- বইয়ের নামঃ কাজল
- লেখকের নামঃ তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০০. ভূমিকা ও বিভূতিভূষণ ও কাজলের পশ্চাৎপট
ভূমিকা
উপন্যাস লেখার অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম। জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে যিনি আমার পিছনে মাভৈঃ বাণী নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন সেই মা আমাকে সর্বক্ষণ উৎসাহ দিয়েছেন, পাণ্ডুলিপি পড়ে প্রয়োজনীয় উপদেশ দিয়েছেন। আমার এবং তঁর পরিশ্রম সমান সমান।
অনেক বিনিদ্র রাত্রির ইতিহাস রয়ে গেল এ বইয়ের পেছনে। লিখতে লিখতে মনে হয়েছে। পাঠকদের কথা, জানি না তারা একে কেমন ভাবে নেবেন। তঁদের জন্যই আমার পরিশ্রম, তারা গ্ৰহণ করলে আমি ধন্য হবো।
তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
আরণ্যক, ব্যারাকপুর
বিভূতিভূষণ ও কাজলের পশ্চাৎপট
১৯৪০ সনের ৩রা ডিসেম্বর আমার বিয়ে হয়। সে সময়ে উনি ৪১ নম্বর মির্জাপুর স্ট্রীটের ‘প্যারাডাইস লজে’ থাকতেন। আমার বিয়ের প্রায় একবছর পরে ঐ মেসের বাস তিনি উঠিয়ে দেন।
ঐ মেসে ছিলেন উনি বহুদিন, কাগজপত্র বইখাতা জিনিসপত্র জন্মেছিল ওখানে অপর্যাপ্ত। মেসের বাস যখন তুলে দেন তখন তার কিছু জিনিস উনি পাঠিয়ে দেন ঘাটশিলায়, কিছু আমাদের দেশের বাড়ি গোপালনগর বারাকপুরে।
ঘাটশিলার যে ঘরে আমি শূতাম তার পায়ের দিকের দেওয়ালে টাঙানো ছিল ভারি সুন্দর একটি শিশুর ছবি, অপূর্ব ছবিটি। খয়েরী রংয়ের সঙ্গে সাদা মেশানো বিলিতি ছবি। নিচে ইংরেজিতে ছবিটির নাম লেখা ছিল—‘বাবলাস’। ছেলেটির কোলের উপর একটি বাটিতে কিছু সারানগোলা জল। একটি কাঠিতে ফু দিয়ে ছেলেটি বুদবুদ তৈরি করছে।
ওঁর কাছে জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলাম, কোনও বিলাতি কোম্পানির বিজ্ঞাপনের ক্যালেন্ডার ওটা। উনি ছবিটি আমাকে দেখিয়ে বলেছিলেন ঐ ছবি দেখেই নাকি উনি কাজলের চরিত্র কল্পনা করেছিলেন। অমন নিম্পাপ, দেবদুর্লভ কৃপবান, কোমল, সুন্দর ছেলেটি-কাজল নাকি ওঁর কল্পনায় ঐ রূপেই ছিল।
উনি নিজে আমাকে বহুদিন বলেছেন, একসময়ে নাকি উনি সস্তান-সস্তান করে ক্ষেপে গিয়েছিলেন। বহু লোকের কাছে শুনেছি, অনেককে উনি নাকি বলতেন—আমাকে বাবা ডাকবি?—ডাক্না।
আরও শুনেছি, এই পিতৃ-সম্বোধন শুনবার জন্য নানাপ্রকার ঘুষও দিতেন। কাউকে কাউকে।
আজ আরও অনেক কথাই মনে পড়ছে। ওঁর ধর্ম মেয়ে, নাম তার রেণু। রেণুর উল্লেখ আছে ওঁর অনেক বইতে, ওঁর দিনপঞ্জিগুলিতে। ওঁর ‘বিচিত্র জগৎ’। বইখানা রেণুকে উৎসর্গ করেছিলেন। রেণুর সঙ্গে ওঁর মেহের সম্পর্ক গভীর ছিল। রেণুকে নিয়েই ওদের পরিবারের সঙ্গে ওঁর গভীর পরিণতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। পরবতী কালে ওদের সকলের সঙ্গেই ওঁর আত্মীয়তার বন্ধন দৃঢ় হয়েছিল।
আমার বিয়ের পরে রেণু এসে আমার সঙ্গে দেখা করে গেছে।
রেণু আমাকে ডাকত মা-মণি বলে, ওঁকে বলত বাবা। রেণুর সঙ্গে ওঁর মাঝে মাঝে দেখা হত কলকাতায়। রেণু তখন কলকাতাতেই ছিল।
বাবলু যখন একবছরের, সে সময় একদিন একটি নিরেট লোহার সুন্দর মোটরগাড়ি এনে বাবলুকে দেন। উনি বলেন, তোর দিদি দিয়েছে-রেণুদিদি।
কাজল সম্বন্ধে উনি কী লিখবেন, তার কিছু কিছু আভাস অপরাজিত বইতে পাওয়া যায়। ওতেই বীজাকারে কাজল সম্বন্ধে সকল কথাই প্রায় বলা আছে। তারপর যে তঁর কল্পনার কাজলকে বাস্তবে রূপ দেবে, প্রতিমার কাঠামোর ওপর খড়-বিচালি বেঁধে মাটি ধরিয়ে রং-তুলির স্পর্শে সেই প্রতিমাকে সঞ্জীবিত করবে, সে দায়িত্ব তার। গল্পকে টেনে নিয়ে যাবার, উপন্যাসকে এগিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব লেখকের, বিভূতিভূষণের অসমাপ্ত রচনা যে সমাপ্ত করবে তার। তিনি জানতেন না ভবিষ্যতে এই কাজ করবে তারই পুত্র।
কাজল উপন্যাস সম্পর্কে কত নিভৃত মধ্যাহ্নে আকাশের নব নব ছায়াবুপ দেখতে দেখতে, সন্ধ্যাবেলায় বিলবিলের ধাবে ঠেস দেয়ালে হেলান দিয়ে বিশ্রাম করতে করতে আলোচনা করেছেন। কাজল এখন কত বড় হয়েছে, কী করছে, কী ভাবছে, এসব আলোচনা করতেন। বাবলু (তারাদাস) হওযার পরে মুহূর্তে মুহূর্তে বাবলুকে দেখা চাই। বাবলু কী করছে, কেমন অঙ্গভঙ্গি করছে।–সর্বদা বাড়ির সকলকে ডেকে দেখাতে ভালোবাসতেন। সর্দার খেলুড়ের সঙ্গে বাবলু যেন ছিল শিশুখেলুড়ে। বুঝতে পাবতাম, কাজল উপন্যাসের পরিকল্পনা মাথায় ঘুরছে। কাজল উপন্যাস সম্বন্ধে বহু নোট নিতেন। কিছু কিছু লিখেও ছিলেন। ওঁর আকস্মিক মৃত্যুর জন্য, এবং এই উনিশ-কুড়ি বছরের ব্যবধানে বিশেষ কিছু বক্ষণ করতে পারি নি।
বাবলু যখন একটু বড় হল এবং স্কুলে যেতে শুরু করল, তখন সে বাবার কথা শুনতে চাইত। তার লেখার বিষয়, তঁরা ভালো-লাগা, তার জীবনচর্চা ও জানতে চাইত। তন্ময় হয়ে শূনত এবং খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইত সব কিছু। দীর্ঘদিন বাবলুর সঙ্গে ওঁর স্মৃতিতর্পণ করতে করতে কাজল উপন্যাস সম্পর্কে খুঁটিনাটি আলোচনা করেছি। বাবলুর তখন থেকেই আগ্রহ ছিল “কাজিল’ লিখবার। অস্তরে অস্তরে গভীর ইচ্ছা ছিল। তার হাযার সেকেন্ডারি পরীক্ষার পরে একেবারে একটানা অবসব, সে অবসর কী করে কাটবে এই ভাবনায় যখন অস্থির হয়ে উঠেছিল, তখন নিজেই একদিন আমায বলল–মা, কাজল’ লিখতে শুরু করি। তুমি কী বল? আমি সেদিন ওকে মুখে উৎসাহ দিয়েছিলাম, বলেছিলাম, লেখ, চেষ্টা কর। চেষ্টার অসাধ্য কী আছে।
সেই শুরু, তারপর তিনবছর পার হয়ে চারবছর চলছে। আজ কাজল সত্যিই শেষ হল।
আমার শ্বশুরমশাই-এবা অসমাপ্ত কাৰ্যভার তুলে নিয়েছিলেন তার পুত্র অসীম শ্রদ্ধার সঙ্গে। আজ তাদের পায়েব তলায়, বঙ্গবাণীর পায়ের তলায় বাবলু কুষ্ঠিত অক্ষম পদক্ষেপে পূজার থালা নিয়ে দাঁড়াল। সামান্য উপচার, অতিসামান্য ওঁর পুজি। কিন্তু পূজায যার যেটুকু ক্ষমতা সে তাই নিয়েই সাঙ্গ করে, এও তাই। তার নির্মল পূজাব আগ্রহটুকুই ভগবান গ্ৰহণ করুন।
১৩৫৭ সালের ২৮শে ভাদ্র ওঁর জীবিতাবস্থায় শেষ জন্মদিনের অনুষ্ঠান হয়েছিল আমার মামাব বাসারাড়ি সুইনহো স্ট্রীটে। এই অনুষ্ঠানে বহু সাহিত্যিক বন্ধুবা এসেছিলেন ওঁর। শ্রদ্ধেয় উপেন-দা, বন্ধুবান্ধব মনোজ বসু, ডাঃ নলিনাক্ষ সান্যাল, বেগম জাহান-আরা খান স্বামী সহ, গজেন ঠাকুরপো, সুমথ ঠাকুরপো ইত্যাদি।
এই জন্মদিনে গজেন ঠাকুরপোরা ওঁকে একখানা খাতা উপহার দেন– তার ওপর একটি কালো কীভাব লাগানো ছিল। সুন্দর করে বাঁধানো, তাতে সোনালী অক্ষবে ইংরাজীতে লেখা ছিল—’কাজল’। এ খাতাখানা আজও আমার কাছে আছে। সেই সময়েই ঠিক হয়ে যায়, ‘কাজল’ উনি লিখতে শুরু করবেন অবিলম্বে এবং তা ধারাবাহিকভাবে বেবুবে কোন পত্রিকায়। আমি জানতাম ‘কাজল’ উনি লিখবেন, যেমন জানতাম ‘ইছামতী’ উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ড উনি লিখবেন, ‘অথৈ জল’ ও দ্বিতীয় খণ্ড লিখবার ইচ্ছে ছিল ওঁর। ওঁরই কাছে আরও শুনেছি ওঁর ‘দেবযান’ লিখবার ইচ্ছা ছিল পথের পাঁচালী লিখবারও আগে। কিন্তু লিখেছেন অনেক পরে। একটা খাতায় উনি দেৱ্যানের খানিকটা লিখে রেখেছিলেন বহুদিন পর্যন্ত। এ লেখার বহু পরে উনি ‘দেবযান’ শেষ করেন–আমার বিয়েরও দু-তিন বছর পরে। তখন দেবযানের নাম ছিল “দেবতার ব্যথা’। ওঁর রচনার প্লট লেখা থাকত ছোট ছোট বইতে। তাতে উনি কী লিখবেন সামান্য কথায় তার স্কেচ করে রাখতেন। পরে ঐ স্কেচ দেখলেই ওঁর মনে পড়ত। উনি কী লিখবেন। ঐ সব বিভিন্ন চরিত্রের বহু ঘটনার সামান্য টুকরো ও নানা লেখার খসড়া আজও আমি রেখে দিয়েছি যত্ন করে আমার কাছে। তাতে কত কী লিখবার, কত কী জানিবার আগ্রহ ছিল ওঁর, তার পরিচয় পাওয়া যায়। আরও পাওয়া যায়, কত কী পড়েছিলেন উনি তার আভাস। উনি যেন ছিলেন চিরদিনের ছাত্র-প্রকৃতির এই মহিমময় অনন্ত ঐশ্বর্যভরা পরিবেশ, এর ভিতরে আত্মহারা ছিলেন তিনি। প্রকৃতিপাগল বিভূতিভূষণ। ঘাটশিলায় ওঁর মৃত্যুর পাঁচ-ছ দিন আগে বেলাশেষে আমি বসেছিলাম আমাদের বারান্দার চওড়া সিঁড়ির ওপর। উনি দাঁড়িয়ে ছিলেন সামনে। বাবলু উঠোনের ঘাসের ওপর ওর বাবাকে নিয়ে খেলছিল। আজও বড় বেশি করে সেই দিনটির কথা, সেই অপরাহ্ন। বেলাটির কথা আমার মনে পড়ে।
উনি সেসময়ে আমাকে বললেন-তুমি আমার দিকে একদম নজর দাও না। আমি কখন কী করি বল তো? এদিকে আমার কাজল’ শুরু করতে হবে। বাবলুকে নিয়ে কী যে করি! তুমি শুধু শুধু বাবলুকে আমার কাছে দাও।
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম! সে কী গো, আমিই বরং ছেলেটাকে কাছে পাই নে, শুধু তুমি ওকে নিয়ে ঘুরছে কোথায় কোথায়। ওরা দুর্বল স্বাস্থ্য-কোথায় আমি ভাবছি, ওরা কী স্বাস্থ্য টিকবে।
চট করে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন উনি।–আর বেড়ানো নয়, কী বল? খুবই বেড়ানো হযেছে। পুজোর ভেতর অত্যন্ত বেড়ালাম, কী বল? বেড়ালাম না?
আমি চুপ করে রইলাম। এমন ভ্ৰমণ-বাতিকগ্রস্ত লোক আমি জীবনে দেখিনি। ছেলেপুলেদের যেমন মিষ্টি ও খেলনার লোভ দেখিয়ে বশীভূত করা যায়, এই বালকস্বভাব। ভদ্রলোকটিকে বেড়ানোর নামে যেখানে সেখানে নিয়ে যাওয়া যেত, যদি জানতে পারতেন সেখানে দেখবার কিছু আছে।
উনি নিজেই আবার বললেন–এইবার লেখা শুরু করি, কী বল? পুজোতে ওরকম সবাই একটু-বুঝলে না? সব বন্ধুবান্ধব এক জায়গায় হওয়া, আমোদ হয় না? কী বল? কাল আমাকে খুব ভোরে তুলে দেবে, বুঝলে?
আমি হাসলাম। তোমার চাইতে ভোরে উঠাব আমি? তোমার চোখে কী ঘুম আছে? আমার তো মনে হয় না।
ওঁরই ডাকে ঘুম ভাঙল সেদিন আমার-ওঠে, ওঠে। গেট খুলে দাও। আমি ‘কাজলে’ব ছক তৈরি করব না। আজ? মনে নেই? ওঠে, দেরি হয়ে যাবে।
আমি ঘুম-জড়ানো চোখে বাইরের দিকে তোকালাম।–রাত রয়েছে যে, আর একটু পরে যাও। যাবে বনে পাহাড়ে, ওখানে তো সদাই নির্জন।
উনি বললেন-না, উপাসনা সেরে নেব না। আমার সেই শিলাসনে? তারপরে লেখা।
আমি জানতাম, উনি ‘ফুলডুংরি’র পেছনে বনের ভেতর একটি বিরাট পাথরেব ওপর বসে লিখতেন। আমাকেও নিয়ে যেতেন ওখানে মাঝে মাঝে, উপাসনা করতেন। সে সব কত কথা, কত স্মৃতি।
তখনও জানি না, কী করাল মেঘ ঝুলছে আমার মাথার ওপর-গর্ভে তার বজ্রাগ্নি লুকিয়ে নিয়ে। সেইদিনই যে আমার জীবনের চরম দিন, তার কিছুমাত্র আভাস পাইনি। আমি।
সকাল সকাল ফেরা ওঁর হল না। উনি ফিরলেন একেবারে বেলা সাড়ে-দশটা এগারোটায়। আমি তখন রান্নায় ব্যস্ত।। ওঁকে দোর খুলে দিলাম। উনি বললেন-প্রচণ্ড ক্ষিদে পেয়েছে আমার।
ওঁর খাবার করাই ছিল। বিছানার উপর বসলে ওঁকে খাবার এনে দিলাম।
উনি সেই খাবারটুকু খেয়ে আমাকে বললেন-আবও কিছু দাও। কী আছে তোমার?
আমি বললাম-নারকেল-চিড়ে খাও। তুমি ভালোবাস।
নারকেল-চিঁড়ে দিয়ে আমি আবার রান্নায় ফিরে গেলাম।
একটু বাদে ওঁর ডাক আবার কানে গেল-শুনে যাও।
আমি রান্নাঘর থেকে ছুটে গেলাম ওঁর কাছে।
এমন করে তো উনি ডাকেন না। আমাকে! আমি যেতেই উনি বললেন-দেখ, আমার বুকে যেন চিড়ে আটকে গেছে।
আমি বললাম, শূকনো চিড়ে খেলে এমনিই হয়। ভিজিয়ে খেতে চাও না। আম কলা না থাকলে। কত ঘুরে এসেছ, গলা শুকিয়ে আছে না?
আমি ওঁর গলায় বুকে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম।
উনি বললেন, একটু কোরামিন দাও আমাকে।
আমার ঘরে কোরামিন থাকত। আমার দেওর নুট্রবিহারী ডাক্তার ছিলেন। আমি ওঁকে ধরে আছি-আমার জা, যমুনাকে ডেকে বললাম-দশ ফোঁটা কোরামিন দে তো।
আমি জীবনে ওঁকে খুব সামান্যই ওষুধ খেতে দেখেছি। কোরামিন চাওয়ায় আমি ঘাবড়ে গেলাম খুব। সেই সূচনা। তখন বুঝিনি। আমি। স্বাস্থ্যবান লোক ছিলেন। একটু পরেই সামলে উঠলেন কিছুটা। আমিও তখন অনভিজ্ঞা। বুঝতে পারিনি কী কঠোর নিয়তি অপেক্ষা করছে আমার জন্য।
উনি স্নান করতে যাবেন বললেন। বাড়িতে স্নান করতেন না কখনও। দেশে থাকলে নদীতে, ঘাটশিলায় নানা পুকুরে। আমাকেও মাঝে মাঝে নিয়ে যেতেন সঙ্গে করে। ইদানীং বাবলুকে নিয়ে যেতেন রোজ-আমি না গেলেও।
সেদিন বললেন-আজ আর বাবলুকে নেব না, শরীরটা ভালো নেই।
অনেক বাধা দিলাম। শরীর ভালো নেই, বাইরে স্নান কবতে যেও না তুমি।
কিছুতেই শুনলেন না।
আমি বললাম-উঠোনের ধারে জল দিই তোমায়। বাথরুমে নাই বা নাইলে। বাথরুমে স্নান করতে একদম ভালবাসতেন না। উনি। আমাদের ঘরের সামনের চওড়া সিঁড়িগুলিতে বসে স্নান করতে বলেছিলাম। আমি।
উনি বললেন–কিছু হবে না। যাব। আর আসব।
তখন কিছু হল না।
দুপুরে ভাত খেতে বসেছেন, তখন ধলভূমগড় বাজবাড়ি থেকে নিমন্ত্রণ কবে গেল টি-পার্টির। উনি খুশী হয়ে বললেন-যাব ঠিক, বঙ্কিমবাবুকে গিয়ে বল। দু-একজন কাকে আরও নিমন্ত্রণ করতে বললেন। তখনও জানি না, কী আছে আমাদের কপালে।
একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি। ঠাকুরপোর ডাকে ঘুম ভাঙল–দাদা কী সাজে যাচ্ছে উঠে দেখ বৌদি।
আমার দুরন্ত অভিমান হল। আমার কী একটুও ইচ্ছে করে না। উনি একটু সাজুন?
আমি চুপ করে রইলাম। উনি হয়তো বুঝলেন আমার অস্তরের অভিমান। তাই বললেনদাও কী দেবে। কী হবে সাজলে-গুজলে? দুখানা হাত বেবুবে আমার?
সেইদিন-আর তারপর তিনদিনের দিন ওকে মহাযাত্রায় সাজিয়ে দিয়েছিলাম।
আপনাদের আশীর্বাদে বাবলু ‘কাজল’ লিখেছে। আজ সকলের সঙ্গে ওঁর আশীর্বাদও বাবলুর মাথায় ঝরে পড়ুক।
বাণভট্টের পুত্ৰ ভূষণভট্ট অসমাপ্ত ‘কাদম্বরী’ শেষ করেছিলেন। বাবলুর হাতে বিভূতিভূষণ পরিকল্পিত ‘কাজল’ প্ৰাণময় হয়ে উঠক এই আমার মঙ্গলময়ের প্রতি প্রার্থনা।
রমা বন্দ্যোপাধ্যায়
(বিভূতিভূষণ ‘কাজল’ উপন্যাস শুরু করার পূর্বেই লোকান্তরিত হন। এই গ্রন্থের সমগ্ৰ আখ্যানভাগই বিভূতিভূষণ-তনয় তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত।)
১. শীত শেষ হইয়া বসন্তের বাতাস
প্ৰথম পরিচ্ছেদ
শীত শেষ হইয়া বসন্তের বাতাস বহিতে শুরু করিয়াছে। পুরাতন পাতা ঝরিয়া গিয়া গাছে গাছে নতুন কচি পাতার সমারোহ। এই দিনগুলাতে কাজলের বেশিক্ষণ বাড়িতে মন বসে না-বিশেষত বৈকালের দিকে। সূর্য বাশবনের মাথা ছাড়াইয়া একটু নামিলেই রোদটা কেমন রাঙা আর আরামদায়ক হইয়া আসে। রানুপসিদের গাইটা অলস মধ্যাহ্নে জঙ্গলে ঘুরিয়া ঘুরিয়া ঘাস লতা খায়। কাজল উত্তরের জানালায় বসিয়া লক্ষ করে। কিছুক্ষণ পরে তাহার আর মন টেকে না-বাহিরে যাইবার জন্য ছটফট করিতে থাকে। বন্য লতাপাতার যে বিশেষ ঘ্রাণটা বাতাসে বহিয়া আসেসেটাই যেন তাহাকে আরও চঞ্চল করিয়া তোলে। গন্ধটার সহিত এই বাহিরে যাইবার ইচ্ছার যে কী সম্পর্ক-তোহা সে বুঝিতে পারে না, কেমন যেন রহস্যময় ভাব হয় মনে।
সন্তৰ্পণে দরজার খিল খুলিতে গেলে অসাবধানে আওয়াজ হয়। রানু আসিয়া বলে-ছেলের বুঝি আবার বেবুনো হচ্ছে?
কাজল একটু অপ্রতিভ হয় বটে, কিন্তু ভয় পায় না। খিলটা হাতে ধরিয়াই দুষ্টামিব হাসি হাসিতে থাকে।
বাহির হইতে দিতে রানুর আপত্তি নাই। শুধু সাবধান করিয়া দেয়—খবরদার, নদীতে নামবি নে, নৌকোয় উঠবি নে কিন্তু-বল, উঠিবি নে?
কাজল প্রতিজ্ঞা করিয়া। তবে বাহিরে যাইবার অনুমতি পায়।
অপু বলিয়া গিয়াছিল—দেখো রানুদি, নদীতে যেন একলা না যায়। চান করবার সময় তুমি সঙ্গে নিয়ে যাবে। ছেলেমানুষ, সাঁতার জানে না-ড়ুবে যেতে পারে। কাজলও রানুপিসির কথার অবাধ্য হয় না-ইছামতীর ঘাটে জেলেদের মাছধরা নৌকাগুলি বাধা থাকে। এপাড়ার ওপাড়ার কিছু ছেলে জমা হইয়া তাহার উপর উঠিয়া খেলা করে। কাজলের পাড়ে বসিয়া দেখা ছাড়া গত্যন্তর নাই। পিসি বারণ করিয়াছে যে।
বাড়ি হইতে বাহির হইয়া কাজল বাবার নতুন কেনা আমবাগানের দিকে হাঁটিতে থাকে। বাগানের প্রান্তে কাহাদের একটা বাঁশঝাড়। সতুকাকা সেদিন বলিতেছিল বাঁশগাছ নাকি খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে। রাতারাতি নাকি বাঁশের কোঁড় একহাত লম্বা হইতে দেখা গিয়াছে। কথাটা শুনিয়া কাজলের মনে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা জাগিয়া উঠিল। তাই এ জায়গাকেই সে উপযুক্ত স্থান হিসাবে নির্বাচিত করিয়াছে। বাগানের শেষ গাছটার নিচে একখানি বাঁশেব কোঁড় হইয়াছে। হাত দিয়া মাপিয়া আমগাছের গুড়িতে সমান উচ্চতায় কাজল ঝামা ঘষিয়া একটা দাগ দিয়া রাখে প্রত্যেক দিন। পরের দিন গিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখে গাছ কতখানি বাড়িল। গাছটার কাছে পৌঁছিয়া কাজল ভালো একটা ঝামা খুঁজিতে লাগিল। কাছাকাছি পাওয়া গেল না। কাজলকে ঢুকিতে হইল বাঁশবনের মধ্যে। বাঁশবনের ভিতরকার আগাছা কেহ কোনদিন পরিষ্কার করে না–মালিকের দায় পড়ে নাই। নির্দিষ্ট সময়ের শেষে কয়েক গাড়ি বাঁশ কাটিয়া চালান দিয়া সিন্দুকে পয়সা তুলিলেই তাহার কাজ শেষ। বাঁশ তো বিনা যত্বেই বাড়ে। তাহার জন্য আবার কে–
কাজল একবার থামিতেই পায়ের নিচের শুকনো বাঁশপাতার মচমচ শব্দও থামিয়া যায়। সঙ্গে সঙ্গে কোথায় লুকানো পাখিটার কুবকুব ডাক স্পষ্ট হইয়া ওঠে। বাঁশপাত হইতে কেমন একটা গন্ধ ওঠে-কাজলের মন-কেমন-করা ভাবটা বাড়িয়া যায়। উপরে-নিচে কোনদিকেই পাখিটাকে দেখা যায় না। রানুপিস ডাকটা চিনাইয়া দিয়া বলিয়াছিল-কুবোপাখি। কাজলের হাসি পাইয়াছিল নামটা শুনিয়া। কেমন নাম দ্যাখো-বলে কিনা। কুবো পাখি–
খোকার মধু-ঝরা হাসি দেখিয়া রানির কী একটা পুরানো কথা মনে পড়ে। এক পলকের জন্য সে অন্যমনস্ক হইয়া যায়। পরমুহূর্তে হাসিয়া বলে-পাগল একটা, এত হাসবার হল কী নাম শুনে?
কাজলের একবার মনে হয় ডাক বাঁদিকের ঝোপ হইতে আসিতেছে। সেদিকেই বনটা বেশি। ঘন। কিছুদিন আগে এই জঙ্গল হইতে কী একটা জন্তু শিকার করিয়া লইয়া গিয়াছে। কাজেই একেবারেই যে গা ছমছম করে না। এমন নহে। কিন্তু পাখিটাকে দেখিবার কৌতূহলও কম নহে। রানুপিসি বলিয়াছে লাল লাল চোখ-সে দেখিবে কেমন লাল চোখ।
কিন্তু বিশেষ সুবিধা করা যায় না। কিছুটা বাঁদিকে হাঁটিলে মনে হয় ডানদিক হইতে আওয়াজ আসিতেছে। ডানদিকে একটু অগ্রসর হইলেই আওয়াজটা পিছনে ঘুরিয়া যায়। আবার খানিকক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরিয়া পরে কাজল হাল ছাড়িয়া দেয়।
ভারি তো পাখি-পরে দেখা যাইবে। আরও একটু সন্ধান করিলে কি দেখা হইত না? নিশ্চয় হইত। নেহাত কাজ আছে বলিয়া তাহাকে অন্যত্র যাইতে হইতেছে।
সন্ধ্যায় সতুকাকার দু-একজন বন্ধুবান্ধব এপাড়া-ওপাড়া হইতে আসিয়া জোটে। মোটা কালোমত একজন লোক-গলায্য কঠি, ঠুকিয়া ঠকিয়া খোলটাকে ঠিক সুরে বাঁধে। পবে সবাই মিলিয়া কীর্তন শুরু করে। একদিন কাজলের খুব মজা লাগিয়াছিল। গানের মাঝামাঝি-যেখানে ‘কোথা যাও প্ৰভু নগর ছাড়িয়া’ পদটা আছে সেখানে সবাই এমন হ্যাঁ করিয়া দীর্ঘ টান দিয়াছিল যে কাজল হাসি চাপিতে পারে নাই। এতগুলি বয়স্ক মানুষকে এক সারিতে হ্যাঁ করিয়া বসিয়া থাকিতে দেখিলে কাহার না হাসি পায়?
কীর্তন তাহার খুব ভালো লাগে নাই। গানের যে স্থানটিতে তাহার আমোদ হয়, সে স্থানটিতেই উহারা পরস্পরের গলা জড়াইয়া ধরিয়া অশ্রুবিসর্জন করিতে থাকে। ব্যাপার দেখিয়া প্রথম দিন। সে অবাক হইয়া গিয়াছিল। রানি তাহকে খাওয়াইয়া বিছানায় শোওযইযা আসার পরেও এক একদিন অনেক রাত্রি পর্যন্ত গান হয়। শুনিতে শুনিতে সে ঘুমাইয়া পড়ে। কখনও কখনও বিনা কারণে মাঝরাত্রে ঘুম ভাঙিয়া যায়-দেখে জানালা দিয়া সুন্দর জ্যোৎস্না আসিয়া বিছানায় পড়িয়াছে। বাহিরের আতাগাছটা-ভূতোবোম্বাই আমগাছটা-উঠানটা অপূর্ব জ্যোৎস্নায ভাসিয়া যাইতেছে। ঘুম-ঘুম চোখে সেদিকে তাকাইয়া থাকিলে বেশ লাগে। মনে হয়, কেহ যেন ওই জঙ্গল হইতে উঠানের জ্যোৎস্নায় আসিয়া দাঁড়াইবে। তাহার গায়ে রূপকথার দেশের পরিচ্ছদ, মৃদু চন্দ্রালোকে সে। একবার কাজলের দিকে তাকাইয়া হাসিবে-পরে ইশাবায় ডাকিয়া আনিবে সঙ্গীদের। একদল পরীর দেশের লোকে উঠান ভরিয়া যাইবে। তাহদের ভাষা বোঝা যায় না-কিন্তু তাহা সংগীতময়। উঠানের ধুলায় চাঁদের আলোয় ছায়া সৃষ্টি করিয়া তাহারা লীলায়িত ভঙ্গিতে নৃত্য করবে। মাঝে মাঝে কাজল নিজে অবাক হইয়া যায় তাহার চিন্তার গতি দেখিয়া।
এই সময় বাবার কথা মনে পড়ে খুব। রানুপিসি পাশে ঘুমাইতেছে। পিসির নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাইতেছে। জানালার বাহিরে উঠানে সেই অপার্থিব চাদের আলোর দেশ। এ সময় বাবা থাকিলে বেশ হইত। মনের যে ভোবই হোক না কেন, বাবাকে বুঝাইয়া বলিবার দরকার পড়েনাবাবা নিজেই কেমন সব বুঝিয়া লয়। বাবা হয়তো বলিতে পারিত কেন সে এমন অদ্ভুত চিন্তা করে। শুধু এ সব কারণেই নহে-অন্য কারণও আছে। হ্যাঁ, সে লুকাইবে না-বাবাকে দেখিতে ইচ্ছা করে, বাবার জন্য তাহার মন কেমন করিতেছে।
পরের দিন দুপুরে ললিতমোহন বাড়জ্যের ছেলে। চনু আসিয়া তাহাকে একা-দোক্কা খেলিতে ডাকে। চড়কতলার মাঠে খেলা জমিয়া ওঠে। অবশ্য কাজল খেলায় খুব পটু নহে। তাহার তাকও প্রশংসার অযোগ্য। তিন নম্বর ঘর টিপ করিয়া ঘুটি খুঁড়িলে সেটা পাঁচ নম্বর ঘরে পড়িবেই। অবশ্য প্রত্যেকবারই কাজল এমন ভান করিয়া থাকে যেন সে ওটা পাঁচ নম্বর ঘরেই ফেলিবার চেষ্টা করিতেছিল। খেলা সমাপ্ত হইলে সন্ধ্যার আরছা আঁধারে বাড়ি ফিরিবার সময় কাজল চনুকে প্রশ্নটা করিয়া ফেলে-তুই জানালার পাশে শুয়ে ঘুমোস?
চনু বাক্যালাপের গতি কোনদিকে বুঝিতে না পারিয়া সংক্ষেপে বলে—
–রাত্তিরে জাগিস নে কখনও? চান্দনি রাত্তিরে?
–কত!
–কিছু দেখিস? মানে, ভাবিস কিছু?
–ভাবিব। আবার কী? দাদা গায়ে পা তুলে দেয় বলেই না ঘুম ভাঙে। পা-টা নামিয়ে দিয়েই আবার ঘুমিয়ে পড়ি। কেন রে?
—মনে হয় না কিছু? এই, কোন অদ্ভুত দেশের কথা, কী গল্পে পড়া কোন লোকের কথা? গল্প বলিতে চনু পড়িয়াছে কথামালার ‘ব্যাঘ্র ও পালিত কুকুর’। তাহা চাঁদনি রাত্রে স্বপ্ন দেখিবার জন্য খুব আদর্শ উপাদান নহে। কাজলটা কি পাগল নাকি? সন্ধ্যাবেলা যত উদ্ভট কথা! না, চন্দ্রালোকিত রাত্রে অগ্রজের তাড়নায় জাগিয়া তাহার বিশেষ কিছু মনে হয় না।
কাজলও যে বিশেষ কিছু দেখিতে পায়, তাহা নহে। কিন্তু একফালি চাঁদের আলো-একটি পাতা খসিয়া পড়া হইতে সে অনেক কিছু কল্পনা করিয়া লইতে পারে। নিজের বৈশিষ্ট্য বুঝিবার বয়স তাহার হয় নাই—তবুও তাহার সঙ্গীদের সহিত একটা চিন্তাগত পার্থক্য সে অনুভব করিতে পারে। যেমন দুৰ্গা পিসির কথা। বাবা ও রানুপিসির কাছে গল্প শুনিয়া সে দুর্গার চেহারা ও স্বভাব কিছুটা কল্পনা করিয়া লইয়াছে, নির্জনে বসিয়া ভাবিতে চেষ্টা করিয়াছে, পিসি সামনে দাঁড়াইয়া কথা বলিতেছে। এই একটা ফল কুড়াইয়া লইল কোন গাছতলা হইতে, এই আধখানা ভাঙিয়া তাহাকে দিল খাইতে। অপু ও রানি দুর্গার শৈশবের গল্পই করিয়াছে—এখন থাকিলে পিসির যে অনেক বয়স হইত, তাহা কাজলের কখনও মনে হয় নাই। শুধু এইটুকু সে বোঝে, পিসি বাঁচিয়া থাকিলে তাঁহাকে খুব ভালোবাসিত।
নিশ্চিন্দিপুরের সহিত কাজলের একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়িয়া উঠিয়াছিল। অথচ কোথায় ছিল সে এক বৎসর আগে! দাদামশায়ের ভয়ে জুজু হইয়া থাকিতে হইত। প্রকৃত ভালোবাসার স্বাদ সে দাদামশায়ের কাছ হইতে পায় নাই কখনও—তাড়নাই জুটিত বেশি। কেবল দিদিমার কথা মনে পড়ে। বাবা যে তাহাকে মামাবাড়ি হইতে নিজের বাড়িতে লইয়া আসিল-দিদিমা পাইল না। তাহা দেখিতে। দিদিমাই যা-একটু বাবার গল্প করিত। আর কাহারও জন্য মন খারাপ করে না তত। এখানে সে ভালোই আছে। বাবা নাই বটে-কিন্তু বাবা তো আসিবে। পিসি তাহাকে ভালোবাসে। সবার উপর তাহকে আকর্ষণ করে গ্রামের একটা নীরব ভাষা। কেহ সঙ্গে থাকিলে অনেক সময় ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে যখন সে নিজেদের পুরাতন ভিটায় যায়-অন্তত তখন তো নয়ই। সম্পত্তির স্বত্ববোধ তাহার মধ্যে এখনও জন্মে নাই। কিন্তু নিজের পিতৃপুরুষের ভিটায় বসিয়া চিন্তা করার মধ্যে যে একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি আছে-তোহা মনকে দোলা দেয়। দুপুরে গিয়া জঙ্গল ঠেলিয়া চুপি চুপি সে উঠানে বসিয়া থাকে। চুপি চুপি বসিবার বিশেষ কারণ আছে। এদিকে বিশেষ লোকজন আসে না-আসিবেই বা কী প্রয়োজনে? একমাত্র আকর্ষণ সজিনাগাছটাও কুড়া হইয়া গিয়াছে, ফল ভালো হয় না তত। কাজেই সেজন্য সতর্ক হইবার প্রয়োজন নাই। আসলে এই জায়গায় উচ্ছ্বলতা প্রকাশ করিতে ইচ্ছা করে না একেবারে। অন্য জায়গা হইলে কাজল বটের ঝুরি ধরিয়া বুলিয়া, এখানে ওখানে লাফাইয়া এক তাণ্ডব বাধাইয়া তুলিত। কিন্তু এ ভিটায় আসিয়া বসিলে কে যেন তাহার ছোট্ট মনটাকে শান্ত করষ্পর্শে স্নিগ্ধ করিয়া দেয়। এখানে তাহার ঠাকুমা রান্না করিয়াছেপিসি পুতুল খেলিয়াছে-বাবা রাজা সাজিয়াছে আরশির সামনে-ঠাকুরদা বসিয়া বালি কাগজে পালা লিখিয়াছে। তাঁহাদের পুণ্যস্মৃতিমণ্ডিত স্থানে কি প্ৰগলভ হওয়া যায়? কেহ তাহাকে বলিয়া দেয় নাই। সে আপনি চুপ হইয়া থাকে। দুপুর গড়াইয়া বিকাল হইয়া যায়। কেমন একটা অদ্ভুত ছায়া নামিয়া আসিতে থাকে। কাজলের মনে হয়, এই বুঝি কেহ পিছন হইতে কথা বলিয়া উঠিবে। যেন সে আমলটা শেষ হইয়া যায় নাই। সে মিথ্যা বলিবে না-ভূতপেত্নীতে তাহার একটু ভয় আছে। কিন্তু এই সময় যদি তাহার ঠাকুমা কী পিসি আসিয়া তাহার সহিত কথা বলে, তবে সে একটুও ভয় পাইবে না। সে তো তাহদের একান্তু আপনার, কাহারও নাতি-কাহারও ভাইপো। কত আদর করিত সবাই বাঁচিয়া থাকিলে। একটু আগের রাঙা বাসন্তী রোদটার মতোই তাহারা কোথায় মিলাইয়া গিয়াছে।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরিবার সময় গাছের মাথায় সপ্তর্ষিমণ্ডল জ্বলজ্বল করিতে থাকে। বাবা তাহাকে চিনাইয়া দিয়াছিল সব। কালপুরুষ ঝুঁকিয়া থাকে। পশ্চিম দিগন্তের কাছাকাছি। বাবা একবার বলিয়াছিল কালপুরুষের ছোরাটা যে তিনটি নক্ষত্ৰ দিয়া তৈয়ারি-তাহার মধ্যে একটা দেখিতে নক্ষত্র বলিয়া মনে হইলেও আসলে নীহারিকা। সে একটা দূরবীন পাইলে দেখিবার চেষ্টা করিত। যাহা হউক, আপাতত আমবাগানটা তাড়াতাড়ি পার হইয়া যাওয়া ভালো। সন্ধ্যা হইয়া আসিতেছে।
বাড়ি ঢুকিলে রানি বলে-এতক্ষণ ছিলি কোথায়, হ্যারে-ও খোকন? এই রাতবিরেতে কি বাইরে বেড়াতে আছে বাবা? কোথায় ছিলি?
কাজল আরক্ত মুখে আমতা আমতা করিয়া বলে-এই, একটু ওই পুরানো ভিটেয়—
রানি আর প্রশ্ন করে না। তাহার হঠাৎ সমস্ত ব্যাপারটা কেমন সুন্দর লাগিতে থাকে। খোকন চিনিয়া লইয়াছে আপনার সঠিক স্থান। রক্তের ভিতরকার অমোঘ আকর্ষণ তাহাকে টানিয়া লইয়া গিয়াছে পবিত্র তীর্থে। ঐতিহ্যের ধারার গতি ধীর-কিন্তু অনিবাৰ্য। এ ভিটাকে ছাড়িয়া তাহারা কেহ। কোথাও থাকিতে পারে নাই। অপু গিয়াছিল চলিয়া-সেও কি বেশিদিন পারিল দূরে থাকিতে? বংশের সন্তানের হাত ধরিয়া আবার তো সেই ফিরিয়া আসিতেই হইল। কী যেন টান রহিয়া যায়, তাহা রানি ব্যাখ্যা করিতে পারে না। হয়তো এতদিনে মণিকণিকার ঘাট হইতে হরিহরের দেহাবশেষ বাতাসে ভাসিয়া অন্ধ সংস্কারে ফিরিয়া আসিয়াছে নিশ্চিন্দিপুরে। সর্বজয়ার অদৃশ্য উপস্থিতি হয়তো এখনও ভিটার অণুতে অণুতে। গোবৎস যেমন জন্মগ্রহণ করিয়াই ঠিক মাতৃস্তন্য খুঁজিয়া লয়তাহাকে চিনাইয়া দিতে হয় না, কাজলকেও তেমনি কোন নির্দেশ দিতে হয় না। সমস্ত বিশ্বজগৎটা একটা নিয়মের শৃঙ্খলে বাধা পড়িয়া গিয়াছে। কাহাকেও কিছু বলিতে হয় না-করাইয়া দিতে হয় না। সব ঠিক ঠিক চলে।
মাস দুই পরের কথা। গরম বেশ পড়িয়াছে। আজ আহার করিতে একটু বেলা হইয়াছিল। রানি এখনও কাজলকে বাহির হইতে দেয় নাই, বিশ্রামের জন্য নিজের কাছে শোয়াইয়া রাখিয়াছে। কাজল কান্ত হইয়া শুইয়া পা দুইটা পিসির গায়ে তুলিয়া দিয়া গল্প শুনিতেছিল। রানির হইয়াছে বিপদ-যতই গল্প চলুক, কাজলও ঘুমায় না।–তাহারও ঘুম হয় না। এমন সময় বাহির হইতে কে ডাকিল-শ্ৰীমান অমিতাভ রায়, চিঠি আছে-অমিতাভ রায়! কাজল প্রথমটা বিশ্বাস করে নাইনিশ্চয়ই ভুল শুনিয়াছে। তাহাকে চিঠি লিখিবে কে?
দৌড়াইয়া চিঠিটা নিতে গেল সে। বেশ মোটা কাগজে রঙীন খামের চিঠি। রানিও উঠিয়া আসিয়াছিল কাজলের পিছু পিছু। সে বলিল–খোল তো খোকন, কার চিঠি-।
রানির বুক টিবি টিব করিতেছিল। হয়তো তাহারই ঠিক-কতদিন আর ভুলিয়া থাকিতে পারে!
কাজল খাম খুলিয়া চিঠিটা বাহির করিয়া প্ৰথমে যেন চোখে ধোঁয়া দেখিল। কিছু বুঝিতে পারিল না প্রথমটা। খুব চেনা, খুব পরিচিত হস্তাক্ষর, এ নিশ্চয়ই-। পরীক্ষণেই রানির হৃৎস্পন্দনকে দ্রুতায়িত করিয়া মুখ তুলিয়া সে বলিল–বাবা দিয়েচে-বাবার চিঠি পিসি। এই দ্যাখো, বাবার হাতের লেখা।
উত্তেজনায় সে হাঁপাইতেছিল।
একটু পরেই রানি দেখিল, সে আর কাজল দুজনেই অঝোরধারে কাঁদিতেছে।
অপু রানিকে লিখিয়াছে—
‘ফিজি থেকে আফ্রিকায় এসেছি। কখন কোথায় ঘুরছি কিছু ঠিক নেই। ফিজিতে একটা মিশনারী স্কুলে মাস্টারি করলাম কিছুদিন। অ্যাশবার্টন সাহেবই সব ঠিক করে দিয়েছিল। জীবনটাকে যেমন করে দেখতে চেয়েছিলাম-ঠিক তেমনি করেই দেখছি রানুদি। কোথাও ধাক্কা খেলাম না। আশ্চর্য একটা অসীমত্বের সন্ধান পেয়ে গেছি। মনে হয় যেন সময় অফুরন্ত–তা ফুরিয়ে যাবে না কোনদিন। জীবনও তাই বাঁধনহারা, অসীম। মহাকাল এত বিশাল-তার আঁচলটুকুই এত বড়ো যে সেই বিশালতাকে অনুভব করা বহু দূরের কথা, ধারণাটাকে কল্পনায় আনতেই মানুষের যুগযুগান্ত কেটে যাবে। এই জীবনকে-ত্রিকালকে বুকের পাঁজরে পাঁজরে ব্যথায়-বেদনায়, আনন্দে-উল্লাসে, স্বপ্নে-জাগরণে প্রতিক্ষণে অনুভব করছি। আমার আর ভয় কী রানুদি? এখন মনে হচ্ছে, ভক্তি ভাবটা শুধু মেয়েদেরই একচেট নয়-আমার মনেও একটা ভক্তির ভাব জেগে উঠেছে। এ ঠিক ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি নয়। বর্তমানের ক্ষুদ্র গণ্ডী পেরিয়ে অতীত ও ভবিষ্যতে রহস্যের প্রদোষালোকে আলোকিত পরিসরে বিস্তৃত যে মহাজীবন-তার প্রতি ভক্তি। এ যেন কিছুটা নিজেরই প্রতি ভক্তি। নিজেকে, বিশেষ করে নিজের জীবনকে জানিবার অদম্য স্পৃহায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। এখন মনে হচ্ছে যেন তা ছাড়িয়ে আরও বেশি কিছু জেনে ফেলেছি। কিন্তু সে কথা প্ৰকাশ করা যায় না। রানুদি-সে বোধ ভাষার অতীত। সে সকল জানার জানা-এক অনির্বাচনীয় পরম পাওয়া।’
কাজলকে লিখিয়াছে—
তোমার জন্যই হয়তো আমাকে ফিরে আসতে হবে। কতদিন ফিজিতে সমুদ্রের তীরে বসে আশ্চর্য সূর্যস্ত দেখতে দেখতে তোমার কথা ভেবেছি। তুমি আমার প্রাণের অংশ দিয়ে তৈরি স্বপ্ন, বাবা। চেষ্টা করছি তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে। তুমি পিসির কথা শুনে চলো তো? বেশি রাতে বেরুবে না। নদীর ধারে বেশি যেয়ে না। আমার যে ফার্স্ট বুকটা আছে–সেটা মনোযোগ দিয়ে পড়বে। এখানে অনেক মজার মজার জিনিস দেখছি।-ফিরে তোমাকে গল্প বলবো। তোমাকে বড়ো দেখতে ইচ্ছে করে। আমার জন্য তোমার মন খারাপ হয় না?’
বাবার জন্য তাহার মন খারাপ হয় কিনা! এমন দিন কবে গিয়াছে যে, সকাল হইতে রাত্রির মধ্যে সে বাবার কথা ভাবে নাই? বরং বাবাই তো তাহাকে ফেলিয়া বেশ থাকিতে পারিতেছে। বাবা ফিরিয়া আসিলে সে বাঁচে।
দুপুরে অপুর রাখিয়া যাওয়া সুটকেস হইতে ডায়েরিখানা বাহির করিয়া সে পড়িতে বসে। ইহা সে মধ্যে মধ্যেই পড়িয়া থাকে। এক বৎসরের ঠাসবুনোট লেখায় ভর্তি ডায়েরি। পাতা উলটাইতে উলটাইতে এক জায়গায় তাহার দৃষ্টি আটকাইয়া গেল। কাশীর কথা লেখা আছে কয়েক পাতা। বাবা তাহাকে রাখিয়া একবার কাশী গিয়াছিল বটে। কাজল পড়িয়া ফেলে পাতা কয়টা। এ কাহার কথা লেখা! লীলা কে? তাহার মেয়ের সহিত বাবা তাহার বিবাহে ইচ্ছা প্ৰকাশ করিয়াছে যে! বিবাহ! এ তো বড়ো মজার কথা হইল। কলিকাতায় থাকিতে গলির ওপারে একটা বাড়িতে সে বিবাহের উৎসব দেখিয়াছিল। বর মোটরগাড়ি করিয়া মালা-চন্দন পরিয়া আসে। পরে গাড়ি হইতে নামিলে একজন মেয়ে কুলোর উপর কী সব সাজাইয়া তাহাকে বরণ করে ও অন্যান্যরা জোরে হাতপাখা নাড়িয়া বাতাস করিয়া থাকে। ওপাড়ার চনুর দিদিরও তো বিবাহের কথা চলিতেছে। চনু বলিতেছিল, দিদি কালো বলিয়া নাকি পত্রিপক্ষ এক হাজার টাকা পণ চাহিয়াছে। বেশ মজা তো! বিবাহ করিলে সেও টাকা পাইবে তাহা হইলে। কিন্তু বাবা তো লিখিতেছে লীলার (এ কে?) মেয়ে ফরসা। ফরসা মেয়েকে বিবাহ করিলে টাকা দিবে তো? টাকা পাইলে সে সব টাকা বাবাকে দিবে। আচ্ছা, কত বৎসর বয়স হইলে বিবাহ হইয়া থাকে?
০২. সেদিন সকাল হইতে মেঘ করিয়াছিল
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
সেদিন সকাল হইতে মেঘ করিয়াছিল–কিন্তু বৃষ্টি হয় নাই। সুন্দর একটা ছায়াঘন আমেজে গ্রামটা ঝিমাইতেছিল। পাখির ডাক শোনা যাইতেছিল কম। কেবল বহু উঁচুতে প্রায় মেঘের গায়ে গায়ে কয়েকটা চিল উড়িতেছিল। কাদের মিঞার ক্ষেতের পাশে কাজল একবার থামিল। কাদের তাহার শালার সহিত নিড়ান দিতেছে ক্ষেতে। কাজলকে দেখিয়া কাদেরের শালা বলিল–বাড়ি চলে যাও কর্তবাবা-বিষ্টি হতে পারে। কাদের আপত্তি করিয়া বলিল—পানি হবে না মোট-দেখছো না চিল উড়ছে ওপরে। ডানায় পানি পালি নামি আসত। নিচপানে। আরহাওয়াতত্ত্ব সম্বন্ধে তাহদের আলাপ করিতে দিয়া কাজল হাটতে লাগিল মেঠোপথ ধরিয়া। ওই পথটা গিয়াছে আষাঢ়-এই পথটা ঘুরিয়া গিয়াছে নদীর দিকে। একটা বড়ো গাছ রহিয়াছে দুইটা পথের সঙ্গমস্থলে। জায়গাটা কাজলের বড়ো ভালো লাগে। গ্রামের যাবতীয় লোক এই পথ দিয়া আষাঢুব হাটে গিয়া থাকে। অচেনা লোকও যায় কত। ভিন-গাঁ হইতে মালপত্ৰ কাঁধে করিয়া আলের পথ মাঠের পথ ধরিয়া এখানে আসে। এখান হইতে কাঁচা পথ ধরিয়া চলিয়া যায় হাটে। পণ্যাদি কাঁধে হাটমুখী জনস্রোত দেখিতে কাজলের বেশ লাগে।
খানিকক্ষণ সেখানে বসিয়া কাজল একবার নদীর পথে কিছুদূর হাঁটিয়া আসিল। ফিরিয়া আসিতে আসিতে দেখিল একজন লোক আষাড়ুর পথ হইতে নামিয়া গ্রামের দিকে চলিয়া গেল। বুকটা তাহার একবার কেমন করিয়া উঠিল। দৌড়াইয়া আগাইযা গেল সে-এইবার লোকটার পিছনে আসিয়া পড়িয়াছে। বহুদিনের অনভ্যাসের ফলে শব্দটা যেন জিভ দিয়া আর বাহির হইতেছে না। মাথার মধ্যে কেমন করিতেছে। পথের পাশে জঙ্গল হইতে বাতাস অজস্র বন্যপুষ্পের গন্ধ বহিয়া আনিতেছে! একটা ধাক্কা দিয়া কাজল শব্দটা বাহির করিল–বাবা!
অপু বিদ্যুৎস্পষ্টের ন্যায় ফিরিযা তাকাইল। এই ডাকটার জন্য সে ছুটিযা আসিতেছে পৃথিবীর আর এক প্রান্ত হইতে। সমুদ্রের ফেনোচ্ছিল। উর্মিমালা, বিষুব-মণ্ডলীব দেশেব তারকাখচিত তমিত্ৰ বাত্ৰিব আকর্ষণ, উষ্ণ বালুকীয় শুইয়া উপরে নারিকেল পাতায় বাতাসেব মর্মরধ্বনি শুনিবার অদ্ভুত অনুভূতিসব সে ত্যাগ করিয়া আসিয়াছে। এই ডাকটা শুনিবার লোভেই তো। সে থাকিতে পাবে নাই।
অপুর হাত হইতে ব্যাগ আর বাক্স পড়িয়া গেল ধূলায়। পথের মধ্যে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া সে দুই হাত সামনে বাড়াইয়া দিয়া চোখ বুজিল। পরীক্ষণেই কাজল ঝাপাইয়া পড়িল অপুর বাহুবন্ধনে।
চিলগুলি ঘুরিয়া ঘুরিয়া নামিয়া আসিতেছিল নিচে। এইবার বৃষ্টি নামিবে।
সন্ধ্যান্য রানির রান্নাঘরের দরজায় পিঁড়ি পাতিয়া বসিয়া অপু গল্প করিতেছিল।
-আর পারলাম না থাকতে রানুদি! সে কী টান, তা যদি একবার বুঝতে! যা দেখি যা করি, সবই যেন কেমন ফাঁকা আর অর্থহীন লাগে। সেই বাড়িতে এনে তবে ছাড়ল।
রানি হাসিয়া বলে–আর আমরা বুঝি কেউ নই?
