বিড়ি খাওয়াটা এখন আর রঘুনাথের কাছে কোনো সমস্যা নয়। সে খুড়া, দাদু, এমন কি বাপের সামনেও বিড়ি টানে। দুর্গামণিরও বিড়ির নেশা জব্বর, আগে সে চাষ-কাজে যেত মাঠে তখন গোটা দশেক লাল সুতোর বিড়ি না হলে কাজে তার মন বসত না। গুয়ারাম সতর্ক করত, অত খাসনে রে বউ, ফুসফুস ঝাঁঝরা হয়ে যাবে। নেশা রঘুনাথের জীবনে বুড়িগাঙের জলের মতো ছুঁয়ে আছে, এর থেকে বেরিয়ে আসার কোনো উপায় নেই, নেশা যেন পাখি ধরার ফাঁস হয়ে চেপে বসেছে গলার উপর।
পাকুড়তলায় আর দাঁড়াল না সূর্যাক্ষ, তার তাড়া আছে, রঘুনাথকে সঙ্গে নিয়ে তাকে আবার গাঁয়ে ফিরতে হবে, না হলে চিন্তায় ভেঙে পড়বে মীনাক্ষী। কপোতাক্ষ সাধারণত ঘরে খুব কম থাকে, বাঁধে-বাঁধে সাইকেল নিয়ে তিনি চলে যান কদবেলতলা ধাওড়া, হলদেপোতা, কমলবাটি আর বসন্তপুর ধাওড়া। মানুষগুলোর প্রতি যত দিন যাচ্ছে তার দায়িত্ব বাড়ছে। সূর্যাক্ষকে তিনি বলেছেন, তৈরি থাকো। শ্ৰেণী-সংগ্রাম আবশ্যক। আমাদের লড়াই করে সুখ-সম্পদ ছিনিয়ে নিতে হবে। ব্রিটিশ পরবর্তী সামন্তপ্রভুরা আমাদের হাতে ভালোবেসে ক্ষীরের সন্দেশ তুলে দেবে না।
কপোতাক্ষর কথাগুলো বড়ো অস্পষ্ট আর ধোঁয়াশা লাগে সূর্যাক্ষর। সংগ্রাম কথাটার অর্থ সে সঠিক জানে না। কদবেলতলা ধাওড়ার বিদুর রাজোয়ার গলার রগ ফুলিয়ে বলে, এ অত্যাচার বঞ্চনা বেশি দিন চলতে পারে না। আগে আমরা এক গালে চড় খেয়ে অন্য গাল বাড়িয়ে দিয়েছি। এখন যুগ পাল্টাচ্ছে। চড়ের বদলে লাথি মারতে হবে ওদের। আমি লেনিন পড়িনি, মার্ক পড়িনি। ওরা কে আমি জানি নে। জানার দরকারও নেই। আমি শুধু জানি-লাঙ্গল যার, জমি তার। যে ভাগের জমি কেড়ে নিতে আসবে তার কাটামুণ্ডু জমির আলে শুইয়ে দেব আমরা।
বুনোপাড়ার ঘরগুলোয় টিমটিম করে বাতি জ্বলে। বেশির ভাগই লম্ফো, ডিবিরি, সলতে পাকানো তেলের প্রদীপ। একমাত্র লুলারামের ঘর ছাড়া আর কারোর ঘরে হ্যারিকেন নেই। ফলে একটু বেশি হাওয়া বইলে বাতি নিভে যায়, ঘুরঘুটি অন্ধকার হামলা চালায় বিনা বাধায়। এভাবেই বছরের পর বছর চলছে। এখনও কারোর কেরোসিন তেল কেনার সামর্থ হল না। দারিদ্রসীমার অনেক নীচে বাস করে ওরা। মাঝে মাঝে রঘুনাথের এসব দৃশ্য দেখতে ভালো লাগে না, তার মাথায় বিষপোকা কামড়ে দেয়, বড়ো বড়ো শ্বাস ছেড়ে সে দুর্গামণির মুখের দিকে তাকায়, কথা আটকে যায় তার মুখগহ্বরে।
সাইকেলটা উঠোনে ঢুকিয়ে বড়ো করে শ্বাস ছাড়ল সূর্যাক্ষ। তার কানে ভেসে এল ঢিলির এলোমেলো গানের স্বরলিপি। গরমটা আজ একটু কম তবু ঢিলির গানের কোনো বিরাম নেই।
এসব এড়িয়ে রঘুনাথ মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াল, হাঁ দেখ মা, কী এনেচি তুর জন্যি।
