- বইয়ের নামঃ ফ্রান্সিস সমগ্র
- লেখকের নামঃ অনিল ভৌমিক
- বিভাগসমূহঃ সমগ্র
০১. সোনার ঘন্টা
সোনার ঘন্টা– ফ্রান্সিস কাহিনী – অনিল ভৌমিক
অনেকদিন আগের কথা। শান্ত সমুদ্রের বুক চিরে চলেছে একটা নিঃসঙ্গ পালতোলা জাহাজ। যতদূর চোখ যায় শুধু জল আর জল সীমাহীন সমুদ্র।
বিকেলের পড়ন্ত রোদে পশ্চিমের আকাশটা যেন স্বপ্নময় হয়ে উঠেছে। জাহাজের ডেক এ দাঁড়িয়ে সেইদিকে তাকিয়ে ছিল ফ্রান্সিস। সে কিন্তু পশ্চিমের আবিরঝরা আকাশ দেখছিল না। সে ছিল নিজের চিন্তায় মগ্ন। ডেক-এ পায়চারি করতে করতে মাঝে-মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ছিল। ভুরু কুঁচকে তাকাচ্ছিল, কখনো আকাশের দিকে, কখনো সমুদ্রের দিকে। তার মাথায় শুধু একটাই চিন্তা–সোনার ঘন্টার গল্প কি সত্যি, না সবটাই গুজব। নিরেট সোনা দিয়ে তৈরী একটা ঘন্টা–বিরাট ঘন্টা–এই ভূমধ্যসাগরের কাছাকাছি কোন দ্বীপে নাকি আছে সেটা। কেউ বলে সেই সোনার ঘন্টাটা নাকি জাহাজের মাস্তুলের সমান উঁচু, কেউ বলে সাত-আট মানুষ সমান উঁচু। যত বড়ই হোক–নিরেট সোনা দিয়ে তৈরী একটা ঘন্টা, সোজা কথা নয়।
এই ঘন্টাটা তৈরী করার ইতিহাসও বিচিত্র। স্পেন দেশের সমুদ্রের ধারে ডিমেলো নামে ছোট্ট একটা শহর। সেখানকার গীর্জায় থাকতো জনপঞ্চাশেক পাদ্রী। তারা দিনের বেলায় পাদ্রীর কাজকর্ম করতো। কিন্তু সন্ধ্যে হলেই পাদ্রীর পোশাক খুলে ফেলে সাধারণ পোশাক পরে নিতো। তারপর ঘোড়ায় চড়ে বেরুত ডাকাতি, লুটপাট করতে। প্রতি রাত্রে দশ পনেরোজন করে বেরুত। টাকা-পয়সা লুঠ করা তাদের লক্ষ্য ছিল না। লক্ষ্য শুধু একটাই–সোনা সংগ্রহ করা। শুধু সোনাই লুঠ করত তারা।
ধারে কাছে শহরগুলোতে এমন কি দূর-দূর শহরেও তারা ডাকাতি করতে যেত। ভোর হবার আগেই ফিরে আসত ডিমেলোর গীর্জায়। গীর্জার পেছনে ঘন জঙ্গল। তার মধ্যে একটা ঘন্টার ছাঁচ মাটি দিয়ে তৈরি করেছিল। সোনার মোহর বা অলংকার যা কিছু ডাকাতি করে আনত, সব গলিয়ে সেই ঘন্টার ছাঁচে ফেলে দিত। এইভাবে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর সোনা দিয়ে ছাঁচ ভরানো চলল।
কিন্তু ঘন্টা অর্ধেক তৈরি হবার পর কাজ বন্ধ হয়ে গেল। এত ডাকাতি হতে দেখে দেশের সব বড়লোকেরা সাবধান হয়ে গেল। তারা সোনা সরিয়ে ফেলতে লাগল। ডাকাতি করে সিন্দুক ভেঙে পাদ্রী ডাকাতরা পেতে লাগল শুধু রুপার মুদ্রা। মোহর বা সোনার অলংকারের নামগন্ধও নেই।
