করতে লাগল। যে করেই হোক পালাতেই হবে। পালাতে গিয়ে যদি মৃত্যু হয় আফশোসের কিছু নেই। কারণ না পালালেও তার মৃত্যু অবধারিত।

পরের সমস্তটা দিন কেউ এল না। একজন পাহারাদার শুধু খাবার দিয়ে গেল। সুলতানও এলো না–চাবুক মারতে ফজলও এল না। কি ব্যাপার।

ফ্রান্সিস ভাবল–হয়তো সুলতান সদয় হয়েছে। সে যে সত্যিই সোনার ঘন্টার হদিশ জানে না, এটা বোধহয় সুলতান বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু সন্ধ্যের পরেই ফ্রান্সিসের ভুল ভাঙল। সুলতান যে কত বড় শয়তান, সে পরিচয় পেতে বিলম্ব হল না।

সন্ধ্যের একটু পরে তিন-চারজন পাহারাদার এল ফ্রান্সিসের ঘরটায়। বড়-বড় সাড়াশি দিয়ে একটা গনগনে উনুন ধরাধরি করে নিয়ে এল ওরা। ফ্রান্সিস অবাক। উনুন দিয়ে কি হবে? ফ্রান্সিস দেখল–দুটো লম্বা লোহার শিক উনুনটায় গুঁজে দেওয়া হলে।

একটু পরেই সুলতান এলেন। সঙ্গে রহমান। ফ্রান্সিস রহমানের পেছনে তাকাল। না ফজল আসে নি। ফ্রান্সিস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। একমাত্র ভরসা ছিল ফজল। আজকে সেও নেই। ফ্রান্সিস মনকে শক্ত করল। ফজল যা বুদ্ধি দেবার দিয়ে গেছে। এর বেশী ও একা আর কি করতে পারে? এবার বাঁচতে হলে ফ্রান্সিসকে নিজের সাহস, প্রত্যুতপন্নমতিত্ব আর বুদ্ধির ওপর নির্ভর করতে হবে। সারারাত ধরে যে ফন্দিটা মনে মনে এঁটেছে সেটাকে কাজে লাগাতে হবে।

–কি হে–চাবুকের মার খেযেও তো বেশ চাগগা আছ দেখছি। সুলতান মুখ বেঁকিয়ে হেসে বললেন।

ফ্রান্সিস চুপ করে রইল। সুলতান বললেন–এবার চটপট বলে ফেল বাছাধন, নইলে—

–সুলতান আপনি মিছিমিছি একটা নির্দোষ মানুষের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছেন।

–ঠিক আছে সোনার ঘন্টার হদিশ বলে ফেল–আমি এক্ষুণি তোমায় ছেড়ে দিচ্ছি।

–আমি যা জানি সেটা—

ফ্রান্সিসের কথা শেষও হল না। সুলতান আঙ্গুল নেড়ে ইঙ্গিত করলেন। একজন পাহারাদার গনগনে উনুন থেকে লাল টকটকে শিক দুটো তুলে নিল। তারপর ফ্রান্সিসের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।

–এখন বলো–নইলে জন্মের মত .খ দুটো হারাতে হবে। সুলতানের চড়া গলা শোনা গেল।

ফ্রান্সিস শিউরে উঠল। মানুষ এমন নৃশংসও হয়? ততক্ষণে লোকটা শিক দুটো ওর চোখের সামনে নিয়ে এসেছে। আগুনের উত্তাপ মুখে লাগছে। চোখের একেবারে কাছে লাল শিক দুটো। লাল টকটকে শিকের মুখ ছাড়া ও আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। আর এক মুহূর্ত। পৃথিবীর সমস্ত আলো রং হারিয়ে যাবে চিরদিনের মত। আর দেরি করা যায় না। ফ্রান্সিস চিৎকার করে উঠল নানা সব বলছি আমি। সুলতান ইঙ্গিতে লোকটাকে সরে যেতে বললেন।

–এই তো সুবুদ্ধি হয়েছে। সুলতান হাসলেন।

–সব বলছি সুলতান। কিন্তু তার আগে আমার হাতের শেকল খুলে দিতে বলুন। সুলতান ইঙ্গিত করলেন। একজন পাহারাদার এসে ফ্রান্সিসের হাতের শেকল খুলে দিল। দুহাতে কবজির কাছে লোহার কড়ার দাগ পড়ে গেছে। সেই দাগের ওপর হাত বুলিয়ে ফ্রান্সিস এগিয়ে এল। হাত বাড়িয়ে একজন পাহারাদারের খাপ থেকে তরোয়ালটা খুলে নিল। সঙ্গে সঙ্গে অন্য পাহারাদাররা সাবধান হয়ে গেল। সবাই যে যার তরোয়ালের হাতলে হাত রাখল। এমন কি সুলতানও। ফ্রান্সিস সকলের দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর তরোয়ালটা দিয়ে পাথরের মেঝেতে দাগ কাটতে লাগল। সবাই দেখলো ফ্রান্সিস একটা জাহাজের ছবির মত কিছু আঁকছে। সুলতানেরও কৌতূহল। সবাই ঝুঁকে পড়ে দেখতে লাগল। ফ্রান্সিস বলতে লাগল–সুলতান এই হল আপনার জাহাজ। এখান থেকে সোজা দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে লক্ষ্য করে আপনাকে যেতে হবে।

সুলতান মাথা ঝাঁকালেন। ফ্রান্সিস এখানে-ওখানে কয়েকটা ঢ্যাঁড়া দিল, বলল–এইগুলো হল দ্বীপ। জনবসতি নেই। সব কটাই পাথুরে দ্বীপ। এসব পেরিয়ে যেতে হবে একটা ডুবো পাহাড়ের কাছে। ডুবো পাহাড়টা উঁচু হবে–এই ধরুন ঐ জানালাটা থেকে–ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে জানালাটার দিকে এগোল। বলতে লাগল–এই জানালাটা থেকে হাত পাঁচেক—বলেই ফ্রান্সিস হঠাৎ তরোয়ালটা দাঁতে চেপে ধরে জানালাটার দিকে তীরবেগে ছুটল এবং কেউ কিছু বোঝবার আগেই জানালার মধ্যে দিয়ে বাইরের অন্ধকারে রাত্রির শূন্যতায় ঝাঁপ দিল। কানের দুপাশে সমুদ্রের মত্ত হাওয়ার শোঁ-শোঁ শব্দ। বাতাস কেটে ফ্রান্সিস নামছে তো নামছেই।

হঠাৎ–ঝপাং। জলের তলায় তলিয়ে গেল ফ্রান্সিস। পরক্ষণেই ভেসে উঠল–জলের ওপর। সমুদ্রের ভেজা হাওয়া লাগছে চোখেমুখে। মাথার ওপর নক্ষত্রখচিত আকাশ। ফ্রান্সিসের সমস্ত দেহমন আনন্দের শিহরণে কেঁপে উঠল। আঃ–মুক্তি!

ওদিকে দুর্গের জানালায়, জানালায় প্রাচীরের ওপর সৈন্যরা মশাল হাতে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্ধকারে ফ্রান্সিসকে খুঁজছে। ফ্রান্সিস তরোয়ালটা কোমরে গুঁজে নিল। তারপর গভীর সমুদ্রের দিকে সাঁতার কাটতে লাগল। চচপ–জল কেটে তীর ঢুকছে। সৈন্যরা আন্দাজে তীর ছুঁড়তে শুরু করেছে। ফ্রান্সিস আর মাথা ভাসিয়ে সাঁতার কাটতে ভরসা পেল না। যদি একবার নিশানা করতে পারে! সে ডুব সাঁতার দিতে লাগল। ডুবসাঁতার দিতে দিতে অনেকটা দূরে চলে এল। পেছন ফিরে দেখল-দুৰ্গটা। এখনও দেখা যাচ্ছে। মশালের ক্ষীণ আলোগুলো নড়ছে। আবার ডুব দিল ফ্রান্সিস। হঠাৎ কিসের একটা টান অনুভব করল। সমুদ্রের নীচের স্রোত ওকে টানছে। একটু পরেই টানটা আরো প্রবল হল আর তাকে মুহূর্তের মধ্যে অনেকদূরে নিয়ে গেল। এবার ভেসে উঠে পেছনে তাকিয়ে দেখল সব অন্ধকার। দুর্গের চিহ্নমাত্রও দেখা যাচ্ছে না। ফ্রান্সিস নিশ্চিন্ত মনে সাঁতার কাটতে লাগল।

সারারাত সাঁতার কাটল ফ্রান্সিস। অবসাদে হাত নড়তে চায় না। তখন কোনরকমে শুধু ভেসে থাকা। এইভাবে বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে সাঁতার কেটে চলল। পূবের আকাশে অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। একটু পরেই পূর্বকোণায় লাল সূর্য উঠল। আবার সমুদ্রে সেই সূর্যোদয়ের দৃশ্য। ফ্রান্সিস ভালো করে তাকাতে পারছে না। তাকিয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। সবকিছু যেন ঝাপসা দেখাচ্ছে।

তবু চেয়ে-চেয়ে সূর্য ওঠা দেখল। কত পরিচিত দৃশ্য। তবু ভালো লাগল। আবার নতুন করে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসা–আবার এই পুরোনো পৃথিবী আকাশ, সূর্যোদয় দেখা। ফ্রান্সিসের হাত আর চলছেনা। হাত পা ছেড়ে দিয়ে ভেসে চলল অনেকক্ষণ। হঠাৎ সামনেই দেখে একটা পাথুরে দ্বীপ। হোক ছোট দ্বীপ–হাত পা ছড়িয়ে একটু বিশ্রাম তো নেওয়া যাবে। দ্বীপটার কাছাকাছি আসতেই পায়ের নীচে পাথুরে মাটি ঠেকল। শ্যাওলা ধরা পাথরে পা টিপে টিপে দ্বীপটায় উঠল। তারপর একটা মস্ত বড় পাথরের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। কানে আসছে সামুদ্রিক পাখির ডাক আর দ্বীপের পাথরে সমুদ্রের ঢেউ ভেঙে পড়ার শব্দ। হঠাৎ ফ্রান্সিসের মনে হল–সামুদ্রিক পাখিরা তো এমনি সব দ্বীপেই ডিম পারে। দেখাই যাক না দুটো একটা ডিম পাওয়া যায় কিনা। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। পাথরের খাঁজে খাঁজে গর্ত খুঁজতে লাগল। প্রথম গর্তটায় কিছুই পেল না। শুধু খড়কুটো শুকনো ঘাস। পরের গর্তটায় ডিমের মস্ত খোল হাতে ঠেকল। দুটো ডিম! ফ্রান্সিস আনন্দে লাফিয়ে উঠল। ডিম দুটো পাথরে ঠুকে ভেঙে খেয়ে নিল। আঃ কি তৃপ্তি! কিন্তু আর শুয়ে থাকা নয়। এখনও নিরাপদ নয় সে। যদি সুলতানের সৈন্যরা জাহাজ বা নৌকা নিয়ে ওকে খুঁজতে বেরোয়? অনেকক্ষণ তো বিশ্রাম নেওয়া গেল। পেটেও কিছু পড়ল। এবার জলে নামতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই এলাকা থেকে দূরে পালাতে হবে।

ফ্রান্সিস জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পূর্ণোদ্যমে সাঁতার কাটতে লাগল। সূর্য মাথার ওপর উঠে এসেছে। যতদূর চোখ যায় শুধু জল আর জল। উজ্জ্বল রোদ জলের ঢেউয়ের মাথায় ঝিকিয়ে উঠছে। ফ্রান্সিস এবার ডুব দিল–আশা–যদি জলের তলায় কোন স্রোতের সাহায্য পায়। কিন্তু না। নীচে কোন স্রোত নেই। ওপরে ভেসে ওঠার আগে হঠাৎ দেখল ওর ঠিক হাত পাঁচেক সামনে একটা মাছের লেজের মত কি যেন দ্রুত সরে গেল।

হাঙর! হাঙরের মুখ করাতের দাঁতের মত দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস মনে-মনে সাহস সঞ্চয় করতে লাল। এখন ভয় পাওয়া মানেই নিশ্চিত মৃত্যু। হাঙরটা আর একবার সাঁৎ করে ওর পায়ের খুব কাছ দিয়ে ঘুরে গেল। বোধহয় পরখ করে নিচ্ছে লোকটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে কিনা হাতে অস্ত্র আছে কিনা।

ফ্রান্সিস ভেবে দেখল–ওটাকে এক আঘাতেই নিকেশ করতে হবে—নইলে–একটু আধটু খোঁচা খেলে সঙ্গে সঙ্গে সাবধান হয়ে যাবে। তখন আর এঁটে ওঠা যাবে না। হাঙরের চলাফেরা জলের ওপর থেকে বোঝা যাবে না। ডুব দিয়ে দেখতে হবে। ফ্রান্সিস কোমর থেকে তরোয়ালটা খুলল। তারপর ডুব দিল। ঝাপসা দেখল–হাত দশেক দূরে হাঙরটা এক পাক ঘুরেই সোজা ওর দিকে ছুটে আসছে! ফ্রান্সিস তরোয়ালের হাতলটা শক্ত করে ধরল। হাঙরটা কাছাকাছি আসতেই ফ্রান্সিস দু’পায়ে জলে ধাক্কা দিয়ে আরো নিচে ডুব দিল। হাঙরটা তখন ওর মাথার ওপর চলে এসেছে। ফ্রান্সিস শরীরের সমস্তশক্তি দিয়ে বিদ্যুৎগতিতে তরোয়ালটা হাঙরের বুকে বসিয়ে দিল। হাঙরটা শরীর এঁকিয়ে-বেঁকিয়ে ল্যাজ ঝাঁপটাতে লাগল। ফ্রান্সিস তরোয়াল ছাড়ল না। এখন ঐ তরোয়ালটাই একমাত্র ভরসা। এটাকে কিছুতেই হারানো চলবে না। ফ্রান্সিস তলোয়ালের হাতলটা ধরে জলের ওপরে মুখ তুলল। তখনও হাঁপাচ্ছে। কিন্তু হাঙরটা যেভাবে শরীর মোচড়াচ্ছে–তাতে তরোয়ালটা ধরে রাখাই কষ্টকর।

ফ্রান্সিস আবার ডুব দিল। হাঙরটার পেটে একটা পা চেপে প্রাণপণ শক্তিতে তরোয়ালটা টানল। তরোয়ালটা উঠে এল। সঙ্গে সঙ্গে গাঢ় লাল রক্তে জলটা লাল হয়ে যেতে লাগল। হাঙরটা মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল। ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি তরোয়ালটা কোমরে গুঁজে পাগলের মত সাঁতার কাটতে লাগল। এই সাংঘাতিক জায়গাটা এখুনিই ছেড়ে যেতে হবে। রক্তের গন্ধ পেলে আরো হাঙর এসে জুটবে তখন?

ফ্রান্সিস আর ভাবতে পারল না। সাঁতারের গতি আরো বাড়িয়ে দিল।

কতক্ষণ এভাবে সাঁতার কেটেছে তা সে নিজেই জানে না, কিন্তু শরীর আর চলছে না চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসতে চাইছে। ঠিক তখনই ফ্রান্সিস অস্পষ্ট দেখতে পেল বাতাসে ফুলে ওঠা পাল। জাহাজ! ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি জল থেকে মুখ তুলে দু’চোখ কচলে তাকাল। হ্যাঁ–জাহাজই। খুব বেশি দূরে নয়। আনন্দে ফ্রান্সিস চিৎকার করে উঠতে গেল। কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরুচ্ছে না। সে তাড়াতাড়ি গায়ের ঢোলাহাতা জামাটা তরোয়ালের ডগায় আটকে জলের ওপর নাড়তে লাগল। একটুক্ষণ নাড়ে। তারপর তরোয়ালটা নামিয়ে দম নেয়। আবার নাড়ে। জাহাজের লোকগুলো বোধহয় ওকে দেখতে পেয়েছে। জাহাজটা ওর দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।

ঝপাং–জাহাজ থেকে দড়ি ফেলার শব্দ হল। ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি দড়ির ফাঁসটা কোমরে বেঁধে নিল। তারপর দু’হাত দিয়ে ঝোলান দড়িটা ধরল। কপিকলে কাঁচকাঁচ শব্দ উঠল। নাবিকেরা ওকে টেনে তুলতে লাগল। ফ্রান্সিস দেখল–জাহাজের রেলিঙে অনেক মানুষের উৎসুক মুখ। নিচে জলের মধ্যে ল্যাজ ঝাঁপটানোর শব্দে ফ্রান্সিস নিচের দিকে তাকাল। মাত্র হাত সাতেক নিচে জলের মধ্যে হাঙরের পাল অস্থিরভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফ্রান্সিস শিউরে উঠে চোখ বন্ধ করল।

জাহাজটা ছিল মালবাহী জাহাজ। নাবিকেরা বেশিরভাগই আফ্রিকার অধিবাসী। কালো-, কালো পাথরের কুঁদে তোলা শরীর যেন। ইউরোপীয় সাদা চামড়ার মানুষ যে ক’জন ছিল, ফ্রান্সিস তাদের মধ্যে নিজের দেশের লোক কাউকে দেখতে পেল না।

ফ্রান্সিসের বিছানার চারপাশে নাবিকদের ভিড় জমে গেল। সবাই জানতে চায় ওর কি হয়েছিল, কোথা থেকে আসছিল, যাবেই বা কোথায়? কিন্তু ফ্রান্সিস তাকিয়ে-তাকিয়ে ওদের দেখছিল শুধু। কথা বলার শক্তি ওর অবশিষ্ট নেই। শুধু ইশারায় জানাল–ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে। কয়েকজন নাবিক ছুটল খাবার আনতে।

রুটি আর মুরগীর মাংস পেট পুরে খেল ফ্রান্সিস। ওর যখন খাওয়া শেষ হয়েছে তখনই ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল জাহাজের ক্যাপটেন। গোলগাল মুখ, পাকানো গোঁফ, ছুঁচালো দাড়ি। ক্যাটেনকে দেখে ভিড় অনেক পাতলা হয়ে গেল। যে যার কাজে চলে গেল। ক্যাপটেন ফ্রান্সিসের বিছানার পাশে বসল। জিজ্ঞেস করল–আপনার কি জাহাজডুবি হয়েছিল?

ফ্রান্সিস ঘাড় কাত করল। ক্যাপটেন বলল–কোথায় যাচ্ছিলেন?–যাবার কথা ছিল মিশরের দিকে। কিন্তু–ফ্রান্সিস দুর্বল কণ্ঠে বলল।

–ও, তা আর কেউ বেঁচে আছে?

–জানি না।

ক্যাপটেন উঠে দাঁড়াল–আপনাকে আর বিরক্ত করব না। আপনি বিশ্রাম করুন, দু’চার দিনের মধ্যেই সেরে উঠবেন।

–এই জাহাজ কোথায় যাচ্ছে?

–পর্তুগাল।

খুশীতে ফ্রান্সিসের মন নেচে উঠল। যাক, দেশের কাছাকাছিই যাবে। তারপর ওখান থেকে দেশে যাওয়ার একটা জাহাজ কি আর পাওয়া যাবে না?

তিন দিন ফ্রান্সিস বিছানা ছেড়ে উঠল না। চার দিনের দিন ডেক-এ উঠে এল। এদিক-ওদিক একটু পায়চারি করল। রেলিঙে ভর দিয়ে সীমাহীন সমুদ্রের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। দু’একজন নাবিক এগিয়ে এসে ওর শরীর ভালো আছে কিনা জানতে চাইলো! ফ্রান্সিস সকলকেই ধন্যবাদ দিল। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ওরা তাকে বাঁচিয়েছে। নানা কথাবার্তা হল ওদের সঙ্গে। কিন্তু ফ্রান্সিস সোনার ঘন্টার কথা, মরু-দস্যুদের কথা, সুলতানের দুর্গে বন্দী হয়ে থাকার কথা–এসব কিছু বললো না। কে জানে আবার কোন বিপদে পড়তে হয়।

কয়েকদিন বিশ্রাম নেবার পর ফ্রান্সিসের শুধু শুয়ে-শুয়ে থাকতে আর ভালো লাগল না। নাবিকের কাজ করবার অভিজ্ঞতা তো ওর ছিলই। একদিন ক্যাপটেনকে বলল সেকথা! ছুঁচালো দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে ক্যাপটেন বলল এখন তোমার শরীর ভালো সারেনি।

–আমি পারবো।

–বেশ হালকা ধরনের কাজ দিচ্ছি তোমাকে।

এ বন্দরে সে বন্দরে মাল খালাস করতে করতে প্রায় দুমাস পরে জাহাজটা পর্তুগালের বন্দরে পৌঁছল।

যাত্রা শেষ। বন্দরে জাহাজ পৌঁছতেই নাবিকেরা সব শহরে বেরুল আনন্দ হই-হুঁল্লা করতে। ফ্রান্সিস গেল অন্য জাহাজের খোঁজে। ওর দেশের দিকে কোন জাহাজ যাচ্ছে কিনা। ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। পেয়েও গেল একটা জাহাজ। ওদের দেশের রাজধানীতে যাচ্ছে। পরদিন ভোর রাত্রে ছাড়বে জাহাজটা। আগের জাহাজে কাজ করে ফ্রান্সিস যা জমিয়েছিল, সবটাই দিল এই জাহাজের ক্যাপটেনকে। ক্যাপটেন ওকে নিতে রাজী হল। জাহাজটা ছোট। মালবাহী জাহাজ। নাবিকের সংখ্যাও কম। অনেকের সঙ্গে আলাপ হল ফ্রান্সিসের। শুধু একজন বৃদ্ধ নাবিকের সঙ্গে ফ্রান্সিসের খুব ভাব হল। ডেক ধোয়া-মোছার সময় ফ্রান্সিস তাকে সাহায্য করত।

একদিন সন্ধ্যেবেলা সেই বৃদ্ধনাবিকটি ডেক-এর রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে চুরুট খাচ্ছিল। ফ্রান্সিস তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। লোকটা একবার ফ্রান্সিসকে দেখে নিয়ে আগের মতই আপন মনে চুরুট খেতে লাগল। ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল–আপনি কত জায়গায় ঘুরেছেন?

নাবিকটা শূন্যে আঙুলটা ঘুরিয়ে বলল–সমস্ত পৃথিবী।

–সোনার ঘন্টার গল্পটা জানেন?

নাবিকটি ফ্রান্সিসের দিকে ঘুরে তাকাল। এ রকম একটা প্রশ্ন সে বোধহয় আশা করেনি। মৃদুস্বরে জবাব দিল–জানি।

–আপনি বিশ্বাস করেন?

–করি।

–আমি সেই সোনার ঘন্টার খোঁজেই বেরিয়েছিলাম।

–কিছু হদিস পেলে?

–ঠিক বলতে পারছি না, তবে ভূমধ্যসাগরের একটা জায়গায় নাবিকটা ওকে ইঙ্গিতে থামিয়ে দিয়ে ম্লান হাসল কুয়াশা, ঝড় আর ডুবো পাহাড়–তাই কি না?

ফ্রান্সিস আশ্চর্য হয়ে গেল। বলল–তাহলে আপনি, —

–হ্যাঁ, ভাই–আমাদের জাহাজ প্রায় ডুবে যাচ্ছিল। তবে আমরা বহু কষ্টে পেছনে। হটে আসতে পেরেছিলাম। তাই জাহাজ ডুবির হাত থেকে বেঁচেছিলাম।

নাবিকটা একটু চুপ করে থেকে বলল–একটা কথা বলি শোন–চারদিকে দেখে নিয়ে ফিসফিস করে বলতে লাগল–তুমি বোধহয় গল্পের শেষটুক জান না।

–জানি বৈকি, ডাকাত পাদরিরা সবাই জাহাজডুবি হয়ে মরে গেল।

–না। নাবিকটি মাথা নাড়ল–একজন বেঁচেছিল। সে পরে নিজের জীবন বিপন্ন করে সোনার ঘন্টার দ্বীপে যাওয়ার একটা পথ আবিষ্কার করেছিল। আসার অন্য একটা পথও আবিষ্কার করেছিল।

–কেন, যাওয়া-আসার একটা পথ হতে বাধা কি?

–নিশ্চয়ই কোন বাধা ছিল। যাকগে যাওয়া আসার দুটো সমুদ্র পথের নকশা সে দুটো মোহরে খুঁদে রেখেছিল। সব সময় নাকি গলায় ঝুলিয়ে রাখত সেই মোহর দুটো, পাছে চুরি হয়ে যায়। হয়তো ডাকাত পাদরিটার ইচ্ছে ছিল দেশে ফিরে জাহাজ, লোকলস্কর নিয়ে যাবে। সোনার ঘন্টা থেকে সোনা কেটে-কেটে আনবে, কিন্তু–ডাকাত পাদরিটা মারা গেল।

তাই নাকি?

–হ্যাঁ, মরু-দস্যুদের হাতে সে প্রাণ হারাল।

ফ্রান্সিস চমকে উঠল। ফজল তো ঠিক এমনি একটা ঘটনাই ওকে বলেছিল। ফ্রান্সিস আগ্রহের সঙ্গে প্রশ্ন করল–আর সেই মোহর দুটো?

–মরু-দস্যুরা লুঠ করে নিয়েছিল। তারপর সেই মোহর দুটোর হদিস কেউ জানে না।

–আচ্ছা, মরু-দস্যুরা কি জানত, মোহর দুটোয় নকশা আঁকা আছে?

–ওরা তো অশিক্ষিত বর্বর, নকশা বোঝার ক্ষমতা ওদের কোথায়।

এমন সময় কয়েকজন নাবিক কথা বলতে বলতে ওদের দিকে এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস আর কোন প্রশ্ন করল না। তার কেবল মনে পড়তে লাগল সেই মোহর দুটোর কথা। আবছা একটা মাথায় ছাপ ছিল, আর কয়েকটা রেখার আঁকিবুকি।

ঘুম আসতে চায় না ফ্রান্সিসের। নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে!ইস-মোহর দুটো একবার ভালো করে দেখেও নি সে। এইবার মকবুলের মোহর চুরির রহস্য ফ্রান্সিসের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। মকবুল নিশ্চয়ই জানত মোহর দুটোর কথা। তাই ও সাঙ্গ গায়ে পড়ে আলাপ জমিয়ে ওকে এতিমখানায় নিয়ে গিয়েছিল। ফ্রান্সিসের মোহরটা চুরি করেছিল। কিন্তু আর একটা মোহর? সেটা হাতে না পেলে তো মকবুল পুরো পথের নকশা পাবে না। হঠাৎ ফ্রান্সিসের মনে পড়ল একটা ঘটনা। আশ্চর্য! সেদিন ঐ ঘটনার গুরুত্ব সে বুঝতে পারেনি। একদিন সকালে বাজারে যাওয়ার পথে দেখেছিল সেই জহুরির দোকানটার কাছে বহুলোকের ভিড়। দোকানটা কারা যেন ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আশেপাশের দোকানগুলোর কোন ক্ষতি হয়নি, অথচ ঐ দোকানটা ভেঙেচুরে একশেষ। ফ্রান্সিস শুনল–গত রাত্রে দোকানটায় ডাকাত পড়েছিল। আজকে ঐ ডাকাতির অর্থ পরিষ্কার হল। আসলে মকবুল তার সঙ্গীদের নিয়ে সেই দোকানটায় হানা দিয়েছিল। লক্ষ্য সেই মোহরটা চুরি করা। তাহলে মকবুলও সোনার ঘন্টার ধান্ধায় ঘুরছে। আশ্চর্য!

পাঁচদিন পরে জাহাজটা ভাইকিংদের দেশের রাজধানীতে এসে পৌঁছাল। ফ্রান্সিসের যেন তর সয় না। কতক্ষণে শহর-বন্দরে ভিড়বে। জাহাজটা ধীরে ধীরে এসে জেটিতে লাগল। জেটির গেট খুলে দিতেই ফ্রান্সিস এক ছুটে রাস্তায় এসে দাঁড়াল।

তখন সকাল হয়েছে। কুয়াশায় ঢেকে আছে শহরের বাড়িঘর, রাস্তাঘাট।

একটা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করল ফ্রান্সিস। টস্টন্টস্ট’ ঘোড়ার গাড়ি চলল পাথর বাঁধানো পথে শব্দ তুলে। ফ্রান্সিসের আবাল্য পরিচিত শহর। খুশিতে ফ্রান্সিস কি করবে বুঝে উঠতে পারল না। একবার এই জানালা দিয়ে তাকায়, আর একবার ঐ জানালা দিয়ে। কতদিন পরে দেশের লোকজন, পথঘাট দেখতে পেল! এক সময় বাড়ির সামনে এসে পড়ল।

বাড়ির গেট-এর লতাগাছটা দুদিকের দেয়ালে বেয়ে অনেকক্টা ছড়িয়ে পড়েছে। ফ্রান্সিস ওটাকে চারাগাছ দেখে গিয়েছিল। কত অজস্র ফুল ফুটেছে গাছটায়। গেট ঠেলে ঢুকল ফ্রান্সিস। প্রথমেই দেখল মা’কে। বাগানে ফুলগাছের তদারকি করছে। ফ্রান্সিস শব্দ না করে আস্তে আস্তে মা’র পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। সেই ছোটবেলা সে মাকে এমনি করেই চমকে দিত। ওদের বুড়ো মালিটা হঠাৎ মুখ তুলে ফ্রান্সিসকে দেখেই প্রথমে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। তারপর ফোকলামুখে একগাল হাসল। মা ওকে হাসতে দেখে ধমক লাগাল। তবু হাসছে দেখে মা পেছন ফিরে তাকাল। বয়সের রেখা পড়েছে মার মুখে। বড়শীর্ণ আর ক্লান্ত দেখাচ্ছে মাকে। ফ্রান্সিস আর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল। মার কান্না আর থামে না। ফ্রান্সিসের মাথায় হাত বুলোয় আর বিড়বিড় করে বলে পাগল, বদ্ধ পাগল ই-আমার কথা একবারও মনে হয় না তোর? হ্যাঁ পাগল কোথাকার—

ফ্রান্সিসের চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল। সে বহুকষ্টে নিজেকে সংযত করল। ওর চোখে জল দেখলে মাও অস্থির হয়ে পড়বে।

বাবা বাড়ি নেই। রাজপ্রাসাদে গেছেন সেই ভোরবেলা। কি সব জরুরী পরামর্শ আছে রাজার সঙ্গে। যাক–বাঁচা গেল। এখন খেয়ে-দেয়ে নিশ্চিন্তে একটা ঘুম দেবে।

কিন্তু ফ্রান্সিসের কপালে নিশ্চিন্ত ঘুম নেই। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। মা’র কণ্ঠস্বর শুনল–বেচারা ঘুমুচ্ছে–এখন আর তুলে–

–হুঁ। বাবার সেই গম্ভীর গলা শোনা গেল।

একটু পরে দরজা খুলে গেল। আস্তে আস্তে ফ্রান্সিসের বাবা এসে বিছানার পাশে দাঁড়ালেন। ভুরু কুঁচকে ফ্রান্সিসের দিকে। তাকিয়ে রইলেন স্থির দৃষ্টিতে। ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি বিছানার ওপরে উঠে বসল। বাবা কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই আমতা-আমতা করে বলতে লাগল—ম্‌-মানে ইয়ে হয়েছে—

–পুরো এক মাস এইখান থেকে কোথাও বেরোবে না।

–বেশ–ফ্রান্সিস আর কোন কথা বলার চেষ্টা করল না।

–পালিয়েছিলে কেন?

–বললে তো আর যেতে দিতে না।

–হুঁ!

–বিশ্বাস কর বাবা, সোনার ঘন্টা সত্যিই আছে।

–মুণ্ডু।

–আমি সোনার ঘন্টার বাজনার শব্দ শুনেছি।

–এখন ঘরে বসেই সোনার ঘন্টার বাজনা শোন।

–একটা জাহাজ পেলেই আমি—

–আবার! বাবা হেঁকে উঠলেন।

ফ্রান্সিস চুপ করে গেল। ফ্রান্সিসের বাবা দরজার দিকে পা বাড়ালেন। তারপর হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে ডাকলেন–এদিকে এসো।

ফ্রান্সিস ভয়ে-ভয়ে বিছানা থেকে নেমে বাবার কাছে গেল।

–কাছে এসো।

ফ্রান্সিস পায়ে-পায়ে এগোল। হঠাৎ বাবা তাকে দু’হাত দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলে। কয়েক মুহূর্ত। ফ্রান্সিস বুঝল বাবার শরীর আবেগে কেঁপে কেঁপে উঠছে। হঠাৎ ফ্রান্সিসকে ছেড়ে দিয়ে ওর বাবা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ফ্রান্সিস দেখল, বাবা হাতের উল্টেপিঠ দিয়ে চোখ মুছলেন।

বেশ কিছুদিন গেল। ফ্রান্সিস আবার সেই আগের মতই শক্তি ফিরে পেয়েছে–দৃপ্ত, সতেজ। কিন্তু মনে শান্তি নেই। এও তো আর এক রকমের বন্দী জীবন। ওর মত দুরন্ত ছেলের পক্ষে একটা ঘরে আটকা পড়ে থাকা অসম্ভব ব্যাপার। তবু বাবার অজান্তে মা ওকে বাগানে, যেতে দেয়, গেট-এ গিয়েও দাঁড়ায় কখনো কখনো। কিন্তু বাড়ীর বাইরে যাবার উপায় নেই। মার কড়া নজর। বন্ধু বান্ধবের দল বেঁধে আসে। ফ্রান্সিসের কথা যেন আর ফুরোতে চায় না। বন্ধুরা সব অবাক হয়ে ওর বিচিত্র অভিজ্ঞতার কাহিনী শোনে। ফ্রান্সিস বলে–ভাই তোমরা যদি আমার সঙ্গে যেতে রাজী হও, তাহলে সোনার ঘন্টা আমার হাতের মুঠোয়।

ওরা তো সবাই ভাইকিং। সাহসে, শক্তিতে ওরাও কিছু কম যায় না; ওরা হইচই করে ওঠে আমরা যাব। ফ্রান্সিস ঠোঁট আঙ্গুলে ঠেকিয়ে ওদের শান্ত হতে ইঙ্গিত করে। মা টের পেলে অনর্থ করবে।

ফ্রান্সিসের নিকট বন্ধু হ্যারি। কিন্তু সে চেঁচামেচিতে যোগ দেয় না। সে বরাবরই ঠাণ্ডা প্রকৃতির, কিন্তু খুবই বুদ্ধিমান। সে শুধু বলে আগে একটা জাহাজের বন্দোবস্ত করো–আমাদের নিজেদের জাহাজ–তারপর কার কত উৎসাহ দেখা যাবে।

আবার চেঁচামেচি শুরু হয়। মা ঘরে ঢোকে। বলল–কি ব্যাপার?

সবাই চুপ করে যায়। মা সবই আন্দাজ করতে পারে। তাই ফ্রান্সিসের ছোট ভাইটাকে পাঠিয়ে দেয়। সে এসে ওদের আড্ডায় বসে থাকে। ব্যাস আর কিছু বলবার নেই! ওরা যা বলবে ঠিক ফ্রান্সিসের মার কাছে পৌঁছে যাবে। সব মাটি তাহলে–

একা-একা ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে দিন কাটতে চায় না। সমুদ্রের উন্মত্ত গর্জন, উত্তাল ঢেউ তাকে প্রতিনিয়ত ডাকে! আবার কবে সমুদ্রে যাবে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে, ফ্রান্সিস শুধু ভাবে আর ভাবে। বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করবে তারও উপায় নেই। মার কড়া নজর। অগত্যা একটা উপায় বের করতে হল। রাত্রে মা একবার এসে দেখে যায়, ছেলে ঘুমোল কিনা। ফ্রান্সিস সেদিন ঘুমের ভান করে পড়ে রইল। মা নিশ্চিন্ত মনে ঘর থেকে চলে যেতেই ফ্রান্সিস জানলা খুলে মোটা লতাগাছটা বেয়ে নিচে বাগানে নেমে এল। তারপর দেয়াল ডিঙিয়ে রাস্তায়।

বন্ধুদের ডেকে পাঠাতে একটু সময় গেল। ততক্ষণ ফ্রান্সিস হ্যারিকে সঙ্গে নিয়ে একটা পোড়া বাড়িতে বন্ধুদের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। একজন-দুজন করে সবাই এল। সোনার ঘন্টা আনতে যাবে, এই উত্তেজনায় হইচই শুরু করে দিলে ফ্রান্সিস হাত তুলে সবাইকে থামতে বলল। গোলমাল একটু কমলে ফ্রান্সিস বলতে শুরু করল–ভাই সব, শুধু উৎসাহকে সম্বল করে কোন কাজ হয় না। ধৈর্য চাই, চিন্তা চাই। দীর্ঘদিন ধরে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হবে আমাদের। নিজেদের দাঁড় বাইতে হবে, পাল খাটাতে হবে, ডেক পরিষ্কার করতে হবে, আবার ঝড়ের সঙ্গে লড়তে হবে, ডুবো পাহাড়ের ধাক্কা সামলাতে হবে। কি, পারবে তোমরা?

–আমরা পারবো–সবাই সমস্বরে বলে উঠল।

–হয়তো আমরা পথ হারিয়ে ফেললাম, খাদ্য ফুরিয়ে গেল, জল ফুরিয়ে গেল–তখন কিন্তু অধৈর্য হবে না–নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করাও চলবে না। মাথা ঠাণ্ডা রেখে বুক দিয়ে সব কষ্ট সহ্য করতে হবে। কি পারবে?

–পারবো। আবার সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল সবাই।

কয়েক রাত এই রকম সভাও পরামর্শ হল। কিভাবে একটা জাহাজ জোগাড় করা যায়? ফ্রান্সিস দু’একবার বাবাকে বলবার চেষ্টা করেছে–যদি উনি রাজার কাছ থেকে একটা জাহাজ আদায় করে দেন। কিন্তু ফ্রান্সিসের বাবা ওকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছেন।

হ্যারিই প্রথমে বুদ্ধিটা দিল। হ্যারি কথা বলে কম, কিন্তু যথেষ্ট বুদ্ধিমান। সে বলল–। আমরা রাজার জাহাজ চুরি করব।

–জাহাজ চুরি? সবাই অবাক।

–হ্যাঁ, রাজা যখন চাইলে জাহাজ দেবেন না, তখন চুরি ছাড়া উপায় কি।

–কিন্তু–ফ্রান্সিস দ্বিধাগ্রস্ত হল।

–আমরা তো সমুদ্রে ভেসে পড়ব, রাজা আমাদের ধরতে পারলে তো! তাছাড়া–যদি সত্যিই সোনার ঘন্টা আনতে পারি–তখন–

–ঠিক–ফ্রান্সিস লাফিয়ে উঠল। সকলেই এই প্রস্তাবে সম্মত হল।

গভীর রাত্রি। বন্দরের এখানে-ওখানে মশাল জ্বলছে। মশালের আলো জলে কঁপছে। রাজার সৈন্যরা বন্দর পাহারা দিচ্ছে। অন্ধকারে নোঙর করা রয়েছে রাজার জাহাজগুলো।

প্রহরীদের চোখ এড়িয়ে ফ্রান্সিস আর তার পঁয়ত্রিশজন বন্ধু জাহাজগুলোর দিকে এগোতে লাগল। পাথরের ঢিবি, খড়ের গাদা, স্তূপীকৃত কাঠের বাক্সের আড়ালে-আড়ালে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চলল ওরা। হাতের কাছে সব চাইতে বড় যে জাহাজটা, সেটাতেই নিঃশব্দে উঠতে লাগল সবাই। যে সব প্রহরীরা পাহারা দিচ্ছিল, তারা এতগলো লোককে হঠাৎ যেন। মাটি খুঁড়ে জাহাজে উঠতে দেখে অবাক হয়ে গেল। ওরা খাপ থেকে তরোয়াল খোলবার। আগেই ফ্রান্সিসের বন্ধুরা একে একে সবাইকে কাবু করে ফেলল। তারপর জাহাজ থেকে ছুঁড়ে জলে ফেলে দিল। জাহাজটা কূল ছেড়ে সমুদ্রের দিকে ভেসে চলল।

এদিকে হয়েছে কি, সেই জাহাজে রাজার নৌবাহিনীর সেনাপতি একটা গোপন ষড়যন্ত্র চালাচ্ছিল রাজার বিরুদ্ধে। সেনাপতিই ছিল সেই ষড়যন্ত্রের নেতা। যাতে আরো সৈন্য তারদলে এসে যোগ দেয়, গোপন সভার সেটাই ছিল উদ্দেশ্য। তারা আলোচনায় এত তন্ময় হয়ে গিয়েছিল যে, তারা জানতেও পারল না কখন জাহাজটা চুরি গেছে, আর জাহাজ মাঝ সমুদ্রের দিকে এগিয়ে চলেছে। হঠাৎ জাহাজটা দুলে-দুলে উঠতে লাগল। সেনাপতি আর তার দলের লোকেরা তো অবাক। জাহাজ মাঝ সমুদ্রে এল কি করে? ওরা সিঁড়ি বেয়ে ডেক-এ উঠে এল কি ব্যাপার দেখতে। ওরা উঠে আসছে বুঝতে পেরে ফ্রান্সিসের বন্ধুরা সব লুকিয়ে পড়ল। সেনাপতি তার দলবল নিয়ে ডেক-এ এসে দাঁড়াতেই সবাই লুকোনো জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে ওদের ঘিরে দাঁড়ালো। সেনাপতি খুব বুদ্ধিমান। বুঝল, এখন ওদের সঙ্গে লড়তে গেলে বিপদ বাড়বে বই কমবে না। লোকদের ইঙ্গিতে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে? বলল।

ফ্রান্সিস এগিয়ে এসে বলল–সেনাপতি মশাই, আপনাকেও আমরা সঙ্গে পাব, এটা ভাবতেই পারিনি। যাকগে, মিছিমিছি তরোয়াল খুলবে না, দেখতেই পাচ্ছেন আমরা দলে ভারি। এবার আপনাদের তরোয়ালগুলো দিয়ে দিন।

সেনাপতি নিঃশব্দে নিজের তরোয়াল সুদ্ধ বেল্টটা ডেক-এর ওপর রেখে দিল। সেনাপতির বেল্টটা ডেক-এর ওপর রেখে দিল। দেখাদেখি তার দলের সৈন্যরাও তরোয়াল খুলে ডেক-এর ওপর রাখল। ফ্রান্সিসের দলের একজন তরোয়ালগুলো নিয়ে চলে গেল। সেনাপতি গম্ভীর মুখে বলল–তোমরা রাজার জাহাজ চুরি করেছ–এজন্যে তোমাদের শাস্তি পেতে হবে।

–সে আমরা বুঝবো–ফ্রান্সিস বলল।

–কিন্তু তোমরা জাহাজ নিয়ে কোথায় যাচ্ছো?

–সোনার ঘন্টা আনতে—

সেনাপতি মুখ বেঁকিয়ে হাসল–ওটা একটা ছেলে ভোলানো গল্প।

–দেখাই যাক না। ফ্রান্সিস হাসল।

ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশ। পালগুলো ফুলে উঠেছে হাওয়ার তোড়ে। শান্ত সমুদ্রের বুক চিরে জাহাজ চলতে লাগল দ্রুতগতিতে। ফ্রান্সিসের বন্ধুরা খুব খুশী। দাঁড় টানতে হচ্ছে না। সমুদ্রও শান্ত। খুব সুলক্ষণ। নির্বিঘ্নেই ওঁরা গন্তব্যস্থানে পৌঁছে যাবে।

ফ্রান্সিস কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারে না। তার মনে শান্তি নেই। সারাদিন যায় জাহাজের কাজকর্ম তদারকি করতে। তারপর রাত্রে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, ফ্রান্সিস তখন একা-একা ডেক-এর ওপর পায়চারী করে। কখনও বা রেলিং ধরে দূর অন্ধকার দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকে। একমাত্র চিন্তা–কবে এই যাত্রা শেষ হবে–দ্বীপে গিয়ে পৌঁছবে। মাঝে-মাঝে হ্যারি বিছানা থেকে উঠে আসে। ওর পাশে এসে দাঁড়ায়। বলে এবার শুয়ে পড়গে যাও।

–হ্যারি–ফ্রান্সিস শান্তস্বরে বলে–তুমি তো জানো সোনার ঘন্টা আমার সমস্ত জীবনের স্বপ্ন। যতদিন না সেটার হদিস পাচ্ছি, ততদিন আমি শান্তিতে ঘুমুতে পারব না।

তবু শরীরটাকে তো বিশ্রাম দেবে! হ্যারি বলে।

-হ্যাঁ, বিশ্রাম। ফ্রান্সিস হাসল–চল। কতদিন হয়ে গেল। জাহাজ চলেছে তো চলেছেই। এরমধ্যে তিনবার ফ্রান্সিসদের জাহাজ ঝড়ের মুখে পড়েছিল। প্রথম দু’বারের ঝড় ওদের তেমন ক্ষতি করতে পারেনি। কিন্তু শেষ ঝড়টা এসেছিল হঠাৎ। পাল নামাতে নামাতে দুটো পাল ফেঁসে গিয়েছিল। পালের দড়ি ছিঁড়ে গিয়েছিল। সে সব মেরামত করতে হয়েছে। কিন্তু সেলাই করা পালে তো ভরসা করা যায় না। জোর হাওয়ার মুখে আবার ফেঁসে যেতে পারে।

জাহাজতখন ভূমধ্যসাগরে পড়েছে। কোন বন্দরে জাহাজ থামিয়ে পালটা পালটে নিতে হবে। কিন্তু ফ্রান্সিসের এই প্রস্তাবে সকলে সম্মত হল না। কেউ আর দেরি করতে চায় না। কতদিন হয়ে গেল দেশ বাড়ি ছেড়ে এসেছে। ফেরার জন্যে সকলেই উদগ্রীব। কিন্তু ফ্রান্সিস দৃঢ় প্রতিজ্ঞ–পালটা পালটাতেই হবে। যে প্রচণ্ড ঝড়ের মুখে তাদের পড়তে হবে, সে সম্বন্ধে কারো কোন ধারণাই নেই। শুধু ফ্রান্সিসই জানে তার ভয়াবহতা। সেই মাথার ওপর উন্মত্ত ঝড় আর নীচে ডুবো পাহাড়ের বিশ্বাসঘাতকতা। সে সব সামলানো সহজ ব্যাপার নয়। প্রায় সকলেরই ধারণা হল, ফ্রান্সিস বিপদটাকে বাড়িয়ে দেখছে। এই নিয়ে ফ্রান্সিসের সঙ্গীদের মধ্যে গুঞ্জনও চলল।

সেনাপতি আর তার সঙ্গীরা এতদিন চুপ করেসব দেখছিল। ফ্রান্সিসের বিরুদ্ধে তার সঙ্গীদের খেপিয়ে দেবার সুযোগ খুঁজছিল। এবার সুযোগ পাওয়া গেল! এরমধ্যে ফ্রান্সিসের একটা হুকুমও ভালো মনে নিল না। ফ্রান্সিসেরই তিনজন সঙ্গী দেশে ফিরে যাবার জন্যে বারবার ফ্রান্সিসকে করছিল। কিন্তু ফ্রান্সিস অটল। অসম্ভব ফিরে যাওয়া চলবে না। সে সোজা বলল–ওসব ভাবনা মন থেকে তাড়াও। কাজ শেষ না করে কেউ ফেরার কথা মুখেও এনো না। কিন্তু ওরাও নাছোড়বান্দা। ওদের প্যানপ্যানিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল ফ্রান্সিস। তাই যে ছোট্ট বন্দরটায় পালটা পাবার জন্যে জাহাজটা থামল, ফ্রান্সিস ওদের সেখানে জোর করে নামিয়ে দিল। অন্য জাহাজে করে ওরা যেন দেশে ফিরে যায়। এমনিতেই ফ্রান্সিসের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ধুমায়িত হয়ে উঠেছিল। এই ঘটনাটা তাতে আরো একটু ইন্ধন জোগাল। সেই ছোট্ট বন্দরে পালটা বদলে, জাহাজের টুকিটাকি মেরামত সেরে নিয়ে তাদের যাত্রা আবার শুরু হল।

দিন যায়, রাত যায়। কিন্তু কোথায় সেই দ্বীপ? কোথায় সেই সোনার ঘন্টা? সকলেই হতাশায় ভেঙে পড়তে লাগল। এ কোথায় চলেছি আমরা? গল্পের সোনার ঘন্টার অস্তিত্ব আছে কি? না কি সবটাই ফ্রান্সিসের উদ্ভট কল্পনা? সেনাপতি আর তার দলের লোকেরা এতদিনে সুযোগ পেল। তারা গোপনে সবাইকে বোঝাতে লাগল–ফ্রান্সিস উন্মাদ। একটা ছেলে ভুলানো গল্পকে সত্যি ভেবে নিয়েছে। আর দিন নেই, রাত নেই সেই কথা ভাবতে-ভাবতে ও উন্মাদ হয়ে গেছে। কিন্তু ও পাগল বলে আমরা তো পাগল হতে পারি না? দীর্ঘদিন আমরা দেশ ছেড়েছি। কোথায় চলেছি, তার ঠিকানা নেই। কবে দেশে ফিরব, অথবা কেউ ফিরতে পারবে কি না, তাও জানি না। একটা কাল্পনিক জিনিসের জন্যে আমরা এভাবে আমাদের জীবন বিপন্ন করতে যাব কেন?

কিন্তু উপায় কি? সবাই মুষড়ে পড়ল। সেনাপতিও ধীরে-ধীরে ফ্রান্সিসের বন্ধুদের মন তার বিরুদ্ধে বিষিয়ে তুলতে লাগল।

এর মধ্যে আর এক বিপদ। জাহাজে খাদ্যাভাব দেখা দিল। মজুত জলে তখনও টান পড়েনি। কিন্তু কম খেয়ে আর কতদিন চলে? খাদ্য যা আছে, তাতে আর কিছুদিন মাত্র চলবে। তারপর? সেনাপতি বুদ্ধি দিল সবাইকে এখনও সময় আছে। চল আমরা ফিরে যাই। এই সবকিছুর মূলে হচ্ছে ফ্রান্সিস। তার নেতৃত্ব অস্বীকার করো। বেশী বাড়াবাড়ি করলে ওকে জলে ফেলে দাও। তারপর জাহাজ ঘোরাও দেশের দিকে।

কথা সকলেরই মনে ধরল। শুধু হ্যারি সবকিছু আঁচ করে বিপদ গুনলো।

ফ্রান্সিস কিন্তু এসব ব্যাপার কিছুই আঁচ করতে পারেনি। ওর তো একটাই চিন্তা যে করেই হোক সেই দ্বীপে পৌঁছতে হবে। আজকাল ওর বন্ধুরা কেমন যেন এড়িয়ে-এড়িয়ে চলে। ওর দিকে সন্দিগ্ধ চোখে তাকায়। একমাত্র হ্যারিই আগের মত ফ্রান্সিসের সঙ্গে সঙ্গে থাকে। তবে তার প্রশ্নেও সংশয়ের আভাস ফুটে ওঠে।

গভীর রাত্রিতে ডেক-এ দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল দু’জনে। হ্যারি জিজ্ঞাসা করল–ফ্রান্সিস তুমি কি সত্যিই বিশ্বাস কর, সোনার ঘন্টা বলে কিছু আছে?

–তোমার মনে সন্দেহ জাগছে? ফ্রান্সিস একটু হাসে।

–সে কথা নয়। এতগুলো লোক একমাত্র তোমার ওপর ভরসা করেই যাচ্ছে।

–হ্যারি আমি জাহাজ ছাড়ার সময়ই বলেছিলাম–যারা আমার সঙ্গে যাচ্ছে, সকলের জীবনের দায়িত্ব আমার। কাউকে বিপদের মুখ থেকে বাঁচাতে গিয়ে আমাকে যদি প্রাণ দিতে হয়, তাই আমি দেব।

–তোমাকে আমি ভালো করেই জানি ফ্রান্সিস–কথার খেলাপ তুমি করবে না! কিন্তু হাজার হোক মানুষের মন তো–

-–আমি বুঝি হ্যারি! দীর্ঘদিন আমরা দেশ ছেড়ে এসেছি–আত্মীয়স্বজন, বাড়ী ঘরের জন্যে মন খারাপ করবে, এ তো স্বাভাবিক। কিন্তু বড় কাজ করতে গেলে সব সময় পিছুটান। অস্বীকার করতে হয়। নইলে আমরা এগোতেই পারব না।

-–আচ্ছা ফ্রান্সিস, তুমি আমাদের যা-যা বলেছ, সে সব তোমার কল্পনা নয় তো?

ফ্রান্সিস কিছু বলল না। কাঁধের কাছে জামাটা একটানে খুলে ফেলল। ও তরোয়ালের কোপের সেই গভীর ক্ষতটা দেখিয়ে বলল–এটা কি কল্পনা হ্যারি?

হ্যারি চুপ করে গেল। বলতে সাহস করল না যে, ওর বন্ধুরা সবাই ওকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে। ফ্রান্সিস কথাটা শুনলে হয়তো ক্ষেপে গিয়ে আর এক কাণ্ড বাধিয়ে বসবে।

ফ্রান্সিসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চূড়ান্ত রূপ নিল একদিন। সেদিন সকাল থেকেই সেনাপতি আর তার দলের লোকেরা গোপনে ফ্রান্সিসের কয়েকজন বন্ধুকে বলল–জানো আমরা পথ হারিয়েছি। ফ্রান্সিস নিজেই জানে না, জাহাজ এখন কোনদিকে, কোথায় চলেছে।

এমনিতেই সকলের মনে অসন্তোষ জমেছিল। এই মিথ্যা রটনা যেন শুকনো বারুদের স্তূপে আগুন দিল। মুহূর্তে খবরটা সকলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল! সেনাপতির নেতৃত্বে গোপন সভা বসল। সবাই একমত হলো সেনাপতিই হবে জাহাজের ক্যাপটেন। ফ্রান্সিসের হুকুম আর চলবে না। হ্যারিও সভার ব্যাপারটা আঁচ করে সেখানে গিয়ে হাজির হল। সে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে উঠল। কিন্তু পারল না। তার আগেই কয়েকজন মিলে তাকে ধরে ফেলল। একটা ঘরে কয়েদী করে রেখে দিল। ফ্রান্সিস যাতে আগে থাকতে ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতে না পারে, তার জন্যে সবাই সাবধান হল।

তখন গভীর রাত। ফ্রান্সিস এক-একা ডেকে পায়চারী করছে! পরিষ্কার আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। জ্যোত্সার ছড়াছড়ি। ফ্রান্সিসের কিন্তু কোনদিকে চোখ নেই। ভুরু কুঁচকে তাকাচ্ছে জ্যোৎস্নধোয়া দিগন্তের দিকে।

হঠাৎ পেছনে একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনে ফ্রান্সিস ঘুরে দাঁড়াল। ও ভেবেছিল হ্যারি এসেছে বোধহয়। কিন্তু না। হ্যারি নয়–সেনাপতি। পেছনে তার দলের কয়েকজন। ফ্রান্সিসের আশ্চর্য হওয়ার তখনও বাকি ছিল। নীচ থেকে সিঁড়ি বেয়ে ফ্রান্সিসের সবাই দল বেঁধে উঠে আসছে ডেক-এ। ব্যাপারটা কি?

সেনাপতি এগিয়ে এসে ডাকল–ফ্রান্সিস?

–হুঁ।

–আমরা কেন উঠে এসেছিল বুঝতে পেরেছ?

–না।

–তোমাকে একটা কথা জানাতে।

–কি কথা?

–এই জাহাজ তোমার হুকুমে আর চলবে না।

–কেন?

–তোমাকে কেউ আর বিশ্বাস করে না।

–তাহলে কাকে বিশ্বাস করে?

-–আমাকে। এই জাহাজের দায়িত্ব এখন আমার।

ফ্রান্সিসের কাছে এবার সমস্ত ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। এই ষড়যন্ত্রের মূলে সেনাপতি আর তার সঙ্গীরা। তারাই ওর বন্ধুদের মন বিষিয়ে তুলেছে। ফ্রান্সিস এবার সকলের দিকে তাকাল। চীৎকার করে বলল–ভাইসব, আমাকে বিশ্বাস করো না তোমরা?

কেউ কোন কথা বলল না। ফ্রান্সিস সকলের মুখের দিকে তাকাতে লাগল। কেউ-কেউ মুখ ফেরাল। কেউ-কেউ মাথা নিচু করল। আশ্চর্য! হ্যারি কোথায়?

ফ্রান্সিস বুঝল, তাহলে ব্যাপার অনেক দূর গড়িয়েছে।

ফ্রান্সিস কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। গভীর দুঃখে তার বুক ভেঙে যেতে লাগল। একটা স্বপ্নকে কেন্দ্র করে এত কষ্ট, এত পরিশ্রম, সব ব্যর্থ হয়ে গেল। স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। ফ্রান্সিস অশ্রু রুদ্ধস্বরে বলতে লাগল, ভাইসব, অতি নগণ্য সংখ্যক হলেও পৃথিবীর এমন কিছু মানুষ আছে, ঘরের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য যাদের ঘরে আটকে রাখতে পারে না। বাইরের পৃথিবীতে জীবনমৃত্যুর যে খেলা চলছে–নিজের জীবন বিপন্ন করেও সেই খেলায় মাতে সে। এর মধ্যেই সে বেঁচে থাকার আনন্দ খুঁজে পায়। আমিও তেমনি একজন মানুষ ফ্রান্সিস একটু থামল। তারপর বলতে লাগল, তোমাদের কারো মনে হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে, সোনার ঘন্টা খুঁজে বের করার পেছনে আমার উদ্দেশ্য কি? উত্তর খুবই সহজ আমি বড়লোক হতে চাই? কিন্তু তোমরা আমার বন্ধু। ভালো করেই জানো আমাদের পরিবার যথেষ্ট বিত্তশালী। তবে কেন এত আগ্রহ? কেন এই অভিযান? ভাইসব, উদ্দেশ্য আমার একটাই। ছেলেবেলা থেকে যে গল্প শুনে আসছি, কত রাতের স্বপ্নে দেখেছি যে সোনার ঘন্টা সেটা খুঁজে বের করব। তারপর দেশে নিয়ে যাব। আমাদের রাজাকে উপহার দেব। ব্যস–আমার কাজ শেষ। এর জন্যে যে কোন দুঃখকষ্ট, বিপদ-বিপর্যয় এমনকি মৃত্যুর। মুখোমুখি হতেও আমি দ্বিধাবোধ করব না।

ফ্রান্সিস একটু থেমে আবার বলতে লাগল–তোমরা সেনাপতিকে ক্যাপটেন বলে মেনে নিয়েছো। ভালো কথা। জাহাজের মুখ ঘোরাও দেশের দিকে। ফিরে গিয়ে ঘরে সুখস্বাচ্ছন্দ্যের জীবন কাটাগে। কিন্তু আমি ফিরে যাব না। ফেরার পথে প্রথমে যে বলটা পাব, আমি সেখানেই নেমে যাব। জাহাজ জোগাড় করে আবার আসবো। আমাকে যদি সারাজীবন ধরে সোনার ঘন্টার জন্যে আসতে হয়, আমি আসব।

ফ্রান্সিস থামল। কেউ কোন কথা বলল না। হঠাৎ সেনাপতি চেঁচিয়ে বলল–এসব বাজে কথা শোনার সময় নেই আমার। জাহাজের মুখ ঘোরাও।

ভীড়ের মধ্যে চাঞ্চল্য জাগল। দেশে ফিরে যাবে, এই আনন্দে সবাই চীৎকার করে উঠল। কিন্তু কেউ লক্ষ্য করেনি, চাঁদের আলো ম্লান হয়ে গেছে। ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘের মত কুয়াশা ভেসে বেড়াচ্ছে চারিদিকে! বাতাস থেমে গেছে। জাহাজের গতিও কমে এসেছে। ভাড়ের মধ্যে কে একজন বলল–এত কুয়াশা এল কোত্থেকে?

কথাটা কারো কারোকানে গেল। তারা কুয়াশা দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আশ্চর্য! এত কুয়াশা? এই অসময়ে? গুঞ্জন উঠল ওদের মধ্যে। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কুয়াশার সেই আস্তরণের দিকে।

ফ্রান্সিস রেলিঙে ভর দিয়ে হাতে মাথা রেখে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। সেও লক্ষ্য করেনি? চারিদিকের পরিবেশ এই পালটে যাওয়ার ঘটনাটা। হঠাৎ ওর কানে গেল সকলের ভীত গুঞ্জন। ফ্রান্সিস মুখ তুলল। এ কি! চাঁদের আলো ঢাকা পড়ে গেছে। অন্ধকার হয়ে গেছে। চারদিক। কুয়াশার ঘন আস্তরণ ঢেকে আস্তরণ ঢেকে দিয়ে সমুদ্র আকাশ।

ফ্রান্সিস চীৎকার করে বলে উঠল–‘এক মুহূর্ত নষ্ট করবার মত সময় নেই। দাঁড়ে হাত লাগাও। সামনেই প্রচণ্ড ঝড় আর ডুবো পাহাড়ের বাধা। সবাই তৈরী হও।

কিন্তু সেই ভীড়ে কোন চাঞ্চল্য জাগল না। সবাই স্থানুর মত দাঁড়িয়ে রইল। কি করছে কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।

হঠাৎ সেনাপতি চীৎকার করে বলে উঠল–সব ধাপ্পাবাজি।

ফ্রান্সিস সেনাপতির দিকে একবার তাকাল। তারপর দুহাত তুলে ভাঙা-ভাঙা গলায় বলল–আমাকে বিশ্বাস কর। আমার বন্ধুত্বের মর্যাদা দাও। সবাই তৈরি হও দেরি করো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমরা সোনার ঘন্টার বাজনার শব্দ শুনতে পাবে।

–পাগলের প্রলাপ–সেনাপতি গলা চড়িয়ে বলল।

এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করো না। ফ্রান্সিস তবু বলে যেতে লাগল পাল নামাও, দাঁড়ে হাত লাগাও!

