- বইয়ের নামঃ সরস গল্পসমগ্র
- লেখকের নামঃ তারাপদ রায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
অদূরভাষ
অনেকদিন পরে দুই বাল্যবন্ধুর দেখা। অনেকদিন মানে প্রায় চল্লিশ বছর।
এক ভদ্রলোক দুজনের পরিচয় করিয়ে দিলেন ইনি হচ্ছেন মি. এস চাকলাদার, বিখ্যাত সলিসিটর। আর ইনি মি. এম হালদার, হালদার এক্সপোর্ট অ্যান্ড ইমপোর্ট কোম্পানির চেয়ারম্যান।
এতক্ষণ দুজন দুজনকে লক্ষ করছিলেন, কেমন যেন চেনা চেনা হাজার হলেও বাল্যবন্ধু তো। এবার পরিচিত হতে দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরলেন, আরে তুই ভ্যাবল না? আরে তুই ক্যাবল না?
সেই কবেকার প্রাণের বন্ধু, তদুপরি এই এতকাল পরে দেখা এবং সেই সঙ্গে কিঞ্চিৎ সুরাপানের ফলে আলিঙ্গন খুবই দীর্ঘ হল।
আনন্দ-উচ্ছ্বাস কমার পর দুজনে কথাবার্তা হল। এতকাল দেখা না হলেও পুরনো বন্ধুবান্ধবদের সূত্রে ভ্যাবল ক্যাবলের সম্পর্কে এবং ক্যাবল ভ্যাবলের সম্পর্কে খোঁজখবর রাখে।
ভ্যাবলরা কলকাতার পুরনো লোক। তাদের চার পুরুষের ওকালতি ব্যবসা, সলিসিটর ফার্ম। ক্যাবলের বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরে, সে যখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে সেই সময় তার বাবা বদলি হয়ে দিল্লি চলে যান। সেই থেকে ভ্যাবল ক্যাবলের ছাড়াছাড়ি।
ভ্যাবল পৈতৃক সলিসিটর ফার্মে ঢুকেছে। ক্যাবল লেখাপড়া শেষ করে এক্সপোর্ট ইমপোর্টের ব্যবসায় ঢুকেছে, কলকাতাতেই কর্মস্থল। দুজনেই মোটামুটি সফল।
কিছুক্ষণ হাসি-গল্প, স্মৃতি রোমন্থনের পর যথারীতি পরস্পর কার্ড বিনিময় হল। স্থির হল, আবার দেখা হবে। সামনের শুক্রবার সন্ধ্যায় ক্যাবলের বাড়িতে ভ্যাবল আসবে।
আজ শুক্রবার। তখন বেলা তিনটে। নিজের অফিসে বসে কাজ করতে করতে ক্যাবলের মনে হল, আজ সন্ধ্যাবেলায় আসার ব্যাপারটা ভ্যাবলকে একবার মনে করিয়ে দেওয়া ভাল।
সেদিনের সেই কার্ডটা মানিব্যাগের মধ্যে ছিল। সেটা বের করল সে। এস চাকলাদার, চাকলাদার, চাকলাদার অ্যান্ড চাকলাদার কোং এই কার্ডটাই কি ভ্যাবলের? একটু চিন্তা করতে ক্যাবলের মনে পড়ল, সেদিন যিনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, চাকলাদারই বলেছিলেন এবং ভ্যাবলদের পদবি যেন চাকলাদারই ছিল, এরকম পদবি শেষ পর্যন্ত মনে থাকে। কিন্তু এস চাকলাদারের এস-টা যে কী, কিছুতেই মনে পড়ল না। আবছা আবছা খেয়াল হচ্ছে মহাভারতের একটা চরিত্রের নাম।
ভাবতে ভাবতে ক্যাবল টেলিফোনের ডায়াল ঘুরিয়েছেন:
-হ্যালো।
–হ্যালো।
–হ্যালো, এটা কি চাকলাদার, চাকলাদার অ্যান্ড চাকলাদার কোম্পানির অফিস?
–কটা চাকলাদার বললেন?
–সে আবার কী?
–যদি তিনটে চাকলাদার হয়, তবে এটা সেই অফিস। আর যদি চারটে চাকলাদার হয় তবে সেটা এখানকার সাহেবদের জ্ঞাতিভাইদের অফিস, এ বাড়ির ওপাশে।
–মানে?
(নিচু গলায়) মানে আর কী? জ্ঞাতিশত্ৰু, কর্তারা ভিন্ন হয়ে গেছেন? দুই কোম্পানির দারুণ ঝগড়া।
–তা বুঝলাম। আমি কার্ডে গুনে দেখছি ঠিকানায় তিনটে চাকলাদার লেখা আছে। এই অফিসই হবে, আপনি মিস্টার চাকলাদারকে একটু লাইনটা দেবেন?
–কোন চাকলাদার? সাহেবরা তো সবাই চাকলাদার।
মিস্টার এস চাকলাদার।
সুবিধে হচ্ছে না। এ বাড়িতে সবাই তো এস চাকলাদার, পুরো নাম বলতে পারেন?
–দেখুন, ঠিক মনে করতে পারছি না। চার অক্ষরে নাম, মহাভারতের একটা চরিত্রের নামে নাম।
–আরে মশায় এটা সলিসিটর অফিস। ওসব হেঁয়ালি ধাঁধা করবেন না।
প্রায় স্বগতোক্তি) কী করা যায়।
–আচ্ছা, শুনুন। আমি আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করছি। আপনি কাকে চাইছেন, সিনিয়র পার্টনার বা জুনিয়র পার্টনার, ওয়ার্কিং পার্টনার না স্লিপিং পার্টনার, কাকে?
–তা আপনাদের সিনিয়র পার্টনারের বয়েস কত হবে?
–ঠিক বলতে পারব না। সত্তর-পঁচাত্তর তো হবেই।
জুনিয়র পার্টনার?
–পঞ্চাশ।
কী নাম ওঁর?
–এস চাকলাদার।
–আপনি তো বললেন শুধু এস বললে হবে না। পুরো এস-টা কী?
সহদেব। মি. সহদেব চাকলাদার।
-ইউরেকা। ইউরেকা। ওই সহদেবই তো মহাভারতের চরিত্র। জুনিয়র পার্টনার সাহেবকে দয়া করে লাইনটা দিন।
–স্যারকে কী বলব?
বলুন হালদার এক্সপোর্ট অ্যান্ড ইমপোর্টের চেয়ারম্যান কথা বলবেন।
–(একটু পরে) স্যার বলছেন, উনি আপনাকে ঠিক চিনতে পারছেন না।
বলুন, এম. হালদার।
একটু পরে) না উনি তো চিনতে পারলেন না। আচ্ছা আপনি সরাসরি সাহেবের সঙ্গে কথা বলুন।
–হ্যালো, আমি চাকলাদার, চাকলাদার অ্যান্ড চাকলাদার কোম্পানির জুনিয়র…
–আরে তুই তো ভ্যাবলা।
–আরে তুই তো ক্যাবলা।
সন্ধ্যাবেলায় তোর বাড়িতে যাচ্ছি তো। ফোন কেন?
–ঠিক আসছিস তো?
নিশ্চয়।
–দেখা হবে।
অন্য এক মাতালের গল্প
প্রত্যেক শুক্রবার কিশোর তারকেশ্বরে যায়।
না, কোনও ধর্মকর্ম করতে সে যায় না। ভোলাবাবার ওপর তার অগাধ বিশ্বাস, যত কাজই থাক তারকেশ্বরে গেলে অন্তত একবার সে মন্দিরের দেওয়ালে মাথা ছুঁইয়ে আসে। কিন্তু সে শুক্রবার শুক্রবার তারকেশ্বরে যায় ব্যবসার খাতিরে। তারকেশ্বরের কাছেই ময়নাপাড়ায় তার কোন্ড স্টোরেজ, পাশাপাশি দুটো। একটা বাবা তারকেশ্বরের নামে–দি নিউ ভোলাবাবা কোল্ড স্টোরেজ।
প্রথমে অবশ্য এটার ভোলাবাবা কোল্ড স্টোরেজ নামই দিয়েছিল কিশোর, কিন্তু পরে জানতে পারে যে আশেপাশে আরও তিনটি ভোলাবাবা কোল্ড স্টোরেজ, ভোলেবাবা কোল্ড স্টোরেজ ভোলেবাবা কোল্ড স্টোরেজ রয়েছে। তখন সে বাধ্য হয়ে নাম পালটিয়ে দি নিউ ভোলাবাবা কোল্ড স্টোরেজ নামকরণ করে।
দ্বিতীয়টির নাম নিয়ে কিশোরের অবশ্য কোনও অসুবিধেই হয়নি।
অসুবিধে হওয়ার কথাও নয়। কিশোরের প্রাণাধিকা পত্নী শ্যামা শতকরা একশোভাগ লক্ষ্মী। শ্যামার সঙ্গে পরিণয়ের পর থেকেই কিশোরের রমরমা।
তার একটা কারণ অবশ্য শ্যামার কৈশোর এবং যৌবন ইতিহাস খুব প্রাঞ্জল ছিল না, কিন্তু শ্যামার বাবার টাকা ছিল। কিশোর এসব কিছু না ভেবেচিন্তে শুধু শ্যামার রূপসুধা পান করে এবং শ্যামার পিতৃদেবের দশ লক্ষ টাকার নিরভিমান পণ গ্রহণ করে শ্যামার পাণিগ্রহণ করেছিল।
তারপর থেকে পরম আনন্দে কেটেছে তার দিন।
শুধু দিন নয়, কিশোরের রাতও পরম আনন্দে কেটেছে। রঙিন দেশলাই কাঠির মতো একেক সন্ধ্যায় কখনও সবুজ, কখনও লাল–একেক সায়াহ্নে গাঢ় নীল অথবা ঝকঝকে সাদা আলোর রেশনাই। শ্যামা তাকে অনেক দিয়েছে।
সুতরাং দ্বিতীয় কোল্ড স্টোরেজটির নামকরণ যখন কিশোর করল শ্যামা কোল্ড স্টোরেজ তার মন ও হৃদয় আত্মতৃপ্তিতে ভরে উঠল।
শুধু একটা অসুবিধে হয়েছিল, স্বয়ং শ্যামা সজোর প্রতিবাদ জানিয়েছিল, আমার বন্ধুরা আমাকে বলত গরম হাওয়া, আর তুমি আমাকে কোল্ড স্টোরেজ করে দিলে?
কিশোর সরল প্রকৃতির মানুষ। এতশত কথার কায়দা বোঝে না। দুটো আলুর কোল্ড স্টোরেজে মাসে পাঁচ-পাঁচ দশ হাজার টাকা, সন্ধ্যাবেলা আধ থেকে এক বোতল রঙিন রাম, তারপরে গৃহে শয়নে-স্বপনে শ্যামাসুন্দরী–এই তার জীবনের পরমার্থ।
আজ শুক্রবার। তারকেশ্বর যাচ্ছিল কিশোর। আজকাল লোকজনদের মোটেই বিশ্বাস করা যায়, তাই সপ্তাহের শেষ দিকটা নিজেই তারকেশ্বরে এসে হিসেবনিকেশ করে, টাকা আদায় করে দেনাপাওনা মেটায়।
কোল্ড স্টোরেজের লাগোয়া তার একটা সুন্দর বাংলো মতন ঘর আছে, সেখানে রাত্রিযাপন করে। কলকাতা থেকে আসার সময় দু-চার বোতল রাম সঙ্গে নিয়ে আসে। ব্যবসা চালাতে গেলে স্থানীয় মাস্তানদের, থানার বাবুদের একটু খুশি রাখতে হয়।
শনি-রবিবার কোল্ড স্টোরেজের আলুভাজা আর রাম। বিশ্রাম-ফুর্তিও হয় আবার পাবলিক রিলেশনও হয়।
কিন্তু আজ কিশোরের তারকেশ্বর যাওয়া হল না। দক্ষিণ আফ্রিকায় গণধর্ষণের প্রতিবাদে কোন্নগরের সুহৃদ বান্ধব সঙেঘর সদস্যরা বোমা, লাঠি নিয়ে রেললাইনের ওপরে বসে পড়েছে। শ্রীরামপুর থেকে এস ডি ও সাহেব পুলিশ সাহেব এসে অনেক বুঝিয়েছেন, তারা কথা দিয়েছেন যে ভবিষ্যতে যাতে এরকম আর কখনও না হয় তা তারা দেখবেন এবং নিশ্চয়ই এর প্রতিকারের ব্যবস্থা করবেন।
কিন্তু সুহৃদ বান্ধব সঙেঘর সদস্যরা অদম্য। বিকেল চারটে পাঁচ মিনিট থেকে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের খেলা, তারা ঠিক চারটে বাজতে পাঁচ মিনিটে সুহৃদ বান্ধব সঙ্ঘ জিন্দাবাদ ধ্বনি দিতে দিতে রেললাইন পরিত্যাগ করল।
এর পরেও তারকেশ্বরে যে যাওয়া যেত না তা নয়। ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যেই রেল চলাচল প্রায় স্বাভাবিক হল। কিন্তু বহুক্ষণ রেলকামরার গুমোটে আটকে থেকে তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল। সে রেলগাড়ি থেকে লাইন বরাবর কিছুটা হেঁটে তারপর একটা রিকশা নিয়ে জি টি রোডে এসে একটা প্রাইভেট ট্যাকসি ধরল।
কিশোরের নিজের একটা নতুন লাল মারুতি ভ্যান আর পুরনো ফিয়াট আছে। কিন্তু গাড়ি-টাড়ি নিয়ে সে কলকাতার বাইরে বেরোতে চায় না, তার অনেক ঝামেলা। জি টি রোডে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ট্রাফিক জ্যাম, মোড়ে মোড়ে চাঁদার খাতা।
আজকের ট্রেন ঝাঞ্ঝাটটা একটু অস্বাভাবিক, এমন সাধারণত হয় না। যা হোক, প্রাইভেট ট্যাকসিতে উঠে সে প্রথমে তারকেশ্বরেই যাওয়ার কথা বলল, কিন্তু ট্যাকসিওয়ালা বলল যে এ গাড়ি কলকাতার, সে কলকাতায় ফিরছে, তারকেশ্বর যেতে পারবে না। একটু দোনামোনা করে অবশেষে বাধ্য হয়েই কিশোর কলকাতা ফিরে যাওয়া সিদ্ধান্ত করল।
সন্ধ্যাবেলার জি টি রোডের ভিড়ে ভরতি রাস্তায় ফুঁকতে ধুকতে মন্থরগতিতে ট্যাকসি কলকাতার দিকে রওনা হল।
কিশোরের হাতে একটা শান্তিনিকেতনি চামড়ার ব্যাগে সপ্তাহ শেষের খোরাক দু-বোতল রাম, একটা ভোয়ালে আর একটা টুথব্রাশ রয়েছে।
হাওড়া শহরের মুখে জি টি রোডের একটা বাঁক যেখানে দীর্ঘ ঊকারের (ূ) জটিলতা নিয়েছে, অথচ বান মাছের লেজের মতো সূক্ষ্ম হয়ে গেছে, সেখানে ট্যাকসিটা রীতিমতো আটকে গেল গাড়ির জটলায়। কিশোর চারদিক পর্যবেক্ষণ করে বুঝল ঘণ্টাখানেকের আগে এ জট খোলার কোনও সম্ভাবনা নেই। তবে সান্ত্বনার কথা এই যে হাতের ব্যাগে দু-বোতল পানীয় রয়েছে।
লোডশেডিং চলছে। সন্ধ্যা বেশ জমাট হয়ে এসেছে। ধুলো, ধোঁয়া, গরম, অন্ধকার। কিশোর ধীরে ধীরে ব্যাগ খুলে একটা বোতলের ছিপি খুলে অল্প অল্প করে গলায় ঢালতে লাগল। একবার ড্রাইভার পিছন ফিরে তাকাতে দ্বিতীয় বোতলটা তার হাতে ধরিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে গরম, গাড়িতে ঘামতে ঘামতে বসে থাকা, ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করা–কোনও বোধই আর রইল না। ড্রাইভারের অবস্থাও তদ্রুপ। দুজনে ধীরে ধীরে চুক চুক রাম খেয়ে চলল।
এরপর রাত তখন প্রায় একটা। কখন যে ট্রাফিকের জট খুলেছে, ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে কলকাতার ভিতর চলে এসেছে, কিছুই হুশ হয়নি কিশোরের।
এখন একটু জ্ঞান হতে সে উঠে বসল। গাড়ির পিছনের সিটে সে, আর সামনের সিটে ড্রাইভার। ড্রাইভার এখনও বেহুঁশ।
জানলার বাইরে মেঘলা আকাশে ভাঙা চাঁদ উঠেছে। জায়গাটা বোধহয় লেকের কাছাকাছি কোথাও হবে। একটু চোখ কচলিয়ে নিয়ে দরজা খুলে গাড়ির বাইরে এসে দাঁড়াল কিশোর। সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে। আশেপাশে একটু তাকিয়ে কিশোর ধরতে পারল, জায়গাটা শরৎ বসু রোড আর সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের মোড়ে লেকের মুখোমুখি।
গাড়িতে ওঠার পরে কিশোর ড্রাইভারকে বলেছিল শরৎ বসু রোডে তার বাড়ি। ড্রাইভার যে এত মদ খাওয়ার পরেও কোনও দুর্ঘটনা না করে এতদূরে আসতে পেরেছে সেটা ভাগ্যের কথা। তবে শরৎ বসু রোডের ওই মাথায় পদ্মপুকুরের পাশে একটা দোতলা বাড়িতে থাকে কিশোর, সে জায়গাটা এখান থেকে খুব কাছে নয়।
সামনের সিটে ড্রাইভারকে দুবার ধাক্কা দিয়ে তোলার চেষ্টা করল কিশোর। লোকটা দুবার হু হু করে, তারপর সিটের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে গাঢ় নিদ্রায় নিমগ্ন হল। চাঁদের আলোয় কিশোর দেখতে পেল ওর পায়ের কাছে রামের বোতলটা পড়ে রয়েছে, তাতে এক-তৃতীয়াংশ পানীয় এখনও বর্তমান। কিশোরের নিজের বোতলটাও পিছনের সিটে রয়েছে কিন্তু সেটা খালি, তাতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই।
ড্রাইভারের পায়ের কাছ থেকে হাত বাড়িয়ে বোতলটা তুলে নিল কিশোর। ড্রাইভার বোধহয় কিছু টের পেয়েছিল, ওই আচ্ছন্ন অবস্থাতেই মৃদু বাধাদানের চেষ্টা করল। কিশোর তার হাত ছাড়িয়ে বোতলটা বগলে নিয়ে টালমাটাল চরণে বাড়ির দিকে রওনা হল।
এখান থেকে নাক-বরাবর মাইল দুয়েক রাস্তা যেতে হবে। এটুকু রাস্তা মাতালের পক্ষে কিছুই। নয়, বিশেষ করে হাতের বোতলে এখনও যখন একটু পানীয় আছে। একটাই ভয়, হঠাৎ পা জড়িয়ে পড়ে না যায়। কিন্তু গাড়িতে ঘুমিয়ে নেশাটা এখন একটু ধাতস্থ হয়েছে। সুতরাং বোতল থেকে অল্প অল্প পানীয় গলায় ঢালতে ঢালতে বাড়ির পথে ভালই এগোল কিশোর।
এক সময়ে কিশোরের খেয়াল হল যে তার হাতের বোতল শূন্য হয়ে গেছে এবং সে নিজের বাড়ির সামনে এসে গেছে।
কিশোরের কাছে বাড়ির সদর দরজার একটা ডুপ্লিকেট চাবি থাকে। এই মাতাল অবস্থাতেই সেটুকু খেয়াল আছে তার। পকেট হাতড়িয়ে চাবিটা বার করল কিশোর, ভাগ্যিস গাড়ির মধ্যে পড়ে যায়নি, শান্তিনিকেতনি ব্যাগটা তো গাড়িতেই রয়ে গেল।
কিশোরের মাথাটা ঝিমঝিম করছে। পরের বারের মদটা না খেলেই ভাল হত। তার হাত পা টলছে, কিছুতেই চাবি দিয়ে বাড়ির দরজাটা খুলতে পারছিল না কিশোর। বার বার চাবির মুখটা পিছলে পিছলে যাচ্ছিল।
হঠাৎ পিছন থেকে একটা পুলিশের কালো গাড়ি এসে দাঁড়াল। গাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে নেমে এল লম্বাচওড়া হৃষ্টপুষ্ট গুম্ফমান এক হিন্দুস্থানি জমাদার। জমাদারজির গায়ে লংক্লথের ঢোলাহাতা পাঞ্জাবির সঙ্গে মালকোঁচা দিয়ে ধুতি পরা পায়ে কালো পামশু।
জমাদার সাহেব নেমেই প্রথমে কিশোরের হাত থেকে বোতলটা ছিনিয়ে নিলেন এবং সেটা শুন্য দেখে একটু রেগে সেটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, তারপরে ঘাড়ের পেছন থেকে কিশোরের জামার কলারটা ধরে হুমকি দিলেন, এই মাতাল, এত রাতে হচ্ছেটা কী? চল, থানায় চল।
পুলিশ বুঝতে পেরে কিশোর একটু থমকিয়ে গেল, তারপর হেঁচকি তুলে বলল, জমাদারসাহেব, বাড়িতে ঢুকব, তাই দরজাটা চাবি দিয়ে খুলছি… বলে হাতের চাবিটা তুলে দেখাল।
জমাদারসাহেব অবাক হলেন, বাড়ি? দরজা? কেয়া বোলতা তুম?
কিশোর করজোড়ে বলল, হুজুর, এই আমার বাড়ির সদর দরজা আর দোতলায় ওই যে দেখছেন আলো জ্বলছে, ওটা আমার শোয়ার ঘর।
একটা খারাপ গালাগাল দিয়ে কিশোরের কলার ধরে শক্ত হাতের মুঠোয় একটা জোরে ঝকানি দিলেন জমাদার সাহেব।
ঝাঁকুনি খেয়ে কিশোরের মাথা থেকে কিছুটা অ্যালকোহল নেমে গেল। সে দেখতে পেল যে সে এতক্ষণ ধরে বাড়ির সামনের ল্যাম্পপোস্টটায় চাবি লাগানোর চেষ্টা করছিল এবং পোস্টের ওপরের বালবটাকে ভাবছিল তার দোতলার শোয়ার ঘরের আলো, যেটা জানলা দিয়ে রাস্তা থেকে দেখা যায়।
একটু সম্বিৎ ফিরে এসেছে কিশোরের। কিন্তু এখন জমাদারসাহেব তাকে ঘাড়ে ধরে পুলিশভ্যানের দিকে ঠেলা শুরু করেছে। সে কাকুতিমিনতি করতে লাগল, জমাদার সাহেব, ছেড়ে দিন। এই দেখুন, সত্যি এই সামনের দোতলা বাড়িটা আমার।
কিশোরের কথা শুনে জমাদারসাহেবের মনে হল, হয়তো লোকটা মিথ্যে কথা বলছে না। তা ছাড়া এত রাতে থানায় মাতাল নিয়ে যাওয়া সেও এক হাঙ্গামা। সুতরাং দেখা যাক সত্যিই এই সামনের বাড়িটা এই মাতালটার কিনা। তাহলে এটাকে ছেড়ে দিয়ে থানায় গিয়ে ঘুমনো যায়, রাতও অনেক হয়েছে।
জমাদারসাহেবের বজ্রমুষ্টি কিঞ্চিৎ শিথিল হতে কিশোর নিজের সদর দরজার দিকে এগোল। কর্তব্যপরায়ণ জমাদার সাহেব কিন্তু পিছু ছাড়লেন না।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পিতলের যুগ্ম নেমপ্লেটের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল কিশোর, তারপর নিজের বুকে হাত রেখে বলল, ওই যে প্রথম লাইনে লেখা দেখছেন মি. কে কে পাল, ওই কে কে পাল কিশোরকুমার পাল হলাম আমি। আর নীচের লাইনে মিসেস এস পাল মানে মিসেস শ্যামা পাল হলেন আমার পত্নী।
আত্মপরিচয় শেষ করে দরজায় চাবি লাগিয়ে ঘোরাল কিশোর, দরজাটা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকে সিঁড়ির নীচের বাতিটা সুইচ টিপে জ্বালালো কিশোর। জমাদারসাহেব ইতস্তত করছিলেন, কিশোর তাঁকে অনুরোধ করল, আসুন, ভেতরে আসুন স্যার।
জমাদারসাহেব ভেতরে আসতে সামনের দেওয়ালে একটা বড় ফটো দেখিয়ে কিশোর বলল, এটা হল আমার শ্বশুরমশায়ের ছবি, মিস্টার পরেশচন্দ্র দাশ, আয়রন মার্চেন্ট, লোহাপট্টিতে নিজের গদি আছে।
আর সরেজমিন করার ইচ্ছা নেই জমাদারসাহেবের কিন্তু কিশোর তাকে জোরজার করে। দোতলায় তুলল। দোতলায় উঠে ছোট বারান্দা পেরিয়ে শোবার ঘর।
এবার একটা ছোট নাটক হল।
কিশোরের বউ শ্যামাসুন্দরীর চরিত্র বিয়ের আগে যেমন ছিল, বিয়ের পরেও তাই রয়েছে। মোটেই বদলায়নি। কিন্তু সে তার চরিত্রদোষের কথা ঘুণাক্ষরেও কিশোরকে টের পেতে দেয় না। তবু অত্যন্ত সেয়ানা হওয়া সত্ত্বেও আজ সে একেবারেই আঁচ করতে পারেনি যে, তার স্বামী যার সোমবার সকালে ফেরার কথা সে শুক্রবার রাত কাবার হওয়ার আগেই ফিরে আসবে।
শোয়ার ঘরে আলো জ্বলছিল, বড় ডাবল বেডের খাটে শ্যামা শুয়েছিল। সহসা ঘরের মধ্যে কিশোর ও জমাদারসাহেবের প্রবেশ। শ্যামা এবং শ্যামার সঙ্গী দুজনেই পরস্পরের কণ্ঠলগ্ন হয়ে ঘুমে অচেতন, কেউ কিছু টের পেল না।
শয়নঘরের ঘনিষ্ঠ দৃশ্য দেখে জমাদারসাহেব বেরিয়ে আসছিলেন, তাকে হাতে ধরে দাঁড় করাল কিশোর, তারপরে বিছানার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ওই যে দেখুন, বালিশের ওপর খোলা চুল, নীল শাড়ি পরা ওই হল শ্যামাসুন্দরী আমার ওয়াইফ, আর ওর পাশে ওর গলা জড়িয়ে শুয়ে ওই হলাম আমি, কিশোরকুমার পাল, এই বলে কিশোর নিজেকে নির্দেশ করল।
অবস্থা কিছু বুঝতে না পেরে কিশোরের হাত ছাড়িয়ে জমাদারসাহেব তোবা তোবা করতে করতে এক দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে রাস্তায় কালো গাড়িতে উঠে বসলেন। হুশ করে ধোঁয়া ছেড়ে ভ্যানটা চলে গেল।
জমাদারসাহেবকে আরও কিছু বোঝানোর জন্যে তার পিছু পিছু কিশোর সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এসেছিল। কিন্তু জমাদারসাহেব রণে ভঙ্গ দেওয়ায় সে বিফলমনোরথ হয়ে সিঁড়ির নীচের আলো নিবিয়ে সদর দরজা বন্ধ করে দোতলায় উঠে গেল। তারপর গুটিসুটি হয়ে শ্যামাসুন্দরীর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ আর ঘরের মধ্যে কথাবার্তা শুনে একটু আগেই শ্যামাসুন্দরীর ঘুম ভেঙেছিল। এমন বিপদে সে আর কখনও পড়েনি। সিঁড়ি দিয়ে কিশোর যখন নেমে গেল সে ভেবেছিল এখনকার মতো কিশোর বিদায় হল, পরে যদি আজকের ব্যাপারে কোনও কথা তোলে, ঝেড়ে অস্বীকার করবে। বলবে, মাতাল অবস্থায় কী না কী দেখেছ, তার ঠিক নেই।
কিন্তু এখন কিশোর এসে পাশে শুয়ে পড়ায় শ্যামাসুন্দরী বিচলিত বোধ করতে লাগল। তবু ভাল যে এপাশে শুয়েছে, ওপাশের লোকটার ওপরে গিয়ে পড়েনি!
কিশোরের মাথার মধ্যে কী সব এলোমেলো চিন্তা ঘুরছিল। একটু আগে সে কী একটা দেখেছে যেটা মোটেই ঠিক নয়। সে শ্যামাকে একটা ধাক্কা দিল, শ্যামা জবাব দিল, উ!
কিশোর শ্যামাকে বলল, ওগো আমাদের বিছানায় তোমার পাশে আর কেউ কি শুয়ে আছে?
এ প্রশ্ন শুনে শ্যামা ধমকিয়ে উঠল, কী-যা তা বলছ! মদ টেনে টেনে তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে!
ধমক খেয়ে একটু চুপসিয়ে গেল কিশোর। কিন্তু তবুও তার মনের মধ্যে সন্দেহের কাটা খোঁচা দিতে লাগল। সে বালিশ থেকে একটু মাথা উঁচু করে নীচে পায়ের দিকে তাকিয়ে ভাল করে গুনল, তারপর জিজ্ঞাসা করল, ওগো, বিছানায় যদি আর কেউ না থাকবে তবে নীচের দিকে ছটা পা দেখা যাচ্ছে কী করে?
এ কথায় চতুরা শ্যামাসুন্দরী কপাল চাপড়িয়ে কেঁদে উঠল, ছিঃ ছিঃ, আমার নামে এই অপবাদ! আমি দুশ্চরিত্রা? আমি মিথ্যাবাদী?
বোকা বনে গিয়ে শ্যামাসুন্দরীর মাথায় হাত বুলাতে বুলোতে কিশোর স্বীকার করল যে সে অনেক মদ খেয়েছে সন্ধ্যা থেকে, প্রায় দেড় বোতল। সুতরাং তার ভুল হতেই পারে। মাতালে তো সব জিনিসই বেশি বেশি দেখে। হয়তো চারটে পা-কেই সে ছটা পা দেখেছে, নেশার ঘোরে গুনতে ভুল করেছে।
শ্যামাসুন্দরী এখন ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে লাগল আর বলতে লাগল, তুমি কী করে আমাকে দুশ্চরিত্রা ভাবলে! এসব মদ খেয়ে নেশার ঘোরে অনুমানের কথা নয়, তুমি একবার খাট থেকে নেমে আমাদের পা-গুলো গুনে এসো, তারপরে আমাকে বলল।
কিশোরের তখন মাথা টলছে তবু স্ত্রীর আদেশে খাট থেকে নেমে পায়ের কাছে গিয়ে খুব সতর্ক হয়ে বেশ কয়েকবার পায়ের সংখ্যা গুনল। বলা বাহুল্য, প্রত্যেকবারই পায়ের সংখ্যা দাঁড়াল চার। এক, দুই, তিন, চার–এইভাবে বারকয়েক গুনবার পরে কিশোর বলল, ওগো, আমাকে মাপ করে দাও। সত্যিই নেশার ঘোরে আমি পা গুনতে ভুল করেছিলাম। ঠিক দুজনার চারটে পা-ই রয়েছে। বিছানায়।
তারপর খাটের নীচে বসে অনুতপ্ত কিশোর সামনের পা-দুটো জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। সে পা-দুটো যে কার কে জানে!
অবসরের দিনলিপি
ভালই আছি।
ভেবেছিলাম খুব ছাড়া ছাড়া, নিঃসঙ্গ হয়ে যাব।
এক সঙ্গে দুটো বড় ব্যাপার ঘটে গেল। আমার মত ঘর-গৃহস্থী মানুষের পক্ষে দুটো বড় মাপের জবরদস্ত জীবন বিদারক ঘটনা।
এক নম্বর হল, চাকরি থেকে অবসরগ্রহণ করলাম। পঁয়ত্রিশ বছরের দশটা-পাঁচটা থেকে অব্যাহতি। অবসরগ্রহণ করলাম কথাটা যদিও সঠিক নয়। কথাটা অবশ্য সম্মানজনক, যেন আমি স্বেচ্ছায় অবসরগ্রহণ করেছি। কিন্তু সত্যি কথাটা হল বয়েস হয়ে যাওয়াতে অবসর নিতে বাধ্য হলাম।
দুনম্বর ব্যাপারটা হল আরও গুরুতর। পুরনো বাসস্থান ছেড়ে নতুন বাসায় চলে এলাম। সরকারি আবাস ছাড়তেই হত।
তবে এই শেষ বাসাবদল। খুব সম্ভব এর পরে আর বাসা বদলাতে হবে না। গত পঁয়তাল্লিশ বছরে এই পোড়া শহরে বাক্স-বিছানা ঘাড়ে করে কত জায়গায় যে ছুটলাম। শুরু হয়েছিল সেই সাহেব পাড়ায় নাবালক বয়েসে এসপ্ল্যানেডের গলিতে, তারপর দক্ষিণ দিকে হটতে হটতে বিদায় নিলাম গড়িয়াহাটার কাছ থেকে।
শেষ দিকে নিকট বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যে খুব ঘন ঘন দেখাশোনা হত, আড্ডা হত তা তো নয়। কিন্তু মনে মনে স্বস্তি পেতাম এই ভেবে যে সবাই কাছাকাছি আছে। একটা কেমন নিরাপত্তাবোধ ছিল, এক ডাকে দশ-বিশটা চেনাজানা আপন লোক দৌড়ে আসবে।
তা নয়, এ যে কোথায় চলে এলাম। উড়ো উড়ো, কঁকা ফাঁকা নতুন গড়ে ওঠা এই শহরতলিতে আমি যেন কেমন বেমানান। যেন থাকতে আসিনি, বেড়াতে এসেছি।
তবুও মোটামুটি নতুন বাসায় এসে থিতু হয়ে বসেছি।
বাসা বদলের ঝামেলা অনেক। রেশন কার্ড, গ্যাস, ইলেকট্রিক মিটার, টেলিফোন এমনকী কাজের লোক, মুদির দোকান এই সব এক ধাক্কায় বদলানো সোজা কথা নয়। কত রকম দৌড়-ঝাঁপ, তদ্বির-তদারক। এই বয়েসের পক্ষে যথেষ্টই হ্যাঁপা।
তবু মাসদুয়েকের মধ্যে প্রায় সব কিছুই সড়গড় হয়ে এসেছে। মোটামুটিভাবে বলতে পারি, ভাল আছি, ভালই আছি। এতটা ভাল থাকব, ভাবিনি। একটা নতুন রুটিনে ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। তেমন ধরাবাঁধা কিছু ব্যাপার নয়, ঢিলেঢালা একটা জীবন।
কিন্তু সম্পাদকমশায়, এ তো মোটেই গল্প হচ্ছে না। জনৈক অবসরপ্রাপ্ত প্রৌঢ়ের আত্মবিলাপ কিংবা বড় বাবুর পরিণাম নামে এরকম রচনা আপনার পত্রিকায় না হলেও ছোট-মাঝারি কাগজে প্রকাশিত হতে পারে।
কিন্তু সম্পাদকমশায়, আমি তো পাকা গল্প লিখিয়ে। আপনার কাগজেই এ যাবৎ অন্তত পঞ্চাশটা গল্প লিখেছি। এমন কোনও পুজোসংখ্যা আছে যেখানে আমি প্রত্যেক বছর গল্প লিখি না।
কিন্তু সম্পাদকমশায়, আপনি আমার সুহৃদ না হতে পারেন আপনি অবশ্যই আমার শুভানুধ্যায়ী। আপনি কত কিছু নিয়ে ভাবেন। আমাকে নিয়েও একটু ভাবুন। আমার এমন অবস্থা কেন হল? সে কি শুধু চাকরি খতম, বাসা বদল বলে?
সে যা হোক, এবার ধারাবিবরণীতে ফিরে যাই। আগে সকালবেলায় প্রথম কাজ ছিল হাঁটা। ভোরবেলায় উঠে হাতমুখ ধুয়ে হাঁটতে বেরোতাম। যখন যে পাড়ায় থেকেছি, সেই রকম হেঁটেছি। কখনও ফুটপাথ ধরে সকালবেলায় খালি রাস্তায় হেঁটেছি, কখনও বাড়ির কাছের পার্কে বা স্কোয়ারে। দশ-বারো বছর লেকের চারপাশে হেঁটেছি। কাছাকাছি থাকার সুবাদে বছর দশেক ময়দানেও হেঁটেছি।
মর্নিং ওয়াক কিন্তু শুধু ওয়াক নয়। এটা এক ধরনের মর্নিং ক্লাব। বহু লোকের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হয়, পরিচয় ঘঠে। নানা রকম যোগাযোগ, তথ্য ও অভিজ্ঞতা বিনিময় হয়। একটু হাসি-ঠাট্টাও হয়।
এখানে এসেও, বাসা গুছিয়ে নেওয়ার পরে, দিন পনেরো বাদে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। পুরনো অভ্যাস যাবে কোথায়?
তা ছাড়া এই নতুন অঞ্চলটা হাঁটার পক্ষে অনুপম। রাস্তাঘাট ফাঁকা, মোটামুটি পরিষ্কার। আলো-বাতাস সুপ্রচুর। পরিবেশ দূষণ তুলনামূলকভাবে কম।
প্রথম দিন হাঁটতে বেরিয়েই যাঁদের সঙ্গে দেখা হল তাদের মধ্যে অনেকেই আমার পূর্ব-পরিচিত। তাদের সঙ্গে কখনও দেখা হবে ভাবিনি। কারও কারও সঙ্গে বা অধীনে আমি একসময় কাজ করেছি। তাদের কথা কবে ভুলে গিয়েছিলাম, এমনকী তারা যে এখনও আছেন তা পর্যন্ত কখনও ভাবিনি।
তাঁদের অনেককে এক সঙ্গে দেখে আমি সেই আলো-আঁধারি ভোরবেলায় কেমন বিচলিত হয়েছিলাম, তারাও তেমনই উল্লসিত হয়েছিলেন।
আদিত্যবাবু। এঁর সঙ্গে বছর তিনেক কাজ করেছিলাম, আমাকে দেখে এগিয়ে এসে বললেন, এই তারাপদ, তুমিও তা হলে সল্ট লেকে এসে গেলে? আমি মৌনভাবে ব্যাপারটা স্বীকার করলাম।
আরেক ভদ্রলোক, ঠিক ভদ্রলোক নন একদা সাহেব ছিলেন, আমার চেয়ে তিন ধাপ ওপরে চাকরি করতেন যখন তিনি অবসর নেন বছর কুড়ি আগে, মুখের বাঁধানো দাঁতজোড়া জিব দিয়ে ভাল করে সেট করতে করতে বললেন, আরে মিস্টার রায়, আপনি দেখছি ভয়ংকর মোটা হয়ে গেছেন।
এরকম কথা সাতসকালে শুনতে আমার ভাল লাগে না। বলতে পারতাম, ভয়ংকর মোটা হয়েছি তো বেশ করেছি। তাতে কার কী? আপনার খেয়ে-পরে তো মোটা হইনি। তা না বলে অন্যভাবে বললাম, ভয়ংকর মোটা হইনি। কিছুটা মোটা হয়েছি। ভয়ংকর মোটা হলে কি আর এই পনেরো বছর বাদে চিনতে পারতেন?
আমার এই বোকা রসিকতায় ওঁরা সকলেই আমার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে রইলেন। ঠিক এই সময়ে আমি চিরকাল যে রকম প্রগলভ আচরণ করেছি তাই করে ফেললাম, মুখ ফসকিয়ে বলে ফেললাম, স্যার আপনাদের সঙ্গে আবার দেখা হবে ভাবিনি।
স্যার বললেন, কেন?
আমি বললাম, আমার কেমন একটা ধারণা ছিল আপনার কেউ নেই। এমনকী কেমন যেন মনে হচ্ছে আপনাদের কারও কারও মৃত্যুসংবাদ পেয়ে অফিসে শোকসভা করেছি, ঘণ্টা দুয়েক আগে অফিস ছুটি দিয়েছি।
জারুল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে নবোদিত সূর্যের রশ্মি রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছে, শিশির-ভেজা ঘাসের ওপর শালিকেরা হুটোপুটি করছে, একটু উত্তুরে হাওয়া দিয়েছে, একটু শীত শীত ভাব। সমবেত ভদ্রমণ্ডলী আমার কথা শুনে বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। সব নিস্তব্ধ, শুধু দূরে একটা ঘুঘুর ডাক শোনা যাচ্ছে। একটু পরে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে, অন্য এক স্যার বললেন, বুড়ো হয়ে তোমার একটুও লাভ হয়নি। তুমি সেই একই রকম ফাজিল রয়ে গেলে।
আমি রণে ভঙ্গ দিলাম। বাড়ি ফেরার পথে ভাবতে লাগলাম, বুড়ো হয়ে সত্যি কী লাভ হল। এবং ওঁরা সবাই সত্যি জীবিত কি না।
ফল হল, আমি প্রাতঃভ্রমণ করা ছেড়ে দিলাম। আরও দু-চারদিন যে চেষ্টা করিনি তা নয়। কিন্তু পরিণতি একই হয়েছে। যারা নেই বলে জানি, তাদের সঙ্গেই ক্রমাগতু দেখা।
কিন্তু আমি তো অসামাজিক জীব নই। চিরকাল সকলের সঙ্গে মেলামেশা করে চলতে ভালবাসি। সুতরাং নতুন পরিচয় হতে লাগল।
চিরঞ্জীববাবুর সঙ্গে পরিচয় হল। তাঁর কাছে আমি একটা নতুন হিসেব পেলাম। জীবনের এ হিসেবটা এর আগে ভাবিনি।
চিরঞ্জীববাবু থুরথুরে বুড়ো। বাইশ বছরের পেনশনার। চাকরিতে ঢুকেছিলেন অভঙ্গ বঙ্গের মুসলিম লিগ আমলে, ইংরেজের যুগে। পুলিশের দারোগা হয়ে ঢুকে ছোট সাহেব হয়ে বিদায় নিয়েছিলেন।
সাধারণত পুলিশের লোকেরা রিটায়ার করার পরে কখনও বলতে চান না পুলিশের চাকরি করতেন, বড় জোর বলেন, সরকারি কাজ করতাম। সেই জন্যে বাড়ির নেমপ্লেটে অবসরপ্রাপ্ত হেডমাস্টার থেকে মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন সার্জন, কৃষি বিভাগের উপ অধিকর্তা লেখা থাকে কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত আই পি এস বা পুলিশের ডেপুটি সুপার কিংবা দারোগা–এসব দেখতে পাওয়া যায় না।
চিরঞ্জীববাবু অবশ্য উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তিনি নিজে যেচে এসে আলাপ করেছিলেন। একদিন কথাপ্রসঙ্গে তার প্রতিবেশিনী এক দুশ্চরিত্রা মহিলার উল্লেখ করে নিজের অক্ষমতার কথা বলে জানলেন, চাকরির প্রথম জীবনে বড়তলা থানার দারোগা ছিলাম, প্রচুর বেশ্যা পিটিয়েছি।
তাঁর কথা শুনে আমি আঁতকিয়ে উঠলাম, বললাম, নতুন যুগ। ভেবেচিন্তে ভালভাবে কথা বলুম। বলুন, প্রচুর যৌনকর্মীকে নিপীড়ন করেছি।
চিরঞ্জীববাবু মাথা নেড়ে বললেন, না মশায়। পুলিশে কাজ করলে কী হবে আমার স্বভাবচরিত্র খারাপ ছিল না। নিপীড়ন-টিপীড়ন নয়, কর্ম-কর্ম করিনি, স্রেফ পিটিয়েছি।
এই চিরঞ্জীববাবুই আমাকে বুঝিয়েছিলেন, আমি দুগ্ধপোষ্য, নাবালক। নিতান্তই জুনিয়র, এক বছরও হয়নি রিটায়ার করেছি। রিটায়ারদের মধ্যে পর্যন্ত সিনিয়ারিটি আছে। কী চাকরি ছিল, কত বড় চাকরি তা নয়। কতদিন হল রিটায়ারের পর সেটাই একমাত্র বিবেচ্য। এর পরে প্রমোশন পরলোকে। তবে যমরাজা এই সিনিয়রিটি খুব একটা মর্যাদা দেন বলে মনে হয় না।
আমি বললাম, যমরাজের কাছে এ বিষয়ে একটা ডেপুটেশন দিলে হয় না। তিনি আমার এই প্রস্তাবে খুব একটা গুরুত্ব দিলেন না।
চিরঞ্জীববাবুর সঙ্গেই একদিন এসেছিলেন বনবিহারীবাবু। সার্থক নাম রেখেছিলেন তাঁর গুরুজনেরা। তিনি বনদপ্তরে দীর্ঘ সাঁইত্রিশ বছর কাজ করেছিলেন।
বনবিহারীবাবু চিরঞ্জীববাবুর থেকে বছর পাঁচেকের জুনিয়র। তিনি কেমন থপথপ করে হাঁটেন। এমনিতে শরীর-স্বাস্থ্য বেশ ভাল। লাঠি ব্যবহার করেন না, আজকাল কেই বা করে। কিন্তু বনবিহারী যখন হেঁটে আসেন, দূর থেকে মনে হয় তিন পায়ে হেঁটে আসছেন। তার একটা বড় কারণ অবশ্য তার আভূমিলম্বিত দীর্ঘ কোঁচা। তিনি এখনও সামান্য সংখ্যক ধুতিপরিয়েদের দলে।
বনবিহারীবাবুর প্রধান গুণ কৌতূহল এবং অনুসন্ধিৎসা। এই বয়েসেও সব বিষয়ে, বিশেষ করে খবরের কাগজের প্রথম পাতায় যেসব মোটা খবর বেরোয়, সেই সব নিয়ে তাঁর নানা প্রশ্ন।
সম্প্রতি গণেশ ঠাকুরের দুধ পানের সময় এবং এর পিঠোপিঠি পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সময় বনবিহারীবাবু আমাকে খুব অত্যাচার করেছেন। দুগ্ধ পানের মহাদিনের পরের দিন সকালে বনবিহারীবাবু এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি তো কিছুদিন এলগিন রোডে ছিলেন?
আমি বললাম, ঠিক এলগিন রোডে নয়, কাছেই গোখেল রোডে বছর দেড়েক ছিলাম এক সময়ে।
বনবিহারীবাবু প্রশ্ন করলেন, আপনি কি শুনেছেন ওই গোখেল রোডের মোড়ের লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরের গণেশ ঠাকুর ফার্স্ট হয়েছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, ফার্স্ট হয়েছে? মানে?
বনবিহারীবাবু বললেন, লোকেরা বলছে ওই গণেশটাই সবচেয়ে বেশি দুধ খেয়েছে। ডানকুনি থেকে মাদার ডেয়ারি স্পেশ্যাল এক গাড়ি দুধ পাঠিয়েছিল।
আমি বললাম, তা কী করে হয়?
কিন্তু সূর্যগ্রহণের সময় এত সহজে পরিত্রাণ পাইনি। গ্রহণের আগের দিন এসে বললেন, জানেন গ্রহণের সময় ভেড়ারা ঘাস খায় না। কাগজে বেরিয়েছে।
আমি জানতাম না, চুপ করে রইলাম। কিন্তু বনবিহারীবাবু চুপ করে থাকার লোক নন। কিছুক্ষণ ধরে বার বার বলে যেতে লাগলেন, ভেড়ারা পর্যন্ত গ্রহণ চলাকালীন ঘাস মুখে দেয় না, আমাদের কি কিছু খাওয়া উচিত?
বনবিহারীবাবুর অবশ্য একটা গুণ অস্বীকার করা অনুচিত। তিনি শুধু প্রশ্নই করেন উত্তর আশা করেন না। আমি একটি কথা না বললেও চলে যাওয়ার সময়ে বলে যান, আপনার সঙ্গে আলোচনা করে মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গেল। আপনার সঙ্গে কথা বলেও সুখ।
আমি বুঝতে পারছিলাম, এ সুখ আমার বেশিদিন সইবে না।
এ দিকে চিরঞ্জীববাবু বনবিহারীবাবুকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে কেটে পড়েছেন। আজকাল কালেভদ্রে আসেন। সেও বনবিহারীবাবুকে দেখলে কোনও অজুহাতে কেটে পড়েন।
সে দিন হঠাৎ দুজনে আবার এক সঙ্গে এলেন। দেখলাম দুজনেই বেশ উত্তেজিত, বিষয় যুবরানি ডায়ানা। আমার ঘরে ঢুকেই চিরঞ্জীববাবু বললেন, তার যৌবন বয়সে ওই মহিলাকে বড়তলা থানা এলাকায় পেলে তিনি পিটিয়ে তক্তা করে দিতেন। বিপথগামিনী রমণীদের ওপর তার খুব রাগ; তদুপরি তিনি ইংরেজ আমলের রাজভক্ত পুলিশ, রাজ পরিবারের অবমাননা তিনি দেখতে পারেন না।
দুই বৃদ্ধের মধ্যে খটাখটি শুরু হয়ে গেল। চিরঞ্জীববাবু রাজপুত্রের পক্ষে আর বনবিহারীবাবু রাজবধূর পক্ষে। উৎকট চেঁচামেচি, প্রায় হাতাহাতি। বাড়িটা যে আমার, আমি যে ঘরের মধ্যে জলজ্যান্ত একজন তৃতীয় ব্যক্তি বসে আছি, সেটা কারও হুশ হল না। সুদূর ব্রিটেনের রাজ পরিবারের ঘরোয়া কলহে আমার বৈঠকখানা ঘর গমগম করতে লাগল।
ঘণ্টা খানেক পরে রাগে গরগর করতে করতে, আমার টেবিলের ওপরে রাখা শ্ৰীযুক্তেশ্বরী ডায়ানার আবক্ষ চিত্র-সম্বলিত সেদিনের দৈনিক পত্রিকাটি কুটি কুটি করে ছিঁড়ে চিরঞ্জীববাবু নিষ্ক্রান্ত হলেন।
এর পরে আরও আধ ঘণ্টা বনবিহারীবাবু কোনও কথা না বলে মাথায় হাত দিয়ে চুপ করে বসে রইলেন। শুধু যাওয়ার আগে একবার ক্ষীণ প্রশ্ন করলেন, ডায়না কি দোষী? তিনি কি কুলটা?আমি কিছু বললাম না। কী বলব?
যাওয়ার সময়ে বনবিহারীবাবু বলে গেলেন, দেখুন আপনি সমস্ত বিষয়ে এত খবর রাখেন, আপনার সঙ্গে আলোচনা করে এত উপকার হয়, আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা আমার জানা নেই।
আমি কী আলোচনা করলাম, কখন করলাম, কিছুই বুঝতে পারলাম না।
আবার জীবনে উত্তেজনা ফিরে আসছে।
সকালে হাঁটা আবার শুরু করেছি। টগবগ করতে করতে বাড়ি ফিরে আসি। ফিরে এসে কিংবা পরে দুপুরে কিংবা সন্ধ্যায় কখনও বনবিহারীবাবু, কখনও চিরঞ্জীববাবু, কখনও বা দুজনেই একসঙ্গে আসেন। আমি কিছু বলি বা না বলি, যাওয়ার সময়ে আমার সুচিন্তিত মতামতের জন্যে তারা ধন্যবাদ জানাতে ভোলেন না।
অবিচ্ছিন্ন
সেই কবেকার ডোডোতোতাই। তারা এখন আর সেই ছয়-সাত বছরে আটকিয়ে নেই, ঢের বড় হয়েছে।
তাতাইবাবু এখন বিদেশবাসী। সেখানে পড়াশুনো শেষ করে এখন নিজেই পড়াচ্ছেন। আর ডোডোবাবু পুরোদস্তুর এঞ্জিনিয়ার, তাকেও কাজেকর্মে প্রায়ই বিদেশে যেতে হয়।
প্রায় আড়াই বছর পরে এবার তাতাইবাবু কলকাতায় এসেছিলেন। সঙ্গে মেমবউ, বিশাল বড়সড় মেমসাহেব। তাতাইয়ের কাকা বউ দেখে বলেন, এই একটা বউ একাই চারটে বউয়ের সমান, বাড়ি ভরে গেছে।
তাতাইবাবু কিন্তু একদম বদলাননি। প্রথম দিন এসেই দশ বারোটা কঁচা জলপাই নুন দিয়ে খেয়ে ফেললেন। জলপাইগুলো বাজার থেকে আনা হয়েছিল চাটনি করার জন্যে। তাতাইবাবুর গোগ্রাসে জলপাই খাওয়া দেখে তাতাইবাবুর মা হায়-হায় করে উঠলেন। তাতাইবাবু বললেন, ভয় পেয়ো না। কিছু হবে না।তাতাইবাবুর মা বললেন, চাটনিও হবে না। এই শুনে তাতাইবাবুর কাকা সাইকেল নিয়ে বেরোলেন আবার জলপাই কিনে আনতে।
তাতাইবাবুর মা খুব চিন্তা করেন, বউয়ের সঙ্গে আমি তো ইংরেজিতে কথা বলতে পারব না।
তাতাইবাবু বলেন, পারবে না কেন?
বউয়ের উচ্চারণ তো আমি কিছুই ধরতে পারি না।তাতাইবাবুর মা কবুল করেন।
সে ভেবো না।তাতাইবাবু আশ্বাস দেন, আমি ওকে চটপট বাংলা শিখিয়ে দিচ্ছি।
শুরু হল মেমবউকে বাংলা শেখানো। প্রথমে লেখাপড়া নয়, কথাবার্তা বলা। তাতাইবাবুর ইচ্ছে চমকপ্রদ কিছু বাক্য শিখিয়ে সবাইকে বিস্মিত করে দেওয়া।
ইতিমধ্যে কয়েকদিন বাদে তাতাইবাবুর আসার খবর পেয়ে ডোডোবাবু এলেন। ডোডোবাবু ছিলেন কুয়ালালামপুরে, সেখানে ব্রিজ বানাচ্ছেন। কাজের ছুটিতে তিনি তাতাইবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এলেন।
ডোডোবাবু কুয়ালালামপুরে কী কাজ করছেন শুনে তাতাইবাবু বললেন, ওখানে সাঁকো বানাচ্ছেন কেন, আমাদের দেশে কি সাঁকো বেশি হয়ে গেছে?
সঙ্গে সঙ্গে ডোডোবাবু পালটা প্রশ্ন করলেন, আপনিই-বা বাইরে কী পড়াচ্ছেন, আমাদের দেশে কি ছাত্র কম পড়ে গেছে?
প্রায় পুরনো দিনের মতো বাদ-বিসম্বাদ শুরু হয়ে যায় আর কী এমন সময় ডোডোবাবু এসেছেন শুনে বাইরের ঘরে তাতাইবাবুর মেমবউ এলেন। তাতাইবাবুর কাছে ডোডোবাবুর কথা তিনি অনেক শুনেছেন।
ডোডোবাবু ঝাড়া পৌনে ছয় ফুট লম্বা। ডোডোবাবু দেখলেন, তাতাইবাবুর বউ বোধ হয় তার চেয়েও লম্বা। বিস্ময়ের ভাবটা কেটে যেতে ডোডোবাবু পকেট থেকে একটা চকোলেটের বার বের করে মেমবউকে দিলেন।
মেমবউ হাসিমুখে সেটা হাতে নিয়ে ভাঙা বাংলায় বললেন, এখন খাওয়া আছে না। এখন লুচি পায়েস খেয়েছি। পেটে ছুঁচো ডন দিচ্ছে।
মেমসাহেবের কথা শুনে ডোডোবাবু অবাক হয়ে তাতাইবাবুর দিকে তাকালেন, তাতাইবাবু বললেন, আমি ওকে বাংলা বলা শেখাচ্ছি।
ডোডোবাবু বললেন, কিন্তু এসব কী শেখাচ্ছেন? খিদে লাগলে পেটে ছুঁচোয় ডন দেয়, ভরা পেটে ছুঁচো ডন দিতে যাবে কেন?
তাতাইবাবু কিছু বলার আগে মেমসাহেব ভুলটা অনুমান করতে পেরে বললেন, ওই একই কথা, যা ফিফটি থ্রি তাই ফিফটি টু।
ডোডোবাবু এবার তাতাইবাবুকে চেপে ধরলেন, এসব ওঁকে কী শেখাচ্ছেন।
তাতাইবাবুদের বাড়ির পুরনো রান্নার মহিলা তাকে তাতাইবাবু মাসি বলেন, মেমবউও মাসি বলছেন। সেই মাসি এর মধ্যে ডোডোবাবু এসেছেন শুনে নালিশ জানিয়ে গেলেন, আজ সকালে বউ আমাকে বরের ঘরের পিসি কনের ঘরের মাসি বলেছে।
ডোডোবাবু বুঝলেন ব্যাপার গুরুতর। তাতাইবাবুর মা-ও বললেন পুরো অবস্থা খুব জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং তিনি এই জন্যে তাতাইবাবুকেই দোষী সাব্যস্ত করলেন।
কিন্তু কী আর করা যাবে মেমসাহেব তখন গড়গড় বলে চলেছেন, রীতিমতো প্রশ্নের ভঙ্গিতে, রাতে মাছি, দিনে মশা, এই জন্যে কলকাতায় আসা?
কলকাতা বিষয়ে এরকম কথা বলায় ডোডোবাবু খুব চটে গেলেন, তিনি সামাজিকতার ধার না ধরে কড়া ভাবে বললেন, এলেন কেন?
মেমবউ তখন প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাতাইবাবুর দিকে তাকাতে তিনি ডোডোবাবুর মন্তব্যটা ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিলেন, সঙ্গে সঙ্গে মেমবউ বললেন, পড়ে পাওয়া সাতাশি পয়সা।
তার মানে? ডোডোবাবু অবাক হয়ে তাতাইবাবুর কাছে জানতে চাইলেন। তাতাইবাবু বললেন, সাতাশি পয়সা বুঝলেন না, সেই পুরনো চৌদ্দ আনা।
একটু ভেবে নিতেই বুদ্ধিমান ডোডোবাবু ব্যাপারটা বুঝলেন, বললেন, তার মানে পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা। এবার এ কথার নিহিতার্থ ধরে ফেলতে তিনি রাগে ফুসতে লাগলেন। মেমসাহেবকে বললেন, তা হলে ব্যাপারটা হল, আপনার কলকাতায় শ্বশুরবাড়িতে আসা হল পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা। আপনি ভাবেন কী?
তাতাইবাবু মধ্যস্থতা করে বললেন, আপনার মেমবউদি বাংলা কিছু বোঝেন না। ওঁকে এসব কথা বলে কোনও লাভ নেই।
ডোডোবাবু উত্তেজিত হয়ে বললেন, তা হলে এই সব আপনি মুখস্থ করিয়েছেন মেমকে দিয়ে আর উনি কিছুই না বুঝে ঝরঝর করে বলে যাচ্ছেন।
বছর কুড়ি-পঁচিশ আগে হলে এতক্ষণে ডোডোবাবু আর তাতাইবাবুর মধ্যে হাতাহাতি হয়ে যেত।
এ বার অবশ্য তা হল না। ডোডোবাবুর কোথায় একটা কাজ ছিল, তিনি তাড়াতাড়ি চলে গেলেন, বলে গেলেন দুয়েকদিনের মধ্যেই আসছেন। বেরোনোর সময় সদর দরজা চৌকাঠের ওপরে তাতাইবাবু ডোডোবাবু মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, মেমবউ ঠিক মধ্যিখানে এসে দাঁড়ালেন। তার পর দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে দুজনকে বার দুয়েক ভাল করে দেখে কোনও রকম দ্বিধা না করে মেমসাহেব ডোডোবাবুকে বললেন, তুমি যেমন বুনো তেঁতুল আর ইনি তেমনই বাঘা ওল, বলে তাতাইবাবুকে দেখালেন।
আধকপালে
সকলেই কেমন ভাল ভাল গল্প লেখে। প্রেমের, ভালবাসার, বিরহ-বিচ্ছেদের গল্প। জীবনের জয় পরাজয়, বাঁচার লড়াইয়ের গল্প। কত আর্থসামাজিক প্রশ্ন। বর্তমানের সমস্যাবলি সেই সব গল্পের মধ্যে ফুটে ওঠে।
সুখ-দুঃখের নিটোল গল্প সেসব। তার মধ্যে পাত্র-পাত্রী, চরিত্রাবলি রয়েছে, কথোপকথন অর্থাৎ চোখা চোখা লাগসই সব ডায়ালগ আছে। সব চেয়ে বড় কথা সেখানে কাহিনি আছে। সেই কাহিনির গতি আছে। পরিণতি আছে।
আমার গল্পগুলো কিছুতেই কেন যেন, সেরকম হয় না। হাজার চেষ্টা করলেও না। কী রকম ন্যালাখ্যাপা, উলটোপালটা গল্প হয়ে যায় আমার। সেগুলোর কারণ নেই, কাহিনি নেই শুধু ফ্যা-ফ্যা করে হাসি। কেন যে দয়ালু পাঠক, দয়াবতী পাঠিকা সেই হাঘরে গল্প পড়েন, কেন যে সম্পাদক মহোদয় অনুগ্রহ বশত সেই ফাপা গল্প ছাপেন, সেটা আমি যেমন বুঝতে পারি না, আরও অনেকেই পারেন না। এমনকী আমার স্ত্রী পর্যন্ত পারেন না।
বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচির মতো একটা যৎকিঞ্চিৎ গল্পে তিন অনুচ্ছেদ ভূমিকা ফেঁদে বসার পরে খেয়াল হল যে এরকম ভাবে কালক্ষেপণ করা উচিত হচ্ছে না কারণ আমাদের বর্তমান কাহিনির নায়কের আধকপালে হয়েছে। তাঁকে বেশিক্ষণ ঝুলিয়ে রাখা উচিত হবে না।
আমাদের এই কাহিনির নায়কের নাম সুদর্শন পাল। সুদর্শনের আধকপালে হয়েছে।
আধকপালে ব্যাপারটা যাঁরা জানেন না তাদের বোঝানোর চেষ্টা করব না। তবে যেটা আশঙ্কা করেছিলাম যে এই আজব শব্দটি কোনও অভিধানেই থাকবে না, সেটা ঠিক নয়। শব্দটি দেখছি সব অভিধানেই রয়েছে, খুব সম্ভব অভিধানকারেরা সঙ্গত কারণেই এই আধকপালে ব্যারামে খুব ভোগেন, সে জন্যেই শব্দটি অভিধানে চলে গেছে।
অভিধানের কথাই যখন উঠল, আগে আধকপালে শব্দটার অভিধানগত মানেটা দেখে নিই। চলন্তিকায় আধকপালে মানে রয়েছে এক দিকে মাথা ধরা। আর সংসদ বিস্তারিত করে বলেছেন, অর্ধেক বা আংশিক মাথা বা কপাল জুড়িয়া আছে এমন মাথাধরা।
আধকপালে খুব গোলমেলে ব্যারাম। সহজে সারতে চায় না। মাথার একদিকে বাঁয়ে বা ডাইনে একটা মাথাধরা সদাসর্বদা লুকিয়ে থাকে। কিছুতে যেতে চায় না। সারা দিনমান ধরে খুব কষ্ট দেয়। সেই সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে শোয়া পর্যন্ত যন্ত্রণা, কখনও কম, কখনও বেশি।
কিন্তু আমাদের এই কাহিনির নায়ক সুদর্শনবাবুর আধকপালে অসুখটা অভ্যেস হয়ে গেছে। তিনি প্রায় বছরখানেক ধরে এই অসুখে ভুগছেন। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট, খাওয়া-পরা, অফিস-কাছারি করা, টিভি দেখা, খবরের কাগজ পড়া, সব কিছুতেই কষ্ট হত। সব সময় মাথার মধ্যে একটা যন্ত্রণা। কপালের বাঁদিক ঘেঁষে একটা অসহ্য টনটনানি। অডিকলোনের পট্টি কপালে দিলে দরজা জানলা বন্ধ করে চোখ বুজে অন্ধকার ঘরে শুয়ে থাকলে একটু আরাম হত।
মাথা ধরাটা এখনও সব সময়ই মাথার মধ্যে আছে, কিন্তু ব্যাপারটা সহ্য হয়ে গেছে সুদর্শনবাবুর। মাথায় একটু ঝাঁকি লাগলেই যন্ত্রণাটা চিড়িক দিয়ে ওঠে, তা ছাড়া অন্য সময়ে তেমন কষ্ট হয় না। কোনও রকমে কাজকর্ম, দিনগত পাপক্ষয় করে যাওয়া যায়। ব্যথাটা থাকলেও জানান দেয় না।
গত বছরের গোড়ায় যখন প্রথম আধকপালে হল সুদর্শনবাবুর, তিনি দু-চারবার পাড়ার ডাক্তারের কাছে যাতায়াত করে অবশেষে একশো টাকা ভিজিটের বড় ডাক্তার দেখিয়েছিলেন। বড় ডাক্তার নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা, মেডিকেল টেস্ট করেও যখন অসুখটার প্রকৃত কারণ নিরূপণ করতে পারলেন না, তিনি সুদর্শনবাবুকে বললেন, সরি, আপনার অসুখটা সহজে সারবে না। ওষুধপত্র খেয়ে কিছু সুরাহা হবে বলে মনে হয় না। অপেক্ষা করে দেখুন। একা একা সেরে যায় কিনা।
কালক্রমে অসুখটা সম্পূর্ণ সেরে যায়নি বটে, তবে তার দাপট অনেকটা কমেছে। সুদর্শনবাবু টের পান যন্ত্রণাটা মাথার মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে আছে, মাথা নড়া-চড়া করলে, বিশেষ করে জোরে হাসলে মাথায় লাগে। তা ছাড়া মালুম হয় না।
সম্প্রতি কয়েক সপ্তাহ আগে সেই বড় ডাক্তারবাবুর কাছে আবার গিয়েছিলেন সুদর্শনবাবু। আরেকবার একশো টাকা ভিজিট দিয়ে দেখালেন। সব শুনে ডাক্তারবাবু বললেন, তাহলে তো এখন আর আপনার কষ্ট নেই।
সুদর্শনবাবু বললেন, না স্যার কষ্ট আছে, ওই যে বললাম না হাসলে পরে মাথায় কঁকি লাগলে ব্যথা লাগে। যন্ত্রণা হয়। ডাক্তারবাবু বললেন, এর কিছু করা যাবে না। আপনি হাসা ছেড়ে দিন। এখন থেকে হাসবেন না।
সেই থেকে সুদর্শনবাবু হাসা ছেড়ে দিয়েছেন। মানে ছাড়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু হাসা ছেড়ে দেয়া সহজ কাজ নয়। হাসি সম্পূর্ণ বন্ধ করার আগে এ নিয়ে আরও একদিন আরও একশো টাকা ভিজিট দিয়ে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন, সুদর্শনবাবু। সুদর্শনবাবুর জিজ্ঞাসা ছিল একটা, হাসা ছেড়ে দিলে কোনও ক্ষতি হবে না তো? সুদর্শনবাবু বলেছিলেন, অতি বড় বেয়াড়া বদমাইস, শয়তান লোক পর্যন্ত হাসে। হার্টের রোগী, ফঁসির আসামি, জজসাহেব, মন্ত্রী, উকিল, পুলিশের দারোগা, ডাক্তার পর্যন্ত হাসে। হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে, থানার লক-আপে, শ্মশানে পর্যন্ত তোক হাসে। এ অবস্থায় যদি আমি হাসি বন্ধ করি আমার কোনও ক্ষতি হবে না তো?
অনেক রকম ভেবেচিন্তে ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, আপনার কথার মধ্যে একটা যুক্তি আছে। কিন্তু আপনি তো ইচ্ছে করে বা শখ করে হাসি বন্ধ করছেন না। হাসতে আপনার কষ্ট হয়, যন্ত্রণা বাড়ে তাই আপনি হাসি বন্ধ করছেন। তা ছাড়া আরও একটা কথা আছে হাসতে যে হবেই এমন কোনও কথা নেই। কোথাও কোনও বইতে, ডাক্তারি শাস্ত্রে এমন কথা লেখা নেই যে হাসতে হবেই, প্রতিদিন এতক্ষণ না হাসলে মানুষ মরে যাবে বা তার কোনও কঠিন অসুখ হবে।
সুদর্শনবাবু বললেন, একদম হাসে না এমন কোনও রোগী আপনি দেখেছেন কি?
ডাক্তারবাবু বললেন, না। সেরকম দেখেছি বলে হলফ করে বলতে পারব না। তবে অনেক রোগীর মধ্যে দু-চারজন এরকম ঘটতেই পারে। সে হয়তো হাসে না কখনওই, কোনও কারণেই হাসে না। সে হয়তো নিজেই জানে না, যে সে কখনও হাসে না। অন্যেরাও হয়তো খেয়াল করে না। এই রকমভাবে না হেসে সে দিব্যি মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, কাটিয়ে দেয়। খায়-দায়-ঘুমোয়, বাজার করে, অফিস করে কেউ কিছু টের পায় না। কেউ ধরতে পারে না যে এই লোকটি একদম হাসে না। এই পর্যন্ত একদমে বলে একটু থেমে খুবই দার্শনিকের মতো গলায় ডাক্তারবাবু বললেন, আর ধরবেই বা কী করে। কেউ তো আর সব সময় হাসে না। কথায় কথায় তো আর সর্বদা হাসার দরকার পড়ে না। কেউ যদি একেবারেই কখনও না হাসে সেটা ধরা সহজ নয়। যে লোকটাকে এখন হাসতে দেখা যাচ্ছে না সে যে কখনওই হাসে না সেটা কী করে বোঝা যাবে?
ডাক্তারবাবুর সুপরামর্শ শুনে খুবই দুশ্চিন্তা নিয়ে বাড়ি ফিরলেন সুদর্শনবাবু।
বলা বাহুল্য ডাক্তারবাবুর কথা শুনে তার খুব হাসি পাচ্ছিল। বহু কষ্টে ডাক্তারবাবুর সামনে হাসির বেগ দমন করেছিলেন।
কিন্তু ডাক্তারবাবুর ওখান থেকে ফিরে এসে যখনই ডাক্তারবাবুর উপদেশ তার মনে পড়ছে তিনি অনর্গল হাসির দমকে ফেটে পড়েছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে মাথার মধ্যে বাঁদিকের কপালটা যন্ত্রণায় মুচড়িয়ে উঠেছে। তীব্র ব্যথায় হাসি থেমে গেছে। কিন্তু হাসির কারণটা থেকে গেলে, যত যন্ত্রণাদায়কই হোক হাসি বন্ধ করা কঠিন।
এ ছাড়া আরেকটা গোলমেলে ব্যাপার আছে। সুদর্শনবাবুর ঠাকুরদা ছিলেন হেড পণ্ডিত। বাবা ছিলেন হেডমাস্টার। দুজনেই মোটাসোটা লম্বাচওড়া, কৃষ্ণকায় পুরুষ। আর, সুদর্শনবাবু রোগা, ফরসা চিকন চেহারার মানুষ।
আসলে সুদর্শনবাবু হলেন, মা-গঠনী মানুষ। মায়ের মতো গঠন পেয়েছেন। সুদর্শনবাবুর সেই কৃশকায়া অনতিদীর্ঘা পরমা সুন্দরী জননীর জননী অর্থাৎ তাঁর দিদিমাও একই রকম ছিলেন।
সুদর্শনবাবুর পিতা-পিতামহ ছিলেন স্বভাবত এবং বৃত্তিগত কারণে গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। দৈনন্দিন পৃথিবীতে তাঁরা হাসির কারণ খুঁজে পাননি। বিশেষ কখনও হাসতেন না।
আদতে এটা একটা শৃঙ্খলার নিয়মানুবর্তিতার ব্যাপার। সব কিছু নিয়মমাফিক, শৃঙ্খলার মধ্যে চললে এমন কিছু ঘটা বা ভাবা সম্ভব নয়, যাতে হাসি পেতে পারে।
সুদর্শনবাবু যদি পিতৃপিতামহের সরাসরি উত্তরাধিকার পেতেন তাহলে হাসি বন্ধ করার ব্যাপারে তাকে অত কষ্ট করতে হত না।
কিন্তু ওই যে বলেছি, সুদর্শনবাবু মা-গঠনী সন্তান। তার জিন-কোষ, চিন্তা-ভাবনা সবই মাতৃতান্ত্রিক। ফলে হাসির ব্যাপারটা তিনি জন্মসূত্রে পেয়েছেন মায়ের দিক থেকে।
সুদর্শনবাবুর দিদিমা ছিলেন সুখে-দুঃখে দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে সদারসিকা। দুয়েকটা ছোট উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা প্রমাণ হবে।
দিদিমা ছাদে আমসত্ত্ব শুকোতে দিয়েছেন হালকা বাঁশের ফাঁক ফাঁক ঝুড়ি চাপা দিয়ে। সেই ঝুড়ি উলটিয়ে কালো পাথরের অতিকায় থালা ভরতি আমসত্ত্ব নামাতে গিয়ে ওলটানো ঝুড়ি এবং শূন্য থালা দেখে দিদিমা হেসে আকুল হয়ে গেলেন। সেদিন কেন যে তিনি অত হেসেছিলেন সুদর্শনবাবুর সেটা আজও বোধগম্য নয়।
আরেকবার একটা ব্যাঙ উঠোন থেকে বার বার লাফ দিয়ে ঠাকুরদালানের বারান্দায় উঠবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু কিছুতেই প্রয়োজনীয় উচ্চতায় উঠতে না পারায় বার বার বারান্দার নীচে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে যাচ্ছিল। দিদিমা পুজোর ঘরে পুজো বন্ধ করে হাসতে লাগলেন।
সুদর্শনবাবুর মায়ের ব্যাপারে একটা ঘটনার উল্লেখ করলেই যথেষ্ট।
সুদর্শনবাবুর মা একদিন পা পিছলিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। সে সাংঘাতিক পড়া। এক ঘর লোকের সামনে ভারী শরীর নিয়ে মেঝেতে মাথা ঠুকে গিয়েছিল। সাধারণত কেউ হঠাৎ পা পিছলিয়ে পড়ে গেলে যে পড়ে সে ছাড়া বাকি সবাই হেসে ওঠে। কিন্তু এক্ষেত্রে একটা ব্যতিক্রম হয়েছিল। সকলের সঙ্গে নিজের পতনে তিনিও হেসেছিলেন, তখন কিন্তু তাঁর মাথা ফেটে গিয়ে রক্ত পড়ছে কপাল দিয়ে।
মা-দিদিমার ধাতটা সুদর্শনবাবুও পেয়েছেন। সব কারণেই তার হাসি পায়। ডাক্তারবাবুর হাসতে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও সুদর্শনবাবু ভেবে দেখলেন যে তার মা যদি মাথা ফেটে গেলেও হাসতে পারেন তিনি কেন মাথা ধরা নিয়ে হাসতে পারবেন না। কিন্তু ব্যাপারটা বেশ কষ্টের ব্যাপার।
পূর্বজন্মের গুণ বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। সুদর্শনবাবু নিশ্চয়ই বড় ডাক্তারবাবুর কাছে আগের জন্মে অনেক টাকা ধার করেছিলেন। এ জন্মে সেটা শোধ না দিয়ে অব্যাহতি নেই।
তাই এর পরেও আরেকদিন সেই বড় ডাক্তারবাবুর কাছে যেতে হল সুদর্শনবাবুকে। তিনি ইতিমধ্যে সুদর্শনবাবুকে মোটামুটি বুঝে ফেলেছেন। আজ ভদ্রতার খাতিরে আর ভিজিট নিতে চাইলেন না। কিন্তু সুদর্শনবাবু জোর করে একটা একশো টাকার নোট ডাক্তারবাবুর টেবিলে পেপার ওয়েট চাপা দিয়ে রেখে দিলেন। তিনি বিচক্ষণ লোক। তিনি জানেন ডাক্তারের ভিজিট আর উকিলের ফি সব সময়েই দেওয়া উচিত। তাতেই মঙ্গল হয়।
সে যা হোক, আজ মহা দুর্যোগের দিন। বাইরে চারদিক কালো করে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। ডাক্তারবাবুর চেম্বারে আজ ভিড় নেই। সর্বশেষ রোগী এক সুদর্শনবাবুই রয়েছেন। আজ সুযোগ পেয়ে তিনি ডাক্তারবাবুর সঙ্গে মন খোলসা করে আলোচনা করলেন।
সুদর্শনবাবু বললেন, ডাক্তারবাবু আপনার পরামর্শ মেনে যে চলা যাচ্ছে না।
ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, কী পরামর্শ?
সুদর্শনবাবু বললেন, ওই যে আপনি বলেছিলেন না, ওই যে না-হাসতে বলেছিলেন।
ডাক্তারবাবু বললেন, হাসলে আপনার কষ্ট হয় তাই আপনাকে হাসতে বারণ করেছিলাম।
সুদর্শনবাবু বললে, না হেসে যে পারি না। হাসব না ভাবলে আমার যে আরও বেশি হাসি পায়।
ডাক্তারবাবু প্রশ্ন করলেন, কিন্তু আপনি বলেছিলেন না বেশি হাসলে আপনার যন্ত্রণা বেশি হয়, ব্যথা বাড়ে।
সুদর্শনবাবু জানালেন, খুব কষ্ট হয়। খুব ব্যথা হয়।
ডাক্তারবাবু বললেন, তা হলে আপনি হাসবেন কেন? এত কী হাসির ব্যাপার আছে। কীসে আপনি হাসেন।
সুদর্শনবাবু স্বীকার করলেন যে, বাজারে জিনিসপত্রের দাম শুনলে তার হাসি পায়। খবরের কাগজের খবর পড়লে, নেতাদের বক্তৃতা শুনলে তার হাসি পায়। হাসির গল্প পড়লে, হাসির সিনেমা বা সিরিয়াল দেখলে তার হাসি পায়। দুঃখের গল্প পড়লে, দুঃখের সিনেমা বা সিরিয়াল দেখলে তিনি হাস্য সম্বরণ করতে পারেন না।
সব শুনে ডাক্তারবাবু বললেন, কিন্তু আপনাকে তো হাসলে চলবে না। একটু সাবধানে থাকতে হবে। আচ্ছা আপনি কি ভেবে দেখেছেন এই যে এত পশুপাখি এরা কখনও হাসে না। কুকুর হাসে না, বিড়াল হাসে না, কাক হাসে না, কোকিল হাসে না, গোরু-ঘোড়া, বাঘ-সিংহ এমনকী হায়েনা পর্যন্ত হাসে না। অথচ এদের না হেসে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। যে যার মতো বেশ তরতাজা থাকছে, খাচ্ছে-দাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে। না হেসে জীব জগতের এদের কারও বিন্দুমাত্র অসুবিধে বা ক্ষতি হচ্ছে না। তা হলে আপনি কেন হাসবেন? লতা-পাতা গাছ কেউ কখনও হাসে না, তবু আপনাকে হাসতে হবে?
ডাক্তারবাবুর এই বক্তৃতা শুনে ছোট করে অট্টহাস্যে ভেঙে পড়লেন সুদর্শনবাবু। হাসতে হাসতে মাথার যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠতে উঠতে সুদর্শনবাবু বললেন, কিন্তু আমি যে মানুষ। না হেসে আমার যে কোনও গতি নেই। না হেসে আমার কোনও উপায় নেই।
এই বলে ডাক্তারবাবুর চেম্বারের মেঝেতে পেটে হাত দিয়ে হেসে গড়াতে গড়াতে সেই সঙ্গে মাথার ঝুঁকিতে অসহ্য যন্ত্রণায় গোঙাতে লাগলেন সুদর্শনবাবু। তাঁর বক্তৃতার পরিণতি দেখে ডাক্তারবাবু স্তম্ভিত। এর চেয়েও অবাক কাণ্ড হো-হো করে হাসতে হাসতে হঠাৎ এক সময় যন্ত্রণার গোঙানিটা থেমে গেল সুদর্শনবাবুর। তিনি টের পেলেন যন্ত্রণাটা মাথা থেকে চলে গেছে। ডাক্তারবাবুও বুঝতে পারলেন তার সেই পুরনো রোগী এই মাত্র রোগমুক্ত হয়েছেন।
কিন্তু কী করে সেটা সম্ভব হল সেটা তিনি ধরতে পারলেন না।
ধরতে পারলেও তেমন কোনও সুবিধে ছিল না।
শুধু হাসতে হাসতে আধকপালের কঠিন অসুখ সেরে যেতে পারে ডাক্তারবাবুর পক্ষে সেটা ভাবা কঠিন।
আবগারীশ্বরী
০১. স্থায়ী
বঙ্গীয় কুলীন কায়স্থ বংশে, একটি প্রাচীন রক্ষণশীল পরিবারে শ্রীযুক্ত সনাতন মিত্রের জন্ম।
কিন্তু নিতান্ত দুঃখের বিষয় এই যে সনাতনবাবু মানুষটি যাকে ধার্মিক বা ধর্মপরায়ণ লোক বলে ঠিক সেই ধরনের নন। পুজো-আর্চায় তাঁর মোটেই মন নেই। দেবদ্বিজে বিগ্রহে-প্রতিমায় তাঁর ভক্তি অচলা নয়।
তবে এসবের জন্যে একটা বয়েস লাগে। সে বয়েসে পৌঁছাতে এখনও সনাতনবাবুর ঢের দেরি আছে। সনাতন নামটি ঊনবিংশ শতকীয় হলেও তার বাহক মোটেই ঊনবিংশ শতকের নয়। এই নামটি শুনে যার মনে যাই হোক, ভুল ধারণা পোষণ করে লাভ নেই। আমাদের এই অকিঞ্চিৎকর আখ্যানের প্রাণপুরুষ উক্ত শ্রীযুক্ত সনাতন মিত্রের বয়েস এখন সদ্য বিশের ধাপ গুটি গুটি পার হয়ে তিরিশাভিমুখী, উচ্ছল কুড়ি আর উজ্জ্বল তিরিশের মধ্যের দরজায় তিনি দাঁড়িয়ে।
বলা বাহুল্য, এই সনাতন নামকরণটির পিছনে একটি ক্ষুদ্র ইতিহাস রয়েছে।
স্বর্গীয় নিত্যপ্রসাদ মিত্র ছিলেন সনাতনবাবুর পিতামহ। তিনি কর্মজীবনে পুলিশ কোর্টের দারোগা বা কোর্ট ইনসপেক্টর ছিলেন কিন্তু অনেক পুলিশ দারোগার মতোই তিনি খুব ধার্মিক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। সনাতন সঙ্কীর্তন সঙ্ঘ-এর তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা এবং আমৃত্যু সভাপতি।
যে বছর সনাতন সঙ্কীর্তন সঙঘ এক কথায় স-সস প্রতিষ্ঠিত হয় ঠিক তার আগের বছর সনাতন জন্মান। এবং অনিবার্যভাবেই সনাতন নামটি তার কাঁধে পড়ে।
চাকুরি জীবনের শেষভাগে নিত্যপ্রসাদের মূল কাজ ছিল বিভিন্ন ধরনের ফৌজদারি মামলার আসামিকে আদালতে সোপর্দ করা।
এখানে বলা রাখা উচিত যে নিত্যপ্রসাদ অত্যন্ত ন্যায়নিষ্ঠ অফিসার ছিলেন। নিজের কাজ খুব মন দিয়ে করতেন। উৎকোচে তাঁর যে খুব অনীহা ছিল তা নয়। কিন্তু তাঁর নিজস্ব একটা বিচারবুদ্ধি ছিল। তিনি নিজে যে মামলাটা খারাপ মনে করতেন, সে মামলার আসামি তার বিচারে গর্হিত অসামাজিক কর্ম করেছে বলে তিনি ভাবতেন সেখানে খুবই কঠোর হতেন। তাঁর তদ্বির তদারকিতে অসংখ্য প্রতারক-জোচ্চোর, মদ্যপ-লম্পট শ্রীঘরবাসী হয়েছে।
আসল কথা এই যে কোর্ট ইনসপেক্টর এন পি মিত্র প্রতারণা, লাম্পট্য, ব্যভিচার ইত্যাদি সহ্য করতেন পারতেন না। তার হাতে পড়লে এদের নিস্তার ছিল না। কিন্তু সাধারণ চুরি-ডাকাতি, রাগের মাথায় খুন এই সব ধর্তব্যের মধ্যে নিতেন না। সুতরাং এদের কাছ থেকে ঘুষ নিতে তার বিবেক দংশন হত না।
পুলিশের দারোগার বিবেক দংশন এই কথাটা হয়তো কারও কারও কাছে গোলমেলে ঠেকতে পারে। তাদের অবগতির জন্যে জানাই যে পুরুষানুক্রমে ধর্মপরায়ণ বংশের সন্তান শ্রীযুক্ত নিত্যগোপাল মিত্র নিজেও চিরকালই খুব ধর্মপ্রাণ ছিলেন। প্রথম যৌবনে সেই যুদ্ধের বাজারে যখন চিনি ও চিনিজাত সব দ্রব্য অদৃশ্য হয়ে গেছে তিনি সখেরবাজারে বাতাসাপট্টি ঘুরে ঘুরে তার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত গৃহদেবতা গোপালঠাকুরের জন্যে সাদা বাতাসা কিনে আনতেন। প্রতিবার কাজে বা অকাজে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় অষ্টধাতু নির্মিত গৃহদেবতার মুখে একটি সাদা বাতাসা গুঁজে দিয়ে বেরোতেন।
বেশি বয়েসে রিটায়ার করার মুখে এন পি মিত্র অতিশয় ধর্মপ্রবণ হয়ে পড়েন। গঙ্গার ঘাটের হিন্দুস্থানি কুলিদের আখড়ার বজরং ব্যায়ামগার থেকে শুরু করে আট হাজার আটশত আটবার অবিরাম হরিনাম সমিতির সঙ্গে তিনি যুক্ত হন।
রিটায়ার করার পর এন পি মিত্র নিজ উদ্যোগে অবিরাম হরিনাম সমিতির নাম বদল করে সনাতন সঙ্কীর্তন সঙঘ নামে রেজিস্ট্রি করেন এবং নিজে তার সভাপতিত্ব গ্রহণ করেন।
সেই সময় সনাতন নিতান্ত শিশু। পিতামহের অতি আদরের পৌত্র। আদরের আতিশয্যে এখন আজীবন সনাতনকে নামের বোঝাটি বহন করে যেতে হচ্ছে।
০২. অন্তরা
আসানসোল থেকে একটু এগিয়ে ধানবাদের পথে বঙ্গ-বিহার সীমান্তের কিঞ্চিৎ আগে একটি সদাব্যস্ত অঞ্চলের অনতিখ্যাত কিন্তু সুচালু কারখানার সহকারী ফোরম্যানের কাজ করেন সনাতন। তার ভাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নেই। একটি ডিপ্লোমা আছে কিন্তু কাজ জানেন, নিজের কাজটা খুব ভালভাবেই জানেন। সেখানে তার যোগ্যতা অনস্বীকার্য। তা ছাড়া শক্ত সমর্থ যুবক, লোহাপেটা শরীর। কোম্পানিতে সনাতন মিত্রের সুনাম ও কদর দুই-ই আছে।
সনাতন মিত্র যে কোম্পানিতে কাজ করেন, সেটি খুব বড় না হলেও পুরনো এবং ভাল। কোনও উটকো, কাঁচা টাকায় হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ব্যাঙ্ক ঠকানো কারখানা নয়।
কারখানার কর্মচারিদের জন্যে একটা পুরনো আবাসন ব্যবস্থা আছে। কিন্তু ব্যাচেলারদের কোয়ার্টার দেয়া হয় না। তাদের জন্যে তিন কিলোমিটার দূরে কোলিয়ারি গঞ্জে একটা দোতলা বাড়ি ভাড়া নেয়া আছে। সেটাই হল ব্যাচেলারস মেস।
এই মেসেরই একটা ঘরে সনাতন মিত্র থাকেন। কলকাতার সখের বাজারে তাদের সাবেকি বাড়িতে সনাতনবাবুর দাদা-বউদি, বাবা-মা, অনূঢ়া দিদি রয়েছেন। সনাতনবাবু আর তার এই অনূঢ়া দিদিটি পিঠোপিঠি ভাইবোন।
দিদিটির নাম অনুরাধা। পিতামহ প্রদত্ত নাম ছিল নিতান্তই রাধা। সেকেন্ডারি পরীক্ষার ফর্ম পূরণ করার সময় বড়দিমণি মানে প্রধান শিক্ষিকা মহোদয়ার হাতে পায়ে ধরে রাধা অনুরাধা হয়েছিল। তবে রাধা নামটা আজও বহাল আছে, সেটা ডাকনাম হিসেবে।
সেই রাধা কিংবা অনুরাধার বিয়েতে একদম মন নেই। কিন্তু ভালবাসার দিকে খুব ঝোঁক। আজ পর্যন্ত তিরিশ-চল্লিশ বার তিনি প্রেমে পড়েছেন, এমনকি একই ব্যক্তির সঙ্গে পাঁচ-সাতবার। তবে পুরো ব্যাপারটাই মানসিক, মৌখিক, ওই সেই যে রজকিনী প্রেম, কীসের গন্ধ যেন তাতে নেই। সেই ব্যাপার আর কী!