-কে বলেছে একথা রানুদি? তোমরা সবাই মিলে আমার জীবন সার্থক করে তুলেছি। কোথায় যেত আজ কাজল-তুমি না থাকলে? তোমার দান কি ভোলবোর? মায়ের স্নেহ দিয়ে আমাদের দুজনকেই ঘিরে রেখেছি তুমি।
রানির গলার কাছে হঠাৎ একটা কী কুণ্ডলী পাকাইয়া ওঠে! এত সুখের দিনও ভগবান তাহার কপালে লিখিয়াছিলেন। পরে সামলাইয়া বলে-এই নে, এ দুটো পরোটা আগে খা, তারপর গরম গরম ভেজে দিচ্ছি–
রাত্রে ছেলেকে লইয়া শোয় অপু। অনেক রাত্রি পর্যন্ত কাহারও ঘুম আসে না। বৈকালে একবার খুব ঝড় হইয়া বৃষ্টি নামিয়াছিল। তাই গরম নাই তত। জানালার পাশে শুইয়া আকাশে নক্ষত্রগুলি দেখা যায় স্পষ্ট। মধ্যপ্রদেশ হইতে ফিরিয়া একই নক্ষত্র কলিকাতার আকাশে দেখিয়া তাহার কেমন অবাক লাগিয়াছিল। আবার ফিজি ঘুরিয়া আসিয়া এই নক্ষত্রগুলিকে কেমন চেনা-চেনা অথচ অনেক দূরের বলিয়া মনে হইতেছে। বিদেশে ইহারাই ছিল তাহার সঙ্গী-এই নক্ষত্র, মুক্ত উদার আকাশ, প্রান্তরের বুকের উপর দিয়া বহিয়া যাওয়া ভবঘুরে বাতাস। সেও সুন্দর জীবন-সে যে জীবন চাহিয়াছিল, সেই জীবন। কিন্তু এখন কাজলের পাশে শুইয়া তাহার উদ্দাম জীবনের গতিবেগ কিছুটা প্রশমিত করিতে ইচ্ছা করিল। কোথায় ফেলিয়া যাইবে একে? একবার গিয়া তো মর্মে মর্মে অনুভব করিয়াছে নাড়ির টান। শৈশবে বাবা অনেকদিন বাড়ি না। আসিলে তাহার রাগ হইত-অভিমান হইত। বাড়ি ফিরিয়া অনেক চেষ্টা করিয়া হরিহরকে অপুর রাগ ভাঙাইতে হইত। এখন বড়ো মমতা হয়। হরিহরের প্রতি। বাবা কি আর ইচ্ছা করিয়া আসিত না! সংসার চালাইবার দুৰ্বহ প্ৰয়াসে বাবাকে কোথায় না ঘুরিতে হইয়াছে।–কী না করিতে হইয়াছে। বেচারী বাবা-তাহারও কত ইচ্ছা করিত অপুকে দেখিতে। আসিতে পারিত না শুধু কাজের চাপে। বই-খাতা বগলে তালিমারা ছাতা হাতে স্থান হইতে স্থানান্তরে বেড়াইত কাজেব সন্ধ্যানে। আজ অপু লেখক হইয়াছে।-বই বাজারে কাটিতেছে মন্দ নয়, তাহার চাইতে বেশি মিলিতেছে প্ৰশংসা। কত বৎসর পরে তাহদের বাড়ির লোক আজি সচ্ছলতার মুখ দেখিতেছে। কিন্তু বাবাকে দেখানো গেল না। এই সব দিন-বাবা বাঁচিয়া থাকিলে বৃদ্ধ হইয়া যাইত, তাহাকে অপু শিশুর মতো পরিচর্য কবিত। থোক-কাজলের মধ্য দিয়া সে তাহার শৈশবে হারাইয়া যাওয়া পিতাকে খুঁজিয়া পাইয়াছে। তাহাকে মনের মতো করিয়া মানুষ করিতে হইবে।–ঠিক যেমন করিয়া সে চায়, তেমনি করিয়া। ভাবিয়াছিল, গ্রামে না। রাখিয়া কাজলের প্রতি সে অন্যায় করিতেছে। গ্রামে হয়তো কাজলের শিশুমন পূর্ণভাবে বিকশিত হইয়া উঠিবার সুযোগ পাইবে। তাই ছেলেকে কলিকাতার অসুন্দর পরিবেশ হইতে আনিয়া একেবারে প্রকৃতির মধ্যে ছাড়িয়া দিয়াছিল। এখন ভাবিল, এইভাবে রাখিলে উহার পড়াশুনা কিছুই হইবে না। বরং কোন একটা ছোট শহরে লইয়া যাই। মাঝে মাঝে গ্রামে লইয়া আসিবা-মাঝে মাঝে বেড়াইতে লইয়া যাইব দূরে। তাহাতে উহার চোখ ভালো করিয়া ফুটিবে। সব দিক দিয়াই ছেলেকে চৌকস করিয়া তোলা প্রয়োজন।
পরের দিন। সারাবেলা অত্যন্ত গরম ছিল–কোথাও বাহির হওয়া যায় নাই। বিকালের দিকে বোদ একেবারে কমিয়া গেলে অপু ছেলেকে জিজ্ঞাসা করিল–বল দেখি কোথায় বেড়াতে যাওয়া। যায়? পরে নিজেই খানিকক্ষণ ভাবিয়া বলিল–চল, আগে বেরুই তো, তারপর দেখা যাবে। নে, হাতীমুখ ধুয়ে জামাটা পরে নে।
নিজের শার্টটা আনিবার জন্য ঘরে ঢুকিতে গিযা কী মনে করিয়া জেবে ডাকিল-রানুদি!
রানি ভিতরে ছিল, আসিয়া বলিল–কী? আবে, বেবুচিছস বলে মনে হচ্ছে।
–রানুদি, একটা জিনিস খেতে বড়ো ইচ্ছে করচে, খাওয়াবে?
–ও মা? সে আবার কী কথা। খাওয়াবো না কেন। বল না-
–গরম পড়েছে খুব, একটু আমপোড়া-শরবৎ খাওয়াবে?
—আমপোড়া-শরবৎ। সে আবার কী রে! কখনও শুনি নি।
–আমাদের এদিকে খায় না। বাবা পশ্চিম থেকে শিখে এসেছিলেন। পশ্চিমে খুব খায়। বাবা মাঝে মাঝে মাকে করতে বলতেন। তুমি বানাও রানুদি, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।
-করচি। এই সামান্য ব্যাপার, আমি ভুবি কী না কী খেতে চাইবি।
–এটা কিন্তু সামান্য ব্যাপার নয় রানুদি।। কতদিন খাইনি বলো তো? ছোটবেলায় মাঝে মাঝে মা করে দিতেন। আমাদের অবস্থা কী ছিল সে তো তুমি জানেই। নিজেদের বাগান ছিল না, ঘরে সব সময় চিনিও থাকত না–আমপোড়া-শরবৎ তখন একটা বিরাট বিলাসিত। কালেভদ্রে হলে খুব ভালো লাগতো। আজ বানাও তো রানুদি। খেয়ে দেখি, ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে কি না। খোকাকেও একটু দিয়ো–কাঁচা আম আছে তো?
–সে তোকে ভাবতে হবে না। কাল এক ঝুড়ি আম দিয়ে গিয়েছে তুলসীর মা।
কাজল আসিয়া বলিল–বাবা, তোমার হয়েচে? আমার এই বোতামটা লাগিয়ে দাও, আমি পারাচি নে–
অপু হাসিতে হাসিতে বলিল–দেখেচো কাণ্ড বানুদি? উলটো ঘরে বোতাম লাগিয়ে বসে আছে। হ্যাঁরে, তোর বুদ্ধিসুদ্ধি কবে হবে?
একটু পরে বারান্দায় বসিয়া শরবতে প্রথম চুমুক দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেবেলাটা ফিরিয়া আসিল। অপু চোখ বুজিয়া আমপোড়ার সোদা গন্ধ উপভোগ করিতেছিল। এই গন্ধটা কেমন পুরাতন দিনগুলিকে মনে পড়াইয়া দেয়। সেই দাওয়ায় চাটাই পাতিয়া বসিয়া তালের বড়া খাওয়া, সেই মাটির দোয়াত হাতে প্ৰসন্ন গুরুমশায়ের কাছে পড়িতে যাওয়া। কত কথা মনে পড়ে। রাত্রে প্রদীপের আলোয় বসিয়া পড়িতে পড়িতে কানে আসিত মায়ের খুন্তি নাড়িবার শব্দ। বিদেশ হইতে বাবা আসিলে অপুর অত্যস্ত আনন্দ হইত। রাত্রে বিছানায় শুইয়া অনেক রাত্রি পর্যন্ত শুনিত বারান্দায় বসিয়া বাৰা গান করিতেছে।
আর একজনের কথা মনে পড়ে!
বাংলা দেশ হইতে বহুদূরে তারকাখচিত আকাশেব নিচে সমুদ্রবেলায় শুইয়া থাকিতে থাকিতে হঠাৎ একসময় তাহার। তন্দ্রার ঘোরে। মনে হইয়াছে, সে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। সে বদলায় নাই, বয়স বাড়ে নাই। তাহার চোখের দৃষ্টির পরিবর্তন হয় নাই। তাহার আঁচলে বাধা নাটাফলগুলির সংখ্যা একটিও কমে নাই। সে অপুর সামনে দাঁড়াইয়া হাসিতেছে।
তন্দ্ৰা ছুটিয়া গেলে অপু অবাক হইয়া আকাশের দিকে চাহিত। সমস্ত দুঃখের দিনে উদার আকাশ তাহকে শান্ত করিয়াছে। দেখিত, বাংলার আকাশের সহিত বিদেশের আকাশের কোন প্রভেদ নাই। দেখিত, তাহার দিদির দৃষ্টি যেন ক্ৰমশঃ আনীহারিকাসৌরচরাচরে ব্যাপ্ত হইয়া পড়িতেছে। এইমাত্র এইখানে ছিল—তাহার ঘুম ভাঙিতে দেখিয়া দূরে সরিয়া গিয়াছে।
–বেড়াতে যাবে না। বাবা?
ছেলেকে কাছে টানিয়া লইয়া অপু বলিল–চলো বাবা, যাই।
পথে বাহির হইয়া বলিল–আমরা যদি এখান থেকে চলে গিয়ে অন্য জায়গায় থাকি, তবে তোর মন খারাপ হবে–না রে?
কাজল প্রথমে অবাক হইয়া গেল। চলিয়া যাইবাব কথা উঠিতেছে কেন? অবশ্য বাবা যেখানে আছে, এমন জায়গায় থাকিতে তাহার খারাপ লাগিবে না, কিন্তু পিসিকে ছাড়িয়া থাকা বড়ো কষ্টের।
–কোথায় যাবো বাবা?
কোথায় যাওয়া হইবে তাহা অপুও কিছু ভাবে নাই। গ্রাম ছাড়িয়া বেশিদূর যাওয়া হইবে না, আবার কলিকতাও কাছে হইবে–এমন স্থানের সন্ধান সে মনে মনে করিতেছিল। ছেলের প্রশ্নের জবারে সংক্ষেপে বলিল–আমিও তাই ভাবচি রে।
গ্রাম ছাড়িয়া বেশিদূর যাওয়া ঘটিবে না–সে যাইতে পরিবে না। বার যার তাহাকে ভিক্ষুকের মতো ফিরিয়া আসিতে হইয়াছে নিশ্চিন্দিপুরে। এ গ্রামের প্রকৃতি তাহার কাছে জীবনধারণের জন্য বাতাসের মতো প্রয়োজনীয়। তবুও ছেলের কল্যাণের জন্য যাইতেই হইবে বাইরে। ভালো স্কুলে না। পড়িলে কাজলের চোখ ফুটিবে না। দেওয়ানপুর স্কুলের মিঃ দত্ত-র কাছে সে নিজে ঋণী; বৃহত্তর জীবনে প্রবেশের মুখে তিনি তাহাকে প্রস্তুত করিয়া দিয়াছিলেন। কাজলকে সে নিজে তৈয়ারি করিয়া দিবে।
নদীর ধারে যাইবার পথে আধ্যবয়সী স্থূলবপু এক ভদ্রলোক ডাকিয়া নমস্কার করিলেন–আপনিই তো অপূর্ববাবু?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনাকে তো আগে এ গ্রামে দেখিনি বলেই বোধ হচ্ছে। নতুন এসেছেন বুঝি?
—নতুনই বটে। তাও ধরুন গিয়ে খুব নতুন আর কী! বছর কয়েক তো হয়ে গেল। আমার নাম রাধারমণ চাটুজ্যে। বরাবরের নিবাস ঝাপড়দহর কাছে, গ্রামে, তা সে মশাই এমন ম্যালেরিয়া যে কী বলব। দেখা দেখা করে একেবারে গ্রাম উজাড়–
–ও।
–হ্যাঁ। তারপর আর সে গ্রামে ভরসা করে বাস করা–বুঝলেন না? তাও গিন্নি বলেছিলেন, যেখানে যোচ্ছ সেখানে কি আর জুরজারি নেই? কথাটা অবশ্য মন্দ বলে নি, কী বলেন?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। ঠিক কথাই বলেছেন। উনি।
–মশাই শুনলাম দেশ-বিদেশ অনেক ঘুরেছেন, একদিন গল্প শুনতে যাবো। সেজন্যেই মশায়ের সঙ্গে আলাপ করা।
–দেশ-বিদেশ আর কী, সে এমন কিছু নয়। তবে যাবেন নিশ্চয়ই, তার জন্য আর বলার কী আছে?
এই শুরু হইল। রাধারমণ তো আসিলই, সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম হইতে অন্যান্যরাও একে দুয়ে আসিয়া হাজির হইল। ঘরে প্রায়ই নতুন মুখ দেখা যাইতেছে। অনেকেই যাচিয়া আলাপ করিতেছে। অপু যেখানে গিয়াছিল, তাহার ভৌগোলিক অবস্থান সম্বন্ধে জ্ঞান সকলেরই প্ৰায় একপ্রকার। সবাই জানিতে চায় দেশটা কেমন, পৌঁছাইলেই ধরিয়া তাহারা স্লেচ্ছ করিয়া দেয় শোনা গিয়াছে, এ কথা কতদূর সত্য? একদিন সন্ধ্যাবেলা একজন প্রতিবেশী আসিয়া হাজির হইল, সে কাহার কাছে শুনিয়াছে বিলাতে অমাবস্যার রাত্রে রামধনু দেখা যায়। অপু সদ্য বিদেশ হইতে আসিয়াছে–অতএব সত্যমিথ্যা যাচাই করিবার জন্য সে ছাড়া উপযুক্ততর লোক আর কই?
অপু শুনিয়া হাসিয়া বলিল–বিলেত যাকে বলে ঠিক সেখানে তো আমি যাই নি। আর তাছাড়া রাত্তিরে রামধনু, কী করে দেখা সম্ভব? রামধনু তৈরি হয় কী ভাবে? জলকণার ওপর আলো–
একঘণ্টা সময় লাগিল। অনেক পরিশ্রম করিয়া বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা দেওয়ার পর শ্রোতার মাথা নাড়ার ভাব দেখিয়া গত একঘণ্টার পরিশ্রমের সার্থকতা সম্বন্ধে অপুর কেমন একটা সন্দেহ জন্মিল। বুকুক আর নাই বুকুক, লোকটা ইহার মিনিট দুই পরে বিদায় লইল।
গ্রাম হইতে বিদায় লইতে হইবে বলিয়া অপু ছেলেকে লইয়া দুইবেলা পথে পথে বেড়ায়। রাস্তায় লোকে তাহার সহিত আলাপ করিয়া তাহার আশ্চর্য ভ্রমণবৃত্তান্ত শুনিতে চায়। অপু কাহাকেও নিরাশ করে না। সে জানে ইহাদের মধ্যে অনেকেই সারাজীবনে বাংলাদেশের বাহিরে পা দেওয়ার সুযোগ পাইবে না। ভাবিয়া তাহার দুঃখ হয়। এই সহজ মমত্ববোধের ফলে সে কয়েকশতবার। কথিত গল্প পুনরায় হাসিমুখে করিতে থাকে।
অপু বলি-বলি করিয়াও কথাটা রানিকে বলিতে পারিতেছিল না। চলিয়া যাইবার কথা শুনিলে রানি যে আদৌ সুখী হইবে না। ইহা অপুর জানা ছিল বলিয়াই কথাটা সে সাহস করিয়া রানির নিকট তুলিতে পারিতেছিল না। যাইবার সময় আচমকা না বলিয়া এখন হইতে আভাস দিয়া রাখা ভালো। অথচ সাহসের অভাব। দুই-চার দিন বলি বলি করিয়া অপু রান্নাঘরের সামনে ঘোরাফেরা করিল, তারপর, একসময় দুর্গানাম করিয়া কথা পাড়িয়া ফেলিল।
-একটা কথা ছিল রামুদি।
রানি তোরঙ্গ গোছাইতেছিল। অপুর গলার স্বরে এবং মুখভাগে বিস্মিত হইয়া তাকাইল।
-কী কথা রে?
অপু একটা ঢোঁক গিলিল–এই মানে-কাজলের পড়াশুনোটা এবার ভালোভাবে শুরু করে দেওয়ার দরকার।
–তাতে কী?
–না, বলছিলাম কী, ওকে এখন থেকে একটু-মানে একটু ভালো স্কুলে তো পড়াতে হবে। তাই রানুদি, ভাবছি কিছুদিনের জন্য শহর এলাকায় বাসাভাড়া করে থাকব। আগামী হণ্ডায় হয়তো রওনা দিতে হবে। বুঝতেই পারছি, ছেলেটার পড়াশুনো তো হওয়া দরকার।
রানি কোনো কথা বলিল না, তেরঙ্গের ডালা খোলাই রাখিয়া বিছানায় আসিয়া বসিল, মুখটা রহিল খোলা জানালার দিকে। তাহার অত্যন্ত শান্ত ভঙ্গি দেখিয়া মনে হইতে পারিত অপুর কথা তাহার কানো যায় নাই, সে অন্যমনস্কভাবে বাহিরের কাঁঠালগাছটা দেখিতেছে মাত্র।
অপু জিজ্ঞাসা করিল–রাগ করলে রানুদি?
অপু ভাবিয়ছিল রানুদি কাঁদিয়া ভাসাঁইয়া দিবে, রানি মুখ ফিরাইলে দেখিল তাহার চোখে জল নাই।
হাত দিয়া বিছানার চাদরটা মসৃণ করিতে করিতে রানি বলিল–না রে, রাগ করিনি। রাগ করবো কেন? তুই কি পাগল হলি অপু? এতে তো কাজলেরই ভালো হবে, ওর লেখাপড়া কি কিছু হবে এখানে থাকলে?
একটু থামিয়া বলিল–তাছাড়া পরের জিনিস আর কতদিন নিজের কাছে রাখব? মায়া পড়ে গেলে ছাড়তে যে বড়ো কষ্ট হবে। তার চাইতে তুই এখনই নিয়ে যা–
এত সহজে ব্যাপার মিটিয়া যাইবে অপু আশা করে নাই। যাই হউক, রানুদি যে চলিয়া যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা বুঝিতে পারিয়াছে তাহাই যথেষ্ট। অপু বলিল–মাঝে মাঝে এখানে নিয়ে আসবে রানুদি, প্রত্যেক ছুটিতে আসবো। আমারই বা কে আছে বলো তুমি ছাড়া? বরং তখন তুমি বিরক্ত হয়ে উঠবে দেখো–
একটু পরেই হাতপাখা চাহিবার জন্য ঘরে ঢুকিতে গিয়া অপু চৌকাঠেই দাঁড়াইয়া গেল। বিছানার ওপর উপুড় হইয়া রানি ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতেছে।
অনেক ভাবিয়া অপু মালতীনগরে যাওয়া স্থির করিয়াছিল। মালতীনগর জায়গাটা এখনও পুরা শহর হইয়া উঠিতে পারে নাই, তবে শহবের সুবিধা মোটামুটি প্রায় সমস্ত পাওয়া যায়। অনেক বাড়িঘর, মানুষ-জন ও হাট-বাজারের মধ্যে গ্রাম হইতে শহরের স্পৰ্শই বেশি। নিশ্চিন্দিপুর হইতে অবশ্য খুব কাছে হইল না। কিন্তু কী আর করা যায়। সব সুবিধা দেখিতে গেলে চলে না। কিছুদিন আগে অপু মালতীনগর স্কুলে গিয়া হেডমাস্টার মহাশয়ের সঙ্গে কথা বলিয়া আসিয়াছিল। সেখানকার ব্যবস্থা তাহার পছন্দ হইয়াছে। ভর্তি করাইবার যাবতীয় ব্যবস্থা করিয়া ফিরিতে ফিরিতে হঠাৎ একটা কথা ভাবিয়া তাহার খুব অবাক লাগিল। সে আজ ছেলেকে ভর্তি করাইবার জন্য ঘুরিতেছে, ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভাবিতেছে। আশ্চর্য, এই কিছুদিন আগে তাহার কথাই তাহার মা-বাবা চিন্তা করিয়াছে। সত্যই সে অনেক বড়ো হইয়া গিয়াছে। অথচ সন্তানের পিতার যতটা গভীর ও রাশভারী হওয়া উচিত, তাহা সে বিস্তর চেষ্টা করিয়াও হইতে পারিতেছে না। রাশভারী মুখ করিষ্কার চেষ্টা করিল, হইল না। খানিক পরে নিজেরই হাসি পাইল। আসলে সে বৃদ্ধ হয় নাই, তাহার পক্ষে বৃদ্ধ হওয়া সম্ভব নহে।
বিদায় লইবার পালা বেশ কয়েকদিন ধরিয়া চলিল। রানি ভালোমন্দ রান্না করিতে লাগিল, পাড়ার মানুষ এবং গল্প-পিপাসুরা দল বাঁধিয়া আসিয়া বিদায় লইয়া গেল। কড়ার রহিল, অপুকে প্রায়ই আসিতে হইবে। কাজল সকাল-বিকাল একবার করিয়া বন্ধুদের নিকট হইতে বিদায় লইতে লাগিল।
সময়কে যাইতে দিব না বলিলে সময় অধিকতর তাড়াতাড়ি চলিয়া যায়। ক্রমশ যাইবার দিন আসিয়া গেল। অপু মালতীনগরে একখানি বাসা ভাড়া করিয়াছে। সামান্য কিছু প্রয়োজনীয় আসবাব কিনিয়া সেখানে রাখা আছে। একসঙ্গে সমস্ত কেনা গেল না। দৈনন্দিন কাজে প্রয়োজন দেখা দিলে ক্রমশ কেনা হইবে। বহুকাল বাদে অপু সংসার পাতিতেছে-একা। কী কী জিনিস লাগিবে তাহা রানির সহিত পরমার্শ করিয়া কেনা হইয়াছে। অপুর একার উপর ভার থাকিলে হয়তো নূতন বাড়ি গিয়া প্রথম দিন উপবাস করিতে হইত।
যাইবার গোলমাল, বাক্স গোছানো, নানাবিধ উপদেশ এবং উত্তেজনায় কাজল কিছুটা দিশাহারা হইয়া পড়িয়ছিল, নতুবা রওনা হইবার সময় সে নিশ্চয়ই একবার কাঁদিয়া ফেলিত। পরে তাহার মনে হইয়াছিল–পিসি অত কাঁদলে আর আমি দিব্যি চলে এলাম। পিসি হয়তো ভাবলে ছেড়ে আসতে আমার মন খারাপ হয়নি।
মন খারাপ তাহার অবশ্যই হইয়াছে, কিন্তু সেই গোলমালে তাহার কান্না আসে নাই।
অপুর মনটা কেমন ঝিমাইয়া পড়িয়াছিল। রানির কাছে কাজলকে রাখিয়া তাহার যে সহজ নিশ্চিন্ততা ছিল, তাহা সে ফিরিয়া পাইতেছিল না। অনেক প্রতিজ্ঞা, অনেক পত্র লিখিবার প্রতিশ্রুতি, অনেক চোখের জলের মধ্য দিয়া তাহারা মাঝেরপাড়া স্টেশনে পৌঁছিয়া গেল।
ট্রেনে উঠিয়া কাজল বলিল–একটা কথা বলব বাবা?
-কী?
–আমবা মালতীনগরে যাচ্ছি, না?
–হ্যাঁ।
-সেখানে থাকতে কেমন লাগবে বাবা?
কঠিন প্রশ্ন। অপু জানালা দিয়া বাহিরে তাকাইয়া রৌদ্রদগ্ধ প্ৰান্তর দেখিতে দেখিতে উত্তর খুঁজিতে লাগিল।
০৩. মালতীনগর জায়গাটা
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
মালতীনগর জায়গাটা কাজলের খুব খারাপ লাগিল না। ঘনবসতি সে ভালোবাসে না, মালতীনগরে তাহা নাই। বাবা যে বাসা ভাড়া লইয়াছে সেটা শহরের অপেক্ষাকৃত ফাঁকা জায়গায়। জানালায় দাঁড়াইলে অনেক দূর দেখা যায়, দৃষ্টির কোন প্রতিবন্ধক নাই। একটা জানালা আর মুক্ত আদর্শ কাজলের অত্যন্ত প্রয়োজন। দুপুরের আকাশে চিল ওড়া দেখিয়া সে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাইয়া দিতে পারে। তাই জানালা একটা অবশ্যই দরকার প্রান্তরের দিকে। সে যে শুধু চিল দেখিবার জন্যই দাঁড়াইয়া থাকে। এমন নহে। আসলে চিলগুলা উঠিতে উঠিতে যখন বিন্দুবৎ হইয়া আসে তখন কাজলের মনটা হঠাৎ বিপুল একটা প্রসারলাভ করে। মনে মনে রোজ ভাবে-বাব্বাঃ, কোথায় উঠে গিয়েছে। চিলগুলো, এই এতোটুকু দেখাচ্চে একেবারে! আচ্ছ, ওখান থেকে না জানি পৃথিবীটা কেমন দেখায়। সুদূরের কল্পনা তাহার শিশুমনে স্বপ্নের রঙ বুলাইয়া দেয়। আরও কী একটা মনের মধ্যে হয়, সেটা সে ঠিক বুঝাইয়া উঠিতে পারে না, সেটা বুঝাইবার উপযুক্ত ভাষা তার আয়ত্তে নাই। দুরের কথা ভাবিলে দুপুরের জানালায় বসিয়া মেঘস্পশী পাখি দেখিলে তাহার বুকের গভীরে কী একটা কথা গুমরাইয়া উঠে, সে তাহা ভাষায় অনুবাদ করিতে পারে না।
একদিন অপু বাহির হইতে আসিয়া কাজলকে জানালায় দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছিল-কী রে, কী দেখছিস হ্যাঁ করে?
কী দেখিতেছিল তাহা সে বাবাকে মোটেই বুঝাইয়া উঠিতে পারে নাই, প্রকাশের চেষ্টায় তাহার মুখ লাল হইয়া গিয়াছিল। চিলগুলি নহে, অগ্নিবৰ্ষী আকাশটা নহে, মাঠ-প্ৰস্তর নহে, মেঘ নহে, অথচ এই সবগুলি মিলিয়া যে গভীর ঐকতান সাধারণ মানুষের ইন্দ্ৰিয়গ্রাহ্যতার বাহিরে সর্বদাই বাজিতেছে, তাহা সে কেমন করিয়া শুনিয়া ফেলিয়াছে। অপু একেবারে অবাক হইয়া গিয়াছিল। তাহার নিজের শৈশবের চিন্তা হুবহু কাজলের মনে প্রতিফলিত হইয়াছে–হুবহু। ছোটবেলায় সেও রোয়াকে বসিয়া গ্ৰীষ্মের দুপুরে অবাক হইয়া আকাশ দেখিত। প্রকৃতির আশ্চর্য নিয়মগুলির কাছে শ্রদ্ধায় তাহার মাথা নত হইয়া আসে। মানুষের মতামত, ইতিহাসের গতি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া প্রকৃতি কঠোর হাতে পৃথিবী শাসন করিতেছে। প্রকৃতি স্পষ্ট, জড়তাশূন্য অথচ রহস্যময়। প্রকৃতির রহস্যময়তার প্রতি আকর্ষণ কাজলের রক্তেও সঞ্চারিত। আর মুক্তি নাই। সে মুক্তি পায় নাই, কাজলও পাইবে না।
রান্নাবান্না কোন রকমে হইতেছিল। সৌভাগ্যের কথা এই যে, কাজলের মুখে অপুর রান্না মোটামুটি খারাপ লাগে না।
কিন্তু এইভাবে বেশিদিন চলিবে না, তাহা অপু বুঝিতে পারিয়া একটি বুড়িকে রান্নার জন্য ধরিয়া আনিল। খুব বুড়ি নয়, দুইজনের রান্নার কাজ চালাইয়া লইতে পারে। বুড়িরও কোথাও আশ্রয় মিলিতেছিল না, বলিবামাত্র পোটল হাতে করিয়া আসিয়া পড়িল। তাহার ব্যস্ততা দেখিয়া অপু মনে মনে ভাবিল–আহা, বুড়ি মানুষ, কোথাও কেউই নেই। একে তাড়াব না, রেখে দেব যতদিন থাকে। মুখে বলিল–তোমাকে কী বলে ডাকব বলো দেখি? তোমার ছেলের নাম তো গোপাল? তাহলে গোপালের মা বলে ডাকব, কেমন?
–আর বাবা ছেলে। সে কী আমায় দেখে, না খেতে দেয়? তবুও কী জ্বালা, তার নাম ধবেই লোকে আমায় ডাকবে। যেখানে যাই, শুধু গোপালের মা আর গোপালের মা–
–তবে অন্য একটা কিছু বলো, সেভাবেই ডাকবাখন।
তাহাতেও বুড়ির আপত্তি। দেখা গেল যে ছেলে খাইতে বা পরিতে দেয় না, মুখে আপত্তি করা সত্ত্বেও বুড়ি তাহারই নামে পরিচিত হইতে চায়। অপুর কেমন মায়া পড়িয়া যাওয়ায় গোপালের মা থাকিয়া গেল।
মালতীনগরে আসিবার পরদিন অপু কাজলকে লইয়া বেড়াইতে বাহির হইল। পথটা বাজারেব মধ্য দিয়া গিয়া রেললাইন পার হইয়াছে, সে পথ ধরিয়া দুজনে কিছুক্ষণ হাঁটিল। বাজার ছাড়াইবাব পর বাঁদিকে একটি দোকান হইতে অপু একটা সিগারেট কিনিল। লুঙ্গি পর একজন মানুষ হাত-পা নাড়িয়া বলিতেছে–বেরিয়েছে কি এখন! সেই দুপুরের আগে একবার জাবনা খেয়ে বেরিযেছে। তা কোথাও খুঁজে পাচ্চি নে, কী করি বলো দেখি হরিধান? দুধেলো গাই–কোথাও বেঁধে রেখে দুধ টুধ দুয়ে নিচ্ছে না তো?
হরিধান, দোকানের মালিক, অপুকে পয়সা ফেরত দিতে দিতে বলিল–খুঁজে দেখা পাবে’খন, এখনও তো সন্ধে লাগে নি। তুমি বড়ো বেশি ভাবে কামাল।
কামাল একটা বিড়ি ধরাইয়া বসিল।
বাজার ছাড়াইয়া কাজল বলিল–বাবা, শোনো।
–কী রে!
–আমায় আর একবার কলকাতায় নিয়ে যাবে?
-কেন রে? শহর বুঝি খুব ভালো লাগে? বায়োস্কোপ দেখবি?
–না।
–তবে?
একটু চুপ করিয়া কাজল বলিল–যাদুঘর আবার দেখব।
অপু অবাক হইল, আনন্দিতও হইল।
–নিশ্চয় নিয়ে যাবো। আমারও দু-চার দিনের মধ্যে একবার কলকাতায় যেতে হবে। তোকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবো’খন।
পথটা এখন নির্জন, ফাঁকা। শহরের এদিকে লোকবসতি কম। কাজল চারিদিকে তাকাইতে তাকাইতে চলিয়াছিল। সারাদিন রৌদ্রে পুড়িবার পর সন্ধ্যায় মাটি হইতে কেমন চমৎকার একটা গন্ধ বাহির হয়। গন্ধটার সহিত গরমকালের একটা যোগাযোগ আছে। শীতকালেও তো রৌদ্র ওঠেকিন্তু তখন এমন গন্ধ বাহির হয় না। এক জায়গায় পথের ধারে অনেকগুলি রাধাকুড়া গাছ-হলদে। ফুল ফুটিয়া আছে। অপু ছেলেকে চিনাইয়া দিল-ওই দেখ, ওই হচ্ছে রাধান্ডুড়া ফুল। কালকেই নাম করেছিলাম, মনে আছে?
বেশ শান্ত সুন্দর সন্ধ্যা। এইবার একটি একটি করিয়া নক্ষত্ৰ উঠিবে। অপুর হঠাৎ মনে হইলবেশ হতো, যদি বাড়ি গিয়ে দেখতাম অপর্ণ জলখাবার তৈরি করে বসে আছে। কাজলের হাতমুখ ধুইয়ে খাবার খাইয়ে পড়তে বসাতো। আমায় লুচি আর বেগুনভাজা এনে দিয়ে চা চড়াতে যেতো। মন্দ হয় না। যদি সত্যিই–
অনেক দূর আসা হইয়াছে। সামনেই রেললাইন।
ফিরিবার জন্য অপু ছেলের হাত ধরিয়া টানিবে, এমন সময় কাজল মুখে একটা শব্দ করিয়া দাঁড়াইয়া গেল।
অপু সবিস্ময়ে তাকাইয়া দেখিল কাজল রেললাইনেব ধাবে ঢালু জমিটার দিকে চাহিয়া ভয়ে কাঠ হইয়া দাঁড়াইয়া আছে।
রেললাইনের পাশে একটা গরু পড়িয়া রহিয়াছে—মৃত। ট্রেনের ধাক্কায় নিশ্চয় মাবা গিয়াছে। শিং দুইটা ভাঙিয়া কোথায় গিয়াছে কে জানে, মেরুদণ্ড ভাঙিয়া শরীরটাকে প্রায় একটা মাংসপিণ্ডে পরিণত করিয়াছে। পিঠের কাছে চামড়া ফুটা হইয়া একটুকরা রক্তাক্ত মেরুদণ্ডের হাড় বাহির হইয়া আছে। ঘাড় ভাঙা, মুখের কোণে রক্তমাখা ফেনা।
–বাবা!
কাজল যেন কেমন হইয়া কাঁপিতে কাঁপিতে উবু হইয়া বসিয়া পড়িল, তাহার মুখের ভাব দেখিয়া অপু ভয় পাইয়া গেল।
-কী রে? ভয় কী? ওঠে। বাবা, মানিক আমার। কোন ভয় নেই।
কাজল রক্তশূন্য মুখে বলিল–সেই লোকটার গরু। একেবারে মরে গেছে বাবা? আমার খারাপ লাগছে।
বাড়ি আসিবার পথে কাজল কাঁদিয়া অস্থির। জোরে কাঁদে নাই, ফুঁপাইয়া কাঁদিতেছে। অপু অনুভব করিতেছিল, তাহার হাতের ভিতর কাজলের হাত বরফের মতো ঠাণ্ডা। অপুর নিজেরও খারাপ লাগিতেছিল। বীভৎস দৃশ্যটা। কেন যে ওই পথে গেল তাহারা।
–তুই অত ভয় পেলি কেন? হ্যাঁ রে?
কাজল জবাব দিতে পারিল না। তাহার মনের মধ্যে ঘুরিতেছিল ঈষৎ ফাঁক হওয়া রক্তফেনামাখা মুখ, ভাঙা মেরুদণ্ডের বাহির হইয়া থাকা হাড়টা আর মৃত গরুর পড়িয়া থাকিবার অস্বাভাবিক ভঙ্গি।
অসুন্দর জিনিসের সহিত তাহার পরিচয় কম, সুন্দর সন্ধ্যায় বেড়াইতে বাহির হইয়া এই প্রথম সরাসরি অসুন্দরের সহিত পরিচয় হইয়া গেল।
এ দিনটা কাজল ভুলিতে পারে নাই।
মালতীনগরে যে স্কুলে কাজল ভর্তি হইয়াছে, সেটা অপুর বাসা হইতে খুব একটা দূর নহে। তবু অপু কাজলকে স্কুলে পৌঁছাইয়া দিয়া আসে। আবার ছুটি হইলে লইয়া আসে। বাদবাকি সময় তাহার একবি, নিজস্ব। এই সময় সে একটি নূতন উপন্যাস লিখিয়া থাকে। প্রথম উপন্যাসের সাফল্য তাহাকে সাহসী করিয়াছে। এক উপন্যাসেই তাহার বলিবার কথা শেষ হইয়া যায় নাই। অনেক বাকি বহিয়াছে। এই উপন্যাসে তাহা লিখিবে।
আশেপাশের দুই একজন প্রতিবেশী অপুর কাছে যাতায়াত করিয়া থাকেন। ইঁহারা জানিয়া গিয়াছেন, অপু লেখক। অপুর উপন্যাস এরা পড়েন নাই, কিন্তু লেখকের উপর এঁদের অবিচল ভক্তি। ফলে শহরে সাহিত্যিকের আগমন সংবাদ রটিতে বিশেষ বিলম্ব হইল না। তাহার বাসায় কয়েকটি ছোকরা যাতায়াত শুরু করিল! ইহাদের রচনা অপুকে মনোযোগ দিয়া শুনিতে হইত– দরকার হইলে কলম চালাইয়া ঠিক করিয়া দিতে হইত। অপুর উপন্যাস ইহারা পড়িয়াছে। অপু অবাক হইয়া লক্ষ করিল, তাহার নাম বেশ ছাড়াইয়াছে। এত দ্রুত খ্যাতি আসিবে ইহা তাহার কল্পনার বাহিরে ছিল। একদিক দিয়া ভালেই হইয়াছে। একা থাকিতে হয়, এ ধরনের কিছু তরুণের সহিত আলাপ থাকা ভালো।
কাজলকে প্রতিবেশীব বাড়িতে রাখিয়া মাঝে মাঝে সে একদিনের জন্য কলিকাতায় যায়। বই হইতে আৰ্য হইতেছে মন্দ নহে! পাবলিশারের কাছে গিয়া অপু টাকা লইয়া যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি মালতীনগরে ফেরে। কাজলকে ছাড়িয়া সে বেশিক্ষণ থাকিতে পারে না। আজকাল তাহার এই ভাবিয়া অবাক লাগে যে, কাজলকে ফেলিয়া কীভাবে এতদিন সে বাহিরে পড়িয়া ছিল। হৌক ফিজি সুন্দর স্থান, কাজল সুন্দরতর।
কলিকাতায় একদিন তাহাকে প্রকাশকের দ্বারে দ্বারে পাণ্ডুলিপি লইয়া ফিরিতে হইয়াছে। নূতন লেখকের উপন্যাস কেউ ছাপিতে রাজি হয় নাই। এখন পরিস্থিতি কিছুটা অন্যরকম। প্রকাশক খাতির করিতেছে যত্ন করিতেছে। পূর্বের সে হেনস্থার দিন আর নাই।
একদিন প্রকাশকের দোকানে ঢুকিতেই প্রকাশক হাসিয়া বলিলেন, আসুন অপূর্ববাবু, বহুদিন বঁচবেন। এইমাত্র আপনার কথাই হচ্ছিল; ইনি হচ্ছেন ‘শরবী’ কাগজের সম্পাদক। আপনার একটা উপন্যাস চান, তাই ঠিকানা চাইছিলেন। তা আপনার নাম করতে কবতে আপনি এসে হাজির।
পরে পার্শ্বস্থ স্থূলকায় ব্যক্তিটির দিকে ফিরিয়া বলিলেন—নিন, আর ঠিকানা দিতে হল না, একেবারে লেখক মশাইকে ধবে দিলাম।
কথার্বতা ঠিক হইয়া গেল। আগামী সংখ্যা হইতে অপু লিখিবে। একটা বিজ্ঞাপন দেওয়া হইতেছে। সম্পাদক ভদ্রলোক অপুর লেখার অত্যন্ত প্রশংসা করিলেন।
অগ্রিম টাকা পকেটে লইয়া অপু পুরাতন দিনের মতো খেয়ালে কিছুক্ষণ রাস্তায় বাস্তায় বেড়াইল। এখন সে হোটেলে ঢুকিয়া যাহা ইচ্ছা এবং যত ইচ্ছা খাইতে পারে, ইচ্ছা করিলে নোটগুলি একটা একটা করিয়া হাওয়ায় উড়াইয়া দিতে পারে। আজ হইতে অনেকদিন আগে, অবশ্য খুব বেশিদিন আর কী, তাহাকে অভুক্ত অবস্থায় রাস্তায় বেড়াইতে হইয়াছে শুকনো মুখে। কেহ ভালোবাসিয়া বলে নাই, আহা, তোমার বুঝি খাওয়া হয় নি? এসো, যা হয় দুটো ডাল-ভাত–না, সেরূপ কেহ বলে নাই; ববং তেওয়ারী-বধূ বেশ ভালো ছিল, তাহার স্নেহে খাদ ছিল না। জীবনের পথে তেওয়ারী-বধূর মতো কয়েকজনের নিকট হইতে স্নেহস্পর্শ পাইয়াই তো কষ্টের মধ্যেও মানুষ সম্বন্ধে সে হতাশ হইয়া পড়ে নাই। আজ টাকা কয়টা পকেটে করিয়া সে পরিচিত স্থানগুলিতেঁ একবার করিয়া গেল। মনে মনে ভাবিল, মানুষ যেখানে কষ্ট পায়, ভগবান সেইখানেই আবার তাকে সুখ দেন। আমার সেই পুরোনো মেসের সামনেই পকেটে আজ একগাদা টাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কথাটা ভাবিয়া তাহার কেমন অদ্ভুত লাগিল। মনে হইল, রাস্তার ওপারের ওই দোকানে বসিয়া থাকা ধূমপানরত মানুষটিকে ডাকিয়া বলে—শুনুন, আমি ওই গলিতে থাকতাম অনেকদিন আগে। খেতে পেতাম না, কলেজের মাইনে দিতে পারতাম না। মা বাড়িতে কষ্ট পেতেন, টাকা পাঠাতে পারতাম না। আর এখন আমার পকেটে এই দেখুন, অনেক টাকা-অনেক। এ দিয়ে আমি কী করি বলুন তো?
কিছুদিনের মধ্যেই অপু আরও একটি পত্রিকায় ধারাবাহিক উপন্যাস লিখিতে শুরু করিল। বাজারে তাহার বেশ নাম। বিশেষ করিয়া তরুণদের কাছে তাহার নূতন দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত আদর পাইতেছে। মালতীনগরের সেই তরুণ বাহিনী রোজ তাহার দুর্গ আক্ৰমণ করে, সে মাঝে মাঝে বিরক্ত হইলেও মুখে কিছু বলিতে পারে না। ছেলেগুলোকে সে পছন্দ করে, কিন্তু বড়ো বেশি বক বক করে তাহারা। অপুর মাথা ধরিয়া যায়।
অপু প্ৰতি মাসে একগাদা পত্রিকা ও বই কিনিয়া থাকে। ছেলের জন্য ভালো শিশুসাহিত্য আনে। এমন বই আনে, যাহা কাজলের মনেব গভীরে ঘুমন্ত ইন্দ্ৰিয়গুলিকে জাগাইয়া তোলে। কূপমণ্ডুক হইয়া বাঁচিয়া থাকিবার কোন অর্থ হয় না, ছেলেকে সে মধ্যবিত্ত মনের অধিকারী করিয়া গড়িবে না। অপু নিজে ওয়াইড ওয়ার্লড ম্যাগাজিন পড়িতে ভালোবাসে। সে পড়ে ও ভালো গল্প পাইলে তৎক্ষণাৎ ছেলেকে ডাকিয়া শোনায়। এইভাবে অপু ছেলের মনে একটা পিপাসা জাগায়।
কাজলের বিশেষ বন্ধু কেহ নাই। স্কুলে নাই, পাড়াতেও নাই। সে সমবয়সীদের মতো দৌড়ঝাপ করিতে পারে না-যেসব খেলায় শারীরিক কসরতের প্রযোজন, সেগুলি কাজল সভয়ে এড়াইয়া চলে। চেষ্টা করিয়া দেখিয়াছে, সে পারে না। এই তো সেদিন বেণু আর শ্ৰীশ আম পাড়িবার জন্য মুখুজ্যেদের বাগানে পাচিল ডিঙাইয়া ঢুকিতেছিল। আম খাইতে কাজলের আপত্তি নাই, কিন্তু মধ্যে প্রাচীররূপী বড়ো একটা বাধা রহিয়াছে। অতি উঁচু পাঁচিল তাহার পার হইবার সাধ্য নাই! বেণু আর শ্ৰীশ অদ্ভুত কৌশলে তর তর করিয়া পাঁচিলের মাথায় উঠিয়া গেল। শ্ৰীশ মিটমিটি হাসিয়া বলিল–কী রে, পাববি নে?
তাহাদের উঠিবার কায়দা দেখিয়া কাজলের মনে হইতেছিল, ভূমিষ্ঠ হইয়া অবধি তাহারা এই কার্যের অনুশীলন করিয়াছে। মনে মনে নিজের অক্ষমতা বুঝিয়া কাজল ম্রিযমাণ হইয়া বলিল–না ভাই, আমার ডান পায়ে ব্যথা। একটা ফেলে দে না ভাই, খাই।
শ্ৰীশ এবং বেণুরা। দয়া করিয়া একটা দুইটা আমি তাহাকে খাইতে দেয়। উপায় কী! নিজ উঠিয়া পাড়িবার সাধা তাহার নাই।
বাহিরের দুনিয়ায় লাফালাফি করিয়া বেড়াইবার সমর্থ্য নাই বলিয়া সে ঘরের মধ্যে অধিকাংশ সময় কাটায়। মাঝে মাঝে কাজল বাবার ওয়াইড ওয়ার্লড ম্যাগাজিনগুলি নাড়িয়া-চাড়িয়া দেখে। গল্পগুলির আকর্ষণ তীব্র। ছবি দেখিয়া তাহার গায়ের লোম কাঁটা দিয়া ওঠে- যে ছবিটায় খুব রহস্যজনক ঘটনার আভাস পাওয়া যায়, বাবাকে বলিয়া গল্পটা কাজল শুনিয়া লয়।
অপু বুঝিতে পারে, কাজলের মানসিক বৃদ্ধি শুরু হইয়াছে। ঠিক এই একই জিনিস সেও করিত দেওয়ানপুরের স্কুলে। কঠিন ইংরাজি বুঝিতে না পারিলে ছবি দেখিয়া কিছুটা আভাস পাইবার চেষ্টা করিত, অনেক সময় রমাপতিদাকে ধরিয়া গল্পটা বুঝিয়া লইত। সেই একই জিনিস আবার ঘটিতেছে। রক্তের ভিতর অদৃশ্য বীজ রহিয়াছে–তাহাই এ সব সম্ভব করিতেছে।
ধারাবাহিক উপন্যাস দুইখানি শুরু করিবার কিছুদিন পরে অপু বিকালে বসিয়া ছেলের সঙ্গে জলখাবার খাইতেছিল। গোপালের মা পরোটা ভাজিয়া দিয়া রাস্তার ও পারের দোকানে দোক্তা আনিতে গিয়াছে। এমন সময় বসিবার ঘরের দরজার মুখে আসিয়া দাঁড়াইল একটি মেয়ে! কিশোরী বলাই অধিক সঙ্গত, মেয়েটির বয়স কোনমতেই পনেরো-ষোলর বেশি নহে। অপু অবশিষ্ট পরোটাসুদ্ধ থালাখানা তাড়াতাড়ি খাটের নিচে লুকাইবার চেষ্টা করিল।
আশ্চর্যের উপর আশ্চর্য! মেয়েটি একা আসে নাই, তাহার পিছনে আরও একটি মেয়ে আসিয়াছে। এ মেয়েটি হয়তো প্রথমটির চেয়ে বৎসর দুই-তিনের বড়ো হইবে।
অপু উঠিয়া কোঁচা দিয়া খাটটা পরিষ্কার করিয়া মেয়ে দুটিকে বসিতে দিল। কাজল অবাক হইয়া ব্যাপারটা দেখিতেছে। অপেক্ষাকৃত কমবয়সী মেয়েটি লজ্জিত সুরে বলিল–আপনিই তো অপূর্বকুমার রায়, লেখক?
অপুর মনে ভারি আনন্দ হইল। সে লেখক বলিয়া মেয়ে দুটি দেখা করিতে আসিয়াছে। এ অভিজ্ঞতার স্বাদ তাহার নিকট একেবারে নূতন। প্রশংসা সে আগেও পাইয়াছে, কিন্তু মেয়েদের নিকট হইতে তাহ পাওয়ার একটা আলাদা আনন্দ রহিয়াছে।
মেয়ে দুটি মালতীনগরেই থাকে। ছোট মেয়েটির নাম হৈমন্তী, বড়টি তাহার দিদি, নাম—সরযূ। হৈমন্তীর সাহিত্যে গভীর অনুরাগ আছে, সে অপুর লেখা পড়িয়া অবাক হইয়াছে তাহার ক্ষমতায়। অপু কি তাহাকে একটা অটোগ্রাফ দিবে?
অপু সত্যই অবাক হইল। মফঃস্বলে মেয়েরা একা বেড়াইতেছে, ইহা বেশ নূতন দৃশ্য। তাহা ব্যতীত কলিকাতায় অটোগ্রাফ চাহিলে ততটা অবাক হইবার কারণ থাকে না, কিন্তু মালতীনগরে অটোগ্রাফা! নাঃ, মেয়ে দুটি দেখা যাইতেছে বেশ আলোকপ্ৰাপ্তা।
অটোগ্রাফ দেওয়ার পর অপু তাহাদের চা খাইতে অনুরোধ করিল। তাহারা লেখকের সহিত কথা বলিতেই আসিয়াছিল, অতএব বিশেষ আপত্তি করিল না।
কথায় কথায় প্রকাশ পাইল হৈমন্তী গল্প লিখিয়া থাকে। অপু বলিল– সেটা আগে বলেন নি কেন? বাঃ, খুব ভালো কথা। একদিন নিয়ে আসুন, পড়া যাক। দিদি কথাটা প্রকাশ করিয়াছিল। হৈমন্তী সরযূর দিকে কটমট করিয়া তাকাইল। অপুর মজা লাগিতেছিল। হৈমন্তীর ছেলেমানুযি তাহার মনের আনন্দকে হঠাৎ জগোইয়া তুলিল। নারীর স্পর্শ না থাকিলে জীবনটা পানসে লাগে, নারীর কল্যাণ-হস্তই জীবনের রূপ পালটাইয়া দেয়।
হৈমন্তী একখানা চাঁপাফুল রঙের শাড়ি পরিয়া আসিয়াছিল, শাড়ির আঁচল হাতে জড়াইতে জড়াইতে লজ্জিত মুখে বলিল–দিদির যেমন কাণ্ড! লেখা-টেখা কিছু নয়, ও এমনি–
সবযু বাধা দিয়া বলিল–না অপূর্ববাবু বিশ্বাস করবেন না। ওর কথা। এই সেদিনও ওর লেখা বেরিয়েছে কাগজে।
সরযূ যে পত্রিকার নাম করিল, সেটা শুনিয়া অপু সত্যিই বিস্মিত হইল। বাংলা দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাসিকপত্রে যদি এই দুগ্ধপোষ্য বালিকার রচনা ছাপা হইয়া থাকে, তবে অবশ্যই একবার পড়িয়া দেখিতে হইতেছে।
অপু বলিল–কোনো আপত্তি শুনছি নে, কবে লেখা আনবেন বলুন। ফাঁকি দিলে চলবে না।
সরযূ বলিল–বাবাও শুনেছেন। আপনি এখানে থাকেন। উনি বলেছিলেন একদিন আপনাকে দুপুরে খাবার কথা বলতে। না, আপনারও কোন আপত্তি শোনা হবে না। কবে যাবেন বলুন।–যেদিন যাবেন, সেইদিন হৈমন্তী আপনাকে লেখা শোনাবে।
অপু বিশেষ আপত্তি করিল না। রবিবারে নিমন্ত্রণ রহিল। কাজলও সঙ্গে যাইবে হৈমন্তী এবং সরযূ দুইজনে কাজলকে অনেক আদর করিয়া বিদায় লইল। ঠিকানাটা অপু রাখিয়া দিল।
মেয়ে দুটি বিদায় লইলে অপু বিছানার কাছে আসিয়া বসিতে যাইবে, চাদরের উপর নজর পড়িল-কয়েকটা বেলফুল। তখনও বেশ তাজা, বেশিক্ষণ তোলা হয় নাই। অপু মনে মনে ভাবিল-এখানটায় হৈমন্তী বসেছিল। ওই নিয়ে এসেছিল ফুলগুলো। ভুলে ফেলে গেছে, আচ্ছা! মেয়ে যাহোক–
অপু ফুলগুলি তুলিয়া একবার গভীর ঘ্রাণ লইল।
রবিবারে ছেলেকে লইয়া অপু নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে গেল। নিজে একটু বিলাসিত করিতে ছাড়ে নাই, একটা শাস্তিপুরী ধুতি পরিয়াছে। কিন্তু সেই তুলনায় জামাটা ভালো হইল না–ময়লা মতো। অথচ এই ধুতিটা পরিয়া নিমন্ত্রণ খাইতে যাইবার তাহার বড়ো শখ। ফলে বিসদৃশ জামাকাপড় পরিহিত অপু নিমন্ত্রণ খাইতে গেল।
বাড়িতে পা দিতেই হৈমন্ঠীর বাবা আসিয়া তাহাকে অভ্যর্থনা করিয়া বসাইলেন। ভদ্রলোক সরকারি কাজ করেন–বদলির চাকরি। তিনি অপুর উপন্যাসটি পড়িয়াছেন। সম্প্রতি যে পত্রিকা দুটিতে অপু উপন্যাস লিখিতেছে, সেগুলিও তাহার বাড়িতে রাখা হয়।
অপু অবাক হইয়া দেখিল, বাড়িময় সাহিত্যের আরহাওয়া। বাবা, ভাই, বোন সবাই বেশ শিক্ষিত ও উদার। বসিবার ঘরে প্রচুর বই রহিয়াছে—অগোছালোভাবে খাটের উপর ও টেবিলের উপর ছড়ানো। অপু নিজের অভিজ্ঞতা হইতে দেখিয়াছে যে বাড়িতে বই সাজানো থাকে, সে বাড়িতে পাঠক কম। পড়ুয়াদের বই কখনও গোছানো থাকিতে পারে না। যাহারা শখের আসবারের মতো বই দিয়া ঘর সাজাইয়া সুরুচির পরিচয় দিতে চায়—তাহদের বই সাজানো থাকিতে পারে। হৈমন্তীদের পরিবার সম্বন্ধে অপুর বেশ একটা শ্রদ্ধা জন্মিল। তাহার মনে বদ্ধমূল ধারণা আছে-যাহারা বই পড়িতে ভালোবাসে তাহারা কখনও খারাপ মানুষ হইতে পাবে না। অনেকদিন পরে এই বাড়িতে আসিয়া অপুর মনে হইল, বেশ সহজ পছন্দসই আবেষ্টনীর মধ্যে আসিয়াছে। কাজল আসিবামাত্রই বই-এর কাছে গিয়া বসিয়াছে, বই পাইলে সে আর কিছু চায় না। অপু কিছুক্ষণ বাদে বলিল–তা, এবার লেখাগুলো পড়লে হতো না?
হৈমন্তী কিছুটা সঙ্কোচের সহিত খান দুই পত্রিকা আনিয়া অপুর হাতে দিল। অপু ব্যগ্রতার সহিত একটি হইতে সূচিপত্র দেখিয়া গল্প খুঁজিয়া পড়িতে শুরু করিল। ভাবিয়াছিল, মেয়েলি প্রেমের মিষ্টি মিষ্টি গল্প হইবে। একটি মেয়েকে একজন ছেলে দূর হইতে ভালোবাসিল, দুই-একটা চিঠি দিল। বাগানে একবার দেখাও হইল–পরে অভিভাবকগণ জানিতে পাবিয়া মেয়েটিকে ঘরে বন্দী করিল। ইহার পর নায়ক দাড়ি কামানো বন্ধ করিল, বোগা হইতে লাগিল এবং স্কুল-মাস্টারিতে ঢুকিয়া বড়ো বড়ো কবিতা লিখিয়া পরে টিবি হইয়া সাধনোচিত ধামে প্রস্থান করিল। ইহা ব্যতীত মেয়েরা আর লিখিবেই বা কী?