ফ্রান্সিস আর বলতে পারল না। পিঠে কে যেন তরোয়ালের ডগাটা চেপে ধরেছে। ফ্রান্সিস ঘুরে দাঁড়াতে গেল। পারলো না। সঙ্গে সঙ্গে তরোয়ালের চাপ বেড়ে গেল। শুনল সেনাপতি দাঁত চাপা স্বরে বলছে–আর একটা কথা বলেছো তো, জন্মের মত তোমার কথা বলা থামিয়ে দেব।

সেনাপতির কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের প্রচণ্ড ধাক্কায় সমস্ত জাহাজটা ভীষণভাবে কেঁপে উঠল। উত্তাল ঢেউ জাহাজের রেলিঙের ওপর দিয়ে ছুটে এসে ডেকে আছড়ে পড়ল। সেনাপতি কোথায় ছিটকে পড়ল। অন্য সকলেও এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ল। শুরু হল জাহাজের প্রচণ্ড দুলুনি। ডেকে দাঁড়ায় তখন কারসাধ্য। ঠিক তখনই ঝড়ের শব্দ ছাপিয়ে বেজে উঠল সোনার ঘন্টার গম্ভীর শব্দ–ঢং–ঢং–ঢং।

ডেকে এখানে-ওখানে তালগোল পাকিয়ে পড়ে থাকা মানুষগুলো উৎকর্ণ হয়ে শুনল সেই ঘন্টার শব্দ। এই ঘন্টা যেন মন্ত্রের মত কাজ করল। সোনার ঘন্টা–এত কাছে। জাতে ভাইকিং ওরা। সমুদ্রের সঙ্গে ওদের নিবিড় সম্পর্ক। ঝড় প্রচণ্ড সন্দেহ নেই। সমুদ্রও উন্মত্ত। কিন্তু ওরাও জানে কীভাবে ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করতে হয়। ওরা আর কারো নির্দেশের অপেক্ষা করল না। একদল গেল দাঁড় বাইতে, আর একদল গেল মাস্তুলের দিকে পাল নামাতে।

মাস্তুলের মাথায় উঠে দেখতে হবে ঘন্টার শব্দটা কোন দিক থেকে আসছে। ফ্রান্সিস জাহাজের ভীষণ দুলুনি উপেক্ষা করে মাস্তুল বেয়ে উঠতে লাগল। একেবারে মাথায় উঠে প্রাণপণ শক্তিতে মাস্তুলটা আঁকড়ে ধরে রইল। তারপর যেদিক থেকে ঘন্টার শব্দ আসছে, সেইদিকে তাকাল। ঝড়-বৃষ্টির আবছা আবরণের মধ্যে দিয়ে দেখল, দুটো পাহাড়ের মত পাথুরে দ্বীপ। মাঝখানে সমুদ্রের জল বিস্তৃত। আশ্চর্য! সেখানে সমুদ্র শান্ত। সেই সমুদ্রের মধ্যে দূরে একটা নিঃসঙ্গী পাহাড়ের মত দ্বীপ। পাথুরে দ্বীপ নয়। সবুজ ঘাস আছে দ্বীপটার গায়ে। তার মাথায় একটা সাদা রং-এর মন্দির মত। শব্দটা আসছে সেই দিক থেকেই। ফ্রান্সিস আর কিছুই দেখতে পেল না। ঝড়ের ধাক্কায় জাহাজটা কাত হয়ে গেল। মাস্তুল থেকে প্রায় ছিটকে পড়ার মত অবস্থা। ও তাড়াতাড়ি মাস্তুল বেয়ে নীচে নামতে লাগল। ডেকে পা দেবার আগেই দুটো পাল খাটাবার কাঠ সশব্দে ভেঙে পড়ল। ডেকে কয়েকজন চীৎকার করে উঠল। কি হল, তা আর তাকিয়ে দেখবার অবকাশ নেই।

ফ্রান্সিস ডেকে নেমেই ছুটল সিঁড়ির দিকে। নীচে নেমে চলে এল দাঁড় টানার লম্বা ঘরটায়। সারি সারি বেঞ্চিগুলোর দিকে তাকাল। দেখলো, সবাই প্রাণপণে দাঁড় টানছে। জাহাজের দুলুনিতে ভালোভাবে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। ফ্রান্সিস সেই দুলুনির মধ্যে কোনরকমে দাঁড়িয়ে চীৎকার করতে লাগল–ভাইসব, সামনেই ডুবো পাহাড়। আমরা আর সামনের দিকে যাব না। জাহাজ পিছিয়ে আনতে হবে। ডুবো পাহাড়ের ধাক্কা এড়াতে হবে। তারপর ঝড়ের ঝাঁপটায় জাহাজ যে দিকে যায় যাক।

সবাই দাঁড় বাওয়া বন্ধ করে ফ্রান্সিসের কথা শুনল। নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। ফ্রান্সিস যে সত্য কথাই বলেছে, এ বিষয়ে কারও মনে আর সন্দেহ রইল না। এবার সবাই উল্টেদিকে দাঁড় বাইতে লাগল। জাহাজ পিছিয়ে আসতে লাগল। ঝড়ের কয়েকটা প্রচণ্ড ধাক্কায় অনেকটা পিছিয়ে এল। কিন্তু ডুবো পাহাড়ের ধাক্কা এড়াতে পারলোনা। খুব জোরে ধাক্কা লাগল না তাই রক্ষে। পেছনের হালটা মড়মড় করে ভেঙে গেল। সেই সঙ্গে পেছনের রেলিঙের কাছে অনেকটা জায়গা ভেঙে খোঁদল হয়ে গেল। তবু খোদলটা খুব উঁচুতে হল বলে বেশী জল ঢুকতে পারলো না। জাহাজ ডোবার ভয়ও রইল না। তারপরঝড়-বিক্ষুব্ধ সমুদ্রে কলার মোচার মত নাচতে নাচতে জাহাজ কোনদিকে যে চললো, তা কেউ বুঝতে পারল না।

ফ্রান্সিস ততক্ষণে জাহাজের খোলের ঘরগুলো খুঁজতে আরম্ভ করেছে। এ ঘরের দরজায় ও ঘরের কাঠের দেওয়ালে ধাক্কা খেতে-খেতেও হ্যারিকে খুঁজতে লাগল। একটা বন্ধ ঘরের দরজায় ফ্রান্সিস জোরে ধাক্কা দিয়ে ডাকল–হ্যারি!

ভেতর থেকে হারির উচ্চকণ্ঠ শোনা গেল–কে? ফ্রান্সিস!

ফ্রান্সিস আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করল না। সমস্ত শক্তি দিয়ে দরজায় লাথি মারতে লাগল। কিন্তু দরজা ভাঙল না। মরচে ধরা কড়াটা একটু আলগা হল। তলাটা ঠিকই ঝুলতে লাগল। এদিক-ওদিক তাকাতে-তাকাতে একটা হাতলভাঙা হাতুড়ি নজরে পড়ল। সেটা এনে মরচে ধরা কড়াটায় দমাদ্দম ঠুকতে লাগল। কয়েকটা ঘা পড়তেই কড়াটা দুমড়ে ভেঙে গেল। খোলা দরজা দিয়ে হ্যারি কোনরকমে ছুটে এসে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল।

ফ্রান্সিস দ্রুত বলল এখন কথা বলার সময় নেই, ডেকে চলো। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ফ্রান্সিস বুঝলো জাহাজটা আর তেমন দুলছে না। ডেকে উঠে দেখলো, জল-ঝড় তেমন নেই আর। তবে সমুদ্রে আকাশে এখনও পাতলা কুয়াশার আস্তরণ রয়েছে। হাওয়ায় কুয়াশা উড়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব পরিস্কার হয়ে যাবে। হলোও তাই। কুয়াশা উড়ে গেল। আকাশে দিগন্তের দিকে হেলে পড়া পাণ্ডুর চাঁদটা দেখা গেল। রাত শেষ হয়ে আসছে।

ফ্রান্সিস ডাকল–হ্যারি!

হ্যারি এগিয়ে আসতে ফ্রান্সিস বললো–চলো, হালের অবস্থাটা একবার দেখে আসি।

দেখা গেল, হালটা একেবারেই ভেঙে গেছে। তার সঙ্গে জাহাজের অনেকটা জায়গা, ভেঙে হাঁ হয়ে গেছে। সব দেখে-শুনে ফ্রান্সিস বললো–বেহাল জাহাজ, কোথায় যেন চলেছে তা ঈশ্বরই জানে।

–সে সব কাল ভাবা যাবে। এখন ঘুমিয়ে নেবে চল। হ্যারি তাগাদা দিলো।

–হ্যাঁ চল। খুব পরিশ্রান্ত আমি। পা টলছে, দাঁড়াতে পারছি না। পরদিন ঘুম ভেঙে যেতেই ফ্রান্সিস ধড়মড় করে উঠল। সকাল হয়ে গেছে। সবাই অঘোরে ঘুমুচ্ছে। গত রাত্রির কথা মনে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ডেকের দিকে ছুটল। ডেকে দাঁড়িয়ে দেখলো, আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। মেঘের চিহ্নমাত্র নেই। সমুদ্রও শান্ত। সাদা রংয়ের সামুদ্রিক পাখিগুলো উড়ছে। তীক্ষ্মস্বরে ডাকছে। কিন্তু এ কোথায় এলাম? একটা ধুধুমরুভূমির মত জায়গায় জাহাজ কাত হয়ে বালিতে আটকে আছে। এখন আর ভাববার সময় নেই। সবাইকে ডেকে তুলতে হবে। জাহাজ মেরামত করতে হবে। তারপর সেই দ্বীপের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে।

ফ্রান্সিস সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এল। কাউকে ধাক্কা দিয়ে, কাউকে আস্তে পেটে ঘুষি মেরে, কারো পিঠে চাপড় দিয়ে সে গলা চড়িয়ে বলল–ওঠ সব, ডেক-এ চল।

সবাই একে-একে উঠে পড়ল। উপরে ডেকে এসে দাঁড়াল। ডাঙার ধু-ধু বালির দিকে তাকিয়ে বোধহয় ভাবতে লাগল–কোথায় এসে ঠেকলাম? ওদের মধ্যে গুঞ্জন উঠল–সবাই কথা বলতে লাগল। সবার মুখে একই প্রশ্ন–কোথায় এলাম?

ফ্রান্সিস ডেকে এসে দাঁড়াল! সবাইকে লক্ষ্য করে বলতে লাগল, ভাইসব, জাহাজ কোথায় এসে ঠেকেছে, আমরা কেউই বলতে পারব না। ওসব ভাবনা পরে ভাবা যাবে।

এখন নষ্ট করার মত সময় আমাদের হাতে নেই। একদল চলে যাও রসুই ঘরে রান্নার বন্দোবস্ত করো। আর সবাই জাহাজ মেরামতির কাজে হাত লাগাও।

ফ্রান্সিস সেনাপতি আরতার দলের লোকেদের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল–আপনাদেরও হাত লাগাতে হবে।

সেনাপতি আর তার সঙ্গীরা মুখ গোমড়া করে সকলের সঙ্গে চলল। ফ্রান্সিস আবার তার বন্ধুদের বিশ্বাস ফিরে পেয়েছে, এটা সেনাপতির দলের কাছে ভাল লাগল না। ওরা ধান্ধায় রইল, কি করে ফ্রান্সিসকে অপদস্থ করা যায়।

জাহাজ থেকে কাঠের তক্তা নামানো হল। হালের জায়গাটায় যেখানে খোঁদল হয়ে গেছে, সেই জায়গাটা জোড়া দেবার কাজ চলল! নির্জন সমুদ্রতীর মুখর হয়ে উঠল ওদের হাঁকডাক কথাবার্তায়।

পূর্ণোদ্যমে কাজ চলছে। হঠাৎ কে যেন বলে উঠল–ওটা কি? তার কণ্ঠে বিস্ময়। তার কথা যাদের কানে গেল, তারা ঘুরে লোকটার দিকে তাকাল। কি ব্যাপার? লোকটা আঙুল তুলে সেই মরুভূমির মত ধু-ধু বালির দিগন্ত দেখাল। সত্যিই তো। দিগন্ত রেখার একটু উঁচুতে কি যেন চিকচিক করছে, একটা, দুটো, তিনটে, অনেকগুলো। চিকচিক করছে যে জিনিসগুলো, সেগুলো চলন্ত। এদিকেই লোকটা আঙ্গুল তুলে সেই মরুভূমির মত। এগিয়ে আসছে। এতক্ষণে সবাই সেদিকে তাকাল। ধু-ধু বালির দিগন্ত দেখাল। সকলের চোখেমুখেই বিস্ময়। ওগুলো কি?

সবাই ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি জাহাজ থেকে ঝোলানো দড়ি বেয়ে জাহাজে উঠেপড়ল। রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে দিগন্ত রেখার দিকেভুরু কুঁচকেতাকিয়ে খুব নিবিষ্টমনে দেখতে লাগল। একটু পরে নিচের দিকে তাকিয়ে সবাইকে লক্ষ্য করে বলতে লাগল–একদল সৈন্য আসছে কালো ঘোড়ায় চেপে। ওদের পরনেও কালো পোশাক। ওদের গলায় লকেটের মত কিছু ঝুলছে। লকেটে সূর্যের আলো পড়েছে, তাই চিকচিক করছে। নিচে দাঁড়িয়ে থাকা আর সবাইও এতক্ষণে দেখতে পেল, একদল অশ্বারোহী ঘোড়া ছুটিয়ে বালির ঝড় তুলে ওদের দিকেই ছুটে আসছে।

ফ্রান্সিস দড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল। এখন কি করা? সকলেই ফ্রান্সিসের দিকে উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে রইল। ফ্রান্সিস মাথা নীচু করে গম্ভীরভাবে চিন্তা করল। তারপর মুখে তুলে চীৎকার করে বললো–ওরা লড়তে চাইলে আমরাও লড়ব।

সবাই সমস্বরে হইহই করে উঠল। চীৎকার করে উঠল–ও-হো-হো। এবার অস্ত্র সংগ্রহ। সেনাপতি আর তার দলের লোকদের তরবারিগুলো জাহাজ থেকে আনা হল। তাছাড়া যাদের তরবারি ছিল, তারাও সেগুলো নিয়ে এলো। ফ্রান্সিস সেনাপতি আর দলের লোকদের তরবারিগুলো বেছে বেছে কয়েকজনের হাতে দিলো। বাদ-বাকিরা হাতের কাছে যে-যা পেল জোগাড় করে নিয়ে এল। ভাঙা দাঁড়, লোহার শেকল, কুড়ুল, লোহার বড়-বড় পেরেক, কাঠের খুঁটি–এসব যে যা পেল, হাতে নিয়ে সারি বেঁধে দাঁড়াল।

সৈন্যদল ঝড়ের গতিতে এগিয়ে আসতে লাগল। ফ্রান্সিস হিসেব করে দেখল সৈন্যরা সংখ্যায় ওদের চেয়ে বেশি নয়। সমানই হবে। ফ্রান্সিস চেঁচিয়ে বলল–সবাই তৈরি থাকো, কিন্তু আমি না বলা পর্যন্ত কেউ এগিয়ে যাবে না। ওরা ঘোড়ায় যুদ্ধ করবে, ওদেরই সুবিধে বেশি। আমাদের প্রথম কাজই হবে, যেভাবে হোক ওদের মাটিতে ফেলে দেওয়া। তাহলেই জিত আমাদের।

সৈন্যদল অনেক কাছে এসে পড়েছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ওদের।

কালো পোশাক পরনে। গলায় ঝুলছে চকচকে লকেট। আরো কাছে! ফ্রান্সিস ওদের ঘোড়া ছোটানোর ভঙ্গি দেখেই বুঝল, ওরা বন্ধুত্ব করতে আসছে না। ওদের লক্ষ্য যুদ্ধ। হঠাৎ ফ্রান্সিসের উচ্চ কণ্ঠস্বর শোনা গেল–এগোও–আক্রমণ করো–

প্রচণ্ড কোলাহল উঠল ভাইকিংদের মধ্যে। চীৎকার করতে-করতে সবাই ছুটল সৈন্যদলের দিকে।

প্রথম সৃংঘর্ষেই বেশ কিছু সৈন্য ঘোড়া থেকে বালির ওপর পড়ে গেল। ভাইকিংদের মধ্যেও আহত হ’ল কয়েকজন। ভাইকিং অশ্বারোহী সৈন্যদের পায়ে তরোয়াল বিঁধিয়ে দিতে লাগল। ভাঙা দাঁড়, পেরেক, কুড়ুল দিয়ে ওদের পেছনে আঘাত করতে লাগল। আরও কিছু সৈন্য বালির ওপর পড়ে গেল। এবার শুরু হলো হাতাহাতি যুদ্ধ। ফ্রান্সিসের বাছাই করা দল নিপুণ হাতে তরোয়াল চালাতে লাগল। সৈন্যরা কিছুতেই ওদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারল না। একে-একে সৈন্যরা প্রায় সবাই মারা গেল, নয়তো মারাত্মক ভাবে আহত হয়ে বালির ওপর শুয়ে-শুয়ে গোঙাতে লাগল। জনা দশেক যারা বেঁচেছিল, ঘোড়ার পিঠে উঠে তারা পালাতে শুরু করল। ভাইকিংরা হইচই করে তাদের তাড়া করলো। অশ্বারোহী সৈন্যরা দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে পালিয়ে গেল। ভাইকিংদের মধ্যে খুশির বন্যা বয়ে গেল। সবাই আনন্দে চীৎকার করতে লাগল–কেউ নাচতে লাগল, কেউ হেঁড়ে গলায় গান ধরল। যুদ্ধে জয়ের উত্তেজনা স্তিমিত হতে সবাই আবার জাহাজ মেরামতির কাজে হাত লাগাল। আবার কাজ চালালো।

হঠাৎ চিকচিক্–বালির দিগন্ত রেখায় আবার লকেটের ঝিকিমিকি। ফ্রান্সিস হাতুড়ি দিয়ে পেরেক ঠুকছিল। হ্যারি পেরেক এগিয়ে দিচ্ছিল। হঠাৎ হ্যারি ডাকল–ফ্রান্সিস।

–কি?

–ওদিকে চেয়ে দেখ।

ফ্রান্সিস ফিরে তাকাল। দেখলো, দিগন্তরেখার একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত অজস্র লকেটের ঝিকিমিকি। এতক্ষণে সবাই দেখল। কাজ ফেলে দিয়ে ফ্রান্সিসের কাছে এসে ভিড় করে দাঁড়াল। সবাই উত্তেজিত–লড়াই হবে। একটু আগেই একটা লড়াইতে জিতেছে। সেই জয়ের উন্মাদনা এখনও কাটেনি। ফ্রান্সিস কিছুক্ষণ দিগন্তের দিকে তাকিয়ে রইল। বালির ঝড় তুলে এগিয়ে আসছে কালো পোশাক পরা সৈন্যবাহিনী। সূর্যের আলোয় চিকচিক করছে লকেটগুলো। উত্তেজিত ভাইকিংদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হল। কারও উচ্চ কণ্ঠস্বর শোনা গেল–লড়বো আমরা, পরোয়া কিসের? সবাই চীৎকার করে উঠল–ও-হো-হো।

ফ্রান্সিস কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। গভীরভাবে কি যেন ভাবল। তারপর মুখ তুলে সকলের দিকে তাকাল। গুঞ্জন থেমে গেল। সবাই উৎসুক হলো–ফ্রান্সিস কি বলে?

ফ্রান্সিস হাত থেকেহাতুড়িটা বালির ওপর ফেলে দিল। বলল না, আমরা লড়াই করবনা।

ফ্রান্সিসের এই সিদ্ধান্ত অনেকেরই মনঃপুত হল না। আবার গুঞ্জন শুরু হল। সেনাপতি তার দলের লোকদের নিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে শলাপরামর্শ করছিল। এবার সুযোগ বুঝে এগিয়ে এল। সেনাপতি বলল–ফ্রান্সিস, তুমি ভীরু কাপুরুষ, ভাইকিংদের কলঙ্ক। ভিড়ের মধ্যে কেউ-কেউ চীৎকার করে সেনাপতিকে সমর্থন করল। ফ্রান্সিস শান্তস্বরে বলল আমাকে যা খুশি বলতে পারেন, কিন্তু এতগুলো মানুষের প্রাণ নিয়ে আমি ছিনিমিনি খেলতে পারব না।

–লড়তে গেলে প্রাণ নিতেও হবে, দিতেও হবে। তাই বলে কাপুরুষের মত আগে থাকতে হার স্বীকার করে বসে থাকবো? সেনাপতি ক্রুদ্ধস্বরে বলল।

ফ্রান্সিস আঙ্গুল দিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে আসতে থাকা সৈন্যবাহিনীকে দেখাল–বলল আন্দাজ করতে পারেন ওরা সংখ্যায় কত?

–যতই হোক আমরা লড়ব।

–সাধ করে নিশ্চিত মৃত্যুকে ডেকে আনছেন।

–তুমি ভীরু দুর্বল।

–বেশ আমার বন্ধুরা কি বলে শোনা যাক।

ফ্রান্সিস ভাইকিংদের ভিড়ের দিকে তাকিয়ে বলল–ভাইসব, আমি কাপুরুষ নই। তোমরা যদি লড়তে চাও, আমিও তোমাদের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করব। কিন্তু তোমরা একটু ভেবে দেখ যদি ওরা আমাদের বন্দী করেও নিয়ে যায়, তবু সময় আর সুযোগ বুঝে আমরা পালাতে পারব। কিন্তু একবার এই লড়াইয়ে নামলে আর পালাবার কোন প্রশ্নই ওঠে না। কারণ এই লড়াইতে আমরা কেউ বাঁচবো না।

সবাই ফ্রান্সিসের কথা মন দিয়ে শুনল। ফ্রান্সিস বলতে লাগল–তোমরা হয়তো ভাবতে পারো লড়াই না করে তার স্বীকার করা কাপুরুষের কাজ। আমি বলল–না! শুধু কবজির জোরে লড়াই হয় না, সঙ্গে বুদ্ধির জোরও চাই। আজকে আমরা লড়ব না, কিন্তু পরে লড়তে আমাদের হবেই, শত্রুর দুর্বলতার মুহূর্তে। একেই বলে বুদ্ধির লড়াই।

সবাই চুপ করে রইল। শুধু সেনাপতি গজরাতে লাগল–আমরা ভাইকিং, এভাবে হার স্বীকার করা আমাদের পক্ষে লজ্জার কথা। কিন্তু কেউ তাকে সমর্থন করল না। সেনাপতির দলের লোকেরা গণ্ডগোল পাকাবার চেষ্টা করলো, কিন্তু সুবিধে করতে না পেরে তারা চুপ করে গেল।

সেই কালো পোশাক পরা সৈন্যদল কাছাকাছি এসে ঘোড়ার চলার গতি কমিয়ে দিল। সারবন্দী হয়ে ওরা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগল। ওদের সেই সারি থেকে দুজনকে সকলের আগে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। ফ্রান্সিস চমকে উঠল–একি! সুলতান আর রহমান। তাহলে জাহাজ ডুবি হয়েও যে ভাসতে ভাসতে যেখানে এসেছিলে, এবার জাহাজটাও সেইখানে এসেই ঠেকেছে।

সুলতান এবং ফ্রান্সিস দুজনেই দুজনকে দেখতে পেলেন। ফ্রান্সিসের সামনে ঘোড়া থামিয়ে সুলতান ক্রুর হাসি হাসলেন–এই যে, পুরোনো বন্ধু দেখছি।

ফ্রান্সিস কোন কথা বলল না। সুলতান বললেন—হ্যাঁ ভালো কথা, দুর্গের সেই জানালাটায় গরাদ লাগানো হয়েছে।

ফ্রান্সিস চুপ করে রইল। সুলতান তরোয়াল খুলে সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে হুকুম দিলেন–সব কটাকে বেঁধে নিয়ে চলো।

সৈন্যদল থেকে কিছু সৈন্য ঘোড়া থেকে নেমে এল। সবাইকে সারি বেঁধে দাঁড় করাল। জাহাজে যারা রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত ছিল, তাদেরও এনে সারিতে দাঁড় করানো হল। সকলের বাঁধা হাতের ফাঁক দিয়ে একটা লোহার শেকল টেনে নেওয়া হল। শেকলটার দুই মাথা দুজন অশ্বারোহী সৈন্যের হাতে রইল। পেছনে চাবুক হাতে একজন অশ্বারোহী সৈন্য চলল। বন্দীরা বালির উপর দিয়ে হেঁটে চলল। কেউ দল থেকে একটু পেছলেই চাবুকের ঘা পড়তে লাগল।

পায়ের নীচে বালি তেঁতে উঠেছে। গরম হাওয়া ছুটছে। এর মধ্য দিয়ে বন্দীরা চলল। কেউ-কেউ ভাবল, এই অপমানের চেয়ে লড়াই করা অনেক ভাল ছিল। কিন্তু এখন আর সেই সুযোগ নেই। এখন ওরা বন্দী। বন্দীদের নিয়ে সুলতান যখন আমদাদ শহরে এসে পৌঁছলেন, তখন সূর্য পশ্চিমদিকে হেলে পড়েছে।

আমদাদ শহরের রাস্তার দুপাশে ভিড় জমে গেল। সবাই অবাক হয়ে ভাইকিং বন্দীদের দেখতে লাগল। মরুভূমির ওপর দিয়ে এতটা পথ ওরা হেঁটে এসেছে। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে গেছে। পা দুটো যেন পাথরের মত ভারী। শরীর টলছে। অথচ দাঁড়াবার উপায় নেই, বসবার উপায় নেই। অমনি সপাং করে চাবুকের ঘা এসে পড়ছে।

দলের মধ্যে শুধু ফ্রান্সিসই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখনও। একবারও পিছিয়ে পড়েনি। ওর মুখে ক্লান্তির কোন ছাপ নেই। কারণ বাইরের কোন কিছুই তাকে ছুঁতে পারছে না। ওর মাথায় শুধু চিন্তা আর চিন্তা কি করে পালানো যাবে। এতগুলো মানুষের জীবনের দায়িত্ব তার ওপর, সে নিশ্চিন্ত থাকে কি করে?

সুলতানের প্রাসাদে যখন ওরা পৌঁছল, তখন সন্ধ্যে হয়-হয়। প্রাসাদের সামনের চত্বরে, একপাশে ঘোড়াশালের কাছে বন্দীদের বসতে বলা হল। সুলতান প্রাসাদের মধ্যে চলে গেলেন। রহমান কয়েকজন সৈন্যকে ডেকে পাঠাল। চত্বরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তারা কি সব পরামর্শ করতে লাগল। ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় ফ্রান্সিসের দলের সবাই কাতর হয়ে পড়ল। বিশেষ করে হ্যারি এমনিতে অসুস্থ ছিল, এখন প্রায় অজ্ঞানের মত হয়ে গেল।

যে সৈন্য ক’জন ওদের পাহারা দিচ্ছিল, ফ্রান্সিস তাদের একজনকে কাছে ডাকল। সৈন্যটি কাছে এলে ফ্রান্সিস রহমানকে দেখিয়ে বলল–ওকে ডেকে দাও। পাহারাদার ফ্রান্সিসের কথা যেন শুনতে পায়নি, এমনি ভঙ্গিতে খোলা তরোয়াল হাতে যেমন হেঁটে বেড়াচ্ছিল, তেমনি হেঁটে বেড়াতে লাগল। ফ্রান্সিস চীৎকার করে বলে উঠল–পেয়েছ কি আমাদের? আমরা জন্তু-জানোয়ার? এতদূর পথ চাবুক খেতে-খেতে হেঁটে এসেছি। আমাদের খিদে পায় না, তেষ্টা পায় না?

ফ্রান্সিসের কথা শেষ হওয়া মাত্র তার দলের লোকেরা হইহই করে উঠে দাঁড়াল। পাহারাদার। সৈন্যটা বেশ ঘাবড়ে গেল। কি করবে বুঝে উঠতে পারল না।

এখানকার চীৎকার হইচই রহমানের কানে গেল। সে তাড়াতাড়ি ছুটে এলো। সব শুনে সে তখনি একজন সৈন্যকে সুলতানের কাছে পাঠাল। তারপর ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বললো সবই বুঝতে পারছি, কিন্তু সুলতানের হুকুম না হলে কিছুই দেবার উপায় নেই।

–তাহলে ক্ষুধায় তেষ্টায় আমরা মারা যাই, এই চান আপনারা?

–সুলতান যদি তাই চান, তবে তাই হবে।

ফ্রান্সিসের দলের লোকেদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য জাগল। শেকলে ঝনঝন শব্দ উঠল। কিন্তু কিছুই করবার নেই। তাদের হাত বাঁধা। শেকলের দুটো মুখ দেয়ালে গাথা। সেই সৈন্যটা ফিরে এল। সুলতান বোধহয় অনুমতি দিয়েছে। রহমান জল আর খাবার আনতে হুকুম দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার এল। পিঁপে ভর্তি জল এল।

খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই শুয়ে পড়ল। চোখ জড়িয়ে এল ঘুমে। শুধু কয়েকজন মিস্ত্রীর হাতুড়ি পেটানোর শব্দে মাঝে-মাঝে ওদের ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল। মিস্ত্রীরা মোটা মোটা কাঠ পুঁতে কাটা তার দিয়ে ঘিরে দিলো জায়গাটা। এটাই হল ভাইকিংদের বন্দীশালা। বন্দীশালা তৈরী হলে সকলের হাত খুলে দেওয়া হল। বাইরে খিলানওয়ালা দরজার পাশেও মিস্ত্রীরা কাজ করছিল। ফ্রান্সিসের দলের লোকেরা কেউ জানতে পারেনি যে, ওখানে মিস্ত্রীরা একটা ফাঁসিকাঠ তৈরী করছিলো।

রাত্রি গভীর হলো। চারদিক নিস্তব্ধ। শুধু মিস্ত্রীদের হাতুড়ি ঠোকার শব্দ সেই নৈঃশব্দ ভেঙে দিচ্ছিল। ফ্রান্সিসের চোখে ঘুম নেই। দু’হাতে মাথা রেখে সে ওপরের দিকে তাকিয়ে ছিল। ওর চিন্তার যেন শেষ নেই। হঠাৎ একজন পাহারাদার কাঁটাতারের দরজার কাছে মুখ এনে জিজ্ঞেস করল–ফ্রান্সিস কে?

কেউ কোন উত্তর না দিতে লোকটা আবার বললো–ফ্রান্সিস কে?

প্রশ্নটা কয়েকজনের কানে যেতে তারা বললো–ফ্রান্সিসকে কেন?

–সুলতান ডেকেছেন।

এইসব কথাবার্তা কানে যেতে ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। সে যাবার জন্যে পা বাড়াল। কিন্তু যাদের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, তারা ফের চেঁচিয়ে বলল না ফ্রান্সিস যাবে না। সুলতানকে হয় এখানে আসতে বল।

চিৎকার আর কথাবার্তায় অনেকেরই ঘুম ভেঙে গেল। তারা সবাই একসঙ্গে রুখে দাঁড়িয়ে বললো–না, ফ্রান্সিস একা যাবে না।

এবার কাঁটাতারের দরজার কাছে রহমানের মুখ দেখা গেল। সে হেসে বলল–আমি ফ্রান্সিসকে নিয়ে যাচ্ছি। তোমাদের ভয় নেই, ওর কোন ক্ষতি হবে না।

ফ্রান্সিস হাত তুলে সবাইকে শান্ত করল। পাহারাদার। কাঁটাতারের দরজার তালা খুলে দিল। ফ্রান্সিস বাইরে এসে, রহমানের সামনে এসে বললো–চলুন।

রহমান ওকে সঙ্গে নিয়ে চলল। প্রাসাদে ঢোকার আগে রহমান একবার দাঁড়াল। ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল–সুলতান তোমায় ডাকেননি।

–তবে?

–সুলতানের বেগম তোমাকে ডেকেছেন।

–সুলতানের বেগম তোমাকে ডেকেছেন।

ফ্রান্সিস আশ্চর্য হল। বেগমের উদ্দেশ্য কি? কিন্তু–ফ্রান্সিস বলল–আমার মত একজন বিদেশীকে–

–বেগমের সঙ্গে কথা হোক, তাহলেই জানতে পারবে।

সুসজ্জিত ঘরের পর ঘর পেরিয়ে অন্দরমহলে এল ওরা। অন্দরমহলের জৌলুসে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। মেঝের দেয়ালে জাফরী কাটা জানালায় কি সুন্দর কারুকাজ! একসময়ে সিঁড়ি বেয়ে ওরা একটা পুকুরের সামনে এসে দাঁড়াল। পুকুরের চারিদিক শ্বেত পাথরে বাঁধানো। কাঁচের মত শান্ত জল টলটল করছে। পুকুরের ওপাশে বাগানে ফুলের গন্ধে বাতাস ভরে গেছে। বাগানের কাছে একটা দোলনা রূপোর শেকলে বাঁধা। দোলনায় কে যেন বসে আছে। রহমান ফিস ফিস করে বলল–বেগমসাহেবা দোলনায় বসে আছেন।

–একা?

–হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে এই সাক্ষাৎটা খুবই গোপনীয়।

বেগম সাহেবার কাছে গিয়ে রহমান আদাব করে সরে এল। ফ্রান্সিসও রহমানের দেখাদেখি আদাব করল। এখানে মশালের ক্ষীণ আলো এসে পৌঁছেছে, তাতে স্পষ্ট বেগমসাহেবার মুখ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু তবু ফ্রান্সিস বুঝল, বেগমসাহেবা অপরূপা সুন্দরী। ভুরু দুটো যেন তুলিতে আঁকা। টানা লাল ঠোঁটের পাশে একটা তিল। মশালের আলোয় ঝিকিয়ে উঠেছে বেগমের পোশাকের সোনার কারুকাজ করা নকশাগুলো।

-–তুমিই ফ্রান্সিস? সুরেলা গলায় বেগমসাহেবা প্রশ্ন করলেন।

–হ্যাঁ, –ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল।

–তুমি জানো সোনার ঘন্টা কোথায় আছে?

–না।

–কিন্তু সুলতান বলেন, তুমি নাকি সব জানো।

–আমি যা জানি সুলতানকে বলেছি।

–সেই মোহর দু’টোর কথাও বলেছো?

–কোন মোহর?–ফ্রান্সিস আশ্চর্য হল।

–তোমার কাছে যে দুটো মোহর ছিল।

–তার একটা বিক্রি করে দিয়েছি, আর একটা চুরি হয়ে গেছে।

–তুমি জানো, এ দুটো মোহরের একটাতে সেই সোনার ঘন্টার দ্বীপে যাওয়ার, অন্যটাতে ফিরে আসার নকশা খোদাই করা ছিল।

–না, আমি জানতাম না।

–তুমি মিথ্যে কথা বলছে। মোহর দুটো তোমার কাছেই আছে।

ফ্রান্সিসের বেশ রাগ হলো। সে গম্ভীর স্বরে বলল–আমি মিথ্যে কথা বলছি না, বেগম সাহেবা।

–তোমার মৃত্যু তুমি নিজেই ডেকে আনছে।

–তার মানে?

–দেউড়ির খিলানে এতক্ষণে ফাঁসিকাঠ তৈরি হয়ে গেছে।

ফ্রান্সিস চমকে উঠল–তাহলে আমাকে–

-হ্যাঁ, তোমাকে কাল সকালে ফাঁসি দেওয়া হবে।

ফ্রান্সিস কোন কথা বলতে পারল না। একবার মনে হলো, বেগমের কাছে সে প্রাণ ভিক্ষা করে। পরক্ষণেই মনে হল, না আমরা ভাইকিং। আমাদের মৃত্যু ভয় থাকতে নেই।

–আমার বন্ধুদের কী হবে?

–তারা বন্দী থাকবে।

ফ্রান্সিসের মন শান্ত হল। যাক, আমার বন্ধুরা তো বেঁচে থাকবে। বেগম সাহেবা কি যেন ইঙ্গিত করলেন। রহমান এগিয়ে এসে আদাব করল। মৃদুস্বরে ফ্রান্সিসকে বলল–চল।

এদিকে ফ্রান্সিসকে নিয়ে রহমান চলে আসার পর ফ্রান্সিসের বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে শলা পরামর্শ করতে লাগল। পরামর্শমত সবাই যে যার জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। একটু পরেই হঠাৎ একজন উঠে পরিত্রাহি চীৎকার শুরু করল। যেন সেই চীৎকার শুনেই উঠে পড়েছে, এমনি ভঙ্গি করে বেশ কয়েকজন ওর দিকে ছুটে এল। লোকটা তখন পেটে হাত দিয়ে গোঙাতে লাগল, আর মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগল। একজন পাহারাদার ওদের চীৎকার চ্যাঁচামেচি শুনে কাঁটাতারের দরজা দিয়ে মুখ বাড়ালো কি হয়েছে?

–দেখছো না, পেটের ব্যথায় কাতরাচ্ছে।

–ও কিছু হয়নি।

–বেশ, তুমি নিজেই দেখে যাও।

–হুঁ। পাহারাদারটা ঘুরে দাঁড়ালো।

তখন সবাই মিলে ওকে চটাতে লাগল–ব্যাটা সবজান্তা, তালপাতার সেপাই।

পাহারাদারটা ভীষণ চটে গেল। হেঁকে উঠল–এ্যাই!

কে মুখ ভেংচে ওর হাঁকের নকল মুখে করে বলে উঠল–এ্যাই!

আর যায় কোথায়! পাহারাদারটা তালা খুলে ভেতরে ছুটে এল। কিন্তু খাপ থেকে তরোয়াল খোলবার আগেই পাঁচ-ছয়জন একসঙ্গে ওর ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বেচারা টু শব্দটিও করতে পারল না। মাটিতে ফেলে কয়েকজন চেপে ধরল। বাদবাকিরা পাহারাদারের কোমর বন্ধনীর কাপড়টা খুলে ফেলল তারপর ঐ কাপড় দিয়ে মুখ বেঁধে কোণায় ফেলে রাখলো।

এবার খোলা দরজা দিয়ে একজন বেরিয়ে বাইরের অবস্থাটা দেখতে গেল। দেখলো, ওদের যে আর একজন পাহারা দিচ্ছিল সে দেউড়ির কাছে অন্য পাহারাদারদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। প্রাসাদের সম্মুখে দুজন পাহারাদার শুধু টহল দিচ্ছে। দেউড়ি দিয়ে পালানো যাবে না। ওখানে পাহারাদার সৈন্যদের সংখ্যা বেশি। একমাত্র পথ প্রাচীর ডিঙিয়ে প্রাসাদের ভেতরে ঢুকে যদি অন্য কোন দিক দিয়ে পালানো যায়। শেষ পর্যন্ত তাই স্থির হল। পা টিপে টিপে সবাই বেরিয়ে এল। অসুস্থ হ্যারিকেও ওরা ধরাধরি করে সঙ্গে নিয়ে চলল। আস্তে আস্তে নিঃশব্দে ওরা প্রাচীর টপকাল। প্রাচীরের ওপাশেই দেখা গেল, একটা ছোট্ট বাগান মত। ফোয়ারাও আছে, তাতে। তারপরেই একটা দরজা। দরজাটা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। কয়েকটা ঘর পেরোতেই দেখা গেল লম্বামত একটা ঘর। টানা টেবিলের মত দেয়ালে কাঠের তক্তা লাগানো। কতরকম খাবার ঢাকা দেওয়া রয়েছে। কোর্মা, কোপ্তা, শিক কাবাবের গন্ধে ঘরটা ম-ম করছে। এতক্ষণে বোঝা গেল, ওরা রসুই ঘরে ঢুকে পড়েছে। পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল ওরা। তারপরেই পাগলের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল। খাবারের ওপর। দুহাত ভরে যে যতটা পারল নিয়ে খেতে আরম্ভ করল। কামড়ে কামড়ে মাংস খেতে লাগল। এক সঙ্গে এত লোক, তার ওপর খাওয়ার আনন্দ। অল্প সল্প শব্দ হতে হতে একেবারে হইচই শুরু হয়ে গেল। ওরা বোধহয় ভুলেই গেল, যে ওদের পালাতে হবে। খাবারের ঘরের দরজা দিয়ে তরোয়াল হাতে সৈন্যদল ঢুকতে লাগল। সৈন্যরা ঘিরে ফেলে ওদের পিঠে তরোয়ালের খোঁচা দিয়ে কুম করল–চলো।

এতক্ষণে এরা সম্বিত ফিরে পেল। কিন্তু এখন আর কিছু করবার নেই। আবার সেই ফিরে আসতে হল কাটার তার ঘেরা বন্দীশালায়।

ফ্রান্সিস ফিরে এসে দেখলো, প্রাসাদের সামনের চত্বরে সৈন্যরা ভোলা তরোয়াল হাতে ছুটোছুটি করছে। কিছু একটা হয়েছে নিশ্চয়ই। একজন সৈন্য রহমানকে এসে কি যেন বললো। রহমান ফ্রান্সিসকে বলল–কাণ্ড শুনেছ?

–কি?

–তোমার বন্ধুরা পালিয়েছে।

ফ্রান্সিস হাসলো, যাক, সমস্যার সমাধান ওরা নিজেরাই বুদ্ধি খাঁটিয়ে বের করেছে তাহলে। রহমান আড়চোখে ফ্রান্সিসকে হাসতে দেখে বলল–কিন্তু ফিরে আসতে হবে। এখান থেকে পালানো অত সহজ নয়।

ফ্রান্সিসকে কাঁটাতারের বন্দীশালায় ঢুকিয়ে দেওয়া হল। ফ্রান্সিস দেখল, পাহারাদারের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। পালাবার সব পথই বন্ধ। যাক সান্ত্বনা, বন্ধুরা তো পালাতে পেরেছে। হঠাৎ পাথরে বাঁধানো চত্বরে অনেক মানুষের পায়ের শব্দ শোনা গেল। ফ্রান্সিস চমকে উঠল–তবে কি ওরা ধরা পড়ল?

দরজার তালা খোলার শব্দ হল। দরজা খুলে গেল। দেখা গেল ফ্রান্সিসের বন্ধুরা ঢুকছে। তখনও কারও হাতে পাঁঠার ঠ্যাং, কোর্মার মাংসের টুকরো, শিক-বেঁধা শিক কাবাব। ফ্রান্সিস ছুটে গিয়ে অসুস্থ হ্যারিকে ধরল। তারপর ধরে এনে ওকে শুইয়ে দিল। কেউ কোন কথা বলল না। পরদিন যে তাকে ফাঁসি দেওয়া হবে, একথা ফ্রান্সিস কাউকে বলল না। শুধু, বাইরের সৈন্যদের টহল দেওয়ার শব্দ শোনা গেল—টক্‌-টক্‌।

তখন কাল হয়েছে। দেউড়ির কাছে যেখানে ফাঁসিকাঠ তৈরী হয়েছে, সারা আমদাদ শহরের মানুষ সেখানে এসে ভেঙে পড়ল। দুর্গে তুরী বেজে উঠল। একটু পরেই ফাঁসিকাঠের পাশে ফ্রান্সিসের বন্ধুদের এনে দাঁড় করানো হল। ভীড়ের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। সবাই বন্দীদের দেখতে চায়। ফ্রান্সিসকে দাঁড় করানো হল ফাঁসিকাঠের মঞ্চের ওপর। একটা সাদা ঘোড়ায় চড়ে সুলতান এলেন। পেছনে রহমান। রমহানের পেছনে ও কে? এ কি! এ যে সেনাপতিমশাই।

এদিকে হয়েছে কি, ফ্রান্সিসরা যখন ভোরের দিকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন সেনাপতি একজন পাহারাদারকে ডেকে বলেছিল–আমি রহমানের সঙ্গে দেখা করতে চাই। পাহারাদারটি প্রথমে রাজী হয়নি। সেনাপতি তখন বলেছিল–রহমানকে শুধু বলবে ভাইকিং দেশের নৌবাহিনীর সেনাপতি দেখা করতে চায়। পাহারাদারটি কি ভেবে রাজি হল। একটু পরেই ফিরে এসে সেনাপতিকে নিয়ে গেল।

সবাই তখন অঘোর ঘুমে। শুধু অসুস্থ হ্যারি জেগেছিল। সে সবই দেখলো। বুঝল–সেনাপতি নিজের জীবন বাঁচাবার জন্যে মরীয়া হয়ে উঠেছে। এতে যদি অন্যদের প্রাণও যায়, ও ফিরে তাকাবে না। হ্যারি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে শুয়ে রইল! কাউকে ডাকলও না। ভোর থেকেই সেনাপতিকেও ওরা দেখতে পায়নি। এবার মানে বোঝা গেল। সেনাপতি সুলতানের দলে ভিড়ে গিয়েছে।

সুলতান আসতেই দর্শকদের মধ্যে উল্লাসের বন্যা বইল। চীৎকার করে সবাই সুলতানের জয়ধ্বনি করল। সুলতান ঘোড়া থেকে নেমে ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগিয়ে এলেন। ফ্রান্সিসকে লক্ষ্য করে বললেন, ফ্রান্সিস, গলায় দড়ির ফাঁস পরাবার আগে এখনও সময় আছে বলে–সেই মোহর দুটো কোথায়?

–আমি জানি না।

–জাহাজ নিয়ে এসেছ, সোনার ঘন্টা নিয়ে যাবে বলে। এবার জাহান্নামে যাও, সেখানে সোনার ঘন্টার বাজনা শুনতে পাবে।

ফ্রান্সিস কোন কথা বলল না।

সুলতান চীৎকার করে বলতে লাগলেন–আমাদের দরিয়ায় এসে আমাদেরই চোখের সামনে দিয়ে সোনার ঘন্টা নিয়ে যাবে, তোমাদের দুঃসাহস তো কম নয়? সুলতান এবার ফ্রান্সিসের বন্ধুদের দিকে তাকালো। বললো, আমি জাহাজ নিয়ে যাব, তোমাদের জাহাজও মেরামত করিয়ে দেব। তোমরা যদি জাহাজ চালানোর ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করো, তবে তোমাদের আমি মুক্তি দেব।

সবাই চুপ করে রইল। হঠাৎ হ্যারি চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো–আমরা যেতে রাজি, কিন্তু আমাদের ক্যাপটেন হবে কে?

সুলতান হাসলেন এবং বললেন–তোমাদেরই দেশের নৌবাহিনীর সেনাপতি।

-ওকে আমরা নেতা মানি না, আমরা ফ্রান্সিসকে চাই। হ্যারি বলল।

–হ্যাঁ-হ্যাঁ, আমরা ফ্রান্সিসকে চাই সবাই চীৎকার করে উঠল।

সুলতান মুশকিলে পড়লেন। এই ভাইকিংদের মত দক্ষ জাহাজ-চালকদের ছাড়া তার পক্ষে যাওয়া অসম্ভব। কিন্তু নিজের এই সমস্যার আভাসও তিনি প্রকাশ পেতে দিলেন না। চীৎকার করে বলে উঠলেন–তোমরা যদিনা যাও, তাহলে তোমাদের সকলের ফ্রান্সিসের দশা হবে। তাকিয়ে দেখ, ওকে কি ভাবে ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে।

সুলতান রহমানকে কি যেন বললেন। রহমানের ইঙ্গিতে কালো কাপড়ের আলখাল্লা পরা, কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা একজন লোক ফাঁসির মঞ্চে উঠে এল। সে এসে ঘাড়ধাক্কা দিতে দিতে ফ্রান্সিসকে দড়ির ফাঁসের কাছে নিয়ে এল। কালো কাপড়ের ফুটো দিয়ে লোকটার চোখ দুটো যেন জ্বলজ্বল করছে।

ফ্রান্সিস সম্মুখের সেই দর্শকদের ভিড়ের দিকে তাকাল। বন্ধুদের দিকে তাকাল। দেখলো, হ্যারি চোখের জল মুছছে। আরও কেউ-কেউ অন্যদিকে তাকিয়ে আছে, পাছে চোখের জল দেখে ফ্রান্সিস দুর্বল হয়ে পড়ে। ফ্রান্সিস আকাশের দিকে তাকাল। ঝকঝকে নীল আকাশ। সাদা সাদা হালকা মেঘ উড়ে যাচ্ছে। পাখি উড়ছে। কি সুন্দর পৃথিবী। ফ্রান্সিসের চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল। মা’র কথা, বাবার কথা মনে পড়ল। ছোট ভাইটাও কি ওর মতই আধপাগলা হবে? বাড়ির গেটের সেই লতা গাছটা একদিন সমস্ত দেওয়ালটায় ছড়িয়ে পড়বে। অজস্র নীল ফুল ফুটিয়ে জায়গাটাকে সুন্দর করে তুলবে। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ, তারাভরা আকাশ, ঢেউয়ের মাথায় সূর্য ওঠা–এসব আর কোনদিন দেখবে না সে।

কিন্তু ফ্রান্সিসের চিন্তায় বাঁধা পড়ল। কালো কাপড়ের মুখ ঢাকা লোকটা ফাঁসের দড়ি টেনে-টেনে পরীক্ষা করতে করতে বিড়বিড় করে বলছে–ফাঁসটা আলগা, হাতের বাঁধনটা সময়মত কেটে নিও। পাটাতনের নীচে গর্তটা বুজিয়ে রেখেছি, নেমেই মাটি পাবে।

ফ্রান্সিসের সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল–ফজল!

ফজল ধমকের সুরে বলল–তোমার মুখে যেমন খুশীর ভাব ফুটে উঠেছে, যেন ফাঁসি হবে না, বিয়ে হবে তোমার। হুঃ।

ফ্রান্সিস সাবধান হলো। ফজল বলতে লাগল–নীচে পড়েই দড়িটা ধরে দু’চারবার জোরে হ্যাঁচকা টান দেবে। তারপর চুপচাপ বসে থাকবে। রাত হলে পেছনের পাটাতনটা খুলে বেরোবে। সামনেই একটা ঘোড়া পাবে।

ফজল থামলো। তারপর দুহাত তুলে সুলতানের দিকে ইঙ্গিত করল–সব ঠিক আছে। এবার সুলতানের হুকুম। সব গোলমাল থেমে গেল।

ফ্রান্সিস হঠাৎ হাত তুলে এগিয়ে এল। সুলতান জিজ্ঞেস করল–কি ব্যাপার।

–মরবার আগে আমার বন্ধুর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।

–কে সে?

–হ্যারি।

সুলতানের হুকুমে হ্যারিকে ধরে ধরে মঞ্চে নিয়ে আসা হল। হ্যারি আর নিজেকে সংযত করতে পারুল না। ওর ছেলেবেলার বন্ধু ফ্রান্সিস। কত হাসি কান্না মান-অভিমানের জীবন কাটিয়েছে ওরা। হ্যারি ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরে কাঁঁদতে লাগল। ফ্রান্সিস নীচুস্বরে বলতে লাগল–হ্যারি, ভয় নেই, আমি মরবো না। যা বলছি, শোন। তোমরা কেউ সুলতানের বিরোধিতা বা সেনাপতির হুকুমের অবাধ্য হয়ো না। আমি আমাদের ভাঙা জাহাজটায় থাকবো। পরে দেখা হবে।

হ্যারি কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারল না। চোখ মুছে অবাক হয়ে ফ্রান্সিসের দিতে তাকাতে-তাকাতে মঞ্চ থেকে নেমে এল।

ফজল ফ্রান্সিসের মাথায় কালো কাপড়ের ঢাকনা পরিয়ে দিল। কাপড়টা পরাবার সময় সকলের অলক্ষ্যে ফ্রান্সিসের হাতের বাঁধনটা আলগা করে দিল। তারপর গলায় দড়ির ফাঁসটা পরিয়ে সুলতানের দিকে তাকাল। আবার চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কি হয় দেখবার জন্যে সবাই উদগ্রীব হয়ে আছে। সুলতান হাত তুলে ইঙ্গিত করল। ফজল ফ্রান্সিসের পায়ের নীচের পাটাতনটা এক টানে সরিয়ে দিল। ফ্রান্সিস ঝুপ করে নিচে পড়ে গেল। সকলেই দেখল দড়িটায় কয়েকটা হ্যাঁচকা টান পড়ল। দুলতে-দুলতে দড়িটা থেমে গেল।

ফ্রান্সিসের ফাঁসি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বধ্যভূমিতে উপস্থিত আমদাদবাসীরা উল্লাসে চীৎকার করে উঠল। ওদের ফাঁসি দেখা হয়ে গেল। সুলতান, রহমান আর ভাইকিং সেনাপতিকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন। দর্শকরাও সব আস্তে-আস্তে চলে গেল। ভাইকিং বন্দীরে নিয়ে সৈন্যরা চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বধ্যভূমি নির্জন হয়ে গেল।

দুপুর গেল। সন্ধ্যে পার হল। রাত্রি বাড়তে লাগল। চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। ফ্রান্সিস হাতের দড়ির বাঁধনটা খুলে ফেলল। তারপর আস্তে আস্তে পেছনের পাটতনটা ধরে নাড়া দিল। সত্যিই আলগা। ওটা খুলে এল সামনেই প্রাচীরের ধার ঘেঁষে একটা ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে, লেজ ঝাঁপটাচ্ছে। ঘোড়াটার পিঠে জিন বাঁধা। ফ্রান্সিস এক লাফে ঘোড়ায় চড়ে বসল। তারপর কোনদিকে না তাকিয়ে দ্রুত বেগে একটা গলিপথে ঢুকে পড়ল। আন্দাজে দিক ঠিক করে দুর্গের দিকে চলল। সমুদ্র ঐ দিকেই। একসময় হু-হুঁ হাওয়া এসে লাগল। সেই সঙ্গে সমুদ্রের মৃদু গর্জন। ঐ তো সমুদ্র। ওপাশে দুর্গের টানা প্রাচীর। সমুদ্রের ধার দিয়ে ফ্রান্সিস বিদ্যুৎবেগে ঘোড়া ছোটাল। অল্প অল্প চাঁদের আলোয় জল ঝিকমিক করছে। হুহু হাওয়া শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে। সারাদিনের বন্দীদশা, উপবাস, একফোঁটা জলও খেতে পায়নি। তবু মুক্তির আনন্দ, বেঁচে থাকার আনন্দ। ফ্রান্সিস প্রাণপণে ঘোড়া ছোটাল। একটু পরেই দূর থেকে দেখা গেল, একটা প্রকাণ্ড কালো জন্তুর মত ওদের ভাঙা জাহাজটা কাত হয়ে পড়ে আছে জলের ধারা।

কেবিন ঘরে ঢুকে নিজের বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল ফ্রান্সিস। সারাদিন যে উত্তেজনা গেছে, শরীর আর চলছে না। কিন্তু খিদেও পেয়েছে ভীষণ। এতক্ষণে ও সেটা বুঝতে পারল। রসুই ঘরটা একবার দেখলে হয়। ফ্রান্সিস উঠে পড়ল। রসুইঘর খুঁজে পেতে দেখলো একজনের পক্ষে যথেষ্ট খাদ্য মজুত রয়েছে। যাক কয়েকদিনের জন্য নিশ্চিন্ত। উনুন ধরিয়ে ময়দা-আটা-চিনি দিয়ে এক অদ্ভুত খাবার তৈরী করলো ফ্রান্সিস। খিদের জ্বালায় তাই খেলো গোগ্রাসে। তারপর একেবারে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুম।

সকাল হয়েছে। রোদ্দুরের তেজ তখনও বাড়েনি। ফ্রান্সিস ডেক-এ পায়চারি করছে আর ভাবছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাহাজটা মেরামত করতে হবে। আবার সমুদ্রে ভেসে পড়তে হবে। সোনার ঘন্টা আনতেই হবে। কিন্তু কি করে হবে?

ফ্রান্সিস ভেবে-ভেবে কোন কুলকিনারা পেল না। পায়চারি করতে করতে হঠাৎ ফ্রান্সিস থমকে দাঁড়াল। একটা জাহাজ আসছে এই দিকে। খুব সুন্দর ঝকঝকে একটা জাহাজ। বাতাসের তোড়ে ফুলে ওঠা সাদা পালগুলো দেখে মনে হচ্ছে যেন উড়ন্ত রাজহাঁস। মাস্তুলে একটা পতাকা উড়ছে পত পত করে। ফ্রান্সিস ভাল করে লক্ষ্য করল–হ্যাঁ, সুলতানের জাহাজ। পতাকায় বাদশাহী চিহ্ন ছুটন্ত ঘোড়া আর সূর্য আঁকা।

ফ্রান্সিস আর ডেকে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ মনে করল না। কেবিন ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। রাজ্যের চিন্তা মাথায় ভিড় করে এল। সুলতানের জাহাজ এদিকে আসছে কেন? তবে কি হ্যারি বিশ্বাসঘাতকতা করলো? অত্যাচারের মুখে সব বলে দিল? ফ্রান্সিসের হদিশ জানিয়ে দিলো? কিন্তু ওকে ধরিয়ে দিয়ে হ্যারির কি লাভ? লাভ আছে বৈকি? তাহলে সুলতান ওদের মুক্তি দেবে। সবাই দেশে ফিরে যেতে পারবে।

সুলতানের জাহাজটা বালিয়াড়িতে এসে ভিড়লো। ফ্রান্সিসের সব বন্ধুরা হইহই করতে করতে জাহাজ থেকে নেমে এল। ফ্রান্সিস অনেকটা আশ্বস্ত হল। ওরা যখন এত আনন্দ হই-হুল্লা করছে, তখন নিশ্চয়ই অন্য কারণে জাহাজটা এখানে আনা হয়েছে। গা ঢাকা দিয়ে ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে ডেক এ উঠে এল। মাস্তুলের আড়ালে লুকিয়ে সব দেখতে লাগল। ফ্রান্সিসের বন্ধুরা নেমে আসতেই সৈন্যের দল নেমে এসে ওদের ঘিরে দাঁড়াল তারপর সবাই দল বেঁধে এই জাহাজটার দিকে আসতে লাগল। আরো কিছু লোক তখন সুলতানের জাহাজ থেকে হাতুড়ী, পেরেক বড়-বড় কাঠের পাটাতন নামাতে লাগল। তাহলে ওদের ভাঙা জাহাজটা মেরামত হবে। ঐ লোকগুলো কাঠের মিস্ত্রী। ফ্রান্সিস স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

মালপত্র নামানো হল। ফ্রান্সিসদের জাহাজটায় মেরামতির কাজ শুরু হল। ভাইকিংরাও হাত লাগাল। কিছুক্ষণের মধ্যেই নির্জন সমুদ্রতীর বহুলোকের হাঁকডাকে ভরে উঠল। ফ্রান্সিস আড়াল থেকে লক্ষ্য করল, হ্যারি কাজ করার ফাঁকে আড়চোখে এই জাহাজটার দিকে তাকাচ্ছে। বোধহয় ফ্রান্সিসের সঙ্গে দেখা করবার সুযোগ খুঁজছে।

দুপুর নাগাদ সুলতানের জাহাজে কার হাঁক শোনা গেল–খানা তৈরি। সবাই চলে এসো। সবাই কাজ রেখে দল বেঁধে জাহাজে খেতে চললো। শুধু হ্যারি থেকে গেল। কেউ কেউ হ্যারিকে ডাকলে। হ্যারি বলল হাতের কাজটা শেষ করেই যাচ্ছি। তোমরা এগোও।

জাহাজে ভাঙা হালের জায়গাটায় হ্যারি কাজ করছিল। সে জাহাজের আড়ালে পড়ে গেল। সুলতানের সৈন্যরাও খেয়াল করল না। সবাই জাহাজে উঠে গেল। হ্যারি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। যখন দেখলো কেউ ওকে লক্ষ্য করছে না তখন দড়ি বেয়ে ভাঙা জাহাজটায় উঠে এল। সুলতানের জাহাজ থেকে যাতে পাহারাদার সৈন্যরা দেখতে না পায়, তার জন্যে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে চাপাস্বরে ডাকলো ফ্রান্সিস!

ফ্রান্সিস মাস্তুলের আড়াল থেকে সবই দেখছিল। এবার ছুটে এসে হ্যারিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। হ্যারি প্রথমে একটু চমকেই উঠেছিল পরক্ষণে গভীর আবেগে ফ্রান্সিসকে আলিঙ্গন করলো। দুজনেরই চোখ জলে ভরে উঠল। আঃ! ফ্রান্সিস তাহলে সত্যিই বেঁচে আছে! সময় অল্প। বেশি কথা হল না। ফ্রান্সিস বললো–তোমরা কেউ সুলতান বা ক.. সেনাপতির হুকুমের বিরোধিতা করো না।

–সেসব আমরা ভেবে রেখেছি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জাহাজ নিরাপদে নিয়ে যেতে পারবো তো?

–হ্যাঁ, আমি দিনরাত শুধু ঐ ভাবনা নিয়েই আছি।

–তোমার কি মনে হয়? পারবে?

–নিশ্চয়ই পারবো, পারতেই হবে। লবর শোনা গেলো। হ্যারি দ্রুত উঠে দাঁড়াল। বললো–এখন চলি। নিশ্চয়ই ওরা আমাকে খুঁজতে বেরিয়েছে।

–আবার দেখা হবে। ফ্রান্সিস হেসে হাত বাড়াল। হ্যারি আবেগে ওকে চেপে ধরল। এক মুহূর্ত। তারপরেই দ্রুত ডেকের রেলিঙে দাঁড়িয়ে তীরে বন্ধুদের জটলার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল। সবাই হইহই করে উঠল। যাক, হ্যারির কোন বিপদ হয়নি। হ্যারি দড়ি বেয়ে নেমে এল। তারপর বন্ধুরা ওর জন্যে যে খাবার নিয়ে এসেছিল, বালির ওপর বসে তাই খেতে লাগলো। সঙ্গে সৈন্য আর মিস্ত্রীরা। সারাদিন মেরামতির কাজ চলে। সন্ধ্যে নাগাদ আবার ওদের নিয়ে জাহাজটা আমদাদ বন্দরে ফিরে যায়। জাহাজ রঙ করা হলো। দেখতে হলো যেন, ঝকঝকে নতুন জাহাজ একটা।

সেদিন হ্যারি লুকিয়ে ফ্রান্সিসের সঙ্গে দেখা করল। বললো–কালকে জাহাজ ছাড়বে।

–কখন? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।

–সকালবেলা।

–সুলতান যাচ্ছে নিশ্চয়ই।

–সে আর বলতে। সুলতানের নাকি ভালো করে ঘুমই হচ্ছে না।

–খুবই স্বাভাবিক নিরেট সোনা দিয়ে তৈরি ঘন্টা তো।

–মরুক গে। তুমি কিন্তু ডেকে উঠবে না তে লাগল। তারপর জিজ্ঞেস করল–আচ্ছা, সুলতান সঙ্গে কত সৈন্য নিয়ে যাচ্ছে।

–ঠিক বলতে পারবো না। তবে রহমান বলেছিল, বাছাই করা সৈন্য নেওয়া হবে।

–হুঁ। ফ্রান্সিস নিজের চিন্তায় ডুবে গেল।

–লড়বে নাকি?