দিদির বিয়ে না হলে সনাতন বিয়ে করেন কী করে? তাই তাঁরও বিয়ে হয়নি। দিদির যা মনোভাব দেখা যাচ্ছে তাতে সদ্য সদ্য সেরকম কোনও সম্ভাবনাও নেই।
সে যা হোক, অনুরাধাদির কাহিনি এখানে প্রক্ষিপ্ত। সনাতন মিত্রের কথা বলি। গল্পের প্রথমেই তাকে অধার্মিক বলেছি। ভাবনাটা ব্যাখ্যা করা দরকার।
সনাতন মিত্রের মতো একজন পঁচিশ-তিরিশ বছর বয়েসের যুবকের আবার ধর্মান্ধতা কী? এ বয়েসে আজকাল কেউ টিকিও রাখে না, তিলকও কাটে না, ত্রিসন্ধ্যা জপ-আহ্নিক করার করার প্রশ্নও আসে না।
আর একবারও অস্বীকার করার উপায় নেই যে আর দশটি স্কুল কলেজের ছেলের মতোই সনাতন পরীক্ষার সময় কপালে দইয়ের ফোঁটা দিয়ে ঠাকুর প্রণাম করে পরীক্ষার হলে যেতেন। কলকাতায় থাকতে রাস্তাঘাটে যাতায়াতের পথে মন্দির পড়লে আর দশজনের মতোই চোখ বুজে হাত জোড়া করে কপালে ঠেকাতেন।
আসানসোলের এই কাঠখোট্টা, খরা অঞ্চলে এসে ধর্মভাবটা কী করে যেন বিদায় নিয়েছে সনাতন মিত্রের কাছ থেকে। সনাতনবাবুও ব্যাচেলারস মেস থেকে কারখানার পথটুকু কাজে ঢুকে প্রথম প্রথম হেঁটেই চালিয়ে দিচ্ছিলেন। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসে এ অঞ্চলে গরম সাংঘাতিক। বেলা উঠতে না উঠতে চারদিক তেতে ওঠে। রোদ্দুর ঝাঁঝ করে। তখন রাস্তায় হাঁটা খুব কষ্ট। যাতায়াতের সুবিধের জন্যে কিছুদিন পরে একটা সাইকেল কিনেছিলেন।
তা সাইকেলেই হোক অথবা পায়ে হেঁটেই হোক, মেস থেকে কারখানা যাতায়াতের রাস্তা একটাই। সেই পথে কারখানা থেকে একটু এগিয়ে ঠিক কারখানায় ঢোকার পথের মুখে একটা হনুমানজির মন্দির আছে। খুবই জাগ্রত মন্দির। তার সামনের উঠোনে কারখানার দারোয়ানরা সকাল সন্ধে জয় বজরঙ্গবলী বলে ঊরুতে থাপ্পড় দিয়ে কুস্তি লড়ে।
কারখানার সমস্ত কুলি কামিন, বাবু-অফিসার এই হনুমানজির মন্দির পেরোবার সময় প্রণাম করে। কেউ যেতে যেতে কপালে হাত ঠেকিয়ে কেউ মনে মনে, কেউ বা গড় হয়ে আবার অতি ভক্তিমানরা সাষ্টাঙ্গে প্রণতি জানায়।
তা ছাড়া বড় রাস্তার মোড়ে রয়েছে নবগ্রহ মন্দির। শিল্পাঞ্চলের গরিব মানুষদের মনে ভাগ্য, তুকতাক এই সব নিয়ে, তন্ত্রে-জ্যোতিষীতে খুবই বিশ্বাস। নবগ্রহ মন্দিরেও দিনরাত ভিড় লেগেই আছে। এমনকী সনাতনবাবুর বন্ধুদের, সহকর্মীদের মধ্যে এমন অনেকে আছেন যাঁরা নবগ্রহ মন্দিরের দেয়ালে পরপর তিনবার মাথা না ঠুকে কারখানায় যান না। তার জন্যে তাদের কারখানায় ঢুকতে লেট হলেও তারা সেটা মেনে নেন।
কিন্তু মাথা ঠোকা বা কপাল ছোঁয়ানো তো দূরের কথা সনাতনবাবু পায়ে হেঁটে বা সাইকেলে যাতায়াতের পথে হনুমানজির বা নবগ্রহ মন্দিরে কখনও প্রণাম জানান না। অনেকে এসব জায়গায় থেমে, সাইকেল বা হাঁটার গতি কমিয়ে মনে মনে কিংবা ঠোঁট বিড় বিড় করে দেবতাকে নমো করেন।
সনাতনবাবু এসব কখনওই করেননি। এমনকী কাছেই বিহার বর্ডারে আন্তরাজ্য একসাইজ চেকপোস্টের পাশে এক জাগ্রত দেবী রয়েছেন। দূর দূরান্ত থেকে লোকজন, দেহাতি মানুষ সেখানে পুজো দিতে আসে।
দেবীর নাম আবগারীশ্বরী। কলকাতা হাইকোর্টে যেমন এক শিবলিঙ্গ আছে। লর্ড হাইকোর্টেশ্বর; কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরানো বটতলায় ছিল বিশ্বেশ্বরী, ঠিক তেমনই আবগারীশ্বরী।
এই রাস্তায় আবগারির মানে একসাইজের বাবুদের বড় অত্যাচার। এই চেকপোস্টে নজরানা না দিয়ে এ রাস্তা দিয়ে যাওয়া কঠিন। সরকারি নীতির সঙ্গে সঙ্গে আবগারির থাবা ক্রমশ বড় হচ্ছে, বিশেষ করে বিহার এলাকায় শুধু গাঁজা-ভাং, মদ বা মাদকদ্রব্য নয়, আবগারির আওতায় ওষুধ থেকে দেশলাই, প্রসাধনী থেকে বিলাস দ্রব্য অনেক কিছুই এসে গেছে।
রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা বিশাল বিশাল হিন্দি ফর্ম পূরণ করতে দেওয়া। মালপত্তর কিছু লোপাট করা তদুপরি নগদ অর্থ-আবগারির বাবুদের খাই বড় বেশি।
স্বাভাবিক কারণেই পাঞ্জাবি ধাওয়া, ভাতের হোটেল, পানের দোকান এবং এই বড় মন্দিরটি গড়ে উঠেছে। এই মন্দিরের জাগ্রত দেবী আবগারীশ্বরীর পুজো দিলে চেকপোস্ট থেকে তাড়াতাড়ি পরিত্রাণ পাওয়া যায়। শোনা যায়, আবগারীশ্বরীর প্রধান পুরোহিত চেকপোস্টের দারোগাবাবুর যমজ ভাই। দুজনে নাকি একইরকম দেখতে।
দুষ্ট লোকে বলে, এই দুজনে নাকি একই লোক। কারণ দারোগাবাবুকে আর পুরোহিতমশায়কে কখনও নাকি একসঙ্গে পাশাপাশি বা মুখোমুখি দেখা যায়নি। তা ছাড়া একজনের পরনে খাকি ইউনিফর্ম, বুট জুতো, মাথায় বারান্দা টুপি। অন্য জনের খালি গা, কপালে সিঁদুরের ফোঁটা, পায়ে খড়ম, মাথায় টিকি। দুজনের মধ্যে চট করে মিল খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।
যেমন হয় বিভিন্নরকম গাড়ি ড্রাইভারের মারফত আবগারীশ্বরী এই এলাকার চারদিকে বিখ্যাত হয়ে পড়েছে। যথারীতি তার কিছু মহিমা ও বিভূতির কথাও শোনা যাচ্ছে। শুধু ড্রাইভাররা নয়, সাধারণ মানুষ যাদের আবগারির চেকপোস্টে কোনও কাজ নেই, তারাও যাচ্ছে দেবীকে প্রণাম করতে। প্রতি অমাবস্যার রাতে মেলা বসছে দেবীমন্দির ঘিরে। পাঁঠা বলি হচ্ছে, ঢাক বাজছে, রাস্তায় হাইপাওয়ার লাইন থেকে তার টেনে বিদ্যুতের আলোয় চারপাশ ঝলমল করছে। এইসব রাত আবগারি মুক্ত। একসাইজ ফ্রি। মদের ফোয়ারায়, গাঁজার কুণ্ডলিতে আচ্ছন্ন হয়ে যায় মেলা প্রাঙ্গণ।
এদিকে আরেকটা খ্যাতি হয়েছে আবগারীশ্বরীর। ড্রাইবারদের কল্যাণেই সেটা হয়েছে। নতুন গাড়ি কিনলে, লাইসেন্স নিলে, পারমিট নিলে আবগারীশ্বরীর পুজো বাঁধা। প্রতিমার পায়ে ছুঁইয়ে লাল জবা ফুলের মালা গাড়িতে লাগাতে হবে। দৈব দুর্ঘটনা থেকে প্রতিকারের এটাই অমোঘ উপায়।
সনাতন বাবুর সহকর্মীরা, মেসবাসীরা অনেকেই অনেকবার আবগারীশ্বরীকে পুজো দিয়ে এসেছেন। প্রণাম করে এসেছেন। অমাবস্যার রাতে গিয়ে হইহুল্লোড় করে এসেছেন, কিন্তু সনাতনবাবু তাদের সঙ্গে যাননি। পুরো ব্যাপারটা তাঁর বাজে মনে হয়েছে।
০৩. সঞ্চারী
সনাতনবাবুদের কারখানার উলটোদিকে সারি সারি কর্মচারিদের কোয়ার্টার। পুরনো আমলের লাল ইটের বাংলো ধরনের ছোট ছোট বাড়ি।
ঢুকবার মুখে সবচেয়ে প্রথম বাড়িটায় থাকেন কারখানার বড়বাবু অনিল দাস। অনিলবাবুর মেয়ের নাম সঞ্চারী। বছর কুড়ি-একুশ বয়েস হবে। গোলগাল, বেঁটেখাটো, একটু মোটাসোটা, ফরসা, আহ্লাদি গোছের মেয়ে। আসানসোলের কলেজে পড়ে।
সকালবেলা কারখানার জিপে করে আরও অনেকের সঙ্গে সে কলেজে যায়। বিকেলে একা একাই বাসে ফেরে। অনেকের সঙ্গে আলাপ আছে সঞ্চারীর। কিন্তু কাউকেই বিশেষ পাত্তা দিতে চায় না।
সঞ্চারী সনাতন মিত্রকেও চেনে, ভালই চেনে। মুখোমুখি দেখা হলে মুচকি হাসে। কখনও সম্বোধন করার প্রয়োজন হলে সনাতনদা বলে। খুচরো কথাবার্তাও হয়।
ঠিক এই পর্যন্তই সনাতনের সঙ্গে তার সম্পর্ক। এর চেয়ে একটুও বেশি নয়। সঞ্চারীর মনের কথা বলা যাবে না, কথাবার্তা তো একটু বেশি হলে সনাতনের আপত্তি ছিল না।
এর মধ্যে একটা কাণ্ড ঘটল। নিজের পুরনো সাইকেলটা বেচে দিয়ে অফিস থেকে স্কুটার অ্যাডভান্স নিয়ে তিনি একটা টু-হুইলার কিনে ফেললেন।
এই টু-হুইলার কেনার পর কারখানায় বা মেসে না হলেও সঞ্চারীর কাছে সনাতনের গুরুত্ব খুব বেড়ে গেল। টু-হুঁইলারে দু তিনদিন সনাতন মিত্রকে দেখার পর সঞ্চারী আর লোভ সামলাতে পারল না। সনাতনকে বলেই বসল, সনাতনদা আমাকে একটু পিলিয়নে চড়াবেন।
পেছনের বসার জায়গাটা যে পিলিয়ন বলে সেটা সনাতন মিত্র সঞ্চারীর কাছে শিখলেন এবং পিলিয়নে সঞ্চারীকে নিয়ে আসানসোল শহর একপাক ঘুরে নিয়ে পরে পথে নেমে সঞ্চারীকে আলুকাবলি, লস্যি খাওয়ালেন।
এসবের চেয়ে বড় কথা সঞ্চারীকে বসিয়ে অভূতপূর্ব এক শিহরণ বোধ করলেন সনাতনবাবু। এরকম অভিজ্ঞতা এই সামান্য জীবনে আর কখনও হয়নি বিশেষ করে যখন উঁচুনিচু এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় টু-হুইলার ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে উঠছিল। এস্তা সঞ্চারীর বাহুবন্ধন কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। সেই স্পর্শ, সেই সুখানুভূতি সনাতন মিত্রকে আবিষ্ট করে ফেলল।
কিন্তু সনাতন মিত্র একটা মহাপাপ করেছিলেন। নতুন গাড়ি কেনার পর প্রথামত আবগারীশ্বরীর মন্দিরে পুজো দিয়ে জবাফুলের মালা পরাতে হয়, নিজের কপালে এবং গাড়ির কপালে সিঁদুরের ফোঁটা দিতে হয়, সনাতন সেসব কিছুই করেননি। দোকান থেকে কিনে এনে সরাসরি চালানো শুরু করেছেন।
শুভানুধ্যায়ী বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী বন্ধুরা বারণ করেছিলেন, পরামর্শ দিয়েছিলেন আবগারীশ্বরীর মন্দিরে পুজো দিয়ে দ্বিচক্রযানটিকে বিশুদ্ধ করে নিতে। কোনওরকম ফঁড়া বা দুর্ঘটনার যোগ থাকলে তা হলে নিশ্চয় কেটে যেত।
কিন্তু অধার্মিক সনাতনবাবু সেসব কথা মান্য করেননি। সুতরাং যা হওয়ার তাই হল।
টু-হুইলার কেনার সাতদিনের মধ্যে পরপর দুটো দুর্ঘটনায় পড়ে গেলেন সনাতন মিত্র। সন্ধ্যাবেলা চালাতে গিয়ে রাস্তায় বাম্প ছিল খেয়াল করেননি, একদম গাড়ি সুদ্ধ ছিটকিয়ে রাস্তার মধ্যিখানে চিত হয়ে পড়ে গেলেন তিনি।
আরেকদিন একটা লরির পাশ কাটাতে গিয়ে উলটোদিকের একটা দ্রুতগামী ম্যাটাডোরের মুখে পড়ে গেলেন তিনি, কী করে যে সেদিন প্রাণ রক্ষা হয়েছিল ভাবতে গেলে এখনও সনাতনবাবুর হৃৎকম্প হয়।
এই দ্বিতীয় দিনে আবার সনাতনবাবুর পিলিয়নে ছিলেন তাঁরই মেসের এক বন্ধু জগৎলাল।
জগৎলাল সনাতনবাবুকে চেপে ধরলেন, অবিলম্বে আবগারীশ্বরীর পুজো দিয়ে বাহনটিকে বিপদমুক্ত করতে হবে। না হলে সমূহ সর্বনাশ হবে।
সুতরাং অনেক কিছু ভেবেচিন্তে পরের অমাবস্যার সন্ধ্যায় টু-হুইলারটি নিয়ে সনাতনবাবু। আবগারীশ্বরীর মন্দিরে গেলেন। একাই গেলেন, তার এই ধর্মকর্মের তিনি কোনও সাক্ষী রাখতে চান না।
গেঁজেল মাতালদের ভিড় রাতের দিকে বাড়ে, তাই সূর্যাস্তের পরে পরেই ভাল করে অন্ধকার। হওয়ার আগেই তিনি মন্দিরে পৌঁছে গেলেন। মন্দিরের মুখে অনেকগুলো টু-হুইলার, ট্রাক, লরি, এমনকী নতুন সাইকেল এসে গেছে, পুজো দেওয়ার জন্যে। সনাতনবাবু দেখলেন তাদের কোম্পানির জিপটাও তার মধ্যে রয়েছে।
টু-হুইলারটা ঠিকমতো রেখে সনাতন মন্দিরের মধ্যে ঢুকতে যাবেন এমন সময় দেখেন সঞ্চারী মন্দির থেকে বেরোচ্ছে, তার হাতে জবার মালা, শালপাতার ঠোঙা ভর্তি প্যাঁড়া, সঙ্গে বেশ কয়েকজন বন্ধুবান্ধবী। তাদেরও কারও কারও হাতে ওইরকম ঠোঙা, জবাফুলের প্রসাদী মালা।
হঠাৎ এমন জায়গায় সনাতনকে দেখে খুবই খুশি হল সঞ্চারী, ওমা, সনাতনদা আপনি এখানে। খুব লুকিয়ে লুকিয়ে পুজো দেন, তাই না। আজ ধরা পড়ে গেছেন। নিশ্চয়ই আপনার গাড়ির পুজো দিতে এসেছেন।
সত্যিই তো, এই তো সেদিনই পিলিয়নবাহিনী সঞ্চারীকে সনাতন বুঝিয়েছেন, সবাই যা করে তা আমি করি না। কোনও রকম পুজো না দিয়েই আমি আমার টু-হুইলার চালাচ্ছি। এসব ব্যাপারে আমার কোনও সংস্কার নেই।
ভাগ্যিস অন্যান্য স্কুটার ও গাড়ি ইত্যাদির ভিড়ে এখন সনাতনবাবুর টু-হুইলারটি চোখের আড়ালে পড়ে গেছে, তাই যে মুহূর্তে সঞ্চারী তার বন্ধুদের বলল, তোমরা চলে যাও, আমি সনাতনদার সঙ্গে ফিরব। সনাতন বলে বসলেন, সে কী করে হবে? আমার গাড়ি তো সঙ্গে আনিনি। আমি বাসে ফিরব।
ব্যাপারটা কিন্তু আরও বেকায়দা হয়ে গেল। সনাতনবাবুর এই কথায় সঞ্চারী তাকে জোর করতে লাগল, আমাদের জিপ থাকতে আপনি বাসে ফিরবেন কেন? আপনি আমাদের সঙ্গে জিপে উঠে আসুন।
সনাতনকে সঞ্চারী প্রায় হাত ধরে টেনে জিপে তুলল। জিপের পিছনের সিটের শেষপ্রান্তে সঞ্চারীর উষ্ণ শরীর ঘেঁষে বসে হাইওয়ের উদ্দাম হাওয়ার মধ্যেও তিনি ঘামতে লাগলেন।
সঞ্চারীর সঙ্গে তাদের বাড়িতে যেতে হল। আবগারীশ্বরীর পুজোর প্রসাদী প্যাঁড়া খেতে হল। কিন্তু এদিকে সারাক্ষণ সনাতনবাবুর মনটা খুঁত খুঁত করছিল নতুন টু-হুইলারটা মন্দিরের ওখানে পড়ে রইল। চুরি-টুরি না হয়ে যায়। তবু এই মুহর্তে তার পক্ষে আর কিছু করার ছিল না। সঞ্চারীদের বাড়ি থেকে বেরোতে বেরোতে রাত দশটা বেজে গেল। তখন লাস্ট বাসটাও চলে গেছে। এই রাতে দশ-এগারো মাইল রাস্তা উজিয়ে আবগারীশ্বরীর মন্দিরে যাওয়া অসম্ভব।
কোনওরকমে একটা রিকশা ধরে মেসে ফিরে এলেন সনাতনবাবু।
০৪. আভোগ
সারারাত সনাতন মিত্রের ঘুম হল না। মেসের বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করলেন, অত শখের নতুন টু-হুইলারটা নিশ্চয় চুরি হয়ে গেল। একটা পুরো রাত কি সেটা মন্দিরের সামনে পড়ে থাকবে?
ভোর হতে না হতে আলো ফোঁটার আগেই মেস থেকে বেরিয়ে বাস রাস্তায় এলেন সনাতনবাবু। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ভোরের প্রথম বাসের দেখা মিলল।
আধঘণ্টার মাথায় চেকপোস্ট স্টপে নেমে আবগারীশ্বরীর মন্দির। উৎকণ্ঠা ভরা হৃদয়ে দ্রুত হেঁটে মন্দিরের সামনে গিয়ে সনাতন দেখলেন মন্দিরের ফাঁকা উঠোনে শুধু তার বাহনটি কাত হয়ে পড়ে রয়েছে। দুবার চোখ কচলিয়ে বুঝতে পারলেন ঠিকই দেখছেন।
কাল রাতে বিছানায় শুয়ে মনে মনে আবগারীশ্বরীর কাছে সনাতন প্রার্থনা করেছিলেন যে যদি কোনও কারণে তিনি টু-হুইলারটি ফেরত পান একান্ন টাকার পুজো দেবেন।
তার সে প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন দেবী। এবার একান্ন টাকা মানতের পুজোর ব্যবস্থা করতে হয়।
তখন সদ্য মন্দিরের দরজা খুলেছে। কিন্তু বেশ ভিড়। রাস্তার ধারে সারারাত আটকিয়ে থাকা সারবন্দি ট্রাক-লরির ড্রাইভারের পুজো দিতে এসেছে।
কোনওরকমে ধাক্কাধাক্কি করে ঘণ্টাখানেক পরে একান্ন টাকার পুজো দিয়ে এক হাতে জবাফুলের মালা আর অন্য হাতে এক চাঙারি পাড়া, ঠিক কাল সন্ধ্যার সঞ্চারীর মতো সনাতন মিত্র বেরিয়ে এলেন মন্দির থেকে।
বেরোনোর মুখে মন্দিরের দেয়ালে কপাল ঠেকিয়ে জোর প্রণাম করলেন। মনে মনে ঠিক করলেন আজ বিকেলেই সঞ্চারীকে পিলিয়নে বসিয়ে একেবারে বরাকর পর্যন্ত ঘুরে আসবেন। কাল রাতের উষ্ণ সান্নিধ্যের স্বাদ এখনও শরীরে লেগে আছে।
কিন্তু মন্দির থেকে বেরিয়ে স্বপ্নভঙ্গ হল সনাতনবাবুর। কোথায় তার টু-হুইলার। এই এক ঘণ্টায় সেটা হাওয়া হয়ে গেছে। সকালবেলার রোদে আবগারীশ্বরী মন্দিরের সামনের ফাঁকা উঠোন ঝকঝক করছে। টু-হুইলার কেন, কোনও কিছুই সেখানে নেই। শূন্য উঠোনটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন সনাতন মিত্র।
আবহাওয়া
শ্রীযুক্ত নিত্যানন্দ পাটনায়েক কটক বেতার কেন্দ্রের একজন সামান্য ঘোষক। তিনি নিউজ বুলেটিনগুলি পাঠ করে শ্রোতাদের শোনান। মূল সংবাদের সঙ্গে তার সংযোগ খুবই কম, কারণ সে সবই রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে রিলে হয়ে আসে, স্থানীয় সংবাদ প্রচার করার সুযোগ কখনও কখনও পাটনায়েক যে পান না তা নয়, কিন্তু সেও খুবই কম। কারণ ঘোষকদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে জুনিয়ার।
নিত্যানন্দবাবু যদিও উড়িষ্যাবাসী, উড়িষ্যাতেই তার জন্ম এবং ওড়িয়াই তার মাতৃভাষা, তবু যৌবনকালে তিনি কলকাতায় কলেজে পড়াশুনা করেছিলেন এবং স্বাভাবিক ভাবেই বাংলা ভাষা তার বেশ আয়ত্ত হয়েছিল এবং এই ভাষার প্রতি তার একটা অনুরক্তিও মনে মনে গড়ে উঠেছিল।
কটক বেতারকেন্দ্রে কাজ করতেন তিনি, কিন্তু তার কান পড়ে থাকত আকাশবাণী কলকাতায়। প্রত্যেক মুহূর্তেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে, রেডিও স্টেশনের সেটে কলকাতা কেন্দ্রের প্রোগ্রামে কান পেতে তিনি মনে মনে তুলনা করে যেতেন কটক কতটা উঠল কিংবা নামল। কখনও তার হৃ কুঞ্চিত হত অপার বিরক্তিতে, কখনও বা একটু বঙ্কিম হাসির রেখা দেখা দিত ঠোঁটের সীমানায়।
আজ কিছুদিন হল একটা একঘেয়ে কাজের ভার পড়েছে নিত্যানন্দ পাটনায়েকের উপর। আবহাওয়া পূর্বাভাসটি তাঁকে পাঠ করতে হয়। প্রতিদিন একই ভাষায় একই রকম কয়েকটি শব্দ, মধ্যে দু-একটি হয়তো সম্ভবত জাতীয় ওড়িয়া অব্যয় ব্যবহার করে দু মিনিটের নীরস বুলেটিন।
এই আবহাওয়া বুলেটিন শুধুই যে নীরস বা একঘেয়ে কেবল তাই নয়, কয়েকদিন ঘোষণার পর নিত্যানন্দবাবু নিজেই ধরতে পেরেছেন ব্যাপারটা নিতান্তই বাজে এবং ফালতু। যেকোনও ভবিষ্যৎ বাণীর মতোই এই বাণী পুরোটাই লেগে গেলে গেল, না লাগলে লাগল না। কিন্তু অসুবিধা এই যে আবহাওয়ার ভবিষ্যৎ বার্তার ভবিষ্যৎ নিতান্তই কাজের ব্যাপার, একবারে বর্তমানের ঘাড়ের পিছনে দাঁড়িয়ে সকালে বলতে হয় বিকেলে কী হবে, বিকেলে বলতে হয় রাতে কী হবে।
আজকাল পাবলিক আছে, খবরের কাগজ আছে। তারা ভুল ঘোষণা নিয়ে হাসাহাসি করে, অম্ল-তিক্ত কটাক্ষ এমনভাবে করে, যেন আকাশবাণীর ঘোষক শ্রীযুক্ত নিত্যানন্দ পাটনায়েকেরই সম্পূর্ণ দায়িত্ব ব্যাপারটায়, যেন তার বাড়িতেই হাওয়া অফিস, সেখানে বসেই গবেষণা করে ব্যারোমিটারের পারা মেপে আর মুরগির নাচ দেখে নিজেই আবহাওয়ার বিজ্ঞপ্তি প্রস্তুত করে নিরীহ জনসাধারণকে বেকুব ভেবে আকাশবাণীর মাধ্যমে প্রচার করেন শ্রীযুক্ত পাটনায়েক।
ব্যাপারটা তো আর ঠিক তা নয়। হাওয়া অফিস থেকে ইংরেজিতে টাইপ করা বুলেটিন এসে পৌঁছায় রেডিও দপ্তরে, নিত্যানন্দবাবুর কাজ সেটিকে ওড়িয়ায় অনুবাদ করে নির্দিষ্ট সময়ে আকাশবাণী কটকে প্রচার করা।
কিন্তু অসুবিধা হল এই যে, নিত্যানন্দবাবুর নিজেরও একেক সময় ভীষণ খটকা লাগে এই বুলেটিনগুলো প্রচার করতে। ঝকঝক করছে রোদ্দুর, কটকের আকাশের একশো মাইলের মধ্যে একবিন্দু মেঘ নেই এমন টনটনে সকালে একবার গলা খাঁকারি দিয়ে যখন তাকে ঘোষণা করতে হয়, আজ সকালের দিকে প্রবল বৃষ্টিপাত হতে পারে সঙ্গে ঝড়ের সম্ভাবনা তখন যে শ্রোতার দল তাকে নিয়ে হাসাহাসি করবেই এ বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে না, কিন্তু তার দুঃখ হয় শ্রোতারা কি ঘোষকের কণ্ঠস্বরেও একটু সংশয়, একটু দ্বিধা খুঁজে পান না, তারা কি বুঝতে পারেন না যে এই সামান্য ঘোষক অনুবাদক মাত্র, নিতান্তই রুটিনের চাকরি তা না হলে তিনিও জানেন ঘোষণা করা উচিত ছিল, দুচার ছয় মাসের মধ্যে বৃষ্টি বা ঝড়ের সম্ভাবনা নেই, অন্তত আজ সকালের রোদ্দুর দেখে এই রকমই মনে হচ্ছে, এ সত্ত্বেও যদি বৃষ্টি হয় তার জন্যে আবহাওয়ার অফিসের কর্তারা দায়ী, কারণ তারা বলেছেন সাংঘাতিক ঝড় বৃষ্টি হতে পারে, কেন বলেছেন ঈশ্বর জানেন, শ্রোতারাও তাদের কাছে জানতে চাইতে পারেন।
দুঃখের বিষয়, এ ধরনের কোনও ঘোষণা আকাশবাণী একদিনের বেশি বরদাস্ত করবে না। শুধু একদিন মানে ওই প্রথম দিন, তার পরদিনই কানে ধরে আকাশবাণী থেকে বার করে দেবে, না হয় পাগলা গারদে পাঠিয়ে দেবে। এই দুর্দিনে নিজের কাজটিকে যতই উপহাসযোগ্য মনে হোক, নিত্যানন্দ পাটনায়েক কিছুতেই কাজ হারাতে রাজি নন।
নিত্যানন্দবাবুর মনের যখন এই অবস্থা, যখন নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও নেহাত প্রাণের দায়ে তাকে চাকরি করে যেতে হচ্ছে অর্থাৎ আবহাওয়ার অসম্ভব বুলেটিন পাঠ করে যেতে হচ্ছে সেই সময় একদিন সকালে সাড়ে সাতটার একটু আগে দৈববাণী শুনতে পেলেন।
আগেই বলেছি যে কলকাতা বেতারকেন্দ্রের প্রোগ্রামগুলির উপরে স্বাভাবিক অনুরাগ এবং কৌতূহলবশত তিনি যথাসম্ভব কান পেতে রাখতেন। কলকাতা বেতারকেন্দ্রেও কটকের মতোই আবহাওয়ার বুলেটিন প্রচারের আয়োজন আছে এবং তার জন্যেও একজন সংশয়াচ্ছন্ন, দ্বিধান্বিত ঘোষক আছেন।
তবে কলকাতা কেন্দ্রের আবহাওয়া ঘোষণা কটক কেন্দ্রের কয়েক মিনিট আগে হয়ে যায়। একদিন বুলেটিন পাঠ করার জন্য স্টুডিওতে প্রবেশ করার আগে নিত্যানন্দবাবু অভ্যাসমতো নিজের অনুবাদে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলেন। সেদিন সকালবেলা বেশ মেঘলা, মাঝে মধ্যে জোর ঝাপটা বৃষ্টি হচ্ছে সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া।
বাইরের যখন এইরকম প্রাকৃতিক অবস্থা তখন যথারীতি নিত্যানন্দবাবুকে পাঠ করতে হবে, আজ সকালের দিকে আকাশ পরিষ্কার এবং সুন্দর আবহাওয়া থাকবে..ইত্যাদি, ইত্যাদি।
একবার নিজের অনুবাদ করা ঘোষণাপত্রটির দিকে তাকাচ্ছেন, আরেকবার জানলা দিয়ে বাইরে যেখানে আকাশবাণীর দেয়াল ঘেঁষে বুড়ো নিমগাছটার ডালে টপটপ করে জলের ফোঁটা পড়ছে আর শোঁ শোঁ হাওয়ার ঝাপটা লাগছে সেইদিকে অসহায়ভাবে তাকাচ্ছেন পাটনায়েক, এমন সময় তার কানে এল দৈববাণী। তারই প্রিয় বাংলা ভাষায় কলকাতা বেতারকেন্দ্রের ঘোষক বলছেন, প্রবল ঝড় ও বৃষ্টি হবে, এমনকী শিলাবৃষ্টি, সাইক্লোন হতে পারে।
কলকাতার ঘোষণা সম্পূর্ণ মিলে যাচ্ছে কটকের প্রাকৃতিক অবস্থার সঙ্গে কিন্তু নিত্যানন্দবাবুকে কটকের আবহাওয়া দপ্তরের বিজ্ঞপ্তিটিই পাঠ করতে হবে মিলুক বা না মিলুক।
সেইদিন বিজ্ঞপ্তিটি পাঠ করার পরেই ভীষণ শিলাবৃষ্টি হল কটকে। রেডিও স্টেশনের গেটে খোয়াবাঁধানো রাস্তা বরফকুচিতে ছেয়ে গেল তার পর এল সাইক্লোন। সেই সাইক্লোনে শুধু কটক শহরের কয়েকটি টিনের চালা এবং ছোট-বড় গাছই যে উলটে গেল তাই নয় শ্রীযুক্ত নিত্যানন্দ পাটনায়েকের মনের মধ্যেও একটা বিরাট আলোড়ন তৈরি হল। তিনি একনাগাড়ে সাত দিন ছুটির দরখাস্ত করে বাসায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন।
বাসায় শুয়ে শুয়ে চারবেলায় চারবার করে কলকাতা আর কটকের আবহাওয়ার পূর্বাভাস শুনতে লাগলেন এবং বাইরের প্রাকৃতিক অবস্থার সঙ্গে মেলাতে লাগলেন। যতই মেলাতে লাগলেন তত চমৎকৃত হলেন পাটনায়েক। কলকাতার আবহাওয়া দপ্তর যাই বলে সব অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায় কটকের অবস্থার সঙ্গে কিন্তু উড়িষ্যা হাওয়া অফিসের একটি ভবিষ্যৎ-বার্তাও মিলতে চায় না। মনে হয় কে যেন ইচ্ছে করে রসিকতা করছে।
বিছানায় শুয়ে থাকার জন্যেই হোক বা অন্য যেকোনও কারণেই হোক এই সাতদিনে নিত্যানন্দ পাটনায়েকের বুদ্ধি খুবই খুলে গেল। তিনি কলকাতায় তাঁর এক পুরনো কলেজি বন্ধুকে চিঠি লিখলেন–প্রত্যেকদিন সকাল, দুপুর, বিকেল এবং রাত্রিতে কেমন আবহাওয়া থাকে তার বিবরণ যেন অবশ্যই তাকে পরের দিনের সকালের ডাকে পাঠানো হয়, সঙ্গে কয়েকটি ঠিকানা লেখা রিপ্লাই। কার্ড পাঠিয়ে দিলেন। পুরনো বন্ধুটি নিত্যানন্দকে শান্ত সুস্থির লোক বলেই জানতেন, হঠাৎ এই ধরনের আদেশ পেয়ে তিনি ভাবলেন নিত্যানন্দ বুঝি পাগল হয়ে গেছে। তিন দিনের মধ্যে যখন কোনও উত্তর এল না, নিত্যানন্দ একটা অর্ডিনারি আর একটা এক্সপ্রেস পর পর দুটি টেলিগ্রাম পাঠালেন। বন্ধুটি তখন ব্যস্ত হয়ে পাগল ক্ষ্যাপানো আর উচিত হবে না এই ভেবে পর পর সাতদিন ধরে যথারীতি বন্ধুকৃত্য পালন করলেন।
বলাই বাহুল্য, ইতিমধ্যে নিত্যানন্দবাবু তার ছুটি আরও পনেরো দিন বাড়িয়ে দিলেন। একটি লম্বা চার্ট তৈরি করে খাতা বাঁধিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। পাঠকদের অনুধাবনের সুবিধার জন্যে একদিন একবেলার চার্টটি নীচে হুবহু মুদ্রিত করা হল:
ক) তারিখ ৩০ জুন রবিবার
খ) সময় সকালবেলা ৭টা-১০টা
গ) কটকের আবহাওয়া বিজ্ঞপ্তি
ভীষণ ঝড় বৃষ্টি হতে পারে
ঘ) কটকের প্রকৃত আবহাওয়া।
উজ্জ্বল রৌদ্র, নির্মেঘ নীলাকাশ
ঙ) কলকাতার আবহাওয়ার বিজ্ঞপ্তি
উজ্জ্বল রৌদ্র, নির্মেঘ নীলাকাশ
চ) কলকাতার প্রকৃত আবহাওয়া
ভীষণ ঝড় বৃষ্টি।
সাতদিন চারবেলা করে এই রকম আটাশটি চার্ট পূর্ণ হল, অবশ্য চার্টের (চ) অংশটি পূরণ করতে দুদিন বা তিনদিন দেরি হত, কারণ ওটা পূরণ করা হত কলকাতার চিঠি পেয়ে।
আটাশটি চার্ট দেখে দেখে নিত্যানন্দ নিশ্চিত হলেন যে কটকের আবহাওয়ার পূর্বাভাস কলকাতার ক্ষেত্রে এবং কলকাতার পূর্বাভাস কটকের ক্ষেত্রে চমৎকার মিলে যাচ্ছে। যেকোনও চার্টের (গ) এর সঙ্গে (চ) এবং (ঙ) এর সঙ্গে (ঘ) মেলালেই জিনিসটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
তাঁর এই সদ্য আবিষ্কৃত তথ্য নিয়ে ছুটির পরদিনই নিত্যানন্দবাবু প্রথমে আকাশবাণীর অধিকর্তা এবং পরে হাওয়া ভবনের অধিকর্তার সঙ্গে দেখা করলেন। দুঃখের বিষয় এই দুজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীই পাটনায়েক সাহেবকে পাগল ভেবে বসলেন। তবে তারা এ বিষয়ে আর বেশি মাথা ঘামালেন না।
এর মধ্যে পাটনায়েক কাজে যোগদান করেছেন এবং যথারীতি আবার তাঁর ভাগে পড়েছে আবহাওয়ার বুলেটিন। সদ্যলব্ধ জ্ঞানে অকুতোভয় এবং দ্বিধাহীন পাটনায়েক হাওয়া অফিসের বুলেটিন আর ছুঁয়ে দেখেন না। তাঁর ঘোষণার ঠিক পনেরো মিনিট আগে কলকাতা বেতারকেন্দ্রের ঘোষক বাংলায় যা বলেন তাই হুবহু টুকে নিয়ে ওড়িয়ায় তিনি পুনঃপ্রচার করেন।
ব্যাপারটা ধরা পড়ল দিন দশেকের মধ্যে। হাওয়া অফিসের অধিকর্তা আর আকাশবাণীর অধিকর্তা যুগপৎভাবে কয়েকটি অভিনন্দন পেয়ে বিস্মিত, হতবাক হয়ে গেলেন। এমন অভূতপূর্ব সঠিক পূর্বাভাস কটক বেতারকেন্দ্রে তো দূরের কথা পৃথিবীর কোনও বেতারকেন্দ্রে প্রচারিত হয় কিনা এ বিষয়ে অনেকেই অভিমত দিলেন।
দুই অধিকর্তা হতভম্ব। বৃষ্টি বললে বৃষ্টি, ঝড় বললে ঝড়, রোদ বললে রোদ এমন তো হওয়ার কথা নয়। সবই যদি এমন অবিশ্বাস্যভাবে মিলে যায়, লোকে যদি সরকারি ঘোষণা বিশ্বাস করতে আরম্ভ করে তা হলে তো সমূহ বিপদ।
সামান্য খোঁজ হতেই পাটনায়েক ধরা পড়ে গেলেন এবং সাসপেন্ড হয়ে গেলেন।
এখন আর তার জন্যে পাটনায়েকের দুঃখ নেই, কারণ তিনি জ্ঞান ও গবেষণার জন্যে শাস্তি পেয়েছেন, সক্রেটিস, গ্যালিলও থেকে পরশুদিনের ড. খোরানা পর্যন্ত সকলের কথা মনে করে পাটনায়েক সান্ত্বনা দিলেন নিজেকে।
এদিকে কিন্তু তিনি মোটেই থেমে থাকলেন না। তার চার্ট বইটি সাইক্লোস্টাইল করে ছাপিয়ে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার প্রতিটি মন্ত্রীকে, প্রতিটি বিরোধী দলের নেতাকে এমনকী লন্ডন, নিউইয়র্ক, মস্কো পৃথিবীর সব রাজধানীতে এবং ইউনেসকোতে এক কপি করে পাঠিয়ে দিলেন।
মাস তিনেক পরে ইউনেসকো ভারত সরকারের কাছে এ বিষয়ে একটি রিপোর্ট প্রার্থনা করলেন।
তখন খোঁজ পড়ল নিত্যানন্দ পাটনায়কের। কটক বেতার কেন্দ্রের অধিকর্তা ভাবলেন কীসে আবার কী হয়ে যায়। যেন কিছুই জানেন না এই ভাবে নিত্যানন্দবাবুকে ডেকে বললেন, কী মশায়, কাজে আসছেন না কেন আজকাল? তারপর নিত্যানন্দবাবু উত্তর দেওয়ার আগেই বললেন যে, আপনি একবার দিল্লি থেকে ঘুরে আসুন, আপনারা হলেন কৃতবিদ্য লোক।
অর্থাৎ নিত্যানন্দবাবুর সাসপেনশন রদ হয়ে গেল, অনেকগুলো টাকা বকেয়া মাইনে একবারে হাতে পেলেন এবং তদুপরি দিল্লি যাওয়া এবং থাকার খরচ।
এর পরের ঘটনা অতি সংক্ষিপ্ত করে বলা যেতে পারে, কারণ যাঁরা খবরের কাগজ পড়েন তারা। সবাই মোটামুটি বিষয়টি জানেন। নয়াদিল্লিতে একটি সর্বভারতীয় আবহাওয়া পূর্বাভাস তদন্ত ও অনুসন্ধান কমিটি গঠিত হয়েছে। তিনজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, তিনজন বৈজ্ঞানিক, একজন আই সি এস সেক্রেটারি এবং শ্রীযুক্ত নিত্যানন্দ পাটনায়েককে এই গুরুত্বপূর্ণ কমিটির সদস্য মনোনয়ন করা। হয়েছে।
কমিটি এখন পুরাদমে তাঁদের গবেষণা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন। আকাশবাণীর সমস্ত কেন্দ্রের ঘোষকদের এই তথ্যানুসন্ধান কমিটির সামনে সাক্ষী ডাকা হয়েছে। হাওয়া অফিসের প্রধান কর্তারাও তাদের বিস্তারিত রিপোর্ট ও মতামত পেশ করেছেন।
মোট কথা, আবহাওয়া পূর্বাভাস তদন্ত ও অনুসন্ধান কমিটি পূর্ণোদ্যমে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সমস্ত বড় বড় খবরের কাগজে এই কমিটি গঠন ও তার কার্যাবলি বিষয়ে একাধিক গুরুগম্ভীর সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছে।
এদিকে কটক মিউনিসিপ্যালিটি শহরতলির একটি মোটামুটি পরিচিত রাস্তার নাম পালটে নিত্যানন্দ পাটনায়েক স্ট্রিট নামকরণ করেছেন। আগামী বছর নিত্যানন্দবাবু অন্তত পদ্মভূষণ উপাধি পাবেন বলে অনেকেই অনুমান করেছেন। কেউ কেউ বলছেন নিত্যানন্দবাবুর নোবেল বিজ্ঞান পুরস্কার পাওয়াও উচিত। তবে সেটা পদার্থ না রসায়ন না অন্য কোনও শাখায় হবে সে বিষয়ে স্যার সি.ভি. রামনের কাছে খোঁজখবর নেয়ার জন্যে একটি ছোট কমিটি গঠিত হয়েছে কটক শহরে।
তবে কমিটির চূড়ান্ত রিপোর্ট এখনও প্রকাশিত হয়নি এবং সেই রিপোর্টের জন্যে দেশবাসী অধীর প্রতীক্ষা করছে।
.
শেষ সংবাদ
ভারত কা রাজপত্রে ঘোষিত একটি প্রেসনোটে এই মাত্র জানা গেল আবহাওয়ার পূর্বাভাস তদন্ত ও তথ্যানুসন্ধান কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। তদন্ত কমিটি আশা করছেন এই রিপোর্টটি কার্যকরী করা হলে ভারতবর্ষে কোথাও আর আবহাওয়ার পূর্বাভাসে কোনও ভুলত্রুটি থাকবে না। সব অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাবে।
এখন থেকে কটকের হাওয়া অফিসের বিজ্ঞপ্তি প্রচারিত হবে আকাশবাণী কলকাতায়, পাটনার বিজ্ঞপ্তি মাদ্রাজে, মাদ্রাজের বিজ্ঞপ্তি শিলং-এ এবং কলকাতার বিজ্ঞপ্তি কটকে। আকাশবাণীর সমস্ত কেন্দ্র এবং হাওয়া অফিসগুলির নাম তালিকা করে সাজিয়ে দিয়েছেন কমিটি, কোন কেন্দ্র থেকে কোন অফিসের বিজ্ঞপ্তি প্রচারিত হবে।
এর পর থেকে আশা করা যাচ্ছে কেউ আর আকাশবাণীর আবহাওয়া ঘোষণা নিয়ে হাসাহাসি করবে না, সবাই স্পষ্ট মিলিয়ে দেখতে পাবে, বৃষ্টি বললে বৃষ্টি হচ্ছে, রোদ বললে সঙ্গে সঙ্গে ঝকঝকে রোদ উঠছে, হোক না শ্রাবণ মাস।
আরম্ভ
এ গল্প উত্তম বা প্রথম পুরুষে আমি লিখব না। এর মধ্যে আমি কোথাও নেই। আমি এই কাহিনির তথাকথিত কোনও চরিত্র নই। কিন্তু গল্পলেখক হিসেবে কিঞ্চিৎ ভূমিকা করার প্রয়োজন আছে।
নির্মেদ পাঠক এবং নির্মেদিনী পাঠিকাদের কাহিনির সুবিধার্থে, দুয়েকটি মোটা তথ্য নিবেদন করি। মাতাল নিয়ে গল্প, তাই মদের ব্যাপারটা অল্প বলে নিচ্ছি। কেউ যেন ভাববেন না, প্রচুর মদ্যাসক্তির জন্যে এসব জিনিস আমি ধরে ধরে জেনেছি। তা নয়, প্রথম যৌবনে অধুনালুপ্ত ঐতিহাসিক রাজস্ব পর্ষদের বিলীয়মান আবগারি শাখায় কয়েক বছর কাজ করে কিঞ্চিৎ জেনেছিলাম।
ছোট গল্পের পরিসরে বিস্তারিত বলা যাবে না। আমাদের এই আখ্যানের কুশীলবেরা বাংলা খান। বাংলা মানে দিশি মদ, এ যাত্রা দিশি মদের কথাই বলছি।
দিশি মদ, বাংলা মদ নামেই সমধিক প্রচলিত। বাংলাদেশেও শুনেছি, পশ্চিমবঙ্গেও তাই সরকারি দিশি মদের পরিচয় বাংলা বলে। অবশ্য এর বাইরে বেআইনি, বেসরকারি চোলাই দিশি মদ আছে, যাকে গ্রাহকেরা ভালবেসে চু বলে।
সরকারি দিশি মদকে যে বাংলা মদ বলা হয় এ বিষয়ে আমার মনে একটা খটকা আছে। দিশি মদ এই বাংলাতেই বাংলা মদ, বিহারে কিন্তু বিহার মদ নয়। মাদ্রাজে মাদ্রাজ মদ বা তামিল মদ নয়।
আরেকটা কথা উল্লেখ করে রাখি, আমাদের দেশে যেসব বিলিতি মদ তৈরি হয় সরকারি পরিভাষায় সেও দিশি মদ, কানট্রি মেড ফরেন লিকার, সংক্ষেপে (সি এম এফ এল) আর বাংলা মদ হল কানট্রি লিকার, দিশি মদ।
বাংলা মদের দোকানের আরেকটা বিশেষত্ব হল এসব দোকানের কোনও নাম থাকে না। সাইনবোর্ড পর্যন্ত থাকে না। কোথাও কদাচিৎ সাইনবোর্ড থাকলে তাতে দোকানের কোনও নাম দেয়া থাকে না। সেখানে লেখা থাকে, মদের দোকান, ভেন্ডার রামচন্দ্র সাউ কিংবা শ্যামনাথ সাধুখাঁ।
আরশোলা এবং নিদারুণ বার্তা
রুদ্রনারায়ণ আচার্য মহাশয় বিভাগপূর্ব বঙ্গদেশের এমন একটি জেলায় বাস করিতেন যেখানে আরশোলাকে তেলাচোরা বলা হইয়া থাকে। আরশোলাই আমাদের বর্তমান গল্পের বিষয়বস্তু। তাই পূর্বাহ্নে কিঞ্চিৎ ভূমিকা করিয়া লইতে হইতেছে।
প্রথমে আচার্য মহাশয়ের পরিচয় প্রদান আবশ্যক। দেশে আচার্য মহাশয়ের বিরাট নারিকেল এবং সুপারি বাগান ছিল। নারিকেল এবং সুপারি বাগানের সুবিধা এই যে, এই প্রকার ফসল বৎসর বৎসর চাষ করিতে হয় না। কোনও পরিশ্রম নাই, লবণাক্ত মাটির আর্দসৌজন্যে অপর্যাপ্ত ফলন হয় এবং যথাকালে শুকাইয়া মাটিতে পড়ে। কোনও এক পরিশ্রমী পূর্বপুরুষের কল্যাণে বৎসর বৎসর পায়ের উপর পা তুলিয়া বংশধরদের চলিয়া যায়। যাহা কিছু পরিশ্রম বা অর্থব্যয় এই ফসলগুলি পাড়িয়া নামাইবার।
আচার্য মহাশয় অতিশয় বুদ্ধিমান ব্যক্তি ছিলেন। এইনামাইবার জন্যও তিনি কোনও রূপ পরিশ্রম বা তোক নিয়োগ করিতেন না। যতদিন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কার্যকরী আছে, শুকাইয়া বুনা হইলে, নারিকেল-সুপারি আপন আগ্রহেই ভূমিতলে খসিয়া পড়িবে, তাহার জন্য অপব্যয় করা একান্তই নিরর্থক।
এই সময়ে একবার তাঁহাকে আয়কর কমিশনের সঙ্গে দেখা করিতে হয়। আবেদন ছিল, এবার আয় ভাল হয় নাই, কিছু আয়কর পরবর্তী বৎসরে প্রদানের অনুমতি দেওয়া হউক। আয়কর সাহেব দেখিলেন, লোকটি আয়কর কমাইতে বলিতেছে না, শুধু সময় চাহিতেছে, কী মনে হইল, প্রশ্ন করিলেন, তোমার ফসল কম হলে আয়কর কম হবে, তুমি সময় চাও কেন, আয়কর কমাবার জন্য প্রার্থনা করো।
আচার্য মহাশয় ঘাড় চুলকাইয়া বলিলেন, ফসল ঠিক কম হয়েছে তা নয়, তবে এবার হাওয়া বড় কম।
সাহেব অবাক, হাওয়া কম!
আজ্ঞে হ্যাঁ, আচার্য মহাশয় জানাইলেন, এই হাওয়া লেগে শুকনো নারকেল-সুপারি মাটিতে পড়ে, এবার সেটা একটু কম পড়ছে।
ইহার পরে কী হইয়াছিল তাহা এই কাহিনির বিষয় নহে, তবে এই একটি প্রাক্তন ঘটনার উল্লেখ এইজন্য করিলাম যে, ইহাতে শ্রীযুক্ত রুদ্রনারায়ণ আচার্যের সম্পর্কে কিছু ধারণা করা সম্ভব হইতে পারে।
দেশ বিভাগের পরে আচার্য মহাশয় প্রথমেই কলিকাতায় চলিয়া আসেন। এই সময়েই টালিগঞ্জ থানার অফিস ঘরে তাহার সঙ্গে আমার আলাপ হয়।
আমরা ছাদে কাপড় মেলিয়া দিলে বিকালে যখন শুকাইয়া যাইত তখন আমাদের পরবর্তী প্রতিবেশী গোপনে সেগুলি একটি হোসপাইপ দিয়া ভিজাইয়া দিতেন। ইহাতে বিশেষ অসুবিধার সৃষ্টি হইত। এবং প্রথম প্রথম সবই সহ্য করিতাম, বস্তুত বুঝিতেই পারিতাম না কেন আমাদের বস্ত্রাদি সারাদিনের রৌদ্রে শুকাইত না। অবশেষে একদিন আমার কনিষ্ঠ ভাগিনেয় মাতুলালয়ে বেড়াইতে আসিয়া নিকট প্রতিবেশীর এরূপ গর্হিত কার্য আবিষ্কার করিয়া ফেলে। আমরা উপায়ান্তর না দেখিয়া প্রতিদিন রাত্রে পাঁচফোড়নের তরকারি খাইতে লাগিলাম। সায়াহ্নবেলায় যখন প্রতিবেশীদের বাড়িতে সংগীতশিক্ষক আসিতেন, সেই সময়ে তিনি যে ঘরে বসিয়া সংগীত শিক্ষাদান করিতেন সেইমুখী আমাদের বারান্দায় যথাসমারোহে পাঁচফোড়নের ব্যঞ্জন প্রস্তুত করা হইত। ব্যঞ্জনের ঋজে ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষকদের নাসারন্ধ্রে এবং কণ্ঠদেশে যে আকুতি উপস্থিত হইত তাহাতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হইলেও সংগীত ওষ্ঠাগত হইত না। কিন্তু ইহাতেও কিছু হইল না। একদিন আমাদের অসাবধানতার সুযোগে শীতের অপরাহ্নে তাহারা আমাদের লেপগুলি ভিজাইয়া দিল।
বাধ্য হইয়া থানায় ডায়েরি করিতে আসিয়াছিলাম, দেখিলাম এক প্রৌঢ় ব্যক্তি প্রবল আবেগে ফুসিতেছেন। তাহার সামনে মোটা ধুতি ও নীল কোট পরিধানে এক ব্যক্তিকে পুলিশ ধরিয়া রাখিয়াছে। দ্বিতীয় ব্যক্তিটির এক হাতে বর্শা এবং অন্য হাতে একটি প্রজ্বলিত পেট্রম্যাক্স। কিছুক্ষণ পরে বুঝিলাম এই দ্বিতীয় ব্যক্তিটি প্রথম ব্যক্তির সঙ্গী বা রক্ষী। প্রথম ব্যক্তি অর্থাৎ আচার্য মহাশয় কিছুতেই সন্ধ্যাবেলায় রাস্তায় পেট্রম্যাক্স এবং আলোবাহক একজনকে অগ্রবর্তী না রাখিয়া বাহির হইতে পারেন না, ইহা তাহার বহুকালের অভ্যাস। তদুপরি ইহা দ্বারা, আচার্য মহাশয়ের মতে, কোনওরকম আইনভঙ্গ হয় নাই। বর্শা অস্ত্র আইনে পড়ে না। বর্শার ফলা মাত্র ছয় ইঞ্চি ইত্যাদি ইত্যাদি বহু যুক্তি তিনি প্রবল রোষে প্রদান করিতে লাগিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তৃতীয় ব্যক্তিরূপে আমাকে সাক্ষী মানিতে লাগিলেন।
থানা অফিসার বিবেচক ছিলেন। সব শুনিয়া তিনি আচার্য মহাশয়কে বলিলেন, কলকাতার রাস্তায় যথেষ্ট আলো। পেট্রম্যাক্স কী কাজ করবে আর এখানে রাস্তায় সাপ, শুয়োর, বুনো শেয়াল কিছুই নেই যে একজন বর্শাবাহী লাগবে। আপনি আজ যান কিন্তু ভবিষ্যতে এরকম করবেন না।
কী ভাবিয়া আমিও সেদিন আর থানায় কোনও ডায়েরি না করিয়া চলিয়া আসিলাম, আচার্য মহাশয়, তাহার রক্ষী এবং আমি তিনজনেই এক সাথে রাস্তায় নামিলাম।
পথে চলিতে চলিতে আলাপ হইল। আচার্য মহাশয় আর যাহা হউক তোক খারাপ নহে। তাঁহার কথাবার্তায় বুঝিলাম যে, তাহার আর কলিকাতায় থাকিবার মোটেই বাসনা নাই। দেশে দাঙ্গাহাঙ্গামা চলিতেছে, সেখানেও ফেরা সম্ভব নহে, কলিকাতারই কিছু দূরে গঙ্গাতীরে কোথাও বাড়ি করিয়া বাকি জীবনটা কাটাইয়া দিতে চান।
কী কারণে জানি না, আচার্য মহাশয় আমার সহিত যোগাযোগ রক্ষা করিতেন, এখনও করেন, নিয়মিত তাহার খবর পাই।
আচার্য মহাশয় সম্পর্কে এই পর্যন্ত পাঠ করিয়া যদি কাহারও কোনও ভুল ধারণা গঠিত হইয়া থাকে তাহাকে এখনই বলিয়া রাখা ভাল, আচার্য মহাশয়ের বুদ্ধির অভাব কখনওই ছিল না।
বর্ধমানের দিকে গঙ্গার ধার ঘেঁষিয়া বিঘা দেড়েক জমি লইয়া বাড়ি প্রস্তুত করিলেন। বাড়ির পিছনে গঙ্গা-সংলগ্ন নিচু জমিতে প্রথমে কচুর চাষ করিলেন, প্রচুর কচু ফলিল। কিন্তু একটি কচুও বিক্রয় না করিয়া, না খাইয়া সেইখানে পঞ্চাশটি শূকর কিনিয়া পুষিতে লাগিলেন। শূকরের অত্যাচারে এবং নোংরায় বাড়ির এবং পাড়ার লোক অস্থির হইয়া উঠিল। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি শূকরের দুগ্ধের কারবার শুরু করিলেন। প্রচারপত্রে লম্বা প্রবন্ধ লিখিয়া দেখাইলেন শূকর-দুগ্ধ যেকোনও দুগ্ধ হইতে বেশি উপকারী। কিন্তু একাধিক কারণে এই ব্যবসা চলিল না। প্রথমত বহু বিজ্ঞাপন দিয়াও শূকরী দুহিবার যোগ্য ব্যক্তি পাওয়া গেল না। অবশ্য আচার্য মহাশয় শেষভাগে নিজেই দুহিতে লাগিলেন কিন্তু ক্রেতার বড় অভাব হইল। বিশেষ কেহ শূকরের দুগ্ধপানে উৎসাহী হইল না।
ফলে কচুক্ষেত এবং শূকরপাল অন্তর্হিত হইল। এইবার ওই নিচু জমিতে তিনি পেঁপে গাছ লাগাইলেন, প্রচুর ফলিল। কাঁচা পেঁপেগুলি কাটিয়া রৌদ্রে শুকাইয়া তারপর চূর্ণ করিয়া একপ্রকার মশলা প্রস্তুত করা হইল। নাম দেওয়া হইল হজমি মশলা। এই দুষ্ট পাকস্থলীর দেশে সেই মশলা কেন যে জনপ্রিয় হইল না তাহা অনুধাবন করিতে একান্তই ব্যর্থ হইয়া আচার্য মহাশয় প্রায় ভগ্নহৃদয় হইয়া পড়িলেন।
শূকর-দুগ্ধ এবং হজমি মশলা উভয় দ্রব্যই আমাকে খাইতে হইয়াছিল। আচার্য মহাশয়ের অনুরোধ এবং আগ্রহে আমি তাহার বাড়িতে একাধিকবার গিয়াছি।
সম্প্রতি এক পত্র পাইয়া জানিতে পারি যে, তিনি এখন একটি বিশেষ গবেষণায় ব্যস্ত আছেন। পত্রের পরে পরেই কয়েকটি এক্সপ্রেস চিঠি এবং দুটি তারবার্তা পাইলাম, আমাকে চলিয়া আসার জন্য বিশেষ অনুরোধ। বিগত কয়েকবারের অভিজ্ঞতা ভাল নহে, তবু অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া যাওয়াই স্থির করিলাম।
আচার্য মহাশয়ের বাড়ির সদরে তাহার ভ্রাতুস্পুত্রী করতোয়ার সহিত সাক্ষাৎ হইল। আচার্য মহাশয় চিরকুমার। এই বৃদ্ধ বয়সে এই ভ্রাতৃ-কন্যাটি তাঁহার একচ্ছত্র সঙ্গিনী। আমাকে দেখিয়া করতোয়া স্মিতহাস্য করিল, আপনি তাহলে এসে গেলেন! সে আমাকে কয়েকবারই দেখিয়াছে, তাহার জ্যেঠামহাশয়ের এই অনুগ্রাহকটিকে বিশেষ মমতার সঙ্গে দেখে।
আমি প্রশ্ন করিলাম–এবার কী?
মৃদু হাসিয়া করতোয়া জবাব দিল, আরশোলা। ইতিপূর্বে শূকর-দুগ্ধ এবং হজমি মশলা খাইয়া গিয়াছি, আরশোলা শুনিয়া হৃৎকম্প উপস্থিত হইল। ভাবিলাম তখনই ফিরিয়া যাই। করতোয়া বোধহয় আমার মনোভাব বুঝিতে পারিল, বলিল, ভয় নেই, আসুন। আরশোলা খেতে হবে না।
বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিতে যাইব, এমন সময় আকস্মিক গুলির শব্দে চমকিয়া উঠিলাম। তাকাইয়া দেখি একতলার চিলেকোঠার ছাদে পূর্ব-দক্ষিণ দিকে মুখ করিয়া আচার্য মহাশয় বন্দুকের আওয়াজ করিতেছেন। কী লক্ষ করিয়া করিতেছেন কিছুই বুঝিতে পারিলাম না।
করতোয়াকে আবার প্রশ্ন করিতে হইল। করতোয়া বলিল, জ্যেঠামশায় পাক্ষিক নিদারুণ বার্তার সম্পাদক নিবারণ সামন্তের বাড়ির দিকে ফঁকা আওয়াজ করছেন। নিদারুণ বার্তায় ওঁর একটা থিসিসের যাচ্ছেতাই সমালোচনা করা হয়েছে। সে যাহোক, ভয়ের কিছু নেই।
একটু পরেই আচার্য মহাশয় নামিয়া আসিলেন, ভীষণ উত্তেজিত। সেই টালিগঞ্জ থানায় প্রথমদিন যেরকম দেখিয়াছিলাম। আমাকে দেখিয়া কিছুটা শান্ত হইলেন। কিছুক্ষণ কুশল প্রশ্নাদি করিয়া ভিতরের ঘরে গিয়া একতাড়া কাগজ লইয়া আসিলেন। তাহার পরে করতোয়াকে ডাকিলেন, করতোয়া মা, এটা একবার পড়ে শোনা তো!
পিতৃব্যের আজ্ঞাতে আমার দিকে তাকাইয়া একটু মুচকি হাসিয়া নিয়া করতোয়া পড়িতে লাগিল। প্রবন্ধটির নাম কেশ-চর্চা এবং আরশোলা। অত দীর্ঘ প্রবন্ধ উদ্ধৃত করিয়া লাভ নাই। সারাংশ এইরকম:
আরশোলাকে কোথাও কোথাও তেলাচুরা বলা হইয়া থাকে। ইহার কারণ এই যে, ইহা মাথা হইতে নিদ্রাকালে তেল শুষিয়া লয়। অনেক সময় চুলও খাইয়া ফেলে। যে স্থানের চুল খায় সেখানে আর চুল গজাইতে চাহে না। ইহা প্রায় সকলেই জানেন।
আরশোলার যখন এবম্বিধ প্রকৃতির পরিচয় মানুষ মাত্রেই জ্ঞাত আছেন, ইহাকে অনায়াসেই মানুষের কাজে নিয়োগ করা যাইতে পারে। রজক, ক্ষৌরকার ইত্যাদি বাবদ প্রত্যেক গৃহস্থেরই এদেশে যথেষ্ট ব্যয় হয়। কিন্তু বিলাত ইত্যাদি দেশে কাপড় কাচিবার যন্ত্র, এমনকী দাড়ি কামাইবার বৈদ্যুতিক যন্ত্র আবিষ্কার হইয়াছে।
আমাদের দরিদ্র দেশের পক্ষে এইগুলি খুবই ব্যয়সাধ্য। সকলের ব্যবহার করিবার আর্থিক যোগ্যতা নাই।
জীব-জন্তুকে শিক্ষিত করিয়া নানাবিধ কার্য সম্পাদন করা যায়। বানর, হাতি, ঘোড়া, কুকুর, এমনকী পাখিও নানা কাজ করিতে পারে। আরশোলাকেও উপযুক্ত ট্রেনিং দিতে পারিলে তাহার দ্বারা কোনও কার্য অসম্ভব নহে। যথাসময়ে মাথায় ছাড়িয়া দিলে উপযুক্ত পরিমাণ চুল খাইয়া লইলেই চুল কাটার কাজ হইয়া যাইবে। প্রথম দিকে শিশুদের মাথায় ছাড়িয়া এবং গায়ে সুতা বাঁধিয়া মাথায় ঠিকমতো চালাইলে পরে ভাল কাজ পাওয়া সম্ভব।
এক-একটি আরশোলা গড়ে নয়মাস বাঁচে, অর্থাৎ একটি সামান্য আরশোলা নয়বার চুল কাটা এবং দুইশত সত্তর বার (যাঁহারা দৈনিক দাড়ি কামান) দাড়ি কামানোর খরচ বাঁচাইতে পারিবে।…
করতোয়া যখন প্রবন্ধটি পাঠ করিতেছিল, প্রত্যেক অংশ শুনিতে শুনিতে আচার্য মহাশয়ের মুখভাব উজ্জ্বল হইয়া উঠিতেছিল। আমার প্রায় কিছুই বলিবার ছিল না। শুধু জানিতে চাহিলাম, এইরূপ ট্রেনিংপ্রাপ্ত কোনও আরশোলা…
আচার্য মহাশয় আমাকে বাক্য সম্পূর্ণ করিতে দিলেন না। একটি কাঁচের বাক্স বারান্দা হইতে লইয়া আসিলেন। তাহাতে দশ-পনেরোটি আরশোলা এবং একটি প্লেটে অল্প একটু দুধ রহিয়াছে। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, প্লেটে কী, দুধ?
উপরের ছাদে আরেকটি খাঁচা আনিবার জন্য আচার্য মহাশয় উঠিয়া গিয়াছিলেন, করতোয়া ছিল, সেই জবাব দিল, হ্যা দুধ খেলে ওদের বুদ্ধি হবে। আচার্য মহাশয় ঘরে ঢুকিতে ঢুকিতে করতোয়ার কথা ধরিলেন, দুধ হল স্নেহ পদার্থ, এতে বুদ্ধি হবে। তবে তেলই ওদের খাদ্য, তবে সেটা দিলে মাথার চুলের তেল আর ওরা খেতে চাইবে না।
সন্দেহ নাই, অকাট্য যুক্তি। কিন্তু স্থানীয় পাক্ষিক নিদারুণ বার্তার মুর্থ সম্পাদক নিবারণ সামন্ত আচার্য মহাশয়ের এই গবেষণাকে পাগলামি বলিয়া হাসি-তামাসা করিয়াছে। আজ সকালেই নিদারুণ বার্তার বর্তমান সংখ্যা আচার্য মহাশয়ের হস্তগত হইয়াছে। পাঠ করিয়াই ছাদে উঠিয়া নিবারণ সামন্তের বাড়ির দিকে মুখ করিয়া তিনবার বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ করিয়াছেন।
আরশোলার বুদ্ধি এবং নিবারণ সামন্তের বুদ্ধির অভাব বিষয়ে আচার্য মহাশয়ের সঙ্গে সেইদিন সারা দুপুর আলোচনা করিয়া বৈকালে করতোয়ার সঙ্গে গঙ্গাতীরে ভ্রমণ করিয়া সন্ধ্যাবেলা ফিরিয়া আসিলাম। কথা দিয়া আসিলাম, সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে আবার আসিব। আরশোলা দিয়া চুল কাটাইয়া যাইব। ততদিনে আরশোলাগুলি উপযুক্ত শিক্ষিত হইবে এইরূপ আশা করা গেল।
কিন্তু দুই সপ্তাহ লাগিল না। আচার্য মহাশয় গুরুতর অসুস্থ, করতোয়ার নামে প্রেরিত এক তার পাইয়া সাতদিনের মধ্যে আরেকবার যাইতে হইল।
আচার্য মহাশয়ের বিরূপ সমালোচনা করিবার পর নিবারণ সামন্ত একটু মর্মপীড়ায় ভুগিতেছিলেন। তাহা ছাড়া নিদারুণ বার্তার নয়জন ক্রেতার মধ্যে আচার্য মহাশয় একজন। তাই তিনি একদিন আচার্য মহাশয়ের সঙ্গে একটি আপোস-রফায় আসিবেন ইচ্ছায় একদিন তাঁহার বাড়িতে আসেন। সামন্ত মহাশয় বুদ্ধিমান ব্যক্তির ন্যায় এইবার আরশোলা বিষয়ে যথেষ্ট উৎসাহ প্রদর্শন করিতে থাকেন। সামন্তকে দেখিয়া আচার্য মহাশয় প্রথমে উত্তেজিত হইলেও পরে তাহার আচরণের পরিবর্তন দেখিয়া তাঁহাকে যথেষ্ট সৌজন্য প্রদর্শন করেন। আরশোলাগুলিকে কীভাবে শিক্ষা দেওয়া হইবে তাহা খাঁচা খুলিয়া দেখাইতে যান। কিন্তু ইতিমধ্যে দুধ-ক্ষীর ইত্যাদি স্নেহপদার্থ খাইয়া আরশোলাগুলি যে ভীমরুলের প্রকৃতি ধারণ করিয়াছে, ইহা সামন্ত বা আচার্য মহাশয় কেহই অনুমান করিতে পারেন নাই। খাঁচা খোলামাত্র পনেরোটি দুর্দান্ত আরশোলা তাহাদের দুইজনের উপর ঝাপাইয়া পড়ে। করতোয়া বঁটা লইয়া ছুটিয়া না আসিলে সেইদিনই বোধ হয় এই দুইজনকেই আরশোলার দংশনে প্রাণত্যাগ করিতে হইত।
বর্তমানে সামন্ত ও আচার্য মহাশয় দুইজনেই স্থানীয় হাসপাতালে পাশাপাশি শয্যায় চিকিৎসিত হইতেছেন। দুজনেরই মুখ এত ফুলিয়া গিয়াছে যে প্রথম দর্শনে কে নিবারণ সামন্ত আর কে রুদ্রনারায়ণ আচার্য ঠাহর করা কঠিন।
করতোয়াকেও একটি আরশোলা দংশন করিয়াছিল, তাহার বিশেষ কিছু হয় নাই, শুধু গণ্ডদেশ কিঞ্চিৎ রক্তিম ও স্ফীত হইয়াছে।
এক প্রধানের গল্প
শ্রীযুক্ত বটেশ্বর প্রধানের উপাধিই শুধু প্রধান নয়, তিনি গ্রাম প্রধানও বটেন। খলিলপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের তিনিই প্রধান।
এত জায়গা থাকতে কেন খলিলপুর নামক একটি সাধারণ গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানকে নিয়ে এই গল্প লিখছি। সে প্রশ্ন যেকোনও পাঠক করতে পারেন।
আশা করি এই গল্পটি পাঠ করার পরে তাঁদের কারও মনে আর এরকম কোনও প্রশ্ন থাকবে। তার কারণ বটেশ্বরবাবু কোনও সামান্য ব্যক্তি নন, তাঁর মতো স্থিতধী, ঠান্ডা মাথার বুঝমান লোক খুব বিরল। কোনও রকম ছল-চাতুরী বা চালাকি করে বটেশ্বরবাবু গ্রাম প্রধান হননি। গ্রামবাসী প্রায় প্রত্যেকেই তাকে প্রধান বলে মেনে নিয়েছেন, তার বুদ্ধি ও বিবেচনার কথা স্মরণে রেখে।
বেশি নয়, মাত্র একটা উদাহরণ দিয়ে বটেশ্বরবাবুর বিবেচনাবোধ প্রমাণ করছি।
খলিলপুর গ্রামের চক্রবর্তীরা সম্পন্ন গৃহস্থ ছিলেন। বিরাট একান্নবর্তী পরিবার ছিল তাদের। এখন ভাই-ভাই ঠাই ঠাই হয়েছে। খুড়তুতো-জ্যাঠতুতো ভাইয়েরা সব ভিন্ন হয়ে গেছে। উঠোনে কোনাকুনিভাবে কঞ্চির বেড়া টেনে যে যার এলাকা ভাগ করে নিয়েছে। পুরনো বড় একতলা পৈতৃক দালানের বারান্দাতেও দেয়াল গাঁথা হয়েছে।
কিন্তু এত করেও খিটিমিটি, গোলমাল বন্ধ হয়নি। রাতদিন কলহ লেগেই আছে।
সে কলহ কখনও ফসলের ভাগ নিয়ে, কখনও গাছের ফল নিয়ে, কখনও বা এজমালি মানে যৌথ পুকুরের মাছের অংশ নিয়ে।
যেমন হয় পাড়াগাঁয়ের সম্পন্ন গৃহস্থবাড়ি। একটা বড় কোঠাদালান, কয়েকটা ইতস্তত টিনের ঘর। অনেক ফলবান বৃক্ষ। একটা বড় পুকুর, যার জলে বাসনমাজা, কাপড় কাঁচা থেকে স্নান সবই হয়। আবার যথেষ্ট মাছও পাওয়া যায়।
সবাই জানেন এসব জিনিস কখনও চুলচেরা ভাগ করা যায় না, পুকুর ভাগ করা তো অসম্ভব। তা ছাড়া কোনও ভাগ-বাঁটোয়ারাই সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারে না।
গল্পে নামধাম গোপন রাখতে হয়। না হলে একেক সময় খুবই গোলমালে পড়তে হয়।
দুঃখের বিষয় এই গল্পে ধাম গোপন রাখতে পারিনি। খলিলপুরের চক্রবর্তী বাড়ি বলে ফেলেছি। তবে নামগুলো গোপন করছি।
বেশি নয় খুড়তুতো-জ্যাঠতুতো পরস্পর সংগ্রামী ভাইদের চারজনকে ধরছি। তাদের নাম ধরা যাক নরেনবাবু, সুরেনবাবু, ধীরেনবাবু, বীরেনবাবু।
সেদিন এই চার পরিবারের মধ্যে তুলকালাম কাণ্ড হয়েছে, যাকে বলে এলাহি কাজিয়া। ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, পুকুরের মাছ নিয়ে। সাধারণ পুকুর থেকে জাল দিয়ে যে মাছ ধরা হয় সেটা চারভাগে ভাগ করা হয়, যদিও ভাগ নিয়ে, সমান অংশ নিয়ে গোলমাল যথেচ্ছই হয়।
এবার গোলমালটা একাধিক কারণে খুবই জটিল আকার ধারণ করেছে। সকলের চেয়ে বড় ভাই নরেনবাবুর ছেলে কলকাতায় কলেজে পড়ে। তার নাম বরেন। সেই বরেন গত শনিবার দিন কলকাতা থেকে চার-পাঁচজন বন্ধু সঙ্গে করে বাড়ি ফেরে, বরেন এবং বন্ধুদের সকলের সঙ্গে এক বা একাধিক ছিপ। বোঝা গেল বরেন নিজেদের বাড়ির পুকুরের কথা বন্ধুদের বলেছে এবং তারই উৎসাহে বন্ধুরা সবাই খলিলপুর চক্রবর্তীবাড়ির প্রাচীন পুকুরে মাছ ধরতে এসেছে।
এবং মাছ তারা ভাল ধরেছে, পাকা মৎস শিকারী প্রত্যেকে, একেকজন এক কেজি, দেড় কেজি ওজনের নোনা মাছ তিন-চারটে করে ধরেছে। এর মধ্যে একজন আবার বেশ কয়েক কেজি ওজনের একটা অতিকায় বোয়াল মাছও ছিপে গেঁথে তুলেছে।
আজ জাল দিয়ে মাছ ধরার পর মাছ ভাগাভাগির সময় প্রথমে সুরেনবাবু, নরেনবাবুর ছেলে। বরেনের বন্ধুদের মাছ ধরার কথা তুললেন। না হলেও সাকুল্যে পনেরো কেজি মাছ এরা সেদিন বড়শি দিয়ে ধরে নিয়ে গেছে। সুরেনবাবু প্রস্তাব করলেন আজকের মাছের ভাগ থেকে ওই পনেরো কেজি মাছের দাম বড়দার মানে নরেনবাবুর অংশ থেকে বাদ দিয়ে হিসেব ধরতে হবে।
বলা বাহুল্য এই প্রস্তাবে বাকি দুই জ্ঞাতি ভ্রাতা ধীরেনবাবু এবং বীরেনবাবু সায় দিলেন। সেই সঙ্গে একটা উপরি দাবি করলেন ধীরেনবাবু। বছর তিনেক আগে পুকুরে চারাপোনা ছাড়া হয়েছিল। তখন নানা অজুহাতে সুরেনবাবু চারাপোনার দাম দেওয়া এড়িয়ে গেছেন। ফলে অন্য তিন শরিককে এই ব্যয়ভার বহন করতে হয়েছে।
আজ ধীরেনবাবুর বক্তব্য হল যে মেজদা মানে সুরেনবাবু যখন মাছের চারার দাম দেননি এখন গোটা মাছেও তার কোনও অধিকার নেই। মাছ তিনভাগ হবে, সেই সঙ্গে হিসেবে বড়দার ভাগ থেকে পনেরো কেজি বাদ দিয়ে, তাকে এবং বীরেনবাবুকে সাড়ে সাত কেজি করে বেশি দিতে হবে। মাছ বেচার টাকার হিসেবটা এইভাবে করতে হবে।
এই সময়ে বাদ সাধলেন ওই বড়দা নরেনবাবু। তিনি বললেন, তিনি পনেরো কেজি মাছ ছাড় দিতে রাজি আছেন। কিন্তু গত বছর বন্যার সময় নিজের উঠোনে জল দাঁড়াচ্ছে দেখে বীরেন পুকুরের ধার কেটে নালা দিয়ে জল ঢুকে পুকুর ভাসিয়ে দেয় এবং সব বড় মাছ বেনোজলে ঢুকে বেরিয়ে যায় পুকুর থেকে। সেই জরিমানা তাকে দিতে হবে। আর বোধহয় বেশি বাড়িয়ে লাভ নেই। সবাই বুঝতে পারছেন এ গোলমাল মেটে না, মেটবার নয়।
এদিকে চক্রবর্তী বাড়ির মাছের ভাগ করতে গিয়ে আমরা এই গল্পের নায়ক শ্রীযুক্ত বটেশ্বর প্রধানকে বিস্মৃত হয়েছি। যে সকালে মাছের ভাগ নিয়ে চক্রবর্তী বাড়িতে জ্ঞাতি ভাইদের বিবাদ সেদিনের বিকালের কথায় যাই। ৫৯২
নিজের বাড়ির বারান্দায় একটা তক্তাপোশের শতরঞ্জির ওপর বসে আছেন বটেশ্বরবাবু, ভেতরে ঘরের মধ্যে বটেশ্বর গৃহিণী সুপুরি কুচোচ্ছেন আর সাংসারিক কথাবার্তা বলছেন।
এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে চক্রবর্তী বাড়ির জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা নরেনবাবু এলেন।
সকালবেলায় মাছের ভাগ নিয়ে গোলমালের ব্যাপারটা ইতিমধ্যেই বটেশ্বরবাবুর কানে উঠেছিল, সুতরাং তিনি প্রস্তুত ছিলেন।
এখন নরেনবাবু এসেই গজগজ করে জ্ঞাতি ভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে লাগলেন। সোনার টুকরো ছেলে বরেন তার কলেজের বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে পিতৃপুরুষের পুকুরে মাত্র দুচারটে মাছ ধরেছে, তার জন্যে খেসারত দিতে হবে। এদিকে বীরেন এই করেছিল, ধীরেন ওই করেছিল, নানারকম কঁদুনি গাইতে লাগলেন নরেনবাবু, তারপর বললেন, আমি যা যা বললাম সবই তো শুনলেন, আমি কি ভুল বললাম।
গম্ভীর চিন্তান্বিত মুখে বটেশ্বরবাবু বললেন, না। না নরেনদা, আপনি ঠিকই বলেছেন।
গ্রাম প্রধানের অভিমত পেয়ে নরেনবাবু এবার উঠলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উদয় হলেন সুরেনবাবু। তারও বলবার কথা কিছু কম নয়। তিনি আবার কৈশোরে একই স্কুলে বটেশ্বরবাবুর সহপাঠী ছিলেন। তাঁর সঙ্গে বটেশ্বরবাবুর তুই-তোকারির সম্পর্ক। তিনি সুরেনবাবুর সব কথা শুনে কিছুক্ষণ গম্ভীর চিন্তান্বিত মুখে থেকে তারপর তাঁকে বললেন, তুই ঠিকই বলেছিস।
অতঃপর সন্ধ্যার দিকে এবং তারপরে একটু রাতের দিকে এলেন যথাক্রমে ধীরেনবাবু ও। বীরেনবাবু। তাঁদের কথাও খুবই মনোযোগ দিয়ে শুনলেন বটেশ্বরবাবু এবং সব শোনার পরে আলাদা করে দুজনকেই বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ।
বটেশ্বর গৃহিণী এতক্ষণ ঘরের মধ্যে কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে স্বামীর কথাবার্তা শুনছিলেন। এবার শেষ ভাই মানে বীরেনবাবু চলে যাওয়ার পরে গৃহিণী বারান্দায় এসে স্বামীকে বললেন, ওরা চার ভাই, চাররকম কথা বলল। আর তুমি সবাইকে বললে, ঠিকই বলেছ। এতে চক্রবর্তী বাড়ির গোলমাল আরও বেড়ে যাবে। এটা তুমি মোটেই ভাল করলে না। অন্ধকার বারান্দায় তক্তপোশে বসে একটা বিড়ি খাচ্ছিলেন শ্রীযুক্ত বটেশ্বর প্রধান। শেষ সুখটান দিয়ে বিড়িটা উঠোনে ফেলে দিয়ে এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে নির্বিকার কণ্ঠে তিনি গৃহিণীকে বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ।
একটি অখাদ্য গল্প
আমার এ পথে হাঁটা আবার বন্ধ করতে হবে। মনে মনে এই কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরছিলাম। আজ সকালবেলাতেই প্রথম লক্ষ করলাম বাণী শাড়ি ধরেছে। প্রথম বয়সের শাড়িতে মেয়েটাকে ভালই দেখাচ্ছিল, এর দিদিদের মতোই বলা যায় কিংবা তাদের চেয়েও রাণী, মণি দুজনের চেয়েই হয়তো একটু বেশিই সুন্দরী, কিন্তু আমাকে এ পথে হাঁটা বন্ধ করতে হবে।
আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে সদরে ট্রামরাস্তার এইটাই সোজা পথ, কিন্তু আবার সেই বাড়ির পেছন ঘুরে সেই উলটোপথ, সেইটাই ধরতে হবে। না, বয়স হয়েছে আর ধাক্কা সামলাতে পারব না। মনে মনে প্রথম যৌবনের সেই দুঃসাহসী দিনগুলির কথা ভাবতে একটু বেদনা, একটু দুঃখও যেন হচ্ছিল। তখন কত কী করা যেত, ওর দিদিদের রাণী-মণিদের আমি থোড়াই তোয়াক্কা করেছি। কিন্তু বয়েস কিছু বাড়ল, একটু সমঝে চলতে হবে।
খোকনদা, এই খোকনদা…, কখন থেকে ডাকছি, মোটেই সাড়া দিচ্ছ না! বুকটা আঁতকে উঠল। পিছনে ফিরে দেখি যাকে এড়ানোর জন্যে এত পরিকল্পনা এত বুদ্ধির মারপ্যাঁচ, ঘোরালো সড়ক, সেই মেয়েই ছুটতে ছুটতে প্রায় পাশাপাশি এসে দাঁড়িয়েছে। গরমের দিনের সকাল বেলা। এইটুকু ছুটে এসে কপালে ঘামের ফোঁটা জ্বল জ্বল করে জ্বলছে, কঁপতে কাঁপতে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে। কয়েকটা স্বচ্ছ তরল স্বেদবিন্দু। শাড়ির বিব্রত বেসামাল ভঙ্গিটা, সব মিলিয়ে বাণীকে যেন অস্বীকার করা যায় না। আমার বুক কাঁপতে লাগল। আমি জানি, জানি এখনি অথবা আগামী কাল ও সেই মারাত্মক প্রস্তাব করবে, এই শাড়ি পরার সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রস্তাব সেই আমন্ত্রণের অধিকার ওর জন্মেছে একদিন ওর দিদিদের মতোই।
রাণী-মণির হাত থেকে আমি পরিত্রাণ পাইনি, এবারেও হয়তো পাব না। কিন্তু আর কতকাল! আর বাণীই যদি শেষ হত তাহলে হয়তো চোখ বুজে ঝাঁপিয়ে পড়া যেত। কিন্তু আরও ছোট, আরও ছোট–অনেক, বাণীর বোনেদের সংখ্যা অর্থাৎ ভুবনবাবুর, আমার প্রতিবেশীর, মেয়েদের সংখ্যা আমি শুনে দেখিনি, হয়তো ভুবনবাবুও গুনে দেখেননি। এরা প্রত্যেকে বড় হবে, প্রত্যেকেই মণিরাণীবাণীর মতো একদিন পল্লবিনী হবে কিন্তু কতকাল, আর কতকাল আমি তাদের প্রথম অভিজ্ঞতার শিকার হব। মনের মধ্যে একটা বিদ্রোহের ভাব দেখা দিয়েছে কিন্তু এইটুকু মেয়ের সামনে সেটা দমন করতে হল।
খোকনদা, একেবারে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলে? তুমি কতদিন আমাদের বাসায় আস না। মা বলছিল, ছোড়দি সেদিন শ্বশুরবাড়ি থেকে এসেছিল, তোমার খোঁজ করলে। আমি তোমাকে ডাকতে গিয়েছিলাম। তুমি বাসায় ছিলে না। রাতদিন বাইরে বাইরে কোথায় এত টো-টো করে ঘোরো! বেশ পাকা গিন্নির মতো কথা বলতে লাগল বাণী। তারপর হঠাৎ কথা ঘুরিয়ে বলল, দ্যাখো আমি শাড়ি পরেছি, বেশ ভাল দেখাচ্ছে না! বলেই একটু লজ্জিত হয়ে পড়ল, কথাটা একটু ঘুরিয়ে শাড়ির আঁচলটা বাঁ হাতের একটা আঙুলে জড়াতে জড়াতে বলল, বাবা কিনে দিয়েছে, শাড়িটা বেশ সুন্দর, তাই না!