একটু তাচ্ছিল্যের সহিত পড়িতে শুরু করিয়াছিল বলিয়াই বোধ হয় ধাক্কাটা জোরে লাগিল। সাধারণ ন্যাকা-ন্যাক ভাষায় লেখা নহে–প্রেমের গল্পও নহে। একটি মেয়ে গল্প লিখিতে ভালোবাসিত। বিবাহ হইয়া পতিগৃহে অজস্র সাংসারিক কাজের ভিড়ে তাহার লেখিকা-সত্তা গেল চাপা পড়িয়া। একদিন বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় মেয়েটি অবসর পাইয়া টিনের তোরঙ্গ খুলিয়া তাহার লেখার খাতা বাহির করিয়াছে। সঙ্গে সঙ্গে ভিজা বাতাসের সহিত তাহার কুমারী জীবনের স্মৃতি যেন হু হু করিয়া ঢুকিয়া পড়িল ঘরের ভিতর। এই গল্প। ভাষার উপর লেখিকার দখলের কথা সহজেই বোঝা যায়। অপু অবাক হইল। গল্প পড়িয়া মামুলি ধরনের কী প্রশংসা করিবে তাহা ঠিক ছিল, এখন গল্পটা সত্য সত্যই ভালো হইয়া পড়ান্য সে কিছু বলিতে পারিল না।
খাইতে বসিয়া অপু বলিল–সত্যিই খুব ভালো লেখা আপনার। এতটা ভালো, মিথ্যে বলবো না, আমি আশা করতে পারি নি।
হৈমন্তী বলিল–আমাকে আর আপনি বলছেন কেন, তুমি বলুন।
–তোমার গল্প সত্যিই ভালো লাগল হৈমন্তী। এত সাধাবণ প্লট নিয়ে এত চমৎকার কবে তা ফুটিয়ে তোলা–না, তোমার মধ্যে শিল্পীমান লুকিয়ে আছে।
হৈমন্তীর বাবা হাসিয়া বলিলেন-অত প্রশংসা করবেন না অপূর্ববাবু, মাথা বিগড়ে যাবে ওর। তবে হ্যাঁ, এ মেয়েটি আমার সত্যিই–পড়াশুনোতেও বড়ো ভালো ছিল। বরাবর ক্লাসে ফার্স্ট হতো। বড়ো অসুখে পড়েছিল বলে বছরখানেক পড়া বন্ধ আছে।
খাওয়া হইলে হৈমন্তী অপুর জন্য মশলা আনিল। মশলা লইতে লইতে অপু জিজ্ঞাসা করিল–আচ্ছা, সেদিন তুমি আমার খাটের ওপরে বেলফুল ফেলে এসেছিলে, না? তুমি যাবার পর দেখি পড়ে আছে। আমার অবশ্য ভালেই হয়েছিল, সারা সন্ধে গন্ধ শুঁকে শুঁকে বেশ কবিত্ব করা গেল।
মাথা নিচু করিয়া হৈমন্তী বলিল–ফেলে আসি নি, আপনার জন্যেই নিয়ে গিয়েছিলাম, রেখে এসেছি। আপনার লেখা পড়ে মনে হয়েছিল ফুল পেলে আপনি খুশি হবেন।
-আমার জন্য নিয়ে গিয়েছ। তো আমাকেই দিলে না কেন?
উত্তরে হৈমন্তী কিছু বলিল না, কিছুক্ষণ চুপ করিয়া পরে মাথা তুলিয়া অপুর দিকে তাকাইয়া একটু সলজ্জ হাসি হাসিল।
-কই বললে না তো দাওনি কেন?
–দিয়েই তো এসেছিলাম। আপনি বুঝতে পারেন নি, সে কি আমার দোষ?
বাড়ি ফিরিতে ফিরিতে কাজল বলিল–বেশ লোক এরা, না বাবা! উত্তর না পাইয়া অভিযোগের সুরে বলিল–হুঁ। বাবা, তুমি সেই থেকে শুনছো না কিছু!
অপু চমক ভাঙিয়া বলিল–অ্যাঁ, ও হ্যাঁ তা ভালো লোক। বেশ ভালো লোক–নাও, এখন তাড়াতাড়ি পা চালাও, বাড়ি গিয়ে তোমার ইংরাজি বানানগুলো—
হৈমন্তী প্রায়ই অপুর বাসায় আসে। অপু সম্প্রতি খ্যাতি পাইতেছে–কিন্তু এই মেয়েটি তাঁহাকে সত্য করিয়া চিনিয়াছে। পুস্তক সমালোচকদেব দায়সারা ভাসা ভাসা আলোচনা নহে, হৈমন্তী তার অন্তরে প্রবেশ করিয়া তার চোখ দিয়া বিচার করিয়াছে। অপুর লেখক এবং ব্যক্তিসত্তাকে এমন করিয়া আর কেহ আদর করে নাই–এক লীলা ছাড়া। হৈমন্তী তাহাকে বুঝিতে পারিয়াছে, চিনিতে পারিয়াছে। অপুর মনে ধীরে ধীরে কেমন একটা বুভুক্ষা জাগিয়া উঠিল। ভালোবাসা পাইবার ক্ষুধা। তার মনে হইল, সারাজীবন এইভাবে ভাসিয়া বেড়ানো সম্ভব নহে, জীবনের মূল মাটির মধ্যে চালাইয়া নিজেকে মৃত্তিকার উপরে প্রতিষ্ঠিত করিবার দিন আসিয়াছে। যতবার সে স্থায়ী হইবাব চেষ্টা করিয়াছে, দুর্ভাগ্যের ঝড়ে তাকে ভাসাইয়া লইয়াছে দূরে। এখন গৃহের শাস্তি পাইতে ইচ্ছা করে। তবে সে স্থাণু হইয়া পড়িতে চায় না, গৃহকে সে পায়ের বেড়ি না ভাবিয়া জীবনানন্দের একটি দিক হিসাবে পাইতে চায়।
একদিন বিকালে হৈমন্তী আসিল। সঙ্গে তাহার ভাই। অপু হাসিয়া বলিল–আরে, এসো, এসো। ভালোই হলো। বিকেলটা মোটে কাটছিল না, এখন বেশ গল্প করা যাবে তোমার সঙ্গে।
–তা তো করবেন। কিন্তু আজ আমার একটা গল্প শুনতে হবে আপনাকে। দেখছেন তো, একদিন প্রশ্ৰয় দিয়ে কী কাণ্ড করেছেন!
–বারে, সে কী কথা! নিশ্চয় শুনব গল্প। তোমার গল্প আমার সত্যিই ভালো লাগে হৈমন্তী, সেদিন তোমায় মিথ্যে বলিনি। মামুলি প্রশংসাও করিনি। সত্যিই তোমার মধ্যে অদ্ভুত গুণ আছে। কোত্থেকে পেলে বলে তো?
-বাড়িয়ে বলা আপনার অভ্যোস। আমার লেখা এমন কিছু নয়—
জোর তর্ক শুরু হইয়া গেল। অপু প্রমাণ করিবেই হৈমন্তী ভালো লিখিয়া থাকে। আধঘণ্টা বাগযুদ্ধের পর হৈমন্তী হার মানিল। অপু বলিল–চলো, উঠোনে মাদুর পেতে বসি, ভেতরে বড্ড গরম।
চারজনে উঠানে বসিল। কাজলের সহিত হৈমন্তীর আশ্চর্য সম্পর্ক গড়িয়া উঠিয়াছে। প্রথম প্রথম কাজল তাহাকে তত পছন্দ করিতে পারে নাই। কিন্তু পরে কী ভাবে যেন কাজলের মতের পরিবর্তন ঘটিয়াছে, এখন সে সর্বদা হৈমন্তীর কাছে কাছে ঘোরে। হৈমন্তী প্ৰথম দিন দেখিয়াই ভালোবাসিয়াছিল। কাজলের উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, মুখের গড়ন, সবটাই যেন অপুর ধাঁচে গড়া। দেখিলে আদর না করিয়া থাকা যায় না।
সন্ধ্যা হইয়া আসিতেছিল। কাজল হৈমন্তীর কোলের কাছে ঘোষিয়া বসিয়াছে। প্ৰতাপ (হৈমন্তীর ভাই) হাঁটুর উপরে থুতনি রাখিয়া কী যেন ভাবিতেছে। উঠানের সন্ধ্যামালতীর ঝাড়ে ঝিঁঝির শব্দ। সমস্ত দিনের তাপের পর এখন চারিদিকে কেমন শান্ত স্তব্ধতা।
হঠাৎ একমুহূর্তের জন্য অপুর কেন যেন ফিজির সমুদ্রবেলার কথা মনে পড়িল। এই সময় স্কুল হইতে বাড়ি ফিরিয়া পাউরুটি ও সামুদ্রিক মাছের ঝোল দিয়া জলযোগ করিয়া সে বেলাভূমিতে আসিয়া বসিত। সমুদ্রের ওপরেই একটি ছোট শহরে সে মাস্টারি করিত। কোনদিনই তার তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা হইত না। সে পা ছাড়াইয়া বসিয়া থাকিত। সামনে অবিশ্রাস্ত গর্জন করিতেছে সমুদ্র। মাঝে মাঝে ঢেউগুলি তাহার কাছ বরাবর আসিয়া পড়িতেছে, চলিয়া যাইবার সময় ফেলিয়া যাইতেছে একটি টানা লম্বা সাদা রেখা আর কয়েকটি ঝিনুক। অপুর অদ্ভুত অনুভূতি হইত-একটা অপার রহস্যের অনুভূতি। সমুদ্রের প্রকাণ্ডত্বের সহিত নিজেকে একাত্ম করিবার মহৎ অনুভূতি। অথচ এই এখন সে মালতীনগরে বসিয়াও তো বেশ আনন্দ পাইতেছে। অত বিশাল দৃশ্যের সম্মুখীন যে হইয়াছে—তাহার এই ক্ষুদ্র স্থানে আরদ্ধ থাকিয়াও কি আনন্দ পাওয়া সম্ভব?
অপু মনে মনে নিজের আনন্দের কারণটা অনুভব করিল। উন্মত্তের মতো উল্কাবেগে পৃথিবীর এ প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরিয়া মরিলেই সার্থকতা লাভ হয় না। জীবনের আনন্দ রহিয়াছে অনুভূতির গাঢ়ত্বের ভিতর, জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করিবার ভিতর। ফিজির সমুদ্রতীরে বসিয়া সে যেমন হইতে পারে–মালতীনগরেও হইতে পারে।
স্তব্ধতা ভাঙিয়া অপু বলিল–তুমি গান গাইতে পারো হৈমন্তী?
একটু চুপ করিয়া থাকিয়া হৈমন্তী বলিল–পারি।
—একখানা গাও না, শুনি।
সামান্য পরেই হৈমন্তী গাহিল—’দিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘোমটা পরা ওই ছায়া, ভুলালো রে ভুলালো মোর প্ৰাণ।’
অপু সামনের দিকে ঝুঁকিয়া শুনিতেছিল। হৈমন্তীর গলা ভালো। বিশেষ করিয়া গানেব কথা এবং উদাস সুব অপুর হৃদয় স্পর্শ করিল। পরিবেশের সঙ্গে গানটা যেন কেমন করিয়া মিলিয়া গেল।
‘ঘরেও নহে পারেও নহে
যে জন আছে মাঝখানে
সেই বসেছে ঘাটের কিনারায়-’
গান শেষ হইয়া গেল। অন্ধকার নামিয়াছে। বেশ বাতাস। অপু ওপরে তাকাইল–সব নক্ষত্র এখনও দেখা যাইতেছে না বটে, কিন্তু বৃহস্পতি গ্ৰহ ঝকঝক করিতেছে। অপু বলিল–বৃহস্পতি চেনো? ওই দেখ। ওই যেটা ও-বাড়ির কার্নিসের ডানদিকে জ্বল জ্বল করছ–দেখছো?
–হ্যাঁ।
—ভাবো দেখি, ওটা পৃথিবীর চেয়ে কত বড়। অন্ধকারের বুকে দীর্ঘপথে সূর্যকে পরিক্রমা করছে সৃষ্টির উষাকাল থেকে। ও রকম কত গ্রহ, কত নীহারিকা ধূমকেতু মহাশূন্যের। অকল্পনীয় ব্যাপ্তিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জীবনটা বড়ো অদ্ভুত, বড়ো সুন্দর, না? তুমি অনুভব করো?
–করি। সেজন্যই তো আপনার লেখা আমার ভালো লাগে।
একটা দমকা বাতাস আসিল। সন্ধ্যামালতীর ঝাড়ে লাগিল দোলা। অনেক শূকনো পাতা খড়খাড় শব্দ করিয়া উঠানের উপর দিয়া সরিয়া গেল। কাজল বলিল–সেই যে বাবা তুমি বলেছিলে, এদের দেবে সেই জিনিস–
অপু হাসিয়া বলিল–ওই দ্যাখো, একদম ভুলে বসে আছি। কলকাতা থেকে অরেঞ্জ ক্রীম দেওয়া বিস্কুট এনেছি। তাই কাজলকে বলেছিলাম, তোমরা এলে দেবার কথা। ভাগ্যিস তুই মনে করিয়ে দিলি খোকা–
অপু উঠিয়া ঘরে বিস্কুট আনিতে গেল।
হৈমন্তীদের বাড়িতে অপু প্রায়ই যাতায়াত করে আজকাল। হৈমন্তীর বাবা-মা তাহাকে পাইলে সত্যই খুশি হন। সে গিয়া গল্পগুজব করিয়া জলখাবার খাইয়া বাড়ি ফেরে। কাজলও সঙ্গে যায়। মাঝে মাঝে গানের আসর বসে, হৈমন্তী আগে হইতে নিমন্ত্ৰণ করিয়া যায়। সাংস্কৃতিক আরহাওয়া অপু পছন্দ করে, ফলে এ বাড়ির সহিত তাহার ঘনিষ্ঠতা গড়িয়া উঠিতে বেশি দেরি হয় নাই।
অপু অনেক ভাবিয়া দেখিয়াছে, এক সারাজীবন কাটানো তাহার পক্ষে সম্ভবপর নহে। অপর্ণর কথা ভাবিয়াই সে অন্তর হইতে সায় পাইতেছিল না। কিন্তু পরে চিন্তা করিয়া দেখিল, অপর্ণার স্মৃতি তাহার মনের যে গোপন কন্দরে স্থায়ী রঙে আঁকা হইয়া গিয়াছে—সেখানে আর কাহারও স্থান নাই। কিন্তু হৈমন্তীকে সে অস্বীকার করিতে পারিবে না। সে যদি বলে-আমি হৈমন্তীকে ভালবাসি না, তবে তাহা মিথ্যা কথা বলিবে।
অপর্ণার স্মৃতিকে শ্রদ্ধার আলোয় বাঁচাইয়া রাখিয়াই সে বর্তমান সত্যকে মর্যাদা দিবে। একমাত্র ভয় ছিল কাজলকে লইয়া। কিন্তু কাজল ও হৈমন্তী পরস্পরকে নিকটবন্ধনে বাঁধিয়াছে। সেদিক দিয়া চিন্তার আর কারণ নাই।
একদিন অপু কথাটা হৈমন্তীর বাবার কাছে পাড়িল। ভদ্রলোক আপত্তি করিলেন না। অপু সজ্জন, সুপুরুষ, বাজারে নামডাক হইয়াছে। সম্প্রতি বই লিখিয়া ভালো উপার্জন করিতেছে। এমন পাত্রের সহিত বিবাহ না দিবার কোনো কারণ নাই। তিনি নিজেও বুদ্ধিমান এবং সাহিত্যরসিক। অপুর ব্যক্তিত্ব এবং রচনা-ক্ষমতা তাহাকে মুগ্ধ করিয়াছিল। তিনি মত দিলেন।
দিনস্থির করিবার জন্য ভিতর বাড়ি হইতে পঞ্জিকা আনানো হইল।
০৪. বিবাহের পর মাস তিনেক কাটিয়াছে
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
বিবাহের পর মাস তিনেক কাটিয়াছে। বৃষ্টি তেমন হইতেছে না। আকাশের রঙ কটা, তামার মতো। গরমে দেশসুদ্ধ লোক হাঁপাইয়া উঠিয়াছে। মাটিতে বড়ো বড়ো ফাটল, বৃষ্টির জন্য আকাশের দিকে মুখব্যাদান করিয়া রহিয়াছে। গরমে কাকদের স্বরভঙ্গ হইয়াছে, ডাকিলে তীব্র কা-কা শব্দের বদলে একটা ফ্যাসফ্যাস শব্দ বাহির হইতেছে মাত্র। লোকে প্রতি দণ্ডে একবার আকাশের দিকে তাকাইয়া মেঘ আসিল কিনা দেখিতেছে।
অপু স্ত্রী-পুত্ৰকে মালতীনগরে রাখিয়া নিশ্চিন্দিপুরে গেল। হৈমন্তীকে সে দেশের বাড়িতে রাখিবে। মালতীনগর ভালো জায়গা হইতে পারে, কিন্তু মালতীনগরের সহিত তাহার আত্মিক যোগাযোগ নাই। যদি গৃহী হইতে হয়, নিশ্চিন্দিপুরে সে গৃহী হইবে!
রাধারমণ চাটুজ্যের কাছে খোঁজ করিতে বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেল। তাহদের পুরানো ভিটার কাছেই ছোট পাকাবাড়ি, মন্দ নহে। দামও অপুর কাছে সস্তা বলিয়া বোধ হইল। নিজেদের ভিটায় নূতন করিয়া বাড়ি তুলিতে গেলে যা খরচ পড়ে, তাহা এখন অপুর পক্ষে জোগাড় করা মুশকিল। বাড়ি একেবারে ভাঙিয়া পড়িয়াছে–তাহার উপর বাড়ি তোলা অনেক ঝামেলার কাজ। ফলে অপু এই বাড়ি কেনাই মনস্থ করিল।
রাধারমণ হাসিয়া বলিলেন–আমাদের বাড়ির কাছে হল। আমরা দু’ভাই ও বাড়ির একেবারেই পাশেই থাকি কিনা। বেশ গল্প-টল্প করা যাবে। আপনার মতো পড়শী পাওয়া, বুঝলেন কিনা, রীতিমত ভাগ্যের ব্যাপার।
অপু প্ৰথমে রাধারমণের গায়েপড়া ভাবটা পছন্দ করে নাই, কিন্তু পরে লোকটাকে ভালো লাগিয়া গেল। একটু বেশি কথা বলিলেও চাটুজ্যে লোক মন্দ নহে।
মালতীনগরে ফিরিবার আগে অপু একবার জঙ্গলাবৃত পুরানো ভিটার সামনে গিয়া দাঁড়াইল। মনে মনে বলল–বৌ নিয়ে আবার আসছি তোমাদের কাছে ফিরে। দেখলে তো, কোথাও থাকতে পারলুম না। তোমরা আশীৰ্বাদ করো, কাজল যেন মানুষ হয়। যেন ওর জীবনে পূর্ণতা আসে।
হৈমন্তীকে লইয়া নিশ্চিন্দিপুরে আসিলে বেশ বড়ো রকমের হৈ-চৈ হইল। রানি আগে হইতেই অপুর কেনা বাড়িতে আসিয়া প্রস্তুত হইয়াছিল। আরও অনেকে আসিয়া ভিড় জমাইয়াছিল উঠানে। অপুরা আসিতেই রানি সবার আগে আসিয়া অভ্যর্থনা করিল, হৈমন্তীর পিঠে হাত দিয়া তাহাকে ঘরের ভিতর লইয়া গেল।
গোলমাল মিটিলে অপু বলিল–বৌ কেমন লাগল রানুদি?
–সুন্দর হয়েচে। চমৎকার বৌ হয়েচে। তুই যে বিয়েথাওয়া করে আবার এসে গ্রামে উঠেছিস, তাতে যে কী খুশি হয়েচি, তা আর–এবার মন দিয়ে সংসারধর্ম কর। বড্ড বাউণ্ডুলে হয়ে গিয়েছিলি তুই।
সর্বাপেক্ষা খুশি হইয়াছে কাজল। এই কদিন তাহাকে স্কুলে যাইতে হইতেছে না, পড়া মুখস্থ করিতে হইতেছে না। বাবা বলিয়াছে, গ্রামের কাছেই স্কুলে ভর্তি করিবে। তাহাতে যে দু’একদিন লাগিবে, তাহা বেশ মজায় কাটিয়া যাইবে।
নিশ্চিন্দিপুরে ফিরিবার সময় অপু ছেলের কথা ভাবিয়াছিল। শেষে ভাবিল–কী আর হবে, গ্রামের স্কুলেই ভর্তি করিয়ে দিই। বাদবাকি পড়া আমি নিজে দেখব’খন। আমি নিজেও তো একসময় গ্ৰাম্য স্কুলে পড়েচি, আমার কি পড়াশুনো কিছুই হয়নি?
প্রতিবেশীরা ফিরিয়া গিয়াছে। কাজল রানির সহিত তাহদের বাড়ি গিয়াছে। দুপুরে অপু ঘরে ঢুকিয়া বলিল–প্রথম দিন আর বেশি কিছু রান্না করতে হবে না। যাহোক একটা ছেচকি-টেচকি কিছু নামিয়ে ফেলো। এমনিতেই আসার কষ্ট গেছে–রানুদি ডাল আর তরকারি পাঠিয়ে দেবে বলেছে। বলেছে, নতুন বৌ এল, তাকে খাটালে গায়ের নিন্দে হবে যে।
হৈমন্তী মুখ তুলিয়া নতুন ঘরকন্না করিবার আনন্দে হাসিল। সঙ্গে সঙ্গে অপুর মনে একটা আনন্দেব রেশ ছড়াইয়া পড়িল। সে সংসাব করিতেছে স্ত্রী-পুত্ৰ লইয়া। সবাই খুশি। চারিদিক বেশ কেমন ভরিয়া উঠিয়াছে।
সে হৈমন্তীকে জিজ্ঞাসা করিল–তুমি অনেক বড়ো বড়ো জায়গায় ঘুরেচো বাবার সঙ্গে। এই অজ পাড়াগাঁয়ে থাকতে পারবে তো?
–পাববো মশাই, পারবো। আমি সে রকম মেয়ে নই, তা হলে তোমাকে বিয়ে করতাম না। ববং শহরই আমার ভালো লাগে না।
–বিকেলে তোমাকে নিয়ে নদীতে যাবো গা ধুতে। এই পেছন দিয়েই পথ, বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে। দেখো, খুব ভালো লাগবে।
–তুমি তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। বেলা পড়ে এলো যে, কাজল কই?
–সে রানুন্দির ওখানে খাবে। না, না, শুধু আমাকে নয়, তোমারটাও বাড়ো–একসঙ্গে নিয়ে বসে যাই।
–তুমি খেয়ে ওঠে তো আগে, তারপর আমি বসবো।
বিকাল হইয়া আসিতেই অপু, হৈমন্তীকে লইয়া পুরানো ভিটার কাছে গেল।
—এই আমার পৈতৃক ভিটে হৈমন্তী। এখানে আমার জন্ম। ওই যে আকন্দগাছ দেখছ–ওখানে একটা ঘর ছিল, সেই ঘরে। আমার বাবা-মার পুণ্যস্মৃতিমণ্ডিত মাটি এখানকার।
হৈমন্তী ভিটার দিকে মুখ করিয়া গলায় আঁচল দিয়া মাটিতে উপুড় হইয়া প্ৰণাম করিল। বলিল–তাদের তো দেখলাম না। কপাল করে আসি নি শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে ঘর করবো। তঁদের আশীৰ্বাদ যেন পাই। কাজলকে যেন মানুষ করে তুলতে পারি।
ব্যাপারটা আদৌ নাটকীয় হইল না। বরং হৈমন্তীর সাষ্টাঙ্গে প্ৰণাম করিবার মধ্যে অপু অনেক কিছু দেখিতে পাইল। সকাল হইতেই নানা মিশ্র অনুভূতিতে তাহার বুক ভরিয়া উঠিতেছিল। বৌ লইয়া জঙ্গলাকীর্ণ ভিটার সামনে দাঁড়াইয়া তাহার মনে হইল মায়ের স্নেহ, বাবার আশীৰ্বাদ যেন তাহাদের দুইজনকে ঘিরিয়া ধরিয়াছে। এতদিন বাদে অতীতের দিনগুলির সহিত যেন একটা যোগাযোগ স্থাপিত হইল।
রানুপিসি নানা কাজে ব্যস্ত ছিল, তাহাকে বলিয়া কাজল বেড়াইতে বাহির হইল। রানি বলিয়া দিল–বেশি দেরি করিস নে, দূরে যাস নে।
গ্রামের প্রান্তে যে মাঠ আছে তাহার আল ধরিয়া পড়ন্ত বেলায় হাঁটিতে কাজলের খুব ভালো লাগে। মাঠের মধ্যে দূরে দূরে লোক থাকে, অধিকাংশ সময়েই মাঠ ফাঁকা। ওয়াইড ওয়ার্লড ম্যাগাজিন হইতে শোনা গল্পগুলির পটভূমি হিসাবে এই ফাঁকা মাঠ ও বন্য ঝোপ তাহার মনে আধিপত্য বিস্তার করে। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রচণ্ড গরমে মরুভূমির ভিতর হীরকসন্ধ্যানী দুইটি দলের মধ্যে যে ভীষণ সংঘর্ষ হইয়াছিল, এই মাঠে সে তাহা প্রত্যক্ষ করিতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকার গরমের সহিত সংগতি রাখিবার জন্য সে হাতের উলটা পিঠ দিয়া শক্ত আলোর উপরকার উত্তাপ অনুভব করে। মনে মনে ভাবে, আফ্রিকার মরুভূমির বালিও এমনি গরম। বাবার কাছে গল্প শুনিয়া সে লক্ষ করিয়াছে, যাবতীয় রোমাঞ্চকর ঘটনা আফ্রিকাতেই ঘটিয়া থাকে। আফ্রিকা তাহার কাছে বহস্যোব দেশ। বড়ো হইলে সে আফ্রিকায় যাইবে, বাওবাব গাছ (বাবার কাছে নাম শুনিয়াছে) দেখিবে।
সূর্য দিগন্তরেখা স্পর্শ করিয়াছে। কাজল তাকাইয়া দেখিল মস্ত লাল সূৰ্যটা আস্তে আস্তে দিগন্তের নিচে নামিয়া পড়িতেছে। ততক্ষণে একটু ঠাণ্ডা বাতাস ছাড়িয়াছে। আলেব পাশে ছোট ছোট ঝোপের মধ্য দিয়া হালকা শব্দ তুলিয়া হাওয়া বহিতেছে। কেহ কোথাও নাই। যত দূর দৃষ্টি যায়, উদার বিশাল মাঠ পড়িয়া আছে। বিকালে কেমন একটা ছায়া ছায়া ভাব নামিতেছে। বাতাসেব অদ্ভুত শব্দ। এর মধ্যে একলা দাঁড়াইয়া থাকিবার যে একটা ভয়মিশ্রিত আনন্দ আছে, তাহা কাজলকে অভিভূত করে। ঠিক ভয় নহে, একটা অচেনা অনুভূতি। এই সময়, দিন ও বাত্রিব সন্ধিক্ষণে বাড়ি হইতে দূরে মাঠের ভিতর পৃথিবীটাকে যেন অচেনা বোধ হয়।
ফিরিবে বলিয়া ঘুরিয়া দাঁড়াইতেই কাজলের সেই লোকটার সহিত দেখা হইয়া গেল। মানুষটার হাতে খঞ্জনী, পরনে আটহাত খাটো মোটা ধুতি। নাকে বসকলি, বগলে ছাতা–তাপ্পি মারা, কাঁধে ঝুলি। আপন মনে আসিতেছিল, সামনে কাজলকে দেখিয়া খঞ্জনীটা দ্রুত লয়ে একবার বাজাইয়া দিল। কাজল প্ৰথমে ভয় পাইয়াছিল। পরে লোকটার চোখের দিকে তাকাইয়া বুঝিল, এ চোখ যাহার, তাহাকে ভয় পাইবার কোন কারণ নাই।
লোকটা হাসিয়া বলিল— বেড়াচ্ছেন বুঝি বাবাজি? ভালো, বেড়ানো ভালো। বেড়ালে মানুষের চোখ ফোটে–তাঁর দুনিয়াটার রূপ দেখতে পায় মানুষ–
-কার দুনিয়া?
লোকটা আর একবার দ্রুত খঞ্জনী বাজাইয়া ওপরে আকাশের দিকে দেখাইয়া বলিল–ওই ওখানে যিনি থাকেন, তার। সবই তো তার বাবাজি।
সম্পূর্ণটা না পারিলেও, কাজল লোকটার কথার খানিকটা অর্থ ধরিতে পারিল। বেশ কথা বলে মানুষটি। কাজল বলিল–তুমি বুঝি অনেক বেড়িয়েচ?
লোকটা মৃদু হাসিল।
–বেড়ানো আর হল কোথায়? অকাজেই বড্ড বেলা হয়ে গেল। হ্যাঁ, কিছু কিছু ঘুরেছি বাবাজি। বেশির ভাগটাই না-দেখা রইল।
খঞ্জনী বাজাইয়া লোকটা ভাঙা বেসুরো গলায় দুকলি গান গাহিল–
ও মন তুই পোড়া সুখে রাইলি ভুলে
যখন তোর মনের পদ্ম উঠল দুলে
প্রভুর পদপরশনে–
কাজল লোকটাকে ভালোবাসিয়া ফেলিল। সুন্দর মানুষ। গান গাহিতে পারে–গল্প করিতে পারে, আর কী চাই? বলিল–তোমার কী তাড়াতাড়ি আছে? এইখানটায় বসে আমার সঙ্গে একটু গল্প করে যাও না।
লোকটা ছাতাটা আলোর গায়ে হেলান দিয়া রাখিয়া বসিল।
–তুমি যদি থাকতে বলো, তবে আমার কোন তাড়া নেই।
অনেক গল্প হইল লোকটার সহিত। লোকটা সুন্দর গল্প করিতে জানে। সাধারণ ঘটনাও তাহার বলিবার গুণে চিত্তাকর্ষক হইয়া ওঠে। একটি মেয়ের বাপের বাড়ির গাঁয়ে সে ভিক্ষা করিতে যাইত প্রায়ই। মেয়েটির কবে বিবাহ হইয়া গিয়াছে, সে খবর পায় নাই। একদিন না জানিয়াই তাহার শ্বশুরবাড়িতে ভিক্ষা চাহিয়া দাঁড়াইতে বাপের বাড়ির চেনা বলিয়া মেয়েটি তাহাকে অনেক কথা লুকাইয়া বলিয়াছে। ইহাতে লোকটা খুব খুশি।
—জগতে কেউ কারুর নয় বাবাজি। আপন মনে করলেই আপন, পর ভাবলেই পর।
গল্প শেষ হইলে সে ঝুলির ভিতর হইতে একটি পাকা আম বাহির করিল।
–তুমি এটা নাও খোকন। বাড়ি গিয়ে খেয়ো।
–না, তোমার জিনিস। আমি কেন নেবো?
–আমার আর কই? এটা তোমারই, আমি তোমাকে দিচ্ছি।
–নিশ্চিন্দিপুর এই তো কাছেই। একদিন যেয়ে না। আমাদের বাড়ি।
–যাব, নিশ্চয় যাব।
খঞ্জনীতে আওয়াজ তুলিয়া গুনগুন করিতে করিতে সে বিদায় লইল। দুই পা হাঁটিয়াই কাজল তাহাকে ডাকিল- তোমার নাম তো বলে গেলে না?
সে ফিরিয়া বলিল–আমার নাম রামদাস বোষ্টম।
স্বল্প আলাপেই রামদাস কাজলের মনে গভীর ছাপ রাখিয়া গেল। কেমন সুন্দর জীবন, একা এক বেড়ায় মাঠে-ঘাটে, ঘরবাড়ির ঠিক নাই। কোন বন্ধন নাই–আবার পিছুটান নাই বলিয়া দুঃখও নাই। খোলা আকাশের নিচে একা খঞ্জনী বাজাইয়া ফেরে।
সন্ধ্যার আরছা অন্ধকারে কাজল বাড়ির পথ ধরিল।
বিকালে নদীতে স্নান করিতে যাইবার কথা ছিল।
অপু আর হৈমন্তী গল্প করিতে করিতে অনেক দেরি করিয়া ফেলিল।
হঠাৎ খেয়াল হইতে অপু ধড়মড় করিয়া মাদুরের উপর উঠিয়া বসিল-ওই যাঃ, এ যে প্রায় অন্ধকার হয়ে এলো, চল চল, আর কথা নয়। দু’খানা গামছা, তোমার শাড়ি, আমার ধুতি, আর শিশিতে একটু তেল নাও-ওবেলা তেল মাথায় দিতে ভুলে গেছি। একেবারে ঘাটে মেখে নেব।
তাড়াতাড়ি গোছগাছ করিয়া বাহির হইতে আরও পনেরো মিনিট দেরি হইল। হৈমন্তী জিজ্ঞাসা করিল–কাজল এলো না যে?
–রানুদির ওখানে আছে, সন্ধে উতরে গেলে রানুদিই দিয়ে যাবে’খন।
অন্ধকার নামিতেছে। নদীর পথে ঝোপে-ঝাড়ে বেশ অন্ধকার ঘনাইয়াছে। বাগান দিয়া যাইবার সময় একটা কী জন্তু ঝরাপাতার উপর দিয়া খড় খড় শব্দ করিয়া দূরে সরিয়া গেল। হৈমন্তী বলিল–ও কী গো?
–ভয় পেয়েছে? কিছু না, শেয়াল-টয়াল হবে হয়তো কিংবা বেজি!
—সুন্দর লাগছে কিন্তু, না? শহরে এ সময় গোলমাল, গাড়ির ভেঁপু, মানুষের ভিড়। তার চেয়ে এই ভালো। মনের শান্তির চেয়ে বড়ো জিনিস নেই।
–তুমি যে একেবারে নাটুকে কথাবার্তা বলতে শুরু করলে।
–না গো, এই আমার মনের কথা। আমি এই চেয়েছিলাম। শহর আমার ভালো লাগে না। যখনই তোমার লেখা প্ৰথম পড়েছি, মনে হয়েছে–
–কী মনে হয়েছে?
হৈমন্তী অপুর দিকে তাকাইল।–না, সে আমার বলতে লজ্জা করে।
–আহা, বলেই না। আন্দোকটা যখন বললে
–প্রথম তোমার লেখা পড়েই মনে হয়েছিল–এ মানুষটার সঙ্গে আমার খুব মিল খাবে। প্রকৃতি যে এত ভালোবাসে–
দুইজনে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া হাঁটিল। বেশ কেমন সন্ধ্যায় নদীতে স্নান করিতে যাওয়া বনপথ বাহিয়া এইসব শাস্তি ছাড়িয়া সে কীসের অন্বেষণে ঘুরিতেছিল সমুদ্রপারে?
বাঁশবাগানের মধ্যে হৈমন্তী হঠাৎ থামিয়া গেল। চারিদিকে তাকাইয়া বলিল–শোনো।
–কী?
–একটা মজার ব্যাপার হয়েছে।
–তোমার তো দেখি দুপুর থেকে খালি মজার ব্যাপারই ঘটছে। কী ব্যাপার?
–মালতীনগর থেকে আসবার আগে পত্রিকায় একটা গল্প দিয়ে এসেছি না? সেই গল্পে একটা বাঁশবাগানের বর্ণনা আছে। মনে মনে একটা বাঁশঝাড়ের কল্পনা করে লিখেছিলাম। হঠাৎ এখানটায় দাঁড়িয়ে চারিদিক দেখে মনে হচ্ছে অবিকল যেন আমার কল্পনাব সেই বাগানটা। কেমন আশ্চর্য, না?
অপুর বেশ ভালো লাগিল ঘটনাটা। হৈমন্তী এ গ্রামের বউ হইয়া আসিবে, ইহা যেন ভগবানই স্থির করিয়া রাখিয়াছেন। নিজের অতীত জীবনটা এই আনন্দের মুহূর্তে গোটানো মানচিত্রের মতো চোখের সামনে খুলিয়া গেল। বহু কষ্ট গিয়াছে, জীবনযুদ্ধে বহু রণক্ষেত্রের সে সৈনিক। এখন পুরস্কারের দিন-সার্থকতার দিন।
অন্ধকার ঝোপে ঝোপে কীটপতঙ্গের ঐকতান শুরু হইয়াছে। বাতাসে দিনশেষের আমেজ আর একটা বন্য গন্ধ।
অপু বলিল–নাও, তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চল। সন্ধে উতরে গেল—
এক-একদিন রাত্রিতে চাঁদ থাকিলে মাদুর পাতিয়া তারা বারান্দায় শোয়। বাবার পাশে মাদুরে শুইয়া কাজল চাঁদ নক্ষত্র আকাশ পৃথিবী সম্বন্ধীয় অজস্র বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন করিতে থাকে। অপুকে তাহার উত্তর দিতে হয়। অপু মাঝে মাঝে কাজলকে বিশ্বসাহিত্যের গল্প শোনায-কাজল মনোযোগ দিয়া শোনে। বেশি রাত হইলে অপু ভাবে কাজল ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। সে গল্প থামাইয়া বলে-কী রে, ঘুম পেয়েছে?
অমনি কাজল বলে, বাবা আমার ঘুম পায়নি। থামলে কেন? বলো–
অপুকে গল্প চালাইতে হয়। এইভাবে কিছুদিনের মধ্যেই কাজল বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কয়েকটি গ্ৰন্থ শুনিয়া ফেলিল।
একদিন অপু কাজলকে ডাকিয়া বলিল–নে, চল। কাল আমার সঙ্গে কলকাতা চল। যাদুঘর যাবি বলছিলি, কাল যাদুঘর দেখাব’খন। আমারও এমনি কাজ আছে কয়েকটা-সেই সঙ্গে সেরে ফেলব।
পরদিন সকালে অপু ছেলেকে লইয়া কলিকাতা রওনা দিল। কাজল একটা ঘিয়ে. রঙের হাফপ্যান্ট আর সাদা শার্ট পরিয়াছে। হৈমন্তী চুল আঁচড়াইয়া দিয়াছে পরিপাট করিয়া। যাইবার সময় অপুকে বলিয়া দিয়াছে–ওকে ভালো করে দেখেশুনে নিয়ে যাবে। যা দুষ্টু–
কাজল অনেকদিন বাদে কলিকাতা আসিল। আবার সেই বড়ো বড়ো বাড়ি, লোকজন, হৈ-চৈ, রাস্তায় গাড়ির ভেঁপু, ট্রামের ঘণ্টা। সব মিলিয়া জিনিসটা মন্দ লাগে না। বাবা তাহাকে বলিয়াছে বড়ো হইলে তাহাকে কলিকাতার কলেজে পড়াইবে। কলিকাতার বড়ো বড়ো কলেজের গল্প বাবা তাহার নিকট করিয়াছে, সেখানে লাইব্রেরিতে কত বই আছে–তাহা নাকি গণিয়া শেষ করা যায় না। ওই সমস্ত বই সে পড়িবে।
অপুর কাজ ছিল বিকালে। খুব সকালে রওনা হওয়ায় তাহারা বেশি বেলা হইবার আগেই কলিকাতা পৌঁছিয়াছিল। ট্রামে করিয়া অপু এসপ্ল্যানেড আসিয়া নামিয়া বলিল–এইটুকু চল হেঁটে যাই। কেমন দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে।
যাদুঘরে ঢুকিতেই কাজলের সেই অদ্ভুত ভাবটা হইল–যাহা সে কিছুতেই কাহাকেও বুঝাইয়া উঠিতে পারে না। মাথার মধ্যে কেমন একটা ঝিম-ঝিম ভাব। যাদুঘরের একটা নিজস্ব গন্ধ আছে, তাহা কাজলকে পুরানো দিনের কথা মনে করাইয়া দেয়। নিজের জীবনের কথা নহে, বাবার কাছে শোনা ইতিহাসের কথা-মানবসৃষ্টির আগেকার পৃথিবীর কথা। সমস্ত আবেদনটা সে ঠিক ধরিতে পারে না। কিন্তু তাহার মনে হয়, এই জীবনের বাহিরে আর একটা বৃহত্তর জীবন তাহাকে হাতছানি দিয়া ডাকিতেছে।
সারাদিন ভারি আনন্দে কাটিল। প্রাচীন স্তূপ হইতে গুহামানবের মাথার খুলি পর্যন্ত সবকিছুই কাজলের কাছে সমান আকর্ষণীয়। প্রাচীন জীবজন্তুর কঙ্কালগুলি যে ঘরে আছে, সে ঘর ছাড়িয়া কাজল আর নড়িতে চায় না। উল্কাপিণ্ডটার সামনে দাঁড়াইয়া উত্তেজনায় তাহার চোখ কোটর হইতে বাহির হইয়া পড়ে আর কী! ফসিলের ঘরে সে অপুকে জিজ্ঞাসা করে–তুমি যে বলেছিলে পলিমাটিতে তারামাছের ফসিল আছে, সে কই বাবা?
এ সমস্ত অত্যন্ত পক্কতার লক্ষণ সন্দেহ নাই–কিন্তু অপু কাজলকে এইভাবেই মানুষ করিয়াছিল। এই বয়সে অন্যরা যাদুঘরে গিয়া মুগ্ধ বিস্ময়ে চতুর্দিক একবার দেখিয়া আসে মাত্র। কক্ষ হইতে কক্ষান্তরে ঘুরিয়া পা ব্যথা করিয়া বেতের ঝুড়িতে আনা জলখাবার খাইয়া মা-বাবার সহিত বাড়ি ফিরিয়া যায়। কিন্তু কাজল বুঝিতে চায়, কাজল অনুভব করে।
বিকালে যাদুঘর বন্ধ হইবার সময় অপু বলিল–চল, এবার আমার কাজটা সেরে আসি। বইএর দোকানের দিকে যেতে হবে।
পাবলিশারের কাছে কিছু টাকা পাওনা ছিল। দোকানে ঢুকিতেই মালিক হাসিয়া বলিল–আসুন অপূর্ববাবু, বসুন। এবার তো অনেকদিন বাদে এলেন। আপনার ও বইটার স্টক প্রায় শেষ। নতুন এডিশন সম্বন্ধে একটু কথাবার্তা বলে নিতে হয়। এটি কে? বাঃ বেশ বেশ।
অপুর এসব আজ ভালো লাগিতেছিল না। সকালে খুব আনন্দ করিয়া বাহির হইয়াছিল বটে, কিন্তু দুপুরের পর হইতেই শরীরটা ভালো বোধ হইতেছিল না। বুকের কাছটায় কেমন একটা ব্যথাব্যথা ভাব। এখন আবার নতুন এডিশন সম্বন্ধে বাক্যালাপের ঝামেলা আসিয়া জুটিল।
সমস্ত কথা মিটিতে প্ৰায় ঘণ্টাখানেক সময় লাগিল। অপুর মাথা ঘুরিতেছিল। বুকের যন্ত্রণাটাও বেশ বাড়িয়াছে। কেন যে হঠাৎ এমন হইল, বোঝা যাইতেছে না। শরীর লইয়া পূর্বে সে কখনও চিন্তায় পড়ে নাই। দোকান হইতে বাহির হইয়া সে কাজলের হাত ধরিয়া রাস্তা পার হইবার জন্য ফুটপাথ হইতে পিচের রাস্তায় নামিতে গেল। সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীটা যেন তাহার পায়ের নিচু হইতে সরিয়া যাইতে লাগিল হু-হু করিয়া। সে যতই পা নামাইতেছে, পা আর রাস্তায় ঠেকিতেছে না। ফুটপাথ হইতে রাস্তা এত নিচু?
পরীক্ষণেই বুকের বেদনটা বাড়িয়া উঠিল। মাটিতে পড়িতে পড়িতে সে হাত বাড়াইয়া কাজলকে ধরিতে গেল। কাজল যেন অনেক দূরে সরিয়া গিয়াছে, তাহাকে আর ধরা যাইতেছে না। সব দূরে সরিয়া গিয়াছে। সে একটা অন্ধকার অতল গহ্বরের মধ্যে পড়িতেছে।
প্রকাশক ভদ্রলোক দোকান হইতে ছুটিয়া আসিলেন, রাস্তায় লোক জমা হইয়া গেল। কাজলের হাত-পা কেমন ঝিমঝিম করিতেছিল। ঘটনার আকস্মিকতায় সে হতবুদ্ধি হইয়া সাহায্যকারীদের মুখের দিকে কয়েকবার তাকাইয়া দেখিল মাত্র। বাবা পড়িয়া গিয়াছে। ব্যাপারটা তাহার বিশ্বাস হইতেছিল না। তাহার কাছে বাবা সর্বশক্তিমান, বাবার ক্ষমতা অপ্রতিরোধ্য। বাবাকে মাটিতে পড়িতে দেখিয়া কাজলের সমস্ত হৃদয় আতঙ্কে সংকুচিত হইয়া আসিল। অপুকে উহারা ধরাধরি করিয়া দোকানের ভিতর তুলিয়া আনিল। কাজলকে কেহ ডাকিল না। সে নিজেই আস্তে আস্তে হাঁটিয়া সবার পিছন পিছন দোকানে ঢুকিয়া দেখিল, তাহার বাবাকে একটা বেঞ্চির উপর শোওয়াইয়া জলের ছিটা দিয়া বাতাস করা হইতেছে। কাঠের একটা টেবিলে হেলান দিয়া সে ভাবিবার চেষ্টা করিল, বাবার কিছুই হয় নাই-ঘটনাটা একটা দুঃস্বপ্ন। স্বপ্ন ভাঙিয়া গিয়া এখনই দেখিবে সে বাবার পাশে শুইয়া আছে, গল্প শুনিতে শুনিতে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল।
মিনিট কুড়ি বাদে অপু তাকাইল। সে চিৎ হইয়া শুইয়া আছে, ওপরে যেন কালো কড়িকাঠ, চারপাশে লোকের কণ্ঠস্বর। বুকে কাহারা একটা ওজন চাপাইয়া দিয়াছে যেন। এটা কোন জায়গা? সে এখানে শুইয়া কেন? একটু বাদেই সমস্ত কিছু মনে পড়িতে সে আচ্ছন্নের মতো হাত বাড়াইয়া বলিল–খোকা কোথায় গেল? খোকা?
কলিকাতার সেদিনকার সেই ঘটনার পর হইতেই অপুর শরীর খুব ভালো যাইতেছে না। কলিকাতার ভালো স্পেশালিস্ট দেখাইয়াছে। ডাক্তার বলিয়াছে, ব্লাডপ্রেসার আছে, কিডনিও ভালো কাজ করিতেছে না। খাওয়ার ব্যাপারে নজর রাখিতে হইবে। লবণ কম খাইতে বলিয়াছে। অপু হাসিয়া বলিয়াছিল–এই বয়সে প্রেসার হয়? বলিয়াই তাহার মনে হইয়াছিল, খুব একটা কম বয়স তাহার নয়, দেখিতে দেখিতে বয়স বেশ বাড়িয়াছে।
ডাক্তার বলিলেন–সাধারণত এই বয়সে প্রেসার হয় না। আমার মনে হয়, কিডনির জন্যে এরকম হচ্ছে। কতকগুলো ওষুধ দিলাম, খেয়ে দেখুন কেমন থাকেন।
ওষুধ খাইয়া অপু বিশেষ উপকারবোধ করিল না। মাঝে মাঝে শরীর খারাপ লাগে, সে আমল দেয় না। হৈমন্তীর কড়া পাহারার জন্য নিয়মের হেরফের হইতে পারে না, খাওয়া শোওযা ইত্যাদি বাঁধা সময়ে করিতে হয়। অপুর স্বাস্থ্যের জন্য হৈমন্তী বড়ো উদ্বিগ্ন–সে কোথাও বাহির হইলে না ফেরা পর্যন্ত হৈমন্তী ঘর-বাহির করে। দেরি হইলে কাজলকে বলে-দেখা তো খোকা একটু এগিয়ে কাঁঠালতলার কাছে, তোর বাবা এলো নাকি–
অপু বেশিক্ষণ ঘরে থাকিতে পাবে না। তাহার ছেলেবেলা যেন আবার ফিরিয়া আসিয়াছে। বৈকালে রৌদ্র পড়িতে না পড়িতে ছেলেকে লইয়া বাহির হইয়া পড়ে। মাঠে ঘাটে ঘুরিতে ঘুরিতে সন্ধ্যা উতরাইয়া যায়। কোনদিন একই বেড়াইতে যায়। বিকালগুলি তাহার একান্ত নিজস্ব, ব্যক্তিগত। কোন কারণেই একটা বিকাল সে কাহাকেও দিয়া দিতে পারে না। অসুস্থ হইবার পর হইতেই অপুর কেমন একটা ভাব হইয়াছে। প্রায়ই সে বিষণ্ণ মুখে কী যেন ভাবে। প্রকাশকদের নিকট পাওনা টাকার আগে সে হিসাব রাখিত না, এখন বড় একটা খাতা বানাইয়াছে। তাহাতে টাকাকড়ির কথা লিখিয়া রাখে। নিশ্চিন্দিপুরে হৈমন্তীর নামে কিছু জমি কিনিয়াছে, নূতন উপন্যাসখানির টাকা দিয়া হৈমন্তীকে গহনা গড়াইয়া দিয়াছে। হৈমন্তী একদিন চটিয়া বলিল–এ সব শুরু করলে কী! নবাব-বাদশা হয়েছ নাকি? রাজ্যের জমি-জমা, গয়না-পত্তর–এসব তোমার কাছে আমি কবে চেয়েছিলাম?
–তুমি চাও নি হৈমন্তী, আমি দিচ্ছি।
হৈমন্তীর ঠোঁট কাঁপিয়া উঠিল–কেন দিচ্ছ? আমি এ সব চাই না।
–এ সবে তোমার প্রয়োজন নেই, আমি জানি। কিন্তু কাজলের তো ভবিষ্যৎ আছে। প্রথম জীবনটা যেন ওকে কষ্ট করতে না হয়। তারপর চাকরি-বাকরি করলে ওই তোমার ভার নেবে। অন্তত ততদিন–
হৈমন্তীর চোখে কিসের একটা ঝলক খেলিয়া গেল। সে অপুর কাছে সরিয়া আসিয়া বলিল–আমার ভার! শুধু আমার ভার। কেন, তুমি–তোমার ভার নেবে না? বলো?
অপু কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। তাহার পর আস্তে বলিল–হ্যাঁ, আমার ভরও নেবে বইকি। তাবপরই সে হাসিয়া ব্যাপারটা লঘু করিতে গেল বটে, কিন্তু নিজেই বুঝিল হাসিবার জনা তাহাকে চেষ্টা করিতে হইতেছে।
গম্ভীর হইয়া থাকে সে। মন তা বলিয়া খুব খারাপ নহে। কেমন একটা আনন্দে সে বুঁদ হইয়া অস্তিত্বকে উপভোগ করে। শত কোটি নক্ষত্র এবং নীহারিকার ভিতর নিজের অস্তিত্বকে উপলব্ধি করিবার তীব্র আনন্দ অন্য সমস্ত কিছু তুচ্ছ করিতে শিখাইয়াছে। মৃত্যুকে সে ভয় করে না। কারণ মৃত্যুর আগেই সে জানিতে পারিয়াছে জীবন কাহাকে বলে। জীবনকে যে জানিতে পারিয়াছে, মৃত্যুকে তাহার ভয় কী?
আকাশটা দুপুরে ধকধক করিয়া জুলে, বিকালের দিকে স্নিগ্ধ হইয়া আসে। সন্ধ্যায় বাতাসে দিনশেষের সুর বাজে। অন্ধকার ঘন হইলে অপু নদীর ধাবে ঘাসে ছাওয়া ঢালু জমিতে শুইয়া দেখে আকাশে তারা ফুটিয়া উঠিতেছে। তাহার ছোটবেলায্য যেমন উঠিত। এ সময়টা সে নৌকায় কবিঘা নদীর উপর বেড়াইত। ছোটবেলাটা কত দূরে চলিয়া গিয়াছে।
মনে কোন দুঃখ নাই, কেমন উদার আনন্দ। পাড়ের নিচে নদীর বহিয়া যাইবার সহজ ভঙ্গির মতো আনন্দ। নদীর ওপারে দিগন্তের উপর উল্কাপাত হইল। বুপালী আগুনের তীব্র শিখা সন্ধ্যা আকাশে একটা উজ্জ্বল সরলরেখা টানিয়া দিয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে অপুর মনে সুদূরের চিন্তা জাগিয়া উঠিল। উল্কাটি এক বিশাল বিশ্বের দূত–মহাজগতের সংবাদবাহক। তাহার মনটা হঠাৎ বড়ো হইয়া, ব্যাপ্ত হইয়া দেখিতে দেখিতে যেন সমস্ত আকাশে ছড়াইয়া গেল।
০৫. অপু ডাক্তার দেখাইতে গিয়াছিল
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
অপু ডাক্তার দেখাইতে গিয়াছিল। ডাক্তারবাবু চশমাটা নাকের উপর ঠিকভাবে আঁটিয়া লইয়া বলিলেন—আসল কথা এই, বাংলাদেশের হিউমিড আরহাওয়া আপনার স্যুট করছে না। আপনি কিছুদিন বাংলার বাইরে থেকে দেখুন তো, মনে হয় সুস্থ হবেন।
কথাটা অপুর মনে ধরিল। মধ্যপ্রদেশে সে যে কয়েক বৎসর কাটাইয়াছে, সে সময়। তাহার অসুখবিসুখ কিছু হয় নাই। প্রচণ্ড উল্লাসে হৈ হৈ করিয়া প্রায় একটা বন্য জীবন যাপন করিয়াছে। বিহারের দিকে কোথাও গিয়া থাকিলে মন্দ হয় না।
রাত্রে শুইয়া একদিন সে হৈমন্তীর সঙ্গে পবামর্শ করিল। হৈমন্তী কিছুটা অবাক হইয়া বলিল– নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে চলে যাবে? অন্য কোথাও ভালো লাগবে তোমার?
—একেবারে যাবো না হৈমন্তী। আমাদের গা ছেড়ে পৃথিবীতে কোথাও গিয়ে শাস্তি পাব না। এ বাড়িও রইল, ইচ্ছে হলেই চলে আসব।
আসল কথা, অপুর বক্তে ভবঘুরেমি আবার জাগিয়া উঠিতেছে! স্থবিরতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিতেছে। অসুখের জন্যই সে যাইতেছে, এ কথা সম্পূর্ণ সত্য নহে! এক সমস্ত জীবন কাটানো তাহার পক্ষে অসম্ভব। এ তাহার পূর্বপুরুষদেব নিকট হইতে প্রাপ্ত। তাহাদের ভবঘুরে রক্ত তাহাকেও স্থির থাকিতে দিতেছে না। সে যাইবে, আমৃত্যু সে পৃথিবীর ধূলিতে পা ডুবাইয়া হাঁটিবে।
সামান্য সময়ের ভিতরেই অপু কিছু টাকা জোগাড় করিয়া ফেলিল। সবাই তাহাকে আগাম টাকা দেয়, তাহার বই পাইবার জন্য হাঁটাহাঁটি করে। সকালে দুপুরে বিকালে প্রচু্র চিঠি আসে। পাঠকেরা মুগ্ধ হইয়া লিখিতেছে। অপু সবার চিঠির উত্তর দেয়, সামান্য এক লাইনে চিঠি দেয়। প্রত্যেককে দীর্ঘ চিঠি দেওয়া সম্ভব নহে।
জীবন কানায় কানায় পূর্ণ হইয়া উঠিতেছে। আর কী প্রত্যাশা করিবার আছে? টাকা পাইতেছে এবং নাম করিয়াছে এটাই বড়ো কথা নহে–সে দুই চোখ ভরিয়া প্ৰাণ ভরিয়া জগৎটা দেখিয়া লইয়াছে। আরও দেখিবে। থামিবে না। গাৰ্হস্থ্য তাহার কপালে লেখা নাই।
টাকা আনিতে পাবলিশারের কাছে গিয়া একদিন জিজ্ঞাসা করিল–আপনার সন্ধ্যানে কোন ভালো জায়গা আছে বিহারের দিকে? ভাবছি কিছুদিন ওদিকে থাকবো।–
প্রকাশক হাসিয়া বলিল–আপনার ঘোরা বাতিকটা আর গেল না। হ্যাঁ, জায়গার খোঁজ দিতে পারি। অল্প কয়েকদিন থাকবেন, না–
–ভাবছি। একটা ছোটমতো বাড়ি পেলে কিনে নিতাম।
অপুকে তিনি একটা জায়গার কথা বলিলেন, কলিকাতা হইতে খুব দূর নহে, জামসেদপুরের কাছাকাছি। হাওড়া হইতে ট্রেনে মাত্ৰ ঘণ্টা পাঁচেক লাগে। পাহাড়ি এলাকা-অপুর ভালো লাগিবে, তিনি বার বার বলিতে লাগিলেন।
–জঙ্গল আছে? প্রাকৃতিক দৃশ্য কেমন?