–সে সব সময় সুযোগ বুঝে দেখতে পেলে সৈন্যদের মনে সন্দেহ জাগতে পারে। হ্যারি চলে গেল।

সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত জেগে রইল ফ্রান্সিস। কত চিন্তা মাথায়। ঘুম আসতে চায় না। এক সময় ফ্রান্সিস উঠে পড়ল। দড়ি বেয়ে বালির ওপর নেমে এল। আকাশে চাঁদ, চারদিক ভেসে যাচ্ছে জ্যোৎস্নায়। নতুন রঙ করা জাহাজটার দিকে তাকিয়ে রইল ফ্রান্সিস। সকালেই তো সমুদ্র যাত্রার শুরু। হয়তো এই যাত্রাই তার শেষ যাত্রা। হয়তো সবাই ফিরে যাবে দেশে, তার আর কোন দিন ফেরা হবে না। দেশ থেকে বহুদূরে এক অজানা সমুদ্রে তার মৃতদেহ। ঢেউয়ের ধাক্কায় ভেসে যাবে। হয়তো তার মৃত্যু নিয়ে দেশের লোকেরা কয়েকদিন জল্পনা কল্পনা করবে। তারপর আস্তে আস্তে সবাই তাকে একদিন ভুলে যাবে।

ফ্রান্সিস শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো জাহাজটার দিকে। চাঁদের আলো যেন ঠিকরে পড়ছে জাহাজটার গা থেকে। চারদিকে সেই অসীম শূন্যতার মাঝখানে জাহাজটাকে মনে হতে লাগল, যেন কোন স্বপ্নপুরী থেকে ভেসে এসেছে। বালিয়াড়িতে কিছুক্ষণ পায়চারী করে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল ফ্রান্সিস।

তখন সবে সকাল হয়ে সূর্য উঠেছে। ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেল। ওপরের ডেক-এ অনেক লোকের চলাফেরার শব্দ। দাড়িদড়া বাঁধছে। পাল খাটাচ্ছে। ওদের কর্মচাঞ্চল্যে ঘুমন্ত জাহাজটা জেগে উঠল।

ফ্রান্সিস উঠে বসলো। তাড়াতাড়ি বিছানাপত্র গুটিয়ে নিয়ে যে ঘরটায় হ্যারিকে আটকে রাখা হয়েছিল, সেই ঘরটায় চলে এলো। এখন থেকে এই ঘরটাই হবে তার আস্তানা। সুলতানের সৈন্যদের চোখের আড়ালে থাকতে হবে। ওরা যাতে ঘুণাক্ষরেও জানতে না পারে, ফ্রান্সিস বেঁচে আছে, আর এই জাহাজেই আছে।

রহমানের কথাই ঠিক। সুলতান ভাইকিংদের চেয়ে বেশিসংখ্যক বাছাই করা সৈন্য সঙ্গে নিয়েছেন। কিছু রেখেছেন তার নিজের জাহাজে আর বাকি সব ফ্রান্সিসদের জাহাজে। ভাইকিংদের পাহারা দিতে হবে তো! যদি জলে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে যায়।

পাল খাঁটিয়ে দড়িদড়া বেঁধে দুটো জাহাজই যাত্রার জন্য প্রস্তুত হল। দুটো জাহাজেই সুলতানের বাদশাহী চিহ্ন ছুটন্ত ঘোড়া আর সূর্য আঁকা পতাকা ভোরের হাওয়ায় পপত্ করে উড়ছে।

তখন সূর্য দিগন্তের একটু ওপরে উঠেছে। আলোর তেজ তখনও প্রখর হয়নি। সুলতান নিজের জাহাজের ডেক-এ এসে দাঁড়ালেন। সঙ্গে রহমান আর ভাইকিংদের সেই সেনাপতি। সুলতানের সামনে দাঁড়িয়ে বেঢপ পোশাক পরা দাড়িওলা একটা লোক সুর করে কি যেন দ্রুত ভঙ্গিতে বলতে লাগলো। বোধহয় ঈশ্বরের কাছে দয়া প্রার্থনা করা হচ্ছে। সুলতান মাথা নীচু করে শুনতে লাগলেন। লোকটা বলা শেষ করে এক পাশে সরে দাঁড়াল। এবার সুলতান। মাথা তুললেন। খাপ থেকে তরবারি খুলে নিলেন। তারপর তরবারিটা সমুদ্রের দিকে তুলে যাত্রার ইঙ্গিত করলেন। সকালের আলোয় সোনাবাঁধানো হাতলওলা তরবারিটা ঝকঝক করতে লাগল। একটা ঝাঁকুনি খেয়ে ফ্রান্সিসদের জাহাজ চলতে শুরু করল। দাড়িরা দাঁড় বাইতে লাগল। জাহাজটা মাঝসমুদ্রের দিকে চললো। সুলতানের জাহাজটা চললো পেছনে পেছনে। সমুদ্রের বুকে কিছুটা এগোতেই হাওয়া লাগল পালে। পালগুলো দুলে উঠল। পরিষ্কার আকাশের নীচে শান্ত সমুদ্রের বুকে দুটো জাহাজ, একটা সামনে আর একটা পেছনে। চলল জাহাজ দু’টো।

দিন যায়, রাত যায়। একা বদ্ধ ঘরে ফ্রান্সিসের দিন কাটে, রাত কাটে। হ্যারি সারাদিন একবার করে আসে। সব খবরাখবর দেয়। ভাইকিংদের মধ্যে বিশ্বস্ত কয়েকজন মাত্র জানে, ফ্রান্সিস এই ঘরে আছে। তারা কিন্তু ফ্রান্সিসের কাছে আসে না। ফ্রান্সিসের ঘরের বাইরে পালা করে দিনরাত পাহারা দেয়। ওর খাবার-টাবার দিয়ে যায়। সবাই খুব সাবধান–সুলতানের লোক যাতে ফ্রান্সিসের কোনো কথা না জানতে পারে।

একদিন এক কাণ্ড হলো। সেদিন গভীর রাত। ফ্রান্সিসের ঘরের সামনে পাহারাদার ভাইকিংটা ঘুমে ঢুলছে। হঠাৎ একটা খুট করে শব্দ হতেই সে চমকে উঠে দেখল, একটা ছায়া পিঁপের আড়ালে সাঁৎ করে সরে গেল। ও তাড়াতাড়ি পাটাতনের আড়ালে লুকনো তরবারি বের করল। কিন্তু আর কোন সাড়াশব্দ নেই। হঠাৎ একটা গড়গড় শব্দ হতেই ও চমকে ফিরে তাকাল। দেখলো, অন্ধকার থেকে দু-তিনটে পিঁপে ওর দিকে গড়াতে-গড়াতে ছুটে এক আসছে। প্রথম পিঁপেটার ধাক্কায় সে, কাঠের মেঝেটায় উপুড় হয়ে পড়ে গেল। অন্ধকার থেকে ছায়ামূর্তিটা ছুটে এসে পাহারাদারটার পিঠের ওপর চড়ে বসল। তারপর নিজের কোমরবন্ধনীর কাপড় দিয়ে পাহারাদারের মুখটা বেঁধে ফেলল।

বাইরের পিঁপের গড়গড় শব্দে, পাহারাদারের। উপুড় হয়ে পড়ার শব্দে ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেল। ও নিঃশব্দে বিছানার তলায় লুকানো তরোয়ালটা বের করে পা টিপেটিপে দরজার দিকে এগোল। কোনরকম শব্দ না করে দরজাটা খুলে বাইরে এসে দেখল, একটা ছায়ামূর্তি পাহারাদারের পিঠের ওপর চড়ে বসে আছে। ফ্রান্সিস তরোয়ালটা ছায়ামূর্তির পিঠে ঠেকিয়ে বললো–উঠে পড়ো বাছাধন।

পাহারাদারের মুখ আর বাঁধা হল না। ছায়ামূর্তি আস্তে-আস্তে উঠে দাঁড়াল। পাহারাদারটা গোঙাতে লাগলো। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বললো—ঘুরে দাঁড়াও। ছায়ামূর্তি ঘুরে দাঁড়ালো। ফ্রান্সিসের চোখে তখন অন্ধকারটা সয়ে এসেছে। সে চোখ কুঁচকে ভালো করে দেখল। আরে? এ কি? এ যে ফজল। ফ্রান্সিস তরোয়াল ফেলে ফজলকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো। পাহারাদারটা তখনও গোঙাচ্ছে। ফজল তাড়াতাড়ি তার মুখ থেকে কাপড়টা খুলে দিল। পাহারাদারটা ওদের দুজনকে দেখেই হেসে উঠলো। ফ্রান্সিস পাহারাদারকে বলল–যাও ভাই ঘুমিয়ে নাও গে!

ফ্রান্সিস আর ফজল কাঁধ ধরাধরি করে ঘরে এসে বিছানায় বসল। ফ্রান্সিস বলল–ফজল ভাই, তোমার ঋণ আমি জীবনেও শোধ করতে পারবো না।

–কি যে বলো তোমার কাছেও কি আমার ঋণ কিছু কম।

–অবাক কাণ্ড–তুমি এখানে এলে কি করে?

–তোমাকে চাবুক মারা, ফাঁসি দেওয়া, এসব দেখে রহমান আমাকে বেশ বিশ্বাসী লোকবলে ধরে নিয়েছিল। তারপর কিছু ঘুষও দিয়েছি। কাজেই সুলতানের সৈন্যদলে জায়গা পেতে খুব অসুবিধে হলো না।

–আমি এই জাহাজেই যাচ্ছি, তুমি বুঝলে কি করে? ফজল হাসলো। বললো–সোনার ঘন্টা আনতে জাহাজ যাচ্ছে, আর তুমি বেঁচে থাকতে সেই জাহাজে যাবে না, এ কি হয়। ভাল কথা তোমাকে যে দুটো মোহর দিয়েছিলাম, সেগুলো আছে?

ফ্রান্সিস দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোহর বিক্রির কথা, মকবুলের মোহর চুরির কথাও বলল।

–মকবুল? ফজল বেশ চমকে উঠল।

–হ্যাঁ, লোকটা নিজের নাম বলেছিল মকবুল।

–কেমন দেখতে বলো তো?

–মোটাসোটা। গোলগাল বেশ হাসিখুশী।

–হুঁ। ফজল দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

–তুমি মকবুলকে চেন? ফ্রান্সিস জিজ্ঞাসা করলো।

–ফজল ম্লান হেসে কপালের কাটা দাগটা আঙ্গুল দিয়ে দেখালো–মকবুলের তরোয়ালের কোপের দাগ।

ফজল বলতে লাগল, ভাই মকবুল আমার খুড়তুতো দাদা। বাবা আর খুড়ো মারা গেল। তারপর বিষয়সম্পত্তি নিয়ে লাগল গণ্ডগোল। বিষয়সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারর সময় পাওয়া গেল একটা পুরানো বাক্স। তাতে সেই মোহর দুটো। বংশপরম্পরায় ঐ বাক্সটা প্রাপ্য ছিল মকবুলেরই, কিন্তু সে ভীষণ লোভী। একটা ছোট মরূদ্যান আমার ভাগে পড়েছিল। ঐ মরুদ্যানটার ওপর ওর লোভ ছিল বরাবর। সে বলল–তুই বরং এই মোহরের বাক্স বদলে আমাকে ঐ মরুদ্যানটা দে। আমি রাজী হলুম, কি হবে ঐ মরুদ্যানটা নিয়ে। আমি তো আর ব্যবসা করবো না। তার চেয়ে বরং আমাদের বংশের একটা স্মৃতি মোহরের বাক্সটাই আমি রাখি। মকবুলের হাতে পড়লে বিক্রি করে দেবে। আমি রাজী হলাম। মোহরের বাক্সটা আমার কাছেই রইল।

–তারপর?

–মককুলন পাওয়া সম্পত্তি বিক্রি করে ব্যবসার ধান্ধায় আমদাদ গেল, হায়াৎ গেল, আরো কত জায়গায় ঘুরে বেড়ালো। আফ্রিকাও নাকি গিয়েছিল। তারপর হঠাৎ একদিন বাড়ি এলো। মোহন্ত্রে বাক্সটা আমার কাছ থেকে ফেরৎ চাইলো। আমি দেব কেন? ওকে তো চিনি। নিশ্চয়ই মোহর দুটো বিক্রি করে দেবে। আমি স্পষ্ট বলে দিলাম এই বাক্স আমার, আমি দেব না।

–তারপর?

–সেই রাত্রেই মকবুল আমাকে খুন করতে এল। খুব ভাগ্যিস আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তবু তরোয়ালের কোপ এড়াতে পারিনি। কপালে সেই চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছি।

–মকবুল মোহর দুটোর জন্যে এত পাগল হয়ে উঠেছিল কেন?

–কারণটা আমি পরে জেনেছি। সোনার ঘন্টা যে দ্বীপে রয়েছে, সেই দ্বীপে যাবার এবং ফিরে আসার দুটো পথেরই নকশা আঁকা আছে সেই মোহর দুটোতে।

–তাহলে কথাটা সত্যি? ফ্রান্সিস চিন্তিত স্বরে বললো।

–কি সত্যি?

–জানো ফজল, আমিও ঠিক এই কথা শুনেছি।

–তাই নাকি?

–হ্যাঁ।

–যা হোক এই কথাটা জানবার পরই আমি বাড়ি ছাড়লাম। মোহর দুটো রুমালে বেঁধে সব সময় আমার কোমরে রাখতাম। ইচ্ছে ছিল, ঐ নকশাটা কারো কাছে থেকে বুঝে নেব, তারপর কিছু টাকা জমিয়ে জাহাজ কিনে একদিন সোনার ঘন্টা আনতে যাবো। কিন্তু–

–কেন যেতে পারলে না?

–আচ্ছা ফজল, তুমি আমাকে মোহর দুটো দিয়েছিলে কেন?

–মকবুলের হাত থেকে মোহর দুটো বাঁচাবার জন্যে।

ফ্রান্সিস দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বললো–আশ্চর্য! নিজের জীবন বিপন্ন করেও তুমি যে মোহর দুটো হাতছাড়া করো নি–আমি খিদের জ্বালায় সেটা বিক্রি করে দিলাম।

–তোমার দোষ নেই ভাই। আমারই বোঝা উচিত ছিল। তুমি বিদেশী কে তোমাকে চেনে? কে খেতে দেবে তোমাকে? আশ্রয়ই বা দেবে কে? যাকগে যা হবার হয়ে গেছে।

–তোমার কি মনে হয়? মকবুল সোনার ঘন্টার দ্বীপে যেতে পেরেছে?

–মনে হয় না। কারণ ও একটা মোহরই পেয়েছে। দুটো মোহর আছে জেনে নিশ্চয়ই অন্যটার খোঁজে আছে। জহুরী ব্যাটা সোনার লোভে অন্যটা বোধহয় এতদিনে গালিয়েই ফেলেছে।

গল্প করতে করতে দুজনের কারোরই খেয়াল নেই যে, রাত শেষ হয়ে এসেছে। ভোর হয় হয়। হ্যারি ফ্রান্সিসের খোঁজখবর নিতে এল। তখন দুজনের খেয়াল হল যে ভোর হয়েছে। ফজল তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল। যে ঝোলানো দড়িটা বেয়ে ফ্রান্সিসদের জাহাজে উঠে এসেছিল সেটা বেয়েই নেমে গেল সমুদ্রের জলে। আবছা অন্ধকারের মধ্যে সাঁতরাতে সাঁতরাতে সুলতানের জাহাজের কাছে গেল। ওখানে একই দড়ি ঝুলিয়ে নেমে এসেছিল। সেই দড়িটা বেয়ে জাহাজে উঠে গেল। তারপর দড়িটা তুলে রেখে পা টিপে টিপে কেবিন ঘরের দিকে চলে গেল।

জাহাজ দুটো চলল। দিন যায়, রাত যায়। এদিকে ফ্রান্সিসের চোখে ঘুম নেই। এক চিন্তা কি করে ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে, ডুবো পাহাড়ের ধাক্কা এড়িয়ে সে সাদা মন্দিরের দ্বীপটায় জাহাজ নিয়ে যাবে।

হ্যারি আসে। দুজনে পরামর্শ হয়।

একদিন গভীর রাত্রে ফজল এলো। তাকে বেশ উত্তেজিত মনে হল। ফ্রান্সিস বেশ অবাকই হল। কি ঘটলো এমন? ফজল কোন কথা না বলে কোমর বন্ধনী থেকে সাবধানে একটা ভাজ করা কাগজ বের করল। আস্তে-আস্তে ভাজ খুলে ফ্রান্সিসের সামনে পাতলো। পার্চমেন্ট কাগজের মত শক্ত পুরোনো কাগজ। হলদেটে হয়ে গেছে। বললো যে বাক্সটাতে মোহর দুটো ছিল, সেই বাক্সে এই কাগজটা পেলাম।

–কিছু লেখা আছে এটাতে?

–না। তবে আমার বেশ মনে আছে, মোহর দুটো এই কাগজটায় জড়ানো ছিল। একটু লক্ষ্য করে দেখো অনেকদিন জড়ানো ছিল বলে দুটো মোহরের দুপিঠের আবছা ছাপ পড়েছে কাগজটাতে।

ফ্রান্সিস এবার উৎসুক হল। হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। সত্যিই তাই। কাগজটার দুপাশে দুটো অস্পষ্ট ছাপ। একটাতে মাথার ছাপের মত। অন্যটাতে কয়েকটা ত্রিকোণের আভাস। ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি পাহারাদারকে ডাকলো। বললো–রসুইঘর থেকে একটু কাঠকয়লার গুঁড়ো নিয়ে এসো।

খুব সন্তর্পণে ফ্রান্সিস সেই কাগজটায় কাঠকয়লার গুঁড়ো ঘষলো। আস্তে আস্তে কালো ছাপগুলো স্পষ্ট হলো। একটাতে মাথা আঁকা। অন্যটাতে কয়েকটা ত্রিকোণ নকশা দেখা গেল। ফ্রান্সিস বললো–এটা উলটো ছাপ আলোয় ধরলে সোজা ছাপ পাবো।

ফ্রান্সিস কাগজটাকে আলোর সামনে ধরল। একটা অস্পষ্ট নকশা ফুটে উঠল।

ফজল একটু উসখুস করে ডাকলো ফ্রান্সিস?

–কি হলো?

–এটা যাওয়ার পথের নকশা।

–হ্যাঁ। কিন্তু কয়েকটা চিহ্নের মানে বুঝতে পারছি না। ভাবতে হবে।

–কিন্তু আমি তো এখন—

–হ্যাঁ তুমি জাহাজে ফিরে যাও। কাগজটা থাক আমার কাছে।

–বেশ–ফজল চলে গেল।

পরের দিন ফ্রান্সিস হ্যারিকে নকশাটা দেখালো। হ্যারি মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারলনা। গম্ভীর মুখে বলল–ভুতুরে নকশা।

ফ্রান্সিস হাসলো। বললো–এই দেখ, তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি–বলে ফ্রান্সিস ‘ক’ ‘খ’ করে প্রত্যেকটি চিহ্নের আলাদা নামকরণ করল। প্রত্যেকটি চিহ্নের অর্থ কি তাও বলল। ক = জাহাজ। খ ও গ = ডুবো পাহাড়। ঙ = সোনার ঘণ্টার দ্বীপ। য ও ঘ = পাথুরে দ্বীপ।

হ্যারি হতবাক হয়ে ফ্রান্সিসের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে তারপর বলল–তুমি কি করে বুঝলে ত্রিকোণগুলো পাথুরে দ্বীপ?

–ঝড়ের সময় মাস্তুলে উঠে ঠিক যা-যা দেখেছিলাম–নকশাটাতে তাই আঁকা আছে।

–তাহলে এটাই যাওয়ার পথের নকশা?

–নিশ্চয়ই। কিন্তু গোলমাল বাধিয়েছে ‘ক’ থেকে ‘ঘ’ পর্যন্ত এই অস্পষ্ট রেখাটা। রেখাটা আবার ‘ঘ’ দ্বীপটার চারদিকেও রয়েছে।

–এ তো সোজা।

–সোজা?

–হ্যাঁ, জাহাজটা এই পথে যাবে।

–ধোৎ ধোৎ, এ তো শিশুও বুঝবে–কিন্তু, প্রশ্ন হলো–কি করে?

হ্যারি এবার ঠাট্টা করার লোভ সামলাতে পারল না। বললো–দাগটা মনে হয় সুতো।

–সুতো?

–হ্যাঁ–সুতো দিয়ে জাহাজটা টেনে নিয়ে যেতে বলছে।

ফ্রান্সিস এক মুহূর্ত হ্যারির দিকে তাকিয়ে রইলো। পরক্ষণেই ওর চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সে আচমকা এক রদ্দা কষালো হ্যারির ঘাড়ে। হ্যারি বিছানা থেকে প্রায় ছিটকে পড়ে আর কি। ফ্রান্সিসের সেদিকে নজর নেই। সে তখন বিছানায় উঠে দাঁড়িয়ে নাচতে শুরু করেছে। হ্যারি ঘাড়ে হাত বুলোত বুলোতে অবাক চোখে ফ্রান্সিসের নাচ দেখতে লাগল। নাচ থামিয়ে ফ্রান্সিস ডাকল–হ্যারি ঘাড়ে লেগেছে খুব?

-–নাঃ–এমন আর কি! কিন্তু তোমার এই হঠাৎ পুলকের কারণটা কি?

–সুতো।

–সুতো?

–তুমি যে বললে, সুতো দিয়ে জাহাজ টেনে নিয়ে যাওয়া।

–তুমি কি তাই করতে চাও নাকি?

–হ্যাঁ, তবে সুতো নয়, মোটা কাছি। দ্বীপটার চারদিকে গোল দাগ মানে কাছিটা দ্বীপের, পাথরের সঙ্গে বাঁধতে হবে।

ফ্রান্সিস হ্যারির পাশে এসে বসলো। শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো–আচ্ছা, হ্যারি, আমাদের জাহাজে কাঠের পাটাতন কত আছে।

–আর একটা জাহাজ তৈরি করার মতো নেই।

–কিন্তু একটা বেশ শক্ত নৌকো।

–হ্যাঁ, তা তৈরি করা যাবে।

–আর দড়িকাছি এসব?

–যথেষ্ট আছে।

–আজ থেকে তাহলে কাজে লাগাতে হবে। আমাদের দলের লোকদের ডেকে বলে দাও–সবাইকে হাত লাগাতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা শক্ত নৌকো তৈরি করতে হবে, আর একটা শক্ত লম্বা কাছি।

–কতটা লম্বা?

–যতটা লম্বা হতে পারে?

–বেশ।

দিন-রাত কাজ চললো। নৌকো, জাহাজ তৈরি করতে ভাইকিংরা খুবই দক্ষ। প্রয়োজনীয় সাজসরঞ্জাম সবই জাহাজে মজুত থাকে। দিনকয়েকের মধ্যেই একটা নৌকো তৈরি হয়ে গেল। দড়িদড়া যা ছিল, পাক দিয়ে দিয়ে বেশ শক্ত কাছিও তৈরি হলো একটা। এবার কুয়াশা, ঝড় আর ডুবো পাহাড়ের প্রতীক্ষা। পরদিন সকাল থেকেই সূর্যের আলো কেমন ম্লান হয়ে গেল। সমুদ্রের বুকে এদিক-ওদিক কুয়াশায় জটলা দেখা গেল। হ্যারি ছুটে এলো ফ্রান্সিসের কাছে। বললো–ফ্রান্সিস, আমরা এসে গেছি।

–কুয়াশা? ফ্রান্সিস শুধু এই কথাটাই বললো।

–হ্যাঁ।

–দাঁড়াও, সেনাপতি কি করে দেখা যাক।

–কিন্তু ওর ওপর নির্ভর করতে গেলে আমাদের জাহাজ টুকরো-টুকরো হয়ে যাবে।

–সেনাপতিরও সেই ভয় আছে। দেখোই না, ও কি করে। সেনাপতি ছিল ফ্রান্সিসদের জাহাজে। সে শিঙা বাজাবার হুকুম দিলো। এই জাহাজে শিঙা বাজাতে সুলতানের জাহাজেও শিঙা বেজে উঠল। বাতাস পড়ে গেছে। দাঁড় টানতে হবে। পাল নামাতে হবে। সবাই যে যার জায়গায় চলে গেল।

জাহাজ ললো। চারদিকের কুয়াশা ঘন হতে লাগল। একটু পইে পকেই প্রচণ্ড ঝড়ের ঝাপ্টায় ঢেউগুলি ফুলে উঠেজাহাজের গায়ে এসেবঁপিয়েপল। সেনাপতিঙ্কুম দিল–পঁড় বাইতে থাকে।

দাঁড়িরা প্রাণপণে দাঁড় বাইতে লাগল। জাহাজ একটু এগোয়, আবার ঝড়ের ধাক্কায় পিছিয়ে আসে। সেই ঝড়ের শব্দের মধ্যে সোনার ঘন্টা বেজে উঠল–ঢং-ঢং-ঢং। সবাই সেই শব্দ শুনলো। সুলতান নিজের জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়েই সেই শব্দ শুনলেন। তার চোখ দুটো ক্ষুধার্ত বাঘের মত জ্বলে উঠল। সোনার ঘন্টা–এত কাছে? সেই জল ঝড়ের মধ্যে সেনাপতি দেখলো–দুদিকে দুটো ডুবো পাহাড়। ঝড়ের ধাক্কাটা আসছে ডানদিক থেকে। ডানদিকের ডুবো পাহাড়ের জন্যে ভয় নেই। কারণ জাহাজ ওদিকে যাবে না। কিন্তু আর একটু এগোলে ঝড়ের ধাক্কায় জাহাজটা বাঁদিকের ডুবো পাহাড়ের গায়ে গিয়ে ছিটকে পড়বে। তারপরের কথা সেনাপতি আর ভাবতে পারলো না। সে আর এগোতে সাহস পেল না। জাহাজ ধীরেধীরে পিছিয়ে আসতে লাগল। দেখা গেল সুলতানের জাহাজটা এই জাহাজের দিকে এগিয়ে আসছে। এই জাহাজের গায়ে এসে লাগল ওটা। ক্রুদ্ধ সুলতান ভাইকিংদের

জাহাজে উঠে চীৎকার করে সেনাপতিকে ডাকলেন। সেনাপতি এগিয়ে এসে দাঁড়ালো।

–জাহাজ পিছিয়ে নিয়ে এলেন কেন?

–সামনেই ডুবো পাহাড়। পিছিয়ে না এলে এতক্ষণে দুটো জাহাজই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেত।

–আমি কোন কথা শুনতে চাই না। আমাকে সোনার ঘন্টার দ্বীপে নিয়ে যেতেই হবে। সুলতান গর্জে উঠলেন।

সেনাপতি চুপ করে রইলো। সুলতান কিছুক্ষণ সেনাপতির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন–কি? আপনি জাহাজ নিয়ে যেতে পারবেন না?

সেনাপতি মাথা নাড়ল–না।

সুলতান চারপাশে ভিড় করে দাঁড়ানো ভাইকিংদের দিকে তাকিয়ে গলা চড়িয়ে বললেন–তোমাদের মধ্যে কেউ পারবে?

কেউ কোন কথা বলল না। সুলতান অসহিষ্ণু স্বরে মন্তব্য করলেন ভাইকিংরা নাকি খুব সাহসী। জাহাজ চালাতে ওস্তাদ?

হ্যারি ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বললো–কথাটা মিথ্যে নয়, সুলতান।

সুলতান কম করে হ্যারির দিকে তাকিয়ে বললেন–বেশ, তার প্রমাণ দাও।

–ডুবো পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে জাহাজ নিয়ে যাওয়া অসম্ভব।

–তাহলে তোমরা কেউই পারবে না?

–একজন হয় তো পারে।

–কে সে?

–ফ্রান্সিস?

সুলতান অবাক চোখে হ্যারির দিকে তাকালেন। তারপর গম্ভীর স্বরে বললেন তুমি কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছো?

–আজ্ঞে না। ফ্রান্সিস বেঁচে আছে, আর এই জাহাজেই আছে।

সুলতান ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে রহমানের দিকে তাকালেন।

রহমান তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করলো–কিন্তু ফ্রান্সিস বাঁচলো কী করে?

–আপনারা কি সেই ইতিহাসই শুনবেন এখন, না দ্বীপে যাবার চেষ্টা করবেন।

সুলতান এতক্ষণে যেন একটু শান্ত হলেন। ধীর স্বরে বললেন–যদি ফ্রান্সিস দুটো জাহাজই নিরাপদে নিয়ে যেতে পারে, তাহলে ওকে মুক্তি দেবো।

–বেশ। তাহলে ফ্রান্সিসকে ডাকি?

–হ্যাঁ।

ফ্রান্সিস সিঁড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে সবই শুনছিল। এবার আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে সুলতানের সামনে দাঁড়াল। ভাইকিংরা ফ্রান্সিসকে দেখে অবাক। পরক্ষণেই সবাই আনন্দে চীৎকার করে, উঠল। সুলতান ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন তুমি বোধহয় সবই শুনেছ।

–হ্যাঁ, কিন্তু আমি একা মুক্তি চাই না, আমাদের সবাইকে মুক্তি দিতে হবে।

সুলতান মাথা নীচু করে একটু ভাবলেন। তারপর মাথা তুলে বললেন–বেশ। তাই হবে।

সুলতান আর কোন কথা না বলে নিজের জাহাজে ফিরে গেলেন।

ফ্রান্সিস এবার ভাইকিং বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল–ভাইসব, আমি জানি তোমরা আমাকে বিশ্বাস করো। আমি জীবন দিয়েও তোমাদের সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখব।

সবাই হর্ষধ্বনি করে উঠল। ফ্রান্সিস বললো–অনেক দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিয়ে আজকে আমরা

সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছি। জীবনের কোন সুলতান ফ্রান্সিসের মখের দিকে তাকিয়ে দুঃখ-কষ্টই বৃথা যায় না। আমরা সফল হবোই। বললেন, তুমি বোধহয় সবই শুনেছ। সোনার ঘন্টার সেই দ্বীপ আমাদের নাগালের মধ্যে। শুধু একটা বাধা ডুবো পাহাড়। সেই বাধা অতিক্রমের উপায় আমরা জানতে পেরেছি। এখন সবকিছু নির্ভর করছে আমাদের শক্তি সাহস আর বুদ্ধির ওপরে। তোমরা আমাকে সাহায্য করো।

সবাই চীৎকার করে ফ্রান্সিসকে উৎসাহিত করলো।

ফ্রান্সিস বলতে লাগল এবার আমাদের কি কাজ তাই বলছি। কয়েকজন চলে যাও জাহাজের পেছনে। সুলতানের জাহাজটা আমাদের জাহাজের সঙ্গে শক্ত করে বাঁধতে হবে। আর একদল চলে যাবে দাঁড় টানতে। বাকি সবাই থাকবে ডেকের ওপর।

ফ্রান্সিস একটু থেমে আবার বলতে লাগল–ঝড় শুরু হলেই আমি আর হ্যারি যে নৌকোটা আমরা তৈরি করেছি, সেটাতে চড়ে এগিয়ে যাবো। আমাদের সঙ্গে থাকবে একটা লম্বা কাছি। দুটো ডুবো পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে একটু এগোতে পারলেই শান্ত সমুদ্র পাব। তার ডানপাশেই ন্যাড়া পাহাড়ের দ্বীপ। সেখানে পাহাড়ের মাথায় আমরা কাছির একটা প্রান্ত বাঁধবো। কাছিটার আর একটা প্রান্ত থাকবে ডেকে যারা দাঁড়িয়ে থাকবে, তাদের হাতে। আমি কাছিটার তিনবার ঝাঁকুনি দিলেই তারা কাছি টানতে শুরু করবে। দাঁড়িরা দাঁড় বাইতে শুরু করবে। দাঁড়িরা দাঁড় বাইতে শুরু করবে। দুটো জাহাজই বিনা বাধায় ডুবো পাহাড় পেরিয়ে যেতে পারবে। আমরা সফল হবোই।

সবাই হর্ষধ্বনি করে উঠল–ও-হো-হো। ফ্রান্সিসের নির্দেশমত কাজে লেগে পড়ল সব। জাহাজ আবার এগিয়ে চলল সোনার ঘন্টার দ্বীপের দিকে। একটু পরেই কুয়াশার ঘন আস্তরণ ঘিরে ধরলো জাহাজটাকে। তারপরেই শুরু হলো ঝড়ের তাণ্ডব। ফ্রান্সিস আর হ্যারি নৌকোটা জলে ভাসালো। সেই মস্ত লম্বা কাছির একটা প্রান্ত ধরে রইলো জহাজের ডেকে দাঁড়ানো ভাইকিংরা। ফ্রান্সিস নৌকোর দাঁড় বাইতে লাগল। হালে বসল হ্যারি। ওরা কাছি ছাড়তে ছাড়তে এগিয়ে চলল। কিন্তু সেই উঁচু-উঁচু ঢেউ পেরিয়ে এগোনো সোজা কথা নয়। তার সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া, ঢেউয়ের ঝাঁপটা। ফ্রান্সিস প্রাণপণে দাঁড় বাইতে লাগল। সেই প্রচণ্ড দুলুনি উপেক্ষা করে হ্যারি হাল ধরে চুপ করে বসে রইলো।

এমন সময় সোনার ঘন্টার গভীর শব্দ শোনা গেল–ঢং-ঢং-ঢং।

জাহাজ থেকে ভাইকিংরা মহা উল্লাসে চীৎকার করে উঠল। ঝড়ের শব্দ ছাপিয়ে ওদের সেই চীৎকারের শব্দ ফ্রান্সিস আর হ্যারি শুনতে পেল। আজকে চূড়ান্ত লড়াই। দুজনে নতুন উদ্যমে নৌকো চালাতে লাগল। প্রচণ্ড ঢেউয়ের ওঠা-পড়ার মধ্যে দিয়ে ফ্রান্সিস পাকা নাবিকের মত নৌকো চালাতে লাগল। এক-একবার মনে হচ্ছে নৌকোটা বোধহয় ঢেউয়ের গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে, আবার ঢেউয়ের মাথায় উঠে আসছে। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে ফ্রান্সিস আবছা দেখলো বাঁদিকের ডুবো পাহাড়ের ভেসে ওঠা মাথাটা। সমুদ্রের জলের ঢেউ সরে যেতেই মাথাটা ভেসে উঠছে, পরক্ষণেই ডুবে যাচ্ছে। ঝড়ের ধাক্কাটা আসছে ডানদিক থেকে। কাজেই যে করেই হোক ডানদিক ঘেঁষেই ওদের বেরিয়ে যেতে হবে। নইলে ঝড়ের ধাক্কায় নৌকো বাঁদিকের ডুবো পাহাড়ে গিয়ে আছড়ে পড়বে। নকশটাতে ডানদিক ঘেঁষে যাওয়ার নির্দেশ আছে। ফ্রান্সিস চীৎকার করে হ্যারিকে বললো–ডানদিক ঘেঁষে।

হ্যারি শক্ত করে হাল ধরে রইলো। আস্তে-আস্তে নৌকো এগোতে লাগলো। সমস্ত শরীর জলে ভিজে গেছে। যেন স্নান করে উঠেছে দুজনে। সমুদ্রের নোনা জলে চোখ জ্বালা করছে। তাকাতেও কষ্ট হচ্ছে। বুকে যেন আর দম নেই। হাত অবশ হয়ে আসছে। শুধুতো দাঁড়টানাই না, কাছিটাও শক্ত করে ধরতে হচ্ছে মাঝে মাঝে। সমস্ত কাছিটাই যাতে সমুদ্রের জলে পড়ে না যায়, তার জন্যে ফ্রান্সিস কাছির প্রান্তটি নৌকার সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল।

হঠাৎ ডানদিকের ডুবো পাহাড়ের মাথাটা একবার ভেসে উঠেই ডুবে গেল। সঙ্গে সঙ্গে পর-পর কয়েকটা ঢেউয়ের প্রচণ্ড ধাক্কায় নৌকোটা সামনের দিকে এগিয়ে এলো। আশ্চর্য আর বৃষ্টি নেই। হাওয়ার তেজও কমে গেছে। ফ্রান্সিস পেছন ফিরে তাকালো। নৌকো ডুবো পাহাড় ছাড়িয়ে অনেকখানি এগিয়ে এসেছে। তারও পেছনে জাহাজ দুটো। ঝাপসা কাঁচের মধ্যে দিয়ে যেন দেখছে ফ্রান্সিস, ঝড়ের ধাক্কায় জাহাজ দুটো একবার উঠছে, একবার পড়ছে। আর ঝড় নেই। আকাশে জ্বলন্ত সূর্য। পরিষ্কার নির্মেঘ আকাশ। সমুদ্রের ঢেউ শান্ত। সূর্যের আলোয় ঝকঝক করছে দুদিকের পাথুরে দ্বীপ। আরো দূরে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, সবুজ ঘাসে ঢাকা একটা পাহাড়ের দ্বীপ। পাহাড়ের মাথায় একটা সাদা রঙের মন্দির মত। ফ্রান্সিস হ্যারির দিকে তাকিয়ে হাসল। হ্যারিও হাসল। কিন্তু আনন্দের সময় এখন নয়। আসল কাজই এখন বাকি।

ডানদিকের ন্যাড়া পাহাড়ের দ্বীপটায় ওরা নৌকো লাগাল। নৌকায় বাঁধা কাছির মুখটা খুলে কাঁধে নিলো ফ্রান্সিস। তারপর পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে লাগল। ছোট্ট পাহাড়। শ্যাওলা ধরা পেছল পাথরে সন্তর্পণে পা ফেলে-ফেলে ওরা এক সময় পাহাড়টার মাথায় উঠে এল। তারপর কাছিটাকে শক্ত প্যাঁচ দিয়ে পাহাড়ের মাথায় বাঁধলো। টেনে দেখলো যথেষ্ট শক্ত হয়েছে। দুজনে মিলে কাছিটাকে যথাসাধ্য টান-টান করে ধরল। তারপর তিনবার জোরে ঝাঁকুনি দিলো। জাহাজের ডেকে যারা কাছিটার আর একটা প্রান্ত ধরে ছিল, তারা সংকেতটা বুঝতে পারল। তারা এবার সবাই মিলে কাছিটা টানতে লাগল। দাঁড়িদেরও খবর দেওয়া হলো। তারাও প্রাণপণে দাঁড় টানতে লাগল। জাহাজ দুটো সেই জল ঝড়ের মধ্যে দিয়ে দোল খেতে-খেতে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল। একসময় ডুবো পাহাড় দুটোও পেরিয়ে গেল। হঠাৎ আর বৃষ্টি নেই, ঝড় নেই। শান্ত সমুদ্র। চারদিকে যতদূর চোখ যায়, শুধু ঝলমলে রোদ। সবাই আনন্দে চীৎকার করে উঠল। একদল ডেকের ওপর নাচতে শুরু করলো। কেউ-কেউ হেঁড়ে গলায় গান ধরলো। সুলতানের জাহাজেও আনন্দের বান ডাকলো। সৈন্যরা কেউ-কেউ চীৎকার করতে করতে শূন্যে তরোয়াল ঘেরাতে লাগল। সুলতান ডেকে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে-নেড়ে সবাইকে উৎসাহিত করতে লাগলেন।

ফ্রান্সিস আর হ্যারি কাছি বেয়ে-বেয়ে জাহাজে উঠে এল। সবাই উঠে এলো ওদের জড়িয়ে ধরবার জন্যে। ওদের দুজনকে কাঁধে নিয়ে নাচানাচি শুরু হয়ে গেল। সেই শান্ত সমুদ্রের বুক ভরে উঠল বহু কণ্ঠের চীৎকার, হই-চই আনন্দধ্বনিতে। জাহাজ দুটো এবার চললো সামনের সেই ঘাসে ঢাকা পাহাড়ের দ্বীপটার দিকে। চুড়োয় সাদা গোল মন্দিরটায় সূর্যের আলো পড়ছে। ওখানেই আছে সোনার ঘন্টা।

দূরত্ব বেশী নয়। একটু পরেই জাহাজ দুটো সবুজ ঘাসে ঢাকা দ্বীপটায় এসে ভিড়ল। দ্বীপে প্রথমে নামলেন সুলতান। তার সঙ্গে রহমান, তারপর আরো কয়েকজন সৈন্য। সুলতান ফ্রান্সিসকে ডেকে পাঠালেন। ফ্রান্সিস ও হ্যারি আর কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে জাহাজ থেকে নেমে এলো। তারপর সবাই সেই ঘাসে ঢাকা পাহাড়ের গা বেয়ে-বেয়ে উঠতে লাগল। খাড়া পাহাড় নয়, কাজেই পাথরের খাঁজে-খাঁজে পা রেখে ঝোঁপঝাড় ধরে উঠতে খুব একটা কষ্ট হলো না। মন্দিরের কাছে পৌঁছে সবাই থামলো। তাকিয়ে-তাকিয়ে গোল মন্দিরটা দেখলো। সাদাটে রঙের আস্তরণ মন্দিরটায়। এখানে-ওখানে সবুজশ্যাওলার ছোপ। জাহাজ থেকে যতটা ছোট মনে হচ্ছিল, ততো ছোট নয়। মন্দিরটায় একটা মাত্র ছোট দরজা। দরজাটা খোলা। কোন পাল্লা নেই। সুলতান একাই মন্দিরটার দিকে এগোলেন। আর সবাই অপেক্ষা করতে লাগল। জাহাজের সবাই ডেকে এসে ভীড় করে দাঁড়িয়েছে। তাকিয়ে দেখছে এখানে কি ঘটছে। সবার মনেই বোধহয় এক প্রশ্ন–সোনার ঘন্টা কি এখানেই আছে?

সুলতান মন্দিরে মধ্যে ঢুকলেন। সবাই উৎকণ্ঠিত। সবাই যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে চুপ হয়ে আছে। শুধু সমুদ্রে ঢেউয়ের ওঠা-পড়ার শব্দ। শুধু বাতাসের শোঁ-শোঁ শব্দ। আর কোন শব্দ নেই। এতগুলো মানুষ। কারো মুখে কোন কথা নেই।

একটু পরে সুলতান ধীরে পায়ে মন্দিরটা থেকে বেরিয়ে এলেন। ফ্রান্সিসরা যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখানে এসে একবার ফ্রান্সিসের দিকে আর একবার রহমানের দিকে তাকিয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। ফ্রান্সিসের বুক দমে গেল। তবে কি সোনার ঘন্টা এখানে নেই? এত দুঃখ-কষ্ট, এত পরিশ্রম সব অর্থহীন? সব ব্যর্থ?

ফ্রান্সিস আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। ছুটে মন্দিরটার মধ্যে গিয়ে ঢুকলো। কোথায় সোনার ঘন্টা? মন্দিরটার মাথা থেকে পেতলের শেকলে ঝুলছে একটা পেতলের ছোট্ট ঘন্টা। চারদিকেই দেয়াল। আর কিছু নেই মন্দিরটাতে। রাগে-দুঃখে ফ্রান্সিসের চোখ ফেটে জল এলো। এই তুচ্ছ একটা পেতলের ঘন্টার জন্যে এত দুঃখ-কষ্ট? সেই ছেলেবেলা থেকে যে স্বপ্ন দেখে এসেছে, সেই স্বপ্ন, এইভাবে ব্যর্থ হয়ে যাবে? সোনার ঘন্টার গল্প তাহলে একটা ছেলেভুলোনা কাহিনী মাত্র? ফ্রান্সিসের মাথায় যেন খুন চেপে গেল। সে দুহাতে পেতলের ঘন্টাটা জোরে ছুঁড়ে দিলো দেওয়ালের গায়ে।

ঢং-ঢং-ঢং–প্রচণ্ড শব্দে ফ্রান্সিস ভীষণ চমকে উঠল। দুহাতে কান চেপে বসে পড়ল। একি? তবে–তবে কি–সমস্ত গোলাকার মন্দিরটাই একটা সোনার ঘন্টা?

ঢং-ঢং ঘন্টার শব্দ বেজে চললো। বাইরে সুলতান, রহমান, হ্যারি, সঙ্গের সৈন্যরা, নীচে জাহাজের উৎসুক ভাইকিংরা সবাই প্রচণ্ড বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল গোল মন্দিরটার দিকে। এত বড় সোনার ঘন্টা! ঢং-ঢং, গম্ভীর শব্দ ছড়িয়ে পড়তে লাগল মাথার ওপরে নীল আকাশের নিচে শান্ত সমুদ্রের বুকের ওপর দিয়ে দূর-দূরান্তরে।

সুলতানের মুখে হাসি ফুটলো। ফ্রান্সিস মন্দির থেকে বেরিয়ে আসতে হ্যারি তাকে। জড়িয়ে ধরলো। আনন্দে অতগুলো মানুষের চীৎকার হৈ-হুঁল্লায় নির্জন দ্বীপমুখর হয়ে উঠল। কিন্তু এই আনন্দ আর উল্লাসের মুহূর্তে কেউই লক্ষ্য করেনি, যে সেই ডুবো পাহাড়ের দিক থেকে একটা জাহাজ তীরবেগে সোনার ঘন্টার দ্বীপের দিকে ছুটে আসছে।

সেই জাহাজটাকে প্রথম দেখলো রহমান। সে সুলতানের কাছে ছুটে এলো। সুলতান তখন সোনার ঘন্টার বাইরের পলেস্তারটা কতটা শক্ত, তাই পরীক্ষা করছিলেন। রহমান সুলতানকে জাহাজটা দেখালো। তখন জাহাজটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। এতক্ষণে সবাই দেখতে পেল সেই দ্রুত ছুটে আসা জাহাজটাকে। একটা কালো পতাকা উড়ছে জাহাজটার মাস্তুলে। তাতে সাদা রঙের মড়ার মাথার খুলি আর ঢ্যাঁড়ার মত দুটো হাড়ের চিহ্ন আঁকা। জলদস্যুদের জাহাজ। নীচের জাহাজ দুটোয় সাজ সাজ রব পড়ে গেল। সবাই যুদ্ধের জন্য তৈরি হতে লাগলো। সুলতান, রহমান, ফ্রান্সিস সবাই দ্রুত পায়ে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসতে লাগল।

জলদস্যুদের জাহাজটা প্রথমে সুলতানের জাহাজের গায়ে এসে লাগল। খালি গা, মাথায় কাপড়ের ফেট্টি বাঁধা খোলা তরোয়াল হাতে জলদস্যুরা জাহাজে লাফিয়ে উঠে এল। এবার ফ্রান্সিসদের জাহাজের গায়ে লাগল। সেখানেও শুরু হল তরোয়ালের যুদ্ধ। চীৎকার, হই-চই, তরোয়ালের ঠোকাঠুকির শব্দ, আহত আর মুমূর্ষদের আর্তনাদে ভরে উঠল সমস্ত এলাকাটা। লড়াই চলতে লাগল। সুলতান রহমান, ফ্রান্সিস তারাও ততক্ষণে নেমে এসেছে। তারাও ঝাঁপিয়ে পড়ল তরোয়াল হাতে জলদস্যুদের উপর।

যুদ্ধ করতে করতে হঠাৎ ফ্রান্সিস মকবুলকে দেখতে পেল। তার পরনে জলদস্যুদের পোশাক নয়, আরবীয়দের পোশাক। এতক্ষণে ফ্রান্সিসের কাছে সব স্পষ্ট হলো। তাহলে মকবুলই এই জলদস্যুদের সোনার লোভ দেখিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে। যুদ্ধের ফাঁকে এক সময় ফ্রান্সিস চীৎকার করে মকবুলকে ডাকলো মকবুল, আমাকে চিনতে পারছো?

মকবুল ওর দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে হাসল। তারপর গলা চড়িয়ে বলল–আমি বেঁচে থাকতে সোনার ঘন্টা কেউ নিয়ে যেতে পারবে না।

ফ্রান্সিস আর কোন কথা বলল না। নিপুণ হাতে তরোয়াল চালিয়ে জলদস্যুদের সঙ্গে লড়াই করতে লাগল।

–ফ্রান্সিস! ডাক শুনে ফ্রান্সিস পেছনে তাকিয়ে দেখল ফজল।

–মকবুল এদের সঙ্গে এসেছে তাইনা? ফজল জিজ্ঞেস করল।

–ঠিক ধরেছ।

–কিন্তু ওরা এল কি করে?

–আমাদের জাহাজ অনুসরণ করে ওরা এসেছে। আমরা যেভাবে ডুবো পাহাড় পেরিয়েছি, ওরা ঠিক সেইভাবেই পেরিয়েছে।

–মকবুলকে দেখেছো?

–ঐ যে মাস্তুলটার ওপাশে লড়াই করছে।

ফজল আর দাঁড়ালো না। সেইদিকে ছুটলো। মকবুল কিছু বোঝবার আগেই ফজল মকবুলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। দুজনের লড়াই শুরু হয়ে গেল। মকবুলের তুলনায় ফজলের হাত অনেক নিপুণ। ফজল বেশ সহজ ভঙ্গিতেই তরোয়াল চালাচ্ছিলো।

অল্পক্ষণের মধ্যেই মকবুল বেশ হাঁপিয়ে পড়লো। ফজলও হাঁপাচ্ছিল। একবার দম নিয়ে ফজল বললো–মরুদস্যুদের দলে ঢুকেছিলাম, শুধুই তরোয়াল চালানো শেখবার জন্যে। তারপর কপালের কাটা দাগটা দেখিয়ে বলল–এটার বদলা নিতে হবে তো।

মকবুল কোন কথা না বলে তরোয়াল উঁচিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আবার লড়াই শুরু হল। প্রথম আক্রমণের মুখে ভাইকিং আর সুলতানের সৈন্যরা হকচকিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আক্রমণের প্রথম ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে তাদের বেশি সময় লাগল না। সুলতানের বাছাই করা সৈন্য আর দুধর্ষ ভাইকিংদের হাতে জলদস্যুরা কচুকাটা হতে লাগল। ওরা পিছু হটতে লাগল। দুজন একজন করে নিজেদের জাহাজে পালাতে লাগল। এদিকে মকবুল ফজলের সঙ্গে লড়াই করতে করতে হঠাৎ দড়িতে পা আটকে ডেকের ওপর চিৎ হয়ে পড়ে গেল। ফজল ওর বুকে তরোয়ালটা চেপে ধরল। দুজনেই ভীষণভাবে হাঁপাচ্ছে তখন। দেখতে পেয়ে ফ্রান্সিস ছুটে এলো। ফজলের হাত চেপে ধরে বলল ফজল, ওকে মেরে ফেলোনা।

ফজল দাঁত চিবিয়ে বললো–আমি যদি না মারি, ও আমায় মারবে।

–তবু আমার অনুরোধ, ওকে ছেড়ে দাও।

ফজল এক মুহূর্ত ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–বেশ। তোমার কথাই রাখলাম।

ফজল তরোয়াল সরিয়ে নিলো। মৃত্যু ভয়ে মকবুলের মুখটা কাগজের মত সাদা হয়ে । গিয়েছিল। ও হাঁ করে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে যে ও বেঁচে গেল, এটা ওর বুঝতে সময় লাগল। কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো ওদের দিকে।

তারপর আস্তে-আস্তে উঠে বসল। ফ্রান্সিস ডাকলো–মকবুল!

মকবুল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ফ্রান্সিসের দিকে তাকালো।

–এই জলদস্যুরা কি তোমার বন্ধু? তুমি কি এদের সঙ্গে ফিরে যেতে চাও?

–না।

–এখনও ভেবে দেখো, ওরা কিন্তু জাহাজ ছেড়ে দিচ্ছে।

সত্যিই জলদস্যুরা তখন নিজেদের জাহাজে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করছে। বাকি কয়েকজন গিয়ে উঠলেই জাহাজ ছেড়ে দেবে। মকবুল ভয়ার্ত চোখে ফ্রান্সিসের দিকে তাকালো। বললো–না-না, আমাকে ঐ জাহাজে আর পাঠিয়ো না।

–কেন? ফ্রান্সিস ব্যঙ্গ করে বললো–তোমার বন্ধু ওরা। তোমার জন্যে সোনার ঘন্টা উদ্ধার করে দিতে এসেছিলো। এক সঙ্গেই যেমন এসেছে, ফিরেও যাও একসঙ্গে।

–না-না, ওরা আমাকে পেলে হাঙরের মুখে ছুঁড়ে ফেলে দেবে।

–হুঁ। ফ্রান্সিস একটু চুপ করে থেকে বললো–এবার আমার মোহরটা ফেরত দাও।

মকবুল কোমরবন্ধনী থেকে একটা থলে বের করলো। থলে থেকে ফ্রান্সিসের সেই চুরি যাওয়া মুদ্রাগুলো আর মোহরটা বের করে ফ্রান্সিসের হাতে দিলো। মোহরটা হাতে পেয়েই ফ্রান্সিস আর ফজল মোহরটার ওপর ঝুঁকে পড়লো। মনোযোগ দিয়ে উল্টে পিঠের দ্বীপ থেকে ফিরে আসার নকশাটা দেখতে লাগল।

মকবুল ত্রুর হাসি হেসে বললো–অন্য মোহরটা যদি পেতাম, তাহলে এই সোনার ঘন্টা তোমরা নিয়ে যেতে পারতে না।

–জানি। ফ্রান্সিস মোহরটা থেকে চোখ না সরিয়েই বললো।

জলদস্যুদের দল দ্রুত জাহাজ চালিয়ে সরে পড়লো। ওদের জাহাজ সমুদ্রের দিগন্তে মিলিয়ে যেতেই সুলতান সোনার ঘন্টা নামিয়ে আনার হুকুম দিলেন। সৈন্যরা সব দড়ি জোগাড় করে তৈরি হতে লাগলো।

নীচে জাহাজে যখন যুদ্ধ চলছিল, তখন সুলতানের হুকুমে মিস্ত্রীরা সোনার ঘন্টার গা থেকে পলেস্তারা খসাচ্ছিলো। এতক্ষণে পলেস্তারা খসানো শেষ হলো। সবাই কাজ ফেলে ডেকে এসে ভীড় করে দাঁড়ালো। সে এক অপরূপ দৃশ্য। বিস্ময়ে অবাক চোখে সবাই তাকিয়ে দেখতে লাগল।

অন্ধকার নামলো সোনার ঘন্টার দ্বীপে, বালিয়াড়িতে, সুদূর প্রসারিত সমুদ্রের বুকে। দ্বীপের সমুদ্রতীর বিরাট একটা কাঠের পাটাতন তৈরি করা হতে লাগল। ঐ পাটাতনে রাখা হবে সোনার ঘন্টা তারপর জাহাজের সঙ্গে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হবে।

রাত গভীর তখন। আকাশে আধভাঙা চাঁদ। ফ্রান্সিসের চোখে ঘুম নেই। ডেকের ওপরে পায়চারী করছে। কখনও দাঁড়িয়ে পড়ে দেখছে মশালের আলোগুলো কাঁপছে। ঠকঠক পেরেক পোঁতার শব্দ উঠছে। মিস্ত্রীদের কথাবার্তাও কানে আসছে। কিন্তু ফ্রান্সিসের সেদিকে কান নেই। নিজের চিন্তায় সে ডুবে আছে। এত দুঃখকষ্টর পর সোনার ঘন্টা যদিও বা পাওয়া গেল, কিন্তু সেটাকে নিজের দেশে নিয়ে যাওয়া হলো না! ফ্রান্সিস পাহাড়ী দ্বীপের চূড়োর দিকে তাকালো! জ্যোৎস্না পড়েছে সোনার ঘন্টার মসৃণ গায়ে। একটা মৃদু আলো চারিদিকবিচ্ছুরিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে, ওটা যেন মাটিতে নেই। শূন্যে ভাসছে। স্বপ্নময় রহস্যেভরা এর অপার্থিব সৌন্দর্যের আভাস। ফ্রান্সিসের মন বিদ্রোহ করলো। অসম্ভব! এমন সুন্দর একটা জিনিস, যেটাকে ঘিরে তার আবাল্যের স্বপ্ন গড়ে উঠেছে, সেটা এভাবে শুধু অর্থ আর লোকবলের জোরে সুলতান নিয়ে যাবে? আর ওরা তাকিয়ে দেখবে? না, এ কখনই হতে পারে না। আপন মনেই ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকাল–না না। যে করেই হোক, সোনার ঘন্টা তারা নিজের দেশে নিয়ে যাবে। এতে যদি তাদের জীবন বিপন্ন হয় হোক্।

পরদিন সকালেই ঘন্টার মাপ অনুযায়ী একটা মস্ত বড় কাঠের পাটাতন তৈরী হলো। এবার সোনার ঘন্টা নামিয়ে আনবার পালা। পাহাড়ের ঢালু গায়ে যে কটা খাটো গাছ ছিল, তাতেই দড়িদড়া বেঁধে কপিকলের মত করা হলো। তারপর সোনার ঘন্টা বেঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে নামানো হতে লাগল। কিন্তু দড়ি দড়ার কপিকল সোনার ঘন্টার অত ভার সহ্য করতে পারল না। দুতিন জায়গায় দড়ি ছিঁড়ে গেল। একটা গাছ তো গোড়সুদ্ধ উপড়ে গেল। পাহাড়ের ঢালু গা বেয়ে সোনার ঘন্টা ঢং-ঢং শব্দ তুলে গড়িয়ে পড়লো ধারে। কয়েকজন ছেঁড়া দড়িদড়াসুদ্ধ ছিটকে মারা পড়লো। কিন্তু সুলতানের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। হুকুম দিলেন, যে করেই হোক সোনার ঘন্টাকে কাঠের পাটাতনের ওপর তুলো। তারপর সেটাকে সুলতানের জাহাজের পেছনে বেঁধে যাত্রা শুরু হলো আমদাদ বন্দরের উদ্দেশ্যে।

মোহরের গায়ে যে নকশা আঁকা ছিল সেটা দেখে হিসাব করে ফ্রান্সিসই ফেরার পথের নিশানা বের করলো। জাহাজ দুটো চললো সেই পথ ধরে একটা অদ্ভুত পাহাড়ের নির্দেশ দেওয়া ছিল নকশাটায়। সেইউঁচু পাহাড়টারবনীচে একটা সুড়ঙ্গ পথ। ফ্রান্সিস হ্যারিকে যখন নকশাটা বোঝাল, হ্যারি বলল–তাহলে এই সুড়ঙ্গ পথটা দিয়েই তো । ফ্রান্সিস হাসল। বলল–প্রথমতঃ, এই সুড়ঙ্গ পথের খবর আমরা জানতাম না।

–আর দ্বিতীয় কারণ?

–আমার মনে হয়, ঐ পথ দিয়ে একটা জাহাজ এদিক থেকে ওদিকে যেতে পারে, কিন্তু ওদিক থেকে এদিকে আসতে পারে না।

–এ আবার হয় নাকি। হ্যারি অবাক হলো।

–প্রকৃতির বিচিত্র খেয়াল। ফ্রান্সিস হাসলো।

সন্ধ্যের সময় সেই উঁচু পাহাড়টায় দেখা পাওয়া গেল। কাছে যেতে সুড়ঙ্গ পথটাও দেখা গেল। একটা জাহাজ যেতে পারে, এমনি বড় পথ সেটা। ফ্রান্সিসের অনুমানই ঠিক।

সামনে রাত্রির অন্ধকার। অন্ধকারের মধ্যে সুড়ঙ্গ পথে ঢোকা বিপজ্জনক। স্থির হলো সকালের আলোর জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

পরদিন সকালে প্রথমে ফ্রান্সিসদের জাহাজটা ধীরে ধীরে সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকলো। একটু এগোতেই বাইরের আলো ম্লান হয়ে গেল। কেমন ছায়া-ছায়া হয়ে এল ভেতরটা। তবু মাথার ওপর ঝুঁকে পড়া ছাদ, দুপাশের পাথুরে দেওয়াল দেখা যাচ্ছিলো। সুড়ঙ্গটা একষ্টা জায়গায় বাঁক নিয়েছে। খুব সতর্কতার সঙ্গে দেওয়ালে ধাক্কা না লাগিয়ে জাহাজটাকে বাঁক ঘুরিয়ে বের করে নিয়ে আসা হলো। বাঁক ঘুরতে এক অপূর্ব দৃশ্য! এদিকে ওদিকে থামের মত গোল এবড়ো খেবড়ো পাথুরে দেয়াল জল থেকে উঠে ওপরের ছাদের সঙ্গে লেগে আছে যেন। সেগুলোর গায়ে নীলাভ দ্যুতিময় পাথরের টুকরো। ওপরের পাথুরে ছাদেও কত বিচিত্র বর্ণের পাথর। সেই ছাদের গা বেয়ে কোথাও বা শীর্ণ ঝরণার মত জল পড়ছে। যেটুকু আলো সুড়ঙ্গের থেকে বাইরে আসছিল, তাই দ্বিগুণিত হয়ে জায়গাটায় এক অপার্থিব আলোর জগৎ রচনা করেছে। বিচিত্র বর্ণের মৃদু আলোর বন্যা যেন। সবাই বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল।

ভাইকিংদের মধ্যে দু-একজন হাতুড়ি নিয়ে এলো। হাতের কাছে এত সুন্দর রঙিন পাথর। পাথুরে থামের গায়ে-গায়ে সেই নীলাভ পাথরের ঝিলিক। লোভ সামলানো দায়। ওরা নিশ্চয় থামগুলো ভেঙে পাথর নিয়ে আসতো। কিন্তু পারলো না ফ্রান্সিসের জন্যে।

ফ্রান্সিস চীৎকার করে বলল–কেউ থামগুলোর গায়ে হাত দেবে না।

ফ্রান্সিসের গম্ভীর কণ্ঠস্বর সুড়ঙ্গের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।

–কেন? হাতুড়ি হাতে একজন ভাইকিং বললো।

–এই থামগুলো পাহাড়টার ভারসাম্য রক্ষা করছে। যদি কোন কারণে ভেঙে যায়, সমস্ত পাহাড়টাই জাহাজের ওপর ভেঙে পড়বে।

সবাই বিপদের গুরুত্বটা বুঝলো। অগত্যা চেয়ে-চেয়ে দেখা ছাড়া উপায় কি? সবাই নিঃশব্দে সেই অপূর্ব স্বপ্নময় জগতের রূপ দেখতে লাগল। জাহাজ এগিয়ে চললো।

একসময় সুড়ঙ্গের ওপাশে আলো ফুটে উঠল। সুড়ঙ্গ শেষ হয়ে আসছে। সুড়ঙ্গের মুখ ছেড়ে জাহাজটা বাইরের রৌদ্রালোকিত সমুদ্রের বুকে আসতেই সবাই আনন্দে হই-চই করে উঠল। ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল–কিছু লক্ষ্য করেছিলে?

–কি?

–সুড়ঙ্গটা ভেতরের দিকে একটা অদ্ভুত বাঁক নিয়েছে। এপাশের কোন জাহাজই সেই বাঁক পেরোতে পারবে না।

–হ্যাঁ, এটা সত্যিই অদ্ভুত ব্যাপার। পর-পর সুলতানের জাহাজ আর সোনার ঘন্টা বসানো কাঠের পাটাতনটাও সুড়ঙ্গ পেরিয়ে চলে এলো। আবার চললো জাহাজ শান্ত সমুদ্রের বুক চিরে আমদাদ বন্দরের উদ্দেশ্যে।

সবাই নিশ্চিন্ত। যাক, অনেকদিন পরে আবার মাটির ওপর পা ফেলা যাবে। ভাইকিংদের কাছে আমদাদ বিদেশ। তবু তোক বিদেশ, মাটি তো! সুলতানের আদেশে মিস্ত্রীরা এর মধ্যেই বড়-বড় চাকা বানাতে শুরু করেছে। সোনার ঘন্টা বসানো পাটাতনটা চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত। চাকা লাগাতে পারলে কোন অসুবিধে নেই। ঘোড়া দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া যাবে। চাকা বানানোর কাজ চলছে পুরো দমে। জাহাজের সবাই খুসিতে মশগুল।

কিন্তু ফ্রান্সিসের চোখে ঘুম নেই। শুধু হ্যারিই ওর একমাত্র সমব্যথী। গভীর রাত্রে ডেকের ওপর দুজন দেখা হয়। সোনার ঘন্টার দিকে আঙুল দেখিয়ে ফ্রান্সিস বলে জানো হ্যারি, ওটা আমাদের প্রাপ্য, সুলতানের নয়।

–কিন্তু উপায় কি বলো!