এসব কথায় আমার কোনও আপত্তি নেই, আমি শুধু মূল প্রস্তাবটির আশঙ্কা করছিলাম, বললাম, শাড়িটা বেশ সুন্দর, আর তুমিও মন্দ না।
একটু মুখ ঘুরিয়ে হেসে ফেলে বাণী বলল, কিন্তু তুমি কবে আসবে আমাদের বাড়িতে? মুখে বললাম, যেদিন আজ্ঞা করবে সেদিনই। মনে মনে অন্য কুমতলব ভাজতে লাগলাম। তখনকার মতো বাণী চলে গেলো।
যদিও ধরেই নিয়েছিলাম যে আজ-কালের মধ্যেই বাণী আসবে, আর আসবে সেই সাংঘাতিক মর্মান্তিক প্রস্তাব, কিন্তু সে যে এত তাড়াতাড়ি সেটা আশা করিনি। পরদিন সকালে ঘুম থেকে আমি উঠি সাড়ে নটায়, তখন ছটা–মানে আমার মধ্যরাত্রি, সেই সময়ে হাঁকাহাঁকি দরজায় কড়া নাড়া, প্রায় ভেঙে ফেলবার উপক্রম। উঠে দরজা খুলতে হল। খোকনদা, বড়দি এসেছে। আজ শেষ রাত্রিতেই ফিরেছে।
দেখি একটু পিছনে রাণী দাঁড়িয়ে। কাটিহার না কোথায় বিহারের দিকে এর বিয়ে হয়েছে। আরে এসো এসো, বাধ্য হয়েই আমাকে বলতে হয়। বলতে বলতে আমি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করি। ওরাও পিছে পিছে আসে। তা আজকেই ফিরছ রাণী, কেমন? শ্বশুরবাড়ির খবর কী? যে খবরগুলি না জেনেও অন্যান্য দিনের মতো আজকের দিনটাও কেটে যেতে পারত, সেইগুলিই জানবার জন্যে আমাকে এই মুহূর্তে ভদ্রতার খাতিরে বিশেষ উৎসাহ দেখাতে হয়। রাণী এতসব প্রশ্নের উত্তরে একটু মুচকি হাসে। আজ সকালেই ফিরলে? ফিরেই সাত তাড়াতাড়ি আমার এখানে ছুটলে, মন কেমন করছিল?
এইবার রাণী যেন একটু গম্ভীর হল, পাশের টেবিল থেকে একটা বই তুলে নিয়ে আলগোছে পাতা ওলটাতে লাগল। বাণী কিন্তু এর মধ্যেই একটু ফিক করে হেসে ফেলল। রাণী ধমকে উঠল, থাম ফাজিল কোথাকার! আসলে ধমকটা আমার উদ্দেশেই। সুতরাং আমাকে নিরত হতে হল। এবং সেই মুহূর্তেই লক্ষ করলাম রাণী আর বাণী দুইজনে চোখে চোখে কী একটা কথা আলোচনা করে নিল। আমার অন্তরাত্মায় আমি অনুভব করলাম আমি অবিলম্বে সেই ভয়ংকর দুর্ঘটনার মুখোমুখি হব।
এইবার বাণী কথা বলল, দিদি আজই ফিরে যাচ্ছে। ওর দেওরের বিয়ে, কিছু কেনাকাটি করতে হবে। তারপর রাত্রেই ফিরে যাবে।
সে কী, আজকেই ফিরে যাবে? আমাকে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হতে হয়।
এইবার রাণী বলল, , আর সেইজন্যেই তুমি অনেকদিন আমাদের বাসায় যাও না, আজ দুপুরে আসবে, ওখানেই খাবে। এবং বাণী যোগ করল, জানো খোকনদা, আমি রান্না করব। আমি কেমন সুন্দর রান্না করতে শিখেছি।
আমার মাথায় বজ্রাঘাত হয়। যা ভেবেছি ঠিক তাই হল। রাণী-মণির বেলায় যা হয়েছে, এবারও বাণীর বেলাতে তাই হল। বাণীর প্রথম রান্না, তার স্বাদ আমাকেই সর্বাগ্রে গ্রহণ করতে হবে। আমিই এদের এই প্রাণহরা অভিজ্ঞতার সবচেয়ে সুলভ শিকার। যা এড়াব বলে কালকেই মনে-প্রাণে প্রতিজ্ঞা করেছি, এই দুই তরুণী প্রতিবেশিনীর সামনে কিছুতেই সেটা করা যাবে না সেটা আমি এখনই বুঝলাম। না, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমাকে আবার সেই একই দৃশ্যে অভিনয় করতে হবে।
এই তো রাণী আমার সামনে বসে রয়েছে। সাধারণ সুন্দরী, নববিবাহিতা। চেহারায়, আচরণে একটা স্মিত কোমলতার ছাপ রয়েছে। কিন্তু একে দেখলে কে বুঝতে পারবে এর হাত দিয়েই বেরোতে পারে হাত-বোমার চেয়েও মারাত্মক সেই সব খাবার। সেই মানকচুর চপ। শরীর এখনও রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। যারা আমাকে সম্প্রতি চেনেন, তারা জানেন না, চিরকাল আমার কণ্ঠস্বর এমন ছিল না। এককালে আমি আপনাদের মতোই, সাধারণ মানুষদের মতোই, কোমল কণ্ঠস্বরে কথা বলতে পারতুম। কেউ কি বিশ্বাস করবে, করা কি সম্ভব যে আমার সেই অমায়িকতা এই একটি কোমল-দর্শনা যুবতীর হাতে নিহত হয়েছে!
তবে রাণীর চেয়ে মণি আরও সাংঘাতিক ছিল। এই পৃথিবীতে অনেক খাদ্যদ্রব্য নিশ্চয়ই আছে এবং আমরা সকলেই সেরকম খাবার লোভে পড়ে বা বিপদে পড়ে গ্রহণ করে থাকি যার জন্যে যকৃৎ, প্লীহা বা অন্ত্রাশয়ে নানা অসুবিধা দেখা দেয়। কিন্তু বিশ্বাস করুন আর নাই করুণ মণির তৈরি এক ধরনের পরটা খেয়ে আমার হাঁটুতে, কাঁধের জোড়াতে এবং দাঁতের মাড়িতে ভয়ংকর ব্যথা হয়েছিল, দুহাতের শিরা এক সপ্তাহ ফুলে ছিল, একুশ দিন অফিস যেতে পারিনি। জোড়াসন হয়ে মেজেতে খেতে বসেছিলাম। এদের বোনেদের এবং মায়ের অনুরোধে উপরোধে, বলা উচিত বলপ্রয়োগে, হাঁটু গেড়ে মেজেতে কাঁধের ও হাতের শিরায় শিরায় এবং দাঁতের মাড়িতে শরীরের সমস্ত শক্তি নিবিষ্ট করে পর পর চারটে খণ্ড গলাধঃকরণ করতে হয়েছিল এবং খেয়ে আর উঠতে পারিনি, মেজেতেই শুয়ে পড়েছিলাম। এদের ধারণা সেটা ভোজনাধিক্যবশত, আমার ধারণা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। পরে অবশ্য রোগশয্যায় মণি আমাকে বলেছিল, খাবারটা অবশ্য ভালই হয়েছিল, কিন্তু খোকনদার অতটা খাওয়ার কি দরকার ছিল?
এবং মণির কাছেই তার প্রস্তুত-প্রণালী শুনেছিলাম। এখন ঠিক স্পষ্ট মনে নেই তবে এই ঘটনার প্রতি সন্দেহশীল পাঠকদের (এবং পাঠিকাদের) একটু নমুনা দিচ্ছি। ধৈর্য সহকারে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। প্রথমেই বলা উচিত যে পরটাগুলি গম বা যব, এমনকী কোনও শস্যবীজ থেকেই তৈরি হয়নি, এগুলি ফলজাত। আরেকটু খোলসা করলে হয়তো ভাল হয়। আমের আঁটির ভেতরের সাদা সার গুঁড়ো করে কঁঠালের বিচির সঙ্গে সেটা সেদ্ধ করে রোদ্দুরে শুকনো হয়। তারপর জল দিয়ে চটকে মেখে আবার রোদ্দুরে শুকানো হয়। তারপর একে উপাদেয় করবার জন্য কিঞ্চিৎ মশলা এবং খাদ্যপ্রাণযুক্ত করবার জন্যে পুঁইশাক নিংড়ে তার রস দিয়ে আবার শুকানো হয়। বিজ্ঞানের শিক্ষা এবং মণির উদ্ভাবনী শক্তি দুই-এ মিলে এই মারাত্মক পরিণতি।
সেই রাণী-মণির বোন বাণী, তার হাতের রান্না খেতে হবে আমাকে আবার আজ দুপুরে এবং আমি আবার স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করলাম, ওদের সেই ছোট ছোট বোনেরা যারা প্রতিদিন বড় হচ্ছে এবং কাল হোক, পরশু হোক, শাড়ি পরা শুরু করবে আর আবার সেই সঙ্গে সেই রান্না আর আমি। আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। একটা কিছু কোনও একটা প্রতিবিধান, একটা প্রতিকার করতেই হবে। বছরের পর বছর এই অত্যাচার আর নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে আমি নিজেকে ঠেলে দিতে পারি না। আজ আবার আমার সেই প্রভুভক্ত কুকুরটির কথা মনে পড়ল। রাস্তা থেকে এনেছিলাম বাচ্চা অবস্থায়, তারপরে শত অপমানে, প্রহারেও গৃহত্যাগ করেনি। মণি একবার এক ধরনের পোলাও তৈরি করেছিল। কী দিয়ে তৈরি করেছিল বলতে পারব না, কিন্তু তৈরি করে একটা ঠোঙায় করে রুমালে বেঁধে দিয়ে বলেছিল, খোকনদা, এটা নিয়ে যাও। আজ খেয়ো না। দু-একদিন পরে খাবে। যত বাসি হবে ততই মুখরোচক হবে। খাবারটি বাসায় এনে আমার টেবিলের উপর রেখেছিলাম, পরদিন সকালে সেই ঠোঙাটি মুখে করে আমার প্রিয় কুকুরটি হঠাৎ ঘরের বাইরে চলে গেল, সেই যে গেল, আর এল না, চিরদিনের মতো নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। পরে একবার পাড়ার বাইরে বহুদুরে একটা রাস্তায় হঠাৎ কুকুরটি দেখতে পেয়েছিলাম, কিন্তু আমাকে দেখেই এত ভীত, আতঙ্কিত হয়ে পালিয়ে গেল যে বলার নয়।
সুতরাং, আর অত্যাচার সহ্য করা যায় না। এর একটা বিহিত করতেই হবে। আমি মরিয়া হয়ে উঠি।
যথাসময়ে মধ্যাহ্নকাল এল, আমাকে উঠতে হল, বাণীর ছোট জনাচারেক দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাকে নিয়ে যেতে। ভাল করে স্নান করলাম, মাথাটি এই গুরুতর সংকটে কিঞ্চিৎ ঠান্ডা থাকা দরকার। তারপর পায়ে পায়ে গুটি গুটি এগুনো গেল ওদের বাড়ির দিকে।
গিয়ে দেখি ত্র্যহস্পর্শ যোগ। মণিও এসেছে, বলল, দিদি এসেছে খবর পেয়ে চলে এলাম।আমি বললাম, তা বেশ। তুমিও রান্না করলে নাকি? না সবই বাণী? মণি বললে, আমি একটা মাত্র তৈরি করেছি, শুধু মশল্লা দিয়ে, শুধুই মশল্লা আর কিছু নয়, একটা মশল্লা চচ্চড়ি।মশল্লার সঙ্গে জিনিসটা। কী দিলে, কী দিয়ে চচ্চড়িটা হল? আমি একটা ছোট প্রশ্ন করি। মণি জানায়, আরে বলছি তো, শুধু মশল্লা দিয়ে আর কিছু নেই, ধনে-মৌরি চচ্চড়ি। শুধু ধনে-মৌরি? তবুও আমার সংশয় দূর না হওয়ায় মণি অসম্ভব ধমকে ওঠে। আগে খাও, খেয়ে বলো। ইতিমধ্যে বাণী এসে উপস্থিত। কপালে কালি, হাতে হলুদের দাগ, শাড়ির আঁচলেও, বিশেষ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। এসেই প্রশ্ন করল, কাঁচকলার মধ্যে নুন থাকে, জানো খোকনদা? আমি কাতর-কণ্ঠে জানাই, থাকা স্বাভাবিক। সেই কঁচকলা গরম জলে কুচি কুচি করে সেদ্ধ করে তার থেকে নুন বের করে নিয়েছি। তারপর সেই জল দিয়ে আর সব রান্না করেছি, আলাদা করে নুন দেওয়ার দরকার করেনি। বাণীর কথা শুনে আমি অভিভূত এবং মণি উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ে, রাণীও এসে যোগ দেয়। ওরা এরকম কোনওদিন ভাবতেই পারেনি বাণী এই পনেরোতেই যেটা করে ফেলল। ওরা বোনের জন্যে বিশেষ গর্বিতও হতে থাকে। সবচেয়ে ছোট একটি বাচ্চা ঘরের কোণে বসে পুতুলের রান্না-বান্না করছিল খুব মন দিয়ে। তার দিকে আঙুল দেখিয়ে মণি বলল, দেখছ, কেমন মনোযোগী। ও বাণীর চেয়েও সরেস হবে।
ইতিমধ্যে ওদের মা চলে আসেন। এসেই হাঁকডাক শুরু করে দেন। এখনি জায়গা করে দাও, আর দেরি করো না। খাবার ঠান্ডা হয়ে গেলে সে আর খাবারই থাকে না।
সুতরাং খেতে বসতে হল। বিচিত্র বর্ণগন্ধসমন্বিত অপূর্ব খাদ্যদ্রব্য আমার চতুর্দিকে। তাকালেই চোখে জল আসে জিভ শুকিয়ে যায়। অনুমান করি, এত প্রয়োজন ছিল না, এর যেকোনও একটিই কালান্তক হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। মুখেও তাই বলি, এত করার কী ছিল, অল্প দু-একটা রান্না করতে পারতে। তোমরা এত পরিশ্রম করলে। বলতে বলতে একসঙ্গে সবগুলি তরকারি ধীরে ধীরে অল্প অল্প করে মেশাতে থাকি। এই নীল রঙের পটলের ডালনাটার সঙ্গে ওই সাদা ধবধবে দুধ দিয়ে রাঁধা মাংসের ঝোলটা, তার সঙ্গে লাল টকটকে মুগের ডাল মেশাতেই একটা আশ্চর্য নতুন রং দেখা দিল। যেমন খাবারটায় তেমনি বোনেদের ও মায়ের মুখে। এবার আমি এগুলো সব চটকে মাখি, ভাত মেশাই দলা পাকাই। এই দলাটা রাণী খাবে মণি খাবে, এই দলাটা। এইভাবে এক একজনের নামে এক-একটা দলা পাকিয়ে আলাদা করে রাখতে থাকি। ওরা এক-একজনের নাম হতেই আঁতকে আঁতকে উঠতে থাকে।
খোকনদা, তুমি কি পাগল হয়ে গেছ নাকি! আমরা রান্না করেছি, আমরা তো খাবই। তুমি খাও।
এইবার আমি উঠে দাঁড়াই। আজ আর আমার পক্ষে খাওয়া সম্ভব নয়।
কেন? কী হল? ওরা সবাই বড় হতাশ হয়ে পড়ে, কেমন ক্লান্ত করুণ দেখায় ওদের। আমি অনেকটা থিয়েটারের অভিনেতার মতো উদাত্ত কণ্ঠে বলে যাই, আজ তোমাদের বাণীর এই সব রান্না দেখতে দেখতে আবার আমার মণির রান্নার কথা, রাণীর রান্নার কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল সব কতদিন আগের কথা, সেই কবে ছোটবেলায় পুরী গিয়েছিলাম।…
পুরীর সঙ্গে, তোমার পুরী যাওয়ার সঙ্গে আমাদের রান্নার সম্পর্ক কী?মণি প্রশ্ন করে। এতক্ষণে আমি আমার জুতোজোড়ার মধ্যে পা গলিয়ে দরজার কাছে গিয়ে ওদের দিকে ঘুরে দাঁড়াই, তোমাদের রান্না, তোমাদের প্রত্যেক বোনের রান্না খেতে খেতে আমার আবার পুরীর সমুদ্রতীরের কথা বারবার মনে পড়ে। আহা, সেই শৈশব, নীল সমুদ্র, বনরাজিনীলা। বিয়োগান্ত নাটকের নায়কের মতো আমার কণ্ঠস্বর ওদের মুগ্ধ করে ফেলে, বুঝি আমার প্রাক্তন কণ্ঠের কোমলতা আবার ফিরে আসে আমার স্বরে, আমি বলে যাই তোমাদের প্রত্যেকটি খাবারে সেই পুরীর সমুদ্রতীরের স্বাদ আবার ফিরে পাই। ঠিক তেমনই লবণাক্ত, তেমনই বালুকাকীর্ণ তোমাদের প্রত্যেকটি রান্না যেমন লোনা তেমন বালি কিচকিচে। এর উপরে ভ্রমণ করা যায় কিন্তু গলাধঃকরণ করা যায় না। পুরীর সমুদ্রতীরের সেই ভ্রমণের এত সহজ আনন্দ থেকে কলকাতার লোকদের আমি বঞ্চিত করতে চাই না। এই বলতে বলতে সমস্ত খাবারগুলো আমি দ্রুতবেগে রাস্তার দিকে হাত বাড়িয়ে ছুঁড়ে দিই, নিজেকেও ছুঁড়ে দিই রাস্তায়। ছুটে যাই সেই খাবারগুলোর উপর দিয়ে লবণাক্ত বালুকাকীর্ণ রাস্তার উপর দিয়ে দৌড়ে যেতে যেতে পুরীর সমুদ্রতীরে ভ্রমণের আস্বাদ ফিরে পাই।
একটি আদ্যোপান্ত দুর্ঘটনা
এ বাসটায় খুব ভিড়। অবশ্য সব বাসেই খুব ভিড় আজকাল। শনিবার রবিবার, সকাল-বিকেল কিছু নেই, সব সময়েই লোক উপছিয়ে পড়ছে; বাসে, রাস্তায়, বাজারে, সিনেমায়। এত লোক কোথা থেকে আসে, কেন আসে, কোথায় যায়, কেন যায়, রাতে কোথায় ঘুমায়?
নির্মলা লেডিস সিটের এক প্রান্তে বসে এই সব ভাবছিলেন, ক্রমশ বাসটা যত ধর্মতলার দিকে এগোচ্ছিল, বাসে ভিড় বেড়েই যেতে লাগল। নির্মলা বসে বসে আরও ভাবছিলেন, এই রবিবারের সন্ধ্যাবেলায় এত লোক ধর্মতলায় কী করতে যাচ্ছে? এরা সবাই কি ময়দানে বেড়াতে যাচ্ছে, অথবা চৌরঙ্গিতে ফুর্তি করতে চলেছে? কিন্তু এদের দেখে তো সেরকম মনে হয় না, বেড়ানোর বা ফুর্তি করার লোকের চেহারা, সাজ-পোশাক, এমনকী মুখ-চোখ দেখলেই বোঝা যায়।
কলকাতার উত্তরে এক মফসল শহর থেকে এই বাসটা সরাসরি ধর্মতলা পর্যন্ত চলে আসে। এর যাত্রীদের অধিকাংশের চেহারা ও চালচলনে সেই মফসলি ছাপ। এই সব বহিরাগত প্রাইভেট বাসের যাত্রীদের মোট চেহারা প্রায় একরকম। স্টেট বাসের লোকদের চেহারা একটু আলাদা, তাতে খাস কলকাতার ছাপ। এই পার্থক্য চোখে দেখে যতটা বোঝা যায়, বলে বোঝানো কঠিন। সেই
একই রকম লম্বা-ফরসা, বেঁটে-কালো, নাইলন-টেরিলিন, হ্যান্ডব্যাগসানগ্লাস–কিন্তু কোথায়। একটা সূক্ষ্ম প্রভেদ রয়ে গেছে যা শুধু চোখের নজরে ধরা পড়ে। নির্মলা এই সব ভাবতে ভাবতে চলেছেন, ইতিমধ্যে বাস প্রায় বিবেকানন্দ রোডের মোড়ে; নির্মলা উঠেছেন শ্যামবাজারের মোড় থেকে। ইতিমধ্যে অনেক লোক নেমেছে এবং তার চেয়ে বেশি লোক উঠেছে। ভাগ্যক্রমে প্রায় উঠেই নির্মলা সামনে একটা লেডিস সিট খালি পেয়ে যান, এবং নির্মলা এখন সেখানেই বসে আছেন।
সিটে বসেও অবশ্য নিস্তার নেই। ক্রমবর্ধমান জনমণ্ডলীর প্রচণ্ড চাপ নির্মলার সামনে দাঁড়ানো। এক ভদ্রলোকের হাঁটু বাহিত হয়ে বারে বারে নির্মলার হাঁটুতে এসে লাগছিল। এমন একটা কোণার দিকে নির্মলা বসেছেন যে ইচ্ছে হলেই হাঁটুটা সরিয়ে রক্ষা করতে পারবেন তার কোনও উপায় নেই।
নির্মলার হাঁটুর উপর চাপ ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছিল, তিনি বিরক্ত হয়ে সামনের ভদ্রলোকটির দিকে তাকালেন। ঠিক সাদা ভাষায়, কলকাতায় যাদের ভদ্রলোক বলে তেমন নয়, গ্রাম্য গৃহস্থ চেহারা, মোটা ধুতি মোটা শার্ট গলায় আধময়লা সুতির চাদর, বয়স বছর পঞ্চাশ বা কিছু কমের দিকেই হবে। ভদ্রলোকটিকে মৃদু তিরষ্কার করতে গিয়ে নির্মলার একটু বরং মায়াই হল, এঁর কোনও দোষ নেই, ইনি নিতান্তই অসহায়। আ-দরজা যাত্রীসাধারণের অদম্য চাপ কেন্দ্রীভূত হয়ে এঁর হাঁটুর উপরে পড়ছে, তারই কিছুটা ইনি চালান করে দিচ্ছেন নির্মলার হাঁটুতে, তবু তো নির্মলা বসে, ইনি ত্রিভঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
বাসটা ইতিমধ্যে কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে এসে গেছে, এইখানে আর একটা প্রচণ্ড ভিড়ের ধাক্কা সৃষ্টি হল, নামল মাত্র একজন লোক, উঠবার চেষ্টা করছে শতাধিক লোক। নির্মলার সামনে দাঁড়ানো যে ভদ্রলোক এতক্ষণ নির্মলার হাঁটুতে হাঁটু ঠেকিয়ে আত্মরক্ষা করছিলেন, এবার তিনি সত্যি সত্যি হুমড়ি খেয়ে পড়লেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বাস তীব্রগতিতে ছাড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটল।
প্রাইভেট বাসগুলোর জানলার উপরে ছাদ বরাবর লাল-নীল কাঁচের জাফরি লাগানো থাকে। সেইখানে হাতের চাপ রেখে নির্মলার হাটুতে আরেকটু চাপ ফেলতে গিয়ে হঠাৎ উপরের জাফরির কাঁচ ভেঙে একসঙ্গে ভদ্রলোকের বাঁ এবং ডান হাতের দশটা আঙুল সেই জাফরির মধ্যে ঢুকে গেল। জাফরি থেকে ভাঙা কাঁচের টুকরোগুলো ঝরঝর করে ভেঙে নির্মলার মুখের উপর পড়তে লাগল, সেই কাঁচের টুকরোগুলি সব রক্তে রক্তময়, এর উপরে ভদ্রলোকের আঙুল কাটা রক্ত ফোঁটায় ফোঁটায় প্লাবিত করে দিলে নির্মলার চোখ, মুখ, মাথার চুল।
সে এক বীভৎস দৃশ্য। ভদ্রলোক একবার আর্ত চিৎকার করেই নির্মলার মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দ হয়ে গেলেন। বাসের লোকেরা প্রচণ্ড হই হই শুরু করে দিল, নির্মলার মাথা, শরীর, শাড়ি সমস্ত রক্তে আর কাঁচে মাখামাখি, সবাই রোকখে রোকখে করে বাস থামিয়ে ফেলল।
অন্যের গায়ের রক্ত নাক দিয়ে, চোখ দিয়ে, ঠোঁট দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে আর মাথায়, ঘাড়ে কিছু ধারালো কাঁচের টুকরো, নির্মলা একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলেন। কিন্তু বাসের লোকেরা তাঁকে হতভম্ব হওয়ার অবকাশ দিল না, সামনেই মেডিক্যাল কলেজ, কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই মিলে হই-হই করে মেডিক্যাল কলেজের সদর দরজার ভিতর দিয়ে একেবারে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের সামনে এনে পুরো বাসটাকে দাঁড় করাল। কয়েকজন ছুটে ইমার্জেন্সির ভিতরে চলে গেল, আর কয়েকজন। পাঁজাকোলা করে নির্মলাকে সামনের একটা খালি হুইল চেয়ারে বসিয়ে দিল। বাকি সবাই নির্মলার। ওই রক্তাক্ত মুখশ্রী দেখে, কী হয়েছে, কী হয়েছে বলে কলরব করতে লাগল।
ঘটনার আকস্মিকতায় নির্মলার তখন বিপর্যস্ত অবস্থা, সত্যিই তার কী হয়েছে, কোথাও সত্যি কেটে-টেটে গেছে কি না তাও বুঝতে পারছিলেন না। একটু দূরেই সেই গ্রাম্য ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে, তার অবস্থা আরও নিদারুণ, তার হাত দিয়ে তখনও দরদর করে রক্ত পড়ছে, কিন্তু কেউই সেটা খেয়াল করছে না, তিনি একা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন, তার হাত দুটো থরথর করে কাঁপছে, বোধ হয় এতটা রক্তক্ষরণের জন্যেই।
হুইলচেয়ার ঠেলে নির্মলাকে ইমার্জেন্সির মধ্যে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে একজন পৌর প্রশাসনের গর্তে পড়ে পা ভাঙা এবং একজন মিনিবাস চাপা পড়া লোকের পর্যবেক্ষণ করছিলেন দুজন তরুণ ডাক্তার। নির্মলার রক্তময় মুখ দেখে তাদের ফেলে তারা ছুটে এলেন। এসেই প্রথমে নার্সকে ডেকে তাড়াতাড়ি ধুয়ে মুছে ড্রেসিং করতে বললেন, তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে?
ডাক্তারেরা যখন শুনলেন বাসে, স্পষ্টই ধরে নিলেন বাস থেকে পড়ে গিয়ে রাস্তায় মাথা থেঁতলে গিয়েছে; সবাই চুপ করুন, চুপ করুন, বাইরে দাঁড়ান, এটা হাসপাতাল, গোলমাল করবেন না, বলে, নার্সের ড্রেসিং শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে লাগলেন। ওই প্রান্তে তখন পা-ভাঙা এবং চাপা-পড়া লোক দুজন ভীষণ কেঁকাচ্ছে এবং বাইরে সিঁড়ির উপরে বসে সেই গ্রাম্য ভদ্রলোক, তার রক্ত পড়া তখনও থামেনি।
এদিকে যে নার্স নির্মলাকে ড্রেসিং করে বোয়াতে-মোছাতে গিয়েছিলেন, তিনি যত রক্ত মোছেন তারপর আর কিছুই পান না কোথাও, শুধু রক্ত আর রক্ত, দু-একটা কাঁচের টুকরো, কিন্তু কোথাও একটা কাটা নেই, একটু ছড়ে যাওয়া পর্যন্ত নেই।
বিব্রত নার্স ডাক্তারদের ডাকলেন। ডাক্তারেরা এসেও অবাক। তারা ভাবলেন, তা হলে বোধ হয় নাক বা মুখ দিয়ে এত রক্ত বেরিয়েছে, কিন্তু সে রক্ত কপালে, মাথায় চুলে লাগবে কী করে? কিছুক্ষণ বিমূঢ়তার পর একজন ডাক্তার নির্মলাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এত রক্ত এল কোথা থেকে? নির্মলা বললেন, এ রক্ত আমার নয়, অন্য লোকের রক্ত। উত্তর শুনে ডাক্তারদ্বয় এবং নার্স স্তম্ভিত হয়ে নির্মলার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তাদের চোখেমুখে প্রচণ্ড সন্দেহের ছায়া। একটু পরে একটু সরে গিয়ে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কী আলোচনা করে একজন এসে কঠিন কণ্ঠে নির্মলাকে বললেন, আপনার কিছুই হয়নি। যান, বাড়ি চলে যান।
হাসপাতাল থেকে ধমক খেয়ে নির্মলা বেরিয়ে এলেন। বউবাজারে চলেছিলেন দিদির বাড়িতে। আর বউবাজারে গিয়ে দরকার নেই, সাতটা বেজে গেছে, রাত্রির শো-য় সিনেমার টিকিট কাটা আছে, গিয়েই তৈরি হতে হবে। বি টি রোডের ফ্ল্যাটে ফিরে চললেন নির্মলা।
বাসায় ফেরার পর নির্মলার স্বামী মহাদেব সব শুনে তো হই-চই লাগিয়ে দিলেন, তুমি যে রকম বোকা। নির্মলা যত বলেন, আমি কী করব? মহাদেব আরও ক্ষেপে যান কী সাংঘাতিক, এখনও তো কানে, ঘাড়ে রক্ত লেগে রয়েছে, কার না কার রক্ত, ছি ছি ছি।
নির্মলারও ঘেন্না করছিল, বাথরুমে গিয়ে ভাল করে সাবান মেখে স্নান করলেন। কিন্তু মহাদেব অত সহজে ছাড়বার লোক নন, কার কী ইনফেকশন আছে কে জানে, কার কীরকম রক্ত, হাসপাতালে রক্ত পরীক্ষা করালে না কেন? নির্মলা বলেন, অন্যের রক্ত আমি কী পরীক্ষা করাব? অবশেষে অনেক তর্ক-বিতর্কের পর স্থির হল পরিশুদ্ধ হওয়ার জন্যে নির্মলা সমস্ত মুখ, ঘাড়, পিঠ কোনও লোশন দিয়ে মুছে ফেলবে। কিন্তু ডেটল খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, শিশিতে একবিন্দু ডেটল। নেই। এদিকে সিনেমার সময় হয়ে এসেছে, দোকানে গিয়ে ডেটল কিনে আনতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। এ ছাড়া বাসায় কোনও অ্যান্টিসেপটিক লোশন নেই। পাশের ফ্ল্যাটে খোঁজ করতে গেলেন। নির্মলা, তাদের মলমের ব্যবসা, নিশ্চয়ই কিছু পাওয়া যাবে। কিন্তু সেখানেও কিছু নেই, তবে তাদের কাছে বিশুদ্ধ অ্যালকোহল, যাকে র অ্যালকোহল বলে তা কয়েক বোতল আছে, তাই দিয়ে নাকি সব মলম তৈরি হয়। আধ শিশি তাই নিয়ে এল নির্মলা।
মহাদেব তো অ্যালকোহল দেখে উত্তেজিত, দাও অর্ধেক আমি খাই, অর্ধেক তুমি মাখো। শেষ পর্যন্ত সত্যি অর্ধেক জল মিশিয়ে মহাদেব খেলেন, বাকি অর্ধেক নির্জলা নির্মলা মাখলেন। প্রথমে। নির্জলা মাখতে তিনি রাজি হননি, কিন্তু মহাদেব জোর করলেন, জল-টল মিশিয়ো না, এইভাবে মাখো, সম্পূর্ণ শুদ্ধ হয়ে যাবে।
অ্যালকোহল মাখবার ও পান করার পর মহাদেব-নির্মলা দম্পতি বেরোলেন সিনেমা দেখতে। ওই বিশুদ্ধ তরল পদার্থ মাখবার পর থেকে কীরকম অস্বস্তি বোধ করছিলেন নির্মলা। সিনেমা হলে বসে নিউজ-রিল শেষ হয়ে আসল বই আরম্ভ হওয়ার আগেই নির্মলার মুখে-চোখে কীরকম একটা ব্যথা করতে লাগল। আলগোছে মুখের উপর হাত বোলাতে বুঝতে পারলেন ফোঁসকা উঠছে: ক্রমশ। ফোঁসকা উঠতে লাগল; ফোঁসকা আরও ফোঁসকা, আরও ফোঁসকা।
ইন্টারভ্যালের আলো জ্বলতেই চমকে উঠলেন মহাদেব। নির্মলার মুখমণ্ডল ফোঁসকায় ছেয়ে গেছে, যেগুলো সদ্য উঠেছে সেগুলো গোলাপি রঙের, পরের গুলি টকটকে লাল আর কতকগুলি এরই মধ্যে কালচে রং ধরেছে।
সিনেমা আর দেখা হল না। মহাদেব আঁতকে লাফিয়ে উঠলেন, সর্বনাশ, তোমার মুখের কী অবস্থা হয়েছে! প্যাসেজ দিয়ে দ্রুত বেরোতে বেরোতে লম্বা টানা আয়নায় নিজের চেহারা দেখে নির্মলা নিজেও অস্থির হয়ে উঠলেন, কী সাংঘাতিক!
হল থেকে বাইরে এসে মহাদেব ট্যাক্সি ডাকলেন, এই চলো মেডিক্যাল কলেজ। নির্মলা মেডিক্যাল কলেজের কথা শুনে কী একটা প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ব্যথা-যন্ত্রণায় তখন তিনি অস্থির।
মেডিক্যাল কলেজের ইমার্জেন্সির সামনে আবার এসে ট্যাক্সি দাঁড়াল। আবার সেই একই ওয়ার্ড, ডাক্তার দুজন এবং নার্স এখনও অপরিবর্তিত। নির্মলাকে দেখে এবার তারা চমকে উঠলেন, সন্ধ্যায় যাঁর রক্তাক্ত মুখ দেখে তারা বিচলিত হয়েছিলেন, এখন তার মুখে নানা বর্ণের, নানা আকারের ফোঁসকা। এবার কিন্তু তারা মুহূর্তের মধ্যে মনঃস্থির করে ফেলেছেন, একজন এগিয়ে এসে নির্মলাকে গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনিই না সন্ধ্যাবেলায় রক্ত মেখে এসেছিলেন? নির্মলা ক্ষীণ কণ্ঠে কী উত্তর দিলেন বোঝা গেল না। এবার ফোঁসকা লাগিয়ে এসেছেন? পরের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। নির্মলার জবাবের জোর নেই, মহাদেব নির্বাক। অবশেষে পিছন থেকে নার্সটি কাংস্যকণ্ঠে বললেন, এসব চালাকি এখানে চলবে না।
নির্মলা আর মহাদেব গুটি গুটি বেরিয়ে এলেন হাসপাতাল থেকে। ব্যথায় যন্ত্রণায় নির্মলা তখন অস্থির, তারই মধ্যে দেখতে পেলেন সেই গ্রাম্য ভদ্রলোকটি বারান্দায় দেয়ালে ঠেস দিয়ে পড়ে রয়েছে, তার হাতের তালুতে চাপ চাপ রক্ত জমাট ধরে তখন কালো হয়ে গিয়েছে, তবে নতুন করে আর রক্ত পড়ছে না।
একটি গল্পের নবজন্ম
অর্থ বড় না প্রেম (মতান্তরে কাম) বড় এই রকম জটিল বিষয়ে আমার একটি গল্প ছিল সম্পাদকের দপ্তরে।
সারা বছর ধরে কত গল্পই যে লিখি। সম্পাদক ছাপেন, পাঠকেরা পড়েন, তারপর ভুলে যান।
আমিও ভুলে যাই। এত লিখলে কারও কিছু মনে থাকে।
এখন যে গল্পের কথা বলছি, সে গল্পের ব্যাপার কিন্তু একটু আলাদা।
এই গল্পটি ছাপা হয়নি।
সম্পাদক মহোদয়ের পছন্দ হয়নি তা নয়। অনিবার্য এক কারণে ছাপা হয়নি। পাঠকেরা গীতা না পড়লেও সেই শ্লোক মাঝে মধ্যে খবরের কাগজে পড়ে থাকবেন, ধনাঢ্য ব্যক্তিদের পরলোক গমনের অলংকৃত বিজ্ঞাপনে ছাপা হয়, যার মোদ্দা কথা হল আত্মাকে সুঁচ ফুটো করতে পারে না, আগুন পোড়াতে পারে না। ইত্যাদি, ইত্যাদি।
আমার গল্পও সেইরকম।
এই পটভূমিকায় এবারের এই গল্প।
গল্পটি নতুন করে লিখতে হবে।
কিন্তু একই গল্প কি দুবার লেখা যায়?
গল্পের ধরনটা আবছা আবছা মনে আছে। কিন্তু পুরো গল্পটা কিছুতেই একরকম হবে না।
একই নদীর জলে দুবার ডুব দেওয়া যায় না। একই পথে দুবার হাঁটা যায় না। নদীর জল বয়ে যায়, রাস্তার লোকজন, আলোছায়া বদলিয়ে যায়। আরও একটু ঘনিষ্ঠভাবে একবার আমি নিজেই লিখেছিলাম, একই ঠোঁটে দুবার চুমু খাওয়া যায় না। প্রথম চুমু খেতে দ্বিতীয় চুমু ওষ্ঠাধিকারিণী খণ্ডমুহূর্তে বদলিয়ে যান।
এ সমস্তই মেনে নিয়ে এবার গল্পটাকে ধরার চেষ্টা করছি।
গল্পের নায়িকার নাম খুব সম্ভবত জয়ন্তী। এ নামটা আমার খুব প্রিয়। তা ছাড়া, এ নামে আমার পরিচিত কেউ নেই, তাই নিরাপদে ব্যবহার করা যায়। তবু অনেক সময় একটু এদিক ওদিক করে জয়ন্তী, জয়া, বিজয়া এসব নামও ব্যবহার করি।
তবু, আপাতত জয়ন্তীই চলুক।
জয়ন্তী নববিবাহিতা। বারাসতের কাছে একটা গ্রাম মাঠপুকুর। সেখানে বাপের বাড়িতে থাকে। কাছেই কাটাখালি গ্রামের একটা প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা।
জয়ন্তীর বরের নাম যাই হোক, আমরা এ গল্পে জয়ন্তীর নাম মিলিয়ে তাকে জয়ন্ত বলে ডাকব। জয়ন্ত বারাসত কলেজের বি এস সি। বেশ ভাল ছাত্র। সরকারি ক্লার্কশিপ পরীক্ষা দিয়ে সে একটি কেরানির চাকরি করছে সল্টলেকে রাজ্য সরকারের একটি ডিরেক্টরেটে। আজকাল এসব চাকরিতে মাইনে ভাল, ভবিষ্যত ভাল, নিরাপত্তাও যথেষ্ট।
জয়ন্তের একটাই মহাদোষ। সে বড় কৃপণ। আড্ডার ভাষায় রাম চিপপোস।
অবশ্য অনেক সময় দেখা যায় কৃপণ দুর্নাম কোনও কোনও মানুষের ঘাড়ে অনায়াসে চেপে বসে অতি সামান্য কারণেই। হয়তো ভদ্রলোক চায়ে চিনি কম খান, হয়তো তিনি অফিসে প্রভিডেন্ট ফান্ডে টাকা খুব বেশি কাটান। হয়তো প্রতিবেশীর মেয়ের বিয়েতে দুশো টাকা দামের শাড়ি না দিয়ে চল্লিশ টাকা দামের কবিতার বই দেন।
কিন্তু জয়ন্তের কৃপণ অখ্যাতির ব্যাপারে আরও গুরুতর ঘটনা আছে। দু-একটা উদাহরণ দিই :
(১) জয়ন্ত নিজে রান্না করে খায়। সে প্রথমে ডাল রাঁধে। তারপর রাঁধা ডাল থেকে সেদ্ধ হয়ে যাওয়া কাঁচা লঙ্কা, শুকনো লঙ্কা তুলে সেগুলো দিয়ে তরকারি রাঁধে নতুন করে লঙ্কা দেয় না।
(২) জয়ন্ত দাড়ি কামানোর পরে সাবানের বুরুশ ধধায় না। ভাত খেয়ে উঠে ধোয়। এতে ভাত খেয়ে হাত ধোয়ার জন্যে আলাদা সাবান ব্যয় করতে হয় না।
(৩) দেশলাই অগ্নিমূল্য হওয়ার পরে জয়ন্ত আর দেশলাই ব্যবহার করে না। সিগারেট লাইটার ব্যবহার করে। কিন্তু যখন ব্যবহার করত, দেশলাই বাক্সগুলোর মোটা মোটা কাঠিগুলো বার করে ব্লেড দিয়ে সেগুলো দু-টুকরো করত। এভাবে বিশ-পঁচিশটা কাঠি বেশি হয়ে যেত।
কৃপণ স্বভাবের মানুষদের সম্পর্কে এসব গল্প তো অনেক ক্ষেত্রেই খাটে। কিন্তু জয়ন্ত সম্পর্কে তার ব্যক্তিগত ঘটনাগুলো না বললে তাকে পুরোটা বোঝা যাবে না।
সল্টলেকে চাকরি হওয়ার পরে সে বাগুইহাটির প্রত্যন্ত সীমানায় একটা বাড়ির বাইরের দিকে একটা ঘর ভাড়া করে। কমন বাথরুম, এক চিলতে বারান্দায় রান্নার জায়গা।
চাকরিতে ঢোকার কয়েক মাসের মধ্যে জয়ন্ত নতুন বাসস্থানে চলে গেল। অফিসের সহকর্মীরা, তাদের মধ্যে যারা ঘনিষ্ঠ তারা চাপ দিতে লাগল খাওয়াতে হবে, পানীয় প্রবণ দু-একজন বলল, হাউস ওয়ার্মিং পার্টি দাও জয়ন্ত, শুধু দু-বোতল হুইস্কি, আমরা চানাচুর নিয়ে যাব।
জয়ন্ত উচ্চবাচ্য করেনি। কিন্তু তার সহকর্মীরা, তার বন্ধুরা সে যে কী জিনিস বুঝতে পারেনি।
সহকর্মীরা যখন দেখল জয়ন্ত মোটেই উৎসাহ দেখাচ্ছে না, তারা ঠিক করল অনাহূত চলে যাবে।
এক রবিবার সকালে তিন-চারজন সহকর্মী বন্ধু অনেক খুঁজে খুঁজে বাগুইহাটির বাসস্টপ থেকে সচ্ছল জনপদ, ইতস্তত বহুতল, পানাপুকুর, ধানক্ষেত ইত্যাদি পার হয়ে অনেক খুঁজে জয়ন্তের বাড়িতে পৌঁছল।
কৃপণ ব্যক্তিরা খুব অলস হয়। ছুটির দিনের সকাল, আরামে লম্বা হয়ে শুয়ে ছিল জয়ন্ত। হঠাৎ সে জানলা দিয়ে দেখে বাড়ির পাশের পুকুরপাড়ের পাশের রাস্তা দিয়ে তার অফিসের তিনজন সহকর্মী হই হই করে আসছে।
উপস্থিত বুদ্ধির কোনও অভাব নেই জয়ন্তের। তাদের গৃহাভিমুখী এই চলন্ত দৃশ্য দেখে সঙ্গে সঙ্গে সে জানলা বন্ধ করে দরজা ভেজিয়ে মশারি টাঙিয়ে বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল।
একটু পরে দরজায় টক টক শব্দ হতে সে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, কে?
বাইরে থেকে উত্তর এল, আমরা, সেই সঙ্গে ভেজানো দরজাটা একটু ঠেলে তিনজনই ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে জয়ন্ত চেঁচিয়ে উঠল, এসো না, এসো না।
সবাই থমকিয়ে যেতে জয়ন্ত বলল, আমার মায়ের দয়া হয়েছে। আজকের দিনেই তোমরা এলে?
এই দুঃসংবাদে সবাই হতচকিত হয়ে গেল, এই তত পরশু দিন শুক্রবারেই জয়ন্ত অফিস থেকে সুস্থ শরীরে বাড়ি ফিরেছে।
কিন্তু মায়ের দয়া মানে বসন্ত, মানে পক্স। এখন যদিও স্মল পক্স কদাচিৎ, চিকেন পক্স কম গোলমেলে নয়। বান্ধববৃন্দ খুব বেশি বাহাদুরি না দেখিয়ে সঙ্গে সঙ্গে পশ্চাদপসরণ করল।
এর পরের ঘটনা আরও চমৎকার। বারাসত কলেজে পড়ার সময় জয়ন্তের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল অমলেশ। সেই অমলেশ সেলস ট্যাক্স ইনস্পক্টর হয়েছে। এখন কাজ করছে জিয়াগঞ্জে। সে কী কাজে একদিন কলকাতায় এসেছে, সেটা ছিল এক শনিবার, অফিস কাছারি বন্ধ। খুঁজে খুঁজে অমলেশ জয়ন্তের বাড়িতে সকালবেলায়। জয়ন্ত যখন অমলেশের কাছে শুনল সে দুদিন থাকবে, সে অমলেশকে বাসায় বসিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল। ঘণ্টা খানেক পরে ঘামতে ঘামতে ফিরল। ফিরে এসে বলল, শনিবার পোস্ট অফিসে বড় ভিড় হয়।
অমলেশ জিজ্ঞাসা করল, হঠাৎ পোস্ট অফিসে কেন?
জয়ন্ত বলল, টাকা পয়সা ঘরে যা ছিল সব মানিঅর্ডার করে দিয়ে এলাম।
অমলেশ বলে, সব টাকা কাকে পাঠালে? কাকে আর পাঠাব? জয়ন্ত জবাব দেয় অফিসের ঠিকানায় আমার নামেই টাকাটা পাঠালাম।
অমলেশ অবাক। কিন্তু কেন?
জয়ন্ত বুঝিয়ে বলে, তুমি পুরনো বন্ধু। অনেকদিন পর এসেছ, দুদিন থাকবে। হঠাৎ যদি আবেগের মাথায় বেহিসেবি খরচ করে ফেলি। তিন-চার দিন পরে অফিসে তো টাকাটা পেয়েই যাব।
ইতিমধ্যে জয়ন্তের বিয়ে হয়েছে। নববধূ জয়ন্তী হাসিখুশি, দিলখোলা তন্বী তরুণী। জয়ন্তী স্বামীকে খুব একটা কাছে পায় না। শনিবার সন্ধ্যাবেলা সে স্বামীর কাছে বাগুইহাটিতে আসে। কিন্তু জয়ন্তের সেটা পছন্দ নয়। বাড়িতে বউ আসা মানেই সে বড় খরচের ব্যাপার। তার ইচ্ছে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলো সে শ্বশুরবাড়িতেই কাটায়, শুক্রবার সন্ধ্যায় গিয়ে একেবারে সোমবার সকালে শ্বশুড়বাড়ি থেকে সরাসরি অফিস চলে আসবে। কিন্তু বাপের বাড়িতে জয়ন্তী লজ্জা পায়। তার ইচ্ছে নয় জয়ন্ত ঘনঘন আসে। পয়সা বাঁচবে তাই জয়ন্তর শ্বশুরবাড়ির ব্যাপারে কোনও সংকোচ নেই। তবে কোনও কোনও সপ্তাহে জয়ন্তী জোর করে স্বামীর ঘরে চলে আসে। এইভাবে চলে যায়। জয়ন্ত জয়ন্তীকে থাকতে মানা করে বলে, ছোটঘর, ছোট বিছানা। রান্না খাওয়ার জায়গা নেই। জয়ন্তী বলে, আমার কোনও অসুবিধে নেই। মাঝেমধ্যে সে আচমকা এসে জয়ন্তকে নিয়ে নিউমার্কেটে কিংবা সিনেমায় যাওয়ার চেষ্টা করে। সব সময়ে অবশ্য সফল হয় না। তখন ঘরদোর সাজায়, জানলার পর্দা টাঙায়, যাই হোক নিজের ঘর।
গত সপ্তাহে জয়ন্তের শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথা। সপ্তাহান্তে সোমবার দোল। নতুন জামাই দোল খেলে মঙ্গলবার শ্বশুরালয় থেকে অফিসে চলে যাবে। কিন্তু এ যাত্রায় ভাগ্য জয়ন্তীর সহায়, মধ্য সপ্তাহে বুধবার ভোরে আচমকা ঝড়ে কাটাখালি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুরনো টিনের চালা মুখ থুবড়ে পড়ে গেল, ভাগ্যিস তখন ক্লাস হচ্ছিল না। সোমবারের আগে স্কুল হওয়ার সম্ভাবনা নেই, এদিকে শুক্রবার বিকেলেই জয়ন্ত চলে আসবে। অনেক ভেবেচিন্তে জয়ন্তী বৃহস্পতিবার সকালে জয়ন্ত অফিস বেরোনোর আগেই নিজের বাড়িতে প্রবেশ করল।
আর মাত্র আজকের রাত। জয়ন্ত সপ্তাহশেষের খরচ বাঁচানোর আনন্দে গুনগুন করে আমার পরান যাহা চায় গাইতে গাইতে গেঞ্জি গায়ে দিচ্ছিল এমন সময় জয়ন্তীকে কাঁধে একটি ঝোলা ব্যাগ নিয়ে বারান্দায় উঠতে দেখে আঁতকিয়ে উঠল।
জয়ন্তী বলল, ভয় পেলে চলবে না। আমি এসে গেছি। দোল কাটিয়ে যাবাস্তম্ভিত জয়ন্ত বলল, এ কদিন খাবে কী, চাল-ডাল সঙ্গে কিছু এনেছ।
জয়ন্ত কিছু বোঝার আগে জয়ন্তী তাকে অচকিতে দুই বাহুতে জড়িয়ে দুদিনের না কামানো গালে চুমু খেতে খেতে বলল, আমার চাল-ডাল কিছু লাগবে না, আমি শুধু এই খাব। ছাড়ো, ছাড়ো বলে জয়ন্ত ছাড়াতে গিয়ে আরও জড়িয়ে পড়ল, অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে যে। আমার দেরি হচ্ছে না, জয়ন্তী আরও জাপটিয়ে ধরল জয়ন্তকে। পুনশ্চঃ এক কৃপণের গল্প এভাবে শেষ করা উচিত নয়। আগের গল্পটায় আরও একটু জাপটা-জাপটি ছিল। কিন্তু তার প্রয়োজন নেই। জয়ন্ত-জয়ন্তী সুখেই আছে, দুজনেই বাগুইহাটিতে আছে।
একটি পুস্তক সমালোচনা
০১.
শ্রীমতী সুকুমারী পালদত্ত প্রণীত যত দেখি, যত জানি, যত ভাবিবইটি সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। এই একটি বইই তাঁকে বিখ্যাত করে দিয়েছে। গত বইমেলায় এই বই নিয়ে হইচই পড়ে যায়।
এ কালের যেকোনও হেঁদো সমালোচকের মতো ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোছের, প্রকাশক ও লেখকের মুখরক্ষা করে অথচ বেশি প্রশংসা না করে, ছাপা বাঁধাই-প্রচ্ছদ ভাল গোছের আলোচনা করার পাত্র আমি নই।
তা ছাড়া সুকুমারী দেবীকে আমি ভালই চিনি। এই বই রচনা সম্পর্কে তাঁর কাছে বিস্তর শুনেছি। এই বইয়ের প্রসঙ্গে তারই কিছু কিছু উল্লেখযোগ্য।
সে প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা। সুকুমারী তখন অবিবাহিতা, সদ্য এম এ পাস করে একটি কনসালট্যান্ট কোম্পানিতে সাময়িক একটা সমীক্ষার কাজ করছেন। বোধহয় কোনও খবরের কাগজের ব্যাপার হবে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে লোকের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে, তাঁরা কী কাগজ পড়েন, কেন পড়েন ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রতিটি প্রশ্নোত্তর বাবদ তিন টাকা, দৈনিক কয়েক ঘণ্টায় দশ-পনেরো টাকা উপার্জন, মাসে তিন-চারশো টাকা, সে সময় সে টাকার অনেক দাম।
এই কাজ করতে করতে একদিন সুকুমারী ঘোর বিপদে পড়লেন। অচেনা পাড়ায় একটা পুরনো বাড়িতে পাগলের পাল্লায় পড়লেন।
কলিংবেল দিতে গৃহকর্তা স্বয়ং দরজা খুলে দিয়েছেন। তাঁর এক হাতে কাঁচি, অন্য হাতে সেদিনের প্রায় সবগুলো দৈনিক পত্রিকা। ভদ্রলোকের রক্তচক্ষু, তিনি দরজা খুলেই সুকুমারী দেবীকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কী বেচতে এসেছ? ইঁদুর মারা ওষুধ? এই ধেড়ে ইঁদুরকে কোনও ওষুধ দিয়ে মারতে পারবে না।
সুকুমারী বললেন, না স্যার, ওষুধ-টষুধ নয়, আমি জানতে এসেছি আপনি কী কী খবরের কাগজ পড়েন, কেন পড়েন?
কী কী কাগজ পড়ি? কেন পড়ি? এই বলে সেই ভদ্রলোক বললেন, কোনও কাগজ পড়ি না। কাগজের নিকুচি করেছে। প্রত্যেকটা কাগজ সকালবেলা পাওয়ামাত্র কাঁচি দিয়ে কুচিকুচি করে কাটি,বলে হাতের কাগজগুলো কুচিকুচি করতে লাগলেন। এই সময় বাড়ির মধ্য থেকে অন্য এক ব্যক্তি বেরিয়ে এলেন, গৃহকর্তার চেয়ে কিঞ্চিৎ লম্বা, কিন্তু দেখেই বোঝা যায় বয়েস কিছুটা কম। বোধহয় ছোটভাই।
এই দ্বিতীয় ব্যক্তি একটু একরোখা প্রকৃতির, এসেই গৃহকর্তাকে বললেন, দাদা, তুমি একাই সবগুলো কাগজ কুচিকুচি করলে, একবারও ভাবলে না যে কাঁচিটা আমিই তোমাকে দিয়েছিলাম। অত্যন্ত রাগত অবস্থায় এই কথা বলতে বলতে দ্বিতীয় ব্যক্তি সুকুমারী দেবীকে দেখতে পায়। সঙ্গে সঙ্গে দাদাকে জিজ্ঞাসা করে, দাদা, এই মহিলা কে? এর সঙ্গে কী নটঘট করছ? গৃহকর্তা বললেন, নটঘট নয়, জানতে এসেছে আমরা কী খবরের কাগজ পড়ি, কেন পড়ি?
এই কথা শুনে দ্বিতীয় ব্যক্তি উত্তেজিত হয়ে দাদার হাত থেকে কাঁচিটা একটানে ছিনিয়ে নিয়ে সুকুমারীকে তাড়া করে আসেন, আমরা খবরের কাগজ পড়ি না, খবরের কাগজ কুচোই। আয়, আজ তোকে কুচোই। দ্বিতীয় উন্মাদ কুচোনোর সুযোগ পাওয়ার আগেই সুকুমারী দৌড়ে পালিয়ে প্রাণরক্ষা করেন।
.
সেদিন বিকেলেই সুকুমারী তাঁর নিয়োগকর্তার সঙ্গে দেখা করে চাকরি ছেড়ে দিলেন। অবশ্য সমীক্ষা তখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল, দু-চার দিন পরেই কাজ শেষ হয়ে যেত।
কিন্তু এই কাঁচি নিয়ে তাড়া করে আসার ঘটনাটা তাঁর মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল। তিনি অনেকরকম চিন্তাভাবনা করে খুব ভাল করে মুসাবিদা করে একটা বড় দৈনিক কাগজের দপ্তরে সম্পাদক সমীপেষু চিঠিপত্রের স্তম্ভে প্রকাশের জন্যে একটি দীর্ঘ পত্র প্রেরণ করলেন। এই পত্রে তিনি তাঁর ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা সবিস্তারে বর্ণনা করে প্রশ্ন তুলেছিলেন,
পাগলদের কি খবরের কাগজ পড়া উচিত?
পাগলদের কি খবরের কাগজ পড়তে দেওয়া উচিত?
দুঃখের বিষয় আর দশটি চিঠির মতোই এ চিঠিও ছাপা হয়নি। মাস দুয়েক অপেক্ষা করার পর তিনি ওই খবরের কাগজের অফিসের চিঠিপত্র দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করেন। বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান তিরিশ-পেরোনো এক অনতি যুবক ভদ্রলোক চিঠিপত্র দেখেন। সমস্যা এই যে ভদ্রলোকের মাথায় তখন সদ্য টাক পড়া শুরু হয়েছে। ভদ্রলোকের পাঞ্জাবির পকেটে একটা ছোট গোল আয়না, প্রতিনিয়ত সেই ভদ্রলোক পকেট থেকে আয়নাটি বের করে তাঁর টাকের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করেন এবং হতাশভাবে ধুৎ বলেন।
এইরকম গোটা পঞ্চাশেক ধুৎ বলার ফাঁকে ফাঁকে সেই টাকোদ্বিগ্ন (টাক+উদ্বিগ্ন) সাংবাদিক সুকুমারীর বক্তব্য শুনে নিয়ে বললেন, দেখুন, আপনার চিঠি হয়তো আমরা ছাপব না, বা ছাপতে পারব না। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি আপনাকে বলতে পারি, আপনি এই চিঠিতে যেরকম মৌলিক চিন্তার পরিচয় দিয়েছেন, সেটা খুব সাধারণ ব্যাপার নয়।
সুকুমারী বললেন, তা হলে?
সাংবাদিক বললেন, তা হলে আবার কী? একটা বাঁধানো মোটা খাতায় এইরকম যা যা, যেমন যেমন মাথায় থাকে লিখে যান। অনেকটা লেখা হয়ে গেলে বই করবেন।
যেতে যেতে সুকুমারী জিজ্ঞেস করলেন, কী নাম দেব বইয়ের, চিন্তা-ভাবনা?
দুঁদে সাংবাদিক বললেন, সর্বনাশ! ওরকম নামে কোনও বই এক কপিও বিক্রি হবে না। হালকা নাম ভাবুন।
.
সাংবাদিক ভদ্রলোকের কাছে আশকারা পেয়ে সুকুমারী বাড়ি ফেরার পথেই চার দিস্তে কাগজ কিনলেন, ভাঁজ করে মাঝবরাবর সেলাই করে চমৎকার একটা লম্বা খাতা হল, বেশ মোটা।
খাতার ওপরে বাঁশ কাগজের মলাট লাগিয়ে লাল ডট পেনসিল দিয়ে সেখানে বড় করে লিখলেন-সুকুমারী পাল প্রণীত মজার বই (?) তৃতীয় পঙক্তিতে মজার বই নামের পর একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন, যার মানে হল এই নামকরণ চূড়ান্ত নয়, পরিবর্তিত হতে পারে।
এরপর বহু বহু বছর চলে গেছে, মজার বই নামটা সহজে পালটানো যায়নি, অবশ্য ইতিমধ্যে মজার বই নামে অন্যদের অন্তত পাঁচ-সাতটা বই বাজারে বেরিয়ে গেছে। আসলে যেটা পরিবর্তিত হয়েছে, সেটা বইয়ের লেখিকার নাম। কুড়ি বছর হল সুকুমারী পাল বিয়ে করে সুকুমারী দত্ত হয়েছেন। অবশ্য তিনি শুধু দত্ত লেখেন না, আধুনিক কায়দায় লেখেন সুকুমারী পালদত্ত। বাপের বাড়ির আর শ্বশুর বাড়ির পদবি মিলিয়ে।
মজার বই নামের খাতার মলাটে তিনি নতুন পদবি সংযোগ করে সুকুমারী পালদত্ত হয়ে গেলেন। যদিও বিয়ের পর অনিবার্য কারণে লেখা কমে গেল।
সুকুমারী কিন্তু চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, পালদত্ত হওয়ার আগে অর্থাৎ বিয়ের আগে তিনি যথাসাধ্য মজার বই নামাঙ্কিত খাতা নিজের বুদ্ধি এবং প্রতিভা অনুযায়ী যতটা পেরেছেন, ভরিয়েছেন। দত্তবাড়িতে বিয়ে হবে নিশ্চিত জেনে তিনি দুই দত্তকুলোঙব কবি মধুসূদন এবং সুধীন্দ্রনাথের মিলিত অনুকরণে কাব্যচর্চা শুরু করেন। মজার বইয়ের প্রথম দিকেই তাঁর সেই প্রচেষ্টার ফসল রয়েছে :
… অজয়ের স্পর্ধা দেখি, চক্ষু রক্তলাল, ফিরাও চপ্পল তব, গর্জিল উৎপল কিন্তু হায় ইতিমধ্যে উড়ন্ত চপ্পল গোপালে খোঁতা মুখ করি দিল লাল ॥…
সুকুমারী এই প্রসঙ্গে, বিশেষত অজয় এবং উৎপলের পরস্পরের প্রতি আক্রোশ বিষয়ে কিঞ্চিৎ পর্যালোচনা করেছিলেন। সুকুমারীর এখনও মনে আছে অজয় এবং উৎপল উভয়েই একদা তাঁর প্রাণের বন্ধু ছিলেন, একদা তাঁকে নিয়েই চটি-চপ্পল ছোঁড়াছুড়ি হয়েছিল এই দুজনের মধ্যে, কিন্তু অজয় হেরে গিয়েছিল, তার হালকা হাওয়াই চটি নিয়ে সে যুঝে উঠতে পারেনি উৎপলের পায়ের ভারী কোলাপুরি চপ্পলের সঙ্গে।
সুকুমারী ঠিকমতো রচনা করলে চপ্পল সংহিতা কাব্য অনায়াসেই মজার বইয়ের প্রথম অধ্যায় হতে পারত, কিন্তু কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে?
সুকুমারীর বিয়ে হয়ে গেল, চমৎকার লম্বা-চওড়া, সরকারি চাকুরে মণিলাল দত্তের সঙ্গে। শুধু সরকারি চাকুরে নয়, সুকুমারীর বর মণিলাল পুলিশের চাকরি করেন।
বিয়ের অব্যবহিত পরে অন্য দশটি দম্পতির মতো সুকুমারী পালদত্ত মধুচন্দ্রিমা যাপনের সুযোগ পাননি। বিয়ের অষ্টমঙ্গলার পরে বরের সঙ্গে তাঁর কর্মস্থলে বীরভূম জেলার রামপুরহাটে যেতে হয়।
রামপুরহাট প্রথমে সুকুমারীর ভাল লেগেছিল, তা ছাড়া নববিবাহের মোহ, মণিলাল দত্তের আকর্ষণ। এখানেই মজার খাতার অনেকগুলি পৃষ্ঠা তিনি ভরিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু রামপুরহাটে বেশিদিন থাকা হয়নি। তার অন্যতম কারণ তাঁর ওই খাতায় লেখা আছে:
রামপুরহাটের দিনলিপি
এখানকার মশা হিংস্র ও ধূর্ত, কুকুরের মতো।
গতকাল সন্ধ্যাবেলায় একটি বলবান, হৃষ্টপুষ্ট পুং (পুরুষ) মশা আমাকে কামড়াইতে আসে। আমি বারান্দায় বসিয়াছিলাম। বারান্দা হইতে নামিয়া উঠান পার হইয়া রাস্তায় নামিলাম, মোড় পর্যন্ত চলিয়া গেলাম। কুকুরের মতো মশাটি আমার পিছু পিছু ধাওয়া করিল।
যদি কেহ জানিতে চান ইহা যে পুং মশা তাহা কীভাবে বুঝিলাম, ইহা সোজা ব্যাপার, স্ত্রী মশা রক্তপানের পূর্বে গুনগুন করিয়া গান করে, পুরুষ মশারা করে না। এখানকার মুড়ি-গুড় যতই সুস্বাদু হউক মশার অত্যাচারে এই স্থান শীঘ্রই ছাড়িতে হইবে।
০৩.
কিছুদিন পরে মণিলাল দত্ত রামপুরহাট থেকে কোচবিহারের দিনহাটায় বদলি হলেন। ইতিমধ্যে সুকুমারী রীতিমতো সংসারী হয়ে পড়েছেন, তাঁর কোল আলো করে একটি পুত্রসন্তান এসেছে।
মজার বইয়ের কথা আজকাল সুকুমারীর মনে থাকে না। বইয়ের তাকের একপাশে সে খাতা অনাদরে পড়ে থাকে।
বলা বাহুল্য, তাঁর স্বামী পুলিশ সাহেব মণিলাল দত্ত সুকুমারীর এই সাহিত্যচর্চার কথা জানেন এবং সম্প্রতি লক্ষ করেছেন যে তাঁর স্ত্রীর মজার বইয়ের বিষয়ে আসক্তি প্রায় বিলীয়মান।
তিনিই সুকুমারীকে উদ্বুদ্ধ করলেন আবার মজার লেখা লিখতে।
নিতান্ত বশংবদ স্বামীর অনুরোধ রক্ষা করার জন্যে বহুদিন পরে ধুলো ঝেড়ে খাতা খুলে সুকুমারী দেবী প্রথমে নিজের শিশুসন্তানকে নিয়ে লিখলেন, আমার খোকা বোকাসোকা। খোকার মা মোটাসোটা..
এইটুকু লেখার পর সুকুমারীর খেয়াল হল আমি হলাম খোকার মা, কিন্তু আমি তো মোটাসোটা নই।
এমন করে ভাবলে তো লেখা চলে না, লিখতে হয় চোখকান বুজে, অগ্র-পশ্চাৎ, ডাম-বাম বিবেচনা করে। সব কিছু মেলাতে গেলে বিপদ।
এসব অবশ্য মণিলাল দত্তের কথা, তিনি সুকুমারীকে বলেছিলেন, থানায় ডায়েরি করার সময়ে ছাড়া মানুষ কখনও কিছু ভেবেচিন্তে লেখে না।
না ভেবেচিন্তে কী লিখব আবার? সুকুমারীর প্রশ্নের উত্তরে পুলিশ সাহেব বলেছিলেন, যা দেখবে, তাই নিয়ে লিখবে। এ নিয়ে ভাবনা করলে লেখা কঠিন হবে।
স্বামীর সুপরামর্শ শুনে সুকুমারী অনেকরকম ভাবলেন, চারদিকে চোখ খুলে তাকালেন, তারপর যেখানে যে জায়গায় যা কিছু আছে ভাল করে দেখতে লাগলেন। এই সময় তাঁর চোখে পড়ল, তাঁদের কোয়ার্টারের পাশে মহকুমা সদর থানার সাইনবোর্ড
দিনহাটা থানা
মহকুমা–দিনহাটা
জেলা–কোচবিহার।
মুহূর্তের মধ্যে সুকুমারীর মাথায় খেলে গেল, দিনহাটা নিয়ে একটা পদ্য লিখতে হবে।
এবং অল্প একটু চেষ্টা করেই তিনি লিখে ফেললেন–
…দিনে হাঁটা দিন হাটা।
জমি চাই এক কাঠা ॥
রাতে হাঁটা রাত হাটা ॥
ডাকাতের গলা কাটা ॥
ভোরে হাঁটা ভোর হাটা।
টনটন করে পা-টা ৷ …
দুঃখের বিষয়, এই শেষ পঙক্তিতে সুকুমারী দেবীর ব্যক্তিগত সমস্যা কিঞ্চিৎ প্রাধান্য পেয়েছিল। তিনি সম্প্রতি মুটিয়ে যাচ্ছিলেন। তাই মণিলালবাবুর পরামর্শমতো প্রতিদিন ভোরে বাড়ির সামনের রাস্তা ধরে হাটছিলেন।
কিন্তু এই ভোরে হাঁটা তথা ভোর হাটা পাঠ করে দত্তসাহেব তাঁকে বলেন, ঠিক আছে, যথেষ্ট হয়েছে। এবার তুমি কল্পনার জগতে যাও।
এবারেও স্বামীর নির্দেশ অমান্য করেননি সুকুমারী, দু-চারদিন ভেবেচিন্তে লিখলেন দীর্ঘ পঁচিশ পৃষ্ঠা, যার মধ্যে রয়েছে
… লোহিত সাগরের তীরের সেই গ্রামের ঘাটে তখন উত্থানশক্তিরহিত রোহিত মাছটি খাবি খাইতেছিল।
খাবি খাইবার জিনিস কিনা? খাইতে কীরকম? খাবি একবার খাইলে আরেকবার খাওয়া যায় নাকি?
জানি এসব প্রশ্ন একদিন উঠিবে। তাই সদাপ্রস্তুত হইয়া আছি। পরশুরামের ভাষায় বলিতে পারি।
দস্তুর মতো প্রস্তুত আমি।…
এর পরেও পনেরো বছর কেটে গেছে। সময়ে-অসময়ে সংসার করতে করতে সুকুমারী প্রাণে যা চায় উলটোপালটা লিখে গেছেন। বলা বাহুল্য, পুলিশ সাহেব তাঁকে সুপরামর্শ দিয়ে অনুপ্রাণিত করেছেন, অবশেষে তিনিই যত দেখি, যত জানি, যত ভাবি এই নতুন নামকরণ করে বই ছাপিয়ে দিয়েছেন।
এই বইটির পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করতে গেলে বইটির প্রতি অন্যায় করা হবে। শুধু একটি কথা উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে।
এই বইটির প্রথম অধ্যায় যত দেখি অংশটি সুকুমারী দেবীর রচনা নয়। আসলে এ অংশ পুলিশ সাহেব মণিলাল দত্তের রচনা। ভদ্রলোক নিজের নাম কোথাও দেননি, স্ত্রীর লেখা জনপ্রিয় করার জন্যে প্রথম দিকের অংশটুকু লিখে দিয়েছেন। তাই মজার বই পাণ্ডুলিপিতে এই লেখাগুলি নেই।
প্রথম অংশের কয়েকটি লেখা এইরকম, নোট জাল করিবার সহজ উপায় অথবা নিজের টাকা নিজে ছাপুন কিংবা পকেটমার বন্ধুদের জন্যে কিছু সাবধানী বাণী অথবা মিথ্যা সাক্ষ্য কীভাবে দিতে হয়।
উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই। মণিলাল এবং সুকুমারীর একেবারে মণিকাঞ্চন যোগ হয়েছে।
যত জানি, যত দেখি, যত ভাবি গ্রন্থের চাহিদা এত বেড়ে গেছে যে প্রকাশকদের আগ্রহাতিশয্যে সুকুমারী একটি নতুন বইয়ে হাত দিয়েছেন। দ্বিতীয় বইয়ের নাম মণিকাঞ্চন।
একদা প্রভাতকালে
০১.
শীতের হালকা আমেজ। বাতাসে একটু শিরশিরানি। পৌষ মাসের এই সময়টা কলকাতায় ভারি মধুর। গত বছর এ সময় হাড়কাঁপানো, রক্ত-হিম করা ঠান্ডায় দেশে ছিলাম, সেই জন্যেই বোধ হয়। কিংবা বয়েস বেড়ে যাচ্ছে, আর কতগুলো শীত-বসন্ত এ জীবনে আসবে জানি না, তাই শীতঋতু এবার খুব উপভোগ করছি। সুযোগ পেলেই বাড়ির সামনের চাতালে কিংবা পাশের পার্কে গিয়ে সকালবেলায় রোদে দাঁড়াই।
আমাদের দোতলার শোয়ার ঘরের চিলতে বারান্দাটায় খুব সকালে একটু রোদ আসে। সাড়ে সাতটা বাজার আগেই রোদটা সরে যায়। প্রায় সময়ই তাই সুযোগ হয় না বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ানোর, বাজারে ছুটতে হয়।
আজ খুব সকাল সকাল ঘুম ভেঙেছে। সাতটা এখনও বাজেনি। চোখ মেলে দেখি শিয়রের দিকের জানলা দিয়ে আবছায়া রোদ আমার লেপের ওপরে এসে পড়েছে। অর্ধাঙ্গিনী বিছানার পাশে নেই, নীচতলায় চায়ের বাসনের টুংটাং শব্দে তার সরব উপস্থিতি টের পাচ্ছি।
অন্যদিন আধ-ঘুমে, আধা-জাগরণে এ সময়টায় লেপমুড়ি দিয়ে পড়ে থাকি। বিছানায় হস্তবাহিত এক পেয়ালা ধূমায়িত চা এসে পৌঁছায়, তারপর শয্যাত্যাগ করি।
আজ কী যে মতিভ্রম হল!
লেপটা শরীরের ওপর থেকে সরিয়ে দিয়ে উঠে বসলাম। যাই, সরকারি চাতালে কিংবা পার্কে নয়, নিজের বাড়ির বারান্দার ক্ষণিক রোদে একটু দাঁড়াই। কিন্তু বারান্দায় পৌঁছতে গেলে বারান্দার দিকের দরজাটা খুলতে হবে। এবং সেটা একটা সমস্যা।
আমাদের এই নতুন বাড়ির কয়েকটা দরজা, বিশেষ করে এই দোতলা ঘরের সামনের দিকের দরজাটা একটু গোলমেলে।
গোলমালের ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলি।
স্কুলপাঠ্য বিজ্ঞান বইতে পদার্থবিদ্যার অধ্যায়ে তাপ বিষয়ে বলা আছে।
তাপে পদার্থ প্রসারিত হয়, বেড়ে যায়। আর শৈত্যে পদার্থ সংকুচিত হয়, ছোট হয়ে যায়।
একদা এক বিদ্যালয়ের বালিকাকে পদার্থ বিজ্ঞানের তাপের এই প্রসার এবং সংকোচনের বিষয়ে একটি উদাহরণ দিতে বলা হয়েছিল।
সে বলেছিল, দিন।
বিস্মিত দিদিমণি জিজ্ঞাসা করেন, দিন? দিন কেন?
মেয়েটি বলেছিল, গরমের দিনে দিন বড় হয়, আর শীতে দিন ছোট হয়ে যায়।
আমাদের ঘরের সামনের এই দরজাটা উক্ত বালিকার দিন-রাতের হ্রাস-বৃদ্ধির উদাহরণের মতোই গ্রীষ্মে বিশেষ করে বর্ষায় ফুলে-ফেঁপে ওঠে, তখন আর চৌকাঠের মধ্যে গলে না। ছিটকিনি লাগানো সম্ভব হয় না। দুটো কড়া লাগিয়ে তালাবদ্ধ করে রাখি।
আবার শীতে সংকুচিত হতে থাকে, তখন ধীরে ধীরে চৌকাঠে গলিয়ে যায়। অবশেষে শুকোতে শুকোতে এমন হয় যে দরজা আর চৌকাঠের মধ্যে প্রায় এক-দেড় ইঞ্চি ফাঁক দেখা দেয়। হয়তো কাঠটা কাঁচা ছিল, তাই।
অবশ্য সারা বছরে দিন পনেরো কমাবাড়ার মধ্যবর্তী সময়ে দরজাটা মোটামুটি ফিট করে। বছরের এই সময়টায় সেটা সম্ভব হয়।
এ বছর কাল রাতেই প্রথম দরজাটা চৌকাঠের মধ্যে প্রবেশ করেছে, অবশ্য তার জন্যে কাল রাতে শোয়ার আগে আমাকে রীতিমতো গলদঘর্ম হতে হয়েছিল।
বারান্দায় রোদে দাঁড়াব বলে আজ সকালে দরজাটা খুলতে গিয়ে দেখি বন্ধ করতে যতটা কষ্ট হয়েছিল, দরজাটা খোলা তার চেয়ে অনেক বেশি কষ্টসাধ্য।
অনেকদিন আগে আমি একটা কবিতায় লিখেছিলাম, অথচ বাসনা ছিল, শীতের রৌদ্রের মতো জনপ্রিয় হব। সেই আমি রৌদ্রস্নাত হওয়ার জন্যে আজ মরিয়া। তালা লাগানোর কড়া ধরে ভেতরদিক থেকে প্রাণপণ টান দিলাম।
ঠিক সেই সময়ে আমাদের কাজের মেয়েটি একতলা থেকে চায়ের পেয়ালা নিয়ে আমার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেছে। হঠাৎ সজোরে আকর্ষিত দরজা দড়াম শব্দ করে বিদ্যুৎগতিতে খুলে গেল। আমি ঘরের মধ্যে ছিটকিয়ে গিয়ে পড়লাম কাজের মেয়েটির গায়ে। গরম চায়ের পেয়ালাসহ সে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল, ঝনঝন করে পেয়ালা পিরিচ ভাঙল, গরম চায়ে ফোঁসকা পড়ে গেল মেয়েটির হাতে। সে ওরে বাবারে মেরে ফেলল রে বলে আর্তনাদ করতে লাগল। আমার স্ত্রী একতলা থেকে ছুটে এসে আমার দিকে অতিশয় সন্দেহাকুল দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলেন। একটু পরে কাজের মেয়েটিকে নিয়ে তিনি পাড়ায় ডাক্তারবাবুর কাছে চলে গেলেন।
০২.
আমি মূৰ্ছাহতের মতো ঘরের মধ্যে খাটের বাজু ধরে ত্রিভঙ্গমুরারি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
সকালবেলায় শুকনো মুখে এখনও জল দেওয়া হয়নি। এককাপ চা পর্যন্ত কপালে জোটেনি। তার ওপরে এই বেকায়দা এবং অপমান।
আমার কিছু হয়েছে কিনা সে বিষয়ে গৃহিণী আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা না করে পরিচারিকাকে ডাক্তার দেখাতে চলে গেলেন, ব্যাপারটা আমার মোটেই ভাল লাগেনি।
তবে সঠিক কথা এই যে, পরিচারিকার সঙ্গে সংঘর্ষে আমি তেমন বিধ্বস্ত হইনি। একটু বেকুব বনেছি এবং একছলক গরম চা পায়ের পাতায় পড়েছে।
কিছুক্ষণ খাটের বাজু ধরে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর এবার বারান্দার দিকে তাকালাম।
শীতের সকালের মোলায়েম রোদে ঝলমল করছে বারান্দা। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে, সে বাতাসে শীতের তীক্ষ্ণতার চেয়ে বসন্তের আহ্লাদ অনেক বেশি।
মনের দুঃখ মনে রেখে ধীরে ধীরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। সাড়ে তিনফুট রেলিং দিয়ে ঘেরা ঝুল বারান্দা, ওপরদিকটা খোলা। বারান্দার সামনেটা রাস্তার দিকে, পেছনটা পার্কের দিকে।
এই অনতিদূর বসন্তে পার্কে নানারকম চেনা-অচেনা পাখি। যথারীতি কয়েকটা শালিক হুটোপাটি খাচ্ছে। পার্কের মধ্য দিয়ে পায়ে চলার পথের ধুলোয় ছাতারে পাখিরা গড়াগড়ি খাচ্ছে। কোনও একটা গাছের পাতার আড়ালে বসে চিরদিনের ঘুঘু পাখি থেমে থেমে বিলম্বিত লয়ে ডেকে যাচ্ছে, ঘু-উ-উ-উ-ঘু-ঘু।
এইরকম একটি সকালের জন্যে মানুষ সারাজীবন অপেক্ষা করে দুঃখ-দৈন্য, শোক-গ্লানি উপেক্ষা করে। কাব্য ও দর্শন আমার মনের মধ্যে চুলবুল করতে লাগল। পার্কের দিকে মুখ করে আমি বারান্দার রেলিং ধরে সূর্যমুখো হয়ে আরামে-আবেশে দাঁড়ালাম।
কিন্তু এ আনন্দ ক্ষণস্থায়ী।
হঠাৎ পিছনদিক থেকে কে যেন আমার মাথায় লাঠি দিয়ে সজোরে আঘাত করল। কিছু বুঝবার আগেই আমি বারান্দার মেঝেতে গড়িয়ে পড়লাম। রেলিং উপচিয়ে নীচেও পড়তে পারতাম, ভাগ্য ভাল, অপমৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেলাম।
ভূলুণ্ঠিত হলাম বটে, কিন্তু জ্ঞান হারালাম না। আমি অবশ্য সহজে জ্ঞান হারানোর পাত্র নই। আমার বন্ধুরা বলেন, তোমার জ্ঞান নেই, হারাবে কী করে?
