- বইয়ের নামঃ তারানাথ তান্ত্রিক
- লেখকের নামঃ তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
০১. দিনটা সকাল থেকেই মেঘলা
দিনটা সকাল থেকেই মেঘলা। দুপুরের দিকে বেশ একপশলা বৃষ্টিও হয়ে গেল। তারপর আর বৃষ্টি নেই বটে, কিন্তু আকাশ থমথম করছে কালো মেঘে। জোলো বাতাস দিচ্ছে।
এমন দিনে মনে একটা কি-করি কি-করি ভাব হয়। দু-একখানা বিলিতি ম্যাগাজিন বন্ধুদের কাছ থেকে চেয়ে এনে পরে পড়ব বলে জমিয়ে রেখেছিলাম। এখন সেগুলো উলটে–পালটে দেখলাম বাদলার দিনের মেজাজের সঙ্গে ঠিক খাপ খাচ্ছে না।
কি করা যায়? স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করব? নাঃ, সাত বছর বিয়ে হয়ে যাবার পর আর বাদলার দিনে খোলা জানলার ধারে স্ত্রীকে নিয়ে কাব্য চলে না। যতই নিষ্ঠুর শোনাক, কথাটা সত্য। মহাকালের নির্মমতা এবং অতীত সুখের দিন সম্বন্ধে বিমর্ষ ভাবে চিন্তা করছি, এমন সময় দরজার কড়া নড়ে উঠল।
উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখি কিশোরী সেন। ভেতরে ঢুকে কাদামাখা রবারের পাম্প ছাড়তে ছাড়তে সে হেসে বললে, এই বর্ষার দিনে বাড়ি বসে করছ কি?
বললুম, যে অশ্ব নেই তার তৃণ সংগ্রহ করছিলুম। খুব ভাল হয়েছে তুমি এসেছ। একেবারে মিয়োনো দিন, না?
কিশোরী বললে, আর বসে কাজ নেই। একটা জামাটামা যাহোক কিছু গলিয়ে নাও। চল, তারানাথ জ্যোতিষীর বাড়ি ঘুরে আসি। আর কিছু না হোক, দুএকটা আজব গল্প তো শোনা যাবে। এমন দিনেই তো উদ্ভটগল্প জমে–
তারানাথের কথা আমার যে কেন আগেই মনে পড়েনি তা ভেবে অবাক লাগল। বললুম, বসো, ধুতিটা বদলে নিই—
পথে বেরিয়ে বললুম, ট্রামে উঠে কাজ নেই। মাসের শেষ, সেই আট পয়সা দিয়ে বরং। সিগারেট কেনা যাবে। হেঁটে মেরে দিই চল। এইটুকু তো পথ—
কিশোরীরও মাসের শেষ। আট পয়সার পাশিং শো কিনে হাঁটতে হাঁটতে দুজনে মট লেনে তারানাথের বাড়ি হাজির হলুম।
দরজা খুলে দিল তারানাথের মেয়ে চারি। আমাকে দেখেই বললে, কাকাবাবু, আজ আমার লেসের ডিজাইন ভোলেননি তো? রোজরোজ-ই আপনি ভুলে যান–
আজ ভুলিনি। আগে থেকেই পকেটে রেখে দিয়েছিলাম। বের করে হাতে দিতে চারি হাসিমুখে বাড়ির ভেতরে যেতে যেতে বললে, বসুন, বাবাকে ডাকি–
খবর পেয়ে তারানাথ খুব খুশী হয়ে বেরিয়ে এল। বহুদিনের মধ্যে তারও এমন একনিষ্ঠ শ্রোতা ও ভক্ত জোটেনি। গল্পে লোক শ্রোতার মর্ম বোঝে। তক্তাপোশে বসতে বসতে তারানাথ বললে, তারপর, হঠাৎ যে?
বললুম, ভাল লাগছিল না বাড়ি বসে। তাই আড্ডা দিতে চলে এলুম। দু’একখানা গল্প হবে নাকি?