–উপায়–বিদ্রোহ।

–সে কি! হ্যারি চমকে উঠে।

ফ্রান্সিস ডেকে অস্থিরভাবে পায়চারী করতে করতে বলে–কালকে রাত্তিরে কয়েকজন ভাইকিংকে নিয়ে এসো। সুলতানের সৈন্যদের একটু কায়দা করে হার স্বীকার করাতে হবে। তারপর সোনার ঘন্টা নিয়ে আমরা দেশের দিকে পাড়ি জমাবো।

–সুলতানের সৈন্যরা কিন্তু সংখ্যায় আমাদের প্রায় দ্বিগুণ।

–হ্যারি, আমি সব ভেবে রেখেছি।

পরের দিন গভীর রাত্রে ফ্রান্সিসের ঘরে সভা বসলো। কয়েকজন বিশ্বস্ত ভাইকিং এলো। কিভাবে বিদ্রোহ হবে, সুলতানের সৈন্যদের কিভাবে বোকা বানানো হবে, এসব কথা ফ্রান্সিস কিছু ভাঙলো না। শুধু ওদের মতামত চাইলো। দুজন বাদে সবাই ফ্রান্সিসকে সমর্থন করলো। সেই দুজন বললো–যদি বিদ্রোহ করতে গিয়ে আমরা হেরে যাই, সুলতান আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে। কারণ ওর কাছে আমাদের বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে।

ফ্রান্সিস বলল কথাটা সত্য!কিন্তু এছাড়া আমাদের উপায় কি? একবার আমদাদের রাজপ্রাসাদে সোনার ঘন্টা নিয়ে যেতে পারলে আমরা কোনদিনই ওটা উদ্ধার করতে পারবো না।

শেষ পর্যন্ত স্থির হল, অন্য ভাইকিং বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কিন্তু ফ্রান্সিসের কপাল মন্দ। এ কান সে কান হতে হতে কথাটা সুলতানের কানে গিয়েও উঠলো। সুলতান সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ভাইকিংদের কাছ থেকে তরবারি কেড়ে নেবার কুম দিলেন। তারপর নিরস্ত্র ভাইকিংদের জাহাজের নীচের কেবিনে বন্দী করে রাখা হল। সেনাপতি আর তার দলের লোকেরাও বাদ গেল না। সুলতান বোধহয় কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। ফ্রান্সিসের বিদ্রোহের পরিকল্পনা সমস্ত ভেস্তে গেল।

তখনও সূর্য ওঠেনি। আবছা অন্ধকারের মধ্য দিয়ে দূরে আমাদের দুর্গ চূড়া দেখা গেল। সূর্য উঠল। চারিদিক আলোয় ভেসে গেল। আমদাদ বন্দরের জাহাজ, লোকজন, দূর্গের। পাহারাদার সৈন্য সব স্পষ্ট হল। বন্দর আর বেশি দূরে নেই।

জাহাজ দুটো বন্দরে ভিড়লো। কিন্তু এ কি হলো? জনসাধারণের মধ্যে সেই আনন্দ উল্লাস কোথায়? কই কেউ তো সুলতানের জয়ধ্বনি দিচ্ছে না। দলে-দলে ছুটে আসছে না, সেই আশ্চর্য সোনার ঘন্টা দেখতে? সবাই যেন পুতুলের মত নিস্পৃহ চোখে তাকিয়ে দেখছে সুলতানের জাহাজ তীরে ভিড়লো, পেছনে সোনার ঘন্টার পাটাতন, তারপর ভাইকিংদের জাহাজ।

সুলতান আর রহমান রাজপথ দিয়ে ঘোড়ার পিঠে চললেন রাজ প্রাসাদের দিকে। পেছনে হাতে দড়ি বাঁধা ভাইকিংদের দল। তাদের দুপাশে খোলা তরোয়াল হাতে সৈন্যরা ঘোড়ায় চড়ে চলেছে। তাদের পেছনে সোনার ঘন্টা টেনে নিয়ে আসছে আটটি ঘোড়া। চাকা বসানো পাটাতন গড়গড়িয়ে চলছে। এত কাণ্ড সব, তবু রাস্তার দুপাশে দাঁড়ানো আমদাদবাসীদের মধ্যে কোন উত্তেজনা নেই। সৈন্যরা পুতুলের মত দাঁড়িয়ে আছে। এসব দেখে সুলতানের রাগ বেড়েই চললো। এর মধ্যে যে একটা কাণ্ড ঘটে গেছে, সেটা সুলতান বা ভাইকিংরা কেউই জানতো না। ফ্রান্সিস আর তার বন্ধুরা ভাইকিং রাজার জাহাজ নিয়ে পালিয়ে আসার কয়েকদিন পরে ভাইকিংদের রাজা মন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সমুদ্রপথে যাত্রা শুরু করেন। রাজার সঙ্গে ছিল দুজাহাজ ভরতি সৈন্য। তারা ফ্রান্সিসের খোঁজ করতে করতে এই আমদাদ নগরে এসে উপস্থিত হল। তখন সুলতান। সৈন্য আর ভাইকিংদের নিয়ে সোনার ঘন্টার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছেন। সুলতানের সঙ্গে বাছাই করা সৈন্যরা চলে গেছে। ভাইকিংদের রাজা খুব সহজে যুদ্ধ করে আমদাদ দখল করে নিলেন। এবার সুলতানের আর ভাইকিংদের ফেরার জন্য অপেক্ষা করা।

যেদিন সুলতান সোনার ঘন্টা নিয়ে ফিরলেন, সেদিন রাস্তার দু’পাশের দাঁড়ানো লোকজন আর সুলতানের সৈন্যদের আগে থেকেই সতর্ক করে দেওয়া হল–সবাই যেন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সুলতান যেন ঘুনাক্ষরেও বুঝতে না পারেন, আমদাদ শহর বিদেশীরা দখল। করে নিয়েছে। তাই সেদিন কোথাও না ছিল উত্তেজনা, না ছিল উল্লাস। সুলতানের প্রত্যেকটা সৈন্যের পেছনে দাঁড়িয়ে তাদের পিঠে তরোয়াল ঠেকিয়ে ভাইকিং সৈন্যরা আত্মগোপন করেছিল। কেউ যেন টু শব্দটি না করে। ভাইকিংদের রাজা চাইছিলেন–সুলতান যেন। আগে থাকতে কোনো বিপদ আঁচ করে পালাতে না পারেন।

রাজপথ দিয়ে চলেছেন সুলতান। পেছনে বন্দী ভাইকিংরা। তারও পেছনে সোনার ঘন্টা। প্রাসাদের কাছে এসে সুলতান দেখলেন, প্রাসাদের প্রধান ফটকের কাছে একটা মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। সেখানে মন্ত্রী ও প্রধান-প্রধান অমাত্যরা বসে আছেন। মাঝখানে সুলতানের সিংহাসন, সেটা ফাঁকা। তার পাশে একটা সিংহাসনে বেগম বসে আছেন। সুলতান এগিয়ে চললেন।

হঠাৎ বেগম সিংহাসন থেকে নেমে এসে রাজপথ দিয়ে সুলতানের দিকে ছুটে আসতে কম লাগলেন। কারা যেন তাকে বাধা দেবার চেষ্টা করলো। কিন্তু ততক্ষণে বেগম অনেকটা চলে এসেছেন। সুলতান স্পষ্ট শুনলেন, বেগম চীৎকার করে বললেন–পালাও, পালাও ভাইকিংরা এদেশ দখল করে নিয়েছে।

কিন্তু বেগম কথাটা আর দুবার বলতে পারলেন না। তার আগেই ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা বর্শা বিদ্যুৎ বেগে ছুটে এসে তার পিঠে ঢুকে গেল। বেগম রাজপথের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। সুলতান ঘোড়া থেকে নেমে ছুটে গিয়ে বেগমের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়লেন। বেগম ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন–পালাও।

আর কিছু বলতে পারলেন না। তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন।

ততক্ষণে সুলতানের সৈন্যদের সঙ্গে ভাইকিং সৈন্যদের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষেরা চীৎকার করতে করতে যে যেদিকে পারছে ছুটে পালাতে শুরু করেছে। ব্যাপার দেখে ফ্রান্সিসরা তো অবাক। তারপর ওরা সব বুঝতে পারলো। ভাইকিং সৈন্যরা ছুটে এসে ওদের হাতের দড়ি কেটে দিলো। তরোয়াল হাতে নিয়ে ফ্রান্সিস আর তার বন্ধুরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সুলতানের সৈন্যরা প্রাণপণে যুদ্ধ করতে লাগল। কিন্তু দুর্ধর্ষ ভাইকিং সৈন্যদের সঙ্গে তারা কিছুতেই এঁটে উঠতে পারছিলো না। প্রচণ্ড যুদ্ধ চললো। সুলতান নিজেও তখন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এঁর নিপুণ তরোয়াল চালনায় বেশ কয়েকজন ভাইকিং ঘায়েল হলো। যুদ্ধের এই ডামাডোলের মধ্যে ভাইকিং সেনাপতি আর তার অনুচরেরা পালিয়ে গেলো।

যুদ্ধ করতে করতে ফ্রান্সিস হঠাৎ দেখলো, সুলতান রক্তমাখা খোলা তরোয়াল হাতে ঠিক তার সামনে দাঁড়িয়ে। ফ্রান্সিস তরোয়াল উঁচিয়ে হাসলো। বললো-সুলতান, আমি এই দিনটির অপেক্ষাতেই ছিলাম। সুলতান সে কথার কোন জবাব না দিয়ে উন্মাদের মত ফ্রান্সিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ফ্রান্সিস খুব সহজেই সে আঘাত ফিরিয়ে দিয়ে পালটা আক্রমণ করলো। শুরু হলো দুজন নিপুণ যোদ্ধার যুদ্ধ।

যুদ্ধ চললো। দুজনের নাক দিয়ে ঘন-ঘন শ্বাস পড়ছে। দুজনেই দুজনের দিকে কুটিল চোখে তাকাচ্ছে। আঁচ করে নিচ্ছে, কোন দিক থেকে আক্রমণটা আসতে পারে। একসময় সুলতানের আক্রমণ ঠেকাতে-ঠেকাতে ফ্রান্সিস মঞ্চের সিঁড়িতে পা রেখে রেখে ওপরে উঠে গেল। পরক্ষণেই পালটা আক্রমণ করলো। সুলতান এক পা এক পা করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে লাগলেন। হঠাৎ ফ্রান্সিসের পর-পর কয়েকটা তরোয়ালের আঘাত সামলাতে গিয়ে সিঁড়িতে পা পিছলে পড়ে গেলেন। গড়িয়ে গেলেন কয়েকটা সিঁড়ির নীচে। ঠিক তখনই চাকাওয়ালা কাঠের পাটাতনটায় করে সোনার ঘন্টাটা নিয়ে যাওয়া। হচ্ছিল। হঠাৎ একটা চাকা গেল ভেঙে। ঘোড়াগুলো টান সামলালো, কিন্তু সোনার ঘন্টাটা রাজপথে পড়ে ঢং-ঢং। শব্দ তুলে কয়েকবার গড়িয়ে গেল। সুলতান ঠিক তখনই মঞ্চের সিঁড়িটা থেকে ওঠবার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কে উঠতে আর পারলেন না। সোনার ঘন্টা গড়িয়ে সুলতানের ওপর গিয়ে পড়ল। সুলতান আর্ত-চীৎকার করে দুহাত তুলে সোনার ঘন্টাটাকে ঠেকাতে গেলেন, কিন্তু ও ভারী নিরেট সোনার ঘন্টা–পারবেন কেন! সিঁড়ির সঙ্গে পিষে গেলেন। একটা মর্মান্তিক চিৎকার উঠল ধারেকাছের সকলেই ছুটে এলো। এই অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা ফ্রান্সিসও বিমূঢ় হয়ে তাড়াতাড়ি ছুটে এলো। কিন্তু ততক্ষণে সুলতানের রক্তাপ্লুত দেহ বার কয়েক নড়ে স্থির হয়ে গেছে। সুলতান মারা গেছেন।

ফ্রান্সিস! ডাক শুনে ফ্রান্সিস মঞ্চের দিকে তাকালো। দেখলো বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। সঙ্গে ভাইকিংদের রাজা। দুজনেই মিটিমিটি হাসছেন। ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেল। রাজা বললেন তুমি ভাইকিং জাতির মুখ উজ্জ্বল করেছে।

–তবু–ফ্রান্সিসের বাবা বললেন, জাহাজ চুরির অপরাধটা?

রাজা বললেন, হ্যাঁ, শাস্তিটা তো পেতেই হবে, এই রাজত্বের শাসনভার তোমাকে দিলাম।

ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি বলে উঠল দোহাই, ঐ-টি আমি পারবো না। জাহাজ চলানো, ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করা তরোয়াল চালানো, এসব এক জিনিস, আর একটা রাজত্ব চালানো, সে অন্য ব্যাপার। যদি অভয় দেন তো একটা কথা বলি, এই রাজত্বের ভার ফজলকে দিন।

–কে ফজল?

–আমার বন্ধু। সবদিকে থেকে ফজলের মত উপযুক্ত আর কেউ নেই। সেই এই দেশেরই মানুষ। যাদের দেশ, তারাই দেশ শাসন করুন, এটাই কি আপনি চান না?

–নিশ্চয়ই চাই। বেশ! ডাক ফজলকে।

ফ্রান্সিস চারিদিকে তাকিয়ে ফজলকে খুঁজলো। কিন্তু কোথাও তার দেখা পেল না। ফ্রান্সিস বললো–ফজল এখানেই আছে কোথাও। আমাকে সময় দিন, ওকে খুঁজে বের করব।

–বেশ, রাজা সম্মত হলেন।

ফ্রান্সিস দেখলো যুদ্ধ থেমে গেছে। সুলতানের সৈন্যদের বন্দী করা হচ্ছে। সুলতানের মৃতদেহ ঘিরে শোকার্ত মানুষের ভীড়। ফ্রান্সিসের ভালো লাগছিল না এসব। নাঃ আবার বেরিয়ে পড়তে হবে। মাথার ওপরে অন্ধকার ঝোড়ো আকাশ, পায়ের কাছে পাহাড়ের মত উঁচু ঢেউ আছড়ে পড়ছে, উন্মত্ত বাতাসের বেগ। জীবন তো সেখানেই।

ফ্রান্সিস পায়ে-পায়ে রাজার কাছে গিয়ে বললো–এবার একটা ভাল জাহাজ দেবেন?

রাজা সবিস্ময়ে ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন–কেন?

–আফ্রিকার ওঙ্গালি বাজারে যাব—

–আবার?

–চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না–ফ্রান্সিস উৎসাহের সঙ্গে বলতে লাগল–কি বিরাট হীরে! কি চোখ ধাঁধানো আলো ছিটকে পড়ছে!

ফ্রান্সিসের আর বলা হলো না। পেছন থেকে বাবার গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনতে পেল–এখান থেকে আমার সঙ্গে সোজা বাড়ি ফিরে যাবে।

হীরের পাহাড় – ফ্রান্সিস সিরিজ – অনিল ভৌমিক

ফজল সুলতান হল। আমদাদ নগর জুড়ে খাওয়া-দাওয়া, হৈ-হল্লা চলল সাতদিন ধরে। ভাইকিংদের রাজা, মন্ত্রী, ফ্রান্সিস আর তার বন্ধুরা সকলেই আনন্দ-উৎসবে যোগ দিল।

সাতদিন পরে আনন্দ-উৎসব শেষ হল। এবার ঘরে ফেরার পালা। আমদাদ বন্দরে ভাইকিং-রাজার তিনটে জাহাজ তৈরী হল। জাহাজগুলোর কিছু মেরামতির কাজ ছিল, তাও শেষ হল। যে কাঠের পাটাতনে সোনার ঘণ্টাটা রাখা হয়েছে, সেটা একটা জহাজের পেছনে কাছি দিয়ে বাঁধা হল। রাজা, মন্ত্রী, ফ্রান্সিস, তার বন্ধুরা, আর সব সৈন্যরা সবাই জাহাজে উঠল। ফ্রান্সিস ফজলকে অনুরোধ করল, মকবুলকে যেন তার সঙ্গে যেতে দেওয়া হয়। ফজলের আপত্তি থাকার কোন কারণ নেই, কিন্তু মুশকিল হল ভাইকিংদের রাজাকে নিয়ে। তিনি বিদেশী বিধর্মী মকবুলকে নিজের দেশে নিয়ে যেতে রাজি হলেন না। ফ্রান্সিস রাজামশাইকে বোঝাল-মকবুল মানুষ হিসেবে খুবই ভাল। তার দায়িত্ব ফ্রান্সিস নিজেই নিল। রাজা আর আপত্তি করলেন না। ফ্রান্সিস তাদের নৌকোটা একটা জাহাজের সঙ্গে বেঁধে নিল। এই নৌকোটাতে করেই বিরাট লম্বা কাছি নিয়ে ফ্রান্সিসরা কুয়াশা ঝড় আর ডুবো পাহাড়ের বিপদ পার হয়ে সোনার ঘন্টা আনতে পেরেছিল। সবাই ঐ নৌকোটার কথা ভুলে গিয়েছিল, কিন্তু ফ্রান্সিস তা ভোলে নি। নৌকোটাকে বরাবর নিজেদের জাহাজের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল। আসল কথা, ফ্রান্সিস আবার পালাবার ফিকির খুঁজছিল। নৌকোটা থাকলে জাহাজ থেকে পালানো সহজ হবে। ফ্রান্সিসের এই পালানোর ফন্দীর কথা কেউ জানত না, জানত শুধু ফ্রান্সিসের বন্ধু হ্যারি। নৌকো করে জাহাজ থেকে পালিয়ে আফ্রিকায় নামা যাবে।

–তা যাবে। কিন্তু সেই পাহাড়টাতে যেভাবে ধ্বস নেমেছিল, তারপর এখন যে ওটার কী অবস্থা হয়েছে–

–পাহাড়ের অবস্থা যাই হোক, হীরেটা তো আর পালাবে না?

–হুঁ, কিন্তু আমাদের তো প্রথমে ওঙ্গালির বাজারে যেতে হবে। অনেকটা পথ।

–তাই যাব আমরা। –বেশ আমার কোন আপত্তি নেই।

–মকবুল, তুমি হবে গাইড। আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।

–বেশ।

ফ্রান্সিস বলল–মকবুল সমস্ত ঘটনাটা আর একবার বলো তো।

–কোন্ ঘটনা?

–সেই হীরের পাহাড়ের সন্ধান তুমি কীভাবে পেয়েছিলে। কী ঘটেছিল সেখানে।

–কেন? তোমাকে তো সব ঘটনাই বলেছিলাম।

–আবার শুনতে চাইছি। ঘটনাটা আবার শুনলে বুঝতে পারব, ওখানে যে হীরেটা ছিল, সেটার কী হল।

–বেশ, শোন; বলে মকবুল বলতে আরম্ভ করল–আমি কার্পেট বিক্রীর ধান্দায় গিয়েছিলাম ওঙ্গালিতে। জায়গাটাতে কেরুর বন্দর থেকে যেতে হয়। আমি ঘোড়ায় টানা গাড়ীতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ গাড়ীর চাকাটা রাস্তায় পাথরের সঙ্গে লেগে গেল ভেঙে। কাছেই এক কামারের কাছে সারাতে দিলাম। কামারটার নাম বুঙ্গা। ওই আমাকে প্রথম সেই অদ্ভুত গল্পটা শোনাল। ওঙ্গালি থেকে মাইল পনেরো উত্তরে একটা পাহাড়। গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। পাহাড়টার মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে একটা গুহা। দূর থেকে গাছ-গাছালি ঝোঁপ-জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গুহাটার সমান্তরালে এসে সূর্যের আলো সরাসরি গিয়ে গুহাটায় পড়ে। তখনই দেখা যায় গুহার মুখে আর তার চারপাশের গাছের পাতায়, ডালে-ঝোপে এক অদ্ভুত আলোর খেলা। আয়না থেকে যেমন সূর্যের আলো ঠিকরে আসে, তেমনি রামধনুর রঙের মত বিচিত্র সব রঙীন আলো ঠিকরে আসে গুহাটা থেকে। অনেকেই দেখেছে এই আলোর খেলা। ধরে নিয়েছে ভূতুড়ে কাণ্ড কারখানা। ভূত-প্রেতকে ওরা যমের চেয়েও বেশী ভয় করে। কাজেই কেউ এই রঙের খেলার কারণ জানতে ওদিকে পা বাড়াতে সাহস করে নি।

–আচ্ছা, এই আলোর খেলা সারাদিন দেখা যেত?ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

–উঁহু, সূর্যের আলোটা যতক্ষণ সরাসরি সেই গুহাটায় গিয়ে পড়ছে, ততক্ষণই শুধু। তারপর আবার যে-কে সেই।

–সেই কামার বুঙ্গা সে-কি এর কারণ জানতে পেরেছিল?

–না, ও গুহাটায় গিয়ে দেখে নি–তবে অনুমান করেছিল। বুঙ্গা বলেছিল–ঐ আলো হীরে থেকে ঠিকরানো আলো না হয়েই যায় না। ও নাকি প্রথম জীবনে কিছুদিন এক জহুরীর দোকানে কাজ করেছিল। হীরের গায়ে আলো পড়লে সেই আলো কীভাবে ঠিকরোয়, এই বাপারটা ওর জানা ছিল। আমি তো বুঙ্গার কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম।

-কেন?

–ভেবে দেখ ফ্রান্সিস–অত আলোমানে, আমি তো পরে সেই আলো আর রঙের খেলা দেখেছিলাম–মানে, ভেবে দেখ–হীরেটা কত বড় হলে অত আলো ঠিকয়োয়।

–তারপর?

–তারপর একদিন দড়ি-গাঁইতি এসব নিয়ে পাহাড়টার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। যে করেই হোক, সেই গুহার মধ্যে ঢুকতে হবে। কিন্তু সেই পাহাড়টার কাছে পৌঁছে আক্কেল গুরুড়ম হয়ে গেল। নীচ থেকে গুহা পর্যন্ত পাহাড়টা খাড়া উঠে গেছে। কিছু ঝোঁপ ঝাড়, দু’একটা জঙ্গলী গাছ, আর লম্বা লম্বা বুনো ঘাস ছাড়া খাড়া পাহাড়ের গায়ে আর কিছুই নেই। নিরেট পাথুরে খাড়া গা। কামার ব্যাটা বেশ ভেবেচিন্তেই এসেছে বুঝলাম।

ও বলল–চলুন আমরা পাহাড়ের ওপর থেকে নামবো। ভেবে দেখলাম সেটা সম্ভব। কারণ পাহাড়টার মাথা থেকে শুরু করে গুহার মুখ অবধি আর তার আশেপাশে বেশ ঘন হীরের পাহাড় জঙ্গল। দড়ি ধরে নামা যাবে। একটু থেমে মকবুল বলতে লাগল সন্ধ্যের আগেই পাহাড়ের মাথায় উঠে বসে রইলাম। ভোরবেলা নামার উদ্যোগ আয়োজন শুরু করলাম। পাহাড়টার মাথায় একটা মস্ত বড় পাথরে দড়ির একটা মুখ বাঁধলাম। তারপর দড়ির অন্য মুখটা ঝুলিয়ে দিলাম। দড়ির মুখটা গুহার মুখ পর্যন্ত পৌঁছাল কিনা, বুঝলাম না। কপাল ঠুকে দড়ি ধরে ঝুলে পড়লাম। দড়ির শেষ মুখে পৌঁছে দেখি, গুহাটা তখনও অনেকটা নীচে। সেখান থেকে বাকি পথটা গাছের ডাল, গুঁড়ি, লতাগাছ এসব ধরে ধরে শ্যাওলা ধরা পাথরের ওপর দিয়ে সন্তর্পণে পা রেখে একসময় গুহাটার মুখে এসে দাঁড়ালাম। বুঙ্গাও কিছুক্ষণের মধ্যে নেমে এল। ও যে বুদ্ধিমান, সেটা বুঝলাম ওর এক কাণ্ড দেখে। বুঙ্গাও দড়ির মুখটাতে আরও দড়ি বেঁধে নিয়ে পুরোটাই দড়ি ধরে এসেছে। পরিশ্রমও কম হয়েছে ওর।

-তারপর? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।

–দু’জনেই গুহাটায় ঢুকলাম। একটা নিস্তেজ মেটে আলো পড়েছে গুহাটার মধ্যে। সেই আলোয় দেখলাম, কয়েকটা বড়-বড় পাথরের চাই–তারপরেই একটা খাদ থেকে উঠে আছে একটা ঢিবি। ঠিক পাথুরে ঢিবি নয়। অমসৃণ এবড়োখেবড়ো গা–অনেকটা জমাট আলকাতারার মত। হাত দিয়ে দেখলাম, বেশ শক্ত। সেই সামান্য আলোয় ঢিবিটার যে কি রঙ, ঠিক বুঝলাম না। তবে দেখলাম ওটা নীচে অনেকটা পর্যন্ত রয়েছে, যেন কেউ পুঁতে রেখে দিয়েছে। বুঙ্গা এতক্ষণ গুহার মুখের কাছে এখানে-ওখানে ছড়ানো ছিটানো বড়-বড় পাথরগুলোর ওপর একটা ছুঁচোলো-মুখ হাতুড়ির ঘা দিয়ে ভাঙা টুকরোগুলো মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করে দেখছিল। তারপর হতাশ হয়ে ফেলে দিচ্ছিল। আমি বুঙ্গাকে ডাকলাম–বুঙ্গা দেখতো এটা কিসের ঢিবি? বুঙ্গা কাছে এল। এক নজরে ঐ এবড়ো-খেবড়ো ঢিবিটার দিকে তাকিয়েই বিস্ময়ে ওর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। ওর মুখে কথা নেই। ঠিক তখনই সূর্যের আলোটা সরাসরি গুহাটার মধ্যে এসে পড়ল। আমরা ভীষণভাবে চমকে উঠলাম। সেই এবড়ো-খেবড়ো ঢিবিটায় যেন আগুন লেগে গেল। জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ড যেন। সে কি তীব্র আলোর বিচ্ছুরণ!সমস্ত গুহাটায় তীব্র চোখ ঝলসানো আলোর বন্যা নামল যেন। ভয়ে-বিস্ময়ে আমি চীৎকার করে উঠলাম বুঙ্গা শীগগির চোখ ঢাকা দিয়ে বসে পড়–নইলে অন্ধ হয়ে যাবে।

দু’জনেই চোখ ঢাকা দিয়ে বসে পড়লাম। কতক্ষণ ধরে সেই তীব্র, তীক্ষ্ণ চোখ-অন্ধ করা আলোর বন্যা বয়ে চলল, জানি না। হঠাৎ সব অন্ধকার হয়ে গেল। ভয়ে-ভয়ে চোখ খুললাম। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার চারদিকে। অসীম নৈঃশব্দ। হঠাৎ সেই নৈঃশব্দ ভেঙে দিল বুঙ্গার ইনিয়ে-বিনিয়ে কান্না। অবাক কাণ্ড! ও কাঁদছে কেন? অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে বুঙ্গার কাছে এলাম। এবার ওর কথাগুলো স্পষ্ট শুনলাম। ও দেশীয় ভাষায় বলছে

অত বড় হীরে আমার সব দুঃখকষ্ট দূর হয়ে যাবে–আমি কত বড়লোক হয়ে যাব। বুঝলাম, প্রচণ্ড আনন্দে, চূড়ান্ত উত্তেজনায় ও কাঁদতে শুরু করেছে। অনেক কষ্টে ওকে ঠাণ্ডা করলাম। আস্তে-আস্তে অন্ধকারটা চোখে সয়ে এল। বুঙ্গাকে বললাম–এসো, আগে কিছু খেয়ে নেওয়া যাক।

কিন্তু কাকে বলা! বুঙ্গা তখন ক্ষুধাতৃষ্ণা ভুলে গেছে। হঠাৎ ও উঠে গেল ঢিবিটার দিকে। হাতের ছুঁচলো হাতুড়িটা দিয়ে আঘাত করতে লাগল ওটার গায়ে। টুকরো টুকরো হীরে চারিদিকে ছিটকে পড়তে লাগল। হাতুড়ির ঘা বন্ধ করে বুঙ্গা হীরের টুকরোগুলো পকেটে পুরতে লাগল। তারপর আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল হাতুড়িটা নিয়ে। আবার হীরের টুকরো ছিটকোতে লাগল। আমি কয়েকবার বাধা দেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু উত্তেজনায় ও তখন পাগল হয়ে গেছে।

-তারপর? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল। একবার বুঙ্গা করল এক কাণ্ড! গুহার মধ্যে পড়ে থাকা একটা বড় পাথর তুলে নিল। তারপর দু’হাতে পাথরটা ধরে হীরেটার ওপর ঘা মারতে লাগল, যদি একটা বড় টুকরো ভেঙে আসে। কিন্তু হীরে ভাঙা কি অত সোজা? সে কথা কাকে বোঝাব তখন? ও পাগলের মত পাথরে ঘা মেরেই চলল। ঠক্ ঠক্ পাথরের ঘায়ের শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে লাগল গুহাটায়। হঠাৎ

–কী হল?

–সমস্ত পাহাড়টা যেন দুলে উঠল। গুহার ভেতরে শুনলাম, গম্ভীর গুড়গুড় শব্দ। শব্দটা কিছুক্ষণ চলল। তারপর হঠাৎ একটা কানে তালা লাগানো শব্দ। শব্দটা এল পাহাড়ের মাথার দিক থেকে। বিরাট-বিরাট পাথরের চাঁই ভেঙে পড়ছে। বুঝলাম, যে কোন কারণেই হোক পাহাড়ের মধ্যে কোন একটা পাথরের স্তর নাড়া পেয়েছে, তাই এই বিপত্তি। এখন আর ভাববার সময় নেই, গুহা ছেড়ে পালাতে হবে, অবলম্বন একমাত্র সেই দড়িটা। ছুটে গিয়ে দড়িটা ধরলাম। টান দিতেই দেখি, ওটা আলগা হয়ে গেছে। বুঝলাম, যে পাথরের চাইয়ে ওটা বেঁধে এসেছিলাম সেটা নড়ে গেছে। এখন দড়িটা কোন ঝোপে বা গাছের ডালে আটকে আছে। একটু জোরে টান দিলাম। যা ভেবেছি তাই। দড়ির মুখটা ঝুপ করে নীচের দিকে পড়ে গেল। এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে খোদাতাল্লাকে ধন্যবাদ জানালাম। কিন্তু আর দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছিল না। পায়ের নীচের মাটি দুলতে শুরু করেছে। ভালোভাবে দাঁড়াতে পারছি না। পায়ের নীচের মাটি দুলতে শুরু করেছে। ভালোভাবে দাঁড়াতে পারছি না। টলে পড়ে যাচ্ছিলাম। তাড়াতাড়ি দড়ির মুখটা একটা বড় পাথরের সঙ্গে বেঁধে ফেললাম। এখন দড়ি ধরে নামতে হবে। কিন্তু বুঙ্গা? ওকি সত্যিই পাগল হয়ে গেল। এত কাণ্ড ঘটছে, বুঙ্গার কোনো হুঁশও নেই। ও পাথরটা ঠুকেই চলেছে। ছুটে গিয়ে ওর দু’হাত চেপে ধরলাম–বুঙ্গা শীগগির চল–নইলে মরবি।

কিন্তু কে কার কথা শোনে। এক ঝটকায় ও আমাকে সরিয়ে দিল। আবার ওকে থামাতে গেলাম। এবার ও হাতের পাথরটা নামিয়ে উঁচলো-মুখ হাতুড়িটা বাগিয়ে ধরল। বুঝলাম, ওকে বেশী টানাটানি করলে ও আমাকেই মেরে বসবে। ওকে আর বাঁচানোর চেষ্টা করে লাভ নেই।

আবার একটু থেমে মকবুল বলতে লাগল–

–গুহার মধ্যে তখন পাথরের টুকরো, ধুলো ঝুরঝুর করে পড়তে শুরু করেছে। আর দেরী করলে আমিও জ্যান্ত করব হয়ে যাবো। পাগলের মত ছুটলাম গুহার মুখের দিকে। তারপর গুহার মুখে এসে দড়িটা ধরে কীভাবে নেমে এসেছিলাম, আজও জানি না। পরপর পাঁচদিন ধরে শুধু বুনো ফল আর ঝর্ণার জল খেয়ে হাঁটতে লাগলাম। গভীর জঙ্গলে কতবার পথ হারালাম। বুনো জন্তু-জানোয়ারের পাল্লায় পড়লাম। তারপর যেদিন ও লির বাজারে এসে হাজির হলাম, সেদিন আমার চেহারা দেখে অনেকেই ভূত দেখার মত চমকে উঠেছিল।

মকবুলের গল্প শেষ হলে ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়িয়ে ঘরময় পায়চারী করতে লাগল। এক সময় সে জিজ্ঞেস করল–ওঙ্গালির বাজারে যেতে হলে আমাদের কোন্ বন্দরে নামতে হবে?

–তেকরুর বন্দরে নামতে হবে।

–এই জাহাজগুলো কি সেই বন্দর হয়ে যাবে।

–না। তেকরুর বন্দর পশ্চিম আফ্রিকায়।

ফ্রান্সিস এবার হ্যারির দিকে তাকাল। বলল–হ্যারি, একটু বুদ্ধি-টুদ্ধি দাও। হ্যারি হাসল–তোমার বুদ্ধি আমার চেয়ে কিছু কম নয়।

–তবু তুমি কিছু বল।

–কী আর বলব! আমাদের ছোট নৌকোটায় করে জাহাজ থেকে পালাতে হবে।

–কখন? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।

–আর দু-তিন দিনের মধ্যেই জাহাজটা উত্তর আফ্রিকার ধার ঘেঁসে যাবে। তখন নৌকোটায় উঠে পালিয়ে গিয়ে উত্তর আফ্রিকায় নামব আমরা।

-তারপর?

–সেখান থেকে তেকরুরগামী জাহাজে করে আমরা তেকরুর যাব।

–বেশ। ফ্রান্সিস আবার পায়চারী করতে লাগল। তারপর থেমে বলল–তাহলে। পরশু রাতে ঠিক এ সময় মকবুল এখানে আসবে। তারপর পালাব।

মকবুল চলে গেল। হ্যারিও বিছানায় শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পরেই ওর নাক ডাকতে শুরু করল। কিন্তু ফ্রান্সিসের চোখে ঘুম নেই। শুয়ে-শুয়ে ফ্রান্সিস হিসেব করতে লাগল–কতটা খাবার-দাবার, খাওয়ার জল, আর কী কী নিতে হবে।

***

পরের দিন। ফ্রান্সিস ডেক-এ পায়চারি করছিল। তখনই দেখা ভাইকিংদের রাজার সঙ্গে। রাজা হেসে ডাকলেন–ফ্রান্সিস?

–আজ্ঞে বলুন।

–হীরের পাহাড়ের ভূত মাথা থেকে নামল?

ফ্রান্সিস নিরীহ ভঙ্গিতে বলল–ওসব ভেবে আর কী করব? আপনি তো একটা জাহাজ দিলেন না।

–ওসব ভাবনা ছাড়। এখন সোজা বাড়িতে।

–বেশ।

রাজামশাই চলে গেলেন। ফ্রান্সিস আবার নিজের ভাবনায় মগ্ন হল। দু’দিন মাত্র হাতে। এরমধ্যে ফ্রান্সিস অনেক খাবার-দাবার একটা প্যাকিং বাক্সে পুরল। একটা বড়কুঁজো ভরতি খাবার জল, দড়ি, আর দু’টো তরোয়াল সব নিজেদের কেবিন ঘরে জমা করল।

তিন দিনের দিন গভীর রাতে মকবুল এল। অনেক রাত হয়েছে তখন। ধরাধরি করে তিনজনে মিলে খাবারের বাক্সটাকে জাহাজের ডেক-এ তুলল। তারপর ওটাকে নিয়ে এল জাহাজের হালের কাছে। আকাশে চাঁদের আলো। ফ্রান্সিস দেখল, ওদের নৌকোটা ঢেউয়ের দোলায় দুলছে। হালের সঙ্গে কাছি দিয়ে বাঁধা। ফ্রান্সিস কাছিটা টেনে নৌকোটাকে কাছে নিয়ে এল। তারপর খাবারের বাক্সটা দড়ি দিয়ে বেঁধে আস্তে আস্তে নৌকোটার মাঝখানে নামিয়ে দিল। এবার ফ্রান্সিস দড়ি ধরে ঝুলতে ঝুলতে নৌকার ওপর নেমে এল। তারপরেই নেমে এল হ্যারি। মকবুল জলের কুঁজোটা দড়িতে বেঁধে ঝুলিয়ে দিল।

ফ্রান্সিস কুঁজোটা ধরে নৌকায় নামিয়ে নিল। এবার মকবুল দড়ি ধরে নেমে এল। সবাই তৈরী হল এবার। ফ্রান্সিস কোমরে গোঁজা তরোয়ালটা খুলে জাহাজের সঙ্গে বাঁধা নৌকার কাছিটা কেটে ফেলল। নৌকোটা একবার পাক খেয়ে ঘুরে অনেকটা সরে এল। জাহাজটা আস্তে আস্তে দুরে সরে যেতে লাগল। চাঁদের আলোয় বেশ কিছুক্ষণ জাহাজটাকে দেখা গেল। তারপর আর দেখা গেল না। জাহাজ থেকে ওরা তখন অনেক দূরে চলে এসেছে। চারদিকে শুধু জল আর জল। জলে ছোট-ছোট ঢেউ। চাঁদের আলো পড়ে চিকচিক করছে। হ্যারি আর মকবুল গায়ে কম্বল জড়িয়ে নৌকোর পাঠাতনে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল ওরা। ফ্রান্সিসের চোখে ঘুম নেই। সে নৌকো বাইতে লাগল। ফ্রান্সিস আমদাদ বন্দরে নৌকোটার মেরামতি করিয়েছিল। তখন একটা কাঠের মাস্তুলও লাগিয়ে নিয়েছিল পাল খাটাবার জন্যে। হাওয়ার জোর নেই তেমন। কাজেই ফ্রান্সিস পাল খাটায় নি। বৈঠা দিয়ে নৌকো বাইতে লাগল। সারা রাত ফ্রান্সিস নৌকো বইতে লাগল। ভোরের দিকে জোর হাওয়া ছুটল। ফ্রান্সিস হাওয়ার দিকটা অনুমান করল। ঠিকই আছে। হাওয়া দক্ষিণমুখো বইছে। ফ্রান্সিস পাল খাটাল। হাওয়ার তোড়ে পাল ফুলে উঠলো। নৌকো তরতর জল কেটে ছুটল। ফ্রান্সিস পালের দড়িদড়া হালের সঙ্গে বেঁধে হ্যারির পাশে এসে শুয়ে পড়ল। পূর্বদিকে তাকিয়ে দেখলো আকাশটা লাল হয়ে উঠেছে। মাথার ওপর আকাশটা তখনও কালো। তারাগুলো জ্বলজ্বল করছে। আস্তে-আস্তে আকাশের অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। সূর্য উঠতে বেশী দেরী নেই। উত্তর আফ্রিকার কোথায় নৌকো ঠেকবে, সেখান থেকে তেকরুর বন্দরেই বা কী করে যাওয়া যাবে, এসব ভাবতে-ভাবতে ফ্রান্সিস একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।

হ্যারির ধাক্কায় ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেল। চোখ কচলাতে কচলাতে ফ্রান্সিস উঠে বসল। দেখল বেশ বেলা হয়েছে। রোদের তেজও বাড়ছে। হ্যারি ডাকল সকালের খাবার খেয়ে নাও। ফ্রান্সিস সমুদ্রের জলে হাত-মুখ ধুয়ে নিল। তারপর খেতে বসল।

হ্যারি বলল–কাল সারারাত বোধহয় ঘুমোও নি।

ফ্রান্সিস হাসল। হ্যারি বললো–হাসির কথা নয় ফ্রান্সিস। এভাবে রাত জাগতে শুরু করলে ওঙ্গালির বাজারে আর ইহজন্মে পৌঁছতে পারবে না।

-কিন্তু আফ্রিকার উপকূলে যেখানে হোক, আমাদের পৌঁছুতে হবে।

–তাই বলে রাত জেগে নৌকা বাইতে হবে? হ্যারি অবাক চোখে ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। ফ্রান্সিস হেসে বললে কত দিনের খাদ্য আর জল আমাদের সঙ্গে আছে জানো?

-না।

–মাত্র চার দিনের। এই চার দিনের মধ্যে আমাদের মাটিতে পৌঁছোতে হবে।

–চারদিন যথেষ্ট সময়। এর মধ্যে আমরা ঠিক পৌঁছে যাব।

–অত নিশ্চিন্ত থাকা ভাল নয় হ্যারি। ফ্রান্সিস বলল। সে দেখল, পাল গুটিয়ে ফেলা হয়েছে। নৌকো এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। হ্যারিকে জিজ্ঞেস করল–পাল গুটিয়ে ফেললে কেন?

–দেখছো না, হাওয়া পড়ে গেছে।

–তাহলে বৈঠা বাইতে হবে।

–আমরা বাইছি। তুমি শুয়ে বিশ্রাম কর, পারো একটু ঘুমিয়ে নাও।

–বেশ। ফ্রান্সিস কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল।

ফ্রান্সিস নৌকোর পাঠাতনে শুয়ে পড়ল। প্রচণ্ড রোদ। হাত দিয়ে চোখ ঢাকা দিল। বেশ ঝিরঝিরে হাওয়া দিচ্ছে, জলে বৈঠা চালাবার শব্দ উঠছে–ছপ ছপ। হ্যারি আর মকবুল কথা বলছে। সমুদ্রে বাতাসের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। ফ্রান্সিস কাত হয়ে শুলো। রাত জাগা চোখ ঘুমে জড়িয়ে এল।

হঠাৎ ঘুম ভেঙে ফ্রান্সিস ধড়মড় করে উঠে বসল। দেখল, বেশ বেলা হয়েছে। মকবুল বৈঠা বাইছে। হ্যারি খাবার-দাবার প্লেটে সাজাচ্ছে।

খেতে-খেতে ফ্রান্সিস বলল–হ্যারি, নিশানা ভুল হয় নি তো?

–কী করে বলি, তবে দক্ষিণদিক নিশানা করেই তো নৌকা চালাচ্ছি।

–দেখা যাক।

বেলা পড়ে এল। পশ্চিমদিক লাল হয়ে উঠল। অস্তে-আস্তে সূর্য অস্ত গেল। চারদিক অন্ধকার করে রাত্রি নামল। রাত্রিরে খাওয়া-দাওয়ার পর ফ্রান্সিস বৈঠা নিয়ে বসল। আজকেও হয়ত সারারাত বৈঠা বাইতে হবে। হাওয়ার জোর বাড়ে নি এখনও। হ্যারি আর মকবুল পাঠাতনে শুয়ে পড়ল। বেশ কয়েক ঘণ্টা কেটে গেল। আস্তে-আস্তে হাওয়ার জোর বাড়তে লাগল। কপাল ভাল–হাওয়াটা দক্ষিণমুখো। ফ্রান্সিস পাল বেঁধে দিল। হাওয়ার জোরে পাল ফুলে উঠল। নৌকো চলল দ্রুতগতিতে। কেমন শীত শীত করছে। ফ্রান্সিস কম্বল জড়িয়ে পাঠাতনের একপাশে শুয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুম আসতে চায় না। নানা চিন্তা মাথায়। তেকরুর বন্দরে কী করে পৌঁছানো যাবে। সেখান থেকে ওঙ্গালির বাজারে। তেকরুর বন্দরে পৌঁছতে পারলে ওঙ্গালির বাজারে যাওয়ার একটা হিল্লে হয়ে যাবে। কিন্তু মাটির তো দেখা নেই। আগে তো আফ্রিকার উপকূলে পৌঁছোতে হবে, তারপর তো কেরুর যাওয়া। হঠাৎ মার কথা মনে পড়ল। বাবার কথা। ওর এইভাবে জাহাজ থেকে পালিয়ে যাওয়ায় বাবা নিশ্চয় ভাল চোখে দেখবেন না। তারায় ভরা কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সিস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

এক সময় ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল। তিনদিন কেটে গেল। নৌকো চলছে তো চলেছেই। মাটির কোন চিহ্নমাত্র নজরে পড়ছে না। চিন্তায় ওদের মুখ শুকিয়ে গেল। তাহলে কি দিক ভুল হয়ে গেল? নৌকোয় যা খাবার-দাবার মজুত আছে টেনেটুনে আর দুটো দিন চলতে পারে। তারপর? খাদ্য নেই জল নেই। দিনে রোদের প্রচণ্ড তেজ। রাত্রে ঠাণ্ডা। উপপাসী শরীরে আর কতদূর যেতে পারবে ওরা? কতক্ষণই বা নৌকো বাইতে পারবে?

চার দিন কেটে গেল। পাঁচ দিনের দিন রাত্রে অবশিষ্ট খাদ্য আর জল ওরা খেল না। একেবারে উপোস করে রইল। পরের দিনটা তো চালানো যাবে। পরের দিন গেল আধপেটা খেয়ে। তারপরের দিন একেবারে উপোস। এক ফোঁটা জল নেই। খাদ্যও না। উপোসী শরীর নেতিয়ে পড়ে। বৈঠা বাইবার শক্তি নেই। পাল বেঁধে দিল। নৌকা যেদিকে খুশী চলল। ওরা নিজেদের মত পাঠাতনে শুয়ে রইল। সূর্য যেন আগুন বর্ষণ করে সারাদিন। ওরা দিনের বেলা জামা খুলে রাখে, শুধু রাত্রে জামা গায়ে দেয়। ওদের গা পোড়া তামার মত হয়ে গেছে। তৃষ্ণায় বুক পর্যন্ত শুকিয়ে যায়। কিন্তু একফোঁটা খাবার জল নেই। তৃষ্ণার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে মকবুল সমুদ্রের জলই খেয়ে নিল। কিন্তু খালি পেটে ঐ নোনতা জল–পেটে পাক দিয়ে বমি উঠে আসে। শরীর আরো অবসন্ন করে দেয়।

হঠাৎ আকাশের কোণায় কালো মেঘ দেখা দিল। দেখেতে-দেখতে আকাশ অন্ধকার হয়ে গেল। একটু পরেই প্রচণ্ড বৃষ্টি নামল। ওরা আনন্দে নাচতে লাগল। মুখ হাঁ করে বৃষ্টির জল খেতে লাগল। ওরা বৃষ্টির জলে জামা ভিজিয়ে নিতে লাগল। তারপর সেটাই চিপে চিপেকুঁজোয় জল ভরতে লাগল। একটু পরেই বৃষ্টি থেমে গেল। ততক্ষণে কুঁজোতে অনেকটা জল ভরা হয়ে গেছে। জলের সমস্যা যা হোক মিটল। কিন্তু খাদ্য? ফ্রান্সিস কোন সমস্যার সামনেই চুপ করে বসে থাকার মানুষ নয়। সে ভাবতে লাগল–কী করে খাবার জোগাড় করা যায়। পেয়েও গেল একটা উপায়। মাছ ধরতে হবে। অমনি পাঠাতনের নীচে থেকে পেরেক হাতুড়ি বের করল। দড়ি তো ছিলই। একটা লম্বা পেরেক হাতুড়ি দিয়ে ঠুকে ঠুকে বঁড়শীর মত বানাল। তারপর খাবারের বাক্সটা তন্ন তন্ন করে খুঁজে রুটির কয়েকটা টুকরো আর গুঁড়ো পেল। সেগুলোই জল দিয়ে মেখে টোপ তৈরী করল। তারপর দড়ির ডগায় পেরেকের বড়শী বাঁধল। বড়শীর ডগায় টোপ লাগিয়ে সমুদ্রের জলে ফেলে বসে রইল।

ঠিক তখনই ওর হঠাৎ নজরে পড়ল তিন-চারটে হাঙর ঠিক নৌকোর পেছনে পেছনে আসছে। মৃত্যুদূত? ফ্রান্সিসের অন্যমনস্ক মনটা নাড়া পেল। তবে কি ঐ সাংঘাতিক প্রাণীগুলো ওদের আসন্ন মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে এসেছে?ফ্রান্সিস মকবুলের দিকে তাকাল। দেখল, মকবুল অসাড় হয়ে আছে।

ফ্রান্সিস হ্যারির দিকে তাকাল। এই বিপদের কথা তো ওদের জানাতে হয়। হ্যারি ফ্রান্সিসের মুখ দেখেই ব্যাপারটা অনুমান করল। বিষণ্ণ হাসি হেসে বলল–ফ্রান্সিস, আমি জানি তুমি জলে কী দেখছ।

–হ্যারি, তুমি কি আগেই এগুলো দেখেছ?

–হ্যাঁ, পরশু বিকেল থেকে ওরা আমাদের পিছু ধাওয়া করছে।

–কই, আমাকে তো বল নি?

–মকবুল পাছে জানতে পারে, তাই বলি নি।

কথাটা বোধ হয় মকবুলের কানে গেল। সে পাশ ফিরে ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে দুর্বলস্বরে জিজ্ঞেস করলকী হয়েছে?

–কিছু না, তুমি ঘুমোও। মকবুল আর কোন কথা না বলে ক্লান্তিতে চোখ বুজলো। ফ্রান্সিস বুঝল, কেন হ্যারি হাঙরগুলোর কথা তাকে বলেনি। মকবুল এমনিতেই প্রচণ্ড রোদে উপবাসে জলকষ্টে নেতিয়ে পড়েছে। হাঙরে কথা জানতে পারলে, সে আরো দুর্বল হয়ে পড়বে। মনোবল একেবারে হারিয়ে ফেলবে। কাজেই মকবুলকে কিছুতেই হাঙরগুলোর কথা বলা হবে না। ফ্রান্সিস বঁড়শী জলে ফেলে চুপ করে বসে রইল। মাঝে-মাঝে তাকিয়ে হাঙরগুলোকে দেখতে লাগল। ওরমন সংকল্প আরো দৃঢ় হল, যে করেই হোক বাঁচতেই হবে। অনাহারক্লিষ্ট শরীর। বেশীক্ষণ এক ঠায় বসে থাকতে কষ্ট হয়। শিরদাঁড়াটা টনটন করতে থাকে। তবু ফ্রান্সিস দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইল। খাদ্য চাই, বাঁচতেই হবে আমাদের। মাথায় শুধু এক চিন্তা বাঁচতেই হবে।

হঠাৎ দড়িটায় টান লাগল। ফ্রান্সিস দড়িটায় হ্যাঁচকা টান মেরে ঝাঁপিয়ে দেখলে–বেশ ভারী কিছু আটকেছে বঁড়শীটায়। ফ্রান্সিস আনন্দে লাফিয়ে উঠল। হ্যারিও উঠে দাঁড়াল–কী ব্যাপার?

ফ্রান্সিস ডাকল–হ্যারি শীগগির এসো, একটা মাছ পাকড়েছি।

হ্যারিও এক লাফে ওর কাছে এল। দুজনে মিলে দড়ি ধরে টানতে লাগল। একটু পরেই মাছটাকে টেনে নৌকোর ওপর তুলল। বড় আকারের একটা সামুদ্রিক মাছ। দু’জনের আনন্দ দেখে কে? যা হোক দু’তিন দিনের খাবার জুটল। হ্যারি তার কোমরে গোঁজা ছুরিটা ফ্রান্সিসকে দিল। সে ছুরিটা দিয়ে মাছটা কাটতে লাগল। একটু কাটা হলে দু-তিনটে টুকরো বের করে নিল। হ্যারিকেও একটুকরো দিল। মহা আনন্দে দু’জনে কঁচা মাছই চিবিয়ে খেতে লাগল। একটু পরে মকবুলকে ডাকল। তাকেও কয়েক টুকরো মাছ দিল। মকবুল ক্ষিদের জ্বালায় তাই খেতে লাগল। কয়েকদিন উপবাসের পর কঁচা মাছ ভালোই লাগল। ক্ষিদের জ্বালায় অনেকটা মাছই খেয়ে ফেলল ওরা। বাকীটুকু পাঠাতনের নীচে রেখে দিল, পরের দিনের জন্যে।

দিন যায়, রাত যায়, ডাঙার দেখা নেই। শুধু জল আর জল। আধ খাওয়া মাছটা শেষ হলে ফ্রান্সিস আবার চেষ্টা করলো মাছ ধরবার জন্যে। কিন্তু ওর পেরেক-বঁড়শীতে আর মাছ ধরা পড়ল না। সুতরাং একটানা উপবাস চলল কয়েকদিন। শরীরে যেন আর একফোঁটাও শক্তি নেই। অসাড় শরীর নিয়ে তিনজনে নৌকার পাঠাতনে শুয়ে থাকে। ফ্রান্সিস মাঝে-মাঝে মাথা উঁচু করে চারিদিকে একবার তাকিয়ে নেয়–যদি মাটির দেখা মেলে। হাঙরগুলোকে দেখে আর ভাবে, বাঁচবার কোন আশা নেই। খাদ্য নেই, বৃষ্টির পরে রাখা জলও শেষ। এবার আস্তে-আস্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হবে।

সেদিন বিকেলের দিকে হঠাৎ ফ্যান্সিসের নজরে পড়ল দূরে জাহাজের পাল। ফ্রান্সিস দ্রুতপায়ে উঠে দাঁড়াল। শরীর দুর্বল! পা দুটো কাঁপছে। তবু ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। হ্যাঁ জাহাজই। কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু অনেক দূরে। তবু একবার শেষ চেষ্টা করতে হবে! বৈঠার সঙ্গে গায়ের জামাটা বেঁধে নাড়তে লাগল। যদি জাহাজের লোকদের নজরে পড়ে। কিন্তু, না জাহাজ এদিকে ফিরল না। যেমন যাচ্ছিল, তেমনি যেতে লাগল।

ততক্ষণে সন্ধ্যে হয়ে এসেছে সংকেত জানাবার আর কোন উপায় নেই। একমাত্র উপায় জাহাজটার দিকে লক্ষ্য করে নৌকাটা চালানো। যদি কোনরকমে জাহাজটার সঙ্গে দূরত্বটা কমানো যায়। শরীরটলছে। হাঁটু দুটো কাঁপছে। কিন্তু এই শেষ চেষ্টা। নইলে মৃত্যু অবধারিত। হঠাৎ মনে পড়ল হাঙরগুলোর কথা। ফ্রান্সিস জলের দিকে তাকাল। হাঙরের দল মাঝে মাঝে জল থেকে লেজ তুলে ঝাঁপটা দিচ্ছে। বোধহয় সংখ্যায় আরো বেড়েছে ওরা। ফ্রান্সিস আর চুপ করে শুয়ে থাকতে পারলে না। শরীরের সমস্ত জোর একত্র করে বসল, বৈঠাটা হাতে নিল। তারপর প্রাণপণে নৌকো বাইতে লাগল জাহাজটাকে লক্ষ্য করে।

সারারাত ধরে নৌকো বাইল ফ্রান্সিস। ক্লান্তিতে-অবসাদে শরীর ভেঙে পড়তে চাইছে। চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু ফ্রান্সিস হার মানে নি। ঐ অবস্থাতেই নৌকো বেয়েছে।

সূর্য উঠল। ভোর হল। ভাল করে তাকাতেও কষ্ট হচ্ছে। তবু তাকাতে হবে–দেখতে হবে জাহাজটা কত দূরে। হঠাৎ দেখল একটা পাতলা কুয়াশার মত আস্তরণের পিছনেই বিরাট জাহাজের পাল। আনন্দে ফ্রান্সিস চীৎকার করে উঠতে গেল। কিন্তু পারল না। গলা দিয়ে শব্দ বেরুল না। ফ্রান্সিস নিজের শরীরটাকে পাঠাতনের ওপর দিয়ে হিঁচড়ে নিয়ে চলল। হ্যারির কাছে এনে হ্যারিকে ধাক্কা দিল। হ্যারি আস্তে-আস্তে তাকাল ওর দিকে। ফ্রান্সিস অবসাদগ্রস্ত ডান হাতখানা তুলে জাহাজের দিকে ইঙ্গিত করল। তারপর ওর চোখের সামনে সব কিছু মুছে গেল। শুধু শোনা গেল, হ্যারি চীৎকার করে কী বলছে। সেই চীৎকারের শব্দটাও দূরবর্তী হতে হতে এক সময় মিলিয়ে গেল। সব অন্ধকার। কোনও শব্দই আর ওর কানে পৌঁছোল না। ফ্রান্সিসের অবসন্ন দেহটা জ্ঞান হারিয়ে পাঠাতনের উপর গড়িয়ে পড়ল।

জ্ঞান ফিরে পেয়ে ফ্রান্সিস যখন তাকাল, দেখল, ও একটা কেবিনঘরে শুয়ে আছে। দাড়িওলা একজন বুড়োমত লোক ওর নাড়ী টিপে দেখছে। ফ্রান্সিস বুঝল, ইনি ডাক্তার। ফ্রান্সিসকে চোখ মেলে তাকাতে দেখে ডাক্তার হাসলেন। বললেন কী? কেমন লাগছে?

–শরীরটা দুর্বল। ফ্রান্সিস টেনে-টেনে বলল।

–সব ঠিক হয়ে যাবে। এবার একটু খেয়ে নাও। একেবারে বেশী করে খেতে দেওয়া হবে না। কম কম করে খাবে।

ফ্রান্সিসের মনে হল, ক্ষুধাতৃষ্ণার বোধটুকুও যেন আর নেই ওর।

–কদিন উপোস করে ছিলে? ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন।

–চার-পাঁচদিন হবে।

–হুঁ–দু’তিন দিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

হঠাৎ ফ্রান্সিসের মনে পড়ল হ্যারি আর মকবুলের কথা। ফ্রান্সিস ধড়মড় করে বিছানা থেকে উঠতে গেল। ডাক্তার হাঁ-হাঁ করে উঠলেন।

–বিছানা ছেড়ে এখন ওঠা চলবে না।

–কিন্তু আমার সঙ্গে যারা ছিল আমার বন্ধুরা–তারা কোথায়?

–পাশের কেবিনেই আছে—

–আমি ওদের দেখতে চাই।

–উঁহু, আজকে নয়, কালকে।

–কিন্তু—

কোন কথা নয়–শুধু বিশ্রাম এখন।

একটু পরেই একজন তোক মাংসের ঝোল আর রুটি নিয়ে ঢুকল।

ডাক্তার বললেন–নাও, খেয়ে নাও।

ফ্রান্সিস খেতে বসল। এতদিনের উপবাস অথচ খেতে ইচ্ছে করছে না। আসলে উপবাসে-উপবাসে ওর খিদেই মরে গিয়েছিল। যতটা ভাল লাগল খেল। খাওয়া-দাওয়ার পর শরীরে যেন একটু বল পেল। ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বলল–অনেক ধন্যবাদ।

-আমাকে নয়–জাহাজের ক্যাপ্টেনকে। এক্ষুনি আসবেন।

একজন লোক কেবিনঘরে ঢুকল। মুখে। ছুঁচালো গোঁফদাড়ি। ঝাপ্টেনের পোশাকপরে। ফ্রান্সিস ঝল ইনিই ক্যাপ্টেন।

ক্যাপ্টেন ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করল–এখন কেমন আছে?

–ভালো। জ্ঞান ফিরেছে, তবে শরীরের দুর্বলতা কাটতে কয়েক দিন যাবে।

–হুঁ। এবার ক্যাপ্টেন ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করুল–কেমন লাগছে?

ফ্রান্সিস মাথা কাত করে জানালে–ভালো।

ক্যাপ্টেন জিজ্ঞেস করল–নৌকো করে কোথায় যাচ্ছিলেন?

ফ্রান্সিস সাবধান হল। হীরের পাহাড়ের কথা বললেই বিপদ বাড়বে তো কমবেনা। কাজেই অন্য ছুতো দেখাতে হল। বলল–আমাদের জাহাজ জলদস্যুরা আক্রমণ করেছিল। অনেক কষ্টে আমরা তিনজন জাহাজ থেকে নৌকা করে পালাতে পেরেছিলাম।

ক্যাপ্টেন আর কোন কথা জিজ্ঞেস করল না। ফ্রান্সিসও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যাবার সময় ক্যাপ্টেন বলল কয়েকদিন বিশ্রাম নিন, খাওয়া-দাওয়া করুন, শরীর ঠিক হয়ে যাবে।

পরের দিনটিও ফ্রান্সিস কেবিন ঘরে বিছানায় শুয়েই কাটালো। সন্ধ্যে নাগাদ হ্যারি আর মকবুল এল। হ্যারি খুশীতে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল। মকবুলও খুশী। বলল–ফ্রান্সিস, তোমার জন্যেই এ যাত্রায় আমরা বেঁচে গেলাম।

হ্যারি জিজ্ঞেস করল ফ্রান্সিস, তুমি কি শরীরের ঐ অবস্থায় সত্যিই সারারাত নৌকো বেয়েছিলে?

–উপায় কি? নইলে এই জাহাজটার কাছে পৌঁছানো যেত না।

তিনজনে মিলে কিছুক্ষণ গল্পগুজব চলল। গল্প বেশির ভাগই ওরা কী করে উদ্ধার পেল, তাই নিয়ে হল। কী করে অচৈতন্য ফ্রান্সিসকে জাহাজে তোলা হল, ওরাই বা দড়ি ধরে কী ভাবে জাহাজে উঠল–এসব নিয়ে কথাবার্তা হল। ফ্রান্সিস একসময় জিজ্ঞেস করল–তোমরা খোঁজ নিয়েছে, জাহাজটা কোথায় যাচ্ছে?

–হ্যাঁ। আমি খোঁজ নিয়েছি–মকবুল বলল–জাহাজটা পর্তুগীজদের। ওদের একটা বন্দর আছে পশ্চিম আফ্রিকার নিম্বাতে। সেই বন্দরেই যাচ্ছে জাহাজটা।

–ফ্রান্সিস বললে–তাহলে তেকরুর বন্দরে যাবার উপায়?