বারান্দায় শায়িত অবস্থায় আমার কোলের পাশে পেলাম খুব ছোট কোলবালিশের মতো একটি জিনিস। কিন্তু মোটেই নরম নয়, ভারি শক্ত। একটু কসরত করে জিনিসটিকে চোখের সামনে নিয়ে এসে বুঝতে পারলাম, শক্ত করে মুড়িয়ে দড়ি দিয়ে বাঁধা খবরের কাগজের গোল প্যাকেট।
বাসায় চার-পাঁচটা খবরের কাগজ আসে। সবগুলো একসঙ্গে গোল করে বাঁধা হয়েছে। প্রতিদিনই এইভাবে কাগজ বাড়িতে দেওয়া হয়।
কিন্তু এ যে এত মারাত্মক হতে পারে, আগে কখনও ভাবতে পারিনি। আজকাল অধিকাংশ পত্রিকাই প্রায় ষোলো পৃষ্ঠার অথবা তার চেয়ে বেশি। সেইসঙ্গে বিশেষ সংখ্যা, ক্রোড়পত্র ইত্যাদি। সবকয়টি কাগজ মিলিয়ে এক কেজি না হলেও হাফ কেজির বেশি।
হকার কিশোরের ছুঁড়ে দেওয়া ওই ক্ষেপণাস্ত্র আমার ব্রহ্মতালুতে এসে লেগেছে, পিছন দিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম বলে দেখতে বা বুঝতে পারিনি।
তবে চোট-টোট তেমন কিছু লাগেনি। ব্যথাও পাইনি মনে হচ্ছে। আচমকা পড়ে গেছি এই যা।
সত্যি কথা বলতে কি, শীতের সকালের রোদে ভরা বারান্দায় শুয়ে থাকতে ভালই লাগছিল। একটু পরে ধীরে ধীরে বন্ধন মোচন করে খবরের কাগজগুলো পড়তে লাগলাম। বালিশ নেই, চাদর-তোশক নেই, স্রেফ খালি মেঝের ওপরে শুয়ে থাকা। বারান্দার ওপারে খোলা আকাশ দেখা যাচ্ছে। মৃদুমন্দ শীতের হাওয়া।
সেই কতকাল আগে নৌকোর ছইয়ের ওপরে লম্বালম্বি শুয়ে টাঙ্গাইল সিরাজগঞ্জ ধলেশ্বরী যমুনা পারাপার করেছি, সেইসব প্রকৃতি মনের মধ্যে ফিরে এল।
ঘুঘুটা এখনও ডেকে যাচ্ছে, ঘু-উ-উ-ঘু৷
মিনিট পনেরো পরে সহধর্মিণী দোতলায় এলেন। আমাকে এইরকম শায়িত অবস্থায় দেখে একবারও জানতে চাইলেন না কী হয়েছে। শুধু বললেন, যাও আর আদিখ্যেতা করতে হবে না। মুখ। ধুয়ে এসো, চা খাবে।
গুটি গুটি ভূমিশয্যা পরিত্যাগ করলাম।
০৩.
কবে, কতকাল আগে সেই মহাকবি কালিদাস বলেছিলেন, গৃহিণী গৃহমুচ্যতে অর্থাৎ গৃহিণী ঘর মোছেন। আমার গৃহিণী ঘর মোছেন না। কিন্তু চা-জলখাবার, দুবেলার আহারাদি তিনিই দেখাশোনা করেন। আরও অনেক কিছু করেন এবং সেই সঙ্গে যিনি ঘর মোছেন তারও দেখাশোনা করেন।
আমার গৃহিণী সুবিবেচিকা এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। তিনি যখন পরিচারিকাকে প্রতিবেশী ডাক্তারবাবুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, ডাক্তারবাবুকে আমার অধঃপতনের কথাও সবিস্তার বলেছিলেন।
ডাক্তারবাবু সব শুনে কাজের মেয়ের গায়ে ছলকে-পড়া চায়ের আঁকার জন্যে লোশন এবং অ্যাসপিরিন দিয়েছেন। আর আমার নাকি রক্তচাপ বৃদ্ধির জন্যে এমন হয়েছে, তাই রক্তচাপ স্বাভাবিক করার ওষুধ গৃহিণীকে দিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু এর মধ্যে একটা হযবরল আছে।
আমি শোধবোধহীন, ছোট মাপের, হালকা চালের মানুষ। আমার বিশ্বাস আমার কোনও রক্তচাপ নেই। এ ব্যাপারে কোনওদিন ডাক্তারকেও দেখাইনি।
কিন্তু আমার গৃহিণীর অন্য মত। তিনি বলেন সকলেরই রক্তচাপ আছে। মানুষের নিশ্বাস ফেলার মতো, হৃদস্পন্দনের মতো রক্তচাপও জীবনের সাধারণ লক্ষণ। মারা গেলে রক্তচাপ থাকবে না, শূন্য হয়ে থাকে। কিন্তু বেঁচে থাকলে, কম বা বেশি রক্তচাপের মধ্যে থাকতে হবে।
আমার ঘরোয়া ডাক্তার বলেছেন, লক্ষণ শুনে মনে হচ্ছে, হঠাৎ রক্তচাপ বেড়ে গেছে। আমি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আসছি। আপনি এখনই গিয়ে এই ট্যাবলেটটার অর্ধেক খাইয়ে দিন। ড্রয়ার খুলে একটা ছোট ট্যাবলেট বের করে দিয়ে ডাক্তার বলে দিয়েছেন, খুব কড়া ওষুধ। পুরোটা দেবেন না যেন।
সতীসাধ্বী পত্নী সেই ট্যাবলেট আঁচলে গিট দিয়ে বেঁধে এনেছেন। এবার আঁচল খুলে বার করে আমার সামনে খাওয়ার টেবিলে রেখে বললেন, এটা অর্ধেক করে খেয়ে নাও।
মোড়ক খুলে অতি ক্ষুদ্র আকারের ট্যাবলেটটি বার করতে করতে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এটাই কি আজকের ব্রেকফাস্ট?
স্ত্রী বললেন, এখন তো আধখানা ট্যাবলেট খেয়ে নাও। ডাক্তারবাবু এসে তোমাকে দেখে। ডায়েট চার্ট করে দেবেন। আজ থেকে সেই অনুযায়ী খাওয়া-দাওয়া হবে। আপাতত একটা দুধ-চিনি ছাড়া চা করে দিচ্ছি। তুমি ততক্ষণে ওষুধটা ভেঙে অর্ধেক খেয়ে নাও।
সাধারণ বড়ির চেয়েও ছোট আকারের ওষুধ। ব্যাসার্ধ এক সেন্টিমিটারের এক চতুর্থাংশ হবে।
মোড়ক খোলা ট্যাবলেটটি হাতে নিয়ে আমি সেটাকে দ্বিখণ্ড করায় ব্রতী হলাম। বাঁ হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ এবং তর্জনীর মধ্যে ট্যাবলেটটির সূক্ষ্ম একদিক শক্ত করে ধরে অন্যদিক ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ এবং তর্জনীর মধ্যে চেপে ভাঙবার চেষ্টা করলাম।
পৃথিবীর কঠিনতম কর্মগুলির তালিকার শীর্ষে থাকা উচিত এই ট্যাবলেট দ্বিখণ্ডীকরণের কাজ। প্রভূত বলপ্রয়োগ করেও কোনও সুবিধে হল না।
ইতিমধ্যে গৃহিণী ধূমায়িত লাল চা নিয়ে এসে গেছেন এবং আমি যে এতক্ষণেও সামান্য একটা ওষুধের বড়ি দুটুকরো করতে পারিনি তাতে রীতিমতো উত্তেজিত। আমাকে অকর্মণ্য বলে সম্বোধন করে তিনি ট্যাবলেটটি আমার হাত থেকে কেড়ে নিলেন এবং টেবিলের ওপরে রেখে একটা ফলকাটা ছুরি দিয়ে ভাগ করতে গেলেন। একটু জোরে চাপ দিতেই ছুরিটির ফলা বরাবর বড়িটি টেবিলের ওপর দিয়ে ছিটকিয়ে জানলাপথে বেরিয়ে আসলে আকাশে উঠে গেল। বলা যায়, মহাশূন্যে বিলীন হয়ে গেল। আমি স্পষ্ট দেখলাম ঊর্ধ্বমুখী বড়িটা আকাশপানে উঠে যাচ্ছে। মুখে বললাম, তু চিজ বড়ি হ্যায়…।
হায়! হায়! করতে করতে গৃহিণী রাস্তায় ছুটে গেলেন। কিন্তু কোথাও সেই বড়িটার চিহ্ন পাওয়া গেল না। তিনি আর বাড়ির মধ্যে ঢুকলেন না, আবার ডাক্তারের কাছে ছুটলেন।
.
দুধ-চিনি ছাড়া লাল চা দেখলে চিরদিনই আমার মাথায় রক্ত উঠে যায়। কী করব, সেই চা নিজেকে একা একা বসে গলাধঃকরণ করতে হল।
এদিকে ঘটনার ডামাডোলে শরীর তছনছ হয়ে গেছে, পেট চোঁ চোঁ করছে। এরপরে আবার ডাক্তার এসে হয়তো সব খাওয়াই বন্ধ করে দেবে, তার চেয়ে এই অবসরে যা পারি কিছু খেয়ে নিই।
সামনে ফ্রিজের ওপরে পাউরুটি রয়েছে। এখন আর সেঁকে নেওয়ার সময় নেই, কঁচা চার-পাঁচ পিস বের করে নিলাম। একটু মাখন মাখিয়ে চিনি দিয়ে খাব।
সামনেই টেবিলের ওপরে মুখবন্ধ গোলাকার স্টিলের কৌটো, ওটাই আমাদের মাখনদানি। কৌটোটা হাতে নিয়ে কৌটোর মুখটা ঘোরালাম। সুন্দর, মসৃণভাবে মুখটা ঘুরছে। কিন্তু ওপরদিকে যত টানি কিছুতে খোলে না।
একে স্টিলের কৌটো, তার ওপরে মাখন রাখা হয়। রীতিমতো পিচ্ছিল। টেনে খোলা অসম্ভব। কৌটোটাকে নিয়ে প্রথমে মেঝেতে, তারপরে দেয়ালে কাত করে ঠুকতে লাগলাম। কিন্তু কিছুই হওয়ার নয়। জোরে ঠুকতে গিয়ে দু-জায়গায় টোল খেয়ে গেল।
অবশেষে মাখনের কৌটোটি গোল করে টেবিলের ওপরে শক্ত করে ধরে সেই তরকারি কাটা ছুরি দিয়ে কৌটো আর মুখের জায়গায় খুব শক্ত চাপ দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে কাজ হল। কৌটোর মুখটা খুলে গিয়ে ছিটকিয়ে আমার কাঁধে লেগে ঝনঝন শব্দে মেঝেতে পড়ল এবং মাখনভরতি কৌটো লাফিয়ে উঠে আমার মুখে এসে লাগল। বিলিতি হাসির সিনেমায় যেমন দেখা যায় আমার ঠোঁটে মুখে চিবুকে গালে মাখন লেপটে গেল।
ঠিক এই সময়ে ডাক্তারবাবুকে নিয়ে স্ত্রী ঘরে প্রবেশ করলেন। আমার অবস্থা দেখে দুজনেই স্তম্ভিত। ডাক্তারবাবু বললেন, এ বয়েসে এভাবে মাখন খাবেন না, একটু রয়েসয়ে খান।
» একদিন রাত্রে
আজ সকাল থেকে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। শীতের প্যাচালো বৃষ্টি। সেই সঙ্গে যথারীতি উত্তুরে হাওয়া। ঠান্ডাও পড়েছে খুব। অনেকদিন কলকাতা শহরে এরকম জমাট ভাব, ভারী ঠান্ডা দেখা যায়নি।
সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটা হয়ে গেল, বৃষ্টি থামবার কোনও নামগন্ধ নেই। যদি জোরে দু-চার পশলা হয়ে যেত তবে সে ছিল মন্দের ভাল, হয়তো মেঘটা কেটে যেত। কিন্তু আকাশ ঘন হয়ে শীতের রাতের অন্ধকার নেমে এল, টিপটিপ করে বৃষ্টিও হয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে লোডশেডিং, আজ সারাদিন ধরেই বিদ্যুৎবিভ্রাট হচ্ছে। অথচ কাগজে কোলাঘাট-ব্যান্ডেলের কোনও গোলমালের খবর নেই, কী জানি, হয়তো ঠান্ডার জন্যেই বিদ্যুতের বাবুরা কাজে আসেনি, বিদ্যুৎ সরবরাহ করার লোকের অভাব। হয়েছে।
সে যা হোক, এসব অবান্তর চিন্তা। জয়দেব বলেছিলেন, ঠিক পাঁচটার সময় আসবেন। একেবারে কাটায় কাঁটায় পাঁচটায়। সওদাগরি অফিস মহিমাময়ের, ওই ঠিক পাঁচটাতেই ছুটি হয়। দশটা-পাঁচটা-ইংরেজ আমলের সেই পুরনো রুটিন এখনও বদল হয়নি।
পাঁচটা থেকে জয়দেবের জন্যে মহিমাময় বসে আছেন। এই বৃষ্টির দুর্দিনে বিকেল বিকেলই অফিস ফঁকা হয়ে গিয়েছিল, এখন ছুটির পরে প্রায় কেউই নেই। শুধু বড়সাহেবের ঘরে আলো জ্বলছে। আর ওখানে বড়সাহেবের কাছে বোধ হয় কোনও ভিজিটর এসেছে। আর এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দু-চারজন দারোয়ান, চাপরাশি রয়েছে। ওরা এ অফিসেরই কেয়ারটেকারের স্টাফ; অফিসেরই একতলায় থাকে।
এ ছাড়া এক প্রান্তে অপেক্ষা করছেন নরহরিবাবু। বিপত্নীক, প্রৌঢ় এবং এই অফিসের বড়বাবু। অফিসের মধ্যে নরহরিবাবুর পোষা নিজস্ব একটা হুলো বেড়াল আছে, সাদাকালো শরীর, মোটা মাথা, বেড়ালটার নরহরিবাবুর প্রদত্ত নাম কালাহরি। কালাহরিটা এক নম্বরের শয়তান, পাকা চোর।
এই পরশুদিনই একটা ফিশ কাটলেট টিফিনের সময় প্লেটে টেবিলের উপর রেখে বারান্দায় কলে হাত ধুতে গিয়েছিলেন মহিমাময়, কালাহরি সেটা নিয়ে চম্পট দেয়।
এসব কথা অবশ্য নরহরিবাবুকে বলা চলবে না। কালাহরি অন্ত-প্রাণ তাঁর। বৃষ্টির মধ্যে এই ঠান্ডায় হুলোটা কোথায় বেরিয়েছে, এখনও ফেরেনি। প্রতিদিন অফিস থেকে বেরোনোর সময় নরহরিবাবু কালাহরিকে চারটে মিল্ক বিস্কুট খাইয়ে যান। আজ কালাহরি আসছে না বলে তিনি বেরোতে পারছেন না, এখন ভ্রুকুটিকুটিল মুখে অধীর প্রতীক্ষা করছেন হুলো বেড়ালটার জন্যে।
জয়দেব হুলো বেড়াল নয়, একটা আস্ত মানুষ। মহিমাময় ঘড়িতে দেখলেন, কাটা প্রায় ছটার কাছে পৌঁছেছে। উঠে গিয়ে রাস্তার দিকের জানলায় উঁকি দিয়ে দেখলেন, রীতিমতো অন্ধকার, লোডশেডিং এখনও চলছে, তার মধ্যে বৃষ্টির ঝিরঝির শব্দ আসছে।
এ অফিসটায় একটা জেনারেটর আছে তাই রক্ষা, অন্ধকারে ঘুপচি মেরে জয়দেবের জন্যে অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। কিন্তু আর নয়, ছটা বেজে যাওয়ার পরে মহিমাময় আর এক মুহূর্তও জয়দেবের জন্যে অপেক্ষা করবেন না।
দুপুরে আড়াইটা নাগাদ মহিমাময় টিফিন করতে বেরিয়ে এক পাঁইট বাংলা দু নম্বর খেয়ে এসেছিলেন। সবদিন এটা করেন না, কিন্তু আজ জয়দেব আসবেন, দুজনের সারা সন্ধ্যার প্রোগ্রাম, তাই টেম্পোটা একটু তুলে রাখতে চেয়েছিলেন। তা ছাড়া জয়দেবের সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলে একটু তৈরি হয়ে থাকতে হয়।
দুপুর আড়াইটার সে নেশা কখন কেটে গেছে। জয়দেব সত্যিই আসছেন না। মিনিট কয়েক আগে কালাহরি এসে নরহরিবাবুর হাত থেকে বিস্কুট খেয়ে নরহরিবাবুকে ভারমুক্ত করে গেছে। এবার টেবিল গুছিয়ে নরহরিবাবুও রওনা হলেন। মহিমাময় ঠিক করলেন তিনিও উঠবেন, আর অপেক্ষা করা যায় না।
যাওয়ার পথে নরহরিবাবু একবার মহিমাময়ের টেবিলের পাশে এলেন। মহিমাময় ভাবলেন, বোধহয় বড়বাবু কোনও দরকারি কাজের কথা বলবেন। কিন্তু বড়বাবু যা বললেন তা শুনে মহিমাময় বিস্মিত হয়ে গেলেন।
জয়দেবকে বিশ্বসংসারে চেনে না এমন লোক নেই। এ অফিসেও মহিমাময়ের বন্ধু হিসেবে তাকে সবাই চেনে, নরহরিবাবুও চেনেন। নরহরিবাবু অফিস থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন, আপনার বন্ধু জয়দেববাবু বড়সাহেবের ঘরে আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।
বড়সাহেবকে জয়দেব কী করে চিনল, কবে কোথায় আলাপ হল? তা ছাড়া তাঁর কাছে তার অফিসে এসে, তার ঘরে না গিয়ে, তাকে কিছু না জানিয়ে বড়সাহেবের ঘরে জয়দেবমহিমাময় ব্যাপারটা ঠিক হিসেবে মেলাতে পারলেন না। তবে জয়দেবের কটা ব্যাপারই বা মহিমাময় বা অন্য কেউ কোনওদিন মেলাতে বা বুঝতে পেরেছেন!
সে যা হোক, এখন সমস্যা দুটো। জয়দেব ঠিক কী অবস্থায় আছে এবং বড়সাহেবের ঘরে গিয়ে ডেকে বার করে আনা কতটা সঠিক হবে। এই প্রশ্ন দুটো মনে মনে বিবেচনা করতে করতে মহিমাময় বড়সাহেবের ঘরের দিকে এগোলেন। কিন্তু শেষ পর্যায়ে এসে বাধা পেলেন বড়সাহেবের খাস আর্দালির কাছে। আর্দালি জানাল, এখন কামরায় ঢোকা যাবে না। সাহেব দোস্তের সঙ্গে বাত করছেন।
এরই মধ্যে মহিমাময়ের সুশিক্ষিত কানে একটু গেলাসের টুংটাং, খুব পরিচিত একটা শব্দ ধরা পড়েছে। সর্বনাশ! জয়দেব এখানে অফিসের মধ্যে খোদ বড়সাহেবের সঙ্গে জমিয়ে মদ খাচ্ছে?
নিঃশব্দে কেটে পড়তে যাচ্ছিলেন মহিমাময় বড়সাহেবের দরজার ওপাশ থেকে, কিন্তু ভারী পর্দার অন্তরাল থেকেও সামান্য ফঁক দিয়ে মহিমাময়কে দেখে ফেলেছেন বড়সাহেব, তিনি বেল বাজিয়ে আর্দালিকে ডাকলেন, এই দ্যাখো তো ওখানে কে দাঁড়িয়ে?
আর্দালি এগিয়ে আসার আগেই মহিমাময় পর্দা উঁচু করে বড়সাহেবের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন, ভিতরে আসব, স্যার?
বড়সাহেব যথেষ্টই মুডে আছেন, অস্বাভাবিক সৌজন্যে বিগলিত হয়ে সাদর আহ্বান জানালেন, আরে আসুন আসুন, মহিমাবাবু, বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
মহিমাময় ঠিক এতটা আশা করেননি। তা ছাড়া এই মুহূর্তে তার চোখ জুড়িয়ে গেল অন্য একটা দৃশ্য দেখে। একটা মদের বোতল এবং দুটো গ্লাস। খুব মহার্ঘ্য বা দুর্লভ পানীয় বলা যাবে না, স্কচ বা শ্যাম্পেন নয়, তবে মোটামুটি উচ্চমানের দিশি প্রিমিয়াম হুইস্কি।
মহিমাময়ের নজরে এটাও এড়াল না যে বোতল প্রায় অর্ধেক ফাঁকা। তাকে চেয়ারে বসতে বলে বড়সাহেব ভেতরের টিফিনঘরে গেলেন। মহিমাময় বসার পরে জয়দেব তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, বোতলের দিকে তাকিয়ে কী দেখছিস?
নিজের অফিসের বড়কর্তার ঘর, মহিমাময় নিচু গলায় বললেন, অর্ধেক ফাঁকা।
জয়দেব ভুরু কুঁচকিয়ে বললেন, তুই ভাল কিছু দেখতে পাস না। অর্ধেক ফঁকা দেখলি, অর্ধেক ভরা সেটা দেখলি না?
ইতিমধ্যে বড়সাহেব পিছনের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন হাতে একটা কাঁচের গেলাস নিয়ে। ইঙ্গিতটা স্পষ্ট, মহিমাময়কেও পানীয় দেবেন। একটু চিন্তান্বিত হলেন মহিমাময়, অফিসের বড়সাহেবের সঙ্গে বড়সাহেবের ঘরে বসে মদ্যপান কতটা নিরাপদ সে বিষয়ে তিনি ভাবতে লাগলেন।
কিন্তু ভাবার অবসর দিলেন না বড়সাহেব। নিজেই একটা গেলাসে পানীয় ঢেলে তার সঙ্গে নিজের জলের ফ্লাস্ক থেকে জল মিশিয়ে এগিয়ে দিলেন মহিমাময়কে। তারপর জয়দেবের দিকে তাকিয়ে মহিমাময়কে বললেন, আমার বন্ধু জয়দেব পালের সঙ্গে শুনলাম আপনার আলাপ আছে, তা তো থাকবেই, নামকরা লোক, সিনেমা ডিরেক্টর। আমার ছোটবেলার বন্ধু। একসঙ্গে স্কুলে পড়েছি।
পরিচয়ের শেষ অংশ শুনে মহিমাময় একটু বিস্মিত হলেন। অবশ্য এরকম আগেও হয়েছে। বহু ব্যক্তিরই মনে ধারণা যে স্বনামধন্য সিনেমা ডিরেক্টর জয়দেব পালের সঙ্গে তিনি একই স্কুলে পড়েছেন। শুধু কলকাতায় নয়, পশ্চিমবঙ্গে বিহারে এমনকী বাংলাদেশে এই সব স্কুল। যেভাবেই হোক জয়দেব বেশ কিছু লোককে সব সময়েই বোঝাতে পারেন কিংবা ধারণা দেন যে তিনি তাদের সঙ্গে এক স্কুলে এক ক্লাসে পড়তেন। এই ধারণাটা মহিমাময়ের বড়সাহেবের মধ্যেও ঢুকেছে, বিগত বিদ্যালয়-জীবনের মধুর স্মৃতি স্মরণ করে তিনি এখন কাল্পনিক সহপাঠী সুবিখ্যাত জয়দেব পালের দিকে গর্বিত ও আপ্লুত নয়নে তাকিয়ে আছেন।
বহু অভিজ্ঞতা-সূত্রে মহিমাময় জানেন, যদি এই মুহূর্তে বড়সাহেব তার প্রাক্তন স্কুল বিষয়ে কোনও আলোচনা শুরু করেন, অতীতকালের এক সহকারী শিক্ষকের নিষ্ঠুরতা নিয়ে বা ফাঁইনাল খেলায় অবিশ্বাস্যভাবে স্কুলের শূন্য-চার গোলে হেরে যাওয়া বিষয়ে, সেই স্মৃতিচারণে অনায়াস দক্ষতায় জয়দেব যোগ দেবেন। এ ঘটনা বহুবার মহিমাময় প্রত্যক্ষ করেছেন।
এতক্ষণে চিয়ারস বলে গেলাস তুলে বড়সাহেব মহিমাময়কে পানে যোগদান করতে আহ্বান জানিয়েছেন। বহুক্ষণ শুকনো মুখে বিরক্তিকর প্রতীক্ষার পরে মহিমাময়ের এবার দ্বিধা কেটে গেছে। তিনি এক চুমুকে অর্ধেক গেলাস খেয়ে নিলেন। দুপুরের নেশাটা সবে জুড়িয়ে আসছিল, অল্প পান করেই মহিমাময় বেশ চনমনে বোধ করলেন।
চেয়ারে একটু নড়েচড়ে বসে মহিমাময় জয়দেবের দিকে একবার, আরেকবার বড়সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমিও জয়দেবের ক্লাসফ্রেন্ড স্যার, একই স্কুলে ক্লাস ওয়ান থেকে ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়েছি।
মহিমাময়ের কথা শুনে বড়সাহেব চমকিত ও চিন্তিত হলেন, মহিমাময়কে জিজ্ঞাসা করলেন, নেবুতলা?
মহিমাময় বললেন, হ্যাঁ স্যার। নেবুতলা করোনেশন বয়েস হাই ইংলিশ স্কুল। আমরা লাস্ট স্কুল ফাঁইন্যাল ব্যাচ।
বিস্মিত বড়সাহেব বললেন, কিন্তু আমি তো জয়দেবের সঙ্গে পুর্নিয়া জুবিলি স্কুলে একসঙ্গে পড়েছি। সিক্সটির হায়ার সেকেণ্ডারি।
মহিমাময় বলতে যাচ্ছিলেন যে জয়দেবের চোদ্দোপুরুষে কেউ পুর্নিয়া যায়নি কিন্তু তার আগেই জয়দেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন, সরি, এখনই আমার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, রাত্রে দেখা হবে বলে তিনি দ্রুতপদে নিষ্ক্রান্ত হলেন। মহিমাময় কী করবেন স্থির করতে না পেরে হাতের গেলাসের বাকি অংশটুকু মুহূর্তের মধ্যে গলাধঃকরণ করে জয়দেবের অনুগামী হলেন। বড়সাহেবের সামনে এই রকম আচরণ সমীচীন কিনা, বেরিয়ে যাওয়ার আগে অনুমতি গ্রহণ করা উচিত কিনা এসব প্রশ্ন এই মুহূর্তে চাপা পড়ে গেল।
বাইরে লোডশেডিং এখনও আছে। তবে বৃষ্টিটা ধরেছে। ঠান্ডা আরও জোরদার।
মহিমাময় মোড়ের মাথায় পৌঁছেই দেখতে পেলেন, জয়দেব প্রাণপণ চেষ্টা করছেন যে কোনও একটা ট্যাকসি দাঁড় করাতে। কিন্তু এই দুর্দিনের সন্ধ্যায় কোনও ট্যাকসিই দাঁড়াচ্ছে না। মহিমাময় জয়দেবকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলেন, এই সময় দুম করে বিদ্যুৎ ফিরে এল। আলো ফিরে আসায় মনটা একটু প্রসন্ন হয়েছে, তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলেন জয়দেব তাকে দেখতে পেয়েছেন এবং হাত তুলে ডাকছেন।
মহিমাময় জয়দেবের কাছে গিয়ে বুঝতে পারলেন যে জয়দেব এখনও পুরো মাতাল হননি, তবে তাঁর বেশ নেশা হয়েছে। জয়দেব মহিমাময়কে দেখে বললেন, তুই পুরো ব্যাপারটা কঁচিয়ে দিচ্ছিলি। জানিস তোর বড়সাহেব আমার একটা বইয়ের প্রডিউসার হতে চলেছে।
এ তথ্যটা মহিমাময়ের জানা ছিল না। নিজের অফিসের বড়কর্তা অফিসে বসে মদ্যপান করছেন, তার ওপর সিনেমা প্রযোজনা করতে যাচ্ছেন সম্ভবত অফিসেরই টাকায় ব্যাপারটা ভাল ঠেকল না মহিমাময়ের কাছে। কোম্পানিটা এবার লাটে না ওঠে।
কিন্তু আশার বাণী শোনালেন জয়দেব, তোর বড়সাহেবের কাছে তোর খুব প্রশংসা করেছি। এবার তুই অফিসার হয়ে যাবি। নির্ঘাত প্রমোশন হবে। খুব যে আশ্বস্ত হলেন মহিমাময় তা নয়, তিনি মনে মনে ভাবলেন, আগে কোম্পানি টিকুক, তারপরে প্রমোশন।
ইতিমধ্যে জয়দেবের অনুরোধ উপেক্ষা করে আরও দু-তিনটি ট্যাকসি তাকে অতিক্রম করে চলে গেছে। কয়েকদিন আগে লালবাজার থেকে কাগজে বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে, ট্যাকসি যাত্রী নিতে না চাইলে সেই গাড়ির নম্বর পুলিশে জানিয়ে দিতে।
বেশ কয়েকটি ট্যাকসি পাত্তা না দেওয়ার পর উত্তেজিত জয়দেবের সেই পুলিশি বিজ্ঞপ্তির কথা হঠাৎ মনে পড়ল, তিনি হিপপকেট থেকে একটা নোটবুক বার করলেন আর একটা ডট পেন। এইমাত্র মিটার নামানো যে ট্যাকসিটা তাকে পার হয়ে গেছে তিনি সেটার নম্বর টুকতে গেলেন।
সঙ্গে সঙ্গে একটা বিসদৃশ কান্ড ঘটল। যে ট্যাকসিটি চলে গিয়েছিল তার ড্রাইভার পিছন ফিরে তাকিয়ে জয়দেবকে গাড়ির নম্বর টুকতে দেখে ঘ্যাচ করে গাড়িটা ব্যাক করে একদম জয়দেবের পাশে দাঁড়িয়ে গেল, তারপর ট্যাকসির বাঁদিকের জানলা দিয়ে গলা বাড়িয়ে বলল, আপনি এখন সিনেমা করেন, তাই না?
এই আকস্মিক প্রশ্নে জয়দেব একটু পিছিয়ে এলেন, একটু আমতা আমতা করে অপ্রস্তুতভাবে একবার মহিমাময়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে বললেন, হ্যাঁ, আমি জয়দেব পাল, সিনেমা করি। তাই কী হয়েছে?
ট্যাকসিওয়ালা উত্তেজিত হয়ে বলল, কী হয়নি! আজ আপনার নাম হয়েছে। সিনেমা তুলছেন, হিল্লি-দিল্লি যাচ্ছেন। খবরের কাগজে আপনার নাম বেরোচ্ছে ছবি বেরোচ্ছে। আপনি মোটা হয়েছেন, লম্বা জুলফি রেখেছেন, মোটা গোঁফ রেখেছেন। আপনি এখন পকেট থেকে নোটবুক বার করে ট্যাকসির নম্বর নিচ্ছেন। পুলিশকে দিয়ে আমাদের জেল ফাঁসি করাবেন। ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ! ঘৃণাভরে বার বার ধিক্কার দিল ট্যাকসি-ড্রাইভার।
জয়দেব তখন একেবারে বেকুব বনে গেছেন, কাচুমাচু মুখে ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে আছেন, কী যে করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না এবং কেনই বা ট্যাকসিওয়ালা এসব বলছে তাও ধরতে পারছেন না।
ট্যাকসিওয়ালা কিন্তু তখনও নিরস্ত হয়নি, সমানে ধিক্কার বর্ষণ করে চলেছে, ছিঃ ছিঃ জয়দেববাবু, আপনার কোনও লজ্জা নেই! আপনি এত নেমকহারাম! আপনি আজ ট্যাকসি ড্রাইভারদের পিছনে লাগছেন? কিন্তু এই কলকাতার ট্যাকসিওয়ালারা না থাকলে আজ আপনি কোথায় থাকতেন, কোন ভাগাড়ে? জোড়াবাগান থেকে, খালাসিটোলা থেকে, খিদিরপুর থেকে, ফুটপাথ থেকে, গুণ্ডাদের হাত থেকে, পুলিশের হাত থেকে রাত বারোটা, একটা, দুটো, ট্যাকসিওয়ালারা আপনাকে কোলে করে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে। আপনি তাদের গাড়ির সিটে, তাদের গায়ের জামায় বমি করে দিয়েছেন। আজ এই তার প্রতিদান!
এই ভয়াবহ অভিযোগমালার সামনে জয়দেব অসহায় হয়ে পড়লেন, করুণ কণ্ঠে বললেন, ঠিক আছে, যাও যাও। তোমার নম্বর নিচ্ছি না।
ট্যাকসিওয়ালার রাগ তখনও যায়নি, কীসের জন্যে নম্বর নেবেন, দাদা? বৃষ্টির রাতে একটু শেয়ারে ট্যাকসি খাটাচ্ছি, মাতাল-বাদমাইশদের তুলছি না, এটা কি অন্যায় হল?
নিস্তব্ধ হয়ে মহিমাময় এতক্ষণ ধরে এই নাটক দেখছিলেন, এবার যথেষ্ট হয়েছে এই ধরে নিয়ে এগিয়ে এসে ট্যাকসিকে বললেন, ঠিক আছে, এবার আপনি যান। শেয়ারে খাটুন।
মহিমাময়কেও মনে হল ট্যাকসিওলা চেনে, সে বলল, ও আপনিও আছেন! নিশ্চয়ই কোথাও বসবেন। কাছাকাছি কোথাও হলে বলুন আমি আপনাদের নামিয়ে দিয়ে আসছি।
বহুরকম গালাগাল খেয়ে জয়দেব নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন, এই ট্যাকসিতে উঠতে তার ভরসা হচ্ছে না। কিন্তু মহিমাময় বুঝলেন এ সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত হবে না। জয়দেবকে ঠেলে তুলে দিলেন ট্যাকসিতে, তারপর নিজেও উঠলেন, উঠে ট্যাকসি-ড্রাইভারকে বললেন, পার্ক স্ট্রিট।
পার্ক স্ট্রিটে একটা পুরনো বারে ওঁদের দুজনেরই একটা চেনা আজ্ঞা আছে। আজ কিন্তু নিয়মিত আড্ডাধারীদের কেউই আসেনি। এই ঠান্ডায় আর বৃষ্টিতে কেউ বাড়ি থেকে বেরোয়নি মনে হচ্ছে। দুজনে গুটিগুটি বারে ঢুকে এক প্রান্তে এসে একটা টেবিলে বসলেন।
ট্যাকসির মধ্যে জয়দেব গুম মেরে বসেছিলেন, মহিমাময়ও কোনও কথা বলেননি। এখন বারে চুকে দুটো পানীয়ের অর্ডার দিয়ে জয়দেব বললেন, এই ট্যাকসিগুলো যা হয়েছে না।
মহিমাময় এই দুঃখজনক আলোচনায় গেলেন না। এক প্লেট সসেজ নিয়ে নিঃশব্দে পানীয় খেতে লাগলেন। দুজনের মধ্যে একটা ভারী ভাব, কেউ কোনও কথা বলছেন না। মহিমাময় একটা সসেজ তুলে জয়দেবকে অফার করলেন, জয়দেব প্রত্যাখ্যান করলেন।
আরও কিছুক্ষণ পরে আরও দু-তিন গেলাস পানীয় প্রায় নিঃশব্দে শেষ হওয়ার পরে মহিমাময় আপনমনে বললেন, আবার বোধ হয় বৃষ্টি আসছে। যাই বাড়ি ফিরি।
জয়দেব এবার হাত তুলে বাধা দিলেন। বললেন, কোথায় যাচ্ছিস? আজ রাতে যে তোর বড়সাহেবের বাড়িতে আমাদের ডিনারে নিমন্ত্রণ, তোকেও নিয়ে যাব বলেছি।
মহিমাময় আতঙ্কিত হয়ে বললেন, সন্ধ্যায় অফিসে বড়সাহেবের সঙ্গে মদ খেয়েছি, তারপরে রাতে তার বাসায় গিয়ে তার সঙ্গে ডিনার খাব। এবার নির্ঘাৎ চাকরিটা খোয়াব।
জয়দেব শুনে বললেন, আরে এত ভয় কীসের? আমার যে বইটায় উনি টাকা দেবেন সেটা নিয়ে আলোচনা আছে। আরও দু-একজন আসবে, তুইও যাবি। নিশ্চয়ই যাবি, আমার জন্যে এটুকু করবি না।
মহিমাময় বললেন, কিন্তু তোর স্কুল নিয়ে যদি আবার কথা ওঠে!
জয়দেব বললেন, ধুর, ওসব এড়িয়ে যাব। কত লোক যে ভাবে আমি তার সঙ্গে পড়েছি, সবাইকে কি আর সব ব্যাখ্যা দিতে হয়!
কী জানি কী ভেবে উঠতে গিয়েও মহিমাময় বসে গেলেন। মনে মনে ভাবলেন, বড়সাহেবের ব্যাপারটা একবার শেষ পর্যন্ত দেখা যাক।
সুতরাং বারের এক প্রান্তে জয়দেব এবং মহিমাময়ের সময় ধীরেসুস্থে কাটতে লাগল। আরও কিছুক্ষণ পরে আরও বেশ কয়েক গেলাস পানীয়ের অবসানে, যখন জয়দেবের মুখটা মহিমাময়ের কাছে এবং মহিমাময়ের মুখটা জয়দেবের কাছে ঝাঁপসা দেখাতে লাগল দুজনে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালেন।
দুজনেরই প্রচুর মদ্যপান হয়েছে। দুজনেরই এখন টইটম্বুর অবস্থা। জয়দেব বললেন, দাঁড়া একটু বাথরুম থেকে আসি। মহিমাময় একটা দেয়াল ধরে বাইরের দরজার ধারে দাঁড়িয়ে রইলেন কিন্তু জয়দেব সেই যে গেলেন আর আসেন না। ঝিম মেরে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একসময় মহিমাময়ের মনে হল জয়দেব বহুক্ষণ গেছেন, দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার আর কোনও মানে হয় না।
মহিমাময় কিঞ্চিৎ টলতে টলতে রাস্তায় বেরিয়ে এলেন, পাশে একটা চেনা পানের দোকান। বহুদিনের পুরনো অভ্যেস, এখান থেকে এক খিলি জর্দাপান খেয়ে তারপরে বাড়ি ফেরা। পানের দোকানটায় এখন বেশ একটু ভিড়। আশেপাশের বার-রেস্তোরাঁগুলো খালি হচ্ছে। রাত দশটা বেজে গেছে। বৃষ্টিটা নেই, হাওয়া কম। ঠান্ডাটাও তেমন নয়। আসলে অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলেই ওরকমটা মনে হচ্ছে মহিমাময়ের।
সে যা হোক, পান কিনতে গিয়ে ভিড়ে বাধা পেয়ে একটু সামনের দিকে একটা বন্ধ ওষুধের দোকানের সিঁড়িতে একটু বসলেন মহিমাময়। তাঁর ঝিমুনি মতো এসেছিল, হঠাৎ একটা রাস্তার কুকুর এসে পাশে শোয়ার চেষ্টা করতেই তার তন্দ্রাটা আচমকা ভাঙল।
তন্দ্রা কেটে যাওয়ামাত্র মহিমাময়ের খেয়াল হল জয়দেবের কথা এবং মনে পড়ল সেই বারের বাথরুমে তিনি ঢুকেছিলেন, বারটা যে পাশেই, মাত্র কয়েক কদম দূরে এটা তার চট করে খেয়াল হল না। বিশেষ করে গাড়িবারান্দার নীচে এই সিঁড়িতে কুকুরের পাশে বসে পরিচিত জায়গাটা নেশার ঘোরে বেশ অচেনা লাগছিল তাঁর।
মাতালের আর যতই দোষ থাক, কোনও বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করে না। মহিমাময়ও মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, এইভাবে জয়দেবকে ফেলে যাওয়া উচিত হবে না।
তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফুটপাথে নেমে সামনের রাস্তায় একটা ট্যাকসিকে ডাকলেন। এই সময়ে পার্ক স্ট্রিটের রাস্তায় ট্যাকসির অভাব নেই, দিগদিগন্তের নেশাতুরদের জন্যে সারি সারি ট্যাকসি অপেক্ষমান রয়েছে।
ডাকতেই সামনের ট্যাকসিটা দাঁড়িয়ে গেল। মহিমাময় সেটায় উঠে বসলেন, পার্ক স্ট্রিট।
বলেই সিটে হেলান দিয়ে আবার তন্দ্রাচ্ছন্ন হলেন। ড্রাইভার একটু অবাক হলেও এরকম সওয়ারি নিয়ে চালানো তার অভ্যেস আছে। সে একটুক্ষণ থেমে থেকে বলল, পার্ক স্ট্রিটে কোথায়? জড়ানো কন্ঠে চোখ বোজা মহিমাময় একটু আগে ছেড়ে আসা বারের নামোল্লেখ করলেন। বারের নাম শুনে ড্রাইভারও আর দ্বিরুক্তি না করে তিন সেকেন্ডে ব্যাক করে ট্যাকসিটাকে ওই বারের দরজার সম্মুখে নিয়ে এসে বসল, এই তো আপনার বার!
মহিমাময় চোখ খুলে দেখেন সত্যি তাই। সঙ্গে সঙ্গে তিনি গাড়ি থেকে নেমে বখশিশসুদ্ধ একটা দশ টাকার নোট ড্রাইভারকে দিয়ে বললেন, খুব তাড়াতাড়ি চালিও না, অ্যাক্সিডেন্ট করে বসবে। একদিন।
বারের দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে মহিমাময় দেখতে পেলেন জয়দেব দাঁড়িয়ে আছেন। জয়দেব মহিমাময়কে দেখে বললেন, আমি ভাবলাম তুই বোধ হয় কোথায় চলে গেলি!
এই সময় জয়দেবের পরিচিত এক ভদ্রলোক কালুবাবু, বারে ঢুকছিলেন, তিনি জয়দেবকে দেখে বললেন, কী হল, এত তাড়াতাড়ি বেরোচ্ছেন নাকি?
জয়দেব মহিমাময়কে দেখিয়ে বললেন, না, এই আমাদের দুজনের একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, ডিনার। তাই একটু তাড়াতাড়ি।
কালুবাবু আটকালেন, এক রাউণ্ড, বসে যান।
মহিমাময় কোনও আপত্তি করার সুযোগ পেলেন না, জয়দেবের সঙ্গে তাকেও বসতে হল। মাতালের শেষ রাউন্ড কিছুতেই শেষ হতে চায় না, ওয়ান ফর দা রোড, ওয়ান ফর দা ডিনার, এই রকম ধারাবাহিক চলতে থাকে। তা ছাড়া কালুবাবুর নিজস্ব একটা ভয়াবহ সমস্যা আছে, তিনি বারে এসে সদাসন্ত্রস্ত থাকেন। নিজেই দুঃখ করে ভাঙলেন ব্যাপারটা, জানেন জয়দেববাবু, আমার স্ত্রীর জন্যে মুখ দেখাতে পারছি না। প্রত্যেকদিন বারে আসে।
মহিমাময়ের নেশাটা জমজমাট হয়ে উঠেছে, কিন্তু কথাটা তার কানে গেল, তিনি বললেন, ছিঃ ছিঃ, তিনি বারে আসেন কেন?
কালুবাবু সদ্য আলাপিত মহিমাময়ের হাত ধরে বললেন, আর বলবেন না দাদা, প্রত্যেকদিন রাতে এসে আমাকে জামার কলার ধরে এখান থেকে টেনে বার করে বাড়ি নিয়ে যায়। আজ আপনারা আছেন দাদা, আমাকে একটু রক্ষা করবেন।
জয়দেব ঝিমাচ্ছিলেন, সন্ধ্যা থেকে পেটে কম তরল পদার্থ পড়েনি! কিন্তু তিনি মাতাল হলেও সেয়ানা মাতাল, কালুবাবুর দজ্জাল স্ত্রীর কথা তার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল। মহিমাময়ের ব্যাপারটা ভাল জানা নেই, কারণ তিনি সাধারণত রাত করেন না। কিন্তু জয়দেব জানেন কালুবউদি মধ্যরজনীর বারে এক মূর্তিমতী বিভীষিকা। জয়দেব চট করে গেলাসের অবশিষ্ট পানীয়টুকু গলাধঃকরণ করে মহিমাময়কে বললেন, এই ওঠ। ডিনারের নেমন্তন্নে দেরি হয়ে যাচ্ছে। তারপর মহিমাময়ের হাত ধরে প্রায় হিঁচড়ে বার করে রাস্তায় নেমে এলেন, অসহায় কালুবাবুর ঘাড়ে বিল মেটানোর পুরো দায় ঢেলে দিয়ে।
রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। এখন আবার গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। নিঝুম, শীতল পার্ক স্ট্রিট। তবে ভাগ্য ভাল, এখনও দু-একটা ট্যাকসি রয়েছে শেষ সওয়ারির আশায়।
মহিমাময়ের স্ত্রী পিত্রালয়ে গেছেন দুদিনের জন্যে। তবু এত রাত হবে তিনি ভাবেননি। এখন বাড়ি ফিরলে সিঁড়ির নীচে থেকে ঘুমন্ত বুড়ি ঝিটাকে ডেকে তুলে দরজা খোলাতে পুরো পাড়া জেগে যাবে। সুতরাং জয়দেবের সঙ্গে থাকাই মহিমাময় শ্রেয় মনে করলেন। তা ছাড়া অতিরিক্ত মদ্যপান করে তার মনে একটা সাহস এসেছে, চাকরি তুচ্ছ করে আজ তিনি এখন বড়সাহেবের মোকাবিলা করতে প্রস্তুত।
সুতরাং জয়দেব এবং মহিমাময় দুজনে এবার ট্যাকসিতে রওনা হলেন বড়সাহেবের বাড়ির ডিনারে। বড়সাহেবের বাড়ি সেই সল্টলেকে। ট্যাকসিওয়ালা কুড়ি টাকা একস্ট্রা চাইল। জয়দেব তাতেই রাজি হলেন। পার্ক স্ট্রিটে আলো ছিল কিন্তু সল্টলেকে এখন গভীর অন্ধকার। লোডশেডিংয়ে ধুকছে উপনগরী।
দেখা গেল, জয়দেব বাড়িটা চেনেন। কোনও রকমে খুঁজে খুঁজে বাড়িটা বেরোল। নতুন একতলা বাড়ি, বাইরের ঘরের সঙ্গে লাগানো ছোট একটা শোয়ার ঘরে কোনও অজ্ঞাত কারণে সংসার থেকে একটু আলাদা হয়ে বড়সাহেব থাকেন। জয়দেব ঘরটা জানেন। ঘরের জানলায় গিয়ে টুকটুক করতে অন্ধকারে কম্বল জড়িয়ে এসে বড়সাহেব একপাশের দরজাটা খুলে দিলেন। তিনি আশা করেননি রাত বারোটার পরে এই দুই ব্যক্তি ডিনার খেতে আসবেন। তবু ভদ্রতার খাতিরে তিনি এঁদের দুজনকে ভেতরে নিজের শোয়ার ঘরে নিয়ে বসালেন।
বড়সাহেব একটা মোমবাতি ধরানোর জন্যে বালিশের নীচে দেশলাই হাতড়াচ্ছিলেন। জয়দেব বললেন, গলাটা বড় শুকিয়ে গেছে। কোনও ড্রিঙ্ক আছে?
দেশলাই খুঁজতে খুঁজতে বড়সাহেব বললেন, না, বাসায় তো কোনও ড্রিঙ্ক নেই! ততক্ষণে দেশলাই জ্বালিয়ে সামনের তেপায়া টেবিলের ওপরে একটা মোমবাতি ধরিয়ে ফেলেছেন তিনি।
মোমবাতির ক্ষীণ আলোয় জয়দেব দেখতে পেলেন, বড়সাহেব মিথ্যে কথা বলেছেন, তেপায়া টেবিলের নীচে একটা পানীয়ের বোতলে প্রায় গলা পর্যন্ত ভর্তি পানীয় রয়েছে।
হঠাৎ দমকা ফুঁ দিয়ে, কেউ কিছু বুঝবার আগে জয়দেব মোমবাতিটা নিবিয়ে দিলেন, তারপরে তবে রে শালা, মদ নেই এই বলে তেপায়া টেবিলের নীচ থেকে অন্ধকারে বোতলটা তুলে নিয়ে মুখের মধ্যে ঢকঢক করে ঢেলে দিলেন।
বড়সাহেব যথাসাধ্য বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তার আগেই জয়দেবের আর্ত চিৎকার শোনা গেল, সর্বনাশ, ওরে বাবা রে মারা গেলাম, গলা পুড়ে গেল, বুক জ্বলে গেল! হচতে হঁচতে কাশতে কাশতে বমি করতে লাগলেন জয়দেব। ঘটনার আকস্মিকতায় ভীষণ ভয় পেয়ে ঘামতে লাগলেন মহিমাময়, ভাবলেন হয়তো বোতলে অ্যাসিড-ট্যাসিড কিছু ছিল, জয়দেব তাই খেয়ে ফেলেছেন। এদিকে বড়সাহেব আবার মোমবাতি জ্বালিয়ে ফেলেছেন, মোমবাতির আলোয় পানীয়ের বোতলটার আর এক পাশে উবু হয়ে জয়দেব গলায় আঙুল দিয়ে বমি করেছেন।
বড়সাহেব কপাল চাপড়াতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন ছিঃ ছিঃ, আমার শালা খাঁটি জিনিসটা এনে দিয়েছিল আলিগড় থেকে, কলের ঘানির খাঁটি সরষের তেল, সেটা এইভাবে নষ্ট হল।
মহিমাময় কিছু বুঝতে পারছিলেন না। একে ঘোর নেশা হয়েছে, তার উপরে এই বিচিত্র বিপজ্জনক কাণ্ড। ব্যাপারটা বড়সাহেবের খেদোক্তিতে ক্রমশ স্পষ্ট হল।
বড়সাহেবের শীতকালে গায়ে সরষের তেল মাখার বাতিক আছে। শীতকালে তার চামড়া ফেটে যায় প্রত্যেক বছর। উত্তরপ্রদেশে আলিগড়ে থাকেন তাঁর এক শালা। তিনি শীতের আগে জামাইবাবুকে সরষের তেল দিয়ে গেছেন গায়ে মাখবার জন্যে। সেই তেলটাই ছিল বিছানার কাছে তেপায়া টেবিলের নীচে ওই খালি হুইস্কির বোতলে। আর তাই পান করে জয়দেবের এই দুর্দশা।
এই গল্প এর পরে আর টেনে নিয়ে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। কিন্তু পরবর্তী একটি মর্মান্তিক দৃশ্যের কথা না বললে ঘটনাটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়, যদিও ঘটনাটির সঙ্গে মদ্যপানের কোনও সম্পর্ক নেই।
সেদিন রাত্রে বড়সাহেবের বাইরের ঘরে জয়দেব আর মহিমাময় শুয়েছিলেন। পরদিন সকালবেলা মহিমাময় ঘুম থেকে উঠে দেখলেন, মেঘ কেটে গেছে, বৃষ্টি নেই, নির্মল আকাশ, সুন্দর ঝকঝকে রোদ উঠেছে। জানলা দিয়ে রোদ এসেছে বড়সাহেবের ঘরে। সেই রোদে একটা লুঙ্গি মালকোচা দিয়ে পরে মহিমাময়ের পরম শ্রদ্ধেয় বড়সাহেব মেঝের বমির উপরে ভাসমান সরষের তেল হাত দিয়ে আলতো করে তুলে গায়ে মাখছেন। মহিমাময়ের এদিকে দৃষ্টি পড়ায় কিঞ্চিৎ লজ্জিত হলেন তিনি, তারপরে বললেন, জিনিসটা বড় খাঁটি। নষ্ট করতে মন চাইছে না। আপনিও মাখবেন নাকি একটু?
একশো টাকার ভাঙানি
ভবানীপুরে তাঁর বাড়ির একতলার বাইরের ঘরে বসে আছেন সিদ্ধেশ্বর চক্রবর্তী মশায়। সিদ্ধেশ্বরবাবু ছাপোষা লোক, বেশ বৈষয়িক এবং হিসেবি। বিশেষ করে এখন তাঁকে খুবই হিসেব করে চলতে হচ্ছে, কারণ এই সম্প্রতি তিনি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন।
ভবানীপুরের এই বাড়িটি পৈতৃক। দোতলা বাড়ি, একতলায় বসবার বা বাইরের ঘর। আশ্বিন মাস শেষ হতে চলেছে। এখন ভরা সন্ধ্যা। বাইরে একটু একটু ঠান্ডা ভাব। বিকেলে এক পশলা অদিনের বৃষ্টি হয়ে গেছে। ঘরের জানলা দরজা ভেজিয়ে দিয়ে সিদ্ধেশ্বর পুরনো একটা বেতের চেয়ারে গালে হাত দিয়ে বসে নানারকম হিসেব করছেন। ঘরে একটা পঁচিশ পাওয়ারের আলো টিমটিম করে জ্বলছে। হিসেব করতে করতে সিদ্ধেশ্বরবাবু মনে মনে বহু কথাও ভাবছেন।
একই ছেলে তার, হিতেশ্বর। বাইশ বছর বয়েস হয়েছে। লেখাপড়ায় ভাল নয়, দুবার মাধ্যমিক দিয়েছে। কিন্তু চালাকচতুর, অতিরিক্ত চালাকই বলা যায়। তা ছাড়া ছেলের বন্ধুবান্ধবও মোটেই সুবিধের নয়। হিতেশ্বরের বন্ধুরা কেউই ভাল করে লেখাপড়া করেনি, তা ছাড়া তারা নানারকম বদমায়েসি করে, জুয়ো খেলে, গাঁজা মদ চরস হিরোইন-টিরোইন কী সব খায়। এসব ব্যাপারে একটা জিনিস সিদ্ধেশ্বরবাবুর খুব খটকা লাগে। তাদের আমলে বখা ছেলেরা হিরোইনের পিছে ঘুরত, হিরোইনের ফটো মাথায় নীচে রেখে রাতে ঘুমোত, কিন্তু একালের ব্যাপার অতি সাংঘাতিক–একালের এরা সাক্ষাৎ হিরোইন খেয়ে নিচ্ছে।
নিজের মনে মনে এই হেঁদো রসিকতায় সিদ্ধেশ্বরবাবুর বেশ হাসি পায়। হঠাৎ হাসতে গিয়ে তার খেয়াল হয়, একটু পরে হাসি গোয়ালিনী আসবে, গত মাসের দুধের দাম ষাট টাকা পাওনা আছে, সেটা নিতে।
সিদ্ধেশ্বরবাবু আলগোছে নিজের ফতুয়ার পকেটে হাত তিলেন। পুরনো চামড়ার মানিব্যাগটা খুলে দেখলেন একটা একশো টাকার নোট রয়েছে আর গোটা তিরিশেক খুচরো টাকা। হাসি নাম হলেও গোয়ালিনীটা খুব গোলমেলে। একশো টাকার নোট দিলে চল্লিশ টাকা ফেরত কিছুতেই দেবে না। খুচরোটা নিয়ে আসছি বলে চলে যাবে। তারপর আর খোঁজ মিলবে না। শেষে সামনের মাসের হিসেবের সঙ্গে খাইয়ে দেবে।
ঠিক এই সময়ে বাইরের দরজা দিয়ে হিতেশ্বর বাড়িতে ঢুকল। সারাদিন কোথায় টো-টো করে বেড়িয়েছে কে জানে, এখন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে এল। হিতেশ্বরকে তার বাবা খুব যে একটা বিশ্বাস করেন তা নয়, কিন্তু সামান্য একশো টাকা এখনই ভাঙিয়ে আনবে এতে আর অবিশ্বাসের কী থাকতে পারে, এই ভেবে সিদ্ধেশ্বরবাবু হিতেশ্বরকে একশো টাকার নোট দিয়ে বললেন, মোড়ের মুদিখানার দোকান থেকে নোটটা ভাঙিয়ে নিয়ে আয়। তাড়াতাড়ি আসবি।
একশো টাকার নোটটা নিয়ে রাস্তায় বেরোতেই হিতেশ্বরের সঙ্গে ব্ৰজেনের দেখা। ব্ৰজেন আর হিতেশ্বর বহুদিনের পুরনো বন্ধু। এক পাড়ায় কাছাকাছি বাড়ি, তা ছাড়া দুজনে একই স্কুলে ক্লাস ওয়ানে একই বছরে ভর্তি হয়েছিল। সেই ওয়ান থেকে আজ পর্যন্ত ব্ৰজেন ওরফে বেজা আর হিতেশ্বর ওরফে হিতুর লেখাপড়ার ব্যাপারে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। রেসের ঘোড়া যেমন ঘাড়ে ঘাড়ে অর্থাৎ নেক-টু-নেক ছোটে তেমনই এদের দুজনের ইস্কুলে দৌড়। একবছর বেজা প্রমোশন পেল হিতু পেল না, সে পিছিয়ে গেল। পরের বছর হিতু পাশ, বেজা ফেল, হিতু বেজাকে ধরে ফেলল। এইভাবে একবার ও ওঠে আর একবার ও থাকে, কোনও কোনও ভাল বছরে দুজনেই ওঠে, আবার দুর্বৎসরে দুজনেই আটকে যায়। অবশেষে এখন দুজনেই একসঙ্গে মাধ্যমিক দিয়ে যাচ্ছে।
বাড়ি থেকে বেরিয়েই বেজার সঙ্গে হিতুর দেখা। আজ সারাদিন হিতু গাঁজাপার্কে পাতাল রেলের গুদামের পিছনে তিনতাসের জুয়ো খেলেছে। এত বেশি হেরেছে যে শেষ পর্যন্ত হাতের ঘড়িটা চল্লিশ টাকায় বন্ধক দিয়ে রক্ষা পেয়েছে। বেজাও সঙ্গে ছিল, কিন্তু দুটোর সময় গোটা পঁচিশেক টাকা জিতে বেজা কেটে পড়ে। অবশ্য তার মোটেই উপায় ছিল না, বেজার দুপুরে সিনেমা টিকিট ব্ল্যাকের পার্টটাইম ব্যবসা আছে। আজকাল নাইট শোতে টিকিট মোটেই ব্ল্যাক হয় না, তাই সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় বেজা বাড়ি ফেরত এসেছে।
হিতুকে দেখে বেজা দাঁড়াল, হিতুর হাতে একশো টাকার নোট। আজ বেজার খুব খারাপ দিন গেছে। জুয়োয় জিতলে কী হবে সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক করতে গিয়ে সে আজ রামভরোসা জমাদারের পাল্লায় পড়েছিল। অন্যসব সেপাই জমাদারের টিকিট ব্ল্যাকের ঘুষের রেট হল দশ টাকা। বড় জোর পনেরো টাকা। কিন্তু রামভরোসা চৌধুরীর স্টাইল আলাদা, জমাদারজি দৈনিক একজনের বেশি কাউকে ধরেন না, কিন্তু যাকে ধরেন তাকে একেবারে গজভুক্ত কপিৎবৎ মানে হাতির খাওয়া কয়েতবেলের মতো খোসা গুঁড়ো করে ছেড়ে দেন।
আজ বেজার ভাগ্যে রামভলোসা এসে গিয়েছিল। বাঁ হাতের তর্জনীতে পলাবসানো রুপোর আংটি থেকে পকেটের টাকা, হাতঘড়ি এমনকী বঙ্গলক্ষ্মী লটারির দুটো টিকিট কিনেছিল আজ-কালকেই খেলা, সেটা পর্যন্ত নিয়ে নিয়েছে রামভরোসা, তারপর সজোরে একটা থাপ্পর মেরে বিদেয় দিয়েছে।
দুপুরবেলা জুয়োয় জিতে বেজা হাসিমুখে উঠে গিয়েছিল। হিতু দেখল এখন তার মুখে যেন আলকাতরা মাখানো। সে বেজাকে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে রে বেজা?
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বেজা বলল, রামভরোসা। সবাই রামভরোসাকে চেনে, সুতরাং হিতুকে বুঝিয়ে বলতে হল না।
হিতু ধীরে ধীরে মোড়ের দোকানের দিকে এগিয়ে গেল, বেজাও সঙ্গে গেল। বেজা হিতুকে জিজ্ঞাসা করল, একশো টাকার নোটটা কোথায় পেলি?
হিতু বলল, বাবা ভাঙাতে দিয়েছে।
বেজা বলল, ও আর ভাঙিয়ে কী হবে। তার চেয়ে চল সোজা হাওড়ায় গিয়ে কোথাও পালিয়ে গিয়ে কিছু করার চেষ্টা করি।
কথাটা হিতুর অপছন্দ নয়, একদিকে হিসেবি বাবার কড়াকড়ি, তা ছাড়া ডিসেম্বরের গোড়াতেই এই বুড়ো বয়সে আবার মাধ্যমিকের টেস্ট, তারপরে মার্চে সেই ভয়াবহ পরীক্ষা। একটু ইতস্তত করে হিতু বলল, কোথায় যাবি?
বেজা বলল, আসানসোল, ধানবাদ এসব দিকে যাই। কয়লাখনির মুলুক। ওয়াগন ভাঙা, কয়লা চুরি, চোলাই বিক্রি কতরকম ব্যবসা ওখানে।
হিতু রাজি হয়ে গেল। গলি থেকে বেরিয়ে দুজনে সোজা হাওড়া স্টেশন, সেখান থেকে সরাসরি ধানবাদ। ধানবাদে পৌঁছে দু-একদিনের মধ্যে বেজা খুব জ্বরে পড়ল। ওয়াগন ভাঙা, কয়লা চুরি এসব মাথায় উঠল। বেজাকে নিয়ে হিতু বিপাকে পড়ে গেল। বাজারের মাথায় এক মস্ত হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের দোকান। অল্প পয়সায় হবে জেনে হিতু সেখানে বেজাকে নিয়ে গেল।
বেজার জ্বর সহজে ছাড়ে না। হিতুরও আর্থিক সঙ্গতি শেষ। সে এদিক ওদিক খুচখাচ কাজ করে কোনওরকমে চালিয়ে যাচ্ছে। ওই হোমিও ডাক্তারের সঙ্গে সামান্য মুখ-পরিচয় হয়েছিল হিতুর। বেজার চিকিৎসার খরচ সে চালাতে পারছিল না, একদিন ডাক্তারকে ধরে বলল, স্যার, একটা কিছু কাজ দিন।
ডাক্তার তাকে বললেন, তুমি আমার এখানে ফাঁইফরমাস খাটো। দু-চার টাকা যখন যা পারি দেব।
হিতু লেগে গেল। এদিকে দু-চারদিনের মধ্যে অসুখ একটু ভাল হতেই বেজা কলকাতায় ফিরল। হিতু বেজাকে বার বার বলে দিল, আমাদের বাসায় আমার কথা কিছু বলবি না। বাবা আমাকে ধরতে পারলে আস্ত রাখবে না।
হিতু কয়লাশহরে ডাক্তারবাবুর কাছে রয়ে গেল। দিন যায়। ক্রমশ সে ডাক্তারখানার বাইরের ফাঁইফরমাস খাটা থেকে ফার্মেসির অন্দরে প্রবেশ করল। সে লেখাপড়ায় খারাপ হলেও নির্বোধ নয়। আস্তে আস্তে সে কম্পাউন্ডারবাবু না এলে কম্পাউন্ডারের কাজ চালাতে শিখল। তারপর যেমন হয়, একদিন বুড়ো কম্পাউন্ডারবাবু অবসর নিতে সে পাকাপাকি কম্পাউন্ডার হয়ে গেল।
এখানেই শেষ নয়, কিছু টাকা জমিয়ে বছর দুয়েকের মাথায় নিজেই একটা হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারখানা খুলে ফেলল। সে নিজেই ডাক্তার, ডক্টর এইচ চক্রবর্তী। অল্পদিনের মধ্যে রমরমা পশার জমে উঠল। আগের ডাক্তারবাবুর পশার এখন পড়তির দিকে, সে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাঁকে হারিয়ে দিল। এইবার থামতে হচ্ছে। আর নয়।
হিতু নামক এক বাড়িপালানো যুবকের জীবনের সাফল্য বর্ণনার জন্য এ গল্প আমি লিখতে বসিনি। এ গল্প হিতুর বাবাকে নিয়ে।
সংক্ষেপে শেষ ঘটনাটা বলি।
বাড়ি থেকে একশো টাকার নোট ভাঙাতে গিয়ে পালানোর পাঁচ বছর পরে প্রাক্তন হিতু বর্তমান ডাঃ চক্রবর্তী একদিন ভবানীপুরের বাড়িতে দেখা করতে এল। তার পরনে ক্রিম রঙের সাফারি স্যুট, হাতে আন্তর্জাতিক মানের ঘড়ি। সঙ্গে সালঙ্কারা বধূ। সে নিজস্ব মারুতি ডিলাক্সে চেপে নিজের বাড়ির দরজায় এসে পৌঁছাল এক সন্ধ্যায়।
বাইরের ঘরের দরজা ভেজানো ছিল। হিতু আস্তে আস্তে ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকল, পিছনে বউ। ঘরের মধ্যে একটা পঁচিশ পাওয়ারের আলো টিমটিম করে জ্বলছে। সেই পুরনো দৃশ্য। তার বাবা সিদ্ধেশ্বরবাবু একটা প্রাচীন বেতের চেয়ারে গালে হাত দিয়ে বসে রয়েছেন। স্পষ্টতই মনে মনে কোনও হিসেব করছেন। হিতুকে ঘরে ঢুকতে দেখে, পাঁচ বছর পরে হিতু ফিরছে, তা সত্ত্বেও কোনও ভাবান্তর হল না সিদ্ধেশ্বর চক্রবর্তীর। তাঁর পিতৃহৃদয়ে কোনওরকম উচ্ছ্বাস দেখা গেল না, একবার মুখ তুলে ছেলেকে দেখে বললেন, একশোটা টাকা ভাঙাতে গিয়ে এত দেরি করলি! দে, ভাঙানিটা তাড়াতাড়ি দে!
এখনই
অধ্যাপক সুদর্শন সেন বাইরের ঘরে বসে চা খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। তিনি নিজের পয়সা দিয়ে একটা ইংরেজি, একটা বাংলা, দুটো খবরের কাগজ রাখেন। এ ছাড়া আর একটি বাংলা কাগজে তিনি কখনও-সখনও প্রবন্ধাদি লিখে থাকেন বলে, পত্রিকা কর্তৃপক্ষ সেই কাগজটা তাঁকে বিনামূল্যে দেয়।
এখন সকাল সাতটা। এখন থেকে সকাল নটা সাড়ে নটা পর্যন্ত তিনটে কাগজই তিনি প্রথম পৃষ্ঠার হেডলাইন, ফটো-ক্যাপশন থেকে শেষ পৃষ্ঠার প্রিন্টার্স-লাইন আগাগোড়া উলটে পালটে পড়বেন। অনেক অসঙ্গতি, ভুল বার করবেন।
এই তো সেদিন মার্কিন রাষ্ট্রপতি কটকটি বিস্কুট খেতে খেতে আরাম করে চেয়ারে শরীর এলিয়ে দূরদর্শনে খেলা দেখছিলেন। হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে যান। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর জ্ঞান ফিরে আসে। এরকম অবস্থা যেকোনও সুস্থ মানুষের যেকোনও সময় হতে পারে। এ হল সাময়িক ব্ল্যাক-আউট।
মার্কিন রাষ্ট্রপতির এই হঠাৎ অজ্ঞান হওয়া, তা নিয়ে সারা পৃথিবী মাথা ঘামিয়েছে। সুদর্শনবাবুও মাথা ঘামিয়েছেন। কিন্তু সেটা একটু অন্য কারণে। তিনি যে কাগজ প্রতিদিন বিনামূল্যে পান, সেই কাগজে লিখেছে বুশসাহেব প্রেটজেল নামে ওষুধের ট্যাবলেট খেতে গিয়ে গলায় আটকে অজ্ঞান হয়ে যান।
মার্কিনিদের কটকটি বিস্কুটের নাম প্রেটজেল, এটা কোনও ওষুধের ট্যাবলেট নয়। যিনি অনুবাদ করেছেন, ব্যাপারটা গুলিয়ে ফেলেছেন। প্রবীণ অধ্যাপক এ ধরনের ভুল মোটেই বরদাস্ত করেন না।
সুদর্শনবাবু কাগজ পড়া থামিয়ে টেলিফোন করেন পত্রিকার সহকারী সম্পাদককে। সহকারী সম্পাদক রাজকমল রায় একদা অধ্যাপনা করতেন, সুদর্শনবাবুর সঙ্গে একই কলেজে পড়াতেন। পরে অধ্যাপনা ছেড়ে সাংবাদিকতায় চলে যান।
এই রাজকমলবাবুই মাঝেমধ্যে সুদর্শনকে দিয়ে নানা বিষয়ে প্রবন্ধ লেখান। সংবাদ সাময়িকী জাতীয় রচনা সুদর্শন খুব ভাল লেখেন। তথ্যের প্রতি তাঁর কড়া দৃষ্টি, হেঁয়ালিহীন ভাষা।
প্রেসিডেন্ট বুশ অজ্ঞান হওয়ার সংবাদ খুব গুরুত্ব দিয়ে বেরিয়েছিল রাজকমলবাবুদের কাগজে এবং সেখানেই বলা হয়েছিল, ওষুধের ট্যাবলেট গলায় আটকে বুশসাহেব অজ্ঞান।
সুদর্শনবাবু তাঁর ওয়েবস্টারের বড় ডিকশনারিতে ওই প্রেটজেল শব্দের অর্থ ভাল করে যাচাই করে সেই সকালেই অনুজপ্রতিম রাজকমলকে ফোন করে বললেন, রাজকমল আজকের কাগজে ওটা কী করেছ?
বলা বাহুল্য, রাজকমল ব্যাপারটার দায় এড়িয়ে যেতে চাইছিলেন, সুদর্শনবাবুকে অনুরোধ করলেন, দাদা চেপে যান। পাঠকেরা কেউ ওসব খেয়াল করবে না।
তা সুদর্শনবাবু ভাল করেই জানেন। বেশ কয়েক বছর আগে ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রধান সুব্রত মুখার্জি বিদেশে ডিনারের আগে হঠাৎ হার্টফেল করে মারা যান। মৃত্যুর সময় তিনি অ্যাপেটাইজার খাচ্ছিলেন যার নাম হর্স-দ্য-অ্যাভুয়ার, ছোট বিস্কুটের ওপরে আচার বা চিজ বা একরত্তি খাদ্য, ফরাসি মুখরোচক। কিন্তু ওই হর্স শব্দটি বিভ্রান্ত করেছিল অনুবাদককে, পরদিন সকালে কাগজে ছাপা হল, ঘোড়ার মাংস গলায় ঠেকিয়া এয়ার মার্শালের মৃত্যু।
এই ঘটনার পর বহুকাল চলে গেছে, কিন্তু এখনও কোথাও কোথাও শোনা যায় এয়ার মার্শালের ঘোড়ার মাংসের হাড় গলায় ঠেকে মৃত্যু হয়েছিল। এরই সূত্র ধরে অনেকে এ রকমও মন্তব্য করেন। যে, বাঙালির ছেলের ওরকম অখাদ্যকুখাদ্য না খাওয়াই উচিত।
সে যা হোক, আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে খবরের কাগজের পৃষ্ঠায় একটা অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বের সংবাদ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন অধ্যাপক সেন।
তিনটে কাগজে সংবাদটা তিন রকমভাবে বেরিয়েছে। ইংরেজি দৈনিকে খুবই ছোট করে খবরটি ছাপা হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে যে মধ্য কলকাতায় এক পুরনো সমাজবিরোধীকে একটি অফিসে অগ্নিসংযোগের কালে হাতেনাতে ধরা হয়েছে। এর কারণ জানা যায়নি, পুলিশি তদন্ত চলছে।
বাংলা কাগজগুলোর একটায় সংবাদটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁরা অবশ্য ঘটনাটি অন্যভাবে নিয়েছেন, তাঁদের সংবাদের ওপরে একটা ছোট হেডলাইন, পাগলের কীর্তি।
ঘটনার বিবরণ প্রায় একই রকম। তবে এই সংবাদটিতে দুষ্কৃতকারীকে পুরনো সমাজবিরোধী না বলে বুড়ো পাগল বলা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে যে উক্ত ব্যক্তি, যে ওই অফিসে আগুন লাগাতে গিয়েছিল, সে ওই অফিসেরই কর্তা ও মালিক।
এই দুটি সংবাদেই বলা হয়েছে যে গ্রেফতারের সময় উক্ত ব্যক্তির হাতে এক বোতল কেরোসিন ছিল।
তৃতীয় পত্রিকাটির একটু রঙচঙে খবরের দিকে ঝোঁক। এই পত্রিকাতেই রাজকমল আছেন এবং সুদর্শনবাবু লেখেন।
এই কাগজে বেশ বড় করে হেডলাইন দিয়ে ছাপা হয়েছে।
ছদ্মবেশী আতঙ্কবাদী পুলিশের জালে।
এই পত্রিকার সংবাদেও একটু ব্যতিক্রম দেখা গেল। এরা লিখেছে সন্ত্রাসবাদীর হাতে পেট্রলের টিন ছিল, সে পেট্রলে রাইটার্স বিল্ডিংস, হাওড়া স্টেশনের মতো বড়ো বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া যায়। পুরো ব্যাপারটা গোয়েন্দা পুলিশ দেখবে। প্রয়োজনে সি-বি-আই, মার্কিনি এফ-বি-আই, এমনকি ইন্টারপোলের সাহায্য নেওয়া হবে।
তিনটে পত্রিকাই চায়ের টেবিলের ওপরে পাশাপাশি ফেলে এই সামান্য ব্যাপারটির একটি সামঞ্জস্য রচনা করার চেষ্টা করছিলেন অধ্যাপক সেন।
এটা তাঁর একটা বাতিক। সেই কবে ছোটবেলায় তাঁর জ্যাঠামশায় তাঁকে বলেছিলেন, পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ–এই যেমন চার দিক, প্রত্যেক ঘটনার তেমনই চার দিক আছে। প্রথম, আমি যেমন জানি বা দেখেছি। দ্বিতীয়, তুমি যেমন জান বা দেখেছ। তৃতীয়, সে যেমন জানে বা দেখেছে। আর চতুর্থ দিক হল, সত্যিই যা ঘটেছে।
এই বয়সে এসে, প্রত্যহ সকালবেলা তিনটি খবরের কাগজের নানা রকম সংবাদ যাচাই করতে করতে জ্যাঠামশায়ের কথা মনে পড়ে যায় সুদর্শনবাবুর।
বহুকাল পরলোকহত জ্যাঠামশায়ের উপদেশ মনে রেখে খবরের কাগজ খুঁটিয়ে দেখেন সুদর্শনবাবু।
গরমিল সাধারণত বেশি দেখা যায় স্থানীয় সংবাদে। খুন-মারামারির বিবরণ এক এক কাগজ এক এক রকম ছাপে। সেগুলি বিশ্লেষণ করে ভালই সময় কাটে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকের।
ঘটনার বিবরণে প্রকাশ
তিনটি খবরের কাগজ পাশাপাশি বিছিয়ে আজ সকালে অধ্যাপক সুদর্শন সেন গভীর অভিনিবেশসহকারে অগ্নিসংযোগের একটা ঘটনার সমীক্ষা করছিলেন। রীতিমতো তুলনামূলক পর্যালোচনা।
এরকম ব্যাপারে তাঁর কৌতূহল যতটা, ধৈর্য ততোধিক। দুয়েকবার মূল ঘটনা অনুধাবন করবার জন্যে সশরীরে সংবাদের উৎসমূলে গিয়ে খোঁজখবর করেছেন। সব সময় অভিজ্ঞতা সুখের হয়নি। অকুস্থলের লোকেরা তাঁকে সঙ্গত কারণেই সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেছে। একবার পুলিশের পাল্লায়ও পড়েছিলেন, কী প্রয়োজন, কেন এসব খোঁজ করছেন–এইসব প্রশ্ন।
সেটা ছিল একই পাড়ার দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের মধ্যে সাংঘাতিক মারামারির ঘটনা। দলে জনাবিশেক জখম হয়েছিল, দশজনকে হাসপাতালে পাঠাতে হয়েছিল, তার মধ্যে একজন, দু-কানকাটা বোঁচা নামে পরিচিত এক স্থানীয় মস্তান, মরণাপন্ন অবস্থায়।
সাধারণত ঠাকুমা-দিদিমারা শিশুর নাক একটু বেশি চ্যাপটা হলে সেই নবজাতককে বোঁচা নামে সম্বোধন করতে থাকেন, যে ডাকনাম সারাজীবন মানুষটার সঙ্গে লেপটে থাকে, এমন কী তার ভাল নাম যদি হয় শান্তনীল কিংবা অপরাজিত তবু লোকসমাজে তার পরিচয় হয় বোঁচা, বোঁচাদা কিংবা বোঁচাবাবু নামে। কেউ কেউ মোটা বোঁচা, কিংবা নেকা বোঁচাতেও পরিণত হয়।
এক্ষেত্রে সুদর্শনবাবু সমস্যার আরও গভীর প্রদেশে গিয়েছিলেন। কানকাটা বোঁচা কথাটা অধ্যাপক মহোদয়কে বিচলিত করেছিল। বোঁচা মানে যৎসামান্য নাক, তদুপরি কানকাটা, মাস্তান-ফাস্তান যাই হোক, নাক কান হীন মানুষটির জন্যে সরল প্রকৃতির দর্শনের অধ্যাপক সুদর্শন সেনের খুব মায়া হয়েছিল। খবরের কাগজে ঘটনার বিবরণ পাঠ করে তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে কানকাটা বোঁচার খবর নিতে গিয়েছিলেন।
এলাকায় পুলিশের গোয়েন্দারা ঘোরাঘুরি করছিল, সুদর্শনবাবুর মহৎ উদ্দেশ্য তারা অনুধাবন করতে পারেনি, তাদের মনে সন্দেহ দেখা দেয়, তারা তাঁকে থানায় নিয়ে যায়।
ভাগ্য ভাল যে ওই থানার এক দারোগা ছিল সুদর্শনবাবুর প্রাক্তন ছাত্র। ছাত্রজীবনে সুদর্শন স্যারের নানারকম খামখেয়ালিপনার বিষয় নিয়ে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সে নিজেও খুব হাসাহাসি করেছে।
একবার ক্লাসরুমে ঘরের ভেন্টিলেটারের চড়ুই পাখির বাসা থেকে পাখির ডিম মেঝেতে পড়ে ভেঙে যায়। সুদর্শনবাবু তখন পড়াচ্ছিলেন, ক্লাসে প্রায় দেড়শো ছাত্র–সব উপেক্ষা করে চড়ুই বাবা-মা প্রচণ্ড লাফালাফি, ঝাঁপাঝাঁপি চিৎকার-চেঁচামেচি করতে লাগল। পরের দিন বাজার থেকে একটা খুব ছোট মুরগির ডিম কিনে সেটা সুদর্শনবাবু রুমালে আলতো করে জড়িয়ে পকেটে নিয়ে কলেজে এলেন। তারপর একজন লম্বা ছাত্রকে অনুরোধ করে জানলায় উঠিয়ে ভেন্টিলেটারে চড়ুইয়ের বাসায় ডিমটা রেখে দেন। চড়ুই মা-বাবাকে ভোলানোর জন্যে এই ব্যবস্থা। ছাত্ররা কেউ কেউ বলেছিল, স্যার, চড়ুইয়ের এত বড় ডিম! চড়ুই মেনে নেবে না। আত্মসন্তুষ্ট অধ্যাপক সেদিন বলেছিলেন, ওই টুকু পাখি চড়ই, তার পক্ষে এই তারতম্য ধরা খুব সহজ হবে না।
সেদিনের সেই ছাত্র এখন দারোগা। তিনি এখন নিজের চেয়ারে বসে টেবিলের পাশে দাঁড়ানো এক ছিঁচকে চোরের হাত-পায়ের গিটে গিটে রুলার দিয়ে মারছিলেন। থানায় মারধর নিষেধ। একধরনের আসামিদের বলা থাকে, চেঁচাবি না। যদি বাইরে কেউ টের পায় থানার পিছনের গ্যারেজে নিয়ে ডাণ্ডা-ধোলাই দেব। তাই প্রহৃত আসামিটি বিনা বাক্যব্যয়ে নীরবে অশ্রুবিসর্জন করছিল।
এই সময়ে সুদর্শনবাবুকে নিয়ে গোয়েন্দাদের থানায় প্রবেশ। সেই চড়ুইয়ের বাসায় ডিম তুলে দেয়া লম্বা ছাত্রটি এখন দারোগা। তিনি এখন আসামিকে কেঁচকি দেওয়ার কথা ভাবছিলেন। পিঠের নীচে যেখানে মেরুদণ্ডের শুরু, উত্তমাঙ্গ এবং অধমাঙ্গ শরীরের এই দুই অংশের সীমানা, সেখানে দক্ষ হাতে পেটালে যথাসময়ে প্রহৃত ব্যক্তির হেঁচকি উঠতে থাকে, এই হেঁচকি অন্তত চব্বিশ ঘণ্টা থাকে। হেঁচকি তোলার এই মারকেই বলে কেঁচকি।
সুদর্শন স্যারকে দেখে কেঁচকি মার মুলতুবি রেখে তাড়াতাড়ি দারোগাবাবু এগিয়ে এলেন, স্যার, আপনি এখানে?
.