—খুব ভালো। সে আপনি নিজের চোখে দেখবেন। আপনাকে তো চিনি। ভালো না হলে আমি আপনার কাছে ও জায়গার নাম করি। কখনও!
অপু আরও দু’পাঁচজনকে জিজ্ঞাসা করিল। অনেকে বিশেষ কোন খবর দিতে পারিল না। কেবল দুইজন লোক, যাদের কথার অপু মূল্য দেয়, জায়গাটার সম্বন্ধে প্রশংসা করিল।
প্রকাশকই খোঁজ করিয়া একটা বাড়ি বাহির করিলেন এবং অপু বিশেষ দেরি না করিয়া বাড়িটা কিনিয়া ফেলিল। কিনিবার জন্য সে নিজে যায় নাই, বাড়ির ছবি দেখিয়াছিল মাত্র। টালির ছাদওয়ালা ছোট সুন্দর বাড়ি। পাশে দুইটা ইউক্যালিপটাস গাছ পাশাপাশি যমজ ভাইয়ের মতো উঠিয়াছে। বহু পিছনে একটা পাহাড় দেখা যায়। ছবিতে বেশ একটা রহস্যের ভাব ফুটিয়াছিল। বিশেষত পিছনের পাহাড়টা অপুকে আকর্ষণ করিল। ছবিটা প্রকাশককে ফেরত দিয়া সে বলিল–আমি আর দেখতে যাবো না। আপনার ওপর ভরসা করে কিনছি। আপনি লোক পাঠিয়ে দিন টাকা সঙ্গে দিয়ে। দলিলপত্রে আমি একেবারে গিয়ে সই কবব।
রাত্রে শুইয়া শুইয়া অপু বলিল–খোকা, তুই তো পাহাড় দেখিস নি? এবার দেখবি’খন। কাজল পাহাড় দেখে নাই। বাবার কাছে শুনিয়া সে মনে মনে জিনিসটা সম্বন্ধে একটা ধারণা করিবার চেষ্টা করে। চড়কতলার ডাইনে যে মাটির উঁচু ঢিবিটা আছে, অনেকটা সেইরূপ কি?
–সেখানে নদী নেই বাবা?
–আছে। কী নাম জনিস?
–কী বাবা?
–সুবর্ণরেখা। নামটা তাহার পছন্দ হয়। সুবর্ণরেখা। এক নিঃশ্বাসে বলিবার মতো নাম। সাঁই করিয়া একবার তলোয়ার ঘুরাইবার মতো। কত নূতন জিনিস সে দেখিবে–পাহাড়, শালবন, সুবৰ্ণরেখা। সুবর্ণরেখা মিষ্টি নাম, সুন্দর নাম।
সুবৰ্ণরেখা। সু-ব-র্ণ-রেখা–নামটা কাজলকে ঘুম পাড়াইয়া ফেলে।
কাজল ঘুমাইলে অপু বলিল–ঠিক বুঝতে পারছিনে হৈমন্তী, কাজটা ভালো হল বিকা। সবে এসে নিশ্চিন্দিপুরে বসতে না বসতেই আবার রওনা দেওয়া-অবশ্য ডাক্তার বলল যেতে, তবু—
হৈমন্তী একটু ভাবিয়া বলিল–না, চলো কিছুদিন থেকেই দেখি তোমার শরীরটা সারে কিনা। এই ভালো, এক জায়গায় না থেকে বেশ ঘুরে ঘুরে বেড়ানো। ও রকম শেকড় গেড়ে সংসায় করতে আমিও ভালোবাসিনে।
–আচ্ছা, তোমার পাহাড়ি দেশ ভালো লাগে, না আমাদের এই পাড়াগাঁ ভালো লাগে?
–দুই-ই। এক এক দেশের এক এক রকম সৌন্দৰ্য–
একটু চুপ করিয়া থাকিয়া অপু বলিল–তুমি তো সমুদ্র দেখনি, না?
–না। কী করে দেখবো বল? বরাবর তো বাবার সঙ্গেই ঘুরেছি, সমুদ্রের কাছাকাছি বাবা কখনও বদলি হননি।
–যাবে?
হৈমন্তী উৎসাহে বিছানায় উঠিয়া বসিল।
–সত্যি বলছো? কবে নিয়ে যাবে? চলো দু’এক দিনেব মধ্যেই যাই।
– কোথায় যাবে?
হৈমন্তী চিন্তা করিয়া বলিল–তুমি বলো।
-পুরী যাবে?
পুরী যাওয়াই ঠিক হইল। কাজলের কিছুদিন বাদেই পরীক্ষা। সে রানির কাছে থাকিবে। অপুরা কাজলের পরীক্ষার আগেই ফিরিবে। রানির কাছে থাকিতে কাজলের কোন অসুবিধা নাই। কাজল সঙ্গে যাইবে বলিয়া অবশ্য হাত-পা ছুঁড়িয়ছিল এবং অপু রাজিও হইয়াছিল। কিন্তু রানি আসিয়া বলিল–তোরা যাচ্ছিস যা। এ ছেলেটার সামনে পরীক্ষা। এটাকে আবার দলে টনছিস কেন? ও আমার কাছে থাকুক, দুবেলা পড়াতে বসাব এখন। তোরা একা যা
কাজল রানির কাছে থাকিয়া গেল। অবশ্য অপুকে বাববার প্রতিশ্রুতি দিতে হইল যে, পরীক্ষার পরেই কাজলকে লইয়া সে পুবী যাইবে।
অপু হাসিয়া হৈমন্তীকে বলিতেছিল–আমাকে কোথাও একদণ্ড তিষ্ঠোতে দিচ্চে না, বুঝলে? দুই জায়গায় তো সংসার পেতে ফেললাম, তাতেও দেখচি খালি ঘুরে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছা কবীচে। বেশিক্ষণ ঘরের মধ্যে থাকলে মন কেমন হ্যাঁপিয়ে ওঠে, জানো!
—তোমার তো ওইরকমই। খালি বেড়ানো, খালি ঘুরে বেড়ানো! এখন তোমার যাযাবববৃত্তি একটু বন্ধ ব্যাখতে হবে, নইলে ছেলেটার পড়াশুনো আব্ব কিছু হবে ভেবেছ?
–হবে হবে। সে কি আমি ভাবিনি মনে করচো? কাজল এতে ভালো কবে মানুষ হয়ে উঠেচে। পড়াশুনায় ওর ঝোঁক বড়ো বেশি, সব সময় বই মুখে করে বসে আছে। নতুন বাড়িতে গিয়েই ওকে আবার সেখানকার ইস্কুলে ভর্তি করে দেব।
হৈমন্তী বলিল–আচ্ছা, সমুদ্রে স্নান করা যাবে তো? নাকি ভাসিয়ে নিয়ে যাবে ঢেউয়েব টানে?
–তা কেন, কত লোক স্নান কবচে দেখবে। সবাইকে কি জলে ভাসিযে নিয়ে যাচ্ছে? তা ছাড়া নুলিয়া আছে–
–নুলিয়ারা কখনও ডোবে না, না?
অপু হাসিয়া বলিল–তুমি বড়ো ছেলেমানুষ হৈমন্তী। একেবারে বাচ্চাদের মতো প্রশ্ন করছে। এই জন্যেই তোমাকে এত ভালো লাগে।
–আর তুমি খুব বুড়ো হয়ে গেছ, না?
-হয়েছিই তো।
–উঃ, একেবারে তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে–
কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া অপু বলিল–কাপড়চোপড় গুছিয়ে নাও। শীগগিরই রওনা দেবো।
অপু আর হৈমন্তী পুরী যাইবার দিন চারেক পর নিশ্চিন্দিপুরে একদিন বৃষ্টি নামিল। রাস্তার ধূলা নিমেষের মধ্যে কাদায় রূপান্তরিত হইয়া গেল। গ্রামের ভিতরের সমস্ত রাস্তা কাদায় ভর্তি, বালকের দল সেখানে আছাড় খাইতে লাগিল। বড়ো বড়ো আম কাঁঠাল গাছ হইতে টুপটাপ করিয়া অবিশ্রান্ত জল পড়িতেছে নিচের কচুবনের উপর। বৃষ্টি এক-একবার ধরিয়া আসে, কিন্তু উঁচু গাছ হইতে জল পড়া থামে না।
মেঘাচ্ছন্ন দিনে কাজলের বড়ো মন কেমন করে। কেন করে, তা সে বোঝে না। ঘন মেঘে। আকাশ কালো, গুম গুম করিয়া মেঘ ডাকিতেছে, ঝপ ঝুপ করিয়া অবিরাম বৃষ্টির শব্দ। কেমন একটা মনখারাপ-করা চাপা আলো চারিদিকে– এই আলোটা কাজলকে উদাস করিয়া দেয়।
রানুপিসির উত্তরের জানালায় বসিয়া সে দেখে, বাহিরের অন্ধকার ক্রমশ ঘন হইতেছে, দুপুরটা সন্ধ্যাবেলার মতো দেখাইতেছে। রানি বৃষ্টিতে তাহাকে বাহির হইতে দেয় নাই। জানালায় বসিয়া সে দেখিল, চণু একটা পুঁটিমাছধরা ছিপ আর একটা চটের থলে হাতে কোথায় যাইতেছে।
কাজল তাহাকে ডাকিয়া বলিল–কোথায় যাচ্ছিস রে?
–মাছ ধরতে।
— কোথায়? নদীতে?
—দূর! নদীর পথে বেজায় কাদা। বামুনপুকুরে যাবো। যাবি?
কাজল মাথা নাড়িল।
— যাবি না?
–না।
— কেন রে, জ্বর হযেছে?
–না।
–তবে?
—ইচ্ছে করছে না যেতে। তুই ধরগে যা মাছ।
ইচ্ছা খুবই করিতেছে। কিন্তু পিসি ঘরে বন্দী করিয়া রাখিয়াছে—এ কথা বলিলে চনুর কাছে দর কমিয়া যায়। চনুব মা-বাবা কেমন ছাড়িয়া দিয়াছে, তাহার বেলা সবার যত কড়াকড়ি।
একটু পরে রানি ঘরে ঢুকিলে সে বলিল–চানু কেমন মাছ ধরতে গেল এই একটু আগে! ওকে তো বেশ ছেড়ে দিয়েছে, আমাকে তুমি একটু বেরুতে দাও না কোথাও–
–দিই না তো বেশ করি। ও সব হাভাতে ছোঁড়ারা তো ঘুরবেই–
অনুমতি মিলিল না। অতঃপর জানালায় বসিয়া শিকে গাল রাখিয়া নির্মিমেষ দৃষ্টিতে বাহিরে তাকাইয়া থাকা ছাড়া উপায় নাই।
বাহিরে জল জমিয়াছে। একটা চড়ুই পাখি হঠাৎ কোথা হইতে উড়িয়া আসিয়া রাস্তার ধারের জমা জলে স্নান করিতে লাগিল। মাথা ড়ুবাইয়া জল তুলিয়া গায়ে দেয়, কখনও সমস্ত শরীরটা ড়ুবাইয়া দেয় জলে। বৃষ্টি হওয়ায় মহাস্মৃতি–এদিকে ওদিকে অনেক পাখি ঝোপঝাড়ে কিচমিচ করিতেছে। ভয়ানক গরম পড়িয়াছিল, তাহা হইতে মুক্তি পাইয়া সবাই খুশি! একটা শেয়াল সামনের বাগানটা পার হইয়া গিয়া একবারে রানুপিসিদের উঠানে আসিয়া পড়িল। কাজল দিনের বেলা এত কাছ হইতে কখনও শেযাল দেখে নাই, উৎসাহে সে উঠিয়া দাঁড়াইল। শেয়াল বড়ো চালাক, দিনমানে মনুষ্যবসতির নিকটে ঘোরাফেরা করিতে বড়ো দেখা যায় না। কাজলের চোখ বিস্ময়ে কোটার হইতে বাহির হইয়া আসিতেছিল। শেয়ালটা মিনিটখানেক স্থাণুবৎ দাঁড়াইয়া হঠাৎ তীরবেগে পাশের কচুবনে ঢুকিয়া পড়িল।
বিকালের দিকে কাজলের মনটা খারাপ লাগিতেছিল। বাবা বাড়ি নাই। এ সময়টা সে সাধারণত বাবার সঙ্গে কাটায়। পড়ন্ত বেলার চাপা আলো তাহার মনে বেদনার একটা সুর ছড়াইয়া দিল। শুধুই কি বাবার জন্য মন খারাপ? কাজল অবাক হইয়া আবিষ্কার করিল, মায়ের জন্যও তাহার মন কেমন করিতেছে। কদিনই বা হইল মা তাহাদের দুইজনের সংসারে আসিয়াছে—তাহার জন্য মন খারাপ হয় তবুও।
জানালা দিয়া বাহিরে তাকাইয়া ভেজা গাছপালা দেখিতে দেখিতে কাজলের মনে হইল, মাকে সে সত্যই খুব ভালোবাসিয়া ফেলিয়াছে।
পুরী হৈমন্তীর ভালো লাগিতেছিল। জীবনের প্রথম সমুদ্রদর্শনে তাহার মন অকস্মাৎ আকাশের মতো খোলামেলা হইয়া গেল।
সারাদিন বেশ গরম থাকে। বিকালে দুইজনে সমুদ্রের ধারে যায়। পায়ে পায়ে হাঁটিয়া হঠাৎ আবিষ্কার করে শহর অনেকটা পেছনে ফেলিয়া আসিয়াছে। বাঁ-পাশে উঁচু বালির ডিাঙা, এদিকে বিস্তৃত একখানি নীল আয়নার মতো সমুদ্র। প্রথম দিন রেল স্টেশন হইতে আসিবাব সময় পথের বাঁক ফিরিয়াই হঠাৎ সামনে সমুদ্র দেখিয়া হৈমন্তী অবাক হইয়া গিয়াছিল। সমুদ্র সম্বন্ধে তাহার মনে যে ধারণাটা ছিল সেটাকে চুরমার করিয়া আসল সমুদ্র চোখের সামনে একটা অগাধ বিস্তুতি খুলিয়া দিল।
সেদিন তাহারা বেড়াইতে বেড়াইতে অনেক দূর গিয়াছিল। অপু বলিল–কেমন লাগছে?
–ভালো।
–শুধু ভালো? আর কিছু না?
—বিরাট ভালোর বর্ণনা কী করে দিই বলে তো? মোটামুটি ভালো লাগলে বেশ বড়ো করে বলা যায়। খুব বেশি ভালো লাগলে তখন আর প্রগল্ভ হওয়া যায় না।
অপু বলিল–ভালো করে অনুভব করে দেখো, সমুদ্রের সঙ্গে মানুষেব জীবণের একটা আশ্চর্য সাদৃশ্য পাবে। জীবনও সমুদ্রের মতো বড়। জীবনেও সমুদ্রের মতো ঝড় ওঠে। সমুদ্র যেমন সৃষ্টির আদি থেকে অবিশ্রাম তীরে এসে আঘাত করছে, বাধা পেয়ে আবার ফিরে যাচ্ছে– আবার নতুন করে আসছে, তেমনি জীবনও একটা লোহার পর্দায় বাব বার আঘাত করছে যেন। কিছুতেই ভাঙতে পারছে না। কী একটা যেন জানবার কথা আছে–কিছুতেই জানা যাচ্ছে না–
অপু থামিতেই হৈমন্তীর কানে সমুদ্রের শো শো শব্দটা খুব স্পষ্ট হইয়া উঠিল।
সন্ধ্যা নামিয়াছে। দিগন্ত পর্যন্ত অন্ধকার।–কেবল এখানে ওখানে সাদা ফেনা অন্ধকারেও দেখা যাইতেছে।
হৈমন্তী চুপি চুপি প্রশ্ন করিল–কী জানবার আছে মানুষের?
অপু ঘাড় ফিরাইয়া চোখ তীক্ষ্ণ করিয়া দূরে তাকাইয়া ছিল। অনেকক্ষণ বাদে ধীরে ধীরে বলিল–প্রশ্নটা জানা আছে, উত্তরটা কেউ জানি না।
ফিরিবার সময় হৈমন্তীর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে লইয়া অপু বলিল– কেন চিন্তা করতে শিখলাম বল তো? জীবনটা তো এমনিতেই বেশ কাটিয়ে দেওয়া যেতো।
পরের দিন সকালে অপু বলিল–সব ঠিক করে ফেললাম। চল, কাল কোনারক থেকে ঘুরে আসি। পুরী এসে কোনারক না দেখে ফেরা যায় না।
হৈমন্তীর আপত্তির কোন কারণ ছিল না। আরও একটি পরিবাব কোনারক দেখিতে যাইতেছে-অপুও তাঁহাদের সহিত যাইবে ঠিক করিয়াছে, কথাবার্তা সব ঠিক।
সারাদিন একটু একটু করিয়া কোনারকের ইতিহাসটা হৈমন্তী অপুর নিকট হইতে শুনিয়া লইল। ইতিহাস জানিবার পর কোনারক দেখিবার ইচ্ছা আরও বাড়িল। পরদিন সূর্যমন্দিরের চূড়াটা উঁচু গাছের পাতার ফাঁক দিয়া একটু একটু করিয়া স্পষ্ট হইয়া উঠিতেই আনন্দে হৈমন্তীর গলার কাছে কী একটা পাকাইয়া উঠিল।
বিরাট মন্দির। প্রশস্ত উঠানের অপর প্রান্তে বিশাল প্রধান দ্বার। মন্দিরের ভিত্তিতে রথচক্রের অনুকরণে বড়ো বড়ো পাথরের চক্ৰ খোদাই করা। হু হু করিয়া বাতাস বহিতেছে। মন্দিরের ওপাশের উঁচু গাছে হাওয়া লাগিয়া একটা মাতামাতি কাণ্ড হইতেছে। চারিদিক একেবারে স্তব্ধ। এত স্তব্ধ যে, হৈমন্তী নিজের শান্তিপুরী শাড়ির খস-খাস শব্দ শুনিতে পাইতেছে স্পষ্ট।
সহযাত্রী পরিবারটি খাওয়ার ব্যবস্থায় লাগিল। তাহারা সঙ্গে লুচি-তরকারি ও মিষ্টি আনিয়াছে। শতরঞ্চি বিছাইয়া সেগুলিকে পাত্র হইতে বাহির করিয়া পাতায় সাজাইতে আরম্ভ করিল। কর্তাটি অপুকে ডাকিয়া বলিলেন-অপূর্ববাবু, খাবেন তো এখন? আমার মশাই, সত্যি বলতে কি, ভীষণ খিদে পেয়েছে–
—আপনারা শুরু করুন, আমরা একটু ঘুরে আসি। আমাদেরটা রেখে দিন ববং।
অপু হৈমন্তীকে লইয়া মন্দিরটা ঘুরিয়া দেখিতে লাগিল। বিরাট প্রাঙ্গণের মধ্যে ধূসর পাথরের মন্দিরটা কেমন উদাস ভাবে দাঁড়াইয়া আছে। মাটি হইতে ক্ৰমশ চুড়ার দিকে উঠিবার কয়েকটি সংকীর্ণ পথ আছে। তাহারই একটা দিয়া অপু, হৈমন্তীকে লইয়া উঠিতেছিল। একদিকে মন্দিরের পাথর–অপবদিকে অনেক নিচে মাটি। হঠাৎ তাকাইলে মাথা ঘোরে। হৈমন্তী অপুকে ধরিয়া উঠিতেছিল।
অপু বলিল–ভালো করে ধরে থেকে। হাওয়া দিচ্ছে বেশ, বেসামাল হলে ঝুপ করে পড়ে যাবে।
অদ্ভুত! অদ্ভুত! শতাব্দীর ইতিহাসবাহী মৌন প্রান্তর, দূরে গাছের সারি, সুন্দর বাতাস। আকাশের রঙ তাহদেরই মনোলোকের স্বপ্নের মতো নীল। ধীরে ধীরে হৈমন্তীর মনের ভিতর কেমন একটা ঘুম ঘুম ভাব ছড়াইয়া পড়িতেছিল। বহু-তারবিশিষ্ট যন্ত্রের ঝিমঝিম বাজনার মতো আবেশ।
কিন্তু এত সব ভালো লাগিবার মধ্যে একটা কী চিন্তা যেন হৈমন্তীকে খোঁচা দিতেছে। অনেক আনন্দের মধ্যে একটু কী অতৃপ্তির আভাস। কযেকদিন হইতেই হৈমন্তী নিজের অতৃপ্তির কারণ অনুসন্ধান করিতে করিতে আজ এই সূর্যমন্দিরের ভগ্নসোপানে দাঁড়াইয়া উত্তরটা পাইল। সে অনুচ্চকণ্ঠে বলিল—শুনিছো?
-এবার চলো বাড়ি ফিরে যাই।
-সে কী? এই তো সবে এলে। ভালো কবে সব দেখাও তো হল না। তোমার জন্যেই তো আসা।
–তা হোক। আর ভালো লাগছে না।
–কেন?
একটু স্তব্ধ থাকিয়া হৈমন্তী বলিল–খোকাকে ছেড়ে থাকতে পারছি নে।
ফেরা হইল।
কাজলের ষান্মাসিক পরীক্ষা শেষ হইয়া গিয়াছে। অপু ঠিক করিয়াছে এখন বিহারের নতুন বাড়িতে যাইবে না, কাজলের বাৎসরিক পরীক্ষা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করিবে। নতুন জায়গায় একেবারে নতুন শ্রেণীতে ছেলেকে ভর্তি করিলে। এখন গেলে কাজলের একটা বৎসর নষ্ট হয়।
পরীক্ষার পর কাজল বেশ মজায় আছে। পড়ার চাপ কমিয়াছে। সারাদিন সে ঘুরিয়া কাটাইতেছে। বনজঙ্গল ভাঙিয়া মাঝে মাঝে চলিয়া যায় পাশের গ্রামে।
একদিন কাজল বেড়াইতে বেড়াইতে একটা বাড়ির উঠানে গিয়া হাজির হইল। বেশি সুন্দর ঝকঝকে বাড়ি, উঠানে ধানের গোলা, সিঁদুর দিয়া তাহাতে মঙ্গলচিহ্ন আঁকা। কয়েকটা ছেলে ছোটাছুটি করিতেছে। গোয়ালের একটা গরু বাছুরের গা চাটিতেছে। উঠানে ক্ৰীড়ারত চারটি কুকুরছনা। সে মুগ্ধ নয়নে হৃষ্টপুষ্ট বাচ্চাগুলির খেলা দেখিতেছিল। এমন সময় একটি ছেলে আসিয়া তাহার সামনে দাঁড়াইল।
-কী দেখছ?
তাই সে আমতা আমতা করিয়া বলিল–না, এই–মানে–ওই বাচ্চাগুলো বেশ সুন্দর কিনা, তাই–
–তুমি নেবে একটা?
অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্যের সম্মুখীন হইয়া কাজল প্রথমটা কিছু বলিতে পারিল না। পরে বলিল–একেবারে দিয়ে দেবে? তোমার বাড়ির লোক কিছু বলবে না?
—দুর! আরও তো তিনটে রইল।–তুমি একটা নাও।
প্রথমে কাজল ধরিতে ভয় পাইতেছিল। পরে গায়ে হাত বুলাইয়া বুলি তাহারা নিতান্তই নিরীহ।
একটা বাচ্চা বগলদাবা করিয়া দ্রুত সে স্থানত্যাগ করিল। প্রতি মুহূর্তে ভয় হইতেছিল, পেছন হইতে ছেলেটি ডাকিয়া বলিবে–না ভাই, বাচ্চা দেবো না। তুমি রেখে যাও।
দ্রুত বড়ো মাঠটা পার হইয়া কাজল নিশ্চিন্দিপুরে ঢুকিল।
হৈমন্তী রাগ করিয়া বলিল–এঃ, এটা আবার কোত্থেকে জুটিয়ে আনলি, নেড়ির বাচ্চা—
হাত-পা নাড়িয়া কাজল দুর্বল জীবটির পক্ষে অনেক ওকালতি করিল। অবশেষে অনুমতি মিলিল। এবারে বাচ্চাকে তো কিছু খাওয়ানো প্রয়োজন। কুকুরের বাচ্চা কী খায়, এ সম্বন্ধে ধারণা না থাকায় হৈমন্তীর কাছে আবার গিয়া দাঁড়াইতে হইল।
–মা।
–কী রে?
–ওটাকে কী খেতে দিই এখন?
রাগ করিতে গিয়া হৈমন্তী হাসিয়া ফেলিল। ছেলেকে কাছে টানিষা লইয়া বলিল–বড্ড বাচ্চা যে, দুধ ছাড়া কি অন্য কিছু খেতে পারবে? বরং রান্নাঘরের কড়া থেকে খানিকটা দুধ নারকোলের মালায় নিয়ে খাওয়াগে।
খাদ্যের প্রতি বাচ্চাটার একটা দার্শনিকসুলভ নিস্পৃহতা দেখা গেল। কাজল জোর করিয়া দুধের মধ্যে মুখ ড়ুবাইয়া দিলে নাকের মধ্যে দুধ ঢুকিয়া হ্যাঁচিয়া সে অস্থির হইল। এক মালা দুধ খাওয়াইতে বেলা গড়াইয়া অন্ধকার নামিল।
দুই-তিনদিনের মধ্যে কুকুরছানা নূতন জায়গায় অভ্যস্ত হইয়া আসিল! কাজল বাবাকে বলিয়াছে, কলিকাতা হইতে কুকুরের গলার চেন আনিয়া দিতে। চেন গলায় দিয়া সকাল বিকাল কাজল তাহাকে লইয়া গ্রাম পরিক্ৰমা করিবে। ওয়াইড ওয়ার্লড ম্যাগাজিনে কুকুরের বীরত্ব সম্বন্ধে ভালো ভালো গল্প ছাপা হয়–বাবার কাছে কাজল তেমন অনেক গল্প শুনিয়াছে। সেও ইহাকে সুশিক্ষিত করিয়া বীরত্বপূর্ণ অভিযানের সঙ্গী করবে।
কুকুরের নাম রাখা হইল–কালু। সাতদিনের মধ্যেই কালু কাজলের পরম ভক্ত হইয়া উঠিল। কাজল নিজে আসিয়া খাইতে না দিলে খায় না, সর্বদা কাজলের পেছনে পেছনে ঘোরে। বেশ ভালো চলিতেছিল, কিন্তু মাসখানেক বাদে হঠাৎ কালুর কী অসুখ করিল। সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঝিমায়, খাওয়াদাওয়া একদম ছাড়িয়া দিয়াছে। প্রথমে কাজল আমল দেয় নাই, পরে দেখিল কালুর উঠিবার ক্ষমতা লুপ্ত হইয়াছে। তিনদিন আগেও লাফালাফি করিয়া বেড়াইয়াছে, ইদানীং সৰ্বক্ষণ শুইয়া থাকে। কাজলের সাড়া পাইলে অতিকষ্টে একবার মাথা তুলিয়া তাকায়। অশক্ত ঘাড়ের উপর মাথাটা কাঁপে, কিছুক্ষণ বাদে আবার চটের উপর পড়িয়া যায়।
অপু দেখিয়া বলিল–আহা রে! কালু বোধ হয় আর বাঁচিবে না।
গোঙানি। কালু মারা যাইতেছে, কালু ভীষণ কষ্ট পাইতেছে, অথচ কাজলের কিছুই করিবার নাই। চাপা গোঙানির শব্দ তাহাকে কিছুতেই ঘুমাইতে দিল না। রাত্রে মায়ের বুকের কাছে শুইয়া তাহার মনে হইল তাহার অসুখ করিলে মা-বাবা ব্যস্ত হইয়া সেবা করে, আর বেচারা কালু অন্ধকারের ভিতর একা একা কষ্ট পাইয়া মরিতেছে।
কাজল ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল।
হৈমন্তী তাহাকে কাছে টানিয়া বলিল–কাঁদতে নেই মানিক আমার। ছিঃ—
আদরের কথা শুনিয়া কান্নাটা আরও বাড়িল। অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে কাজল বলিল–কালু কত কষ্ট পাচ্ছে, অন্ধকারের মধ্যে রয়েছে–
হৈমন্তী তাহার মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিল–একা কোথায় পাগলা! ওর কাছে ঠিক ভগবান এসে বসে আছেন, জানিস! যারা কষ্ট পেয়ে মারা যায়, তাদের আত্মাকে ভগবান নিজের হাতে স্বৰ্গে নিয়ে যান। ঠিক ওর পাশে ভগবান এসে বসেছেন
কাজলের দুঃখের বেগটা একটু কমিয়া আসিল। এভাবে সে কখনও ভাবিয়া দেখে নাই। একথা যদি সত্য হয়, তবে দুঃখের কিছুই নাই। ভগবান যদি আসিয়া থাকেন—তবে ভালোই তো। কাজল স্পষ্ট দেখিল, কালুর পাশে এক জ্যোতির্ময়দেহ বিশাল পুরুষ–উন্নতললাট, দীপ্তনয়ন। তাঁহার হাতে পৃথিবীর শাসনের স্বর্ণদণ্ড। তিনি আসিয়াছেন ক্লিষ্ট আত্মাকে স্বহস্তে স্বৰ্গে লইয়া যাইবার জন্য।
০৬. সুবৰ্ণরেখা
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
সুবৰ্ণরেখা।
বালির চর বুকে করিয়া নদীটিা সারাদিন পড়িয়া থাকে। স্বল্প জল এখানে ওখানে বালির মধ্য দিয়া বহিয়া যায়। নদীর মাঝখানে বড়ো বড়ো কালো পাথরের চাই প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর মতো পড়িয়া আছে। উপরের প্রখর নীল আকাশ ধূসর দিগন্তের সহিত একটা অদ্ভুত বৈষম্য সৃষ্টি করিয়াছে। মাটির রঙ লাল। জমি সর্বত্র উঁচুনিচু। স্থানটিতে কেমন একটা বৈবাগ্যের ভাব আছে, মাটিব গৈরিক রঙটির মতো।
মৌপাহাড়িতে লোকজন কম। দিনের বেলায় মনে হয় কিসের উপলক্ষে যেন ছুটি হইয়া গিয়াছে–সবাই ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। সন্ধ্যার সময় একটা কালো চাদর ক্রমশ সবকিছু ঢাকিয়া ফেলে। ঝিঁঝি এবং অন্যান্য পতঙ্গের ডাকের মধ্যে দিয়া রাত্রি মৌপাহাড়িকে গ্ৰাস করিয়া লয়। অপু ইহার ভিতরে কী একটা যেন খুঁজিয়া পাইয়াছে। মানুষের সঙ্গ–কেবল কাজল এবং হৈমন্তী ছাড়া–তাহার কাছে আর কাম্য নহে। বইখাতা বগলে দিনের প্রায় সময়টাই সে বাহিরে ঘুরিয়া কাটায়।
নদীর ধারে একখানি বড়ো পাথরের উপর বসিয়া সে লেখে। জীবনকে সে অলসভাবে একদিক হইতে দেখে নাই। তাহার দেখা বিচিত্র জীবনের কথা সে আগামী যুগের জন্য রাখিয়া যাইবে। লিখিতে লিখিতে কখনও মুখ তুলিয়া দেখে সামনে সুবর্ণরেখার বিস্তৃত বক্ষ, ওপারে প্রান্তরের গৈরিক প্রসার। পড়ন্ত সূর্যালোকে নদীর বালির মধ্যে মিশ্ৰিত অভ্রকণা চিক্ চিক করিতেছে। আকাশে বাতাসে কীসের একটা অস্পষ্ট ইঙ্গিত অপুকে বিচলিত করে। কী একটা এখনই করিতে হইবে, কী একটা করিবার আছে–কিন্তু কিছুতেই করা হইতেছে না। শরীরের মধ্যে একটা বিচলিত ভাব বাড়িয়া ওঠে। মনে হয়, সবটাই বাকি রহিল, নির্দিষ্ট কাজের ভগ্নাংশও করা হইল না। যাহা জানিবার ছিল, তাহার কণামাত্রের আস্বাদন হইল মাত্র।
শরীর লইয়া অপু খুবই বিব্রত। নিশ্চিন্দিপুর ছাড়িয়া আসার পর মৌপাহাড়িতে তিন-চার বৎসর কাটিল, কিন্তু স্বাস্থ্যের খুব একটা উন্নতি হয় নাই। প্রায়ই বুকে একটা যন্ত্রণা হয়। মাথা ভার ঠেকে, অম্বল হয়। এসব কথা সে কাহাকেও বলে না। অসুখ গা সওয়া হইয়া গিয়াছে। সন্ধ্যা ঘনাইলে লেখা বন্ধ করিয়া নক্ষত্রের আলোয় বাড়ি ফিরিতে ফিরিতে হঠাৎ ছোট টিলেটার গা ঘেঁষিয়া বিশাল বৃহস্পতি গ্রহটাকে উঠিতে দেখিয়া তাহার অসুখের কথা বিস্মরণ হইয়া যায়। সেতারের জলদের মতো জীবনটা কাহার হাতের স্পর্শে যেন বাজিতেছে। কীসের স্পর্শে যেন জীবনের রঙ বদলাইতেছে, সুরের পরিবর্তন ঘটিতেছে।
সুবৰ্ণরেখার ধারে বসিয়া অপু নদীর সঙ্গে নিজের মিল খুঁজিয়া পায়। একা থাকিলেও মনে হয় না সে একা আছে। কাহার উপস্থিতি যেন রহিয়াছে আশেপাশে, অনুভব করা যায় কেহ পেছনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, সে চোখ ফিরাইলে সরিয়া যায় দূরে।
একদিন একটা কাণ্ড ঘটিল। অপু বসিয়া লিখিতেছে, একটা প্ৰজাপতি আসিয়া বসিল তাহার খাতার পাতায়। সে হাত বাড়াইয়া ধরিতে গেলে সেটা উড়িয়া একটু দূরে একটা পুটুস গাছের উপর বসিল। অপুর কেমন মনে হইল, সুন্দর প্রজাপতিটাকে ধরিতেই হইবে। এক টুকরা পাথর খাতার উপর চাপা দিয়া সে উঠিল।
প্রজাপতিটা ধরা গেল না। গাঢ় লাল আল বাদামী ডানাওয়ালা পতঙ্গটা তাহাকে দূর হইতে দূরে লইয়া গেল। এক ঝোপ হইতে অন্য ঝোপ করিতে করিতে অপু আচ্ছন্নের মতো দৌড়াইল। বাতাস অপুর চুল অবিন্যস্ত করিয়া দিল, তাহার ধুতিতে চোরাকাঁটা লাগিয়া গেল। পাথরে লাগিয়া পায়ের এক জায়গা কাটিয়াও গেল, কিন্তু প্ৰজাপতির নাগাল পাওয়া গেল না।
মাইলখানেক দৌড়াদৌড়ি করিয়া অপু নিজের বসিবাব জায়গায় ফিরিয়া আসিল। পাথরের উপর রাখা খাতার পাতা বাতাসে অল্প অল্প উড়িতেছে, চাপা আছে বলিয়া একেবারে উড়িয়া যায় নাই।
অপু পাথরটার এক কোণে বসিয়া শূন্যদৃষ্টিতে সুবৰ্ণরেখার দিকে তাকাইয়া রহিল।
বয়স বাড়িবাব সঙ্গে সঙ্গে কাজলের দুষ্টামি কমিয়াছে। আগের মতো লাফালাফি করিতে আর ভালোবাসে না। মৌপাহাড়িতে তাহার সমবয়সী কম। সমবয়সীদের সঙ্গে কখনই তাহার বন্ধুত্ব গড়িয়া ওঠে নাই। বয়সে যাহারা অনেক বড়, তাহদের সঙ্গেই বরং কাজলের জমে ভালো।
একদিন কয়েকটা ছেলে মিলিয়া মাইলতিনেক দূরের একটা পাহাড়ে বেড়াইতে গিয়াছিল। কাজলের মনে হইয়াছিল ছেলেগুলি এক একটি আস্ত বর্বব। ঢিল কুড়াইয়া ভীষণ জোরে ছুঁড়িতেছে, লাফাইতেছে, চিৎকার করিতেছে, নিজেদের মধ্যে তুচ্ছ কারণে মারামারি করিতেছে। অথচ চারিপাশে কেমন সুন্দর পাহাড়ি পরিবেশ। নির্জন স্থানে স্তব্ধতা খা খাঁ করিতেছে। মাঝে মাঝে বাসায় ফেরা কী এক ধরনের পাখি মাথার উপর দিয়া মধুর সুরে ডাকিয়া যাইতেছে। সব মিলাইয়া বেশ ঘনিষ্ঠ আনন্দময় পরিবেশ। ছেলেরা এসব মোটেই বুঝিতেছে না। কাজল ক্রমশ বিরক্ত হইয়া উঠিল। বড়ো গোলমাল করে ইহারা। তাহার মনের সঙ্গে ইহাদের কোন যোগাযোগ নাই। থামাইবার জন্য সে কিছুদিন আগে পড়া একটা গল্প শুরু করিল, কিন্তু সে গল্পে কেহ উৎসাহ পাইল না।
ধীরে ধীরে অল্প বয়সেই কাজলের ভিতর একটা বোধ জাগিয়া উঠিতেছিল, তাহার সহিত অন্যের মনের মিল হয় না–হইবে না।
সে একা থাকে। অপু প্রচুর বই আনি যা দিয়াছে। অনেক বিদেশী সাহিত্যের অনুবাদ সে পড়িয়া শেষ করিয়াছে। অপু তাহাকে নিজে ইংরাজি শিখাইতেছে, যাহাতে কাজল শীঘ্রই বিশ্বসাহিত্যে প্ৰবেশলাভ করিতে পারে, কাজলও অসাধারণ দক্ষতা দেখাইয়া ইংরাজি ভাষা শিক্ষায় অনেক দূর অগ্রসর হইয়াছে। সন্ধ্যায় দুই ঘণ্টা তাহাকে বাবার কাছে বসিয়া পড়িতে হয়।
চোখের সামনে তাহার এ কী জগতের দ্বার খুলিয়া যাইতেছে! এ কী আনন্দ আর আলোর জগৎ। পৃথিবীর সাধারণ অকিঞ্চিৎকর বস্তুও এ আলোর স্পর্শে অসাধারণ হইয়া উঠিতেছে। এমনভাবে যাহারা তাহাকে পৃথিবীটা দেখিতে শিখাইয়াছে, তাহাদের কাছে সে কৃতজ্ঞ থাকিবে।
ফরাসী ছোটগল্পের অনুবাদ পড়িয়া প্রথম তাহার চোখ ফুটিয়াছিল। রোজাকার জীবনে দেখা সামান্য ঘটনা লেখকদের হাতে এক গভীর তাৎপর্য লাভ করিয়াছে। এক জায়গায় একটি বৃষ্টির বর্ণনা এবং অপর জায়গায় একটি জ্যোৎস্নারাত্রির বর্ণনা তাহাকে পাগল করিয়া দিয়াছিল। এখনও বর্ষার দিনে এবং জ্যোৎস্নারাত্ৰিতে গল্প দুটিকে সে মনে করিয়া থাকে।
একটু বয়স হওয়ায় সে বাবাকে চিনিতে পারিতেছে। বাবার কেমন একটা আলাদা অস্তিত্ব আছে, সে বুঝিতে পারে। সেটা বাবার সাংসারিক অস্তিত্ব নহে–অন্য কিছু। সবকিছুর ভিতরে থাকিয়াও বাবা সব কিছু হইতে আলাদা। একদিন বাবাকে বড়ো অদ্ভুত লাগিয়াছিল। বেড়াইতে যাইবে বলিয়া বাহির হইতে গিয়া সে দেখিল বাবা উঠানের প্রান্তে ইউক্যালিপটাস গাছটার নিচে শতরঞ্চি পাতিয়া বসিয়া লিখিতেছে। হয়তো কিছু মনে আসিতেছে না, কোন উপযুক্ত শব্দ খুঁজিয়া পাওয়া যাইতেছে না, তাই বাবা কলমটা হাতে ধরিয়া উদাসভাবে দূরে তাকাইয়া আছে। ডানদিকের কাঁধটা একটু নিচু দেখাইতেছে। ফরসা, ঋজু দেহ বাবার। হঠাৎ বাবার জন্য ভীষণ মায়া হইল, ভীষণ-ভীষণ ইচ্ছা হইল বাবার কোলের কাছে গিয়া মুখ গুজিয়া থাকে। শরীরের ভিতরের প্রতি শিরায় সে পিতার জন্য ভালোবাসার স্রোত অনুভব করিল। বাবার শরীর মোটে ভালো যাইতেছে না–বাবা কাহাকেও বলে না, কিন্তু কাজল জানে।
হৈমন্তীর বাবা সুরপতিবাবু একদিন মৌপাহাড়িতে আসিয়া হাজির হইলেন। কী কাজে জামসেদপুর আসিয়াছিলেন-পথে মৌপাহাড়ি ঘুরিয়া যাইতেছেন। হৈমন্তী দৌড়াইয়া আসিয়া প্ৰণাম করিল। অপু ব্যস্ত হইয়া পড়িল খাওয়াইবার আয়োজনের জন্য। কাজল প্রথমটা একটু থতমত খাইয়াছিল, কিন্তু লজ্জা কাটিয়া গেলে দেখিল দাদু খুব ভালোমানুষ। কাজলকে ডাকিয়া তিনি বলিলেন, আজকে সারাদিন আমি তোমার সঙ্গে গল্প করব দাদু, কেমন?
হৈমন্তী বলিল–তুমি দু’একদিন থাকবে তো বাবা?
–না মা, সময় নেই হাতে একদম। পরের কাজে আসা—
আপত্তি টিকিল না। দুই দিন থাকিয়া যাইতে হইল। সারাদিন কাজল আর দাদুর গল্প চলিত, অপু যোগ দিতে পারিত না। সে একখানি বড়ো উপন্যাস লিখিতেছে। সন্ধ্যান্য উঠানে শতরঞ্চি পাতিয়া বসিয়া অপু শ্বশুর মহাশয়ের সহিত কথাবার্তা বলিত। সুরপতিবাবু জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ লোক। জীবনের তিক্ত এবং মধুর দুই দিকের সহিতই নিবিড় পরিচয় আছে। পরলোকে অত্যন্ত বিশ্বাসী। সন্ধ্যায় পরলোক লইয়া অপুর সহিত কথা হইল।
দুই দিনের বেশি সুবপতিবাবু থাকিতে পারিলেন না। যাইবার সময় অপুকে শরীরের প্রতি বিশেষ যত্ন লাইতে বাব বার বলিয়া গেলেন। হৈমন্তীকে আড়ালে ডাকিয়া বলিলেন–তোর কপাল ভালো হৈম যে এমন স্বামী পেয়েছিস।
জামাই সত্যিই বড়ো ভালো, এমন মানুষ দেখা যায় না। কাজলকে গোপনে দুইটি টাকা দিয়া তিনি ছাত-ব্যাগ সহ রওনা হইলেন। অপু তাঁহাকে ট্রেনে তুলিয়া দিতে গেল।
ট্রেনে তুলিয়া দিয়া ফিরিবার সময় অপুর বুকে কেমন একটা যন্ত্রণা বোধ হইল। বাঁদিকে একটা চিনচিনে ব্যথা, কমিতেছে না। বুকে হাত দিয়া অপু কিছুক্ষণ বসিল, কিছু হইল না। মাথাটা বেশ ঘুরিতেছে, অপু ঠিক করিল। ডাক্তারের কাছে একবার ঘুরিয়া যাইবে।
স্থানীয় ডাক্তার বিশ্বনাথ সোম অপুকে দেখেন, ডিসপেনসারিতে ঢুকিতেই তিনি অপুর মুখ দেখিয়া অবাক হইয়া বলিলেন–কী হয়েছে অপূর্ববাবু? বসুন, ওই চেয়ারটাতে, হ্যাঁ–
যন্ত্রণা বাড়িতেছিল। মাথার মধ্যে যেন বিমঝিম বাজনা। বিশ্বনাথবাবু নাড়ি দেখিয়া কমপাউন্ডারকে ডাকিলেন–সুরেন, মেজার গ্লাসে পনেরো ড্রপ কোরামিন চট করে নিয়ে এসো।
কোরামিন খাইয়া অপু একটু সুস্থ বোধ করিল। বিশ্বনাথবাবু প্রেসার লাইলেন। খুব হাই।
–কিছুদিন বিশ্রাম নিন। এরকম বারবার হওয়াটা তো ভালো নয় রায়মশায়! খাওয়াদাওয়া নিয়মমাফিক, আমাকে প্রতি হগুপ্তায় একবার করে দেখিয়ে যাবেন।
অপু বাহিরে আসিল। রাস্তায় লোক কম। মাথার ভিতরটা এখনও পুরাপুরি পরিষ্কার হয় নাই। একটু হাঁটিলেই মনে হইতেছে আবার মাথা ঘুরিয়া উঠিবে। ডাক্তার বিশ্রাম লইতে বলিয়াছে, এইবার তাহাকে বিশ্রাম লইতে হইবে। একটা উপন্যাস সে লিখিতেছে, শেষ হওয়ার পূর্বে বিশ্রাম নাই। উপন্যাসটা শেষ করিয়া। তবে ছুটি।
ক্লান্ত শরীর-সামনে একটা উপন্যাস লিখিবার পরিশ্রম। হঠাৎ অপুর নিকট ‘ছুটি’ শব্দটা অত্যন্ত তৃপ্তিদায়ক বোধ হইল।
কলিকাতা হইতে প্ৰকাশকের পত্ৰ আসিল, লেখাটা তাহদের শীঘ্র প্রয়োজন। দেরি করিলে আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা।
সকালে জলখাবার খাইয়া অপু লেখা শুরু করে, দুপুরে খাইবার সময় বাদ দিয়া সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ক্ৰমাগত লেখে। সন্ধ্যায় ক্লান্ত দেহে একটু নদীর দিকে বেড়াইতে যায়। ফিরিয়া আসিয়াই আবার রাত্ৰি বারোটা পর্যন্ত লেখে। শরীরের উপর অত্যন্ত অত্যাচার হইতেছে। উপন্যাসটি অপু হৃদয় উজাড় করিয়া লিখিবে। অপরিণত বয়সের ভাবারেগ আর নাই, এখন জীবন,সত্য উপলব্ধি করিবার সময়।
কোন সময় লিখিতে লিখিতে মাথা একেবারে ফাঁকা হইয়া যায়, হাত-পা অবশ হইয়া আসে। কলামটা টেবিলে নামাইয়া অপু অনুভব করে, শরীর ভাঙিয়া আসিতেছে-আচ্ছন্নের মতো সে কাজ করিয়া যাইতেছে। কিছুটা লোভে লোভেও বটে। কাজটা শেষ হইলে আপাতত ছুটি।
হৈমন্তী আসিয়া বকে–রেখে দাও তো! এরকম খাটলে শরীর দুদিনে ভেঙে পড়বে। শোবে চলো।
অপু চুলের ভিতর হাত চালাইতে চালাইতে বলে–আর একটু, এই চ্যাপ্টারটা শেষ করে ফেলি।
হৈমন্তী বুঝাইয়া পারে না।
একদিন অপু টেবিলেই ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। হাত হইতে কলম খসিয়া পড়িয়াছিল। খাতার উপর মাথা রাখিয়া অপু স্বপ্ন দেখিতেছিল, মধ্যপ্রদেশের সেই বন্যজীবনটা আবার ফিরিয়াছে। সে তেজী ঘোড়ার সওয়ার হইয়া আদিগন্ত হাঁটুসমান জঙ্গলে তীব্ৰবেগে ভ্ৰমণ করিতেছে। কালপুরুষ পশ্চিম দিগন্ত ছুঁই-ছুঁই করিয়াছে। বাতাসে সেই সজীব ভাবটা।
বাধা দিবার কেহ নাই, মহাশূন্যে গাঢ় অন্ধকারে ভীমরেগে ধাবমান উল্কার মতো জীবন আবার ফিরিয়াছে। চিন্তা নাই, দুঃখ নাই, ক্ষোভ নাই-স্বপ্নের মধ্যেই সব পাইবার তৃপ্তি তাহাকে আচ্ছন্ন করিতেছে। খুব জোরে ঘোড়া ছুটাইয়াছে সে। দৌড়-দৌড়-দৌড়। সামনে কালোমত কী একটা আসিতেছে, বিশাল পাহাড়ের মতো। সে ঘোড়ার রাশ টানিল।
ঘুম ভাঙিয়া সে কলমটা আবার তুলিয়া লইল, কিন্তু আর লিখিবার উৎসাহ নাই। স্বপ্ন এখনও মাথার মধ্যে ঘুরিতেছে। অর্থটা বোঝা যাইতেছে না বলিয়া অস্বস্তি হইতেছে। টেবিলের ওপাশে জানালা খোলা, হু-হু বাতাস আসিয়া কাগজ-পত্ৰ এলোমেলো হইতেছে। সবাই ঘুমাইয়া, কেবল বহুদূরের কোন সাঁওতাল বস্তির ক্লান্ত মাদলের শব্দ এখনও শোনা যায়।
চিঠি লিখিবার প্যাডটা টানিয়া লইয়া অপু মনে করিয়া করিয়া বহু পুরাতন বন্ধু আর আত্মীয়দের এক-একখানা চিঠি লিখিল। অনেককে লেখা হইল না, তাহাদের ঠিকানা মনে নাই। লিখিল–ভালো আছো? অনেকদিন খবর নিতে পারিনি, স্বার্থপরের মতো নিজের ভেতরে নিজেকে গুটিয়ে বসে ছিলাম। কিন্তু মানুষ এক বাঁচে না, তোমাদের সবাইকে আমার জীবনে বড়ো দরকার। আমাকে মনে রেখো, একেবারে ভুলে যেয়ো না যেন। মানুষের মধ্যে বেঁচে আছি—এ বোধটা আমার জীবনে যেমন প্রয়োজন, তোমাদের জীবনেও তেমনি।
চিঠিগুলি লিখিতে রাত শেষ হইয়া গেল। পূর্বদিকের টিলোটার পাশের আকাশে লাল রঙ ধরিল। মেঘের লম্বা স্তরগুলিকে দেখাইতেছে যেন আঁকা ছবি। আলো ফু দিয়া নিভাইয়া অপু বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইল।
বিকালে অপু ছেলেকে ডাকিয়া বলিল–খোকা চল, বেরুই কোথাও।
উঁচুনিচু লালমাটির ডাঙা ধরিয়া দুইজনে কিছুক্ষণ হাঁটিল। অনুচ্চ একটি পাহাড়ের কাছে আসিয়া অপু বলিল–আয়, এখানে বসি।
দুইটা ছোট পাথরে দুইজনে বসিল। কাজল বলিল–বাবা, সেই যে গল্পটা। নির্জন দুর্গে একলা রাজকুমারী থাকতো, সেটা আজ শেষ করো।–
সে কথা কানে না লইয়া অপু, ডাকিল-খোকা।
-কী বাবা?
-আমার কাছে উঠে আয় তো একটু।
কাজল বাবাব কোল ঘেঁষিয়া দাঁড়াইল।
–খোকা, তুই আমায় ভালোবাসিস?
উত্তর না দিয়া কাজল বাবাব বুকে মুখ গুজিয়া রহিল। তাহার বয়সী ছেলের পক্ষে ইহা বিসদৃশ হইলেও, বাবা ও মায়ের আদর পাইলে সে এমনি করিয়া থাকে।
অপু ছেলের মাথায় হাত বুলাইতে লাগিল। সূর্যাস্তের রঙে রঞ্জিত প্রান্তরে সে অনেকক্ষণ ছেলের সহিত বসিয়া রহিল। ক্রমে আলো কমিয়া কীটপতঙ্গের গুঞ্জন শুরু হইল। অপু উঠিয়া ছেলের হাত ধরিল।
–চল, বাড়ি চল, তোর মা ভাববে।
বাবার হাত ধরিয়া কাজল হাঁটিতেছিল। বাবা আজ এত গম্ভীব কেন?
কী একটা প্রাণী সুড়ৎ করিয়া রাস্তা পার হইল, অন্ধকারে দেখা গেল না। হয়তো মেঠো ইঁদুর। বাড়ি ফিরিতেই হৈমন্তী বলিল–তোমাকে বলে আর পারা গেল না। এত দেরি করে ফিরিতে হয়। খাবাব এদিকে জুড়িয়ে ঠাণ্ডা হয়ে গেল–
অপু কাজলের হাত ছাড়িয়া দিয়া অদ্ভুত ছেলেমানুষির সুরে বলিল– আর করব না। হৈমন্তী, সত্যি বলছি- আর কখনও না–
রাত্ৰে শুইয়া অপু, হৈমন্তীকে ডাকিল–হৈমন্তী।
–কী গো?
–বাইরে কেমন জ্যোৎস্না উঠেছে দেখেছি?
সুন্দর জ্যোৎস্নায় উঠান ভাসিতেছে। অষ্টমী তিথি, চাঁদ দিগন্তের দিকে ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে। বিষণ্ণ অথচ সুন্দর জ্যোৎস্না।
হৈমন্তী বলিল–সুন্দর।
–চল, একটু বাইরে গিয়ে বসি। ঘরে ভালো লাগছে না।
ঘুমন্ত কাজলের চারপাশে মশারি গুজিয়া দিয়া দুইজনে উঠানে গিয়া বসিল। শব্দহীন রাত্রি। চাঁদের আলোয় একটু বসিতেই কেমন একটা আবেশ জড়াইয়া আসে দেহে-মনে।
-হৈমন্তী, কাল আমার উপন্যাস শেষ হয়ে যাবে। বড়ো ভালো লাগছে। যা লিখতে চেয়েছিলাম–ঠিক সেই রকমটি হল না, কিন্তু অনেকখানি পেরেছি বলে মনে হচ্ছে।
কাছেই কোথাও ঝিঁঝি ডাকিতে শুরু করিল।
–ছোটবেলায় দূরে তাকিয়ে ভাবতাম, ওই যেখানে আকাশ আর মাটি মিলেছে, তার ওপারেই আছে রূপকথার ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর দেশ। তেমনি আমার লেখায় একটা দূর দিগন্তের ইঙ্গিত রয়েই গেল। সারাজীবন আমিও এগুলাম, স্বপ্নটাও মরীচিকার মতো পিছিয়ে গেল।
হৈমন্তী অপুর হাঁটুতে হাত রাখিয়া বলিল–তোমার জীবনে কি কোন দুঃখ আছে?
–না, আমি পবিপূর্ণ, আমি তৃপ্ত। কারণ আমি বুঝেছি সন্ধানেই আনন্দ, প্ৰাপ্তিতে পরিসমাপ্তি। আমি পথ চলতে ভালোবাসি হৈমন্তী। আমি পথের শেষ চাই না।
দুইজনে কোন কথা না বলিয়া বসিয়া রহিল। বিবি ডাকোব বিবাম নাই। চাঁদ ইউক্যালিপটাস গাছ দুইটাব মাঝখান দিয়া ধীরে ধীরে নামিয়া পড়িতেছে। তাহাদের ছায়া ক্রমশ দীর্ঘ হইতে দীর্ঘতর হইয়া আসিল। চাঁদের আলো স্নান হইবাব সঙ্গে সঙ্গে নক্ষত্রগুলি উজ্জ্বল হইয়া ফুটিয়া উঠিতেছে। বাতাস একবার গাছের পাতায় হালকা দোলা দিল।
–হৈমন্তী।
–কী?
–না, থাক–
হৈমন্তী অপুর হাত ধরিয়া বলিল–বলো না, কী বলবে।
অপু একবার আকাশের দিকে তাকাইল, তারপর বলিল—বলা যায় না, বলা যায় না। ভাষা জানি নে—
পরের দিন সকালে যদু পিওন আসিল মনি অর্ডার দিতে। কিছুদিন আগে কাগজে হৈমন্তীর গল্প বাহির হইয়াছিল। তাহার পারিশ্রমিক পনেরোটি টাকা আসিয়াছে। যদু পিওন এমনি মনি অর্ডার আগেও কয়েকবার বিলি করিয়াছে। মৌপাহাডির নিরালায় হৈমন্তী বেশ কয়েকটি গল্প লিখিয়াছে।
মনি অর্ডার ফর্মে হৈমন্তী সই করিতেছে, অপু আসিয়া পিছনে দাঁড়াইল।
— বঙ্গবাণীর টাকাটা এলো বুঝি?