–নিম্বা থেকেই আর একটা জাহাজ ধরে কেরুর যেতে হবে—

মকবুল বলল–আর এই জাহাজ দু’একদিনের মধ্যেই নিম্বা পৌঁছুবে।

আরো কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে হারি আর মকবুল চলে গেল। ফ্রান্সিস চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল। শরীরের দুর্বলতা এখনো কাটেনি। বেশ ক্লান্ত লাগছে শরীরটা। তবু ফ্রান্সিসের চিন্তার যেন শেষ নেই। কী করে তেকরুর বন্দরে পৌঁছুবে। সেখান থেকে কী করে ওঙ্গ লির বাজারে যাওয়া যাবে। এসব সাত-পাঁচ ভাবতে-ভাবতে ফ্রান্সিস আবার একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।

দু’দিন পরে জাহাজটা নিম্বা বন্দরে ঢুকলো। ছোট বন্দর। জনবসতি খুবই কম। কিন্তু উপায় নেই। এই বন্দরেই অপেক্ষা করতে হবে অন্য জাহাজের জন্য। ফ্রান্সিসরা জাহাজ থেকে নামবার আগে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে দেখা করতে গেল। ক্যাপ্টেনকে বারবার ধন্যবাদ জানাল। ক্যাপ্টেনই ওদের হদিশ দিল একটা সরাইখানার। একজন পর্তুগীজ সরাইখানাটা চালায়। ফ্রান্সিসরা জাহাজ থেকে নেমে সেই সরাইখানাটা খুঁজে বের করল। খুবই সস্তা সরাইখানা। খাওয়ার টেবিল, বাসনপত্র নোংরা। তা হোক–এই সরাইখানা এখন স্বর্গ ওদের কাছে। কতদিন অপেক্ষা করতে হয়, কে জানে? একটা বড়ো দেখে ঘর ওরা ভাড়া নিল। ঘরটার জানালা থেকে সমুদ্র আর নিম্বা বন্দর স্পষ্ট দেখা যায়। কোন নতুন জাহাজ এলে ওদের চোখে পড়বেই।

আগের জাহাজের ক্যাপ্টেন ফ্রান্সিসের একটা মোহরের ভাঙানি দিয়ে গিয়েছিল পর্তুগীজ মুদ্রায়। মুদ্রাগুলো খুব কাজে লেগে গেল। ফ্রান্সিস খাওয়া থাকার জন্যে দু’দিনের আগাম পাওনা সরাইখানাকে মিটিয়ে দিল। সরাইওলা তাতেই বেজাই খুশী। দু’বেলা ওদের খোঁজপত্তর করতে লাগল। স্নানের জল, আলো আর ভাল খাবার-দাবারের সুবন্দোবস্ত করে দিল। জাহাজের খালাসীদের হাঁকে-ডাকে নিম্বা বন্দরটা মুখরিত হয়ে রইল একদিন। কিন্তু জাহাজটা চলে যেতেই আবার নিঃসাড় হয়ে গেল নিম্বা বন্দর।

নিম্বা বন্দরের একপাশে সমুদ্র। তা ছাড়া সবদিকেই ঘন জঙ্গল। শুধু জঙ্গল ছাড়া দেখবার কিছুই নেই। ফ্রান্সিসরা দুটো দিন নিজেদের ঘরেই শুয়ে বসে কাটিয়ে দিল।

তিন দিনের দিন দুপুর নাগাদ একটা মস্ত বড় জাহাজের পাল দেখা গেল সমুদ্রের ঢেউয়ের মাথায়। জানলা থেকেই দেখা গেল জাহাজটা। তিনজনেই ছুটে বেরিয়ে এল। সরাইখানা থেকে। জাহাজঘাটায় গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল জাহাজটার জন্যে। এক সময় জাহাজটা ঘাটে এসে লাগল। ফ্রান্সিসের আর তর সইল না। পাঠাতন ফেলার সঙ্গে সঙ্গে জাহাজে গিয়ে উঠল। মকবুল আর হ্যারি জাহাজঘাটায় দাঁড়িয়ে রইল। নতুন জাহাজের ক্যাপ্টেন বেশ দিলদরিয়া মেজাজের মানুষ। দু’চার মিনিট কথাবার্তা চলতেই ক্যাপ্টেন ফ্রান্সিসদের সঙ্গে পুরনো বন্ধুর মত ব্যবহার করতে লাগল। কথায় কথায় ক্যাপ্টেন জানাল–পানীয় জলের ঘাটতি পড়েছে বলেই এই বন্দরে জাহাজ ভেড়াতে হয়েছে। কালকেই আবার জাহাজ সমুদ্রে ভাসবে। কেরুর বন্দরে মাত্র একবেলার জন্য নোঙর করবে। তারপর আরো কয়েকটা বন্দরে থেমে-থেকে পর্তুগাল যাত্রা করবে।

ফ্রান্সিস খুব খুশী হল। কেরুর বন্দরে যাওয়ার একটা উপায় হলো। জাহাজ থেকে নেমেই বন্ধুদের এই খবরটা দেবার জন্যে ছুটলো।

সন্ধ্যের সময় কম্বল-টম্বল যা ছিল, তাই নিয়ে ফ্রান্সিসরা জাহাজে এসে উঠল। তেকরুর বন্দরে যাওয়া যাবে, এই উত্তেজনায় ফ্রান্সিসের সারারাত ভালো করে ঘুম হলো না। শুধু তেকর বন্দরে পৌঁছুনোইনয়, তারপরেও আছে ওঙ্গালির বাজারে যাওয়া। সেখান থেকে হীরের পাহাড়ে যাওয়া। এইসব ভাবনাচিন্তায় রাত কেটে গেল।

ফ্রান্সিস কেবিন-ঘর থেকে বেরিয়ে ডেক-এ এসে দাঁড়াল। পূর্ব আকাশটা লাল হয়ে উঠেছে। একটু পরে সূর্য উঠল। নিম্বা বন্দরের জঙ্গলের মাথা আলোয় আলোময় হয়ে উঠল। অন্ধকার কেটে গিয়ে সূর্যের আলোয় চারদিক ঝলমল করতে লাগল। ঘড়-ঘড়শব্দে নোঙর তোলা হল। সাড়া পড়ে গেল জাহাজের দাঁড়ি আর লোকজনের মধ্যে। ভালো করে পাল বাঁধা হল। ভোরের হাওয়ায় পালগুলো ফুলে উঠল। জাহাজ চললো তেজরুর বন্দরের উদ্দেশ্যে।

দুদিন পরে জাহাজটা তেকরুর বন্দরে পৌঁছল। তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। এখানে ওখানে দু’চারটে আলো টিমটিম করে জ্বলছে। অন্ধকারেও ফ্রান্সিস যতটা আন্দাজ করতে পারল, তাতে বুঝল, তেকরুর বন্দর নিম্বার চেয়ে বড়। জাহাজের ক্যাপ্টেনের কাছে জানতে পারল যে, এই তেকরুর বন্দর থেকে হাতির দাঁতের চালান যায় ইউরোপে। তাই এই বন্দরটা হাতির দাঁতের ব্যবসার প্রধান কেন্দ্র। ব্যবসার খাতিরে লোকজনের বাস আছে এখানে। সরাইখানাও আছে।

পরের দিন সকালে ফ্রান্সিসরা জাহাজ থেকে নেমে এল। একটা মাথা গোঁজার আস্তানা খুঁজতে হয়। এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করতেই একটা সরাইখানার খোঁজ পেল। এখানকার অধিবাসী প্রায় সবাই এদেশীয় নিগ্রো। কালো পাথরে কেঁকড়া চুল, থ্যাবড়া ঠোঁট। সরাইখানার মালিক কিন্তু আরবীয়। ব্যবসার ধান্ধায় এখানে এসে সরাইখানা খুলে বসেছে। সে বেশ সাদরেই ওদের গ্রহণ করল। থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করে দিল।

দিনকয়েক কাটলো নিশ্চিন্ত বিশ্রামে। এই কদিন কতরকম জাহাজ ভিড়ল তেকরুর বন্দরে। কত দেশের লোক যে নামল, তার ঠিক নেই। এর মধ্যেই ঘটলো এক কাণ্ড।

সেদিন দুপুরে ফ্রান্সিসরা খাওয়া-দাওয়া করছে। খাওয়ার ঘরে বেশী লোকজন নেই। এমন সময় দু’জন লোকঢুকল সরাইখানায়। খাওয়ার ঘরে এসে খাবারের টেবিলে বসল। দু’জনেই পরনে আরবীয় পোশাক। একজনের একটা চোখের ওপর কালো ফিতে দিয়ে বাঁধা কালো কাপড়ের টুকরো। এক চোখ অন্ধ নোকটার। সেই লোকটাই মোটা গলায় ডাক দিল খাবার দিয়ে যাওয়ার জন্যে। ফ্রান্সিস এতক্ষণ লক্ষ্য করে নি যে, মকবুল খাওয়া ছেড়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রয়েছে। ফ্রান্সিস মকবুলের দিকে তাকিয়ে আরো আশ্চর্য হলো। মকবুলের মুখটা ভয়ে সাদা হয়ে গেছে। ও কোনো কথা বলতে পারছে না।

ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল–কি হয়েছে মকবুল?

কাঁপা কাঁপা গলায় মকবুল বলল–ঐ লোকটাকে দেখেছো তো?

–কার কথা বলছো?

–ঐ যে একচোখ কানা লোকটা?

–হ্যাঁ দেখছি। তাতে কী হয়েছে?

–লোকটা এক নম্বরের শয়তান। পরে সব বলবো। আমাকে এখন একটু আড়াল করে বসো।

ফ্রান্সিস ওকে আড়াল দিয়ে বসল। মকবুল ভালা করে খেতে পর্যন্ত পারছেনা। ফ্রান্সিস আড়াল করে বসা সত্ত্বেও মকবুল কানা লোকটার দৃষ্টির সামনে নিজেকে আড়াল করে রাখতে পারলে না। সাংঘাতিক দৃষ্টি লোকটার। লোকটা তরোয়ালে হাত রাখল। তারপর টেবিল ছেড়ে উঠেআস্তে-আস্তে এগিয়ে এল ফ্রান্সিসদের দিকে। মকবুল ভয়ে অস্ফুট চীৎকার করে উঠল। ফ্রান্সিস বুঝল, লোকটার মতলব ভালো নয়। যে কারণেই হোক মকবুলকে সহজে ছাড়বে না লোকটা। ফ্রান্সিস ফিসফিস করে হ্যারিকে ডাকল–হ্যারি।

–উঁ।

–ঘর থেকে আমার তরোয়ালটা নিয়ে এসো তো।

হ্যারি এক মুহূর্তও দেরী করল না। ঘরের দিকে ছুটল ফ্রান্সিসের তরোয়ালটা আনতে। কানা লোকটাও ফ্রান্সিসের কাছে এসে দাঁড়াল। ফ্রান্সিসও টেবিল ছেড়ে উঠে ওর মুখোমুখি দাঁড়াল। ঝনাৎ করে শব্দ হলো। লোকটা খাপ থেকে তরোয়াল বের করে ফেলেছে। তরোয়ালের ছুঁচলো ডগাটা ফ্রান্সিসের বুকে ঠেকিয়ে দাঁতচাপা স্বরে বলল–এই কাফের, তুই সরে যা। ঐ কুত্তাটার সঙ্গে আমার বোঝাপড়া আছে।

ফ্রান্সিস কোন কথা না বলে অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। লোকটা চেঁচিয়ে বলল—তুই সরে যা।

ফ্রান্সিস বলল–তার আগে আমার সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হবে।

লোকটা এ রকম উত্তর আশা করেনি। বেশ অবাক হয়ে ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর তরোয়ালটা নামিয়ে বলল–তা তোর সঙ্গে বোঝাপড়াটা কি এখানেই হবে না, বাইরে যাবি?

হ্যারি ঠিক তখনই তরোয়ালটা এনে ফ্রান্সিসের হাতে দিল। তবোয়ালটা হাতে পেয়ে ফ্রান্সিসের মনের জোর অনেকটা বেড়ে গেল। বলল–তোর যেখানে খুশী।

লোকটা এতক্ষণে ফ্রান্সিসের কথাবার্তা শুনে আর ভাবভঙ্গী দেখে বুঝল, এ বড়। কঠিন ঠাই। তবু এত সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার মানুষও সেনয়। হঠাৎ লেকটা ফ্রান্সিসের?

মাথা লক্ষ্য করে তরোয়াল চালাল। ফ্রান্সিস এই হঠাৎ আক্রমণের জন্যে তৈরীই ছিল। সে তরোয়াল চালিয়ে মারটা ঠেকাল। শুরু হলো তরোয়ালের লড়াই। কেউ কম যায় না। লোকটা বারবার ফ্রান্সিসকে আঘাত করতে চেষ্টা করে চলল। ফ্রান্সিস শুধু মার ঠেকিয়ে চলল–আক্রমণ করল না। যারা টেবিলে বসে খাচ্ছিল, তারা টেবিল ছেড়ে দেওয়ালের দিকে সরে গেল। তারপর তরোয়াল-যুদ্ধ দেখতে লাগল। হঠাৎ কানা লোকটার একটা মার ফ্রান্সিস ঠিকমত ফেরাতে পারল না। তরোয়ালের ঘায়ে হাতের কাছের জামাটা ফেঁসে গেল! কেটেও গেল। রক্ত পড়তে লাগল। কানা লোকটা হা-হা করে হেসে উঠল। ফ্রান্সিস মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়িয়ে আক্রমণ করল। লোকটা এরকম দ্রুত আক্রমণ আশা করে নি। ফ্রান্সিসের মার ঠেকাতে-ঠেকাতে পিছিয়ে পা দিয়ে লোকটার তরোয়ালশুদ্ধ যেতে-যেতে একটা টেবিলের ওপর গিয়ে হাতটা টেবিলের ওপর চেপে ধরল। পড়ল। ফ্রান্সিস লাফ দিয়ে টেবিলে উঠে লেকটা কেমন বিমূঢ় দৃষ্টিতে ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে রইল। ফ্রান্সিস হাঁপাতে হাঁপাতে বলল কী, আর বোঝাপড়ার দরকার আছে?

লোকটা চোখ-মুখ কুঁচকে তরোয়ালটা মুক্ত করতে চেষ্টা করল। কিন্তু ফ্রান্সিস পা দিয়ে যেভাবে চেপে রেখেছে, তাতে লোকটা হাতের তরোয়াল নাড়াতে পারল না। ফ্রান্সিস মৃদু হাসল। তারপর জুতোশুদ্ধ পা’টা নোকটার তরোয়াল-ধরা হাতের মুঠোতে জোরে চেপে দিল। লোকটা তরোয়াল ফেলে হাতটা চেপে ধরল। ফ্রান্সিস তরোয়ালটা পা দিয়ে ঠেলে দিল কানা লোকটার সঙ্গীর দিকে। সঙ্গীটি তরোয়ালটা তুলে নিল। কিন্তু কী করবে বুঝতে না পেরে বোকার মত দাঁড়িয়ে রইল। কানা লোকটা ডান হাতটা চেপে ধরে সঙ্গীটির কাছে এসে দাঁড়াল। সঙ্গীটিকে বেরোবার ইঙ্গিত করে নিজেও দরজার দিকে পা বাড়াল। যাবার সময় মকবুলের দিকে তাকিয়ে বলল–যা, খুব জোর বেঁচে গেলি।

ফ্রান্সিস আবার খেতে বসল। খাওয়া চলছে, তখন ফ্রান্সিসমকবুলকে জিজ্ঞেস করল–কী ব্যাপার মকবুল? তোমার ওপর ঐ কানা লোকটার এত রাগ কেন?

মকবুল বলতে লাগল–কী আর বলবো? বেশ কয়েক বছর আগেকার কথা। তখন আমি এই অঞ্চলে কার্পেট বিক্রি করতাম। এই কানা লোকটা হচ্ছে এক দস্যুদলের সর্দার। এই দস্যুদলের কাজই হলো ইউরোপ আমেরিকার ক্রীতদাস কেনাবেচার বাজারে ক্রীতদাস চালান দেওয়া। এরা জাহাজে করে আসে। সঙ্গে নিয়ে আসে ঘোড়া। ঘোড়ায় চড়ে এরা এই দেশের শান্ত নিরুপদ্রব গ্রামগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। গ্রামবাসীরা ভয়ে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। তখন এরা ঘরগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেয়। প্রাণ বাঁচাতে সবাই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। তখন তাদের ধরে গলায় পরিয়ে দেওয়া হয় তিন-কোণা গাছের ডোলর এক রকম জিনিস। সেটার মধ্যে দিয়ে দড়ি ভরে দেওয়া হয়। কারো পক্ষে তখন দল ছেড়ে পালানো অসম্ভব। এইভাবে পঞ্চাশ একশো অল্পবয়সী ছেলেমেয়েকে এরা বেঁধে নিয়ে যায় নিজেদের জাহাজে। তারপর চড়া দামে সেই সব ক্রীতদাসদের বিক্রি করে ইউরোপ-আমেরিকার ক্রীতদাস বেচা কেনার হাটে।

–কিন্তু তোমার ওপরে ওদের রাগের কারণ কী?

–কারণ আছে বৈকি মকবুল বলল–আমি যে ওদের বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছিলাম।

–সেটা কী রকম?

–এই সব অঞ্চলে তখন কার্পেট বিক্রি করছিলাম। তখনই হঠাৎ একদিন দেখলাম নিরীহ গ্রামবাসীদের ওপর মর্মান্তিক অত্যাচার। আমি তখন সেই গ্রামটিতে ছিলাম। আমিও বাদ যাই নি। আমাকেও ধরে নিয়ে গিয়েছিল ওরা। অবশ্য কানা সর্দার আমাকে জিজ্ঞাসবাদ করে ছেড়ে দিয়েছিল। বারবার সাবধান করে দিয়েছিল, আমি যেন ওদের আসার খবর কাউকে না বলি। আমি অন্য গ্রামে গেলাম। সেখানে এই দস্যুদের আসবার কথা বলে দিলাম। সব লোক গ্রাম ছেড়ে পালাল। দস্যুদল গিয়ে দেখল, গ্রাম-ফাঁকা জনপ্রাণীও নেই। ওরা প্রথমে বুঝতেই পারেনি, গ্রামবাসীরা কার কাছ থেকে দস্যুদলের আসার খবর পেল। একচোখ কানা দস্যুদলের সর্দার কিন্তু ঠিক বুঝল, এটা আমারই কাজ। গ্রাম-গ্রামান্তরে নানা উপজাতির সর্দারদের কাছে তখন কার্পেট বিক্রী করছি। খবরটা আমার পক্ষে রটানোই সম্ভব। আমি করেছিলামও তাই। গ্রাম-গ্রামান্তরে যেখানে গেছি, দস্যুদের দলের আসার খবর রটিয়ে দিয়েছি। গ্রাম ফাঁকা করে সবাই বনে-জঙ্গলে পালিয়ে গেছে। দস্যুরা এসে দেখেছে গ্রামকে গ্রাম শূন্য-খাঁ-খাঁ করছে। একটা মানুষও নেই। এইবার কানা সর্দার হন্যে হয়ে আমাকে খুঁজতে লাগল। আমিও বিপদ আঁচ করে পালিয়ে এলাম এই তেকরুর বন্দরে। তারপর জাহাজে চড়ে নিজের দেশে পাড়ি জমালাম। এখন বুঝছি–দস্যুসর্দারের চোখে ফাঁকি দেওয়া অত সহজ নয়।

–হুঁ–ফ্রান্সিস বলল–তাহলে তো সর্দার ব্যাটাকে একটু শিক্ষা দিয়ে দিলে ভালো হতো। যাকগে ফ্রান্সিস আপনমনে খেতে লাগল।

এখন কি করে ওঙ্গালির বাজারে যাওয়া যায়, তাই নিয়ে ওরা পরিকল্পনা স্থির করতে বসল। এইসব জায়গা সম্বন্ধে ফ্রান্সিস বা হ্যারি কারোই কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। একমাত্র ভরসা মকবুল। মকবুল বলল–এখান থেকে মাইল পাঁচেক পূর্বদিকে পর্তুগীজদের একটা দুর্গ আছে। আগে ওখানে পৌঁছুতে হবে আমাদের, তারপর ইতিকর্তব্য স্থির করা যাবে।

ফ্রান্সিস আর হ্যারি দু’জনেই মকবুলের প্রস্তাবে রাজী হলো।

***

পরের দিন সকালবেলা ওরা যাত্রা শুরু করল পর্তুগীজদের দুর্গার উদ্দেশ্যে। তেকরুর বন্দর এলাকা ছাড়তেই শুরু হল গভীর বন। এরই মধ্যে দিয়ে একটা রাস্তামত রয়েছে। তেকরুর বন্দর থেকে দুর্গে মালপত্র নিয়ে যাওয়া-আসার জন্যে ঘোড়ায় টানা গাড়ী ব্যবহার করতে হয়। তাই গাড়ী চলার মত রাস্তা হয়েছে। দু’ধারে ঘন জঙ্গল। তারই মাঝখান দিয়ে এই সরু রাস্তা ধরে ওরা হাঁটতে লাগল। এতদিন আফ্রিকার জঙ্গল সম্বন্ধে গল্পই শুনেছে ফ্রান্সিস। এবার চাক্ষুষ দেখল আফ্রিকার জঙ্গল কাকে বলে। বন যে এত নিবিড় হতে পারে, ফ্রান্সিস তা ভাবতেও পারে নি কোনোদিন। দুপুর নাগাদ ওরা দুর্গার সামনে এসে হাজির হল। পাথরের তৈরী দুর্গা বেশ বড়ই বলতে হবে। সিংহদরজা দিয়ে ওরা দুর্গে ঢুকতে গিয়ে বাধা পেল। দ্বাররক্ষী কিছুতেই ওদের ঢুকতে দেবে না। ফ্রান্সিস ভাঙা-ভাঙা পর্তুগীজ ভাষায় বলল–ঠিক আছে–তুমি গিয়ে দুর্গ-রক্ষককে বলো আমরা ব্যবসার ধান্ধায় এদেশে এসেছি। একটা রাত দুর্গে থাকবো।

দ্বাররক্ষী চলে গেল। একটু পরেই একজন বেশ বলশালী লোক দরজার দিকে এগিয়ে এল। তার পরনে যুদ্ধের পোশাক। তার পেছনে-পেছনে এল দ্বাররক্ষী। ফ্রান্সিস বুঝল–ইনিই দুর্গরক্ষক।

দুর্গরক্ষক বেশ ভারিক্কি গলায় জিজ্ঞেস করল–আপনারা কে?

–আমরা ব্যবসায়ী। ফ্রান্সিস উত্তর দিল।

–কীসের ব্যবসা আপনাদের?

ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি বলে উঠল–কার্পেটের।

–কই–আপনাদের সঙ্গে তো কার্পেট দেখছি না।

–আমরা এই এলাকাটা ভালো করে দেখছি কার্পেট আনলে বিক্রি-বাট্টা হবে কিনা।

–ও।

–আমরা আজ রাত্তিরের মত এখানে থাকতে পারি? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।

–নিশ্চয়ই। দুর্গরক্ষক রক্ষীটিকে কি যেন ইঙ্গিত করল। রক্ষীটি ডাকল–আসুন আমার সঙ্গে।

রক্ষীকে অনুসরণ করে ফ্রান্সিসরা একটা ঘরে এসে হাজির হলো।

দুর্গের মধ্যে বেশ পরিচ্ছন্ন একটা ঘর। ফ্রান্সিসদের সেখানে থাকতে দেওয়া হল। যা রাত কাটাবার একটা আশ্রয় পাওয়া গেল। এবার আহারের ব্যবস্থা কি হবে? কিন্তু সে। চিন্তা তাদের বেশীক্ষণ রইল না। খাবার সময়ে রক্ষী এসে তাদের ডেকে নিয়ে গেল।

রাত্রে মস্ত লম্বা একটা টেবিলে সবাই একসঙ্গে খেতে বসল! প্রায় পঞ্চাশজন সৈন্য দুর্গায় থাকে। তাছাড়া আজকে রয়েছে দুর্গরক্ষকের দু’জন অতিথি আর ফ্রান্সিস ওরা। দেখতে-দেখতে দুর্গরক্ষক তার অতিথি দু’জনকে ফ্রান্সিসদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। অতিথিদের মধ্যে একজন বয়স্ক। তার নাম জন। অন্যজন যুবক। তার নাম ভিক্টর। ফ্রান্সিস জনের সঙ্গে আলাপ জমাল। হ্যারি আর মকবুল আলাপ করতে লাগল ভিক্টরের সঙ্গে। কথায় কথায় জন বলল–আমরা এখানে এসেছি হাতি শিকার করতে। দাঁতাল হাতি মেরে দাঁতগুলো নিয়ে ইউরোপের বাজারে বিক্রি করবো। অবশ্য দাঁতগুলো নিয়ে যাবার সময় এই দুর্গরক্ষককেও কিছু প্রাপ্য অর্থ দিতে হবে।

ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল–আপনারা কি হাতিশিকার করতে ওঙ্গালির বাজারে যাবেন?

–সেটা আমি তো ঠিক বলতে পারবো না। আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে একজন এদেশীয় নিগ্রো। মাসাই উপজাতির লোক। এরা বাধ্য আর খুব ভালো তীরন্দাজ। সেই গাইডই জানে আমরা কোথা দিয়ে কোথায় যাবো।

–সেই গাইড কোথায়?

–সে তার সঙ্গীদের সঙ্গে বারান্দায় বসে খাচ্ছে।

–তার সঙ্গী মানে।

–আমরা কুড়িজন মাসাইকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। মালপত্র বওয়া, রান্না করা, বিষ মাখানো তীর দিয়ে হাতী শিকার করা, হাতীর দাঁতগুলো বয়ে আনা–এইসব ওরাই করবে।

–আপনার গাইডটিকে জিজ্ঞেস করুন তো সে ওঙ্গালির বাজার চেনে কিনা।

–ডাকছি–বলে যারা খাবার পরিবেশন করছিল, তাদের একজনকে ডেকে বলল–গাইডটাকে একবার ডেকে দিতে।

একটু পরেই নেংটি পরা খালি গায়ে একজন নিগ্রো এসে জনের সামনে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস অনেক চেষ্টা করেও লোকটাকে বোঝাতে পারল না। তখন মকবুল মাসাইদের ভাঙা-ভাঙ্গা ভাষায় জিজ্ঞাসা করল–ওঙ্গালির বাজার চেনো?

নোকটা মাথা ঝাঁকাল অর্থাৎ চেনে। মকবুল আবার জিজ্ঞেস করলো–ওখানে আমাদের নিয়ে যেতে পারবে?

লোকটা মাথা ঝাঁকাল অর্থাৎ নিয়ে যেতে পারবে।

ফ্রান্সিস তখন জনকে বলল–আপনাদের সঙ্গে আমরাও যাবো।

বেশ তো। জন খুশী হয়ে সম্মত হল। মকবুল তখন গাইডটাকে নিয়ে পড়ল। নানা ভাবে বোঝাতে লাগল–ওরা যেখানে হাতি শিকার করতে যাবে, সেখান থেকে ওঙ্গালির বাজারে যাওয়া যাবে কিনা! লোকটাও বার বার মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, হ্যাঁ, যাওয়া যাবে।

রাত্তিরে বিছানায় শুয়ে ফ্রান্সিস, হ্যারি আর মকবুলের মধ্যে কথা হতে লাগল। ফ্রান্সিস এই ভেবে খুশী যে, কিছুদিনের মধ্যে ওরা ওঙ্গালির বাজারে পৌঁছুতে পারবে। তারপর হীরের পাহাড়। মকবুল বেশী কথা বলছিল না। খুব গম্ভীরভাবে কিছু ভাবছিল। ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল–কি হে মকবুল, তুমি চুপচাপ যে!

–একটা কথা ভাবছি।

–কী ভাবছো?

–জন সাহেবের গাইড কোন্ এলাকা দিয়ে নিয়ে যাবে জানি না। যদি উত্তর দিক দিয়ে আমরা ওঙ্গালির বাজারে যাই, তবে ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু দক্ষিণ দিক দিয়ে গেলে সেই অঞ্চলে ‘মোরান’ নামে একদল উপজাতির পাল্লায় পড়বো। ভীষণ হিংস্র এই মোরান উপজাতির লোকেরা। এদের খাদ্য হলো শুধু কাঁচা মাংস, দুধ আর ষাঁড়ের রক্ত।

–কিন্তু আমরা তো আর তাদের সঙ্গে লড়াই করতে যাচ্ছি না। ফ্রান্সিস বলল।

–তাহলেও। এরা সহজে কাউকে ছেড়ে দেয় না। এরা সব সময় যুদ্ধের পোশাক পরে থাকে। কোমরে ঝোলানো থাকে লম্বা দা, হাতে বর্শা আর তীর-ধনুক, কোমরের গোঁজা চকমকি পাথর, তারপর জলের থলি। সারা গায়ে-মুখে নানা রঙের উল্কি আঁকা।

–তুমি মিছিমিছি ভয় পাচ্ছ মকবুল–ফ্রান্সিস হেসে বলল।

–হয় তো তাই। মকবুল পাশ ফিরতে-ফিরতে বলল।

***

সকালবেলা লোকজনের ডাকাডাকি-হাঁকাহাকিতে দুর্গের চত্বরটা মুখর হয়ে উঠল। মাসাই কুলীরা সব মালপত্র নিয়ে তৈরী হল। ফ্রান্সিস, হারি আর মকবুল তৈরী হয়ে এসে অপেক্ষা করতে লাগল জন আর ভিক্টরের জন্যে। একটু পরে জন আর ভিক্টর এল। কুলীদের লাইন করে দাঁড় করানো হল। সামনে রইল সেই গাইড। সঙ্গে জন আর ভিক্টর। লাইনের মাঝামাঝি রইল ফ্রান্সিস আর মকবুল। দলের শেষের দিকে রইল হ্যারি।

যাত্রা শুরু হল। দুর্গের সামনে বেশ বড় একটা মাঠ। তারপরেই শুরু হয়েছে গভীর জঙ্গল। গাইডটির হাতে একটা লম্বাটে দা। কোথাও কোথাও দা দিয়ে জঙ্গল কেটে যাওয়ার পথ করে নিতে হচ্ছে। শুধু বন আর বন। কত রকমের গাছগাছালি, ফল-ফুলই বা কত রকমের। জঙ্গল এত ঘন যে সূর্যের আলো পর্যন্ত ঢুকতে পারছে না। আন্দাজেই বেলা বুঝে নিতে হচ্ছে। বনে আর কোন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না–শুধু বানর আর বেবুনের কিচিমিচি ডাক। সেই সঙ্গে বিচিত্র সব পাখির ডাক। দুপুর নাগাদ একটা ঝরণার কাছে এসে দলটি থামল। এবার খাওয়া-দাওয়া সেরে নিতে হল। ফ্রান্সিসের ভীষণ তেষ্টা। পেয়েছিল। প্রাণ ভরে ঝরণার জল খেয়ে নিল। আঃ!কি সুন্দর স্বাদ জলের। ওর দেখাদেখি অনেকেই ঝরণার জল খেল! খাবারের বাক্স খোলা হলো। সবাইকে খেতে দেওয়া হল। আসার সময় ফ্রান্সিস পথে কয়েকটা বনমুরগী দেখেছিল। মনে-মনে ঠিক করল কালকে কয়েকটা বনমুরগী মেরে মাংস খেতে হবে।

খাওয়া-দাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার শুরু হল যাত্রা। গভীর জঙ্গলের মধ্যে পথ করে নিতে হচ্ছে। কাজেই তাড়াতাড়ি হাঁটা যাচ্ছিল না। থেমে থেমে চলতে হচ্ছিল।

সন্ধ্যে হবার আগেই বনের রাস্তা অন্ধকারে ছেয়ে গেল। এবার রাত্তিরের জন্যে বিশ্রাম। ফ্রান্সিসদের একটা আলাদা তাঁবু দেওয়া হ’ল। রাতটা নির্বিঘ্নেই কাটল। তাঁবুর কাছেই একটা চিতাবাঘ কিছুক্ষণ ধরে গর গরূ করে ডেকেছিল। পরে আর চিতাবাঘের ডাক শোনা যায়নি। শেষ রাত্তিরের দিকে দুটো হায়না তাবুর কাছে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কুলীরা আগুন জ্বেলে শুয়েছিল। পোড়া কাঠ ছুঁড়ে মারতে সে দুটো পালিয়েছিল।

পরদিন সকালে তাবু আর জিনিসপত্র গোছ-গাছ করে আবার রওনা হল সবাই। সেই জঙ্গল কেটে পথ তৈরী করতে হল। গভীর বন। শুধু বাঁদর, বেবুন আর পাখির কিচিমিচি। সবাই সার দিয়ে চলছে। গতকালকের মত কয়েকটা বনমুরগীর দেখা পাওয়া গেল। ফ্রান্সিস আর লোভ সামলাতে পারল না। গাইড নিগ্রোটির কাছ থেকে তীর-ধনুক চেয়ে নিল। তারপর একটা মুরগীর দিকে নিশানা করে তীর ছুঁড়ল। কিন্তু তীরটা কয়েক হাত দূরে গিয়ে পড়ল। পরের বার আরো সাবধানতার সঙ্গে তীর চালাতে একটা মুরগী বিদ্ধ হল। এইভাবে সাতটা মুরগী মারা পড়ল। সেদিন দুপুরে মুরগীর মাংস দিয়ে খায়াটা ভালোই হল। খাওয়া-দাওয়ার পর একটু জিরিয়ে আবার যাত্রা শুরু হল!

সেই একঘেয়ে বন। বাঁদর, বেবুন আর পাখি-পাখালির ডাক। মাঝে সুন্দর ঝরণা। তৃপ্তিভরে ঝরণার জল খেয়ে নিল সবাই। তারপর আবার পথচলা। কুলীদের সর্দার পথ চলতে-চলতে কাঁপা কাঁপা গলায় কী একটা দুর্বোধ্য গানের সুর ধরল। বাকী কুলীরা সবাই সেই সুরে গাইতে গাইতে পথ চলল।

***

ছ’দিন পরের কথা। দুপুর নাগাদ ওরা একটা বিস্তীর্ণ মাঠের মত জায়গায় এসে উপস্থিত হল। সেই মাঠে দলবদ্ধভাবে চরে বেড়াচ্ছে অনেক জেব্রা। কুলীদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। জেব্রার মাংস ওদের খুব প্রিয়। কুলীদের সর্দার তীর-ধনুক নিয়ে কয়েকটা বুনো ঝোঁপের আড়ালে-আড়ালে জেব্রাগুলোর অনেক কাছাকাছি চলে গেল। তারপর মাত্র কয়েক সেকেন্ডের বিরতিতে প্রায় একসঙ্গে পাঁচটা তীর ছুঁড়ল। সবগুলো তীরই একটা জেব্রার গলায়, পেটে, কাঁধে গিয়ে বিধলো। আহত জেব্রাটা ছুটে চলল। সর্দার কুলীও ছুটল। তার সঙ্গে আরো দুতিনজন জেব্রাটাকে ধাওয়া করল। অন্যান্য জেব্রাগুলো ততক্ষণে পালিয়েছে। আহত জেব্রাটার সাদা-কালো ডোরা কাটা চামড়ায় রক্তের ছোপ লাগল। জেব্রাটা আর দ্রুত ছুটতে পারছিল না। বোঝা গেল, জেব্রাটা বেশ আহত হয়েছে। কিছুক্ষণ ছুটোছুটি করবার পর জেব্রাটাই ক্লান্তিতে মাটিতে বসে পড়ল। তখন কুলীদের সর্দার আর কয়েকজন নিগ্রো কুলী মিলে জেব্রাটাকে বেঁধে নিয়ে এল। জেব্রাটাকে কাটা হল। তারপর আগুন জ্বেলে জেব্রার মাংস পুড়িয়ে ওরা মহানন্দের খেতে লাগল। সন্ধ্যে হয়ে এল। ঐ মাঠেই একটা নিঃসঙ্গী গাছের নীচে তাবু ফেললো। রাষ্ট্রা নিরুপদ্রব্রেই কাটাল।

কিছু খেয়ে-দেয়ে সকালবেলা আবার যাত্রা শুরু হল। মাঠের এলাকা ছেড়ে আবর নিবিড় মনের মধ্যে দিয়ে দলটি এগিয়ে চলল। সেই গভীর বনের নীচে আধো আলো-অ ব্ধ কারের মেশামেশি! তারই মধ্য দিয়ে পথ করে দলটি এগিয়ে চলল।

হঠাৎ যেন জাদুমন্ত্রবলে কয়েকজন লোকদলটির চলার পথের ওপর এসে দাঁড়াল। মনে হলো, এতক্ষণ যেন ওরা এঁদের গতিবিধির ওপর নজর রেখেছিল। কারণ ওরা এদের যাবার পথের ওপরেই দাঁড়াল। অগত্যা দলটি থমকে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস দেখল, সেই লোকগুলি নেংটি পরে আছে। সারা গায়ে মুখে নানা রঙের উলকি আঁকা। হাতে বর্শা তীর-ধনুক, কোমরে ঝোলানো লম্বাটে দা। মকবুল তখন ওর পাশে দাঁড়িয়েছে, ফ্রান্সিস বুঝতে পারেনি। মকবুল ফ্রান্সিসের কাঁধে হাত রাখতেই ফ্রান্সিস ফিরে তাকাল। বলল কী ব্যাপার?

মকবুল ইশারায় আস্তে কথা বলতে বলল। তারপর চাপাস্বরে বলল–এরাই উপজাতির লোক। এদের কথাই তোমাকে বলেছিলাম।

–কিন্তু এদের মতলবটা কি? ফ্রান্সিস চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করল।

–ঠিক বুঝতে পারছি না। মকবুল গলা নামিয়ে উত্তর দিল। ফ্রান্সিসদের দলের সামনে ছিল গাইডটি। তার সঙ্গেই এদের কথা-বার্তা চলল। গাইডটি ফিরে এসে জনকে বলল–এই লোকগুলি কাপড়, আয়না, চিরুনি, পুঁতির মালা এইসব চাইছে।

জন রেগে বলল–ওসব আমরা দেব না। তারপর আগন্তুক দলটির দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল–ভালো চাও তো রাস্তা থেকে সরে দাঁড়াও।

লোকগুলোর মধ্যে যে দলপতি, তার গালে লম্বা কাটা দাগ। জনের কথা শুনে তার চোখ দুটো যেন জ্বলে উঠল মুহূর্তের জন্যে। সে চীৎকার করে কী একটা বলে উঠল। তারপর যেমন বন ফুঁড়ে হঠাৎ এসে দাঁড়িয়েছিল, তেমনি বনের মধ্যে মিলিয়ে গেল।

জন এসব নিয়ে মাথা ঘামাল না। চেঁচিয়ে হুকুম দিল–চলো সব।

আবার হাঁটা শুরু হল। হাঁটতে হাঁটতে মকবুল এক সময় ফ্রান্সিসের কাছে এল। ধীরে ধীরে বলল–জন সাহেব কাজটা ভালো করল না।

–কেন? ফ্রান্সিস বলল।

–ওরা সহজে ছেড়ে দেবে না। আপোসে মিটিয়ে নিলেই ভালো ছিল। কিন্তু তা না করে ওদের রাগিয়ে দেওয়া হল।

ফ্রান্সিস কোন কথা বলল না। মনে-মনে ভাবল–মকবুল মিছিমিছি ভয় পাচ্ছে। কী করবে ওরা? মকবুল কিন্তু ব্যাপারটা সহজ ভাবে নিল না। মাথা নীচু করে কী যেন ভাবতে-ভাবতে হাঁটতে লাগল। আবার মাঝে-মাঝে ভীত সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে বনের চারদিকে তাকিয়ে কী যেন দেখে নিতে লাগল। মকবুল যে ভীষণ ভয় পেয়েছে, এটা ওর চোখ-মুখ দেখেই ফ্রান্সিস বুঝতে পারল।

আরো দু’দিন হাঁটা পথে যাত্রা চলল। তিন দিনের দিন ফ্রান্সিসদের দল একটা ছোট পাহাড়ের নীচে উপস্থিত হল। এদিকে জঙ্গলটা তত ঘন নয়। একটু ছাড়াছাড়া গাছপালা। তারই মধ্যে দেখা গেল ইতস্ততঃ ছড়ানো হাতীর কঙ্কাল। গাইড বুঝিয়ে বলল–মরবার সময় উপস্থিত হলে হাতীরা নাকি বুঝতে পারে। তখন দল ছেড়ে বনের মধ্যে নিরুপদ্রব একটা জায়গা বেছে নিয়ে সেখানে শুয়ে পড়ে। তারপর হয় মৃত্যু। এসব জায়গাগুলো গাইডরা খুব ভালোভাবেই চেনে। সেই জন্যেই গাইডদের নিয়ে হাতীর দাঁত শিকার করতে আসা সুবিধাজনক! দেখা গেল, পাহাড়টা একেবারে চাঁছাছোলা পাথরের ঢিবি। একটা গাছও নেই পাহাড়টায়। তবে একটা জলপ্রপাত আছে। আঁজলা ভরে সেই জলপ্রপাতের জল খেল অনেকেই।

হঠাৎ গাইডটিকে দেখা গেল উত্তেজিত ভঙ্গীতে ছুটে আসছে। গাইডটি যে সংবাদ দিল তা অপ্রত্যাশিত। পাহাড়টাতে একটা গুহা রয়েছে। সেখানে নাকি অনেক হাতির দাঁত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। ফ্রান্সিস, জন, ভিক্টর সবাই ছুটল গুহাটার দিকে। বাইরের আলো থেকে প্রায় অন্ধকার গুহাটায় ঢুকে প্রথমে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। আস্তে-আস্তে গুহার অন্ধকারটা সরে আসতে দেখা গেল অনেকগুলো হাতীর দাঁত ও হাতীর কঙ্কাল ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে। জন আর দেরী করল না। কুলীদের হুকুম দিল দাঁতগুলো সব একত্র করে বেঁধে তাবুতে নিয়ে রাখতে। ফেরবার সময় প্রত্যেক কুলীকে একটা করে দাঁত বয়ে নিয়ে আসতে হবে।

হাতীর দাঁতগুলো নিয়ে আসার বন্দোবস্ত হচ্ছে, এমন সময় গাইড খবর নিয়ে এল, একপাল হাতী পাহাড়ের নীচের জঙ্গল ঝোঁপঝাড় ভেঙে এই দিকেই আসছে। তাড়াতাড়ি লম্বামত একটা বাক্স থেকে তীব্র বিষমাখা তীর-ধনুক বের করা হল। গাইডটি নিজে তীর ধনুক নিল। তাছাড়া আরো দু’জন কেতীর ধনুক দিল। তিনজন তিন জায়গায় দাঁড়াল। গাইডটি দাঁড়াল পাহাড়ের গায়ে লাগা একটা বড় পাথরের ওপর। অন্য দুজনের মধ্যে একজন পাহাড়ের নীচে ঝোঁপ-জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে রইল। আর একজন দাঁড়াল পাথরের আড়ালে।

কিছুক্ষণ পরেই একদল হাতি গাছপালা, ঝোঁপঝাড় ভাঙতে-ভাঙতে এগিয়ে এল। যেখানে এসে হাতীগুলো দাঁড়াল, সেখানটায় বন-জঙ্গল ছাড়া-ছাড়া। ওদের ওপর নজর রাখতে কোন অসুবিধে হল না। হাতীগুলোর মধ্যেই দুটো হাতী দাঁতাল ছিল। বাকীগুলো মা-হাতী আর বাচ্চা হাতী। পাথরের ওপর থেকে গাইডটি চীৎকার করে বলল–শুধু দাঁতাল হাতী দু’টোকে মার।

কথাটা শেষ হতে না হতেই তীর ছুটল। পাঁচ-সাতটা তীর পর-পর গিয়ে বিধল হাতী দু’টোর গায়ে। হাতী দু’টো কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করতে লাগল। তারপর এক সময় ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল। অন্য হাতীগুলো ততক্ষণে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল। আবর তীর ছুঁড়ল। হাতী দু’টোর গায়ে বিদ্ধ হল তীরগুলো। হাতী দু’টো আর উঠতে পারল না। আস্তে-আস্তে মাটির ওপরে এলিয়ে পড়ল। তীব্র বিষের প্রতিক্রিয়া শুরু হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাতী দু’টো জোরে-জোরে শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে মারা গেল। তখন কুলীদের মধ্যে আনন্দের সাড়া পড়ে গেল। তারা সবাই ছুটে গেল হাতী দু’টোর কাছে। ওদের মধ্যে একজন ধারাল ছুরি দিয়ে হাতীর পেটটা গোল করে কাটল। তারপর ভেতরে ঢুকে হাতীর মস্তবড় মেটেটা কেটে নিয়ে এল। ততক্ষণে আর এক দল কুলী জঙ্গল থেকে শুকনো পাতা কাঠ এনে আগুন জ্বালিয়ে ফেলেছে। ফ্রান্সিস একবার ভাবল, ওদের বারণ করে। কারণ হয়তো হাতীটির রক্তের সঙ্গে-সঙ্গে মেটেটাও বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু বারণ করতে যাওয়া বৃথা। হয়তো এরকম অবস্থায় হাতীর মেটে এর আগেও ওরা খেয়েছে। ওরা হাতীর মেটে আগুনে ঝলসাতে লাগল। ফ্রান্সিসরা তীর দিয়ে যে বুনো মুরগী মেরেছিল–তাই রান্না চাপাল।

রান্না শেষ হলে ফ্রান্সিসরা কয়েকজন জলপ্রপাতেস্নান করতে গেল। গত বেশ কয়েকদিন স্নান করা হয় নি। এখন স্নান করার সাধ মনের সুখে মেটাল ওরা! তারপর খেতে বসল। ওদিকে কুলীরা খাচ্ছে, আর এদিকে ফ্রান্সিসদের দল খাওয়া-দাওয়া চলছে। হঠাৎ বনের চারদিক কেমন যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। না পাখি-পাখালির ডাক, না বাঁদর, বেবুন, শিপাঞ্জীর কিচিরমিচির ডাক। ফ্রান্সিসের কাছে ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত লাগল। এ সময় মকবুল ফ্রান্সিসের কাছে সরে এলো। তারপর মৃদুস্বরে বলল ফ্রান্সিস, আমরা বোধহয় বিপদে পড়বো।

–কীসের বিপদ?

–লক্ষ্য করো নি–এই জায়গাটা কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

–তাতে কী হয়েছে–

–কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারবে, মোরান উপজাতির লোকেরা সাংঘাতিক। বনের পশুপাখিও ওদের ভয় করে চলে। মকবুলের কথা শেষ হবার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে জন চীৎকার করে নিজের খাবারের থালার ওপর ঝুঁকে পড়ল। দেখা গেল জনের পিঠে একটা তীর এসে বিঁধেছে। জন বারকয়েক উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। মাটিতে শুয়ে পড়ল। কী হল, সেটা বোঝবার আগেই আর একটা তীর এসে বিঁধলো ভিক্টরের পিঠে। ভিক্টর মাটিতে পড়ে কাতরাতে লাগল। মকবুল খাওয়া ছেড়ে লাফিয়ে উঠল–ফ্রান্সিস, শীগগির পালাও। ফ্রান্সিস আর হ্যারি সঙ্গে-সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো। ইতিমধ্যে দু একজন কুলীর গায়ে তীর লেগেছে। তাদের মধ্যেও হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। সবাই পালাতে চাইছে। এলাপাথাড়ি আরো কয়েকটা তীর ফ্রান্সিসদের আশেপাশে পড়ল।

ফ্রান্সিস, হ্যারি আর মকবুলকে আঙ্গুল দিয়ে পাহাড়টা দেখিয়ে চীৎকার করে বলল–পাহাড়ের দিকে চলো। তারপর তিনজনেই ছুটতে শুরু করল। কিন্তু একটু পরেই ওদের থামতে হল। পাহাড়ের নীচে থেকে শুরু করে সমস্ত জঙ্গল এলাকায় ওদের চারদিক ঘিরে আস্তে-আস্তে জঙ্গলের আড়াল থেকে উঠে দাঁড়াতে লাগল–মোরান উ পজাতির যোদ্ধারা। কোমরে ঝোলানো লম্বাটে দা। হাতে তীর-ধনুক আর বর্শা। মুখে খালি গায়ে উঁকি আঁকা। প্রায়শ’ পাঁচেক হবে। পালাবার কোন উপায় নেই। ফ্রান্সিসরা আস্তে-আস্তে ওদের তাবুর কাছে এসে অপেক্ষা করতে লাগল দেখা যাক, ভাগ্যে কী আছে?

মোরান যোদ্ধাদের মধ্যে একজন তীব্রস্বরে কু-উ-উ বলে ডাক দিল। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত যোদ্ধারা বর্শা উঁচিয়ে একসঙ্গে আনন্দে চীৎকার করে উঠল। অর্থাৎ যুদ্ধে জয় হয়েছে। শত্রুরা পরাস্ত। প্রায় সবাই একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল তাঁবুগুলোর ওপর। জিনিসপত্র সব ছত্রাখান করে দিল। তারপর তাঁবুগুলোতে আগুন লাগিয়ে দিল। সেই আগুন ঘিরে চলল উন্মত্ত নৃত্য। ফ্রান্সিসরা অসহায়ভাবে তাই দেখতে লাগল।

একটু পরে পাঁচ-ছয় জন মোরান যোদ্ধা এগিয়ে এল ফ্রান্সিসদের দিকে। ওদের দলের প্রথমেই রয়েছে সেই গাল কাটা সর্দার। খুশীতে ওর চোখ দুটো চিকচিক করছে। ফ্রান্সিসদের কাছে এসে লোকটা চীৎকার করে কী যেন বলল। সঙ্গে-সঙ্গে দু’তিনজন যোদ্ধা এগিয়ে এল। তারা ফ্রান্সিস, মকবুল আর হ্যারির হাত পেছনে দিকে বেঁধে ফেলল। লতাগাছ যে এত শক্ত হয়, ফ্রান্সিসের তা জানা ছিল না। বাঁধনটা যেন চামড়াটা কেটে বসে গেল।

এতক্ষণ বাক্স-প্যাটরা ভাঙা চলছিল। হঠাৎ ওদের নজরে পড়ল গুহা থেকে এনে জড়ো করে রাখা হাতীর দাঁতগুলোর ওপর। একজন ছুটে এসে সর্দারকে বোধহয় সেই কথাই জানাল। সর্দার সব হাতীর দাঁতগুলো নিতে হুকুম দিল। এমন কি মরা হাতী দু’টোর দাঁতও ছাড়ানো হল। বোঝা গেল–ওরা হাতীর দাঁতের মূল্য জানে।

ফ্রান্সিসদের হাত বাঁধবার সঙ্গে সঙ্গে কুলীদের হাতও বাঁধা হয়েছিল। এটা হ্যারির নজরে পড়ল একবার। হ্যারি মকবুলকে ডাকল–মকবুল।

–কি?

–আমাদের ভাগ্যে যা আছে হবে। তুমি ওদের সর্দারকে বুঝিয়ে বলো যে, কুলীদের ওপর কোন অত্যাচার না করে। ওদের তো কোন দোষ নেই।

মকবুল গালকাটা সর্দারকে মোরানদের ভাঙা ভাষায় কথাটা বলল। সর্দার এক মুহূর্ত হ্যারির দিকে তাকাল। তারপর কী একটা বলে উঠতেই কুলীদের হাতের বাঁধন কেটে দেওয়া হল। এবার গালকাটা সর্দার ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে চলতে ইঙ্গিত করল। পেছন থেকে কয়েকজন ফ্রান্সিসদের ধাক্কা দিল। সর্দার পাঁচ-ছয় জন সঙ্গী নিয়ে আগে আগে চলল। তাদের পেছনে ফ্রান্সিসদের তিনজন। তাদের পেছনে অন্য সব মোরান যোদ্ধারা। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলা শুরু হল। যতক্ষণ বনজঙ্গলের ছায়ায়-ছায়ায় হেঁটেছে ওরা ততক্ষণ গরম লাগেনি, কিন্তু যখনইবন ছাড়িয়ে ফাঁকা ফাঁকা মেঠোজায়গা দিয়ে হাঁটতে হয়েছে, তখনই অসহ্য গরমে ঘেমে উঠেছে ফ্রান্সিসরা। পথে দু’জায়গায় মাত্র থেমেছিল ওরা জল খাবার জন্যে। বিকেল নাগাদ ওরা সকলে মোরানদের গ্রামে এসে পৌঁছাল। গোল-গোল পাতায় ছাওয়া বাড়ীগুলো। সামনে উঠোন–বেশ নিকোনো–পরিষ্কার। গ্রামের মধ্যস্থলে একটা উন্মুক্ত চত্বরে খুঁটির সঙ্গে ফ্রান্সিসদের তিনজনকে বেঁধে রাখা হল।

***

রাত হতেই শুরু হল জয়োল্লাস। ওদের ঘিরে মোরানদের নাচ শুরু হল। একজন তীক্ষ্ণসুরে কী গাইতে লাগল। বাকীরা সবাই নাচতে লাগল। মশালের কাঁপা কাঁপা আলোয় জায়গাটা যেন আরো ভয়ানক হয়ে উঠল। সারারাত ধরে ফ্রান্সিসরা কেউ দু’চোখের পাতা এক করতে পারল না। শেষরাতের দিকে মোরানদের উল্লাসে একটু ভাটা পড়ল। একটু পরেই ভোর হল। সারারাতের অতিনিদ্রায় ফ্রান্সিসের একটু তন্দ্রা এসেছিল। সেই তন্দ্রাটুকুও ভেঙে গেল সর্দারে হাঁকডাকে। একটা কিছুর আয়োজন চলছে, এটা ফ্রান্সিস বুঝল। কিন্তু আয়োজনটা কীসের, সেটা তখনও বুঝতে পারল না।

একটু বেলা হতেই দেখা গেল, গাঁয়ের লোকেরা সেই চত্বরে এসে গোল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মাঝখানে ফাঁকা জায়গাটায় একটা হাঁড়িমত বসালো। তার সামনে বালি দিয়ে সীমা টেনে একটা গোলমত করা হল। তার ওপর গাছের শুকনো ডাল বিছিয়ে দেওয়া হল। সেই গোলের একটা দিক শুধু খোলা রইল। এসব দেখে মকবুল আস্তে ডাকল–ফ্রান্সিস!

ফ্রান্সিস মুখ ঘুরিয়ে মকবুলের দিকে তাকাল। দেখল-ভয়ে মকবুলের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। স্পষ্টই বোঝা গেল, ওর সারা শরীর কাঁপছে। ফ্রান্সিস বলল…কী হয়েছে মকবুল?

মকবুল অরুদ্ধস্বরে বলল… ফ্রান্সিস আমাদের মৃত্যু সুনিশ্চিত।

ফ্রান্সিস কথাটা শুনে চমকে উঠল। তবু শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করল–কী করে বুঝলে?

–ঐ যে গোলমত জায়গাটা সাজাচ্ছে–ওখানে শুকনো ডাল গুলোতে ওরা আগুন দেবে। তারপর ঐ গোল জায়গাটায় ছেড়ে দেবে একটা বিষধর সাপ। গোলের যে দিকটা খোলা, সেইদিক দিয়ে সাপটা বেরোতে চেষ্টা করবে। আর সেখানে মাথা প্রায় মাটিতে ঠেকিয়ে রাখা হবে আমাদের কাউকে। আগুনের বেড়াজাল থেকে বেরোতে না পেরে সাপটা ক্ষেপে উঠবে। তারাপর খোলা দিকটায় শোয়ানো মাথায় ছোবল মারবে।

বিমূঢ় ফ্রান্সিস কোন কথা বলতে পারল না। কী সাংঘাতিক? সত্যিই একটু পরে গোল করে সাজানে-শুকনো ডালগুলোতে ওরা আগুন লাগিয়ে দিল। জোর ঢাক বেজে উঠল। ঝুড়ি থেকে একটা সাপ বের করে ছেড়ে দেওয়া হলো সেই গোল জায়গাটায়। সাপটা যতবার বেরোবার চেষ্টা করলো, ততবারই আগুনের তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে ফুঁসতে লাগল।

এবার দু’তিনজন লোক মকবুলের কাছে এসে দাঁড়াল। তারপর মকবুলকে টানতে লাগল। মকবুল বুঝল নিশ্চিত মৃত্যু। নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়েও যেন হঠাৎ মনোবল ফিরে পেল। চীৎকার করে বলে উঠল–ফ্রান্সিস এরা নানাভাবে কষ্ট দিয়ে মানুষ মারে। আমার মৃত্যু অবধারিত। তাই বলছি তোমরা সুযোগমাত্র পালিও।

–কিন্তু কী করে? হতাশার ভঙ্গীতে ফ্রান্সিস বলল। লোকগুলো মকবুলকে ধরে টানাহ্যাচঁড়া শুরু করল। মকবুল দ্রুত বলে যেতে লাগল–এরা বুনো হাতির দঙ্গলে মানুষ ছুঁড়ে দিয়ে মারে, কুমীরভরা নদীতে মানুষকে জোর করে ঠেলে দেয়। আর একটা খেলা খুব প্রিয়। সর্দার একটা তীর ছোঁড়ে। তারপর যাকে মারবে, তাকে বলা হয় ছুটে গিয়ে তীরটা খুঁজে বের করতে। সে ছুটতে শুরু করলেই এদের দলের একজন তাকে ধরতে ছোটে। যদি লোকটা তাকে ধরবার আগেই সে তীরটা খুঁজে পেয়ে যায়, তাহলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়–নইলে মৃত্যু। ’মকবুল হাঁপাতে লাগল। লোকগুলো মকবুলকে সজোরে টানতে লাগল। মকবুল গায়ের সমস্ত শক্তিকে ফ্রান্সিসের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। বলল–যদি তীর খোঁজার খেলা হয় তাহলে তীর খোঁজার জন্য দাঁড়িও না। প্রাণপণে ছুটে পালিয়ে যেও। এছাড়া এদের কাছ থেকে বাঁচবার আর কোন পথ নেই। এদের কোনদিন বিশ্বাস করো না।

এবার লোকগুলো মকবুলের ঘাড় ধরে ধাক্কা দিতে লাগল। মকবুল আর বাধা দিল না। ওদের নির্দেশমতই চলল গোল জায়গাটার দিকে। গোল জায়গাটার যেদিকটা ফাঁকা সেইখানে মকবুলকে ঠেলে হাঁটু গেড়ে বসানো হল। তারপর জোর করে ওর মাথাটা নুইয়ে দেওয়া হলো। মকবুল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সাপটার দিকে। পালাতে গিয়ে বারবার আগুনের ছ্যাকা খেয়ে-খেয়ে সাপটা তখন ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। হঠাৎ মকবুলের মাথাটা সামনে রেখে ফুঁসে উঠে ছোবল মারল। চারপাশে ঘিরে দাঁড়ানো লোকেরা চীৎকার করে উঠল। মকবুল মাটিতে এলিয়ে পড়ল। ওর সারা মুখটা কালছে হয়ে উঠল। দু’একবার এপাশ-ওপাশ করতে করতে স্থির হয়ে গেল মকবুলের শরীরটা। উল্লাসে মোরানরা চীৎকার করে উঠল। ঢাক বেজে উঠল।

ফ্রান্সিস অসহায়ভাবে তাকিয়ে রইল। কত সুখ-দুঃখের সঙ্গী মকবুল। এমনি করে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হল। চোখ ফেটে জল এল ফ্রান্সিসের। কিন্তু কাঁদতে পারল না। ঘটনার ভয়াবহতা তাকে কিছুক্ষণের মধ্যে বিমূঢ় করে দিল। পরক্ষণেই দৃঢ় হয়ে উঠল ফ্রান্সিস। যেমন করেই হোক এর শোধ তুলতেই হবে।

ফ্রান্সিস হ্যারিকে ডাকল–হ্যারি।

হ্যারি মাথা নীচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। হয়তো যা ঘটে গেল, সেটা আন্দাজেই বোঝবার চেষ্টা করছে। তাকিয়ে দেখতে পারেনি। আস্তে আস্তে মাথা তুলে হ্যারি ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল।

ফ্রান্সিস বলল হ্যারি আমাদের ভাগ্যে কী আছে, জানি না। যা-ই ভাগ্যে থাকুক এবার হাতদুটো খোলা পেলে এর প্রতিশোধ আমাদের নিতেই হবে–মনে থাকে যেন।

হ্যারি কোন কথা বলল না। মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে আবার মাথা নীচু করে নিজের ভাবনায় ডুবে গেল।

বেলা বাড়তে লাগল। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে খুঁটিতে বাঁধা অবস্থায় ওরা দাঁড়িয়ে রইল। গতকাল দুপুরে আধপেটা খাওয়া হয়েছিল। তারপর থেকে একটা দানাও পেটে পড়ে নি। তার ওপর সারারাত ঘুম হয় নি। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গেল–তবু ফ্রান্সিস জল খেতে চাইল না। হ্যারিজল খেতে চেয়েছিল। ফ্রান্সিস রেগে-ফুঁসে উঠেছিল–হ্যারি–জল না খেতে পেয়ে যদি মরেও যাই, কোন দুঃখ নেই। কিন্তু এদের কাছ থেকে এক ফোঁটা জলও খেতে চাই না। ওরা হ্যারির জন্য জল নিয়ে এল। কিন্তু হ্যারি মাথা নেড়ে জল খেতে অস্বীকার করল।

সূর্য তখন মাথার ওপরে–যেন আগুন ছড়াচ্ছে। গালকাটা সর্দার দু’জন। সঙ্গী নিয়ে ওদের কাছে এল। সকলেরই পরনে যুদ্ধের সাজ। কোমরে লম্বাটে দা, একহাতে ধনুক, অন্য হাতে বর্শা। কোমরে জলের থলি আর চকমকি পাথর। সর্দার এগিয়ে এসে কী একটা বলল। একজন লোক এসে ফ্রান্সিস আর হ্যারির হাতের বাঁধন খুলে দিল। সর্দার কী একটা চীৎকার করে হুকুম করল। সর্দারের দু’তিনজন সঙ্গী ফ্রান্সিসের পিঠে ধাক্কা দিয়ে চলতে ইঙ্গিত করল। ফ্রান্সিস আর হ্যারি এগিয়ে চলল। সকলের সামনে গালকাটা সর্দার।

জঙ্গলের মধ্যে একটা কামত জায়গায় সবাই এসে দাঁড়াল। সর্দারের হাতে তীর ধনুক ছিল না। সে একজনের হাত থেকে তীর নিয়ে ইঙ্গিতে ফ্রান্সিসদের বোঝাতে লাগল, কী করতে হবে ওদের। মকবুলের কথা ফ্রান্সিসের মনে পড়ল। এটা সেই তীর খুঁজে বার করার খেলা। এই শেষ সুযোগ–পালাবার একমাত্র উপায়–ফ্রান্সিস নিজের মনকে বোঝাল। খুব মৃদুস্বরে লক্ষ্য করে বলল–আমি যা-যা বলবো, মন দিয়ে শুনে সেই মত কাজ করবে। ফ্রান্সিস সর্দারের দিকে এবার মাথা ঝাঁকিয়ে বোঝাল যে, সর্দার যা বলছে, সে তা বুঝতে পেরেছে। তারপরে সর্দারকে ইঙ্গিতে বোঝাল যে, দু’জনকেই একসঙ্গে ছুটতে দেওয়া হোক। সর্দার কী ভাবল। তারপর মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। সর্দারের হুকুমে ফ্রান্সিস আর হ্যারিকে জামা-জুতো খুলে ফেলতে হল। এবার ধনুকে তীর লাগিয়ে যেদিকে তাক করল, সেদিকে বেশ কিছু দূরে একটা টিলা রয়েছে, দেখা গেল। ওদিকে যেতে হলে কাটাগাছের ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। খালি পায়ে যে কী অবস্থা হবে, ফ্রান্সিস সেটা সহজেই অনুমান করতে পারল। যাতে কাটাগাছ ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে বেশী জোরে ছুটতে না পারে, তার জন্যই জুতো খুলতে হুকুম দেওয়া হল। সর্দার আর সঙ্গীদের পায়ে কিন্তু চামড়া জড়ানো লাতাপাতা দিয়ে বাঁধা জুতোর মত জিনিস পরা। এদের পক্ষে ছুটতে ততো অসুবিধে হবে না।

সর্দার টিলার দিকে লক্ষ্য করে একটা তীর ছুঁড়ল। তীরটা কোথায় পড়বে ফ্রান্সিস মোটামুটি আন্দাজ করে নিল। ফ্রান্সিস ছুটবে কিনা ভাবছে সর্দার ওর গায়ে ধনুকের খোঁচা দিল। ফ্রান্সিস অস্ফুটস্বরে হ্যারিকে বলে উঠল–টিলার তলায়।

তারপর ছুটতে আরম্ভ করল। হ্যারি বুঝল, টিলার তলায় ফ্রান্সিস অপেক্ষা করবে।

একটু পরে সর্দার একজনকে ইঙ্গিত করতেই সে ফ্রান্সিসকে ধরতে ছুটল। সর্দার আবার তীর ছুঁড়ল। তীরটা বাঁদিক ঘেঁসে বেরিয়ে গেল। আগের তীরটা গিয়েছিল টিলার দিকে। হ্যারি ছুটতে শুরু করল।

এদিকে ফ্রান্সিস কিছুদূরে ছুটে আসতেই বুঝতে পারল, কাঁটাগাছে ঝোঁপঝাড়ে ওর দুটো পা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। কিন্তু জীবন তা চাইতে মূল্যবান। তাই প্রাণপণে ছুটতে শুরু করল টিলা লক্ষ্য করে। হঠাৎ নজরে পড়ল, তীরটা বুনো ঝোপে আটকে আছে। কিন্তু ফ্রান্সিস মূহুর্তের জন্যেও দাঁড়ালো না। সমান বেগে ছুটতে লাগল। টিলার তলায় পৌঁছে ফ্রান্সিস একটা পাথরে বসে হাঁপাতে লাগল। একটু পরে হারির অস্পষ্ট গলা শুনতে পেল। হ্যারি ডাকছে–ফ্রান্সিস।

ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলল–এই যে আমি এখানে।

হ্যারি হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল–তুমি দৌড় শুরু করার একটু পরেই একজনকে পাঠানো হয়েছে তোমার সন্ধানে হয়তো বা আমার পেছনে কাউকে পাঠানো হয়েছে। নষ্ট করার সময় নেই–দৌড়াও।

ওরা ছুটতে শুরু করবে, এমন সময় পেছনের পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল সর্দারের ছ’জন সঙ্গীর মধ্যে একজন। সেও হাঁপাচ্ছে, ফ্রান্সিস বলে উঠল–হ্যারি, বাঁদিকের পাথরের আড়ালে যাও–ওখান দিয়েই বোরুবো আমরা। লোকটা তখন কোমরে গোঁজা লম্বাটে দা-টা বের করে ফ্রান্সিসের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। হ্যারি একলাফে পাথরের আড়ালে চলে গেল। তারপর আড়াল থেকে বেরিয়ে প্রাণপণে ছুটতে শুরু করল। এদিকে ফ্রান্সিস এক দৃষ্টিতে লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। লোকটার দশাসই চেহারা, তার ওপর হাতে দা। ফ্রান্সিস নিরস্ত্র। সে পালাবার ফিকির খুঁজতে লাগল। লোকটা হঠাৎ ফ্রান্সিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস খুব দ্রুত উবু হয়ে বসে পড়ল, লোকটা তাল সামলাতে পারল না। উবু হয়ে পাথরের উপর গিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস সুযোগ বুঝে ছুটতে লাগালো। লোকটা মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কপালে হাত বুলাতে লাগল। ততক্ষণে ফ্রান্সিস অনেক দূরে চলে গেছে। লোকটা ওদের লক্ষ্য করে দা হাতে ছুটতে লাগল।

হ্যারি যেদিকে ছুটে গিয়েছে, সেদিকে লক্ষ্য রেখে ফ্রান্সিস ছুটতে শুরু করল। হঠাৎ আঁকড়া-পাতা গাছের তলা থেকে হ্যারির চাপাস্বরে ডাক শুনতে পেল। গাছটার তলায় গিয়ে দেখল, হ্যারি ভয়ার্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রান্সিস কোন কথা বলল না। নিঃশব্দে দৌড়াবার ইঙ্গিত করল। আবার দুজনের ছুট শুরু হলো। বেশ কিছুটা দৌড়োবার পর ফ্রান্সিস কান পেতে রইল, যদি পেছনে কোন শব্দ শোনা যায়। কিন্তু কোন শব্দ তো নেই। শুধু বাঁদর আর পাখির কিচিরমিচির। পেছনের জঙ্গলটা ভাল করে দেখার জন্যে সামনেই যে পাথরের ঢিবিটা ছিল, হ্যারি সেটাতে গিয়ে উঠল। তারপর পেছনের জঙ্গ লের দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল–যদি অনুসরণকারী কাউকে নজরে পড়ে। হঠাৎ ফ্রান্সিসের মনে পড়ল ওদের হাতে তীর ধনুক আছে। ফ্রান্সিস চাপা স্বরে ডাকল–হ্যারি, শীগগির নেমে এসো।

হ্যারি নামবার জন্যে মাত্র একা পা তুলেছে, পেছনের জঙ্গল থেকে একটা তীর। এসে হ্যারির পায়ে বিধল। হ্যারি একটুদাঁড়িয়ে থাকবার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। পাথরের গা ঘেঁসে গড়িয়ে মাটিতে পড়ে গেল। ফ্রান্সিস পাগলের মতো ছুটে গিয়ে প্রথমে একহঁচকা টানে তীরটা খুলে ফেলল। তারপর মাথাটা কোলে তুলে নিল। হ্যারি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–ফ্রান্সিস, শীগগির পালাও।

–না, তোমাকে ছেড়ে যাবো না। এবার ফ্রান্সিসের চোখ বেয়ে জলের ধারা নামল।

হ্যারি বলে উঠল–পাগলামি করো না ফ্রান্সিস শীগগির পালাও। তোমার কাছে এখন এক সেকেন্ডের দামও অনেক। পালাও শীগগির।

ফ্রান্সিস তবুও অনড় হয়ে বসে রইল। হ্যারির তখন কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে। অনেক কষ্টে বলতে লাগল–আমি বাঁচবোনা–আমার জন্যে ভোবা না। তুমি পালাও।

–না। ফ্রান্সিস কাঁদতে কাঁদতে বলল–আমি তোমাকে না নিয়ে যাবোই না।

হ্যারি শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে আস্তে আস্তে উঠে ফ্রান্সিসের গালে একটা চড় মারল। উপবাসে অনিদ্রায় তৃষ্ণায় কাতর ফ্রান্সিসের শরীরটা ঝিমঝিম করে উঠল।

–শীগগির পালাও–হ্যারি ক্লান্তস্বরে বলল। হঠাৎ পেছনের জঙ্গলে ঝোপেঝাড়ে শব্দ উঠল। ফ্রান্সিস আর বসল না। হ্যারির মাথাটা কোল থেকে মাটির ওপর নামিয়ে দিল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আবার ছুটতে শুরু করল। কিছুটা এগিয়ে যাবার পর পেছনে শুনল একজন লোকের হর্ষোল্লাস। নিশ্চয়ই হ্যারিকে দেখতে পেয়েছে।

ফ্রান্সিস প্রাণপণে ছুটটে লাগল। যতবার হ্যারির কথা মনে পড়েছে, ততবারই চোখে জল এসেছে। দু’গাল ভেসে যাচ্ছে চোখের জলে। বারবার চোখ মুছতে লাগল হাতের উলটো পিঠ দিয়ে। কিন্তু চোখের জল বাধা মানছেনা। চোখের দৃষ্টি বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে। চোখ মুছে নিতে হচ্ছে বারবার। ফ্রান্সিস মনে-মনে নিজের ওপরেই দোষারোপ করতে লাগল। কেন সে হ্যারিকে পথের টিবিটায় উঠতে বাধা দিল না। অনুসরণকারীর হাতে তীর ধনুক আছে, এই কথাটা মনে করতে তার এত সময় লাগছে কেন? একটু সাবধান হলে হ্যারিকে এভাবে প্রাণ দিতে হত না। দু দুজন সঙ্গীকে চিরদিনের জন্যে হারানোর বেদনা তার মনকে গভীরভা আলোড়িত করল। তবু ভীত হল না ফ্রান্সিস। বরং প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় হয়ে উঠল তার মন। এর প্রতিশোধ নিতেই হবে। হ্যারি আর ফিরবে না। মকবুলও নয়। তবু তাদের হয়ে প্রতিশোধ নিতে হবে। ফ্রান্সিস চোখ মুছল। না, কান্না নয়। বজ্রকঠিন হতে হবে। সংকল্পে দৃঢ় থাকতে হবে।

ফ্রান্সিস ছুটে চলল। এখন ভীষণ সাবধান হতে হবে। সজাগ থাকতে হবে। কোন শব্দই যেন কান এড়িয়ে না যায়। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ। নাক-চোখ-মুখ দিয়ে যেন। আগুনের হালকা বেরোচ্ছে। একটু জল চাই। কপাল ভালো ফ্রান্সিসের। হঠাৎ একটা ঝরণার দেখা পেল একটু জল খাওয়ার সময় হয়তো পাওয়া যাবে। ফ্রান্সিস জল খেতে হাঁটু গেড়ে বসল। কিন্তু জল খাওয়া হলো না। পেছনে শুকনো ডাল ভাঙার শব্দ উঠল। ফ্রান্সিস চকিতে উঠে দাঁড়িয়ে আবার ছুটতে শুরু করল।

এবার সামনেই পড়ল কয়েকটা বড়-বড় পাথরের টিলা। ফ্রান্সিস ছুটতে ছুটতে টিলার ওপাশে চলে গেলো। পেছনেই একটা পাহাড়ী নদী। বেশী বড় নয়, কিনতু তীব্র স্রোত। ফ্রান্সিস নদীর কাছে একটা বড় পাথরের আড়ালে বসে হাঁপাতে লাগল। একটু জিরিয়ে নিয়ে আঁজলা ভরে নদীর জল খেলো। তারপরে টিলার পাথরগুলোর আড়ালে-আড়ালে ওপরে উঠল। বেলা পড়ে এসেছে–তবু পাথরগুলো আগুনের মত গরম। একটা পাথরের গায়ে-গায়ে লেগে, আড়াল থেকে আস্তে আস্তে মাথা তুলে দাঁড়াল। দেখল, বনজঙ্গলের মধ্যে থেকে অনুসরণকারীদের মধ্যে একজন মাথা নীচু করে কী যেন দেখতে-দেখতে এগিয়ে আসছে। ফ্রান্সিস বুঝল, এদের চোখে ধূলো দেওয়া প্রায় অসম্ভব। বনজঙ্গলের নাড়ী-নক্ষত্র ওদের জানা। ছুটে আসার সময় ফ্রান্সিসের পায়ের চাপে যে গাছগুলোর ডালপালা ভেঙেছে, লোকটা তাই দেখে ঠিক ফ্রান্সিসের পালাবার পথ চিনে নিচ্ছে। ফ্রান্সিস ভেবে দেখল, এই এক মস্ত সুযোগ। একজনের সঙ্গে তবু লড়া যাবে। কিন্তু গালকাটা সর্দার আর তার সঙ্গীরা এসে পড়লে ভীষণ বিপদ। মৃত্যু অনিবার্য। ফ্রান্সিস একটা ফন্দী বার করল।

টিলাটার নীচেই অনেকটা জায়গা জুড়ে বালি রয়েছে। তারই একধারে ফণীমনসা গাছের মত এক ধরনের গাছ। হাতী শিকার করতে যাওয়ার সময় ফ্রান্সিস এ ধরণের গাছ দেখেছে। এই গাছটার মোটা-মোটা পাতা ভেঙে দিলেই টপ করে ঘন সাদা দুধের মত রস পড়তে থাকে। ফ্রান্সিস কিছু শুকনো পাতা জড়ো করে একটা গাছের নীচে রাখলে। তারপর গাছটার দুটো পাতা ভেঙে দিল। টপ-টপ্ করে শুকনো পাতাগুলোর ওপর রস পড়তে লাগল আর বেশ শব্দ হতে লাগল। শব্দ শুনলেই মনে হবে কেউ যেন শুকনো পাতার ওপর দিয়ে হাঁটছে। এবার ফ্রান্সিস একটা বড় গোছের পাথরকাঁধেরওপর তুলে ধরে রাখল। ওর এক মাত্র অস্ত্র। তারপর দাঁড়াল এসে সেই গাছটার ঠিক উল্টেদিকে একটা পাথরের আড়ালে। আশঙ্কা উত্তেজনায় ফ্রান্সিসের বুক টিপ্ টি করতে লাগল। সময় যেন আর কাটে না।

একসময় দেখা গেল, সেই লোকটা খুব সন্তর্পণে বালির ওপর পা ফেলে-ফেলে এগিয়ে আসছে। হঠাৎ লোকটা ফ্রান্সিসের দিকে পেছন ফিরে উপ্টেমুখো হয়ে দাঁড়াল। নিশ্চয়ই শুকনো পাতায় গাছের রস পড়ার শব্দ কানে গেছে ওর। ফ্রান্সিস এই সুযোগের প্রতীক্ষাতেই ছিল। লোকটা চালাকি ধরে ফেলার আগেই কাজ সারতে হবে। ফ্রান্সিস আর দেরী করল না। দুই লাফে এগিয়ে এসে পাথরটা দুহাতে তুলে প্রচণ্ড বেগে ঘা বসাল লোকটার মাথায়। লোকটা এই হঠাৎ আক্রমণে একদিকে যেমন হকচকিয়ে গেল, তেমনি মাথায় জোর ঘা লাগতে বালির ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। ফ্রান্সিস আর এক মুহূর্তও দেরী করল না। ঝাঁপিয়ে পড়ে লোকটার হাত থেকে বর্শা ছিনিয়ে নিল। লোকটাও উঠে ঘুরে বসেছে তখন। ফ্রান্সিসও সঙ্গে সঙ্গে লোকটার বুক লক্ষ্য করে শরীরের সমস্তশক্তি দিয়ে বর্শা চালাল। অ–করে একটা শব্দ বেরিয়ে এল লোকটার মুখ থেকে। তারপরেই লোকটা চিত হয়ে বালির ওপর পড়ে গেল। বার কয়েক ওঠবার চেষ্টা করল। তারপর স্থির হয়ে গেল। হ্যারি আর মকবুলের মৃত্যুর প্রতিশোধ সে নিতে পেরেছে, এই ভেবে ফ্রান্সিস উল্লাসে চীৎকার করে উঠতে চাইল। কিন্তু বিপদের গুরুত্ব বুঝে চুপ করে রইল। হাঁপাতে হাঁপাতে কপালের ঘাম মুছল। তারপর মৃত লোকটির কোমর থেকে লম্বাটে দাঁটা নিল, বুক থেকে টেনে বর্শাটা খুলে নিল। ধনুক নিল–তীরগুলো নিল, জলের থলি আর চকমকি পাথর নিয়ে কোমরে গুঁজল এবার জুতো। বুনো লতাপাতা দিয়ে বাঁধা চামড়ার জুতোর মত জিনিসটা পায়ে পরে নিল। যখন নীচু হয়ে জুতো পরছে, তখনই বেলা শেষের একটা লম্বাটে ছায়া নড়ে উঠল। চকিতে মুখ তুলে তাকাতেই দেখল আর একটা লোক। গালকাটা সর্দারের আর একটা সঙ্গী। লোকটা দাঁত বের করে হাসল। বীভৎস সেই হাসি। প্রকাণ্ড লোকটা কোমর থেকে লম্বাটে দাটা খুলে নিল।

শুরু হ’ল দা নিয়ে যুদ্ধ। দা’য়ে-দায়ে যখন ঘা লাগছে, ফ্রান্সিসের হাতটা ঝঝন্ করে উঠছে। হাত অবশ হয়ে আসছে। উপবাসে অনিদ্রায় শরীরের যা অবস্থা, তাতে সামনা সামনি-লড়াইয়ে এর সঙ্গে পেরে ওঠা অসম্ভব। অন্য পথ নিতে হবে। হঠাৎ ফ্রান্সিস নীচু হয়ে এক মুঠো বালি তুলে নিল। আর লোকটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছুঁড়ে মারল লোকটার চোখে। লোকটার মুখের বীভৎস হাসি মিলিয়ে গেল। চোখ-মুখ কুঁচকে লোকটা এলোপাতাড়ি দা ঘোরাতে লাগল। ফ্রান্সিস দ্রুতহাতে লোকটার পেটে বর্শাটা আমূল বিঁধিয়ে দিল। লোকটা পেটে হাত দিয়ে বসে পড়ল। টেনে বর্শাটা খোলবার চেষ্টা করতে লাগল। পারল না। কাৎ হয়ে বালির ওপর শুয়ে শুয়ে গোঙাতে লাগল। লোকটার পেট থেকে বর্শাটা খুলে নিয়ে ফ্রান্সিস এগিয়ে চলল নদীটার দিকে। খুব সাবধানে নদীতে নামল। নদীতে জল বেশী নয়, তীব্র স্রোত। তার ওপর পাথরগুলো শ্যাওলা ধরা। পা টিপে টিপে সাবধানে নদী পার হলো। তার ওপারে উঠেই দেখতে পেল, বনের নীচে অন্ধকার জমে উঠেছে। অন্ধকারে ভালো করে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। এবার রাত্রির আশ্রয় খুঁজতে হয়। একটু এগিয়েই বনের মধ্যে কয়েকটা বিরাট আকারের গাছ জড়াজড়ি করে আছে দেখা গেল। তারই মধ্যে একটা গাছে ফ্রান্সিস উঠল। অনেকটা ওপরে একটা মোটা ডাল খুঁজে নিয়ে হেলান দিয়ে শুয়ে বিশ্রাম করতে লাগল। শরীর যেন আর চলতে চাইছেনা। মাথাটা খালি-খালি লাগছে। একটুক্ষণ চোখ বুজে থাকল। চোখ খুলতেই নজরে পড়ল গাছটায় বেশ কিছু ফল ঝুলছে। পাকা হলুদ রঙের ফলও রয়েছে। কিন্তু গাছাকী গাছ ফলগুলোই বা খাওয়া যায় কিনা–এসব কিছুই জানা নেই। খিদের জ্বালায় ফ্রান্সিস ডাল বেয়ে-বেয়ে মগডালে উঠে কয়েকটা পাকা ফল পেড়ে নিয়ে এল। দা’ দিয়ে কাটল। মুখ দিয়ে একবার চিবোতেই থুঃ থু করে ফেলে দিল। কী অসম্ভব তেতো! ফলগুলো ফেলে দিল।

রাত গভীরহ’ল। দুর্বল-ক্ষুধার্ত শরীরে ঘুমও আসতে চায়না। হ্যারি আর মকবুলের কথা মনে পড়ল। ফ্রান্সিসের চোখের কোণে জল চিকচিক করে উঠলো। কোথায় রইলো বন্ধুরা, ওঙ্গালির বাজার আর হীরের পাহাড়। এই গভীর রাতে এক সম্পূর্ণ অপরিচিত বন্য পরিবেশেও গাছের ডালে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে।

হঠাৎ নদীর ধার থেকে ভেসে এল কাদের চড়া সুরের কান্না। নিশ্চয়ই গালকাটা সদরের দলের লোকদের কান্না। তাহলে সর্দার তার সঙ্গীদের নিয়ে নদী পর্যন্ত এসে গেছে। তারাই তাদের দুই মৃত সঙ্গীদের জন্যে কাঁদছে। মৃতদেহ দুটো বোধহয় নদীর জলে ভাসিয়ে দেবে। তার আগে এই কান্না। সারারাত চড়া সুরে ইনিয়ে-বিনিয়ে কাদল ওরা। ফ্রান্সিসের যতবার তা ভেঙে গেছে, ততবারই শুনতে পেয়েছে এই কান্না। হ্যারি আর মকবুলের জন্যে ফ্রান্সিসের মনেও কম বেদনা জমে নেই। ওরা তবু কাঁদছে–মনের ব্যথা-বেদনার ভার কমছে তাতে। কিন্তু ফ্রান্সিস? কাঁঁদতেও পর্যন্ত পারছে না।

ফ্রান্সিস চোখ মুছে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

ভোরের দিকে একটু ঘুম এসেছিল। ঘুম ভাঙতেই দেখল, ভোর হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি গাছ থেকে নেমে এল। তারপর ছুটতে শুরু করল। ছুট ছুট। সর্দারের দলের সবাই এসে গেছে। কাজেই এবার ধরা পড়লে আর রক্ষে নেই। ছুট–ছুট। পাগলের মত ছুটতে লাগল ফ্রান্সিস।

ছুটতে ছুটতে একটা ফাঁকা মাঠের মত জায়গায় এসে পৌঁছল। একটা মাটির ঢিবিরওপর ব’সে ফ্রান্সিস হাঁপাতে লাগল। হঠাৎ নজরে পড়ল সাপ টিবি থেকে বেরিয়ে এল। এই সাপটাকে মেরে খেলে কেমন হয়? ভাবতেই ফ্রান্সিসের ক্ষিদে আরো বেড়ে গেল। দায়ের এককোপে সাপটার গলার কাছ থেকে দু’টুকরো করে ফেলল। তারপর মাথাটা ফেলে দিয়ে দা’ দিয়ে বাকীটুকুর চামড়া ছাড়িয়ে নিল। এবার টুকরো টুকরো করে কেটে মুখে ফেলে চিবোতে লাগল। কাঁচ কঁচা স্বাদটুকু বাদ দিলে খেতে মন্দ লাগল না। খাওয়া শেষ হলে একটা ঢেঁকুর তুলল। যা হোক একটা কিছু তো পেটে পড়ল। তিন দিন হতে চলল–চান নেই, খাওয়া নেই, ঘুম নেই শরীর যেন আর চলতে চাইছে না। ছুটে আসতে-আসতে পথে একটু-একটুকরে জল খেয়েছে। জলের থলি খালি। জল খাওয়া হল না।

হঠাৎ সামনের দিকে নজর পড়তেই দেখা গেল, একটা বাচ্চা হরিণ বেড়াচ্ছে। এই হরিণের বাচ্চাটাকেইমারা যাক। ফ্রান্সিস বর্শাটা ভালো করে বাগিয়ে ধরে ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটু গেড়ে চলতে লাগল। হরিণটার খুব কাছে এসে পড়ল ফ্রান্সিস। তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়েই বর্শাটা ছুঁড়ল। কিন্তু ক্ষুধার ক্লান্তিতে হাতটা কেঁপে গেল। বর্শাটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হতেই হরিণটা এক ছুটে পালিয়ে গেল।

বর্শাটা মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়ে হরিণটাকে খুঁজতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখতে লাগল। ঠিক তখনইনজরে পড়ল একটা ডোবার মতো জলাশয়। ফ্রান্সিস নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। দুতিন বার চোখটা ঘষল। নাঃ মিথ্যা নয়। সত্যিই একটা জলাশয়। ফ্রান্সিস একটু অস্পষ্ট চীৎকার করে সোজা ছুটল জলাশয়টার দিকে। তারপর সারা গায়ে জল ছিটোতে লাগল। শরীরটা যেন জুড়িয়ে গেল। থলিটাতে জল ভরে নিল। হঠাৎ লোকজনের কথাবার্তা কানে যেতেই তাড়াতাড়ি জঙ্গলের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে নজরে পড়ল একটা গ্রাম। খড়ে ছাওয়া বাড়ি-ঘর। পরিস্কার তকতক করছে উঠোন। ফ্রান্সিস আরো ভালো করে দেখতে চাইল। তাইনীচু হয়ে কিছুটা এগিয়ে এসে একটা বুনো খেজুরে গাছের আড়ালে বসে দেখতে লাগল। কোন্ উপজাতি এরা, ফ্রান্সিস বুঝল না। তখন গ্রামের লোকজনের দুপুরের খাওয়া চলছে। ফ্রান্সিসের ক্ষিদে দ্বিগুণ বেড়ে গেল। কিন্তু উপায় নেই। রাত্রি না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

সন্ধ্যের মধ্যেই গ্রামবাসীরা রাত্রির খাওয়া খেয়ে নিল। তারপর সবাই গ্রামটার মাঝামাঝি একটা জায়গায় এসে জমায়েত হ’ল। চাঁদের স্নান আলোর চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়াল, সবাই। ঢোলের মত মাটিতে বসানো একটা বাজনা বাজিয়ে নাচ আর গান শুরু হল। একজন মিহি সুরে গান ধরল। সে থামলে যারা নাচছিল, তারা সেই সুরে গান গাইতে লাগল। সেই সঙ্গে চলল নাচ। অনেক রাত অব্দি হল্লা চলল। তারাপর তারা কেউ-কেউ ঘুমুতে ঘরে গেল–কেউ-কেউ বা গরমের জন্যে তালপাতার চাটাই পেতে বাইরেই শুলল।

সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে, ফ্রান্সিস আস্তে-আস্তে গাছের আড়ালে থেকে বেরিয়ে এল। তারপর পায়ে-পায়ে এগোলো সামনেই যে বাড়িটা পড়ল তার দিকে। ঘরের খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল। তারপর রান্না করা খাবার-দাবার যা অবশিষ্ট ছিল, সব নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। ঠিক তখনই দেখল, একটা তেরো-চোদ্দ বছরের ছেলে চ্যাটাইয়ের বিছানা ছেড়ে উঠে বসেছে। চাঁদের ম্লান আলোয় ছেলেটি অবাক চোখে ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে রইল। ফ্রান্সিস বুঝলো–ছেলেটি তাকে নিশ্চয়ই খাবার চুরি করতে দেখেছে। কী আর করা যায়। ফ্রান্সিস মুখের ওপর আঙুল রেখে চুপ থাকতে ইঙ্গিত করল। ছেলেটি কিন্তু এবার ভয় পেল। পাশে শোয়া বাবাকে ডাকতে লাগল। কী যেন বারবার বলতে লাগল। ওর বাবা বিরক্তির ধমকদিতে পাশ ফিরে শুল। ছেলেটিও আর কোন কথা না বলে শুয়ে পড়ল।

গাছের আড়ালে বসে ফ্রান্সিস গোগ্রাসে খাবারগুলো গিলতে লাগল। সেই খাবারের কীই বা গন্ধ, কীই বা স্বাদ কিছুই বুঝে ওঠার মত মনের অবস্থা ফ্রান্সিসের ছিল না। শুধু খাবারটা গোগ্রাসে খেতে লাগল। খাওয়া শেষ হলে ফ্রান্সিস সেই জলাশয়টার ধারে । গেল। পেট ভরে জল খেয়ে বুনো খেজুর গাছের আড়ালে ফিরে এসে বসল। ঘুম পাচ্ছে। ফ্রান্সিস কয়েকটা গাছের ডাল ভেঙে নিয়ে এল। সেগুলো পেতে বিছানার মত করল। তারপর সটান শুয়ে পড়ল। অসহ্য ক্লান্তিতে শরীর এলিয়ে পড়ল। সব দুশ্চিন্তা মন থেকে মুছে ফেলে ঘুমিয়ে পড়ল কিছুক্ষণের মধ্যেই।

পাখি-পাখালির ডাকে ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল অনুসরণকারী গালকাটা সর্দার আর তার সঙ্গীদের কথা। ফ্রান্সিস দ্রুত উঠে বসল। তারপর চারিদিকে সাবধানে তাকিয়ে দেখে নিল। না! কেউ নজরে পড়ছে না। ফ্রান্সিস নিশ্চিত হয়ে গাছে ঠেস দিয়ে বসল। গ্রামটার দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হলো! কাল রাত্তিরে কত নাচগান বাজনা চলেছিল। এই সকালবেলাতেই কোথায় গেল সব। এখন গ্রামটাকে পরিত্যক্ত শ্মশানের মত মনে হচ্ছে।

একটু বেলা হতেই দেখা গেল গ্রামের শেষ প্রান্তের দিক থেকে একদল অশ্বারোহী লোক ছুটে আসছে। সকালের আলোয় ঝিকিয়ে উঠছে তাদের হাতের তরোয়াল। তাদের পরনে আরবীর পোশাক। কিছুক্ষণের মধ্যেইতাদের আসার কারণটা স্পষ্ট হল। ঘরের দরজা ভেঙে তারা সবাইকে টেনে-টেনে বের করতে লাগল। কেউ বাধা দেবার চেষ্টা করলে তরোয়ালের ঘায়ে তাকে মেরে ফেলতে লাগল। এতক্ষণে ফ্রান্সিসের মনে পড়ল মকবুলের কথা। মকবুল বলেছিল, কী করে একদল লোক দেশের নিরীহ গ্রামবাসীদের ধরে জাহাজে করে ইউরোপে-আমেরিকায় ক্রীতদাস বেচা-কেনার বাজারে নিয়ে যায়। কী অমানুষিক অত্যাচার!ওরা যাদের ধরেছিল, তাদেরই গলায় তিনকোণা গাছেডালের একটা বেড়ীরমত পরিয়ে দিচ্ছিল, তারপর বেড়ীগুলো দড়ি দিয়ে পরপর বেঁধে দু’তিনজন অশ্বারোহী টেনে নিয়ে যেতে লাগল। নিশ্চয়ই এখান থেকে হাঁটিয়ে ওদের জাহাজে নিয়ে গিয়ে ভোলা হবে। তারপর চালান দেওয়া হবে। হঠাৎফ্রান্সিসের নজর পড়ল সর্দারের ওপর। আরে! এটাই তো সেই লোক। বাঁ চোখটা কাপড়ের ফালিতে ঢাকা–এক চোখ কাণা লোকটা। তের বন্দরের সরাখানায় এই লোকটাই তো মকবুলের দিকে তেড়ে গিয়েছিল। সেদিন হাতে পেয়েও ছেড়ে দিয়েছিল। আজকে এই সর্দারের দফা রফা করতেই হবে। রাগে ফ্রান্সিস কাঁপতে লাগল। ইতিমধ্যে অনেক বাড়ীঘরেই আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। সকালের আকাশ ভরে উঠেছে ভয়ার্ত মানুষদের কান্না আর চীৎকারে। কী নির্মম এই ক্রীতদাসের ব্যবসায়ীরা। গতরাত্রের সেই ছেলেটা ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরেকাঁদছে। অশ্বারোহী লোকটার ভ্রূক্ষেপ নেই। গলায় বাঁধা দড়িটা টেনে নিয়ে চলেছে।

ফ্রান্সিসের আর সহ্য হল না। গাছের আড়াল থেকে একলাফে বেরিয়ে এসে বর্শা হাতে বিদ্যুৎগতিতে ছুটে চলল কানা সর্দারের দিকে। কেউ কিছু বোঝবার আগেই ফ্রান্সিস ঘোড়ায় বসা সর্দারের বুকে বর্শাটা বিঁধিয়ে দিল। সর্দার ঘোড়া থেকে উল্টেমাটিতে পড়ে গেল। সর্দারের ধারে কাছে যারা ছিল, তারা হইচই করে উঠল। তারপর ফ্রান্সিসের পেছনে ছুটল। ফ্রান্সিস প্রাণপণে ছুটতে ছুটতে একটা জলপ্রপাতের কাছে এল। তারপর এক মুহূর্ত দেরীনা করে জলপ্রপাতে ঝাঁপ দিল। জলের টানে কোথায় ভেসে গেল–অশ্বারোহী দস্যুর দল তার কোনো হদিসই করতে পারল না।

ফ্রান্সিসের মনে হলো জলের টানটা কমেছে। জল থেকে মুখ তুলে জলপ্রপাতটা আর দেখতে পেল না। অনেকটা দূরেই চলে এসেছে। এবার পাহাড়ী নদীটার ধারে এসে পাড়ে উঠতে চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু শরীর এত দুর্বল যে, স্রোতের বিপরীতে দাঁড়াতে পারছে হঠাৎ পারের দিক থেকে একটা বাড়িয়ে ধরা হাত দেখে ফ্রান্সিস চমকে উঠল, ও–সেই গত রাত্রিতে দেখা ছেলেটা হাত বাড়িয়ে আছে। ফ্রান্সিস ছেলেটার হাত ধরল। তারপর বেশ কষ্ট করেই নদীর পাড়ে উঠে মাটিতে শুয়ে পড়ল।

***

কতক্ষণ শুয়ে পড়েছিল খেয়াল নেই। হঠাৎ কে যেন গায়ে ধাক্কা দিতে লাগল। ফ্রান্সিস চোখ মেলে তাকাল। সেই ছেলেটি। সে আস্তে উঠে বসল। দেখল, ছেলেটির হাতে ধরা একটা পাতায় কী সব খাবার। একটা মাছও সেদ্ধও রয়েছে তার মধ্যে। ফ্রান্সিস পাতাটা টেনে নিল। তারপর খেতে লাগল আরাম করে। ছেলেটি মুখ দেখে মনে হলো, ছেলেটি খুব খুশী হয়েছে। কেউ কারো কথা বুঝলো না। তাই দুজনেই তাকিয়ে আছে দু’জনের দিকে।

একটু সুস্থ হয়ে হাঁটতে লাগল। ছেলেটিও তার সঙ্গে সঙ্গে চলল। কিছুদূর যাওয়ার পর একটা পাহাড়ী জায়গায় এসে দাঁড়াল ওরা। সেখান থেকে অনেক দূরে ছেলেটির গ্রাম দেখা গেল। গ্রামের কিছু কিছু ঘরবাড়ি অর্ধদগ্ধ হয়ে পড়ে আছে। ছেলেটি কিছুক্ষণ সেই দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ফ্রান্সিসকে ইঙ্গিতে বলল–আমি গ্রামে যাবো। ফ্রান্সিস আপত্তি করল। কে জানে, আরবীয় দস্যুরা এখনও ওৎ পেতে আছে কিনা। কিন্তু ছেলেটি কোন কথাই শুনল না। আস্তে-আস্তে পা বাড়াল নিজের গ্রামের দিকে। কেমন একটা মায়া পড়ে গিয়েছিল ছেলেটার ওপর। ফ্রান্সিসের চোখে জল এল।

ছেলেটি চলে যেতে ফ্রান্সিস আবার একা হয়ে গেল। কেউ কারো কথা না বুঝলেও ছেলেটি সঙ্গী তো ছিল। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ফ্রান্সিসের। হঠাৎ মনে পড়ল–অনুসরণকারী গালকাটা সর্দার আর তার সঙ্গীদের কথা। ফ্রান্সিস দ্রুত পা চালাল।

এদিকে ফ্রান্সিসকে অনুসরণকারী দলের নিজেদের মধ্যেই ঝগড়া লেগে গেল। একজন আর বেশী দূর যেতে আপত্তি করল। সে বারবার বলতে লাগল নিজেদের গ্রাম থেকে আমরা অনেকদূরে এসে পড়েছি। একটা লোকের জন্য আমাদের এই ছুটোছুটি করা অর্থহীন। সে শুধু আপত্তিই করল না। একেবারে বেঁকে বসল। সর্দার বোঝাবার চেষ্টা করল। কিন্তু লোকটা শুনল না। সে উল্টেমুখে নিজেদের গ্রামের উদ্দেশ্যে চলতে শুরু করল। কিন্তু বেশীদূর যেতে পারল না। সর্দার ছুটে এসে তার পিঠে বর্শা বসিয়ে দিল। লোকটা উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। দু একবার কাতর আর্তনাদ করল। তারপর মারা গেল। রইল সর্দার আর তিনজন। তারা এবার ফ্রান্সিসের যাওয়ার পথের নিশানা খুঁজতে লাগল।

ওদিকে ফ্রান্সিস দ্রুত পায়ে ছুটতে লাগল। প্রচণ্ড গরমে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে যেন। মাথার ওপরে সূর্য যেন আগুন ছড়াচ্ছে। ফ্রান্সিসের মাথা ঘুরতে লাগল। চোখের সামনে সবকিছু যেন ঝাপসা হয়ে আসছে।

ফ্রান্সিস এসময় যাচ্ছিল হলুদ নুড়ি ছড়ানো একটা পাহাড়ে জায়গা দিতে টলতে টলতে। নুড়িগুলো ওপর প্রায় পড়ে যেতে-যেতে ফ্রান্সিস হঠাৎ ভীষণভাবে চমকে উঠল। নুড়িগুলোর গায়ে-গায়ে জড়িয়ে আছে, কত বিচিত্র রঙের কত রকম সাপ ফ্রান্সিস শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে দ্রুত ছুটে পেরিয়ে গেল সাপের জায়গাটা! তারপর একখণ্ড ঘাসের জমির ওপর বসে হাঁপাতে লাগল।

কিছুক্ষণ পরেই ফ্রান্সিসের অনুসরণকারী দলটি এই সাপজড়ানো নুড়িগুলোর ওপর এসে দাঁড়াল। তারাও বুঝতে পারে নি যে, এক জায়গায় এত সাপ রয়েছে। একটা সাপ একজনের পায়ে জড়িয়ে ধরল। সে ঝাঁকুনি দিয়ে দূরে ছুঁড়ে দিল সাপটাকে। কিন্তু আর সবাইকে সাবধান করবার আগেই একজনের পায়ে সাপ কামড়াল। লোকটা মাটিতে পড়ে গেল। এতক্ষণে সবাই বুঝল, কী সাংঘাতিক জায়গা দিয়ে ওরা যাচ্ছে। তারা সঙ্গীকে রেখেই দৌড়ে পালিয়ে গেল। গালকাটা সর্দারের সঙ্গী রইল মাত্র দু’জন। তবু ছাড়লনা। দু’জন সঙ্গী নিয়েই সে ছুটতে লাগল। তাড়াতাড়ি ছোটবার জন্যে ওরা তীর-ধনুক বর্শা ফেলে দিয়েছিল। শুধুলম্বাটে দা’গুলো কোমরে ঝোলানো রইল।

কী একটা শব্দ হতে ফ্রান্সিস পিছনে ফিরে তাকাল। দেখলো দু’জন সঙ্গী নিয়ে গালকাটা সর্দার ছুটে আসছে। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে উঠেদাঁড়িয়ে ছুটতে লাগল। ছুট-ছুট প্রাণপণে ছুটতে লাগল ফ্রান্সিস। ছুটতে ছুটতে সে একটা মালভূমির মত জায়গায় এসে দাঁড়াল। দেখল, চারপাশের গাছগাছালি কেমন শুকনো। অসহ্য গরমে ঘাসগুলো পর্যন্ত শুকিয়ে খড়ের মত হয়ে গেছে। দূরে দেখা গেল, ঢালু পাহাড়ে জায়গা ধরে সর্দার সঙ্গী সহ ছুটে আসছে।

ফ্রান্সিস তীরধনুক হাতে নিল। কিছু শুকনো ঘাস ছিঁড়ে কয়েকটা তীরের মাথায় বাঁধল। তারপর চকমকিটুকে আগুন জ্বালিয়ে তীরগুলো চারিদিকের শুকনো গাছগুলোর ওপর ছুঁড়ে মারতে লাগল। গাছগুলো এত শুকনো ছিল যে, তীরগুলো এসে পড়বার সঙ্গে সঙ্গে আগুন জ্বলে উঠলো। মালভূমির মত জায়গাটায় দাঁড়িয়ে ফ্রান্সিস দেখল, চারিদিকে আগুনের লেলিহান শিখা।

সর্দার আর তার সঙ্গীরা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। আগুনের জাল পেরিয়ে ফ্রান্সিসকে ধরা অসম্ভব। আর ফ্রান্সিসতীরধনুক আর বর্শা হাতে আনন্দে নাচতে লাগল। সর্দার শুধু তাকিয়ে-তাকিয়ে ফ্রান্সিসের নাচ দেখতে লাগল। রাগে সর্দারের মুখটা আরে কুৎসিত হয়ে উঠল। কিন্তু কোন উপায় নেই। প্রায় সারারাত আগুন জ্বলল। ফ্রান্সিস আগুনের মাঝখানে একটু নিশ্চিন্তে রাতটা কাটাল।

ভোর হতেই ফ্রান্সিস লাফিয়ে লাফিয়ে গাছের পোড়া কাণ্ড ডাল-পালা পার হয়ে আবার ছুটতে শুরু করল। এক সময় পিছন ফিরে দেখল সর্দার তার সঙ্গী দুজনকে নিয়ে ছুটে আসছে। উপবাসে অনিদ্রায়, উৎকণ্ঠায় ফ্রান্সিসের শরীর আর চলছিল না যেন। তবুও সে পাগলের মত ছুটতে লাগল। কিন্তু দূরত্ব ক্রমেই কমে আসছে। সর্দার আর সঙ্গীদের পায়ের চাপে ঝোঁপঝাড়ের ডালপালা ভাঙার শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।

ফ্রান্সিস হাঁ করে মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে লাগল। শরীরে আর একফেঁটা শক্তি নেই। ক্লান্তিতে, অবসাদে ইচ্ছে করছিল মাটিতে শুয়ে পড়ে বিশ্রাম নেয়। কিন্তু পেছনেই ওরা যমদূতের মত আসছে। আর দৌড়তে পারছে না ফ্রান্সিস। ওর মাথা ঘুরতে লাগল।

হঠাৎ বনটা শেষ হয়ে গেল। ফ্রান্সিস দেখলো। সামনেই মাঠ পেরিয়ে পর্তুগীজদের সেই দুৰ্গটা। ফ্রান্সিস আর ছুটতে পারল না। চোখের সামনে সব কিছু দুলছে যেন। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। ফ্রান্সিস মাঠের মধ্যেই শুয়ে পড়ল।

গালকাটা সর্দার বনের মধ্যে থেকেই দেখতে পেল ফ্রান্সিস মাটিতে শুয়ে পড়েছে। সর্দার সঙ্গী দু’জনকে বনের মধ্যেই অপেক্ষা করতে বলল। তারপর নিজে ছুটে এল ফ্রান্সিসের কাছে। ফ্রান্সিস দেখল, কী ভয়ংকর হয়ে উঠেছে সর্দারের মুখ। সর্দার কোমর থেকে দাটা খুলে নিল। তারপরদাটা উচিয়ে ধরল। ফ্রান্সিস মাটিতে গড়িয়ে-গড়িয়ে দূরে সরে যাবার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। সর্দার / দাটা উঁচু করে কোপ মারতে গেল। ঠিক। তখনই একটা তীর এসে সর্দারের ডান কাঁধে বিঁধল। সর্দার দা’টা ফেলে কাঁধে হাত দিয়ে চেপে বসে পড়ল। আরো কয়েকটা তীরে এখানে-ওখানে লাগল।

ফ্রান্সিস দেখল দুৰ্গটা থেকে জন পঞ্চাশেক পর্তুগীজ তীরন্দাজ পায়ে-পায়ে এগিয়ে আসছে। গালকাটা সর্দার তীরন্দাজ বাহিনীকে দেখল। হাত দিয়ে তখন রক্ত ঝরছে। একবার ফ্রান্সিসের দিকে কটমট করে তাকিয়ে নিয়ে এক ছুটে বনের মধ্যে লুকিয়ে পড়ল। বনের আড়াল থেকে সর্দার আর সঙ্গী দু’জন তাকিয়ে রইল তীরগুলো চারিদিকের শুকনো গাছগুলোর ফ্রান্সিসের দিকে। হাতের শিকার ফসকে গেল। ওপর ছুঁড়ে মারতে লাগল। ফ্রান্সিস দেখল, তীরন্দাজ বাহিনী অনেক কাছে। এসে পড়েছে। আর কিছু দেখতে পেল না। চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে গেল।

পর্তুগীজ সৈন্যরা অজ্ঞান ফ্রান্সিসকে ধরাধরি করে দুর্গের দিকে নিয়ে চলল। ঝোঁপ জঙ্গলের আড়াল থেকে গালকাটা সর্দার আর তার সঙ্গীরা অসহায়ভাবে তাকিয়ে রইল। কিছুই করবার নেই। শিকার হাতছাড়া হয়ে গেছে।

***

ফ্রান্সিস যখন জ্ঞান ফিরে পেল, দেখল দুর্গেরই একটা পরিচ্ছন্ন ঘরে সে শুয়ে আছে। আগেরবারও তাদের এই ঘরটাতেই থাকতে দেওয়া হয়েছিল। ওর জ্ঞান ফিরে এসেছে দেখে একজন সৈন্য বিছানার দিকে এগিয়ে এল। জিজ্ঞেস করল–কিছু খাবেন?

ফ্রান্সিস আস্তে-আস্তে মাথা নেড়ে জানাল সে খাবে। ফ্রান্সিসের ক্ষুধার বোধই ছিল না। তবু ভাবল কিছু খেলে হয়তো শরীরটা ভালা লাগবে। সৈন্যটি চলে যাবার একটু পরেই দুর্গাধ্যক্ষ হেনরী দু’জন সৈন্য নিয়ে ঢুকে। ফ্রান্সিসকে বলল–কেমন আছেন?

ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে জানাল, সে ভালো আছে।

হেনরী জিজ্ঞেস করল–আপনার সঙ্গী দু’জন কোথায়?

হ্যারি আর মকবুলের কথা মনে পড়ল। চোখ ছলছল করে উঠল ফ্রান্সিসের। ভারী গলায় আস্তে আস্তে বলল–ওরা কেউই বেঁচে নেই।

–আপনারা নিশ্চয়ই মোরান উপজাতিদের পাল্লায় পড়েছিলেন। এই উপজাতির লোকেরা সাংঘাতিক হিংস্র। আবার ধর্মভীরুও খুব। জঙ্গলের নানা গাছ-পাথর পূজা করে। যাক যে, আপনি যে বেঁচে আসতে পেরেছেন–এটাই মহাভাগ্যি আপনার।

এমন সময় একজন সৈন্য খাবার-দাবার নিয়ে ঢুকল। হেনরী বলল–নিন, এখন চারটি খেয়ে নিন–পরে কথা হবে।

দুর্গাধ্যক্ষ হেনরী চলে গেল। ফ্রান্সিস বিছানায় উঠে বসল। তারপর আস্তে-আস্তে খেতে লাগল। সবকিছুই বিস্বাদ লাগছে। তবু না খেলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে।

খাওয়া-দাওয়ার পর ফ্রান্সিস বিছানায় শুয়ে-শুয়ে ভাবতে লাগল–এখন কী করবো? ওঙ্গালির বাজারে যাওয়া, হীরের পাহাড়ের খোঁজ করা, একা-একা সম্ভব নয়। আরো কয়েকজনকে চাই। আর যদি হীরেটা পাওয়াই যায়, সেটা নিয়ে আসার জন্যেও আরও লোকজন চাই, গাড়ি চাই। এখন দেশে ফিরে যাওয়াই ভালো। গাড়ি-ঘোড়া লোকজন নিয়ে আবার আসবো। এত সহজে হাল ছেড়ে দেব না। এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ফ্রান্সিস ঘুমিয়ে পড়ল।

ফ্রান্সিস দিন-পাঁচেক সেই দুর্গে রইল। প্রচুর খাওয়া-দাওয়া আর বিশ্রামে শরীরটা ভালো হয়ে উঠল। হেনরীকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফ্রান্সিস একদিন তেকরুর বন্দরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল।

***

সন্ধ্যে নাগাদ কেরুর বন্দরে পৌঁছল। উঠল সেই পুরনো সরাইখানাতেই।

পরের দিন থেকে ফ্রান্সিস জাহাজঘাটায় গিয়ে খোঁজ করতে লাগল–ওর দেশের দিকে কোন জাহাজই পেল না। এদিকে সঞ্চিত পর্তুগীজ মুদ্রাও ফুরিয়ে আসছে।

অবশেষে একটা জাহাজ পাওয়া গেল। যাবে ফ্রান্সের ক্যালে বন্দরে। ফ্রান্সিস সেই জাহাজেই উঠল। ক্যাপ্টেনকে সব কথাই বলল। শুধু হীরের পাহাড়ের কথাটা বলল না। ক্যাপ্টেন সব শুনে তাকে নিয়ে যেতে রাজী হল।

ফ্রান্সিস বলল–আমাকে কিন্তু খালাসীর কাজ দিতে হবে।

–বেশ, তাই করবেন। ক্যাপ্টেন বলল।

তেকরুর বন্দর থেকে জাহাজ ছাড়ল দুপুরবেলা। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। চারিদিকে কেমন একটা মেটে আলো ছড়িয়ে আছে। ফ্রান্সিস ডেক-এ দাঁড়িয়ে রইল তেকরুর বন্দরের দিকে। বার-বারহ্যারি ও মকবুলের কথা মনে পড়তে লাগল। চোখে জল এল ফ্রান্সিসের। দু’জন বন্ধুকে আফ্রিকার মাটিতে রেখে তাকে ফিরতে হচ্ছে দেশে। ফ্রান্সিস অপসৃয়মাণ তেকরুর বন্দরের দিকে তাকিয়ে মনে-মনে বলল–আমি আবার আসবো। যে হীরের সন্ধানে বেরিয়ে আমি আমার প্রিয় বন্ধুদের হারিয়েছি, সেই হীরে আমাকে পেতেই হবে। যতদিন পর্যন্ত না সেই হীরে পাই, ততদিন আমি আসবো।

একটু পরে তেকরুর বন্দরের চারিদিকের বনজঙ্গল সব মুছে গেল। জাহাজ চলে এল মধ্য সমুদ্রে।

দিন যায়, রাত যায়। জাহাজ চলেছে। ইতালীর কয়েকটা বন্দর ছুঁয়ে এবার চলেছে স্পেন-এর দিকে। ফ্রান্সিস জাহাজটার খালাসীর কাজকরে, আর দেশে যাবার জাহাজ ভাড়া জমায়। স্পেন হয়ে জাহাজ চলল এবার ফ্রান্সের ক্যালে বন্দরের অভিমুখে। ফ্রান্সিস একা-এক থাকতেই ভালোবাসে। জাহাজের কারো সঙ্গে বন্ধুত্বও হয় নি। জাহাজের লোকেরা তাকে দাম্ভিক বলেই ধরে নিয়েছে। ফ্রান্সিস নিজের ভাবনা নিয়েই ব্যস্ত। কাজেই কে কী ভাবল, এই নিয়ে মাথা ঘামায় নি। জাহাজে দেশের কাউকে পায়নি। এজন্যে মনটা যেন আরে খারাপহয়ে গেছে। কারো সঙ্গেই সে ঘনিষ্ঠভাবে–মিশতে পারল না।

একদিন সকালের দিকে ক্যালে বন্দরে এসে জাহাজটা ভিড়ল। ফ্রান্সিস ক্যাপ্টেনকে অনেক ধন্যবাদ দিল। তারপর জাহাজ থেকে জাহাজঘাটায় এসে দাঁড়াল।

দিনটা সেদিন পরিষ্কার। উজ্জ্বল রোদে চারদিক ঝলমল করছে। ক্যালে বন্দরে অনেক, জাহাজের ভীড়। ফ্রান্সিস এক জাহাজ থেকে আর এক জাহাজে খোঁজ করতে লাগল–নরওয়েগামী কোন জাহাজ পাওয়া যায় কিনা। পাওয়া গেল একটা জাহাজ। জাহাজটা ছোট। জাহাজটার কাজ গরু-ঘোড়া চালান দেওয়া। তাই খড়ে-গোবরে জাহাজটা নোংরা হয়ে আছে। কিন্তু উপায় কি? জাহাজটা জার্মানীর কয়েকটা বন্দরে থেমে-থেমে ভাইকিং রাজ্যের রাজধানী রিবকায় যাবে। সরাসরি রিবকা যাচ্ছে, এমন জাহাজ কবে পাওয়া যাবে, কে জানে?তাই ফ্রান্সিস এই ছোট্ট জাহাজটাতেই মালপত্র নিয়ে এসে উঠল। জমানো টাকা দিয়ে ভাড়া মিটিয়ে দিল। একটা রাত জাহাজেই অপেক্ষা করতে হল। পরের দিন ভোরবেলা জাহাজ ছাড়ল।

দিন পনেরো পরে জাহাজটা একদিন সন্ধ্যেবেলা রিকা বন্দরে এসে পৌঁছাল। ফ্রান্সিসের আর তর সইছিল না, জাহাজ থেকে পাঠাতন ফেলার সঙ্গে সঙ্গে বন্দরে নেমে এল। কতদিন পরে আবার ফিরে এসেছে তার আবাল্য পরিচিত শহরে।

ফ্রান্সিস আনন্দে প্রায় ছুটে এসে দাঁড়াল শহরের রাস্তায়।

একটা গাড়ি ভাড়া করল। গাড়ি চলল শহরের রাস্তা ধরে। ফ্রান্সিস একবার এই জানালা, একবার অন্য জানালা দিয়ে দেখতে লাগল শহরের পরিচিত দৃশ্য বাড়ি ঘর দোকানপাট। তখন রাত হয়েছে। এখানে-ওখানে আলো জ্বলে উঠেছে।

একসময় গাড়িটা ওদের বাড়ির গেট-এর কাছে এসে থামল। ফ্রান্সিস সামান্য মালপত্র যা ছিল, তাই নিয়ে গাড়ি থেকে নামল। ভাড়া মিটিয়ে লতা গাছে ঘেরা গেট-এ এসে–দাঁড়াল। গেট-এর লতাগাছটা সারা দেয়াল ঘিরে ফেলেছে। গেট-এ ঝোলানো কড়াটা জোরে-জোরে নাড়ল। বাগানের মালীটা এল। গেট-এর আলোতে সে ফ্রান্সিসকে চিনতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, কাকে চাই?

ফ্রান্সিস হাসল। বলল–আরে আমি ফ্রান্সিস। দরজা খোল।

এতক্ষণে ফ্রান্সিসকে চিনতে পেরে মালীটা ফোকলা ফাঁতে একবার হাসল। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে ফ্রান্সিসের মালপত্র হাতে নিল। ফ্রান্সিস ঢুকলে মালপত্র নিয়ে মালীটা তার পিছু পিছু আসতে লাগল।

মা বাইরের ঘরেই বসেছিল। কোলের ওপর একটা ছিটকাপড়ের টুকরো। বোধহয় কিছু সেলাই-ফেঁড়াই করছিল। মালীটাকে বারণ করবার আগেইও ডেকে বসল কর্তা মা। মা সেলাই থেকে মুখ তুলে তাকাল, মা’র মুখটা বড় শীর্ণ দেখাচ্ছে, তাতে বয়সের বলিরেখা। মা একটুক্ষণ ফ্রান্সিসের দিকে চেয়ে রইল। ফ্রান্সিসের চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। ফ্রান্সিস গভীর কণ্ঠে ডাকল–মা।

ফ্রান্সিস ফিরে এসেছে। মা তাড়াতাড়ি আসন ছেড়ে উঠতে লাগল! ফ্রান্সিস তার আগেই মাকে জড়িয়ে ধরে বলল তুমি বসো মা।

মা ফ্রান্সিসের মুখে মাথায় হাত বুলোতে লাগল। ধরা গলায় বলল হ্যাঁরে পাগল, তুই কবে সুস্থির হবি বলতে পারিস?

ফ্রান্সিস সে কথার জবাব না দিয়ে আবেগজড়িত কণ্ঠে বলতে লাগল–মা-মাগে–আমার মা।

মা এবার কেঁদে ফেলল। ফ্রান্সিস বলল–আমি তো ফিরে এসেছি মা–তবে আর তুমি কাঁদছে কেন মা?

একটু পরে মা চোখ মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করল–তোর বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছে?

–না, বাবা কোথায়?

–লাইব্রেরী ঘরে। আজকে আর দেখা করিস না, তোকে দেখলেই রাগারাগি শুরু করবে। আজকে চুপচাপ খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়গে। কাল সকালে বলা যাবে’খন।

কিন্তু ফ্রান্সিস ফিরে এসেছে, এমন একটা আনন্দ সংবাদমালীটা চেপে রাখতে পারল না। ফ্রান্সিসের বাবাকে গিয়ে বলল।

ফ্রান্সিস সবে খেতে বসেছে, এমন সময় বাবা এসে হাজির। ফ্রান্সিসকে একটা কথাও জিজ্ঞেস করলেননা। মাকে বললেন কুলাঙ্গারটা ফিরে এসেছে, কই আমাকে তো বলোনি!

–ম্‌–মানে ভাবছিলাম মা আমতা-আমতা করতে লাগল।

–তোমার আদরেই তো ছেলেটা উচ্ছন্নে গেল–বাবা বললেন।

–ঠিক আছে, আগে ওকে খেতে দাও কতোদিন ভালো করে খায়নি, কে জানে!

বাবা সে কথার কোন জবাব না দিয়ে ফ্রান্সিসের কাছে এসে দাঁড়ালেন। বললেন–জাহাজ থেকে কোথায় পালিয়ে গিয়েছিলে?

ইয়ে–আফ্রিকা।

–সেখানে আবার কিসের জন্য?

–জানো বাবা–একটা মস্ত বড় হীরে—

বাবা হাত নাড়লেন–বুঝেছি বুঝেছি, এইজন্যেই তুমি রাজামশাইয়ের কাছে জাহাজ চেয়েছিলে।

–হ্যাঁ।

–আচ্ছা–তোমার একবারও কি আমাদের কথা মনে পড়ে না?

বাবার গলা বুজে আসে। তার মন কাঁদছে, কিন্তু বাইরে সেটা প্রকাশ করতে রাজী নন। ফ্রান্সিস সে কথার কোন জবাব না দিয়ে মাথা গুঁজে বসে রইল।

–অনেক হয়েছে–এবার ওকে খেতে দাও–মা বলল।

–হুঁ–বলে বাবা চলে গেলেন। বেরিয়ে যাবার সময় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শুধু বললেন–তোমার এখন বাড়ী থেকে বেরুনো বন্ধ!

সত্যি কয়েদখানায় থাকার মত অবস্থা করে তোলা হল। দু’জনকে মোতায়েন করা হল। একজন বাড়ীর ভেতরে, অন্যজন গেট-এ। ফ্রান্সিস ভেবে দেখল–এখন চুপচাপ থাকাই ভালো।

এইভাবেই কাটল কয়েক মাস। বাড়ীর মধ্যেই বন্ধ হয়ে রইল ফ্রান্সিস। রাজামশাই ডেকে পাঠিয়ে ছিলেন। সেই দিনটিতেই শুধু বাইরে যাবার অনুমতি মিলেছিল। অবশ্য সঙ্গে একজন সৈনিক ছিল। আর একটা অনুমতি অনেক কষ্টে আদায় করেছিল ফ্রান্সিস। রাজার সৈন্যদের তাঁবুতে গিয়ে ওদের সঙ্গে তীর ছোঁড়ার অভ্যাস করা। এই তীর ছোঁড়া অভ্যাস করার সময়ও ফ্রান্সিসের সঙ্গে একজন সৈন্য পাহারা থাকত। ফ্রান্সিস প্রতিদিন খুব মনোযোগ দিয়ে তীর ছোঁড়া অভ্যাস করতে লাগল। কিছুদিনের মধ্যেই ফ্রান্সিস সেরা তীরন্দাজ হয়ে উঠল।

মাস কয়েক পরে ছেলের সুমতি হয়েছে দেখে বাবা ভেতর বাড়ির সৈন্যটিকে সরিয়ে নিলেন। এই কাজের ভার পড়ল ছোট্ট ভাইটির ওপর। কিন্তু গেট-এর সৈন্যটি বহাল রইল। এবার ফ্রান্সিস তৎপর হলো। শুরু হলো, একটু রাত হলেই বাড়ি থেকে পালানো। রাতে ঘুমুতে যাবার আগে মা ছেলেকে একবার দেখে যায় ঘুমুলো কিনা। ফ্রান্সিস তখন নিঃসাড় শুয়ে থাকে। মা নিশ্চিত মনে চলে গেলেই জানালার পাশে লতাগাছটা ধরে নীচে নামে। তারপর দেওয়াল ডিঙিয়ে রাস্তায়।

বন্ধুরা নির্দিষ্ট পোড়ো বাড়িটায় এসে জমায়েত হয়। জোর মতলব চলে। এবারের লক্ষ্য হীরের পাহাড়! হ্যারির জন্যে সবাই দুঃখ করে। ফ্রান্সিস এই উদাহরণটি তুলেই বলল–ভাইসব হ্যারি যেভাবে জীবন দিয়েছে, তেমনি একইভাবে আমাদেরও জীবন যেতে পারে। তাই বলছি–যারা নিভীক, যে কোন বিপদের মোকাবিলা করতে রাজী আছে–শুধু তারাই এগিয়ে এসো। অনেক বাছাইয়ের পর প্রায় চল্লিশজনকে পাওয়া গেল। এর মধ্যে দশজনকে ফ্রান্সিস নির্বাচন করল–এরাই যাবেহীরের পাহাড়ে। বাকীরা তেকরুর বন্দরে জাহাজেই থাকবে।

এবার শুরু হলো যাত্রার আয়োজন। প্রথমেই ছুতোর মিস্ত্রী ডেকে একটা খোলাঘোড়ায় টানা গাড়ি তৈরী করানো শুরু হল। ঘোড়ায় টানা গাড়িটা শেষ হতে প্রায় মাসখানেক লাগল। গাড়িটা চালানোর জন্যে চারটে ঘোড়াও কেনা হল। দলের মধ্যে রিঙ্গোই ছিল ওস্তাদ গাড়িচালক। সে দু’বেলা বিরকার রাজপথে গাড়িটা চালিয়ে অভ্যেস করে নিতে লাগল। ফ্রান্সিস অনেক কষ্টে বাবার কাছ থেকে রিঙ্গোর সঙ্গে গাড়ি চালানোর শেখার অনুমতি আদায় করল। রাজপথে গাড়ি চালায় দু’জনে। রাস্তার লোকেরা দেখে, কিন্তু এতবড় একটা খোলা ছাদের গাড়ি তৈরি করার কোন কারণ খুঁজে পায় না। গাড়ি আর ঘোড়াগুলো রাখা হয় পোড়ো বাড়িটাতে।

এবার জাহাজের বন্দোবস্ত। রাজামশাইয়ের কাছে চাইলে হয়তো একটা জাহাজ পাওয়া যেত। কিন্তু ফ্রান্সিসের বাবা ছেলেকে আবার সমুদ্রযাত্রায় বেরুতে দিতে ঘোরতর আপত্তি করবেন, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কাজেই রাজামশাইয়ের ইচ্ছা থাকলেও উনি জাহাজ দিতে পারবেন না। সুতরাং একমাত্র উপায় জাহাজ চুরি করা। পোড়ো বাড়িতে শেষ জমায়েত-এর রাত্রে জাহাজ চুরি করে চালানোর নির্দিষ্ট দিনক্ষণও স্থির হয়ে গেল।

***

সেদিন গভীর রাত। জাহাজঘাটায় রাজার সৈন্যরা জাহাজ পাহারা দিচ্ছে। এখানে-ওখানে মশাল জ্বলছে। মশালের কাঁপা কাঁপা আলোয় অন্ধকার একেবারে দূর হয়নি। জায়গায় জায়গায় অন্ধকার বেশ গাঢ়। তেমনি এক অন্ধকার কোণা থেকে একদল লোক একটা জাহাজে উঠে এল। তারপর একে একে পাহারাদার সৈন্যদের কাবু করে ফেলল। হাত মুখ বেঁধে তাদের কেবিন ঘরে আটকে রাখা হল। লোকগুলো ধরাধরি করে একটা গাড়ি জাহাজে তুলল। তারপর পাঠাতনের ওপর দিয়ে চারটে ঘোড়াকে সন্তর্পণে হাঁটিয়ে এনে জাহাজে তোলা হল। ঠিক তখন জ্বলন্ত মশাল ছুঁড়ে দু’টো খড়ের গাদায় আগুন লাগানো হল। বলা বাহুল্য, এইসবই ফ্রান্সিস আর তার বন্ধুদের কাজ। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। আগুনের শিখা অনেক উঁচুতে উঠল। জাহাজের খালাসীরা আর পাহারাদার সৈন্যরা ছুটোছুটি করে জল এনে খড়ের গাদায় ঢালতে লাগল। জাহাজঘাটায় অপেক্ষমান জাহাজগুলোতে পাছে আগুন লেগে যায়, এই আশঙ্কায় অনেক জাহাজের নোঙর তুলে দূরে গভীর সমুদ্রে নিয়ে যাওয়া হল। সেইখানে জাহাজগুলো অপেক্ষা করতে লাগল, আগুন একেবারে নিভে যাওয়ার জন্যে। শুধু একটি জাহাজ অপেক্ষা করল না। লোকলস্কর নিয়ে জাহাজটা পাল তুলে জল কেটে ছুটে চলল। এটা ফ্রান্সিস আর তার বন্ধুদের কাণ্ড। জাহাজঘাটায় আগুন নিভল। গভীর সমুদ্র থেকে জাহাজগুলো জাহাজঘাটায় ফিরে এল। হিসেব করে দেখা গেল, ভাইকিং রাজার একটা জাহাজ কম পড়েছে। জাহাজটা যে চুরি করে একদল লোক পালিয়ে গেছে, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ রইল না। রাজার কাছে খবর গেল। কিন্তু রাজামশাই এই নিয়ে বেশী উচ্চবাচ্য করলেন না। তিনি বুঝলেন, এ নিশ্চয়ই ফ্রান্সিসেরই কাজ। কিন্তু ফ্রান্সিসের বাবা ব্যস্ত হলেন। ভোরবেলাই শুনলেন তিনি, ফ্রান্সিসকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। সঙ্গে সঙ্গে রাজপ্রাসাদে গিয়ে রাজামশাইয়ের সঙ্গে দেখা করলেন। রাজামশাই সব শুনে বললে–কটা দিন যাক–ওরা যদি তার মধ্যে না ফেরে, তবে আমরা ওদের খোঁজে বেরুবো।

ফ্রান্সিসের বাবা অগত্যা রাজার কথাই মেনে নিলেন।

***

দিন যায়, রাত যায়। জাহাজ চলছে, ফ্রান্সিস আর তার বন্ধুদের নিয়ে। হাওয়ার তোড়ে পালগুলো ফুলে ওঠে। দাঁড়িদের তখন কোন কাজ থাকে না। তারা ডেক-এর ওপর গোল হয়ে বস ছক্কা-পাঞ্জা খেলে। আর একজন তখন ডেক ধোয়া-মোছা করে পালের দড়িদড়া ঠিক করে। এইভাবে দিনরাত জাহাজটা ভেসে চলে।

দু’বার ভীষণ ঝড়ের পাল্লায় পড়তে হয়েছিল। প্রথম ঝড়টি জাহাজের কোন ক্ষতি করতে পারে নি। কিন্তু দ্বিতীয় ঝড়টির সময় পাল নামাতে একটু দেরী হয়েছিল। দু’টো পাল ফেঁসে গিয়েছিল। পাল দু’টো আবার সেলাই করা হল। পালের দড়িদড়া কাঠসব পালটানো হলো।

পালে হাওয়া লাগলে সবাই দাঁড় টানার। একঘেঁয়ে কাজ থেকে ছুটি পায়। গান গেয়ে, ছক্কাপাঞ্জা খেলে, তাসে খেলে সময় কাটায়। শুধু : অবসর নেই ফ্রান্সিসের। সে একা-একা ডেকের। ওপর পায়চারী করে। মাঝে-মাঝে ছাদখোলা । গাড়িটা দেখে। কখনও বা শূন্যদৃষ্টিতে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর ভাবনার শেষ নেই। তেকরুর বন্দরে পৌঁছবার পর কী কী করতে হবে–মোরান উপজাতিদের এলাকা দিয়ে না গিয়ে উত্তরদিক থেকে কী করে ওঙ্গালির বাজারে যাওয়া যাবে। এতগুলো লোকের নিরাপত্তার চিন্তা তার মাথায়। এটা তাকে পালন করতেই হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন রয়েছে, তেমনি জন্তু-জানোয়ারের দিক থেকেও বিপদ কম নেই। এইসব বিপদের মধ্যে দিয়ে হীরের পাহাড়ে যেতে হবে, আবার ফিরেও আসতে হবে। লোভার্ত মানুষের সংখ্যাও পৃথিবীতে কম নেই। বিপদ সেইদিক থেকেও কিছু কম নয়। কাজেই সব সময় সজাগ থাকতে হবে। নিশ্চিন্ত হবার সময় এখনও আসেনি।

দীর্ঘদিন মাটির সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। কেউ-কেউ অসহিষ্ণুস্বরে পরস্পরকে জিজ্ঞেস করে; কবে জাহাজটা তেকরুর বন্দরে পৌঁছোবে। কারো পক্ষেই সঠিক কতদিন লাগবে, বলা শক্ত। তাই অনেকেই অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। ফ্রান্সিসের সোনার ঘণ্টা নিতে যাবার সময় জাহাজের বন্ধুদের বিদ্রোহী হয়ে ওঠার অভিজ্ঞতা ছিল। তাই এবার সে স্পষ্টই বলে দিয়েছে–অধৈর্য হলে চলবে না! সবেতেই তার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে। কোনোরকম বিশৃঙ্খলা দেখা গেলে, সে যে কোন বন্দরে নেমে যাবে। সেখান থেকে ফিরে আবার নতুন লোকজন নিয়ে আসবে। সোনার ঘণ্টা আনতে যারা তার সঙ্গে গিয়েছিল, তারা অনেকেই এই অভিযানে তার সঙ্গী হয়েছে। তাদের ওপরেই ফ্রান্সিসকে বেশী নির্ভর করতে হচ্ছে। ফ্রান্সিসের ওপর তাদের অগাধ বিশ্বাস। মুশকিল হয়েছে নতুনদের নিয়ে। তারা বেশ অধৈর্য হয়ে উঠেছে। এ খবর ফ্রান্সিসের কানেও ওঠে। সে ডেক-এ সবাইকে নিয়ে সভা মতো করে। সেখানে সে বলে–ভাইসব, হীরের পাহাড়ের হীরে ছেলের হাতের মোয়া নয় যে, সেই আগ বাড়িয়ে হাত তুলে দেবে। দস্তুরমত মরণপণ সংগ্রাম করে, সেটা সংগ্রহ করতে হবে। কাজেই আমাদের অধৈর্য হলে চলবে না। তেকরুর বন্দরে পৌঁছুতে আমাদের আর বেশীদিন লাগবে না। তারপরেও যে কাজ আছে, তা বেশ কঠিন। দেশে ফিরে যাবার কথা, ঘরে নিশ্চিত জীবনের কথা, আমাদের ভুলে যেতে হবে। এখন চাই অটল সাহস, শক্তি আর বুদ্ধি। সবাই শান্ত হয়ে ফ্রান্সিসের কথা শোনে। এই অভিযানের গুরুত্ব মনে করে অসহিষ্ণু বন্ধুরা শান্ত হয়। যে যার নিজে নিজের কাজে লেগে পড়ে।

একদিন সকালে জাহাজটা তেকরুর বন্দরে এসে পৌঁছলো। দীর্ঘদিন পরে মাটির দেখা পেয়ে সবাই উল্লসিত হল। দল বেঁধে নেমে পড়ল জাহাজঘাটায়। চিৎকার করে কথা বলতে লাগল, হৈ-হল্লা করতে লাগল, গান গাইতে লাগল, গাড়িটা আর ঘোড়া চারটেকে জাহাজ থেকে নামানো হলো। রিঙ্গো দ্রুতহাতে গাড়িটায় ঘোড়া জুড়ল। গাড়িটায় তোলা হলো বেশ কয়েকদিনের খাবার-দাবার, তাদের নিয়ে ফ্রান্সিস গাড়িতে উঠে বসল।

দুপুর নাগাদ ওদের গাড়িটা পর্তুগীজ দুর্গৰ্টার সামনে এসে হাজির হলো। দুর্গে তখন খাওয়া-দাওয়া আরম্ভ হবার আয়োজন চলেছে। একজন সৈনিক এসে দুর্গাধ্যক্ষ হেনরীকে ফ্রান্সিসের কথা জানাল। হেনরী দুর্গের ভিতরে আসতে বলে দিল।

সেই রাতটা ফ্রান্সিসরা দুৰ্গটাতেই রইল। রাত্রে খাবার টেবিলে হেনরীর সঙ্গে দেখা হল। কথায় কথায় হেনরী একটু বিস্ময়মিশ্রিত সুরে ফ্রান্সিসকে জিজ্ঞেস করল-কাপের্ট বিক্রী করতে এত লোকজন নিয়ে এসেছেন কেন?