তিনটি কাগজের তিন রকম খবর পাশাপাশি বিশ্লেষণ করতে করতে আজ সুদর্শনবাবু পরিষ্কার বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা বেশ জটিল। যেটুকু বোঝা যাচ্ছে তা হল, এক বৃদ্ধ স্বহস্তে নিজের অফিসে অগ্নিসংযোগ করতে গিয়ে আনাড়ির মতো ধরা পড়ে গিয়েছেন।
কিন্তু কেন তিনি এরকম করলেন? সুদর্শনবাবু ঠিক করলেন, ঘটনাস্থলে যাবেন। কী দুঃখে, কতটা দুঃখে সেই বৃদ্ধ নিজের অফিসে আগুন লাগাতে পারেন–সুদর্শনের সমবেদনাপূর্ণ বিশ্লেষণের জন্যে পরিপূর্ণ তথ্য প্রয়োজন। তিনি ঠিক করলেন, নিশ্চয় ঘটনাস্থলে যাবেন। কালকেই যাবেন।
এরপর একটু ভাবলেন। গেলে দেরি করা উচিত নয়। আজকেই যাওয়া উচিত। আবার ভাবছেন খোঁজখবর করতে গিয়ে আবার ঝামেলার মধ্যে না পড়েন। তিনি যে নিতান্তই মানবিক কৌতূহলবশত এধরনের খোঁজখবর নিচ্ছেন এ কথা সকলকে বোঝানো কঠিন।
ঠিক এই সময়ে সামনের দরজায় দ্রুত এবং ব্যস্ত করাঘাতে চিন্তায় ছেদ পড়ল অধ্যাপক সেনের। ধাক্কার চোটে দরজা ভেঙে যেতে পারে তাই তাড়াতাড়ি ছুটে গেলেন।
একতলার সামনের দিকের এই ঘরটা এ বাড়ির বাইরের ঘর। এখানেই অধ্যাপক সেন চা খান, খবরের কাগজ পড়েন, লেখাপড়া করেন। ছাত্র-ছাত্রীরা এলে তাদের সঙ্গে কথা বলেন, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দেন।
একতলা-দোতলার দু ঘর-দু ঘর ছোট চার ঘরের বাড়ি। রিটায়ার করার পর বাইরের ঘরটায় আশ্রয় নিয়েছেন সুদর্শনবাবু। শুধু স্নান-খাওয়া এবং শোয়ার জন্যে ভেতরে যান। ভেতরে গেলেই নানা ঝামেলা। এখুনি বাজারে যাও, ডাক্তার ডাক, না হলে ইলেকট্রিক মিস্ত্রিকে খবর দাও। এধরনের কাজ পছন্দ নয়, অবসরপ্রাপ্ত অকৃতদার অধ্যাপকের। ভ্রাতুস্পুত্রর সঙ্গে থাকেন। মাসের শেষে পেনশন থেকে চার হাজার টাকা ভ্রাতুস্পুত্রবধূর হাতে তুলে নিয়ে তিনি নিশ্চিন্তে বাইরের ঘরে অবসরজীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেন। সাধারণত কেউ তাঁকে বিশেষ ঘাঁটায় না। তিনি নিরিবিলিতেই থাকেন।
তবে একটা কাজ তাঁকে করতেই হয়। সেটা হল এই বাইরের ঘরের দরজা খোলা আর বন্ধ করা। কেউ এ বাড়িতে আসতে গেলে বা এ বাড়ি থেকে যেতে গেলে এই একটা দরজাই ভরসা।
যাচ্ছি। যাচ্ছি। বলে চেঁচিয়ে বাইরে যে ধাক্কা দিচ্ছিল তাকে নিবৃত্ত করে সুদর্শন গিয়ে বাইরের ঘরের দরজা খুললেন। সঙ্গে সঙ্গে জিনসের প্যান্ট এবং লাল-নীল স্ট্রাইপ শার্ট পরিহিতা এক উদ্ভিন্নযৌবনা অষ্টাদশী দুই হাতে তার নরম শরীরের মধ্যে সুদর্শনকে জাপটিয়ে ধরে কাঁদতে লাগল, ও দেড়তলার মামা, দাদুকে যে পুলিশ নিয়ে গেছে।
দেড়তলার মামা
এই পর্বে প্রবেশের মুখে দেড়তলার মামা এবং আনুষঙ্গিক ব্যাপারগুলি পরিষ্কার করে না বললে পাঠক-পাঠিকার প্রতি অন্যায় করা হবে।
এই মাত্র প্রবীণ অধ্যাপককে দেড়তলার মামা সম্বোধন করে যে বিস্ৰস্তবসনা এই বাইরের ঘরে এবং কাহিনিতে প্রবেশ করল, তার নাম ঝিমলি, সেই ঝিমলির মাতামহের বাড়ির দেড়তলার ঘরে প্রথম জীবনে বেশ কয়েক বছর সুদর্শনবাবু ভাড়া ছিলেন। মফস্সল থেকে এম.এ. পাশ করে কলকাতায় এসে অধ্যাপনার কাজে যোগ দিয়েছিলেন। সেই সময়ে দেড়তলার বড়সড় ঘরটিতে ডেরা বাঁধেন। অনেক পরে, সাত ঘাটের জল ঘেঁটে অবশেষে একসময় দোতলা বাড়িতে ঠাঁই জুটেছে।
তা, এই বাড়ির দোতলায় বাড়িওলা তারিণীবাবু থাকেন। দেড়তলা মানে মেজানিন ফ্লোরে সুদর্শনবাবু ছাড়াও একতলায় আরও দু-তিন ঘর ভাড়াটে ছিলেন। বাড়িটা মানিকতলা অঞ্চলে।
সুদর্শনবাবুর মনে আছে ও বাড়িতে কেউ তাঁকে নাম ধরে ডাকত না। তারিণীবাবু এবং তাঁর স্ত্রী তাঁকে একটু স্নেহের সঙ্গে দেড়তলার ছেলেটি বলতেন। তখনও বর্তমান ঝিমলির মা রমা বেশ ছোট, আট-দশ বছর বয়স হবে। সে সুদর্শনবাবুর খুব ন্যাওটা ছিল। দেড়তলার দাদার চারপাশে ঘুরঘুর করত।
চিরকুমার সুদর্শনবাবুর এখন মনে পড়লে হাসি পায়, রমা কলেজে পড়ার সময় একবার তার সঙ্গে বিয়ের তোড়জোড় হয়েছিল। সেই সময়েই প্রায় জোর করেই সুদর্শনবাবু ওখান থেকে উঠে একটা মেসে চলে গিয়েছিলেন।
কিন্তু সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি। বাড়িওলা তারিণীবাবু সুদর্শনবাবুর নিয়মিত খোঁজখবর রেখেছেন, তা তিনি যেখানে যখন থেকেছেন। এমনকী সুদর্শনবাবুর কলেজেও গেছেন। দরকারে এবং অদরকারে। সুদর্শনবাবুকেও ও বাড়িতে যেতে হয়েছে। রমার বিয়ের আগে পর্যন্ত রমা তাঁকে নিয়মিত ভাইফোঁটা দিয়েছিল, শুধু যে সময় রমার সঙ্গে বিয়ের কথা উঠেছিল সেই দু-এক বছর বাদ দিয়ে।
এ ছাড়া নববর্ষ, বিজয়া দশমী, উৎসবে-অনুষ্ঠানে তারিণীবাবুর বাড়িতে অবারিত দ্বার সুদর্শনের।
তিরিশ পঁয়তিরিশ বছর কম সময় নয়। রমা বড় হল। রমার বিয়ে হল। তারিণীবাবুর স্ত্রীকে, যদিও বয়সের তেমন ব্যবধান ছিল না, সুদর্শন অন্যান্য ভাড়াটের দেখাদেখি মাসিমা বলতেন। সেই মাসির সঙ্গে ঘুরে ঘুরে রমার বিয়ের বাজার করলেন। এমনকী রমার বিয়েতে সাত পাকের সময় পিড়ি পর্যন্ত ধরেছিলেন।
সেই রমা বিয়ে হয়ে দিল্লি চলে গেল। পরে একদিন বিধবা হয়ে শিশুকন্যা ঝিমলিকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে এল। ঝিমলি একেবারে ছোটবেলার রমার মতো দেখতে, তারও একই দোষ, সেও সুদর্শনের খুব ন্যাওটা। কবে সুদর্শন তারিণীবাবুর বাড়ির দেড়তলায় থাকতেন সেই সূত্রে রমা তাঁকে দেড়তলার দাদা বলত, এখন রমার মেয়ে ঝিমলি তাঁকে দেড়তলার মামা বলে।
.
এতক্ষণ এ গল্পের আশেপাশের চরিত্র ইত্যাদি নিয়ে অনেক কিছু বলা হল কিন্তু এই গল্প যাঁর জন্যে, এই গল্পের যিনি মূল ও মুখ্য চরিত্র সেই তারিণীবাবু সম্পর্কে প্রায় কিছুই বলা হয়নি।
এ কাহিনিতে তারিণীবাবুর পদবি বা উপাধি অপ্রয়োজনীয়। অশীতিপর সুস্থ, সচল, কর্মময় বাঙালি একালে বিরল। সেদিক থেকে তারিণীবাবু উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব।
মানিকতলার মোড়ের কাছে একটা ছোট বাড়ি আর বউবাজারের কালীবাড়ির পশ্চিমে একটা দুশো বছরের পুরনো গলিতে ভাঙা তিনতলা বাড়ির পুরো একতলা জুড়ে, তারিণীবাবুর পৈতৃক ব্যবসায় ভারত স্টেশনার্স অ্যান্ড সাপ্লায়ার্স।
চিরকাল অবশ্য এ নাম ছিল না, প্রথমে নাম ছিল, ইম্পিরিয়াল স্টেশনার্স। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর নাম হয় ভিক্টরি সাপ্লায়ার্স। পরে চল্লিশের দশকে মুসলিম লিগের আমলে নাম পালটিয়ে করা হয়, মুন অ্যান্ড স্টার স্টেশনার্স অ্যান্ড সাপ্লায়ার্স। তবে গত পঞ্চাশ বছর ধরে ভারত স্টেশনার্স অ্যান্ড সাপ্লায়ার্স নামটি চলছে।
মধ্য কলকাতায় বিবাদী বাগের কাছাকাছি অঞ্চলে ওই রকম কোম্পানি অনেক আছে। এগুলি অধিকাংশই বাঙালি মধ্যবিত্তের পুরনো ব্যবসা। এদের কাজ হল বিভিন্ন সরকারি এবং সওদাগরি দপ্তরে অফিসের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, কলম পেনসিল, আলপিন থেকে আলমারি–যা কিছু একটি অফিসের প্রয়োজনে লাগে এইসব সরবরাহ করা। ছোটখাটো ছাপার কাজ, ফর্ম, মেমো, প্যাড, ভিজিটিং কার্ড, এমনকী বার্ষিক রিপোর্ট পর্যন্ত এইসব কোম্পানির মাধ্যমে মুদ্রিত হয়।
সাদা বাংলায় এর নাম সাপ্লাইয়ের ব্যবসা। এঁরা বাজার থেকে জিনিস সংগ্রহ করে বিভিন্ন অফিসে তাদের চাহিদামতো সরবরাহ করেন। কেনাবেচার মধ্যে যে ফারাক থাকে সেইটাই লাভ।
.
আজ সকালে হঠাৎ বিপর্যস্ত এবং উত্তেজিত অবস্থায় ঝিমলিকে বাড়িতে আসতে দেখে সুদর্শনবাবু বুঝলেন নিশ্চয়ই কিছু একটা বড় রকমের গোলমাল হয়েছে তারিণীবাবুর বাড়িতে।
সোফায় বসিয়ে ভেতরের ঘর থেকে এক গেলাস জল এনে ঝিমলির হাতে দিয়ে বললেন, আগে জল খেয়ে নে। তারপর কী হয়েছে শুনছি।
গলা-পিঠ আর মুখের ঘাম রুমাল দিয়ে আলগোছে মুছে নিয়ে ঝিমলি বলল, সর্বনাশ হয়ে গেছে, দেড়তলার মামা। মা আমাকে তোমার কাছে পাঠাল।
মুখোমুখি বসে ঝিমলির মুখের দিকে তাকিয়ে সুদর্শনবাবুর অনেকদিন আগের সব কথা মনে পড়ল। ঝিমলির মা রমা এই বয়সে ঠিক এই রকমই দেখতে ছিল। এই বয়সেই রমার সঙ্গে তাঁর বিয়ের কথা উঠেছিল।
হাতের গেলাসের জলটা কিন্তু খেল না ঝিমলি। একটু বসেই উঠে পড়ল, সুদর্শনবাবুর হাত ধরে টানল। বলল, দেরি করা যাবে না। আমাদের খুব বিপদ। তুমি আমার সঙ্গে চলো। মা কী করবে বুঝতে পারছে না।
কী হয়েছে? কী করবে? আমিও তো কিছু বুঝতে পারছি না। ব্যাপারটা কী আগে বল তো?
ঝিমলি বলল, সাংঘাতিক ব্যাপার। দাদুকে কাল পুলিশ ধরেছে।
অবাক হয়ে সুদর্শনবাবু বললেন, তারিণীবাবুকে পুলিশে ধরেছে? কেন?
আমরা তা জানি না, ঝিমলি বলল, তবে থানা থেকে খবর দিয়েছে, দাদু নাকি অফিসঘরে আগুন লাগানোর চেষ্টা করেছিলেন। সেই সময় তাঁকে লোকজনেরা ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
ঝিমলির কথা শুনে সুদর্শনবাবুর আজ একটু আগে পড়া অগ্নিসংযোগের সংবাদগুলি মনে পড়ল। তাড়াতাড়ি জামাকাপড় বদলিয়ে, খবরের কাগজ তিনটে হাতে নিয়ে তিনি ঝিমলির সঙ্গে বেরিয়ে পড়লেন।
শেষ কথা
অধ্যাপক সুদর্শন সেনের বর্তমান বাসা থেকে তাঁর প্রাক্তন বাসা, ঝিমলির মাতামহ তারিণীবাবুর বাড়ি খুব দূরে নয়। ট্যাক্সিতে বড়জোর মিনিট দশেক লাগে।
ট্যাক্সি থেকে নামামাত্র ঝিমলি দৌড়ে গিয়ে মাকে খবর দিল যে, দেড়তলার মামা এসেছে।
রমা বোধহয় এতক্ষণ নীরবে চিন্তা করছিল। এবার অধ্যাপক সেনের আগমনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। কিন্তু খুব বেশিক্ষণ ধরে হাউমাউ করার সুযোগ মেলেনি।
সুদর্শনবাবুরা আসবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের ট্যাক্সির পিছনে একটি পুলিশভ্যান থামে। তার মধ্য থেকে তারিণীবাবুকে সঙ্গে করে একজন পুলিশ কর্মচারী নামেন। তিনি বাইরের ঘরে ঢুকে রমার কাছে তারিণীবাবুকে সমর্পণ করে বললেন, বুড়ো কর্তার মাথার গোলমাল হয়েছে। না হলে কেউ নিজের অফিসে আগুন লাগাতে যায়।
ভদ্রলোক চলে যাচ্ছিলেন, অধ্যাপক সেন একটু বিচলিত কণ্ঠে বললেন, বহু ধন্যবাদ। কিন্তু কোনও দিন কোথাও এর আগে দেখেছি বলে মনে পড়ে না যে, থানা থেকে মুক্ত আসামিকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
এই কথা শুনে পুলিশের ভদ্রলোক নিজের বুকের একটা ব্যাজের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, দেখতে পাচ্ছেন না, জনসংযোগ সপ্তাহ চলছে? ভদ্রলোক রাগে গরগর করতে করতে চলে গেলেন।
এদিকে তারিণীবাবুর ভয়াবহ বিধ্বস্ত অবস্থা। তাঁর এই সাতাত্তর বছর বয়সে জীবনের প্রথম হাজতবাস সে খুব সামান্য ব্যাপার নয়। মারধর না করুক, সারা রাত অভুক্ত অবস্থায় মেঝেতে বসে, এক পাল চোর-গুণ্ডার সঙ্গে বেশ তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে।
একটু বসে ধাতস্থ হয়ে বাথরুমে গিয়ে জামাকাপড় ছেড়ে স্নান করে এলেন তারিণীবাবু। রমা মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এরই মধ্যে আলু আর লুচি ভেজে ফেলেছে। তারিণীবাবু বাইরের ঘরে আসতে তাঁর সঙ্গে জলখাবার খেতে খেতে সুদর্শনবাবু সঙ্গে আনা খবরের কাগজ তিনটে তারিণীবাবুকে দেখিয়ে বললেন, আপনার কীর্তিকলাপ সবই এইসব কাগজে প্রকাশিত হয়েছে।
তারিণীবাবু ওই সংবাদ শুনে বিশেষ বিচলিত হলেন বলে মনে হল না। শুধু জিজ্ঞাসা করলেন, নাম-ধাম কিছু দিয়েছে নাকি?
সুদর্শনবাবু বললেন, না তা নয়? কিন্তু আসল ব্যাপারটা কী?
সুদর্শনবাবুর প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে তারিণীবাবু আবার প্রশ্ন করলেন, তোমরা জানলে কী করে?
সুদর্শনবাবু বললেন, আমাকে রমা জানিয়েছে। রমাকে জানিয়েছে বোধহয়…।
কথা শেষ হওয়ার আগে রমা বলল, আমাকে তো কেউ কিছু কাল বলেনি। হাসপাতালে ফোন করেছি। লালবাজারে ফোন করেছি। অবশেষে আজ সকালে খবর পেলাম তোমাকে পুলিশ ধরেছে।
পুলিশ ধরেছিল। তা ছেড়েও তো দিয়েছে। খুব জব্দ করা গেছে পুলিশকে।তারিণীবাবু হাসতে হাসতে বললেন।
মূল ঘটনাটা কী সেটা জানার জন্যে খুবই কৌতূহলী হয়ে পড়লেন সুদর্শন। কিন্তু কতক্ষণ অপেক্ষা করা যায়? চট করে কোনও কিছু তারিণীবাবু কবুল করবেন বলে মনে হচ্ছে না।
অবশ্য একটা সুবিধে হয়ে গেল, অন্য ভাবে।
একটু আগে ঝিমলি বাজারের থলে হাতে বেরিয়ে গিয়েছিল। বাজার থেকে ফিরে রান্নাঘরে বাজারটা নামিয়ে দিয়ে এসে সে বলল, দেড়তলার মামা, তুমি দুপুরে এখান থেকে খেয়ে যাবে। তারপর লোভ দেখাল, চিতলমাছের পেটি এনেছি। বড় বড় পেটি। দাদুর ফিরে আসা সেলিব্রেট করতে হবে।
.
দাদুর ফিরে আসা ভালই সেলিব্রেট করা হল।
রমা ভাল রান্না করে, একেবারে ওর মায়ের মতো। প্রথম যৌবনে প্রবাসের দিনে রমার মায়ের রান্না কারণে-অকারণে কতবার যে খেয়েছেন সুদর্শন। সেসব স্বাদ এখনও জিভে লেগে আছে।
আজ রমার রান্না মটরের ডাল ছড়ানো আদাবাটা মাখা লাউয়ের তরকারি, কাঁচা লঙ্কা, কাঁচা টমাটো দিয়ে মাখো মাখো রাঙা আলু আর রাঙা কুমডোর যুগলবন্দি, হালকা সরষেবাটা দিয়ে চিতল মাছের ঝোল আর সব শেষে গুড়, লঙ্কা, গন্ধরাজ লেবুর রস আর খোসা ছাড়ানো সেদ্ধ কাঁচা তেঁতুলের অম্লমধুর স্বাদ, পুরো মধ্যাহ্নভোজন ব্যাপারটা অনির্বচনীয় করে তুলেছিল।
এই সুখাদ্যের জন্যেই হয়তো, তারিণীবাবু শেষ পাতে তেঁতুলের চাটনি চাটতে চাটতে সব কথা বলে ফেললেন।
সেসব কথা গুছিয়ে বলা যাবে না। সময়াভাব, স্থানাভাব আছে।
তা ছাড়া সব সময় সব কথা বলারও কোনও প্রয়োজন নেই।
এই কাহিনির জন্যে যেটুকু প্রয়োজন শুধুমাত্র সেটুকু বললেই যথেষ্ট।
আর দেরি নয়, এখনই
আজ কিছুদিন হল তারিণীবাবুর ভারত সাপ্লায়ার্স কোম্পানির ব্যবসা ভাল চলছে না। এ জাতীয় সব ব্যবসারই এখন খারাপ অবস্থা।
ভারত সাপ্লায়ার্সের শতকরা নব্বই ভাগ কাজ সরকারি অফিসগুলির সঙ্গে।
আজ কয়েক বছর হল সরকারি অফিসগুলো থেকে বিলের পেমেন্ট পেতে খুব দেরি হচ্ছে। আগে সারা বছরের বিলের পেমেন্ট আর্থিক বছরের শেষে একত্রিশে মার্চের মধ্যে পাওয়া যেত। তারপরে আগের বছরের বিলের পেমেন্ট পরের বছরের মার্চ মাসে পাওয়া যেত।
আজকাল আর সেসব ব্যাপার নেই। কোন বিলের টাকা কবে পাওয়া যাবে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।
আগে যেমন এ বছরের বিল এ বছরেই পাওয়া যেত। না হলে, বড়জোর সামনের বছরে। কিন্তু আজকাল পাঁচ-সাত বছরেও বিল পাশ হয় না। তারিণীবাবুর হিসেব এরকম, তিনি এখনও চুরানব্বই-পঁচানব্বই সালের বিলের পেমেন্ট পাননি। কবে পাবেন জানেন না।
তার মানে সারা বছরের পেমেন্ট বাকি। ভারত সাপ্লায়ার্সের মাত্র দশ বারো জন কর্মচারির মাইনের টাকা সংগ্রহ করতেই তারিণীবাবু হিমসিম খেয়ে যাচ্ছেন। দুয়েকটা বেসরকারি সংস্থার কাজ হাতে আছে, খোলা বাজারের কেনাকাটায় কিছু কমিশন থাকছে। কোনও রকমে চালিয়ে যাচ্ছিলেন তারিণীবাবু, কিন্তু তাঁরও সাপ্লায়ার্স বোধহয় আর জোড়াতালি দিয়ে চলবে না।
তারিণীবাবুর অফিসের ম্যানেজার স্বর্ণেন্দু নামে এক বি.কম পাশ যুবক। বেশ চটপটে এবং কাজের ছিল ছেলেটা, কিন্তু সরকারি অফিসের বিল আদায়ে মোটেই সুবিধে করতে পারছে না। তা ছাড়া আজ কয়েক মাস হল তহমিনা নামে একটি লাজুক মেয়েকে এমপ্লয়মেন্ট টাইপিস্ট পদে নিযুক্ত করেছেন।
সারাদিন এই তহমিনার সঙ্গে স্বর্ণেন্দুর কী সব গুজগুজ, ফুসফুস। তার আর কোনও কাজেই মন নেই। তাকে দিয়ে বিল আদায়ের কাজ অসম্ভব।
জগন্ময়বাবু আছেন পুরনো ক্যাশিয়ার। আগে তিনিও প্রয়োজনে বিলের তাগাদা দিতে যেতেন। কিন্তু কোমরে বাত হওয়ায় আজকাল আর বিশেষ হাঁটাহাঁটি করতে পারেন না। কোনও রকমে অফিসে এসে বসে থাকেন, আর সদাসর্বদা ছোট ছোট স্লিপে কী সব হিসেব করেন।
এ ছাড়া বাকি ছয়-সাতজন তারা সবাই ধান্দায় ঘুরছে। অধিকাংশই বিশ্বাসযোগ্য নয়, কিন্তু কাউকে বলা যাবে না। কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্বও দেওয়া যাবে না। এদিকে মাঝেমধ্যেই ইনকিলাব জিন্দাবাদ করতে করতে সরকারি হারে মহার্ঘভাতা দাবি করে চেঁচায়। কোম্পানির টাকা কোথা থেকে আসবে, তা নিয়ে এরা যদি একটুও ভাবত।
ভাবতে হয় তারিণীবাবুকেই। তাই আজকাল তিনি নিজেই বিলের তাগাদায় যান। বিভিন্ন সরকারি অফিসে ঘোরেন।
সম্প্রতি সরকারি অফিসগুলিতে তাড়াতাড়ি কাজ হওয়ার একটা চেষ্টা চলেছে। কিন্তু বিল পেমেন্টের ক্ষেত্রে তাতে কোনও লাভ নেই। বিল পাশ হলে কী হবে, সরকারের ঘরে অর্থ না থাকলে বিলের টাকা আসবে কোথা থেকে।
আজকাল বিভিন্ন অফিসে একটা নতুন জিনিস দেখতে পাচ্ছেন তারিণীবাবু। খুব পছন্দ হয়েছে তাঁর।
জিনিসটা একটা বিজ্ঞপ্তি। বড় বড় হরফে হিন্দি, বাংলা, ইংরেজি এবং উর্দুতে লেখা
আর দেরি নয়, এখনই।
যার যা করবার আছে
এখনই করে ফেলুন।
পোস্টারের মতো মুদ্রিত এই বিজ্ঞপ্তিগুলি একটা অফিসের দেয়ালের বিভিন্ন জায়গায় সেই অফিসের দুজন পিয়ন আঠা দিয়ে লাগাচ্ছিল। তাদের কাছে চাইতে তারা সানন্দে একটা পোস্টার তারিণীবাবুকে দিয়ে দিল।
পরের দিন সকাল সকাল অফিসে গিয়ে ভেতরের দিকে একটা দেয়ালে এই পোস্টারটি স্বহস্তে তারিণীবাবু লাগালেন। অফিসে এসে সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে দেখল।
তারিণীবাবু সবাইকে ঘুরে ঘুরে বললেন, বিজ্ঞপ্তিটা খেয়াল রাখবেন। হাতের কাজ মোটেই ফেলে রাখবেন না। যার যা কাজ এখনই করে ফেলুন। এখনই।
.
তারিণী কল্পনাও করতে পারেননি, এই বিজ্ঞপ্তির পরিণাম কী ভয়াবহ হতে পারে।
তাঁর খাস আর্দালি রামলাল বছর খানেক হল দু মাসের ছুটি চাইছিল দেশে যাওয়ার জন্যে। ওই বিজ্ঞপ্তি দেখার সঙ্গে সঙ্গে সে, অন্যান্যবারের মতো তারিণীবাবু যাতে বাধা দিতে না পারেন তাই কোনও রকম ঝুঁকি না নিয়ে টেবিলে একটি ছুটির দরখাস্ত রেখে দেশে রওনা হয়ে গেল।
এর অল্প পরেই আর একটা দরখাস্ত এল, তাতে যুগ্ম স্বাক্ষর স্বর্ণেন্দু এবং তহমিনার। দরখাস্তে লেখা আছে।
শ্রদ্ধেয় স্যার,
আর দেরি নয়, এখনই। বিজ্ঞপ্তি পাঠ করে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা এত দিন যা নিয়ে ইতস্তত করছিলাম সেই বিয়ের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখন ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কাছে যাচ্ছি। বিয়ে, হনিমুন ইত্যাদি বাবদ আমরা কেউ মাস দেড়েক অফিসে আসতে পারব না।
ছুটি ও আশীর্বাদ প্রার্থনা করি,
তহমিনা এবং স্বর্ণেন্দু।
.
এর পরে আরও সব দরখাস্ত। বিজ্ঞপ্তি পাঠ করে সবাই উজ্জীবিত হয়েছে যা করার আছে এখনই করে ফেলার জন্য। সবচেয়ে ভয়ানক চিঠি ক্যাশিয়ারবাবুর। সেই যে কাগজের টুকরোগুলোর কী সব খুচখাচ হিসেব রাখতেন, সেইসব হিসেব আলপিন দিয়ে গেঁথে সঙ্গে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন।
কোম্পানির ক্যাশখাত অনুযায়ী নগদ যে এক লক্ষ দশ হাজার টাকা থাকার কথা তাহার মধ্যে বেয়াল্লিশ হাজার টাকা আমি ইতিমধ্যে তছরুপ করেছি, হিসাব সঙ্গের স্লিপগুলিতে আছে। বাকি আটষট্টি হাজার টাকা সঙ্গে নিয়ে গেলাম। আমাকে খুঁজিবার চেষ্টা করিবেন না।
দুপুরের মধ্যে অফিস প্রায় ফাঁকা। যে চার-পাঁচজন ছিল তারা একজোট হয়ে তারিণীবাবুকে ঘেরাও দিল, সরকারি হারে মহার্ঘভাতা দিতে হবে, দিতেই হবে। আজ থেকেই দিতে হবে। তারা তারিণীবাবুকে দিয়ে কবুল করিয়ে অবশেষে সন্ধ্যা ছয়টার পরে গেল।
ঘেরাও থাকা অবস্থায় চুপচাপ বসে বসে তারিণীবাবু নিজেও কী করবেন স্থির করে ফেলেন।
আজ এখনই করতে হবে, আর দেরি নয়।
কাজটি সাংঘাতিক। অগ্নিসংযোগ। আজ পঁচিশ বছর ধরে বছরে বছরে দশ হাজার টাকা করে ফায়ার ইনসিওরেন্স প্রিমিয়াম দিয়ে আসছেন। কখনও এক পয়সা উসুল হয়নি। এবার সুযোগ এসেছে, অফিস পুড়ে গেলে অগ্নিবিমাবাবদ লাখ পনেরো টাকা পাওয়া যাবে।
যেমন চিন্তা, তেমন কাজ। অফিসের প্যাসেজে, চা করার সাজসরঞ্জাম, জনতা স্টোভ, কয়েক বোতল কেরোসিন তেল আছে। এক বোতল তেল নিয়ে দেয়ালে যেখানে আর দেরি নয়, পোস্টারটি সেঁটেছিলেন সেখানেই প্রথমে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন লাগাতে যান। দুঃখের বিষয়, পাশের গঙ্গা কেমিক্যালস কোম্পানির দারোয়ান ব্যাপারটা দেখে ফেলে।
তারপর হইচই পুলিশ ইত্যাদি। তবে পুলিশ জেরা করার পরেও ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি তারিণীবাবু ইন্সিওরেন্সের টাকার জন্যে আগুন লাগাচ্ছিলেন। পুলিশ ভেবেছে, এটা বাণিজ্যে অসফল বৃদ্ধের পাগলামি।
.
তারিণীবাবুর কাহিনি শেষ হতে হতে দুপুর গড়িয়ে গেছে। ঝিমলি গিয়ে বিকেলের চা করে নিয়ে এল।
চা খেয়ে ধীরে ধীরে সুদর্শন সেন বাড়ির দিকে ফিরলেন। তাঁর জীবনে এই প্রথম একটা সংবাদ যার চার দিকই তিনি দেখতে পেয়েছেন।
এন-আর-আই
ডক্টর উমাকুমার চক্রবর্তী একজন এন-আর-আই, অর্থাৎ নন রেসিডেন্ট ইন্ডিয়ান, অর্থাৎ অনাবাসী ভারতীয়। এন-আর-আই এই শব্দটির সঙ্গে এখন অনেকেই রীতিমতো পরিচিত। অনেক সৌভাগ্যবানের নিকট-আত্মীয় বা বন্ধুই হয়তো এন-আর-আই। তবু কেউ যাতে নন রেসিডেন্ট ইন্ডিয়ানকে রেড ইন্ডিয়ান বা ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান জাতীয় কিছু না ভাবেন, তাই প্রথমেই বলে রাখা ভাল এঁরা আমাদের মতো, আমাদেরই লোক। শুধু আমরা দেশে আছি, এঁরা বিদেশে আছেন।
এন-আর-আই-এর সংজ্ঞা সংক্রান্ত আইনের ঝামেলার মধ্যে না গিয়ে সরাসরি সোজা করে বলা চলে যে, মোটামুটি এন-আর-আই-রা হলেন সফল প্রবাসী ভারতীয়, এঁরা আর্থিকভাবে অত্যন্ত সচ্ছল, এঁদের অনেকেই বিদ্যায়-কীর্তিতে বিদেশে দেশের মুখ উজ্জ্বল করছেন।
ডক্টর উমাকুমার চক্রবর্তীও তাই।
আমরা এই সামান্য কথিকায় প্রথমে তার পূর্ব জীবন যথাসম্ভব সংক্ষিপ্তাকারে স্মরণ করে নিচ্ছি।
উমাকুমারবাবু পুর্ববঙ্গীয় উদ্বাস্তু। তাদের পূর্বনিবাস বরিশাল জেলায়। এখন তার বয়েস সাতচল্লিশ। উনিশশো পঞ্চাশ সালে, সেই ভয়াবহ দাঙ্গার বছরে, বরিশাল শহরের কয়েক মাইল দূরে তাদের গ্রামের বাড়ি পুড়ে ছারখার হয় এবং তার দুই কাকা দাঙ্গাকারীদের হাতে নিহত হন।
উমাকুমারবাবুর বাবা থাকতেন কলকাতায় একটা মেসে, কাজ করতেন সেকালের ক্লাইভ স্ট্রিটের একটা সওদাগরি অফিসে। ঠিক এই সময়েই পরাজিত ক্লাইভ সাহেব ওই ঘিঞ্জি রাস্তাটা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসকে ছেড়ে দিয়ে পাশের গলিতে আশ্রয় নেন।
সে যা হোক উমাকুমারবাবুরা দাঙ্গার পরে সর্বস্বান্ত হয়ে যখন কলকাতায় এসে পৌঁছালেন, তাঁর বাবা মেস ছেড়ে দিয়ে দক্ষিণ কলকাতার শেষ সীমান্তে একটি নবগঠিত উদ্বাস্তু কলোনিতে কোনওরকমে একটা টিনের ঘর তৈরি করে নতুন জীবন শুরু করলেন।
উমাকুমারবাবুর পিতামহের বয়েস তখন প্রায় সত্তর। তবে তিনি বেশ শক্ত-সমর্থ ছিলেন। তিনি গ্রামে মাস্টারি করেননি, তবে নাতি-নাতনিদের খুব যত্ন করে পড়াতেন।
অল্প দিনের মধ্যেই উদ্বাস্তু কলোনির ভিতরে একটি স্কুল গড়ে ওঠে এবং সেখানে উমাকুমারবাবু ভরতি হন।
বলা বাহুল্য উমাকুমারবাবু মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং সেই সঙ্গে ছিল তাঁর পিতামহের সুনজর। শুধু ক্লাসের বার্ষিক পরীক্ষাগুলিতে তিনি ভাল করলেন তাই নয়, বিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষায় স্কুল ফাঁইন্যালে তার বছরে তিনি পঞ্চম স্থান অধিকার করলেন। একটি অখ্যাত উদ্বাস্তু পল্লির নগণ্য একটি নতুন স্কুলের নাম তার দৌলতে খবরের কাগজের প্রথম পাতায় বেরোল।
এসব তথ্য অবশ্য আমাদের এই গল্পের পক্ষে মোটেই জরুরি নয়, বিশেষত হালকা গল্পে এসব তথ্য না দেওয়াই রীতি। কিন্তু এই আখ্যান পাঠান্তে কেউ যেন উমাকুমারবাবুকে হাসির পাত্র মনে না করেন, শুধু সেই জন্যে এতক্ষণ কিছু বাস্তব তথ্য জানানো হল।
এর পরের ইতিহাস একটু সংক্ষেপ করেই বলছি। উমাকুমারবাবু সসম্মানে এবং উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের সঙ্গে কলেজ ও ইউনিভার্সিটির স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পরীক্ষাগুলি উত্তীর্ণ হলেন। তার অধীত বিষয় ছিল উদ্ভিদবিদ্যা। উদ্ভিদবিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষার জন্যে তিনি অবশেষে আমেরিকায় পৌঁছালেন।
কিছুদিনের মধ্যেই কয়েকটি ভারী ডিগ্রি অর্জন করে তিনি ওদেশেই অধ্যাপনা শুরু করলেন এবং এই পেশায় প্রচুর খ্যাতি ও অর্থ উপার্জন করলেন। উমাকুমারবাবু নিজে একজন শিক্ষকের পৌত্র, তিনি এর আগে কখনওই কল্পনা করতে পারেননি যে শিক্ষকতা করে এত অর্থ উপার্জন করা সম্ভব।
বছরের পর বছর দুহাতে লক্ষ লক্ষ ডলার উপার্জন করলেন ডক্টর উমাকুমার চক্রবর্তী। উদ্ভিদবিদ্যার উপান্তে পৌঁছে তার বিষয় হল পরিবেশ বিজ্ঞান। এই পরিবেশের ব্যাপারটা আজকের আধুনিক সভ্য পৃথিবী খুব খাচ্ছে, শুধু খাচ্ছে নয়, বলা চলে গোগ্রাসে গিলছে। উত্তর ক্যারোলিনের ফাঁচাচাও গাছের ফুল ফিকে হলুদ থেকে গাঢ় হলুদ হয়ে যাওয়ায় নিখিল বিশ্বের জীবজগৎ যে গভীর সংকটজনক অবস্থায় পড়ছে কিংবা নিম্নবাংলার বদ্বীপে সুন্দরবনের মোহনায় সুন্দরীগাছের পাতাগুলি যদি শীতের শুরুতে অন্তত একবার ঝরে যায় তাতে কুমিরের ডিম থেকে বাঘের বাচ্চা, এমনকী শেষ পর্যন্ত মানুষের শিশু কতটা লাভবান হবে, এসব বিষয়ে ডক্টর চক্রবর্তীর সাবলীল বিশ্লেষণে যেকোনও অনভিজ্ঞ ব্যক্তিও সব কিছু প্রাঞ্জল বুঝতে পারে।
খ্যাতি ও সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন দেশের নিয়মানুযায়ী ডক্টর চক্রবর্তীর নামটা ছোট হতে লাগল। প্রথমে অত কষ্টের ডক্টর ডিগ্রি বিসর্জন দিতে হল, তারপরে গেল তার কৌমার্য, অর্থাৎ নামের মধ্যপদ, তারপরে আরও ছোট হয়ে তিনি উমা চাকর হয়ে গেলেন। অবশ্য কোনও কোনও ভদ্রজন তাকে উমা চাকর না বলে ডক্টর চাকরও বলতে শুরু করলেন।
কিছুই আপত্তি করেননি আমাদের উমাকুমারবাবু। আপত্তির সময় নয় সেটা। সাফল্যের সোপান ধরে দ্রুত উঠতে উঠতে তিনি সম্মান ও অর্থের সঙ্গে এ সমস্তই নিতান্ত ন্যায্য পাওনা বলে ধরে লাগলেন, তিনি মোটেই কিছু মনে করলেন না।
আটাশ বছর বয়েসে বিদেশে গিয়েছিলেন উমাকুমার। প্রথমবার বছর পাঁচেক পরে দেশে ফিরতে পেরেছিলেন তিনি। এর পরের বার ব্যবধান হল প্রায় আট বছরের। ততদিনে দেশের প্রতি আকর্ষণ কমে গেছে। বাবা-মা দুজনেই মারা গেছেন। ঠাকুরদা অনেক আগেই মারা গিয়েছিলেন। উদ্বাস্তু কলোনির সেই বাড়িও বেহাত হয়ে গিয়েছিল স্বাভাবিক নিয়মেই।
উমাকুমারের ব্যস্ত জীবনে বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি। দেশে থাকতে বিয়ে করার সচ্ছলতা আসেনি। বিদেশে সে সুযোগ আসেনি। তবে তার ব্যস্ত সফল জীবনে নারী-সান্নিধ্যের তেমন অভাব ঘটেনি। ছাত্রী, সহকর্মিণী, বান্ধবী, বন্ধুপত্নী অধিকাংশই মেমসাহেব, ভারতীয় বা বাঙালিও কেউ কেউ ছিল।
অবশেষে যখন ছেচল্লিশ বছর বয়েসে এসে পৌঁছলেন উমাকুমার, তখন তার সব কিছুর উপর বিতৃষ্ণা এসে গেল। ঠিক করলেন আর নয়, এবার সব ছেড়ে-ছুঁড়ে দেশে চলে যাবেন। ইতিমধ্যে উমাকুমার পরিবেশ বিজ্ঞান বিষয়ে বিভিন্ন উচ্চকুলশীল প্রতিষ্ঠানে এবং সভা-সমাবেশে বক্তৃতা করে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন।
বছরখানেক আগে মাসখানেকের জন্যে ছুটিতে দেশে এসেছিলেন তিনি। তার কিছুটা কাটিয়েছিলেন কলকাতায়, বাকিটা দিল্লিতে। দিল্লিতে তাঁর একদম ভাল লাগেনি। সন্ত্রাসবাদীদের অত্যাচারে সর্বদা একটা তটস্থ ভাব। তিনি থাকতে থাকতেই দুজন সন্ত্রাসবাদী মোটর সাইকেলে চড়ে এক পাড়ার মধ্যে ঢুকে স্টেনগান চালিয়ে নির্বিচারে নিরীহ লোকদের হত্যা করে। নিউইয়র্কে কিংবা লস এঞ্জেলসে বসে এসব খবর শুনে উত্তেজিত হওয়া যায়, বিতর্ক করা যায়, কিন্তু একেবারে পাশের পাড়ায় এমন ঘটলে খুবই বিড়ম্বনা এবং আতঙ্কের ব্যাপার।
সেই তুলনায় বহু-নিন্দিত কলকাতা ভাল। কিন্তু তার যানবাহন, রাস্তাঘাট, কুখ্যাত লোডশেডিং আর সেই সঙ্গে ডক্টর উমাকুমার চক্রবর্তীর অনাবাসী ভারতীয় অভ্যেসসমূহ বাদ সেধেছিল।
কিন্তু তবুও উমাকুমার নানা দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন, প্রবাসে যে নিঃসঙ্গ জীবন তার চেয়ে কলকাতায় কষ্টে থাকা ভাল। সব চেয়ে বড় কথা, জনমদুখিনী মাতৃভূমির প্রতি কিছু কর্তব্য পালন করার জন্যে, যেমন এসব ক্ষেত্রে হয়, উমাকুমারবাবুর মনে আদর্শবোধ জাগ্রত হল। এই সঙ্গে আর একটা কথাও বিশেষ বিবেচ্য ছিল তার কাছে, সেটা হল যে পরিবেশের ব্যাপারে তৃতীয় পৃথিবীর এই অর্ধসভ্য দেশের লোকদের সচেতন করার দায়িত্বও তার যথেষ্ট রয়েছে। টরেন্টো, ওয়াশিংটন অথবা ব্রাসেলসের সাদা চামড়ার লোকদের পরিবেশ-বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তার নিজের দেশের লোকেদের ব্যাপারটা বোঝানো।
এই যে গাছের পর গাছ কাটা হচ্ছে, বছরের পর বছর খরা হচ্ছে, এই যে কুমিরেরা আর ডিম পাড়ছে না, ব্যাঙ আর বানর সাপ হয়ে যাচ্ছে, ধানখেতে পোকামাকড় নেই, এসবের কারণ ও ফলাফল, অনিবার্য মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কে সকলকে সচেতন করার গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিলেন উমাকুমার। তিনি ঠিক করলেন পাকাপাকিভাবে কলকাতায় এসে বাস করবেন আর গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-শহরে পরিবেশ নিয়ে বক্তৃতা করে এই হতভাগ্য দেশের মানুষদের পরিবেশপরায়ণ করে তুলবেন।
এন-আর-আই জীবনে রীতিমতো ঘেন্না ধরে গিয়েছিল উমাকুমারের। কিন্তু একটা অসুবিধে হয়েছে এই আঠারো বছর প্রায় এক নাগাড়ে বিদেশে থেকে, নানারকম খারাপ-ভাল অভ্যেস তৈরি হয়েছে তার। এখন গরম একদম সহ্য হয় না, মশা কামড়ালে চিৎকার করে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করে, সরষেবাটা সজনেড়াটা চচ্চড়ি চিবোতে বিরক্ত লাগে। রসগোল্লার রস হাতে লেগে থাকলে হাত চটপট করে।
এসব অসুবিধার কথা খুব একটা তোয়াক্কা না করে থিয়েটার রোডের পাশের একটা গলিতে এক বহুতল বাড়িতে একটা ভাল ফ্ল্যাট কিনে ফেললেন উমাকুমার। এয়ার কন্ডিশনার ইনভার্টার ইত্যাদি লাগিয়ে যতটা আরামদায়ক করা যায় বাসস্থান তা করলেন। টাকার অভাব নেই তার। বিদেশ ছেড়ে চলে আসার সময় ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি ছোট বাড়ি আর লাখখানেক ডলারের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ছাড়া আর যা কিছু ছিল তার খানিকটা বেচে, কিছুটা দান করে বা উপহার দিয়েই সেই সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণ নগদ টাকাপয়সা এবং তার নিজস্ব কিছু মার্কিনি গ্যাজেট, ফ্রিজ ইত্যাদি নিয়ে তিনি কলকাতায় চলে এলেন।
শুল্ক বিভাগের সঙ্গে প্রভূত লড়াই করে এবং বহু টাকা ডিউটি দিয়ে এসব দামি সাহেবি জিনিস বহুকষ্টে উদ্ধারও করলেন। এতে লাভক্ষতি যাই হোক, তিনি একসঙ্গে অনাবাসী বিলাস এবং আবাসী আনন্দ অর্জন করতে সমর্থ হলেন।
এসব তেমন কঠিন কঠিন ব্যাপার নয় শেষ পর্যন্ত। একটু লেগে থাকলে হয়ে যায়। সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার হল সেটা, যে-উদ্দেশ্যে তিনি এদেশে ফিরে এসেছেন। উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট, বক্তৃতা করা।
নির্দিষ্টভাবে বলা যায়, পরিবেশ সম্পর্কে বক্তৃতা করা। কিন্তু ডক্টর উমাকুমার খেয়াল করেননি যে তাঁর মাতৃভূমিতে আর যা কিছুর অভাব থাক বক্তার কোনও অভাব নেই।
যেকোনও বিষয়ে যেকোনও স্থানে যেকোনও সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনর্গল বলে যেতে পারে, এমন ব্যক্তির সংখ্যা এদেশে অগুন্তি। দেখে বোঝার উপায় নেই, সভামঞ্চের একপ্রান্তে নড়বড়ে। ফোলডিং চেয়ারে যে-বুড়ো আগাগোড়া ঝিমোচ্ছেন, সভাপতি তাঁর নাম ডাকামাত্র তিনি তোক করে লাফিয়ে উঠে অনায়াসে আড়াই ঘণ্টা বলে যেতে পারেন। আলোচ্য বিষয়ের মূলে না গিয়েও এই রকম মহতি সভায় বক্তৃতা করার সুযোগ পেয়ে এই বৃদ্ধ যে ধন্য হয়েছেন এবং তিনি শ্রোতাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না এবং পূর্ববর্তী বক্তারা যা কিছু বলার সবই বলে দিয়েছেন, এই তিনটি পয়েন্টে তিনি একঘণ্টা করে তিন ঘণ্টা বলতে পারেন, শুধু তার অসুস্থ শরীর বলে আধঘণ্টা কমিয়ে আড়াই ঘণ্টা বলেন।
সে যা হোক, উমাকুমারবাবুর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ধীরে ধীরে যোগাযোগ হতে লাগল। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সমিতি আছে যেগুলির শাখা বিভিন্ন জায়গায় ছোটবড় শহরে ছড়িয়ে আছে। এদের সভ্যবৃন্দ সপ্তাহে সপ্তাহে গুরুগম্ভীর সভা করে জ্ঞানীগুণীদের বক্তৃতা শুনতে ভালবাসেন। ক্রমশ চেনাজানা এর-ওর মাধ্যমে উমাকুমার এই জাতীয় দু-একটি সমিতিতে ভিড়ে গেলেন। দু-এক জায়গায় বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগও জুটে গেল।
বলা বাহুল্য, উমাকুমারের বক্তৃতার বিষয়গুলি যথেষ্টই আকর্ষণীয়। শ্যামবাজার ট্রামডিলোর মধ্যে বহুদিন আগে একটা কাঠবাদাম গাছ ছিল, এখন আর নেই। এ বিষয়ে উমাকুমারের মর্মস্পর্শী বক্তৃতা, শ্যামবাজারের শেষ বাদামগাছ যেকোনও শ্রোতার মনে কৌতূহল সৃষ্টি করতে বাধ্য।
কলকাতার চিরঅবহেলিত রাস্তার কুকুরদের সম্পর্কে তার মনোজ্ঞ আবেদন, নেড়ি কুকুরদেরও দরকার আছে অথবা অসামান্য কবিত্বময় তার উদ্ভিদ-চিন্তা পরের জন্ম যদি থাকে, সেই জন্মে যেন বনতুলসীর জঙ্গল হয়ে জন্মগ্রহণ করি–এই রকম সব বিষয়ের প্রতি সাধারণ মানুষের যথেষ্টই প্রাণের টান আছে, উমাকুমারের এটা ধরতে বিশেষ দেরি হয়নি।
কিন্তু প্রথমদিকে সবচেয়ে হৃদয়গ্রাহী হয়েছিল উমাকুমারের যে আলোচনাটি, তার নামটি একটু দীর্ঘ, কিন্তু বড় ভাল– নিজের ঘরে নিজের জানলা, নিজের জানলায় নিজের টব, নিজের টবে নিজের গাছ, নিজের গাছে নিজের ফুল গন্ধরাজ, বেল কিংবা শেফালি, বকুল।
ব্যাপারটা কিছুদিনের মধ্যেই বেশ জমে উঠল। লোকজন খবর নিতে লাগল, কে এই ডক্টর। উমাকুমার চক্রবর্তী? কম-বেশি নিমন্ত্রণ আসতে লাগল এদিক ওদিক, এ-শহর ও-শহর থেকে।
অতঃপর বক্তৃতাসাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে উদ্যোগী হলেন ডক্টর চক্রবর্তী। ব্যাপারটাকে সম্মানজনক পর্যায়ে রাখতে হবে, এবং তার প্রথম ধাপ হল সুন্দরী, সুশ্রী, শিক্ষিতা ও বুদ্ধিমতী ব্যক্তিগত সহায়িকা বা পার্সোনাল অ্যাসিস্টান্ট নিয়োগ করা।
নিজের চিঠি নিজেই উত্তর দেওয়া, বাইরের কেউ এলে তার সঙ্গে নিজেই দেখা করা বা কথাবার্তা বলা একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বুদ্ধিজীবীর পক্ষে মোটেই সম্মানজনক নয়। সুতরাং একজন পার্সোনাল অ্যাসিস্টান্ট চাই, সবচেয়ে ভাল হয় যদি তাকে বলা হয় প্রাইভেট সেক্রেটারি, তাতে আভিজাত্য আসে এবং সেই সঙ্গে সেই সেক্রেটারি যদি সুন্দরী বিদুষী হয়, তবে তো কথাই নেই।
ডক্টর চক্রবর্তী অনেক ভেবে-চিন্তে একটি খবরের কাগজে রবিবাসরীয় কলমে বিজ্ঞাপন দিলেন।
অনাবাসী বুদ্ধিজীবীর জন্য সপ্রতিভা, সুশিক্ষিতা সুন্দরী মহিলা আবশ্যক। বেতন যোগ্যতানুযায়ী। ফটোসহ আবেদন করুন।
বিজ্ঞাপনটি খবরের কাগজে পাঠিয়ে দিয়ে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন উমাকুমার। আজকাল রবিবারের পাতায় বিজ্ঞাপন ছাপা হতে বেশ সময় লাগে। সে হতেই পারে। কিন্তু কোনও এক রবিবার খুব সকালে হট্টগোলে, চিৎকার-চেঁচামেচিতে, বামাকণ্ঠের কলহে ও আর্তনাদে ঘুম থেকে ধড়মড় করে জেগে উঠলেন ডক্টর চক্রবর্তী। তাড়াতাড়ি জানলার পর্দা সরিয়ে তার পাঁচতলার ফ্ল্যাটের ওপর থেকে নীচে তাকিয়ে দেখলেন বিশাল ভিড়, সামনের রাস্তায় শুধু মহিলা আর মহিলা।
উমাকুমার বিজ্ঞাপনে নির্দেশ দিয়েছিলেন সপ্রতিভা, সুশিক্ষিতা, সুন্দরী, তিনি বিস্মিত হয়ে প্রচুর পরিমাণ সপ্রতিভা মহিলা দেখতে পেলেন, কিন্তু তারা সুশিক্ষিতা অথবা সুন্দরী কিনা এত উঁচু থেকে ধরতে পারলেন না। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই অনুধাবন করতে পারলেন, হয়তো, হয়তো কেন নিশ্চয়, এই মহিলারা তার সেই সরল বিজ্ঞাপন দেখেই এসেছেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আদিম আত্মরক্ষার প্রেরণায় উমাকুমার ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে তার আগে যত দ্রুত সম্ভব প্রাতঃকৃত্যাদি সেরে পেছনের লিফট দিয়ে নেমে সোজা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের আপাতত ঘূর্ণায়মতী কালোপরীর ছায়ায় আশ্রয় নিলেন।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মাঠের মধ্যেই একটা রেস্টুরেন্ট আছে। সেখানে সামান্য চা-জলখাবার খেয়ে দশটা নাগাদ ফ্ল্যাটের দিকে ফিরে এসে দেখলেন ভিড় একটু হালকা হয়ে এসেছে। তবে তখনও মহিলার সংখ্যা যথেষ্ট। এবং তাদের কারও কারও চেহারা দেখে সুন্দরী বা সপ্রতিভা মনে না হলেও যথেষ্টই বিপজ্জনক মনে হচ্ছে। সুখের কথা, এঁরা কেউই তাঁকে চেনেন না এবং সেই সুযোগে অবস্থাটা একটু বুঝে উঠেই ফ্ল্যাটের মধ্যে না গিয়ে উমাকুমার আবার গা-ঢাকা দিলেন।
দুপুরে হোটেলে খেয়ে, বিকেলে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে বার কয়েক চক্কর দিয়ে অবশেষে নাইট শোয়ে সিনেমা দেখে খুব সন্তর্পণে বাড়ি ফিরলেন উমাকুমার। অত রাত পর্যন্ত কারও অপেক্ষা করার কথা নয়, তবু খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন তিনি।
সে যা হোক, লিফটের কাছে নিজের ডাকবাক্সে দেখলেন গাদা গাদা দরখাস্ত পড়ে রয়েছে। তার অনেকগুলির সঙ্গেই সাটিফিকেট এবং ফটো যুক্ত। পাঁচতলায় ফ্ল্যাটে ঢুকতে গিয়ে দেখলেন সেখানেও দরজার ফাঁক দিয়ে বহু সচিত্র এবং স-সার্টিফিকেট আবেদনপত্র গাদা করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মোটামুটি গোনাগুনতি করে মনে হল, অন্তত দুশো-আড়াইশো দরখাস্ত নিশ্চয়ই হবে। এর মধ্যে যেগুলির সঙ্গে ছবি আছে সেগুলি আলাদা করে বাছাই করলেন উমাকুমার। তারও সংখ্যা প্রায় ষাটটা হবে।
সেদিন বিনিদ্র রজনী যাপন করলেন কুমার উমাকুমার। অনেক রকম দেখেশুনে বিবেচনা করে অবশেষে ভোর চারটে নাগাদ মোটমাট সাতজনকে বাছাই করলেন তিনি, যাদের লেখাপড়া ভাল, দেখতে ভাল, তা ছাড়া ছবি দেখে স্মার্ট মনে হয়, বাংলায় যাকে বলে সপ্রতিভা। তবে এর পর এই সাতজনের নাম-ঠিকানা, কাছে থাকে না দূরে থাকে, জাতধর্ম কী ইত্যাদি বিবেচনা করতে গিয়ে শুধুমাত্র একটা দরখাস্তেই আবদ্ধ হয়ে গেলেন উমাকুমার। কারণ আর কিছুই নয়, দরখাস্তকারিণীর তারই নামে নাম, শ্রীমতী উমা চক্রবর্তী।
তখন প্রভাত-সূর্যের রঙিন রশ্মিীমালা পাঁচতলার পূর্বমুখী ফ্ল্যাটের জানলা দিয়ে ডক্টর উমাকুমার চক্রবর্তীর পড়ার টেবিলে এসে পড়েছে। তারপর ভোরের সোনালি আলোয় শ্রীমতী উমা চক্রবর্তীর ছবিটা ভাল করে দেখতে লাগলেন। লোকে যাকে কনে-দেখানো-আলো বলে এটা ঠিক সেরকম আলো নয়, কিন্তু অনেকটা তার কাছাকাছি। শুধু কাছাকাছি নয় বরং বলা চলে আরও মনোরম।
শ্রীমতী উমার চেহারা ভাল, লেখাপড়া ভাল। শ্রীমতী উমাকেই উমাকুমারের পছন্দ হল। তবে নিজের মনে পছন্দ শব্দটা নিয়ে উমাকুমার কিঞ্চিৎ বিব্রত ও লজ্জিত বোধ করলেন। লোকে পাত্রী পছন্দ করে, প্রাইভেট সেক্রেটারি সম্পর্কে এ শব্দটা খাটে না, এ বিষয়ে কী একটা শব্দ আছে, উমাকুমারের কিছুতেই মনে এল না।
সে যা হোক, শেষ পর্যন্ত স্বনামধারিণীকেই নিয়োগপত্র পাঠালেন তিনি। যথাসময়ে মেয়েটি এল এবং তাকে দেখে, ফটো দেখে যতটা মুগ্ধ হয়েছিলেন ততটাই চমকিত হলেন তিনি।
ছবির সঙ্গে কিছুই মিলছে না। সেই ডাগর-ডোগর আঁখি, পাতলা ঠোঁট, উড়ুউড়ু চুল কিছুই মিলছে না। প্রথম দর্শনেই এ কথা উমাকে জানালেন উমাকুমার, আরও বললেন, এটা জোচ্চুরি, রীতিমতো জোচ্চুরি।
ফটোর চেহারার মতো দেখতে না হলেও ঊনপঁচিশ, কালো চোখের ঝকঝকে মণি, মোটা ঠোঁট, শ্যামলা রঙের এই মেয়েটিও তুচ্ছ নয়। সে চোখ নাচিয়ে বলল, জোচ্চুরি আবার কী, আমি তো ইয়ার্কি করেছি, আপনি বুঝতে পারেননি?
উমাকুমার বিব্রত বোধ করলেন, বললেন, কীসের ইয়ার্কি? কী বুঝতে পারব?
উমা বলল, ও ছবিটা কার? ভাল করে দেখুন? সন্ত্রস্তভাবে ভাল করে দেখেও উমাকুমার কিছু বুঝতে পারলেন না। তখন মেয়েটিও খুব ঘাবড়িয়ে গেল, বলল, সত্যি আপনি এই ছবি আগে দেখেননি!
যখন উমাকুমার অকপটে স্বীকার করলেন সত্যিই তিনি এই ছবিরানিকে চেনেন না, উমা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে, তারপর বলল, স্যার, পায়ের ধুলো দিন।
দীর্ঘদিন মার্কিন দেশে বসবাস করে পায়ের ধুলোর ব্যাপারটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন উমাকুমার, ফলে আজ এই ফাজিল মেয়েটির অনুরোধ রক্ষা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হল না।
আসলে এই মেয়েটি নিজের ফটো না পাঠিয়ে সিনেমার কাগজ থেকে এক নায়িকার পাসপোর্ট সাইজের রঙিন ছবি কেটে নিজের দরখাস্তের সঙ্গে লাগিয়ে পাঠিয়েছিল। সে নিতান্তই খেলাচ্ছলে দরখাস্তটি পাঠায়, ধরেই নিয়েছিল চাকরি হবে না, তা না হোক, এই অনাবাসীর সঙ্গে একটু ইয়ার্কি করতে দোষ কী? দোষ নেই কিছু, কিন্তু এই অনাবাসী যে সিনেমা তারকার হৃদয়স্পন্দনকারী ফটো দেখেও ঠাট্টাটা ধরতে পারবেন না, তার কারণ তিনি দীর্ঘ দশ বছর কোনও দিশি ছবি দেখেননি, এটা শ্ৰীমতী উমা বুঝে উঠতে পারেনি। তার মুখে বিস্তৃত ব্যাখ্যা শুনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। উমাকুমার।
এবার মেয়েটি উঠল, উঠে হাসিমুখে বলল, সরি! সত্যিই আমি দুঃখিত। আমি যাচ্ছি। আপনার অসুবিধে করার জন্যে ক্ষমা চাচ্ছি।
মেয়েটির চলে যাওয়া দেখে, কী ভেবে উমাকুমার বললেন, কোথায় যাচ্ছ? তোমাকে তো আমি অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছি?
উমা হাসিমুখে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, অ্যাপয়েন্টমেন্ট! আমার চাকরি এখনও আছে?
উমাকুমার বললেন, অবশ্যই আছে।
কাজে বহাল হয়ে গেল উমা। উমাকুমারের টেলিফোন ধরে, চিঠির উত্তর টাইপ করে, বক্তৃতার বয়ান লেখে। প্রয়োজনে রান্নাঘরে ঢুকে দু পেয়ালা চা বানিয়ে নিয়ে এক পেয়ালা খায়, এক পেয়ালা উমাকুমারকে দেয়। উমাকুমার যখন কোথাও বক্তৃতা করতে যান, সেও তার সঙ্গে যায়। উমাকুমার গাড়ি চালায়, সে পাশের সিটে বসে থাকে। উমাকুমার যখন বক্তৃতা করেন, উমা সামনে বসে নোট রাখে।
এরই মধ্যে একদিন একটা গণ্ডগোল হল। কলকাতার কাছাকাছি একটা অভিজাত সমাজসেবী প্রতিষ্ঠান থেকে একটা বক্তৃতার আমন্ত্রণ এল উমাকুমারের কাছে, বিষয়, আজকাল বাঁশগাছ আর তত লম্বা হচ্ছে না কেন? বিষয়টি মোটেই নতুন নয়, বরং বেশ পুরনো। কিন্তু বিষয়টি উমাকুমারের খুব প্রিয়। আমেরিকায় ওকবৃক্ষের ক্রমহ্রাস্বত্ব-প্রাপ্তি বিষয়ে তাঁর বক্তব্য গত বছরেই সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তা ছাড়া ঠিক এই একই বিষয়ে তিনি এখন একজন প্রায় স্পেশালিস্ট, ইতিমধ্যে অন্তত আরও দশ জায়গায় বাঁশগাছের এই অধধাগতি বিষয়ে তিনি বক্তৃতা করে এসেছেন। এ বিষয়ে এ দেশেও তার খ্যাতি বেশ ছড়িয়ে পড়েছে।
কিন্তু মুশকিল হয়েছে অন্যখানে। এবারের নিমন্ত্রণ একটা অন্য ধরনের গণ্ডগোল। বক্তৃতানুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা একটি মারাত্মক ভুল করেছেন। তাঁরা চিঠিতে ডক্টর উমাকুমার চক্রবর্তীকে শ্রীমতী উমা চক্রবর্তী বলে সম্বোধন করেছেন। কী রকম যেন খটকা লাগল ডক্টরের, তিনি উমাকে বললেন, শ্রীমতী বলে লিখেছেন, মনে হচ্ছে এটা তোমাকেই বক্তৃতা করতে ডেকেছে। আমাকে নয়।
উমা বলল, তা হতে পারে না। আমাকে কেন বক্তৃতা করতে ডাকবে? ওরা আপনাকেই ডেকেছে। ভুল করে আপনাকে মহিলা ভেবেছে।তারপর একটু থেমে থেকে বলল, তবে আপনার এই বাঁশগাছের বক্তৃতাটা এতবার শুনেছি আর নোট নিয়েছি যে আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। আপনি যদি বলেন আমিও গিয়ে বক্তৃতাটি করে আসতে পারি।
সামান্য ভাবলেন উমাকুমার, তারপর ঠিক করলেন, ঠিক আছে, একটু মজা করাই যাক না, আর মেয়েটা কেমন বলে সেটাও দেখা যাবে।
নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট স্থানে উমাকে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেলেন। উমা গটগট করে নেমে মঞ্চেও উঠে একঘণ্টা ঝড়ের মতো বলে গেল পরিবেশ দূষণের ফলে কী করে বাঁশগাছ ছোট হয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ, এতে কী ক্ষতি হচ্ছে পৃথিবীর, মানবসমাজের, জীবজগতের এবং এর প্রতিকারই বা কী?
শ্রোতারা, শুধু শ্রোতারাই বা কেন, ডক্টর উমাকুমার চক্রবর্তীও মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলেন সেই বক্তৃতা। এরপর যখন সভাকক্ষ থেকে পণ্ডিত শ্রোতারা একে একে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নানা প্রশ্ন করতে লাগলেন শ্রীমতী বক্তাকে, উমাকুমার একটু চিন্তিত হলেন, এসব কঠিন প্রশ্নের উত্তর কী করে দেবে মেয়েটা?
কিন্তু উমাকে তখনও তার সঠিক পরিমাপ করা হয়নি। প্রশ্নগুলো শোনামাত্র উমা মঞ্চ থেকে নামতে নামতে বলল, এসব অতি সাধারণ প্রশ্নের আমি আর কী উত্তর দেব? আমার ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করুন সেই সব বলতে পারবে, বলে সে ইঙ্গিতে উমাকুমারকে দেখিয়ে দিল। আইনস্টাইনকে জড়িয়ে এ ধরনের একটা গল্প উমাকুমার আগে কোথায় যেন পড়েছিলেন, এখন উমার কথা শুনে তাজ্জব হয়ে গেলেন।
এ গল্প আর বেশি টেনে নিয়ে লাভ নেই। যাঁরা যা বোঝার, সবাই বুঝতে পেরেছেন। শুধু শুধু কালি কাগজ অপচয় করে কী হবে?
শুধু একটা কথা, এদেশের হাওয়া, ভেজাল সরষের তেল, রোদ, মশা ডক্টর উমাকুমারের আর সহ্য হচ্ছে না। তিনি আমেরিকায় ফিরে যাচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে তার সুযোগ্য সহকারিণী শ্রীমতী উমা চক্রবর্তীও যাচ্ছেন।
কণ্টকাকীর্ণ
যথা সময়েই পৌঁছানো গেল। আমার বন্ধু সমীরের কাকার শ্রাদ্ধবাসর। আশা করেছিলাম বন্ধুবান্ধব অন্যান্য অনেকেই হয়তো আসবেন। কিন্তু গিয়ে দেখলাম আমি একা, আর সবই সমীরদের আত্মীয়স্বজন এবং পারিবারিক বন্ধুবান্ধব। একা একাই চুপচাপ বসেছিলাম, এমন সময় সমীর এসে আমার পাশে বসল।
বাইরের ঘরের পাশে একটা প্যাসেজের মধ্যে বসে আছি। একে একে অতিথি-অভ্যাগত সব প্রবেশ করছেন। সমীর পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে–ইনি আমার মেজো মেলোমশাই, ইনি আমার রাঙাদির দেওর। ইত্যাদি ইত্যাদি। আমিও সময়োচিত গাম্ভীর্যসহকারে ভদ্রতা বিনিময় করছি। এর মধ্যে একজন মধ্যবয়সি ভদ্রলোক প্রবেশ করলেন, সুসজ্জিত অবয়ব। কিন্তু সমীর তার পরিচয় দিতেই আঁতকে প্রায় চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলাম, ইনি আমার যে কাকা মারা গেছেন, আজ যাঁর শ্রাদ্ধ…ইতিমধ্যে ভদ্রলোক আমাদের সামনে এসেছেন। আমি ইতস্তত করতে করতে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আপনার সঙ্গে দেখা হবে আশা করিনি।
ভদ্রলোক বিগলিত হাস্যে জানালেন, হ্যাঁ, আমি একটু দূরে থাকি আজকাল, তার উপরে, আসা-যাওয়ারও অসুবিধা।
ভদ্রলোক ভেতরের দিকে চলে গেলেন। আমি সমীরকে বললাম, আমি চলি ভাই। যাঁর শ্রাদ্ধে এসেছি তার সঙ্গে দেখা হবে এরকম আশা করতে পারা যায় না। এইবার সমীর বলল, আরে, না শুনুন, ইনি হচ্ছেন আমার যে কাকা মারা গেছেন…
আমি বাধা দিয়ে বলি, আমিও সেই জন্যেই বলছিলাম।
এইবার সমীর বাক্য সম্পূর্ণ করে, আরে ইনি হচ্ছেন যে কাকা মারা গেছেন, যাঁর শ্রাদ্ধ তার বন্ধু।
অতঃপর আশ্বস্ত হওয়া গেল। সমীর ইতিমধ্যে আমাকে খুব নিচু চাপা গলায় ফিসফিস করে জানাল যে, এই ভদ্রলোক একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি–কোনও এক বিখ্যাত গন্ধতৈল ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের একমাত্র স্বত্বাধিকারী, থিয়েটার রোডে বিশাল বাড়ি এবং তার অন্যান্য ঐহিক গৌরব সম্বন্ধে বহু বিষয়ও আমাকে অবগত হতে হল।
খাওয়ার ডাক পড়ল। এবং সৌভাগ্যবশত আমি ঠিক সেই ভদ্রলোকের পাশেই বসলাম। খেতে খেতে একটা জিনিস দেখে ক্রমশই বিচলিত হচ্ছিলাম। সত্যি কথা বলতে কি, ভদ্রলোক বড় বেশি গলাধঃকরণ করছিলেন। একে ঠিক খাওয়া বলা সম্ভব নয়, কোনও ধনবান ব্যক্তি যে এরকম গোগ্রাসে খেতে পারেন আমার ধারণায় ছিল না। এবং শেষে সেই সর্বনাশ ঘটল। আমি গুনে যাচ্ছিলাম, ষোড়শ অথবা সপ্তদশ মৎস্য খন্ডটি গিলতে গিয়ে ভদ্রলোকের গলায় কাঁটা ফুটল। এতক্ষণ কাটা যে কেন ফোটেনি সেটাই আশ্চর্য। গলায় না ফুটলেও তার পাকস্থলীতে অন্তত শতাধিক কাটা ইতিমধ্যে সমবেত হয়েছিল সে বিষয়ে আমি এবং হয়তো আরও অনেকেই নিঃসন্দেহ ছিল। সুতরাং যখন তিনি ঘোষণা করলেন যে তার গলায় একটা কাটা ফুটেছে, তখন আমরা কেউই বিশেষ আশ্চর্য হলাম না, বরং কেউ কেউ যেন এই ভেবে আশ্বস্ত হলেন যে, এইবার খাওয়ার বহর একটু কমবে।
কিন্তু কার্যকালে দেখা গেল, ফলাফল অন্য আকার ধারণ করেছে। ভদ্রলোক–ইতিমধ্যে জানা গিয়েছিল যে, ভদ্রলোকের নাম শচীবিলাসবাবু, ভয়ংকর হাঁস-ফাস শুরু করে দিলেন। তখন আমি ভদ্রলোককে বললাম, দেখুন, আমি খুব তাড়াতাড়ি খাই, আমার মধ্যে মধ্যেই গলায় কাঁটা ফোটে ও কিছু হয় না।
শচীবিলাসবাবু একবার গম্ভীর হয়ে আমার দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করলেন তারপর কঠিন কণ্ঠে বললেন সকলের জীবনের দাম সমান নয়। সত্যিই এর পরে আমার আর কিছু বলার থাকে না।
একজন পরামর্শ দিলেন শুকনো সাদা ভাত গিলে খেলে কাটা নেমে যেতে পারে। সাদা ভাত আনতে বলা হল। শচীবিলাসবাবু পর পর বড় লোহার হাতার চার হাতা সাদা ভাত গিলে ফেললেন। কিন্তু তাঁর মুখে-চোখে স্পষ্টই দেখা গেল তার কাটা তখনও রয়েছে। এবার একজন পরামর্শ দিলেন আস্ত কলা গিলে খেলে হয়তো একটা সুরাহা হতে পারে। বাড়িতে অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য সুলভ হলেও কলা নেই। নিকটবর্তী বাজার তখন প্রায় বন্ধ, তবুও অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে একটা ফলের দোকান খোলানো গেল, কিন্তু দোকানদার কিছুতেই দুজনের কম কলা এতরাত্রে বেচতে নারাজ। যে কিনতে গিয়েছিল সে বাধ্য হয়ে তাই-ই কিনে আনল। সবগুলি কলাই শচীবিলাসবাবুর কাজে লাগল, কিন্তু ফল হল না,ন যযৌ ন তস্থৌ, কাঁটা স্থির। রসগোল্লার রস ফেলে শুকনো শুকনো ছিবড়ে খেলে বোধহয় উপশম হতে পারে–এবার শচীবিলাসবাবু নিজেই বাতলালেন। অনুরূপ প্রক্রিয়ায় রসগোল্লা গ্রহণ করা চলল, না গুনিনি–গোনা সম্ভব ছিল না, প্রয়োজনও ছিল না। কেননা আমাদের বাকি অন্যান্যদের জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না, কিন্তু কাটাটি শচীবিলাসবাবুর গলায় তখনও বিধে রয়েছে। না, না এখনও খচখচ করছে। তার কাতরোক্তি অনবরত প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।
সকলেই অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। নমো নমো করে কোনওরকমে খাওয়া শেষ করা গেল। ভাবলাম, যাক এ যাত্রা কোনওক্রমে রক্ষা পাওয়া গেল। কিন্তু শচীবিলাসবাবুর মুখচোখ দেখে চিন্তান্বিত হতে হল। শীতের রাত্রি, ডিসেম্বরের শেষাশেষি প্রবল ঠান্ডা পড়েছে। আমি খেয়ে উঠে ঠান্ডা জলে হাত ধুয়ে শীতে কাঁপছিলাম অথচ শচীবিলাসবাবুর চোখ দেখলাম গোল হয়ে গেছে, তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামও দেখলাম। আমি তখন বাধ্য হয়েই বললাম, একজন ডাক্তারের কাছে গেলে হয় না?
গেলে হয় কী, চলো। শচীবিলাসবাবু ককিয়ে ককিয়ে আদেশ করলেন। আমি সমীরকে বললাম, চলো, দেখা যাক।
শচীবিলাসবাবুর গাড়িতে উঠতে উঠতে শচীবিলাসবাবু বললেন, হ্যারিসের কাছে গেলে হত। হ্যারিস পার্ক স্ট্রিটে বিখ্যাত কর্ণ-কণ্ঠ-নাসিকা বিশেষজ্ঞ। হ্যারিসকে আমিও অল্প অল্প জানি। রাত এগারোটা বেজে গেছে। রাত নটার পর তার কাছে কেউ ভীষণ বিপদে পড়লেও যায় না, পাঁড়মাতাল, বিশেষ করে এই এগারোটা নাগাদ নেশাটা চরমে ওঠে, এখন গলার কাঁটা বার করতে গলা কেটেও ফেলতে পারে। আমি বিশেষ ভরসা পেলাম না। আমি ব্যাপারটা শচীবিলাসবাবুকে একটু সংক্ষেপে বললাম।
শচীবিলাসবাবু বললেন, তা হলে?
তা হলে একটা হাসপাতালে গেলে হয়। সমীর বিনীতভাবে জানাল।
হাসপাতালে…–ভীষণ রকম আঁতকে উঠলেন শচীবিলাসবাবু। যেন তাকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত গত্যন্তর না দেখে তিনি হাসপাতালে যেতেই রাজি হলেন।
গাড়ি চলেছে। শীতের কনকনে হাওয়া। শচীবিলাসবাবু আমাদের দুজনের মধ্যে বসে। একপাশে সমীর, আর একপাশে আমি। গলার ব্যথায় অল্প অল্প কাতরাচ্ছেন। কিন্তু এরই মধ্যে দেখলাম তার বৈষয়িক বুদ্ধি যথেষ্টই প্রখর। আমার সৌভাগ্যবশত আমি শচীবিলাসবাবু যে তৈলব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক সেই তেলটি ব্যবহার করে থাকি। শচীবিলাসবাবু এর মধ্যে একবার আমার মাথা, একবার সমীরের মাথা গুঁকে বললেন, এ ছেলেটি তো বেশ ভাল, আমাদের তেল মাখে। সমীর, তুমি আমাদের তেল মাখো না কেন?
সমীর আমতা আমতা করতে করতে বলল। মাখি, মাখি, কিন্তু আমার মাথা এরকম যে… আমার মাথায় গন্ধ বেরোয় না। শচীবিলাসবাবু এই দুর্দশার মধ্যেও বিচলিত বোধ করলেন এই উক্তিতে। আমি সমীরের এ ধরনের উক্তির সঙ্গে পরিচিত, তবুও হেসে ফেললাম।
গাড়ি হাসপাতালের সামনে এসে গেল। তিনজনে নামলাম। হাসপাতালে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের বারান্দায় গিয়ে উঠলাম। একজন লোক বসে ঝিমুচ্ছিল, আমাদের দেখেই উঠে বসে জিজ্ঞেস করল, কার গলায় কাঁটা ফুটেছে? প্রায় হকচকিয়ে গেলাম লোকটির এই গোয়েন্দাদর্শিতা দেখে। অবশ্য পরে বুঝেছিলাম ব্যাপারটা, ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে এত রাত্রে পরিষ্কার জামাকাপড় পরে জনকয়েক লোক এসে উপস্থিত হলে এদের পুরানো অভিজ্ঞতা থেকেই এরা বুঝতে পারে আসল ঘটনা, কোনও নিমন্ত্রণ বাড়ি থেকে সোজা এতরাত্রে চলে এসেছে। হামেশা এরকম ঘটছে, রোজ রাত্তিরেই এত বড় শহরে কোনও-না-কোনও নিমন্ত্রণ বাড়িতে কারও কারও গলায় কাঁটা ফুটেছে।
যা হোক, লোকটি ভেতরে গিয়ে ডাক্তারকে খবর দিল। একেবারেই তরুণ ডাক্তার। শীতের রাত্রিতে লাল সোয়েটার গায়ে দিয়ে পিছনের একটা কম্পাউন্ডে ব্যাডমিন্টন খেলছিলেন। এত সামান্য ব্যাপারে খেলায় বাধা পড়ায় বেশ একটু রাগতভাবেই প্রবেশ করলেন বলে বোধ হল। অল্প একটু কথা বলে শচীবিলাসবাবুর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বললেন, আসুন আমার সঙ্গে। ভেতরের একটা ঘরে নিয়ে গেলেন আর আমাদের পর্দার বাইরে দাঁড়াতে বললেন।
আমি আর সমীর দুজনে বাইরে দাঁড়িয়ে তাদের কথোপকথন অনুসরণ করতে লাগলাম। শচীবিলাসবাবুর কণ্ঠ কিঞ্চিৎ ক্ষীণ, সব সময় শোনা যাচ্ছিল না, আর ডাক্তারের প্রশ্ন উগ্র থেকে উগ্রতর হচ্ছিল–কটা মাছ খেয়েছিলেন? চল্লিশ, ত্রিশ? কম? কলা? কলা কডজন? লেডিকেনি– লেডিকেনি খাননি? রসগোল্লা? দই খাননি কেন, দই খেলে কাঁটা নামতে পারে। ও, তা জানতেন না। দেখি, হ্যাঁ, হাঁ করুন, আরও, আর একটু। না কাঁটা নেই। কী বললেন! আছে খচখচ করছে নেই! এখন আর নেই, তাহলে গলা কেটে দেখতে হয়। কেন, কাল সকালে আবার আসবেন কেন? এখন দেখছি নেই, আবার গিয়ে মাছ খেতে চান নাকি? তাহলে কাল সকালে আবার কাঁটা আসবে কোথা থেকে?
এতক্ষণে শচীবিলাসের কণ্ঠ শোনা গেল–
না, এই দিনের বেলায় ভাল করে দেখবেন আর কী?
দিনের বেলায়, দিনের বেলায় কি আপনার গলার মধ্যে সূর্য উঠবে? দেখলাম টর্চ দিয়ে, এর আবার দিন-রাত্রি কী? ডাক্তার রীতিমতো উত্তেজিত।
একটু পরেই শচীবিলাসকে প্রায় নিরাশ হয়েই বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। তিনজনে আবার গাড়িতে উঠলাম। একটা ঢেঁকুর তুলে শচীবিলাস বললেন, এই এখনও একটু খচখচ করছে, ডাক্তারটা কোনও কাজের নয়। গাড়ি থিয়েটার রোড পর্যন্ত প্রায় পৌঁছে গেছে, এমন সময় আবার শচীবিলাস চিৎকার করে উঠলেন, এই ভীষণ সাংঘাতিক ভুল হয়ে গেছে। আবার ডাক্তারের কাছে। যেতে হবে। এই গাড়ি ঘোরাও। গাড়ি ঘোরাতে হল, আমি আর সমীর বিস্মিত।
ভয়ানক ঠান্ডা চারদিকে। রাত একটা বোধহয় বেজে গেছে। ঘড়ির দিকে আর তাকাচ্ছি না। আবার হাসপাতালে পৌঁছলাম। অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে প্রায় এক ঘণ্টা পরে ডাক্তারকে ঘুম ভেঙে তোলা হল। তিনিও বিস্মিত। চোখ কচলাতে কচলাতে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হল আবার? শচীবিলাস বললেন, একটা কথা জানা হয়নি স্যার, রাত্রে কী খাব?
কবিতা ও ফুটবল
অ্যানন (Annon) সাহেবের লেখা একটি বহু প্রচলিত ইংরেজি কবিতার অনুবাদ করছিলেন এক অধখ্যাত বাঙালি কবি। তাঁর অনুবাদটি তেমন ভাল হয়নি, উল্লেখযোগ্য নয়, কিন্তু আমার এই নিতান্ত সত্যঘটনা অবলম্বনে রচিত সৎ উপাখ্যানে সেই অক্ষম বাংলা অনুবাদটি একটু স্মরণ করতে হচ্ছে।
সম্পূর্ণ অনুবাদটি পুনরুদ্ধার করা রুচিসুখকর হবে না, শুধু আমাদের এই প্রতিবেদনের জন্যে যেটুকু প্রয়োজন তাই উপস্থাপন করছি।
সেই অনুবাদ পদ্যটি এই মুহূর্তে আমার হাতের কাছে নেই। কিন্তু আমার স্মৃতিশক্তির প্রতি এখনও আমার আস্থা হারায়নি, সুতরাং মনে করা যাক,
যেখানে দুই ল্যাম্পপোস্টের মধ্য দিয়ে
লম্বা পেনাল্টি কিকে
কে যেন শূন্যে পাঠিয়ে দেয়
চাঁদের ফুটবল গ্যালারিতে অস্পষ্ট ছায়াচ্ছন্ন মানুষেরা
চেঁচিয়ে ওঠে, গোল, গোল,
গোল।
ভাগ্যিস এই কবিতাটি এই মোক্ষম মুহূর্তে সদ্য সদ্য মনে পড়ল, তা না হলে কবিতা ও ফুটবল একত্রে মেলানো আমার সাধ্যি ছিল না। গল্পের খাতিরে গল্পটা লিখতেই হচ্ছে, কিন্তু সব কিছুর তো একটা যুক্তি চাই।
বহুকাল আগে এক ভিন্নদেশি যুক্তিবাদী দার্শনিক তার আদর্শ সমাজ থেকে কবিদের নির্বাসন দেওয়ার কথা বলেছিলেন। সেই স্বপ্নের সমাজ এখনও বহুদূরের ব্যাপার।
ফলে সমাজে এখনও যথেচ্ছভাবে কবিরা বিচরণ করছেন। হয়তো তাদের কারও কারও কাছে ফুটবলের গোলমালটা ভাল নাও লাগতে পারে।
কিন্তু আমার একটা ব্যক্তিগত সুবিধা আছে, আমি কোনও কবিকে এখন পর্যন্ত চিনি না। আমার জানাশোনা আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের মধ্যে এমনও একজন নেই যাকে কবি বলা যেতে পারে বা কবি বলে ভাবা যেতে পারে। কোনওদিন কোনও কবিকে আমি স্বচক্ষে দেখিনি এ কথা বলা যাবে না, কিন্তু তারা কেউ আমাকে জানেন না আর আমিও তাদের সঙ্গে পরিচিত নই।
সুতরাং এই অপরিচয়ের সুযোগে একজন কবিকে নিয়ে একটু চপলতা করলাম। আশা করি তিনি এবং অন্য কবিরা কবিজনোচিতগুণে আমার এই অপরাধ ক্ষমা করবেন।
অবশ্য আমার হয়তো এত সাবধানতার প্রয়োজন নেই। ফুটবল বিষয়ক এরকম একটি স্কুল এবং মোটামুটি ভাবে হাস্যকর রচনা কস্মিনকালে কোনও কবি পড়বেন, এরকম ভুল আশা করাই আমার অন্যায়। আমার অন্তরাত্মা বলছে, এই লেখা কোনও কবি চোখ বুলিয়েও দেখবেন না, সরাসরি সংশ্লিষ্ট পৃষ্ঠাকয়টি দ্রুত উলটিয়ে যাবেন। ৩৭০
তবে একচক্ষু হরিণের মতো আমি তো এতক্ষণ অন্যদিকটা মোটেই ভাবিনি। যদি ফুটবলের কোনও লোক–ফ্যান, খেলোয়াড়, রেফারি বা সাংবাদিক কারও নজরে এ লেখা পড়ে, আমি রেহাই পাব তো?