–হায় বাপ, কুথায় পেলিরে এমুন বাবু জিনিস? বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠে গেল দুর্গামণির।
রঘুনাথের মোটা ঠোঁটে গর্বিত হাসি, বল খেলতে গিয়েচিলাম, বাবুরা দেলে গো! রঘুনাথ হঠাৎ করে সূর্যাক্ষর দিকে তাকাল, ওকে বসতে না বলার জন্য মনে মনে অনুতপ্ত হল সে। এক সময় নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল, মারে, আজ আমি ঘরে খাবনি। সূর্য আমারে লিতে এয়েছে। আমি ওর ঘরে গিয়ে খাবো।
–সে তো মানলাম কিন্তু অত রাতে আসবি কী করে? দুর্গামণির কপালে চিন্তার রেখাগুলো নেচে উঠল।
সূর্যাক্ষ এদের আলোচনায় অংশ নিল, কাকিমা, রঘু আজ ফিরবে না। খেয়ে-দেয়ে রঘু আর আমি এক সাথে ঘুমিয়ে যাবো।
-রঘু যে যাবে তুমার মা জানে?
-হ্যাঁ, মা-ই তো বলেছে রঘুকে নিয়ে যেতে। সূর্যাক্ষ বোঝাল, রঘু না গেলে মা মন খারাপ করে বসে থাকবে।
একটা অস্বস্তি দুর্গামণির গলায় ঘোঁট পাকাচ্ছিল, তার থেকে মুক্তি পেতে সে নির্দ্বিধায় বলল, তুমি খাটে শুয়ে, আমার ঘরের রঘুরে নীচে বিছানা করে দিবে।
-তা কেন হবে? আমরা তো এক সাথে ঘুমোবো। ঘুমাতে ঘুমাতে কত গল্প হবে। সূর্যাক্ষ যেন সব দেখতে পেল।
-কী জানি বাবা, আমার ডর লাগে। দুর্গামণি পানসে হাসি দিয়ে নিজের ভয়টাকে লুকাতে চাইল। যুগ বদলেছে কিন্তু তার কোনো আলো ওদের পাড়ার উপর পড়ে নি। এখনও গাঁওবুড়ো রাজ করে চলেছে। চাপা কলটা খারাপ হয়ে গেলে সারাবার লোক আসে না বিডিও অফিস থেকে। অনেকেই গায়ে ছোঁয়া লাগলে ঘেন্নায় নাক কুঁচকায়, দিলি তো ছুঁয়ে, এখন আমাকে ফিরে নাইতে হবে।
এখনও পাল-খেদানোর মুড়ি দেয় গেরস্থ। এমনভাবে দেয় যাতে ছোঁয়া না লাগে শরীরে। দুর্গামণি সব বুঝলেও মুখে তার কোনো ভাষা নেই, শুধু চোখের জল আগুনের অক্ষর হয়ে ঝরে পড়ে!
আঁচলে চোখের জল মুছে নিয়ে দুর্গামণি উদাস হয়ে গেল, তুর দাদুরে বলে যাবিনে? ঘরে এসে বুড়ামানুষটা কি ভাববে বল তো? শেষবেলায় আমাকে গাল মন্দ করবে।
দাদু কুথায়? রঘুনাথের প্রশ্নে দুর্গামণি আঁধার পথের দিকে তাকাল, সে গিয়েছে দুলাল ঠাকুরপোর ঘরে। তার সাঁঝবেলায় আসার কথা। তুর বাপের খপর না পেলে বুড়াটা মনে হয় পাগল হয়ে যাবে।
–পাগল হওয়ার কি আছে, মা? রঘুনাথের অবাক চোখে প্রশ্ন বিছিয়ে গেল।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কষ্ট করে হাসল দুর্গামণি, ও তুই বুঝবিনে বাপ, বড় হ, তারপর বুঝবি। এট্টা ধানে যে এট্টা চাল হয়–এ হিসাবের মতো জেবনটা অত সহজ নয়। বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল চুনারাম, আঁধারে সে সাহস করে বেরিয়ে ফেঁসে গেছে। রাতকানা মানুষের এই এক সমস্যা।