ফ্রান্সিস কী বলবে, বুঝে উঠতে পারতে না পেরে আমতা-আমতা করে বললো ইয়ে হয়েছে–মানে কালকে এখান থেকে বেরিয়ে আমরা এক একজন এক একদিকে যাবো। কার্পেটের চাহিদা কেমন বুঝে নিতে।

–কিন্তু শুনলাম, আপনাদের সঙ্গে নাকি কার্পেটও নেই!

–কার্পেট আছে তেরুর বন্দরে জাহাজে! এখানকার চাহিদা বুঝেইআমরা কার্পেট নিয়ে আসবো।

হেনরী আর কোন কথা জিজ্ঞেস করল না। তবে ফ্রান্সিসের উত্তরগুলো তার যে মনমতো হয়নি, এটা বোঝা গেল। তারপর এটা-ওটা নিয়ে কথাবার্তা চলল। ফ্রান্সিস একসময় জিজ্ঞেস করল–আমাদের একজন গাইড দিতে পারেন?

–গতবার আপনাদের যে গাইড ছিল, তাকে পেতে পারেন।

–তাহলে তো খুবই ভালো হয়। কিন্তু কালকে ভোরবেলা ওকে খবর দিয়ে আনা কি সম্ভব?

–কিছুই ভাববেন না। আমি এই রাত্রেই মাসাইদের গ্রামে লোক পাঠাচ্ছি। কাল সকালেই গাইড পেয়ে যাবেন।

–অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

তখন সবে ভোর হয়েছে, গাইড এসে হাজির। অগত্যা ফ্রান্সিসকে বিছানা ছেড়ে উঠতে হল। অনেক কষ্টে ফ্রান্সিস গাইডকে বোঝাল যে, ওরা উত্তর দিক দিয়ে ওঙ্গালির বাজারে যেতে চায়। গাইড মাথা ঝাঁকালো, অর্থাৎ সে ফ্রান্সিসের কথা বুঝতে পেরেছে।

সকালবেলা ঘোড়ার ডাকে, গাড়ির চাকায় ক্যাছ কেঁচ শব্দে লোকজনের কথাবার্তায় দুর্গপ্রাঙ্গণ মুখর হয়ে উঠল। সকলে কিছু খেয়ে নিল। তারপর গাড়িতে গোছ-গাছ করে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

কিছুদূর বনের মধ্যে দিয়ে যেতে হল। তারপরেই শুরু হল দিগন্তবিস্তৃত মেঠো জমি। গাইড জানাল–এইসব জায়গায় সিংহ থাকে, কাজেই সাবধান। কপাল ভালো সিংহের সামনাসামনি পড়তে হলো না। দূরে একটা সিংহীকে দেখা গেল। একটা গাছের চারপাশে চক্কর দিচ্ছে। গাইড বোঝাল, ওখানে সিংহীটার কাচ্চাবাচ্চা আছে। তাই সিংহীটা ঐ জায়গা ছেড়ে নড়ছে না। গাইডের একটা ব্যবহার ফ্রান্সিসের কাছে রহস্যময় লাগল। যেখান দিয়ে ওরা যাচ্ছিল–ধারে কাছে কোন গাছ থাকলে সেটার ডাল কেটে দিচ্ছিল। গাইডকে কারণটা জিজ্ঞেস করল ফ্রান্সিস। গাইড বোঝাল যে, সিংহের হাত থেকে বাঁচবার জন্যে এসব তুকতাক করছে।

গাড়ি চলছে, চলার বিরাম নেই। ফ্রান্সিস চলেছে তো চলেছেই। গাইড বোঝাল–মোরান উপজাতিদের এলাকার বাইরে দিয়ে যেতে হচ্ছে, তাই ঘুর পথ নিতে হয়েছে–এতে একটা সুবিধে হয়েছে–ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ করে যেতে হচ্ছেনা, ঘোড়ার গাড়ি সহজেই যেতে পারছে।

সেদিন গভীর রাত্রে হঠাৎ ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেল। শুনল–ঘোড়াগুলো অস্বস্তিতে মাটিতে পা ঠুকছে, মাঝে-মাঝে ডেকে উঠছে। ফ্রান্সিস উঠে বসল, নিশ্চয়ই হায়না এসেছে। তীর-ধনুক নিয়ে ফ্রান্সিস তাবু থেকে বেরিয়ে এল। ঘোড়াগুলো যে গাছটায় বাঁধা আছে, সেইদিকে পায়ে-পায়ে এগোলো। কিন্তু গাছটা পর্যন্ত আর যাওয়া হলো না।

ও কি? গাছটার আড়ালে অল্প-অল্প অন্ধকারে দুটো চোখ জ্বলজ্বল করছে। ফ্রান্সিস ভীষণভাবে চমকে উঠল।

সিংহ! দ্রুতপায়ে তাবুতে ফিরে এল। আরো কয়েকজনকে সঙ্গে চাই। ইতিমধ্যে ঘোড়ার ডাকে দু-একজনের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ফ্রান্সিসের ধাক্কায় তারা উঠে বসল। ফ্রান্সিস ফিসফিস করে বলল–সিংহ এসেছে, শীগগির তৈরী হয়ে এসো। কথা ক’টা বলেই তাঁবুর বাইরে চলে গেল। বাইরে আগুনের যে ধুনি জ্বালানো হয়েছিল, সেটা প্রায় নিভে গেছে, আকাশের চাঁদও ক্ষীণ। একটা খুবম্লান আলো চারিদিকে ছড়ানো। এতে সিংহটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছেনা, শুধু চোখ দুটো আবছা অন্ধকারে জ্বলে উঠছে।

ফ্রান্সিস হাঁটু গেড়ে বসল। তখনই কয়েকজন তীর-ধনুক নিয়ে তাবু থেকে বেরিয়ে এল। ফ্রান্সিস ফিসফিস্ করে বলল–সিংহটা সামনের গাছটার পেছনেই রয়েছে। তোমরা দু’দলে ভাগ হয়ে দু’দিকে চলে যাও, আমি প্রথমে ধূনীর পোড়া কাঠ ছুঁড়ে মেরেই তীর চালাবো। তোমরাও লক্ষ্য স্থির করে তীর চালাবে।

যারা তীর-ধনুকনিয়ে এসেছিল, তারা দু’দলে ভাগ হয়ে দু-পাশে চলে গেল। ঘোড়াগুলো আবার মাটিতে পাঠুকতে লাগল, আর দড়ি ছিঁড়ে বেরিয়ে যাবার জন্য দড়িতে টান দিতে লাগল। ফ্রান্সিস আর দেরী করল না। ধূনী থেকে একটা আধপোড়া কাঠ ছুঁড়ে মারল গাছটার দিকে। কাঠটা মাটিতে পড়তেই কতকগুলো স্ফুলিঙ্গ উঠল। ফ্রান্সিস অন্ধকারে চোখ দুটোর দিকে লক্ষ্য রেখে তীর ছুঁড়ল। তীরটা কোথায় গিয়ে বিধল বোঝা গেল না। কিন্তু সিংহটা প্রচণ্ড গর্জন করে লাফিয়ে এসে পড়ল ধুনীটার কাছে। এবার সিংহটার অস্পষ্ট শরীরের রেখা দেখা গেল। সিংহটা আবার গর্জন করে উঠল। বোধহয় ফ্রান্সিসের বন্ধুরা কেউ তীর ছুঁড়েছে।

সিংহটা গরু-গর করে উঠেই লাফ দিয়ে পড়ল গাছটার কাছে। ঘোড়াগুলো জোরে ডেকে উঠল, আর দড়ির বাঁধন ছিঁড়ে ফেলার জন্যে চাপাচাপি শুরু করে দিল। তখনই ফ্রান্সিস তার এক সঙ্গীর ভয়ার্ত চীৎকার শুনতে পেল। সিংহটা কিন্তু আর দাঁড়াল না। চাঁদের ক্ষীণ আলায় দেখা গেল, সিংহটা ছুটে চলে যাচ্ছে। এই রাত্রিবেলা সিংহের পিছু ধাওয়াকরা বোকামি। ফ্রান্সিস ছুটে সঙ্গীটির কাছে গেল। দেখা গেল আঘাতটা মারাত্মক নয়। সিংহের থাবার নখে হাত ছড়ে গেছে। ওরা সঙ্গে যে ওষুধপত্র এনেছিল, তাই দিয়ে হাতটা বেঁধে দিল। সঙ্গীটি প্রাণে বেঁচেছে, এতেই তারা খুশী হল।

সকালে কিছু খাওয়া-দাওয়া করে ফ্রান্সিস দু’জন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে সিংহটার খোঁজে বেরুলো। গাছের তলাটায় দেখল রক্তের গাঢ় দাগ। বোঝা গেল, সিংহটা বেশ আহত হয়েছে। ঘাসের ওপর পাতার ওপর রক্তের দাগ দেখে-দেখে ফ্রান্সিসরা আহত সিংহটার হদিস খুঁজতে বেরুলো। রক্তের দাগ দেখে-দেখে অনেকটা যাবার পর কয়েকটা পাথরের আড়ালে দাগগুলো শেষ হয়েছে দেখা গেল। ফ্রান্সিস ইঙ্গিতে সঙ্গের দু’জনকে দু’পাশ দিয়ে যেতে বলল। নিজে আস্তে-আস্তে খুব সন্তর্পণে পাথরের ওপাশে চলে এল। দেখল ঠিক পাথরের আড়ালেই সিংহটা শুয়ে খুব মৃদুস্বরে গ গ করছে। অন্য পাথরগুলোর মাথায় দুই সঙ্গীর মুখ দেখতে পেল ফ্রান্সিস। ইশারায় তাদের তীর চালাতে বলে নিজেও সিংহটার বুক লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ল। সিংহটা গর্জন করে লাফাতে উঠল। ততক্ষণে আরো কয়েকটা তীর এসে লাগল। সিংহটা নিস্তেজ হয়ে শুয়ে পড়ল। ওর গর গ ডাকও একসময় বন্ধ হয়ে গেল।

সিংহটা মারা গেছে কিনা পরীক্ষা করবার জন্য ফ্রান্সিস কয়েকটা পাথরের নুড়ি ছুঁড়ে মারল। কিন্তু সিংহটা নড়ল না। এবার ফ্রান্সিস সাহসে ভর করে পাথরের আড়াল থেকে এগিয়ে এসে সিংহটার লেজ ধরে পা ধরে টানল। দেখল, ওর তীরটা সিংহটার হৃৎপিণ্ড ভেদ করেছে। এবার ফ্রান্সিস নিশ্চিত হলো যে, সিংহটা মারা গেছে। ফ্রান্সিস তার সঙ্গীদের ডাকল। দু’জন সঙ্গী মহানন্দে চীৎকার করতে লাগল। সিংহটার চারপাশে ঘুরে-ঘুরে নাচতে লাগল। তাঁবুতে ফিরে এই সংবাদ দিতে সবাই হইহই করে উঠল। তাবু গুটিয়ে নিয়ে আবার যাত্রা শুরু হল। মাঠের বিস্তৃত জমি ছেড়ে এবার ছাড়া ছাড়া গাছপালার বন-জঙ্গল শুরু হল।

তিনদিন পর একদিন সন্ধ্যেবেলা ফ্রান্সিসরা ওঙ্গালির বাজারে এসে পৌঁছল। নামেই বাজার। কয়েকটা চারদিক খোলা খড়ের চাল দেওয়া ঘর। এখানেই বোধহয় বাজার বসে। এখন সন্ধ্যেবেলা দু-চারটে দোকানদার আনাজ-পত্র নিয়ে বসে আছে। কিন্তু লোজন এখন এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গাইডটি জানাল, সিংহের ভয়ে সন্ধ্যের পর এখানে কোন লোকজন থাকে না।

একটু রাত হলে হাটের একটা ঘরে তারা আশ্রয় নিল। রাতটা কাটিয়ে পরদিন–সকালবেলাই আবার পথ চলা শুরু হল। ফ্রান্সিস গাইডটিকে বোঝাল ওরা কোথায় যেতে চায়। উত্তর দিকটা দেখিয়ে বলল–ঐদিকে একটা পাহাড়, তা আমরা সেখানেই # যাবো। তুমি আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। গাইডটি রাজী হল।

সেই দিনটি পথেই কাটল। পরদিন দুপুরবেলা ফ্রান্সিসরা একটা পাহাড় দেখতে পেল, পাহাড়টার কাছাকাছি এসে দেখল পাহাড়টা খুব উঁচু নয়। মকবুল ঠিকই বলেছিল–পাহাড়টার একপাশ খাড়া উঠে গেছে। অন্য দিকটা। এবড়ো-খেবড়ো পাথরের ঢিবি রয়েছে। এইদিক দিয়েই মকবুল আর বুঙ্গা বোধহয় পাহাড়ে উঠেছিল। ধ্বস নামায় নিশ্চয়ই গুহার মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। সেই মুখটা খুঁজে বের করতে হবে।

ঘুরে-ফিরে পাহাড়টা দেখতে-দেখতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। সেই রাতটা ওরা পাহাড়টার নীচে কাটাল। পরদিন সকালবেলা শুরু হলো পাহাড়ে ওঠা। রিঙ্গো রইল, গাড়ি-ঘোড়ার পাহারায়। বাকী সবাই পাহাড়ে উঠতে লাগল এবড়ো-খেবড়ো পাথরে পা রেখে। একসময় ওরা পাহাড়ের মাথায় উঠে এল। সেখানে মস্তবড় একটা পাথরের সঙ্গে কাছিটা বেঁধে পাহাড়ের খাড়াই দিকটা ঝুলিয়ে ছিল। ফ্রান্সিস বন্ধুদের বলল–আমিই প্রথমে নামছি। যদি গুহা খুঁজে পাই আমি, দু’বার কাছিটায় হাল্কা টান দেব। তখন তোমরা বেচা-গাঁইতি নিয়ে নেমে আসবে।

ফ্রান্সিস কোমরে তরোয়ালটা গুঁজে কাছিটা ধরে ঝুলে পড়ল। তারপর খাড়াই পাথরের এখানে-ওখানে পা রেখে-রেখে অনেকটা নেমে এল। তখনই দেখল, কয়েকটা গাছ আর বুনো ঝোঁপের আড়ালে একটা গুহার মুখ। কিন্তু মুখটা ধুলো-বালি-পাথরে বন্ধ হয়ে গেছে। মুখটা বন্ধ হয়ে গেলেও দু’তিনজন লোক দাঁড়াবার মত জায়গা সেখানে রয়েছে। ফ্রান্সিস গাছের ডালে পা রেখে গুহার মুখটাতে এসে দাঁড়াল, তারপর কাছিটা ধরে দুটো হ্যাঁচকা টান দিল।

একটু পরেই ফ্রান্সিসের দু’জন সঙ্গী কাছি ধরে ধরে নেমে এল। তাদের হাতে ছিল বেচা আর গাঁইতি। সংকীর্ণ জায়গাটায় তিনজন দাঁড়াল। তারপর একজন গাঁইতি চালিয়ে ধূলোবালি, পাথর আলগা করে দিতে লাগল। অন্যজন বেচা দিয়ে ধুলোবালি, পাথর নীচে ফেলে দিতে লাগল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আট-দশজন দাঁড়াবার মত জায়গা হয়ে গেল। ফ্রান্সিস ঠিক বুঝল, এটাই সেই গুহা। ধুলোবালি পাথরের ধ্বস নেমে মুখটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

এরপর আর সকলে নেমে এল। ধুলোবালি, পাথর সরাবার কাজ চলল পুরোদমে। সারাদিন কাজ চলল, তারপর একটু রাত হলে কাজকর্ম বন্ধ করে সবাই খেয়ে নিল। রাত্রের মত সবাই ওখানেই জায়গা করে শুয়ে পড়ল।

শেষ রাত্রির দিকে ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেল। ও চমকে উঠল কী একটা ঠাণ্ডা জিনিস কাছির মত ওরা পা’টা জড়িয়ে ধরেছে। ফ্রান্সিস পা সরিয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। মশালের কাঁপা কাঁপা আলোয় দেখল, একটা অজগর সাপওর দিকেই এগিয়ে আসছে। ফ্রান্সিস যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেওয়ালের দিকে সরে গেল। তারপর কোমর থেকে তরোয়ালটা খুলে অজগরটার দিকে নজর রাখল। মস্ত বড় সাপটা খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। ওর লেজটা তখনও ফ্রান্সিসের দু’জন সঙ্গীর পায়ের ওপর রয়েছে। মুখ তুলে সাপটা আর একটু এগোতেই ফ্রান্সিস প্রচণ্ড বেগে অজগরটার মাথা লক্ষ্য করে তরোয়াল চালাল। তরোয়ালের আঘাতে সাপটার মাথা কেটে দূরে ছিটকে পড়ল। কাটা শরীরটা থেকে গল্‌-গল্ করে রক্ত বেরোতে লাগল। সাপের শরীরটা কিছুক্ষণ ছটফট করে স্থির হয়ে গেল। ফ্রান্সিস কাউকে আর ডাকল না। সাপের দু-টুকরো শরীর আর মাথাটা তরোয়ালের ডগায় করে গুহার বাইরে ফেলে দিল। তারপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ভোরবেলা ফ্রান্সিসের সঙ্গীরা ঘুম থেকে উঠে ধুলোবালি পাথরের মধ্যের চাপ-চাপ রক্ত এল কোত্থেকে। ফ্রান্সিস তখনও ঘুমোচ্ছে। ওকে ডাকল ওরা। ফ্রান্সিস উঠে বসল। ফ্রান্সিস হেসে বলল–কাল রাত্রিতে একটা অজগর মেরেছি। তারই রক্ত।

সবাই ধুলোবালি-পাথর সরাবার কাজে লেগে পড়ল। হঠাৎ দেখা গেল, ধুলোবালির স্তরটা শেষ হয়ে গেছে। একটা ফোকর পাওয়া গেল। বোঝা গেল, এখানেই ধুলোবালি আর ছোট-ছোট পাথরের স্তর শেষ হয়ে গেছে। সেই স্তরটা খুঁড়ে ফেলতেই গুহাটা স্পষ্ট দেখা গেল। উত্তেজনায় সবাই চেঁচিয়ে উঠল। ফ্রান্সিসও কম উত্তেজিত হয়নি। মদিনা মসজিদের গম্বুজের মত হীরেটা তখন প্রায় হাতের মুঠোয়।

গুহাটার ভিতরটা অন্ধকার। সন্তর্পণে কিছুটা এগোতেই ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখল, একটা বিরাট গহ্বর নীচের দিকে নেমে গেছে। ওকে দাঁড়িয়ে পড়তেই দেখে পিছন থেকে একজন জিজ্ঞেস করল কী হল ফ্রান্সিস?

ফ্রান্সিস বলল–আর এগোনো যাবে না–সামনেই একটা গহ্বর।

সঙ্গীদের একজন জিজ্ঞেস করল–মকবুল কি তোমাকে এই গহ্বরের কথা বলেছিল?

–না।

–তাহলে?

একটু ভেবে ফ্রান্সিস বলল–মনে হচ্ছে, পাহাড়টায় ধ্বস নামার সময় হীরেটা বোধহয় এই গহ্বরেই পড়ে গেছে।

–এটা তো তোমার অনুমান–একজন সঙ্গী বলল।

–পরীক্ষা করলেই অনুমানটা সত্যি কিনা বোঝা যাবে।

–কী ভাবে পরীক্ষা করবে?

–আমি গহ্বরের মধ্যে নামব।

ফ্রান্সিসের সঙ্গীদের মধ্যে গুঞ্জন উঠল। তারা কেউই ফ্রান্সিসকে একা ছাড়তে রাজী–নয়। তারা বলল–তোমার সঙ্গে আমরাও নামবো।

ফ্রান্সিস বলল–সে হয় না। আমাদের সবাইকে সঙ্গে বিপদে পড়া চলবে না।

–কিন্তু তোমার একারও তো বিপদ ঘটতে পারে।

–একটা বিপদ তো কাল রাত্তিরে শেষ করেছি। বড় জোর আর একটা অজগর থাকতে পারে। ভয়ের কিছু নেই। তোমার কাছিটার একটা দিক পাথরের সঙ্গে বেঁধে দাও।

কাছিটা বাঁধা হল ফ্রান্সিস কাছিটা ধরে ঝুলে পড়ল। হাতে একটা মশাল জ্বেলে আস্তে-আস্তে গহ্বরের মধ্যে নামতে লাগল। চারিদিকে পাথরের চাই, তারই মধ্যে দিয়ে গহ্বরটা সুড়ঙ্গের মত নেমে গেছে।

বেশ কিছুটা নামবার পর পায়ের নীচে একটা পাথরের মতো কি যেন ঠেকল। জিনিসটার গা এবড়োখেবড়ো। ওটার ওপর দাঁড়িয়ে ফ্রান্সিস মশালটা নীচে নামিয়ে আনল। আশ্চর্য! সেই অমসৃণ জিনিসটায় মশালের আলো পড়তে আলো ঠিকরে পড়ল। তাহলে এটাই মকবুলের হীরে। ফ্রান্সিস মশালটা এদিক-ওদিক ঘোরালো। ঠিকরে পড়া আলোর দ্যুতিও অন্ধকারে এদিক-ওদিক নড়তে লাগল। ফ্রান্সিস আনন্দে চীৎকার করে উঠল। সমস্ত গহ্বরটা সেই চীৎকারে প্রতিধ্বনিত হল। গহ্বরের মুখে দাঁড়ানো ফ্রান্সিসের বন্ধুরা চীৎকার করে সাড়া দিল।

এবার আসল কাজ। ফ্রান্সিস হীরেটার ওপর বসে একটু জিরিয়ে নিল। তারপর কাছিটা দিয়ে হীরেটাকে চারদিক থেকে বাঁধল। এই বাঁধার সময় ফ্রান্সিস লক্ষ্য করল গহ্বরটা এখানেই শেষ হয়নি। হীরেটা আটকে আছে খাঁজের মত জায়গায়। তার পাশেই গহ্বরটা নেমে গেছে আরো নীচে। মশাল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আন্দাজ করে দেখল মকবুল যত বড় হীরের কথা বলেছিল, এই হীরেটা ততো বড় নয়। তখনই ফ্রান্সিসের মনে হলো পাহাড়ের ধ্বস নামার সময় নিশ্চয়ই হীরেটা দু’টুকরো হয়ে গিয়েছিল। একটা টুকরো এখানকার খাঁজে আটকে আছে, অন্যটা এই গহ্বরের আরো নীচে পড়ে আছে। গহ্বরের জমাট অন্ধকারে নীচে আর কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না।

হীরেটা ভালো করে বেঁধে ফ্রান্সিস কাছি ধরে ধরে ওপরে উঠতে লাগল। একসময় গহ্বরের মুখে এসে উঠে দাঁড়াল। আনন্দে উত্তেজনায় ফ্রান্সিস তখন কথা বলতে পারছে না। বন্ধুদের সুসংবাদটা দেখার জন্যে ঘুরে দাঁড়াতে গেল, তখনই পিঠে কে যেন তরোয়ালের ডগা চেপে দাঁতচাপা স্বরে বলল, চুপ করে দাঁড়ান আপনাদের বন্ধুদের মত।

ফ্রান্সিস আস্তে-আস্তে ঘুরে দাঁড়ালো। দেখল, ওর পিঠে তরোয়াল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুর্গাধক্ষ্য হেনরী। তার সঙ্গে একদল সৈন্য। ফ্রান্সিস অবাক হয়ে গেল। দেখল ওদের বন্ধুদের সব গুহার একপাশে আটকে রাখা হয়েছে। তাদের তরোয়াল কেড়ে নেওয়া হয়েছে। দু’একজনকে আহতও মনে হল। হেনরী ঠাট্টার সুরে বলল–এখানে নিশ্চয়ই কার্পেট বিক্রী করতে আসেননি? ফ্রান্সিস কোন কথা বলল না।

–বোধহয় ভাবছেন আমরা এখানে এলাম কি করে? খুবই সোজা উত্তর। আপনারাই পথ দেখিয়ে এনেছেন।

–আমরা? ফ্রান্সিস বিস্ময় সুরে বলল।

–হ্যাঁ–আপনাদের গাইডকে বলাই ছিল, সে যেন পথে চিহ্ন রেখে আসে–ও তাই করেছিল সুতরাং আপনাদের খুঁজে পেতে কোন অসুবিধা হয় নি।

ফ্রান্সিস এবার বুঝল, কেন গাইডটি গাছের ডাল কেটে রাখত, মাটিতে দা দিয়ে হিজিবিজি দাগ কাটত। ফ্রান্সিস বেশ কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করল–আমাদের পিছু ধাওয়া করার মানে কি?

আপনাদের যাওয়ার কথা ছিল ওঙ্গালির বাজারে–কিন্তু এখানে এলেন কেন?

–আমরা যেখানে খুশী যেতে পারি।

–তা পারবেন। কিন্তু এত কষ্ট করে এখানে আসার নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। কিছুক্ষণ আগে আপনি গহ্বর থেকে আনন্দে চীৎকার করে উঠেছিলেন। আপনার বন্ধুরাও তাতে সাড়া দিয়েছিল। আমরা তখন গুহার মুখে আড়ালে দাঁড়িয়েছিলাম। আপনার এত আনন্দিত হওয়ার কারণটা জিজ্ঞেস করতে পারি কি?

–বেশ দেখুন, ফ্রান্সিস বলল।

হেনরী তার সৈন্যদের হুকুম দিল কাছিটা ধরে টেনে তুলতে।

ফ্রান্সিসদের বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল–আপনারাও একটু সাহায্য করুন। সকলে মিলে কাছিটা টানতে লাগল। আস্তে-আস্তে কাছি-বাঁধা হীরেটা উঠে আসতে লাগল। যখন গুহার ওপর হীরেটা রাখা হল, তখন হেনরী হেসে বলল–এই পাথরটার জন্যে আপনাদের এত উল্লাস?

জিনিসটা সামান্য নয়–ফ্রান্সিস শান্ত স্বরে বলল–এটা একটা হীরের খণ্ড।

–বলেন কি! হেনরীর চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল।

ধ্বস নামার আগে এই পাহাড়ের এই গুহার মুখেই আলোর বিচিত্র খেলা দেখা যেত।

–হ্যাঁ, শুনেছি একটা পাহাড় আছে, লোকে বলে মায়াপাহাড়।

–এই পাহাড়ই এই মায়াপাহাড়। আর গুহার মুখেই আলোর বর্ণচ্ছটা দেখা যেত। বিস্ময়ে হেনরীর চোখ বড়-বড় হয়ে গেল। সে হীরেটার কাছে ছুটে গেল। হীরের অমসৃণ গায়ে হাত বুলোতে লাগল। কিন্তু তার মানে সন্দেহ থেকেই যায়। সে বলল আপনি কি করে জানলেন এটা হীরে?

–মকবুলের কাছ থেকে।

–মকবুল কে?

–আমার বন্ধু। আগেরবার যাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু সে আমার সঙ্গে আর ফিরতে পারে নি। হিংস্র মোরানদের হাতে মারা গেছে।

–ও। কিন্তু এটা কি সত্যিই হীরের খণ্ড? হেনরীর সন্দেহ তবু যেতে চায় না।

–গুহার মুখে হীরেটা নিয়ে আসুন, তা হলেই বুঝতে পারবেন।

–বেশ। হেনরী তার সৈন্যদের ইঙ্গিত করল। তারা সবাই কাছিটা ধরে টেনে হীরের গুহার মুখের কাছে নিয়ে এল। যেটুকু সূর্যের আলো তেরচা হয়ে পড়ল, তাতেই হীরেটা জ্বলজ্বল করে উঠল। বিচিত্র রঙের ছাট বেরোতে লাগল হীরেটার গা থেকে। হেনরী চোখ দুটো লোভে চকচক করে উঠল। সে সঙ্গে-সঙ্গে তার সৈন্যদের হুকুম দিল–কাছিটা ধরে আস্তে-আস্তে হীরেটা পাহাড়ের নীচে নামিয়ে দাও।

ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি হাত তুলে সৈন্যদের ইঙ্গিত করে হেনরীর কাছে এগিয়ে এসে বলল–এই হীরেটা কি আপনি নিয়ে যেতে চান?

–অবশ্যই–হেনরী হাসল–নইলে এত কষ্ট করে আপনাদের পিছু এলাম কেন? ফ্রান্সিস গম্ভীর স্বরে বলল–দেখুন, আপনারা একদিন আমার প্রাণ বাঁচিয়ে ছিলেন। সেই কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই আপনাকে আমি সব কথা বলেছি, কিছুই গোপন করি নি। আমি যদি না বলতাম, তাহলে একটা এবড়োখেবড়ো পাথরের খণ্ড ভেবে আপনারা চলে যেতেন।

–তা কি বলা যায়। সমুদ্র পেরিয়ে এতদূর থেকে আপনারা এসেছেন কার্পেট বিক্রী করতে, তাও সঙ্গে আপনাদের কার্পেট নেই। একটা গাড়ী এনেছেন, তার আবার মাথা খোলা। এই সবকিছুই আমার মনে সন্দেহের উদ্বেগ উঠেছিল। যে পাথরটা আপনারা তোলার আয়োজন করেছিলেন, সেটা দামী কিছু, এ বিষয়ে আমার মনে কোন সন্দেহ ছিল না। কিন্তু সেটা যে একটা আস্ত হীরে, এটা আমার কল্পনারও বাইরে ছিল।

–তাহলে আর একটা কথা অপনাকে জানাই। এই হীরেটা একটা খণ্ডমাত্র।

–বলেন কি?

–হ্যাঁ, এটা আমার অনুমান। পাহাড়ে যখন ধ্বস নেমেছিল, তখন আস্ত হীরেটা দু’খণ্ড হয়ে যে গহ্বরের সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে পড়ে যায়। এই খণ্ডটা আমি পেয়েছি গহ্বরটার একটা খাঁজে। অন্য খণ্ডটা গহ্বরের তলদেশে কোথাও পড়েছে।

–তাই নাকি। হেনরী খুশীতে লাফিয়ে উঠল।

–আমার কথা এখনও শেষ হয়নি। ফ্রান্সিস গম্ভীরস্বরে বলল–সেই অন্য হীরের খণ্ডটার জন্যে আমি আবার গহ্বরে নামব। যদি সেই খণ্ডটা পাই, তাহলে আপনারা এটা নিয়ে যাবেন, আমাদের কোন আপত্তি নেই।

–আপত্তি থাকলেই বা শুনছে কে?

–তাহলে লড়ে নিতে হবে।

হেনরী হো-হো করে হেসে উঠল–একমাত্র আপনার কোমরেই তরোয়াল আছে–ওটা আর নিইনি। আপনার দলের বাদবাকী সকলের অস্ত্র কেড়ে নেওয়া হয়েছে এবং গুহার মুখ থেকে নীচে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এর পরেও লড়তে চান?

–হ্যাঁ, আমি একাই লড়বো।

–কেন মিছিমিছি বেঘোরে প্রাণটা দেবেন।

ফ্রান্সিস তরোয়ালের হাতলে হাত রাখল। হেনরী তাই দেখে বলে উঠল–উঁহু, উঁহু খুন-খারাপি আমি দু’চোখে দেখতে পারি না। তার চেয়ে আমাদের একজন লোক গহ্বরে নামুক। খোঁজ করে দেখুক, আর একটা হীরের খণ্ড পায় কিনা।

–আগে বলুন সেটা পেলে কে নেবে?

–বেশ। আর একটা হীরের খণ্ড পেলে আপনারা নেবেন।

–খুব ভালো কথা।

হেনরীর ইশারায় সৈন্যদল থেকে একজন এগিয়ে এল। আবার গহ্বরের মধ্যে কাছি ফেলা হল। লোকটি কাছি ধরে নামতে লাগল। এক হাতে মশাল ধরে লোকটি অনেকটা নেমে গেল। একটু পরেইহঠাৎ লোকটির আর্তনাদ শোনা গেল। সেই আর্তনাদ গহ্বরের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। সবাই ছুটে গহ্বরের কাছে গেল। কাছি টেনে দেখা গেল, লোকটা। কাছি ছেড়ে গহ্বরের নীচে পড়ে গেছে। কি কারণে এমনটা হলো, কেউই ভেবে পেল না। হেনরী কি করবে বুঝে উঠতে পারল না। চোখের সামনে এরকম মৃত্যু দেখে কেউই আর গহ্বরে নামতে সাহস পেল না।

এবার ফ্রান্সিস এগিয়ে এল। ফ্রান্সিসের বন্ধুরা তাকে নানাভাবে নিবৃত্ত করতে চাইল। কিন্তু পারল না। ফ্রান্সিস বলল, আমার জন্যে কাউকে ভাবতে হবে না। আমি এখন যা বলি মন দিয়ে শোন। যারা কাছি ধরে ছিল তাদের বলল–আমি কাছি ধরে দুবার ঝাঁকুনি দিলেই কাছি ছাড়তে থাকবে, যতক্ষণ না আমি গহ্বরের একেবারে শেষে নেমে কাছিটায় আমার দুটো ঝাঁকুনি না দিই। যদি হীরের খণ্ডটা পাই, তাহলে সেটাকে কাছি দিয়ে বেঁধে কাছিটাতে আবার দুটো ঝাঁকুনি দেব। তখন তোমার কাছি টেনে তুলবে।

ফ্রান্সিস এক হাতে জ্বলন্ত মশাল নিয়ে কাছি বেয়ে নীচে নামতে লাগল। কিছুদূর নামতেই সেই গহ্বরের খাঁজটার কাছে এল। মশালের আলো পড়তে দেখল দুটো বিষধর সাপ সেই খাঁজটায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এবার ফ্রান্সিস বুঝতে পারল। আগের লোকটা নিশ্চয়ই বিশ্রাম নিতে এখানে দাঁড়িয়েছিল। তখনই সাপ কামড়েছে। আর লোকটাও এই অতর্কিত আক্রমণে হকচকিয়ে নীচে পড়ে গেছে। ফ্রান্সিস হাতের মশালটা সেইখাঁজের ধুলোবালির মধ্যে পুঁতে দিল। এবার সাপ দুটোকে স্পষ্ট দেখা গেল। ফ্রান্সিস পা দুটো দিয়ে কাছিটা জড়িয়ে ধরল। কোমর থেকে তরোয়াল খুলল। তারপর একটা সাপের মাথার দিকে লক্ষ্য রেখে সজোরে তরোয়াল চালাল, সেই সাপের মাথাটা কেটে ছিটকে পড়ল। সাপের শরীরটা বারকয়েক নড়ে উঠল। তারপর আর নড়ল না। এবার আর একটা সাপ। সেই সাপটা কিন্তু বিপদ বুঝে পাহাড়ের ফাটলটার মধ্যে ঢুকে পড়ল। আর সাপটাকে দেখা গেল না। ফ্রান্সিস আবার কাছিটাতে দু’বার ঝাঁকুনি দিল, ওপর থেকে যারা কাছি ধরেছিল, তারা কাছি ছাড়তে লাগল। ফ্রান্সিস মশালটা ধুলোবালি থেকে তুলে নিয়ে আবার নামতে লাগল।

বেশ কিছুটা নামবার পর দেখল, নীচে যেখানে গহ্বরটা শেষ হয়ে গেছে, সেখানে লোকটা চিৎ হয়ে পড়ে আছে। ওর হাতের মশালটা একপাশে পড়ে গিয়ে তখনও জ্বলছে। সেই মশালের আলো যে এবড়ো-খেবড়ো পাথরটায় পড়ে বিচ্ছুরিত হচ্ছে, আর সেটা যে আর একখণ্ড হীরে, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ রইল না। ফ্রান্সিস নামতে নামতে হীরেটার ওপর এসে দাঁড়াল। তারপর লোকটার মৃতদেহ একপাশে সরিয়ে কাছি টেনে টেনে হীরেটা বাঁধল। বাঁধা হল কাছিটায় ধরে দুটো ঝাঁকুনি দিল। গহ্বরের ওপর থেকে সবাই আস্তে-আস্তে হীরেটা ওপরে উঠতে লাগল। সেই সঙ্গে ফ্রান্সিসও উঠতে লাগল।

গহ্বরের মুখে আসতেই ফ্রান্সিস নেমে এল। তারপর সবাই মিলে টানতে টানতে হীরেটাকে গুহার মধ্যে নিয়ে এল।

হীরের আর একটা খণ্ড দেখে হেনরীর আনন্দ দেখে কে! সে একবার একখণ্ড হীরের কাছে যায়, আর পরক্ষণেই অন্য হীরেটার কাছে যায়। ফ্রান্সিস আস্তে-আস্তে দৃঢ় পদক্ষেপে হেনরীর কাছে এসে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল–তাহলে আপনি কি স্থির করলেন?

–কোন ব্যাপারে?

–একটা হীরের খণ্ড আমরা নেব, আর একটা আপনারা নেবেন।

–অসম্ভব!

–জানেন, এত বড় দুই খণ্ড হীরে যদি পর্তুগালে নিয়ে গিয়ে রাজাকে দিতে পারি–রাজসভায় আমার সম্মান কত বেড়ে যাবে।

–কিন্তু কথা ছিল–একখণ্ড হীরে আমরা নেব।

–তেমন কোন কথা হয়েছে বলে তো আমার মনে পড়ছে না।

–তাহলে আপনি কি রক্তক্ষয় চান?

–হেনরী ফ্রান্সিসের কথা কানেই নিল না। নিজের সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল হাঁ করে দেখছ কি। হীরে দু’টো নীচে নামাও।

সৈন্যরা তাড়াতাড়ি কাছি দিয়ে বাঁধা হীরের খণ্ডটা টানতে-টানতে গুহার মুখের কাছে নিয়ে এল। তারাপর ধরে ধরে আস্তে আস্তে নীচে নামিয়ে দিতে লাগল।

ফ্রান্সিস শক্ত চোখে একবার হেনরীর মুখের দিকে তাকিয়ে নিল। তারপর তরোয়ালের হাতলে হাত রাখল। বন্ধুরা সব ছুটে এসে ওর হাত চেপে ধরল, বললো–ফ্রান্সিস, এমন পাগলামি করো না।

ফ্রান্সিস অশ্রুরন্ধস্বরে বলে উঠল–যে হীরের জন্যে আমার দু’জন বন্ধু প্রাণ দিয়েছে, সেটা আমি এভাবে হাতছাড়া হতে দেব না।

বন্ধুরা কোন কথা শুনল না। বারবার ফ্রান্সিসকে শান্ত হতে অনুরোধ করতে লাগল। ফ্রান্সিস কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে কি যেন ভাবল। তারপর তরোয়ালের হাতল থেকে হাত সরাল।

দ্বিতীয় হীরের খণ্ডটাও ততক্ষণে নামানো শুরু হয়েছে। আস্তে-আস্তে ওটাও নামানো হল। এবার সকলের নামবার পালা, প্রথমেই নেমে গেল হেনরী, তারপর তার সৈন্যরা।

এবার নামল ফ্রান্সিস আর তার বন্ধুরা। নীচে নেমে ফ্রান্সিস দেখল, ওদের গাড়িতে একখণ্ড হীরে তোলা রয়েছে। হেনরীও একটা গাড়ি নিয়ে এসেছে। সেটাতে হীরের অন্য খণ্ডটা তোলবার তোড়জোড় চলছে। সৈন্যরা সবাই মিলে ধরাধরি করে হীরেটা হেনরীর গাড়িতে তুলল।

বেলা পড়ে এল। সন্ধ্যে হতে আর বেশী দেরী নেই। ফ্রান্সিসদের তত আর কিছু করবার নেই!তারা সে রাতটা এখানেই। কাটিয়ে যাবে স্থির করল। হেনরীও তার সৈন্যদের নিয়ে রাত্রিবাসের জন্য বন্দোবস্ত করতে লাগল।

***

রাত গম্ভীর হল। সারাদিন খাটুনির পর সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুম নেই শুধু ফ্রান্সিসের চোখে আর হেনরীর দুই প্রহরারত সৈন্যের চোখে। ওরা দুজন খোলা তরোয়াল হাতে হীরে দুটো পাহারা দিচ্ছে।

ফ্রান্সিস শুয়ে ছটফট করছে। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না এখন কি করবে। শুধু সুযোগের আশায় বসে থাকা ছাড়া কিছুই করবার নেই। অথচ সময় নেই। একবার যদি হীরে দুটো নিয়ে হেনরী দুর্গে ঢুকতে পারে, তাহলে হীরে দু’টো আর ফিরে পাওয়া অসম্ভব। ফ্রান্সিস এক-একবার উঠে মশালের আলো দেখছে হেনরীর সৈন্যরা আর তার বন্ধুরা সবাই অকাতরে ঘুমুচ্ছে। ওর কিন্তু ঘুম আসছে না। চুপচাপ শুয়ে আছে ও।

হঠাৎ দেখল, অন্ধকারে গুঁড়ি মেরে-মেরে কে যেন এদিকেই আসছে। ফ্রান্সিস ঘুমের ভান করে শুয়ে-শুয়ে লোকটাকে দেখতে লাগল। লোকটা কাছাকাছি আসতে দেখল লোকটার খালি গা, পরনে শুধু একটা নেংটি। মুখে গায়ে উল্কি আঁকা। ফ্রান্সিস ভীষণভাবে চমকে উঠল–মোরান উপজাতির লোক। ফ্রান্সিস শিয়র থেকে তরোয়ালটা টেনে নিয়ে এক লাফে উঠে দাঁড়াল। লোকটা প্রথমে হকচকিয়ে গেল তারপরই ছুটে এসে ফ্রান্সিসের তরোয়ালসুদ্ধ হাতটা চেপে ধরল। ফ্রান্সিস হাতটা ছাড়াবার জন্যে লোকটাকে ধাক্কা দিতে যাবে তখনই শুনল–ফ্রান্সিস–আমি হ্যারি।

ফ্রান্সিস প্রায় লাফিয়ে উঠল–হ্যারি, তুমি এখনও বেঁচে আছ!

হ্যারি আস্তে বলল–একটুও শব্দ করো না। পরে সব বলবো।

ফ্রান্সিসের আনন্দে তবু বাধা মানছে না। হারির হাত চেপে ধরল।

হ্যারি চুপিচুপি বলল–এখন আমাদের অনেক কাজ। মন দিয়ে শোন, তোমাকে কি করতে হবে।

–বলো।

–সব বন্ধুদেরও জাগাও। পাহারাদার সৈন্য দু’টোকে কাবু করে সবাই যেন গাড়ি দু’টোয় উঠে বসে। তারপর ঘোড়াগুলোকে এনে গাড়িতে জুড়তে হবে। কোনরকম শব্দ যেন না হয়। কিন্তু সমস্যা হল গাড়ি চলাবে কে?

–রিঙ্গো একটা গাড়ি চালাবে, অন্যটি আমি চালাবো।

–তুমি পারবে তো?

–হ্যাঁ–আমি অনেকদিন চালিয়ে-চালিয়ে অভ্যেস করেছি।

–বেশ। এবার পরের কাজ। সমস্ত জায়গাটা মোরান উপজাতিরা ঘিরে ফেলেছে। আমি একটা সংকেত দিলেই ওরা এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তবে মোরানদের বলা আছে। তারা যুদ্ধ করবেনা–শুধু এদের আটকে রাখবে।

–বলো কি!

-হ্যাঁ। আমি খড়কুটো তীরের ডগায় আটকে আগুন জ্বালিয়ে চারদিকে ছুঁড়ে মারব। ঠিক তখনই ওরা চারদিক থেকে ঘিরে ধরবে। আগুনের তীর ছুঁড়েই আমি লাফিয়ে তোমার গাড়িতে উঠবো। তারপর আর কিছু করবার নেই। যত দ্রুত সম্ভব গাড়ি চালিয়ে আমাদের পালাতে হবে। বুঝেছ?

ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকাল। তারাপর গুঁড়ি মেরে তার বন্ধুদের কাছে কাছে গিয়ে একে একে সবাইকে জাগাল। ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে সবাইকে চুপ করে থাকতে নির্দেশ দিল। তারপর রিঙ্গোকে সঙ্গে নিয়ে গুঁড়ি মেরে-মেরে চলল পাহারাদার দু’টির উদ্দেশ্যে। হঠাৎ পিছন থেকে লাফ দিয়ে মুহূর্তে পাহারাদার দুটিকে কাবু করে ফেলল ওরা। দুটো পাহারাদারের মুখে রুমাল গুঁজে হাত-পা দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে রাখল। তারপর ঘোড়াগুলোকে আস্তে আস্তে এনে গাড়ি দু’টোতে জুড়ল। চাপা স্বরে সবাইকে ডাকল গাড়িতে ওঠার জন্যে। সবাই দু’ভাগ হয়ে সন্তর্পণে গাড়ি দু’টোতে উঠে বসল।

এবার হ্যারি খড়কুটো বাঁধা তীরগুলো মশাল থেকে আগুন জ্বালিয়ে নিয়ে চারদিকে ছুঁড়ে মারতে লাগল। সবকটা তীর ছুঁড়েই হ্যারি এক লাফে গাড়িতে উঠে বসল। ফ্রান্সিস আর রিঙ্গো গাড়ি ছেড়ে দিল। আর ঠিক তখনই শোনা গেল চারদিকে মোরানদের চীৎকার। বনের চারদিকে আগুন ধরে গেছে। তারই মধ্য দিয়ে ফ্রান্সিসরা জোরে জোরে চালিয়ে গাড়ি দুটোকে বের করে নিয়ে এল। তারপর গাড়ি দুটো বেগে ছুটল। ফ্রান্সিস পেছনে তাকিয়ে দেখল সমস্ত বনটায় আগুন লেগে গেছে। হেনরীর সৈন্যরা যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে।

সারাদিনে মাত্র একবার দুপুরবেলায় গাড়ি থামিয়ে একটা ঝরণার ধারে বসে খেয়ে নিল সবাই। তারপর আবার গাড়ি ছুটল। হেনরী যে গাড়িটায় এসেছিল, তার মধ্যে হীরের খণ্ডটা আটেনি। তাই কাছি দিয়ে গাড়িটার সঙ্গে বাঁধা হয়েছিল। গাড়ি চলার আঁকুনিতে কাছিটা আলগা হয়ে গিয়েছিল। সেটার আবার নতুন করে বাঁধা হলো। আবার ছুটল গাড়ি। সন্ধ্যার সময় গাড়ি থামানো হল। রাতটা কাটল উন্মুক্ত আকাশের নীচে। তাঁবু ফেলে আসতে হয়েছে। ফ্রান্সিস বুদ্ধি করে খাবারের বাক্সটা তুলে নিয়েছিল, তাই যাহোক কিছু খাবার জুটল। রাত্রে বিশ্রাম নিয়ে আবার ভোর হতেই গাড়ি ছুটল।

হ্যারি ফ্রান্সিসের পাশে এসে বসল। ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল–হ্যারি এবার বলতো, তুমি কি করে বাঁচলে?

হ্যারি বলতে লাগল–তোমার মনে আছে নিশ্চয়ই, পায়ে তীর লাগার পর একটা পাথরের ঢিবি থেকে আমি মাটিতে পড়ে গিয়েছিলাম।

–হ্যাঁ, মনে আছে।

–যে পাথরের ঢিবির নীচে আমি পড়ে গিয়েছিলাম, সেই পাথরটাকে মোরানরা দেবতার জ্ঞানে পূজো করত। পাথরটাতে রঙ-বেরঙের দাগ, নীচে পূজোর ফুল এসব ছিল। আমরা কেউ কিন্তু সেসব লক্ষ্য করি নি। আমাদের অনুসরণকারী যে লোকটা আমাকে দেখে উল্লাসে চীৎকার করে উঠেছিল। আমাকে মারবার জন্যে দা উঁচিয়ে এগিয়ে এল। কিন্তু পাথরের ঢিবিটার দিকে হঠাৎ নজর পড়তেই দাঁড়িয়ে পড়ল। এমনিতেই মোরানরা ধর্মভীরু। তার ওপর যে পাথরটাকে ওরা পূজো করে, তারই নীচে আমি পড়ে আছি–এসব দেখে-শুনে লোকটার মুখ শুকিয়ে গেল। সে দা’টা কোমরে গুঁজে আমার কাছে এল। পা দিয়ে তখন গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। লোকটা আমাকে পাঁজাকোলা করে গালকাটা সর্দারের কাছে নিয়ে এল। সর্দার সব কথা শুনে ওদের এক সঙ্গীকে ইঙ্গিত করল। সে বনের মধ্যে ঢুকে গেল। একটু পরেই কিছু লতাপাতা নিয়ে বন থেকে বেরিয়ে এল। সেই লতাপাতা দিয়ে আমার পা’টা বেঁধে দিল। অনেকটা আরামবোধ করলাম। তারপর সর্দারের দু’জন সঙ্গী কাঁধ ধরে ধরে এগোলাম ওদের গ্রামের দিকে। সেখানে একটা বাড়িতে রেখে ওরা চলে এল।

–তারপর?

–আমার চিকিৎসা আর সেবা-শুশ্রূষা করল। কিছুদিনের মধ্যেই আমি সুস্থ হয়ে উঠলাম। তবে একনও একটু খুঁড়িয়ে চলতে হয়। হোক, আমার সঙ্গে মোরানরা ভালো ব্যবহার করতে লাগল। আসলে ওরা ধরে নিয়েছিল, আমি ওদের দেবতা প্রেরিত মানুষ। আস্তে-আস্তে আমি ওদের পরামর্শদাতা হয়ে গেলাম। আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে মোরান-সর্দার কোন কাজই করত না।

–হ্যারি, তুমি আমাদের খোঁজ পেলে কী করে?

–ওঙ্গালির বাজার থেমে মাইল পনেরো উত্তরে হীরের পাহাড়, এটা আমি জানতাম। আমি সেইজন্যে সেই পাহাড়টার কাছে একজন মোরানকে পাহারায় রেখেছিলাম। আমি জানতাম, তুমি আসবেই। তোমরা যখন এলে তারপর থেকে সমস্ত ঘটনাই আমরা দেখেছি। দুর্গরক্ষক লোকটা যে কিছুতেই হীরে দুটো হাতছাড়া করবে না, এটা বুঝেছিলাম। আমি তখনই দুর্গরক্ষক আর তার সৈন্যদলকে নিঃশেষ করতে পারতাম। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম বিনা রক্তক্ষয়ে কার্যোদ্ধার করতে। শুধু পালাবার সুযোগ করে নেওয়া। মোরানদের নির্দেশ দিয়েছিলাম, আমি আগুনের তীর ছোঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা যেন চীৎকার হইহুল্লো করে দুর্গরক্ষক আর তার সৈন্যদের ঘাবড়ে দেয়। এই সুযোগটা পেলে গাড়ি নিয়ে আমরা পালাতে পারবো। হলোও তাই।

–কিন্তু তুমি আমাদের সঙ্গে পালাবে এটা মোরানরা জানে?

–না, ওরা জানে আমি আবার ওদের কাছে ফিরে আসবো। তাই চারিদিকে আগুন লাগাবার সংকেত দিয়েছিলাম। আগুন নিয়ে ওরা এত ব্যস্ত থাকবে যে, আমার পালানোটা ওরা লক্ষ্য করতে পারবে না।

–হ্যারি তুমি বেঁচে আছো, দেখে এত খুশী হয়েছি যে–কি বলবো আমি। আবেগে ফ্রান্সিসের গলা খুঁজে এল।

ফ্রান্সিস ওসব আর ভেবো না। হ্যারি ফ্রান্সিসের কাঁধে হাত রাখল। বলল–তোমরা নিশ্চয়ই জাহাজ নিয়ে এসেছে।

–হ্যাঁ, তেকরুর বন্দরে জাহাজ রয়েছে।

–তাহলে এখন আমাদের একটা কাজ–যে করেই হোক হীরে দু’টো জাহাজে তোলা। গাড়ি ছুটে চলল। ফ্রান্সিস আর রিঙ্গো দুজনেই যথাসাধ্য দ্রুত গাড়ি চালাবার চেষ্টা করছে। দিগন্তবিস্তৃত মেঠো জমিতে পড়ে রাত্তিরেও গাড়ি চালাতে লাগল। গাইডটির নির্দেশে চলে ওরা পথটা আরো সংক্ষিপ্ত করে নিল। এই সংক্ষিপ্ত পথে নাকি সিংহের ভয় আছে। কিন্তু কপাল ভাল বলতে হবে সামনাসামনি কোন সিংহ পড়েনি।

***

দু’দিন পরে এক সন্ধ্যায় ওরা তেকরুর বন্দরে এসে পৌঁছল। সঙ্গের গাইডটিকে এবার বিদায় দিল ওরা। ওকে পুঁতির মালা, আয়না, চিরুনি দিল, গাইডটা খুশী হল।

ফ্রান্সিসের জাহাজের-বন্ধুরা হইহই করে উঠল। অবাক চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগল হীরের খণ্ড দুটি। তারপরেই আনন্দে কেউ-কেউ হেঁড়ে গলায় গান ধরলনাচতে লাগল কেউ-কেউ। ফ্রান্সিস গাড়িতে দাঁড়িয়ে সবাইকে ডেকে বলল–ভাইসব, এখনও নিশ্চিন্ত হবার সময় আসেনি। আনন্দ করার সময় পরে অনেক পাবে। এখন হীরে দু’টো জাহাজে তোলার জন্যে সবাই হাত লাগাও।

হীরেদু’টো গাড়ি থেকে নামাতে রাত হয়ে গেল। চারদিক মশাল পুঁতে তারই আলোতে কাজ চললো। এবার হীরে দুটো জাহাজে তোলার জন্য সবাই কাঁধ লাগালো। জাহাজে ওঠার পাটাতনে সাবধানে পা ফেলে একটা হীরের খণ্ড জাহাজে তোলা হল। দুর্ঘটনা কিছু ঘটল না। তবে একজন পা পিছলে সমুদ্রের জলে পড়ে গেল। জাহাজ থেকে দড়ি ফেল হল। লোকটি নিজেই দড়ি বেয়ে জাহজে উঠে এল। ফ্রান্সিস সবাইকে ডেকে বলল আমাদের এক্ষুনি জাহাজ ছেড়ে দিতে হবে। এখানে এক মুহূর্তও আর দেরী করবো না আমরা।

ঘড়ঘড় শব্দে নোঙর তোলা হলো। পাল খাটানো হলো। হাওয়া লাগতেই পালগুলো ফুলে উঠল। জাহাজ চললো গভীর সমুদ্রের দিকে।

জাহাজে ততক্ষণে মশাল হাতে নাচ শুরু হয়ে গেছে। গান গাওয়া চলল সেই সঙ্গে। সবাই জুটলো সেখানে হীরের খণ্ডদু’টোর চারপাশে ঘুরে-ঘুরে সবাইনাচতে লাগল। শুধু ফ্রান্সিস একা ডেকে-এ দাঁড়িয়ে তেকরুর বন্দরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। বারবার মকবুলের কথা মনে পড়তে লাগল। চোখ ঝাপসা হয়ে এল বারবার। তেকরুর বন্দরের আলো আস্তে-আস্তে দূরে মিলিয়ে গেল। চোখ মুছে তারা ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সিস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

। শেষ ।

মুক্তোর সমুদ্র – ফ্রান্সিস সমগ্র – অনিল ভৌমিক

 

‘যদি চিরদিনের জন্য যাও, তবে মুক্তোর সমুদ্রে যাও। –‘ভাজিম্বা’দের প্রবাদ

ফ্রান্সিসদের জাহাজ পশ্চিম আফ্রিকা উপকূলের বন্দর ছেড়ে এসেছে অনেকক্ষণ। জাহাজএখন মাঝসমুদ্রে। নির্মেঘ আকাশে বাতাসে তেমন জোর নেই। সমুদ্রও তাই শান্ত। জাহাজের ডেক এর ওপর পায়চারী করছিল ফ্রান্সিস। ভাবছিল, আফ্রিকা থেকে হীরে নিয়ে আসার কষ্টকর অভিজ্ঞতার কথা। সেই সঙ্গে বারবার মনে পড়ছিল মোরান উপজাতিদের হাতে মকবুলের নির্মম মৃত্যুর কথা। বারবার চোখে জল আসছিল এইকথা ভেবে। মকবুলকেও বাঁচাতে পারল না। নিজের জীবনের বিনিময়ে মকবুলই তাকে বাঁচাবার পথ করে দিলো। পায়চারী করতে করতে ফ্রান্সিস এসে দাঁড়াল ডেক-এ রাখা গাড়ি দু’টোর কাছে। বিরাট হীরের খন্ডদু’টো গাড়িতে রাখা। কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে জাহাজের সকলেই একবার করে হীরে দু’টো দেখে যাচ্ছে। কী বিরাট হীরের টুকরো দু’টো! তাদের চোখে বিস্ময়ের শেষ নেই। ফ্রান্সিস হীরে দু’টোর কাছে–দাঁড়াল। তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। পশ্চিম আকাশে গভীর লাল সূর্যটা জলের ঢেউয়ের মাথায়। পশ্চিম দিগন্ত থেকে প্রায় মাঝ আকাশ পর্যন্ত লাল রঙের শব্দহীন ঢেউ। সেই আলো পড়েছে। জাহাজে। হীরেদু’টো লাল রঙের সেই রঙীন আলোয় স্বপ্নময় হয়ে উঠেছে। অনেকেই চারপাশে ভীড় করে সেই অপরূপ রঙের খেলা দেখছে। ঢেউ ছোঁয়া দিগন্তে আস্তে আস্তে সূর্য অস্ত গেল। তারপরেও পশ্চিমাকাশে লাল আলোর ছাপ রইল অনেকক্ষণ। তারপর অন্ধকার নামতে হীরে দু’টোর গায়েও আলোর খেলা মিলিয়ে গেল।

ফ্রান্সিস ডেকের ধারে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। আকাশে ততক্ষণে তারা ফুটে উঠেছে। নিষ্প্রভ ভাঙা চাঁদটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। একটা নরম জ্যোৎস্না-ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে।

হ্যারি কাছে এসে ডাকল–ফ্রান্সিস।

ফ্রান্সিস ফিরে তাকিয়ে হ্যারিকে দেখে বলল–হুঁ।

তারপর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলো।

–এবার ঘরে ফেরা যাক্, তুমি কি বলো? হ্যারি বলল।

–হ্যাঁ–ফ্রান্সিস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

–মনে হচ্ছে, তুমি এতেও খুব খুশী নও? হ্যারি হেসে বললো।

ফ্রান্সিস মাথা নাড়ল। বললো সত্যিই আমি খুশী নই। কী হবে ফিরে গিয়ে? আবার তো সেই সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন। উদ্দেশ্যহীন একঘেঁয়ে জীবন, খাও-দাও ঘুমোও।

–আবার বেড়িয়ে পড়বে ভাবছো।

–দেখি–

হ্যারি হাসল–তুমি আর বেরোতে পারবে বলে মনে হয় না।

–কেন?