কবির প্রতিভা
কবিতা ও ফুটবল এই দুই বিপজ্জনক পদার্থ একত্র করা উচিত হল কি না এবং পরিণামে সেটা কতটা বিস্ফোরক হতে পারে, সেই বিষয়ে এই গল্পের দুর্বল কাহিনিকার তারাপদ রায়ের নিজের মনেও দুশ্চিন্তা রয়েছে। ভণিতায় তা কিছুটা বলেছি।
তবে গল্প যখন লিখতে হবেই, উপায় কী? বিস্ফোরক যদি হয় হল, দ্বিধা না করে দ্রুত মূল কাহিনিতে প্রবেশ করছি।
রঞ্জন চক্রবর্তী একজন উদীয়মান তরুণ কবি। সম্প্রতি কিছুদিন হল তার বেশ নাম হয়েছে। চারদিকে পত্র-পত্রিকায় রঞ্জনবাবুর কবিতা অল্পবিস্তর প্রকাশিত হচ্ছে। সম্পাদকের এবং অনেক পাঠক-পাঠিকার সেসব কবিতা পড়ে বেশ ভাল লাগছে।
ফলে রঞ্জনবাবু ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছেন। সভাসমিতি থেকেও তাঁর ডাক আসছে মাঝে মধ্যেই। কবি হতে গেলে শুধু কবিতা লিখলে বা ছাপিয়েই শেষ হয় না, একালে চল হয়েছে কবিকে সভায়। বা কবিসম্মেলনে সেসব কবিতা নিজেকে পাঠ করে শোনাতে হবে শ্রোতাদের। শ্রোতারা কখনও কখনও হাততালি দিয়ে, চেয়ারের হাতল চাপড়িয়ে উৎসাহ দেন, আবার কখনও ওই একই কবিতা পাঠের মধ্যস্থলে হাততালি দিয়ে বা চেয়ার চাপড়িয়ে বসিয়ে দেন।
আজ রঞ্জন চক্রবর্তী উত্তর বারাসত রাইজিং স্টার ক্লাবের সভায় কবিতা পড়তে এসেছেন। রাইজিং স্টার ক্লাবের এবার রৌপ্য জয়ন্তী উৎসব হচ্ছে। রাইজিং স্টার আসলে একটি ফুটবল ক্লাব, তবে ওই জয়ন্তী বৎসর বলে এরা এবার বার্ষিক অনুষ্ঠানটি একটু ধুমধাম করে করছে। স্থানীয় কয়েকজন ফুটবল প্লেয়ারের সঙ্গে তারা একজন অভিনেত্রী, দুজন গায়ক এবং পাঁচজন কবিকেও সংবর্ধনা জানাচ্ছে।
ফুটবল প্লেয়ারদের বক্তৃতা, অভিনেত্রীর আবৃত্তি, গায়কদের গান ইত্যাদির শেষে কবিরাও কবিতা পাঠ করলেন। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার ছিল এসবের পর। একে একে সকলকে ক্লাবের তরফ থেকে একটি করে উপহার দেওয়া হল।
রঞ্জন চক্রবর্তীও একটি উপহার পেলেন। রঙিন কাগজে জড়ানো কী একটা জিনিস। সংকোচ-বশত সেটা আর খুলে দেখলেন না।
ফেরার পথে ট্রেনে বসে শেয়ালদার পথে অন্য কবিদের সঙ্গে রঞ্জনবাবুও প্যাকেটের রঙিন মোড়ক ছাড়িয়ে দেখলেন ভিতরে কী উপহার আছে। প্রত্যেক কবিই একটা করে প্যাকেট পেয়েছে। প্রত্যেকেরই প্যাকেটে একটা করে সুদৃশ্য ফুলদানি রয়েছে, সুন্দর রঙিন কাঁচের জিনিস। কিন্তু রঞ্জনবাবুর মোড়কের ভেতর থেকে যেটা বেরোল, সেটা একটু অন্যরকম। জিনিসটা ঠিক কাব্যময় নয়।
একটা কালো আবলুস রঙা কাঠের ওপর তামার তৈরি কয়েকজন ফুটবল খেলোয়াড়ের সাবলীল মূর্তি এবং তাদের পদপ্রান্তে একটি ফুটবল। অর্থাৎ, একটি সচল ফুটবল খেলার দৃশ্য। সাধারণ ছোটখাটো ম্যাচে বিজয়ীদের এই ধরনের শিল্ড দেয়া হয়।
অন্য দশজনের মতো বাল্যে ও কৈশোরে রঞ্জনবাবুও ফুটবল খেলেছেন। সে আহামরি কিছু নয়। আজ কবি হিসেবে এসে ফুটবলের শিল্ড পেয়ে তিনি একটু বিব্রত বোধ করলেন। সহযাত্রী কবি চারজনও ঠোঁট টিপে হাসলেন, একজন বক্রোক্তি করলেন, খুব ভাল খেলেছ রঞ্জন, একেবারে শিল্ড পেয়ে গেলে।
রঞ্জন চক্রবর্তী বুঝতে পারলেন, কোথাও একটা কিছু ভুল হয়েছে। কোনও খেলোয়াড়ের উপহারটা তার ভাগে এসে পড়েছে আর সেই খেলোয়াড় তাঁর কাঁচের ফুলদানিটা লাভ করেছে।
এই ঘটনা এখানে শেষ হলে এ গল্প লেখার দরকার হত না। আমাদের এই সামান্য কথিকা এর পরেই শুরু হচ্ছে। এরপরে, মানে কবি রঞ্জন চক্রবর্তী ফুটবলের শিল্ড পাওয়ার পরে।
রঞ্জনবাবুর বয়েস তিরিশের কাছাকাছি। এখন পাকাপাকিভাবে তার কোনও জীবিকা নেই। যাদবপুরের দিকে একটা বাড়ির দেড়তলায় গ্যারেজের উপরের ঘরে নিজের থাকার জায়গা করে নিয়েছেন। সেই ঘরে একটা ছোট র্যাকে ভরতি যত রাজ্যের কবিতার বই, তারই উপরের তাকে তিনি উত্তর বারাসাত থেকে পাওয়া ফুটবলের শিল্ডটি সাজিয়ে রেখেছেন।
এর মধ্যে একদিন একটা ঘটনা ঘটল। দেড়তলার ঘরে জানলার পাশে একটা চেয়ারে বসে এক সন্ধেবেলা রঞ্জনবাবু বাইরের দৃশ্য অবলোকন করছিলেন, এমন সময় রাস্তা দিয়ে হিপ হিপ হুররে চেঁচাতে চেঁচাতে একটা অল্পবয়েসি ছেলেদের প্রসেশন গেল। সেই মিছিলের সকলের আগে একজন যুবকের হাতে উঁচু করে ধরা রয়েছে একটা কালো কাঠের শিল্ড, রঞ্জনবাবুর ঘরে যেমন আছে। অনেকটা সেই রকম। কোনও পাড়ার টিম খেলায় জিতে শিল্ডটা নিয়ে এই মিছিল বার করেছে।
কিছুদিন আগে একদিন দুপুরবেলা রঞ্জনবাবু তার এক বন্ধুর সঙ্গে রবীন্দ্রসরোবরে বেড়াতে বেড়াতে দেখেছিলেন এখানে ওখানে রীতিমতো উত্তেজনাপ্রদ প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল ম্যাচ চলছে। রঞ্জনবাবুর তাঁর নিজের কৈশোরের কথা মনে পড়েছিল যখন তিনি নিজেও এরকম ম্যাচ দু-চারটে খেলেছেন।
আজ এই বিজয়োৎসবের মিছিল দেখে সেই সঙ্গে সেদিনের রবীন্দ্রসরোবরের ম্যাচগুলো মনে করে নানারকম ভাবলেন। নানারকমের ভাবনা করার কবিদের অবাধ অধিকার রয়েছে, তবে আমাদের রঞ্জনবাবু কবি হলেও নির্বোধ নন। এদিন সারা সন্ধ্যা রঞ্জনবাবুর মাথায় কবিতার বদলে ফুটবল বিষয়ে নানারকম চিন্তা খেলা করল।
পরদিন দুপুরবেলা তিনি কোনও প্রেমিকা ছাড়াই জীবনে প্রথমবার একা একা রবীন্দ্র সরোবরে গেলেন। দূরদূরান্তের পাঠকপাঠিকা যাঁরা রবীন্দ্রসরোবর সম্পর্কে ভাল জানেন না, তাঁদের জানাই এই রবীন্দ্রসরোবর আগে কলকাতার লেক বলে পরিচিত ছিল। পুরনো দক্ষিণ কলকাতার শেষপ্রান্তে কয়েকটি জলাশয়, ক্লাব, মাঠ এবং একটি স্টেডিয়াম নিয়ে এই সরোবর।
রঞ্জনবাবু সরোবরে প্রবেশ করতেই একটি ছেলে তার হাতে একটি লিফলেট ধরিয়ে দিল। একটি আপ্তবাক্য আছে, যে যেমন ভাবনা করে তার তেমন সিদ্ধি হয়। রঞ্জনবাবুর ক্ষেত্রেও তাই হল। প্রথম ধাপেই তিনি যা চাইছিলেন তার অনেকটা পেয়ে গেলেন। ছোট ছাপানো কাগজটিতে একটি ফুটবল টুর্নামেন্টের ঘোষণা।
শিবকালী মেমোরিয়াল কাপের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। লিফলেটটিতে। পাঁচ ফুট উচ্চতার এবং ষোলো বছরের কম বয়েসিদের যে-কোনও টিম এই ম্যাচে অংশ নিতে পারবে। প্রবেশ ফি দশটাকা মাত্র। উচ্চতা এবং বয়েসের ব্যাপারে শিথিলতার ব্যবস্থা আছে, তবে তার জন্য খেলোয়াড়-প্রতি প্রত্যেক ইঞ্চিতে আট টাকা এবং প্রত্যেক বছরের জন্য পাঁচ টাকা জরিমানা প্রদেয়।
লিফলেটটি পাঠ করে এবং তারপর রবীন্দ্র সরোবরের মধ্যে বিভিন্ন মাঠে ঘুরে ঘুরে ফুটবল ম্যাচ দেখে দেখে কবি রঞ্জন চক্রবর্তীর অন্তর্দৃষ্টি খুলে গেল। তিনি গোলপার্কের দিক থেকে রবীন্দ্রসরোবরে প্রবেশ করে হাঁটতে হাঁটতে খেলা দেখে দেখে এবং সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে টালিগঞ্জ ব্রিজের দিক দিয়ে বেরিয়ে এলেন।
সামনেই রসা রোডে একটা ছোট ছাপাখানা। সেখানে ঢুকে একটি বিজ্ঞপ্তি খসড়া করে ফেললেন ছাপার জন্যে। রঞ্জন চক্রবর্তী চ্যালেঞ্জ ফুটবল টুর্নামেন্ট। দক্ষিণ কলকাতায় কিশোরদের ফুটবল খেলার প্রতিযোগিতার বিপুল আয়োজন। সোয়া পাঁচ ফুটের কম উচ্চতাবিশিষ্ট এবং পনেরো বছরের কমবয়স্ক কিশোরদের টুর্নামেন্ট। উপযুক্ত ক্ষেত্রে বয়েস এবং উচ্চতার সীমারেখা শিথিল করা হইবে। প্রবেশ মূল্য পঁচিশ টাকা।
পরের দিনই বিজ্ঞপ্তিটি ছেপে পাওয়া গেল। রঞ্জনবাবু নিজের হাতে লেকের চারধারে দেশপ্রিয় পার্কে, বিবেকানন্দ পার্কে টুর্নামেন্টের ঘোষণাপত্র বিলি করে বেড়ালেন।
রঞ্জন চক্রবর্তী চ্যালেঞ্জ ফুটবল কাপের প্রতি ছেলেদের উৎসাহ বৃদ্ধি করার জন্যে তিনি প্রথম দুটি ক্লাবকে বিনামূল্যে এবং তারপরে কয়েকটি ক্লাবকে অর্ধমূল্যে প্রতিযোগিতায় নিয়ে নিলেন। সকালবেলা বিবেকানন্দ পার্কের মাঠে খুব ভিড় হয় না, রঞ্জনবাবুর চ্যালেঞ্জ শিন্ডের খেলার সময় করা হল সকাল সাড়ে সাতটা, স্থান বিবেকানন্দ পার্ক।
ক্রমশ রঞ্জন চক্রবর্তী চ্যালেঞ্জ ফুটবল টুর্নামেন্ট দক্ষিণ কলকাতায় বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে উঠল। রঞ্জনবাবু অতি বুদ্ধিমান লোক। তিনি অতি অল্পদিনের মধ্যে এই ফুটবল প্রতিযোগিতাই নিজের স্থায়ী জীবিকা করে তুললেন।
টুর্নামেন্ট একবার জনপ্রিয় হয়ে গেলে তখন আর প্রতিযোগী ক্লাবের অভাব হয় না। রঞ্জনবাবু এনট্রি ফি কুড়ি টাকায় নামিয়ে দিলেন, তা ছাড়া কোনও টিম কোনও রাউন্ডে হেরে গেলে আবার কুড়ি টাকা দিয়ে টুর্নামেন্টে অন্য নামে খেলতে পারবে। টুর্নামেন্টের ফার্স্ট রাউন্ড, সেকেন্ড রাউন্ড প্রায় আড়াই মাস তিন মাস চলে। এই সময় প্রতিদিন সকালে একটি করে খেলা, প্রায় দেড়শো টিমের কাছ থেকে রঞ্জনবাবুর তিন হাজার টাকা আয় হয়।–
এ ছাড়া নানারকম উপরি আয়ের ফিকির আছে ফুটবল প্রতিযোগিতায়। ওই উচ্চতা আর বয়েসের ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি শুরু করলেন। তার আগে রঞ্জনবাবু একটি রঞ্জন টুর্নামেন্ট কমিটি তৈরি করলেন। তার সম্পাদক তিনি স্বয়ং। দুজন গোবেচারা ফুটবল-প্রেমিক পরিচিত ভদ্রলোককে টুর্নামেন্ট কমিটির মেম্বার করা হল। টাকাপয়সার ভাগ তারা পান না, মাঝে-মধ্যে দুএক কাপ চা রঞ্জনবাবু তাঁদের খাওয়ান।
বয়েসের সীমা ঠিক রাখার জন্যে রঞ্জনবাবু ইস্কুলের সার্টিফিকেট ছাড়া কাউকে খেলতে নামতে দেন না। তবে সার্টিফিকেট-মতে কারও বয়েস যদি দু-এক বছর বেশি হয়, একুশ বছর পর্যন্ত, প্রতি বছরে পাঁচ টাকা জরিমানা দিয়ে সে খেলোয়াড়কে নামানো যাবে। আবার উচ্চতার ব্যাপারে ইঞ্চি প্রতি দশটাকা সাড়ে পাঁচ ফুট পর্যন্ত ছাড়।
একটু লম্বা বা বয়েস বেশি প্লেয়ার হলেই রঞ্জনবাবুর সঙ্গে সঙ্গে আয়বৃদ্ধি। এ ছাড়া প্লেয়ারদের লেবু এবং চুয়িংগাম হাফটাইমে সরবরাহ করেও টুর্নামেন্ট কমিটি ওরফে রঞ্জনবাবুর মোটামুটি কিছু বাঁধা উপার্জন হতে লাগল। সেই সঙ্গে নিয়ম করা হল, দুই প্রতিযোগী টিম দুই হাফে খেলার বল দেবে। অনেক সময় কোনও কোনও দল বল না আনলে অথবা তাদের বল ফেটে গেলে, লিক হয়ে গেলে মাত্র বারো টাকা দিলেই টুর্নামেন্ট কমিটি বল সরবরাহ করে।
ইতিমধ্যে আরও দু-একটি নতুন উপসর্গ দেখা গেল। খেলার মাঠে রেফারির বিচারে সন্তুষ্ট না হয়ে বিভিন্ন টিম প্রতিবাদ জানিয়ে আবেদন করছে। রঞ্জনবাবু প্রটেস্ট ফি করে দিলেন পঁচিশ টাকা। এর পরে দেখা গেল যে অপর পক্ষও প্রটেস্টের বিপক্ষে আবেদন জানাচ্ছে। সেক্ষেত্রে দ্বিতীয়। পক্ষের কাউন্টার প্রটেস্ট ফি ধার্য করা হল পঞ্চাশ টাকা।
এইরকম যখন চলছে তখন একদিন রঞ্জনবাবু দেখলেন যে একটা পকেটমার রাস্তায় ধরা পড়ে খুব মার খাচ্ছে। রঞ্জনবাবু হাজার হলেও কবি মানুষ, তার কী রকম মায়া হল, তিনি আর দু-চারজন ভাল লোকের সহযোগিতায় লোকটিকে গণধোলাই থেকে কোনওক্রমে উদ্ধার করে, দুটো ধমক দিয়ে ছেড়ে দিলেন। পকেটমারটি যাওয়ার সময় জানাল, হুজুর, আমার নাম লাল্লু, আপনি আমার প্রাণ বাঁচালেন।
কয়েকদিনের মধ্যে লাল্লুর সঙ্গে রঞ্জনবাবুর আবার দেখা হল। ময়দানে একটা বড় ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলেন, বেরিয়ে আসার মুখে দেখলেন লাল্লু কয়েকজনের সঙ্গে উত্তেজিত হয়ে খেলার কথা আলোচনা করছে।
সেইদিন রাতে একটা নতুন চিন্তা এল কবি রঞ্জন চক্রবর্তীর মাথায়। না, কোনও নতুন আধুনিক কবিতা নয়। তার চেয়ে অনেক দামি, অনেক জরুরি, রঞ্জন টুর্নামেন্টের আয় বাড়ানোর একটা পাকা বন্দোবস্ত।
লাল্লু ফুটবল খেলাটা নিশ্চয় কিছু বোঝে। আর তা ছাড়া সে মার খেতেও ওস্তাদ। সুতরাং তাকে যদি একটা হুইসিল দিয়ে হাফপ্যান্ট পরিয়ে রেফারি করে দেয়া যায় আর সে যদি প্রতি খেলায় দু-চারটে গোলমেলে সিদ্ধান্ত যথা ভুল পেনাল্টি, গোল হয়ে যাওয়ার পরে অফসাইড, অথবা নির্বিচারে লাল কার্ড দেখায়, তবে ভুক্তভোগী দলের সমর্থকদের হাতে তার প্রহৃত হওয়ার সম্ভাবনা অবশ্য থাকবে। কিন্তু প্রটেস্ট-ফি, কাউন্টার প্রটেস্ট-ফি বাবদ যথেষ্ট আয় হবে।
দু-চারদিনের মধ্যে ময়দানে গিয়ে লাল্লুকে পূর্বস্থানে ধরে ফেললেন রঞ্জনবাবু। সে ফুটবলে পরমোৎসাহী। রঞ্জনবাবু লাল্লুকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পাশে একটা বেঞ্চিতে বসে বিস্তারিত আলোচনা করলেন।
লাল্লু জাতে পকেটমার এবং অতি চতুর। সে কিছুক্ষণের কথাবার্তাতেই রঞ্জনবাবুর অভিসন্ধি ধরে ফেলল। রঞ্জনবাবু তাকে পাকা মাস-মাইনেয় রঞ্জন টুর্নামেন্টের রেফারি হিসেবে নিয়োগ করলেন। লাল্লু মাসে তিনশো টাকা পাবে, সকালে সাড়ে সাতটা থেকে নয়টা পর্যন্ত ডিউটি। তাকে রেফারির ড্রেস এবং জুতো, সেইসঙ্গে হুইসিল কিনে দেওয়া হল। লাল কার্ড, হলুদ কার্ড ইত্যাদিও সংগ্রহ করে দেয়া হল।
লাল্লুর প্রধান কাজ হল মার খাওয়া। প্রত্যেক খেলায় তাকে মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত দিতে হবে, এতে মারামারি হয়ে খেলা ভেঙে যায় যাবে। তারপর প্রটেস্ট-ফি আর কাউন্টার প্রটেস্ট-ফি বাবদ নিশ্চয় পঁচাত্তর টাকা আয় হবে।
মার খাওয়া লাল্লুর যথেষ্ট অভ্যেস আছে। আর খেলার মাঠে গোলমাল বাধানোয় সে যাকে বলে এক্সপার্ট।
রঞ্জন টুর্নামেন্টের রমরমা শুরু হয়ে গেল। ফাউল, অফসাইড, এমনকী পেনাল্টি পর্যন্ত ভুল সিদ্ধান্ত দিতে লাগল লাল্লু, হরদম বাঁয়ে ডাইনে প্লেয়ারদের লাল কার্ড, হলুদ কার্ড দেখাতে লাগল সে।
গোলমাল, হইচই, মারপিট, অকহতব্য অবস্থা প্রতিদিন রঞ্জন টুর্নামেন্টের খেলায়, প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে প্রহৃত হতে লাগল লাল্লু। মার খাওয়ায় সে পোক্ত, দু-চার হাজার ঘুষি, লাথিতে তার কিছু হয় না, কিন্তু অভিনয় করে দুটো লাথির মাথাতেই সে কোঁক করে চোখ উলটে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। লড়াকু জনতা তার এই অবস্থা দেখে সরে পড়ে।
তারপর প্রটেস্ট, কাউন্টার-প্রটেস্ট। রঞ্জন টুর্নামেন্টের তহবিল স্ফীত হতে লাগল, রঞ্জনবাবুও একলাফে তিনশো টাকা থেকে পাঁচশো টাকা করে দিলেন লাল্লুর মাসিক বেতন।
এক বাঙালি কবির বাণিজ্যপ্রতিভার এই কাহিনিটি এখানে শেষ করতে পারলেই ভাল হত, তাতে গল্প হয়তো তেমন জমত না কিন্তু সকলেরই মুখরক্ষা হত।
তদুপরি কাহিনিকারের পক্ষেও বিপদটা হয়তো অনেক কম হত। কিন্তু গল্পকে এখানে শেষ করা সম্ভব নয়। কারণ এর পরে যা ঘটেছে সেটা না লিখলে অন্যায় হবে এবং লাল্লুর প্রতি নিতান্ত অবিচার করা হবে।
অকবির প্রতিভা
রঞ্জন টুর্নামেন্টের প্রতিযোগিতা ইতিমধ্যে তিন দফা হয়ে গেছে। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সারা বছর ধরে জমজমাট খেলার আসর। দক্ষিণ কলকাতার ফুটবল প্রেমিক কিশোররা তো বটেই, এমনকী তাদের অভিভাবকদের কাছেও রঞ্জন টুর্নামেন্টের খ্যাতি যথেষ্ট প্রচারিত হয়েছে।
কবি রঞ্জন চক্রবর্তী আজকাল আর কবিতা লেখার বিশেষ সময় পান না, প্রয়োজনও বোধ করেন। না। একটি ফুটবল টুর্নামেন্ট পরিচালনা করা যতটা অর্থকরী এবং উত্তেজনাপ্রদ, কবিতা লেখা তার ধারেকাছে আসে না।
তা ছাড়া ফুটবল মারফত তার যথেষ্ট সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিও হয়েছে। উত্তর টালিগঞ্জ বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় রঞ্জন চক্রবর্তী সভাপতি হয়ে রৌপ্যপদক বিজয়ীদের গলায় পরিয়ে দিলেন। আবার আন্তঃ বেহালা কাবাডি প্রতিযোগিতায় তিনি প্রধান অতিথি হয়ে দেড় ঘণ্টা কাবাডির ঐতিহ্য নিয়ে সুললিত বক্তৃতা করলেন।
মোট কথা, রঞ্জনবাবু এখন মহানগরীর দক্ষিণাঞ্চলের ক্রীড়াসংসারে রীতিমতো মান্যগণ্য ব্যক্তি। শোনা যাচ্ছে, কী সব সূত্রে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল, ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন ইত্যাদি সব কেউকেটা প্রতিষ্ঠানেও তিনি ঠাই করে নিতে চলেছেন।
আজকাল আর রঞ্জনবাবু যাদবপুরের সেই দেড়তলার ঘরে থাকেন না। কালীঘাটের একটা পুরনো বাড়ির দুটো একতলার ঘরে এখন তাঁর আবাস, সেই সঙ্গে সেটা রঞ্জন টুর্নামেন্টের হেড কোয়ার্টার্স। প্রত্যেকদিন সকালবেলা ক্রীড়ারসিক এবং নবীন খেলোয়াড়ের ভিড়ে গমগম করে। রঞ্জনবাবুর বাইরের ঘর।
রঞ্জনবাবুর জীবনযাত্রার ধারাও রীতিমতো পালটিয়ে গিয়েছে। তিনি একটু পুরনো একটা মোটরবাইক ক্রয় করেছেন। সেটা অবশ্য যাতায়াতের পথে একটু অস্বাভাবিক শব্দ করে, শব্দ শুনে। মনে হয় যেন কোনও আগ্নেয়গিরি অগ্নি উদগিরণের আগে গর্জন করছে।
কালীঘাট পাড়ার কুকুরদের কোনওকালেই মোটরবাইক জিনিসটা পছন্দ নয়। চিরকালই তারা রাস্তায় চলমান মোটরবাইকের পিছনে তাড়া করে আনন্দ পায়। রঞ্জনবাবুর গাড়িতে বীভৎস শব্দের ফলে তাঁর প্রতি কুকুরদের ক্রোধ আরও বেশি। বহু দূর থেকে রঞ্জনবাবুর গাড়ির আওয়াজ পেয়ে কুকুরেরা সম্মিলতভাবে তেড়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। প্রতিদিন রাতে রঞ্জনবাবু যতক্ষণ পর্যন্ত বাড়ি না ফেরেন, পাড়ার কুকুরেরা বিনিদ্র প্রতীক্ষা করে তাকে গর্জনমুখর সংবর্ধনা জানানোর জন্যে।
রঞ্জনবাবুর সঙ্গে বাইকের পিছনের সিটে প্রায় প্রতিদিন এক ব্যক্তি যাতায়াত করে। ব্যক্তিটি বেঁটে, কালো, তার চুল ছোট করে ছাটা, গায়ে চকরাবকরা রঙিন জামা, লাল প্যান্ট।
কুকুরেরা সাধারণত চেষ্টা করে পশ্চাতের এই ব্যক্তিটিকে কামড়ানোর। কিন্তু সে সুকৌশলে পা দুটো এমনভাবে গুটিয়ে রাখে যে কুকুরেরা চলন্ত অবস্থায় তাকে কিছু করতে পারে না। তবে মজার কথা এই যে মোটরবাইক থেমে গেলেই কুকুরেরা একদম চুপ, যে যার মতো মুখ ঘুরিয়ে যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গি করে কেটে পড়ে।
সে যা হোক, রঞ্জন চক্রবর্তীর বাইকের পিছনের ওই ব্যক্তিটি আর কেউ নয়, স্বনামধন্য লাল্লু।
স্বনামধন্য কথাটা যে এখানে ব্যবহার করলাম সেটা রসিকতা করে নয়। লাল্লুর আজকাল যথেষ্ট নামডাক। এখন আর সে লাল্লু নয়, ক্রীড়ামোদিরা তাকে মিস্টার লাল্লু অথবা লাল্লুসাহেব বলে ডাকে। ফুটবলের আলোচনায় অত্যন্ত সম্ভ্রমের সঙ্গে তার নাম উচ্চারিত হয়।
ঘটনার যা গতিক তাতে এখন থেকে আমরাও তাকে লাল্লুসাহেব বলে বলব এবং আপনি বলে মর্যাদা দেব।
বিবেকানন্দ পার্কের মাঠে লাল্লুসাহেবের জীবনপণ, অসমসাহসী রেফারিয়ানা অতি অল্পদিনের মধ্যে জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। হাজার মার খেয়েও যে রেফারি দমিত হয় না, আত্মবিশ্বাস হারায় না, তাকে তো সবাই শ্রদ্ধা করবেই।
লাল্লুসাহেবের খেলা পরিচালনা যারাই দেখেছে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেছে। ভুল দু-চারটে সব রেফারিই করে থাকেন, রেফারি তো আর ভগবান নন। অফসাইড, ফাউল, হ্যান্ডবল–এগুলো অনেক সময়েই খুব কাছে থেকেও সঠিক বিচার করা যায় না–সেটা বড় কথা নয়।
বড় কথা হল লাল্লুসাহেবের মার খাওয়ার ক্ষমতা। টু শব্দটি উচ্চারণ না করে ছাতা পেটা হওয়া, লাথি খাওয়া, কখনও কখনও অজ্ঞান হয়ে যাওয়া–তারপর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে লাফ দিয়ে উঠে আবার হুইসিল বাজিয়ে খেলা আরম্ভ করা–লাল্লুসাহেবের এই সব অসাধারণ যোগ্যতা ধীরে ধীরে চারিদিকে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ল।
অবশ্য লাল্লুসাহেবের তরফ থেকে বলা যায় এসব মার তার কাছে তুচ্ছ, লোকে যাকে বলে নস্যি ঠিক তাই। তার প্রাক্তন পকেটমার জীবনে যেসব প্রহার তাঁকে খেতে হয়েছে, যেসব গণধোলাইয়ের তিনি বারংবার সম্মুখীন হয়েছেন, তার কাছে ফুটবল খেলার মাঠে রেফারি হয়ে মার খাওয়া ছেলেখেলা।
আজকাল সকালবেলা সাতটায় একবার আর সাড়ে আটটায় একবার এই দু দফা রঞ্জন টুর্নামেন্টের খেলা হয়। উভয় খেলারই পরিচালনার দায়িত্ব লাল্লুসাহেবের। অবশ্য একটার জায়গায় দৈনিক দুটো খেলা খেলানোর জন্যে রঞ্জনবাবু লাল্লুসাহেবের বেতন বাড়িয়ে এক হাজার টাকা পুরোপুরি করে দিয়েছেন। তা ছাড়া রাত্তিরে রঞ্জন টুর্নামেন্টের হেডকোয়ার্টারে অর্থাৎ রঞ্জনবাবুর বর্তমান বাড়ির বাইরের ঘরে একটা সোফা কাম বেডে তিনি শুতেও পান।
অসুবিধা হয়েছে অন্য জায়গায়। লাল্লুসাহেবেরা চার পুরুষের পকেটমার। তাঁর পূর্বপুরুষেরা সুদূর বিহারের আরা জেলার একটা গোহাটে বহুশতাব্দী প্রতিদ্বন্দ্বী গাঁটকাটা ছিলেন। শতাধিক বৎসর পূর্বে, সিপাহি যুদ্ধের কিছুদিন বাদে লাল্লুসাহেবের প্রপিতামহ দেহাত পরিত্যাগ করে এই কলকাতা শহরে জীবিকার অন্বেষণে আসেন। সেই কবে গ্যাসের আলোর রোমাঞ্চকর যুগে ঘোড়ার টানা ট্রামে তিনি হাতসাফাই আরম্ভ করেছিলেন, তারপর পুত্রপৌত্রাদিক্রমে ধীরে ধীরে বহু বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গাঁটকাটা থেকে কাছাকাটা, কাছাকাটা থেকে জোব্বাকাটা, জোব্বাকাটা থেকে পিরানকাটা ইত্যাদি বহু বিচিত্র এবং জটিল স্তর পাড়ি দিয়ে অবশেষে লাল্লুসাহেব এসে পৌঁছেছে সেই পাইয়োনিয়ার পূর্বপুরুষের উত্তরাধিকারে।
এবং সত্যি সত্যি লাল্লুসাহেবের হাতে এই উত্তরাধিকার মর্যাদা বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয়নি।
কিন্তু রেফারি হিসেবে লাসাহেব যত বিখ্যাত এবং সুপরিচিত হতে লাগলেন ততই তার পকেটমার ব্যবসায় ভাটা পড়তে লাগল। হয়তো ট্রামে উঠে পাদানির এককালে ভিড়লগ্ন হয়ে তিনি গভীর অভিনিবেশ সহকারে সম্ভাব্য শিকারকে পর্যবেক্ষণ করছেন, শেষ মুহূর্ত হয়তো সমাগত, তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের মধ্যে আধলা ব্লেডের ভগ্নাংশ নিপুণ ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ধরে নির্বাচিত পকেটটির দিকে অত্যন্ত সতর্কভাবে এগোচ্ছেন–
সেই মুহূর্তে ভিড়ের মধ্য থেকে কে একজন বলল, গুড মর্নিং, লাল্লুসাহেব। আজ খেলা নেই?
সঙ্গে সঙ্গে ধ্যানভঙ্গ হল। এইরকম অবস্থায় আর যাই করা যাক, পকেটমার বা পকেটকাটা নিশ্চয়ই কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
কিন্তু সদাসর্বদা হাত নিশপিশ করে লাল্লুসাহেবের। রেফারির জীবিকায় যথেষ্ট উত্তেজনা আছে, পয়সাও ভালই দিচ্ছেন রঞ্জন চক্রবর্তী, কিন্তু দিনে দু-একটা পকেট না কাটতে পারলে মনে হয়। জীবনটাই বরবাদ।
এই কবিতা লেখা কমে গিয়েছে কিন্তু রঞ্জনবাবু যথেষ্ট সংবেদনশীল এবং প্রকৃতই কবিপ্রাণ। তিনি লাল্লুসাহেবের মনোবেদনা যে বুঝতে পারেন না তা নয়। কিন্তু তিনি নিজেই লাল্লুসাহেবকে মানা করেছেন রাস্তাঘাটে, ট্রামেবাসে পকেট কাটতে। লোকে যদি ধরে ফেলে, লোকে যদি চিনে ফেলে এই সেই রঞ্জন টুর্নামেন্টের মৃত্যুঞ্জয় রেফারি মিস্টার লাল্লু, তা হলে সমূহ সর্বনাশ, একেবারে ধনে-প্রাণে বিনাশ হতে হবে।
লাল্লুসাহেব বোকা নন। এ সমস্যা বুঝতে তার মোটেই দেরি হয়নি। পকেটমার জীবনের উত্তেজনা আনন্দ যতই থাকুক, তিনি ধীরে ধীরে নিজের রেফারিজীবন উপভোগ করতে শিখেছেন। লোকেরা গালাগালি করুক, ছাতাপেটা করুক–সব ঠিক আছে, একটু দম খিচে শুধু সহ্য করতে হবে কিন্তু একটি সবুজ মাঠে, সহস্র দর্শকের চোখের সামনে বাইশজন চনচনে খেলোয়াড়কে অঙ্গুলিহেলনে শাসনে রাখা, প্রয়োজনে যে কোনও প্রতিবাদ, প্রতিরোধের সামনে উন্নতশির হয়ে উপস্থিত হওয়া, এর মধ্যে যে গৌরব যে মর্যাদা আছে লাল্লুসাহেবের ঊর্ধ্বতন গাঁটকাটা চোদ্দোপুরুষ তা কোনওদিন অনুভব করেননি। এমনকী খেলা পরিচালনা করতে গিয়ে প্রহৃত হওয়ার মধ্যেও যে রীতিমতো গৌরব ও মর্যাদার ব্যাপার আছে এবং সেটা যে পকেটমার হিসেবে মার খাওয়ার চেয়ে অনেক মহৎ ব্যাপার সেটাও লাল্লুসাহেব ভালই বোঝেন।
তবে লাল্লুসাহেব একটা কায়দা আবিষ্কার করেছেন, রেফারি হয়ে ইচ্ছাকৃত ভুল এবং গোলমেলে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ফলে যখন উত্তেজিত টিমের সমর্থকেরা তাঁর উপর মারমুখী হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন তিনি তার সহজাত প্রতিভাবলে আক্রমণকারীদের মধ্যে থেকে শাঁসালো ব্যক্তি নির্দিষ্ট করে ওই ভিড় ঠেলাঠেলির মধ্যে হাতসাফাই করেন। ঘড়ি, কলম, মানিব্যাগ যেদিন যেমন পারেন অনায়াস দক্ষতায় হস্তগত করে মাঠের উপরে ফেলে দেন, তারপর সেই অপহৃত দ্রব্যের উপরে নিজের শরীর চাপা দিয়ে কোঁ-কোঁ করতে করতে উলটিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। তারপর শোয়া অবস্থায় সময়মতো অপহৃত দ্রব্যটি তুলে গেঞ্জির নীচে লুকিয়ে ফেলা একজন প্রাক্তন দক্ষ হাতসাফাইকারের পক্ষে এমন আর কঠিন কী?
অন্যদিকে যাদের জিনিস গেল তারা ঘৃণাক্ষরেও সন্দেহ করতে পারে না যে রেফারি সাহেবের এই কীর্তি। তারা ধরে নেয়, ধস্তাধস্তি হাতাহাতির সময় তাদের জিনিস কোথাও ছিটকিয়ে পড়ে হারিয়ে গেছে। যাকে তারা প্রহার করছিল সেই যে তাদের ঘড়ি, কলম বা মানিব্যাগ গণ্ডগোলের সুযোগে হাতিয়ে নিয়েছে এরকম কিছু চিন্তা করার অবকাশ কোথায়।
রেফারির কাজের সঙ্গে পকেটমার কাজ সংমিশ্রণ করতে পেরে লাল্লুসাহেব মোটামুটি আত্মতৃপ্ত ভাবেই দিন কাটাচ্ছিলেন। রাত্রিও ভালই কাটছিল রঞ্জনবাবুর বাইরের ঘরে।
অবসর এবং ইচ্ছামতো একটু-আধটু সাট্টা খেলা, সন্ধ্যার দিকে খালাসিটোলা বা বারদোয়ারিতে গিয়ে কিঞ্চিৎ বাংলা মদ্যপান অথবা আরও কোনও কুস্থান গমন। আবার একেকদিন রাতে রঞ্জনবাবুর সঙ্গে বসে থ্রি-এক্স রাম পান, সঙ্গে হাজরার মোড় থেকে কিনে আনা মাংসের রোল। কোনও কোনও দিন আরও কেউ থাকে, ফুটবল খেলার ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা, রঞ্জন টুর্নামেন্টের সমস্যা ও সাফল্য বিচার গবেষণা।
দিন ভালই যাচ্ছিল লাল্লুসাহেবের। রঞ্জনবাবুর হৃদয়ে তবু কিছু বেদনা ছিল তার অপূর্ণ কবিজীবন নিয়ে, কিন্তু লাল্লুসাহেব ক্রমশ বিগত পকেটকাটা জীবন সম্পর্কে উদাসীন হয়ে উঠলেন। জুতো, মোজা, হাফপ্যান্ট, রেফারির পোশাক, দামি হুইসিলে ফুঁ দিতে দিতে যখন টগবগ করে লাল্লুসাহেব মাঠে গিয়ে নামেন তখন তাঁর মনেই পড়ে না অনতিদূর অতীত জীবনের কথা।
আজকাল কেবলমাত্র রঞ্জন টুর্নামেন্টের খেলা নয়, কাছে দূরে বারাসাত, আরামবাগ কাকদ্বীপ থেকে ডাক আসতে শুরু করেছে লাল্লুসাহেবের। প্রচণ্ড গোলমালের মধ্যে এমন অসমসাহসী, স্থিতধী রেফারি আর দেখা যায় না। আর তা ছাড়া, সব জায়গায় তো আর রঞ্জন টুর্নামেন্টের মতো প্রটেস্ট-ফি এবং কাউন্টার-ফি-এর লোভে গোলমেলে সিদ্ধান্ত দিয়ে মারামারি বাধিয়ে দেয়া দরকার পড়ে না, ফলে রঞ্জন টুর্নামেন্টের বাইরে যদি কোনও খেলায় লাল্লুসাহেব যান মার খাওয়ার ভয় কম থাকে।
ধীরে ধীরে লোকমুখ থেকে খবরের কাগজের পৃষ্ঠায় লাগ্লসাহেবের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। খেলার কাগজগুলি প্রশংসামুখর হয়ে উঠল লাল্লুসাহেবের সুনিপুণ পরিচালনার একের পর এক বর্ণনায়।
রবীন্দ্রসরোবর স্টেডিয়ামে একটা জুনিয়ার ফুটবলের গুরুত্বপূর্ণ খেলায় গ্যালারি থেকে ছুটে আসা আধলা থানইটের আঘাতে মাথা ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল লাল্লুসাহেবের, তবু অদমিত, অকম্পিত লাল্লুসাহেব খেলা চালিয়ে যেতে লাগলেন।
ময়দানের এক খোলা মাঠের দুই কলেজ টিমের খেলায় চূড়ান্ত বোমাবাজির মধ্যে অবিচল লাল্লুসাহেব কলকাতার ফুটবল মাঠের অরাজক পটভূমিকায় নিজ সাহসে ভাস্বর হয়ে উঠলেন।
স্টেটসম্যানের মতো সাহেবি খবরের কাগজে শ্রীযুক্ত শ্যামসুন্দর ঘোষ মিস্টার লাল্লুকে ভ্যালিয়ান্ট স্মল ম্যান (Valiant small man) নামে অভিহিত করে সাহসের প্রতিমূর্তি বলে বর্ণনা করলেন। আনন্দবাজার পত্রিকায় খ্যাতনামা ক্রীড়াসাংবাদিক মতি নন্দী মহোদয় লাল্লুসাহেবকে কলকাতার ময়দানের ঘনান্ধকার গগনে উজ্জ্বল রূপালি চমক বলে স্বাগত জানালেন। আর আজকাল কাগজে বিখ্যাত অশোক দাশগুপ্ত পাকা আড়াই কলম জীবনীও লেখার কথা ভেবেছিলেন কিন্তু সঙ্গত কারণেই কিছুটা জানার পরে পিছিয়ে গেলেন।
এর মধ্যে একদিন ডাক এল বার্নপুর স্টেডিয়াম থেকে। তারপরে জামসেদপুর, শিলিগুড়ি। শোনা যাচ্ছে আই এফ এ শিল্ড, ফেডারেশন কাপ, এমনকী এশিয়ান কাপ পর্যন্ত লাল্লুসাহেবের খ্যাতি পৌঁছে গেছে। শিগগিরই তার ডাক আসবে এইসব চমকপ্রদ খেলা পরিচালনা করার জন্যে।
লাল্লুসাহেব এখন মনেপ্রাণে প্রস্তুত যেকোনও ধরনের যত দামি, যত উঁচু খেলাই হোক তার রেফারিত্ব করতে। তিনি কলম্বো, এমনকী কুয়ালালামপুর বা কুয়োয়েতে গিয়ে খেলাতেও রাজি। আমন্ত্রণ আসতে এখন যেটুকু বাকি শুধু তারই অপেক্ষা।
রঞ্জনবাবু হাজার হলেও একদা কবি ছিলেন, তারই মানসপুত্র লাল্লুসাহেবের এই উন্নতিতে তিনি মোটেই ঈর্ষান্বিত নন। বরং নিজেকেও সঙ্গে সঙ্গে গৌরবান্বিত বোধ করেন। দু-একটা কাগজে মিস্টার লাল্লু সংক্রান্ত সচিত্র প্রতিবেদনে শ্রীযুক্ত রঞ্জন চক্রবর্তীর ছবিও ছাপা হয়েছে নবযুগের অকুতোভয়, লৌহশরীর মহৎ রেফারির আবিষ্কর্তা হিসেব।
রঞ্জনবাবুর মাথায় চিন্তা ঢুকেছিল যদি লাল্লুসাহেব সত্যি সত্যি কলকাতার বাইরে চলে যান তা হলে রঞ্জন টুর্নামেন্টের কী গতি হবে?
সে সমস্যা লাল্লুসাহেব স্বয়ং সমাধান করে দিয়েছেন। তারই এক পুরনো বন্ধু জগুকে নিয়ে। এসেছেন তিনি। জগু আরও বেঁটে, আরও কালো, আরও রোগা। দাতে দাঁত আটকিয়ে মার খেতে আরও ওস্তাদ। সেও ময়দানের এক বড় ক্লাবের ফুটবল ফ্যান, ফুটবল খেলার অ-আ ক-খ মোটামুটি জানে। তা ছাড়া বুদ্ধি, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ইত্যাদির তার অভাব নেই। লাসাহেবের মতো সেও যথাস্থানে প্ররোচনামূলক ভুল সিদ্ধান্ত দিয়ে যথেষ্ট গোলমাল বাধিয়ে দিতে পারবে, মার খেয়ে টু-শব্দটি করবে না। তাকে দিয়েও লাল্লুসাহেবের মতোই রঞ্জনবাবুর দুবারে দুটো খেলার প্রটেস্ট-ফি, কাউন্টার প্রটেস্ট-ফি বাবদ অনায়াসেই শ দেড়েক টাকা দৈনিক সকালে আসবে।
জগু প্রথমে একটু ইতস্তত করেছিল, তার বহু সাধের পুরনো পেশা ছেড়ে চলে আসতে। কিন্তু এক হাজার টাকা মাইনে এবং তৎসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুবিধার কথা শুনে সে রাজি হয়েছে।
উপসংহার
এই কাহিনির উপসংহার বড় দুঃখজনক। লিখতে কলম সরছে না। তবু লিখতে তো হবেই।
লাল্লুসাহেবের কলম্বো বা কুয়ালালামপুর কোথাও যাওয়া হয়নি। তার প্রাক্তন পকেটমার জীবনে একটি হাতসাফাইয়ের মামলায় তিনি জামিনে খালাস ছিলেন এবং যথারীতি জামিন ফাঁকি দিয়ে আত্মগোপন করেছিলেন। কিন্তু অফিসক্লাবের একটি খেলায় তার মতো বুদ্ধিমান লোকের কিঞ্চিৎ মতিভ্রম হয়। তার সেই খেলাটি আদতে পরিচালনা করতে যাওয়াই উচিত হয়নি।
খেলাটি ছিল গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে আবগারি পুলিশের। গোয়েন্দা পুলিশ টিমের স্টপারকে প্রথম থেকেই লাল্লুসাহেবের কেমন চেনা চেনা মনে হচ্ছিল। কিন্তু খেলাচলাকালীন উত্তেজনায় বুদ্ধিভ্রংশ হয়ে লাল্লুসাহেব স্টপারটিকে লাল কার্ড দেখালেন। স্টপার ভদ্রলোকেরও অনেকক্ষণ ধরে রেফারিকে কেমন চেনা চেনা মনে হচ্ছিল। হঠাৎ মোক্ষম মুহূর্তে তিনি চিনে ফেললেন। এই তো সেই হাওড়া ধর্মতলা ট্রামের লাল্লু ওস্তাদ, হুইসিল মুখে হাফপ্যান্টে জার্সিতে চেনাই যাচ্ছিল না। সর্বনাশ! জামিন পালিয়ে রেফারি হয়েছে!স্টপার ভদ্রলোক গোয়েন্দা দফতরের পকেটমার শাখার ছোট দারোগা। তিনি মাঠ থেকে বেরোনোর মুখে লাল্লুসাহেবের জামার কলার ধরে হিড়হিড় করে টেনে বাইরে অপেক্ষারত একটি পুলিশের গাড়িতে তুলে নিলেন।
লাল্লুসাহেব পুরনো দাগি আসামি, পুলিশের খাতায় তাঁর সাড়ে তিনপাতা রেকর্ড। তা ছাড়া জামিন টপকেছেন। মাননীয় মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে দুদফায় তার আড়াই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হল।
মধ্য থেকে বেকায়দায় পড়লেন রঞ্জনবাবু। তিনি জগুকে যোগাযোগ করলেন। কিন্তু লাল্লুসাহেবের করুণ পরিণতি থেকে শিক্ষালাভ করে জগু আর ক্রীড়া-পরিচালনার লাইনে আসতে চাইল না।
এমতাবস্থায় রঞ্জনবাবুর আর কী-ই বা করণীয় ছিল? তিনি যা যুক্তিসঙ্গত তাই সিদ্ধান্ত নিলেন। লাল্লু যদি পারে আমি কেন পারব না, আমিও তো বিপ্লবী কবি। দু-চার ঘা মার খেলে আমার কী ক্ষতি হবে?
অতঃপর কবি রঞ্জন চক্রবর্তী হাফপ্যান্ট ইত্যাদি পরিধান করে মুখে হুইসিল নিয়ে নিজেই একদিন মাঠে নামলেন। তারপর যা হওয়া স্বাভাবিক তাই হল, প্রটেস্ট-ফি এবং কাউন্টার প্রটেস্ট-ফিয়ের লোভে খেলা আরম্ভের পনেরো মিনিটের মাথায় একটি অন্যায় পেনাল্টি দিলেন।
যে পক্ষের বিরুদ্ধে এই রায় দিলেন তাদের নামটা খেয়াল রাখলে তিনি এই মারাত্মক ভুল করতেন না।
সেই পক্ষ বা ক্লাবের নাম রক্তরাঙা শিবির। এর পরের ঘটনা না লেখাই ভাল। শ্ৰীযুক্ত রঞ্জন চক্রবর্তীর এই কাহিনি পাঠ করে যদি কোনও কোমলহৃদয়া পাঠিকার মনে সামান্য। অনুকম্পাও দেখা দেয় তিনি দয়া করে বাঙ্গুর হাসপাতালের সার্জিকাল ওয়ার্ডে দুশো বত্রিশ নম্বর বেডে তাঁকে দেখতে যাবেন। ভদ্রলোক আজ আড়াই মাস কোমর এবং ঘাড় ভেঙে শয্যাশায়ী হয়ে আছেন।
হিতোপদেশ
ক্ষুদ্র একটি ভ্রম নিরসনের জন্য এই শেষ পর্বটিতে হাত দিতে হল।
ভ্রমটি আর কিছুই নয়, এই সামান্য কাহিনির নাম কবিতা ও ফুটবল না দিয়ে আমার উচিত ছিল কাহিনিটির একটি সর্বজন গ্রাহ্য এবং পরিচ্ছন্ন নাম দেয়া।
স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় নাম কেমন হত কে জানে? কিন্তু শ্রেয় বানানে বিসর্গ দিতে হবে কি না ঠিক করতে না পেরে কবিতা ও ফুটবল নামই রাখতে হল।
কাঁঠালহাটির গল্প
এই গল্পের নাম পাঠ করেই সকল বুদ্ধিমান পাঠক এবং অনুরূপ বুদ্ধিমতী পাঠিকা বুঝতে পেরেছেন যে এই গল্পটা কাঁঠালহাটি নামে একটা গ্রামের ব্যাপার নিয়ে।
সর্বশ্রী পাঠকগণ ও সর্বশ্রীমতী পাঠিকাগণ ঠিকই ধরেছেন।
কিন্তু একটা গোলমাল আছে।
গ্রামের নাম কাঁঠালহাটি শুনে আপনারা কেউ যদি ভেবে থাকেন, এই গাঁয়ে প্রচুর কাঁঠাল হয়, গ্রামের ভিতরে বা পাশে সেই কঁঠালের হাট বসে সেই কারণে এমন নামকরণ, তা হলে কিন্তু ভুল করেছেন।
কাঁঠালহাটিতে কাঁঠালগাছ নেই তা নয় কিন্তু সে হাট বসানোর মতো ব্যাপার নয়।
তা ছাড়া কাঁঠালহাটিতে কোনও হাট নেই। নিকটতম হাট এখান থেকে চার কিলোমিটার দক্ষিণে মোল্লারপাড়ায়। সেখানে তরিতরকারি, মাছ-মাংস, চাল-ডাল, মরশুমি ফল এইসব পাওয়া যায়। কাঠালের মরশুমে দু-চারটে কাঁঠালও পাওয়া যায়, তবে তাকে কঁঠালের হাট বলা যায় না।
কাঁঠালহাটিতে হাট না থাকলেও বেশ বড় বাজার আছে। গ্রামের সামনের দিকে হাইওয়ের পাশে নতুনবাজার, সেখানে সুপার মার্কেট হবে এমন কথাও শোনা যাচ্ছে। গ্রামের ভিতরের দিকে রয়েছে পুরনো বাজার।
কাঁঠালহাটিকে অবশ্য গ্রাম বলা অনুচিত হচ্ছে। কাঁঠালহাটিতে পঞ্চায়েত অফিস আছে, থানা আছে। বিডিও অফিস থেকে ভিডিও হল সবই আছে। উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল আছে। হাইওয়ের পেট্রল পাম্পের পাশে বাসস্টপ থেকে এক্সপ্রেস বাস ধরলে সাড়ে তিন ঘণ্টায় কলকাতার ময়দানে পৌঁছে দেয়।
বছর তিরিশ চল্লিশ আগে কাঁঠালহাটিকে হয়তো বলা যেত গ্রাম, গণ্ডগ্রাম। কিন্তু এখন জায়গাটি পুরো গ্রাম্যতা বিসর্জন না দিলেও আধাআধি শহর হয়ে উঠেছে।
কাঁঠালহাটি গ্রামের মাঝখানে পুরনো বাজারের উলটো দিকে রয়েছে পঞ্চায়েত ও বিডিও অফিস। ডাকঘর আর থানা।
কাঁঠালহাটি থানার বড় বিপদ।
না। পাঠক-পাঠিকা চট করে ভুল ভেবে নেবেন না।
এখানে প্রতিদিন দিনে-রাতে ডাকাতি-রাহাজানি হচ্ছে, তা নয়, খুন-ধর্ষণ খুব বেড়ে গেছে তাও বলা যাবে না। এত বড় একটা থানা এলাকায় মাসে-দুমাসে দুয়েকটি খুন, দুয়েকটি ধর্ষণ, দু-চারটি ডাকাতি-রাহাজানি, দু-দশটি চুরি বাটপারি এসব তো থাকবেই। যতদিন চন্দ্রসূর্য আছে, জোয়ার ভাটা আছে এসব তো ঘটবেই। মানুষের চরিত্র কি কখনও বদল হবে?
কিন্তু এসব কোনও সমস্যা নয়। এসব তো চিরদিনের মামুলি ঝামেলা। কাঁঠালহাটি থানার বিপদ হয়েছে একটি হনুমানকে নিয়ে। হনুমান না বলে বীর হনুমান বলাই ভাল।
বিপুল আকার ও আয়তনের এই হনুমানটিকে গ্রামের লোকেরা ভালবেসে নাম দিয়েছে বীর হনুমান। কৃত্তিবাসের রামায়ণে অঙ্গদ রায় পরে (লঙ্কাকাণ্ডের প্রায় প্রথমেই যে বিশাল বানরের কথা বলা আছে, তার বর্ণনা এই হনুমানের সঙ্গে বেশ মেলে।
এই বীর হনুমানটির সঙ্গে আজ প্রায় দশ-এগারো দিন হয়ে গেল বিরোধ বেধেছে কাঁঠালহাটি থানার বীরবিক্রম বড়বাবুর।
কোনও এক অজ্ঞাত কারণে অধিকাংশ পুলিশ থানারই ও. সি. বা বড় দারোগা হলেন সদব্রাহ্মণ। কারণটা কেউ জানে না, বোধ হয় সরকার বাহাদুরও অবহিত নন।
কাঁঠালহাটি থানার ও. সি. হলেন রামগতি গঙ্গোপাধ্যায়। ত্রিসন্ধ্যা আহ্নিক করেন। একাদশী-অমাবস্যায় উপোস করেন। বস্তুত গাঙ্গুলিমশায় এই আজকের দিনেও এক নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। বর্ণহিন্দু ভিন্ন অন্য কোনও আসামিকে পেটালে কিংবা চড়-চাপড় দিলেও জামাকাপড় ছেড়ে গঙ্গাস্নান করেন। বেজাত কুজাতের বাড়িতে কিংবা নিষিদ্ধ পল্লিতে তল্লাশি বা ধরপাকড় করতে গেলে গলার পইতে, হাতের পলা বসানো মন্ত্রসিদ্ধ রুপোর আংটি একটা টিনের কৌটোয় ভরে থানার সিন্দুকে রেখে যান।
অপর দিকে রামগতিবাবুর মতো দোর্দণ্ডপ্রতাপ বড় দারোগা আজকাল বিরল। তাঁর প্রতাপে সরকার পক্ষীয় এবং সরকার বিরোধী স্থানীয় পানাসক্ত নেতারা একই ঠেকে চুল্লু খায়, কখনও কোনও গোলমাল হয় না।
যাঁরা ঠেকের ব্যাপারটা জানেন, বুঝতে পারছেন, মুরশিদকুলি খাঁর আমলে বাঘে-গোরুতে এক ঘাটে জল খাওয়ার পরে এরকম ঘটনা আকছার ঘটে না।
প্রবল প্রতাপান্বিত রামগতিবাবুর শাসনে এই কাঁঠালহাটি অঞ্চলে মোটামুটি স্বাভাবিক অবস্থাই ছিল। চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি মধ্যে মধ্যে হয়, দু-চারজন দোষী ধরা পড়ে ঘুষ দেয়, খালাস হয়। আবার চুরি-ডাকাতি করে। সব কিছু বেশ চক্রাকারে চলছিল। গোলমাল শুরু হল নিতাইমাস্টারকে দিয়ে। তিনি একজন স্থানীয় নেতা।
এই নিতাইমাস্টার গত দশ বছরে ছয়বার দল পালটেছেন। তিন পাত্র পেটে পড়ার পর তার আর মনে থাকে না তিনি এখন কোন দলে আছেন।
ঠেকের চারচালা ঘরের এক প্রান্তে একটা নড়বড়ে টুলে শালখুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে একাই কখনও গান্ধীর সঙ্গে, কখনও ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে, কখনও সুভাষ বসুর সঙ্গে, কখনও ডাঙ্গেনাম্বুদ্রিপাদ বা চারু মজুমদারের সঙ্গে আপন মনে ঝগড়া করেন।
নিতাইমাস্টার হিসেবি মানুষ। ইচ্ছে করেই নড়বড়ে টুলটায় বসেন। একটু এদিক ওদিক হলেই টুলটা দুলতে থাকে, ভ্রম হয় খুব বেশি নেশা হয়েছে। দু-পাত্র পানীয় কম খেলে চলে।
বীর হনুমানের হাতে প্রথম নির্যাতিত হন এই নিতাইবাবু।
সেদিন সকাল থেকে ছিল বৃষ্টি বৃষ্টি, মেঘলা। সন্ধ্যার পর থেকে ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছিল। নিতাইমাস্টার যে শালখুঁটিটায় হেলান দিয়ে নড়বড়ে টুলে বসেন তার পাশেই একটা গরাদহীন জানলা।
অনিবার্য কারণেই এইসব চুল্লু বা চোলাই মদের স্বাধীন ঠেকগুলিতে জানলায় গরাদ থাকে না। সমস্ত প্রতিষেধক ব্যবস্থা নেওয়ার পরেও আবগারি ও পুলিশের কর্তারা রুটিনমাফিক হানা দেন অকুস্থলে। দরজায় দাঁড়িয়ে খুব হম্বিতম্বি করেন। সেই সময়ে মাননীয় খদ্দেররা অনর্গল জানলাপথে নিষ্ক্রান্ত হন। খদ্দেরদের এটুকু না দেখলে তারা পড়ে থাকবে কেন, চারপাশে তো ঠেকের অভাব নেই।
সেই বৃষ্টির সন্ধ্যায় সেই খোলা জানলা দিয়ে শীতল বাতাস এবং গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুড়িখানার ঘরের মধ্যে ঢুকছিল। নিতাইমাস্টার বেশ উপভোগ করছিলেন পরিবেশটা।
আজকের চুল্লু বেশ কড়া আঁঝের। দু গেলাস খেতেই বেশ গোলাপি নেশা হয়েছে।
ঠেকে গেলাস দেয় না। এখানে মাটির ভড়। কিন্তু মাটির ভাঁড়ে মদ খেতে নিতাই মাস্টারের আত্মসম্মানে লাগে। তিনি একটা ছোট কাঁচের গেলাস তাঁর পাঞ্জাবির পকেটে রাখেন।
দ্বিতীয় গেলাসটি শেষ করে সবে তৃতীয় গেলাসটি পূর্ণ করেছেন। বাইরে ঝিঁঝি ডাকছে। কোথায় একটা কামিনী ফুলের গাছ থেকে জলে ভেজা সুঘ্রাণ ভেসে আসছে। ঘরের সামনের দিকে। ঝোলানো স্তিমিতপ্রায় একটা হ্যারিকেন লণ্ঠনের হলুদ আলোয় সব কিছুই কেমন ছায়া-ছায়া। খুব মৌজে ছিলেন নিতাইমাস্টার।
আজ ভাগ্য খারাপ ছিল স্বর্গীয় ইন্দিরা গান্ধীর। সন্ধ্যা থেকে তাকে তুলোধোনা করেছেন নিতাইমাস্টার। শুধু তাকে নয়, তার বাপ-ঠাকুরদা জহরলাল-মতিলালকে নিয়ে পড়লেন তিনি তৃতীয় পাত্রে ছোট একটি চুমুক দিয়ে।
সেই মুহূর্তে একটি অভাবিত ঘটনা ঘটল। আধো অন্ধকার ঘরে, নিতাইমাস্টার কিংবা অন্য কেউ কিছু বুঝবার আগে শীর্ণ অথচ ক্ষিপ্র ও সবল, একটি লোমশ হাতের থাপ্পড় খেলেন নিতাইমাস্টার। ডান গালে সটান এক চড়।
সেই সঙ্গে সেই লোমশ হাতের মালিক এক ঝটকায় কেড়ে নিল নিতাইবাবুর হাতের চুল্লুর গেলাস। দুই দমে সে সেটা শূন্য করে দিল।
ইতিমধ্যে নিতাইবাবুর আর্ত চিৎকারে পুরো ঠেক নেশার আমেজ ছিঁড়ে সচেতন হয়ে উঠেছে।
লণ্ঠনের আলোয় কিছু বোঝা যাচ্ছিল না। কী হচ্ছে? কেন মাস্টার চেঁচাচ্ছেন?
একজন কারও হাতে একটা টর্চলাইট ছিল। সে তাড়াতাড়ি টর্চটা জ্বেলে আলো ফেলতে গেলাস হাতে কে যেন খোলা জানলা দিয়ে বেরিয়ে চলে গেল।
এই ক্ষণিক দৃশ্য সেইসঙ্গে নিতাইমাস্টারের আর্তনাদ, এ দুটো মিলিয়ে সবাই বুঝতে পারল যে জানলা দিয়ে কেউ ঠেকের মধ্যে ঢুকে নিতাইমাস্টারের হাত থেকে মদের গেলাস কেড়ে নিয়ে চলে গেল।
এরকম অসম্ভব ঘটনা এই ঠেকের ইতিহাসে কখনও হয়নি। ঘোর নকশাল আমলে নকশালেরা একবার এসে মালিক আর খদ্দেরদের লাঠিপেটা করে, মদ ঢেলে ফেলে দিয়ে, কাঠের বেঞ্চি ভেঙে ঠেক তুলে দিয়েছিল।
আরেকবার আবগারির এক গান্ধীবাদী বড়সাহেব স্বয়ং সেপাই নিয়ে এসে ঠেক তছনছ করে মালিক সহ জনাপাঁচেক খদ্দেরকে পিঠমোড়া দিয়ে বেঁধে জেলা সদরে নিয়ে যান।
কিন্তু এরকম অতর্কিতে জানলা দিয়ে ঢুকে সম্মানিত খদ্দেরের হাত থেকে পানীয়ের গেলাস। কেড়ে নিয়ে যাবে–এ তো ভাবা যায় না। কাঁঠালহাটিতে এমন কখনও ঘটেনি।
মাতালেরা সবাই প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠতে না উঠতে সেই জানলার মধ্য দিয়ে বীর হনুমান একটি হুম শব্দ করে ঠেকে প্রবেশ করলেন।
তার হাতে তখনও নিতাইবাবুর কাঁচের গেলাসটি ধরা রয়েছে, চুল্লুর স্বাদ হনুমানজির খুব পছন্দ হয়েছে। তিনি আরেক পাত্র পানীয় নিতে এসেছেন।
কাঁঠালহাটি ঠিক রামরাজ্যের এলাকা নয়। এ অঞ্চলে বানর-হনুমান খুব সুলভ নয়।
তদুপরি বীর হনুমান ঘরে ঢুকেই চোখে টর্চের আলো পড়তে যেরকম দাঁত খিচোলেন আর সঙ্গে সঙ্গে কিঞ্চিৎ আগের চড় খাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে নিতাইমাস্টার যেরকম ওরে বাবারে, গেছি রে বলে চেঁচিয়ে লাফ দিলেন–তাতে হুলুস্থুল পড়ে গেল।
রীতিমতো হইচই শোরগোল। লোকে ভাবল বুঝি ডাকাত পড়েছে। আশেপাশের পাড়া থেকে, পুরনো বাজার থেকে লোজন এমনকী থানা থেকে সেপাইরা ছুটে এল।
বড় দারোগা রামগতিবাবু থানার অফিস ঘরে বসে সন্ধ্যার পর এই সময়টা শক্তিসাধনা করেন। তার একটা পকেট কালী আছে। তিনি টেবিলের ওপরে একটা সুদৃশ্য কাঁচের পেপারওয়েটের গায়ে। ঠেস দিয়ে মা কালীকে স্থাপিত করেন। তারপর টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা সিঁদুর কৌটো আর। দুটো প্লাস্টিকের লাল জবা বের করেন। লাল জবা দুটো মায়ের পদতলে রেখে কৌটো খুলে এক বিন্দু সিঁদুর নিয়ে মায়ের পায়ে ঠেকিয়ে তারপর নিজের কপালে সিঁদুরফেঁটা পরেন।
এইসব আনুষঙ্গিক কাজ শেষ হলে পিছনের কাঠের আলমারি থেকে জমাদার শুকদেও যাদব একটি বিলাতি সুধার বোতল এবং একটি শ্বেতপাথরের গেলাস বার করেন। টেবিলের বাঁদিকের একটি শূন্য ড্রয়ার টেনে শুকদেও গেলাস ও বোতলটি রেখে দেন।
এবার রামগতিবাবু শ্বেতপাথরের গেলাসে অল্প অল্প করে কারণসুধা ঢেলে চুকচুক করে পান। করতে করতে ইষ্টদেবীর জপ করতে থাকেন। তাঁর ইষ্টদেবী হলেন ধূলোচন কালীমাতা।
গুনে গুনে একশো আটবার বড় দারোগা সাহেব ইষ্টদেবীর জপ করেন। জপের সংখ্যা ঠিক রাখবার জন্যে তিনি একটি উপায় উদ্ভাবন করেছেন। তার হাতের মাপ খুব পাকা। প্রতিবার গেলাসে ছোট চুমুকের পরের চুমুক পানীয় ঢালেন। প্রতিটি চুমুকের পর একবার করে ইষ্টদেবীর জপ করেন। এইভাবে নয় গেলাস পান করার সঙ্গে একশো আটবার জপ সম্পূর্ণ হয়।
জপ করার সময় কেউ রামগতিবাবুকে বিরক্ত করতে সাহস পায় না, শুধুমাত্র ঘুষদাতা ছাড়া। তবে তিনি তাদের সঙ্গে কোনও কথাই বলেন না। তা ছাড়া তিনি ঘুষের টাকা হাত দিয়ে স্পর্শ করেন না।
পানীয়ের বোতল এবং গেলাস যে খোলা ড্রয়ারে থাকে সেখানেই নিঃশব্দে টাকা রেখে যেতে হয়, কেউ কেউ অতি সাবধানী সঙ্গে একটা ছোট চিরকুটে নিজের নাম, ঠিকানা, প্রয়োজনে একটা রবারের গার্টারে টাকার সঙ্গে জড়িয়ে দেন। অবশ্য তার কোনও দরকার পড়ে না। বড় দারোগার শ্যেন দৃষ্টি দিয়ে তিনি বুঝে নেন কে কীসের জন্যে টাকা দিচ্ছে।
আজ এই ঝিরঝিরে বৃষ্টির সন্ধ্যায় রামগতিবাবু খুব আয়েশ করে ইষ্টনাম জপ এবং কারণ সুধা পান করছিলেন। পানীয়টি খুবই উচ্চমানের। খাঁটি বিলিতি এবং তাই শুধু নয় খুবই পবিত্র। মহামান্য পোপের ভ্যাটিকান প্রাসাদের ব্যক্তিগত ফোন নম্বর দিয়ে পানীয়টির নামকরণ হয়েছে ভ্যাটিকান বা ভ্যাট ৬৯ (Vat 69)৷
রামগতিবাবু সবে একাত্তর নম্বর ইষ্টজপে পৌঁছেছেন, ধূলোচনার সাধনা করতে করতে ক্রমশ তিনিও ধূলোচন হয়ে উঠেছেন। আজ আমদানিও ভাল হয়েছে।
মালেরপাড়ায় বনমালী চট্টরাজ খুন হয়েছে বলে সেই পাড়ার একুশজন লোককে কিছুদিন আগে খুনের মামলায় ফৌজদারিতে চালান দিয়েছিলেন। আজ সেই বনমালী চট্টরাজ সশরীরে আদালতে উপস্থিত হয়েছিলেন।
বিকেল থেকে বড় দারোগার মনটা খুঁতখুঁত করছিল। দিনকাল খারাপ, কীসে কী হয়ে যায় কে জানে?
অবশেষে এতক্ষণে একাত্তর চুমুক প্রসাদ সুধা পান করে এবং সমপরিমাণ ইষ্টনাম জপ করে তিনি একটু ধাতস্থ বোধ করছিলেন।
আরেক চুমুক হলেই ছয় নম্বর গেলাস শেষ হয় এমন সময় ইষ্টজপে বাধা পড়ল।
চুল্লুর ঠেকে ডাকাত পড়েছে ভেবে যে সেপাইরা থানা থেকে ছুটে গিয়েছিল, তারা এবং তাদের সঙ্গে আরও বহু লোকজন, তার মধ্যে ঠেকের খদ্দেররাও আছে চেঁচাতে চেঁচাতে থানার মধ্যে ঢুকে পড়ল। সকলের মুখে এক কথা, হনুমান নিতাইমাস্টারকে চড় মেরেছে।
এই অবৈধ প্রবেশে তদুপরি তার ধর্মকর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টি করায় বড়বাবু খুবই চটে গিয়েছিলেন। কিন্তু দিনকাল বড় খারাপ। আজ আদালতের ঘটনাটাও খুব সুবিধের নয়। তা ছাড়া থানার মধ্যে উত্তেজিত জনতা।
ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবন করার চেষ্টা করলেন রামগতিবাবু। বহু লোকের সম্মিলিত কলরবে তিনি হনুমান শব্দটি শুনতে পাননি শুধু শুনেছেন নিতাইমাস্টারকে চড় মেরেছে।
পাকা দারোগার মতো রামগতিবাবু ঘটনার ভিতরে প্রবেশ করলেন, নিতাইমাস্টারকে কেন চড় মেরেছে?
জনতার মধ্যে একজন বলল, নিতাইমাস্টার মদ খাচ্ছিলেন।
রামগতিবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, চড় যে মেরেছে সে অন্যায় কিছু করেনি। মাতালদের চাবকান উচিত। বলতে বলতে ছয় নম্বর গেলাসের শেষ চুমুকটি না খেয়েই গেলাসটি অতি সন্তর্পণে খোলা ড্রয়ারে স্থানান্তরিত করলেন।
নিতাইমাস্টারকে কেউ চড় মেরেছে এটা জেনে রামগতিবাবু মনে মনে খুশিই হয়েছিলেন। লোকটা কখন কোন দলে কিছু বোঝা যায় না। একেক সময় বড় জ্বালায়, এমন কী সরকারের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয়। কিন্তু এখন মনের ভাব গোপন করে দারোগাসুলভ গাম্ভীর্যে তিনি জানতে চাইলেন, তখন নিতাইমাস্টার কী করছিলেন?
চুল্লুর ঠেকের এক প্রত্যক্ষদর্শী খদ্দের বললেন, কী বলব স্যার, নিতাই মহীয়সী ইন্দিরা গান্ধীকে গালাগাল করছিল, অনেকক্ষণ ধরেই করছিল।
একথা শুনে রামগতিবাবুর মাথায় রক্ত উঠে গেল। তিনি ইমারজেন্সি রিক্রুট। দিনের পর দিন মাসের পর মাস দেয়ালে দেয়ালে এশিয়ার মুক্তিসূর্য ইন্দিরা গান্ধী লিখে দারোগার চাকরি পেয়েছিলেন।
রামগতিবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় কী যে হল। হঠাৎ আঁতকিয়ে উঠে উত্তেজিত জনতা দ্বিখণ্ডিত হয়ে পথ করে দিল আর সেই বীর হনুমান তার হাতে তখনও ধরা রয়েছে নিতাইমাস্টারের কাঁচের গেলাস সে মুখে হুপ-হুঁপ শব্দ করতে করতে এবং স্পষ্টতই প্রমত্ত অবস্থায় টলতে টলতে থানা কক্ষে প্রবেশ করল।
তখন বড় দারোগা রামগতিবাবুসম্বিৎ হারাননি, তিনি হনুমানের উদ্দেশ্যে হেঁকে উঠলেন, এই এখানে কী? ভাগ এখান থেকে?
হনুমান ঘরের মধ্যখানে এসে গেছে। সে কটমট করে রামগতিবাবুর দিকে তাকাল, সেও ইতিমধ্যে ধূম্রলোচন হয়ে গেছে, সে দৃষ্টি বড় ভয়ংকর।
জমাদার শুকদেও যাদব বড় দারোগার পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি বললেন, সাহেব হিন্দিমে বলিয়ে বজরঙ্গবলি বাংলা সমঝায় না।
উপস্থিত জনতার মধ্যেও অনেকে বলল, স্যার হনুমান বাংলা কি বুঝবে, ওর সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলুন।
কিন্তু, দুঃখের বিষয়, হিন্দি বা বাংলা কোনও ভাষাই ব্যবহার করার সুযোগ পেলেন না রামগতিবাবু। তার আগেই হনুমান এক লাফে টেবিলে উঠে সটান এক চড় কষাল রামগতিবাবুর গালে।
একাত্তর চুমুক কারণ সুধার পরে এই রকম একটা মত্ত হনুমানের চড়ে রামগতিবাবু চোখ উলটিয়ে মেঝেতে টলে পড়লেন।
হইহই কাণ্ড। চোখে মুখে জল ছিটাও, ডাক্তার ডাকো।
বীর হনুমান কিন্তু নির্বিকার। সে ধীরে-সুস্থে টেবিলের ওপর বসে খালি ড্রয়ারের মধ্যে হাত গলিয়ে প্রথমে বড় দারোগার পাথরের গেলাসটা বার করে অবশিষ্ট বাহাত্তরতম চুমুকটি শেষ করল।
জিনিসটা তার ভালই লাগল। এবার সে শ্বেতপাথরের গেলাসটা মেঝেতে ছুঁড়ে ভেঙে ফেলে দিল। তারপর নিতাইমাস্টারের কাঁচের গেলাসটায় ভ্যাট ঊনসত্তুরের বোতল থেকে মূল্যবান পানীয় ঢেলে ঢেলে খেতে লাগল।
এতক্ষণে তার দৃষ্টি পড়ল টেবিলের ওপর স্থাপিত পেপার-ওয়েট নির্ভর পকেট কালীটার দিকে। মা কালীর পদপ্রান্তের সিঁদুর সাবধানে সাবধানে একটা আঙুলে ছুঁইয়ে নিজের নোমশ কপালে মাখল, তার আগে অবশ্য অল্প একটু সিঁদুর জিব দিয়ে চেটে পরীক্ষা করেও দেখেছিল।
এরপর যেটুকু করার বাকি ছিল সেটুকুও করল। একটি ছোট লাফ দিয়ে বড়বাবুর সদ্য পরিত্যক্ত সামনের চেয়ারে গিয়ে বসল।
এদিকে ধরাধরি করে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে মুখে চোখে জল ছিটোতে একটু পরে রামগতিবাবুর জ্ঞান ফিরল। জ্ঞান ফিরতেই তিনি প্রথম আদেশ দিলেন, ওই বানর হারামজাদাকে গুলি করে মার।
আদেশ শুনে হনুমানভক্ত জমাদার শুকদেও যাদব শিউরে উঠলেন। জিব কেটে, চোখ বুজে, কানে আঙুল দিলেন। তারপর ধাতস্থ হয়ে বীরের মতো জানালেন, তিনি তার শরীরে প্রাণ থাকতে বজরঙ্গবলির ওপর গুলি চালাতে দেবেন না। জনতার মধ্যেও অনেক সমস্বরে শুকদেওজিকে সমর্থন জানাল।
ব্যাপার সুবিধের নয় বুঝে, ভঙ্গ নেশা নিয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে রামগতিবাবু কোয়ার্টারে ফিরে গেলেন।
পরের দিন সকালবেলায় হনুমানটাকে কাঁঠালহাটির কোথাও দেখা গেল না। সবাই, বিশেষ করে রামগতিবাবু এবং নিতাইমাস্টার হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
কিন্তু ভর সন্ধ্যায় কোথা থেকে যে ফিরে এল হনুমান। প্রথমে চুল্লুর ঠেকে এবং পরে থানায় আক্রমণ চালাল। যথাক্রমে নিতাইমাস্টার এবং রামগতিবাবু নির্যাতিত হলেন।
তারপর থেকে আজ দশদিন একনাগাড়ে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়ে চলেছে।
দিনমানে বীর হনুমানের টিকিটিও দেখতে পাওয়া যায় না। অন্ধকার ঘন হতেই তার হামলা শুরু হয়।
দ্বিতীয় দিন চড় খাওয়ার পরেই নিতাইমাস্টার ঠেকে আসা এবং চুলু খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন।
তৃতীয় দিন থেকে রামগতিবাবু সন্ধ্যাবেলা থানায় না বসে নিজের কোয়ার্টারেই ধূম্রলোচনার সাধনা করেছিলেন। কিন্তু চতুর্থ দিনেই গন্ধে গন্ধে হনুমান সেখানে হাজির।
বন দপ্তরকে রামগতিবাবু খবর দিয়েছিলেন, তাঁরা বলেছেন দিনের বেলায় হনুমান বেরোলে জানাবেন। আমাদের লোক গিয়ে ধরে আনবে। রাতের বেলায় সম্ভব হবে না, কর্মীদের তা হলে ওভারটাইম দিতে হবে।
ফায়ার ব্রিগেড অনেক সময় এ ধরনের কাজ করে। মহকুমা সদরে গিয়ে দমকল দপ্তরে কথা বলে এসেছেন। কিন্তু তারা নারাজ। আগুন না লাগলে তারা নড়বেন না।
.
কাঁঠালহাটি থানার বড় বিপদ।
রামগতিবাবু স্থির করেছেন একদিন সন্ধ্যায় গোপনে থানায় আগুন ধরিয়ে দেবেন।
কাণ্ড-কারখানা
০১. বর্তমান
এখন যাঁরা বর্তমানে আছেন মর্ত্যলোকে
– রবীন্দ্রনাথ
পার্ক স্ট্রিটের পাশের একটি গলির মধ্যে অফিস। একটা পুরনো বাড়ির দোতলায়, সিঁড়িটা কাঠের। ঘরের দরজা জানলাগুলো অতিকায় আকারের, নয় ফুট বাই পাঁচ ফুট, ছাদের সিলিং প্রায় চৌদ্দ ফুট উঁচুতে।
এসব বাড়িতে এককালে সাহেবসুবোরা, সিভিলিয়ান বা ব্যারিস্টাররা থাকতেন। তাঁরা প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে বিদায় নিয়েছেন। তারপরে বেহাত, বেদখল হতে হতে এখন কে যে মালিক সেটা বোঝাই কঠিন।
বাড়ির মেরামত নেই, চুনকাম নেই। তবে সামনের লন-এ পুরনো দিনের দু-চারটে চাঁপা, গন্ধরাজ, কামিনী ফুলের গাছ রয়েছে। সময়ে-অসময়ে সেসব গাছে ফুল ফোটে, সেই ফুলের গন্ধ। একেকদিন অকারণে আচ্ছন্ন করে তোলে পুরনো সাহেবপাড়ার জরাজীর্ণ বাড়ির চারপাশ।
বাড়িটার নীচে-ওপরে ফুটবল খেলার মাঠের মতো লম্বা-চওড়া বড় বড় ঘরগুলোকে নানা কায়দায় পার্টিশন করে ছোট ছোট ঘর বানানো হয়েছে। এই যাকে বলে কিউবিকল।
এইসব কিউবিকলের অধিকাংশই ডাক্তারের চেম্বার। কিছু কিছু ঘরে নতুন যুগের ধোপদুরস্ত জোচ্চোর প্রমোটর, ডেভলপার কোম্পানি বানিয়েছে। তা ছাড়া রয়েছে কমপিউটার কারবার, হরেকরকম ব্যবসার প্রতিষ্ঠান। এবং একটি বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠান, যাদের মডেল সুন্দরীরা এতই জনপ্রিয় যে দিনের বেলায় কখনও আসেন না। তাদের প্রবেশ ঘটে সন্ধে গড়িয়ে রাতে।
এসব কথা ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের গল্প এই প্রাচীন বাড়ির দোতলায় সিঁড়ির ডান পাশের একটি ছোট কিউবিকলের ব্যানার নিয়ে। কারণ এর ব্যাপারটা একটু অন্যরকম।
নীচে কাঠের সিঁড়ির পাশে একটা ডাকবাক্সে এবং উপরোক্ত ছোট কিউবিকলের গায়ে ইংরেজিতে কোম্পানির নাম লেখা আছে। দুই শব্দের নাম কিন্তু চট করে উচ্চারণ করা বেশ কঠিন। ইংরাজি ভাষায় লেখা হলেও যেকোনও সামান্য ইংরেজি জানা লোক বুঝতে পারে এই কোম্পানির নামের শব্দ দুটো মোটেই ইংরেজি নয়। কেউ কেউ এমনও ভাবতে পারে, ফরাসি বা ইতালীয় কোম্পানি এটা।
বাগাড়ম্বর না বাড়িয়ে ওই কোম্পানির নামটা আপাতত জানিয়ে রাখছি। তবে সাদা বাংলায় জানালে বিষয়টা বোধগম্য হবে না। তাই লেটার বাক্সে সাইনবোর্ডে যেমন আছে তাই জানাচ্ছি।
KANDA-KARKHANAA
যাঁদের এরপরেও বুঝতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে তাদের সুবিধের জন্যে নামটা সাদা বাংলায় পড়ে দিচ্ছি,
কাণ্ডকারখানা
কারও কারও মনে কৌতূহল জাগতে পারে এরকম অদ্ভুত নামের কোনও কোম্পানি হতে পারে কিনা? না, পারে না, মাত্র এই একটিই আজ পর্যন্ত হয়েছে।
এর পরেই অবশ্য প্রশ্ন উঠবে এই রকম বেগতিক নামের কোম্পানি, কারখানা বা অফিসে কী কাজ হয়, কেন এই কাণ্ডকারখানা?