হৈমন্তী ফিরিয়া মুখ টিপিয়া হাসিল।
যদু, পিওন বলিল–এই তল্লাটে এমন রোজগেরে বৌ আর দেখিনি বাবু।
হৈমন্তী হাসিয়া বলিল– তোমাকে আর বকবক কবতে হবে না যদুদা। এই টাকাটা নাও, বাচাঁদের মিষ্টি কিনে দিয়ো।
টাকা দুইটি হাত পাতিয়া লইয়া বলিল–দিদির আরও অনেক মনি অর্ডার আসুক।
হাসিতে হাসিতে যদু চিঠির ব্যাগ তুলিয়া রওনা দিল।
সারাদিন অপু টেবিলেই বসিয়া রহিল। লিখিতে লিখিতে কখন যে দিন কাটিয়া গেল কে জানে। উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ের শেষ বাক্যটি লেখা হইয়া গেল। স্তূপাকার কাগজগুলির দিকে তাকাইয়া অপুর অবাক লাগিল। শেষ হইয়া গিয়াছে। বিনিদ্র রাত্রির বেদনা-অনুভূতির ফল ওই কাগজগুলি। এইবার প্যাকেটবন্দী হইয়া কলিকাতায় যাইবে, নাকের উপর চশমা নামিয়া আসা বৃদ্ধ কম্পোজিটার বানান করিয়া করিয়া কম্পোজ করিবে।
শরীরে ভীষণ ক্লান্তি। এত পরিশ্রম সে একসঙ্গে কখনও করে নাই। ডান হাত ব্যথায় টনটন করিতেছে, হৈমন্তীকে ডাকিয়া অপু বলিল– একটু গরমজল করে দাও তো, হাতটা বড্ড বাথা করছে, ড়ুবিয়ে রাখব।
কাজ মিটিয়া গেল। সামনে অব বড়ো কোন কাজ নাই। অপু আপনমনে বেড়াইতেছিল। ছেলেবেলাকার অভ্যাসমত হাতে সরু কঞ্চির মতো একটা লাঠি লইয়াছে। অনেকক্ষণ ঘুরিবার পর মনে হইল, সে আজ ভীষণ অন্যমনস্ক। অনেক পুরাতন কথা মনে পড়িতেছে। অনেক পুরাতন মুখ। অপৰ্ণার কথা বড়ো বেশি মনে আসিতেছে। তাহাকে কিছু দেওয়া হয় নাই–তখন অপুর পয়সা ছিল না। অথচ অপর্ণা হাসিমুখে অবস্থার সহিত খাপ খাওয়াইয়া নিয়াছিল–কখনও অভিযোগ করে নাই। বড়ো সিঁদুরের টিপ পরা অপর্ণার সলজ্জ মুখখানি আজ অনেকদিন বাদে মনে পড়িয়া গেল। তাহার চিবুকের টোলটা সে স্পষ্ট দেখিতে পাইতেছে।
কাশীতে যখন বাবা মারা যায়–উঃ কী দিন গিয়াছে। কনকনে শীতের রাত্রে সেই গঙ্গাস্নান করিয়া বাড়ি ফেরা।
সবার হইতে বেশি মনে পড়ে মাকে। কখনও কিছু চায় নাই, আশা করে নাই। অপু সুখে থাকিলেই সুখী হইত। মনসাপোতার বাড়িতে ফিরিয়া তাহার প্রতি ছাত্রীর অভিভাবকদের সদয় ব্যবহারের কথা সে মাকে খুশি করিবার জন্য বানাইয়া বানাইয়া বলিত। মা সরল মনে সব বিশ্বাস করিত। ছিন্নবেশ-পরা মায়ের হাস্যময়ী চেহারা মনে পড়িয়া যায়।
ঘুরিতে ঘুরিতে সুবর্ণরেখার তীরে আসিয়া পড়িয়াছে অপু। বসিলে মন্দ হয় না। যে পাথরটার উপর বসিয়া সে লিখিত, জুতা ছাড়িয়া তাহার উপর অপু বসিল। জনপ্রাণী নাই কোনদিকে। সুবর্ণরেখার শূন্য বুকটা খা-খাঁ করিতেছে। কয়েকটি বক একপায়ে নদীর চরে ধ্যানমগ্নের মতো দাঁড়াইয়া। সূর্য যেন জ্বলিতেছে। অপুর মনে হইল, সবদিকে কেমন একটা নাই-নাই ভাব। আকাশ বিক্ত। এতটুকু মেঘ নাই। নদীর বুক রিক্ত, জল নাই। দিগন্ত পর্যন্ত প্রান্তর রিক্ত, নদীর ওপারে কেবল একটিমাত্র পলাশ গাছ বিপুল একটি প্রাকৃতিক কবিতার যতিচিহ্নের মতো সোজা মাথা তুলিয়া আছে। গাছটার সর্বাঙ্গে যেন আগুন। নিঃস্ব প্রান্তরের পটভূমিতে পুষ্পিত পলাশগাছটাকে সামান্য এতটুকু সত্ত্বনার মতো দেখাইতেছে।
এমনি একটা দিনে কলিকাতা হইতে মায়ের জন্য সামান্য কিছু জিনিস কিনিয়া গ্রামের পথে হাঁটিয়া মনসাপোতায় ফিরিয়াছিল। দরজা খুলিয়া তাহাকে দেখিয়া মা কি খুশিই না হইয়াছিল! মাকে জড়াইয়া আদর করিলে কেমন সুন্দর গন্ধ পাওয়া যাইত মায়ের গায়ে।
মাকে মনে পড়িতেছে। ছোটবেলায় মা তাহাকে পাঠশালায় যাইবার জন্য খুব সকালে ঘুম হইতে তুলিয়া দিত, নিজের হাতে সাজাইয়া হাতে বই দিয়া বলিত–যাও বাবা, পাঠশালায় যাও। তুমি লেখাপড়া শিখে মানুষ হলে বংশে্র নাম উজ্জ্বল হবে।
সে কি মানুষ হইতে পারিয়াছে? অথবা মা কি অন্য কিছু চাহিয়াছিল, যা সে হইতে পারে নাই?
একদিন রাগ করিয়া সে মায়ের দেওয়া তালের বড়া ছুঁড়িয়া উঠানে ফেলিয়া দিয়াছিল। অনেকদিন আগের ঘটনাটা। মায়ের কত কষ্টে জোগাড় করা জিনিসে তৈয়ারি।
এসব মনে করিয়া তাহার চোখে জল আসিতেছে কেন? আশ্চর্য! ইহা কি কাঁদিবার সময় হইল? এমন সুন্দর পরিবেশে? কিছু দূরে নদীর বাঁকের মুখটায় বালির উপর তাপতরঙ্গ থর থর করিয়া কাঁপিতেছে, আকাশে সূর্য, ধূ-ধূ প্ৰান্তর-সব মিলাইয়া স্বরলিপির তীব্র মধ্যমের মতো।
একটা ঢিল তুলিয়া জোরে নদীর দিকে ছুঁড়িল, বেশ জোরে। সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করিল বুকের বাঁদিকে যন্ত্রণা শুরু হইয়াছে। সামনে হইতে জোরে ধাক্কা মারিলে যেমন হয়, তেমনি ভাবে বুকে হাত দিয়া কিছুটা ছিটকাইয়া পিছনে সরিয়া আসিলা। মুহূর্তে মাথা কী রকম খালি হইয়া গেল। সূর্যটা যেন একবার কাছে আসিতেছে, সঙ্গে সঙ্গে আবার দূরে সরিয়া যাইতেছে।
অপু অনুভব করিল, পা দুইটা তাহাকে আর দাঁড় করাইয়া রাখিতে পাবিতেছে না। পাথরটার গায়ে হেলান দিয়া সে মাটিতে বসিয়া পড়িল। ব্যথাটা বাড়িতেছে-শ্বাস লাইতে কষ্ট হইতেছে। খুব গভীর ঘুম আসিবার আগে যেমন হয়, শরীরে তেমনি অবসাদের ভাব। দেহে-মনে অবসাদ মাকড়সার জালের মতো জড়াইয়াছে। সে কি এইখানে একটু ঘুমাইবে?
বাবা বাড়ি আসিয়া বলিতেছে–দুৰ্গা কই? তার জন্য শাড়ি কিনে এনেছি যে—
বাবা থলির ভিতর হইতে অনেক জিনিস বাহির করিতেছে। হঠাৎ অপুর মনে হইল–সত্যিই তো, দিদি কই? তাহাকে সবাই কোথায় হারাইয়া ফেলিয়াছে। দিদিকে খুঁজিতে হইবে।
ঘুম-ঘুম-ঘুম-। বুক বাহিয়া চিনচিনে ব্যথাটা উপরে উঠিতেছে। যন্ত্রণা ততটা আর বোধ হইতেছে না, তাহার খুব ঘুম পাইয়াছে। কানের কাছে তীক্ষ্ণস্বরে একটা পাখি ডাকিয়া উঠিল। নিশ্চিন্দিপুরে সেই পাখিটা যেমন ডাকিত। সামনের ওই ব্যাপ্তির ভিতর কোথায় যে বাজনা বাজিতেছে। গম্ভীরনাদ বীণার উদারার তারে আলাপের মতো। তারের উপর এক-একটি আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে সে একটু একটু ঘুমাইয়া পড়িতেছে। হাত-পায়ের সমস্ত শক্তি চলিয়া গিয়াছে। আর সে চলিতে পরিবে না, সমস্ত জীবনে অনেক ঘোরা হইয়াছে–এইবার সে একটু বিশ্রাম করিয়া লইবে। এইখানেই বিশ্রাম করিবে।
আশবার্টন সাহেব বলিতেছে–East opened my eyes, Roy, it really enthralls me, this call of the mysterious-this mystic span of the river–
অ্যাশবার্টনকে দেখিয়া সে উঠিবার চেষ্টা করিল। সে শুইবে না। সে অনড় হইয়া থাকিবে না–কিছুতেই না। কিন্তু শরীর তাহার কথা মান্য করিতেছে না। তাহাকে কেহ উঠাইয়া দিতেছে না। কেন?
ওই বড়ো পাথরটার আড়ালে যে দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাকে সে চিনিতে পারে নাই। এইবার সে বাহির হইয়া সামনে আসিয়াছে।
লীলা!
–পোর্তোপ্লাতায় যাবে না অপূর্ব? তুমি যে বলেছিলে সোনা উদ্ধার করে আনবে সমুদ্রের তলা থেকে?
হ্যাঁ, যাইতে হইবে বৈকি! অতল সমুদ্রের নিচে তাহার জন্য যে রত্ন অপেক্ষা করিয়া আছে, তাহাদের সে সূর্যের আলোয় বাহির করিয়া আনিবে।
–খোকা কোথায় গেল, খোকা? খোকা, আমার পাশে আয়–এইখানটায়। কোল ঘেঁষে বোস, উঠে যাসনে কোথাও। আমি তোকে কলকাতা থেকে সেই বইটা এনে দেবো এবার। উঠে যাস নে বাবা আমার–তোকে না দেখে আমি যে মোটে থাকতে পারি না।
তাহার মা বলিতেছে—ঘুমো অপু, ঘুমো। আহা বে, বড় খাটুনি গেছে তোর—
ঘুমাইয়া পড়িবার আগে অপু জোর করিয়া একবার তাকাইল। দেখিল, লাল ফুল ফুটিয়া থাকা পলাশ গাছটার পাশ দিয়া একটা পথ সমস্ত প্ৰান্তরকে দ্বিধাবিভক্ত করিয়া দূরে দিগন্তে মিশিয়া গিয়াছে।
০৭. বুধন সর্দার আর তার ছেলে
সপ্তম পরিচ্ছেদ
বুধন সর্দার আর তার ছেলে সুবর্ণরেখার ধারে কী কাজে আসিয়াছিল। অপুকে বুধন চিনিত, বেড়াইতে বাহির হইয়া অপু বহুদিন তাহার বাড়িতে জল চাহিয়া খাইয়াছে। বুধন দেখিল, ঢালু পাড়ের উপর একখণ্ড পাথরে হেলান দিয়া বাবু ঘুমাইয়া রহিয়াছে। পাশেই চটিজোড়া খোলা রহিয়াছে। পাথরের উপর সরু কঞ্চি।
ছেলেকে দাঁড় করাইয়া বুধনই প্রথম লোক ডাকিয়া আনে।
বাড়িতে শহরের লোক ভাঙিয়া পড়িয়াছে। ডাক্তার বিশ্বনাথ সোমও আসিয়াছেন। তখন আর কিছু করিবার ছিল না। বিশ্বনাথ বিষণ্ণমুখে বলিলেন–রায়মশায়কে এই জন্যই বলেছিলাম পরিশ্রম কম করতে, শুনলেন না সে কথা–
অপুর অনেক ভক্ত আসিয়াছিল। যোগাড় যন্ত্র করিয়া তাহারা দাহ করিবার ব্যবস্থা করিল। অনেক মানুষ, অনেক গোলমাল–তাহার মধ্যে অপু যেন চুপ করিয়া শুইয়া আছে। মুখ দেখিয়া হৈমন্তী স্পষ্ট বুঝিতে পারিল, শেষ সময়ে অপু বেশি কষ্ট পায় নাই। মুখে একটি তৃপ্তির ভাব মাখানো।
পাড়ার লোকেই হৈমন্তীর বাপের বাড়ি টেলিগ্রাম করিয়াছে। ঘটনাগুলি হৈমন্তীর চোখের সামনে ছায়াবাজির মতো ঘটিয়া যাইতেছিল। সে যেন ইহার সঙ্গে জড়িত নয়, সে শুধু দর্শক মাত্র।
দাহ শেষ করিয়া শেষরাত্রে সবাই ফিরিল। খাটের পায়ার কাছে হৈমন্তী একভাবে বসিয়া আছে, একটুও নড়ে নাই। দিন তাহার চোখের সামনেই রাত্রি হইয়াছিল, আবার রাত্রিও ভোর হইতে চলিল।
সবাই অবাক হইল কাজলকে দেখিয়া। শ্মশানে সে মুখাগ্নি করিয়াছে অত্যন্ত শান্তভাবে। ফিরিয়া সেই যে জানালায় দাঁড়াইল, পরের দিন দুপুর পর্যন্ত আর সেখান হইতে নড়িল না। পাশের বাড়ির ওভারসিয়ারবাবুর স্ত্রী আসিয়া সারারাত হৈমন্তীর কাছে বসিয়া ছিলেন। তিনি পর্যন্ত কাজলের নিস্পৃহতা দেখিয়া অবাক হইলেন।
অকস্মাৎ বজ্ৰপাত হইয়া সব যেন বিনষ্ট করিয়া দিয়াছে। উনানে আগুন নাই, ঠাকুরের কাছে প্ৰদীপ জ্বালা হয় নাই, পরের দিন সন্ধ্যা হইয়া গেল, তখনও কেহ ঘরে আলো জ্বলিল না। ওভারসিয়ারবাবুর স্ত্রী সমস্ত রাত জাগিয়া ক্লান্ত ছিলেন, বিশ্রাম করিতে তিনি বাড়ি চলিয়া গিয়াছেন। আবার সকালে আসিবেন বলিয়াছেন। কিছু ফল ও দুধ আনিয়া তিনি বার বার খাইতে বলিয়া রাখিয়া গিয়াছেন। ফলের থালা এবং দুধের ঘটি এখনও জলচৌকিটার উপর পড়িয়া আছে-কেহ তাহাতে হাত দেয় নাই।
দুপুরে কাজল অপুর লেখার ঘরে গিয়া বসিল। সমাপ্ত পাণ্ডুলিপিটা বড়ো খামের ভিতর টেবিলের উপর রাখা। টেবিলের এক কোণে বাবার চুল আঁচড়াইবার যশোরের চিরুনিখানা, তাহাতে বাবার কয়েকটা চুল এখনও জড়াইয়া আছে। ঘাড়ের কাছে ময়লা হইয়া যাওয়া দুইটা জামা দেয়ালের পেরেকে ঝুলিতেছে। এসব দেখিতে দেখিতে কাজল জানালা দিয়া বাহিরে তাকাইল। বেলা পড়িয়া আসিতেছে। সূৰ্যটা কেমন করুণাহীন-কাহারও দুঃখের সমবাহী নহে, সমস্ত দিন কেবল ঘুরিতেছে। একটা মাকড়সাই দুই দেয়ালের কোণে জাল বুনিতেছে অখণ্ড মনোযোগে।
অনেক রাত্রি পর্যন্ত কাজল টেবিলে এবং হৈমন্তী খাটের পায়ের কাছে বসিয়া রহিল। ঝকঝক শব্দ করিয়া রাঁচি এক্সপ্রেস জামসেদপুবের দিকে রওনা হইয়া গেল। সমস্ত দিন গরমের পর একটু ঠাণ্ডা বাতাস দিতেছে। ঘরে আলো নাই, অন্ধকারের ভিতর সমস্ত বাড়ির শূন্যতাটা হৈমন্তীর কাছে বেশি করিয়া ফুটিল। হঠাৎ পায়ের শব্দ। একটা পরিচিত গলার স্বর শোনা গেল। মানুষটি বারান্দায় উঠিল। সঙ্গে সঙ্গে ওভারসিয়ারবাবুর গলা–বাঁচি একসপ্রেসেই এলেন বুঝি?
একটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বলিয়া উঠিল অন্ধকারে। সেই আলোয় কে পথ দেখিয়া আসিতেছে। ঘরের মধ্যে আবার একটা কাঠি জ্বলিতে হৈমন্তী বিরক্তির সহিত মুখ ফিরাইল। কে আসিয়া তাহার মাথায় হাত রাখিয়া বলিল–ভয় নেই মা, আমি এসেছি। বাড়ি অন্ধকার কেন?
সুরপতিবাবু আসিয়াছেন। মালতীনগরে যাইবার আয়োজন হইতে লাগিল। সুরপতিবাবু, হৈমন্তী ও কাজলকে মালতীনগরে লইয়া যাইবেন জিনিসপত্র প্রায় সবই এখানে রাখিয়া যাওয়া হইতেছে, লইয়া যাওয়া খুব কষ্টকর এবং তাহার প্রযোজনও নাই। দুই-চারখানা কাপড় সঙ্গে যাইতেছে মাত্র।
সুরপতিবাবু দিন পাঁচেক মৌপাহাড়ি থাকিলেন। মেয়ে সদ্য শোক পাইয়াছে, একটু সামলাইয়া নিক। বিকালের দিকে শতরঞ্চি পাতিয়া তিনি উঠানে বসেন। অন্যমনস্ক হইয়া চাহিয়া থাকেন কোন একদিকে। কিছুদিন আগে এইখানে বসিয়াই অপুর সহিত গল্প হইয়াছিল। অপু বলিয়াছিল-আত্মার বিনাশ নেই বাবা! আত্মা একটা শক্তি! একটা ভীষণ শক্তি। শক্তির বিনাশ নেই, রূপান্তর আছে মাত্র।
পরলোকে বিশ্বাসী সুরপতিবাবু চারদিকে তাকাইয়া দেখেন। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা হইতেছে। তাঁহার মনে হয় এই মাটি জল বাতাসের ভিতর, ওই দূরের নক্ষত্রটার ভিতর অপুর আত্মা বুপান্তরিত হইয়া মিশিয়া গিয়াছে।
সারাদিন ধরিয়া মৌপাহাড়ি ছাড়িয়া যাওয়ার তোড়জোড়–অথচ সবাই জানে তোড়জোড় করিবার কিছু নাই। সঙ্গে বেশি জিনিসপত্র যাইতেছে না। মৌপাহাড়ির সহিত এতদিনে যে সম্পর্কটা বন্ধু সুখস্মৃতির সঙ্গে জড়িত হইয়া বাড়িয়া উঠিয়াছে, আসল কষ্ট সেটাকে ছিন্ন করা।।
রাত্রি ঝিমঝিম করিতে থাকে। তখনও আলোকবিন্দুহীন অন্ধকারের ভিতর হৈমন্তী কাজলের পাশে শুইয়া চুপ করিয়া তাকাইয়া থাকে। দূরের থানায় ঘণ্টা বাজিয়া যায়। অনেকক্ষণ পরেও হৈমন্তী বুঝিতে পারে, কাজল জাগিয়া আছে।
পর পর কয়েক রাত জাগিয়া চতুর্থদিন শেষরাত্রে হৈমন্তী ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। ঘুমাইয়া সে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখিল। দেখিল সে বড়ো স্টিলের ট্রাঙ্কটা খুলিয়া তার সামনে দাঁড়াইয়া। কোথাও বেড়াইতে যাওয়া হইতেছে। পাশেই বই–এর আলমারি। অপু হাসিয়া বলিতেছে—শুধু জামাকাপড় নিলেই কি চলবে? আমি তো বই ছাড়া মোটে থাকতে পারি নে–
অপু তাহাকে বই আগাইয়া দিতেছে, সে সাজাইয়া লইতেছে ট্রাঙ্কের ভিতর। মন ভরা বেড়াইতে যাইবার আনন্দ। যেন সব ঠিক আছে। যেন কিছুই বদলায় নাই।
পরের দিন ঘুম হইতে উঠিয়া হৈমন্তী সুরপতিবাবুর কাছে গিয়া দাঁড়াইল।
–বাবা!
–কী মা?
–এখান থেকে আর কিছু নয়—শুধু বইগুলো নিয়ে যাবো।
সুরপতি হৈমন্তীর দিকে তাকাইলেন। কোনো প্রশ্ন করিলেন না। কিছুক্ষণ তাকাইয়া মুখ নিচু করিয়া বলিলেন–তাই হবে মা। একটা বইও ফেলে যাবে না।
কয়েকটা প্যাকিং বাক্সে বইগুলি ভর্তি করিয়া সুরপতি মালতীনগরের ঠিকানায় রেলে বুক করিয়া দিলেন।
যাইবার দিন সকালে কাজল একবার সুবর্ণরেখাব ধাবে গেল। বাবা যে পাথরটার উপর বসিয়া লিখিত, সেটা একইভাবে পড়িয়া আছে। কাজলের অবাক লাগিল। যখন কাজলও পৃথিবীতে থাকিবে না, তখনও এটা এইভাবে এখানে পড়িয়া থাকিবে। এই নদী, এই চর, ওই প্রান্তর-সবই একই রকম থাকিবে। আকাশটা নীল থাকিবে। কেবল সে থাকিবে না। যেমন এখন বাবা নাই।
কী-একটা পাখি মাথা সামনে পেছনে নাড়াইতে নাড়াইতে ক্ৰমশ চর বাহিয়া নদীর ভিতরে যাইতেছে। ওপারে বাঁদিকে টিলার মাথায় সূর্যটা যেন আটকা পড়িয়াছে। বাবা এই সমযে অনেকদিন এইখানে বসিয়া লিখিত। সে কতদিন আসিয়া বাবাকে ডাকিয়া লইয়া গিয়াছে। একবার তাহার মনে হইল, পিছন ফিরিয়া তাকাইলে বাবা একটা ঝোপের আড়াল হইতে বাহির হইয়া আসিবে।
–অমন লুকিয়ে ছিলে কেন বাবা?
অপু হাসিয়া বলিবে–দেখছিলুম, আমায় না দেখতে পেয়ে তুই ভয় পাস কি না। এমন কতদিন ঘটিয়াছে। বাবা তাহার সহিত ছেলেমানুষের মতো খেলা করিত। লুকোচুরি খেলা শেষ হইলে খাতপত্র গুটাইয়া তাহারা বাড়ির পথ ধরিত।
এবার বাবা বড়ো কঠিন জায়গায় লুকাইয়াছে। আর কেহ তাহাকে পাইতেছে না। আব্ব তাহাকে কোনদিন কেহ খুঁজিয়া বাহির করিতে পরিবে না।
খেলিতে খেলিতে খেলাটা হঠাৎ যেন ভারী রকমের হইয়া গিয়াছে।
হৈমন্তী জানালা খুলিয়া দিতেই প্রথম নজরে পড়িল ইউক্যালিপটাস গাছ দুইটা। সকালেও বাতাস তাহদের পাতায় পাতায় সামান্য কঁপনি ধরাইয়াছে। এই গাছ দুইটার ফাঁক দিয়াই সেদিন রাত্রে চাঁদ ধীরে ধীরে দিগন্তের দিকে নামিতেছিল।
-এবার চল, আমার উপন্যাসটা শেষ হলে হরিদ্বার ঘুরে আসি।
–সত্যি বলছ?
—এমন ভাবে বলছি যেন কোনদিন কোথাও নিয়ে যাইনি। তৈরি হও, এবার বেরিয়ে পড়ব।
কথা রাখে নাই। একই সে লম্বা পাড়ি জমাইয়াছে।
বেলা বাড়িয়া চলিয়াছে। বিকালের গাড়িতে চলিয়া যাইতে হইবে। বাড়িটার, ছোট্ট শহরটার প্রতি ধূলিকণায় তাহার স্মৃতি রহিল। সদর দরজায় তালা ঝুলাইয়া যাইবার পরেও বাড়ির ভিতরে সে থাকিবে একা। তখন হৈমন্তী থাকিবে না। সেই পরিচিত গলা শোনা যাইবে না।
–ভাত নেমেছে? না খাইয়ে আজ মারবার মতলব করেছ নাকি?
দিন কাটিয়া যাইবে, আসবাবপত্রে ধূলা জমিবে। মাস এবং বৎসর আপনি খেয়ালে কাটিতেই থাকিবে। একটা অর্থহীন অস্তিত্ব হৈমন্তীকে সারা জীবন ক্লান্ত করিতে করিতে এক নিরালম্ব অবস্থায় আনিয়া দিবে।
সত্যিই কি অর্থহীন অস্তিত্ব?
একটা কাজ অস্তুত তাহার এখনও রহিয়াছে। অপু শুরু করিয়াছিল, তাহাকে শেষ করিতে হইবে। অনুচ্চারিত প্ৰতিজ্ঞায় সে অপুর কাছে সত্যবদ্ধ।
ঘরের দরজায় শব্দ হইল, কাজল ফিরিয়াছে।
হৈমন্তী বলিল–তোর পড়াশুনোর বইগুলো বেঁধে নিয়েছিস বুড়ো?
দরজায় তালা লাগানো হইয়া গেল। সুরপতি তালাটা ভালো করিয়া টানিয়া দেখিলেন, ঠিকমতো লাগিয়াছে কিনা। ওভারসিয়ারবাবুকে বলা রহিল, এদিকে একটু নজর রাখিবার জন্য।
কাজল বারান্দায় রেলিংয়ে হাত দিয়া গম্ভীর হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। তাহার,বিশ্বাস হইতেছিল না, এখনই এসব ছাড়িয়া অনেকদিনের জন্য-হয়তো বা চিরদিনের জন্য চলিয়া যাইতে হইবে। যাইতেই হইবে তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। তাহদের ট্রেন এতক্ষণে জামসেদপুর ছাড়াইয়াছে।
হৈমন্তীর বুকের ভিতর কী একটা আবেগ কোন বাধা না মানিয়া ঠেলিয়া উঠিতেছিল। দরজা বন্ধ না হওয়া অবধি সে বারান্দায় দাঁড়াইয়া একদৃষ্টি শুইবার ঘরের কুলুঙ্গিতে লক্ষ্মীর পটাটার দিকে চাহিয়া ছিল। দরজার পাল্লা বন্ধ হইতে দৃশ্যটা আড়াল হইয়া গেল। কাজলের হাত ধরিয়া চলিতে শুরু করিয়াই হৈমন্তীর চোখের বাঁধ ভাঙিল, এতক্ষণে বিচ্ছেদটা যেন সম্পূর্ণ হইল। মৌপাহাড়ির মাটি হইতে পা তুলিয়া লইবার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক মিটিয়া যাইবে।
কয়েকটা শুকনো পাতা বারান্দার উপর দিয়া খড়খড় শব্দে সরিয়া গেল। সিড়ি দিয়া উঠানে নামিতে নামিতে কাজল অবাক হইয়া ফিরিয়া তাকাইল। ঠিক মনে হইয়াছিল, কাহার যেন পায়ের শব্দ।
উঁচুনিচু লালমাটির পথে রিকশা চলিল স্টেশনের দিকে। সেখানে তাহদের বিদায় দিবার জন্য অনেকে অপেক্ষা করিয়া আছে, তাহারা ভিড় করিয়া আসিল। এই কয়েক বৎসরে যাহাদের সহিত পরিচয় হইয়াছিল, যাহারা অপুর লেখার ভক্ত–সবাই আসিয়াছিল। এত কলববের মধ্যেও হৈমন্তী বার বার স্টেশনের লাল রাস্তাটার দিকে তাকাইতেছিল। কী একটা যেন ফেলিয়া আসিয়াছে।
০৮. মামাবাড়িতে আসিবার আগে
মামাবাড়িতে আসিবার আগে কাজলের মনে দ্বিধার ভাব ছিল। কিন্তু কয়েকমাস কাটিবার পর সে অনুভব করিল, এ বাড়ির সহিত তাহার মানসিকতা বেশ খাপ খাইয়াছে। মামাবাড়িতে সবসময়ই একটা সাহিত্য ও শিল্পের হাওয়া বহিতেছে। সেটাই তাহাকে ক্রমশ সুস্থ করিয়া তুলিল। প্রতাপ একটি গ্রন্থকীট। তাহার সহিত কাজলের চমৎকার সময় কাটে। দিদিমা তাহাকে খুব ভালোবাসেন, তার সম্বন্ধে কাজলের অস্বস্তি দু’দিনেই চলিয়া গিয়াছিল। সর্বাপেক্ষা বেশি জমিয়াছে কিন্তু দাদুর সঙ্গে।
সুরপতি কাজলকে ছাড়া একটুও থাকিতে পারেন না। কাজলের জন্য প্রাইভেট টিউটর রাখেন নাই, নিজেই পড়ান। ধাৰ্মিক মানুষ তিনি, কাজলের চারিত্রিক শিক্ষার জন্য তাহাকে শিষ্য বানাইয়া লইলেন। সন্ধ্যায় ঘরের বাতি নিভাইয়া দাদুর পাশে বসিয়া কাজলকে ধ্যান করিতে হয়। সুরপতি তাহাকে বলিয়াছেন। মনঃসংযোগ ব্যতীত জীবনে সিদ্ধি আসে না, সন্ধ্যায় কাজল তাই মনঃসংযোগ অভ্যাস করে। দুইগাছা রুদ্রাক্ষের মালা কেনা হইয়াছে–তাহার একটা সুরপতি নিজের গলায় দেন, অন্যটা ধ্যান করিবার সময় কাজল পরে।
এই তিন-চার বৎসরে মালতীনগরে আরও অনেক উন্নতি হইয়াছে। নতুন দোকানপাট বসিয়াছে, রাস্তায় গাড়িঘোড়ার ভিড বাড়িয়াছে, বাড়িঘর অনেক তৈয়ারী হইয়াছে। কলিকাতা খুব দূরে নহে, ব্যবসাপত্রের বেশ প্রসার হইতেছে।
মালতীনগরের গোলমাল ছাড়িয়া মাইল দুয়েক গেলে কয়েকটি সুন্দর গ্রাম আছে। পিচের রাস্তা ছাড়িয়া মাঠের মধ্যে দিয়া হাঁটিয়া কিছুটা দূরে চমৎকার বাঁশবন, পুকুর, কলসী-কাঁখে গ্ৰাম্যবধূ দেখা যায়। ধুলাবালি মানুষজনে বিবক্ত হইয়া কাজল মাঝে মাঝে হাঁটিয়া গ্রামের দিকে যায়। নিশ্চিন্দিপুরে যাওয়া হইয়া ওঠে না, এই ভাবেই কাজল প্রকৃতির সহিত সম্পর্ক বাঁচাইয়া রাখিয়াছে। এক ছুটির দিনে কাজল দুপুরে বসিয়া পড়িতেছে, এমন সময় দরজায় কড়া নাড়িয়া উঠিল। দরজা খুলিয়া দেখে গোফদাড়িওয়ালা এক বলিষ্ঠদেহ লোক দাঁড়াইযা, কাঁধে কাপড়ের ঝুলি, পায়ে সস্তা দামের চটি। কাজল প্ৰথমে চিনিতে পারে নাই। তারপরে সে অবাক হইয়া বলিল–মামা?
প্ৰণব জেলে গিয়াছিল। পুলিশ সন্দেহ করিয়াছিল, বিপ্লবীদের সহিত তাহার যোগাযোগ আছে। তিন বৎসর আগে সে গ্রেপ্তার হয়। জেলে বসিয়াই সে অপুর মৃত্যু সংবাদ খবরের কাগজে পড়িয়াছে। সব কাগজেই সাহিত্যিক অপূর্বকুমার রায়ের মৃত্যুসংবাদ ছাপা হইয়াছিল। নিশ্চিন্দিপুর গিয়া রানির নিকট হইতে ঠিকানা সংগ্ৰহ করিয়া প্রণব এখানে আসিয়াছে।
দৌড়াইয়া কাজল হৈমন্তীকে ডাকিয়া আনিল। হৈমন্তী প্রণবকে কখনও দেখে নাই। ঝুলিটা নামাইয়া প্রণব বসিতে বসিতে বলিল–এ পৃথিবীতে অপূর্ব আমার সবচেয়ে বড়ো বন্ধু ছিল। তা ছাড়া আরও একটা পরিচয় আমার আছে–আমি কাজলের মামা।
বিকালে জলখাবার খাইয়া প্ৰণব কাজলের বইপত্ৰ দেখিতেছিল। কাজলের আলমারিতে বেশ কিছু বই জমিয়াছে। কিছু অপু কিনিয়া দিয়াছিল, কিছু মালতীনগরে আসিবার পর কাজল প্রতাপকে দিয়া কিনাইয়াছে। কাজল এখন বেশ ইংরাজি পড়িতে পারে।
বইগুলি নাড়িতে নাড়িতে প্রণব বলিল–অনেক পড়ে ফেলেছিস খোকা। তুই আর সেই বাচ্চা খোকন নেই।
সত্যিই, অবাক হইয়াছিল সে। বয়সের তুলনায় কাজল বেশি পড়াশুনা করিতেছে। তার বয়সী অন্য ছেলে এসব বইয়ের নামও শোনে নাই।
–তুই বাপের ধারা পেযেছিস। বাব্বাঃ, অপু তো কলেজ লাইব্রেরি প্রায় শেষ করে ফেলেছিল।
–আমিও রিপন কলেজে পড়ব পুলুমামা!
প্রণব নিজের ঘন দাড়িতে একবার আঙুল চালাইল।
–বেশ তো, তাতে আপত্তি কী? স্কুলে ভালো রেজাল্ট কর—
–আজকে রাত্তিরে তোমাদের কলেজের গল্প বলবে?
প্ৰণব হাসিল।
–আমাকে আজকেই চলে যেতে হবে খোকন।
কাজলের মুখ শুকনো হইয়া গেল।
–সে কথা বললে শুনচি নে, তোমাকে থাকতেই হবে ক’দিন।
–আজকের রাতটা না হয় থাকবো, কিন্তু বেশি তো থাকবার উপায় নেই খোকা।
–কেন?
প্রণব কাপড়ের ঝুলিটা দেখাইয়া বলিল–কারণ এইটে।
–কী আছে ওতে?
–ওতে একটা যাদুকাঠি আছে, মানুষের দুঃখ দূর করার।
কাজল আবছাভাবে ব্যাপারটা বুঝিল।–এটা নিয়ে কী কববে তুমি?
–আমি কিছু কবব না। ঝোলোটা যথাস্থানে পৌঁছে দিয়ে আমোর ছুটি।
সন্ধ্যাবেলা অনেক গল্পগুজব হইল। প্রতাপ, হৈমন্তী, কাজল, সরযূ সবাই বসিয়া প্ৰণবের গল্প শুনিল। জেলের নৃশংসতার কথা শুনিয়া সরযূ আর হৈমন্তী প্রায় কাঁদিয়া ফেলিল। কাজল প্ৰণবের কাছে ঘেষিয়া বসিল।
–পুলুমামা, বলেছিলে তোমাদের কলেজ-জীবনের গল্প করবে?
-সে কি একদিনে হয় রে? কী মজাই না করতাম আমরা! তোর বাবা আর আমি ছিলাম দুটো পাগল। তবে আমার চেয়ে ও একটু উঁচু ধরনের পাগল ছিল। একবার তো মাঝরাতে আমাদের পুলিশে তাড়া করেছিল—
–কেন?
—পার্কে বসে মাতালের অভিনয় করছিলুম থিয়েটার দেখে বেরিয়ে। তাড়া করতেই দুজনে রেলিং টপকে দৌড়।
সরযূ বলিল–আপনি মানুষটিও দেখছি খুব শান্তশিষ্ট নন।
প্ৰণব কৌতুক বোধ করিয়া দাড়িতে ঘন ঘন আঙুল চালাইল, তারপর বলিল–শান্ত যে নই তা ভারত সরকারও জানে। দৌরাত্ম্য করার অভ্যোস একেবারে রক্তের ভেতরে মিশে গেছে।
পরের দিন সকালে প্রণব বিদায় লইল। যাইবার সময় হৈমন্তীকে বলিল–আপনাকে সান্ত্বনা দেবো না। অপু আমার জীবনের একটা বড়ো অংশ জুড়ে ছিল। সে চলে যাওয়ায় নিজেই অনুভব করছি, এর সান্ত্বনা হয় না। তবে আপনি তার সঙ্গে ছিলেন, ভরসা করি শোক সহ্য করবার ক্ষমতা আপনি তার কাছ থেকে পেয়েছেন।
কথা থামাইয়া বার দুই দাড়িতে হাত বুলাইয়া পরে কাজলকে দেখাইয়া বলিল–ওকে দেখবেন। ওর চোখে ওর বাবার আগুন রয়েছে।
রাত্রে কাজল ছাদে একটা মাদুর পাতিয়া শোয়, যতক্ষণ না নিচে হইতে খাওয়ার ডাক আসে। আকাশে মেঘ না থাকিলে ছায়াপথটা দেখা যায়–আকাশের এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত বিরাট সাদা নদীর মতো দুই দিগন্তকে যুক্ত করিতেছে। বাবাব জ্যোতির্বিজ্ঞানের বইগুলি সে প্রায়ই নাড়াচাড়া করিয়া দেখে, তাই আকাশের আকর্ষণ তার কাছে অসীম। নক্ষত্রে গ্রহে নীহারিকায় একটা রহস্য লুকাইয়া আছে, সে ছাদে শুইয়া রহস্যের আমেজটা উপভোগ করে। বই দেখিয়া দেখিয়া সে অনেক রাশি এবং নক্ষত্রমণ্ডলী চিনিয়াছে।
একদিন হঠাৎ তাহার গায়ে কাঁটা দিয়া উঠিয়াছিল। কোথায় অনন্ত শূন্যে ধূমকেতু গ্ৰহ-উপগ্ৰহ বিশাল নীহারিক অনন্তকাল হইতে ভ্ৰমণ করিতেছে, আর কোথায় ক্ষুদ্র এক গ্রহ পৃথিবীর অতিক্ষুদ্র মালতীনগরে সে ছাদে শুইয়া তাহাদের কথা ভাবিতেছে। বিশ্বের বিশালত্বের নিকট তাহার তাৎপর্যহীনতা একেবারে স্পষ্ট হইয়া গেল।
পুরাতন সেই স্কুলেই সে আবার ভর্তি হইয়াছে। পড়াশুনায় সে সাধারণ ছাত্রদের অপেক্ষা অনেক আগাইয়া আছে বলিয়া কয়েকজন শিক্ষক তাহাকে স্নেহ করেন, কিন্তু বেশির ভাগই বিরূপ। পরীক্ষার খাতায় বা হোম টাস্কের খাতায় কাজলের লেখা উত্তর তাহদের নিকট অকালপক্কতা বলিয়া মনে হয়। ছুটির দিনে দুপুরে সবাই ঘুমাইয়া পড়লে বাবার বই যে আলমারিতে রাখা আছে, সেটা খুলিয়া বই নামাইয়া সে পড়ে। অনেক বই-এর বিষয়বস্তু বুঝিতে পারে না, কিন্তু সব বই সে নাড়িয়া চাড়িয়া দেখে। শুধুমাত্র বই নাড়াচাড়া করিয়া নীটসে, সোপেনহাওয়ার, ইমানুয়েল কান্ট, প্রভৃতির নাম মুখস্থ হইয়া গিয়াছে।
দুপুরবেলা কোথাও কোনো শব্দ নাই, রাস্তায় গাড়িঘোড়ার চলাচল কম, বাড়িটা যেন ঝিমাইতেছে। সময়টা পড়াশুনা করিবার অত্যন্ত উপযুক্ত। বই খুলিয়া কোলের উপর রাখিয়া পড়িতে পড়িতে মাঝে মাঝে সে মুখ তুলিয়া চাহিয়া দেখে। দুপুরবেলার নির্জনতার সহিত তাহার মনটা একাত্ম হইয়া আসে। বিভিন্ন বিষয়ের বই একটা অদ্ভুত জগৎকে হাতের কাছে আনিয়া দেয়-নীহারিকার জগৎ, প্রাণীজগৎ, বিভিন্ন দেশের বিচিত্র উদ্ভিদের জগৎ। ছোটবেলায় বাবা মুখে মুখে তাহাকে বিবর্তনবাদ বোঝাইত, এখন সে আলমারি হইতে বাবার নাম সই করা ‘অরিজিন অব দি স্পিসিজ’ বইটা নামাইয়া পড়িবার চেষ্টা করে। দাঁত ফুটাইতে পারে না, কিন্তু বইখানা খুব আকর্ষণ করে। চারিদিকে যেন শীতকালের শেষবেলার রৌদ্রের মতো একটা সুদূরের হাতছানি-অজানার আহ্বান।
সেদিন আকাশ দেখিয়া মনে হইতেছিল বৃষ্টি নামিবে। কিন্তু কাজলের মনটা সকাল হইতেই কী কারণে বেশ প্রসন্ন ছিল। বৃষ্টির আশঙ্কা উপেক্ষা করিয়া সে বিকালে বেড়াইতে বাহির হইল।
চারিদিকে যেন সন্ধ্যার ছায়া। মেঘ খুব নিচে নামিয়াছে। যে কোন সময়ে বৃষ্টি আসিতে পারে। আকাশে একটাও পাখি নাই, রাস্তায় লোক কম। গাছের ঘন সবুজ পাতা নীল মেঘের পটভূমিতে ভারি সুন্দর দেখাইতেছে। গুমগুম করিয়া একবার মেঘ ডাকিয়া উঠিল।
রাস্তার ধারে ঘন ঘাসের মধ্যে অজস্র ঘাসফুল ফুটিয়া আছে। কাজলের ইচ্ছা হইল ঘাসে একবার হাত লাগাইয়া দেখে। রাস্তা ছাড়িয়া নিচু হইয়া সে ঘাসের উপর হাত দিল। সুন্দর কার্পেটের মতো পুরু হইয়া ঘাস জন্মিয়াছে। নরম, সবুজ, সজীব। অসংখ্য ঘাসফুল কালো আকাশে নক্ষত্রের মতো ছড়াইয়া ফুটিয়াছে। কাজল লক্ষ করিয়া দেখিল, প্রত্যেকটি ফুলের তিন পাশে তিনটি করিয়া ঘাসের শীষ বাহির হইয়াছে। কোথাও নিয়মভঙ্গ হয় নাই। একটা করিয়া সাদা ফুল, পাশ দিয়া তিনটি করিয়া ঘাসের শীষ।
একটা ঘাসফুল হাতে করিয়া দাঁড়াইয়া কাজলের মনে হইল—কী অদ্ভুত নিয়ম! কিছুতেই একটু এদিক ওদিক হয় না। এই ছোট সামান্য ফুলটাও সেই নিয়মের শিকল দিয়া আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা। নীহারিকাময় বিশ্বের কত ক্ষুদ্র নাগবিক, তবু নিজের স্নিগ্ধ সৌন্দর্যে বিশ্বে একটা স্থান অধিকার করিয়া আছে। কয়েকটা ঘাসফুল হাতে করিয়া লইল কাজল মাকে দেওয়ার জন্য। আর একটু হাঁটিয়া সে বাড়ি ফিরিবে।
কয়েক পা হাঁটিয়াই সে হঠাৎ দাঁড়াইয়া পড়িল। সামনে রেললাইন। ডাইনে সেই ঘাসে ছাওয়া ঢালু জায়গাটা, সেখানে অনেকদিন আগে বাবার সঙ্গে বেড়াইতে আসিয়া মৃত গরু পড়িয়া থাকিতে দেখিয়াছিল।
বুকের মধ্যে হঠাৎ কেমন করিয়া উঠিল। ভয় পাইয়াছিল বলিয়াই বাবা সেদিন সস্নেহে হাত ধরিয়া বাড়ি লইয়া গিয়াছিল, আজ কেহ নাই।
একটা ভয়ের ঢেউ তাহার মনকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। হনাহন করিয়া হাঁটিয়া প্ৰায় হাঁপাইতে হাঁপাইতে হৈমন্তীর কাছে পৌঁছিয়া মুঠ খুলিয়া বলিল–এই দ্যাখো মা, তোমার জন্যে কী এনেছি।
০৯. কাজলের মনের গভীরে
নবম পরিচ্ছেদ
কাজলের মনের গভীরে ছন্দপতনের প্রতি একটা বিতৃষ্ণা আছে। জিনিসটা সে সব সময় ভাষায় প্রকাশ করিয়া বলিতে পারে না। যে জিনিসটার যেমন থাকিলার কথা, যেখানে যে জিনিসটা মানায়, সেখানে তাহা না থাকিলে কাজল ভীষণ অস্বস্তি বোধ করে। অস্বস্তিটাও অদ্ভুত। ব্ল্যাকবোর্ডে খড়ি পিছলাইয়া কিঁ-চ্ করিয়া তীক্ষ্ণ শব্দ হয়—তাহা শুনিলে যেমন গা গুলাইয়া ওঠে, অনেকটা তেমনি। সুন্দর কিছুর মধ্যে সামান্যতম ক্ৰটি, তাহার মতে, সমস্ত ব্যাপারটাকে একেবারে মাটি করিয়া দেয়। বাবার সঙ্গে বেড়াইতে গিয়া সুন্দর বিকেলবেলাটায় রেললাইনের পাশে বীভৎস দৃশ্য দেখিয়া সে চমকাইয়া উঠিয়াছিল। এই কারণেই তখন কারণটা বুঝিতে পারে নাই, এখন আবছাভাবে আন্দাজ করিতে পারে। জগতে সমস্ত দিক ব্যাপিয়া এত অতিমানবিক সংগীত বাজিতেছে, তাহার মধ্যে অসুন্দর কিছু মানায় না। সেতার বাজাইতে বাজাইতে ভুল তারে হাত পড়িয়া যাইবার মতো লাগে।
বাবা তাহাকে একখানি ‘ডেভিড কপারফিল্ড’ কিনিয়া দিয়াছিল। বইখানি শিশুদের জন্য সংক্ষিপ্ত করা। আজ তাহার ইচ্ছা হইল বইখানি নির্জনে কোন জায়গায় বসিয়া পড়িবে। এ জিনিসটা তাহার বাবাকে দেখিয়া শেখা। কোন ভালো বই অপু সাধারণত বাড়ির মধ্যে বসিয়া পড়িত না।
দুপুরে কাজল বাড়ি হইতে বাহির হইয়া সোজা গ্রামের পথ ধরিল। হাতে বইখানা, পকেটে আনা দুই পয়সা-সকালে সুরপতির নিকট হইতে লইয়াছে। পিচের রাস্তা যেখানে দূরের এক মহকুমা শহরের দিকে বাঁকিয়া গিয়াছে, কাজল সেখানে রাস্তা ছাড়িয়া মাঠে নামিল। মাঠে ধান বুনিয়াছেগাছ এখনও খুব লম্বা হয় নাই, কাজলের কোমর বরাবর হইবে। মাঠের মাঝখানে আসিয়া চারিদিকে তাকাইলে ব্যাপারটাকে একটা সবুজ ধাঁধা বলিয়া মনে হয়। সামান্য বাতাসেই মাঠ জুড়িয়া সবুজের ঢেউ শুরু হয়, ভারি ভালো লাগে দেখিতে। একদিক হইতে ঢেউ শুরু হয়, একেবারে অপর প্রান্তে গিয়া শেষ হয়।
মাঠ পার হইয়া সামনে একটা বড়ো বাঁশবন পড়ে। দিনের বেলাতেও তাহার ভিতরটা আধো অন্ধকার থাকে। লম্বা সরু বাঁশপাতা ঝরিয়া ঝরিয়া তলার মাটি একেবারে ঢাকিয়া গিয়াছে। মাঠের উজ্জ্বল আলোক ছাড়িয়া বাঁশবনে ঢুকিলেই মনে হয়, হঠাৎ সন্ধ্যা নামিল। বেশ ঠাণ্ডা জায়গাটা। বাতাসে বাঁশ গাছ দুলিয়া আওয়াজ হইতেছে কট্-কট্, ক্যাঁ-চ।
বাঁশের গা হইতে কতকগুলি খোলা টানিয়া ছিঁড়িয়া কাজল তাহার উপর বসিল। বই খুলিয়া পড়িতে পড়িতে সে মগ্ন হইয়া যায়। ডেভিডের দুঃখ, ডেভিডের সংগ্রাম করিতে করিতে বড়ো হওয়া, সব তাহার মনে দাগ কাটে। মানুষের জন্য লেখকের সমবেদনার অশ্রু তাহাকে ডিকেনসের প্রতি আকৃষ্ট করে। অন্য কে এমন ভাবে লিখিতে পারিত? অনাদৃত শুষ্কমুখ ডেভিডকে সে যেন স্পষ্ট দেখিতে পায়।
একটা কঞ্চি সামনে বাঁকাভাবে মাটির উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে। তাহার উপর হঠাৎ একটুনটুনি আসিয়া বসিল। কাজল তাকাইয়া দেখিতেছে, পাখিটা বসিয়া আছে–ভয় পাইয়া উড়িয়া যাইতেছে না। কঞ্চিটা অল্প অল্প দুলিতেছে।
কাজল অনুভব করিল। তাহার মনে কোনো দুঃখ নাই, গতকাল রেললাইনের ধারে যে ভয়টা হৃৎপিণ্ড চাপিয়া ধরিয়াছিল, তাহাও অদৃশ্য। চারিদিকে শুধু ছায়াছায়া আলো, পাখির ডাক, ঘন বাঁশবনে নিঃকুম দুপুরে বাঁশ দুলিবার শব্দ। আর সবকিছুর সঙ্গে মিলাইয়া রহিয়াছে–ডেভিডের জীবনচিত্র।
বইটি রাখিয়া কাজল চিত হইয়া শুইল। গতকাল বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে, মাটি সামান্য ভিজা। উপরে বাঁশপাতা জড়াজড়ি করিয়া একটা সবুজ চাঁদোয়া বানাইয়াছে, তাহার ফাঁক দিয়া আকাশ দেখা যায়। মাটি হইতে সোদা গন্ধ আসিতেছে। আবার বোধহয় বৃষ্টি হইবে-এক সার পিঁপড়া মুখে ডিম লইয়া ছুটিতেছে। বৃষ্টি হইবার আগে পিঁপড়া নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধ্যানে ঘোরে। একটা বাছুর গলায় দড়ি এবং দড়ির প্রান্তে আটকানো খোঁটাসুদ্ধ তাহার সামনে আসিয়া পড়িল। ছোট্ট বাছুরটা, কাহাদের কে জানে–খোঁটা উপড়াইয়া এখানে হাজির হইয়াছে। বাছুরের চোখের শান্ত দৃষ্টি তাহাকে মুগ্ধ করিল। সে হাত বাড়াইয়া ডাকিল–আয়, আয়।
নাক উঁচু করিয়া বাতাসে কী শুঁকিয়া বাছুরটা উলটা পথ ধরিল।
কেমন আরামে তাহার সময় কাটিতেছে। কাজলের একবার দেবেশের কথা মনে পড়িল। সে এখনও মৌপাহাড়িতে তেমনই বন্ধুদের সহ্যিক অকারণে হৈ হৈ কারিয়া কাঁটাইতেছে। একটা বই পড়া নাই, দুদণ্ড একলা বসিয়া চিন্তা করা নাই। এই ছায়ায় বসিয়া বই হাতে সে চিন্তা করিয়া যে আনন্দ পাইতেছে, সে আনন্দের সন্ধান কি সারা জীবনেও উহারা পাইবে?
বিকাল হইয়া আসায় সে বাঁশবাগান ছাড়িয়া গ্রামের ভিতরে চলিল। এক জায়গায় একটা পানাপুকুর টোপাপনায় আচ্ছন্ন হইয়া আছে। পানা সরাইয়া এক কিশোরী থালা মাজিতেছিল। কাজলকে দেখিয়া ত্বরিতপদে তালগাছের গুড়ির তৈয়ারি ঘাট বাহিয়া উপরে উঠিয়া দৌড়াইল। একটা কুকুর, বেশ স্বাস্থ্যবান, তাহার দিকে পুকুরের ওপার হইতে তাকাইয়া আছে। কাজলের মনে হইলআমার কালু বেঁচে থাকলে ঠিক অত বড়ো হত।
কালুর কথা মনে পড়িতে তাহার মন খারাপ হইয়া গেল। কালু মারা যাইবার পরেও তাহার গলার চেনটা উঠানের কাঠচাপার ডালে ঝুলিত।
সামনে একটা খোড়োচালের বাড়ি। কাজল উঠানে দাঁড়াইয়া ডাকিল–শুনছেন?
খাটো ধুতি পরা একজন বাহির হইয়া আসিল।
–কে? কী চাই?
–একটু খাবার জল দেবেন?
লোকটা কাজলকে আপাদমস্তক দেখিয়া বলিল–আমরা কিন্তু মুসলমান।
কাজল বলিল–হোক গে, আপনি দিন জল।
–ওখানে কেন? এই দাওয়ায় এসে বোসো খোকা।
–এই গ্রামে বুঝি সবাই মুসলমান?
লোকটা হাসিয়া বলিল–না, না। সবাই নয়, আমরা কয়েকঘর আছি আর কী?
তাহার পর যেন একটা খুব গোপনীয় কথা হইতেছে, এমনভাবে মুখটা কাজলের কাছে আনিয়া ফিসফিস করিয়া বলিল–মুড়ি খাবে দুটো?
ভাব জমিয়া গেল।
একটু পরেই কাজল দাওয়ায় বসিয়া মুড়ি খাইতে খাইতে গল্প করিতেছে, নাক দিয়া সর্দি ঝরা একটা বাচ্চা পাশে রাখা ডেভিড কপারফিল্ডখানা লইয়া নাড়াচাড়া করিতেছে।
লোকটা বলিল–আর দেবো মুড়ি?
–না, এই অনেক। তোমার নাম কী?
লোকটা নাম বলিবাব আগে গামছায় একবার মুখ মুছিয়া লইল, যেন তাহার বিবাহের সম্বন্ধ হইতেছে।
–আমার নাম আখের আলি।
ভিতর হইতে একটি বৌ আসিয়া তাহার সামনে একটা বাটি নামাইয়া রাখিল। কাজল অবাক হইয়া বলিল–এ কী! দুধ কে খাবে?
বৌটি বলিল–খেয়ে নাও। আমাদের নিজেদের গরুব দুধ, ছিটেফোঁটাও পানি নেই। চিনি দেওয়া আছে, মুড়ি দিয়ে খাও। শুধু মুখে মুড়ি খেতে নেই।
কাজল আখেরকে জিজ্ঞাসা করিল–এ কে?
-আমার বৌ। ওর নাম রাবেয়া।
-এত দুধ খেতে হবে?
আখের আলি বলিল–উপায় নেই, রাবেয়া বিবি যখন ধরেছে, তখন আর–আমাকেই কেবল মোটে আদর যত্ন করে না।
রাবেয়া অনুচ্চ কণ্ঠে বলিল–আঃ!