তারানাথ স্পষ্টতই খুশী হল, বললে, বসো, বসো জমিয়ে আগে। কি খাবে বল? ও চারি, চারি। এদিকে শোন দিকি একবার–
চারি এসে দাঁড়াতে তারানাথ বললে, যা দিকি চট করে তেল-নুন-কাঁচালঙ্কা দিয়ে মুড়ি মেখে নিয়ে আয়। পরে চা দিবি।
তারপর আমাদের দিকে ফিরে বললে, কি গল্প বলব? তোমরা তো এসব বিশ্বাস করো না—
কিশোরী বললে, অমনি বলে বসলেন বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস যদি না-ই করব, তাহলে এই বাদলায় এতখানি পথ ঠেঙিয়ে এলুম কি করতে?
—সে গল্প শোনার লোভে। নাস্তিক আর অবিশ্বাসীরাই অলৌকিক গল্পের ভাল শ্রোতা হয়। আমি বললুম, আপনার কাছে এতদিন আসছি, আপনি কিন্তু আমাদের অলৌকিক কিছু দেখালেন না—
তারানাথ উজ্জ্বল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললে, মানে শূন্যে হাত নেড়ে সন্দেশ রসগোল্লা আনা? জলকে মন্ত্র পড়ে সরবৎ করে দেওয়া? তোমাকে তো একদিন বলেছি, ওসব খুব নিম্নশ্রেণীর শক্তি—ভেলকি ও করায় গুরুর বারণ ছিল। তবে করিনি কি? করেছি। কম বয়েসে ভক্তদের অবাক করার জন্য, পয়সা রোজগারের ফিকিরে করেছি কিছু কিছু। বাকি শক্তিও তাতেই গেল। ওতে কিছু নেই বাপু-আসল তান্ত্রিক কখনো ভেলকি দেখায় না।
কিশোরী বললে, আচ্ছা, সাধুরা যে চোখ বুজে ত্রিভুবন ত্রিকাল সামনে দেখতে পান, এখানে বসে বিলেতে কি হচ্ছে সব বলে দিতে পারেন, এসব কি বিশ্বাসযোগ্য।
তারানাথ জোর দিয়ে বললে, নিশ্চয়। সদগুরু পেলে আর প্রকৃত সাধনা করতে পারলে তুমিও পারবে।
—যেমন?
—যেমন ধর, সদ্যোমৃত কোনো চণ্ডালের শব থেকে মুণ্ড কেটে এনে অমাবস্যা বা সংক্ৰাত্তি তিথিতে শ্মশানে গর্ত করে তাতে সেই মুণ্ড নিক্ষেপ করতে হবে। পরে গভীর রাতে সেই গর্তের ওপর পদ্মাসনে বসে মাথার ওপরে মরা দাঁড়কাকের বঁদিকের ডানা রেখে এক লক্ষ বার বীজমন্ত্র জপ করলে তুমিও সর্বজ্ঞ হতে পার।
কিশোরী বললে, বীজমন্ত্রটি কি?
তারানাথ বললে, সেটি বলা যাবে না। তন্ত্রে অদীক্ষিত লোকের কাছে সাধনার গুহ্যমন্ত্র বলা নিষেধ। বীজমন্ত্ৰই আসল কিনা—
চারি তেলে জবজবে করে মুড়ি মেখে নিয়ে এল। খেতে খেতে বললুম, আপনি কখনও সত্যিকারের কাপালিক দেখেছেন?
কিশোরী জিজ্ঞেস করলে, তান্ত্রিক আর কাপালিকে পার্থক্য আছে নাকি কিছু?
তারানাথ বললে, পার্থক্য আছে। তবে সে সব তোমাদের বোঝানো কঠিন, জেনেও তোমাদের কোন কাজ নেই। হ্যা, কাপালিক দেখেছি কিছু। কিন্তু একবারের স্মৃতি কখনও ভুলতে পারব না।
তারানাথ যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে চুপ করে গেল।
বললুম, বলুন না সে গল্প, বেশ লাগবে শুনতে।
–বলছি এখন। তোমরা খেয়ে নাও আগে। সে এক ভয়াবহ কাহিনী হে অনেকদিন বাদে মনে পড়ে গেল। এখনও মনে হলে গায়ে কাটা দেয়।
আমি বললুম, এ ঘটনা কি মধুসুন্দরী দেবীর আবির্ভাবের আগের?