এ প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আমাদের ওই ইংরেজিতে নাম লেখা কিউবিকলের মধ্যে, কাণ্ডকারখানার মধ্যে প্রবেশ করতে হবে।
কাণ্ডকারখানার ভেতরটা অবিকল ডাক্তারের চেম্বারের মতো, বোধহয় এককালে তাই ছিল কারণ পার্টিশনের কাঠের দরজার গায়ে একটা পুরনো দিনের গ্ল্যাক্সো বেবির ছবি, তার নীচে একটা। দুই কাঁটাওয়ালা নকল প্লাস্টিকের ঘড়ি, যার কাটা দুটো হাত দিয়ে ঘোরানো যায় এবং যার উপরে লেখা আছে ডাক্তারবাবুর জন্যে ঘড়ির সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।
চেম্বারটি দুই অংশে বিভক্ত। ঘরের প্রথম আধাআধি অংশ ভিজিটরস রুম। সেখানে কয়েকটি পুরনো সোফা, বাড়তি দুটো কাঠের চেয়ার, একটা লম্বা নিচু টেবিলে অনেক রকম ইংরেজি বাংলা পত্র-পত্রিকা রয়েছে। সেগুলো প্রায় সবই ময়লা, ছেঁড়া। একটা সিনেমা পত্রিকার প্রচ্ছদে দেখা যাচ্ছে, একটি প্রশ্নমূলক প্রবন্ধের অবতারণা। উত্তমকুমার কি বোম্বাই চলে যাচ্ছেন? আর একটি খেলাধুলার পত্রে ছেঁড়া পাতায় বড় বড় অক্ষরে ঘোষণা রয়েছে পতৌদি এবার অবসর নিচ্ছেন। এই আদ্যিযুগের কাগজগুলো বোধহয় সেই ডাক্তারের চেম্বার থেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া।
ভিজিটরস রুমের পরেই দরজা বন্ধ প্রকৃত চেম্বার। তার মধ্যে টেবিল-চেয়ার। সেক্রেটারিয়েট টেবিলের এক পাশে একটা গদিমোড়া চেয়ার, সামনে দুটো হাতলওলা সাবেকি কাঠের চেয়ার।
ওই গদিমোড়া চেয়ারটায় বসেন শশাঙ্ক রায়চৌধুরী, এই কাণ্ড-কারখানার প্রাণপুরুষ, উদ্ভাবক ও পরিচালক। সামনের চেয়ার দুটো কাণ্ডকারখানার মক্কেলদের জন্যে। অধিকাংশই গোপন ব্যাপার। অনেকে একা আসেন। অনেকে আবার স্ত্রী কিংবা কোনও অন্তরঙ্গ বন্ধুবান্ধবকে সঙ্গে আনেন।
কাণ্ডকারখানায় কী ধরনের কাজ হয় সেটা বোঝনোর জন্যে দু-একটা উদাহরণ দিচ্ছি।
তার আগে একটু ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন।
মনে করুন আপনি সারা সন্ধ্যা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে, তাস পিটিয়ে হই হই করে কাটিয়েছেন, এখন চোরের মতো বাড়ি ফিরছেন, আপনার স্ত্রী হাতা কিংবা খুন্তি হাতে আপনার জন্য। অধীর প্রতীক্ষা করেছেন। ঘড়িতে এগারোটা বাজে।
এই অবস্থায় আপনি নিশ্চয় আপনার স্ত্রীকে বলবেন না এত রাত পর্যন্ত তাস খেলেছেন, আড্ডা দিয়েছেন। আপনাকে বলতে হবে আপনার অফিসের এক সহকর্মী হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। তাকে ডাক্তার দেখিয়ে শহরের অপর প্রান্তে তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসতে দেরি হয়ে গিয়েছিল, কিংবা মানিব্যাগ পকেটমার হওয়ার আপনি অফিস থেকে বাড়ি পর্যন্ত এগারো মাইল পথ হাঁটতে হাঁটতে আসছেন।
বলা বাহুল্য, এই দুটোর কোনওটাই তেমন বিশ্বাসযোগ্য নয় এবং এর ফলে আপনাকে হয়তো আপনার স্ত্রীর হাতে আরও বেশি মার খেতে হবে।
কিন্তু আপনি যদি কাণ্ডকারখানায় এসে মাত্র দশ জেম অর্থাৎ একশো সত্তর টাকা ফি দিয়ে শশাঙ্ক রায়চৌধুরীর কাছ থেকে পরামর্শ নিতেন তা হলে এমন হত না।
ঠিক এই রকম একটা কেস কাল বিকেলেই শশাঙ্কবাবুর কাছে এসেছিল। বরানগরের ধনঞ্জয়বাবু বাড়িতে কুটুম এসেছে বলে দমদম বাজারে গিয়েছিলেন ভাল মাছ কিনতে। কিন্তু গলির মোড়েই আটকে গিয়েছিলেন একটা তিন তাসের ঠেকে। সকাল গড়িয়ে দুপুর, বেলা চারটে পর্যন্ত চলল সেই জুয়াখেলা। বাজারের ব্যাগ পড়ে রইল ধনঞ্জয়বাবুর পায়ের কাছে।
বিকেল চারটেয় যখন ক্লান্ত জুয়াড়িরা যে যার মতো পাততাড়ি গোটাল, তখন ধনঞ্জয়বাবুর প্রতি ভাগ্যদেবী শ্রীযুক্ত জুয়া ঠাকুরানি খুবই প্রসন্না। তিনি প্রায় হাজার বারোশো টাকা জিতেছেন।
বাজারের ব্যাগটা পায়ের কাছ থেকে কুড়িয়ে নিয়ে ঠেক থেকে বেরিয়ে ধনঞ্জয়বাবু ভাদ্র মাসের বিকেলবেলার কড়া রোদে হুশ ফিরে পেলেন। বাড়িতে কুটুম, রীতিমতো বড় কুটুম, স্ত্রীর বড় ভাই, তারই জন্যে ভাল মাছ কিনতে বার হয়ে তারপর এই কাণ্ড।
কিন্তু ধনঞ্জয়বাবু নানাসূত্রে কাণ্ডকারখানার খবর জানতেন। ভাসা ভাসা ভাবে কোথায় কাণ্ডকারখানার অফিসটা সেটারও ধারণা ছিল। সঙ্গে সঙ্গে একটা ট্যাক্সি নিয়ে সাহেব পাড়ায় এসে খুঁজে খুঁজে কাণ্ড কারখানায় পৌঁছে গেলেন।
ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করার পরে একশো সত্তর টাকার বিনিময়ে শশাঙ্কবাবুর পরামর্শ পেলেন।
শশাঙ্কবাবু ধনঞ্জয়বাবুর কথা শুনে বললেন, রদ্দি পুরনো বস্তাপচা ব্যাখ্যায় এ যাত্রা পার পাবেন। আপনাকে নতুন কৌশল নিতে হবে।
নতুন কৌশলগুলির অবশ্য রকমফের আছে। এবং তা আগেই লিখে সাইক্লোস্টাইল করে রাখা আছে। শশাঙ্কবাবু তার টেবিলের বাঁ পাশে গাদা করে রাখা ফাঁইলের মধ্য থেকে একটা ফাইল খুঁজে বার করলেন, ফাঁইলের গায়ে লেখা গৃহশান্তি।
গৃহশান্তি শীর্ষক নথিটি খুলে তার মধ্যে থেকে একটি নির্দেশাবলী বার করলেন তিনি, তারপর সেটা ধনঞ্জয়বাবুকে দিলেন।
নির্দেশাবলী অতি দীর্ঘ ও বিস্তৃত, বেশ কয়েক শিট মুদ্রিত পৃষ্ঠা। তার মধ্য থেকে কয়েকটি বাছাই করে সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপন করছি।
(১) আপনার যদি টাকা থাকে ও সাহস থাকে, এখান থেকে সরাসরি বেহালা ফ্লাইং ক্লাবে চলে যান। একটা বিমান ভাড়া করে সেই বিমান থেকে প্যারাসুটে করে নিজের বাড়ির ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। শুধু আপনার গৃহিণী কেন, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই এত চমৎকৃত হবেন যে দেরি করে আসার প্রশ্নই উঠবে না।
(২) বুকে ব্যথা করছে বলে যেকোনও নার্সিংহোমে ভরতি হয়ে যান, সেখান থেকে বাড়িতে খবর পাঠান।
(৩) যেকোনও ট্রাফিক পুলিশের হুইসেল বা ছাতা কেড়ে নিন। এক ঘণ্টা পরে থানার হাজত থেকে বাসায় খবর পাঠান।
এইরকম আরও অনেক আছে। পুরো ব্যবস্থাপত্রটি খুঁটিয়ে পড়ার পর ধনঞ্জয়বাবু বলেছিলেন, এর কোনওটাই তার পক্ষে সম্ভব নয়। তখন টেবিলের ওপর থেকে খবরের কাগজের কাটিং লেখা একটি নথি তুলে নিয়ে সেটা খুলে কয়েকটা কাটিং পর্যালোচনা করে শশাঙ্কবাবু বললেন, বাগবাজারের ঘাটে চলে যান। সন্ধ্যার দিকে ইলিশ উঠছে, দুটো বড় দেখে মাছ কিনুন। তারপর সেখান থেকে দৌড়ে বাড়ি চলে যান, ঘামে জামাকাপড় ভিজে জবজবে হয়ে যাবে, বাসায় প্রবেশ করে ধপ করে বসে পড়ুন, এক গেলাস জল চান। তারপর বলুন, বসনিয়ায় গণহত্যার প্রতিবাদে ঘুঘুডাঙায় পথ অবরোধ চলেছে। এই রোদ্দুরে এতটা পথ হাঁটতে হাঁটতে আসছি। আঃ আরেক গেলাস জল।
সৎ পরামর্শ পেয়ে ধনঞ্জয়বাবু খুশি মনে জোড়া ইলিশ হাতে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন।
এই তো আজ এখন শশাঙ্কবাবুর সামনে বসে রয়েছে নতুনবাজার থানার বড় দারোগা রমজান খান সাহেব।
খান সাহেব মহা বেকায়দায় পড়েছেন। তিনি বছর দেড়েক আগে নতুনবাজার থানার পোস্টিং নিলামে তিন লাখ টাকায় ডেকে নিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে নিলামের ডাকে হেরে গিয়ে তাঁর পুরনো ব্যাচমেট তথা প্রতিদ্বন্দ্বী জগা মাইতি দুর্নীতি প্রতিরোধ দপ্তরে ইনসপেক্টর হয়ে চলে যায়। সেই জগা এখন তার পিছনে লেগেছে।
বালিগঞ্জ লেকে, লেক গার্ডেনে, লেক টাউনে, সল্টলেকে, কলকাতার মধ্যে, আশেপাশে যতরকম লেকের ব্যাপার আছে সব জায়গায় খান সাহেবের বাড়ি বা ফ্ল্যাট আছে। লেকের ওপর খুব ঝোঁক তার। এ ছাড়া বেনামিতে সতেরোটা ট্রাক, বারোটা বাস মিনিবাস, গোটা তিনেক ট্যাকসি, শখানেক রিকশা তার হয়েছে। আর সেই অনুযায়ী ধনসম্পদ বিভিন্ন ব্যাঙ্কের বিভিন্ন শাখায় অ্যাকাউন্ট এবং লকার। প্রায় সবই ধরে ফেলেছে জগা।
ঘোর বিপদে পড়ে খান সাহেব কাণ্ড-কারখানায় এসেছেন। তার সমস্ত কথা শুনে শশাঙ্কবাবু সম্পত্তি রক্ষা শীর্ষক একটি নথি খুলে একটা ব্যবস্থাপত্র রমজান খানের হাতে দিলেন। সেটা একবার চোখ বুলিয়ে রমজান খান বললেন, দাদা, সবই ট্রাই করেছি, এই বিয়ের সময় শ্বশুরবাড়ি থেকে যৌতুক পেয়েছি, নানান সম্পত্তি, চাচার সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে, দান সূত্রে পেয়েছি, লটারিতে টাকা পেয়ে করেছি কিন্তু কিছুই ধোপে টিকছে না। জগা বড় ধূর্ত।
তখন শশাঙ্ক বললেন, আমি আপনাকে নতুন একটা পরামর্শ দিচ্ছি, এটাই লেটেস্ট চলছে। আপনি যেকোনও বড় নেতা, মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী এমনকী লাটসাহেব বা বিচারপতির নাম বলুন, একটা গ্রহণযোগ্য নাম ভেবেচিন্তে বলবেন, তাঁর সঙ্গে কার্যকারণ কোনও সূত্রে আপনার যোগাযোগ আছে বা কখনও ছিল। তারপর বলুন এসব সম্পত্তি, টাকা পয়সা, সোনাদানা সবই তার, আপনার বেনামে তিনিই এসব করেছেন। নিজের নামে করতে অসুবিধে আছে কিনা তাই। দরকার হলে এফিডেবিট করে বলে দিন।
রমজান খান হাজার হলেও পুলিশের লোক, আদালতকে এখনও ভয় পান। তিনি বললেন, আদালতে এফিডেবিট করে এসব কথা বলা যাবে?
শশাঙ্কবাবু বললেন, কলকাতায় এফিডেবিট করতে না চান, সুইজারল্যান্ড লন্ডন বা নিদেন পক্ষে ঢাকায় চলে যান। সেখানে নিশ্চয় আপনার আত্মীয়স্বজন আছেন, সেখানে গিয়ে এফিডেবিট করিয়ে ফিরে আসুন।
আশা করি ইতিমধ্যেই পাঠক-পাঠিকা ধরে ফেলেছেন, কাণ্ডকারখানা কোম্পানির কাজকর্ম কী।
এই কোম্পানির একজনই লোক। এই শশাঙ্ক রায়চৌধুরী। তিনি কীভাবে এই কোম্পানির পরিকল্পনা করলেন সেটা অনুধাবনের জন্যে শশাঙ্কবাবুর অতীত ইতিহাস একটু সংক্ষেপে আলোচনা করছি।
০২. অতীত
হে অতীত তুমি গোপনে গোপনে
–রবীন্দ্রনাথ
শশাঙ্ক রায়চৌধুরীর অতীত জীবনের মাত্র দুটো ঘটনা বলব।
প্রথমে তার স্কুল জীবনের একটা দুঃখজনক ঘটনার কথা বলি। তখন তিনি বিদ্যালয়ের মাঝারি ক্লাসে এই সিক্স-সেভেনে পড়েন। একবার পর পর কয়েকদিন জ্বরে ভুগে প্রায় সপ্তাহখানেক কামাই করে প্রথম যেদিন অন্নপথ্য করে স্কুলে ফিরলেন সেদিনই পড়লেন বিপদে।
ভয়ংকর বিপদ। প্রথম পিরিয়ডে ইংরেজির ক্লাস। সব ছাত্র হোম ওয়ার্কের খাতা জমা দিল, শুধু শশাঙ্কবাবু বাদ। তিনি যে স্কুলেই আসতে পারেননি, হোম টাস্ক কী ছিল তাই জানতেন না। এদিকে ইংরেজির মাস্টারমশাই ছিলেন একজন পার্টটাইম গুণ্ডা। জ্বর হয়েছে, তাই আসতে পারিনি এই সব কোনও কথাই তিনি বিশ্বাস করলেন না। সদ্য রোগমুক্ত শশাঙ্ককে তিনি বেধড়ক পেটালেন।
কী করে শশাঙ্ক যেন বুঝে গেলেন সত্যি কথায় কাজ হবে না। বানিয়ে বিশ্বাসযোগ্য বিচিত্র কারণ দেখাতে হবে। মাস দুয়েক মামার বাড়িতে মাসির বিয়েতে দিন দশেক কাটিয়ে স্কুলে ফিরতেই আবার সেই ইংরেজি মাস্টারের হাতে পড়লেন শশাঙ্কবাবু।
কিন্তু এবার ব্যাখ্যা প্রস্তুত ছিল। মামার বাড়ি তিনি গিয়েছিলেন তবে সেটা মাসির বিয়েতে, তা বললেন না। বদলে যা বললেন, সেটা হল তার দাদু মানে মাতামহ আমলকী গাছ থেকে আমলকী পাড়তে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে হাত-পা ভেঙে ফেলেছেন, সেই সংবাদ পেয়ে তিনি তার মাকে সঙ্গে করে মামার বাড়িতে গিয়েছিলেন, অবস্থা গুরুতর দেখে এ কয়দিন তাকে মায়ের সঙ্গে মামার বাড়িতে থাকতে হয়।
ছাত্রের এই কথা শুনে মারকুটে মাস্টার পর্যন্ত উদ্যত চড় থামিয়ে জিজ্ঞাসা করতে বাধ্য হলেন, দাদু, মানে তোমার মার বাবা?
শশাঙ্ক বলেছিলেন, আজ্ঞে হ্যাঁ।
মাস্টারমশায় তখন আবার প্রশ্ন করেন, বয়েস নিশ্চয় অনেক হয়েছে।
শশাঙ্ক জানিয়েছিলেন, বেশি নয়, এই সদ্য বাহাত্তর হয়েছে।
মাস্টারমশায় স্তম্ভিত হয়ে বললেন, বাহাত্তর বছর কম বয়েস নাকি? এই বয়েসে তোমার দাদু গাছে উঠে ফল পাড়েন।
শশাঙ্ক জানিয়েছিলেন, শুধু আমলকী নয়, আম, লিচু এমনকী দাদু তরতর করে নারকেল গাছের মাথায় উঠে গিয়ে ডাব-নারকেল পেড়ে আনেন।
হতবাক মাস্টারমশায় সেদিন শশাঙ্ককে মারেননি। পরে নিয়মিত সেই কল্পিত দাদুর শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেন। মাস তিনেক পরে যখন তিনি জানলেন যে সেই বৃদ্ধ সুস্থ হয়ে উঠেছেন এবং আবার গাছে উঠে ফল পাড়া আরম্ভ করেছেন, তখন তিনি স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বাঁচলেন।
ছাত্রজীবনের পরে শশাঙ্কবাবুর চাকুরি জীবনের কথা বলতে হয়। বাইশ বছর বয়সে একটা সরকারি অফিসে কেরানির চাকরিতে তিনি প্রবেশ করেন। এ বয়েসটায় চাকরি করতে ভাল লাগে না। শশাঙ্কবাবু রাত জেগে চুটিয়ে আড্ডা দিতেন। ফলে মাঝেমধ্যেই অফিসে কাজের সময় ঘুমিয়ে পড়তেন।
শশাঙ্কবাবু দুর্ভাগ্যক্রমে রমলা পাল নামে এক মহিলা বড়বাবুর অধীনে কাজ করতেন। অবিবাহিতা, মধ্যবয়সিনী কুমারী রমলা পাল ভারি খিটখিটে স্বভাবের ছিলেন। তা ছাড়া খুব খোঁচা দিয়ে কথা বলতেন।
একদিন শশাঙ্কবাবু প্রায় সারারাত আড্ডা দিয়ে সকালে স্নান-খাওয়া করে অফিস যাওয়ার আগে বিছানায় একটু গা এলিয়ে শুয়েছিলেন। ওই অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েন। ফলে অফিসে আসতে দেরি হয়ে যায়।
বড়বাবু মানে রমলা পালকে তিনি নিজে থেকেই জানান যে বাসায় খাওয়া-দাওয়ার পরে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তাই এই বিলম্ব। তার ব্যাখ্যা শুনে রমলা পাল কাষ্ঠহাসি হেসে জানতে চান, সে কী আপনি বাড়িতেও ঘুমোন নাকি?
এর পরে যে মাস ছয়েক চাকরিতে ছিলেন, শশাঙ্কবাবু আর রমলা পালকে একটিও সত্যি কথা বলেননি। একবার বন্ধুর বিয়েতে বরযাত্রী গিয়ে পরের দিন বরযাত্রীর সাজে সিল্কের পাঞ্জাবি আর কোঁচানো ধুতি পরে বেশি দেরি করে কনের বাড়ি ডোমজুড় থেকে অফিসে এসে পৌঁছলেন।
বলা বাহুল্য, একে দেরি, তার ওপরে এই সাজপোশাক দেখে রমলা পাল কটাক্ষ করেছিলেন। তখন শশাঙ্কবাবু বললেন, আমার বড় পিসিমার বিয়ে ছিল ম্যাডাম।
রমলা পাল বিস্মিত হয়ে বললেন, আপনার বড় পিসিমার বিয়ে?
শশাঙ্কবাবু বললেন, তেমন বয়েস হয়নি। এই আর্লি ফিফটি। আমারই এক বন্ধুকে বিয়ে করলেন।
রমলা পাল বললেন, আপনার বড় পিসিমা আপনার বন্ধুকে বিয়ে করলেন, আর্লি ফিফটিতে?
ইয়েস ম্যাডাম, শশাঙ্কবাবু বললেন, আপনার চেয়ে অন্তত দশ বছরের বড় হবেন।
এরপর থেকে রমলা পাল কেমন সলজ্জ দৃষ্টিতে শশাঙ্কবাবুর দিকে তাকাতেন। তাঁকে দেখলেই শাড়ির আঁচলটা দিয়ে গলা ঢাকা দিতেন কিংবা অন্যমনস্কভাবে হাতের আঙুলে জড়াতেন।
ইতিমধ্যে শশাঙ্কবাবু বুঝে গেছেন যদি ঠিকমত মিথ্যার বেসাতি করা যায় তাহলে তার থেকে লাভজনক আর কিছু নেই।
স্ত্রীকে, বাবাকে, অফিসের ওপরওলাকে, বাড়িওলাকে, প্রেমিকাকে–পাড়ার মাস্তানকে, সবাইকে কত কারণে কতরকম ব্যাখ্যা দিতে হয়। সেই ব্যাখ্যা যদি চমকপ্রদ অথচ বিশ্বাসযোগ্য হয়, তবেই কাজ চলে, না হলে বিপদ অনিবার্য।
প্রথম প্রথম শৌখিনভাবে একে-ওকে চেনা-জানাদের পরামর্শ দিতেন শশাঙ্ক রায়চৌধুরী। এখন ক্রমশ তার নাম ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন, না ছেড়ে উপায়ও ছিল না। শেষের। দিকে রমলা পাল বড়ইব্রীড়াপরায়ণা হয়ে উঠেছিলেন, তাঁকে দেখলেই কেমন ডগমগ হয়ে উঠতেন।
চাকরি ছেড়ে অবশ্য শশাঙ্ক রায়চৌধুরীর কোনও ক্ষতি হয়নি। কাণ্ড-কারখানার এখন রমরমা চলছে। প্রতি সন্ধ্যায় হাজার খানেক টাকা আয় হয়।
বিশেষ জরুরি প্রয়োজনে আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট না করেও যাওয়া যায়। পুজোসংখ্যার জন্যে যে লেখা ১ জুন দেয়ার কথা ছিল সেটা এই যে আমি এই ভাদ্রশেষেও লিখছি তা সম্ভব হয়েছে শশাঙ্কবাবুর কৃপায়। তারই পরামর্শে হাতের বুড়ো আঙুলে একটা মিথ্যে ব্যান্ডেজ বেঁধে সম্পাদকদের দেখিয়েছি, ঘুমের মধ্যে টিকটিকিতে কামড়িয়ে দিয়েছে বলে। তারা যে আমার কথা অবিশ্বাস করেননি, আমার জন্যে শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করেছেন, এই লেখা ছাপা হওয়াই তার প্রমাণ।
কালমেঘ
বঙ্গাব্দ তেরোশো ছিয়াশি।
রোববার ফাল্গুন মাস শেষ সপ্তাহ, সকাল সাড়ে দশটা।
বাইরের তিন কোনাচে ঘরে পুরনো বেতের চেয়ারে বসে পা দোলাতে দোলাতে মহিমাময় দেয়ালঘড়িটার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
এ বছর দোল পড়েছে মাসের দ্বিতীয় শনিবারে। একটা চমৎকার ছুটি বেঘোরে মারা গেল। শুধু তাই নয়, রোববারের আড়াটাও মারা পড়েছে। বন্ধুবান্ধব, জানাশোনা সবাই গেছে শান্তিনিকেতনে, বসন্ত উৎসবে। কেউ কাল সকালের আগে ফিরছে না। অথচ সুন্দর ফাল্গুন মাস। হালকা ফিকে রসুনের মতো একটু একটু ঠান্ডার আস্তরণ এখনও দিনের গায়ে জড়ানো আছে। আর সেই সঙ্গে সেই বিখ্যাত দক্ষিণের ফুরফুরে বাতাস, এই তো কলকাতার সবচেয়ে ভাল সময়।
এই সময়ে কেউ কলকাতা ছেড়ে বাইরে যায়! তাও আবার এই বুড়ো বয়সে শান্তিনিকেতনের বসন্ত মেলায়! মনে মনে তিনবার বন্ধুদের ধিক্কার দিলেন মহিমাময়।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জিবটা কেমন যেন খরখর করছে, গলা থেকে তালু পর্যন্ত মুখটা শুকিয়ে যাচ্ছে। বাড়ির মধ্য থেকে মহিমাময়ের স্ত্রী ভেতরের দরজার পর্দা তুলে স্বামীকে একা বসে ঘন ঘন পা দোলাতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, এক পেয়ালা চা খাবে নাকি? তাড়াতাড়ি বলল, উনুনে জল বসাচ্ছি
চায়ের কথাটা শুনে মহিমাময়ের মাথাটা বেশ গরম হয়ে গেল। বেশি বাক্যবিনিময়ে না গিয়ে তিনি শুধু সংক্ষিপ্ত ও সুগম্ভীর জবাব দিলেন না।
নিরাসক্তের মতো আর একবার দেয়ালঘড়ির দিকে তাকালেন মহিমাময়। এগারোটা বাজতে চলল। বাইরে নতুন এক টাকার কয়েনের মতো ঝকঝকে রোদ, দূরে ত্রিকোণ পার্কে না কি কোনও বাড়িতে একটা পোষা কোকিল ভোর থেকে ডাকছে তো ডাকছেই। নবীন বসন্তের মনোরম উষ্ণতায় চারদিক মেতে উঠেছে। এইরকম সুন্দর ছুটির দিনে কোনও ভদ্রলোক দুপুরবেলায় বাড়িতে বসে চা খায়! কোথাও গাছের ছায়ায় ফুরফুরে বাতাসে বসে বিয়ারের সোনালি তরলতায় চুমুক দিতে দিতে আজ হল নব বসন্তকে অভ্যর্থনা জানানোর দিন।
পাজামার উপরে গায়ে একটা পাঞ্জাবি চাপিয়ে ধুত্তোরি বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন মহিমাময়। কিন্তু একা একা আর কতদূর কোথায় যাবেন? আর সবচেয়ে বড় কথা, রাস্তাঘাট এখনও তেমন নিরাপদ হয়নি। আজ কয়েক বছর হল বড়বাজারওয়ালারা উঠে এসেছে দক্ষিণ কলকাতার বহুতল বাড়িগুলিতে। সেখানে হিন্দুস্থানি আর রাজস্থানিদের হোলি হো, হোলি হ্যায়, এখনও পুরোদমে চলেছে। কোথায় কোন অলিন্দ কি গবাক্ষ থেকে চপলা তরুণী রাজপথের অসহায় পদাতিকের গায়ে ফাগ কিংবা ইনডেলিবল কুমকুম ছুঁড়ে মারবে তা বলা যায় না।
ইতস্তত গলির মোড়ের দিকে এগোতে এগোতে সহসা মহিমাময় দেখলেন খুব চেনা একটা লোক তার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বড় রাস্তা থেকে এগিয়ে আসছে।
আগন্তুকের চুলে-মুখে নানারঙের আবির, গায়ের হাওয়াই শার্ট আর ফুল প্যান্টও বহুবর্ণরঞ্জিত, উজ্জ্বল রঙে এমন ঢাকা পড়ে গেছে অবয়ব ও গঠন যে বেশ কাছে না আসা পর্যন্ত মহিমাময় বুঝতে পারলেন না–তার বন্ধু জয়দেব আসছেন।
জয়দেবকে দেখে মহিমাময় যুগপৎ খুশি ও বিস্মিত হলেন। তাহলে যে শুনেছিলেন জয়দেব শান্তিনিকেতনে গেছে, গিয়েছিল হয়তো, আজই ফিরছে!
কাছে আসতে জয়দেবকে মহিমাময় জিজ্ঞাসা করলেন, তুই শুনলাম শান্তিনিকেতনে গিয়েছিস?
জয়দেব বললেন, কী করে যাব? পরশুদিন রাত থেকে আমি কেজরিওয়ালের বাড়িতে আটকে আছি!
মহিমাময় কেজরিওয়ালকে চেনেন না, জয়দেবের সমস্ত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির খবর রাখা কারও সাধ্য নয়। সুতরাং মহিমাময় প্রশ্ন করলেন, কেজরিওয়াল কে?
তিনরঙের আবির মাখা ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে জয়দেব বললেন, তুই চিনবি না। বড় ব্যবসা করে, বলপেনের রিফিল বানানোর যন্ত্র তৈরির মেশিনের পাইকারি কারবার করে। তা ছাড়া…
ঠিক আছে, যথেষ্ট হয়েছে, আর লাগবে না কেজরিওয়ালের অন্য ব্যবসা সম্পর্কে উৎসাহ না দেখিয়ে জয়দেবকে মধ্যপথে থামিয়ে দিয়ে মহিমাময় বললেন, তা এরকম রং খেললি কোথায়? কেজরিওয়ালের বাড়িতে?
জয়দেব করুণ কণ্ঠে বললেন, আরে না! ওই কেজরিওয়ালদের ওখানে কাল দুপুরে গানবাজনা, খাওয়া-দাওয়া হল। অল্পস্বল্প আবির ছিল, কিন্তু আসল গোলমালটা হল রাতে।
মহিমাময় বললেন, রাতে কী হল?
জয়দেব লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন, সে মহা বেকায়দা। সন্ধ্যাবেলা আমি ওদের বাড়িতে বাইরের ঘরে ঘুমোচ্ছি, কেজরিওয়ালার আত্মীয়স্বজন কাঁদের বাড়িতে যেন গেছে। আমি ঘুম ভেঙে উঠে দেখি ওদের আউট হাউসে চাকর ড্রাইভারেরা বড় বড় পিতলের লোটায় কী সব খাচ্ছে। আমি চোখ কচলাতে কচলাতে সেখানে গিয়ে বসলাম। চমৎকার ভাঙের শরবত, সবাই খুশি হয়ে আমাকে খাওয়াতে লাগল। তারপরে অল্প অল্প মনে পড়ছে–হই-হুঁল্লোড়, নাচগান, রং। একটা মোটামতন
টিকি মাথায় লোক আমাকে কাঁধে নিয়ে অনেকক্ষণ বেরিলিকা বাজারমে… গাইতে গাইতে খুব নাচল। তারপর ভাল মনে পড়ছে না। এই আধ ঘণ্টা আগে ঘুম ভেঙে দেখি দারোয়ানদের ঘরের পাশে একটা দড়ির খাঁটিয়ায় ডুমুর গাছের নীচে শুয়ে আছি, গায়ে-মাথায়, জামা কাপড়ে রং মাখা।
আর বেশি বলার দরকার ছিল না। মহিমাময় ব্যাপারটা অনেকখানিই বুঝলেন। এবার প্রশ্ন করলেন, তা এরকম ভূতের মতো বেশে কোথায় যাচ্ছিস?
জয়দেব বললেন, কেন, তোর ওখানে? চল, একটু বসা যাক!
মহিমাময় একটু ভেবে বললেন, কিন্তু তোর কি ভাঙের নেশা এখনও কেটেছে? চোখ তো জবাফুলের মতো লাল দেখছি।
জয়দেব বললেন, আরে ধ্যুৎ, ভাঙে আবার নেশা হয় নাকি! চোখ লাল হয়েছে বেশি ঘুমিয়ে। তারপর একটু থেমে নিয়ে বললেন, বাড়িতে কিছু আছে?
মহিমাময় বললেন, বাড়িতে একটু আধটু তলানি পড়ে আছে। সেসবে হবে না। আর আজ বিয়ার খাওয়ার দিন। আবহাওয়া দেখছিস না, বসন্তকালের দুপুরে বিয়ার ছাড়া খাওয়া যায়?
জয়দেব গম্ভীর হয়ে বললেন, মহিমা, তোর বয়েস কত হল?
প্রশ্নের গতিক দেখে একটু হকচকিয়ে গিয়ে মহিমাময় বললেন, কেন, এই অঘ্রানে বেয়াল্লিশ পূর্ণ হল!
জয়দেব বললেন, তা হলে তোর থেকে আমি আড়াই বছরের বড়, আমার বয়েস হল সাড়ে চুয়াল্লিশ। তারপর একটু থেমে থেকে বেশ বড় রকমের একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে জয়দেব এগিয়ে এসে মহিমাময়ের কাঁধে হাত রাখলেন, অবশেষে বললেন, আমাদের কি আর বয়েস আছে রে বিয়ার খাওয়ার? আমরা তো বুড়ো হয়ে গেছি। বিয়ার খাবে তো বাচ্চা ছেলেরা।
এরকম আশ্চর্য কথা শুনে মহিমাময় কিছু বুঝতে না পেরে বললেন, বাচ্চা ছেলেরা খাবে মায়ের বুকের দুধ, ফিডিং বোতলের দুধ, নিদেনপক্ষে গোরুর দুধ গেলাসে বা কাপে করে। তারা বিয়ার খাবে কেন?
জয়দেব মধুর হেসে বললেন, আরে না না, অত বাচ্চা নয়। অন্নপ্রাশনের কুড়ি বছর পর থেকে চল্লিশ বছর পর্যন্ত গাঁজা, ভাং, চুরুট, দোক্তা, বিয়ার, তাড়ি যা তোক একটা লোক খাক, খেয়ে যাক, কিছু আসে যায় না। কিন্তু যেই মানে মানে চল্লিশ পার হয়ে গেলি, তখন তোকে মানে মানে। ভেবেচিন্তে চলতে হবে। এমনকী সর্ষেবাটা সজনোটা চিবনোর আগে ভেবে নিতে হবে কটা উঁটা চিবনো ঠিক হবে।
জয়দেবের এরকম বয়সোচিত বক্তৃতা শুনে মহিমাময় অধৈর্য হয়ে পড়লেন, জয়দেবকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, স্টপ জয়দেব! অলরাইট, বিয়ার নয়, একটু আগে বাড়িতে দেখে এসেছি বউ চা করছে। চল দুজনে গিয়ে দু পেয়ালা চা খাই। এরপর থেমে গিয়ে মহিমাময় দুটি দন্তপাটি কিড়মিড় করে স্বগতোক্তি করলেন, এমন সুন্দর দিনটা জলে গেল! এবং সঙ্গে সঙ্গে তার খেয়াল হল, জলে নয়, বিনা জলে গেল!
ততক্ষণে জয়দেব মহিমাময়কে স্বগতোক্তি করা থেকে নিবৃত্ত করেছেন, তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, এই ভরদুপুরে চা খাবে কোন শালা? আমার সঙ্গে চল, এক বোতল জিন কিনে আনি।
মহিমাময় এই অবস্থায়ও রফা করার চেষ্টা করলেন, জিন খাওয়া যাবে না। বিটারস ফুরিয়ে গেছে।
জয়দেব এখন রীতিমতো উত্তেজিত, বললেন তুই একেবারে সাহেব হয়ে গেছিস মহিমা, বিটারস দিয়ে কী হবে? আর বিটারসের কী দাম জানিস?
বলা বাহুল্য, এত তর্কাতর্কির মধ্যেও জয়দেব এবং মহিমাময় ইতিমধ্যে বড় রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিজেদের অজান্তে গড়িয়াহাটের চৌমাথায় মদের দোকানের সামনে এসে গেছেন। এবার জয়দেব নির্দেশ দিলেন, মহিমা, তুই এক কাজ কর, সামনের ওষুধের দোকান থেকে তুই এক বোতল কালমেঘ নিয়ে আয়। ততক্ষণে আমি এখান থেকে জিনটা কিনে ফেলছি।
কিছুই অনুধাবন করতে না পেরে মহিমাময় সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে ভিক্টোরিয়া ফার্মেসি থেকে সাড়ে সাত টাকা দিয়ে এক শিশি কালমেঘ কিনে আনলেন, ততক্ষণে জয়দেব জিনের বোতল কিনে ফুটপাথে নেমে এসেছেন।
দুজনে মিলে বাড়িমুখো হাঁটতে হাঁটতে মহিমাময় জয়দেবের কাছে জানতে চাইলেন, কালমেঘ দিয়ে কী হবে? তোর কি লিভার খারাপ হয়েছে? তারপর বেশ ভেবে নিয়ে বললেন, লিভার খারাপ হলে মদ খাবি কেন? শুধু শুধু কালমেঘ খেয়ে কি সুরাহা হবে?
জয়দেব এবার চটে গেলেন, লিভার খারাপ হবে কেন আমার? আমার লিভার পাথরের মতো শক্ত। কালমেঘ লিভারের জন্যে নয়, ওটা নেওয়া হল জিন খাওয়ার জন্যে।
মহিমাময় বেশ অবাক হলেন, এই তেতোর তেতো কালমেঘ দিয়ে জিন! এর থেকে কুইনিন মিক্সচার খাওয়া ভাল!
এতক্ষণে ওঁরা দুজনে মহিমাময়ের বাড়ির দরজায় পৌঁছে গেছেন। ঘরে ঢুকে মহিমাময় তাড়াতাড়ি বাড়ির মধ্যে গিয়ে এক বোতল ঠান্ডা জল আর দুটো গেলাস নিয়ে এলেন।
এবার ঢালাঢলির পালা জয়দেবের। তিনি জিনের বোতলটা খুলে দু গেলাসে দু আঙুল পরিমাণ নিয়ে তার মধ্যে জল মেশালেন, তারপর সত্যি সত্যি ওই কালমেঘের শিশিটা খুলে দু গেলাসে দু ফোঁটা ঢেলে দিলেন। তারপর এক গেলাস মহিমাময়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, নে, খেয়ে দ্যাখ, মধুর মতো লাগবে।
মধুর মতো কালমেঘ? তুই কি একেবারে পাগল হয়ে গেলি জয়দেব? কাল রাতে কয় লোটা ভাং খেয়েছিস বল তো? হাতে গেলাস ধরে মহিমাময় জিজ্ঞাসা করলেন।
পরম আয়েস ও তৃপ্তির সঙ্গে একটা লম্বা চুমুকে গেলাসটা প্রায় অর্ধেক ফাঁক করে দিয়ে জয়দেব বললেন, দ্যাখ মহিমা, কালমেঘ হল দিশি বিটারস। বিলিতি বিটারসের চেয়ে ডবল ভাল। আর বিলিতি বিটারসও তেতো একটা গাছের রস। মদের মধ্যে দু ফোঁটা দিলেই এর স্বাদ বদলিয়ে যায়। আমার বড় জামাইবাবু আমেরিকায় এক ডজন সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল। যাদের যাদের দিয়েছিল, তারা এখনও চিঠি লেখে, খোঁজ নেয়।
এবার মহিমাময় সন্তর্পণে তার হাতে ধরা গেলাসটা জিবে ছোঁয়ালেন। সত্যিই তো, সামান্য কালমেঘের জাদুর পরশে ঝজালো ড্রাই জিনে অমৃতের স্বাদ এসেছে।
এ ঘটনা দীর্ঘ চার বছর আগেকার।
তারপর কলকাতার রাজপথে অনেক জনস্রোত বয়ে গেছে। সে জনস্রোতে আজকাল কদাচিৎ মহিমাময়ের সঙ্গে জয়দেবের দেখা হয়। স্রোতের স্বতন্ত্র পথে নিজ নিজ ধান্দায় দুজনে দু ধারায় প্রবাহিত হন।
শহরটা তেমন বড় নয়। তাই তবুও কখনও কখনও এখানে সেখানে দেখা যায়। জয়দেবকে দেখে খুশি হন মহিমাময়। মহিমাময়কে দেখে খুশি হন জয়দেব।
জয়দেবকে মহিমাময় আমন্ত্রণ জানান, বলেন, আয় জয়দেব, বাসায় যাই। সেই কালমেঘ এখনও শিশিতে অনেকটা রয়েছে। চল, বাসায় গিয়ে একটু জিন খাই।
জয়দেব আপত্তি করেন, ধ্যুৎ, জিন পুরুষমানুষে খায় নাকি, ও তো মেয়েলি পানীয়। আর তোর ওই কালমেঘ, ওয়াক, থুঃ! কুইনিন জলে গুলে খাবি, নিমপাতা চিবিয়ে খাবি, সজনোটা উচ্ছে কাঁচা খাবি। অনেক স্বাদ পাবি।
ক্ষুণ্ণ মনে মহিমাময় বাড়ি চলে আসেন। তিন কোনাচে বাইরের ঘরের পুরনো বেতের চেয়ারে বসে পা দোলাতে দোলাতে সামনের দেয়ালে তাকের উপরে চোখ রাখেন। ওখানে কালমেঘের শিশিটা রয়েছে। এখনও ওই শিশিটার মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কালমেঘ আছে। অন্তত পাঁচ টাকার জিনিস। এই দুর্দিনে জিনিসটা নষ্ট করতে মন চায় না।
কিন্তু শিশিটা কিছুতেই ফুরোচ্ছে না। গেলাসে এক-দুই ফোঁটা, এক বোতলে পনেরো পেগ, পনেরো গেলাস। পনেরো গেলাসে পনেরো থেকে তিরিশ ফোঁটা।
গত চার বছরে কত গেলাসের পর গেলাস, বোতলের পর বোতল জিন শেষ হয়ে গেল, কিন্তু ওই কালমেঘের শিশি সদ্য গলা পর্যন্ত নেমেছে।
কালমেঘের জন্যে জিন, নাকি জিনের জন্যে কালমেঘ? একটা কঠিন ধাঁধায় পড়ে যান মহিমাময়। তারপর কাগজ-পেনসিল টেনে নিয়ে সমান কঠিন একটা অঙ্ক কষতে থাকেন।
সপ্তাহে দু বোতল জিন, একশো ষাট টাকা বছরে আট সাড়ে আট হাজার টাকা।এই চার বছরে সে অন্তত ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা হবে।
এখনও বাকি যা কালমেঘ আছে তাতে আরও হাজার সত্তর টাকার জিন খেয়ে যেতে হবে। আর আট বচ্ছর–মোটমাট এক লাখ টাকার ধাক্কা!
প্রৌঢ় মহিমাময় করুণ চোখে কালমেঘের শিশিটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ভাবেন, একটা ছোট একতলা বাড়ি হয়ে যেত। ভাবতে ভাবতে পাঞ্জাবি গলিয়ে পথে বেরিয়ে পড়েন আরেক বোতল জিন আনতে।
কে মারা যাচ্ছে?
আজ চব্বিশ এপ্রিল।
আর হাতে তিন দিন রয়েছে, মাত্র তিন দিন। এই বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে যদি জগৎহরি মারা না যান তবে কেলেঙ্কারি হবে।
এই গল্পের নায়ক জগহরি, শ্রীযুক্ত জগৎহরি মুখোপাধ্যায় এই কয়েকদিন আগেও মৃত্যুমুখী ছিলেন। চৈত্রমাসের প্রথমে সেই এক শনিবার বিকেলে বাড়ির কাছে পার্কে বেড়াতে যাওয়ার পথে হঠাৎ অকাল বর্ষণে প্রচণ্ড ভিজে গিয়েছিলেন জগৎহরি।
সেই ঠান্ডা লেগে বুকে জল জমা, শ্বাস কষ্ট। বুড়ো বয়েসে এসব অসুখ মারাত্মক।
তা ছাড়া জগৎহরিবাবুর বয়েস তো আর কিছু কম হয়নি। তিরাশি পূর্ণ হয়ে চুরাশিতে পা দিয়েছেন গত বৌষ মাসে। সে তুলনায় শরীর-স্বাস্থ্য ভালই ছিল, কিন্তু এ বয়েসে আচমকা অসুখ খুব বিপজ্জনক।
জগৎহরিবাবু মৃত্যুর মুখে চলে গিয়েছিলেন। ডাক্তাররা জবাব দিয়ে দিয়েছিল। গত সোমবার তো মনে হয়েছিল আজকের রাত্রিটা কাটে কি না কাটে।
সুখের কথা শুধু সেই সোমবারের রাত্রি নয় তারও পরে আরও পাঁচ-পাঁচটা রাত্রি বহাল তবিয়তে কাটিয়ে দিয়েছেন শ্রীযুক্ত জগৎহরি, নামের পূর্বে শ্রীর বদলে চন্দ্রবিন্দু বসানোয়, স্বর্গীয় জগৎহরি হওয়ায়, তার তেমন বিশেষ কোনও উৎসাহ দেখা যায়নি।
ওইখানেই হয়েছে বিপদ।
শ্রীযুক্ত জগৎহরি মুখোপাধ্যায় কোনও সামান্য লোক নন। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার প্রবাদসিদ্ধ এক মুখুজ্যে বংশের তিনি মুখোজ্জ্বলকারী উত্তরপুরুষ। পিতৃপুরুষদের বিশাল পারিবারিক ব্যবসা ছিল চেতলা হাটে। মশারি আর মাছ মারার জালের পাইকারি কারবার। সেই ব্যবসা ধীরেসুস্থে অনেকটা গুটিয়ে নিয়ে তিনি চলচ্চিত্রে প্রযোজনায় মনোনিবেশ করেন।
জগৎহরি বিশ-পঁচিশ বছর আগে চিত্রজগতে রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত নোক ছিলেন। নীতিশ মুখার্জির ভাইপোর বিয়েতে তিনি বরযাত্রী হয়েছিলেন, মলিনা দেবী তাঁকে ভাইফোঁটা দিতেন, এমনকী স্বয়ং উত্তমকুমার তাকে জগদা বলতেন। বাড়িতে কড়া করে ইলিশ মাছ ভেজে, বিমানযাত্রী পেলে, জগৎবাবু গীতা দত্তকে বোম্বাইতে পাঠাতেন। কলকাতায় কালেভদ্রে রাজকাপুর এলে তিনি ঘি-গরমমশলা দেওয়া পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া পাঁঠার মাংসের ঝোল রাজকাপুরকে হোটেলে পাঠাতেন। রাজকাপুর যাওয়ার সময়ে তাঁর কলকাতার এজেন্টকে বলে যেতেন। তাঁর হোটেলের ঘরে কয়েক বোতল স্কচ হুইস্কির বোতলে সব সময়েই যথেষ্ট অবশিষ্টাংশ পড়ে থাকত, কারণ তিনি নতুন বোতল না খুলে খেতেন না এবং প্রচুরই খেতেন, সেই বোতলগুলো জগত্তরিকে এজেন্ট সাহেব পাঠিয়ে দিতেন। এবং সেই প্রসাদ পেয়ে জগৎহরিবাবু ধন্য বোধ করতেন। লোকজনকে ডেকে ডেকে খাওয়াতেন, বলতেন, এটা রাজকাপুরের স্কচ।
জগৎহরি অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেছিলেন শরৎচন্দ্রের গল্পের সিনেমা করে। গল্পটা শরৎচন্দ্রের। কিন্তু একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে রচনা করে, কপিরাইট না কিনে অন্য নামে চলচ্চিত্রায়ণ করতেন, যেমন গৃহদাহ তার সুবাদে হয়েছিল মনের আগুন, চরিত্রহীন হয়েছিল পথে বিপথে। চিত্রনাট্যকারের নাম থাকত না, তাকে এজন্যে কিছু বেশি পয়সা দেয়া হত। বইয়ের টাইটেলে লেখা থাকত কাহিনি ও চিত্রনাট্য ছদ্মবেশী।
এসব বই দুর্বল অশ্রুগ্রন্থি বাঙালি মধ্যবিত্ত দর্শক লুফে নিয়েছিল। তারাই তখনকার সিনেমার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। কান্নাহাসির দোল-দোলানো পৌষফাল্গুনের পালা চিরদিনই বাঙালি দর্শকের অতি প্রিয়।
যথেষ্ট পয়সা করেছিলেন জগহরিবাবু, মশারির ব্যবসায় এর চেয়ে বেশি উপার্জন হওয়া সম্ভব ছিল না। তা ছাড়া চেতলার মশারির দোকানটা ছোট করে ভালই চলছিল, দোকানটা থেকে সংসার খরচা মোটামুটি চলে যেত। সিনেমার লাইনে যেমন হয় জগৎহরিবাবুর কিন্তু চরিত্রদোষ ছিল না, সে বড় খরচার ব্যাপার।
ফলে সিনেমা করে যেটুকু লাভ হয়েছিল প্রায় পুরো টাকাটাই জগৎহরি নানাভাবে বিনিয়োগ করেছিলেন। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া পারিবারিক বিষয়বুদ্ধি এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য করেছিল।
যোধপুর পার্কে পাঁচ কাঠা জমি কিনেছিলেন, ক্যামাক স্ট্রিটে একটা বড়সড় ফ্ল্যাট। শান্তিনিকেতনে বাড়ি করলেন এক বিঘে জমির ওপরে। এ ছাড়া পোস্টাফিসে ক্যাশ সার্টিফিকেট কিনলেন প্রায় দু লাখ টাকার মতো, যা ডবল হয়ে হয়ে এখন আটলাখে দাঁড়িয়েছে।
তবে জগৎহরি ব্যবসায়ের পথ সবটাই যে কুসুমাস্তীর্ণ ছিল তা নয়। একবার খ্যাতির লোভে আর্ট ফিল্ম করে বেশ কয়েক লাখ টাকা গচ্চা দিয়েছিলেন, তবে এই সুযোগে একবার লাক্সেমবার্গে ঘুরে এসেছিলেন। সেখানে তার প্রযোজিত বই ঘাম ও রক্ততৃতীয় বিশ্বের চিত্রমেলায় প্রদর্শিত হয়েছিল। ব্যস ওই পর্যন্তই, তার পরে আর এ ব্যাপারে কোনও খবর পাওয়া যায়নি। প্রদর্শনের সময় আন্ডারগ্রাউন্ড ঘুপচি হলে দেড়শো সিটের মধ্যে মাত্র বারোটি সিট পূর্ণ ছিল, তার মধ্যে তিনটেতে ছিলেন তিনি, তার পরিচালক কাবুল মল্লিক এবং শ্রীমতী কাবুল।
শ্ৰীমতী ও শ্রীমান কাবুল মল্লিক অত্যন্ত তুখোড় দম্পতি। ঘাম ও রক্ত ছিল জোতদার বর্গাদার সম্পর্ক নিয়ে একটি আর্থ-সামাজিক প্রতিবেদন। বইটি এক পয়সাও ফেরত দেয়নি, কলকাতায় একদিনও চলেনি। তবে বড় বড় কাগজে, বৈদ্যুতিক প্রচার মাধ্যমে প্রচুর বাহবা পেয়েছিল। তবে সেসবের পিছনেও ছিল পাঁচতারা হোটেলে পার্টি, অবশ্য জগৎহরির পয়সায়।
সেই জগৎহরি এখন মরতে বসেছেন। কিংবা সঠিক করে বলা উচিত আগে মরতে বসেছিলেন, এখন বাঁচতে বসেছেন।
কিন্তু তার বোধহয় বাঁচা হবে না। তার বোধহয় আর বাঁচা হবে না, অন্ততপক্ষে বাঁচা উচিত হবে না।
এভাবে বলা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু কী ভাবেই বা বলা যায়? ব্যাপারটা গোলমেলে।
জগৎহরিবাবুর কোনও মেয়ে নেই, পর পর চার ছেলে। ছেলেরা এখন লায়েক হয়েছে, সিনেমা প্রযোজকের ছেলেদের যতটা বখে যাওয়া সম্ভব, তার চেয়ে কিছু কম বখে যায়নি তারা।
তাই বলে তারা যে কেউ পিতৃভক্ত নয়, তা নয়। জগৎহরির মৃত্যু নিশ্চিত জেনে তারা একেকজন নিজের মতো সিদ্ধান্ত নেয়।
বড় ছেলেটি প্রশান্ত, বাবার টাকায় যাত্রাদল করেছে, যাত্রা-উর্বশী আইভরি দাশের সঙ্গে আগামী দুসপ্তাহ তার উত্তরবঙ্গ সফরের প্রোগ্রাম ছিল। বাবার জন্যে সেটা ক্যানসেল করেছে।
দ্বিতীয়টি অশান্ত। চিটফান্ড কোম্পানি করেছে। এক বছরে টাকা ডবল করে দেয়। তার বাবা, জগহরি, তাকে বিশ্বাস করতেন না। তিনি বাড়িতেই বছর বছর টাকা ডবল হওয়ার সুবিধে আছে জেনেও পোস্টাপিসে টাকা জমিয়েছিলেন ছয় বছরের মেয়াদে।
তৃতীয়টি সুশান্ত। সে পারিবারিক ব্যবসা চেতলার হাটে মশারির ব্যবসাটা দেখে। সে বেশ সব্যবস্থ। দোকানের আয় থেকে সংসার খরচের জন্য দৈনিকই দুশো-আড়াইশো টাকা তার মা নিরুপমার হাতে দেয়। লোক-লৌকিকতা, পুজো, নববর্ষ ইত্যাদির মোটা টাকার দায়ও সে বহন করে।
এই তিনজনই বিবাহিত। স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, শ্বশুরবাড়ি ইত্যাদি আছে। চতুর্থটির বিয়ে হয়নি, সে বোবা। সঙ্গত কারণেই তার নাম শান্ত। তার বিশেষ কোনও দোষ বা গুণ নেই। শুধু সন্ধ্যাবেলা কালীঘাট বাজারে গিয়ে দু পাইট দুনম্বর বাংলা মদ না খেলে তার রাতে ঘুম আসে না।
ভালই চলছিল সব। গোল বাধিয়েছেন জগৎহরিবাবু নিজে। তিনি কিছুতেই মারা যাচ্ছেন না।
সব রকম বিধি বন্দোবস্ত করা আছে। গঙ্গাজল, তামা, তুলসী। দৈনিক চেতলা বাজার থেকে এক টাকায় আস্ত তুলসীগাছ কিনে আনা হচ্ছে। বড়বাজার থেকে এক কেজি খাঁটি তিল এনে পুজোর ঘরে রাখা হয়েছে। এক বালতি খুচরো পয়সা জমানো হয়েছে, সেইসঙ্গে এক টিন খই। শবযাত্রার সময়ে ছিটোতে হবে।
ডাক্তাররা তো দিনক্ষণ বলেই দিয়েছিলেন। কিন্তু জগহরি ডাক্তারি নির্দেশ অমান্য করে বেঁচে রয়েছেন।
সবচেয়ে সমস্যা দাঁড়িয়েছে হরিমোহিনী দেবীকে নিয়ে। আগাম ১০ হাজার টাকা দিয়ে তাঁকে শ্রাদ্ধবাসরে কীর্তন গাওয়ার জন্যে বুক করা হয়েছে। জগৎহরিবাবুর মতো কৃতবিদ্য ব্যক্তির শ্রাদ্ধবাসরে যেখানে চিত্রজগতের দিকপালেরা, নট-নটিরা অবশ্যই আসবেন সেখানে হরিমোহিনী দেবী ছাড়া আর কাউকে দিয়ে কীর্তন গাওয়ানো একেবারেই ঠিক হবে না। মোটেই সম্মানজনক হবে না জগৎহরিবাবুর পুত্রদের পক্ষে।
এদিকে, হরিমোহিনী দেবী স্টেটসে চলে যাচ্ছেন সাতই মে। নিউ জার্সিতে, বস্টনে, লস এঞ্জেলসে তাঁর কীর্তন গানের চুক্তি। টিকিট, প্রোগ্রাম সব ফাঁইনাল। শ্রাদ্ধ হবে মৃত্যুর পরে এগারো দিনে, বড় জোর সাতই মে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা সম্ভব।
অবশেষে সমস্ত সমস্যা হৃদয়ঙ্গম করে এক শুভানুধ্যায়ী একটি সুপরামর্শ দিলেন। জগৎহরিবাবুকে উইল করতে বলুন। অনেক সময় দেখা যায় মুমুর্ষ ব্যক্তি উইল করার পরেই মারা যান। উইল করার সঙ্গে সঙ্গে বাঁচবার ইচ্ছে সম্পূর্ণ দূরীভূত হয়। সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা মনোমতো ভাবে করে তিনি শান্তিতে দ্রুত পরলোকে গমন করেন। পরামর্শটা পেয়েছিল বড় ভাই প্রশান্ত। সে এসে অশান্ত এবং সুশান্তকে বলে। হাবেভাবে শান্তকেও ব্যাপারটা যথাসাধ্য বোঝানো হয়। তার পরে চার ভাই দল বেঁধে মা নিরুপমাকে বোঝাতে গিয়ে দেখল তারও কোনও আপত্তি নেই। তিনি আগে থেকে মন শক্ত করে বসে আছেন। তা ছাড়া তিনি হরিমোহিনী দেবীর কীর্তনের অত্যন্ত ভক্ত। হরিমোহিনী দেবীর কীর্তনই যদি না হল তা হলে তাঁর বিধবা হয়ে লাভ কী?
যথাসময়ে আলিপুর আদালতে পারিবারিক উকিল রামতনু ঘোষকে খবর দেওয়া হয়েছিল। আজ ২৪ এপ্রিল রবিবার সকালে তিনি উইল করতে এসেছেন।
জগহরিবাবু আগে থেকে কিছু জানেন না। তিনি রামতনুবাবুকে দেখে ভেবেছেন, পুরনো পরিচিত লোক, হয়তো তার শারীরিক অবস্থার কথা শুনে দেখতে এসেছেন।
সুতরাং যখন রামতনুবাবু বললেন যে, তিনি তাঁর উইল করতে এসেছেন। জগৎহরিবাবু একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন। উইল? আমি কেন উইল করতে যাব? জগৎহরিবাবু আইন কিছু কম জানেন না, তিনি বললেন, আমি মারা গেলে আমার সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর বিষয়সম্পত্তি আমার স্ত্রী আর চার ছেলে সমান ভাগে পাবে। এর জন্যে আবার উইল করতে যাব কেন? রামতনুবাবু পুরনো, ঝানু উকিল। তিনি বললেন, উইল করা ভাল। তা হলে পরে আর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা নিয়ে গোলমাল হয় না। কিছুটা কথাবার্তার পর জগহরিবাবু উইল করতে নিমরাজি হলেন। ততক্ষণে চার ছেলে এবং বিরাট ঘোমটা টেনে নিরুপমাদেবীও জগৎহরিবাবুর শয্যার পাশে এসে গেছেন।
জগৎহরিবাবুর খাটের সামনে একটা নিচু তক্তাপোশ রয়েছে, সেটায় বাড়ির সবাই বসলেন। পাশে একটা কাঠের চেয়ারে রামতনুবাবু। রামতনুবাবুর মুহুরিও সঙ্গে এসেছে, সে মেঝেতে কাগজ কলম নিয়ে বসল। তার নাম সহদেব।
সজ্ঞানে, সুস্থ শরীরে ইত্যাদি প্রথা ও আইন মাফিক বয়ান শেষ হওয়ার পরে জগহরিবাবু বললেন, যোধপুর পার্কে আমার পাঁচ কাঠা জমি রয়েছে, সেই জমি আমি আমার সতীসাধ্বী স্ত্রী। শ্রীযুক্তা নিরুপমা দেবীকে দিলাম।
সঙ্গে সঙ্গে নিরুপমা দেবী ঘোমটার আড়াল থেকে কাংস্য কণ্ঠে প্রতিবাদ করলেন, দ্যাখো কাণ্ড! আমি বুড়ি মানুষ, বিধবা হতে যাচ্ছি, খালি জমি দিয়ে আমি কী করব?
নিরুপমা দেবীর প্রতিবাদ শুনে একটু থমকিয়ে গেলেন জগৎহরি। মুখে বললেন, ঠিক আছে ওটা পরে দেখছি। সহদেব মুহুরিও চতুর লোক, যোধপুর পার্কের জমির লাইনটা যেটা সে এইমাত্র লিখেছিল সেটার গায়ে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন লাগিয়ে দিল।
এবার জগহরিবাবু বললেন, আমার ক্যামাক স্ট্রিটের ফ্ল্যাটটা আমার বড় ছেলে প্রশান্তকে দেব।
সঙ্গে সঙ্গে বাধা দিলেন নিরুপমা দেবী, না। না। ও ফ্ল্যাটটা অশান্তকে দাও। ও একটু সাহেবি মেজাজের। তা ছাড়া ওর যা কাজ করবার সেটা বাঙালিপাড়ায় নিরাপদ নয়।
ঢোক গিললেন জগৎহরিবাবু, রামতনুবাবু। মেঝেতে সহদেব মুহুরিও সদ্য সমাপ্ত পংক্তিটির পাশে আবার একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিল।
কিছুক্ষণ গুম হয়ে থেকে জগৎহরি বললেন, আমার চেতলা বাজারে মশারির ব্যবসাটা তৃতীয় ছেলে সুশান্ত দেখাশোনা করে ওটা তাকেই দিয়ে যাব।
বাক্য শেষ হওয়ার আগেই আবার নিরুপমার আপত্তি, এই তোমার বুদ্ধি? তুমি মরে গেলে মশারির ব্যবসা করবে নাকি কেউও? ওটা প্রশান্তকে দাও। চেতলা বাজারে অত ভাল জায়গা, ওখানে প্রশান্ত যাত্রা কোম্পানির অফিস করবে।
আবার কিঞ্চিৎ নীরবতা এবং সহদেব মুহুরির প্রশ্নবোধক চিহ্ন।
ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত হচ্ছিলেন জগৎহরি, তিনি এবারে অনেকদিন পরে খাটের ওপরে উঠে বসলেন, বললেন, আমি যদি শান্তিনিকেতনের নিরিবিলি বাড়িটা এই বোবা কালা ছেলে শান্তকে দিই, ওর মতো ও শান্তিতে থাকতে পারবে, তাতে নিশ্চয় তোমাদের কোনও আপত্তির কারণ নেই।
নিরুপমা বললেন, নিশ্চয় আপত্তি করব। তোমার বুদ্ধিসুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে। শান্তিনিকেতনে শান্তকে দেখবে কে। সেটা হল গানবাজনার জায়গা। কালাবোবার সেখানে কোনও ঠাই নেই।
আর সহ্য করতে পারলেন না জগৎহরি। যাঁর চিত হয়ে খাটে শুয়ে শ্মশানে যাওয়ার কথা, তিনি তড়াক করে খাট থেকে মেঝের ওপর নেমে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। সহদেব মুহুরি আর একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিতে যাচ্ছিল, জগৎহরিবাবুর ডান পাটা তার ডান হাতের ওপর পড়ায় সে একটু কোঁক করে উঠল।
ঘোমটা টানা নিরুপমার মুখপানে তাকিয়ে জগহরি গর্জে উঠলেন, বলি উইলটা কার? আমার, না তোমার? বলি মারা যাচ্ছে কে? আমি, না তুমি?
বলা বাহুল্য এ গল্প এখানেই শেষ। পুরনো দিনের পাঠকেরা যারা গল্পের শেষে একটা পরিণতি প্রত্যাশা করেন, তাঁদের অবগতির জন্যে তিনটি ঘটনা জানাচ্ছি। এক, জগহরিবাবু উইল করেননি। দুই, জগৎহরিবাবু এখনও মারা যাননি। তিন, জগৎহরিবাবু একটা নতুন সিনেমা প্রযোজনায় হাত দিয়েছেন, কাহিনির নাম, যতক্ষণ শ্বাস।
খদ্দের
ওই বসে রয়েছে রমেশ। একটা ভাঙা সুটকেস, সেটা নারকেলের দড়ি দিয়ে বাঁধা, তার মধ্যে দুটো ছেঁড়া পুরনো জামা প্যান্ট। পরনে একটা হাফপ্যান্ট, দু সাইজ বড় ময়লা হাওয়াই শার্ট। পায়ের হাওয়াই চটিজোড়া অবশ্য নতুন, শেষ সম্বল মাইনের টাকা থেকে আজকে সকালেই কিনেছে।
রমেশের হাতে একটা টিকিট ধরা রয়েছে, এখনই কিনেছে টিকিটের কাউন্টার থেকে, টিকিটটা হাওড়া থেকে খঙ্গপুর। রমেশ বসে আছে হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের উপরে, সে গ্রামে ফিরে যাচ্ছে। কলকাতায় তার পোষালো না, সে কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। সে হাওড়া থেকে যাবে খড়গপুরে, সেখান থেকে বাসে দু ঘণ্টা, তারপর হেঁটে দেড়ঘণ্টা–সেখানে তাদের গ্রাম, সেখানে তার গরিব বিধবা মা, ছোট ছোট ভাইবোনেরা রয়েছে। রমেশ গাঁয়ের একজন লোকের সঙ্গে কলকাতায় এসেছিল উপার্জন করতে। কিছুই বিশেষ চায়নি সে, সামান্য চাকরের কাজ নিয়েই সে সন্তুষ্ট ছিল অথবা সন্তুষ্ট থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু সেটা সম্ভব হল না।
রমেশ বাসন মাজতে পারে, ঘর মুছতে পারে, কাপড় কাঁচতে পারে। বাজার করে হিসেব দিতে পারে। গাঁয়ের স্কুলে সে পাঁচ ক্লাস পড়েছিল।
রমেশ শেষরাতে ভোর চারটের সময় উঠে কয়লা ভাঙতে পারে। দরকার পড়লে উনুন থেকে। ভাতের হাঁড়ি নামাতে পারে। কলকাতা শহরে তার চাহিদা কিছু কম নয় কিন্তু সে এখানে কাজ করতে পারল না।
কলকাতায় আসার আগে রমেশ কাঁথিতে এক ভদ্রলোকের বাড়িতে অল্প কিছুদিন কাজ করেছিল। সেই ভদ্রলোক ছিলেন উকিল। রমেশদের গ্রামের বাড়িতে বাইরের লোকজন বিশেষ কেউ আসে না। কেই বা আসবে কীসের দরকারে? পাড়া-প্রতিবেশী যারা আসে সবাই চেনাজানা। কিন্তু কাঁথির উকিলবাবুর বাড়িতে রমেশ দেখল সকাল, সন্ধ্যা, রবিবারে, ছুটির দিনে অনেক লোকজন আসে। বাইরের ঘরটা গমগম করে লোকের ভিড়ে আর কথাবার্তায়।
অল্পদিনের মধ্যে রমেশ জানতে পারে, এই যারা দুবেলা উকিলবাবুর বাড়িতে আসে, উকিলবাবুর সঙ্গে আদালতে ছোটাছুটি করে, তাদের বলে মক্কেল। কিছুকালের মধ্যেই সে বাইরের ঘর খুলে দিয়ে লোকজন বসিয়ে বাড়ির মধ্যে থেকে উকিলবাবুকে ডেকে আনা শিখে গেল, কর্তামশায়, মক্কেল এসেছে। উকিলবাবু হেঁকে বলতেন, ওদের বসাও। আমি যাচ্ছি। একটা ঝাড়ন দিয়ে চেয়ারগুলো ঝেড়ে মক্কেলদের বসিয়ে রমেশ এসে উকিলবাবুকে জানাত, মক্কেলবাবুদের ভাল করে বসিয়ে এসেছি।
কিন্তু কাঁথির এই উকিলবাবুর বাড়িতে রমেশের বেশিদিন কাজ করা সম্ভব হয়নি। উকিলবাবুর এক মক্কেলের মামলায় হেরে গিয়ে ছয় মাস জেল হয়, কী একটা মারামারির মামলা ছিল সেটা। মক্কেলটাও ছিল খুব মারকুটে। ছয়মাস কারাবাসের পর জেল থেকে বেরিয়েই সে উকিলবাবুর খোঁজে আসে। উকিলবাবুর ভাগ্য ভাল যে ঠিক সেই সময় বাসায় ছিলেন না। কিন্তু জেলখাটা মক্কেলটির কোপ গিয়ে পড়ে রমেশের উপর। রমেশ যথারীতি যখন ঝাড়ন দিয়ে চেয়ার পরিষ্কার করে মক্কেলটিকে বসাতে গেছে এবং ঘোষণা করেছে যে উকিলবাবু বাড়ি নেই, একটু অপেক্ষা করতে হবে–সেই মুহূর্তে লোকটি রমেশের হাত থেকে কাপড়ের ঝাড়নটি কেড়ে নিয়ে তাকে পিঠমোড়া করে বেঁধে ফেলে এবং জুনপুটে বা দিঘায় নিয়ে সমুদ্রে নিক্ষেপ করবে বলে ক্রুদ্ধ ইচ্ছা জ্ঞাপন করে। রমেশের হাত বাঁধা ছিল, কিন্তু মুখ বাঁধা ছিল না, সে প্রাণভয়ে যথাসাধ্য চেঁচাতে থাকে।
রমেশের চিৎকারে রাস্তা থেকে লোকজন এবং পাড়া-প্রতিবেশী ছুটে এসে বিপজ্জনক মক্কেলটিকে ধরে ফেলে, তারপর পুলিশ এসে তাকে হাজতে চালান দেয়। তারপর আবার ফৌজদারি মামলা।
কী এক অজ্ঞাত, অবোধ্য কারণে এবারেও এই মারকুটে অধোম্মাদ লোকটি রমেশের উকিলবাবুকে তার মামলায় নিযুক্ত করে। ফলে যদিও রমেশই ভুক্তভোগী, উকিলবাবুর প্ররোচনায় রমেশ মামলার দিন আদালতে সাক্ষ্য দিতে যায় না। কিন্তু পাড়া-প্রতিবেশী ও রাস্তার লোকজনের সাক্ষ্যে এবং বিশেষ করে এই কারণে যে লোকটি জেল থেকে ছাড়া পেয়েই আবার গোলমাল করেছে সেই দিনই, এই সব বিবেচনা করে মহামান্য আদালত এই দাগি আসামিকে আবার ছয় মাসের জেল দেন। রমেশের উকিলবাবু বহু ধরাধরি, অনুনয়, বিনয়, যুক্তিতর্ক দিয়েও লোকটির জেলখাটা আটকাতে পারলেন না। রোষ কষায়িত লোচনে লোকটি উকিলবাবুর দিকে তাকাতে তাকাতে পুলিশের সঙ্গে আবার জেলে চলে গেল।
লোকটির জেল হয়েছে এই খবর শোনার পরে রমেশ খুবই আতঙ্কিত বোধ করতে লাগল এবং ছয় মাস পূর্ণ হওয়ার সপ্তাহখানেক আগেই উকিলবাবুর গৃহ তথা কথি থেকে পালাল।
গাঁয়ে গিয়ে দু-এক মাস থাকার পর সে অন্য এক গ্রামবাসীর সঙ্গে অতঃপর কলকাতায় এল। সেই ব্যক্তি কলকাতায় এক ডাক্তারবাবুর বাড়িতে রান্নার কাজ করে, সেই বাড়িতেই রমেশের জন্য একটা ফাঁইফরমাস খাটার কাজ জুটল।
চাকরের কাজে যে হতভাগ্য বালকের জীবন শুরু তার যে ভাগ্য ভাল নয় সে কথা বলার অবকাশ রাখে না। তারই মধ্যে কারও কারও ভাগ্য একটু কম খারাপ হয়। রমেশের ভাগ্য কিন্তু খুবই খারাপ।
রমেশ যে ডাক্তারবাবুর বাড়িতে এসেছে সেই ডাক্তাবাবু মনস্তত্ত্ববিদ অর্থাৎ দুই কথায় পাগলের ডাক্তার। ঠিক রাস্তার ন্যাংটো পাগল বা উন্মাদ, বদ্ধ পাগল নয়, রোগীদের প্রত্যেকেরই মাথায় অল্পবিস্তর গোলমাল। প্রায় প্রত্যেকেই সুবেশ ও মার্জিত রুচির। কিন্তু এদের সকলের চোখের মধ্যে একটা ঘোলাটে ভাব আছে যে ভাবটা কাথির সেই উকিলবাবুর মক্কেলের চোখে মার খাওয়ার মুহূর্তে রমেশ দেখতে পেয়েছিল।
প্রথমে কিন্তু গোলমালটা বাধল অন্যভাবে। রমেশ কাঁথির কাজ থেকে শিখে এসেছে বাইরের লোক যারা আসে তারা হল মক্কেল। তার কাজ পড়েছিল সকাল-সন্ধ্যায় বাইরের ঘরের চেম্বারে রোগী এলে বসিয়ে ডাক্তারবাবুকে ভিতরে খবর দেয়া। সে এখানেও চেয়ার ঝেড়েঝুড়ে রোগীকে বসাত, বলত, বসুন মর্কেলবাবু। তারপর ভিতরে গিয়ে খবর দিত, একজন মক্কেল এসেছে।
দু-একদিনের মধ্যে খটকা লাগল ডাক্তারবাবুর, রোগী আবার মক্কেল হল কী করে? ছোকরা চাকরটা ইয়ার্কি করছে না তো? এক আধপাগল উকিল এসেছিলেন ডাক্তারকে দেখাতে, তাঁর মাথার মধ্যে অহরহ টং টং করে কী একটা বাজে, বেজেই যায়। তিনি রমেশের মুখে মক্কেলবাবু সম্বোধন শুনে হেসে কুটিপাটি। তাঁর মাথার টং টং ভুলে তিনি ডাক্তারবাবুকে না দেখিয়েই রাস্তায় বেরিয়ে গেলেন হাসতে হাসতে। সেদিন সন্ধ্যায় একমাত্র পাগল বেপাত্তা হয়ে যাওয়ায় ডাক্তারবাবু রমেশের উপরে খেপে গেলেন। পরে অনেক কষ্ট করে রমেশকে শেখালেন, আমার কাছে যারা আসে তারা মক্কেল নয়, পেশেন্ট।
রমেশের বঙ্গোপসাগরীয় জিহ্বায় যত সহজে মক্কেল কথাটা আসে পেশেন্ট তত সোজা নয়। অনেক কসরত করে সে শেষ পর্যন্ত পিসেন্ট বলা শিখে উঠতে পারল। পিসেন্টদের চেয়ার ঝেড়ে বসিয়ে সে ডাক্তারবাবুকে ডাকতে যেত, বাবু, পিসেন্ট এসেছে।
মোটামুটি চালিয়ে যাচ্ছিল রমেশ। কিন্তু ফ্যাসাদ বাধল ডাক্তারবাবুকে নিয়ে। ডাক্তারবাবুর একটা মারাত্মক খারাপ ব্যাপার ছিল, সন্ধ্যার পর সেজেগুঁজে রোগী দেখার নাম করে বেরোতেন আর সহজে গৃহমুখী হতে চাইতেন না। একেকদিন গভীর রাতে পা টিপে টিপে চোরের মতন ঘরে ঢুকতেন। চেম্বারের বাইরের দরজায় খুব আস্তে দুটো টোকা দিলে, রমেশ রাতে চেম্বারের মেঝেতে শুত, সে দরজাটা আলগোছে খুলে দিত। এই রাতে বাড়ি ফেরা নিয়ে ডাক্তার-গিন্নির সঙ্গে ডাক্তারবাবুর কোনও কোনও সময় তুলকালাম কাণ্ড হত।
বিপদ হয়েছিল রমেশের। তাকেই সাক্ষী মানতেন ডাক্তারগিন্নি, তুই বল তো, ঠিক কটায় বাড়ি ফিরেছে? চেম্বারে একটা দেয়ালঘড়ি আছে, ভদ্রমহিলা রমেশকে ঘড়ি দেখা ভাল করে শিখিয়ে নিয়েছিলেন স্বামীর ফেরার হিসেব রাখতে। কারণ তিনি নিজে কদাচিৎ কষ্ট করে ঘুম থেকে উঠে স্বামীর ফেরার তদারকি করতেন। যা চেঁচামেচি, তাণ্ডব সেটা করতেন সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে চা-টা খেয়ে, নিজের সুবিধাজনক সময়ে। ফুটন্ত কড়া ও উনুনের মধ্যে অর্থাৎ ডাক্তারবাবুর আর ডাক্তার-গিন্নির মধ্যে কোনওটাই রমেশের পক্ষে কম বিপজ্জনক নয়। সে যদি সঠিক সময় বলত, ডাক্তারবাবু খেপে যেতেন আর বানিয়ে সময় বললে ডাক্তার-গিন্নির হাতে ধরা পড়লে রক্ষা নেই। ভদ্রমহিলা বিছানায় নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে কী করে যে আসল সময়টা ধরে ফেলতেন সেটা রমেশ এবং রমেশের ডাক্তারবাবু উভয়েরই সমস্যা ছিল।
কিছুটা বুদ্ধি খরচ করে মোটামুটি জোড়াতালি দিয়ে রমেশ চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু শেষে আর পারল না। একদিন একেবারে রাত কাবার করে দিয়ে ডাক্তারবাবু বাড়ি ফিরছেন, ফিরেই চাপা গলায় রমেশকে শাসিয়েছেন, এই সাবধান! যদি বলবি তো রাত কাবার করে ফিরেছি, একদম ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বার করে দেব।ডাক্তারবাবু তো বাড়িতে ঢুকেই নিজের বিছানায় গিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন। পাশের খাটে গৃহিণী তখনও ঘুম থেকে ওঠেননি। মহিলা সময়মতো ধীরেসুস্থে ঘুম থেকে উঠে পরিতৃপ্তির সঙ্গে প্রাতঃরাশ সমাপ্ত করে গভীর নিদ্রায় মগ্ন স্বামীকে বিছানা থেকে চুলের মুঠি ধরে তুললেন, তোমার এত বাড় বেড়েছে, রাতে বাড়িতেই ফিরছ না! দাঁড়াও আজ পাগলের ইলেকট্রিক শক তোমাকেই দেব! সদ্য কাঁচা ঘুম ভাঙা রাত্রির অত্যাচারে ক্লান্ত ডাক্তারবাবু শেষ পর্যন্ত রমেশের শরণাপন্ন হলেন। স্ত্রীকে অনুরোধ করলেন, রমেশ তো দেখেছে কখন ফিরেছি, ওকে জিজ্ঞাসা করো।
রমেশকে ডাকতে সে এল। ডাক্তারগিন্নি গর্জন করে উঠলেন, এই কী রে! এই লোকটা কখন বাড়ি ফিরেছে? ঠিক সময় বললে বিপদ, ডাক্তারবাবু মারবে, তাড়াবে। আবার বেঠিক সময় বলে গিন্নির হাতে ধরা পড়লে সে তো আরও মারকুটে, আরও দজ্জাল। দুপক্ষের হাত থেকে বাঁচতে সে খুব বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, ডাক্তারবাবু যখন ফিরলেন তখন তো আমি ঘড়ি দেখতে পারিনি। তাই বলতে পারছি না সময়টা। গিন্নি গর্জে উঠলেন, কেন ঘড়ি দ্যাখোনি? তোমাকে বলিনি আমি? রমেশ বলল, কী করে দেখব, তখন যে আমি ঘুম থেকে উঠে কলতলায় মুখ ধুচ্ছিলাম।
বলাবাহুল্য, অতঃপর রমেশের অন্ন ডাক্তারবাবুর বাড়ি থেকে উঠল। কিন্তু কলকাতা শহরে চাকরের কাজের অভাব হয় না। গলির মোড়েই থাকেন এক ব্যবসায়ী ভদ্রলোক, কাপড়ের পাইকারি বিক্রেতা, বাড়িতেই একতলায় তার গদি। যাতায়াতের পথে রমেশকে তিনি দেখেছেন, তার প্রতি দৃষ্টিও ছিল। তার গদিঘরের একজন বয় দরকার। রমেশ বেকার হওয়া মাত্র উক্ত ব্যবসায়ী ভদ্রলোক, নকুলবাবু, তাকে লুফে নিলেন।
নকুলবাবুর গদিতে গিয়ে রমেশ আরেকবার বোকা বনল। ওই ডাক্তারবাবুর বাড়ির কায়দায় যারা গদিতে আসে রমেশ তাদের সরল চিত্তে পিসেন্ট বলে। গদি পরিষ্কার করে ঝাড়ন দিয়ে ঝেড়ে তাদের বসতে বলে, দোতলায় নকুলবাবুকে গিয়ে বলে, চারজন পিসেন্ট এসেছে।
নকুলবাবু প্রথমে ধরতে পারেননি। পরে রমেশকে বললেন, আরে গাধা, আমি কি ডাক্তার নাকি যে ওরা পেশেন্ট হবে? রমেশ বোকা নয়, সে প্রাক্তন অভিজ্ঞতা থেকে বলল, ও বুঝতে পেরেছি, ওরা মক্কেল।নকুলবাবু স্থিতধী ব্যবসায়ী, খুব শান্ত কথায় রমেশকে বোঝালেন, যারা এসেছে, যারা গদিতে আছে, আসবে তারা পেশেন্ট নয়, মক্কেল নয়, তারা খদ্দের।
রমেশ এ ব্যাপারটা বুঝল। কিন্তু অন্য একটা ব্যাপারে নকুলবাবুর ওখানে রমেশের পোষালো। রমেশকে আগে ডাক্তারবাবুর ওখানে নকুলবাবু দেখেছেন, কিন্তু তার নামটা জানতেন না। যখন জানলেন নতুন চাকরের নাম রমেশ, তিনি একটু বেকায়দায় পড়লেন, কারণ তার শ্বশুরের নামও রমেশ। তিনি রমেশকে বললেন, তোমাকে আমরা রমেশ না বলে গদাই বলে ডাকব।
কিন্তু রমেশ গরিব হলে কী হবে, তার আত্মাভিমান অতি প্রখর। সে প্রতিবাদ করল, না, আমাকে রমেশ নামেই ডাকবেন। গদাই আবার একটা নাম নাকি!
ব্যাপারটা ঝুলে রইল। কিন্তু নকুলবাবুর সাহস নেই পূজনীয় শ্বশুরমশায়ের নামে চাকরকে ডাকেন। তিনি ওরে, হরে করে চালাতে গেলেন।
এ ব্যাপারটাও রমেশের অপছন্দ। এমন চমৎকার তার একটা নাম, এর আবার ওরে, হরে কী?
ইতিমধ্যে অন্য একটা ব্যাপার ঘটেছে। রাস্তার ওপরেই থাকেন এক নবীনা চিত্রতারকা ও তার তৃতীয় স্বামী। মহিলা অতি নাবালিকা বয়েস থেকেই সাতিশয় পক্ক এবং একাধিক স্বামী ও স্বামীস্থানীয়ের কণ্ঠলগ্না হয়েছেন। তার বাড়িতে অনিবার্য নানা কারণে কাজের লোক থাকে না। সুন্দরীর বর্তমান স্বামী একটি উপযুক্ত কাজের লোকের সন্ধানে আকাশ-পাতাল খুঁজছিলেন। নিজের নামের প্রশ্নে দ্বিধা ও সংশয়ে আচ্ছন্ন রমেশকে ভাঙিয়ে নিতে তাঁর এক মুহূর্ত সময়ও লাগল না। এর চেয়ে তার অনেক বেশি সময় এবং পরিশ্রম ব্যয় হয়েছিল সুন্দরীকে তার দ্বিতীয় স্বামীর হাত থেকে ভুলিয়ে আনতে।
সে যা হোক, রমেশ এই চিত্রতারকার বাড়ি থেকে প্রথম দিনেই, বলা উচিত সন্ধ্যাবেলাতেই, বিতাড়িত হল। সন্ধ্যাবেলা তারকা শয়নঘরে সাজগোজ করছেন। এমন সময় বাইরের দরজায় বেল বাজল। রমেশ গিয়ে দরজা খুলে তিনজন সুসজ্জিত ভদ্রলোককে ড্রইংরুমের সোফায় বসাল। তারপর ভিতরের ঘরে গিয়ে সুন্দরীকে খবর দিল। সুন্দরী এতক্ষণ এঁদের প্রতীক্ষা করছিলেন, এঁরা তার আগামী ছবির প্রযোজক এবং প্রযোজকের বন্ধুরা। নকুলবাবুর বাড়িতে সদ্য রপ্ত করা বুলিতে রমেশ সুন্দরীকে জানাল, বাইরের ঘরে তিনজন খদ্দের এসেছে। সুন্দরীর হাত থেকে পাউডারের পাফ পড়ে গেল। সুন্দরীর স্বামী বিছানায় শুয়ে চিত হয়ে সিগারেট টানছিলেন।
খদ্দের এসেছে শুনে তার মাথায় কেন যেন রক্ত উঠে গেল, রমেশকে কান ধরে হিড়হিড় করে টানতে হারামজাদা, রাস্কেল ইত্যাদি অবর্ণনীয়, অকথ্য গালাগাল দিতে দিতে ভাঙা সুটকেস সমেত পিছনের দরজা দিয়ে গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দিলেন।
ওই বসে রয়েছে রমেশ। সে তার দুঃখিনী মায়ের কাছে ফিরে যাচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেও সে শহরে এসে বুঝতে পারেনি, বাবুদের বাড়িতে যারা আসে তারা মক্কেল, না পেশেন্ট, না খদ্দের? নাকি আরও কিছু আছে?
খেজুরে গুড়ের সন্দেশ
মহীতোষবাবুর বয়েস ষাটের খারাপ দিকে, এখনও সত্তরের ঘরে পৌঁছতে দু-তিন বছর লাগবে। কিন্তু তার জীবনের মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে; অদ্য শেষ দিবস বা শেষ রজনী, মহীতোষবাবুর পরমায়ু আজকেই শেষ।
মারাত্মক অসুখ হয়েছে মহীতোষবাবুর। এখন বিছানায় শুয়ে শুয়ে জীবনের শেষ প্রহর গুনছেন।
কী অসুখ? কেন অসুখ? কেমন অসুখ? কবে থেকে অসুখ?
