–না ভাই, ছোটবেলার কথা ছেড়ে দাও। এখন কি আর তোমাদের সঙ্গে আমার মেলে?
তাহাদের পুরানো ভিটার দিকের বকুল গাছটা হইতে একটা নিমপেঁচা ডাকিয়া উঠিল। উঠানে জ্যোৎস্নায় গাছপালার পাতা আর ডালের ছায়া পড়িয়া কাঁপিতেছে।
কাজল বলিল—বিকেলে আমাদের ভিটের দিকে গিয়েছিলাম, দেখলাম অনেকখানি জমি কারা বেড়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে—তুই এ ব্যাপারে কিছু জানিস?
চনু অকারণেই একটু গরম হইয়া বলিল—আমি ঘিরেছি। আমাদের জমি আছে, তাই ঘিরেছি। কেন, তাতে কী হয়েছে?
-রাগ করছিস কেন ভাই? আমি কি অন্যায় কিছু বলেছি? ওদিকটায় তোর কিছুটা জমি আছে সে আমি জানি, কিন্তু দেখে মনে হল আমাদের কিছু জমি তোর দেওয়া বেড়ার মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। তাই
–তাই কী? তুমি ভুল করছে, ওখানে তোমার কোনো জমি নেই–
কাজল দুঃখিত গলায় বলিল—আছে কিনা সে আমরা দুজনেই জানি। মনের অগোচরে তো কোনো সত্য গোপন থাকে না। তুই এমন করলি কেন? আমাকে একবার খবর দিলে তো পারতিস! তোর জমির প্রয়োজন থাকে, আমি তোকে অন্য জায়গায় জমি দিতাম। বাবা মারা যাবার আগে গ্রামে কিছু জমি মায়ের নামে কিনে দিয়ে গিয়েছিলেন, তার থেকে দিতাম। তোর পছন্দমত প্লট বেছে নিতে পারতিস, আমি টাকা নিতাম না। তুই ছোটবেলার বন্ধু হয়ে আমার সঙ্গে এমন করলি?
–অন্য জায়গায় জমি নিয়ে আমি কী করবো? বাড়ির লাগোয়া না হলে আমার চলবে না। তাছাড়া আমি কোনো অন্যায় করিনি–জমি আমার।
–পুরোনো ভিটের পাশে পৌনে একবিঘে জমির টুকরোটা কি করে তোর হল চনু?
চনু বলিল—এটা তোমার বাবা আমার মাকে দান করেছিলেন। আমার কাছে কাগজ আছে—
কাজল প্রথমটা এত অবাক হইয়া গেল যে তাহার মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না, তাহার পর সে বলিল—কাগজ আছে? কী কাগজ? পাকা দলিল, না দানপত্র?
-কেন, পাকা দলিল না হলে কি তুমি মানবে না?
—তা নয়, বাবা যদি সাদা কাগজেও কাউকে কিছু লিখে দিয়ে থাকেন আমি তার মর্যাদা দেব। কই সে কাগজ?
চনু বলিল—আজ রাত্তিরে খুঁজে বার করতে পারব না। কাল সকালে এসো, দেখাব।
নিমপেঁচাটা আবার ডাকিয়া উঠিল।
জ্যোৎস্নাভরা এই উঠানে সে আর চনু ছোটবেলায় খেলা করিত। তে হি নো দিবসাঃ গতা।
কাজল বলিল—আচ্ছা ভাই উঠি। কাল সকাল আটটা নাগাদ একবার আসব, দেখাস কাগজখানা। বাবা যদি সত্যি ও জমি তোদের লিখে দিয়ে থাকেন, তাহলে অন্তত আমার দিক থেকে তোর কোনো চিন্তা নেই। চলি।
হেমন্তরাত্রিতে হালকা কুয়াশার আররণে তাহাদের গ্রামের কী অপূর্ব রূপই না বিকশিত হইয়াছে! হায় রে, ইহার সঙ্গে মানুষগুলিও যদি ভালো হইত! সংকীর্ণ পরিধির মধ্যে ইহাদের মন সঠিকভাবে বাড়িয়া ওঠে নাই, এই গ্রামের দিগন্তেই তাহাদের জীবনের দিগন্তের সীমা। সংস্কৃত উপকথার সেই যাযাবর হাঁসেদের কথা মনে পড়িল, যাহারা মানস সরোবর যাইবার পথে বাংলাদেশের এক গ্রামে একটি ছোট পুকুরের ধারে রাত্রির আশ্রয় লইবার জন্য নামিয়াছিল। স্থানীয় গ্রাম্য হাঁসেরা বুঝিতে পারিল না, এত কষ্ট করিয়া তাহারা কেন মানস সরোবরে যাইতেছে, কী আছে সেখানে? যাযাবর হাঁসেরা হিমালয়ের পর্বতশৃঙ্গ, তুষার আর অপার্থিব সৌন্দর্যের বিবরণ দিল। শুনিয়া গ্রাম্য হাঁসেরা হাসিয়া আকুল। সেখানে তাহাদের পুকুরের মতো গুগলি পাওয়া যায় কি? তাহা না হইলে এত কষ্ট করিয়া কী লাভ?