কাজল ভাবিল, বড়ো হইয়া সে তাহার দেখা মানুষ লইয়া–ইহাদের জীবন লইয়া উপন্যাস লিখিবে ডিকেন্সের মতো। এমন সময় গলায়-খোঁটা সেই বাছুরটা গুটিগুটি আখেরের উঠানে আসিয়া ঢুকিল। আখের বলিল–ওই এতক্ষণে এসেছে। সারাদিন ঘুরে ফিরে এখন আসা হলো। আমি গিয়ে দেখি, বুঝলে, খোটা উপড়ে কোথায় হাওয়া হয়েছে। তারপর আসছে আসছে করে এই এলো
কাজল এক চুমুকে কিছুটা দুধ খাইয়া বলিল–তোমাদের বাছুর?
খাওয়া হইলে আখের কাজলকে লইয়া তাহার পোষা হাঁস মুরগি ইত্যাদি দেখাইল। বলিল–কিছুদিন বাদে এসো, তোমাকে একটা হাঁসের বাচ্চা দেবো।
বইখানি বগলদাবা করিয়া কাজল আবার সেই বাঁশবন পার হইয়া মাঠে পড়িল। সূর্য ড়ুবিয়া গিয়াছে। বাঁশবাগানে ঘন ছায়া। সে যেখানটায় শুইয়াছিল, সেখানে বাঁশের খোলাগুলি এখনও পড়িয়া আছে। ছোটবেলায় নিশ্চিন্দিপুরে এই সময়টায় অন্ধকার বনের মধ্য দিয়া যাইতে ভয় করিত, ভাবিলে এখন হাসি পায়। গা ছমছমে অনুভূতি একটা হয় ঠিকই, তবে তাহা ভূতের ভয় নহে।
বাঁশবনটার মাঝখানে সে হঠাৎ দাঁড়াইয়া গেল। ঘনায়মান অন্ধকারে সে একা। জনপ্ৰাণী নাই কোথাও কোনোদিকে। সন্ধ্যার শব্দহীনতায় বাঁশ দুলিবার শব্দটা আরও স্পষ্ট লাগে।
মাঠের ভিতর দিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে কাজল দেখিল, দিগন্তে মেঘ জমিয়া বিদ্যুৎ চমকাইতেছে। মনে অদ্ভুত আনন্দ। আখেরের সহিত সন্ধ্যাটা খুব ভালো কাটিয়াছে। অচেনা অজানা মানুষ কত তাড়াতাড়ি আপন হইয়া যায়। আবার সে এখানে আসিবে।
মাঠের উপরে সেই সন্ধ্যায় তাহার এক অপূর্ব অনুভূতি হইল। বুঝিল, তাহার জীবন অন্যদের বাঁচিবাব প্ৰণালী হইতে একেবারে ভিন্ন রকম। অযথা সে পৃথিবীতে আসে নাই, তাহার একটা কিছু করিবার আছে। দিগন্তের ওই বিদ্যুচ্চমকের মতো সে জীবনের একঘেয়ে আকাশে চমক লাগাইয়া দিয়া যাইবে। উত্তেজনার প্রাবল্যে জোরে জোরে হাঁটিয়া কাজল বাড়ি পৌঁছিয়া গেল।
ঘরে ঢুকিতেই সুরপতি ডাকিয়া বলিলেন-কোথায় ছিলি দাদু?
–বেড়াতে গিয়েছিলাম দাদু, ওই গ্রামের দিকে।
–রাত বিরেতে মাঠে-ঘাটে বেশি থাকিস নে, সাপ-খোপ বেবোয়।
কাজল হাসিয়া জামাকাপড় ছাড়িয়া মুখ ধুইতে গেল। সুরপতি ডাকিয়া বলিলেন—চট করে হাতমুখ ধুয়ে আয়। আজ একটু আলো নিভিয়ে বোস তো। বড়ো চঞ্চল হয়েছিস, তোর মনঃসংযোগ হবে না ইয়ে হবে–
মেঘ আকাশের অনেকখানি ঢাকিয়া ফেলিয়াছে। বাতাস একদম বাহিতেছে না। ঝড় আসিতে পারে।
আঃ! মনে কোনো ভার নাই, মালিন্য নাই। দুপুরের দেখা সেই মাঠের মতো দিগন্তবিস্তৃত সবুজ জীবন।
ঘরে ফিরিয়া হৈমন্তীকে জড়াইয়া ধরিয়া কাজল বলিল–বড় ভালো লাগছে মা, আজ বড়ো ভালো লাগছে।
১০. হৈমন্তীর ঘরের দেওয়ালে
দশম পরিচ্ছেদ
হৈমন্তীর ঘরের দেওয়ালে দরজার মাথায় অপুর একখানা ছবি টাঙানো হইয়াছে। সারাজীবনে অপু ছবি তুলিয়াছে খুব কম। বিবাহের পরে পরেই হঠাৎ কী খেয়ালে কলিকাতার এক স্টুডিয়ো হইতে ছবিটা তুলিয়াছিল। রোজ স্কুলে যাইবার সময় কাজল বাবার ছবিকে প্ৰণাম করিয়া বাহির হয়। ছবিটা উঠিয়াছিল সুন্দর, মনে হয়। অপু হাসিহাসি মুখে ফ্রেমের ভিতর হইতে তাকাইয়া আছে। পারতপক্ষে হৈমন্তী ছবির দিকে তাকায় না, তাকাইলে বুকটা কেমন করিয়া ওঠে।
স্কুলে মাঝে মাঝে সাপ্তাহিক পরীক্ষা লওয়া হয়। এক পরীক্ষায় কাজল বাংলা রচনা লিখিতে গিয়া বিদেশী উপন্যাস হইতে একটা উপমা দিয়াছিল, পরদিন তাহা লইয়া খুব হৈ-চৈ। বাংলার শিক্ষক অখিলবাবু ক্লাসে তাহার খাতাখানা লইয়া আসিলেন। প্রথমেই কাজলের খোঁজ করিলেন।
–অমিতাভ এসেছে? কোথায় সে?
কাজল ভীতমুখে উঠিয়া দাঁড়াইল।
–এসেটা তোমার নিজের লেখা?
–হ্যাঁ সার।
অখিলবাবু চোখ লাল করিলেন–আবোলতাবোল এসব কী লিখেছ?
আবোলতাবোল কোনখানটা কাজল ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছিল না।
–কী সার?
–যে বইটার কথা তুমি লিখেছে, সেটা পড়া আছে তোমার? না জেনে লেখো কেন? নাকি অন্য কারুর লেখা মুখস্থ করে লিখেছে? সত্যি কথা বলো।
কাজল লেখার মধ্যে ড়ুমার ‘থ্রি মাসকেটিয়ার্স’-এর উল্লেখ করিয়াছিল। ইংরাজিতে বইটির শিশুপাঠ্য সংস্করণ সে পড়িয়াছে।
–বইটা আমি পড়েছি। সার।
–আবার তর্ক? মিছে কথা বলছে কেন? এই বই পড়েছে তুমি?
–মিছে কথা নয়। সাব, গল্পটা আপনাকে আগাগোড়া বলতে পারি।
কাজলের বয়সী কোনো ছেলে ‘থ্রি মাসকেটিয়ার্স’ পড়িয়া থাকিতে পারে, এ কথা অখিলবাবু বিশ্বাস করিলেন না। তাহার দৃঢ় ধারণা হইল কাজল মিথ্যা কথা বলিয়াছে, এবং একবার বলিয়া ফেলিয়া এখন আর কথা ঘুরাইতে পারিতেছে না।
অল্প বয়সে যাহা হয়–সে যে অনেক পড়িয়াছে, ইহা লোককে না জানাইয়া কাজল শান্তি পাইতেছিল না। বাহাদুরি দেখাইবার জন্য সে কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হইলেও বইটাব কথা উল্লেখ করিয়াছিল। অখিলবাবু চটিয়া হেডমাস্টার মশায়ের কাছে গিয়ে নালিশ করিলেন। ললিতবাবু হেডমাস্টার, তিনি কাজলকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। অন্য ছেলেরা ভয় দেখাইল—যাও না, মজা দেখবে। ফিরে এসে পিঠে মলম লাগাতে হবে।
ললিতবাবু বলিলেন—অখিলবাবু বললেন, তুমি তাঁর সঙ্গে উদ্ধত ব্যবহার করেছ। সত্যি?
–না।সার। উনি বললেন আমি মিথ্যে কথা বলছি, আমি নাকি বইটা পড়িনি। আমি বললাম যে গল্পটা ওঁকে শোনাতে পারি।
–সত্যি পড়েছে তুমি?
–সত্যি সার।
-ইংরাজিতে?
-হ্যাঁ সার। বাবা আমাকে বইটা উপহার দিয়েছিলেন। আমি এমন অনেক বই পড়েছি সার। কেন আমি শুধু শুধু অখিলবাবুর কাছে মিথ্যে কথা বলবো?
—আর কী কী বই পড়েছে তুমি?
–‘ডেভিড কপারফিল্ড’ পড়েছি, ‘গালিভারস ট্রাভেলস’, ‘ববিনসন ক্রুসো’, ‘টলস্টয়ের গল্প’一
—‘রবিনসন ক্রুসো’ কার লেখা?
–ডানিয়েল ডিফো-র।
ললিতবাবু টেবিলের ওপরে রাখা পেপারওয়েটটা নাড়াচাড়া করিতে করিতে বলিলেন–তোমাকে ইংরাজি কে পড়ান বাড়িতে।
-আমার বাবা পড়াতেন সার। বাবা মারা যাওয়ার পর দাদু পড়ান।
—বেশ। পড়াশুনা করা ভালো, তবে মাস্টারমশাইদের মুখের ওপর তর্ক কোরো না। বিদ্যা দদাতি বিনয়ম্। পড়ে যাও, পড়া ভালো।
কাজল চলিয়া গেলে হেডমাস্টার অখিলবাবুকে ডাকাইলেন।
–ছেলেটি মিথ্যে কথা বলেছে বলে তো মনে হলো না অখিলবাবু।
–বাচ্চা ছেলে ওইসব বই পড়েছে বলে আপনি বিশ্বাস করেন? তাছাড়া এই বয়সে ওইসব পাকামির বই পড়া কি ভালো?
–জিনিসটা ওভাবে দেখবেন না অখিলবাবু। বই তো খারাপ নয়। বিষয়বস্তুর কথা যদি বলেন, তবে বলতে হয়–
অখিলবাবু আলোচনা চাপা দিয়া দিলেন। বইটি তাঁহারও পড়া নাই।
বিকাল চারটায় স্কুলের ছুটি হয়। মসজিদের পাশের রাস্তা দিয়া কাজল রোজ বাড়ি ফেলে। আজ ছুটির পরে বেশ ক্ষুধা অনুভব হওয়ায় অন্যদিন হইতে বেশি জোরে হাঁটিয়া সে বাড়ি ফিরিতেছিল। পথে স্কুলের ইংরাজির শিক্ষক আদিনাথবাবু ডাকিয়া বলিলেন–অমিতাভ, শোন।
আদিনাথবাবু কাজলকে খুব ভালোবাসেন। ক্লাসে ছেলেদের উপদেশ দেন তাহাকে অনুসাবণ করিতে। পড়িতে পড়িতে কাজলের নিজস্ব একটা ইংরাজি লেখার ভঙ্গি তৈয়ারি হইয়াছে, তাহা আদিনাথবাবুর ভালো লাগে।
কাজল আগাইয়া গেল।–কী সার?
—আজ তোকে নিয়ে কী গোলমাল হয়েছে রে স্কুলে?
কাজল খানিকটা বলিতে তিনি বলিলেন-যে যা বলে বলুক। কারও কথায় আমল দিবি নে। পড়াশুনার অভ্যোস কখনও ছাড়বি নে, জীবনে উন্নতি হবে, দেখিস।
হৈমন্তী বসিয়া কী-একটা বই পড়িতেছিল। কাজলকে ঢুকিতে দেখিয়া বলিল–আয়। আজ এত দেরি হল যে আসতে? হাতমুখ ধুয়ে আয়, খেতে দিই।
স্কুল হইতে ফিরিয়া কাজল ভাত খাদ্য। হৈমন্তী আসন পাতিতে পাতিতে বলিল– আজকে রাত্তিরে শুয়ে সেই গল্পটা বলবি কিন্তু—
রাত্রে মায়ের কাছে শুইয়া কাজল মাকে গল্প শুনাইয়া থাকে। অপুর একটা ইংরাজি বইতে সে একটা ভূতের গল্প পড়িয়াছিল, সেই গল্পটা সম্প্রতি হৈমন্তীকে বলিতেছে।
দাদুর কাছে পড়া সাঙ্গ হইলে হ্যারিকেন লইয়া সে শতবঞ্চিব উপর বসিযা গল্পের বই পড়ে। ভূতের গল্প হইলে পরিবেশটা অদ্ভুত জমিয়া উঠে। হ্যারিকেনের আলোর পরিধির বাইরে যেন অজানা রাজ্য—আলোকবৃত্তের সামান্য পরিসবের ভিতরেই তাহার থাকিতে ইচ্ছা করে। গল্প খুব জমিলে কাজল কল ঘুরাইয়া পলতে আর একটু বাড়াইয়া দেয়।
খাওয়ার পর কাজল বাহির হইবার উদ্যোগ করিতেছিল। হৈমন্তী বলিল—আবার বেবুবি নাকি? তোর দেখা পাওয়া যায় না সারাদিন। এখন আবার টই টই করে বেরুবার কী দরকার? থাক, বাড়িতে থাক–
বোধহয় খুব একটা ইচ্ছা ছিল না বলিয়াই কাজল এক কথায় রাজি হইয়া গেল। বলিল–তুমি খাটে শোও মা। আমি পাশে শুয়ে গল্প করি। ব
হৈমন্তী প্রায়ই ছেলেকে নিজের ছোটবেলার গল্প শোনায়। যে দিনগুলি কাজল দেখে নাই, কাজলের ধারণা সেগুলি বর্তমানের চেয়ে অনেক ভালো ছিল। অতীতের প্রতি তাহার যে স্বপ্নময় কল্পনা রহিয়াছে, তাহাই হৈমন্তীর গল্পকে তাহার নিকট বাস্তব করিয়া তোলে। সেই দুর্গাপূজার আগে শিউলি ফুল তুলিতে যাওয়া, শিউলি ফুলের বোঁটা দিয়া কাপড় রঙিন করা, দল বাঁধিয়া হৈ হৈ করিয়া ঠাকুর দেখি, বাহির হওয়া কাজলের ধারণা সে দিনগুলি অনেক ভালো ছিল—অনেক, অনেক ভালো। মাকে বলে–মা, সেই গল্পটা বলো, সেই ঢাকায় যা হয়েছিল।
ঢাকায় থাকার সময়, হৈমন্তী তখন খুব ছোট, কাজলের দিদিমা একবার গভীর রাত্রে উঠিয়া ঘুমের মধ্যেই দোতলা হইতে একতলায় আসিয়া গিয়াছিলেন। গভীর রাত, কেহ কোথাও নাই, হঠাৎ দিদিমা বিছানায় উঠিয়া বসিয়া বলিলেন, বাবা এসেছেন–আমি দরজা খুলে দিই গে যাই। সুরপতি উঠিয়া পেছন পেছন গেলেন। দরজা খুলিয়া দেখা গেল, কিছুই নাই। তখনও দিদিমার ঘুম ভালো করিয়া ভাঙে নাই।
গল্প শুরু হইল। এক গল্প হইতে অন্য গল্পে যাইতে যাইতে ক্রমশ সন্ধ্যা হইয়া আসিল। জানালার বাহিরে দিনের আলো শেষ হইয়া আসিতেছে, ঘরের ভিতর এখনই আরছা অন্ধকার। হৈমন্তী গল্প থামাইয়া বলিল–যাই, সন্ধেটা দেখিয়ে আসি। দিদি বোধহয় চা করে ফেলল। এতক্ষণে।
কাজল চুপ করিয়া ছিল। পুরাতন দিনের গল্প, সন্ধ্যার বিষণ্ণ অন্ধকার তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছে। উঠিতে গিয়া হৈমন্তী কী একটা মনে পড়িয়া যাইবার ভঙ্গিতে বলিল–একটা ব্যাপার হয়েছে, জনিস?
-কী?
–আজ কদিন ধরে দেখছি, যার কথা খুব ভাবি সে এসে হাজির হয়। বিয়ের আগে বকুলের সঙ্গে আমার খুব ভাব ছিল, যাকে বলে গলায়-গলায় বন্ধুত্ব। তার বিয়ে হয়েছে কোন্নগরে। আজ দুপুরে বকুলের কথা খুব মনে পড়ছিল। ওমা, হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই, দুপুরেই বকুল এসে হাজির। বললে-বেড়াতে এসেছি, তোমাদের এখান থেকে ঘুরে গেলাম। দুদিন আগে এলো উমা, তার কথাও ভাবছিলাম সেদিন।
কাজল হৈমন্তীর দিকে তাকাইল।
–যাকে দেখতে ইচ্ছে করছে, সে-ই এসে হাজির হচ্ছে?
হৈমন্তী মাথা নাড়িল।
কাজল দরজার উপরে বাবাব ছবিটার দিকে তাকাইল। যদিও ঘর অন্ধকার, তবুও বাবার মৃদু হাসি ঠিক ধরা যায়।
১১. কাজলের স্কুল হইতে ফিরিবার পথে
একাদশ পরিচ্ছেদ
কাজলের স্কুল হইতে ফিরিবার পথে একটা দোকান পড়ে। ছাত্রেরা দোকান হইতে চকোলেট বিস্কুট কিনিয়া খায়। সেদিন কাজল দোকানটায় ঢুকিল। উদ্দেশ্য, বিশেষ এক ধরনের লজেন্স ক্রয় করা। একদিন খাইয়া ভালো লাগিয়াছিল, আবার কিনিবার জন্য সুরপতির নিকট হইতে পয়সা লইয়া আসিয়াছে।
দোকানদারকে সবাই আন্টি বলিয়া ডাকে। ওষ্ঠদেশে প্রলম্বিত গুম্ফযুক্ত একজন দশাসই পুরুষের উদ্দেশে কেন যে উক্ত বিদেশী স্ত্রীলিঙ্গ শব্দটি প্রযুক্ত হয় বোঝা মুশকিল। তবে মানুষটি ওই ডাকে সাড়া দিয়া থাকে কোনো উত্মা প্রকাশ না করিয়াই।
আন্টি কাজলকে লজেন্স গণিযা দিতেছে, এমন সময় দোকানের পিছন হইতে বেশ ভাল গলায় গাওয়া গান ভাসিয়া আসিল। কাজল জিজ্ঞাসা করিল—কে গান গাইছে আন্টি?
আন্টি বলিল—আপনাদের ইস্কুলেই ছেলে, এখানে এসে বসে মাঝে মাঝে।
আন্টি তর্জনী আর মধ্যমা একত্রে ঠোঁটের কাছে ধরিয়া হুশ হুশ করিয়া ব্যাপারটা বুঝাইয়া দিল।
কৌতূহলী কাজল দোকানের পিছন দিকে ঢুকিল।
জায়গাটা আন্টির শুইবার স্থান। দরমার বেড়া দিয়া ঘেরা, উপরে টিনের চাল। মেঝেয় কালি পড়া মেটে হাঁড়ি, এনামেলের সানকি, তোলা-উনান এবং ঘরের কোণে রাখা একটা প্যাকিং বাক্সে তৈল-তণ্ডুলাদি। একপ্রান্তের দড়ির খাটিয়ায় ময়লা কুটকুটে বিছানা, তাহার উপর বসিয়া একটি ফরসামত ছেলে চোখ বুজিয়া হাত সামনে বাড়াইয়া রীতিমত ওস্তাদি ঢঙে গান গাহিতেছে। কোনো ষষ্ঠেন্দ্রিয় দ্বারা কাজলের উপস্থিতি বুঝিয়া সে গান থামাইল এবং চোখ খুলিয়া তাকাইল।
কাজল এবং ফরসা ছেলেটি কিছুক্ষণ পরস্পরের দিকে তাকাইয়া রহিল। নীরবতা অস্বস্তিকর হইয়া উঠিতেছে দেখিয়া কাজল বলিল—গাও না, বেশ তো গাইছিলে।
ছেলেটি হাসিল। ময়লা বিছানার এক প্রান্ত হাত দিয়া ঝাড়িয়া বলিল—এখানে বসো।
এতক্ষণে কাজলের মনে পড়িয়াছে, ছেলেটি তাহাদেরই ক্লাসে অন্য সেকশনে পড়ে। আলাপ হয় নাই, দূর হইতে বারকয়েক দেখিয়াছে। কাজল জিজ্ঞাসা করিল-তুমি তো বি-সেকশনে পড়ো, না? তোমার নাম কী?
ছেলেটি মাথা পিছনে হেলাইয়া, চোখ অর্ধনিমীলিত করিয়া গম্ভীর গলায় বলিল—আমার নাম ব্যোমকেশ চৌধুরী।
তাহার ভঙ্গি দেখিয়া সন্দেহ হইতে পারিত সে বলিতেছে–আমার নাম নেপোলিয়ন বোনাপার্ট।
কাজল বুঝিল একটি অদ্ভুত চরিত্রের সহিত তাহার পরিচয় হইতে চলিয়াছে। সে আন্টির বিছানায় বসিল।
—তুমি কী গাইছিলে? সুন্দর সুর।
–মালকোষ গাইছিলাম, বেশ মেজাজ আসে গাইলে।
কাজল অবাক হইল। এ অঞ্চলে রবীন্দ্রসংগীতই কেহ গায় না, তার উপর রাগসংগীত।
-তুমি গান শেখো?
—ছোড়দা শেখে। ছোড়দা ওস্তাদের কাছে শেখে, আমি ছোড়দার কাছে শিখি। কাজেই আমিও শিখি বলতে পারো। তুমি সিগারেট খাও?
খাওয়া দূরের কথা, কাজল কল্পনাও করিতে পারে না।
—আমিই খাই তবে।
পকেট হইতে একটা সিগারেট বাহির করিয়া আন্টির বিছানার নিচ হইতে ব্যোমকেশ দেশলাই বাহির করিল। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়িয়া বলিল—আমাদের দেশ বগুলায়। বগুলার নাম শুনেছো? বগুলার কাছেই কুমারী রামনগর গ্রামে আমাদের বাড়ি। বাবা ডাক্তার। তোমার বাড়ি কোথায়?
আমাদের দেশ নিশ্চিন্দিপুবে, সেও গ্রাম। বাবা মা যাওয়ার পর এখানে মামাবাড়িতে থাকি।
-রবি ঠাকুরের কবিতা কেমন লাগে?
কাজল বিপদে পড়িল। রবীন্দ্রনাথের কবিতা তাহার খুব বেশি পড়া নাই, দুই-একটা যাহা পড়িয়াছে, সম্পূর্ণ মানে বোঝে নাই। বলিল—বেশি তো পড়ি নি, যা পড়েছি বেশ লেগেছে।
অনেক কথাবার্তা হইল। কাজল দেখিল, ব্যোমকেশ একটু ছিটগ্রস্ত। মনের খুশিতে ঘোরে, গান গায়, বই পড়ে। মাঠে মাঠে ঘুরিয়া গাছপালা চিনিয়া বেড়ায়। এমন সব গাছপালাব নাম করিল, যাহা কাজল চিনিলেও অনেক শহুরে ছেলে নামও শোনে নাই। উঠিবার সময়ে আড়মোড়া ভাঙিয়া বলিল—তাও কতকিছু ভুলে যেতে বসেছি। গ্রামে থাকতে অনেক কিছু জানতাম–
—গ্রাম ছেড়ে এলে কেন?
–ছোড়দা এখানে চাকরি করে। ছোড়দার কাছে থেকে পড়ি। বাবর একার আয়ে চলে না। নতুন পাস করা ভালো ভালো সব ডাক্তার গিয়ে বাবার পসার মাটি করেছে। বাবা খুব তেজী সোক ছিলেন, জানো? অনেকদিন আগে সেটেলমেন্টের লোক জমি জরিপ করতে গিয়েছিল—সঙ্গে ছিল এক সায়েব। সে কঠিন অসুখে পড়লে বাবা চিকিৎসা করে তাকে সারিয়ে তোলেন। সায়েব বলেছিল বাবাকে বিলেতে নিয়ে যাবে। এক রাত্তিরে বাবা তো পালিয়ে যাওয়ার মতলব করলেন। বাবার বয়স তখন সাতাশ-আটাশ, রক্ত গরম। কথা ছিল মাইল দশেক দূরে এক জায়গায় দেখা করার, সেখান থেকে সায়েব বাবাকে নিয়ে চলে যাবে, ঠাকুমা কী করে জানতে পেরে আগে থেকে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালেন। বাবা ঘোড়ায় চেপে বাড়ির পাশে বড়ো আমবাগানটা পার হচ্ছেন, ঠাকুমা এসে পড়লেন একেবারে ঘোড়ার সামনে। বললেন–হরু, যেতে হয় আমার উপর দিয়ে ঘোড়া চালিয়ে যা। বাবার আর বিলেতে যাওয়া হল না।
পরের দিন আবার দেখা হইবে বলিয়া কাজল বিদায় লইল।
ব্যোমকেশের সহিত কাজলের ঘনিষ্ঠতা বেশ বাড়িয়া উঠিল। দুইজনে শহর ছাড়াইয়া গ্রামের দিকে বেড়াইতে যায়, কাঠালিয়া গ্রামের আখের আলির বাড়ি যায়। ব্যোমকেশ মাঠের মধ্যে হাত পা নাড়িয়া গান করিতে করিতে হাঁটে। কখনও বৃষ্টি আসিলে দুজনে দৌড়াইয়া চাষীদের ধান পাহারা দেওয়া চালার নিচে আশ্রয় নেয়। বৃষ্টি দেখিতে দেখিতে ব্যোমকেশ একটা সিগারেট ধরাইয়া বলে— চমৎকার বৃষ্টি, গাইতে ইচ্ছে করছে। দেশ আর মল্লার—এ দুটো ঝম ঝম বৃষ্টিতে ভারি জমে, বুঝলে?
কোথায় একটা পাখি ডাকিয়া ওঠে—কুউ-কুউ-কুউ-কুউ। স্বরটা খাদ হইতে আরম্ভ হইয়া চড়ায় গিয়া শেষ হয়। ব্যোমকেশ বলে–বর্ষাকোকিল ডাকছে, শুনছো?
কাজল ডাকটা আগেও শুনিয়াছে, কিন্তু পাখির নামটা যে বর্ষাকোকিল তাহা জানিত না। সে বলিল—বর্ষার কোকিল আছে নাকি আবার?
–নেই তো ওটা কী ডাকছে?
চারিদিকে বুক সমান ধানগাছ দেখাইযা ব্যোমকেশ বলে—রামনগরে এইরকম ধানক্ষেতে বর্ষার দিনে আমাকে একবার সাপে তাড়া করেছিল। টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছে, আলের ওপর দিয়ে হাঁটছি, এমন সময় ধানগাছের ভেতর থেকে বিরাট এক কেউটে এসে আলের ওপর উঠল। কী তার ফেঁসফোসানি, কী তার কুলোপানা চক্কর! নেহাত আমার কাছে বেদের দেওয়া সাপের ওষুধ ছিল, তাই বেঁচে গেলাম।
-কী করলে ওষুধ দিয়ে?
—ওষুধ একরকম শেকড়। সাপের ভয়ে তাই সবসময পকেটে নিয়ে ঘুরতাম—আমাদের ওদিকে ভীষণ সাপের উপদ্রব কিনা। ছোবল মারবে বলে সাপটা যেই ফণা তুলেছে, অমনি শেকড়টা সামনে বাড়িয়ে দিলাম। সাপ মাথা নিচু করে চলে গেল, না কামড়ে।
স্কুল-জীবনে ব্যোমকেশ কাজলের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল—একমাত্র বন্ধু। পরে অবশ্য যোগাযোগ ক্ষীণ হইয়া আসিয়াছিল। প্রবেশিকা পরীক্ষায় তিন দিন পরীক্ষা দিবার পর ব্যোমকেশ আর আসিল না। কে আসিয়া বলিল—স্কুলে আসিবার সময়ে সে দেখিয়াছে ব্যোমকেশ মাঠের ধারে বসিয়া গান গাহিতেছে, পাশে খাতা-কলম-দোয়াত।
পরীক্ষা হইয়া যাইবার পর কাজল ব্যোমকেশকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, তুই পরীক্ষা দিলি না কেন?
ব্যোমকেশ হাসিল। পরীক্ষা দিবে বলিয়াই খাতা-কলম লইয়া সে বাহির হইয়াছিল, পথে মাঠের দৃশ্যটা এমন ভাল লাগিয়া গেল যে বসিয়া একটা গান না গাহিয়া সে পারে নাই। গানটা কিঞ্চিৎ দীর্ঘ হওয়ায় দেড়ঘণ্টা সময় পার হইয়া গিয়াছি।
ব্যোমকেশ কোনদিনই প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করিতে পারে নাই। বৎসর চারেক বাদে একদিন কাজলের সহিত তাহার দেখা হইয়াছিল—তখন ব্যোমকেশের খুব দুঃসময় যাইতেছে। পড়াশুনা হয় নাই, চাকরি পায় নাই। বাবা মারা গিয়াছেন, দাদার সংসারে অনটন—সেখানে বসিয়া বসিয়া খাওয়া ভাল দেখায় না। শুষ্ক মুখে চাকরির সন্ধানে ঘুরিতেছে। আর গান গায় না, আগের সে প্রাণোচ্ছলতা নাই। কাজলের খুব খারাপ লাগিতেছিল, কিন্তু করিবার কিছু ছিল না।
প্রথম আলাপের মাসখানেক বাদে একদিন বিকালে ব্যোমকেশ কাজলের বাড়িতে আসিল। কাজল ঘরে বসিয়া পড়িতেছে (পাঠ্য নহে—-অপাঠ্য বই), হৈমন্তী আসিয়া বলিল–বুড়ো, তোকে কে ডাকছে। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, ভেতরে আসতে বললাম, এলো না।
কাজল বাহির হইতেই ব্যোমকেশ বলিল—খুব বেশি হলে পাঁচ মিনিট সময় দেওয়া যেতে পারে। চট করে একটা জামা গলিয়ে বেরিয়ে পড়বি। দেরি করিস না, যা
—কিন্তু যাবোটা কোথায়?
—সে সব পরে। আগে বেরিয়ে আয়।
বাহির হইয়া ব্যোমকেশ বলিল—বিপুলগড়ের শিবমন্দিরে যাবো, চল্। যাবো যাবো করছিলাম, আজকে মনস্থির করে ফেলেছি।
—বিপুলগড়ে যাবি এখন? তোর কি মাথা খারাপ?
–মেলা বকিস না। খুব মজা হবে, দেখবি।
বিপুলগড় কাঁঠালিয়া ছাড়াইয়া অনেক দূর। গ্রামের বাহিরে জঙ্গলের ভিতরে একটা পোড়ো শিবমন্দির আছে। দিনের বেলাও কেহ সেখানে যায় না। কারণ প্রথমত ঘন জঙ্গল, দ্বিতীয়ত মন্দিরে আকর্ষণীয় কিছু নাই। বড়লোক জমিদার শখ করিয়া মন্দির বানাইয়াছিল–তাহারা সপবিবারে কলিকাতায় উঠিয়া গিযাছে। সে প্রায় সত্তর বৎসর আগের কথা। তাহাদের বড়ো বাড়ির ভগ্নাবশেষ পাশেই পড়িয়া আছে—জঙ্গলাবৃত অবস্থায়।
কাজল একটু আপত্তি করিয়া বলিল–বৃষ্টি আসতে পারে, দেখছিস না আকাশে মেঘ। অমন জায়গায় যাওযাটা উচিত হবে এখন?
–তবে থাক তুই।
ব্যোমকেশ সত্যই চলিয়া যাইতেছে দেখি কাজল দৌড়াইয়া তাহাকে ধরিল।
-রাগ করছিস কেন? চল, আমিও যাবো।
আকাশে মেঘ ছিল—আরও মেঘ চাপিয়া অন্ধকার হইয়া আসিল। ব্যোমকেশ বলিল–অ্যাডভেঞ্চারের পরিবেশ তো এই। মেঘলা দিন, জঙ্গলের ভেতরে পোড়ো মন্দির, ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া। একেবারে পাঁচকড়ি দের গল্প, অ্যাঁ?
ততক্ষণে কাজলেরও ভাল লাগিতে শুরু করিয়াছে। ওয়াইড ওয়ার্লড ম্যাগাজিন পড়িয়া বহু দুর্গম দেশে সে মনে মনে অ্যাডভেঞ্চার করিয়াছে। ঘন জঙ্গলের মধ্যে একটা সুঁড়িপথে তাহারা ঢুকিল। বেলা আছে, কিন্তু মনে হইতেছে সন্ধ্যা নামিল বলিয়া। শিবমন্দিবের চাতালে উঠিয়া দুইজনে দাঁড়াইল। মন্দিরের মাথায় বটগাছ গজাইয়াছে, ভারি কাঠের দরজা ভাঙিয়া কব্জায় আটকাইয়া ঝুলিতেছে। চাতাল চৌকা টালি বসাইয়া তৈয়ারি, এতদিন বাদেও বেশ মসৃণ। একটুও শব্দ নাই কোন দিকে, বাতাসে একটা বন্য গন্ধ।
কাজল চালের উপর বসিয়া পড়িল। কয়েকটা কালো ডেয়ো পিঁপড়া এখানে ওখানে ঘুরিতেছে। ঠিক নিচেই কতকগুলি বনতুলসীর গাছ জড়াজড়ি করিয়া আছে। দূরে ভাঙা নাটমন্দির দেখা যাইতেছে। কাজল ভাবিতেছিল, এই জায়গাটা না জানি কত জাঁকজমকপূর্ণ ছিল। দেলদুর্গোৎসবে কুলবধুরা ভিড় করিয়া পূজা দেখিত, ঝাড়লণ্ঠনের আলো প্রতিমার মুখে পড়িয়া ঘামতেল চকচক করিত। সন্ধ্যায় শাঁখ বাজিত, বৃদ্ধারা মালাজপ করিতেন। কে কোথায় চলিয়া গিয়াছে—কেহ নাই, কিছু নাই। তাহাদের চিহ্ন পৃথিবী হইতে একেবারে মুছিয়া গিয়াছে সাক্ষী হিসাবে রহিয়াছে কেবল এই ভাঙা নাটমন্দির।
ব্যোমকেশ ডাকিল–অমিতাভ।
–কী?
কী রকম একটা লাগছে না? কাজল ব্যোমকেশের দিকে তাকাইল। ব্যোমকেশের মুখ গম্ভীর, যেন একটা ভয়ানক কিছুর জন্য অপেক্ষা করিতেছে।
-কী রকম লাগছে মানে?
—চারিদিকে কেমন একটা থমথমে ভাব, তাই না? এমনি জায়গাতেই তো বহুদিনের মৃত আত্মারা নেমে আসে।
কাজল সমর্থন করিল। আসিয়াই জিনিসটা সে অনুভব করিয়াছে। বাতাসে রহস্যের গন্ধ। সাধারণত জীবনে যাহা ঘটে না, তাহা যেন এখানে এখনই ঘটিবে। কিছুদিন আগেই সে রিপ ভ্যান উইঙ্কল পড়িয়াছে। ওই সুঁড়িপথটির বাঁক হইতে এখনি হাফমুন জাহাজের কোনো মৃত নাবিক বাহির হইয়া আসিলে সে বিন্দুমাত্র অবাক হইবে না।
ব্যোমকেশ বলিল—মন্দিরের ভেতরে ঢুকে দেখি চল—
ভিতরে বেশ অন্ধকার। ব্যোমকেশ পকেট হইতে দেশলাই বাহির করিয়া জ্বালিল। কাঠি পুড়িতে যতটা সময় লাগে তার মধ্যেই দেখা গেল, মন্দিরের ভিতরে কালো পাথরের শিবলিঙ্গ, তাহার মাথায় কয়েকটি ফুল। ঘরের ভিতরে আর কিছু নাই—দেওয়ালে একটা কুলুঙ্গি ছাড়া।
বাহিরে আসিয়া একটা সিগারেট ধরাইয়া ব্যোমকেশ বলিল–একটু ভূপালী গাই।
কাজল হাঁটুর উপর থুতনি রাখিয়া শুনিতে লাগিল। ভূপালী রাগ ব্যোমকেশ ভালোই আয়ত্ত করিয়াছে। দরাজ গলায় ষড়জ লাগাইয়া আলাপ শুরু করিল। এমন সময় কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়িল। গান থামাইয়া ব্যোমকেশ উপরদিকে তাকাইয়া বলি—বৃষ্টি এলো বলে মনে হচ্ছে।
কথা শেষ হইতে না হইতে ঝম ঝম বৃষ্টি নামিল। ব্যোমকেশ লাফাইয়া উঠিয়া বলিল—ঢোক মন্দিবে।
হুড়মুড় করিয়া তাহারা মন্দিরে ঢুকিল। বৃষ্টির তোড় প্রতি মুহূর্তে বাড়িতেছে। সাবধানে শিবলিঙ্গের স্পর্শ বাঁচাইয়া দুইজনে এক কোণে চুপ করিয়া দাঁড়াইল। দরজার ফ্রেমে আটকানো বাহিরের বনজঙ্গল, মন্দিরের চাতালেব কিয়দংশ প্রচণ্ড বৃষ্টিতে অদ্ভুত দেখাইতেছে। কাজল বলিলমুশকিল হল, এখন ফিরবো কী করে?
–ফেরবার তাড়া কীসের? বেশ তো লাগছে। ব্যোমকেশের গলা স্বপ্নালু।
বৃষ্টি কমিল না। জোলো হাওয়া এক একবার ভীষণ দাপটে দরজার ভাঙা পাল্লাটাকে খটখট করিয়া নাড়িতেছে। বাতাসের জোর খুব বাড়িয়াছে, অত ভারি পাল্লাটা নাড়িতেছে তখন। মাঝে মাঝে বৃষ্টির ছাঁট আসিয়া পড়িতেছে। ঠাণ্ডা হাওয়ায় শীত শীত করিতে লাগিল।
ঘরের ভিতর কিছু দেখা যায় না, ঘন অন্ধকার। ব্যোমকেশ বলিল–যখন আলো জ্বাললাম, ঠাকুরের মাথায় ফুল দেখেছিলি অমিতাভ?
–হুঁ।
–তার মানে, রোজ কেউ পুজো করে যায়। কুলুঙ্গিতে কী আছে দেখি দাঁড়া, মানুষ এখানে আসে যখন–
একটু পরেই অন্ধকারের ভিতর আবার ব্যোমকেশের গলার স্বর—কী পেলাম বল তো?
-কী?
–মোমবাতি। দাঁড়া জ্বালি। মোমবাতির সঙ্গে আরও একটা জিনিস আছে। গাঁজার কল্কে।
মন্দিরে অতএব শিবভক্তদের আনাগোনা প্রমাণিত হইল। কাজলের হাসি পাইতেছিল। মোমবাতি জ্বালাইয়া সেটাকে কোণের দিকে রাখিয়া ব্যোমকেশ গান ধরিল–দেশ রাগে।
বাহিরে হাওয়ার মাতামাতি—অন্ধকার, ভিতরে মোমবাতির কাঁপা কাঁপা স্বল্প আলো, তাহার সহিত ব্যোমকেশের গান। কাজল ভুলিয়া গেল বাড়ি ফিরিতে আজ অনেক দেরি হইবে, মা ভাবনা করিবে। ভুলিয়ে গেল যে স্থানে তাহারা বসিয়া আছে, তাহা আদৌ নিরাপদ নহে। রোমাঞ্চকর পরিবেশ তাহাকে সব ভুলাইয়া দিয়াছিল।
দরজার কাছে দাঁড়াইয়া কাজল বাহিরে তাকাইল। ভাঙা নাটমন্দিরের দিকটা একেবারে ভূতের দেশ বলিয়া মনে হইতেছে। বিদ্যুৎ চমকাইলে চারিদিক পলকের জন্য আলোকিত হইয়া উঠিয়াই আবার আবছা অন্ধকারে ডুবিয়া যাইতেছে। দরজার দুইদিকে হাত রাখিয়া সে অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল।
একনাগাড়ে প্রায় চার ঘণ্টা বৃষ্টি হইয়া তারপর থামিল। ব্যোমকেশ আর কাজল পাশাপাশি হাঁটিয়া বাড়ি ফিরিতেছিল। কাহারও মুখে কথা নাই। এই চার ঘণ্টার অভিজ্ঞতা তাহাদের প্রাণ পূর্ণ করিয়া দিয়াছে। মেঘ জমিয়া আছে, তবে বৃষ্টি নামিবার আপাতত আর আশঙ্কা নাই।
রাত্রে কাজল চোরের মতো বাড়িতে পা দিল, তখন তাহাকে খুঁজিবার জন্য লোক বাহির হইয়া গিয়াছে।
একদিন কানে আসিল খঞ্জনীর বাজনা—কে যেন খঞ্জনী বাজাইয়া গান গাহিতেছে। মানুষটাকে কাজলের চেনা লাগিল, তারপরই দৌড়াইয়া লোকটির কাছে গিয়া ডাকিল–রামদাস কাকা!
রামদাস প্রথমে কাজলকে চিনিতে পারে নাই। একটু পরেই প্রসন্ন হাসিতে তাহার মুখ ভরিয়া গেল। পুরাতন দিনের অভ্যাসমত খঞ্জনীটা একবার দ্রুত বাজাইয়া বলিল—খোকনবাবা না? তুমি এখানে কোথায়? তোমাকে মাধবপুরের মাঠে দেখেছিলাম–
কাজল তাহাকে সমস্ত ঘটনা বলিল, শুনিয়া রামদাস অনেকক্ষণ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। একটু পরে গলা সাফ করিয়া বলিল–বাবার সঙ্গে দেখা হলো না, আমারই দোষ। তোমাকে কথা দিয়েছিলাম তোমাদের বাড়ি যাবো–গিয়ে উঠতে পারি নি।
কাজল দেখিল রামদাস একই রকম আছে, বিশেষ বদলায় নাই। কথায় কথায় হাসে, কথায় কথায় খঞ্জনী বাজায়। অপুর মৃত্যুর কথা শুনিয়া সে একটুখানি গম্ভীর হইয়াছিল বটে, কিন্তু পরমুহূর্তেই হাসিয়া বলিল—আমারই বা আর কদিন খোকনবাবা? তার নামেই জীবন, তার নামেই মৃত্যু। নিজের নামে কিছু রাখলেই যত বখেড়া এসে জোটে। বেশ তো আমি তাঁর নাম করে—
কাজল বলিল—তুমি আজ আমাদের বাড়ি যাবে চলো, কোনো কথা শুনবো না।
–কিন্তু আজকাল আমি একবেলা আহার করি, ওবেলা একবার হয়ে গেছে।
–মিষ্টি খাবে চল, তাতে দোষ নেই। মা তো একাদশীর দিন মিষ্টি খান।
—মিষ্টি খাওয়া যায় হয়তো, কিন্তু অত হাঙ্গামায় কী দরকার? খাওয়াটাই সব নয়, তার চেয়ে কোথাও বসে একটু কথা বলি তোমার সঙ্গে।
কাজল কিছুতেই শুনিল না, রামদাসকে ধরিয়া বাড়ি লইয়া গেল।
হৈমন্তী যত্ন করিয়া আসন পাতিয়া বসাইয়া তাহাকে খাওয়াইল। খাইতে পাইয়া রামদাস ছেলেমানুষের মতো খুশি হইল। খাইবে না খাইবে না করিয়া অনেকগুলি মণ্ডা খাইয়া ফেলিল। হৈমন্তী মুখ টিপিয়া হাসিয়া বলিল—আর দেবো বাবা?
রামদাস ব্যস্ত হইয়া বলে—আর না, আর না। খোকনবাবা, এবার তুমি খাও।
—আমি খেয়েছি কাকা, চলো তোমার সঙ্গে বরং একটু ঘুরে আসি।
বাহির হইবার আগে হৈমন্তী রামদাসকে বেশ বড়রকমের একটা সিধা আনিয়া দিল। সিধার চালের উপর একটা টাকাও আনিয়াছে। রামদাস হাসিয়া বলিল—এই সব কার জানো?
—এ আপনাকে নিতে হবে বাবা, সামান্য দিয়েছি।
–শ্রদ্ধার দান মাত্রেই অসামান্য, সামান্য নয়। কিন্তু এ তো আমি নিতে পারবো না।
–কেন বাবা?
—প্রয়োজন মতো আমি ভিক্ষা করি, প্রয়োজনের অধিক কখনও নিই না। তাতে আর একজনের অমে ভাগ বসানো হয়। আজ ভিক্ষা করে কালকের মতো চাল পেয়ে গেছি—আজ আর নেবে না।
বহু অনুরোধেও রামদাস রাজি হইল না। রাস্তায় বাহির হইয়া কাজলকে বলিল—নিলে কেবল লোভ বাড়ে, লোভ বড়ো খারাপ জিনিস খোকনবাবা।
লোভ কথাটা উচ্চারণ করিবার সময় সে এমন ভাব করিল যেন সামনে সাপ দেখিয়াছে।
কাজল বলিল–তোমাকে যদি এখন কেউ এক লাখ টাকা দেয়, তাও নেবে না?
–কী করব নিয়ে? তাতে আমার মনের শান্তি চলে যাবে, সব সময়ে ভালো খেতে ভালো পরতে ইচ্ছে হবে। রাত্তিরে জেগে বসে থাকতে হবে, পাছে চোরে টাকা নিয়ে যায়। এই করে করে যখন বুড়ো হব, তখন হঠাৎ একদিন দেখবো আমার এক লাখ টাকা কবে জমার খাতা থেকে খরচের খাতায় চলে গেছে, জমার খাতায় মস্ত বড় একটা শূন্য। না না, খোকনবাবা, তিনি আমাকে যেন কখনও টাকাপয়সা না দেন—সে আমি সহ্য করতে পারবো না, মরে যাবো।
কাজলের রামদাসের প্রতি শ্রদ্ধা হইল। সে বলিল—কিন্তু সারাজীবন এই ভাবে ছন্নছাড়ার মতো ঘুরে বেড়াতে তোমার ভালো লাগবে? শেষ জীবনে একটা আশ্রয় তো দরকার
রামদাস মৃদু মৃদু খঞ্জনী বাজাইতে বাজাইতে বলিল—ছন্নছাড়া! আমাকে ছন্নছাড়া বলছে, তোমার সাহস তো কম নয় বাবাজী। আমাকে তিনি যেমন রেখেছেন, তেমনি আছি। তিনি যেমনভাবে যেখানে খেলা শেষ করতে বলবেন, সেখানে তেমনিভাবে খেলা শেষ করে দেবো। তার হাতে আছি—তার মধ্যে আবার খারাপ ভালো কী?
কাজলের পক্ষে যদিও রামদাসের দর্শনের গভীরে প্রবেশ করা সম্ভবপর হইল না, তবুও তাহার কথা কাজলের ভালো লাগিতেছিল। সহজ বিশ্বাসের সুরটি তাহার হৃদয় অধিকার করিতে বেশি সময় নেয় নাই।
কাজল বলিল—এর মধ্যে অনেক ঘুরেছ তুমি, না? গল্প বলো না শুনি।
হ্যাঁ, এই চার বৎসরে রামদাস অনেক ঘুরিয়াছে, অনেক নূতন জায়গা দেখিয়াছে। একস্থানে সে বেশিদিন থাকিতে পারে না, প্রাণ পালাই পালাই করে। দুনিয়াটা যদি ঘুরিয়াই না দেখিবে, তবে ঈশ্বর তাহাকে চোখ দুইটা দিয়াছেন কী প্রয়োজনে?
একবার তাহার এক সাকরেদ জুটিয়াছিল। সে জোগাড় করে নাই, লোকটা জুটিয়া গিয়াছিল। ভক্তিভাবের কথা বলে, গদগদ কণ্ঠস্বর। দিন সাতেক ছিল সঙ্গে। এক শহরে কোন এক বড়লোকের বাড়ি গান করিয়াছিল রামদাস। তাহারা খুশি হইয়া রামাসকে একখানা নূতন কাপড় দিয়াছিল। রাত্রে সামান্য আহার করিয়া দুইজনে একটা হাটচালায় শুইয়াছিল। পরদিন সকালে ঘুম হইতে উঠিয়া দেখে সাকরেদটি উধাও—তন কাপড়খানাও নাই।
কাজল বলিল—তুমি কী করলে তখন?
—কী আবার করবো? ভারি দুঃখ হল মনে। কাপড়টা চেয়ে নিতে পারতো আমার কাছ থেকে, আমি দিয়ে দিতাম। অনর্থক চুরি করে সে পাপের ভাগী হল।
-তোমার রাগ হল না?
—না বাবাজী। তার নিশ্চয়ই আমার চেয়ে বেশি দরকার ছিল, নইলে সে নেবে কেন? তবে আমাকে বললেই পারতো। মানুষের অসাধুতা দেখলে বড়ো কষ্ট পাই মনে। কী লাভ অসাধুতায়! সেই তো একদিন সবকিছু ছেড়েছুড়ে বেরিয়ে পড়তে হবে চিরদিনের জন্য, তবে আর কেন পেছনে কুকীর্তি রেখে যাওয়া?
রামদাস বিদায় লইবার আগে কাজল তাহাকে বলিল—তুমি মাঝে মাঝে আসবে তো রামদাস কাকা? আমাদের বাড়ি তো চেনা হয়ে গেল।
–বলতে পারি না বাবাজী। কখন কোথায় থাকি তার তো ঠিক নেই। আজ এখানে আছি, কাল থাকব আর এক জায়গায়। সেখো না, সেই মাধবপুরের মাঠের পর আবার কতদিন বাদে আমার দেখা হল।
—তুমি বোধ হয় কাউকেই বেশি ভালোবাসোনা রামদাস কাকা, তাহলে কি না দেখে থাকতে পারতে? খালি ঘুরে ঘুরে বেড়ালে আর একজনকে ভালোবাসা যায়?
প্রশ্নটা শুনিয়া রামদাস কেমন অন্যমনস্ক হইয়া গেল, আনমনে খঞ্জনীতে টিন-টিন আওয়াজ তুলিতে লাগিল। কাজল বলিল—সত্যি কথা বলিনি, কাকা?
মুখটা এদিকে ফিরাইয়া রামদাস বলিল—একজনকে ভালোবাসার জন্য তো জীবনটা নয় বাবাজী, আমি চেয়েছিলাম সবাইকে ভালোবাসতে। তা আর হল কই? একজনকে ভালোবাসলে জীবনটা বড়ো ছোট হয়ে যায়। কিন্তু সবাইকে ভালোবাসার মতো হৃদয়ও তো ভগবান আমাকে দেননি, কী করি তুমিই বলো?
একটু চুপ করিয়া রামদাস বলিল—এখন মনে হয় গাছ নদী ফুল ফল সবকিছুর ভেতরেই আলাদা করে দেখবার মতো রূপ আছে, এমন কী পাথবের মধ্যে মাটির মধ্যে আলাদা সত্তা–আমি তাই দেখি। কী পেলে চাওয়া আমার পূর্ণ হয় তা আমি এখনও জানি না, তারই সন্ধানে ঘুরে বেড়াই।
অপুর শেষ উপন্যাসটা পাঠকমহলে আলোড়ন আনিয়াছিল। জীবনকে এত বিচিত্রভাবে অন্য কোনো লেখক দেখেন নাই—এই বলিয়া বড়ো বড়ো কাগজে সমালোচনা বাহির হইল। নূতন উপন্যাসখানির কাটতি অত্যন্ত বেশি, অন্যান্য বইও ভালো চলিতেছে। অপুর মৃত্যুর পর পাঠকেরা হঠাৎ যেন তাহাকে লইয়া ক্ষেপিয়া উঠিয়াছে।
বইপত্র হইতে আয়ের হিসাব এবং টাকাকড়ি আদায় ইত্যাদি এখন সুরপতি ও প্রতাপ করিয়া থাকে। হৈমন্তীর ভাঙা সংসারের হাল সুরপতি এখন শক্ত হাতে ধবিয়াছেন। মেয়েকে অভয় দিয়া বলিয়াছেন—তোর কোন ভয় নেই, হৈম, কাজলের ভবিষ্যতের ভার আমার হাতে রইল।
গ্রীষ্মে প্রখর রৌদ্র পৃথিবীটাকে পোড়াইয়া খা করে, বর্ষায় ঝর ঝর করিযা বৃষ্টি পড়ে অদৃশ্য হস্তনিষিক্ত শান্তিবারির মতো। হেমন্তে শিশির পড়ে, শীতে কুয়াশা পাক খায়—সমস্ত হৈমন্তী জানালায় বসিয়া দেখে। যে দেখিতে শিখাইয়াছিল, সে নাই।
কলিকাতা হইতে প্রথম প্রথম যখন প্রকাশকদেব নিকট হইতে অপুর লেখার জন্য মনি অর্ডার আসিত এবং হৈমন্তীকে সই করিয়া টাকা লইতে হইত, তখন হৈমন্তীর চোখে জল আসিত। সে যেন খালি টাকা চাহিয়াছিল! এ সকলইয়া সে কী করিবে? শেষ বইটা এত নাম করিল, অপু দেখিয়া গেল না। স্বামীর এত সুনাম এত যশ লইয়া সে এখন কী করিবে?
সুরপতির দৃঢ় বিশ্বাস কাজল বড়ো রকমেব একটা কিছু হইবে। জজ-ম্যাজিস্ট্রেট করিবার দিকে তাহার তেমন ইচ্ছা নাই, তিনি চান অপুর মতো কাজলও একটা স্থায়ী কিছু করুক। সন্ধ্যায় পড়াইতে পড়াইতে তিনি ডাক দেন-হৈম, একবার শুনে যা এদিকে।
হৈমন্তী আসিয়া বলে—কী বাবা?
–দেখ কাজল এই ইংরেজি এসেটা কী সুন্দর লিখেছে! বানান ভুল, ব্যাকরণের ভুল একটাও নেই। আমি বলে দিচ্ছি হৈম, এ ছেলে বংশের নাম উজ্জ্বল করবে।
—আশীর্বাদ করো বাবা, তাই যেন হয়।
হৈমন্তী নিজের ঘরে ফিরিয়া জানালার কাছে দাঁড়ায়। বাহিরে ঘন অন্ধকার। ওই অন্ধকারের ভিতর সুরপতি আলোর প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন। কাজল মানুষ হইতেছে, সুরপতি বলিয়াছেন কাজল বড়ো হইবে।
ছেলেবেলা হইতে হৈমন্তী বাবাকে বড়ো বিশ্বাস করে।
১২. কাজল রিপন কলেজে ভর্তি হইল
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
স্কুল হইতে বাহির হইয়া কাজল রিপন কলেজে ভর্তি হইল। প্রবেশিকা পরীক্ষায় সে খুব ভালো ফল করিয়াছিল—বিশেষত ইংরেজিতে। যে কোনো অধিকতর অভিজাত কলেজে সহজেই সে ভর্তি হইতে পারিত, কিন্তু একরকম জিদ করিয়াই রিপনে ভর্তি হইল।
কাজল একদিন আদিনাথবাবুকে প্রণাম করিতে গেল। আদিনাথবাবু আদর করিয়া তাহাকে ঘরের ভিতর লইয়া গেলেন। কাজল বলিল—আশীর্বাদ করুন সার, যেন মানুষ হতে পারি। সবাই বলছে রিপনে ভর্তি না হয়ে প্রেসিডেন্সি বা অন্য কোথাও যাওয়া উচিত ছিল।
আদিনাথবাবু চশমা খুলিয়া কোঁচার প্রান্তে কাচ পরিষ্কার করিতে করিতে বলিলেন—মানুষ হওয়া তোর কেউ আটকাতে পারবে না অমিতাভ। অনেকদিন ধরে শিক্ষকতা করছি, চুল পেকে গেছে-আমি মানুষ চিনি। তোর মধ্যে ক্ষমতা আছে, সেটা নষ্ট হতে দিস্ না। চশমা মুছিবার পর, না পরিয়া অনেকক্ষণ সেটা হাতে ধরিয়া রাখিলেন। অন্যদিকে তিনি তাকাইয়া আছেন। হঠাৎ তাহাকে যেন বেশি বৃদ্ধ দেখাইতে লাগিল। কাজল ভাবিল—বড্ড বুড়ো হয়ে গেছেন সার, বয়সের তুলনায়। চোখের নিচে কালি পড়ে গিয়েছে। একা মানুষ, কত আর খাটবেন!