এই সামান্য সংক্ষিপ্ত রম্যরচনায় এসব প্রসঙ্গে যাওয়া অনুচিত হবে। তা ছাড়া যেকোনও অসুখের আদ্যন্ত বিবরণ খুব ক্ষতিকর, মন খারাপ করে, দুশ্চিন্তা হয়, ভয় হয় এই অসুখ হয়তো আমারও হয়েছে, বিশেষ করে অসুখের লক্ষণগুলো খুব চট করে মিলে যায় নিজের সাম্প্রতিক দেহকষ্টের সঙ্গে।
আর তা ছাড়া, এই রম্য গল্পে অসুখ ব্যাপারটা গৌণ, মুখ্য ব্যাপার হল মৃত্যু, মহীতোষবাবুর মৃত্যু, যে ব্যাপারটা অনতিদূরেই রয়েছে।
মহীতোষবাবু বিছানায় শুয়ে ধুঁকছেন। মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছেন।
ডাক্তার গতকাল সকালেই জবাব দিয়ে দিয়েছেন, আর আশা নেই। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের খবর পাঠানো হয়েছে। তাঁরা ঘন ঘন সশরীরে উপস্থিত হয়ে, টেলিফোন করে মহীতোষবাবুর শেষ অবস্থার খবর নিচ্ছেন।
মহীতোষবাবুর এক ছেলে। এক মেয়ে। ছেলে মহীতোষবাবুর সঙ্গেই থাকে, এখনও বিয়ে করেনি। বয়েস সাতাশ-আটাশ। সে গত দুদিন ধরেই বাবার শরীরের অবস্থার অবনতি দেখে অফিসে যাচ্ছে না, ক্যাজুয়াল লিভ নিয়েছে।
মহীতোষবাবুর মেয়ে ছেলের চেয়ে বছর দুয়েকের বড়। তিন বছর আগে আসানসোলে তার বিয়ে দিয়েছেন। এখনও ছেলে-পিলে কিছু হয়নি। সে আজ সকালের ট্রেনেই বাবার অবস্থার খবর পেয়ে আসানসোল থেকে তার বাপের বাড়ি মহীতোষবাবুর এই দমদম নাগেরবাজারের বাসায় চলে এসেছে।
মহীতোষবাবুর ছেলে আর মেয়ে দুজনের নামই অনু, অনুতোষ আর অনুকণা।
এ ছাড়া এই নাগেরবাজারের বাড়িতে আছেন মহীতোষবাবুর স্ত্রী, দুই অনুর মা। তার নামটা জানা হয়নি। আপাতত তাকে মহীতোষিণী বলে উল্লেখ করলেই কাজ চলে যাবে।
কিন্তু শ্রীযুক্তা মহীতোষিণীকে এতটা দায়সারাভাবে নেওয়া উচিত নয়। তিনিই এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিয়োগান্ত কাহিনির নায়িকা।
দীর্ঘ তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর দাপটের সঙ্গে সংসার চালিয়েছেন মহীতোষিণী দেবী। দাপটটা অবশ্য শতকরা একশো ভাগই পতিদেবতা মহীতোষবাবুর ওপর। তবে দু-চারবার ছেলেমেয়ে, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন অথবা বাড়ির কাজের লোক এদের ওপরে দাপট খাটাতে যাননি তা নয়, কিন্তু যা হয় আর কী, তেমন সুবিধে করতে পারেননি। অবশেষে পুরো দাপটটাই মহীতোষবাবুর ওপর দিয়ে গেছে।
সমস্ত জীবন মহীতোষবাবু স্ত্রীর ভয়ে সন্ত্রস্ত ছিলেন। টিপে টিপে, মেপে মেপে চলতেন। কীসে কী দোষ হয়, গাফিলতি হয় কিছুই অনুমান করতে না পেরে দুরুদুরু বক্ষে সদাসর্বদাই স্ত্রীর হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতেন।
জামাকাপড়, জুতো নতুন কিছু কিনলেই সেটা মহীতোষিণী দেবীর নজরে পড়ত এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি মহীতোষবাবুকে জানিয়ে দিতে দ্বিধা বোধ করতেন না যে এগুলো ভদ্রলোকের ব্যবহাযোগ্য নয়। তিনি স্বামীর রুচিবোধ নিয়ে ধিক্কার দিতেন, টিটকিরি কাটতেন।
মহীতোষবাবুর খাবার-দাবার সম্পর্কে তাঁর ছিল ভয়াবহ সতর্কতা। দেড় কেজি ইলিশ মাছ হয়তো মহীতোষবাবু বাজার থেকে এনেছেন তার থেকে দুবেলায় মাত্র দু টুকরো মাছ বরাদ্দ মহীতোষবাবুর। এক কেজি মাংস আনলেও ওই দুটুকরো দিনে রাতে। কোনও দিন প্রাণভরে বাসায় খেতে পাননি মহীতোষবাবু, তাই ইদানীং এদিকে ওদিকে লুকিয়ে চুরিয়ে খারাপ ভাল দ্রব্যাদি নিজে কিনে খেতেন।
আজ মহীতোষবাবু মারা যাবেন। তার দীর্ঘ, নির্যাতিত জীবনের এই শেষ দিনে এসব কথা স্মরণ করে লাভ নেই।
একটু আগে ডাক্তার এসে ঘুরে গেছেন। নাড়ি দেখে, স্টেথসকোপ দিয়ে হৃৎস্পন্দন পরীক্ষা করে ডাক্তারবাবু গম্ভীর মুখে চলে গেছেন।
বোধ হয় আর কিছুক্ষণ মাত্র। ব্যাপারটা মহীতোষবাবুও বুঝতে পেরেছেন। বুঝতে পেরেছেন, তার বিদায় আসন্ন।
কিন্তু সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল মহীতোষবাবুর জ্ঞান, বুদ্ধি সব কিন্তু টনটনে রয়েছে। চোখেও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন, কানেও মোটামুটিও শুনতে পাচ্ছেন। তার শয্যার পাশেই ছেলেমেয়ে, দু-চারজন আত্মীয়স্বজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাদের সঙ্গে কখনও কখনও দু-চারটে কথাও বলছেন।
সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে। মহীতোষবাবুর এই একতলায় শোয়ার ঘরে বাইরে থেকে দক্ষিণের খোলা দরজা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস আসছে। বছর কয়েক আগে শেয়ালদায় রথের মেলা থেকে একটা গোলাপ গাছ কিনে এনেছিলেন তিনি, সেটা লাগিয়েছিলেন ওই দক্ষিণের দরজার বাইরে বারান্দার নীচের উঠোনে।
দুয়েকটা গোলাপ ফুটেছে তার মৃদু গন্ধ আসছে বাতাসে। কে একজন ঠান্ডা হাওয়া আসছে বলে দরজাটা বন্ধ করতে যাচ্ছিল, মহীতোষবাবু তাকে হাত নেড়ে বারণ করলেন। তার ঘ্রাণশক্তি এখনও বেশ প্রবল রয়েছে, এই শেষসন্ধ্যায় গোলাপের মধুর গন্ধ তার বেশ ভালই লাগছে।
এমন সময় অন্য একটা সুঘ্রাণ এসে তাকে চনমনে করে তুলল। খেজুরে গুড়ের পাকের গন্ধ। দুয়েকবার শুকে তিনি তার মাথার কাছে দাঁড়ানো মেয়ে অনুকণাকে বললেন, রান্নাঘরে তোর মা বোধ হয় খেজুরে গুড়ের সন্দেশ বানাচ্ছে? অনু বলল, হ্যাঁ ঠিকই তাই।
মৃত্যুমুখী মহীতোষবাবু কেমন প্রলুব্ধ হয়ে পড়লেন, মেয়েকে বললেন, দ্যাখ, তোর মা তো সারাজীবন আমাকে ভাল-মন্দ কিছুই খেতে দেয়নি। আজ যা তো, রান্নাঘর থেকে দুটো সন্দেশ নিয়ে আয়, মরার আগে খেয়ে যাই।
মেয়ে মাকে ভালই চেনে। একটু দোনামনা করে সে রান্নাঘরে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে মুখ কালো করে ফিরে এল।
মহীতোষবাবু মেয়েকে বললেন, কীরে, সন্দেশ কী হল?
মেয়ে বলল, মা দিল না। ও সন্দেশগুলো শ্মশানবন্ধুদের জন্যে বানানো হচ্ছে। তুমি মারা যাওয়ার পরে তোমাকে পুড়িয়ে ফিরে এসে তারা ওই সন্দেশগুলো খাবে। ওর একটাও তোমার জন্যে নয়।
গয়া ১৯২৪
শেষবার আমরা যখন বাড়ি বদলালাম, অর্থাৎ আগের বাড়ি ছেড়ে এখনকার বাড়িতে এলাম, সে প্রায় আট বছর আগের কথা।
লোকে যখন একটা বাড়ি ছেড়ে অন্য বাড়ি যায়, অনেক জিনিস ফেলে আসে; কিছু ভুলে ফেলে আসে, আবার কিছু ইচ্ছে করেও ফেলে আসে। অনেক সময় বড় বাড়ি থেকে ছোট বাড়িতে উঠে যাওয়ার সময় অনেক কিছুই ছেড়ে যেতে হয়।
কিন্তু এ যাত্ৰা আমরা এসেছিলাম আগের থেকে বেশ একটু বড় বাড়িতে, ফলে আগের বাড়ির প্রায় সবকিছুই ঝেটিয়ে নিয়ে এসেছিলাম।
কিন্তু সেটাই সব নয়। এ বাড়িতে এসে আমরা কতকগুলো জিনিস উপরি পেয়ে গেলাম।
এটা একটা সরকারি বাসাবাড়ি। আমার চাকরির সুবাদে সরকার থেকে আমাকে থাকতে দেওয়া হয়েছে, আমার আগে যিনি ছিলেন, তিনি তখন বদলি হয়ে দিল্লি চলে গেছেন। ফলে অনেক ছোটখাটো জিনিসই তিনি নিয়ে যেতে পারেননি।
আরও দু-চার মাস ব্যবহার হতে পারত এমন দুটো ঝাটা ও একটা বড় পাপোশ, অল্প ভাঙা কিন্তু বেশ কাজ চলে যায় এমন একজোড়া শিল-নোড়া, মরচেধরা পাখিহীন শূন্য একটা লোহার খাঁচা, একটা কুকুরের চেন, দুটো পুরনো বকলস–এই সব জিনিস তো ছিলই, আর ছিল কিছু শূন্য বোতল, পুরনো বই ও ম্যাগাজিন।
কিন্তু এ সমস্ত ছাড়াও বাড়িতে আমরা আরেকটা জিনিস পেয়েছিলাম। সেটা একটা ফটো, বাইরের ঘরের দেয়ালে টাঙানো কাঁচের ফ্রেমে বাঁধানো একটা পুরনো ফটোগ্রাফ।
ফটোগ্রাফটি অনেক পুরনো, উনিশশো চব্বিশ সালের। গয়া জেলা আদালতের বার লাইব্রেরির কর্মকর্তা ও সদস্যদের গ্রুপ ফটো। কালো কোট ও চাপকান পরা একদল নানা বয়েসের উকিল, তাদের অনেকেরই বড় বড় গোঁফ, দু-চারজনের লম্বা দাড়িও আছে। ছবির নীচে ধারাবাহিকভাবে সকলের নাম লেখা। সম্ভবত বার লাইব্রেরির বারান্দার সামনের সিঁড়িতে ছবিটা তোলা হয়েছিল। সিঁড়ির বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন উচ্চতায় উকিলবাবুরা গম্ভীরমুখে দণ্ডায়মান রয়েছেন। ছবির ওপরে ইংরেজিতে সন এবং লাইব্রেরির নাম লেখা রয়েছে, যেমন থাকে এধরনের সব ছবিতে।
বুঝতে পারলাম এই বাড়িতে আমার আগের বাসিন্দা যিনি ছিলেন, তিনি ভুল করে এই ফটোটি ফেলে রেখে চলে গিয়েছেন। শেষ মুহূর্তে দেয়াল থেকে ছবিটি খুলে নিয়ে যেতে ভুলে গেছেন।
এই ফ্ল্যাটের সেই পূর্ববর্তী বাসিন্দা, মিস্টার তরফদার, চাকরিসূত্রে আমার যথেষ্ট পরিচিত। এই গ্রুপ ফটোগ্রাফের মধ্যে রয়েছেন হয়তো তার কোনও নিকট আত্মীয়, বাবা বা ঠাকুরদা। তাঁদের মূল্যবান পারিবারিক স্মৃতিচিহ্ন এই ফটোটা।
আমার পুরনো অফিস থেকে মিস্টার তরফদার দিল্লি বদলি হয়েছেন। সেখানে গিয়ে তার দিল্লি অফিসের ঠিকানা সংগ্রহ করে তাঁকে ওই ভুলে ফেলে যাওয়া ফটোটি সম্বন্ধে জানালাম ও লিখে দিলাম : ফটোটা দেয়ালে যেখানে ছিল সেখানেই থাকছে, ওটায় আমি হাত দিচ্ছি না। তিনি যদি কখনও কলকাতায় আসেন, আমাদের এখান থেকে যেন ওটা নিয়ে যান।
কয়েকদিন পরেই মিস্টার তরফদারের চিঠি এলো, এবং তার চিঠি পড়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম। তিনি লিখেছেন, ওই ফটোর কোনও ব্যক্তির সঙ্গে তার কিংবা তার পরিবারের কারও কোনও সংস্রব নেই। তাদের বংশের কেউ কখনও গয়ায় বাস করেনি, দু-একবার পিণ্ড দিতে গিয়েছেন, কিন্তু সেই পর্যন্তই।
মিস্টার তরফদারের চিঠি পড়ে আরও জানলাম যে, তিনিও এসে দেয়ালে ঝোলানো অবস্থায় ফটোটি পেয়েছিলেন এবং আমারই মতো তার পূর্ববর্তী বাসিন্দাকে যোগাযোগ করে ফটোটি ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। দুঃখের বিষয় তিনি ফটোটি ফেরত দিতে পারেননি, কারণ সেই পূর্বতর বাসিন্দা ফটোটির দায়িত্ব সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন এবং জানান যে, তিনিও বাড়িতে এসে দেয়ালে ঝোলানো অবস্থায় ফটোটি পেয়েছিলেন।
আমার যদি অনেক সময় থাকত এবং সরকারি নথি খুলে আমার বর্তমান ফ্ল্যাটের প্রাক্তন বাসিন্দাদের তালিকা ও নাম-ঠিকানা জোগাড় করে একে একে যোগাযোগ করতে পারতাম, হয়তো প্রকৃত মালিকের কাছে, যিনি প্রথমবার ভুল করে ছবিটি ফেলে রেখে যান, তার জিনিস ফেরত দিতে পারতাম।
কিন্তু সে বড় কঠিন কাজ। ছবিটি তোলা হয়েছিল উনিশশো চব্বিশ সালে আর আমাদের এই সরকারি ফ্ল্যাট বাড়িটায় সরকারি কর্মচারীর বসবাস শুরু হয়েছে পঞ্চাশ দশকের শুরু থেকে।
এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে আমিই শুধু একটানা আট বছর আছি। অন্যেরা কেউ দুবছর, বড় জোর আড়াই বছর। কেউ কেউ তার চেয়ে কম সময়েও থেকেছেন।
মোটমাট অন্তত জনা-দশ-বারো সরকারি কর্মচারী আমার আগে এ বাসায় থেকে গেছেন। খোঁজ নিয়ে দেখলাম, তাদের মধ্যে কয়েকজন ইতিমধ্যে লোকান্তরিত হয়েছেন, একজন সন্ন্যাসী হয়ে গেছেন, আর অন্য একজন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ সরকারি তহবিল তছরুপ করে যথাকালে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন।
সুতরাং অনেক রকম চিন্তা করে আমি আর এই ফটোর মালিককে খুঁজে বার করার চেষ্টা করিনি। আমার পূর্বের বাসিন্দারা যা করেছিলেন, আমিও ঠিক তাই করেছি। দেয়ালে ঠিক যে জায়গায় ফটোটা ছিল সেখানেই রেখে দিয়েছি, একটুও নড়চড় করিনি। শুধু চুনকামের সময় খুলে একটু সরিয়ে রাখি, আবার চুনকাম সারা হয়ে গেলে ফটোর ওপরের কাঁচটা ভাল করে মুছে দেয়ালের নির্দিষ্ট স্থানে টাঙিয়ে দিই, সাদা দেয়ালে কালো কোট, চাপকান পরা পুরনো কালের ভারী ভারী মানুষদের চমৎকার মানায়।
আমাদের বাইরের ঘরে কেউ এলেই ছবিটার দিকে তাঁর নজর যায়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ জানতে চান, আপনারা কি আগে গয়ায় থাকতেন? আমি এই প্রশ্নের কোনও সরাসরি উত্তর দিই না, শুধু একটু মৃদু হাসি।
গয়া-গঙ্গা ভ্যারাইটি
বন্ধুতে বন্ধুতে, আত্মীয়স্বজনের মধ্যে নানা রকমের যৌথ কারবার হয়।
রাস্তাঘাটে, খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনে হামেশাই দেখতে পাওয়া যায় চক্রবর্তী অ্যান্ড চ্যাটার্জি কোম্পানি কিংবা জি.সি. দত্ত অ্যান্ড সনস। অবশ্য শুধুমাত্র সনসেই ব্যাপারটা সীমাবদ্ধ নয়।
এ পাড়াতেই মোড়ের মাথায় আছে, কে. কে. মিটার অ্যান্ড গ্র্যান্ডসনসের ঘড়ির দোকান। তার থেকে কিছুটা এগিয়েই ঘোষ ব্রাদার্সের মিষ্টির দোকান। সনস এবং ব্রাদার্সের পরেও একটু এদিক ওদিক খোঁজ করলেই নেফিউ, কাজিন এদেরও দেখা যায়। দরজি মহম্মদ আলি অ্যান্ড নেফিউ, গয়নার দোকান দত্ত কাজিনস খুবই বিখ্যাত।
সুতরাং গয়া এবং গঙ্গা দুইজনে মিলে একটি ভ্যারাইটি স্টোরস খুলেছে, তাতে বিস্ময়ের ব্যাপার কিছু নেই। অন্তত, আপাতত তাই মনে হয়।
কিন্তু ব্যাপারটা অন্য রকম। গয়া-গঙ্গা এই দুজনে পিতাপুত্র, ভাইবন্ধু, আত্মীয়স্বজন নয়।
গয়া-গঙ্গা পরস্পর সম্পর্ক হল যে তারা স্বামী-স্ত্রী। সংক্ষেপে নাম গয়া-গঙ্গা হলেও পুরো নাম হল গয়ারাম দাস এবং গঙ্গামণি দাসী।
বাজারের মধ্যে একটা পুরনো, পারিবারিক মুদির দোকান ছিল গয়ারামদের। গঙ্গামণির অপুত্রক পিতার মৃত্যুর পর সে কিছু ধনসম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে পায়। তারই কিছু অংশ ব্যবহার করে নামহীন মুদির দোকানের জায়গায় কাঁচের রঙিন সাইনবোর্ড ফ্লুরোসেন্ট আলো জ্বালা গয়া-গঙ্গা ভ্যারাইটি স্টোরস হয়েছে।
গয়ারাম অকৃতজ্ঞ নয়। স্ত্রীর টাকা নিজ ব্যবসায়ে অনেকেই বিনিয়োগ করে। কিন্তু সে এটাকে। কাগজপত্রে স্বামী-স্ত্রীর যৌথ ব্যবসা করেছে, যা একেবারে অভিনব। এবং তেমনি অভিনব এই গয়া-গঙ্গা ভ্যারাইটি স্টোরস নামকরণ, উভয়েরই নামে কোনও দোকান আর বোধহয় কোথাও। নেই। দেশে বিদেশে হাজার জায়গা খুঁজেও ওরকম নামের একটা ব্যবসা বা দোকান খুঁজে পাওয়া যাবে না।
গয়ারাম অবশ্য এ কাজটা, এই নামকরণের ব্যাপারটা সচেতন ভাবে করেনি। এর গুরুত্বও সে বোঝে না। বোঝার দরকারও নেই।
সপ্তাহের শেষে রবিবার বিকেলে ও সন্ধ্যায় বাজারে-দোকানে ভিড় খুব কম হয়। কেনাকাটা প্রায় থাকে না বললেই চলে।
অনেক বাজারই রবিবারের সন্ধ্যায় বসে না। যেসব বাজার খোলা থাকে, সমস্ত দোকান খোলা থাকে না। অধিকাংশ বন্ধ।
রবিবার অপরাহ্নে যাঁরা বাজারে আসেন প্রায় সকলেই মহিলা, বাড়ির গিন্নি বান্নি। সপ্তাহান্তিক মোটা বাজারটা বাড়ির কর্তারা শনিবার ছুটি থাকলে ওই দিন সকালে বা সন্ধ্যায় সেরে ফেলেন। না। হলে রবিবারের সকালে।
রবিবার সন্ধ্যায় গৃহিণীরা বাজারে আসেন প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয়, খুচরো বা শৌখিন কিছু কেনাকাটা করতে। পাশের বাড়ির তমালী এক পাতা চৌকো বিন্দি কিনেছে, তাই শ্যামলী কিনতে এসেছেন এক পাতা ছক্কা বিন্দি। এই রকম আর কী। যাঁরা জানেন না, এসব বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন।, যাদের বিদ্যাবুদ্ধি খবরের কাগজের হেডলাইন পর্যন্ত, তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে, বিন্দি হল মেয়েদের কপালের রঙিন (এবং সাদা) এক পিঠে আঠা লাগানো টিপ। চৌকো আর ছক্কা বিন্দি হল, যথাক্রমে চতুর্ভুজ এবং ষড়ভুজ আকারের।
তবে শুধু বিন্দিই নয়, সদ্য দূরদর্শনে দেখা দুর্গন্ধ দূরীকরণ সাবান, জীবানুনাশক টুথপেস্ট, বর্ণে-গন্ধে অনুপম গুঁড়োমশলা রবিবার সন্ধ্যায় তমালী দেবী, শ্যামলী দেবীরা কিনতে বেরোন।
রবিবারের সন্ধ্যাটাই গৃহিণীদের নিজস্ব সময়। ছেলেমেয়েদের ইস্কুল থেকে ফেরার ব্যাপার নেই। ক্ষুধার্ত গৃহকর্তার ঘর্মাক্ত কলেবরে অফিস কাছারি সেরে বাড়ি আসা নেই। এমনকী কাজের মেয়েটিরও এই অপরাহ্নে ছুটি।
গৃহিণীরা বাজারে আসেন, কিন্তু এই সন্ধ্যায় অতি অল্প দোকান খোলা থাকে। তার মধ্যে একটি হল এই আমাদের গয়া-গঙ্গা ভ্যারাইটি স্টোরস।
গয়ারাম জানেন খদ্দের হিসেবে মেয়েরা ভাল। অধিকাংশ ওজন ব্যাপারটা কিছুই বোঝে না, হিসেবও ভাল করতে পারে না।
আর আজকের বাজারে হিসেব করাও কম কঠিন নয়। সাড়ে তেরো টাকা দরের জিনিস আড়াইশো গ্রাম কিনে দশ টাকার নোট দিলে কত ফেরত পাওয়া যাবে এ হিসেব করতে গেলে বাঘা বাঘা অঙ্কের ছাত্রেরা হিমশিম খেয়ে যায়। গৃহবধূরা পারবেন এরকম আশা করা যায় না।
মোট কথা গৃহবধূরা হিসেব করতে পারেন না, ওজন বোঝেন না। খদ্দের হিসেবে অবশ্যই লোভনীয়।
কিন্তু তাই বলে গয়ারাম যে মহিলাদের দোকানে পেলেই ঠকায় তা কিন্তু নয়। গয়ারামের হাত নিশপিশ করে, মন চুলবুল করে ঠকানোর জন্যে। কিন্তু সাহস পায় না, গঙ্গামণির নিষেধ আছে।
গঙ্গামণির বক্তব্য খুব সোজা, ওজনের হেরফের, দামের গোলমাল করে অন্যান্য খদ্দেরদের যতটা ঠকানো হয় মহিলাদের তার চেয়ে বেশি ঠকানো চলবে না। আমি নিজে মহিলা হয়ে আমার দোকানে মহিলাদের অতিরিক্ত ঠকাতে দেব না।
এ কারণে গয়া-গঙ্গা ভ্যারাইটি স্টোরসের ব্যবসায়ে লাভ হয়তো কিছু কম হয়। কিন্তু গঙ্গামণি সেটা পুষিয়ে দিয়েছে নতুন একটা কায়দা করে। গয়া-গঙ্গা ভ্যারাইটি স্টোরসের দেয়াল ঘেঁষে কাঁচের টানা শো-কেস রয়েছে। সেই শো-কেসের মাথায় একটা গণেশ মূর্তি রয়েছে। রোজ দুবেলা সেই মূর্তিতে ধূপধুনো দিয়ে, আলো জ্বালিয়ে পুজো করা হয়। সেই গণেশ ঠাকুরের একপাশে রয়েছে। একটা অতি পুরনো অ্যালার্ম ঘড়ি। ঘড়িটা গয়ারামের বাবা গয়ারামকে কিনে দিয়েছিলেন, সেই যখন সে ইস্কুলে পড়ত।
এই অ্যালার্ম ঘড়িটা খুব কাজে লাগিয়েছে গঙ্গামণি। গঙ্গামণির পরামর্শে গয়ারাম দোকানের ভেতর এবং বাইরে দুটো বড় নোটিশ দিয়েছে:
নোটিশ
প্রতি রবিবার বৈকাল বেলায়
অভাবনীয় লাভের সুযোগ।
ভেতরে অনুসন্ধান করুন।
ভেতরে অনুসন্ধান মানে গয়ারাম কিংবা তার তিন বালক কর্মচারীর কাছে জিজ্ঞাসা করলে যা জানা যাচ্ছে সে যেমনি চমকপ্রদ, তেমনি অভিনব।
স্বীকার করা উচিত, কস্মিনকালেও কোনও মুদির দোকানে এ জাতীয় কিছু দেখা যায়নি। এ বিষয়ে পরে বলছি। যেহেতু বুদ্ধিটা বেরিয়েছে গঙ্গামণির মাথা থেকে তাই তার আগে গঙ্গামণি প্রসঙ্গে একটু আসা যেতে পারে।
ব্যবসায়িক ভাষায় একটা পুরনো চালু কথা আছে Sleeping partner। এর সরাসরি মানে হল ঘুমন্ত অংশীদার। অনেক সময় টাকাওয়ালা লোকেরা ব্যাঙ্ক, পোস্টঅফিস কিংবা কোম্পানির ফিক্সড ডিপোজিটের সুদের চেয়ে কোনও নির্ভরযোগ্য লোকের ব্যবসায়ে টাকা ঢালেন বেশি আয়ের আশায়। তারা কিন্তু কিছুই করেন না সেই ব্যবসায়ের জন্য। তারা শুধুই মূলধন জোগান আর অন্যে খাটে। লাভ সমান সমান ভাগ হয়।
এই রকম ভাবে যারা টাকা খাটান তাদের বলা হয় স্লিপিং পার্টনার বা ঘুমন্ত অংশীদার।
গয়া-গঙ্গা ভ্যারাইটি স্টোরসের ক্ষেত্রে ওই স্লিপিং পার্টনার কথাটা আক্ষরিক অর্থে সত্য। স্বামী-স্ত্রী এক বিছানায় ঘুমোয় আবার তারা দুজনে একই ব্যবসার অংশীদার। সুতরাং গয়ারাম এবং গঙ্গামণি এরা দুজনে আদর্শ স্লিপিং পার্টনার।
তবে কোনও অর্থেই গঙ্গামণি ঘুমন্ত অংশীদার নয়। দোকানের ব্যাপারে গঙ্গামণির অনেক রকম কূটবুদ্ধি গয়ারামের কাজে লাগে।
মাখনের ব্যাপারটাই ধরা যাক। গঙ্গামণি যে পরামর্শ দিয়েছিল সেটা প্রথমে নির্ভরযোগ্য মনে হয়নি গয়ারামের।
.
গঙ্গামণি কখনও দোকানে বসে না। তবে বিকেলের দিকে বাড়ির কাজকর্ম বিশেষ কিছু না থাকলে দোকানের দিক দিয়ে একবার ঘুরে যায়। কখনও কখনও দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কেনাবেচা দেখে।
গঙ্গামণিকে বাজারের প্রায় সবাই চেনে। দোকানদাররা অনেকেই তাকে বউদি বলে, কেউ কেউ বলে গঙ্গাদি। নতুন ছেলেছোকরারা বলে কাকিমা বা মাসি।
শ্বশুরের আমলে এ দোকানে গঙ্গামণি একদিনই আসত বছরে, সেটা হল অক্ষয় তৃতীয়ার দিন। হালখাতাও হত সেদিন। সত্যনারায়ণ পুজো হত বাড়িতে। পুজোর পর এক মাথা ঘোমটা টেনে, হাতে কাঠের বারকোশ ভরতি করে ফলমূল, ঘরে তৈরি নারকেলের সন্দেশ, নাড়ু, বাতাসা, নকুলদানা নিয়ে গঙ্গামণি সন্ধ্যাবেলা দোকানে আসত।
এই প্রসাদটা বাজারের অন্য দোকানদারদের জন্যে। খদ্দেরদের আলাদা বন্দোবস্ত, কাগজের বাক্সে বোঁদে, গজা আর নিমকি। সেটা হালুইকরের দোকান থেকে আসত।
এ সব তিরিশ বছর আগের কথা। তখন এক সের জিনিসের যা দাম ছিল এখন একশো গ্রামের তাই দাম। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশি।
তারপর শ্বশুর-শাশুড়ি গত হয়েছেন। এক পাগল ভাশুর ছিল, তিনি কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন, তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
গঙ্গামণির পর পর তিনটি মেয়ে জন্মেছে। জন্মেছে, কিছুটা লেখাপড়া করেছে, বড় হয়েছে, পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে অল্পবিস্তর ফষ্টিনষ্টি করেছে। তারপর তাদের বিয়ে হয়েছে। বরের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে। এখন তাদের ভরা সংসার, কালে ভদ্রে বাপের বাড়িতে আসে।
.
গয়ারাম-গঙ্গামণির ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এই গল্প নয়, তার জন্যে উপন্যাস লিখতে হবে।
আপাতত আমরা মাখনের প্রসঙ্গে একটু ফিরে যাচ্ছি। কারও ফ্রিজ আছে। কারও ফ্রিজ নেই। কেউ হয়তো একটু কৃপণ। কারও হয়তো আর্থিক সম্পত্তির অভাব আছে। গঙ্গামণি বিকেলের দিকে বেড়াতে বেড়াতে দোকানে এসে লক্ষ করেছে সবাই বারো টাকা দিয়ে এক প্যাকেট মাখন নিতে চায় না। কেউ বলে অর্ধেক দিতে, কেউ জিজ্ঞাসা করে, অল্প পাওয়া যাবে কি না।
এ সব দেখে গঙ্গামণির মাথায় একটু বুদ্ধি এল।
বুদ্ধিটা গোলমেলে। গয়ারাম প্রথমে সায় দেয়নি। কিন্তু স্ত্রীর পরামর্শ অগ্রাহ্য করার মতো মানুষ। জগৎসংসারে সামান্য যে কয়েকজন আছে তার মধ্যে গয়ারাম পড়ে না।
গঙ্গামণির ব্যাপারটা, মানে মাখন বেচার বুদ্ধিটা খুবই সরল।
বারো টাকার মাখনের প্যাকেটটা মধ্য দিয়ে ঠিক সমান সমান ভাবে ছুরি দিয়ে কেটে দুভাগ করতে হবে। এখন দুভাগের দামই যদি ছয় টাকা করা যায় তাহলে বিক্রি হয়তো সামান্য বাড়বে কিন্তু শেষ পর্যন্ত হিসেবে পোষাবে না। কিছু মাখন নষ্টও হতে পারে। গঙ্গামণি কিন্তু একটা উলটো কাজ করল, বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না।
গঙ্গামণি প্রত্যেকটা মাখনের প্যাকেটকে সমান দু টুকরো করে, এক অংশের দাম করল সাড়ে ছয় টাকা, অন্য অংশের দাম সাড়ে পাঁচ টাকা।
গঙ্গারামের মাথায় হাত। হাফ প্যাকেট যদি সাড়ে পাঁচ টাকায় বেচা হয়, পুরো প্যাকেট এগারো টাকা। কেনা দামই যে উঠবে না।
গঙ্গামণি নির্বিকার। সে বলল, একবার পরীক্ষা করেই দেখা যাক না।
দোকানের মধ্যে নোটিশ আটকানো হল,
মাখন।
আধ প্যাকেট ৫-৫০, ৬-৫০
পরীক্ষা প্রার্থনীয়
অন্য কোথাও পাইবেন না।
এই নোটিশ দেওয়ার পরে মাখনের বিক্রি বাড়ল। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, গয়ারামের আশঙ্কা ধুলিসাৎ করে দিয়ে সাড়ে ছয় টাকার মাখনই বেশি বিক্রি হতে লাগল।
মাখন আধ টুকরো করে, ফ্রিজের মধ্যে দুটো আলাদা কাঁচের বাটিতে রাখা আছে। দেখা গেল সাড়ে ছয় টাকার বাটি যখন নিঃশেষে ফুরিয়ে গেছে, তখনও সাড়ে পাঁচ টাকার কাঁচের বাটি প্রায় ভর্তি। কেউই মাত্র এক টাকার জন্যে কম দামি মাখন নিতে চায় না।
ঘি-মাখন, দুধ-ডিম এই সব স্বাস্থ্যকর জিনিস লোকে বিশুদ্ধ ও খাঁটি কিনতে চায়। তাই বেশি দাম দিয়ে কিনতে আপত্তি করে না।
গয়া-গঙ্গার মাখনের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সবাই ভাবে দাম বেশি যখন এই মাখনটা অনেক ভাল। দুটোই যে একই মাখন, এই বাটির সাড়ে ছয় টাকার মাখনের টুকরোগুলো যে গতকালই সাড়ে পাঁচ টাকার বাটিতে ছিল, খদ্দের সেটা জানেও না, এ নিয়ে তলিয়ে ভাবেও না।
মাখন বৃত্তান্ত পাঠ করে গঙ্গামণির বুদ্ধির ওপর পাঠকদের নিশ্চয় একটু আস্থা হয়েছে।
এবার গল্পের শেষ অংশে সন্ধ্যাবেলায় ফিরে যাই।
সেই যে অ্যালার্ম ঘড়ির কথা লিখেছি, দোকানের শো-কেসের ওপরে গণেশঠাকুরের পাশে আছে। সেই পুরনো ঘড়িটাকে এবার গঙ্গামণি রবিবারের বিকেলের বিক্রিবাটা বাড়ানোর কাজে লাগাল।
গল্প অতিরিক্ত না বাড়িয়ে গঙ্গামণির বুদ্ধিটা একটু সংক্ষিপ্ত করে বলছি।
প্রতি রবিবার সকালে গঙ্গামণি নিজের হাতে ঘড়িটায় দম দেয়। অ্যালার্মের স্প্রিংয়েও দম দেয়, দিয়ে ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা থেকে আটটার মধ্যে কোনও একটা সময়ে অ্যালার্ম বাজিয়ে রাখে।
একেকদিন একেক রকম সময়ে অ্যালার্ম বাজে। কোনওদিন সোয়া পাঁচটায়, কোনও দিন সাড়ে ছটায়, কোনও দিন পৌনে আটটায় বা অন্য কোনও সময়ে। অবশ্য অধিকাংশ রবিবারই আটটার। কাছাকাছি সময়ে অর্থাৎ দোকান বন্ধ করার একটু আগে অ্যালার্ম বাজে।
চাবি দেওয়া হয়ে যাবার পরে শো-কেসের ওপরে একটা ছোট তোয়ালে দিয়ে ঘড়িটা ঢেকে রাখে গঙ্গামণি। ঘড়ির ডায়ালটা দেখতে না পারায় কেউ বুঝতে পারে না কখন অ্যালার্মটা বাজবে।
এইখানেই গঙ্গামণির কেরামতি। গয়া-গঙ্গা স্টোরসে নিয়ম করা হয়েছে প্রতি রবিবার সন্ধ্যাবেলা যে মুহূর্তে অ্যালার্মটা বেজে উঠবে ঠিক তখন যে সব খদ্দের যা যা জিনিস কিনছিলেন তা অর্ধেক দামে দেওয়া হবে।
ফলে অ্যালার্ম বাজার অপেক্ষায় খদ্দেররা সারা সন্ধ্যা জিনিস কিনে যাচ্ছেন। গয়া-গঙ্গা স্টোরসে বিক্রি রবিবার সন্ধ্যায় সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। অ্যালার্ম বাজার শুভ মুহূর্তে ডবল লাভের লোভে টিভি-তে বাংলা সিনেমা ফেলে রেখে এ পাড়া ও পাড়ার গৃহিণীরা ভিড় করছেন গয়া-গঙ্গা ভ্যারাইটি স্টোরসে।
.
কোনও রবিবার সন্ধ্যায় আমাদের ওদিকে এলে আপনিও দেখে যেতে পারেন গয়া-গঙ্গার কেমন রমরমা চলছে। ইচ্ছে হলে কোনও জিনিস কিনতে পারেন, ভাগ্য প্রসন্ন হলে, অ্যালার্ম বেজে উঠলে জিনিসটা অর্ধেক দামে পেয়ে যাবেন।
গুপ্তপ্রসঙ্গ
রাত সাড়ে দশটার সময় সদ্য খাওয়া শেষ হয়েছে, এর পরে খবরের কাগজগুলোতে একটু চোখ বুলিয়ে শুতে যাব, এমন সময় ফোন এল।
এই সময়টা ফোন-টোন খুব বিরক্তিকর। আমার নিতান্ত নিজস্ব এই কিছুক্ষণ খবরের কাগজের জন্যে নির্দিষ্ট এবং উৎসর্গীকৃত।
সারাদিন খবরের কাগজ পড়ার অবকাশ আমার হয় না। সকালে উঠে ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে পার্কে গিয়ে ভেজা ঘাসের উপরে খালিপায়ে এক ঘণ্টা হাঁটি। তারপর চা, দাড়ি কামানো, স্নান ইত্যাদি, অবশেষে ব্রেকফাস্ট। ততক্ষণে অফিসের প্রিজনভ্যান এসে যায়, ছুটে গিয়ে বন্দি হই। বন্দিদশা থেকে মুক্ত হতে সন্ধে সাড়ে সাতটা-আটটা। ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরি।
বাড়ি ফিরেও বিশেষ বিশ্রাম হয় না। আমার একমাত্র মামাতো ভাই ন্যাড়া গত বছর মন্ত্রী হয়েছে। আমার সূত্রে অনেকেই তার কাছে তদ্বির-তদারক করে। সন্ধ্যার এই সময়টা সেই সব লোকজন আসে৷ যদিও ক্লান্ত থাকি, কিন্তু ভালই লাগে। মন্ত্রী মামাতো ভাইয়ের ক্ষমতার কিঞ্চিৎ ভগ্নাংশ উপভোগ করতে করতে নিজেকেও বেশ ক্ষমতাবান মনে হয়। তাও তো নাড়ু এখনও পুরোপুরি মন্ত্রী নয়, নেহাত উপমন্ত্রী।
কাউকে কাউকে বেশ ধমকিয়ে দিই, বলি, নতুন রেশন কার্ড করার জন্যে বলা যাবে না, ওসব ছোট ব্যাপার পাড়ার কাউন্সিলরকে বলো, মন্ত্রীকে বলা যাবে না।
আবার কাউকে বলি, মন্ত্রীকে কি জামিনের কথা বলা যায়? জজ কোর্টে জামিন না পাও হাইকোর্টে যাও। মন্ত্রী এর মধ্যে মাথা গলাতে পারবে না।
কেউ কেউ ক্ষুণ্ণ হয়ে ফিরে যায়, আবার কারও কারও দরখাস্ত রেখে দিই। প্রত্যেক রোববার সকালে মামার বাড়ি যাই, মামাতো ভাই কদাচিৎ থাকে। আমি মামিমার হাতে কাগজপত্র বুঝিয়ে দিয়ে আসি। আমার মামিমা খুব বুদ্ধিমতী, চব্বিশ বছর বয়েসে ছয় বছরের ছেলে নিয়ে বিধবা হয়েছিলেন। কত আপদ-বিপদ, ঝড়-ঝঞ্ঝা মাথায় করে ছেলেকে মানুষ করেছেন, শুধু মানুষ নয়, মন্ত্রী করেছেন।
সে যা হোক, সে অন্য গল্প। মন্ত্রীর গল্প বলার সময় বা জায়গা এটা নয়। আর তত সাহসও আমার নেই।
বরং স্রেফ নিজের কথা বলি। সেটাই নিরাপদ। সুতরাং যা বলছিলাম, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়ি-অফিস-বাড়ি। তারপর সন্ধ্যাবেলার তদ্বির-তদারক শেষ হওয়ার পরে হাত মুখ ধুয়ে রাতের খাবার খেয়ে নিই। তারপর ডাক্তারের পরামর্শ মতো আধ ঘণ্টা, এবার আর খালিপায়ে নয়, চটিপায়ে রাস্তায় হাঁটি। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ বিছানায় শুতে আসি সকালবেলার খবরের কাগজ হাতে নিয়ে। তখন সেগুলো আর খবরের কাগজ নেই, ইতিহাস হয়ে গেছে। কিছু কিছু লোকমুখে অফিসে বা বাসায় সকাল থেকে শুনেছি, তেমন অতীব চমকপ্রদ সংবাদ হলে অফিসের বারোয়ারি কাগজে একবার দূর থেকে হেডলাইনে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিয়েছি।
কিন্তু হেডলাইনের চেয়েও আমাকে অনেক বেশি আকর্ষণ করে খুচরো খবর, আইন-আদালতের কলম এবং নানা ধরনের বিজ্ঞাপন।
রাতে নির্ভার শরীর ও মনে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে আরাম করে খবরের কাগজগুলো পড়ি। তিনটে কাগজ রাখি আমি, তিনটেই বাংলা কাগজ, দিশি কাগজের ইংরেজি খবরে তেমন জুত পাই না, তার জন্যে টাইম, নিউজ উইক সপ্তাহান্তে যথেষ্ট।
খবরের কাগজ পড়ার সময় আমাকে কেউ বিরক্ত করে আমি সেটা চাই না। একদিক থেকে আমি নিশ্চিন্ত, আমি চিরকুমার, বিয়ে-টিয়ে করিনি। রাতের বেলা বিছানায় আমাকে বিরক্ত করার তেমন কেউ নেই।
কিন্তু সত্যিই আজ বিরক্ত হলাম। সবে প্রথম কাগজটার দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় নিরুদ্দেশ বিজ্ঞাপনের এক যুবতীর (উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, উচ্চতা সোয়া পাঁচ ফুট, পরনে নীল তাঁতের শাড়ি) বর্ণনা পড়ে ফটোর চেহারার সঙ্গে যেটুকু সম্ভব মিলিয়ে নিচ্ছি, এমন সময় ফোনটা এল।
বেশ কয়েকবার ক্রিং ক্রিং করে বেজে ফোনটা থেমে গেল। দিনের বেলায় ফোনটা ভাইয়ের ঘরে থাকে, রাতে আমি আমার ঘরে নিয়ে আসি ওটা। সেটা নিতান্ত আত্মরক্ষার জন্যে, যাতে কাজের লোকজন কেউ ফোনটা ধরে আমাকে না ডাকতে পারে।
অন্যান্য দিন সাধারণত শোয়ার সময় ফোনের রিসিভারটা মেঝেয় নামিয়ে রাখি কিন্তু আজ ভুল হয়ে গিয়েছিল, সেই সুযোগে ফোনটা বাজছে। কার কী তদ্বির পড়েছে এত রাতে, এসব ফোন আমি চট করে ধরি না। এরকম ক্ষেত্রে আমি ফোনটাকে গুণে গুণে কুড়িবার বাজতে দিই, তারপর রিসিভারটা তুলে কট করে কেটে দিই।
এই রকম পরপর তিনবার ট্রায়াল দিই। তারপরেও ধৈর্য ধরে কেউ চতুর্থবার ফোন করে তাহলে ধরেই বলি, রং নাম্বার।
কিন্তু আমার গলার স্বর খুব মিহি, দুরভাষী তারের মধ্যে সে আরও মিহি হয়ে যায়, ফলে প্রায় প্রত্যেকেই ধরতে পারে, বলে, খোকাদা ঘুমুচ্ছিলে নাকি?
আজও সে রকম হতে পারত। কিন্তু আজকের ফোন যে করেছে সে কুড়িবার ক্রিং ক্রিং করার। জন্যে অপেক্ষা না করে আবার ফোন করল। আবারও দু-তিনবার বাজার পর ছেড়ে দিল।
কেমন খটকা লাগছিল। তৃতীয়বারে ফোনটা বাজতেই খপ করে ধরলাম। আমার ফোন ধরার কায়দাটা একটু অন্যরকম। বাইশ বছর বয়েস পর্যন্ত এমন এলাকায় ছিলাম যেখানে রেল স্টেশন, থানা আর দু-তিনটে মাড়োয়ারি গদি ছাড়া কোথাও ফোন ছিল না। আমি দূর থেকে ফোন দেখেছি। আমাকে কেউ কখনও ফোন করেনি, আমিও কাউকে করিনি।
কলকাতায় এসে আরও কিছুর সঙ্গে ফোন ব্যবহার করা শিখলাম। সদাগরি অফিসের কাজের দৌলতে নিজের বাড়িতেও একটা ফোন এল। কিন্তু ফোনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক এখনও গড়ে ওঠেনি। জিনিসটাকে আমি দূরে দূরে রাখতেই চাই। নিজে বিশেষ ফোন করি না বা ধরি না, কিন্তু যদি কখনও বাধ্য হয়ে ধরতে হয় তবে অতর্কিতে, খপ করে, শক্ত পাঞ্জায় ধরি, যেন বিষধর সাপের গলা ধরেছি, অসতর্ক হলেই সর্বনাশ।
অবশেষে আজও তাই করলাম, এবং সাপটা ধরা পড়ল দুবার হ্যালো হ্যালোর পর, সাপটা কথা বলল, খোকাদা, আমি প্রসঙ্গ বলছি। বলা বাহুল্য প্রসঙ্গ কারও আসল নাম নয়, প্রসঙ্গ প্রসঙ্গমাত্র। টেলিফোনে আমি প্রসঙ্গ বলছি যে বলল তার পিতৃদত্ত নাম প্রমীলাকান্ত দাশগুপ্ত। সে ছবি আঁকে।
হায় ছবি তুমি শুধু ছবি
প্রমীলাকান্ত ওরফে প্রসঙ্গ আমার খুবই অনুগত। সে আর ন্যাড়া মানে আমার মামাতো ভাই একসঙ্গে ইস্কুলে পড়ত, দুজনে একই সঙ্গে পরপর দুবার হায়ার সেকেণ্ডারি ফেল করে। পরে ন্যাড়া সাপ্লাইয়ের ব্যবসা শুরু করে, কী সাপ্লাই তা অবশ্য কখনও বলেনি। আর প্রসঙ্গ আমার পরামর্শে আর্ট কলেজে ভর্তি হয়। সেখানেও সে আঁকাজোকা শেষ করে পাশ হয়ে বেরোতে পারেনি। তার। আগেই সে আর্ট কলেজ ছেড়ে দেয়। কিন্তু ওই মহাবিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষা এবং সেই সঙ্গে জটিল অভিজ্ঞতা এখন তাকে জীবনে একটা পঁড়াবার জায়গা খুঁজে দিয়েছে।
তাকে নাম বদলের পরামর্শও আমি দিই, বলি যে, প্রমীলাকান্ত দাশগুপ্ত নামে এ বাজারে ছবি এঁকে সুবিধে করা কঠিন, নাম তোমাকে পালটাতে হবে। সে আমাকে বলেছিল, খোকাদা, তুমি যদি খোকা নামে বুড়ো হতে পারলে, তাহলে প্রমীলাকান্ত নামে আমার কী অসুবিধে হবে?
দু-চারবার চাপ দেবার পর প্রমীলাকান্ত অবশ্য আমার পরামর্শ গ্রহণ করেছিল। তার নতুন নামকরণও আমারও করা, প্রমীলার প্র রইল, সেই প্র দিয়ে হল প্রসঙ্গ, মধ্যপদ কান্ত সম্পূর্ণ বাদ আর। দাশগুপ্তের দাশ ঘেঁটে দিয়ে শুধু গুপ্ত রইল। অর্থাৎ প্রমীলাকান্ত দাশগুপ্ত হল প্রসঙ্গ গুপ্ত।
বেশ কাব্যময় নাম। নামটার মধ্যে একটু আর্টিস্ট আর্টিস্ট ভাব, একটা রহস্যময়তা আছে। আর নামটা বেশ লাকিও বটে, প্রথম একজিবিশনেই উতরিয়ে গেল প্রসঙ্গ গুপ্ত। কাগজে কাগজে অনেকটা লেখালেখিও হল। বাংলা দৈনিকের প্রৌঢ় কলারসিক মন্তব্য করলেন, প্রসঙ্গ অবান্তর নয়। ইংরেজি কাগজে প্রসঙ্গ গুপ্তকে সংক্ষিপ্ত করে দিয়ে লিখল, পি জি ইস ডিফারেন্ট। একটু ধরাধরি করতে হয়েছিল, কিন্তু সেটা বিফলে যায়নি।
তার প্রথম প্রদর্শনীতেই একটা অচেনা লোক একটা ছবি সস্তায় কেনার চেষ্টা করল। যদিও সে কিনল না কিন্তু দামদর করতে করতে পঁচিশ টাকা থেকে ষাট টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। ষাট টাকাতে দিলেও বিশেষ কোনও ক্ষতি ছিল না, কিন্তু ছবির গায়ে দাম লেখা ছিল বাইশশো পঞ্চাশ টাকা। এরপরে ষাট টাকায় দেওয়া খুব সম্মানজনক নয়।
সম্মানজনক হোক আর নাই হোক, শিল্পীর অপরিচিত ব্যক্তি ছবি কিনতে চাইছে–এরকম সাধারণত দেখা যায় না। এই ধরনের প্রদর্শনীতে যারা ছবি-টবি কেনে তারা সবাই শিল্পীর আশেপাশের চেনাশোনা লোক।
তবে এসব কথা বলার কোনও অধিকার নেই। আমি জীবনে কোনওদিন কোনও ছবি কিনিনি। ছবি বুঝিও না, সেটা প্রসঙ্গ জানে। এবং সম্ভবত সেই জন্যেই আমাকে একটু সম্মান-উম্মান করে।
প্রসঙ্গ যে খুব ফালতু নয় সেটা আমি এবং অনেকে টের পায় তারাপদবাবুর একটা লেখা পড়ে। তারাপদবাবু তাঁর কাণ্ডজ্ঞানে এক শিল্পীর কথা লিখেছিলেন, প্রদর্শনীতে যাঁর একটা ছবি দেখে জনৈক দর্শক উক্তি করেছিল, অপূর্ব ছবি। দেখলেই জিবে জল আসে। প্রসঙ্গ বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করেছিল সেই দর্শককে, এটা হল সূর্যাস্তের ছবি। দেখে আপনার মনে আনন্দ হতে পারে। চোখে আরাম হতে পারে, কিন্তু জিবে জল আসে কী করে?
জবাবে নির্বিকার দর্শক বলেছিলেন, আমি ভেবেছিলাম ডবল ডিমের ওমলেটের ছবি। সূর্যাস্তের ছবি বুঝতে পারিনি। মাপ করবেন।
তারাপদবাবুর রসিকতা আমার একদম ধাতে সয় না, কিন্তু তিনি যে প্রসঙ্গের এই ব্যাপারটা নিয়েও রসিকতা করবেন এবং সেটা পড়ে পাবলিক হাসবে তা ভাবতে পারিনি।
গতবার সিঙ্গাপুরে এক কনফারেন্সে আমার যাওয়ার কথা ছিল। সব ঠিকঠাক, কিন্তু কীসে কী হল, আমার বড়সাহেব সেই কনফারেন্সে চলে গেলেন, আমার নিমন্ত্রণ আর এল না, অথচ বিষয়টা আমারই ছিল।
সে যা হোক, চাকরি করতে গেলে এমন অনেক হয়। বড়সাহেব আমি যাতে মনে দুঃখ না পাই, সিঙ্গাপুর থেকে ফেরার সময় আমার জন্যে এক বোতল লাল জনিওয়াকার আর একটা গেঞ্জি নিয়ে এসেছিলেন।
বোতলটা পেয়ে খুশি হয়েছিলাম কিন্তু গেঞ্জিটার বুকে আর পিঠে বড় বড় বেগুনি অক্ষরে লেখা ছিল, কিক মি এগেইন, প্লিজ মানে আমাকে আবার লাথি মারুন।
বড়সাহেবের ইঙ্গিতটা আমি বুঝেছিলাম, কিন্তু মৃদু আপত্তি জানালাম, না স্যার। এ গেঞ্জিটা আমি গায়ে দিতে পারব না। লোকেরা হাসবে। বড়সাহেব বলেছিলেন, কী যা-তা বলছেন আপনি? জানেন না হাস্যকর হওয়াই এখন আধুনিকতা?
বড়সাহেবের কথাটা আমার মনে ধরেছিল। সুতরাং যখন তারাপদবাবুর কল্যাণে প্রসঙ্গ হাস্যকর হয়ে গেল, বুঝতে পারলাম এবার আর তাকে ঠেকানো যাবে না।
কে কাকে ঠেকাতে চায়? চাইলেও কেউ কাউকে কি ঠেকাতে পারে? যখন সে উঠতে থাকে, উঠতেই থাকে। হয়তো, হয়তো কেন নিশ্চয়, কেউ কেউ তাকে ঠেকাতে চেয়েছিল। প্রসঙ্গ আমার নিজের লোক। তা ছাড়া তার সঙ্গে আমার স্বার্থের কোনও সংঘাত নেই, তাকে যে ঠেকানো যায়নি তাতে আমি খুশি।
অবশ্য আজকাল প্রসঙ্গের সঙ্গে আমার খুব কম দেখাসাক্ষাৎ হয়। কিন্তু আমি মোটামুটি টের পাই যে সে ছবির আকাশে জেট বিমানের মতো তরতর করে উড়ছে।
কথাবার্তা
(পাঠক পাঠিকা মনে রাখবেন সত্যনারায়ণ = আমি এবং প্রমীলাকান্ত = প্রসঙ্গ)
প্রমীলাকান্ত: খোকাদা, আমি প্রসঙ্গ বলছি।
সত্যনারায়ণ: কে, প্রমীলা? তুমি এত রাতে বিরক্ত করছ? তুমি জান না আমি এখন খবরের কাগজ পড়ি!
প্রমীলাকান্ত: তা জানি। খুব ভালভাবেই জানি। কিন্তু একটা খবর কাগজে ছাপা হয়নি অথচ আপনার জানা দরকার সেই জন্যেই ফোন করছি।
সত্যনারায়ণ: (কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে) বলো কী খবর?
প্রমীলাকান্ত: খবরটা শুনলে আপনি চমকে উঠবেন।
সত্যনারায়ণ: তাড়াতাড়ি বলো। দেরি করে চমকাতে আমার মোটে ভাল লাগে না।
প্রমীলাকান্ত: আমি কলম্বো যাচ্ছি। ন্যাড়া পাঠাচ্ছে।
সত্যনারায়ণ: এই দুর্দিনে কলম্বো? তুমি কি ভারতীয় শান্তিসেনায় যোগ দিয়েছ?
প্রমীলাকান্ত: আরে তা নয়, আমি আমার বারোটা ছবি নিয়ে কলম্বোয় ভারত-উৎসবে যাচ্ছি।
সত্যনারায়ণ: এই দুর্দিনে ভারত-উৎসব! সাংঘাতিক কথা বলছ, তোমার কি কোনও বোধ নেই? নাড়ার কথায় ওদিকে যেয়ো না, মারা পড়বে। শোনো, আমাদের কোম্পানির একটা ব্রাঞ্চ অফিস ছিল কলম্বোয়, তার তামিল ম্যানেজারকে আজ আড়াই মাস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো গুমখুন হয়েছে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
প্রমীলাকান্ত: দোহাই খোকাদা, এই মাঝরাত্তিরে ভয় দেখাবেন না। সব ঠিকঠাক, এখন ভয় খেলে। চলবে না। ভয় দেখাবেন না।
সত্যনারায়ণ: তুমিও মাঝরাত্তিরে আমার খবরের কাগজ পড়ায় বাধা দিয়ো না। (এই সময় টেলিফোনের মধ্যে একটা তৃতীয় কণ্ঠস্বর মহিলার গলা শোনা গেল, থ্রি মিনিটস ওভার, থ্রি মিনিটস৷)।
সত্যনারায়ণ: (একটু চমকিয়ে উঠে) সর্বনাশ, এটা ট্রাঙ্কল নাকি! এটা তো লোকাল কল মনে হচ্ছে না! প্রমীলাকান্ত তুমি কোথা থেকে কথা বলছ?
প্রমীলাকান্ত: কলকাতায় আমার ফ্ল্যাট থেকেই কথা বলছি। সত্যনারায়ণ: তাহলে থ্রি মিনিটস ওভার–থ্রি মিনিটস এসব কী হচ্ছে?
প্রমীলাকান্ত: আমি নিজে তো ফোন পাইনি। বাড়িওয়ালির কাছ থেকে টাইলাইন নিয়েছি। তার সঙ্গে চুক্তি একনাগাড়ে তিন মিনিটের বেশি কথা বলব না। তাই তিনি তিন মিনিট হয়ে গেলেই ওইরকম আওয়াজ দেন।
সত্যনারায়ণ: কিন্তু মহিলার গলার স্বর কেমন চেনা চেনা মনে হল। উনি কি টেলিফোন ডিপার্টমেন্টে ট্রাঙ্ক সেকশানে আগে কাজ করতেন? (এই সময় টেলিফোনের মধ্যে আবার তৃতীয় কণ্ঠস্বর শোনা গেল, শাট আপ!)।
প্রমীলাকান্ত: খোকাদা আপনি ডোবালেন। বাড়িওয়ালি টাইলাইনে সব কান পেতে শুনছে। (পুনরায় টেলিফোনের মধ্যে তৃতীয় কণ্ঠস্বর, না, আমি শুনছি না। মিথ্যুক কোথাকার!)
সত্যনারায়ণ: উনি তো শুনছেন না বলছেন, শুধু শুধু ভদ্রমহিলার নামে দোষ দিচ্ছ। (আবার টেলিফোনের মধ্যে করুণ তৃতীয় কণ্ঠস্বর, দেখুন তো!)।
প্রমীলাকান্ত: খোকাদা, বাড়িওয়ালির সাইড নেবেন না। ওর গ্যারেজের ঘরে ছবিগুলো রেখেছিলাম। হঠাৎ তালা দিয়ে দিয়েছে। এখন ছবিগুলো কী করে বার করি, কী করে ভারত-উৎসবে নিয়ে যাই! অনেকটা সেই জন্যেই আপনাকে ফোন করছি।
তৃতীয় কণ্ঠস্বর: আগে দেড় বছরের গ্যারেজ ভাড়া মেটাও। তার সঙ্গে দেড় কুইন্টাল দুধের দাম দিতে হবে।
প্রমীলাকান্ত: ভারত-উৎসব থেকে ফিরেই আপনার গ্যারেজ ভাড়া দিয়ে দেব। কিন্তু দুধের দামটা কেন বুঝতে পারছি না।
তৃতীয় কণ্ঠস্বর: বুঝতে পারছ না? গ্যারেজের ঘরে আমার মেনি বেড়াল চারটে বাচ্চা দিয়েছিল। সে তোমার ছবিগুলো দেখে ভয় পেয়ে বাচ্চা ফেলে পালিয়ে যায়। সেই চারটে বাচ্চাকে তাদের তিন মাস বয়েস পর্যন্ত বড় না হওয়া পর্যন্ত একেকটাকে দৈনিক সিকি লিটার করে মাদার ডেয়ারির দুধ খাওয়াতে হয়েছে। হিসেব করলে অনেক হয়, তুমি দেড় কুইন্টালের দামটাই দাও। তা ছাড়া এখন মাদার ডেয়ারির দুধের দাম অনেক বেড়ে গেছে, তুমি না হয় পুরনো দামটাই দাও।
প্রমীলাকান্ত: সব মিথ্যে কথা। আপনি ভঁহা কৃপণ। আপনার মেনি বেড়াল খেতে না পেয়ে পালিয়েছে, আমার ছবি দেখে ভয় পাবে কেন?
তৃতীয় কণ্ঠস্বর: মিথ্যে কথা কেন হতে যাবে? সেবার তুমি যখন খোলা উঠোনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছবি আঁকছিলে, এক রাজ্যের কাক এসে পরপর তিনদিন ধরে চিৎকার চেঁচামেচি করেনি?
প্রমীলাকান্ত: তার কারণ ছিল, ওটা আমি কাকতাড়ুয়ার ছবি আঁকছিলাম।
তৃতীয় কণ্ঠস্বর: কিন্তু তখন তুমি আমাকে বলেছিলে আমার পোর্ট্রেট আঁকছ, সেই জন্যে আমি তোমাকে আমার গ্যারেজের ঘরটা ছেড়ে দিয়েছিলাম।
প্রমীলাকান্ত; কী করব বলুন! আমি তো আপনার ছবিই আঁকতে চেয়েছিলুম। কিন্তু একে আপনার চেহারাটা কেমন যেন, তার পরে সেই আমার প্রথম পোর্ট্রেট, তালেগোলে কাকতাড়ুয়া হয়ে গেল! সে যা হয়েছে ক্ষমা করে দিন! দয়া করে আমার ছবিগুলো ছেড়ে দিন।
সত্যনারায়ণ: (হাই তুলতে তুলতে) ও বাড়িওয়ালি দিদি, ছবিগুলো ছেড়ে দিন না। বুঝছেন না কত বড় ব্যাপার। কলম্বোয় ভারত-উৎসবে যাচ্ছে ভারত-শ্রীলঙ্কা মৈত্রীর পথে বাধা দেবেন না।
তৃতীয় কণ্ঠস্বর: তা বাধা দেব না কিন্তু যা বলেছি, আমার গ্যারেজ ভাড়া আর দুধের দাম মিটিয়ে দিতে হবে।
সত্যনারায়ণ: (বিরক্ত কণ্ঠে) ভাড়া আর দুধের দাম সবসুদ্ধ কত টাকা হবে?
তৃতীয় কণ্ঠস্বর: গ্যারেজ ভাড়া তিনশো টাকা করে, মাসে, দেড় বছরে চার হাজার আটশো টাকা আর সেই সঙ্গে দেড় কুইন্টাল দুধের দাম চার টাকা দরে ছশো টাকা।–পাঁচ হাজার চারশো টাকা হচ্ছে মোটমাট, আমি পাঁচ হাজার পেলেই ছেড়ে দেব।
সত্যনারায়ণ: প্রমীলাকান্ত, তোমার কাছে কত টাকা আছে?
প্রমীলাকান্ত: বহুকষ্টে হাজার দেড়েক টাকা জমিয়েছিলাম। কিন্তু ন্যাড়া বলল, আর্টিস্ট হয়ে বিদেশ সফরে যেতে হলে ভেক চাই। তাই দুজোড়া লাল সিল্কের পাজামা-পাঞ্জাবি বানালাম, একজোড়া জরির নাগরা কিনলাম। তারপরে ফটো ভোলা, পাসপোর্ট করা, তাতেও খরচা হল! এখন হাতে আর একাশি টাকা ষাট পয়সা মাত্র আছে। নাডু বলেছে সরকারি টাকা পাওয়া যাবে, কিন্তু সে কবে পাব কে জানে!
সত্যনারায়ণ: তাহলে ও পাঁচ হাজার টাকা আমিই তোমাকে ধার দেব। ফিরে এসে শোধ দিও। কাল হবে না, পরশু এসে টাকা নিয়ে যেও।
তৃতীয় কণ্ঠস্বর: বাঁচালেন। প্রমীলাকান্ত: এবার দুজনে ফোনটা ছেড়ে দিয়ে আমাকে বাঁচাও তো!
যাত্রাভঙ্গ
এই বাক্যালাপের দুদিন পরে অফিসে গিয়ে প্রথমে ব্যাঙ্ক থেকে প্রসঙ্গের জন্যে পাঁচ হাজার টাকা তুলোম। সন্ধ্যাবেলা বাসায় সে এসে টাকাটা নিয়ে যাবে, এইরকম ধরে নিয়েছিলাম।
কিন্তু সে এল না। যদি কোনও ফোন করে সেই জন্যে ফোনটা রিসিভার থেকে না নামিয়ে রেখে দিলাম যাতে এলে ধরতে পারি।
কিন্তু কোনও ফোনও এল না। রাতে নির্বিঘ্নে খবরের কাগজ পড়া শেষ করে ঘুমোলাম। খবরের কাগজে দেখলাম মন্ত্রিসভায় রদবদলের সম্ভাবনা কিন্তু বিস্তারিত কিছু লেখেনি। ন্যাড়া ছোটখাটো উপমন্ত্রী, নিশ্চয়ই এই রদবদলের মধ্যে সে আসবে না। কিন্তু তবু কেমন সন্দেহ হল, হয়তো প্রসঙ্গ ন্যাড়া ব্যাপারেই কোথাও আটকে গিয়েছে। পুরনো বন্ধু হিসেবে অনেক সময় ন্যাড়ার হয়ে সে অনেক দৌড়াদৌড়ি করে।
রাতে কোনও ফোন-টোন আসেনি। কিন্তু ভোরবেলা ঘুম ভাঙল ফোনের আওয়াজে। মামিমা ফোন করছেন, খুব উত্তেজিত ও খুশি, খোকা শুনেছিস, একটু আগে খবর পেলাম ন্যাড়া প্রমোশন পেয়েছে।
হায়ার সেকেন্ডারি দুবার ফেল করার পরে ন্যাড়া লেখাপড়া ছেড়েছে সে আজ প্রায় কুড়ি বছর। কোনও চাকরি-বাকরিও করে না, রীতিমতো মন্ত্রী, তার বার আবার প্রমোশন কী! আর এই শেষরাতে কীসের প্রমোশন?
মামিমা নিজেই বুঝিয়ে বললেন, ন্যাড়া কাল রাতে প্রতিমন্ত্রী হয়েছে। আগে তো উপমন্ত্রী ছিল, এখন ক্ষমতা বাড়ল। বড় বাংলো পাওয়া যাবে। খুব বড় প্রমোশন হল।
আপন মামাতো ভাইয়ের এই উন্নতিতে খুশি হয়ে মামিমাকে বললাম, খুব সুখবর। আমি সন্ধ্যাবেলা আসছি।
ফোন নামিয়ে রাখতে না রাখতে প্রসঙ্গ এল। তার মুখে চোখে তেমন আনন্দের ছটা দেখতে পেলাম না, বরং কেমন একটা হতাশ ভাব। বুঝলাম ন্যাড়ার খবরটা সে পায়নি, তাকে চাঙ্গা করার জন্যে প্রমোশনের খবরটা তাকে বললাম।
প্রসঙ্গ বলল, এ তো বাসি খবর। কাল বিকেল থেকেই জানি। আজ সকালে সব খবরের কাগজেই বেরিয়েছে। ন্যাড়ার তো প্রমোশন হল কিন্তু ঠেকে গেলাম আমি।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কী ঠেকে গেলে?
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলল, আমার ভারত-উৎসবটা মারা পড়ল।
প্রসঙ্গের কথা প্রথমে ধরতে না পারলেও পরে বুঝলাম যে ন্যাড়া ছিল ঐতিহ্য ও উৎসবদপ্তরের উপমন্ত্রী, এখন সে হল জাহাজ নির্মাণ দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী। সুতরাং কলম্বোয় আগের মন্ত্রীর বন্ধুর ছবি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না। আমলারা আগে থেকেই আঁচ পেয়েছিল ব্যাপারটা, কাল বিকেলেই প্রসঙ্গের নাম কেটে দিয়ে নতুন বিহারি উপমন্ত্রীর শ্যালিকার নাম ঢুকিয়ে দিয়েছে। সে মহিলা অবশ্য ছবি আঁকেন না, তাঁর নাচের ইস্কুল আছে পাটনায়।
প্রসঙ্গ বলল, বড় আশা করে ছিলাম, খোকাদা। ন্যাড়া তো আর দুদিন পরেও প্রমোশন পেতে পারত।
আমি একদিকে আশ্বস্ত হলাম এই ভেবে যে পাঁচ হাজার টাকাটা আমাকে ধার দিতে হল না। তবু প্রসঙ্গকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে বললাম, দ্যাখো নাড়ু এখনও হয়তো কিছু করতে পারবে।
প্রসঙ্গ শুকনো মুখে বলল, জাহাজ নির্মাণ দপ্তরে ন্যাড়া আমার জন্যে কী করতে পারবে, আমি তো আর জাহাজ বানাতে পারব না! বলে প্রসঙ্গ ভগ্নহৃদয়ে চলে গেল। আমি তাকে বিশেষ ভরসা দিতে পারলাম না।
কিন্তু আমি আর প্রসঙ্গ দুজনেই ন্যাড়াকে মাপতে ভুল করেছিলাম। পরের দিন সকালে আবার প্রসঙ্গ এল হাঁপাতে হাঁপাতে, খোকাদা, খবরের কাগজ দেখেছেন?
আমি তখন পার্কে খালিপায়ে হাঁটছিলাম ভেজা ঘাসের ওপরে, সেখানেই প্রসঙ্গ এসে আমাকে ধরল। আমি তাকে বললাম, তুমি তো জানো, আমি সকালে খবরের কাজ দেখি না।
প্রসঙ্গ বলল, আজ একটু দেখুন। দেখলাম চারের পাতায় সপ্তম কলমে একটা ছোট খবর:
ভারতীয় জাহাজে ছবি
…জাহাজ নির্মাণ দপ্তরের নতুন প্রতিমন্ত্রী কার্যভার গ্রহণ করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে ভারতীয় যাত্রী জাহাজগুলিকে আরও সুন্দর ও সুষমামণ্ডিত করা হবে। প্রত্যেকটি জাহাজের ডেকে একটি করে উচ্চমানের ছবি টাঙানো হবে।
প্রসঙ্গত জানা গেল বিখ্যাত চিত্রকর শ্রীযুক্ত প্রসঙ্গ গুপ্ত প্রথম বারোটি জাহাজের জন্যে তাঁর বারোটি বিখ্যাত ছবি সরকারকে দিতে সম্মত হয়েছেন।
জাহাজ দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন যে, এর জন্যে উপযুক্ত মূল্য শিল্পীকে সরকার দেবেন। খবরটা পড়া শেষ হবার পর প্রসঙ্গের মুখের দিকে তাকালাম। তার মুখভরা হাসি, সে বলল, ন্যাড়া কী করল দেখলেন! এখন সেই পাঁচ হাজার টাকাটা দিন তো, বাড়িওয়ালির কাছ থেকে ছবিগুলো ছাড়াতে হবে! তারপর একটু থেমে বলল, আচ্ছা একেকটা ছবির জন্যে সরকার যদি দশ হাজার টাকা করে দেয়, তাহলে তার থেকে বেশি চাওয়া কি উচিত হবে?
আমার অনেকদিন আগের প্রসঙ্গের প্রথম প্রদর্শনীর সেই ক্রেতাটির কথা মনে পড়ল যে ষাট টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। লোকটা এখন এখানে থাকলে অজ্ঞান হয়ে যেত।
গেঞ্জি
ভূমিকা
আমার ছেলে কিছুতেই বাঁচামাছ খেতে চায় না। যাঁরা খান, জানেন বাঁচামাছ জাবদা বা ট্যাংরার। মতোই কিংবা তার চেয়েও সুস্বাদু জাতের মাছ। এবার কয়েকদিন পরপর বাজারে বাঁচামাছ উঠল, দামও খুব চড়া নয়।
আমি নিজেই বাজার করি, ইচ্ছে করে এবং ছেলেকে জোর করে বাঁচামাছের স্বাদ গ্রহণ করানোর জন্যে পরপর তিনদিন বাঁচামাছ কিনে আনলাম বাজার থেকে। হয়তো এর পরেও আরও কয়েকদিন আনতাম যদি না আমার স্ত্রী মারমুখী হতেন।
সে যাহোক, বাড়িতে বাঁচামাছের প্লাবনেও আমার ছেলে কিন্তু বাঁচামাছ স্পর্শ করল না, বাঁচামাছের একটা টুকরোও খাওয়ার পাতে ছুঁল না। তৃতীয় দিনে তার এই মৎস সত্যাগ্রহের পর যখন তাকে কঠোরভাবে জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপারটা কী? সে বিনীতভাবে জানাল, এ লড়াই বাঁচার লড়াই।
ভূমিকাতেই বলে রাখা ভাল আমার এই সামান্য গল্পটি মাছ বা মাছ খাওয়া নিয়ে নয়, তার চেয়ে অনেক গুরুতর বিষয়ে, একালের ওই স্লোগান বাঁচার লড়াই নিয়ে।
সম্ভবত এই গল্পটির নাম পাঠ করে কোনও কোনও কৃতবিদ্য পণ্ডিত তৎসহ সাহিত্যের পাঠকের এই নামে একটি বিখ্যাত উপন্যাসের কথা মনে পড়তে পারে। আমার স্বীকার করা উচিত, ওই কালজয়ী গেঞ্জি উপন্যাসটির কাহিনির সঙ্গে মিল না থাকলেও এবং এটি একটি ক্ষুদ্র গল্প হলেও, ওই একই জাতের জীবনসংগ্রাম, যাকে অধুনা বাঁচার লড়াই বলে, আমার অক্ষম লেখনীতে এক্ষণে আমি ব্যক্ত করার চেষ্টা করছি।
কাহিনি
পৈলান বাসস্ট্যান্ডে নেমে একটু এগিয়ে মোড় ঘুরে হাঁটাপথে মাত্র সাড়ে তিন মাইল। জীবনে এই আমার দীর্ঘতম পদযাত্রা। কোনও উপায় নেই, প্রাণের দায়ে হাঁটতেই হল। পথে রেলিংহীন একটি পঞ্চাশ হাত বাঁশের সাঁকো, যার শেষ প্রান্ত এবং খালধারের মধ্যের দূরত্ব দীর্ঘ লক্ষে অতিক্রম করতে হয়, সেও প্রায় ছয়-সাত হাত। প্রাণের দায়ে সেটুকুও লাফাতে হল। কাদামাটিতে মুখ থুবড়িয়ে পড়ে একটা গড়াগড়ি দিতে হল। সকালবেলা ধোপদুরস্ত জামাকাপড় পরে বেরিয়েছিলাম। এখন যা চেহারা হল বলার নয়।
লাফের পর মিনিট দশেক দম নিয়ে আবার হাঁটতে হল। এমনিই সারাক্ষণ আমার দমবন্ধ ভাব, তার উপরে এই হুজ্জোত।
কিন্তু এই দমবন্ধ ভাবটা কাটানোর জন্যে এ হুজ্জোত আমাকে পোহাতেই হচ্ছে।
ব্যাপারটা আরেকটু আগের থেকেই খুলে বলা উচিত। বছর দুয়েক হল আমার কেমন একটা গলাচাপা, দমবন্ধ ভাব। বাসায় বা বিছানায় ভালই থাকি। সকালবেলা খোলামেলা খালি গায়ে ইজিচেয়ারে শুয়ে বেশ আরাম এবং স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে চা খাই, খবরের কাগজ পড়ি। বিকেলে কাজ থেকে বাড়ি ফিরে স্নান-টান করে স্বস্তি ফিরে পাই। কিন্তু যখনই রাস্তায় বেরোই বা কাজে যাই, কেমন যেন কানের ভেতরটা ভোঁ ভোঁ করে, নাকের ডগা লাল হয়ে ওঠে, চোখ টনটন করে, মাথা। ঘুরতে থাকে, রীতিমতো দমবন্ধ অবস্থা দাঁড়িয়ে যায়।
একদিনে এরকম হয়নি। আস্তে আস্তে হয়েছে। যখন কষ্ট বাড়ল অফিসের এক বন্ধুকে বললাম। তিনি একবাক্যে রায় দিলেন, তোমার প্রেশার হয়েছে।
প্রেশার হয়েছে কথাটা এমনিতে নিরর্থক। নিচু হোক, উঁচু হোক প্রেশার তো জীবিত মানুষের থাকবেই। শুধু যখন সে মরে যাবে তখন প্রেশার থাকবে না।
প্রেশারের ব্যাপারটা আমি অবশ্য ভাল বুঝি না। আমার দাদাকে একবার ডাক্তার বলেছিলেন, আপনার হাই-লো-প্রেশার। দাদা ধরে নিয়েছিলেন হাই এবং লো যখন একসঙ্গে, সুতরাং মাঝারি, সুতরাং নর্মাল; তাই কোনও চিকিৎসা করাননি। শেষে এক গোধূলি লগ্নে আমাদের এক আত্মীয়কন্যার বিবাহমণ্ডপে কনের পিড়ি ধরে সাতপাক ঘোরানোর সময় প্রথম পাকের মাথায় দাদা মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। এবং মুহূর্তের মধ্যে তাঁর সেই ভূপতিত মস্তকে প্রথমে পড়ল শতাব্দীপ্রাচীন আধমণি কাঁঠাল কাঠের পিড়ি এবং তারপরে পড়ল সিকি শতাব্দীপ্রাচীন দেড়মণি নাদুসনুদুসী কনেটি।
পরে জানা গিয়েছিল ওই হাই-লো প্রেশারের ব্যাপারটা। হাই-লো অর্থাৎ উচ্চনীচ রক্তচাপ অর্থাৎ খুব বেশি নিচু। ব্যাপারটা না বোঝার জন্যে আমার অগ্রজের সমূহ ক্ষতি হয়েছিল, ওই ঘটনার পরে জ্ঞান ফিরে আসার থেকে তার বিবাহ, রমণী এবং কাঠের উপরে সম্পূর্ণ অনীহা জন্মায়।
আমার অশ্রুগ্রন্থি দুর্বল। অগ্রজের কথা লিখতে গেলে আমার চোখে জল আসে। তার চেয়ে নিজের কথা লিখি।
আমার রক্তচাপ বার বার বহু ডাক্তারের কাছে মাপিয়ে দেখেছি, মোটামুটি স্বাভাবিক। নানা রকম ডাক্তারি পরীক্ষা করিয়েও দেখলাম, আমার তেমন খারাপ কিছু ধরা পড়ল না। ঘুম, খিদে হজম ইত্যাদিও চমৎকার। কিন্তু বাড়ির মধ্যেও কেমন একটা দমবন্ধ ভাব, কানের মধ্যে ভোঁ ভোঁ করে, গলা শুকিয়ে যায়, মাথা ঘোরে।
কোনও ডাক্তারই যখন চিকিৎসা করে সুরাহা করতে পারলেন না, তখন কোবরেজি, হোমিওপ্যাথি সবই চেষ্টা করলাম। কিছুতেই কিছু হল না, পরশুরামের চিকিৎসা সংকটের মতো অবস্থা প্রায়। তবু অবশেষে মুষ্টিযোগ, তারপরে যোগ ব্যায়ামের পথে এগোলাম। বিশেষ সুবিধে হল না। মধ্য থেকে সর্বাঙ্গে প্রচণ্ড ব্যথা হল। শীর্ষাসন করার সময় হঠাৎ বাড়ির বহু পুরনো বুড়ো হুলো বেড়ালটা কেমন চমকে গিয়ে আমার নাকটা আঁচড়ে দিল। নাকের মাংস বড় নরম, দরদর করে কপাল বেয়ে রক্ত পড়ে মাথার চুল আঠা হয়ে গেল।
সবচেয়ে বেকায়দা হয়েছিল জল চিকিৎসা করতে গিয়ে। কাঁচা মাটির হাঁড়িতে শায়িত অবস্থায় চুমুক দিয়ে সাত সকালে পরপর সাত হাঁড়ি জল শুয়ে শুয়ে খেতে হবে বিছানা পরিত্যাগ না করে। যে সময়ে জলত্যাগ করার জন্যে মানুষ বিছানা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয় ঠিক সেই সময়ে সাত হাঁড়ি জলপান করা আমার পক্ষে সম্ভব হল না। এদিকে সেই মাথা ঘোরা, কান ভোঁ ভোঁ, দমবন্ধ ভাব সেটা কিন্তু লেগেই রয়েছে।
অগত্যা পৈলান, পৈলানের পথে আসি। অবশ্য ঠিক পৈলান নয়। পৈলান থেকে তিন মাইল অর্থাৎ পাঁচ কিলোমিটার দূরে বড় মহাদেবপুর। বড় মহাদেবপুরের শেষ সীমানায় গ্রামের কুমোরপাড়া, সেখানে খোকা পালের বাড়িতে সাদা আমড়া, ভগবানের এক আশ্চর্য দান, পৃথিবীতে আর কোথাও পাওয়া যায় না। এই সাদা আমড়া রোদ্দুরে শুকিয়ে যখন ঝরঝরে হয়ে যাবে, হামানদিস্তায় হেঁচে একরকম হালকা তেল বেরোবে, সেই তেল নাকে দিয়ে রাতে ঘুমোতে হবে। এই রকম সাত রাত চালাতে পারলেই চোখ টনটন, কানের ভেতর ভোঁ ভোঁ ডাক, নাকের ডগা লাল হওয়া সব সেরে যাবে।
পরামর্শটা দিয়েছিলেন আমার এক সহকর্মী মহেশবাবু। মহেশবাবুর মামাশ্বশুর এই সাদা আমড়ার তেল নাকে দিয়ে সাক্ষাৎ মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে এসেছিলেন। মহেশবাবু আরও বলেছিলেন, কলকাতার যত বড় বড় ডাক্তার তারা রোগীকে যতসব উলটোপালটা ওষুধ খাওয়ান কিন্তু নিজেরা গোপনে এই সাদা আমড়ার তেল নাকে দেন, কোনও ওষুধ স্পর্শ করেন না।
আজ বড় মহাদেবপুরে বড় আশা নিয়ে এসেছি। কিন্তু আশা পূর্ণ হল না। কুমোরপাড়ার খোকা পালের বাড়ি খুঁজে পেতে কোনও অসুবিধেই হল না। সারা অঞ্চলে ওই সাদা আমড়ার দৌলতে খোকা পালের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু সম্প্রতি বড় একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমড়া গাছে আর সাদা আমড়া হচ্ছে না, অন্য সব গাছে যেমন হয় তেমনই স্বাভাবিক সবুজ রঙের আমড়া হচ্ছে।
খোকা পাল মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছে। যদিও সে আমাকে কখনও দেখেনি, আমি তাদের উঠোনে পা দিতেই ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল। বোঝা গেল সাদা আমড়ার ব্যবসায় তার বিলক্ষণ দু পয়সা হচ্ছিল, এখন আমড়ার শুভ্রতা চলে যাওয়ায় সে পথে বসে পড়েছে। সাদা আমড়ার উপর নির্ভর করে সে তার জাতব্যবসার সম্বল কুমোরের চাকটা পর্যন্ত বেচে দিয়েছে।
আমি আর কী করব, নিজের ভাগ্যকে মনে মনে বলিহারি দিয়ে দমবন্ধ, কান ভোঁ ভোঁ, নাক লাল, চোখ টনটন অবস্থা চিরস্থায়ী ধরে নিয়ে পৈলানের হাঁটাপথে কলকাতার মুখে রওনা হলাম।
এখন রোদ আরও চড়া। তবে এবার আর সেই খালধার থেকে বাঁশের সাঁকোয় লাফিয়ে উঠতে গেলাম না। খালের মধ্য দিয়ে হেঁটে পার হলাম। জামাকাপড় তো আগের বারেই কাদা মাখামাখি হয়ে গেছে। আরও একটু কাদাজল লাগল।
বাসস্ট্যান্ডে যখন এসেছি, রোদ্দুরে শুকিয়ে সারা গায়ে কাদা চটচট করছে। শরীরের অস্বস্তির জন্যে কষ্ট হচ্ছে, এমন সময় চোখে পড়ল পাশে একটা হোসিয়ারির দোকান। মনে মনে ভাবলাম, এখান থেকে গেঞ্জি কিনে নিই। তারপর গায়ের কাদামাখা জামা আর গেঞ্জি ছেড়ে নতুনটা পরে নেব, একটু আরাম হবে।
দোকানটার ভেতরে গেলাম। অল্পবয়েসি একটি ছেলে, বড় জোর কুড়ি-বাইশ বছর বয়েস হবে, কাউন্টারে বসে রয়েছে। আমি তাকে গিয়ে বললাম, ভাই, একটা চৌত্রিশ সাইজ হাওলা গেঞ্জি হবে?
ছেলেটি এতক্ষণ আমার কর্দমাক্ত পোশাক পর্যবেক্ষণ করছিল। আমার কথা শুনে আমার মুখের দিকে তাকাল, তারপর প্রশ্ন করল, কত সাইজ? চৌত্রিশ? কার জন্যে?
আমি বললাম, আমার জন্যে। আমার চৌত্রিশই লাগে।
ছেলেটি বলল, আপনি আগে নিশ্চয় রোগা ছিলেন তখন চৌত্রিশ লাগত।
আমি ভেবে দেখলাম, ছেলেটি ঠিকই বলেছে। বহুকাল ধরে চৌত্রিশ নম্বর গেঞ্জি গায়ে দিয়ে আসছি, এর মধ্যে আমার ওজন সোয়াগুণ বেড়েছে।
ছেলেটি এরপরে বলল, আর তা ছাড়া আজকাল গেঞ্জির সাইজগুলোও ঠিক নয়। চৌত্রিশ সাইজের গেঞ্জির দরকার হলে কিনতে হবে ছত্রিশ। আর আপনার এখন দরকার ছত্রিশ, আপনাকে। কিনতে হবে আটত্রিশ।
আমি অবাক হয়ে ছেলেটির কথা শুনছি, এবার ছেলেটি মোক্ষম কথা বলল, আটত্রিশের জায়গায় এখন যদি আপনি চৌত্রিশ গেঞ্জি গায়ে দেন তাহলে আপনার কানের ভেতরটা ভোঁ ভোঁ করবে, নাকের ডগা লাল হয়ে উঠবে, চোখ টনটন করবে, মাথা ঘুরবে, দম বন্ধ হয়ে আসবে।
আমি অবাক হয়ে দোকানি ছেলেটির কথা শুনছি। সমস্ত লক্ষণ মিলে যাচ্ছে, কান ভোঁ ভোঁ, নাক লাল, চোখ টনটন, দম বন্ধ, আমার দিব্যদৃষ্টি খুলে গেল। মুহূর্তের মধ্যে আমি আমার কর্দমাক্ত জামাসুদ্ধ চৌত্রিশ নম্বর