রানুপিসিদের বাড়ির পথে বাঁশবাগানটায় ঢুকিয়া কাজল দাঁড়াইয়া পড়িল।
এমন সৌন্দর্যময় রাত্রিও পৃথিবীতে আসে! চারিদিক নিঃশব্দ, কেবল দূরে কাহাদের বাড়িতে একটা কুকুর ডাকিতেছে। জ্যোৎস্নায় বাঁশপাতার নকশাকরা ছায়া মাটিতে পড়িয়াছে। বাতাসে আসন্ন শীতের মনোরম স্পর্শ আর কীসের যেন মৃদু সুগন্ধ। কবেকার সব কথা যেন মনে পড়িয়া যায়, তাহার জন্মেরও আগে ঘটিয়া যাওয়া সেসব ঘটনা কী করিয়া তাহার চেতনায় ধরা দিতে পারে তাহা সে বুঝিতে পারে না, কিন্তু কেমন একটা মেদুর অনুভূতি হয় সে কথা সত্য। জীবনের পটভূমি অকস্মাৎ অনেক বিস্তৃত হইয়া যায়। সে কেবল তাহার গৃহাঙ্গনে, ভারতবর্ষে কিংবা পৃথিবী নামক এই গ্রহটায় বাস করে না, বিশাল অনন্ত বিশ্ব সমস্ত নক্ষত্র নীহারিকাসহ তাহার অস্তিত্বের অংশ, এই সুন্দর জ্যোৎস্নাময়ী রাত্রি সেই মহত্তর জীবনের সংবাদ পৌঁছাইয়া দিতেছে। আনন্দ—আনন্দেই মুক্তি, আনন্দেই সত্যকার বাঁচিয়া থাকা।
পরের দিন চনু তাহাকে একটা ময়লা কাগজের টুকরা হাতে দিয়া বলিল—এই যে, পড়ে দেখ—
কাজল হাসিবে কী কাঁদিবে ঠিক করিতে পাবিল না। বহু ভাঁজ হওয়া একটা নোংরা কাগজ, তাহাতে আঁকাবাঁকা অক্ষরে, ভুল বানানে একখানি হিজিবিজি জমি দানের প্রতিশ্রুতি। নিচে লেখা— অপূর্বকুমার রায়। এই হস্তাক্ষর কখনওই তাহার বাবার নহে। স্বাক্ষরের নিচে যে তারিখ, তাহার দেড় বৎসর আগেই তাহার বাবা মারা গিয়াছে। বেচারা চনু! গ্রাম্যবুদ্ধিতে সঠিক হিসাব করিয়া উঠিতে পারে নাই। এরূপ ভৌতিক দানপত্র সহসা দেখা যায় না।
কাগজটা চনুর হাতে ফেরত দিয়া কাজল বলিল—চনু, আমার এক মাস্টারমশাই বলতেনসত্যি কথা বলতে প্রয়োজন সাহসের, আর মিথ্যে কথা বলতে বুদ্ধির। ঠিক বলতেন না?
-কী বলতে চাও তুমি?
–কিছুই না। এটা আমার বাবার হাতের লেখা নয়।
–আমি এই কাগজ জাল করেছি বলতে চাও?
–সেটা তো আমার চেয়ে তুই-ই ভালো জানিস। তাছাড়া এমন একটা লেখাকে দানপত্রও বলে না। আইনের চোখে এ জিনিস টিকবে বলে মনে হয় না। এতে অনেক গোলমাল রয়েছে।