কি করা যায়? ডাকাত পাদ্রীরা সব মাথায় হাত দিয়ে বসল। সোনার ঘন্টাটা অর্ধেকহয়ে থাকবে? তারা যখন ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছে না, তখন একজন পাদ্রী খবর নিয়ে এল–দেশের সব বড়লোকেরা বিদেশে সোনা সরিয়ে ফেলছে জাহাজে করে। ব্যাস। অমনি পাদ্রী ডাকাতরা ঠিক করে ফেলল, এবার জাহাজ লুঠ করতে হবে। যেমন কথা তেমনি কাজ। এ একটা জাহাজ কিনে ফেলল তারা। তারপর নিজেদের মধ্যে থেকে তিরিশজন বাছাই করা লোক নিয়ে একদিন গভীর রাত্রে তারা সমুদ্রে জাহাজ ভাসাল। বাকি পাদ্রীরা গীর্জাতেই রইল। লোকের চোখে ধুলো দিতে হবে তো! ডিমেলোশহরের লোকেরা জানল-গীর্জার তিরিশজন পাদ্রী বিদেশে গেছে ধর্মপ্রচারের জন্য। কারো মনেই আর সন্দেহের অবকাশ রইল না।
দীর্ঘ তিন-চার মাস ধরে পাত্রী ডাকাতরা সমুদ্রের বুকে ডাকাতি করে বেড়াল। স্পেনদেশ থেকে যত জাহাজ সোনা নিয়ে বিদেশে যাচ্ছিল, কোন জাহাজ রেহাই পেল না। লুঠতরাজ শেষ করে ডাকাত পাদ্রীরা ডিমেলো শহরের গীর্জায় ফিরে এল। জাহাজ থেকে নামানো হল সোনাভর্তি বাক্স। দেখা গেল কুড়িটা কাঠের বাক্স ভর্তি অজস্র মোহরআর সোনার অলংকার। সবাই খুব খুশী হল। যাক এতদিনে ঘন্টাটা পুরো তৈরী হবে।
ঘন্টাটা সম্পূর্ণ তৈরী হল। কিন্তু মাটির ছাঁচটা ভেঙে ফেলল না। ছাঁচ ভেঙে ফেললেই তো সোনার ঘন্টাটা বেরিয়ে আসবে। যদি সোনার ঝকমকানি কালোর নজরে পড়ে যায়।
তারপরের ঘটনা সঠিক জানা যায় না। তবে ফ্রান্সিস বুড়ো নাবিকদের মুখে গল্প শুনেছে, ডাকাত পাদ্রীরা নাকি একটা মস্তবড় কাঠের পাঠাতনে সেই সোনার ঘন্টা তুলে নিয়ে জাহাজের পেছনে বেঁধে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছিল। সোনার ঘন্টার গায়ে ঘন কালো রং লাগিয়ে দিয়েছিল যাতে কেউ দেখলে বুঝতে না পারে যে ঘন্টাটা সোনার। ভূমধ্যসাগরের ধারেকাছে এক নির্জনদ্বীপে তারা সোনার ঘন্টাটা লুকিয়ে রেখেছিল। তারপর ফেরার পথে প্রচন্ড ঝড়ের মুখে ডাকাত পাদ্রীদের জাহাজ ডুবে গিয়েছিল। একজনও বাঁচেনি। কাজেই সেই নির্জন দ্বীপের হদিস আজও সবার কাছে অজানাই থেকে গেছে।
–এই যে ভায়া।
ফ্রান্সিসের চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল। ভুঁড়িওলা জ্যাকব কখন কাছে এসে দাঁড়িয়েছে ও বুঝতেই পারেনি। জ্যাকব হাসতে হাসতে বলল–ভুরু কুঁচকে কি ভাবছিলে অত?
ফ্রান্সিস নিঃশব্দে আঙুল দিয়ে পশ্চিমের লাল লাল আকাশটা দেখল।
–ওখানে কি? জ্যাকব বোকাটে মুখে জিজ্ঞেস করল।
–ওখানে–আকাশে কত সোনা–অথচ সব ধরাছোঁয়ার বাইরে। জ্যাকব এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বাজখাই গলায় হেসে বললো–ফ্রান্সিস তোমার নির্ঘাৎ ক্ষিদে পেয়েছে, খাবে চলো।
খেতে বসে দুজনে কথাবার্তা বলতে লাগল। ফ্রান্সিস জাহাজের আর কোন নাবিকের সঙ্গে বেশী মিশতনা। ওর ভালও লাগত না। কিন্তু এই ভুঁড়িওয়ালা জ্যাকবের সঙ্গে ওর খুব, বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। ও জ্যাকবের কাছে মনের কথা খুলে বলত।