মুখ ফিরাইয়া আদিনাথবাবু বলিলেন-কত আশা ছিল বড়ো হবো, নাম করবো। সেই ভাবেই জীবনটাকে তৈরি করবার চেষ্টা করেছিলাম। তারপর সংসারের ঘানিকলে বাঁধা পড়ে ঘুরছি তো ঘুরছিই। বিলেত যাবার খুব ইচ্ছে ছিল। সে কথা মনে পড়ে হাসি পায়। কত চিন্তা করেছি, রাত্তিরে শুয়ে শুয়ে ভেবেছি পালিয়ে চলে যাই। কিন্তু ততদিনে বড় খোকা হয়েছে। আটকা পড়ে গেছি। আর যাওয়া হল না।
নিঃশ্বাস ফেলিয়া আদিনাথবাবু বলিলেন—জীবন তো প্রায় শেষ হয়ে এলো অমিতাভ।
কাজল জানে মাস্টারমশাই খুব দুঃস্থ–মেয়ের বিবাহে সব টাকা জোগাড় করিতে না পারিয়া চড়া সুদে ধার করিয়াছিলেন, এখনও তাহা শোধ করিয়া উঠিতে পারেন নাই। বামুনপাড়ার মতি মুখুজ্যে টাকাটা মাসিক দুই আনা সুদে ধার দিয়াছিল মওকা বুঝিয়া। আদিনাথবাবু অনুরোধ করিয়াছিলেন সুদের হার এক আনা করিতে-মতি মুখুজ্যে শোনে নাই। ইস্কুলে কে যেন তাহাকে বলিয়াছিল কথাটা। মতি মুখুজ্যের পাশাপাশি তাহার রামদাস বোষ্টমের কথা মনে পড়িল—দুইটি চরিত্রের অদ্ভুত বৈপরীত্যের জন্য।
আদিনাথবাবু কাজলের আপত্তি না শুনিয়া তাহাকে পেট ভরিয়া জলযোগ করাইয়া ছাড়িলেন।
কলেজ সম্বন্ধে কাজলের বিরাট ধারণা ছিল। স্কুলে সে ব্যোমকেশ ছাড়া মনের মতো সঙ্গী পায় নাই। ভাবিয়াছিল কলেজে তো কত ভালো ছাত্র পড়িতে আসে দূর দূরান্ত হইতে, একজনও কি তাহার পছন্দমত হইবে না? প্রতাপ বলিয়াছিল, এই মফঃস্বলে তোর বন্ধু হবে না কাজল কলকাতার কলেজে যখন পড়বি, দেখবি কত ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র আছে দেশে।
–ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র দিয়ে কী করবো মামা? আমি চাই এমন বন্ধু, যে আমার মনের কথা বুঝতে পারবে, আমার মতো যে চিন্তা করবে।
-হলে কলকাতাতেই হবে।
কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখিল তাহা হইতেছে না। ছাত্রদের মধ্যে অধিকাংশই নিরীহ, গোবেচারা। দুএকটি বড়লোকের ছেলে আছে—তাহারা গরমে আদ্দির পাঞ্জাবি, শীতে সার্জের কোট পরিয়া কলেজে আসে, কথায় কথায় সিগারেট খায় এবং পরস্পরের পিতার কাজকর্ম লইয়া আলোচনা করে। তাহাদের সহিত কথা বলিতে গিয়া কাজল বোকা বনিয়া ফিরিয়াছে, কাজলকে তাহারা গ্রাহের মধ্যে আনে নাই। মোটর উপর কাজল দেখিল গত কয়েক বৎসরে তাহার মানসিক বৃদ্ধি জ্যামিতিক হারে হইয়াছে, ফলে তাহার চারিধারে বহুদূর অবধি লোকজন নাই। অগত্যা সে লাইব্রেরিতে আশ্রয় গ্রহণ করিল। ছেলেবেলায় বাবার কাছে রিপন কলেজের লাইব্রেরির গল্প শুনিয়াছিল। প্রত্যেকটা বইয়ে যেন বাবার স্পর্শ লাগিয়া আছে। নানা বিষয়ে কৌতূহল থাকার দরুন লাইব্রেরির ভিতর সে যেন দিশাহারা হইয়া ওঠে। কোন বইটা ছাড়িয়া কোটা পড়িবে ঠিক করিতে পারে না। কতকগুলি পছন্দসই বই-এর লিস্ট করিয়া ফেলিল সে, এক এক করিয়া পড়িবে। এই ব্যাপারে তাহার কিছু সুবিধা ছিল, এমন সব বইয়ের সে স্লিপ দিত, যাহা সাধারণত কেহ নেয় না। দপ্তরী তাক হইতে বই পাড়িয়া তাহার হাতে আনিয়া দিলে সে ফু দিতে দিতে বলে, বাব্বাঃ, বেজায় ধুলো জমে গেছে দেখছি।
দপ্তরী হাসিয়া বলিত-বহুকাল বাদে বেরুলো তো বাবু।
কাজল অবাক হইয়া যায়। এত ভালো বই কেহ পড়ে না কেন? তাহাকে যদি লাইব্রেরিতে থাকিতে দিত, দিনরাত সে মাদুর পাতিয়া বসিয়া বই নামাইয়া নামাইয়া পড়িত। চাকরি হইলে সে টাকা জমাইয়া ভালো লাইব্রেরি করিবে-বাড়িতে। মৌপাহাড়িতে গিয়া থাকিবে তখন, সেখানকার স্কুলে মাস্টারি কবিবে। কলিকাতা হইতে বই কিনিয়া একটা ঘর সে ভর্তি করিয়া ফেলিবে। দেওয়াল দেখা যাইবে না, শুধু আলমারি। সারাদিন বইয়ের মধ্যে কাটানোউঃ! এত বেশি আনন্দ আর কীসে পাওয়া যাইতে পারে?
একবার কাজলের উর্দু শিখিবার শখ হইল। কী একটা বই পড়িতে পড়িতে সে মির্জা গালিবের দুইটা লাইন পাইয়াছিল। লাইন দুইটা তাহার এত ভাল লাগিল যে, ক্রমশ উর্দু কবিতা সংগ্রহ করা তাহার বাতিকে দাঁড়াইয়া গেল। কলেজে এক সহপাঠীকে সে উর্দু কবিতা আবৃত্তি করিয়া শোনাইতেছিল, ছেলেটি তাহাকে উর্দু শিখিবার উপদেশ দেয়। কথাটা মনে ধরিল। অনেক সন্ধানের পর এক বৃদ্ধ মুসলমান ভদ্রলোককে পাওয়া গেল, তিনি সপ্তাহে তিনদিন সন্ধ্যায় কাজলকে উর্দু পাঠ দিতে বাজি হইলেন। সন্ধ্যাবেলা খাতা হাতে কাজল তার কাছে গিয়া হাজির হয়। মালতীনগরের প্রান্তে এক মসজিদে তিনি থাকেন, সবাই মৌলবী সাহেব বলিয়া ডাকে। কাজল গেলে মৌলবী সাহেব হাসিয়া বলেন—সেলাম আলেক। ইহার প্রত্যুত্তরও কাজল তাহার নিকট হইতে শিখিয়া লইয়াছে— সে মাথা বুকাইয়া বলে, ওআলেক সেলাম। মৌলবী সাহেব বুঝাইয়া বলিলেন, এটা হচ্ছে শুভেচ্ছা জানান, ভগবানের আশীর্বাদ প্রার্থনা করা। একজন বলছে—তোমার ওপর ভগবানের আশীর্বাদ নেমে আসুক। অন্যজন বলছে—তোমার ওপরও ভগবানের আশীর্বাদ নেমে আসুক।
মৌলবী সাহেবের ছোট ঘরে মোমবাতি জ্বলে, মাদুরের উপর বসিয়া কাজল মনোযোগ দিয়া আপাত-বৈসাদৃশ্যহীন উর্দু অক্ষরের পার্থক্য বুঝিবার চেষ্টা করে। মৌলবী সাহেব হাঁ-হাঁ করিয়া বলেন–নেহি, নেহি-এয়সা করকে লিখ্খো, ইয়ে হম্জা নেহি হুয়া।
কখনও কখনও তিনি মূল ফারসী হইতে কাজলকে ওমর খৈয়াম পড়িয়া শোনান। বলেনএই কবিতা অনেক গোঁড়া মুসলমান অপছন্দ করে। এতে নাকি অধর্মের কথা, ভোগবিলাসের কথা লেখা আছে। আমি কিন্তু তা মানি না, যা ভালো কবিতা, তা না পড়ে আমি থাকতে পারি না।
ওমর খৈয়াম শুনিয়া কাজলের এত ভালো লাগিল যে, সে একখানা ফিটজেরালড় অনূদিত রুবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম কিনিয়া ফেলিল, কেননা ফারসী বুঝিবার ক্ষমতা তাহার নাই। ওমর খৈয়ামের স্বপ্নিল জীবনরহস্য, মধ্যপ্রাচ্যের অতীত দিনগুলির রোম্যান্টিক অনুভূতি কাজলকে মুগ্ধ করিল। কী সুন্দর এক একটি ছোট কবিতা—
They say the Lion and the Lizard keep
The Courts where Jamshyd gloried and drank deep;
And Bahram, that great hunter-the Wild Ass
Stamps oer his Head, but cannot break his sleep.
অনিবার্যভাবে মৃত্যু আসিয়া দাম্ভিক নৃপতি এবং বলদর্পী শিকারীকে চিরকালের মতো ঘুম পাড়াইয়া গিয়াছে, তাহাদের সমাধির উপরে বাড়িয়া ওঠা জঙ্গলের বন্য গর্দভের মাতামাতিও আর তাহাদের ঘুম ভাঙাইতে পারে না।
মৌলবী সাহেব বলেন–তাড়াতাড়ি শিখতে চেষ্টা করো, উর্দু সাহিত্যের ভেতরে ঢুকলে মুগ্ধ হয়ে যাবে। তাছাড়া উর্দু হয়ে গেলে ফারসী শেখাও বিশেষ আর কষ্টকর হবে না।
মেজাজ ভালো থাকিলে তিনি বলেন–আজ পড়া থাক—এসো, তোমাকে কিছু শের শোনাই। সম্রাট বাহাদুব শাহের লেখা কবিতা শুনবে? একেবারে শেষ জীবনে লেখা, শোনো
উমরে দরাজ মাকর লায়ে থে ইয়ে চার রোজ।
দো আরজুমে কাটগয়ে, দো ইজারমে।
***
কিতনা হ্যায় বদনসীব জাফর দনেকে লিয়ে।
দো গজ জমিন না মিল সকি ইস কুয়েয়ার মে।
কিছুদিন যাতায়াত করিয়া কাজলের উর্দু শিখিবার উৎসাহ চলিয়া গেল। জটিল ব্যাকরণ এবং ততোধিক জটিল লিখন প্রণালী সে কিছুতেই আয়ত্ত করিয়া উঠিতে পারিতেছিল না। অবশ্য উর্দু সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ তাহার থাকিয়াই গেল।
কলেজ হইতে ফিরিবার সময় একদিন কাজল কী কাজে কলেজ স্ট্রীটে গিয়াছিল। একটা পুরাতন বইয়ের দোকানে নজরে পড়িল, ডস্টয়েভস্কির ব্রাদার্স কারামাজখানা। কাজল নগদ দেড় টাকা মূল্যে বইখানি হস্তগত করিয়া বাড়ি ফিরিল। খুব নাম শুনিয়াছে বইখানার—কিন্তু পড়িয়া ওঠা হয় নাই। বাড়ি ফিরিয়া সন্ধ্যায় অন্যদিনের মতো বেড়াইতে বাহির না হইয়া সে বিছানায় শুইয়া হ্যারিকেন কাছে টানিয়া পড়া শুরু করিল।
সে ভাবিয়াছিল নাম করা উপন্যাস যখন, প্রথম পাতা হইতেই গল্প খুব জমিবে। তাহা হইল না। পাতার পর পাতা পড়িয়া যাইতেছে, কিন্তু রস যাহাকে বলে, তাহা ঠিক জমিতেছে না। শতখানেক পৃষ্ঠা পড়িয়া সে বিরক্ত হইয়া বই মুড়িয়া তুলিয়া রাখিয়া দিল। মাস আটেকের মধ্যে আর সে হাত দেয় নাই। একদিন কি খেয়াল হওয়ায় তাক হইতে নামাইয়া নূতন করিয়া পড়িতে শুরু করিল।
জমিয়া গেল।
কষ্ট করিয়া, তেতো ওষুধ খাইবার মতো করিয়া দুইশত পৃষ্ঠা পড়িবার পর বই আর হাত হইতে নামাইতে পারিল না। বৃহৎ পটভূমিতে জীবনকে এমনভাবে অঙ্কন করিতে সে অন্য কোনো শিল্পীকে দেখে নাই। বিশেষত দিমিত্রির চরিত্র তাহার কাছে অসাধারণ সৃষ্টি বলিয়া মনে হইল।
দিমিত্রির উন্মত্ততা, জীবনকে আকুল হইয়া জড়াইয়া ধবিবার চেষ্টা—এসব সত্ত্বেও দিমিত্রির পরিণতিতে কাজল কেমন মুহ্যমান হইয়া পড়িল। মনে হইল, জীবনটা এক অদৃশ্য শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাহা ঈশ্বর না, মানবিক কিছু নহে—বরং মানবিকতা বিরোধী।
জীবনকে ভালোবাসিবার পরিণতি যদি এই হয়, তবে বাঁচিয়া লাভ কী? ব্রাদার্স কারামজভ জীবনকে নূতন এক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখিতে শিখাইল।
১৩. শীত আসিতেছে
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
শীত আসিতেছে। সকালে ঘাসে আলগা শিশির লাগিয়া থাকে, শেষরাতের দিকে চাদর গায়ে টানিয়া দিতে হয়। সন্ধ্যাবেলা ঘরে ঘরে উনানে আঁচ পড়িলে ধোয়া জমিয়া যায়, বাতাস না থাকায় ধোঁয়া সরে না। রাত্রে আকাশ একেবারে পরিষ্কার হইয়া যায়, মেঘ আসিয়া নক্ষত্রদের ঢাকিয়া দেয় না। পাড়ায় পাড়ায় ধুনুরীদের হক শোনা যায়-লেপ বানাবে নাকি মা-ঠাকরুন, বাছাই করা ভালো তুলে ছিল–
তারপর শীত আসিয়া গেল। কাজল শীত ভালোবাসে, শীত পড়িলে তাহার মনের ভিতরে একটা বড়ো রকমের ওলটপালট হয়। যে মন লইয়া সে গ্রীষ্ম উপভোগ করে, তাহা লইয়া কখনই শীতের রিক্ত রূপ উপলব্ধি করা যায় না। শীত আসিবার আগে হইতেই সে মনে মনে প্রস্তুতি চালাইতে থাকে, মনের জানালা হইতে পুরাতন পর্দা খুলিয়া নূতন পর্দা লাগায়, ফ্রেম হইতে ছবি খুলিয়া দেয় সেখানে নূতন ছবি লাগাইবে বলিয়া। হেমন্তের মাঠে মাঠে হাঁটিয়া বেড়াইতে বেড়াইতে শীতের জন্য মন তৈয়ারি হইয়া ওঠে। খাইতে বসিয়া রান্নায় ধনে পাতার গন্ধ পাইলেই বোঝা যায় আর দেরি নাই।
ঠাণ্ডার মধ্যে মাঠে ঘুরিতে আলাদা আমেজ। মৃদু রৌদ্রে পিঠ দিয়া দূরে তাকাইয়া থাকিলে ক্রমশ মনটা উদাস হইয়া যায়। কলিকাতার কলরবের ভিতর সে নিজেকে ঠিক মেলিয়া ধরিতে পারে না–নিজের মনে বসিয়া চিন্তা করিবার অবকাশও সেখানে নাই। সমস্ত সপ্তাহ নগর জীবনের কোলাহলের মধ্যে কাটাইয়া একটা দিন শীতের মাঠে কাটাইতে ভালো লাগে। আল ছাড়াইয়া মাঠে নামিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে পায়ের নিচে মাটির ঢেলা গুঁড়াইয়া যায়, রৌদ্রদগ্ধ মাটি হইতে কেমন গন্ধ আসিতে থাকে—যে গন্ধ নিশ্চিন্দিপুরে ছোটবেলায় সে পাইত।
একদিন হাতকাটা সোয়েটারটা লইয়া কাজল কাঠালিয়ার মাঠে বেড়াইতে গেল। রৌদ্র তখন পড়িয়া আসিয়াছে, ঠাণ্ডা কিছুক্ষণ বাদেই হাড়ের ভিতর উঁচ ফুটাইতে আরম্ভ করিবে।
কাঁঠালিয়ার বাঁশবনটায় ঢুকিতে মনে হইল সে যেন স্বপ্নের রাজ্যে আসিয়া পড়িয়াছে। উৎসবের দিনে বাড়ির ছাদে সামিয়ানা খাটাইলে তাহার নিচে দ্বিপ্রহরেও যেমন একটা নরম আলো থাকে, বাঁশবনের ভিতরও তেমনি। না নড়িয়া চুপ করিয়া থাকিলে বাঁশপাতা ঝরিয়া পড়ার হালকা শব্দ শোনা যায়। বাতাস ক্রমেই ঠাণ্ডা হইতেছে, কিন্তু শীতের আমেজ জমাইবার জন্য কাজল সোয়েটার পরে নাই। একটা বাঁশের গায়ে হাত দিয়া দাঁড়াইয়া সে অনুভব করে এ সমস্ত ছাড়িয়া সে বাঁচিতে পারিবে না। কলিকাতা তাহাকে প্রিয় বস্তু হইতে দূরে লইয়া যাইতেছে।
পানাপুকুরের পাশ দিয়া কাজল আখের আলির বাড়ি গেল। আখের উঠানের কিছু অংশ লইয়া একটা মুদির দোকান দিয়াছে। জিনিসপত্র বেশি নাই, নুতন দোকান। ব্যস্ত হইয়া আখের তাহাকে একটা নড়বড়ে কাঠের টুলে বসিতে দিল। কাজল বসিয়া বলিল–কেমন আছ আখের ভাই?
—আমাদের আবার থাকা না থাকা, তুমি কেমন আছ সেইটেই বড়ো কথা। তুমি তো এখন কলেজে পড়ো, না?
-হ্যাঁ, আই-এ পড়ি।
—কবছর লাগে এটা পড়তে?
–দু’ বছর। তারপর পাস করলে আবার দুবছর লাগে বি-এ পড়তে।
–বাব্বাঃ! তোমাদের দেখছি সারাজীবন ধরে পড়া আর পড়া! পড়া শেষ হতে হতে তো বুড়ো হয়ে যাবে।
–পড়াশুনো না শিখলে চলবে না আখের ভাই, চাকরি তো করতে হবে।
আখের একটা বড়ো রকমের নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল—তা তো বটেই। আমার মতো নয়, সারাটা জীবন এখানেই কাটল–কিছুই শিখতে পারলাম না।
-কতদিন আছ তোমরা এখানে?
–অনেকদিন হয়ে গেল, আমার ঠাকুরদার বাবা প্রথমে এই জায়গায় এসে বসতি করেন। আমারও সারাজীবন এই গ্রামে কাটল বারকয়েক কলকাতায় গিয়েছিলাম বটে, কিন্তু দেশ বেড়ানো যাকে বলে তা কিছুই হয়নি আমার কপালে।
এরপর আখের তাহাকে খাওয়াইতে ব্যস্ত হইয়া উঠিল। কাজল খাইবে না, সেও ছাড়িবে না। দোকানের টিন হইতে একটা ঠোঙায় করিয়া মুড়কি তাহার হাতে দিয়া বলিল—খাও, ভালো মুড়কি। নিজেদের খাবার জন্য রয়েছে, বিক্রির নয়।
আখেরের দোকান হইতে উঠিতে সন্ধ্যা হইয়া গেল। কিছুতেই সে ছাড়িতে চায় না। শীঘ্রই আসিবার প্রতিশ্রুতি দিয়া কাজল মাঠের দিকে রওনা দিল। ঠাণ্ডা আর সহ্য করা যায় না, সোয়েটার গায়ে দিতে দিতে কাজল দেখিল, গোধূলির শেষ আলোকচ্ছটাও আকাশের গা হইতে মিলাইয়া গিয়াছে।
অন্ধকার মাঠের মধ্য দিয়া রোমাঞ্চকর যাত্রা। আকাশে চুমকির মতো অজস্র নক্ষত্রের ভিড়। জীবনটা যেন হঠাৎ শরীরের সংকীর্ণ পরিসর হইতে বাহির হইয়া দিহীন মহাশূন্যে মিশিয়া যাইতে চাহিতেছে। কাজলের মনে হইল, জীবন পৃথিবীর গণ্ডীর মধ্যে আরদ্ধ নহে—পৃথিবীতে বাঁচিয়া আছে বটে, কিন্তু পৃথিবী শেষ কথা হইতে পারে না। আপন অস্তিত্বকে সে মহাবিশ্বের এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত বলিয়া অনুভব করিতেছে—তাহা কি মিথ্যা?
কাজল আজকাল বুঝিতে পারিতেছে বাবার সহিত তাহার মানসিকতার একটা আশ্চর্য মিল আছে। বাবার উপন্যাসগুলি পড়িতে পড়িতে সে অবাক হইয়া ভাবে, এমন নির্ভুলভাবে তাহার মনের কথা বাবা লিখিল কী করিয়া? ছোটবেলায় সে যাহা ভাবিত, আকাশের দিকে তাকাইলে তাহার মনে যে ভাব হইত, সব বাবা হুবহু লিখিয়াছে।
কাজল জানে, জীবন সাধারণভাবেই কাটিয়াছে। বাবা দারিদ্র্যের সহিত যুদ্ধ করিয়া, প্রতিপদে সংগ্রাম করিয়া তবে মানুষ হইয়াছিল। সে কিন্তু জন্মের পরে খুব একটা অসচ্ছলতা দেখে নাই, দারিদ্রের ভিতর যে কল্যাণস্পর্শ আছে তাহা সে কখনও অনুভব করে নাই। মাঝে মাঝে কাজলের মনে হয়, কিছুই তাহার বলিবার নাই। ইট-কাঠ-পাথরের ভিতর বাস করিয়া কিছু বলিবার থাকিতে পারে না। তবু এ কথাও মিথ্যা নয় যে তাহার তীক্ষ অনুভূতি তাহাকে অনেক রহস্যের সম্মুখীন করিয়াছে। জীবনের ভিতরও আর একটা গভীরতর জীবন আছে, তাহা সে বুঝিতে পারে। কী করিয়া সে এসব কথা না বলিয়া পারিবে?
একটা খাতায় দুইটি গল্প লিখি সে বন্ধুদের পড়াইয়াছিল। কলেজের বন্ধুদেব (মনেব মিল বেশি না থাকা সত্ত্বেও দুই-একটি বন্ধু তাহার হইয়াছে) মধ্যে অনেকেই তাহার বাবাব ভক্ত। তাহারা গল্প দুইটা আদ্যোপান্ত শুনিয়া বলিল–ভালোই হয়েছে, মন্দ কী! তবে ব্যাপার কী জানো, লেখার মধ্যে তোমার বাবার প্রভাব বড্ড বেশি।
কাজল মহা হাঙ্গামায় পড়িয়াছে। সে ইচ্ছা করিয়া বাবার বই দেখিয়া নকল করিতেছে না। তাহার চিন্তাধারার সহিত বাবার চিন্তাধারা মিলিয়া গেলে সে কী করিতে পারে?
প্রকাণ্ড মাঠের অর্ধেক পার হইয়াছে—এমন সময় কাজল দেখিল, কিছুদূরে মাঠের ভিতর বসিয়া কাহারা আগুন পোহাইতেছে। বেশ দৃশ্যটা। চারিদিকে শূন্য মাঠ, উপরে খোলা আকাশ, তাহার নিচে বসিয়া খড়-বিচালি জ্বালাইয়া কেমন আগুন পোহাইতেছে লোকগুলি। কীসের আকর্ষণে সে পায়ে পায়ে আগাইয়া গিয়া অগ্নিকুণ্ডের সামনে দাঁড়াইল।
লোকগুলি দরিদ্র। এই ভয়ানক শীতে গায়ে একটা করিয়া সূতির জামা। তাহারা গায়ে গায়ে ঘেঁষিয়া হাত আগুনের উপর ছড়াইয়া নিজেদের মধ্যে কী গল্প করিতেছিল। কাজল আসিয়া দাঁড়াইতে লোকগুলি অবাক হইয়া তাহার দিকে তাকাইল। কৌতূহলী দৃষ্টির সামনে কাজল অপ্রস্তুত বোধ করিয়া বলিল—আগুন পোহাচ্ছেন বুঝি?
অবান্তর প্রশ্ন। শীতের রাতে আগুন জ্বালাইয়া তাহার উপর হাত ছড়াইয়া অতগুলি লোক আগুন পোহানো ছাড়া অন্য কী করিতে পারে?
একজন বলিল–হ্যাঁ বাবা, আপনি বুঝি শহরে থাকেন? এই বুধো, সরে যা ওদিকে। বসুন বাবু ওইখেনটায়, আগুনের কাছে এসে বসুন।
বুধো তাহাকে সম্মান দেখাইয়া সরিয়া বসিল, কিন্তু বাকি কয়জন কেমন আড়ষ্টভাবে তাহার দিকে তাকাইয়া রহিল। তাহাদের চোখে শুধু বিস্ময় নহে, একটু যেন আতঙ্কও মিশ্রিত আছে।
প্রথম লোকটি বলিল—এই বুধেই গল্প বলছিল বাবু। শ্বশুরবাড়ি থেকে ফেরবার সময় মাঠের মধ্যে ওকে এলে-ভূতে পেয়েছিল। এলে-ভূত জানেন তো? মাঠের মধ্যে পথ ভুলিয়ে লোককে দুরে বেজায়গায় টেনে নিয়ে যায়, তারপর মেরে ফেলে। তা বুধো সন্ধেবেলা বেরিয়েছে শ্বশুরবাড়ি থেকে, আর ভূত লেগেছে তার পেছনে–
একজন অনুচ্চকণ্ঠে বলিল–নাম করিস্ না রাত্তিরে—
গল্পটা দীর্ঘ। কাজলকে সবটা শুনিতে হইল-কী করিয়া কাপড়টা ঝাড়িয়া উলটাইয়া পরিয়া তবে বুধো ভূতের হাত হইতে রক্ষা পায়। শুনিতে শুনিতে অনেকে পিঠের উপর দিয়া পিছনের মাঠের দিকে তাকাইয়া দেখিতেছিল। এবং ক্রমাগত আগুনের কাছে অগ্রসর হইতেছিল। ইহাদের আতঙ্কের কারণ এইবার কাজল বুঝিল। অন্ধকার মাঠে বসিয়া প্রেতযোনির গল্প হইতেছিল-রীতিমত গাশিরশির-করা পরিবেশ। এমনি সময় মাঠের ভিতর হইতে আচমকা কাজলের নিঃশব্দ আবির্ভাব। প্রথমটা তাহারা বেজায় চমকাইয়াছিল, আগুনের আলোয় কাজলের ছায়া পড়িতেছে ইহা না দেখা পর্যন্ত স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়িতে পারে নাই।
ঠাণ্ডা ক্রমশ বাড়িতেছে। তাহারা আরও কাঠকুটা আনিয়া আগুনের মধ্যে ফেলিয়া দিল। শুকনা ডালপালা পুড়িবার পটপট শব্দ উঠিতেছে, বাতাসে পোড়া পাতার গন্ধ। হাত বাড়াইয়া আগুনের উত্তাপ উপভোগ করিতে করিতে কাজলের মনে হইল, এই লোকগুলি তাহার ভারি আপন।
(কাজলের ডায়েরি থেকে)
আমার ডায়েরি লেখার অভ্যেস মোটেই পুরোনো নয়। ছোটবেলায় কিছুদিন লিখেছিলাম বটে, কিন্তু সে বাবাকে দেখে শখ করে। আজ হঠাৎ মনে হচ্ছে আমার এ বয়সটা একটা বেকর্ড বাখা দরকার—যাতে পরবর্তী সময়ে এর থেকে মানসিক প্রগতির হারটা ধরতে পারি।
কিছুদিন আগে কয়েকজন বন্ধু মিলে পুরী থেকে ঘুরে এলাম। কলেজে প্রথমে খুব খারাপ লাগছিল। পরে তিন-চার জন ছেলের সঙ্গে আলাপ হল, যাদের সঙ্গে এখন বেশ হৃদ্যতা গড়ে উঠেছে। তারাই উদ্যোগ করে বেড়াতে যাবার আয়োজন করলে আমি তাদের সঙ্গী হয়ে পড়লাম।
মার এখনও ধারণা, আমি সেই ছেলেমানুষই আছি। ঘুমোলে আমার গায়ে চাদর টেনে দেন—সকালে উঠে টের পাই। তাছাড়া আমার বইপত্র গুছিয়ে রাখা, কলেজে বেরুনোর সময়ে কলম পেনসিল খুঁজে দেওয়া, এসব তাকেই করতে হয়। কাজেই স্বনির্ভরতার পথে খুব একটা এগিয়ে গেছি—এমন বলা চলে না। মার চোখে হোটই রয়ে গেছি।
আমি, পরমেশ, অমল আর রমানাথ একদিন সন্ধেবেলা ট্রেনে চেপে বসলাম। সারারাত্তির জেগে বসেছিলাম। ছোট স্টেশনে গাড়ি থামছে না, হুহু কবে প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে যাচ্ছে। কখনও নদীর ওপর দিয়ে গুম গুম করে ব্রিজ পার হচ্ছে—কখনও নীর অন্ধকারের ভেতর তাকিয়ে দেখছি এঞ্জিন থেকে ভেসে আসা জ্বলন্ত কয়লার কুচি।
সকালে কটক। আমার চোখ রাত্রি জাগরণক্লান্ত। তাকিয়ে দেখলায় অদ্ভুত পোশাক পরা রেলওয়ে পুলিশ প্ল্যাটফর্মে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। পরমেশ চা খাওয়ালে সবাইকে। জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে চায়ের ভাড় নিয়ে চুমুক দিতে দিতে মনে হলো সত্যিই এক বেড়াতে চলেছি তাহলে। জীবনে কখনও কোথাও একা বেরুই নি।
দুদিন আগে রাত্তিরে স্বপ্নে সমুদ্র দেখেছিলাম। তখন পুরী যাওয়ার কথা চলছে, দেখলাম সমুদ্রের ধারে বালির উপর পায়চারি করছি। হলুদ বালির বেলাভূমি, তার ওপর শ্রেণীবদ্ধ নারকেলগাছ অশান্ত হাওয়ায় থরথর করে কাঁপছে। মাথার ওপরে দীপ্ত সূর্য। ভালো করে দেখতে পাইনি, কারণ সমুদ্র সম্বন্ধে আমার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না।
কটক ছেড়ে কেয়াঝোপ দেখতে দেখতে চললাম। লাইনের দুদিক কেয়াঝোপে সবুজ হয়ে আছে। মনের মধ্যে উচ্চগ্রামে মাদল বাজছে যেন, একটু পরেই জীবনে প্রথম সমুদ্র দেখবো।
ট্রেন মালতীপাতপুর ছাড়াল, সামনে পুরী। কী সুন্দর নামটা-মালতীপাতপুর!
দু হাত পেছনে রেখে সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে মনে পড়ল বাবার কথা। অনেকদিন আগে, আমি তখন ছোট, বাবা এসেছিল পুরীতে মাকে নিয়ে। বেলাভূমিতে বাবার পায়ের ছাপ কবে মুছে গেছে ঢেউ-এর অক্লান্ত তাড়নায় কিন্তু তবু মনে হচ্ছে, পুরীর বাতাসে যেন বাবার গায়ের গন্ধ– ছোটবেলায় বাবার বুকে মুখ গুঁজে থাকলে যেমন পেতাম।
মৌপাহাড়িতে বিস্তৃত প্রান্তর দেখেছি, কিন্তু বিস্তৃতি যে কতদূর প্রসারলাভ করতে পারে তা আজ বুঝলাম। ভালো লাগছে বলার চেয়ে কষ্ট হচ্ছে বলাই বেশি সঙ্গত, কারণ সমস্ত সমুদ্রটা আমি একসঙ্গে বুকের ভেতর পুরে নিতে পারছি না। এত বিশালকে একই সঙ্গে সমস্ত দিক দিয়ে দেখা সম্ভব নয়। ভীষণ ছটফট করছি, কিছুতেই একজায়গায় মন বসাতে পারছি না। সমুদ্র যেন ক্রমশঃ রক্তের মধ্যে মিশে যাচ্ছে। প্রাণের স্পন্দন প্রথম জেগেছিল জলে। সূর্যের অনুকূল উত্তাপে প্রথম এককোষী প্রাণীর সৃষ্টি সমুদ্রের বুকে। সমুদ্র জীবনের ধাত্রী। জীবনসৃষ্টির কোটি কোটি বছর আগেও এই সমুদ্র এইরকম অশান্ত হয়ে ঝাপাঝাপি করত বেলাভূমিতে। অন্য সব কিছু থেকে সমুদ্র অনেক বেশি অভিজ্ঞ-বহুদর্শী। অন্ধকার ঢেউ-এর মাথায় মাঝে মাঝে স্বতঃপ্রভ আলো। দিনরাত ভীষণ শব্দ করে সমুদ্র যে কী একটা জানাতে চাইছে, আমি তার ভাষা বুঝতে পারছি না। বাবা হয়তো বুঝতে পেরেছিল। এখন বেঁচে থাকলে বাবার কাছ থেকে জেনে নিতাম।
মানুষ বড়ো অসহায়, তার বলবার কথা সে কিছুতেই গুছিয়ে বলতে পারে না। সামনে ওই elemental fury দেখে মনে একটা আশ্চর্য প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। সমস্ত বিশ্বটার মধ্যে যে একটা master plan আছে সেটা সমুদ্রের মতোই বিশাল, অতিমানবিক। কী রহস্য লুকিয়ে আছে আকাশে-মাটিতেজলে-জীবনে! দর্শনগ্রন্থের সামনে সদ্য অক্ষরপরিচয়প্রাপ্ত শিশুর মতো আমাকে এই বিশালত্বের সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
একটা জিনিস আমি বুঝেছি, আমার জীবনটা অন্যান্য মানুষের চেয়ে একেবারে আলাদা হয়ে গেছে। উত্তরাধিকারসূত্রে যেদিন থেকে চিন্তা করতে শিখেছি, সেদিন থেকে আমার ভেতরে সৃষ্টি এবং ধ্বংসের বীজ একই সঙ্গে উপ্ত হয়েছে। চিন্তা দিয়ে আমার নিজের জন্য একটা ভিন্নতর জগৎ তৈরি করে নিয়েছি। কিন্তু চিন্তা আমাকে আলোর পথ দেখাতে পারছে না, শুধুমাত্র একটা বৃত্তের মধ্যে ঘুরিয়ে ক্লান্ত করছে। মুক্তি চাইলেও পাবে না—যে চিন্তাশীল, তার মুক্তি নেই। বন্ধুরা আমার সান্নিধ্য থেকে আর যথেষ্ট আনন্দ পাচ্ছে না। তারা যেভাবে আনন্দ ভোগ করতে চায়, তা আমার আনন্দের ধারণা থেকে আলাদা। ফলে আমি অনেক মানুষের মধ্যেও একা বোধ করি। চেনা মুখের ভিড়ে একলা থাকা বড়ো কষ্টের। আমি প্রাণপণে চাইছি ওদের সবার সঙ্গে ওদের মতো হয়ে মিশে যেতে, ওদের মতো ভাবতে, কথা বলতে। প্রত্যেকবারই কে পেছন থেকে টানছে, বলছে-হবেনা, আর তা হয় না। বাবার সহজ আনন্দটা আমার মধ্যে কমে আসছে, আমি শুধু চিন্তার কঠিন মাটিতে খালি পায়ে হাঁটছি।
কোনারক।
বন্ধুরা ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিকওদিক, আমি চুপ করে বসে আছি। সমুদ্রের দিক থেকে হাওয়া এসে প্রাঙ্গণের ধুলো ওড়াচ্ছে। নোনা বাতাসে মন্দিরের গায়ে উত্তীর্ণ ভাস্কর্য দিন দিন ক্ষয়ে আসছে। বন্ধুদের গলার শব্দ শুনতে পাচ্ছি, দূর থেকে ভেসে আসছে কানে। কী নিয়ে যেন ওরা খুব হাসাহাসি করছে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে মন্দিরের চাতালে একটা কোণায় বসে আছি। এখানটা বেশ ছায়াচ্ছন্ন, কাছেপিঠে লোকজন নেই। মনে হয় শব্দের জগৎ থেকে আমি নির্বাসিত। বন্ধুরাও হাসি থামিয়েছে।
আমার ডানদিকে পাথরে উৎকীর্ণ একটা পদ্ম। তাতে কনুই রেখে ওপরে তাকিয়ে দেখলাম মন্দিরের চুড়ার কাছে দুই পাথরের দেওয়ালের ফাঁকে নীল আকাশ ঝকঝক করছে। ফাঁকটা দিয়ে একটুকরো সাদা মেঘ ত্বরিত গতিতে ভেসে গেল।
হঠাৎ দেখলাম, আমার মনে সেই বিশেষ ভাবটা জাগছে—বিপুলগড়ের শিব-মন্দিরে যেমন হয়েছিল। ইতিহাস যেন চাদরের মতো গায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। বহু শতাব্দী আগে যখন রোজ পুজো হতো, পুরোহিতের উদাত্ত কণ্ঠের মন্ত্রোচ্চারণ শোনা যেতো, সেই আগেকার দিনগুলোকে বড্ড ফিরে পেতে ইচ্ছে করছে। আমার কাছে বর্তমান যেমন সত্য, উঠোনের ওই ধুলোর ঘূর্ণি যেমন সত্য—সেই সব অতীতের মানুষদের কাছেও তাদের বর্তমান তেমনই সত্য ছিল। কিছুই আমরা চিরদিন আঁকড়ে থাকতে পারি না। সমুদ্রের ঢেউ, সূর্যাস্তের বং সব কিছু একদিন আমাকে ছেড়ে দিতেই হবে।
পরমেশ ফিরে আসছে।
-কী রে অমিতাভ, আমাদের সঙ্গে না থেকে বড়ো যে এখানে একলা বসে আছিস?
কী-ই বা উত্তর আমি দিই? উঠে বললাম—চল, তোদের সঙ্গে যাই।
যেতে যেতে ওপরে তাকিয়ে চোখ-ধাঁধানো সূর্যটা দেখে মনে হলো, বছরের পর বছর ধরে সূর্য কর্কটক্রান্তি থেকে মকরক্রান্তি পর্যন্ত এইরকম ভাবে পরিক্রমা করবে, সমুদ্রে একবার জোয়ার একবার ভাটা আসবে। আমাদের স্মৃতিটুকুও উত্তরপুরুষদের মন থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে—কেবল মাথা তুলে সুর্যমন্দিরটা দাঁড়িয়ে থাকবে আরও অনেক শতাব্দী।
১৪. শীতের শেষে সুরপতি অসুখে পড়িলেন
চর্তুদশ পরিচ্ছেদ
শীতের শেষে সুরপতি অসুখে পড়িলেন। শরীর খুবই মজবুত ছিল, বাগানের প্রিয় গাছগুলিতে নিজের হাতে পাম্প করিয়া জল তুলিয়া দিতেন। প্রত্যহ কয়েক মাইল হাঁটাহাঁটি চাকবিজীবনের অভ্যাসের মধ্যেই ছিল। তবুও কোন এক রন্ধ্রপথে দেহে অসুখ ঢুকিয়া পড়িল। অসুখ সুরপতি গ্ৰাহেব মধ্যে আনিতেন না, জ্বরজারি হইলে তিনি আরও বেশি ঘোরাঘুরি করিতেন। মনে ভয় ছিল, শুইলেই অসুখ তাহাকে কাবু করিয়া ফেলিবে। কাজল দাদুকে কখনও কোন কারণে শুইয়া থাকিতে দেখে নাই। একদিন কলেজ হইতে ফিরিয়া সন্ধ্যাবেলা সুরপতিকে শুইয়া থাকিতে দেখিয়া সে অবাক হইল। পাশে সরযূ বসিয়া হাওয়া করিতেছে, বাড়িতে থমথমে আরহাওয়া।
হৈমন্তী বলিল–জ্বরটা হঠাৎ বেড়েছে বুড়ো। দুপুরের দিকে আমায় ডেকে বললেন গায়ের ওপর চাদরটা এনে দিতে। নিঃশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে, বুকে খুব সর্দি। তুই খেয়ে নে, কী দরকার পড়ে কখন–
কাজল খাইতেছে, দিদিমা আসিয়া বলিলেন—খোকা, তুই খেয়ে সুরেশ ডাক্তারকে একটা খবর দিয়ে আসিস তো, তোর দাদুকে যেন দেখে যায়।
অসুখটা যে বেশি তাহাতে সন্দেহ নাই। বাড়ির সবাই সে কথা বুঝিতে পারিয়াছে। সুরেশবাবুও অনেকদিন হইতে সাবধান করিতেছিলেন, সিগারেট ছাড়িবার উপদেশ দিয়াৰ্হিলেন। সুরপতি তাহাতে কর্ণপাত করেন নাই।
সুরেশ ডাক্তার সুরপতিকে দেখিয়া গেলেন। প্রতাপ তাহাকে আগাইয়া দিতে গিয়া জিজ্ঞাসা করিল—ভয়ের কিছু আছে নাকি ডাক্তারবাবু?
—ভয়ের তো বটেই। অনেক দিনের পোষা লোগ। নিঃশাস নিতে কষ্ট হচ্ছে কেন, সেটা ঠিক বুঝতে পারছি নে। দেখি দুদিন–
সকালে খবরের কাগজ আসিলে সুরপতি আগে পড়িতেন। প্লাস পাওয়ারের চশমা চোখে লাগাইয়া কাগজটা আদ্যোপান্ত পড়িয়া শেষ করিতেন। আজ কয়েক দিন কাগজ আসিয়া তাহার টেবিলে পড়িয়া থাকে, প্রতাপ সময় পাইলে বিকালের দিকে একবার দেখে। কলিকাতায় সে ভালো কাজ করিতেছে কোন একটা সওদাগরী অফিসে, খুব সকালে বাহির হইয়া যায়।
রান্নাবান্নর দিকটা হৈমন্তী দেখে। কাজলের দিদিমা এবং সরযূ সুরপতিকে দেখাশুনা করে। খাওয়াদাওয়ার হাঙ্গামা মিটিয়া গেলে হৈমন্তী আসিয়া বাবার কাছে বসে। সুরপতির শরীরের শক্তি
একেবারে চলিয়া গিয়াছে, মাসাধিক কাল শয্যাগত থাকিয়া বুঝিতে পারিয়াছেন, রোগ কঠিন। হৈমন্তী আসিলে জিজ্ঞাসা করেন—ডাক্তার কী বললে রে?
–ভয় কী বাবা? বলে গেছেন কিছুদিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
–বলেছে এই কথা?
–নয় তো আমি কি মিথ্যে বলছি?
অসুখ উত্তরোত্তর বাড়িয়া চলিল, কমিবার লক্ষণ নাই। বুকে যেন কে দুই মণ পাথর চাপাইয়া রাখিয়াছে, নিঃশ্বাস লইতে কষ্ট হয়। সুরেশ ডাক্তার নানাভাবে পরীক্ষা করিয়া বুকে টোকা মারিয়া বলিলেন—জল হয়েছে বুকে, ট্যাপ করতে পারলে ভালো হত। কিন্তু এত দুর্বল রোগী! সবাই এখন স্পষ্ট বুঝিয়াছে, সুরপতির আর বিছানা ছাড়িয়া উঠিবার আশা নাই। বোঝেন নাই কেবল সুরপতি নিজে। কঠিন অসুখ হইয়াছে ইহা অনুভব করেন, কিন্তু অসুখটা যে তাহাকে পরপারগামী খেয়ায় তুলিয়া দিয়াছে ইহা বুঝিতে পারেন নাই। দুর্বল গলায় প্রত্যেককে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা কবেন, অবস্থার কিছু উন্নতি দেখিতেছে কিনা।
শেষের দিকে বাঁচিবার আগ্রহ প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল। অন্য কাহারও কথা বিশ্বাস হইত না, দুপুরবেলা হৈমন্তী আসিয়া বসিলে চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করিতেন—হৈম, সত্যি বল। আমার কাছে লুকোস নে—আমি বাঁচবো তো?
কাজলের যেন কেমন লাগিল। দাদু ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, পরলোকে বিশ্বাস করেন, পুনর্জন্মের স্বপক্ষে অনেক কথা কাজলকে বলিয়াছেন, অথচ পৃথিবী ছাড়িয়া যাইতে তিনি এত কাতর কেন?
বিছানার সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছেন সুরপতি—দুই মাস আগে যাহারা দেখিয়াছে, এখন দেখিলে তাহারা চিনতে পারিবে না। চোখ.কোটরে ঢুকিয়া গিয়াছে, হাড়ের উপর চামড়াটা কোনমতে লাগিয়া আছে মাত্র। নিঃশ্বাস লইবার সময়ে পাঁজরাগুলি প্রকট হইয়া ওঠে।
দিদিমা সমস্ত জীবন দাদুর দেখাশোনা করিয়াছেন। খাইতে বসিলে পাশে বসিয়া হাওয়া করিয়াছেন। শীতকালে আদা-চা এবং গরমকালে বেলের পানা করিয়া দিয়াছেন, বোম ছিড়িয়া গেলে লাগাইয়া দিয়াছেন। কাজল বোঝে এখন দিদিমা অস্থির হইয়া উঠিয়াছেন। অথচ তাহাকে পরিষ্কার করিয়া কেহ কিছু বলে না। সকলের মুখের দিকে তিনি শঙ্কিতভাবে তাকান–যেটা তাহারা গোপন করিতেছে, মুখভাব হইতে সেটা বুঝিবার চেষ্টা করেন।
ডাক্তার একদিন বলিলেন—আর ভরসা দিতে পারছি না, আপনারা প্রস্তুত থাকুন।
প্রস্তুত সকলেই। সুরপতি মানুষ চিনিতে পারিতেছেন না। কষ্ট করিয়া শ্বাস লইবার সময় মুখ দিয়া হা-হা শব্দ হইতেছে। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে, অর্থহীন। দুপুরে সবাইকে বিশ্রাম করিতে পাঠাইয়া হৈমন্তী বাবার কাছে বসিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। অপুর মৃত্যুর পর সুরপতি বিরাট মহীরুহের নিচে তাহাকে আশ্রয় দিয়াছিলেন, সে আশ্রয় এইবার নষ্ট হইতে চলিল।
সুরপতি তাকাইয়া চিনিবার চেষ্টা করিলেন। বলিলেন—কে? হৈম?
-হ্যাঁ বাবা, আমি।
সুরপতির কথা বলিতে কষ্ট হইতেছিল, অস্বাভাবিক স্বরে বলিলেন-কাঁদিস নে, তোদর কান্না দেখলে আমি মনে জোর পাই নে।
কান্নার বেগটা হৈমন্তী জোর করিয়া দমন করিল।
-তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেবো বাবা?
মাথা নাড়িয়া সুরপতি সায় দিলেন। হৈমন্তী মাথায় হাত বুলাইয়া দিতেছে, এমন সময় সুরপতি হঠাৎ বলিলেন–দাদু কই?
কাজল কলেজে গিয়েছে বাবা।
কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সুরপতি বলিলেন–হৈম, দাদু খুব বড়ো হবে, দেখে নিস। ও অন্য রকম–
-তুমি ঘুমোও বাবা, কথা বোলো না–
–আমি বলে গেলাম হৈম, তুই মিলিয়ে নিস!
একটু পরে সুরপতি বলিলেন–গায়ে চাদর দিয়ে দে, আমার শীত করছে।
একদিন মাঝরাত্রে ঘুম ভাঙিয়া কাজল শুনিল, পাশের ঘর হইতে দাদুর ক্ষীণ গলার স্বর ভাসিয়া আসিতেছে। দাদু কী বলিতেছেন, কেহ উত্তর দিতেছে না।
মশারি তুলিয়া কাজল সুরপতির ঘরে গিয়ে দাঁড়াইল। প্রথম রাত্রে সরযূর জাগিয়া থাকার কথা, অতিরিক্ত ক্লান্তিতে সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। পরপর কয়েক রাত্রি জাগিয়া দিদিমাও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কোথাও কেহ নাই, সমস্ত বাড়িতে অপার্থিব নীরবতা খাঁ-খা করিতেছে।
সুরপতির মাথা বালিশ হইতে নিচে বিছানার চাদরে গড়াইয়া পড়িয়াছে। মাথা তুলিবার বার বার চেষ্টা করিয়াও পারিতেছেন না। কাজলকে দেখিয়া বলিলেন-মাথাটা তুই বালিশে তুলে দিয়ে যা দাদু, কেউ তো আসছে না।
কাজলের বড়ো খারাপ লাগিল। জীবনের পরিণতি যদি এমন হয়, তবে মানুষ বাঁচে কীসের আশায়! যৌবন অতিক্রান্ত হইবার আগেই তো আত্মহত্যা করা উচিত পরবর্তী দুর্দশার হাত হইতে রেহাই পাইবার জন্য।
পরের দিন সকালে সুরেশ ডাক্তার বলিলেন, দিন কাটে কিনা সন্দেহ। কাজল কলেজ এবং প্রতাপ অফিস কামাই করিয়া বাড়িতে থাকিয়া গেল। দুপুরে অনেক মাছ রান্না হইয়াছিল-সরযূ আর হৈমন্তী পরামর্শ করিয়া কাজটা করিয়াছিল। অন্য দিন হইতে বেশি মাছ দেখিয়া দিদিমা বলিলেন— এত মাছ কেন রে?
সরযূ বলিল–খাও না মা। সস্তা পেয়ে প্রতাপ নিয়ে এসেছে।
দিদিমা হাঁটুর ওপর মাথা রাখিয়া দিতে লাগিলেন—আমাকে তোরা সবাই কেন ঠকাচ্ছিস, আসল কথাটা কেন বলছিস নে?
কিছুতেই তাঁহাকে খাওয়ানো গেল না।
দুপুরবেলা সুরপতির শ্বাসকষ্ট ভীষণ বাড়িল। এক-একবার দম লইবার সময় মনে হইতেছিল, প্রাণ বাহির হইয়া যাইবে।
হৈমন্তী কাজলকে বলিল—একবার তুই চট করে সুরেশবাবুর কাছে যা, তাকে সঙ্গে নিয়ে আসবি অবস্থাটা বলে—
গায়ে একটা জামা গলাইয়া কাজল সুরপতির কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। সুরপতি তাকাইয়া আছেন, কিন্তু চিনিতে পারিতেছেন কিনা কাজল বুঝিল না। সে ঝুঁকিয়া বলিল—দাদু, আমি কাজল।
সুরপতি কিছুক্ষণ তাকাইয়া থাকিলেন। বুকটা হাপরের মতো সমানে ওঠা-পড়া করিতেছে। গোঙানির স্বরে সুরপতি বলিলেন—দা বুকে বড়ো কষ্ট
দাদুর আর্তস্বর কাজলের ভীষণ খারাপ লাগিল, সে দৌড়াইল সুরেশবাবুর বাড়িতে। রিকশা করিয়া সুরেশবাবুর সঙ্গে ফিরিবার সময় দেখিল প্রতাপ খালি পায়ে বাহির হইতেছে। তাহাদের দেখিয়া বলিল—বাবা মারা গেছেন ডাক্তারবাবু।
ডাক্তারবাবুর ঘড়িতে তখন তিনটা বাজিয়া পাঁচ মিনিট। কুড়ি মিনিট আগেও কাজল দাদুর সহিত কথা বলিয়াছে।
সুরপতির সঙ্গে দেওয়ার জন্য কাজল পাঞ্জাবি কিনিতে গিয়াছে, একটা নামাবলী কিনিতে হইবে। পাড়ার ছেলেরা ফুলের মালা ধূপকাঠি ইত্যাদির জোগাড় করিয়া ফেলিয়াছে। দোকানী রেডিমেড পাঞ্জাবির স্তূপ সামনে আনিয়া বলিল, কী মাপের চাই?
কাজলের শুনিয়া অদ্ভুত লাগিল। গলা পরিষ্কার করিয়া সে বলিল—মাপের দরকার নেই, মাঝারি দেখে দিন। যার জন্যে যাচ্ছে, তিনি মারা গেছেন।
দোকানীর এই মাপ জানিতে চাওয়ার কথা কাজলের বহুদিন মনে ছিল।
দাহ অন্তে লোহা এবং আগুন স্পর্শ করিবার জন্য শ্মশানবন্ধুরা বাড়িতে ঢুকিতেই দিদিমা অনেকদিন বাদে কাঁদিয়া উঠিলেন—ওরে, তোরা কোথায় শীতের মধ্যে রেখে এলি বুড়োকে–ও যে মোটে একলা থাকতে পারে না–
(কাজলের ডায়েরি থেকে)
এখন অনেক রাত। সবাই ঘুমুচ্ছে, আমার পোষা বেড়ালটাও গুঁড়িসুড়ি মেরে মা’র ট্রাঙ্কের ওপর শুয়ে আছে। বহু দূরের রেলওয়ে সাইডিং থেকে শান্টিং-এর শব্দ শুনতে পাচ্ছি। পাশের বাড়ির মুকুলবাবুর পোষা কুকুরটা ঘুমের মধ্যেই স্বপ্ন দেখে গরগর করে উঠছে।
আমার কেন ভালো লাগছে না, জানি না। দাদু মারা যাবার পর থেকেই কেমন একটা চিন্তার পোকা মাথার ভেতরের সুস্থ কোষগুলি কুরে কুরে খেয়ে যাচ্ছে। বাবার মৃত্যুর পর আমার চিন্তাশক্তি বেশ কিছুদিন অবশ হয়ে ছিল, তাছাড়া আমার বয়সও তখন ছিল কম। কিন্তু দাদুর মৃত্যু আমি খুব কাছ থেকে দেখলাম, মৃত্যুর কালো পোশাক পরা অতিলৌকিক শরীরটা একেবারে আমার গা ছুঁয়ে গেল। সে চলে গেল বটে, কিন্তু তার ক্ষণিক উপস্থিতির নিদারুণ মুহূর্তগুলো আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না।
পাশের ঘরের দরজা খোলা। এ ঘরে এই একমাস আগেও দাদু শুয়ে থাকতেন। আলো পছন্দ করতেন না। বিশ্রামের সময় আলো নেভানো থাকতো। অন্ধকারে দাদুর সিগাবেটের আগুন দেখতে পেতাম। গরমকালে দাদু হাত-পা নাড়তে নাড়তে আপনমনে গাইতেন—ধীরসমীরে যমুনাতীরে বসতি বনে বনমালী।
মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী এ কথা জানবার জন্য সন্ন্যাসী হওয়ার দরকার হয় না। কিন্তু মৃত্যু এসে একদিন সব কেড়ে নিয়ে বিষাণ বাজাতে বাজাতে চলে যাবে—এটা সহ্য করতে হলে দৃঢ় মন দরকার। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছি, আমার সে শক্তি নেই। মৃত্যু এসে অলক্ষ্যে আমার ঘরে দাঁড়াবে, তর্জনী তুলে ইঙ্গিত করে কঠিন আদেশ উচ্চারণ করবে—এসো। আমাকে চলে যেতে হবে। আমি পৃথিবীকে ভালোবাসি, জীবনকে শীতের রোদুরের মতো ভালোবাসি। বৃষ্টির দিনে জানালায় বসে ক্রমঘনায়মান অন্ধকারে অবিশ্রাম বৃষ্টি দেখতে দেখতে হঠাৎ আমার মনে হয়, মাটির পৃথিবী হয় ঋতু সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত বর্ষণকান্ত আকাশের ময়ূরকণ্ঠী রঙ-এসব ছেড়ে কখনও আমি যেতে পারবো না। কবিতা লিখি না কিন্তু আমি কবি, আমি রসিক। মাটির সঙ্গে যে নাড়ীর বন্ধন, তাকে ছিঁড়ে যেতে আমি পারবো না। অথচ সে আমার কথা শুনবে না। সে আমায় ছেড়ে যাবে না, প্রতিজ্ঞা শুনে নিঃশব্দে অহাস্য করে দিকচিহীন অন্ধকারে আমাকে চিরকালের জন্যে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
বেঁচে থাকার তবে অর্থ কী? সমস্ত পৃথিবীটার সৃষ্টি না হলেও ক্ষতি ছিল না। আমি তো চিরদিনের জন্য তাকে নিজের কাছে রাখতে পারবে না, তবে সামান্য সময়ের জন্য ধরে রাখার কী অর্থ?