–রাজাকে এর আগে সোনার ঘন্টা এনে দিয়েছে, এবার অতবড় দু’টো হীরে নিয়ে যাচ্ছে। এবার রাজামশাই তোমাকে নির্ঘাৎ সেনাপতি করে দেবে।

ফ্রান্সিস হাসলো–ওসব তালপাতার সেপাইগিরির মধ্যে নেই। ঠিক পালাবো আবার।

দু’জনে আর কোন কথা বললো না। হ্যারি একটু পরেই চলে গেল। ফ্রান্সিস দূরে অন্ধকারে সমুদ্র আর তারা ভরা দিগন্তের দিকে তাকিয়ে নানা কথা ভাবতে লাগল।

***

দিন যায়। ওদের জাহাজ চলে শান্ত সমুদ্রের ওপর দিয়ে। ভাইকিংরা সকলেই আনন্দে আছে। কতদিন পরে আবার দেশে ফিরে চলেছে!যখন ডেক ধোয়া, রান্না করা, পাল ঠিক করা, দড়ি-দড়া বাঁধা, দাঁড়-বাওয়া এসব কাজ থাকে না, তখন জাহাজের ডেক-এর এখানে ওখানে জড়ো হয়; ছোট-ঘোট দল বেঁধে ছক্কা পাঞ্জা খেলে, নয়তো গান নাচের আসর বসায়, নয়তো দেশবাড়ির গল্প করে। এতবড় দু’টো। হীরের খন্ড নিয়ে দেশে যাচ্ছে ওরা কী। সম্বর্ধনাটাই না পাবে, এসব কথাও হয়।

শুধু ফ্রান্সিস অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমুতে পারে না। ডেক-এ একা-একা পায়চারী করে বেড়ায় আর ভাবে এখন নিরাপদে দেশে ফিরতে পারবে তো? পথে জলদস্যুদের ভয় আছে, প্রবল সামুদ্রিক ঝড়ে জাহাজ ডুবি হওয়াও বিচিত্র নয়। তবে লক্ষণ ভাল। সমুদ্র শান্ত, বাতাসও বেগবান। পালগুলো ফুলে উঠেছে। দ্রুত গতিতে জাহাজ চলেছে। আর দাঁড় বাইতে হচ্ছে না। কিছুদিনের মধ্যেই দেশে পৌঁছানো যাবে। কিন্তু শান্ত আর নিরুপদ্রব সমুদ্রযাত্রা ফ্রান্সিসের ভাগ্যে নেই। এটা ও কয়েকদিন পরেই বুঝতে পারলো।

***

সেদিন অমাবস্যার রাত! কালো আকাশ, সমুদ্র সব একাকার। মাথার ওপর শুধু কোটি-কোটি তারার ভীড়। তারাগুলো জ্বলজ্বল করছে! পরিষ্কার, নির্মল আকাশ।

তখন মধ্যরাত্রি। এতক্ষণ ডেকে একা-একা পায়চারী করছিল ফ্রান্সিস। কিছুক্ষণ আগে কেবিনে ফিরে এসেছে। ঘুমিয়ে পড়েছে একটু পরেই। জাহাজে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু হীরের গাড়ি দুটো পাহারা দিচ্ছে দু’জন ভাইকিং। তারাও এতক্ষণ গল্পগুজব করে গাড়ির চাকায় ঠেসান দিয়ে এখন তন্দ্রায় আচ্ছন্ন।

অন্ধকার সমুদ্রের মধ্য দিয়ে একটা পর্তুগীজ জলদস্যুর জাহাজ নিঃশব্দে ওদের জাহাজের গায়ে এসে লাগল। সেই ধাক্কায় একজন পাহারাদারের তন্দ্রা ভেঙে গেলেইহাই তুলে চোখ তুললো। কেবিনের সামনে একটা কাঁচে ঢাকা লণ্ঠনের আলো জ্বলছিল। হঠাৎ সেই আলোয় ও মুক্তোর সমুদ্র ও দেখলো কারা যেন হাতে খোলা তরোয়াল নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। এত রাত্রে এরা আবার কারা? ভুল দেখছে মনে করে ও দু’চোখ কচ্‌লে নিলো! আর সত্যিই তো। মাথায় ফেট্টি বাঁধা, বুকে-হাতে উল্কি আঁকা একটা লোক এগিয়ে আসছে। পেছনে আরো ক’জন। জলদস্যু! আতঙ্কে ও চিৎকার করে উঠতে গেল। কিন্তু পারল না। তরোয়ালের এক আঘাতে ও ডেক-এ লুটিয়ে পড়ল। ওর সঙ্গীটির যখন তন্দ্রা ভাঙল দেখলো, কয়েকটা বলিষ্ঠ হাত ওকে দ্রুত দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলছে। চিৎকার করে উঠেকি হচ্ছে সেটা বলবার আগেই ওকে হীরের গাড়ির চাকার সঙ্গে বেঁধে ফেলা হলো।

তারপর জলদস্যুরা ছুটলো কেবিনঘরগুলোর দিকে। তার মধ্যে দু’জন অস্ত্রশস্ত্র রাখার ঘরের সামনে পাহারায় দাঁড়িয়ে গেল, যাতে কেউ এখান থেকে অস্ত্র না নিয়ে যেতে পারে। কেবিন ঘরে সবাই অঘোরে ঘুমুচ্ছিল। হঠাৎ তরোয়ালের খোঁচা খেয়ে সবাই একে-একে উঠে বসলো। সামনে তাকিয়ে দেখলো মাথায় ফেট্টি বাঁধা বড়-বড় গোঁফ আর বড়-বড় জুলপীওলা জলদস্যুরা দাঁড়িয়ে। হাতে খোলা তরোয়াল। যুদ্ধ করা দূরে থাক, কেউ অস্ত্রাগারের দিকে পা বাড়াতে পারল না। ফ্রান্সিস-হ্যারিরও এক অবস্থা। এখন ওদের সঙ্গে লড়তে যাওয়া মানে স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে ডেকে আনা। জলদস্যুদের দলের একজন বেঁটে মত লোক এগিয়ে এসে পর্তুগীজ ভাষায় সবাইকে বললো–সবাই ডেকে এ চলো।

সবাইকে সার বেঁধে ওপরে ডেক-এ আনা হলো। ডেক-এর একপাশে সবাইকে বসতে বলা হলো। ওরা যখন বসলো, তখন বেঁটে জলদস্যুটা চীৎকার করে কী যেন বলে উঠলো। সঙ্গের জলদস্যুরা একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল। ওদের ক্যারাভেল জাহাজ থেকেও আর একদলের চিৎকার শোনা গেল। ভাইকিংরাও বুঝলো, এটা ওদের জয়ধ্বনি। বেঁটে জলদস্যুটা এবার চিৎকার করে বলতে লাগল–তোমাদের এখানেই থাকতে হবে। কাল সকালে আমাদের ক্যাপ্টেন লা ব্রুশ এই জাহাজে আসবেন। তিনি যা বিবেচনা করবেন, তোমাদের ভাগ্যে তাই ঘটবে। এখন চুপচাপ বসে থাকো। চাও কি ঘুমোতেও পারো। কিন্তু কেউ যদি বেশী চালাকি দেখাতে যাও, তাহলে তার মুন্ডু উড়িয়ে দেবো।

একমাত্র বেঁটে জলদস্যুটার গায়ে ডোরাকাটা গেঞ্জি। ও পেটের কাছ থেকে গেঞ্জীটা একটু তুলে মুখ মুছে নিলো। ভাইকিংদের ঘিরে আট-দশ জলদস্যু খোলা তরোয়াল হাতে পাহারা দিতে লাগল। এদিকে ক্যাপ্টেন লা ব্রুশের নাম শুনে ভাইকিংদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হলো। লা ব্রুশের নাম শোনেনি, এমন লোক এই তল্লাটে নেই। লা ব্রুশ জাতিতে ফরাসী, একটা পা কাঠের। ওর মতো নৃশংস-নির্মম জলদস্যুকে সকলেই যমের মত ভয় করে। ও জাহাজ লুঠ করে শুধু ধনরত্নই নেয় না, জাহাজের লোকেদের ধরে ক্রীতদাসের হাটে বিক্রী করে। ভাইকিংরা বেশ ভীত হলো। ভাগ্যে কী আছে, কে জানে? বেঁটে জলদস্যুর কথাগুলো ফ্রান্সিস, হ্যারি শুনল। হ্যারি-ফ্রান্সিসের কাছে ঘেঁসে এসে বসে চাপাস্বরে ডাকলে–ফ্রান্সিস?

–হুঁ।

–আমরা তাহলে কুখ্যাত জলদস্যু লা ব্রুশের পাল্লায় পড়লাম।

–হুঁ।

–এখন কি করবো? হ্যারি জিজ্ঞাসা করল।

–কিছু করবার নেই। সময় আর সুযোগের সন্ধানে থাকতে হবে। একটু থেমে ধরা গলায় ফ্রান্সিস বললো, আমার সবচেয়ে দুঃখ কি জানো? এত দুঃখ কষ্ট সহ্য করে এক বন্ধুর প্রাণের বিনিময়ে যে হীরে দু’টো আনলাম, সেটা লা ব্রুশের মত একটা জঘন্য জলদস্যুর সম্পত্তি হয়ে যাবে।

–ফ্রান্সিস জলদস্যুর দল এখনো জানে না ও গাড়ি দু’টোয় কী আছে। সূর্য উঠলে ওরা হীরে দু’টো চিনে ফেলবে। সূর্য ওঠার আগেই আমাদের একটা উপায় বার করতে হবে, যাতে ওরা হীরের খন্ড দুটোকে না চিনে ফেলে।

–তুমি কিছু ভেবেছো? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।

–হ্যাঁ, বুদ্ধি করে হীরে দুটোকে ঢাকা দিতে হবে। হ্যারি বললো।

–কিন্তু কী করে?

-–তুমি ওদের বেঁটে সর্দারটাকে গিয়ে বলো, যে গাড়ি দু’টোয় বারুদ আছে। বৃষ্টি হলে বারুদ ভিজে যাবে। কাজেই ছেঁড়া পাল দিয়ে গাড়ি দু’টো ঢাকতে হবে।

ফ্রান্সিস একমুহূর্ত হ্যারির দিকে হেসে কাঁধে এক চাপড় দিলো–জব্বর উপায় বের করেছে। বলছি এক্ষুণি, কিন্তু ও ব্যাটা রাজি হবে কি?

–রাজি হবে। তুমি কিন্তু এরকম ভাব করবে যে ঢাকা দিলেও হয়, না দিলেও হয়। সাবধান বেশি আগ্রহ দেখাবে না। তাহলে ওদের মনে সন্দেহ হতে পারে।

–দেখি, ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। ফ্রান্সিসকে উঠে দাঁড়াতে দেখে একজন পাহারাদার তরোয়াল উঁচিয়ে ছুটে এলে। ফ্রান্সিস দু’হাত ওপরে তুলে দিল। পাহারাদার এসে বাজখাঁই গলায় বলল–কি হলো তোমার?

–আমাকে ক্যাপ্টেনের কাছে নিয়ে চলো, বিশেষ জরুরী কথা আছে।

–ক্যাপ্টেন এখন ঘুমুচ্ছে। যা বলবার কাল সকালে বলবে।

–না, এখুনি দেখা করতে হবে।

পাহারাদারটা মুখ ভেংচে উঠল–কোথাকার রাজা হে তুমি, যখন খুশী লা ব্রুশের সঙ্গে দেখা করতে চাও–তোমার ভাগ্য ভালো যে এখনো তোমার মাথাটা শরীরের সঙ্গে লেগে আছে, উড়ে যায় নি।

ফ্রান্সিস একবার ভাবলো, লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে উচিত শিক্ষা দেবে কিনা! পরমুহূর্তে ভাবলো, মাথা গরম করলে সব কাজ পন্ড হয়ে যাবে। আগে হীরে দুটোকে ঢাকতে হবে।

ফ্রান্সিস হেসে বলল–ভাই তোমরা হচ্ছো বীরের জাত, আমাদের মত ভীতু-দুর্বল লোকেদের ওপর কি তোমাদের চোখ রাঙানো উচিত।

পাহারাদারটাও হেসে গোফমুচরে বলল তুমি বড় সর্দারের সঙ্গে কথা বলতে পারো।

ডোরাকাটা গেঞ্জী গায়ে বেঁটে লোকটাই বড় সর্দার। সে কথা কাটাকাটি শুনে এগিয়ে এসে মোটা গলায় বলল–কী হয়েছে!

ফ্রান্সিস বড় সর্দারকে হাত তুলে সম্মান দেখাল। তারপর বললো–দেখুন, একটা কি সমস্যার কথা বলছিলাম।

–কী সমস্যা?

হীরে রাখা গাড়ি দুটোর দিকে হাত দেখিয়ে ফ্রান্সিস বললো–ঐ গাড়ি দু’টোয় প্রচুর বারুদ রাখা আছে। বৃষ্টি হলে সব বারুদ ভিজে যাবে। যদি ছেঁড়া পাল টাল দিয়ে ঢেকে দেওয়ার অনুমতি দেন তাহলে–

–পাগল নাকি? পরিস্কার আকাশ–বৃষ্টি হবে না–বড় সর্দার বললো।

–বলছিলাম, আপনি তো আমার চেয়েও অভিজ্ঞ, জানেন তো। ভূমধ্যসাগরের কাছাকাছি এসব জায়গায় কখন মেঘ করে, কখন ঝড় হয়, বৃষ্টি হয়, মা মেরীও তা জানেন না।

বড় সর্দার ভেবে বললো, হুঁ।

–তাছাড়া ভেবে দেখুন, আমি শুধু আমাদের জন্য বলছি না, আমাদের আর বারুদ দিয়ে কি হবে কিন্তু আপনাদের তো যুদ্ধ-টুদ্ধ করতে হবে, ভেজা বারুদ নিয়ে।

কিন্তু আপনাদের তো যুদ্ধ-টুদ্ধ করতে হবে। তখন কী করবেন?

–হুঁ, তা ঠিক। বড় সর্দার মাথা ঝাঁকাল–কিন্তু তোমরা কেমন বেআক্কেলে হে, যে খোলা ডেকে বারুদ রেখেছো?

–ভিজে গিয়েছিল তাই শুকোতে দিয়েছিলাম।

–অ। যাও, ঢাকা দিয়ে দাও।

ফ্রান্সিস হ্যারিকে ডাকল। হ্যারি কাছে এলে চোখ টিপে বললো–কেল্লা ফতে! ক্যাপ্টেন রাজী হয়েছে।

ও আরো কয়েকজনকে ডাকল। তারপর গুদোম ঘর থেকে দুটো বড়-বড় ছেঁড়া পালের অংশ এনে ঢাকা দিতে শুরু করলো। বড় সর্দার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। প্রায় অন্ধকারে ও কিছুই বুঝতে পারছিল না। পাল ঢাকা দিয়ে ফ্রান্সিসরা দড়িদড়া দিয়ে শক্ত করে হীরেটাকে গাড়ির সঙ্গে বেঁধে দিলো। ওদের কাজ সারতেই ভোর হয়ে গেল। ভাইকিংদের মধ্যে যারা জেগে ছিল, তারা হীরের গাড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। কিন্তু আর আলোর খেলা দেখা গেল না। পাল দিয়ে ঢাকা হীরে থেকে দ্যুতি বেরোবে কি করে? জলদস্যুরাও গাড়ি দু’টো বারুদের গাড়ি ভেবে তাকিয়ে দেখলো না। ফ্রান্সিস আর হ্যারির মুখে সাফল্যের হাসি ফুটে উঠলো। যাক্–হীরে দু’টোকে জলদস্যুদের হাত থেকে এখন আপাততঃ বাঁচানো গেছে।

সকাল হলো। এবার জলদস্যুদের ক্যারাভেল জাহাজটা দেখা গেল! পালের গায়ে ক্রশ চিহ্ন। মাস্তুলের মাথায় পতাকা উড়ছে। কালো কাপড়ের মাঝখানে মানুষের কঙ্কাল আঁকা। ফ্রান্সিসদের জাহাজের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা।

একটু বেলা হতেই পাহারাদার জলদস্যুদের মধ্যে ব্যস্ততা দেখা গেল। বড় সর্দার একবার দ্রুত ওদের জাহাজে গেল। তারপর দ্রুত পায়ে ফিরে এলো। জলদস্যুদের মধ্যে বেশ একটা সাজো সাজো রব পড়ে গেল। একটু পরেই কাঠের পায়ে ঠক্‌ঠক্ শব্দ তুলে একটু খোঁড়াতে-খোঁড়াতে এই জাহাজে এলো লা ব্রুশ। মাথায় বাঁকানো টুপী। গালপাট্টা দাড়ি গোঁফ। কালো জোবরা পরনে, তাতে সোনালী জরির কাজ করা, গলায় ঝুলছে একটা হাঁসের ডিমের মত মুক্তোর লকেট। কোমরে মোটা বেল্ট। তাতে হাতীর দাঁতে বাঁধানো বাঁটের তরোয়াল ঝোলানো। পায়ে হাঁটু অবধি ঢাকা বুট, অন্য পা-টা কাঠের। ডানহাতে ধরা একটা শেকল। শেকলে বাঁধা একটা বাচ্চা চিতাবাঘ। লা ব্রুশ খুব ধীর পায়ে এসে এই জাহাজের ডেক-এ দাঁড়াল। জলদস্যুরা সব চুপ করে পুতুলের মত দাঁড়িয়ে রইলো। লা ব্রুশ একবার চোখ পিটপিট করে চারদিকে তাকিয়ে নিলো। তারপর ভাইকিংদের দিকে তাকিয়ে বলল–তোমরা ভাইকিং, ভালো জাহাজ চালাও, ভালো যুদ্ধ করো, কিন্তু তোমরা, বড় দরিদ্র, তোমাদের এই জাহাজে মূল্যবান কিসু পাবোনা।

ভাঙা-ভাঙা পর্তুগীজ ভাষার সঙ্গে ফরাসী ভাষা মিশিয়ে লা ব্রুশ বলতে লাগলো–তবে কেন আশী মাইল সমুদ্র পথ তোমাদের পেছনে ধাওয়া করে এলাম?

খুকখুক করে হেসে উঠল লা ব্রুশ। তারপর হাসি থামিয়ে বলল–সেটা এই জন্যে। কথাটা বলেই লা ব্রুশ খাপ থেকে তরোয়াল খুললো। তারপর বেশ দ্রুত ছুটে গিয়ে হীরের গাড়ির ওপর বাঁধা দড়িগুলো কাটতে লাগলো। তারপর ওখান থেকে সরে এসে ভাইকিংদের দিকে তাকিয়ে খুকখুক করে হেসে উঠলো। ফ্রান্সিস ও হ্যারি পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো। তবে কী লা ফ্রশ হীরের কথা জানে? লা ব্রুশ হঠাৎ চিৎকার করলো–ওপরের ঢাকনা সরাও।

তিন-চারজন জলদস্যু ছুটে গিয়ে ছেঁড়া পাল দুটো খুলে ফেলল। সূর্যের আলোয় ঝিকিয়ে উঠল হীরে দু’টো। নীলচে-হলুদ কত রকমের আলো বিচ্ছুরিত হতে লাগল। ভাইকিংরা কেউ অবাক হলো না। কারণ, এসব রঙের খেলা ওরা অনেকদিন দেখেছে। অবাক হল জলদস্যুরা। ওরা হাঁ করে তাকিয়ে রইলো। চোখে পলক পড়ে না। লা ফ্রশও কম অবাক হয় নি। এত বড় হীরে? ওর কল্পনারও বাইরে। কিছুক্ষণ চুপ করে হীরে দুটোর দিকে তাকিয়ে রইলো লা ব্রুশ। তারপর ভাইকিংদের দিকে তাকিয়ে লা ব্রুশ বলতে লাগল–তেকবুর বন্দরের কাছে যে দুর্গ আছে, সেখান থেকে হেনরী সময় মতই আমার কাছে লোক পাঠিয়ে ছিল। তোমরা ওকেভাওতা দিয়ে হীরে নিয়ে পালাচ্ছো, এইসংবাদ পেতেই তোমাদের পিছু নিলাম। আমাদের ক্যরাভেল’ জাহাজ যে অনেক দ্রুত গতিসম্পন্ন, সেটা আর একবার প্রমাণিত হলো। খুকখুক করে হেসে উঠল লা ব্রুশ।

ফ্রান্সিসের আর সহ্য হ’ল না। ও আস্তে-আস্তে উঠে দাঁড়াল। হ্যারি ওকে বারণ করতে গেল। কিন্তু ফ্রান্সিস শুনল না। ও উঠে দাঁড়িয়ে বললো–ক্যাপ্টেন লা ব্রুশ আমার কিছু বলবার আছে।

দু’তিন জন পাহারাদার তরোয়াল হাতে ছুটে এলো। লা ব্রুশহাত তুলে ওদের থামিয়ে দিল। বললে–বলো।

–দুর্গাধ্যক্ষ হেনরী মিথ্যে অভিযোগ করেছেন। আমরা তাকে ভাওতা দিতে চাই নি। তিনি আমাকে প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন। তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তাকে এক খন্ড হীরে দিয়েছিলাম। কিন্তু লোভের বশেতিনি দু’টো খন্ডই জোর করে নিতে গিয়েছিলেন আমরা সেটা হতে দিইনি। কারণ হীরের দু’টো খন্ডই আমাদের প্রাপ্য। আমরাইহীরের পাহাড়ের খোঁজ জানতাম। আমার এক বন্ধু এই জন্য প্রাণ দিয়েছে। কাজেই এই হীরের নায্য দাবীদার আমরা। হেনরীকে এই হীরে পেতে বিন্দুমাত্র কষ্টও করতে হয় নি। তবে কি করে উনি বলেন, যে আমরা ওকে ভাওতা দিয়েছি।

লা ব্রুশ কী ভাবল। তরোয়ালের হাতলে হাত বুলোল দু’একবার! দাড়িতে হাত বুলিয়ে, তারপর কেশে নিয়ে বললো–ওসব তোমাদের ব্যাপার। হীরে দুটো আমি পেয়েছি, ব্যাস। বলে ব্রুশ চোখ পিটপিট করে হাসল।

–আমাদের কি হবে?

–তোমাদের আমার জাহাজে কয়েদ ঘরে থাকতে হবে।

–কেন?

লা ব্রুশ খুকখুক করে হাসল–তোমরা যে বেঁচে আছো, এই জন্য মা মেরীকে ধন্যবাদ দাও। তোমাদের যে প্রাণে মারতে বলিনি, তার কারণ এই হীরে দু’টো। তোমাদের নিয়ে আমরা প্রথমে যাবো ডাইনীর দ্বীপে। সেখানে লুঠের মাল রেখে যাবো চাঁদের দ্বীপে। তারপর ইউরোপের দিকে। ক্রীতদাস বিক্রীর হাটে তোমাদের বিক্রী করবো। এরমধ্যে অবশ্য ভালো খদ্দের পেলে হীরে দু’টোও বিক্রী করে দেব।

–আমাদের বিক্রী করা হবে কেন?

লা ব্রুশ ক্রুদ্ধ স্বরে বলে উঠল–তুমি যে এখনো আমার সঙ্গে কথা বলতে পারছো, জেনো সেটা আমার দয়া।

হ্যারি ফ্রান্সিসের হাত ধরে টানল–ফ্রান্সিস মাথা গরম করো না। ব’সে পড়ো।

ফ্রান্সিস বসে পড়ল। লা ব্রুশ বড় সর্দারের দিকে তাকিয়ে বলল–এদের সব কয়েদ ঘরে ঢোকাও। তারপর এই জাহাজটাকে আমাদের ক্যারাভেলের পেছনে বেঁধে নাও।

লা ব্রুশ আর কোনদিকে না তাকিয়ে কাঠের পা ঠক্‌ঠক্ করতে করতে নিজের ক্যারাভেল-এ ফিরে গেল।

বড় সর্দার চেঁচিয়ে হুকুম দিলো–সব কটাকে কয়েদ ঘরে ঢোকাও। পাহারাদার জলদস্যুরা সব এগিয়ে এলো। ভাইকিংদের সারি বাঁধা হলো। ক্যরাভেলে নিয়ে যাওয়া হ’ল ওদের। ডেক থেকে কাঠের সিঁড়ি নেমে গেছে। ওরা নামতে লাগল। অনেক ক’টা ধাপের পর ক্যারাভেলের সবচেয়ে নীচের অংশে একটা লম্বা ঘর। লোহার মোটা-মোটা শিক লাগানো। ঘরটার জানালা বলে কিছুই নেই। ঐ শিকল লাগানো দরজা থেকেই যেটুকু আলো আসে। স্যাৎসেঁতে অন্ধকার। বাইরের আলো থেকে এসে কিছুই নজরে পড়ে না। অন্ধকার স’য়ে আসতে ওরা দেখল লম্বা ঘরটার ধার বরাবর একটা মোটা–শেকল। শেকলের দুটো দিক। একদিকে জাহাজের কাঠের খোলের সঙ্গে গাঁথা। অন্য এক দিকটা একটা বড় কড়ার সঙ্গে আটকানো। বড় সর্দার সেই দিকে শেকলটার মুখ একটা আংটা থেকে খুলে নিলো। এদিকে কোনের দিকে একজন জলদস্যু দাঁড়িয়ে। সে প্রত্যেকের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিয়ে এক-এক করে চাবি দিয়ে হাতকড়া আটকে দিতে লাগল। বড় সর্দার এক একজনের হাত কড়ার মধ্যে দিয়ে শেকলের মুখটা ঢুকিয়ে দিতে লাগল। হাতকড়ার মধ্যে দিয়ে শেকল বাঁধা অবস্থায় ওরা পরপর বসতে লাগল। যখন সবাইকে এভাবে বসানো হলো, তখন বড় সর্দার শেকলটা একটা আংটার মধ্যে আটকে দিয়ে যে হাতকড়া পরাচ্ছিল, তাকে ডাকল। সে এসে শেকলটা চাবি দিয়ে এঁটে দিল। বোঝা গেল, এই লোকটাই কয়েদ ঘরের পাহারাদার। ওই বন্দীদের সব দেখাশুনা করে। অদ্ভুত দেখতে লোকটা। যেমন কালো চেহারা, তেমনি মুখটা। মুখটা যেন আগুনে পোড়া তামাটে কালো। এমন ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, যেন কিছুই দেখছেনা, শুনছে না। মুখ দেখলে মনে হয় যেন জীবনে কোনদিন হাসে নি। মাথায় কঁকড়া চুল। একেবারে নরকের প্রহরী। এতক্ষণে হাতকড়া শেকলের ঝন্ঝন্ শব্দ হলো। তবু ভাইকিংদের মধ্যে কেউ উঠে দাঁড়ালে শেকলে ঝন্‌ঝন্‌শব্দ উঠেছে। এতক্ষণে চোখে অন্ধকার সয়ে আসতে ফ্রান্সিস চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। যে ভাবে শেকল বাঁধা হাতকড়ি পরানো হোল তাতে এসব ভেঙে পালানো অসম্ভব, দু’দিকে নিরেট কাঠের খোল। দরজায় মোটা গরাদ। ফ্রান্সিসের মন দমে গেল। শেষে ক্রীতদাসত্বকে মেনে নিয়ে জীবন শেষ করতে হবে? ও এইসব ভাবছে, তখনই শুনল প্রায় অন্ধকার কোন থেকে কে ফ্যাসফেসে গলায় চেঁচিয়ে উঠল–

উউ গেলাম–পা মাড়িয়ে দিয়েছে–ও হোহো–। ফ্রান্সিস ভালো করে তাকিয়ে দেখলো–কোণার দিকে একটা লোক পায়ে হাত বুলোচ্ছে আর চ্যাঁচাচ্ছে। এই লোকটা তো আমাদের দলের নয়, ফ্রান্সিস ভাবলো। তাহলে এই লোকটা আগে থেকেই শেকল বাঁধা ছিল। পুরানো কয়েদী। হাতে শেকল আটকানো; ও এগিয়ে যেতে পারল না। ঐ লোকটার পাশেই ছিল হ্যারি। লোকটার পায়ে হাঁটুতে হাত বুলোতে বুলোতে বললো–খুব লেগেছে? অন্ধকারে দেখতে পাইনি।

লোকটা এতক্ষণে শান্ত হলো। দু’একবার উ–হুঁ-হুঁ করে চুপ করলো।

হ্যারি জিজ্ঞেস করল–তুমি ভাই কদ্দিন এখানে আছো?

লোকটা বলল–এখানে কি দিন-রাত বোঝা যায়, যে দিন-মাস-বছর গুণবো?

এবার ফ্রান্সিস লোকটির দিকে ভালো করে তাকাল। দেখলো, লোকটার মাথা ভর্তি লম্বা লম্বা কঁচাপাকা চুল। মুখে কঁচাপাকা দাড়ি গোঁফের জঙ্গল। গায়ে শতছিন্ন একটা জামা। পরণে ভেঁড়া পায়জামা। প্রায় বুড়ো এই মানুষটা ক্রীতদাসের হাটে হয়তো ভালো দামে বিকোবে না। তাই হয়তো একে এখনও কয়েদঘরে রেখে দিয়েছে, মরে গেলে সমুদ্রে ফেলে দেবে।

লোকটার জন্যে ফ্রান্সিসের সহানুভূতি হলো। কে জানে কতদিন এই পশুর জীবন কাটাচ্ছে লোকটা? ও হ্যারিকে বলল–হ্যারি, জিজ্ঞেস করতো–ওর নাম কি? হ্যারি জিজ্ঞেস করতে, লোকটা ফ্যাসফেসে গলায় বলল–ফ্রেদারিকো।

–তুমি কি পর্তুগীজ? হ্যারি জিজ্ঞেস করলো।

–না স্প্যানিশ, তবে পর্তুগীজদের সঙ্গে থেকে-থেকে ওদের ভাষাতেই কথা বলা অভ্যেস হয়ে গেছে।

কথাটা বলে ফ্রেদারিকো কোমর থেকে কী বের করে মুখে দিয়ে চিবোতে লাগল। হ্যারি জিজ্ঞেস করল–কি চিবুচ্ছো?

–তামাকপাতা।

–এখানে তামাকপাতা পেলে কি করে?

ফ্রেদারিকো খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠল। মাথায় আঙুল ঠুকে বললো–বুদ্ধি-টুদ্ধি খরচ করলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

তারপর আস্তে-আস্তে বললো–ঐ যে পাহারাদারটাকে দেখছো পাথরের মত মুখ, মনে হয় দয়া-মায়া বলে কোন জিনিস ওর মনে নেই।

–ওর মুখ দেখে তো তাই মনে হয়।

–ঠিক। কিন্তু ওরও বৌ-ছেলেমেয়ে আছে। ওর মনেও স্নেহ-ভালোবাসা আছে। ওর নাম বেঞ্জামিন। ও মাঝে মাঝে হাত দেখায়। একবার একদল জিপসীদের সঙ্গে আমি বেশ কিছুদিন ছিলাম। ভালই হাত দেখতে শিখেছিলাম। বেঞ্জামিন হাত দেখায়, আর আমি ওকে ওর বৌ-ছেলেমেদের খবরাখবর বলে দিই। ব্যাস, বেঞ্জামিন এতেই খুশি।

ফ্রেদারিকো একটু থেমে বললো একবার লিসবনের কাছে দিয়ে এই ক্যারাভেলটা যাচ্ছিল, আমি ওর হাত দেখে বললাম–তুমি শিগগীর বাড়ি যাও, তোমার ছেলের মরণাপন্ন অসুখ।

ও লা ব্রুশের কাছে ছুটি নিয়ে লিসবন ওর বাড়িতে ছুটে গেল। দেখল, সত্যিই ছেলেটি মারা যায় যায়। চিকিৎসা-টিকিৎসার পর ছেলেটি সুস্থ হ’ল। বেঞ্জামিন আবার ফিরে এল। ব্যস্। তারপর ওর কাছে আমার কদর বেড়ে গেল। যা চাই, তাই এনে দেয়। লুকিয়ে আমার জন্য মাংস-টাংস নিয়ে আসে।

–তাহলে তো ওর সাহায্যে তুমি পালাতেও পারো।

–তা’ পারি। কিন্তু লা ব্রুশ মাঝে-মাঝেই আমার কাছে আসে। প্রতিদিন আমার খোঁজ করে। যদি কোনদিন এসে দেখে আমি পালিয়েছি, প্রথমেই বেঞ্জামিনের গর্দান যাবে। অন্য পাহারাদার যে দু’জন আছে, তাদের হাঙরের মুখে ছুঁড়ে ফেলে দেবে।

–লা ব্রুশ তোমার কাছে আসে কেন? হ্যারি জানতে চাইলো।

–সে অনেক ব্যাপার!

ফ্রেদারিকো আর কোন কথা বলল না। চোখ বন্ধ করে তামাকপাতা চিবুতে লাগল।

এক সময় হ্যারি লক্ষ্য করল ফ্রেদারিকো গলায় লকেটের মত ঝোলানো একটা কী যেন বের করল। তারপর মুখের কাছে ধরে দাঁত-মুখ খিচোতে লাগল। হ্যারি দেখলো, ওটা একটা আয়নার ভাঙা টুকরো। গলার সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা। একদিকের ভাঙা মুখটা ছুঁচলো। ফ্রেদারিকো আয়নাটার মুখ দেখছে আর ভেংচি কাটছে। ওর কান্ড দেখে হ্যারির হাসি পেলো। বললো–এই অন্ধকারে মুখ দেখতে পাচ্ছো?

–পারছি বৈ কি! ফ্রেদারিকো হাসলো–কিছুদিন থাকো, বেড়ালেরমত অন্ধকারে, তুমিও দেখতে পাবে। তখন আর আলো সহ্য হবে না। আলোর সামনে চোখ জ্বালা বা করবে। চোখ জলে ভরে যাবে।

হ্যারি ভাবল, সত্যিই দীর্ঘদিন এভাবে অন্ধকার কয়েদ ঘরে পড়ে থাকলে বাইরের আকাশ-মাটি-জলের কথা ভুলেই যেতে হবে।

ফ্রান্সিসদের কয়েদ ঘরের বন্দীজীবন কাটলো কয়েকদিন। দু’বেলা খাওয়া জুটল পোড়া পাউরুটি, আর আলু-মুলো এবং আনাজ মেশানো ঝোল। বেঞ্জামিনই ওদের খাবার দাবার জল দেয়। বেঞ্জামিনকে আরো দু’জন পাহারাদার সাহায্য করে। ফ্রেদারিকো কিন্তু মাংস, সামুদ্রিক মাছের ঝোল, এসব খেতে পায়। ওর বেলা বেশ ভালো ফুলকো রুটি। হ্যারি বুঝল, ফ্রেদারিকো বেঞ্জামিনের হাত দেখেই বেশ সুবিধে করে নিয়েছে।

ফ্রান্সিসদের কয়েদ ঘরের জীবন এভাবেই কাটতে লাগল। দিন যায়, রাত যায়। দিনরাতের পার্থক্যও ওরা ভালোভাবে বুঝতে পারে না! দরজার পেছনে অন্ধকার না থাকলে বোঝে দিন, আর ওদিকটা অন্ধকার হলে বোঝে রাত্রি। ফ্রেদারিকোর সঙ্গে হ্যারির আর কোন কথাবার্তা হয়নি, ফ্রেদারিকো শুধু তামাক পাতা চিবোয় আর ঝিমোয়। আর মাঝে-মাঝে আয়নার ভাঙা টুকরোটা বের করে মুখ দেখে। মুখ ভ্যাংচায়। আপন মনেই বিড়বিড় করে কী বলে আর ঝিমোয়।

***

একদিন। তখন দিনই হবে। কারণ গরাদ দেওয়া দরজার ওপাশে আলোর আভাস ছিল। হঠাৎ বেঞ্জামিন আর দু’জন পাহারাদারকে খুব সন্ত্রস্ত মনে হ’লো। বেঞ্জামিন এক সময় ফ্রেদারিকোর কানের কাছে মুখ নিয়ে কী কী সব ফিফিস্ করে বলে গেল।

একটু পরেই গারদ দরজার কাছে খট খট শব্দ উঠল। লা ব্রুশ আসছে বোঝা গেল। দরজা খুলে পাহারাদারেরা সরে দাঁড়াল। লা ব্রুশ কাঠের পাঠাতনে ঠক্‌ঠক্ শব্দ তুলে এগিয়ে এল। ওর হাতে একটা শঙ্কর মাছের চাবুক। আর কারো দিকে না তাকিয়ে লা রুশ ফ্রেদারিকোর সামনে এসে দাঁড়াল। গম্ভীরগলায় ডাকল ফ্রেদারিকো।

–আজ্ঞে–ফ্রেদারিকো আস্তে-আস্তে উঠে দাঁড়াল। ও যেন কাঁপছে। কেমন ভীত-সন্ত্রস্ত ওর ভাবভঙ্গী।

–তাহলে কি ঠিক করলে। পনেরো দিন সময় চেয়েছিলে। সে সময় পেরিয়ে গেছে।

ফ্রেদারিকো ফ্যাসফেসে গলায় বলল–আমি সত্যিই কিছু জানি না।

–তুমি সব জানো। মুক্তোর সমুদ্র থেকে অক্ষত দেহে বেরোবার উপায় একমাত্র তুমিই জানো।

–আমি যা জানি সবই আপনাকে বলেছি।

ফরাসী ভাষায় গালাগাল দিয়ে লা ব্রুশ চাবুক চালাল। চাবুকের ঘায়ে ফ্রেদারিকো পড়ে যেতে-যেতে কোন রকমে দাঁড়িয়ে রইল। লা ব্রুশ ওর গলায় ঝোলানো লকেটের হাঁসের ডিমের মতো মুক্তোটা দেখিয়ে বলল, বল; এটা তুই কী করে আনলি?

ফ্রেদারিকো পিঠে হাত বুলোতে-বুলোতে বলল–ভাজিম্বাদের রাজার ভান্ডার থেকে চুরি করে এনেছি।

মিথ্যে বলছিস। লা ব্রুশ বাঘের মতো গর্জন করে উঠল। আবার চাবুক পড়ল ফ্রেদারিকোর গায়ে। একটা অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ উঠল ওর গলায়। একে বয়েসের ভারে জীর্ণ-শীর্ণ শরীর; তার ওপর এই চাবুকের মার। ফ্রেদারিকোর শরীর কাঁপছে তখন। ফ্রান্সিসের আর সহ্য হল না। ও দ্রুত উঠে দাঁড়াল হাতকড়া বাঁধা হাতটা তুলে বলল–ওকে আর চাবুক মারবেন না।

লা ব্রুশ তীব্র দৃষ্টিতে ফ্রান্সিসের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। তারপর দাঁত চাপাস্বরে বলল–তাহলে ওর মারটা তুমিই খাও।

প্রচন্ড জোর চাবুক চালিয়ে চলল ফ্রান্সিসের শরীরের উপর। চাবুকের আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্সিসের শরীর কেঁপে-কেঁপে উঠতে লাগল। কিন্তু ওর মুখ থেকে একটা কাতর ধ্বনিও বেরোল না। দাঁতে দাঁত কামড়ে মুখ বুজে চাবুকের মার সহ্য করতে লাগল। লা ব্রুশ এক সময় চাবুক মারা থামিয়ে হাঁপাতে লাগল। ফ্রান্সিস শরীরের অসহ্য ব্যথায় ভেঙে পড়ল না। সোজাসুজি লা ব্রুশের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। ফ্রান্সিসের ওপর এই অত্যাচার দেখে ভাইকিংদের রক্ত গরম হয়ে উঠল। শেকলে প্রচন্ড শব্দ তুলে সবাই উঠে দাঁড়াল। ফ্রান্সিসকে কয়েকজন ঘিরে দাঁড়াল। হ্যারি চেঁচিয়ে বলল–এবার আমাদের মারুন।

লা ব্রুশ একবার ওদের দিকে তাকাল। তীব্ৰদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর হাতের চাবুকটা কাঠের মেঝের ওপর ছুঁড়ে ফেলল। ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে ফ্রেদারিকোর দিকে তাকিয়ে বলল–এই শেষবার বলছি আর পনেরো দিন সময় দিলাম। এই শেষ। এর মধ্যেই আমরা চাঁদের দ্বীপে পৌঁছব। যদি অক্ষত দেহেমুক্তোর সমুদ্র থেকে মুক্তো আনার উপায় না বলিস, তাহলে হাঙরের মুখে ছুঁড়ে ফেলবো তোকে।

বলে লা ব্রুশ কাঠের পায়ে ঠক্‌ঠক্ শব্দ তুলে চলে গেল।

চাবুক কুড়িয়ে নিয়ে বেঞ্জামিন ক্যাপ্টেনের পেছনে-পেছনে চলে গেল।

ফ্রান্সিস বসে পড়ল। কিন্তু পেছনে হেলান দিয়ে বসতে পারল না। পিঠে অসহ্য যন্ত্রণা। হ্যারি ওর জামাটা তুলে ধরল। চাবুকটা পিঠের মাংস কেটে বসে গেছে। সারা পিঠে কালসিটে দাগ। কিন্তু ও চোখ বুজে চুপ করে বসে রইল। দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করতে লাগল।

রাত্রে খাবার সময় ফ্রান্সিস বুঝলো, জ্বর এসেছে। কিছুই খেতে পারল না। কুন্ডলী পাকিয়ে কাঠের পাটাতনের উপর শুয়ে রইলো। অসম্ভব শীত করছে। মাথাটা ভীষণ দপ দ করছে। পিঠের জ্বালাটা আরো বেড়েছে। ওর শরীরটা কুঁকড়ে যেতে লাগল। কিন্তু ও মুখ দিয়ে একটা শব্দ করলো না। তাই কেউ ওর শরীরের অবস্থাটা বুঝতে পারলো না। যখন ও খেতেও উঠলোনা, তখন হ্যারির মনে সন্দেহ হ’ল। ও হাতকড়ি বাঁধা দুটো হাত বাড়িয়ে ফ্রান্সিসের কপালে রাখলো। জ্বলে কপাল পুড়ে যাচ্ছে। হ্যারি ওর গালে গলায় হাত দিল। ভীষণ জ্বর উঠেছে। হ্যারি তাড়াতাড়ি ডাকল, ফ্রান্সিস।

প্রথম ডাকে সাড়া পেলো না। আবার ডাকল–বন্ধু—

ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে সাড়া দিতে হ্যারি বললো–শরীর খুব খারাপ লাগছে?

–জ্বর এসেছে। সেরে যাবে। স্পষ্ট বোঝা গেল যে ওর গলা কাঁপছে।

কিন্তু হ্যারি বুঝলো, জ্বর এত বেশি যে ফ্রান্সিসের বোধশক্তিও লোপ পেয়েছে। আর কিছুক্ষণ পরে ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। হ্যারি দ্রুত ভাবতে লাগল, ওষুধ কী করে পাওয়া যায়। জ্বরটা কমাতেই হবে। ও ফ্রান্সিসের শরীরের অবস্থা অন্য কয়েকজন ভাইকিংকে বললো, কিন্তু কেউ কোন উপায় বলতে পারলো না। ওরা অসহায়ভাবে ফ্রান্সিসের কুন্ডলী পাকানো শরীরের দিকে তাকিয়ে রইলো। হঠাৎ ওর নজর পড়লো ফ্রেদারিকোর ওপর। ফ্রেদারিকোও তখন থেকে একটানা গোঙাচ্ছে। শরীরের এই অবস্থায় ওর পক্ষে চাবুকের মার সহ্য করা সম্ভব হয়নি।

হ্যারি ভেবে দেখলো, একমাত্র ফ্রেদারিকোই পারে ফ্রান্সিসের জন্য ওষুধ আনতে। ও যদি বেঞ্জামিনকে বলে তাহলেই একটা উপায় হতে পারে। হ্যারি ঝুঁকে পড়ে ফ্রেদারিকোকে ডাকল, –ফ্রেদারিকো—ফ্রেদারিকো–।

ফ্রেদারিকোর মাথাটা বুকের ওপর ঝুঁকে পড়েছিল। এই অবস্থাতেই ও গোঙাচ্ছিল। আরো কয়েকবার ডাকতে ফ্রেদারিকো জলে ভেজা চোখ মেলে হ্যারির দিকে তাকাল।

হ্যারি বললো, ফ্রেদারিকো শোন। খুব বিপদ–ফ্রান্সিসের ভীষণ জ্বর এসেছে। আর কিছুক্ষণ এই জ্বর থাকলে ও অজ্ঞান হয়ে যাবে। শীগগির একটা উপায় বের করো।

–কার জ্বর এসেছে?

–যে ছেলেটি তোমার হয়ে চাবুক খেলো।

–এ্যাঁ বলো কি!

হ্যারি তখন আঙ্গুল দিয়ে ফ্রান্সিসের কুন্ডলী পাকানো শরীরটা দেখালো। ফ্রেদারিকো কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল–আমাকে বাঁচাতে গিয়ে–ঈস্! আমি কী করি এখন?

ফ্রেদারিকো নিজের কষ্টের কথাও ভুলে গেল।

–বেঞ্জামিন তো তোমার কথা শোনে, ওকে একবার বলে দেখো।

–ভালো বলেছে, কিন্তু ও কী অতটা করবে? রাতের খাওয়া হয়ে গেছে। এঁটো থালা, গ্লাস নিতে প্রহরী দু’জন এসেছে। বেঞ্জামিন ওদের পেছনে এসে দাঁড়াল। ওরা থালা নিয়ে বেরিয়ে গেলে দরজা বন্ধ করবে। প্রহরী দু’জন থালা গ্লাস নিয়ে চলে গেল। চকিতে ওদের যাওয়ার পথের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বেঞ্জামিন দ্রুতপায়ে ফ্রেদারিকোর কাছে এলো। নীচু হয়ে বসে ফিসফিস্ করে জিজ্ঞেস করলো ফ্রেদারিকো–কেমন আছো?

ফ্রেদারিকো মাথা নেড়ে বলল, আমার কথা বাদ দাও, ঐ ছেলেটাকে একটু দেখো তো, ভীষণ জ্বর এসেছে ওর।

বেঞ্জামিন একবার ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। তারপর কোন কথা না বলে উঠে চলে গেল।

ফ্রান্সিস তখন জ্বরের ঘোরে বেঁহুশ। ও যেন স্বপ্নের মত স্পষ্ট দেখতে পেলো, ওদের বাড়িটা বাগানটা সূর্যালোকে ঝম করছে। গাছপালা, ফুল কী, হাওয়া। উজ্জ্বল আলোয় ভরা মধ্য বসন্তের আকাশ। ও বাগানের দোলনায় দোল খাচ্ছে। হাস্যোজ্জ্বল মা’র মুখ। ওর দোলনা ঠেলে দিচ্ছে। ও উঁচুতে উঠে যাচ্ছে নেমে আসছে। ছোটবেলার একটা আলোকোজ্জ্বল দিন ও যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। একজন পরিচারিকা কী নাম যেন, ওর মাকে এসে ডাকলো। ওর মা চলে গেল। পরিচারিকাটি দোলনা ঠেলে দিতে লাগল। ফ্রান্সিস চাঁচাচ্ছে আরো উঁচুতে ঠেল, আরো উঁচুতে। পরিচারিকাটি ভীতস্বরে বলছে–না, কর্তামা বকবে। তবু সে বেশ জোরেই ঠেলতে লাগল। ফ্রান্সিসের চোখের সামনে আকাশ, সাদাটে মেঘ, ঘরবাড়ি, গাছ-বাগান সব দুলছে। গায়ে হাওয়া লাগছে। ও খুশীতে চিৎকার করছে। হঠাৎ ছবিটার উজ্জ্বলতা কমতে লাগল। আস্তে-আস্তে অন্ধকার হয়ে গেল চারিদিক। মাথাটা যেন যন্ত্রণায় ছিঁড়ে পড়ছে।

কয়েদ ঘরের লোহার দরজা খোলার শব্দ হলো। বেঞ্জামিন কী যেন একটা জিনিস লুকিয়ে নিয়ে আসছে। ও চুপিচুপি এসে ফ্রেদারিকোর হাতে একটা চিনেমাটির ছোট বোয়াম দিয়ে ফিফিস্ করে বললো–এটা ওর পিঠে আস্তে-আস্তে লাগিয়ে দাও, তুমিও লাগাও, সব সেরে যাবে। পরে ওটা নিয়ে যাবো। সাবধান, কেউ যেন না দেখে ফ্যালে। বলে কাঠের পাটাতনে কোন শব্দ না তুলে বেঞ্জামিন চলে গেলো।

হ্যারি বোয়ামটা ফ্রেদারিকোর হাত থেকে নিলো। তারপর আস্তে-আস্তে ফ্রান্সিসের পিঠে লাগিয়ে দিতে লাগলো। লাল আঠা-আঠা ওষুধটা। ওটা লাগাতেই ফ্রান্সিসের শরীর কেঁপে উঠলো। হ্যারি সাবধানে আলতো হাতে লাগাতে লাগলো। কেটে যাওয়া কালসিটে পড়া জায়গায় লাগানো শেষ হলো। কে জানে এটা কী ওষুধ? সারবে কিনা? এবার ফ্রেদারিকোর দিকে ফিরলো। ওর শতচ্ছিন্ন জামাটা সরিয়ে ওষুধটা লাগিয়ে দিল আস্তে আস্তে। ফ্রেদারিকো অস্পষ্ট স্বরে গোঙাতে-গোঙাতে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়লো। রাত বাড়তে লাগলো। আস্তে-আস্তে সবাই ঘুমিয়ে পড়তে লাগলো। শুধু হ্যারির চোখে ঘুম নেই। হাতকড়া বাঁধা হাতটা দিয়ে মাঝে-মাঝেই ফ্রান্সিসের কপালের উত্তাপটা দেখছে।

রাত গম্ভীর হতে বেঞ্জামিন পা টিপে টিপে এলো। ওষুধের বোয়ামটা নিয়ে চলে গেল খুব সাবধানে। দু’জন প্রহরীর দৃষ্টি এড়িয়ে।

সেই রাত্রির দিকে হ্যারির একটু তন্দ্ৰামত এসেছিল। ফ্রান্সিস বোধহয় পাশ ফিরে শুলো, তাই শেকলে শব্দ উঠলো। হ্যারির তন্দ্রা ভেঙে গেল। ও তাড়াতাড়ি ওর কড়া লাগানো হাতটা ফ্রান্সিসের কপালে রাখল। দেখলো, কপাল ঠান্ডা। বোধহয় জ্বর একেবারে ছেড়ে গেছে। ফ্রান্সিস অস্ফুটস্বরে হ্যারিকে ডাকতেই হ্যারি মুখ নীচু করে ওর দিকে তাকিয়ে বলল–কি?।

ফ্রান্সিস বললো–শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে।

–ও কিছু না–কয়েকদিন বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে–হ্যারি বলল।

তারপর কড়া লাগানো হাতটা দিয়ে ফ্রান্সিসের কপালে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। ফ্রান্সিস আবার ঘুমিয়ে পড়লো। হ্যারি আর ঘুমোল না। ফ্রান্সিসের কপালে মাথায় হাত বুলোত লাগলো।

সকাল হয়ে গেছে। সকলেই উঠে বসেছে। শুধু ফ্রান্সিস আধশোয়া হয়ে। শরীরের দুর্বলতাটা এখনও সম্পূর্ণ কাটে নি। ওদের সকালে বরাদ্দ খাবার আলুসেদ্ধ আর কফিপাতা মেশানো সূপ। সকলেই খাচ্ছে। ফ্রেদারিকো তখন হ্যারিকে জিজ্ঞেস করলো, তোমার বন্ধু কেমন আছে?

–মনে হচ্ছে জ্বরটা ছেড়েছে। তবে শরীরটা এখনও দুর্বল আছে।

–বন্ধুর নাম কি?

–ফ্রান্সিস।

ঠিক এই সময়ে বেঞ্জামিন খাবারের থালা নিয়ে এলো। ফ্রেদারিকো ইশারায় ওকে ডাকলো। কাছে আসতে মুখ বাড়িয়ে ফিসফিস করে বললো ঐ যে ছেলেটি ফ্রান্সিস, ওকে আমার সঙ্গে রাখো। বেঞ্জামিন সাবধানে চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিলো। তখন আর দু’জন প্রহরী খেতে গেছে। বেঞ্জামিন চাবি বের করে ফ্রান্সিসের কাছে এসে ওর হাতের কড়া খুলে দিল। তারপর বললো–তুমি ফ্রেদারিকোর পাশে থাকবে। এসো।

ফ্রান্সিস আস্তে-আস্তে উঠে ফ্রেদারিকোর পাশে বসলো। ওখানে ওর হাতকড়া আটকে দিয়ে বেঞ্জামিন চলে গেল। এবার হ্যারি আর ফ্রান্সিস ফ্রেদারিকোর পাশেই জায়গা পেল। ফ্রান্সিসও এটাই চাইছিল। কিন্তু বেঞ্জামিন তো কথা শুনবে না তাই ও কোন কথা বলেনি। ফ্রেদারিকোকে লা ব্রুশ মুক্তোর সমুদ্রের কথা জিজ্ঞেস করেছে। মুক্তোর সমুদ্র কী? কোথায় আছে এই মুক্তোর সমুদ্র? কথাটা শুনে পর্যন্ত ফ্রান্সিসের মনে তোলপাড় চলছে। ফ্রেদারিকোর পাশে বসতেই ফ্রেদারিকো ওর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল–তুমি আমাকে চাবুকের মার থেকে বাঁচিয়েছে ফ্রান্সিস, তোমার ঋণ আমি জীবনেও শোধ করতে পারবো না।

–পারবে! ফ্রান্সিস ক্লান্ত হাসি হেসে বলল।

–কি করে।

–যদি বলো মুক্তোর সমুদ্র ব্যাপারটা কি?

কথাটা শুনে ফ্রেদারিকোর মুখে ভয়ের ছায়া পড়ল। ভীতমুখে ও বললো না না–মুক্তোর সমুদ্রের কথা ভুলে যাও–ওখানে গেলে কেউ ফেরে না।

ফ্রান্সিস হাসল। তুমি বলো তো মুক্তোর সমুদ্র ব্যাপারটা কি?

–তুমি ওখানে যেতে চাও? ফ্রেদারিকো অবাক চোখে তাকাল।

–আগে শুনি তো।

–গেলেও ফিরে আসতে পারবে না।

–ঠিক আছে, ধরে নাও না আমার কৌতূহল হয়েছে।

ফ্রেদারিকো মুখ নীচু করে কী ভাবলো। তারপর বলল–দেখো লা ব্রুশকে আমি সবই বলেছি, কিন্তু মুক্তোর সমুদ্র থেকে অক্ষত দেহে বেরিয়ে আসবার ব্যাপারটা আজও আমার কাছে রহস্য থেকে গেল। কিন্তু লা ব্রুশের বিশ্বাস যে অমি সেটাও জানি। অথচ ঐ রহস্যটা যে ভেদ করা অসম্ভব, সেটা আমি ওকে বোঝাতে পারি নি।

ঠিক আছে–ফ্রান্সিস উঠে বসে বলল–তুমি যা জানো, বলো।

একটু থেমে ফ্রেদারিকো বলতে লাগলো–কত বছর আগেকার কথা আমি বলতে পারবো না। কারণ এখানকার এই নরকে দিন রাত্রির কোন পার্থক্য নেই। আমি প্রথম প্রথম দিনরাত্রের হিসাবের বহু চেষ্টা করেছি। পরে হাল ছেড়ে দিয়েছি।

ফ্রেদারিকো থেমে তার কোমরের গাঁট থেকে তামাকপাতা বের করে মুখে ফেলে চিবুতে চিবুতে বলতে লাগল–একবার চাঁদের দ্বীপের কাছাকাছি আমাদের জাহাজ এসেছিল। আমাদের জাহাজটা ছিল মালবাহী জাহাজ। গায়েরও জোরছিল, খাটতেও পারতাম খুব। ক্যাপ্টেন আমাকে খুব ভালোবাসতো। সেই প্রথম আমরা চাঁদের দ্বীপে যাচ্ছি।

–চাঁদের দ্বীপ কোথায়?

–আফ্রিকার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ডাইনী দ্বীপ, তারও দক্ষিণে।

–লা ব্রুশ যে সেদিন বলেছিল এই ক্যারাভাল ডাইনী দ্বীপে যাবে।

–তা-তো যাবেই। লা ব্রুশ সমস্ত লুঠের সম্পদ ঐ দ্বীপেই রাখে। তারপরেই ও যাবে চাঁদের দ্বীপে।

–ও। তারপর?

–চাঁদের দ্বীপের বন্দরটার নাম সোফালা। এই দ্বীপের অধিবাসীদের বলা হয় ভাজিম্বা। হলদে চামড়া, বেঁটেখাটো মানুষ এরা। সোফালা বন্দর থেকে প্রচুর তামাক আর মধু রপ্তানি হয়। আমাদের জাহাজ থেকে চিনি, ময়দা, কাপড়-চোপড় এসবের বদলে তামাক পাতা, মধু নেওয়া হলো। এসব বাণিজ্যের জন্য ভাজিম্বাদের রাজার অনুমতি নিতে হয়। রাজপ্রাসাদে গিয়ে রাজসভায় রাজার অনুমতি প্রার্থনা করতে হয়–এই। রীতি। কিন্তু এই চাঁদের দ্বীপের খ্যাতি অন্য কারণে। সেটা হলো এখানকার মুক্তোর সমুদ্র। এই অঞ্চল দিয়ে যে সব জাহাজ যায়, সেইসব জাহাজের লোকরা সকলেই এই মুক্তোর সমুদ্রের গল্প শোনে। কিন্তু কেউ জানে না সেই মুক্তোর সমুদ্র কোথায়। তবে এটা সবাই জানতে পারে, যে সেখানে গেলে কেউ ফিরে আসে না। পরে সেই মুক্তোর সমুদ্র আমি দেখেছিলাম। আসলে ওটা একটা ল্যাগুন। ভাজিম্বারাও বলে মুক্তোর সমুদ্র। মস্তবড় ঝিনুক-এর তলায় বড়-বড় মুক্তো। হাঁসের ডিম থেকে শুরু করে উটপাখির ডিমের মতো বড় সেই মুক্তো।

–বলো কি? ফ্রান্সিস আশ্চর্য হয়ে বললো। হ্যারিও কম অবাক হয় নি। বলো কি? এত বড় মুক্তো।

–সেই মুক্তোর সমুদ্র কী ঐ দ্বীপের মধ্যেই?

–হ্যাঁ–বলে ফ্রেদারিকো চুপ করে গেল। আর কোনো কথা না বলে চোখ বুজে তামাক পাতা চিবুতে লাগল। ফ্রান্সিস হ্যারি দু’জনেই অধীর হয়ে উঠলো। ফ্রান্সিস বলে উঠলো–তারপর?

ফ্রেদারিকো সেই চোখ বুজে তামাকপাতা চিবুতে লাগল। হ্যারি ওকে মৃদু ঝাঁকুনি দিল–ফ্রেদারিকো, কি হলো?

ফ্রেদারিকো পাতা চিবুনো বন্ধ করে চোখ মেলে ফ্যাফেসে গলায় বললো–এই জোয়ান বয়েসে তোমার জীবন শেষ হয়ে যাক, এটা আমি চাই না।

–সেটা আমরা বুঝবো। তুমি বলো। ফ্রান্সিস অধৈর্য হয়ে বলল। কিন্তু ফ্রেদারিকো সেই যে চুপ করলো আর একটি কথাও বললো না। ফ্রান্সিস আর হ্যারি অনেক ভাবে কথা বলাবার চেষ্টা করল, কিন্তু ফ্রেদারিকো মুখে একেবারে কুলুপ এঁটে দিল! সেই চোখ বুজে তামাক পাতা চিবুতে লাগল। শেষে ফ্রান্সিস আর হ্যারি হাল ছাড়লো।

এর মধ্যে ফ্রান্সিস সুস্থ হলো। বেনজামিনের ওষুধে খুব উপকার হতে কয়েকদিনের মধ্যেই আবার ও আগের মতো গায়ে শক্তি ফিরে পেল।

***

দিন যায়। ক্যরাভেলও চলেছে। কোনদিকে কোথায় যাচ্ছে, ফ্রান্সিসরা কেউ জানে । ওদের একঘেঁয়ে বন্দীজীবন কাটাতে লাগল। ফ্রান্সিস আর হ্যারি পালাবার কত ফন্দী বার করে, কিন্তু কোনটাই শেষ পর্যন্ত কার্যকরী করা যাবে না মনে হয়। ওরা হাল ছেড়ে দিয়ে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।

এদিকে ফ্রেদারিকোও আর মুক্তোর সমুদ্রের গল্প করে না। ঐ প্রসঙ্গ তুললেই ও চুপ করে যায়। চোখ বুজে তামাকপাতা চিবোয়। কখনও বা গলায় লকেটের মতো ঝোলানো ভাঙা আয়নাটায় মুখ দেখে, চোখ বড়-বড় করে নাম কুঁচকে ভেংচি কাটে। অন্য অনেক কথা বলে–ওর অতীত জীবনে জিপসিদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াবার গল্প বা জাহাজী জীবনের গল্প সব বলে। কিন্তু মুক্তোর সমুদ্রের কথা উঠলেই চুপ করে থাকে।

এক দিন। সকালই হবে তখন। হঠাৎ ক্যারাভেলটা যেন থেমে আছে মনে হলো। জলদস্যদের হাঁক-ডাক শোনা গেল। নোঙর ফেলবার ঘড়ঘড় শব্দ ভেসে এলো। সেই সঙ্গে পাখির