অথচ ঘুমের ঘোরে মাঝে মাঝে মনে হয়, জীবনের কী যেন গৃঢ় অর্থ আছে। জীবনের সার্থকতা কোথায়, কে যেন তা আমাকে কানে কানে বলে যায়। আধো ঘুমের মধ্যে আমি হাতুড়ে বিছানায় খুঁজি—যেন সার্থকতার চাবিকাঠি কেউ আমার কাছেই রেখে গেছে। পাই না, হাতে ঠেকে মায়ের গা। শেষ রাত্রের তরল অন্ধকারে হঠাৎ জেগে যাওয়া চোখে মাকে আঁকড়ে শুয়ে থাকি। যেন মাকে ছেড়ে দিলেই আঁধার সমুদ্রের ঢেউ আমাকে ভাঙা পানসির মতো ভাসিয়ে নিয়ে যাবে কোথায়।
আমার স্বভাব বড়ো রুক্ষ হয়ে উঠছে। হয়তো মানসিক অসন্তুষ্টিই এর কারণ। আমি বুঝতে পারি না, সবাই কী করে একে অস্বীকার করে হাসিমুখে বেঁচে আছে। হয় তারা সবাই একযোগে বোকা, নয়তো আমার থেকে অনেক জ্ঞানী। আজকাল বেড়াতে গিয়ে মাঠের মধ্যে জঙ্গলের মধ্যে সব জায়গায় অতৃপ্তি অনুভব করি। কালো পোশাক পরা কে একজন আমার পেছন পেছন আসেতাকে আমি দেখতে পাই না, তাকে অনুভব করি। জানি দিন যত কাটবে, তার আর আমার ব্যবধান ততই কমে আসতে থাকবে।
পরমেশের বোনের শশুরবাড়ি ব্যারাকপুরে। বোনকে শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে দিতে সে ব্যারাকপুরে গিয়েছিল, সঙ্গে নিয়েছিল আমাকে। দুপুরবেলা তার ভগ্নীপতির বাড়ি খাওয়া-দাওয়া সেবে গঙ্গার ধারে গিয়ে বসলাম। এধারে লোজন কম, কাছেই মিলিটারি ব্যারাক। গঙ্গার পাড়ে বাবলার বন, দূর থেকেই দেখা যায় বাবলাগাছের ফাঁকে ফাঁকে নদীর জল চিকচিক করছে।
উঁচু পাড়ে বসে ওপারে শ্রীরামপুরের দিকে তাকিয়ে কী ভাবছি, এমনি সময় নজরে পড়ল পাড়ের নিচেই কাদার ওপর পড়ে আছে একটা ছোট কাগজের বাণ্ডিল-নীল সুতো দিয়ে বাঁধা। কী রকম মনের ভাব হল—জুতো খুলে টপ করে নিচে নামলাম জলের কাছাকাছি। তখন ভাটা চলছে, জল এসে কাগজগুলোকে স্পর্শ করেনি। যে ফেলেছে, কিছুক্ষণ আগেও সে এখানে ছিল।
সুতোটা না খুলে ভাববার চেষ্টা করলাম, এগুলো কী হতে পারে। বাজে কাগজ? দলিল? বাড়িভাড়ার পুরোনো রসিদ? প্রেমপত্র?
খুলে দেখি প্রেমপত্রই বটে। ঘটনাটা উপন্যাসের মতো শোনাচ্ছে—ডায়েরির ছেঁড়া পাতায় কাঁচা হাতের লেখায় ভুল বানানে প্রায় পনেরো-কুড়িটি প্রেমপত্র নীল সুতো দিয়ে বাঁধা। যাকে লেখা, তার জীবনে হয়তো এগুলোর প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এতদিন সযত্নে রাখা ছিল বাক্সের কোণে, বেব করে আজ গঙ্গার বুকে ফেলে দিয়ে গেছে।
চিঠিগুলো তখন পড়িনি। বাড়ি এসে পড়বার ঘরে টেবিলল্যাম্প জ্বেলে এক-একখানা করে পড়ে ফেললাম। নাম দেওয়া নেই। তবে এটুকু বোঝা যায় কোনো মেয়ে তার প্রেমিককে উদ্দেশ করে চিঠিগুলি লিখেছিল। চিঠির নিচে লেখা—’ইতি তোমার মিতা’। সম্বোধনেও প্রাণের মিতা। কাজেই মিতা তার নাম নয়। এদের ভালোবাসা পরিণতি লাভ করেনি, চিঠি ফেলে দেওয়া থেকে তা বোঝা যাচ্ছে। একটিতে লেখা—তোমাকে অনেকদিন পর দেখলাম। মনটা আনতে নেচে উঠলো। সত্যি, আজ সকাল থেকে দিনটা খুব ভালো যাচ্ছে। তোমার কাছ থেকে যা আশা করেছিলাম, তার থেকে অনেক বেশি পেলাম। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, তোমাকে সারাজীবন যেন এমনি করেই পাই। ইতি—তোমার মিতা। আর একটিতে—তুমি চলে গেলে, কিন্তু একবারও তো বললে না—যাচ্ছি। হয়তো ভুল হয়ে গেছে, হয়তো তুমি দেখো নি, দরজার পাশে আমি দাঁড়িয়েছিলাম তোমার পছন্দসই সেই ডুরে শাড়িটা পরে। আমার এক বন্ধু বলেছিল ভালোবাসলে দুঃখ পেতে হয়। আমার ভাগ্যে তাই আছে। সারাজীবন হয়তো কেবল দুঃখই পাবো। কেন যে এমন ভুল করলাম। ইতি—তোমার অবুঝ মিতা।
অন্য কেউ পড়লে হয়তো মনে মনে বিরাট এক গল্প তৈরি করে নায়িকার দুঃখে সন্ধেটা মুহ্যমান হয়ে কাটাতো। একবছর আগে চিঠিগুলো পড়লে আমিই অচেনা মেয়েটির কথা ভেবে ঘন্টা দুই কাটিয়ে দিতাম। কিন্তু আজ আমার মনে এক উলটো প্রতিক্রিয়া হল। বাইরে থেকে বাতাস এসে বারবার টেবিল ল্যাম্পের আলো কঁপিয়ে দিয়ে দেওয়ালের ক্যালেন্ডারের পাতা নিয়ে খেলা করছে, বাড়ির সামনে শম্ভ পাগলা এসে প্রতিদিনের মতো খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা মুখ তুলে টানা সুরে বলে যাচ্ছে-ভাত খাবো, ভাত খাবো, ভাত—ভাত-ভাত! পাশের বাড়ির ছাদে কে যেন দুমদুম করে কয়লা ভাঙছে। এর মধ্যে আমার মনে বিচিত্র অসন্তোষের ঝড়। চিঠিগুলোর প্রেরক এবং প্রাপককে যেমন আমি কোনোদিনই জানতে পারবো না, তেমনি আমার প্রশ্নের উত্তরও আমি কোনদিন পাবো না। আমার অস্থিরতার সঙ্গে চিঠির ব্যাপারটা হঠাৎ মিলেমিশে এক হয়ে গেল। বাতি নিভিয়ে দিতেই তারাদের ছায়া নিয়ে একরাশ জ্যোৎস্না লুটিয়ে পড়ল মেঝের ওপরে। বাতাস বাইরের গাছগুলোকে ধবে খুব করে এক-একবার ঝাকিয়ে দিয়ে গেল। বাতিটা থেকে পোড়া সলতের কেমন একটা গন্ধ আসছে, নামিয়ে রাখতে গিয়ে নজবে পড়লো মেঝেয় জ্যোৎস্নার ফালি। আমার মাথার ভেতরে চেতনাটা অতীতকে ভালোবাসে, নাম-না-জানা ফুলের গন্ধে ভারাক্রান্ত অতীতের সন্ধেগুলোয় ফিরে যেতে চায়—সেই চেতনা শেকল ছিঁড়ে হঠাৎ লাফালাফি শুরু কবে দিল। চাদের আলোটুকুর দিকে তাকিয়ে আমি ভাবতে লাগলাম একশো বছর আগেকার স্বাভাবিক সুন্দর জীবনের কথা, যেমনটি পড়েছি বই-এ। সে জীবনের সঙ্গে তুলনা কবে বর্তমানে ওপর আমার বিতৃষ্ণা হল, অসন্তুষ্টি বেড়ে উঠে মনে হতে লাগলো—পাই নি, পাবো না।
তখনও শম্ভ পাগলা সমানে চিৎকার করে চলেছে ভাত—ভাত—ভাত!
একদিন মিউজিয়ামে গেলাম। বহুদিন আগে বাবার সঙ্গে গিয়েছিলাম, আর এই। সময়ের দিক দিয়ে দেখতে গেলে খুব বেশিদিন নয় কিন্তু আমিই পালটে গেছি।
মিউজিয়ামের ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা ঘুম-ঘুম ভাবটা আমার ভালো লাগে। করিডোরের সারি সারি ধ্যানী বুদ্ধমূর্তি, অল্প আলোয় প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর কঙ্কাল, মৃত্তিকাভ্যন্তর থেকে আনা বিচিত্র পাথর— এসবের মধ্যে, আমার মনে হয, কী যেন লুকিয়ে আছে। বহুদিন আগের হারিয়ে যাওয়া মানুষের উপস্থিতি আমার চোখের সামনে, আমার মনের ভেতরে অনুভব করতে পারি।
লম্বা ঘরগুলোর মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চারপাশে তাকিয়ে মন বাধাবন্ধ মানতে চায় না ইচ্ছে করে সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে ফেটে পড়ি। ভূ-বিজ্ঞান প্রত্নতত্ত্ব জ্যোতির্বিজ্ঞান ইত্যাদি জ্ঞানের শাখাগুলোর মধ্যে লুকোনো আছে মানুষের জন্মের ইতিহাস। সবকিছু একসঙ্গে না জানতে পেরে খালি মনে হয়, ঠকে গেলাম—বোকা রয়ে গেলাম। একটি ঘরে বৌদ্ধযুগেব মূর্তিশিল্প সংগৃহীত। আমি আইকনোগ্রাফির ধার ধারি না, অথচ কী এক আকর্ষণে আজ ঢুকেছিলাম। ভালোই করেছিলাম, তার ফলে আমার এক চমৎকার অভিজ্ঞতা হল।
পাথরের এক নারীমূর্তি আমার বড় ভালো লেগে গেল। মূর্তিকারের নাম নেই। শুধু লেখা মূর্তিটি খ্রিস্ট-জন্মের আগে তৈবি, সম্ভবত শিল্পীর প্রেয়সীর প্রতিকৃতি। ঘরের আয়তনের তুলনায় আলো যথেষ্ট নয়। ফলে সব সময়ই কেমন আধো আলো আধো অন্ধকার ভাব ঘরের মধ্যে। সেই মৃদু আলোকিত স্বপ্ন-স্বপ্ন পরিবেশে মূর্তিটির সামনে দাঁড়িয়ে গেলাম।
স্পষ্ট দেখলাম মেয়েটি হাসছে।
তখন কাছাকাছি কোনো মানুষ ছিল না, খুব কাছে গিয়ে আমি মুখের দিকে তাকালাম। সে হাসি পাথরে উৎকীর্ণ বটে, কিন্তু আমার মনে হল মেয়েটি যেন এইমাত্র আমাকে দেখে হেসে উঠেছে।
আমার সে সময়কার মনের অবস্থা বোঝানো যায় না বলেই তেমন চেষ্টা করছি না। দরকারই বা কী, এ ডায়েরি আমি ছাড়া যখন অন্য কেউ পড়বে না। খালি মনে হতে লাগল, কবে যেন এর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। বহুদিন আগে উপহার পাওয়া আতরের শিশি বাক্স থেকে বার করে শুকলে তার গন্ধের সঙ্গে সঙ্গে যেমন পুরোনো দিনটা আবার ফিরে আসে, তেমনি ওখানে দাঁড়িয়ে মনে হল অতীত আমার সর্বাঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। বাতাসে ধূপের মৃদু গন্ধ পেলাম, প্রাচীন যুগের মহিলারা ধূপের ধোয়ায় চুল শুকোতে বসলে যেমনটি পাওয়া যেতো। অনুভূতি এত তীব্র ও স্পষ্ট যে, আমি নিজেকে সরাসরি সে যুগটার সঙ্গে জড়িত বলে বোধ করলাম।
বাড়ি আসতে মনে হলো আমি এবং সে অস্তিত্ব একই সমতলে অবস্থিত নই–দেশকালের বিভিন্ন দুই স্তরে কবে থেকে আমরা পরস্পরকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, কিন্তু কিছুতেই কোনো এক ধ্রুবকেন্দ্রে এসে মিলিত হতে পারছি না। শুধু খুঁজছি, শুধু খুঁজছি।
কবে যেন সে আমার জন্য কুটিরাঙ্গণে দাঁড়িয়ে উদগ্রীব দৃষ্টিতে পথের দিকে চেয়ে থাকত। সে কবেকার ভুলে যাওয়া অতীতের কথা।
সমস্ত মনে কী যেন হারানোর যন্ত্রণা, খুঁজে না পাওয়ার অতৃপ্তি।
১৫. কলেজে যাইবে বলিয়া কাজল
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
কলেজে যাইবে বলিয়া কাজল বইপত্র গোছাইতেছে, হৈমন্তী ডাকিয়া বলিল—হ্যাঁ রে, কলকাতার অবস্থা কেমন? শুনলাম লোকজন নাকি খুব পালাচ্ছে? ভট্টাচার্যপাড়ায় বকুলের বাবার যে বাড়িটা খালি পড়েছিল, সেটায় এক পরিবার এসে উঠেছে। এখানে থাকবে না বলেছে, আরও গায়ের দিকে চলে যাবে।
কাজল বলিল—আমি তো এখন পর্যন্ত ভয়ের কিছু দেখলাম না। লোজন কিছু গাঁয়ের দিকে পালিয়েছে ঠিকই, রাস্তাঘাট একটু ফাঁকা ঠেকে আগের চেয়ে। তবে অফিস কাছারি ঠিকই চলছে
—আমাদের এদিকে ভয়ের কিছু নেই, না?
–দুর! কোথায় রইল যুদ্ধ, কোথায় আমরা! যারা পালিয়েছে তারাও ফিরলো বলে, দেখ না।
একদিন কলেজ হইতে ফিরিবার সময় কাজল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হইবার খবর পায়। শেয়ালদূহের মোড়ে খবরের কাগজের হকার হাঁকিতেছে—টেলিগ্রাম! টেলিগ্রাম! বহুলোক ভিড় করিয়া পড়িতেছে এবং সরব আলোচনা করিতেছে। একখানা কিনিয়া কাজল পড়িয়া দেখিল। পোলিশ করিডর দাবি করিয়া হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করিয়াছেন। যুদ্ধ শুরু হইয়াছে।
ক্রমে কলিকাতার চেহারা পালটাইল। ল্যাম্প পোস্টের আলোয় কালো ঠুলি পরাইয়া দেওয়া হইল। এ. আর. পি. বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়া নাম ধাম লিখিয়া লইতে লাগিল, প্রয়োজনীয় উপদেশ দিতে লাগিল। অন্ধকার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটিতে কাজলের মনে একটা বিশ্রী ভাব যেন চাপিয়া বসিত। শীতকালে সন্ধ্যা হয় বিকাল শেষ হইতে না হইতেই। কলেজ হইতে বাহির হইয়া কাজল দেখিত, বিশাল শহরের উপরে দুঃস্বপ্নের মতো অন্ধকার চাপিয়া বসিতেছে।
মালতীনগরে বিশেষ পরিবর্তন হয় নাই। কাঠালিয়ার কাছে একটা বিরাট মাঠ সৈন্যেরা কাটাতারে ঘিরিয়া সেখানে রাইফেল প্র্যাকটিস করে। সাধারণের সেখানে প্রবেশ নিষেধ।
সকালে উঠিয়া শোনা যায়। দূর হইতে রাইফেলের আওয়াজ আসিতেছে। সুন্দর সকাল। জানালার পাশে গিরগাছায় সকালের রোদূর আসিয়া পড়িয়াছে, এটা টুনটুনি পাখি বার বার ঘুরিয়া ঘুরিয়া তাহার ডালে আসিয়া বসিতেছে। মিষ্টি আমেজের ভিতর রাইফেলের শব্দে কাজলের মেজাজ খারাপ হইয়া যায়। তাহার জীবনের সহিত বন্দুকের শব্দ মাই খাপ খায় না।
একদিন রাস্তায় আদিনাথবাবুর সহিত দেখা হইয়া গেল। সে প্রণাম করিয়া বলিল—ভালো আছেন সার?
আদিনাথবাবু কাজলকে জড়াইয়া ধরিলেন, বলিলেন—তুই কেমন আছিস অমিতাভ? তোর চেহারা বড় খারাপ হয়ে গেছে, অসুখবিসুখ করেছিল নাকি?
–না সার।
—তবে এমন চেহারা কেন?
কাজলের মনে হইল আদিনাথবাবু তাহার মনের কথা বুঝিবেন, তিনি তাহাকে সমাধানের পথ বলিয়া দিতে পারিবেন। কিন্তু বলিতে গিয়া দেখিল, জিনিসটা সে সহজে প্রকাশ করিতে পারিতেছে না। জীবনের কোনো অর্থ নাই, একথা ভাবিয়া তাহার বয়সী একটি ছেলের রাত্রে ঘুম হইতেছে না, ইহা রীতিমত হাস্যকর। এই কথা ভাবিয়া শরীর খারাপ হওয়া নিঃসন্দেহে অন্যদের কাছে অবিশ্বাস্য। সে বলিল—আমি ঠিক গুছিয়ে বলতে পারছি না সার। ছোটবেলা থেকে যে পরিবেশে মানুষ হয়েছি, তার সঙ্গে আমার মন যেন আর খাপ খাচ্ছে না।
–পরিষ্কার করে বল।
-সার, এত দীর্ঘদিন ধরে বেঁচে থাকার মানে কী? এত কষ্ট করে পড়াশুনা করা, জীবনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা, জীবনকে ভালোবাসা-এর কী অর্থ? মৃত্যুর পর তো একটা ভয়ানক অন্ধকার আমাদের গ্রাস করে নেবেই।
মালতীনগর স্টেশনের লোকের ভিড়ে ব্যাগ হস্তে আদিনাথবাবুর সামনে দাঁড়াইয়া কথাটা ভীষণ নাটকীয় শোনাইল। কাজল বুঝিতে পারল, বিষয়টা সে পরিষ্কার করিতে পারে নাই কিছুটা ফঁকা আওয়াজ হইয়াছে।
কিন্তু আদিনাথবাবুর মুখ আস্তে আস্তে গম্ভীর হইল। কাজলের কাঁধে হাত দিয়া বলিলেন—চ, কোনো জায়গায় বসে কথা বলি।
স্টেশন ছাড়াইয়া নির্জন পথে পড়িয়া বাঁধানো কালভার্টের উপব আদিনাথবাবু বসিলেন। বলিলেন–বোস আমার পাশে।
কাজল বসিল।
কিছুক্ষণ আদিনাথবাবু কথা বলিলেন না, ব্যাগটা পায়ের কাছে নামাইয়া চুপচাপ বসিয়া রহিলেন। কাজলও পাশে বসিয়া রহিল। সময় কাটিতেছে, কাহারও যেন কথা বলিবার চাড় নাই।
আদিনাথবাবু হঠাৎ কাজলের দিকে তাকাইয়া গম্ভীর স্বরে মন্ত্র পড়িবার মতো করিয়া বলিলেন—তোর জীবনের সুখ একেবারে চলে গেছে অমিতাভ, আর কখনও আসবে না।
কাজল চমকাইয়া উঠিল। কথাগুলি তাহার বুকের গভীরে যেন তীক্ষমুখ শলাকার মতো বিধিয়া গেল। মাস্টারমশাই ঠিকই বলিয়াছেন—তাহার মতো করিয়া আর কে বুঝিয়াছে যে সুখ আর কখনও আসিবে না? সঙ্গে সঙ্গে কাজলের মেরুদণ্ড বাহিয়া একটা ভায়ের স্রোত নিচে নামিয়া গেল। যে অসুখ শুরু হইয়াছে, তাহা কখনও সারে না।
—অমিতাভ।
—সার?
আদিনাথ বলিলেন-যে চিন্তা করে, তার জীবনে কখনও সুখ আসে না। তুই জীবনের একেবারে আসল জায়গায় ঘা দিয়েছিস। ভাবতে অবাক লাগছে, এত অল্প বয়সে তুই এই চিন্তা পেলি কোথা থেকে।
—একটা কথা বলব সার?
–বল্?
–কী মনে হয় আপনার জীবন সম্বন্ধে? আপনি কি বিশ্বাস করেন মৃত্যুতেই জীবনের শেষ?
–সত্যি উত্তর দেবো?
–তা নইলে আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করবো কেন?
-আমার কিছুই মনে হয় না। অনেকদিন আছি পৃথিবীতে, কিছুই বুঝতে পারলাম না। সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগেই আমার চিন্তাশক্তি নিঃশেষ হয়ে গেল। এখন আমি দেনায় জর্জরিত ভবিষ্যৎহীন বৃদ্ধ। আমার এই বর্তমানের চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর আর কী হতে পারে? তবুও অমিতাভ আমার মন চায়, একটা কিছু অর্থ থাকুক এ-সবের। কিন্তু আমি জানি, সমস্ত জিনিসটা signifies nothing কেবল sound অমিতাভ, কেবল fury, আর কিছু নয়।
অকস্মাৎ আদিনাথবাবু হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন। হাসিতে হাসিতে বলিলেন-ওসব চিন্তা একদম বাদ দিয়ে দিয়েছি। এককালে খুব ভাবতাম, বুঝলি? এখন তোদর জন্যই বেঁচে আছি বলতে পারিস। তোরা মানুষ হবি, বড়ো হবি—বিশ্বাস কর, আমার খুব ভালো লাগবে দেখতে।
-আপনি পুনর্জন্মে বিশ্বাস করেন সার?
–তুই বিশ্বাস করিস?
–করতে ইচ্ছা হয়, পারি না।
–কেন?
–বুদ্ধি দিয়ে যাচাই করে দেখলে কোনো মানে হয় না বলে।
–বুদ্ধি দিয়ে যা বোঝা যায় না, তা মিথ্যে?
—তাকে হৃদয় দিয়ে মেনে নেওয়া যায়, বাস্তবে স্বীকার করা যায় না।
—স্বীকার না করায় বাহাদুরি কী অমিতাভ? তাতে তো শুধু কষ্ট—
–কষ্ট তো বটেই মাস্টারমশাই। স্বীকার না করায় কিছু বাহাদুরি নেই, আমি বিশ্বাস করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি। কিন্তু বুদ্ধিতে বাধা দেয় যে।
–অমিতাভ, আমি তোকে আশীর্বাদ কবি, তোব জীবনে যেন বিশ্বাস আসে, তুই যেন কখনও পরাজিত না হোস।
–শুধু বিশ্বাস দিয়ে কী হবে সার, যদি আসলে কোনো অর্থ না থাকে? শূন্যতায় বিশ্বাস করা কি নিজেকে ঠকানো নয়?
আদিনাথবাবু কাজলের কাঁধে হাত দিয়া একটা ঝাকুনি দিলেন, তারপর বলিলেন—তবু সে নিছক sound আর fury থেকে ভালো। বড় হয়ে তোর মনে হবে, বিশ্বাসের একটা মূল্য আছে। মনে হবেই, দেখিস।
আদিনাথবাবুর সঙ্গে কাজলের এই শেষ দেখা। এর কিছুদিন বাদেই র্তাব মৃত্যু হয়। ব্যোমকেশ হঠাৎ আসিয়া খবরটা দিয়াই আবার চলিয়া গিয়াছিল।
রাত্রে বিছানায় শুইয়া পরদিন আদিনাথবাবু আর ঘুম হইতে ওঠেন নাই। ঘুমের ভিতরেই তাহার মৃত্যু হইয়াছিল। সংসারের জন্য এক পয়সাও বাখিয়া যাইতে পারেন নাই, কিন্তু দেনা পাই পয়সা পর্যন্ত মিটাইয়া দিয়াছিলেন।
১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের পয়লা সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু। ৩রা সেপ্টেম্বর ব্রিটেন এবং ফ্রান্স যুদ্ধে নামিল। ১৮ই সেপ্টেম্বরের ভিতর পোল্যান্ডের পতন হইল। ওয়ারশ-তে নাজী বাহিনীর এমুনিশন বুটের শব্দ শোনা যাইতে লাগিল।
প্রথমদিকে কাজল কলিকাতায় বিশেষ কিছু অস্বাভাবিকতা দেখে নাই। কিন্তু যত দিন যাইতে লাগিল, মানুষ ততই দিশাহারা হইয়া পড়িল। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে জাপান হঠাৎ পার্ল হারবার আক্রমণ করায় আমেরিকা যুদ্ধে নামিল। ইহার কিছুদিন বাদে ব্রহ্মদেশের পতন হওয়ায় ভারতবর্ষ অনুভব করিল, বিপদ একেবারে ঘাড়ের উপর আসিয়া পড়িয়াছে। শুরু হইল বা বিনা ঘাড়ে গ্রামের দিকে সদলে পলায়ন। তাড়া খাওয়া প্রাণীর মতো অবস্থা।
অনেক সময় কাজলের ক্লাস করিতে ভালো লাগত না। পরমেশের সঙ্গে রাস্তায় ঘুরিতে ঘুরিতে তাহার মনে হইত, মানুষ মোকা যুদ্ধ করে মরছে কেন? এমনিই তো মরবে কদিন বাদে।
সে বলিত-পরমেশ, যুদ্ধ বড়ো বীভৎস আর অর্থহীন, না?
—হয়তো তাই, কিন্তু যুদ্ধেরও যে অনেক সৃষ্টিশীল দিক আছে। কলকারখানা বাড়ছে, নতুন নতুন আবিষ্কার হচ্ছে। কত প্রথম শ্রেণীর সাহিত্য সৃষ্টি হবে হয়তো পরে। প্রথম মহাযুদ্ধের ফসল যেমন রেমার্ক, রুপার্ট ব্রুক–
–ভালো সাহিত্যের জন্য, নতুন আবিষ্কারের জন্য কি মানুষ মারতে হবে?
পরমেশ হাসিল। বলিল—তুমি নিজেই বলে থাকো জীবনের কোন অর্থ হয় না, জীবনটা দীর্ঘদিন ধরে ক্লান্ত হবার একটা পন্থা মাত্র। মানুষের জীবন থাকলে কী গেল, তাতে তোমার দুঃখিত হবার কারণ নেই।
কাজল ভাবিয়া দেখিল, পরমেশ ঠিকই বলিয়াছে। তাহার দর্শন অনুযায়ী যুদ্ধে মন-মরা হইবার কারণ নাই।
অথচ এ কথাও ঠিক যে, সে হাঁপাইয়া উঠিয়াছে। কলিকাতার আলোকহীন নিপ্রাণ সন্ধ্যা, লোজনের পলায়ন, প্রতিদিন যুদ্ধের নূতন নূতন নারকীয় সংবাদ তাহার মনে এত অবসাদ আনিয়াছে যে, আই-এ পরীক্ষায় যেমন করা উচিত ছিল, তাহা সে পারে নাই। পরীক্ষার হলে বসিয়া অনেকবার কাগজ জমা দিয়া উঠিয়া আসিবার কথা ভাবিয়াছে, কিন্তু মায়ের কথা ভাবিয়া পারে নাই।
মায়ের আশা সে বড়ো হইবে। টাকার দিক দিয়া নহে, যশের দিক দিয়া। রাত্রে শুইয়া সে বাচ্চা ছেলের মতো মায়ের বুকে মুখ খুঁজিয়া থাকে। সারাদিনের চিন্তার পরিশ্রমে ক্লান্ত মস্তিষ্ক তাহাতে বিশ্রাম পায়। পৃথিবীর বড়ো বড়ো ফাঁকির ভিতরে মায়ের ভালোবাসাই তাহার কাছে একটুকু সার পদার্থ বলিয়া বোধ হয়। প্রায় রাত্রে দুইজনে নিশ্চিন্দিপুরের গল্প করে, মৌপাহাড়িব গল্প করে। গল্প কিছুক্ষণ চলিবার পর কাজল টের পায়, মা কাঁদিতেছে। তখন সে বলে—মা, তোমার ছোটবেলার গল্প বলল।
হৈমন্তী কাজলকে বুকের কাছে লইয়া মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে তাহার রঙিন শৈশবের গল্প করে।
ভারি সুন্দর ছিল সে সমস্ত দিন। কত জায়গায় সে ঘুরিয়াছে বাবার সঙ্গে। এক জায়গায় সংসার পুরাতন হইতে না হইতেই সব কিছু গুটাইয়া আবার নূতন স্থানে যাত্রা শুরু হইত। জামালপুরে তাহাদের পাশের বাড়ির সেই সুমিত্রাদি কী ভালোই না বাসিত তাহাকে! স্বামী রাত্রে মদ খাইয়া বাড়ি ফিরিত, হুঁশ থাকিত না। সুমিত্রাদি জামাকাপড় ছাড়াইয়া বিছানায় শোয়াইয়া বাতাস করিয়া ঘুম পাড়াইত। একদিন অভিযোগ করিতে গিয়া কী মারটাই না খাইয়াছিল স্বামীর হাতে! হৈমন্তীকে ডাকিয়া সে একদিন গহনাপত্র দেখাইয়াছিল। শখ করিয়া কত কিছু গড়াইয়াছিল সুমিত্রাদি, খুব শখ ছিল ভালো করিয়া সংসার করিবে। হয় নাই। মাতাল, অপদার্থ স্বামী কোথা হইতে আর একজনকে বিবাহ করিয়া আনিল। কয়েকদিন বাদে সুমিত্রাদি গেল পাগল হইয়া। তাহাকে বাপের বাড়ি পাঠাইয়া দেওয়া হইল। সুমিত্রাদি আর সারিয়া উঠে নাই, তাহার সংসার করিবার সাধ পূর্ণ হয় নাই।
—তখন ভারি টক খেতে ভালোবাসতাম, জানিস বুড়ো। আমি আর দিদি সারাদিন এ বাগানে ও-বাগানে ঘুরতাম চালতে করমচার খোঁজে। এক বুড়োর বাগানে লুকিয়ে ঢুকেছিলাম। বুড়ো দেখতে পেয়ে আমাদের ডেকে বলললুকিয়ে নিচ্ছ কেন খুকিরা, যত ইচ্ছে নিয়ে যাও, কেউ কিছু বলবে না। কোথায় থাকো মা তোমরা?
মায়ের জন্য কাজলের দুঃখ হয়। মা জীবনে কিছু পায় নাই। কত অল্প বয়সে বিধবা হইয়াছে, এখন পুরাতন স্মৃতি মন্থন করিয়া দিন কাটায়। বাবা মারা যাইবার পর হইতে কী-ই বা রহিয়াছে। একটা বড়ো রকমের কিছু করিয়া মাকে খুশি করিতে হইবে। সে বলে—একটা গল্প শুনবে মা?
-কী গল্প রে খোকন?
সে ফিয়োদর সোলোগাব-এর ‘দি হুপ’ গটা মাকে বলে। সোলোগা এমন কিছু বড়ো সাহিত্যিক নন। কিন্তু গল্পটা তাহার খুব ভালো লাগিয়াছিল। আশি বছরের এক বৃদ্ধের গল্প। মায়ের সহিত বাচ্চাকে হাঁটিয়া যাইতে দেখিয়া বৃদ্ধের শিশু হইতে ইচ্ছা করিয়াছিল। বাচ্চাটি বেশি দূরে গিয়া পড়িলেই মা ডাকিয়া বলিতেছে–ওদিকে যাস নে, পড়ে যাবি। পরের দিন বৃদ্ধ কাজ কামাই করিয়া সারাদিন বালকের মতো নির্জন পাহাড়ের ধারে খেলিয়া বেড়াইল। বৃদ্ধের কেহ ছিল না। শৈশবে সে মায়ের স্নেহ পায় নাই। অশক্ত শরীরে পাহাড়ের পথে দৌড়াইতে দৌড়াইতে কেবল তাহার মনে হইতেছিল, মা পিছন হইতে সাবধান করিয়া দিতেছে—ওদিকে যাস নে, পড়ে যাবি।
সম্বলহীন আত্মীয়হীন বৃদ্ধের গল্পটা কাজলের মনে দাগ কাটিয়াছিল। বলিতে বলিতে সে বিছানার উপর উঠিয়া বসিল। শেষ দিকটায় তাহার গলার কাছটায় একটা কান্না আটকাইয়া যাইতেছিল। অবাক হইয়া সে লক্ষ করিল, জীবনের অর্থহীনতা আবিষ্কারের পরেও সে জীবনকে কত ভালোবাসে। অরুদ্ধ কণ্ঠে বলিল—কত লোক জীবনে কিছু না পেয়েই মবে যায় মা!
হৈমন্তী তাহাকে কাছে টানিয়া বলিল–ওমা বুড়ো, তুই কাঁদছিস? তুই না বি. এ. পড়িস? বই পড়ে কান্না!
–আমি মানুষের দুঃখ দূর করার জন্য একটা কিছু করবো, দেখে নিয়ো। সারাজীবন যারা কষ্ট পায়, চোখের জলে ডুবে থাকে, আমি তাদের নতুন পৃথিবী তৈরি করে দেবো।
-আমি জানি বাবা, তুই পারবি।
–বি. এ.-টা দিয়ে আমি চাকরি নিয়ে চলে যাবো কোনো নির্জন জায়গায়। মৌপাহাড়ি স্কুলে মাস্টারি করবে হয়তো। তুমি আমার সঙ্গে যাবে তো মা?
–তোকে ছেড়ে কোথায় থাকব বুড়ো? তুই তো আমার সব।
-আমি বেশি টাকাপয়সা দিতে পাবো না মা, কিন্তু তোমাকে শাস্তি দিতে পারবো। তাতে তুমি তৃপ্তি পাবে না?
–আমার কিছু চাই নে। কীর্তিমান স্বামী পেয়েছি, পুত্র যদি বিদ্বান হয়, তবে আমার সমস্ত পাওয়া হবে।
কাজল আবার শুইল বটে, কিন্তু ঘুম আসিল না। বলিল—মা, আমার একদম ভালো লাগছেন এই জীবন। পড়াশুনো হয়ে গেলেই বেরিয়ে পড়ব যেখানে হোক। এই তো আর কদিন পর থেকে মাঠে শিশির পড়তে শুরু করবে। বাত্তিবের পরিষ্কার আকাশে ঝকঝক করবে নক্ষত্র। পৃথিবীটা আমাকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আমি বাইরে বেরুব মা, আমি কিছুতেই ঘরের কোণে সারাজীবন কাটাব না।
—তোর বাবার রক্ত রয়েছে যে তোর শরীরে, কে তোকে আটকাবে খোকন?
–বাঁচতে গেলে বিশ্বাস লাগে, তা কেন পাই না?
–ঈশ্বরে বিশ্বাস?
–শুধু ঈশ্বরের নয়, জীবনের বিশ্বাস।
—বিশ্বাস আসবে, দেখতে পাবি। মনটা খুব উদার খুব বড়ো করে রাখিস, যাতে সুখ-দুঃখ সবই সেখানে ধরে। দেখবি, দুঃখ আর সুখ তুল্যমূল্য হয়ে গেছে-দুঃখের জন্য আর কষ্ট নেই।
কাজলের মনে হইল, মা এইভাবে দুঃখকে জয় করিয়াছে। সুখ আর দুঃখের বিরাট ভার মনের ভিতর জমা করিয়া দুইটাকে এক করিয়া দেখিতে সক্ষম হইয়াছে মা। এইটাই মায়ের স্থৈর্যের মূল কথা।
পরমেশ বলিল—কী অমিতাভ, চুপ করে আছ যে?
কাজল মুখ তুলিয়া তাহার দিকে তাকাইতে সে অবাক হইল। পূর্বের সে আশাহত পাণ্ডুর ভাবটা কাটিয়া গিয়া নূতন একটা উদ্যমের আলো কাজলের মুখে প্রতিফলিত হইয়াছে। চোখ দুইটা চকচক করিতেছে।
-তোমাকে বেশ উত্তেজিত বলে মনে হচ্ছে।
—পরমেশ, আমি বোধহয় ভুল করছিলাম। জীবনের অর্থ হয়তো সত্যিই নেই—আমার এক মাস্টারমশাই বলতেন, জীবন শুধুই sound আর fury, আর কিছু নয়। শেকপীয়রই হয়তো ঠিক, তবু বেঁচে থাকার মানে একটা খুঁজে বের করবোই পরমেশ। লোক ভুলোনো দর্শন নয়, বাস্তব একটা কিছু দিয়ে যাবো–
পরমেশ কাজলের হাত চাপিয়া ধরিল।
–আমি বিশ্বাস করি অমিতাভ, তা তুমি পারবে
-আমাকে দূরে চলে যেতে হবে মানুষের থেকে, আরও বেশি করে মানুষের ভেতরে ফিরে আসার জন্য। আমি পেছনে হাঁটবো পরমেশ।
দুইজনে হাঁটিয়া মিউজিয়ামে গেল। পরমেশ জানে, কাজল সঙ্গে থাকিলে মিউজিয়াম দেখার আনন্দ আলাদা। বেলা গড়াইয়া বিকালের দিকে ঝুঁকিয়াছে। মিউজিয়ামে লোক প্রায় নাই বলিলেই হয়। বড়ো বড়ো মূর্তি এবং দুষ্প্রাপ্য অনেক বস্তু বোমার ভয়ে মাটির নিচে পুঁতিয়া ফেলা হইয়াছে। ঘরগুলি কেমন ন্যাড়া ন্যাড়া লাগে।
পরমেশ বলিল—অনেক কিছু নেই, রিপ্লেসড লেখা টিকিট পড়ে আছে।
–ইউনিভার্সিটিও বহরমপুরে উঠিয়ে নেওয়া হচ্ছে, জান না?
বহুদিন বাদে কাজলের মনে আবার পুরাতন আনন্দটা ফিরিয়াছে। মিউজিয়াম হইতে বাহির হইয়া দেখিল রৌদ্র পড়িয়া গিয়াছে, শীতকালের বেলা নাই বলিলেই চলে। গেটের সামনে ফুটপাতের উপর ইটের বেড় দিয়া ঘেরা কৃষ্ণচূড়া গাছ। তাহার ডালগুলি অস্তদিগন্তের পটে আঁকা বলিয়া মনে হইতেছে। বাতাস নাই, সব নিঝুম। সন্ধ্যার কেমন একটা বিষণ্ণতা–তাহাদের দিকে তাকাইয়া বুঝি ওষ্ঠে তর্জনী রাখিয়া চুপ করিতে সঙ্কেত করিতেছে।
পাতলা জামা গায়ে কাজলের শীত করিতেছিল। ফিরিতে এত দেরি হইবে, তাহা সে বুঝিতে পারে নাই। পরমেশকে বলিল—চলো, রাত হয়ে এলো।
ধর্মতলা মোড়ে একটা বাচ্চা মেয়ে, নোংরা জামা পরা, কাজলের গায়ে ধাক্কা খাইল। কাজলের হাত হইতে বইখাতা ধুলায় পড়িয়া গেল। পালায নাই মেয়েটি, ভয়ে পালাইতে পারে নাই। আতঙ্কে কেমন যেন হইয়া গিয়া তাহার দিকে তাকাইয়া আছে। বয়স বেশি নহে, নয় কী দশ হইবে হতদরিদ্রের চেহারা, কিন্তু চোখ দুটি উজ্জ্বল। কাজলের হঠাৎ ওল্ড কিউরিওসিটি শপ-এর ডিক সইভেলারের ছোট্ট বান্ধবীটির কথা মনে পড়িল। কাজল ভাবিল-ও ভেবেছে, আমি ওকে বকবো। কী সুন্দর চোখ দুটো ওর!
মেয়েটির হাতে একখানি একআনা দামেব পাঁউরুটি, এইটি কিনিতেই সে আসিয়াছিল, রাস্তা পার হইয়া ফিরিবার সময় ধাক্কা লাগিয়াছে। পাঁউরুটি শক্ত করিয়া ধরিয়া মেয়েটি কাঠ হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। মেয়েটির চোখ, পাউরুটি আঁকড়াইয়া ধরিবার ভঙ্গি, সন্ধ্যাবেলার বিষণ্ণতা, সব মিলাইয়া কাজলের মনে একটা ঢেউ তুলিল—মেয়েটির চোখে চোখ রাখিয়া সে হাসিল। মেয়েটি হাসিল না।
কাজল বলিল–তোমার নাম কী খুকি? কোথায় থাকো?
উত্তর না দিয়া মেয়েটি রাস্তার ওপাবে তাকাইল, সেখানে এক অন্ধ ভিখারি ঘোড়ার জল খাইবার চৌবাচ্চার কিনারায় বসিয়া আছে। কাজল বলিল–ও কে হয় তোমার–বাবা?
মেয়েটি ঘাড় নাড়িল। কাজল পকেট হইতে একটা আনি বাহির করিয়া বলিল—এটা তুমি নাও।
মেয়েটি কিছুতেই লইবে না। অনেক সাধ্যসাধনার পর হাত হইতে আনিটা লইয়া সে সংকুচিতভাবে হাসিল, তারপর হঠাৎ ফিরিয়া লোহার চৌবাচ্চাটা লক্ষ করিয়া দৌড় দিল।
ট্রেনে জানালার পাশে বসিয়া কাজল সমস্ত রাস্তা ভাবিতে ভাবিতে চলিল। ঠাণ্ডা বাতাসে হাড়ের ভিতর কাঁপন ধরে। গলা বাড়াইলে দেখা যায় কালপুরুষমণ্ডলীর বেটেলজয়ুস নক্ষত্রটা লালচে আভায় ঝকঝক করিতেছে।
কাহারা গোপন ছাউনির নিচে আগুন করিয়া হাত-পা সেঁকিতেছে। হাওয়ায় শীতের ঘ্রাণ, পোড়া ডালপালার ঘ্রাণ। বোমারু বিমানের ভয়ে উন্মুক্ত স্থানে আগুন জ্বালায় নাই।
ট্রেনের এঞ্জিন হইতে বারদুয়েক হুইস্লের শব্দ ভাসিয়া আসিল।
(কাজলের ডায়েরি থেকে)
গতকাল আমাদের একজন অধ্যাপক না আসায় একটা পিরিয়ড ছুটি পাওয়া গেল। পরমেশ লাইব্রেরিতে বসে পড়ছিল, তাকে না ডেকে আমি একাই একটু হাঁটছিলাম রাস্তায়।
অন্যমনস্ক ভাবে চলতে চলতে ভেবে দেখলাম, আমার ভেতরে যে দ্বন্দ্বটা চলছে সেটা মোটেই আকস্মিক নয়। ছোটবেলা থেকেই ধীরে ধীরে পরিপক্ক হয়ে উঠেছিল, হঠাৎ একদিন বেরিয়ে পড়েছে। আমার সমস্যা অন্যের কাছে অবাস্তব, কিন্তু আমার কাছে অন্ধকারের ভেতর প্রজ্বলন্ত আগুনের মতো বাস্তব ও প্রত্যক্ষ। চিন্তার একটা বিশেষ ধাপ পর্যন্ত এসে আটকে গেছি আমি, মৃত্যুকে অতিক্রম করতে পারছি না। হয়তো কেউই তা পারে না।
হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, চলা বন্ধ করে আমি সামনের তেতলা বাড়ির ছাদের ওপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে কী ভাবছি। চোখ নামিয়ে নিয়ে হাঁটতে শুরু করবো, দেখি রাস্তার ওপারে মিষ্টির দোকানে গোলমাল-বোগামতো একটা লোকের ঘাড় ধরে বিশালদেহ দোকানদার ঝাকুনি দিচ্ছে, আর একজন তার কাপড়চোপড়ের ভেতর হাতড়ে কী খুঁজছে। রোগা লোকটি হাতজোড় করে কী বলতে গেল—দোকানদার মারল তাকে এক রদ্দা, ছিটকে সে ফুটপাথে গিয়ে পড়ল।
ভারি খারাপ লাগল ব্যাপারটা। হাত জোড় কবে লোকটা কী বলতে চাইছে, কেউ শুনছে না। রাস্তা পেরিয়ে ওপারে গেলাম—ততক্ষণে সে এক হাতে ভর দিয়ে উঠে বসেছে। থমকে গেলাম আমি, দেখলাম লোকটি রামদাস বৈষ্ণব। রামদাস বৈষ্ণবকে এরা মারছে।
-রামদাস কাকা!
রামদাস চমকে আমার দিকে তাকাল। কী চেহারা হয়ে গিয়েছে তার। চোখের নিচে গভীর কালি, চুল লালচে, উস্কোখুস্কো। শরীর শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। মারের চোটে এখনও সে অল্প অল্প কাপছে।
রামদাস আমায় চিনতে পেরেছে। পুরোনো দিনের মতোই খুশি-খুশি গলায় বলে উঠলো বাবাজী, তুমি!
দোকানদার এবং তার দুই সঙ্গীকে জিজ্ঞাসা করলাম—কী হয়েছে? আপনারা মারছেন কেন একে?
দোকানদার খিচিয়ে উঠল—মারবে না তো কি সিংহাসনে বসিয়ে পুজো করবে? চারআনার জিলিপি খেয়ে এখন বলছে পয়সা নেই! শালা ইয়ের বাচ্চা–
ইতর কথা এবং তাদের মুখচোখের ইতর ভাব দেখে আমার এত খারাপ লাগলো! বললাম–বৈষ্ণবকে মারতে হাত উঠলো আপনার? আবার গালগালও দিচ্ছেন–
-যান যান মশাই, অমন অনেক বোষ্টম দেখেছি। ভেক নিলেই বোষ্টম হয় না, ওসব লোক ঠকাবার ফন্দি–
রামদাসকে জিজ্ঞাসা করলাম–কী হয়েছে রামদাস কাকা?
রামদাস তখন দাঁড়িয়ে উঠেছে। বলল–গেঁজেতে পয়সা রেখেছিলাম। কখন পড়ে গেছে বুঝতে পারিনি। সারাদিন ঘুরছি তো রাস্তায় রাস্তায়। তুমি তো জানো বাবাজী, পয়সা নেই জানলে আমি একদানাও মুখে দিতাম না এখানে–
দোকানদারের লোক বলল—ওরে আমার ধার্মিক যুধিষ্ঠির রে!
তাকে থামিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম-কত পয়সা আপনাদের? চার আনা? এই নিন, ছেড়ে দিন একে। চলো রামদাস কাকা–
রামদাস বলল—আমার একটা থলে ওরা রেখে দিয়েছে। একটা দোতারা ছিল সঙ্গে, সেটা ভেঙে দিয়েছে–
দোকানদার ভেতর থেকে দোতারা এবং একটা ছেঁড়া ক্যাম্বিসের থলে এনে দিলে। খানিকদূর এসে দোতারায় হাত বুলিয়ে রামদাস বললো—এটা একদম ভেঙে দিয়েছে বাবাজী। তারগুলো ছিঁড়ে দিয়েছে, আর বাজানো যাবে না
থলের ভেতর হাতড়ে খঞ্জনীটা বের করল সে, হেসে বলল–এটা নেয় নি। যাক, একটা তবু রইলো
খঞ্জনী বাজিয়ে সে তার অভ্যেসমতো হাসলো। বলল—জয় গুরু, জয় গুরু!
-তুমি হাসছ রামদাস কাকা! তোমাকে ওরা অপমান করল, মারল—তার পরেও হাসছো?
–হাসবো না কেন? দুঃখ করার সময় কোথায় আমার?
—ওদের ওপর রাগ হচ্ছে না?
—না বাবাজী, সত্যি বলছি—ওরা যদি বুঝতো খারাপ কাজ, তাহলে কি আর মারত আমাকে? না বুঝে যা করেছে তার জন্য ওদের আমি দোষ দেব না। গুরু ওদের ভালো করুন।
–তুমি বড়ো ভালো মানুষ রামদাস কাকা। আমরা হলে অপমান সইতে পারতাম না।
মার খাওয়াটা যেন ভারি একটা মজার ব্যাপার, রামদাস এমনিভাবে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল–একটা কথা তো তোমায় বলা হয়নি বাবাজী, আমার যক্ষ্মা হয়েছে।
যক্ষ্মা রামদাসের! সে কথা এতক্ষণ না বলে দিব্যি হাসছিল সে!
—কী বলছো রামদাস কাকা! যক্ষ্মা?
–হ্যাঁ, বাবাজী। ডাক্তার দেখাতে এসেছিলাম কলকাতায়। গাঁয়ের ডাক্তার বললো শহরে গিয়ে দেখাতে। হাসপাতালে হাঁ করে বসেছিলাম সারাদিন, আমার ডাক আসার আগেই ডাক্তারের রুগী দেখার সময় পেরিয়ে গেল। চাপরাসী বলেছে, কাল যেতে। কাল যাব আবার–
–রাত্তিরে থাকবে কোথায়?
—শুয়ে পড়ব রাস্তার ধারে কোথাও কাপড় মুড়ি দিয়ে। রাস্তায় শুলে তো মারবে না।
এই হিমবর্ষী রাতে রামদাস অচেনা শহরের ফুটপাতে শুয়ে থাকবে, খাওয়া মিলবে কিনা ঠিক নেই। তা সত্ত্বেও সে হাসছে।
—তুমি আমার সঙ্গে চলো রামদাস কাকা, আমাদের বাড়ি চলল। আমি তোমায় ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করে দেবো।
খঞ্জনী বাজাতে বাজাতে রামদাস বললো–তা হয় না। কালব্যাধি হয়েছে, বড্ড ছোঁয়াচে। এ রোগ আমি তোমার বাড়িতে ছড়াতে পারবো না। এই জন্য দোকানেও আজকাল শালপাতায় খেয়ে আঁজলা ভরে জল খাই। এঁটো গেলাসে থালায় খেয়ে অন্য লোকের যদি অসুখ করে!
কিছুতেই সে যেতে রাজি হলো না। পকেট থেকে তিনটে টাকা (এ ছাড়া আমার কাছে আর ছিল না) বের করে বললাম—টাকা কটা তোমায় নিতে হবে। কোনো আপত্তি শুনবো না-তোমার এখন টাকার দরকার।
আমার দিকে তাকিয়ে রামদাস একটুখানি ভেবে তারপর বলল–দাও।
—থলের ভেতরে কিছুতে বেঁধে রাখো, আবার না হারায়।
কাপড়ের খুঁটে সে শক্ত করে বেঁধে নিল। বাঁধবার সময় ফাঁস করে একটু ছিঁড়ে গেল কাপড়টা। রামদাস মুখ তুলে অপ্রতিভ ভাবে হেসে বলল–বড্ড পুরোনো কিনা।
-আবার দেখা কোরো, আমাদের বাড়িতে যেয়ো কাকা।
–যদি গুরু টেনে না নেন, নিশ্চয়ই যাবো খোকন।
–আমাকে খোকন বলছে, আমি কিন্তু আর ছোট নেই।
রামদাস হেসে স্নেহপূর্ণ চোখে আমার দিকে তাকাল। একটা হাত আমার কাঁধে রেখে কী বলতে গিয়ে হাতটা সরিয়ে নিল। বলল—তোমাকে না ছোঁয়াই ভালো। যদি তোমার যক্ষ্মা হয়।
তাকিয়ে দেখলাম, ভবঘুরে রামদাস গুনগুন করে গান করতে করতে ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে। জানি না, তার সঙ্গে আর দেখা হবে কিনা।
১৬. আজ রাত্তিরে অপূর্ব জ্যোৎস্না উঠেছে
যোড়শ পরিচ্ছেদ
(কাজলের ডায়েরি থেকে)
আজ রাত্তিরে অপূর্ব জ্যোৎস্না উঠেছে। রাস্তার পাশের গাছে বাসা বেঁধে থাকা পাখিগুলো ডাকছে সকাল হয়ে গেছে মনে করে। চাদের আলোয় একবার বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। ঘাসের ওপর হালকা শিশির চক চক করছিল।
অনেকদিন আগে আমার পোষা কুকুর কালু যখন মারা যায়, মা বলেছিলেন-দেখিস বুড়ো, ভগবান ঠিক এসে বসে আছেন ওর কাছে। সেদিন আমি মার কথা বিশ্বাস করতে পেরেছিলাম, আজ হয়তো আর পারবো না। তবে এক নতুন বিশ্বাসে আমার মন ভরে উঠছে। ধর্মতলার মোড়ে সেদিনকার সেই খুকিটা, যে পাউরুটি শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়েছিল, সোলেগাব-এর গল্পের সেই আশি বছরের দুঃখী বুড়ো, সবাইকে আমার কত আপন বলে মনে হচ্ছে। এদের প্রতি ভালোবাসা আমার অন্ধকার ঘরে একটা নতুন জানালা খুলে দিয়েছে।
কদিন ধরে খুব নিশ্চিন্দিপুরে যেতে ইচ্ছে করছে। এখন সেখানেও শুকনো বাঁশপাতা ঝরে ঝরে বাঁশবাগানের পথ আচ্ছন্ন হয়ে আছে, সোঁদা গন্ধ উঠছে বাঁশতলা থেকে। দুধরঙের সজনেফুল ঘন নীল আকাশের পটে থোকা থোক। ফুটে আছে। আমাদের পুরোনো ভিটের সজনেগাছটা—সেটা ঠেলে উঠেছে আকাশে মাথা তুলে অনেকখানি। নদীতে নৌকোয় বসে থাকা মাঝি হঠাৎ বোঝে, জলে জোয়ারের টান লেগেছে। একটু একটু কবে কর্দমময় তীর ঢেকে গিয়ে জল বাড়তে থাকে।
আমাদের পুরোনো ভিটে কি চিরকালই অমনি পড়ে থাকবে—চামচিকে আর বাদুড় বাসা বানাবে কেব? বাবার স্মৃতি কি একেবারে মুছে যাবে আমাদের সুন্দর গাঁ নিশ্চিন্দিপুর থেকে? আমি তা হতে দেবো না। আমি মাকে নিয়ে আবার ফিরে যাবো গাঁয়ে। শহর আমার থেকে যা কেড়ে নিয়েছে, আমার গ্রাম আমাকে তা ফিরিয়ে দেবে।
বেচারি রামদাসের কথা বড়ো মনে পড়ছে এ সময়। এবার দেখা হলে বলবো–দুঃখ করো না রামদাস কাকা, আমি তোমাকে একটা নতুন দোতারা বানিয়ে দেবো।